ক্রান্তিকাল – প্রফুল্ল রায়
অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ২০০৩
দে’জ পাবলিশিং কলকাতা ৭০০ ০৭৩
KRANTIKAL A Bengali Novel by PRAFULLA ROY Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Dey’s Publishing 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata 700 073
প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তকমেলা জানুয়ারি ১৯৯৮, মাঘ ১৪০৪
দ্বাদশ সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৭, বৈশাখ ১৪২৪
.
সবে নভেম্বরের শুরু। কিন্তু এরই মধ্যে বিকেলের আয়ু ফুরোতে না ফুরোতে সীমান্তের এই শহরটিতে চিনির মিহি দানার মতো হিম ঝরতে থাকে। দূরে, আকাশ যেখানে ঝুঁকে অনেকখানি নেমে এসেছে ঠিক সেইখানটায় পাহাড়ের উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো একটা লাইন স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলা রোদের ঝকমকে আলোয় পাহাড়গুলোকে নীল মেঘপুঞ্জের মতো দেখায়। কিন্তু বেলা পড়ে এলে রোদের রং যত ফিকে হয়, ওগুলোও দ্রুত ঝাপসা হতে থাকে। পাহাড়ের রেঞ্জটাকে তখন আবছা একটা পেনসিল স্কেচের মতো মনে হয়।
সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে। যদিও হিম ঝরতে শুরু করেছে, তবু দিনের আলো একেবারে নিভে যায়নি। হঠাৎ লজ্জা-পাওয়া কিশোরীর আরক্ত মুখের মতো একটু আধটু লালচে আভা আকাশের গায়ে এখনও লেগে আছে। কিন্তু কতক্ষণ আর? খানিক পরেই ঝপ করে নেমে আসবে সন্ধে। কুয়াশা আর অন্ধকারে ডুবে যাবে সমস্ত চরাচর।
নভেম্বরের গোড়া থেকে সারাদিন সারারাত এখানে উত্তুরে হাওয়া বয়ে যায়। দিনের দিকটায় রোদের তাত থাকায় ততটা গায়ে লাগে না, কিন্তু বিকেলের পর থেকে চামড়া কুঁড়ে যেন হাড়ের ভেতর পর্যন্ত ছুরির ছুঁচলো ফলার মতো বিধে যায়।
সাতচল্লিশের আগে সীমান্তের এই শহরটা ছিল দেশীয় রাজ্য প্রতাপপুর স্টেটের রাজধানী। রাজ্যের নামেই রাজধানীর নাম। অর্থাৎ প্রতাপপুর স্টেটের ক্যাপিটাল প্রতাপপুর সিটি।
স্বাধীনতার আগে, শুধু আগেই বা কেন, তার পরেও বেশ কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটিটা ছিল ছবির মতো, পিকচার পোস্টকার্ডে ঠিক যেমনটা দেখা যায়। চওড়া চওড়া অ্যাসফাল্টের মসৃণ রাস্তা, দু’ধারে বাগানওলা বাংলো ধরনের বাড়ি, পার্ক, ফোয়ারা, দুই রাস্তার ক্রসিংয়ে শ্বেতপাথরের পরি। এছাড়া ছোট একটা জু-গার্ডেন, স্টেট লাইব্রেরি, ঝকঝকে হাসপাতাল, নানা ধরনের স্পোর্টসের জন্য একটা স্টেডিয়াম ইত্যাদি। যেদিকেই তাকানো যাক, তখন এখানে প্রচুর গাছপালা, ফুলের বাগান আর নির্জনতা। শহরটা যত বড়, সেই তুলনায় মানুষজন ছিল অনেক কম।
স্বাধীনতার পর অ্যাকসেসন অফ নেটিভ স্টেটস’ অর্থাৎ দেশীয় রাজ্যগুলো যখন ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হল, রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটল, তখন ক্রান্তিকাল থেকেই প্রতাপপুর সিটি তার পুরনো আভিজাত্য, সৌন্দর্য আর মর্যাদা খুইয়ে ফেলেছে।
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সেকালের পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল সীমান্তের এপারে। তার ধাক্কা এই প্রতাপপুরেও এসে লাগে। স্বাধীনতার পর যে দু-চারটে বছর রাজতন্ত্র চালু ছিল, জনস্রোত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তারপর আর পারা গেল না। প্রতাপপুর সিটি আমূল বদলে যেতে লাগল। যেখানে যত বাগান, পার্ক বা ফাঁকা জায়গা ছিল, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা সমস্ত কিছু দখল করে তুলতে লাগল ছিরিছাঁদহীন, বেঢপ চেহারার বাড়িঘর। রাজাদের সময় ভিক্টোরিয়ান আমলের ধাঁচে সন্ধের পর রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলত। পরে মিউনিসিপ্যালিটি সেগুলো তুলে ফেলে লম্বা লম্বা ল্যাম্পপোস্ট বসিয়ে তার গায়ে একটা করে বা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাল্বগুলোর বেশির ভাগই জ্বলে না। রাস্তাগুলো খানাখন্দে বোঝাই। দু’ধারের নর্দমা কত কাল যে সাফাই হয় না। বছরের পর বছর সেগুলোতে থকথকে কালচে রঙের তরল অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এইসব নদৰ্মা হল যাবতীয় রোগের জীবাণু আর মশাদের মেটার্নিটি হোম। রাস্তার মোড়ের শ্বেতপাথরের যে পরীগুলি একদা এই শহরে অলৌকিক স্বপ্ন নামিয়ে আনত, কবেই তারা উধাও হয়ে গেছে। চারিদিকে আবর্জনার পাহাড়। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে প্রতাপপুর সিটি এখন নোংরা, ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধে-ভরা এক শহর।
রাজতন্ত্র নেই, তবু রাজা আর রানীদের নাম এখানকার অনেক কিছুর সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে। যেমন, ‘রাজা বিক্রম সিংহ রোড’ বা ‘রানী স্বর্ণময়ী গার্লস কলেজ’ কিংবা ‘মহারাজা বীরেন্দ্র সিংহ হাসপাতাল’ ইত্যাদি। গণতন্ত্র পুরোমাত্রায় চালু হয়ে গেলেও প্রতাপপুর অদূর অতীতের রাজমহিমা একেবারে খারিজ করে দেয়নি, তার কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও সযত্নে ধরে রেখেছে।
এই শহরে পা দিলে প্রথমেই যা চোখে পড়বে সেটা রাজবাড়ি, যার নাম ‘প্রতাপপুর প্যালেস’। সিটির দক্ষিণ দিকের শেষ মাথায় পাঁচ একর জমির মাঝখানে গথিক স্থাপত্যের এই বিশাল দোতলা বাড়িটা মধ্যযুগের ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের কোনও রাজপ্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। লর্ড কার্জনের সময়ে তৈরি এই রাজবাড়িকে এখন ভগ্নস্তূপের মতো দেখায়। দেওয়ালে এবং ছাদে কত জায়গায় যে ফাটল ধরেছে, হিসেব নেই। পলেস্তারা খসে খসে দগদগে ঘায়ের মতো ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতে আর কার্নিসে অশ্বথেরা শিকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ। অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে। সামনের দিকে একধারে ছিল চমৎকার টেনিস লন, আরেক পাশে ফুলের বাগানের মাঝখানে বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। ফুলবাগান আর টেনিস কোর্টের চিহ্নমাত্র নেই। সেখানে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল। পেছন দিকে ছিল বাঁধানো দীঘি, সেটা কবেই মজে গেছে। জল শুকিয়ে যে তলানিটুকু পড়ে আছে তা আর দেখা যায় না, গুঁড়িপানা এবং ঢোলকলমির ঠাসবুনট চাদরের তলায় তা ঢাকা।
রাজবাড়ি, বাগান, দীঘি ইত্যাদি ঘিরে যে কম্পাউন্ড ওয়াল, নানা জায়গায় সেটা ভেঙেচুরে গেছে। রাস্তার দিকে মোটা গরাদওলা যে জমকালো লোহার গেটটা ছিল, রোদে জলে মরচে ধরে সেটার আয়ু প্রায় শেষ। গরাদগুলোর বেশ কয়েকটাই উধাও হয়ে গেছে। যেভাবে গেটটা হেলে আছে, যে কোনওদিন হুড়মুড় করে ঘাড় খুঁজে পড়ে যাবে।
আকাশের গায়ে যে ফ্যাকাসে আলোটুকু আটকে ছিল, চোখের পলকে কেউ যেন অদৃশ্য একটা ব্রাশ টেনে সেটা মুছে দিল। এই জায়গাটা এমনই, নভেম্বর মাসে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আর কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
ঠিক এই সময় ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দোতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিল সুবর্ণা আর দেবী। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই সিঁড়ি আধখানা বৃত্তের আকারে একতলার বিশাল হলঘরের ঠিক মাঝখান থেকে দোতলা হয়ে ছাদের দিকে চলে গেছে। এক সময় সিঁড়ি এবং হল-ঘর দামি কাশ্মিরি কার্পেট দিয়ে মোড়া ছিল। সিঁড়ির কার্পেট পায়ের ঘষায় কবেই উঠে গেছে, তার একটি সুতোও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। হলের কার্পেটটাও ছিঁড়ে খুঁড়ে বেশির ভাগটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু একধারে খানিকটা অংশ কোনওরকমে টিকে আছে। এক সময় ওটার রং ছিল টকটকে লাল, এখন শুকনো রক্তের মতো কালো, তার ওপর ইঞ্চিখানেক পুরু ধুলো।
হলঘরে সাবেক কালের ভারী ভারী আসবাব–সোফা, ডিভান, চেয়ার, পিয়ানো, আলমারি ইত্যাদি। সবই দামি মেহগনি কাঠের, কিন্তু কোনওটাই আস্ত নেই। পালিশও বহুকাল আগে নষ্ট হয়ে গেছে। রং-চটা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোতে রাজবংশের নানা প্রজন্মের কয়েকজনের বিরাট বিরাট অয়েল পেন্টিং। সিলিং থেকে যে প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে তার অগুনতি কাঁচের দীপাধারের মাত্র কয়েকটাই টিকে আছে। বাকিগুলো অনেক দিন আগে কখন ভেঙে পড়েছে, কেউ লক্ষ রাখেনি। ঝাড়লণ্ঠনটা এখন আর জ্বলে না। আলোর জন্য এধানের ওধারে ক’টা টিউব লাইট লাগানো হয়েছে। সেগুলো এই মুহূর্তে জ্বলছে, তবে বিশাল হলঘরটাকে পুরোপুরি আলোকিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। টিউব লাইটগুলো থেকে দূরে হলের কোণে কোণে আবছা অন্ধকার।
এবার সুবর্ণা আর দেবীর দিকে তাকানো যেতে পারে। সুবর্ণার বয়স সাঁইত্রিশ আটত্রিশ। লম্বা, টানটান চেহারা। গায়ের রং এক সময় ছিল রৌদ্রঝলকের মতো, এখন তার ওপর পাতলা, কালচে সরের মতো কিছু পড়েছে। ডিম্বাকৃতি মুখ। চিবুকের গঠনটি দৃঢ়, ঠোঁট ঈষৎ পুরু। বড় বড় চোখের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু দুরভেদী। চমৎকার স্বাস্থ্য তার। সুবর্ণার দিকে এক পলক তাকালেই টের পাওয়া যায়, সে প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এবং কোনওরকম বেচাল করে এর কাছে পার পাওয়া যাবে না।
সুবর্ণার পরনে হালকা রঙের কোটা শাড়ি আর বাদামি ব্লাউজের ওপর গরম পশমি চাদর জড়ানো, পায়ে পাতলা স্লিপার। বাঁ হাতের কবজিতে সরু ফিতেয় বাঁধা সুদৃশ্য ঘড়ি, ডান হাতে একটি মাত্র মোটা রুলি, গলায় লকেটওলা সোনার চেন।
দেবীর বয়স এগারো। সে সুবর্ণার একমাত্র মেয়ে। মায়ের পুরো আদলটি দেবীর চেহারায় বসানো। তেমনই চোখমুখ, নাক বা চিবুক। তার পরনে স্কার্ট আর ফুলহাতা জামার ওপর উলের পুলওভার। চুল হেয়ার-ব্যান্ড দিয়ে আটকানো, পায়ে মায়ের মতোই ঘরে পরার স্লিপার। তার হাতে বইভর্তি একটা ব্যাগ।
হলঘরের একধারে দশ ফুট উঁচু, ছ ফুট চওড়া নকশা-করা দরজা, যার মাথার দিকটা গোলাকার। দরজার কারুকাজ এখন আর বোঝা যায় না। বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে এবং ধুলোময়লা জমে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
রোজই এই সময় দরজাটা ভেজানো থাকে। হলের টিউব লাইটগুলো জ্বালিয়ে বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে দিয়ে যায় হরেন। কেননা এই সন্ধেবেলায় দেবীর প্রাইভেট টিউটর পড়াতে আসেন। হলের ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে চেয়ার-টেবিল পেতে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আজ কিন্তু দেখা গেল দরজাটা পুরোপুরি ভেজানো নেই, তার একটা পাল্লা খোলা। খুব সম্ভব হাওয়ায় খুলে গেছে। খোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে দূরে শহরের একটা দিক চোখে পড়ে। সেখানে আলো জ্বলছে। কুয়াশা এবং অন্ধকারে আলোগুলো রহস্যময় সংকেতের মতো মনে হয়।
‘প্রতাপপুর প্যালেস’ শহর থেকে খানিকটা দূরে। সামনের দিকের গেটের পর অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, তারপর শহরের ঘরবাড়ি শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষজনের কাছ থেকে দূরত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য রাজবাড়িটা এভাবে তৈরি করা হয়েছিল। রাজা-রাজড়ারা যে রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের থেকে আলাদা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়াটাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। আশ্চর্যের ব্যাপার, জনগণতন্ত্র চালু হওয়ার পরও মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। জবর দখল করে কেউ ওখানে কলোনি টলোনি বসায়নি। সারা দেশ জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ডেমোক্রেসির হাওয়া বয়ে গেলেও মানুষের মনে রাজা মহারাজাদের সম্পর্কে খানিকটা সম্ভ্রম এখনও থেকে গেছে। হয়তো এটা সহজাত সংস্কার, মানুষের রক্তের মধ্যে আবহমানকাল অদৃশ্য শিকড়ের মতো ছড়িয়ে আছে। সেটা কাটিয়ে উঠতে আরও একশ বছর লেগে যাবে কিনা, কে জানে।
শহর দূরে থাকায় বাইরের শব্দ ট রাজবাড়িতে তেমন একটা ঢোকে না। তবে এই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কোথায় যেন পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ, মানুষজনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, অনেকের ছোটাছুটির শব্দ অস্পষ্টভাবে সুবর্ণার কানে ভেসে এল। ইদানীং কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটি নানা ধরনের ক্রিমিনালদের প্রায় অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পুলিশ অ্যান্টি-সোশালদের দু-একটা দলকে মাঝে মধ্যে তাড়া করে কর্তব্য পালন করে এবং এভাবেই চাকরি বজায় রাখে। নেহাত রুটিন ব্যাপার। সুবর্ণা বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করল না। মেয়েকে নিয়ে যেমন নামছিল তেমনই নামতে লাগল। সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি যখন ওরা চলে এসেছে সেই সময় হল-ঘরের দরজার দ্বিতীয় পাল্লাটা ঝড়াং করে খুলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকে বিদ্যুৎগতিতে ছিটকিনি আটকে খিল তুলে দিল। তারপর দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে জোরে জোরে হাঁফাতে লাগল। মনে হল, বহুদূর থেকে কারও তাড়া খেয়ে ছুটে আসছে সে।
সুবর্ণা আর দেবী থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। রাজবাড়ির প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে কেউ কখনও এভাবে ঢুকে পড়েছে কিনা সুবর্ণার জানা নেই। দেবী ভীষণ ভয় পেয়েছিল। মায়ের একটা হাত খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রইল সে।
সুবর্ণাও এমন একটা অভাবনীয় ঘটনায় একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিল। তবে সে খুবই সাহসী। দু-এক পলকেই নিজেকে সামলে নেয়। তারপর মেয়ের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ভয়ের কিছু নেই। লোকটার দিকে চোখ রেখে চাপা গলায় বলে, কথা বলিস না, চুপ করে থাক।
দরজার মাথায় টিউব লাইটটা দিন পনের আগে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার হরেনকে ওটা পালটানোর কথা বলেছে সুবর্ণা। কিন্তু কথাটা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। টিউবটা পালটানো হয়নি। হরেন রাজবাড়ির দারোয়ান এবং বাজার সরকার। তাছাড়া টুকিটাকি নানা কাজ তার করার কথা। কিন্তু সে প্রচণ্ড রকমের ফাঁকিবাজ। এই যে অচেনা লোকটা আচমকা হল-ঘরে ঢুকে পড়েছে, সেটা আদৌ সম্ভব হত না যদি এই সময়টা সে গেটের কাছে থাকত। নিশ্চয়ই কোথাও আড্ডা টাড্ডা দিতে গেছে।
হল-ঘরে অন্য যে টিউবগুলো জ্বলছিল তার আলোয় লোকটাকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তার চোখে মুখে খানিকটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ। ভাঙা গালে দাড়ির জঙ্গল। চোখের তলায় সিকি ইঞ্চি পুরু কালি। উসকো-খুসকো, রুক্ষ চুলে বহুদিন কাঁচি পড়েনি। পরনে রং-ওঠা ফ্যাকাসে জিনস, যেটার ডান পায়ের নিচের অনেকটা অংশ ছেঁড়া। এছাড়া হাফশার্টের ওপর রোঁয়াওলা মোটা উলের ময়লা সোয়েটার। পায়ে যে ফিতেওলা পুরনো স্পোর্টস শুটা রয়েছে তার রং একসময় ধবধবে সাদাই ছিল, এখন কালচে। সোলও অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। কপাল, গাল, কনুই থেকে হাতের নিচের দিকটা–অর্থাৎ শরীরের যেসব অংশ খোলা, সেগুলোর চামড়া কর্কশ এবং তামাটে। মনে হয় একদিন লোকটার গাত্রবর্ণ হলদেটে ছিল। রোদে পুড়ে। জলে ভিজে, প্রচণ্ড হিমে আর অসহ্য গরমে রংটা জ্বলে গেছে।
লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে যে মারাত্মক রকমের বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর, দেখামাত্র টের পাওয়া যায়। তার এক কাঁধে ক্রিকেটারদের কিট ব্যাগের মতো ক্যানভাসের ঢাউস একটা ব্যাগ। আরেক কাঁধে লম্বাটে একটা বাক্স যেটার নিচের দিক চওড়া, তবে ক্রমশ সরু হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। তার ডান হাতের চওড়া কবজিতে স্টিল ব্যান্ডে আটকানো একটা চৌকো ঘড়ি।
লোকটা ফাঁকা হল-ঘরের এধারে ওধারে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ে সুবর্ণা আর দেবীর ওপর। মুহূর্তে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।
সুবর্ণাও পলকহীন লোকটাকে লক্ষ করছিল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে তিনটে সিঁড়ি পেরিয়ে ল্যান্ডিংটায় এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে দেবীও রয়েছে।
সুবর্ণা তীব্র গলায় এবার বলে, কে আপনি? এ বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?
লোকটা নিজের ঠোঁটের ওপর ডান হাতের তর্জনী রেখে সুবর্ণাকে নীরব থাকতে ইঙ্গিত করে। তারপর তার চোখে আগের মতোই চোখ রেখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়ায়।
লোকটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকেই মুখ বুজে থাকতে বলছে। লোকটার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, থাকতে পারে। এ বাড়িতে দুজন অসুস্থ বৃদ্ধ, রান্নাবান্না এবং ছোটখাট ফাইফরমাস খাটার জন্য মাঝবয়সী একটি মেয়েমানুষ যার নাম মায়া আর সে এবং দেবী ছাড়া অন্য কেউ নেই এই মুহূর্তে। হরেনটাও কোথায় বেপাত্তা হয়ে আছে কে জানে। সুবর্ণা যদি চেঁচিয়ে গলার শির ছিঁড়েও ফেলে কেউ সাহায্য করতে আসবে না। কেননা তার চিৎকার শহর পর্যন্ত পৌঁছুবার আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই। লোকটাকে দেখে যা মনে হচ্ছে, নার্ভাস হয়ে হইচই বাধালে কিংবা রাগের মাথায় কিছু করে বসলে সে তাদের ছেড়ে দেবে না। তার চোখে মুখে যে ধরনের চিরস্থায়ী নিষ্ঠুরতা রয়েছে তাতে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা তার পক্ষে। ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। কাজেই এখন মাথা ঠান্ডা রাখাটা ভীষণ জরুরি। সুকৌশলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করতেই হবে।
সে যে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি সেটা বোঝানোর জন্য কঠোর স্বরে সুবর্ণা বলে, কী চান আপনি?
লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে বলে, আপনি কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি যা বলব, চুপচাপ শুনে যাবেন।
এই প্রথম লোকটা কথা বলল। তার কণ্ঠস্বর নিচু কিন্তু কর্কশ, একটু ঘষা ঘষা। নির্ভুল বাংলাতেই সে বলেছে, তবে উচ্চারণটা সঠিক নয়। নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার লোকজনদের কেউ বাংলা ভাষাটা রপ্ত করে বললে যেমন শোনায় অনেকটা সেইরকম।
লোকটার বলার ভঙ্গিতে প্রচণ্ড রকমের কর্তৃত্বের সুর রয়েছে; চাপা একটা হুমকিও। সুবর্ণার মতো সাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েও ভেতরে ভেতরে থমকে গেল। তার কী করা উচিত, ঠিক করে উঠতে পারছিল না। লোকটা এরপর কী বলে বা করে, সে জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এই সময় হরেন বা দেবীর টিউটর, কেউ একজন এসে পড়লে তার মনোবল অনেকটা বাড়ত।
লোকটা এবার বলে, এ বাড়িতে কে কে আছে?’
বাইরে যতই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করুক, প্রবল উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সুবর্ণা। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, যে-ই থাক, সেটা জানা কি খুবই প্রয়োজন?
অবশ্যই।
আগে বলুন প্রয়োজনটা কিসের?
লোকটার দুচোখে আগুনের হলকার মতো কিছু খেলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ডোন্ট আস্ক মি এনি কোশ্চেন। আমি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দেবেন। একটু থেমে বলে, কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অভ্যস্ত নই। ইজ ইট ক্লিয়ার?
সুবর্ণা চুপ করে থাকে। লোকটা ফের বলে, আমার প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি। বলুন পরক্ষণে কী ভেবে দ্রুত বলে ওঠে, আপনি যদি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেন, আপনাদের এতটুকু ক্ষতি হবে না। নইলে স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত দিয়ে সে থেমে যায়।
সুবর্ণা বুঝতে পারে, এখন এই লোকটার হুকুম মতোই তাকে চলতে হবে। ধীরে ধীরে সে জানায়, এ বাড়িতে তার নব্বই বছরের প্রায় অথর্ব দাদাশ্বশুর আছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি একরকম লোপ পেয়ে গেছে। এই মানুষটির কাছে অতীত এবং বর্তমান একাকার। হঠাৎ কখনও পুরনো দিনের কোনও ঘটনা বা মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিন্তু তা পলকের জন্য। পরক্ষণে সে সব ছবি মুছে যায়। স্মৃতির অদৃশ্য পেটরা খুলে যে দু-একটা টুকরো বেরিয়ে পড়ে, ফের তারা কোথায় উধাও হয় তিনি বুঝতে পারেন না। সুবর্ণার শ্বশুরও এ বাড়িতেই থাকেন। তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি, দু’দুবার স্ট্রোক হয়ে এখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। কাজের লোক আছে দু’জন–হরেন আর মায়া। এরা ছাড়া সে নিজে এবং দেবী।
আগে সুবর্ণা ততটা লক্ষ করেনি, এবার তার মনে হল নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি লোকটার চোখে মুখে চাপা একটা টেনসানও ছিল। সব শোনার পর সেটা যেন অনেকখানি কেটে গেছে। তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞেস করে, আপনি ঠিক বলছেন?
লোকটা কী বোঝাতে চায়–সে মিথ্যেবাদী? তার স্পর্ধায় মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনওরকম হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলে, আপনাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন?
লোকটা বলে, ধরে নিলাম আপনি ঠিকই বলছেন–
তার কথা শেষ হতে না হতেই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে কারও কণ্ঠস্বর, হরেন–হরেন, দরজা বন্ধ কেন? খুলে দাও।
লোকটার চেহারা মুহূর্তে পালটে গেল। কেমন একটা মরিয়া ভাব যেন ফুটে উঠেছে তার মধ্যে। গলা অনেকটা নামিয়ে বলে, লোকটা কে?
সুবর্ণা বলে, দেবীর মাস্টারমশাই। এই সময় পড়াতে আসেন। রোজই দরজা খোলা থাকে। আজ বন্ধ বলে ডাকাডাকি করছেন। লোকটাই যে দরজায় খিল আটকে দিয়েছে সেটা আর বলল না। তবে নিচে নামার জন্য পা বাড়াল।
কিন্তু সুবর্ণার নামা আর হল না। তার আগেই লোকটা গর্জে ওঠে, স্টপ। কোথায় যাচ্ছেন?
সুবর্ণা থেমে যায়। বলে, দরজা খুলে দিতে হবে না? মাস্টারমশাই কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
হিংস্র চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে সিঁড়ি টপকে টপকে সুবর্ণাদের কাছে চলে আসে লোকটা। উগ্র গলায় বলে, কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।
চালাকি মানে?
দরজা খুলে লোকটাকে ভেতরে এনে আমাকে ঝাটে ফেলতে চাইছেন?
দেবীর টিউটরই যে ডাকাডাকি করছেন, লোকটা তা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি। হয়তো সে ভেবেছে টিউটরের নাম করে সুবর্ণা অন্য কাউকে ঢোকাতে চাইছে। তার ফলে সে বিপন্ন হয়ে পড়বে।
সুবর্ণা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা জিনসের পকেট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে একটা পিস্তল বের করে শাসানির ভঙ্গিতে বলে, লুক ম্যাডাম, আমি অ্যাট অল ভায়োলেন্স চাই না। আমি কতদূর যেতে পারি, আপনার ধারণা নেই। লাস্ট টাইম আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার সঙ্গে ডার্টি ট্রিক খেলতে চেষ্টা করবেন না।
দেবী মায়ের একটা হাত চেপে ধরে আছে। সুবর্ণা চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, পিস্তল দেখে মেয়েটার মুখ ভয়ে, আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। তাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে লোকটাকে বলে, বিশ্বাস করুন, উনি সত্যিই আমার মেয়ের মাস্টারমশাই। খুবই ভাল মানুষ। নিরীহ এলডারলি পার্সন। ওঁর পক্ষে কারও এতটুকু ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
লোকটা কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, অল রাইট, মেনে নিচ্ছি, উনি আপনার মেয়ের প্রাইভেট টিউটর। ওঁকে বলে দিন, আজ পড়াতে হবে না।
সুবর্ণা বলে, উনি অত্যন্ত রেসপেক্টেড টিচার। ওঁকে এভাবে চলে যেতে বলা যায় না।
কী একটু ভাবে লোকটা। তারপর বলে, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে বলে আসুন। দরজা খুলবেন, কিন্তু আপনাদের টিউটরকে ভেতরে ঢুকতে দেবেন না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুবর্ণাকে বলতে হয়, আচ্ছা দেবীকে নিয়ে সে পরের সিঁড়িটায় পা রাখতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বাধা পড়ল। লোকটা দেবীকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলে, নো নো, আপনি একাই যান। আপনার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
লোকটার এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে দেবীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবীর সমস্ত শরীর ভীষণ কাঁপছে। এবার সে সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো বলে, কিন্তু
তার মনোভাব বুঝতে পারছিল লোকটা। বলল, আপনি যদি গোলমাল না করেন, কোনও সমস্যাই নেই। আপনার মেয়ে আমার কাছে নিরাপদে থাকবে। তবে ওর সেফটি টোটালি ডিপেন্ড করছে আপনার অ্যাক্টিভিটির ওপর। যান–
ল্যান্ডিংয়ের পাশেই একটা গোল পিলার। দেবীকে নিয়ে সেটার আড়ালে চলে যায় লোকটা। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। ওখান থেকে বাইরের দরজার দিকে নজর রাখা যায়। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে তাকে খুব সহজে দেখা যাবে না।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুবর্ণার পা খুব কাঁপছিল। হঠাৎ কী মনে পড়তে লোকটা ডাকে, শুনুন–
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়ায়। লোকটা বলে, আপনাদের টিউটরের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলবেন না। এমনভাবে বলবেন যাতে এখান থেকে আমি শুনতে পাই। আমার সম্বন্ধে ওঁকে কিছু জানাবেন না, এমনকি ইঙ্গিতেও না। এক মিনিটের ভেতর ভদ্রলোককে বিদায় করে ফিরে আসবেন। যান–
সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে।
লোকটা বলে, মাস্টারমশাইকে বলবেন, আপাতত এক উইক তার আসার দরকার নেই।
সুবর্ণা বিঢ়ের মতো বলে, এ আপনি কী বলছেন! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি সিম্পল বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজে কথা বলছি। না বোঝার কোনও কারণ নেই ম্যাডাম। কিন্তু–
কী?
মাস্টারমশাইকে এক উইক আসতে বারণ করব কেন?
লোকটা বলে, কারণ একটা উইক আমাকে এখানে থাকতে হতে পারে। আমি চাই না এই সাতদিন বাইরের কেউ এসে আমাকে দেখতে পাক।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, আপনি সাতদিন এ বাড়িতে থাকবেন।
দরকার হলে সাতদিন কেন, দু-এক মাসও থেকে যেতে পারি।
এই সময় কড়া নাড়ার আওয়াজ জোরাল হয়ে ওঠে। বোঝা যায় দেবীর টিউটর ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সুবর্ণা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা বলে, আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
হল-ঘরে নেমে দরজার দিকে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকায় সুবর্ণা। একটু আগে লোকটার বাঁ-হাতে পিস্তলটা ঝুলছিল। এখন সেটা উঠে এসে দেবীর কপালের ডান পাশের রগের ওপর ঠেকে আছে। দৃশ্যটা এমনই ভয়ঙ্কর যে দেখতে দেখতে সুবর্ণার মনে হয়, শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কোনওরকমে মুখটা ফিরিয়ে উতে টলতে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
.
০২.
লোকটার কথামতো দেবীর মাস্টারমশাইকে বিদায় করে দরজায় খিল তুলে ফের সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে আসে সুবর্ণা! ম ট,শাই মানুষটি অত্যন্ত প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক। প্রতাপপুর সিটির সবাই তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। দুই জেনারেশন ধরে এই শহরের অসংখ্য ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তিনি নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছেন। তাদের কেউ এখন সধ্যা, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আই.এ.এস বা আই.পি.এস, কেউ বিদেশে ভারতীয় রাষ্ট্র। কেউ আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে, কেউ বা ইউনাইটেড নেশনসে। সারা পৃথিবী জুড়ে তার ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে রয়েছে। এমন একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের সঙ্গে সুবর্ণা যে ব্যবহার আজ করেছে তা খুবই অসম্মানজনক। সে তাঁকে দরজার এধারে পা রাখতে দেয়নি, ওপার থেকেই সামান্য দু-একটা কথা বলে চলে যেতে বলেছে। ব্যাপারটা এমনই গ্লানিকর যে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় অনুশোচনায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। দেবীকে পড়াতে এসে তাকে এভাবে ফিরে যেতে হবে, এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি। শান্ত, সংযত, অন্তর্মুখী মানুষটি একটু অবাক হয়েছিলেন ঠিকই, তবে কোনও প্রশ্ন করেননি, নিঃশব্দে চলে গেছেন। কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে এমন একটা জঘন্য আচরণ সুবর্ণাকে করতে হয়েছে সেটা আজ জানানো সম্ভব হয়নি। সে ঠিক করে ফেলেছে, পরে সব জানিয়ে তার কাছে ক্ষ: চেয়ে নেবে। যতক্ষণ না ক্ষমাটা চাওয়া হচ্ছে, মানসিক অস্থিরতা, অস্বস্তি আর অপরাধবোধ কিছুতেই কাটবে না তার।
সুবর্ণার দিকে আগাগোড়া নজর রেখেছিল লোকটা! নির্বিঘ্নে এবং অক্ষরে অক্ষরে তার হুকুম পালিত হয়েছে দেখে সে মোটামুটি খুশি। দেবীর কপালের পাশ থেকে এবার পিস্তলের নলটা সরিয়ে আস্তে আস্তে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
সাহস বলতে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না সুবর্ণার মধ্যে। যে তলানিটুকু পড়ে আছে প্রাণপণে তা জড়ো করে সে বলে, সাতদিন মাস্টারমশাই আসবেন না। মাস দেড়েক বাদে দেবীর অ্যানুয়াল একজামিনেশন। ওর পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
লোকটা উত্তর দিল না।
সুবর্ণা আবার বলে, আপনি তখন বললেন, এক উইক থাকবেন। দরকার হলে দু-একমাসও থেকে যেতে পারেন।
লোকটা আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
উদ্বিগ্ন মুখে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, যতদিন আপনি থাকছেন, মাস্টারমশাই কি আসতে পারবেন না?
লোকটা কয়েক পলক কী চিন্তা করে বলে, সেটা পরে ভেবে বলব।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
লোকটা বলে, এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? আপনার মেয়ের কষ্ট হচ্ছে। চলুন কোথাও বসা যাক। এমনভাবে কথাগুলো সে বলল যেন এ বাড়িটা তার খাস তালুক, সুবর্ণা মেয়েকে নিয়ে এখানে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
এই মারাত্মক, সশস্ত্র লোকটাকে দোতলায় নিয়ে যাওয়া যায় না। এদিক সেদিক তাকিয়ে হল-ঘরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, আসুন, ওখানে যাই।
দেবীর পড়াশোনার জন্য যে চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে সেখানে গিয়ে লোকটাকে বসায় সুবর্ণা। দেবী আর সে তার মুখোমুখি বসে।
লোকটা বলে, আপনার নামটা জানতে পারলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হত।
সুবর্ণা তার নাম জানিয়ে দিয়ে বলে, আপনার পরিচয়ও কিন্তু এখন পর্যন্ত জানান নি।
চোখ কুঁচকে কী ভেবে নেয় লোকটা। তারপর বলে, আমার নাম রাজীব।
লোকটা যে সঠিক নাম জানায়নি সেটা তার মুখের চেহারা এবং বলার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এই গোপনতার কারণ কী? তার হাতে পিস্তল টিস্তল দেখে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলীতে এমন চাপ পড়েছে যে মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ তার মনে পড়ে, এই লোকটা হল-ঘরে ঢোকার আগে সে রাস্তায় অস্পষ্টভাবে হইচই এবং পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। লোকটা কি পলাতক কোনও আসামী? যার চেহারা এমন উগ্র, ভয়ানক মারণাস্ত্র নিয়ে যে জোর করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়ে তার পক্ষে দু-চারটে খুন টুন করে আসা অসম্ভব নয়। একটা নৃশংস হত্যাকারী তাদের ঘাড়ের ওপর কতদিন চেপে বসে থাকবে কে জানে। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে তাকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো যায় তা-ই বা কে বলে দেবে! ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা শুধু বলে, রাজীব কী?’ সারনেম বা পদবিটা জানতে পারলে নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চলের মানুষ সেটা বোঝা যেত।
লোকটা কিন্তু সেদিক দিয়েই গেল না। বলল, ডাকাডাকি, কথা বলা–এ সব কাজ চালিয়ে নেবার জন্যে রাজীব নামটাই যথেষ্ট। সারনেমের কী প্রয়োজন?
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না সুবর্ণার।
লোকটা অর্থাৎ রাজীব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হল-ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একবার দেখে নেয়। যেদিকটায় দরজা, সেটা ছাড়া অন্য তিন ধারে হল-ঘরটা ঘিরে সবসুদ্ধ পাঁচটা বেডরুম, যার চারটেতেই ঢাউস ঢাউস তালা লাগানো। তালাগুলোতে মরচে ধরে গেছে। বহুকাল যে ওগুলো ব্যবহার করা হয় না, সেটা বলে না দিলেও চলে। তবে ডান পাশের শেষ ঘরটায় তালা নেই; বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে বন্ধ করা। দরজাটা মোটামুটি পরিষ্কার। বোঝা যায়, ওই ঘরটায় কেউ থাকে।
রাজীব বলে, আমার কয়েকটা ইনফরমেশন দরকার মিসেস সিংহ।
সুবর্ণা বলে, কী জানতে চান বলুন।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি হরেন নামে একটা লোকের কথা বলেছিলেন। সে আপনাদের গেটকিপার ছাড়া আরও কী কী যেন করে। লোকটা কি এ বাড়িতে থাকে?
হ্যাঁ। যে ঘরটায় তালা নেই সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, ওখানে—
আমি যে ক’দিন থাকব, হরেনকে ছুটি দিন।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। বলে, তা কী করে সম্ভব?
রাজীব রুক্ষ গলায় বলে, মিসেস সিংহ আপনাকে আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম, আমি যা বলব চুপচাপ তাই করবেন। কোনওরকম প্রোটেস্ট বা বিরুদ্ধতা করবেন না। আমাকে যেন আর তা মনে করিয়ে দিতে না হয়। একটু থেমে কী ভেবে জিজ্ঞেস করে, হরেনকে ছুটি দেওয়া সম্ভব নয় কেন?
সুবর্ণা অনুনয়ের সুরে বলে, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আওয়ার ফ্যামিলি প্রবলেম। আমার শ্বশুর হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্ট; দাদাশ্বশুরের মেমোরি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব আপনাকে জানিয়েছি। ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা, বাজার করা, গেট পাহারা দেওয়া থেকে অনেক কিছুই হরেন করে থাকে। ওকে ছাড়া আমাদের ফ্যামিলি একেবারে অচল। এই অবস্থায়–’বলতে বলতে চুপ করে যায় সে।
সুবর্ণাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো হয়তো রাজীবকে সামান্য নাড়া দেয়। সে বলে, হরেন থাকতে পারে একটা কন্ডিশনে–
কী কন্ডিশন?
আমার কথা তাকে বলা চলবে না। আর—
আর কী?
তার সঙ্গে আমার কোনওভাবেই দেখা হওয়া চলবে না।
সুবর্ণা বলে ইমপসিবল!’
রাজীবের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে। সে বলে, ইমপসিবল কেন?’
সুবর্ণা বুঝিয়ে দেয়, রাজীব এ বাড়িতে থাকলে একতলার এই হল-ঘরের তিন দিকে যে তালাবন্ধ ঘরগুলো রয়েছে তার একটা খুলে সাফ টাফ করে বাসযোগ্য করে দেওয়া হবে। আর এই একতলাতেই হরেন থাকে। তার সঙ্গে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে রাজীবের দেখা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
রাজীব মুখ নামিয়ে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে। তারপর বলে, আমি কোথায় থাকব, পরে ঠিক করব।
লোকটা হাবেভাবে কথায়বার্তায় প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে-ই যেন এই ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর মালিক। এ বাড়ির কোথায় কোন অংশে রাজীব থাকবে সেটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সুবর্ণার মতামতের তোয়াক্কা করাটা সে প্রয়োজন বোধ করে না।
সুবর্ণা কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। বিমূঢ়ের মতো শুধু তাকিয়ে থাকে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, হরেন ছাড়া এ বাড়ির আর কাকে কাকে বাইরে বেরুতে হয়?
সুবর্ণা বলে, আমাকে আর দেবীকে।
কী ভেবে রাজীব বলে, দেবীর স্কুল থাকে। তাকে তো বেরুতেই হবে। দেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে, ইউ আর আ গুড গার্ল। আমি তোমার আঙ্কল। ক’দিন তোমাদের কাছে থাকব। আমি যে এখানে আছি সেটা বাইরের কাউকে, এমনকি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও জানাবে না। কথাটা মনে থাকবে?
দেবী দারুণ বুদ্ধিমতী। হাসিমুখে খুব নরম গলায় বললেও যার সঙ্গে পিস্তলের মতো একটা মারণাস্ত্র রয়েছে তার কথা সারাক্ষণ, অন্তত যে কদিন রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আছে সেটা যে মাথায় রাখতে হবে তা সে ভাল করেই জানে। নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে দেয় দেবী।
আদরের ভঙ্গিতে তার গালে আঙুল ছুঁইয়ে রাজীব বলে, ফাইন। পরক্ষণে তার চোখ সুবর্ণার দিকে ফিরে আসে। বলে, আপনার সম্বন্ধে কিছুই আমার জানা নেই। আপনাকে বেরুতে হয় কেন?
কোনও মানুষ সারাদিন একটা বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে পারে?
ধরুন, ভীষণ অসুস্থ হয়ে আপনি স্যানাটোরিয়ামে এসেছেন। আপনার ঘরের বাইরে যাওয়া বারণ।
সেটা কি আপনার সুবিধার জন্যে?’ নিজের অজান্তে সুবর্ণার মুখ ফসকে কথাগুলো বেরিয়ে আসে।
রাজীব কিন্তু রেগে যায় না। শান্ত গলায় বলে, এজাক্টলি।
কিন্তু–
বলুন—
আমি একটা কলেজে পড়াই। বাড়ি থেকে না বেরুলে ক্লাস নেব কী করে?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। ভুরুদু’টো ক্রমশ কুঁচকে যেতে থাকে। এক সময় বলে, ইটস আ প্রবলেম। কয়েকটা দিন আপনি ছুটি নিন।
সুবর্ণা বলে, কী করে নেব? আমার ডিপার্টমেন্টে সবসুদ্ধ তিনজন টিচার। একজন ছুটিতে আছেন। আরেকজনের অপারেশন হবে। তিনি কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। আমাকে একা ডিপার্টমেন্ট চালাতে হচ্ছে।
রাজীব উত্তর না দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে সুবর্ণা তাকে ধোঁকা দিতে চাইছে কিনা।
সুবর্ণা ফের বলে, আমি কলেজে না গিয়ে যদি বাড়ি বসে থাকি, প্রিন্সিপ্যাল লোক পাঠাবেন। যদি বলি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি, সারা কলেজ আমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে।
রাজীবের মুখচোখের চেহারা মুহূর্তে পালটে যায়। যে হিংস্র, উগ্র ভাবটা অল্পক্ষণের জন্য সে লুকিয়ে রেখেছিল সেটা চামড়ার তলা থেকে ফের বেরিয়ে আসে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেষ্টা করবেন না মিসেস সিংহ।
সুবর্ণা বুঝতে পারে, তার কথার একটি বর্ণও বিশ্বাস করেনি রাজীব। হয়তো ভেবে নিয়েছে, বাইরে গিয়ে তোকজন জুটিয়ে, থানায় খবর দিয়ে সে তাকে ফাঁদে ফেলবে। সুবর্ণা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সামনের দিকে ঝুঁকে শ্বাস-টানা গলায় বলে, আপনাকে আগেও বলেছি আমি মিথ্যে বলি না। ইচ্ছে হলে আমাদের। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে পারেন, আমার একজন কলিগ। কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন কিনা; আরেক জন
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় রাজীব। ধীরে ধীরে তার মুখের হিংস্রতা মুছে যেতে থাকে। হয়তো সুবর্ণার কথা বিশ্বাস করেছে। বলে, আপনাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে?
আছে।
সেটা কোথায় থাকে?
আমার বেডরুমে।
রাজীব কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় বাইরের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা যায়। সেই সঙ্গে কেউ গলা উঁচুতে তুলে ডাকছে, দেবী দিদি–দেবী দিদি-মায়া–এ সময় দরজা বন্ধ করল কে?
রাজীব চমকে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছে, এই সন্ধেবেলাটা বাইরের দরজা খোলা থাকে। সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, কে ডাকছে?
সুবর্ণা বলে, হরেন। কী বলব ওকে?
দ্রুত কিছু ভেবে নিয়েছিল রাজীব। বলে, ওকে দু’ঘন্টা পর আসতে বলুন।
সুবর্ণা আপত্তি করে না। করেও লাভ নেই। চেয়ারে বসেই যান্ত্রিক নিয়মে রাজীবের শোনানো কথাগুলো আওড়ে যায়।
হরেন দরজার বাইরে থেকে একটু অবাক হয়েই যেন বলে, দু’ঘণ্টা পরে কেন বৌদিদি? বাড়িতে ঢের কাজ পড়ে রয়েছে যে–
সুবর্ণা বলে, তোমাকে যা বলছি তাই করো।
ঠিক আছে বৌদিদি।
এরপর আর হরেনের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। খুব সম্ভব দু’ঘণ্টার জন্য সে শহরের দিকে চলে গেছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
তারপর রাজীব বলে, আপনাকে যখন কলেজে যেতেই হবে তখন আর জোর করে আটকাব না। কিন্তু দেবীকে যা বলেছি সেটা আপনাকেও সবসময় মনে রাখতে হবে। আমার কথা কাউকে বলা চলবে না।
সুবর্ণা উত্তর দেয় না। ভাবতে চেষ্টা করে, এই হুঁশিয়ারিটা রাজীব আগেও দিয়েছিল কিনা।
রাজীব বলে, আপনাদের একজন কাজের মেয়ের কথা বলেছিলেন না–
হ্যাঁ, মায়া।
সে কি বাড়ির বাইরে বেরোয়?
প্রশ্নটার পেছনে যে উদ্দেশ্যটা রয়েছে সেটা খুবই পরিষ্কার। মায়া বাইরে বেরুলে রাজীবের এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার খবর চারিদিকে চাউর হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই সব দিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। সুবর্ণা বলে, না। ওর বেরুবার দরকার হয় না। তবে–
রাজীব বলে, তবে কী?
মায়ার এক ভাইপো এই শহরেই থাকে। দু উইক পরপর সে তাকে দেখতে যায়। সকালে যায়, সন্ধের আগে আগে ফিরে আসে।
এ বাড়িতে ভিজিটর টিজিটর কেমন আসে? খুব বেশি কি?
বেশি না হলেও কিছু তো আসেই। ছুটির দিনে দেবীর বন্ধুরা কেউ না কেউ এসে সারাদিন কাটিয়ে যায়। আমার কলিগরাও আসে। আর
সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতে রাজীব বলে ওঠে, আর কে?
সুবর্ণা বলে, আমি একটা উইমেন্স ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। ওর মেম্বাররা অনেকেই মাঝে মাঝে নানা ব্যাপারে আসে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করে না রাজীব। শুধু বলে, এবার চলুন, আপনাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাবেন।
কেন রাজীব বাড়ি দেখতে চাইছে, বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিতভাবে তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে না।
তার মনোভাব আন্দাজ করে নেয় রাজীব। বলে, এ বাড়ির ঠিক কোন জায়গাটা আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ সেটা দেখে নিতে হবে না? এ কী, আর বসে থাকবেন না। উঠুন–
দেবীকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুবর্ণা। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা চলছিলই। সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
চেয়ারে বসার আগে কাঁধ থেকে ঢাউস ব্যাগ আর লম্বাটে বাক্সটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিল রাজীব। সে দু’টো ফের তুলে নিয়ে উঠে পড়ে সে।
.
০৩.
একতলার হল-ঘর এবং সেটাকে ঘিরে যে বেডরুমগুলো রয়েছে, আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। ডানধারের শেষ ঘরটার পাশ দিয়ে একটা চওড়া প্যাসেজ সোজা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে সেটা একটা দরজা। সেখানে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল। বাটার ওপর ধুলোময়লা জমেছে। ফলে যে ম্যাড়মেড়ে আলোটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়, সব কেমন যেন ঝাপসামতো।
দরজাটা দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল রাজীবের। জিজ্ঞেস করে, আপনাদের বাড়িতে ঢোকার জন্যে তা হলে দু’টো দরজা?’
সুবর্ণা আর দেবী রাজীবের পাশাপাশি আসছিল। সুবর্ণা মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, হ্যাঁ।
আগে তো বলেননি।
আপনি কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?
অল্প একটু থতিয়ে যায় রাজীব। তার একটু ভুল বা বোকামিই হয়ে গেছে। গোগাড়া থেকে সে শাসিয়ে আসছিল, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া বাড়তি কথা যেন না বলে সুবর্ণা। এ বাড়িতে যে দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়, আগে সেটা তার মাথায় আসেনি। সুবর্ণার কথার জবাব না দিয়ে সে জানতে চায়, দরজার ওধারে কী আছে?
সুবর্ণা বলে, ওপাশটা বাড়ির পেছন দিক। দেখবেন?
হ্যাঁ। রাজীব দরজাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতে খিল খুলে ফেলে। চৌকাঠের ওধার থেকে শ্বেতপাথরের নিচু সিঁড়ি নেমে গেছে। স্টেপগুলোর একটা পাথরও অক্ষত নেই–সব ফাটা, ভাঙা। সিঁড়ির তলা থেকে কঁকা জমি। কুয়াশা আর অন্ধকারে কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না। তবু বোঝা যায়। বাউন্ডারি ওয়ালের গা ঘেঁষে টালির শেড-দেওয়া টানা অনেকগুলো ঘর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, এদিকে আলো টালো আছে?
সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, এ বাড়ি তার পক্ষে কতটা নিরাপদ সেটা যাচাই করে নিতে চাইছে রাজীব। সে বলে, একটা ছিল। ক’দিন আগে খারাপ হয়ে গেছে। পালটানো হয়নি।
ওই ঘরগুলোতে কারা থাকে?
কেউ না। এক সময় অবশ্য ড্রাইভার, বেয়ারা, চাকর বাকর মিলিয়ে ষোল সতেরজন কাজের লোক থাকত। পাশেই বিরাট গ্যারেজ। সেখানে থাকত পাঁচ ছ’টা দামি গাড়ি। এখন দু’টো ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে, কোনও কাজে লাগে। না। আনইউজেবল। একটা অবশ্য চলে; তবে সেটার হালও ভাল নয়–
দরজাটা বন্ধ করতে করতে হঠাৎ এই বিশাল বাড়ি, তার পরিবেশ এবং সুবর্ণার একটু আগের কথাগুলো রাজীবকে কিছু একটা মনে করিয়ে দেয়। খিল লাগিয়ে; ঘুরে দাঁড়িয়ে সামান্য হালকা গলায় সে বলে, আমি কি কোনও পুরনো রাজা-মহারাজার বাড়িতে ঢুকে পড়েছি?
সুবর্ণা বলে, ঠিক তাই।
বেশ অবাক হয়ে সুবর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক পলক দ্রুত দেখে নেয় রাজীব। সে কিছু বলার আগে সুবর্ণা ফের বলে, এটা রাজবাড়িই। প্যালেস। যদিও ইন্ডিপেনডেন্সের পর রাজতন্ত্রের আর অস্তিত্ব নেই।
রাজীব বলে, জানা রইল। গ্রাউন্ড ফ্লোর দেখা হয়ে গেছে। এবার দোতলায় যাওয়া যাক।
পা বাড়াতে গিয়ে থমকে যায় সুবর্ণা। ভয়ে ভয়ে বলে, দোতলায় আমরা থাকি। সেখানে আপনাকে একটা ইঙ্গিত দিয়ে চুপ করে যায় সে।
এক দৃষ্টে তাকে লক্ষ করছিল রাজীব। বলল, প্রাইভেসির কথা বলছেন?
সুবর্ণা জবাব দেয় না।
রাজীব বলে, আমার সঙ্গে কিছু ডেডলি ওয়েপন আছে। তার একটা আপনি দেখেছেন। আপনাকে জানিয়ে রাখি এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার অনেকগুলো হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে। বিউটিফুল ইয়ং উইমেন দেখলে পুরুষের যে গ্ল্যান্ডগুলো এক্সাইটেড হয়ে ওঠে, আমার সেই গ্ল্যান্ড মরে, শুকিয়ে গেছে। একেবারে স্টোনডেড। আমার আর ঠান্ডা পাথরের মধ্যে কোনো ডিফারেন্স নেই।
সুবর্ণা বলে, আমি সে কথা বলছি না।
তবে?
সুবর্ণা স্পষ্টাস্পষ্টি না বললেও বুঝিয়ে দেয় দোতলায় দেবী, সে এবং মায়া ছাড়া স্মৃতিভ্রষ্ট দাদাশ্বশুর এবং শয্যাশায়ী শ্বশুরমশাই রয়েছেন। রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তাদের শিরায় শিরায় রাজরক্ত এখনও বয়ে চলেছে। অনেক কিছুই তারা হারিয়েছেন কিন্তু পুরনো দিনের রাজকীয় রুচি, মেজাজ এবং দাম্ভিকতার রেশ তাঁদের অস্তিত্বের মধ্যে তলানির মতো থেকে গেছে। নিজেদের পারিবারিক কোড অফ কনডাক্ট প্রতাপপুর রাজবংশ বহু কাল আগে তৈরি করে নিয়েছিল। তার অনেকগুলো আজও টিকে আছে। বাড়ির অন্তঃপুর সম্পর্কে এঁরা ভীষণ রক্ষণশীল এবং স্পর্শকাতর। সেখানে অচেনা, উটকো কোনও লোককে নিয়ে গেলে প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি হবে। দাদাশ্বশুরের বোধবুদ্ধি কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। পূর্বপুরুষের তৈরি যাবতীয় পারিবারিক রীতি-নীতি ধ্যান-ধারণা তিনি যখের মতো আগলে আছেন। রাজীবকে দোতলায় দেখলে খুবই অসন্তুষ্ট হবেন।
রাজীব ঠান্ডা গলায় বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।
ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলে, দেখুন, উনি প্রায় বেড-রিডন–’
এই ইনফরমেশনটা আমার কাছে নতুন নয়। আগেও দু-একবার বলেছেন, তাঁর বার কয়েক হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে–এই তো?
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব বলে, এই টাইপের পেশেন্টদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করতে হয় আমার জানা আছে। আপনার প্রবলেম যাতে না হয় সেটা মাথায় রাখতে চেষ্টা করব। একটু থেমে বলে, তবে একটা পয়েন্ট ক্লিয়ার করে দিই। আমার ধৈর্য কিন্তু খুব কম।
সুবর্ণা প্রায় একটি ঘণ্টা এই মারাত্মক লোকটার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছে। এ তো বন্ধুদের সঙ্গে হালকা মেজাজে আড্ডা দেওয়ার মতো আনন্দের ব্যাপার নয়। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে রাখতে হয়েছে, কোনওরকম হঠকারিতা করা চলবে না। দাবার চতুর চাল দেবার ভঙ্গিতে রাজীবের সঙ্গে অঘোষিত একটা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। ক্রমাগত উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় যে পায়নি তা নয়। অসীম মনোবলে লোকটার মুখোমুখি নিজেকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে। রেখেছে। কিন্তু টান টান স্নায়ুগুলো এবার কেমন যেন আলগা হয়ে আসছে। রাজীব বলেছে তার ধৈর্য কম। ওদিকে শ্বশুরমশাই অসম্ভব বদরাগী, তার পছন্দমতো কিছু না হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়েন। এর পরিণতি কী ঘটতে পারে সেটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না সুবর্ণার, আর সেই কারণে মনে হয় সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, যুদ্ধের তো সবে শুরু। প্রথম রাউন্ডটা এখনও শেষ হয়নি। এরপর কতদিন ধরে লড়াইটা চলতে থাকবে, কে জানে। যতদিনই চলুক, তার ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের ভেতরকার শক্তিকে অটুট রেখে অনবরত রণকৌশল ঠিক করে যেতে হবে।
রাজীব এবার বলে, চলুন, দোতলায় গিয়ে আপনার শ্বশুরমশাইদের দেখা যাক।
ঝাপসা গলায় সুবর্ণা বলে, আসুন–
হল-ঘরে ফিরে এসে কাঠের সেই অর্ধবৃত্তাকার সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে আগে আগে উঠতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের পেছন পেছন অনিবার্য নিয়তির মতো রাজীব। হঠাৎ থমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুবর্ণা। অগত্যা রাজীবকেও থামতে হয়। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হল?
শ্বশুরমশাই যদি জানতে চান, আপনাকে এ বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি কেন? তাকে কি বলব আপনি জোর করে থাকতে চাইছেন, তাই বাধ্য হয়ে–
না।
আপনার থাকার কারণটা কী বলব, বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলে দেবেন?
এই প্রথম একটু থতিয়ে যায় রাজীব। খানিকক্ষণ ভেবে বলে, বলবেন আমি আপনার আত্মীয়। মামাতো ভাই, পিসতুতো ভাই, কাকা, মেসোর শালা–এনি ড্যাম থিং বলতে পারেন। বহুদিন বাইরে-কঙ্গো, ঘানা, আমস্টারডাম, সিয়েরা লিওন, বুরকিনা ফাসো কি প্যারাগুয়েতে ছিলাম। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ খোঁজ পেয়ে চলে এসেছি।
অদ্ভুত চোখে খুব আস্তে আস্তে রাজীবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে সুবর্ণা।
রাজীব এভাবে তার তাকানোর উদ্দেশ্যটা বুঝে নিয়ে বলে, আমাকে অবশ্য আপনার আত্মীয় বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার যা চেহারা তাতে হার্ড-ফিচারড অ্যান্টিসোশাল বলে মনে হবে। এনিওয়ে, আমার ব্যাগে শেভিং সেট আর পরিষ্কার দু-একটা জামাপ্যান্ট আছে। শেভ টেভ করে পোশাক চেঞ্জ করলে খানিকটা ভদ্র দেখাতে পারে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে চিন্তিতভাবে বলে, কিন্তু
সুবর্ণা উত্তর দেয় না। স্থির চোখে রাজীবকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব বলে, আপনার আত্মীয়স্বজন, মানে আপনার বাপের বাড়ির দিকের রিলেটিভরা এ বাড়িতে এলে তাদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে না তখন ঝাট হতে পারে।
সুবর্ণা বলে, আমার মা-বাবা নেই। একমাত্র দাদা থাকে দিল্লিতে। বছরে একবার এসে আমাকে দেখে যায়। মাস দুই আগে এসেছিল, ফের আসবে নেক্সট ইয়ারে।
অন্য রিলেটিভরা?’
আমার শ্বশুরমশাই তাদের একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই তাদের এ বাড়িতে যাতায়াত নেই।
লোকটার নিজের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। সুবর্ণার বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনরা এখানে আসে না, কাজেই তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। এতে সে খুশি। তার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির ছাপ ফুটে বেরোয়। বলে, ঠিক আছে, ওপরে যাওয়া যাক।
যন্ত্রচালিতের মতো ফের আগে আগে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের দু’ধাপ পেছনে রাজীব। আচ্ছাদনহীন কাঠের সিঁড়িতে তিন জোড়া নানা ধরনের জুতোর ভারী এবং হালকা আওয়াজ ছাড়া এ বাড়িতে এখন আর কোনও শব্দ নেই।
দোতলার নকশাটা হুবহু একতলার মতোই। তেমনই বিশাল হল-ঘরের তিন দিক ঘিরে লাইন দিয়ে ঘর। তবে সবগুলোই কিন্তু বেড র নয়। একটা ঘরকে কিচেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নিচের তুলনায় ওপরে আলোটালো অনেক বেশি। চারিদিক পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে। একতলার মতো সিলিং থেকে এখানেও একটা বিশাল ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, সেটা অবশ্য জ্বলছে না। নিচে একটা ছাড়া বাকি ঘরগুলোতে তালা লাগানো। এখানে সবগুলো ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে, দরজাও খোলা। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরেই এখানে লোকজন থাকে।
নিচের কার্পেটটা ছিঁড়ে খুঁড়ে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু দোতলার হল-ঘরে যেটা পাতা রয়েছে সেটা বহুদিনের পুরনো, রংও নষ্ট হয়ে গেছে, তবু তার হাল নিচেরটার মতো অত খারাপ নয়। মোটামুটি অটুটই আছে বলা যায়।
চারপাশের দেওয়াল থেকে দু ফুটের মতো বাদ দিয়ে কার্পেটটা হল-ঘরের মেঝে ঢেকে রেখেছে। নিচের মতোই এখানে তিন সেট ভারী ভারী সোফা, সেগুলোর ওপর দামি কাপড়ের কভার। একধারে রঙিন টিভি, আরেক ধারে লম্বা ধাঁচের অ্যাকোয়ারিয়াম। ডানদিকের গোটা দেওয়াল জুড়ে উঁচু নিচু কাঁচে ঢাকা ক্যাবিনেটের ভেতর অজস্র বই। ক্যাবিনেটের নিচু অংশগুলোতে নানা ধরনের পেতল এবং মার্বেলের সুদৃশ্য সব শিল্পকর্ম। আর আছে বিচিত্র চেহারার অনেকগুলো ক্যাকটাস। আরেক দেওয়ালের উঁচুর দিকটায় পনের কুড়িটা বাঘ, হরিণ এবং শিংওলা বুনো মোষের মাথা সারিবদ্ধভাবে সাজানো। প্রতাপপুর রাজবংশের পূর্বপুরুষদের কেউ হয়তো দুর্ধর্ষ শিকারি টিকারি ছিলেন। বাঘটাঘের মুণ্ডুগুলো সেই স্বর্ণযুগের স্মৃতিচিহ্ন। হল-ঘরের শেষ মাথায় কিচেনের কাছাকাছি বিরাট লম্বাটে ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে বাবোটা করে চব্বিশটা চেয়ার। ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় মস্ত একটা গ্র্যান্ড-ফাদার ক্লক।
দোতলায় এসে হল-ঘরটা দ্রুত একবার দেখে নিয়ে রাজীব বলে, বেড-রুম, কিচেন টিচেনগুলো এবার দেখিয়ে দিন।
সুবর্ণা সবে রাজীবকে নিয়ে বাঁদিকে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ কিচেন থেকে মায়া বেরিয়ে এসে অচেনা একটা লোককে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটার পোশাক এবং চেহারা এই রাজপ্রাসাদের পক্ষে এতই বেমানান যে তাকে যতই দেখছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল সে।
মায়ার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ। মাঝারি মাপের শক্তপোক্ত, চালাক চতুর চেহারা। মুখটা চৌকো ধরনের। গায়ের রং ময়লা। চওড়া কাধ এবং ছড়ানো চোয়াল এবং হাতের মোটা মোটা হাড়ের দিকে তাকালে বোঝা যায় মেয়েমানুষটি অসীম শক্তির অধিকারিণী। পরনে একটু খাটো ধরনের সবুজ সবুজ খোপ-কাটা শাড়ি, আর ডগডগে লাল রঙের ব্লাউজ। দু’হাতে কয়েক গাছা করে রুপোর চুড়ি, গলায় সোনার সরু চেন হার। নাকের পাটায় সাদা পাথর বসানো একটা বেঢপ নাকছাবি।
কিছু বলার জন্য ঠোঁটদু’টো ফাঁক করতে যাচ্ছিল মায়া, চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, তুমি এখন রান্নাঘরে যাও। দরকার হলে ডাকব।
সন্দিগ্ধ চোখে রাজীবের দিকে তাকাতে তাকাতে কিচেনে চলে যায় মায়া। তার তাকানোর ভঙ্গিটা বুঝিয়ে দেয়, রাজীবকে তার পছন্দ হয়নি।
সুবর্ণা বাঁ ধারের যে বিশাল বেড-রুমটার সামনে রাজীবকে নিয়ে এল সেটার। ভেতর একটা ডিভানে যে বৃদ্ধটি বসে আছেন তাঁর মাথায় মরা ঘাসের মতো সামান্য ক’টি চুল। দু’পাটির একটা দাঁতও আর অবশিষ্ট নেই। গাল তুবড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। হাত দু’টো গাছের শুকনো ডালের মতো কাঁধ থেকে ঝুলছে। চামড়া কুঁচকে কুঁচকে একেবারে জালি জালি। থুতনির হাড় এবং হনু দু’টো অস্বাভাবিক বেরিয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। পরনে সরু পাজামার ওপর ঢলঢলে সোয়েটার। যৌবনে তার চেহারা কেমন ছিল, প্রবল কল্পনাশক্তি দিয়েও এখন আর তা আন্দাজ করার উপায় নেই।
বৃদ্ধটি সুবর্ণাদের দিকে তাকিয়ে হাবলার মতো নিঃশব্দে হাসছিলেন। বার্ধক্য তার শারীরিক সৌষ্ঠব এবং ক্ষমতা, বোধবুদ্ধি, সব কিছু শুষে নিয়ে ছিবড়েটুকু ফেলে রেখেছে।
সুবর্ণা এঁর কথা আগেই জানিয়েছিল। দেখামাত্রই চিনে নিতে পারল রাজীব। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার ইন-ল?
হ্যাঁ–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, আসুন–’
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পরের চমৎকার সাজানো ঘরটা সুবর্ণা আর দেবীর। তারপরের বেড-রুমটায় নকশা-করা, প্রকাণ্ড মেহগনির খাটে কাত হয়ে, লেপ গায়ে, শুয়েছিলেন একজন বয়স্ক মানুষ। মাথা, নাক এবং গালের খানিকটা দেখে বোঝা যায় এঁরও বয়স হয়েছে, তবে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো অতটা নয়। বাইরে থেকে রাজীবের মনে হল, তার চোখ দুটি বোজা। বালিশ থেকে মাথা না তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে, বৌমা?
নিচু গলায় সুবর্ণা সাড়া দিল, হা, বাবা। রাজীবের দিকে ফিরে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে বলে, আমার শ্বশুরমশাই সংগ্রামনারায়ণ সিংহ।
মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে রাজীব জানায়, সে বুঝতে পেরেছে। চাপা গলায় বলে, এবাড়ির সবারই দেখছি মিলিটারি মার্কা নাম। শৌর্যে–সংগ্রাম–
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
সংগ্রামনারায়ণ আগের মতো শুয়ে শুয়ে সুবর্ণাদের দিকে মুখ না ফিরিয়ে এবার বলেন, তিনরকম পায়ের শব্দ কানে আসছে। একজোড়া তোমার, একজোড়া দেবী দিদিভাইয়ের, আরেক জোড়া অচেনা লাগছে। হরেন বা মায়ার তো নয়।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। দ্রুত একবার রাজীবকে দেখে নেয়। রাজীবের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে ভীতভাবে সুবর্ণা বলে, না। আমার এক আত্মীয় এসেছেন। তিনি আমার দাদার–
তার কথা শেষ হতে না হতেই সংগ্রামনারায়ণ বলে ওঠেন, অনেক বছর পর, অ্যাবাউট থারটিন ইয়ারস, তোমার দাদাকে বাদ দিলে তোমার বাপের বাড়ির দিকের অন্য কোনও রিলেটিভ এ বাড়িতে এলেন। তাই না?
আবছা গলায় সুবর্ণা বলে, হ্যাঁ বাবা—
আমি তোমার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম, তবু যখন একজন এসেই পড়েছেন, আদরযত্নের ক্রটি যেন না হয়।’
কথা বলছিল ঠিকই, তবু সুবর্ণা টের পাচ্ছিল তার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে বের করে সে বলে, আচ্ছা।
ডাক্তার এবার যে ওষুধটা দিয়েছে সেটা ভীষণ কড়া। বিকেলের ট্যাবলেটটা খাওয়ার পর থেকে খালি ঘুম পাচ্ছে, চোখ আর মেলতে পারছি না। কাল তোমার আত্মীয়ের সঙ্গে আলাপ করব।
সুবর্ণা আপাতত বেঁচে গেল। ঘাড়ের ওপর চেপে বসা উগ্র চেহারার লোকটাকে সংগ্রামনারায়ণের কাছে হাজির করতে হলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত, ভাবতে পারে না সে। চোখের ইশারায় রাজীবকে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলল।
সংগ্রামনারায়ণের পাশের ঘরটা হল প্রতাপপুর রাজপরিবারের পুরনো অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা। সেখানে এসে রাজীব বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কান তো সাঙ্ঘাতিক। পায়ের আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারেন কোনটা কার–
সুবর্ণা বলে, শুধু কানই না, সবগুলো ইন্দ্রিয়ই ওঁর ভয়ানক রকমের প্রখর।
উনি বলেছিলেন আপনার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। কারণটা–’বলতে বলতে থেমে যায় রাজীব।
এই প্রথম রাজীব কোনও ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করল। ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনি নিজের নিরাপত্তার জন্যে একটা শেলটার খুঁজছেন। সেটা ছাড়া অন্য সব কিছুই কিন্তু অবান্তর।
একটু চমকে ওঠে রাজীব, আর কোনও প্রশ্ন করে না।
অস্ত্রশালার পরের ঘরটা চেয়ার টেবিল এবং নানা রেফরেন্স বই-টই দিয়ে সাজানো। এটা সুবর্ণার নিজস্ব লাইব্রেরি। এখানে বসেই সে পড়াশোনা করে, পরীক্ষার খাতা দেখে।
সুবর্ণার পড়ার ঘরের গায়েই কিচেন। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে তার চোখে পড়ল দরজা সামান্য ফাঁক করে মায়া তাদের লক্ষ করছে। চোখাচোখি হতে চট করে সরে গেল সে।
কিচেনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুবর্ণা বলে, এটা আমাদের রান্নাঘর। রাত্তিরে মায়া এখানেই শোয়।
রাজীব কিছু বলল না।
কিচেনের পাশ দিয়ে একতলার মতোই একটা প্যাসেজ দোতলার শেষ মাথায় চলে গেছে। ওদিককার দরজা খুললে একটা বিরাট ঝোলানো ব্যালকনি।
যেভাবে কোনও প্রদর্শনী বা দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়, অবিকল তেমনি প্রতাপপুর প্যালেসের একতলা এবং দোতলা দেখানো হলে ফের ওরা হল-ঘরে ফিরে আসে।
সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এমনিতে সে খুবই নরম ধরনের মেয়ে। অচেনা, সশস্ত্র লোকটার ভয়ে তার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।
সুবর্ণা মনে মনে খানিকটা সাহস এনে বলল, দেবীর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর কি এখানে থাকার আর দরকার আছে?
রাজীব তক্ষুণি বলে, না না, ও যেতে পারে।
সুবর্ণা দেবীকে তাদের ঘরে যেতে বলে। সাময়িক মুক্তি পেয়ে দেবী পা বাড়াতে যাচ্ছিল, রাজীব বলে ওঠে, তোমার মাকে যে কথাটা বলেছিলাম সেটা মনে আছে তো? আমার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।
আস্তে মাথা হেলিয়ে দেবী জানায়-মনে আছে। তারপর হল-ঘর পেরিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে যায়।
সুবর্ণার হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করে, আমি কি একবার নিচে যেতে পারি?
রাজীবের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। সে বলে, কেন?
সুবর্ণা বলে, হরেন ফিরে আসবে। বাইরের দরজাটা বন্ধ রয়েছে। ওটা খুলে দিয়ে আসি।
ওর তো দু’ঘণ্টা পর ফেরার কথা। গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে তাকিয়ে সময় হিসেব করে নেয় রাজীব। বলে, মাক্সিমাম চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটেছে।
সুবর্ণা বলে, ফিরে এসে ডাকাডাকি করলে কাউকে না কাউকে তো দরজা খুলতে হবে। মায়াকে পাঠাতে পারি কিন্তু ও যদি ফস করে আপনার সম্পর্কে কিছু বলে বসে। একটু ভেবে বলল, ওর চোখমুখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল আপনাকে আমার রিলেটিভ বলে হয়তো বিশ্বাস করেনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। তারপর বলে, ঠিক আছে, খুলে দিয়ে আসুন। মায়াকে বলবেন কোনওরকম বজ্জাতি করার চেষ্টা যেন না করে।
পরে আমি বুঝিয়ে দেবো।
সুবর্ণা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। রাজীব তার সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডিং পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পকেটে নিঃশব্দে একটা হাত ঢুকে গেছে। তবে অস্ত্রটা এবার। আর বের করেনি সে।
দরজা খোলা হলে সুবর্ণাকে সঙ্গে করে ফের দোতলায় উঠে আসে রাজীব।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমাকে এখন কী করতে হবে?
তার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি রাজীব। জবাব না দিয়ে বলে, আপনাদের গোটা বাড়িটা দেখার পর মনে হয়েছে, দোতলাটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ।
অর্থাৎ এই লোকটা সর্বক্ষণ দোতলায় একটা দম বন্ধ-করা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রাখবে। কিন্তু তাকে ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। সুবর্ণা বলে, এখানে লাইব্রেরি আর যে ঘরে পুরনো অস্ত্রশস্ত্র থাকে সে দু’টোয় রাতে কেউ থাকে না। ওর একটায় আপনার জন্যে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
নো, নো ম্যাডাম। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে রাজীব।
রীতিমত অবাক হয়ে সুবর্ণা বলে, কেন, ও দু’টো আপনার পছন্দ নয়? বেশ বড় বড় রুম। শোওয়ার জন্যে ডিভান টিভান পেতে দিলে–
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে রাজীব বলে, আমাকে কি আপনার স্টুপিড মনে হয়?
মানে?
ওই ঘর দু’টোর কোনও একটায় থাকলে আপনাদের খুবই সুবিধে হয়, তাই না? সারা রাত তো জেগে থাকতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলবেন, সেটা কোনওভাবেই হাতে দিচ্ছি না।
এমন একটা চিন্তা ঘুণাক্ষরেও সুবর্ণার মাথায় আসেনি। দেখা যাচ্ছে লোকটা খুবই প্যাচালো। তার মানসিক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নয়, অত্যন্ত জটিল। রাজীব সম্পর্কে সুবর্ণা কিছুই জানে না। হয়তো তার জীবনে এমন কিছু ঘটে গেছে যাতে কাউকে সে বিশ্বাস করে না, পৃথিবীর সবার সম্বন্ধেই সে সন্দেহপরায়ণ। হয়তো তার ধারণা, চেনা-অচেনা প্রতিটি মানুষ তার বিরুদ্ধে গভীর কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তা হলে কোথায় থাকতে চান?
ওই যে ওল্ডেস্ট মেম্বার অফ ইয়োর ফ্যামিলি, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল, আমি ওঁর ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকতে চাই। বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় রাজীব।
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। একজন জড়ভরত মার্কা নব্বই বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে কেউ থাকতে চাইছে, শুনেও তার বিশ্বাস হয় না।
রাজীব সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল। বলল, মনে হচ্ছে, বুঝতে পারছেন না।
আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা।
রাজীব এবার যা বলে তাতে আতঙ্কে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় সুবর্ণার। একটা অর্থ বুড়ো যার বোধবুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে, ওয়ার্ল্ডে যার কোনও প্রয়োজন নেই, তবু পরিবারের লোকজনের কাছে তার জীবন অবশ্যই মূল্যবান। সেটা সেন্টিমেন্টাল আর ইমোশনাল কারণে। রাজীবের মধ্যে এই সব আবেগ টাবেগের ছিটেফোঁটাও নেই। যদি দেখা যায় তাকে বিপাকে ফেলার চক্রান্ত চলছে, বৃদ্ধটির আয়ু তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যাবে। তার সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে। সেটার ট্রিগারে আঙুলের একটা চাপই যথেষ্ট।
শ্বাসরুদ্ধের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই বুড়ো লোকটার ঘরে থেকে ওঁকে আপনার হাতের মুঠোয় রাখতে চান?
এগজ্যাক্টলি। আশা করি বুঝতে পারছেন আমার সিকিউরিটির জন্যে এটা খুবই প্রয়োজন। ওল্ড ম্যান আমার জিম্মায় থাকলে আপনারা তেমন কোনও ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন না।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় রাজীব বলে ওঠে, আপনাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে বলেছিলেন না?
হ্যাঁ—
সেটা ডিসকানেক্ট করে দিতে হবে।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, না না, আমার শ্বশুরমশাই ভীষণ অসুস্থ। প্রায়ই ডাক্তার ডাকতে হয়। টেলিফোন না থাকলে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?
কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজীব বলে, ওটা ছাড়া আর কোনও ফোন নেই তো? যেমন ধরুন কর্ডলেস টেস–’
না। ওই একটাই।
ওটা খুলে আপনার দাদাশ্বশুরের ঘরে এনে লাগিয়ে দেবেন।
অর্থাৎ নিরাপত্তার দিক থেকে কোনওরকম ত্রুটি থাকতে দেবে না রাজীব। টেলিফোনটাও নিজের হেপাজতে রাখতে চাইছে সে। সুবর্ণা বলে, ঠিক আছে।
রাজীব এবার বলে, আমি ভীষণ টায়ার্ড আর হাংগ্রি। দু’টো দিন এক মিনিটের জন্যেও ঘুমোতে পারিনি, ক’টা বিস্কুট আর কয়েক কাপ চা ছাড়া কিছু জোটেনি।
এই প্রথম সুবর্ণা লক্ষ করল, লোকটার চোখে মুখে উগ্রতা থাকলেও সে সত্যিই খুব ক্লান্ত। তার কথা মেনে নিলে ক্ষুধার্তও। সুবর্ণা বলল, আসুন–
কোথায়?
আপনিই তো আমার দাদাশ্বশুরের বেড-রুমটায় থাকার জন্যে ঠিক করে ফেলেছেন। সেখানে যাওয়া যাক।
রাজীব উত্তর দেয় না। হল-ঘর পেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে আসে। আগের মতোই তিনি ডিভানে বসে ছিলেন। সুবর্ণা বলল, দাদাভাই, ইনি আমার আত্মীয়। দিনকয়েক আপনার সঙ্গে থাকবেন। বলে রাজীবকে দেখিয়ে দেয়।
কথাগুলো বৃদ্ধের মাথায় ঢুকলো কিনা কে জানে। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই হল না তার। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তিনি। তারপর শব্দহীন বোকাটে হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে।
একধারে একটা চামড়ায়-ঢাকা আর্ম চেয়ার রয়েছে। কাঁধের ব্যাগ দু’টো মেঝেতে নামিয়ে রেখে রাজীব বলে, আমি একটু বসছি। আপনি টেলিফোনটা খুলে এখানে নিয়ে আসুন।
বোঝা যাচ্ছিল অসীম ক্লান্তিতে রাজীব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে আর্মচেয়ারে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। নিজের ঘর থেকে টেলিফোন নিয়ে এসে এ ঘরের প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে দেয় সুবর্ণা।
রাজীব বলে, আমি স্নান করব। বাথরুম কোথায়?
ডানপাশের দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা দেখিয়ে সুবর্ণা বলে ওখানে—
ভালই হল, এখানে অ্যাটাচড বাথরুমও রয়েছে। স্নানটানের জন্যে বাইরে বেরুতে হবে না।
এখানকার গিজারটা কিন্তু নষ্ট হয়ে গেছে। গরম জল পাওয়া যাবে না।
নো প্রবলেম।
আমি কি এখন যেতে পারি? আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে—
ঠিক আছে।
সুবর্ণা চলে যাচ্ছিল, রাজীব পেছন থেকে ডাকে, মিসেস সিংহ—
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
রাজীব বলে, বাড়তি একটা লোক কিছুদিন থাকলে আপনাদের ওপর প্রেসার পড়বে। আমি সেটা চাই না।–
বুঝতে না পেরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কীসের প্রেসার?
আমি আর্থিক ব্যাপারের কথা বলছি। আমার কাছে কিছু টাকা আছে—
রাজীবকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনাকে আগেই বলেছি এটা একটা প্যালেস। প্রতাপপুর রাজবংশের লোকেরা একসময় বহু মানুষকে খাইয়েছে। জোর করে এ বাড়িতে ঢুকে পড়লেও আপনি আমাদের গেস্ট। পয়সা নিয়ে অতিথিকে খাওয়ানোর কথা আমরা ভাবতে পারি না।
কয়েক পলক সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর বলে, আপনার। যেমন ইচ্ছে।
তার কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনভাবে সুবর্ণা বলে, ইন্ডিয়ান হসপিটালিটি বলে একটা কথা আছে। এই পরিবার তার রীতিনীতিগুলো মেনে চলে। তা। ছাড়া–
কী?
রাজত্ব বা রয়ালটি কোনওটাই আর নেই। মর্যাদা, অর্থ, বংশগৌরব, সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবু একটা লোককে কয়েকদিন খাওয়ানোর ক্ষমতা আমাদের এখনও আছে।
রাজীব উত্তর দেয় না।
সুবর্ণা চলে যায়। রাজীব দরজার পাল্লা দু’টো টেনে ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে দেয়। পুরনো জং-ধরা কজার আওয়াজে নিজের ঘরের দিকে, যেতে যেতে একবার মুখ ফেরায় সুবর্ণা। লোকটা যে নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত হুঁশিয়ার সেটা আগে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছে। পাছে বাথরুমে ঢুকলে সুবর্ণা কিছু করে বসে তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেছে। রাজীব।
.
০৪.
নিজের ঘরে এসে সুবর্ণা দেখল, খাটের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে দেবী। ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায় সে। মুখটা মাত্র এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ঠোঁট দু’টো ভীষণ কাগছে।
মেয়ের গা ঘেঁষে বসে পড়ে সুবর্ণা। এতক্ষণ একটা মারাত্মক আততায়ীর সঙ্গে প্রাণপণে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। এখন মনে হচ্ছে হাত-পায়ের জোড়গুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর এবং মনের যাবতীয় শক্তি আর সাহস লোকটা যেন প্রায় শুষেই নিয়েছে। সুবর্ণা টের পাচ্ছিল, তার রক্ত হঠাৎ অনেক কমে গেছে। মাথার ভেতরটা ভীষণ টলছিল।
দেবী বলল, মা, লোকটার কাছে পিস্তল আছে। আমাদের সবাইকে কি খুন করে ফেলবে?’
দেবীর কাঁধে একটা হাত রেখে সুবর্ণা ম্লান একটু হাসে। বলে, আরে না না, এমনি ভয় দেখাচ্ছিল। আমি তো আছি, ও কিছু করতে পারবে না।
দেবী কতটা ভরসা পায় সে-ই জানে। ভয় তার এক ফোঁটাও কমেছে বলে মনে হয় না। ভীরু চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
সুবর্ণা বলে, স্কুলে গিয়ে ওই লোকটা সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবি না।
দেবী খুবই ভাল মেয়ে। মা যা বলে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। কোনওদিন অবাধ্য হয় না। সে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, বলব না। ওই লোকটাও বারণ করে দিয়েছে।
দেখা গেল, রাজীবের হুঁশিয়ারি ভুলে যায়নি দেবী। সুবর্ণা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এ নিয়ে আর একদম ভাববি না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
লোকটা আমাদের বাড়ি ক’দিন থাকবে মা?’ দেবী জিজ্ঞেস করে।
সুবর্ণা বুঝতে পারছিল রাজীব যতদিন তাদের বাড়িতে থাকবে হাজার বললেও দেবীর ভয় বা আতঙ্ক কোনওটাই কাটবে না। ব্যাপারটা হালকা করে দেওয়ার জন্য বলে, ক’দিন আর? পাঁচদিন, সাতদিন, কি দশদিন।’ বলছিল আর ভাবছিল, দশটা দিনও যদি রাজীব এ বাড়িতে থাকে এবং পিস্তলের একটি কার্তুজও খরচ না করে, আতঙ্কে তাদের আয়ু প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।
দেবী এবার বলে, মাস্টারমশাইকে তো আসতে বারণ করে দিলে। আমার। পড়াশোনার কী হবে?
আমি তোকে পড়িয়ে দেবো। বলতে বলতে উঠে পড়ে সুবর্ণা। রাজীবকে খেতে দিতে হবে। রান্নাবান্নার কতদূর কী হয়েছে খোঁজ নেওয়া দরকার। না হলে মায়াকে তাড়া দিতে হবে।
এ বাড়িতে দু’বেলাই রান্না হয়। দুপুরের তৈরি খাবার রাতে কেউ মুখে তোলে না।
কিচেনে আসতেই সুবর্ণার চোখে পড়ল মায়া লুচির জন্য ময়দা মাখছে। সে। জিজ্ঞেস করল, রান্নার কত বাকি?’
মায়া জানায়, ভাত, ছোলার ডাল, মাংস, আলু-কপির তরকারি আর বেগুনভাজা হয়ে গেছে। খাওয়ার সময় গরম গরম লুচি ভেজে দেবে।
সুবর্ণা মনে মনে হিসেব করে নিল, দাদাশ্বশুরের ঘর থেকে সে আধ ঘণ্টা আগে চলে এসেছে। এর ভেতর নিশ্চয়ই রাজীবের স্নান হয়ে গেছে। কিচেনের দরজার কাছে গিয়ে হল-ঘরের ওধারে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমের দিকে তাকায় সে। ওই ঘরটার দরজা এখন খোলা। ভেতরে রাজীবকে দেখা যাচ্ছে, সে বৃদ্ধকে বোধহয় কিছু বলছে। তার একটা কথাও এখান থেকে অবশ্য শোনা গেল না।
সুবর্ণা মায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, লুচি পরে ভেজো। যা রান্না হয়েছে, একটা থালায় করে দাদাভাইয়ের ঘরে নিয়ে এসো। আমি ওখানে যাচ্ছি।’ বলে হল পেরিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে যায় সে।
রাজীব একটা গদি-মোড়া চেয়ারে বসে ছিল। বলল, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল কি কথা বলতে পারেন না?
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ আপনার এরকম মনে হল?
এক ঘরে পাশাপাশি থাকব। তাই ওঁর সঙ্গে একটু আলাপ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যাই জিজ্ঞেস করি না কেন, উনি শুধু হাসেন। কোনও উত্তর দেন না।
ওঁর কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে বলতে পারেন।
খুব বেশিদিন বাঁচলে এরকম হয়, তাই না? ওল্ড এজ হাজার্ড।
সুবর্ণা বলে, সবার কি একরকম হয়? নব্বই বছরের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধকে। জানি যাঁদের চমৎকার হেলথ, মস্তিষ্কের সেলগুলো পুরোপুরি অ্যাক্টিভ, রোজ দু মাইল মর্নিং ওয়াক করেন, গুছিয়ে সুন্দর কথা বলেন। আমার দাদাশ্বশুর যে কথা বলতে পারেন না, তাঁর স্মৃতিশক্তি যে নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
কী একটু ভেবে রাজীব চোখ কুঁচকে বলে, এই যে হাবা সেজে থাকা, এটা আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’র কোনও ধান্ধা নয় তো?
সুবর্ণা কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, হাবা সাজা, ধান্ধা–এসব কী বলছেন আপনি!
রাজীব বলে, হয়তো ওভাবে অ্যাক্টিং করে আমার ওপর উনি নজর রাখবেন।
প্রচণ্ড রাগে মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু লোকটা যে মারাত্মক খুনে ধরনের সেটা এক মুহূর্তের জন্যও ভোলার উপায় নেই। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে সুবর্ণা বলে, হি ইজ মোস্ট রেসপেক্টেড মেম্বার অফ আওয়ার ফ্যামিলি। ওঁর সম্পর্কে আপনি যা বললেন সেটা কিন্তু একেবারেই সম্মানজনক নয়। তাছাড়া আপনি যখন এ বাড়িতে ঢুকলেন আমি আর দেবী নিচেই ছিলাম। ওঁকে অ্যাক্টিং করতে বলার সুযোগ কিন্তু পাইনি। সে যাক, আপনার খাবার নিয়ে। মায়া আসছে। কোথায় বসে খাবেন? এই ঘরে, না ওখানে?’ বলে হল-ঘরের এক কোণে বিশাল ডাইনিং টেবলটা দেখিয়ে দেয় সে।
কয়েক পলক চুপ করে থাকে রাজীব। পরে বলে, চলুন, ওখানেই যাওয়া যাক। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।
ডাইনিং টেবলে এসে রাজীব এমন একটা চেয়ারে বসে যেখান থেকে পুরো দোতলাটা তো বটেই, একতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত দেখা যায়। অর্থাৎ কোনও দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে সে তক্ষুণি সতর্ক হয়ে যাবে।
সুবর্ণা আন্দাজ করল, সেই পিস্তলটা রাজীবের প্যান্টের পকেটেই রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও খুব সম্ভব সে নিরস্ত্র থাকে না।
সুবর্ণা আগে ততটা খেয়াল করেনি। এবার লক্ষ করল, রাজীবের গালে দাড়িটাড়ি তেমনই রয়েছে। স্নান করার পর ভাল করে মাথাটাথা মোছে নি। তাই ভেজা চুলদাড়ি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঝরছে।
রাজীবের চোখও সুবর্ণার দিকেই ছিল। তার তাকানোটা লক্ষ করে নিজের গালে হাত দিল রাজীব। বলল, এত টায়ার্ড লাগছিল যে আজ আর দাড়িটা কামানো হয়ে উঠল না। কাল শেভটেভ করে খানিকটা ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করব। অন্তত আপনার আত্মীয় বলে যাতে মনে হয় সেদিকে আমার লক্ষ্য থাকবে। আপনি। শেলটার দিয়েছেন। যাতে শ্বশুর মশাইয়ের কাছে বিপন্ন হয়ে না পড়েন সেটা আমি দেখব।’ বলে অল্প একটু হাসল।
এই প্রথম রাজীবকে হাসতে দেখল সুবর্ণা, সে কিছু বলল না।
একতলা থেকে হঠাৎ হরেনের গলা ভেসে আসে, বৌদিদি, আমি ফিরে এসেছি। ওপরে আসব কি?’ এ বাড়ির কাজের লোকেরা, অনুমতি না নিয়ে কখনও দোতলায় উঠত না। সেই রেওয়াজ এখনও চালু রয়েছে।
সুবর্ণার নজরে পড়ল, রাজীবের শিরদাঁড়া মুহূর্তে টান টান হয়ে গেছে এবং চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। সর্বক্ষণ যারা আক্রমণের আশঙ্কা করে, তাদের বোধহয় এমনটাই হয়ে থাকে। সিঁড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে সুবর্ণা বলে, এখন আসার দরকার নেই।
হরেন বলে, কিন্তু বৌদিদি, বড়বাবাকে খাওয়াতে হবে, জামাকাপড় বদলে ঘুম। পাড়াতে হবে। বেশি রাত করলে–
হরেনের ওপর বড়বাবা অর্থাৎ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খানিকটা দায়িত্ব দেওয়া আছে। সকালে তার মুখ ধোয়ানো, ব্রেকফাস্ট করানো, দুপুরে কলেজে বেরুবার আগে স্নান করিয়ে ভাত খাওয়ানো–এ সবই নিজের হাতে করে সুবর্ণা। কিন্তু টানা চার পাঁচটা বড় ক্লাস এবং দু-তিনটে স্পেশাল ক্লাস নেবার পর শরীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে বাড়ি ফিরে আর কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। তাছাড়া পরের দিন ক্লাস নেবার জন্য রাতে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়। অন্য ফাঁকিবাজ অধ্যাপকদের মতো প্রস্তুত না হয়ে দায়সারাভাবে সে পড়াতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের ঠকানোটা সে অন্যায় মনে করে। তাই সন্ধের পর হরেন এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য সব দিনের থেকে আলাদা।
হরেনকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আমিই আজ দাদাভাইকে খাওয়াব।
হরেন বলে, ঠিক আছে বৌদিদি–
মায়া কিচেন থেকে স্টেনলেস স্টিলের বিরাট থালায় ভাত এবং বাটিতে বাটিতে ডাল তরকারি মাংস ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে আসে; খাদ্যবস্তুগুলো রাজীবের সামনে রেখে খানিক দূরে গিয়ে আড় হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে তখনকার মতোই ভীত, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি।
সুবর্ণা মায়ার মনোভাব আন্দাজ করতে পারছিল। একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইনি কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন। আমি কলেজে বেরিয়ে গেলে ওঁর যখন যা দরকার হয় দিও।
এ বাড়িতে কাজের লোকদের প্রশ্ন করার রীতি নেই। মায়া আস্তে মাথা নাড়ল শুধু।
এদিকে ভাতের থালাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজীব। সে যে কতটা ক্ষুধার্ত, তার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
মায়া বার তিনেক আরও ভাত, আরও তরকারি এবং মাংস টাংস এনে দিল। সেগুলো যখন ফুরিয়ে এসেছে সেই সময় একতলার হল-ঘর থেকে হরেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌদিদি, শীগগির নিচে আসুন–
তার গলায় এমন এক আতঙ্ক, ব্যগ্রতা আর উৎকণ্ঠা মেশানো ছিল যাতে ভীষণ চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কী হয়েছে হরেনদা?’
থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
নিজের অজান্তেই সুবর্ণার চোখ দু’টো রাজীবের দিকে ঘুরে যায়। রাজীবও একদৃষ্টে তাকেই লক্ষ করছে। খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। ডান হাতটা মুঠো পাকিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। বাঁ হাতটা নিঃশব্দে পকেটের ভেতর কখন ঢুকে গেছে, টের পাওয়া যায়নি। দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে সে। প্রবল উত্তেজনায় কণ্ঠমণিটা দুরন্ত গতিতে ওঠানামা করছে।
মায়া টেবলের ওধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে খুব চাপা গলায় সুবর্ণা বলে, থানার ওসি’র সঙ্গে দেখা না করে উপায় নেই। আমাকে নিচে যেতে হবে।
গলার স্বর অনেকখানি খাদে নামিয়ে রাজীব বলে, হ্যাঁ যাবেন। নইলে ওসিই ওপরে উঠে আসবে।
সুবর্ণা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে, রাজীব ফের বলে, ওসি কী জিজ্ঞেস করবে, আমি জানি না। ইউ আর সাফিসিয়েন্টলি ইনটেলিজেন্ট। পুলিশের কথার কী জবাব দেবেন সেটা মনে মনে ঠিক করে নিন। ভুলে যাবেন না, আপনার হোল ফ্যামিলি দোতলায় রয়েছে, সেই সঙ্গে আমিও আছি। আর আমার পকেটে কী আছে, ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।
সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার শরীর ভীষণ কাঁপছে।
.