দ্বিতীয় ভাগ : রাতের কবিতা
প্রেমে বন্ধু পঞ্জরের বাধা,
আলোর আমার মাঝে মাটির আড়াল,
রাত্রি মোর ছায়া পৃথিবীর।
বাম্পে যার আকাশেরে সাধা,
সাহারার বালি যার উষর কপাল,
এ কলঙ্ক সে মৃত্য সাকীর।
শান্ত রাত্রি নীহারিকা লোকে,
বন্দী রাত্রি মোর বুকে উতল অধীর–
অনুদার সঙ্কীর্ণ আকাশ।
মৃত্যু মুক্তি দেয় না যাহাকে
প্রেম তার মহামুক্তি।–নূতন শরীর
মুক্তি নয়, মুক্তির আভাষ।
হেরম্ব বলল, ‘এতকাল পরে এইখানে সমুদ্রের ধারে আপনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে, এ কথা কল্পনাও করতে পারি না। বছর বার আগে মধুপুরে আপনার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল, মনে আছে?’
অনাথ বলল, ‘আছে।’
‘সেবার দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতেই পারতাম না। সত্যবাবুর বাড়ি মাস্টারি করতে করতে হঠাৎ আপনি যেদিন চলে গেলেন, আমার বয়স বোরর বেশি নয়। তারপর কুড়ি–একুশ বছর কেটে গেছে। আপনার চেহারা ভোলবার মতো নয়, তবু মাঝখানে একবার দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতে না পেরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম।’
অনাথ একটু নিস্তেজ হাসি হাসল।
‘আমাকে চিনেও চিনতে না পারাই তোমার উচিত ছিল হেরম্ব।’
‘আমার মধ্যে ওসব বাহুল্য নেই মাস্টারমশায়। সত্যবাবুর মেয়ে কেমন আছেন?’
‘ভালোই আছেন।’
হেরম্ব অবিলম্বে আগ্রহ প্রকাশ করে বলল, ‘চলুন দেখা করে আসি।’
অনাথ ইতস্তত করে বলল, ‘দেখা করে খুশি হবে না হেরম্ব।’
‘কেন?’
‘মালতী একটু বদলে গেছে।’–অনাথ পুনরায় তার স্তিমিত হাসি হাসল।
হেরম্ব বলল, ‘তাতে আশ্চর্যের কি আছে? এতকাল কেটে গেছে, উনি একটু বদলাবেন বৈকি! আপনি হয়তো জানেন না, ছেলেবেলা আপনার আর সত্যবাবুর মেয়ের কথা যে কত ভেবেছি তার ঠিক নেই। আপনাদের মনে হত রূপকথার রহস্যময় মানুষ।’
অনাথ বলল, ‘সেটা বিচিত্র নয়। ওসব ব্যাপারে ছোট ছেলেদের মনেই আঘাত লাগে বেশি। তারা খানিকটা শুনতে পায়, খানিকটা বড়রা তাদের কাছ থেকে চেপে রাখে। তার ফলে ছেলেরা কল্পনা আরম্ভ করে দেয়। তাদের জীবনে এর প্রভাব কাজ করে। আচ্ছা, তুমি কখনো ঘৃণা কর নি আমাদের?’
‘না। সংসারের সাধারণ নিয়মে আপনাদের কখনো বিচার করতে পারি নি। মধুপুরে আপনাদের সঙ্গে যখন দেখা হল, আমি ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। হয়তো ছেলেবেলা থেকেই আপনাকে জানবার বুঝবার জন্য আমার মনে প্রবল আগ্রহ ছিল। এখনো যে নেই সে কথা জোর করে বলতে পারব না। আমার মনে যত লোকের প্রভাব পড়েছে, বিশ বছর অদৃশ্য থেকেও আপনি তাদের মধ্যে প্রধান হয়ে আছেন।’
অনাথ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভগবান! পৃথিবীতে মানুষ একা বেঁচে থাকতে আসে নি–সকলের এটা যদি সব সময় খেয়াল থাকত? মালতীকে না দেখলে তোমার চলবে না হেরম্ব?’
হেরম্ব ক্ষুন্ন হয়ে বলল, ‘আপত্তি করছেন কেন?’
অনাথ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘দুর্বলতা। মনের দুর্বলতা হেরম্ব, চল।’
শহরের নির্জন উপকণ্ঠে সাদা বাড়িটি পার হয়ে হেরম্বের মনে হল, এইখানে শহর শেষ হয়েছে। অনেকক্ষণ সমুদ্রের অর্থহীন অবিরাম কলরব শুনে হেরম্বের মস্তিষ্ক একটু শ্ৰান্ত হয়ে। পড়েছিল। এখানে সমুদ্রের ডাক মৃদুভাবে শোনা যায়। হেরম্বের নিজেকে হঠাৎ ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল। অনাথ গভীর চিন্তামগ্ন অন্যমনস্ক অবস্থায় পথ চলছে। হেরম্ব তাকে প্রশ্ন করে জবাব পায় নি একটারও। বেলা আর বেশি অবশিষ্ট নেই। পথের দুপাশে খোলা মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে রাখালেরা গরুগুলিকে একত্রে করছে। পথ সোজা এগিয়ে গিয়েছে সামনে।
আরো খানিকদূর গিয়ে হেরম্ব ভাঙা প্রাচীরে ঘেরা বাগানটি দেখতে পেল। সামনে পৌঁছে হঠাৎ সচেতন হয়ে অনাথ বলল, ‘এই বাড়ি।’
কোথায় বাড়ি? বাড়ি হেরম্ব দেখতে পেল না। বাগানের শেষের দিকে গাছপালায় প্রায় আড়াল-করা ছোট একটি মন্দির মাত্র তার চোখে পড়ল। বাগানে গোলাপ গন্ধরাজ ফোটে কিনা বাইরে থেকে অনুমান করার উপায় ছিল না। যে গাছে হয়তো ফুল ফোটে কিন্তু গন্ধ দেয় না, যে গাছের ফল অথবা পাতা মানুষে খায়, তাই দিয়ে বাগানটিকে ঠেসে ভর্তি করা হয়েছে। সমস্ত বাগান জুড়ে গাছের নিবিড় ছায়া আর অস্বাভাবিক স্তব্ধতা।
কাঠের ভগ্নপ্রায় গেটটি খুলে অনাথ বাগানে প্রবেশ করল। তাকে অনুসরণ করে বাগানের মধ্যে প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে হেরম্বের মনে হল এ যেন একটা পরিবর্তন, একটা অকস্মাৎ সংঘটিত বৈচিত্ৰ্য। মানুষের অশান্ত কলরব ভরা পৃথিবীতে, ভাঙা প্রাচীরের আবেষ্টনীর মধ্যে এমন সংক্ষিপ্ত একটি স্থানে এই মৌলিক শান্ত আবহাওয়াটি অক্ষুন্ন থাকা হেরম্বের কাছে বিস্ময়ের মতো প্রতিভাত হল।
বাগানের সরু পথটি ধরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গাছের পর্দা পার হয়ে তারা দাঁড়াল। এখানে খানিকটা স্থান একেবারে ফাঁকা। সামনে সেই পথ থেকে দেখা যায় মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণে অল্প তফাতে পুরোনো একটি ইটের বাড়ি। মন্দির আর বাড়ি দুই-ই নোনাধরা।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। দরজার সামনে ফাটলধরা চত্বরে গরদের শাড়ি-পরা স্কুলাঙ্গী একটি রমণী বসে ছিল। যৌবন তার যাব যাব করছে। কিন্তু গায়ের রং অসাধারণ উজ্জ্বল। চেহারা জমকালো, গম্ভীর।
‘কাকে আনলে গো? অতিথি নাকি?’
শ্লেষ্মাজড়িত চাপা গলা। হেরম্ব একটু অভিভূত হয়ে পড়ল।
অনাথ বলল, ‘চিনতে পারবে মালতী। কলকাতায় তোমাদের বাড়ির পাশে থাকত। নাম হেরম্ব। মধুপুরেও একবার দেখেছিলো।’
মালতী বলল, ‘চিনেছি। তা ওকে আবার ধরে আনবার কি দরকার ছিল! যাক এনেছ যখন, কি আর হবে? বোস বাছা! আহা, সিঁড়িতেই বোস না, মন্দিরের সিঁড়ি পবিত্র। কাপড় ময়লা হবার ভয় নেই, দুবেলা সিঁড়ি ধোয়া হচ্ছে।…তুমি বুঝি গিয়েছিলে সমুদ্রে? একদিন সমুদ্রে না গেলে নয়। যদি গেলেই, বলে কি যেতে নেই?’
অনাথ বলল, ‘আসন থেকে উঠেই চলে গিয়েছিলাম মালতী। তোমাকে বলে যাওয়ার কথা মনে ছিল না।’
মালতী বলল, ‘তবু ভালো, কথার একটা জবাব পেলাম। শহর হয়ে এলে, আমার জিনিসটা আনলে না যে? কাল থেকে পইপই করে বলছি।‘
অনাথ বলল, ‘তোমাকে তো কবে বলে দিয়েছি ওসব আমি এনে দেব না।’
মালতী উষ্ণ হয়ে বলল, ‘কেন, দেবে না কেন? তোমার কি এল গেল।’
‘গোল্লায় যেতে চাও তুমি নিজে নিজেই যাও। আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত নই।’
‘কেতাৰ্থ করলে! আমাকে গোল্লায় এনেছিল কে বের করে? পরের কাছে অপমান করা হচ্ছে!’
মালতী হঠাৎ হেসে উঠল–‘তুমি না। এনে দিলেও আমার এনে দেবার লোক আছে, তা মনে রেখা।–চললে কোথায় শুনি?’
‘স্নান করব?–সংক্ষেপে এই জবাব দিয়ে অনাথ বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘শহর থেকে কি জিনিস আনবার কথা ছিল?’
‘আমার একটা ওষুধ।’ বলে মালতী গম্ভীর হয়ে গেল। তার গাম্ভীর্য হেরম্বকে বিস্মিত করতে পারল না। সে টের পেয়েছিল মালতীর উচ্চ হাসি এবং মুখভার কোনোটাই সত্য অথবা স্থায়ী নয়। যে কোনো মুহূর্তে একটা অন্তৰ্ধান করে আর একটা দেখা দিতে পারে। এর প্রমাণ দেবার জন্যই যেন মালতীর মুখে হঠাৎ হাসি দেখা গেল, ‘কাণ্ড দেখলে লোকটার? তোমায় ডেকে এনে স্নান করতে চলে গেল। জ্বলিয়ে মারে। জানলে? জ্বলিয়ে মারে!…তুমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছ।’
‘আশ্চৰ্য নয়। বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে।’
‘তাই বটে! আমি কি আজকে বাড়ি ছেড়েছি! কত যুগ হয়ে গেল। দাঁড়াও, কত বছর হল যেন! কুড়ি। ষোল বছর বয়সে বেরিয়ে এসেছিলাম, আমার তবে ছত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। আঃ কপাল, বুড়ি হয়ে পড়লাম যে! কাণ্ড দ্যাখ!’
হেরম্বকে আগাগোড়া সে ভালো করে দেখল।
‘তোমায় তো বেশ ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে? সাতাশ-আটাশের বেশি বয়স মনে হয় না। তুমি একদিন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে গো! তখন হেসে না মরে যদি রাজি হয়ে যেতাম! আমার তাহলে আজ দিব্যি একটি কচি সুপুরুষ বর থাকত।’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘মাস্টারমশায় তখন যে রকম সুপুরুষ ছিলেন–’
‘মনে আছে?’ মালতী সংগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘বল তো, সেই মানুষকে এখন দেখলে চেনা যায়? আমার বরং এখনো কিছু কিছু রূপ আছে। দেখে তুমি মুগ্ধ হচ্ছ না?’
‘না। ছেলেবেলা মুগ্ধ করে যে কষ্টটাই দিয়েছেন।–’
‘তাই বলে এখন মুখের ওপর মুগ্ধ হচ্ছে না বলে প্রতিশোধ নেবে? তুমি তো লোক বড় ভয়ানক দেখতে পাই। বিয়ে করেছ?’
‘করেছিলাম। বৌটি স্বর্গে গেছে।’
‘ছেলেমেয়ে?’
‘একটা মেয়ে আছে, দু বছরের। আছে বলছি। এই জন্য যে পনের দিন আগে ছিল দেখে এসেছি। এর মধ্যে মরে গিয়ে থাকলে নেই।’
‘বালাই ষাট, মরবো কেন! এখন তুমি কি করছ?’
‘কলেজে মাস্টারি করি।’
‘বৌয়ের জন্য বিবাগী হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড় নি তো?’
‘না। সারাবছর ছেলেদের শেলি কীটুস পড়িয়ে একটু শ্ৰান্ত হয়ে পড়ি মালতী—বৌদি। গরমের ছুটিতে তাই একবার করে বেড়াতে বেরুনো অভ্যোস করেছি। এবার গিয়েছিলাম রাচি। সেখান থেকে বন্ধুর নেমন্তন্ন রাখতে এসেছি। এখানে।’
‘বন্ধু কে?’
‘শঙ্কর সেন, ডেপুটি।’
‘বেশ লোক। বৌটি ভারি ভক্তিমতী। এই মন্দির সংস্কারের জন্য এক শ টাকা দান করেছে।’
মালতী ভাবতে ভাবতে এই কথা বলছিল, অন্যমনস্কের মতো। হঠাৎ সে একটু অতিরিক্ত। আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এখানে কতদিন থাকবে?’
‘দশ-পনের দিন। ঠিক নেই।’
‘ভালোই হল।’
মালতী হাসল।
‘তোমাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। তাই বললাম। ছেলেদের তুমি কি পড়াও বললে?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘কবিতা পড়াই। ভালো ভালো ইংরেজ কবির বাছা বাছা খারাপ কবিতা। বেঁচে থেকে সুখ নেই মালতী-বৌদি।’
আকস্মিক দার্শনিক মন্তব্যে মালতী হাসল। গলার শ্লেষ্মা সাফ করে বলল, ‘সুখ? নাই-বা রইল সুখ! সুখ দিয়ে কি হবে? সুখ তো শুটকি মাছ! জিভকে ছোটলোক না করলে স্বাদ মেলে না। সুখ স্থান জুড়ে নেই, প্রেম দিয়ে ভরে নাও, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করা। সুবিধা কত! মদ নেই যদি, মদের নেশা সুধায় মেটাও। ব্যস, আর কি চাই?’
হেরম্ব মালতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিন সুধা।’
‘আমি দেব?’ মালতী জোরে হেসে উঠল, ‘আমার কি আর সে বয়স আছে!’
‘তবে একটু জল দিন। তেষ্টা পেয়েছে।’
‘তা বরং দিতে পারি।’ বলে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, আনন্দ! একবার বাইরে শুনে যাও!’
‘আনন্দ কে?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।
‘আমার অনন্ত আনন্দ! মনে নেই? মধুপুরে দেখেছিলে! চুমু খেয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলে!’
‘ওঃ আপনার সেই মেয়ে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘ভুলে গিয়েছিলে? তুমি অবাক মানুষ হেরম্ব! সে কি আমার ভুলবার মতো মেয়ে?’
হেরম্ব বলল, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কথা আমার মনে থাকে না মালতী—বৌদি। আপনার মেয়ে তখন খুব ছোটই ছিল নিশ্চয়?’
মালতী স্বীকার করে বলল, ‘নিশ্চয় ছোট ছিল। ছোট না থাকলে চুমু খেয়ে তাকে কাঁদাতে কি করে তুমি! তাছাড়া, তখন ছোট না থাকলে মেয়ে তো আমার এ্যাদিনে বুড়ি হয়ে যেত!’
তার পর এল আনন্দ।
আনন্দকে দেখে হেরম্ব হঠাৎ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ল। আনন্দ অন্সরী নয়, বিদ্যাধরী নয়, তিলোত্তম নয়, মোহিনী নয়। তাকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হওয়া যায়, উত্তেজিত হয়ে ওঠার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু হেরম্বের কথা আলাদা। এই মালতীকে নয়, সত্যবাবুর মেয়ে মালতীকে সে আজো ভুলতে পারে নি! এই স্মৃতির সঙ্গে তার মনে বার বছর বয়সের খানিকটা ছেলেমানুষ, খানিকটা কাঁচা ভাবপ্রবণতা আজো আটকে রয়ে গিয়েছে। আনন্দকে দেখে তার মনে হল সেই মালতীই যেন বিশ্বশিল্পীর কারখানা থেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত হয়ে, গত বিশ বছর ধরে প্রকৃতির মধ্যে, নারীর মধ্যে, বোবা পশু ও পাখির মধ্যে, ভোরের শিশির আর সন্ধ্যাতরার মধ্যে রূপ, রেখা ও আলোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাকে তৃপ্ত করার যোগ্যতা অর্জন করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শীতকালের ঝরা শুকনো পাতাকে হঠাৎ এক সময় বসন্তের বাতাস এসে যে ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আনন্দের আবির্ভাবও হেরম্বের জীৰ্ণ পুরাতন মনকে তেমনিভাবে নাড়া দিয়ে দিল।
বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে সে আনন্দকে দেখতে লাগল। তার মনের উপর দিয়ে কুড়ি বছর ধরে যে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে, তাই যেন কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে এসেছে।
এই উচ্ছ্বসিত আবেগ হেরম্বের মনে প্রশ্ৰয় পায়। আবেগ আরো তীব্র হয়ে উঠলেই সে যেন তৃপ্তি পেত। তার বন্দি কল্পনা দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ যেন আজ মুক্তি পায়। তার সবগুলি ইন্দ্ৰিয় অসহ্য উত্তেজনায় অসংযত প্ৰাণ সঞ্চয় করে। চারিদিকের তরুলতা তার কাছে অবিলম্বে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষ অপরান্ত্রের রঙিন সূর্যালোককে তার মনে হয় চারিদিকে ছড়িয়ে-পড়া রঙিন স্পন্দমান জীবন।
বাড়ির দরজা থেকে কাছে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত আনন্দ হেরম্বকে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে। দেখেছিল। সে এসে দাঁড়ানো মাত্র হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল। কৌতূহল অন্তর্হিত হয়ে আনন্দের চোখে তখন ঘনিয়ে এল ভাব ও ভয়। হেরম্ব এটা লক্ষ করেছে। সে জানে এই ভয় ভীরুতার লক্ষণ নয়, মোহের পরিচয়। আনন্দের চোখে যে প্রশ্ন ছিল, হেরম্বের নির্বাক নিষ্ক্রিয় জবাবটা তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।
সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এসে হেরম্বের যা হয় নি, এখন তাই হল। নিজের কাছে নিজের মূল্য তার অসম্ভব বেড়ে গেল। সে জটিল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ সুস্থ মানুষ সে নয়। মন তার সর্বদা অপরাধী, অহরহ তাকে আত্মসমর্থন করে চলতে হয়। জীবনে সে এত বেশি পাক খেয়েছে যে মাথা তার সর্বদাই ঘোরে। আনন্দ, পুলক ও উল্লাস সংগ্ৰহ করা আজ তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু আনন্দ আজ তাকে আর তার দৃষ্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, বিচলিত হয়ে তাকে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত করে দিয়েছে। তার দেহ,মন হঠাৎ হাল্কা হয়ে গিয়েছে। তার মনে ভাষার মতো স্পষ্ট হয়ে এই প্রার্থনা জেগে উঠেছে, আনন্দ যেন চলে যাবার আগে আর একবার তার দিকে এমনিভাবে তাকিয়ে যায়।
‘ডাকলে কেন মা?’ আনন্দ মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল।
‘এঁকে এক গেলাস জল এনে দে।‘
আনন্দ জল আনতে চলে গেলে হেরম্ব যেন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। অনেকদিন আগে অস্ত্রোপচারের জন্য তাকে একবার ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল। সেই সময়কার অবর্ণনীয় অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে।
মালতী নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রকম দেখলে আমার আনন্দকে?’
‘বেশ, মালতী-বৌদি।’
‘আঠার বছর আগে ওকে কোলে পেয়েছিলাম হেরম্ব। জীবনে আমার দুটি সুদিন এসেছে। প্রথম, তোমার মাস্টারমশায় যেদিন দাদাকে পড়াতে এলেন, অন্দরের জানালায় অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে আমি লোকটাকে দেখলাম, সেদিন। আর যেদিন আনন্দ কোলে এল। প্রসববেদনা জান?’
হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘জানি।‘
‘জান! পাগল নাকি, তুমি কি করে জানবে!’
‘আমি এককালে কবিতা লিখতাম যে মালতী-বৌদি!’
‘কবিতা লেখা আর প্রসববেদনা কি এক? মাথা খারাপ না হলে কেউ এমন কথা বলে! তোমাতে আর ভগবান লক্ষ্মীছাড়াতে তাহলে আর কোনো প্রভেদ থাকত না বাপু। আমরা প্রসব করি ভগবানের কবিতাকে, তার তুলনায় তোমাদের কবিতা ইয়ার্কি ছাড়া আর কি! যাই হোক, আনন্দকে দেখে আমি সেদিন প্রসববেদনা ভুলে গেলাম হেরম্ব।’
‘সব মা-ই তাই যায়, মালতী—বৌদি।‘
‘মালতী রাগ করে বলল, ‘তুমি বড় রূঢ় কথা বল হেরম্ব।’
আনন্দ জল আনলে গেলাস হাতে নিয়ে হেরম্ব বলল, ‘বোসে আনন্দ।‘
আনন্দ অনুমতির জন্য মালতীর মুখের দিকে তাকাল।
মালতী বলল, ‘বোস লো ছুঁড়ি, বোস। এ ঘরের লোক। কেমন ঘরের লোক জানিস? আমার ছেলেবেলার ভালবাসার লোক। ওর যখন বার বছর বয়স আমাকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। রোজ সন্দেশ-টন্দেস খাইয়ে কত কষ্টে যে তুলিয়ে রাখতাম, সে কেবল আমিই জানি। হাসিস ক্যানো লো! একি হাসির কথা? বিশ বছর ধরে খুঁজে খুঁজে তোর বোপকে খুন করতে এসেছে, তা জানিস্?’
আনন্দ বলল, ‘কি সব বলছ মা? এর মধ্যেই…’
‘এর মধ্যেই কি লো? বল না, এর মধ্যেই কি বলছিস্!’
‘কিছু না মা। চুপ কর।’ মালতী কিন্তু ছাড়ল না।
‘এর মধ্যেই গিলেছি নাকি আজ, এই তো বলছিলি? না গিলি নি! কারণ হল সাধনে, বসার জন্য, যখন তখন আমি ওসব গিলি না বাপু।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কি মালতী—বৌদি? মদ?’
‘মদ নয়। কারণ। ধর্মের জন্য একটু একটু খাওয়া, এই আর কি!’
আনন্দ বলল, ‘মদ খাওয়া হল ধর্ম!’
মালতী বলল, ‘নয়? এবার বাবা এলে শুধোস্।’ মালতী হেরম্বের দিকে তাকল, ‘বাবার আদেশে একটু একটু খাই হেরম্ব। প্রথমে হয়েছিলাম। বৈষ্ণব–ভক্তিমোর্গ পোষাল না। এবার তাই জোরালো সাধনা ধরেছি। বাবা বলেন।–’
‘বাবা কে?’
‘আমার গুরুদেব। শ্ৰীমৎ স্বামী মশালবাবা!–নাম শোন নি? দিবারাত্রি মশাল জ্বেলে সাধন করেন।’ মালতী যুক্ত কর কপালে ঠেকাল।
আনন্দ বলল, ‘কারণ খাওয়া যদি ধর্ম মা, আমি সেদিন একটু খেতে চাইলাম বলে মারতে উঠেছিলে কেন? কাল থেকে আমিও পেট ভরে ধর্ম করব মা।’
হেরম্ব ভাবে : আনন্দ একথা বলল কেন? সে কারণ খায় না। আমাকে এ কথা শোনাবার জন্যে?
মালতী বলল, ‘করেই দেখিস!’
‘তুমি কর কেন?’
‘আমার ধর্ম করবার বয়স হয়েছে। তুই একরাত্তি মেয়ে, তোর ধর্ম আলাদা। আমার মতো বয়স হলে তখন তুই এসব ধর্ম করবি, এখন কি? যে বয়সের যা। তুই নাচিস্, আমি নাচি?’
আনন্দ হেসে বলল, ‘নেচো না, নোচে। নাচতে তো বাপু একদিন। এখনো এক একদিন বেশি করে কারণ খেলে যে নাচটাই নাচো-’
‘তোর মতো বেয়াদব মেয়ে সংসারে নেই আনন্দ!’
মালতীর পরিবর্তন হেরম্ব বুঝতে পারছিল না। সে মোটা হয়েছে, তার কণ্ঠ কৰ্কশ, তার কথায় ব্যবহারে কেমন একটা নিলাজ রুক্ষতার ভাব। আনন্দের মধ্যস্থতা না থাকলে মালতীর মধ্যে সত্যবাবুর মেয়ের কোনো চিহ্নই খুঁজে না পেয়ে হেরম্ব হয়তো আজ আরো একটু বুড়ো, আরো একটু বিষাদগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। কুড়ি বছরের পুরোনো গৃহত্যাগের ব্যাপারটার উল্লেখ মালতী নিজে থেকেই করেছিল, দ্বিধা করে নি, লজ্জা পায় নি। এটা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে দশ বছরের মধ্যে একদিনের লজ্জাতুরা নববধূ যদি সকলের সামনে স্বামীকে বাজারের ফর্দ দিতে পারে, মালতীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা কুড়ি বছর পরে তুচ্ছ হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। কিন্তু তার, পরিচয় পাবার পরেও কারণ না এনে দেবার জন্য অনাথকে সে তো অনুযোগ পর্যন্ত করেছিল! আনন্দের সঙ্গে তর্ক করে মদকে কারণ নাম দিয়ে ধর্মের নামে নিজেকে সমর্থন করতেও তার বাধে নি। মালতী এভাবে বদলে গিয়েছে কেন? তার ছেলেবেলার রূপকথার অনাথ আজো তেমনি আছে, মালতীকে এভাবে বদলে দিল কিসে?
আনন্দ আর একবারও হেরম্বের দিকে তাকায় নি। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে তাকে না দেখে হেরম্বের উপায় ছিল না। ওর সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা তার মনে এসেছে যে, মালতীর পরিবর্তন যদি বেশি। দিনের হয় আনন্দের চরিত্রে হয়তো ছাপা পড়েছে। আনন্দের কথা শুনে, হাসি দেখে, মালতীর দেহ দিয়ে নিজেকে অর্ধেক আড়াল করে ওর বসবার ভঙ্গি দেখে মনে হয় বটে যে, সত্যবাবুর মেয়ের মধ্যে যেটুকু অপূর্ব ছিল, যতখানি গুণ ছিল, শুধু সেইটুকুই সে নকল করেছে; মালতীর নিজের অর্জিত অমার্জিত রুক্ষতা তাকে স্পর্শ করে নি। কিন্তু সেইসঙ্গে এই কথাটাও ভোলা যায় না যে, যে আবহাওয়া মালতীকে এমন করেছে আনন্দকে তা একেবারে রেহাই দিয়েছে।
মালতীর উপর হেরম্বের রাগ হতে থাকে। এমন মেয়ে পেয়েও তার মা হয়ে থাকতে না পারার অপরাধের মার্জনা নেই। মালতী আর যাই করে থাক হেরম্ব বিনা বিচারে তাকে ক্ষমা করতে রাজি আছে, মদ খেয়ে ইতিমধ্যে সে যদি নরহত্যাও করে থাকে। সে চোখ-কান বুজে তাও সমর্থন করবে। কিন্তু মা হয়ে আনন্দকে সে যদি মাটি করে দিয়ে থাকে, হেরম্ব কোনোদিন তাকে মার্জনা করবে না।
খানিক পরে অনাথ বেরিয়ে এল। স্নান সমাপ্ত করে এসেছে।
‘আমার আসন কোথায় রেখেছি মালতী?’
মালতী বলল, ‘জানি না। হ্যাঁগা, স্নান যদি করলে আরতিটা আজ তুমিই করে ফেল না? বড় আলসেমি লাগছে আমার।’
অনাথ বলল, ‘আমি এখুনি আসনে বসব। আরতির জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না।’
‘একজনকে বাড়িতে ডেকে এনে এমন নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারলে আসনে বসব? কে তোমার অতিথিকে আদর করবে শুনি? স্বার্থপর আর কাকে বলে! সন্ধ্যা হতেই-বা। আর দেরি কত, এ্যাঁ?’
অনাথ তার কথা কানে তুলল না। এবার আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার আসন কে সরিয়েছে আনন্দ?’
‘আমি তো জানিনে বাবা?’
অনাথ শান্তভাবেই মালতীকে বলল, ‘আসনটা কোথায় লুকিয়েছ, বার করে দাও মালতী। আসন কখনো সরাতে নেই এটা তোমার মনে রাখা উচিত ছিল।‘
মালতী বলল, ‘তুমি অমন কর কেন বল তো? বোস না। এখানে—একটু গল্পগুজব কর! এতকাল পরে হেরম্ব এসেছে, দুদণ্ড বসে কথা না কইলে অপমান করা হবে না?’
হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলতে গেল, ‘আমি —’
কিন্তু মালতী তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমাদের ঘরোয়া কথায় তুমি কথা কয়ো না হেরম্ব।’ হেরম্ব আহত ও আশ্চর্য হয়ে চুপ করে গেল। অনাথ তার বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, ‘আমি অপমান করব কল্পনা করে তুমি নিজেই যে অপমান করে বসলে মালতী! কিছু মনে কোরো না হেরম্ব। ওর কথাবার্তা আজকাল এরকমই দাঁড়িয়েছে।‘
হেরম্ব বলল, মনে করার কি আছে!’
মালতীর মুখ দেখে হেরম্বের মনে হল তাকে সমালোচনা করে এভাবে অতিথিকে মান না। দিলেই অনাথ ভালো করত।
অনাথ বলল, ‘আমার চাদরটা কোথায় রে আনন্দ?’
‘আলিনায় আছে–মার ঘরে! এনে দেব?’
‘থাক। আমিই নিচ্ছি গিয়ে। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ হল না বলে অনাদর মনে করে নিও না হেরম্বা। আমার মনটা আজ একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে। আসনে না বসলে স্বস্তি পাব না।?’
হেরম্ব বলল, ‘তা হোক মাস্টারমশায়! আর একদিন কথাবার্তা হবে।‘
মালতী মুখ গোঁজ করে বসেছিল। এইবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাদর দিয়ে হবে কি?’
অনাথ বলল, ‘পেতে আসন করব। আসনটা লুকিয়ে তুমি ভালোই করেছ মালতী। দশ বছর ধরে ব্যবহার করে আসনটাতে কেমন একটু মায়া বসে গিয়েছে। একটা জড় বস্তুকে মায়া করা থেকে তোমার দয়াতে উদ্ধার পেলাম।’
মালতী নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘যা আনন্দ, আমার বিছানার তলা থেকে আসনটা বার করে দিগে যা।‘
অনাথ বলল, ‘থাক, কোজ নেই। ও আসনে আমি আর বসব না।’
মালতী ক্রোধে আরক্ত মুখ তুলে বলল, ‘তুমি মানুষ নও। জানলে? মানুষ তুমি নও! তুমি ডাকাত! তুমি ছোটলোক!’
‘রেগো না মালতী। রাগতে নেই।’
রাখতে নেই, রাগতে নেই! আমার খাবে পরবে, আমাকেই অপমান করবে—রাগতে নেই!’
‘মাথা গরম করা মহাপাপ মালতী।’ —মৃদুস্বরে এই কথা বলে অনাথ বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
খানিকক্ষণ নিঝুম হয়ে থেকে মালতী হঠাৎ তার শদিত হাসি হেসে বলল, ‘দেখলে হেরম্ব? লোকটা কেমন পাগল দেখলে?’
হেরম্ব অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, ‘আমি কি বলব বলুন?’
আনন্দ বলল, ‘বাইরের লোকের সামনেও ঝগড়া করে ছাড়লে তো মা?’
মালতী বলল, ‘হেরম্ব বাইরের লোক নয়।’
হেরম্ব এ কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘না। আমি বাইরের লোক নই আনন্দ।’
আনন্দ বলল, ‘তা জানি। বাইরের লোকের সঙ্গে মা ঠাট্টা-তামাশা করে না। প্রথম থেকে মা আপনার সঙ্গে যেরকম পরিহাস করছিল, তাতে বাইরের লোক হওয়া দূরে থাক, আপনি ঘরের লোকের চেয়ে বেশি প্রমাণ হয়ে গেছেন।’
মালতী বলল, ‘ঘরের লোকের সঙ্গে আমি ঠাট্টা-তামাশা করি নারে, আনন্দ? তামাশা করার কত লোক ঘরে! একটা কথা কওয়ার লোক আছে আমার?’
আনন্দ হাতের তালু দিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর পিঠ ঘষে দিতে দিতে বলল, ‘ঘরে নাই-বা লোক রইল মা, তোমার কাছে বাইরের কত লোক আসে, সমস্ত সকালটা তুমি তাদের সঙ্গে কথা কও।’
পিঠ থেকে মেয়ের হাত সামনে এনে মালতী বলল, ‘তারা হল ভক্ত, লক্ষ্মীছাড়ার দল। ওদের ঠকাতে ঠকাতেই প্ৰাণটা আমার বেরিয়ে গেল না! খাচ্ছিস্ দাচ্ছিাস, মনের সুখে আছিস্, লোককে ঠকিয়ে পয়সা করতে কেমন লাগে তুই তার কি বুঝবি! সারা সকালটা গম্ভীর হয়ে বসে বসে শুধু ভাব, কি করে কার কাছে দুটো পয়সা বেশি আদায় হবে। আমি মেয়েমানুষ, আমার কি ওসব পোষায়! তোর বাবা একটা পয়সা রোজগার করে? একবার ভাবে, দিন গেলে পোড়া পেটে পিণ্ডি কোথা থেকে আসে? তুই ভাবিস?’
আনন্দ অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘ওঁর কাছে তুমি সব প্রকাশ করে দিচ্ছ মা!’
এই অভিযোগে মালতী কিছুমাত্র বিচলিত হল না, বলল, ‘তাতে কি, যা করছি জেনেশুনেই করছি। হেরম্ব লুকোচুরি ভালবাসে না।’
এই ব্যাখ্যা অথবা কৈফিয়ত হেরম্বের মনে লাগল। সে বুঝতে পারল তার মতামতকে অগ্রাহ্য করে বলে নয়, শেষপর্যন্ত তার কাছে কোনো কথাই লুকানো থাকবে না বলেই মালতী কোনো বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় গ্রহণ করছে না। নিজের এবং নিজেদের সঠিক পরিচয় আগেই তাকে জানিয়ে রাখছে।
এর মধ্যে আরো একটা বড় কথা ছিল, হেরম্বকে যা পুলকিত করে দিল। মালতী আশা করে আজই শেষ নয়, সে আসা-যাওয়া বজায় রাখবে। ভূমিকাতে তার সামনে নিজের সব দুর্বলতা ধরে দিয়ে মালতী শুধু এই সম্ভাবনাই রহিত করে দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে তার যেন আবিষ্কার করার কিছুই না থাকে। হেরম্বের মনে হল এ যেন একটা আশ্বাস, একটা কাম্য ভবিষ্যৎ। সে বার বার আসবে এবং তাদের সঙ্গে এতদূর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে যে মালতীর খাপছাড়া জীবনের সমস্ত দীনতা ও অসঙ্গতি সে জেনে ফেলবে, মালতীর এই প্রত্যাশা নানা সম্ভাবনায় হেরম্বের কাছে বিচিত্র ও মনোহর হয়ে উঠল। মালতীর এই মৌলিক আমন্ত্রণে তার হৃদয় ও প্রফুল্ল হয়ে রইল।
‘একথা মিথ্যা নয় মালতী—বৌদি। আমার কাছে কিছুই গোপন করবার দরকার নেই।’
‘গোপন করার কিছু নেই-ও হেরম্ব।’
‘কি থাকবে?’
‘তাই বলছি। কিছুই নেই।’
একটা যেন চুক্তি হয়ে গেল। মালতী স্বীকার করল সে কারণ পান করে, লোক-ঠকানো পয়সায় জীবিকা নির্বাহ করে। হেরম্ব ঘোষণা করুল, তাতে কিছু এসে যায় না।
জীবন মালতীকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। হয়তো সে শিক্ষা হৃদয় সংক্রান্ত নয়। কিন্তু তার তীক্ষ্ম বুদ্ধিতে সন্দেহ করা চলে না।
কিন্তু আনন্দ?
আনন্দের হৃদয় কি প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও মার্জনা পায় নি? ওর জমকালো বাইরের রূপ তো ওর হৃদয়কে ছাপিয়ে নেই? —হেরম্ব এই কথা ভাবে। মালতী যে মেয়েকে কুশিক্ষা দেবে তার এ আশঙ্কা কমে এসেছিল। সে ভেবে দেখেছে, মালতী ও আনন্দের জীবন এক নয়। যে সব কারণ মালতীকে ভেঙেছে, আনন্দের জীবনে তার অস্তিত্ব হয়তো নেই। তাছাড়া ওদিকে আছে অনাথ। মেয়েরা মার চেয়ে পিতাকেই নকল করে বেশি, পিতার শিক্ষাই মেয়েদের জীবনে বেশি কার্যকরী হয়। অনাথের প্রভাব আনন্দের জীবনে তুচ্ছ হতে পারে না। মালতীর সঙ্গে পরিচয় করে মানুষ যে আজকাল খুশি হতে পারে না, অনাথ সমুদ্রতীরে একথা স্বীকার করেছে। অনাথের যদি এই জ্ঞান জন্মে থাকে, মেয়ের সম্বন্ধে সে কি সাবধান হয় নি?
অনাথ ওস্তাদ কারিগর, হৃদয়ের প্রতিভাবান শিল্পী। আনন্দ হয়তো তারই হাতে গড়া মেয়ে। হয়তো মালতীর বিরুদ্ধ-প্রভাবকে অনাথের সাহায্যে জয় করে তার হৃদয়-মনের বিকাশ আরো বিচিত্র, আরো অনুপম হয়েছে। ঘরে বসে হৃদয়ের দলগুলি মেলবার উপায় মানুষের নেই, মনের সামঞ্জস্য ঘরে সঞ্চয় করা যায় না। মন্দের সম্পর্কে না এলে ভালো হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। জীবনের রুক্ষ কঠোর আঘাত না পেলে মানুষ জীবনে পঙ্গু হয়ে থাকে, তরল পদার্থের মতো তার কোনো নিজস্ব গঠন থাকে না। আনন্দ হয়তো মালতীর ভিতর দিয়ে পৃথিবীর পরিচয় পেয়ে সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। টবের নিস্তেজ অসুস্থ চারাগাছ হয়ে থাকার বদলে মালতীর সাহায্যেই হয়তো সে পৃথিবীর মাটিতে আশ্রয় নেবার সুযোগ পেয়েছে, রোদ বৃষ্টি গায়ে লাগিয়ে আগাছার সঙ্গে লড়াই করে ও মাটির রস আকর্ষণ করে বেড়ে ওঠা তিরুর মতো সতেজ, সজীব জীবন আহরণ করতে পেরেছে।
কিছুক্ষণের জন্য তিনজনেই নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। অনাথের কিছু দরকার আছে কিনা দেখতে গিয়ে আনন্দ সমস্ত মুখ ভালো করে ধুয়ে এসেছে। হেরম্বের দৃষ্টিকে চোখে না দেখেও তার মুখে যে অল্প অল্প রক্তের ঝাজ ও রং সঞ্চারিত হচ্ছিল বোধহয় সেইজন্যই। তবে আনন্দের সম্বন্ধে কোনো বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবার সাহস হেরম্বের ছিল না। তার যতটুকু বোধগম্য হয় আনন্দের প্রত্যেকটি কথা ও কাজের যেন তারও অতিরিক্ত অনেক অর্থ আছে।
আনন্দ বলল, ‘আজ আরতি হবে না মা?’
‘হবে।’
‘এখনো যে মন্দিরের দরজাই খুললে না?’
‘তোর বুঝি খিদে পেয়েছে? প্ৰসাদের অপেক্ষায় বসে না থেকে কিছু খেয়ে তো তুই নিতে পারিস আনন্দ?’
‘খিদে পায় নি মা। খিদে পেলেও আজ খাচ্ছে কে?’
মালতী তার মুখের দিকে তাকাল।
‘কেন, খাবি না কেন? নাচবি বুঝি আজ?’
আনন্দ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। এখন নয়। চাঁদ উঠুক, তারপর।’
‘আজ আবার তোর নাচবার সাধ জাগল! তোকে নাচ শিখিয়ে ভালো করি নি আনন্দ। রোজ রোজ না খেয়ে–’
আনন্দ নিরতিশয় আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘অনেক রাত্রে আজ চন্দ্ৰকলা নাচটা নাচব মা।’
‘তারপর রাত্রে না খেয়ে ঘুমোবি তো?’
‘ঘুমোলাম-বা! একরাত না খেলে কি হয়? আজ পূর্ণিমা তা জান?’
মালতী বলল, ‘আজ পূর্ণিমা নাকি? তাই কোমরটা টনটন করছে, গা ভারি ঠেকছে।’
হেরম্ব কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নাচতে পার নাকি আনন্দ?’
মালতী বলল, ‘পারবে না? আর কিছু শিখেছে নাকি মেয়ে আমার। গুণের মধ্যে ওই এক গুণ–নাচতে শিখেছেন। দুটি লোকের রান্না করতে দাও —মেয়ে চোখে অন্ধকার দেখবেন!’
আনন্দ হেসে বলল, ‘মিথ্যে আমার নিন্দ কোরো না মা! বাবাকে দুবেলা রোধে দেয় কে?’
‘যে রান্নাই রোধে দিস, ও তোর বাপ ছাড়া আর কেউ মুখেও করবে না।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু রাধি তো! বসে বসে খাই আর নাচি এ কথা বলতে হয় না।’
হেরম্ব বলল, ‘আমি তোমার নাচ দেখতে পারি আনন্দ?’
‘খুব। কেন পারবেন না? এ তো থিয়েটারের নোচ নয় যে দেখতে পয়সা লাগবে! কিন্তু আপনি কি অতক্ষণ থাকবেন?’
‘থাকতে দিলেই থাকব।‘
মালতী বলল, ‘থাকবে বৈকি। তুমি আজ এখানেই খাবে হেরম্ব।’
আনন্দ হেসে বলল, ‘নেমন্তান্ন তো করলে, ঘরের লোকটিকে খাওয়াবে কি মা?’
‘আমরা যা খাই তাই খাবে।’
‘তার মানে উপোস। আজ পূর্ণিমার রাত, তুমি একটু দুধ খাবে, আমি কিছুই খাব না। অতিথিকে খাওয়াবার বেশ ব্যবস্থাই করলে মা।’
মালতী বলল, ‘তোর কথার, জনিস আনন্দ, ছিরিছাদ নেই। আমরা খাই বা না খাই একটা অতিথির পেট ভরাবার মতো খাবার ঘরে নেই নাকি!’
আনন্দে মুচকে হেসে বলল, ‘তাই বল! আমরা যা খাব ওঁকেও তাই খেতে হবে বললে কিনা, তাই ভাবলাম ওঁর জন্যেও বুঝি উপোসের ব্যবস্থা হচ্ছে।’
হেরম্ব ভাবে, মাকে মধ্যস্থ রেখে আমার সঙ্গে আলাপ করা কেন? এতক্ষণ যত কথা বলেছে। সব আমাকে শোনাবার জন্য, কিন্তু নিজে থেকে সোজাসুজি আনন্দ আমাকে একটা কথাও বলে নি। আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে, আমার কথার পিঠে দরকারি কথাও চাপিয়েছে কিন্তু আমাকে এখন পর্যন্ত কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। আমার সম্বন্ধে ওর যে বিন্দুমাত্র কৌতূহল আছে তার নিরীহতম প্রকাশটিকেও অনায়াসে সংযত করে চলেছে। আমাকে এভাবে অবহেলা দেখানোর মানে কি? আমাকে একটা নিজস্ব ছোট্ট প্রশ্ন ওতো অনায়াসে করতে পারে, একটা বাজে অবান্তর প্রশ্ন!’
‘আপনি কি ভাবছেন?’
হেরম্ব চমকে উঠে ভাবল, মনের প্রার্থনা আমি তো উচ্চারণ করে বসি নি। তাকে অত্যন্ত চিন্তিত ও অন্যমনস্ক দেখে আনন্দ এই প্রশ্ন করেছিল, তার অপ্রকাশিত মনোভাবকে অনুমান করে নয়। এর চেয়ে বিস্ময়কর যোগাযোগও পৃথিবীতে ঘটে থাকে। কিন্তু হেরন্থের মনে হল, একটা অঘটন ঘটে গেছে, এই নিয়মচালিত জগতে একটা অত্যাশ্চর্য অনিয়ম। সে খুশি হয়ে বলল, ‘ভাবছি, তুমি আমার মনের কথা জানলে কি করে।’
আনন্দ ভুকুঞ্চিত করে বলল, ‘আপনার মনের কথা কখন জানলাম?’
‘এইমাত্র।’
‘কি বলছেন, বুঝতে পারছি না।’
‘হেঁয়ালি করছেন?’
হেরম্ব অপ্রতিভা হয়ে বলল, ‘না। হেঁয়ালি করি নি।’
‘তবে ও কথা বললেন কেন, আপনার মনের কথা জেনেছি?’
‘এমনি বলেছি। রহস্য করে।’
‘এ কিরকম দুৰ্বোধ্য রহস্য! আমি ভাবলাম, একটা কিছু মজার কথা বুঝি আপনার মনে হয়েছে, এটা তার ভূমিকা। শেষে ব্যাখ্যা করে আমাদের হাসিয়ে দেবেন।’
হেরম্ব ইতিমধ্যে আত্মসংবরণ করেছে।
‘তাই মনে ছিল আনন্দ। শেষে ভেবে দেখলাম, ব্যাখ্যা না করেই হাসিয়ে দেওয়া ভালো।‘
‘এটা এখুনি বানিয়ে বললেন।’
‘নিশ্চয়ই। সঙ্গে সঙ্গে না বানাতে পারলে চলবে কেন? হাসির কথা আধামিনিটে পচে যায়।’
‘আর হাসি? হাসি কতক্ষণে পচে যায়? আপনার কথাটা শুনে এমন সব অদ্ভুত কথা মনে হচ্ছে! আচ্ছা, আপনি কখনো ভেবেছেন হাসতে হাসতে মানুষ হঠাৎ কেন থেমে যায়? সিদ্ধি খেয়ে যারা হাসে তাদের কথা বলছি না। যারা হঠাৎ খুশি হয়ে হাসে–মজার কথায় হোক, হাসির ব্যাপারে হোক অথবা আনন্দ পেয়েই হোক। হাসতে আরম্ভ করলেই মানুষের এমন কি কথা মনে পড়ে যায়, যার জন্য আস্তে আস্তে হাসি থেমে আসে? তাছাড়া এমন মজা দেখুন, পাগল না হলে মানুষ একা একা হাসতে পারে না। হাসতে হলে কম করে অন্তত দুজন লোক থাকা চাই। ঘরের কোণে বসে নিজের মনে যদিই-বা? কেউ কখনো হাসে তার তখন নিশ্চয়ই এমন একটা কথা মনে পড়েছে যার সঙ্গে অন্য একজন লোকের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। নিছক নিজের কথা নিয়ে কেউ না! হাসে?’
‘না।‘
‘খুব আশ্চর্য না ব্যাপারটা? হাসির কথা পড়লে কিংবা শুনলে মানুষ হাসবে–কেউ হাসবে তবে! হাসবার মতো কিছু হাতের কাছে না থাকলে কেউ মরলেও হাসতে পারবে না। হাসির উপলক্ষটা সব সময় থাকবে বাইরে, আবার তা থেকে তার নিজেকে বাদ থাকতে হবে। এসব কথা ভাবলে আমি একেবারে আশ্চৰ্য হয়ে যাই। হাসি এমন ভালো জিনিস, নিজের জন্য কেউ নিজে তা তৈরি করতে পারবে না! সাধে কি মানুষ দিনরাত মুখ গোজ করে থাকে। মাঝে মাঝে একটু একটু না হেসে মানুষ যদি সব সময় হাসতে পারত!’
মালতী বলল, ‘তোর আজ কি হয়েছে রে আনন্দ? এত কথা কইছিস যে?’
আনন্দ বলল, ‘বেশি কথা বলছি? বলব না! তোমরা থাকবে যে যার তালে, চুপ করে থেকে আমার এদিকে কথা জমে জমে হিমালয় পাহাড়! সুযোগ পেলে বলব না বেশি কথা?’
‘তুই আজ নিশ্চয় চুরি করে কারণ খেয়েছিস!’
‘না গো না, চুরি করে ছাইপােশ খাবার মেয়ে আমি নই। মনের স্ফূর্তির জন্য আমার কারণ খেতে হয় না।’
হেরম্বের কাছে এইটুকু গৰ্ব প্রকাশ করেই আনন্দ বোধহয় নিজেকে এত বেশি প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করে যে, কিছুক্ষণের জন্য মালতীর দেহের আড়ালে নিজেকে সে প্রায় সম্পূর্ণ লুকিয়ে ফেলে। অথচ এ কাজটা সে এমন একটি ছলনার আশ্রয়ে করে যে মালতী বুঝতে পারে না, হেরম্ব বুঝতে ভরসা পায় না।
মালতী বলে, ‘কোমর টনটন করছে বলে তোকে আমি টিপতে বলি নি আনন্দ! এমনি টিপুনিতে যদি ব্যথা কমত। তবে আর ভাবনা ছিল না।’
হেরম্ব শুধু আনন্দের পায়ের পাতা দুটি দেখতে পায়। আঙুল বঁকিয়ে আনন্দ পায়ের নখ সিঁড়ির সিমেন্টে একটা খাজে আটকেছে। হেরম্বের মনে হয়, আনন্দের আঙুলে ব্যথা লাগছে। এভাবে তার নিজেকে ব্যথা দেবার কারণটা সে কোনোমতেই অনুমান করতে পারে না। সিমেন্টের খাজ থেকে আনন্দের আঙুল ক’টিকে মুক্ত করে দেবার জন্য তার মনে প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়। একটি নিরীহ ছোট কালো পিঁপড়ে, যারা কখনো কামড়ায় না। কিন্তু একটু ঘষা পেলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে প্রাণ দেয়, সেই জাতের একটি অতি ছোট পিঁপড়ে, আনন্দের আঙুলে উঠে হেরম্বের চেতনায় নিজের ক্ষীণতম অস্তিত্বকে ঘোষণা করে দেয়। হেরম্ব তাকে স্থানচ্যুত করতে গিয়ে হত্যা করে ফেলে।
আনন্দ বলে, ‘কি?’
‘একটা পোকা।’
‘কি পোকা?’
‘বিষপিঁপড়ে বোধহয়।’
মালতী বলে, ‘একটা বিষপিঁপড়ে তাড়াতে তুমি ওর পায়ে হাত দিলে!–আহা কি করিস আনন্দ, করিস নে পায় হাত দিয়ে প্ৰণাম করিম না। কুমারীর কাউকে প্ৰণাম করতে নেই জানিন নে তুই?’
আনন্দ হেরম্বকে প্রণাম করে বলল, ‘তোমার ওসব অদ্ভুত তান্ত্রিক মত আমি মানি না মা।’
হেরম্বের আশঙ্কা হয় মেয়ের অবাধ্যতায় মালতী হয়তো রেগে আগুন হয়ে উঠবে। কিন্তু তার পরিবর্তে মালতীর দুঃখই উথলে উঠল।
‘আগেই জানি কথা শুনবে না! এ বাড়িতে কেউ আমার কথা শোনে না হেরম্বা। আমি এখানে দুইিটরও অধম। কত গুর বাপ, দেখতে কথা শোনার কি ঘটা মেয়ের! আমি তুচ্ছ মা বৈ তো নই।’
তার এই সকরুণ অভিযোগে হেরম্বের সহানুভূতি জাগে না। আনন্দ মাির অবাধ্য জেনে সে খুশিই হয়ে ওঠে। আনন্দ বাপের দুলালী মেয়ে এ যেন তারই ব্যক্তিগত সৌভাগ্য। আনন্দের সম্বন্ধে প্রথমে তার যে আশঙ্কা জেগেছিল এবং পরে যে আশা করে সে এই আশঙ্কা কমিয়ে এনেছিল, তাদের মধ্যে কোনুটি যে বেশি জোরালো এতক্ষণ হেরম্ব তা বুঝতে পারে নি। অনাথ এবং মালতী এদের মধ্যে কাকে আশ্রয় করে আনন্দ বড় হয়েছে সঠিক না জানা অবধি স্বস্তি পাওয়া হেরম্বের পক্ষে অসম্ভব ছিল। আনন্দের অন্তর অন্ধকার, এর ক্ষীণতম সংশয়টিও হেরম্বের সহ্য হচ্ছিল না। মালতীর আদেশের বিরুদ্ধেও তাকে প্ৰণাম করার মধ্যে তার প্রতি আনন্দের যতটুকু শ্রদ্ধা প্রকাশ পেল, হেরম্ব সেটুকু তাই খেয়াল করারও সময় পেল না। মালতীকে আনন্দ নকল করে নি। শুধু এইটুকুই তার কাছে হয়ে রইল প্রধান! আনন্দের অকারণ ছেলেমানুষ ঔদ্ধত্যে তার এই স্বপ্নের ঘোর কেটে গেছে।
আনন্দকে চোখে দেখে হেরম্বের মনে যে আবেগ ও মোহ প্রথমেই সঞ্চারিত হয়েছিল। এতক্ষণে তার মনের সর্বত্র তা সঞ্চারিত হয়ে তার সমস্ত মনোভাবকে আশ্রয় করেছিল। নিজেকে অকস্মাৎ উচ্ছ্বসিত ও মুগ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করার বিস্ময় অপনোদিত হয়ে গিয়েছিল। তার মন সেই স্তরে উঠে এসেছিল যেখানে আনন্দের অনির্বচনীয় আকর্ষণ চিরন্তন সত্য। আনন্দকে চোখে দেখা ও তার কথা শোনা হেরম্বের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। নেশা জমে এলে যেমন মনে হয় এই নেশার অবস্থাটিই সহজ ও স্বাভাবিক, আনন্দের সান্নিধ্যে নিজের উত্তেজিত অবস্থাটিও হেরম্বের কাছে তেমনি অভ্যস্ত হয়ে এসেছিল। আনন্দ এখন তাকে আবার নতুন করে মুগ্ধ ও বিচলিত করে দিয়েছে। বয়স্ক হেরম্বের মনেও যে লোকটি এক রহস্যময় মায়ালোকবাসী হয়ে আছে নিজেকে সেই অনাথের অনুরক্ত কন্যা বলে ঘোষণা করে আনন্দ তার আবিষ্ট মোহাচ্ছন্ন মনের উন্মাদনা আরো তীব্র আরো গভীর করে দিয়েছে।
প্রেমিকের কাছে প্রেমের অগ্রগতির ইতিহাস নেই। যতদূরই এগিয়ে যাক সেইখান থেকেই আরম্ভ। আগে কিছু ছিল না। ছিল অন্ধকারের সেই নিরন্ধ কুলায়, যেখানে নব জন্মলাভের প্রতীক্ষায় কঠিন আস্তরণের মধ্যে হৃদয় নিষ্পন্দ হয়ে ছিল। হেরম্ব জানে না তার আকুল হৃদয়ের আকুলতা বেড়েছে, এ শুধু বৃদ্ধি, শুধু ঘন হওয়া। আনন্দের অস্তিত্ব এইমাত্র তার কাছে প্রকাশ পেয়েছে, এতক্ষণে ওর সম্বন্ধে সে সচেতন হল। এক মুহূর্ত আগে নয়।
এক মুহূর্ত আগে তার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছিল। কেবল শিরায় শিরায় রক্ত পাঠাবার প্রাত্যহিক প্রীতিহীন প্রয়োজনে। এইমাত্র আনন্দ তার স্পন্দনকে অসংযত করে দিয়েছে।
খানিক পরে মালতী উঠে দাঁড়াল।
আনন্দ বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ মা?’
‘গা ধুতে হবে না, আরতি করতে হবে না? সন্ধে হল, সে খেয়াল আছে!’
গোধূলিলগ্নে হেরম্বের কাছে আনন্দকে ফেলে মালতী উঠে চলে গেল।
পৃথিবী জুড়ে নয়, এইখানে সন্ধ্যা নামছে। পৃথিবীর আর এক পিঠে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমগ্রভাবে বিস্তৃত চলমান অবিচ্ছিন্ন দিন। এখানে যে রাত্রি আসছে তাকে নিজের দেহ দিয়ে সৃষ্টি করেছে মাটির পৃথিবী। থেকে সূৰ্য যতদূর, মহাশূন্যে রাত্রির বিস্তার তার চেয়েও অনন্তগুণ বেশি। রাক্রির অন্ত নেই। মধ্যরাত্রিকে অবলম্বন করে কল্পনায় যতদূর খুশি চলে যাওয়া যাক, রাক্রির শেষ মিলবে না। পৃথিবীর এক পিঠে যে আলো ধরা পড়ে দিন হয়েছে, অসীম শূন্যের শেষ পর্যন্ত তার অভাব কোথাও মেটে নি।
মালতী চলে গেলে মুখ তুলে আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে হেরম্বের মনে যে কল্পনা দেখা দিয়েছিল, উপরের কথাগুলি তারই ভাষান্তরিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আনন্দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এ তার ক্ষণিকের বিশ্রাম মাত্র। মালতীর অন্তরাল সরে যাওয়ায় আনন্দ যে নিজেকে অনাবৃত অসহায় মনে করছে হেরম্বের তা বুঝতে বাকি থাকে নি। চোখের সামনে ধূসর আকাশটি থাকায় আকাশকে উপলক্ষ করেই সে তাই কথা আরম্ভ করল। আকাশ থেকে কথা পৃথিবীতে নামতে নামতে আনন্দ তার লজ্জা ও সঙ্কোচকে জয় করে নেবে।
‘ক’টা তারা উঠেছে বল তো আনন্দ?’
‘ক’টা? একটা দেখতে পাচ্ছি। না, দুটো।’
‘দুটো তারা দেখতে পেলে কি যেন হয়?’
‘কি হয়? তারার মতো চোখের জ্যোতি বাড়ে?’
আনন্দের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার পায়ের নখের দিকে।
অবান্তর কথা বেশিক্ষণ চলে না। আনন্দই প্ৰথমে আলাপকে তাদের স্তরে নামিয়ে আনল।
‘বাবা বললেন, আপনি কলেজে পড়ান। আপনি খুব পড়াশোনা করেন বুঝি?’
‘না। পড়া হল পরের ভাবনা ভাবী। তার চেয়ে নিজের ভাবনা ভাবতেই আমার ভালো লাগে। তুমি বুঝি বাবার কাছে আমার কথা সব জেনে নিয়েছ?’
‘সব। শুধু বাবার কাছে জানি নি, মা জল দিতে ডাকা পর্যন্ত ওই জানালায় দাঁড়িয়ে মার সঙ্গে আপনার যত কথা হয়েছে সব শুনে ফেলেছি।‘
আনন্দ চোখ তুলল। কিন্তু এখনো সে হেরম্বের দিকে তাকাতে পারছে না।
‘শুনে কি মনে হল?’
আনন্দ হঠাৎ জবাব দিল না। তারপর সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, ‘মনে হল খুব নিষ্ঠুরের মতো স্ত্রীর কথা বললেন। আপনার স্ত্রী কতদিন মারা গেছেন?’
হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন। প্রায় দেড় বছর।’
আনন্দ হেরম্বের জামার বোতামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক দিন বললেন যে? দেড়বছর কি অনেক দিন?’
হেরম্ব বলল, ‘অনেক দিন বৈকি। দেড়বছরে ক’বার সূর্য ওঠে, কত লোক জন্মায়, কত লোক মরে যায় খবর রাখ?’
আনন্দ মনে মনে একটু হিসাব করে বলল, ‘দেড়বছরে সূর্য ওঠে। পাঁচ শ, সাতচল্লিশ বার। লোক জন্মায় কত? কত লোক মরে যায়?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘পনের-কুড়ি লাখ হবে।’
আনন্দও তার চোখের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘মোটে? আমি ভাবছিলাম একবছরে পৃথিবীতে বুঝি কোটি কোটি লোক জন্মায়। মার কাছে রোজ যে সব মেয়ে ভক্ত আসে তাদের সকলেরই বুকে একটি, কাঁখে একটি, হাত-ধরা একটি, এমনি গাদা গাদা ছেলেমেয়ে দেখি কিনা, তাই মনে হয় পৃথিবীতে রোজ বুঝি অগুনতি ছেলেমেয়ে জন্মাচ্ছে। কিন্তু দেড়বছরে আর যাই হোক, মানুষ কি বদলাতে পারে?’
‘পারে। এক মিনিটে পারে।’ হেরম্ব জোর দিয়ে বলল।
আনন্দ একটু লাল হয়ে বলল, ‘আপনার স্ত্রীর কথা ভেবে বলি নি। এমনি সাধারণভাবে বলেছি।‘
দেড়বছরে মানুষ বদলাতে পারে কিনা প্রশ্ন করে তার মনে স্ত্রীর শোকটা কতখানি বর্তমান আছে আনন্দ তাই মাপতে চেয়েছিল হেরম্ব এ কথা বিশ্বাস করে নি। সে জেনেছে আনন্দের হৃদয়ে মানুষের সহজ অনুভূতিগুলি সহজ হয়েই আছে। মৃতা স্ত্রীকে কেউ তুলে গেছে শুনলে খুশি হবার মতো হিংস্র আনন্দ নয়।
কিন্তু আনন্দকে মিথ্যা কথা শোনানোও হেরম্বের পক্ষে অসম্ভব।
‘আমার স্ত্রীর কথা ভেবে বললেও দোষ হত না আনন্দ। সংসারে কত পরিচিত লোক, কত আত্মীয় থাকে, যারা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। বেঁচে থাকবার সময় আমাদের কাছে তাদের যতটুকু দাম ছিল, মরে যাবার পর কেবল কাছে নেই বলেই তাদের সে দাম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। দিলে মরণকে আমরা ভয় করতে আরম্ভ করব। আমাদের জীবনে মৃত্যুর ছায়া পড়বে। আমরা দুর্বল অসুস্থ হয়ে পড়বা।’
‘কিন্তু —’ বলে আনন্দ চুপ করে গেল।
হেরম্ব বলল, ‘তুমি যা খুশি বলতে পাের আনন্দ, কোনো বাধা নেই।’
‘কথাগুলির মধ্যে আপনার স্ত্রী এসে পড়েছেন বলে সঙ্কোচ হচ্ছে। যাই হোক, বলি। মনের কথা চেপে রাখতে আমার বিশ্ৰী লাগে। আমার মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক নয়। ভালবাসা থাকলে শোক হবেই। শোক মিথ্যে হলে ভালবাসাও মিথ্যে।’
হেরম্ব খুশি হল। প্রতিবাদ তার ভালো লাগে। প্রতিবাদ খণ্ডন করা যেন একটা জয়ের মতো।
‘ভালবাসা থাকলে শোক হয় আনন্দ। কিন্তু ভালবাসা কতদিনের? কতকাল স্থায়ী হয়। ভালবাসাঃ প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার। প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত। না। প্রেমের জন্ম আর মৃত্যুর ব্যবধান বেশি নয়। প্রেম যখন বেঁচে আছে তখন দুজনের মধ্যে একজন মরে গেলে শোক হয়–অক্ষয় শোক হয়। প্রেমের অকালমৃত্যু নেই বলে শোকের মধ্যে প্রেম চিরন্তন হয়ে যায়। কিন্তু প্রেম যখন মরে গেছে, তখন আছে শুধু মায়া, অভ্যাস আর আত্মসাত্ত্বনার খেলা, তখন যদি দুজনের একজন মরে যায়, বেশিদিন শোক হওয়া অসুস্থ মনের লক্ষণ। সেটা দুর্বলতা, আনন্দ। তুমি রোমিও জুলিয়েটের গল্প জান?’
‘জানি। বাবার কাছে শুনেছি।‘
‘প্রেমের মৃত্যু হওয়ার আগেই ওরা মরে গিয়েছিল। একসঙ্গে দুজনে মরে না গিয়ে ওদের মধ্যে একজন যদি বেঁচে থাকত। তার শোক কখনো শেষ হত না। কিন্তু কিছুকাল বেঁচে থেকে ক্রমে ক্ৰমে ভালবাসা মরে যাওয়ার পর ওদের মধ্যে একজন যদি স্বর্গে যেত, পৃথিবীতে যে থাকত চিরকাল তার শোকাতুর হয়ে থাকার কোনো কারণ থাকত না। একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ করেছ। আনন্দ? রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাদের মৃত্যুতে নয়?’
‘কিসে তবে?’
‘ওদের প্রেমের অসমাপ্তিতে। রোমিও জুলিয়েটের কোনো দাম মানুষের কাছে নেই। জগতের লক্ষ লক্ষ রোমিও জুলিয়েট মরে যাক, কিছু এসে যায় না। কিন্তু ওভাবে ভালো বাসতে বাসতে ওরা মরল কেন ভেবেই আমাদের চোখে জল আসে।’
আনন্দ আনমনে বলল, ‘তাই কি? তা হবে বোধহয়।’
হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘হবে বোধহয় নয়, তাই। ওদের অসম্পূর্ণ প্রেমকে আমরা মনে মনে সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করে ব্যথা পাই–রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি। তাই। নইলে, ওদের জীবনে ট্রাজেডি কোথায়? ওরা দুজনেই মরে গিয়ে সবকিছুরই অতীত হয়ে গেল–ওদের জীবনে দুঃখ সৃষ্টি হবার সুযোগও ছিল না। আমরা সমবেদনা দেব কাকে? কিসের জোরে রোমিও জুলিয়েট আমাদের একফোঁটা অশ্রু দাবি করবে? ওরা তো দুঃখ পায় নি। প্রেমের পরিপূর্ণ বিকাশের সময় ওরা দুঃখকে এড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ওদের প্রেমের জন্য শোক করি, ওদের জন্য নয়।’
আনন্দ বলল, ‘প্রেম কতদিন বাঁচে?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘কি করে বলব আনন্দ! দিন গুনে বলা যায় না। তবে বেশিদিন নয়। এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস।’
শুনে আনন্দ যেন ভীত হয়ে উঠল।
‘মোটে।‘
হেরম্ব আবার হেসে বলল, ‘মোটে হল? একমাসের বেশি প্ৰেম কারো সহ্য হয়? মরে যাবে আনন্দ–একমাসের বেশি হৃদয়ে প্রেমকে পুষে রাখতে হলে মানুষ মরে যাবে। মানুষ একদিন কি দুদিন মাতাল হয়ে থাকতে পারে। জলের সঙ্গে মদের যে সম্পর্ক মদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তাই—প্রেম এত তেজী নেশা।’
আনন্দ হঠাৎ কথা খুঁজে পেল না। মুখ থেকে সে চুলগুলি পিছনে ঠেলে দিল। ডান হাতের ছোট আঙুলটির ডগা দীতে কামড়ে ধরে এক পায়ের আঙুল দিয়ে অন্য পায়ের নখ থেকে ধুলো মুছে দিতে লাগল। তার মনে প্রবল আঘাত লেগেছে বুঝে হেরম্ব দুঃখ বোধ করল। কিন্তু এ আঘাত না দিয়ে তার উপায় ছিল না। আনন্দের কাছে সত্য গোপন করার ক্ষমতা তার নেই। তাছাড়া, প্রেম চিরকাল বাঁচে কোনোদিন কোনো অবস্থাতে কোনো মানুষকেই এ শিক্ষা দিতে নেই। হেরম্ব বিশ্বাস করে পৃথিবী থেকে যত তাড়াতাড়ি এ বিশ্বাস দূর হয়ে যায় ততই মঙ্গল।
আনন্দ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রেম মরে গেলে কি থাকে?’
‘প্রেম ছাড়া আর সব থাকে। সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করবার জন্য যা যা দরকার। তাছাড়া খোকা অথবা খুঁকি থাকে–আরো একটা প্রেমের সম্ভাবনা। ওরা তুচ্ছ নয়।’
‘কিন্তু প্রেম তো থাকে না। আসল জিনিসটাই তো মরে যায়! তারপর মানুষের সুখ সম্ভব কি করে?’
‘সুখ হল শুটকি মাছ–মানুষের জিভ হল আসলে ছোটলোক। তাই কোনো রকমে সুখের স্বাদ দিয়ে জীবনটা ভরে রাখা যায়। জীবন বড় নীরস আনন্দ-বড় নিরুৎসব। জীবনের গতি শ্লথ, মৃত্ন দিয়ে বিনিয়ে মানুষকে জীবন কাটাতে হয়। তার মধ্যে এই গ্রেমের উত্তেজনাটুকু তার উপরি লাভ।‘
‘সুখ হল —? ঔটকি মাছ। আগে যেন কার কাছে কথাটা শুনেছি।’
‘তোমার মা খানিক আগে আমাকে বোঝাচ্ছিলেন।’
‘হ্যাঁ, মা-ই বলছিল বটে। কিন্তু আপনি এমন সব কথা বলছেন যা শুনলে কান্না আসে।’
হেরম্ব একটি পা একধাপ নিচে নামিয়ে বলল, ‘কান্না এলে চলবে না আনন্দ, হাসতে হবে। বুক কাঁপিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস উঠবে তার সবটুকু বাতাস হাসি আর গানে পরিণত করে দিতে হবে। মানুষের যদি কোনো ধৰ্ম থাকে, কোনো তপস্যার প্রয়োজন থাকে, সে ধর্ম এই, সে তপস্যা এই। মানুহ কুকুবুলা পঞ্চাশ-আট বছর তাকে বাঁচতে হবে অথচ তার কাজ নেই।
‘কাজে নেই?’
‘কোথায় কাজ? কি কাজ আছে মানুষের? অঙ্ক কষা, ইঞ্জিন বানানো, কবিতা লেখা? ওসব তো ভান, কাজের ছল। পৃথিবীতে কেউ ওসব চায় না। একদিন মানুষের জ্ঞান ছিল না, বিজ্ঞান ছিল না, সভ্যতা ছিল না, মানুষের কিছু এসে যায় নি। আজ মানুষের ওসব আছে কিন্তু তাতেও কারো কিছু এসে যায় না। কিন্তু মানুষ নিরুপায়। তার মধ্যে যে বিপুল শূন্যতা আছে সেটা তাকে ভরতেই হবে। মানুষ তাই জটিল অঙ্ক দিয়ে, কায়দাদুরস্ত ভালো ভালো ভাব দিয়ে, ইস্পাতের টুকরো দিয়ে, আরো সব হাজার রকম জঞ্জাল দিয়ে সেই ফাকটা ভরতে চেষ্টা করে। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখ, জীবন নিয়ে মানুষ কি হৈচৈ করছে, কি প্রবল প্রতিযোগিতা মানুষের, কি ব্যস্ততা! কাজ! কাজ! মানুষ কাজ করছে! বেঁকে কাঁদিয়ে বৈজ্ঞানিক খুঁজছে নূতন ফরমুলা, আজো খুঁজছে, কালও খুঁজছে। দোকান খুলে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে চারিদিক ছেয়ে ফেলে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ব্যবসায়ী করছে টাকা। ঘরের কোণে প্ৰদীপ জ্বেলে বসে বিদ্রোহী কবি লিখছে কবিতা, সারাদিন ছবি এঁকে আৰ্টিষ্ট ওদিকে মদ খেয়ে ফেনাচ্ছে জীবন। কেউ অলস নয়। আনন্দ, কুলি মজুর গাড়োয়ান, তারাও প্রাণপণে কাজ করছে। কিন্তু কেন করছে আনন্দ? পাগলের মতো মানুষ খালি কাজ করছে কেন? মানুষের কোজ নেই বলে। আসল কোজ নেই বলে। ছটফট করা ছাড়া আর কিছু করার নেই বলে।’
‘কিন্তু আসল কাজটা কি? মানুষের যা নেই?’
‘এ প্রশ্নেরও জবাব নেই আনন্দ। মানুষের কি নেই তাও মানুষের বুঝবার উপায় নেই। কাজ না পেয়ে মানুষ অকাজ করছে এটা বোঝা যায়। কিন্তু তার কাজ কি হতে পারত। তার কোনো সংজ্ঞা নেই। এর কারণ কি জােন? মানুষ যে স্তরের, তার জীবনের উদ্দেশ্য সেই স্তরে নেই। ঈশ্বরের মতো, শেষ সত্যের মতো, আমিত্বের মানের মতো সেও মানুষের নাগালের বাইরে। জীবনের একটা অর্থ এবং পরিণতি অবশ্যই আছে, বিশ্বজগতে কিছুই অকারণ হতে পারে না। সৃষ্টিতে অজস্র নিয়মের সামঞ্জস্য দেখলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু জীবনের শেষ পরিণতি জীবনে নেই। মানুষ চিরকাল তার সার্থকতা খুঁজবে, কিন্তু কখনো তার দেখা পাবে না। যোগী ঋষি হার মানলেন, দার্শনিক হার মানলেন, কবি হার মানলেন, অমার্জিত আদিমধর্ম মানুষও হার মানলে। চিরকাল এমনি হবে। কারণ সমগ্র সত্তাকে যা ছাড়িয়ে আছে, মানুষ তাকে আয়ত্ত করবে কি করে!’
কথা বলার উত্তেজনায় হেরম্বের সাময়িক বিস্মৃতি এসেছিল। শব্দের মোহ তার মন থেকে আনন্দের মোহকে কিছুক্ষণের জন্যে স্থানচ্যুত করেছিল। জীবন সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ করে পুনরায় আনন্দের সান্নিধ্যকে পূর্ণমাত্রায় অনুভব করে সে এই ভেবে বিস্মিত হয়ে রইল যে শ্রোতা ভিন্ন আনন্দ এতক্ষণ তার কাছে আর কিছুই ছিল না। আনন্দকে এতক্ষণ সে এমনি একটা সাধারণ পর্যায়ে ফেলে রেখেছিল যে শ্রবণশক্তি ছাড়া ওর আর কোনো বিশেষত্বের সম্বন্ধেই সে সচেতন হয়ে থাকে নি। হেরম্ব বোঝে, বিচলিত হবার মতো ত্রুটি অথবা অসঙ্গতি এটা নয়। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো তবু সে আনন্দের প্রতি তাঁর এই তুচ্ছ অমনোযোগে আশ্চর্য হয়ে যায়।
হেরম্ব এটাও বুঝতে পারে, তার কাছে জীবনের ব্যাখ্যা শুনতে আনন্দ ইচ্ছুক নয়। জীবন কি,জীবনের উদ্দেশ্য আছে কি নেই, এসব তত্ত্বকথায় বিরক্তি বোধ হচ্ছিল। অন্য সময় বিশ্লেষণ ওর ভালো লাগে। কিনা হেরম্ব জানে না, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তার মুখের বিশ্লেষণ ওর কাছে শাস্তির মতো লেগেছে। সে থেমে যেতে আনন্দ স্বস্তি লাভ করেছে। রোমিও জুলিয়েটের কথা বলুক, প্রেমের ব্যাখ্যা করুক, আনন্দ মন দিয়ে শুনবে। কিন্তু সেইখানেই তার ধৈর্যের সীমা। অনুভূতির সমন্বয় করা জীবনের সমগ্রতাকে সে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, ভাবতে চায় না।
তাই হোক। তাই ভালো। হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘চন্দ্ৰকলা নাচটা কি আনন্দ?’
আনন্দ বলল, ‘ধরুন, আমি যেন মরে গেছি। অমাবস্যার চাঁদের মতো আমি যেন নেই। প্রতিপদে আমার মধ্যে একটুখানি জীবনের সঞ্চার হল। ভালো করে বোঝা যায় না। এমনি একফোঁটা একটু জীবন। তারপর চাঁদ যেমন কলায় কলায় একটু একটু করে বাড়ে আমার জীবনও তেমনি করে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে যখন পূর্ণিমা এল, আমি পূর্ণমাত্রায় বেঁচে উঠছি। তারপর একটু একটু করে মরে—‘
‘এ নাচ ভালো নয়, আনন্দ।’
‘কেন?’
‘একটু একটু করে মরার নাচ নেচে তোমার যদি সত্যি সত্যি মরতে ইচ্ছা হয়?’
আনন্দ একটু হাসল।’মরতে ইচ্ছা হবে কেন? ঘুম পায়। এক মিনিটও তারপর আমি আর দাঁড়াতে পারি না। কোনো রকমে বিছানায় গিয়ে দাঁড়াম করে আছড়ে পড়েই নাক ডাকতে আরম্ভ করে নিই। মা বলে—‘
‘কি বলে?’
‘আপনাকে বলতে লজ্জা হচ্ছে।’
‘চোখ বুজে। আমি এখানে নেই মনে করে বল।’
‘না, দূর! সে বলা যায় না।’
হেরম্ব মৃদু হেসে বলল, ‘প্রথম তোমাকে দেখে মনে হয় নি তুমি এত ভীরু। এটা তোমার ভয় না লজ্জা, আনন্দ?’
আনন্দ বলল, ‘মানুষকে আমি ভয় করি নে।’
‘তবে তুমি ছেলেমানুষ–লাজুক।’
‘ছেলেমানুষ? আমায় এ কথা বললে অপমান করা হয় তা জানেন?’ আনন্দ হঠাৎ হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে হেরম্বের হাঁটুতে টোকা দিয়ে বলল, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে। আমাকে সম্ভ্রম করে কথা কইবেন।’ হেরম্ব জানে, এসব ভূমিকা। তার নাচ সম্বন্ধে মালতী কি বলেছে আনন্দ তা শোনাতে চায়, কিন্তু পেরে উঠছে না। হেরম্ব মৃদু হেসে অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘ছেলেমানুষকে আবার সম্ভ্রম করব কি?’
‘ছেলেমানুষ হলাম। কিসে?’
‘ছেলেমানুষরাই একটা কথা বলতে দশবার লজ্জা পায়।’
আনন্দ উদ্ধত সাহসের সঙ্গে বলল, ‘লজ্জা পাচ্ছে কে? আমি? জগতে এমন কথা নেই। আমি যা বলতে লজ্জা পাই। নাচার পর আমার ঘুম দেখে মা বলে, তোর আর বিয়ের দরকার নেই আনন্দ।’
বলে আনন্দ হঠাৎ উদ্ধতভাবে হেরম্বকে আক্রমণ করল, বলল, ‘আপনি নেহাত অভদ্র। মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে জানেন না।‘
মনে হয় সে বুঝি হঠাৎ উঠে চলে যাবে। হেরম্বের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে।
নিষ্ঠুর আনন্দের সঙ্গে হেরম্ব লজ্জাতুর অপ্রতিভা আনন্দের আত্মসংবরণের ব্যাকুল প্রয়াসকে উৎসারিত করে বলে, ‘বল বল, থেম না আনন্দ।‘
‘না, বলব না। কেন বলব!’
হেরম্ব আরো নির্মম হয়ে বলে, ‘তুমি তাহলে বুড়ি নও আনন্দ? মিছামিছি তোমার তাহলে রাগ হয়? এতক্ষণ আমাকে তুমি ঠকাচ্ছিলে?’
‘আপনি চলে যান। আপনাকে আমি নাচ দেখাব না।’
‘দেখিও না। আমি ঢের নাচ দেখেছি।’
‘তাহলে অনর্থক বসে আছেন কেন? রাত হল, বাড়ি যান না।’
‘বেশ। তোমার মাকে ডাক। বলে যাই।’
আনন্দ চুপ করে বসে রইল। হেরম্ব বুঝতে পারে, সে কি ভাবছে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। হেরম্ব নিষ্ঠুরতা করেছে বলে নয়, নিজেকে সে সত্য সত্যই সম্পূর্ণ অকারণে ছেলেমানুষ করে ফেলেছে বলে। এ ব্যাপাের আনন্দ বুঝতে পারছে না। নৃত্য করে সে মেয়েদের বিবাহিত জীবনের আনন্দ ও অবসাদ পায় এই কথাটি সে এত বেশি লজ্জাকর মনে করে না যে হেরম্বকে শোনানো যায় না। হেরম্বকে অবাধে এ কথা বলতে, পারার বয়স তার হয়েছে বলেই আনন্দ মনে করে। তাই অসঙ্গত লজ্জার বশে বিচলিত হয়ে ব্যাপারটাকে এ ভাবে তাল পাকিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের উপর সে রেগে উঠেছে। লজ্জা পেয়েও চুপ করে থাকলে অথবা পাকা মেয়ের মতো হাসি-তামাশার একটা অভিনয় বজায় রাখতে পারলে হেরন্থের কাছ থেকে লজ্জাটা লুকানো যেত ভেবে তার–আফসোসের সীমা নেই। আঠার বছর বয়সে হেরম্বের কাছে আটাশ বছরের ধীর, সপ্রতিভা ও পূর্ণ পরিণত নারী হতে চেয়ে একেবারে তের বছরের মেয়ে হয়ে বসার জন্য নিজেকে আনন্দ কোনোমতেই ক্ষমা করতে পারছে না।
আনন্দের অস্বস্তিতে হেরম্ব কিন্তু খুশি হল। আনন্দ রাগ করতে পারে এই ভয়কে জয় করে তার প্রতি নিষ্ঠুর হতে পেরে নিজের কাছেই সে কৃতজ্ঞতা বোধ করেছে। যার সান্নিধ্যই আত্মবিস্মৃতির প্রবল প্রেরণা, তাকে শাসন করা কি সহজ মনের জোরের পরিচয়! হেরম্বের মনে হঠাৎ যেন শক্তি ও তেজের আবির্ভাব ঘটল।
কিন্তু সেই সঙ্গে এই জ্ঞানকেও তার আমল দিতে হল যে, আনন্দকে সে আগাগোড়া ভয় করে এসেছে। আনন্দ ইচ্ছা করলেই তার ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে, কোনো এক সময়ে এই আশঙ্কা তার মনে এসেছিল এবং এখনো তা স্থায়ী হয়ে আছে। নিজের এই ভীরুতার জন্ম-ইতিহাস ক্রমে ক্রমে তার কাছে পরিস্ফুট হয়ে যায়।
সে বুঝতে পারে অনেক দিক থেকে নিজেকে সে আনন্দের কাছে সমৰ্পণ করে দিয়েছে। অনেক বিষয়েই সে আনন্দের কাছে পরাধীন। দুঃখ না পাবার অনেকখানি স্বাধীনতাই সে স্বেচ্ছায় আনন্দের হাতে তুলে দিয়েছে। তার জীবনে ওর কর্তৃত্ব এখন সামান্য নয়, তার হৃদয়মনের নিয়ন্ত্রণে ওর প্রচুর যথেচ্ছাচার সম্ভব হয়ে গিয়েছে।
যতক্ষণ পারে দেরি করে মালতীকে আসতে হল।
‘তোমাদের দুটিতে দেখছি দিব্যি ভাব হয়ে গেছে।’
আনন্দ বলল, ‘আমার বন্ধু, মা।’
‘বন্ধু!’ মালতীর স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ পেল।’বন্ধু কি লো ছুঁড়ি। হেরম্ব যে তোর গুরুজন, শ্ৰদ্ধার পাত্র।’
‘বন্ধু বুঝি অশ্রদ্ধার পাত্র মা?’
মালতী প্ৰদীপ জ্বেলে এনেছিল। মন্দিরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে সে আরো একটি বৃহৎ প্ৰদীপ জ্বেলে দিল। হেরম্ব উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। মন্দির প্রশস্ত, মেঝে লাল সিমেন্ট করা। দেবতা শিশুগোপাল। ছোট একটি বেদির উপর বাৎসল্য আকর্ষণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। মালতী দুটি নৈবেদ্য সাজচ্ছিল। হেরম্ব দেবতাকে দেখছে, মুখ না ফিরিয়েই এটা সে কি করে টের পেল বলা যায় না।
‘কি রকম ঠাকুর হেরম্ব?’
‘বেশ, মালতী-বৌদি।’
আনন্দ ওঠে নি। সেইখানে তেমনিভাবে বসে ছিল। হেরম্ব ফিরে গিয়ে তার কাছে বসল।
‘তুমি দেবদাসী নাকি আনন্দ?’
‘আজ্ঞে না, আমি কারো দাসী নই।’
‘তবে মন্দিরে ঠাকুরের সামনে নাচ যে?’
‘ঠাকুরের সামনে বলে নয়। মন্দিরে জায়গা অনেক, মেঝেটাও বেশ মসৃণ। সবদিন মন্দিরে নাচি না। মাঝে মাঝে। আজ এইখানে নাচব, এই ঘাসের জমিটাতে। ঠাকুর আমাদের সৃষ্টি করেছেন, ভিক্তের কাছে যা প্ৰণামী পান। তাই দিয়ে ভরণপোষণ করেন। এটা হল তার কর্তব্য। কর্তব্য করবার জন্য সামনে নাচব, নাচ আমার অত সস্তা নয়।’
‘বোঝা যাচ্ছে দেবতাকে তুমি ভক্তি কর না।’
‘ভক্তি করা উচিত নয়। বাবা বলেন, বেশি ভক্তি করলে দেবতা চটে যান। দেবতা কি বলেন, শুনবেন? বলেন, ওরে হতভাগার দল! আমাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তোরা একটু আত্মচিন্তা কর তো বাপু আমাকে নিয়ে পাগল হয়ে থাকবার জন্য তোদের আমি পৃথিবীতে পাঠাঁই নি। সবাই মিলে তোরা আমাকে এমন লজ্জা দিস!’
হেরম্ব খুশি হয়ে বলল, ‘তুমি তো বেশ বলতে পার আনন্দ?’
‘আমি বলতে পারি ছাঁই! এসব বাবার কথা।’
‘তোমার বাবা বুঝি খুব আত্মচিন্তা করেন?’
‘দিনরাত। বাবার আত্মচিন্তার কমাই নেই। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আজ বোধহয় মন একটু বিচলিত হয়েছিল, এসেই আসনে বসেছেন। কখন উঠবেন তার ঠিক নেই। এক একদিন সারারাত আসনে বসেই কাটিয়ে দেন।’
মন্দিরের মধ্যে মালতী শুনতে পাবে বলে আনন্দ হেরম্বের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
‘এই জন্য মা এত ঝগড়া করে। বলে বাড়ি বসে ধ্যান করা কেন, বনে গেলেই হয়। বাবা সত্যি সত্যি দিনের পর দিন ফেন কি রকম হয়ে যাচ্ছেন। এত কম কথা বলেন যে, মনে হয় বোবাই বুঝি হবেন।’
হেরম্ব এ কথা জানে। অনাথ চিরদিন স্বল্পভাষী। সেরকম স্বল্পভাষী নয়, বেশি কথা কইলে দুর্বলতা ধরা পড়ে যাবে বলে যারা চুপ করে থাকে। নিজেকে প্রকাশ করতে অনাথের ভালো লাগে। না। তার কম কথা বলার কারণ তাই।
মন্দিরের মধ্যে পঞ্চপ্রদীপ নেড়ে টুইটাং ঘণ্টা বাজিয়ে মালতী এদিকে আরতি আরম্ভ করে দিয়েছিল। হেরম্ব বলল, ‘প্ৰণামী দেবার ভক্ত কই আনন্দ?’।
‘তারা সকালে আসে! দু মাইল হেঁটে রাত করে কে এতদূর আসবে! বিকেলে আমাদের একটি পয়সা রোজগার নেই। আজ আপনি আছেন আপনি যদি কিছু দেন।’
‘তুমি আমার কাছে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছ।’
‘আমি আদায় করব কেন? পুণ্য অর্জনের জন্য আপনি নিজেই দেবেন। আমি শুধু আপনাকে উপায়টা বাতলে দিলাম।’ আনন্দ হাসল। মালতীর ঘণ্টা এই সময় নীরব হওয়ায় আবার হেরম্বের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘তাই বলে মা প্ৰণাম করতে ডাকলে প্ৰণামী দিয়ে বসবেন না যেন সত্যি সত্যি। মা তাহলে ভয়ানক রেগে যাবে।‘
‘মাকে তুমি খুব ভয় কর নাকি আনন্দ?’
‘না, মাকে ভয় করি না। মার রাগকে ভয় করি।’
হেরম্ব এক টিপ নস্য নিল। সহজ। আলাপের মধ্যে তার আত্মাগ্লানি কমে গেছে।
‘আমাকে? আমাকে তুমি ভয় কর না আনন্দ?’
‘আপনাকে? আপনাকে আমি চিনি না, আপনার রাগ কি রকম জানি না। কাজেই বলতে পারলাম না।’
‘আমাকে তুমি চেন না আনন্দা! আমি তোমার বন্ধু যে!’
আনন্দ অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ব্যস! শোন কথা! আপনি আবার বন্ধু হলেন কখন?’
‘একটু আগে তুমি নিজেই বলেছ। মালতী—বৌদি সাক্ষী আছে।’
আনন্দ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ভুল করে বলেছিলাম। আমি ছেলেমানুষ, আমার কথা ধরবেন না। কখন কি বলি-না—বলি ঠিক আছে কিছু?’
‘এরকম অবস্থায় তোমার তবে কিছু না বলাই ভালো, আনন্দ।’
‘কিছু বলছিও না। আমি। কি বলেছি? চুপ করে বসে আছি। আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আমি বেশি কথা বলছি, আপনার ভুল মনে হয়েছে জানবেন।.. ওই দেখুন চাঁদ উঠেছে।’
আনন্দ মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর হেরম্ব তাকায় তার মুখের দিকে। তার অবাধ্য বিশ্লেষণপ্রিয় মন সঙ্গে সঙ্গে বুঝবার চেষ্টা করে তেজী আলোর চেয়ে জ্যোৎস্নার মতো মৃদু। আলোতে মানুষের মুখ আরো বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। কেন। আলো অথবা মানুষের চোখ, কোথায় এ ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়?
হেরম্বের ধারণা ছিল কাব্যকে, বিশেষ করে চাঁদের আলোর কাব্যকে সে বহুকাল পূর্বেই কাটিয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নার একটি মাত্র গুণের মৰ্যাদাই তার কাছে আছে, যে এ আলো নিষ্প্রভ, এ আলোতে চোখ জ্বলে না। অথচ, আজ শুধু আনন্দের মুখে এসে পড়েছে বলেই তার মতো সিনিকের কাছেও চাঁদের আলো জগতের আর সব আলোর মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠল।
হেরম্বের বিশ্লেষণ-প্রবৃত্তি হঠাৎ একটা অভূতপূর্ব সত্য আবিষ্কার করে তাকে নিদারুণ আঘাত করে। কবির খাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যে কবিতা নেই, কবির জীবনে পর্যন্ত নয়, তার এই জ্ঞান পুরোনো। কিন্তু এই জ্ঞান আজো যে তার অভ্যাস হয়ে যায় নি, আজ হঠাৎ সেটা বোঝা গেছে। কাব্যকে অসুস্থ নার্ভের টঙ্কার বলে জেনেও আজ পর্যন্ত তার হৃদয়ের কাব্যপিপাসা অব্যাহত রয়ে গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কল্পনার যোগসূত্রটি আজো ছিঁড়ে যায় নি। রোমান্সে আজো তার অন্ধবিশ্বাস, আকুল উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগ আজো তার কাছে হৃদয়ের শ্ৰেষ্ঠ পরিচয়, জ্যোৎস্না তার চোখের প্রিয়তম আলো। হৃদয়ের অন্ধ সত্য এতকাল তার মস্তিষ্কের নিশ্চিত সত্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। তার ফলে, জীবনে কোনো দিকে তার সামঞ্জস্য থাকে নি, একধার থেকে সে কেবল করে এসেছে ভুল। দুটি বিরুদ্ধ সত্যের একটিকে সজ্ঞানে আর একটিকে অজ্ঞাতসারে একসঙ্গে মৰ্যাদা দিয়ে এসে জীবনটা তার ভরে উঠেছে শুধু মিথ্যাতে। তার প্রকৃতির যে রহস্য, যে দুর্বোধ্যতা সম্মোহনশক্তির মতো মেয়েদের আকর্ষণ করেছে, সে তবে এই? রূঢ় বেদনা ও লজ্জার সঙ্গে হেরম্ব নিজেকে এই প্রশ্ন করে।
মিথ্যার প্রকাণ্ড একটা স্তুপ ছাড়া সে আর কিছুই নয়, নিজের কাছে এই জবাব সে পায়।
আনন্দের মুখ তার চোখের সামনে থেকে মুছে যায়। আত্মোপলব্ধির প্রথম প্রবল আঘাতে তার দেখবার অথবা শুনবার ক্ষমতা অসাড় হয়ে থাকে। এ সহজ কথা নয়। অন্তরের একটা পুরোনো শবগন্ধী পচা অন্ধকার আলোয় ভেসে গেল, একদা নিরবচ্ছিন্ন দুঃস্বপ্নের রাত্রি দিন হয়ে উঠল। এবং তা অতি অকস্মাৎ।–এরকম সাংঘাতিক মুহূর্ত হেরম্বের জীবনে আর আসে নি। এতগুলি বছর ধরে তার মধ্যে দুজন হেরম্ব গাঢ় অন্ধকারে যুদ্ধ করেছে, আজি আনন্দের মুখে লোগা চাঁদের আলোয় তারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় দেখা গেছে শত্রুতা করে পরস্পরকে দুজনেই তারা ব্যৰ্থ করে দিয়েছে। হেরম্বের পরিচয়, ওদের লড়াই। আর কিছু নয়। ফুলের বেঁচে থাকবার চেষ্টার সঙ্গে কীটের ধ্বংসপিপাসার দ্বন্দু, এই রূপকটাই ছিল এতকালের হেরম্ব।
সমারোহের সঙ্গে দিনের পর দিন নিজের এই অস্তিত্বহীন অস্তিত্বকে সে বয়ে বেড়িয়েছে। চকমকির মতো নিজ্র সঙ্গে নিজেকে ঠুকে চারিদিকে ছড়িয়ে বেড়িয়েছে আগুন। কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাস লাগিয়ে সে-ই উমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সে খুনী!
হেরম্ব নিঝুম হয়ে বসে থাকে। জীবনের এই প্রথম ও শেষ প্রকৃত আত্মচেতনাকে বুঝেও আরো ভালো করে বুঝবার চেষ্টায় জল-টানা পচা পুকুরের উথিত বুদবুদের মতো অসংখ্য প্রশ্ন, অন্তহীন স্মৃতি তার মনে ভেসে ওঠে।
আনন্দ দুবার তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে তবে সে তার কথা শুনতে পায়।
‘কি ভাবছি? ভাবছি। এক মজার কথা, আনন্দ।‘
‘কি মজার কথা?’
আমি অন্যায় করে এতদিন যত লোককে কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিলে।‘
এই হেঁয়ালিটি নিয়ে আনন্দ পরিহাস করল না।
‘বুঝতে পারলাম না যে। বুঝিয়ে বলুন।’
‘তুমি বুঝবে না আনন্দ।’
‘বুঝব। আমি কি করেছি, আমি তা বুঝব। যত বোকা ভাবেন আমি তত বোকা নাই।’
হেরম্ব বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, ‘তোমার বুদ্ধির দোষ দিই নি! কথাটা বুঝিয়ে বলবার মতো নয়। আমার এমন খারাপ লাগছে আনন্দ।
আনন্দ সামনের দিকে তাকিয়ে নিরানন্দ স্বরে বলল, ‘তার মানে আমার জন্য খারাপ লাগছে? আচ্ছা লোক যাহোক আপনি!’
হেরম্ব অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘আমার মন কত খারাপ হয়ে গেছে জানলে তুমি রাগ করতে না আনন্দ।‘
আনন্দ বলল, ‘মন বুঝি খালি আপনারই খারাপ হতে জানে? সংসারে আর কারো বুঝি মন নেই? হেঁয়ালি করা সহজ। কারণ তাতে বিবেচনা থাকে না। লোকের মনে কষ্ট দেওয়া পাপ। এমনিতেই মানুষের মনে কত দুঃখ থাকে।’
আনন্দের অভিমানে হেরম্বের হাসি এল।
‘তোমার দুঃখ কিসের আনন্দ?’
‘আপনারই-বা মন খারাপ হওয়া কিসের? চাঁদ উঠেছে, এমন হাওয়া দিচ্ছে, এখুনি প্রসাদ খেতে পাবেন, তারপর আমার নোচ দেখবার আশা করে থাকবেন–আপনারই তো ষোল আনা সুখ। দুঃখ হতে পারে আমার। আমি এত মন্দ যে লোককে মিছিমিছ কখনো শাস্তি দিই, নিজে তা টেরও পাই না। আমার কাছে বসতে হলে লোকের এমনি বিশ্ৰী লাগে, আমি মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও। ই আমার দুঃখের নাকি তুলনা আছে!’
হেরম্ব ভাবল, আজ নিজের কথা ভেবে লাভ নেই। নিজের কথা ভুল করে ভেবে এতদিন জীবনটা অপচয়িত হয়ে গেছে, এখন নির্ভুল করে ভাবতে গেলেও আজ রাত্রিটা তাই যাবে। আনন্দের অমৃতকে আত্মবিশ্লেষণের বিষে নষ্ট করে আগামীকালের অনুশোচনা বাড়ানো সঙ্গত হবে না।
‘খারাপ লাগছে কেন জান?’
‘কি করে জানব? বলেছেন?’ আনন্দ আশান্বিত হয়ে উঠল।
‘তোমার কাছে বসে আছি বলে যে খারাপ লাগছে। এ কথা মিথ্যে নয় আনন্দ।’
‘তা জানি।’
‘কিন্তু কেন জান?’
আনন্দ রেগে বলল, ‘জানি জানি। আমার সব জানা আছে। কেবল জান জান করে একটা কথাই এক শ বার শোনাবেন তো!’
কৃষ্টা কথা এক শ বন্ধ আমি কারকেই শোনাই না। এমন কথা শেলাব, কখনো তুমি যা শোন নি।‘
‘থাক। না শুনলেও চলবে। আপনি অনেক কথা বলেছেন, ফুসফুস হয়তো আপনার ব্যথা হয়ে গেছে। এইবার একটু চুপ করে বসুন!’
‘আর তা হয় না। আনন্দ। তোমাকে শুনতেই হবে! তোমার কাছে বসে আমার মনে হচ্ছে এতকাল তোমার সঙ্গে কেন আমার পরিচয় ছিল না? তাই খারাপ লাগছে।‘
আনন্দের নালিশ করবার পর থেকে বিনা পরামর্শেই তাদের গলা নিচু হয়ে গিয়েছিল। নিজের কথা নিজের কানেই যেন শোনা চলবে না।
হেরম্ব নয়, সে-ই যেন মিথ্যা কথা বলেছে এমনিভাবে আনন্দ বলল, ‘আপনি এমন বানিয়ে বলতে পারেন!’
আরতি শেষ করে আনন্দ আজি মন্দিরে নাচবে না। শুনে মালতী মন্দিরের দরজায় তালা দিল।
‘এসে থেকে ঠায় বসে আছ সিঁড়িতে। ঘরে চল হেরম্ব। তুই এই বেলা কিছু খেয়ে নে না আনন্দ।‘
বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করে আনন্দ বলল, ‘প্ৰসাদ খেলাম যে?’
‘প্ৰসাদ আবার খাওয়া কি লো ছড়ি? আর কিছু খা। নাচবেন বলে মেয়ে আমার খাবেন না, ভারি নাচনেউলি হয়েছেন।’
আনন্দ তাকে ভয় দেখিহে বলল, ‘শোন মা, শোন। আজ যদি আমায় বক, সেদিনের মতো হবে কিন্তু।’
হেরম্ব দেখে বিস্মিত হল যে, এ কথায় মালতী সত্য সত্যই ভড়কে গেল।
‘কে তোকে বকিছে। বাবু! শুধু বলেছি, কিছু খা। খেতে বলাও দোষ?’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘সেদিন কি হয়েছিল?’
আনন্দ বলল, ‘বোলো না মা।’
মালতী বলল, ‘আমি একটু বকেছিলাম। বলেছিলাম, উপোস করে থাকলে নাচতে পারবি না। আনন্দ। এই শুধু বলেছি, আর কিছুই নয়। যেই বলা–
আনন্দ বলল, ‘যেই বলা! কতক্ষণ ধরে বকেছিলে মনে নেই বুঝি?’
মালতী বলল, ‘হ্যারে হ্যাঁ, তোকে আমি সারাদিন ধরে শুধু বকেছি। খেয়েদেয়ে আমার আর কোজ নেই। তারপর মেয়ে আমার কি করুল জন হেরম্ব? কান্না আরম্ভ করে দিল। সে কি কান্না হেরম্ব, বাপের জন্মে আমি অমন কান্না দেখি নি। কিছুতেই কি থামো! লুটিয়ে লুটিয়ে মেয়ে আমার কাঁদছে তো কাঁদছেই। আমরা শেষে ভয় পেয়ে গেলাম। আমি আদর করি, উনি এসে কত বোঝান, মেয়ের কান্না। তবু থামে না। দুজনে আমরা হিমশিম খেয়ে গেলাম!’
হেরম্ব ফিসফিস করে মালতীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আনন্দ পাগল নয় তো, মালতী-বৌদি?’
‘কি জানি। ওকেই জিজ্ঞেস কর।’
আনন্দ কিছুমাত্র লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হল না। সপ্রতিভভাবেই সে বলল, ‘পাগল বৈকি! আমি অভিনয় করেছিলাম, মজা দেখেছিলাম।’
‘চোখ দিয়ে জলও তুই অভিনয় করেই ফেলেছিলি, না রে আনন্দ?’
‘চোখ দিয়ে জল ফেলা শক্ত নাকি! বল না, এখুনি মেঝেতে পুকুর করে দিচ্ছি। বসুন। এই চৌকিটাতে।‘
হেরম্ব বসল। দুটি ঘরের মাঝখানে সরু ফাঁক দিয়ে বাড়িতে ঢুকে অন্দরের বারান্দা হয়ে সে এই ঘরে পৌছেছে। বারান্দায় বোঝা গিয়েছিল, বাড়িটা লম্বাটে ও দুপেশো। লম্বা সারিতে বোধহয় ঘর তিনখানা, অন্যপাশে একখানি মাত্র ঘর এবং তার সঙ্গে লাগানো নিচু একটা চালা। চালার নিচে দুটি আবছা গরু হেরম্বের চোখে পড়েছিল। বাড়ির আর দুটি দিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের মাথা ডিঙিয়ে জ্যোৎস্নালোকে বনানীর মতো নিবিড় একটি বাগান দেখা যায়।
এ ঘরখানা লম্বা সারির শেষে।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কার ঘর?’
আনন্দ বলল, ‘আমার।’
চৌকির বিছানা। তবে আনন্দের? প্রতি রাত্রে আনন্দের অঙ্গের উত্তাপ এই সজায় সঞ্চিত হয়। বালিশে আনন্দের গালের স্পর্শ লাগে? হেরম্ব নিজেকে অত্যন্ত শ্ৰান্ত মনে করতে লাগল। জুতো খুলে বলল, ‘আমি একটু শুলাম আনন্দ।’
‘শুলেন? শুলেন কি রকম!’ তার শয্যায় হেরম্ব শেবে গুনে আনন্দের বোধহয় লজ্জা করে মালতী বলল, ‘শোও না, শোও। একটা উঁচু বালিশ এনে দে আনন্দ। আমার ঘর থেকে তোর বাপের তাকিয়াটা এনে দে বরং। যে বালিশ তোর!’
হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলল, ‘বালিশ চাই না মালতী—বৌদি। উঁচু বালিশে আমার ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়।’
মালতী হেসে বলল, ‘কি জানি বাবু, কি রকম ঘাড় তোমার। আমি তো উঁচু বালিশ নইলে মাথায় দিতে পারি না। আচ্ছা তোমরা গল্প কর, আমি আমার কাজ করি গিয়ে। ওঁকে খেতে দিস আনন্দ!’
আনন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কি কাজ করবে মা?’
‘সাধনে বসব।‘
‘আজো তুমি ওই সব খাবে? একদিন না খেলে চলে না তোমোর?’
মালতীর মধ্যেও হেরম্ব বোধহয় সাময়িক কিছু পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। রাগ না করে সে শান্তভাবেই বলল, ‘কেন আজ কি? হেরম্ব এসেছে বলে? আমি পাপ করি না আনন্দ যে ওর কাছে লুকোতে হবে। হেরম্বও খাবে একটু।’
আনন্দ বলল, ‘হ্যাঁ খাবে বৈকি! অতিথিকে আর দলে টেন না মা।’
মালতী বলল, ‘তুই ছেলেমানুষ, কিছু বুঝিসনে, কেন কথা কইতে আসিস আনন্দ? হেরম্ব খাবে বৈকি। তোমাকে একটু কারণ এনে দিই হেরম্ব?’ বলে সে ব্যগ্র দৃষ্টিতে হেরম্বের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
হেরম্বের অনুমানশক্তি আজ আনন্দসংক্রান্ত কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করতেই অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়েছিল। তবু নিজে কারণ পান করে একটা অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা অর্জন করার আগেই তাকে মদ খাওয়াবার জন্য মালতীর আগ্রহ দেখে সে একটু বিস্মিত ও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। ভােবল, মালতী—বৌদি আমাকে পরীক্ষা করছে নাকি। আমি মদ খাই কিনা, নেশায় আমার আসক্তি কতখানি তাই যাচাই করে দেখছে?
মালতীর অস্বাভাবিক সারল্য এবং ভবিষ্যতে আসা-যাওয়া বজায় রাখার জন্য তাকে অল্প সময়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতায় বেঁধে ফেলার প্রাণপণ প্ৰয়াস স্মরণ করে হেরম্বের মনে হল মালতী যে সন্ধ্যা থেকে তার দুর্বলতার সন্ধান করছে–এ কথা হয়তো মিথ্যা নয়। মালতীর মনের ইচ্ছাটা মোটামুটি অনুমান হেরম্ব অনেক আগেই করেছিল। যে গৃহ একদিন সে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে এসেছে, মেয়ের জন্য তেমনি একটি গৃহ সৃষ্টি করতে চেয়ে মালতী ছটফট করছে। তারা চিরকাল বীচাবে না, আনন্দের একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। কিন্তু গৃহ যাদের একচেটিয়া তারা যে কতদূর নিয়মকানুনের অধীন সে খবর মালতী রাখে। কুড়ি বছরের পুরাতন গৃহত্যাগের ব্যাপারটা লুকিয়ে অনাথ যে তার বিবাহিত স্বামী নয় এ খবর গোপন করে মেয়ের বিয়ে দেবার সাহস মালতীর নেই। অথচ আনন্দ যে পুরুষের ভালবাসা পাবে না, ছেলেমেয়ে পাবে না, মেয়েমানুষ হয়ে এ কথাটাও সে ভাবতে পারে না। আজ সে এসে দাঁড়ানোমাত্র মালতীর আশী হয়েছে। বার বছর আগে মধুপুরে তার যে পরিচয় মালতী পেয়েছিল হয়তো সে তা ভোলো নি।
কিন্তু তবু সে যাচাই করে নিতে চায়। বুঝতে চায়, অনাথের শিষ্য কতখানি অনাথের মতো হয়েছে।
হেরম্ব বলল, ‘না, কারণ-টারণ আমার সইবে না। মালতী-বৌদি।’
‘খাও নি বুঝি কখনো?’
কখনো খাই নি বললে মালতী বিশ্বাস করবে না মনে করে হেরম্ব বলল, ‘একদিন খেয়েছিলাম। আমার এক ব্যারিস্টার বন্ধুর বাড়িতে। একদিনেই শখ মিটে গেছে মালতী—বৌদি।’
সুপ্রিয়ার কথা হেরন্থের মনে পড়ছিল। একদিন একটুখানি মদ খেয়েছিল বলে তাকে সে ক্ষমা করে নি। আজ মিথ্যা বলে মালতীর কাছে তাকে আত্মসমৰ্পণ করতে হচ্ছে।
মালতী খুশি হয়ে বলল, ‘তাহলে তোমার না খাওয়াই ভালো। সাধনের জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে খেতে হয়, তাছাড়া ওতে আমার কোনো ক্ষতিই হয় না, হেরম্ব। কারণ পান করলে তোমার নেশা হবে, আমার শুধু একাগ্রতার সাহায্য হয়। প্রক্রিয়া আছে মন্ত্রতন্ত্র আছে–সে সব তুমি বুঝবে না, হেরম্ব। বাবা বলেন, নেশার জন্য ওসব খাওয়া মহাপাপ। আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য খাও কোনো দোষ নেই।’
আনন্দ মিনতি করে বলল, ‘আজ থাক মা।’
মালতী মাথা নেড়ে অস্বীকার করে চলে গেল।
ঘরের মাঝখানে লণ্ঠন জ্বলছিল। কাচ পরিষ্কার, পলতে ভালো করে কাটা, আলোটা বেশ উজ্জ্বল। পূর্ণিমার প্রাথমিক জ্যোৎস্নার চেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল। হেরম্বের মনে হল, আনন্দের মুখ ম্লান দেখাচ্ছে।
আনন্দ বলল, ‘মা’র দোষ নেই।’
‘দোষ ধরি নি, আনন্দ।’
‘দোষ না ধরলে কি হবে! মেয়েমানুষ মদ খায় একি সহজ দোষের কথা।’
সুপ্রিয়াকে মনে করে হেরম্ব চুপ করে রইল। একটা জলচৌকি সামনে টেনে আনন্দ তাতে বসল।’কিন্তু মা’র সত্যিই দোষ নেই। এসব বাবার জন্য হয়েছে। জানেন মা’র মনে একটা ভয়ানক কষ্ট আছে। একবার পাগল হয়ে যেতে বসেছিল। এই কষ্টের জন্য।’
‘কিসের কষ্ট?’
আনন্দ বিষণ্ণ চিন্তিত মুখে গোলাকার আলোর শিখাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘মা বাবাকে ভয়ানক ভালবাসে। বাবা যদি দুদিনের জন্যও কোথাও চলে যান, মা ভেবে ভেবে ঠিক পাগলের মতো হয়ে থাকে। বাবা কিন্তু মাকে দুচোখে দেখতে পারেন না। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে একদিন বাবাকে একটি মিষ্টি কথা বলতে শুনি নি।’
হেরম্ব অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু মাস্টারমশায় তো কড়া কথা বলবার লোক নন!’
‘রেগে চেঁচামেচি করে না বললে বুঝি কড়া কথা বলা হয় না? আপনার সামনে মাকে আজ কি রকম অপদস্থ করলেন, দেখলেন না। চব্বিশ ঘণ্টা এক বাড়িতে থাকি, মার অবস্থা আমার কি আর বুঝতে বাকি আছে! এমনি মা অনেকটা শান্ত হয়ে থাকে। মদ খেলে আর রক্ষে নেই। গিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দেবে। শুনতে পাবার ভয়ে আমি অবশ্য বাগানে পালিয়ে যাই, তবু দু-চারটে কথা কানে আসে তো। আমার মন এমন খারাপ হয়ে যায়।’ ক্ষণিকের অবসর নিয়ে আনন্দ আবার বলল, ‘বাবা এমন নিষ্ঠুর!’
কত হয়ে আনন্দ্রের বালিশে গাল রেখে হেরম্ব শুয়েছিল। বালিশে মৃগনাভির মৃদু গন্ধ আছে। মালতীর দুঃখের কাহিনী শুনতে শুনতেও সে স্মরণ করবার চেষ্টা করছিল। কিন্তুরীগন্ধের সঙ্গে তার মূল কার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আনন্দের উচ্চারিত নিষ্ঠুর শব্দটা তার মনকে আনন্দের দিকে ফিরিয়ে দিল।
‘নিষ্ঠুর’
‘ভয়ানক নিষ্ঠুর। আজ বাবার কাছে একটু ভালো ব্যবহার পেলে মা মদ ছোয় না। জেনেও বাবা উদাসীন হয়ে আছেন। এক এক সময় আমার মনে হয়, এর চেয়ে বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন তাও ভালো ছিল। মা বোধহয় তাহলে শান্তি পেত।’
বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন! আনন্দও তাহলে প্রয়োজন উপস্থিত হলে নিষ্ঠুর চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে? মালতীর দুঃখের চেয়ে আনন্দের এই নূতন পরিচয়টিই যেন হেরম্বের কাছে প্রধান হয়ে থাকে। তার নানা কথা মনে হয়। মালতীর অবাঞ্ছনীয় পরিবর্তনকে আনন্দ যথোচিতভাবে বিচার করতে অক্ষম নয় জেনে সে সুখী হয়। মালতীর অধঃপতন রহিত করতে অনাথকে পর্যন্ত সে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা পোষণ করে, মালতীর দোষগুলি তার কাছে এতদূর বর্জনীয়। মাতৃত্বের অধিকারে যা খুশি করবার সমর্থন আনন্দের কাছে মালতী পায় নি। শুধু তাই নয়। আনন্দের আরো একটি অপূর্ব পরিচয় তার মালতী সম্পৰ্কীয় মনোভাবের মধ্যে আবিষ্কার করা যায়। মালতীকে সে দোষী বলে জানে, কিন্তু সমালোচনা করে না, তাকে সংস্কৃত ও সংশোধিত করবার শতাধিক চেষ্টায় অশান্তির সৃষ্টি করে না। মালতীকে কিসে বদলে দিয়েছে আনন্দ তা জানে। কিন্তু জানার চেয়েও যা বড় কথা, মনোবেদনার এই বিকৃত অভিব্যক্তিকে সে বোঝে, অনুভব করে। জীবনের এই যুক্তিহীন অংশটিতে যে অখণ্ড যুক্তি আছে, আনন্দের তা অজানা নয়। ওর বিষণ্ণ মুখখানি হেরম্বের কাছে তার প্রমাণ দিচ্ছে।
আনন্দ চুপ করে বসে আছে। তার এই নীরবতার সুযোগে তাকে সে কত দিক দিয়ে কতভাবে বুঝছে হেরম্বের মনে তার চুলচেরা হিসাব চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় হঠাৎ সে অনুভব করে এই প্রক্রিয়া তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আনন্দকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার চেষ্টায় তার মধ্যে কেমন একটা অনুত্তেজিত অবসন্ন জ্বালা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্মুখে পথ অফুরন্ত জেনে যাত্রার গোড়াতেই অশ্ৰান্ত পথিকের যেমন স্তিমিত হতাশা জাগে, একটা ভারবোধ তাকে দমিয়ে রাখে, সেও ভুটা বিমানো চেপে-ধর কক্টর অধীন হয়ে পড়েছে। আনন্দের অন্তরঙ্গ প্রয়ে তার ফেন সুখ নেই।
হেরম্ব বিছানায় উঠে বসে। লন্ঠনের এত কাছে আনন্দ বসেছে যে তাকে মনে হচ্ছে জ্যোতির্ময়ী,
আলো যেন লণ্ঠনের নয়। হেরম্ব অসহায় বিপনের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আরো একটি অভিনব আত্মচেতনা খুঁজে পায়। তার বিহ্বলতার সীমা থাকে না। সন্ধ্যা থেকে আনন্দকে সে যে কেন নানা দিক থেকে বুঝবার চেষ্টা করছে, এতক্ষণে হেরম্ব সে রহস্যের সন্ধান পেয়েছে। ঝড়ো রাক্রির উত্তাল সমুদ্রের মতো অশান্ত অসংযত হৃদয়কে এমনিভাবে সে সংযত করে রাখছে, আনন্দকে জািনবার ও বুঝবার এই অপ্ৰমত্ত ছলনা দিয়ে। আনন্দ যেমনি হোক কি তার এসে যায়? সে বিচার পড়ে আছে সেই জগতে, যে জগৎ আনন্দের জন্যই তাকে অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। জীবনে ওর যত অনিয়ম–যত অসঙ্গতিই থাক, কিসের সঙ্গে তুলনা করে সে তা যাচাই করবে? আনন্দকে সে যে স্তরে পেয়েছে সেখানে ওর অনিয়ম নিয়ম, ওর অসঙ্গতিই সঙ্গতি। ওর অনিবাৰ্য আকর্ষণ ছাড়া বিশ্বজগতে আজ আর দ্বিতীয় সত্য নেই, ওর হৃদয়মনের সহস্র পরিচয় সহস্রাবার আবিষ্কার করে তার লাভ কি হবে? তার মোহকে সে চরম পরিপূর্ণতার স্তরে তুলে দিয়েছে, তাকে আবার গোড়া থেকে শুরু করে বাস্তবতার ধাপে ধাপে চিনে গিয়ে তিল তিল করে মুগ্ধ হবার মানে কি হয়? এ তারই হৃদয়মনের দুর্বলতা। ঈশ্বরকে কৃপাময় বলে কল্পনা না করে যে দুর্বলতার জন্য মানুষ ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারে না, এ সেই দুর্বলতা? আনন্দকে আশ্রয় করে যে অপার্থিব অবোধ্য অনুভূতি নীহারিকালোকের রহস্যসম্পদে তার চেতনাকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে দিতে চায়, পৃথিবীর মাটিতে প্রোথিত সহস্র শিকড়ের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে উর্ধািয়ত জ্যোতিস্তরের মতো তাকে উক্তৃঙ্গ আত্মপ্রকাশে সমাহিত করে ফেলতে চায়, সেই অব্যক্ত অনুভূতি ধারণ করবার শক্তি হৃদয়ের নেই বলে অভিজ্ঞতার অসংখ্য অনভিব্যক্তি দিয়ে তাকেই সে আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছে! আকাশকুসুমকে আকাশে উঠে সে চয়ন করতে পারে না। তাই অসীম ধৈর্যের সঙ্গে বাগানের মাটিতে তার চাষ করছে। হৃদয়ের একটিমাত্র অবাস্তব বন্ধনের সমকক্ষ লক্ষ বাস্তব বন্ধন সৃষ্টি করে সে আনন্দকে বাঁধতে চায়। সুখ-দুঃখের অতীত উপভোগকে সে পরিণত করতে চায় তার পরিচিত পুলকবেদনায়। আজ সন্ধ্যা থেকে সে এই অসাধ্য সাধনে ব্ৰতী হয়েছে।
আনন্দ পুরাতন প্রশ্ন করল।
‘কি ভাবছেন?’
‘অনেক কথাই ভাবছি, আনন্দ। তার মধ্যে প্রধান কথাটা এই, আমার কি হয়েছে।’
‘কি হয়েছে?’
‘কি রকম একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে।’
আনন্দ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমারও হয়। নাচবার আগে আমার ওরকম হয়।’
হেরম্ব উৎসুক হয়ে বলল, ‘তোমার কি রকম লাগে?’
‘কি রকম লাগে?’ আনন্দ একটু ভাবল, ‘তা বলতে পারব না। কি রকম যেন একটা অদ্ভুত—’
‘আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, আনন্দ।’
‘আমিও আপনারটা বুঝতে পারছি।‘
পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে তারা হেসে ফেলল।
আনন্দ বলল, ‘আপনার খিদে পায় নি? কিছু খান।’
হেরম্ব বলল, ‘দাও। বেশি দিও না।’
একটি নিঃশব্দ সঙ্কেতের মতো আনন্দ যতবার ঘরে আনাগোনা করল, জানালার পাটগুলি ভালো করে খুলে দিতে গিয়ে যতক্ষণ সে জানালার সামনে দাঁড়াল, ঠিক সম্মুখে এসে যতবার সে চোখ তুলে সোজা তার চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল—তার প্রত্যেকটির মধ্যে হেরম্ব তাঁর আত্মার পরাজয়কে ভুলে যাবার প্রেরণা আবিষ্কার করল। তার ক্রমে ক্রমে মনে হল, হয়তো এ পরাজয়ের গ্লানি মিথ্যা। বিচারে হয়তো ভুল আছে। হয়তো জয়-পরাজয়ের প্রশ্নই ওঠে না।
হেরম্বের মন যখন এই আশ্বাসকে খুঁজে পেয়েও সন্দিগ্ধ পরীক্ষকের মতো বিচার করে না দেখে। গ্ৰহণ করতে পারছে না, আনন্দ তার চিন্তায় বাধা দিল। আনন্দের হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে, সিঁড়িতে বসে হেরম্বকে একটা কথা বলবে, মনে করেও বলা হয় নি। কথাটা আর কিছুই নয়। প্রেম যে একটা অস্থায়ী জোরালো নেশ্যমাত্র হেরম্ব এ খবর পেল কোথায়! একটু আগেও এ কথা জিজ্ঞাসা করতে আনন্দের লজ্জা হচ্ছিল। কিন্তু কি আশ্চৰ্য, এখন তার একটুও লজ্জা করছে না।
‘আপনাকে সত্যি কথাটা বলি। সন্ধ্যার সময় আপনাকে যে বন্ধু বলেছিলাম, সেটা বানানো কথা। এতক্ষণে আপনাকে বন্ধু মনে হচ্ছে।’
‘এখন কত রাত্রি?’
‘কি জানি। দশটা সাড়ে-দশটা হবে। ঘড়ি দেখে আসব?’
‘থাক। আমার কাছে ঘড়ি আছে। দশটা বাজতে এখনো তের মিনিট বাকি।’
আনন্দ বিস্মিতা হয়ে বলল, ‘ঘড়ি আছে, সময় জিজ্ঞেস করলেন যে?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘ঘড়ি দেখতে জান কিনা পরখ করছিলাম। মালতী—বৌদির সাড়াশব্দ যে না?’
আনন্দ হাসল। বলল, ‘অত বোকা নাই, বুঝলেন? এমনি করে আমার কথাটা এড়িয়ে যাবেন, তা হবে না। রোমিও জুলিয়েট বেঁচে থাকলে তাদের প্ৰেম অল্পদিনের মধ্যে মরে যেত, আপনি কি করে জানলেন বলুন।’
হেরম্ব এটা আশা করে নি। লজ্জা না করার অভিনয় করতে আনন্দের যে প্রাণান্ত হচ্ছে, এটুকু ধরতে না পারার মতো শিশুচোখ হেরম্বের নয়। একবার মরিয়া হয়ে সে প্রশ্ন করছে, তার সম্বন্ধে এই সুস্পষ্ট ব্যক্তিগত প্রশ্নটা। তার এ সাহস অতুলনীয়। কিন্তু প্রশ্নটা চাপা দিয়েও আনন্দের শরম-তিক্ত অনুসন্ধিৎসাকে চাপা দেওয়া গেল না দেখে হেরম্ব অবাক হয়ে রইল।
‘বুদ্ধি দিয়ে জানলাম।’ হেরম্ব এই জবাব দিল।
‘শুধু বুদ্ধি দিয়ে?’
‘শুধু বুদ্ধি দিয়ে আনন্দ! বিশ্লেষণ করে।’ আনন্দের বালিশ থেকে সদ্য আবিষ্কৃত লম্বা চুলটির একপ্রান্ত আঙুল দিয়ে চেপে ধরে ফু দিয়ে উড়িয়ে সেটিকে হেরম্ব সোজা করে রাখল।
‘জল খেয়ে আসি!’ বলে আনন্দ গেল পালিয়ে।
হেরম্ব তখন আবার ভাবতে আরম্ভ করল যে কোন অজ্ঞাত সত্যকে আবিষ্কার করতে পারলে তার হৃদয়ের চিরন্তন পরাজয়, জয়-পরাজয়ের স্তর চূত হয়ে সকল পার্থিব ও অপার্থিব হিসাবনিকাশের অতীত হয়ে যেতে পারে। চোখ দিয়ে দেখে, স্পর্শ দিয়ে অনুভব করে, বুদ্ধি দিয়ে চিনে ও হৃদয় দিয়ে কামনা করে, মর্তলোকের যে আত্মীয়তা আনন্দের সঙ্গে তার স্থাপিত হওয়া সম্ভব, আত্মার অতীন্দ্ৰিয় উদাত্ত আত্মীয়তার সঙ্গে তার তুলনা কোথায় রহিত হয়ে গেছে। কোন হৃদ্য যুক্তি, সীমারেখার মতো, এই দুটি মহাসত্যকে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছে যে, তাদের অস্তিত্ব আর পরস্পরবিরোধী হয়ে নেই, তাদের একটি অপরটিকে কলঙ্কিত করে দেয় নি।
আনন্দের ফিরে আসতে দেরি হয়। হেরম্বের ব্যাকুল অন্বেষণ তার দেহকে অস্থির করে দেয়। বিছানা থেকে নেমে সে ঘরের মধ্যে পায়চারি। আরম্ভ করে। এদিকের দেয়াল থেকে ওদিকের দেয়াল পর্যন্ত হেঁটে যায়, থমকে দাঁড়ায় এবং প্রত্যাবর্তন করে। তিনটি খোলা জানালা প্ৰত্যেকবার তার চোখের সামনে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত পৃথিবীকে মেলে ধরে। কিন্তু হেরম্বের এখন উপেক্ষা অসীম। সম্মুখের সুদূর সাদা দেয়ালটির আধ হাতের মধ্যে এসে গতিবেগ সংযত করে, আর কিছুই দেখতে পায় না। মেঝেতে আনন্দের পরিত্যক্ত একটি ফুল তার পায়ের চাপে পিষে যায়।
হেরম্ব জানে, আলো এই অন্ধকারে জ্বলবে। তাকে চমকে না দিয়ে বিনা আড়ম্বরে তার হৃদয়ে পরম সত্যটির আবির্ভাব হবে। তার সমস্ত অধীরতা অপমৃত্যু লাভ করবে না, ঘুমিয়ে পড়বে। জীবনের চরম জ্ঞানকে সুলভ ও সহজ বলে জেনে সে তখন ক্ষুন্ন অথবা বিস্মিত পর্যন্ত হবে না। কিন্তু তার দেরি কত?
ফিরে এসে তার চাঞ্চল্য লক্ষ্য করে আনন্দ অবাক হয়ে গেল কিন্তু কথা বলল না। একপাশে বসে তার অস্থির পদচারণাকে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে লাগল। হেরম্ব বহুদিন হল তার চুলের যত্ন নিতে ভুলে গেছে। তবু তার চুলে এতক্ষণ যেন একটা শৃঙ্খলা ছিল, এখন তাও নেই। তাকে পাগলের মতো চিন্তাশীল দেখাচ্ছে। আনন্দের সামনে এমনিভাবে সে যেন কত যুগ ধরে ক্ষ্যাপার মতো অসংলগ্ন পদবিক্ষেপে হেঁটে হেঁটে শুধু ভেবে গিয়েছে। পৃথিবীতে বাস করার অভ্যাস যেন তার নেই। প্রবাসে আপনার অনির্বচনীয় একাকিত্বের বেদনায় এমনি প্রগাঢ় ঔৎসুক্যের সঙ্গে সে সর্বদা স্বদেশের স্বপ্ন দেখে।
আনন্দের আবির্ভাব হেরম্ব টের পেয়েছিল। কিন্তু সে যে মানসিক অবস্থায় ছিল তাতে এই আবির্ভাব কিছুক্ষণের জন্য মূল্যহীন হয়ে থাকতে বাধ্য।
হেরম্ব হঠাৎ তার সামনে দাঁড়াল।‘
‘ব্যায়াম করছি, আনন্দ।‘
‘ব্যায়াম শেষ হয়ে থাকলে বসে বিশ্রাম করুন।’
হেরম্ব তৎক্ষণাৎ বসল বলল, ‘তুমি বার বার মুখ ধুয়ে আসছ কেন?’
‘মুখে ধুলো লাগে যে!’ আনন্দ হাসবার চেষ্টা করল।
তাদের অদ্ভুত নিরবলম্ব অসহায় অবস্থাটি হেরম্বের কাছে হঠাৎ প্রকাশ হয়ে যায়। তাদের কথা বলা অর্থহীন, তাদের চুপ করে থাকা ভয়ঙ্কর। পায়ের তলা থেকে তাদের মাটি প্রায় সরে গেছে, তাদের আশ্রয় নেই। মানুষের বহু যুগের গবেষণাপ্রসূত সভ্যতা আর তারা ব্যবহার করতে পারছে না। দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ ও ধর্ম, এমন কি, ঈশ্বরকে নিয়ে পর্যন্ত তাদের আলাপ আলোচনা আচল, এতদূর অচল যে, পঁাচ মিনিট ওসব বিষয়ে চেষ্টা করে কথা চালালে নিজেদের বিশ্ৰী অভিনয়ের লজ্জায় তারা কণ্টকিত হয়ে উঠবে। এই কক্ষের বাইরে জ্ঞান নেই, সমস্যা নেই, প্রয়োজনীয় কিছু নেই–মানুষ পর্যন্ত নেই। তাদের কাছে বাইরের জগৎ মুছে গেছে, আর সে জগৎকে কোনো ছলেই এ—ঘরে টেনে আনা যাবে না। একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলবার কিছু নেই। অথচ এই সীমাবদ্ধ আলাপেও যে কথাগুলি তারা বলতে পারছে সেগুলি বাজে, অবান্তর। বোমার মতো ফেটে পড়তে চেয়ে তাদের তুড়ি দিয়ে খুশি থাকতে হচ্ছে।
এ অবস্থা সুখের নয়, কাম্য নয়, হেরম্বের তা স্বীকার করতে হল। কিন্তু ক্ষতিপূরণ যে এই অসুবিধাকে ছাপিয়ে আছে। এ কথা জানতেও তার বাকি ছিল না। পরস্পরের কত অনুচ্চারিত চিন্তাকে তারা শুনতে পাচ্ছে। তাদের কত প্রশ্ন ভাষায় রূপ না নিয়েও নিঃশব্দ জবাব পাচ্ছে। শাড়ির প্রান্ত টেনে নামিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে দিয়ে বলছে, পা দু’টি আড়াল করে দেখবার মতো নয়; আঁচলের তলে হাত দুটি আড়াল করে বলছে, পা দেখতে দিলাম না বলে তুমি অমন করে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তা হবে না। সে তার মুখের দিকে চেয়ে জবাব দিচ্ছে এবার তুমি মুখ ঢাক কি করে দেখি! আনন্দের মৃদু রোমাঞ্চ ও আরক্ত মুখ প্রতিবাদ করে বলছে, আমাকে এমন। করে হার মানানো তোমার উচিত নয়। দরজার দিকে চেয়ে আনন্দ ভয় দেখাচ্ছে। আমি ইচ্ছা! করলেই উঠে চলে যেতে পারি।
হঠাৎ তার মুখে বিষণ্ণতা ঘনিয়ে আসছে। তার চোখ ছলছল করে উঠছে। চোখের পলকে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এও ভাষা-সুস্পষ্ট বাণী! কিন্তু এর অর্থ অতল, গভীর, রহস্যময়। তার কত ভয়, কত প্রশ্ন, নিজের কাছে হঠাৎ নিজেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠে তার কি নিদারুণ কষ্ট, হেরম্ব কি তা জানে? তার মন কতদূর উতলা হয়ে উঠেছে হেরম্ব কি তার সন্ধান রাখে? একটা বিপুল সম্ভাবনা গুহানিরুদ্ধ নদীর মতো তাকে যে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে, হেরম্ব তাও কি জানে? হয়তো আজি থেকেই তার চিরকালের জন্য দুঃখের দিন শুরু হল, এ আশঙ্কা যে তার মনে জ্বালার মতো জেগে আছে, হেরম্ব কি তা কল্পনাও করতে পারে?
নিঃশব্দ নির্মম হাসির সঙ্গে উদাসীন চোখে খোলা জানোলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে হেরম্ব জবাব দিচ্ছে: দুঃখকে ভয় কোরো না। দুঃখ মানুষের দুর্লভতম সম্পদ! তাছাড়া আমি আছি। আমি!
কথার অভাবে তাদের দীর্ঘতম নীরবতার শেষে আনন্দ বলল, ‘চলুন নাচ দেখবেন।’
আনন্দের নাচ যে বাকি আছে, সে কথা হেরম্বের মনে ছিল না।
‘চল। বেশ পরিবর্তন করবে না?’
‘করব। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।’
হেরম্ব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনাথের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় ভেজানো জানালার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল এককোণে মেরুদণ্ড ষ্টান করে নিস্পন্দ হয়ে সে বসে আছে। জীবনে বাহুল্যের প্রয়োজন আছে। কত বিচিত্র উপায়ে মানুষ এ প্রয়োজন মেটায়!
বাড়ির বাইরে গিয়ে মন্দিরের সামনে ফাঁকা জায়গায় হেরম্ব দাঁড়াল। ইতিমধ্যে এখানে অনেক পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে গেছে। তা যদি না হয়ে থাকে, তবে হেরম্বের চোখেরই পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চয়। মন্দির ও বাড়ির শ্যাওলার আবরণ এক প্রস্থ ছায়ার আস্তরণের মতো দেখাচ্ছে। বাগানে তরুতলের রহস্য আরো ঘন আরো মর্মস্পৰ্শী হয়ে উঠেছে। আনন্দ যে ঘাসের জমিতে নাচবে সেখানে জ্যোৎস্না পড়েছে আর পড়েছে দেবদারু গাছটার ছায়া। সমুদ্রের কলরব ক্ষীণভাবে শোনা যাচ্ছে। রাত্রি আরো বাড়লে, চারিদিক আরো স্তব্ধ হয়ে এলে, আরো স্পষ্টভাবে শোনা যাবে।
পৃথিবীতে চিরদিন এই সঙ্কেত ও সঙ্গীত ছিল, চিরদিন থাকবে। মাঝখানে শুধু কয়েকটা বছরের জন্য নিজেকে সে উদাসীন করে রেখেছিল। সে মরে নি, ঘুমিয়ে পড়েছিল মাত্র। ঘুম ভেঙে, দুঃস্বপ্নের ভগ্নস্তৃপকে অতিক্রম করে সে আবার স্তরে স্তরে সাজানো সুন্দর রহস্যময় জীবনের দেখা পেয়েছে। যে স্পন্দিত বেদনা প্রাণ ও চেতনার একমাত্র পরিচয় আজ আর হেরম্বের তার কোনো অভাব নেই।
হেরম্ব মন্দিরের সিঁড়িতে বসল।
আনন্দের প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে বাড়ির দরজায় সে চোখ পেতে রাখল না। আনন্দ বেশ পরিবর্তন করেই বাইরে এসে তাকে নাচ দেখাবে, চঞ্চল হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। এই সংক্ষিপ্ত বিরহাটুকু তার বরং ভালোই লাগছে। আনন্দ যদি আসতে দেরিও করে সে ক্ষুন্ন হবে না।
আনন্দ দেরি না করেই এল। চাঁদের আলোতে তাকে পরীক্ষা করে দেখে হেরম্ব বলল, ‘তুমি তো কাপড় বদলাও নি আনন্দ?’
‘না। শুধু জামা বদলে এলাম। কাপড়ও অন্যকরম করে পরেছি। বুঝতে পারছেন না?’
‘বুঝতে পারছি।’
‘কি রকম দেখাচ্ছে আমাকে?’
‘তা কি বলা যায় আনন্দ?’ হেরম্ব সিঁড়ির উপরের ধাপে বসেছিল। তার পায়ের নিচে সকলের তলার ধাপে আনন্দ বসতেই সেও নেমে এল। আনন্দ চেয়ে না দেখেই একটু হাসল।
হেরম্ব কোনো কথা বলল না। আনন্দের এখন নীরবতা দরকার এটা সে অনুমান করেছিল। হাঁটুর সামনে দুটি হাতকে বেঁধে আনন্দ বসেছে। তার ছড়ানো বাবরি চুল কান ঢেকে গাল পর্যন্ত ঘিরে আসছে। তার ছোট ছোট নিশ্বাস নেবার প্রক্রিয়া চোখে দেখা যায়।
আনন্দ এক সময় নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘জামাকাপড়! কি ছোট মন আমাদের!’
‘আমাদের, আনন্দ।’
‘না, আমাদের। এসব সৃষ্টি করেছি আমরা। এ আমাদের এক ধরনের ছল।’
নিঃশব্দে সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তারা চুপ করে বসে থাকে। আনন্দকে চমকে দেবার ভয়ে হেরম্ব নড়তে সাহস পায় না; জোরে নিশ্বাস ফেলতে গিয়ে চেপে যায়। আকাশে চাদ গতিহীন। আনন্দের নাচের প্রতীক্ষায় হেরম্বের মনেও সমস্ত জগৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে।
তারপর এক সময় আনন্দ উঠে গেল। ঘাসে-ঢাকা জমিতে গিয়ে চাঁদের দিকে মুখ করে সে ধ্ৰুপতে বসল। প্ৰণামের ভঙ্গিতে মাথা মাটিতে নামিয়ে দুহাত সম্মুখে প্রসারিত করে স্থির হয়ে রইল।
আনন্দ কতক্ষণ নৃত্য করল হেরন্থের সে খেয়াল ছিল না।
চাঁদের আলো তার চোখে নিভে নিভে মান হয়ে এসেছিল নাচের গোড়াতেই। এটা তার কল্পনা অথবা আকাশের চাঁদকে মেঘে আড়াল করেছিল, হেরম্ব বলতে পারবে না। কিন্তু শ্লথ, মন্থর গতিছন্দ থেকে আনন্দের নৃত্য চঞ্চল হতে চঞ্চলতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোৎস্নাও যে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল। এ কথা হেরম্ব নিঃসংশয়ে বলতে পারে। হয়তো চোখে তার ধাঁধা লেগেছিল। হয়তো চন্দ্ৰকলা নৃত্যের শোনা ব্যাখ্যাটি তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
পূর্ণিমা থেকে আনন্দ কিন্তু অমাবস্যায় ফিরে যেতে পারে নি। নৃত্য যখন তার চরম আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, তার সর্বাঙ্গের আলোড়িত সঞ্চালন এক ঝলক আলোর মতো প্রখর দ্রুততায় হেরম্বের বিস্ময়চকিত দৃষ্টির সামনে চমক সৃষ্টি করেছে, ঠিক সেই সময় অকস্মাৎ সে থেমে গেল।
ঘাসের উপর বসে তাকে হাঁপাতে দেখৈ হেরম্ব তাড়াতাড়ি উঠে তার কাছে গেল।
‘কি হল, আনন্দ?’
‘ভয় করছে।’ আনন্দ বলল। রুদ্ধস্বরে, কান্নার মতো করে।
সে থারথার করে কাঁপছে। তার মুখ আরক্ত, সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। তার দুচোখে উত্তেজিত অসংযত চাহনি। চুলগুলি তার মুখে এসে পড়ে ঘামে জড়িয়ে গিয়েছিল। চুল পিছনে সরিয়ে হেরম্ব তার কানের পাশে আটকে দিল। তাকে দম নেবার সময় দিয়ে বলল, ‘ভয় করছে? কেন ভয় করছে, আনন্দ?’
আনন্দ বলল, ‘কি জানি। হঠাৎ সমস্ত শরীর আমার কেমন করে উঠল! মনে হল, এইবার আমি মরে যাব। মরে যেতে আমার কখনো ভয় হয় নি। আজ কেন যে এরকম করে উঠল! অন্য দিন নাচের পর ঘুম আসে। আজ শরীর জ্বালা করছে!’
‘গরম লাগছে?’
‘না। ঝাঁজের মতো জ্বালা করছে–হাড়ের মধ্যে। আমি এখন কি করি! কেন এই রকম হল?’
‘একটু বিশ্রাম করলেই সেরে যাবে। শোবে আনন্দ? শুয়ে পড়লে হয়তো —’
আনন্দ হেরম্বের কোলে মাথা রেখে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। তার নিশ্বাস ক্রমে ক্রমে সরল হয়ে আসছে, কিন্তু মুখের অস্বাভাবিক উত্তেজনার ভাব একটুও কমে নি। হেরম্বের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতেই তার দুচোখ জলে ভরে গেল।
‘এরকম হল কেন আজ? তোমার জন্যে?’
‘হতে পারে। আমি তো সহজ লোক নই। পৃথিবীতে আমার জন্যে অনেক কিছুই হয়েছে।’
অন্ধ যে ভাবে আশ্রয় খোজে, আনন্দ তেমনি ব্যাকুল ভঙ্গিতে তার দুটি হাত বাড়িয়ে দিল। হেরম্বের হাতের নাগাল পেতেই শক্ত করে চেপে ধরে সে যেন একটু স্বস্তি পেল।
‘ঠিক করে কিছুই বুঝতে পারছি না। আরো যেন কত কি দুঃখ একসঙ্গে ভোগ করছি। আচ্ছা! তুমি তো কবি, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?’
‘আমি কবি নই, আনন্দ। আমি সাধারণ মানুষ।’
আনন্দ তার এই সবিনয় অস্বীকারের প্রতিবাদ করল।
‘তুমি আমার কবি। কবি না হলে কেউ এমন ঠাণ্ডা হয়? সন্ধ্যার সময় তোমাকে দেখেই আমি চিনেছিলাম। তুমি না থাকলে আমি এখন এখানে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে নাচের জ্বালায় জ্বলে মরে যেতাম।‘
‘জ্বালা কমে নি আনন্দ?’
‘কমেছে।’
‘নাচ শেষ করবে?’
‘না। নাচ শেষ করে ঘুমোবে কে? তার চেয়ে এ কষ্টও ভালো। ঘুম তো মরে যাওয়ার সমান, শুধু সময় নষ্ট।’
আনন্দ হঠাৎ উৎকৰ্ণ হয়ে বলল, ‘ক’টা বাজল? অনেক দূরে থানায় ঘণ্টা বাজছে। ক’টা বাজল শুনলে?’
হেরম্ব বলল, ‘ও ঘণ্টা ভুল, আনন্দ। এখন ঠিক মাঝরাত্রি।’
আনন্দ বলল, ‘তাই হবে, চাঁদটা আকাশের ঠিক মাঝখানে এসেছে।’
ওইখানে, আকাশের চাঁদের কাছে পৌঁছে, আনন্দ একেবারে নির্বাক হয়ে গেল। হেরম্বের দেহের আশ্রয়ে নিজের দেহকে আরো নিবিড়ভাবে সমৰ্পণ করে সে আকাশের নিষ্প্রভ তারা আবিষ্কারের চেষ্টা করতে লাগল।
হেরম্ব এখন তাও জানে। তাই তার গালের উত্তেজনা, তার চিবুকের মনোরম কুঞ্চন, তার স্বপ্নাতুর চোখে কালো ছায়ার গাঢ় অতল রহস্য মিথ্যা নয়। তার ওষ্ঠে তাই শুধু স্পৰ্শই নয়, জ্যোৎস্নাও আছে। ওর মুখের প্রত্যেকটি অণুর সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছ। আর তাই অর্থহীন এমন একটি মুখকে তিল তিল করে মনের মধ্যে সঞ্চয় করার অপরাধ নেই, সময়ের অপচয়
এতকাল হেরম্ব এক মুহূর্ত বিশ্লেষণ ছাড়া থাকতে পারে নি। সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হয়ে এসে এবার তার বিশ্লেষণলব্ধ সত্য সূক্ষ্মতার সীমায় পৌঁছেছে। আর তার কিছুই বুঝবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু হেরম্বের আফসোস তা নয়; এই অক্ষমতার পরিচয় তার জানা : এই তার চরম জ্ঞান। সে বিজ্ঞান মানে, আজ বৈজ্ঞানিকের মন নিয়ে কাব্যকে মানল। চোেখ যখন আছে, চোখ দেখুক। দেহ যখন আছে, দেহে রোমাঞ্চ হোক। হেরম্ব গ্রাহ্য করে না। অনাবৃত আনন্দের দেহ থেকে জ্যোৎস্নার আবরণ আজ কিসে ঘোচাতে পারবে? লক্ষ আলিঙ্গনও নয়, কোটি চুম্বনও নয়।
‘আছেন? বললে ঈশ্বর অস্তিত্ব পান এবং সে অস্তিত্ব মিথ্যা নয়, কারণ ‘আছেন’ বলাটাই স্ব-সম্পূর্ণ সত্য, আর কোনো প্রমাণসাপেক্ষ সত্যের উপর নির্ভরশীল নয়। হেরম্বের প্রেমও শুধু আছে বলেই সত্য। কল্পনার সীমা আছে বলে নয়, সে অনুভূতির স্রোত তার জীবন তার ঐতিহাসিকতায় নেই বলে নয়, নিজের সমগ্র সচেতন আমিত্ব দিয়ে আয়ত্ত করতে পারছে না বলে নয় : প্ৰেম আছে বলে প্রেম আছে। কাম-পঙ্কের পদ্ম এর উপমা নয়। মানুষের মধ্যে যতখানি মানুষের নাগালের বাইরে, প্রেম তারই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
প্রেমকে হেরম্ব অনুভব করছে না, উপলব্ধি করছে না, চিন্তা করছে না–সে প্রেম করছে। এ তার নব ইন্দ্ৰিয়ের নবলব্ধ ধর্ম।
আনন্দের মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, দুহাতের তালুতে পৃথিবীর সবুজ নমনীয় প্রাণবান তৃণের স্পর্শ অনুভব করে হেরম্ব খুশি হয়ে উঠল। প্রশান্ত চিত্তে সে ভাবল, পূর্ণিমার নাচ শেষ করে অমাবস্যায় ফিরে না গিয়ে আনন্দ ভালোই করেছে।