মায়াবিনী
প্রথম খণ্ড – নারী না পরী
প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন সংবাদ
একদিন অতি প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয় স্থানীয় থানায় আসিয়া ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন।
যাঁহারা আমার “মনোরমা” নামক উপন্যাস পাঠ করিয়া আমাকে অনুগৃহীত করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের পরিচয় আর নূতন করিয়া দিতে হইবে না। যে সময়কার ঘটনা বলিতেছি, তখনকার ইনি একজন সুপ্রসিদ্ধ, সুদক্ষ ও শ্রেষ্ঠ ডিটেক্টিভ। তাঁহার ভয়ে তখন অনেক চোর চুরি ছাড়িয়াছিল, অনেক ডাকাত ডাকাতি ছাড়িয়াছিল, অনেক জালিয়াৎ জালিয়াতী ছাড়িয়াছিল; স্ব স্ব ব্যবসায়ে এরূপ একটা অপরিহার্য্য ব্যাঘাত ঘটায় সকলে কায়মনোবাক্যে অহর্নিশ ইষ্টদেবতার নিকটে দেবেন্দ্রবিজয়ের মরণ আকাঙ্খা করিত। সকলেই ভয় করিত; ভয় করিত না—গর্বিত জুমেলিয়া। সে ইষ্টদেবতার নিস্ফলসহায়তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া, সেই সময়ে স্বহস্তে দেবেন্দ্রবিজয়কে খুন করিবার জন্য ‘মরিয়া’ হইয়া উঠিয়াছিল। সে তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত। দেবেন্দ্রবিজয় যদি তেমন একজন ক্ষমতাবান, বুদ্ধিমান লোক না হইয়া একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতেন, তাহা হইলে সে তাঁহাকে পদতলে দলিত করিয়া মনের সাধ মিটাইতে পারিত। তা’ না হইয়। দেবেন্দ্র কি না প্রতিবারেই তাহাকে হতদর্প করিল—ছিঃ—ছিঃ—ধিক্ ধিক্; এই সব ভাবিয়া জুমেলিয়া আরও আকুল হইয়া উঠিত। এই বর্তমান আখ্যায়িকা পাঠ করিবার পূৰ্ব্বে পাঠকের ‘মনোরমা’ নামক পুস্তকখানি পাঠ করিলে ভাল হয়; এখানিকে মনোরমা পুস্তকের পরিশিষ্ট বলিলেও চলে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন, তখন তিনি নিশ্চিন্তমনে বাঁশের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ন্যায় একটি চুরুট দন্তে চাপিয়া ধুমপান করিতেছিলেন; তেমনি পরম নিশ্চিন্তমনে দেখিতেছিলেন, সেই ধূমগুলি কেমন কুণ্ডলীকৃত হইয়া, উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া, দল বাধিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল। তেমন প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয়কে সহস৷ সেই কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া তিনি কিছু বিস্মিত হইলেন। সসম্মানে তাহাকে নিজের পার্শ্বস্থিত চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, “কি হে, ব্যাপার কি? আমাকে দরকার না কি? এত সকালে যে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ব্যাপার বড় আশ্চৰ্য্য; শুনলেই বুঝতে পারবে, ব্যাপারটা কতদূর অলৌকিক; তেমন অলৌকিক ঘটনা কেউ কখনও দেখে নাই—শুনে নাই।”
রাম। এমন কি ঘটনা হে?
দেবেন্দ্র। বড়ই অলৌকিক—একেবারে ভৌতিক-কাণ্ড–তুমি শুনলে তোমারও বিস্ময়ের সীমা থাকবে না।
রাম। বেশ, আমিও বিস্মিত হইতে চাই। প্রায় দশ বৎসরের মধ্যে আমি একবারও বিস্ময়ান্বিত হইয়াছি কি না সন্দেহ; তোমার কথায় যদি এখন তা ঘটে, সে বিস্ময়টায় কিছু-না-কিছু নূতনত্ব আছেই।
দেবেন্দ্র। ফুলসাহেবকে তোমার স্মরণ আছে?
রাম। বিলক্ষণ!
দেবেন্দ্র। জুমেলিয়াকে? যে এতদিন জাল-মনোরমা সেজে নিজের বাহাদুরী দেখাইতেছিল, শেষে হাজরার বাগান-বাড়ীতে আত্মহত্য করে, তাকে স্মরণ আছে কি?
রাম। হা, সেই পিশাচী ত?
দেবেন্দ্র। সত্যই সে পিশাচী বটে!
রাম। তার কি হয়েছে?
দেবেন্দ্র। তার মৃত্যুর বিবরণটা কি এখন তোমার বেশ স্মরণ আছে?
রাম। বেশ আছে!
দে। জুমেলিয়ার দেহ যতক্ষণ না কবরস্থ করা হয়েছিল, ততক্ষণ আমি তৎপ্রতি সতর্ক-দৃষ্টি রেখেছিলাম ব’লে, তুমি আর কালীঘাটের থানার ইনস্পেক্টর হেসেই অস্থির।
রাম। শুধু কবরস্থ নয়—সেই শবদেহ কবরস্থ ক’রে কবর-স্মৃত্তিক পূর্ণ করা পৰ্য্যন্ত তোমার সতর্ক দৃষ্টি সমভাবে ছিল। ইহা ত হাসিবারই কথা, দেবেন্দ্র বাবু! [ হাস্য ]
দেবেন্দ্র। এখন সেই ঘটনা, আমার সে সতর্কতা যে বৃথা নয়, তা’ প্রমাণ করেছে। তবু যতদুর সতর্ক হওয়া আবশ্যক, তা আমি হ’তে পারি নি; আরও কিছুদিন সেই কবরের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখাই আমার উচিত ছিল।
রা। অ্যাঁ—বল কি হে! তোমার মাথাটা নিতান্ত বিগড়াইয়। গিয়াছে দেখছি। কবরের উপর এত সাবধানত কেন? তার পর তুমি জুমেলিয়ার কবরের উপর আর পাহারী দিয়াছিলে কি?
লে। হ্যাঁ, এক সপ্তাহ।
রা। যে লোক ম’রে গেছে—যাকে পাঁচ হাত মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়েছে—তার উপর তুমি এক সপ্তাহ নজর রেখেছ; এখনও আবার বল্ছ যে, আরও কিছুদিন নজর রাখতে পারলে ভাল হ’ত, –এ সব কথার অর্থ কি? মাটির নীচে—এক সপ্তাহ—তবু যে কোন মানুষ বাঁচতে পারে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
দে। তা’ মিথ্যা বল নাই, এরূপ স্থলে সাধারণ লোকের পক্ষে জীবিত থাকা অসম্ভব।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, মৃত্যুর কাছে আবার সাধারণ আর অসাধারণ কি?
দে। তুমি কি আরবদেশের ফকিরদিগের এরূপ পুনরুখান সংক্রান্ত কোন ঘটনার কথা কখনও শোন নাই?
রা। অনেক সময়ে অনেক শুনেছি।
দে। তারা কি করে জান?
রা। হ্যাঁ, কিছু কিছু।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “আরবদেশের ফকিরের দ্রব্যগুণ প্রক্রিয়ায় আপনাদিগকে এমন নিম্পন্দন নিশ্চেতন করে যে, বড় বড় ডাক্তারের বিশেষ পরীক্ষায় জীবনের কোন চিহ্নই বাহির করিতে পারে না। তার পর সকলের সম্মুখে সেই ফকিরকে সমাধিস্থ করা হয়। ফকির ইতিপূৰ্ব্বে এমন একজন চেলা ঠিক ক’রে রাখে যে, ফকিরের স্থিরীকৃত দিবসাবধি—সম্ভবতঃ একমাস সেই কবরের উপর সতত দৃষ্টি রাগে। তার পর নির্দিষ্ট দিনে ফকিরের পুনরুত্থান হয়। পরক্ষণেই সেই ফকিরের মৃতকল্প দেহে চৈতন্তচিহ্ন প্রকাশ পায়; তার পর সে ওঠে, বসে, কথা কহে, স্বচ্ছন্দচিত্তে এদিকে ওদিকে বেড়াইতে পারে; মোট কথা—সে পূৰ্ব্বে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই হইয় উঠে।”
রা। [ সহাস্তে ] যাদের সমক্ষে এ কাও হয়, তারা গাধা।
দে। আমাকেও কি ‘গাধা’ ব’লে তোমার বিবেচনা হয়?
রা। না |
দে। না কেন? আমিই স্বচক্ষে এমন কাগু অনেক দেখেছি; আমি এ ঘটনা অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি; এ ঘটনা অসম্ভব নয়।
রা। বেশ, এখন ব্যাপার কি বল? তোমার সুদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিক যে আর ফুরায় না!
দে। ডাক্তার ফুলসাহেব অনেক দিন আরবদেশে ছিল; তার পর কামরূপ ঘুরে আসে। সে নানা প্রকার দ্রব্যগুণ ও মন্ত্রাদি জানত— তার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।
র: তা’ সে সকলকে প্রচুর পরিমাণে দেখিয়ে মরেছে।
দে। জুমেলিয়া তারই ছাত্রী—শুধু ছাত্রী নয়, স্ত্রী।
রা। হ্যাঁ জানি, জুমেলিয়া বড় সহজ মেয়ে ছিল না।
দে। শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রীর শিক্ষা আরও বেশি।
রা। হ’তে পারে, কি হয়েছে তা’?
দে। জুমেলিয়া—সেই নারী-পিশাচী এখনও মরে নি।
রা। [ সবিস্ময়ে ] বল কি হে!
দে। আমি সেই কথাই তোমাকে বলতে এসেছি। যদি সে বেঁচে থাকে, অবশ্যই তুমি শীঘ্রই তা জানতে পারবে। সে বড় সহজ স্ত্রীলোক নয়, নিজের হাতে সে অসংখ্য নরহত্যা করেছে। সে এখন জীবিত কি মৃত, তুমি তার কবর খুঁড়ে দেখলেই জানতে পারবে।
রা। কতদিন তাকে গোর দেওয়া হয়েছে?
দে। আজ বৈকালে ঠিক উনচল্লিশ দিন পূর্ণ হবে।
রা। না না; যে মৃতদেহ এতদিন গোরের ভিতর রয়েছে—তা’ আবার টেনে বের করা যুক্তিসিদ্ধ ব’লে বিবেচনা করি না।
দে। মৃতদেহ! মৃতদেহ পাবে কোথায় তুমি? দেখবে কবর শূন্য প’ড়ে আছে।
রা। এ খেয়াল বোধ হয়, তোমার সম্প্রতি হ’য়ে থাকবে।
দে। হ্যাঁ, সম্প্রতি।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, ব্যাপারটা কি হয়েছে বল দেখি?
দে ৷ শ্ৰীশচন্দ্র নামে একটি চতুর ছোকরা আমার কাছে শিক্ষানবীশ আছে। “১৭—ক” পুলিন্দার কেসে সে আমার অনেক সহায়তা করেছে। যে গোরস্থানে” জুমেলিয়াকে গোর দেওয়া হয়েছে, সেই গোরস্থানে কাল শ্ৰীশচন্দ্র বেড়াতে যায়। ফিরে আসার সময়ে জুমেলিয়ার কবর দেখতে যায়। জুমেলিয়া তাকে যেরূপ বিপদে ফেলেছিল, তাতে সে জুমেলিয়াকে কখনও ভুলতে পারবে বলে বোধ হয় না। শ্ৰীশচন্দ্রের যদিও বয়স বেশি নয়, বেশ চতুর বটে—আর দৃষ্টিটাও যে বেশ তীক্ষ্ণ আছে, এ কথা স্বীকার করা যায়। জুমেলিয়ার কবরটার উপরকার মার্টিগুলো আলগা আলগা দেখে তার মনে কেমন একটা সন্দেহ হয়; তার পর সে এক টুক্রা কাগজ সেইখানে কুড়িয়ে পায়; তাতে তার সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়। সেই কাগজ টুক্রায় জুমেলিয়ার, নাম লেখা ছিল। তার পর সে অপর টুকরাগুলির সন্ধান করতে লাগল; সেইরূপ ছোট ছোট টুক্রা কাগজ চারিদিকে অনেক ছড়ান রয়েছে দেখতে পেলে। সেদিন সে কেবল সেই কাগজ টুকরাগুলি বেছে বেছে সংগ্ৰহ ক’রে বাড়ী ফিরে আসে। সে আমাকেও সকল কথা তখন কিছুই বলে নাই, নিজেই সে সেই ছোট ছোট কাগজগুলি ঠিক ক’রে সাজিয়ে আর একখানা কাগজে গদ দিয়ে জুড়ে রাখে।
রা। শ্ৰীশচন্দ্র টুক্রা কাগজগুলো ঠিক সাজাতে পেরেছিল?
দে। পেরেছিল।
রা। কেমন লোকের ছাত্ৰ! ভাল, তার পর?
দে। কাল রাত্রে আমার হাতে সে সেই পত্ৰখানা এনে দেয়, তেমন আশ্চৰ্য্য পত্র আমি কখনও দেখি নাই।
রা। কিরূপ আশ্চৰ্য্য শুনতে পাই না কি?
দে। আমার কাছেই আছে, শ্ৰীশ সেই ছিন্নপত্ৰখানা বেশ পাঠোপযোগী ক’রেই আমার হাতে দিয়েছে। আগেকার টুকরাগুলি পাওয়ার যায় নাই; মধ্যেরও দু-এক টুকরা পাওয়া যায় নাই। শ্ৰীশ নিজে সেই-সেইখানে কথার ভাবে আন্দাজ ক’রে ঠিক কথাগুলিই বসিয়েছে; প’ড়ে দেখ। [ পত্র প্রদান ]
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অভিনব পত্র
পত্রে লেখা ছিল;–
——হইল না। অপেক্ষা করিবার সময় নাই, থাকিলে করিতাম–কি করিব, দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত দেখা হইল না। আমি কোন বিশেষ প্রয়োজনে বালিগঞ্জের দিকে চলিলাম। হয় ত সেখানে আমি ধরা পড়িতে পারি। যদি ধরা পড়ি, আমি সেইরূপে আত্মহত্যা করিব; তুমি তা জান। আমার মৃত্যুর দিন হইতে ত্রিশ দিন পৰ্য্যন্ত আমি কবরের মধ্যেও জীবিত থাকিব; সেই সময়ের মধ্যে তুমি আমায় উদ্ধার করিবে। যদি আমাকে উদ্ধার করিতে তোমার আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের এক রাত্রি পূৰ্ব্বে বরং চেষ্টা পাইবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের এক রীত্রি পরে চেষ্টা না পাও; তাহা হইলে চেষ্টা বিফল হইবে।
কবর হইতে আমাকে বাহির করিয়া যদি দেখ, দাতকপাট লাগিয়াছে, তবে জোর করিয়া ছাড়াইবে। তাহার পর সেই শিশি হইতে আট ফোট ঔষধ আমার মুখে দিবে। যেন আট ফোটার এক ফোটা কম কি বেশি না হয়, খুব সাবধান।
তাহার পর আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করিবে। তুমি যদি আমার এই সকল অনুরোধ উপেক্ষা না কর, আধ ঘণ্টার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পারিব। তুমি বলিয়াছ, আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাস। এমন কি, যদি আমি তোমার স্ত্রী হই, তুমি আমার আগেকার অসংখ্য পাপ—যে সকল আমি স্বহস্তে করিয়াছি, তুমি গ্রাহ্যই করিবে না।
বাঁচাও—আমায় রক্ষা কর; আমি তোমারই হইব। স্মরণ থাকে যেন—পুর্ণমাত্রায় ত্রিশ দিন—এক মুহূৰ্ত্ত উত্তীর্ণ হইয়া গেলে আর তুমি আমায় কিছুতেই বাঁচাইতে পরিবে না—আমি মরিব।
তুমি আমার জীবন দান কর—এ জীবন চিরকাল তোমারই অধিকারে থাকিবে।
তোমার প্রেমাকাঙ্খিণী
জুমেলা।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বন্দোবস্ত
রামকৃষ্ণ বাবু সবিস্ময়ে বলিলেন, “একি অদ্ভুত কাণ্ড! দেবেন্দ্র বাবু, সত্যই সে কবর থেকে উঠে গেছে না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত তাহাই বিশ্বাস।”
“কখনও তা’ হ’তে পারে?”
“হ’তে পারে কি? হয়েছে।”
“শ্রীশচন্দ্র একটা বড় ভুল করেছে, যার নামে পত্র লেখা হয়েছে, তার নামটা যদি সেই সকল টুকরা কাগজগুলা থেকে কোন রকমে বেছে বের করতে পারত—বড়ই ভাল হ’ত।”
“সন্ধান করেছিল, পায় নি। এখন এক কথা হচ্ছে, রামকৃষ্ণ বাবু।”
“কি?”
“এস, আমরা জুমেলিয়ার কবরটা আগে খুড়ে দেখি, ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে; তার পর অন্ত কথা।”
“বেশ, আমি প্রস্তুত আছি।”
“আজই বৈকালে।”
“হাঁ।”
“বেল তিনটার সময়ে এখানেই হ’ক, কি সেখানেই হ’ক, আমাদের দেখা হ’বে।”
“এখানে তুমি ঠিক বেলা দু’টার সময়ে অতি অবশ্য আসবে; যাবার সময়ে গঙ্গাধরকে সঙ্গে নেওয়া যাবে। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে তার বাড়ী হ’তে গাড়ীতে তুলে নেব, তার পর সকলে মিলে গোরস্থানে যাওয়া যাবে।”
“আমার গাড়ী আমি নিয়ে আসব, সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না; আমি ঠিক সময়েই আসব। পারি যদি শচীন্দ্রকে সঙ্গে আনব। তুমি
তমধ্যে ঠিক বন্দোবস্ত ক’রে ফেল।”
“এদিককার যোগাড় আমি সব ঠিক ক’রে রাখব।”
“দেখে, আমার কথা যেন স্মরণ থাকে; নিশ্চয়ই কবর-গহবর শূন্য প’ড়ে আছে, দেখতে পাবে।”
“বেশ বেশ, দেখা যাবে, দেবেন্দ্র বাবু।”
“জুমেলিয়া তার মৃত্যুর পরেও যে আমার অনুসরণ করবে ব’লে ভয় দেখিয়েছিল—সে কথা কি আমি তোমায় আগে বলি নাই?”
“কই না।”
“তার কবর সম্বন্ধে আমার সতর্ক থাকার এই এক কারণ; এই জন্যই আমি তার কবরের উপর বিশেষ নজর রেখেছিলাম। এখন আমি তার সেই ভয়-প্রদর্শনের প্রকৃত কারণ বুঝতে পারছি; এইজন্যই সে বলেছিল, তার মৃত্যুর পরেও সে তার প্রতিজ্ঞ পুর্ণ করবে।”
“তখন বুঝি, তোমার মনে এ ধারণা হয় নাই? এখন তুমি তার মনের অভিপ্রায় বেশ বুঝতে পেরেছ?”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সমাধিক্ষেত্র
ঠিক বেলা দুইটার সময়ে পূৰ্ব্বোল্লিখিত থানার সম্মুখে একখানি গাড়ী আসিয়া দাঁড়াইল; তন্মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় ও তাঁহার ভাগিনেয় শচীন্দ্র বসিয়াছিলেন।
তখন রামকৃষ্ণ বাবু সাদাসিধে পরিচ্ছদে এবং গঙ্গাধর বাবু [অন্য একজন ইনস্পেক্টর] পুলিশের ইউনিফৰ্ম্মে দেবেন্দ্রবিজয়ের গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন। কোচ ম্যান গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে গাড়ীতে তুলিয়া লওয়া হইল।
যথা সময়ে সকলে সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। যথায় নারী-পিশাচী ডাকিনী জুমেলিয়াকে প্রোথিত করা হইয়াছিল, তথায় সকলে উপস্থিত হইলেন।
তথায় দুইজন ধাঙ্গড় তাহাদের কোদাল, সাবল ইত্যাদি যন্ত্র লইয়া উপস্থিত ছিল।
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট অনুমতি করিলে তাহারা জুমেলিয়ার কবর খননে প্রবৃত্ত হইল।
যখন কবর হইতে শবাধার উত্তেলিত ও উন্মুক্ত হইবে, তখন তাহাদিগের সম্মুখে কি যে একটা অভিনব দৃপ্ত প্রদর্শিত হইবে, তাহাই তখন সেই পুলিশ-কৰ্ম্মচারিত্রয় ও গোয়েন্দাদ্বয় ভাবিতেছিলেন। আগ্রহপূর্ণলোচনে উদ্গ্ৰীব হইয়া প্রত্যেকেই নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভূগর্ভ হইতে শবাধার বহিষ্কৃত হইল – শবাধার অত্যন্ত ভারযুক্ত; তদনুভবে তথাকার সকলেই বুঝিতে পারিলেন, তাহা শূন্য নহে, সেই শবাধার মধ্যে জুমেলিয়ার মৃতদেহ আছে। দেবেন্দ্রবিজয় যথেষ্ট অপ্রতিভ ও চিন্তাযুক্ত হইলেন। সত্যই কি তাহাকে তাহাদের নিকট অপমানিত হইতে হইল? ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া, পরিহাসব্যঞ্জক ভ্রভঙ্গি করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় অনুমানে এই রহস্তের ভাব এখন অনেকটা বুঝিয়া লইতে পারিলেন। পরক্ষণে যখন সেই শবাধারের আচ্ছাদন উন্মুক্ত করা হইল, তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের স্নান মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল—সকলেরই কণ্ঠ হইতে এক প্রকার বিস্ময়স্থচক শব্দ নিঃস্থত হইল। সকলেই চমকিতচিত্তে, বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে শবাধারের প্রতি চাহিয়া রছিলেন। তাঁহারা সেই শবাধারে শব দেখিতে পাইলেন বটে, কিন্তু সে শব ত জুমেলিয়ার নহে-স্ত্রীলোকের নহে–পুরুষের ভদ্রোচিত পরিচ্ছদধারী কোন সুন্দর যুবকের—এ কি হইল!
দেবেন্দ্রবিজর ভিন্ন আর সকলেই এককালে স্তম্ভিত ও প্রায় বিলুপ্তচৈতন্ত্য হইয়া পড়িলেন।
অনেকক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু প্রকৃতিস্থ হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, এ কি ব্যাপার হে! কিছু বুঝতে পার কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কছিলেন, “যা’ ঘটেছে, তা সহজেই আমি বুঝতে পেরেছি।”
রা। তা’ তুমি পার; এখন আমাদের বুঝা ও দেখি; আমার ত বোধ হচ্ছে, আমি এখন স্বপ্ন দেখছি।
দে। [ মৃতদেহ নির্দেশে ] এই লোকটাকেই জুমেলিয়া নিশ্চয়ই সেই পত্ৰখানা লিখে থাকবে; এই লোকটারই সে স্ত্রী হ’তে চেয়েছিল। তার কথামত এই যুবক কাজ করে। জুমেলিয়া একে যেমন যেমন ব’লে দিয়েছিল, এ লোকটি সেই সেই উপায়ে জুমেলিয়াকে উদ্ধার ক’রে থাকবে। তার পর সেই পিশাচী তার এই উদ্ধারকতাঁকে হত্যা করেছে; নিজের শবাধারে এই মৃতদেহ পুর্ণ ক’রে নিজেরই কবর-গহবরে প্রোথিত ক’রে শেষে পলায়ন করেছে। আমার বিশ্বাস, জুমেলিয়া এখন এই দেশেই আছে; তার কারণ এই যে, এ ব্যক্তিই জুমেলিয়াকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছিল, এ তার এই গুপ্তরহস্য ও তাহার জীবিত থাকার কথা অবগত ছিল; পাছে এই লোকটা পরে সেই সকল কথা অন্তের কাছে প্রকাশ করে, এই ভয়ে জুমেলিয়া ইহাকে হত্যা করেছে। মনে করেছে সে, সে এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ হ’তে পেরেছে; সকলেই এখন বুঝবে, জুমেলিয়ার মৃত্যু হয়েছে, এখন আর কেহ তার সন্ধানে ফিরবে না।
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সেখানকার সকলেই অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।
রামকৃষ্ণ বাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, তোমার সেই পত্রের সঙ্গে একটা বিষয় ঠিক মিলছে না; তোমার সেই পত্রের হিসাবে যদি ধরা যায়, তা’ হ’লে এই লোকটার মৃতদেহ পাঁচদিন এইখানে আছে, কেমন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হঁ৷ ”
বুামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এ মৃতদেহ পাঁচদিনের বলে কিছুতেই বোধ হয় না; বেশ টাটুকা রয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এর দুটী কারণ আছে।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট জিজ্ঞাসিলেন, “পাঁচদিনের মড়া এমন টাট্কা থাকবার কারণ কি, বলুন দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “প্রথম কারণ, লোকটাকে হঠাৎ হত্য করা হয়েছে, শরীরের সমস্ত রক্ত বাহির হইতে পারে নাই। দ্বিতীয় কারণ, মৃত্যুর পরেই বিনা-বিলম্বে কবরস্থ করায় বাহিরের বাতাস অধিকক্ষণ এ মৃতদেহে সঞ্চালিত হ’তে পারে নাই।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বলিলেন, “তা যেন হ’ল, কিন্তু এখন এ খুনটার তদন্ত করা বিশেষ আবশ্যক। জুমেলিয়ার দ্বারা কি প্রকারে এ খুন হ’তে পারে? তাকে যখন কবর দেওয়া হয়, সঙ্গে কোন অস্ত্র-শস্ত্র দেওয়া হয়েছিল কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিল্লেন, “স্বীকার করি, ছিল না; কিন্তু এই হতভাগ্য যখন জুমেলিয়াকে উদ্ধার করতে আসে, তখন যে এর কাছে কোন প্রকার সাংঘাতিক অস্ত্র ছিল না—এ কথা সম্ভব নয়। ডাকিনী নিজ অভীষ্টসিদ্ধ করবে ব’লে কোন ছলে ইহারই সেই অস্ত্র গ্রহণ ক’রে থাকবে।
ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এস, এখন দেখা যাক, লোকটা কে। সে সন্ধান আগে ক’রে তার পর কিরূপে খুন হয়েছে, সে বিষয়ের মীমাংস হবে।
শবাধার হইতে শবদেহ বাহির করা হইল; শচীন্দ্র তৎ-পরীক্ষার্থে নিযুক্ত হইল; অন্তান্ত সকলে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
মৃতব্যক্তির পরিধানে সূক্ষ্ম দেশীবস্ত্র, ফুলদার মোগল-আস্তিন জামা, সাঁচ্চাজরীর কাজ করা টুপী, দক্ষিণ হস্তের অনামিকা ও মধ্যমাঙ্গুলিতে দুইটা হীরকাঙ্গুরী, জামার বুক পকেটে সোণার ঘড়ী ও চেইন। ভিতর কার পকেটে একখানি কলম-কাটা ছুরি, একটা রীংএ এক গোছা চাবী, বিশ টাকার একখানি নোট, চারিট টাকা, দুইটা সিকি, তিনটা দ্রুয়ানী, দুখানি রেশমী ( একখানি রংদার—একখানি সাদা ) রুমাল, একটা ক্ষুদ্র পিস্তল ও কয়েকখানি পত্র।
পত্রগুলি অন্তান্ত বিষয়-সম্বন্ধে লিখিত। সকলগুলির শিরোনাম ‘সেখ কবীরুদিন, সাং খিদিরপুর, মেটেবুরুজ * নং * * * লেন, লিখিত রহিয়াছে।
সেই মৃত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা সম্বন্ধে আর কাহারও কোন সন্দেহ রহিল না। দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রামকৃষ্ণ বাবু, জুমেলিয়াকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে, তা আমি অনুমানে কতকটা বুঝেছি।”
রামকৃষ্ণ বাবু জিজ্ঞাসিলেন, “কোথায়?”
দেবেন্দ্র। থিরোজা বিবির বাড়ীতে ঐ ঠিকানায় থিরোজা বিবির বাড়ী। রামকৃষ্ণ বাবু, এখন ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে, সব বুঝতে পেরেছ কি?
রাম। বড়ই অদ্ভূত, আমি হতবুদ্ধি হ’য়ে গেছি!
দে। জুমেলিয়াকে এখন কি বোধ কর? এমন অদ্ভূত স্ত্রীলোক আর কোথায়ও দেখেছ কি?
রা। না, পরেও যে কখন দেখতে পাব—বিশ্বাস হয় না। দেবেন্দ্র বাবু, তুমিও তাকে কিছু না-কিছু ভয় কর; কেমন কি না?
দে। তার বিক্রম আর বাহাদুরীকে আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, আর আমার স্ত্রীর উপরে তার যেরূপ গুঢ় অভিসন্ধি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে; কিন্তু ভয়? ‘ভয়’ কাকে বলে, তা আমি জানি না— ভয়’ শব্দটি সুমাৱ জন্মপত্রিকায় লেখা নাই।
রা। এখন তুমি কি করবে?
দে। তার সন্ধানে যাব।
রা। সন্ধান পাবে কি?
দে। সম্ভব—ন পেতে পারি; কিন্তু তা’ হ’লে এই আমার জীবনে প্রথম অকৃতকাৰ্য্যতা।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
থিরোজা বিবি
পরদিন বেলা দশটার সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় বুদ্ধ, মুসলমান-বেশে মেটেবুরুজে থিরোজা বাইএর বাটীতে উপস্থিত হইলেন—হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
দ্বারে বারদ্বয় করাঘাত করিবামাত্র একটী সুন্দরী স্ত্রীলোক দ্বারোদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখা দিল। তাহার বয়স ছাবিবশ-সাতাশ বৎসর হইবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠনপ্রণালী পরিপাটি ও সুন্দর। রমণী সুন্দরী। কৃষ্ণতার নয়নের নিম্নপ্রান্তে অতি স্বল্প কজ্জলরেখা তাহার প্রচুরায়ত নয়ন যুগলের সমধিক শোভাবৰ্দ্ধন করিতেছে। পরিধানে প্রশস্ত সাচ্চাজরীর কাজ করা, সাঁচ্চা সন্মা-চুমকী বসান, ঘন নীলরঙ্গের পেশোয়াজ। উন্নত ও সুঠাম বক্ষোদেশে সবুজ রংএর সাটিনের কাঞ্চলী। তাহার উপরে হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ম ওড়না। টিকল নাসিকায় একটি ক্ষুদ্র নর্থ, একগাছি সরু রেশম দিয়া নথ হইতে কর্ণে টানা-বাধা। রমণী চম্পকবরণী, তাহাতে আবার নীলবসন; তাহার অনন্তরূপে সৌন্দৰ্য্যরাশি উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে। এই সুন্দরীর নাম থিরোজা বাই।
ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখীন হইয়া থিরোজা বাই জিজ্ঞাসিল, “কে আপনি মহাশয়? কাহাকে খুঁজেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখানে কবীরুদ্দীন নামে কেহ থাকে?”
থিরোজা। হা মহাশয়, থাকে বটে।
দেবেন্দ্র। তার সঙ্গে কি এখন আমার সাক্ষাৎ হ’তে পারে?
থি। না, তিনি আজ তিন-চারিদিন কোথায় গেছেন, এখনও ফিরিয়া আসেন নাই। তাঁহার চলিয়া যাইবার পরে তাঁহার এক ভগিনী আসিয়াছেন; তিনিও তাঁহার দাদার সহিত দেখা করিবার জন্য এখনও অপেক্ষা করিতেছেন।
দে। কোন দিন কবীর ফিরবে, তা কি তাহার ভগিনী জানে?
থি। বলিতে পারি না।
দে। তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ দেখি?
থি। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি।
দে। কোথায়, কোন ঘরে কবীর থাকে?
থি। ত্রিতলের একটা বড় ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন।
দে। কবীরের ভগিনী আমার পর নয়, আমি তার কাকা হই; তার সঙ্গে দেখা করতে উপরে যেতে আমার বাধা কি? তুমিও আমার সঙ্গে এস।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ছদ্মবেশে
থিরোজ বাই দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া ত্রিতলে উঠিল; তথায় যে কক্ষ কবীরুদ্দীনের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহা দেখাইয়া বাহিরে দণ্ডায়মান রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন, তন্মধ্যে কেহ নাই। একপার্শ্বে একখানা টেবিল—নিকটেই একখানা চেয়ার পড়িয়া রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় টেবিলের উপর দুইখানি পত্র পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন। থিরোজাকে ডাকিয়া বলিলেন, “কই, কেহ নাই ত!”
“চ’লে গেছেন–কখন গেলেন! কি আশ্চৰ্য্য, একি কথা! আমাকে কিছু বলে যান নি ত।” এই বলিয়া থিরোজ বাই সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল; বলিল, “তিনি ত বলিয়াছিলেন, তাহার দাদার সঙ্গে দেখা না ক’রে যাইবেন না।”
কক্ষমধ্যে টেবিলের উপর যে দুইখানি পত্র পড়িয়া ছিল, তাহার একখানি থিরোজ বাইএর, অপরখানি ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নামে।
“দুইখানি পত্র রেখে গেছে—একখানি ত আমার দেখছি; অপরখানি বুঝি তোমার—এই লও,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় একখানি নিজে লইয়া অপরখানি থিরোজার হাতে দিলেন।
থিরোজ বাই বলিল, “তাই ত, আপনার জন্যও একখান লিখে গেছেন; আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, এ ইচ্ছা বোধ হয়, তার নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কবীরের না থাকতে পারে; কিন্তু তার ভগিনী আমার ভয়ে পালাবে কেন? কবীর যে পালাবে, তা আমি জানি। কবীর ভারি বখাট্, যতদূর ফিচেল ছোকরা হতে হয়—ছোঁড়াটা আমাকে চিরকাল জ্বালিয়ে মারলে!”
থিরোজা বাই তখনই তাহার পত্ৰখানি আপন-মনে পাঠ করিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় নিজের পত্ৰখানি নিজের চোখের সম্মুথে ধরিলেন বটে, কিন্তু দৃষ্টি রাখিলেন–থিরোজার পত্রের উপর। থিরোজার পত্রে বড় বেশি কিছু লেখা ছিল না, কেবল দুই-একটা বাজে কথামাত্র।
“তাই ত, স্ত্রীলোকটি এখন কিছুদিনের জন্য এখান থেকে চ’লে গেলেন। ব্যাপার কি, কিছু ত বুঝতে পারলেম না। লিখছেন, তার ভাই কবীর এখন আর ফিরবেন না।” গিরোজ বই এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কোথায় গেল, ত’ কিছু তোমার ত্রে লিখে নাই?”
“না, কই আমার পত্রে ত তা’ কিছু লেখেন নাই—আপনার পত্রে?”
“কিছু না—কিছু না।”
“কি জানি, তাদের মনের কথা কি?”
“আমার ভয়েই তা’র পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
“কেন, আপনাকে তাদের এত ভয় কেন?”
“আছে, একটা মস্ত ভয়ের কাজ কবীর ক’রে ফেলেছে।”
“কি রকম! কি রকম?”
“ইদানীং সে কি বড় ভাবত, বড় খিটখিটে মেজাজ হ’য়ে পড়েছিল?”
“হাঁ, তা কতকটা হয়েছিল বটে।”
“মুখখানা শুকিয়ে আমসী হ’য়ে গেছল কি না, বল দেখি?”
“হাঁ, মুখখান কেমন এক রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে দেখাত।”
“বড় একটা কারও সঙ্গে কথাবার্তা, কি কোন বিষয়ে গল্প-সল্প করত না?”
“না, একেবারেই তিনি মুখ বন্ধ করেছিলেন।”
“কতদিন তুমি তাকে এ রকম দেখে আসছ?”
“প্রায় সপ্তাহ তিনেক।”
“এর ভিতর অনেক কথা আছে—শোন ত, বুঝতে পারবে।”
“বলুন।”
“হাঁ, তিন সপ্তাহ হবে, কবীর অন্ত আর একজনের নামে একখানা দলিলে জাল সই করেছে।”
“জাল!”
“হাঁ, জাল; এখন সেই কথা আদালতে উঠিবার উপক্রম হয়েছে—
সব প্রকাশ পেয়েছে।”
“অ্যাঁ, তবে ত বড় সৰ্ব্বনেশে কথা!”
“হাঁ, তবে একটা উপায় আছে।”
“কি?”
“সে যে নাম সহি করেছে, সে আমারই নাম।”
“তার পর?”
“তাই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম; এখন আমি তার সকল অপরাধ মার্জন করতে প্রস্তুত আছি; তার এ কলঙ্কের কথা ভুলে যেতে প্রস্তুত আছি; তার জন্য—তার এই বিপত্নদ্ধারের জন্য আমি শতাবধি টাকা সঙ্গেও এনেছি; মনে করেছিলাম, তাকে সেইগুলো দিয়ে যাতে ভবিষ্যতে আর এমন বদখেয়ালীতে হাত না দেয়, তা বুঝিয়ে বলব।”
“আপনি বড়ই সদাশয়, বড়ই দয়ালু আপনি।”
“দয়ালু হ’লে কি হবে? সে যে পাজীর পা-ঝাড়া—সে কি আমার দয়া চায়—না আমাকে মানে? বেকুব –বেকুব – বড়ই বেকুব বড় দুঃখের বিষয়, আমি তাকে কত ভালবাসি, সে একদিনও মনে বুঝে দেখলে না। যাই হ’ক, তুমি একটু অনুগ্রহ—”
[বাধা দিয়া] “কি বলুন, অনুগ্রহ আবার কি?”
“সে কিংবা তার সেই ভগিনী, আবার এখানে ফিরে আসতে পারে।”
“আমার তা’ ত বিশ্বাস হয় না।”
“চিঠি-পত্ৰও তোমাকে লিখতে পারে।”
“তা’ লিখতে পারেন, সম্ভব।”
“তা সে লিখ বেই লিখবে।”
“বেশ বেশ, তা’ হ’লে আমি তাকে পত্রদ্বারা আপনার কথা জানাব।”
“না, থিরোজা বিবি, তা হ’লে বড় মুস্কিল বেধে যাবে; সে ভারি একগুঁয়ে—ভারি বেয়াড় বদ্স্বভাব তার, আমার কথা এখন তার কাছে কিছুতে প্রকাশ ক’রে না—তাকে এখন কিছু ব’লে না—সে কোথায় থাকে, কেবল তাই তুমি গোপনে আমাকে পত্র লিখে জানাবে, তা’ হ’লেই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারব। আমার জন্য যে পত্ৰখানা রেখে গেছে, সে পত্রের কথা যদি জিজ্ঞাসা করে, তুমি ‘জানি না’ ব’লে একেবারে উডিয়ে দিয়ে। দাও, তোমার পত্রের একপাশে আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যাই।” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার হস্তস্থিত পত্ৰখানি লইয়া তাহার একপার্শ্বে উডেনপেন্সিলে অপ্রকৃত নামে নিজের ঠিকানা লিখিয়ু দিলেন। বলিলেন, “এখন তবে আসি—সেলাম।”
“সেলাম।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার পত্র
“মায়াবিনী জুমেলিয়া, যথার্থই মায়াবিনী।” দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার বাটী ত্যাগ করিয়া যখন পথে বহির্গত হইলেন; আপনা-আপনি অনুচ্চস্বরে বলিলেন।
কবর অনুসন্ধান করা হইয়াছে এবং সে যে জীবিত আছে, এ কথা তিনি অবগত হইয়াছেন, তাহ জুমেলিয়া যে জানিতে পারিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় অনুভবে তাহা বুঝিয়া লইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় গিরোজা বাইএর বাটীতে যে পত্ৰখানি পাইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি সে বিষয়ের যথাসম্ভব প্রমাণও প্রাপ্ত হইলেন। কবীরের বাসায় তাহার ভগিনী বলিয়া যে সপ্তাহাধিককাল অবস্থিতি করিতেছিল, সে যে জুমেলিয়া ছাড়া আর কেহই নয়, তাহা বুঝিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বড় বিলম্ব হইল না।
পত্ৰখানি নূতন ধরণের—অতিশয় অলৌকিক! তাহার প্রতি ছত্রে জুমেলিয়ার সেই পৈশাচিক হৃদয় এবং কল্পনার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, আমরা তাহ অবিকল লিপিবদ্ধ করিলাম; —
“শ্ৰীল শ্রীযুক্ত মরণাপন্ন গোয়েন্দা
দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র
আমার হতগৰ্ব্ব প্রতিদ্বন্দী
মহাশয় সমীপেযু;—
আবার আমরা উভয়ে সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ। এইবার তোমার প্রতি আমার ভীষণ আক্রমণ অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমি ধীরে ধীরে, একটির পর একটি করিয়া, এক-একটি কাজ সমাধা করিয়া আসিতেছিলাম; এবার এখন হইতে তোমার বিরুদ্ধজনক আমার সকল উদ্যম অতি দ্রুত স্বসম্পন্ন হইবে।
তুমি কিছুই জানবে না—শুনবে না—জানতেও পারবে না, এমন ভাবে হঠাৎ আমি তোমাকে নিহত করিব। থাম—পত্রপাঠ অল্পক্ষণের নিমিত্ত একবার বন্ধ ক’রে আগে মনে মনে ভাল ক’রে ভেবে দেখ দেখি, আমি তোমাকে কত ঘৃণা করি! কেমন মেয়ে আমি!
আমি ভাবিয়াছিলাম, আঁধারে আঁধারে—গোপনে আমার এই কাৰ্য্য সিদ্ধ করিব; তাহ হইল না। আমি জীবিত আছি, তাহা তুমি জানিতে পারিয়াছ। পারিয়াছ? ক্ষতি কি?
আমি ভয় পাইবার—জুজু দেখিয়া আঁৎকে উঠিবার মেয়ে নহি! এ জুমেলিয়া! তোমাকে এক নিমেষে সাত-সমুদ্র তের-নদীর জল আস্বাদন করাইয়া আনিতে পারে।
গোয়েন্দা মহাশয় গো, এ বড় শক্ত মেয়ের পাল্লা—বড় শক্ত! বুঝিয়া-সুঝিয়া সুবিধা মত কাজে হাত দিলে ভাল করিতে। তুমি কি করিবে? তোমার পত্নীর বৈধব্য যে অবশ্যম্ভাবী।
জুমেলিয়া কেমন তোমাকে কাণে ধরিয়া ঘুরপাক খাওয়াইতেছে, বুঝিতে পারিতেছ কি? তা কি আর পার নাই!
আর বেশি দিন ঘুরিতে হইবে ন!—শীঘ্রই মরিবে—যমপুরী আলো করিবে। কেন বাপু, প্রাণটি খোয়াইতে জুমেলিয়ার সঙ্গে লাগিয়াছিলে? এই বেলা উইল-পত্র যাহা করিতে হয়, করিয়া ফেল। চিত্রগুপ্তের তালিকা-বহিতে তোমার নাম উঠিয়াছে।
যখন তুমি আর তোমার দুই-চারিজন বন্ধু আমার গোর খুড়ে শবাধার বহিরু কর, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ আমি সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হই; গোপনে তোমাদের সকল কাৰ্য্যই দেখিয়াছি—সকল কথাই শুনিয়াছি।
কেমন করিয়া তুমি আমার এ গুপ্তচক্র ভেদ করিতে পারিলে— কেমন করিয়া তুমি গুপ্তসংবাদ জানিতে পারিয়াছিলে, তাহা আমি জানি না; কিন্তু বুঝিতে পারিয়াছিলাম, থিরোজ বিবির বাড়ীর ঠিকানা অনুসন্ধানে তোমরা পাইবে, এবং তাতে আমি কোথায় থাকিব, তাহী বুঝিয়া লইতে পারিবে।
দেবেন, তুমি ধূৰ্ত্ত বটে! বুদ্ধিমান বটে! যদি তুমি সৎপথাবলম্বী ন হইতে, যদি তুমি বুদ্ধিমান হইয়া এমন নিৰ্ব্বোধ না হইতে, আমি তোমাকে সত্য বলছি, তোমার এই তীক্ষবুদ্ধির জন্য আমি তোমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসতেম।
ডাক্তার ফুলসাহেব ছাড়া আমার সমকক্ষ হইতে পারে, এ পর্য্যন্ত আর কাহাকেও দেখি নাই; কেবল তোমাকেই এক্ষণে দেখিতেছি; তা’ বলিয়া তোমাকে আমি ভয় করিয়া চলি না—চলিবও না। আমি ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, জুমেলিয়া ভয় পাইবার মেয়ে নয়।
ফুলসাহেব বয়সে বড় ছিলেন; তুমি যুবা বটে, কিন্তু বড় ধৰ্ম্মভীরু। কি ভ্রম, তোমাকে ভালবাসিতে আমার প্রাণ চায়; চাহিলে হইবে কি, তুমি যা’ চাহিবে, তা আমি জানি; তুমি যে আমাকে ভালবাসিবে না—তা আমি জানি, তাই ত তোমার উপরে আমার এত ঘৃণা।
জুমেলিয়া শুধু ঘৃণা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু হিংসা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু শঠতা করিতে জানে না—জুমেলিয়া প্রাণ দিয়া ভালবাসিতেও জানে। যদি তুমি আমার প্রতি একবার প্রেম-কটাক্ষপাত করিতে, তাহা হইলে জানিতে পারিতে, জুমেলিয়া কেমন প্রাণ সঁপিয়া ভালবাসিতে জানে, কেমন সোহাগ করিতে জানে, কেমন আদর করিতে জানে, কেমন স্বৰ্গীয় সুখসাগরে প্রেমিককে ভাসাইতে জানে; বুঝিতে পারিতে, জুমেলিয়ার মুখচুম্বনে কত সুখ পাওয়া যায়! জুমেলিয়ার বুকে বুক বাখিলে কেমন তৃপ্তি হয়।
তুমি আমাকে মনোরমার বিষয়-সম্পত্তির অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়াছ, সেইজন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি—তোমার স্ত্রীকে ঘৃণা করি—শচীন্দ্রকে ঘৃণা করি—শ্ৰীশচন্দ্রকে ঘৃণা করি—মনোরমাকে ঘৃণা করি—আরও দুই-চালিজনকে ঘৃণা করি।
তুমি আমাকে ভাল রকমে জান, আমি কোন অভিপ্রারে এত কথা লিখিতেছি, মনে মনে বুঝিয়া দেখিয়ো।
যাহাদের আমি ঘৃণা করি, তাহারা শীঘ্রই মরিবে।
আমি আমার বাসনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত বেশ একটা সদ্বপায় স্থির করিয়া রাখিয়াছি; যে সময়ে তোমাকে এই পত্র দ্বারা সতর্ক করা হইতেছে, সেই সময়ের মধ্যেই জুমেলিয়ার কাছে তুমি পরাজিত হইলে। সদা সাবধান থাকিয়ো।
আমি তোমার নারী-অরি
জুমেলা।”
নবম পরিচ্ছেদ
কুসংবাদ
পত্রের একস্থানে লিখিত আছে, জুমেলিয়ার প্রাগুক্ত পত্রপাঠ-সময়ের মধ্যেই দেবেন্দ্রবিজয় তাহার নিকটে পরাজিত হইয়াছেন। জুমেলিয়া যদিও মানবী—কিন্তু তাহার কল্পনায়—তাহার অভিরুচিতে—তাহার আচরণে—সে পিশাচী অপেক্ষা ও ভয়ঙ্করী।
দেবেন্দ্রবিজয় নিজের জন্য ভীত নহেন, তাহার স্নেহাম্পদগণের জন্য তিনি চিন্তিত ও উৎকন্তিত।
কে জানে, জুমেলিয়া এক্ষণে কাহাকে প্রথম আক্রমণ করিবে? কাহাকে সে প্রথম লক্ষ্য করিবে? দেবেন্দ্রবিজয় পকেটে পত্ৰখানি রাখিয়া গৃহাভিমুণে দ্রুতবেগে গমন করিলেন।
বাটীর সদর দরজায় শ্ৰীশচন্দ্র দণ্ডায়মান ছিল, দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া তাহার নয়নদ্বয় আনন্দোদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহা দেখিতে পাইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ! তুমি এখানে? ব্যাপার কি?”
শ্ৰীশচন্দ্র উত্তরে কহিল, “যাই হ’ক , আপনাকে দেখে এখন ভরসা হ’ল, মাষ্টীর মশাই, বড়ই ভাবনা হচ্ছিল; মনে করেছিলাম না জানি, কি সৰ্ব্বনাশ হয়েছে!”
দেবেন্দ্র। কেন, এ কথা বলিতেছ কেন? কি হইয়াছে?
শ্ৰীশ। শুনলেম, আপনাকে না কি কে বিষ খাইয়েছে—আপনার জীবনের আশা নাই।
দে। কে এ সংবাদ দিল? কতক্ষণ এ সংবাদ পেয়েছ?
শ্ৰী। কেন? প্রায় দুইঘণ্টা হবে।
দে। কে এ সংবাদ দিয়েছে?
শ্ৰী। একজন পাহারা ওয়ালা।
দে। সংবাদটা কি?
শ্ৰী। পাহারাওয়ালাট এসে বললে, কে একট। মেয়ে মানুষ আপনাকে বিষ খাইয়েছে; আপনি অজ্ঞান হ’য়ে থানায় পড়ে আছেন; আপনার তাতে জীবনসংশয় ভেবে সেখানকার সকলেই ভয় পেয়েছে, সেইজন্য সে তাড়াতাড়ি মামী-মাকে* নিয়ে যেতে
এসেছিল।
দে। কোথায় যেতে হবে?
শ্ৰী। থানায়।
দে। তার সঙ্গে তিনি গেছেন? ত্র। না।
দে। ধন্য ঈশ্বর।
শ্ৰী। মামী-ম। তখনই তার সঙ্গে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে শচী দাদা এসে পড়েন।
দে। ঠিক সেই সময়ে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। শচী দাদা এসে বললেন, তিনিই আপনাকে দেখতে যাবেন। মামী-মা তার সঙ্গে যেতে চাইলেন।
দে। তার পর?
শ্ৰী। তিনি মামী-মার কথায় কাণ দিলেন না।
দে। [ সহৰ্ষে ] শচীন্দ্র ভাল করেছে—বুদ্ধিমান ছোকরা—বুদ্ধির কাজই করেছে।
শ্ৰী। তিনি বললেন, ‘আমি আগে যাই, তাতে যদি মামা-বাবু আপনাকে নিয়ে যেতে বলেন, আমি খবর পাঠাব’। এ কথা মামী-ম। কিছুতেই শুনিবেন না; শেষে শচী দাদা অনেক ক’রে বুঝিয়ে রেখে একাই চ’লে গেলেন।
দে। যা হউক, বিপদটা ভালয় ভালয় কেটে গেছে; তোমার মামীমাকে গিয়ে বল, আমি এসেছি।
শ্রী। কই, এখনও মামী-মা ফিরে আসেন নি।
দে। [ সবিস্ময়ে ] ফিরে আসেন নি কি!
শ্ৰী। না, মাষ্টার মহাশয়।
দে। কোথায় গেলেন তিনি?
শ্রী। আপনাকে দেখতে।
দে। আমাকে দেখতে! এই না তুমি আমাকে বললে, শচীন্দ্রের নিকট হ’তে কোন খবর না এলে তিনি যাবেন না?
শ্ৰী। হাঁ তা’ত বললেম।
দে। [ ব্যগ্রভাবে ] তবে আবার তুমি এ কি বলছ?
শ্ৰী। শচী দাদা ত লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। [ সাশ্চর্য্যে ] অ্যাঁ!
শ্ৰী। তিনি ত মামী-মাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। কতক্ষণ?
শ্ৰী। প্রায় একঘণ্টা হ’ল।
দে। [ উদ্বেগে ] অ্যাঁ। তার পর—তার পর? শ্ৰীশ, বল—বল, শীঘ্র বল—যা’ জান তুমি শীঘ্র বল—কে এসেছিল? খবর নিয়ে কে আবার এসেছিল।
শ্ৰী। পাহারাওয়ালা।
দে। যে আগে এসেছিল সে-ই?
শ্ৰী। হাঁ, সে-ই।
দে। তুমি জান তাকে?
শ্ৰী। না।
দে। কি লোক সে?
শ্ৰী। মুসলমান।
দে। সে ফিরে এসে কি বললে?
শ্ৰী। কি বলবে? কিছুই না।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। একখানা চিঠি এনেছিল।
দে। শচীন্দ্রের নিকট হ’তে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। তুমি সে চিঠি দেখেছ?
শ্ৰী। আমার কাছে সেখানা আছে।
দে। কই, কই দাও দেখি।
শ্ৰী। এই নিন। [ পত্র প্রদান ]
দেবেন্দ্রবিজয় সেই কাগজের টুকরাখানি লইয়া তখনই পাঠ করিলেন। তাহাতে লিখিত ছিল —
“মামী-মা! পত্র পাইবামাত্র আসিবেন; আপনার জন্য একখানা গাড়ী পাঠাইলাম—মামা-বাবুর অবস্থা বড় মন্দ।
শচীন্দ্র ”
—————-
[* শ্ৰীশচন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পত্নী রেবতীকে শচীন্দ্রের ন্যায় মামী-মা বলিয়া ডাকিত।]
দশম পরিচ্ছেদ
“৩৫”
দেবেন্দ্রবিজয় হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন; বিস্ময়, ক্রোধ ও আশঙ্কা যুগপৎ তাঁহার হৃদয় অধিকার করিল; এখনকার মত যন্ত্রণাময়, ভীষণ অবস্থা তিনি
জীবনে আর কখনও ভোগ করেন নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় কিঞ্চিৎ চিন্তার পর কহিলেন, “শ্ৰীশ, সে গাড়ীখান তুমি দেখেছ?”
শ্ৰীশচন্দ্র কহিল, “হাঁ, দেখেছি, গাড়ীখানা একেবারে বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ায়।”
“শচীন্দ্র প্রায় দুই ঘণ্টা গেছে?”
“হাঁ, দুই ঘণ্টা বেশ হবে।”
“তোমার মামী-মা একঘণ্টা গেছেন?”
“হাঁ।”
“কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি জানতেন?
“থানায়।”
“যেখানে শচীন্দ্র গেছে?”
“আজ্ঞে, হাঁ।”
“শচীন্দ্র কি যাবার সময় গাড়ীতে গিয়াছিল?”
“না, মহাশয়।”
“শচীন্দ্র যখন যায়, তখন পাহারাওয়ালা সঙ্গে গাড়ী আনে নাই?”
“না, গাড়ী দেখি নাই।”
“তবে হাটিয়া গিয়াছে?”
“হাঁ, তিনি দৌড়ে আপনাকে দেখতে গেলেন।”
“সে পাহারাওয়ালাও তখনই সঙ্গে ফিরে গিয়েছিল কি?”
“আজ্ঞে, গিয়েছিল।”
“শচীন্দ্রের সঙ্গে গিয়েছিল?”
“না মাষ্টার মহাশয়, পাহারাওয়ালা অন্ত পথ দিয়ে ছুটে গেল।”
“তুমি সে পাহারাওয়ালার কত নম্বর, জান?”
“জানি, ৩৫I”
“এখন যদি তুমি সে লোকটাকে দেখ, চিনতে পার?”
“আজ্ঞে হাঁ৷ ”
“তবে তুমি এখনই থানায় যাও, আমার নাম ক’রে রামকৃষ্ণ বাবুকে বল যে, আমি এখনই পয়ত্রিশ নম্বরের পাহারাওয়ালাকে চাই। তিনি তোমার সঙ্গে যেন তাকে পাঠান।”
তখনই শ্ৰীশচন্দ্র ঊর্দ্ধশ্বাসে থানার দিকে ছুটিল। দেবেন্দ্রবিজয় বহিৰ্ব্বাটীতে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।
এমন সম্মুখীন ভীষণ বিপদে হঠাৎ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে কাৰ্য্য সফল হওয়া দুরে থাক, বরং ইষ্ট করিতে বিষময় ফল প্রসব করিবে, তাহা দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন।
এখন তাঁহাকে ধীর ও সংযতচিত্তে একটির পর একটি করিয়া অনেকগুলি কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। রেবতীকে যে জুমেলিয়া অপহরণ করিয়াছে, তদ্বিয়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।
এইজন্যই কি জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে পত্রে জানাইয়াছিল যে, তাহার পত্রপাঠ সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে তিনি পরাজিত হইলেন? রেবতী গোয়েন্দা-পত্নী—তাঁহাকে গৃহের বাহির করা বড় সহজ ব্যাপার নহে— সুবলীলায় সমাধা হইবারও নহে, জুমেলিয়া প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়াছে—অতি কৌশলপূৰ্ণ চাতুরীর খেলা খেলিয়াছে।