০১. বাবা খুব ঘটা করে

বাবা খুব ঘটা করে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে দেখতে ভাল, চরিত্রবান, মদ বা মেয়েমানুষের নেশা নেই। ভাল চাকরি করে। পাড়ায় তার সুনাম আছে। এমন ছেলে পছন্দ না হয়ে উপায় আছে! আমি তখন সবে হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়েছি। দেখতে সুন্দরী। লোকে বলে, তাছাড়া আয়নায় দেখি। গায়ের রঙ ফর্সা, খাড়া নাক, চোখ বড় বড়, চিকন ঠোঁট। লম্বায় আমি পাঁচফুট পাঁচ। আর কী চাই! ছোটবেলায় খালারা বলতেন—’হীরার আর চিন্তা কী! ভাল জামাই পাবে।’ আমার ঘন কালো চুল পিঠের নিচে পড়ে। মা রিঠা দিয়ে চুল ধুয়ে দিতেন আর বলতেন–এমন মেয়ে লাখে নেই। আমি যে ভাল বিকোব, তা আমার বারো বছর বয়স থেকেই আমাকে জানানো হয়েছে। আমার এক ফুপু আমার দু’বছরের বড়, তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন-তোমার তো লেখাপড়া না করলেও চলবে।

আমি বলতাম–কেন?

ফুপু বলতেন–তোমার তো ভাল বিয়ে হবেই। ভাইজান বলেছেন এখন থেকেই নাকি বড় বড় বিয়ের ঘর আসছে তোমার।

ফুপু চাইতেন তাঁরও বিয়ে হয়ে যাক, পড়ালেখার ঝামেলা চুকুক। কিন্তু চাইলেই কী। হয়। ফুপু ছিলেন খাটো, কালো, তায় দাঁত উঁচু। ফুপুর পার হতে যে সময় লাগবে তা ফুপুও বুঝতেন।

আমি খুব বেশি সুন্দরী বলে স্কুল কলেজে কখনও আমাকে একা যেতে দেওয়া হয়নি। সঙ্গে একটি লোক দেওয়া হত। কবে আমার বিয়ে হবে আর এইসব পাহারা থেকে মুক্ত হব আমি সেকথাই ভাবতাম। আলতাফকে সবাই যখন পছন্দ করল আমার আপত্তি করবার কিছু ছিল না। আপত্তি করবই বা কেন, কার জন্য? এমন কেউ তো ছিল না যার জন্য বাড়ির পছন্দে ভেটো দেব। বাদলের সঙ্গে যেটুকু কথা হত, চোখে চোখেই হত। ও আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত। আমাকে যেচে নোট দিত, সালেহার হাতে পাঠাত। সালেহা ছিল আমার ক্লাসমেট, ওদিকে বাদলের বোন। ওর নোটের ভেতর ছোট ছোট চিঠি থাকত। আমাকে ভালবেসে তার মরে যেতে ইচ্ছে করে এইসব লেখা থাকত চিঠিতে। আমি কখনও কোনও উত্তর দিইনি, বাদলকে যে আমার ভাল লাগত না তা নয়। আসলে আমার ভয় করত খুব, বাবাকে ভয়, রাস্তার ছেলেপেলেদের দিকে তাকাতে বারণ ছিল বাবার। বলতেন—’কলেজে সোজা যাবে, সোজা আসবে। কোনও দিকে তাকাবে না। লোকে যেন ভাল বলে এই ভাবে চলবে। কোনও বদনাম যেন কেউ করতে না পারে।’ আলতাফের সঙ্গে বিয়ে হলে সারাজীবন আমি রাজরাণী হয়ে থাকব এমন কথা আমার আত্মীয় স্বজন বলেছে, পাড়া পড়শিও বলেছে। রাজরাণী হবার খুব যে ইচ্ছে আমার ছিল তা নয়। কিন্তু বাবা মা আর বড় দুই ভাইএর স্বপ্নকে ভেঙ্গে দেব এমন ইচ্ছে আমার হয়নি কখনও, তাই ওঁরা আমাকে লক্ষ্মী মেয়ের মত যেদিন বিয়ের পিড়িতে বসতে বললেন, আমি বসেছি।

.

আলতাফ পি ডব্লু ডির ইঞ্জিনিয়ার। গুলশানে বাড়ি আছে নিজেদের। ইস্কাটন থেকে ফুল সাজানো গাড়ি করে আমি গুলশানে চলে এসেছি সে অনেকদিন। আলতাফ সুদর্শন যুবক একথা মানতে আমার কোনও আপত্তি নেই। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। বাবা দেখেছেন, বাড়ির সবাই দেখেছে, আমার দেখবার দরকার কী! ছবি দেখেছি শুধু। ফুপু বলেছেন–কী যে সুন্দর তোমার বর, দুজনে চমৎকার মানাবে। আমাদের যে. মানাবে ভাল, তা আমিও মনে মনে বুঝতাম। সুন্দরের প্রতি আমার পক্ষপাত তো ছিলই সবসময়। কিন্তু বিয়ের একমাসের মধ্যে আমি যখন সুটকেস নিয়ে বাবার বাড়ি ফেরত এলাম, সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল–আলতাফ কোথায়?

–আসেনি। আমি একা এসেছি। আমার নির্লিপ্ত উত্তর।

–একা? একা কেন?

এর উত্তর আমার জানা ছিল না। বিত্তবান চরিত্রবান স্বামী রেখে বাবার বাড়ি একা একা চলে আসা যে উচিত হয়নি আমার, তা আমাকে বাড়ির সবাই তাদের কথা এবং ব্যবহারে বুঝিয়ে দিল। বাবার বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয় না আমার। শাশুড়ি নিজে গিয়ে নিয়ে আসেন। বলেন–’বিয়ের পর ঘন ঘন বাবার বাড়ি এলে লোকে খারাপ বলে। আমার মা বাবাও বলেন—’ওঁরা যখন আসতে বলবেন, তখন এস। নিজের ইচ্ছেয় এস না আর। বিয়ে হয়েছে, এখন ওঁরা যা বলেন, যেভাবে চলতে বলেন, সেভাবে চলবে। নাহলে লোকে ভাল বলবে কেন?’

আমার মা চিরকালই লোকের ভাল কথা শুনতে চান। লোকে যদি মন্দ বলে তাই আমার কোনও ইচ্ছে টিচ্ছের দাম দেওয়া যাবে না। স্বামী শাশুড়ির যত্ন করলে লোকে নাকি ভাল বলে, তাই মন দিয়ে ওঁদের যত্ন করতে হবে। ওঁরা যেন আমার ওপর কিছুতেই অসন্তুষ্ট না হন।

শ্বশুর শাশুড়ি আমার ওপর সন্তুষ্ট কি না আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমাদের জন্য যে ঘরটি বরাদ্দ, আমাদের বলতে আমার এবং আলতাফের শোবার জন্য, সেই ঘরটিতেই বেশির ভাগ সময় আমার কাটে। বিয়ের পর পর আলতাফ আমাকে বলেছে–প্রথম প্রথম একটু আরাম করে নাও, এরপর তো সব দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। প্রথম প্রথম আরাম করব এরপর আর আরাম করা হবে না এইসব কথা আমাকে খুব ভাবাত। আমি ফিরে জিজ্ঞেস করতাম–আচ্ছা গো সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে কেন, তুমি নেবে না?’ আলতাফ হেসে বলত—’বোকা মেয়ে, আমার বাইরে বাইরে থাকতে হয় না? তুমি ঘরে থাকো, তুমিই সংসারের সব দায়িত্ব নেবে।’—’কী রকম দায়িত্ব শুনি?’—’যেমন ধর বাজার করানো, রান্নাঘরের কাজ করানো, বাড়িঘর দেখাশুনো, তারপর আমার যত্নআত্তি। মা কি এখনও আমার সেবা করবেন, বল? ঘরে এখন বউ এসেছে। আমার আর চিন্তা কী।’ এসব বলতে বলতে আলতাফ আমার কোমর জড়িয়ে ধরত।

আমি হঠাৎ হঠাৎ নিজেকে প্রশ্ন করতাম আলতাফের বাড়িতে আমি থাকি কেন? প্রশ্নের উত্তর অবশ্য নিজেই পেতাম, যেমন আলতাফকে আমার সুখ দিতে হবে, শারীরিক এবং মানসিক সুখ; আলতাফের ঘরবাড়ির শোভা আমাকে বৃদ্ধি করা। নিজেকেই আবার প্রশ্ন করতাম আমার শোভা কে বৃদ্ধি করবে? আমার শোভা তো আমার ত্বকের রঙ ও মসৃণতা, আমার চুলের দৈর্ঘ্য, আমার কোমর নিতম্ব আর বুকের গঠন–সে আমাকেই তলে তলে রক্ষা করতে হবে। মা যেমন বিয়ের আগে চুল এবং ত্বকের যত্ন করতে শেখাতেন, বিয়ের পর সেই প্রক্রিয়াকেই টেনে নিতে হবে। স্বামী আমাকে শোভা বর্ধক দেবে, অর্থাৎ শাড়ি দেবে, গয়না দেবে, কসমেটিকস দেবে। বিনিময়ে তাকে আমার জীবনের সবটুকু দিতে হবে। আমার মান মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব সব। আমার কোনও পৃথক ইচ্ছে টিচ্ছে, আমার কোনও স্বপ্ন সাধ তখন আর স্বীকৃত নয়। আর কবেই বা ইচ্ছের মর্যাদা পেয়েছি? এই যে বিয়ে বসেছি, এই যে আমার লেখাপড়া হঠাৎ থামিয়ে আমি স্থবির জীবনে প্রবেশ করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হইনি–সে তো দশটা লোকের শেখানো বলে। আমি আমার দাদি নানি মা খালা ফুপুর কাছে শিখেছি যে ছেলেরা মনে যা চাইবে তা করবে আর মেয়েরা, ছেলেরা যা করাবে, তা করবে। দাদি নানি মা এঁরা কখনও তাঁদের স্বামীদের আদেশ ছাড়া এক পাও বাইরে বেরোতো না। আমাকেও তারা সেরকম শেখাতে চাইছেন যে আমিও যেন তাদের মত হই, সমাজের আর দশটা মেয়ে মানুষের মত হই। আমি অবশ্য সেরকমই গড়ে উঠছিলাম, সেরকম করেই আমার বোধ বুদ্ধির সীমানা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু অল্প অল্প করে সীমানা অতিক্রম করবার ইচ্ছে হল আমার। কেন হল, কী করে হল আমি বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝি, হল বলেই আমি স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছি। একা বাবার বাড়ি উঠে আমি বলতে পেরেছি–’হ্যা একলা এলাম।‘

কেন এলাম এই প্রশ্ন উঠেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত পারিবারিক বৈঠকে এই প্রশ্ন নিয়ে সবাই মাথা ঘামিয়েছেন। আমি কিছুই বলিনি। নিরুত্তর থেকেছি। আমার নিরুত্তর থাকা নিয়ে ওঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। ওঁদের বিস্ময়ের সীমা নেই। তারপর যখন স্বামী শাশুড়িরা আমাকে নিয়ে আসতে গেলেন আমার ইচ্ছে ছিল না আসবার। আসতে হল কারণ কার কাছে থাকব আমি? বাবা মা ভাইদের কাছে? ওঁরাই তো আমাকে রাখতে রাজি নন। ওঁরাই তো আমাকে ঠেলে পাঠান স্বামীর বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *