০১-৫. সন্ধের আগে

এক নায়িকার উপাখ্যান – উপন্যাস – চিত্তরঞ্জন মাইতি

সন্ধের আগে আগে আজ বাড়ি ফিরে এল রণিতা। তার বয়স সবে সাতাশ পেরিয়েছে। ইস্পাতের ফলার মতো মেদশূন্য, ঝকঝকে চেহারা। ধারাল, লম্বাটে মুখ। চিবুকের দৃঢ়তা, বড় বড় চোখের গভীর, উজ্জ্বল দৃষ্টি এবং কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা উড়ন্ত বাদামি চুল তার মধ্যে এনে দিয়েছে দারুণ এক ব্যক্তিত্ব। তাকে বাঙালি তো নয়ই, কেমন যেন অভারতীয় মনে হয়। পুরনো উপমা দিয়ে বলা যায়, রণিতার গায়ের রং একদা ছিল স্বর্ণাভ আশ্বিনের রৌদ্রঝলকের মতো। কিন্তু রোদে পুড়ে, জলে ভিজে চামড়া ট্যান হয়ে গেছে। তার যা কাজ তাতে ভারতীয় ঋতুগুলির তীব্র উত্তাপ বা শীতলতা থেকে নিজেকে বাঁচানো অসম্ভব। দার্জিলিং-এর চা-বাগানে, আসামের জঙ্গলে, মধ্যপ্রদেশ কি ওড়িশার আদিবাসী গ্রামে ব্যস্ত ভূপর্যটকের মতো তাকে আকছার ছুটে বেড়াতে হয়। তার কাজটাই অনেকের থেকে আলাদা কিন্তু সে কথা পরে।

রণিতার পরনে এই মুহূর্তে ফেডেড জিনস আর শার্ট, পায়ে পুরু সোলেব লেডিজ শ্যু, বাঁ হাতে চওড়া স্টিল ব্যাণ্ডে ওভাল শেপের ঘড়ি, গলায় লম্বা সৰু সোনার চেইন যার লকেট হল একটা বড় সাইজের ক্রস। রণিতা নিষ্ঠাবান হিন্দু মা-বাবার সন্তান, নিজেকে সে অবশ্য বলে নন-প্র্যাকটিসিং হিন্দু। ক্রসটা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার উত্তর–এক মহামানবের জীবনদানের প্রতীক ওটা। ক্রসটা নাকি তাকে কখনও ভেঙে পড়তে দেয় না, সারাক্ষণ অফুরান সাহস জুগিয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপার। এছাড়া কাঁধ থেকে একটা ঢাউস চামড়ার ব্যাগ ঝুলছে। ওটার ভেতরে কী নেই? ক্যামেরা, বিরাট সাইজের ডায়েরি, পেন, পেন্সিল থেকে শুরু করে নানা বই এবং ম্যাগাজিন থেকে টুকে আনা গোছ গোছ নোটস, নিজের লেখা দু-একটা ফিল্ম স্ক্রিপ্ট, ইত্যাদি।

রণিতাদের বাড়িটা ও বালিগঞ্জের এক নিরিবিলি পাড়ায়। নাম অন্তরা। পঞ্চাশ বছর আগে এটা তৈরি করিয়েছিলেন তার ঠাকুরদা, নামকরণও তাঁরই। রণিতাদের পদবি মিত্র। সেই হিসেবে মিত্র নিবাস, মিত্র ভিলা বা মিত্র লজ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। শান্তিনীড় কি সন্ধ্যাদীপও হতে পারত।

তার জায়গায় কিনা অন্তরা। নামটার ভেতর গানের সুরেলা ঝংকার রয়েছে। ঠাকুরদা কবেই মারা গেছেন, রণিতার জন্মেরও বেশ কয়েক বছর আগে, তবু এমন একটা চমৎকার নামের জন্য সে এখনও ভদ্রলোককে দশবার কুর্নিশ করে।

ফুটপাথের গা ঘেঁষে লোহার ভারি গেট। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসে রণিতা।

গেটের পর থেকেই মাঝারি মাপের ছিমছাম বাগান। সেখানে সবুজ ঘাসের কার্পেট, বট আর অশ্বথের বনসাই, ছাতার আকারের সারি সারি ঝাউ এবং সিলভার পাইনের লাইন। আর আছে নানা চেহারার মরশুমি ফুলের গাছ। প্রতিটি গাছের সতেজ পাতায় বা ফুলে রয়েছে যত্ন, পরিশ্রম ও মমতার ছাপ। এমন একখানা চমৎকার বাগান নিজের থেকে তৈরি হয়নি, ঢালতে হয়েছে প্রচুর টাকা।

বাগানটাকে দুভাগ করে মাঝখান দিয়ে মুড়ির পথ চলে গেছে। রণিতা নুড়ির ওপর পা ফেলে ফেলে চলে আসে গাড়ি-বারান্দায়। তারপর চওড়া চওড়া দশটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সেগুন কাঠের কারুকাজ-করা প্রকাণ্ড দরজা। তার গায়ে কলিং বেলের সুইচ। রণিতা সেটায় আঙুলের চাপ দিতেই ভেতর থেকে পিয়ানোর টুং টাং আওয়াজ ভেসে আসে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়ায় অনাথ।

নিরেট চেহারার মাঝবয়সী এই কাজের লোকটি তিরিশ বছর এ বাড়িতে আছে। পরনে খাটো ধুতি আর মোটা লং ক্লথের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। এই পোশাকেই তাকে আজন্ম দেখে আসছে রণিতা।

অনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলে, ছোটদিদি, তুমি! অ্যাত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে। তার আদি বাড়ি লীকান্তপুর লাইনের কোনো একটা গ্রামে। তিরিশটা বছর বালিগঞ্জের মতো জায়গায় কেটে গেল, তবু তার জিভ থেকে এখনও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আঞ্চলিক টানটা মুছে যায়নি।

অনাথের বিস্ময়ের কারণ আছে। কেননা রণিতা রাতে সাড়ে আটটা নটার আগে ফেরে না। কোনো কোনো দিন আরো দেরি হয়ে যায়। আজ সে গিয়েছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী মারিয়াদের সম্বন্ধে বেশ কটা বই পড়ে অনেক নোট নিয়েছে। সেখান থেকে তার যাবার কথা ছিল শিশির মঞ্চে। নিউ ফিল্ম ক্লাব সন্ধ্যায় ফেদেরিকো ফেলিনির লা স্ট্রাডা ছবিটা ওখানে দেখাবার ব্যবস্থা করেছে। রণিতা ওই ক্লাবের মেম্বার। কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাজটা শেষ হবার পর কেন যেন শিশির মঞ্চে যেতে ইচ্ছা হল না। হয়তো ভেতরে ভেতরে ক্লান্তি জমে ছিল, সোজা সে বাড়ি চলে আসে। এ সপ্তাহেই ছবিটার আরেকটা শো হবে, তখন দেখে নেওয়া যাবে।

এমনি চলে এলাম– ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে অনাথের পাশ দিয়ে ভেতরে চলে আসে রণিতা।

দরজার পর থেকেই বেশ চওড়া একটা প্যাসেজ। তার দুধারে ড্রইং রুম, ডাইনিং হল, কিচেন, স্টোর এবং কাজের লোকদের থাকার ঘর।

নাম বাদ দিলে এই দোতলা বাড়িটার সমস্ত কিছুতেই প্রাচীন কালের ছাপ। গাড়ি-বারান্দার সিঁড়ি থেকে শুরু করে সবগুলো ঘরের মেঝেই শ্বেত পাথরে মোড়া। দরজাগুলো পুরু এবং ভারি ভারি। জানালায় খড়খড়ি ছাড়াও রঙিন কাঁচের শার্সি। সিলিংয়ে এবং দেওয়ালে পঙ্খের নিখুঁত নকশা। মেহগনি কাঠের জমকালো ক্যাবিনেট, ল্যাম্প শেড, চার ব্লেডের ফ্যান-সব যেন পঞ্চাশ বছর আগের সময়টাকে গভীর আবেগে ধরে রেখেছে।

রণিতার বন্ধুরা যখনই আসে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলে, দারুণ! তোদের বাড়িতে এলে অ্যারিস্টোক্র্যাসি ব্যাপারটা ফিল করা যায়। তারা কতটা অভিজাত, রণিতা কোনো দিন ভেবে দেখেনি। তবে শতাব্দী যখন শেষ হয়ে আসছে, চারপাশের বনেদি বাড়িগুলো ভেঙে তোলা হচ্ছে বাক্স প্যাটার্নের বিশাল বিশাল হাই-রাইজ, কলকাতা মেট্রোপলিসের মানুষ আটশ কি হাজার স্কোয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টে নিজেদের বন্দি করে ফেলছে ক্রমাগত, তখন পঞ্চাশ বছর আগের খোলামেলা পুরনো গন্ধওলা আবহাওয়ায় থাকতে ভালই লাগে রণিতার।

চারপাশে আলো জুলছিল। প্যাসেজ ধরে কপা এগুলেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। তার দুধারে পেতলের চকচকে পাত-বসানো কাঠের রেলিং।

সিঁড়িতে সবে পা রেখেছে রণিতা, অনাথ দরজা বন্ধ করে প্রায় দৌড়েই কাছে চলে আসে। একটু অবাক হয়ে রণিতা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?

ব্যস্তভাবে অনাথ বলে, হ্যাঁ। কে একজন দিল্লি না বোম্বাই থিকে তোমারে দুবার ফোন করেছিল। খুব নাকিন জরুরি।

রোজ অনেক ফোন আসে রণিতার কিন্তু দিল্লি বা বম্বে থেকে কে করতে পারে? ওই দুই শহরে তার বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে, তাদেরই কি কেউ? দুবার যখন করেছে, নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আর্জেন্ট। সে জিজ্ঞেস করে, কে ফোন করেছে, জানো?

অনাথ বলে, আমিই ফোনটা ধরেছিলাম গ ছোটদিদি। ইংরিজি আর হিন্দি মিন্দিতে কী কইতে লাগল। বুজতে না পেরে মাকে দিলাম। মা সব জানেন। রণিতার মাকে সে মা বলে।

ঠিক আছে।

একসঙ্গে দুটো করে স্টেপ পেরিয়ে পেরিয়ে পলকে দোতলায় উঠে আসে রণিত। এখানে প্রকাণ্ড একটা হল-কে ঘিরে পাঁচটা বেডরুম, প্রতিটি ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। বেড-রুমগুলোর একটা রণিতার, একটা তার মা-বাবার, একটা দাদার, একটায় বাবার লাইব্রেরি, বাকিটা খালি পড়ে থাকে। দিদি-জামাইবাবু বা অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে ওখানে থাকে।

হল-ঘরের তিন কোণে তিন সেট সোফা আর সেন্টার টেবল। একসঙ্গে রণিতা, তার দাদা বা বাবার কাছে ভিজিটররা এলে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেই জন্য এই ব্যবস্থা। অবশ্য একতলায় একটা ড্রইং রুম আছে, কিন্তু সেটা বন্ধই থাকে। কেউ এলে পারতপক্ষে রণিতারা নিচে নামতে চায় না, অগত্যা ভিজিটরদের সঙ্গে করে অনাথ ওপরে নিয়ে আসে।

হল-এর মাঝখানে রঙিন টিভি, পিয়ানো, ভি সি আর, টেলিফোন এবং অজস্র ক্যাসেট নানা সুদৃশ্য ক্যাবিনেটে চমৎকার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চার দেওয়ালে ল্যাম্পশেডের ভেতর আলো জ্বলছে এখন, সিলিং থেকে বিরাট একটা ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, তার আলো অবশ্য জ্বালানো হয়নি।

বাড়িটা এখন প্রায় ফাঁকাই। রণিতার দাদা পূর্ণেন্দু অয়েল ইণ্ডিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, মাস দুই হল কলকাতা থেকে তাকে বরোদায় বদলি করা হয়েছে, বৌদি বন্দনাও তার সঙ্গে গেছে। বাবা অর্থাৎ ইন্দ্রনাথ ইউনিভার্সিটি থেকে রিটায়ারমেন্টের পর দুপুরের পর বেশির ভাগ দিনই বাড়িতে থাকেন না; মিটিং সেমিনার, এসব নিয়েই আছেন। আজও তিনি যথারীতি বাড়ি নেই।

রণিতা লক্ষ করল, দক্ষিণ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা গদি-মোড়া ইজিচেয়ারে আধশোয়া ভঙ্গিতে খুব মগ্ন হয়ে বই পড়ছেন সুধাময়ী। তাঁর বয়স যাটের কাছাকাছি। এমন তুলতুলে, নরম মানুষ চিৎ চোখে পড়ে। এখনও প্রচুর ঘন চুল তাঁর, সময় অবশ্য অদৃশ্য ব্রাশ টেনে তার রং অনেকটাই বদলে দিয়েছে। কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য রুপোর তার। এই বয়সেও সুধাময়ীর মুখখানায় অপার্থিব সারল্য মাখান, নিষ্পাপ কিশোরীর মুখে যেমনটি থাকে। পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ি, গরদেরই ব্লাউজ। কপালে মস্ত সিঁদুরের ফোঁটা। সব মিলিয়ে তাঁকে ঘিরে যেন আশ্চর্য এক দেবমহিমা।

রণিতা জানেসুধাময়ী কী বই পড়ছেন। রাজশেখর বসু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মূল মহাভারতের ডালপালা হেঁটে একটা তরতরে চেহারা দিয়েছেন, ইদানীং মনের দিক থেকে সেটাই তাঁর স্টেপল ফুড। এছাড়া মাঝে মাঝে রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড়মঠ বা দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া তো আছেই। আজকাল এই নিয়েই তাঁর নিজস্ব জগৎ।

ইজিচেয়ারের ডান পাশের মেঝেতে বসে কুচি সুপুরি, লবঙ্গ, এলাচ, চুন, খয়ের আর দু-এক টুকরো সুগন্ধি জর্দা দিয়ে ছোট ছোট পানের খিলি তৈরি করছে মুক্তা। সুধাময়ীর খুব পান-জর্দার নেশা, দিনে কম করে তিরিশ চল্লিশ খিলি পান খান। তার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে হয় মুক্তাকে। তার বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ. মোটামুটি সুশ্রী, বাপ-মা নেই। অল্প বয়সে বিধবা হবার পর ভাইরা দায়িত্ব নিতে চায়নি, নানা জায়গায় ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত এ বাড়িতে এসে ঠেকেছে। বছর তেরো এখানে আছে, তাকে রণিতাদের বাড়ির একজন পার্মানেন্ট মেম্বারই বলা যায়।

সুধাময়ী তো ছেলেমেয়ে বা স্বামীকে বিশেষ কাছে পান না, যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একমাত্র মুক্তাই তাঁকে সঙ্গ দেয়। সে তাঁর সর্বক্ষণের সহচরী এবং পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট।

কোনাচেভাবে পায়ে পায়ে সুধাময়ীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রণিতা। একটু অস্বস্তি হয় তার, কেননা সাতদিন সুধাময়ীর সঙ্গে তার কথা বন্ধ। শেষ পর্যন্ত ডাকতেই হয়, মা

মহাভারতের পাশ দিয়ে মেয়ের দিকে তাকান সুধাময়ী কিন্তু কিছুই বলেন । রণিতা জিজ্ঞেস করে, আমাকে কে ফোন করেছিল?

আঙুল বাড়িয়ে টেলিফোন স্ট্যান্ডটা দেখিয়ে দেন সুধাময়ী, পরক্ষণে মহাভারতের আড়ালে তাঁর মুখ অদৃশ্য হয়।

ঠিক বুঝতে না পেরে সুধাময়ীকে ফের ডাকতে যাবে রণিতা, হঠাৎ মুক্তা বলে ওঠে, ওখানে যাও ছোটদি, যা জানতে চাইছ ফোনের কাছে সব আছে।

অর্থাৎ এতক্ষণ নিচে বসে রণিতার কথাগুলো শুনেছে মুক্তা। সুধাময়ী তো মুখ ফুটে কিছু বলবেন না, তাঁর হয়ে উত্তরটা ওকেই দিতে হল।

রণিতা কিন্তু তক্ষুণি ফোনের কাছে যায় না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকে দেখতে থাকে। সুধাময়ী তার ওপর অনেকদিন ধরেই অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। তিনি পুরনো ধ্যান-ধারণার মানুষ। রণিতার চালচলন, পোশাক আশাক, কোনোটাই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে সে যে ধরনের কাজকর্ম করে এবং সে জন্য সারা ভারতে টই টই করে ঘুরে বেড়ায়, এতে ঘোর আপত্তি সুধাময়ীর। এ ব্যাপারে স্বামীর ওপরেও তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত। মেয়েদের সম্বন্ধে ইন্দ্রনাথ বড় বেশি লিবারেল, স্ত্রী-স্বাধীনতার তিনি একজন বিরাট পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই আশকারায় তাঁদের এই হোট মেয়েটা একেবারে মাথায় চড়ে বসেছে।

আসলে সাতাশ পেরিয়ে আটাশ বছরে পড়েছে রণিতা। তার বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন সুধাময়ী। কদিন আগে রণিতার ছোট মামা একটা ছেলের খোঁজ এনেছিলেন। পাত্রটি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট এবং এম বি এ, আপাতত একটা

বড় কোম্পানিতে একজিকিউটিভ, কয়েক মাসের ভেতর আমেরিকায় চলে যাবে। সেখানকার এক ফার্ম তাকে বিশাল অফার দিয়েছে। যাবার আগে মা-বাবা ছেলের বিয়ে দিতে চান। রণিতাকে ওঁরা দেখেছেন, পুত্রবধূ হিসেবে তাকে পেতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু রণিতা রাজি হয় নি, হেসে হেসে এমন একটা চমৎকার সম্বন্ধ উড়িয়েই দিয়েছে, জানিয়েছে, কোথাও বাঁধা পড়ার সময় এখনও হয়নি। আগে কেরিয়ার, তারপর অন্য সব। কিন্তু কেউ জানে না, অমিতেশকে সে কথা দিয়ে রেখেছে, সেখান থেকে তার পক্ষে ফেরা আর সম্ভব নয়।

সেই থেকে সুধাময়ী অঘোষিত এক যুদ্ধই শুরু করে দিয়েছেন। রেগে গেলে তিনি চিৎকার টিকার করেন না, শুধু কথা বন্ধ করে দেন, তাতেও কাজ না হলে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খাবেন না। স্রেফ নির্জলা অনশন। এই নীরব অহিংস প্রতিবাদ এক ধরনের প্যাসিভ রেজিস্টান্স, নিজেকে কষ্ট দিয়ে অন্যের নার্ভে এই যে ক্রমাগত চাপ দেওয়া, এটাকে ভীষণ ভয় পায় রণিতা। একবার সে ভাবল মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, রাগ কোরো না মা। তুমি কথা না বললে আমার কত কষ্ট হয়, জানো না? কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করল না সে, কিছুই বলল না, সোজা ফোনের কাছে চলে গেল।

ফোন-স্ট্যান্ডে পেপার ওয়েটের তলায় এক টুকরো কাগজ রয়েছে। ঢাউস ব্যাগটা কাঁধ থেকে মেঝেতে নামিয়ে সেটা তুলতেই কটা লাইন চোখে পড়ল। গোটা গোটা অক্ষরে মা লিখে রেখেছেন রজনী দুবার ফোন করেছিল। সে তাদের বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। তুই ফেরামাত্র ফোন করতে বলেছে। লাইনগুলোর নিচে একটা ফোন নাম্বারও লেখা রয়েছে।

কোন রজনী প্রথমটা ধরতে পারল না রণিতা। বম্বেতে আছে রজনী যোশি আর দিল্লিতে রজনী শর্মা। সুধাময়ী লেখেননি, ফোনটা ঠিক কে করেছিল। তাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে কিনা ভাবতে গিয়ে ফোন নাম্বারটার দিকে আবার নজর গেল। আগে ভাল করে লক্ষ করেনি, এখন দেখা গেল ওটা দিল্লিরই নাম্বার। তার মানে রজনী শর্মা।

কয়েকটা বছর পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে দুই রজনী আর রণিতা একসঙ্গে কাটিয়েছে। ওখানকার কোর্স শেষ করার পর তিনজন এখন তিন শহরে। ওদের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই রণিতার। হঠাৎ দিল্লির রজনী কেন ফোন করল, কে জানে।

রণিতা ডায়াল করে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর রজনীকে ধরে ফেলল। কলকাতার লোকাল লাইন ধরতে জিভ বেরিয়ে যায় কিন্তু লং ডিসটাল লাইনে কোনরকম সমস্যা নেই। নেহাত এনগেজড না থাকলে দু-একবার ডায়াল করলেই পাওয়া যায়।

রণিতা বলে, হ্যালো রাজু, আমি রণি– রজনীর ডাক নাম রাজু।

রজনী বলে, হাই রণি, দুদুবার তোকে ফোন করেছিলাম। আন্টি বললেন, বেরিয়েছিস, কখন ফিরবি ঠিক নেই!

ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম, কিছু নোট নেবার দরকার ছিল। কেমন আছিস বল–

ফাইন। আমি কখনও খারাপ থাকি না। এভার চিয়ারফুল। তোর খবর কী?

রজনী খুবই টগবগে ছটফটে আমুদে ধরনের মেয়ে, দারুণ উচ্ছ্বাসপ্রবণ। সেটা তার কাছে আসামাত্র টের পাওয়া যায়। পুনেতে কটা বছর ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসটাকে সে মাতিয়ে রেখেছিল।

রণিতা বলে, চলে যাচ্ছে। তারপর বল ফোন করেছিলি কেন? আসলে ফোনের কারণটা জানার জন্য প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল তার।

মজার গলায় রজনী বলে, বোলুঙ্গি বাবা, বোলুঙ্গি। দুমিনিটের জন্যে ধৈর্য ধর! ওনলি টু মিনিটস। আগে বল বাড়ির কে কেমন আছেন?

ভাল।

তোর কাজটাজ কেমন চলছে?

নট ব্যাড়। দার্জিলিংয়ের টি গার্ডেনগুলোর ওপর চল্লিশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি করলাম। শুটিং শেষ হয়েছে, এডিটিং চলছে। এরপর ভাবছি মধ্যপ্রদেশের মারিয়া ট্রাইবের ওপর একটা ছবি করব। তার জন্যে কিছু মেটিরিয়াল জোগাড় টোগাড় করছি।

ভেরি গুড।

তুই কী করছিস?

তিনটে বিগ কর্পোরেট হাউসের অ্যাড করছি। কম লেবার, অনেক টাকা। তুই যদি করতে চাস বল, অ্যাড-এর কাজ পাইয়ে দিতে পারি।

এখন ইচ্ছে নেই। পরে যদি ভাবি তোকে জানাব।

রজনী বলে, ওকে ওকে। দুমিনিট হয়ে গেছে। এবার শোন, তোর জন্যে একটা দারুণ সুখবর আছে, এক্সট্রিমলি গুড নিউজ।

এক্সট্রিমলি শব্দটার ওপর এমন জোর দেয় রজনী যে শিরদাঁড়া টান টান করে বসে রণিতা। বলে, কী খবর রে?

কাল মাণ্ডি হাউস-এ আমার একটা টেলিফিল্মের ব্যাপারে গিয়েছিলাম। তখন তোর পোপোজালগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিলাম–

রণিতার মনে পড়ে মাস ছয়েক আগে সে দুটো টেলিফিল্ম এবং দুটো ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রের স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছিল। রজনীকে বলে এসেছিল, মাঝে মাঝে গিয়ে যেন ওগুলো সম্পর্কে খবর টবর নেয়–অ্যাপ্রুভাল পাওয়া যাবে কিনা, পেলে কতদিন লাগবে, ইত্যাদি। রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী বললেন ওঁরা?

রজনী বলে, ওগুলো যেমন দিয়েছিলি তেমনি পড়ে আছে অ্যান্ড অ্যাজ ইয়ুজুয়াল গ্যাদারিং ডাস্ট। তবে ওঁদের দিক থেকে একটা অফার দিয়েছেন।

কী অফার?

ওঁরা তোকে দিয়ে একটা ডকু-ফিচার করাতে চান।

গত তিন বছরে ডকুমেন্টারি ছবি করে দেশের তো বটেই, বাইরেও কম করে সাত আটটা পুরস্কার পেয়েছে রণিতা। সে যে আর সব তথ্যচিত্র-করিয়েদের থেকে আলাদা, তার দেখার চোখ, ক্যামেরার ব্যবহার, ছিমছাম এডিটিং ডকুমেন্টারিগুলোকে যে শিল্পের স্তরে তুলে নিয়ে যায়, এ নিয়ে কাগজে কাগজে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মাণ্ডি হাউস তার সম্বন্ধে সব খবরই রাখে।

রণিতা জিজ্ঞেস করে, কিসের ডকু-ফিচার? সাবজেক্টটা কী?

নয়নতারা।

নয়নতারা? আই মিন–

রজনী বলে, ইয়া বাবা, ইন্ডিয়ান স্টেজ আর স্ক্রিনের লিজেন্ডারি নায়িকা– লাস্ট পঞ্চাশ বছরের মধ্যে যাঁর মতো আর্টিস্ট আর আসেনি।

কথাটা ঠিকই বলেছে রজনী। বাংলা সিনেমা আর নাটকে মূলত অভিনয় করলেও নয়নতারা হিন্দি ছবি আর নাটকও করেছেন প্রচুর। এর প্রায় সবগুলোই সারা দেশকে তোলপাড় করে দিয়েছে। চার চারবার উর্বশী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, বিদেশের কয়েকটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট অ্যাকট্রেস হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন, অসামান্য শিল্পী হিসেবে দেওয়া হয়েছে পদ্মভূষণ খেতাব। সারা দেশ জুড়ে তাঁর অজস্র অনুরাগী, কত যে ফ্যানক্লাব নয়নতারার নামে তৈরি হয়েছে তার হিসেব নেই। বিপুল জনপ্রিয়তা এবং মর্যাদা দুই-ই পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ছবি করা অকল্পনীয় ব্যাপার।

রণিতা হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলে, ইমপসিবল রাজু, অ্যাবসোলুটলি ইমপসিবল।

রজনীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, হোয়াই? তোর মতো ডেয়ারিং ডেসপারেট মেয়ের কাছে এমন একটা শব্দ এক্সপেট করিনি।

রজনীর মতো হৈ-হুল্লোড় করতে না পারলেও রণিতা ভীষণ জেদি, প্রচণ্ড একলোখা আর সাহসী। কিছু একটা মাথায় চাপলে সেটা না করে ছাড়ে না। ভারতবর্ষের নানা দুর্গম জায়গায় ঘুরে ঘুরে এমন জটিল, দুরূহ সব বিষয় নিয়ে সে ছবি করেছে, মেয়েরা তো বটে, অনেক পুরুষ ফিল্মমেকারও তা ভাবতে পারে না।

রণিতা বলে, কেন অসম্ভব, জানিস না। আট বছর আগে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন। মিডিয়ার লোকেরা পাগলের মতো তাঁকে খুঁজে বেড়িয়েছে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। তাঁকে নিয়ে করব অথচ তিনিই থাকবেন না, এটা তত হতে পারে না।

অফ কোর্স। ওঁকে খুঁজে বার কর। আর দেরি করলে ইট উড বি টু লেট। অন্য কান্ট্রি হলে এতদিনে ওঁর ওপর পঁচিশটা ডকুমেন্টারি হয়ে যেত। শোন, টাকাটা কোনো ফ্যাক্টর নয়, নয়নতারাকে নিয়ে লন্ডন কি নিউইয়র্কে শুটিং করলেও ওঁরা সব খরচ দেবেন। মোটামুটি একটা বাজেট তৈরি করে দিন পনেরো পর দিল্লি চলে আয়।

একটু ভেবে রণিতা বলে, ছবিটা তুইই কর না।

রজনী বলে, আরে বাবা, বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজটা কি আমি ভাল জানি? উনি বেশির ভাগ কাজই করেছেন বাংলা ফিল্ম আর স্টেজে। ল্যাংগুয়েজ না জানলে ফাইনার ব্যাপারগুলো ধরব কী করে?

কিন্তু–

কিন্তু ফিন্তু না, ইটস আ চ্যালেঞ্জিং জব। এটা তোকে করতেই হবে। দ্যাট গ্রেট লেডি, নয়নতারা রায়, কিভাবে স্টেজ আর ফিল্ম অ্যাক্টিংয়ে এলেন, কে বা কারা তাঁকে ইন্সপায়ার করেছে, কেমন ছিল তাঁর ডে-টু-ডে লাইফ, কেনই বা তিনি হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে নিরুদ্দেশ হলেন, এর সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন হিসেবে যে সব ছবিতে আর নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন তার কিছু ক্লিপিং জুড়ে দিতে পারলে দারুণ একটা ব্যাপার হবে।

রণিতা উত্তর দেয় না।

রজনী থামেনি, শুনেছি, ওঁর পারিবারিক জীবনে প্রচণ্ড অশান্তি ছিল। অনেকে ওঁর ক্ষতি করতে চেয়েছেন। ওঁকে নিয়ে এক সময় থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান স্ক্যান্ডাল রটেছে। সব বাধা পার হয়ে কিভাবে আজকের এই হাইটে উঠেছেন, এগুলোও ছবিটায় থাকা চাই।

রজনী নানাভাবে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চাইছে কিন্তু রণিতার সংশয় কিছুতেই কাটছে না। সে বলে, তা তো চাই। তবে–

তার কথা কানেও তোলে না রজনী। নন-স্টপ টকিং মেশিনের মতো একটানা বলে যায়, আমাদের ইন্ডিয়ানদের মতো এমন ক্যালাস, ইনডিফারেন্ট জাত হোল ওয়ার্ল্ডে আর দ্বিতীয়টি নেই। এত বড় একজন আর্টিস্ট সম্বন্ধে এখনই যদি কিছু করে না রাখি ফিউচার জেনারেশন আমাদের গায়ে থুতু দেবে। একটু থেমে দম নিয়ে ফের শুরু করে, আমরা হয়তো কিছু করলাম না কিন্তু দেখবি হুট করে ইয়োরোপ আমেরিকা থেকে কেউ এসে কাজটা করে ফেলল। দে আর মাচ মোর এন্টারপ্রাইজিং। তখন আর কারো কাছে মুখ দেখানো যাবে না। আ শেম ফর অল অফ আস।

সবই বুঝলাম কিন্তু নয়নতারাকে পাচ্ছি কোথায়?

এনিহোয়ার ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। চারদিক চষে ফেল। মৃত্যুর খবর যখন এতদিন পাওয়া যায়নি তখন কোথাও না কোথাও তিনি আছেন।

রণিতা কিছু বলে না।

আচমকা যেন সব মুশকিলের আসান হয়ে গেছে এমন উল্লসিত সুরে চেঁচিয়ে ওঠে রজনী, আরে বাঃ, তোর হাতে এমন একটা সুপার হিরো রয়েছে। ওই শালেকে নয়নতারার পেছনে লাগিয়ে দে। কাম হো যায়েগা। বলে গলা নামিয়ে অতীব মধুর স্বরে কটি চোস্ত ইংরেজি খিস্তি আওড়ায়। সেগুলো অশ্লীল হলেও বেশ মুখরোচক।

রজনীর মুখে কিছুই আটকায় না। হিন্দি বাংলা ইংরেজি গুজরাটি মারাঠি সিন্ধি, মোট কথা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যতগুলো চালু ভাষা আছে তার বাছা বাছা কিছু গালাগাল তার কণ্ঠস্থ। চার অক্ষরের একটা অস্বস্তিকর ইংরেজি শব্দ আকছার তার মুখে শোনা যায়। পুনেতে কোর্স করার সময় বাৎস্যায়নের কামসূত্র থেকে এখনকার ফ্রি সেক্স নিয়ে ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গে এমন হৈ চৈ বাধিয়ে দিত যে রণিতার মতো স্মার্ট মেয়েরও কান লাল হয়ে উঠত।

সুপার হিরো বা শালেটা কে বুঝতে না পেরে রণিতা জিজ্ঞেস করে, কার কথা বলছিস?

তোর সেই ব্লডি হেল বয়ফ্রেন্ড-ওই যে নিউজপেপারের রোভিং রিপোর্টার। কী যেন নাম? কী যেন–

এবার বোঝা গেল, অমিতেশের কথা বলছে রজনী। রণিতা যখন ফাস্ট ইয়ারে, অমিতেশের তখন থার্ড ইয়ার। প্রেমটা ওই কলেজের সময় থেকেই। পুনেতে যাবার পর রজনীর সঙ্গে যখন দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল, একদিন সারা রাত ধরে ওরা একজন আরেক জনকে তাদের প্রেমের গল্প শুনিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, অমিতেশের কথা রজনী ভোলেনি। রণিতাও মনে রেখেছে, একটি সিন্ধি যুবক, নাম কমল শিবদাসানি, কয়েক বছর ধরে রজনীর জন্য অপেক্ষা করে আছে। রণিতার মতো রজনীরও ধনুর্ভাঙা পণ, চোখ-ধাঁধানো কেরিয়ার না করা পর্যন্ত বিয়ে নয়।

রণিতা বলে, ওর নাম অমিতেশ–

রজনী বলে, রাইট। বুঝলি রণি, রিপোর্টাররা হল একেকটা শার্লক হোমস কি হারুকুল পয়নোর বাচ্চা। তোর ওই হারামজাদে ব্লাড-হাউন্ডের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক নয়নতারার কাছে পৌঁছে যাবে। লাভারের জন্যে লোকে লাইফ পর্যন্ত দিয়ে দেয়, আর এ তো একজন মহিলাকে খুঁজে বার করা। আজই ওর সঙ্গে কথা বলে নিবি। কী হল না হল, আমাকে তাড়াতাড়ি জানাস।

আচ্ছা—

এখন ছাড়ছি। ভেরি গুড লাক অ্যান্ড গুড নাইট।

গুড নাইট।

.

০২.

রণিতার মধ্যে একটি বেপরোয়া, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মেজাজ রয়েছে। সেটাকে উসকে দিল রজনী। প্রাথমিক দ্বিধা এবং সংশয় কাটিয়ে সে ঠিক করে ফেলে নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারটা করতেই হবে। হঠাৎ তার আবছাভাবে মনে পড়ল, ওঁকে নিয়ে আগেও দু-একজন ছবির কথা ভেবেছিল কিন্তু বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেনি। অন্যেরা পারেনি বলে সে পারবে না, এমন কোনো কথা নেই। অন্তত চেষ্টা সে করে যাবে, তারপর দেখা যাক কত দূর কী হয়।

অমিতেশের ব্যাপারে রজনী খুব দামি একটা পরামর্শ দিয়েছে। নয়নতারাকে খুঁজে বার করতে হলে ওকে সবার আগে দরকার। তাছাড়া প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্যও ভীষণ জরুরি, অমিতেশ পাশে না থাকালে সেটা একেবারেই সম্ভব নয়।

আসলে নয়নতারার বেশ কিছু ফিল্ম দেখলেও তাঁর জীবন সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছু জানে না রণিতা। অথচ সলিড, সত্য কিছু ঘটনা জানা না থাকলে ডকু-ফিচারটা সাজাবে কী করে?

রণিতার মনে আছে, নয়নতারা যখন অভিনয়ের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন তখন সবে এ দেশে টিভি এসেছে। আকাশবাণী বা দূরদর্শনের কোনো প্রোগ্রামে তাঁকে দেখা গেছে কি? কখনও কি টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছেন? রণিতার মনে পড়ে না। যদি দিয়েও থাকেন, তার জানা নেই। অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়ার কাছ থেকে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তবু আকাশবাণী আর দূরদর্শন ভবনে গিয়ে সে খোঁজ নেবে।

নয়নতারার ব্যাপারে তাকে অনেকখানি নির্ভর করতে হবে প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর। রণিতা জানে, নয়নতারার জীবন এবং অভিনয় নিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলোতে। শুধু চকচকে রঙিন সিনেমা ম্যাগে নয়, নাক-উঁচু বিখ্যাত সব লিটল ম্যাগাজিনেও। এখনও, তাঁর নিরুদ্দেশ হবার এত বছর বাদেও তাঁর সম্বন্ধে মানুষের বিপুল আগ্রহ। ফিল্ম এবং স্টেজ সম্পর্কে কোথাও কোনো লেখা বেরুলে নয়নতারা প্রসঙ্গ এসে যাবেই।

অমিতেশদের দৈনিক দিনকাল-এর অফিসে চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে ওদের কাগজ তো বটেই, অন্য সব বড় বড় ডেইলিরও পঞ্চাশ বছরের ফাইল যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর আছে অসংখা নামকরা ম্যাগাজিন আর নানা বিষয়ের ওপর দামি দামি রেফারেন্সের বই। নয়নতারা সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করার জন্য এইসব পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু লাইব্রেরি শুধুমাত্র দিনকাল-এর স্টাফের জন্য, সেখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এডিটরের কাছ থেকে রণিতার জন্য স্পেশাল পারমিশান এনে ওখানে কাগজপত্র দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে অমিতেশই। এর আগেও কয়েক বার করে দিয়েছে। দুতিনটে ডকুমেন্টারির জন্য নানা দৈনিকের পুরনো কিছু রিপোর্ট দরকার হয়েছিল তার।

রজনী লাইন ছেড়ে দিয়েছিল। তারপরও কিন্তু ফোন-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রণিতা। নয়নতারার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকবার পর ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। আর কোনো কিছু তার মাথায় চাপলে শুরু না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। অস্থিরতা এবং টেনশন ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এখনই অমিতেশের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ডায়াল করে রণিতা দিনকাল-এর রিপোর্টিং সেকশানটা ধরে ফেলল কিন্তু অমিতেশকে পাওয়া গেল না।

ওধারে ফোনটা ধরেছিল অমিতেশের কলিগ এবং প্রিয় বন্ধু মৃণাল। রণিতাকে সে খুব ভালই চেনে। বলল, ফরাক্কায় আজ সকালে একটা মারাত্মক বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। দশজন স্পট ডেড। কত জখম হয়েছে তার হিসেব পাওয়া যায়নি, ওদের ভেতর কয়েকজনের অবস্থা খুবইক্রিটিক্যাল। খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে চিফ রিপোর্টার অমিতকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওর ফিরতে অনেক রাত হবে।

অমিতেশের বন্ধু হিসেবে মৃণালের সঙ্গে রণিতার সম্পর্কটা বেশ মধুরই বলা যায়। মৃণাল দারুণ মজাদার মানুষ, রঙ্গপ্রিয়। খানিকটা ফাজিল ধরনের। তবে ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র মালিন্য নেই। তাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা বললে মন ভাল হয়ে যায়। মৃণাল আর রণিতা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে।

রণিতা জিজ্ঞেস করে, অমিতের সঙ্গে আজ কি তোমার দেখা হতে পারে?

মৃণাল বলে, আমি এগারোটা পর্যন্ত অফিসে আছি। তার ভেতর এলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। কী ব্যাপার? এনিথিং ভেরি আর্জেন্ট?

হ্যাঁ। ওকে বলল, কাল সকালে আমাকে যেন ফোন করে।

বলব।

যদি দেখা না হয় আমার নাম করে একটা মেসেজ রেখে দিও।

মৃণাল বলে, রাখব। তারপর ম্যাডাম—

রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী?

আচমকা গলার স্বর পালটে ফিচেল স্বরে মৃণাল বলে, কেন অমিতকে এত ভোগাচ্ছ?

অবাক হয়ে রণিতা বলে, ভোগাচ্ছি। তার মানে?

সিম্পল। অমিত আর আমি একই ইয়ারে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি, একই দিনে দিনকাল-এ ঢুকেছি। দেখ এর ভেতর আমার বিয়ে হয়ে গেছে। নাউ আই অ্যাম আ প্রাউড ফাদার অফ থ্রি কিডস। তার মধ্যে দুটো আবার যমজ-টুইন। রেসে অমিত আমার থেকে কফার্লং পিছিয়ে পড়ল, একবার ভাবো। এ শুধু তোমার জন্যে–

আমার জন্যে!

নয় তো কী। তুমি করুণা করলে ওর নামটা ম্যারেডদের লিস্টে উঠে যেত। এতদিনে দু-চারটে ইন্ডিয়ান সিটিজেন কি আর ও পয়দা করতে পারত না?

রণিতা ধমকে ওঠে, একদম অসভ্যতা করবে না।

নিপাট ভালমানুষের গলায় মৃণাল বলে ওঠে, অসভ্যতা অবার কী! ইটস আ রিয়ালিটি অফ লাইফ। অমিত মা-বাবার একই ছেলে। ওর বিয়ে না হলে ওদের বংশের দফা রফা। শাস্ত্রে লেখা আছে বংশরক্ষা না করলে নরকে যেতে হয়। তুমি ওকে মহাপাপ থেকে বাঁচাও ম্যাডাম।

আবার ফাজলামো! এই আমি ফোন রাখছি। কিন্তু রাখতে গিয়েও হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় রণিতা বলে, আচ্ছা, তুমি একবার বলেছিলে না তোমার

কে একজন রিলেটিভ আছেন যিনি ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত।

মৃণাল বলে, হ্যাঁ, আমার বড়মামা মণিময় চ্যাটার্জি। উনি মর্নিং স্টার কাগজের সিনেমা এডিটর ছিলেন।

ছিলেন মানে?

ওটা পাস্ট টেন্স, এখন আর নেই। বছর সাতেক হল রিটায়ার করেছেন।

উনি নিশ্চয়ই ফিল্ম ওয়ার্ল্ডের অনেক খবর রাখেন?

রাখেন কী বলছ! বড়মামা সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়া। হিরো-হিরোইন থেকে ডিরেক্টর, টেকনিশিয়ান, প্রোডিউসার, এমন কি ফালতু এক্সট্রাদের নামধাম ওঁর মুখস্থ। দিনের পর দিন পাবলিসিটি দিয়ে, ভাল ভাল লিখে কত অ্যাক্টর অ্যাকট্রেসকে ফেমাস করে দিয়েছেন তার হিসেব নেই।

উনি নিশ্চয়ই নয়নতারাকে চিনতেন?

নয়নতারা, মানে লিজেন্ডারি স্টেজ অ্যান্ড ফিল্ম অ্যাকট্রেসের কথা বলছ?

রাইট।

শুধু চেনেন! ওঁর কেরিয়ারের শুরুতে বড়মামা যেভাবে হেল্প করেছেন ভাবতে পারবে না। মণিময় চ্যাটার্জি সেই সময় ছিলেন নয়নতারার গডফাদার।

খুবই উৎসাহিত হয়ে ওঠে রণিতা। বলে, তোমার বড়মামার কাছে নয়নতারা সম্পর্কে তা হলে অনেক কিছু জানা যাবে।

আশ্চর্য।

কিসের আশ্চর্য?

মৃণাল জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ নয়নতারাকে নিয়ে খেপে উঠলে কেন?

রণিতা বলে, দরকার আছে, পরে শুনো। তোমার বড়মামার কাছে আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারবে?

তরল গলায় মৃণাল বলে, তোমার যখন হুকুম, পারতেই হবে। তবে—

কী?

বড়মামার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বয়স হয়েছে তো, তার ওপর তিন মাস আনে হার্টে একটা ম্যাসিভ অ্যাটাকও হয়ে গেছে। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলা ডাক্তারের বারণ।

তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আমি ওঁকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।

আমি বড়মামাকে ফোন করে জেনে নেব কবে গেলে ওঁর অসুবিধা হবে না। টাইম আর ডেট ঠিক করে তোমাকে জানিয়ে দেব।

খুব আন্তরিক গলায় রণিতা বলে, মেনি, মেনি থ্যাংকস। এখন তা হলে ছাড়ি?

মৃণাল বলে, ওক্কে ম্যাডাম–

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে ঘুরে একবার হল-ঘরের দূর প্রান্তে তাকায় রণিতা। সেখানকার দৃশ্যাবলীর কোনোরকম পরিবর্তন হয়নি। সুধাময়ী তখনকার মতোই মহাভারতে নিমগ্ন হয়ে আছেন, আর মুক্তা ক্ষিপ্র হাতে পান সেজে যাচ্ছে।

এক পলক ওদের দেখে ব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে, মুখ ফিরিয়ে হল ঘরটা কোনাকুনি পার হয়ে নিজের ঘরে চলে আসে বণিতা।

এ বাড়ির অন্য বেড-রুমগুলোর মতো এই ঘরটাও বিশাল, বিশ ফিট বাই পনেরো ফিট। খাট, আলমারি, বইয়ের র‍্যাক, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল, সোফা, পড়ার টেবল, ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার সাজানো। শুধু বাইরের হল-ঘরই না, এ ঘরেও ক্যাবিনেট বোঝাই নানা ফিল্ম আর গানের ক্যাসেট। একটা পোর্টেবল ফরেন টিভি আর টু-ইন-ওয়ানও রয়েছে।

ব্যাগটা একটা সোফায় রেখে, আলো জ্বেলে ফ্যান চালিয়ে দেয় রণিতা। তারপর জুতো খুলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।

বাড়ির কুক দশরথ এই সময় এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি আর কিছু চিজ বিস্কিট নিয়ে আসে। সে টের পেয়েছিল রণিতা ফিরে এসেছে।

দশরথের বয়স ষাটের কাছাকাছি কিন্তু এখনও পেটানো মজবুত চেহারা, প্রায় চল্লিশ বছর তার এ বাড়িতে কেটে গেল। রণিতাদের তিন ভাইবোনকে সে জন্মাতে দেখেছে। কখন কার কী দরকার সে জানে এবং নীরবে, অত্যন্ত মসৃণ নিয়মে সে সব জোগান দিয়ে যায়।

রণিতা উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, দশরথদা, তুমি একজন দারুণ থট-রিডার। মনে মনে এখন এক কাপ কফি চাইছিলাম। বাঁচালে

দশরথ কথা খুব কম বলে। নিঃশব্দে হেসে একটা নিচু টিপয় টেবল খাটের কাছে টেনে এনে তার ওপর কফির কাপ টাপ রেখে চলে যায়।

আগস্ট মাস শেষ হয়ে এসেছে। বর্ষা এখনও পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, আকাশে সেই বিকেল থেকে অল্প অল্প মেঘ জমতে শুরু করেছে। তবে সারাদিনে আজ একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। হয়তো বেশি রাতের দিকে হবে। মাঝে মাঝে পুব থেকে দক্ষিণে আড়াআড়ি বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে।

কফিটা খেয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ শোনে রণিতা। তারপর একটা রঙিন বারমুডা প্যান্ট আর ঢোলা শার্ট হাতে ঝুলিয়ে অ্যাটাচড টয়লেটে ঢুকে যায়। শাওয়ার খুলে স্নান টান সেরে, পোশাক পালটে বেডরুমে এসে, চুলটুল আঁচড়ে ফের শুয়ে পড়ে।

ক্যাসেট এখনও বেজে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে রণিতার দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।

.

০৩.

তিন ঘুমটা ভাঙে অনাথের ডাকাডাকিতে, ছোটদিদি, ওঠো ওঠো। খাবে না? বড়বাবু আর মা তোমার জন্যে বসে আছেন।

ধড়মড় করে উঠে পড়ে রণিতা, তারপর অনাথের সঙ্গে নিচে নামতে নামতে হলঘরের বড় ওয়াল ক্লকটায় দেখতে পায় এখন দশটা বেজে চল্লিশ।

এ বাড়ির রেওয়াজ হল রাতের খাওয়াটা সবাই একসঙ্গে বসে খায়। বিয়ের আগে রণিতার দিদি শমিতার প্রথমে কলেজ, পরে ইউনিভার্সিটিতে ছোটার ব্যাপার ছিল, রণিতারও তাই। দাদা পূর্ণেন্দুর ছিল অফিস, বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। পূর্ণেন্দু ছাড়া অন্য কারো বেরুবার নির্দিষ্ট সময় ছিল না। কেননা রোজ একই সময়ে ওদের ক্লাস শুরু হত না। একেক জন একেক সময় খেয়ে বেরুত। রণিতার বাবা ইন্দ্রনাথ মনে করেন, দিনে অন্তত একবার বাড়ির সকলের একসঙ্গে বসা দরকার। এতে পারিবারিক সম্পর্কটা অনেক নিবিড় হয়। সেই জন্যই সবাই মিলে রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা।

রণিতাদের খাওয়ার ঘরটা একতলায়। সেখানে আসতে দেখা যায়, ইন্দ্রনাথ আর সুধাময়ী ডাইনিং টেবলে বসে আছেন। এই ঘরটা আর কিচেনের মাঝখানে একটা দরজা, সেখানে দাঁড়িয়ে মুক্তা। দশরথই সবাইকে খেতে দেয়, মুক্তা এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে তাকে সাহায্য করে।

ইন্দ্রনাথের বয়স সাতষট্টি। পাতলা মেদহীন চেহারা, লম্বাটে মুখে বুদ্ধির ধার। এই বয়সেও মেরুদণ্ড টান টান, চুলও খুব বেশি পাকেনি। চওড়া কপাল, ঈষৎ পুরু ঠোঁট, চোখের দৃষ্টি শান্ত কিন্তু দূরভেদী। গায়ের রং একসময় ছিল টকটকে, বয়স তার উজ্জ্বলতা অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে। হালকা মলিন ছায়া পড়েছে ইন্দ্রনাথের ওপর।

হঠাৎ দেখলে তাঁকে খুব রাশভারী মনে হয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলে টের পাওয়া যাবে গাভীর্যটা বাইরের খোলস মাত্র। তাঁর মধ্যে এমন একটি পরিহাসপ্রিয় মানুষ রয়েছে যে চারপাশের রুক্ষ কর্কশ আবহাওয়া থেকে আনন্দ আর মজাকে হেঁকে বার করে নিতে পারে।

ইন্দ্রনাথ ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে সোসিওলজির দুর্ধর্ষ অধ্যাপক। শুধু সমাজতত্ত্ব নয়, ইতিহাস পুরাতত্ত্ব অর্থনীতি নৃতত্ত্ব ভারতীয় দর্শন, এমন কি সিনেমা নাটক ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর বিপুল আগ্রহ এবং অগাধ পড়াশোনা। এত পাণ্ডিত্য তাঁকে শুকিয়ে কাঠ করে দেয়নি। সব বয়সের মানুষের সঙ্গে তিনি অবাধে মিশতে পারেন, নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর মতো।

ইন্দ্রনাথ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনলাম বাড়ি ফিরে তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস। শরীর খারাপ নাকি?

রণিতা অল্প হেসে জড়ানো গলায় বলে, না বাবা, স্নানটান করে একটু শুয়েছিলাম। কখন ঘুম এসে গেছে, টের পাইনি।

এখনও ঘুম ভাবটা রয়েছে। যা, চোখে জল দিয়ে আয়।

ডাইনিং রুমের একধারে দুধসাদা বেসিন। পাশেই একটা র‍্যাকে ভোয়ালে, লিকুইড সোপ, ইত্যাদি।

ট্যাপ খুলে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতেই আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে ইন্দ্রনাথের পাশে এসে বসে রণিতা। সঙ্গে সঙ্গে প্লেটে প্লেটে খাবার সাজিয়ে সবাইকে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে দশরথ। রণিতাদের আরো কিছু দরকার হলে দেবে।

দিনের বেলা তাড়াহুড়ো করে খেয়ে সবাই বেরিয়ে যায়। কিন্তু ডিনারটা ওরা করে ধীরেসুস্থে, অনেকটা সময় নিয়ে। এই রাত্রিবেলায় তো আর ব্যস্ততা থাকে না, সকলেই তখন চাপমুক্ত, ঢিলেঢালা মেজাজে থাকে।

পূর্ণেন্দু, তার স্ত্রী বন্দনা আর শমিতারা যখন ছিল, আসর দারুণ জমে উঠত। সারাদিন কে কী করেছে, কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কোথায় গেছে, সবাই তা জানাতে। শুধু তাই না, দেশের রাজনৈতিক হালচাল, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বেকারিত্ব, বম্বে ব্লাস্ট, অযযাধ্যা, ফুটবল, ক্রিকেট যাবতীয় বিষয় নিয়ে তারা বাড়ি সরগরম করে তুলত। পূর্ণেন্দুরা চলে যাবার পর আড্ডা আর তেমন হয় না। সুধাময়ী বরাবরই স্বল্পভাষী, বলার চেয়ে তিনি শোননন বেশি। আজকাল রণিতার বিয়ের ব্যাপারে তিনি এমনই ক্ষুব্ধ যে প্রায় সারাক্ষণই মুখ বুজে থাকেন। গল্প যা করার রণিতা আর ইন্দ্রনাথই করেন।

খেতে খেতে রণিতা জিজ্ঞেস করে, তোমার না আজ সেন্ট্রাল ক্যালকাটা রোটারি ক্লাবে একটা সেমিনার ছিল?

ইন্দ্রনাথ বলেন, হ্যাঁ।

বিষয়টা যেন কী?

বাঃ, কালই তো তোকে বললাম। ভুলে গেছিস? সাবজেক্টটা হল নারী নির্যাতন।

ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কেমন হল তোমাদের সেমিনার?

ইন্দ্রনাথ নিরুৎসুক সুরে বললেন, ভাল না। এসব যেন কিছু একটা করতে হয় তাই করা। অ্যাবসোলুটলি মেকানিক্যাল। নামকরা জানালিস্ট, অধ্যাপক, সোসাল ওয়াকার, পুলিশের বড় কর্তা, পলিটিক্যাল নেতারা এলেন। মেয়েদের ওপর যে ক্রাইম চলছে, সে সম্বন্ধে লম্বা লম্বা ভাষণ দিলেন কেউ কেউ, কেউ পেপার পড়লেন। এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হল। বাস এই পর্যন্ত।

রণিত বাবাকে লক্ষ করতে লাগল, কিছু বলল না।

ইন্দ্রনাথ থামেননি, বুঝলি ছোট খুকি, এভাবে এয়ার-কনডিশানড অডিটোরিয়ামে সেমিনার করে, দামি লাঞ্চ খেয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না। উই শ্যাল হ্যাভ টুডু সামথিং পজিটিভ, ফিল্ডে নেমে যেতে হবে। যে মেয়েরা টরচারড হচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সব রকম সাহায্য দিতে হবে লিগ্যাল, মোরাল অ্যান্ড মনেটারি। কিভাবে এটা করা যায়, ভেবে দেখব। তারপর খুব তাড়াতাড়ি কাজে নামব। সে যাক, তোর তো আজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাবার কথা ছিল। গিয়েছিলি?

আস্তে মাথা নাড়ে রণিতা–গিয়েছিল।

দণ্ডকারণ্যের যে ট্রাইবটা নিয়ে কাজ করবি, তাদের সম্বন্ধে কিছু মেটিরিয়াল পাওয়া গেল?

প্রচুর। রণিতা বলে, কিন্তু বাবা, ওই ডকুমেন্টারিটা এখন আমি করছি না।

অবাক হয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, কেন রে?

ওটার আগে আমাকে অন্য একটা ডকু- ফিচার করে নিতে হবে।

বিষয়টা কী? নয়নতারার কথা বলে রণিতা।

ইন্দ্রনাথ সোজা হয়ে বসেন। বলেন, খুব ভাল সাবজেক্ট। এটা তোর মাথায় এল কী করে?

রজনীর সঙ্গে সন্ধেবেলায় ফোনে যে সব কথা হয়েছে মোটামুটি সব জানিয়ে রণিতা বলে, করতে পারলে দারুণ একটা ব্যাপার হয়, তাই না বাবা?

বেশ জোর দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, নিশ্চয়ই। কাজটা কিন্তু খুব ডিফিকাল্ট। ভদ্রমহিলার বহুদিন খোঁজ নেই। তাকে ছাড়া ছবিটা কিন্তু হতে পারে না।

আস্তে মাথা নাড়ে রণিতা।

ইন্দ্রনাথ বলেন, কিভাবে এগুবি, কিছু ভেবেছিস?

রণিতা জানায় এই সবে রজনীর কাছ থেকে দূরদর্শনের অফারটা পেয়েছে। এখনও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভেবে উঠতে পারেনি। তবে প্রিন্ট মিডিয়ার সাহায্য নেবে, মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করবে, সেই সঙ্গে নয়নতারার সন্ধানও চালিয়ে যাবে। অমিতেশের নামটা অবশ্য করে না। আপাতত সেটা স্থগিত রইল, তবে মা যেভাবে তার বিয়ের ব্যাপারে অস্থির হয়ে উঠেছেন, ইন্দ্রনাথকে খুব তাড়াতাড়িই জানাতে হবে। রণিতার ধারণা, বাবা অমত করবেন না এবং সুধাময়ীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অমিতেশের ব্যাপারে রাজি করাতে পারবেন।

ইন্দ্রনাথ বলেন, হ্যাঁ, এটাই কারেক্ট ওয়ে। শুধু মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে না, নয়নতারা যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন সেই কো-অ্যাক্টররা, তাঁর ছবির প্রোডিউসার, ডিরেক্টর, আর্ট ডিরেক্টর, মেকআপম্যানদের অনেকেই বেঁচে আছেন। তাঁদের সঙ্গেও দেখা করতে হবে। ওঁরা অনেক মেটিরিয়াল দিতে পারবেন।

উৎসুক সুরে রণিতা বলে, তুমি ঠিক বলেছ বাবা। আর কী কী করা যায়, তুমি একটু চিন্তা কোরো।

অবশ্যই। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় খুব উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন ইন্দ্রনাথ, জানিস তো, নয়নতারা স্টেজ অ্যাক্টিংয়ে নতুন স্টাইল নিয়ে এসেছিলেন।

শুনেছি। কিন্তু ওঁর নাটক দেখার সুযোগ পাইনি।

কী করে দেখবি! নয়নতারা যখন স্টেজ ছেড়েছেন তখন তোর বয়েস আর কত, খুব বেশি হলে বারো তেরো। ওই বয়েসে নাটক টাটক সম্পর্কে তোর ইন্টারেস্ট গ্রো করেনি।

রণিতা কিছু না বলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ইন্দ্রনাথ বলেন, যতটা মনে আছে, নয়নতারা সবসুন্ধু কুড়ি বাইশটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আমার জানাশোনা এক ভদ্রলোক, নাম রমেন লাহা, এর মধ্যে চোদ্দ পনেরোটা প্রোডিউস করেছেন। উনি বেঁচে থাকলে নয়নতারা সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশন পেয়ে যাবি।

রণিতা বলে, কাল রমেনবাবুর খোঁজ করবে?

ইন্দ্রনাথ বলেন, করব। মুনলাইট থিয়েটার হলটা ওঁদেরই। ওখানে ফোন করলে জানা যাবে।

ইন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই ডাইনিং রুমে বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্বে বসে নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছিলেন সুধাময়ী। হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, নাচাও নাচাও, যত পার মেয়েকে নাচিয়ে যাও।

খুব ধীর, নিমগ্ন গলায় কথা বলেন সুধাময়ী। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর স্বর কয়েক পা উঁচুতে উঠেছে, উত্তেজনায় রন রন করছে। রাগে মুখ থমথমে।

সুধাময়ীর এমন চেহারা আগে আর দেখা যায়নি। রণিতারা হকচকিয়ে যায়।

ইন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, নাচাচ্ছি মানে?

স্বামীর কথা বুঝিবা সুধাময়ীর কানে যায় না। রুষ্ট মুখে বলতে থাকেন, কোথায় মেয়ের বিয়ে দেবে, সে আর দশজনের মতো ঘর-সংসার করবে, তা নয়। সিনেমা করার জন্যে সমানে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। এমন সৃষ্টিছাড়া বাপ আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। একটু থেমে শুরু করেন, মেয়ে যখন পুনেতে যাবার জন্যে খেপে উঠল আমি বার বার বারণ করলাম কিন্তু কে কার কথা শোনে! লাফাতে লাফাতে গিয়ে তাকে ভর্তি করে এলে। এখন ক্যামেরা ঘাড়ে করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘর-সংসারে এ মেয়ের আর মন বসবে।

এটা ঠিক, ইন্দ্রনাথ পাশে না দাঁড়ালে পুনেতে কোর্স করতে যাওয়া রণিতার পক্ষে আদৌ সম্ভব হত না। সুধাময়ীর প্রবল বাধা সত্ত্বেও তিনি ওকে পছন্দমতো কেরিয়ার গড়ে তুলতে দিয়েছেন। আসলে মেয়েদের সম্বন্ধে সুধাময়ীর ধ্যানধারণা অনেকটাই সেকেলে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক, এটা তিনি অবশ্যই চান। তবে তারা সব কিছু ফেলে শুধু কাজকর্মে মেতে উঠুক, এ ব্যাপারে তাঁর মন একেবারেই সায় দেয় না। একান্তই যদি কিছু করতে হয় স্কুল-কলেজে পড়াক, বড় জোর কোনো অফিসে ভদ্র পরিবেশে দশটা-পাঁচটা চাকরি করুক। কিন্তু তাদের লক্ষ বা অভীষ্ট হবে ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান। মেয়েরা পুলিশ অফিসার হবে, ফিল্ম-মেকার হবে, প্লেন চালাবে, কাজের অছিলায় যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াবে, যখন ইচ্ছা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, যখন ইচ্ছা ফিরে আসবে–এসব তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁর ধারণায় পুরুষ পুরুষই, মেয়ে মেয়েই। কখনই তারা সমান হতে পারে না। শারীরিক মানসিক, সমস্ত দিক থেকেই তাদের অনেক তফাত। সারা পৃথিবী জুড়ে মেয়েরা ইদানীং বহু ব্যাপারেই যে পুরুষদের টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে সব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও তিনি দেখবেন না। লোহার ফ্রেমে আটা নিজের ভাবনা-চিন্তা ধ্যানধারণার বাইরে একটা পা-ও ফেলতে তিনি রাজি নন।

ইন্দ্রনাথ বলেন, আরে বাবা, বসবে বসবে। তুমি এত উতলা হচ্ছ কেন?

সুধাময়ী বলেন, হচ্ছি শখ করে। ছোটদার সম্বন্ধটা তো ভেঙে দিলে তোমার মেয়ে। তুমি যে বলেছিলে দুটি ভাল ছেলে আছে–

শশব্যন্তে ইন্দ্রনাথ বলেন, আছেই তো।

তুমি তাদের বাবা-মার সঙ্গে কথা বল।

বলব, নিশ্চয়ই বলব।

সত্যি বলবো তোমাকে তো পঁয়ত্রিশ বছর ধরে দেখছি। সুধাময়ীর কণ্ঠস্বর ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে, চিরটা কাল বনের মোষ তাড়িয়ে গেলে। নিজের ছেলেমেয়ে, ঘর-সংসারের দিকে যদি নজর থাকে!

সুধাময়ীর এই কথাগুলো শতকরা একশ ভাগ সত্যি। নিজের পড়াশোনা, লেখালিখি, ইউনিভার্সিটি, ছাত্রছাত্রী–এ সব নিয়েই এত কাল মগ্ন থেকেছেন ইন্দ্রনাথ। ছেলেমেয়েরা যে ভাল রেজাল্ট করেছে, বড় মেয়ে এবং ছেলের বিয়ে সম্ভব হয়েছে, তা শুধু সুধাময়ীর জন্য। মৃদু, আপাতকোমল এই মানুষটির মধ্যে প্রবল এক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তিনি যা ভাবেন, শেষ পর্যন্ত করে ছাড়েন।

ইন্দ্রনাথ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বিব্রত মুখে বলেন, এবার দেখে নিও।

সুধাময়ী বলেন, দেখব। তোমাকে তিন মাস সময় দিলাম, তার মধ্যে মেয়ের বিয়ে না হলে আমি দাদাদের কাছে চলে যাব। এ বাড়ির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

ভয়ে ভয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তিন মাসের ভেতরেই ছোট খুকির বিয়ে দেব।

খাওয়াদাওয়ার পর সুধাময়ী কিছুক্ষণের জন্য খাবার ঘরে থেকে গেলেন। পরদিন কী বাজার হবে, কোন কোন পদ রান্না হবে, সব বুঝিয়ে দেবেন দশরথকে।

ওদিকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রণিতা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সত্যি সত্যি তিন মাসের মধ্যে আমার বিয়ে দেবে বাবা? তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

ইন্দ্রনাথ বলেন, দিতে তো হবেই। তোমার মায়ের আদেশ। তাছাড়া আমাদের কাছে ছোট থাকলেও অন্যের চোখে আটাশ বছর বয়েসটা খুব কম না ছোট খুকি।

রণিতা বুঝতে পারে বাবা মজা করছেন না। ঢোক গিলে সে বলে, কিন্তু–

কী?

নয়নতারার ওপর ডকু-ফিচারটা করব বলে কথা দিয়েছি। এর ভেতর বিয়ে– বলতে বলতে চুপ করে যায় রণিতা।

ইন্দ্রনাথ বলেন, নিশ্চয়ই করবি ছবিটা। তবে বিয়েটাও করতে হবে।

ওরা দোতলায় উঠে এসেছিল।

রণিতা একটু চাপা গলায় ডাকে, বাবা–

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আছে যাতে কিছুটা অবাক হয়ে যান ইন্দ্রনাথ। বলেন, কী রে?

মুখ নামিয়ে রণিতা বলে, আমার বিয়ের জন্য তোমাকে কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে না।

মানে?

একটু চুপ করে থাকে রণিতা। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে, অমিতেশের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।

বুঝতে খানিকটা সময় লাগে ইন্দ্রনাথের। একসময় গলার স্বরটাকে উঁচুতে তুলে বলে ওঠেন, আই সি, আই সি। কী করে ছেলেটি?

জানালিস্ট।

আমাদের কাস্টের তো?

না। তুমি জাতপাত মানো?

নেভার। কিন্তু তোর মা মানেন, তাঁর অমতে কিছু করা প্রায় অসম্ভব।

রণিতা বলে, তুমি সোসাল জাস্টিসের কথা বল। মানুষে মানুষে ইকোয়ালিটির কথা বল, আর মায়ের নাম করে ইনজাস্টিসকে সাপোর্ট করতে চাইছ! তার গলায় ক্ষোভ ফুটে ওঠে।

মেয়ের কাঁধটা আলতো করে ছুঁয়ে ইন্দ্রনাথ একটু হাসেন, এত অস্থির হয়ো না। তোমার মাকে আঘাত দেওয়া তো কোনো কাজের কথা নয়। তিনি যাতে মনে কোনো দ্বিধা বা তিক্ততা না রেখে রাজি হন সেটা দেখতে হবে। তার জন্যে সময় দরকার। এবার ছেলেটি সম্পর্কে ডিটেলে বল।

বাবাকে যে ভুল বুঝেছিল, অকারণে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, সে জন্য মনে মনে লজ্জা পায় রণিতা। নিচু গলায় জানায় অমিতেশরা বাঙালি ক্রিশ্চান। তারা একভাই, এক বোন, বাবা নেই। সে বড়, ছোট বোন ইংরেজি নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এম. এ করছে, খুব ভাল স্টুডেন্ট। মা একটা হায়ার সেকেন্ডারি মিশনারি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। ডোভার লেনে ওদের নিজেদের বাড়ি।

ইন্দ্রনাথ বলেন, ঠিক আছে, জানা রইল। কিভাবে এগুবো, সেটা ভাবতে হবে। তোর মায়ের তো বটেই, আত্মীয়স্বজনদের সাপোর্টও পাওয়া দরকার।

রণিতা চমকে ওঠে, সে কী! তুমি–

হাত তুলে মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলেন, আরে বাবা, এক্ষুণি আমি ঢাল পিটিয়ে কাউকে জানাতে যাচ্ছি নাকি? ধীরে ধীরে. সইয়ে সইয়ে, সবার পালস বুঝে কথাটা তুলব। তাড়াহুড়ো করতে গেলে গোলমাল হয়ে যাবে।

রণিতা বুঝতে পারে, অধৈর্য হলে চলবে না। তাদের বংশে এখন পর্যন্ত জাত গোত্র মিলিয়ে এবং যোক দেখে বিয়ে হয়েছে। পারিবারিক সেই প্রথাকে ভাঙা খুব সহজ নয়। এখানে শুধু জাতের ব্যাপার নয়, অমিতেশদের ধর্মও আলাদা। ফলে সমস্যাটা আরো জটিল এবং স্পর্শকাতর। বাবার ওপর তার চিরকালই অগাধ বিশ্বাস, তিনি সবাইকে দিয়ে এ বিয়ে যে মানিয়ে নিতে পারবেন, সে সম্বন্ধে তার সংশয় নেই। তবু–

ইন্দ্রনাথ এবার বলেন, আসল খবরটা কিন্তু এখনও পাইনি।

রণিতা অবাক হয়ে বলে, আসল বলতে!

ছেলেটা কিরকম? অনেস্ট আর সিনসিয়ার তো?

আমার তো তাই মনে হয়।

ওর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?

দশ বছরের। আমি যেবার প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলাম ও তখন থার্ড ইয়ারে। সেই থেকে–

ঠিক আছে।

একটু চুপ।

তারপর আদুরে গলায় রণিতা বলে, বাবা, কাল কি পরশু বিকেলে তোমার কি একটু সময় হবে?

ইন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেন, কেন?

অমিতকে তোমার কাছে নিয়ে আসতাম।

এখন না। কবে আনবি পরে বলে দেব।

রণিতা আর কিছু বলে না। সে বুঝতে পারে, তাদের বিয়ের ব্যাপারে মনের দিক থেকে পুরোপুরি প্রস্তুত না হয়ে ইন্দ্রনাথ অমিতেশের সঙ্গে আলাপ করবেন না।

.

০৪.

পরদিন সকালে চা খাওয়ার পর নিজের ঘরে বসে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে টুকে আনা আগের দিনের নোটগুলো দেখছিল রণিতা, এই সময় হল-ঘরে ফোন বেজে উঠল। বেরিয়ে এসে সেটা তুলে কানে ঠেকাতেই ওধার থেকে অমিতেশের গলা ভেসে এল, কে, রণি?

হ্যাঁ। দ্রুত চারপাশ একবার দেখে নিল রণিতা। হলঘরট এখন একেবারে ফাঁকা। ইন্দ্রনাথ তাঁদের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। সুধাময়ী আশেপাশে কোথাও নেই, রোজ সকালের দিকে দশটা পর্যন্ত তাঁর পুজোর ঘরে কেটে যায়।

অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, আজ সকালে ফোন করতে বলেছিলে কেন?

রণিতা বলে, মৃণাল তোমাকে কিছু বলেনি?

ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। কাল রাতে সাড়ে এগারোটায় ফরাক্কা থেকে ফিরেছি। মৃণাল তার আগেই চলে গেছে। তবে তোমার মেসেজটা রেখে গিয়েছিল। বল কী করতে হবে।

নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারের পরিকল্পনাটা সংক্ষেপে জানিয়ে রণিতা বলে, তোমাদের অফিস লাইব্রেরিতে আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।

রীতিমত উত্তেজিতই হয়ে ওঠে অমিতেশ। বলে, এ তো দারুণ প্রোজেক্ট। লাইব্রেরির ব্যাপারটা হয়ে যাবে। নো প্রবলেম। অফিসে চলে এসো।

কখন আসব বল–

এডিটর এগারোটায় অফিসে আসেন, তুমি তখনই আসতে পার। ওঁকে একবার শুধু বলে নিতে হবে।

ঠিক আছে। তোমাকে আরেকটা ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।

কী সেটা?

নানা সোর্স থেকে নয়নতারা সম্পর্কে ডাটা জোগাড় করতে পারব। কিন্তু দ্যাটস নট সাফিসিয়েন্ট। আসল মানুষটাকে না পেলে ডকু-ফিচারটা ড্রাব, লাইফললস হয়ে যাবে, কোনো চার্ম থাকবে না। ওঁকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে কিন্তু।

ওরে বাবা! গলার স্বর শুনে মনে হয় আঁতকে উঠেছে অমিতেশ, রিপোটারকে তুমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বানাতে চাইছ। ক্রিমিনাল হয়, পলিটিক্যাল লিডার হয়, তাদের খোঁজ তবু করতে পারি। এ সব আমার জুরিসডিকশানে পড়ে। তুমি ছাড়া অন্য কোনো মহিলার পেছনে কখনও ঘুরিনি। কিন্তু এ একেবারে চলচ্চিত্রের হিরোইন, এক সময়ের গ্ল্যামার কুইন। স্রেফ মরে যাব রণি।

রণিতা ধমকে ওঠে, ইয়ার্কি করো না। দু উইক টাইম দিলাম, তার ভেতর নয়নতারাকে চাই। মনে রেখো, এখন থেকে তিন মাসের মাথায় শুটিং শুরু করব।

ঠিক হ্যায় শ্রীমতীজি, তাই হবে। যিনি আট বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন তাঁর পাত্তা লাগাতে পারব কিনা জানি না, তবে একটা এক্সপিরিয়েন্স তো হবে।

একটু চুপচাপ।

তারপর গলার স্বর অনেকটা নিচে নামিয়ে গোপন ষড়যন্ত্রকারীরমতো রণিতা বলে, তোমার আর আমার ব্যাপারে একটা দারুণ ডেভলপমেন্ট হয়েছে।

উৎসুক সুরে অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, কিরকম?

কাল বাবাকে তোমার কথা বলেছি।

ইজ ইট?

ইয়া—

কী বললেন তিনি?

কণ্ঠস্বরে বোঝা যায়, অমিতেশের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা চারিয়ে গেছে। রণিতা বলে, তোমার অফিসে গিয়ে বলব।

অমিতেশ তবু জানতে চায়, ফেভারেবল তো?

এখন সাড়ে আটটা বাজে। ঠিক এগারোটায় তোমাদের অফিসে পোঁছচ্ছি। আড়াই ঘন্টা সাসপেন্সে থাকো।

ঠিক আছে। দশ বছর যখন নাকে বঁড়শি আটকে ঝুলিয়ে রেখেছ তখন আরো আড়াই ঘন্টাও ঝুলে থাকতে পারব।

সময়ের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন রণিতা। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় দিনকাল অফিসে পৌঁছে যায়।

বাড়িটা পাঁচতলা এবং আগাগোড়া এয়ার-কণ্ডিশনড। একতলায় রিসেপশন, প্রেস, সাকুলেশন, ইত্যাদি নানা ডিপার্টমেন্ট। দোতলার বেশির ভাগটা জুড়ে বিজ্ঞাপন বিভাগ। দিনকাল-এর তিনটে ম্যাগাজিন আছে- দুটো উইকলি, একটা ফোর্টনাইটলি। সেগুলোর দপ্তরও দোতলাতেই। তেতলার গোটাটা নিয়ে নিউজ এবং এডিটোরিয়াল ডিপার্টমেন্ট। এখানে বিরাট একটা হল ঘিরে এডিটর, নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার, ফিচার এডিটর, ফিল্ম এডিটরদের জন্য ছোট বড় মাঝারি, নানা সাইজের চেম্বার। হলঘরের একটা দিক সাব-এডিটর এবং অন্য দিকটা রিপোর্টারদের জন্য সংরক্ষিত। প্রত্যেকের টেবলেই রয়েছে ছোট ছোট পার্সোনাল কম্পিউটার। দুই এলাকার সীমানায় পি টি আই আর ইউ এন আই-এর টেলিপ্রিন্টার। চারতলায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস এবং লাইব্রেরি। পাঁচতলায় ক্যান্টিন, ফোটোগ্রাফি আর আর্ট ডিপার্টমেন্ট।

বছর চারেক হল দিনকাল-এ চাকরি পেয়েছে অমিতেশ। তারপর অসংখ্য বার এখানে এসেছে রণিতা। এই বিশাল, পাঁচতলা বাড়িটার গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে টপ ফ্লোর পর্যন্ত কোথায় কী আছে, সব তার মুখস্থ।

দিনকাল অফিসে ঢোকার ব্যাপারে প্রচণ্ড কড়াকড়ি। কেননা এই কাগজে মাঝে মাঝে এমন সব রিপোর্ট বেরোয় যাতে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মস্তানরা এসে হামলা করে থাকে। তাই সবাইকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। রিসেপশানের তুখোড় তরুণীটি যার নাম বিপাশা সেন, অবাঞ্ছিত ভিজিটরদের একতলাতেই আটকে দেয়। কিন্তু রণিতার ব্যাপারে বাধা নেই, তার কাছে এ অফিসের দরজা সব সময় খোলা।

বিপাশা রণিতাকে ভালই চেনে। মিষ্টি হেসে বলে, অমিতেশ দাস মিনিট দশেক হল এসেছেন। যান, চলে যান এ অফিসে নিয়মিত ভিজিটররা কে কার কাছে আসে, সব তার জানা।

রণিতাও হাসে। তারপর মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে থ্যাঙ্ক য়ু বলে রিসেপশান কাউন্টারের পাশ দিয়ে লিফটের দিকে চলে যায়।

তেতলায় আসতেই দেখা যায় নিউজ ডিপার্টমেন্টের প্রকাণ্ড হল-টা প্রায় ফাঁকা। সাব-এডিটরদের কেউ কেউ অবশ্য এসেছে। রিপোর্টিং সেকশানে অমিতেশ ছাড়া কেউ নেই, পার্সোনাল কম্পিউটারে বোম টিপে টিপে কী যেন কম্পোজ করছিল।

নিঝুম, প্রায় নির্জন হল-টায় সদা তৎপর টেলিপ্রিন্টার মেশিন দুটো শুধু খটখট আওয়াজ তুলে হিন্নি-দিল্লি-মক্কা-মদিনা-লন্ডন-প্যারিসের খবর দিয়ে যাচ্ছে। রণিতা জানে, খবরের কাগজের অফিস, বিশেষ করে নিউজ ডিপার্টমেন্ট জমে ওঠে বিকেলের পর থেকে। মারাত্মক কোনো ঘটনা না ঘটলে সকালের দিকটায় এখানে জড়িয়ে থাকে ঢিলেঢালা, আলস্যের ভাব।

রণিতাকে দেখে কম্পিউটারে কম্পোজ বন্ধ করে অমিতেশ বলে, এস এস। একেবারে ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটি! এগারোটা মানে এগারোটাই।

একটু হেসে মুখোমুখি এসে বসে রণিতা।

অমিতেশের বয়স তিরিশ একত্রিশ। বেশ ভাল হাইট তার। লম্বাটে মুখে সযত্নে ছাঁটা দাড়ি, চুল ব্যাকব্রাশ করা, গায়ের রং তামাটে, চওড়া কপাল, বড় বড় চোখের দৃষ্টি শান্ত কিন্তু দুরভেদী। পরনে এই মুহূর্তে দামি কটনের ট্রাউজার আর টি-শার্ট। বাঁ হাতে চৌকো জাপানি ঘড়ি।

অমিতেশ বলে, এডিটরের পারমিশান পেয়ে গেছি। তারপর ফোন তুলে অপারেটরকে সম্পাদকের ঘরে লাইনটা দিতে বলে। যোগাযোগ হলে সে জিজ্ঞেস করে, স্যার, রণিতা এসে গেছে। ওকে কি নিয়ে যাব?

ওধার থেকে খুব সম্ভব সম্পাদকের সম্মতি পাওয়া যায়। ফোন নামিয়ে রেখে অমিতেশ বলে, চল, এডিটর তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।

রণিতা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলে, কী ব্যাপার? এর আগেও কত বার তোমাদের লাইব্রেরিতে পেপার টেপার দেখেছি, উনি তো কখনও দেখা করার কথা বলেননি।

এবার দরকার হয়েছে। এস।

হল-ঘরের ডান দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে সম্পাদক পরাশর বসুর চেম্বার। আগাগোড়া কাঠের প্যানেল-করা চেম্বারটা চমৎকার সাজানো। দামি কাশ্মীরি কার্পেটে ওয়াল টু ওয়াল গোটা ফ্লোরটা মোড়া। কাঁচ আর কাঠের সুদৃশ্য ক্যাবিনেট অজস্র রেফারেন্সের বই। মাঝখানে বিশাল অর্ধবৃত্তাকার টেবলের ওধারে সম্পাদকের পুরু গদিওলা রিভলভিং চেয়ার। টেবলের এধারে আরো ডজন দেড়েক চেয়ার, সেগুলো দর্শনার্থীদের জন্য। টেবলের ওপর দশ বারোটা নানা রঙের টেলিফোন, কিছু ফাইল, পেন-হোল্ডারে গোটাকয়েক পেন যার সবগুলোই বিদেশি। আর আছে টেবল ক্যালেন্ডার, একটা বড় গ্লোব, ঘোট কম্পিউটার ইত্যাদি।

রণিতারা ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে আছেন পরাশর। বয়স ছাপ্পান্ন সাতান্ন, নিখুঁত কামানো মুখ, গায়ের রং লালচে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ভারি গম্ভীর মুখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখামাত্র টের পাওয়া যায় এই মানুষটির মধ্যে রয়েছে প্রবল, অনমনীয় এক ব্যক্তিত্ব।

পরাশর বলেন, বসুন মিস মিত্র, তুমিও বসো অমিতেশ।

রণিতারা টেবলের এধারে তাঁর মুখোমুখি বসে পড়ে।

পরাশর রণিতার দিকে তাকিয়ে বলেন, আগে কফি খান, তারপর কাজের কথা শুরু করা যাবে।

দিনকাল অফিসে মাঝে মাঝে এলেও পরাশরের সঙ্গে আগে রণিতার আলাপ হয়নি। আলাপের কারণও ছিল না। লাইব্রেরিতে কাগজপত্র দেখার পারমিশান তাকে বরাবরই এনে দিয়েছে অমিতেশ। ব্যস, ঐ পর্যন্ত। তবে পরাশরকে অনেক বার দূর থেকে দেখেছে সে! অল্প হেসে বলে, ঠিক আছে।

বেয়ারাকে দিয়ে কফি আনিয়ে হালকা চুমুক দিতে দিতে পরাশর বলেন, অমিতেশের কাছে শুনলাম নয়নতারাকে নিয়ে আপনি একটা ডকু-ফিচার করতে চাইছেন। এ ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড।

টেবল থেকে কফির কাপ খানিকটা তুলেছিল রণিতা, আস্তে আস্তে সেটা নামিয়ে রাখে। পরাশরকে লক্ষ করতে করতে তার আগ্রহের কারণটা বুঝতে চেষ্টা করে।

পরাশর জিজ্ঞেস করেন, প্রোজেক্টটা কী অবস্থায় আছে?

রণিতা বলে, কী অবস্থায় বলতে?

অমিতেশ বলছিল দূরদর্শন ওটাকরার জন্যে আপনাকে কমিশন করতে চায়।

হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে ওদের এগ্রিমেন্ট হয়ে গেছে?

এত কথা কেন পরাশর জানতে চাইছেন, বুঝতে পারছিল না রণিতা। সে বলে, এখনও হয়নি। দিন পনেরোর ভেতর ওরা আমাকে দিল্লি যেতে বলেছে। আশা করি তখন হয়ে যাবে।

পরাশর বলেন, যদি কোনো কারণে না হয় জানাবেন। আমরা প্রোজেক্টটা স্পনসর করব।

খুব অবাক হয়ে যায় রণিতা। বলে, আপনারা কি অডিওভিসুয়াল মিডিয়ায় আসতে চাইছেন?

প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে ওর তো কোনো বিরোধ নেই। হেসে হেসে পরাশর বলেন, অডিওভিসুয়াল মিডিয়া ভীষণ পাওয়ারফুল। আমরা ঠিক করেছি ঐ মিডিয়াতেও কিছু কাজ করব। নয়নতারার ওপর ডকু-ফিচার দিয়ে শুরু করতে পারলে রাতারাতি নেশানওয়াইড পাবলিসিটি পেয়ে যাব। আ ফ্যান্টাসটিক বিগিনিং।

রণিতা বলে, আপনাদের স্পনসরশিপে করতে পারলে ভালই হত কিন্তু দূরদর্শন প্রোজেক্টটা ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।

একান্তই যদি না ছাড়ে, আমার অন্য একটা পোপোজাল আছে।

বলুন।

নয়নতারা সম্পর্কে একটা ধারাবাহিক লেখা আমাদের কাগজে লিখুন। কিভাবে তিনি স্টেজ এবংফিল্মে এলেন, কী কী ছবি করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সব ডিটেলে চাই। যে আট বছর তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন, তাঁকে খুঁজে বার করে সেই পিরিয়ডটার ওপর বিশেষভাবে জোর দেবেন। সেই সঙ্গে চাই এখনকার বিভিন্ন মুডের প্রচুর ছবি। প্রতি সপ্তাহে কাগজের একটা ফুল পেজ আপনাকে দেব। অ্যান্ড য়ু নো আওয়ার পেমেন্ট ইজ নট ব্যাড। উই উড পে হ্যান্ডসামলি। বলতে বলতে একটু থামেন পরাশর। টেবলের ওপর অনেকটা ঝুঁকে ফের শুরু করেন, সব মেটিরিয়াল তো আমাদের লাইব্রেরিতে পাবেন না। নানা জায়গায় ছোটাছুটি, বহু লোকের সঙ্গে মিট করা, স্টেশনারি–এ সবের জন্যে প্রচুর খরচ আছে হবে। আপাতত হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

নয়নতারা সম্পর্কে মানুষের অফুরন্ত কৌতূহল। রণিতা বুঝতে পারছিল, তাঁর একটা ক্যানডিড বায়োগ্রাফি অর্থাৎ খোলামেলা অকপট জীবনী, বিশেষ করে অজানা রহস্যময় গত আটটি বছরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যদি নিয়মিত বেরুতে থাকে, নিকাল-এর সার্কুলেশন দেড় দুগুণ বেড়ে যাবে। পরাশরের আগ্রহ বা ইন্টারেস্টটা সেখানেই। সে বলে, এখন টাকা লাগবে না। কাজটা তো শুরু করি। পরে দরকার হলে বলব।

একটু চিন্তা করে পরাশর বলেন, ঠিক আছে। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে।

কী কথা?

লেখাটা কিন্তু আমরাই ছাপব। আমার অনুরোধ এ নিয়ে অন্য কোন কাগজের সঙ্গে কথা বলবেন না।

ঠিক আছে। কিন্তু—

আবার কী?

দ্বিধান্বিতভাবে রণিতা এবার বলে, কাগজে লেখার অভ্যাস তো আমার নেই। স্ক্রিপ্ট ছাড়া কিছুই লিখিনি। কেউ হেল্প না করলে আমি কি পারব?

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন পরাশর। অমিতেশের দিকে তাকিয়ে বলেন, মিস মিত্রকে তুমি সাহায্য করবে। ইটস আ সিরিয়াস ওয়র্ক। যখনই দরকার হবে অফিস থেকে এর জন্যে ছুটি নেবে।

আস্তে মাথা নাড়ে অমিতেশ।

পরাশর এবার রণিতাকে জিজ্ঞেস করেন, ছবি তোলার জন্যে তো লোক চাই। যখনই বলবেন, আমাদের একজন স্টাফ ফোটোগ্রাফার সব সময়ের জন্যে আপনাকে দিয়ে দেব।

রণিতা বলে, লাগবে না, ছবি আমিই তুলে নিতে পারব।

একটু চুপ।

তারপর পরাশর বলেন, কিভাবে কাজ শুরু করবেন, কিছু ঠিক করেছেন?

পরাশরকে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয় রণিতা।

পরাশর বলেন, ফাইন। আমার একটু সাজেশান আছে।

বলুন।

এর সঙ্গে আমাদের কাগজে বক্স নাম্বারে একটা নোটিশ দিয়ে দিন। নয়নতারাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানে, ফিল্ম আর স্টেজ ওয়ার্ল্ডের ভেতরে এবং বাইরে এমন বহু মানুষ এখনও বেঁচে আছে। লিখবেন তাদের কাছে যদি কোনো অজানা তথ্য বা ফোটো থাকে যেন পাঠিয়ে দেয়। মনে হয়, এতে ভাল কাজ হবে। কুড়ি দিন পর পর দুমাস ধরে নোটিশটা বেরুবে। প্রথম বার মিস করলেও সেকেন্ড বা থার্ড টাইমে লোকের নজরে পড়বেই।

রণিতা বলে, গুড আইডিয়া। কিন্তু নোটিশটা কিভাবে দেব?

পরাশব বলেন, ও ব্যাপারে আপনাকে ভাবতে হবে না। অমিতেশকে বলেন, তুমি একটা ড্রাফট করে অ্যাড ম্যানেজারের হাতে দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে।

অমিতেশ বলে, আচ্ছা স্যর।

পরাশর বলেন, তা হলে মিস মিত্র, আপনি লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ আরম্ভ করুন। গুড লাক।

রণিতা আর অমিতেশ উঠে দাঁড়ায়। রণিতা বলে, থ্যাঙ্ক য়ু স্যর।

সম্পাদকের কামরা থেকে বেরিয়ে সোজা চারতলায় লাইব্রেরিতে চলে এল রণিতারা।

প্রায় সাত আট হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে উঁচু উঁচু কাঁচ আর কাঠের বুক কেসের ভেতর অজস্র বই এবং ম্যাগাজিন। আর আছে বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি ভাষার অজস্র খবরের কাগজ, সাল তারিখ অনুযায়ী সেগুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের পুরনো কাগজ মাইক্রো ফিল্ম করে রাখার ব্যবস্থাও আছে এখানে।

একধারে কোমর-সমান উঁচু ঘেরা জায়গায় লাইব্রেরিয়ান জ্যোতির্ময় বসাকের চেম্বার। এখন তিনি সেখানেই বসে আছেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, পাতলা মেদহীন চেহারা, ধারাল নাক মুখ, সরু থুতনি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ডান দিকে সিথি। চোখে হালকা ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। পরনে ট্রাউজার আর শার্ট। তাঁর সামনের মস্ত টেবলটায় বই আর ম্যাগাজিনের স্তূপ। দেখেই বোঝা যায়, ওগুলো নতুন এসেছে, এখনও নাম্বার লাগিয়ে বুক-কেসে ভোলা হয়নি। এছাড়া আছে টেলিফোন, কিছু ফাইল, টেবল ক্যালেন্ডার, ইত্যাদি।

জ্যোতির্ময় বসাকের তিন জন অ্যাসিস্টান্ট। কাল মর্নিং আর ইভনিং এডিশানের যে সব কাগজ এসেছে দুজন সেগুলো মোটা নাইলনের সুতো দিয়ে গেঁথে ফাইল করে রাখছে। অন্য অ্যাসিস্টান্টটি বইয়ের ধুলো টুলো ঝেড়ে সাফ করছে।

জ্যোতির্ময় অমিতেশদের দেখে ডাকেন, আরে এস এস—

অমিতেশ জ্যোতির্ময়ের সামনে গিয়ে বসে।

আগেই রণিতার সঙ্গে জ্যোতির্ময়ের আলাপ হয়েছিল। হাসিমুখে চোখের ভুরু সামান্য তুলে বলেন, কী ব্যাপার রণিতা, এবার তোমার ডকুমেন্টারির কী থিম? রণিতাকে তিনি তুমি করেই বলেন।

রণিতা মজা করে হাসে, ও বাবা, বসতে না বসতেই কাজের কথা!

কাজ ছাড়া কি তোমার দর্শন পাওয়া যায়? জ্যোতির্ময়ও হাসতে থাকেন।

কথাটা ঠিক। একটু লজ্জা পেয়ে রণিতা বলে, অকারণে এসে আপনার সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তাই–

জ্যোতির্ময়ের দুই চোখ নেচে ওঠে। বলেন, খুব শাহেনশা মেয়ে! চমৎকার ম্যানেজ করেছ। আজকালকার ছেলেছোকরাদের ইডিয়মগুলো তিনি ভালই জানেন এবং জায়গামতো প্রয়োগও করে থাকেন।

রণিতা শুধু হাসে, উত্তর দেয় না।

জ্যোতির্ময় এবার বলেন, নো সঙ্কোচ, নো লজ্জা, বল তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।

অমিতেশ রণিতার নতুন প্রোজেক্টটার কথা জানিয়ে দেয়।

নয়নতারা! দ্যাট গ্রেট লেডি অফ স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিন! বলে ভুরু কুঁচকে, চোখ বুজে অনেকক্ষণ যেন ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন জ্যোতির্ময়, সেই অবস্থাতেই একসময় বলে ওঠেন, যতদূর মনে পড়ছে, ওঁরা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গলের রিফিউজি, নাইনটিন ফর্টিনাইনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ফিফটিতে সিনেমায় নামেন। ফার্স্ট ছবি ফ্লপ, সেকেন্ড ছবি ফ্লপ, থার্ড ছবি ফ্লপ, ফোর্থ ছবি ফ্লপ, ফিফথ অ্যাভারেজ বিজনেস। ফিফটি টুতে ওঁর সিক্সথ ছবি জন্মভূমি রিলিজ করল। সুপার ডুপার হিট। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। জন্মভূমি থেকেই একটা লিজেন্ডের জন্ম হল, শুরু হল ফ্যাবুলাস এন্ডলেস সাকসেস স্টোরি। বলতে বলতে চোখ খুলে ব্যস্তভাবে একজন অ্যাসিস্টান্টকে ডাকেন, সুরেশ, ডানদিকের ওয়ালের চার নম্বর বুক-কেসের ফিফথ তাক থেকে নয়নতারার ওপর চারটে ফাইল আছে। নিয়ে এস।

রণিতা জানে, এই লাইব্রেরির কোন আলমারি বা বুক-কেসে কোন ফাইল, কোন পেপার কাটিং বা বই আছে, সব চোখ বুজে বলে দিতে পারেন জ্যোতির্ময়।

বছর চল্লিশ বয়স সুরেশের, মাঝারি হাইট, নিরেট চেহারা। দুমিনিটের ভেতর চারখানা ঢাউস ফাইল এনে জ্যোতির্ময়ের টেবলে রাখে।

জ্যোতির্ময় রণিতাকে বলেন, এর ভেতর শুধু আমাদের কাগজেরই না, অন্য লিডিং ডেইলিরও বেশ কিছু পেপার কাটিং রয়েছে। আপাতত এগুলো দেখ। পরে ম্যাগাজিনের কাটিং আর ওঁর ফোটোও দেব। মনে হচ্ছে নয়নতারার সাত ভলিউম ফোটো অ্যালবাম আছে আমাদের লাইব্রেরিতে।

রণিতার ধারণা ছিল, উনিশ শ পঞ্চাশে নয়নতারা যখন প্রথম সিনেমায় নামেন সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব কাগজ ঘেঁটে ঘেঁটে তথ্য বার করতে হবে। এত সহজে সব পাওয়া যাবে ভাবতে পারেনি সে। জ্যোতির্ময় যেন তার জন্য সমস্ত কিছু আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। মনে মনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে বণিতা।

হল-ঘরের মাঝখানে টানা লম্বা টেবলের দুপাশে সারি সারি চেয়ার পাতা রয়েছে, ওখানে বসে পড়ার ব্যবস্থা।

ফাইলগুলো নিয়ে রণিতা আর অমিতেশ পড়ার টেবলে চলে আসে।

অমিতেশ চারদিক ভাল করে লক্ষ করে গলা নামিয়ে বলে, তোমার এখানকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি কিন্তু এখনও সাসপেন্সে ঝুলে আছি। পূজ্যপাদ ভাবী শ্বশুরমশাই কী বললেন, এখনও জানাও নি।

রণিতা এই নিয়ে খানিকটা মজা করতে পারত, করল না। প্রথমত, নয়নতারা সম্পর্কিত পেপার কাটিং এবং ছবিগুলো দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে সে খুবই উদগ্রীব হয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, এই লাইব্রেরি ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনার জায়গা নয়। তার জন্য আলাদা মুডও দরকার।

রণিতা বলে, বাবার সাপোর্ট আছে কিন্তু বিয়েটা তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হয় না। হোল ব্রিগেড অব রিলেটিভস ক্রিশ্চানকে বিয়ে করছি জানলে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার বাধিয়ে দেবে। বাবা তাদের সামলাবার জন্যে সময় চেয়েছেন। ততদিন ধৈর্য ধরে ওয়েট করতে হবে, বুঝলে?

দুই হাতের তালু উলটে দেয় অমিতেশ। তার মুখে বিষণ্ণ হাসি ফোটে। বলে, বুঝলাম।

এবার যাও। আমি ফাইলগুলো খুলি।

যাচ্ছি। আমারও কটা জরুরি কাজ আছে, সেগুলো সেরে ফেলি। তুমি কতক্ষণ এখানে থাকবে?

চারটে, সাড়ে চারটে পর্যন্ত।

তখন আসব।

আচ্ছা।

অমিতেশ চলে যায়।

.

০৫.

দিন দশক কেটে গেল। এর মধ্যে দৈনিক কাগজের ফাইলগার ম্যাগাজিন ঘাঁটাঘাঁটি করে নয়নতারার অভিনয় জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়ে গেছে রণিতার। প্রচুর নোট নিয়েছে সে।

উনিশ শ পঞ্চাশে সিনেমায় নামার পর থেকে ছিয়াশিতে নিরুদ্দেশ হবার আগে পর্যন্ত সবসুদ্ধ একশ একুশটা ছবিতে নয়নতারা নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। জ্যোতির্ময় যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। প্রথম চারটে ছবির সবগুলোই তাঁর ফ্লপ হয়েছে। কুড়িটা ছবি মোটামুটি ব্যবসা করেছিল। বাকি সাতানব্বইটা ছবির প্রতিটি বক্স-অফিসের দিক থেকে দু কোটি টাকা পর্যন্ত লাভ করেছে। এ সবের কারণ নয়নতারার প্রবল স্ক্রিন পার্সোনালিটি, চমৎকার অভিনয়ের ক্ষমতা, চোখ-ঝলসানো গ্ল্যামার। তাঁর হাসিটি ছিল এমনই মাদকতাময় যে দর্শকের হৃৎপিণ্ডে ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিত। পনেরো বছরের কিশোর থেকে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সব পুরুষের তিনি স্বপ্নের নায়িকা। তাঁর যে কোনো ছবি রিলিজ হওয়া মানেই তখনকার দিনের বিরাট ঘটনা। কম করে বানো চোদ্দ উইক প্রতিটি শো থাকত হাউসফুল। ব্ল্যাকাররা রমরমা ব্যবসা করত, পাঁচ টাকার টিকিট বেচত পনেরো কুড়ি টাকায়। তারা চাইত অন্তত মাসে একটা করে তাঁর ছবি রিলিজ করুক।

প্রথম সত্তর আশিটা ফিল্মে নয়নতারা ছিলেন মামার কুইন। দেখা গেছে সেই সময়ের কোনো কোনো প্রতিবেদক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন সেক্স বম্ব। কিন্তু সত্তরটার মতো ছবি হয়ে যাবার পর তাঁর অভিনয়ের স্টাইল আগাগোড়া পালটে যায়। বদলে যায় তাঁর ইমেজ। আর মামার বা সেল নয়। তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এমন এক শিল্পী যিনি বহুবর্ণময় জীবনকে নানা দিক থেকে ছুঁতে চান। এই সময় তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন আর অর্থহীন, অসার রোমান্টিক রোলে নামবেন না। এখন থেকে তাঁর ভূমিকাগুলি এই রকম। কখনও অধ্যাপিকা, কখনও প্রতিবাদী গৃহবধু, কখনও ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, কখনও ফায়ারব্র্যান্ড রাজনৈতিক নেত্রী, কখনও বহুজনের হিতে নিবেদিত মিশনারি নান বা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। নয়নতারার নতুন ইমেজ সারা দেশকে চমকে দিল।

গ্ল্যামার কুইন হিসেবে তিনি মানুষকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। এবার যা পেলেন তা হল মর্যাদা আর শ্রদ্ধা। তাঁর প্রতি আকর্ষণ কিন্তু এতটুকু কমল না, পুরনো জনপ্রিয়তা অটুট থেকে গেল।

ফিল্ম কেরিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চে যোগ দেন নয়নতারা। মোট একুশটি নাটকে অভিনয় করেছেন। এর কোনোটাই প্যানপেনে, স্যাঁতসেতে, আবেগসর্বস্ব নয়। বেশির ভাগেরই বিষয় নানা সামাজিক সমস্যা, মূল্যবোধের ক্ষয় বা অস্তিত্বের সঙ্কট। নাটকগুলি, বিশেষ করে নয়নতারার অভিনয় দর্শককে অভিভূত করে ফেলল। একেকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়, আর নতুন করে দেশ যেন তাঁকে আবিষ্কার করে।

এত জনপ্রিয়তা, মানুষের এত শ্রদ্ধাই শুধু নয়, এর পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে রয়েছে অজস্র স্ক্যান্ডাল। রঙিন ট্যাবলয়েড আর ফিল্ম ম্যাগাজিন এবং খবরের কাগজ থেকে এ ব্যাপারে যেটুকু পাওয়া গেছে তা এইরকম। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার কেরিয়ার তাঁর জন্যই নাকি শেষ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের নাম রমাপতি সরখেল। সত্তরের দশকে নয়নতারাকে পাবার জন্য খেপে উঠেছিলেন, উন্মাদের মতো তিনি ওঁর পেছন পেছন সারাদিন ঘুরতেন। এই নিয়ে আবহাওয়া তখন সরগরম, আঁশটে গন্ধের মতো বাতাসে গুজব আর কুচ্ছো উড়ে বেড়াচ্ছে। খবরের কাগজে বোজ দুজনকে নিয়ে মদের চাটের মতো রগরগে মশলাদার স্টোরি বেরুচ্ছে। এতে রমাপতির দলের সুনাম নষ্ট হতে থাকে। উদ্বিগ্ন, ক্রুদ্ধ পাটি লিডারশিপ প্রথমে তাঁকে সাসপেন্ড করে, পরে অনেক ধরাধরির পর সাধারণ মেম্বার হয়েই রমাপতিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে যাঁর আকাশ ছোঁয়ার কথা, তিনি কোথায় হারিয়ে গেছেন কে জানে। যদি এখনও বেঁচে থাকেন, তাঁর হাল পোড়া তুবড়ির খোলের মতো। কেউ তাঁর খবর রাখে না।

নয়নতারার জন্য সেই আমলের একজন ডিরেক্টর বিষ খেয়ে মরেছেন। আরেক জন গলায় দড়ি দিয়েছিলেন, স্ত্রী ঠিক সময়ে দেখে ফেলায় আত্মহত্যাটা আর শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। দুজন বিখ্যাত হিরো নাইনটি সেঞ্চুরির নাইটদের কায়দায় পিস্তল নিয়ে ডুয়েল লড়েছিলেন, খুনখারাপি অবশ্য হয়নি। তবে একজনের ট্রাউজার হাঁটু পর্যন্ত তুললে এক টাকা সাইজের একটা শুকনো কালো দাগ চোখে পড়বে, গুলিটা তাঁর পায়ের মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। নয়নতারাকে নিয়ে এরকম আরো কত যে ঘটনা তার হিসেব নেই।

নয়নতারা বিবাহিত। কিন্তু যাঁকে ঘিরে এত স্ক্যান্ডাল তাঁর দাম্পত্য জীবন কখনও সুখের হয় না। খবরের কাগজে তাঁর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটুকুই শুধু জানা গেছে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি স্বামীর সঙ্গে নয়নতারার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, গলফ ক্লাবের কাছাকাছি একটা বাড়িতে তিনি একলা থাকতে শুরু করেন। তবে কোর্ট থেকে বিবাহ বিচ্ছেদটা হয়েছিল কিনা তার হদিস মেলেনি। এই বাড়ি থেকেই উনিশ শ ছিয়াশিতে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

নয়নতারা আলৌকিক কোনো দেবী নন, ভাল-মন্দ পাপ-পুণ্য স্তুতি-কুৎসার মিশ্রণে রক্তমাংসের উষ্ণ, পরিপূর্ণ এক মানুষী। খবরের কাগজের হলদে হয়ে আসা শুষ্ক পুরনো পাতা আর তাঁর অভিনীত ফিল্মগুলি থেকে কতটুকুই বা তাঁকে পাওয়া যাবে! ডকু-ফিচারটায় জীবনের উত্তাপ, উত্তেজনা আর গাঢ় আবেগ চারিয়ে দতে হলে নয়নতারাকে চাইই চাই।

লাইব্রেরিতে কাগজপত্রের স্কুপের ভেতর মুখ ডুবিয়ে রণিতা যেমন নোট নয়েছে সেই সময় ফিল্ম স্টুডিওগুলোতে গিয়ে নয়নতারার খোঁজ করেছে অমিতেশ কিন্তু কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারেনি।

শেষ পর্যন্ত ওরা ঠিক করেছে, প্রথমে যাবে পুলিশের মিসিং পার্সনস ডিপার্টমেন্টে। ওদের কাছে নিখোঁজ মানুষজনের অনেক খবর থাকে। তারপর দেখা করবে মৃণালের মামা, দি মর্নিং স্টার পত্রিকার প্রাক্তন সিনেমা এডিটর মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে। মৃন্ময় তাঁর সঙ্গে কথা বলে রেখেছে। যে কোনো দিন সন্ধের দিকে রণিতারা মণিময়ের বাড়ি যেতে পারে।

.

আজ দুপুরে লালবাজারে মিসিং পার্সনস ডিপার্টমেন্টে গেল রণিতা আর অমিতেশ। আগেই ওরা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিল।

অফিসার-ইন-চার্জ রণজয় সেন রণিতাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বয়স চল্লিশের নিচে, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা। পুলিশ বলতে যে গভীর ভয়ঙ্কর একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে তিনি মোটেই তা নন। তাঁকে দেখলে মন ভাল হয়ে যায়।

রণজয় হাসিমুখে রণিতাদের বসিয়ে বললেন, বলুন মিস মিত্র, আপনাদের জন্য কী করতে পারি–

এখানে আসার কারণটা জানিয়ে দেয় রণিতা।

রণজয় রীতিমত উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন, নয়নতারাকে নিয়ে ছবি করবেন। দারুণ ব্যাপার। জানেন আমি ওঁর অন্ধ ভক্ত। কিন্তু ম্যাডাম–

রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী?

রণজয় বলেন, ওঁর সম্বন্ধে আমাদের কাছে কোনো ইনফরমেশন নেই।

খুব অবাক হয়ে যায় রণিতা। বলে, এত বড় একজন আর্টিস্ট, আট বছর তিনি নিরুদ্দেশ, অথচ আপনারা তাঁর খবর রাখেন না! স্ট্রেঞ্জ।

দেখুন, নয়নতারার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ এসে আমাদের বলেননি, ওঁকে খুঁজে বার করে দিন।

তাই আপনারা কিছু করেননি! ন্যাশনাল ইন্টারেস্টেও ওঁর খোঁজ করা উচিত ছিল।

তক্ষুণি উত্তর দেন না রণজয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বলেন, যিনি নিজের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন, চেনাজানা কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে চান না, তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লাগানোটা কি ঠিক?

এদিকটা ভেবে দেখেনি রণিতা। সে চুপ করে থাকে। রণজয় বলেন, তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপারও চিন্তা করা দরকার।

উৎসুক চোখে তাকায় রণিতা।

রণজয় থামেন নি, প্রত্যেক মানুষের একটা প্রাইভেট লাইফ আছে। সোসাইটির কারো কোনো ক্ষতি না করে নিজের পছন্দমতো কেউ যদি লাইফ কাটাতে চান, কেন তাঁকে আমরা ডিসটার্ব করব? কারো ব্যক্তিগত জীবনে ইন্টারফেয়ার করাটা শুধু অনুচিতই নয়, অন্যায়ও।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল অমিতেশ। এবার সে বলে ওঠে, কিন্তু—

তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রণজয় বলেন, কিন্তু কী?

নয়নতারা খুব সাধারণ সিটিজেন নন, তিনি বিরাট পাবলিক ফিগার। আমাদের কালচারাল ওয়ার্ল্ডে তাঁর কনট্রিবিউশানের তুলনা নেই। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মান তিনি নিয়ে এসেছেন। ভারতবর্ষ তাঁর জন্য গর্বিত। এমন একজন আউটস্ট্যান্ডিং পার্সোনালিটির আট বছর কোনো খোঁজ নেই, অন্য দেশ হলে কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকত না।

অমিতেশের কথাগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম শ্লেষ ছিল। রণজয় কিন্তু অসন্তুষ্ট হন না, আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, পুলিশের দিক থেকে না হলেও তাঁর অনুরাগী হিসেবে আমাদের সবারই ওঁর খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।

বণিতা সোজা কাজের কথায় চলে আসে, আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে আপনি শুনবেন।

রণজয় উৎসুক চোখে রণিতার দিকে তাকান।

রণিতা বলে, এতদিন কেউ বলেনি, তাই আপনারাও কিছু করেননি। আমাদের বিশেষ অনুরোধ, ওঁর এখনকার ঠিকানাটা জোগাড় করে দিন।

রণজয় চুপ করে থাকেন। মনস্থির করতে হয়তো তাঁর খানিকটা সময় লাগে। তারপর বলেন, পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে, জানতে পারলে উনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন। যতটা সম্ভব গোপনে কাজটা করতে হবে। ঠিক আছে, আপনারা এত বড় একটা প্রোজেক্টে হাত দিতে চলেছেন, সে জন্য এই রিস্কটুকু নেব।

আরেকটা কথা—

বলুন।

ঠিকানাটা যদি সত্যি সত্যিই পাওয়া যায়, প্লিজ অন্য কাউকে জানাবেন না। মিডিয়ার লোকেরা টের পেলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের প্রোজেক্টটাই তখন ভেস্তে যেতে পারে। আমরা চাই এক্সকুসিভলি কাজটা করতে।

রণজয় হাসেন, ঠিক আছে। ঠিকানাটা পাওয়া গেলে আপনারা ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

অনেক, অনেক ধন্যবাদ মিস্টার সেন। আমরা কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিকানাটার জন্য ফোন করে বিরক্ত করব।

বিরক্ত কী! ইটস আ প্লেজার। আপনাদের ফোন নাম্বার দিয়ে যান। হঠাৎ যদি নয়নতারার খোঁজ পেয়ে যাই আমিও যোগাযোগ করব।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *