ইস্টিশন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মায়া চিৎকার করে বলল, “টেরেন আহে। টেরেন!”
মায়ার সামনের দাঁতগুলো পড়ে গিয়েছে তাই কথা বলার সময় তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের হয়ে শব্দগুলোকে অন্যরকম শোনা যায়। সে আসলে বলার চেষ্টা করেছে”ট্রেন আসছে-ট্রেন!” মায়া শুধু যে ট্রেনকে টেরেন বলে তা নয়–সে গ্রামকে বলে গেরাম, ড্রামকে বলে ডেরাম! তাকে কেউ অবশ্যি সেটা শুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করে না, কারণ রেলস্টেশনে সে অন্য যে কয়জন বাচ্চা-কাচ্চার সাথে থাকে তারাও ট্রেন আর টেরেন কিংবা ড্রাম আর ডেরামের মাঝে পার্থক্যটা ভালো করে ধরতেও পারে না, বলতেও পারে না।
মায়ার চিৎকার শুনে জালাল আর তার সাথে সাথে অন্যেরাও মাথা ঘুরিয়ে রেল লাইনের দিকে তাকাল, দূরে ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে–আন্তঃনগর জয়ন্তিকা। পাকা দেড়ঘণ্টা লেট।
জালালের হাতে একটা তরমুজের টুকরা, তার মাঝে যেটুকু খাওয়া সম্ভব সেটুকু সে অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছে তারপরেও সে অন্যমনস্কভাবে টুকরাটাকে কামড়া-কামড়ি করছিল। তরমুজটা এনেছে মজিদ, ফুট মার্কেটের পাশে দিয়ে আসার সময় প্রত্যেক দিনই সে কলাটা না হয় আপেলটা চুরি করে আনে। স্টেশনে এসে সে প্লাটফর্মের রেলিংয়ে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে সবাইকে দেখিয়ে তৃপ্তি করে খায়। আজকে সে কীভাবে জানি আস্ত একটা তরমুজ নিয়ে এসেছে। কলাটা কিংবা আপেলটা চুরি করে আনা সম্ভব, তাই বলে আস্ত একটা তরমুজ? কীভাবে এতো বড় একটা তরমুজ চুরি করে এনেছে মজিদকে সেটা জিজ্ঞেস করে অবশ্যি কোনো লাভ হল না, সে কিছুই বলতে রাজি হল না। আস্ত একটা তরমুজ মজিদের একার পক্ষে খেয়ে শেষ করা সম্ভব না তাই সে আজকে অন্যদেরও ভাগ দিয়েছে। তরমুজটা ভাগাভাগি করার সময় অবশ্যি মায়া কিংবা মরি মতো ছোট বাচ্চাগুলো বেশি সুবিধে করতে পারেনি। জালাল, জেবা আর শ হজাহানের মতো একটু বড়রাই তরমুজটা কাড়াকাড়ি করে নিয়েছে।
ট্রেনটা আরো কাছে চলে এসেছে, রেল লাইনে হালকা একটা কাঁপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে। জালাল তার হাতের তরমুজের টুকরাটা রেললাইনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ সবাই একসাথে হইহই করে ট্রেনের দিকে ছুটতে শুরু করে। জালাল কিংবা মায়ার মতো যারা স্টেশনেই থাকে তাদের কাছে ট্রেনটাই হচ্ছে বেঁচে থাকার উপায়। এই ট্রেনের ওপরেই তাদের থাকা-খাওয়া সবকিছু নির্ভর করে। ট্রেনে যে যত আগে উঠতে পারবে কিছু একটা আয় রোজগার করার সম্ভাবনা তার তত বেড়ে যাবে, তাই সবাই ট্রেন থামার আগেই লাফিয়ে সেটাতে ওঠার চেষ্টা করে। সবার আগে জালাল বিপজ্জনকভাবে লাফ দিয়ে ট্রেনের একটা বগিতে উঠে গেল। প্রায় সাথে সাথে জেবা, মজিদ, শাহজাহানও লাফিয়ে একেকজন একেকটা বগিতে উঠে পড়ল। মায়া কিংবা মতির মতো যারা ছোট, যারা এখনো লাফিয়ে চলন্ত ট্রেনে ওঠা শিখেনি তারা ট্রেনটার পাশাপাশি ছুটতে থাকে–ট্রেনটা থামলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা ট্রেনে উঠবে।
ট্রেনের বগিতে উঠেই জালাল সতর্ক চোখে প্যাসেঞ্জারদের লক্ষ করে। ট্রেন দেড়ঘণ্টা লেট করে এসেছে তাই প্যাসেঞ্জারদের পেটে খিদে, সবাই কম-বেশি ক্লান্ত, সবারই মেজাজ কম-বেশি খারাপ। এর মাঝে জালালের মতো রাস্তার একটা বাচ্চাকে ট্রেনের মাঝে ছোটাছুটি করতে দেখে তাদের মেজাজ আরো গরম হয়ে উঠতে লাগল। জালালের মতোই অন্যেরাও ট্রেনের বগিতে ছোটাছুটি করে সিটের উপরে, সিটের নিচে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যায়। খালি পানির বোতল, ফেলে যাওয়া চিপসের প্যাকেট, খবরের কাগজ, আধ খাওয়া আপেল কুড়াতে কুড়াতে তারা ছুটতে থাকে। তাদের ছোট ছোট নোংরা শরীরের ধাক্কা খেয়ে প্যাসেঞ্জাররা খুবই বিরক্ত হয়, দুই একজন মুখ খিঁচিয়ে তাদের গালাগালিও করে। বাচ্চাগুলো অবশ্যি সেই গালাগালকে কোনো পাত্তা দেয় না। তারা পথে-ঘাটে গালাগাল চড়-থাপড় খেয়ে বড় হয়েছে, মুখের গালাগাল তাদের জন্যে কোনো ব্যাপারই না। সত্যি কথা বলতে কী তারা এই গালাগাল ভালো করে শুনতেও পায় না।
জালাল প্যাসেঞ্জারদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝারি বয়সের একজনকে বের করল, মানুষটা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন থেমে যাবার সাথে সাথে নেমে যাবার জন্যে ব্যস্ত। চেহারা দেখে মনে হয় মানুষটার মাঝে একটু দয়া-মায়া আছে। জালাল কাছে গিয়ে মাথাটা বাঁকা করে নিজের চেহারার মাঝে একটা দুঃখি দুঃখি ভাব ফুটিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “স্যার! ব্যাগটা নিয়া দেই?”
মানুষটা মুখ শক্ত করে বলল, “লাগবে না। যা–ভাগ।”
জালাল তার চেহারায় আরো কাচুমাচু ভাব নিয়ে আসে, “স্যার, একটু ভাত খাইতাম। কিছু খাই নাই। পেটে ভুখ।”
কথাটা সত্যি না, আজকে দুপুরে সে ঠেসে খেয়েছে। স্টেশনের পাশে জালালীয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। সকালবেলা সেখানে যখন মুরগি জবাই করছে তখন একটা মুরগি কেমন করে জানি ছুটে গেল। কঁক কঁক করে ডাকতে ডাকতে সেটা নালার উপর দিয়ে দৌড়াতে লাগল। শুধু তাই না মুরগি হওয়ার পরও পাখির মতো ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে সেটা রেলওয়ে গেস্ট হাউজের দেয়ালের উপর উঠে গেল। জালাল সেই দুর্ধর্ষ মুরগিটাকে ধরে এনে দিয়েছে। হোটেল ম্যানেজার সেই জন্যে তাকে দুপুরবেলা এক পেট খেতে দিয়েছে। ভাত, বিফ ফ্রাই আর ডাল। হোটেলের রান্নাঘরের কাছে যেখানে মোটা মোটা মহিলারা বসে পেঁয়াজ কাটে সেখানে বসে সে অনেকদিন পর তৃপ্তি করে খেয়েছে–যতবার বলেছে”আরো ভাত” ততবার তাকে ভাত দিয়েছে, সাথে বিফ ফ্রাইয়ের ঝোল আর ডাল। তারপর স্টেশনে এসে মজিদের চুরি করে আনা তরমুজের বিশাল একটা টুকরা খেয়েছে। কাজেই পেটে আর যাই থাকুক খিদে নাই-কিন্তু এই কথাগুলো
তো আর প্যাসেঞ্জারদের জানার দরকার নেই। জালাল মুখ আরো কাচুমাচু করে বলল, “ব্যাগটা নিয়া দেই? পেটে খিদা একটু ভাত খামু।”
মানুষটার নরম ধরনের মুখটা এক সেকেন্ডে কেমন যেন হিংস্র হয়ে যায়, জালালের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, “ভাগ হারামজাদা। কথা কানে যায় না?”
জালাল মনে মনে বলল, “তুই হারামজাদা!” তারপর এই মানুষটার পিছনে আর সময় নষ্ট করল না। ভালো মানুষ ধরনের অন্য একজনের কাছে গিয়ে তার পেট মোটা ব্যাগটা ধরে বলল, “স্যার ব্যাগটা নামায়া দেই?”
মানুষটার চেহারাই শুধু ভালো মানুষের মতো–আসলে সে মহা বদ। সে জালালের দিকে তাকালই না, কথাটা শুনেছে সেরকম ভান পর্যন্ত করল না। কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব করে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্যাসেঞ্জারের পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ নাই জানার পরও জালাল শেষ চেষ্টা করল, ডান হাতটা বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে ধরে মাথাটা একটুখানি বাঁকা করে মুখের মাঝে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বলল, “স্যার! ব্যাগটা নামায়া দেই। পেটে ভুখ। একটু ভাত খামু।”
মানুষটা একটু হাই তুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল যেন জালাল আশেপাশে আছে, কিছু একটা বলছে সেটা সে লক্ষ পর্যন্ত করেনি। জালাল আর সময় নষ্ট করল না, মনে মনে মানুষটাকে একটা গালি দিয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেল।
ট্রেনটা এতোক্ষণে থেমে গেছে, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে উপর থেকে মালপত্র নামানো শুরু করেছে। বগির মাঝামাঝি একটা মেয়ে তার ব্যাগগুলো হাতে তোলার চেষ্টা করছে। জালাল কাছে গিয়ে বলল, “আফা আপনার ব্যাগটা নিয়া দেই?”
মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি কেমন করে ব্যাগ নিবে? এতো ছোট মানুষ!”
মেয়েটার কথা, গলার স্বর, বলার ভঙ্গি শুনেই জালাল বুঝে গেল এই মেয়েটাকে সে নরম করে ফেলতে পারবে। হাতটা বুকের কাছে এনে মুখের মাঝে দুঃখি দুঃখি একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “সারাদিন কিছু খাই নাই আফা! পেটের মাঝে ভুখ–একটু ভাত খাবার চাচ্ছিলাম।”
মেয়েটা জালালের মুখের দিকে তাকায়, এটা খুবই ভালো লক্ষণ। যাদের মন নরম তারা মুখের দিকে তাকায়, চোখের দিকে তাকায়। যারা বদ টাইপের লোক তারা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে–কথা না শোনার ভান করে। জালাল গলার স্বরটা আরো দুঃখি দুঃখি করে বলল, “দেন আফা! ব্যাগটা নিয়া দেই।”
“কত নেবে?”
.
আনন্দে জালালের বুকের মাঝে রক্ত ছলাৎ করে উঠল কিন্তু সে মুখে কিছুই বলল না। মুখটা আরো দুঃখি দুঃখি করে বলল, “আপনি যা দিবেন তাই”
“উঁহু। কত দিতে হবে আগে থেকে বল।”
জালাল কোনো কথা না বলে টান দিয়ে একটা ব্যাগ মাথায় তুলে নিয়ে বলল, “আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই আফা!”
মেয়েটা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “চল।”
জালালের মুখে হাসি ফুটে উঠল এবং এইবারে সে এটা লুকানোর চেষ্টা করল। এই মেয়েটা এখন তাকে যতই দিতে চাইবে সে ভান করবে সেটা কম আর আরো বেশি দেওয়ার জন্যে সে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে। পৃথিবীতে এই মেয়েটার মতো সহজ সরল দুই চারজন মানুষ আছে বলেই সে মাঝে মধ্যে দুই চারটা টাকা বেশি রোজগার করতে পারে।
ট্রেন থেকে নেমে ব্যাগটা মাথায় নিয়ে সে মেয়েটার সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মজিদ এখনো কারো ব্যাগ নিতে পারেনি, মুখ কাচুমাচু করে পাটফর্মে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাধাটা ফাস্ট ক্লাশে উঠেছিল! ফার্স্ট ক্লাশের প্যাসেঞ্জারদের ব্যাগ নেওয়ার জন্যে নিজেদের লোকজন থাকে। যদি নিজেদের লোকজন না থাকে তা হলে ব্যাগের নিচে চাকা লাগানো থাকে তারা সেই চাকা লাগানো ব্যাগ টেনে টেনে নিয়ে যায়। গরিব মানুষের পেটের ভাত মারার জন্যে কত রকম কায়দা কানুন সেটা দেখে জালাল মাঝে মাঝে তাজ্জব হয়ে যায়।
ব্যাগটা তুলে দেবার পর মেয়েটা তাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। হালকা একটা ব্যাগ যেটা মেয়েটা নিজেই নিয়ে আসতে পারত তার জন্যে পাঁচ টাকার বেশি দেওয়ার কথা না। কিন্তু জালাল হতভম্ব হয়ে যাবার একটা ভঙ্গি করল। মুখের এমন একটা ভঙ্গি করল যেন মেয়েটা তার মুখে একটা চড় দিয়ে ফেলেছে। চোখ কপালে তুলে বলল, “এইটা কী দিলেন আফা?”
“কেন কী হয়েছে?” মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি না বললে আমি খুশি হয়ে যা দিতে চাই দিব।”
“তাই বইলা এতো কম?”
”আমি বলেছিলাম আগে থেকে বল–”
“আপনার সাথে আমি দরদাম করমু? ভাত খাওয়ার জন্যে একটু টাকা দিবেন না?”
“যাও-যাও বিরক্ত করো না! এইটুকুন একটা ব্যাগের জন্যে পাঁচ টাকাই বেশি। টাকা গাছে ধরে না।”
জালাল চোখে-মুখে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বলল, “আফা-আজকাল পাঁচ টাকা কেউ ফকিরকেও ভিক্ষা দেয় না। আমি কি ফকির?”
মেয়েটা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে জালালের দিকে তাকাল। জালাল পাঁচ টাকার নোটটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আফা, আপনার টাকা আমার লাগত না। নেন–”
মেয়েটা মনে হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জালালের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ব্যাগ থেকে আরো একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে জালালের দিকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে স্কুটারে ঢুকে গেল।
স্কুটারটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত মুখে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে জালাল দাঁড়িয়ে রইল। স্কুটারটা চলে যাবার পর সে নোট দুইটাতে চুমু খেয়ে তার বুক পকেটে রেখে দেয়। আজকের দিনটা এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই যাচ্ছে–সারাটা দিন এইভাবে গেলে খারাপ হয় না।
প্যাসেঞ্জাররা চলে যাবার পর প্লাটফর্মটা একটু ফাঁকা হল। তবে স্টেশনের মজা হচ্ছে এটা কখনোই পুরোপুরি ফাঁকা হয় না। একটা ট্রেন যখন আসে কিংবা ছাড়ে তখন হঠাৎ করে স্টেশনে অনেক মানুষের ভিড় হয়ে যায়। ট্রেনটা চলে যাবার পর ভিড় কমে গেলেও অনেক মানুষ থাকে। পত্রিকার হকার, ঝালমুড়িওয়ালা, অন্ধ ফকির, দুই চারজন পাগল, স্টেশনের লোজন, কাজকর্ম নেই এরকম পাবলিক। এই মানুষগুলোর মাঝে অবশ্যি প্যাসেঞ্জারদের ছটফটানি ভাবটা থাকে না। তারা শান্তভাবে এখানে সেখানে বসে থাকে না হয় হাঁটাহাঁটি, করে।
জালাল পকেটে চকচকে দুইটা নোট নিয়ে পাটফর্মে ঢুকল। গেটের কাছে হঠাৎ একটা মানুষ তাকে থামাল, “এই পিচ্চি-এইখানে বাথরুম কোনদিকে?”
মানুষটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অবস্থা বেশি ভালো না–এখনই বাথরুমে না গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। দোতলায় ভদ্রলোকদের বাথরুম, নিচে ডান দিকে পুরুষদের, বাম দিকে মেয়েদের, সোজা সামনে গেলে গরিব মানুষের ময়লা বাথরুম। জালাল তার কোনোটা না দেখিয়ে একেবারে উল্টো দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “হুই যে হেই দিকে।”
মানুষটা জালালের কথা বিশ্বাস করে লম্বা লম্বা পা ফেলে সেদিকে হাঁটতে থাকে। জালাল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তাকিয়ে দেখে মানুষটা এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। কোনো বাথরুম খুঁজে না পেয়ে তার কী অবস্থা হবে চিন্তা করে তার মুখের হাসিটা প্রায় দুই কান ছুঁয়ে ফেলল।
জালাল প্লাটফর্মে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকিয়ে অন্যদের একটু খোঁজ নিল। তারপর এক কোনায় জড়ো করে রাখা অনেকগুলো বড় বড় বস্তার একটার উপর হেলান দিয়ে বসল। বস্তার মাঝে কী আছে কে জানে, আশেপাশে একটু বোটকা গন্ধ, কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ্যি জালাল গন্ধটার কথা ভুলে গেল। জালালকে দেখে একটু পর অন্য বাচ্চাগুলোও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে যায়। এই ট্রেনটা থেকে কার কী আয়-রোজগার হয়েছে সেটা নিয়ে নিজেরা একটু কথাবার্তা বলল। মায়া তার হাতে মুঠি করে রাখা ময়লা নোটগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে, সে এখনো গুনতে শিখে নাই তাই দেখে একটা আন্দাজ করতে হয়। জালাল জিজ্ঞেস করল, “কয় টাকা পাইলি?”
“জানি না।”
“আমারে দে, গুইনা দেই।”
মায়া মুখ বাঁকা করে বলল, “ইহ্!” তার এই মূল্যবান রোজগার আর কারো হাতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
জালাল সরল মুখ করে বলল, “আমি নিমু না। আল্লার কসম খোদার কিরা।”
মায়া ভুরু কুঁচকে তাকাল, জালাল সত্যি সত্যি বলছে না কী তার কোনো বদ মতলব আছে বুঝতে পারছে না।
মজিদ বলল, “দিস না মায়া। জালাল তোর টেহা গাপ কইরা দিব।”
জালাল বলল, “গাপ করুম না। খোদার কসম।”
মায়া তার পরেও জালালকে বিশ্বাস করল না, নিজেই টাকাগুলো গোনার চেষ্টা করতে লাগল। সে সব নোট চিনে না কিন্তু প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে সে এক দুই টাকার নোট আর খুচরা পয়সা ছাড়া কিছু পায় না, তাই গোনার বিশেষ কিছু থাকেও না।
মায়া তার ফোকলা দাঁত দিয়ে বাতাস বের করে বলল, “কেউ টেহা দিবার চায় না।”
মজিদ বলল, “কেন তোরে দিব? হেরা কি তোর জন্যি টেহা কামাই করে?”
জালাল মায়াকে উপদেশ দিল, “যখন টাকা চাইবি তখন হাসবি না। মুখটা কান্দা কান্দা করে রাখবি।”
মায়া বলল, “রাখি তো।”
“গায়ে হাত দিবি। পা ধরে রাখবি।”
“রাখি তো।”
“যতক্ষণ টাকা না দেয় ছাড়বি না।”
“ছাড়ি না তো।”
মজিদ বস্তায় শুয়ে ছিল হঠাৎ সোজা হয়ে বসে দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে, চিৎকার করে ডাকল, “কাউলা। হেই কাউলা।”
সবাই দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে তাকায়, সেখানে তিন চার বছরের একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে–তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। কখনো থাকে না। কাউলা তার নাম নয়, সত্যি কথা বলতে কী তার আসলে কোনো নাম নেই, গায়ের রং কুচকুচে কালো বলে তাকে কাউলা বলে ডাকে। জেবার ধারণা কাউলার গায়ের রং আসলে কালো নয়–শরীরে ময়লা জমতে জমতে তার গায়ের রং এরকম কুচকুচে কালো হয়েছে!
মজিদ আবার চিৎকার করে বলল, “হেই কাউলা! তোর মা কই?”
অন্যেরাও তার সাথে যোগ দিল, “তোর মা কই? মা কই?”
কাউলা তাদের কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না। তাকে কেউ কথা বলতে শুনেনি, সে কথা বলতে পারে কি না সেটাও কেউ জানে না। কেউ কিছু বললে সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এবারেও সে দুই নম্বর প্লাটফর্ম থেকে তাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
জেবা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “তোর পাগলি মা কই?”
কথা শেষ হবার আগেই কাউলার মাকে দেখা গেল। শুকনো খিটখিটে একজন মহিলা দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় না। রুক্ষ মাথার চুলে জটা, শরীরে ময়লা কাপড়। মাথায় নিশ্চয়ই উকুন কিলবিল কিলবিল করছে, এক হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে হাঁটছে।
মজিদ চিৎকার করে ডাকল, “পাগলি! এই পাগলি।”
মহিলাটা তাদের চিৎকারে কান দিল না, বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে থাকে।
শাহজাহান গলা উঁচিয়ে বলল, “এই পাগলি! তোর পাগলা কই?”
শাহজাহানের কথায় সবাই মজা পেয়ে গেল, তখন সবাই গলা উঁচিয়ে বলতে লাগল, “এই পাগলি! তোর পাগলা কই?”
মহিলাটা হঠাৎ দুই হাত আঁকাতে ঝাঁকাতে মাথা নাড়তে থাকে এবং সেটা দেখে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। পাগল মানুষের বিচিত্র কাজ দেখে তারা খুব মজা পায়।
মজাটাকে আরো বাড়ানোর জন্যে মজিদ বলল, “আয় ঢেলা মারি!”
মহিলাটি তখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এখান থেকে ঢেলা মেরে তার গায়ে লাগাতে পারবে না। তা ছাড়া আশেপাশে অন্য মানুষজন আছে তাদের গায়ে ঢেলা লাগলে তাদের খবর হয়ে যাবে তাই মজাটাকে আজকে আর বাড়ানো গেল না।
কাউলা এততক্ষণ দুই নম্বর পাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ সে ছুটতে ছুটতে তার মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে তার মায়ের কাপড় ধরে ফেলল। তার মা অবশ্যি ভ্রূক্ষেপ করল না, বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাঁটতে থাকল।
এরকম সময় জেবা জালালকে বলল, “এই জংলা তোর দোস্তু আইছে!”
জেবার যখন ঠাট্টা-তামাশা করার ইচ্ছা করে তখন সে জালালকে জংলা ডাকে। তার কথা শুনে সবাই খুব আনন্দ পেল, কারণ যাকে সে দোস্ত বলছে সেটি হচ্ছে একটি কুকুর। কুকুরটা স্টেশনের আশেপাশে থাকে তবে জালালের সাথে তার একটি অন্যরকম সম্পর্ক। সময় পেলেই সেটা জালালের পাশে ঘুরঘুর করে, তাকে দেখলেই লেজ নাড়ে, আহ্লাদ করে।
জালাল বস্তা থেকে নেমে কুকুরটার পাশে গিয়ে সেটাকে ধরে একটু আদর করল। এইটুকু আদরেই কুকুরটা একেবারে গলে গেল। মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে সেটি তার চার পা উপরে তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে সোহাগ করতে থাকে।
মজিদ হি হি করে হেসে বলল, “জংলার দোস্তু কুত্তা!”
কথাটাতে সবাই মজা পেল। হি হি করে হাসতে হাসতে সবাই বলতে লাগল, “জংলার দোস্তু কুত্তা! জংলার দোস্তু কুত্তা!”
জালাল তাদের কথায় কান দিল না, কুকুরটার পেটে হাত দিয়ে সেটাকে আদর করতে থাকে।
শাহজাহান বলল, “কুত্তারে হাত দিয়া ধরন ঠিক না।”
জেবা জানতে চাইল, “ক্যান? হাত দিয়া ধরলে কী অয়?”
“কুত্তা নাপাক। এরে ধরলে তুইও নাপাক হবি।”
জালাল মুখ ভেংচে বলল, “তরে কইছে। এই কুত্তা তোর থাইকা পরিষ্কার।”
সবাই তখন আবার হি হি করে হাসল, কারণ কথাটা সত্যি। তাদের জামা কাপড়, শরীর যথেষ্ট নোংরা, তাদের মাঝে শাহজাহান আবার বাড়াবাড়ি নোংরা এবং তাদের সবার তুলনায় এই কুকুরটা রীতিমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
জালাল আরো কিছুক্ষণ কুকুরটাকে আদর করে বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
জেবা বলল, “কুক্কু?”
জালাল মাথা নাড়ল, “হ। আমি এইটার নাম দিছি কুক্কু।”
“কুক্কু কী জন্যি? ভালা কুনু নাম দিতি পারলি না?”
“আমারে দেখলেই মাটিত শুইয়া কু-কু করে। এই জন্যি এর নাম হইল কুক্কু।”
.
সবাই তখন কুকুরটাকে ডাকতে লাগল, “কুক্কু! এই কুক্কু!”
কুকুরটা মনে হয় এতে বেশ মজা পেল। সেটা লেজ নেড়ে মুখটা উঁচু করে ঘেউ ঘেউ করে দুইবার ডাকল, মনে হল বুঝি বলছে, “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
জালাল কুকুরটাকে ডাকল, বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
মজিদ জানতে চাইল, “কই যাস?”
“টাউনে।”
“কী জন্যি?”
“পানির বুতল বেচমু।”
তারা সবাই ট্রেন থেকে পাস্টিকের খালি পানির বোতলগুলো খুঁজে খুঁজে এনে জমা করে রাখে। সেগুলো নানা জায়গায় বিক্রি করে। জালাল তার বোতলগুলো শহরে বিক্রি করতে যায়, তার একটা কারণ আছে। কারণটা গোপন তাই সেটা কেউ জানে না, জানানো নিষেধ।
.
জালাল তার পানির খালি বোতলগুলো একটা দোকানের পিছনে রাখে। সে দোকানদারের ফাইফরমাস খাটে তাই দোকানদার জালালকে বোতলগুলো এখানে রাখতে দেয়। জালাল হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে তার খালি বোতলগুলো বের করে সেগুলো ভালো করে লক্ষ করল। যেগুলো পুরোপুরি অক্ষত সেই বোতলগুলো আলাদা করে বড় একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে ঘাড়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কুক্কু গভীর মনোযোগ দিয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। দেখে মনে হয় সে বুঝি সবকিছু বুঝতে পারছে।
জালাল বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
কুক্কু লেজ নেড়ে জালালের সাথে রওনা দিল।
কুক্কুকে নিয়ে শহরে যাওয়ার অবশ্যি একটা বড় সমস্যা আছে, পথে-ঘাটে যত কুকুর আছে তার সবগুলোর সাথে সে ঝগড়া আর মারামারি করতে করতে যায়। কুকুরদের মনে হয় নিজেদের একটা এলাকা থাকে, সেই এলাকায় অন্য কুকুর এলে আর রক্ষা নেই, একটা ভয়ংকর মারামারি হবেই হবে। স্টেশনের এই পুরো এলাকাটা কুকুর দখলে, অন্য যে কুকুর আছে সবগুলো কুকুর সামনে লেজ গুটিয়ে থাকে, বাইরে থেকে নতুন কুক্কুরের ধারে কাছে আসার সাহস নেই।
স্টেশনের বাইরে গেলে অবশ্যি ভিন্ন কথা, অন্য কুকুরগুলোর তেজ তখন। একশ গুণ বেড়ে যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেই মাস্তান কুকুরগুলো তাদের এলাকা পাহারা দেয়। কুক্কুকে দেখেই সেগুলো ঘাড় ফুলিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে থাকে। জালাল লক্ষ করেছে কুক্কু কীভাবে কীভাবে জানি আগেই বুঝে যায় যে সামনে কোনো একটা কুকুর তার জন্যে অপেক্ষা করছে। মনে হয় সেই জন্যে সে খানিকটা ভয়ও পায় আর সেই ভয়টাকে দূর করার জন্যে সে ঘাড় উঁচু করে –থাকে, চাপা গরগর শব্দ করে। কুকুর বীরত্বটুকু অবশ্যি বেশিরভাগই জালালের জন্যে, সে জানে হঠাৎ করে যদি অনেকগুলো মাস্তান কুকুর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তা হলে জালাল তাকে রক্ষা করবে। মনে হয় বড় একটা কুকুরও ছোট একটা মানুষকে অনেক ভয় পায়।
জালাল কুক্কুকে সামলে সুমলে নিয়ে যেতে থাকে। কাজটা মোটেও সোজা না। কুক্কু মাঝে মাঝেই নিজেই আগ বাড়িয়ে অন্য কুকুরদের সাথে মারামারি করতে যায়। শুধু তাই নয় প্রত্যেকবার নতুন এলাকাতে গিয়ে একটা লাইটপোস্টের সামনে এসে সে তুলে একটুখানি পেশাব করে ফেলে! জালালের মনে হয় এটা করে কুক্কু এই এলাকার সব কুকুরকে অপমান করার চেষ্টা করে। তার ভাবখানা এইরকম যে, এই দেখ আমি তোমার এলাকায় পেশাব করে দিয়ে যাচ্ছি তোমরা কিছুই করতে পারছ না!
.
জালাল আর কুক্কু যখন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে তখন ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটি হওয়ার সময়। কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনো একটা স্কুল আছে সেই স্কুল থেকে সব ছেলেমেয়েরা বের হয়েছে। বড়লোকের বাচ্চারা গাড়ি চেপে হুশ হাশ করে বের হয়ে যাচ্ছে। সাবধানী মায়েরা নিজেরা এসে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাচ্চা রিকশা ভ্যানে চেঁচামেচি করতে করতে যাচ্ছে। যেসব ছেলেমেয়েদের বাসা কাছাকাছি কিংবা রিকশা করে বাসায় যাবার টাকা নেই তারা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় কোন বাচ্চাগুলো বড়লোকের ছেলেমেয়ে আর কোন বাচ্চাগুলোর বাবা-মা গরিব টাইপ। বড়লোকের বাচ্চাগুলো কেমন জানি ঢিলেঢালা নাদুস নুদুস। গরিব টাইপের বাচ্চারা শুকনো আর টিংটিংয়ে–অনেকটা জালালের মতো।
যে বাচ্চাগুলো স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে যাচ্ছে তাদের অনেকেই জালালের বয়সি। এই বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে পারছে আর জালাল স্কুলে যেতে পারছে না, সেই জন্যে তার মোটেও হিংসা হয় না, বরং খানিকটা আনন্দ হয়। দরজা-জানালা বন্ধ একটা ঘরের ভেতরে মাস্টারেরা ধরে ধরে তাকে পেটাবে আর সেই পিটুনি মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হবে এর কোনো অর্থ হয় না। তার তো আর বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা নাই তা হলে খামোখা স্কুলে গিয়ে কষ্ট করবে কেন? ছোট থাকতে যখন নিজের গ্রামে ছিল তখন এক দুই বছর স্কুলে গিয়েছিল। স্কুলের স্যারদের ধুম পিটুনি খেয়ে বানান করে একটু একটু পড়তে পারে। টাকা-পয়সা গুনতে গুনতে যোগ-বিয়োগ খুব ভালো শিখে গেছে, এর থেকে বেশি তার জানার দরকার নেই, জানার কোনো ইচ্ছাও নেই।
মহাজন পট্টিতে গিয়ে জালাল একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। গলির শেষের দিকে পুরানো একটা বিল্ডিং, সেই বিল্ডিংয়ের দরজায় সে ধাক্কা দিল।
ভেতর থেকে ভারি গলায় একজন জিজ্ঞেস করল, “কে?”
জালাল বলল, “আমি ওস্তাদ। জালাল।”
“ও।” একটু পরেই দরজাটা খুট করে খুলে গেল, দরজার সামনে শুকনো একজন মানুষ জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় জাল্লাল।”
শুকনো এই মানুষটির নাম জগলুল, জালাল তাকে ওস্তাদ ডাকে, আর এই মানুষটি জালালকে কেন জানি জাল্লাল বলে ডাকে!
জালাল কুক্কুকে বাইরে বসিয়ে রেখে তার পলিথিনের ব্যাগ বোঝাই প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকল। জগলুল নামের মানুষটা–জালাল যাকে ওস্তাদ ডাকে, সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, চোখটা সয়ে যেতেই একটু পরে ওস্তাদের ফ্যাক্টরিটা দেখা গেল। এই ফ্যাক্টরির মালিক ম্যানেজার শ্রমিক সবকিছুই ওস্তাদ একা! জালালের ওস্তাদ কামেল মানুষ। তার ফ্যাক্টরিতে অনেক কিছু তৈরি হয়–এখন ওস্তাদ প্লাস্টিকের খালি বোতলে পানি ভরে তার মুখটা সত্যিকারের ফ্যাক্টরির কায়দায় সিল করছে যেন সেগুলো সত্যিকারের পানির বোতল হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। ওস্তাদের এক পাশে সারি সারি খালি পাস্টিকের বোতল। সামনে একটা বড় বালতিতে পানি। বালতির কিনারে একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের মগ। ওস্তাদ মগে করে বালতি থেকে পানি নিয়ে প্রাস্টিকের খালি বোতলে ভরে ভরে এক পাশে রাখতে লাগল। জালাল পলিথিনের ব্যাগে করে আনা তার খালি প্লাস্টিকের বোতলগুলো নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে।
ওস্তাদ বেশ অনেকগুলো বোতলে পানি ভরে ছিপিগুলো জুড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। একপাশে ইলেকট্রনিক্সের কাজ করার একটা সল্ডারিং আয়রন গরম হচ্ছিল। ওস্তাদ সেটা হাতে নিয়ে খুব সাবধানে পানির বোতলের ছিপিটা একটু গলিয়ে আলগা রিংটার সাথে জুড়ে দিতে লাগল। ওস্তাদের হাতের কাজ খুবই ভালো, খুব ভালো করে তাকিয়েও কেউ বুঝতে পারবে না এটা আলাদাভাবে জুড়ে দেওয়া আছে। খোলার সময় সিলটা ভেঙে খুলতে হবে কাজেই মনে হবে বুঝি একেবারে ফ্যাক্টরি থেকে আসা বোতল। ছিপিটা লাগানোর পর তার উপরে স্বচ্ছ পাস্টিকের ছোট একটা টিউব ঢুকিয়ে সল্ডারিং আয়রনের জোড়া দিয়ে একটু সেঁক দিয়ে সেটাকেও ভালো করে লাগিয়ে নেয়। কাজ শেষ হবার পর ওস্তাদ পানির বোতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে মুখে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল।
জালাল মুগ্ধ চোখে ওস্তাদের কাজ দেখছিল, বলল, “ফাস্ট ক্লাশ! আসল বুতল থাইকা ভালা।”
ওস্তাদ মাথা নেড়ে বুকে থাবা দিয়ে বলল, “জগলুল ওস্তাদের হাতের কাজে কোনো খুত নাই।”
“না ওস্তাদ। কুনো খুত নাই।”
“চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়িস ধরা।”
জালাল আপত্তি করল, “জে না ওস্তাদ। এইটা তো চুরি না। এইটা তো ফ্যাক্টরি। এইখানে তো কেউ চুরি করে না ওস্তাদ। এইখানে কারো কুনু ক্ষতি হয় নাই।”
ওস্তাদ মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক। আমি তো বোতলে ময়লা পানি দেই না। টিউবওয়েলের পরিষ্কার পানি দেই। খাঁটি পানি।” ওস্তাদ আরেকটা বোতল রেডি করতে করতে বলল, “কিন্তুক পুলিশ-দারোগা টের পেলে খবর আছে।”
“টের পাবি না ওস্তাদ। কুনুভাবে টের পাবি না।”
“না পাইলেই ভালো। তুই খবরদার কাউরে বলবি না।”
“কী বলেন ওস্তাদ! আমি কারে বলমু? কুনুদিন বলমু না।”
বেশ কিছুক্ষণ কাজ করে জগলুল ওস্তাদ একটু বিশ্রাম নেয়। খুব যত্ন করে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে উপর দিকে ধোয়া ছাড়ল। জালাল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারও মনে হয় সিগারেট খাওয়াটা শিখতে হবে। তা হলে সেও এইরকম সুন্দর করে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে পারবে। তবে কাজটা সোজা না। একদিন চেষ্টা করে দেখেছে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা।
ওস্তাদ বলল, “আমার ফ্যাক্টরি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার সমস্যা কোন জায়গায় জানিস জাল্লাল?”
“কুন জায়গায়?”
“মার্কেটিং। যদি ঠিকমতো মার্কেটিং করতে পারতাম তা হলে এততদিনে ঢাকার মালিবাগে একটা ফ্ল্যাট থাকত।”
বিষয়টা জালাল ঠিক বুঝল না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না, ওস্তাদের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওস্তাদ বলল, “তয় মার্কেটিংয়েও কিছু সমস্যা আছে।”
“কী সমিস্যা?”
“বেশি মার্কেটিং মানে বেশি মানুষ। আর বেশি মানুষ মানে বেশি জানাজানি। জানাজানি যদি একটু ভুল জায়গায় হয় তা হলেই আমি ফিনিস।”
জালাল আবার বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, “অ।”
ওস্তাদ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “সেই জন্যে আমি দুই চারজন বিশ্বাসী মানুষ ছাড়া আর কাউরে আমার বিজনেসের কথা বলি না।”
জালাল ওস্তাদের দুই-চারজন বিশ্বাসী মানুষের মাঝে একজন সেটা চিন্তা করেই গর্বে তার বুক ফুলে উঠল।
.
জালাল একেবারে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত ওস্তাদের বাসায় থাকল। ওস্তাদ তাকে দিয়ে কিছু টুকটাক কাজ করিয়ে নিল। সে ঘরদোর একটু পরিষ্কার করল, ওস্তাদের সিগারেটের গোড়া, কলার ছিলকে, চিপসের খালি প্যাকেট বাইরে ফেলে এল। মোড়ের টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি এনে দিল। বিকালবেলা চা নাস্তা খাওয়ার জন্যে চায়ের দোকান থেকে লিকার চা আর ডালপুরি কিনে আনল।
ওস্তাদ তার হাতের কাজ শেষ করে জালালের পলিথিনের ব্যাগের ভেতরের পানির খালি বোতলগুলো বুঝে নিল। তার বদলে ওস্তাদ তাকে এক ডজন পানির বোতল দিল। হাফ লিটারের বোতল, ঠিক করে বিক্রি করতে পারলে তার একশ টাকা নিট লাভ!
ওস্তাদকে সালাম দিয়ে জালাল ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঘরের দরজার কাছে বসে কুক্কু খুব মনোযোগ দিয়ে বিদ্ঘুটে একটা হাড় চিবাচ্ছিল। হাড়টাতে খাওয়ার কিছু নেই, মনে হয় সময় কাটানোর জন্যে এটা কামড়াচ্ছে। কোথা থেকে এই বিদ্ঘুটে হাড় খুঁজে বের করেছে কে জানে। জালালকে পানির বোতলের প্যাকেট নিয়ে বের হতে দেখে কুক্কু তার হাড় ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ল।
স্টেশনে ফিরে আসার সময় আবার সেই একই কাহিনী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাস্তান কুক্কুরেরা তাদের এলাকা পাহারা দিচ্ছে। কুক্কু তাদের সাথে মারামারি করতে করতে ফিরে আসছে। মারামারিতে জিততে পারলে কাছাকাছি লাইটপোস্টে পা তুলে সে একটুখানি পেশাব করে পুরো কুকুর বাহিনীকে অপমান করার চেষ্টা করছে।
ওস্তাদের বাসায় যাবার সময় ছিল হালকা খালি পাস্টিকের বোতল। এখন ফিরে যাবার সময় পানি ভরা বোতল। বোতলগুলো অনেক ভারি–একটা রিকশা নিতে পারলে হত কিন্তু জালাল রিকশা নিয়ে পয়সা নষ্ট করল না। টাকা-পয়সা রোজগার করা যে কথা, খরচ না করে বাঁচিয়ে ফেলা সেই একই কথা। অনেকদিন থেকে সে টাকা জমানোর চেষ্টা করছে।
.
রাত গম্ভীর হলে মজিদ তার বাড়ি চলে গেল, সে স্টেশনের কাছেই টিএন্ডটি বস্তিতে থাকে। মতির মা তার কাজ শেষ করে বাড়ি যাবার সময় মতিকে নিয়ে গেল। অন্য যারা আছে তাদের বাড়িও নেই মা-বাবার খোঁজও নেই, তারা স্টেশনেই থাকে। এটাই তাদের বাড়ি-ঘর। এখানে তারা নিজেরাই একজন আরেকজনের বাবা-মা ভাই বোন সবকিছু। তারা এমনিতে সবসময় একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়াঝাটি মারপিট করছে কিন্তু তারপরেও কীভাবে কীভাবে জানি একজন আরেকজনের উপর নির্ভর করে। স্টেশনে নানারকম বিপদ-আপদ, মাঝে মাঝে গভীর রাতে পুলিশ এসে তাদেরকে মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়। ফেনসিডিল, হেরোইন খাওয়া কিছু খারাপ মাস্তান আছে মাঝে মাঝে তারা হামলা করে তাদের টাকা-পয়সা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। সবাই একসাথে থাকলে এই রকম বিপদ-আপদ কম হয়। কিংবা যখন হয় তখন সেটা সামাল দেওয়া যায়।
শেষ ট্রেনটা চলে যাবার পর তারা সবাই গুটিশুটি মেরে শুয়ে গেল। জালাল একপাশে তার মাথার কাছে কুক্কু। শাহজাহান একটু বিলাসী তার একটা ময়লা কাঁথা পর্যন্ত আছে। জেবা আর মায়া দুইজন একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে ধরে শুয়ে আছে। প্রাটফর্মের শেষ মাথায় সিঁড়ির নিচে কাউলা আর তার মায়ের সংসার। প্লাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে কিছু ভিখিরি, থুরথুরে একজন বুড়ি, একজন লম্বা চুল-দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী। এমনিতে সারাদিন স্টেশনে থাকে না কিন্তু রাতে ঘুমানোর জন্যে শহর থেকে বেশ কিছু মানুষ আসে। তাদের কারো কারো চেহারা ভালো মানুষের মতো আবার কেউ কেউ ষণ্ডা ধরনের, লাল চোখ দেখে ভয় লাগে।
জালাল কুক্কুকে জড়িয়ে ধরে একসময় ঘুমিয়ে গেল। গভীর রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। কেন ভেঙেছে সে জানে না। তার মনে হল সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করল তারপর উঠে বসল। মনে হয় জেবা। জালাল উঠে বসল, তার ধারণা সত্যি। জেবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নার সাথে সাথে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “জেবা। কী হইছে, কান্দস ক্যান?”
সাথে সাথে জেবার কান্নার শব্দ থেমে গেল। জালাল আবার ডাকল, “জেবা।”
জেবা বলল, “উঁ।”
“কান্দস ক্যান?”
জেবা সহজ গলায় বলল, “কে কইছে কান্দি? কান্দি না।” একটু থেমে যোগ করল, “মনে হয় খোয়াব দেখছি।”
জালাল জানে খোয়াব বা স্বপ্ন না, জেবা সত্যিই কাঁদছে। কিন্তু স্বীকার করতে চাচ্ছে না। কখনো স্বীকার করে না। সবসময় ভান করে সে খুব শক্ত মেয়ে কোনো কিছুতে কাবু হয় না। কিন্তু জালাল জানে জেবার ভেতরেও কোনো জায়গায় একটা দুঃখ আছে, কষ্ট আছে। তার নিজের যেরকম আছে। প্লটফর্মে যারা শুয়ে আছে তাদের সবার যেরকম আছে। কুক্কু ছাড়া–মনে হয় শুধু কুক্কুর মনে কোনো দুঃখ নেই।
জালাল আবার শুয়ে পড়ল। অনেকটা অভ্যাসের বশে কোমরে প্যান্টের ভাজে হাত দিল, সে যেটুকু টাকা জমাতে পারে তা প্যান্টের এই ভাঁজে লুকিয়ে সেলাই করা আছে। গত রাতে লুকিয়ে একবার গুনেছে, সাতশ টাকা হয়েছে তার জন্যে সাতশ টাকা অনেক টাকা। প্যান্টের পকেটে সবসময় কিছু খুচরা টাকা রাখে, যদি কোনো হেরোইনখোর তাদের উপর হামলা করে তা হলে এই টাকাগুলো নিয়েই যেন বিদায় হয়, তার আসল টাকা যেন ধরতে না পারে। জালাল যখন প্যান্টের ভঁজে হাত দিয়ে তার জমানো টাকাগুলো ছুঁয়ে দেখে তখনই তার মনটা ভালো হয়ে যায়।
আজকে কেন জানি তার মনটা ভালো হল না। কেন জানি তার মনটা খারাপ হয়ে থাকল। মাঝে মাঝেই এরকম হয়।
.
০২.
ইভা রিকশা থেকে নেমে স্টেশনের দিকে তাকাল, চকচকে নতুন মডার্ন টাইপের একটা বিল্ডিং–দেখে স্টেশন মনেই হয় না। রেল স্টেশন হলেই কেন জানি মনে হয় এটাকে লাল ইটের পুরানো একটা দালান হতে হবে। ইভা যখন ছোট ছিল তখন বাবার সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছে–অনেক রেল স্টেশন দেখেছে, তাই স্টেশনের একটা ছবি তার মাথায় রয়ে গেছে–সেই ছবির সাথে না মিললে ইভার কেন জানি মনে হয় তাকে বুঝি কেউ ঠকিয়ে দিয়েছে!
রিকশা ভাড়া দিয়ে সে রিকশা থেকে নামল। ছোট ব্যাগটা হাতে নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে কাঁচের দরজা ঠেলে স্টেশনের ভেতরে ঢোকে। আগামী তিন মাস প্রত্যেক বৃহস্পতিবার তাকে এই স্টেশনে আসতে হবে। হেড অফিস থেকে তাকে তিন মাসের জন্যে এখানে পাঠিয়েছে। এখানে যে কয়টা ব্রাঞ্চ অফিস রয়েছে তার প্রত্যেকটাতে ট্রেনিং দিতে হবে। অপরিচিত জায়গায় সবাই অপরিচিত মানুষ। এখানে টানা তিন মাস ইভা থাকতে পারবে না। তাই ঠিক করেছে শনিবার রাতে ঢাকা থেকে এখানে পৌঁছাবে আবার বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা ফিরে যাবে। ঢাকা শহরে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, বাতাসে ধূলাবালি আর পোড়া ডিজেলের গন্ধ, ফুটপাথে মানুষের ভিড়, অফিসে রাগি রাগি চেহারার মানুষ, দোকানপাটে জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দাম তারপরেও ঢাকা শহরের বাইরে গেলে ইভার কেন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে।
ইভা এক নম্বর পাটফর্মে এসে দাঁড়াল। ট্রেন আসার সময় হয়নি, প্যাসেঞ্জাররা এর মাঝে আসতে শুরু করেছে। ইভা আস্তে আস্তে পাটফর্মটা ঘুরে ঘুরে দেখে। পৃথিবীর সব রেল স্টেশনের মাঝেই একটা মিল আছে, মিলটা কী ইভা ঠিক ধরতে পারে না।
কে যেন ঠাণ্ডা একটা হাত দিয়ে তার কনুইটা ছুঁয়েছে। ইভা ঘুরে তাকাল। তিন-চার বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে, মাথায় লাল রুক্ষ চুল, সারা শরীরে ধুলো ময়লার একটা আস্তরণ, ময়লা একটা গেঞ্জি হাঁটু পর্যন্ত চলে এসেছে। বাচ্চাটার চেহারায় অবশ্যি একটা তেজি ভাব আছে দেখে রোগা কিংবা দুর্বল মনে হয় না। বাচ্চা মেয়েটা মুখের মাঝে খুব দুঃখ দুঃখ একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “আফা দুইটা টেহা দিবেন?”
ইভা লক্ষ করল মেয়েটার সামনের দাঁতগুলো নেই। জিজ্ঞেস করল, “কী করবে টাকা দিয়ে?”
“ভাত খামু।”
“ভাত খাও নাই?”
“নাহ!” মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিল, ইভা বুঝতে পারল বাচ্চা মেয়েটা এখনো চোখের দিকে তাকিয়ে সরল মুখে মিথ্যে কথা বলা শিখেনি। ইভা তার ব্যাগ খুলে চকচকে একটা দুই টাকার নোট বের করে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম তোমার?”
“মায়া।”
ইভা মনে মনে ভাবল এই নামটিই তার হওয়ার কথা, তারপর দুই টাকার নোটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে নাও।”
মায়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না–কোনো বকাবকি নেই, রাগারাগি নেই এতোটুকু বিরক্ত না হয়ে চাওয়া মাত্রই দুই টাকা দিয়ে দিল? প্রায় খপ করে নোটটা নিয়ে সে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। কয়েক পা যেতেই তার জেবার সাথে দেখা হল, মায়া চোখ বড় বড় করে বলল, “একটা আফা চাইতেই দুই টেহা দিল।”
“কোন আফা?”
মায়া দেখিয়ে দেয়, “হুই যে লাল শাড়ি কালা ব্যাগ, সুন্দর মতোন আফা।”
কাজেই এবার জেবা তার ভাগ্য পরীক্ষা করতে গেল। কী আশ্চর্য! চাওয়া মাত্রই সেও দুই টাকা পেয়ে গেল, মুখ কাচুমাচু পর্যন্ত করতে হল না। মুহূর্তের মাঝে স্টেশনের সব বাচ্চার কাছে খবরটা পৌঁছে যায়। এক নম্বর প্লাটফর্মে সুন্দর মতোন একজন লাল শাড়ি পরা আপার কাছে চাইলেই সে দুই টাকা দিয়ে দিচ্ছে। শাহজাহান দুই টাকা নিয়ে নিল, মজিদ দুই টাকা নিয়ে নিল, মতিও গিয়ে একটা চকচকে দুই টাকার নোট পেয়ে গেল।
জালাল জগলুল ওস্তাদের তৈরি করা হাফ লিটারের পানির বোতল বিক্রি করছিল, চাইতেই দুই টাকা পাওয়া যাচ্ছে শুনে সেও পানি বিক্রি বন্ধ রেখে সুন্দর মতোন আপার কাছ থেকে দুই টাকা নিয়ে নিল। টাকাটা পকেটে রেখে জালাল বলল, “আপা মিনারেল নিবেন?”
ইভা জিজ্ঞেস করল, “কী নিব?”
জালাল পানির বোতলটাকে দেখিয়ে বলল, “মিনারেল।”
ইভা ফিক করে হেসে বলল, “ও পানি!”
“জি আপা।”
বোতলের পানি বিক্রি করার সময় পানি না বলে কেন এটাকে মিনারেল বলতে হয় জালাল সেটা ভালো করে জানে না। কিন্তু এই আপা যদি এইটাকে পানি বললেই কিনতে রাজি হয় সেটাকে পানি বলতে তার কোনো আপত্তি নেই।
ইভার ব্যাগে ছোট একটা পানির বোতল ছিল তারপরেও সে জালালের কাছ থেকে এক বোতল পানি কিনে নিল। ভেজাল পানি।
.
ট্রেন আসার আগে আরো অনেক বাচ্চা হাজির হল, ইভা ধৈর্য ধরে সবাইকে একটা করে দুই টাকার নোট দিল। তার ব্যাগে সবসময় দুই টাকার নোটের একটা বান্ডিল থাকে, কোথাও সে পড়েছে এই নোটের ডিজাইনটা না কী একটা পুরস্কার পেয়েছে। সেই জন্যে এটা সে সাথে রাখে।
ট্রেনে ওঠার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কাজটা ঠিক করলেন না।”
ইভা থতমত খেয়ে বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে সব বাচ্চাগুলোকে দুই টাকা করে ভিক্ষা দিলেন। এদের অভ্যাস নষ্ট করে দিলেন।”
“অভ্যাস নষ্ট করে দিলাম?”
“হ্যাঁ। এদেরকে ভিক্ষা করতে শিখালেন।”
“আমি ভিক্ষা করতে শিখালাম?”
মানুষটা ফোঁস করে আরেকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই দেশে এই রকম রাস্তাঘাটের বাচ্চা কলোজন আপনি জানেন?”
এইটা সত্যিকারের প্রশ্ন না তাই ইভা কিছু বলল না। মানুষটা বলল, “আপনি দুই টাকা করে দিয়ে এদের সমস্যা মিটাতে পারবেন না। এইটা কোনো সমাধান না।”
ইভা এবারে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা লম্বা, মাথার সামনের দিকে চুল নেই, ঝাঁটার মতো গোঁফ। চেহারা দেখে মনে হয় এই মানুষটার নিজের উপর খুব বিশ্বাস, মানুষটার ধারণা সে সবকিছু জানে আর সে যে কথাটা বলেছে সেটাই হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র সত্যি কথা। মানুষটা চাইছে ইভা কিছু একটা বলুক, আর তখন সে আরো নতুন উৎসাহে ইভার সাথে তর্ক শুরু করবে। তাই ইভা কিছু বলল না, ছোট বাচ্চারা অর্থহীন কথা বললে বড়রা তাদের দিকে তাকিয়ে যেভাবে হাসে সেভাবে মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন!” তারপর তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের সিটটা খুঁজে বের করে বসে পড়ল। চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মানুষটা কেমন যেন হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে-তর্ক করার এরকম একটা সুযোগ পেয়েও একজন মানুষ যে তর্ক না করেই বসে যেতে পারে মনে হয় মানুষটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
.
পরের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা আবার ইভা স্টেশনে এসে হাজির হল। আবার সে তার ছোট ব্যাগটা হাতে নিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে হাঁটছে তখন আবার সে তার কনুইয়ে ঠাণ্ডা একটা হাতের স্পর্শ টের পেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখে লাল রুক্ষ চুলের সেই ছোট মেয়েটি। ময়লা একটা গেঞ্জি হাঁটু পর্যন্ত চলে এসেছে। ফোকলা দাঁত দিয়ে বাতাস বের করে বলল, “আফা। দুইটা টেহা দিবেন?”
ইভা বাচ্চাটার দিকে তাকাল। বলল, “কী খবর মায়া?”
মায়া চমকে ওঠে এবং হঠাৎ করে সে ইভাকে চিনে ফেলল, সাথে সাথে সে তার সবগুলো ফোকলা দাঁত বের করে হাসল বলল, “দুই টেহি আফা!”
“কী আপা?”
“দুই টেহি। আফনি সবাইরে দুই টেহা দেন হের লাগি আফনি দুই টেহি আফা!”
ইভা বড় বড় চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি দুই টেকি আপা?”
মায়া মাথা নাড়ল। ইভা তখন তার ব্যাগ থেকে দুটি টাকা বের করে মায়াকে দিল। মায়া চকচকে নতুন নোটটা হাতে নিয়ে একবার তার গালে চুঁইয়ে হাতের অন্যান্য টাকার সাথে রেখে দিল। গতবারের মতো মায়া আজকে সাথে সাথে চলে গেল না, কাছে দাঁড়িয়ে ইভাকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একটু পরে বলল, “আফা। আপনার শাড়িটা কয় টেহা?”
ইভা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল, শাড়িটা সে বছর খানেক আগে অনেক দাম দিয়ে কিনেছে কিন্তু এই বাচ্চাটাকে সেটা বলার কোনো যুক্তি নেই। তাই মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। এটা তো আমাকে একজন দিয়েছে তাই কত দাম জানি না।”
“কে দিছে? আফনের জামাই?
ইভা হেসে ফেলল, বলল, “না, আমার জামাই নাই। অন্য একজন দিয়েছে।”
“আফনের শাড়িটা অনেক সোন্দর।”
ইভা বলল, “থ্যাংক ইউ।”
মায়া সাথে সাথে হি হি করে হাসতে থাকে। ইভা অবাক হয়ে বলল, “কী হল? হাস কেন?”
মায়া হাসতে হাসতে বলল, “আফনে আমারে কন থ্যাংকু।”
এর মাঝে কোন অংশটা হাসির ইভা ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাল না। মায়ার ফোকলা দাঁতের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী জান, তোমার সামনে দাঁত নাই।”
মায়া সাথে সাথে ঠোঁট দিয়ে তার মুখটা বন্ধ করে ফেলল। তার ভঙ্গি দেখে মনে হল দাঁত না থাকাটা খুবই লজ্জার একটা ব্যাপার আর সেটা কোনোভাবেই কাউকে দেখানো যাবে না।
মায়া বলল, “তোমার দাঁত কেমন করে পড়ল? মুখ হা করে ঘুমিয়েছিলে আর ইঁদুর এসে খেয়ে ফেলেছে?”
মায়া মুখ বন্ধ রেখেই জোরে জোরে মাথা নেড়ে অস্বীকার করল কিন্তু ইভা চারপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেল। সে লক্ষ করেনি বেশ কয়েকজন বাচ্চা এর মাঝে আশেপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে এবং ঘুমের মাঝে ইঁদুর এসে দাঁত খেয়ে ফেলার বিষয়টা তাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। একজনে হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইন্দুরে খাইছে, ইন্দুরে খাইছে! আমি দেখছি হে মুখ হা কইরা ঘুমায়।”
ইভা বলল, “তুমি এতো খুশি হচ্ছ কেন? তুমি যখন ছোট ছিলে তোমারও তো দাঁত ছিল না! তুমিও নিশ্চয়ই মুখ হা করে ঘুমিয়েছিলে!”
জেবা হাত বাড়িয়ে বলল, “আফা। দুইটা টেহা দিবেন?”
তখন অন্য সবাই হাত বাড়িয়ে দাঁড়াল। ইভা একটা নিশ্বাস ফেলে সবাইকে একটা করে দুই টাকার নোট দিল। টাকা নিয়ে বাচ্চাগুলো উধাও হয়ে যায়, স্টেশনে প্যাসেঞ্জাররা এসেছে এখন তাদের অনেক কাজ।
ঠিক তখন খুব কাছে থেকে কে একজন বলল, “কাজটা ভালো করলেন না।”
গলার স্বর শুনে ইভা চমকে উঠে পাশে তাকাল। সেদিনের লম্বা এবং মাথার চুল উঠে যাওয়া মানুষটা আজকেও স্টেশনে এসেছে। মনে হচ্ছে এই মানুষটাও তার মতো প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকা যায়। মানুষটা মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভা মানুষটার দিকে তাকাতেই সে মাথা নেড়ে আবার বলল, “কাজটি ভালো করলেন না।”
ইভা উত্তর দেবার চেষ্টা করল না, মাথা নেড়ে মেনে নিল যে কাজটা ভালো হয়নি। গত সপ্তাহে এই মানুষটার কথা শুনে অবাক হয়েছিল আজকে সে খুব বিরক্ত হল। কথার উত্তর না দিলে মানুষটি চলে যাবে ভেবে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু মানুষটি চলে গেল না, বরং আরেকটু কাছে এসে বলল, “এই যে এদের সাথে ভালো করে কথা বলেন এইটা হচ্ছে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। এভাবে গায়ে পড়ে কেউ কথা বলতে পারে সে চিন্তাও করতে পারেনি। মানুষটি ইভার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন এই লোকটা কে। এইভাবে গায়ে পড়ে কথা বলছে কেন! পাগল না কী! আমি আপনাকে রি এশিউর করছি আমি পাগল না। আমার নাম মশিউর রহমান। ডক্টর মশিউর রহমান। আমি এনথ্রোপলজির প্রফেসর, কানাডা থাকি। ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসেছি। কাল চলে যাব।”
ইভা এবারে ভালো করে মানুষটার দিকে তাকাল, মানুষটা দেশের বাইরে থাকে তাই এতো সহজে অপরিচিত মানুষের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে শিখেছে। অপরিচিত একজন মেয়ের সাথেও কোনো সংকোচ ছাড়া কথা বলতে পারে। ইভা মানুষটার দিকে তাকাল তখন এনথ্রোপলজির প্রফেসর মানুষটা বলল, “আপনি জানতে চান না কেন কাজটা ডেঞ্জারাস?”
“কেন?”
“এই বাচ্চাগুলোর সেফটি এন্ড সিকিউরিটির জন্যে। এদের লাইফ স্টাইল আমার আপনার লাইফ স্টাইলের মতো না। এদের লাইফ স্টাইল অনেক কঠিন। এদেরকে এখানে টিকে থাকা শিখতে হয়। প্রতি মুহূর্তে এদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। ওদের চারপাশে কোনো বন্ধু নেই–ওদের জন্যে কারো কোনো মমতা নেই।”
ইভা মনে মনে বলল, “আপনারও নেই!” মনে মনে বলেছে বলে এনথ্রোপলজির প্রফেসর কথাটা শুনতে পেল না, তাই সে কথা বলেই চলল, “বেঁচে থাকার জন্যে ওদের নিজেদের মতো করে স্কিল তৈরি করতে হয়। সেখানে কেউ যদি ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তা হলে ওরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ওদের সব হিসাব গোলমাল হয়ে যায়। সেই জন্যে আপনি যখন তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছেন তখন আসলে আপনি তাদের ক্ষতি করছেন।”
ইভা বলল, “আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
ইভার কথা শুনে মানুষটার নিরুৎসাহী হবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না বরং আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে সে কথা বলতে শুরু করল। বলল, “বুঝতে পারছেন না? মূল বিষয়টা খুব সহজ। এদেরকে আপনি আপনার নিজেকে দিয়ে বিচার করবেন না। আপনি আপনার চারপাশে যাদেরকে দেখেন তাদেরকে দিয়েও বিচার করবেন না। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের মোরালিটি-নৈতিকতা বোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি আমি যে কাজটি করতে দেখে আঁতকে উঠব এরা অবলীলায় সেটা করে ফেলবে। সারভাইবালস ইন্সটিংট।”
ইভা এতোক্ষণে নতুন করে বিরক্ত হতে শুরু করেছে। যে মানুষের কথা শুনে আগা মাথা বোঝা যায় না তার কথা শোনা থেকে যন্ত্রণা আর কী হতে পারে? ইভা এবারে কানাডাবাসী এনথ্রোপলজির প্রফেসরের সাথে কথাবার্তা শেষ করে ফেলতে চাইল, বলল, “আপনি যা বলছেন সেগুলো নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা–আমি অবশ্যি তার কিছুই বুঝতে পারি নাই। তাতে কোনো সমস্যা নাই আমি স্টক মার্কেটও বুঝি না ক্রসফায়ারও বুঝি না। অনেক জিনিস না বুঝেই আমি দিন কাটাই। কোনো সমস্যা হয় না। থ্যাংকু।”
ইভা কথা শেষ করে হাঁটতে শুরু করল, ইঙ্গিতটার মাঝে কোনো রকম রাখ ঢাক নাই-তোমার সাথে অনেক কথা হয়েছে এবারে তুমি থাম, আমি গেলাম!
মানুষটা হয় ইঙ্গিতটা বুঝল না, না হয় বোঝার চেষ্টা করল না কিংবা বুঝেও বোঝার ভান করে ইভার পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আপনাকে স্পেসিফিক এক্সাম্পল দেই তা হলে বুঝবেন। মনে করেন–”
ইভা না শোনার ভান করে হেঁটে যেতে থাকে, মানুষটা তখন হেঁটে তার সামনে এসে বলল, “মনে করেন এই বাচ্চাগুলোর একজন এসে আপনার কাছে দুই টাকা চাইল। আপনি বললেন আমার কাছে ভাংতি দুই টাকা নেই। একটা দশ টাকার নোট আছে তুমি টাকাটা ভাঙিয়ে এনে দাও। তারপর আপনি বাচ্চাটাকে দশ টাকার নোটটা দেন–দেখবেন বাচ্চাটা দশ টাকার নোট নিয়ে ভেগে যাবে।”
ইভা এই প্রথম মানুষটার একটা কথা বুঝতে পারল। মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার তাই ধারণা?
“হ্যাঁ। ধারণা না এটা হচ্ছে সত্য। টুথ ওয়ে অফ লাইফ। আপনি মনে করবেন না সেই জন্যে আমি এই বাচ্চাটাকে দোষী বলব। আমি-”
ইভা মানুষটাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমি যদি একটা ছোট বাচ্চাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে ভাংতি করে আনতে বলি সে টাকাটা নিয়ে পালিয়ে যাবে?”
“অফকোর্স। হি শুড।”
“আর যদি না যায়?”
“তা হলে আমি বলব আমার হাইপোথিসিস ভুল। আমি পরাজয় স্বীকার করে নেব।”
“কার কাছে পরাজয় স্বীকার করবেন?”
“আপনার কাছে।”
ইভা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি তো কোনো গেম খেলছি না যে এখানে জয় পরাজয় আছে!”
“শুধু কী গেমে জয়-পরাজয় থাকে? আইডিয়াতেও থাকে।”
“থাকলে থাকুক আমার সেখানে কোনো মাথা ব্যথা নেই।” ইভা একবারে পাকাঁপাকিভাবে কথাবার্তা শেষ করার জন্যে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন জালাল এসে হাজির হল। সে এই মাত্র খবর পেয়েছে গত সপ্তাহের দুই টেকি আপা আজকেও এসেছে। আজকেও সবাইকে চাইতেই দুই টাকা করে দিচ্ছে। জালাল ইভার দিকে তাকিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলল, “আফা, সবাইরে দিছেন, আমারে দুই টেহা দিবেন না?”
এনথ্রোপলজির প্রফেসর মনে হল এই সুযোগটার জন্যে অপেক্ষা করছিল, গলা বাড়িয়ে বলল, “তুই আমার কাছে আয়, আমি দিচ্ছি। আপাকে ছেড়ে দে।”
জালাল কী করবে বুঝতে না পেরে একবার ইভার মুখের দিকে আরেকবার চুল নেই লম্বা মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বলল, “আমার কাছে ভাংতি নাই, তুই টাকাটা ভাঙিয়ে আন–”
ইভা তখন তার ব্যাগ খুলে বলল, “দাঁড়াও।”
সাথে সাথে জালাল ইভার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ইভা বলল, “আমার ভাংতি শেষ হয়ে গেছে। তুমি এই একশ টাকার নোটটা ভাঙিয়ে নিয়ে এস। পারবে না?”
জালালের চোখ দুটি চকচক করে উঠল। বলল, “পারমু আফা।”
ইভা নোটটা বাড়িয়ে দেয়, জালাল কাঁপা হাতে নোটটা হাতে নিল। আজকে সকালে সে কার মুখ দেখে উঠেছিল? এরকম কপাল একজনের জীবনে আর কয়দিন আসে?
জালাল নোটটা নিয়ে ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর এনথ্রোপলজির প্রফেসর হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, “আপনি এটা কী করলেন? দশ টাকা দিলে তবুও হয়তো একটা কথা ছিল, হয়তো একটা চান্স ছিল! একশ টাকার লোভ এই বাচ্চা ছেলে কেমন করে সামলাবে? আমিই সামলাতে পারব না।” কথা শেষ করে মানুষটা হা হা করে হাসল।
ইভা কোনো কথা বলল না।
মানুষটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে একটা ফেয়ার কম্পিটিশন করি আপনি আমাকে ওয়াক ওভার দিয়ে দিলেন।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।”
“আমি সরি, শুধু শুধু আমার কথায় একশটা টাকা নষ্ট করলেন।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।
”আমি যাই। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।”
ইভা ভাবল। মনে মনে বলল, “আগেই যাবেন না, দেখে যান।” কিন্তু কিছু বলল না, সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। মানুষটি তখন ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইভা ভেবেছিল পাঁচ মিনিটের মাঝে ছেলেটা ভাংতি টাকা নিয়ে আসবে। ছেলেটি এলো না। দশ মিনিট পরেও এলো না। পনেরো মিনিট পর স্টেশনে ঘোষণা দিল ট্রেন আধা ঘণ্টা লেট তখনো ছেলেটা এলো না। বিশ মিনিট পরেও যখন এলো না তখন ইভা বুঝতে পারল এনথ্রোপলজির প্রফেসরের কথা সত্যি, ছেলেটা আর আসবে না। হয়তো একশ টাকার একটা নোট না দিয়ে দশ টাকার একটা নোট দেওয়া উচিত ছিল তা হলে হয়তো আসত, হয়তো ইভা নিজেই বাচ্চাটাকে লোভের মাঝে ঠেলে দিল। ইভার মনটা একটু খারাপ হল। সারা জীবনই সে মানুষকে বিশ্বাস করে এসেছে। মানুষ সেই জন্যে অনেকবার তাকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু তারপরেও সে মানুষকে বিশ্বাস করে এসেছে। সে কখনোই মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে না। শুধু মনের ভেতর খচখচ করছে–এইটুকুন একটা ছেলে তার বিশ্বাসটাকে সম্মান করল না? নিজেকে কেমন জানি অপমানিত মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস হামবাগ কানাডার প্রফেসর আশেপাশে নেই, তা হলে মনে হয় অপমানটা আরো বেশি গায়ে লাগত।
ত্রিশ মিনিট পর স্টেশনে ঘোষণা দিল ট্রেনটা আজকে এক নম্বর পাটফর্মের বদলে দুই নম্বর পাটফর্মে আসবে। প্যাসেঞ্জাররা সবাই যেন দুই নম্বর প্লাটফর্মে চলে যায়। ইভা তখন শেষবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ওভার ব্রিজের উপর দিয়ে দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে যেতে থাকে। ছেলেটা যদি এখন একশ টাকার ভাংতি নিয়ে চলেও আসে আর তাকে খুঁজে পাবে না।
দুই নম্বর প্লাটফর্মে ইভার সাথে আবার এনথ্রোপলজির প্রফেসরের দেখা হয়ে গেল। প্রফেসর কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “ড্র।”
ইভা ঠিক বুঝতে পারল না, বলল, “কী বললেন?”
“বলেছি ড্র হয়ে গেল।”
“কীসের ড্র?”
“আমাদের কম্পিটিশানের। আপনি এখন বলতে পারবেন ছেলেটা হয়তো ঠিকই ভাংতি নিয়ে এসেছিল কিন্তু আপনাকে আর খুঁজে পায় নাই। টেকনিক্যাল কারণে ড্র হয়ে গেল।”
ইভা কিছু বলল না, সে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে ড্র করতে চায়নি। সে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে জিততে চেয়েছিল। পারল না।
.
ঠিক যখন ট্রেনটা এসেছে, ইভা যখন ট্রেনে উঠতে যাবে তখন সে পিছনে উত্তেজিত একটা গলা শুনতে পেল, “আফা! আফা! দুই টেকি আফা!”
ইভা মাথা ঘুরিয়ে জালালকে দেখতে পায়। তার হাতে মুঠি করে ধরে রাখা অনেকগুলো নানা ধরনের নোট। জালাল ইভার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আফা, আপনের ভাংতি টাকা।”
ইভা টাকাগুলো নিল, অনেকগুলো ময়লা নোট, তার ভেতর থেকে দুই টাকার একটা নোট বের করে জালালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
জালাল নোটটা হাতে নিয়ে বলল, “আসলে আফা আপনারে খুইজা পাইছিলাম না। প্লাটফর্ম বদলি হইছে তো।”
ইভা জালালের চোখের দিকে তাকাতেই চোখটা নামিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমারে কেউ একশ টাকার ভাংতি দিতেও চায় না, হেই জন্যে–”
ইভা নরম গলায় বলল, “আমার দিকে তাকাও।”
জালাল ইভার দিকে তাকাল। ইভা বলল, “সত্যি করে বল দেখি কী হয়েছে?”
জালাল ইভার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে কোনো রাগ নেই, অভিযোগ নেই। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারে এই আপাকে সত্যি কথাটি বলা যায়। সে অপরাধীর মতো বলল, “আসলে আমি আপনার টাকা নিয়া ভাইগা গেছিলাম।”
“তারপর?”
“তারপর মনে হইল কামটা ঠিক হয় নাই। অন্যের লগে করা ঠিক আছে–আপনার লগে করা ঠিক হয় নাই।”
ইভা জালালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “নাম কী তোমার?”
“জালাল।”
“ভেরি গুড জালাল। যাও।”
“আফনে উঠেন আফা, আমি আফনার ব্যাগটা তুইলা দেই। টেরেন ছাইড়া দিব।”
ইভা ওঠার পর জালাল ইভার হাতে ব্যাগটা তুলে দিল।
.
ট্রেন ছেড়ে দেবার পর যখন সেটা মোটামুটি স্পিড় নিয়েছে, শহরের ঘিঞ্জি অংশটুকু পার হয়ে গ্রাম, ধানক্ষেত, গরু, রাখাল, নদী নৌকা এসব দেখা যাচ্ছে তখন ইভা শুনতে পেল কেউ একজন তাকে ডাকছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল কানাডার প্রফেসর।
ইভা কিছু বলার আগেই এনথ্রোপলজির প্রফেসর বলল, “আমি দেখেছি। দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখেছি।”
ইভা কিছু বলল না। মানুষটি বলল, “আমি হেরে গেলাম, কিন্তু আপনি একটা জিনিস জানেন?”
“কী?”
“আমি যদি টাকাটা দিতাম তা হলে মনে হয় ছেলেটা কোনোদিন ফিরে আসত না। সে ফিরে এসেছে কারণ টাকাটা দিয়েছেন আপনি।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।
কানাডার প্রফেসর বলল, “আমি মানুষটা একটু গাধা টাইপের। সেই জন্যে আপনার সাথে কম্পিটিশন করতে গিয়েছিলাম। আমার উচিত শিক্ষা হয়েছে।”
ইভা বলল, “আসলে–” বলে থেমে গেল।
মানুষটা বলল, “আসলে কী?”
“মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে মনে হয় কম্পিটিশন করতে হয় না। মানুষকে মনে হয় বিচার করতে হয় না। যখন যে যেভাবে আসে তাকে মনে হয় সেভাবে নিতে হয়। আমি তাই নেই।”
কানাডার প্রফেসরকে কেমন জানি বিমর্ষ দেখায়, সে অন্যমনস্কর মতো মাথা নাড়ল। তার এততদিনের হাইপোথিসিসে গোলমাল হয়ে গেছে–মানুষটার মনে হয় একটা সমস্যা হয়ে গেল। ইভার মনে হল : আহা বেচারা!
.
০৩.
সবুজকে দেখে জালাল অবাক হয়ে বলল, “ভাই, তুমি?”
সবুজ তার ময়লা দাঁত বের করে হেসে বলল, “হ। আমি।”
জালাল অবাক হয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে দেখে চেনাই যায় না। একটা জিন্সের প্যান্ট, বুকের মাঝে ইংরেজি কথাবার্তা লেখা একটা টি-শার্ট পায়ে টেনিস সু। পকেটে সিগারেটের প্যাকেট। জালাল বলল, “ভাই তুমারে দেইখা তো চিনাই যায় না!”
সবুজ কথার উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে ঘাড় মুছল তারপর মুখে একটা তাচ্ছিল্য টাইপের হাসি ফুটিয়ে বলল, “না চিনার কী আছে? আমার কী মাথার মাঝে শিং গজাইছে যে চিনবি না?”
সবুজ এই কয়দিন আগেও স্টেশনে তাদের একজন ছিল। ট্রেন এলে দৌড়ে ট্রেনে উঠত, ব্যাগ নেবার জন্যে কাড়াকাড়ি করত, আবর্জনা জঞ্জাল ঘেঁটে নানা ধরনের জিনিসপত্র বের করত-দরকার হলে একটু চুরি-চামারি একটু ভিক্ষা করত। রাত্রিবেলা সবার সাথে প্রাটফর্মে ঘুমাত। মাঝখানে হঠাৎ সে উধাও হয়ে গেল। কোথায় গেছে কেউ জানে না–এটা অবশ্যি নতুন কিছু না স্টেশনে যারা থাকে তাদের যাবার কোনো জায়গা নেই তাই সব জায়গাই তাদের জায়গা। কেউ স্টেশনে কিছুদিন থেকে হয়তো বাজারে থাকা শুরু করল, বাজার থেকে হয়তো মাজারে, মাজার থেকে হয়তো স্টেডিয়ামে! একবার পথে-ঘাটে থাকা অভ্যাস হয়ে গেলে তখন কোথাও আর থাকার সমস্যা হয় না। তাই স্টেশনে যারা থাকে তারা যে সবসময়ই স্টেশনে থাকে তা নয়-তারা যায় আসে। সেই জন্যে সবুজ যখন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল অন্যেরা এমন কিছু অবাক হয়নি। সবুজের বয়স তেরো চৌদ্দ এর কাছাকাছি, জালালের কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়ে থেকে একটু বেশি তাই তাদের সাথে যোগাযোগটা ছিল একটু কম। সবুজের ওঠা বসা ছিল একটু বড়দের সাথে যারা একটু মাস্তান টাইপের, যারা মুখ খারাপ করে গালাগাল করতে পারে, যারা ধুমসে বিড়ি-সিগারেট খায় তাদের সাথে। তারপরেও এক স্টেশনে এক পাটফর্মে যারা ঘুমায় তাদের মাঝে একটা সম্পর্ক থাকে।
জালাল বলল, “ভাই, কই থাক এখন?”
সবুজ সরাসরি উত্তর না দিয়ে ঘাড় নাড়াল, চোখ নাচাল যেটার মানে যা কিছু হতে পারে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে খুব কায়দা করে সেটাকে ধরাল। তারপর একটা টান দিয়ে খক খক করে কাশতে লাগল-বোঝাই যাচ্ছে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা সে এখনো শিখতে পারে নাই তাই কায়দা-কানুনটাই হচ্ছে এখন আসল ব্যাপার।
সবুজ ধোয়া ছেড়ে বলল, “তরার খবর কী?”
“ভালা।”
“রোজগারপাতি কী রকম?”
“বেশি ভালা না। কুনো পাবলিক টেহা-পয়সা দিবার চায় না।”
সবুজ বড় মানুষের মতো হা হা করে হাসল, হাসিটা অবশ্যি শুনতে ঠিক আসল হাসির মতো শুনাল না। মনে হল হাসিটাতে ভেজাল আছে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “হাস ক্যান?”
“হাসুম না? তুই ছাগলের মতো কথা কইবি আর আমি হাসুম না? পাবলিক কি তোর সমুন্দী লাগে যে তরে টেহা-পয়সা দিব?”
“তয় তুমি এতো টেহা-পয়সা কই পাও?” সবুজ রহস্যের মতো ভঙ্গি করে বলল, “পাবলিক কুনো দিন টেহা-পয়সা দেয়। পাবলিক হইল কিরপনের যম। কিন্তুক বাতাসের মাঝে টেহা উড়ে, তুই যদি জানস তা হইলে তুই সেই টেহা ধরবি আর পকেটে ঢুকাবি!”
জালাল বিষয়টা ঠিক বুঝল না, ভুরু কুঁচকে বলল, “বাতাসে টেহা উড়ে?”
“হ।“
“তুমি হেই টেহা ধর আর পকেটে ঢুকাও?”
সবুজ মাথা নাড়ল। জালাল বলল, “আমারে দেহাও টেহা কোনখানে উড়ে আমিও ঢুকাই।”
“দেখবার চাস?”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “হ।”
“ঠিক আছে তুই যদি দেখবার চাস তা হইলে তোরে দেখামু। তোরে শিখামু কিন্তুক তুই সেইটা কাউরে কইতে পারবি না।”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “কমু না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“আল্লাহর কিরা?”
“আল্লাহর কিরা।”
কেমন করে বাতাসে উড়তে থাকা টাকা ধরতে হয় সবুজ তখনই সেটা বলতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মায়া আর জেবা এসে হাজির হল বলে বলতে পারল না। জেবা অবাক হয়ে বলল, “সবুজ বাই! তুমারে দেহি ইস্কুলের ছাত্রের মতো লাগে!”
মায়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল তারপর সাবধানে সবুজের শার্টটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল, “তুন সাট!”
সবুজ মায়ার হাত সরিয়ে বলল, “হাত সরা, ময়লা হাত দিয়া ধরবি না।”
জেবা হি হি করে হেসে বলল, “লতুন বড়লোক।”
সবুজ চোখ পাকিয়ে বলল, “ঢং করবি না।”
জেবা ছোট বড় মানে না, হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “বাই, ইস্কুল ছাত্রের কাপড় কোন বাড়ি থাইকা চুরি করছ?”
“চুরি করমু কেন? কিনছি।”
“কিনতে তো টেহা লাগে। তুমার টেহা আছে?”
“তুই কী মনে করস? আমার টেহা নাই?”
জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “থাকনের কথা না!”
সবুজ তখন প্যান্টের পিছন থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে জেবাকে খুলে দেখাল, ভেতরে অনেকগুলো নোট। জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝছি।”
“কী বুঝছস?”
“তুমি পকেট মাইরের ইস্কুলে ভর্তি হইছ। তুমি মাইনসের পকেট মার।”
“মারলে মারি। তোর সমিস্যা কী?”
“আমার কোনো সমিস্যা নাই। সমিস্যা তোমার। যেদিন ধরা খাইবা সেইদিন তোমারে পিটায়া মাইরা ফেলব। সাপরে যেইরকম মাইনসে পিটায়া মারে হেইভাবে।”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাদের সবার চোখের সামনে কয়েক মাস আগে এই স্টেশনে একজন পকেটমারকে পাবলিক পিটিয়ে শেষ করে দিয়েছিল। পুলিশ এসে কোনোভাবে পকেটমারটাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে, মানুষটা বেঁচে গেছে না মরে গেছে তারা জানে না।
সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “আমি পকেট মারি না।”
“তয় মানিব্যাগ কই পাইছ।”
“কিনছি।”
“টেহা কই পাইছ?”
“রোজগার করছি।”
“কেমনে? তুমি কী জজ-বেরিস্টরের চাকরি কর?” কথা শেষ করে জেবা হি হি করে হাসতে থাকে।
সবুজ চোখ পাকিয়ে জেবার দিকে তাকিয়ে তাকে একটা খারাপ গালি দিল। জেবা গালিটা গায়ে মাখল না, মায়াকে বলল, “আয় মায়া যাই।”
মায়া সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমার এতো টেহা। আমরারে বিরানী খাওয়াও।”
সবুজ বলল, “যা ভাগ।”
“তা হইলে ঝাল মুড়ি খাওয়াও।”
“ভাগ। না হইলে মাইর দিমু।”
মায়া জিব বের করে সবুজকে একটা ভেংচি দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সবুজ তার সিগারেটে আরো একটা টান দিয়ে আরেকবার কেশে উঠে সিগারেটটা জালালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে। খা।”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্।”
সবুজ তখন শুকনো মুখে সিগারেটটা হাতে নিয়ে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে আবার সিগারেটটাতে টান দেয়।
জালাল বলল, “বাই। তুমি টেহা উড়ার কথা বইলতে চাইছিলে।”
সবুজ গম্ভীর মুখে বলল, “কমু। কিন্তুক সাবধান।”
“ঠিক আছে। সাবধান।”
.
সবুজ আকাশে টাকা উড়ার বিষয়টা জালালকে বলল দুইদিন পর। সেটা বলার জন্যে জালালকে অবশ্যি সবুজের পিছন পিছন রেল লাইন ধরে অনেক দূর হেঁটে যেতে হল। শহরের বাইরে একটা নিরিবিলি জায়গায় কালভার্টের উপর বসে সবুজ বিষয়টা জালালকে বোঝাল। শহরে হেরোইন ব্যবসায়ী আছে, সবুজ তাদের হেরোইন আনা-নেওয়ার কাজে সাহায্য করে–এই কাজে অনেক টাকা।
জালাল জানতে চাইল, কেমন করে আনা-নেওয়া করে, মাথায় করে না কী ঠেলা গাড়ি করে? শুনে সবুজ হি হি করে হাসল, বলল, হেরোইন সোনা থেকে দামি, একটা ছোট প্রাস্টিকের ব্যাগে পাঁচ-দশ লাখ টাকার হেরোইন থাকে। স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়, ছোট মানুষ বলে কেউ সন্দেহ করে না। ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিলেই নগদ টাকা। জালাল জানতে চাইল হেরোইন দেখতে কী রকম, সবুজ জানাল দেখতে সাদা রঙের দেখে মনে হয় গুড়া সাবান। জালাল জানতে চাইল হেরোইন কেমন করে খায়। সবুজ তখন কেমন করে মানুষ হেরোইন নেয় সেটা অভিনয় করে দেখাল। জালাল তখন জানতে চাইল মানুষ কেন হেরোইন খায়, সবুজ তখন বলল নেশা করার জন্যে। জালাল তখন জানতে চাইল সবুজ কখনো হেরোইন খেয়েছে কি না। সবুজ তখন হঠাৎ রেগে উঠে বলল সে কেন হেরোইন খাবে? সে কি হেরোইনখোর? জালাল তখন আর কোনো প্রশ্ন করল না।
সবুজ তখন তার সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিল আর জালাল তখন একটু অবাক হয়ে দেখল সবুজ আগের মতো কেশে উঠল না। সবুজ কালভার্টের উপর থেকে নিচের খালে থুতু ফেলে বলল, “তোরে আসলে এখনো আসল কথাটা কই নাই।”
“কী কথা?”
“কাউরে কইবি না তো?”
জালাল মাথা নাড়ল, “কমু না।”
সবুজ তখন জালালকে দিয়ে নানা রকম কিরা-কসম কাটিয়ে নিল, তারপর বলল, “আমি যখন হেরোইন আনা-নেওয়া করি তখন হেরোইনের প্যাকেট থেকে এক চিমটি হেরোইন সরায়া রাখি–কেউ টের পায় না। এই রকমভাবে আস্তে আস্তে যখন একটু বেশি হইব তখন আমি নিজে হেরোইনের ব্যবসা শুরু করুম।”
“তুমি নিজে শুরু করবা?”
“হ্যাঁ।”
“কার কাছে বেচবা?”
“পাবলিকের কাছে। হেরোইনখোরের কাছে।”
জালাল অবাক হয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা যখন স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমায় তখন তাদের সবচেয়ে বড় বড় বিপদ দুই জায়গা থেকে আসে, এক হচ্ছে পুলিশ আর দুই হচ্ছে হেরোইনখোর। যখনই তারা ক্ষ্যাপা কোনো মানুষ দেখে ধরেই নেয় সেই মানুষগুলো হচ্ছে হেরোইনখোর। সবুজ সেই হেরোইনখোরদের কাছে হেরোইনের ব্যবসা করবে শুনে জালালের হাত-পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
সবুজ তার সিগারেটে টান দিয়ে নাক দিয়ে ধোয়া ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি জালাইল্যা, হেরোইন হইল গিয়া সোনার থেকে দামি–এই মনে কর এক কাপ হেরোইনের পাইকারি দাম হচ্ছে কম পক্ষে পাঁচ লাখ টাকা। খুচরা আরো বেশি।”
“তোমার কাছে কয় কাপ আছে?”
সবুজ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিগারেটে আবার টান দিল। বলল, “তুই করবি বিজনেস?”
“ভাই, ডর করে।”
“ডরের কী আছে। আমি আছি না। তুই পয়লা আমার সাথে থাকবি তারপরে নিজে নিজে করবি।”
জালাল কিছু বলল না, হেরোইনখোরদের নিয়ে সে যত ভয়ংকর গল্প শুনেছে সেগুলো জেনে শুনে তার এই বিজনেসে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু সবুজকে সেটা বলতেও তার সাহস হল না। তাকে বিশ্বাস করে সবুজ সব কথা বলেছে এখন সেখান থেকে পিছিয়ে যাওয়া রীতিমতো বিশ্বাসঘাতকের কাজ হবে।
.
সবুজ আবার কয়েকদিনের জন্যে উধাও হয়ে গেল। কয়েকদিন পর আবার যখন স্টেশনে ফিরে এসেছে তখন তার চেহারা আরো খোলতাই হয়েছে। টি-শার্টের উপর গোলাপি একটা শার্ট, শুধু তাই না, বাম হাতে একটা ঘড়ি। এবারে অবশ্যি সবুজকে আগেরবারের মতো নিজেকে জাহির করতে দেখা গেল না, কথাবার্তা বলল কম আর তাকে কেমন জানি চিন্তিত দেখাল।
জালাল একদিন সবুজকে আবিষ্কার করল গোডাউনের পিছনে। এমনিতে সেখানে কেউ যায় না, জায়গাটা নির্জন একটু অন্ধকার। জালাল যখন মাঝে মাঝে তার গোপন টাকা গুনতে চায় এখানে এসে গুনে যেন কেউ দেখতে না পায়। সেখানে সবুজকে দেখে জালাল যেরকম চমকে উঠল, জালালকে দেখে সবুজও সেরকমভাবে চমকে উঠল। সবুজ জালালকে ধমক দিয়ে বলল, “কী করস এইখানে?”
জালালের মনে হল সেও সবুজকে একই প্রশ্ন করতে পারে কিন্তু সাহস করল না। আমতা আমতা করে বলল–”সকালবেলা ডাইলপুরি খাইছিলাম, বাসি মনে হয়। পেটের মাঝে মোচড় দিছে তাই এইখানে আসছিলাম ইয়ে করতে–”
খুবই বিশ্বাসযোগ্য কথা, নিরিবিলি জায়গা বলে অনেকেই এখানে”ইয়ে” করতে আসে, সবসময়ই এখানে চাপা দুর্গন্ধ। সবুজ জালালের কথা বিশ্বাস করল তখন জালাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী কর এইখানে?”
“এই তো–” বলে হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে সবুজ হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছন ফিরে দেখল তারপর গোডাউনের পিছন থেকে বের হয়ে গেল। জালাল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর তার প্যান্টের শেলাইটা খুলে সেখান থেকে তার দুমড়ানো-মমাচড়ানো নোটগুলো বের করে গুনতে শুরু করে।
.
রাত্রিবেলা সবাই দুই নম্বর প্লাটফর্মে শুয়েছে। এখন কোন মাস কে জানে একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ির মাঝে থাকে তাই শোয়ার সাথে সাথে সবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। জালাল ঘুমিয়েই ছিল হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল, কুক্কু তার কাপড় কামড়ে ধরে তাকে টানছে।
জালাল চোখ খুলতেই কুক্কু চাপা স্বরে ডাকল, কেমন যেন ভয়ার্ত একটা ডাক, লেজটা নোয়ানো কান দুটো পিছনে, দেখে মনে হয় কিছু একটা দেখে কুক্কু ভয় পেয়েছে। জালাল ঘুম ঘুম চোখে কুক্কুকে কাছে টেনে এনে পাশে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, কুক্কু শুতে চাইল না, চাপাস্বরে গরগর করে শব্দ করল তারপর লেজ নামিয়ে জালালের চারপাশে হাঁটতে থাকে, পা দিয়ে মাটি আচড়ায়। জালাল বুঝতে পারল কুক্কু তাকে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মানুষের মতো কথা বলতে পারে না বলে বলতে পারছে না। জালাল উঠে বসে বলল, “কী হইছে?”
কুক্কু কয়েক পা হেঁটে গেল তারপর দূরে তাকিয়ে থেকে মাথা উঁচু করে ঘেউ ঘেউ করে ডাকল। তারপর হঠাৎ করে মাথা নামিয়ে জালালের কাছে ফিরে এল। আকারে-ইঙ্গিতে আবার কিছু বলার চেষ্টা করছে। জালাল মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, “গুলমাল?”
কুক্কু মাথা নেড়ে কুঁই কুঁই শব্দ করল, যার অর্থ যা কিছু হতে পারে। জালাল বলল, “আমি যামু তোর লগে?”
কুক্কু আবার মাথা নিচু করে চাপা ভয়ের শব্দ করল। জালাল তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কুক্কু কিছু একটা বলতে চাইছে, ব্যাপারটা মনে হয় খারাপ কিন্তু তার আর কিছু করার নেই। ব্যাপারটা কী হতে পারে চিন্তা করতে করতে জালাল ঘুমিয়ে গেল। কুক্কু অবশ্যি ঘুমাল না। দুই পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে বসে রইল। একটু পর পর চাপা স্বরে ভয়ার্ত একটা শব্দ করতে লাগল।
ভোরে মায়ার চিৎকারে জালালের ঘুম ভেঙে গেল, মায়া রেল লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে, তার চোখে-মুখে অবর্ণনীয় আতংক। তার ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে চিৎকার করতে করতে আসছে, কী বলছে কেউ বুঝতে পারছে না। সে ভয়ে ঠিক করে কথা বলতেও পারছিল না, আতঙ্কের এক ধরনের শব্দ ছাড়া মুখ থেকে আর কিছু বের হচ্ছে না। জেবা ছুটে গিয়ে মায়াকে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে?”
মায়া কথা না বলে থরথর করে কাঁপতে থাকে। জেবা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হইছে?”
“মাইরা ফালাইছে।”
“মাইরা ফালাইছে? কে মাইরা ফালাইছে? কারে মাইরা ফালাইছে।”
“সবুজ ভাইরে।” বলে মায়া হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
কুক্কু দাঁড়িয়ে জালালের দিকে তাকিয়ে দুইবার ডাকল, জালালের মনে হল কুক্কু স্পষ্ট করে বলল, “আমি তোমারে রাত্রেই বলছিলাম। আমার কথা তুমি বিশ্বাস করলা না।”
প্লাটফর্মে শুয়ে থাকা অনেকে তখন উঠে রেল লাইন ধরে দৌড়াতে থাকে। আউটার সিগন্যালের কাছে একটা ছোট ঝোঁপের পাশে সবুজ পড়ে আছে। তার জিন্সের প্যান্ট, লাল শার্ট, টেনিস সু এমনকি হাতের ঘড়িটাও আছে। সবুজের পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় যে সে বেঁচে নেই।
জালাল ভয়ে ভয়ে একটু কাছে যায়, ঠোঁটের কোনায় একটু রক্ত শুকিয়ে আছে। চোখগুলো আধখোলা। সেই আধখোলা চোখে কোনো প্রাণ নেই-কী ভয়ংকর সেই প্রাণহীন দৃষ্টি! কুক্কু কাছে গিয়ে সবুজকে শুকলো তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে একবার ডাকল। এ ছাড়া আর কেউ কোনো কথা বলল না।
.
সবাই একটু দূরে মাটিতে চুপচাপ বসে থাকে। কী করবে তারা কেউ বুঝতে পারছে না। আস্তে আস্তে একজন দুইজন বড় মানুষ এসে হাজির হতে থাকে, চাপা গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে। কী হয়েছে কেন সবুজকে মেরে ফেলেছে কেউ বুঝতে পারছে না। শুধু জালাল জানে কী হয়েছে, কিন্তু সে কাউকে এটা বলতে পারবে না। হেরোইন ব্যবসায়ীরা সবুজের ব্যবসার কথা টের পেয়ে গেছে। সবুজের খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা ছিল, এই রকম ইচ্ছা মনে হয় খুবই ভয়ংকর। তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়া যদি এতো সোজা হত তা হলে মনে হয় সবাই বড়লোক হয়ে যেত। সেই জন্যে মনে হয় পৃথিবীতে বড়লোক মানুষ বেশি নাই, সেই জন্যেই মনে হয় অনেক মানুষকে প্লাটফর্মে ঘুমাতে হয়।
পুলিশের লোক এসে চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে সবুজের শরীরটা না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত জালাল, জেবা, মায়া, মজিদ তারা সবাই সেখানে বসে থাকে। আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এসে গেল আবার চলেও গেল, আজকে কেউ সেই ট্রেনে গিয়ে ছোটাছুটি করল না।
.
দুপুরের দিকে মজিদ খবর আনল বিকালবেলা সবুজের লাশ কাটাকুটি করার জন্যে লাশকাটা ঘরে আনবে। মায়া চোখ কপালে তুলে বলল, “ক্যান? লাশ কাটাকুটি করবি ক্যান?”
মজিদ গম্ভীর হয়ে বলল, “মার্ডার হলি লাশ কাটতি হয়। দেখতি হয় কেমনি
মার্ডার হল আগেই যে আবার কাটা
একদিন আগেই যে পুরোপুরি একজন মানুষ ছিল এখন সে শুধু যে একটা লাশ তাই নয়–সেই লাশ আবার কাটাকুটি করা হবে চিন্তা করেই সবাই কেমন জানি মন মরা হয়ে যায়।
মজিদ বলল, “বেওয়ারিশ লাশ। মনে অয় হাসপাতালে বিক্রি করি দিবি।”
মায়া জিজ্ঞেস করল, “বেওয়ারিশ কী?”
জেবা বলল, “যেই লাশের কুনো মালিক নাই সেই লাশ হইল বেওয়ারিশ।”
“লাশের মালিক ক্যামনি অয়?”
“মা বাপ ভাই বুন হইল মালিক। যার মা বাবা ভাই বুন নাই, তার লাশের কুনো মালিক নাই।”
মায়া চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে, এই স্টেশনে যারা থাকে তাদের কারোই মা বাবা ভাই বোন নাই, থাকলেও তাদের খোঁজ নাই। তার মানে তার চারপাশে যারা আছে তারা সবাই বেওয়ারিশ?
জালাল মজিদকে জিজ্ঞেস করল, “লাশকাটা ঘরে যাবি?”
মজিদ প্রথমে একটু অবাক হল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “যামু।”
জেবা বলল, “আমিও যামু।”
মায়া বলল, “আমিও।”
কিছুক্ষণের মাঝেই স্টেশনের বাচ্চাদের ছোট একটা দল লাশকাটা ঘরের দিকে রওনা দিল। দলটার সামনে কুক্কু এবং কুকুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল সে খুব ভালো করে জানে কোথায় যেতে হবে এবং সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সবার একটা ধারণা ছিল যে লাশকাটা ঘরটা হবে ফাঁকা একটা মাঠের মাঝখানে ঝোঁপঝাড় গাছপালা দিয়ে ঢাকা ছোট একটা অন্ধকার ঘর। কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে তারা যে জায়গায় হাজির হল সেটা সরকারি হাসপাতাল। সাদা রঙের একটা বিল্ডিংয়ের একপাশে একটা একতলা বিল্ডিং না কী লাশকাটা ঘর। আশেপাশে আরো বিল্ডিং, সেখানে মানুষজন যাচ্ছে আসছে দেখে মনেই হয় না এইখানে একটা লাশকাটা ঘর থাকতে পারে। বিল্ডিংয়ের সামনে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, জালাল সাহস করে পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করল, “এইখানে কি আমাগো সবুজের লাশ কাটব?”
পুলিশটা ভালো করে তার কথা শুনলই না, খেঁকিয়ে উঠে বলল, “যা বদমাইশের বাচ্চা। ভাগ।”
|||||||||| কুক্কু কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা পুলিশের দিকে তাকিয়ে রাগি রাগি গলায় চাপা একটা শব্দ করল, সেটা শুনে মনে হয় পুলিশটাও একটু ভয় পেল। তখন জেবা এগিয়ে এসে ক্যাটক্যাটে গলায় বলল, “আফনেরে একটা জিনিস জিগাই তার উত্তর দেন না কিল্লাই। আমাগো ভাই মরছে আমাগো দুঃখু অয় না?”
পুলিশটা কিছুক্ষণ জেবার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “কী জিজ্ঞেস করলি?”
জালাল বলল, “সবুজ ভাইয়ের লাশ এইখানে কাটব?”
পুলিশ ভুরু কুঁচকিয়ে বলল, “স্টেশনে যেটা মার্ডার হয়েছে?”
“জে।”
“তার নাম সবুজ? তোরা চিনিস?”
“জে।”
“কেমন করে মারা গেছে তোরা জানিস?”
সবাই মাথা নেড়ে বলল তারা জানে না। পুলিশটার তখন তাদের নিয়ে সব কৌতূহল শেষ হয়ে গেল। সে খুব যত্ন করে নাকের একটা লোম ছিঁড়ে বলল, “হ্যাঁ। ছেলেটার এইখানে পোস্টমর্টেম হচ্ছে।”
ওরা পোস্টমর্টেম বলে এই ইংরেজি শব্দটা আগে কখনো শুনেনি কিন্তু বুঝে গেল এটার মানে হচ্ছে লাশ কাটা। মায়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “সবুজ ভাইয়ের লাশরে কয় টুকরা করব?”
পুলিশটা একটু অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, “ধুর বোকা মেয়ে! এই একটুখানি কাটবে তারপর আবার সেলাই করে দিবে। দেখে বোঝাই যাবে না।”
মায়া কী বুঝল কে জানে, ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। জেবা তখন মায়াকে ধরে সরিয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মায়া একটু শান্ত হওয়ার পর ওরা সবাই মিলে বিল্ডিংটার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কেন বসে আছে কেউ জানে না।
কুক্কু বেশ উত্তেজিত হয়ে আশেপাশে ঘুরতে থাকে। তাকে দেখে বোঝা যায় কোনো একটা কারণে সে এই জায়গাটাকে মোটেই পছন্দ করতে পারছে না। সারাক্ষণ এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে একটু পরপর চাপা গলায় গরগর করছে, হঠাৎ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রাগি চোখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। জালাল কুক্কুকে ধরেও থামিয়ে রাখতে পারে না, কী হয়েছে কে জানে।
বেশ খানিকক্ষণ পর লাশকাটা ঘরের কলাপসিবল গেট খুলে একজন মানুষ বের হয়ে পুলিশটাকে কী যেন বলল, পুলিশটা তখন পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে হাতে নিয়ে লাশকাটা ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পর সে বের হয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে জানি কোথায় চলে গেল।
বাচ্চাগুলো কী করবে বুঝতে পারল না। তারা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, ঘরটার ভেতরে ঢুকবে কী না বুঝতে পারছিল না। একটু এগিয়ে গিয়ে তারা কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়ায়।
ঠিক তখন একটা মোটর সাইকেল বিকট শব্দ করে লাশকাটা ঘরের সামনে এসে থামে। ঠিক কী কারণ জানা নেই মানুষ দুইজনকে দেখেই জালালের বুকটা ধক করে ওঠে। মানুষ দুইজনের বয়স বেশি না, একজন শ্যামলা অন্যজন অসম্ভব ফরসা। শ্যামলা মানুষটা মোটর সাইকেল চালাচ্ছিল, সে বসেই রইল। ফরসা মানুষটা মোটরসাইকেল থেকে নেমে এদিক-সেদিক তাকায়, বাচ্চাদের দিকে চোখ পড়তেই সে লম্বা পায়ে তাদের দিকে আসতে থাকে। জালাল দেখল ফরসা মানুষটার লালচে রংয়ের চুল, চুল ছোট করে ছাটা। চোখে কালো চশমা। হাতে একটা চাবির রিং সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে ফর্সা মানুষটা ওদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কি স্টেশনের লাফাংরা?”
লাফাংরা শব্দটার মানে কী কেউ জানে না কিন্তু তারা ধরেই নিল শব্দটা দিয়ে তাদেরকেই বোঝানো হচ্ছে। তাই তারা সবাই ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল।
“হারামির বাচ্চা সবুজরে তোরা চিনিস?”
জালাল চমকে ওঠে। গতরাতে যাকে মেরে ফেলা হয়েছে তাকে আজকে বিকেলে হারামির বাচ্চা ডাকার মাঝে এক ধরনের ভয়ের ব্যাপার আছে। সেটা সবাই টের পেয়ে গেল, তাই কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা ধমকে উঠল, “কথা বলিস না কেন?”
জালাল বলল, “জে চিনি।”
“তোদের কারো কাছে সবুজ কিছু দিয়ে গেছে?”
জিনিসটা কী হতে পারে জালাল সাথে সাথে অনুমান করে ফেলে। অন্যরা কিছু বুঝল না। জেবা জিজ্ঞেস করল, “কী দিয়া যাইব?”
“একটা প্যাকেট। পাস্টিকের প্যাকেট। ভেতরে সাদা গুড়া। সাবানের গুড়ার মতো।”
একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল, জালাল ছাড়া আর কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তাই জালাল মাথা নেড়ে বলল, “না।”
মানুষটা এবারে ছোট একটা গর্জন করে উঠে বলল, “ঠিক করে বল।” এবারে জেবা বলল, “ঠিক কইরাই কইতাছি। আমাগো কেউ কিছু দেয় নাই।”
“তা হলে সবুজের সাথে তোদের এতো খাতির কেন?”
“আমরা হগলে একসাথে থাকতাম হেই জন্যে খাতির।”
“সবুজ তোদের সাথে কী নিয়ে কথা বলত?”
এবারে সবাই চুপ করে রইল, সবুজ কী নিয়ে কথা বলত সেটা আলাদা করে কেউ মনে করতে পারল না। এটা কী রকম প্রশ্ন সেটা নিয়েই সবাই একটু চিন্তার মাঝে পড়ে যায়। শুধু জালাল আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে আর বুক ধক ধক করতে থাকে।
“তোদের মাঝে জালাল কার নাম?”
জালাল ভীষণভাবে চমকে উঠল, শুকনো মুখে বলল, “আমি।”
একেবারে কাগজের মতো ফর্সা মানুষটা এইবারে জালালের মুখের কাছাকাছি নিজের মুখটা নামিয়ে আনে, তারপর হিস হিস করে বলে, “আমি খবর পেয়েছি
সবুজ তোর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছে। কী নিয়ে কথা বলেছে?”
জালাল একটা জিনিস বুঝে গেল, তাকে কিছুতেই সত্যি কথাটি বলা যাবে না আর সে যে কথাটি বলবে সেই কথাটি এই মানুষগুলো বিশ্বাস করে কী না তার উপর নির্ভর করবে সে কী বেঁচে থাকবে না কী তাকেও সবুজের মতো মেরে ফেলবে। পথে-ঘাটে বেঁচে থাকার জন্যে তারা হাজার রকম মিথ্যা কথা বলে কিন্তু আজকের মিথ্যা কথাটা হতে হবে একেবারে অন্যরকম।
মানুষটা হুংকার দিল, “বল, কী নিয়ে কথা বলে?”
“টেহা-পয়সা নিয়া। তার কতো টেহা-পয়সা হে কতো আরামে থাকে হেই সকল কথা কইতো।”
ফর্সা মানুষটা চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে তার মুখটা জালালের মুখের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। মুখটা এতো কাছ এনেছে যে জালাল তার চোখের সাদা জায়গায় চোখের শিরাগুলো পর্যন্ত দেখতে পায়। সেগুলো লাল হয়ে ফুলে আছে মনে হয় এক্ষুনি ফেটে রক্ত বের হয়ে আসবে। মানুষটা হিংস্র গলায় বলল, “সবুজ কেমন করে টাকা কামাই করতো?”
জালাল একটা নিশ্বাস ফেলে প্রথম সত্যিকারের মিথ্যা কথাটা বলল, “আমি তারে অনেকবার জিগাইছি হে কইতে রাজি হয় নাই।”
“রাজি হয় নাই?”
“না।”
“কী বলেছে?”
জালাল প্রথম মিথ্যাটাকে বিশ্বাস করানোর জন্যে দ্বিতীয় মিথ্যা কথাটা বলল, “হে কইছে তারে পাঁচশ টেহা দিলে কইব।”
“পাঁচশ টাকা?”
“হ।”
হঠাৎ করে কিছু বোঝার আগে ফর্সা মানুষটা খপ করে জালালের বুকের কাছে শার্টটা খামচে ধরে তার গালে প্রচণ্ড জোরে একটা থাবা দিয়ে তাকে হ্যাঁচকা টানে উপরে তুলে বলল, “তুই আমার সাথে রংবাজি করিস?”
মানুষটা কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেল। কুক্কু এতোক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে পুরো ঘটনাটি দেখছিল, জালাল সারাক্ষণ তার চাপা গরগর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ফর্সা মানুষটা জালালের মুখে মেরে বসার সাথে সাথে কুক্কু গর্জন করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কুক্কু মানুষটার গলার কাছে কোথাও কামড়ে ধরার চেষ্টা করে–মানুষটা আতঙ্কে চিৎকার করে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টে পড়ে যায়। কুক্কু তার বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে কামড়ে ধরার চেষ্টা করে। মানুষটা দুই হাতে কুকুর মুখটাকে ধরে সরানোর চেষ্টা করে। অন্য যে মানুষটা মোটর সাইকেলে বসেছিল সেও মোটর সাইকেল থেকে নেমে ছুটে আসার চেষ্টা করে।
মজিদ, জেবা, মায়া আর অন্যরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল। জালালেরও পালানোর এই হচ্ছে সুযোগ সেও এখন ছুটে পালিয়ে যেতে পারে–কিন্তু জালাল বুঝতে পারে এখান থেকে ছুটে পালালেও সে এই মানুষগুলো থেকে ছুটে পালাতে পারবে না। তাই সে পালাল না, চিৎকার করে বলল, “কুক্কু! সরে যা।” তারপর কুকুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টেনে সরিয়ে আনে।
কুক্কু ফর্সা মানুষটাকে ছেড়ে দিল কিন্তু হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে গরগর শব্দ করতে থাকল। ফর্সা মানুষটার মুখে মাটি, গলায় আঁচড়ের দাগ, জামা-কাপড়ে ময়লা–সে এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে জালাল আর কুকুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে ময়লা ঝেড়ে পরিষ্কার করতে থাকে। কুকুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে বলে জালালের দিকে খানিকটা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, “এইটা তোর কুকুর?”
“জে। কুত্তার বুদ্ধি তো বেশি হয় না–মনে করছে আমার বিপদ।”
মানুষটা কোমরে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জালালের দিকে তাকাল, “সবুজ তোকে আর কিছু বলে নাই? তুই সত্যি কথা বলছিস!”
“জে। একেবারে সত্যি কথা। আমি দুইশো পর্যন্ত দিতে রাজি হইছিলাম, হে রাজি হয় নাই।”
“রাজি হয় নাই?”
“না।” জালাল নিশ্বাস ফেলে বলল, “মনে অয় ভালাই হইছে আমারে কিছু কয় নাই। কামটা নিশ্চয়ই অনেক বিপদের। আমারও মনে হয় বিপদ হইতো।”
ফর্সা মানুষটা তার গলায় হাত বুলাতে বুলাতে মোটর সাইকেলে ওঠে। মোটর সাইকেলটা গর্জন করে উঠল, ফর্সা মানুষটা বলল, “তোর কুকুরটা আমার কাছে বেচবি?”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “জে না।”
মানুষ দুইজন মোটর সাইকেলে চলে যাওয়ার সাথে সাথে নানা কোনা থেকে জেবা, মজিদ, মায়া আর অন্যেরা বের হয়ে আসে, তাদের চোখে-মুখে একসাথে বিস্ময় আর আনন্দ। তারা সবাই ছুটে এসে জালালকে জাপটে ধরল, জেবা বলল, “এরা সবুজরে মাইরা ফালাইছে?”
“মনে অয়।”
“তোরেও মাইরা ফালাব?”
“ধুর। আমারে ক্যান মাইরা ফালাবে? আমি কী করছি?”
“তা অইলে তর কাছে কেন আইছে?”
“আমি কী জানি?” মায়া বলল, “পুলিশে এগো ধরে না ক্যান?”
কেউ মায়ার প্রশ্নের উত্তর দিল না, ছোট বলে এখনো কিছুই জানে না কয়দিনের মাঝে জেনে যাবে পুলিশ কাকে ধরে আর কাকে ধরে না।
.
লাশকাটা ঘরের কোলাপসিবল গেটের কাছে গাট্টাগোট্টা কালো মতোন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা এখানে ভিড় জমাইছিস ক্যান।”
জেবা বলল, “আমরা সবুজ ভাইরে দেখতে আইছিলাম।”
মানুষটা কয়েক সেকেন্ড কী একটা ভাবল, তারপর বলল, “ডরাইবি না তো?”
জালালের বুকটা ধক করে উঠল, তারপরেও মুখে সাহস এনে বলল, “না।”
“তা হলে আয়। কোনো গোলমাল করবি না, শব্দ করবি না।”
ওরা লাশকাটা ঘরে ঢোকে, ভিতরে ওষুধের ঝাঁঝালো গন্ধ, ছোট একটা ঘর পার হয়ে তারা বড় একটা ঘরে গেল, সেখানে কংক্রিটের টেবিলে একটা লাশ লাল চাদর দিয়ে ঢাকা। চাঁদরে ছোপ ছোপ রক্ত। মানুষটা চাদর তুলে লাশটার মুখটা বের করে দিল।
কংক্রিটের টেবিলে সবুজ শুয়ে আছে। মাথার উপর সেলাই-গলা দিয়ে বুক পর্যন্ত সেলাই। কী ভয়ংকর একটা দৃশ্য! মায়া একটা চিৎকার করে জেবাকে জাপটে ধরল। জেবা সাথে সাথে তার মুখ চেপে ধরে তাকে বাইরে নিয়ে যায়। অন্যেরা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, জালাল একটু কাছে গিয়ে সবুজকে স্পর্শ করল, কী আশ্চর্য, শরীরটা বরফের মতো ঠাণ্ডা। ঠিক কী কারণ কে জানে জালালের মনে হয় সবুজকে এভাবে মেরে ফেলার জন্যে সে কোনো না কোনোভাবে দায়ী! সে যদি ঠিক করে চেষ্টা করত তা হলে সবুজকে হয়তো এভাবে মরতে হত না। জালাল সবুজের বরফের মতো ঠাণ্ডা শরীরটা ছুঁয়ে ফিস ফিস করে বলল, “আমারে মাপ কইরা দিও সবুজ ভাই।”
.
সেদিন রাত্রে তারা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কেউ কোনো কথা বলছে না। তবু সবারই মনে হচ্ছে প্রাটফর্মের বেঞ্চে সবুজ পা দুলিয়ে বসে তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।