০১.৪ ফুলের লাগি কতজন হল বিরাগী

ফুলের লাগি কতজন হল বিরাগী

রামপ্রসাদের ভিটে লাগোয়া গৌরিপদ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। গতকাল জেঠিয়ার এক অনুষ্ঠান সেরে এখানেই এসে উঠেছেন কানাই বাউল। বেলপাহাড়িতে থাকেন তিনি। সে এলাকা রাজনৈতিক চাপানউতরে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত। তবে ওসবের খবর রাখেন না তিনি। আর কতদিনই বা তিনি সেখানে থাকেন। বীরভূমের বেদনাশা বটআশ্রমে যতবারই, যে সময়ে আমি গিয়েছি তাঁর দেখা পেয়েছি। এটা তাঁর গুরুর আশ্রম। ছোটখাটো চেহারার বয়স্ক মানুষটি এখানে থাকলেই বোধহয় ভাবগত তৃষ্ণাকে কিছুটা হলেও নিবারণ। করতে পারেন। কতবার তাঁকে দেখেছি গুরুর সমাধি মাটিতে পড়ে-পড়ে কাঁদতে। তবে শুধু তিনি নন, এ সাধন মাটি গায়ে মাথায় মাখতে, এমন কী মুখে দিতেও আমি অনেক বাউল সাধককে দেখেছি। নামকরা বাউল থেকে অচেনা বাউল অনেকেই খ্যাপা বাবার এই সাধনস্থলকে সিদ্ধপীঠ বলেই মনে করেন। এখানে এসে দু’দণ্ড বসেন, হাসেন, কাঁদেন, গান করেন, অরূপের স্পর্শ অনুভব করেন। তবে সকলেই যে খ্যাপার শিষ্য তা কিন্তু নন।

কানাই বাউল জেঠিয়ায় গান সেরে গতকাল রাতেই গৌরিবাবুর বাড়িতে এসে উঠেছেন। আজ পার্শ্ববর্তী এক আসরে গাইবেন তিনি। হালিশহর শ্মশান লাগোয়া ছিন্নমস্তার আশ্রমে বসেছে সেই আসর। বিকেল নিভু নিভু বাতি জ্বালিয়ে নিয়েছ। গঙ্গায় জোয়ার লেগেছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জল খানিক আছড়ে যাচ্ছে পাড়ে। অন্তিম জীবনের কার্যও সমাধা হচ্ছে কান্না আর শোকে। হরিধ্বনি উঠছে।

আলো সাধুর সন্ধ্যা আরতির পর গান ধরলেন কানাই বাউল। বললেন আজ শুধু গুরুর গানই গাইবেন। অন্য কারও নয়। তাঁকে যেন অনুরোধ করা না হয়। কেননা আজই তাঁর গুরু ইহলোকের মায়া কাটিয়ে ভব সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন। আজ তাঁর গুরুদেবের তিরোভাব তিথি।

প্রথমে আসর বন্দনা করলেন তিনি। গুরুকে প্রণাম করে সুর ধরলেন

আনন্দে বল জয় গুরু জয়।
জয় জয় জয়, যম পরাজয়,
জয় জগন্নাথ, জয় কী জয়।
আনন্দে বল জয় গুরু জয়।

এরপর গান শুরু করলেন তিনি। ডুবকিতে চাপর পড়ল। দোতারা, খমকও সঙ্গত দিল সেই মতো। তাঁর চোখে ভক্তিরস আর গাঁজার আচ্ছন্নতা। অল্পবিস্তর মানুষ সেখানে। ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আলো সাধু তন্ময় হয়ে কানাই বাউলের গান শুনছেন। রামপ্রসাদের। হাওয়া লেগে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর গান। বকুলতলা নিগমানন্দের আশ্রমে সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টাধ্বনিও শোনা যাচ্ছে।

আমরা দুই বন্ধু গৌরীবাবুর পাশে বসে। ভাবছি, বাউলের গান কি চৈতন্য ডোবার গৌর মূর্তিতে কাঁপন ধরাচ্ছে? একটু আগেই দেখা গৌরের প্রসন্ন হাসি যেন এখন কানাই বাউলের জর্দার ছোপ লাগা দাঁতে লেগে। একমনে গেয়ে চলেছেন তিনি।

অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনিতে পারে
জলের গড়ন মণিকোঠা, মণির ভিতর জলের ছটা,
জলের দরজায় জলের চাবি খুলা,
সপ্ততালায় নব জলের খেলা, জলের মানুষ হৃদে ভৃগুপদ ধরে।
ওই জলে জল বিহরে, অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনতে পারে।
জলের স্বর্গ জলের মঞ্চ, জলে সপ্ত পাতাল স্থিত,
ওই জলের কল ঘর্ষণেতে, হর ব্রহ্মা বিষ্ণু হলেও মরে।
জলের জানালায় জলের খেল, জল চিনিলে ছাড়বে যমের জ্বালা,
সেই জলের এক বিন্দুতে শতকোটি ব্রহ্মাণ্ড সঞ্চারে।
জলের পর্বতে জলের অরণ্য, জলের বৃক্ষে জলের লতা ধন্য,
 জলের ফুলে ভৃঙ্গরূপে, শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।
জানি শ্যাম কেমন জল, সে জলে ভাঙ্গিল বিধির বল,
জলের ভিতর স্বতঃ রজঃ তমঃ তিন হয়,
মূঢ় কামিনী কয় অবিশ্বাসে নয়, গুরুর চরণে যে জন দৃঢ় করে।

জলের এই কথকতা প্রথম শুনেছিলাম আমি অজয়ের পাড়ে বসে। তখন বাউল পাঠ পড়তে শুরু করেছি সবে বেশ মনে আছে এই কানাই বাউলই প্রথম আমাকে জলের প্রতীকীকলা খুলে ধরেছিলেন একেবারে সদর দরজা হাট করে। জল যে আমাদের শরীর বস্তুরই অংশভাগ–বীর্য-রজঃপ্রবাহ, কানাই বাউল তার প্রথম হদিশ দিয়েছিলেন।

এই গানের প্রথমেই বলা হয়েছে–’অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনিতে পারে। কে এই তিনি? আমরা বলব এ তো জলের ধারার মতোই পরিষ্কার, তিনি হলেন শ্যাম। তাঁর বর্ণনাও তো এখানে আছে–’শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।‘ তারপরেই অবশ্য ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে–’না জানি শ্যাম কেমন জল’ বলে। আর এই না জানা থেকেই উঠে আসে বাউলের অভিজ্ঞান। তিনি কল্পমূর্তির শ্যামে বিশ্বাস রাখেন না। বাউল সাধক। মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নন। সাধারণত কোনো বাউল আশ্রমে কিংবা আখড়ায় কোনও দেবদেবীর পূজা দেখা যায় না। বাউল কখনও কোনও মূর্তির সামনে মাথা নত করেন না। পুস্পাঞ্জলি পর্যন্ত দেন না। বাউলের পূজা বা সাধনা তা সব ওই মানুষকে নিয়েই। এ মানুষ হল অধর মানুষ। খ্যাপা বাবারই গান আছে–সে যে অধর মানুষ/ দেয় না ধরা/ ধরতে হয় এক কৌশলে। / (সে যে) সহজে আসে, সহজে যায়/ (মন) বসে আছে দ্বিদলে। বা, ‘সহজ মানুষ না হলে/ সহজ উপায় বুঝিবে সে কার বলে। / চল সহজে সোজা, ঘুচাও মনের গজা, / নইলে তুলতে নারবি, কর্ম ফেরের বোঝা, / ওহো গুরু মহাজন বলে। অথবা, ‘সহজের পথে চলে যাও/ থেকো না আঁধার ঘরে। / সহজেতে আসে সহজেতে যায়,/ (খ্যাপা) ধরিবে কেমন করে?’

একবার ঘোষপাড়ার মেলায় এক বৃদ্ধ বাউল আমায় বলেছিলেন, বাউল কথার অর্থ হল আসলে গিয়ে অন্বেষণ।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীসের সেই খোঁজ? কাকে খোঁজা? –কেন বাবা, নিজেকেই তো খোঁজা। হেঁড়াফাটা আমিকে একত্র করে দেখা কোথায় কোথায় ফেটেছে তার, রিপু করতে হবে না বাবা। তা করতে গেলে গুরু লাগবে। জ্ঞানতত্ত্ব লাগবে।

‘গুরু’ কথার অর্থও তো তাই। ‘গু’হল গিয়ে অন্ধকার আর ‘রু’ হল গিয়ে আলো। যে বা যিনি শিষ্যকে সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে ঠেলে তোলেন তিনিই তো আসলে গুরু।

আনন্দগোপাল দাস বাউলের একখানা গান আছে। বোলপুরের সুরিপাড়াতে থাকেন তিনি। কেঁদুলির মেলাতে বসেই তাঁর রচিত গানখানি শুনেছিলাম।

আমায় বল গুরু কানে কানে
আমি শুনে যাব মনে প্রাণে
গুরু স্থান দিও ওই শ্রীচরণে
আমি সহজতত্ত্ব জানতে চাই।

এই মানুষের এমনি কঠিন প্রাণ
সে গায় না গুণগান
তত্ত্ব জানবে গুরুর কাছে
তাঁরে করে না সন্ধান।

ও তাঁর কলিযুগের এই তো প্রমাণ
দাস আনন্দ বসে ভাবছে তাই।

বাউলের সেই ‘সহজতত্ত্ব’ জানা তো আসলে নিজেকেই জানা। এই আমি, দেহগত আমি, আত্মগত আমিকে সদগুরুর সাহায্যে জাগিয়ে তোলা। বাউল আসলেই এক জাগরণকলা। এই জাগরণই যে তাঁর গান। শরীরের সামগ্রিক দলিলসমূহ। বাউল তাই-ই লিখে রাখেন তাঁর দেহতত্ত্বের গানে। যে তত্ত্বের চারটি অনুপম যোগ বর্তমান–হঠযোগ, তন্ত্রযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ। আমাদের আলোচ্য খ্যাপা বাবা বা শ্রী শ্রী খ্যাপা মনোহর ঠাকুরের গানে এই চারটি ক্রিয়াকৈবল্যকে আমরা সব সময়েই দেখতে পাই। যে তিনটি গানের কথা আমরা বললাম বাউলের মানুষ বিকাশের পথটিকে ঋজু করতে, প্রশস্ত করতে-সেগুলো সবই আত্মদর্শনের গান। এক অর্থে এ তো সেই বৃদ্ধ বাউলের বলা অন্বেষণই। বাউলের সমস্ত গানকে, সাধনাকে আমরা তো এই অভিধাতেই রাখতে পারি। খ্যাপা বাবার এই গানগুলি জ্ঞানযোগের।

হঠযোগের কথা প্রায়শ বলে থাকেন বাউল। শিষ্যকে এই যোগ আর রেচক, পূরক, কুম্ভক করার উপদেশ আমি অনেক বাউল আশ্রমেই শুনেছি। এই ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু গানও আছে। যেমন–চণ্ডী গোঁসাইয়ের গান: ‘যদি রেচক পূরক কুম্ভক করবি ভাই তবে নাড়ির কপাট খুলা মায়া / শিখে নেগে আগে তাই।‘ নাড়ির এই কপাট খোলার মায়াই হল গিয়ে যোগ। চারপ্রকার যোগের কথা আমরা জানি। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, রাজযোগ, লয়যোগ। মন্ত্রযোগ সর্বপ্রকার সাধনের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে কথিত। ‘মন্ত্র জপান্মনোলয়ো মন্ত্রযোগঃ।‘ অর্থাৎ মন্ত্র জপ করতে করতে যে মনোলয় হয়ে থাকে, তাই মন্ত্রযোগ। তবে একে নিকৃষ্ট অভিধায় ভূষিত করলেও কিন্তু এও বলা হয়ে থাকে: ‘জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ ন সংশয়ঃ।‘ জপই সাধনায় সিদ্ধি এনে দিতে পারে। কালী, কৃষ্ণ, শিব যাই বলি না কেন আমরা এতে বাঁ এই ইষ্ট সাধনায় সিদ্ধি পেতে গেলে জপের ভূমিকা অনিবার্য। বাউলের ইষ্ট মানুষ। তাঁরই ভজনা বাঁ সাধনা সারাক্ষণ বাউলের সাধনা। সেই সাধনার জপ হল গিয়ে গান। বন্দনা। খ্যাপা বাবা নিজেই এ ধরণের বন্দনা গান অনেক লিখে গেছেন। যেমন-’অনুরাগে ভজরে মন,/ পাবি রাধার যুগলচরণ,/ রাধাকৃষ্ণ একাসনে/ ধ্যানে মগ্ন মদনমোহন।‘ বা, ‘আগে নিষ্ঠারতি করগে মনে, পরে করবিরে উপাসনা/মনের ভুল তোর থাকবে না রে দূরে দিবি রে রূপাসনা।‘ অথবা, ‘আমার নয়ন কোণে লুকিয়ে কালা / বাজাল কি মজার বাঁশি। / সুরে প্রাণটি আকুল করে, / ওলো কুল মজাল এই কি বাঁশি।।’ খ্যাপার এই সব গানকেই তন্ত্রযোগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা যাকে মন্ত্রযোগ বলে জানি। বাউল ক্রিয়াকর্ম। তন্ত্রও তো তাই। শরীর আধারিত সব অধ্যায় এই সব লোকায়ত সাধনা। হঠযোগ হল গিয়ে একত্রে সংযোগ। বাউল সাধনে যা অপরিহার্য। গুরু–শিষ্যর। সাধক-সাধক সঙ্গিনীর। গুরু-শিষ্যর সংযোগের একটি বহুল প্রচারিত গানের কথা আমরা সকলেই জানি–’চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে। করবো কি? ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাঁরে তোমরা বলবে কি?’

এই চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা হল গুরু আর শিষ্যর মিলন। এই গানে ব্যবহৃত প্রথম চাঁদ হল গুরুচাঁদ। যিনি শিষ্যকে টানছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। গুরু এখানে যেন কল্পিত একটি বড়োসড়ো চুম্বকখণ্ড। এই চাঁদের গায়েই শিষ্যচাঁদ লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ শিষ্য হলেন। লৌহকণিকা। গুরু তাঁকে নানা প্রাকরণিক কৌশলে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করছেন। দু’জনের দেহই ঈশ্বরের অংশ হয়ে উঠছে যেন। পূর্ণচন্দ্র গুরু। তাঁর আকর্ষণে চন্দ্রাংশ বা শিষ্য মিলিত হচ্ছেন বা হবেন, এতে কারও কিছু করবার নেই। ক্রিয়াশীল এই নিয়ম। এখানে কোনো রকম ভাবনার অবকাশ থাকবার কথা নয়। শিষ্য এখানে নিজেকে মাতৃঅংশ বলে মনে করেছেন। তাই ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। ঝি হল সন্তানতুল্য অভিধা। নিজেকে তিনি মাতৃভাবে প্রতিপন্ন করে গুরুকে সন্তানের আসনে বসাচ্ছেন।

‘হকার কীৰ্ত্তিতঃ সূৰ্য্যষ্ঠকারশ্চন্দ্র উচ্যতে। সূৰ্য্যচন্দ্রমসোর্যোগাদ্ধঠযোগো নিগদ্যতে।।‘ অর্থাৎ, হ শব্দে সূর্য ঠ শব্দে চন্দ্র, হঠ শব্দে চন্দ্র-সূর্যের একত্র সংযোগ। অপান বায়ুর নাম হল চন্দ্র আর প্রাণ বায়ুর নাম হল সূর্য। প্রাণ আর অপান বায়ুর একত্র সংযোগকেই শাস্ত্রে হঠযোগ বলেছে। যোগশাস্ত্রে এই দুই শরীরের বায়ু ত্যাগ-গ্রহণের মাধ্যমেই ক্রিয়াকর্মের কথা বলা হয়েছে।

সব সময়ে গুহ্য ভাষাতেই কথা বলে থাকেন বাউল। কারণ গুরুর নির্দেশ: ‘আপন সাধন কথা না কহিও যথা তথা/ আপনার আমিরে তুমি হইও সাবধান। বাউলের গানও তাই প্রহেলিকাতে ভরা। হঠযোগের চন্দ্র বাউলের সংকেতময়তার বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক। অর্থাৎ সেই ঘুরে ফিরে শ্বাসপ্রক্রিয়ারই কথা কিন্তু হল। জ্ঞানযোগ শরীর জাগৃতির গাণিতিক অধ্যায়ের পর উপলব্ধ বিশ্বাস। মানুষতত্ত্বের প্রতি পুরোপুরি আস্থা। খ্যাপা বাবার গানগুলো তো তাই-ই প্রমাণ করে। ভক্তিযোগ হল মহামিলনের পর। স্থিতাবস্থা। বাবার গানগুলোতে তারই প্রমাণ মেলে–’শ্বাসের মালা-জপরে ভোলা,/ যাবে। রে তোর ত্রিতাপ জ্বালা, / সদা শান্তি পাবি–প্রাণ জুড়াবি/ নয়নে নাচবে যে তোর নন্দলালা।‘ বা, ‘সে দেশে নাই যুবা বৃদ্ধ বালা, / রেবতীর পতি গুরু, নিজে স্বামী নিজে জরু, / পূর্ব দেশে ভূমি মরু, বিনা আগুনে জ্বলিছে আলা। / সে দেশের আলো, সেথা নাই শ্যাম চিকন কালা,/ ওই হাটের তরণি সুর বাঁধা অনাহত গলা।‘

কানাই বাউলের যে গানের কথা বলে আমরা শুরু করেছি তা খ্যাপা বাবার হঠযোগ পর্যায়ের গান বলেই চিহ্নিত রয়েছে। ভক্ত-শিষ্যরা বাবা গানগুলির এক সংকলনও প্রকাশ করে ফেলেছেন। নাম রেখেছেন ‘ক্ষ্যাপাগীতামৃতে আত্মতত্ত্বের সন্ধান’ (বাউল সংকলন)। তাতে কানাই বাউলের মুখে শোনা গানটি দেখি ওই পর্যায়ভুক্ত রয়েছে। আমরা এখন গানটির অন্তর্নিহিত অর্থের ভেতর প্রবেশ করি।

গানটির প্রথমেই যে কথাটি বলা হয়েছে তা হল অনুরাগ ছাড়া তাঁকে চিনতে না। পাড়ার কথা। এই অনুরাগ হল ভক্তি, প্রেম। প্রীতি, আসক্তি তো তাঁর আভিধানিক মানে। বাউল সাধক এর বাইরে বেরোতে চান। কানাই বাউল অজয়ের পাড়ে বসে যখন আমাকে এ গান শুনিয়ে ছিলেন তখন ভরা বর্ষার মাস আসতে শুরু করেছে সবে। তিনি বললেন, অজয়ের অনুরাগ হয়েছে গো। কৃষ্ণের হাওয়া লেগেছে গায়। তাই উতলা হয়ে উঠেছে। যারা শীত গ্রীষ্মের অজয় দেখেছেন কেব্ল তাঁরা ভরা বর্ষার সময় এর রূপ কল্পনায় আনতে পারবেন না। তার রূপ অনেকটা ওই বাউলের গানের মতোই–’জলের গড়ন মণিকোঠা, মণির ভিতর জলের ছটা / জলের দরজায় জলের চাবি খুলা। অজয় যেন তাঁর জলের চাবি খুলিয়ে এ সময় কানায় কানায় ভর্তি করে ফেলেছে জল। আর তা ওই অনুরাগের মতই। উপচে পড়ছে চারিধারে ডোবাচ্ছে। ভাসাচ্ছে। বাউল সাধক এই অনুরাগেই ডুবে মরছেন। যাকে চেনার কথা, জানার কথা, বোঝার কথাও বলা হয়েছে গানে, সে তো সেই সঙ্গীতে আস্থায়ী অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগের মতোই এক পরিণতির প্রক্রিয়া। এই পরিণতি গুরুর নির্দেশে, দেখানো কায়কল্পে নিজের ভেতরকার শরীরী প্রতিসরণ। যাকে চিনবার কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে গানে। বাউল মূর্তিপুজায় বিশ্বাস করেন না এ তথ্যের কথা আমরা। বলেছিলাম। কিন্তু এ তথ্য সব সময় সর্ববিদভাবে সত্য নয়, অন্তত আজকের বাউল অভিধায়। মন্ত্রদীক্ষার সময় মালসাভোগ নিবেদনে অনেক বাউলের মুখেই শুনেছি আত্মগুরু এবং পঞ্চপ্রভুকে তা নিবেদন করা হয়। আত্মগুরু এখানে নিজের গুরুদেব বাঁ তাঁকে আমরা মনগুরু হিসাবেও দেখতে পারি। আর পঞ্চপ্রভু হলেন–গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর। এরা কেউই কিন্তু প্রতিকৃতি নন কেবল কল্পমূর্তির, এটাও যেমন ঠিক আবার একই রকমভাবে ঠিক বাউল আশ্রমে বা কিছু আখড়ায় সন্ধ্যা-আহ্নিকের কর্মে গোবিন্দ মূর্তির ফটো আমি সামনে রাখাও দেখেছি। এ যথেষ্টই বৈষ্ণবীয় আচার। ‘বাউল আর বৈষ্ণব এক নহে তো ভাই’ বলা হলেও অন্তত এক্ষেত্রে এখন অনেকাংশেই একাকার হয়ে গেছে। বাউলের মাধুকরী তো বৈষ্ণব আচারেরই অঙ্গ। তন্ত্রে পঞ্চ ‘ম’ কারে সাধনার নির্দেশ আছে। যে সাধনা সম্পূর্ণরূপে নাড়িকল্পের বৈষ্ণবীয় এক আচার যেটা দেহাচার নয় বলা ভালো হবে সংযমাচার সেগুলোকে বৈষ্ণবীয় আচরণে অনেকটা তন্ত্রের পঞ্চ ‘ম’ কারের মতোই ভিন্ন প্রতীকী অর্থে সাধনা করা হয়। আর এভাবেই তন্ত্র আর বৈষ্ণবীয় আচরণে মাংসসাধক, মুদ্রাসাধক, মৎস্যসাধক, মৈথুনসাধক, মদ্যসাধক আলাদা হয়ে পড়েন। বাউল পঞ্চ ‘ম’ কার নয় পঞ্চভূতে সিদ্ধির কথা বলেন। তাঁদের পঞ্চভূতের সঙ্গে আবার অঘোরী মতের পঞ্চ ‘ম’ কারে কিছুটা মিল রয়েছে। অঘোরী মতে মৃত্তিকা = মুদ্রা, জল = মৎস্য, অগ্নি = মদ, বায়ু = মাংস, মৈথুন = ব্যোম। তবে সাধক ভেদে এর প্রভেদ থাকতে পারে। যেটুকু বুঝেছি প্রতীকী অর্থময়তাতে এসব তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় পার্থক্য কেবল দৃষ্টিকোণের এর বেশি কিছুই নয়। বাউলের পঞ্চভূতে পরে আসছি। এই বিধিকল্প যথাযথ সময়েই পেশ করব। যেটা বলেছিলাম বাউলের অর্চনার কথা।

শিহালাই সহজিয়া সেবাশ্রম, যাকে পাঁচ পিড়ির আশ্রমও বলা হয়ে থাকে। কারণ হল সেখানে হরিদাস মহান্ত, তুলসীবাবা, রমেন দাস, চম্পক বালা, বৈদ্যনাথ দাস–এই পাঁচ বাউল সাধকের সমাধি আছে। এই পাঁচটি সমাধি পরে ধূপ দীপ জ্বালতে দেখেছি সন্ধ্যাকালে শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যকে। খ্যাপা মনোহরের বেদনাশা বটমূলে, খ্যাপার সমাধি মন্দিরেও ধূপ-প্রদীপ জ্বালানো হয় সন্ধ্যাবেলাতে।

লক্ষ্মণ দাস বাউলের আখড়াতেও রীতিমত ধূপ-দীপ-খোল-করতালে গোবিন্দের আরাধনা করা হয়ে থাকে। খেপামা, বেলহরি, দেশচাঁদপুর, তিকরবে, দৌমড়াও–এই আখড়াগুলো লোক মুখে শুনেছি প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করে যথেষ্ট। এখানেও স্বায়ংকর্মে ধূপ-দীপের উপাচার আছে। এসব তো বৈষ্ণবীয় আচারের আখড়ার সন্ধ্যা, চোদ্দ মাদলের সন্ধ্যার নানারূপ ছবিকে মনে করিয়ে দেয়। বেশ প্রাচীন আখড়াগুলোরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে হালের গুলোর অবস্থা কী? ঘোষপাড়ার বাউল-বাউলানির বাড়িতে / আখড়ায় দেখেছি ঠাকুরের সিংহাসন পাতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে রাধাকৃষ্ণ বিরাজমান। কৃষ্ণা দাসীর বাড়িতে লক্ষ্মীর সিংহাসন আছে। তাঁর লক্ষ্মীবারের ব্রতকথা পাঠও স্বচক্ষে দেখা। তবে এরা কেউই তো আর সাধক বাউল নন। গানকে জীবিকা করে কিছু বাউল-আচরণ সঙ্গে করে এরা জীবন নির্বাহ করছেন মাত্র। মহিলা বাউলরাও তো এখন সেবাদাসী, চরণদাসীর ভূমিকা ছেড়ে কেবল গানকেই সাঙ্গ করেছেন। সাধন সঙ্গীকে ছেড়ে অনেকেই দল গড়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। কৃষ্ণা দাসী তাঁর বাউল সাধনের সঙ্গী নবকুমার দাসের সঙ্গ ছেড়ে সেই কবেই দল গড়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। মুড়াগাছার সুমিত্রা দাসী, কল্যাণী সীমান্তর লক্ষ্মীরানি বিশ্বাস, বীরভূম আহমদপুরের ফুলমালা দাসী এরা সবাই এখন গানকে জীবিকা করে নিয়েছেন। ফুলমালা তো ট্রেনে ট্রেনেও মাধুকরী করে বেড়ান। তবে মাটিয়ারীর মীরা মোহন্ত, নবাসনের নির্মলা মা এখনও পুরনো ধ্যান ধারণা পুষে রাখেন। মেয়েদের হাটে মাঠে গান গেয়ে বেড়ানো তাঁদের কাছে গর্হিত অপরাধ। মেয়েদের আখড়ায় বসে সাধনভজনের কালকে আমরা কিন্তু আজকে পরিস্থিতির চাপে অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছি। বাউল সংস্কৃতিতে মহিলাদের বিদ্রোহী সত্তা, সাধন সঙ্গিনী হয়ে কেবল না-থাকা–এই জেহাদ অনেকাংশেই ওই ফেমিনিজমের নামান্তর। দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা, অপমান, বঞ্চনা, অসম্মান থেকে তাঁরা বেড়িয়ে আসতে চাইছেন। সেই প্রক্রিয়াকরণও অনেকদিনই হল জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে। তাই বাউলের ক্ষেত্রে আচরণ নয়, গানই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে, উঠছে কেবল। ধস নামতে শুরু করে দিয়েছে বাউল সংস্কৃতিতে।

এবার আমরা আচরণে ফিরে যাব কানাই বাউলের গানকে সাঙ্গ করেই। বাউল বলছিলেন অনুরাগের কথা।

বললেন–অনুরাগে সায় মেলে।

জিজ্ঞাসা করলাম–কার সাড়া পেতে চাইছেন?

–কেন গো, নিজের অন্তরের সাড়া। সে সায় দিলেই তো আত্মার জাগৃতি হবে।

তবে বাউলের আত্মার ফর্দ অন্য। উপনিষদের ব্যাখ্যার সঙ্গে তা সচরাচর মিলবে না। সে সবে পরে আসছি। আগে কানাই বাউলের উপলব্ধির আসরে খানিক বসি। একতারা বাজাই।

সদাচারী বাউল বলতে যা বোঝায় কানাই বাউল তাই। মন্ত্র দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন খ্যাপাবাবার কাছে। ওখানেই তাঁর নাড়া বাঁধা। তবে ছেলে-মেয়ে নিয়ে তিনি এখন রীতিমতো সংসারী। মেয়েও গান গায়। জামাই বাউল-আসরে ক্যাসিও বাজায়। ছেলেটাও গাইতে পারে। কানাই বাউলের স্ত্রীকেও আশ্রমে সন্ধ্যাবেলায় সাধনার গান গাইতে দেখেছি। বলা ভালো তাঁর বাউলের সংসার। তাঁকে সদাচারী বলেছি এ কারণেই, কানাই বাউলের সেই শুদ্ধ আচরণ ধর্মকথায় তত্ত্বকথায় আবদ্ধ। বাউল সাধনাকে তিনি বহন করে আসছেন এভাবেই। প্রকৃত সাধকের সন্দর্ভ তাঁর নেই ঠিক কথা কিন্তু হৃদয় ও চৈতন্যের অভিমুখে সর্বদাই তিনি দাঁড়িয়ে অভিসারী ভাবনায়।

বললেন–এ জল তোমার শরীরের জল গো। জলের খেলায় সাধক মাতে। জলের মধ্যেই যে উল্টাস্রোতে নৌকাকে বাইতে হয়।

জানি তিনি যা বলেছেন, বোঝাতে চাইছেন তাঁর আকারগত রূপটি বাউলের কেবল অনুভূতির। গানের প্রতীকী আলোকসম্পাত তিনি জানেন ঠিকই, মরমে উপলব্ধি করতেও পারেন। কিন্তু জীবনের স্বতঃসিদ্ধ ধারায় তা কোনোভাবে আর হয়ে ওঠেনি। তবে শুধু তিনি কেন, এখানকার বাউলরা তো প্রায় সকলেই কেবল গানের শাণিত উচ্চারণের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বাউল যে সাধন কৌশল সেই সারবত্তা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। রয়ে যাচ্ছে তাঁর অনূদিত গান। এর কারণগত বিচার-বিশ্লেষণে আমরা কিন্তু বসিনি এখানে। এখানে যেটা বলতে চাইছি বাউল গানের ভেতরে যে মুদিতাক্ষ সৌন্দর্য, শরীরের সেই প্রবক্তাসুলভ আচরণ যা এখন বাউল ধরে রেখেছেন তাঁর তদগত ভাবনায়–সেই শরীরিণী কলাকৈবল্য কীভাবে আমাদের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বা সৃজনশৈলীর মধ্যে ক্রমাগত এক রূপকসর্বস্ব কথকতার জন্ম দিচ্ছে যার মধ্যে আমাদেরই ভাব সংস্কৃতির বিস্তৃত অধ্যায়গুলো সব পড়ে। আমরা এখানে তাকেই কেবল খুলে ধরতে চাইছি। যেটা বলতে চাইছি, বাউল গানের স্বভাব ন্যস্ত অরূপে যে ধরা-ছোঁয়ার অনূদিত শিল্পরূপ তাঁর বিচ্ছুরণ আমরা কেন আমাদের গভীরতর সন্ধিৎসার ভেতর রাখছি না? সেটিকে না রেখে বাউলের সাধনাগত অধ্যায়ের অবক্ষয়জনিত যে ধারাপাত তা নিয়ে ভাবছি। তবে এটাও ঠিক সাধনার প্রক্রিয়াগত যে পুঞ্জ আধার বাউল যদি তা এখন আর জীবনে, যাপনে ধারণ না করেন কেবল গানের আখরগুলোর ভেতর রসাস্বাদনের বস্তুপুঞ্জকে শুধু বিতরণ করেন অনুগত ভক্ত-শিষ্যর মধ্যে তবে সাধন সংস্কৃতির ধারাটি একদিন তত্ত্বধর্মী অগ্নিশিল্পে পরিণত হবে। রূপায়ণ আর হবে না।

কানাই বাউল জলের মণিকোঠায়, মণির ভেতর ছটায় যে ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাওয়া’র কথা বলেছেন সেটিকেই আগে আমরা প্রতিরূপে সাজাই। উল্টা স্রোত হল বিপরীতমুখীতা তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কীসের এই বিপরীতমুখীতা? এই বিপরীতমুখীতা হল যুগল সাধনার গুরু-শেখানো পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সাধকের বীর্যের স্থায়িত্ব রক্ষা করার পদ্ধতিটি গুরু নির্দেশিত পথে করানো হয়।

বাউলের আত্মা। উপনিষদে আত্মা কী? কীভাবে দেখানো হয়েছে তাকে? ‘স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ’–তিনিই আমার স্বরূপ। ‘ওঁ আত্মা বাঁ ইদমেক একাগ্র আসীৎ। আত্মা হল আমি নিজেকে এই আমি? আমি হল পঞ্চেন্দ্রিয়ের শরীর–বাক, নাসিকা, চক্ষু, শ্রোত্র ও মন। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই দেহ দ্বারা অধিগত থাকে। এজন্য এদের আধ্যাত্মিক বলা যেতে পারে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় আবার পঞ্চপ্রকৃতি বা পঞ্চভূতের সঙ্গেও যুক্ত। বাক = অগ্নি, নাসিকা = বায়ু, চক্ষু = আদিত্য, শ্রোত্র = দিক, মন = চন্দ্রমা। আত্মাকে আমরা জ্ঞানের ব্যাপ্তি হিসাবেও দেখতে পারি। ভারী সংজ্ঞায় আমরা যাচ্ছি না। আমরা বলছি আত্মা সৰ্ব্বজ্ঞ। আমার এই যে আদান প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত তার ক্রিয়া দু’প্রকারের। স্বরূপ পরিণাম আর বিরূপ পরিণাম। স্বরূপ পরিণাম কী? আপনার বাঁ নিজের সত্ত্বকে সত্ত্বরূপে, রজকে রজরূপে, তমকে তমরূপে অবস্থান করানো। এগুলো সবই হল ব্যক্তিসত্ত্বার আবরণ। যা নিজের স্বরূপকে বিস্মৃত করিয়ে রাখে। সত্ত্ব হল নিজের প্রকৃতি, স্বভাব, মন–এই তিনটি গুণকে ঠিকভাবে চিনে নেওয়া। রজ হল দর্শনজনিত গুণ আর তম তামসিক গুণ বা অজ্ঞানতাকে দূর করা। আবরণ তিনটি। যা নিজস্ব স্বরূপকে বিস্মৃত করে দেয়। মোহ-দরজা বন্ধ করে দেয়। সাধক এই তিন আবরণ খসিয়ে ফেলে। প্রথম আবরণ তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) যার কথা এতক্ষণ বললাম। দ্বিতীয় আবরণ ছয়টি স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিক্ত, ঝাল, কষা)। তৃতীয় আবরণ পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম)। তিন গুণ আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। পঞ্চভূত আমাদের দৈহিক গঠনকে ঠিক রাখে। ছয় স্বাদ আমাদের দেহের রাসায়নিক অবস্থাকে ঠিক করে দেয়। এভাবেই আমাদের মন ও দেহ এক সুতোয় বাঁধা পড়ে। তার সঙ্গে দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়) যুক্ত হয়ে কুণ্ডলিনী শক্তির উপর চব্বিশটি আবরণ সৃষ্টি করে। কুণ্ডলিনী হল চৈতন্যস্বরূপ। শক্তিরূপবলে শাস্ত্র তাকে চৈতন্যস্বরূপা করে নারীর অভিজ্ঞান দিয়েছে। এই কুণ্ডলিনী বাঁ চৈতন্যস্বরূপ / স্বরূপা যাই বলি না কেন তা যদি নিজের স্বচ্ছ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে তবেই গণ্ডগোল লাগে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। আর দৃষ্টি যদি সে অর্জন করে ফেলে তবে ব্যক্তিসত্ত্বা বাঁ আমিরই সব রকমভাবে জাগরণ ঘটে। আমরা স্বরূপ পরিণাম বুঝলাম। অরূপ পরিণামও একে বলতে পারি। আর বিরূপ পরিণাম কী? পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ আর সেই সময়ে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। পুরুষ হল আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা ধরছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলেই এক সংযোগ। যে যোগে প্রাণের সৃষ্টি হয়। বাউলের আত্মাও এই দেহগত প্রাণকে ঘিরে। কিন্তু তার অবস্থান বস্তুগত। কী এই বস্তু যা বাউলের আত্মাতে সামিল। দুদ্দু শাহর একটি গান আছে, তাতে বলা হয়েছে: বস্তুকেই আত্মা বলা হয়। আত্মা কোন অলৌকিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এতে স্পষ্ট হল না। আরেকটি গানে দুদ্দু বলেছেন: ‘যে বস্তু জীবনের কারণ/ তাই বাউল করে সাধন।‘ এই বস্তু শরীরের রজ-বীর্য। সাধক বাউল নিজেদের শরীরের অন্তঃস্থিত পদার্থকে সংরক্ষণ করেন। কানাই বাউলরা কেবল গানের তত্ত্বকথাকেই ব্যক্ত করেন ধর্ম কথায়। পালন করেন তা কেবল সাধক বাউলরা। তার সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। আরও একটি গানে দুদ্দু মেয়ের চরণ ধরেই সাধনার কথা জানিয়েছেন: ‘সাধন করো রে মন ধরে মেয়ের চরণ। বলেছেন–’পিতা শুধু বীর্যদাতা/ পালন ধারণ কর্তী মাতা/ সে বিনে মিছে কথা সাধন ভজন/ আগে মেয়ে রাজী হবে/ ভজনের রাহা পাবে/ কেশ ধরে পাড়ে নেবে দুদ্দুর বচন।‘

মনোহর খ্যাপার গানটিতে ‘জলের দরজায় জলের চাবি খুলা’ বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনকেই। আর এই তিন দিনই সাধক বাউলকে ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাইতে হয়। বাউলরা বিশ্বাস করেন, মানেন শরীরের ভেতরই পরমেশ্বরের সিংহাসন পাতা। তাঁকে লাভ করাই সাধক জীবনের মোক্ষ। কীভাবে তা সম্ভব? গুরুর শেখানো দম ও শ্বাসের কাজে–হঠযোগে, কুম্ভকে, পূরকে, রেচকে বীর্যের নিম্নগতিকে তাঁরা রুদ্ধ করে দেন। ওপরে উঠিয়ে দিতে তাঁরা পারেন। বীর্য নারীর যোনিতে রমণের পর চিহ্নস্বরূপ লেগে থাকবে না। রীতিমত সেখানে যোনি পরীক্ষার নিয়ম। দুটো শব্দ বাউল ব্যবহার করেন। বিন্দুধারণ’ আর ‘বিন্দুপতন। তার মানে হল বীর্যের গতিবেগকে ওপরে উঠিয়ে নাওয়া হল বিন্দুধারণ। পতন হল বাউল বলেন–’যোনিতে পতন।‘ মানে রমণে বীর্যপাত হয়ে যাওয়া। এই মিলন হয় সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন। বাউল বলেন এই এর উৎকৃষ্ট সময়। এই তিন দিন তাঁরা কামকে এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ স্তরে, তাঁদের মতে প্রেমে রূপান্তরিত করেন। মেয়েদের রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন বাউলের ভাষায় ‘মহাযোগের সময়’। ঠিকঠাক উত্তীর্ণতায় বাউল সিদ্ধ স্তরে। পৌঁছান। তাঁরা বলেন নারী শরীরের মধ্যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্ম আছে। সে সব জেনে বুঝে তারপর হবে ‘জেন্তে মরা’ ‘জেন্তে মরা’ হল কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া।

আমাদের প্রশ্ন, নারী শরীরের মধ্যে যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্মের কথা বাউল বলেন তা শুধু নারী শরীর কেন পুরুষ তথা মানব শরীরেও বর্তমান। তবে বাউল সাধক শুধু নারী শরীরে থাকবার কথা বলছেন কেন? শরীরের নটা চক্রে এই সব পদ্মরূপের কল্পনা করা হয়েছে। কারণ হল পদ্ম কাদায়, পাঁকে জন্মায় কিন্তু নিজে সে পঙ্কিল হয় না। কাদার উপরে সুন্দর ফুল হিসাবে ফুটে থাকে। রামকৃষ্ণদেব আমাদের সংসারে পাঁকাল মাছের মতো থাকবার কথা বলেছেন। পাঁকাল মাছও পাঁকে জন্মায় অথচ গায়ে পাঁক থাকে না। এই কাদা বা পাঁক হল প্রতীকী অর্থে মায়া। এই মায়াকে ভেদ করে পদ্মফুল ফুটছে। পদু সূর্যের আলো পেলেই তার পাপড়ি খোলে। তেমনই আমাদের শরীরের পদ্মগুলো তাঁদের দল খোলে কুণ্ডলিনী শক্তি জেগে উঠলে। সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি পদ্মের উপর জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তবে দেখা যাবে পাপড়িগুলো সব মুড়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন মানুষকে হতে হবে এই জলের উপরে ফোটা পদ্মের মতো পদ্মের পাপড়ি যেমন গায়ে জল পড়লে গুটিয়ে যায় তেমনই ইন্দ্রিয়ের আচরণগুলোও বদ্ধ হয়ে যেতে পারে বিরূপ আচরণে। যার জন্যই যোগক্রিয়ায়, সংযমে তাকে জাগিয়ে রাখতে বলছেন সাধক। যোগীতন্ত্রগুলো আমাদের সেই পথেই নির্দেশিত করেছে বারবার। যোগীগুরু, তন্ত্রসাধকরা এই সব পদ্মে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। মানে শরীর ক্রিয়ায় শরীরকে জাগান। উপাসনা করেন। তন্ত্র সাধনাতেও সঙ্গিনী অনিবার্য। ভৈরবের ভৈরবী অবশ্যই দরকার। তবে তাঁরা রমণের পূর্বে যোনি পূজা, বুক, ললাট, কণ্ঠ, লিঙ্গ ইত্যাদি প্রত্যঙ্গর পূজা সারেন। বাউল তা করেন না। তবে তাঁদের মতও তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মেরও মত সেই কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া। আমাদের প্রশ্ন, যে কোনো মিলনই, নারী-পুরুষের একত্র সম্ভোগই তো আনন্দের, উপভোগের শুধু লোকায়ত সাধনার মিলনে করণকৌশল যেটা তা হল যোনিতে বীর্যপাত ঠেকানো। বস্তুরক্ষা। বাউল নারীর শরীরে এই পদ্ম, ওই পদ্ম বলে সাধন সঙ্গিনীকে মনে হয় উচ্চাসনই দিতে চান। কিন্তু এটা তো ঠিক লালন ফকির, চণ্ডীদাস গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, পদ্মলোচন, দুদ্দু শাহ প্রভৃতি পদকর্তারা তাঁদের সব ক্রিয়াকরণের গানে নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছেন সে সম্মান বাস্তবে নারীর বা সাধন। সঙ্গিনীর এখন নেই। তার কারণ অবশ্যই পুরুষের, সঙ্গীর, সাধকের ব্যভিচার। না হলে আমাদের লোকায়ত সাধন আধার কিন্তু নারীকে যোগ্য আসনই দিয়েছিল। কী তন্ত্র, কী বৈষ্ণব, কী বাউল সাধনে। বাউল, সঙ্গিনীটিকে ‘রাধারানি’, ‘মনের মানুষী’ ইত্যাদি বিশেষণের মালা পরান ঠিকই যেমন তন্ত্রে ভৈরব সঙ্গিনীকে, ভৈরবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এই বিশেষণ, সম্বোধন, মান্যতা, যথাযোগ্য প্রাপ্য স্বীকৃতি সব ছিল এখনকার কারও রচনা নয়। বেশির ভাগটাই সাধক পদকর্তাদের।

খ্যাপা বলেছেন–’সপ্ততালায় নব জলের খেলা, জলের মানুষ হৃদে ভৃগুপদ ধরে।‘ সপ্তপ্তালা কী? আমরা বলব এ হল শরীরের প্রবেশ দ্বারের বা ভেতরের অংশবিশেষ। আমাদের শরীর শুক্র, শোণিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্থি ও ত্বক–এই সাতটি উপাদান দিয়ে তৈরি। যাকে সপ্তধাতুও বলা হয়ে থাকে। বাউল বলেছেন–’সপ্ততালা। অর্থাৎ সমগ্র শরীরে এই জলের খেলা চলছে। সাতটি উপাদানের শুক্রকে বাউল সাধক উর্ধ্বগতিতে নিয়ে যাচ্ছেন কেবল। শুধু বাউল সাধক কেন, তন্ত্র সাধকরাও এই বিধিকর্ম মানেন। পালন করেন। তান্ত্রিকরা বলেন তন্ত্র মন্ত্রমূলক নয়, ক্রিয়ামূলক। মন্ত্রের গুরুত্ব যা কেবল তন্ত্রে তা ক্রিয়াকরণের জন্যই। আমরা বলব বাউলও ক্রিয়ামূলক। মন্ত্রের গুরুত্ব যা কেবল তন্ত্রে তা ক্রিয়াকরণের জন্যই। তার মন্ত্র গানগুলোই। যেগুলো সব ক্রিয়াকর্মের আধারেই বিরচিত। এটা তো ঠিক ‘বাউল গান নয় কোনো’। ‘বাউল’ প্রকৃতপক্ষে দেহবাদী এক সাধনা। গান। তার উপাচার মাত্র। এর বেশি কিছুই নয়। বর্তমানে পরিবেশ পরিস্থিতিতে গানই মুখ্য হয়ে গেছে এই যা। বাউল বলছেন সমগ্র শরীরেই জলের খেলা চলছে। সাতটি উপাদানের শুক্রকে সাধক উধ্বগতিতে নিয়ে যাচ্ছেন কেবল। যাকে ‘সপ্ততালা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই শুক্র ঊর্ধ্বগতিতে উঠে গেলে, বিন্দুধারণ হলে, যোনিতে পতন না। ঘটলেই সাধকের সিদ্ধ স্তর। জলের মানুষ অর্থাৎ বস্তু বা বীর্যরক্ষাকারী মানুষ ‘ভৃগুপদ’লাভ করেন বা করবেন। সাধক সিদ্ধ স্তরে বিচরণ করবেন। ‘হৃদে ভৃগুপদ ধরে’র অর্থ হল হৃদয়ে পর্বতের উচ্চস্থান ধরে রাখা। মানে সাধনায় নির্বিকল্প লাভ করা।

শাস্ত্রে বলছে–’ন তপস্তপ ইত্যাহুর্ব্রহ্মচর্য্যঃ তপোত্তমম্। / উৰ্দ্ধরেতা ভবেদ্‌ যস্তু স দেবো ন তু মানুসঃ।।‘ ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ বীর্যধারণই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট তপস্যা। যে ব্যক্তি এই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে উৰ্দ্ধরেতা হয়েছেন, তিনিই মানুষ নামের প্রকৃত দেবতা। বাউল যাকে ‘বিন্দুধারণ’ বলেছেন। যোগও তাই বলছে–’যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ। সব সময় বিন্দুধারণ করলে যোগীগনের সিদ্ধিলাভ হয়। বীর্য সঞ্চিত হলে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চিত হয়–এই মহতী শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন সম্ভবপর হয়। সন্ন্যাসীর মূলমন্ত্র আসক্তিমোচন। তাই নারী আসক্তি তার থাকবে না একেবারে। সেখানের। দেহসাধনা একক ক্রিয়াকরণের। লোকায়ত দেহসাধনার মতো কখনও যুগলের নয়। লোকায়ত সাধকরা সম্ভোগ সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না কিন্তু কখনও। শুধু ‘বিন্দুধারণ’ পদ্ধতিটিকে রপ্ত করেছেন। নারী আসক্তি তাঁদের রয়েছেই। যুগল সাধনার সৃষ্টিকল্পে আমাদের তাই মনে হয় বেশ বুঝেশুনে পরিকল্পিতরূপে এই ক্রিয়াকরণকে ভাবা হয়েছে। তবে এর পেছনে কারণ আছে। চর্যাপদের সময়কেই যদি আমরা মান্য দেহসাধনার নিদর্শন রূপে সামনে এনে দেখি, তবে দেখব সিদ্ধাচার্যরা সবাই কিন্তু গৃহী। বাউলরাও গৃহী। তাঁদের গৃহ হয়তো আখড়া অভিধার। তান্ত্রিকদের বরং সেই অর্থে গৃহ নেই। তবে এদেরও তো এখন ডেরা আছে। বাউল দেহসাধনা আখড়ায় সম্পন্ন হয়। তান্ত্রিক শরীরসাধনা। অমাবস্যাতে হয়। শ্মশানে ভৈরবীচক্র বসে। সন্ন্যাসীরা যুগলতত্ত্বের ধারেপাশে যান না। ত্যাগই তাঁদের প্রধান কর্ম। তাঁদের মতে ত্যাগের সাধনা না করলে ব্ৰহ্মচিন্তা নিস্ফল। কামিনী কাঞ্চন তাই সেখানে একেবারে নিষেধ। বিন্দুধারণ’ সেখানে কেবল বীর্যকে শুক্রকে উধ্বগমনে নিয়ে গিয়ে অতল আনন্দ লাভ করা।

বাউল ‘জলের জানলায় জলের খেলা’র কথা বলেছেন। বলেছেন–’ওই জলের কল ঘর্ষনেতে, হর ব্রহ্মা বিষ্ণু হলেও মরে।‘ দেহতাদের মরার কথা কেন? তাঁদের অমরত্বে আমরা তো বিশ্বাসী। কিন্তু বাউল তো আর দেবতা বিশ্বাস করেন না। তাই হর ব্রহ্মা বিষ্ণু তাঁদের কাছে শক্তিধর মানুষ। আসলে তো তাই-ই। শিবত্ব প্রাপ্তি কী? তা তো ওই শক্তিরই বিকাশ শরীরের ধৌতকণায়। তাই বাউল বলছেন হর ব্রহ্মা বিষ্ণুও যদি বিন্দুধারণ করতে না পারেন, বীর্যকে নিম্নগতি দিয়ে ফেলেন তবে তারাও পথভ্রষ্ট হবেন। সিদ্ধি আসবে না তাঁদের। যা মরারই নামান্তর। বলা হয়েছে–’জল চিনিলে ছাড়বে যমের জ্বালা’। ‘যম’ কী? যম হল যোগের আটটি অঙ্গের একটি রূপ। ‘যমশ্চ নিয়মশ্চৈব আসনঞ্চ তথৈব চ / প্রাণায়ামস্তথা গার্গি প্রত্যাহারশ্চ ধারণা/ ধ্যানং সমাধিরেনি যোগাঙ্গানি বরাননে।।‘ অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই আটটি হল যোগের অঙ্গ যোগসাধন করতে হলে, স্বরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলে, নিজেকে, আমিকে, আত্মাকে উপলব্ধ করতে হলে এই অষ্টযোগের অভ্যাস বিশেষ প্রয়োজনীয়। অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ এগুলোকে যম বলে। যখন মনের মধ্যে কোনো রূপ হিংসার ছায়া আসবে না। পরের দ্রব্য নেবার ইচ্ছা যখন চলে যাবে তখনই অস্তেয় সাধন হবে। শাস্ত্রে তো বীর্যধারণকে ব্রহ্মচর্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে সম্পর্কে তো আগেই বলেছি। অপরিগ্রহ হল অতিরিক্ত ভোগত্যাগ। খ্যাপা মনোহর এই গানে যমের জ্বালা ছেড়ে যাওয়া বলতে যোগের এই প্রথম ক্রিয়াকর্ম বলে সাধকের উদ্দীপিত ধ্রুপদী প্রতিসরণকেই দেখাতে চেয়েছেন। যে প্রতিসরণে অনুগত ছাড়া সিদ্ধি আসে না। এই অনুগত ভাব আসে জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য দ্বারা। এই অনুগত ভাব অর্জনে গুরুর সহায়তা অবশ্যই প্রয়োজন। সেই সহায়তাতেই ‘জলের এক বিন্দুতে শতকোটি ব্রহ্মাণ্ড সঞ্চারে’–অর্থাৎ বিন্দুধারণে শরীর হয়ে উঠেছে ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ। জলের এই ব্রহ্মাণ্ড প্রাপ্তিতে মানে সাধকের সিদ্ধ দশাতে ‘জলের পর্বতে জলের অরণ্য, জলের বৃক্ষে জলের লতা ধন্য হয়ে যাচ্ছে। যুগল মিলনের শরীরে চরমত্ব প্রাপ্তি ঘটছে। যার জন্যই ‘জলের ফুলে ভৃঙ্গরূপে, শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।‘ ‘ভূঙ্গ’ হল ভ্রমর। বিন্দুধারণে সাধক শরীরে, যুগল শরীরে সিদ্ধির ভ্রমর গুনগুন করে যাচ্ছে আর জলের সেই সরোবরে শ্যাম হংস চরাচ্ছেন। হংস চরানো হল সম্ভোগ করছেন সাধক। সরোবর হল গিয়ে যোনি। রজঃপ্রবাহে সাধক বাউল সম্ভোগ অবস্থাতে বীর্যকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে দিচ্ছেন। তিনি শ্যামরূপ হয়ে উঠছেন। ‘শ্যাম’ এখানে প্রেমের দ্যোতক। কামকে রূপান্তরিত করে নিচ্ছেন তিনি প্রেমে। এই শ্যামরূপ জলে ‘সত্বঃ রজঃ তমঃ তিন হয়।‘ মানে হল এই ত্রিবিধ গুণ আয়ত্তের ফলে ‘তিন’ অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না এই তিন নাড়ি শরীরের আজ্ঞাচক্রের উপরে মিলিত হচ্ছে। যে স্থানে তা হয় তাঁকে বলা হয় ত্রিকূট। বাউল বলেন ‘ত্রিবেণী’। এই মিলনে ‘মূঢ় কামিনী কয়, অবিশ্বাসে নয়, গুরুর চরণ যে জল দৃঢ় করে।‘ সেই-ই এর প্রতিরূপ চিনতে পারে। মানে নিজেকে সিদ্ধ স্তরে নিয়ে যেতে পারে। বাউল গুরুর অনুগত হয়ে সেই পথেই যেতে চান। ‘মূঢ় কামিণী’ হল মোহাবিষ্ট জন, অজ্ঞানতার ফুল। কামিনী এখানে স্ত্রী দ্যোতক নয়। ফুলটি হল সেই শরীরের চক্রকলার চিহ্নিত প্রতীক। এই প্রতীকে ধ্যানে, যোগে তাঁকে চেনা যাবে। তিনি হলেন ‘দেহব্রহ্মাণ্ড।‘ অবিশ্বাসে তা হবে না। হবে গুরুর প্রদর্শিত পদে যে। পথ যথার্থ বাউলের পথে। খ্যাপা তাকেই নির্দেশিত করছেন গানে।

এবার যে গানটির কথা বলব তা শুনেছিলাম কেঁদুলির খ্যাপা বাবার আখড়ায়। তরুণ এক অচেনা বাউল গাইছিলেন সে গান। হাতে একতারা। সুদর্শন। গায়কিতেও ফুলের। রঙ লেগেছে যেন। কণ্ঠ থেকে ফুলেরই শোভা ঝরে পড়ছে।

এক বঁকে তিন ফুল ফুটেছে, লাল, নীল পীত জরদ সাদা,
এক ফুলে সুরসিক বসে, আর এক ফুলে রয় রাধা।
আ মরি কি ফুলের লীলা, ফুলের মাঝে নন্দলালা
ভাঁড় ভেঙে ননী খায় দু’বেলা, বাঁশী বাজায় রাধা রাধা।
সে ফুল আছে থির পবনে, রসিকে তার সন্ধান জানে,
বায়ু বরুণ নাই যেখানে, ফুলেই খায় ফলের মাথা।।
দীন খ্যাপা কয় ফুলের লাগি, কতজন হল বিরাগী,
কেউ বা হল দেশত্যাগী, কেউ পেলরে ফুলের সুধা।

এখন ‘এক বঁকে’ মানে হল গিয়ে নারীর যোনি। সেই বাউল অবশ্য আমাকে বেশ শুদ্ধ ভাষাতেই ‘এক বঁকে’র মানে বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এক বঁকে হল গিয়ে স্ত্রী জননাঙ্গ–বলেই আমাকে বলেছিলেন, এত আগ্রহ আপনার, আপাদের গুরুর আশ্রমে আসুন, সঙ্গ করুন সব জেনে-বুঝে যাবেন, এসব জানতে তো সাধুগুরুর সঙ্গ করতে হয়।

বললাম, খ্যাপা বাবার আশ্রম থেকে আপনি দীক্ষিত নন?

বললেন, না। এখানে তো কেবল মন্ত্রদীক্ষা দেওয়া হয়। তা আমার হয়েছে খ্যাপার আশ্রমেই। উনি তো নেই, দেহ রেখেছেন। ওর ছেলের কাছেই মন্ত্রদীক্ষা হয়েছিল আমার। এখানে নয়, রাধাকুঞ্জ আশ্রমে। তা শিক্ষাদীক্ষার পাঠ নেব ভাবছি।

জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় আপনার গুরুর আশ্রম?

বললেন, শিহালাই, এই বীরভূমেই। পাঁচ পিড়ির আশ্রমের নাম শোনেননি? ওখানেই এখন থাকি। শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যের কাছে নাড়া বেঁধেছি।

ভাবলাম, শিক্ষাদীক্ষার পাঠ ছাড়াই এরা কীরকম গানের ভেতরকার তত্ত্বকথা, শরীর কথার পাঠ নিয়ে ফেলেছেন। কোনোদিনই কি সম্পন্ন হবে ওর শিক্ষাদীক্ষার পাঠ। শিবশঙ্কর দাস তো এখন প্রধানত গানজীবি। বউ-মেয়ে আছে। মেয়েটাও ক্লাস সেভেনে পড়ে তিনি শিক্ষাদীক্ষা দেন কী?

এ গানের মূল কথা, কায়া সাধন; এই বাউলও গড়ে নিয়েছেন ভাবসাধনে। যার বলেই তিনি আমাকে বোঝাতে চাইছেন। আকৃষ্ট করতে চাইছেন। সেই জন্যই তো গুরুর আশ্রমে যেতে বলছেন। অনুসন্ধিৎসু লোকজনকে যদি ভক্ত-শিষ্যরা গুরুর দরবারে নিয়ে যেতে পারেন তবেই তো গুরু তার প্রতি সদয় হবেন। মিলবে অনুষ্ঠানে তার গান গাইবার ছাড়পত্র, গুরু গাইবার আগেই। এই জন্যই তো এই বাউল পিছন ছাড়ছেন না আমার।

খ্যাপার এই গানের প্রথম শব্দ দুটোর প্রতীকী রহস্য ভেদ করে নিয়েছি আমরা। তা নারীর যোনিতে কীভাবে ফুটছে এই তিনরঙা ফুল? অনেক বাউলকে নারীর যোনিকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ও বলতে শুনেছি। বৃন্দাবনে যেমন রাধার রসধারা ঝরে, তেমনি নারীর যোনিতে রজঃপ্রবাহ ঘটে।

-তিন দিনের এই স্রোতধারা গো। তিন দিনে তিন রঙ ধরে। লাল হয় প্রথম দিন, দ্বিতীয়তে নীল, তৃতীয় দিনে সাদা রঙ তার।

অনেকে আবার চার রঙের কথাও বলেন। তিনদিন হল রজঃপ্রবাহের সূচনা দিন থেকে নিবৃত্তির দিন। প্রতিমাসেই এদিন, তিনদিন ঘুরে ফিরে আসে। এজন্য প্রচলিত এক কথাও আছে ‘মাসিক’। এ নিয়ে কমল দাসের একখানা গানও আছে–’মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী/ মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি। / যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা/ একজন কালা একজন ধলা একজনা লালমতী।‘

দেহসাধক নারীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনের ‘মহাযোগ’ এ শরীর যুগলের মিলনকে মনে করে থাকেন রাধাকৃষ্ণের যুগলতত্ত্ব। ত্রিগুণময়ী রাধা সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যার বিবৃতি আমরা ‘কথামৃত’তে পাই ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৫ তারিখে শ্যামপুকুর বাটির কথোপকথনে–’বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে কামরাধা, প্রেমরাধা, নিত্যরাধা। কামরাধা চন্দ্রাবলী। প্রেমরাধা বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। নিত্যরাধা নন্দঘোষ দেখেছিলেন গোপাল কোলে। … নিত্যরাধার স্বরূপ–যেখানে নেতি নেতি বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নিত্য রাধাকৃষ্ণ, আর লীলা রাধাকৃষ্ণ। যেমন সূর্য আর রশ্মি। নিত্য সূর্যের স্বরূপ, লীলা রশ্মির স্বরূপ।‘

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল শ্রীরাধাতত্ত্ব তিনটি স্তরের। চন্দ্রাবলী হলেন আমাদের কামনা-বাসনা, মান-অভিমানের প্রতীকী রূপ। কামধারা তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রাবলীকে কৃষ্ণের সখি না ধরে জ্যোৎস্নারূপও ধরে নিতে পারি। এই রূপ তেজস্ক্রিয়াকে পরিহার করছে। সূর্যের আলোর পরক্ষতা রয়েছে চাঁদের মধ্যে। চাঁদ সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়েও কমনীয়তা বজায় রেখেছে। চাঁদ বাঁ চন্দ্রাবলী তাই প্রেমসংগ্রামের রূপ। সূর্যকে এখানে কাম হিসাবে ধরছি। কাম প্রেমে রূপান্তরিত হচ্ছে যেন। প্রেমরাধা কী? প্রেমরাধা হল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক। যার কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, কেবল সমর্পণ আছে। চৈতন্য তো সেই ভাবরসেই কৃষ্ণের উপাসনা করেছিলেন।

চৈতন্য মঠের সদানন্দ বাবাজি একবার আমায় বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ। আমরা তার ভক্তরা স্ত্রী-স্বরূপা হয়েই তাঁকে ডাকছি,প্রেমরূপে সব সমর্পণ করছি।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, শ্রীকৃষ্ণকে একমাত্র পুরুষ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?

ফিক করে হাসলেন বাবাজি। অল্প দাড়ির গালে হাত বুলোলেন। বললেন, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের পরমাত্মা। হৃদয়ের সচ্চিদানন্দ ঘন আনন্দও ধরতে পারে। এই আনন্দ পুরুষরূপ। তার বিকাশ, প্রকাশ, নারীরূপ। তাই তো মহাপ্রভু নারীরূপ ধরে সেই আনন্দকেই পেতে চেয়েছিলেন।

ঠাকুর বলেছিলেন ‘নিত্যরাধা নন্দঘোষ দেখেছিলেন গোপাল কোলে।‘ যেটা মনে হয় ঠাকুর এখানে ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের’কাহিনীতে আলো ফেলতে চেয়েছিলেন। সেখানেই আছে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আবহাওয়া অনুকূল, এর ভেতরেই নন্দের অনুরোধে যুবতী রাধা শিশু কৃষ্ণকে কোলে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। যেটা মনে হয় নিত্যরাধা বলতে রামকৃষ্ণদেব আসলে নিত্যস্বরূপা পরমা প্রকৃতির কথাই বলতে চেয়েছেন। সাধক নিত্যস্বরূপা পরমা প্রকৃতি বলতে কিন্তু কুণ্ডলিনীযোগকেই বোঝেন। এই যোগেই শরীরের। জানলা-দরজা সব খুলে যায়। শরীরে চৈতন্যের আলো প্রবেশ করে। চৈতন্য হল গিয়ে ‘সচ্চিদানন্দ’। সৎ + চিৎ + আনন্দ। জগৎ সৃষ্টির মূলে তিনটি অবস্থা বর্তমান। সৎ হল অপরিচ্ছন্ন জ্যোতি। সৃষ্টির আদি প্লাজমাও আমরা বলতেই পারি। চিৎ হল হৃদয়ের স্বচ্ছতা। আনন্দ হল পরমশূন্যতা। আবার আরেকভাবেও আমরা ভাবতেই পারি ‘সচ্চিদানন্দ’কে উল্টো দিক থেকে সাজিয়ে নিলে। আনন্দকে অপরিচ্ছন্ন জ্যোতি ধরতেই পারি, সৃষ্টির আদি প্লাজমা হল এটাই। পণ্ডিচেরি বসবাসের কালক্ষেপ সম্পর্কে শ্রীমা একবার বলেছিলেন–’হৃদয়ে যেন আনন্দের পূর্ণঘট বসানো থাকত সর্বদা। একটু এদিক ওদিক হলেই, উছলে পড়বে।‘ এই আনন্দই সৃষ্টিদ্যোতক। দুঃখের একপ্রকার আনন্দ থাকে। তাঁকে চিনতে জানতে-বুঝতে হবে। তবেই না সৃষ্টিক্রিয়ার নকশা বুনতে সুবিধা হবে। চিৎ এবার ধরছি ইদম ব্যতিত অহম বোধ। অর্থাৎ নিজের অহংকারকে বাদ রেখে, সরিয়ে রেখে জাগতিক উৎসের অহংকারকে সাথে রাখতে চাইছি। সৎকে ধরছি পরম শূন্যতা হিসাবে (supervoid))

বাবাজি আমায় বলেছিলেন, ভগবান, শ্রীকৃষ্ণ, লীলা করবার জন্যই দুটো হয়েছেন গো। তাই তো রাধাকৃষ্ণ লীলা। কৃষ্ণের অঙ্গ থেকেই রাধা বেরিয়েছেন।

–মানে আপনি বলতে চাইছেন আমাদের শরীরেরই দুটো রূপ।

–হ্যাঁ গো বাবা, ঠিক তাই।

আমার তখন মনে পড়ছে অর্ধনারীশ্বরের কথা।

বললেন, যা কিছু, যত কিছু তুমি দেখছ সবই পুরুষ প্রকৃতি যোগ।

বাউলও এ কথা বলে থাকেন। সনাতন খ্যাপাকে ঘোষপাড়ায় মেলায় ভক্ত শিষ্যদের বলতে শুনেছিলাম। ওকে ঘাটাসনি তোরা। ও যে স্বয়ং প্রকৃতি।

তন্ত্রসাধক খ্যাপা ব্রহ্মানন্দর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা চলার পর বলেছিলেন, প্রকৃতিরে কিছু জিজ্ঞাসা করবা না। প্রকৃতিরে আগে তুষ্ট কর। তিনি রুষ্ট হলি….

তখন দেখছি মানদা ভৈরবী স্থির হয়ে বসে জপে মগ্ন। ধ্যান ভাঙলে পর কথা প্রসঙ্গে বললেন,পুরুষের যোগে প্রকৃতি সব কাজ করছেন। দু’জনকে ছাড়া দু’জন অচল পয়সা। ফুটো কড়ি। শিবের উপর কালী কী?

–কী?

–পুরুষকে সংহার করছেন প্রকৃতি। প্রকৃতি জাগছেন। আওয়াজ তুলছেন।

আর রাধাকৃষ্ণ? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

ভৈরবী মা খ্যাপার দিকে একবার ফিরে বললেন, এ যে প্রেমে মজেছে গো। রাধাকৃষ্ণ হল গিয়ে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়। সংহার নেই। প্রেমের ঝাঁকুনি আছে কেবল। যা তোমার লেগেছে গো–বলেই হাসলেন ভৈরবী। তার হাসির বিকট শব্দে একাকার হয়ে গেল যেন সব–পুরুষ ও প্রকৃতি।

খ্যাপার গানে রয়েছে ‘এক বঁকে তিন ফুল ফুটেছে, লাল, নীল, পীত জরদ সাদা / এক ফুলে সুরসিক বসে, আর এক ফুলে রয় রাধা।‘ ফুল যে রজঃস্রাব তা এতক্ষণে আমরা বুঝে গেছি। ‘এক ফুলে সুরসিক বসে আছেন–সাধক মিলনে ব্যাপৃত আছেন। আর এক ফুলে রাধা’ আছেন–পরমা প্রকৃতি, সঙ্গিনী, রাধাস্বরূপিনী সেই নারী দেহ, যে দেহের রূপ-উপমায় সাধক বলছেন–’আর মরি কি ফুলের লীলা’। এই লীলারূপে অংশ নিচ্ছেন তো স্বয়ং সাধক। যার জন্যই ‘ফুলের মাঝে নন্দলালা’। যিনি ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন আর বাঁশি বাজিয়ে বলছেন–’রাধা রাধা’ বাঁশি হল গিয়ে নারী দেহ। ‘ভাঁড়’ ভাঙা হল যোনির ভেতর প্রবেশ। সাধনলিঙ্গ যোনির মধ্যে অবস্থান করছে। সাধক। ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন। ননী’ হল কামকে প্রেমরূপে আস্বাদন করে নেওয়া। রাধা এখানে রামকৃষ্ণদেবের সেই ‘কামরাধা’ থেকে ‘প্রেমরাধা’তে পরিণত হচ্ছেন। খ্যাপা বলছেন–’সে ফুল আছে থির পবনে, রসিকে তার সন্ধান জানে, / বায়ু বরুণ নাই যেখানে, ফুলেই খায় ফলের মাথা।।‘

ফল কী? ফল হল দেহপ্রকৃতির নিয়ম। যে নিয়মে সন্তান হয় কিন্তু এখানে ফল হল গিয়ে সাধকের অন্বিষ্ট সেই রজঃপ্রবাহ। যাকে বশে এনে সাধক সেই সিদ্ধ স্তরে যেতে চাইছেন। যে স্তরে যাওয়ার আকুতি গানেতেই ধরা আছে–’দীন ক্ষ্যাপা কয় ফুলের লাগি, কতজন হল বিরাগী, কেউ বা হ’ল দেশত্যাগী, কেউ পেল রে ফুলের সুধা।।‘

‘দেশত্যাগী’ হওয়ার অর্থ হল সাধন-ভজন ছেড়ে দেওয়া। কারণ গুরু নির্দেশিত শ্বাস আর দমের কাজে যে বীর্যকে উধ্বগতি কিছুতেই দিতে পারেনি। এক বঁকে বা নারীর যোনিতে রজঃবীজে তা মিশে গেছে। সেজন্যই অকৃতকার্য হয়ে ‘দেশত্যাগী’ হওয়া। আর যিনি রজঃস্রোতের ভেতর ‘উল্টা স্রোতে’ নৌকা বাইতে পেরেছেন, ‘জেন্তে মরা’ হয়ে যেতে পেরেছেন তিনি বা সেই সাধক দেহপ্রকৃতির সুধাকণা লাভ করতে পেরেছেন। আর তা লাভের জন্যই তো বিরাগী হওয়া। অর্থাৎ কিনা বৈরাগ্য নেওয়া। এ বৈরাগ্য হল গিয়ে সাধন বৈরাগ্য।

এই পদের সামনে আমরা যদি একটু সম্মোহিত হয়ে বসি, তবে দেখব তার ভাষা কীভাবে অমূর্ত এক বিহ্বলতা দিচ্ছে। সেই ভাষা-শব্দের শিল্পময় সিঁড়িটিতে দাঁড়ালেই দেখতে পারব অপ্রতিম এক আনন্দ গ্রাস করছে আমাদের, যে আনন্দ শব্দ সংগীতের দার্শনিক প্রস্থানবিন্দুকে সরিয়ে ফেলে প্রতীকী যৌক্তিকতার প্রকরণকে তৈরি করছে খালি। যার ভাষা-আনন্দ কবিতার সার্বভৌম কলাকেই মূর্ত রাখছে বারবার। তাঁরই সংবেদী অংশীদার হতে চাইছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আভরণ ভেদ করতে চাইছি আমরা।

মন্ত্রগুরুর আখড়াতে তরুণ অচেনা বাউল আরেকটি গানও গেয়েছিলেন সেদিন। ততক্ষণে তিনি অবশ্য চেনা হয়ে উঠেছেন। সুরুলের নিবাসী তিনি। নাম রাজেন দাস। তার পরিবারের তিনকূলে কেউ গান গাননি। তিনি কীর্তন গাইতেন। এখন বাউলে মজে সেখানেই নাড়া বেঁধেছেন। তবে খ্যাপার আশ্রমে তার বাবাও দীক্ষিত। সেই সুবাদেই তিনি হয়তো দীক্ষা নিয়েছিলেন। রাজেন দাস গাইলেন–

অকৈতব গাছের লতা পাতায় পাতায় গৌর জুড়া,
গৌর গোবিন্দ রসে, যুগল হয়ে রইছে খাড়া।।
ছয় গোঁসাই সদা শান্ত, করে পঞ্চভাবে উপাসনা,
কেউ বা হাসে, কেউ বা কাঁদে, কেউ হয়েছে জেন্তে মরা,
রূপ লাবণ্যে ভুবন আলো অমাবস্যার জ্যোতি জুড়া,
পেল তাই রসিক জনা প্রেম সাধনা, ছেড়ে দিলে জেঠা খুড়া।।
 দীন খ্যাপা তুই ঘুচাবে ভুল ছেড়ে দে ওই গোলক ধাঁধা,
ডাক্‌ নিত্য রসে চাঁদ গৌরে, গদাধরের চরণ জড়া।।

‘অকৈতব গাছের লতা’ হল গিয়ে সেই দেহপ্রকৃতি। তাতে পুরুষ এসে যুক্ত হয়েছেন বাউল মতের যুগলভাবে। যে ভাবে পুরুষ ‘গৌর গোবিন্দ’। অকৈতব গাছের। লতাপাতা সমস্তই যুগল হয়ে ‘খাড়া’ হয়ে রয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতি মিলিত হয়ে পড়েছেন। বাউল মতে সাধক ও সাধন সঙ্গিনী। এই মহামিলনে, ‘মহাযোগে’ ‘ছয় গোঁসাই’ শান্ত হয়ে রয়েছেন। চলছে ‘পঞ্চভাবে উপাসনা’। সে যে যথার্থ বৈষ্ণবীয় আচার! বৈষ্ণব মতের ‘পঞ্চভাবে’ পূজা সারছেন ‘ছয় গোঁসাই’। আদতে কিন্তু তা মোটেই না। এখানে যা রয়েছে তা হল বাউলেরই যথার্থ দেহাচার।

পূজার্চনার সময় আমরা যে সমস্ত উপাচার ব্যবহার করে থাকি তা কিন্তু সবই পঞ্চভাবের সমাহার। বাউল একে ‘পঞ্চভূত’, ‘পঞ্চবাণ’ নানাভাবে ব্যবহার করে থাকেন। খ্যাপার গানেই আছে–’পরিপক্ক মুখমালা, ভাব বিভূতি ভোলা / আজ ভূবন মোহিনী পী ধায় গো। / ভাবেরি ঘরেতে রাই আঁখি পালটিয়া চায় / মারল মদন পঞ্চবান গো।‘ বা, ‘পাঁচটা ভুতের হাতে পড়ে মন/ লাগলো মস্ত গণ্ডগোল–/ জন ছয় রিপু আর ইচ্ছা জ্ঞানে / পাকায় যত হট্টগোল। / পঞ্চ ভূতের হাতে পড়ে মন / লাগালো মস্ত গণ্ডগোল।।‘

পঞ্চভূত আমরা জানি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই পাঁচ ভূতকে ‘ব্যোমপঞ্চকং’ হিসাবে চিহ্নিত করছে তন্ত্র। ‘আকাশন্তু মহাকাশং পরাকাশং পরাৎপরম। / তত্ত্বাকাশং সূৰ্য্যাকাশং আকাশং পঞ্চলক্ষণ।।‘ আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ, সূৰ্য্যাকাশ–এই হল গিয়ে পঞ্চব্যোম। পৃথ্বী(ক্ষিতি), জল(অপ), অগ্নি(তেজ), বায়ু(মরুৎ), আকাশ(ব্যোম)–এই পঞ্চতত্ত্ব হল গিয়ে পঞ্চাকাশ। এই পঞ্চাকাশের বাসস্থান আমাদের শরীরের মধ্যে।

কোথায় কীভাবে রয়েছে এই পঞ্চাকাশ? শরীরের নীচের দিক থেকে উপরের দিকে আমাদের যে পাঁচটি চক্র আছে সেগুলো সবই পঞ্চভূতের উপাদান দ্বারা তৈরি। যেমন–মূলাধার চক্রে ক্ষিতির (পৃথ্বী) অবস্থান। স্বাধিষ্ঠান চক্রে রয়েছে অপ (জল)। মণিপুরে তেজ (অগ্নি)। অনাহত চক্রে মরুৎ (বায়ু)। বিশুদ্ধ চক্রে ব্যোমের (আকাশের) উপস্থিতি।

পূজায় দেবদেবীর উদ্দেশ্যে আমরা যে ফুল নিবেদন করি তা ব্যোম/ আকাশের প্রতীক। ধূপ মরুৎ / বায়ুর প্রতীক। প্রদীপ বা দীপ তেজ/ অগ্নির প্রতীক নিবেদিত নৈবেদ্য অপ/জলের প্রতীক। চন্দন, অগুরু ইত্যাদি সুগন্ধি যা লাগে পূজাকার্যে তা সবই ক্ষিতি/ পৃথিবীর প্রতীক।

তন্ত্রে যে পঞ্চ ‘ম’ কারের সাধনা তাও এই পাঁচটি তত্ত্বেরই প্রতীক। যেমন–মদ হল অগ্নি, মাংস বায়ু, মৎস্য জল, মুদ্রা পৃথ্বী, মৈথুন আকাশ। তবে ভিন্ন ভিন্ন সাধক প্রতীকাৰ্থের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেছেন। করলেও এটুকু বলা যায় সবই ওই পাঁচটিকেই ইঙ্গিত করছে।

ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা বলেন তাঁরা যীশুর রক্তমাংস ভক্ষণ করেন। এর মানে কী? যে উৎসবে এটা করা হয় তার নাম ইউকারিষ্ট। এই উৎসবে রুটি মদ ইত্যাদি তাঁরা খান। রুটি হল মাংস, মদ রক্ত। এই রক্তমাংস। একবার নেতাজি বাজারের ছোট্ট চার্চে ফাদার পীটার গেমসের সঙ্গে কথা চলছিল। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলেন তিনি।

বললেন, যীশু কী?

বললাম, কী?

–তাঁর অবতারত্ব তো আসলে প্রতীকময়তাতেই ঢাকা।

–কী সেই প্রতীক? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।

ফাদার বললেন, যীশু মহাপ্রকৃতি। যার মধ্যে আমরা বেঁচে আছি।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম ফাদারের এই প্রতীকময়তার ব্যাখ্যা শুনে।

খ্যাপার গানে পঞ্চভূত আমরা বুঝে নিয়েছি। শরীরের পাঁচটি উপাদান আমরা পেয়ে গেছি যা দিয়ে ধ্যানে, যোগে, ভক্তিতে, বিশ্বাসে উপাসনা করতে হয়। বাউলের সেই উপাসনা শরীর মন্দিরেই চলে। সহজিয়া সাধক শরীরকে মন্দির বলে থাকেন। দেহকে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেন তাঁরা। দেহ আসলেই এক প্রতীককল্পের মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, গুরুদুয়ার–যা ভাবব তাই।

কীভাবে? ভাবনাকে ভাবে, কল্পনায় প্রসারিত করে নিতে হবে আমাদেরকে। ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে যদি শরীরকে কল্পনা করি, ভাবি তবে আমাদের মস্তিষ্ক সেই মন্দির মসজিদ গীর্জা গুরুদুয়ার ইত্যাদির প্রতীক। ধ্যান যোগীরা সাধারণত পদ্মাসনে বসেই করে থাকেন। এই অবস্থাতে বসলে প্রসারিত হাতদুটি মন্দির-মসজিদের খিলান। ভাজস্থ পা দুখানি ভিত্তিভূমি। নাভি হল তাঁর প্রবেশদ্বার। প্রশস্ত বুক সেই অধিষ্ঠানের স্থান। যেখানে প্রতীকে, অনুভবে তিনি বিরাজমান।

এই একই কথা আমাকে সরাটির মৌলবী সাহেব বলেছিলেন। আমার বন্ধু বাবলু শেখের সঙ্গে আমি সেই গ্রামের মসজিদ দেখতে গিয়েছিলাম।

বললাম, দেখতে এলাম আপনাদের মসজিদ।

বললেন, আমাদের এখানে কিছুই দেখার নেই বাবা। সমস্তই তো তাই। তোমাদের ঈশ্বরকেও কি দেখা যায়? যায় না। প্রতীকময়তায় ভেবে নিতে হয়। তুমি যদি ভাবতে পারো তাহলে তোমার শরীরও মসজিদ।

–কীভাবে?

তিনি তখন আমার শরীরী গঠনকে মসজিদ বানিয়ে দিলেন। বললেন, তোমার শরীররূপী মসজিদেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঠ হচ্ছে। রোজা চলছে।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলেন কী মৌলবী সাহেব! কীভাবে সেখানে রোজা চলছে, নামাজ পাঠ হচ্ছে? বুঝলাম তিনিও কোনো প্রতীকময়তায় এর ব্যাখ্যা সারবেন।

মৌলবী সাহেব বললেন, রোজা হল গিয়ে রোজকার কাজ। রুটিন। তা ঠিকঠাক পালনই তো ধর্ম। নামাজ হচ্ছে তোমাদের নামসংকীর্তন। আমি বেশ চমকিয়েই গেলাম গ্রামীণ এক মসজিদ প্রধানের এই কথায়, বিশ্বাসে, ভাবনায়, প্রতীকময়তায়।

খ্যাপার গানের ‘পঞ্চভাবে উপাসনা’ নিয়ে আমরা বিস্তর সব প্রতীককল্পের আলোচনা চালালাম। এবার ‘ছয় গোঁসাই’ এ আসি। বাউল ‘ছয়’ শব্দের মানে করেন ষড়রিপু বা ষটযন্ত্র। আসলেই তাই। এটা তো হল ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–এই ছয়টি ইন্দ্রিয়ের ছলনা বা শত্রু হতে দূরে থাকতে হয় সাধককে। অনেক সাধক এগুলোকে তন্ত্রের পঞ্চ ‘ম’ কারের মৎস্য প্রতীকের মধ্যে রাখেন। তাঁরা বলেন অহংকার, দম্ভ, মদ, পৈশূন্য, হিংসা, মাৎসর্য–এই ছয়টি মৎস্যকে বৈরাগ্যজালে আবদ্ধ করে রাখলে সাধক সত্ত্বগুণের অধিকারী মানুষ হয়ে ওঠেন। গানে এই ছয়টি ইন্দ্রিয় প্রতীককেই শান্ত রাখতে বলা হচ্ছে। খ্যাপা বলেছেন–’ছয় গোঁসাই সদা শান্ত, করে পঞ্চভাবে উপাসনা/ কেউ বা হাসে, কেউ বা কাঁদে, কেউ হয়েছে জেন্তে মরা/ রূপ লাবণ্যে ভুবন আলো অমাবস্যার জ্যোতি জুড়া/ পেল তাই রসিক জনা প্রেম সাধনা, ছেড়ে দিলে জেঠা খুড়া।।‘

বাউল ‘কাম’কে ‘অমাবস্যা’ বলে থাকেন। রজঃপ্রবৃত্তির সময়কেই তাঁরা ‘অমাবস্যা’ হিসাবে ধরে থাকেন। ইন্দ্রিয়গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে নিচ্ছেন সাধক। যুগল সাধনায় কামেন্দ্রিয় অবশ হয়ে গিয়ে প্রেমে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। সাধক বাউল হয়ে। উঠেছেন ‘জেন্তে মরা’। আর তা তিনি হচ্ছেন অমাবস্যাতেই। মাহেন্দ্ৰযোগে। বাউল কথিত ‘মহাযোগে’ এই প্রেম সাধনা চলছে। এই সাধনার আলোকরশ্মি রসিকই কেবল নিতে জানেন। ‘রসিক’ হলেন সাধক বাউল। আর এই রসের চাঁদ গৌরে বলেই ডাকা যায়। সম্বোধন করা যায়। এই ডাক আত্মার জাগৃতি। বাউলের বস্তুরূপী ‘আত্মা’কে সাধক বাউল অমাবস্যাতেই ঊর্ধ্বগতি প্রদান করেন। সিদ্ধরূপে বিচরণ করে তিনি গদাধরের চরণ জড়াতে পারেন। ‘গদাধর’ হলেন গুরুর দ্যোতক। গুরুই তাঁকে সিদ্ধাসনে বসিয়ে দেন। তাই সাধক বাউল গদাধররূপী গুরুর পদযুগল জড়িয়ে ধরেন। এই প্রেম সাধনায় সাধক রসিক হতে পারেন। ‘রসিক’ এখানে সিদ্ধতা। সাধারণ স্তর থেকে উপরে ওঠা। আর প্রেম সাধনা ছেড়ে দিলে তিনি জেঠা খুড়ার নামান্তর। ‘জেঠা খুড়া’ হলেন অতি সাধারণজন। সাধনমার্গ থেকে দূরে থাকা লোক। এভাবেই এই গান আমাদেরকে প্রতীকদ্যোতক এক শিল্পভঙ্গির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যে প্রতীকের আকস্মিক অভিঘাতগুলো আমরা ছুঁয়ে ধরে দেখতে চাইছি। গৌণ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভাষাকে কাব্যের অভিক্ষেপে দেখে নিতে চাইছি বারবার। কারণ তাঁর প্রতীক-প্রতিমা-রূপকে শিল্পরূপের নিরীক্ষণ কর্তাটি সব সময় দাঁড়িয়ে আছে। যাকে আমরা প্রান্তিক কারুকলার মধ্যে কখনও রেখে দিতে পারি না। তেমনই এক গান। কানাই বাউলের মুখে শুনেছিলাম সেই ছিন্নমস্তার আশ্রমে।

এ কোন কারিকর,গড়লে এ ঘর, একটা রূপের নিশান
নয় দরজা ষোলতালা, দ্বাদশে বাতি ঘোষণা।।
সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু, ষড়দলে দীনবন্ধু,
শতদলে প্রাণগোবিন্দ, দ্বিদলে রূপ সাধনা।।
এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা,
ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।।
আর কেউ বা শুনে, কেউ বা দেখে, কেউ করে ভাই প্রবঞ্চনা।
কেউ দেখে শুনে চুপটি করে, করে নিত্যলীলার রটনা।।
জরা মৃত্যুর নয় সে অধীন, প্রতি নব নব জানা,
কৈশরা কিশোরী রূপে, ক্ষ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।।

কানাই বাউল কথকতার ঢঙ্গে এ গানের ব্যাখ্যা করছিলেন সে আসরে। সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে নিজস্ব চিন্তাধারাকে মিলিয়ে এ গানকে বুঝবার চেষ্টা করব আমরা। ঘর এখানে দেহভাণ্ড। বাউল বলেছিলেন, দেহবাড়ি, নারীদেহবাড়ি। আমরা বলব প্রবোধের বেড়া। যা ভাঙতে চাইছেন সাধক। ঘরের নয় দরজা হল শরীরে নয়টি প্রত্যঙ্গ। বাউল সাধক একে ‘নবদ্বার’ও বলে থাকেন। এই প্রত্যঙ্গগুলো হল দুই কান, দুই চোখ, দুই নাক, মুখবিবর, পায়ু ও উপস্থ। উপস্থ বললে সঠিক পরিষ্কার হল না। বলি জননেন্দ্রিয়, লিঙ্গ। যোনি। ‘ষোলতালা’ হল মোলটি আধার। যে আধারে লয়যোগ সাধন হয়। একে যোগী যাজ্ঞবল্ক বলেছেন ‘ষোড়শাধারং’। ‘পাদাঙ্গুষ্ঠী চ গুলফৌ চ / পায়ুমূলং তথা পশ্চাৎ দেহমধ্যঞ্চ মেট্ৰকং।।/ নাভিশ্চ হৃদয়ং গার্গি কণ্ঠকূপস্তথৈব চ। / তালুমূলঞ্চ নাসায়া মূলং চাক্ষুশ্চ মণ্ডলে। / ভ্ৰবোৰ্মধ্যং ললাটঞ্চ মূর্ধা চ মুনিপুঙ্গবে।’ অর্থাৎ ডান পায়ের আঙুল (দক্ষিণ পদাঙ্গুষ্ঠ), গোড়ালি (পাদগুল), গোপনীয় বা অপ্রকাশ্য অংশ (গুহ্যদেশ), পুংজননেন্দ্রিয় বা শিশ্ন (লিঙ্গমূল), নাভির গর্ত বা কুণ্ড (নাভিমণ্ডল), মন (হৃদয়), কণ্ঠনালীর নিচস্থ গর্ত (কণ্ঠকূপ), জিভের অগ্রভাগ (জিহ্বাগ্র), দন্তপংক্তি বা দাঁতের পাটি (দন্তাধার), টাকরা (তালুমূল), নাক বা নাকের ফুটো (নাসাগ্রভাগ), দুই ভুরুর মধ্যবর্তী স্থান বা অংশভাগ (ভ্রমধ্য), চোখ বা চোখের অংশভাগ (নেত্ৰাধার), কপাল (ললাট), মাথা বা মস্তক (মূর্ধ্বা), শিরোমধ্যস্থ বা মাথার ভেতরে অধোমুখের সহস্রদল পদ্ম(সহস্রার)। এই ষোলটি স্থানের ক্রিয়াবিশেষ অনুষ্ঠানে লয়যোগ হয়, লয়যোগ হল আমাদের মনকে যে কোনো পদার্থের উপর একত্র করে একতানে বেঁধে ফেলা। ‘দ্বাদশ বাতি’ হল শরীরের। মধ্যে অবস্থিত অনাহতচক্র। এর বারোটি পাপড়ি থাকে। এই দ্বাদশ দল হল–ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ। এগুলো সবই মাতৃকাবর্ণাত্মক। মায়ের ভাষা। আমাদের। বর্ণমালা। মাতৃকা হল শক্তিস্বরূপিণী। সেই আধারেও রাখতে পারি এই বারোটি পাপড়িকে। এর রঙ সিঁদুর বর্ণের। এর প্রত্যেক দলে একেকটি বৃত্তি রয়েছে আমাদের। এগুলো হল–আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিকলতা, বিবেক, অহংকার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক ও অনুতাপ। এই অনাহত চক্রে বা পদ্মের মধ্যে অরুণবর্ণের সূর্যমণ্ডল ও ধূম্রবর্ণের বায়ুমণ্ডল আছে। এই পদ্মে সাধক ধ্যানে বসলে অণিমাদি লাভ করেন। অনিমিত্ত ঘটনারাশি তাঁর চোখের সামনে ভাসে।

তাহলে আমরা বুঝতে পারছি এ গানে পদকর্তা নারীদেহের ভেতরকার সৌন্দর্যের জাগৃতি দিয়েছেন। তবে যেটা মনে হয় ‘ঘর’কে কানাই বাউল নারী দ্যোতকের রূপ দিলেও ভঙ্গির প্রতিচ্ছায়াতে এ গানের বর্ণিত ‘ঘর’ যুগল দেহের। যুগল সাধনার ব্রহ্মাণ্ড। খ্যাপা বলেছেন ‘সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু’–’সপ্ততালার কথা আমরা এর আগেও খ্যাপার গান প্রসঙ্গে বলেছি। তবু প্রসঙ্গত এখানে আবারও বলি। আমাদের শরীরের বীর্য, রক্ত, মজ্জা, মেদ, মাংস, হাড়, চামড়া–এই সাতটি পদার্থকে ‘সপ্ততালা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক। তারপরই বলেছেন ‘ষড়দলে দীনবন্ধু’–’ষড়দল’ হল ষড়রিপু। সেখানে ‘দীনবন্ধু’ রয়েছেন কীভাবে? যদি ভাবি ‘দীনবন্ধু’ সাধকেরই দীনতা খুব কি ভুল ভাবব আমরা? সেই দীনতা ‘ষড়দল’এ আটকে যাচ্ছে। ‘ষড়রিপু’কে পরিণামী মেজাজ দিতে চাইছেন তিনি। যার জন্যই ‘শতদলে প্রাণ গোবিন্দ’কে দেখতে পারছেন তিনি। ‘প্রাণগোবিন্দ’ হল সাধকের অপরিমেয়তা। তাঁরই দিব্যবানী শোনাতে চাইছেন তিনি পরবর্তী দু’লাইনে। ‘শতদল’ হল গিয়ে শরীরের গুরুচক্র। অষ্টম পদ্ম এটি। এই পদ্মের কর্ণিকাতে (বীজকোষে) ত্রিকোণমণ্ডল আছে। ত্রিকোণমণ্ডল তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত। এই বর্ণগুলো হল–হল, ক্ষ। এই তিনটি শক্তিদ্যোতক। নটি চক্রেরই বিকাশ তো শক্তির অভিক্ষেপের জন্যই। যার জন্য একে শক্তিমণ্ডল বলে। অনেকে যোনিপীঠও বলে। যা প্রকৃতি দ্যোতক। নারীর জননাঙ্গ সৃষ্টির সন্নিবেশকেই প্রতীকী করে রাখে। সাধক বলেন তেজময় এই শক্তির মধ্যে কামকলা মূর্তি থাকে। সেই মূর্তিকেই তিনি দিব্য প্রেমের ইঙ্গিত দেন। গুরুপদ্ম বা চক্র শতদল পদ্মকে কেন বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে এই কারণেই, এই পদ্মেই। সাধক গুরুদেবের ধ্যানজপ করেন। এই ধ্যানে সাধক মনে করেন সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। দিব্যজ্ঞান স্ফুটমান হয়। এই দিব্যতা লাভ করার উদ্দেশ্যেই সাধক ‘দ্বিদলে রূপ সাধনা’ করেন। দ্বিদল হল আজ্ঞাপদ্ম। দুটো দলের বর্ণ হ এবং ক্ষ। এই পদ্মের বীজকোষে যে ত্রিকোণমণ্ডল আছে তাতে তিনটি গুণ বর্তমান–সত্ত্ব, রজ, তম। সাধক বলেন ত্রিগুণান্বিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এই জন্যই খ্যাপা গানকে সেই দ্বিদ্বলের দ্যোতনা দিয়েছেন। তাঁকে একটু আগে আমরা ‘দিব্যবাণী’ হিসাবে চিহ্নিত করে নিয়েছি। এই দিব্যবাণী হল–’এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা/ ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।‘ ‘নবরস’ নটা চক্রেরই দ্যোতক। বাউল একে ‘নববিধা ভক্তি’ বলেন। নববিধা ভক্তি হল অলংকার শাস্ত্রের নয়টি রস–শৃঙ্গার, হাস্য, বরুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। কানাই বাউল আমাকে বলেছিলেন, নবরসে শরীরের নটি দ্বার খোলে গো।

এই নটি দ্বার–শরীরের নটি ছিদ্র। দুই চোখ, দুটি কান, দুই নাক, মুখ, যোনি লিঙ্গ। তা যদি খোলে ‘ঘর’ কে কানাই বাউল কথিত ‘নারীদেহ’ হিসাবে কীভাবে মেনে নেব? যার জন্যই তাঁকে যুগল দেহের প্রেম সাধনার (কাম সাধনার? !) দীর্ঘসূত্রতা দিয়েছিলাম। তা কিন্তু গানের শেষ লাইনে একেবারেই স্পষ্ট–কৈরা কিশোরী রূপে, খ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।

খ্যাপা বাবার গানে রূপের এই রণন ফিরে ফিরে দেখব আমরা। সাধন পর্যায়ে বাউলের গানকে তিন ভাগে অনায়াসে ভাগ করতে পারি আমরা। ‘ক্ষ্যাপা গীতামৃত’ যতই চারটি ভাগের আত্মপক্ষ তৈরি করে নিক না কেন। এই তিনটি ভাগ পদকর্তাদের আত্মতত্ত্ব বা সাধকের দেহতত্ত্ব, সঙ্গিনীর দেহতত্ত্ব বা পরতত্ত্ব আর পরম তত্ত্ব। খ্যাপার গানের চৈতন্যতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব, রসতত্ত্ব তাঁকে বৈষ্ণব ভাবিত সাধক হিসাবেই চিহ্নিত করে। তাঁর গুরুদেব শ্রী শ্রী সদানন্দ দাসী (শ্রীশ্রী বুড়াবাবা) তাঁকে ‘খ্যাপা বাবা’র আখ্যাটি দিয়েছিলেন। মানভূম জেলার সোনাথলীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘই এখন ‘মনোহর সেবাশ্রম সংঘ’ নামে খ্যাত। খুব বেশীদিন যে তিনি দেহ রেখেছেন। তা নয়। ১৯৯৬ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রথম জীবনে তিনি সংসারী ছিলেন। পরবর্তীতে সংসারের মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। শ্রী শ্রী রাধারানি দেবী (শ্রীশ্রীমা) ছিলেন তাঁরই মন্ত্রশিষ্যা। খ্যাপা বাবার মন্ত্রশিষ্য অনেকেই। মনোহর সেবাশ্রম সংঘের সভাপতি শ্রীরাধানাথ দাস ঠাকুর আমাকে যে নামগুলো দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই নাম করা বাউল। সনাতন দাস, পূর্ণচন্দ্র দাস, বিশ্বনাথ দাস, বিশ্বনাথ দাস(সনাতন দাসের ছেলে), রাখালচন্দ্র দাস–এসব নামগুলো তিনিই আমাকে। জানিয়েছিলেন। খ্যাপার গান এই সব প্রতিষ্ঠিত বাউল গায়করা প্রায়শই গেয়ে থাকেন। কেঁদুলির মেলাতেই সরকারি বাউল মঞ্চে একবার পূর্ণচন্দ্রের কণ্ঠে শুনেছিলাম যে গান তা শ্রুত বাউল গান হিসাবে বিশেষ পরিচিত। পূর্ণচন্দ্র খ্যাপার কথা বলেই সেদিন গান শুরু করেছিলেন।

কাঁচা হাড়িতে রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)
কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে
শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)
রাখিতে নারিলি প্রেমজল।।
যদি হবি পাকা হাঁড়ি
চলে যাবি গুরুর বাড়ি,
প্রেমানলে দগ্ধ হবি।
রূপে করবে টলমল গো।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।
সদানন্দ ভেবে আউল
এই কথা যে বুঝেছে সেইত বাউল,
ধান কুটিলে হবে চাউল
(ক্ষ্যাপা) তুষ কুটিলে কিবা ফল।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।

এই গানে কথিত ‘কাঁচা হাঁড়ি’ হল আমাদেরই স্থূল দেহ। এই স্থূল দেহকে প্রবর্ত স্তরে নিয়ে যেতে হলেই গুরুর কাছে যেতে হয়। গুরু শিক্ষা দেন স্থূল স্তর থেকেই। স্থূলকে মোটা হিসাবে না দেখে অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার নামান্তর ধরলেই বোধহয়। ভালো। গুরু এই অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকেই প্রবর্তস্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাঁর জন্যই গানে গুরুর বাড়ি যেতে বলা হচ্ছে। ‘প্রেমজল’ নারীর বা সাধন সঙ্গিনীর রজঃস্রাব। সহজিয়া বলছেন ‘কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে/ শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)।‘ এই ‘জল’ পুরুষ দ্যোতক বা পুরুষের কিংবা সাধকের বীর্যপাত। স্থূল দেহেই যদি বাউল সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরেন তাহলে তিনি বীর্যকে চূড়ান্ত মিলনের সময় উর্ধগতিতে উঠিয়ে নিতে পারবেন না। বীর্য ‘প্রেমজল’ এ মিশে যাবে। পথভ্রষ্ট হবেন সাধক। যাকে ‘গণ্ডগোল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক খ্যাপা। তাঁর জন্যই গুরুর কাছে যাওয়া।

মজলিশপুরের প্রবীণ প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য আমাকে বলেছিলেন, জীবনে চার বার জন্ম হয়।

–কী রকম ভাবে? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বলেছিলেন, প্রথম জন্ম মাতৃক্রোড়ে। পিতার বীর্য মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় জন্ম দেন দীক্ষাগুরু। মন্ত্রদীক্ষা হয় আমাদের। তৃতীয় জন্ম ক্রিয়াকরণের। গুরুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। চতুর্থ জন্ম হয় ভেকে।

ভেক হল সিদ্ধি। প্রচলিত ভাষায় ভেক নেওয়া হল ছদ্মবেশ। যেমন বলা হয়–ছিল চোর, বদমাশ এখন সাধুর ভেক নিয়েছে। হতভম্ব হয়ে যাওয়াকেও ভেক বলা হয়। কিন্তু শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্যের বলা ভেক হল বাউল সিদ্ধি সাধনার সর্বোচ্চ দশা।

‘পাকা হাঁড়ি’ হল বাউল কথিক ভেক। যার জন্য গুরুর কাছে যাওয়া। শিক্ষাপ্রণালী রপ্ত করা। সাধক হয়ে ওঠা। প্রেমানলে দগ্ধ হওয়া। প্রেমানল’ হল পুরুষ ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্যতা। বাউল ভাষায় বললে, রজঃবীজ বা বীর্যকে উধ্বদিকে উল্টিয়ে দেওয়া। ‘উল্টোস্রোতে নৌকা বাওয়া’। এই বাহ্য অবস্থার রূপই ‘জেন্তে মরা’। অর্থাৎ কিনা সাধক ও সাধন সঙ্গিনী আত্মবিস্মৃত, চেতনাহীন হয়ে পড়বেন। দেহগত আকর্ষণ থাকবে না। তাঁদের। লালনের গানেই আছে তাঁর প্রকাশ–’জেন্তে-মরা প্রেম-সাধনা কি পারবি তোরা। যে প্রেমে কিশোর-কিশোরী হয়েছে হারা।।/ শোসায় শোষে না ছাড়ে বাণ, / ঘোর তুফানে বায় তরী উজান,/ ও তাঁর কাম-নদীতে চর পড়েছে/ প্রেম-নদীতে জল পোরা। এই অবস্থাই খ্যাপার গানে–’প্রেমানলে দগ্ধ হবি/রূপে করবে টলমল গো।‘ এই রূপ অরূপের প্রগাঢ় প্রস্বর যিনি বুঝেছেন তিনিই বাউল–’সদানন্দ ভেবে আউল / এই কথা যে বুঝেছে সেই তো বাউল।’ আউল হল গুহ্য সাধনার সম্প্রদায়। সহজিয়া কর্তাভজাও বলা যেতে পারে তাঁদের। অনেকে এঁদের বৈষ্ণব ভাবিত সম্প্রদায়ও বলে থাকেন। ‘সদানন্দ’ পদকর্তা নন। হৃদয়ের আনন্দধারা। রূপ বিকাশের মূর্ততা। ‘প্রেমানলে’ দগ্ধ। হওয়ার রূপ। এই রূপ প্রস্ফুটিত হবে ‘পাকা হাঁড়ি’ হলেই। না হলে তা কোনওভাবে সম্ভব। নয় একেবারে। তাঁর জন্যই বলেছেন খ্যাপা ধান কুটলে, খোসা ছাড়ালে চাল পাওয়া যাবে। ‘ধান’ এখানে ‘পাকা হাঁড়ি’র দ্যোতক। ‘চাল’ ‘প্রেমানলের’। ‘তুষ’ হল ‘কাঁচা হাঁড়ি’। যা ছাড়ালে শূলতার বিপর্যয়ই থাকবে জীবনে। তা ভেঙে প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ স্তরে কখনও আর ওঠা হবে না–’ধান কুটিলে হবে চাউল / (ক্ষ্যাপা) তুষ কুটিলে কিবা ফল। ফল’ এখানে অসিদ্ধতার প্রকাশ। বাউল সাধক সেই উচ্চমার্গে স্বচিহ্নিত শিল্পবস্তুর কথাই বলেছেন। এই বস্তুকে পিতৃবস্তু শুধু বলছি না। বলছি সাধকের গুরুর শিষ্যর প্রতি বেদবাণী। খ্যাপা গানে রূপকে, প্রতীকে তাঁরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ইঙ্গিতের অনাশ্রয়ী দুর্গ ভাঙতে পারলে অসাধারণ অভূতপূর্ব প্রতীকী ভাষার বা পারিভাষিক শব্দসূত্রের পরিণত এক বিস্তীর্ন। অধ্যায় দিতে পারেন। যার সংরক্ষণ, রসাস্বাদন প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এগোলে তবেই সম্ভব।

জয়দেবের মেলাতে খ্যাপা বাবার আখড়ায় বেশ রাতের দিকেই গাইতে ওঠেন। বিশ্বনাথ দাস। এ-আখড়া ও-আখড়া ঘুরে তিনি এখানে আসেন। এসে বেদনাশা বটমূলে আগে প্রণাম সারেন। তারপর আসরে এসে বসেন। বার দুই এ দৃশ্য আমি দেখেছি। বিশ্বনাথ নামকরা বাউল সনাতন দাসের পুত্র। নিজেও যথেষ্ট নামকরা বাউল সমাজে। বার দুই বিদেশে গেছেন গানের সুবাদে। বিশ্বনাথ নিজেও পদ রচনা করেন। তাঁর পিতা সনাতন দাসকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিশ্বনাথের মুখেই শুনেছিলাম ওঁর কথা। তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। সে পদের বেশ কিছু শুনবার সৌভাগ্য আছে আমার। তবে তিনি যে বাউলতত্ত্ব বিষয়ে দু’দুইখানি বই রচনা করেছিলেন এ তথ্য আমি জানতাম না। বিশ্বনাথই আমাকে বলেছিলেন। সনাতন দাসের মন্ত্রদীক্ষা নাকি খ্যাপার কাছেই। সংঘের সভাপতি এ কথা একবার বলেছিলেন। বিশ্বনাথ দাসকে এ কথা আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি এবং তাঁর মন্ত্রদীক্ষা খ্যাপার আশ্রমে কিনা এও জানা হয়নি। বিশ্বনাথ দাসই আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর বাবার আকাদেমি পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা। লালন পুরষ্কারও তিনি পেয়েছিলেন।

বিশ্বনাথের কণ্ঠে খ্যাপা বাবার যে গানটি একবার শুনেছিলাম সেটিও ছিল যথেষ্ট শ্রুত গান। অনেক বাউলরাই এই গানখানি গেয়ে থাকেন। পূর্ণদাসের গানখানাও তাই। বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’ পর্যন্ত খ্যাপার ‘কাঁচা হাঁড়িতে…’ গানখানা রেকর্ড করেছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা এই গানখানা গেয়ে থাকে। তা সে রাতে বিশ্বনাথের কণ্ঠে খ্যাপার গানখানা যেন মহোজ্জ্বল আলোকসম্পাত রচনা করেছিল। খুবই একাগ্র মনে গাইছিলেন তিনি। অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিলেন যেন গানখানির প্রকৌশলে। দেহের আশ্চর্য সব অলব্ধ চারপাশ যেন তিনি কণ্ঠের অভিঘাতেই সামনে আনছিলেন। গাইছিলেন–

ইড়া পিঙ্গলার মাঝে,
সুষুম্না এক নাড়ী আছে,
সহজ সরল তাঁরই কাছে
সপ্তাঙ্গ অষ্টাঙ্গ ভেদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।

চতুর্দল মূলাধারে
মণিপুর তার উপরে,
অনাহত বিশুদ্ধ পারে;
লক্ষ যোজন যাও না কেঁদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।।

চেতনে চৈতন্য যিনি,
কুণ্ডলীতে আছেন তিনি,
দ্বাদশ পবন বইছে সদাই;
(ক্ষ্যাপা) পূর্ণচন্দ্র প্রতিপদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।।

দেহাত্মবাদী কায়া সাধনার মূল কথা হল শ্বাস আর দমের কাজ। যে শ্বাসপ্রশ্বাসে আমরা সাধারণ মানুষেরা জীবনধারণ করি, সেই শ্বাসপ্রশ্বাসকেই কাজে লাগিয়ে তাঁরা যৌন জীবনযাপনে বিশেষ প্রক্রিয়া গ্রহণ করে থাকেন, যে প্রক্রিয়ায় বীর্য-রজ একাকার হবে না কোনো সময়। সন্তান আসবে না। শ্বাসক্রিয়াই জন্মনিরোধক হিসাবে কাজ করবে। শ্বাসকে তাঁরা গুরু হিসাবে মানেন। বায়ু বা পবন বলতে তাঁরা শ্বাসক্রিয়াকে ধরেন। শ্বাস তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপন-বিভাব। যার দ্বারা শরীরকেই নির্জনতম সাধনার স্থান তাঁরা করে নিতে পারেন। শরীর তাঁদের কাছে সাধনার পূর্ণাঙ্গ দলিল। ভবা পাগলার গানের মধ্যেই রয়েছে দেহের তামসিক উপকরণ–’দেহ অট্টালিকা অতি মনোরম/ তাহাতে বসতি করে একটুখানি দম। / সতর্ক থাকিও তুমি খুব হুঁশিয়ার/ রক্ষই ভক্ষক কিন্তু খবরদার খবরদার।

খ্যাপার এই গান যেন শরীরে আপাতবিক্ষিপ্ত অধ্যায়গুলোকে পরপর সাজিয়েই ধরা। তিনি বলছেন–’ইড়া পিঙ্গলার মাঝে/ সুষুম্না এক নাড়ী আছে।‘ সুষুম্না আমাদের দেহে অবস্থান করছে মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলকে মাঝ বরাবর বিদীর্ণ করে একেবারে মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রকে ছুঁয়ে। সুষুম্নার বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া। পিঙ্গলা অবস্থান করছে ডানদিকে। সুতরাং ‘ইড়া পিঙ্গলার মাঝে সুষুম্না’র অবস্থান। খ্যাপা বলছেন–’সহজ সরল তাঁরই কাছে/ সপ্তাঙ্গ অষ্টাঙ্গ ভেদে।‘ ‘সপ্তাঙ্গ’ ‘অষ্টাঙ্গের’ প্রতীককলা কী? ‘সপ্তাঙ্গ’ শরীরের সাত ধাতু। অষ্টাঙ্গ হল অষ্টশক্তি। কী এই অষ্টশক্তি? এই অষ্টশক্তি হল অণিমা, মহিমা, লঘিমা, গরিমা, প্ৰাপতি, প্রকাশ্য, ইশিত্ব, বশিত্ব।

সাধক ধ্যানে অণুর মতো ক্ষুদ্র হবার ক্ষমতা অর্জন করেন তা হল অণিমা। ধ্যানযোগে তিনি বৃহৎ হবার ক্ষমতাও রাখেন যা মহিমা। ইচ্ছাকৃত হালকা হবার ক্ষমতা হল লঘিমা। ভারী হবার ক্ষমতা গরিমা। যা কিছু বা যা ইচ্ছা লাভ করার ক্ষমতা হল প্ৰাপতি। অনেক সাধক একে কামবসয়িতাও বলে থাকেন। ইচ্ছামতো যে কোনো জিনিস পাবার ক্ষমতা ইশিত্ব। আর ইচ্ছামত বশ করার ক্ষমতা হল গিয়ে বশিত্ব।

গৌতম বুদ্ধ আবার আকাক্ষা বিলোপের জন্য আটটি পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শালুয়া বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু আমাকে বলেছিলেন, গৌতম বুদ্ধের এই আটটি পথের অভিধাকে তাঁরা বলে থাকেন অষ্টমার্গ।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী এই অষ্টমার্গ?

তিনি বললেন, ভগবান বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন সংসারে দুঃখ আছে। দুঃখের কারণও আছে। আর এই দুঃখের কারণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি আটটি পথের কথা বলেছিলেন তাই-ই অষ্টমার্গ।

বললাম, তন্ত্রক্রিয়াতেও আটটি মার্গ আছে।

বললেন, দেহসাধনার আটটি মার্গ এটা নয়।

আমি আর তাই বাউল সাধনার ‘অষ্টভাবে’রও কথা তাঁকে বললাম না।

সবে সন্ধ্যা হয়েছে। উপাসনা শুরুর আগে তিনি বললেন, আজ আর নয়। তোমাকে অষ্টমার্গটি বলে ছেড়ে দিচ্ছি। আমার সময় হয়েছে।

শরীরের তিনচক্রে আমাদের সাধকরা যে আটটি শক্তিমূর্তির কল্পনা করেন, সে কথাও সেদিন তাঁকে বলা গেল না।

ঘন্টা বাজা শুরু হয়েছে সবে। ভগবান বুদ্ধের সামনে সান্ধ্যজ্যোতি দপদপ করে জ্বলছে। বললেন, আমাদের অষ্টমার্গ হল–সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ সংকল্প, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবন, সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সমাধি। এ তোমাদেরও নয় কি?

সেদিন আর কথা হল না। বৌদ্ধবিহারের ঘণ্টা বাজতে থাকল জোরে জোরে।

খ্যাপা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন সাধক ছিলেন যেমন একাধারে, তেমনই তিনি তন্ত্রজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। তাঁর গুরুর নির্দেশে তিনি ধরমপুরের ক্রোশজুড়ি সিদ্ধেশ্বরের মন্দিরে একমাস রাজযোগের ক্রিয়াকরণ করেছিলেন। এটিও একটি সহজি পন্থা। এই যোগ সংসারী লোকের পক্ষে করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই কোনো বইতেও বিস্তারিত এই যোগের ক্রিয়াকর্মের আলোচনা নেই। খ্যাপা মনোহর এক ভক্তের অনুরোধে অবশ্য রাজযোগে নিজের উপলব্ধির কথা ‘রাজযোগ সাধনা’ বইতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধতন্ত্র-সাধনার সঙ্গে বাউল সাধনার কিছু মিলকরণ আছে। তান্ত্রিক বলেন কুণ্ডলিনী। বাউলও তাই বলেন। বৌদ্ধাচার্য আবার একে আহলাদিনীও বলে থাকেন। যে নামেই আমরা একে অভিহিত করি না কেন আসলে এ সবই হাওয়ার গতি। এই হাওয়া বাউলের শ্বাস। হাউড়ে গোঁসাই তা অনুধাবন করেই বোধহয় লিখেছিলেন–’মৃণাল হাওয়ার গতি, ত্রিগুণ ধারিণী শক্তি যথায় বসতি/ তারে জাগালে যোগনিদ্রা, সাধ্যধন বাধ্য হয়;/ তবে দ্বার পারাপার দম দামোদরে,/ উর্ধ্বেতে হইবে গতি দ্বিদল ‘পরে,/ তবে হবে দৃষ্ট প্রণব পুষ্ট, ঘুচবে কষ্ট তাই ভেবে।

আমাদের মণিপুর চক্র ও অনাহত চক্রে আটটি শক্তিমূর্তির কল্পনা করেন তন্ত্রসাধক। তন্ত্রের আটটি শক্তির কথা বলেছি। বাউলের অষ্টশক্তিও তাই তবে নামকরণে কিছু প্রভেদ আছে। তন্ত্রের অণিমা ও লঘিমা বাউল মতেও তাই। তবে বাকি ছটাতেও নামে পার্থক্য আছে একটিতে। ব্যাখ্যায় হেরফের আমরা সেরকম কিছু দেখি না। তন্ত্রের গরিমা বাউল মতে ব্যাপ্তি। ব্যাপার কিন্তু একই। গরিমার ইচ্ছামতো ভারী হবার সঙ্গে ব্যাপ্তির মিল আছে। তন্ত্রের আটটি মূর্তি হল–বাসিনী, কামেশ্বরী, মোদিনী, বিমলা, অরুণা, জয়িনী, সর্বশ্বরী, কালী বা কৌলিনী।

সাধক বলেন আটটি বিভিন্ন অক্ষরমণ্ডলের দেবী এরা। অ থেকে ঘ এই ষোলোটি অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বাসিনী। পাঁচটি অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামেশ্বরী। পাঁচটি অক্ষর হল ক থেকে ঙ। আবার চ থেকে ঞ, এই পাঁচটি অক্ষরেরও অধিষ্ঠাত্রী দেবী মোদিনী। বিমলা (ট–ণ), অরুণা (ত–ন), জয়িনী (প–ম)। য থেকে ব, এই চার অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী হলেন সর্বেশ্বরী। শ থেকে ক্ষ, এই পাঁচ অক্ষরেরও অধিষ্ঠাত্রী হলেন কালী বা কৌলিনী।

খ্যাপা তন্ত্রসিদ্ধ হলেও যেহেতু এটা বাউল তত্ত্ব তাই অষ্টাঙ্গ ভেদকে তিনি বাউল মতেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘চতুর্দল মূলাধারে’। মূলাধারে এই চতুর্দল পদ্মের বর্ণ চারটে হল–ব, শ, ষ, স।

বাউলের রজঃবীজের উধ্বগতি হল সাধকের কুণ্ডলিনীর গতিকে স্থূল জগৎ থেকে ক্রমশ সূক্ষ্ম জগতের দিকে নিয়ে যাওয়া। বাউল ভাষায় একে ‘প্রবর্ত’ বলা যেতে পারে। এই স্তরেই বাউল ‘বায়ু’র কাজ শেখেন।

তন্ত্রসাধক বলেন কুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতিতে শরীরের ভিতরস্থ বিভিন্ন এলাকার চরিত্র অনুযায়ী সেই অঞ্চলের দেবতা ও বৃত্তিগুলো সব নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাঁরা বলেন মূলাধারে ব্রহ্মা, সাবিত্রী, ডাকিনী, মাতৃকা–এইসব দেবদেবীর বসবাস। এগুলো সবই তাঁদের কাছে প্রতীককল্পের বৃত্তি। মূলাধারে দেবদেবী ও বৃত্তি কুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় উধ্ব অঞ্চলে। একে নদীর সঙ্গে আমরা তুলনা টানতে পারি। নদী যেমন প্রবল জোয়ারে তাঁর মধ্যকার সমস্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলে; সেগুলো বুকের থেকে, নসীর শরীর থেকে হারিয়ে যায়। পাড়ে এসে পড়ে। সাধকের বৃত্তিও একই ভাবে নষ্ট হয়। মাতৃকা হল শরীরের মধ্যস্থ পৃথ্বী অঞ্চল। যার বীজ সাধক বলেন লং। একে আমরা শব্দশক্তি হিসাবে ধরতে পারি। এই লং হল চৈতন্যের সেই অবস্থা সে অবস্থাতে সাধকের চৈতন্য শব্দের আকারে প্রকাশ পায়। আমরা প্রায়শই বাকসিদ্ধ সাধুর কথা বলে থাকি। মূলাধার পদে ধ্যানে, জপে সাধকের সেই বাকসিদ্ধতা আসে।

মূলাধার দেহের সর্বনিম্ন চক্র বা পদ্ম। কিন্তু বাউল সাধক মূলাধারকে স্বাধিষ্ঠান চক্র বা পদ্ম বলেন। বিশ্বনাথ দাস বাউল আমাকে মূলাধার বলতে সেই স্বাধিষ্ঠানই বুঝিয়েছিলেন।

গান শেষে প্রায় ভোর ভোর সময়, যখন প্রভাতী গাইবেন এক বাউল গায়ক তখন তাঁকে একটু নিভৃতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মূলাধার কী?

বললেন, আমাদের শরীরের মধ্যকার সেই জননেন্দ্রিয়। ষড়দলের রূপ তাঁর। মুলাধারেই রজঃবীজ থাকে। বাউল রজঃবীজকে উপরে উঠিয়ে দিতে পারেন।

বুঝলাম চক্রের যে পদ্ম-কল্পনার প্রকাশ তাই-ই হল তাঁদের রজঃপ্রকাশ। রজকে তাঁরা ফুল বলেন। ‘যোনিপদ্ম’ তান্ত্রিকরাও বলেন। বাউল ‘রাধাপদ্ম’ বলেন। রাধাপদ্মতেই তো রজঃবীজের প্রকোপ না ঘটানো–এটাই তো তাঁদের মূল সাধনা। সংস্কৃত শাস্ত্রে রজের আভিধানিক মানে হল ফুল।

খ্যাপাও বাউল মতো মেনেই মূলাধারকেই স্বাধিষ্ঠান বলেছেন। তাঁর প্রমাণ রয়েছে গানেই–’চতুর্দল মূলাধারে/ মণিপুর তাঁর উপরে।‘ তাহলে দাঁড়াল মূলাধারের পরই মণিপুর। তা যদি হয়, তাহলে স্পষ্ট স্বাধিষ্ঠানই এখানে মূলাধার। নয় কি? তবে তাঁর দল তিনি চতুর্দলই করেছেন। মনে হয় যেটা তিনি তন্ত্রসিদ্ধ বলেই দলকে আর বদলাতে চাননি।

কুণ্ডলিনী যখন মূলাধার ত্যাগ করে তখন যে প্রাণপ্রবাহ উপরের দিকে উঠে আসে তাঁর ধাক্কাতেই স্বাধিষ্ঠানের পাপড়ি ঘেঁড়ে। ফলে এর মুখও খুলে যায়। যা খুলে গেলে এখানকার শক্তিরূপের দেবদেবী বিষ্ণু, লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাকিনী, মাতৃকা এবং বৃত্তি সব কুণ্ডলিনীর সঙ্গে মিশে ভয়াবহ ভাবে ডুবে যায়। পৃথ্বীরূপী লং বীজ তখন জলতত্ত্বকে ধারণ করে বসে। হয় অপ, রং বীজ। মণিপুরের অগ্নিবীজ বায়ুবীজে মেশে। এখানে বিষ্ণুর রূপকল্পনা থাকে। বায়ু বীজ যং বীজে রূপান্তরিত হয়। অনাহত পার হয়ে উঠে আসে আজ্ঞাচক্রে। এই চক্র থেকেই শক্তি আরও উপরে উঠে প্রণব নাদ আরও সব সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম। পর্যায়ে গিয়ে মেশে। তারপর থাকে কেবল পরম চৈতন্যের শক্তি। যে শক্তি শিবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বলে থাকেন সাধক। শিব এখানে সর্বোচ্চ শক্তিতরঙ্গের প্রতীক। সাধকের জগদীশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা। তাঁকে প্রাপ্তি। উপলব্ধি। আমরা বলব সাধক এখানে এসে এই চরম পন্থায় যে নির্বাণ লাভ করে থাকেন সেই জ্ঞান পরমাত্মা। অর্থাৎ কিনা আমিকে, আমার শক্তিকে সর্ববিধভাবেই চেনা। খ্যাপা যার জন্যই বলেছেন–’লক্ষ যোজন যাও না। কেঁদে।‘ এই কান্না সিদ্ধ স্তরে পৌঁছানোর জন্যই প্রচেষ্টার অশ্রুপাত। সে স্তরে নিজের চেতনাকেই উপলব্ধ করা যায়–’চেতনে চৈতন্য যিনি/ কুণ্ডলীতে আছেন তিনি।‘ ‘দ্বাদশ পবন’ কী? এই ‘দ্বাদশ পবন’ হল গিয়ে শরীরের মূল বারোটি শিরার মধ্যে রক্তের যে একমুখী প্রবাহ। এই রক্তপ্রবাহ হৃৎপিণ্ড থেকে নির্গত হয়ে চৌষট্টিটি ধমনী পার হয়ে তিনশত ষাট শিরার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে উপশিরা ও স্নায়ুতে ছড়িয়ে যায়। যার জেরেই ‘পূর্ণচন্দ্র’ লাভ করা যায়। বাউলের ‘পূর্ণচন্দ্র’ হল গিয়ে প্রেম প্রেম এখানে সিদ্ধতা। সঙ্গিনীর শরীর ভ্রমণ করে, সেই শরীরকে নিগূঢ় বোধিচর্চা দিয়ে নিজের সর্বাত্মক ধাঁচটি বজায় রাখা। তাঁর জন্যই খ্যাপা গাইছেন–’দ্বাদশ পবন বইছে সদাই/ (ক্ষ্যাপা) পূর্ণচন্দ্র প্রতিপদে।‘ বাংলার দেহসাধনা এভাবেই দ্বৈততত্ত্বকে প্রকাশ করেছে গানে। খ্যাপা বাবার গানগুলোর মধ্যে আমরা তাঁরই প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি বার বার।

আমার ঘরের বাঁধন আঁটা,
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
কত শক্ত করে বেঁধেছে ঘর
কেউ গিরে তাঁর ঠিক দিয়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
(দেখ) সপ্ততালা এ ঘরখানি
নয় দরজা-তায় রেখেছে
মাপে কিন্তু চৌদ্দ পোয়া
তিন জনার এ ঘর গড়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন-আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।

এ ঘরে কি মজার সন্ধি
জলআগুনে–করেছে বন্দি।
বইছে উনপঞ্চাশ পবন,
জীবেরে ধরে রেখেছে
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।

ঘরে পঞ্চভূত আর ষড়রিপু
তায় এগার জন বসেছে
তাঁরা হাসায় কাঁদায় নাচায় গাওয়ায়
সুফল কুফল দুই রয়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।

(এ) ঘরে সুমতি কুমতি দুজন।
দিবারাতি বাস করেছে
তাঁরা ইচ্ছা জ্ঞানে ভাঙে গড়ে (ঘর)
ক্ষ্যাপা পূর্ণানন্দে প্রাণ সঁপেছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
কত শক্ত করে বেঁধেছে ঘর,
কেউ কিরে তাঁর ঠিক দিয়েছে।।

খ্যাপার আশ্রমেই রাখাল দাস বাউলের মুখে শুনেছিলাম এ গান। সন্ধ্যার ক্রিয়াকর্মের পরে গান ধরেছিলেন রাখাল দাস। বেদনাশা বটের প্রদীপ তখন অজয়ের হাওয়ায় এদিক-ওদিক করে কাঁপছে। এরই মধ্যে রাখাল দাস গান ধরেছেন। একতারাতে সুর উঠেছে। আমার শরীরেও হাওয়া এসে লাগছে অজয়ের। গৌরীবাবু এই আশ্রম থেকেই দীক্ষিত। তিনিও ছিলেন সেদিন পাশে। আমি ধরে দাঁড়িয়ে আছি গৌরীবাবুর ছেলে সুজীবকেই। ও আমার বন্ধু। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির সুজীব। সন্ধ্যেবেলাতে একেবারেই দেখতে পায় না ও। আস্তে আস্তে ওর চোখের সব নাড়িগুলোই শুকিয়ে যাচ্ছে। আমিই ওকে ধরে আশ্রম থেকে বেদনাশা বটের কাছে নিয়ে এসেছি। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে আমরা দাঁড়িয়ে। গরমের ক্লান্তি অনেকখানি দূর করে দিচ্ছে অজয়ের হাওয়া। ফাঁকা নির্জন চারপাশ। সংক্রান্তির ভিড় এ সময় এলে কল্পনা করা যাবে না। আমি ভাবছি সুজীব তো এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ও কি রাখাল দাসের কথা অনুযায়ী নিজের ঘরের বাঁধনখানা দেখতে পাচ্ছে? এ বাঁধন আমাদের কাছে তো একেবারেই অনুভবের বাঁধন। সাধক বাউলের কাছে। ক্রিয়াকরণের উদ্দেশ্যে পথ নির্দেশিকার বাঁধন। শরীরকে জানা, বোঝার বাঁধন। গিঁট খুলে স্থূল শরীরকে প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ স্তরে নিয়ে যাওয়ার বাঁধন।

‘ঘর’ এখানে শরীর। ‘গিরে’ হল গিঁট। ‘সাড়ে তিন কোটি’ গিরে শরীরের মধ্যেকার সাড়ে তিন কোটি নাড়ি। যেগুলো সব শরীরকে বেঁধে রেখেছে। তাঁর জন্যই খ্যাপা বলছেন ‘আমার ঘরের বাঁধন আঁটা/ সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।’ ‘সার্ধলক্ষত্ৰয়ং নাড্যঃ সন্তি দেহান্তরে না।‘ লক্ষ নাড়ি দেহের অভ্যন্তরে রয়েছে। যা হল বাউলের ঘর। ঘরের সপ্ততালা শরীরের সাত ধাতুর একেকটি মৌল। যাকে তালা বা পর্যায় হিসাবে। দেখাচ্ছেন খ্যাপা। মৌলগুলোর কথা আমরা আগেও বলেছি। ‘নয় দরজা’ নখানা দরজা। সে সম্পর্কেও বলা রয়েছে আগে। ‘চৌদ্দ পোয়া’র পরিমাণ চৌদ্দটি গুরুত্বপূর্ণ সেই নাড়ি। ‘তিন জনার এ ঘর’–চোদ্দ নাড়ির মধ্যে প্রধানা তিন নাড়ি। ঘরের সন্ধি ‘জল আগুনে’র সন্ধি। ‘জল’ এখানে রজ। ‘অগ্নি’কে তেজ না ধরে বীর্যস্বরূপ হিসাবে দেখছি। উনপঞ্চাশ’ বায়ুর বিষয়ে আসছি। আগে বলি, শাস্ত্র সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ির নির্দেশ দিচ্ছে। খ্যাপা সাড়ে তিন কোটি বলছেন কেন? বলছেন, এ কারণেই ঘরের সামগ্রিক ব্যাপ্তি দিতে চাইছেন তিনি। কোটি হল অঙ্কের হিসাবে শেষ নির্ধারক। তাই খ্যাপা কোটিতে এসে ঠেকেছেন। ‘চোদ্দ পোয়া’কে গোটা শরীরের পরিমাপও বলতে পারি।

‘বায়ু’ যোগক্রিয়ায় অনিবার্য এক ব্যাপার। বাউল বলেন ‘দমের কাজ’। দম কথার অর্থ নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে রোধ করা। গুরুর কথামতো তাঁরা প্রথমে শ্বাসক্রিয়া বা প্রাণায়াম রপ্ত করেন। পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে আছে–’তস্মিন সতি শ্বাসপ্রশ্বাসইয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়াম।‘ অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতি ভঙ্গ করে শাস্ত্রোক্ত নিয়মে অভ্যাস বা বিধৃত করার নাম হল প্রাণায়াম। প্রাণ বায়ু আর অপান বায়ু। দ্বয়ের সংযোগ। শ্বাসের এই যুগল ক্রিয়া শরীর সাধনার যুগল দেহের আনুরূপ্য আরও ঈষৎ রূপকেই যেন বিস্তার করে। ‘প্রাণাপানসমাযোগঃ প্রাণায়াম ইতীরিতঃ/ প্রাণায়াম ইতি প্রোক্তো রেচকপূরককুম্ভকৈঃ।।‘ প্রাণায়াম বলতে আমরা সাধারণত রেচক, পূরক, কুম্ভকের কথাই বুঝি। বাউলও এই তিন প্রাণায়ামের কথাই বলেন। চণ্ডী গোঁসাইয়ের গানেই আছে–’ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নাতে/ রেচক পূরক কুম্ভক তাতে/ দেখিস যেন এক নাড়িতে/ ভাবিসনে তিন সেরে যাই।‘

গুরুর নির্দেশে শিক্ষানবীশ বাউল প্রথমে বাঁ নাকের সাহায্যে বাইরের বাতাসকে টেনে এনে শরীরের অভ্যন্তরে রেখে ধীরে ধীরে ডান নাক দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই যে বাইরের বাতাসে শরীরের অভ্যন্তর পূর্ণ হচ্ছে সেজন্য এর নাম পূরক। শরীরের ভেতরে এই যে বাতাস ধরে রাখা তা অনেকটা কলসিতে জল ভরে রাখার মতই। তাই এর নাম কুম্ভক। আর বাতাসকে যখন ডান নাক দিয়ে নিয়ে বাঁ নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে তখন তাঁর নাম রেচক। এই ক্রিয়া বাউলকে শিখতে হয়, এতে সমস্ত নাড়ি পরিশুদ্ধ হয়ে সুষুম্না দিয়ে সোজা উপরে উঠতে আরম্ভ করে। উর্ধ্বপথ এভাবেই তৈরি করে নিতে থাকেন শিক্ষানবীশ বাউল। এই উধ্বযোগেই বিন্দুধারণ শক্তি অর্জন করা যায়।

শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য বাউলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কতবার এই প্রাণায়াম করতে হয়?

তিনি দাঁতহীন গালের দুদিকে হাসিতে সেই গর্ত বুজিয়ে কিছু পর আমাকে বললেন, এই করণকৌশলের নানা নিয়ম আছে। গুরুর কাছে এসবই শিখতে হয়।

বললাম, আমাকে করণকৌশল জানতে হবে না। যদি বাধা থাকে বলতে। শুধু বলুন দিনে কতবার এই প্রাণায়াম করতে হয়?

তিনি আমাকে ভাসা ভাসা ভাবে তিন আসনের কথা বলে বললেন, এই সব প্রাণায়াম প্রথম-প্রথম আট, তারপর বাড়িয়ে ষোলোষোলোর পর দ্বিগুণ, এরপর আবারও দ্বিগুণ।

বুঝলাম আট, ষোলো, বত্রিশ তারপর একেবারে চৌষট্টিবার করতে হবে। বাউলের ভাষায় যে যতক্ষণ ‘দম’ রাখতে পারবে সে তত তাড়াতাড়ি সিদ্ধ স্তরে উঠে যাবে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে চরিত্র বিশ্লেষণের সুন্দর এক গল্প আছে। বাউলের এই দম ক্রিয়াটির সেখানে উল্লেখ আছে ‘দ’ এর প্রতীককল্পে। গল্পটি এরকম–প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে একবার দেবতা, মানুষ, অসুরেরা এসে বললেন, আপনি কিছু আমাদের নির্দেশ দেন। যা আমাদের কাজে লাগবে।

ব্রহ্মা দেবতা, মানুষ, অসুর–সবাইকেই বললেন কেবল ‘দ। বলে বললেন, কিছু বুঝলে তোমরা?

সকলেই ঘাড় নাড়লেন।

ব্রহ্মা প্রথমে দেবতাদের বললেন, কী বুঝেছ তোমরা সাংকেতিক এই ‘দ’ এর দ্বারা।

দেবতারা বললেন, আপনি ‘দ’ এর মাধ্যমে আমাদেরকে দমের কথা বোঝাতে চাইছেন।

তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমরা সব ঠিকই বুঝেছ।

দম হল এখানে বাউলের ‘বায়ু’র দ্যোতক নয়। দম হল সংযম। দেবতাদের যা একেবারেই ছিল না।

মানুষরা ‘দ’ এর মানে বুঝলেন দান। কারণ তাঁরা স্বভাবতই একটু লোভী প্রকৃতির। অসুরেরা ‘দ’ এর মানে বুঝলেন দয়া। যা তাঁদের একেবারেই ছিল না। যেটা এখানে বলতে চাইছি তা হল, প্রতীককল্পকেই দেহসাধনা বার বার চিহ্নিত করে। এই চিহ্ন মনের গ্রথিত পাণ্ডুলিপিকেই যেন ছেপে বের করা। মন তাঁর চিন্তাকে, ভাবনাকে, উপলব্ধিকে, বিশ্বাসকে যোগক্রিয়ায় ছেপে বের করে দিচ্ছে। এই ক্রিয়াকে সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে বায়ু খ্যাপা উনপঞ্চাশ বায়ুর কথা বলেছেন। এই বায়ুগুলো আমাদের শরীরের ভেতরই বিরাজমান। উনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান ও উদান, এই পাঁচ বায়ুই প্রধান। এই পাঁচটির মধ্যে আবার প্রাণ ও অপান এই দুই বায়ু প্রধান প্রাণ বায়ুতে শ্বাসক্রিয়া হয় ইড়া নাড়িতে। এই নাড়ি জ্ব-মধ্যে আজ্ঞাচক্রের বাঁ দিকে আসে মূলাধার থেকে। এসে সে মেরুদণ্ডকে জড়িয়ে ধরে। অপান বায়ুতে শ্বাসক্রিয়া হয় পিঙ্গলা নাড়িতে। পিঙ্গলা মূলাধারচক্রের বাঁ দিকে কিন্তু উধ্বমুখ বজায় রেখে আজ্ঞাচক্রকে ডান দিকে রাখে। শ্বাস যখন নেওয়া হয় অপান বায়ু প্রাণ বায়ুকে টেনে নীচের দিকে নামায়। শ্বাস যখন ছাড়া হয় তখন প্রাণবায়ু অপান বায়ুকে উপরের দিকে টেনে তোলে। এতেই সাধকের উধ্বযোগ রপ্ত হয় ভালো করে। উনপঞ্চাশ বায়ুর ভেতর এই প্রধান বায়ুদ্বয়ই সাধনক্রিয়ায় সাহায্য করে থাকে বেশিমাত্রায়।

‘সপ্ততালা’কে সাত ধাতুর সমষ্টি হিসাবে দেখেন বাউল। শরীরের সাতটি উপাদান মিশিয়ে এই সাতটি স্তর। কিন্তু আমার মনে হয় ‘সপ্ততালা’কে আজ্ঞাচক্রের উপরিভাগ হিসাবে দেখা ভালো। ছটি চক্র পেরিয়ে শক্তি উপরে উঠে যাচ্ছে সপ্ততালাতে। যেটা লালন চক্র। এখানে চৌষট্টিদল বিশিষ্ট পদ্ম আছে। বৃত্তি আছে বারোটা। শ্রদ্ধা, সন্তোষ, স্নেহ, দম, মান, অপরাধ, শোক, খেদ, অরতি, সন্ত্রম, উৰ্ম্মি ও ঔদ্ধতা। এরপরই শক্তি গুরুচক্র ছুঁয়ে সহস্রারে প্রবেশ করে। যেখানে গেলেই সাধকের নির্বাণপ্রাপ্তি, চিন্তামনি দর্শন, এই সব হয়। তাই আজ্ঞাচক্রের উপরে শক্তি ওঠা মানেই সপ্ততালায় প্রবেশ করা। নটা চক্রকে যদি শরীরের নটা ধাপ হিসাবে দেখি। আর সেটাই তো দেখা উচিত অন্তত বাউল সাধনে। শরীর তো সেখানে ঘরবাড়ির নামান্তর। হাসন রাজার একখানা গান আছে–’লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালো না আমার/ কী ঘর বান্ধিমু আমি শূন্যেরই মাঝার।‘ হাসনের এই বেদনাময় উপলব্ধি ধরেই বলি, খোদা এ ঘর বানিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এ ঘরের তদারকি গুরু দেখানো পদ্ধতিতে ঠিকমতো না হলে তা সেই ‘ঘরবাড়ী ভালো না আমার’ই হবে। সাধকের কাছে এই অকৃতকার্যতা অনুতাপের। তাই তো বাউলের নানা গানে, আলোচিত খ্যাপার গানেও ‘ঘরবাড়ি ভালা’ রাখার নির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছেন সিদ্ধ বাউল। শিষ্যদের মঙ্গলের জন্যই তাঁদের এ সমস্ত করা।

শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য প্রাণায়াম চৌষট্টি বার করতে বলেছেন কেন? এই প্রশ্ন স্বভাবতই মনে আসতে পারে। বাউল তাঁর অনেক গানেই ‘চৌষট্টি গলির কথা বলেছেন। চৌষট্টি গলি রক্তবাহী প্রধান চৌষট্টিটি ধমনী। শ্বাসক্রিয়া এগুলোতে ঠিকমত ছড়ানোর জন্যই এই বিধি। আট বার প্রথমে করতে বলার নির্দেশ। যেটা মনে হয় ‘অষ্টশক্তি’কে জাগিয়ে দেবার জন্যই বোধহয় আটবার করতে বলা। ষোলবারের ব্যাখ্যা দিতে পারি এইভাবে–শরীরের ষোলোটি প্রধান ধমনী। চারটি হৃদপিণ্ডের আ বাঁকি বারোটি শরীরের অন্যপ্রান্তের। এখানেও শ্বাস ছড়ানো দরকার উর্ধ্বযোগের জন্য ঠিকমতো। বৈষ্ণব সাধকও প্রাণায়াম করেন। মহেশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সনাতন বাবাজি ষোলো বার প্রাণায়ামের বিধিকে ষোলো নাম আর বত্রিশ বার করাকে বত্রিশ অক্ষরের সদৃশ মানে তাঁকেই স্মরণ করা বলে আমাকে বলেছিলেন। এই ষোলো নাম–হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। তা বত্রিশ অক্ষরের হয়ে থাকে। প্রথম ধাপটি অর্ধাংশ আট বারের। একে আট বার করার সঙ্গে মেলাতে পারি আর নাম দু’বার সম্পূর্ণ জপলে চৌষট্টি হয়ে যাচ্ছে।

ঘরে পঞ্চভূত আর ষড়রিপুর কথা খ্যাপা বলেছেন। যার যোগফল এগারো জন সদস্যের। যারা ‘হাসায় কাঁদায় নাচায় গাওয়ায়’–অর্থাৎ কিনা এই পাঁচটি উপাদান। শরীরের পাঁচচক্রে জড়িয়ে গিয়ে সাধককে সিদ্ধিতে বা অকৃতকার্য হতে সাহায্য করে। ষড়রিপুর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। সাধককে তো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের উপরে উঠতে হয়। পাঁচটি উপাদানের ক্ষিতি থাকে মূলাধারে, অপ স্বাধিষ্ঠানে, তেজ মণিপুরে, অনাহতে মরুৎ এবং বিশুদ্ধচক্রে ব্যোম অবস্থান করে। এই পাঁচ চক্রে পঞ্চভূতের এই ধ্যানে উধ্বগতির যোগ চলতে থাকে। আর এসব ঠিকমতো সাধক না করতে পারলেই কাঁদা হাসার প্রশ্ন। আর ঠিক হলে নাচা-গাওয়ার। অর্থাৎ কিনা সিদ্ধ স্তরে অগ্রগতির আনন্দ। ঘরে কুমতি সুমতির বাস। সুমতি হল সিদ্ধ মতি। যা অগ্রগতি ঘটাবে। আর কুমতি হল পশ্চাৎগমন। যা সাধককে ঠেলে নামাবে নীচে। এই নীচে নামানো হল কুমতি। মানে বীর্যের নিম্নগতি। ‘সুমতি ঊর্ধ্বারে’ অবস্থা। তাঁদের ঠিকমত চালনা না হলেই ঘর ভাঙাগড়ার প্রশ্ন। এই গড়া-ভাঙার ইচ্ছা সাধকেরই হাতে। গুরু তাঁকে পথ দেখান মাত্র। সঠিক পথে ‘পূর্ণানন্দে প্রাণ’ একীভূত হয়। এই আনন্দ সিদ্ধস্তরেরই ছায়ানুবাদ। খ্যাপা তাঁর কথাই বলতে চেয়েছেন পদে। যেখানে উন্মীলিত সৌন্দর্যের সুধাকনা আছে। স্তব্ধ, ছায়াচ্ছন্ন। হয়ে ভাবলেই তাঁর ছবি ফুটে উঠতে পারে মনে। বাউলের গান সেই ছবিরই প্রতিলিপি হাজির করতে চায় সব সময়, সকল সময়।

গানে কথিত পূৰ্ণানন্দকে আমরা ভাবতে পারি এভাবেও–নটি চক্রের শেষ চক্র সহস্রার। এই চক্রের ধ্যানেই সাধক পরমাত্মা বা মূলসত্তার স্বরূপ ধরতে পারেন। মূলাধারের আগত শক্তি সহস্রারে এসে মিলিত হয়ে সাধকের মধ্যে এক তেজোময় দীপ্তি ফুটে ওঠে। এই দুই চক্রের সংযোগে সাধক এই সৌন্দর্য্যের বা নিরাকার মহাশূন্যতার। শোভা উপভোগ করেন। এই শোভা উপভোগকেও আমরা পূর্নানন্দ হিসাবে দেখতে পারি। বায়ুসাধনা বা প্রাণায়াম বাউল সাধক যে বলছেন আট, ষোলো, বত্রিশ, চৌষট্টি বার করতে। এটাও চার গুণিতকে বেড়ে যাচ্ছে অঙ্কের হিসাবে। চৌষট্টির পর একশো আট বার। শশাঙ্ক দাস তা না বললেও, বেশি বার করার অর্থই উধ্বরে অবস্থাতে দ্রুত পারঙ্গমতা। তাই চৌষট্টির পর আর করা যাবে না এ কখনওই ঠিক না। নইমুদ্দীনের গানে আমরা তাঁরই উল্লেখ পাই–’এক দুই তিন হবে চারি তাহাতে দুই গুন করি/ চতুর্থ গুণ করলে পরে নির্বাস হয় ভারি।।/ সাধ্যমতি উর্ধ্বগতি তখন খেলিবে রূপের কাঞ্চন।।/ ও সে নইমের বচন তিন বীজে প্রাণায়াম/ অধঃলিঙ্গে উধ্বশৃঙ্গে কি লিঙ্গে মিলন/ কুম্ভক পুরা হবে সারা। বললাম তোরে বিবরণ।।‘

শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে দিঘরাতে প্রতিবারই বসে বাউল গানের আসর। একবার এই আসরেই ষষ্ঠী খ্যাপার গান শুনেছিলাম। নানা গানের মাঝে তিনি সেদিন একখানা খ্যাপার গানও গেয়েছিলেন। খ্যাপা মনোহরের গান তিনি আরও অনেক আসরেই গেয়েছিলেন। আমার বহুবার এই গানখানা তাঁর মুখে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।

ষষ্ঠী খ্যাপা ভাবোন্মাদ থাকেন সব সময়। যত বারই কথা বলেছি তাঁর সঙ্গে সেরকমই আমার মনে হয়েছে। গেরুয়া পরেন না তিনি। নানা রঙের তালি লাগানো জোব্বা পরে মঞ্চে ওঠেন। তাঁর নাচ সাধারণত বাউল নাচের যে আঙ্গিক সেরকমটি একেবারে নয়। তাঁর নাচের কৌশল ভিন্নতর। মঞ্চে অনেকখানি জায়গা জুড়ে গোল ঘূর্ণাবর্তকে ভেঙেচুরে তিনি নাচেন। যা বাউলরা একেবারে করেন না।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মন্ত্রদীক্ষার মত কী আপনার?

বলেছিলেন, বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত আমি। এখনও গাঁয়ে-গাঁয়ে মাধুকরী করেই বেড়াই। তবে বাউল শিক্ষার জন্য তিনি অনেকেরই কাছে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। বেশ কিছু নাম বলেছিলেন সে সময়।

দিঘরাতেই তাঁর বাড়ি। তাই এ আসরে রাত করেই তিনি মঞ্চে ওঠেন। বহিরাগত বাউলদের গাওয়া হয়ে গেলে। বলা ভালো, তাঁর টানেই এরা এখানে আসেন। মাঝরাতে তিনি সেবার ধরেছিলেন খ্যাপার গান। গানের মাঝে মাঝে কিছু প্রতীকের রূপকল্পকে সামনে আনছিলেন। শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল। গাইছিলেন তিনি খ্যাপার গান। একতারাকে বাজিয়ে নিয়ে নাচে যেন সারা শরীরই বাজিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি।

শুনরে (তোরা) ক্ষ্যাপার কথা–
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট।
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যাথা।।
শুনরে তোরা খ্যাপার কথা।
চব্বিশের ছয় ছেড়ে দিয়ে…
এবার, যুক্তি কর যেথা সেথা।
বাহান্নর চার বাদ দিয়ে দেখ
(তোরা) পাবি নিজের মনের কথা।
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা।
 ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।

একশ আটের চব্বিশ বাদে
গণনাতে হয় চুরাশি
সাধক সিদ্ধ মহাপুরুষ
কথায় বলে একাই আসি
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা।।
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।

বিশ্বজুড়ে দেখনা ঘুরে
(আছে) চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের কথা।
অষ্টাদশে শ্রীমদ্ভাগবত
(ক্ষ্যাপা) গুরুশিষ্যের স্বার্থকতা–
শুনরে (তোরা) ক্ষ্যাপার কথা।
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ, ক্ষেপীর আট বল,
এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।
শুনরে (তারা) ক্ষ্যাপার কথা।।
যায় বাহান্ন তায় তিপান্ন
ওই দেখ আছে পঞ্চ, তত্ত্ব গাঁথা।
(ক্ষ্যাপা) সহস্র দল দেখবি হেথা–
শুনরে তোরা ক্ষ্যাপার কথা
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।

তিনি বলেছিলেন, খ্যাপার চৌদ্দ হল গিয়ে আমাদের শরীরের দশ-দশটা ইন্দ্রিয় আর চারভূত। খেপীর আট অষ্টপাশ।

অষ্টপাশ বললেন তিনি–ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল, মান।

প্রচলিত এক প্রবাদের কথা আমরা সকলেই জানি–’লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়।‘ বাউলও তাই বিশ্বাস করেন। তান্ত্রিক সাধকদেরও এমতে পূর্ণ আস্থা আছে।

খ্যাপা ব্রহ্মানন্দ আমায় বলেছিলেন, আগে পাশমুক্তি। পাশমুক্তি না হলে সাধন হবে না।

অমাবস্যার রাতে নিঝুম গৌরনগর শ্মশানে যজ্ঞে বসবেন তিনি। কুণ্ড তৈরি করতে তখন ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা বুঝিয়ে বলুন। এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি আমার নানা জিজ্ঞাসা, কৌতুহলের উত্তর দিয়েছেন।

বললেন, পাশ হল বন্ধন। এই বন্ধনই তোমার স্বরূপকে বাউরে আসতে দিচ্ছে। লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষুধা, নিদ্রা, ভয়, ক্রোধ, কাম প্রভৃতি নানারকম পাশ আছে। তাঁর উর্ধ্বে যেতে হবে। ছিঁড়ে দিতে হবে বন্ধন।

বললাম, কীভাবে ছিঁড়বে এই বন্ধন?

শ্লোক আওড়ালেন বাবা: ‘পাশবদ্ধো ভবেৎ জীবঃ, পাশমুক্তঃ সদা শিবঃ।‘

হোমকুণ্ডে যন্ত্র আঁকছিলেন তখন বাবা। রেড়ির তেলে জ্বালানো প্রদীপের শিখা তখন কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে, বেঁকেচুরে আবার জ্বলছে সোজা হয়ে। হাওয়া থামলে স্থির হয়ে যাচ্ছে শিখা। তবে সেটা দু’এক মিনিটের জন্য। অদূরে গঙ্গার হাওয়ার আজ সেইভাবে নেই বিরাম কোনও শিখা কাঁপছে। সেই কাঁপা শিখার আলোতে দেখলাম বাবা একটি সোজা ত্রিভূজ এঁকে তার উপর উল্টানো ত্রিভূজ আঁকছেন। তাদের গায়ে সোজা-উল্টো অসংখ্য ত্রিভূজ।

আঁকতে আঁকতেই বললেন, মনে কর ভয়ের পাশ থেকে মুক্ত হতে হবে, তার জন্য অমানিশায় শবের উপর বসে একমনে ধ্যান করতে হবে। কাম জয় করতে ভৈরবী মা’র সঙ্গে সম্পূর্ণ উত্তেজিত অবস্থায় মৈথুনের ভেতরই জপে মগ্ন হতে হবে। আমার গুরুর গুরুদেব শ্মশানে মরা এলে তার মাথা ফাটানোর সময় চিতার সামনে এসে দাঁড়াতেন। খুলি ফাটলেই সেই রস তিনি নিয়ে রাখতেন পাত্রে। পরে ভাতের সঙ্গে মেখেমুখে খেতেন। ঘেন্না পেলে চলবে?

বাউলের অষ্টপাশের সঙ্গে তন্ত্রের অষ্টপাশে কিছু হেরফের আছে। কারণ বাউলকরণ, সাধন তন্ত্রসাধনের মতো অত ভয়াবহ ক্রিয়া কখনওই নয়। বিভৎস রস সেখানে বেশ কম।

খেপীর আট অষ্টপাশ সাধক ও সাধনসঙ্গিনীকেও পেরোতে হয়। ব্রহ্মানন্দ যে মরার মাথার খুলির রস খাবার কথা বলছিলেন অঘোরী সাধুরা তা খান। তন্ত্রক্রিয়া শ্মশানে করতে হয় কেন? একবার ব্রহ্মানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি। তিনি কিছু উত্তর দেননি। শুধু নিজের দেহকে বার বার দেখাচ্ছিলেন।

বললাম, দেহকে শ্মশানরূপ দিতে চাইছেন কি?

কিছু বললেন না তিনি।

তার ভৈরবী ছিলেন মানদা মা।

মা গলায় একটা স্নেহময়ী সুর নিয়ে বললেন, ঠিক ধরেছিস তুই।

বললেন, শ্মশান আসলে আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, মান, রাগ, দ্বেষ–এই সব থেকে মনকে বের করে আনা। মনকে ধুয়ে মুছে নির্জন ধূ ধূ করে দেওয়া। শ্মশানপুরীর রূপ দেওয়া। মনের কামনাকে পুড়িয়ে দাওয়াই হল শ্মশান। তন্ত্রক্রিয়া পাশমুক্তির সাধনা। তাই শ্মশানেই করতে হয় বেশিরভাগ ক্রিয়াকর্ম।

‘অষ্টপাশে’ বাউল ’জাত কুল’কে ধরেন। তান্ত্রিক তা ধরেন না। তাঁরা আবার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা–এভাবেও ‘অষ্টপাশ’ বলেন। তবে ব্যাপার কিন্তু ঘুরে ফিরে মনের কামনাকেই সংবেদন ও বোধের মাঝখান থেকে টেনে বের করে আনা বোঝায়। কী তন্ত্রে, কী বাউলে।

 ‘জাত কুল’ বাউল ‘অষ্টপাশে’ আনেন বোধহয় এই কারণেই, তথাকথিত যাতে তাঁরা বিশ্বাস রাখেন না বলেই। পাঞ্জু শাহের গানেই আমরা পাই–’জেতের বড়াই কী/ ইহকাল-পরকালে জেতে করে কী–/ আমার মন বলে অগ্নি জ্বেলে দিই জেতের মুখি।‘

পাঞ্জু ‘জেতের মুখি’ অগ্নি জ্বাললেও মূলত তফসিল পরিবার থেকেই তাঁরা আসেন বেশি। বর্ণহিন্দু, বৈষ্ণব ও মুসলমান পরিবার থেকেও বাউল উঠে আসেন। বৈষ্ণব পরিবার থেকে অনেকে আসেন বলেই বোধহয় বৈষ্ণবীয় আচরণ তাঁরা বাউল-আচরণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। মুসলমান পরিবার থেকে উঠে আসা বাউলরা তাঁদের গানে আরবি, উর্দু, মুসলমানি শব্দকে ব্যবহার করেন অকাতরে। তবে ফকিরি গানে এর আধিক্য বেশি দেখা যায়।

বিশ্বাস করেন বীর্য প্রকৃতি বা সৃষ্টির জড় উপাদান। তাই তা ভক্ষণ করাও উচিত। শিক্ষার্থে তাঁরা গুরুর নির্দেশে শরীরের জিনিস শরীরের মধ্যে ফিরিয়ে আনেন। সকালবেলাকার বিষ্ঠা থেকে খানিক তুলে মুখে দেন। বাকিটা ফেটিয়ে মাখনের মতো করে ফেলেন। তাতে বদ গন্ধ কমে। তা গায়ে-মুখে-চোখে-নাকে সর্বাঙ্গে মেখে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে স্নান করে পরিষ্কার হন। পেচ্ছাব/প্রস্রাব মাটির হাঁড়ি বা নারকেল মালাতে ধরে খেয়ে শরীরের মধ্যেই ফিরিয়ে নেন ফের। ‘অষ্টপাশ’ না ঘুচলে এ কখনও সম্ভব নয়। তবে এখনকার বাউল এই আচরণ কতটা পালন করেন যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাউল সাধনে গানই পুরনো সিদ্ধ স্তরের মানুষজনদের লেখা। এখনকার বাউল যে গান লেখেন তাতে চটকদারি কথাবার্তা যত থাকে সাধনতত্ত্বের কথা সেভাবে থাকে না। এরকম গান আমরা আকছার শুনতেও পাই। বাউল বলেন, শ্রোতারা এখন এসবই পছন্দ করেন। তাই আমরা লিখি, সুর করি, গাই। যার জন্য বাউল আসরে এখন ‘সাইকেলের মধ্যে চাকা দু’দিক ফাঁকা’, ‘বন্ধু আমার রসিয়া’, ‘এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে’–এসব গানও শোনা যায়। তবে শখের বাউলরাই শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য এসব পরিবেশন করেন বেশি। যারা দশ-কুড়ি বছরের বেশি বাউল গান করছেন, গানকেই পেশা হিসাবে নিয়েছেন, হয়তো কিছু আচরণও পালন করছেন জীবনে, তাঁরা কিন্তু চট করে আসরে আজেবাজে গান গানই না একেবারে। গাইলেও আসর বুঝে গান।

খেপীর ‘অষ্টপাশের’ কথা বাউল বলেছেন। যা থেকে মুক্ত হয়ে না এলে সাধন সঙ্গিনী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বাকি রইল খ্যাপার চোদ্দ। ‘দশ-দশটা ইন্দ্রিয় আর চারভূতের’ কথা ষষ্ঠী খ্যাপা বলেছিলেন। তবে গানের তালে তাঁকে আর ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেননি বোধহয়। না হয় গাইতে-গাইতে আবেশে, ভাবোন্মাদনায় ভুলেই গেছেন সেসব।

‘দশ-দশটা ইন্দ্রিয়’ কী? এই দশেন্দ্রিয়ের পাঁচটি হল জ্ঞানেন্দ্রিয়, বাকি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। অর্থাৎ দশেন্দ্রিয়ের দুই ভাগ। পাঁচটি করে। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো হল–চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক/চামড়া। কর্মেন্দ্রিয়–বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

খ্যাপা বলছেন–’ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।‘ অর্থাৎ সাধক ও সাধন সঙ্গিনীর যুগল সাধনক্রিয়াতে কারও মাথা ব্যথা হবার কথা নয়। এ যে দু’জনের একত্র সাধনা। তাই এই সাধনক্রিয়া অপরের জানবার দরকার নেই। খ্যাপা জানুক তার এই ‘দশ দশটা ইন্দ্রিয়কে’। খেপীও চিনে নিক ‘অষ্টপাশ’কে তবেই সাধনা অগ্রগতির পথে যাবে।

তবে খ্যাপার ‘চৌদ্দ’কে আমরা মূলাধার পদ্ম কি ভাবতে পারি না? আর খেপীর আটকে যদি ‘অষ্টপাশ’ না ধরে ধরি সঙ্গিনীর আটটি প্রত্যঙ্গ–মুখ, দুই স্তন, দুই হাত, বুক, নাভি, যোনি। বাউল একে ‘অষ্টমচক্র’ও কিন্তু বলেন। আমার মনে হয় এই ভাবনাও আদতে খুব একটা ভুল হবে না।

কারণ, মূলাধারে চতুর্দশ পাপড়ির পদ্ম কল্পনা করে থাকেন সাধক। এই পদ্মে ধ্যানে,প্রাণায়ামে, শ্বাসক্রিয়ায় তিনি একেক চক্রের গাঁট খুলতে খুলতে বা পদ্মের পাপড়ি ছিড়তে ছিড়তে ক্রমশই উপরের দিকে ওঠেন আর তা উঠতে থাকলেই তো সেই বাউল কথিত জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও চারভূতকে পরাস্ত করে দিতে পারেন। আর এই চারভূত তো শরীরের চারটি চক্ৰতেই বিরাজ করে। মূলাধারেই পৃথ্বীমণ্ডল। স্বাধিষ্ঠানে বরুণমণ্ডল, মণিপুরে অগ্নিমণ্ডল, অনাহতে বায়ুমণ্ডল, বিশুদ্ধে আকাশমণ্ডল। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। যাঁদের রুদ্ধদ্বার খুলতে পারেন সাধক ধ্যানে, যোগে, ক্রিয়ায়।

‘অষ্টপাশ’কে আটটি প্রত্যঙ্গ ভাবার কারণ তন্ত্রমতে ভৈরব মৈথুনে বা ভৈরবী চক্রে ভৈরবীর এইসব প্রত্যঙ্গগুলোর পূজা সেরে নেন প্রথমে কামপাশ মুক্ত করেন সাধক বা তান্ত্রিক এভাবে। বাউলও যুগল আসনে সঙ্গিনীর তীর্থক্ষেত্র স্বরূপ মুক্ত শরীরে ভ্রমণ করেন। মোহ কাটান, কাম নিয়ন্ত্রণ করেন প্রত্যঙ্গগুলোতে প্রবেশ করে গুরু নির্দেশিত ‘শরীরই তীর্থক্ষেত্র এই ভাবনায়। তাহলে সঙ্গিনীর ‘অষ্টপাশ’কে আটটি প্রত্যঙ্গ ভাবতে দোষ কোথায়? বাউল ‘অষ্টপাশ’ খেপীকে আট দিয়ে খ্যাপার দশেন্দ্রিয়র সঙ্গে মিল দিতে চেয়েছেন। ১০+8= ‘চোদ্দ’ প্রতীককে ‘আট’ এ এনেছেন সেই ভেবেই। না হলে বাউল সঙ্গিনীকেও কিছু তো শ্বাসের কাজ শিখতেই হয় সাধককে সাহায্যার্থে। তা শিখতে শিখতেই তো মোহপাশ/ অষ্টপাশ কাটে। পাশমুক্তি হয়। তাই অষ্টপাশ ও দশেন্দ্রিয় আর চারভূতের ‘আট’ ‘চোদ্দ’কে এভাবেও প্রতীকীরূপ দিতে পারি। বাউল তা না মানলেও শরীরবিজ্ঞানকে কী করে অস্বীকার করব আমরা?

খ্যাপা ‘চব্বিশের ছয়’ ছেড়ে দিতে বলেছেন। ছয় বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ষড়রিপু। কিন্তু চব্বিশ কী? চব্বিশ হল সেই ‘চোদ্দ’র মতই যোগফল। ষড়রিপুর ছয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় আর কর্মেন্দ্রিয় মিলিয়ে দশ, অষ্টপাশের আট। মোট চব্বিশ। এর থেকেই ছয় বাদ দিতে বলা হচ্ছে। তাহলেই নিজের মনের কথা পাওয়া যাবে। কীভাবে তা সম্ভব হবে? ষড়রিপুর ‘ছয়’ বাদ হলে জাগতিক জিনিসগুলো তো সব বাদ পড়ে যাচ্ছে। যা সাধনায় অনিবার্য। মনকে সেই স্তরে নিতে ষড়রিপু বর্জন প্রয়োজনীয়। তাই বাউল সাধক বলছেন সক্রিয় রিপুগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে নিতে।

‘চব্বিশ’কে আরেক রূপে কল্পনা করে নিতে পারি আমরা। জৈন ধর্মাবলম্বীরা চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন এই চব্বিশজনের বসবাস মানবদেহেই। কীভাবে? ছটি চক্র, ষট্‌যন্ত্র বা চক্রকে যারা অতিক্রম করতে পারবেন তারাই চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের দেখা পাবেন। এই মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্রকে অতিক্রম করে যাওয়াই হচ্ছে চব্বিশ। অতিক্রমে রয়েছে এক, সংসার সমুদ্র পার হবার বাসনা। দুই, সংসারের অপরিপূর্ণতা। তিন, পেরিয়ে যাওয়া। চার পূর্ণতা। এই চারকে সাঙ্গ করে ছয়কে দিয়ে গুণ দিলেই বেরোবে চব্বিশ। ৬x ৪=২৪।

একশ আটেরও চব্বিশ বাদ দিতে বলেছেন খ্যাপা। ‘একশো আট’ হল চক্র সমষ্টি। মূলাধারে চতুর্দল, স্বাধিষ্ঠানে ষড়দল, মণিপুরে দশদল, অনাহতে দ্বাদশ দল, বিশুদ্ধে ষোড়শদল, আজ্ঞায় দ্বিদল। যোগ করলে দাঁড়ায় একশো। (১৪+১৬+১০+১২+২৬+২) =১০০ আর অষ্টপাশের আট যদি নিই তাহলে সর্বমোট একশো আটই হয়। ১০০+৮=১০৮। চব্বিশ বাদ ধরি এইভাবে ১০+৪+৮=২৪। জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের দশ,চারভূতের চার, অষ্টপাশের আট। হল গিয়ে সর্বমোট চব্বিশ।

আবার গুরুচক্রে শতদল বিশিষ্ট পদ্ম থাকে। এইটি অষ্টম চক্র, তাহলে শতদল। আর অষ্টম চক্রের আট যোগেও একশো আটই হয়। ১০০+৮=১০৮। এই পদ্মে ধ্যানে বসলে সাধক গুরুর কৃপায় সর্বসিদ্ধি ও দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। এখানে ধ্যানে খ্যাপার গানের কথানুযায়ী সাধক সিদ্ধ মহাপুরুষ’ হন।

সাধক বলে থাকেন এটি একটি হংসপীঠ। গুরুপীঠও বলতে শুনেছি আমি অনেককে। গুরুপীঠ কেন? গুরুচক্রের মধ্যে যে শতদলবিশিষ্ট পদ্মের কল্পনা তার কর্ণিকায় ত্রিকোণমণ্ডল থাকে। তিনটি বর্গের তা–হল,ক্ষ। এই মণ্ডলকে যোনিপীঠ ও। শক্তিমণ্ডল বলে। ওই শক্তিমণ্ডলের মধ্যেই তেজোময় কামকলামূর্তির দেখা মেলে। তেজোময় জ্যোতিকে হংস স্বরূপিনী করে নিচ্ছেন সাধক। এই হংস শ্বেতবর্ণের। ধবধবে সাদা রঙের। শরীর জ্ঞানময়ের। পাখা দুটি আগম, নিগমের। পা দুটি শিবশক্তিময়, চক্ষুদ্বয় প্রণবস্বরূপ, নেত্র ও কণ্ঠ কামকলাময়। এই হংসই গুরুদেবের পাদপীঠ স্বরূপ। এই হংসের উপর গুরুবীজ ঐং আছে। বলা হয় গুরুদেব স্বয়ং এখানে অবস্থান করেন। তার বাঁ দিকে গুরুপত্নীও রয়েছেন।

হংস’র এই যে রূপকল্পনা তা মনে হয় শ্বাসবায়ুরই কল্পনা। আমাদের শ্বাস ও প্রশ্বাসে যে শব্দ হয় তার রূপ ‘হং’ ও ‘স’। এই ‘হং’ ও ‘স’ যদি সরলরেখায় হয় তাহলেই কুম্ভক হয়।

গানে খ্যাপা, ‘চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের কথা’ও বলছেন। চুরাশি সংখ্যার কথাও আছে। চুরাশি যোনি শরীরে চুরাশিটি আঙুল। ৮৪ লক্ষ বিভিন্ন যোনিতে জন্মের পর মানুষ জন্ম হয় বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। একশো আট থেকে চব্বিশ বাদের এই হল প্রতীকময়তা। ‘চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ড’কে শরীরের প্রধান চোদ্দটি নদীরূপী নাড়িও ভাবা যেতে পারে। তার মধ্যে প্রধানা তিন নাড়ি ইড়া/গঙ্গা, পিঙ্গলা/যমুনা, সুষুম্না/সরস্বতী। সাধক বলেন ত্রিবেণী। এই তিন নদীরূপী নাড়িকে জাগিয়ে দিয়ে সাধক বাহ্য স্নান সারেন। আর এই স্নানে অর্থাৎ তিন নাড়িকে ঠিকমতো যোগক্রিয়ায় জাগাতে পারলে মহাশক্তির বিকাশ ঘটে। যা চার বেদ চোদ্দ শাস্ত্রের জ্ঞান হয়। ‘চোদ্দ ব্রহ্মাণ্ড’কে এই প্রতীকেও রাখতে পারি আমরা। কিন্তু সঠিক হিসাবে রাখতে গেলে চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডকে ধরতে হবে শরীর। মদন শা ফকিরের গানেও তার প্রকাশ পাই–’জান গা কোথায় হাওয়ার স্থিতি। / ও তার চৌদ্দ পোয়া চৌদ্দ ভুবনে কে কোথায় করে বসতি।।’ চোদ্দ ভূবন–ও দেহভাণ্ড। ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ তা। ‘চোদ্দ পোয়া’ও কিন্তু শরীরের গড়ন। মানে হল সাড়ে তিন হাত। আমরা সবাই মৃত্যুর পর সাড়ে তিন হাত জমির কথাই বলি। লোকায়ত গানেও তার প্রকাশ আছে। এটাও একটা প্রতীককল্প। বলি এই কারণেই, যার যার নিজের হাতের মাপে তার শরীর সাড়ে তিন হাতই। তাই ওটুকু জায়গা না হলে পোড়াতে, গোর দিতে, সমাধিস্থ করতে শরীরকেই আটানো যাবে না।

খ্যাপা বলেছেন–’যায় বাহান্ন তায় তিপান্ন/ ওই দেখ আছে পঞ্চতত্ত্ব গাঁথা।‘ কী এই সংখ্যা? বাহান্ন বা তিপান্ন হল–রস বহন করা বিভিন্ন নাড়ি। এই রস নারী শরীরের রজ। বাউল ‘তিপান্ন গলি’ বলতে গানে বোঝান সঙ্গিনীর/ নারীর শরীরের রূপকল্পকেই। ফিকিরচাঁদ সরকার ওরফে চাদমুদ্দিনের গানেও তার প্রকাশ পাই–’ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ/ ঢাকা খুলে দেখলে পরে থাকবে না তোর সাবেক মন।।/ ঢাকার কথা শোন তোরে বলি ঢাকার ভিতর আছে ঢাকা তিপান্ন গলি।‘ ‘পঞ্চ’ তো পঞ্চভূত। ‘পাঁচে পাঁচে পঁচিশ’ পঞ্চভূতকে পাঁচ দিয়ে গুণ। যেজন্য এই গুণ, শরীরের পাঁচচক্রে তাঁদের স্থান। সহস্রদল দেখার কথা বলেছেনে খ্যাপা শেষে। সহস্রদল সহস্রার চক্রের দ্যোতক। যা শরীরের নবম পদ্ম। সহস্রদল পদ্মের চারদিকে পঞ্চাশ দল বিরাজিত এবং এটি কুড়িটি স্তরে সাজানো। প্রত্যেক স্তরে পঞ্চাশ দলে পঞ্চাশটি মাতৃকাবর্ণ আছে। এই শক্তিমণ্ডলেই সাধক বলেন তেজপুঞ্জ আছে। যা বিন্দুস্বরূপ। এই বিন্দুই পরমশিব। এই বিন্দু প্রত্যক্ষ করাকে বলা হয় ব্রহ্মসাক্ষাৎকার। অর্থাৎ তিনি সমগ্রশক্তিকে জেনে নিজেই শিবস্বরূপ ব্ৰহ্ম হয়ে ওঠেন। সহস্রদলে ধ্যানে এসবের দর্শন হয়। জগদীশ্বরত্ব প্রাপ্তি এই পদ্মের ধ্যানেই।

গানে তাই বলা হচ্ছে সহস্রদল দেখবি হেথা। শরীর এভাবেই দ্যোতিত হচ্ছে। প্রতীকমান হচ্ছে, দ্বৈতাদ্বৈতের ভেতরে দাঁড়িয়ে শরীর সৃষ্টির হোমাগ্নিকেই জাগ্রত করছে। যেন। সাধক সেখানেই দেখে ফেলছেন আধ্যাত্মিক বিগ্রহ। খ্যাপা গানে তাঁরই হদিশ দিয়েছেন।

খ্যাপার সমসাময়িক পদকর্তারা হলেন নিতাই খ্যাপা, নবদ্বীপ গোঁসাই, ত্রিভঙ্গ গোঁসাই, রাধাশ্যাম দাস, গোপাল খ্যাপা, ঘনশ্যাম দাস। পরবর্তী পদকর্তারা হরিপদ গোঁসাই, হেমন্ত দাস, সনাতন দাস, লক্ষ্মণ দাস, মদন নাগ, সুধীর বাবা, সুধাময় দাস, ঠাকুর দাস। যেটা বলতে চাইছি বেশ কিছু সংকলনে এঁদের গান(সমসাময়িক, পরবর্তী) সংকলিত হয়েছে কিন্তু খ্যাপার গান বাউল কণ্ঠে শোনা ছাড়া কোথাওই কোনও গবেষকদেরই সংকলিত বাউল গানের গ্রন্থে গ্রথিত হয়নি। অথচ আশ্চর্যের, নামকরা। বাউলরাও সব গেয়ে থাকেন তার গান। এখানে তার সাতটি গানকে পূর্ণাঙ্গ পরিসর দিয়ে আমি গবেষকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলাম আরকি। যাতে পরবর্তীতে তার গানও সংকলন ভুক্ত হবার সময় কোনও ভাবে বাদ না পড়ে। তাহলে বাউল গানের মান্য পরিসর সেইভাবে গড়ে উঠবে না। তবে আশার বিষয় যেটা, খ্যাপা প্রতিষ্ঠিত সংঘ থেকেই তার রচিত ৫২৬ টি বাউল গানের সংকলন বেড়িয়েছে ২০০৫ সালে। যতদূর জানি সে বইও এখন পাওয়া যায় না কোনোভাবে। তার শিষ্যদের মধ্যেই যা কিছু ছড়িয়েছে। আমার শোনা গানগুলো এখন সবই সংকলিত। আমি রেকর্ডারে বাউলদের কণ্ঠে শোনা গানগুলো সব রেকর্ড করে রাখলেও এখানে উল্লেখের সময় সংকলন গ্রন্থেরই সাহায্য নিয়েছি। তার ছেলের মুখে একবার শুনেছিলাম বেদনাশা বট আশ্রমে মহোৎসব চলার সময় পূর্ণদাস এসেছিলেন খ্যাপার আশীর্বাদ নিতে। তখনও নাকি পূর্ণদাসের নাম হয়নি। নবনী দাসের হাত ধরে কলকাতাতে আসেননি তিনি। পূৰ্ণকে দেখা মাত্রই খ্যাপা ঠাকুর তার গলার মালা খুলে পূর্ণদাসের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোর জগৎ জোড়া নাম হবে।

পরে অবশ্য একবার পূর্ণদাসের স্ত্রী মঞ্জু দাসের মুখে শুনেছিলাম, ঠাকুরের সেই আশীর্বাদ কাজে লেগেছে।

মঞ্জু দাসী দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে একথা বলেছিলেন সেদিন। আমি মঞ্জু দাসের জবানীতে ঠাকুরের সেই মালা ছোঁড়ার দৃশ্য আর পূর্ণদাসের পরিতৃপ্ত হাসি মুখখানাই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। বেদনাশা বটের পাতা তখন সমানে উথাল পাতাল করছে অজয় নদের বুক থেকে উঠে আসা পাগলা হাওয়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *