০২. আমেনার দিকে চেয়ে চেয়ে

আমেনার দিকে চেয়ে চেয়ে তিন বউ মুখ টিপে হাসলো। বড় বউ বললো : কিরে মাস? ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখখানা অনা দিকে সরিয়ে নিলো আমেনা। জানি না। তিন বউ ওকে তিন দিক থেকে হেঁকে ধরলো।

বল না! বল নারে।

ইস্ বিয়ে হতে না হতেই

আমি কিন্তু ঠিক বলে দিতে পারবো।

কচু! আমেনা মুখ ভেংচালো।

বড় বউ বললো : জামাই তোকে খুব আদর করে তাই না?

মেজ বউ বললো : বিয়ের সময় তো খুব হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছিলি এখন কেমন লাগছে আঁ।

ছোটবউ বললো—এই মিনা শোন। বলে আমেনার মুখটা কাছে টেনে এসে চাপা-স্বরে কানে কানে বললো।

শফি ভাই বিয়ে করেছে।

কবে? আমেনা চমকে উঠলো যেন।

এই তো গত মাসে।

কোথায়?

কোথায় ঠিক জানি না, শুনেছি বাড়ির কাছে, টাঙ্গাইলে। বউটা নাকি ভীষণ সুন্দর দেখতে।

ও। আমেনা কেমন যেন ফেকাসে হয়ে গেলো।

জোহরা খাতুন এসে তিন বউকে ডাক দিলেন। এই তোমরা এসো, বাচ্চাদের খাওয়ার পাট চুকিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। তারপর বুড়োরা খাবে। আমেনা ছোট বউকে তার কাছে রেখে দিলো। তোমরা যাও মা, ছোট ভাবী আমার কাছে এখন থাকুক। একটু গল্প করবে।

মা আর দুই বউ চলে যেতে আমেনা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলো সে। তারপর ধীরে ধীরে বললো।

পুরুষ মানুষগুলো ভীষণ স্বার্থপর তাই না ভাবী?

ছোট বড় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালো। বললো, বিয়ের পর এই তো সেদিন আমাদের এখানে এসেছিলো শফি ভাই। আমিও ছাড়িনি। বেশ করে শুনিয়ে দিয়েছি!

কি শুনিয়েছো? উঠে আবার বসলো আমেনা। কি কমিয়েছো, বলো না ভাবী?

বললাম। আপনি একটা এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ। খুবতো লম্বা লম্বা কথা বলতেন, মিনাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি এ পৃথিবীতে আর কাউকে চিন্তা করতে পারি না। ওকে না পেলে সারা জীবন আমি আর বিয়ে করবো না। এখন? কি হলো?

শুনে কি বললো? আমেনার গলার স্বরে ঈষৎ উত্তেজনা। ছোট বউ জবাব দিলো। কি আর বলবে। বলার মুখ আছে। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

কিছু বললো না?

না।

আমেনা নীরবে কিছুক্ষণ হোট বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। আসলে আমি একটা বোকা মেয়ে ভাবী। কেমন করে ওর ফাঁদে পা দিয়েছিলাম ভেবে দেখ তো।

সম্পর্কে মামাতো ভাই। তাই বাড়ির মধ্যে আসা যাওয়া আর মেলামেশায় কোন বাধা ছিলো না। তুমি তো সব জানো ভাবী।

প্রথম প্রথম সে কি কথা বলতো?

কেমন করে তাকিয়ে থাকতো।

আর আমি দুর্বল হয়ে গেলাম।

প্রেমে পড়লাম।

তোমার কাছে তো কিছুই লুকোইনি আমি ভাবী। আর হ্যাঁ ভাবী।

চিঠিগুলো কোথায় রেখেছো?

আছে। কাউকে দেখাওনি তো?

না।

আল্লাহর কসম?

আল্লার কসম।

কোথায় রেখেছো নিয়ে এস তো।

না, এখন পারবো না। সেই ট্রাঙ্কের মধ্যে এগাদা কাপড় চোপড়ের নিচে। কাল দুপুরে বের করে দেবো। কিন্তু ওগুলো দিয়ে এখন কি করবি তুই?

পুড়িয়ে ফেলবো। মনে হলো এক্ষুণি কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে আমেনা। সত্যি, আমি একটা বোকা মেয়ে ভাবী। বাবা যখন বিয়ে ঠিক করে ফেললো ভোমরা তো দেখেছো, কত কেঁদেছিলাম আমি।

তোমরা আমায় বুঝিয়েছিলে। কেঁদে কি হবে। কাঁদিসনে। বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কথা কি জানো ভাবী, লোকটার চরিত্র বলতে কিছু নেই। একটা আস্ত ছোটলোক। সহসা চুপ করে গেলো আমেনা।

স্বামীর কথা মনে পড়লো।

কেন যেন তাকে এখন আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে আমেনার। মনে ভাবলো, খেয়েদেয়ে এসে ওর কাছে একটা চিঠি লিখতে হবে।

নামাজ পড়া শেষ করে বুড়োকর্তা আহমদ আলী শেখ আবার পরিচয় পর্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ওকে যখন তুমি দেখেছো তখন সে হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু আমার সেই সেজো ছেলেটাকে বুঝলে আজ, বড় ইচ্ছে ছিলো সি, এস, পি বানাবো। উলক কোথাকার, আবার দাঁত বের করে হাসে দেখ না। তিনি এখন ব্যাবসা করাচ্ছেন। পাটের ব্যবসা। অবশ্য ব্যবসায়-রুজি-রোজগার ভালোই হচ্ছে।

সহসা বুড়া কর্তার চোখ পড়লো বাচ্চা ছেলেটার দিকে। ঐ দ্যাখো। লেখাপড়া ফেলে তিনি এদিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। কাল না তোর পরীক্ষা। ভালোমত পড়াশোনা করো। পড়ে পড়ে পুরো বইটাকে মুখস্ত করে ফেলো। রেজালটা যদি ভালো হয় তাহলে কালাদ থেকে একসের মিষ্টি কিনে খাওয়াবোতোমায়। পড়ো, পড়ো।

ঠিক এমনি সময় দরজা দিয়ে চোরের মতো ভেতরে এলো দুটি চৌদ্দ পনেরো বছরের ছেলেমেয়ে।

আহমদ আলী শেখ তা এই যে, কোত্থেকে এলে তোমরা আঁ? কোথায় গিয়েছিলে?

বাইরে।

বইয়ে। সেতো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কোথায়?

ছোট খালার বাসায়।

এতক্ষণ সেখানে কি করছিলে? তোমাদের না সন্ধের পর বাইরে কোথাও থাকতে নিষেধ করেছিলাম। একটু সুযোগ পেলেই দুজনে ফাঁকি দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরঘুর করো। দাঁড়াও এবার তোমাদের দুজনকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবো আমি। সহসা মফিজ মামার দিকে তাকালেন আহমদ আলী শেখ। মৃদু হেসে বললেন, আমার বড় নাতি। মনসুরের ছেলে রসুল। আর ওর নাম রেখেছি পেঁচি। মেজোর বড় মেয়ে। দুটিতে বড় ভাব। দাঁড়াও, তোমাদের রোজ রোজ বাইরে যাওয়ার মজা দেখাচ্ছি আমি।

রসুল আর পেঁচি মাথা নত করে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কারো দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেলো। বাচ্চা ছেলেটা এতক্ষণ চেয়ে চেয়ে ওদের দেখছিলো। আড়চোখে একবার বুড়ো কর্তাকে দেখে নিয়ে আবার বইয়ের প্রতি মনোযোগ দিলো। আল্লাহতায়ালা বলিলেন, ইহাদের সেজদা করো। কিন্তু ইবলিশ তবু রাজি হইলো না। ইবলিশ বললো, হে রব্বল আলামীন। ইহারা মাটির তৈরি। আর আমাদের আপনি আগুন দ্বারা তৈরি করিয়াছেন। আমরা আগুনে তৈরি হইয়া কেন মাটির ঢেলাকে সেজদা করিবো।

জোহরা খাতুনের গলার স্বরে বুড়ো কর্তার চমক ভাঙ্গলো। কি মেহমানকে নিয়ে সারারাত গল্প করবে নাকি! খাবে না? সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

বুড়ো কর্তা সহসা চিৎকার করে উঠলেন। আবদুল, আবদুল, উল্লুক কোথাকার। বাইরে হাত মুখ ধোয়ার পানি দিয়েছিস? জলদি করে দে। এসো মফিজ, হাতমুখ ধুয়ে নাও।

গিন্নী চলে যাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে থামালেন আহমদ আলী শেখ। শোন, মনসুর আহসান ওদের সবাইকে ডাকো। আমেনা কোথায়, না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি। ওকে তোলো। আজ আমরা সবাই এক সঙ্গে খাবো। ওঘরে জায়গা না হলে, এক কাজ করো, এখানে ফরাশ বিছিয়ে দিতে বলো।

বড় বউ মেজ বউয়ের কানে কানে প্রশ্ন করলো, মামা মামী কি আজ রাতে এখানে থাকবেন নাকি?

মেঝে বউ বললো, না, আমেনাকাছিলো ওরা রাতের ট্রেনে চাটগাঁ চলে যাবে।

যাক বাবা বাঁচোয়া। বড় বউ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, ওদের জায়গা দেব কোথায়।

ছোট বউ ছুটতে ছুটতে এলো। বড় দস্তরখানটা কোথায়, দেখেছো?

কেন?

ওটা পাচ্ছি না। বাইরের ঘরে ফরাশ বিছিয়ে দিতে বললেন মা। সবাই একসঙ্গে ওখানে খাবে। ও, মুখ টিপে হাসলো মেজ বউ। বুড়োর আজ আবার ক্ষেতের ফসল দেখতে ইচ্ছে হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *