বাঙলা ও বাঙালী
।।এক।।
একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, বাঙালীর ইতিহাস নেই। আজ আর সে-কথা ঘাটে না। নানা সুধীজনের প্রয়াসের ফলে আজ বাঙলার ও বাঙালীর এক গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির। বর্তমান শতাব্দীর সূচনায় ওই সোসাইটির পক্ষ থেকে রমাপ্রসাদ চন্দ লেখেন “গৌড়রাজমালা” ও অক্ষয়কুমার মৈত্র প্রকাশ করেন “গৌড়-লেখমালা।” তারপর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন তাঁর “বাঙলার ইতিহাস।” কিন্তু বইখানা ছিল রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, বাঙালীর জীবনচর্যার ইতিহাস নয়। তিনের দশকে বাঙলার ইতিহাসের একটা কঙ্কাল ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত করেন বর্তমান লেখক মহাবোধি সোসাইটির মুখপাত্র ‘মহাবোধি’-তে। চল্লিশের দশকের গোড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বের করল তাদের “হিস্ট্রি অভ্ বেঙ্গল।” এই বইটাতে প্রথম প্রদত্ত হল বাঙালীর জীবনচর্যার বিভিন্ন বিভাগের ইতিহাস। এর ছ’বছর পরে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় অসামান্য অর্জন করলেন বাঙলা সাহিত্যের অনবদ্য সৃজন তাঁর “বাঙালীর ইতিহাস—আদিপর্ব” লিখে। কিন্তু বাঙলার ইতিহাসের প্রাগৈতিহাসিক যুগটা শূন্যই থেকে গেল। ষাটের দশকে বর্তমান লেখক তাঁর “হিস্ট্রি অ্যাণ্ড কালচার অভ্ বেঙ্গল” ও “প্রি-হিস্ট্রি অ্যাণ্ড বিগিনিংস অভ্ সিভিলিজেন ইন বেঙ্গল” বই দুটি লিখে বাঙলার প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা ইতিহাস দেবার চেষ্টা করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাঙলার ইতিহাসকে টেনে আনলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় পর্যন্ত। ওই দশকেই রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত বের করলেন তাঁর “একস্ক্যাভেসনস্ অ্যাট পাণ্ডুরাজার ঢিবি।” এর পর ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখলেন চারখণ্ডে তাঁর “বাঙলার ইতিহাস।”
এদিকে বাঙালীকে সম্যকরূপে বুঝবার চেষ্টাও চলতে লাগল। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে রমাপ্রসাদ চন্দ তাঁর “ইণ্ডো-আরিয়ান রেসেস্” বইয়ে বাঙালীর দৈহিক গঠনে আল্পীয় উপাদানের কথা বললেন। এর পনেরো বছর পরে ডঃ বিরজাশঙ্কর গুহ বাঙালীর দৈহিক গঠনে আল্পীয় রক্ত ছাড়া, দিনারিক রক্তের কথাও বললেন। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত অ ক্ষিতিশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও এ-বিষয়ে অনুশীলন করলেন। নূতন তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালীর প্রকৃক নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের একটা প্রয়োজন অনুভূত হল। এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু মহাসভার অনুরোধে বর্তমান লেখক লিখলেন তাঁর “বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়” (জিজ্ঞাসা, পুনর্মুদ্রন ১৯১৭ ও ১৯১৯)। অপর দিকে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে কাজ চালালেন প্রবোধচন্দ্র ভৌমিক প্রভুখ নৃতত্ত্ববিদগণ।
অনেক আগেই বাঙালী সংস্কৃতির সাত-পাঁচের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি রাজ্য পরিভ্রমণ করে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন অবহট্ট ভাষায় ‘সন্ধ্যা’-রীতিতে রচিত লুইপাদের “চর্যাপদ-বিনিশ্চয়,” সরোজ বজ্রের “দোহাকোষ,” ও কাহ্নপাদের “দোহাকোষ” ও “ডাকার্ণব”, এই চারখানা বই আবিষ্কার করা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আরও অনেকে অনুশীলন করলেন, যথা রামগতি ন্যায়রত্ন, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন চক্রবর্তী, আশুতোষ ভট্টাচার্য, শশিভূষণ দাসগুপ্ত, তমোনাশ দাসগুপ্ত, সজনীকান্ত দাস ও আরও অনেকে। তাঁদের সকলের অনুশীলনের ফলে, আজ আমরা সম্পূর্ণরূপে পরিচিত হয়েছি বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ, ও বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে।
।।দুই।।
বাঙলা অতি প্রাচীন দেশ। ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে বাঙলাদেশ গঠিত হয়ে গিয়েছিল প্লাওসিন যুগে (প্রায় দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে)। পৃথিবীতে নরাকার জীবেরও বিবর্তন ঘটে এই প্লাওসিন যুগে। এর পরের যুগকে বলা হয় প্লাইস্টোসিন যুগ। এই যুগেই মানুষের আবির্ভাব ঘটে।
যদিও প্লাইস্টোদিন যুগের মানুষের কোনও নরকঙ্কাল আমরা ভারতে পাই নি, তবুও তার আগের যুগের নরাকার জীবের কঙ্কাল আমরা এশিয়ার তিন জায়গা থেকে পেয়েছি। জায়গাগুলো হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ শিবলিক গিরিমালা, জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূহ যে সে-যুগে বাঙলাদেশের ওপর দিয়েও যাতায়াত করত, সেরূপ অনুমান করা যেতে পারে। (লেখকের “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস,” জিজ্ঞাসা, দ্রষ্টব্য)। সাম্প্রতিক কালে মেদিনীপুর জেলার রামগড় সিজুয়ায় যে মানুষের অশ্মীভূত চোয়াল পাওয়া গিয়েছে, তা বৈজ্ঞানিক মহলে যদি চূড়ান্তরূপে গ্লাইস্টোসিন যুগের বলে স্বীকৃত হয়, তবে এটাই হবে এশিয়ার প্রাপ্ত প্রাচীন প্রকৃত মানবের একমাত্র নিদর্শন।
সিজুয়ায় প্রাপ্ত চোয়ালের অনুশীলন সাপেক্ষে, বলা যেতে পারে যে, প্লাইস্টোসিন যুগের মানুষের কঙ্কাল আমরা এদেশে পাইনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যে বাঙলাদেশে বাস করে এসেছে, তার প্রমাণ আমরা পাই বাঙলাদেশে পাওয়া তার ব্যবহৃত আয়ুধ সমূহ থেকে। এই আয়ূধ সমূহের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে প্লাইস্টোসিন যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ার, যা দিয়ে সে-যুগের মানুষ পশু শিকার করত তার মাংস আহারের জন্য। এগুলো পাওয়া গিয়েছে বাঁকুরা, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার নানা স্থান থেকে। এগুলোকে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের আয়ুধ বলা হয়। প্রত্নপলীয় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে। তারপর সূচনা হয় নব প্রস্তর বা নবপলীয় যুগের। নবপলীয় যুগের প্রাদুর্ভাবের পর, অভ্যুদয় হয় তাম্রাশ্ম যুগের। তাম্রাশ্ম যুগেই সভ্যতার সূচনা হয়। বাঙলায় তাম্রাশ্ম যুগের ব্যাপক বিস্তৃতি ছিল মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলায়। এই যুগের সভ্যতার প্রতীক হচ্ছে সিন্ধুসভ্যতা। বাঙলা এই সভ্যতার নিদর্শন হচ্ছে পাণ্ডু রাজার টিবি। (পরের নিবন্ধ ‘বাঙলা কি সভ্যতার জন্মভূমি?’ দ্রষ্টব্য)।
।।তিন।।
বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ছিল অস্ট্রিক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের প্রাক্-দ্রাবিড় বা আদিঅস্ত্রাল বলা হয়। প্রাচীন সাহিত্যে এদের ‘নিষাদ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, লোধা প্রভৃতি উপজাতিসমূহ এই গোষ্ঠীর লোক। এছাড়া, হিন্দুসমাজের তথাকথিত ‘অন্ত্যজ’ জাতি সমূহও এই গোষ্ঠীরই বংশধর। বাঙলার প্রথম অনুপ্রবেশ করে দ্রাবিড়রা। এরা দ্রাবিড় ভাষার লোক ছিল। বৈদিক সাহিত্যে এদের ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এদের অনুসরণে আসে আর্যভাষাভাষী আল্পীয়রা। মনে হয়, এদের একদল এশিয়া মাইনর বা বেলুচিস্তান থেকে পশ্চিম সাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে, ক্রমশঃ সিন্ধু, কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ, কন্নাদ ও তামিলনাড়ু প্রদেশে পৌঁছায় এবং আর একদল পূর্ব উপকূল ধরে বাঙলা ও ওড়িষায় আসে। এরাই মনে হয়, বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে বর্ণিত ‘অসুর’ জাতি। আরও মনে হয়, এদের সকলেই সামাজিক সংগঠন কৌমভিত্তিক ছিল, এবং এই সকল কৌমগোষ্ঠীর নামেই এক একটা জনপদের সৃষ্টি হয়।
বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের অন্ততঃ দুটি কৌমগোষ্ঠীর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিল। একটি হচ্ছে ‘বঙ্গ,’ যাদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ‘বয়াংসি’ বা পক্ষী জাতীয় বলা হয়েছে। মনে হয় পক্ষী বিশেষ তাদের ‘টটেম’ ছিল। বৈদিক সাহিত্যে দ্বিতীয় যে নামটি আমরা পাই, সেটি হচ্ছে ‘পুণ্ড্র’। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তাদের ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মনে হয়, তাদের বংশধররা হচ্ছে বর্তমান ‘পোদ’ জাতি। বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের লোকদের বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণার চক্ষে দেখতেন। এটার কারণ—দুই বিপরীত সংস্কৃতির সংঘাত। বাঙলায় আর্যদের অনুপ্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত, তাদের মনে এই বিদ্বেষ ছিল। (‘বাঙলার লৌকিক জীবন’ নিবন্ধ দেখুন)।
।।চার।।
মহাভারতীয় যুগে আমরা বঙ্গ, কর্বট, সুহ্ম, প্রভৃতি জনপদের নাম পাই। মহাভারতে আরও বলা হয়েছে যে অসুররাজা বলির ক্ষেত্রজ সন্তানসমূহ থেকেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পৌন্ড্র, ও সুহ্ম জাতিসমূহের উদ্ভূত হয়েছে।
বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ সমূহ থেকে আমরা বাঙলার দুটি রাষ্ট্রের নাম পাই। একটি হচ্ছে শিবি রাজ্য ও অপরটি হচ্ছে চেত রাজ্য। এ দুটি রাষ্ট্র বুদ্ধদেবের প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। বর্ধমান জেলার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে শিবি রাজ্য গঠিত ছিল। তার রাজধানী ছিল জেতুত্তর নগরে (বর্তমান মঙ্গলকোটের নিকটে ও টলেমী উল্লিখিত সিব্রিয়াম বা শিবপুরী)। এরই দক্ষিণে ছিল চেত রাজ্য। তার রাজধানী ছিল চেতনগরীতে (বর্তমান ঘাটাল মহকুমার অন্তর্ভূক্ত চেতুয়া পরগণা)। এই উভয় রাজ্যেরই সীমান্ত কলিঙ্গ রাজ্যের সীমানার সঙ্গে এক ছিল। কলিঙ্গ রাজ্য তখন বর্তমান মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সিংহল দেশের ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুটি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে বঙ্গদেশের বঙ্গ নগরে এক রাজার বিজয়সিংহ নামে এক পুত্র দুর্বিনীত আচারের জন্য সাত শত অনুচর সহ বাঙলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে সিংহলে যায়, এবং সিংহল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
আলেকজাণ্ডারের (৩২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) ভারত আক্রমণের সময় বাঙলায় গঙ্গারাঢ় নামে এক স্বাধীন রাজ্য ছিল। গঙ্গারাঢ়দের শৌর্যবীর্যের কথা শুনেই আলেকজাণ্ডার বিপাশা নদীর তীর থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এর অনতিকাল পরেই বাঙলা তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। কেননা, মহাস্থানগড়ের এক শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে, উত্তর বাঙলা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কারণ মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত পুণ্ড্রবর্ধন নগরে এক কর্মচারীকে অধিষ্ঠিত করেছিল। মনে হয় এই সময় থেকেই আর্যসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙলা দেশে ঘটেছিল। ‘মনুসংহিতা’ রচনাকালে (২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) বাঙলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হত। কুষাণ সম্রাটগণের মুদ্রাও বাঙলার নানা জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে বাঙলাদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক হয়। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙলাদেশ আবার স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময় গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদের নামে তিনজন স্বাধীনরাজা ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। গোপচন্দ্র ওড়িষারও এক অংশ অধিকার করেন। এর অনতিকাল পরে বাঙলাদেশের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) পশ্চিমে কান্যকুজ্ব ও দক্ষিণে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন। এরপর বাঙলাদেশে কিছুকাল অরাজকতা দেখা দেয়। এই অজারকতার হাত থেকে বাঙলাদেশকে রক্ষা করেন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল (৭৫০-৭৭০) খ্রীষ্টাব্দ)।
অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাবে গোপালের সময় থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে গোবিন্দপালের সময় পর্যন্ত পালবংশই বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। একই রাজবংশের ক্রমাগত চারশো বছর (৭৫০-১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্ব করা ভারতের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। গোপালের পৌত্র দেবপাল নিজের রাজ্য বিস্তার করেছিলেন দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত। দেবপালের পিতা ধর্মপাল দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে গান্ধার পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারত জয় করেছিলেন। বস্তুতঃ পালরাজগণের রাজত্বকালই বাঙলার ইতিহাসের গৌরবময় যুগ।
পালবংশের পতনের পর বাঙলায় সেনবংশ রাজত্ব করে। এরাও প্রতাবশালী রাজা ছিলেন। সেনবংশের তৃতীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলেই বাঙলা মুসলমানদের হাতে চলে যায়। এ ঘটনা ঘটেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর (১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে) শুরুতেই। তখন থেকেই ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত বাঙলাদেশ স্বাধীন সুলতানদের শাসনাধীনে ছিল। পরের পঞ্চাশ (১৫৩৯-১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) বছর বাঙলা পাঠানদের অধীনে যায়। তারপর ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সম্রাট আকবরের (১৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে) আমলে বাঙলা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর অপরাহ্নে বাঙলা মোগলদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
।।পাঁচ।।
বাঙলার ধর্মীয় সাধনার ও লৌকিক জীবনের আচার-ব্যবহারের একটা চিত্র পাঠক পাবেন ‘পশ্চিম বাঙলার লৌকিক জীবন’ ও ‘ধর্মীয় চেতনার যাদুঘর’ নিবন্ধদ্বয়ে। এখান কেবল বাঙলার সমাজবিন্যাস ও প্রথাসমূহের একটা রূপরেখা টানবার চেষ্টা করব। আগেই বলেছি যে, বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম খুব বিলম্বে প্রবেশ করেছিল। সুতরাং ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলায় চাতুর্বর্ণ সমাজবিন্যাস ছিল না। প্রথম ছিল কৌমগোষ্ঠিক সমাজ। তারপর যে-সমাজের উদ্ভব হয়েছিল, তাতে জাতিভেদ ছিল না, ছিল পদাধিকারঘটিত বৃত্তিভেদ। এটা আমরা জানতে পারি ‘প্রথম কায়স্থ’, ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ’, ‘প্রতিবেশী’, ‘কুটুম্ব’ প্রভৃতি নাম থেকে। এ সব নাম আমরা পাই সমকালীন তাম্রপট্ট লিপি থেকে। তারপর পাই বৃত্তিধারী গোষ্ঠীর নাম, যথা ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘সার্থবাহ’, ‘ক্ষেত্রকার’, ‘ব্যাপারী’ ইত্যাদি। পরে পালযুগে যখন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য ঘটে, তখন বাঙলায় বৃত্তিধারী গোষ্ঠীগুলি আর বৈবাহিক আদান-প্রদানের সংস্থা হিসাবে স্বীকৃত হয় না। তখনই বাঙলার জাতিসমূহ সঙ্করত্ব প্রাপ্ত হয়। সুতরাং পালরাজগণের পর সেনরাজগণের আমলে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে তখন বাঙলার সকল জাতিই সঙ্করত্ব দোষে দুষ্ট। সেজন্য বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ ব্রাহ্মণ ছাড়া, বাঙলার আর সকল জাতিকেই সঙ্কর জাতি বলে অভিহিত করা হয়েছিল ও তাদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল—১) উত্তম সঙ্কর, ২) মধ্যম সঙ্কর ও ৩) অন্ত্যজ। এরপর আর একটা শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছিল—‘নবশাখ’ বিভাগ। নবশাখ মানে যাদের হাতে ব্রাহ্মণরা জল গ্রহণ করত। বিবাহের অন্তর্গোষ্ঠী (endogamous) হিসাবে মধ্যযগে যে সকল জাতি বিদ্যমান ছিল, তাদের নাম আমরা মঙ্গলকাব্যসমূহে পাই। এ সকল জাত আজও বিদ্যমান আছে। ময়ূরভট্টের ‘ধর্মপুরাণ’-এ যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা নীচে উদ্ধৃত করা হয় :
“সদ্গোপ কৈবর্ত আর গোয়ালা তাম্বুলি।
উগ্রক্ষেত্রী কুম্ভকার একাদশ তিলি।।
যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকর।
নাপিত রজক দুলে আর শঙ্খধর।।
হাড়ি মুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্রভৃতি।
মাজি ও বাগদী মেটে নাহি ভেদজাতি।।
স্বর্ণকার সুবর্ণবনিক্ কর্মকার।
সূত্রধর গন্ধবেনে ধীবর পোদ্দার।।
ক্ষত্রিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা।
পরিল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা।।”
(বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ সংস্করণ, পৃ. ৮২)
মধ্যযুগের সমাজ জীবনকে কলুষিত করেছিল তিনটি অপপ্রথা—১) কৌলিন্য, ২) সহমরণ ও ৩) দাসদাসীর হাট। এ সবের বিশদ বিবরণ আমি দিয়েছি আমার “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস”-এ। সুতরাং এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ সকল প্রথা বাঙালীসমাজে প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ-সংস্কারকের প্রচেষ্টার ফলে ইংরেজ সরকার কর্তৃক এগুলি নিবারিত হয়। তারপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। পরে অসবর্ণ বিবাহের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন হয়। আরও পরে বিবাহের ন্যূনতম বয়সও বর্ধিত করা হয়।