০১-৪. ঠক-ঠক-ঠক

সাইকো
মূল : রবার্ট ব্লচ
অনুবাদ : অনীশ দাস অপু

ভূমিকা

বিশ্বখ্যাত হরর লেখক রবার্ট ব্লচের প্রথম উপন্যাস সাইকো। রচিত হয় ১৯৫৯ সালে। অসাধারণ এ সাইকোলজিকাল থ্রিলার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয় বেস্টসেলারে। এ কাহিনী নিয়ে পরবর্তীতে সাসপেন্স কিং চিত্র পরিচালক আলফ্রেড হিচকক নির্মাণ করেন ছায়াছবি–সাইকো। তার এ ছবিটি বিশ্বের সেরা দশটি সাইকো-থ্রিলারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। রবার্ট ব্লচের সাইকো রচিত হয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এ কাহিনীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ভয়, উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ। বইটি পশ্চিমা বোদ্ধারা সর্বকালের সেরা সাইকোলজিকাল থ্রিলার হিসেবে অভিহিত করেছেন। বইটি পড়লেই বুঝবেন কেন এ বইয়ের এত প্রশংসা!

অনীশ দাস অপু
ধানমণ্ডি, ঢাকা।

.

০১.

ঠক-ঠক-ঠক।

শব্দটা কানে যেতেই চমকে উঠল নরমান বেটস। ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। কে যেন টোকা মারছে জানালার কাঁচে!

ঘাড় ঘুরিয়ে ইতস্তত দৃষ্টিতে তাকাল নরমান। হাত থেকে বইটা গড়িয়ে পড়ল কোলে। বুঝতে পারল ভয়ের কিছু নেই। ওটা বৃষ্টির শব্দ। শেষ বিকেলের বৃষ্টি। ছাঁট এসে লাগছে জানালার কাঁচে। বাতাসের ধাক্কায় হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছে জানালা।

বৃষ্টি কখন এল? বাইরেটা দেখি অন্ধকার হয়েও এসেছে। আসলে বইয়ের মধ্যে এমন ঝুঁদ হয়ে ছিল নরমান যে খেয়ালই করেনি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ঘরে হালকা অন্ধকার। হাত বাড়াল নরমান। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালল। আবার মন দিল পড়ায়।

এই টেবিল ল্যাম্পটা বহুদিনের পুরানো। চারদিকে ঝালর দেয়া সুদৃশ্য এই ল্যাম্পটাকে জ্ঞান হবার পর থেকে দেখে আসছে নরমান। ওর মায়ের খুব পেয়ারের জিনিস। চল্লিশে পা দিয়েছে নরমান। এই বাড়ির প্রতিটি কোণের সঙ্গে ভীষণ ভাবে পরিচিত সে।

আশ্চর্য পুলক অনুভব করে সে বাড়ির পরিচিত জিনিসগুলোর মধ্যে থাকতে। বাইরে বেরুতেই খালি ভয়। ওর ধারণা বাইরের জগৎ হচ্ছে অশ্লীল আর খারাপ কাজের জায়গা। যত রাজ্যের আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা আর অশুভরা রাজত্ব করছে ওর চৌহদ্দির সীমানার বাইরে। ধরুন, সে একদিন বিকেলে হাঁটতে বেরুল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল জলার কাছে। তারপরই যদি ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নামে, তখন? তখন মহাসর্বনাশ হবে। সারাটা পথ তাকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে হবে। ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে মারাও যেতে পারে সে। কি দরকার বাপু অযথা বাইরে ঘুরঘুর করার। তারচে এখানে, এই বারান্দায়, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই পড়তে কত মজা।

বইটা ইনকা সভ্যতার ওপর লেখা। খুবই মজার একটা বই। এখন ইনকাদের বিজয় নৃত্যের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পড়ছে নরমান। এই নাচকে ইনকারা বলে ক্যাচুয়া, এই নাচে বিজয়ী বীরেরা পরাজিত শত্রুকে ঘিরে বিরাট এক বৃত্ত করে সাপের মত মোচড় খেতে খেতে নাচতে থাকে। শত্রুর চামড়া জ্যান্ত অবস্থায় ছিলে নেয়া হয়, পেটটাকে বানানো হয় ড্রাম। মুখ হাঁ হয়ে থাকে শত্রুর। ভুমভুম আওয়াজ বেরিয়ে আসে খোলা মুখ থেকে। তাই দেখে কি উল্লাস বিজয়ীদের। পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে উঠল ইরমান। কল্পনায় দেখতে পেল বিশাল নীল আকাশের নিচে জ্বলজ্বলে সূর্যতাপে একটা জীবিত মানুষের চামড়া ছিলে ফেলা হচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে সে! নগ্নদেহী যোদ্ধারা তার মরণ চিৎকার শুনে আরও উল্লসিত হয়ে উঠছে। পরাজিত শত্রুর পেটটাকে তারা ব্যবহার করছে ড্রাম হিসেবে। ফুলে উঠেছে পেট। প্রতিটি আঘাতের সাথে অদ্ভুত একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে। ভাবতে গিয়ে, এই দেখুন না নরমান নিজেও কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে।

ঠিক এই সময় একটা শব্দ শুনতে পেল নরমান। কেউ আসছে এদিকে। পায়ের এ শব্দ চিরচেনা নরমানের। শব্দটা কানে যাওয়ামাত্র তটস্থ হয়ে ওঠে সে। কেন জানি ধুকপুক করে ওঠে বুকের ভেতর। মা আসছে!

নরমান বইয়ের মধ্যে জোর করে মুখ গুঁজে রইল। ভান করল যেন কুঁদ হয়ে আছে পড়ায়। জানে মা ঘুম ভাঙার পর কেমন তিরিক্ষি মেজাজের হয়ে ওঠে। তখন তার সঙ্গে কোন কথা না বলাই ভাল।

নরমান, কটা বেজেছে দেখো তো?

নরমান হাই তুলল। বইটা রাখল টেবিলের ওপর। বলতে ইচ্ছে করল, মা, এত ঢঙের কি দরকার? তুমি নিজেই তো গ্রান্ড ফাদার ক্লকে দিব্যি দেখে আসতে পারতে কটা বাজে! কিন্তু বলল না সে কথাটা। হাতঘড়ির দিকে তাকাল। হেসে বলল, সাড়ে পাঁচটা। আমি বুঝতেই পারিনি এত বেলা হয়ে গেছে। আসলে একটা বই পড়ছিলাম তো-।

আমার চোখ নেই নাকি? তুমি কি করো না করো সবই আমি দেখতে পাই, বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঝাঁঝিয়ে উঠল মা, অন্ধকার হয়ে গেছে অথচ এখনও সাইনবোর্ডের আলো জ্বালোনি কেন? আর এখনও অফিসেও যাওনি কি মনে করে, শুনি?

মানে, এত বৃষ্টি হচ্ছিল যে ভাবলাম এমন বৃষ্টিতে কেই বা আসবে এদিকে, মিনমিন করে বলল নরমান।

গাধা কোথাকার! আরে বুদ্বু, কাস্টমার আসার এটাই উপযুক্ত সময়। অনেকে বিশেষ প্রয়োজনে এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেও কাজে বেরোয়।

কিন্তু এই দিকে কেউ আসবে বলে মনে হয় না। সবাই নতুন হাইওয়েটা ব্যবহার করছে, ক্ষীণ প্রতিবাদ করল বটে নরমান কিন্তু গলায় তেমন জোর পেল না। কিন্তু শুরু যখন করেছে, শেষটাও তাকেই করতে হবে। প্রায় বমি করার মত উগরে দিল সে মনের কথা। আমি তো তোমাকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তখনই সাবধান করে দিয়েছিলাম। হাইওয়ে এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার খবর পাবার পরপরই তোমাকে পইপই করে বলেছিলাম মোটেলটা বিক্রি করে দাও। ফেয়ারভেলের ওদিকে, নতুন রাস্তায় কত কম টাকায় জমি পেয়ে যেতাম। নতুন বাড়ি হত আমাদের, নতুন মোটেল তৈরি হত। সেই সাথে টাকাও আসত। কিন্তু তুমি আমার কথায় আমলই দিলে না। তুমি কখনোই আমার কোন কথার মূল্য দিতে চাও না। নিজে যা ভাল বোঝে, নিজে যা চাও সেটাই তোমার কাছে প্রধান। আমি যেন কিছুই না। তোমার জ্বালাতেই আমি মরলাম।

তাই নাকি, থোকা? মা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা গলায় বলল। মেজাজ খিঁচড়ে গেল নরমানের। চল্লিশ বছরের এক বুড়ো ধাড়িকে খোকা বলার কোন মানে হয়? মা জানে খোকা ডাকটা সে একদম পছন্দ করে না। কিন্তু তারপরও বলবে। ইচ্ছে করে হুল ফোঁটাবে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না নরমান। কখনও করেনি। চুপচাপ মুখ বুজে সয়ে গেছে। আজকেও সইল।

তাই নাকি, খোকা? মা আবারও বলল। হিমশীতল কণ্ঠ। তোমাকে আমি জ্বালিয়ে মারছি, আঁ? না, খোকা, কথাটা ঠিক না। আমি তোমাকে জ্বালিয়ে মারছি না। তুমি নিজের দোষে নিজেই জ্বলে মরছ। তুমি সবসময় এই ঘরের কোণে চোরের মত ঘাপটি মেরে বসে থাকো কেন, নরমান? কারণ বাইরে বেরুবার সাহসই তোমার নেই। কোন কালে ছিলও না। বাইরে গিয়ে একটা কাজ জুটিয়ে নেয়ার হিম্মত তোমার কখনোই হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত একটা গার্লফ্রেন্ড পর্যন্ত জোগাড় করতে পারোনি-

তুমিই তো আমাকে যেতে দিতে চাওনি।

ঠিক, নরমান। আমি তোমাকে যেতে দিতে চাইনি। কিন্তু তোমার মধ্যে যদি সামান্য পৌরুষও থাকত তাহলে তুমি নিজেই নিজের পথটা বেছে নিতে।

মায়ের কথাগুলো তীরের মত খোঁচা মারছে নরমানকে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলে মা যা বলছে সব ভুল। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসই হলো না ওর। আসলে, সে নিজেও ভাল করে জানে মা যা বলছে তার মধ্যে মিথ্যে নেই একরত্তি। এই কথাগুলোই নিজেকে সে মনে মনে কম করে হলেও হাজারবার শুনিয়েছে। এটা ঠিক যে মা তার ওপর সবসময় কর্তৃত্ব করতে চেয়েছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে সবসময় তাকে সেই নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। মায়েরা মাঝে মাঝে সন্তানদের প্রতি একটু বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েই থাকে। কিন্তু সব সন্তানই কি তাদের সব কথা শোনে? শোনে না। তবে নরমানের মা অন্য সব মায়ের চেয়ে একটু বেশি কঠোর হলেও সে যদি ঘরের বার হতে চাইত, তবে কি পারত না? কিন্তু পারেনি। বাইরের পৃথিবীকে তার যে বড় ভয়। কিভাবে এই পরিচিত ভুবন ছেড়ে ওই অচেনা দুনিয়ায় সে পা বাড়াবে? ওই সাহসটুকুর তার বড় অভাব।

তুমি জেদ ধরতে পারতে, বলেই চলেছে মা। তুমি নিজেই একদিন বাইরে গিয়ে নতুন একটা জায়গা খুঁজে নিতে পারতে। তারপর এই মোটেলটাও বিক্রি করা যেত। কিন্তু না, তুমি তা করেনি। কি করেছ তুমি? সারাক্ষণ নাকি কান্না কেঁদেছ বাচ্চাদের মত। আর কেন কেঁদেছ তাও আমার অজানা নেই। তুমি আসলে এই জায়গা ছেড়ে নড়তেই চাওনি। কক্ষনো চাওনি। আর কোনদিন যে চাইবে না তাও আমার খুব ভাল করেই জানা আছে। এখান থেকে নড়ার ক্ষমতাই তোমার নেই, তাই না, নরমান?

নরমান ভয়ে মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। ওর খুব ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালায়। কিন্তু নড়াচড়ার শক্তিটুকুও সে যেন হারিয়ে ফেলেছে। আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? এই বাড়ির প্রতিটি কোণে মায়ের এই হুলের খোঁচা ওকে বিদ্ধ করবে। এ যেন ইনকাদের সেই ঢাকের মত। অবিরাম বেজেই চলে। স্নায়ু ছিঁড়ে যেতে চায়। তবু থামার কোন লক্ষণ নেই।

নরমান ভুলে থাকতে চাইল মার উপস্থিতি। জোর করে চোখ রাখল বইতে। কিন্তু কোন কাজ হলো না। ঢাকের বাজনার মত মার কণ্ঠ একটানা দ্রিম দ্রিম বেজেই চলল।

আমি জানি আজ তুমি কেন অফিসে যাওনি। কারণ তুমি মনেপ্রাণে চেয়েছ আজ যেন কেউ মোটেলে না আসে। অফিসে বসতে তোমার ভাল লাগেনি।

ঠিক আছে, বিড়বিড় করে বলল নরমান। তোমার কথাই মানলাম। অফিসে যেতে আমার ভাল লাগেনি। এই মোটেল চালাবার কথা ভাবলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।

আসল কারণ ওটা নয়, খোকা। (আবার সেই থোকা, খোকা, খোকা! উফ, পাগল করে ছাড়বে।) আসলে তুমি লোকজনের সঙ্গে মিশতে ভয় পাও, তাই না? সেই ছোটবেলা থেকেই তুমি কারও সাথে মিশতে চাইতে না। বলা উচিত সেই ক্ষমতাই তোমার ছিল না। তুমি শুধু একটা কাজই পেরেছ চেয়ারে একঠায় বসে গল্পের বই গিলতে। ত্রিশটা বছর ধরে তুমি শুধু এই কাজটাই করেছ। সবসময় বইয়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছ।

আমি তো খারাপ কিছু করছি না। বই পড়ে মনের উন্নতি ঘটাচ্ছি।

মনের উন্নতি ঘটাচ্ছ? হাহ্, হাসানে দেখছি। তুমি আমাকে বোকা বানাতে চাও, খোকা? তুমি যে কি ছাইপাশ পড়ো তা বুঝি আমি জানি না, না?

এটা ছাইপাঁশ না, মা। এটা ইনকা সভ্যতার ওপর লেখা একটা– 

রাখো তোমার ইনকা সভ্যতা! দাবড়ে উঠল মহিলা। যত রাজ্যের জংলীদের নিয়ে আজগুবী খবরে ঠাসা ওসব বই পড়ে হবেটা কি, শুনি? শুধু এগুলোই না, লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি অনেক নোংরা বইও যে পড়ো তাও আমি জানি।

মনস্তত্ত্ব নোংরা না, মা।

মনস্তত্ত্ব, মা যেন প্রথম শুনল কথাটা। চোখ কপালে তুলে তীব্র ব্যঙ্গ ভরে বলল, হুঁ, বলে কি এই ছেলে! কি জানো তুমি মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে?

না- মানে এগুলো পড়লে মনের ভেতর একরকম পরিবর্তন আসে।

পরিবর্তন? তোমার পরিবর্তন, খোকা? জীবনেও হবে না। একটা আট বছরের বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারবে তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তুমি হচ্ছ একটা মা কাতুরে ছেলে, বুঝলে? হোঁতকা, মোটা, বুড়ো থোকা।

কথার তোড়ে মাথা ঝিমঝিম করছে ইরমানের। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে ধড়াস ধড়াস করে। বুক শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। মাটা চিরকালই এরকম, ভবিষ্যতেও এমনই থাকবে, যদি না–

যদি না কি?

দারুণ চমকে উঠল নরমান। মা কি তার মনের ভেতরটাও দেখতে পায়?

তুমি মনে মনে কি ভাবো না ভাবো সবই আমি বুঝতে পারি, নরমান। আবার সেই একঘেয়ে কণ্ঠ শুরু হলো। তুমি নিজেকে যতটা না জানো, তারচে অনেক বেশি আমি তোমাকে চিনি। তুমি ভাবছ আমাকে খুন করে ফেললে কেমন হয়, তাই না? পারবে না। চাইলেই তুমি তা পারবে না। কারণ সেই সাহস তোমার নেই। তোমার সমস্ত শক্তি আমার হাতের মুঠোয়। তুমি আমার হাতের পুতুল মাত্র। আমার ওপর নির্ভর করেই তুমি বেঁচে আছ। তাই আমাকে ছেড়ে এক পা নড়ার কথা তুমি স্বপ্নেও ভাবতে পারো না, ঠিক?

নরমান কোন কথা বলল না। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। নিজের ওপর ওর খুব রাগ হচ্ছে। না, এখন রাগ করার সময় নয়। শান্ত হতে হবে তাকে। মা কি বলছে না বলছে সেদিকে নজর দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মা বুড়ো মানুষ। তায় মাথার নেই ঠিক। ওর এখন একমাত্র কাজ হবে বেচারীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোনমতে তার ঘরে পাঠানো। কারণ মেজাজ যে হারে চড়ছে বলা যায় না হয়তো হাত দুটো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা এগিয়ে যেতে পারে শুকনো ওই গলাটার দিকে

হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। কেউ এসেছে মোটেলে। বিরাট হাঁপ ছাড়ল নরমান। মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এগোল হলঘরের দিকে। তাড়াহুড়ো করে হ্যাঁঙার থেকে রেইনকোটটা নিয়ে পা বাড়াল বাইরে।

.

০২.

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। থামার কোন লক্ষণ নেই। গাড়ির ওয়াইপার চালিয়ে দিয়েছে মেরি অনেক আগেই। বাইরে ঘন অন্ধকার। সিল্কের অস্পষ্ট পর্দার মত অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। হেডলাইটের তীব্র আলো চিরে দিচ্ছে সেই পর্দাটা। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ভিজছে কাক ভেজা হয়ে। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আশ্চর্য রকম ভৌতিক ঠেকছে চারপাশ। গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল মেরির। স্টিয়ারিং-এর ওপর প্রায় স্থির হয়ে আছে হাত দুটো। আড়ষ্ট। মন খচখচ করে কেন? কোথাও বড় রকমের একটা ভুল হয়ে গেছে, অথচ সে ধরতে পারছে না, এই অনুভূতি মেরিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো মন খারাপ করে থাকার কথা নয়। তার এখন আনন্দ করার সময়। খারাপ সময়টাকে সে পেছনে ফেলে এসেছে। চিরদিনের জন্য। জীবনের দুঃখময় সময় ওর কাছে এখন অতীত। যে মুহূর্তে সে টাকাটা হাতে পেল- মেরির চোখের সামনে সেলুলয়েডের ছবি হয়ে যেন ফুটে উঠল পুরো দৃশ্য।

লোরি এজেন্সীর অফিসে দাঁড়িয়েছিল মেরি। মি. লোরি আর বুড়ো টমি ক্যাসিডির মধ্যে তখন লেনদেন চলছে। ক্যাসিডি বাড়ি কিনছেন। চুক্তিপত্র, সইসাবুদ ইত্যাদি চলছে। টেবিলে চল্লিশ হাজার ডলারের এক তাড়া নোট পড়েছিল নিতান্ত অবহেলায়। মেরির চোখ দুটো বারবার আটকে যাচ্ছিল সবুজ নোটগুলোর দিকে। সই-টইয়ের পালা শেষ হলে উঠে পড়লেন ক্যাসিডি। হেলাফেলার ভঙ্গিতে টাকাগুলো তুলে নিলেন মি. লোরি। বুড়ো বেরিয়ে যেতেই দাঁতগুলো সব বেরিয়ে পড়ল তাঁর। হাসতে হাসতে তিনি বড় একটা ম্যানিলা খামে টাকাগুলো ভরে মুখটা আটকে দিলেন গাম দিয়ে। মেরি লক্ষ করল খামের মুখ বন্ধ করার সময় উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে।

নাও, খামটা ধরো, ব্যস্ত সুরে বললেন মি. লোরি। এটা নিয়ে এখুনি ব্যাংকে চলে যাও। চারটে প্রায় বাজে। তবুও গিলবার্টকে আমার কথা বললে জমা দিতে সমস্যা হবে না। কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন তিনি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন মেরির দিকে, কি হয়েছে মিস ক্রেন- তোমার শরীর খারাপ নাকি?

মি. লোরি খেয়াল করেননি টাকাভর্তি খামটা হাতে নেয়ার সময় মেরির শরীর কেমন কেঁপে উঠেছিল। অবশ্য তাঁর খেয়াল করার কথাও নয়। এই চল্লিশ হাজার ডলারে তার লাভ থাকবে দুই হাজার ডলার। সেই খুশিতেই তিনি বাগবাগ।

মেরির উত্তর যেন তৈরি হয়েই ছিল। তড়িঘড়ি জবাব দিল, আমার মাথাটা একটু ধরেছে, স্যার। আপনার কাছে ছুটি চাইব ভাবছিলাম। এখন তো কোন কাজ নেই। আর সোমবারের আগে দলিলও তৈরি হবে না। আপনি যদি ।

দুই হাজার ডলার লাভের আশায় হাড়কঞ্জুস লোরি এখন মহাউদার। হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি টাকাটা জমা দিয়েই বাড়ি চলে যেয়ো। আজ আর অফিসে আসতে হবে না। তোমাকে লিফট দেব?

না, না, ঠিক আছে। লিফট দিতে হবে না। আমি কাজ সেরে একাই বাড়ি ফিরতে পারব।

তাহলে আর দেরি কোরো না। সোমবার আবার দেখা হবে, কেমন?

মেরি মনে মনে হাসল। মি. লোরির বদান্যতায় মুগ্ধ হয়েছে এমন একটা ভাব করে মিষ্টি একটু হেসে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।

চিরদিনের জন্য।

চল্লিশ হাজার ডলার সহ।

এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না। আর এমনই একটি সুযোগের অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন ধরে স্বপ্ন দেখেছে মেরি ক্রেন।

প্রচণ্ড টানাটানির সংসার ছিল মেরিদের। বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পরেই বিপর্যয় নেমে এল ওদের সংসারে। সতেরো বছর বয়সেই লেখাপড়ার আশা চিরতরে জলাঞ্জলি দিতে হলো ওকে। মা আর ছোটবোনের দায়িত্বসহ পুরো সংসারের বোঝা টেনে নিতে হলো কাঁধে। চেষ্টাচরিত্র করে ছোটখাট একটা কাজ জুটিয়ে নিল ও। বোন লিলাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলল। যত কষ্টই হোক, লিলার ক্যারিয়ার সে নষ্ট হতে দেবে না।

বাইশ বছর বয়সে আরেকটা বড় ধাক্কা খেলো মেরি। ডেল বেল্টারের সঙ্গে ওর প্রেম ছিল। মনে আশাও ছিল এই প্রেম একদিন পরিণত হবে পরিণয়ে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি আর কখনোই ভোর সকালের সোনালী রোদের মত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেনি ওর জীবনে। ডেল আর্মিতে ঢোকার পর ভুলে গেল ওকে। হাওয়াইতে পোস্টিং হয়েছিল ডেলের। প্রথম প্রথম চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখত। তারপর হঠাৎ করেই একদিন চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। মেরি পরে শুনেছে ডেল এখন আরেক মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, কিন্তু হতাশ হয়নি। জীবন যে কঠিন, বড় হতে হলে ওকে যে আরও সংগ্রাম করতে হবে এটা মেরি এতদিনে খুব ভালমত বুঝেছে। এখন আর ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হবার মত সময় নেই। না, মেরি অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে গোপনে কাঁদবে না। তাকে শক্ত হতে হবে। আরও কঠোর হতে হবে।

মার শরীর ভাল যাচ্ছিল না অনেক আগে থেকেই। বাবা মারা যাবার পরপরই মার মন এবং শরীরে একই সাথে ভাঙন ধরে। রোগ আর শোকে এতটুকু হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে দাঁড়াল। লিলা মার অবস্থা দেখে আর পড়াশোনা করতে চাইল না। তাছাড়া আপা তাকে এত কষ্ট করে পড়াচ্ছে, পুরো সংসারের ঘানি তাকে একাই টানতে হচ্ছে এই চিন্তা প্রায়ই বিব্রত করত কিশোরী লিলাকে। তখন সে সবে স্কুল ফাইনাল পাস করেছে। কিন্তু মেরি কোন কথাই শুনল না। বলল, যত কষ্ট হোক, লিলাকে সে কলেজে পড়াবেই। বড় বোনের জেদের কাছে হার মানল লিলা। কলেজে ভর্তি হলো। মেরি আগের চাকুরিটা ছেড়ে তখন লোরি এজেন্সীতে কাজ নিয়েছে। সারাদিন অফিসে থাকে। রাতে বাসায় ফিরে মায়ের সেবা করে। ব্যস, এই নিয়েই ওদের ছোট্ট ভুবন ছিল। এর বাইরে আর কিছু ভাবার সুযোগ কিংবা সময় কোনটাই পায়নি সে। কিন্তু একদিন, কাউকে কিছু জানান না দিয়ে ঘুমের মধ্যে চোখ বুজলেন মা। তারপর থেকে কেমন জানি ওলটপালট হয়ে গেল সব। লিলা আর কলেজে পড়তে চাইল না। বোনের ওপর বোঝা হয়ে থাকতে আর ভাল লাগছিল না তার। মেরির কোন আপত্তিই শুনল না অষ্টাদশী লিলা। চাকুরি খুঁজতে লাগল সে। দুই বোন আলোচনা করে বিক্রি করে দিল নিজেদের বাড়িটা। অবশ্য লোরি এজেন্সীই সাহায্য করল বাড়ি বিক্রিতে। ওদের কাজই তো এই। বাড়ি বিক্রি করে কমিশন খাওয়া। আজ এ পক্ষের, কাল ও পক্ষের। লিলা কিছুদিনের মধ্যে ডাউনটাউনের এক রেকর্ডশপে একটা কাজও জুটিয়ে ফেলল। তারপর দুবোন উঠে এল ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টে।

এখন তোমার বাইরে কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসা উচিত, ছোটবোন বলছিল বড় বোনকে। ছুটি নাও অফিস থেকে। না, না তোমার কোনও আপত্তি শুনছি না। গত আটটা বছর তুমি একাই কলুর বলদের মত সংসারের জোয়াল টেনেছ। এখন তোমার কিছুদিনের জন্য হলেও খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানো দরকার। নিজের চেহারাটা দেখেছ কখনও আয়নায়? সংসারের চিন্তায় চিন্তায় কি করে ফেলেছ শরীরটাকে! মেরি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল। এ কাকে দেখছে সে? চোখের কোলে কালি পড়েছে, চোখ দুটো ভয়ানক বিষণ্ণ। এই আট বছরে ওর বয়স যেন আরও বিশ বছর বেড়ে গেছে। চেহারা ভেঙে পড়েছে ভীষণভাবে। না, লিলার কথাই ঠিক। কিছুদিনের জন্য তাকে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে হবে। খোলা হাওয়ায় কতদিন নিজেকে মেলে ধরেনি মেরি। সূর্যের ঝকমকে আলোর ছোঁয়া কেমন ভুলে গেছে, মনেও নেই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ কেমন আলো ছড়ায়।

ভেসে পড়ল মেরি এস. এস. ক্যালিডোনিয়ায়। নীল সাগরের বুক চিরে ছুটে চলল বিশালকায় জলযান। চারদিকে সীমাহীন জলরাশি যেন আকাশের নীলকেই ধারণ করে আছে। দূরে উড়ে যায় সীগাল। ফুরফুরে হাওয়া লুটিয়ে পড়ে গায়ে। রাতে মস্তবড় থালার মত চাঁদ ওঠে আকাশে। মাখন কোমল সেই আলো গায়ে মেখে নেয় মেরি। বড় ভাল লাগে। বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। জীবনটাকে আশ্চর্য মধুর মনে হতে থাকে। নিজেকে উচ্ছলা এক কিশোরী ভাবতে ইচ্ছে করে। ওর ভোঁতা অনুভূতিগুলো আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চোখের কালি দূর হয়েছে কবে, সজীব ত্বক। আগের চেয়েও তন্বী তরুণী লাগছে নিজেকে। ভালবাসায় ভরাট অন্তর। বুকের মাঝে কি জানি কি সুর বাজে। তারপর একদিন, কি হতে কি হয়ে গেল জানে না মেরি, প্রেমে পড়ে গেল সে স্যামের। স্যাম লুমিস। একহারা, সুদর্শন এক যুবক। ভুবন ভোলানো হাসি হাসে। বয়স মেরির চেয়ে একটু বেশিই হবে। কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে বয়স কোনকালে বাধা মানেনি। আজকেও মানল না। স্যামের ব্যক্তিত্ব, মনকাড়া হাসি আর প্রাণ চাঞ্চল্য দারুণ মুগ্ধ করল মেরিকে। আর ভাল লাগল ওর সরলতা। মেরি জানল স্যামের বাড়ি ফেয়ারভেল নামে ছোট্ট এক শহরে। এখানে তার হার্ডওয়্যারের একটা দোকান আছে। ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন ওর বাপ। বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তান হিসেবে সে এখন ওটার উত্তরাধিকারী। স্যাম অকপটে স্বীকার করল ব্যবসাটা পৈতৃকসূত্রে পাওয়ার সাথে সাথে আরেকটা জিনিসও তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মত চেপে বসেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সে জানতে পেরেছে অনেক টাকার দেনা রেখে গেছেন তিনি। বিশ হাজার ডলারের দেনা। বাড়িটা মর্টগেজুড়, ইনভেনটরি মর্টগেজড়, মায় ইনস্যুরেন্স পর্যন্ত। স্যামের সামনে তখন দুটো পথ খোলা ছিল– হয় নিজেকে দেউলে বলে ঘোষণা করা নয়তো বাপের ঋণ শোধ করে ব্যবসাটাকে আবার চাঙা করে তোলা। ব্যাপারটাকে সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। সহজে দমে যাবার পাত্র সে নয়। সিদ্ধান্ত নেয় যত কষ্টই হোক বাপের সমস্ত ঋণ শোধ করবে। ব্যবসাটা ভাল, স্যাম পরে বলেছে মেরিকে। একলাফে আমি সবকিছুর সমাধান করতে পারব না এটা ঠিক। কিন্তু বছরে আট থেকে দশ হাজার ডলারের মত লাভ থাকবে হিসেব করে দেখেছি। ফার্ম মেশিনারীতে যদি ভাল কাজ দেখাতে পারি, তাহলে আরও কিছু টাকা প্রাপ্তির আশা করছি। আমি ইতিমধ্যে চার হাজার ডলারের ঋণ শোধ করেও দিয়েছি। পুরোটা শোধ করতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। ব্যস, তারপর ঝাড়া হাত পা।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তোমার মাথায় যদি ঋণের এত বোঝা থাকে তাহলে কি করে এই বোঝা মাথায় নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরুলে?

স্যাম মিষ্টি করে হেসেছে। একটা প্রতিযোগিতায় জিতেছিলাম আমি। ফার্ম মেশিনারী আউটফিটের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম। ওরাই পুরস্কার হিসেবে সমুদ্র যাত্রার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন সময় একটু বিশ্রামের প্রয়োজন, কি বলো?

মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে মেলা। সেই মেঘে ধরেছে রঙ। ভালবাসার রঙ। দুটি মন এক হয়েছে। দুই হৃদয়ের দুটি সুর এক হয়ে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তারপর একদিন, এক সন্ধ্যায় বিদায়ী সূর্যের রক্তিম চুম্বনে মেরির গোলাপী গালের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে স্যাম গভীর ভালবাসায় বলেছে, জানো মেরি, আমার না প্রায়ই মনে হয় আমরা বুঝি হানিমুনে চলেছি।

মেরি ফিরল ওর দিকে। গাঢ় গলায় বলল, কেন স্যাম, কল্পনায় হানিমুনকে দেখতে হবে কেন? আমরা তো- 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম। মাথা নেড়ে বলল, তুমি যা ভাবছ তা এখনই সম্ভব নয়, সোনা। পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে আমার এখনও দুই তিন বছর লাগবে।

আমি পারব না! পারব না ততদিন অপেক্ষা করতে। তোমার দেনার কথা আমি ভাবতে চাই না। প্রয়োজন হলে চাকুরিটা ছেড়ে দিয়ে দুজনে মিলে তোমার স্টোর চালাব- 

তারপর আমি যে জঞ্জালের মধ্যে থাকি তার মধ্যে দুজনে ঘুমাব, এই তো? হাসার চেষ্টা করল স্যাম। কিন্তু বিকৃত দেখাল মুখ। তুমি জানো না, মেরি, কোন নরকের মধ্যে আমি বাস করি। ওখানে আমার মত মানুষ থাকতে পারে কিন্তু তোমার পক্ষে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। জানো, বেশিরভাগ সময় আমাকে শুধু বরবটি সেদ্ধ খেয়ে থাকতে হয়।

মেরি প্রথমে জনের কোন কথাই শুনতে চায়নি। কিন্তু স্যামের ওই এক কথা। তাকে বিয়ে করতে হলে মেরিকে আরও দুতিন বছর অপেক্ষা করতেই হবে। সম্পূর্ণ সচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত সে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ বিয়ে করার পর বউকে সে কোন কষ্ট দিতে রাজি নয়। সুতরাং মেরিকে ধৈর্য ধরতেই হবে। তবে খুব বেশি হলে বছর তিনেক। একটু সচ্ছলতার মুখ দেখলেই সে মেরিকে বউ করে নিয়ে আসবে ঘরে।

শেষ পর্যন্ত মেরিকে ধৈর্য ধরতেই হলো। এভাবে কেটে গেল এক বছর। গত গ্রীষ্মে মেরি ফেয়ারভেলে এসে নিজের চোখে দেখে গেছে স্যামের অবস্থা। জেনেছে আরও পাঁচ হাজার ডলারের ঋণ শোধ করে দিয়েছে তার প্রেমিক। আর মাত্র এগারো হাজার ডলারের দেনা বাকি, স্যাম গর্বভরে বলেছে মেরিকে, ওটাও শোধ হয়ে যাবে। দুই বছর কিংবা আরও কম সময়ে।

দুই বছর! মেরির বয়স তখন ঊনত্রিশ হবে। এই দুই বছর ওর জন্য অনেক সময়। কিন্তু স্যাম ওর কাছে তারচেও অনেক বেশি। এমন বর ওর জীবনে এবেলা ওবেলা আসবে না, জানে মেরি। তাই সে জনের কথার উত্তরে কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে হেসেছে। ঠিক আছে, দরকার হলে আরও দুই বছর সে অপেক্ষা করবে জনের জন্য।

কাজে লাগল মেরি আবার লোরি এজেন্সীতে। মি. লোরিকে দেখে মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে ওর। কেমন পুরানো জিনিস, জমি এ সব কিছু দুমদুম বিক্রি করে, সাদা ভাষায় স্রেফ দালালি করে মাসে দুপাঁচ হাজার ডলার দিব্যি কামিয়ে নিচ্ছেন। দুপক্ষ থেকেই লোরি দেদারসে টাকা খাচ্ছেন। তার কাছে এগারো হাজার ডলার মানে মাত্র দুমাসের কামাই। আর বেচারা স্যাম ওদিকে রাতদিন খেটেও আগামী দুবছরের মধ্যে এগারো হাজার ডলারের ঋণটা শোধ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। ভাবতেই মেরির গা জ্বলে ওঠে মি. লোরিরর ওপর। তবে ওর বেশি রাগ ওই টমি ক্যাসিডির ওপর। বুড়োভামটা একবার মেরিকে একশো ডলার দিয়ে নির্লজ্জভাবে রাত কাটাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। মেরির চোখ ফেটে পানি এসেছে। কিন্তু মি. লোরি হঠাৎ এসে পড়ায় ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যায় ওখানেই। বুড়ো ক্যাসিডিকে সেই থেকে দুচোখে দেখতে পারে না মেরি। ভয়ানক বাজে স্বভাবের লোক। কোথায় কে বিপদে পড়েছে তার জিনিস কম দামে কিনে বেশিতে বেচে দেয়ার কারবার করে ব্যাটা। লোক ঠকানোর ওস্তাদ একটা। সত্যি বলতে কি মেরি যখন ওর চল্লিশ হাজার ডলার মেরে দিল, ভারী তৃপ্তি বোধ করেছে সে তখন। মনে হয়েছে সেদিনের অপমানের খানিকটা শোধ নেয়া গেছে।

অফিস থেকে বেরিয়ে মেরি ভাবছিল কি চমৎকার খাপেখাপ মিলে গেল সবকিছু। আগামী দুদিন ব্যাংক বন্ধ থাকবে। মি. লোরি সোমবারের আগে জানতেই পারবেন না তাঁর টাকাটা হাপিস হয়ে গেছে। এ তো গেল একটা দিক। ওদিকে লিলাও আজ বাড়িতে নেই। দোকানের জন্য কেনাকাটা করতে ডালাস গেছে। সোমবারের আগে তারও ফিরে আসার কোন চান্স নেই। সুতরাং সবদিক থেকেই মেরির পোয়াবারো।

বাড়ি ফিরেই মেরি ঝটপট তার সুটকেস গুছিয়ে ফেলল। একটা খালি কোল্ডক্রীমের কৌটায় ওদের দুজনের জমানো সাড়ে তিনশো ডলারের মত ছিল। লিলার কাজে লাগতে পারে ভেবে সে ওটা ছুঁয়েও দেখল না। একবার ভাবল লিলার জন্য ছোট্ট একটা চিরকুট রেখে যাবে। কিন্তু পরে আর সাহস হলো না। তাছাড়া লিলা দেরিতে হলেও সবকিছু তো জানতেই পারবে।

সবকিছু গুছিয়ে বেরুতে বেরুতে সাতটা বেজে গেল। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা শহরতলিতে পৌঁছুল মেরি। রাতের খাবার স্থানীয় এক রেস্তোরাঁয় সেরে নিল সে। গাড়ি পাল্টাল। লজ্রঝড়ে একটা সেডান ভাড়া করে আবার যাত্রা শুরু করল। দুশো মাইল উত্তরে যাওয়ার পর এই গাড়িটাও বদলাল। পকেট থেকে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে টাকা। কিন্তু উপায় নেই। চিহ্ন মুছতে হলে এটুকু লোকসান তো দিতেই হবে। সূত্র মোছার এরচে ভাল কোন পথ নেই। শেষ গাড়িটা সে ভাড়া করল মিসেস স্যাম লুমিস নামে। এই গাড়িটাও সে বেচে দেবে ফেয়ারভেল পৌঁছুবার পর। ব্যস, তারপর আর তাকে কে পায়? পুলিশের বাপেরও সাধ্য নেই মিসেস স্যাম লুমিসের সাইকো ছদ্মবেশে মেরি লুইসকে ধরে।

টাকার ব্যাপারটা জনের কাছে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে তাও ঠিক করে ফেলেছে মেরি। বলবে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তবে পুরো চল্লিশ হাজার ডলারের কথা বলা যাবে না। পনেরো হাজারের কথা বলবে সে। আর লিলাও একই পরিমাণ অর্থ পেয়ে চাকুরি ছেড়ে ইউরোপ চলে গেছে- এমন বললে বিয়েতে লিলাকে ডাকার ঝামেলা থেকেও সে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্যাম যদি টাকা নিতে আপত্তি করে? তাও ভেবে রেখেছে মেরি। স্যামকে বিয়ে করে মিসেস লুমিস হয়ে গেলে এই ল্যাঠা চুকে যায়। স্যাম তো আর কোনদিন জানতে পারবে না সে লোরি এজেন্সীর টাকা মেরে এই হাজার মাইল দূরে এসেছে তার বউ হতে। হ্যাঁ, মেরি আর দেরি করতে পারবে না। লোরি এজেন্সীর টাকা দিয়েই সে জনের যাবতীয় ঋণ শোধের ব্যবস্থা করবে। তারপর দুজনে মিলে বাঁধবে সুখের ঘর।

লিলার জন্য ভাবে না মেরি। লোরি এজেন্সী জনের ঠিকানা জানে না বলে এদিকে খোঁজ নিতে আসার কোনই অবকাশ নেই। কিন্তু ওরা লিলার কাছে অবশ্যই যাবে। তবে লিলা বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে বুঝতে পারবে মেরি কোথায় গেছে। কিন্তু ও নিশ্চই সে কথা বলতে যাবে না। বোনকে ভালবাসে সে। আর বোনের প্রতি তার তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মেরি বিশ্বাস করে লিলা অবুঝ হবে না। যাকগে, সেটা অনেক পরের কথা। ওটা পরেই ভাবা যাবে। এখন তার সামনে একটাই কাজ- সোজা ফেয়ারভেল যাওয়া। কিন্তু আঠারো ঘণ্টা একনাগাড়ে গাড়ি চালিয়ে ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে কি ভুলটা করেছে। আসলে পথই গুলিয়ে ফেলেছে। গত গ্রীষ্মে দিনের বেলা ফেয়ারভেল গিয়েছিল মেরি। রাস্তার ধারে তখন এত ঘন গাছপালা ছিল না। মাত্র এক বছরে নিশ্চই এত বড় বড় গাছ গজিয়ে উঠতে পারে না। সন্দেহ নেই, প্রচণ্ড ক্লান্তিতে বুঝতে পারেনি সে কখন ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। নিজের ওপর ভয়ানক রাগ হলো মেরির। এই বৃষ্টির মধ্যে, বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে এখন ও কোথায় যায়? একটু বিশ্রাম না নিলে আর কিছুতেই চলছে না। বসে থাকতে থাকতে সমস্ত শরীরে খিল ধরে গেছে। রিয়ারভিউ মিররে তাকাল মেরি। ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে মুখে। স্যাম এই মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝতে পারবে কোন অঘটন ঘটিয়ে এসেছে মেরি। সে হয়তো কোন খারাপ সন্দেহও করে বসতে পারে। না, সেটা ঠিক হবে না। স্যামকে সন্দেহ করার কোন সুযোগ দেবে না মেরি। বরং কোথাও একটু বিশ্রাম নিয়ে ফিটফাট হয়ে দেখা করবে প্রেমিকের সঙ্গে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে রাস্তা তো গুলিয়ে গেল। এখন সে যায় কোথায়? কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে যে বাঁকে পথ ভুল করেছিল সেখানে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরবে নাকি এখানেই হোটেল জাতীয় কিছু একটা খুঁজে বের করবে ভেবে পেল না মেরি।

হঠাৎই সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল ওর। মোটেল-খালি। যদিও সাইনবোর্ডের আলো জ্বলছে না (সম্ভবত ভুলে গেছে, ভাবল মেরি) কিন্তু হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুরো মোটেল অন্ধকার। ওটার পেছনে ছোট্ট টিলার ওপর একটা বাড়ি। বাড়ির সামনের জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত বাড়ির মালিক ওখানেই থাকে। গাড়ি নিয়ে সামনে বাড়ল মেরি। হঠাৎ টের পেল গাড়ির টায়ার একটা তারের সঙ্গে বেধে গেছে। বাড়ির ভেতরে, দূরে কোথাও কলিংবেলের শব্দ হতে লাগল। মেরি বুঝল ভুল করে সে ইলেকট্রিক সিগন্যাল কে ছুঁয়ে দিয়েছে। ইগনিশন সুইচ অফ করে দিল ও। অপেক্ষা করতে লাগল। বৃষ্টির একটানা ঝুপঝুপ আর হাওয়ার শনশন ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে আনমনা হয়ে গেল মেরি। মনে পড়ছে আরেকটি বৃষ্টি ভেজা রাতের কথা। সেই রাতে ওর মাকে কবর দিতে গিয়েছিল ওরা। দারুণ অন্ধকার ছিল চারদিক। শুধু হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন আর ঝমঝমে বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর অপার্থিব মনে হচ্ছিল সবকিছু…হঠাৎই ছায়াটা চোখে পড়ল মেরির। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। ভয়ানক চমকে উঠল ও। দীর্ঘদেহী একটা ছায়ামূর্তি ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। গা শিরশির করে উঠল মেরির। ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে…এগিয়ে আসছে। এইবার হাত রাখল গাড়ির দরজায়। হাঁ হয়ে গেল মেরির মুখ, চোখ বিস্ফারিত। প্রচণ্ড চিৎকার করতে যাচ্ছে।

.

০৩.

কি চাইছেন? রাত কাটানোর মত জায়গা? নরম, দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলাল মেরি। না, গলার স্বরে তো ভয়ানক কিছু মনে হচ্ছে না। সুতরাং একে বিশ্বাস করা যেতে পারে। সে মাথা ঝাঁকাল। দরজা খুলে নেমে এল গাড়ি থেকে। লোকটা ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। হাঁটতে গিয়ে পায়ের রগে টান ধরল মেরির। একঠায় বসে থাকতে থাকতে খিচ ধরে গেছে ও দুটোতে।

লোকটা দরজা খুলল, পার্টিশন করা ছোট একটা রুমে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। বলল, দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চই অনেকক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আসলে আমার মার শরীর খুব খারাপ তো তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।

অফিস ঘরটায় চাকচিক্য না থাকলেও বেশ উষ্ণ এবং আরামদায়ক মনে হলো মেরির। এতক্ষণ ঠাণ্ডার মধ্যে থাকার পর এই উষ্ণতাটুকু বেশ লাগল। সে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মোটা লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসল। লোকটা কাউন্টারের ওপর রাখা লেজার বইটা খুলল।

আমাদের সিঙ্গল রুমগুলোর ভাড়া সাত ডলার করে। আপনি কি আগে ঘরটা একবার দেখবেন?

না, না তার দরকার হবে না, মেরি তাড়াতাড়ি ওর পার্স খুলে একটা পাঁচ ডলার আর দুটো এক ডলারের নোট বের করে কাউন্টারের ওপর রাখল। কলম আর রেজিস্ট্রি খাতাটা ওর দিকে ঠেলে দিল লোকটা।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল মেরি, তারপর লিখল জেন উইলসন- পাশে ঠিকানা- সান অ্যান্টোনিও, টেক্সাস। গাড়ির টেক্সাস প্লেটের নাম্বারটা বদলাতে পারেনি ও। বাধ্য হয়ে টেক্সাসের নাম লিখতে হয়েছে।

আমি আপনার ব্যাগগুলো নিচ্ছি, বলল লোকটা। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে সামনে বাড়ল। মেরি তার পিছুপিছু এগোল। টাকাগুলো এখনও বড় এনভেলাপটায় রাবার ব্যান্ডে বাঁধা অবস্থায় গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে পড়ে আছে। অবশ্য মেরি গাড়ির দরজা বন্ধ করেই এসেছে। আশা করা যায় কোন অনুপ্রবেশকারী ওর গাড়ির ব্যাপারে অনাবশ্যক কৌতূহল দেখাবে না।

ব্যাগ নিয়ে লোকটা অফিস রুমের পাশের ঘরটায় ঢুকল। ঘরটা ছোট। কিন্তু মেরির তাতে কিছু অসুবিধে নেই। এই প্রবল বর্ষায় যে মাথা গোঁজার একটা ঠাই পাওয়া গিয়েছে তাই যথেষ্ট।

খুবই খারাপ আবহাওয়া, বলল লোকটা। আপনি বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালিয়েছেন?

মেরি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, হ্যাঁ। সারাদিন।

হাত বাড়িয়ে বাতি জ্বালল লোকটা। ঘরটা ছোট হলেও সুন্দর। বেশ সাজানো গোছানো। বাথরুমের শাওয়ারের দিকে চোখ পড়তেই মন আইঢাই শুরু করল গোসলের জন্য।

পছন্দ হয়েছে? জানতে চাইল লোকটা।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল মেরি। হঠাৎ পেটে মোচড় পড়তেই খাওয়ার কথা মনে পড়ল। বলল, আচ্ছা, ধারে কাছে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য কোন ব্যবস্থা আছে?

ধারে কাছে বলতে মাইল তিনেক দূরে হামবার্গারের একটা দোকান ছিল বটে। কিন্তু নতুন হাইওয়েটা চালু হওয়ার পর থেকে ওটা বন্ধ। নাহ্, খেতে হলে আপনার ফেয়ারভেল যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

কতদূর ওটা?

সতেরো-আঠারো মাইলের মত হবে। কিন্তু আপনার তো ওই দিক দিয়ে ফেয়ারভেলের দিকেই চলে যাওয়ার কথা।

আসলে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝেছি। ট্রাফিক নেই বলেই এই অবস্থা।

মেরি অন্যমনস্কভাবে হাসল। লোকটা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবছে। মেরি তার দিকে তাকাতেই সে খুক খুক কেশে বলল, আ মিস্ আমি ভাবছিলাম এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি আবার ফেয়ারভেলে যাবেন, আসবেন। তারচেয়ে যদি কিছু মনে না করেন আমার সঙ্গে ডিনারটা করে নিতে পারেন। আমি তো বাড়িতেই খাই। তাছাড়া আমি এখুনি খেতে যাচ্ছিলাম।

না, না তা কি করে হয়?

কেন, মিস? অসুবিধে কিসের? মা এখন ঘুমাচ্ছেন। তাঁকে আমরা আমরা বিরক্তও করব না। সামান্য কাটলেট আর কফিতে যদি আপনার চলে- 

না, মানে-।

আর মানে মানে করবেন না তো। আমি গিয়ে এখুনি খাবার রেডি করছি। আপনিও এই ফাঁকে তৈরি হয়ে নিন।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মি.-

নরমান। নরমান বেটস। বেরুতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেলো নরমান। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার জন্য ফ্লাশলাইটটা রেখে গেলাম। কাজে লাগতে পারে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল সে।

মেরি মনে মনে হাসল নরমান বেটসের লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে। যেন প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছে। নরমান দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর ব্যাগ খুলে সে প্রিন্টেড একটা জামা বের করল। জামাটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকল। হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল। খেয়ে এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে চমৎকার একটা ঘুম দেবে ঠিক করল মেরি। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নরমান বেটসের বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।

পনেরো মিনিট পর।

মেরি দরজা ধাক্কাচ্ছে, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। বৈঠকখানার খোলা জানালায় একটা বাতি জ্বলছে। কিন্তু ওপরতলায় উজ্জ্বল আলোর প্রতিফলন দেখতে পেল মেরি। লোকটা বলেছিল তার মা অসুস্থ। উনি বোধহয় দোতলায় থাকেন, ভাবল সে।

মেরি কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবারও দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। কোন উত্তর নেই। কি মুশকিল, নক্ করার শব্দ কেউ শুনতে পাচ্ছে না নাকি? বিরক্ত হয়ে বৈঠকখানার জানালা দিয়ে উঁকি দিল মেরি। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল। বিংশ শতাব্দীর এই শেষ ভাগেও পৃথিবীতে এমন জায়গা থাকতে পারে কল্পনাও করেনি সে।

একটা বাড়ি, সে যতই পুরানো হোক না কেন, তার মধ্যে কিছু না কিছুতে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকেই, কিন্তু এই ঘরের আসবাবপত্রের কোথাও সেই ছোঁয়া নেই। ফুল, লতাপাতা আঁকা ওয়ালপেপার, কালো, ভারী মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র, লাল টকটকে কার্পেট, উঁচু পিঠওয়ালা গদি-চেয়ার, চারকোণা ফায়ারপ্লেস সবই যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া থেকে উঠে এসেছে। টেলিভিশন চোখে পড়ল না মেরির, কিন্তু টেবিলের ওপর খুব পুরানো একটা গ্রামোফোন দেখতে পেল। একটা গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল সে অনেকক্ষণ ধরে। গ্রামোফোনটা দেখে ভাবল শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। কিন্তু একটু খেয়াল করতেই বুঝল শব্দের উৎস গ্রামোফোন নয়, ওপরের ওই আলোকিত রুম।

ফ্লাশলাইট দিয়ে এবার দরজায় আঘাত করতে লাগল মেরি। দুম দুম শব্দ হতে লাগল। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল সে। এদিকেই আসছে। এক মুহূর্ত পর নরমান বেটসকে দেখতে পেল মেরি। সিঁড়ি বেয়ে নামছে। দরজা খুলল নরমান, ইশারা করল ওকে ভেতরে আসতে।

আমি খুবই দুঃখিত, বলল সে, আপনি নিশ্চই অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। আসলে মাকে শোয়াতে গিয়েই দেরি হলো। মাঝে মাঝে উনি এমন ঝামেলা করেন যে

আপনার মা যখন অসুস্থ তখন তাকে এভাবে ডিস্টার্ব করা-  লজ্জায় পড়ল মেরি।

না, না, ঠিক আছে, বলে উঠল নরমান, কোন ডিস্টার্ব হবে না। উনি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ঘুমালে উনি কামানের শব্দেও জাগেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল সে, গলার স্বর নেমে এল নিচে, শারীরিকভাবে অসুস্থ বলতে যা বোঝায় আমার মা ঠিক তা নন। তবে মাঝে মাঝে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। যাকগে, এখন চলুন, খেতে বসা যাক।

রান্নাঘরে ঢুকল ওরা। নরমান বিড়বিড় করে বলল, এখানে বসে খেতে আশা করি আপনার খুব বেশি অসুবিধে হবে না। সবকিছু রেডিই আছে। বসে পড়ুন। আমি কফি দিচ্ছি।

বড় বড় আলমারি দাঁড় করানো রান্নাঘরের চারধারে। এক কোণায় বড় একটা কাঠের স্টোভ। গরম রেখেছে ঘরটাকে। লম্বা কাঠের টেবিলে সসেজ, চিজ আর বাড়িতে তৈরি আচার সাজানো। অন্তত শহরতলীর নোংরা, ভেজা ক্যাফেগুলোর চেয়ে তো ভাল, ভাবল মেরি।

নরমান খাবারের প্লেট এগিয়ে দিল ওর দিকে। নিন, শুরু করুন।

এত খিদে পেয়েছিল যে গোগ্রাসে খেতে খেতে মেরি লক্ষই করল না নরমান প্রায় কিছুই খাচ্ছে না, খাওয়া শেষে তার পেটের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল ও।

সে কি, আপনি দেখি কিছুই খাননি!

না, মানে আমার তেমন খিদে পায়নি, মেরির কাপে কফি ঢালল নরমান। মাকে নিয়ে বড় চিন্তায় আছি। তার কণ্ঠ আবার নিচু হয়ে এল, দোষটা আমারই। আমিই তাঁর ঠিকমত যত্ন নিতে পারছি না।

আপনারা দুজনই কি শুধু এখানে থাকেন?

হ্যাঁ।

তাহলে তো আপনার বেশ কষ্ট হয়।

তা কিছুটা হয়। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই, রিমলেস চশমাটা নাকের ওপর ঠিকমত বসাল নরমান। ছোটবেলায় আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে মা-ই আমার সব। আমি বড় হওয়ার পর মা বাড়িটাকে মর্টগেজ রাখেন, ফার্মটা বিক্রি করে দেন। তারপর এই মোটেলটা কেনেন। আমাদের ব্যবসা ভালই চলছিল। কিন্তু নতুন হাইওয়েটা হওয়ার পর থেকে সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। তারপর থেকেই মার মাথার গোলমাল দেখা দেয়। এখন মার সমস্ত দায়িত্ব আমাকেই বইতে হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে ব্যাপারটা এমন কঠিন হয়ে পড়ে যে- 

আপনাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?

না।

আপনি বিয়ে করেননি?

নরমানের মুখ লাল হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে একদৃষ্টিতে লাল-সাদা চেকের টেবিল ক্লথটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

ঠোঁট কামড়াল মেরি। দুঃখিত, মি. নরমান। আমি ভুল করে আপনাকে আঘাত দিয়ে ফেলেছি।

না, না। ঠিক আছে, ম্লান শোনাল নরমানের গলা। আমি এখনও বিয়ে করিনি। মা আসলে এসব ব্যাপার একদম পাত্তা দিতে চান না। আ-আমি এর আগে এভাবে কোন মহিলার সঙ্গে এক টেবিলে বসিনি পর্যন্ত।

সে কি- 

আপনি খুব অবাক হচ্ছেন, না? অবাক হবারই কথা। আমার ধারণা ছিল আমাকে ছাড়া মা থাকতেই পারবেন না। কিন্তু এখন দেখছি আমিই মাকে ছাড়া একদণ্ড টিকতে পারি না।

মেরি কফি শেষ করে পার্স খুলে সিগারেট বের করল। প্যাকেটটা এগিয়ে দিল নরমানের দিকে।

ধন্যবাদ। আমি সিগারেট খাই না।

আমি খেলে আপনার অসুবিধে হবে?

অবশ্যই না। একটু ইতস্তত করে সে বলল, আপনাকে একটা ড্রিঙ্ক খাওয়াতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু মা আবার এসব একদম পছন্দ করেন না।

মেরি চেয়ারে হেলান দিল। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ভাবল জীবন কি আশ্চর্যের। এক ঘণ্টা আগেও সে কেমন নিঃসঙ্গ ছিল, ভয় আর আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন, পেটে খাবার যাওয়ার পর, নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় পাওয়ার পর, সবকিছু কত পরিবর্তিত লাগছে। বেচারী নরমানের জন্য ওর একটু খারাপই লাগছে। এ বেচারা ওর চেয়েও কত নিঃসঙ্গ আর দুঃখী। তার তুলনায় মেরি তো স্বর্গে আছে।

আপনি সিগারেট খান না, মদ আপনার জন্য নিষেধ, মেয়েদের সঙ্গেও মিশতে পারেন না। তাহলে আপনি করেন কি? শুধু এই মোটেল চালানো আর আপনার মাকে দেখাশুনা?

মেরির ঠাট্টা বুঝতে পারল না নরমান। প্রতিবাদ করে বলল, তা কেন হবে? আমি পড়ি তো। প্রচুর বই পড়ি। তাছাড়াও আমার অন্যান্য শখও আছে। দেয়ালের একটা তাকের দিকে ইঙ্গিত করল সে। মেরি তাকাল ওদিকে। স্টাফ করা একটা মরা কাঠবিড়ালী ওদের দিকে পিটপিট করে চেয়ে আছে।

শিকার করেন?

না, তা নয়। তবে মরা জন্তু স্টাফ করে রাখার শখ আছে আমার। আমার বন্ধু জর্জ ওই কাঠবিড়ালীটা আমাকে দিয়েছিল স্টাফ করার জন্য। ও ওটাকে মেরেছিল। মা আমাকে বন্দুক ধরতে দেন না।

মি, নরমান। কিছু মনে করবেন না, এই রকম ভাবে আপনার আর কতদিন চলবে? আপনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। সারাজীবন নিশ্চই বাচ্চাদের মত আচরণ করলে চলবে না।

আমি বুঝি। আমি আমার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। শুনলেনই তো, আমি অনেক বই পড়েছি। মনোবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন তাও আমি জানি। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। মার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে।

দায়িত্বটা আপনি অন্য ভাবেও পালন করতে পারেন। তাঁকে কোন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে?

আমার মা পাগল নন! হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো নরমান। লাফিয়ে উঠল। হাতের ধাক্কায় একটা কাপ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। মেরি হাঁ করে তাকিয়ে থাকল নরমানের দিকে।

আমার মা পাগল নন, কথাটা আবার বলল সে। লোকে যে যাই বলুক কিন্তু আমি জানি তিনি পাগল নন। পাগলা গারদের ডাক্তাররা সুযোগ পেলেই তাকে গারদে ঢোকাবে। এও আমি জানি। কিন্তু তারা জানে না আমার মা আমার জন্য কি প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যখন ছোট ছিলাম, আমাকে দেখার কেউ ছিল না, তখন এই মা-ই আমাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। তার মাথায় যে সামান্য গণ্ডগোল, এর জন্য আমিই দায়ী। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার দোষেই আজ তাঁর এই অবস্থা। উনি যখন আমার কাছে এলেন, বললেন আবার বিয়ে করবেন, তখন আমিই তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলাম। নিষেধ করার আমি কে? কিন্তু ঈর্ষায় বলুন, হিংসায় বলুন, আমিই তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই। আমি কি করেছি, কি বলেছি তা যদি পাগলা গারদের ডাক্তাররা জানত তাহলে অনেক আগেই আমাকে লকআপে পুরত। আমার কারণেই মার মাথাটা খারাপ হলো। কিন্তু আপনি আমার মাকে পাগলা গারদে রাখতে বলার কে? আমরা সবাই কোন না কোন সময় পাগলের মত আচরণ করি। কিন্তু তাই বলে সবাই তো আর পাগল হয়ে যাই না।

নরমান থামল। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। লাল টকটকে হয়ে উঠেছে মুখ, কাঁপছে ঠোঁট দুটো।

মেরি দাঁড়িয়ে গেল। আ-আমি দুঃখিত, নরম গলায় বলল ও। সত্যিই দুঃখিত। আমাকে মাফ করবেন। ওভাবে বলাটা আমার মোটেও ঠিক হয়নি।

ঠিক আছে। আসলে একা থাকি তো। হঠাৎ আবেগের চোটে কথাগুলো বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। আপনি যেন আবার কিছু মনে করবেন না। নরমানের মুখের রঙ আবার দ্রুত ফিরে আসতে শুরু করেছে।

মেরি পার্স হাতে নিল। আমাকে এখন যেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেল।

রাগ করে চলে যাচ্ছেন না তো?

না না তা নয়। আসলে ভীষণ ক্লান্ত আমি।

আপনার সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললে ভাল লাগত আমার। বেসমেন্টে আমার একটা ওয়ার্কশপ আছে। আপনাকে দেখাব ভেবেছিলাম- 

কিন্তু আমার এখন সত্যি বিশ্রামের দরকার।

ঠিক আছে। তাহলে চলুন। আপনাকে এগিয়ে দেই। অফিস বন্ধ করতে হবে। মনে হয় না আজ আর কোন কাস্টমার আসবে।

ফ্লাশলাইট জ্বেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল নরমান মেরিকে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশ এখনও তারাহীন, অন্ধকার। মেরি বিল্ডিঙ-এর পাশ ঘোরার সময় পেছন ফিরে চাইল। ওপরতলায় এখনও আলো জ্বলছে। মহিলা এখনও জেগে!

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল মেরি।

গুডনাইট, বলল নরমান। আশা করি ভাল ঘুম হবে আপনার।

ধন্যবাদ, বলল মেরি।

কি যেন বলার জন্য মুখ খুলল নরমান, কিন্তু কিছু না বলেই ঘুরে দাঁড়াল। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মত তার মুখ লাল হয়ে উঠতে দেখল মেরি।

দরজা বন্ধ করল মেরি। পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝল ইরমান তার অফিসে ঢুকেছে। কিন্তু ওদিকে আর মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না সে। ব্যাগ খুলে দ্রুত পাজামা, পীপার, কোল্ডক্রিম, টুথব্রাশ আর টুথপেস্ট বের করল। বড় সুটকেসটাও খুলল। স্যামের সঙ্গে দেখা করার সময় কোন্ পোশাকটা পরবে সেটা বাছাই করছে মেরি। আগে থেকে বের করে না রাখলে কাল সকালে তাড়াহুড়ার সময় গোলমাল হয়ে যাবে। তাছাড়া পোশাকে ভাজও থেকে যাবে।

পছন্দের পোশাক খুঁজতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। আচ্ছা, নরমান হঠাৎ অত চটে গেল কেন? আর কেন বলল আমরা সবাই কোন না কোন সময় পাগলের মত আচরণ করি?

মেরি হঠাৎ উপলব্ধি করল নরমান আসলে ঠিকই বলেছে। আমরা সত্যি সবাই কোন না কোন সময় পাগল হয়ে যাই। পাগলামি শুরু করি। গতকাল বিকেলে সেও এই পাগলামি করেছে যখন ডেস্কের ওপর টাকাটা দেখেছিল। আর পাগল না হলে কি করে ভাবল অতগুলো টাকা নিয়ে সে পালিয়ে থাকতে পারবে? পুরো ব্যাপারটাই কি একটা পাগলামি নয়?

সে হয়তো পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে। কিন্তু স্যাম তো ওকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করে তুলবে। জানতে চাইবে কে সেই আত্মীয় যে তাকে এতগুলো টাকা দিয়েছে। সে কোথায় থাকে? তার কথা মেরি আগে কেন তাকে কখনও বলেনি? সে এতগুলো টাকা নগদ নিয়ে এল কোন্ সাহসে? এত তাড়াতাড়ি চাকরি ছেড়ে দিল মেরি, মি. লোরি কোন আপত্তি তোলেননি?

তারপর লিলার ব্যাপারটা তো রয়েই গেল। হয়তো পুলিশকে সে কিছুই বলবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে মেরিকে ছোটই ভাববে। তাছাড়া আজ হোক কাল হোক স্যাম অবশ্যই লিলার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে, অথবা তাকে এখানে আসার জন্য দাওয়াত দেবে। তখন তো সব জানাজানি হয়ে যাবে। তখন কি হবে?

এ তো গেল একটা দিক।

তারপর তার গাড়িতে টেক্সাসের নাম্বার প্লেট দেয়া। সে কেন টেক্সাসে যেতে চায় না এটা স্যাম জানতে চাইলে কি জবাব দেবে মেরি?

নাহ্, পুরো ব্যাপারটাই দেখছি একটা পাগলামি হয়ে গেল, ভাবল মেরি। এখন আর ফেরার পথ নেই

সত্যি নেই?

সাপোজ, সে আজ রাতে চমৎকার একটা ঘুম দিল। কাল রোববার। কাল সকাল নটায় যদি সে এখান থেকে যাত্রা করে তাহলে সোমবার সকাল নাগাদ শহরে পৌঁছুতে পারবে। তখনও লিলা এসে পৌঁছুবে না, ব্যাংকও থাকবে বন্ধ। তারপর ব্যাংক খুললে টাকাটা জমা দিয়ে দিব্যি অফিসে হাজিরা দিতে পারবে সে।

এতে অবশ্য সে মরার মত হয়ে পড়বে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে চাইলে এ ছাড়া আর কোন পথ নেই। কেউ ব্যাপারটা টেরই পাবে না।

কিন্তু গাড়িটার কি হবে? সেটার ব্যাখ্যাও মনে মনে ঠিক করে ফেলল মেরি। লিলাকে বলবে সে স্যামকে সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে যাচ্ছিল ফেয়ারভেল। কিন্তু পথে গাড়িটা নষ্ট হয়ে যায়। মেকানিক বলে নতুন ইঞ্জিন ছাড়া ওটা চালানো যাবে না। তাই সে ওটাকে ফেলে এই পুরানো গাড়িটাকে নিয়ে এসেছে।

হ্যাঁ, এটা বললে লিলা বিশ্বাস করতে পারে। অবশ্য সে যদি ফিরে যায় তাহলে তার সাতশো ডলারই গচ্চা যাবে। কিন্তু মানসম্মান এবং ভবিষ্যতের চেয়ে সাতশো ডলারের মূল্য বেশি নয়।

উঠে দাঁড়াল মেরি।

মনস্থির করে ফেলেছে সে। টাকাটা ফেরত নিয়ে যাবে। নিজেকে খুব হালকা লাগল ওর। যেন বড় একটা পাপের বোঝা থেকে রেহাই পেয়েছে। যাক বাবা, এখন সবার আগে দরকার চমৎকার একটা গোসল।

গুনগুন করতে করতে বাথরুমে ঢুকল মেরি। জুতো জোড়া ছুঁড়ে মারল, খুলল মোজা। হাত দুটো মাথার ওপর উঠিয়ে জামাটাও খুলে ফেলল। ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। মেঝেতে গিয়ে পড়ল ওটা। কেয়ার করল না সে। তারপর হাত দিল অন্তর্বাসে।

দরজার সঙ্গে লাগানো আয়নার সামনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল মেরি। ওর চেহারায় সাতাশ বছরের ছাপ পড়লেও দুধের মত ধবধবে শরীরটা একুশের একপাও বেশি নয়। এই শরীর নিয়ে স্যামের জন্য আরও দুটো বছর দিব্যি অপেক্ষা করতে পারবে সে।

হাসল মেরি। আয়নায় নিজের প্রতিমূর্তিকে চুমু খেলো। তারপর গিয়ে দাঁড়াল শাওয়ারের নিচে। খুলে দিল শাওয়ার।

উষ্ণ পানির ধারায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল মেরির শরীর। ঠাণ্ডা পানির কলটা ছেড়ে দিল। তারপর একসঙ্গে দুটো কলই পুরো খুলে দিল।

পানি পড়ার প্রচণ্ড শব্দ হতে লাগল। ঘরটা ভরে উঠল বাপে।

শব্দ এবং বাপের কারণে মেরি টের পেল না বাথরুমের দরজা খুলে গেছে। পায়ের শব্দ সে শুনতেই পেল না। শাওয়ারের পর্দা ফাঁক হয়ে গেল। বাপের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল একটা মুখ।

মেরি এই সময় দেখতে পেল তাকে। মুখটা পর্দার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন শূন্যে ভেসে আছে একটা মুখোশ। চুলগুলো স্কার্ফ দিয়ে বাঁধা, চকচকে কাঁচের মত চোখ দুটো ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সারা মুখে পাউডারের প্রলেপ, দুই গালে টকটকে লাল রুজ। কদাকার এই মুখ নিঃসন্দেহে কোন পাগলী বুড়ির।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার জন্য হাঁ করল,মেরি, ঠিক তখন শাওয়ারের পর্দা আরও ফাঁক হয়ে গেল, বেরিয়ে এল একটা হাত, বিশাল ছুরিসহ। বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল ধারাল ব্লেড। পরক্ষণে নেমে এল ওটা মেরির গলা লক্ষ্য করে।

.

০৪.

নরমান মেরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের অফিসঘরে এসে ঢুকল। রীতিমত কাঁপছে। আজ খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। মনের অস্থিরতা কমানোর জন্য এই মুহূর্তে একটা ড্রিঙ্কের খুবই দরকার। মেরিকে মিথ্যে বলেছে সে। অবশ্য ওর মা বাড়িতে কোন মদ রাখতে দেয় না, এটাও ঠিক। কিন্তু নরমান লুকিয়ে মদ খায়। একটা বোতল এই ঘরেই লুকিয়ে রেখেছে। কারণ মাঝে মাঝে এমন সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে মদ না খেলে মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। যেমন এখন ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়েছে।

জানালা বন্ধ করল নরমান, নিভিয়ে দিল সাইনবোর্ডের আলো। আজকের মত বন্ধ হোটেল। এখন আর কেউ দেখতে পাবে না অফিস ঘরে বসে সে কি করছে। ড্রয়ার খুলল নরমান। মদের বোতলটা বের করল। কাঁপা হাতে ছিপি খুলে তরল আগুনটা ঢেলে দিল মুখে। জ্বলতে জ্বলতে আগুনটা নেমে গেল নিচে। গরম করে তুলল শরীর। মেরিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল ইরমান।

মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে আসা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটা খুব সুন্দরী, তাছাড়া দেখেশুনে মনে হচ্ছিল বড় ধরনের কোন বিপদে পড়েছে। এমন অসহায় একটা মেয়েকে সে কি আশ্রয় না দিয়ে পারত? আর ওর নিজেরও ইচ্ছে ছিল মেয়েটার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর। তাই মা নিষেধ করা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে এসেছে সে বাড়িতে। এখানে মার যতটা অধিকার ইরমানের অধিকারও ততটাই।

তারপরও হয়তো সে মেয়েটাকে আসতে বলত না। কিন্তু মার ওপর মেজাজ এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে স্রেফ জিদের বশেই সে মেরিকে ডেকে এনেছে বাড়িতে।

কিন্তু মেয়েটা বাড়িতে আসছে এটা মাকে জানানো উচিত হয়নি নরমানের। কারণ কথাটা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল মা। মৃগী রোগীর মত আচরণ শুরু করল। উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে বলল, মেয়েটাকে যদি তুমি এখানে আনো ওকে আমি খুন করে ফেলব!

দৃশ্যটা মনে পড়তেই মেজাজ আরও খারাপ হলো নরমানের। মেয়েটা আসলে ঠিকই বলেছে মাকে কোথাও রেখে আসা উচিত। কাঁহাতক আর সহ্য হয়? এটা একটা জীবন হলো? এভাবে আরও কিছুদিন চলতে থাকলে মরেই যাবে সে।

মেয়েটার সাথে খাওয়ার সময় ভয়ানক টেনশনে ছিল নরমান। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা চলে এসে একটা কেলেঙ্কারি করে বসে। মার ঘর অবশ্য তালা মারা ছিল। কিন্তু দরজায় লাথি মেরে, চিৎকার করে মহিলা কোনও সিনক্রিয়েট করে না বসে এই চিন্তায় নরমান ভাল করে খেতেই পারেনি। কিন্তু মা সেরকম কিছুই করেনি। বড় বেশি চুপচাপ ছিল। হয়তো কান পেতে তাদের কথা শুনছিল।

তৃতীয় পেগ হুইস্কি গিলল নরমান। আশা করল মা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে হয়তো তার কোনকিছুই মনে থাকবে না। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। আবার এমনও হয়েছে যেটা নরমান ভেবেছে মা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে, কিন্তু সেই কথাটাই সে কয়েকমাস পর হঠাৎ করে মনে করেছে।

হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেল নরমান। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। মা আসছে নাকি? তা কি করে সম্ভব। সে নিজের হাতে তাকে তালা মেরে এসেছে। তাহলে? তাহলে আওয়াজটা নিশ্চয়ই পাশের রুমের ওই মেয়েটা করেছে। কান পাতল নরমান। সুটকেস খোলার শব্দ। শুনল। ধারণা করল জামাকাপড় পাল্টাতে যাচ্ছে মেয়েটা, ঘুমাবে।

নরমান আরেক ঢোক হুইস্কি খেলো। টান টান হয়ে গেল স্নায়ু, হাত কাঁপছে না আর। এখন আর ভয় করছে না। মেয়েদের ব্যাপারে বরাবরই নার্ভাস সে। কিন্তু এখন মেয়েটার কথা ভাবতে ভাল লাগছে তার, বরং একটু আগের কথা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। মার সম্বন্ধে মেয়েটা যখন ওইসব কথা বলছিল তখন তার অমন উত্তেজিত হয়ে পড়া মোটেও ঠিক হয়নি। এখন নরমানের মনে হচ্ছে জেন নামের মেয়েটা তার মা সম্পর্কে যা বলেছে, ভুল বলেনি। অমন রেগে না গেলে ওর সঙ্গে নিশ্চই আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানো যেত, ভেবে আফসোস হতে লাগল তার। হয়তো মেয়েটার সঙ্গে তার আর কোনদিনই দেখা হবে না। এরকম সুন্দরী একটা মেয়ের প্রেমে পড়তে মাঝে মাঝে সাধ হয় নরমানের। জেনের প্রেমেই যদি পড়া যেত! মেয়েটা হয়তো হেসে ফেলত তার মনের কথা জানতে পারলে। এতে হাসাহাসির কিছু নেই। কিন্তু নরমান জানে সব মেয়েই একরকম। অকারণে, কিছু না বুঝেই হাসে! এ জন্যই তো মা ওদেরকে খচ্চর বলে।

কিন্তু, নরমান নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে, জেন খচ্চর হলেও ভারী সুন্দরী। আমার উচিত ছিল ওকে একটা বোতল অফার করা। একসঙ্গে মদ খেতাম। দুজনেই মাতাল হতাম। তারপর ওকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে…

না, তা আমি পারিনি, মনে মনে ভাবে নরমান। কারণ আমার মধ্যে পৌরুষ নেই। মা ঠিকই বলে আমি পৌরুষহীন, নইলে এতবড় একটা সুযোগ পেয়েও কেন হেলায় হারালাম?

নরমান আবার চুমুক দিল গ্লাসে। আজ যেন মাতাল হয়েই ছাড়বে। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? মাতাল বলে কি আর সে মেয়েটার ঘরে যেতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। এখনই যাবে সে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল নরমান। মাথাটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। কান পাতল দেয়ালে। জুতো খোলার শব্দ শুনল। এখন মেয়েটা বাথরুমের দিকে যাচ্ছে।

নরমানের হাত দুটো আবার কাঁপতে শুরু করল, উত্তেজনায়। ডান হাতটা বাড়াল সামনের দিকে। দেয়ালে লটকানো হোটেলের লাইসেন্সটা আলতো করে একদিকে সরাতেই ছোট্ট একটা ফুটো দৃশ্যমান হয়ে উঠল। এখানকার প্লাস্টার খসে গিয়ে এই ছোট্ট ফুটো তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটাতে চোখ লাগালে পাশের ঘরের বাথরুম স্পষ্ট দেখা যায়। এই ফুটোর কথা মাও জানে না। সে এই ফুটো দিয়ে খচ্চর মেয়েগুলোকে আগেও দেখেছে। তারা তাকে নিয়ে যতই হাসাহাসি করুক কিন্তু নরমান তাদের সম্পর্কে যা জানে তা তারা কল্পনাও করতে পারবে না।

উত্তেজনায় কাঁপছে নরমান। কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে। ফুটোতে চোখ রাখতেই মেয়েটাকে দেখতে পেল সে। বাথরুমে ঢুকেছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাসছে আপনমনে। আঙুলে চুল পেঁচাচ্ছে! এবার সামনের দিকে ঝুঁকল সে, মোজা খুলল। সোজা হয়ে দাঁড়াল আবার। জামাটা মাথা গলিয়ে খুলে ফেলতেই ব্রা আর প্যান্টিতে ঢাকা অর্ধনগ্ন শরীর দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো নরমানের। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগল যেন মেয়েটা ঘুরে না দাঁড়ায়। কিন্তু নরমানকে হতাশ করে দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল সে। রাগে আরেকটু হলে চিৎকার করে উঠছিল নরমান। দেখল দরজার সঙ্গে আটকানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা ব্রার হুক খুলছে।

মাথা ভোঁ ভোঁ করছে নরমানের। ইচ্ছে করছে দেয়াল ভেঙে মেয়েটার কাছে ছুটে যায়। টের পাচ্ছে নিজের ওপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে। হঠাৎ মেয়েটা দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। তারপর কল থেকে পানি পড়ার শব্দ আসতে লাগল। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল নরমান। অবসন্ন লাগছে খুব। চোখ বুজে বসে থাকল সে আচ্ছন্নের মত।

হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে উঠল নরমান। অফিস ঘরের দরজা খুলছে কে যেন। কিন্তু চাবি তো তার কাছে। চোখ খোলার সাহস হলো না নরমানের। বুঝে গেছে কে দরজা খুলেছে। অফিস ঘরের চাবি আরও একজনের কাছে থাকে।

মার কাছে।

শুধু অফিস ঘরের চাবিই নয়, নিজের রুমের চাবি, এই বাড়ির চাবি সব চাবিই মার কাছে আছে।

চোখ মেলল না নরমান। জানে মা এখন তার সামনে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে এসেছে নরমান খচ্চর মেয়েটার সঙ্গে কোন নষ্টামি করছে কিনা।

চোখ বুজেই থাকল নরমান। নড়াচড়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। পানি পড়ার ছন্দায়িত শব্দে কেমন ঘুম আসছে। মা ঠিক সময়ই এসে পড়েছে। নয়তো সে সত্যি ওই খচ্চরটার খপ্পরে পড়ে যেত। মা সবসময় তার প্রয়োজনের সময়ই আসে। তাকে রক্ষা করে প্রচুর মেয়েছেলেগুলোর হাত থেকে। এখন আর কোন সমস্যা নেই। তার ঘুম এসে যাচ্ছে…ঘুম…

হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠল নরমান। ও কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? মাথাটা এমন ব্যথা করছে কেন? কতক্ষণ এরকম অবস্থায় ছিল সে? এক ঘণ্টা নাকি দুঘণ্টা? মেয়েটার কথা মনে পড়তেই ফুটোয় চোখ লাগাল নরমান।

খাঁ খাঁ করছে বাথরুম। শাওয়ারের পর্দা টানা। কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

নরমান ডাবল মেয়েটা নিশ্চই শাওয়ার বন্ধ করতে ভুলে গেছে। হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। কিন্তু পানি তো পড়ছে খুব জোরে। বোধ হয় খুব ক্লান্ত বলেই ওর ঘুম ভাঙছে না।

হঠাৎ মেঝের দিকে নজর গেল নরমানের। ঝকঝকে সাদা টাইলসের ওপর গোলাপী পানির ধারা।

পানির রং গোলাপী কেন?

শুধু তাই নয় পানির মধ্যে লাল রংয়ের সরু সরু সুতোর মত কি যেন। দেখে মনে হয় শিরা।

মেয়েটা নির্ঘাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে বুঝে ফেলল নরমান। বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল আতঙ্ক। কিন্তু কর্তব্যকর্মে গাফিলতি করল না একমুহূর্তও। ডেস্ক থেকে চাবি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। মেয়েটার রুমের দরজা খুলল। বেডরুমে নেই সে, বিছানার ওপর খোলা সুটকেস চোখে পড়ল। তার মানে নরমান যা ভেবেছে, তাই। অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছে মেয়েটা।

ছিটকে বাথরুমে ঢুকল নরমান।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক।

মেঝেতে ছিন্নভিন্ন তালগোল পাকানো রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটার দিকে তাকিয়ে বুক হিম হয়ে গেল নরমানের। মুহূর্তে মনে পড়ল মার কাছেও একসেট চাবি আছে এবং সে সেই চাবি জোড়ার যথাযোগ্য ব্যবহারও করেছে।

Leave a Reply to Shrestha Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *