ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপট
(বিঃদ্রঃ ভালো করে প্রুফরীড করা হয়নি)
ভূপৃষ্ঠে তার আবির্ভাবের দিন থেকেই মানুষ ভারতে বাস করে আসছে। এর পেছনে যে যুক্তি আছে, সেটাই এখানে দিচ্ছি। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে। তার আগের দুইশত ষাট লক্ষ বৎসর ধরে প্রকৃতির কর্মশালায় চলেছিল এক বিরাঙ্কুর্মকাণ্ড এক শ্রেণীর বানর-জাতীয় জীবগণ ( dryopithecus ) চেষ্টা করছিল বিভিন্ন লক্ষণযুক্ত হয়ে নানা বৈশিষ্ট্যমূলক শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হতে। এরূপ এক শাখা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল নরাকার জীবসমূহ। এসব জীবের মধ্যে যারা বৃক্ষ ত্যাগ করে ভুমিতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অন্যতম জীবের নাম রামপিথেকাস ( Ramapithecus )। রামপিথেকাস থেকেই পরে মানুষ উদ্ভূত হয়েছিল। রামপিথেকাসের আবিষ্কার ঘটেছিল বর্তমান শতাব্দীর ত্রিশের দশকে।
১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে বিখ্যাত প্রত্নাস্থিতত্ত্ববিদ ( palaeontologist ) স্যার আর্থার কীথ তাঁর Antiquity of Man গ্রন্থে লেখেন–‘India is – a part of the world from which the student of early man has expected so much and so far has obtained so little.’ ( ‘প্রাচীন মানুষের সম্বন্ধে যাঁরা অনুসন্ধান করেন, তারা ভারতের দিকেই আশার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, কিন্তু এ পর্যন্ত র্তাদের নিরাশ হতে হয়েছে। ) স্যার আর্থারের এই উক্তির অনুসরণেই ত্রিশের দশকে আমেরিকার ইয়েলের স্যাচারাল মিউজিয়ামের অধ্যাপক ডক্টর টেরা (Dr. H. De Terra) ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এ বিষয়ে এক অনুসন্ধান চালান। যদিও তার এই প্রথম অভিযানে প্রাচীন যুগের প্রকৃত মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি, তথাপি মানবের বিবর্তনের কতকগুলি মূল্যবান সূত্র তিনি এখানে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এককথায় বলতে গেলে, মানবাস্থির সন্ধান না পেলেও মানবের পূর্ববর্তী পুরুষদের অস্থির সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিবালিক গিরিমালা অঞ্চলে তিনি রামপিথেকাস, সুগ্ৰীবপিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস প্রভৃতি নামধেয় নরাকার জীবের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কারগুলি নৃতত্ত্বের ওপর নূতন আলোকপাত করে ; কারণ ইতিপূর্বে এই পর্যায়ের জীবগণের তথ্য অজ্ঞাত ছিল। ইয়েল অভিযানের সদস্ত লুইস সাহেবের মতে এইজাতীয় জীবগুলি ( higher primates ) জগতের এই অঞ্চলেই প্রথম প্রাতৃভূত হয়েছিল। এদের চিবুকাস্থি ও দান্তিক সংস্থান অনেকটা মানবেরই কাছাকাছি। এ থেকে মনে হয় যে, মানবের বিবর্তন এই অঞ্চলেই ঘটেছিল।
এর অল্পদিন পরে ইয়েল ও কেম্বিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ডক্টর টেরা ভারতে তাঁর দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় অভিযানেও তিনি আদিম যুগের মানবের জীবাশ্ম পাননি। তথাপি এই প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযানের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, এই অভিযানদ্বয়ে এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসরের পুরাতন ভূ-স্তর থেকে তৎকালীন ভারতে মানব-বাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। এ থেকে মনে হয় যে ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্মের সন্ধান নিতান্ত স্বপ্ন বিলাস মাত্র নয়।
ভারতের উত্তর-পশ্চিমে শিবালিক শৈলমালা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে রামপিথেকাসের আবিষ্কারের পর আমরা তার জ্ঞাতি-ভাইদের কঙ্কালাস্থি পেয়েছি চীন দেশের কেইয়ুয়ানে ও আফ্রিকার কেনিয়ায়। তবে তাদের মধ্যে রামপিথেকাসই সবচেয়ে প্রাচীন। পণ্ডিতগণ মনে করেন যে আজ থেকে ১২০ লক্ষ বৎসর পূর্বে শিবালিক গিরিমালা অঞ্চলেই রামপিথেকাসের উদ্ভব ঘটেছিল, এবং সেখান থেকেই তার জ্ঞাতিভাইরা আফ্রিকা ও চীনদেশে গিয়ে সেখানকার ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে নিজ নিজ বিশিষ্টতা লাভ করে বিবর্তনের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। রামপিথেকাসের পরবর্তী যে জীবের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি, তারা আজ থেকে কুড়ি লক্ষ বৎসর পূর্বে পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অস্ট্রালোপিথেকাস। এরা সবাই মানুষের পুর্বপুরুষ মাত্র, ঠিক মানুষ নয়। তবে তারা মানুষের বিবর্তনের পথে এক একটা ধাপ। রামপিথেকাস যেমন আফ্রিকা ও চীনদেশ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল, অস্ট্রালোপিথেকাস তেমনই ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জাভা পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছিল। এরূপ জীবের অস্থি আমরা পেয়েছি জাভার সানগিরানে। আরও পেয়েছি আফ্রিকার তানজানিয়ার অন্তর্গত ওলডুভালে ও গারুসিতে, কেনিয়ার অন্তর্গত বারিনগো এবং লোথাগামে, দক্ষিণ আফ্রিকার টাউঙ, মাকাপান, সোয়ারটুক্রানস ও স্টার্কফনটেনে। প্রকৃত মানুষ ও অস্ট্রালোপিথেকাসের মধ্যবর্তী জীবের প্রাতুর্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে দশ লক্ষ বৎসর পূর্বে। তাদের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি জাভার সানগিরানে ও মডজোকারটোতে, আফ্রিকার তানজানিয়ার ওলডুভালে, দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়ারটক্রানস ও সাহার মরুভূমির অন্তর্গত চাদ-এর টায়োতে। তারপর পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে ঋজুভাবে চলাফেরা করতে পারে ( homo erectus ) এরূপ মানবের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি জাভার ট্রিনিলে, চীনদেশের পিকিং ও লানটিয়ানে, তানজানিয়ার ওলডুভালে, আলজিরিয়ার টারনিটাইনে, জারমানির হাইডেলবারগে, হাঙ্গেরির ভেরটেস্জোলোসে। তার পরের পর্যায়ের মানুষের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি ইংলণ্ডের সোয়ানস্কুমে, জারমানির স্টাইনহাইমে ও চীনদেশের মা-পা-তে। এর পরবর্তী পর্যায়ের মানুষের নাম দেওয়া হয়েছে নিয়ানডারথাল (Neanderthal) জাতির মানুষ। নিয়ানডারথাল জাতির মামুষের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি ইউরোপের নানা স্থানে ও মধ্যপ্রাচী থেকে। আমুমানিক চল্লিশ হাজার বৎসর পূর্বে নিয়ানডারথাল জাতির মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার স্থান অধিকার করে ক্রোম্যানিয়োন ( Cromagnon ) জাতির মানুষ। ক্রোম্যানিয়োন জাতির মানুষ হতেই পৃথিবীর বর্তমান জাতিসমূহের উদ্ভব ঘটেছে।
এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদগণ একমত যে পৃথিবীতে বর্তমানে যত জাতি বিদ্যমান আছে, তারা সকলে একই বর্গ (genus ) ও প্রজাতি ( species) হতে উদ্ভূত। তবে তাদের মধ্যে যে-সকল বৈশিষ্ট্যমূলক আবয়বিক পার্থক্য আছে, তার জন্য তাদের বিভিন্ন জাতিপর্যায়ের ( races ) লোক বলা হয়। যে-কারণে এইসকল নর-গোষ্ঠীর মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য ঘটেছে, তা হচ্ছে—(১) gene mutation বা জনঘটিত পরিব্যক্তি, (২) natural selection বা প্রাকৃতিক নির্বাচন, (8) genetic drift qi to fissol, (8) environmental influence qi offo olef”, 3 (4) population mixture বা জন-মিশ্রণ।
আবির্ভাবের দিন থেকেই মানুষের প্রধান সমস্যা ছিল আত্মরক্ষা ও খাদ্য আহরণ। যে যুগে মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল, সে যুগে সে চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত ছিল অতিকায় হস্তী ( mammoth ), বন্যমহিষ ( bison ) ও অন্যান্ত হিংস্র জন্তু দ্বারা ; আর তার খাদ্য ছিল বন্ত ফলমূল ও পশুমাংস। মাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য। সেজন্য তাকে পশুশিকারে বেরতে হত। আত্মরক্ষা ও পশুশিকারের জন্য তাকে নানারকম আয়ুধ তৈরি করতে হত। এই আয়ুধগুলিই হচ্ছে প্রাচীন মানবের একমাত্র কৃষ্টির নিদর্শন। মানুষ ছিল বুদ্ধির ধারক ( homo sapiens )। সেজন্য বুদ্ধি খাটিয়ে ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে, সে প্রস্তরনির্মিত নানারূপ আয়ুধ তৈরি করে ফেলেছিল। তার মানে, মানুষ যে কেবল বুদ্ধির ধারক বা homo sapiens মাত্র ছিল, তা নয়। সে প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপটকারিগর বা homo faber-ও ছিল। তার নির্মিত আয়ুধসমূহ আমরা পৃথিবীর নানা স্থান থেকে পেয়েছি। পশ্চিম ইউরোপে এইসকল আয়ুৰ চকমকি পাথর বা flint দিয়ে তৈরি করা হত। আর ভারতে এগুলি তৈরি করা হত নদীর ধারে পাওয়া মুড়ি ( pebbles ) ও কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে।
ইউরোপে যারা এরূপ আয়ুধ তৈরি করত, তারাই হচ্ছে নিয়ানডারথাল মানুষ। এইজাতীয় মানুষের কঙ্কালাস্থির সঙ্গেই আমরা তাদের তৈরি আয়ুধসমূহ পেয়েছি। ভারতে কিন্তু সে-যুগের মানুষের কোন কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি। মাত্র তার নির্মিত আয়ুধসমূহই পেয়েছি। বস্তুত ভারতে প্রাচীন মানবের জীবাশ্ম পাওয়া না গেলেও, আমরা তার কৃষ্টির নিদর্শন বহুল পরিমাণে পেয়েছি এবং এখনও পাঁচ্ছি। সুতরাং আদিম মানব যে ভারতে বহুবিস্তৃতভাবে বাস করত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ওই যুগের নানা বর্গের আয়ুধ ও ব্যবহার্য বস্তুর নিদর্শন যেমন পশ্চিম ইউরোপে পাওয়া গিয়েছে, তেমনই বঙ্গদেশ, মাদ্রাজ, গোদাবরী, নর্মদা ও কৃষ্ণার অববাহিকায়, মধ্যভারতে, কর্ণাটকে, ছোটনাগপুরে, বিহারের কোন কোন স্থানে, আসাম, পঞ্জাব ও সীমান্তপ্রদেশে পাওয়া গিয়েছে। ওই যুগের আয়ুধসমূহকে প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ (palaeoliths) বলা হয়। ওর পরবর্তী নবোপলীয় যুগেরও আয়ুধ ভারতের নানা অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। তবে মাত্র নবোপলীয় (neolithic) ও তৎপরবর্তী তাম্রাশ্ম ও লৌহ যুগের (chalcolithic and megalithic ages) মানবেরই জীবাশ্ম আমরা ভারতে পেয়েছি। i
ভারতের যে-সব জায়গা থেকে এরূপ কঙ্কালাস্থি পাওয়া গিয়েছে, তার বিবরণ নীচে দেওয়া হচ্ছে : –
১. ১৯২৮-২৯ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত ৪১টি কঙ্কাল।
২. ১৯৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের হরপ্পায় প্রাপ্ত ২৬০টি কঙ্কাল।
৩. ১৯৩০-৩১ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের তক্ষশিলার ধর্মরাজিক মঠে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।
৪. ১৯৩৫-৩৬ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের চামু-ধারোয় প্রাপ্ত ১টি কঙ্কাল।
৫. ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর নিকট কুমহারটেকরিতে প্রাপ্ত ৪২টি কঙ্কাল।
৬. ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে তামিলনাডুর কোদাইকানালে প্রাপ্ত ৫টি সমাধিপাত্রপূর্ণ কঙ্কাল।
৭. ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের ব্রহ্মগিরিতে প্রাপ্ত ১৪টি কঙ্কাল।
৮. ১৯৫১-৫২ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের পিকলিহালে প্রাপ্ত ৩টি সম্পূর্ণ কঙ্কাল ও একটি চিবুকাস্থি।
৯, ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের মাসকীতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
১০. ১৯৫৪-৫৬ খ্রীস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের নেভাসায় প্রাপ্ত ৩০টি কঙ্কাল।
১১. ১৯৫৬-৬০ খ্রীস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুণ্ডের উপকণ্ঠে প্রাপ্ত ১৩টি নবোপলীয় যুগের কঙ্কাল ও ১৪টি মেগালিথিক যুগের সমাধি-কঙ্কাল।
১২. ১৯৫৪-৫৫ খ্রীস্টাব্দে পঞ্জাবের রূপারে প্রাপ্ত ২১টি কঙ্কাল।
১৩. ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে তামিলনাডুর অরিথমঙ্গলে প্রাপ্ত ১০টি সমাধিপাত্র পূর্ণ কঙ্কাল।
১৪. ১৯৫৭-৫৯ খ্রীস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বীতে প্রাপ্ত ৮টি পুরুষ ও ৪টি নারীর কঙ্কাল।
১৫. ১৯৫৮-৬০ খ্রীস্টাব্দে গুজরাটের লোথালে প্রাপ্ত ২১টি কঙ্কাল।
১৬. ১৯৫৮-৫৯ খ্রীস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুণ্ডের ঠিক বিপরীত দিকে কৃষ্ণা নদীর ওপর ইল্লেশ্বরমে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।
১৭. ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের নিকট চণ্ডোলি গ্রামে প্রাপ্ত ২৪টি কঙ্কাল।
১৮. ১৯৬২-৬৩ খ্রীস্টাব্দে রাজস্থানের কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত কয়েকটি কঙ্কাল।
১৯. ১৯৬৩-৬৪ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের টেক্কলকোটায় প্রাপ্ত ৯টি কঙ্কাল।
২০. ১৯৬৩-৬৫ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত ১৪টি সমাধি-কঙ্কাল।
২১. ১৯৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দে কাশ্মীরের শ্রীনগরে নবোপলীয় যুগের সমাধিতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
২২. ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
২৩. ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের রামগড়ের অদূরে সিজুয়ায় প্রাপ্ত প্রাক্-হরপ্পীয় যুগের জীবাশ্মীভূত এক ভগ্ন চোয়াল।
শেষোক্তটি সবচেয়ে প্রাচীন কঙ্কালাস্থি বলে মনে হয়। এ ছাড়া ‘মেগালিথিক’ যুগের ( প্রধানত লৌহযুগের ) যে-সকল সমাধিস্তৃপ আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলির উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে :
১. ১৮৯৯ থেকে ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে আলেকজাণ্ডার রিয়া ( Alexander Rea ) কর্তৃক আবিষ্কৃত তিনেভেলি জেলার আদিচানালুরের সমাধিসমূহ।
২. ১৯১৬ থেকে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ডক্টর হাণ্ট (E. H. Hunt) কর্তৃক আবিষ্কৃত হায়দারাবাদের পূর্বদিকে রায়গির ও ভঙ্গির সমাধিসমূহ।
৩. ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের পরে ব্রহ্মগিরিতে চিংগিলপুট জেলার সামুরিলে, ত্রিচুর জেলার পরকালামে, অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুও ও ইল্লেশ্বরমে, কর্ণাটকের মাসকিতে, মহীশূরের জদিগেহল্লি, ও পণ্ডিচেরিতে সৌটেইকেলি ও মাওস্তরপেলের সমাধিসমূহ।
উল্লিখিত এই কঙ্কালসমূহকে আমরা পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি—(১) নবোপলীয় যুগের, (২) হরপ্পা যুগের, (৩) দাক্ষিণাত্যের তাম্রাশ্ম যুগের, (৪) মেগালিথিক ( প্রধানত লৌহ ) যুগের ও (৫) আদি ঐতিহাসিক যুগের। তবে মেদিনীপুরের সিজুয়ায় প্রাপ্ত অশ্মীভূত চোয়ালটির বয়স ১০,০০০ বৎসর বলে দাবি করা হয়েছে। সেটা যদি যথার্থ হয়, তা হলে ওটি অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের।
কঙ্কালগুলির আবয়বিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করেছেন—(১) হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও লোথালের লোকেরা অধিকাংশই দীর্ঘশিরস্ক এবং বিস্তৃতনাসা ছিল, তবে মহেঞ্জোদারোর লোকদের নাক হরপ্পা-লোথালের লোকদের মত অত বিস্তৃত ছিল না। (২) হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকদের তুলনায় লোথালের লোকদের মাথা চওড়া ছিল। (৩) এইসকল পার্থক্য, যথা—মাথার খুলির আকার, নাকের গঠন, ও আকারের দিক থেকে বোঝা যায় তারা সকলে একই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (৪) তার দীর্ঘশিরস্ক, প্রশস্তনাসা ও আকারে লম্ব ছিল বটে, কিন্তু হরপ্পা যুগে গুজরাটে ও সিন্ধুপ্রদেশে এক বিস্তৃতশিরস্ক জাতিরও অস্তিত্ব ছিল। (৫) ব্রহ্মগিরি, নাগাজুনাকুণ্ড, পিকলিহাল, মাসক ও ইল্লেশ্বরম থেকে মেগালিথিক যুগের প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে মেগালিথ (সমাধিস্তুপের উপর স্মৃতিফলক ) নির্মাণকারীরা অধিকাংশই বিস্তৃতশিরস্ক, আকারে লম্বা ও দৃঢ়-দেহ বিশিষ্ট লোক ছিল। (৬) কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশের আদিচান্নালুরের ও দক্ষিণ ভারতের সমাধি-স্তৃপগুলিতে যে-সকল নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে,তারা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতিদীর্ঘশিরস্ক ছিল। (৭) উজ্জয়িনী, কৌশাম্বী ও তক্ষশিলা হতে প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে ওইসকল স্থানে দীর্ঘশিরঙ্ক জাতির লোকেরাই প্রথমে বাস করত, এবং পরে সেখানে এক বিস্তৃতশিরস্ক জাতির অনুপ্রবেশ ঘটে।
সুতরাং এইসকল সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, (১) নবোপলীয় যুগের লোকের দীর্ঘশিরস্ক ছিল। (২) হরপ্পা ও অন্যান্য তাম্রাশ্ম যুগের লোকেরা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতিদীর্ঘশিরস্ক ছিল। কিন্তু গুজরাট ও সিন্ধুপ্রদেশে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। (৩) মেগালিথিক যুগের লোকেরা বিস্তৃতশিরস্ক ছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিসমূহের আগমন পরে ঘটেছিল। এখানে বক্তব্য যে বাঙলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে তা দীর্ঘশিরস্ক। তারা যে ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর লোক, ত৷ ওখানে প্রাপ্ত ক্রীটদেশীয় এক সীলমোহর দ্বারা সমর্থিত হয়।
খুব বিপদসঙ্কুল ছিল প্রথম মানবের জীবন। একদিকে যেমন তাকে অতিকায় এবং হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হত, অপরদিকে তেমনই খাদ্য আহরণের জন্য তাকে পশুশিকারে বেরতে হত। এককথায় প্রাণের ও পেটের দায়ই ছিল তার সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাছাড়া কোন এক বিশেষ জায়গাতেও সে বহুদিন অবস্থান করতে পারত না। কেননা কোন এক জায়গায় পশুর সংখ্যা হাস পেলে তাকে অপর জায়গায় সরে যেতে হত। তার মানে তাকে যাযাবরের জীবন যাপন করতে হত। এভাবে জীবনের প্রথম অধ্যায়ে তাকে ৪৯০,০০০ বৎসর কাটাতে হয়েছিল। তার জীবনের এই প্রথম অধ্যায়টাকে আমরা প্রত্নোপলীয় (palaeolithic) যুগ বলি। কেননা এ যুগের মানুষ মাত্র পাথর দিয়েই তার আয়ুধ ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিস তৈরি করত। এই দীর্ঘকালের মধ্যে মানুষ কৃষির উদ্ভব ঘটাতে পারেনি এবং কোনরূপ ধাতুর ব্যবহারও জানত না। তবে এই সময়ের মধ্যে মানুষ পাথর দিয়ে তৈরি শিল্পের একটা ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছিল। এই ক্রমবিকাশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রত্নোপলীয় যুগকে তিনটি দশায় ভাগ করা হয় : (ক) early বা আদিম দশা, (খ) middle বা মধ্য দশা, ও (গ) late বা অন্তিম দশা। অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের অপর নাম mesolithic period বা সন্ধিকালের যুগ। সন্ধিকালের যুগ বলবার উদ্দেশ্য এই যে, এটাই ছিল প্রত্নোপলীয় (palaeolithic) নবোপলীয় (neolithic) যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন।
আগেই বলেছি যে ইউরোপে প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ চকমকি পাথর (flint) দিয়ে তৈরি করা হত ; আর ভারতে এগুলি তৈরি করা হত নদীর ধারে পাওয়া মুড়ি (pebbles) ও কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে। আদিম (early) প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ ছিল পাথরের কেন্দ্রগ আয়ুধ (core tools)। একটা মুড়িকে অপর একটা মুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করে, তা থেকে চাকলা তুলে পাথরের পিণ্ডট দিয়ে এগুলি তৈরি করা হত। এ-যুগের বৈশিষ্ট্যমূলক আয়ুধ ছিল হাত-কুঠার (hand-axes), মাংস কাটবার অস্ত্র (choppers), মাংস ছেদন করবার আয়ুধ (cleavers) ইত্যাদি। তবে মূল নুড়ি থেকে যে চাকলাগুলি বেরত, সেগুলিও কোন কোন ক্ষেত্রে ছুরি হিসাবে ব্যবহার করা হত। প্রত্নোপলীয় যুগের মধ্যম দশার বৈশিষ্ট্যমূলক আয়ুধগুলি পাথরের চাকলা দিয়েই তৈরি করা হত। এ যুগের মানুষরা এই শ্রেণীর আয়ুধ নির্মাণেই বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিল। মাংস চাচবার জন্য এইসকল আয়ুধ (scrapers) ব্যবহৃত হত। এরকম আয়ুধসমূহকে ‘flake tools’ বলা হয়। আগেকার যুগের আয়ুধসমূহও এ-যুগের মানুষ ব্যবহার করত, তবে সেগুলির নির্মাণরীতি আগেকার যুগের নির্মাণরীতি অপেক্ষা অনেক পরিমাণে উন্নত ধরনের ছিল। অস্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহকে ‘mesoliths’ বলা হয়। এগুলি নানা ধরনের অতি-ক্ষুদ্রকায় আয়ুধ। এ-যুগের মানুষ পর্বতগুহায় ও পাহাড়ের ছাউনির তলায় (rock-shelters) বাস করত। এবং পর্বতগাত্রে নানারকম চিত্রাঙ্কন করত। বোধহয়, এসকল চিত্রাঙ্কন ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হত। ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়াই ছিল আদিম মানুষের সর্বজনীন ধর্ম।
ভারতে প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রুস ফুট (Bruce Foote), কিংগ (King), ওল্ডহাম (Oldham) ও অন্যান্য অনেকে। সর্বপ্রথম প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দে মাদ্রাজের নিকটে পল্লবরম নামক জায়গায়। তারপর প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন জায়গায়, যথা— পাকিস্তানের রাওলপিণ্ডি জেলার সোহান নদীর তীরে ও ভারতে তামিলনাডু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের অনেক জায়গায়, ওড়িষার ময়ুরভঞ্জ জেলায়, বিপাশা ও বনগঙ্গা নদীর উপত্যকায়, কৃষ্ণা, সবরমতী, মহি, ওরসংগ ও নর্মদা নদীসমূহের উপত্যকায়, উত্তরপ্রদেশের রিহাংগ নদীর অববাহিকায় ও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে। বিলাসপুর, দৌলতপুর, দেহরা, গুলার ও নালাগড় প্রত্নোপলীয় যুগের সংস্কৃতির বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। গুলারে পাঁচটি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে উপরের চারটি স্তরে আয়ুধ পাওয়া গিয়েছে। এই সম্পর্কে কুরনুল জেলার বিল্লসুগম গুহাপুঞ্জের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এসকল গুহা থেকে অশ্মীভূত জীবাস্থি ও অস্থিনির্মিত আয়ুধ পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নোপলীয় যুগের কেন্দ্রসমূহে যে-সকল আয়ুধ পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে আছে হাতকুঠার, মাংস কাটবার যন্ত্র (choppers), চাচবার বা ঘষবার যন্ত্রফলক ইত্যাদি। অধিকাংশ আয়ুধই কোয়ার্টজাইট পাথরের তৈরি। যদিও প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ সম্বন্ধে বেশকিছু অনুশীলন হয়েছে, তবুও আমরা ভারতে প্রত্নোপলীয় যুগের মানবের কাহিনী সম্পূর্ণভাবে রচনা করতে সক্ষম হইনি। তবে বুঝতে পারা যায় যে প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষ নদীর ধারে বা নিকটে বাস করত, এবং পশুপক্ষী শিকার দ্বারা খাদ্য সংগ্ৰহ করত। মনে হয় যে, যারা নদীর ধারে বা সমুদ্রের উপকূলে বাস করত, তারা বোধহয় গোড়া থেকেই মাছ খেতে আরম্ভ করেছিল। আর যে-সকল পাহাড়ে ঝরনা থাকত, সে-সব পাহাড়ের গুহাতে ও পাহাড়ে ছাউনি তৈরি করেও তারা বাস করত।
মধ্য-প্রত্নোপলীয় যুগের ( middle palaeolithic period ) আয়ুধসমূহ পাওয়া গিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধুর উপশাখা সোহান নদীর চত্বরে*। উত্তরভারতে বিপাশা নদীর উপত্যকায়*, পূর্বভারতে আসাম*, বঙ্গদেশ* ও ওড়িশায়*, মধ্যভারতে নর্মদা নদীর উপত্যকায় অবস্থিত আদমগড় পাহাড়ে*, জব্বলপুর অঞ্চলে*, ভেরাঘাট*, বরসিমলায়*, পাণ্ডব জলপ্রপাতে ও বনগঙ্গা নদীর চত্বরে*। দাক্ষিণাত্যে ওই যুগের আয়ুধ পাওয়া গিয়েছে মহারাষ্ট্রের নেভাসায়*, বোম্বাইখাণ্ডিবলি অঞ্চলে*, নর্মদা নদীর উপত্যকায় অবস্থিত গুণ্ডিয়া ব্রহ্মেশ্বরমে*, মাদ্রাজের নিকট অন্তিরাপকমে*, তামিলনাডুর গুডিয়াম পর্বতের ছাউনিতে*, ও কৃষ্ণা সেতুতে। (তারকাচিহ্নিত জায়গাগুলিতে আদিম প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধও পাওয়া গিয়েছে )।
অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ পাওয়া গিয়েছে পূর্বভারতে দামোদর নদীর উপত্যকায় অবস্থিত বীরভনপুরে, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলায় ; মধ্যভারতে আদমগড় পাহাড়ে, জব্বলপুর-ভেরাঘাট অঞ্চলে, ও বরসিমলা প্রভৃতি অঞ্চলে, সিধপুর ও লেখানিয়ায়, মোদি পাহাড়ের ছাউনিতে, বরাকৈচায়, মোরহানা পাহাড়ে, জামবুদিপাদে, ও ডরোথি উীপ পাহাড়ের ছাউনিতে। এ যুগের আয়ুধ দাক্ষিণাত্যে পাওয়া গিয়েছে মহারাষ্ট্রের বোম্বাই-খাণ্ডিবলি অঞ্চলে, তামিলনাডুর অক্তিরাপক্কম ও গুডিয়াম গুহায়, কোণ্ডাপুরে, কৃষ্ণা সেতুতে, জলাহল্লি ও টেরি অঞ্চলে। অধিকাংশ স্থলেই এগুলি হচ্ছে ক্ষুদ্রাশ্ম অস্ত্র (microliths) এবং বিভিন্ন অঞ্চলে এগুলির নির্মাণে বিভিন্ন শৈলীরীতি অনুসৃত হত।
নবোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ আমরা বিশেষ করে পেয়েছি কাশ্মীরে বুরুঝহোমে ; মাত্রাজের তিরুনেলবেলি জেলায় ; সবরমতী নদীর উপত্যকায় ; মহারাষ্ট্রের খাণ্ডিবলি ও অন্যান্ত স্থানে ; গুজরাটে ; গোদাবরী নদীর নিম্ন-অববাহিকায় ; নর্মদা ও মহি নদীর উপত্যকায় ; মহীশূরের ব্রহ্মগিরিতে ; বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে।
নবোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ তৈরি করা হত গভীর রঙের আগ্নেয় শিলাখণ্ড দিয়ে। তাছাড়া, সেগুলোকে ঘর্ষণ করে (polishing) মসৃণ করা হত। এইসকল আয়ুধের মধ্যে আছে—কুঠার, বাটালি, পাথরের লাঠি, মন্থণকারী পাথর (polishing stones), হাতুড়ির মাথ৷ ইত্যাদি। নবোপলীয় যুগের সবচেয়ে প্রাচীন আয়ুধ ডক্টর এইচ. ডি. টেরা (Dr. H. De Terra) কাশ্মীরের বুরঝহোমে আবিষ্কার করেন। বারো ফুট মাটি খনন করে তিনি তিনটি সাংস্কৃতিক পর্যায়ের সন্ধান পান। সবচেয়ে উপরের স্তরের বয়স হচ্ছে খ্ৰীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী। তার তলার পর্যায় হচ্ছে হরপ্পা-উত্তর যুগের। আর সবচেয়ে নীচের স্তর হচ্ছে। নবোপলীয় যুগের। পরে বুরঝহোমে পুনরায় খনন করে জানতে পারা গিয়েছে যে, ওখানকার নবোপলীয় যুগের লোকেরা গর্তের মধ্যে বাস করত এবং গর্তে নামবার জন্য সিড়ি ব্যবহার করত। তারা প্রস্তরনির্মিত কুঠার, অস্থিনির্মিত আয়ুধসমূহ ও ধূসর রঙের মৃৎপাত্র ব্যবহার করত। নবোপলীয় যুগের আয়ুধ ও দ্রব্যসম্ভারসমূহ আরও যে-সব জায়গায় পাওয়া গিয়েছে, তার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের হামিরপুর, আলাহাবাদ ও বান্দা জেলা, লখনউ জেলার নাগওয়া ; মধ্যভারতের পাল্লা ; মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার গারহি, মরিলা ও বুলুতরাই প্রভৃতি জায়গা ; বিহারের হাজারিবাগ, পাটনা, সাওতাল পরগনা ও সিংতুম ; পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, দাৰ্জিলিং ও নদীয়া জেলা ; আসামের গারো ও নাগা পাহাড় এবং কাছাড়। জেলা ; অন্ধ্রপ্রদেশের রায়চুর ও ওয়ারাংগাল জেলা ; মহীশূরের বাঙ্গালোর ও চিতলদুর্গ জেলা ; তামিলনাডুর অনন্তপুর, বেলারি, চিংগলপেট, গুনটুর, উত্তর আর্কট, সালেম ও তাঞ্জোর জেলা। মনে হয়, মহীশূর ও অন্ধ্রপ্রদেশের নবোপলীয় যুগের লোকেরা পরে। কিছু কিছু তামার ব্যবহারও শিখেছিল। উপরের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে ভারতের বিস্তৃত ভূখণ্ডে প্রত্নোপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় ও পরে তাম্রাশ্ম যুগ পর্যন্ত সভ্যতার একটা ধারাবাহিকতা ছিল।
আগেই বলা হয়েছে যে অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষ হয় নদীর ধারে, আর তা নয়তো পাহাড়ের ওপরে বা পাহাড়ের ছাউনির মধ্যে মাটির ঘর তৈরি করে বাস করত। এসব জায়গায় কোন কোন স্থানে আয়ুধ-নির্মাণের কারখানাও পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সে-যুগের মানুষ সম্পূর্ণভাবে যাযাবরের জীবন যাপন করত না। তার মানে, এ যুগের মানুষ সমাজবদ্ধ হবার চেষ্টা করছিল। সেট বুঝতে পারা যায় কয়েক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে তাদের চিত্রাঙ্কন থেকে। এ চিত্রগুলি তারা খুব সম্ভবত ঐন্দ্রজালিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ধর্মেরও উন্মেষ ঘটছিল।
এই স্থায়ী বসতিস্থাপনের প্রবণতা নবোপলীয় যুগেই বিশেষভাবে প্রকটিত হয়। তারা পশুপালন ও কৃষির উপযোগী স্থানেই বসতিস্থাপন করত। কৃষির উদ্ভব কিভাবে ঘটেছিল, সেটা এখানে বলতে চাই। ভূমিকৰ্ষণের সূচনা করেছিল মেয়েরা। পশুশিকারে বেরিয়ে পুরুষের যখন ফিরতে দেরি হত, তখন মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্ত খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর তাদের ভাবনা-চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সস্তানউৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্ত অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে, পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি ( পরবর্তীকালে আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ক্ষেত্র বা “ভূমি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে ) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে। (Przyluski তাঁর ‘Non-Aryan Loans in Indo-Aryan’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’— এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন )। মেয়েরা এইভাবে ভূমি কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। তারা লক্ষ্য করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active | Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হল, সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গপূজা ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। ( অতুল সুর, হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৮১ দ্রঃ)। লিঙ্গপূজার সূচনা যে নবোপলীয় যুগেই হয়েছিল, সে-সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা পাওয়া যাবে আমার ‘বিগিনিংস অভ লিঙ্গ কালটু ইন ইণ্ডিয়া’ প্রবন্ধে (অ্যানালস অভ দি ভাণ্ডারকার ওরিয়েণ্টাল ইনষ্টিট্যুট, ১৯২৯)।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে নবোপলীয় যুগের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তাদের বয়স আজ পর্যন্ত নির্ণীত হয়নি। মাত্র ইদানীং কালে প্রাপ্ত যেগুলির রেডিয়ো-কারবন-১৪ পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলির তারিখ নীচে দেওয়া হল। ( সবই খ্ৰীস্টপূর্ব তারিখ)
১. কাশ্মীরের বুরজহোম — ২৪১৮-১৫৯৩
২. অন্ধ্রপ্রদেশের উটনুর — ২১৭০-১৯২৫
৩. কালিবঙ্গানের প্রাক্-হরপ্পীয় — ২১৪৫-১৬০০
৪. মহীশূরের টেকলকোটা — ২৬৭৫-১৪৪৫
৫. মহীশূরের নরশিপুর তালুক — ১৬৯৫-১৩৯৫
৬. মহীশূরের সঙ্গমকল্লু — ১৪৯০-১৪৫০
৭. মহীশূরের হুল্লুর — ১৬১০-
৮. মাদ্রাজের পৈয়ামপল্লী — ১৩৯০-
( মাত্র এই তারিখগুলি থেকে ভারতে নবোপলীয় কৃষ্টির প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সিদ্ধাস্ত করা ভুল হবে। )
কাশ্মীরের বুরজহোমের নবোপলীয় যুগের লোকেরা মাটির তলায় গুহাগৃহে বাস করত। গুহার প্রবেশদ্বারের নিকট রন্ধনের জন্য উজুন তৈরি করত। বৈষয়িক বস্তুর মধ্যে ধূসর ও কৃষ্ণবর্ণের পালিশ-করা মৃৎপাত্র, হাড়ের তৈরি স্বচাল স্থচ যন্ত্র, ও হারপুন, পাথরের তৈরি কুঠার, পাথরের তৈরি গোল বালা ও মাংস কাটবার ছুরি ও অস্ত্র পাওয়৷ গিয়েছে। তবে এখানে পাথরের তৈরি ছুরির ফলা ও জাতা-জাতীয় কোন পেষণ-যন্ত্র পাওয়া যায়নি। রেডিও-কার্বন-১৪ পরীক্ষা দ্বারা জানা গিয়েছে যে, এই কৃষ্টি খ্রীস্টপূর্ব ২৪১৮ অব্দ থেকে ১৫৯৩ অব্দ পর্যন্ত প্রাকুভূত ছিল। অন্তিমদশায় ধনুকে ব্যবহারের জন্য তামার তৈরি একটিমাত্র বাণমুখ পাওয়া গিয়েছে। এরা মৃতব্যক্তিকে ডিম্বাকার গর্তের মধ্যে কবর দিত এবং মৃতের সঙ্গে কুকুরকেও সমাধিস্থ করত।
দক্ষিণভারতে অনেককাল আগেই ব্রুস ফুট (R. Bruce Foote) কর্ণাটক অঞ্চলে কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় নবোপলীয় যুগের বহু কুঠার পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের পর স্যার মর্টিমার হুইলার (Sir Mortimer Wheeler ) ব্রহ্মগিরিতে খনন শুরু করবার পর থেকে সমনকল্প, পিকলিহাল, মাসকি, টেক্কলকোটা, হুলুর, উটমুর ও কুপগলে নবোপলীয় যুগের বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। উটমুর ও কুপগলে নবোপলীয় যুগের গরুর খাটালও পাওয়া গিয়েছে। এসকল স্থানে প্রাপ্ত বস্তুসমূহের রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছে (উপরে দেখুন )। সবচেয়ে পুরানো যে তারিখ পাওয়া গিয়েছে, তা হচ্ছে খ্রীস্টপূর্ব ২১৭০ অব্দ অন্ধ্রপ্রদেশের উটনুরে।
দক্ষিণভারতের নবোপলীয় যুগের কৃষ্টিসমূহকে তিনটি অবিচ্ছিন্ন অন্তর্দশায় বিভক্ত করা হয়। যারা সর্বপ্রথম বসতিস্থাপন করেছিল তারা গরু, ভেড়া ও ছাগল (তুলনা করুন বাংলা মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত লহনা-ফুল্লরার কাহিনী ) পালন করত। তাদের বৈষয়িক সম্পদের মধ্যে ছিল পাথরের তৈরি মন্থণ কুঠার ও ছুরির ফলা, ধূসর বা বাদামী রঙের হাতে-গড়া মৃৎপাত্র ইত্যাদি। তাদের তৈরি মৃৎপাত্রের সঙ্গে আমরি ও কালিবঙ্গানের প্রাক্-হরপ্পীয় মৃৎপাত্রের কিছু সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়। এদের বসতি ছিল পাহাড়ের ওপর বা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী মালভূমিতে এবং খাটালগুলি নিকটস্থ বনে অবস্থিত ছিল। পাহাড়ের গায়ে তারা চিত্রাঙ্কন করত ও পোড়ামাটির ককুদ-বিশিষ্ট বলীবর্দ প্রভৃতির মূতি তৈরি করত। তাদের মধ্যে জাতার ব্যবহার ছিল ; সুতরাং তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে তারা শস্য উৎপাদন করত। ধাতুর ব্যবহার তাদের মধ্যে মোটেই ছিল না।
দ্বিতীয় অন্তর্দশায় এই কৃষ্টির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে। এযুগে তার ছ্যাচাবেড়ার মাটির ঘর তৈরি করত। মাটির ঘরগুলি চক্রাকারে নির্মিত হত ! এ যুগে প্রস্তরনির্মিত শিল্পের বহুমুখী বিকাশ ঘটে। এদের তৈরি মৃৎপাত্রসমূহের সঙ্গে তামা ও ব্রোঞ্জে নির্মিত কয়েকটা টুকরা বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। রেডিয়ো-কারবন-১৪ পরীক্ষায় এ যুগের বয়স নির্ণীত হয়েছে খ্ৰীস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দ।
তৃতীয় যুগে প্রস্তরনিমিত কুঠার ও ছুরির ফলাশিল্পের অবিচ্ছিন্ন ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তামা ও ব্রোঞ্জ নিমিত বস্তু বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তামার বড়শিও পাওয়া গিয়েছে, এবং তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা মৎস্তভোজী ছিল। এ যুগে মৃৎপাত্রগুলি চক্রে নির্মিত হত এবং সেগুলি আগেকার যুগের মৃৎপাত্রের চেয়েও কঠিন করা হত। তবে মহীশূরের হলুরের লোকেরা ঘোড়া (?) ব্যবহার করত। এসব বস্তুর রেডিয়ে-কার্বন-১৪ পরীক্ষা বিশেষভাবে করা হয়নি। তবে মহারাষ্ট্রের জোরওয়ের কৃষ্টির ভিত্তিতে এর বয়স নিরূপিত হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব ১৪০ থেকে ১০৫০ অব্দ পর্যন্ত।
নবোপলীয় যুগের প্রাদুর্ভাব পূর্বভারতেও ছিল। এই সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত পণ্ডিতমহল মনে করতেন যে মধ্য-প্রাচীর জারমে, জেরিকো ও কাটাল হুয়ুক নামক স্থানসমূহেই নবোপলীয় সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটে, এবং তা বিকশিত হয়ে ক্রমশ ইরানীয় অধিত্যকা ও মধ্য-এশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পরবর্তী আবিষ্কারের ফলে জানা গিয়েছে যে, এরও আগে নবোপলীয় সভ্যতার প্রাতুর্ভাব ঘটেছিল থাইল্যাণ্ডে। এ সভ্যতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন রোনালড শিলার। সি. ও. সয়ারও তার ‘এগ্রিকালচারেল অরিজিনস অ্যাণ্ড ডিসপারসেল গ্রন্থে বলেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই নবোপলীয় বিপ্লবের প্রাচীন লীলাভূমি ছিল বলে মনে হয়। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ কারলটন এস. কুন তার ‘দি হিস্ট্রি অভ ম্যান’ বইয়ের ১৪৫ পৃষ্ঠায় নবোপলীয় সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ’-এর যে মানচিত্র দিয়েছেন, তাতেও তিনি নবোপলীয় সভ্যতার উৎপত্তি সম্বন্ধে পূর্ব-ভারতে এক স্বতন্ত্র উৎপত্তি-কেন্দ্র দেখিয়েছেন। কারলো চিপোলোও ( Cario Cipollo ) তার ‘দি ইকনমিক হিস্ট্রি অভ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে নানা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে ‘বঙ্গোপসাগরের আশপাশের মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ অঞ্চলেই স্বাধীনভাবে ভূমিকৰ্ষণ ও পশুপালনের সূচনা হয়েছিল। তবে পূর্বভারতে নবোপলীয় যুগের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তা উৎখননের ফলে পাওয়া যায়নি। সবই মাটির ওপর থেকে বা নদীর স্তরের মধ্য থেকে পাওয়া গিয়েছে। অধিকাংশই হচ্ছে নবোপলীয় যুগের রীতি অনুসারে নির্মিত পাথরের মন্থণ কুঠার। আসামের নানা স্থানে, গাঙ্গেয় উপত্যকায় মিরজাপুর ও বান্দা জেলায়, বিহারের সাওতাল পরগনায়, ওড়িষার ময়ুরভঞ্জে, ও বাঙলার বন-অসুরিয়া, কচিণ্ডা, জয়পাণ্ডা উপত্যক, অরগণ্ডী, কুকরাধুপি, তমলুক, শুশুনিয়া, তামাজুরি, চাতলা, আগাইবানি, হরিনারায়ণপুর প্রভৃতি স্থান থেকেও এরূপ কুঠার পাওয়া গিয়েছে।
নবোপলায় যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয় এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করে। এ যুগের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। তবে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের মানুষের মত তারা ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিত ও মৃতব্যক্তির সমাধির ওপর একখানা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত। এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত পাথর আমরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলায় লক্ষ্য করি। সেগুলিকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়।
এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক আমরা পশ্চিমবঙ্গের যেসব জায়গায় পেয়েছি, তার একটা বিবরণ দিচ্ছি। বাঁকুড়া শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে ছাতনায় এক পুকুরের কাছে এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত স্মৃতিফলক আমরা দেখতে পাই ; এগুলি চার-পাঁচ ফুট উচু এবং এগুলির গায়ে অপরিণত শৈলীর ক্ষোদিত মূর্তি আছে। এগুলি সম্বন্ধে নানারূপ জনশ্রুতি বিদ্যমান। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যে-সকল সাহসী বীর সৈনিক যুদ্ধে নিহত হতেন, এগুলি তাদেরই সমাধির ওপর প্রোথিত। মেদিনীপুরের কিয়ারার্চাদ গ্রামেও এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত বহু প্রস্তরফলক দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির বর্ণনায় বলা হয়েছে–‘Rounded at the top, they seemed to have been deliberately chiselled and stand on the open field as rigid and uncommunicative sentinels which they certainly are, continuing to baffle his torians as to how they originated.’
এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক বাঁকুড়া জেলার ছাতনার ফু-মাইল দূরে মৌলবনায় ও হুগলি জেলাতেও পাওয়া গিয়েছে। হুগলি জেলাতে এগুলিকে ‘বীরকাড়’ বলা হয়। মনে হয়, এগুলি অনু-অস্ট্রেলীয় বা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতির অবদান। কেননা, দক্ষিণ ভারতের আদিবাসীদের মধ্যেও আমরা এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক দেখি। নীলগিরি পাহাড়ের অধিবাসী কুডুম্বা উপজাতির লোকেরা এরূপ প্রস্তরফলককে বীরকন্তু নামে অভিহিত করে ও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কুডুম্বা ও ইরুল উপজাতিদের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে বীরপুরুষের স্মৃতিফলক। এককথায়, এগুলি হচ্ছে সমাধির ওপর স্মৃতিফলক। সমাধির ওপর এরূপ স্মৃতিফলক ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ড জাতির গ্রামেও ডালটন ( Dalton ) দেখেছিলেন। নীলগিরি পাহাড়ের কুডুম্বাদের মত ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ডারাও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ছোটনাগপুরের খেরিয়া উপজাতির মধ্যে প্রচলিত এরূপ স্মৃতিফলক সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
‘Besides the grave-stones, monumental stones are set up outside the village to the memory of men of note. The Kherias have collections of these monuments in the little enclosure round their houses and libations are constantly made to them’. মনে হয়, বাঙলাদেশে মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে ‘বৃষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলি এরূপ প্রস্তরফলকেরই কাষ্ঠনির্মিত উত্তর-সংস্করণ। (A. K. Sur, “History & Culture of Bengal’ (1963), pages 20-21, ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮ দ্রঃ)।
বস্তুত নবোপলীয় যুগের অনেক কিছুই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধরে রেখেছি ; যথা—ধাম, চুবড়ি, কুলা, ঝাপি, বাটনা বাটবার শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য জাতা ইত্যাদি। তা ছাড়া, বর্তমান শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ( জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতেও সেই প্রথা ছিল) আমরা আমাদের গৃহস্থালিতে পাথরের থালা, গেলাস, বাটি ইত্যাদি ব্যবহার করতাম। এগুলি সবই নবোপলীয় যুগের ‘টেকনোলজি অনুযায়ী, যদিও লৌহনির্মিত যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি হত।
প্রত্নোপলীয় যুগের যে-সব আয়ুধ ভারতে পাওয়া গিয়েছে তার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলির সঙ্গে একদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ও অপরদিকে জাভায় প্রাপ্ত আয়ুধসমূহের অসাধারণ মিল আছে। এছাড়া, ভারতে যে flake tools শিল্প গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে চীন ও ব্রহ্মদেশের flake tools শিল্পেরও সাদৃশ্য আছে। নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি সম্বন্ধেও ওই একই কথা বলা চলে। তবে নবোপলীয় যুগে পূর্ব-ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। ( ‘দি গেজেটিয়ার অভ ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন’, প্রথম খণ্ড দ্রঃ)। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে ভারতের প্রস্তর যুগের কৃষ্টি যে মাত্র দেশজ ছিল, তা নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার বিস্তারলাভ ঘটেছিল। তা ছাড়া, ভারতের যে-সব জায়গায় খননকার্য চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক জায়গাতেই নবোপলীয় যুগের পরেই তাম্রাশ্ম যুগের অভু্যত্থান লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ, নেভাসা, সোনাগাওন প্রভৃতি ও বাঙলাদেশের পাণ্ডুরাজার ঢিবি, মহিষদল প্রভৃতি। সুতরাং ভারতে তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা যে দেশজ সভ্যতা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ভারতের তাম্রাশ্ম সভ্যতাকে আমরা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ বা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামে অভিহিত করি। ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো নামক স্থানে এক ঢিবি উৎখনন করে ভারতের এই লুপ্ত সভ্যতা আবিষ্কার করেন। এই সভ্যতার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে। ওই বৎসর ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষা অধিকরণের সর্বময় কর্তা স্যার জন মারশাল আমাকে নিয়োগ করেন ‘হিন্দু সভ্যতার গঠনে সিন্ধু সভ্যতার অবদান’ সম্বন্ধে গবেষণা করবার জন্য। ওই গবেষণার কাজ দু’পর্যায়ে সমাপ্ত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে মহেঞ্জে দারোয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতায়। প্রথম পর্যায়ে আমি যখন মহেঞ্জোদারোতে সরেজমিনে গবেষণা চালাচ্ছি, তখন এক বাঙালী-বিদ্বেষী অফিসারের হাতে নিপীড়িত হবার ভয়ে আমাকে কলকাতাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে-কথাটা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেণ্ট ডঃ সৰ্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ও সেনেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কানে যায়, তখন তাঁরা আমাকে বৈতনিক গবেষক নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ওই অনুশীলন চালিয়ে যেতে বলেন। দু’বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে আমি এই তথ্য উপস্থাপন করলাম যে হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারো-আনা ভাগ আছে সিন্ধু উপত্যকার প্রাক্-আর্য সভ্যতা ; আর মাত্র চার-আনা ভাগ মণ্ডিত আর্য সভ্যতার আবরণে। আমার গবেষণালব্ধ তথ্যসমূহ আমি স্যার জন মারশালের কাছে পাঠাতাম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশদ প্রতিবেদন পেশ করতাম। আমার সতীর্থ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন, তখন তিনি আমার গবেষণা-সম্পকিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিছু অংশ “ইণ্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়াটারলি’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এগুলি পুস্তকা কারে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডঃ দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ইণ্ডিয়ান কালচারেল কনফারেনসে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণে ( পৃষ্ঠা ১০ ) বলেন–‘হিন্দু সভ্যতা যে আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভূত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তারা হচ্ছেন স্যার জন মারশাল, রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ, ডঃ স্টেল ক্রামরিশ ও শ্রীঅতুলকৃষ্ণ সুর।’
তারপর অনেক বছর কেটে গেল। ভারতের ইতিহাসের ওপর প্রাক-বৈদিক সভ্যতার প্রভাব যে কতখানি, তা আমাদের ঐতিহাসিকরা বুঝলেন না। গতানুগতিকভাবে ভারতের ইতিহাস রচনা করে যেতে লাগলেন, মাত্র বৈদিক যুগের আগে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটা অধ্যায় যোগ করে দিয়ে।
আমি যখন মহেঞ্জোদারোয় যাই, তখন নগরীর যে অঞ্চলে খননকার্য চলছিল, তার নামকরণ করা হয়েছিল : DK Area–Intermediate III period | মহেঞ্জোদারোর প্রশস্ত রাজপথ ও সমান্তরাল রাস্তাগুলি তখনই আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রশস্ত রাজপথটি উত্তর-দক্ষিণমুখী। রাজপথটি তখন মাত্র এক কিলোমিটার পর্যন্ত খুঁড়ে বের করা হয়েছিল। এই পথটি ৩১ থেকে ৩৬ ফুট প্রশস্ত, আর সমান্তরাল পথগুলি ২০ থেকে ২৫ ফুট। সে বৎসর আরও আবিষ্কৃত হয়েছিল নগরীর পয়ঃপ্রণালী। পোড়া ইট দিয়ে তৈরি এই পয়ঃপ্রণালী অনেকটা পথ রাস্তার পশ্চিম ধার দিয়ে এসে, একজায়গায় রাস্তা অতিক্রম করে, রাস্তার পূর্বপাশ ধরে চলে গিয়েছিল। বাড়ির দূষিত জল এই পয়ঃপ্রণালীতে এসে পড়ত, তবে অনেক বাড়িতে ‘সোক্পিট’ও ছিল। প্রতি বাড়ির প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়ত বাড়ির প্রাঙ্গণ। প্রবেশপথের নিকট প্রাঙ্গণের একপাশে থাকত বাড়ির কূপ। স্নানের সময় আবরু রক্ষার জন্য কূপগুলিকে দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত করা হত। রাজপথের দিকে বাড়ির যে দোকান-ঘরগুলি ছিল, তার অনেকগুলির সামনে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম ইটের গাথা পাটাতন। বোধ হয় পাটাতনগুলির ওপর বিক্রেতার দিনের বেলা তাদের পণ্যসম্ভার সাজিয়ে রাখত, এবং রাত্রিকালে সেগুলিকে দোকান-ঘরে তুলে রাখত। ছোট ছোট যে-সব দ্রব্যসামগ্ৰী আমরা সে-বৎসর পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল মেয়েদের মাথার কাটা। তা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম যে, মেয়ের খোপায় কাটা গুজত। তারা যে বেণী ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত, তার প্রমাণও আমরা পেয়েছিলাম।
ব্যাপকভাবে খননকার্যের ফলে এখন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার আরও অনেক কেন্দ্র খুঁজে বের করা হয়েছে। এর ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে এই সভ্যতার বিকাশ পনেরো লক্ষ বর্গ মাইল ব্যাপী এক বিস্তৃত এলাকায় ঘটেছিল। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে দেশ-বিভাগের পর এইসকল কেন্দ্রের কিছু পাকিস্তানে ও কিছু ভারতের মধ্যে পড়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যে-সব কেন্দ্র ভারতের মধ্যে পড়েছে সেগুলি হচ্ছে—কালিবঙ্গান, লোথাল, রূপার, চণ্ডীগড়, স্বরকোটড়া, দেশলপুর, নবিনাল, রঙপুর, ভগৎরাও, মাও, বরা, বরগাওন, বাহাদারাবাদ, শিশওয়াল, মিটাথাল, আলমগিরপুর, কায়াথা, গিলাণ্ড, টড়িও, দ্বারকা, কিনডারখেদ, প্রভাস, মাটিয়ালা, মোটা, রোজড়ি, আমরাফল, জেকডা, সুজনপুর, কানাস্থতারিয়া, মেহগাওন, কাপড়খেদা ও সবলদা। এ ছাড়া তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি—লালকিলা, নোয়া, মানাটি, দৈমাবাদ, মহিষদল, বাণেশ্বরডাঙ্গা, পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রভৃতি স্থান থেকেও। ১৯২৯-৩১ খ্রীস্টাব্দে আমি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতনিক গবেষক হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে অনুশীলন করছিলাম, তখন আমার প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলেছিলাম—‘এ সম্পর্কে বুকি নিয়ে এ-কথা বলা যেতে পারে যে, পরবর্তীকালে অনুরূপ সভ্যতার নিদর্শন গঙ্গা উপত্যকতেও পাওয়া যেতে পারে, যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে এ-সভ্যতা উত্তর ও প্রাচ্য ভারতেও বিস্তারলাভ করেছিল।’ আজ খননকার্যের ফলে আমার সে অনুমান বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
এরূপ অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, সিন্ধু সভাত আর্য সভ্যতার হ্যায় আগন্তক সভ্যতা ছিল না। এ সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ভারতেই ঘটেছিল। মূলগতভাবে সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা (chalcolithic civilization)। তার মানে, প্রস্তর যুগের শেষে এই সভ্যতার ধারকদের মধ্যে তামার ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিল। অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার সঙ্গে প্রস্তর যুগ পর্যন্ত স্তরবিন্যাস আমরা হরপ্পায় পাই। প্রস্তর যুগের যে স্তর থেকে তাম্রাশ্ম যুগের উদ্ভব হয়েছিল, তাকে আমরা নবোপলীয় যুগের (neolithic) সভ্যতা বলি। এই নবোপলীয় যুগের মানুষই প্রথম ভূমিকৰ্ষণ ও স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করে। তা ছাড়া, নবোপলীয় যুগের মানুষরা পশুপালন করত, মৃৎপাত্র তৈরি করত, বস্ত্রবয়ন করত ও নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য যে-সকল আয়ুধ বা যন্ত্রাদি ব্যবহার করত, সেগুলিকে বেশ মসৃণ বা ‘পালিশ করত। বস্তুত নবোপলীয় যুগেই প্রথম সভ্যতার সূচনা হয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পাবে, হরপ্পা সভ্যতা যদি প্রাক্-হরপ্পীয় যুগের নবোপলীয় সভ্যতারই স্বাভাবিক পরিণতি হয়, তাহলে নবোপলীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল কোথায় ? আমি আগেই বলেছি যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পণ্ডিতমহলে এ-সম্বন্ধে বিভ্রান্তি ছিল। প্যালেস্টাইনের ‘ডেড সী’ উপত্যকায় জেরিকো নামক স্থানে একটি প্রাচীন নবোপলীয় গ্রাম আবিষ্কৃত হয়েছিল। রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষায় এর বয়স নিণীত হয় খ্রীস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ। সেখানে নবোপলীয় ও প্রত্নোপলীয় যুগদ্ধয়ের সন্ধিক্ষণের (mesolithic) দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। এই সন্ধিযুগের বয়স প্রায় ৮০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ। সুতরাং এ থেকে অনুমান করা হত যে খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম সহস্ৰকে জেরিকোতেই নবোপলীয় যুগের সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। ইরাকের জারমো ও ইরানের টোপ সবাব নামক স্থানদ্বয় থেকেও খ্রীস্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৬৫০০ অব্দের মধ্যেকার ছ’টি নবোপলীয় যুগের গ্রামের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তি থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে, নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি নিকটপ্রাচীতেই উদ্ভূত হয়ে জগতের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের খনন এবং রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, মধ্য-প্রাচীর নবোপলীয় কৃষ্টির সমসাময়িক কালেই বা তার কিছু আগে নবোপলীয় গ্রাম থাইল্যাণ্ডেও ছিল। আরও জানতে পারা গিয়েছে যে, নিকট-প্রাচীর নবোপলীয় মানুষদের আগেই জাপানের আদিম অধিবাসীরা মৃৎপাত্র তৈরি করতে জানত। এখন এটা একরকম প্রায় স্বীকৃতই হয়ে গিয়েছে যে নবোপলীয় যুগের কৃষ্টি জগতের একাধিক স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল। ভারতে আমরা প্রত্নোপলীয় ও নবোপলীয় এই উভয় যুগের বহু কৃষ্টি-কেন্দ্র আবিষ্কার করেছি। সুতরাং ভারতের তাম্রাশ্ম যুগের কৃষ্টি যে দেশজ নবোপলীয় ও প্রত্নোপলীয় যুগের কৃষ্টি থেকে উদ্ভূত, সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।
১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে আমি আমার ‘প্রি-হিস্ট্রি অ্যাণ্ড বিগিনিংস অভ_ সিভিলিজেশন’ পুস্তকে বলেছিলাম—‘মিশর, ক্রীট, সুমের, এশিয়া মাইনর, সিন্ধু উপত্যকা ও অন্যত্র যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, খুব সম্ভবত সে-সভ্যতার আদি জন্মস্থান পূর্বভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গের সামুদ্রিক বণিকরাই তার বীজ ও মাতৃকাদেবীর উপাসনা পৃথিবীর দূরদেশসমূহে নিয়ে গিয়েছিল। কেননা, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় ঘটেছিল যেখানে প্রচুর পরিমাণে তামা পাওয়া যেত। ধলভূমে ভারতের অন্যতম বিরাট তাম্রখনির বিদ্যমানত ও প্রাচীন বাঙলার প্রধান বন্দরের নাম ‘তাম্রলিপ্তি’, আমার সেই মতবাদকেই সমর্থন করে।
যেহেতু তাম্রাশ্ম সভ্যতাই প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সেহেতু এটা মনে করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গই সভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত এই বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তাম্রাশ্ম যুগের পূর্বে যে-সব কৃষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল,যথা নবোপলীয়, মধ্যপলীয়, প্রত্নোপলীয় ইত্যাদি, এগুলির অস্তিত্ব আমরা পশ্চিমবঙ্গের নানাস্থানে, যেমন—বীরভূমের মালতি, পিতনউ, সুবর্ণরেখার অববাহিকা, কংসাবতী ও ময়ূরাক্ষী নদীর উপত্যক, ঝাড়গ্রামে দুলুর নদীর ধারে, বনকাটি প্রভৃতি স্থানে পেয়েছি।
তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ওই সভ্যতার ধারকদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে খাদ্য-উৎপাদনের স্বয়ম্ভরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আগেকার যুগের মানুষের মত তাদের শিকার, ফলমূল ও মৎস্য আহরণের অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করতে হত না। অবশু, নবোপলীয় যুগের অভু্যত্থানের পর থেকেই এই অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে গিয়েছিল, কিন্তু তাম্রাশ্ম যুগে এই অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চয়তার পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছিল। এ যুগের লোকেরা নগর-নির্মাণ করতে জানত এবং নগরেই বাস করত। এ যুগের নগরগুলি ( যেমন হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি) গ্রামীণ কৃষিজাত ফসলসমূহ গোলাজাত করত এবং গোলাজাত শস্য নগরবাসৗদিগকে খাদ্য-উৎপাদনের সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে তাদের শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিযুক্ত করাতে সক্ষম হত।
সুসভ্য সমৃদ্ধিশালী সভ্যতার যে-সকল লক্ষণ, তার সবই আমরা সিন্ধু সভ্যতার নগরসমূহে লক্ষ্য করি। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রেগরি পসেল বলেন যে চীন, সুমের ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতাসমূহের তুলনায় সিন্ধু সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। কেননা, সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহেই আমরা জগতের প্রাচীনতম পয়ঃপ্রণালী ও পোতাশ্রয় আবিষ্কার করেছি। নগরগুলির রাস্তাঘাট বেশ সুপরিকল্পিত ছিল। ঘরবাড়ি দগ্ধ-অদগ্ধ ইট ও পাথর দ্বারা নির্মিত হত। নগরের মধ্যে ছিল সুদৃঢ় উচ্চ প্রাকার-বিশিষ্ট দুর্গ, শস্যাগার, দেবালয় ও সমাধিস্থান। এককথায়, সংবদ্ধভাবে নাগরিক জীবন যাপনের সব লক্ষণ এই সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে উপস্থিত ছিল। শৃঙ্খলাযুক্ত শাসনব্যবস্থাও ছিল। দৈনন্দিন জীবনে অস্ত্রশস্ত্র ও গৃহসামগ্ৰী নির্মাণে তামা ও ব্রোঞ্জের বহুল ব্যবহার ছিল। পরিবহণের জন্য চক্রবিশিষ্ট যান ছিল। ভাষার রূপদানের জন্য লিখন-প্রণালীরও ব্যাপক ব্যবহার ছিল। তার মানে, সমাজে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল ও তার জন্য শিক্ষায়তনও ছিল। নগরগুলির নির্মাণরীতি ও বিন্যাসের ঐক্য দেখে মনে হয় যে, বাস্তু বা, স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কিত কোন সাধারণ শাস্ত্র ছিল, যার নির্দেশ, অনুযায়ীই নগরগুলি নির্মিত হত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের যে পাটীগণিত, দশমিক গণন ও জ্যামিতির বিশেষরকম জ্ঞান ছিল তার বহুল নিদর্শন আমরা পেয়েছি। ধাতুবিদ্যাতেও তাদের অসাধারণ পারদর্শিত ছিল (অতুল স্থর, ‘সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও অবদান’ দ্রঃ)।
অনেকেই বলেন যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য সভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্রান্ত মত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই তুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পার যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি নীচে দেওয়া হল :
১. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল ও মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দ করত। আর্যর পুরুষ-দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না।
২. আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে, ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (fossilized ) অস্থি আমরা সিন্ধু সভ্যতার কোনও কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা সীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবদের প্রতিকৃতি ক্ষোদন থেকে বুঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবদের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
৩. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধবংস করত। সেজন্য তারা তাদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের নাম পুরন্দর রেখেছিল।
৪. আর্যরা মৃতব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
৫. আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন-প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
৬. সিন্ধু সভ্যতা যে আর্য সভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পাঞ্চাল দেশ অর্থাৎ যেখানে আর্য সভ্যতা বিস্তারলাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে যে-সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলির রঙ ‘কালো-লাল’।
৭. সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যর প্রথমে কৃষিকার্য জানত না। এটা আমরা শতপথব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি। ( এ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য )
৮. সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সুপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নূতন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুত হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকাপ্য নামে এক মুনিই প্রথম পোষ মানিয়েছিলেন।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, আর্য সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা এক নয়।
গোড়ার দিকে আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের সঙ্গে তুমুল সংগ্রাম চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই গোড়ার দিকের বৈরিত পরবর্তীকালে আর স্থায়ী হয়নি। পঞ্চনদ থেকে তারা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হল, ততই তারা এদেশের লোকের সংস্পর্শে এল। তারা এদেশের মেয়েদেরও বিয়ে করল। যখন অনার্য রমণী গৃহিণী হল, তখন আর্যদের ধর্মকর্মের ওপর তার প্রতিঘাত পড়ল। ক্রমশ তারা বৈদিক যজ্ঞাদি ও বৈদিক দেবতাগণকে পশ্চাদভূমিতে অপসারণ করল। আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণে পৌরাণিক দেবতামণ্ডলীর সৃষ্টি হল।
আর্য ও অনার্য সভ্যতার সংশ্লেষ ঘটেছিল সেখানে, যেটাকে আগে আমরা ‘কুরু-পঞ্চাল’ দেশ বলতাম যা গঙ্গা ও যমুনার অন্তর্বর্তী অঞ্চল। সেখানে আর্যদের আপস করতে হয়েছিল অনার্যদের ভাষা, সভ্যতা ও লোকযাত্রার সঙ্গে। এটা বিবর্তনের ক্রমিক ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণতালাভ করেছিল পৌরাণিক যুগে। এই সংশ্লেষণের পর আমরা ভারতীয় সভ্যতার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখি, যা বৈদিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। লোকে আর ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্তুতিগান করে না ; বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদন করে না। নূতন দেবতামণ্ডলীর পত্তন ঘটে। যজ্ঞের পরিবর্তে আসে পূজা ও উপাসনা। বৈদিক আত্মকেন্দ্রিক স্তুতিগানের পরিবর্তে আসে ভক্তি। এর ওপর প্রাগার্য তান্ত্রিক ধর্মেরও প্রভাব পড়ে। বৈদিক যুগের আর্যরা যাদের ঘৃণার চক্ষে দেখতেন ও যাদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতেন, শেষ পর্যন্ত সেই অনার্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহেরই জয় হল। বেদ সংকলন ও মহাভারত-পুরাণ ইত্যাদি রচনার ভার ন্যস্ত হল এক অনার্য রমণীর জারজ সন্তানের ওপর !
তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার অভ্যুদয়ে তাম-ই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মিশর, সুমের, সিন্ধু উপত্যকা সর্বত্রই আমরা সভ্যতার প্রথম প্রভাতে তামার ব্যবহার দেখি। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় হয়েছিল, যেখানে তাম প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানে-সেখানে অবশ্য তামা সামান্য কিছু কিছু পাওয়া যেত, কিন্তু তা নগণ্য। বাঙলাই ছিল সে-যুগের তামার প্রধান আড়ত। তামার বৃহত্তম খনি ছিল বাঙলাদেশে। বাঙলার বণিকরাই ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ পার হয়ে, ওই তামা নিয়ে যেত সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রসমূহে বিপণনের জন্য। এজন্তই বাঙলার সবচেয়ে বড় বন্দরের নাম ছিল ‘তাম্রলিপ্তি’। এই তাম সংগৃহীত হত ধলভূমে অবস্থিত তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম তাম্রখনি থেকে।
বাঙলায় যে এক বিশাল তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটেছিল, তা আমরা খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে জানতে পারি। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার অন্তর্গত আগাইবানিতে ৪০ ফুট গভীর মাটির তলা থেকে আমরা পেয়েছি তামার একখানা সম্পূর্ণ পরশু ও অপর একখানা প্রমাণ-আকারের পরশুর ভাঙা মাথা, ছোট আকারের আর একখানা পরশু, এগারোখানা তামার বালা এবং খনকতক ক্ষুদ্রকায় তামার চাঙারি। পুরাতাত্ত্বিক দেবকুমার চক্রবর্তীর মতে, এগুলি হরপ্পার পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক কোন মানবগোষ্ঠীর। ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুরের বিনপুর থানার অন্তর্গত তামাজুড়ি গ্রামে তাম্রপ্রস্তর যুগের অনুরূপ নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে ওই জেলারই এগরা থান৷র চাতলা গ্রামে ওই ধরনের আরও কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দে পাশ্ববর্তী জেলা পুরুলিয়ার কুলগড়া থানার হাড়া গ্রামেও কিছু কিছু ওই ধরনের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনুরূপ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার পাণ্ডিগায়েও পাওয়া গিয়েছিল। তার অন্তর্ভুক্ত ছিল আগাইবানির ধরনের ৪৭টি তামার বালা ও পরশু। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান ( migration ) পূর্বদিক থেকে পশ্চিমদিকে ঘটেছিল।
বাঙলায় তাম্রাশ্ম সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে। অজয়, কুন্নুর ও কোপাই নদীর উপত্যকার অন্যত্রও আমরা এই সভ্যতার পরিচয় পাই। পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগের লোকরাই তাম্রাশ্ম সভ্যতার ধারক ছিল। তারা সুপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরি করত। তারা গৃহ ও দুর্গ—এই উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। কৃষি ও বৈদেশিক বাণিজ্য তাদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তারা ধান্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কুলালের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তারা মৃতব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং মাতৃকাদেবীর পূজা করত।
এ-সব নিদর্শন থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সুদূর অতীতে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বর্ধমান-মেদিনীপুর অঞ্চল জুড়ে এক সমৃদ্ধিশালী তাম্রাশ্ম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে আমরা সেই লুপ্ত সভ্যতার মাত্র সামান্ত কিছু আভাস পাই। আজ যদি আমরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি স্থানের ন্যায় বাঙলায় প্রণালীবদ্ধভাবে রীতিমত খননকার্য চালাই, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই জানতে পারব যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ বাঙলাদেশেই ঘটেছিল এবং বাঙলাদেশই সভ্যতার জন্মভূমি ছিল।
বাঙলাই যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার জন্মভূমি, তার সপক্ষে আরও অনেক প্রমাণ আছে। শুধু তাই নয়। আজও বাঙালী তাম্রাশ্ম যুগের অনেক কিছু দ্রব্য ব্যবহার করে। প্রথমে, রক্ষণশীল পরিবারের ঠাকুরঘরের কথা ধরা যাক। এ-সব পরিবারের পরিবেশ আগেও যা ছিল, এখনও তাই আছে। যুগ যুগ ধরে এ-সব পরিবারের ঠাকুরঘরের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। এ-সব পরিবারের ঠাকুরঘরে ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যাবে যে ঠাকুরঘরের সব বাসন-কোসন পাথর ও তামা দিয়ে তৈরি ; যথা,— পাথরের থালা-বাটি-গেলাস, তামার কোষাকুষি ইত্যাদি। এগুলো বাঙ্গালী তাম্রাশ্ম যুগ থেকে একনাগাড়ে ব্যবহার করে আসছে। কেননা তামার কোষাকুযি আমরা মহিষদল থেকেও পেয়েছি। মহিষদলের যে স্তর থেকে আমরা ওই কোষাকুষি পেয়েছি, তা তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার। আগেই বলেছি যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান (migration) পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঘটেছিল। সম্প্রতি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক গ্রেগরী পয়সেলও বলেছেন যে ভারতের তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভুত্থানের মূলে ছিল তামার ব্যবহার। বাঙালীরাই সেই তামা তাম্রাশ্ম সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে নিয়ে যেত। বাঙালীরা যে সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে উপস্থিত ছিল, তার প্রমাণ আমরা পাঁচটি সূত্র থেকে পাই—(১) মাতৃদেবীর উপাসনা, (২) মৎস্যভক্ষণ, (৩) হস্তীর সহিত পরিচয়, (৪) ধান্যের ব্যবহার এবং (৫) শিব ও শিবলিঙ্গের আরাধনা ৷
মৎস্যভক্ষণ বাঙালীরই বৈশিষ্ট্য। মহেঞ্জোদারোতে যে বড়শি পাওয়া গিয়েছে তা থেকে স্বতই প্রমাণিত হয় যে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এমন এক শ্রেণী ছিল যারা মৎস্য ভক্ষণ করত। মহেঞ্জোদারোতে আমরা হস্তীর প্রতিকৃতি পেয়েছি। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী হস্তী প্রাচ্যভারতের পালকাপ্য মুনি কর্তৃক পালিত জন্তু। তিনিই প্রথম হস্তীকে বশ করেন ও হস্তীবিদ্যা সম্বন্ধে একখান গ্রন্থ রচনা করেন। বাঙলাদেশই হাতির আদিম নিবাস। মহেঞ্জোদারোতে হাতির উপস্থিতি বাঙলাদেশের সঙ্গে ওই সভ্যতার সম্পর্ক সূচিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মহেঞ্জোদারোর সৗলসমূহে উৎকীর্ণ হাতির প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার উৎকীর্ণ পাঞ্চ-মার্ক মুদ্রায় প্রদর্শিত হাতির বিশেষ মিল আছে।
বাঙলার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্ঠতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে লোথালে ধান্যের ব্যবহার। চাউল বাঙালীর প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ধান্যের চাষ ষে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল, এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে কোন দ্বিমত নেই। কারলো চিপোলো তাঁর ‘দি ইকনমিক হিস্টরি অভ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে এই মতই প্রকাশ করেছেন এবং বাঙলাদেশকে নির্দেশ করেছেন।
মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভূতি নগরে মাতৃদেবীর পূজার যে ব্যাপক প্রচলন ছিল তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূৰ্তিসমূহ থেকে প্রকাশ পায়। বাঙলাই মাতৃদেবীর পুজার লীলাকেন্দ্র। আগেই বলেছি যে, মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব নবোপলীয় যুগে কৃষির সূচনার সঙ্গে ঘটেছিল। বাঙলায় নবোপলীয় বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ধান্যের চাষ নিয়ে। মনে হয়, ধান্যের চাষের সঙ্গে মাতৃদেবীর পূজা বাঙলাতেই গুরু হয়েছিল। ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীপূজার অপর নাম খন্দপূজা। খন্দ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ফসলাদি। লক্ষ্মীপূজা যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে, তা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকেই প্রকাশ পায়। সূচনায় মাতৃদেবীর পূজা যে ফসলাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল তা সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রে (হরপ্পায় ) প্রাপ্ত এক সালের ওপর খোদিত নারীমূর্তি থেকে প্রকাশ পায়। এই নারীমূর্তির যোনি-মুখ থেকে নির্গত হয়েছে পল্লবিত ছোট চারা-গাছ, লতা-পাত, গুল্ম ইত্যাদি। ষাট বৎসর পূর্বে আমি আমার ‘প্রি-আরিয়ান এলিমেণ্টস্ ইন ইণ্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে বলেছিলাম যে মাতৃদেবী আদিতে যে শস্যাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তা তার অন্নপূর্ণ, শাকম্ভরী ইত্যাদি অভিধা থেকেই প্রকাশ পায়। অবশ্য অন্নপূর্ণা নামটি সংস্কৃত। কিন্তু আদিতে এই শব্দটির কী রূপ ছিল, তা আমরা জানি না। তবে প্রাচীন সুমেরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘এ-নান্না’ নামের সঙ্গে এর যথেষ্ট নৈকট্য আছে। (তুলনা করুন হিংলাজের অধিষ্ঠাত্রী ‘নানা’ দেবী )।
মাত্র নামের সাদৃশ্য নয়। সুমের ও ভারতের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে এক অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। এই উভয় দেশের মাতৃদেবীর মূলগত সাদৃশ্য হচ্ছে—(১) উভয়দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী হিসাবে কল্পিত হয়েছিলেন, অথচ তাদের ভর্তা ছিল। বোধ হয়, মহাষ্টমীর দিন বাঙলাদেশে ‘কুমারী পূজা তারই স্মারক। (২) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর বাহন ‘সিংহ ও তাঁর ভর্তার বাহন ‘বলীবর্দ’। (৩) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর নারীসুলভ গুণ থকা সত্ত্বেও তিনি পুরুষোচিত কর্ম, যথা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। (৪) প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লিপিসমূহে তাকে বারম্বার সৈন্যবাহিনীর নেত্রী’ বলা হয়েছে। আমাদের দেশের “মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর ‘দেবীমাহাত্ম্য বিভাগেও বলা হয়েছে যে দেবতারা যখন অসুরগণ কর্তৃক পরাহত হয়েছিলেন, তখন তারা মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। (৫) মেসোপটেমিয়ার মাতৃদেবী পর্বতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট সেজন্য তাঁকে পর্বতের দেবী বলা হত। ভারতে মাতৃদেবীর পার্বতী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি নাম তাই সূচিত করে। (৬) সুমেরে মাতৃদেবীর নাম ছিল “এ-নান্না’ ; সে নাম হিংলাজে ‘নানা’দেবীর নামে এখনও বর্তমান। (৭) সুমেরীয়দের পরিধেয় বসন কৌনক’ তালপাতা দিয়ে তৈরী করা হত ; প্রাচীন ভারতে দেশজ লোকদের পাতা ও বল্কল’ পরিধান ও পণশবরীর ( দেবীর এক নাম ) নাম আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৮) দু’দেশেই ধর্মীয় গণিকাবৃত্তি ( বা সাময়িকভাবে সতীত্বের বিসর্জন দেওয়া ) প্রথা প্রচলিত ছিল। পশ্চিম এসিয়ায় এটার উদ্ভব হয়েছিল ঐন্দ্রজালিক ( mimetic or homoeopathic ) পদ্ধতি থেকে। সধবা ও অনূঢ়া উভয়শ্রেণীর মেয়েরাই দেবীর প্রসন্নতালাভের জন্য সাময়িকভাবে তাদের সতীত্বের বিসর্জন দিত। বলা বাহুল্য, ভারতে এটা বামাচারী তন্ত্রধর্মের বৈশিষ্ট্য। সব তন্ত্রেই বলা হয়েছে মৈথুন ছাড়া কুলপূজা ( তন্ত্র অনুযায়ী দেবীর পূজা ) হয় না। যেমন, ‘গুপ্তসংহিতা’য় বলা হয়েছে, ‘কুলশক্তিম বিনা দেবী যো যপেত স তু পামর’ ! আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণম্ ন কুলার্চনে’। তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতি ত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না। (৯) উভয়দেশেই দেবীপূজার সঙ্গে নরবলি প্রচলিত ছিল। (কালিকাপুরাণ, ৭ অধ্যায়)।
লক্ষ্মীর কথা আগেই বলেছি। লক্ষ্মীর অপর নাম ‘শ্রী’। ‘শ্রী’ প্রাচীন ভারতের এক লোকায়ত দেবী ছিলেন। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ আমরা তার প্রথম উল্লেখ পাই। সেখানে তাকে প্রণয় ও উর্বরতার দেবী বলা হয়েছে। এবং খুব অর্থবহভাবে তার নৈবেদ্য শয্যার মাথার দিকে রাখার কথা বলা হয়েছে। বৈদিকযুগের একেবারে অন্তিমকালের পূর্ব পর্যন্ত কোথাও বিষ্ণুর সঙ্গে তারসম্পর্কের উল্লেখ নেই। ‘সিরি কাল-কন্নিজাতক’ অনুযায়ী ‘সিরিদেবী’ হচ্ছেন চারজন লোকপালের অন্যতম ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা। সেখানে ‘সিরিদেবী’কে আমরা বলতে শুনি : ‘মানবজাতির ওপর আধিপত্য দেবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আমি ; আমি জ্ঞান, সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী।’ মহাভারত অনুযায়ী ‘শ্রী’ দেবী প্রথমে দানবদের সঙ্গে বাস করতেন, পরে দেবগণের ও ইন্দ্রের সঙ্গে। মনে হয় এর মধ্যেই ইঙ্গিত অাছে তিনি গোড়ায় প্রাগার্যগণ কর্তৃক পূজিত হতেন, এবং পরে ব্রাহ্মণ্যদেবতামণ্ডলীতে স্থান পেয়েছিলেন।
সিন্ধু-সভ্যতার অনুরূপ সভ্যতা হচ্ছে সুমেরীয় সভ্যতা। সুমেরের কিংবদন্তী অনুযায়ী সুমেরের লোকেরা পূর্বদিকের কোন পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসেছিল। সে জায়গাটা কোথায় ? সিন্ধু-সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্বেই নিকট-প্রাচীর বিখ্যাত ইতিহাসকার হল (Hall) বলেছিলেন যে সুমেরের লোকেরা ভারত থেকে গিয়েছিল। বহু পূর্বে আমিও দেখিয়েছিলাম যে এসম্বন্ধে যোগিনীতন্ত্র’-এ উল্লিখিত সেীমার দেশের সঙ্গে ‘মুমের’-এর এক শব্দগত সাদৃশ্য আছে। যোগিনীতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে : পূর্বে স্বর্ণনদী যাবৎ করতোয় চ পশ্চিমে দক্ষিণে মন্দশৈলশ্চ উত্তরে বিহগচল/অষ্টকোণম চ সৌমারম্যত্র দিকরবাসিনী।’ তার মানে দিক্করবাসিনীর আবাসস্থল ‘সৌমার’ নামে অষ্টকোণাকৃতি দেশ, যার সীমারেখা হচ্ছে পূর্বে স্বর্ণনদী ( শোনকুশী), পশ্চিমে করতোয় নদী, দক্ষিণে মন্দপর্বতসমূহ (মুণ্ডাজাতি-আধুষিত পর্বতমালা) ও উত্তরে বিহগচল (হিমালয় )। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে সৌমারী দেশ প্রাচ্যভারতে অবস্থিত ছিল। সুমেরের লোকেরা যে প্রাচ্যভারত থেকে গিয়েছিল এবং তাদের নূতন উপনিবেশের নাম আগন্তকদের দেশের নাম অনুযায়ী করেছিল ( এরূপ নামকরণ পদ্ধতি অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে ) ও মাতৃপূজার কল্পনার সাদৃশু থেকে তাই মনে হয়। (ইণ্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়ার্টারলি, ১৯৩৪, পৃষ্ঠা ১৪—২৪, পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য )।
সিন্ধু উপত্যকার প্রাগার্য অধিবাসিগণ যে মাত্র মাতৃদেবীর পূজা করতেন, তা নয়। সুমের ও মধ্য-প্রাচীর প্রাচীন অধিবাসীদের ও বর্তমানকালের ভারতীয় হিন্দুদের মত তাঁর স্বজন-শক্তির আধার হিসাবে এক পুরুষ দেবতারও উপাসনা করতেন। মহেঞ্জোদারো থেকে যে তিন-মুখবিশিষ্ট এক দেবতার উৎকীর্ণ মূর্তি এক সীলের ওপর পাওয়া গিয়েছে, তার দ্বারা এটা প্রমাণিত হচ্ছে। এই দেবতা সিংহাসনের উপর আসীন। তার বক্ষ, কণ্ঠ ও মস্তক উন্নত। তার এক পা অপর পায়ের উপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত, তার দুটি হাত বিস্তৃতভাবে হাটুর উপর স্থাপিত। তিনি পর্যঙ্ক-আসনে উপবিষ্ট হয়ে, ধ্যানস্থ ও উধবলিঙ্গ। তাঁর উভয়পাশ্বে চার প্রধান দিক-নির্দেশক হিসাবে হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষের প্রতিমূর্তি অঙ্কিত। তার সিংহাসনের নীচে দুটি মৃগকে পশ্চাদদিকে মুখ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পাওয়া যায়। এখানেই যে আমাদের আদি-শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বস্তুত পরবর্তীকালের শিবের তিনটি মূলগত ধারণা, আমরা এখানে দেখতে পাই—তিনি (১) যোগীশ্বর বা মহাযোগী, (২) পশুপতি, ও (৩) ত্রিমুখ। আমি আমার ‘প্রি-আরিয়ান এলিমেণ্টস্ ইন ইণ্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে দেখিয়েছি যে, বৈদিক রুদ্রদেবতা যে এই আদিশিবের প্রতিরূপেই কল্পিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
হিন্দুধর্মে শিব ও শক্তি যে মাত্র নরাকারে পূজিত হন, তা নয় ; লিঙ্গ ও যোনি হিসাবেও পূজিত হন। সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন অধিবাসীরা যে লিঙ্গ-যোনি উপাসক ছিলেন তা সেখানে প্রাপ্ত মণ্ডলাকারে গঠিত প্রতীকসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায়। এছাড়া, আমরা সেখানে প্রস্তরনির্মিত পুরুষলিঙ্গের এক বাস্তবানুগ প্রতিরূপ পেয়েছি। সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরাই যে ঋগ্বেদে বর্ণিত সমৃদ্ধিশালী নগরসমূহের আর্য-বৈরী ‘শিশ্নোপাসক’ সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
১৯২৯ খ্রীস্টাব্দে ‘অ্যানালস অভ দি ভাণ্ডারকার ওরিয়েণ্টাল ইনস্ট্রিটু্যট’ পত্রিকায় লিখিত ‘বিগিনিংস অভ লিঙ্গ কালট ইন ইণ্ডিয়া’ প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছিলাম যে লিঙ্গ-উপাসনা ভারতে তাম্রাশ্ম যুগের পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভারতের অধিবাসিগণের ঐন্দ্রজালিক ধ্যানধারণায় এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। মাদ্রাজ মিউজিয়ামের ফুট কালেকশন’-এ নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের একটি সুন্দর প্রতিরূপ আছে। এটা মাদ্রাজের সালেম জেলার শিবারয় পাহাড়ে পাওয়া গিয়েছিল। এটা খুবই বাস্তবানুগ ও নীস’ (gneiss) পাথরের তৈরি। সালেম জেলার শিবারয় পাহাড়ই একমাত্র স্থান নয়, যেখান থেকে নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের প্রতিরূপ পাওয়া গিয়েছে। বরোদার নানা জায়গা থেকেও নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের প্রতিরূপ পাওয়া গিয়েছে। এগুলি যে সবই স্বজন-শক্তি-উৎপাদক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আগেই বলেছি যে প্রৎসিলুসকি (Przyluski ) দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’ ও ‘লাঙ্গল’ শব্দদ্বয় অস্ট্রিক ভাষার অন্তর্ভুক্ত শব্দ, এবং ব্যুৎপত্তির দিক থেকে উভয় শব্দের অর্থ একই। তিনি বলেছেন যে পুরুষাঙ্গের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ‘লিঙ্গ’ শব্দটি অস্ট্রো-এসিয়াটিক জগতের সর্বত্রই বিদ্যমান, কিন্তু প্রতীচ্যের ইন্দোইউরোপীয় ভাষাসমূহে এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরও বলেছেন যে সংস্কৃত ভাষায় যখন শব্দ দুটি প্রবিষ্ট হল, তখন একই ধাতুরূপ ( ‘লনগ্’ ) থেকে লাঙ্গুল, লাঙ্গল ও লিঙ্গ শব্দ উদ্ভূত হয়েছিল। অনেক সূত্রগ্রস্থ ও মহাভারত-এ ‘লাঙ্গুল’ শব্দের মানে লিঙ্গ বা কোন প্রাণীর লেজ। যদি ‘লাঙ্গল = লাঙ্গুল’, এই সমীকরণ স্বীকৃত হয়, তা হলে এই তিনটি শব্দের (লাঙ্গল, লাঙ্গুল ও লিঙ্গ ) অর্থ-বিবর্তন (semantic evolution) বোঝা কঠিন হয় না। কেননা, স্বষ্টি প্রকল্পে লিঙ্গের ব্যবহার ও শস্য-উৎপাদনে লাঙ্গল দ্বারা ভূমিকৰ্ষণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সাদৃশ্য আছে। অষ্ট্রিকভাষাভাষী অনেক জাতির লোক ভূমিকৰ্ষণের জন্য লাঙ্গলের পরিবর্তে লিঙ্গ-সদৃশ খনন-যষ্টি ব্যবহার করে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হিউবার্ট ও. ময়েস বলেছেন যে মেলেনেসিয়া ও পলিনেসিয়ার অনেক জাতি কর্তৃক ব্যবহৃত খননযষ্টি লিঙ্গাকারেই নির্মিত হয়। মনে হয়, ভারতের আদিম অধিবাসীরাও নবোপলীয় যুগে বা তার কিছু পূর্বে এইরূপ যষ্টিই ব্যবহার করত, এবং পরে যখন তারা লাঙ্গল উদ্ভাবন করল, তখন তারা একই শব্দের ধাতুরূপ থেকে তার নামকরণ করল।
আগেই আমরা বলেছি যে লিঙ্গের যেসব প্রতিরূপ পেয়েছি, তা দাক্ষিণাত্য থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা খুবই বিচিত্র ব্যাপার যে একপ্রকার লিঙ্গ-উপাসনা, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী দাক্ষিণাত্যের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। সূত্রসংহিতায় বলা হয়েছে যে দৈত্যরাজ বাণ মহাদেবের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি প্রতিদিন স্বহস্তে একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে, তার অর্চনা করতেন। শতবর্ষ এইরূপ পূজা করবার পর মহাদেব তার প্রতি বিশেষ প্রীত হয়ে তাকে এক বর দিয়ে বলেন—‘আমি তোমাকে চৌদ্দ কোটি বিশেষ গুণ-সম্পন্ন লিঙ্গ দিতেছি।. এইসকল লিঙ্গ নর্মদা ও অন্যান্য পুণ্যসলিলা নদীতে পাওয়া যাবে। ভক্তগণকে এইসকল লিঙ্গ মোক্ষদান করবে।’ হিমাদ্রি যাজ্ঞবল্ক্যকে উদ্ধৃত করে তাঁর ‘চতুর্বর্গচিন্তামণি’ গ্রন্থে বলেছেন : ‘এইসকল লিঙ্গ অনন্তকাল ধরে অবিরাম নর্মদা নদীর স্রোতে আবর্তিত হবে। প্রাচীনকালে নৃপতি বাণ ধ্যানস্থ হয়ে মহাদেবের আরাধনা করলে, মহাদেব প্রীত হয়ে লিঙ্গরূপ ধারণ করে পর্বতের উপরে অবস্থান করেন। সেই কারণে এই লিঙ্গকে বাণলিঙ্গ বলা হয়। এক কোটি লিঙ্গের অর্চনা করে উপাসক যে ফল পাবেন, একটি বাণলিঙ্গ অর্চনা করলেও সেই ফলই পাবেন। নর্মদা নদীর তীরে প্রাপ্ত বাণলিঙ্গের অৰ্চনা করলে মোক্ষলাভ উপাসকের করায়ত্ত হয়।’
বাণলিঙ্গের উপাসনার সঙ্গে বাণের নাম সংযুক্ত থাকাটা খুবই অর্থবহ। কেননা বাণ বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ বলেন যে বর্তমান বাণগড়-ই বাণরাজার রাজধানী ছিল। বাণের পিতা ছিলেন অস্থররাজ বলি। মহাভারত অনুযায়ী অসুররাজ বলির মহিষী স্বদেষ্ণার গর্ভেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড প্রভূতি জাতিগুলির আদিপুরুষদের জন্ম হয়েছিল। বলি শিবেরই উপাসক ছিলেন। সুতরাং শিবপূজার সঙ্গে সঙ্গদেশের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বস্তুত বর্তমানে লিঙ্গরূপী শিবের মন্দির বাঙলাদেশে যত দেখা যায়, ভারতের আর কোথাও তত দেখা যায় না। শিব যে প্রাগার্য দেবতা তা এখন পণ্ডিতমহলে সর্বজনস্বীকৃত। এটা মহেঞ্জোদারোয় আদি-শিবের প্রতিরূপ পাওয়া থেকেই বুঝতে পারা যায়। শিব মাতৃদেবীর ভর্তা। মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব বাঙলাদেশেই ঘটেছিল। বস্তুত যেরূপ জাকজমকের সঙ্গে বাঙলাদেশে মাতৃদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, ভারতের আর কোথাও তা হয় না। আবার বাঙলাদেশে মাতৃদেবীর পূজা যেরূপ জনপ্রিয়, শিবের গাজন উৎসবও (বিশেষ করে নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে ) সেরূপ জনপ্রিয়। এবং প্রাগার্যকাল থেকেই এটা চলে আসছে। ঋগ্বেদে লিঙ্গউপাসকদের প্রতি ঘৃণা-প্রকাশ ও কটক্তি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে লিঙ্গ-উপাসনা প্রাগার্য সভ্যতার অবদান।
আগেই বলেছি যে মাতৃদেবীর পূজা ও লিঙ্গ-উপাসনা ভূমিকৰ্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভূমিকৰ্ষণের ওপর সৌরশক্তির প্রভাব মানুষ বরাবরই লক্ষ্য করেছে। এ-কারণেই কৃষির প্রাচীন কেন্দ্রসমূহে (যথা বঙ্গদেশ ) আমরা মাতৃকাদেবীর পূজার সঙ্গে সূর্যপূজার সংযোগ লক্ষ্য করি। যেহেতু সিন্ধু উপত্যকায় মাতৃপূজার প্রচলন ছিল, এটা খুবই স্বাভাবিক যে সেখানে সূর্যপূজারও অস্তিত্ব ছিল। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত কয়েকটি সীলমোহরের ওপর আমরা চক্র ও স্বস্তিকচিহ্ন লক্ষ্য করি , এগুলি সূর্যেরই প্রতীকচিহ্ন, কেননা প্রাচীনকালে সূর্য নরাকারে পূজিত হতেন না, তার চিহ্ন দ্বারাই উপাসিত হতেন। চক্র ও স্বস্তিক ছাড়া সূর্যের অপর যা প্রতীকচিহ্ন ছিল, তা হচ্ছে মণ্ডলাকার চাকতি ও বলদ। সিন্ধু উপত্যক ছাড়া, সূর্যের এসব প্রতীকচিহ্ন আমরা পেয়েছি মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট মহকুমার গুঙ্গেরিয়া নামক স্থান থেকে। এখানে তামার কুঠারের সঙ্গে আমরা রূপার চাকতি ও বলদের মাথারূপে পরিকল্পিত চাকতি পেয়েছি। এই শেষোক্ত জিনিসগুলি সূর্যপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখনও মধ্যপ্রদেশের মুরিয়া জাতি ধর্মীয় নৃত্যের সময় বৃষের মস্তকের চিহ্ন পরিধান করে।
সূর্যপূজা অবশ্য বৈদিক আর্যগণের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু আর্যগণ কর্তৃক সূর্য নরাকারে কল্পিত হতেন। বৈদিক সূর্যপূজা যে প্রাগার্য ধর্মকে কোনরূপে প্রভাবান্বিত করেছিল, তার কোন প্রমাণ নেই। বরং পরবর্তীকালে আর্যদের সূর্যপূজা যে আগন্তুক মগ-ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক আনীত সূর্যপূজা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল, তার প্রমাণ আছে। তবে প্রাগার্য সূর্যপূজা এখনও হিন্দুর লোকায়ত ধর্মের মধ্যে জীবিত আছে। বিহারের ছটপূজা ও বাঙলার ইতুপূজা ও রালদুর্গার ব্রত তার প্রমাণ।
গুঙ্গেরিয়ায় প্রাপ্ত তামার কুঠারের সঙ্গে রূপার চাকতি ও বলদের মাথারূপে পরিকল্পিত চাকতি বিশেষ অর্থবহ। পশ্চিম এশিয়ার দেবতাগণ প্রায়ই কৃষরূপে কল্পিত হতেন এবং সেখানকার প্রাচীন সীলমোহরসমূহে নরাকার দেবতাগণকে বৃষ-শৃঙ্গের কিৰীট ধারণ করতে দেখা যায়। সুমেরীয়রা তাদের সর্বোচ্চ দেবতাকে ‘স্বর্গের বৃষ’ বলে অভিহিত করত। সুমেরের প্রাচীন সীলমোহরের ওপর তাকে বৃষ-শৃঙ্গের কিরীটপর অবস্থায় ও তাকে বৃষ কর্তৃক অনুষঙ্গী হতে দেখা যায়। অম্বর জাতির সর্বোচ্চ দেবতা ‘অমুর’ও বৃষরূপে কল্পিত হত। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এখানে শিবকে স্মরণ করি। মহেঞ্জোদারোয় আমরা আদি-শিবের যে মূর্তি পেয়েছি, সেখানে আদি-শিবকেও আমরা বৃষ শৃঙ্গের কিরীট পরিহিত অবস্থাতে দেখি।
আরও অনেক পূজা, যথা নাগপূজা, অশ্বত্থবৃক্ষ পূজা, হিন্দু দশাবতার প্রভৃতির কল্পনা, আমরা প্রাগার্যদের কাছ থেকে পেয়েছি। এছাড়া, আমরা আরও পেয়েছি শিল্প ও স্থাপত্য, লিপিপদ্ধতি, গোযানের ব্যবহার ইত্যাদি। ( এ-সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘প্রি-আরিয়ান এলিমেণ্টস্ ইন ইণ্ডিয়ান কালচার’, ১৯৩১, দ্রষ্টব্য। )
বাঙলার মধ্যযুগের লোকায়ত দেবদেবীসমূহ যে নবোপলীয় যুগের, তা মঙ্গলকাব্যসমূহের অভ্যন্তরীণ প্রমাণ ( লহনা-খুল্লনা ও কালকেতুর কাহিনী তুলনা করুন ) থেকেই বুঝতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দিলেই এটা স্পষ্ট হবে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার বারমাস্যায় বর্ণিত হয়েছে : ‘কাতিক মাসেতে হৈল হিমের জনম। জগজ্জনে কৈল শীত নিবারণ বসন নিযুক্ত করিল বিধি সভার কাপড় অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড়। আমি বহুবার বহু জায়গায় বলেছি যে আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যসমূহের রচনাকাল এক, আর তার কাহিনীকাল আর এক। উপরের উদ্ধৃতিতে ফুল্লরার ‘হরিণের ছড় পরাটা নবোপলীয় যুগের বা প্রাচীন অস্ট্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই চণ্ডী-উপাসনার প্রকৃতকাল ইঙ্গিত করছে।
প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে যে আলোচনায় আমরা প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, তা এখানেই শেষ করলাম। এই আলোচনার ফলে, পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমাদের লৌকিক জীবনচর্যার (অন্তত্র এটাকেই আমি কালচার’ বা ধর্ম বলেছি) বনিয়াদ গঠনে প্রাচীন মানবের যথেষ্ট অবদান আছে। সেটাই এই আলোচনার যুক্তি।