০২. অফিস থেকে বের হয়ে

অফিস থেকে বের হয়ে রিকশায় চেপে তারা দুজন মতিঝিল যায় এবং সেখানে একটি ঘটনা ঘটে, খুব ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ ঘটনা; কিন্তু এই ঘটনার পর আবু ইব্রাহীম এমন গম্ভীরভাবে কিছু কথাবার্তা বলে যে, আমাদের মনে হবে, এই ঘটনার তুচ্ছতার ভেতর সে আরো কিছু দেখতে পায়। মতিঝিলের একটি অফিসের দোতালায় বাইরের সোফায় সিদ্দিক হোসেন তাকে বসিয়ে রেখে ভেতরে যায়। তারপর সিদ্দিক হোসেন ফিরে আসার পর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আবু ইব্রাহীম বলে, এখানে কাজটা কি?

ধান্দা।

এই সময় সিদ্দিক হোসেনের সিগারেট ফুরিয়ে যায় এবং তখন টিকাটুলির মোড়ে ফুটপাথের দোকান থেকে সিগারেট কিনতে গেলে ঘটনাটি ঘটে। সেখান থেকে খুব কাছেই একটি মিষ্টির দোকান ছিল, এই দোকানের সামনে একটি ভিখারিনী ছোট্ট একটি বাচ্চাসহ ফেলে দেয়। খালি দইয়ের হাঁড়ির তলায় লেগে থাকা তলানি হাত দিয়ে চেঁছে চেঁছে খাচ্ছিল। সে সময় যখন সিদ্দিক হোসেন সিগারেট কেনার জন্য মানিব্যাগ বের করে, ভিখারিনী মেয়েটি কাপড়ে হাত মুছে এসে তাদের কাছে দাঁড়ায় এবং দোকানিকে পয়সা দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালে ভিখারিনী তাদের সামনে করতল মেলে ধরে।

বাবা।

মাফ করো।

ভিখারিনী তাদেরকে ছাড়ে না, তাদের একেবারে গা ঘেঁষে আসে সে, তার ছেলেটিও তাদের হাঁটুর কাছে সরে আসে। তখন সিদ্দিক হোসেন ধমক দিলে ভিখারিনী এবং তার ছেলে সরে যায় এবং তারা এগোতে পারে। এই সময় সিদ্দিক হোসেন লক্ষ করে যে, তার হাঁটুর একটু উপরে প্যান্টে দইয়ের দাগ লেগে আছে এবং সে চাপা গর্জন করে ওঠে, এই মাতারি।

ভিখারিনীটি এবং তার শিশু সন্তান কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো বিহ্বল হয়ে থাকে, তারপর শিশুটি যেন তার কৃতকর্মের বিষয়ে সচেতন হয়, সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার মাকে পিছনে ফেলে রেখে দৌড় দেয়। আবু ইব্রাহীম দেখে, নোংরা এবং অর্ধ উলঙ্গ ছেলেটি একটি ভয় পাওয়া ইদুরের মতো দৌড়ে গিয়ে একটি খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সিদ্দিক হোসেন তাকে তাড়া করে এগিয়ে গেলে আবু ইব্রাহীমও পেছনে পেছনে যায়। সে দেখে একটি করিডোর পার হয়ে, মাঝখানের একটি সিড়ির নিচে শিশুটি নিজেকে এক কোণায় লুকানোর চেষ্টা করছে। সিদ্দিক হোসেন এই অবস্থায় কি করবে সেটা আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে নী এবং দেখা যায় যে, সিদ্দিক হোসেন নিজেও বুঝতে পারে না সে কি করবে। কারণ, কোণার ভেতর চোরের মতো বসে থাকা ন্যাংটা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। এগোয় না, তারপর সে শিশুটিকে হারামজাদা বলে গাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু আবু ইব্রাহীম দেখে যে, সিদ্দিক হোসেন পুনরায় শিশুটির দিকে এগিয়ে যায় এবং একটি পাঁচ টাকার নোট ভাজ করে শিশুটির দিকে ছুড়ে দেয়। এই ঘটনাটি আবু ইব্রাহীমের মনে রেখাপাত করে, সেটা আমরা বুঝতে পারি; কারণ এর পরেই সে সিদ্দিক হোসেনের সঙ্গে সেই সব বাক্য বিনিময় করে, যেগুলো বহুদিন পর বেইলি স্কোয়ারের মসজিদের সামনে আবু ইব্রাহীমের জানাজায় দাড়িয়ে সিদ্দিক হোসেনের মনে আসে সেদিন সিদ্দিক হোসেনের আচরণে আবু ইব্রাহীম কি বুঝেছিল তা আমাদের জানা নাই। সে কি সিদ্দিক হোসেনের এই মানবপ্রীতিতে মুগ্ধ হয়েছিল? আমরা একথা গ্রহণ করতে পারি না, কারণ আমরা তো জানি যে, একদা সে বিশ্বাস করত দয়া দেখানো নয়; গরিব এবং পতিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু সে কি ক্রমাগতভাবে, বিশেষ করে চাকরিতে এসে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে ভেবেছিল যে, বিপ্লব অনেক দূরে আছে এবং এই ছেলেটির এই মুহূর্তে দয়া প্রয়োজন এবং সিদ্দিক হোসেন সেই দয়া দেখানোয় সে কি ভেবেছিল যে, সিদ্দিক হোসেন তার চাইতে সামাজিকভাবে উপকারী? আবু ইব্রাহীম মূলত কি ভেবেছিল তা আমরা জানি না, সিদ্দিক হোসেনও পরিষ্কারভাবে জানে না, তবে সেদিন টিকাটুলির মোড় থেকে রিকশা করে সচিবালয়ে ফেরার সময় আবু ইব্রাহীম তাকে বলে, একটা কথা বলব?

সিদ্দিক হোসেন বিস্মিত হয়ে হাসে এবং বলে, সিরিয়াস কিছু?

তুমি কি নিজেকে ঘৃণা কর?

কেন?

তোমার জীবন যাপন পদ্ধতির জন্য?

তখন সিদ্দিক হোসেন তাকে এক কঠিন প্রশ্ন করে, তোমার কি মনে হয় আমার নিজেকে ঘৃণা করার মতো কিছু আছে? আবু ইব্রাহীম তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না এবং তখন সে বলে, আমি যদি বদলাই তুমি কি আমাকে ঘৃণা করবে?

তুমি কি নিজেকে দেবতা মনে কর?

আবু ইব্রাহীম পুনরায় উত্তর দিতে পারে না এবং তারপর অনেকক্ষণ সে চুপ করে থাকে। তারপর রিকশা ছেড়ে দিয়ে তারা যখন সচিবালয়ের এক নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তখন, আবু ইব্রাহীম মনে হয় যেন কোনো এক স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠে বলে যে, সে কোনো দেবতা নয়। তার কথা শুনে সিদ্দিক হোসেন বলে, কি বল?

আবু ইব্রাহীম তাকে আর কিছু বলে না। সে তার অফিস রুমের দিকে যায়। সিদ্দিক হোসেন তার এই সব কথায় গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর জানাজার কাতারে দাঁড়িয়ে তার বহুদিন পূর্বে আবু ইব্রাহীমের কথিত উক্তিটি মনে পড়ে যায় এবং সে ভাবে যে, আবু ইব্রাহীম যা বলেছিল তা সঠিক ছিল না। কিন্তু আমরা যখন আবু ইব্রাহীমকে জানব, সিদ্দিক হোসেনের মতো অত সহজে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে সক্ষম হব না। আমরা বিভ্রান্ত হন এবং হয়তো আমাদের বিভ্রান্তি থেকে যাবে।

 

প্রোস্টেট গ্লান্ডের সমস্যাক্রান্ত শ্বশুরকে আবু ইব্রাহীম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে অপারেশন করিয়ে নেয়। মমতার বড় ভাই সঙ্গে থাকায় আবু ইব্রাহীমকে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় না। সামান্য যেটুকু দায়িত্ব পালন না করলেই নয় সেটুকু করতে গিয়ে সে কাহিল হয়ে পড়ে। রিকশা ভাড়ার কারণে মমতার প্রত্যেকদিন বিকেলে পিতাকে দেখতে যাওয়া হয় না, এ নিয়ে সে আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে ঝগড়া করে চুপ হয়ে থাকে। শ্বশুরকে প্রত্যেকদিন দেখতে যাওয়ার কাজটি আবু ইব্রাহীমকে করতে হয় এবং তার সঙ্গে প্রায় দিনই থাকে বিন্দু বিন্দুর জন্য একটু দূর হয়ে গেলেও তারা হেঁটে যেত এবং পথে মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিত। রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোনো চাপা ফুল গাছ তলায় কখনো বাদাম চিবোত চিবোতে আবু ইব্রাহীমের তার এই কন্যাটির সঙ্গে কথা হয়। সেই সময় অথবা হয়তো তার অনেক পূর্বেই সে অনুভব করেছিল যে, বিন্দুর সঙ্গে তার গল্প করতে ভালো লাগে। যেমন অতীতে কখনো হেলেনের সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগত। হেলেন তার প্রেমিকা ছিল এবং তার মনে হয় যে, বিন্দুও তার প্রেমিকা। ভালোবাসা যে একটি ব্যাপার তা চাপা ফুল গাছ তলায় বসে একটি বালিকার সঙ্গে কথা বলার সময় সে বুঝতে পারে; সে বুঝতে পারে যে, সে যখন বিন্দুর মাথায় কর স্থাপন করে তখন সে নিজে আশ্বস্ত হয়ে ওঠে। তখন বিন্দুর প্রসঙ্গে তার মমতার কথা মনে পড়ে। তার মনে হয়, একদিন সে যখন বৃদ্ধ এবং জীর্ণ হয়ে এভাবে হাসপাতালে পড়ে থাকবে, সে দিন হয়তো বিন্দু তাকে দেখতে যেতে পারবে না, সে দিন বিন্দু তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে কাদবে মমতার মতো। এই সময়, সিরাজগঞ্জ শহরের আব্দুল জলিল সরকারের ঢাকা অবস্থান কালে তার জামাতা আবু ইব্রাহীম দেখতে পায়, মেয়ে কিভাবে পিতার স্পর্শে জ্বলে ওঠে এবং একজন বৃদ্ধ কেমন করে কন্যার সান্নিধ্যে এসে জীবনের স্বপ্নের কাছে ফেরে। অপারেশনের ক্ষতের সেলাই কেটে দেওয়ার পর আব্দুল জলিল সরকার তার জামাতার বাসায় কয়েকদিন থাকেন এবং তখন আবু ইব্রাহীম পিতা এবং কন্যার এই সম্পর্ক আবিষ্কার করে। তার শ্বশুর এবং স্ত্রী যমুনা নদীর গল্প কারে; মমতার শৈশবে যখন কাটাখালীতে উপচানো বর্ষা আসত, যখন বেরী বাঁধ ছিল না এবং নদী প্রান্তরের ওপর দিয়ে ঘরের দুয়ারে এসে পড়ত, তারা সেই সব দিনের গল্প করে এবং যমুনার ক্রমাগতভাবে মরে যাওয়ার কথা বলতে বলতে তারা শোকার্ত হয়ে ওঠে। এভাবে তারা এক সোনালি জীবনের গল্প করতে থাকে। যে জীবনে তারা এক সঙ্গে পাশাপাশি ছিল। সেই গল্পের ফাঁকে রুগণ-অসুস্থ সেই বৃদ্ধ মমতার দিকে তাকায়, আবু ইব্রাহীম সেই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারে, সেই দৃষ্টিতে সে হাহাকার দেখে। সেই বৃদ্ধ হেসে বিষণ হয়ে থাকে, অধিকার করতে চায় না। তিন দিন পর তিনি বলেন যে, তিনি চলে যাবেন। মমতা তার কথা শুনতে চায় না, কিন্তু মমতার শুনতে না চাওয়াকে তিনি শোনেন না; মমতা কাঁদে, তিনি হেসে চলে যান।

 

পরবর্তী হেমন্তের এক বিকেলে কলোনির ছোট ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় আবু ইব্রাহীম পুনরায় সেই রমণীটিকে দেখে, যাকে সে কোনো দিনই আর দেখতে চায়নি, সে দেখে যে, কলোনির রাস্তা দিয়ে একজন লোকের সঙ্গে হেলেন হেঁটে যায়। সে দেখে এবং তারপর তার মনে হয়, হেলেনকে সে কতকাল দেখেনি। তখন সে বিন্দুকে পাঠায় হেলেনকে ডেকে আনার জন্য। জিজ্ঞাস করবি আপনের নাম কি হেলেন? যদি কয়, হে। তাহলে কবি, আমার আম্মা আপনাকে ডেকেছে। মমতা হেলেনের নাম জানত, কিন্তু বিন্দু ছুটে নেমে গেলে আবু ইব্রাহীম যখন মমতাকে কথাটি বলে, তখন মমতা একেবারে ফাঁকা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। এরপর তাদের ভেতর আর কোনো কথা হয় না। মমতা রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে এবং আবু ইব্রাহীম বাইরের ঘরে বসে প্রতীক্ষা করে। তখন হেলেন এবং তার স্বামীকে নিয়ে বিন্দু এসে দরজায় দাঁড়ায়। বিন্দু বাইরের দরজা থেকে ডাকে, আব্বু। কিন্তু আবু ইব্রাহীম ওঠে না, তখন শেষ মুহূর্তে মমতা এগিয়ে যায়, দরজার কাছে গিয়ে বলে, আপা আপনের নাম হেলেন, তাই না? তখন আবু ইব্রাহীম দরজার কাছে আসে এবং বলে, হেলেন ভেতরে আস।

আরে ইব্রাহীম তুমি!

আমি এখান থেকে দেখে তোমাকে চিনতে পারছিলাম।

সেদিন হেলেন আর তার স্বামী টুকিটাকি কথাবার্তা বলে, মমতার বানানো নিমকপারা খেয়ে বিদেয় নেয়। তারপর মমতা তার পূর্বের কাজে ফিরে যায় এবং আবু ইব্রাহীম চোখ বুজে বসে থাকে। আবু ইব্রাহীমের নিকট অতি পুরাতন একটি সত্য পুনরায় প্রকাশিত হয়, তা হলো এই যে, হেলেনকে ছাড়া সে মরে যায়নি। তার মনে হয় যে, হেলেনের সে প্রেমিক ছিল না, পূজারী ছিল এবং হেলেন দেবীদের মতোই পূজারীকে অবহেলা করতে শিখেছিল। সে রাতে বিছানায় শুয়ে মমতা হেলেনের প্রসঙ্গে ফিরে আসে এবং আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, সে জানতো এরকম হবে।

এ রকম ধুম মাইরা রইছ ক্যান?

কি করমু!

মমতা তখন হঠাৎ তার বুকের ভেতর এসে পড়ে, তার মাথায় আর চোখেমুখে হাত বুলায়, ঠোঁটে চুম্বন করে; তাকে বেষ্টন করে থাকে। সে রাতে তখন আবু ইব্রাহীম কাত হয়ে মমতার চোখে ঠোঁট রেখে অবাক হয়, কারণ সে দেখে যে, মমতার চোখ ভিজে আছে। অন্তত জীবনে হয়তো এই একটিবার আবু ইব্রাহীম অনুভব করে যে, তার স্ত্রীটির দৈহিক স্থূলতা সর্বব্যাপ্ত নয়। সে রাতের আবু ইব্রাহীমের এই সব অনুভবের কথা মমতা পরে কোনো একদিন তার ডাইরি থেকে চুরি করে পড়ে। আবু ইব্রাহীম লেখে, বহুদিন পর হেলেন এলো আর মমতা আমার ঠোঁটে তুলে দিল ভালোবাসার লবণ। এর দুদিন পর হেলেন তাদের বাসায় আবার আসে; এদিন সঙ্গে তার স্বামী থাকে না। হেলেন বলে, এই কাছেই এসেছিলাম, ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে গল্প করে যাই। ওদিন তো তাড়াহুড়োয় কথাই বলতে পারা যায়নি।

বাইরের ঘরে তারা তিন জন বসে থাকে, মমতা তার চেহারা ভাবলেশহীন করে রাখে এবং হেলেন কিছু বললে শুধু হাসার ভান করে। আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, মমতা হয়তো কেঁদে ফেলবে।

তোমরা বিদেশে ছিলে জানতাম; দেশে এসেছ কবে?

বেশিদিন হয়নি?

এখন কোথায় আছ?

জায়ারেতে।

কেমন লাগে?

একদম বিচ্ছিরি।

তখন আবু ইব্রাহীম হাসলে পরে হেলেন অতীত দিনের সেই অনুকরণীয় তরল ভঙ্গিতে বলে, না, না, তুমি হেসো না, সত্যি বলছি এবং সেই ধ্বনি মূৰ্ছনার স্পর্শে আবু ইব্রাহীমের মনে হয়, পামগাছের বনের ভেতর নিরুদিষ্ট একটি আকাক্ষার ছায়া জেগে ওঠে। আবু ইব্রাহীম তবু আবার হাসে, হেলেন বলে, এই সব লাইফ আর একদম ভালো লাগে না। হেলেনের মুখ কুঁচকে থাকে, ওর চোখে খেই হারানোর ভাব। আবু ইব্রাহীম দেখে মমতা চোখ নিচু করে আছে; ওর ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপে। এমন সময় বিন্দু লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে ঢোকে, হেলেন ওকে কাছে টেনে নেয়।

তোমার মেয়েটা এমন মিষ্টি!

খুব ডানপিটে!

ওর নাম কি তুমি রেখেছ?

ওর মা রেখেছে।

খুব সুন্দর নাম।

ওর মার নাম মমতা।

হ্যাঁ খুব চমৎকার।

হেলেন বিন্দুকে ধরে রাখে।

আমাকে তুমি কি বলে ডাকবে বিন্দু?

বিন্দু হাসে, বলে ফুফু।

না, ফুফু না, খালা।

আপনি আম্মুর বোন?

হু, আমি তোমার আম্মুর আপা।

বিন্দু তখন তার বড় বড় দাঁত বের করে হাসে, হেলেনও তাতে যোগ দেয়। সে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে রাখে, তারপর গালের ওপর আলতো করে চুমু খায়। আবু ইব্রাহীম চুপ করে বসে থেকে হেলেনের আচরণ দেখে এবং বিভ্রান্ত হয়; সে এসবের অর্থ বুঝতে পারে না। হেলেনকে দেখতে তার ভালো লাগে; আর হেলেনের বাহুর ভেতর তার কন্যা! তখন আবু ইব্রাহীমের একবার মনে হয় যে, বহুদিন পূর্বে তার যে ভালোবাসা ব্যর্থতায় কেদেছিল, তার কোনো কিছুই আসলে ব্যর্থ হয় নাই। কিন্তু চিন্তার একই মুহূর্তের ভেতর তার জানা থাকে যে, এসব আসলে কিছুই না। সেদিন হেলেন চলে যাওয়ার পর যখন সন্ধ্যা হতে থাকে তখন বিন্দু এবং শুভ নিচ থেকে খেলা শেষ করে ফিরে আসে এবং আবু ইব্রাহীম ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এ সময় বিন্দু হঠাৎ চিল্কার করতে শুরু করে এবং আবু ইব্রাহীম দেখে যে, মমতা বিন্দুকে পেটাতে শুরু করেছে। আবু ইব্রাহীম আটকাতে গেলে মমতা প্রথমে ক্ষ্যাপে এবং আবু ইব্রাহীম তাকে ধমক লাগালে সে কেঁদে ফেলে। আবু ইব্রাহীম ব্যাপারটি বুঝতে পারে, তার এমন এক অসহায় বিপন্নতা হয় যে, সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। তারপর সে বলে, ঠিক আছে হেলেনের

সঙ্গে আবার দেখা হইলে কয়া দিমুনি যাতে আমাদের এখানে আর না আসে।

আমি আইসপার মানা করি নাই, খালি আমার মেয়েকে নিয়া ঢং দেখানো লাইগব না। তোমার কাছে আইসপ, তোমার কাছ থেইকা বিদায় হয়া যাইব।

আবু ইব্রাহীমের বিষণ্ণতার ভেতর এক ধরনের ক্রোধ হয়, কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। ঘরের ভেতর দেয়ালের কাছ দাঁড়িয়ে বিন্দু ফোঁপায় এবং মমতা গিয়ে রাতের রান্নার আয়োজনে লাগে। সচিবালয়ে আবু ইব্রাহীম এবং সিদ্দিক হোসেনের ভেতর যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা অপরিহার্যরূপে এক চাঞ্চল্য এবং রহস্যময়তার সৃষ্টি করে, কারণ তারা দুজন ছিল ভিন্ন মেরুর মানুষ। সিদ্দিক হোসেনের পৃথিবী ছিল সরল-যুক্তিনির্ভর এবং জীবনের কামনাসমূহ ছিল মানবিক সাধ্যের সীমার ভেতর; অন্যদিকে কখনো স্পষ্ট এবং কখনো অস্পষ্ট, এক লাগাতার স্বপচারিতার ভেতর দিয়ে যেন আবু ইব্রাহীমের জীবন পর হয়ে গেছে। এইসব বিষয় নিয়ে তাদের দুজনের একদিন আলাপ হয়, সেই আলাপের কিয়দাংশ এবং সেদিন বিকেলে মমতার সঙ্গে আবু ইব্রাহীমের কথোপকথন আমরা শুনব। সিদ্দিক হোসেন তদবির করে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় বদলি হয়, এইসব সংস্থায় অঢেল তহবিল তার গাড়ি থাকে। আবু ইব্রাহীম। একদিন তার অফিসে দেখা করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন কইরা বাগাইলা? শুনে সিদ্দিক হোসেন হাসে এবং বলে, আমি কি তোমার মতো নাকি?

তাই?

তাই! আত্মপীড়নবাদী হয়ে লাভ কি!

তখন তারা পুনরায় হাসে এবং সিদ্দিক হোসেন চা আনায়। গাড়ি পাই নাকি?

আরে না। পারসোনাল গাড়ি আমি কিভাবে পাব! অফিসের গাড়ি হয়তো মাঝেমধ্যে ব্যবহার করতে পারব।

বিদেশে যাইতে পারার সম্ভাবনা কেমন?

কি জানি বলতে পারছি না।

প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন জাতীয় কিছু হতে পারে।

তাহলে বিদেশেও তুমি যাইবা অনেকবার!

তখন সিদ্দিক হোসেনের পিয়ন চা পরিবেশন করে যায়।

শুধু চা খাওয়াইবা?

খাও, খাও!

ভালোই করছ, এই কেরানি মার্কা চাকরি ভালো লাগে না।

চাকরি ছাইড়া দেও!

তখন তারা দুজন আবার হাসে।

তুমিও এখানে চলে আস।

লাভ হবে না, আমি চালাতে পারব না, লোকে আমাকে ভয় পায় না।

ভয় না পেলে অসুবিধা নাই, বরং ভয় পেলেই অসুবিধা; লোকে তোমাকে ভয় পায়। মানুষকে ভালোবাসতে শেখো, তারা তোমাকে ভালোবাসা দেবে। এই কথা বলে সিদ্দিক হোসেন পুনরায় হাসতে থাকে, তখন আবু ইব্রাহীম বলে, আমাদের প্রমোশনটা কি হবে?

হওয়াতো উচিত।

চা খাওয়া শেষে বিদেয় নেওয়ার সময় আবু ইব্রাহীম বলে, তুমি ঠকাইলা। কিন্তু সেদিন বিকেলে মমতা তস্তরিতে করে যখন কয়েকটি মিষ্টি তাকে এনে দেয় সে তা খেতে চায় না।

আমার খাইতে ইচ্ছা করতাছে না।

তাহলে পরে খায়ো।

এ পর্যন্ত তাদের কথাবার্তা ভালোই এগোয়, তারপর তা বাঁক নেয় যখন মমতা বলে, সিদ্দিক ভাই কোনে বদলি হইছে? আবু ইব্রাহীমের এ প্রসঙ্গে কথা বলতে উৎসাহ হয় না, সে শুধু বলে, এইতো।

এই-তো কি?

আবু ইব্রাহীম তখন তার মেজাজ হারায়, বলে, কইলেই তুমি বুইঝবা নাকি? এ কথা শুনে মমতা অপমানে চুপ হয়ে যায় এবং সেটা দেখে আবু ইব্রাহীমের খারাপ লাগে। সে বলে, তুমি খাইছ মিষ্টি? মমতা তার কথার উত্তর দেয় না। তখন সে আবছাভাবে হাসে এবং মমতা শঙ্কিত চোখে সে হাসি দেখে। সে বলে, সিদ্দিক একটা আদেখলা; বাসায় মিষ্টি পাঠায়া দিছে! তখনও মমতা কথা বলে না এবং তখন আবু ইব্রাহীম পুনরায় বলে, তুমি খাইছ, মিষ্টি?

মমতা তার দিকে তাকায়, ঢং কর?

সিদ্দিক যে কেন এসব করে; ও একটু বেশি কইরা ফালায়।

হু, সবাইতো তোমার মতো হইব!

আমার মতো কি?

ছোটলোক, আর কি!

আবু ইব্রাহীম তখন, সেদিন, একু ম্লানভাবে হেসেছিল। মমতা হয়তো রসিকতা করেছিল অথবা এটা রসিকতা ছিল না; তবে আবু ইব্রাহীমের মনে হয়েছিল যে, মমতার এই কথায় অভিযোগ আছে এবং এই অভিযোগের প্রসঙ্গটি তার জানা! সে তখন উঠে গিয়ে, তার জীবনের একমাত্র আনন্দ, কলোনির পনেরো বর্গফুট আয়তনের ব্যালকোনিতে দাঁড়ায়। একটুক্ষণ পর বিন্দু নিচ থেকে উঠে আসে, সঙ্গে সিদ্দিক হোসেনের ছোট ছেলে কামাল।

আম্মু পানি খাব।

বিন্দু পানি খায়, কামাল দাড়িয়ে দাড়িয়ে বিন্দুর পানি খাওয়া দেখে; গ্রামের ভেতরকার পানির শেষ ধারাটি গড়িয়ে বিন্দুর মুখের ভেতর চলে যায়। ছেলেটির চোখ চকচক করে; দেখে মনে হয় যেন সে ভাবে যে, বিন্দু মধু খায়। বিন্দু হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে ফেলার পর কামালের তেষ্টা পায় এবং সে যখন পানি খেতে থাকে তখন বিন্দু একই রকম আগ্রহ নিয়ে দেখে। তারপর ছেলেটির পানি খাওয়া শেষ হলে এবং সেও হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে ফেলার পর অকস্মাৎ তারা দুজন ঝুরঝুর করে প্রথমে খানিকটা হাসে, তারপর দুজন পুনরায় বাইরের দিকে রওনা হয়। তখন মমতা এসে বিন্দুকে আটকায়। বলে, এই মেয়ে এখন আর যাইতে হবে না। কামাল তুমি যাও। মমতার এই নির্মমতায় বিন্দু গোঁ গোঁ করতে থাকে এবং কামাল একা ফিরে যেতে চায় না; কিন্তু মমতা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, বলে যাও কামাল; তুমি যাও, খেলগা। বিন্দুর ঘরে কাজ আছে।

ছেলেটি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, আমি যাই, হ্যাঁ, বলে চলে যায়। বিন্দু ঘ্যান ঘ্যান করে এবং মমতা তাকে শাসায়। এই চুপ, এত খেলা কিসের?

হইছেটা কি?

মমতা চুপ করে থাকে।

তুমি অর সঙ্গে রাইত দিন এরকম লাগে কেন?

মেয়ে মানুষের অত খেলা কিসের? রাইতদিন খালি ছেলেদের সঙ্গে খেলা।

মমতার এই কথায় আবু ইব্রাহীম চমৎকৃত হয়, সে বলে, অর বয়স কত? ও এখন ছেলে আর মেয়ের কি বোঝে? আবু ইব্রাহীমের এইসব উদারতা এবং আধুনিকতা সম্পর্কে মমতা বিশদ অবহিত ছিল, তাই সে আবু ইব্রাহীমের কথায় বিচলিত হয় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার মতো করে শুধু বলে, মেয়ে মানুষের অত খেলা লাগে না।

এরপর সেদিন মমতার সঙ্গে আবু ইব্রাহীমের কথা আর এগোয় নাই; আবু ইব্রাহীম-ই আর কিছু বলে নাই, কারণ যে বুঝতে পারে যে, আর কিছু বলার অর্থ হয় না। কিন্তু আমাদের জন্য এ-দিনের সঙ্গেই এই সব ব্যাপার শেষ হয়ে যায় না, মমতার সঙ্গে আবু ইব্রাহীমের ঠোকাঠুকি লাগতে থাকে এবং তার কিছু অংশ আমাদের সম্মুখে যখন প্রকাশিত হয়ে পড়বে, আমরা তা শুনব। কারণ আমরা একটি লোক, আবু ইব্রাহীমকে জানতে চাইব। আবু ইব্রাহীমকে কেন আমাদের জানা প্রয়োজন, তা আমরা জানি না, হয়তো বা তাকে জানার কোনো প্রয়োজন নেই, হয়তোবা আছে। তবু তার কথা আমরা জানব এবং শুনব, হয়তোবা শুধুমাত্র এই কারণে যে, আমরা একটি কথা সাহিত্যের গ্রন্থ পাঠ করতে চাই এবং তা করলে আমাদেরকে এই গ্রন্থের চরিত্র অথবা চরিত্র সমূহকে জানতে হবে যদিও আমরা জানি যে, পাঠ এবং অনুধাবন কখনো কখনো কষ্টসাধ্য বটে। অর্থ বিভাগে আবু ইব্রাহীমের চাকরির মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেলে তাকে বাণিজ্য বিভাগে বদলি করা হয়, এখানে তাকে প্রথমে প্রশাসন শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই শাখায় কাজের চাপ বেশি থাকায় আবু ইব্রাহীমের ঘরে ফিরতে দেরি হতে থাকে, এতে করে মমতার বিরক্তি বাড়ে এবং আমরা ক্রমাগতভাবে তাদের আলাপচারিতা বচসায় নিপতিত হতে দেখি। একদিন কাজলি পচা মাছ কিনে আনলে মমতা সেগুলো ফেলে দিয়ে ডাল আর পটলভাজি রেধে রাখে, বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সেগুলো খেয়ে আবু ইব্রাহীম যখন বলে, ভালোই খেলাম; তখন সে কথায় মমতা ক্ষেপে যায়।

ভালোই খাইলা!

খারাপ কি!

আবু ইব্রাহীমের মুখের দিকে তাকিয়ে মমতা ভ্রু কুঁচকে রাখে, সে অনেক কথা বলে, তারপরেও মনে হয় যেন তার অনেক কথা বলার থেকে যায়। কাজলি করতে পারে না, আবু ইব্রাহীমের বাজার করা উচিত শুভ কদিন থেকে খুস খুস করে কাশে, আবু ইব্রাহীমের তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত বেতের চেয়ারগুলোর ছাউনি খুলে যাচ্ছে। এখনই কারিগর ডেকে আবু ইব্রাহীমের সেগুলো সরানো উচিত সংসারে কত কাজ, আর আবু ইব্রাহীম সারা বিকেল অফিসে কাটিয়ে এসে পটল ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে বলে যে, সে ভালোই খেলো। এরকম কথা শুনে মমতা যখন তার মুখের দিকে তাকায়, তখন আবু ইব্রাহীম মমতার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে এবং সব অবসাদের ভেতর সে হেসে ওঠে। এ রকম একদিন হেসে ওঠার পর সে মমতাকে বলে, কয়দিন থেইকা দেখতাছি বিন্দু সব সময় সালোয়ার পইরা থাকে; ওর ইজার কি সব ছিড়া গেছে?

ইজার আর পরা লাইগব না।

আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে, সে পত্রিকা পড়া রেখে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর মমতা এসে কাছে দাঁড়ালে সে বলে, বিন্দুকে ওড়না দিবা কবে?

ইয়ার্কি মাইরো না।

আমার কচি মেয়েটাকে তুমি বড় বানায়া ফালাইতাছ! কত বয়স হইছে অর?

মমতা কথা বলে না; বিন্দুর বয়স হিসেব করার সময় আবু ইব্রাহীমের পিঠে শিরদঁাড়ার কাছে চিনচিন করে ব্যাথা করে।

আমার পিঠে কয়দিন থেইকা ব্যথা হইছে।

ক্যান?

আমার অফিসের চেয়ারটা খুব বাজে; ঠিক মতো বসা যায় না।

তখন মমতা আবু ইব্রাহীমের গা ঘেঁষে আসে, কাঁধের কাছে একবার আলতোভাবে থুতনি ছোঁয়ায় এবং তখন আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, মমতা সর্বদাই একটি মার্জারির মতো; ফুলো ফুলো, ধীরস্থির আর কুঁড়ে; গায়ে গায়ে, পায়ে পায়ে আদর নিয়ে চলে।

শুভটা খালি ঘুমায়। একদম তোমার মতো ফুলাফুলা, ভোটকা।

সারাদিন যে লাফালাফি করে, না ঘুমায়া কি কইরব।

আবু ইব্রাহীম হাসে।

তুমি কি পিঠে ওষুধ দিবা?

না, কিছু দরকার নাই।

মমতা আবু ইব্রাহীমের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, এইখানে ব্যথা?

তোমার হইছে কি?

কি?

চান্স পায়াই গায়ে হাত দিতাছ?

মমতা হাত গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ায়, আবু ইব্রাহীম হেসে উঠে।

হাসো ক্যান?

আবু ইব্রাহীম তখন মমতাকে সেইসব জটিল বোধের কথা জটিলতর ভাষায় বলে, যার অর্থ মমতা বোঝে না। আবু ইব্রাহীমের কথা শেষ হলে, মমতা বুকের ওপর দুহাত বেঁধে ঘনায়মান সন্ধ্যার ভেতর দিয়ে কোনো এক অনন্তের দিকে গম্ভীর হয়ে তাকায়। আবু ইব্রাহীম বলে, রাস্তা দিয়া হাইটপার যাইবা?

রাস্তা দিয়া হাঁটি না আমি।

তখন বিন্দু আর শুভ এলে, আবু ইব্রাহীম বিন্দুকে বলে, বেড়াইতে যাবি?

কোনে?

এই, রাস্তায়।

বিন্দু এবং শুভ আবু ইব্রাহীমকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিল্কার করে। মমতা রাজি হয় না, বলে, না, বেড়াই না আমি।

চলো রাগ কইরো না।

কাজলিকে ঘরে রেখে তারা বের হয়, কলোনির লোকেরা তাদের হেঁটে যেতে দেখে। শুভ আর বিন্দু আবু ইব্রাহীমের দুহাত ধরে নৌকার গুণ টানার মতো করে টেনে নিয়ে যায়, মমতা কাঁধের উপর দিয়ে আঁচল ছেড়ে দিয়ে বুকের ওপর দুহাত বেঁধে একটু দূর দিয়ে হাটে; তার গোল মুখটা পরিতুষ্ঠ দেখায়। আবু ইব্রাহীমের ভালোলাগে, তার পিঠের ব্যথার কথা সে ভুলে যায়। ওরা কাকরাইল মসজিদের সামনে গিয়ে রমনা পার্কের ভেতর ঢোকে এবং একটি ছোট বকুল গাছের নিচে বেঞ্চের উপর বসে। বিন্দু আর শুভ মাঠের ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়ায় এবং দৌড়াতে গিয়ে শুভ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তখন বিন্দু হাত তালি দিয়ে হেসে কুটিকুটি হয়। শুভ মমতার কাছে ফিরে আসে বলে, বিন্দু আমাক ফালায়া দিছে।

বিন্দু ফালায় নাই, তুমি নিজেই পইড়া গেছ।

হে, বিন্দু ফালায় দিছে।

মমতা শুভর গায়ে লেগে যাওয়া খড়কুটো ঝেড়ে ফেলে; আবু ইব্রাহীম আইসক্রিমওয়ালাকে ডেকে আইসক্রিম কেনে; তাদের বড় আনন্দ হয়।

তুমি খাইবা নাকি একটা?

মমতা হাসে।

খাও না আম্মু একটা!

যা মেয়ে তুই খা!

তা হইলে আমারটা থেইকা এক কামুড় খাও!

বিন্দু ওর আইসক্রিমটি মমতার মুখের দিকে এগিয়ে দেয়, তাতে মমতা কপট রাগ করে, বলে, কি মেয়েরে বাবা।

আব্বু তুমি নিবা এক কামুড়?

দিবি?

আবু ইব্রাহীম বিন্দুর আইসক্রিমটির মাথার দিক থেকে কামড় দিয়ে খানিকটা বরফ খসিয়ে নিয়ে বলে, ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ! বিন্দু তার বড় বড় দাঁত বের করে হাসে, তখন আবু ইব্রাহীম শুভকে বলে, তুইও দিবি নাকি এক কামুড়? শুভ মমতার কোলের কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে, তারপর তার আইসক্রিমটি আবু ইব্রাহীমের দিকে এগিয়ে ধরে। আবু ইব্রাহীম নেয় না, তখন শুভ হাত নামিয়ে আবার খেতে থাকে।

এইটা এক নম্বরের রাক্ষস, বিন্দু বলে।

শুভ এক বিপন্ন দৃষ্টিতে বিন্দুর দিকে তাকায়।

হি, আব্বুই তা খাইলো না!

হু, খাইলো না রাক্ষস!

শুভ চটে গেল, দেখতে আম্মু!

ওরা তখন উঠে পড়ে এবং পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়; ওদের চমৎকার লাগতে থাকে। ওরা যখন একটি গাঁদা ফুল গাছের বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, শুভ একটি ফুল ছিঁড়ে দেওয়ার জন্য বায়না ধরে। আবু ইব্রাহীম দেখে যে, গাছগুলোর খুব দরিদ্র দশা, সবগুলো ফুল লোকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। সে খুঁজে পেতে ছোট্ট একটি ফুল ছিঁড়ে শুভকে দেয়, শুভ ফুলটি শুকে জামার বুক পকেটে রাখে এবং তারপর তারা আবার এগোয়। তখন একটি লোক এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়, তার পরনে লুঙ্গির ওপর খাকি রঙের শার্ট। ফুল ছিড়লেন কেন? সে বলে। আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে যে, এই লোকটি ধারে কাছেই ছিল; সে বলে, একটা বাজে ফুল; ছেলেটা চাচ্ছিল।

চাইলেই ছিড়বেন? ফুল ছেঁড়া নিষেধ জানেন না!

আবু ইব্রাহীম স্ত্রী এবং পুত্র কন্যার সঙ্গে ম্লান মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এখন কি করতে বলেন?

মেজাজ দেখান ক্যান?

মেজাজ কোথায় দেখাইলাম?

ফুল ছেঁড়েন, আবার মেজাজ দেখান!

আবু ইব্রাহীম তখন আর তার মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। দেখ মিয়া, কথা বাড়ায়ো না; তোমার ফুল আমি ছিড়ছি, এখন তুমি কি করবা, কও!

ফুল ছেঁড়া নিষেধ, লেখা দেখেন না?

আবু ইব্রাহীম পুনরায় লোকটিকে ভালো করে দেখে; মধ্যবয়স্ক, বিধ্বস্ত চেহারার হাল্কা পাতলা একটি লোক আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে না, লোকটি কি অসাধারণ সৎ নাকি অসাধারণ বদমাস; তখন খাকি শার্ট পরা আর একজন মালি এসে হাজির হয় এবং সবশুনে সে ব্যাপারটি মীমাংসা করে দেয়। আবু ইব্রাহীম ক্ষুব্ধভাবে বলে, সারা পার্কে দশটার বেশি ফুল নাই, আর এই একটা ফুলের জন্য সব শেষ হয়া গেল।

ওরা পুনরায় চলতে শুরু করে, তখন মমতা এগিয়ে এসে শুভর পকেট থেকে ফুলটি বের করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, বলে, ঘোড়ার আন্ডার ফুল, ফালা! রিকশায় করে ফেরার সময় আবু ইব্রাহীম দেখে, মমতার মুখ কালো হয়ে আছে; সে বলে, কি?

সকলেই ফুল ছিড়তাছে; একটা ফুল নাই, অথচ একটা ছোট্ট ফুলের জন্য কি ব্যবহার করল!

আবু ইব্রাহীম রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, এইটা কোনো যুক্তি না, তবু আর একটা কথা কইলে লোকটাক আমি ঘুষি লাগাইতাম।

এই সময় হেলেন একদিন আবু ইব্রাহীমকে তার অফিসে ফোন করে।

আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো চলেই গেছ।

যাওয়ার সময় প্রায় এসেই গেল। একদম ভালো লাগছে না!

সবাই তো বিদেশ যেতে চায়।

তা চায়, যাওয়ার পর কাঁদে।

হেলেন তখন তাকে বলে যে, পরের শুক্রবার তারা চন্দ্রায় ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে যাবে এবং সে আবু ইব্রাহীমকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে।

যাবে?

ভেবে দেখতে হবে।

ভেবে দেখার কিছু নাই; সকল নটার ভেতর তোমাদেরকে আমরা পিক করব।

আমাদেরকে?

তুমি, তোমার স্ত্রী এবং অবশ্যই বিন্দু।

আমার একটি পুত্রও আছে, শুভ।

হ্যাঁ, শুভও; সরি।

এত লোক নিয়ে নড়বে কি করে?

কোনো সমস্যা হবে না, একটা অনেক বড় মাইক্রোবাস নেব আমরা।

বনে গিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে কি?

হতে পারে।

আমি কি কন্ট্রিবিউট করতে পারি?

না।

ঠিক আছে, মমতাকে বলে দেখি।

বলো; কিন্তু তোমাদের যেতেই হবে।

মমতা শুনে মুখ কালো করে রাখে, বলে, যতসব ঝামেলা। আবু ইব্রাহীম যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করে, মমতার কথার প্রতিবাদ করে না, আবার মমতার এই অনিচ্ছাকে প্রশ্রয় দেওয়া থেকেও নিজেকে বিরত রাখে; এভাবে পরবর্তী শুক্রবার এসে পড়ে। কিন্তু সেদিন সকালে উঠে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে দেখে এমনকি মমতারও মন খারাপ হয়ে যায়। তারপর নটার দিকে অসময়ের এই বৃষ্টি থেমে যায় এবং দশটার দিকে হেলেনদের মাইক্রোবাস এগারো নম্বর বিল্ডিং এর সামনের চত্বরে এসে দাঁড়ায়। তারপর তারা যখন মিন্টো রোড ধরে শেরাটন হোটেল পার হয়ে ছোটে, তখন তারা আকাশে ঝকঝকে রোদ দেখতে পায়।

চন্দ্রা জাতীয় উদ্যানে একটি গজারি ঝোপের পাশে গাড়ি দাড় করিয়ে তারা একটি ঘাসে ছাওয়া চত্বরের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। আবু ইব্রাহীম গুণে দেখে ড্রাইভারসহ মোট চৌদ্দ জন; এর ভেতর ছিল হেলেনের স্বামী, তার দু বন্ধু এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা। সে পরিষ্কার একটি জায়গায় গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর গিয়ে বসে, তার পেছনে অন্যরা আসে। তখন এই দলটির পুরুষরা গল্প শুরু করে এবং মহিলারা কোলের কাছে শিশুদের নিয়ে চুপ করে বসে শোনে। তারা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো এবং সে সব দেশে বাঙালির জীবন নিয়ে কথা বলে, দেশ এবং বিদেশের বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা করে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বিদেশে গেলে পরেই কেবল দেশের মর্ম বোঝা যায় এবং চেতনায় স্বদেশপ্রেম আবিষ্কৃত হয়। তারপর তারা স্বদেশের রাজনীতির প্রসঙ্গে আসে এবং শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সিআইএ-এর ভূমিকার বিষয়ে আলোচনা করে। তারা বলে যে, হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিল, দুজন লোককে সে অপছন্দ করে। এদের একজন ছিল, সালভাদর আলেন্দে এবং অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান এবং এদের দুজনকেই নিজ দেশের সেনাবাহিনী হত্যা করে। তারা মরিস লিফশুলজের অসমাপ্ত বিপ্লব নামে ইংরেজিতে লেখা একটি বই-এর কথা উদ্ধৃত করে বলে যে, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানত যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে। তারা যখন লিফশুলজের বইটি নিয়ে কথা বলতে থাকে তখন তারা খেয়াল করে না যে, তাদের স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা তাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য এক আড্ডা গড়ে তুলছে। এক সময় আবু ইব্রাহীম অলসভাবে দূরে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকায়, তার মনে হয় যেন চারটি প্রজাপতি সবুজ ঘাসের উপর আস্তে আস্তে নড়ে। হেলেনের স্বামীর বন্ধুদের একজনের স্ত্রী ছিল অসাধারণ সুন্দরী; কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা হাসে, আবু ইব্রাহীম দূর থেকে তা দেখে মুগ্ধ হয়। সে দেখে, মমতা বুকের ওপর দুহাত বেঁধে কি যেন বলার চেষ্টা করে। ঘিয়ে রঙের ওপর সবুজ প্রিন্টের সিল্কের শাড়িপরা মমতাকে বস্তুত একটি মোটাসোটা মথের কথা মনে হয়। আর কি সাজ্জাই সেদিন করেছিল হেলেন যে, তার দিকে তাকালে আবু ইব্রাহীমের চোখ পুড়ে যায়, হাতা কাটা লাল ব্লাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা হাতে ওঠা নামা বিদ্যুৎ রেখার মতো তার চোখের তারায় ঝলকায়। তখন হেলেনের স্বামী সঙ্গীতের জন্ম সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করে এবং এ সময় দলের মহিলারা পুনরায় পুরুষদের নিকট ফিরে আসে, তাদের পাঁচটি বাচ্চা একটু দূরে গোল্লাছুট খেলতে থাকে। এভাবে তারা সকলে ক্রমান্বয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, এক সময় তাদের কথা বলা থেমে যায় এবং তারা একেকজন নীরবে একেক দিকে তাকায়, তারপর আবার মেয়েরা উঠে গিয়ে দূরে দাঁড়ায়। আবু ইব্রাহীম দেখে, গজারি গাছের একটি পাতা খসে গিয়ে হেলেনের মাথার উপর নেমে আসতে থাকে, এই স্খলিত হলুদ পাতাটি লুফে নেওয়ার জন্য হাত উঠালে শাড়ির নিচ থেকে ব্লাউজ ঢাকা হেলেনের স্তন, এক জ্যোতির্ময় গোলকের মতো আবু ইব্রাহীমের চোখের সামনে প্রকাশিত হয় এবং হেলেন তখন বুঝতে পারে যে, আবু ইব্রাহীম তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আবু ইব্রাহীমের কাছে এগিয়ে এসে বলে, চলো একটু হেঁটে আসি, যাবে?

এই বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না, এদিনের ঘটনার জন্য আবু ইব্রাহীমের কোনো মানসিক পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, সে কোনো কিছুই কামনা করে নাই; ভুল সময়ে যেন এক ঐশ্বর্য তার জীবনে প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীতে পুনরায় বিলীন হয় স্বপ্নের মতো এবং এ সকল ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আবু ইব্রাহীম তার জীবদ্দশায় দাঁড় করাতে পারে না। হেলেন হেঁটে আসার কথা বললে আবু ইব্রাহীম সম্মত হয় এবং তারা সকলের সামনে, রোদ আর ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়। প্রথমে তারা ক্রমাগত হাঁটতে থাকে, অনেকগুলো ফাঁকা জায়গা এবং অনেকগুলো গজারির ঝোপ তারা পার হয়ে আসে এবং তখন তারা দেখে যে, তারা নীরব হয়ে আছে। এভাবে এই নীরবতার ভেতর দিয়ে তারা অগ্রসর হয়, আবু ইব্রাহীমের দৃষ্টি সামনের গাছ এবং আকাশের দিকে প্রসারিত থাকে, হেলেনের চোখ থাকে পথের লাল ধুলোর ওপর। পায়ে হাঁটা পথ ছেড়ে টিলার ভেতর চলে যায় তারা, তারপর এক জায়গায় বসে। হেলেন মাটির দিকে চোখ রেখে ঘাড় কাত করে মুখ টিপে হাসে এবং হেলেন কেন হাসে, তা আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে না। সে সামনের দিকে পা ছড়িয়ে হাত দুটো পেছনে মাটিতে রেখে আকাশের দিকে চোখ কুঁচকে চেয়ে থাকে এবং সে আকাশের শূন্যতায় কি খোজে হেলেন তা বুঝতে পারে না। হেলেন দুহাত নিজের হাঁটু বেষ্টন করে রাখে, তার বাঁ পায়ের পাতা আবু ইব্রাহীমের ছড়ানো হাঁটুর কাছে প্যান্ট স্পর্শ করে পড়ে থাকে। হেলেন আঁচল দিয়ে দেহ ঘিরে রাখে, তার কানের লাল-রক্তমুখী চুনি গন্ধম ফলের মতো আবু ইব্রাহীমের মুখের এত কাছে থিরথির করে দোলে। এভাবে তারা বসে থাকে, তারপর তারা একজন আরেকজনের স্পর্শ সীমার ভেতর, উঠে দাঁড়ায়। তখন আবু ইব্রাহীম শোনে হেলেন ফিসফিস করে বলে, আমার ভালো লাগে না ইব্রাহীম এবং তখন আবু ইব্রাহীম নিচু স্বরে বলে, চলো হাঁটি।

আবু ইব্রাহীম এবং হেলেন যখন পুনরায় গজারির ছায়ায় অন্যান্যদের কাছে ফিরে আসে তখন তারা দেখে যে, ঘড়িতে দুটো বেজে গেছে, হেলেন বলে, হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গিয়েছিলাম।

সে দিন চন্দ্রা থেকে ফিরে হেলেনের কি অবস্থা হয়, তা আবু ইব্রাহীম তৎক্ষণাৎ জানতে পারে না। তবে তার নিজের পরিবারে ঝড় বয়ে যায়। সেদিন রাতে মমতা দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমায় এবং সকালে উঠে আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে একটিও কথা বলে না; আবু ইব্রাহীম নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে যায়। তারপর বেলা দশটার দিকে সিদ্দিক হোসেন তাকে ফোন করে।

রুমে আছ?

আমি আসছি।

সিদ্দিক হোসেন পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসে। আবু ইব্রাহীম বলে, চা খাও।

না, চলো হাউজিং ডিপার্টমেন্টে যাই, রূপনগরের প্লটের জন্য অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম নিয়ে আসি।

টাকা কোথায় জমি কেনার?

আবু ইব্রাহীমের এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের জন্য কালক্ষেপণ না করে তারা দুজন বাসস্থান পরিদপ্তরে গিয়ে দশ টাকা দিয়ে দুটো আবেদন পত্রের ফর্ম এবং প্রসপেক্টাস নিয়ে আসে। আবু ইব্রাহীমের অফিসে বসে তারা প্রসপেক্টাস পরীক্ষা করে দেখে, আড়াই কাঠা জমির প্লটের দাম চল্লিশ হাজার টাকা, আবেদনপত্রের সঙ্গে অগ্রিম দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা; পাঁচ কাঠার প্লটের দাম ষাট হাজার টাকা, অগ্রিম দিতে হবে দশ হাজার টাকা তখনো আবু ইব্রাহীম জানত যে, সে জমি কিনবে না, তবু সে সিদ্দিক হোসেনকে বলে, আমার আড়াই কাঠা হলেই চলবে। সিদ্দিক হোসেনও বলে যে, সেও আড়াই কাঠার প্লট নেবে, তারপর সে চলে যায়। তখন আবু ইব্রাহীমকে তার বিভাগের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন অফিসার টেলিফোনে ডেকে নিয়ে জানায় যে, তাকে অন্য নূতন একটি সেকশনে বদলির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আবু ইব্রাহীম আপত্তি করে, কিন্তু সে বুঝতে পারে যে, এতে কাজ হবে না; বাসায় ফেরার পথে সে সিদ্দিক হোসেনকে বলে, এই নতুন সেকশনে এত ঝামেলা, একদম মারা পইড়া যাব।

কি রকম ঝামেলা?

রাজ্যের ঝামেলা, সব লোকজন আইসা গ্যাঞ্জাম করে!

বিউটিফুল, সিদ্দিক হোসেন শিস দেয়, মানুষকে ভালোবাসতে শেখো!

তাই?

ইয়েস। জীবন হচ্ছে ভালোবাসা দেওয়া এবং নেওয়া।

এই সময় তাদের গাড়ি কলোনিতে পৌঁছে এবং নিজের বাসার সিড়ি বেয়ে ওঠার পর তার মনে হয় যে, সে ইঁদুরের মতো একটি খাঁচার ভেতর আটকা পড়ে গেছে; কারণ খেতে বসলে মমতা এসে সঙ্গে বসে না এবং সে আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আবু ইব্রাহীম এ প্রসঙ্গে কথা বললে সে বলে যে, আবু ইব্রাহীমের চরিত্রের পুরুষের সঙ্গে বসে সে ভাত খায় না এবং সে সিরাজগঞ্জ চলে যাবে। এক ধরনের অসহায়ত্বের ফলে আবু ইব্রাহীমের ক্রোধ হয়, তাতে প্রসঙ্গটি অমীমাংসিত থেকে যায় এবং পরদিন সে অফিস থেকে ফিরে দেখে যে, মমতা শুভ আর বিন্দুকে নিয়ে চলে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *