শারমিন আজ খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে।
হালকা আকাশি রংয়ের টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি। সকালবেলা গোসল করে শাড়ি পরার ফলে অপূর্ব লাগছে তাকে। যেন এই মাত্র ফুটে ওঠা এক গোলাপ।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শারমিন। তার চুল খুব ঘন। সহজে শুকাতে চায় না। হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে চুল শুকালো শারমিন। মাথার পেছন দিকে চুলগুলো গোছা করে তুলে ফুলের মতো একটা পাঞ্চক্লিপ দিয়ে আটকালো। তারপর হালকা করে গাঢ় খয়েরি রংয়ের লিপস্টিক লাগালো, বেশ মিষ্টি ধরনের একটা পারফিউম স্প্রে করল। পারফিউমের গন্ধে তার শরীর এবং রুম দুটোই ভরে গেল। সুন্দর সাজ এবং গন্ধে মন ভাল হয় মানুষের। শারমিনের একটু বেশি হলো। ড্রেসিংটেবিলের লম্বা আয়নার দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলল, এই সাজ তুমি আজ কাকে দেখাবে?
সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষের কথা মনে পড়ল শারমিনের। কয়েকদিন ধরে শারমিনের পিছু নিয়েছে। যখনই ইউনিভার্সিটিতে এসে নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে যায়, সিঁড়ির একপাশে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে। ক্লাশ থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় দেখে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসিতে যাওয়ার সময় দুদিন হলো শারমিন খেয়াল করছে দূর থেকে মানুষটা তাকে ফলো করছে। পাঁচ ফিট সাত আট ইঞ্চি লম্বা হবে। উত্তম কুমার টাইপের গোলগোল মুখ। মাথার চুল পাতলা ধরনের, চেহারা এবং স্বাস্থ্য দুটোই মোটামুটি। ফেডেড জিনসের স্কিনটাইট প্যান্ট পরে থাকে, পায়ে খয়েরি রংয়ের বুট। বেশিরভাগ দিনই গায়ে থাকে লুজ ধরনের হাফস্লিভ শার্ট। চোখে মুখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। আর বেশ সিগ্রেট খায়। যতবারই তাকে দেখেছে শারমিন, হাতে সিগ্রেট আছে।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত মানুষটার কথা শারমিন কাউকে বলেনি। ক্লাশের বন্ধুবান্ধব কাউকে না। মানুষটা যেমনি তাকে দেখছে সেও যেন তেমনি করেই দেখছে তাকে। তারপর কোনও একদিন হয়তো তার সামনে গিয়ে দাড়াবে। চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, আপনার ব্যাপারটা কী? আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান?
আজ সকালে কি সেই মানুষটার কথা ভেবেই আকাশি রংয়ের শাড়ি পরল শারমিন! সুন্দর করে সাজল কি তার কথা ভেবেই!
ধুৎ!
শারমিন লজা পেয়ে গেল! সে আমার কে যে তার জন্য আমি সাজব। আমি সেজেছি আমার জন্য। এই সাজ আমি এখন বাবাকে দেখাব, নীলুফুফুকে দেখাব।
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বাবার রুমে এল শারমিন। কিন্তু বাবা রুমে নেই, তার রুমের সঙ্গে যে চওড়া সুন্দর বারান্দা সেই বারান্দায় মন খারাপ। ভঙ্গিতে বসে আছেন। শারমিন এসে তার পাশে দাঁড়াল। বাবা।
মুখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। মন খারাপ। ভঙ্গিটা কেটে গেল তাঁর। মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ্। খুব সুন্দর লাগছে।
কিন্তু তোমার কী হয়েছে?
জাহিদ সাহেব একটু থতমত খেলেন। কী হবে? কিছু হয়নি।
নিশ্চয় হয়েছে। কাল বিকেল থেকে তোমাকে খুব অন্যমনস্ক দেখছি। এখনও কী রকম মন খারাপ করে বসে আছে।
জাহিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কারণটা বুঝিসনি?
বাবার কাধে হাত দিল শারমিন। বুঝব না। কেন? মার মৃত্যুদিন ছিল কাল।
জাহিদ সাহেব মাথা নাড়লেন। এই সেদিনের কথা, দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল।
শারমিন কথা বলল না, মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
এই বাড়িটা উত্তরার পশ্চিমে, অনেকখানি ভেতরের দিকে। বাড়ির সঙ্গে নির্জন ধরনের একটা রাস্তা। রাস্তার পশ্চিমপাশে লেক। লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের মাঠ আর নানা রকমের গাছ, ফুল পাতাবাহারের ঝোপঝাড়। লেকের ওপারেও এপারের মতোই দৃশ্য। এসবের ওপর সকালবেলার আকাশ আজ রোদে ভেসে যাচ্ছে। বসন্তকালের মনোরম একটা হাওয়া বইছে হুহু করে।
জাহিদ সাহেব আপনমনে বললেন, সময় যে কী দ্রুত কেটে যায়! তুই তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিস আর এখন ইউনিভার্সিটির শেষ ক্লাসে। কয়েক মাস পর পরীক্ষা। লেখাপড়ার জীবন শেষ হয়ে যাবে তোর।
শারমিন বাবার দিকে তাকাল। এরকমই তো হওয়ার কথা। সাতবছর কি কম সময়! তারপরও তো সেশনজটের মধ্যে পড়েছিলাম, নয়তো আরও আগেই পড়াশুনা শেষ হতো আমার।
হাত বাড়িয়ে মেয়ের একটা হাত ধরলেন জাহিদ সাহেব। আজ কি তোর ইউনিভার্সিটি খোলা?
শারমিন হাসল। খোলা থাকবে না? হঠাৎ করে ইউনিভার্সিটি বন্ধ হবে কেন?
জাহিদ সাহেব যেন একটু লজ্জা পেলেন। তাই তো! কখন যাবি?
এই তো কিছুক্ষণ পর। দেখছি না। আমি রেডি।
জাহিদ সাহেব হাসলেন। দেখছি।
তুমি অফিসে যাবে না?
না।
শুনে খুশি হয়ে গেল শারমিন। তাহলে আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাই। ইউনিভার্সিটিতে নেমে গাড়ি ছেড়ে দেব।
জাহিদ সাহেব আনমনা গলায় বললেন, না দিলেও অসুবিধা নেই। আমি আজ কোথাও যাব না।
না বাবা, তারপরও ছেড়ে দেব। ইউনিভার্সিটি এলাকায় গাড়ি রাখা খুব রিসকি। কখন কী গণ্ডগোল লাগবে, আমাদের গাড়িটা পাবে হাতের কাছে, দেখা গেল ওটার ওপর দিয়েই যাচ্ছে সব।
একটু থেমে শারমিন বলল, আমি তাহলে বেরোই।
মাত্র পা বাড়িয়েছে শারমিন, জাহিদ সাহেব বললেন, শোন।
শারমিন ঘুরে দাঁড়াল। বলো।
তোর কি খুব জরুরি কোনও ক্লাশ আছে আজ?
না তেমন জরুরি কিছু নেই। কেন?
তাহলে যাবার দরকার কী?
শারমিন অবাক হলো। কেন বাবা?
বাড়িতেই থাক। সারাদিন বাপমেয়ে গল্প করি।
তখন আবার সেই মানুষটার কথা মনে পড়ল। শারমিনের। আজও সে নিশ্চয় আসবে। ইউনিভার্সিটিতে না গেলে শারমিনকে সে দেখতে পাবে না। আকাশি রংয়ের শাড়িতে শারমিনকে দেখলে আজ তার মাথা নিশ্চয় আরও বেশি খারাপ হবে। মুখের ভঙ্গিটা তখন কেমন হবে তার, উদাস বিষণ্ণ থাকবে নাকি একটু উজ্জ্বল হবে। চোখের তারা কি কেঁপে উঠবে তার নাকি স্থির হবে! পলক কি পড়বে না চোখে!
বাবার কথায় ইউনিভার্সিটিতে না গেলে এসবের কোনও কিছুই আজ ঘটবে না।
কিন্তু বাবা কখনও এভাবে বলেন না। তিনি একটু সিরিয়াস ধরনের মানুষ। মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে। যেমন নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারেও তেমন। ফাঁকিজুকি অলসতা এসব তাঁর চরিত্রে নেই। শারমিনকেও তিনি তাঁর মতো করেই তৈরি করেছেন। শারমিনের চরিত্রে মায়ের প্রভাব বলতে গেলে নেইই, প্রভাব যা সবই বাবার।
সেই বাবা আজ নিজে অফিসে যাচ্ছেন না, শারমিনকেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে মানা করছেন, নিশ্চয় তাঁর মন খুব বেশি খারাপ। আজ সারাদিন মেয়ের সঙ্গে চাচ্ছেন তিনি। শারামিনের কি উচিত না বাবাকে সঙ্গ দেয়া! একদিন ইউনিভার্সিটিতে না গেলে কী এমন ক্ষতি হবে। এমন কোনও জরুরি ক্লাশও তার নেই। শুধু ওই ব্যাপারটা। ওটাই বা কী এমন ব্যাপার! আজ না হোক কাল দেখা তো তার সঙ্গে হবেই। এই আকাশি রংয়ের শাড়ি আরেকদিন না হয় পরবে শারমিন।
বাবার রুমের সঙ্গের বারান্দাটা বেশ চওড়া, সুন্দর। রেলিংয়ের ধারে ধারে টবে রাখা নানা রকমের গাছপালা। একপাশে তিনটি বেতের চেয়ার, ছোট্ট একটা টেবিল। বিকেলে সন্ধ্যায় কখনও কখনও রাতে কিংবা ছুটিছাঁটার দিনে এখানটায় মা বাবার সঙ্গে শারমিনও বসেছে অনেকদিন। কত গল্প গুজব, হাসি আনন্দ। মা মারা গেলেন, সেই হাসি আনন্দের দিন উধাও হয়ে গেল জীবন থেকে।
এখন একা একা বাবা বসে থাকেন। কোনও কোনও বিকেলে, সন্ধ্যায় কিংবা রাতে। বাবার সঙ্গে শারমিনও বসে কোনও কোনও সময়।
কিন্তু ওয়ার্কিংডেতে সকালবেলা বাবা বসে আছেন বারান্দায়, শারমিনকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে মানা করছেন, এটা সত্যি একটা রেয়ার ঘটনা।
চেয়ার টেনে বাবার মুখোমুখি বসল শারমিন। আবার সেই প্রশ্নটা করল। তোমার কী হয়েছে বাবা?
জাহিদ সাহেব বিষণ্ণমুখে হাসলেন। বললাম না কিছু হয়নি। তোর মায়ের মৃত্যুদিন ছিল…।
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই শারমিন বলল, না, আমার মনে হয় শুধু এটাই কারণ না। অন্যকোনও কারণ আছে। নয়তো তোমার মতো লোক অফিসে যাচ্ছ না, আমাকেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে দিচ্ছ না, বলছ আমার সঙ্গে গল্প করে দিনটা কাটাবে, এসব তোমার চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
বেমানান কাজও কখনও কখনও করতে হয়। নয়তো জীবন বড় একঘেয়ে লাগে।
আমাদের জীবনটা একটু একঘেয়েই বাবা।
কী রকম?
মোবারক আর মোবারকের মাকে নিয়ে সংসারে পাঁচজন মাত্র মানুষ আমরা। তুমি আমি আর নীলুফুফু। তুমি আছ তোমার বিজনেস নিয়ে, আমি আমার পড়াশুনা, বুয়া আর মোবারককে নিয়ে ফুফু সামলাচ্ছে সংসার। সকালবেলা তুমি আর আমি দুজন চলে যাই দুদিকে। সন্ধ্যার আগে দুজনের আর দেখাই হয় না।
তোর মা বেঁচে থাকতেও তো এমনই ছিল সংসারের চেহারা। এখন নীলু যেভাবে সংসার চালাচ্ছে তোর মাও সেভাবেই চালাতেন। সকালবেলা তখনও তুই আর আমি দুজন দুদিকে চলে যেতম।
তারপরও এতটা একঘেয়েমি সংসারে ছিল না। মা খুবই আমুদে ধরনের মানুষ ছিলেন। প্রায়ই আমাদের নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেতেন। এই আত্মীয় বাড়ি, ওই আত্মীয় বাড়ি। লতায়পাতায় আত্মীয়রাও বিয়েশাদির দাওয়াত দিলে ভাল একটা গিফট নিয়ে চলে যেতেন। তুমি আমি দুজনেই খুব বিরক্ত হতাম। কিন্তু মা তবু যেতেন।
মা বেঁচে থাকতে বছরে দুতিনবার ঢাকার বাইরেও যাওয়া হতো আমাদের। কক্সবাজার চিটাগাং রাঙামাটি সিলেট। একবার কক্সবাজার থেকে মহেশখালী চলে গেলাম। একবার বর্ষাকালে সিলেট গিয়ে তুমুল বৃষ্টিতে জাফলং, তামাবিল চলে গেলাম। তোমার মনে আছে, বাবা?
কেন থাকবে না! সব মনে আছে।
শারমিন তারপর আচমকা বলল, চা খাবে?
খেতে পারি। নাশতার পর একবার খেয়েছি। এখন আরেকবার খেলে ভালই লাগবে।
শারমিন উঠল। বসে আসি।
ছুট কিচেনের দিকে চলে গেল শারমিন। যেভাবে গেল মুহূর্তে ঠিক সেভাবি ফিরে এল। নিজের চেয়ারে বসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, মহেশখালীতে গিয়ে আমরা যে খুব মজা করেছিলাম, সেকথা তোমার মনে আছে বাবা?
কেন থাকবে না!
তাহলে বলো তো মহেশখালীতে যাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্টটা কে করেছিল?
জাহিদ সাহেব হাসলেন। আমি কিন্তু ভুলিনি।
বাবাকে হাসতে দেখে শারমিনও হাসল। ভুলেছ কি না পরীক্ষা হোক।
তালেব।
রাইট। তালেব আংকেল।
সেবারের পুরো অ্যারেঞ্জমেন্টটাই তালেব করেছিল। শৈবালে সুইট বুক করা, হিমছড়ি যাওয়া, মহেশখালী যাওয়া, সব। তালেবদের বাড়িই তো কক্সবাজার শহরে। এবং সে খুব স্মার্ট লোক।
গানও খুব ভাল গায়।
জাহিদ সাহেব অবাক হলেন। তালেবের গানের কথা তোর মনে আছে?
বারে, থাকবে না! একরাতে তালেব আংকেলদের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল। ব্রিতা নামে তালেব আংকেলের এক কাজিন খুব সুন্দর রান্না করেছিল। রূপচাদা ফ্রাই, সিদ্ধাডিমের একটা আইটেম, কী কী সব সামুদ্রিক মাছ, শুটকি। সেইরাতে গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছিলেন তালেব আংকেল। এতসব আমার মনে আছে কেন, জানো বাবা?
কেন বল তো?
সেদিন আকাশে বিশাল চাঁদ ছিল। আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম পূর্ণিমা রাতের সমুদ্র দেখতে।
আইডিয়াটা তোরই ছিল। ওইটুকু বয়সেই চাঁদ খুব পছন্দ করতে শুরু করেছিলি তুই। চাঁদ জ্যোৎস্না এসব দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যেত তোর।
এখনও যায়। আর সেদিন প্রথম গানটা চাঁদ নিয়েই গেয়েছিলেন তালেব আংকেল। পুরনো দিনের গান। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের, এখনও আকাশে চাঁদ ঐ জেগে আছে। চাঁদের কারণেই বোধহয় সবকিছু এত পরিষ্কার মনে আছে আমার।
তবে তালেব খুবই আন্তরিক ধরনের লোক। আমার জন্য জানটা একেবারে দিয়ে দেয়।
তারপরও মহেশখালী যাওয়ার দিন তালেব আংকেলের সঙ্গে তুমি খুব বাজে বিহেভ করেছিলে।
জাহিদ সাহেব খুবই অবাক হলেন। তাই নাকি?
হ্যাঁ। কেন, তোমার মনে নেই?
না একদম মনে নেই। কী করেছিলাম বল তো?
যে ঘাট থেকে মহেশখালী যাওয়ার কথা সেই ঘাটে যেন আগেই স্পিডবোট ঠিক করে রাখেন তালেব আংকেল…
শারমিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই চা নিয়ে এল মোবারকের মা। বাপ মেয়ের মাঝখানকার টেবিলে কাপ দুটো নামিয়ে রেখে চলে গেল।
জাহিদ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, এখন তালোবের ওপর রাগের কারণটা মনে পড়ছে। ওকে বলেছিলাম ভাল একটা স্পিডবোট রিজার্ভ করে রাখতে। সকালবেলা আমাদেরকে মহেশখালী পৌঁছে দিয়ে আসবে, বিকেলবেলা গিয়ে আবার নিয়ে আসবে। ভাড়া যা হয় নেবে। ও সেটা করেনি।
শারমিনও তার চায়ে চুমুক দিল। আরে না, করেছিল। স্পিডবোটঅলাটা ছিল ধান্দাবাজ। অন্য কে একজন বেশি পয়সা অফার করেছে, তাকে নিয়ে চলে গেছে।
ও হ্যাঁ, তাই। মনে পড়েছে।
তালেব আংকেল কিন্তু প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা বোট ঠিক করে ফেলেছিল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে চমৎকার একটা জার্নি হলো আমাদের।
চায়ে চুমুক দিয়ে একটু উদাস হলেন জাহিদ সাহেব। দূরাগত গলায় বললেন, মহেশখালী জায়গাটা বিখ্যাত আদিনাথের মন্দিরের জন্য। পাহাড়ের অনেক উপরে গাছপালা ঘেরা চমৎকার একটা পরিবেশে মন্দির। বহু বহুকালের পুরনো মন্দির। বেশ কষ্ট করে উঠতে হয়। সেই মন্দির দেখে তোর মা যে কী খুশি হয়েছিলেন!
পুরনো দিনের মন্দির টন্দির খুবই পছন্দ করতেন মা। ফেরার সময় সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়েও উঠেছিলাম। আমরা। সেই মন্দির দেখেও মা খুব খুশি।
তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে শারমিন বলল, বাবা, তোমার মনে আছে, আদিনাথের মন্দিরের ভেতর আমি আর মা ঢুকে পড়েছি, তুমি আমাদের ছবি তুলছিলে, পূজারী ভদ্রলোক খুব রেগে গিয়েছিলেন।
ঘটনাটা মনে পড়ল না জাহিদ সাহেবের। চিন্তিত গলায় বললেন, তাই নাকি! এটা তো আমার মনে নেই। আচ্ছা শোন, তোর মা যে বৃষ্টি খুব পছন্দ করতেন সেকথা তোর মনে আছে?
কী বলো, মনে থাকবে না! সিলেট থেকে তামাবিল যাচ্ছি আমরা, ইস সারাটা রাস্তায় যে কী বৃষ্টি!
সত্যি, অমন বৃষ্টি সারাজীবনেই কম দেখেছি আমি। আমরা যাচ্ছিলাম মাইক্রোবাসে। তুই আমি তোর মা আর শাহিন। মানে আমাদের সিলেটের দোকানের ম্যানেজার। সিলেট থেকে জাফলং তামাবিলের রাস্তাটা অসাধারণ। একেবারে ইউরোপ আমেরিকার রাস্তার মতো। একদম সোজা, বেশ চওড়া, বেশ স্মুথ। সেই রাস্তার দুপাশে বিশাল বিল। বর্ষার পানিতে একেবারে টইটম্বুর।
কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছিল না বৃষ্টিতে। মনে হচ্ছিল ঘন কুয়াশায় ডুবে আছে চারদিক। দশবিশ হাত দুরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। তবু যে কী এনজয় আমরা করেছি! বৃষ্টি দেখে তোর মা একেবারে মুগ্ধ। শিশুর মতো ছটফট ছটফট করছিল।
শারমিন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। আমার মনে আছে, সব মনে আছে।
জাহিদ সাহেবও তার চা শেষ করেছেন। কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, কিন্তু তামাবিল পৌঁছাবার পর একদম বৃষ্টি নেই। ওখানে নেমে আমরা ঘুরে বেড়ালাম, ছবি তুললাম, চা খেলাম।
আমি যে একটা কাণ্ড করেছিলাম তোমার মনে আছে, বাবা?
মেয়ের মুখের দিতে তাকালেন জাহিদ সাহেব। কী বল তো?
বাংলাদেশ-ইণ্ডিয়ার বর্ডারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে বিডিআর চেকপোস্ট। একটা ঝুলন্ত বীশের এপারে বাংলাদেশ, ওপারে। ইণ্ডিয়া। বাঁশটির সামনে দাঁড়িয়ে ওপাশে একটি পা দিয়ে আমি বললাম, দেখ বাবা, আমি এখন ইণ্ডিয়াতে।
জাহিদ সাহেব হাসলেন। এখন মনে পড়ছে।
আর ফেরার সময়কার কথা তোমার মনে আছে? ওপাশের ভারতীয় আকাশ ছোয়া পাহাড় থেকে যে ছবির মতো ঝরছিল ঝরনা।
হ্যাঁ, ঝরনা দেখেও তোর মা খুব খুশি হয়েছিলেন।
তারপর দুজনেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। কিছুটা সময় কাটল নিঃশব্দে।
একসময় জাহিদ সাহেব বললেন, তোর মার মনটা খুব নরম ছিল। মানুষের জন্য খুব মায়া ছিল তার।
শারমিন বলল, ঠিকই বলেছ। তোমার মনে আছে বাবা, আমাদের বাড়িতে একটা বুয়া ছিল আছিয়া নামে। বুয়ার নদশ বছরের ছোট ভাইটি রিউমেটিক ফিবারে মরো মরো। পা দুটো অচল হয়ে গেছে। প্রায় পঙ্গু। গ্রামে গিয়ে বুয়া তার ভাইটিকে নিয়ে এল। তোমার ভয়ে উপরে আনল না, সিঁড়ির তলায় শুইয়ে রেখে উপরে এসে মারা পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আফা, আমার ভাইটারে আপনে বাঁচান।
সব মনে আছে। ছেলেটির নাম ছিল ইলতুতমিস। আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তোর মা তাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাল। ছসাত মাস চিকিৎসা করাল। কিন্তু পুরোপুরি সেরে সে ওঠেনি, একটা পা টেনে টেনে হাঁটতো। কিন্তু বেঁচে তো গেল। তারপর কিছুদিন আমাদের বাড়িতে কাজও করেছিলে।
জাহিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাল মানুষরা বেশিদিন বেঁচে থাকে না মা, বুঝলি। তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন তোর মা। স্ট্রোক করল, কোমায় চলে গেল। আঠারো দিন থাকল জীবনমৃত্যুর মাঝখানে। তারপর চিরবিদায়। গতকাল সাতবছর পুরো হলো।
মৃত্যুর স্মৃতি পরিবেশ ভারি করে তোলে। বাপ মেয়ে দুজনেই কেমন উদাস হয়ে গেল। বোধহয় এই অবস্থা কাটাবার জন্যই মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে কিছু একটা যেন খেয়াল করার চেষ্টা করলেন।
বাবাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো শারমিন। কী দেখছ?
তোকে।
সঙ্গে সঙ্গে শারমিন তার স্বভাবসুলভ উচ্ছল ভঙ্গিতে বলল, আমাকে কেমন লাগছে বাবা?
ভাল, খুব ভাল। কিন্তু তোর সাজগোজের মধ্যে একটা খুঁত আছে।
কী?
তুই আজ টিপ পরিসনি। টিপ পরলে সাজটা বোধহয় কমপ্লিট হবে।
বুঝলাম। কিন্তু কমপ্লিট করে লাভ কী? সুন্দর সাজগোজ করে ঘরে বসে থাকার কোনও মানে আছে।
চল। তাহলে বাইরে কোথাও যাই।
কোথায়?
তোকে বাইরে কোথাও খাইয়ে নিয়ে আসি।
শুনে আনন্দে একেবারে লাফিয়ে উঠল। শারমিন। সত্যি? তাহলে শেরাটনে নিয়ে যাও বাবা। শেরাটনের পুলসাইটটা আমার খুব ভাল লাগে। ওখানে বসে দুজনে আমরা গল্প করব আর খাব ৷
আচ্ছা। তোকে আজ দুটো ঘটনার কথা বলব। একটা হচ্ছে তোর মায়ের মৃত্যুর সময়কার। তোর মা যখন কোমায়, হাসপাতালের বেডে না জীবিত না মৃত অবস্থায়, সে সময় একদিন ভোররাতে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখেছিলাম আমি। আমাদের এই উত্তরাতেই ঘটেছিল ঘটনাটা।
কী ঘটনা?
জাহিদ সাহেব মাত্ৰ কথা বলবেন, তার বেডসাইডে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। জাহিদ সাহেব প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন। আমরা তাহলে সাড়ে বারোটার দিকে বেরুব।
শারমিনও উঠল। আচ্ছা।
তারপর বাবার রুমে না চুকে বারান্দা দিয়ে নিজের রুমে চলে এল। এসময় আবার মনে পড়ল সেই মানুষটির কথা। কেন শারমিনকে সে ফলো করছে? কী চায়? প্ৰেম! প্ৰেম কি এইভাবে পাওয়া যায়! এইভাবে হয়! গল্প উপন্যাস সিনেমা নাটকে হয়তো হয়। বাস্তবে কি হয়!
ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় অনেকগুলো টিপ লাগানো। যখন যেটা পরে এখান থেকে নিয়েই পরে শারমিন। খুলে এখানেই লাগিয়ে রাখে। আঠা শেষ হয়ে গেলে আপনাআপনিই ঝরে যায় কোনও কোনওটা। তখন নতুন টিপ বের করতে হয়।
কিন্তু এখন যেগুলো আছে সবগুলোই প্রায় নতুন।
মাঝারি সাইজের একটা টিপ নিয়ে পরল। শারমিন। সঙ্গে সঙ্গে তার সৌন্দৰ্য যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। সত্যি এখন যেন সাজটা তার কমপ্লিট হলো। আকাশি রংয়ের শাড়ি, লালটিপ, গোলাপের মতো সৌন্দর্য সবমিলিয়ে বসন্তরাতের একটুকরো চাঁদের আলো এসে যেন ঢুকে গেছে শারমিনের রুমে। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে শারমিন মনে মনে সেই মানুষটির উদ্দেশ্যে বলল, তোমার দুর্ভাগ্য, আজ আমাকে তুমি দেখতে পেলে না। দেখলে মাথা তো খারাপ হতোই, শুধু ইউনিভার্সিটিতে না আমাকে ফলো করতে করতে তুমি নিশ্চয় এই বাড়ি পর্যন্ত চলে আসতে। আমাদের বাড়ির সঙ্গের রাস্তার ওপাশে যে বকুলগাছ ওই বকুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমার রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কখন একপলক দেখতে পাবে আমাকে।
কী রে, কী বলছিস মনে মনে?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল শারমিন। নীলুফুফু। কখন এসে ঢুকেছেন তার রুমে। হাসিমুখে ফুফুকে সে বলল, মনে মনে বলা কথা কি তুমি শুনতে পাও?
নীলু হাসলেন। হ্যাঁ, তোরটা পাই।
তাহলে বলো তো কী বলছিলাম?
বলছিলি তোর সঙ্গে যার বিয়ে হবে সে দেখতে কেমন? কী করে? কোথায় থাকে!
বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেল শারমিন। ধুৎ। আমার মনের কথা তুমি কিছুই শুনতে পাওনি। আমি বলছিলাম। একেবারেই উল্টো কথা।
কী বল তো!
এগিয়ে এসে দুহাতে ফুফুর গলা জড়িয়ে ধরল শারমিন। আমি বলছিলাম, এখন আমি ফুফুর কাছে যাব। গিয়ে বলব, ফুফু, আমি আজ ছোট্ট খুকি। তুমি আমাকে একটু কোলে নাও।
নীলু হাসলেন। ধুৎ পাগল মেয়ে।
নীলুর কথা পাত্তা দিল না শারমিন। শিশুর মতো আবদেরে গলায় বলল, ও ফুফু, নাও না আমাকে একটু কোলে। কতদিন তোমার কোলে চড়ি না।
তারপর আচমকা খিলখিল করে হাসতে লাগল।