০১. বঙ্গভূমি ও বাঙ্গালী
মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র
পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর;–অপর দিকে ভূ-মধ্যসাগর, এই দুইটি সুবিখ্যাত “তোয়া-নিধির” অন্তর্বেদি রূপে যে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা ইউরোপীয় সভ্য-সমাজে “প্রাচী” নামে উল্লিখিত হইয়া আসিতেছে। এই প্রাচী নিকট ও দূর নামক দুই জ্বভাগে বিভক্ত,–যাহা নিকট, তাহার সহিত ভূ মধ্যসাগর-তীরের গ্রীস, মিশর প্রভৃতি দেশের, এবং বহু সংখ্যক দ্বীপপুঞ্জের সম্বন্ধ এত নিকট যে, তাহাদিগকেও কেহ বর্ণনা করিবার জন্য “প্রাচী” সংজ্ঞা দান করিয়া থাকেন। যাহা ‘দূর প্রাচী” নামে উল্লিখিত, তাহার মধ্যেও বহু সংখ্যক দ্বীপ সন্নিবিষ্ট।
মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভব-ক্ষেত্র কোথায়, তৎসম্বন্ধে মানব সমাজ বহু কাল হইতে তথ্যানুসন্ধান করিয়া আসিতেছে। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যসমাজ অনেক। দিন পর্যন্ত রোম এবং গ্রীস এবং কখন কখন মিশর দেশকে সেই আদি উদ্ভব-ক্ষেত্র বলিয়া বর্ণনা করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া, সকল কৌতূহল চরিতার্থ করিতে না পারিয়া, এখনও তথ্যানুসন্ধান চেষ্টায় বিরত হইতে পারে নাই। এখনও নিত্য নূতন অধ্যবসায়, নিত্য নতুন তথ্যানুসন্ধান চেষ্টায় অনেক নূতন স্থানে ভূগর্ভ খননে নানা রূপ ক্লেশ স্বীকার করিতেছে। ইহাতে পুরাতত্ত্ব জ্ঞানের পূৰ্ব্বপরিচিত সংকীর্ণ সীমা ক্রমে অধিক হইতে অধিকতর সম্প্রসারিত হইয়া, বিদ্বৎসমাজকে নিকট হইতে দূর প্রাচীর দিকে আকর্ষণ করিতে আরম্ভ করিতেছে। এখন প্রাচ্য তত্ত্ব মানবতত্ত্বের প্রধান পরিচয়-ক্ষেত্র বলিয়া সৰ্ব্বত্র উত্তরোত্তর অধিক শ্রদ্ধা লাভ করিতেছে।
ইহার ফলে নীলনদ-তটের অনন্ত বালুকাস্তর নিহিত অতি পুরাতন সমাধির মধ্যে ইউরোপীয় বিদ্বৎ-সমাজ ঐতিহাসিক যুগের পূৰ্ব্বকালবর্তী স্মৃতিচিহ্নের আবিষ্কার সাধন করিয়া, তাহাকেই কিছু দিন পর্যন্ত মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভব ক্ষেত্র বলিয়া ঘোষণা করিতেছিলেন। এখন আর সে সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত বলিয়া মৰ্য্যাদা লাভ করিতে পারিতেছে না। এখন সকলের চক্ষু ভারতবর্ষের দিকে আকৃষ্ট হইতেছে।
ভারতবর্ষ একটি অতিবিস্তৃত মহাদেশ, বহু সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন দেশের একত্র সমাবেশে অসীম রহস্যের আধার হইয়া, এত কাল নীরবে কাল-যাপন করিতেছিল। তাহার অতি পুরাতন ভূস্তর-নিহিত পূর্ধ্বতন কীৰ্ত্তি চিহ্ন অনাবিষ্কৃত এবং অনালোচিত থাকিয়া, প্রকৃত তথ্যের সন্ধান প্রদান করিতে পারিত না। তজ্জন্য ইয়োরোপীয়গণ ভারত-পুরাতত্ত্বের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে অনেক অলীক অনুমানের অবতারণা করিয়া আসিতেছিল; এবং কোনস্থলে অকস্মাৎ কোনও পুরাকীৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইলে, তাহার মূলানুসন্ধানের জন্য যথাযোগ্য আয়োজন না করিয়াই, তাহাকে হয় ব্যাবিলনের, না হয় মিশরের, না হয় গ্রীস, রোমের প্রভাবচিহ্ন বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে চাহিতেন। তথাপি কোন কোন মনীষী ভারত স্থাপত্যের মধ্যে কোনপ্রকার পরপ্রভাবের চিহ্ন লক্ষ্য করিতে না পারিয়া, ভারতবর্ষকে প্রহেলিকাময় মনে করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে,–সিন্ধুপ্রবাহের তটভূমির পার্শ্বে, কয়েকটি ধবংসাবশিষ্ট পুরাতন জনপদের পরিত্যক্ত অজ্ঞাত ও অখ্যাত স্থানে কিছু কিছু অনুসন্ধান-চেষ্টা পরিচালিত হইবার পর, অল্পদিন হইল এক বিস্তৃত জনপদের গুপ্তদ্বার সহসা উদঘাটিত হইয়া পড়িয়াছে। ভারত-পূরাতত্ত্ব বিভাগের বহুসংখ্যক সুদক্ষ কর্মচারী তাহার মধ্যে খননকার্যে ব্যাপৃত থাকিয়া, বহু পুরাতন অসংখ্য কীর্তি-চিহ্ন আবিষ্কৃত করিয়া, এক নূতন অধ্যায় উদঘাটিত করিয়া দিতেছেন। তাঁহাদিগের প্রধান অধ্যক্ষ খননবিদ্যাবিশারদ সার জন মার্শাল সেই সকল কীৰ্তিচিহ্ন সভ্য-সমাজের সম্মুখীন করিবার জন্য তিন খণ্ড সচিত্র বিবরণ-পুস্তক প্রকাশিত করিবার আয়োজন করিয়াছেন। তাহা অল্পদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হইবে। তৎপূৰ্ব্বে তিনি তাহার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংবাদপত্রে প্রেরণ করিয়া, সুধীসমাজের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন।
এই দুইটি তথ্যানুসন্ধান-ক্ষেত্রের নাম এখন জগৎ-বিখ্যাত হইয়াছে। একটির নাম মহেঞ্জোদারো, অপরটির নাম হরপ্পা,–দুইটিই পাঞ্জাব দেশের অন্তর্গত সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত। স্থলপথে এবং জলপথে এই দুইস্থানের সহিত ভূমধ্যসাগরতীর পর্যন্ত সকল দেশেরই নানাবিধ সম্বন্ধ ছিল। সেই সূত্রে ভারতবর্ষ হইতে মানব-সভ্যতার মূল সূত্র পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রসারিত হইবার সম্ভাবনা অধিক বলিয়া বিবেচিত হইতেছে। এই প্রদেশটি যখন ভারতবর্ষের অন্তর্গত, তখন ভারতবর্ষের পুরাতন সাহিত্যে ইহার কিছু কিঞ্চিৎ পরিচয় পাইবার সম্ভাবনা থাকিলেও, এপর্যন্ত তাহা যথাযোগ্যরূপে আলোচিত হয় নাই। যে তিনখণ্ড বিবরণ-পুস্তক প্রকাশিত হইতে যাইতেছে, তাহার সহিত এতদ্বিষয়ক আর এক খণ্ড গ্রন্থ সংকলিত করাইয়া প্রকাশিত করিলে সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর হইত।
অতীতের সহিত বর্তমানের সম্বন্ধ আকস্মিক সম্বন্ধ হইতে পারে না। এখন যে সকল লোক-ব্যবহার প্রচলিত আছে, তাহার কিছু কিছু নিতান্ত আধুনিক কালে উদ্ভাবিত হইয়া থাকিলেও, অধিকাংশ লোক-ব্যবহার যে স্মরণাতীত পুরাকাল হইতে কালস্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হইয়া আসিয়াছে, তাহাতে সংশয় প্রকাশের কারণ নাই। তাহার যথাযোগ্য বিশ্লেষণ-কাৰ্য্য সুসম্পাদিত হইলে, বর্তমানের মধ্যেই চির পুরাতনের অনেক সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে। সে ভাবে আলোচনার সূত্রপাত করাইয়া, আরও একখণ্ড পুস্তক প্রকাশিত করাইতে পারিলে, সার জন মার্শাল মহোদয়ের প্রশংসনীয় উদ্যম অধিক প্রশংসনীয় হইতে পারিত। ভারতবর্ষে অনেক পুরাতন লোক-ব্যবহারের বিধি নিষেধ বিস্মৃত বা রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু পুরাতন সাহিত্য হইতে তাহার পরিচয় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া যায় নাই। তাহার সাহায্যে ঐতিহাসিক যুগের পূৰ্ব্বকালবর্তী অজ্ঞাত অখ্যাত বহুযুগের মানব-সভ্যতার কিছু কিছু পরিচয় সংগ্রহের সম্ভাবনা আছে।
দিবসের এক ভাগ ইতিহাসের এবং পুরাণের অনুশীলনে যাপন করিবার প্রাচীন ব্যবস্থার মধ্যে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে,–ইতিহাস এবং পুরাণ দুইটি পৃথক বিষয় বলিয়া পরিচিত ছিল, নচেৎ পৃথক ভাবে দুইটি উল্লিখিত হইত না। উভয়ের মধ্যে একমাত্র সাদৃশ্য এই যে,–উভয়ের কথা-বস্তু পুরাতন।
ইতিহাসের কথা-বস্তু “পূৰ্ব্ববৃত্ত-কথা।” ধৰ্মার্থ কামমোক্ষের উপদেশ-সমন্বিত যে পূৰ্ব্ববৃত্ত কথা, অথবা যে পূৰ্ব্ববৃত্ত কথাযুক্ত ধৰ্মার্থকামমোক্ষের উপদেশ সমন্বিত বিষয়, তাহারই নাম “ইতিহাস” বলিয়া সুপরিচিত ছিল। তাহা সত্যঘটনামূলক পুরা-কাহিনীর আধার। পুরাণে ঠিক এইরূপ ধরা বাঁধা সত্য ঘটনা মূলক কথার উপর ধর্মার্থ কামমোক্ষের উপদেশ নির্ভর করে না। পুরাণ ‘পঞ্চক্ষণ” গ্রন্থ বলিয়া পরিচিত। এখন যাহা অষ্টাদশ মহাপুরাণ এবং অসংখ্য উপ-পুরাণ নামে প্রচলিত, তাহার মধ্যে পুরাতন পুরাণের নানা অংশ অন্তর্ভুক্ত থাকিতে পারে; কিন্তু তাহা পুরাতন পুরাণের ন্যায় সকল বিষয়ে সম্যক “পঞ্চক্ষণ” নহে। “পঞ্চলক্ষণ” পুরাণে থাকিত–সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত ইত্যাদির কথা। সে কথা জনশ্রুতি মূলক চির-প্রচলিত পুরাতন কথা হইলেও, “পূৰ্ব্ববৃত্ত-কথা” বলিয়া পরিচিত ছিল না। এইখানে পুরাণের এবং ইতিহাসের পার্থক্য থাকায় এবং উভয়ের মধ্যে লোকশিক্ষার উপাদান তুল্যভাবে নিহিত থাকায়, অতি পুরাকাল হইতে দুইটি বিষয়কেই পৃথক ভাবে অধ্যয়ন করিবার ব্যবস্থা প্রচলিত হইয়াছিল।
কালক্রমে অতি পুরাতন ব্যাপারে, একটির সঙ্গে আর একটির,–এক শ্রেণীর সহিত আর এক শ্রেণীর,–এক মতের সহিত আর এক মতের সংমিশ্রণে “অতি পুরাতন” নানাপ্রকারে পরিবর্তিত হইয়া যায়। যাহা ছিল না,–পরবর্তিযুগে অভূদিত হইয়াছিল,–তাহার সহিত যাহা ছিল, স্মরণাতীত কাল হইতে চলিয়া আসিতেছিল, তাহার সহিত এক বিচিত্র সমন্বয় সাধিত হইয়া থাকে, এবং তজ্জন্য অনেক ঐতিহাসিক যুগের লোকব্যবহারের মধ্যে অতি “পুরাতন’ কোথায় লুক্কায়িত আছে, তাহার সন্ধান লাভ করা কঠিন হইয়া পড়ে।
তথাপি তাহা যায় নাই, কিছুই যায় নাই, সমস্তই মিলিয়া মিশিয়া কালস্রোতে ভাসিয়া ভাসিয়া, যুগের পর যুগ অতিক্রম করিয়া, এখনও চলিয়া আসিতেছে। সুতরাং ভারতবর্ষের ভূগর্ভ খননে কোনও পুরাকীর্তি চিহ্ন আবিষ্কৃত হইলে, তাহার কালনির্ণয়ের জন্য যে সকল মতামত প্রকাশিত হইয়া থাকে, তাহা নিঃসংশয়ে নির্ভরযোগ্য হইতে পারে না। এই কারণে অনেক স্থানে অনেক অতি পুরাতন কীৰ্তিচিহ্ন আবিষ্কৃত হইয়া থাকিলেও, তাহার কালনির্ণয়ের যথাযোগ্য নৈপুণ্যের অভাবে, তাহাকে পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ এতকাল অপেক্ষাকৃত অল্পকালের কীৰ্ত্তি চিহ্ন বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে গিয়া, ভারত পুরাকীর্তি যে সত্যসত্যই কত পুরাতন, তাহার সন্ধান লাভ করিতে পারেন নাই। এতকালের পর সিন্ধুসৈকতের খননব্যাপারে তাঁহারা নিরতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া, ভারত-সভ্যতার অতিপ্রাচীনত্বে আস্থাবান হইয়াছেন; এবং কেহ কেহ ভারতভূমিকেই মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র বলিয়া বর্ণনা করিতেও অগ্রসর হইতেছেন। ধীরে, অতি ধীরে, এইরূপে সভ্যসমাজে এক নূতন আলোকরেখা বিকীর্ণ হইয়া, ভারতভূমির অতীত গহন মধ্যে সমগ্র সভ্যসমাজকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে। এখন ভারততত্ত্ব কেবল ভারততত্ত্ব বলিয়া সংঙ্কীর্ণভাবে বর্ণিত হইতেছে না। এখন তাহা মানবতত্ত্বের সমুচ্চ পদবীতে সগৌরবে সমারূঢ়।
ইহার জন্য নূতন অনুসন্ধান চেষ্টা আরব্ধ হইতেছে,–নূতন গ্রন্থ প্রকাশিত হইতে যাইতেছে, “নূতন গ্রন্থ প্রকাশিত হইতে যাইতেছে,–নূতন সিদ্ধান্ত নূতন ভাবে সভ্যসমাজকে নূতনের মধ্যে পুরাতনত্বের সন্ধান প্রদান করিতেছে। এই চেষ্টা যথাযযাগ্যভাবে পরিচালিত হইলে, কেবল যে ভারতবর্ষের মুখ সমুজ্জ্বল হইবে তাহা নহে, সমগ্র মানব সভ্যতার মূল যে মানবতা তাহাও সুস্পষ্ট প্রকাশিত হইবে। কারণ পুরাতন কীৰ্ত্তি চিহ্নের মধ্যে যাহা পৰ্যাপ্তরূপে দেদীপ্যমান তাহা পাশবিক আচার ব্যবহারের ধ্যানধারণার এবং শিক্ষাদীক্ষার পরিচয়-বিজ্ঞাপক নহে; তাহা মানবতার শান্ত শীতল অভ্রান্ত নির্দশন। আধুনিক সভ্যতার উচ্ছঙ্খল লীলাভূমি এখন যদি অকস্মাৎ কোনও অচিন্তিতপূৰ্ব্ব বিপৎপাতে ধবংস প্রাপ্ত হইয়া ভূগর্ভ-নিহিত হইয়া পড়ে, এবং বহু যুগের অবসানে ভূগর্ভ খননে আবার তাহা যদি একে একে আবিষ্কৃত হইতে থাকে, তখন তাহার মধ্যে বর্তমান যুগের যে পরিচয় সর্বাগ্রে প্রাপ্ত হওয়া যাইবে, তাহা মানব-স্বভাব অপেক্ষা পশুর স্বভাবের পরিচয় দান করিয়া, একালের সভ্যতার প্রকৃতি নির্ণয় করিয়া, একালকে মানব-গৌরবের সমুন্নত কাল বলিয়া বর্ণনা করিতে পারিবে না।
মানসী ও মর্মবাণী,
ফাল্গুন, ১৩৩৪
.
ভৌগোলিক তথ্য
স্মরণাতীত পুরাকালে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত এবং দাক্ষিণাত্য নামক ভারতবর্ষের দুইটি প্রধান বিভাগ কল্পিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তন্মধ্যে যে বিভাগে আৰ্য্যগণ প্রবল প্রতাপে অধিকার রক্ষা করিয়া, বংশানুক্রমে বাস করিয়া আসিতেছিলেন, তাহা আৰ্য্যাবৰ্ত্ত নামে কথিত হইত। মনুসংহিতার সুবিখ্যাত ভাষ্যকার আৰ্যাবৰ্ত্ত শব্দের ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যায় তাহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।(১)
আর্যাবর্তের পূৰ্ব্ব পশ্চিম উভয় দিকেই সমুদ্র; উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল;–অতি পুরাকাল হইতে এইরূপ সাধারণ ভাবের সীমা নির্দেশের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।(২) এই চতুঃসীমার মধ্যেই আৰ্য-বিজয়-রাজ্য সুসংস্থাপিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে ব্রহ্মাবর্ত, ব্রহ্মর্ষি এবং মধ্যদেশ নামক তিনটি দেশ সৰ্ব্বাপেক্ষা সুপরিচিত ছিল; এবং আর্য্যগণ সেই সকল দেশের নামানুসারেই আত্মপরিচয় প্রদান করিতেন। তাঁহারা ক্রমে পূৰ্বাভিমুখে রাজ্য বিস্তার করায়, উত্তরকালে আৰ্য্যাবৰ্ত্তের সীমা বিস্তৃতি লাভ করিতে আরম্ভ করে। পূৰ্বাংশ প্রথমে প্রাচী নামে কথিত হইত;কালক্রমে তদ্দেশেও বহুসংখ্যক আৰ্যজনপদ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল।
সীমা-বিস্তার
এই সাধারণ সীমার মধ্যে সকল স্থানে,-এবং ইহার বাহিরেও অনেক স্থানে আৰ্য্যগণ ক্রমে ক্রমে রাজ্য বিস্তার করায়, আৰ্য্যাবর্তের সুপরিচিত পুরাতন সীমা অনেক দূর পর্যন্ত পূৰ্বাভিমুখে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। পূৰ্ব্বাংশ প্রথমে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে পার্থক্য রক্ষা করিয়া, প্রাচী নাম গ্রহণ করিয়াছিল। তাহা কেবল দিঙনির্ণয়ের জন্যই ব্যবহৃত হইয়া থাকিবে। কারণ, তদ্দেশেও নানা আৰ্য্য-জনপদ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া তাহাকেও সৰ্ব্বতোভাবে আৰ্য্য-প্রভাব-ক্ষেত্রে পরিণত করিয়াছিল।
আৰ্য প্রবাহক্ষেত্র
আৰ্যবিজয়যুগের ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলিত হইবার সম্ভাবনা নাই। তাহার সকল কথাই স্মরণাতীত পুরাকালের কথা। সুতরাং কোন সময়ে প্রাচ্য রাজ্যে আৰ্য-প্রভাব-ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হইবার সূত্রপাত হয়, কীরূপে, কতকালে, কতদূর পৰ্য্যন্ত, আৰ্য্যোপনিবেশ ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে,–তাহার সকল কথাই বিস্তৃতিগর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছে। পুরাতন সংস্কৃত সাহিত্যে তাহার যাহা কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা জনশ্রুতিমূলক,–নানা তর্ক-বিতর্কে সংশয়াচ্ছন্ন।
আখ্যায়িকা
প্রাচ্য রাজ্যে যে সকল আৰ্য জনপদ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল, তাহা পুরাতন সাহিত্যে জনপদরূপে উল্লিখিত হয় নাই,ব্যক্তি বিশেষের নামানুসারে সমাজ রূপে উল্লিখিত হইয়াছে। কিরূপে সেই সকল সমাজের উৎপত্তি হইয়াছিল, তাহার আখ্যায়িকা নানা ভাবে উল্লিখিত। অথৰ্ব্ব-সংহিতায় অঙ্গ নামক একটি সমাজের উল্লেখ আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখিতে পাওয়া যায়, বিশ্বমিত্র শাপগ্রস্ত হইয়া, অন্ধ্র পুণ্ড ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের সমাজ পতিত হইয়াছিল। ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ সমাজের উল্লেখ আছে। শাংখ্যায়ণ, শ্রৌতসূত্রে পুণ্ড্র সমাজের উল্লেখ আছে। মহাভারতে দৈত্যরাজ বলীর পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে পঞ্চ ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপন্ন হইবার একটি আখ্যায়িকা প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহাদিগের নামেই প্রাচ্য রাজ্যের পঞ্চ প্রদেশের নামকরণ হইয়াছিল। এইরূপে পৌরাণিক আখ্যায়িকা ক্ৰমে নানা আকার ধারণ করিয়াছিল।
ঐতিহাসিক তথ্য
যাঁহারা আর্যাবর্তের বাহিরে আর্য্য-প্রভাব ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, তাঁহারা আৰ্য নামেই পরিচিত ছিলেন। আৰ্যদিগের মধ্যে ক্ষত্রিয়গণের এই রাজ্য-বিস্তার ব্যাপারে প্রাধান্য লাভ করিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহারা তাহার জন্য পুরাতন আৰ্যনিবাস পরিত্যাগ করিয়া, অনাৰ্য প্রভাব-ক্ষেত্রে বিজয় লাভ করিতে ধাবিত হইয়া, পুরাতন আৰ্য সমাজ হইতে ক্রমে বহুদূরে আসিয়া, বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহাদিগের সন্ততিবর্গের এইরূপে চিরপ্রবাসী হইয়া,ব্রাহ্মণ সমাজের অদর্শনে, শাস্ত্রার্থালোচনার অসদ্ভাবে, আৰ্য-সমাজোচিত ক্রিয়াকাণ্ডের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার অসামর্থ্যে, ক্রমে ক্রমে সমাজচ্যুত ‘ব্রাত্য” হইবার কথা মনুসংহিতায় উল্লিখিত আছে। নানা কারণে, ইহাকেই ঐতিহাসিক তথ্য বলিয়া স্বীকার করিতে হয়।
প্রাচ্য রাজ্য
সংস্কৃত সাহিত্যে যে ভাবে এই সকল নাম উল্লিখিত আছে, তাহাতে বোধ হয়, –প্রথমে এই সকল নামে জনপদ বুঝাইত না; মনুসংহিতায় যে সকল জাতি বা সমাজের উল্লেখ আছে, তাহাই বুঝাইত। ক্রমে ক্রমে তাহা জনপদবাচক রূপেও ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে। তখন সেই সকল জনপদে আবার আৰ্য্যাচার প্রচলিত করিয়া, তাহাকে সৰ্ব্বতোভাবে আৰ্য-প্রভাব-ক্ষেত্রের অধীন করিয়া লইবার নানা চেষ্টাও প্রবর্তিত হইয়াছে। এই সকল প্রাচ্য জনপদের মধ্যে অঙ্গ, বঙ্গ এবং পুণ্ড নাম সমধিক পুরাতন;–তাহা বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত হইয়া, প্রাচীনত্বের পরিচয় প্রদান করিতেছে। এই সকল জনপদ কালক্রমে গৌড়ীয় সাম্রাজ্যরূপে পরিচিত হইয়া, বিশ্ববিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। তজ্জন্য এই সকল জনপদের অধিবাসিগণ “গৌড়ীয়া” নামেই কথিত হইত।
পুণ্ড্র
যে সকল পৃথক পৃথক প্রাচ্য জনপদ উত্তরকালে এক অখণ্ড শাসনতন্ত্রের বশীভূত হইয়া, গৌড়ীয়-সাম্রাজ্য নামে ইতিহাসে সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল, তন্মধ্যে একটি জনপদ সৰ্ব্বাপেক্ষা পুরাতন বলিয়া পরিচিত। তাহার নাম পু। একদা তাহা পুদিগের অধিকারভুক্ত ছিল। এখনও মালদহ প্রদেশে তাহাদিগের পৃথক সমাজ বৰ্তমান আছে। কিন্তু তাহারা বহুকাল হইতে রাজ্যাধিকার হারাইয়া, কৃষি ও শিল্পকৌশলে জীবিকার্জন করিয়া আসিতেছে। যাহারা দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়া, আৰ্য-প্রভাব ক্ষেত্র সুবিস্তৃত করিতে আসিয়া, ক্রিয়া লোপে ক্রমে ক্রমে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হইয়া, প্রাচ্যরাজ্যে অগৌরবে কালযাপন করিতে বাধ্য হইয়াছিল, তাহারাই যে এখনও কৃষি ও শিল্পকৌশলে কোনরূপ জীবনধারণ করিতেছে, সে কথা তাহারাও একেবারে বিস্তৃত হইতে পারে নাই। পৌঞগণ এখনও বলিয়া থাকে, এ দেশ একদিন তাহাদিগেরই অধিকারভুক্ত ছিল। এখন তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বিদ্যাশিক্ষা করিয়া আবার উন্নতি লাভের জন্য আয়োজন করিতেছে! মহাভারতের রচনাকালে তাহাদিগের রাজ্য পুণ্ড, পুক, পৌ, পৌণ্ড্রক এবং পৌকি নামে অভিহিত হইত। তন্মধ্যে পুণ্ড নামই সৰ্ব্বাপেক্ষা পুরাতন বলিয়া বোধ হয়।
জাতিবাচক
পুণ্ড শব্দ প্রথম জাতিবাচক থাকিয়া, পরে জনপদরূপে ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ করিলেও, সময়ে সময়ে জাতিবাচক রূপেও ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে। মনুসংহিতার ভাষ্যকার তৎপ্রতি লক্ষ্য করিয়া গিয়াছেন। রামায়ণের রচনাকালে পুণ্ড শব্দই প্রচলিত ছিল। তৎকালেও পুদিগের দেশ কোষকারভূমি বলিয়া পরিচিত থাকিতে পারে। পুঞগণ অদ্যাপি রেশমকীট পালনের এবং কোষসূত্র নিষ্কাসনের অশিক্ষিত-পটুত্বের জন্য বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছে।
জনপদবাচক
ভগবান পতঞ্জলি-বিরচিত পাণিনীয় ‘ব্যাকরণ মহাভাষ্যে” পুণ্ড শব্দই উল্লিখিত আছে। তাঁহার সময়ে অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড প্রভৃতি শব্দ দেশবাচক বলিয়া পরিচিত হইয়া পড়িয়াছিল। তজ্জন্য মহাভাষ্যে তাহা সেই ভাবেই উল্লিখিত হইয়াছে। মহাভারতের রচনাকালে পুণ্ড শব্দ নানাভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। ছন্দের অনুরোধেই হউক, আর প্রচলিত ব্যবহারের প্রভাবেই হউক, মহাভারতে পুণ্ড্র, পুণ্ড্রক,–এমন কি এক স্থলে পৌকি পৰ্য্যন্ত–তুল্যার্থবোধক জনপদবাচকরূপে উল্লিখিত।
চতুঃসীমা
পুরাজ্য সকল সময়ে সমান আয়তন অধিকার করিয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না। আয়তন কখনো সংকীর্ণ হইয়া পড়িত,–কখন বা বহুদূর পর্যন্ত ব্যপ্তি লাভ করিত। অতি পুরাকাল হইতেই এইরূপ সংকোচ-সম্প্রসারণ প্রচলিত হইয়া থাকিবে। উত্তরে কিরাতরাজ্য, দক্ষিণ-পূৰ্ব্বে বঙ্গরাজ্য, দক্ষিণ-পশ্চিমে সুহ্মরাজ্য, এবং পশ্চিমে অঙ্গরাজ্য,–এই চতুঃসীমা এক সময়ে পুরাজ্যের সাধারণ চতুঃসীমা বলিয়া পরিচিত ছিল। মহাভারতীয় সভাপৰ্ব্বে ভীমসেনের দিগ্বিজয় বর্ণনায় তাহার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।
প্রাচ্য সাম্রাজ্য
ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথমে সমাজ, তাহার পরে সাম্রাজ্য। যাহা অতি পুরাকালে সমাজের অধিকারভুক্ত ছিল, তাহাই ক্রমে ক্রমে বিবিধ সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হইয়া, ভারতবর্ষে শাস্ত্রশাসনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়া দিয়াছিল। প্রাচ্য রাজ্যেও যতদিন ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য বলিয়া স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টা করিয়াছে, ততদিন অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গাদি পৃথক পৃথক উল্লিখিত হইয়াছে। তাহার পর যখন সেই সকল খণ্ডরাজ্য এক অখণ্ড শাসনতন্ত্রের অধীনে আসিয়া, গৌড়ীয় সাম্রাজ্যরূপে শক্তিলাভ করিয়াছে, তখন হইতে প্রাদেশিক পার্থক্য বিলুপ্ত হইবার সূত্রপাত হইয়াছিল।১০
পরাক্রম
প্রাচ্য রাজের এই সকল আৰ্য-বিজয় ক্ষেত্র অতি পুরাকালে বাহুবলে এবং সংগ্রাম-কৌশলে পরাক্রান্ত বলিয়া পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। যাঁহারা পুরাতন আৰ্যনিবাস ছাড়িয়া, অনাৰ্য্য-প্রভাব-ক্ষেত্রে আৰ্য প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এই সকল প্রদেশে আৰ্য্যোপনিবেশ সংস্থাপনের আয়োজন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের পক্ষে বাহুবল ভিন্ন অন্য সম্বল অধিক ছিল না। ধীরে ধীরে রাজ্য বিস্তার করিয়া, আত্মরক্ষার জন্য তাঁহাদিগকে নিয়ত সংগ্রামকৌশলের উদ্ভাবনা করিতে হইত। তৎকালে এ দেশের নদ নদী প্রবল ছিল, অনেক স্থান সমুদ্রগর্ভে নিহিত ছিল,–এক পত্তন হইতে অন্য পত্তন দূরে দূরে অবস্থিত ছিল। এই সকল অনিবার্য কারণেই পৃথক পৃথক খণ্ডরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিতে পারে।
পূৰ্ব্ব-কথা
ভীমসেনের দিগ্বিজয়-বর্ণনায় দেখিতে পাওয়া যায়,–এই সকল খণ্ডরাজ্যের মধ্যে দুইটি রাজ্য প্রবল পরাক্রমে ভারত-বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদিগের নাম পুণ্ড এবং কৌশিকীকচ্ছ। তন্মধ্যে পুরাজ্য বাসুদেব নামক পরাক্রান্ত নরপতির
অধীন ছিল। পুরাজ এবং কচ্ছরাজ উভয়েই “বলভুতৌ”–সেনাবল-রক্ষিত, এবং “তীব্র পরাক্রমৌ’–প্রবল প্রতাপশালী বলিয়া উল্লিখিত। ইহারা উভয়ে প্রাচ্য রাজ্যের দ্বাররক্ষক রূপেই বর্তমান ছিলেন। সুতরাং আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়া, ভীম সেনকে প্রথমে এই দুই নরপতির সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। তাহার পর রঙ্গরাজ–তাহার পর সমুদ্র সেন, তাহার পর তাম্রলিপ্তরাজ ও কৱঁটরাজের পরাভূত হইবার কথা লিখিত আছে।
কামরূপ
প্রাচ্য রাজ্যের এই কয়েকটি বিভাগেই আৰ্য-প্রভাব-ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ ছিল বলিয়া বোধ হয় না। কালক্রমে আরও নানা প্রাচ্য জনপদে আৰ্য প্ৰতাপ ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তন্মধ্যে প্রাগ জ্যোতিষপুর নামক একটি রাজ্য বিশেষভাবে উল্লিখিত হইবার যোগ্য। ইহার নামান্তর কামরূপ। এই রাজ্য পৌরাজ্যের পূর্ধ্বসীমায় অবস্থিত ছিল। প্রাচ্য ভারতে অধিকার বিস্তার করিয়া, আৰ্য্যগণ মহাসাগরের তীরে বাণিজ্য-স্থান সংস্থাপিত করিবার পর, সমুদ্রপথে নানা দিগদেশে আৰ্যপ্রভাব বিস্তৃত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।
সমুদ্রযাত্রা
কোন পুরাকালে আৰ্য্য-সমুদ্রযাত্রার সূত্রপাত হয়, তাহার তথ্য নির্ণয় করা অসম্ভব। বৈদিক সাহিত্যেও তাহার উল্লেখ প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই প্রভাব বাণিজ্যের সঙ্গে জ্ঞানবিস্তার কাৰ্যে ব্যাপৃত হইয়া, ভারতবর্ষের বাহিরে এক বৃহত্তর ভারতবর্ষ রচনা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। এখনও তাহার কত কীৰ্তিচিহ্ন নানা স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। ইহাতে প্রাচ্য-ভারতের সকল জনপদেরই কিছু না কিছু সংশ্রব বৰ্ত্তমান ছিল। ইহার জন্য প্রাচ্য ভারতের সকল জনপদেই নৌ-বিদ্যার ও নৌগঠন কৌশলের অভ্যুদয় সাধিত হইয়াছিল। সাহসী সুচতুর নৌচালকগণ পোতারোহণে দ্বীপ হইতে দ্বীপান্তরে গমনাগমন করিয়া, বাণিজ্যপ্রধান প্রাচ্যভারতকে ধনরত্নে সমৃদ্ধশালী করিয়া তুলিয়াছিল। সমুদ্রপথে বাণিজ্য ব্যাপারে শক্তিলাভ করিয়া সমুদ্রতীরে নানাসম্পন্ন নগর প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল। তন্মধ্যে তাম্রলিপ্তের নাম ভুবন-বিখ্যাত হইয়া রহিয়াছে। তাম্রলিপ্তের ন্যায় কামলঙ্গা, ত্রিকলিঙ্গ, সপ্তগ্রাম প্রভৃতি আরও অনেক স্থান বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। এই সকল বাণিজ্য-প্রধান স্থানে নানা দেশের বণিকরাজ সমবেত হইতেন–নানা দেশের ধনরত্ন পুঞ্জীকৃত হইত,–নানা দেশের আচার ব্যবহার পরিলক্ষিত হইত।
সমুদ্রতীর
রামায়ণের রচনাকালে এ বিষয়ের যে সকল সমাচার আর্যসমাজে সুবিদিত ছিল, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে সুগ্রীব কর্তৃক সীতান্বেষণে বানরসেনা প্রেরণ-প্রসঙ্গে তাহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার সকল কথা সত্য না হইতে পারে; তথাপি সকল কথা একেবারে অলীক বলিয়া প্রত্যাখ্যান করা যায় না। ইয়োরোপীয়গণ যখন ইয়োরোপের বাহিরে নানা দ্বীপোপদ্বীপের পরিচয় লাভ করিতে আরম্ভ করেন, তখন সে দেশের কবিকূলের গ্রন্থেও কত অলৌকিক বর্ণনা স্থান লাভ করিয়াছিল। রামায়ণের বর্ণনায় প্রাচ্য-ভারত হইতেই “সমুদ্রমবগাঢ়ান”–সমুদ্ৰান্তৰ্গত পত্তনসমূহের উল্লেখ আবদ্ধ হইয়াছে। তাহাতে নানা দ্বীপোপদ্বীপের এবং ‘সপ্তরাজ্যোপশোভিত” সপ্তদ্বীপেরও উল্লেখ আছে। মহাভারতে “সাগরবাসিনঃ বলিয়া সমুদ্রতীরবর্তী জনপদ উল্লিখিত দেখিতে পাওয়া যায়।
নৌবিদ্যা
এই সকল কারণে প্রাচ্য-ভারতের আর্য্য-সাম্রাজ্য কেবল স্থলভাগ বলিয়া কথিত হইতে পারে না,–তাহা জলে স্থলে সমান প্রতাপে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এক সময়ে নদ-নদী-বক্ষে, সমুদ্রতীরবর্তী বাণিজ্য নগরে, এবং সমগ্র সুদূর সমুদ্র-পথের বন্দরে বন্দরে, প্রাচ্য ভারতের অগণ্য অর্ণবযান দেখিতে পাওয়া যাইত। তাহা যে কেবল বাণিজ্য-ভাণ্ডার বহন করিয়াই গমনাগমন করিত, তাহা নহে। তাহা প্রয়োজন উপস্থিত হইবামাত্র, কখন আক্রমণে, কখন বা আত্মরক্ষায়, জলযুদ্ধের অপূৰ্ব্ব কৌশল প্রদর্শনে, বিশ্ববিখ্যাত গৌরবলাভ করিত। তাহার কথা এখন স্বপ্ন কাহিনীর ন্যায় প্রতিভাত হইলেও, মহাচীন সাম্রাজ্যের বিবিধ গ্রন্থে–যবদ্বীপাদির পুরাতন কবিভাষা-নিবদ্ধ প্রচলিত সাহিত্যে,–সিংহলের পালিভাষা-নিবদ্ধ সুবিখ্যাত ইতিহাসে, এবং পাশ্চাত্য ভ্রমণকারিবর্গের বিবিধ ভ্রমণকাহিনীতে, উল্লিখিত হইয়া, সভ্যসমাজের বিস্ময় উৎপাদিত করিয়া আসিতেছে। যাহারা নক্ষত্রাবলোকন করিয়া, অনন্তবিস্তৃত মহাসমুদ্রে বায়ুবেগের সহায়তায় নৌকারোহণে গমনাগমন করিত, তাহাদিগের সাহস, তাহাদিগের নৌচালন-কৌশল, তাহাদিগের অকুতোভয়তা, কাহার না বিস্ময় উৎপাদন করিবে?
করতোয়া
প্রাচ্য ভারতে আৰ্য প্ৰতাপ এইরূপে জলে স্থলে ব্যাপ্ত হইবার সময়ে, করতোয়া একটি মহানদী বলিয়া পরিচিত ছিল। তাহাই পুরাজ্যের পূৰ্ব্বসীমা বলিয়া উল্লিখিত হইত। প্রাকৃতিক সংস্থান তাহার পক্ষ সমর্থন করে। করতোয়ার পুরাতন নাম “সদানীরা”। সেই নামের একটি নদী শতপথ ব্রাহ্মণেও উল্লিখিত আছে। “অমরকোষ” সদানীরা করতোয়ার প্রতিশব্দ রূপে উল্লিখিত। কিন্তু মহাভারতীয় ভীষ্মপৰ্ব্বে করতোয়া এবং সদানীরা পৃথক পৃথক উল্লিখিত থাকায়, কেহ কেহ অনুমান করেন,–মহাভারতেক্ত সদানীরাই শতপথ ব্রাহ্মণোক্ত সদানীরা,–তাহা করতোয়া নহে;–অন্য কোনও পৃথক নদী। করতোয়া যে এক সময়ে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল, সংস্কৃত সাহিত্যে তাহা অভিব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। অন্যন্য প্রধান প্রধান পবিত্র স্রোতস্বতীর ন্যায় করতোয়া-মাহাত্ম” নামে করতোয়া নদীরও একখানি মাহাত্ম্য-গ্রন্থ বৰ্ত্তমান আছে। তাহাতে করতোয়া “পৌঞগণের প্লাবনকারিণী” বলিয়া মাহাত্ম্যশালিনী–এইরূপ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।
পৌণ্ড্রবর্ধন
বৌদ্ধ-বিজয় যুগে পুরাজ্য “পৌণ্ড্রবর্ধন” নামে কথিত হইতে আরম্ভ করে। অশোকাবদান নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে এবং জৈন স্থবির নামাবলী মধ্যে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই নাম কালক্রমে বিশ্ববিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। মহাচীন সাম্রাজ্য হইতে যে সকল বৌদ্ধ শ্ৰমণ ভারতবর্ষের বৌদ্ধ তীর্থ দর্শন করিবার জন্য ভারতভ্রমণে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাঁহারা কেহ কেহ পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্যেও পদার্পণ করিয়াছিলেন। আধুনিক ত্রিহুত যখন “তীরভূক্তি” নামে পরিচিত হয়, তৎকালে পৌরাজ্যও “পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি” নামে পরিচিত হইয়াছিল। সে কালের সকল সাম্রাজ্যেরই ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল এবং গ্রাম নামক বিবিধ বিভাগে বিভক্ত থাকিবার পরিচয় সংস্কৃত সাহিত্যে প্রাপ্ত হওয়া যায়। পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্তি গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের একটি ভুক্তি বা প্রদেশ বলিয়া পরিচিত ছিল। রাজতরঙ্গিনীতে তাহার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎকালে গৌড় রাজ্যের রাজধানী কোথায় ছিল, তাহা নানা সংশয়ে আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে।
শশাঙ্ক
সেকালে কর্ণসুবর্ণ নামক একটি রাজ্য এবং রাজধানীর নাম সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার অধীশ্বর গৌড়েশ্বর নামে অভিহিত হইতেন। কর্ণসুবর্ণাধিপতি শশাঙ্কের নাম বৌদ্ধ সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। তিনি বৌদ্ধদিগের পবিত্র বোধিদ্রুম বিনষ্ট করিয়া, মগধরাজ্যেও অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের পশ্চিমে কুশীনগর এবং দক্ষিণে পুরুষোত্তম পৰ্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করিবার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়; এবং কান্যকুজ পৰ্য্যন্ত আক্রান্ত হইবার কথাও কোন কোন গ্রন্থে উল্লিখিত আছে। শশাঙ্করাজ্য সমগ্র উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ অধিকার করিয়া এক মহাসাম্রাজ্য সংস্থাপনের আয়োজন করিয়াছিল–সে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর বাণরাজা নামেও কথিত হইতেন। উত্তরবঙ্গে তাঁহার নাম এখনও সুপরিচিত আছে।
অশোক
গৌড়ীয় সাম্রাজ্যে সমর-কলহের অভাব ছিল না। যিনিই যখন ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য সংস্থাপনের আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাকেই গৌড়রাজ্য আক্রমণ বা অধিকার করিতে হইয়াছে। এইরূপে কখন অশোক-রাজ্যের অন্তর্গত হইয়া, কখন গুপ্ত-রাজ্যের অন্তর্গত হইয়া গৌড়ীয় জনপদ নানা সময়ে নানা বিপ্লব দর্শন করিয়াছে। এই সকল জয়-পরাজয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস না থাকিলেও, নানা শিলালিপিতে, তাম্রশাসনে এবং পুরাতন গ্রন্থে ইহার অনেক প্রমাণ বৰ্ত্তমান আছে। গৌড়ীয়গণ বিদ্যাবৃদ্ধি এবং সমর-কৌশলের জন্য চিরদিনই ভারত-বিখ্যাত ছিল।
পঞ্চগৌড়
কাশ্মীরাধিপতি জয়াপীড়ের ছদ্মবেশে পৌণ্ড্রবর্ধনে উপনীত হইবার এক আখ্যয়িকা রাজতরঙ্গিণীতে উল্লিখিত আছে। তিনি পৌণ্ড্রবর্ধনাধিপতি জয়ন্তের কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়া শ্বশুরকে পঞ্চগৌড়ের অধীশ্বর করিয়া দিয়াছিলেন। এই আখ্যায়িকার মূলেও গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের প্রবল প্রতাপের জনশ্রুতি সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে। পঞ্চগৌড়েশ্বর জয়ন্তের বিজয়রাজ্য কতদূর ব্যাপ্তি লাভ করিয়াছিল, তাহার অন্য কোনও প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। তাঁহার শাসন-সময়ে পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্য যে ধনরত্নে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল, রাজতরঙ্গিণীতে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎকালে জ্ঞানগৌরবেও পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্য জয়াপীড়ের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিল।
রাজধানী
এই বিজয়-রাজ্যের রাজধানী কোথায় ছিল, তাহা এখন নানা তর্ক-বিতর্কে সংশয়াচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। মুসলমানাধিকার প্রবর্তিত হইবার পূৰ্ব্ব পৰ্যন্তও পৌণ্ড্রবর্ধনের নাম সুপরিচিত ছিল। তাহার পর হইতে রাজ্য এবং রাজধানী কিছুকাল লক্ষ্মণাবতী নামে উল্লিখিত হইত। তাহার জন্যই পৌণ্ড্রবর্ধনের পুরাতন রাজধানীর স্থান বিস্মৃতিগর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছে। কেহ মহাস্থানে, কেহ বৰ্ধনকোটে, কেহ পাণ্ডুয়া নগরে, কেহ বা পাবনা প্রদেশে পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজধানীর স্থান নির্দেশের চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন। এরূপ তর্ক-বিতর্কের প্রধান কারণ মহাচীন রাজ্যের বৌদ্ধশ্ৰমণদিগের ভারত-ভ্রমণ কাহিনী। তাহাতে পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানীর যে বর্ণনা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাই সকল তর্কের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে।
সংক্ষিপ্তসার
পুণ্ড্ররাজ্য সকল সময়ে সমান আয়তন অধিকার করিত বলিয়া বোধ হয় না। আয়তন কখন সংকীর্ণ হইয়া পড়িত;–কখন বা বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপ্তিলাভ করিত। উত্তর সীমা কখন যথারীতি নির্দিষ্ট হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। উত্তরে কিরাত রাজ্য অবস্থিত থাকায়, নিয়ত কলহ-কোলাহল উপস্থিত হইত, অন্যান্য দিকেও প্রায় সেইরূপ অবস্থাই বৰ্তমান ছিল। উত্তরে কিরাত রাজ্য, দক্ষিণ-পূৰ্ব্বে বঙ্গরাজ্য, দক্ষিণ-পশ্চিমে সুহ্ম রাজ্য, এবং পশ্চিমে অঙ্গরাজ্য,–এই চতুঃসীমা পুণ্ডরাজ্যের সাধারণ চতুঃসীমা। মহাভারতীয় সভাপৰ্ব্বে ভীমসেনের দিগ্বিজয় বর্ণনা করিতে গিয়া মহাকবি তাহারই আভাষ প্রদান করিয়া গিয়াছেন।১২
প্রাচ্য রাজ্যে আৰ্যোপনিবেশ সংস্থাপিত হইবার সময়ে করতোয়া নদী পূৰ্ব্বসীমা রূপে নির্দিষ্ট হইয়া থাকিবে। প্রাকৃতিক সংস্থান এই অনুমানের পক্ষ সমর্থন করে। ক্রমে করতোয়ার পরপারেও আৰ্যোপনিবেশ ব্যাপ্তি লাভ করিয়া, প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। কিন্তু করতোয়া অনেক দিন পর্যন্ত সীমারূপেই নির্দিষ্ট ছিল। তখন ব্রহ্মপুত্র করতোয়ার পশ্চিমাঞ্চল দিয়া প্রবাহিত হইত।
করতোয়ার পুরাতন নাম সদানীরা; তাহা সেই নামেই শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লিখিত। অমরকোষেও করতোয়ার সদানীরা নামক প্রতিশব্দ উল্লিখিত আছে। কিন্তু মহাভারতীয় ভীষ্মপৰ্ব্বে করতোয়া এবং সদানীরা পৃথক পৃথক উল্লিখিত থাকায়, কেহ কেহ অনুমান করেন–শতপথ ব্রাহ্মণণাক্ত সদানীরা মহাভারতেক্ত সদানীরা,–তাহা করতোয়া নহে,–অন্য কোনও পৃথক নদী।১৩
বৌদ্ধবিজয় যুগে পুণ্ড রাজ্য পৌণ্ড বর্ধন নামেই উল্লিখিত। বৌদ্ধ-সাহিত্যে, জৈন-সাহিত্যে, বৌদ্ধভ্রমণকারীর গ্রন্থে এবং রাজতরঙ্গিণীতে সেই নামই দেখিতে পাওয়া যায়।১৪ তৎকালে মিথিলা “তীরভুক্তি” নামে পরিচিত ছিল; এবং করতোয়া পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্তির পূর্ধ্বসীমা রূপে উল্লিখিত হইত। মুসলমানাধিকার প্রবর্তিত হইবার সময় হইতে পৌণ্ড্রবর্ধন নাম বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। তকালে রাজধানী লক্ষ্মণাবতী নামে পরিচিত থাকায়, সমগ্র রাজ্য সেই নামেই মুসলমান লিখিত ইতিহাসে পরিচিত হইয়া গিয়াছিল।
যখন পৌণ্ড্রবর্ধন নাম প্রচলিত ছিল, তৎকালে রাজ্য এবং রাজধানী সেই নামেই কথিত হইত। সে রাজধানী কোথায় ছিল, তাহা লইয়া নানা তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত হইয়াছে। তাহার প্রধান কারণ মহাচীনদেশীয় বৌদ্ধ ভ্রমণকারী হিয়ঙ্গথরসাঙ্গের ভ্রমণবৃত্তান্ত নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থের পৌ-বর্ধনবিষয়ক বিচিত্র বিবরণ।
বৌদ্ধবিজয়যুগে পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্য অনেকদূর পর্যন্ত ব্যাপ্তিলাভ করিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহার রাজধানী সকল সময়ে একই স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। বৌদ্ধ ভ্রমণকারী কোন রাজধানী দর্শন করিয়াছিলেন? তাঁহার ভ্রমণকাহিনী মাত্র অবলম্বন করিয়া তাহার মীমাংসা করিবার উপায় নাই। তাঁহার জীবন-চরিতেও নানা স্থানের বিবরণ সন্নিবিষ্ট আছে। তত্বজ্ঞগণ জীবনচরিতকেই অধিক প্রামাণ্য বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন। জীবনচরিত এবং ভ্রমণকাহিনী একত্র পাঠ করিলে দেখিতে পাওয়া যায়,–পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী হইতে পূৰ্ব্বাস্যে কামরূপরাজ্য এবং দক্ষিণ-পূৰ্ব্বাস্যে কর্ণসুবর্ণ রাজ্য প্রায় সমান দূরেই অবস্থিত ছিল;–তাহার পরিমাণ ৯০০লি বলিয়া লিখিত আছে।
পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী কোনও গ্রন্থে পৌণ্ড্রবর্ধন নগর এবং কোনও গ্রন্থে পৌণ্ড্রবর্ধনপুর বলিয়া উল্লিখিত।১৫ তাহার উপর নির্ভর করিয়া কেহ কেহ বগুড়ার অন্তর্গত মহাস্থানগড়কে, কেহ বা বর্ধনকোট নামক পুরাতন দুর্গস্থানকে রাজধানীর স্থান বলিয়া নির্দেশ করিয়া আসিতেছেন; এবং কেহ বা গৌড়ান্তৰ্গত পাণ্ডুয়া নগরকেই পুরাতন পৌণ্ড্রবর্ধন নগর বলিয়া ব্যক্ত করিয়া আসিতেছেন।১৬
উল্লিখিত সকল স্থানেই কোন না কোন আকারের রাজনগর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু কর্ণসুবর্ণের রাজধানী কোথায় ছিল, তাহা নিঃসংশয়ে নির্ণীত না হইলে, বৌদ্ধ ভ্রমণকারীর গ্রন্থলিখিত পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানীর স্থান নির্ণীত হইতে পারে না।
মহাস্থানগড় এবং বর্ধনকোট পুরাতন প্রান্তদুর্গ বলিয়াই প্রতিভাত হয়। উভয় দুর্গই করতোয়া তীরে অবস্থিত ছিল, এবং তাহাই পৌণ্ড্রবর্ধন এবং কামরূপ রাজ্যের প্রাকৃতিক সীমাচিহ্ন বলিয়া সুপরিচিত ছিল। করতোয়া তীরে রাজধানী সংস্থাপিত থাকিলে, রাজ্য ছাড়িয়া রাজ্যসীমার উপর রাজধানী স্থাপিত থাকা স্বীকার করিয়া লইতে হয়। তাহার অনুকূল প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না। কর্ণসুবর্ণ রাজ্যও করতোয়া তীর হইতে দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত বলিয়া মানিয়া লওয়া যায় না। করতোয়ার অপর তীরেই কামরূপ রাজ্য, –তাহা ৯০০ লি দূরে থাকাই বা কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? এই সকল কারণে বিশেষজ্ঞগণ করতোয়া তীর পরিত্যাগ করিয়া, মহানন্দা তীরে রাজধানী থাকিবার কথাই অনুমান করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। কর্ণসুবর্ণ কোথায় ছিল, তাহা নিঃসংশয়ে নির্ণীত হইলে, এ বিষয়ে সকল তর্ক নিরস্ত হইয়া পড়িবে।
কর্ণসুবর্ণ কোথায় ছিল? এক সময়ে কর্ণসুবর্ণের অধিপতি গৌড়াধিপতি বলিয়া পরিচিত ছিলেন। কর্ণসুবর্ণের রাজধানী গঙ্গাতীরে অবস্থিত ছিল। ইহার অধিক আর কোনও বিবরণ প্রাপ্ত হইবার উপায় অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু কেহ কেহ নানা আনুষঙ্গিক তর্ক-বিতর্কের অবতারণা করিয়া বহরমপুরের অদূরবর্তী রাঙ্গামাটী নামক স্থানকেই কর্ণসুবর্ণ বলিয়া ঘোষিত করিতেছেন। তাহা সত্য হইলেও, করতোয়া তীরে পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী সংস্থাপিত থাকা অসঙ্গত হইয়া পড়ে।
রাজধানী কোথায় ছিল, তাহার সহিত এখন আর পুরাতত্ত্বানুসন্ধানের বিশেষ কোনও সংশ্রব থাকিতে পারে না;–সে রাজধানীর সকল কীৰ্তিচিহ্নই রূপান্তরিত বা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! যে সকল সরোবর রাজধানীর শোভা বর্ধন করিত, তাহার মধ্যেও কোনরূপ সংশয়হীন প্রমাণ আবিষ্কৃত হইবার সম্ভাবনা নাই।
এক সময়ে সমগ্র গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে পৌণ্ড্রবর্ধনই প্রধান স্থান বলিয়া বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। রাজতরঙ্গিণীতে তাহার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যে গৌড়ীয়-সাম্রাজ্য নামক কোনও জনপদের উল্লেখ না থাকিলেও, অতি পুরাকাল হইতে গৌড়ীয় রচনারীতি নামক একটি রচনারীতির উল্লেখ দেখিয়া মনে হয়,–অতি পুরাকাল হইতেই একটি বিদ্বৎসমাজ গৌড়ীয় বিদ্বৎসমাজ বলিয়া সুপরিচিত ছিল।
সেকালের সকল সাম্রাজ্যই ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল এবং গ্রাম নামক বিবিধ বিভাগে বিভক্ত ছিল। পুরাতন সংস্কৃত সাহিত্যে গৌড় এইরূপ একটি বিষয় বলিয়া উল্লিখিত হইত। তাহা হয় ত অঙ্গবঙ্গাদি পুরাতন রাজ্যের “বিষয়” ছিল বলিয়াই এইরূপ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কালক্রমে তাহার নামেই সাম্রাজ্য এবং দেশের নাম পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল।
গৌড়ীয় সাম্রাজ্য যে এক সময়ে ভারতবিখ্যাত বিজয়গৌরব লাভ করিয়া নানা দিদ্দেশে অধিকার বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিল, তাহার নানা প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়া পড়িতেছে। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড এবং সুহ্ম নামক পঞ্চ প্রাচ্য রাজ্য ব্যতীত কিরাত এবং কামরূপরাজ্য গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল; কখন বা সাম্রাজ্যসীমা কাশী এবং পুরুষোত্তম পৰ্য্যন্তও ব্যাপ্তি লাভ করিয়াছিল।
যে সাম্রাজ্য এইরূপে বাহুবলে রাজ্যবিস্তারে ব্যাপৃত হইয়াছিল, যাহার বিজয় পতাকা বহন করিয়া বীরবৃন্দ কাশ্মীর গিরিসংকটেও জীবন বিসর্জন করিত, তাহার সহিত ভারতবর্ষের নানা রাজ্যের নানা সময়ে নানা সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। গৌড়ীয় সাম্রাজ্য এইরূপে কখন পরাভূত হইয়া মগধ বা কান্যকুজের, কামরূপ বা কলিঙ্গের অধীন হইবারও পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু দীর্ঘ কালের জন্য সমগ্র গৌড়ীয়-সাম্রাজ্য অন্য কাহারও অধিকারভুক্ত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। সৌভাগ্যের দিনের গৌড়ীয় সাম্রাজ্য সুদূর সমুদ্রপথে নানা দিগদেশে প্রভাব বিস্তার করিয়া আৰ্য-বিজয়-রাজ্য সুবিস্তৃত করিয়াছিল;–সে কাহিনী এখন স্বপ্ন-কাহিনী বলিয়াই প্রতিভাত হয়।
ভারতবর্ষ, আষাঢ়, ১৩৩৭
তথ্যসূত্র
১ ‘আৰ্যা বসন্তে তত্র, পুনঃ পুনরুদ্ভবন্তি; আক্ৰম্যাক্রম্যাপি ন চিরং তত্র স্লেচ্ছাঃ স্থাতারো ভবন্তি” ।-মেধাতিথিঃ। এই ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করিয়া, ভাষ্যকার আৰ্য্যাবর্ত বলিতে আৰ্য প্রভাবক্ষেত্রকেই বিশেষভাবে সূচিত করিয়া গেছেন।
২ আসমুদ্ৰান্ডু বৈ পূৰ্ব্বাদাসমুদ্ৰাস্তু পশ্চিমাৎ। তয়ো রেবাকরং গিৰ্যোরাৰ্য্যাবর্তং বিদুৰ্বধাঃ। মনুঃ ২।২২
পূৰ্বাচাৰ্য্যগণ এইরূপেই আৰ্য্যাবৰ্ত্তের সীমা নির্দেশ করিতেন; এবং ইহার মধ্যেই আৰ্য প্রভাব সৰ্ব্ব প্রথমে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল।
৩ বৈদিক সাহিত্যে এবং পৌরাণিক সাহিত্যে এতদ্বিষয়ক যে সকল আখ্যায়িকা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার মধ্যে সকল বিষয়ে সামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায় না।
৪ অঙ্গো বঙ্গঃ কলিঙ্গশ্চ পুণ্ডঃ সুহ্মশ্চ তে সুতাঃ। তেষাং দেশাঃ সমাখ্যাতাঃ স্বনাম কথিতা ভুবি। আদি ১০৪৫৩
মুসলমানেরাও এইরূপ জনশ্রুতির অবতারণা করিয়া নোয়ার বংশধরগণের নামানুসারে অঙ্গ বঙ্গের নাম প্রচলিত হইবার আখ্যায়িকা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।
৫ শনকৈস্তু ক্রিয়া লোপদিমাঃ ক্ষত্রিয় জাতয়ঃ। বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ৷৷ পৌণ্ড কাশ্চেদ্ৰুদ্ৰবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ। পারদাপহ্নবা শ্চীনাঃ কিরাতাদরদাঃ খশাঃ। মুখবাহ্রু পজ্জানাং যা লোকে জাতয়ো বহিঃ। স্লেচ্ছাবাচশ্চাৰ্যবাচঃ সৰ্ব্বে তে দস্যবঃ স্থতাঃ। ১০।৪৩।৪৫।।
মনু সংহিতায় প্রথমে “ইমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ” বলিয়া উল্লেখ থাকায়, এক সময়ে –বিজয় যাত্রাকালে–ইহারা যে সকলেই অপতিত ক্ষত্রিয় ছিলেন, তাহারই পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। পরে “শনকৈঃ”–ক্রমে ক্রমে–সকলেই পতিত হইয়া “বৃষলত্ব”–শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাহার মুখ্য কারণ “ক্রিয়ালোপাৎ”–গৌণ কারণ “ব্রাহ্মণাদর্শনাৎ” বলিয়া উল্লিখিত থাকায়, ঐতিহাসিক কারণ-পরস্পরা ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। প্রসঙ্গ ক্রমে আরও একটি ঐতিহাসিক তথ্য “ম্লেচ্ছবাচশ্চৰ্য্যবাচঃ শব্দের মধ্যে অভিব্যক্ত হইয়াছে। আৰ্য্য নিবাস হইতে বহুদূরে আসিয়া কেবল যে ক্রিয়ালোপই সংঘটিত হইয়াছিল, তাহা নহে। ইহদিগের মধ্যে ভাষা পার্থক্যও প্রবেশলাভ করিয়াছিল। কেহ ম্লেচ্ছভাষা ধরিয়াছিলেন, কেহ বা আৰ্য-ভাষা রক্ষার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু আৰ্য সমাজ সকল শ্রেণীর ব্রাত্যগণকেই “দস্যু” নামে অভিহিত করিয়াছিলেন। এইরূপে প্রাচ্যরাজ্যে আৰ্য প্রভাব ক্ষেত্র বিস্তৃত হইবার সূচনা হইতেই, তদ্দেশে একটি স্বতন্ত্র অভিনব সমাজের উৎপত্তি হয়;–তাহা আৰ্য সমাজ হইতে উৎপন্ন বলিয়া আৰ্যত্বাভিমানী; আৰ্যসমাজ কর্তৃক সমাজচ্যুত বলিয়া ব্রাত্যাপবাদগ্রস্ত!
৬ মেধাতিথি লিখিয়া গিয়াছেন :–”পূণ্ডকাদয়ঃ শব্দাঃ পরমার্থতো জনপদশব্দাঃ। যদি বা পুষ্প্রাদয়ঃ শব্দাঃ কথঞ্চিদ্দেশ সম্বন্ধেন বিনা দৃশন্তে, তদৈতজ্জাতীয়া বেদিতব্যাঃ।” ইহাতেই বুঝিতে পারা যায়, উত্তরকালে পুকাদি শব্দ জনপদবাচকরূপেই সাধারণতঃ ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু ঐ সকল শব্দ যে এক সময়ে জাতিবাচক ছিল তাহার ব্যবহারও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় নাই। ভাষ্যকারের এই ব্যাখ্যায় পুরাতন ঐতিহাসিক তথ্যই সমর্থিত হইতেছে।
৭ মাগধাংশ্চ মহাগ্রামান পুংস্তঙ্গাং স্তথৈবচ ভূমিঞ্চ কোষকারাণাং ভূমিঞ্চ রজতাকরাম। কিং৷৷ ৪০।২৩৷৷
বঙ্গবাসী সংস্করণের এই শ্লোক রামানুজ টীকাসমন্বিত মুম্বই-সংস্করণে২২ সংখ্যক শ্লোকরূপে উল্লিখিত। তাহাতে কিঞ্চিৎ পাঠান্তরও বৰ্তমান; যথা :
মাগধাংশ্চ মহাগ্রামান পুন্ড্রন বঙ্গাংস্তথৈবচ। পত্তনং কোষকারাণাং ভূমিঞ্চ রজতাকরাম। ৮ অঙ্গানাং বিষয়েহঙ্গাঃ। বঙ্গাঃ। সুহ্মাঃ পুণ্ডাঃ ॥৪॥২॥৫২৷৷
৯ ভীমসেনের দিগ্বিজয়-বর্ণনায় পুণ্ড, কৌশিকীকচ্ছ, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত এবং কৰ্কট রাজ্যের উল্লেখ আছে। কৌশিকীকচ্ছ মিথিলার একাংশ মাত্র। তৎকালে কিরাত রাজ্য পুরাজ্যের অন্তর্গত হইয়া পড়িয়াছিল। এই সকল রাজ্য পৃথক হইয়া ছিল পৃথক রাজার অধীনে থাকায়, ভীমসেনকে পৃথক পৃথক ভাবে যুদ্ধ করিতে ছিল। তাহার উল্লেখ করিতে গিয়া মহাকবি প্রসঙ্গক্রমে পুরাজ্যের চতুঃসীমার আভাস প্রদান করিয়া গিয়াছেন। মহাভারতীয় সভাপর্বের ত্রিংশৎ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১০ গৌড়ীয় সাম্রাজ্য পঞ্চ ভাগে বিভক্ত থাকায়, প্রত্যেক ভাগ গৌড় নামে কথিত হইয়া, “পঞ্চগৌড়” নামক প্রসিদ্ধ বাক্যের প্রচলন সাধন করিয়া থাকিতে পারে। উত্তরকালে “পঞ্চগৌড়” নামক যে সকল রাজ্যের উল্লেখ প্রচলিত হইয়াছিল তাহা প্রামাণিক হইলে, আৰ্য্যাবৰ্ত্তে অধিকাংশই “গৌড়” হইয়া পড়ে। সুতরাং তাহা কতদূর প্রামাণিক তাহার আলোচনা আবশ্যক।
১১ ততঃ পুস্রাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলং। কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ নহৌজসম। উভৌ বলভূতৌ বীরাভুবৌ তীব্র পরাক্রমৌ নিজ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ। সমুদ্রসেনং নিজ্জ্বিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবং। তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজানং কৰ্বটাধিপতিং তথা।
১২ সভাপৰ্ব্বে ভীমসেনের দিগ্বিজয় বর্ণনায় পুণ্ড, কৌশিক কচ্ছ, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত এবং কৰ্বটরাজ্য জয় করিবার কথা উল্লিখিত আছে। এই সকল রাজ্য তৎকালে পৃথক পৃথক রাজ্যর অধীন ছিল। সুতরাং পুণ্ড রাজ্যের সীমা কতদূর বিস্তৃত ছিল, ইহাতেই তাহার যথেষ্ট আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। যথা :
ততঃ পুণ্ডাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলং। কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম। উভৌ বলভূভৌ বীরাবুভৌ তীব্ৰপরাক্রমৌ। নিৰ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ। সমুদ্রসেনং নিজ্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবং। তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজ্যানং কৰ্বটাধিপতিং তথা। ৩০, ২২-২৪৷৷
১৩ শ্ৰীযুক্ত মনোমোহন চক্রবর্তী মহাশয় (এশিয়াটিক সোসাইটির নবপৰ্য্যায় পত্রিকার চতুর্থ ভাগের পঞ্চম সংখ্যায়) এই সংশয়ের কথা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি করতোয়া-শব্দ খরতোয়া-শব্দের অপভ্রংশ বলিয়াও ইঙ্গিত করিয়াছেন। করতোয়া “করোবা” বলিয়া সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লিখিত, এবং তাহার মধ্যেই তাহার পৌরাণিক জন্মকাহিনী নিহিত হইয়া রহিয়াছে।
১৪ অশোকাবদান গ্রন্থে এবং জৈন স্থবিরগণের নামমালার মধ্যে পৌণ্ড্রবর্ধন শব্দের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।
১৫ বৃহত্ত্বথামঞ্জরী নামক উপাখ্যান পুস্তকে এই নগর “পৌণ্ড্রবর্ধনপুর” নামে উল্লিখিত। পুর বা নগর কবির ইচ্ছাক্রমে ব্যবহৃত হইয়া থাকিতে পারে। তাহার উপর নির্ভর করিয়া কোনও ঐতিহাসিক তথ্য লাভ করিবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প বলিয়াই প্রতিভাত হয়।
১৬ জেনারেল কানিংহাম এক সময়ে মহাস্থানগড়কে বৌদ্ধ ভ্রমণকারীর গ্রন্থলিখিত পৌণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানীর স্থান বলিয়া অনুমান করিতে ইচ্ছা করিয়া তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত করিয়া গিয়াছেন।
.
বাঙ্গালী
যাহারা বাঙ্গালা দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে অনেক বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইতে লজ্জাবোধ করে; তাহারা বলে,–বাঙ্গালা দেশে জন্মগ্রহণ করিলেই বাঙ্গালী হয় না। যাহাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা, তাহাদের মধ্যেও কেহ কেহ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইতে ইতস্ততঃ করিয়া থাকে; তাহারা বলে,–বাঙ্গালা ভাষায় কথাবার্তা কহিলেই বাঙ্গালী হয় না। তবে কাহাকে বাঙ্গালী বলিব?
যাহারা স্মরণাতীত কাল হইতে বাঙ্গালা দেশে বংশানুক্রমে বাস করিয়া আসিতেছে,-কদাপি বাঙ্গালার চতুঃসীমার বাহিরে পদার্পণ করে নাই, কেবল তাহারাই কি বাঙ্গালী? সে হিসাবে গারো কুকী এবং সাঁওতালেরাই খাঁটি বাঙ্গালী! বঙ্গবাসী ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য প্রভৃতি সভ্যজাতি বিদেশাগত উপনিবেশনিবাসী মাত্র।
জন্মস্থান এবং মাতৃভাষা লইয়া বিচার করিতে হইলে বঙ্গদেশপ্রসূত বঙ্গভাষাভাষী ব্যক্তিমাত্রকেই এখন বাঙ্গালী বলিয়া অভিহিত করিতে হইবে। কাহার পূৰ্ব্ব পুরুষ কোন অজ্ঞাত পুরাকালে বঙ্গদেশে প্রথম পদার্পণ করিয়াছিলেন, সে কথা এখন বিচার করিবার প্রয়োজন নাই।
কিন্তু জন্মস্থান নির্ণয় করিবার পূর্বে কোন ভুভাগকে বাঙ্গালা নামে অভিহিত করিব, তদ্বিষয়ে নানা তর্ক বিতর্ক উপস্থিত হইতে পারে। যেখানে বাঙ্গালা ভাষাই সচরাচর কথোপকথনের ভাষা, তাহাকে বাঙ্গালাদেশ বলিতে হইলে, আসাম, উত্তাল, বিহার ও ছোটোনাগপুর পরিত্যাগ করিয়া, রাজসাহী, বর্ধমান, ঢাকা ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের কয়েকটি জেলা লইয়াই বাঙ্গালা দেশের সীমা নির্দেশ করিতে হইবে। এই সকল জেলার জনসাধারণের সচরাচর কথোপকথনের ভাষা বাঙ্গালা;–এখানে যে অল্পসংখ্যক ভিন্ন-ভাষা-ভাষী অন্য লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহারা তীর্থের কাক, দুইদিনের প্রবাসী, দেশের ভূমির সহিত তাহাদের কোনরূপ স্থায়ী সম্বন্ধ সংস্থাপিত হয় নাই। ইহারা অদ্যাপি শারীরিক শ্রম বা শিল্পকৌশল বিনিময়ে জীবিকার্জন করিবার জন্য বাঙ্গালা দেশে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে। বাঙ্গালার এই চারিটি বিভাগকে যথাক্রমে উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ বাঙ্গালা নামে অভিহিত করা যাইতে পারে। উত্তর বাঙ্গালার উত্তরে পার্বত্য জনপদে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন জাতি; সুতরাং উত্তর বাঙ্গালার উত্তরাংশ খাঁটি বাঙ্গালা নহে। পশ্চিম বাঙ্গালার পশ্চিমে বিহার ও ছোটোনাগপুর, দক্ষিণে উৎকল; সুতরাং পশ্চিম বাঙ্গালার উত্তরে আসাম, পূৰ্ব্বে ব্রহ্ম রাজ্য; সুতরাং পূৰ্ব্ববাঙ্গালারও উত্তর এবং পূর্বাঞ্চল খাঁটি বাঙ্গালা নহে। কেবল দক্ষিণ বঙ্গই এই হিসাবে খাঁটি বাঙ্গালা। খাঁটি বাঙ্গালা হউক, কিন্তু দক্ষিণ বঙ্গ আধুনিক জনপদ–পুরাকালে ইহার অস্তিত্ব পৰ্য্যন্ত সমুদ্র-নিহিত ছিল। উত্তর পশ্চিম ও পূর্ব বাঙ্গালা যখন শৌর্য্যে বীর্য্যে সহিত্যে শিল্পে সদাচারে ও সভ্যতায় ভারতবর্ষের সৰ্ব্বত্র সুপরিচিত, দক্ষিণ বাঙ্গালা তখনও গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের স্রোতবিধৌত বঙ্গোপসাগরে তরঙ্গতাড়িত নবোদগত বালুকাতট ভিন্ন আর কিছু নহে। সেই বালুকাতটগুলি কালক্রমে মানব-নিবাসের উপযোগী হইয়া প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপোপদ্বীপ ও পরে সুবিস্তৃত সমতল রাজ্যে পরিণত হইয়াছে। ভূগর্ভ খনন করিবার সময়ে ইহার যথেষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। পুরাতত্ত্বের আলোচনা করিবার সময়েও ইহার কিছু কিছু পরিচয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে।
বাঙ্গালা দেশের ইতিহাস প্রথমে দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা উচিত; দক্ষিণ বঙ্গের অভ্যুদয়ের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কাল লইয়া ইতিহাসের কালবিভাগ করা যাইতে পারে। দক্ষিণ বঙ্গ অভূদিত হইবার পূর্বকালে বাঙ্গালা দেশের অবস্থা কিরূপ ছিল, সেদেশে যাহারা বাস করিত, তাহাদের দ্বারা বাঙ্গালা দেশে কোন কোন কীৰ্ত্তি সংস্থাপিত হইয়াছিল, সে কত দিনের কথা এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। তৎকালে আর্যাবর্তে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ এই তিনটি প্রাচ্য জনপদের নাম পরিচিত ছিল বলিয়া বোধ হয়। তন্মধ্যে বঙ্গ বলিতে কেবল পূর্ব বাঙ্গালাকেই বুঝাইত; পশ্চিম বাঙ্গালা কলিঙ্গের ও উত্তর বাঙ্গালা মিথিলা বা ত্রিহুতের অভিভুক্ত ছিল বলিয়াই বোধ হয়।
অঙ্গ রাজ্যের পূৰ্ব্বে কলিঙ্গ রাজ্যের এক দেশে বনখণ্ডের অভ্যন্তরে আরণ্য গজের প্রাদুর্ভাব ছিল; পশ্চিম বঙ্গের লোকে সেই আরণ্যগজ সুশিক্ষিত করিয়া রণক্ষেত্রে দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছিলেন পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের গ্রন্থে ইহারাই গঙ্গারাঢ়ীয় নামে পরিচিত। তৎকালে উত্তর বঙ্গ মিথিলা বা ত্রিহুতের অন্তর্গত থাকিয়া কৃষি শিল্প ও সাহিত্য সেবায় নিযুক্ত ছিল, পূর্ববঙ্গ এক প্রান্তে আসাম ও অপর প্রান্তে ব্রহ্মরাজ্যের অধিবাসিবর্গের সহিত নিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকিয়া আত্মরক্ষা করিত। পুরাকালের পশ্চিম ও পূৰ্ব্ব বাঙ্গালায় শৌর্য বীৰ্য্য এবং উত্তর বাঙ্গালায় শিল্প ও সাহিত্যোন্নতির এই অনুমান নিতান্ত ভিত্তিহীন বলিয়া বোধ হয় না। শিল্প ও সাহিত্যের ক্রমোন্নতির জন্য যে শান্তি ও বিশ্রাম-সুখের প্রয়োজন, পূৰ্ব্ব বা পশ্চিম বাঙ্গালায় তাহা তখনও প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে নাই। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম বাঙ্গালা অতি প্রাচীন কাল হইতেই বণিজ্যে লিপ্ত হইয়া জলপথে নানা দিগদেশে গমনাগমন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তদুপলক্ষে সমুদ্রপথে প্রশান্ত-মহাসাগমধ্যস্থ দ্বীপপুঞ্জে ও চীনরাজ্যে যে ভারতীয় সভ্যতা সুবিস্তৃত হয়, পূর্ব ও পশ্চিম বাঙ্গালার লোকেরাই তাহার প্রধান নিদান। তাহাদের বীরবাহু স্বদেশরক্ষার্থ নিয়ত নিযুক্ত থাকিয়া স্বদেশের পণ্যভাণ্ডার বিদেশে বহন করিয়া বিদেশের রত্নরাশি স্বদেশে আনয়ন করিত। ইহার ফলে ভারতবর্ষের পূৰ্বাঞ্চল নানা দূরদেশেও সুপরিচিত হইয়াছিল।
তৎকালে আর্যাবর্তের সহিত পশ্চিম ও উত্তর বাঙ্গালার যেরূপ সাক্ষাৎ সম্বন্ধ বর্তমান ছিল, পূৰ্ব্ব বাঙ্গালার সেরূপ সংশ্রব লাভের সুযোগ ছিল না। পূৰ্ব্ব বাঙ্গালা আর্যাবর্তের সুসভ্য আৰ্যনিবাস হইতে বহুদূরে বিচ্ছিন্নভাবে বিন্যস্ত বলিয়া, তথায় যাহা কিছু সভ্যতার বিকাশ হইয়াছিল, তাহা একরূপ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাবেই বিকশিত হইয়াছিল। বোধ হয় এই সকল কারণে তৎকালে বঙ্গ বলিতে কেবল পূৰ্ব্ব বঙ্গকেই বুঝাইত; পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গ বঙ্গমধ্যে পরিগণিত হইত না। পূর্ববঙ্গের প্রতাপ জলে স্থলে পরিব্যাপ্ত হইবার পর হইতেই কালক্রমে উত্তর ও পশ্চিম বাঙ্গালাও বঙ্গমধ্যে পরিগণিত হইয়া পড়িয়াছে–এইরূপ সিদ্ধান্ত নিতান্ত অসঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না।
বঙ্গ বহুদিনের সভ্য জনপদ। এখানকার ভাষা, এখানকার লিখনপ্রণালী, এখানকার গৃহনির্মাণকৌশল ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ হইতে পৃথক। উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালা ভাষা যখন সংস্কৃত সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া ভিন্নরূপধারণ করিতেছিল, পূর্ববঙ্গের ভাষায় তখনও সংস্কৃতের ছায়া সুস্পষ্ট অভিব্যক্ত হইত, অদ্যাপি তাহার অনেক পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। লিখনপ্রণালী পুরাতন পালি বা দেবনাগরী বা মৈথিলী আকার পরিত্যাগ করিয়া যে ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র আকার ধারণ করিয়াছে, তাহাও পূৰ্ব্ববাঙ্গালা হইতে উদ্ভূত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। পূর্ববঙ্গের গৃহনির্মাণকৌশল ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের কেন–উত্তর ও পশ্চিম বাঙ্গালার গৃহনির্মাণকৌশল হইতেও বিভিন্ন; বরং এতদ্বিষয়ে উত্তর ও পশ্চিম বাঙ্গালা প্রায় একরূপ, কেবল পূৰ্ব্ববাঙ্গালাই পৃথক। পূৰ্ব্ববাঙ্গালার শিল্পোন্নতিও পৃথক পথে ধাবিত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। যাহারা নিয়ত মাতৃভূমির সহিত সংলগ্ন থাকিয়া তাহার আদর্শের অনুকরণ করিয়া জীবনযাত্রা নিৰ্বাহ করে, তাহারা ভিন্ন দেশে বাস করিবার সময়েও সে দেশের নূতন দ্রব্যাদির ফললাভ করিতে পারে না। যাহারা জন্মভূমি হইতে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তাঁহারা বাধ্য হইয়া নূতন দেশের নূতন দ্রব্যাদি আত্মকাৰ্য্যে নিয়োগ করিবার জন্য বুদ্ধিকৌশলে নব্যশিল্পের অবতারণা করিয়া থাকে। শিল্পালোচনা করিলে পূর্ববঙ্গেরও যে একদা এইরূপ অবস্থা ছিল, তাহাতে আর সন্দেহ থাকিবে না। পশ্চিম ও উত্তর বাঙ্গালা কৃষিজাত দ্রব্যে সুসম্পন্ন বলিয়া তাহার বিনিময়ে ধনোপাৰ্জন করিবার জন্যই ধাবিত হইত। পশ্চিম বঙ্গের রত্নবণিগবর্গ আমলকি, হরিতকির ছড়াছড়ি করিতেন, তাহারই বিনিময়ে বিদেশ হইতে ধনাহরণ করিতেন। উত্তরবঙ্গের লোকেও কৃষিজাত দ্রব্যের আদান প্রদান দ্বারা ধনোপাৰ্জনে ব্যস্ত ছিলেন। পূৰ্ব্ববঙ্গের কৃষিদ্রব্য অধিক হইলেও, কৃষিজাত রূঢ়দ্রব্য শিল্পকৌশলে রূপান্তরিত হইয়া ধনোপার্জনের সহায়তা করিত। যাহারা ধরিত্রীকে যেরূপ অবস্থায় পাইয়াছিল সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া যায়, তাহারা অলস ও মূর্খ। যাহারা ধরিত্রী হইতে ধনাহরণকালে কৃষির সঙ্গে শিল্পের সংযোগ করিয়া লয়, তাহারা কর্মঠ ও সুপণ্ডিত। এই হিসাবে পূর্ববঙ্গ কৰ্ম্মঠ ও সুপণ্ডিত বলিয়া সম্মানের পাত্র। অতি পুরাকালে স্থলপথ অপেক্ষা জলপথেই বাঙ্গালীর ভ্রমণনৈপুণ্য বর্ধিত হইয়া উঠিয়াছিল। এখনকার বাঙ্গালী ষ্টীমারে চড়িয়াও পদ্মাপার হইতে আশঙ্কা বোধ করে, তখনকার বাঙ্গালী ভেলায় সমুদ্র পার হইত–তকালপ্রচলিত অর্ণবযানে আরোহণ করিয়া সাহস, সহিষ্ণুতা ও বাহুবলমাত্র সম্বল করিয়া দ্বীপোপদ্বীপে বিচরণ করিত। তখন গৃহে অন্নসংস্থানের অভাব ছিল না, তথাপি বাঙ্গালী গৃহকোণে জীবন-পাত না করিয়া নানা দিগদেশে বিচরণ করিত কেন? স্বদেশে স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিয়া চৰ্ব্ব চোষ্য উপভোগ করিবার সুবিধা থাকিতেও তরঙ্গসঙ্কুল সাগরযাত্রায় অৰ্ধাশন বা উপবাসক্লেশ সহ্য করিবার জন্য লালায়িত হইত কেন?
যাহারা সমুদ্রতীরে বাস করে, তাহারা কৌতূহল ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াই প্রথমে সমুদ্রবেলায় বিচরণ করে, পরে কুলে কুলে পরিভ্রমণ ও ক্রমশঃ সমুদ্রবক্ষে বিচরণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পোতাদি নির্মাণ করিতে থাকে; অবশেষে সমুদ্রই তাহাদের শৌর্য বীৰ্য ও ধনাগমের নিদান হইয়া পড়ে–স্থলপথ অপেক্ষা জলপথেই অধিক অনুরাগ বর্ধিত হইতে থাকে। নিত্য নূতন দেশে পদার্পণ নিত্য অপরিজ্ঞাত পূৰ্ব্ব শোভাসন্দর্শন, নিত্য নববাৎসাহে ধনাহরণ, এবং নিত্য নবকীৰ্ত্তি সংস্থাপনের লোভে সমুদ্রকূলনিবাসী মানবসমাজ সমুদ্রভ্রমণে সুদক্ষ হইয়া উঠে। পৃথিবীর সমুদ্রকূলনিবাসী সমস্ত জনপদেই ইহার পরিচয় প্রকাশিত রহিয়াছে; বাঙ্গালার সমুদ্রকূলেও ইহার পরিচয় প্রকাশিত হইয়াছিল;–এখনও তাহার ঐতিহাসিক প্রমাণ একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই।
দক্ষিণ বাঙ্গালা সমুদ্রনিহিত থাকিবার সময়ে মুরশিদাবাদের নিকটবর্তী রাঙ্গামাটী নামক স্থানে একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল বলিয়া শুনিতে পাওয়া যায়; তৎকালে সমুদ্র রাঙ্গামাটীর পদধৌত করিত এবং সিংহলের অর্ণবপোত বাণিজ্যোপলক্ষে রাঙ্গামাটী পৰ্য্যন্ত যাতায়াত করিত। এই স্থানে একটি জলযুদ্ধ সংঘটিত হইবার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বিলুপ্ত কাহিনীর পুনরুদ্ধার সাধিত হইলে এইরূপ আরও কত পুরাতন বন্দরের পরিচয় প্রকাশিত হইবে, তাহা কে বলিতে পারে?
অন্যান্য দেশের ন্যায় বঙ্গদেশের সভ্যতা আধুনিক নহে; ইহার শৌর্য বীর্য্যের কথা, ইহার শিল্পগৌরবের কথা, ইহার শিল্পশালাসঞ্জাত বিচিত্র পণ্যদ্রব্যের পরিচয় প্রাচীন গ্রীক ও রোমক রাজ্যেও সুপরিজ্ঞাত ছিল। তৎকালে বাঙ্গালার পশ্চিম ও উত্তরাংশের পুরাতন জনপদের স্থানে স্থানে যে সকল বৌদ্ধ কীৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, অদ্যাপি তাহার নিদর্শনের অভাব নাই; চৈনিক ভ্রমণকারিগণও তাহা দর্শন করিবার জন্য এদেশে পদার্পণ করিয়াছিলেন। তখনও পূৰ্ব্বোপসাগরের বাণিজ্যপোত বাঙ্গালীর শাসন ও পরিচালন কৌশলের অধীন ছিল। যাহারা তৎকালে বাঙ্গালাদেশে বাস করিত, তাহাদের ভাগ ও সাহিত্য কিরূপ ছিল তাহার নিদর্শন বিলুপ্ত হইলেও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইতে পারে নাই। বাঙ্গালাদেশে তাহার নিদর্শন দুর্লভ, কিন্তু সমুদ্রবেষ্টিত যবদ্বীপ বালিদ্বীপ প্রভৃতি পুরাতন জনপদে তাহা অদ্যাপি দেদীপ্যমান।
ভারতবর্ষের মধ্যে আৰ্য্যাবর্তই সর্বাপেক্ষা পুরাতন সভ্য জনপদ। আৰ্য্যাবর্ত যখন শিক্ষা দীক্ষা ও সভ্যতায় সমুন্নত, দাক্ষিণাত্য তখন তালবন-সমাচ্ছন্ন অজ্ঞানতার ঘনান্ধকারে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন। তাহার পর ক্রমে দাক্ষিণাত্যেও আৰ্যোপনিবাস সংস্থাপিত হইয়া দুই একটি করিয়া গ্রাম নগর সংস্থাপিত হইতে আরম্ভ করে। দাক্ষিণাত্য এইরূপে আৰ্যনিবাসে পরিণত হইবার পূৰ্বে আৰ্য্যাবর্তের পূৰ্ব্বসীমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃতিলাভ করিয়াছিল, তাহার অনুসন্ধান করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, পূৰ্ব্ব বাঙ্গালা পর্যন্ত পূৰ্ব্বে ও কলিঙ্গ পৰ্য্যন্ত পূর্ব-দক্ষিণে আৰ্য্যপ্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তৎকালে বঙ্গোপকূলে তিনটি সম্পন্নজনপদ বিদেশে কলিঙ্গ নামে পরিচিত ছিল; সংক্ষেপে উড়িষ্যা হইতে আরাকানের উপকূল পর্যন্ত কলিঙ্গের অধিকার ছিল। এই কলিঙ্গ জনপদের অধিবাসীবর্গই প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে আৰ্য সভ্যতা, আর্যভাষা আৰ্য সাহিত্য ও আৰ্যপ্রতাপ সুবিস্তৃত করে। যব-দ্বীপ ও বালিদ্বীপের হিন্দু অধিবাসিবর্গের বিশ্বাস, তাহাদের পূর্বপুরুষগণ এই কলিঙ্গরাজা হইতেই দ্বীপে দ্বীপে উপনিবেশ সংস্থাপন করিয়াছিলেন। সে সকল আৰ্য্যোপনিবেশের ভাষা ও লিখন প্রণালীর পরিচয় অদ্যাপি বিলুপ্ত হয় নাই। সে ভাষার নাম ছিল কবি ভাষা, লিখন প্রণালীতে সংস্কৃতের অনুরূপ ক খ গ ঘ ঙ ইত্যাদি সুপরিচিত বর্ণ বিন্যস্ত! কবিভাষার শব্দাবলী বিকৃত উচ্চারণে যৎকিঞ্চিৎ বিকৃত হইলেও বাঙ্গালীর পক্ষে একেবারে দুর্বোধ্য নহে। কবিভাষানিবদ্ধ সাহিত্যও ভারতবর্ষের সুপরিচিত রামায়ণাদি ভিন্ন আর কিছুই নহে। এই সাহিত্যে ও লিখনপ্রণালীতে সংস্কৃতের সম্পূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাঙ্গালা ভাষার সাহিত্য ও লিখন প্রণালীতেও সেই প্রভাব বৰ্ত্তমান। সুতরাং সেকালের বাঙ্গালা দেশেও যে সংস্কৃতের প্রভাব বৰ্তমান ছিল, তাহাই সঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়। আর্যাবর্তের সংস্কৃত হিন্দীতে ও এদেশের সংস্কৃত কালক্রমে বাঙ্গালায় রূপান্তরিত হইয়াছে। লিখন প্রণালীও সংস্কৃতের অক্ষরমালার আদর্শেই গঠিত, কেবল স্থান ও কালের পার্থক্যে ক্রমশঃ পৃথক হইয়া পড়িতেছে।
বিহার ও উল্কলের ন্যায় বাঙ্গালাদেশে পালি অক্ষরের প্রাবল্য দেখিতে পাওয়া যায় না; পালবংশীয় বৌদ্ধ নরপালবর্গের শাসনলিপিতেও মৈথিলী অক্ষরের প্রাদুর্ভাব; তাহাই বাঙ্গালার পুরাতন লিপিপ্রণালী ছিল বলিয়া বোধ হয়। সেই লিপিপ্রণালীলিখিত যে সকল অতি পুরাতন তাম্র বা প্রস্তরফলক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা সংস্কৃত ভাষায় রচিত; সচরাচর কথোপকথনের ভাষা সংস্কৃত হইতে কতদূর স্খলিত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা না জানিলেও, ধর্ম ও রাজকার্যে ব্যবহৃত ভাষা যে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ছিল, তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারা যায়। মধ্য ভারতে পালি ভাষাই সাহিত্যে ব্যবহৃত হইয়াছিল, পূৰ্ব্ব ভারতে তখনও সংস্কৃতের প্রভাব বর্তমান ছিল।
বৌদ্ধবির্ভাবের পূৰ্ব্ববর্তী যুগে বাঙ্গালা দেশের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহার যৎসামান্য সাধারণ আভাস ভিন্ন বিশেষ বিবরণ প্রাপ্ত হইবার আশা নাই। বৌদ্ধবির্ভাবের পরবর্তী যুগে বাঙ্গালার অনেক পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সময়ে মগধ রাজা গৌরবের উচ্চচূড়া স্পর্শ করিয়াছিল; মগধেশ্বরের নাম ও কীৰ্ত্তিকাহিনী পৃথিবীর বহুদূরদেশে বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল, এবং এশিয়াখন্ডের নানা স্থানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অথবা ধৰ্মনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দক্ষিণ বঙ্গ এই যুগে সমতট নামে পরিচিত, লোকনিবাসে পরিণত ও কৃষিকার্যের উপযোগী হইয়াছিল; পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ এই সময়ে সমুদ্র পথে বাণিজ্য ব্যবসায়ে ধনোপার্জনের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল; উত্তর বঙ্গ এই সময়ে বহু বৌদ্ধকীৰ্ত্তিতে সুসজ্জিত হইয়া ভারতবর্ষের সর্বত্র সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। বৌদ্ধপ্রভাবে বর্ধিত হইবার সময়ে উত্তর বঙ্গের পূৰ্বোত্তরাংশে কামরূপের পুরাতন জনপদ ভিন্ন বাঙ্গালার সকল স্থানই বৌদ্ধাচারে দীক্ষিত হইয়াছিল বলিয়া প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ এইরূপে সৌরাষ্ট্র ও মগধের ন্যায় পুরাতন ধর্মমত পরিত্যাগ করিয়া বৌদ্ধভূমি বলিয়া পরিচিত হইয়াছিল।
ভাষা ও সাহিত্য, ধৰ্ম্ম ও লোকাঁচার বৌদ্ধপ্রভাবসময়ে সকল স্থানেই যুগান্তর উপস্থিত করিয়াছিল; বাঙ্গালাদেশেও তাহার পরিচয় প্রকাশিত হইয়াছিল। এই সময়ে বাঙ্গালা দেশের সহিত ভারতবর্ষের অন্যান্য জনপদের কলহবিবাদের অনেক পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সময়ে বাঙ্গালা কখন মগধের, কখন কলিঙ্গের, কখন অঙ্গের, কখন বা বঙ্গের অধীন হইয়াছে; আবার বাঙ্গালীরা কখন বাহুবলে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মিথিলা গুর্জর ও কাশ্মীর পর্যন্তও রাজনৈতিক প্রবলপ্রতাপ বিস্তৃত করিতে সক্ষম হইয়াছে। এই সংঘর্ষ উপলক্ষে বাঙ্গালাদেশে প্রতিনিয়ত নানা দেশের নানা জাতির লোক প্রবেশ করিয়াছে। কেহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে, কেহ বা সপরিবারে বাঙ্গালায় বাসস্থান স্থাপন করিয়াছে, কেহ আবার বাঙ্গালীর সহিত বৈবাহিকসূত্রে মিলিত হইয়া বাঙ্গালীর দলপুষ্টি করিয়াছে। আজ যাহারা বাঙ্গালী নামে পরিচিত, তাহারা এইরূপে কতবার নবাগত অতিথিগণকে আপনাদিগের দলভুক্ত করিয়া লইয়াছে, তাহার তথ্যানুসন্ধান করা এখন অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।
কালক্রমে মোসলমানেরা আসিয়া বাঙ্গালীর দলপুষ্টি করিয়াছেন। এখন হিন্দু এবং মোসলমানেরাই বাঙ্গালার প্রধান অধিবাসী। যাহারা একদা হিন্দু বলিয়া পরিচিত ছিল, তন্মধ্যে বহুলোকে ইসলামের ধর্ম গ্রহণ করায় মোসলমানের সংখ্যা অল্পদিনের মধ্যেই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে। এখন বাঙ্গালার সুখদুঃখের সহিত যাহাদের চিরসংশ্রব, তাহারা মিশ্রজাতি–কেহ হিন্দু, কেহ মোসলমান, কেহ বা খৃষ্টীয়ান; কিন্তু সকলেই বাঙ্গালী।
খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর পূর্বকালের বাঙ্গালার ইতিহাসে কেবল হিন্দুর কথা তৎপরবর্তী কাল হইতে অষ্টাদশ শতাব্দীর কিয়দংশ পর্যন্ত হিন্দু ও মোসলমানের কথা, এবং তাহার পর হইতে হিন্দু মোসলমান ও খৃষ্টীয়ানের কথা। এই ত্রিবিধ যুগেই বাঙ্গালীর অগৌরবের কথা কোন জাতির ইতিহাসেই বা একেবারে নাই? কিন্তু এই ত্রিবিধ যুগেই বাঙ্গালীর অনেক গৌরবের কথাও শুনিতে পাওয়া যায়। বিদেশীয় ইতিহাস লেখকগণ কেবল অগৌরবের কথাই নানা ছন্দোবন্ধে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন; বাঙ্গালী লেখকগণ অনুসন্ধান করিলে তাহার মূলে সত্যের সঙ্গে অনেক মিথ্যাও মিশ্রিত দেখিতে পাইবেন।
বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই; সুতরাং বাঙ্গালীর কীৰ্ত্তিকাহিনী সাধারণ্যে সুপরিচিত নহে। বর্তমান যুগে বাঙ্গালী নানা দেশে বাসস্থান নির্মাণ করিতে বাধ্য হইয়াছে। যাহারা প্রবাসী, তাহারা ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন আচার ব্যবহারে জড়িত হইয়াও আপন স্বাতন্ত্র রক্ষা করিয়া কত ভাবে আত্মপ্রতিভার পরিচয় প্রদান করিতেছে, এতদিনের পর তাহার কাহিনী সঙ্কলিত হইবার উপায় হইল। প্রবাসী বাঙ্গালী মাতৃভাষার পুষ্টিসাধনের জন্য মাসিকপত্রিকা প্রচার করিতেছেন, ইহা বঙ্গসাহিত্যের পক্ষে নিরতিশয় আশা ও আনন্দের সমাচার। বাঙ্গালীর অতীত যাহাই হউক, ভবিষ্যৎ আশাপ্রদ। সে ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যসোপান গঠন করিবার ভার কেবল স্বদেশবাসী বাঙ্গালীর উপরেই ন্যস্ত নহে; প্রবাসী বাঙ্গালীকেও তাহার জন্য শ্রম স্বীকার করিতে হইবে। প্রবাসী এতদিন অর্থোপার্জনে ব্যস্ত ছিলেন, এখন স্বদেশ ও স্বজাতির কথা স্মরণপথে পতিত হইয়াছে। ভগবান এই নবজাত সাধু সংকল্পের সহায় হউন।
প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৮
.
বাঙ্গালীর আদর্শ
অখণ্ড মহাকালকে খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়া তাহারই এক অংশকে অতীত বলি, এক অংশকে বর্তমান বলি, আর এক অংশকে ভবিষ্যৎ বলি। প্রকৃতপক্ষে, তাহাদের মধ্যে এক অখণ্ড যোগসূত্র বর্তমান আছে। ইতিহাস সেই যোগসূত্রের সন্ধান প্রদান করে।
তাহার সাহায্যে বুঝিতে পারি–সংসারে কেবল পরাজয় নাই, জয়-পরাজয় আছে; কেবল পতন নাই, উত্থান-পতন আছে;–কেবল মন্দ নাই, ভালমন্দ আছে। আছে বলিয়াই আশা আছে;–যে পরাজিত, তাহার আবার জয়লাভের আশা আছে;–যে পতিত, তাহার আবার উত্থিত হইবার আশা আছে যে মন্দ, তাহারও আবার ভাল হইবার আশা আছে।
ইহার কোনও নির্দিষ্ট কাল নাই। তাহার শুভাগমনের আশায় কোনও গ্রহ নক্ষত্রের মঙ্গলময় আবর্তনের অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে হয় না। যখন যে জাতি প্রবল পুরুষকারের প্রয়োগ করিতে সমর্থ হয়, তখনই সে কাল আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত হয়।
আমাদিগের সেই কাল আসিতে পারে। মন্থরপদবিক্ষেপে সভয়ে সচকিত চরণে গোপন পথে নহে; প্রকাশ্যে রাজপথ দিয়া সুবিন্যস্ত সুদৃঢ় পদবিক্ষেপে দ্রুতবেগেই চলিয়া আসিতে পারে। যখন তাহা আসিবে, তখন আমরাও অভ্যুদয় লাভ করিতে পারিব।
অধঃপতনের কাল প্রকৃত সঙ্কট-কাল নয়; কিন্তু অভ্যুদয়ের কালই প্রকৃত সঙ্কট-কাল। আমরা এক দিন না একদিন অবশ্যই উঠিব,–জগতের জনসমাজের মধ্যে দশ জনের এক জন হইয়া উঠিব। কিন্তু কেমন হইয়া উঠিব? আমরা কি দৈত্যদানবের মতো ক্ষমাশূন্য বাহুবল লইয়া বসুন্ধরা হইতে সকল সভ্যতা, সকল শৃঙ্খলা, সকল উন্নতি চিরপদদলিত করিতে করিতে, প্রচণ্ড তাণ্ডবে জলস্থল কম্পান্বিত করিয়া উঠিব? অথবা জগতের সম্মুখে মানবতার মহান আদর্শ সুসংস্থাপিত করিবার জন্য ধর্মের নামে, সত্যের নামে, প্রীতির নামে, পবিত্রতার নামে, মনুষ্যত্বের নামে,–প্রসন্ননয়নে প্রবুদ্ধ হইয়া উঠিব? আমরা কোন আদর্শের অনুগামী হইব, তাহার উপরই তাহা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিবে। তাই বলিয়াছি, অভ্যুদয়ের কালই প্রকৃত সঙ্কটকাল।
ভাঙ্গা নহে, গড়া;–গড়া নহে, সংশোধন;–সংশোধন নহে, সংস্কার;–সংস্কার নহে, চিরাগতকে নবাগতের সঙ্গে সুসঙ্গতভাবে খাপ খাওয়াইয়া লওয়া, ইহাই যে যক্তিযুক্ত কাৰ্য্য, বিচারবুদ্ধি তাহারই পক্ষ সমর্থন করিবে। তাহাই প্রকৃত লক্ষ্য বলিয়া সকলের নিকটেই প্রতিভাত হইবে।
এই লক্ষ্য স্থির করিতে হইলে বাঙ্গালীর আদর্শ স্থির করিয়া লইতে হইবে। অতীতে বাঙ্গালীর আদর্শ কিরূপ ছিল;–বর্তমানে বাঙ্গালীর আদর্শ কেমন আছে; ভবিষ্যতে বাঙ্গালীর আদর্শ কেমন হওয়া উচিত;–তাহা ভাবিয়া দেখিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে।
ভবিষ্যতে বাঙ্গালীর আদর্শ কেমন হইয়া দাঁড়াইবে, বর্তমান কিয়ৎপরিমাণে তাহার পথ নির্দেশ করিয়া দিবে। সুতরাং বর্তমান কোন আদর্শের অনুসরণ করিতেছে, তাহার সন্ধান করা কর্তব্য। তাহা আমাদের দেশকালপাত্রের পক্ষে কত দূর উপযোগী, তাহা বুঝিতে হইলে অতীতের আদর্শ কেমন ছিল, তাহারও অনুসন্ধান করা কর্তব্য। যাঁহারা তাহার সন্ধানে নিবিষ্ট হইয়া রহিয়াছেন, তাহারা আমাদের জাতীয় জীবনগঠনের প্রধান সহায়। তাঁহাদের তথ্যানুসন্ধানচেষ্টা যাহাতে প্রকৃতপথে প্রধাবিত হয়, তাঁহাদের অনুসন্ধানলব্ধ ঐতিহাসিক সত্য যাহাতে অকপটে সরলতার সহিত অসঙ্কোচে প্রচারিত হইতে পারে, তাহাতে উৎসাহদান করা পরমপবিত্র পুণ্যব্রত।
কেবল বড় লইয়া বাঙ্গালী নয়, ছোট বড় লইয়াই বাঙ্গালী। কেবল ধনী লইয়া বাঙ্গালী নয়, ধনী দরিদ্র লইয়াই বাঙ্গালী। কেবল শিক্ষিত লইয়া বাঙ্গালী নয়, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লইয়াই বাঙ্গালী। বাঙ্গালী বহু জাতিতে বিভক্ত,–বহু ধৰ্ম্মে বিভক্ত,–বহু আচারব্যবহারে বিভক্ত, মানবসভ্যতার বহু বিভিন্ন অবস্থানস্তরে অবস্থিত। ইহার জন্য অনেকে মনে করেন, বাঙ্গালীর পক্ষে উন্নতি লাভ করা অসম্ভব। কিন্তু যে যুগে ফিলিপিনোর পক্ষে উন্নতিলাভ করা সম্ভব হইয়াছে, সে যুগে বাঙ্গালীর পক্ষে উন্নতিলাভ করা অসম্ভব হইবার আশঙ্কা নাই। বর্তমান যুগে উন্নতিলাভের যে সকল উপায় ও অনুষ্ঠান আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা যখন মানবসমাজের অপরিজ্ঞাত ছিল, তখন সেই তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগেও–যে বাঙ্গালী উন্নতিসোপানে আরোহণ করিতে সমর্থ হইয়াছিল, তাহার পক্ষে বৰ্ত্তমান যুগ অধিক অনুকূল বলিয়াই বিবেচিত হইবার যোগ্য।
আশাহীনের দল–চেষ্টাহীনের দল। তাহারা আলস্য চাহে,–আয়াস স্বীকার করিতে অসম্মত। তাহাদের যাহা কিছু আকাঙ্ক্ষা, তাহার মূল–ব্যক্তিগত সৌভাগ্যসঞ্চয়। তাহার প্রভাবে বাঙ্গালী মনুষ্যত্ব হারাইয়া, আত্মোন্নতিলাভের অযোগ্য হইয়া পড়িতেছিল। সময় থাকিতে আবার সুবাতাস প্রবাহিত হইতেছে, আশা ডুবিতে ডুবিতে ভাসমান হইয়া উঠিতেছে। এ সময়ে আলোচনার আয়োজন করিয়া আপনারা সময়োচিত কৰ্ত্তব্যপালনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। আমার ন্যায় মফস্বল নিবাসী ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া সৌজন্যে সংবর্ধনায় কৃতজ্ঞতাভারে ভারাক্রান্ত না করিয়া, কোনও যোগ্যতর ব্যক্তির উপর এই আলোচনার সূত্রপাত করিবার ভারাৰ্পণ করিতে পারিলে, সৰ্বাংশে সুশোভন ও সুসঙ্গত হইত।
আমি অধিক কথা শুনাইবার আশা প্রদান করিতে পারিব না। আমার কথা, অল্প কথা;–যেমন অল্প, সেইরূপ সরল ও বোধগম্য কথা। কারণ, আমি কেবল অতীতের কথাই শুনাইব,–অন্য কথা শুনাইবার চেষ্টা আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা হইবে। কেবল লর্ড অ্যাকটনের একটি কথার পুনরুক্তি করিয়া বলিয়া রাখিব :
আজ যাহা ইতিহাসের কথা, একদিন তাহা প্রতিদিবসের শাসনতত্ত্বের কথা ছিল; আজ যাহা প্রতিদিবসের শাসনতত্ত্বের কথা, কালে তাহাই আবার ইতিহাসের কথা বলিয়া পরিচিত হইবে।
অতীতের কথা ও বর্তমানের কথা, একই পর্যায়ের কথা;–কেবল কালের পার্থক্যে একটির নাম ইতিহাস, অন্যটির নাম অন্য কিছু। সুতরাং অতীতকে বুঝিবার চেষ্টা বৰ্ত্তমানকে বুঝাইবার চেষ্টার নামান্তরমাত্র।
অতি অল্পদিনমাত্র আমাদের দেশে এই শুভ চেষ্টার সূত্রপাত হইয়াছে। এখনও সকল কথা বুঝিবার ও বুঝাইবার সময় উপস্থিত হয় নাই। সুতরাং অতীত সম্বন্ধেও অধিক কথা শুনাইতে পারিব না; আর যাহা শুনাইতে পারিব, তাহাও আমার নিজের কথা নয়, গৌড়লেখমালার কথা,–গৌড়সাহিত্যলীলার কথা, গৌড়শিল্পকলার কথা। সে কথা পুরাতন লিখিত ও ক্ষোদিত লিপিতে স্থানলাভ করিয়া, কালসমুদ্র উত্তীর্ণ হইয়া, আমাদের গৃহদ্বারে উপনীত হইয়াছে। তাহাকে পরমাত্মীয়ের ন্যায় বরণ করিয়া লইতে হইবে, তাহার সাহায্যে বাঙ্গালীর আদর্শের সন্ধানলাভ করিতে হইবে;–তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিলে, যাহা যথার্থ আলোক, তাহাকে নির্বাপিত করিয়া, অন্ধকারে কোলাহল করাই সার হইয়া রহিবে।
একবার বাঙ্গালী এক হইয়া উঠিয়াছিল। এক অনিৰ্ব্বচনীয় মহাপ্রাণতায় অনুপ্রাণিত হইয়া, সমস্ত পার্থক্যের মধ্যে,–সমস্ত ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের অপরিহার্য অসামঞ্জস্যের মধ্যে,–এক বিচিত্র সামঞ্জস্যের পরিচয় প্রদান করিয়াছিল। বাঙ্গালার প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালদেবকে রাজপদে নির্বাচিত করিয়া, পালসাম্রাজ্য” নামক ইতিহাসবিখ্যাত পরাক্রান্ত প্রবল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। অন্ধ্র সাম্রাজ্য ভিন্ন, সমগ্র ভারতবর্ষে, পালসাম্রাজ্যের ন্যায় দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য আর কখনো প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারে নাই। ব্যক্তিগত প্রাধান্যসংস্থাপনের প্রবল স্বার্থ বিসর্জন দিতে না পারিলে, এই কাৰ্য্য সুসম্পন্ন হইতে পারিত না। সুতরাং ইহা বাঙ্গালীর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কথা।
তাহার মূলমন্ত্র একতা,–তাহার মূলমন্ত্র স্বার্থত্যাগ–তাহার মূলমন্ত্র অকৃত্রিম অনাবিল অপার স্বদেশপ্রীতি। সেই মূলমন্ত্র মহামন্ত্র,– তাহার প্রবল প্রভাবে কৃপণ মুক্তহস্ত হয়, আত্মম্ভরী পরসেবাব্রত গ্রহণ করে, কাপুরুষ লজ্জাহীন চিরবিভীষিকা বিসর্জন দেয়। সেই মূলমন্ত্র মহামন্ত্র, তাহার সাধনায় জনসমাজের শ্রমোপার্জিত বিপুল ‘ধনভাণ্ডার’ ‘‘জলধিমূল গভীরগর্ভ” সরোবর খনন করাইয়া, পিপাসাতুরকে জলদান করে; পান্থশালা নির্মাণ করাইয়া, পরিশ্রান্ত পথপৰ্যটকের বিশ্রামস্থানের সুব্যবস্থা করিয়া দেয়; চিকিৎসালয় প্রতিস্থাপিত করাইয়া, রোগার্তের সেবা করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়ে। সেই মূলমন্ত্র মহামন্ত্র, তাহার প্রভাবে “কুলভূধরতুল্যকক্ষ” অগণ্য ধৰ্ম্মমন্দির গগনচুম্বী সমুচ্চশিখরে বিশ্বনিয়ন্তার সিংহাসনের দিকে দেশের সমগ্র নরনারীর জীবনগত চরম আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করিয়া রাখে। সেই মূলমন্ত্র মহামন্ত্র, –তাহা ভোগে সংযম, ত্যাগে শৃঙ্খলা, জ্ঞানে সত্যনিষ্ঠা, প্রেমে আন্তরিকতা, ধৈর্য্যে অবিচলচিত্ততা, বীর্যে অকুতোভয়তা ও কর্মে অধ্যবসায় আনয়ন করিয়া, বৃহৎ বিজয়গৌরবে জনসমাজকে গৌরবান্বিত করে। ইহার কথাই বাঙ্গালীর পুরাতন ইতিহাসের প্রধান কথা।
তখনকার বাঙ্গালীর প্রধান আদর্শ ছিল–জীবনযাত্রার আড়ম্বরশূন্য সরল ব্যবস্থার সঙ্গে উচ্চ চিন্তা ও মহোচ্চ অবদান। তাহা রাধাধিরাজকে পুত্রহস্তে রাজ্যভার সমৰ্পণ করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতে সমর্থ করিত;–রাজকুমারগণকে বোধিমার্গ হইতে “অবিনিবৰ্ত্তী” হইয়া, পুণ্যব্রত পালন করিতে উৎসাহদান করিত। ভোগের সঙ্গে ত্যাগের, ঐশ্বর্যের সঙ্গে অস্খলিত পরসেবা পরায়ণতার-বীর্যের সঙ্গে ক্ষমার, সমন্বয়সাধন করাইয়া, সে আদর্শ বাঙ্গালীকে মানব-শক্তির মূল প্রস্রবণের সন্ধান প্রদান করিত। তাহার ফলে সে কালের বাঙ্গালী স্বয়ং সমুন্নত হইয়া, অগণ্য অনুন্নত মানবসমাজকে সমুন্নত করিয়াছে;–যাহার সভ্যতা ছিল না, তাহাকে সভ্যতা দান করিয়াছে; যাহার সমাজশৃঙ্খলা ছিল না, তাহাকে সমাজশৃঙ্খলা দান করিয়াছে; যাহার শিল্প-সাহিত্য-ধৰ্ম্মনীতি ছিল না, তাহাকে শিল্পসাহিত্য-ধৰ্ম্মনীতি দিয়া, মনুষ্যত্বের সঙ্গে দেবত্ব দান করিয়াছে;–ভারতবর্ষের বাহিরে এক বৃহত্তর ভারতবর্ষের সীমাবিস্তার করিয়া, জলে স্থলে ভারতবর্ষের প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। কি উত্তালতরঙ্গ তাড়িত মহাসাগরবক্ষ, কি উত্তপ্তবায়ুবিধবস্ত মহামরুভূমি, কি অনাদিকাল-পরিপুষ্ট-বনানী-বিজড়িত পৰ্বত প্রাচীর,–কিছুই বাঙ্গালীর যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করিতে পারে নাই। কারণ তখনকার অধ্যবসায় জীবহিতকামনায় অকুতোভয় ছিল; –জ্ঞান-প্রচারে জুগুপসা, ধর্মপ্রচারে পররাজ্য-লালসা, সভ্যতা-বিস্তারে পরকীৰ্ত্তি-বিনাশলোলুপতা তাহাকে স্বার্থান্ধ করিতে পারিত না।
তখনকার চরিত্রের আদর্শের পরিচয় দিতে হইলে, কেহ বলিতেন;–”জ্ঞানে বৃহস্পতি,–তেজে দিনপতি,–পুরুষকারে শ্রীপতি,–ধৈর্য্যে অম্বুপতি, ধনে ধনপতি,–দানে চম্পাপতি।” তাহাকে আরও ভালো করিয়া বুঝাইবার জন্য কেহ বলিবেন,–”যুধিষ্ঠিরের সত্যবাক্য, পৰ্বতমালায় স্থিরত্ব,–সমুদ্রে গাম্ভীর্য্য, বৃহস্পতিতে গুণশালিনী বুদ্ধি–ভাস্করে তেজস্বিতা।”
জ্ঞান-বুদ্ধি-সত্যনিষ্ঠা চাই,–তাহার অভাবে ব্যক্তি বা জাতি ধৈৰ্য-বীৰ্য-গাম্ভীৰ্য্য লাভ করিতে পারে না। ধৈৰ্য-বীৰ্য-গাম্ভীৰ্য্য চাই, তাহার অভাবে ব্যক্তি বা জাতি তেজস্বিতা ও সৎপৌরুষ লাভ করিতে পারে না। তেজস্বিতা ও সৎপৌরুষ চাই, তাহার অভাবে ব্যক্তি বা জাতি প্রকৃত অভ্যুদয় লাভ করিতে পারে না। জ্ঞান-বুদ্ধি সত্যনিষ্ঠা-হীন বাঙ্গালী বাঙ্গালী নয়,–ধৈৰ্য-বীৰ্য-গাম্ভীৰ্য্যহীন বাঙ্গালী বাঙ্গালী নয়;–তেজস্বিতা-সৎপৌরুষহীন বাঙ্গালী বাঙ্গালী নয়;–সেরূপ অন্তঃসারশূন্য বাঙ্গালীর মধ্যে বাঙ্গালীর ইতিহাসের ধারা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
এই সকল চরিত্রাদর্শ সেকালের রাজচরিত্রে কত দূর বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল, রাজপ্রশস্তিতে তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় :
পৃথু, রঘুবংশাবতংস রামচন্দ্র, নল প্রভৃতি যে সকল গুণাধার পূর্ধ্ব নরপাল সময়ে সময়ে ধরণীতলে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে এক সময়ে একত্র দর্শন করিবার ইচ্ছায় বিধাতা যেন নরপালকুল-গৌরব-সংহারক ধর্মপালকে কলিযুগের চিরচঞ্চল-লক্ষ্মীকরিণীর বন্ধনোপযোগী মহাস্তম্ভরূপে সংস্থাপিত করিয়াছিলেন।
জনসমাজ এই রাজচরিত্রে মুগ্ধ হইয়া ধৰ্ম্মপালের গুণগান করিত :
সীমান্তদেশে গোপগণ কর্তৃক,–বনে বনচরগণ কর্তৃক, গ্রামসমীপে জনসাধারণ কর্তৃক,–গৃহচত্বরে ক্রীড়াশীল শিশুগণ কর্তৃক,–প্রত্যেক ক্রয়বিক্রয়স্থানে বণিকগণ কর্তৃক,–এবং বিলাসগৃহের পিঞ্জরাবস্থিত শুকগণ কর্তৃক, –গীয়মান আত্মস্তব শ্রবণ করিয়া, এই নরপতির বদনমণ্ডল লজ্জাবশে নিয়ত ঈষৎ বক্রভাবে বিনম্র হইয়া রহিত।
পৃথিবীর কোন দেশের, কোন যুগের, কোন রাজা এরূপ লোকপ্রিয় হইতে পারিয়াছিলেন, তাহা অনুসন্ধানের বিষয়। ইহাতে যেমন রাজ-চরিত্রের আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেইরূপ প্রজা-চরিত্রেরও আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহারা গুণমুগ্ধ ছিল; শাসন-তৃপ্ত ছিল; রাজানুরক্ত ছিল; এবং তাহাদের এই অকৃত্রিম অনুরাগই রাজশক্তিকে অজেয় শক্তি দান করিয়াছিল। লোক-সমাজে চরিত্রের উচ্চ আদর্শ বর্তমান না থাকলে, রাজচরিত্র এত সমুন্নত হইতে পারিত না। এরূপ রাজ চরিত্র সামন্ত-মণ্ডলীতে কিরূপ স্বামিনিষ্ঠার ও রাজভক্তির প্রতিষ্ঠা সাধন করিয়াছিল, তাহার উল্লেখ না করিয়া, পরাভূত ও বশীকৃত শত্ৰুমণ্ডলীতে কিরূপ অনুরক্তির সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহার উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে:
এই নরপতি, দিগ্বিজয়াবসানে উৎকৃষ্ট পুরস্কার-বিতরণের দ্বারা পরাজিত ভূপালবৃন্দের পরাজয়-জনিত চিত্তক্ষোভ দূরীভূত করিয়া, তাঁহাদিগকে স্ব স্ব ভবনে গমন করিবার অনুজ্ঞা প্রচার করিলে, ভূপালবৃন্দ স্ব স্ব রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া, যখন রাজাধিরাজের সমুন্নত কাৰ্যকলাপের চিন্তা করিতে বসিতেন, তখন তাঁহাদের হৃদয়, পুণ্যক্ষয়ে স্বর্গচ্যুত জাতিস্মরগণের হৃদয়ের ন্যায়, প্রীতিভরে উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিত।
রাজচরিত্রের ন্যায় মন্ত্রি-চরিত্রও উল্লেখযোগ্য। ধনাঢ্য ও সুপণ্ডিত মন্ত্রীতে একত্র মিলিত হইয়া, পরস্পরের সখ্যলাভের জন্যই, স্বাভাবিক শত্রুতা পরিত্যাগ করিয়া, লক্ষ্মী-সরস্বতী উভয়েই
একত্র অবস্থান করিতেন। শাস্ত্রানুশীলনলব্ধ গভীরগুণসংযুক্ত বাক্যে মন্ত্রী যেমন বিদ্বৎসভায় প্রতিপক্ষের মদগৰ্ব্ব চূর্ণ করিয়া দিতেন, যুদ্ধক্ষেত্রেও সেইরূপ অসীম বিক্রম প্রকাশে অল্পক্ষণের মধ্যেই শত্রুবর্গের ভটাভিমান বিনষ্ট করিয়া দিতেন। যে বাক্যের ফল তৎক্ষণাৎ প্রতিভাত হয় না, মন্ত্রী সেরূপ বৃথা কর্ণসুখকর অলীক বাক্যের অবতারণা করিতেন না; যে দান পাইয়া, অভীষ্ট পূর্ণ হইল না বলিয়া, যাচককে অন্যের নিকট গমন করিতে হয়, সেরূপ কেলিদানেরও অভিনয় করিতেন না।
সমাজ-শিক্ষক ব্রাহ্মণের পবিত্র চরিত্রের বর্ণনা করিতে গিয়া, সেকালের কবি লিখিয়া গিয়াছেন :
গুণগ্রামের উল্লেখ করা দূরে থাকুক, নামমাত্রের উল্লেখ করিলেই সমস্ত পাপপ্রপঞ্চ বিনষ্ট হইয়া যাইত।
সমাজস্থিতির জন্য ও জাতীয় অভ্যুদয়লাভের জন্য ধনী দরিদ্রের প্রকৃত সম্বন্ধ নিৰ্নীত হওয়া আবশ্যক। সে কালের জনৈক ধনাট্যের চিত্তবৃত্তি এ সম্বন্ধে একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছে। তিনি “যাচকগণকে যাচক মনে করিতেন না;–মনে করিতেন, যেন তাঁহার সমুন্নতচিত্তবৃত্তি দাতাকে গৰ্ব্বস্ফীত করিতে পারে না,–যাচককেও আত্মগ্লানিতে অবসন্ন করিয়া দেয় না।”
সেকালের বাঙ্গালী-চরিত্রের এই সকল আদর্শ বাঙ্গালীকে কিরূপ সত্যনিষ্ঠ করিয়াছিল, সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁহার রামচরিতম কাব্যে মুক্তকণ্ঠে শত্রুপক্ষের গুণাবলীর কীৰ্ত্তন করিয়া, তাহার পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছে। অনেক মনে করেন, সেকালে পরলোকই প্রধান লক্ষ্য ছিল; ইহলোকের জন্য লোকসমাজ লালায়িত ছিল না; সুতরাং এই সকল উচ্চ আদর্শ প্রচলিত হইতে পারিয়াছিল। ইহলোকের অভ্যুদয় লাভ করিবার পক্ষে ইহা সহায় হইতে পারে না। সেখানে শঠতাকে শাঠ্যে,–অত্যাচারকে অত্যাচারে,–অবিচারকে অবিচারে, লুণ্ঠনকে লুণ্ঠনেই পরাভূত করিতে হইবে। ইহা সেকালের ইতিহাসের কথা নহে। ইহা বাঙ্গালীর আদর্শ বলিয়াও পরিচিত ছিল না। অকুতোভয় বাঙ্গালীর একটিমাত্র ভয়ের স্থান ছিল,–তাহা “দ্রবজলধিনিপাতে” পতিত হইবার ভয়। ইহা সেই “ভবজলধি নিপাতে” পতিত হইবার প্রশস্ত পথ;–যাহা পরিত্যাগ করিতে হইবে, দমন করিতে হইবে, শাসন করিতে হইবে, লোকসমাজ হইতে চিরনিৰ্বাসিত করিতে হইবে, ইহা তাহারই কুটিলকবলে সর্বাগ্রে আত্মসমর্পণ! এই আদর্শ লোকস্থিতি বিধবস্ত করিয়া, ইউরোপে মহাসমরানল প্রজ্বলিত করিয়া দিয়াছে। ইহা যেন কখনও আমাদের মধ্যে সংক্রামিত না হইতে পারে।
ইহলোক-পরলোকের পার্থক্য কৃত্রিম পার্থক্য,–যাহা পরলোকের কল্যাণকর, তাহাই ইহলোকেরও প্রকৃত অভ্যুদয়-সাধক। সেকালের পারলৌকিক সাংগতিকামনাপূর্ণ সবল সুদৃঢ় চরিত্রবল ইহলোকের বিবিধ বিজয়-সাধনের অন্তরায় হয় নাই। বাঙ্গালীর বাহুবল কান্যকুজের সিংহাসনে রাজ-প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠাপিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল–”মনোহর ভঙ্গিবিকাশে ইঙ্গিতমাত্রে ভোজ-মৎস্য-মদ্র কুরু-যদু-বন-অবন্তি-গান্ধার-কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের সামন্ত নরপালগণকে প্রণতি-পরায়ণ চঞ্চলাবনত-মস্তকে ‘সাধু সাধু’ বলিয়া তকার্য্যের গুণকীর্তন করাইতে” সমর্থ হইয়াছিল। তখনকার রাজধানী তপস্যাপরায়ণ তপোধনের তপোবনের মত শান্তরসাস্পদ আশ্রয়ভূমি ছিল না :
ভাগীরথীপ্রবাহ প্ৰবৰ্ত্তমান নানাবিধ রণতরণী সেতুবন্ধনিহিত-শৈলশিখরশ্রেণিরূপে লোকের মনে বিভ্রমের উৎপাদন করিত–নিরতিশয় ঘনসন্নিবিষ্ট ঘনাঘন নামক মদমত্ত রণকুঞ্জর-নিকর জলদজ্বলবৎ প্রতিভাত হইয়া দিনশোভাকে শ্যামায়মান করিয়া, লোকের মনে নিরবচ্ছিন্ন জলদসময়-সমাগমসন্দেহের উৎপাদন করিয়া দিত;–উত্তরাঞ্চলগত অগণ্য মিত্ররাজন্য কর্তৃক উপটৌকনীকৃত অসংখ্য অশ্ববাহিনীর প্রখরখুরোৎক্ষিপ্ত ধূলিপটলসমাবেশে দিঙমণ্ডলের অন্তরাল নিরন্তর ধূসরিত হইয়া থাকিত;–রাজ-রাজেশ্বর-সেবার্থ সমাগত সমস্ত জম্বুদ্বীপাধিপতিগণের অনন্ত পদাতি-পদভরে বসুন্ধরা অবনমিত হইয়া পড়িত।
অপিচ, “পরাজয় শত্ৰুনরপালগণের মুকুট-সমাহৃত-স্বর্ণ-নির্মিত সিংহমূৰ্ত্তি সমুচ্চ প্রাসাদ শিখরে সংস্থাপিত হইয়া, গ্রাস-ত্রাস-সন্ত্রস্ত চন্দ্রমণ্ডলমধ্যবর্তী বিষাঙ্করূপী মৃগকে পলায়নপর করিবার উপক্রম করিত।” তখনকার রাধাধিরাজ “প্রকটলীলাচলিত-সেনাবল সমভিব্যাহারে দিগবিজয়ার্থ বহির্গত হইলে, সেনাভারাক্রান্ত বিচলিত পৰ্বতমালা বক্রভাব প্রাপ্ত হইত;–তাহাতে মস্তকাবস্থিত নম্ৰীকৃত মণিসঙ্কুচনে মস্তকে বেদনা অনুভব করিয়া বাসুকি বেদনাক্রান্ত শিরঃসমূহের বেদনানিবারণের জন্য হস্তোদগম করিতে বাধ্য হইত।” দিগবিজয়প্রবৃত্ত নরপতির ভৃত্যবর্গ “কেদারতীর্থে যথাবিধি স্থান তৰ্পণ করিয়া, গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে ও গোকর্ণতীর্থে ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করিয়া, দুষ্টদলন-শিষ্টপালন-বিষয়ক ইহলৌকিক কাৰ্যে পারলৌকিক সংগতি সঞ্চয় করিত।” রাজসেনাপতি দিগ্বিজয়ার্থ চতুর্দিকে প্রধাবিত হইলে, “দূর হইতে তাঁহার নামমাত্র শ্রবণ করিয়া, উৎকলাধীশ অবসন্নহৃদয়ে রাজধানী পরিত্যাগ করিতেন,–প্রাগজ্যোতিষের অধীশ্বর রাজাদেশ মস্তকে ধারণ করিয়া সন্ধি বন্ধন করিতেন।” তখনকার গৌরবমণ্ডিত গৌড়জনগণের বিজয়-গৌরবে “দাক্ষিণাত্যের শিল্পরুচি অতিক্রান্ত হইয়াছিল; লাট দেশের কমনীয় কান্তি আবিল হইয়া গিয়াছিল; অঙ্গদেশ অবনত হইয়া পড়িয়াছিল; কর্ণাটের লোলুপদৃষ্টি অধোমুখে অবস্থিত থাকিতে বাধা হইয়াছিল; মধ্যদেশের রাজ্যসীমা সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছিল।” ইহা ইহলোকেরই বিজয়বাৰ্তা বিঘোষিত করিয়া দেয়। ইহাতে দুষ্টদলন-শিষ্টপালন-নীতির যেরূপ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার সহিত শাঠ্যের সম্পর্ক ছিল না,–ছল-প্রতারণার সম্পর্ক ছিল না,–লুণ্ঠন লোলুপতার সম্পর্ক ছিল না। বরং শত্রুকে অন্তরঙ্গ মিত্ৰমধ্যে পরিণত করিয়া লইবার শাসন কৌশলের ও চরিত্রগত অসামান্য উদারতারই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তাহা আপনাকে পর করিত না,–পরকেই আপন করিয়া লইতে পারিত। তাহা গুপ্তহত্যার অকীৰ্ত্তিকর ছদ্মবেশকে বীরত্ব বলিয়া সমাদর করিতে জানিত না;–উন্মুক্ত করাল-করবালকে অকাতরে চুম্বন করিতে পারিত। তাই তাহার মহত্ত্বের মহনীয় পাদপদ্মে পরাভূত অরাতিনিকর সসম্ভমে মস্তক অবনত করিতে বাধ্য হইত।
এই যুগের চরিত্রের আদর্শ কিরূপ ছিল, সাহিত্য অপেক্ষা শিল্পে তাহার অধিক পরিচয় প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা। সাহিত্য ব্যক্তিগত চিত্তবৃত্তির পরিচয় প্রদান করে; চিরপ্রচলিত সৰ্ব্বলোকনমস্কৃত সনাতন আদর্শকে চিরজাগরূপ রাখিবার জন্য পুনঃ পুনঃ পুরাতন কথারই পুনরাবৃত্তি করিয়া থাকে। সাহিত্য জনসমাজের সৰ্ব্বোচ্চস্তরাবস্থিত অল্পসংখ্যক ভাগ্যবানের ভাবপ্রবাহের অভিব্যক্তি। শিল্পের অবস্থা সম্পূর্ণ পৃথক। তাহার ভাষা বিশ্বমানবের সাৰ্বজনীন ও সাৰ্ব্বভৌমিক ভাষা। তাহা অকপটে অকুতোভয়ে অনায়াসবিন্যস্ত বিচিত্র রেখাসম্পাতে জনসমাজের হৃদয়নিহিত চিরসুন্দরের চিরন্তন চিন্তার বাহ্যবিকাশে মানবসমাজের উন্নতি অবনতির অকৃত্রিম দৃশ্যপট উদঘাটিত করিয়া প্রকৃত আদর্শের সন্ধান প্রদান করে।
শিল্পে চরিত্রের আদর্শ কত দূর অভিব্যক্ত হয়, অল্পদিনমাত্র তাহার অনুসন্ধান চেষ্টা আরব্ধ হইয়াছে, তাহা আমাদের দেশে এখনও বহুসংখ্যক সুশিক্ষিত ব্যক্তিকে আকর্ষণ করিতে পারে নাই। যে অল্পসংখ্যক কলাকুতূহলী শিল্পসাধক, সেকালের শিল্প-সম্পদের মর্যাদা উপলব্ধি করিবার আশায়, তাহার যথাসাধ্য অনুকরণচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাঁহারা নানা নিন্দা প্রশংসার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছেন। কিন্তু তাঁহারা এখনও আমাদিগকে একটি মূলসূত্র বুঝাইবার আয়োজন করেন নাই;–শিল্পের প্রকৃতিগত আদর্শ দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকিতে সমর্থ হইলেও, তাহার আকৃতিগত আদর্শ অল্পকালের মধ্যেই পরিবর্তিত হইয়া যায়, এখন আর সে কালের আকৃতিগত আদর্শের অনুকরণচেষ্টা আধুনিক শিল্পচর্চাকে সফল করিয়া তুলিতে পারিবে না। সেকালের শিল্পই সেকালের শিল্পের সূত্র, ভাষ্য ও ভাষ্যপ্রদীপ ছিল।–একালের অনুকরণ টিপ্পনী তাহাকে অধিক উদ্ভাসিত করিয়া তুলিতে পারিবে না। সে কালের শিল্পের প্রধান লক্ষণ কিরূপ ছিল, তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেই দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা বৃহৎ, এবং সুন্দর। তাহাতে আকৃতিপ্রবণতা অপেক্ষা ভাবপ্রবণতা অধিক ছিল। তাহা যেন জাতীয় জীবনের নব যৌবনরসের অমৃতধারার উন্মুক্ত প্রস্রবণ। সে দিন নাই সে যৌবন নাই; সে যৌবন-তরঙ্গ নিরস্ত হইয়াছে; সে অমৃত-প্রস্রবণও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। এখন তাহার আকৃতিগত আদর্শের অনুকরণচেষ্টা সফল হইলেও, তাহার প্রকৃতিগত আদর্শ আবার ফুটাইয়া তুলিতে পারা অসাধ্যসাধন বলিয়াই প্রতিভাত হয়। এই জন্য প্রত্যেক যুগের শিল্পের মধ্যে সেইযুগের এক একটি স্বাতন্ত্রের ছাপ দৃঢ়-মুদ্রিত হইয়া থাকে; তাহার সাহায্যে সেই সেই যুগের লোক-চরিত্রের আদর্শ আবিষ্কৃত ও আলোচিত হইতে পারে। গৌড়-শিল্পের সাঙ্গে যে ছাপটি সর্বাপেক্ষা দৃঢ়-মুদ্রিত হইয়া রহিয়াছে, তাহা ভক্তি,–”সা পরানুরক্তিঃ।’ সেই অনুরক্তি সাধকের অনুরক্তি,রসজ্ঞের অনুরক্তি–প্রেমিকের অনুরক্তি। শিল্প-নিদর্শনের মধ্যে তাহার অনেক পরিচয় আবিষ্কৃত হইতেছে; শিল্প-নিহিত মৌন-প্রসন্নতাই তাহাকে সুচারুরূপে অভিব্যক্ত করে। কিন্তু এক জন শিল্পী একটি সুললিত কবিতা লিখিয়াও তাহার পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছেন। এক খণ্ড মসৃণীকৃত কৃষ্ণমৰ্ম্মরে একটি প্রশস্তি উৎকীর্ণ করিয়া, শিল্পী সকলের শেষে একটি শ্লোক সংযুক্ত করিয়া জানাইয়া দিয়াছেন
প্রেমিক যেমন প্রেমবিহ্বলচিত্তে অনন্যমনা হইয়া, প্রিয়তমার কমনীয় কপোলে পত্ৰলেখা রচনা করিয়া থাকেন, শিল্পীও সেইরূপ প্রেমবিহ্বলচিত্তে অনন্যমনা হইয়া, প্রস্তরফলকে অক্ষয়বিন্যাস করিয়াছেন।
আর এক শিল্পী এক ধূসরবর্ণের সুবৃহৎ অখণ্ড প্রস্তরখণ্ডে এক গরুড়স্তম্ভের রচনা করিয়া, স্তম্ভ-প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ-চরিত্রের পরিচয়-প্রদানের জন্য স্তম্ভগাত্রে এই কথাগুলি উত্তীর্ণ করিয়া গিয়াছেন :
তাঁহার সুকুমার শরীর-শোভার ন্যায় লোকলোচনের আনন্দদায়ক, তাঁহার উচ্চান্তঃকরণের অতুলনীয় উচ্চতার ন্যায় উচ্চতাযুক্ত, তাঁহার সুদৃঢ় প্রেমবন্ধনের ন্যায় দৃঢ়-সংবদ্ধ,–কলি-হৃদয়-প্রোথিত শল্যবৎ সুস্পষ্ট প্রতিভাত এই স্তম্ভে, তাঁহারই যত্নে হরির প্রিয়সখা ফণিগণের চিরশত্রু এই গরুড়-মূর্তি আরোপিত হইয়াছে।
উচ্চ আদর্শ, উচ্চ চিন্তা, উচ্চ আকাঙ্ক্ষা শিক্ষা অপেক্ষা দৃষ্টান্তের দ্বারা অধিক দ্রুতবেগে জনসমাজের অন্তঃকরণে অনুপ্রবিষ্ট করাইতে পারা যায়। শিল্প তাহার পক্ষে সৰ্ব্বপ্রধান অবলম্বন। সেই অবলম্বনের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া, সেকালের বাঙ্গালী বিবিধ প্রস্তরমূৰ্ত্তিতে ও ধাতুমুর্তিতে যে অনিন্দ্যসুন্দর কলাকৌশল বিকশিত করিয়া তুলিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিত, তাহার মধ্যে তন্ময়ত্বই সর্বাগ্রে নয়নপথে পতিত হইয়া থাকে। যে শিল্পনিদর্শনের মধ্যে তন্ময়ত্ব যত অধিক, সে শিল্প তত সমুন্নত চরিত্রাদর্শের পরিচয় প্রদান করে। শিল্পীর চরিত্রের আদর্শ অজ্ঞাতসারে শিল্পের মধ্যে অনুস্যুত হইয়া পড়ে।
ইহাই স্বভাবের নিয়ম। যদি এক বর্ণও লিখিত প্রমাণ বর্তমান না থাকিত, তথাপি পুরাতন গৌড়-শিল্পকলার ধবংসাবশিষ্ট অল্প নিদর্শনই গৌড়জনের চরিত্রাদর্শের অনেক পরিচয় প্রদান করিতে পারিত। তাহার দৃঢ়তা-ব্যঞ্জক স্থিতিভঙ্গী, গাম্ভীৰ্য-ব্যঞ্জক গতি-ভঙ্গীর পরিচয় প্রদান করিত;–তাহার অনাবিল সরল দৃষ্টিপাত, অপাপবিদ্ধ পবিত্র হৃদয়ের পরিচয় প্রদান করিত;–তাহার আড়ম্বরপূর্ণ বস্ত্রালঙ্কারের শিল্প-সুষমা, তাহার ঐশ্বৰ্য্যগৰ্বের পরিচয় প্রদান করিত;–তাহার বিবিধ আয়ুধ-বিন্যাস, তাহার অপরিসীম শৌর্য-বীর্যের পরিচয় প্রদান করিত;–তাহার শিল্প-সমুজ্জ্বল রত্ন-মুকুট, তাহার উন্নত ললাটপটের অকপট মহত্ত্ব-মহিমা উদ্ভাসিত করিয়া রাখিত। সকলের উপর, এমন এক শান্ত সমাহিত মধুর-মূর্তি নয়নপথে পতিত হইত যে, তাহা জন-সমাজের শান্ত সমাহিত আত্মরত আত্মতৃপ্ত মধুর মূৰ্ত্তির ছায়া বলিয়াই প্রতিভাত হইত। দেখিবামাত্র স্বীকার করিতে হইত –”আত্ম-শক্তিতে অটল বিশ্বাস সে কালের গৌড়-শিল্পের সকল রেখা সম্পাতেই সমানভাবে ফুটিয়া রহিয়াছে।”
বাঙ্গালীর সকল আদর্শই বাঙ্গালীর দেশ-কাল-পাত্রের উপযোগী ছিল। বর্তমানে বা ভবিষ্যতে বাঙ্গালী যেরূপ আদর্শেরই অনুসরণ করুন না কেন, তাহাকে বাঙ্গালার দেশ-কাল-পাত্রের উপযোগী করিয়া লইতে পারিলেই, বাঙ্গালী বাঙ্গালী থাকিয়া উন্নতি লাভ করিতে পারিবে। আত্মচেষ্টায় অবিশ্বাস, আত্মসামর্থ্যে অবিশ্বাস, আত্মগৌরবে অনাসক্তি, বাঙ্গালীকে পরমুখাপেক্ষী করিয়া তুলিয়াছে। ছোট বড়, ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত–সকলেই এক কৃত্রিম পার্থক্যের কল্পনায়, তাহাকে উন্নতিলাভের অন্তরায় মনে করিয়া, অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। এই পার্থক্য সকল দেশেই বর্তমান আছে; সকল দেশেই অল্পাধিকমাত্রায় চিরকাল বর্তমান থাকিবে। কিন্তু এই অপরিহার্য্য পার্থক্য বর্তমান থাকিতেও পুরাকালের বাঙ্গালী গুণাবলীকেই প্রকৃত “পূজাস্থান” বলিয়া সকল কাৰ্য্যে স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। ইহা চরিত্রগত প্রশংসনীয় উদারতার দেদীপ্যমান অনাচ্ছন্ন অনির্বচনীয় নিদর্শন।
বাঙ্গালী যখন “মাৎস্যন্যায়ে’র সুদীর্ঘ অরাজকতার অত্যাচারদূরীকরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া ক্ষুদ্র-স্বার্থ-বিসর্জনে স্বদেশের প্রকৃত কল্যাণসাধনের আশায় রাজা নির্বাচন করিতে অগ্রসর হইয়াছিল, তখন হিন্দু বৌদ্ধ সকলে মিলিয়া বৌদ্ধকে রাজপদে নিৰ্বাচিত করিয়াছিল; ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ সকলে মিলিয়া ব্রাহ্মণকে মন্ত্রিপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছিল। আবার যখন নির্বাচিত নরপালের বংশধরের অনীতিকারম্ভে উৎপীড়িত হইয়া, বরেন্দ্রমণ্ডলের প্রজাপুঞ্জ মুক্তিলাভের আশায় নায়ক নির্বাচনের প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিল, তখনও সকলে মিলিয়া অম্লানচিত্তে কৈবৰ্ত্তকে নায়ক-পদে নিৰ্বাচিত করিতে দ্বিধা করে নাই।
এই উদারতার মূল–বাঙ্গালীর ধর্মবিশ্বাস। তাহা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে এক অনির্বচনীয় সামঞ্জস্য সংস্থাপিত করিয়া দিয়াছিল। তাহা সকল নরনারীকে সাধনমার্গে যথাযোগ্য অধিকার দান করিয়া, বুঝাইয়া দিয়াছিল, তাঁহাকে জানা, যাগ যজ্ঞ পণ্ডশ্রম। তাঁহাকে জানিলে, তাহা পণ্ডশ্রম;–তাঁহাকে না জানিলেও, তাহা পণ্ডশ্রম। এই শিক্ষা তন্ত্রের শিক্ষা। ইহাতে সকল কৃত্রিমতার অলীক বন্ধন স্খলিত হইয়া পড়িয়াছিল। জনসমাজ বুঝিয়াছিল, এবং গাহিয়াছিল :
কুলকুণ্ডলিনী যার জাগে,
যার না জাগে,
কি করিবে তার, বল, জপ-তপ-যোগ-যাগে?
কুলকুণ্ডলিনী জাগিলে, সভা-সমিতির আলোচনা অনাবশ্যক। কুলকুণ্ডলিনী না জাগিলেও, সভা-সমিতির আলোচনা অনাবশ্যক। তাই বলি, একবার জাগ মা! জাগিবামাত্র বাঙ্গালীর নিকট বাঙ্গালীর আদর্শ আবার জাগিয়া উঠিতে পারিবে। নমস্তস্যৈ*
সাহিত্য, বৈশাখ, ১৩২৩
* কলিকাতার ‘সরস্বতী ইনস্টিটিউটে’র বার্ষিক সভার (১৩২২) অধিবেশনে পঠিত।
.
সেকাল
এখনও বাঙ্গালার ইতিহাস সঙ্কলন করিবার সময় হয় নাই। আধুনিক সময়ের ইতিহাসের কথা বলিতেছি না;–তাহার উপকরণ পৰ্য্যাপ্ত পরিমাণে পুঞ্জীকৃত হইতেছে। তদ্বারা অপেক্ষাকৃত অল্পায়াসে একালের ইতিহাস গঠিত হইতে পারিবে। কিন্তু মুসলমান-শাসন প্রবর্তিত হইবার পূৰ্ব্বে এদেশের অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহার কোন ধারাবাহিক ইতিহাস সঙ্কলিত হইবার উপায় নাই। মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ যাহা কিছু লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা সবিশেষ অনুসন্ধানলব্ধ ঐতিহাসিক তথ্যরূপে গ্রহণ করিতে সাহস হয় না।
তাঁহারা যাহা কিছু লিখিয়া গিয়াছেন, তাহাও বড় অধিক নহে। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গাগমনের পর ১২৬০ খৃষ্টাব্দের সমকালে আবু-উমর-মিনহাজ-উদ্দীন ওসমান ইবন সিরাজুদ্দীন-অল-জুজ্জানী ‘তবকাৎ-ই-নাসেরী” নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তাহার বিংশ পরিচ্ছেদে বাঙ্গালার যাহা কিছু ইতিবৃত্ত প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহাই বাঙ্গালার মুসলমান-লিখিত সৰ্ব্বপ্রথম ইতিহাস।
অতঃপর মুসলমান লেখকগণ যাহা কিছু লিখিয়া গিয়াছেন তাহাও নিতান্ত সংক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন–অধিকাংশ স্থলে স্বল্পকাহিনীর ন্যায় অকিঞ্চিৎকর!
বিজেতা বিজিতের ইতিহাস লিখিলে তাহাতে অনেক দোষ প্রকাশ করিয়া থাকে। মিনহাজের গ্রন্থে তাহার অভাব নাই। তদ্ভিন্ন, “উহাতে মুসলমানাগমনের পূর্ববর্তী শাসনসময়ের ঐতিহাসিক তথ্য অল্পই প্রাপ্ত হওয়া যায়।
বাঙ্গালা বহুকালের সভ্যদেশ। দক্ষিণ বঙ্গের কথা যাহাই হউক,–পূৰ্ব্ব পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গ যে বহুপ্রাচীন সভ্য জনপদ, তাহাতে সন্দেহ নাই। আৰ্য্যপিতামহগণ কোন সময়ে তদ্দেশে প্রথম পদার্পণ করিয়াছিলেন, তাহার জনশ্রুতি পৰ্য্যন্তও বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে!
ন্যূনাধিক দ্বিসহস্র বৎসর পূৰ্ব্বে মৌৰ্য্যবংশীয় চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসিয়া চাণক্যনীতি-কৌশলে ভারতবর্ষের অধিকাংশ জনপদে অধিকারবিস্তার করিয়াছিলেন। তৎকালে তাঁহার সভায় গ্রীকরাজদূত মেগাস্থিনীস অবস্থিতি করিয়া যে ভারতবিবরণী লিপিবদ্ধ করেন, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তখন বঙ্গভূমি স্বতন্ত্র পরাক্রান্ত রাজ্যরূপে পরিগণিত ও নৌবলহস্ত্যশ্বপদাতি সুরক্ষিত দুজ্ঞেয় ও দুর্জেয় জনপদ বলিয়া পরিচিত ছিল।
।সে অনেক দিনের কথা। তখনও এসিয়াখণ্ডের জলে স্থলে পৰ্ব্বতে প্রান্তরে গ্রামে নগরে ও দ্বীপোপদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল প্রতাপ বিকীর্ণ হইয়া পড়ে নাই। তখনও পাশ্চাত্য সভ্যসমাজে ভারতবর্ষের নাম মাত্রই পরিজ্ঞাত; কিন্তু তাহা বহুবিস্ময়ের লীলাভূমি স্বপ্নরাজ্যের ন্যায় অনিশ্চিত ও অজ্ঞাতপূৰ্ব্ব!
তাহার পর ‘অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে’–সর্বত্র বৌদ্ধমন্ত্র বিঘোষিত হইয়াছিল। তৎসূত্রে যে সকল বৌদ্ধকীর্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, উত্তর বঙ্গের নানা স্থানে অদ্যাপি তাহার ভগ্নাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে। চৈনিক বৌদ্ধাচাৰ্য্য ফা হিয়ান ও হিয়ঙ্গ থসাঙ্গ তদ্দর্শনোপলক্ষে বঙ্গভূমিতেও পদার্পণ করিয়াছিলেন।
তৎকালে বাঙ্গালার গৌরবের অবধি ছিল না। গৌরবের দিনে তাম্রলিপ্তির লবণাম্বুবেলা বাঙ্গালীর পোতারোহণ কোলাহলে নিয়ত কলকলায়মান রহিত; বাঙ্গালীর বাণিজ্যপোত বায়ুবেগে চালিত হইয়া কত দেশের রত্নভাণ্ডার স্বদেশে বহন করিয়া আনিত। তাম্রলিপ্তির শ্রেষ্টীসম্প্রদায় শত সৌধচূড়ায় সে বিভবচ্ছটা বিকীর্ণ করিয়া বাঙ্গালীর পুরুষকার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। আজ তাহা স্বপ্নকাহিনীর ন্যায় প্রতিভাত;–সেই বাঙ্গালী এখন সমুদ্রযাত্রায় অগ্রসর হইলে সমাজচ্যুত হইতেছে!
এক দিনে সহসা এত পরিবর্তন সাধিত হইতে পারে না। কিন্তু কিরূপে কত দিনে এত পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, তাহার কোনো ইতিহাস দেখিতে পাওয়া যায় না। যে যুগে এই পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল তাহা যথার্থই ‘তামসযুগ’। তাহার ঐতিহাসিক তথ্য নিশ্চয় তমসাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে; সমালোচনার খদ্যোতিকামাত্র অবলম্বন করিয়া সে পথে অধিক দূর অগ্রসর হইবার উপায় নাই।
তামস যুগের বঙ্গভূমি ভাগপঞ্চকে বিভক্ত থাকার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। তাহাকে লোকে (১) রাঢ় (২) বাগঢ়ী (৩) মিথিলা (৪) বরেন্দ্র ও (৫) বঙ্গ নামে অভিহিত করিত। ইহার প্রত্যেক ভাগের বহুসংখ্যক উপরিভাগ ছিল; তাহার সৰ্ব্বত্র বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র রাজ্যের ক্ষুদ্র নরপতি আপনাদিগকে সসাগরা ধরিত্রীর অদ্বিতীয় অধিপতি বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেন। কিন্তু তাঁহাদের নাম, গোত্র ও বংশপরিচয় বুদ্বুদবৎ কোথায় বিলীন হইয়া গিয়াছে।
তাঁহাদের অধিকৃত রাজ্য বহুবিপ্লবের লীলাভূমি বলিয়া পরিচিত। তাহাতে বাঙ্গালীর সহিত বাঙ্গালী, হিন্দুর সহিত বৌদ্ধ, এক ভ্রাতার সহিত অন্য ভ্রাতা নিয়ত বিবাদমান হইয়া বঙ্গভূমি বিপর্যস্ত করিত; কখন বা হুনাদি প্রবল পার্বত্যজাতি আপতিত হইয়া শস্যক্ষেত্র বিলুণ্ঠিত করিয়া বাঙ্গালীর শান্তিসুখ তিরোহিত করিয়া দিত। বহিঃশত্রুর অভিযানে, অন্তর্বিপ্লবের আলোড়নে, সে কালের বঙ্গভূমির অবস্থা ভাল থাকিবার কথা নহে।
সেকালের ইতিহাস সঙ্কলনের উপযোগী যে সকল উপকরণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা প্রধানতঃ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত : (১) পুরাতন গ্রন্থ (২) শিলালিপি ও (৩) তাম্রশাসন।
পুরাতন গ্রন্থ বলিতে প্রকৃত পুরাতন গ্রন্থ অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। যাহা পুরাতন তাহারও সকল অংশ সমান পুরাতন নহে; পণ্ডিতমণ্ডলী তন্মধ্যে কত প্রক্ষিপ্ত শ্লোক যোজনা করিয়া দিয়াছেন! এই সকল গ্রন্থে সে কালের একটি অস্পষ্ট ছায়ামাত্রই প্রাপ্ত হওয়া যায়; চৈনিক বৌদ্ধাচাৰ্য্যগণের গ্রন্থে সে ছায়া কিয়ৎপরিমাণে স্পষ্টতর হইয়াছে।
শিলালিপির সংখ্যা অধিক নহে। তন্মধ্যে গৌড়েশ্বর বিজয়সেন দেবের প্রতিষ্ঠিত প্রদ্যুশ্বের নামক শিবমন্দিরের ফলকলিপি ও গুরব মিশ্রের সংস্থাপিত গরুড়স্তম্ভলিপি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তাম্রশাসনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত অধিক। তন্মধ্যে পাল ও সেনবংশীয় নরপতিবর্গের তাম্রশাসনই উল্লেখযোগ্য। পালনরপালগণ বৌদ্ধধর্মানুরাগী ও সেন নরপতিগণ হিন্দুধর্মানুরাগী বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইহাদের মধ্যে বহুবার যুদ্ধকলহের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎকালে বাঙ্গালীকে কখন বহিশত্রুর সহিত সংগ্রাম করিয়া আত্মরক্ষা করিতে হইত; কখন বা দিগ্বিজয়ী গৌড়াধিপতির বিজয় পতাকা বহন করিয়া দূরদেশেও গমন করিতে হইত। সেন নরপতিবর্গের শেষদশায় বাঙ্গালায় মুসলমান শাসন প্রবর্তিত হয়।
এই সকল নরপালবর্গের মধ্যে কাহার পর কে রাজা হইয়া কত দিন পর্যন্ত কোন ভুভাগ শাসন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহার কোন লিখিত প্রমাণ অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু তাহাতে বিশেষ দুঃখ নাই। কাহার পর কে রাজা হইয়াছিলেন তাহা জানিতে না পারিলেও বাঙ্গালার ইতিহাসের বিশেষ ক্ষতি হইবে না। পৃথিবীর কত ধরণীপতি ধরাপৃষ্ঠে পদাঙ্করেখা দৃঢ়মুদ্রিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কালক্রমে তাহার চিহ্নপৰ্য্যন্তও বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! আর সে সংবাদ জানিতে পারিলেই বা বাঙ্গালার ইতিহাসের বিশেষ কি উপকার হইত? ইতিহাস কি কেবল রাজবংশ কাহিনী?
মুসলমানাধিকার প্রবর্তিত হইবার পূর্বে বাঙ্গালাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, সে সংঘর্ষে রাজার সঙ্গে প্রজাপুঞ্জকেও ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। কি সূত্রে সেই সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা কেবল বঙ্গদেশের কেন–সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের মূল সূত্র। কারণ, বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ে ভারতবর্ষের যত না উন্নতি হইয়াছিল, উহার অধঃপতনে এ দেশের ততোধিক অধঃপতন সংঘটিত হয়। শুনিতে পাওয়া যায়, গৃহবিবাদই সে অধঃপতনের মূল। তাহা হইতে কালে যে বিষময় ফল সমুৎপন্ন হইয়াছিল, অদ্যাপি তাহার জ্বালাময় তীব্ররস সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয় নাই!
যে দিক দিয়া দেখ, বাঙ্গালার ইতিহাস ভারতবর্ষের ইতিহাসের সহিত এক সূত্রে গ্রথিত। আর্যাবর্তের পদতললগ্না বঙ্গভূমি স্বতন্ত্র রাজতন্ত্রের অভিভূক্ত হইলেও, তাহা আর্যাবর্তের উপরিভাগ মাত্র। যে চিন্তা প্রবাহ আর্যাবর্তের সভ্যসমাজকে পরিচালিত করিত, যে রাজবিধি ও সমাজনিয়ম আর্যাবর্তের সভ্যসমাজকে নিয়মিত করিত, বঙ্গদেশেও তাহারই প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হইত। সেই জন্য বাঙ্গালার ইতিহাস আৰ্য্যাবর্তের ইতিহাসের অংশমাত্র–তাহা হইতে স্বতন্ত্র বা পৃথক নহে।
এখন সমগ্র আর্যাবর্তের অধিবাসী অধঃপতিত বলিয়া পরিচিত। আমরা যে পৃথিবীর নিকট হীন হইয়া পড়িয়াছি, তাহা আমাদিগকেও মানিয়া লইতে হইতেছে। যাহা সত্য–নিত্য প্রত্যক্ষীকৃত–তাহাকে তর্ক করিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া ফল নাই। আমরা হীন–তাহা সত্য কথা। কিন্তু আমরা কি চিরদিনই হীন?
ইতিহাসের অভাবে এই প্রশ্নের মীমাংসা করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা আমাদের ক্রমোন্নতি সাধন করিবেন বলিয়া পবিত্র কল্যাণব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহারা আমাদিগকে কিয়ৎ পরিমাণে বব্বর বলিয়াই মনে করেন। তাঁহাদের বিচারে আমরা অর্ধসভ্য–কি সেকালে কি একালে, আমরা কদাচ সুসভ্য সমুন্নত ছিলাম না।
অবজ্ঞার প্রতিদান অবজ্ঞা। যাঁহারা আমাদিগকে অবজ্ঞাভরে বর্বর বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহেন, আমরাও অবজ্ঞাভরে তাঁহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া ঘৃণা করি। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সে দুইটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন জনপদ, প্রাচ্য সভ্যতা ও প্রতীচ্য সভ্যতার মধ্যে যে দেশকাল পাত্রভেদে বহু পার্থক্য বিদ্যমান থাকাই স্বাভাবিক, আমরা কেহই তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করি না।
আমরা কি চিরদিনই হীন? হীনজাতির ক্ষীণকণ্ঠ হইতে বেদগাথা উখিত হইত না; হীনজাতির ক্ষীণ মস্তিষ্ক হইতে উপনিষৎ ও ষড়দর্শন সমুৎপন্ন হইত না; হীনজাতির দুর্বল বাহুযুগল দেশ দেশান্তে বিজয় পতাকা বহন করিতে পারিত না; তাহার ভগ্নপদ বহুকাল ধরাপৃষ্ঠে দৃঢ়পদে দণ্ডায়মান থাকিত না!
আমরা যে চিরদিন হীন ছিলাম না, তাহা কেবল আমাদের কথায় মানিয়া লইতে হইবে না; সেকালে যাঁহারা আমাদের সংসর্গে মিলিত হইয়াছিলেন, তাঁহারাও তাহার সাক্ষী। আলেকজাণ্ডার অবলীলাক্রমে ভূমধ্যসাগরতীর হইতে সিন্ধুসীমা পৰ্য্যন্ত অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকেও ভারতবিজয়ের আশা পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করিতে হইয়াছিল। মুসলমানধৰ্ম্মের অভ্যুদয়ে আরবের মরুবক্ষে যে উৎসাহতরু অঙ্কুরিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার প্রতাপে ইসলামের বিজয়পতাকা মধ্য এসিয়া হইতে উত্তর আফ্রিকা ও তথা হইতে দক্ষিণ ইউরোপে প্রোথিত হইতে বিলম্ব হয় নাই; কিন্তু তিনশত বৎসরের তুমুল সংগ্রামে বহু বীরমুণ্ড স্কন্ধচ্যুত হইবার পূৰ্ব্বে সে শক্তি ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না।
কিন্তু সে পুরাকাহিনীর পুনরুল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই। আমরা চিরদিন হীন না হইলেও হীন হইয়া পড়িয়াছি। কি সূত্রে আমাদের মধ্যে হীনতা প্রবেশ করিয়াছিল তাহাই প্রকৃত সমালোচনার কথা। তাহা বিস্মৃত হইয়া অতীত ভারতের গৌরবের ইতিহাস ও আর্য সভ্যতার ক্রমবিকাশের কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া ফল কি? রোমক সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় অপেক্ষা অধঃপতনের ইতিহাসই লোকশিক্ষার উপাদানে পরিপূর্ণ!
এ পর্যন্ত যে সকল ঐতিহাসিক তথা আবিষ্কৃত হইয়াছে, তদ্বারা এই প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইলে সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে–আমাদের উন্নতির মধ্যেই অবনতির ধবংশবীজ নিহিত ছিল! যে ভাবে ভারতবর্ষের আৰ্যসভ্যতা বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা সনাতন নহে–চিরদিন অক্ষুণ্ণ থাকিতে পারে নাই!
স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি প্রীতি স্বাভাবিক হইলেও সকল দেশে স্বাভাবিক নিয়মে তাহা বিকশিত হইতে পারে নাই। আমাদের দেশে যে নিয়মে এই প্রীতি বিকশিত হইয়াছিল, আমাদের সাহিত্য ও ইতিহাসে তাহার কথঞ্চিৎ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
আমাদের দেশে “আমি” সর্বাপেক্ষা প্রধান, “আমার” তদপেক্ষা বহু নিম্নে সংস্থিত। আমি কি উপায়ে বড় হইব, সেই চিন্তায় আমাদের সকল শাস্ত্র পরিপূর্ণ। তাহার মূলমন্ত্র–”আত্মানং সততং রক্ষেৎ”। এক হিসাবে আত্মোন্নতি হইতে ক্রমশঃ জাতীয় বা দেশীয় উন্নতি সাধিত হইতে পারে। কিন্তু ইহার মধ্যেই ধবংশবীজ নিহিত আছে। ‘‘আত্মানং সততং রক্ষেৎ” বলিতে অনেক দূর পর্যন্ত যায়। ইহা হইতেই লোকে যেন তেন প্রকারেণ আত্মরক্ষা করিতে শিক্ষা করে, এবং আত্মরক্ষার্থে ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠে–”ন গণস্যাগ্রততা গচ্ছেৎ”। ইহা হইতে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিপুষ্ট হইতে গিয়া জনসাধারণের স্বার্থ ক্রমশঃ উপেক্ষিত হইতে থাকে।
স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণ হইলেই আমার কল্যাণ–ইহা এক প্রকারের হিসাব। তুমি আমি দশজনে মিলিয়াই দেশ, সুতরাং আমার উন্নতি হইলেই দেশের উন্নতি–ইহা আর এক প্রকারের হিসাব। আমরা শেষোক্ত হিসাবই ভাল বলিয়া বুঝিয়া ছিলাম; সুতরাং আত্মোন্নতির জন্যই ব্যাকুল হইয়াছিলাম।
আত্মোন্নতি যে কেবল আমার উপরেই নির্ভর করে না, তাহা আমরা বুঝি নাই। বুঝি নাই বলিয়াই, গণ্ডীর মধ্যে গণ্ডী আঁকিয়া আপনার চারিদিকে এক সুদৃঢ় দুর্গ প্রাচীর নির্মাণ করিয়া তন্মধ্যে একা “আমি” দীর্ঘ তপস্যায় আত্মোন্নতি সাধন করিতে বসিয়াছিলাম। আমার বলিতে যাহা কিছু, তাহা সেই ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সে গণ্ডীর বাহিরে যাহা কিছু পড়িয়াছিল, তাহা “আমার” বলিয়া বোধ হইত না, তাহা আমার নিকট নিতান্ত “পর” বলিয়াই বোধ হইত। সুতরাং সমগ্র দেশের মধ্যে একপ্রাণতা পরিপুষ্ট হইবার পক্ষে বিলক্ষণ ব্যাঘাত ঘটিয়াছিল। যে দেশে জনসাধারণ এইরূপে বহুধা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, সে দেশে স্বদেশ প্রীতি বিকশিত হইতে পারে না। প্রত্যেকে আপনাপন ব্যক্তিগত লাভালাভের তুলাদণ্ড হস্তে পরিগ্রহণ করে, যে-কোনো উপায়ে হউক স্বার্থসাধন করাকেই পুরুষার্থ বলিয়া বিবেচনা করে। আমাদের ইতিহাস তাহার সাক্ষী।
প্রাচীন ভারতে মহাসাম্রাজ্য সংস্থাপিত হইতে পারে নাই; এক দেশের সহিত অন্য দেশ, এক রাজার সহিত অন্য রাজা বিবদমান হইয়া প্রত্যেকে আপনাপন ক্ষুদ্র গণ্ডী সৰ্ব্বপ্রযত্নে রক্ষা করিতে গিয়া জাতীয় মহাশক্তিকে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রশক্তিতে পরিণত করিয়াছিলেন। বিদেশের পরাক্রান্ত প্রবল জাতি যখনই চেষ্টা করিয়াছে, তখনই অনায়াসে আমাদের এক দলকে দিয়া অপর দলের উচ্ছেদ সাধন করিয়া ভারতবর্ষে অধিকার বিস্তার করিয়াছে। আমাদের অপেক্ষা শিক্ষায় সভ্যতায় বাহুবলে ও সমরকৌশলে যাহারা যথার্থই হীন ও নগণ্য, সেই সকল পার্বত্য হুন ও শক যবনাদি কতবার আমাদিগের শীর্ষ স্থানে পদাঘাত করিয়া গিয়াছে। তখন ভারতবর্ষের গৌরবের দিন ছিল; তথাপি ভারতবর্ষকে নীরবে সে তীব্র অপমান বহন করিতে হইয়াছে!
সুসভ্য গ্রীকজাতি মধ্যএশিয়ায় রাজ্যসংস্থাপন করিলে তাহাদের সহিত ভারতবাসীর সংঘর্ষ হইয়াছিল। সে সংঘর্ষে সিন্ধুপারস্থিত ভারতরাজ্য ভারতবাসীর হস্তচ্যুত হইয়াছিল; তথায় গ্রীকরাজ্য প্রতিষ্ঠালাভ করিতে বিলম্ব হয় নাই।
মুসলমান যখন ভারতসীমান্তে অসিহস্তে উপনীত হইয়াছিল, তখন তাহারা সভ্যতায় শিক্ষায় সমর-কৌশলে সমুন্নত ছিল না; আমাদের তুলনায় তাহারা সুসভ্য ও সমুন্নত জাতি বলিয়া স্পর্ধা করিতেও পারিত না। কিন্তু তাহাদের নিকট ভারতবর্ষকে, আজি হউক আর কালি হউক, একদিন পরাজয় স্বীকার করিতে হইয়াছিল।
আত্মপ্রীতি হইতে পারিবারিক প্রীতি ও তাহা হইতে কালক্রমে বিশ্বজনীন প্রীতি যে আদৌ বিকশিত হইতে পারে না, তাহা বলিতে পারা যায় না। কিন্তু সে কথা কেবল তর্কশাস্ত্রের কূট সিদ্ধান্তেই স্বীকার করিয়া লইতে হয়। সংসারে তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে স্বদেশ বলিয়া কোন প্রীতির প্রতিমা কখনো প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল কি না সন্দেহ। অন্য লোকে যাহাকে স্বদেশ বলিয়া পূজা করে, যাহার জন্য হাসিতে হাসিতে জীবন বিসর্জন করে, আমরা তাহার স্থলে স্বজাতাঁকে স্থাপন করিয়াছিলাম। সে জাতি আর কিছুই নয়–লোকাঁচারমূলক বর্ণাশ্রম বিভাগ মাত্র। তাহাতে ব্রাহ্মণাদি চতুৰ্ব্বর্ণের মধ্যে প্রতিবন্ধন প্রতিষ্ঠিত না হইয়া একত্রাবস্থানজনিত পরিচয়মাত্রই সংস্থাপিত হইয়াছিল; একের জন্য অপরে আত্মবিসৰ্জন করিতে প্রস্তুত ছিল না!
যত দিন অন্য জাতির সহিত সংঘর্ষ উপস্থিত না হয়, ততদিন এরূপ ব্যবস্থায় বিশেষ কিছু ক্ষতি হইতে পারে না। কিন্তু যে দিন অন্য জাতির সহিত প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে সম্মুখসমরে দণ্ডায়মান হইতে হয়, সেই দিন পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হইয়া থাকে। সত্য বটে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” বলিয়া জনশ্রুতি প্রচলিত আছে; কিন্তু সে জন্মভূমি বলিতে গণ্ডীমধ্যস্থ গণ্ডগ্রামের বাস্তুভুমি ভিন্ন আর কিছু নয়।
ভারতবর্ষের ভাল মন্দ বাঙ্গালা দেশেও প্রচলিত হইয়াছিল; এখানে আসিয়া বরং ভাল অপেক্ষা মন্দের ভাগই পুষ্টিলাভ করিয়াছিল। আর্যাবর্ত হইতে ক্রমশঃ গঙ্গাস্রোতের নিস্লাভিমুখীনী ত্বরিতগতির অনুসরণ করিয়া যাঁহারা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে আৰ্যোপনিবেশ সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, তাঁহারা একরূপ বিনাযুদ্ধেই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমিকে পরপদতলে পাতিত করিয়াছিলেন! ইহা বাঙ্গালীর পক্ষে লজ্জার কথা, কিন্তু ইহা সত্য। বাঙ্গালী যেভাবে বঙ্গদেশে রাজ্যবিস্তার করিয়াছিল তাহার মূলেই ধবংশবীজ নিহিত ছিল। মুসলমান উপলক্ষ মাত্র–যে কেহ বাঙ্গালার স্বাধীনতা হরণ করিতে পারিত। কারণ বাঙ্গালী সমগ্র দেশকে এক অখণ্ড রাজ্যরূপে পরিণত করিতে পারে নাই; বরং এক অখণ্ড রাজ্যকে বহুখণ্ডে বিভক্ত করিয়া ক্ষুদ্র শক্তিকে ক্ষুদ্রতর করিয়া আপনার পরাজয়ের পথ পরিষ্কৃত করিয়া রাখিয়াছিল!
বাঙ্গালী যে ভীরু বা কাপুরুষ, তাহা সত্য নহে। বাঙ্গালীর সাহিত্যে স্বদেশপ্রীতির কোন পরিচয় পাওয়া যায় না; সমগ্রদেশের মধ্যে একপ্রাণতা বৰ্ত্তমান থাকার কোন প্রমাণ প্রত্যক্ষ হয় না। সুতরাং মুসলমানসেনা বাঙ্গালা দেশে পদার্পণ করিবার সময়ে যথারীতি বাধা প্রাপ্ত হয় নাই। বাঙ্গালীর বাহুবলের অভাব ছিল না, ইচ্ছা করিলে বাধা দিতে পারি, কিন্তু সকলেই আপনারে লইয়া ব্যস্ত বলিয়া কেহই দেশের কথা ভাবিবার অবসর পায় নাই।
মুসলমান সহসা একদা সমগ্র বঙ্গভূমি পরাজিত করে নাই। সমগ্র বঙ্গভূমি এক অখণ্ড রাজ্যরূপে বৰ্তমান থাকিলে হয়ত মুসলমান সেনা আদৌ প্রবেশ করিতে পারিত না; অথবা পারিলেও সমগ্র দেশ একসঙ্গেই পরাজিত হইত। দেশ বহুধা বিভক্ত ছিল, মুসলমানকেও বহু স্থানে যুদ্ধ করিয়া পুনঃ পুনঃ জয়লাভ করিতে হইয়াছিল।
যে সভ্যতা গৌরবের উচ্চচূড়ায় আরোহণ করিয়া তিষ্ঠিতে পারে নাই, দেখিতে না দেখিতে ভূপতিত হইয়াছে, তাহার মূল্য বড় অধিক নহে। তাহার দম্ভ ও আস্ফালন যতই অধিক হউক, সারবত্ত্বা অতি অল্প। বাঙ্গালার তামস যুগের ইতিহাসের যে অস্পষ্ট ছায়ামাত্র দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতেও ইহা পরিস্ফুট রহিয়াছে।
পালবংশীয় গোপালদেব একদা গৌড়াধিপতি বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তাঁহার রাজ্যলাভের কথা ধর্মপালদেবের তাম্রশাসনে এইরূপ লিখিত আছে :
মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভিৰ্লপ্সাকরঃ গ্রাহিতঃ।
প্রজাপুঞ্জ ‘মাৎস্যন্যায়” বিদূরিত করিবার আশায় তাঁহাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। এক মৎস্য যেমন অন্যকে উদরসাৎ করে, বাঙ্গালীরা সেইরূপ একে অন্যের উৎসাদন করিতেন; তন্নিবারণাৰ্থ আপনাদের মধ্যে কোনো রাজতন্ত্র সংস্থাপিত করিতে না পারিয়া মগধের নরপতির কণ্ঠে বিজয়মাল্য অর্পণ করিয়াছিলেন!
রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা ছাড়িয়া দিয়া ধৰ্মনৈতিক ইতিহাসের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেও বাঙ্গালীর কলঙ্ক কালিমা বিদূরিত হয় না। হিন্দু ধর্মপ্রাণ বলিয়া বিখ্যাত। উঠিতে বসিতে, খাইতে শুইতে, জীবনের প্রতিদিবসের প্রত্যেক কার্য্যে হিন্দুগণ ধৰ্ম্মের কঠিন নিয়মে নিয়মিত। কিন্তু তাঁহার মধ্যেও ধবংশবীজ নিহিত ছিল।
হিন্দু বৌদ্ধ হইয়াছিল, মুসলমান হইয়াছিল, খৃষ্টিয়ান হইতেছে। ধর্মবিশ্বাসের জন্য খৃষ্টিয়ানগণ জ্বলন্ত চিতায় আত্মবিসৰ্জন করিয়াছেন, বৌদ্ধগণ চিরনিৰ্বাসন দণ্ডের সঙ্গে শততাড়না সহ্য করিয়াছেন, শিখ বীরগণ হাসিতে হাসিতে মুণ্ডদান করিয়াছেন, হিন্দু সেরূপ দৃষ্টান্ত রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। সমগ্র ইতিহাস আদ্যন্ত একই ভাবে গঠিত; তাহার মধ্যে স্বধর্মপ্রীতি বিশেষ শক্তিলাভ করিয়াছিল সেরূপ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
অল্পে সন্তুষ্ট বলিয়া আমরা স্বভাবতঃ শান্তিপ্রিয়। যাহা কিছু কলহের উৎসাহ সে কেবল ন্যায়শাস্ত্রের বিচারে প্রকাশিত। সুতরাং আমরা একালের ন্যায় সেকালেও ব্যক্তিগত উন্নতির লোভে দেশের বা জাতির মুখের দিকে চাহি নাই; যেন তেন। প্রকারেণ আপনার গণ্ডীর মধ্যে বসিয়া আপন লাভের গণ্ডার জন্য লালায়িত রহিয়াছি; লাভের লোভে “স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমিকেও” বিক্রয় করিতে ইতস্ততঃ করি নাই!
আজকাল পাশ্চাত্য শিক্ষায় ও পাশ্চাত্য দৃষ্টান্তে অনেকে এদেশে স্বদেশপ্রীতির বীজবপন করিয়া প্রাণপণে জলসেচন করিতেছেন। উষর ক্ষেত্রে সতেজ বীজও অঙ্কুরিত হয় না; আমাদের দেশও তাহাই হইতেছে। কিন্তু পাছে পুরাতন আদর্শ নষ্ট হইয়া নূতনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই আশঙ্কায় আর একদল সনাতনবাদী আমাদিগকে টানিয়া লইবার জন্য প্রাণপণে বর্তৃ তা আরম্ভ করিয়াছেন।
“সেকাল’–কথার কিছু মাহাত্ম আছে;–তাহার নামে স্বভাবতই মনপ্রাণ উৎফুল্ল হইয়া উঠে। কিন্তু সে কোন “সেকাল”? আমরা আমাদের ইতিহাসের কোন যুগে ফিরিয়া দাঁড়াইব?
যে দিন তুল্যাপরাধে ব্রাহ্মণের পক্ষে ভর্ৎসনা ও শূদ্রের পক্ষে অঙ্গচ্ছেদের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, আমরা কি সেই দিনের “সনাতন” পদ্ধতি অবলম্বন করিব? তখন এ দেশে ব্রাহ্মণের অখণ্ড শাসন বর্তমান ছিল। সে শাসন সহ্য করিতে না পারিয়া সাম্যমন্ত্র বিঘোষিত করিয়া বৌদ্ধধর্মের হুঙ্কার সমুচ্ছিত হইয়া জলস্থল প্রকম্পিত করিয়াছিল। সে দিন ভারতের গৌরবের দিন হইলেও, তাহা অধিক দিন স্থায়ী হইতে পারে নাই। তাহার পর যে সকল দিন সমাগত হইয়াছিল, ইতিহাস না থাকিলেও, তাহার স্মৃতি একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। তাহার কোন দিনের প্রলোভনে বর্তমানের বর্ধমান আশাতরুর মূলোচ্ছেদ করিয়া সেকালের প্রতি ধাবিত হইব?
প্রদীপ, মাঘ, ১৩০৬
তথ্যসূত্র
১ ঐতিহাসিক চিত্র, প্রথমবর্ষ, প্রথমখণ্ড, ৩৮ পৃ.।
.
বাঙ্গালীর ইতিহাস
বাঙ্গালা ভাষা যাহাদের মাতৃভাষা, তাহারা সকলেই বাঙ্গালী। কেহ হিন্দু, কেহ মুসলমান,–কেহ বৌদ্ধ, কেহ খৃষ্টীয়ান,–কিন্তু সকলেই বাঙ্গালী। তাহাদের কথাই বাঙ্গালার ইতিহাসের প্রধান কথা। প্রচলিত ইতিহাসে সে কথা অধিক নাই। তাহাতে যুদ্ধবিগ্রহের কথা, জয়পরাজয়ের কথা, রাজা এবং রাজপুরুষদিগের কথা। তাহাকে বাঙ্গালীর ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।
বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিত হয় নাই। বাঙ্গালী নিজে চেষ্টা না করিলে সে ইতিহাস লিখিত হইতে পারে না। চেষ্টার অভাবে অনেক কথা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, এখনও দিন দিন কত কথা লুপ্ত হইয়া যাইতেছে।
বিজেতা বিজয়-কাহিনী লিপিবদ্ধ করিবার জন্যই ব্যস্ত হইয়া থাকে। যাহারা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয় না, তাহাদের কথা বিজেতার নিকট নিতান্ত ছোটো কথা। সেই জন্য বিজেতা ইতিহাসে লিখিলে, তাহাতে সকল কথা স্থান প্রাপ্ত হয় না। বাঙ্গালা দেশের যে সকল ইতিহাস প্রচলিত আছে, তাহার সকল গুলিই এই শ্রেণীর ইতিহাস,–বিজেতার লেখনীপ্রসূত, অথবা তাহা হইতে অংশতঃ অথবা সম্পূর্ণরূপে ভাষান্তরিত। যথারীতি অনুসন্ধান করিয়া, সত্যাসত্যের সমুচিত সমালোচনা করিয়া, বাঙ্গালী এখনও বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিবার জন্য যথাযোগ্য আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। ইহার জন্য কাহাকেও ভর্ৎসনা করা যায় না। স্বদেশকে জানিবার জন্য আগ্রহ উপস্থিত না হইলে, সে চেষ্টা প্রবর্তিত হইতে পারে না। কিছুদিন হইতে আগ্রহের আভাস এবং কিছু কিছু চেষ্টার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। কিন্তু এখনও সমুচিত চেষ্টা প্রবর্তিত হয় নাই।
বাঙ্গালীর ইতিহাস-সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হইলে, চারিদিকে যেন অকূল সমুদ্র দর্শন করিতে হয় কোথায় তাহার আরম্ভকাল, তাহা স্মৃতিপথ হইতে সম্পূর্ণরূপে অপসৃত হইয়া গিয়াছে। বহু পুরাতন কাহিনী বলিয়াই এরূপ ঘটিয়া থাকিবে। সেই জন্য অনেকে ভারতবর্ষের পুরাতন ইতিহাসকেই বাঙ্গালীর পুরাতন ইতিহাস বলিয়া ধরিয়া লইতে পরামর্শ দান করেন। কিন্তু তাহাতে সংশয়ের অভাব নাই।
ভারতবর্ষ বহু প্রদেশে বিভক্ত মহাদেশ। এক প্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশ অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাঙ্গালা দেশ সেইরূপ। সমগ্র ভারতবর্ষের সহিত বাঙ্গালাদেশের সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালাদেশের বিশেষত্বের অভাব নাই; সমগ্র ভারতবাসীর সহিত বাঙ্গালীর সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালীর বিশেষত্ব দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং বাঙ্গালীর একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল। সে ইতিহাস বিলুপ্ত না হইলে, বাঙ্গালীর সর্বপ্রকার বিশেষত্বের কাৰ্যকারণশৃঙ্খলা বুঝিতে পারা যাইত।
বাঙ্গালা দেশের সহিত আৰ্য্যাবর্তের সংস্রব ছিল; দাক্ষিণাত্যেরও সংস্রবের অভাব ছিল না। কেবল তাহাই নহে,–সমগ্র প্রাচ্যরাজের সহিত বাঙ্গালা দেশের একটি সাক্ষাৎ সংস্রব বর্তমান ছিল। তাহা ছাড়া, পারস্য, আরব এবং মীশর দেশের সঙ্গেও বাঙ্গালা দেশের কিছু কিছু সাক্ষাৎ সংস্রব বর্তমান থাকারও প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বাঙ্গালাদেশের সমুদ্রোপকূলে তাহার যে সকল প্রমাণ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা ছিল, তাহা কালক্রমে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সে সংস্রব কতদিনের সংস্রব, কত দূরদেশের সহিত সংস্রব, কোন শ্রেণীর কিরূপ সংস্রব, কিরূপে তাহার আরম্ভ, কিরূপেই বা তাহার শেষ,ইহার সকল কথাই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
ললিতবিস্তরে দেখিতে পাওয়া যায়, উক্ত গ্রন্থ রচিত হইবার সময়ে “বঙ্গলিপি” নামক পৃথক লিপি প্রচলিত ছিল। তাহা দ্বিসহস্র বৎসরের কথা। তখন “বঙ্গলিপি” স্বতন্ত্র লিপি বলিয়া পরিচিত ছিল; তাহাকে চেষ্টা করিয়া শিক্ষা করিতে হইত। বিশেষ পার্থক্য না থাকিলে, এরূপ হইত না। কত যুগে সেরূপ পার্থক্য সংস্থাপিত হইয়াছিল,–কিরূপ কারণে সেরূপ পার্থক্য সংস্থাপিত হইয়াছিল–এ সকল কথা কতকাল বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সে “বঙ্গলিপি” কিরূপ ছিল? তাহাই বা কে বলিতে পারে? কেবল লিপি কেন, বঙ্গভাষাও স্বতন্ত্র ভাষা। তাহার গঠনপ্রণালীতে স্বাতন্ত্রের অভাব নাই। বাঙ্গালীর আচারব্যবহারেও এইরূপ কত স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হয়। তাহার শিল্পের স্বাতন্ত্র্য সৰ্ব্বত্র সুপরিচিত। এই সকল কারণে বাঙ্গালীর পুরাতন ইতিহাস পৃথকভাবে আলোচিত না হইলে, অনেক কথাই বুঝিতে পারা যায় না।
বাঙ্গালীর আধুনিক ইতিহাসেও স্বাতন্ত্রের অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যে পথে গিয়াছে, বাঙ্গালী সকল বিষয়ে, সকল সময়ে সে পথ অবলম্বন করিতে সম্মত হয় নাই। আধুনিক ইতিহাসে বাঙ্গালী ভীরু এবং কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কৃত হইলেও, বাঙ্গালী স্বাতন্ত্রপ্রিয়–স্বাধীনতার উপাসক,–অপরাজিত পৃথক জাতি। বাঙ্গালী কখন বৌদ্ধ হইয়াছে, কখন হিন্দু হইয়াছে, কখন হিন্দুমুসলমান বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কদাচ দীর্ঘকাল পরাধীন থাকিতে সম্মত হয় নাই। পাঠান, মোগল কেহই বাঙ্গালীকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে পারেন নাই; ইংরেজরাও বাঙ্গালীকে রণক্ষেত্রে পরাভূত করিয়া, শাসনভার গ্রহণ করেন নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান অস্ত্রবলে পরাভূত,–বাঙ্গালা দেশ অস্ত্রবলে পরাভূত হয়। নাই।
বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিতে হইলে, বিবরণসংকলনে ব্যাপৃত হইতে হইবে। তাহার জন্যই “ঐতিহাসিক চিত্র” জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহা যে মরিয়াও মারিতেছে না, ইহাতেই আশা হয়,–বাঙ্গালী তাহার ইতিহাস সংকলনের জন্য কিছু কিছু আগ্রহ প্রকাশ করিতে শিখিতেছে। এই আগ্রহ প্রবল হইলে, প্রকৃত অধ্যবসায় আসিয়া বিবরণসংকলনের সহায়তাসাধন করিবে। এই ব্ৰত একের নহে, অনেকের;–অনেকের নহে, সকলের। বাঙ্গালীমাত্রে ইহার সহায়তাসাধন না করিলে, এই কঠিন ব্রত প্রতিপালিত হইতে পারে না। “ঐতিহাসিক চিত্রের” তৃতীয় পৰ্য্যায় আরম্ভ হইতেছে। আবার সকলকে সবিনয়ে ইহার সহায়তাসাধনের জন্য অনুরোধ করি।
ঐতিহাসিক চিত্র, বৈশাখ, ১৩১৪
.
দেশের কথা ১
আমাদের ইতিহাস নাই। কারণ, ইতিহাস নামধেয় কোনও পুরাতন গ্রন্থ দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহাতে স্থির হইয়া গিয়াছে, আমাদের ইতিহাস ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও স্থির হইয়া গিয়াছে, ইতিহাস রচনা করিবার প্রতিভা ছিল না বলিয়াই, আমাদের ইতিহাস ছিল না।
অন্যান্য বিষয়ে প্রতিভার অভাব ছিল না। অনন্ত নভোমণ্ডলের অসংখ্য গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিয়া জ্যোতিষ ও গণিতশাস্ত্রের ন্যায় কঠিন শাস্ত্রের অনুশীলন করিবার প্রতিভা ছিল। অতল সমুদ্রতল হইতে মণিমুক্তা আহরণ করিয়া অলঙ্কার গঠন করিবার প্রতিভা ছিল। তদপেক্ষা অধিক অতলস্পর্শে মানব মনের অন্তস্থল আলোড়িত করিয়া মনস্তত্ত্বের আলোচনায় বিবিধ দর্শনশাস্ত্রের গ্রন্থরচনার প্রতিভা ছিল। কেবল সৰ্ব্বজনবিদিত সাংসারিক ঘটনানিচয়ের ধারাবাহিক কাহিনী লিখিয়া রাখিবারই প্রতিভা ছিল না। কথাটা চিরদিনই কেমন অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইয়াছে। তথ্যানুসন্ধানে যত অগ্রসর হইতে পারিয়াছি, ততই তাহা অধিক অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইয়াছে।
আমাদের ভাষায় ইতিহাস শব্দটি চিরদিন প্রচলিত আছে। স্মরণাতীত পুরাকাল হইতে–বৈদিক সাহিত্যের প্রথম বিকাশের সূত্রপাত হইতে, এই শব্দটি আমাদের সকল যুগের সাহিত্যেই প্রচলিত আছে। ইতিহাসের লক্ষ্মণ কি, “সামান্য বিশেষবতা-লক্ষণেন” তাহাও সুনির্দিষ্ট হইয়া রহিয়াছে, এবং সেই সকল লক্ষণ ধরিয়া, তাহাকে পুরাণ নামক সুপরিচিত গ্রন্থ হইতে পৃথক শ্রেণীর গ্রন্থ বলিয়া মানিয়া লইবার কারণ-পরম্পরারও অভাব নাই। কেবল ইতিহাস নামধেয় গ্রন্থ ছিল না,–এরূপ সিদ্ধান্তে স্বভাবতই আস্থা স্থাপন করিতে সাহস না হইবারই কথা। তথাপি ‘সাহেব’- দিগের দেখাদেখি, আমাদের দেশেরও অনেক লেখক অবনতমস্তকে এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়া, কেহ “হা হতোহস্মি” করিয়া থাকেন, কেহ বা লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া পড়েন! কথাটা কত দূর সত্য, তাহার বিচার-কাৰ্য্য আরব্ধ হয় নাই। বিচারে প্রবৃত্ত হইলে, প্রমাণ আবিষ্কারের নিতান্ত অভাব ঘটিত বলিয়া বোধ হয় না। বিচারে প্রবৃত্ত হইলে, অনেকগুলি কথার বিচারকার্যে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। প্রথম কথা–অন্যান্য দেশে যে প্রয়োজনসাধনের জন্য ইতিহাস সংকলনের সূত্রপাত হইয়াছিল, আমাদের দেশে কখনো সেরূপ প্রয়োজন বর্তমান ছিল কি না? দ্বিতীয় কথা,–প্রয়োজন বর্তমান থাকিলেই হইল না, সেরূপ প্রয়োজন প্রকৃত প্রয়োজন বলিয়া কখনো অনুভূত হইবার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় কি না? তৃতীয় কথা,–আমাদের দেশে ইতিহাস কিরূপ আকার গ্রহণ করিয়াছিল; তাহা কি কখনো লিপিবদ্ধ করিবার চেষ্টা প্রবর্তিত হয় নাই? চতুর্থ কথা,–যদি কখনো সেরূপ গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিত, তবে তাহা কোথায় গেল? পঞ্চম কথা–বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতে হইলে, বিলুপ্ত হইবার কিরূপ অনিবার্য কারণ উপস্থিত হইয়াছিল? শেষ কথাসাহিত্য একবার জন্মগ্রহণ করিলে সম্পূর্ণরপে বিলুপ্ত হইতে পারে না, কিছু না কিছু পদচিহ্ন রাখিয়া যায়। আমাদের দেশে পুরাকালে ইতিহাস রচিত হইবার কোনরূপ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় কি না? একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধে এক সঙ্গে এতগুলি কথার আলোচনা শেষ করিতে হইলে, নিতান্ত সংক্ষিপ্তভাবেই সকল কথার আলোচনা করিতে হইবে। তাহাতে বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য বিফল হইবার আশঙ্কা নাই। বিষয়টির যথাযোগ্য বিচারকার্যে লিপ্ত হইবার জন্য সহিত্যিকগণকে আহ্বান করাই এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। বিচারকার্য আরব্ধ হউক,–সত্য কালক্রমে অবশ্যই আত্মপ্রকাশ করিবে।
আমাদের দেশের যে সকল কথার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এ পর্যন্ত নানা উপায়ে আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। এখনও অনেক কথার বিশ্বাস্য প্রমাণ আবিষ্কার করিবার আশায় সমগ্র সভ্যসমাজের পুরাতত্ত্বনিপুণ সুপণ্ডিতবর্গ আন্তরিক অধ্যবসায়ের সহিত তথ্যাবিষ্কারে ব্যাপৃত হইয়া রহিয়াছেন। ইহাদের কল্যাণে আমরা জানিতে পারিয়াছি, আমাদের দেশে অতি পুরাকাল হইতে রাজ্য ছিল, রাজ্যস্থাপনের ও রাজ্যশাসনের প্রতিভার ও ক্ষমতার অভাব ছিল না, ভারতবর্ষের বাহিরেও–বহুদূর পর্যন্ত–জলে স্থলে–আমাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সমুচিত অধ্যবসায়েরও অভাব ছিল না। এই সকল কাৰ্যসাধনের জন্য বিবিধ ঘটনাবলীর ধারাবাহিক ইতিহাস লিখিয়া রাখিবার প্রয়োজন যে পুনঃপুনঃ উপস্থিত হইত, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। আমাদের দেশে অতি পুরাকাল হইতে বিবিধ ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায় প্রাদুর্ভূত হইয়া লোকসমাজকে নানা তত্ত্বের শিক্ষাদানে ব্যাপৃত হইয়াছিল। তাহাদের অনুষ্ঠিত বিবিধ ক্রিয়াকলাপের বিশুদ্ধিরক্ষার্থ গুরুপরম্পরাগত উপদেশাবলী ধারাবাহিকরূপে রক্ষা করিবার প্রয়োজনে সম্প্রদায়গত ইতিহাস লিখিয়া রাখিবার চেষ্টা যে পুনঃপুনঃ প্রবর্তিত হইবার সম্ভাবনা ছিল, তাহাও সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অন্যান্য দেশে যে সকল প্রয়োজনসাধনের জন্য ইতিহাস-সংকলনের সূত্রপাত হইয়াছিল, আমাদের দেশেও যে তাহার সকল শ্রেণীর প্রয়োজনই বর্তমান ছিল, তাহাতে সংশয়প্রকাশের কারণ নাই।
এই প্রয়োজন প্রকৃত প্রয়োজন বলিয়া পুনঃপুনঃ অনুভূত হইবার অনেক কারণ ছিল। রাজ্য ছিল, যুদ্ধবিগ্রহ ছিল, সন্ধিবন্ধন ছিল, স্বদেশের ও বিদেশের মধ্যে নানা স্থানে দূতাদি প্রেরণের ব্যবস্থা ছিল, বিবাহাদি উৎসব উপলক্ষে নানা রাজন্যবর্গের মধ্যে পরস্পরকে নিমন্ত্রণ করিবার প্রথা ছিল, এবং অনেক সময়ে বংশকীৰ্ত্তনাদি দ্বারা পূৰ্ব্বকাহিনীর পরিচয়-প্রদানেরও প্রয়োজন উপস্থিত হইত। এখনও পুরাতন সাহিত্যে এই সকল বিষয়ের কিছু কিছু প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল প্রয়োজন যে প্রকৃত প্রয়োজন, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কোনরূপ ইতিহাস না থাকিলে, এই সকল প্রয়োজন অন্য কোন উপায়ে সাধিত হইত, তাহা বুঝিতে পারা যায় না।
এই সকল কারণে, কোনও না কোনও শ্রেণীর ইতিহাস প্রচলিত থাকা সম্ভব বলিয়া স্বীকার করিতে হইলেই, লিখিত ইতিহাস প্রচলিত থাকা সম্ভব বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। লিখিত ইতিহাস প্রচলিত থাকিবার কোনরূপ প্রমাণ না থাকিলেও, তাহা নিতান্ত অসম্ভব সিদ্ধান্ত বলিয়া পরিগণিত হইতে পারিত না। কিন্তু লিখিত ইতিহাস প্রচলিত থাকিবার প্রমাণ এখনও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় নাই।
লিখিত ইতিহাস যে ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তাহারও কিছু কিছু প্রমাণ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই শ্রেণীর প্রমাণের অনুসন্ধানকার্যে কেহ সমধিক যত্ন প্রকাশ করেন নাই। কবি কহুণের রাজতরঙ্গিণীতে যাহা কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতেই বুঝিতে পারা যায়,–পুরাকালে ইতিহাসের গ্রন্থের একেবারে অভাব ছিল না। তাহা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
গ্রন্থবিলোপের কারণ-অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবামাত্র, তাহাতে বিস্মিত হইবার কারণ তিরোহিত হইয়া যায়। ভারতবর্ষের ন্যায় দেশে তাহা সৰ্ব্বথা স্বাভাবিক বলিয়াই প্রতিভাত হয়। সাধারণতঃ মুসলমানের স্কন্ধেই গ্রন্থনাশের সকল অপরাধ ন্যস্ত হইয়া আসিতেছে। তাহা সর্বাপেক্ষা স্বাভাবিক কল্পনা বলিয়া, তাহার অধিক আর কোনরূপ কারণের অনুসন্ধানের জন্য কেহ ক্লেশ স্বীকার করিতে সম্মত হন । কিন্তু মুসলমানের অভ্যুদয়ের বহু পূৰ্ব্বেও আমাদের দেশে রাষ্ট্রবিপ্লবের অভাব ছিল না, লুণ্ঠন নরহত্যা অপরিচিত ছিল না, পরাজিত জনপদ অগ্নিশিখায় ভস্মীভূত হইবার অসদ্ভাব ছিল না। দেশ বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত থাকায়, বহুবার বহু বিপ্লব আমাদের দেশকে উপর্যুপরি বিপর্যস্ত করিয়াছে। তাহাতে কাঙ্গালকুটীর সকল সময়ে বিপর্যস্ত না হইলেও, রাজভবন পুনঃপুনঃ বিপর্যস্ত হইয়াছে। যেখানে ইতিহাসের লিখিত ভাণ্ডারের অবস্থান, তাহা এইরূপে পুনঃপুনঃ বিপর্যস্ত হইবার সময়ে গ্রন্থগুলি বিলুপ্ত হইবার কারণ সংঘটিত হইয়াছে।
ইতিহাসের সহিত রাজার ও রাজপুরুষবর্গের সংস্রব কিছু অধিক থাকায়, জনসাধারণের পক্ষে ক্লেশ স্বীকার করিয়া এই শ্রেণীর সমুদয় গ্রন্থ নকল করিয়া রাখিবার প্রবৃত্তি প্রবল থাকিবার কথা ছিল না। যতদিন দেশের শাসনকার্য্যে দেশের লোকের কিছুমাত্র স্বাধীনতা ছিল, ততদিন জনসাধারণের পক্ষেও ক্লেশ স্বীকার করিয়া ইতিহাসের গ্রন্থ নকল করিয়া রাখিবার যাহা কিছু প্রয়োজন অনুভূত হইত, পরাধীনতার যুগে, সে প্রয়োজনও আর অনুভূত হয় নাই। সুতরাং যে কারণে সংক্ষিপ্তসার সংকলিত হইবার পর অনেক মূলগ্রন্থ বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, সেই স্বাভাবিক কারণেই–প্রয়োজনের অভাবে–ইতিহাসের গ্রন্থও একে একে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। তাহার জন্য কেবল মুসলমানকেই অপরাধী বলিয়া স্বীকার করা যায় না।
অন্যান্য প্রদেশের কথা ছাড়িয়া দিয়া, কেবল বাঙ্গালা দেশের কথা লইয়া আলোচনা করিলেও, ইতিহাসের গ্রন্থ লিখিত ও প্রচলিত হইবার কিছু কিছু প্রমাণ এখনও সংকলিত হইতে পারে। তারানাথের গ্রন্থে এক শ্রেণীর প্রমাণের সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়। তারানাথ এক জন বৌদ্ধ শ্রমণ, তিনি বাঙ্গালী ছিলেন বলিয়াই কিম্বদন্তী আছে, কিন্তু তাঁহার জীবন-কাহিনীর অতি অল্প কথাই বাঙ্গালীর নিকট পরিচিত। তারানাথ তিববতে বৌদ্ধধৰ্ম্ম-প্রচারে নিযুক্ত থাকিবার সময়ে তদ্দেশের ভাষায় একখানি ইতিহাসের গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছিলেন। তাহা নিতান্ত আধুনিক সময়ের ঘটনা হইলেও, তাঁহার গ্রন্থে পুরাকালের অনেক তথ্য উল্লিখিত আছে। এই গ্রন্থের সকল কথাই আমাদের কথা। কিন্তু ইহা আমাদের ভাষায় অনূদিত হয় নাই। আমাদের সাহিত্যেও ইহার যথাযোগ্য আলোচনা স্থানলাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু তারানাথের গ্রন্থ সভ্য সমাজের সুধীবর্গের নিকট অপরিচিত নাই। এই গ্রন্থ এক জন রাসায়নিকের যত্নে আবিষ্কৃত হইয়া, আর এক জন অধ্যবসায়শীল সাহিত্যিকের যত্নে জৰ্ম্মণ ভাষায় ভাষান্তরিত হয়। কোন কোন ইংরেজ-লেখক তাহার কোন কোন অংশ ইংরাজী ভাষায় অনূদিত ও সংকলিত করিয়া গিয়াছেন। এইরূপে তাঁহাদের কৃপায় এই গ্রন্থের কিছু কিছু বৃত্তান্ত অবগত হইবার সুযোগ প্রাপ্ত হইবার পর, এত কালেও তার যথাযোগ্য ভাবে বঙ্গভাষায় আলোচিত হয় নাই।
১৬০৮ খ্রীস্টাব্দে তারানাথের গ্রন্থ সংকলিত হয়। তৎকাল পর্যন্ত যে সকল ইতিহাসের গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল, তিনি উপসংহারে তাহার পরিচয় দিবার জন্য লিখিয়া গিয়াছেন :
যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, এই গ্রন্থ কোন কোন গ্রন্থকে প্রমাণরূপে স্বীকার করিয়া লিখিত হইল, তিনি জানিয়া রাখুন,–তিববত দেশে সময়ে সময়ে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস-মূলক নানা গ্রন্থের অংশবিশেষ রচিত হইয়া থাকিলেও, আমি এ পর্যন্ত সেই শ্রেণীর কোনও ধারাবাহিক ইতিহাসের গ্রন্থের সন্ধান লাভ করিতে না পারিয়া, দুই একটি সুপরিচিত কাহিনী ব্যতীত, অন্যান্য বৃত্তান্তের জন্য তিববতীয় গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া তাহা হইতে বিবরণ-সংকলনের চেষ্টা করিতে প্রবৃত্ত হই নাই। মগধের পণ্ডিত ক্ষেমেন্দ্রভদ্রের গ্রন্থের যেরূপ ব্যাখ্যা গুরুপণ্ডিতগণের নিকট শ্রবণ করিয়াছি, তদনুসারে সেই গ্রন্থকেই আবার গ্রন্থের মূলভিত্তিরূপে গ্রহণ করিয়াছি। ক্ষেমেন্দ্রভদ্রের গ্রন্থে রাজা রামপালের শাসন সময় পৰ্যন্ত ইতিহাস লিখিত আছে। এই গ্রন্থ ব্যতীত আরও দুইখানি গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া আমার ইতিহাস সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। একখানির নাম ‘বুদ্ধ-পুরাণ’, ইন্দ্রদত্ত নামক জনৈক ক্ষত্রিয় পণ্ডিত কর্তৃক বিরচিত;–তাহাতে সেনবংশের চারিজন নরপতির শাসন সময় পর্যন্ত নানা ঘটনা ১২০০ শ্লোকে উল্লিখিত আছে। আর একখানি পণ্ডিত ভটঘটি নামক ব্রাহ্মণের বিরচিত বৌদ্ধাচাৰ্য্যগণের ধারাবাহিক বিবরণ।৬
এই শ্রেণীর ইতিহাসের গ্রন্থ এখন এ দেশে দুর্লভ, অথবা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইলেও, তাহার নকল নেপাল, তিববত ও চীনদেশে এখনও প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা আছে। তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। কিন্তু ইতিহাস নাই বলিয়া “হা হতোহস্মি” করিয়া যাঁহারা সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক কলরবে গগনমণ্ডল প্রতিধবনিত করিয়া থাকেন, তাঁহারা এই সকল গ্রন্থের অনুসন্ধানকার্যে প্রবৃত্ত হইবার জন্য এখনও যথাযোগ্য ব্যবস্থা করিতে অগ্রসর হন নাই। তথ্যানুসন্ধান না করিয়া, গৃহে বসিয়া ইতিহাস রচনা করিবার বিড়ম্বনাই এখনও আমাদিগকে সাহিত্য সেবার গৌরবলাভের জন্য লালায়িত করিয়া রাখিয়াছে।
এখনও তথ্যানুসন্ধানের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা হইলে, নানা বিবরণ সংকলিত হইবার আশা আছে। সাহারার মরুভূমির মধ্যে, মধ্য আফ্রিকার সিংহশার্দুলাক্রান্ত ও তদপেক্ষা নৃশংসতর নরখাদক মনুষ্যসমাজাধিকৃত দুর্গম দেশে তথ্যাবিষ্কারের জন্য যাঁহারা জীবন পণ করিয়া অগ্রসর হইয়া থাকেন, তাঁহাদের তুলনায় আমাদের পক্ষে আমাদের দেশের ইতিহাসের তথ্যানুসন্ধানে অগ্রসর হওয়া কত সহজ, কত স্বাভাবিক, কত প্রীতিপদ! অনেকবার এ দেশে সাহিত্যসম্মিলন হইয়া গেল, আবারও উদ্যোগপৰ্ব্ব চলিতেছে;–কিন্তু ইহার কথা কে বলিবে, কে শুনিবে, এই মহাব্রত গ্রহণ করিবার জন্য কাহারা গৃহকোটর ছাড়িয়া বাহির হইবে, কাহারা উত্তরসাধক হইয়া মাভৈঃ মাভৈঃ রবে অভয়দান করিবে,–এখনও তাহার অধিক পরিচয় সংকলিত করিতে পারি নাই। আবার ঢক্কানিনাদে সাহিত্যসম্মিলনের উৎসব সুচনার সূত্রপাত হইয়াছে। তাহাতে কি ইহার কথা আলোচনা করিবার জন্য পাঁচ মিনিটের অধিক মহামূল্য সময় নষ্ট করিবার প্রস্তাব করিয়া কেহ ধৃষ্টতা-প্রকাশে সাহসী হইবেন?
সাহিত্য, মাঘ, ১৩১৭
তথ্যসূত্র
১ ধৰ্মার্থকামমোক্ষানামুপদেশসমন্বিতঃ। পূৰ্ব্ববৃত্তকথাযুক্তমিতিহাসঃ প্রচক্ষতে৷৷
২ রামায়ণে ইহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।
৩ ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে Vassiliev কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত।
৪ ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে Schiefuer কর্তৃক অৰ্ম্মণ অনুবাদ প্রকাশিত।
৫ Heeley ও Miss E Lyall কর্তৃক অংশতঃ ইংরাজি ভাষায় অনূদিত ও সংকলিত।
তাহারই কোনও কোনও অংশ কনিংহাম, হাভেল প্রভৃতি ইংরাজ লেখকগণ কর্তৃক উদ্ধৃত।
৬ If any one ask on what authorities this work depends, let him know that although many fragmentary histories of the origin of the (Budhist) religion, and stories, have been composed in Tibet, I have not met with any complete and consecutive work; I have, therefore, with the exception of a few passeages, the credibility of which proves their truth, taken nothing from Tibetan sources. As, however, I have seen and heard the comments of several Guru-Panditas on a work in two thousand slokas composed by KSHEMENDRABHADRA, a Pundita of Mogadha, which narrates the history as far as King Ramapala, I have taken this as my foundation, and have completed the history by means of two works, namely the Budhapurana, composed by Pandita INDRADATTA of a Kshatriya family, in which all the events up to the four Sena Kings are fully recorded in 1900 slokas, and the ancient History of the Succession of Teachers (Acharyas) composed by the Brahman Pandita PHATAGHATI.–Extracts from Taranath’s History Buddhism in India, by W. L. Heeley, B.C.S., published in the Indian Antiquary, Vol. iv, pp. 101-104.