০১. বুঝলে পার্বতী

হর-পার্বতী সংবাদ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বুঝলে পার্বতী।

আবার, আবার তুমি ওই রেফযুক্ত নামে আমাকে সম্বোধন করছ। বলছি না পারু বলে ডাকবে। তোমার মুখে বড় মিষ্টি শোনায় গো। তা ছাড়া এই সেদিন তোমার দাঁত বাঁধানো হয়েছে। মুখে ধরে রাখার কায়দাটা এখনও রপ্ত করতে পারনি। রেফ্‌, রফলা, যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে গেলেই খুলে-খুলে যাচ্ছে। পেনসানের টাকায় একবারই দাঁত বাঁধানো যায়। বারে বারে কে তোমার দাঁত বাঁধিয়ে দেবে। বয়েস হচ্ছে, বুদ্ধি কিন্তু তেমন খোলতাই হচ্ছে না। এবার থেকে পারু বলবে।

দাঁত বের করে অমন চ্যাংড়া ছোঁড়াদের মতো হাসছ কেন? নতুন দাঁত দুপাটির আনন্দে।

না পারু। দাঁতের আনন্দে সেই একবারই হেসেছিলুম। মায়ের কোলে বসে। ছবছর বয়েসে। তারপর শুধু কেঁদেছি। মিষ্টি আমার দাঁত খেয়েছে। ওই তোমাদের র‍্যাশানের চালের কঁকরে চাকলা উঠে বেরিয়ে গেছে। শেষে দাঁত আমার বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি হাসছি অন্য কারণে। ভাগ্যিস বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার কমিটি তোমার নাম থেকে একটা ব খুলে নিয়েছিল, তা না হলে ববিএ রেফের ঠেলায় আমার দন্তপঙতির কী হত!

এক ধামা কাগজ নিয়ে সাত সকালেই পেছন উলটে বসে আছ কেন? অন্য কাজ নেই?

গিন্নি, ভুলে গেলে? গবাক্ষপথে একবার অবলোকন করো, ওই দেখো এসেছে শরৎ হিমের পরশ। ধামা ধামা ডাক আসছে ভক্তদের। অবশ্য হিন্দিতেই ডাকছে, আযা, আ যা, মেরা জান, দিল পহছান। তৈরি হও। বোধন এসে গেল। এবার ল্যান্ড করতে হবে।

পুজো এবার হবে?

কেন পারু? পুজো কেন হবে না?

গদিতে যাঁরা গর্দানসীন, আমার সেই সব সোনার চাঁদেরা ধম্মকম্ম মানে না রে বাপু। তারা বলে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বুড়ো এবার মনে হয় পুজো হবে না। বন্যা।

তোমার মাথা। প্রতি বছরই বন্যা হয়। বন্যা না হলে কী হয়, চার ছেলেমেয়ের মাকে আমি কী করে বোঝাব? রাজনীতির হালচাল উনি আজও শিখলেন না। কচি খুকি! বন্যা চাই, খরা চাই, খরা চাই, বন্যা চাই।

রেগে যাও কেন? রেগে যাও কেন? কথায়-কথায় অত রাগ ভালো নয়। একে তোমার হাইপ্রেসার, তার ওপর সুগার, তার ওপর এসকেমিক হার্ট।

পারু যেখানে যাচ্ছ, সেখানে ইংলিশ মিডিয়ামের জন্যে সব খেপে আছে। টাকে ছেলে নিয়ে বড়-বড় স্কুলের গেটে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। তোমার মতো দিদিমণিরা সব চুল বব করে, ঠোঁটে লিপস্টিক চড়িয়ে, লম্বা সিগারেট গুঁজে পিড়িং-পিড়িং ইংরিজি ছাড়ছে। ওই যে ইংরিজিটা বললে, ওটা এসকিমোদের দেশে চলতে পারে। বলো, ইসকিমিক হার্ট।

কত্তা আমাদের ভাষা তো দেবভাষা। কোনও ভয় নেই। ওই পূজারী ব্রাহ্মণ অনুস্বার, বিসর্গ লাগিয়ে যা বলবে তাই মন্ত্র হয়ে যাবে। আর ষষ্ঠীর দিন না সপ্তমীর ভোর রাতে রেডিওতে চণ্ডীপাঠ। আমারই বন্দনা। তোমাকে আর কে চায় বলো?

তাই তো। তাই তো। সারা শ্রাবণমাস বাঁক কাঁধে কাতারে কাতারে আমার ভক্তরা যায় কোথায়? আজকাল আবার দু-হাত অন্তর চটি হয়। হিন্দিগানে দিনরাত বাতাস কাঁপতে থাকে। এই ভোলেবাবা পার না করলে গুরুদের কী দশা হত! ভেবে দেখেছ একবার? আমার পয়লা ভক্ত অমিতাভ বচ্চন কী ফ্যানটাসটিক গেয়েছে, জয় জয় শিবশঙ্কর/কাটা লাগে না টঙ্কর…

ফিল্মের কিছু বোঝো না যখন বলতে যাও কেন? অমিতাভ বাবা গায়নি। সে শুধু নেচেছে আর লিপ দিয়েছে। গান গেয়েছে গানের আর্টিস্ট। যাক কজায়গা থেকে নিমন্ত্রণ এল? বেড়েছে না কমেছে?

কমবে? কমবে কেন? বেড়েছে। শোনো সার্বজনীন অনেকটা টিউমারের মতো, আবের মতো। বেড়েই চলে। বেড়েই চলে। বাঙালির জীবনে আর কী আছে বলো? চাকরি নেই, বাকরি নেই, জল নেই, আলো নেই, খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সুখ নেই, নিরাপত্তা নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই। থাকার মধ্যে এই পুজোটুকু আছে।

আমার ভক্তদের এ হাল কেন?

ওই যে কেন্দ্র। মহিষাসুর। এবারে আসার সময় একটু দাবড়ে দিয়ে এসো তো?

কেন্দ্রটা কোথায়?

ওই যে গো, আগে যে জায়গাটাকে আমরা ইন্দ্রপ্রস্থ বলতুম।

সিংহাসনে কে?

গিন্নি, তোমার জ্ঞান কমছে। ওখানে আর সিংহাসন নেই। রিপাবলিক বুঝলে, গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। জনগণমন অধিনায়কেরা সুজলাং সুফলাং নৃত্য করছে। বেগোড়বাঁই কিছু দেখলেই মিছিল নিয়ে পথে নেমে পড়ছে, চলবে না, চলবে না। কী চলবে সেটা এখনও ঠিক হয়নি বলে মোটামুটি সবই অচল হয়ে আছে।

সে কী গো, তাহলে বারোয়ারি হবে তো?

বারোয়ারি ঠিকই হবে। পাবলিকের টাকায় বারো ইয়ারে ঠিক জমিয়ে দেবে। তোমার আর আমার তেমন শত্রু নেই। রাইটার্সে ভেরি পপুলার। মন্ত্রীরাও বলে ফেলেন, ভোলেবাবা পার করে গা। সিনেমার নায়িকা কেঁদে-কেঁদে বলে, ত্রিশূলধারী শক্তি যোগাও। আর তুমি তো ক্যাপিটাল গো, মূলধন। তোমাকে পেছনে রেখে, পুজো, পুজো কমিটি। বাইশের পল্লী, তেইশের পল্লী। বিল বই, চঁদা। প্রিপূজা সেল, পূজা সেল, একজিবিসান, ফাংশান। পটুয়াপাড়ায় তুমি হাফ-ফিনিশ হয়ে এসেছ। দোমেটের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। তোমার ছাঁচে ঢালা মুণ্ডু সার-সার তাকে তোলা আছে। ঠ্যাঙে বায়নার টিকিট ঝুলছে। গেরস্থরা মার্কেটিং-এ নেমে পড়েছে। শ্যামবাজার থেকে গড়িয়া গুতোগুতি শুরু হয়ে গেছে।

বুঝলে, গতবার ভীষণ মশা কামড়েছে। এক-একটার সাইজ কী, যেন টুনটুনির বাচ্চা। কামড়ে কামড়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে।

কার নাম? শ্বশুরমশাইয়ের? বেশ করেছে। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার চির অবনিবনা। হিংসে বুঝলে হিংসে। আমার পপুলারিটি ভদ্রলোক সহ্য করতে পারেন না। এবারে প্যাণ্ডেলে সিংহের পিঠে উঠে পোজ দেওয়ার আগে বড়বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটা নাইলনের মশারি কিনে নিও। ম্যালিরিয়া ফ্লু আর ডেঙ্গু একসঙ্গে ধরলে ধন্বন্তরির বাবার ক্ষমতা নেই সারায়।

কী হবে গো?

আবার কী হল?

গতবারে পুলিশ নাকি খুব বেঁকে বসেছিল। যেখানে-সেখানে প্যাণ্ডেল বাঁধতে দেবে না। চাদা নিয়ে জুলুম করলে চ্যাংদোলা করে তুলে আনবে।

তাতে তোমার পুজোর কোনও অসুবিধে হয়েছিল? প্যান্ডেলের চেকনাই কি কিছু কম ছিল?

তা ছিল না অবশ্য।।

তবে এবারেও ঠিক তাই হবে। পুলিশ যেমন শাসায় তেমনি শাসাবে। চাদা যা ওঠে তার চেয়ে বেশিই উঠবে। ভুলে যেও না গিন্নি দেশের নাম পশ্চিমবাংলা। তাই তো কবি গাহিয়াছেন;

এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/তবু রঙ্গে ভরা।

সব হবে। সব এক মঞ্চে পাশাপাশি হবে। পাতালরেল, চক্ররেল, বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ, দাবি মিছিল, ধর্ম মিছিল, বিয়ের মিছিল, ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাত্রা-উৎসব, বাংলা বন্ধ, বোম, ছোরাছুরি, ভোট, ব্যালে নাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, বন্যা, খরা, বনমহোৎসব, বননিধন, সব পাশাপাশি চলবে। বাপের শ্রাদ্ধ। ছেলের বিয়ে। তুমি কিস্যু ভেবো না।

সরস্বতীটা একটু বেঁকে বসেছে। বলছে রাজ্যপাল রাজভবন থেকে না নড়লে ও যাবে না।

সেরেছে। ও আবার রাজনীতিতে নাক গলিয়েছে! মাথায় ঘোল ঢেলে ছেড়ে দেবে। ওকে বলো এ পুজোয় ওর তো বীণা হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। এ তো তোমার পুজো। সেই মাঘে ওকে যখন একা যেতে হবে তখন যেন নিজের মত খাটায়। বিশ্বকর্মাকে দেখে শিখতে বলো। কল নেই, কারখানা নেই। শিল্পের সমাধিতে কেমন হাতি চেপে ঘুরে এল। চলছে-চলবে-র দেশ। ওখানে সবই তো খেলা গো!

পুজোও খেলা?

আলবাত। পুতুল খেলা। মা-মা করে চেল্লায়, তুমি ভাবো খুব ভক্তি! গিন্নি, তুমি হলে বেওসা। মা আসছেন, মা আসছেন, ঘোড়ার ডিম, আসলে পুজোর বাজার আসছে। বাবুদের বোনাস আসছে। যাদের ভাড়ে মা ভবানী তাদের আতঙ্ক আসছে। দোকানে ঝুলছে শাড়ি। সিল্ক, জর্জেট, পলিয়েস্টার, পিওর সিল্ক, অরগ্যাঞ্জা। ঝুলেছে পোশাক। টপলেস, বটমলেস।

সে আবার কী?

দেবী হয়ে বসে আছ, চিরকাল চেয়ে রইলে পায়ের তলায় হামাগুড়ি অসুরটির দিকে। ক্যাপ্টেন কার্তিককে শুধিয়ো, সে-ছোঁড়া সব জানে। পোশাকের চেয়ে স্টাইল বড়। সিথু, কী বস্তু জানো গিন্নি? বলতে শরম লাগে। তোমার বয়েস না হলে পরাতুম। শাড়ি পরেছ কী পরনি। তোমার কাঠামোটি পুরো দেখা যাবে। যেন একসরের চোখে তোমাকে জগদবাসী জুলজুল করে দেখছে। তোমার ডায়গ্রাম নয় স্কায়াগ্রাম।

মরণ আর কী! ফ্যাশানের মুখে ঝাড়ু মারো। আর বটমলেস, টপলেস কী জানো? বাক্স আছে, মাল নেই। খুলে পরো। কী পরো? মায়া কাঁচুলি। সব খোলা। উদোম। সি সি সিটি। সাধে আমি একটি পাথরের লিঙ্গ হয়ে মন্দিরে-মন্দিরে বসে আছি! চোখ, নাক, কান, মুখ, হাত, পা, দেহ কিছুই নেই।

হ্যাঁ গো, এবার কী রঙের শাড়ি পরে যাব? টকটকে লাল? না ফিকে লাল? নির্বাচনের ফলাফল তো ফিকের দিকে!

গিন্নি, তোমার মাথাটিও গেছে। শাড়ির সঙ্গে রাজনীতি জুড়ছ। চিরকাল তুমি তো খড়ের পোশাক পরেই যাও, তারপর যে বারোয়ারি তোমাকে যেমন সাজায়।

দেব, রাজনীতি ছাড়া ওদেশে আর কী আছে! আর, পুজোর প্রাক্কালে ঘরে-ঘরে গৃহিণীদের শাড়ি পলিটিক্স। মনের মতো দিতে পারলে ভোলেবাবা জিন্দাবাদ। নইলে মুর্দাবাদ। কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *