গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, চন্দ্রভানকে বিয়ে করার অদম্য আকাভক্ষা মফিজুদ্দিনের হয় যখন সে তার যাত্রাদল ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসে এবং একদিন চন্দ্রভানকে দেখে। চন্দ্রভানকে নিশ্চয়ই মফিজুদ্দিন আগেও অনেকবার দেখেছিল, কিন্তু এই দিনের দেখায় কি বিশেষত্ব ছিল, গ্রামের লোকেরা প্রথমে তা বুঝতে পারে না। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন পরবর্তী সময়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বলেছিল, আমি তাকায়া দেহি, আমার সামনে ম্যাসাবের ম্যায়া চন্দ্রভান, আর অক দেইখ্যা আমার মনে হইলো যে, আমি অক বিয়্যা হরমু। গ্রামের মানুষেরা বলে যে, এই ঘটনার বিষয়ে মফিজুদ্দিন এর বেশি কিছু বলে না এবং তারা, গ্রামের লোকেরা, এ সম্পর্কে দীর্ঘদিন খুব অল্পই জানতে পারে, যদিও মফিজুদ্দিনের মনে সেই সব ঘটনার বিশদ স্মৃতি আজীবন থেকে যায়। তারা বলে যে, সেই দিন রাতের বেলা আকাশে কোনো ধরনের পূর্ণ অথবা বাঁকা চাঁদ ছিল কি না তা মফিজুদ্দিন পরে ভুলে যায়, এক নির্জন শূন্যতার ভেতর রাতের গভীর প্রহরে সে রৌহার পানিতে বড়শি ফেলে বোয়াল মাছ ধরার জন্য বসেছিল, তার পায়ের কাছে পানির ধার ঘেঁষে ছিল একটি ছোট হারিকেনের আলো; এই আলো পানিতে গিয়ে পড়েছিল এবং মফিজুদ্দিন পাড়ের ওপর অপেক্ষা করে ছিল। তখন ন্দ্রিামগ্ন চরাচরে কোনো শব্দ ছিল না, কেবলমাত্র তার বড়শিতে টোপ হিসেবে গেঁথে দেয়া জ্যান্ত ব্যাঙটি থেকে থেকে লাফালাফি করে পানিতে শব্দ এবং ছোট ছোট তরঙ্গে সৃষ্টি করছিল। মফিজুদ্দিনের মনে নাই, তখন রাতের কয় প্রহর হয়েছিল; সে সময় তার চোখ ছিল পানিতে ভেসে থাকা ফাত্তার ওপর এবং মন ছিল বোবা মায়ের স্মৃতির শরীর ছুঁয়ে, তখন হঠাৎ তার মনে হয়, অন্ধকারের ভেতর আলতো পায়ে কেউ তার দিকে হেঁটে আসে। প্রথমে এ বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার মনে হয় যে, এই নিশুতি রাতে রৌহার ঘন জঙ্গলের ভেতর কোনো মানুষের এভাবে আসার কথা নয়, এবং তখন তার মনে ভয় দানা বেঁধে ওঠে। তার মনে হয় যে, এটা হয়তোবা মেছোভূত হবে, কাছে এসে নেকো স্বরে মাছ চাইবে, একটো মাছ দে, এবং তারপর পিছন ফিরে তাকানো মাত্র ঘাড় মটকে দেবে; ভয়ে মফিজুদ্দিনের দেহে কাঁপুনি ধরে যায়, কিন্তু সে ফানার ওপর থেকে চোখ সরায় না। তখন সেই আবছা শব্দটা তার পিছন দিয়ে তাকে পার হয়ে একটু দূরে গিয়ে থামে, তারপর কেউ যখন তার কাছে কোনো মাছ চায় না, সে তার মাথা একটুও না ঘুরিয়ে, চোখের কোনায় দেখতে পায় যে, বিলের পানির কিনারায় একজন মানুষের মতো কিছু একটা দাড়িয়ে আছে। মফিজুদ্দিন শরীরের কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করে, বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকে এবং তখন, সেই বিভ্রান্তি এবং আতঙ্কের ভেতর তার মনে হয় যে, অশরীরী অস্তিত্বটির আসলে একটি পূর্ণাঙ্গ শরীর আছে, তার পাগুলোও মনে হয় সামনের দিকে ফেরানো এবং তারপর, তখন, সে বুঝতে পারে, সেটা একটা নারীর শরীর। মফিজুদ্দিন তখন সেই নারীর দিকে তাকায়, কেন এবং কিভাবে সে এই সাহস করে উঠতে পারে, তা সে মনে করতে পারে না, তবে রৌহার পাড়ের ওপর দাঁড়ানো সেই নারীর দিকে তাকিয়ে সে তাকে চিনতে পারে, দুপুর রাতে বিলের কালো রঙের পানির কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল চন্দ্রভান। মফিজুদ্দিন প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারে নাই, এটা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, চন্দ্রভান এভাবে এখানে এসে দাঁড়াতে পারে; সে বড়শির ফাত্তার কথা ভুলে চন্দ্রভানের দিকে এই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে, এত রাতে রৌহার এই জঙ্গলের ভেতর অমলিন কিশোরী চন্দ্রভান কেন! তারপর তার সামনে এমন সব ক্রিয়াকর্ম সংঘটিত হয় যে, সে বুঝতে পারে, চন্দ্রভান রৌহার বিলের এই জায়গায় কোনো এক স্বপ্নের সওদা করে যায়। মফিজুদ্দিন তখন সেই অন্ধকারে, অথবা আধো-অন্ধকারে অথবা জ্যোৎস্যায় দেখে যে, চন্দ্রভান তার পরনের শাড়ি খুলে ফেলে, ব্লাউস খোলে এবং তারপর পেটিকোটের ফিতে খুলে পায়ের কাছে ছেড়ে দেয়। মফিজুদ্দিনের বহুদিন, সম্ভবত আজীবন, সেই দৃশ্য মনে থাকে, তার সম্মুখে উন্মুক্ত আকাশের প্রেক্ষাপটে রৌহার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন চন্দ্রভান; তার নবীন এবং ক্ষুদ্র স্তনের বঙ্কিমতা পদ্মকলির মতো দিগন্ত রেখার ওপর ঠোঁট রেখে স্থির হয়ে আছে, তার নাভির নিচের ঢালু জমি রৌহার বুকের অল্প পানিতে জন্মানো পদ্ম ও হোগলার বনের মতো কালো হয়ে আছে; সেদিকে তাকিয়ে মফিজুদ্দিনের তখন গোঙ্কুরের ফণার মতো মনে হয় এবং সেদিন তার অস্তিত্বে চন্দ্রভানের ফণার ছোবলের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন রাতে মফিজুদ্দিনের চোখের সামনে পেটিকোট খুলে ফেলে নগ্ন চন্দ্রভান কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে থেকে ধীর এবং সতর্ক পায়ে নিচে কালো পানিতে নেমে যায় এবং বুকসমান পানিতে গিয়ে ডুব দেয়, একবার, দুবার, তিনবার, তারপর সে পানি থেকে পুনরায় পাড়ের ওপর ফিরে আসে এবং ভেজা শরীরে কাপড় পরে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। তাজ্জব হয়ে বসে থাকা মফিজুদ্দিনের সম্বিৎ ফিরে আসতে কয়েক মুহূর্ত লাগে, সে তার বড়শির ছিপ পানির কিনারায় মাটিতে পুঁতে রেখে চন্দ্রভানের পেছন পেছন আসে। চন্দ্রভান রৌহার পাড় ধরে দ্রুত এগিয়ে যায়, তারপর মিয়াবাড়ির পিছন দিয়ে গাছপালায় ভরা ভিটার গভীরে প্রবেশ করে; মফিজুদ্দিন এখানে থামে, তারপর সে বিলের কিনারায় মাটিতে পেতা তার ছিপটির কাছে পুনরায় ফিরে আসে এবং সেখানেই মাটির ওপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। পরদিন ভোরের আলোয় সে যখন চোখ মেলে তাকায় এবং দেখে যে, সে বিলের কিনারায় শুয়ে আছে তখন তার আগের দিন রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে এবং সে নিশ্চিত হয় যে, সেসব স্বপ্ন ছিল; সে তখন রৌহার যে জায়গায় চন্দ্রভান পানিতে নেমেছিল সে জায়গাটা পরীক্ষা করে, কাদামাটির ওপর সে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখে; কিন্তু তবুও তার এ রকম মনে হয় যে, এ হতে পারে না, সে যা কিছু দেখেছে তা সত্য নয়। কিন্তু তার পরও মফিজুদ্দিনের মনে রৌহার পানির কিনারায় কাদার ওপর অঙ্কিত পায়ের ছাপের কথা জেগে থাকে এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, সে দীর্ঘ পাঁচ মাস এই স্বপ্ন পুনর্নির্মাণে ব্যয় করে। তার বুড়ো বাপ, আকালুর মনে বড় দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তার ছেলেটি তিন বছর নিখোঁজ থাকার পর গাঁয়ে ফিরে এসে নিশির ডাকের কবলে পড়েছে, সে এর প্রতিবিধানের জন্য একটি তাবিজ সংগ্রহ করে কালো সুতো দিয়ে মফিজুদ্দিনের গলায় ঝুলিয়ে দেয়; কিন্তু অবস্থার তাতে কোনো উন্নতি হয় না। প্রতিদিন রাত গভীর হতে থাকলে মফিজুদ্দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় এবং সারা রাত রৌহার বিলের কাছে নিদ্রাহীন কাটানোর পর রাত শেষে মোরগ ডেকে উঠলে বাড়ি ফিরে প্রাঙ্গণের খড়ের গাদার ওপর সারা দিন পড়ে পড়ে ঘুমায়; ক্রমান্বয়ে তার চেহারা মলিন এবং শরীর রুগ্ণ হয়ে ওঠে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, পরবর্তী সময়ে মফিজুদ্দিন মনে করতে পারে না মিয়াবাড়ির ভিটার পেছন দিকে রৌহার ধারে কতগুলো রাত সে অপেক্ষা করেছিল; এই অপেক্ষা করার সময় তার মনের ভেতর হয়তো জানা ছিল যে, চন্দ্রভান আর আসবে না, কারণ, রৌহার পানিতে চন্দ্রভানের গোসল করার যে দৃশ্য সে দেখেছিল তা বাস্তব ছিল না; কিংবা, এই জানা থাকার ভেতরেও হয়তোবা তার জানা ছিল যে, সে আসবে, এবং সে আসে। দীর্ঘদিন পর রৌহার কিনারায় চন্দ্রভানের দ্বিতীয় আগমন ঘটে; সেদিন মিয়াবাড়ির ভিটার পেছন দিয়ে বের হয়ে ছায়ামূর্তিটিকে হালকা অথচ দ্রুত পায়ে বিলের পাড় দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে মফিজুদ্দিন বুঝতে পারে যে, এটা চন্দ্রভান এবং তখন তার মনে হয় যে, যদি আশা থাকে, আর যদি লেগে থাকা যায়, তাহলে স্বপ্নও কেমন বাস্তব হয়ে ওঠে। এদিন চন্দ্রভান, এক পাশে চুপ করে বসে থাকা মফিজুদ্দিনকে অতিক্রম করে পূর্বের দিনের মতো নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং মফিজুদ্দিন এই দিন বুঝতে পারে যে, চন্দ্রভান জেগে নেই; তার চোখের পাতা মুদিত, নিজের নগ্নতার অনুপমতা সে নিজের চোখে দেখে না। পরবর্তী তিন মাসে মফিজুদ্দিন মোট সাত দিন চন্দ্রভানকে রৌহার বিলের ধারে দেখে এবং তখন একদিন তার মনে হয় যে, এই নারীকে ছাড়া জীবনে বাঁচা যায় না। এবং তখন একদিন সে আলি আসগর মিয়ার সামনে পড়লে তাকে বাঁধা কামলা করার জন্য আলি আসগর মিয়ার পুরনো ইচ্ছে পুনরায় জেগে ওঠে এবং তখন মফিজুদ্দিন বিষয়টি সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে আসে; এক শুক্রবারে জুম্মা নামাজের পর সে মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ায় এবং বলে যে, সে চন্দ্রভানকে বিয়ে করতে চায়। এই সব ঘটনা গ্রামের লোকেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে জানতে পারে এবং তাদের সামনে এই কাহিনীর একটি পরিপূর্ণরূপ ফুটে ওঠে। সেদিন চৌচালা টিনের বৈঠকখানা ঘরের ভেতর আলি আসগর মিয়া এবং মফিজুদ্দিনের যেসব কথা হয় গ্রামের লোকেরা ক্রমান্বয়ে তা জানতে পারে; মফিজুদ্দিনের কথা শুনে আলি আসগর মিয়ার মুখ অপমান ও ক্রোধে লাল হয়ে যায়, সে বলে, নিমক হারাম, বজ্জাত, তর সাহস তো কম না; কিন্তু মফিজুদ্দিন এই রাগ দেখে বিচলিত হয় না, সে চেয়ারে উপবিষ্ট আলি আসগর মিয়ার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং চন্দ্রভানকে তার বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে। সে, স্তম্ভিত আলি আসগর মিয়াকে বলে যে, তার চাঁদের মতো সুন্দরী মেয়ে চন্দ্রভানের ওপর জিনের আসর আছে এবং সেই জিনটাকে সে চেনে, সে সেই জিনটাকে বশে এনেছে; তাই সে বলে যে, চন্দ্রভানকে তার সঙ্গে বিয়ে দিলে মেয়েটা ভালো থাকবে, আর না দিলে মেয়েটার দুঃখ, কষ্ট এবং যন্ত্রণার শেষ থাকবে না। সেদিন আলি আসগর মিয়া তার এই কথা শুনে আরো ক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু মেয়ের এবং মিয়াবাড়ির সম্মানের কথা ভেবে গলার স্বর নিচু রেখে বলে যে, মফিজুদ্দিন একটা ঠক এবং জোচ্চোর, সে কামলা বেচে খাওয়া আকালু এবং তার বেয়াদপ ছেলেকে উচিত শিক্ষা দেবে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আলি আসগর মিয়ার হাতের বাইরে ছিল, সে কেবলমাত্র সে বিষয়ে জানত না; সেদিন তার গালাগালির মুখে মফিজুদ্দিন নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে তারপর একসময় আর কথা না বলে নীরবে মিয়াবাড়ির টিনের বৈঠকখানা ত্যাগ করে আসে; এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনের তখনই জানা ছিল, এরপর সে কি করবে। মিয়াবাড়ির ভিটা ছেড়ে আসার পরের দিন অতিক্রান্ত হয়ে যখন রাত আসে এবং রাত গভীর হয় তখন সে রৌহার ধারে গিয়ে বসে এবং মনে হয় যেন তার ভাগ্য তার প্রতি আরো প্রসন্ন হয়ে ওঠে, কারণ, এবার রৌহার পানির কিনারায় তাকে মাত্র চার দিন অপেক্ষা করতে হয়; পঞ্চম দিন রাতে সবকিছু নূতন করে পুনরায় ঘটে, ন্দ্রিাচ্ছন্ন চন্দ্রভান এসে রৌহার পানিতে নামে এবং তখন পাড়ের ওপর নিশ্চল কালো ঝোপের মতো বসে থাকা মফিজুদ্দিন তৎপর হয়, তার পরিকল্পনা গুছিয়ে আনে। চন্দ্রভান নগ্ন হয়ে পানিতে নেমে যাওয়ার পর মফিজুদ্দিন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পাড়ের ওপর ফেলে রাখা চন্দ্রভানের পরিত্যাক্ত কাপড়গুলো সংগ্রহ করে আনে এবং তার জায়গায় রেখে দেয় কদিন আগে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে তার কিনে আনা লাল রঙের শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট। চন্দ্রভান গুনে গুনে তিন ডুব দিয়ে উঠে আসে এবং মফিজুদ্দিনের রেখে দেয়া নূতন শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট পরে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তখন মফিজুদ্দিন চন্দ্রভানের ফেলে যাওয়া শাড়ি, ব্লাউজ এবং সায়া প্রতিযোগিতায় জয় করা পুরস্কারের মতো মাথার ওপর তুলে ধরে এবং তারপর সেগুলো বুকের ভেতর জড়িয়ে রৌহার পানি এবং পদ্মবনের পাশে উন্মুক্ত প্রান্তরের ওপর শুয়ে থাকে, তার নাকে ঘ্রাণ আসে, নারী এবং মাটির, তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে হালকা অন্ধকার থাকতেই সে ঘুম থেকে ওঠে এবং চন্দ্রভানের কাপড়চোপড় নিয়ে পেছন দিক দিয়ে মিয়াবাড়ির ভিটায় প্রবেশ করে এই ভিটার উত্তর-পশ্চিম কোনায় লম্বা গাব গাছে উঠে চন্দ্রভানের কাপড় সে একটি মগডালে ঝুলিয়ে দিয়ে নেমে আসে, এবং পাশ দিয়ে ঘুরে ভিটার সম্মুখ দিকে বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ায়; রাতের অন্ধকার কেটে দিনের আলো তখনো তেমন স্পষ্ট হয় নাই, সে এই অস্পষ্ট আলোয় অথবা অন্ধকারে ভিটার মাঝখানের ঘুমন্ত টিনের ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে, সকালের প্রথম মোরগ ডেকে ওঠার আগে হাঁক দেয়, ম্যাসাব বাড়িত আছেন নাহি? তাকে সেদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় মিয়াবাড়ির বাইরের উঠোনে, একাধিকবার হাঁক দেয়ার পর ভিটার প্রবেশমুখের কাছে টিনের চৌচালা বৈঠকখানার ভেতর প্রথম মানুষের জেগে ওঠার শব্দ পাওয়া যায়, তারপর দরজা খুলে একজন মুনিষ চোখ কচলাতে কচলাতে বের হয়ে আসে এবং সাড়া দিয়ে ওঠে, কেডা বা? মফিজুদ্দিন এই কামলার দিকে তাকায় না, সে ভিটার মাঝখানের ঘরগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে এবং আলি আসগর মিয়ার ভিতরবাড়ির দিকে মুখ করে পুনরায় হাঁক দিয়ে ওঠে, ম্যাসাব একটু বাইরে আসেন, আমি মফিজুদ্দি। কিন্তু তার পরও অনেকক্ষণ বাড়ির ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না কিংবা বাইরে বের হয়ে আসে না, দিনের আলো দ্রুত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠতে থাকে এবং তার ভেতর চেক লুঙ্গির ওপর হাতাওয়ালা ময়লা গেঞ্জি পরা মফিজুদ্দিনকে দাঁড়ানো দেখতে পাওয়া যায়। তখন একজন চাকরানি এসে ভেতরের এবং বাইরের উঠোন বিচ্ছিন্নকারী টিনের বেড়ার মাঝখানের দরজা খুলে বের হয় এবং বলে, এই বিয়ানবেলা কেডা ডাকাডাকি করে? কিন্তু মফিজুদ্দিন এই চাকরানির সঙ্গেও কথা বলে না, যেন তার কথা সে শোনেই নাই এমন নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আর একবার হাঁক দিয়ে ওঠে, এবং এইবার হাঁক দেয়ার পর সে ভেতরের উঠোনে খড়মের আওয়াজ পায় এবং তখন আলি আসগর মিয়া গম্ভীর মুখে গেঞ্জি পরা অবস্থায় মাঝখানের বেড়ার দরজা পার হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং চাপা ও ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, কি চাইস তুই? গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন মফিজুদ্দিন একধরনের নির্মম মৃদু হাসি তার মুখে বিকশিত করে দিয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়া আলি আসগর মিয়াকে বলে যে, তার মেয়ে চন্দ্রভান সম্পর্কে সে কথা বলতে চায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনের হাঁক শুনে চিনতে পারার পরেই আলি আসগর মিয়ার জানা হয়ে গিয়েছিল সেই সকালে মফিজুদ্দিন পুনরায় কেন এসে হাজির হয়েছে। বাড়ির ভিতর থেকে খড়মের ফট ফট শব্দ করে বের হয়ে আসার পর উত্তেজনার বশে বিনা কারণেই সে প্রশ্নটা করে এবং সে যখন মফিজুদ্দিনের উত্তর শোনে তখন সে লক্ষ করে যে, তার বাইরের উঠোন জুড়ে কামলা এবং চাকরানিদের চলাফেরা এবং কাজের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে; এই অবস্থায় আলি আসগর মিয়া দ্বিতীয় বারের মতো তার ক্রোধ সংবরণ করে ভিটার এক পাশে পুকুরের পাড়ের কাছে মফিজুদ্দিনকে নিয়ে যায় এবং সেখানে মফিজুদ্দিনের আর কোনো কথা শোনার আগেই গাল দিয়ে ওঠে, হারামযাদা, তক আমি ডাল কুত্তা দিয়্যা খাওয়ামু। সুহাসিনীর লোকেরা বহুদিন এই গল্প করে এবং তারা আলি আসগর মিয়ার দুর্দশার ভেতরকার পরিহাসের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে, তারা বলে যে, আলি আসগর মিয়া আকালুর এই ছেলেটিকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তাকে পাওয়ার কোনো উপায় করতে পারছিল না; তারপর সে যখন একদিন শুক্রবার দুপুরে সত্যি সত্যি মিয়াবাড়িতে এসে দাঁড়ায় তাকে তাড়ানোর জন্য আলি আসগর মিয়া অস্থির হয়ে পড়ে, কিন্তু তাকে তাড়ানোর কোনো উপায়ও সে খুঁজে পায় না। সেদিন পুকুরপাড়ে আলি আসগর মিয়ার ধমক খেয়ে মফিজুদ্দিন একটুও ভয় পায় না, কারণ, সে জানত যে, আলি আসগর মিয়া এ রকমই ব্যবহার করবে এবং তুরুপের তাসটি আছে তারই হাতে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন বড় পাকা খেলোয়াড়ের মতো তার হাতের তাসটি খেলে, সে সেই সকালে আলি আসগর মিয়ার ক্রোধ এবং অপমানে লাল হয়ে আসা মুখের দিকে শান্তভাবে তাকায়, তার মুখের পাতলা হাসির জায়গায় এক ধরনের গাম্ভীর্য ফুটে ওঠে এবং নিম্নস্বরে সে চন্দ্রভানের জিনের অপকীর্তির কথা বলে; সে বলে যে, সেই জিন, যে জিনের কথা আলি আসগর মিয়া বিশ্বাস করতে চায় না, আগের দিন রাতে চন্দ্রভানকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। গলার স্বর আরো একটু নরম এবং নিচু করে এনে, মাটির দিকে চোখ নত করে রেখে সে বিড়বিড় করে বলে যে, এই জিন চন্দ্রভানের সঙ্গে কি কাজ করেছে তা সে বলতে পারবে না, তবে অপহরণের খবরটা সে একসময় জেনে যায় এবং বদমাশ জিনটাকে বাধ্য করে চন্দ্রভানকে ঘরে এনে রেখে যেতে। জিনটা চন্দ্রভানকে যথাস্থানে রেখে যায়, কিন্তু মফিজুদ্দিনের ধমক খেয়ে সব উল্টোপাল্টা হয়ে যায় তার, ভয়ের চোটে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চন্দ্রভানকে রেখে যাওয়ার সময় তার পর থেকে নিজের দেয়া কাপড়চোপড় খুলে নিতে ভুলে যায় সে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, চরম ক্রোধের সেই মুহূর্তেও মফিজুদ্দিনের গম্ভীর এবং মাটির দিকে নত করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আলি আসগর মিয়া বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সে কোনো কথা বলতে পারে না, তার প্রু এবং চোখের কোণ সঙ্কুচিত হয়ে আসে; এই সময় মফিজুদ্দিন আনত চোখ উঠিয়ে তার বিভ্রান্ত দৃষ্টির ওপর স্থাপন করে বলে, আপনের বিশ্বাস না হয় ঘরে যায়া দেখেন, আপনের মায়া চন্দ্রভানের বড় বিপদ; এবং তারপর সে আসল কথাটি বলে, সে বলে যে, এই বিপদ থেকে চন্দ্রভানকে সে-ই বাঁচাতে পারে, কারণ, এই দুষ্ট জিনটাকে কেমন করে কাবু করতে হয় তা সে জানে। তখন সেই সকালবেলা, মিয়াবাড়ির পুকুরপাড়ে তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আর একটি শব্দও বিনিময় না করে তারা বিচ্ছিন্ন হয়; আলি আসগর মিয়া সেই অতি সকালে, তখনো নিদ্রিতা তার মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢোকে এবং মফিজুদ্দিন নীরবে মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে আসে।
পরে ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা রাতের রক্তপাতের পরদিন গ্রামের লোকেরা যখন মিয়াবাড়ির বিধ্বস্ত এবং পোড়া বাড়িঘরের ভেতর থেকে লাশ খুঁজে বের করে, তখন তাদের শুধু লাশগুলোর নাম নয়, এক দীর্ঘ ইতিহাস মনের ভেতর জানা থাকে। তারা তখন সেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর মৃতদেহের সঙ্গে তাদের স্মৃতির সম্ভাব্য সাক্ষীগুলোও খুঁজে ফেরে; এর অনেক কিছুই তারা খুঁজে পায় না, কারণ, তারা যা কিছু শুনেছিল তার অনেক কিছুই হয়তো সত্য ছিল না, আবার সত্য ছিল এমন অনেক কিছুর স্মৃতি চিহ্নই হয়তো আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। সেদিন গ্রামের লোকেরা গুলিবিদ্ধ অথবা গুলিবিদ্ধ নয়। এমন, দগ্ধ এবং অর্ধদগ্ধ, লাশগুলো একে একে বের করে বয়ে নিয়ে প্রাঙ্গণে রাখে, তারপর উঠোনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা কবর খোঁড়ে, লাশ পাশাপাশি রেখে মাটিচাপা দেয়। সে সময় হয়তোবা তারা খুব বিহ্বল এবং অন্যমনস্ক ছিল, অথবা, হয়তোবা অন্য কোনো কারণে, তারা মফিজুদ্দিন মিয়ার একাদশতম পুত্র আটচল্লিশ বৎসর বয়স্ক অবিবাহিত ইঞ্জিনিয়ার মোল্লা নাসিরউদ্দিনের কথা ভুলে যায়। পরবর্তী সময়ে মোবারক আলির পোড়ো ভিটার ওপরকার ছ’টি কবর খুঁড়িয়ে দিয়ে রায়গঞ্জ থেকে আসা রাস্তা যখন মাটি কেটে সুরধ্বনি গ্রামের দিকে এগিয়ে নেয়া হয়, সেদিন গ্রামের লোকেরা কবরের ওলট-পালট করা মাটির ভেতর থেকে দুলালির কঙ্কালের হাড় বের করে আনে এবং তখন তাদের মনে হয় যে, পূর্ণিমার রাতে নিহত হওয়ার পরদিন পরিবারের অন্য সকলকে এক কবরে দাফন করার সময় মোল্লা নাসিরউদ্দিনের কথা কারো মনে না পড়ার পেছনে একটি সহজ কারণ ছিল। তারা বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের কথা প্রথমে ভুলে না গেলে তার কবরের সঙ্গে পরবর্তীকালে দুলালির কবর রচনা করা সম্ভব হতো না। সেদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দাফন করার বিষয়টি গ্রামের লোকেরা প্রথমে খেয়াল করে না, কারণ, তার লাশ অন্যদের সঙ্গে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং পোড়া বাড়িঘরের ভেতর পাওয়া যায় নাই; কিন্তু গ্রামের লোকদের সেটা মনে পড়ে নাই, তারা ভাবে যে, সকলকে পাওয়া গেছে এবং কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে যখন আততায়ীদের আগমন নির্গমনের পথের বিষয়ে সন্ধান করা হয় তখন বোঝা যায় যে, আততায়ীরা পায়ে হেঁটে আসে নাই, তারা নৌকোয় করে খাল বেয়ে এসে মিয়াবাড়ির ভিটার পেছন দিকে উত্তর-পশ্চিম কোনায় নামে, তারপর তারা ভিটার কিনার দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঘেরাও করে ধরে। ভিটার উত্তর-পশ্চিম কোনায় যেখানে বহুদিন পূর্বে একটি গাবগাছ ছিল, তার নিকটে একটি বাতাবিলেবু গাছতলায়, ভেন্না, ধুতুরা এবং কাটা শাকের ঝোপের ভেতর গ্রামের লোকেরা মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। মোল্লা নাসিরউদ্দিন সেদিন মাঝরাতে ঘর ছেড়ে কেন বাতাবিলেবু গাছতলায় গিয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারে না, তবে গ্রামের লোকেরা এই বিষয়টি বুঝতে পারে যে, সে রাতে মিয়াবাড়িতে সকলের আগে নিহত হয়েছিল মোল্লা নাসিরউদ্দিন। গ্রামের লোকেরা যখন তার লাশ কাটা শাকের ভেতর থেকে তুলে আনে তারা দেখতে পায় যে, মাথার ওপর কঠিন কোনো বস্তুর প্রবল আঘাতে তার খুলি চূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে গেছে। গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে যে, আততায়ীরা যখন আসে তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিন খালের কিনারায় লেবু গাছের তলে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, সে তাদেরকে নৌকো থেকে নামতে দেখেছিল, হয়তো জিজ্ঞেস করেছিল, কেডা বা? এবং তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকারে তাকে ঘিরে ধরা আততায়ীদের নৌকোর বৈঠার প্রচণ্ড আঘাতে সে প্রাণ হারায়। গ্রামের লোকেরা যখন চূর্ণ হয়ে যাওয়া খুলি তার পরনের শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে লাশ কবর দেয়ার জন্য নিয়ে আসে তখন দেখা যায় যে, অন্যদের পাশে তার জন্য আর জায়গা নাই; লম্বা কবরটা মিয়াবাড়ির বাইরের উঠোনটিকে পূর্ব-পশ্চিমে আড়াআড়িভাবে প্রায় প্রান্ত থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ইতোমধ্যে দ্বিখণ্ডিত করেছে। এই কবর লম্বা করার জায়গা না থাকায় গ্রামের লোকেরা এই কবরের পেছনে, পূর্ব কিনারায় একটি পৃথক কবর খুঁড়ে মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দাফন করে এবং তখন গ্রামের এইসব লোকের এই কথাটি জানা থাকে না যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিনের বিষণ্ণ বিচ্ছিন্ন কবরটির পাশে অন্য একটি কবর রচনা করার জন্য তারা কিছুদিন পর দুলালিকে বাঁশের খাটিয়ায় কাঁধে নিয়ে মিয়াবাড়ির এই পোড়ো ভিটার দিকে রওনা হবে; তবে পূর্ণিমা রাতের পরদিন মফিজুদ্দিন মিয়ার দগ্ধ ভিটায় ছাই আর ধ্বংসস্তুপের ভেতর গ্রামের লোকেরা যখন লাশ এবং স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছিল, তখন সকলের শেষে লেবু গাছতলায় মোল্লা নাসিরউদ্দিনের লাশ পাওয়া গেলে সেখানে উপস্থিত গ্রামের লোকদের অনেকেরই দুলালি কথা মনে পড়েছিল। সেদিন তারা যখন চন্দ্রভানের আগুনে পোড়া লাশ পায়, তাদের মনে পড়ে, তাকে বহুদিন পূর্বে জিনের দেয়া লাল রঙের শাড়িব্লাউজের কথা, এবং চন্দ্রভান দীর্ঘ যাট বছর সেই বস্ত্রগুলো সংরক্ষণ করেছিল কি না তা জানা না থাকলেও গ্রামের লোকদের মনের ভেতর এমন ধারণা জেগে থাকে যে, এই খোজাখুজির ভেতর হয়তো কোনো এক কোণায়, ছাই এবং ধ্বংসস্তৃপের নিচে চাপা পড়া এবং কোনো অজ্ঞাত কারণে রক্ষা পেয়ে যাওয়া, চন্দ্রভানের জিনের কাপড়টি দেখা যাবে। কিন্তু সেদিন ছাইয়ের ভেতর এই রক্তবর্ণ বস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব প্রকাশিত হয় না, বরং গ্রামের লোকেরা একটি ঘরের ভেতর থেকে আলেকজানের অর্ধেক পোড়া এবং কালিতে মলিন, হাতে আঁকা ছবিটা পায়; অন্য আর একটি ঘরের ভেতর থেকে তারা অনেকগুলো আধপোড়া লাল মলাটের বই বের করে এবং তাদের ভেতর যারা পড়তে পারে তারা কয়েকটি মলাটের ওপর বইয়ের অক্ষত নাম পড়ে, পাঁচটি প্রবন্ধ, মাও সে তুঙ; সামরিক বিষয়ে ছয়টি প্রবন্ধ, মাও সে তুঙ; রাষ্ট্র ও বিপ্লব, ভ ই লেনিন।
গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে যে, ছাই এবং ধ্বংসস্তুপের ভেতর পাওয়া এই বইগুলো ধানঘড়া হাইস্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র, মফিজুদ্দিন মিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান রফিকুল ইসলামের এবং এই বইগুলোর ব্যাপারে তাদের তেমন আগহ না দেখা গেলেও গ্রামের লোকদের পরবর্তী সময়ে বহুবার বহু কারণে কিশোর রফিকুল ইসলামের কথা মনে পড়ে, যে তাদেরকে একসময় একটি স্বপ্নের কথা বলেছিল, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে নাই অথবা বুঝতে পারলেও সেটা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে নাই। গ্রামের লোকদের অনেকের মনে পড়ে যে, কখনো কোনো অবসরে গল্পের সময় রফিকুল ইসলাম তাদেরকে সমাজ এবং রাষ্ট্র বদলে ফেলার কথা বলেছিল, সে বলেছিল যে, গরিব মানুষের এবং গরিব কৃষকের সমস্যার সমাধান সাধারণ নিয়মে হয় না, এজন্য প্রয়োজন হয় বিপ্লবের। গ্রামের লোকেরা স্মরণ করতে পারে, কিশোর রফিকুল ইসলাম তাদেরকে বলেছিল যে, বিপ্লব মানে হচ্ছে একটি পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের পর গরিব এবং বড়লোকের ভেতর কোনো পার্থক্য থাকবে না, সব সম্পত্তির মালিক হবে সকলে একসঙ্গে, কারো একার নিজস্ব কোনো সম্পত্তি থাকবে না; এবং তার এইসব কথা শুনে গ্রামের কৃষকদের অনেকে হেসেছিল, তারা রফিকুল ইসলামের কথা হয়তো বুঝেছিল অথবা হয়তো বুঝতে পারে নাই; তারা হেসে ক্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কও কি বাপু! সুহাসিনীর লোকেরা পরে বলে যে, রফিকুল ইসলাম এই একই কথা বেশ কিছুদিন যাবৎ বোঝানোর চেষ্টা করেছিল জান্নাত আরাকে। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার পরদিন সুহাসিনী গ্রামের এই বিপর্যয়ের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং পরিবারের অন্যান্য সকলের সঙ্গে রফিকুল ইসলামের নিহত হওয়ার খবর তার স্কুলের শিক্ষক এবং সহপাঠীরা জানতে পারে; এবং তখন, তারপর, জান্নাত আরার বহুদিন এই ভাবনা হয় যে, রফিকুল ইসলাম তার কাছে কি চেয়েছিল আসলে! তার চাকুরে পিতার সঙ্গে রায়গঞ্জ ছেড়ে আসার কয়েক বছর পর সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বান্ধবীর নিকট তার জীবনের এই রহস্যময় অধ্যায়টিকে উন্মোচিত করে বলেছিল, আমি জানি না কি চেয়েছিল সে। হোস্টেলের জানালার কাছে বসে পিঠের ওপর উপচে পড়া চুল ছেড়ে দিয়ে সে বলে যে, রায়গঞ্জে তার যেতে ইচ্ছে করেনি, তার পিতা যখন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে বদলি হয়ে রায়গঞ্জ যায়, তখন, আবার নূতন এক অজ পাড়াগাঁয়ে যেতে তার খারাপ লেগেছিল; তারপর সে যখন শোনে যে তাকে ছেলেদের সঙ্গে এক স্কুলে পড়তে হবে, সে ভয় পেয়ে যায়; কিন্তু তার চাকুরে পিতা তার জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারে না, ফলে তাকে যেতে হয় এবং ধানঘড়া স্কুলে বিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে সে ক্লাস শুরু করে। এইখানে ইয়াকুব আলি, গিয়াসউদ্দিন, বছির এই সব নামের ভেতর সে একদিন দেখে যে, রফিকুল ইসলাম নামেও একজন আছে। জানালার আলোয় তার ফর্সা মুখে একধরনের হাসি ধরে রেখে সে তার বান্ধবীকে বলে, সে যে ক্লাসে আছে তা বুঝতেই পারি নাই, তারপর একদিন ক্লাসে যাওয়ার সময় কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে রাস্তায় দেখি, রফিকুল ইসলাম, এবং তখন ওর নাম আমার মনে পড়ে এবং বুঝতে পারি যে, ও গিয়াসউদ্দিন, ইয়াকুব আলিদের একজন; সেদিন তার সঙ্গে আমিই প্রথম কথা বলি এবং তখন সে আমাকে জানায় যে, সে সুহাসিনী নামে এক গ্রামে থাকে। জান্নাত আরা বলে যে, রফিকুল ইসলাম যেন তৈরি হয়েই ছিল, প্রথম দিন কথা বলার পর সে তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে এবং এটা বুঝতে পেরে তার ঘৃণা এবং ভয় দুটোই হয়; তার ঘৃণা হয়, কারণ, সে গ্রামের এই ছেলেটির ভেতর এক ধরনের সরল সাহস দেখতে পায়, তার মনে হয় যে, চাষার ছেলেটার স্পর্ধা আছে, থানার সবচাইতে বড় কর্মকর্তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায়; অন্যদিকে তার একই সঙ্গে ভয় করতে থাকে, কারণ, সে রফিকুল ইসলামকে তার এই ঘৃণার অনুভূতির কথাটি কোনোভাবেই বলতে পারে না; এবং কেন তা সে পারে না, সেই সত্যটি জান্নাত আরার তখনই জানা ছিল, বহুদিন পর সে সেই সত্যটি তার বান্ধবীকে পুনরায় বলে, পুরুষ মানুষের এত রূপ আমি কোনোদিন দেখি নাই শিমুল। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, জান্নাত আরা জুলেখা ছিল কি না তা তারা বলতে পারে না, তবে রফিকুল ইসলামের সৌন্দর্যের কথা মনে হলে তাদের পুনরায় পূর্ণিমার চাঁদের উপমার কথাই মনে আসে; তারা বলে যে, এই ছেলে বড় হলে তার সৌন্দর্য হতো ইউসুফ নবীর মতোই এবং ইউএনও সাহেবের ঝকঝকে মেয়ে জান্নাত আরা এই রূপের জালে ধরা পড়ে, রফিকুল ইসলাম যদিও হয়তোবা তাকে ধরতে চায় নাই। গ্রামের লোকেরা বলে যে, জান্নাত আরা যখন খবর পায় যে, সুহাসিনী গ্রামের মফিজুদ্দিন এবং তার পরিবারের সকলে নিহত হয়েছে তখন তার বুকের ভেতর এমন এক শোক হয়, যার কোনো নাম নাই, এবং এই শোকের ভেতরও একটি ক্ষীণ আশা তার জেগে থাকে; সে কাউকে নির্দিষ্ট করে রফিকুল ইসলামের নাম জিজ্ঞেস করতে পারে না, পরদিন স্কুলের সময়ের জন্য প্রতীক্ষা করে; কিন্তু পরদিন স্কুলে গিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেও সে বুঝতে পারে যে, আশা করার কিছু ছিল না, রফিকুল ইসলাম বেঁচে নেই; কারণ, সেদিন স্কুল শুরু সময় অ্যাসেম্বলিতে ছাত্র এবং শিক্ষকেরা রফিকুল ইসলামের স্মৃতি তর্পণ করে। সাধারণত সকালের অ্যাসেম্বলিতে মেয়েরা না এলেও এদিন তারা আসে এবং তখন সেখানে সমবেত গ্রামের স্কুলের ছাত্র এবং মাষ্টারদের কাছে অন্যান্য মেয়েদের ভেতর জান্নাত আরা কোনো বিদেশি ফুলের মতো ফুটে ওঠে এবং তার উপস্থিতির কারণে জাতীয় পতাকার দুপাশে মুখোমুখি দাঁড়ানো ছাত্র এবং শিক্ষকদের এই শোকসভার চাপা দেয়া ভাবটি সহনীয় হয়ে আসে। এই সময় রফিকুল ইসলামের আত্মার জন্য দোয়া করা শেষ হলে, তার ক্লাসের সহপাঠী বন্ধুদের ভেতর থেকে কিছু বলার জন্য যখন কাউকে খোঁজা হয়, তখন সকলের চোখ আবার বালিকাদের ভেতর দাঁড়ানো জান্নাত আরার ওপর গিয়ে পড়ে এবং সে যখন প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে এগিয়ে এসে লাইন করে দাঁড়ানো ছাত্রদের মুখোমুখি হয়ে জাতীয় পতাকার কাছে দাঁড়ায়, সকলে এই প্রথমবারের মতো সচেতনভাবে খেয়াল করে যে, একটি রহস্যময় কালো শিফনের ওড়না তার বিষণ্ণ মুখটি গোল করে ঘিরে আছে। ওড়না দিয়ে শোকের এ রকম মস্তকাবরণ রচনা করায় জান্নাত আরার বক্ষ অরক্ষিত হয়ে পড়ে এবং তখন, রফিকুল ইসলামের মৃত্যু উপলক্ষে আয়োজিত শোকসভার দিনে ধানঘড়া স্কুলের বালক ছাত্রেরা জান্নাত আরার অদ্ভুত আঁধার জড়ানো মুখের রহস্যময় শোক এবং শৈত্য, এবং ফ্রকের উপরের অংশে নরম বাঁকানো চাঁদের মতো প্রকাশিত কাপড়ের ক্ষীণ একটি ভাঁজের উত্তাপের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। জান্নাত আরার উপস্থিতির ফলে শোকের ভেতরেও যে চাঞ্চল্য হয়, একটু পরেই তা অপসৃত হয় এবং অ্যাসেম্বলিতে সমবেত ছাত্র এবং শিক্ষকেরা, মনে হয় যেন, এক নিবিড় বিষাদের ভেতর অবশেষে নিমজ্জিত হতে পারে। মৃদু বাতাসে অল্প কাঁপতে থাকা জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে জান্নাত আরা খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা শুরু করে, সে বলে যে, রফিকুল ইসলাম ভালো ছেলে ছিল, সে মানুষের ভালো এবং মঙ্গলের জন্য ভাবত, এর পর জান্নাত আরা থামে, তার অস্তিত্বের ভেতর দ্রুত টান পড়ে যেন এবং সে উচ্চ নিনাদ করে গ্রাম্য মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে এবং তখন এই বালিকার রোদন ধ্বনির ভেতর রফিকুল ইসলামের কতিপয় সহপাঠীর চোখ পানিতে ভরে যায়। এভাবে ভেঙে পড়ার কারণ সম্পর্কে জান্নাত আরা পরে তার বান্ধবী শিমুলকে বলেও, সেদিন ধানঘড়া স্কুলের মাঠের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র এবং শিক্ষকেরা কিছুক্ষণ পর তার জন্য বিচলিত হয়ে পড়ে, এবং তখন সে হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে মাটির ওপর বসে পড়লে, শোকার্ত বালকদের চোখের সম্মুখ থেকে অলৌকিক দৃশ্যাবলি অপসারিত হয়ে যায় এবং রফিকুল ইসলামের মৃত্যুজনিত প্রবল শোকাচ্ছন্নতার ভেতরও তাদের মনে হয় যে, রোদের ভেতর তাদের খুব গরম লাগছে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন কেউ গিয়ে জান্নাত আরার পিতাকে বিষয়টি সম্পর্কে জানালে সে তার দপ্তরের কাজ ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। জান্নাত আরা যখন মাটির ওপর বসে হাতের ভেতর মুখ গুজে ফুলে ফুলে কাঁদে তখন অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ানো বালকেরা দেখে যে, তাদের মাঠের ওপর দিয়ে ইউএনও সাহেবের জিপগাড়ি ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে এসে নির্বাক সমাবেশটির সম্মুখে দাঁড়ায় এবং জান্নাত আরা কোনো কথা না বলে জিপে উঠে চলে যায়। কয়েক বছর পর ঢাকায় রোকেয়া হলে বসে জান্নাত আরা তার বান্ধবী শিমুলকে রফিকুল ইসলামের কথা বলে। শিমুল যদিও বুঝতে পারে না যে, জান্নাত আরা হঠাৎ করে ধানফাড়া নামক এক গ্রাম্য স্কুলের ছাত্র রফিকুল ইসলামের কথা কেন বলে, তবে তার মনে হয় যে, জান্নাত আরা হয়তো কথা খুঁজে না পেয়ে এমনি রফিকুল ইসলামের গল্প করে, অথবা এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো এই গল্প বলতে চায় বলেই বলে, সে হয়তো শিমুলকে বিশ্বাস করে তার স্মৃতির গোপন দুয়ার খুলে দেয়। জানালা দিয়ে আসা আলোয় জান্নাত আরার চেহারায় কি রঙ খেলা করে, তার উচ্চারিত বাক্যে কি ধ্বনি বেজে ওঠে, শিমুল তা বুঝতে পারে না; জান্নাত আরা বলে যে, রফিকুল ইসলামকে তার পিতার সরকারি বাসভবনের সামনে যেদিন প্রথম দেখে তারপরে তার ক্রমান্বয়ে মনে হতে থাকে যে, রফিকুল ইসলাম এক অসাধারণ রূপবান বালক এবং একই সঙ্গে অসাধারণ বোকা। শিমুলকে সে বলে যে, ব্যাপারটা প্রেম ভালোবাসা জাতীয় কিছু ছিল না, তবে এটা কি ছিল তা সে বলতে পারে না; সে বলে যে, প্রথম দিন কথা বলার পরই রফিকুল ইসলামের সঙ্কোচ দূর হয়ে যায় এবং সে বুঝতে পারে না রফিকুল ইসলাম কি চায় এবং সে-ইবা কেন তার সঙ্গে সংযোগ ছেদ করতে পারে না, রফিকুল ইসলামের সৌন্দর্য, নাকি তার বোকামির অসাধারণ প্রকৃতি তাকে আগুন প্রদক্ষিণরত পতঙ্গের মতো আটকে রাখে। রফিকুল ইসলামের বোকামির বিশেষত্ব সম্পর্কে জান্নাত আরা সচেতন হয় সেদিন, যেদিন বিকেলে সে তাদের বাসায় এসে হাজির হয় এবং তারা নিচের তলায় ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করে। সেদিন অল্প কিছুক্ষণ কথা বলার পর কি এক প্রসঙ্গে তাদের আলোচনার বিষয় মোড় নিয়ে ভারি হয়ে ওঠে এবং রফিকুল ইসলাম তাকে ঐতিহাসিব বস্তুবাদের মূলতত্ত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে চলে, কিন্তু জান্নাত আরা তার কথা কিছুই বুঝতে পারে না। সেদিন দুঘণ্টা পর রফিকুল ইসলাম যখন উঠে যায়, জান্নাত আরা সোফার ওপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, এবং তখন যেকোনো কারণেই হোক জান্নাত আরার কথা তার মা এবং অন্য ভাইবোনদের খেয়াল থাকে না, তাদের যখন তার কথা মনে পড়ে, তারা অন্ধকার ড্রয়িং রুমে এসে জান্নাত আরাকে অঘোর নিদ্রায় নিমজ্জিত দেখে। তখন জান্নাত আরার মায়ের রফিকুল ইসলামের কথা মনে পড়ে এবং জান্নাত আরাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলে তারও রফিকুল ইসলামের কথাই প্রথমে মনে আসে, তারপর সে তার মাকে বলে যে, রফিকুল ইসলাম তাকে পড়ায় সাহায্য করছিল, খুব কঠিন একটা বিষয় ছিল, পড়া বুঝতে বুঝতে তার ভীষণ ঘুম পেয়ে যায়। জান্নাত আরা শিমুলকে বলে যে, এর পরদিন অন্য একটি কাণ্ড ঘটে; এ দিন ক্লাসে রফিকুল ইসলামকে ইংরেজির শিক্ষক যখন দাঁড় করায়, গালিভারকে যে কাঠের গাড়িতে করে লিলিপুটদের দেশের রাজধানীতে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেই গাড়ির কটি চাকা ছিল, তা সে বলতে পারে না, তারপর সে ব্লেফাসকুদের ঝগড়ার কারণ কি ছিল তাও বলতে পারে, ফলে তালেব আলি মাষ্টার তখন তার শাস্তি পাওয়ার ন্যায্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হয় এবং তাকে উঁচু বেঞ্চের ওপর উপুড় করে ঠেসে ধরে, বেরিয়ে আসা, লুঙ্গি ঢাকা নিতম্ব বাঁশের কঞ্চির আঘাতে, জান্নাত আরা এবং অন্য দুটো মেয়ের উপস্থিতিতে, জর্জরিত করে দেয়। রফিকুল ইসলাম এর আগে কখনো বেত খেয়ে কেঁদেছিল কি না জান্নাত আরার তা জানা ছিল না, তবে গালিভারের কাহিনী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বেত খাওয়ার পর তালেব আলি মাষ্টার তখন তাকে ছেড়ে দেয়, সে উবু অবস্থা থেকে সিধে হয় এবং জান্নাত আরা তার মুখের দিকে তাকায়। সেই মুখের কথা জান্নাত আরার বহুদিন মনে থাকে, সে মুখে সেদিন শারীরিক বেদনার একটি স্থির নির্লিপ্ত রঙ মাখানো ছিল; তারপর রফিকুল ইসলাম যখন পুনরায় নিজের জায়গায় বসে তখন জান্নাত আরা তার চোখ থেকে নির্লিপ্ত মুখের ওপর দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নেমে আসতে দেখে এবং ধানঘড়া হাইস্কুলের আধো-অন্ধকার ক্লাসরুমের ভেতর বসে জান্নাত আরার হৃদয় সেদিন প্রথমবার দ্বিখণ্ডিত হয়। তার পরদিন জান্নাত আরা ক্লাসে আসে না, তার পিতার পিওন এসে রফিকুল ইসলামকে শুধু এই খবরটা বলে যায় যে, জান্নাত আরা ক্লাসে আসবে না, তার জ্বর হয়েছে। রফিকুল ইসলাম কথাটা শুনে তার অন্য সহপাঠীদের খবরটা দেয়, তারপর সে বিষয়টা ভুলে যায়; অন্যদিকে তখন জান্নাত আরা স্কুল ছুটির সময় তার পিতার দোতলা কোয়ার্টারের উপরতলায় ব্যালকোনিতে বের হয়ে আসে এবং সেখানে সে নিজেকে এক প্রতীক্ষার ভেতর দাঁড়ানো দেখতে পায়। কয়েক বছর পর সে তার বান্ধবীকে বিষয়টি এই বলে ব্যাখ্যা করে যে, এটা তবুও হয়তো প্রেম কিংবা ভালোবাসা ছিল না, এটা হয়তো কিছুই ছিল না আসলে; এবং তখন হোস্টেলের আলোকিত জানালার সামনে বসে তার মনে পড়ে ধানঘড়ায় তার পিতার কোয়ার্টারের দোতলার বারান্দায় জ্বরতপ্ত দেহে তার সেই কাতর প্রতীক্ষার কথা এবং রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে কথা বলার সময় ভেঙে পড়ার কথা। সুহাসিনীর লোকেরা জান্নাত আরার গল্প এভাবে করে যে, জান্নাত আরা যেন ছিল এক ভিনদেশী পথহারা পাখি, সুহাসিনীর রফিকুল ইসলামের জন্য আকুল হয়ে কাঁদার জন্যই সে তার পিতার সঙ্গে রায়গঞ্জে এসেছিল। ধানঘড়া স্কুলের মাঠের ওপর তার ভেঙে পড়ার পর অন্য সকলে বুঝতে পেরেছিল যে, স্কুলের একটি বালক মরে যাওয়ায় তারা শোকার্ত; তারপর তার পিতা সরকারি জিপগাড়িতে করে এসে যখন ক্রন্দনরত এই বালিকা কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায়, সেদিনের শোকসভা সাঙ্গ হয় এবং বিমূঢ় বিষণ্ণ বালক-বালিকারা তাদের ক্লাসরুমে ফেরে। রফিকুল ইসলামের স্মৃতি এই বালকদের কাছে দ্রুত ম্লান হয়ে আসে এবং জান্নাত আরাও শীঘ্রই তার পিতার সঙ্গে রায়গঞ্জ ত্যাগ করে, তবে জান্নাত আরার পিতার সবুজ রঙের জিপটার কথা সকলের কেন যেন মনে থেকে যায় এবং এই জিপটি দেখলে তাদের প্রথমে ধানঘড়া স্কুলের মাঠের ওপর রোরুদ্যমান জান্নাত আরার কথা মনে পড়ে এবং জান্নাত আরার সেই কান্নার কথা মনে পড়লে তাদের সুহাসিনী গ্রামের মৃত রফিকুল ইসলামের কথা মনে পড়ে।
ক্যানভাসের হুড লাগানো উপজেলা পরিষদের এই জিপটিকে পরবর্তী সময়ে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে যেতে দেখলে সুহাসিনীর লোকদের মফিজুদ্দিন মিয়ার কথাও মনে পড়ে, বস্তুত এই জিপ দেখলে তাদের মনের ভেতর এই কথা জেগে থাকে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার এই গাড়িতে চড়া হলো না; উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পর জিপটির কর্তৃত্ব ইদ্রিস খাঁর অধীনে যায়, সে এই জিপে চড়ে রায়গঞ্জের বুকের ভেতর দিয়ে ক্রমাগতভাবে এ-ফেঁড় ওফোঁড় করে চলে। তখন সুহাসিনীর লোকদের পুনরায় পূর্ণিমা রাতের পরদিন সকালের কথা স্মরণে আসে, যখন অনির্দিষ্টকাল ধরে বেঁচে থাকা মফিজুদ্দিন মিয়ার লাশ তারা ছাই এবং ধ্বংসস্তৃপের ভেতর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারে যে, ম্যাসাবের কম্ম কাবার, তখন সেই সকালে আফজাল খাঁ এবং তার ছেলে ইদ্রিস খা মিয়াবাড়ির ভিটায় এসে ওঠে এবং সেখানে উপস্থিত সুহাসিনীর লোকেরা আফজাল খার পাকা দাড়ি বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে দেখে; চোখের পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিতে নিতে সে এই বলে বিলাপ করে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া তার পিতার বন্ধু ছিল। সেদিন সুহাসিনীর লোকেরা ইদ্রিস খাকে কেমন নিশুপ হয়ে থাকতে দেখে, এবং এর কয়েক দিন পর তারা জানতে পারে যে, ইদ্রিস খাঁ সিরাজগঞ্জ গিয়ে জেলা প্রশাসকের অফিসে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করে এসেছে, এবং তখন সুহাসিনীর লোকেরা এই কথা জানতে পারে যে, যেদিন পূর্ণিমার এক ভয়ঙ্কর চাঁদ উঠে মফিজুদ্দিন মিয়াকে ধ্বংস করে ফেলে, তার এক সপ্তাহ পর ছিল উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের নির্ধারিত দিন। তখন দুটো জিনিস গ্রামের লোকদের একসঙ্গে মনে হয়, তারা প্রথমত বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার এই নির্বাচন করা হলো না, এবং দ্বিতীয়ত, প্রায় পঞ্চাশ বছর ক্রমাগত অপেক্ষা করার পর এবার তারা হয়তো ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু সুহাসিনীর মানুষদের এই অপেক্ষার শেষ হয় না, কারণ, কয়েক দিন পর তারা জানতে পারে যে, উপজেলা চেয়ারম্যানের পদের জন্য মাত্র একটি মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়, সেটা ছিল ইদ্রিস খাঁর মনোনয়ন, ফলে ভোটের আর প্রয়োজন হয় না; ইদ্রিস খা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সুহাসিনীর লোকেরা যখন এ খবর পায় তারা তাদের দাড়িতে হাত বুলায় এবং বলে, ইদ্রিস খা তাইলে চেয়ারম্যান হইলো; তারপর তারা নারকেলের খোলের হুঁকোর ফুটোয় ঠোঁট লাগিয়ে গুড়গুড় করে তামাক খায়, পাটের আঁশে পাক দিয়ে দড়ি বানায় অথবা কলাপাতা কেটে বাড়ির পেছনে পায়খানার বেড়া দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে; এবং এই সময়টায় মনে হয় যেন একটা বিষয়ে তারা অসচেতন প্রতীক্ষায় থাকে, সেইদিন পর্যন্ত, যেদিন সুহাসিনীর মফিজুদ্দিন মিয়া এবং তার পরিবারের লোকদের হত্যার অভিযোগে পুলিশ ইদ্রিস তাঁকে গ্রেফতার করে। গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, রায়গঞ্জ থেকে হেঁটে এসে পুলিশ যখন সুরধ্বনি গ্রামে আফজাল খাঁর বাড়িতে যায় তার ছেলে ইদ্রিস খাঁকে গ্রেফতার করার জন্য, তখন পুলিশের এই দলের নেতা, থানার বড় দারোগাকে ইদ্রিস খা বলে, তাকে হাতকড়া না পরানোর জন্য। কিন্তু পুলিশ তার কথা শোনে না, তারা বাড়ির বৈঠকখানায় আরাম করে বসে চা-নাশতা খায় তারপর তাকে শুধু হাতকড়াই পায় না, তার কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে, রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে আশপাশের গ্রামের লোকদের চোখের ওপর দিয়ে রায়গঞ্জ থানায় নিয়ে যায়, সেখান থেকে তাকে সিরাজগঞ্জ জেলহাজতে পাঠানো হয়। এই ঘটনার বিশদ বর্ণনা, ছ মাস পর সুহাসিনীর লোকেরা ইদ্রিস খাঁর নিজের মুখ থেকেই শোনে, যখন একদিন পুলিশ তার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করার মতো না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয় এবং সে উপজেলা পরিষদের সবুজ জিপে চড়ে রায়গঞ্জে ফিরে আসে। ইদ্রিস খা রায়গঞ্জ উপজেলায় তার শাসন কায়েম করার পর প্রথম এক সপ্তাহ তার সদর দপ্তর ধানঘড়ায় থেকে যায়, তখন রায়গঞ্জের বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন গ্রামের লোক ইদ্রিস ভাই জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে ফুলের মালা নিয়ে উপজেলা কেন্দ্রে এসে হাজির হতে থাকে। এতে করে, ইদ্রিস খাঁ ধানঘড়ায় এসে ওঠার পর ধানঘড়ার জীবন মানুষের ভিড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, এবং এইসব মিছিলের সামনে ভাষণ দিতে দিতে তার গলার স্বর ভেঙে ক্রমান্বয়ে বসে যেতে থাকে, চোখের শিরায় রক্ত জমে লাল হয়ে ওঠে, গলায় ফুলের মালা পরতে পরতে চামড়ায় জ্বালা ধরে যায়। তার সহযোগী এবং শিস্যরা ক্রমাগত স্ফূর্তি এবং অদ্রিায় কাতর হয়ে পড়ে: তারা প্রথমে অনুনয় করে, তারপর ইদ্রিস খাঁর পায়ে ধরে কেঁদে ফেলে, ম্যাকাই, সুরনিত যায় দুই একটা দিন থাইকা আসেন, মাইনষের মিছিল ইকটু কুমুক। তাদের কথা শুনে ইদ্রিস খাঁ রক্তবর্ণ চোখ তুলে তাকিয়ে ভাবে, কিন্তু সে ধানঘড়া থেকে নড়ে না, তার অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে, গলার শব্দের অবশেষটুকু তিরহিত হয়, চোখের যন্ত্রণায় অশ্রু গড়াতে থাকে; তখন, এই অবস্থায়, সপ্তম দিন বিকেলে আব্দুল গাজি আর মুদিদোকানি তোরাপ আলির নেতৃত্বে সুহাসিনী থেকে একটি মিছিল এসে উপজেলা কেন্দ্রের মাঠে দাঁড়ায়। সুহাসিনীর কৃষকেরা তখন উপজেলা কেন্দ্রের দালানের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার প্রান্তে উপনীত ইদ্রিস খাকে একটি আরামকেদারায় উপবিষ্ট দেখে; তখন তার সামনে সুহাসিনীর লোকদের দাঁড়ানো দেখে ইদ্রিস খাঁ তার শারীরিক বেদনা ভুলে হেসে ওঠে এবং পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ এবং কলম বের করে, এই কাগজে ইতোমধ্যে লেখা তেরোটি গ্রামের নামের নিচে চৌদ্দ নম্বরে লেখে সুহাসিনীর নাম; তারপর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে দুহাতে করতালির মতো শব্দ করে ফেসফেসে গলায় বলে ওঠে, এহন আমরা যামু। তখন, এই ঘোষণার পর, সুহাসিনীর মিছিলটির সঙ্গে রায়গঞ্জের নূতন উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস খাঁ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সপ্তম দিনের বিকেলে ধানঘড়া ত্যাগ করে দলবল নিয়ে পূর্ব দিকে রওনা হয়; এই মিছিলটিকে অনুসরণ করে আসে তার গুবরে মাছির মতো সবুজ রঙের গাড়িটা। সেদিন জেলা বোর্ডের পুরনো চওড়া রাস্তা ধরে, ইদ্রিস খাঁকে সামনে রেখে এই মিছিল ক্রমাগতভাবে পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় এবং সুহাসিনীর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে, এই রাস্তার পাশে নয়নতারার হাটের ওপর এসে থামে। সেখানে তখন ইদ্রিস খাঁ বহুদিনের পুরনো সেই বিশাল কড়ই গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং তার চারদিকে জড়ো হয়ে থাকা মানুষদের দিকে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে দিয়ে বক্তৃতা করে, যে গাছের তলায় পঞ্চাশ বছরেরও আগে একদিন সুহাসিনীর কৃষকেরা মফিজুদ্দিনের চারপাশে ঘিরে এসেছিল এবং যে দিন নূতন মাটি কেটে উঁচু করা একখণ্ড জমির নাম রাখা হয় নয়নতারার হাট। বহু বছর পর পুরনো কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ইদ্রিস খার তার উন্মুক্ত করতলসহ ডান হাত, মনে হয় যেন একটি বৃক্ষের শাখার মতো সুহাসিনীর লোকদের মাথার ওপর প্রসারিত করে দেয়, সে সুহাসিনীর লোকদের তাদের জীবন এবং সম্ভাবনা, তাদের স্বপ্ন এবং বঞ্চনার কথা বলে; তারপর সে বলে যে, সুহাসিনীর মানুষের জীবনের উন্নয়নে সে সাহায্য করবে, এতদিন এই গ্রামে, এই ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নে, এই রায়গঞ্জে যে অনাচার হয়েছে সে তার সুরাহা করার চেষ্টা করবে। গ্রামের কৃষকদের সামনে হাত প্রবলভাবে আন্দোলিত করে সে ভাঙা গলায় চিৎকার করে, এখন, এই আইজক্যা থেইক্যা আমার কাম শুরু হইলো, এবং সে গ্রামের বিভ্রান্ত লোকদের এই কথা বলে যে, এই হাটের নাম একটি গণিকার নামে রাখা হয়, এটা মানুষের সভ্যতার, রুচির এবং ধর্মের অপমান। সে বলে যে, বেশ্যা কোনো ধর্মেই সম্মানিত নয়; তাই, সে বলে, আমরা এই হাটের নাম বদলায়া নতুন নাম রাখমু, এখন থেইক্যা এই হাটের নাম হইব রসুলপুরের হাট। গ্রামের লোকদের ভেতরে যারা বয়সে প্রবীণ তারা ঘোলাটে চোখে তাকায়, তাদের বহু বছর আগে এই হাট লাগানোর দিনের কথা মনে পড়ে, যখন তারা ছোট ছিল এবং পরে এ সম্পর্কে শুনেছিল; সেদিন তার চতুর্দিকে ঘিরে আসা সুহাসিনীর মানুষকে মফিজুদ্দিন বলেছিল যে, এই হাটের নাম হবে নয়নতারার হাট এবং নয়নতারা একটি নষ্ট মেয়ে মানুষের নাম; সে বলেছিল, মা হইক কিম্বা হউক, ম্যায় মানুষ ম্যায়া মানুষই, ম্যায়া মানুষেক মাথায় কইর্যা রাইখপেন; এবং এই হাট লাগানোর পরে সেদিন সে পুনরায় আলি আসগর মিয়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ায়।
নয়নতারা হাটের কড়ই গাছতলায় সুহাসিনীর লোকদের দিকে হাত প্রসারিত করে এই হাটের নামের বিষয়ে যখন ইদ্রিস খাঁ তার মতামত প্রকাশ করে, তখন, তার সেই বিজয়ের ভেতরও, সুহাসিনীর লোকদের অবধারিতরূপে মফিজুদ্দিনের কথা মনে আসে। নয়নতারার হাট লাগানোর পর সে আলি আসগর মিয়ার রূপসী কন্যা চন্দ্রভানকে বিয়ে করে, এবং সুহাসিনীর লোকদের সেই সব ঘটনার কথা স্মরণ হয়; তারা বলে যে, রৌহার বিলের ধারে গভীর রাতে ন্দ্রিার ভেতরে ক্রিয়াশীল চন্দ্রভানের পরনের বস্ত্র পরিবর্তন করার পরদিন সকালে মফিজুদ্দিন যখন আলি আসগর মিয়ার কাছে চন্দ্রভানের বস্ত্র হরণের কথা বলে, আলি আসগর মিয়ার কাছে জিনের এই পুরো গল্পটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু নিজের উত্তেজনা ধরে রেখে সে যখন ভেতর বাড়িতে তার কন্যার ঘরের বন্ধ দরজায় গিয়ে আঘাত করে তখন ঝলমলে লাল কাপড় পরা চন্দ্রভান তার সামনে বাস্তব এবং স্বপ্নের এক অবিভাজিত রূপে প্রকাশিত হয়। আলি আসগর মিয়া কয়েক মুহূর্ত সম্বিৎরহিত হয়ে থাকে, তারপর উচ্চ স্বরে কলেমা শাহাদত পড়তে পড়তে সে চন্দ্রভানের দেহ থেকে দ্রুত সেই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট অপসারণের ব্যবস্থা। করে এবং এর একটু পর খুব বিচলিতভাবে সে সিরাজগঞ্জ রওনা হয়ে যায়। মফিজুদ্দিন সে সময় তার পিতার কুঁড়েঘরের সামনে বসে ক্রমাগতভাবে তামাক টেনে প্রতীক্ষা করে, কিন্তু মিয়াবাড়ির চাকরেরা তার জন্য কোনো বার্তা নিয়ে আসে না। মফিজুদ্দিন খুব হতাশ হয়ে পড়ে, তখন দুদিন পর আলি আসগর মিয়া সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে আসে এবং এ সময় একদিন অপরাহ্বে মফিজুদ্দিন তাদের জীর্ণ কুটিরের সামনে উঠোনের ছায়ায় আলি আসগর মিয়ার চাকরকে দেখতে পায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করে ছিল, সে জানত যে এই ডাক আসবে, আলি আসগর মিয়ার চাকরের কাছে খবর পেয়ে সে তৎক্ষণাৎ মিয়াবাড়িতে গিয়ে হাজির হয় এবং অপেক্ষমাণ আলি আসগর মিয়া তাকে সঙ্গে নিয়ে নির্জন বৈঠকখানায় প্রবেশ করে। এরপর তাদের দুজনকে আর কেউ দেখতে পায় না; মফিজুদ্দিন এই ঘরের ভেতর খুব অল্প সময় থাকে, তারপর একসময় গ্রামের লোকেরা দেখে যে, মফিজুদ্দিন মিয়াবাড়ির চৌচালা বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে হালকা এবং দীর্ঘ কদম ফেলে নিজের বাড়ির দিকে যায়। এই ঘটনার পরদিন হাটের মাটি কাটার কাজে ব্যস্ত যুবক এবং কিশোরদের কাজ চালিয়ে যেতে বলে মফিজুদ্দিন নিজে দুপুরের পর সিরাজগঞ্জ রওনা হয়। সে কাউকে বলে যায় না তার সিরাজগঞ্জ যাওয়ার কেন দরকার পড়েছিল, একটানা সতেরো দিন নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকার পর সে গ্রামে ফিরে এসে এক বিধ্বস্ত বোবা জন্তুর মতো পড়ে থাকে। তারপর একদিন পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর পর যখন ফাল্গুন মাসের শেষ বৃহস্পতিবার নতুন হাট বসে এবং সে গ্রামের মানুষের সামনে বলে যে, এর নাম হবে নয়নতারার হাট, তখন নয়নতারাকে গ্রামের লোকেরা চিনতে না পারলেও তাদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন যেন এক ঘোরের ভেতর ডুবে আছে, এবং তার এই ঘোরের ভেতর, তখন তার অস্তিত্ব জুড়ে জেগে আছে একটি নারীর নাম। গ্রামের মানুষ এই নারীটির কথা একসময় ভুলে যায়, তারা আবার হয়তো ভুলে যায়ও না; কারণ, সময় প্রবাহিত হতে থাকলে নয়নতারার প্রসঙ্গটি তাদের সামনে অল্প অল্প করে উন্মোচিত হয় এবং কালক্রমে তাদের পূর্ণরূপে জানা হয় এই নারীর বিষয়টি। গ্রামের লোকেরা ক্রমে এই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় যে, নয়নতারাই মফিজুদ্দিনকে প্রথম বলে সে এক শ এগারো বছর বাঁচবে; কারণ, তারা শুনতে পায় যে, মফিজুদ্দিন গ্রামের কাউকে কাউকে এ কথা বলে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, যমুনার বুকে নৌকোর পেছনের গলুইয়ের কাছে মফিজুদ্দিন নগ্ন অবস্থায় চাটাইয়ের ওপর কাত হয়ে পড়েছিল, তখন তার কোমরের কাছে ঝুঁকে পড়ে নয়নতারা তাকে বলে, তুমি ভয় পাও ক্যা, তুমি একশ এগার বছর বাইচপা! গ্রামের লোকেরা বলে যে, গ্রামের ছেলেদের মাটি কাটার কাজ অব্যাহত রাখার কথা বলে, লুঙ্গির ওপর হাফহাতা শার্ট পরে পায়ে হেঁটে রওনা হওয়ার তিন ঘণ্টা পর, সন্ধ্যার পূর্বে বাহিরগোলা রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে মফিজুদ্দিন সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে; তারপর সে শহরের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে উত্তর প্রান্তে আমলাপাড়ার কাছে পুনরায় শহরের বাইরে এসে পড়ে এবং নিকটের গয়লা গ্রামের দিকে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, গয়লা গ্রামে পৌঁছাই ছিল মফিজুদ্দিনের এই যাত্রার উদ্দেশ্য। শহরের এই প্রান্তের ইট বিছানো রাস্তা ত্যাগ করার পর সে মাটির কাঁচা রাস্তার ওপর এসে পড়ে, তখন আবছা অন্ধকার হয়ে আসা প্রান্তরের মধ্যে সে নিজেকে একা দেখতে পায় এবং এই মেঠোপথ ধরে যমুনার ভোলা পাড়ের কাছে চলে আসে। নদীর কিনার দিয়ে দূরে ঝোপঝাড়ের মতো অন্ধকার গ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়, নদীর পাড়ের সঙ্গে বাঁধা একটি মাঝারি আকারের ছৈ-তোলা নৌকো সে দেখতে পায়, এই নৌকোর ছৈয়ের নিচে একটি হারিকেনের বাতি জ্বলছিল এবং সামনের গলুইয়ের কাছে দুজন লোক বসে হুকো খাচ্ছিল। মফিজুদ্দিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে এবং নৌকাটির সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মাঝিরা তাকে ডাক দেয়, কেডা যায়? কনে যাইবেন? মফিজুদ্দিন তখন পথচলায় ক্লান্ত ছিল এবং তার মনে শীঘ্রই চন্দ্রভানকে পাওয়ার সম্ভাবনার ঘোর ছিল, ফলে ডাক শুনে সে থামে এবং যমুনার পাড়ে পুবদিকে মুখ করে দাঁড়ায় এবং বলে, আমার নাম মফিজদ্দি, বাড়ি সুহাসিনী, আয়গঞ্জ। তখন মাঝিদের একজন মুখ থেকে হুঁকোর ফুটো সরিয়ে মফিজুদ্দিনকে তামাক সেবন করে যাওয়ার আমন্ত্রণ করলে, সে তাদের নৌকায় উঠে আসে। তারা অনেকক্ষণ ধরে তামাক খায় এবং গল্প করে, তারপর একসময় মফিজুদ্দিন লক্ষ করে যে, মাঝিদের একজন পাড়ের উপর পুঁতে রাখা লগির সঙ্গে বাঁধা নৌকোর দড়ি খুলছে; কিন্তু তার পরেও, সন্দেহ করার কোনো কারণ না থাকায়, সে বেখেয়াল হয়ে থাকে, এবং সে যখন বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, সে দেখতে পায় যে, নৌকা নদীর পাড় থেকে সরে এসেছে; তখন সে বিভ্রান্ত এবং বিচলিত বোধ করে এবং বলে, কি করেন; কিন্তু মাঝিরা তার কথার উত্তর দেয় না, নৌকা ভাটির দিকে ভেসে যেতে থাকে। মফিজুদ্দিনের বিভ্রান্তি তখনো কেটে না গেলেও সে ভয় পেতে শুরু করে, সে ভেবে দেখার চেষ্টা করে কি ঘটছে এবং সে এখন কি করবে, কিন্তু সে কিছু বুঝতে পারে না; যতক্ষণ সে হুঁকো হাতে বিমূঢ়ের মত বসে থাকে মাঝিরাও একজন হাল ধরে এবং অন্যজন তার গায়ের কাছ ঘেঁষে পাটাতনের উপর বসে অপেক্ষা করে, সে হুঁকোটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা মাত্র নিকটে বসে থাকা লোকটি তার লোমশ হাত দিয়ে তাকে জাপটে ধরে, অন্য লোকটি তখন কিছুক্ষণের জন্য স্রোতের মুখে নৌকা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে আসে। তারা দুজন বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মফিজুদ্দিনকে কাবু করে, তারপর পাটাতনের তল থেকে দড়ি বের করে পিছমোড়া করে তার হাত-পা বেঁধে ছৈয়ের নিচে ফেলে রাখে। এরপর আততায়ী দুজন হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয় এবং নৌকা দক্ষিণ দিকে নেমে শহরের কাছে সরে এসে অন্ধকারের ভেতর পুনরায় কূলে ভেড়ে। বৈঠা দিয়ে প্রহারের পরও মফিজুদ্দিন জ্ঞানরহিত হয় নাই, নৌকার লোক দুজনের কথাবার্তা অনুসরণ করে সে জানতে পারে যে, এদের ভেতর যে লোকটা হাল ধরেছিল তার নাম জোবেদ এবং অন্য লোকটির নাম হালাকু। নৌকা পুনরায় ভেড়ানোর পর হালাকু নৌকা থেকে নেমে যায় এবং মফিজুদ্দিন সঙ্গের লোকটিকে নিয়ে অন্ধকারের ভেতর পড়ে থাকে; মুখের ভেতর গামছা খুঁজে পেঁচিয়ে বেঁধে দেয়ায় সে কথা বলতে পারে না, তার মুখ দিয়ে শুধু অস্পষ্ট গোঙানোর শব্দ হয়। নৌকায় পেছনের গলুইয়ের ওপর হালের পাশে বসে থাকা লোকটি তার বিষয়ে উদাসীন হয়ে থাকে, তখন মফিজুদ্দিন পরিস্থিতির ভেতরকার সত্যটি উপলব্ধি করতে থাকে এবং সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে; সে বুঝতে পারে যে, আলি আসগর মিয়ার মেয়ে চন্দ্রভানকে তার আর বিয়ে করা হবে না, এই লোকগুলো শিগগিরই জবাই করে তার লাশ যমুনার বুকের কোনো অজানা চরে পুঁতে রেখে যাবে। তার মনে হয় যে, তাকে আসলে ইতোমধ্যেই শোয়ানো হয়েছে, তার আর উঠে দাঁড়ানো হবে না, হালাকু ফিরে আসার পরই হয়তো তার জীবন শেষ হবে; মফিজুদ্দিনের ভেতর তখন হঠাৎ অস্থিরতা দেখা দেয়, গামছার বাঁধনের নিচে তার মুখে ফেনা জমে; এক হতবিহ্বল ঘোরের ভেতর তার চেতনা লুপ্ত হয়ে আসে। এইসব ঘটনার কথা পরবর্তী সময়ে সুহাসিনীর লোকেরা টুকরো টুকরো আকারে ক্রমান্বয়ে জানতে পারে, এবং মফিজুদ্দিন অথবা নয়নতারা হাটের কথা মনে হলে তাদের এইসব কথা স্মরণ হয়; তারা বলে যে, সেদিন কোনো এক সময়, মফিজুদ্দিন বলতে পারে না কোন সময়, হয়তো অনেক্ষণ পর, হয়তো অল্পক্ষণ পর, সে সেই দৃষ্টিরহিত অন্ধকারের ভেতর একটি নারীর কণ্ঠ শুনতে পায় এবং ছৈয়ের ভেতর থেকে সে দেখে, নদীর পাড় থেকে দুটো ছায়ামূর্তি নৌকার ওপর নেমে আসে, তারপর লোকগুলো পুনরায় নৌকা ছেড়ে দেয় এবং অস্পষ্ট চেতনার তল থেকে মফিজুদ্দিন অনেকক্ষণ পর্যন্ত লোক দুজন এবং রমণীটির কথা বলা শোনে। পরদিন ভোর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে রমণীটির চেহারা দেখতে পায় না, সে তার কণ্ঠধ্বনি শোনে, মোটা ফেসফেসে এবং ভাঙা কণ্ঠস্বর মেয়েটার, হেসে উঠলে ভরা কলসির জলের ধ্বনির মতো শব্দের বলক ওঠে। মফিজুদ্দিন বুঝতে পারে যে, হালাকু মেয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে আছে এবং এভাবে অনেক্ষণ থাকার পর, সে মেয়েটাকে হালের বৈঠায় বসে থাকা জোবেদের পায়ের কাছে পাটাতনের ওপর শোয়ায় এবং তার কাপড় খুলে ছৈয়ের ওপর ছুড়ে দেয়। তখন, হয়তোবা হালাকুর শরীরের নিচে পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ার সময় এই নগ্ন গণিকার চোখ খোলা আকাশের দিকে চলে যায়, সেখানে নিকষ অন্ধকারের ভেতর সে দেখে যে, মানুষের চোখের মতো রাতের সব তারা জেগে আছে এবং তখন গণিকার ভেতর নারী জেগে ওঠে, সে বলে যে, এভাবে খোলা আকাশের তলে নয়। ছৈয়ের নিচে, ছৈয়ের নিচে, সে বলে এবং তার এই কথায় হালাকুর যদিও কর্ণপাত না করলেও চলত, তবুও সে মেয়েটির কথায় রাজি হয়। নগ্ন গণিকাকে তখন পাটাতনের ওপর রেখে নগ্ন হালাকু ছৈয়ের ওপর দিয়ে পার হয়ে নৌকোর সামনের দিকে এসে নামে এবং উবু হয়ে হাত বাড়িয়ে ছৈয়ের তল থেকে হাত-পা বাঁধা মফিজুদ্দিনকে বস্তার মতো টেনে বাইরে খোলা আকাশের নিচে বার করে আনে এবং মফিজুদ্দিন যাতে পানিতে গড়িয়ে গিয়ে পড়তে না পারে সে জন্য পাটাতনের সঙ্গে তাকে দড়ি দিয়ে বাঁধে, এবং তখন, মফিজুদ্দিনের চোখে পড়ে উবু হয়ে থাকা খুনির অণ্ডকোষ নক্ষত্র-জ্বলা আকাশের প্রেক্ষাপটে কালো এক জোড়া সুপারির মতো দোল খায়। মফিজুদ্দিনের তখন কি যে হয় তা সে বলতে পারে না, পরবর্তী সময়ে তার শুধু এ রকম মনে পড়ে যে, এই টানাহ্যাচড়ার সময় সে সম্ভবত শব্দ না করে চুপ করে থাকে এবং তখন মেয়েটি যখন জিজ্ঞেস করে যে, জিনিসটা কি, হালাকু উত্তর দেয়, আলুর বস্তা। মফিজুদ্দিনকে বাইরে রেখে হালাকু ছৈয়ের ভেতর প্রবেশ করে এবং মেয়েটি অন্য প্রান্ত থেকে শুয়ে থেকেই গড়িয়ে ভেতরে চলে আসে, তখন একটু পর নৌকাটি দুলতে থাকে এবং শোনা যায় চাপা শব্দ এবং হাসি। তখন সেই বিভীষিকার ভেতর শুয়ে থেকে একধরনের ঘোরের ভেতরও মফিজুদ্দিন এই সত্যটি বুঝতে পারে যে, এই মেয়েটির সঙ্গে খুনিদের মিথুন ক্রিয়া সমাপ্তির সময়টি হবে তার জীবনের প্রান্ত সীমা, কারণ, প্রবল আতঙ্কজনিত হতবুদ্ধিতার ভেতরও তার এ রকম মনে হয় যে, মেয়েটিকে ব্যবহার করার পর খুনি লোক দুটো তাকে নৌকোর কিনারায় রেখে জবাই করবে। হালাকু ছৈয়ের নিচে প্রথমবার মেয়েটিকে টেনে নেয়ার কতক্ষণ পর নৌকার আন্দোলন থামে তা সে মনে করতে পারে না, তবে একসময় তা থামে এবং ছৈয়ের তলায় সব শব্দ বিলীন হয়ে গিয়ে নিথর নীরবতা নামে, এবং তার কিছুক্ষণ পর আবার পাটাতনের কাঠ মচমচ করে, ছৈয়ের নিচে দুজন নড়াচড়া শুরু করে, কথা শুরু হয় এবং মুক্ত হয় ভরা কলসির পানি ঢেলে দেয়ার শব্দের মতো ভারি হাসি। হালাকু এবং মেয়েটি ছৈয়ের নিচ থেকে বের হয়ে কাপড়চোপড় পরে জোবেদের সামনে পাটাতনের ওপর বসে এবং তখন মফিজুদ্দিন ভাবে যে, হাল ধরার দায়িত্ব হালাকুকে দিয়ে জোবেদ এবার মেয়েটিকে ছৈয়ের ভেতর নিয়ে ব্যবহার করবে এবং তার এই কাজ শেষ হলে তারা দুজন তার দিকে নজর দেবে; এই সময় মেয়েটি অশ্লীলভাবে হেসে ওঠে এবং মফিজুদ্দিন বুঝতে পারে যে, হালাকু পুনরায় মেয়েটিকে পাটাতনের উপর ফেলে বুকের তলায় চেপে ধরেছে। মেয়েটি মুখ বন্ধ করে গোঙাতে থাকে এবং নৌকা তোলপাড় করে; হালাকু তখন গণিকাটিকে অনাবৃত করে পুনরায় ছৈয়ের নিচে টেনে আনে এবং তপন, মফিজুদ্দিন বুঝতে পারে না যে, তার নিজের গামছাবাঁধা মুখ থেকেও চাপা গোড়ানোর শব্দ বের হতে থাকে। হালাকু এবং জোবেদ সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, তারা মফিজুদ্দিনের গোঙানোর শব্দ শুনতে পায় না অথবা পেলেও তারা হয়তো মনে করে যে, এই শব্দ মেয়েটির মুখ থেকে নির্গত, কিন্তু নদীর ঢেউ এবং পানিতে বৈঠার আঘাতের শব্দ এবং হালাকুর জ্বালাতনের ভেতরও মেয়েটি সম্ভবত মফিজুদ্দিনের গোঙানোর শব্দ শোনে, কারণ, সে বলে, ওইটা কিসের শব্দ? হালাকু তার নগ্ন শরীরের নিচে নগ্ন নারীদেহ অনুভব করতে করতে, নিজে কিছু না শুনলেও বুঝতে পারে মেয়েটি কিসের শব্দের কথা বলে; তখন মেয়েটি যখন পুনরায় বলে, বাইরে কি যানি নড়ে, হালাকু সেই অবস্থায় থেকেই সব বলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং বলে যে, বাইরে আলুর বস্তাই নড়ে এবং নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে, তারপর আরো পরিষ্কার করে সে মেয়েটিকে জানায় যে, বাইরে পাটাতনের ওপর আসলে হাত-পা বাঁধা একটি লোককে ফেলে রাখা হয়েছে এবং এই লোকটিকে তারা পরে রামদা দিয়ে জবাই করবে। সে সময় হালাকু হয়তো মিথ্যে বলার প্রয়োজনীয়তা দেখে না, কারণ, তার হয়তো মনে হয় যে, একজন দরিদ্র বেশ্যার সঙ্গে আলুর বস্তাবিষয়ক এই রসিকতার চাইতে বেশি কোনো সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন নাই; হালাকু তার শরীরের নিচে এই স্খলিত নারীর উষ্ণতার ভেতর প্রবিষ্ট থেকে মফিজুদ্দিন সম্পর্কে তার বিশদ কথা অকপটে খুলে বলে। সে বলে যে, বাইরে সামনের গলুইয়ের কাছে পাটাতনের ওপর সে লোকটি পড়ে আছে তার জীবনের দাম তিন শ টাকা এবং সে গণিকা নারীর উপস্থিতিজনিত তার তুরীয়াবস্থার কারণে পুনরায় রসিকতায় লিপ্ত হয়, আলিঙ্গনাবদ্ধ নারীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে সে বলে যে, খুনে তার প্রয়োজন নাই, তার প্রয়োজন টাকার; সে বলে যে, এখন কেউ চার শ টাকা দিলে লোকটিকে তারা ছেড়ে দেবে। সুহাসিনীর লোকেরা পরে বলে যে মফিজুদ্দিনের সেই বিপর্যয়ের সময় সহবাসরত খুনি এবং গণিকার এই আলাপের পর্যায়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, তখন মেয়েটির ভেতরকার নারী দ্বিতীয়বারের মতো জাগরিত হয় এবং হালাকুর কথা শুনে অন্ধকারের ভেতর পড়ে থাকা লোকটির জন্য তার হৃদয়ে করুণার প্রথম ধারা প্রবাহিত হয়; তার হাসি থেমে যায়, হালাকুর তৎপর শরীরের নিচে তার দেহ শিথিল হয়ে আসে এবং হালাকু যখন ছৈয়ের তল থেকে বের হয়ে যায়, সে তখনো ছৈয়ের ভেতর চিৎ এবং নগ্ন হয়ে নীরবে পড়ে থাকে; অনেক্ষণ এভাবে পড়ে থাকার পর, মনে হয় যেন, সে পুনরায় তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, ছৈয়ের তল থেকে সে দুই খুনির উদ্দেশে ইতর কথা ছুড়ে দেয় এবং নদীর ঢেউয়ের শব্দের ওপর দিয়ে তার তরঙ্গায়িত হাসি পুনরায় গড়িয়ে যায়। সেদিন ছৈয়ের তলায় জোবেদ যখন মেয়েটিকে নেয় তখন হালাকু গিয়ে নৌকার হাল ধরে এবং পুনরায় নৌকার দুলুনিতে মফিজুদ্দিনের চোখে অবশেষে দ্রিা নেমে আসে। সুহাসিনীর লোকেরা এই গল্প যখন করে, তারা বলে যে, যমুনার বুকে সেদিন রাতে সকল আচ্ছন্নতার ভেতরও সে হয়তো ভেবেছিল যে, খুনিদের হাতের ভেতর ঘুমিয়ে না পড়ে জেগে থাকা প্রয়োজন; যদিও জেগে কি লাভ হবে, বা সে কি করতে পারবে, তা তার জানা ছিল না। সে রাতে নৌকার ক্রমাগত দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ার পর পরবর্তী সকালে জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত সে বুঝতে পারে না যে, সে ঘুমিয়েছে। পথ হাঁটার ক্লান্তি এবং নিহত হওয়ার উৎকণ্ঠায় জর্জরিত দেহ নিয়ে সে এক নিচ্ছিদ্র ঘুমের তলায় ডুবে থাকে; পরদিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে এবং সে চোখ খুলে তাকায়, তার চোখে নিচু হয়ে বয়ে যাওয়া ভোরের সূর্যের আলো স্পর্শ করে এবং তখন নড়াচড়া করতে গিয়ে সে বুঝতে পারে যে, নৌকোর পাটাতনের সঙ্গে তার পা-ও বেঁধে রাখা হয়েছে। গরুর মতো দড়ি-বাঁধা হয়ে থাকলেও রাতের ঘুম এবং ভোরের নরম বাতাসের স্পর্শে মফিজুদ্দিনের ভালো লাগে। সে বুঝতে পারে যে, নৌকোটিকে লগির সঙ্গে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং ঘাড় একটু উঁচু এবং কাত করে নিকটে ডাঙা না দেখে সে বোঝে যে মাঝনদীতে এখানে পানি কম, হয়তো কোমর সমান; এই অল্প পানিতে লগি পুঁতে নৌকো বেঁধে, রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত লোক দুজন ঘুমিয়েছে। ঘাড় কাত করে সে ছৈয়ের নিচে তিনজন নিদ্রামগ্ন মানুষকে দেখতে পায়, সে দেখে যে, নৌকোর দৈর্ঘ বরাবর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা দুজন পুরুষের মাঝখানে একটি নারী, নদীর ক্রমাগত ঠাণ্ডা বাতাসে মফিজুদ্দিনের শীত লাগে এবং একসময় তার শরীরে কাঁপুনি ধরে। তখন হয়তো মফিজুদ্দিনের, পুনরায় তার ঘোর এসেছিল, তারপর একসময় সেই তন্দ্রা কেটে গেলে চোখ খুলে সে অন্ধকারের রমণীটিকে দেখে; সে দেখে যে, আগের দিন রাতে ছৈয়ের নিচে যে অদৃশ্য নারী দাপাদাপি করেছিল, সে ছৈয়ের মুখের কাছে বাইরে পাটাতনের ওপর তার খুব নিকটে এসে বসেছে। এই মেয়েটি তখন হয়তো চোখ বুজে কাত হয়ে পড়ে থাকা মফিজুদ্দিনকে দেখছিল, অথবা দেখছিল ধূসর বয়ে যাওয়া নদী, কিংবা সে হয়তো চোখ বুজে ছৈয়ের মুখের কাছে হেলান দিয়ে ভোরের বাতাস এবং নরম রোদের ভেতর শুধু আরাম করছিল; তখন মফিজুদ্দিন পুনরায় চোখ খুললে, সে দেখতে পায়। মেয়েটি মফিজুদ্দিনের গামছা দিয়ে বাঁধা মুখ এবং বিভ্রান্ত ভীত চোখের দিকে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, জার নাগে? গণিকা মেয়েটির প্রশ্ন শুনে মফিজুদ্দিনের মনে হয় যেন, তার চেতনা নয় বরং তার দেহ স্বয়ংক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সে ঘাড় নাড়ে, শয়েটি তখন উঠে গিয়ে নৌকোর ছৈয়ের ভেতর থেকে একটি কালো রঙের বস্ত্র এনে মফিজুদ্দিনের গলা থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত ঢেকে দেয়; মফিজুদ্দিন বুঝতে পারে যে, এটা এই মেয়েটার সায়া, আগের দিন রাতে হালাকু এটা খুলে তাকে অনাবৃত করেছিল, তারপর সে আর সায়া এবং ব্লাউজ পরে নাই। মফিজুদ্দিনকে পেটিকোট দিয়ে আবৃত করার পর মেয়েটি নৌকোর অন্য প্রান্তে গিয়ে বসে; এই নারীটি, হালাকু যাকে সিরাজগঞ্জ শহরের পতিতালয় থেকে এক রাতের জন্য পাঁচ টাকায় ভাড়া করে আনে, মফিজুদ্দিনকে তার ননাংরা পেটিকোট দিয়ে ঢেকে শীতের কাঁপুনি থেকে রক্ষা করার সময়, অথবা পরে নৌকোর পেছনের গলুইয়ের কাছে পাটাতনের ওপর বসে থাকার সময়, কতগুলো বিষয় হয়তো ভেবে নেয়। কারণ, একটু সময় পর হালাকু এবং জোবেদ জেগে ওঠে এবং নৌকোর পাটাতনের তল থেকে মাটির আলো চুলা বার করে হালাকু যখন মাটির হাঁড়িতে ভাত বসায়, মেয়েটি তখন তার ছলাকলার পেখম বিস্তার করে এবং এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, তার গলার ভেতর থেকে তরল জলের মতো গড়ানো হাসি পুনরায় প্রবাহিত হয় এবং হালাকুর পক্ষে খড়ির চুলোর ওপর বসানো ভাতের হাঁড়ির সামনে বসে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে; সে চুলোর পাশেই মেয়েটিকে কাত করে ফেলে দেহের নিচে চাপা দেয় এবং হালের বৈঠা টানায় ব্যস্ত জোবেদের চোখের সামনে দিনের প্রকাশ্য আলোতে মিথুন ক্রিয়া সমাপ্ত করে। মফিজুদ্দিন তখন মিথুনবিদ্ধ খুনি এবং গনিকার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল কিনা তা বোঝা যায় না, তবে সূর্যের সরাসরি আলো থেকে চোখ বাঁচানোর জন্য ঘাড় কাত করলে নৌকোর ছৈয়ের তল দিয়ে অন্য প্রান্তের এই দেহক্রীড়া হয়তো তার চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ পর চুলো থেকে ভাতের হাঁড়ি নামানোর পর আলু ভর্তা করার সময় হালাকু যে কথা বলে তাতে বোঝা যায় যে, সে যখন দিবালোকে নারকীয় কায়দায় মেয়েটিতে উপগত হয়েছিল তখন তার বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নাই; সে খিক খিক করে হেসে বলে যে, মফিজুদ্দিনকে সে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল; এর নাম মানুষ, সে বলে, আর একটু পরে শ্যাষ হয়্যা যাইব, কিন্তু এমন কইরা তাকায়া দেইখপ্যার নিছিল যানি ও-ই কাম হইরত্যাছে। হালাকুর কথা শুনে জোবেদ এবং হাসে মেয়েটি, মেয়েটি বলে, দিমু নাকি একবার শ্যাষ খাওয়ান খাওয়ায়া? এবং এভাবেই, পরবর্তী সময়ে মফিজুদ্দিনের মনে পড়ে, গণিকা নারীর এই খেলা অথবা বিস্তৃত পরিকল্পনার শুরু হয়; হালাকু তার প্রস্তাবে রাজি হয়, বোঝা যায় যে, গণিকা নারীর ব্যাপারে হালাকু এবং জোবেদের কোনো ঈর্ষাকাতরতা নাই। হালাকুর রান্না করা ভাত তারা তিন জনে খাওয়ার পর মেয়েটি একটি সানকিতে করে ভাত নিয়ে গিয়ে মফিজুদ্দিনের সামনে বসে, পাটাতনের সঙ্গে মফিজুদ্দিনকে বেঁধে রাখা দড়ি খুলে দেয় এবং তাকে ছৈয়ের মুখের কাছে টেনে এনে ছৈয়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসায়, তারপর মুখের গামছা খোলে এবং দেখে যে, তার মুখের কোণায় থুতুর ফেনা জমে আছে। তখন, দিগন্ত রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত ধূসর নদীর বুকের ওপর দিয়ে তাদের নৌকো ক্রমাগতভাবে ভাটির দিকে নেমে যেতে থাকে এবং সেই বিস্তীর্ণ আকাশ এবং পানির মাঝখানে, নিঃসঙ্গ নৌকোর ওপর কৈশোর এবং যৌবনের সীমায় দাঁড়ানো মফিজুদ্দিনের বিস্ফারিত চোখ এবং বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের যুবতী পতিতার চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। মফিজুদ্দিনের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা থাকায় মেয়েটি ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা মাখিয়ে তার মুখে লোকমা তুলে দেয়; কিন্তু তখন, মেয়েটির এই আচরণে মফিজুদ্দিন কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে, তার দেহে পুনরায় কাঁপুনি শুরু হয় এবং পাটাতনের ওপর কাত হয়ে পড়ে সে বোবা জম্ভর মতো গোঙায়, তার মুখ দিয়ে আবার লালা এবং ফেনা গড়াতে থাকে। পেছনের পাটাতনের ওপর বসে হালাকু হুঁকো সেজে তামাক টানতে শুরু করলে মেয়েটা ছৈয়ের মুখের কাছে সামনের পাটাতনের ওপর হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকা মফিজুদ্দিনকে পুনরায় টেনে তুলে বসায়, তারপর কোমর ধরে টেনে ছৈয়ের তলায় নিয়ে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এই গণিকা মেয়েটির মনে কি ছিল তা মফিজুদ্দিন কোনো দিনই বুঝতে পারে নাই; বহু বছর পরে বহুবার তার যখন সেই অসাধারণ দিন এবং রাত্রির কথা মনে পড়ে, সে শুধু বিস্মিত হয়ে থাকে; তার মনে হয় যে, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে এবং সেই ভাড়া করা মেয়েটি, যে যমুনার বুকে নৌকোয় তার প্রতি আগ্রহী হয়েছিল, ছিল মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো, করুণাময়ী ধরনীর মতো। কারণ, সে সময় বিভ্রান্তির এক চরম অবস্থার ভেতর থাকলেও মফিজুদ্দিনের মনে পড়ে যে, তার অবস্থা দেখে মেয়েটির চোখ প্রথমে পানিতে পূর্ণ হয়ে আসে, কিন্তু তারপর তাকে ছৈয়ের নিচে টেনে নেয়ার পর তার অন্য এক পরিচয় যেন প্রকাশিত হয়, এবং সেই পরিচয়ের প্রকৃতি মফিজুদ্দিন তার সমগ্র জীবনে নির্ণয় করতে সক্ষম হয় না। সেদিন ছৈয়ের তলায় টেনে নেয়ার পর মেয়েটা মফিজুদ্দিনের গায়ের শার্ট খুলে ফেলে, লুঙ্গি টেনে নামায়; পিছ-মোড়া করে হাত বাঁধা মফিজুদ্দিনকে সে চিৎ করতে পারে না, তখন সে কাত হয়ে থাকা মফিজুদ্দিনের দুই উরুর সন্ধিতে ডান হাত প্রবেশ করিয়ে দিয়ে একটি আতা ফলের মতো মফিজুদ্দিনের অণ্ডকোষসহ শিশ্ন করতলের ভেতর নেয় এবং তারপর ফিসফিস করে বলে, জুইম্যা একদম বরফ হয়্যা গেছে। এরপর মেয়েটি মফিজুদ্দিনের পাশে শুয়ে পড়ে এবং মা যেমন শিশুকে কোলের ভেতর নেয়, সেভাবে তাকে তার বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রাখে। এভাবে তারা কতক্ষণ ছিল মফিজুদ্দিনের তা মনে পড়ে না, তার মনে হয় যে, রমণীটির আলিঙ্গনের ভেতর সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল, কারণ, সে যখন পুনরায় সচেতন হয় সে দেখে যে, মেয়েটি তাকে বুকের ভেতর নিয়ে শুয়ে নাই–সে উঠে বসে তার শীর্ণ নিতম্বে হাত বুলাচ্ছে। এই সময় মফিজুদ্দিন সেই তথ্যটি প্রথম জানতে পারে, যেটাকে সে এক অলঙ্খনীয় সত্য হিসেবে পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করে এবং যার ভ্রান্ততা বহু বছর পর এক পূর্ণিমা রাতে তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। সেদিন মফিজুদ্দিনের নগ্ন নিতম্বে হাত বুলানোর সময় মেয়েটি তার নিতম্বের কাছে ঝুকে আসে, মুখ নিচু করে চুমু খায়; তখন সে মফিজুদ্দিনের নিতম্বে আঁকা সেই চিহ্নটি দেখে এবং তার কানের কাছে মুখ এনে বলে যে, সে এক শ এগার বছর বাঁচবে, তার নিতম্বের ওপর কালো রঙে লেখা আছে, এক শ এগারো। সে বলে, ভয় পায়ো না, তোমাক মাইরবার পাইরব না কেউ; তারপর সে পুনরায় মফিজুদ্দিনের পাশাপাশি শুয়ে পড়ে এবং তার উরুর ফাঁক দিয়ে হাত প্রবেশ করিয়ে বলে, বরফ! এই মেয়েটি পরবর্তী দুদিন একই জায়গায় তার করস্থাপন করে, তার বলা, এই বরফের অস্তিত্ব অনুভব করে এবং সতেরো দিন পর মফিজুদ্দিন যখন পুনরায় উদভ্রান্তের মতো সুহাসিনীতে এসে দাঁড়ায় এবং তার পিতার কুঁড়েঘরে কয়েক দিন মুখ গুঁজে পড়ে থাকে, তখন সেই আতঙ্কের ঘোরের ভেতরও সে তার উরুসন্ধির জমাট শীতলতা টের পায়।