০১. প্রথম অধিবেশন

মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতিসঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মুখবন্ধ

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এসেছে। বিভিন্ন তাদের উদ্দেশ্য। এক সময় পরোপকার পয়সাওয়ালা লোকেদের ফ্যাশানের অঙ্গ ছিল। মানুষের উপকার করতে হবে। গ্যেটে লিখেছিলেন, To give is the business of the rich. এলিট লিখেছিলেন, one must be poor know the luxury of giving. ইতিহাস খুঁজলে অনেক মজার-মজার প্রতিষ্ঠান কত মজার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জানা যায়, যেমন পঞ্চদশ শতকের weeks charity। এই প্রতিষ্ঠান বিধর্মীদের পুড়িয়ে মারার জন্যে বিনাপয়সায় কাঠ সরবরাহ করতেন। সপ্তদশ শতকে একটি প্রতিষ্ঠানের পাগলামি ছিল, অত্যন্ত অপ্রচলিত একটি ডেনিশ ভাষায় বাইবেলের একটি উপদেশ মুখস্থ করে সারা বছর যিনি ওই প্রচার করবেন তাকে টাকা দিয়ে উৎসাহিত করা। শেষে এমন একদিন এল যেদিন ভাষা বোঝার মতো আর একটি মানুষও রইল না। যাদের একটি পা তাঁদের জুতো দিয়ে সাহায্য করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, The Benefit Shoe Foundation. ঘোড়াকে বড়দিনে খানা খাওয়াবার জন্যে এসেছিল, A Horses Christmas Dinner Trust Fund. Hat Research Foundation আন্দোলন শুরু করেছিলেন টুপি ছাড়া যেন মাথা না থাকে। ক্যালিফোর্নিয়ার Point Foundation পাঁচ হাজার ডলার দান করেছিলেন গণিকাঁদের একটি ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য। National Lough Week Foundation, Lollipop Foundation og হলেও আছে। এক অমেরিকাতেই বত্রিশ হাজার ছোট-বড় ফাউন্ডেশান আছে। বাগেহট লিখেছেন, The most melancholy of human reflection, perhaps is that, on the whole it is a question whether the benevolence of mankind dose most harm or good.

কলকাতায় পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি ছিল। মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি ছিল না। পশু মানুষের হাতেই নিগৃহীত হতো বেশি সেই কারণেই পশুপ্রেমী কিছু মানুষের প্রাণ কেঁদেছিল। বর্তমানে মানুষের অবস্থা নিগৃহীত পশুর চেয়েও বেদনাদায়ক। মানুষকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এই সমিতি কবে স্থাপিত হল জানি না। তবে সমিতির বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ডিজনির পরিকল্পনা ছিল কুকুরদের জন্যে Dalmatian Foundation, কার পরিকল্পনা এই মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি।

.

প্রথম অধিবেশন

আপনারা আমাকে যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন সেই দায়িত্বের আমি উপযুক্ত কিনা জানি না।

অতীতে আমি বিপ্লবী ছিলুম, তখন আমার কাজ ছিল ধ্বংসের। বোমা, বন্দুক, সত্যাগ্রহ। আমার বয়েস হয়েছে। এই বয়েসে মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়াই সাজে। বললেই তো আর সাজা যায় না। গদিতে গদিয়ান হতে হলে দল চাই, বল চাই, ছল চাই। শুনেছি ভালো জন হলে ভালো ছেমোছলা কলা শিখতে হয়। সে যাই হোক, এখন কাজের কথায় আসা যাক। বহুঁকাল আগে এই শহরে সি এস পি সি এ নামে প্রতিষ্ঠান ছিল– ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশান অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস। সেই সোসাইটির এখন কি অবস্থা, কি তাদের কাজ আমি জানি না। সারা শহরের এখানে ওখানে এখনও কিছু পরিত্যক্ত মরচে ধরা লোহার জলপাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন তার আর কোনও ফাংশান নেই। অতীতের স্মৃতি মাত্র। ঘোড়া নেই, ঘোড়ায় টানা ট্রাম নেই। জলধারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। শহরে এখন যে পশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তা হল মানুষ। সেই মানুষের ক্লেশ নিবারণের জন্যে আমাদের প্রস্তাব একটি সমিতি স্থাপন, যার নাম হবে, সি এস পি সি এম, ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশান অফ ক্রয়েলটি টু ম্যান। ক্লেশ নিবারণ করতে হলে জানা দরকার, আমাদের কী কী ক্লেশ, কীসে আমরা ক্লিষ্ট। আমি বসছি, সদস্যরা এইবার একে-একে আলোচনা করুন।

মাননীয় সভাপতি, সমবেত পশুগণ, আপনারা জানেন, জানা না থাকলেও জেনে নিন, সারা পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া যে-কোনও পশু সম্পর্কে ভয়ানক চিন্তাভাবনা চলছে। বাঘ, সিংহ, গন্ডার, হাতি, হায়না, কুমির, সাপ, পাখি, গিরগিটি প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্যে বিশ্বসংস্থা, প্রাদেশিক সংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জ জলের মতো অর্থব্যয় করছেন, আইন তৈরি করছেন, কি না করছেন। এদিকে মানুষের ক্লেশ দিন-দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে কলকাতায়। এই শহরে মোস্ট নেগলেকটেড অ্যানিম্যাল হল মানুষ। যেহেতু আমরা দ্বিপদ সেই হেতু আমরা চতুষ্পদদের সুযোগ সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। দিন-দিন আমাদের বঞ্চনা বেড়েই চলেছে। অন্যান্য পশুরা জন্মেই স্বাধীন, আমরা কিন্তু জন্মেই পরাধীন। দেহের দাসত্ব, পরিবারের দাসত্ব, সমাজের নামের দাসত্ব, অর্থনীতির দাসত্ব। সবচেয়ে বড় ক্লেশ হল এই দাসত্ব। সেই কবিতার লাইন কটা আমার এখন মনে আসছে।

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিয়ে চায় রে
কে বাঁচিয়ে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়
কে পরিবে পায়।

আমাদের যা খুশি আমরা তা করতে পারব না কেন? বাঘ পারে, সিংহ পারে, কুকুর পারে। আমরা দুর্বল, আমরা ভীতু, আমরা অভ্যাসের দাস। কোড অফ কনডাকটের বাইরে গেলেই ছি ছি পড়ে যাবে–লোকটা নরপশু পশ্বাচার। এইটাই হল ফ্যালাসি নাম্বার ওয়ান। সাইকোলজিক্যালি আমাদের মেরে রাখা হয়েছে। আপনারা ফ্রয়েডের নাম শুনেছেন। সাহসী মানুষ, তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন–

Most of what we are conscious of is not real and the most of what is real is not in our consciousness.

এখনও জানা গেল না, হোয়াট ইজ রিয়েলি রিয়েল।

আপনাদের কথা আমি জানি না। আপনাদের সামনে আমি নিজেকেই নিজে অ্যানালিসিস করছি। মনে হয় আমার আয়নাতেই আপনাদের চেহারা দেখতে পাবেন। আমার দুটো ভাব, একটা বায়োফিলিয়া। তার মানে লাভ অফ লাইফ। জীবনকে ভালোবাসা। তার অর্থ কিন্তু জীবে প্রেম নয়। জিভে প্রেম। নিজের জীবনকে ভালোবাসা। আমি বাঁচতে চাই, প্রভুত্ব করতে চাই, ভোগ চাই, সুখ চাই, সম্পত্তি চাই, ভালো খেতে চাই, পরতে চাই, অধিকার করতে চাই। অনায়াসে সব কিছু পেতে চাই। আমি একটা homme machine. এসব ব্যাপারে আমি প্রতিযোগিতা পছন্দ করি না, ভাগাভাগির মধ্যে যেতে চাই না। এই দিক থেকে আমি ডুয়েলিস্ট। আমি আর আমার প্রাচুর্যে ভরা পৃথিবী, এর বাইরে সবাই আমার অপরিচিত। কিন্তু ইয়েস, দেয়ার ইজ এ বিগ বাট। আমি তো আর জায়েন্ট নই যে সব কিছু নিজের ক্ষমতায় দখল করে নেব। তাই আমার দুটো দিক, একটা হল হোমো সেকসুয়ালিস, আর একটা হল হোমো ইকনমিকাস।

ফ্রয়েড সায়েবের মডেল অনুসারে আমার মধ্যে দুটো শক্তি কাজ করছে, একটা হল নিজেকে রক্ষা, সেলফ প্রিজারভেটিভ আর একটা প্রজননেচ্ছু, সেকসুয়্যাল ড্রাইভ। আমার এই দুটো ইচ্ছে প্রতিমুহূর্তে খর্বিত, খণ্ডিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। সমাজ এর ওপর চেপে বসে আছে, সংসার এর মধ্যে গোঁজামিল ঢুকিয়ে দিয়েছে। কালচার মনের মধ্যে ঢুকে দুটো শুম্ভ নিশুম্ভ তৈরি করেছে–আচার, অনাচার। আমি অসুস্থ, আমি ক্লান্ত, অন্তর্দ্বন্দ্বে খণ্ড-খণ্ড। কোনটা আচার, কোনটা অনাচার বুঝতে গিয়ে জীবনটাই জেবড়ে গেল। আবার সেই ফ্রয়েড :

Society imposes unnecessary hardships on man which are conducive to worse results rather than the expected better ones.

বায়োফিলিয়া থেকে আমার মধ্যে এখন প্রবল হয়ে উঠেছে নেক্রোফিলিয়া। মৃত্যুকেই আমি এখন ভালোবাসতে শুরু করেছি–মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান। যে অবস্থায় পড়ে মানুষ মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখে সেই অবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন। এই অবস্থা যাঁরা তৈরি করেছেন তারা কারা? তাঁরা হলেন এক ধরনের পোচার।

কাজিরাঙা ফরেস্টে যে-সব পোচার গণ্ডার মারে তাদের জন্যে কড়া আইন তৈরি হয়েছে। আমাদের যারা মারছে তাদের জন্যে কে কি অবস্থা নিয়েছেন জানতে চাই। সাপ্রেশান, অপ্রেশান। এসব কি অপরাধ নয়? অবশ্যই অপরাধ। কে সেই অপরাধী? সভ্যতা। সভ্যতাই হল রিয়েল অপরাধী। রিয়েল রিয়্যালটি হল, আমি একটা পশু, আমি দেবদূত নই, দেবতা নই। একটা জীবন, একটা জীব।

জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে সভ্য করে তোলার জন্যে কম অত্যাচার হয়েছে! কম মগজ ধোলাই দেওয়া হয়েছে আমাকে একটা ক্রীতদাস করে তোলার জন্যে! আমি যদি বাঘ হতুম, গরিলা কি গণ্ডার হতুম, তাহলে কি আমাকে অত সহজে পোষ মানানো যেত? যেত না। ভয়ের ব্যাটারি চার্জ দিয়ে সার্কাসের রিং মাস্টাররা আমাদের বশে রেখেছেন, একটি মাত্র সত্তাই আমাদের জেগে আছে–হোমো ইকনমিকাস। নো ওয়ার্ক, নো পে। নো সাবমিসান, নো প্রেমোসান।

ছেলেবেলায় মা বলতেন, কথা না শুনলে কিছু পাবি না। বাবা বলতেন, উনিশের নামতা মুখস্ত না দিতে পারলে খাওয়া বন্ধ। মুখে-মুখে তর্ক কোরো না, কান ধরে নিলডাউন করিয়ে রেখে দেব, সেইসব দুঃস্বপ্নের দিনের কথা। বাঁদরটাকে মানুষ করার জন্যে জাঁদরেল একজন শিক্ষক চাই। উঠতে বসতে পিটুনিই হল একমাত্র ওষুধ। এই পিঠের ওপর কত কিছুর স্মৃতি চিহ্ন–জুতো, ঝাটা, লাঠি, বেল্ট দাদুর খড়ম। দুটো কানের দুরকম লেংথ। ডান কানটা পণ্ডিতমশাই টেনে-টেনে বাঁ টার চেয়ে এক ইঞ্চি বেশি লম্বা করে দিয়েছেন। এর থেকে আমি একটা সহজ অঙ্ক পেয়েছি, ব্যাকরণ কৌমুদীর একের চার ভাগ আয়ত্ত করতে কান এক ইঞ্চি লম্বা হয়, পুরোটা আয়ত্ত করতে হলে কানের চেহারা আর মানুষের মতো রাখা যায় না, হাতি কিংবা খরগোশের মতো হয়ে যায়।

ভেবে দেখুন ভাই সব সেই অতীতের কথা। শৈশবে আমাদের কেউ মানুষ বলে মনে করতেন কি? এই দেখুন আমার শৈশব পরিচয়ের একটা লিস্ট তৈরি করেছি, বিভিন্ন পশুর সমন্বয়ে আমার শৈশব–গাধা, গরু, বাঁদর, হনুমান, শূকর, উল্লুক, পাঁঠা, সব মিলিয়ে জানোয়ার। একমাত্র অবতারদেরই একই আধারে এত রূপ কল্পনা করা চলে। প্রেমিকের পক্ষেই প্রেমিকার শরীরে এতরূপ দেখে গান গেয়ে ওঠা চলে–একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে। শৈশবের নামরূপেই আমার রূপ প্রকাশিত। ক্ষণে-ক্ষণে বিভিন্ন পশুর পশ্বাচারে জগৎ প্রমাণিত করেছি ম্যান ইজ এ বাইপেড অ্যানিম্যাল উইদাউট এনি উইংস।

এইবার আসা যাক ব্যবহারিক দিকে। কীভাবে সেই মধুর মানব শৈশবে আমি ব্যবহৃত হয়েছি। কখনও ফুটবলের মতো, কখনও চটি-জুতোর মতো, পাপোশের মতো, তবলার মতো, পাখোয়াজের মতো, আবর্জনার মতো। শরীরের ওপর কোনও স্বাধীনতা ছিল না। যিনি যেভাবে পেরেছেন তিনি সেইভাবে ব্যবহার করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন মানুষ জন্মায় না, আদিতে সবাই অকৃত্রিম পশু। শুধুমাত্র নির্বিচার পেটাই আর ধোলাইয়ের সাহায্যেই মানুষ তৈরি হয়।

পৃথিবীতে এখন বর্ষপালনরীতি চালু হয়েছে। এখন চলছে শিশুবর্ষ। শিশু ক্লেশ নিবারণের, শিশু নির্যাতনের নানা কথা শুনতে পাচ্ছি। যদিও আমি শিশুর পিতা তবু আমি আমার নির্যাতিত শৈশবের জন্যে উপযুক্ত বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি। সেদিনের সেই নির্যাতিত শিশু আজরে নির্যাতক পিতা, তবু বিচার চাই।

এই সভা আজকের মতো মুলতুবি রইল। ক্লেশের ক্লাসিফিকেশান ও কোডিং-এর জন্যে প্রয়োজন হলে আমাদের একাধিকবার বসতে হবে। যারা ঘুমিয়ে পড়েছেন উঠে বসুন। বাড়ি যান। আজ থেকে প্রত্যেকেই লিখতে থাকুন কার কিসে ক্লেশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *