সাধুসন্তদের অলৌকিক কথা
ব্রহ্মচারী বাবা
ছেলেবেলা থেকেই কোন সাধুসন্তর খবর পেলেই তাঁর কাছে দৌড়োই, সত্যি তাঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে কী না জানার ইচ্ছেয়। সালটা বোধহয় ১৯৬৪। আমার কলেজের বন্ধু বরাহনগরের শশীভূষণ নিয়োগী গার্ডেন লেনের গোরাচাঁদ দত্ত একদিন বলল, ওদের পারিবারিক গুরুদেব এক ব্রহ্মচারী বাবার অলৌকিক ক্ষমতার কথা। ওদের গুরুদেবের নাম আমি আগেই শুনেছি। এও শুনেছি, ওঁর লক্ষ লক্ষ শিষ্য-শিষ্যা। বাংলা তথা ভারতে এই ব্রহ্মচারী বাবার নাম ‘বালক ব্রহ্মচারী’ বলে খুবই পরিচিত।
গোরা আমাকে একদিন বলল, ‘”তুই তো অলৌকিক ক্ষমতার মানুষ খুঁজছিস, আমি কিন্তু নিজের চোখে আমার গুরুদেবকে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে দেখেছি। বরানগরের স্কুলে একবার গুরুদেবের জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা হয়ছে। অনুষ্ঠান সন্ধেতে। কিন্তু, বিকেল থেকেই হাজার হাজার লোকের ভিড়। বরানগরে ওঁর প্রচুর শিষ্য-শিষ্যা। আমরা স্থায়ীন কিছু তরুন শিষ্য ভলান্টিয়ার হয়ে অনুষ্ঠান যাতে সুন্দরভাবে হয় তার দেখাশোনা করছি। বিকেলবেলাতেই এক ভদ্রলোক দশ-বারো বছরের ছেলের হাত ধরে এসে হাজির হলেন। উনি আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কখন আসবেন?
বললাম, সন্ধে নাগাদ।
ভদ্রলোক বললেন, তিনি এসেছেন বহুদূর থেকে। শুনেছেন বাবার অপার অলৌকিক ক্ষমতা। এও শুনেছেন, বাবার কাছে কেউ দীক্ষা নিতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে দীক্ষার জপ-মন্ত্র দিয়ে দেন। অনেক আশা করেন তাঁর দুই বোবা-কালা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। বাবাকে বলবেন, এদের দুটিকে দীক্ষা দিতে। দেখতে চান, কেমন করে বোবা-কালারা জপ-মন্ত্র শোনে।
“ভদ্রলোক ও তাঁর ছেলে দুটিকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে ওদের আগমের উদ্দেশ্য ভলাণ্টিয়ার, চেনা, মুখ-চেনা, অনেকের কাছেই বলেছিল গোরা। খবরটা দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল। সব ভক্ত প্রচণ্ড ঔৎসুক্য ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন–কী হয়? কী হয়? সত্যিই কি বাবার দেওয়া জপ-মন্ত্র ওরা শুনতে পাবে?
সন্ধের আগেই হাজার-হাজার শিষ্য-শিষ্যা ও ভক্তেরা বারবার ভদ্রলোক ও তাঁর দুই ছেলেকে কৌতূহলের চোখে দেখে গেল।
শেষ পর্যন্ত সেই শুভ মুহূর্তটি এল। গুরুদেবের চরণে প্রণাম জানিয়ে ভদ্রলোক তাঁর দুই ছেলেকে দীক্ষা দিতে অনুরোধ করলেন। গুরুদেব ছেলেদুটিকে একে একে কাছে টেনে নিয়ে জপ-মন্ত্র দিয়ে বললেন, শুনতে পেয়েছিস তো?
হাজার হাজার ভক্ত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন এরপর কী হয় দেখার জন্য। ছেলে দুটি পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, শুনতে পেয়েছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভক্তেরা হৃদয়াবেগ সংযত করতে পারলেন না। অনেকেরই দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা। স্কুলের হল-ঘর গুরুদেবের জয়ধ্বনিতে ভরে গেল। ভদ্রলোক লুটিয়ে পড়লনে গুরুদেবের পায়ে।”
গোরার কাছে এই ঘটনা শোনার পর একদিন ওর সঙ্গে গেলাম গুরুদেব-বালক ব্রহ্মচারীর দর্শনে। কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় তখন তিনি থাকতেন। একতলার একটা হলের মতো বিরাট ঘরে প্রচুর ভক্ত অপেক্ষা করছিলেন। আমি আর গোরাও ওই সকলকেই ডাকা হবে। ওখানে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে আলাপ করে ফেললাম। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ভারত-বিখ্যাত শিক্ষাবেত্তা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি ওঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নিজে দেখেছেন?”
উত্তর তিনি যা বললেন, তা খুবই বিস্ময়কর। উনি একবার গুরুদেবের কাছে খিদে পেয়েছে বলাতে গুরুদেব বললেন, “দাঁড়া, তোর খাবার আনার ব্যবস্থা করছি।” গুরুদেব ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন, একটা আলো হয়ে গেলেন। তারপর আলোর ভেতর থেকে ভেসে এলো সোনার থালায় সাজানো নানা রকমের মিষ্টি। কী তার স্বাদ! কী তার গন্ধ! অপূর্ব! জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এ ঘটনার সময় আপনার সঙ্গে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন?”
“না, শুধু আমিই ছিলাম।”
একসময়ে আমাদের ডাক পড়ল। সকলের সঙ্গে ওপরে গেলাম। তলার ঘরটার মতোই একতা বড় ঘরে সিল্কের গেরুয়া পরে একটা বাঘছালের উপর বসে আছেন গুরুদেব। চারিদিকে পেলমেট থেকে দীর্ঘ ভারী পরদা ঝুলছে। ঘরে মৃদু আলো। দেখলাম ভক্তেরা একে একে করে তাঁর কাছে গিয়ে প্রণাম করে নিচে চলে যাচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি। কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন মিষ্টির প্যাকেট। কেউ কেউ শিশি বা বোতলে জল নিয়ে এসেছেন। ওই জলে গুরুদেবের পায়ের বুড়ো আঙুল ডুবিয়া পবিত্র পাদোদক করে নিচ্ছেন।
ব্রহ্মচারীর এক সেবক যিনি সমস্ত ব্যাপারটা তদারক করছিলেন, তিনি একসময় আমাকে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বললেন। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম না জানিয়ে ব্রহ্মচারীবাবাকে বললাম, “শ্রদ্ধার থেকেই প্রণাম আসে। আমার একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে আপনার অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গেই প্রণাম করব।” ব্রহ্মচারীবাবা ইশারায় ঘরের কোনায় দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়ালাম। শিষ্যদের প্রণাম শেষ হতে ব্রহ্মচারী আমার দিকে তাকালেন। আমার পাশে ছিল গোরা ও সেবক ভদ্রলোক। বালক ব্রহ্মচারী আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “তোর প্রশ্নটা কী” মুখে একটা রহস্যের হাসি।
বললাম, “আমি গতকাল সন্ধে সাতটার সময় কোথায় ছিলাম?”
ব্রহ্মচারী এবার গোরাকে বললেন, “ও বুঝি তোর বন্ধু? তা, তুই নিচে গিয়ে বোস। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলব।”
গোরা বেরিয়ে যেতেই সেবকটিকে বললেন, “তুই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যা। কেউ যেন আমার কাছে এখন না আসে।”
সেবকটি চলে যেতে ব্রহ্মচারীবাবা আমার সঙ্গে নানা রকম গল্পসল্প করলেন। আমার বাড়ির খবরাখবর নিলেন। এরই মধ্যে এক সময় সেবকটি দরজা খুলে জানাল, “দুই ভদ্রলোক এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এসেছেন। মহিলাটির গল-ব্লাডারে স্টোন হয়েছে। আজই নার্সিংহোমে অপারেশন করার কথা। আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছেন।”
ব্রহ্মচারী বললেন, “অপেক্ষা করতে বল, দেরি হবে।”
আমরা আবার আমাদের গল্পে ফিরে গেলাম। সময় কাটতে লাগল, এক সময় আবার সেকবটি ঘরে ঢুকে বলল, “গুরুদেব পেশেণ্ট যন্ত্রণায় ছটফট করছে। যদি অনুমতি করেন তো–”
বিরক্ত গুরুদেব বললেন, “যা নিয়ে আয়।”
একটু পরেই দুই ভদ্রলোকের সাহায্যে সেবকটি এক মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মহিলাটির মুখের চেহারায় তীব্র যন্ত্রণার চাপ। মহিলাটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের ভঙ্গিতে গুরুদেবের পায়ের কাছে শুইয়ে দেওয়া হলো। গুরুদেব সঙ্গে লোকদুটিকে বললেন, “তোরা নীচে গিয়ে বোস।” সেবকটিকে বললেন, ” যা কুশিতে করে একটু জল নিয়ে আয়।”
সেবক কুশিতে জল নিয়ে এলেন। তারপর তিনিও গুরুদেবের আদেশে বেরিয়ে গেলেন।
ব্রহ্মচারী কুশিটি মহিলাটির পিঠের উপর বসিয়ে তিরিশ সেকেণ্ডের মতো বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়লেন ও কুশির জলে বারকয়েক ফুল ছিঁড়ে পাপড়ি ছুঁড়লেন। তারপর আমাকে বললেন, “দেখ তো, জলটা গরম হয়েছে কি না?”
কুশির জলে হাত দিলাম, গরম। বললাম, “গরম হয়েছে।”
ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “এবার কুশিটা পিঠ থেকে নামিয়ে ওকে তুলে দাঁড় করা।” করলাম। গুরুদেব আদেশ দিলেন, “এবার ওকে জোর করে দৌড় করা।”
তাই করলাম, মহিলাটি, “পারব না, পারব না,” করে ভেঙে পড়তে পড়তেও আবার জন্য দৌড়তে বাধ হলেন। এবং তারপর দৌড়ে গুরুদেবের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে বললেন, “বাবা আমি ভাল হয়ে গেছি।”
গুরুদেব হাসলেন। বললেন, “যা নার্সংহোমে যেতে হবে না, বাড়ি ফিরে যা।”
মহিলাটি নিজেই হেঁটে চলে গেলেন। ব্রহ্মচারী এবার আমাকে বললেন, “তুই মাঝে মাঝে এখানে এলে এমনি আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবি। এবার আমাতে বিশ্বাস জন্মেছে তো তোর?”
বললাম, “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। তা পেলেই আমার বিশ্বাস জন্মাবে।”
জাদুকররা যেমন দর্শকদের মধ্যে নিজেদের লোক রেখে সাজানো ঘটনা দেখিয়ে দর্শকদের অবাক করে দেন, অনেক গুরুদেবই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে এই ধরনের নানা রকমের সাজানো ঘটনার অবতারণা করেন।
গুরুদেব যা দেখালেন সেটা সাজানো ব্যাপার হতে পারে।
কুশির জল মন্ত্র পড়ে গরম করার ঘটনাটির পিছনেও ধাপ্পাবাজি থাকা সম্ভব। ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “দেখ তো কুশির জলটা গরম হয়েছে কিনা?” আমি দেখেছিলাম গরম। এমনও তো হতে পারে, গরম জল এনেই রোগিণীর পিঠে রাখা হয়েছিল।
ব্রহ্মচারীবাবা আমাকে বললেন, “যা দরজাটা ভেজিয়ে দে। তোর সঙ্গে আর কিছু কথা আছে।”
আদেশ পালন করলাম। ব্রহ্মচারীবাবা নিজেই উঠে গিয়ে দেওয়াল-আলমারি খুলে একটা রাইটিং প্যাড ও পেনসিল নিয়ে এলেন। প্যাড আর পেনসিলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “আমাকে না দেখিয়ে এতে লেখ, কাল সন্ধের সময় কোথায় ছিলি?”
লিখলাম, মধ্যমগ্রামে; বিপুলদের বাড়িতে।
ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “প্যাডের কাগজটা ছিঁড়ে তোর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখ।”
ধরে রাখলাম, তবে শক্ত করে নয়, আলতো করে। ব্রহ্মচারীবাবা আমার হাত থেকে প্যাডটা নিলেন। তারপর তাঁর মুখোমুখি আমাকে বসালেন। আমাকে চোখ বুকে এক মনে সমুদ্রে সূর্যোদয়ের দৃশ্য ভাবতে বললেন। আমি ভাবতে লাগলাম।
আমার কপালটা কিছুক্ষণ ছুঁয়ে থেকে গুরুদেব বললেন, “দেখতে পাচ্ছি তুই গিয়েছিলি একটা গ্রাম-গ্রাম জায়গায় মধ্যমগ্রাম। বাড়িটাও দেখতে পাচ্ছি। ঠাণ্ডা, শান্ত, বড় সুন্দর পরিবেশ।”
বললাম, “সত্যিই সুন্দর। মুলিবাঁশের দেওয়াল, মাটির মেঝে, টালির চাল, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা আর শান্ত পরিবেশ।”
গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ তাই দেখতে পাচ্ছি। একটা লাউ না কুমড়ো গাছ যেন ওদের বাঁশের দেওয়াল বেয়ে উঠেছে।”
আরও অনেক কিছুই বলে গেলেন উনি। কিন্তু ততক্ষণে গোরার গুরুর দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে। কারণ। গতকাল সন্ধ্যে ছ’টা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলাম কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। জাদুকররা অনেক অস্ময় কার্বন পেস্টেড কাগজের প্যাডে দর্শকদের দিয়ে কোন কিছু লিখিয়ে তলার কাগজে কার্বনের ছাপে কী উঠেছে দেখে বলে দেন কী লেখা হয়েছিল। অনেক সময় সাধারণ প্যাডে হার্ড পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখলে তলার পাতাটায় পেন্সিলের সীসের গুঁড়ো ঘষেও বলে দেওয়া হয়, কী লেখা হয়েছিল। আমি কফি হাউসে থেকেও ইচ্ছে করে লিখেছিলাম মধ্যমগ্রামে; বিপুলদের বাড়িতে। অলৌকিক ক্ষমতার বদলে কৌশলের আশ্রয় নিতে গেলে গুরুদেব ভুল করতে বাধ্য। আর ভুল করতে বাধ্য হলেনও। আমি সামান্য একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে বিপুলদের বাড়ির যে ধরনের বর্ণনা দিলাম গুরুদেবও সেই বর্ণনাতেই সায় দিয়ে গেলেন। অথচ বিপুলদের বাড়ি দস্তুরমতো পেল্লাই পাকা বাড়ি