(ওসিআর ভার্সন – বানান সংশোধন করা হয়নি)
নমশূদ্রের ইতিহাস – বিপুল কুমার রায়
বিপুল কুমার রায় একজন নিবেদিত লেখক ও গবেষক। ‘নমশূদ্রের ইতিহাস’ গ্রন্থে তিনি তুলে এনেছেন নমশূদ্র তথা ব্রাত্যসমাজ–প্রাকৃতজনের কথা। লেখক অভিযোগের সুরে ইতিহাসবিদদের দিকেও আঙুল তুলেছেন। কারণ এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা ইতিহাসে কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে ইতিহাসবিদই রয়েছেন। তাহলে ইতিহাসবিদরা কি ইচ্ছা করেই এই বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীকে এড়িয়ে গেছেন? লেখক নমশূদ্রের ইতিহাস গ্রন্থে তুলে এনেছেন জাত-পাত বিভাজনের বহুমাত্রিক ইতিহাস, তুলে এনেছেন অস্পৃশ্যতার ইতিহাস। মুক্তসমাজ বিনির্মাণে এই গ্রন্থটি পাঠক-মহলে সমাদৃত হবে বলে আশা করি। গ্রন্থটি প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
প্রকাশক
.
বিপুল কুমার রায়। জন্ম : ১৪ জানুয়ারি ১৯৬২। জন্মস্থান : গ্রাম মনোখালি, উপজেলা : শালিখা, জেলা : মাগুরা। বাবা : ভগীরথ রায়। মা : লক্ষ্মী রাণী রায়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। শিক্ষা : ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স, এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। অমরেশ বসু কলেজ, আলোকদিয়া, মাগুরা।
প্রকাশক শিহাব বাহাদুর মুক্তচিন্তা ৭৪ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপেক্স ২৫৩-২৫৪ এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা ১২০৫ মোবাইল ০১৭২০৬৩৫৭৮৭, ০১৭১১৫৮৭১৬৯ ই-মেইল : [email protected]
প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৪২৩ আগস্ট ২০১৬
NAMOSHUDRER ITIHAS By Bipul Kumer Roy, Date of Publication: August 2016, Cover: Mostafiz Karigor, Published by Muktochinta, 74 Concord Emporium, 253-254 Elephant Road, Katabon, Dhaka 1205, Mobile 01720635787
.
উৎসর্গ
যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ এখানে আসা
আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা ভগীরথ চন্দ্র রায় মা লক্ষ্মী রাণী রায় এবং আমার অগ্রজ শ্রী ভরত চন্দ্র রায়
.
প্রাককথন
শুরুতেই পাঠকবৃন্দের নিকট করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এই জন্যে যে, বৃহৎ সনাতন হিন্দুসমাজের মধ্যে থেকে আমি একটি সম্প্রদায়ের ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছি। আমার এ ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, বৃহৎ হিন্দুসমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়কে সামান্যতম মর্মাঘাত বা হীন করবার বাসনা আছে, বরং আমি চাইছি একটি অস্পৃশ্য ব্রাত্যসমাজ যুগ-যুগ ধরে অন্ধকার গহ্বরে রয়েছে সেটিকে একটুখানি আলোক দান করা। এমনকি এই নমশূদ্র সম্প্রদায়ের আচরণগত অসঙ্গতিও, যা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে সেগুলি আমি আড়াল না করে অকপটে লিখেছি। একথা সত্য যে, যে কোনো জাতিগোষ্ঠীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ইতিহাস লেখা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার; তথাপিও ভারতবর্ষে বিরাজমান সাত হাজারের উর্ধ্বে জাতি বর্ণ, উপবর্ণের মধ্যে একটি মাত্র জাতির (Caste) ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছি। ভারতবর্ষ মহান সাধু-সন্ত ও উদার সংস্কৃতির তীর্থভূমি; তথাপিও জাত-পাত, অস্পৃশ্যতা ও কৌলিন্যদীর্ণ এদেশীয় আন্ত-সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, বর্ণ-উপবর্ণসমূহ। আমাদের অনেক অনেক মহাপুরুষ যেমন–স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ আন্ত-ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্পৃশ্যতা, কৌলিন্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্ৰহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন; কিন্তু সনাতন ধর্মীয় জাতি বর্ণের বর্ণবাদ নামক ক্যানসারের পরজীবীকে বিনাশ করতে পারেননি, প্রত্যেক জাতি-বর্ণের মধ্যেই কোনো-না-কোনো জাত্যাভিমান, অহমিকা, শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি মনোভাব লুকিয়ে আছে। আমার জীবনের একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে না লিখে পারছি না। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে আমি মাগুরা শহরে সামান্য একচিলতে জমি ক্রয়ের মানসে হন্যে হয়ে ঘুরছি। একটি পাড়ায় চার শতক জমির একটি প্লট ‘বিক্রয় হবে’ দেখে এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম। মহিলাটি উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, ও প্লট বিক্রয় হবে। তা আপনি কী জাত?’ আমি খুব লজ্জাবোধ করছিলাম। তথাপিও বললাম, নমশূদ্র। মহিলাটি বললেন, ‘ও-ও ও! নমশূদ্দুরীর জল চলে?’ আমি কথাটি ভুলতে পারিনি। জল সৃষ্টিকর্তার দান। জলের অপর নাম জীবন। এর মধ্যেও অস্পৃশ্যতা? পরবর্তীতে অবশ্য আমি মহিলাটির জাত সম্পর্কে জেনেছিলাম; তিনি ছিলেন সূত্রধর সম্প্রদায়ভুক্ত! যাহোক, এই জাত বৈষম্যের বিষবাষ্প আমাদের ধমনির রন্দ্রে-রষ্ট্রে প্রবাহিত আমরা প্রত্যেকেই কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, কেউ একজন অপরিচিত হিন্দু নর বা নারীর সাক্ষাৎ পেলেই আগেই তার জাত কী তা জানার কৌতূহল অনুভব করি। এই জাত্যাভিমান প্রসঙ্গে আরও একটি সত্য ঘটনা যেটি ঈশ্বরকোটি পুরুষ স্বয়ং লোকনাথ বাবার জীবনেই ঘটেছিল একা ভাওয়ালরাজ রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের কর্ণে পৌঁছায় বারদীর ব্রহ্মচারী লোকনাথ বাবার অসাধারণ যোগবিভূতি ও লীলামাহাত্ম কাহিনী। মহাপুরুষ দর্শন করবার এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় সপরিষদ বারদীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে চলেছেন রাজা, সঙ্গে পাত্র-মিত্র। সাধু দর্শন করবেন এই অভিলাষ, কিন্তু সাধুর জাত সম্বন্ধে কিছু জানা নেই, সেরকম অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেউই সাধুর চরণ স্পর্শ করে বা মাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবেন না। রাজার আদেশ সবাই স্বীকার করে নেন। কিন্তু বারদী আশ্রমে পৌঁছেই সাক্ষাৎ শিবকল্প সৌম্য কান্তিময় মহাযোগীর অপরূপ রূপলাবণ্য দর্শন করে রাজা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় পরম শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে মাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। তাকে দেখে তার পরিষদ সকলেই বাবার চরণধূলি মাথায় নেন। ছোট শিশুর মতো হাসতে হাসতে বাবা লোকনাথ রাজাকে বলেন, ‘বাবা, তোমরা যে সাধুকে প্রণাম করবে না বলেই স্থির করে এসেছিলে! লজ্জায় মস্তক অবনত হয়ে যায় রাজার। যাহোক আমি বইটিতে নমশূদ্র বর্ণ-উৎপত্তি বিষয়ে ধর্মীয় বা পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক এই তিনটি দিকের প্রতিই যতদূর সম্ভব আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি; তবে আমি মনে করি না যে, আমি এ বিষয়ে শতভাগ সঠিক। ভবিষ্যতে নমশূদ্রদের বিষয়ে আরও গবেষণা হলে আরও তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস রাখি। সত্যিকার অর্থে এত বড় একটি বিশাল জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার সাধুসন্ত, সঙ্গীতশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও পথিকৃৎ রয়েছেন যাদের নাম সংগ্রহ করা আদৌ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশ্য এই বইয়ে এই সকল নমকবি-সাহিত্যিক ও অগ্রদূতের নাম লেখাই আমার অভিপ্রায় নয়! নগণ্য কয়েকজনের নাম আমি। শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরেছি সকলের প্রতিভূ হিসেবে। আমার এই সীমাবদ্ধতাকে পাঠকবৃন্দ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। এই বই রচনাকালে বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন আমার বন্ধুর শ্রী বিপুল কুমার পাঠক, আমার অনুজ কুমারেশ চন্দ্র রায়, নিতাই চন্দ্র সরকার, কুমারেশ চন্দ্র দে, নারায়ণ রায় কেষ্ট সাধু, সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, রেনু বালা, সুচিত্রা, প্রভাতী প্রমূখ। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষক ভ, অশোক বিশ্বাস বইখানির সমৃদ্ধকরণে আমাকে বিশেষভাবে পরামর্শ দিয়ে ঋণী করেছেন। আমার পুত্রপ্রতিম জ্যোতির্ময় রায় পাভেল দুর্লভ বই সংগ্রহ করে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। আমার শুভানুধায়ী ছাত্র রফিকুল, তমাল, সেলিম, জনি যারা বইটির প্রস্তুতিপর্বে অকৃপণভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ পরিশেষে এই কথাটুকু বলতে চাই যে, আমার এই লেখা যদি ক্ষয়িষ্ণু সনাতন হিন্দু সমাজের সামান্যতম কল্যাণে আসে তবে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে মনে করি।
বিনয়াবনত
বিপুল কুমার রায়
.
প্রথম অধ্যায় – নমশূদ্র জাতির উৎপত্তি মিথ ও ইতিহাস
মিথ ও ইতিহাস
নমশূদ্র জাতির উৎপত্তি বিষয়ে সত্যিকারভাবে বাংলার কোনো ঐতিহাসিক সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার প্রাচীন বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে পূর্ববঙ্গের জাতিগুলোর মধ্যে ৩৬টি এবং আরো ৫টি সর্বমোট ৪১টি জাতির বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে নমশূদ্রগণের নাম তিনি কোথাও বর্ণনা করেননি। অথচ নমশূদ্রগণ পূর্ববঙ্গের সর্ববৃহৎ কৃষিজীবী। শ্রেণি। সনাতন হিন্দু সমাজে সর্বজন অনুসরণীয় গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ গীতাতেও নমশূদ্রের কোনো উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিকভাবে শ্রীগীতা প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী হিসেবে প্রচলিত। আমি শ্রীমদ্ভগবদ গীতার একটি শ্লোক এখানে উদ্ধৃত করেছি বিশেষ কৌতূহলে যে, গীতার বর্ণবিভাজনেও নমশূদ্র কথাটির উল্লেখ নেই। এই সুপ্রাচীন গ্রন্থেও যেহেতু এ জাতির কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না তাই আমি এই অধ্যায় এই জাতির উৎপত্তি বিষয়ে বিভিন্ন মিথ, ইতিহাস, নৃতাত্ত্বিক গবেষণা তথা বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে নমশূত্র জাতির অস্তিত্ব অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছি। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় মানুষের গুণ ও কর্মানুসারে তাদের সমাজে বিভাজন করা হয়েছে। গীতার শ্রেণিবিভাজনে কোনো কৌলিন্য বা অস্পৃশ্যতা নেই। অথচ তথাকথিত সমাজে নমশূদ্রগণ কোলিন্য ও অস্পৃশ্যতার শিকার। রমেশচন্দ্র মজুমদার তার বাংলাদেশের ইতিহাস প্রাচীন যুগ গ্রন্থে কোথাও নাশূদ্রের কথাটি লেখেননি। বাস্তবিকপক্ষে মজুমদার যে জেলায় জনুগ্রহণ করেছেন সেই বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাতেই বিপুল সংখ্যক নমশূদ্রের বসবাস। সঙ্গতকারণেই বলতে হয় তবে কি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ জাতির কথা এড়িয়ে গেছেন? কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগবশত নয়, আমি শুধু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে এ জাতির উৎপত্তি বিষয়ে অনুসন্ধান করতে চাই। সত্য বলতে কি শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার যুগে নমশূদ্র জাতির অস্তিত্ব হয়তো-বা ছিল না, শুধু গুণ ও কর্মানুসারে শূদ্র বলে বর্ণিত আছে।
নমশূদ্র
শ্রীমদ্ভগবদ গীতার একটি শ্লোকে উল্লেখ আছে যে–
চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভা গশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ব কর্তারমব্যয়ম্ ॥
অ:৪। শ্লোক ১৩
ব্যাখ্যা–বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করেছি বটে, কিন্তু আমি তার সৃষ্টিকর্তা হলেও আমাকে অকর্তা ও বিকার রহিত বলে জেনো।
শ্রী ভগবান বলছেন, গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি বর্ণচুষ্টয়ের সৃষ্টি করেছি। টীকাকারগণ বলেন, ‘গুণ’ বলতে এখানে ‘সত্ত্ব, রজ, তমঃ’ এই তিন গুণ বোঝায়। ‘সত্ত্ব’ প্রধান ব্রাহ্মণ তাদের কর্ম অধ্যাপনাদি। অল্পসত্ত্বগুণ –বিশিষ্ট রজঃ প্রধান ক্ষত্রিয়–তাদের কর্ম যুদ্ধাদি। অল্প তমোগুণবিশিষ্ট রজঃ প্রধান বৈশ্য-তাদের কর্ম কৃষি-বাণিজ্যাদি। তমঃ প্রধান শূদ্র–তাদের কর্ম অন্য তিন বর্ণের সেবা। এইরূপে গুণানুসারে কর্ম বিভাগ করে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রশ্ন এই যে, নমশূদ্র তাহলে সৃষ্ট হলো কখন এবং কীভাবে? নমশূদ্র যে বর্ণ চতুষ্টয়ের মধ্যে নেই, এটি শ্রী ভগবান সৃষ্ট চতুর্বর্ণের বাইরে। তাহলে নমশূদ্র কে সৃষ্টি করলো? এটি একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। বর্ণভেদ সম্বন্ধে বেদ কী বলেছে? বৈদিক বর্ণভেদ সম্বন্ধে যতদূর জানা যায়, তা হচ্ছে ‘সৃষ্টি অনাদি। সৃষ্টি-প্রলয় অনাদিকাল হতে পুনঃ পুনঃ হচ্ছে, তার আলি নেই। সৃষ্টি অনাদি বলে ধর্মাধর্মরূপ ও কর্মসংস্কার প্রকৃতিতে বা শক্তিতে মহাপ্রলয়ে লীন থাকে।’ প্রলয়ান্তে সৃষ্টিকালে সেই সংস্কারবশত সত্ত্বাদি গুণ প্রাধান্য লয়ে ব্রাহ্মণাদি জাতির সৃষ্টি হয়। সুতরাং এই মতে, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জাতিভেদ, অথবা জাতিভেদ নিয়েই সৃষ্টি। এই মতের মূল ঋগ্বেদ-সংহিতার বিখ্যাত পুরুষ সূক্তের দ্বাদশ ঋক। তা এইরূপ —
ব্রাহ্মনোহস্য মুখমাসীদ্ বাহুরাজন্যকঃ কৃতঃ।
উরূ তদস্য যদ্ বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রোহজয়ত ॥
‘ব্রাহ্মণ সেই পুরুষের (সৃষ্টিকর্তার) মুখ হলেন; ক্ষত্রিয় বাহু (কৃত) হলেন; বৈশ্যই এর ঊরু; পদ হতে শূদ্রের জন্ম হলো।’
সৃষ্টিকালে বিধাতার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের, বাহু হতে ক্ষত্রিয়ের, ঊরু থেকে বৈশ্যের এবং পদযুগল থেকে শূদ্রের জন্ম হয়েছে। এই যে বর্ণসৃষ্টির প্রচলিত মত এটি বৈদিক সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।
ঋগ্বেদীয় সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ থেকে ১১০০ অব্দ পর্যন্ত। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় যে ওই সময়টি ব্রোঞ্জ বা. তাম্র যুগের অন্তর্গত যা খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকে ১২০০ অব্দ-এর মধ্যে বিস্তৃত ছিল। বৈদিক যুগে যে চারখানা বেদ সৃষ্টি হয়েছিল তারমধ্যে ঋগ্ববেদই প্রাচীনতম।
আধুনিক ঐতিহাসিকগণ ঋগ্বেদীয় এই বর্ণ সৃষ্টিমত স্বীকার করেন না। তারা বলেন, প্রাচীন বৈদিক যুগে বর্ণভেদ ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগে লোকসংখা বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মভেদের প্রয়োজন হওয়াতে তার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত এই বর্ণভেদ বংশগত ছিল না, এটি ছিল কর্মর্গত। এক পরিবারের কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য বা শূদ্রের কাজ করতেন। পরে পৌরাণিক যুগে তা বংশগত হয়েছে। মূলত জাতিভেদ বংশগত নয়, গুণ ও কর্মগত। এই মতবাদের পক্ষে ঐতিহাসিকগণ যে যুক্তি প্রদর্শন করেন সেটি নিম্নরূপ–
১. প্রাচীন বৈদিক যুগের সামাজিক, পেশাগত ও ধর্মগত রীতি-নীতি পর্যালোচনা করে কোথাও জাতিভেদের অস্তিত্বের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।
২. পূর্বোক্ত ঋগ্বেদীয় সূক্ত সম্বন্ধে তারা বলেন যে, বেদের অনেক ঋকই রূপক বর্ণনা। মুখাদি থেকে ব্রাহ্মণাদির সৃষ্টির বিবরণও রূপক মাত্র। যারা জ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা দেন তারা সমাজের মুখ স্বরূপ, যারা শক্র থেকে সমাজ রক্ষা করেন তারা বাহু স্বরূপ, যারা অন্ন-বস্ত্রাদির সংস্থান করেন তারা উদর বা উরু স্বরূপ। পূর্বোক্ত ঋকে ‘ব্রাহ্মণ মুখ হতে জন্মিলেন, ক্ষত্রিয় বাহু হতে জন্মিলেন’ এরূপ কথা নেই। সেখানে আছে ‘ব্রাহ্মণোহস্যমুখমাসীৎ’–ব্রাহ্মণ মুখ হলেন ইত্যাদি। তবে শূদ্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘অজয়াত’ অর্থাৎ যে জন্মেনি এমন। বিষয়টি এমন হতে পারে যে আর্যদের পদসেবার জন্য শূদ্ররা ছিল এবং তারা ছিলেন অনার্য। তাঁরা ছিলেন আর্য সংস্কারের বাইরে। সুবিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমূলার বলেন যে, নিজ মত বা সংস্কারের অনুকুল হলে আর্যরা প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করতেন, প্রতিকূল হলে শ্লেচ্ছমত বলে অগ্রাহ্য করতেন। আবার বেদের অন্যান্য স্থলে, যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে (২.১০.১১) ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে (৩.১২.২) বর্ণসমূহের উৎপত্তি অন্যরূপে বর্ণিত হয়েছে এবং তথায় শূদ্রের উল্লেখই নেই, কেবল তিন বর্ণেরই উল্লেখ আছে। এতে অনুমান করা যায় যে শূদ্রগণ সমাজে পরে গৃহীত হয়েছেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, আর্যগণ বিজিত অনার্যদিগকে হিন্দু সমাজে গ্রহণ করে পরিচর্যাত্মক কর্মে নিযুক্ত করেছেন। ঋগ্বেদ প্রাচীনতম গ্রন্থ হলেও এর সব ঋক প্রাচীন নয়। বিভিন্ন সময় রচিত ঋকসমূহ পরবর্তীকালে সংহিতাকারে সঙ্কলিত হয়েছে। উক্ত সূক্তটিও জাতিভেদ প্রবর্তিত হওয়ার পরে রচিত হয়েছে বলে অনেকেই অনুমান করেন।
৩. প্রাচীনকালে সকলেই এক বর্ণ ছিল, পরবর্তীতে গুণ ও কর্ম অনুসারে বর্ণবিভাগ হয়েছে। মহাভারত ও অন্যান্য শাস্ত্রেও এই মতের সমর্থক উক্তি পাওয়া যায়। যথা মহাভারতে ভরদ্বাজ প্রতি ভৃগু বাক্য—
ন বিশেষোহস্তি বর্ণানাং সর্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ
ব্রাহ্মণা পূর্ব সৃষ্টং হি কর্মভিবর্ণাং গতম্ ॥
বর্ণসকলের বিশেষত্ব নেই পূর্বে সকলেই ব্রাহ্মণ ছিল, পরে কর্মানুসারে ক্ষত্রিয়াদি বিবিধ বর্ণ হয়েছে। (শান্তিপর্ব ১৮৮ অ.)। বায়ুপুরাণ, রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থেও এরূপ উক্তি আছে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে সমাজের কথা পরিচ্ছেদে জাতিভেদ সম্বন্ধে লিখেছেন। তিনি বলেন, জাতিভেদ আর্য সমাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর্যগণ এদেশে বসবাস করবার ফলে বাংলায়ও জাতিভেদের প্রবর্তন হয়। এর ফলে বঙ্গ, সুহ্ম, শবর, পুলিন্দ, কিরাত, পুণ্ড্র প্রভৃতি বাংলার আদিম অধিবাসীগণ যাদের প্রাচীন গ্রন্থে ক্ষত্রিয় বলে গণ্য করা হয়। মূলত এরা ক্ষত্রিয় নয়, সকলেই শূদ্র।
বৈদিক ধর্মাবলম্বী আর্যগণ যখন সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের পরাস্থপূর্বক পঞ্চনদের তীরে বসতি স্থাপন করে তখন এবং তার বহুদিন পরেও বাংলাদেশের সাথে তাদের কোনো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না। বৈদিক সূক্তে বাংলার কোনো উল্লেখ নেই। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অনার্য ও দস্যু বলে যে সমুদয় জাতির উল্লেখ আছে, তার মধ্যে পুরেও নাম পাওয়া যায়। এই পুণ্ড্র জাতি উত্তরবঙ্গে বাস করত। এতরেয় আরণ্যকে বঙ্গদেশের লোকের নিন্দাসূচক উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষভাগের রচিত বৌধায়ন ধর্মসূত্রেও পু ও বঙ্গদেশ বৈদিক কৃষ্টি ও সভ্যতার বহির্ভূত বলে বর্ণিত হয়েছে এবং এই দুই দেশে স্বল্পকালের জন্যে বসবাস করলেও আর্যগণের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো এরূপ বিধান আছে। এই সমস্ত উক্তি থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীগণ আর্যজাতির বংশোদ্ভূত নয়। ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীগণ শূদ্র তথা অনার্য বলে অভিহিত হতো। আর্যগণ ভারতবর্ষের এই আদিম বা অনার্য জনসাধারণকে শ্লেচ্ছ বা নীচতর বলে মনে করত।
বাংলাভাষার বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আর্যগণ এদেশে আসার পূর্বে বিভিন্ন জাতি এদেশে বসবাস করত। কিন্তু বাংলার অধিবাসী এই সমুদয় অনার্য জাতির শ্রেণিবিভাগ ও ইতিহাস সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ একমত নন। তাদের বিভিন্ন মতবাদের বিস্তৃত আলোচনা না করে সংক্ষেপে এ সম্বন্ধে কিছু বললেই যথেষ্ট হবে।
বাংলাদেশে কোল, ভীল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় জাতি দেখা যায়, এরা বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। ভারত বর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এবং বাইরেও এই জাতির লোক দেখা যায়। ভাষার মূলগত ঐক্য থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, এই সমুদয় জাতিই একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এই মানবগোষ্ঠীকে ‘অস্ট্রো এশিয়াটিক অথবা ‘অস্ট্রিক’ বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো পণ্ডিতগণ এদেরকে ‘নিষাদ জাতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আদি কবি বাল্মিকীর কবিতায় এই নিষাদ জাতির কথা পাওয়া যায়, যেমন–
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমগমা শ্বাস্বতী সমাঃ
যৎ ক্রোঞ্চ মিথুন দেক মবধি ॥
তাছাড়া রামায়ণেও এই নিষাদ জাতির বর্ণনা রয়েছে। ভারতবর্ষের বাইরে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় এই জাতির সংখ্যা এখনো খুব বেশি। সম্ভবত এরা ভারতবর্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের এই নিষাদ জাতি প্রধানত কৃষিকাজ দ্বারা জীবন ধারণ করত এবং গ্রামে বাস করত।
নিষাদ জাতির পরে আরও কয়েকটি জাতি এদেশে আগমন করে। এদের একটির ভাষা দ্রাবিড় এবং আর একটির ভাষা চীনা-তিব্বতীয়। এদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
এই সকল জাতিকে পরাভূত করে বাংলাদেশে যারা বাসস্থান করেন এবং যাদের বংশধরেরাই প্রধানত বর্তমানে বাংলার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি সমুদয় বর্ণভুক্ত হিন্দুর পূর্বপুরুষ। তাঁরা বৈদিক আর্যগণ থেকে ভিন্ন জাতীয় ছিলেন। কোনো কোনো পণ্ডিত এঁদেরকে আলপাইন জাতি বলেন এবং এরা নিষাদ জাতির অব্যবহিত পরেই বঙ্গদেশে বাস করতে থাকেন। পণ্ডিতগণের অধিকাংশই মনে করেন যে, এই জাতি খুবই উচ্চ সভ্যতার অধিকারী ছিলেন। আর্যদের পূর্বে যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় তার কৃতিত্ব প্রধানত আলপাইন জাতিরই প্রাপ্য।
রিজলী সাহেবের মতে মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে প্রাচীন ভারতীয় জাতির উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই মতের পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি নেই। যাহোক বাংলার আদিম অধিবাসীদের অধিকাংশই সূত্র জাতিভুক্ত হয়েছিল। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে যে, পুক ও কিরাত এই দুই ক্ষত্রিয় জাতি, ব্রাহ্মণের সাথে সংশ্রব না থাকায় এবং শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্মাদির অনুষ্ঠান না করায় ক্ষুদ্রত্ব লাভ করেছে।
আর্য সমাজ প্রথমে চার বর্ণে বিভক্ত থাকলেও পরবর্তীতে বহুসংখ্যক বিভিন্ন জাতির সৃষ্টি হয়। যে সময় বাংলায় আর্য প্রভাব বিস্তৃত হয়, সে সময় আর্য সমাজে এরূপ বহু জাতির উদ্ভব হয়েছে। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে যে, বিভিন্ন বর্ণের পুরুষ ও স্ত্রীর সন্তান থেকে এ সকল মিশ্র বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন বর্ণ অথবা জাতির মিশ্রণের ফলে কোন কোন মিশ্র বর্ণের সৃষ্টি হলো, তারও সুদীর্ঘ তালিকা আছে। তবে, এই তালিকাগুলির মধ্যে অনেক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। মিশ্রবর্ণের উৎপত্তি সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, সেগুলি অধিকাংশস্থলেই কাল্পনিক বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু একথাও অস্বীকার করা কঠিন যে, এরূপ ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করেই প্রধানত সমাজের এই সমুদয় মিশ্র বর্ণের উঁচু-নিচু ভেদ নির্দিষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজে যখন এই জাতিভেদ প্রথা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ভারতবর্ষের সর্বত্রই আর্য সমাজের আদিম চতুর্বর্ণের পরিবর্তে এইরূপ মিশ্র জাতিই সমাজের প্রধান অঙ্গে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাঙালি সমাজের প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে, বাংলার এই মিশ্রজাতি সম্বন্ধে সঠিক ধারণা প্রয়োজন।
ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের পূর্বে হিন্দু যুগে এই জাতি বিভাগের উপর যদি কোনো বিশেষ গ্রন্থ রচিত হতো, তবে জাতিভেদ সম্বন্ধে অনেক পরিষ্কার ধারণা। পাওয়া যেত। তবে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ হিন্দু যুগের অবসানের অব্যবহিত পরেই রচিত, এবং এই দুখানি বইয়ে মিশ্র জাতির বর্ণনা আছে। এটা থেকে বাংলার জাতিভেদ প্রথা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণে উল্লেখ আছে যে, ব্রাহ্মণেতর সমুদয় লোককে ৩৬টি শূদ্র জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে। বাংলায় চলিত কথায় এখনো ছত্রিশ জাতির কথা বলা হয়। এই গ্রন্থে পদ্মা ও বাংলা, যমুনা নদীর উল্লেখও বাংলার সাথে এই গ্রন্থেও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত করে। তবে ব্রাহ্মণ ভিন্ন সকলেই যে শূদ্র জাতীয়, সম্ভবত হিন্দুযুগের সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, এর পরবর্তী যুগের অর্থাৎ উক্ত গ্রন্থরচনা কালের ধারণা।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ থেকে জানা যায় যে, রাজা বেন বর্ণাশ্রম ধর্ম নষ্ট করবার অভিপ্রায়ে বলপূর্বক বিভিন্ন বর্ণের নরনারীর সংযোগ সাধন করেন। এর ফলে মিশ্রবর্ণের উৎপত্তি হয়। এই মিশ্র বর্ণগুলি সবই শূদ্ৰজাতীয় এবং উত্তম, মধ্যম ও অধম এই তিন সঙ্কর শ্রেণিতে বিভক্ত।
করণ, অম্বষ্ঠ, উগ্র মাগধ, তন্তুবায়, গান্ধিকবণিক, নাপিত, গোপ (লেখক), কর্মকার, তৌলিক (সুপারি ব্যবসায়ী), কুম্ভকার, কংসকার, শঙ্খিক, দাস (কৃষিজীবী), বারুজীবী, মাদক, মালাকার, সূত, রাজপুত্র ও তামুলী-এই কুড়িটি উত্তম শঙ্কর।
তক্ষণ, রজক, সূর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তৈলকারক, ধীবর, শৌণ্ডিক, নই, শাবাক, শেখর, জালিক–এই বারোটি মধ্যম শঙ্কর।
মলেহি, কুতুব, চণ্ডাল, বরুড়, তক্ষ, চর্মকার, ঘট্টজীবী, দোলাবাহী ও মলু–এই নয়টি অধম শঙ্কর।
এরা অন্ত্যজ ও বর্ণাশ্রম বহিষ্কৃত। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে ৩৬টি জাতির উল্লেখ আছে, কিন্তু এই তালিকায় আছে ৪১টি। সুতরাং পাঁচটি পরবর্তী কালে সংযোজিত হয়েছে।
ব্রক্ষবৈবর্ত পুরাণে মিশ্র বর্ণেও যে তালিকা আছে, তার সহিত বৃহদ্ধর্ম পুরাণোক্ত তালিকার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। তবে কিছু কিছু প্রভেদও দেখা যায়। এটাতে প্রথমে গোপ, নাপিত, ভি, মোদক, কুরে, তামুলী, স্বর্ণকার ও বণিক ইত্যাদি সৎশূদ্র বলে অভিহিত হয়েছে এবং এর পরই করণ ও অম্বষ্ঠের কথা আছে। তারপর বিশ্বকর্মার ঔরসে শুত্র গর্ভজাত নয়টি শিল্পকার জাতির উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে মালকার, কর্মকার, শঙ্কার, কুবিন্দক (তদ্ভুরায়), কুম্ভকার ও কংসকার–এই ছয়টি উত্তম শিল্পী জাতি। কিন্তু সূর্ণচুরির জন্যে সূর্ণকার ও কর্তব্য অবহেলার জন্যে সূত্রধর ও চিত্রকর এই তিনটি শিল্পী জাতি ব্রহ্মশাপে পতিত। সূর্ণকারের সংসর্গহেতু এবং সূর্ণচুরির জন্যে এক শ্রেণির বণিকও (সম্ভবত সুবর্ণবণিক) ব্রহ্মশাপে পতিত। এরপর পতিত সঙ্কর জাতির এক সুদীর্ঘ তালিকার মধ্যে অট্টালিকাকার, কোটক, তীবর, তৈলকার, লেট, মলু, চর্মকার, শুড়ী, পৌকি, মাংসচ্ছেন, রাজপুত্র, কৈবর্ত (কলিযুগে ধীবর), রজক, কৌয়ালী, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গী প্রভৃতির নাম উল্লেখ আছে।
বৃহকর্ম পুরাণোক্ত অধিকাংশ উত্তম ও মধ্যম শঙ্কর জাতিই ব্রহ্মকৈবর্তে সৎশূদ্র বলে কথিত আছে। বৃহষ্কর্মের ন্যায় এই গ্রন্থেও নানা স্লেচ্ছ জাতির কথা আছে। এতদ্ব্যতীত ব্যাধ, ভড়, কোল, কোথ, হভিজ্ঞ, ডোম, জোলা, বাগতাত, ব্যালগ্রাহী (বেদে) এবং চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় নীচ জাতির উল্লেখ আছে, তাদের প্রায় সমস্তই এখনো বাংলাদেশে বর্তমান।
শ্রীগীতা, বেল, পুরাণোক্ত বিভিন্ন জাতির নাম উপযুক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল। বিস্ময়ের বিষয় যে কোথাও নমশূদ্র জাতির কথা পাওয়া গেল না। তবে সূত্র ও সৎ শুত্র বলে দুটি জাতি পাওয়া যায়, কিন্তু নমশুত্র বলে কোনো কৌম বা জাতির নাম উপযুক্ত গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়নি। নমশুত্রগণ অস্পৃশ্য হিসাবে বিবেচিত। মনে করা যেতে পারে সুদূর প্রাচীনকাল থেকে যারা হিন্দু সমাজ তথা ভারতবর্ষকে শাসন করতে চেয়েছে তারা গোটা সমাজকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছে! হতে পারে সমাজ পরিচালনার জন্য এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি, যে পদ্ধতির সাহায্যে শ্রম বিভাগের মাধ্যমে সমাজকে পরিচালনা করা সহজ ও সুশৃঙ্খল হয়। যাহোক, ভারতবর্ষে প্রায় ৭০০০ বর্ণ এবং উপবর্ণ রয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে ব্রাক্ষণ এবং বাকি ৯৭% অন্যান্য বর্ণ। ব্রাক্ষণগণ অন্যান্য বর্ণের লোকদেরকে তির বলে মনে করে।
বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থে নমশূদ্র জাতির অস্তিত্ব অনুসন্ধান
বলতে পারিস বিশ্ব পিতা ভগবান সে কোন সে জাত?
কোন্ ছেলের সে লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
–স্বামী বিবেকান্দ
নমশূদ্র জাতি বা কৌম উৎপত্তির বিষয়ে কিছু লোককাহিনী প্রচলিত আছে। নমশূদ্রগণ এই উৎপত্তি বিষয়ক কাহিনীগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। তাছাড়াও পৌরাণিক উৎপত্তিভাবে তত্ত্ব আছে যা পৌরাণিকভাবে সত্য বলে মনে করা হয়। বিনয়তোষ ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক সম্পাদিত ‘শক্তিসঙ্গতন্ত্র’ গ্রন্থটিতে বর্ণ সৃজনের পৌরাণিক উৎপত্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে যে নমশূদ্রগণ ব্রাহ্মণ পদমর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। এই প্রসঙ্গেই জনৈক মহেশ তর্কালঙ্কার লিখেছেন নমসমুনি নমশূদ্রের পূর্বপুরুষ।
নমশূদ্রের উৎপত্তি বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গ্রন্থ সৃজান্তেকথা বা স্মৃতিকথা থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়। এটি সম্ভবত কোনো জাতি বা কৌম সৃজনে আদিম উপাদান বলা যায়। কিন্তু আধুনিক যুগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বংশানুক্রমিকতার মধ্যে একটি স্বচ্ছ আদিম সীমারেখা বা প্রভেদ খুঁজে বের করা বড়ই কঠিন। যাহোক, প্রত্যেক জাতি/কৌমের মাঝেই নিজেদেরকে মহান করে দেখার একটি সহজাত প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
নমশূদ্ররা বিশ্বাস করেন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং ব্রহ্মার স্বপ্নদূত ভরহুথ এর দ্বারাই প্রকাশ। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতি বা কৌম স্বয়ং ঈশ্বর বা ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট। বিভিন্ন বেদ যেমন অপৌরুষ; জাতি সৃজনের ব্যাখ্যা শ্রীগীতায় দেখা যায়। সৃষ্টি অনালি, সৃষ্টি, প্রলয়, অনাদিকাল থেকে পুনঃ পুনঃ সংঘটিত হচ্ছে। খুব সম্ভবত অরিবন শব্দটির অর্থ হতে পারে বরুণ। আবার অরিবন নামটি হতে পারে কিরিবন। যেমনটি পৌরাণিক বর্ণ উৎপত্তি হয়েছে। শ্রুতির মাধ্যমে পূর্বপূরুষদের দ্বারা। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মই হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। এই সূত্র অনুসারে ব্রহ্মা জন্ম দিয়েহেন ‘মারিচ’কে এবং মারিচ জন্ম দিয়েছেন কাশ্যপকে (এই কাশ্যপ থেকেই গোত্রের উৎপত্তি)। আবার কাশ্যপ সৃজন করেছেন নমসূকে এবং নমস্ সৃজন করেছে দুটি যমজ উপরিউক্ত কির্তিবান এবং উরবান বা বরুন যারা দেখতে অবিকল এইরূপ।
বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকা’ নমশূদ্র জাতি সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছে তা নিম্নরূপ—
নমশূদ্র একটি ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাম বিশেষ করে বাংলার একটি বিশেষ অঞ্চলকে নির্দেশ করে নমশূদ্ররা ঐতিহ্যগতভাবে বংশপরম্পরায় কৃষি কাজে সম্পৃক্ত। তারা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কৃষিজীবী তফসিলি (পরবর্তীকালে) হিন্দু সম্প্রদায়। এদের কেউ কেউ নৌকার মাঝি-মাল্লার কাজ করেও জীবিকা অর্জন করে। তারা মূলত চতুর্বর্ণাশ্রম বহির্ভূত জাতি বা কৌম (উপজাতি) নমশূদ্ররা এক জাতি বা কৌম যারা পূর্ব বাংলার নিচু জলাভূমি অঞ্চলে বসবাস করে। ভারতবর্ষের উচ্চবর্ণের লোকেরা এদেরকে নিন্দাজনক বা অপমানকর চণ্ডাল নামে আখ্যায়িত করে থাকে। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে লিখেছে নমশূদ্রগণ বাঙালি হিন্দুর বৃহত্তম কৃষিজীবী সম্প্রদায়। বর্ণাশ্রম অনুযায়ী চতুর্বর্ণ বহির্ভূত তবে শ্রাদ্ধাদীতে ব্রাহ্মণবর্ণের সামাজিক সংস্কার অনুসারী। ১৯৩৬ সাল থেকে তফশিলি শ্রেণির হিন্দুরূপে চিহ্নিত। নমশূদ্রদের ধর্ম, ভাষা ও তাদের অবস্থানগত নিম্নরূপ একটি উপাত্ত পাওয়া যায়–
নমশূদ্র/ নমস্বজ / নমস্যুত
ধর্ম – সনাতন
ভাষা – বাংলা
বসবাসরত দেশ/রাজ্য – বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, উত্তরপূর্ব রাজ্যসমূহ, নেপাল পাকিস্তান
গোত্র – কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, গৌতম
জনসংখ্যা – ৮ মিলিয়ন (২০০১-এর সেন্সাস রিপোর্ট)
শিক্ষিতের হার – ৭৫% (পুরুষ ৪০.৬, নারী ৬২.৮)
নমশূদ্রের কৌমতান্ত্রিকতা
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে যে ৪১টি জাতি বিন্যাস দেখানো হয়েছে এবং যে সকল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় গীতাক্ত বর্ণবিভাজনের বাইরে মূলত তারাই কৌম বা কোম। ঐ ৪১টি জাত ছাড়াও ম্লেচ্ছ পর্যায়ে আরও কয়েকটি দেশী ও ভিনদেশী আদিবাসী কোমের নাম পাওয়া যায়। স্থানীয় বৰ্ণ-ব্যবস্থার মধ্যে এদের কোনো স্থান ছিল না। যথা পুশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, সূক্ষ, শবর ইত্যাদি। নমগণ কৃষিজীবী কোম, তবে এরা পাহাড়ি শবরদের ন্যায় পশুপাখি শিকার করত। অতীতে এরা দল বেঁধে ফাঁদ পেতে শূকর, খরগোশ, বাদুড় এবং নানারকম পশুপাখি শিকারও করত। এগুলি কৌমতান্ত্রিক চেতনারই প্রকাশ। কালক্রমে এরা শিকার বৃত্তিতে লজ্জাবোধ করতে শেখে।
যতদূর জানা যায় নমশূদ্রগণ সমতলীয় একটি কোম। সমতল ভূমি তথা অপেক্ষাকৃত ডোবা, জলা, দ্বীপ বা নদীর চর এবং বনাঞ্চল ইত্যাদি অঞ্চলে এদের বিস্তৃতি। বল্লাল সেনের নৈহাটি লিপি থেকে জানা যায় যে সূক্ষ, শবর, পুলিন্দ এরা বাংলার প্রাচীনতম আদিবাসী কোমগুলির অন্যতম, নৈহাটি লিপিতে একথার ইঙ্গিত। পাওয়া যায় এবং উক্ত লিপি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে হিন্দু বর্ণ সমাজে ধীরে ধীরে যে স্বাঙ্গীকরণক্রিয়া চলছিল। ফলে কোনো কোনো আদি বাঙালি কোম এবং বিদেশি কোম বর্ণাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল; আবার কোনো কোনো আদিবাসী কোম বর্ণাশ্রমের বাইরে অন্ত্যজ পর্যায়ে স্থান পেয়েছিল। নমশূদ্র কোমের এমনিই পরিণতি হয়েছিল। হয়তো-বা এমনটি হতে পারে এদের নাম তখন চণ্ডাল বলেই বিবেচিত ছিল। হিন্দু সমাজের সামাজিক সাঙ্গীকরণক্রিয়ার যুক্তিপদ্ধতিতে এরা ক্রমশ সমাজের নিয়তর স্তরে স্থান পাচিছল। যতদূর দেখা যায় সেন আমলে সামাজিক নিম্নতম স্তর তো রাষ্ট্রীয় দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, অন্তত রাজকীয় দলিলপত্রে এদের কোনো নাম উল্লেখ নেই।
নমশূদ্রদের কৌমতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থাপনায়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বিশেষ করে মৌর্যযুগ, গুপ্তযুগ, পালযুগ এবং সেনযুগে কোনো নমশূদ্রদের বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। অবশ্য পূর্বে আমি এটি উল্লেখ করেছি। তবে এটি একটুখানি বিস্ময়ের বিষয় যে, নমশুত্র কৌমের পরগণা ভিত্তিক ডিহিদার প্রথা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের বাইরে এদের নিজস্ব কৌমের সামাজিক আচার-আচরণ ও নিয়ম পদ্ধতি ছিল।
যতদূর জানা যায় আফগান বীর শের খান সূর বিহার ও বাংলা জয় করার পর শের খান ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদুদ্দীন আবুল মুজাফফর শের শাহ নাম ধারণ পূর্বক গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রায় এক বছরকাল গৌড়ে বাস করে এবং বাংলাদেশ শাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করে শের শাহ ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হলেন এবং কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। অতঃপর শের শাহ ভারতবর্ষের স্মাট হলেন এবং দিল্লিতে তাঁর রাজধানী স্থাপন করলেন।
শের শাহের রাজত্বকালে তিনি বাংলাদেশকে অনেকগুলি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। রাজস্ব আদায়ের লক্ষে সমগ্র রাজ্যকে তিনি ১১,৬০০টি পরগনায় বিভক্ত করলেন এবং প্রতিটি পরগনায় পাঁচজন করে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। ঐ সময় নবগঙ্গা তীরে অবস্থিত নলদী যা একটি সুপ্রাচীন নগরী অধুনা নড়াইল জেলার অন্তর্গত, একটি পরগনা ছিল। নলদী পরগনা তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল; যথাক্রমে নিজ নলদী, পারনলদী এবং দক্ষিণ নলদী সমগ্র নলদী পরগনায় ১২৭টি গ্রাম নিয়ে নমশূদ্র কৌমের একটি ‘ভিহি’ গঠিত ছিল এবং উক্ত ভিহির একজন ডিহিদার বা শাসনকর্তা ছিলেন। শের শাহের শাসনামলে কতকগুলি গ্রাম নিয়ে একটি মৌজা গঠিত হতো এবং কতগুলি মৌজা নিয়ে একটি ডিহি গঠিত হতো। এই ১২৭টি গ্রামের নাম এখানে লিপিবদ্ধ করবার বিশেষ তাগিদ অনুভব করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র ৭৪টি গ্রামের নাম সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়েছে। কারণ এই নামগুলি লিখিতভাবে নেই; এটি গুরুমন্ত্রের ন্যায় অলিখিতভাবে বংশ-পরম্পরায় ডিহিদার-নমশূদ্র পরিবারের কোনো কোনো উত্তরসূরির নিকট থেকে পাওয়া যায়। এই ডিহিদার প্রথার মধ্যে আবার ১৬ ঘরের ঘর বা বিশ ঘরের ঘর এমন মাতব্বর। বা শিরোনামা ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের নমশূদ্র কৌমের কোনো বৃহৎ সম্মেলনে পান প্রদানের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। একটুখানি আশ্চর্যের বিষয় এই যে শের শাহের রাজত্বকাল থেকে গত পাঁচশত বছর ঐ গ্রামগুলির সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন সংঘটিত হলেও গ্রামগুলির নাম আজও অমলিন রয়ে গেছে এবং যেকোনো নমশূদ্র সম্মেলনে উক্ত গ্রামগুলির শিরোনামা ব্যক্তিত্বগণ যুগ যুগ ধরে সমানভাবে সমাদৃত হয়ে আসছেন। উক্ত ৭৪টি গ্রামই যশোর, নড়াইল এবং মাগুরা জেলার অন্তর্গত।
গ্রামগুলির নাম নিম্নে দেয়া হলো
১. মনোখালী ২. বইখালী ৩. নিত্যানন্দপুর ৪. গজনগর ৫. সিঙ্গিয়া ৬. হাড়িগড়া ৭. সুবদ্ধিডাঙ্গা ৮. সাধুখালী ৯, তারাশি ১০, কাঠিগ্রাম ১১. সোনাকুড় ১২. মধুখালী ১৩. পুলুম ১৪, ঘোষগাতী ১৫. দেশমুখপাড়া ১৬. কুয়াতপুর ১৭. নালিয়া ১৮, বাকলবাড়িয়া ১৯, বুনাগাতী ২০. বাউলিয়া ২১. নরপতি ২২. রইচারা ২৩. আটের ভিটা ২৪. আসবা ২৫. আড়পাড়া ২৬. গঙ্গারামপুর ২৭. ভাঙ্গুড়া ২৮. পাটখালী ২৯, গাঙ্গীপাড়া ৩০. শিমুলিয়া ৩১. ছাবড়ী ৩২. কুচিয়ামোড়া ৩৩. হাটবাড়িয়া ৩৪. কুল্লিয়া ৩৫. হরিশপুর ৩৬. বিলবাড়ি ৩৭. বলুগ্রাম ৩৮, নতুন গ্রাম ৩৯. পলিতা ৪০. বিজয়খালী ৪১. চাঁদপুর ৪২. চেঙ্গারভাঙ্গা ৪৩. বামনডঙ্গা ৪৪. জালিয়াভিটা ৪৫, সরুশুনা ৪৬. পোড়াগাছি ৪৭. কৃষ্ণপুর ৪৮. বাহিরমল্লিকা ৪৯. ভার্নাদহ ৫০. কেচুয়াডুবি ৫১. সেনেরচর ৫২. রামদারগাতী ৫৩. দীঘলকান্দি ৫৪, ফলিয়া (সুবুদ্ধিডাঙ্গা) ৫৫. তাড়রা ৫৬. চুকনগর ৫৭. তেতুলবাড়িয়া ৫৮. বাগডাঙ্গা ৫৯. তালখড়ি ৬০. শতপাড়া ৬১. লোকনাথপুর ৬২, হাজারহাটি ৬৩. বাগভাঙ্গা (সতুবাগভাঙ্গা) ৬৪, খানপুর ৬৫. ষাটখালী ৬৬. ময়লারপুর ৬৭. রামচন্দ্রপুর ৬৮. বলাডাঙ্গা ৬৯, সত্যবানপুর ৭০. চতিয়া ৭১. সাবলাট ৭২ রামেশ্বরপুর ৭৩. আড়ংগাছা ৭৪. যাদবপুর (ডুমুরতলা)।
১২৭টি নমশূদ্র গ্রাম নিয়ে যে ডিহি গঠিত তন্মধ্যে প্রাপ্ত ৭৪টি গ্রাম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করলে একটি বিষয় পরিস্ফুট হয়; সেটি হচ্ছে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শের শাহের রাজত্বকালে উক্ত গ্রামগুলিতে নমশূদ্র কৌমের লোকজন বসবাস করতেন। কিন্তু বর্তমানে উল্লিখিত অধিকাংশ গ্রামে মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাস। এখানে কয়েকটি গ্রাম বিশেষ করে মধুখালী, পুলুম, ঘোষগাতী, সত্যবানপুর, দেশমুখপাড়া ইত্যাদি গ্রামে এখন একটি নমশূদ্র পরিবারও নেই; তবে ঐ গ্রামগুলোতে নমশূদ্রদের পদবিধারী যেমন– বিশ্বাস, মণ্ডল, শিকদার, মল্লিক ইত্যাদি অনেক মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক বাস করেন। এতে অনুমান করা যায় যে, উক্ত গ্রামগুলোর নমশূত্রগণ ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর কোনো এক সময় সকলেই সুন্নি মুসলমানে রূপান্তরিত হন।
প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে কতকগুলি বর্ণাশ্রম বহির্ভূত আদিবাসী কোমের নাম পাওয়া যায়, যেমন–ব্যাধ, হাড়ি (হগড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী?), চণ্ডাল, মল্ল, ডোলাবাহী দুলে, ঘজীবী (পাটনী) বরুড়, পুকশ খর ইত্যাদি আদিবাসী কোম নমশূদ্রগণও হয়তো-বা এই প্রাচীন কোমের অন্তর্গত। প্রাচীন ব-দ্বীপময় যশোর অঞ্চলে অনেক গ্রামের নামের শেষে খালী শব্দটি যুক্ত আছে, যেমন –মনোখালী, মধুখালী, কোমখালী, গদখালী, খলিশাখালী ইত্যাদি। নদীর গতি পরিবর্তিত হয়ে যখন নতুন নতুন দ্বীপ জেগে উঠতে লাগল, তখন সেই চর সকলের মধ্যবর্তী জলভাগ অর্থাৎ গাঙ বা খালের নামে পরিচিত হতে লাগল এবং কালক্রমে ঐ গাঙ বা খালের পাড়ের মধ্যেই মানববসতি শুরু হলো। ঐ নিমাঞ্চলে কৃষিজীবী নমশূদ্র কোমের লোকেরাই বসতি আরম্ভ করেন। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে সিঙ্গিয়া, হাড়িগড়া যদি নমশূদ্র ডিহির অন্তর্গত হয়ে থাকে, তাহলে কোমলীও নমশূদ্র কোমের সুপ্রাচীন বসতি। অধুনা এসব গ্রামে একটি নমশূদ্র পরিবারও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যাহোক বাঙালি বলতে আমরা যা জানি, বাঙালিরা একই নরগোষ্ঠীর লোক নন, এ তথ্য সর্বজনবিদিত। বঙ্গদেশে অধিকাংশ কোমবদ্ধ গোষ্ঠীবদ্ধ জন শতান্দীর পর শতাব্দী ধরে কৌম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নমশূত্রগণ যে একটি স্বতন্ত্র কোম এটি তাদের গ্রাম্যজীবন, কৌমবন্ধ সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ, পূজাঅর্চনা, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এবং এই কৌমস্মৃতি ও কৌমচেতনা আজও তাদের জীবনাচরণে বহমান
নমশূদ্রদের উৎপত্তি বিষয়ে লোককাহিনী ও মিথ
কাশ্যপ মুনি
সনাতন হিন্দুসমাজে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিবাহ, পূজা অর্চনা এবং নানাবিধ শ্রাদ্ধাদি কার্যে গোত্র পরিচয় প্রয়োজন হয়। এই গোত্র পরিচয়টি অলিখিতভাবে। মানুষের মুখে মুখে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসছে। এই গোত্র পরিচয়ের সময় নমশূদ্রদের কাশ্যপ গোত্র বলে পরিচয় পাওয়া যায়। এই গোত্র উৎপত্তির আলোকে কাশ্যপ হলেন এক প্রাচীন মুনি যিনি সপ্তঋষির অন্যতম। এই সপ্তঋষিগণ হলেন মানবন্তর, আত্রী, বৈশিষ্ট্য, বিশ্বমিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ ও কাশ্যপ। বৈদিক সূত্র অনুসারে কাশ্যপমুনি মরিচ’-এর দশ পুত্রের এক পুত্র। এই দশ পুত্র হলেন স্বয়ং ব্রহ্মার মানসপুত্র
কাশ্যপ ও অদিতি পুত্র বামন অবতার বাণী রাজদরবারে দেবনাগরী সংস্কৃত অনুবাদ কাশ্যপ স্বীকৃতি ঋষি।
কাশ্যপ ভার্যাগণ
১. অদিতি, ২. দিতি, ৩, দানু, ৪. অরিশ্যতা, ৫. বিনতা, ৬.সুরামা, ৭. ক্রোধাভাষা, ৮. তামিরা, ৯. কা, ১০. ইদা, ১১. বিশভা, ১২. সুরভী, ১৩. মুনি প্রজাপতি দক্ষরাজ তার উপযুক্ত তেরো কন্যাকে মহমুনি কাশ্যপের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
কাশ্যপ মুনির সন্তানগণ
(অদিতির গর্ভজাত)
১. সূর্যবংশ ২. দেবকুল, অসুরকুল, নাগকুল এবং সকল মানব। ৩. অগ্নি, আদিত্য, বিষ্ণু, বামন অবতার, মানবঅন্তর, দিতির গর্ভে জন্ম নেয় দৈত্যকুল ৪. কাশ্যপ পুত্র আদিত্যের পুত্রগণ –আলসা আর্যমান, ভগ্ন, ধাত্র, মিত্র, পুস্পন এবং কন্যা ভূমিদেবী, সাকরা, সাবিত্রী, বরুণ। যারা সূর্যবংশের সূচনা করেছিলেন। সূর্যবংশ যা পরবর্তীতে ইক্ষাকুবংশ বলে পরিচিত। এই বংশের মহান রাজা ইক্ষাকু, যাঁর পরবর্তী রাজাগণ ছিলেন কুকশি বিকুক্ষি, বানা, অনরণ্য পৃথু, ত্ৰিশংকু এবং পরিশেষে রাজা রঘু অতঃপর রাজা রাম দশরথ পুত্র।
স্ত্রী দিতির সন্তানগণ
হিরণ্যকশিপুর এবং হিরণ্যকাশ্য, কন্যা স্নিগ্ধা। হিরণ্যকশিপুর চার সন্তান। তাঁরা হলেন আনুহলদা, হলদা, প্রহ্লাদ এবং সানহলদা।।
০ কাশ্যপ ও নিতার পুত্র যথাক্রমে গাদা এবং অরুণ।
০ কাশপ ভার্যা কা থেকে এসেহ সমগ্র নাগকুল।
০ স্ত্রী সনু থেকে এসেছে দানব পুত্রগণ।
০ ভগবৎ পুরাণে বর্ণিত আছে অঙ্গরাগ কাশ্যপ এবং মুনি থেকে
উত্তরা রামায়ণ বলছে দিতির মায়া নামে একটি পুত্র ছিল, যে ছিল দৈত্যদের প্রভু কাশ্যপ মুনির বংশধারায় আরও দুটি আবিষ্কার মন্ত্র অর্থাৎ দুই পুত্র অভৎসরা এবং আসিতা অভৎসরার দুই পুত্র নীধরূপা রিভা। এরাও মন্ত্রদ্রষ্টা। মানবান্তর সময়কালে হিমালয় পর্বতমালার ভারতীয় কাশির উপত্যকার নামকরণ করা হয় স্বরচি কাশ্যপ-এর নাম অনুসারে স্বয়ং ব্রহ্মা সৃষ্ট দশ প্রজাপতির একজন।
নমস্ মুনি মিথ
নমশূদ্র জাতি বা কৌমের সৃজনে পৌরাণিক উৎপত্তি তত্ত্বে আরো একটি সংযোজন নমস্ মুনি মিথ। এই নমস্ মুনি কে? নমস মুনি এক সুপ্রাচীন ঋষি। তিনি কাশ্যপ কুলেরই একজন। বর্তমান মানবাত্তরে সপ্তঋষির অন্যতম নমস্ মুনিও একজন। অর্থাৎ বর্তমান মানবাত্তরে সপ্তঋষির তালিকা নিরূপ নমস, আত্রী বৈশিষ্ট্য বিশ্বমিত্র, গৌতম, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ।
এই মহান পৌরাণিক ঋষি নমস্ মুনিই হচ্ছেন বাংলা ভাষাভাষী নমশূদ্র গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই পৌরাণিক ঋষি থেকেই নমশূন্ত্রের উৎপত্তি। স্যার হার্বাট হোপ রিজলে ছিলেন একজন ব্রিটিশ Ethnographer। ১৮৫১ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রশাসক হিসাবে ভারতবর্ষে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাংলা জাতি, উপজাতি নিয়ে The Tribes and Castes of Bengal (২য় খণ্ড) নামক গ্রন্থে গবেষণা করেছিলেন। তাঁর গবেষণায় তিনি নমশূদ্রের উৎপত্তি বিষয়ে নমস্ মুনির যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। ১৮৯১ সালে তিনি প্রকাশ করেন যে নমস মুনিই নমশূদ্রের পৌরাণিক পূর্বপুরুষ। তিনি এভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন– নমস্য সম্মানীয় সূত্র অথবা যেভাবে তাদেরকে প্রচার করা হয়েছে, নমস্ সৃজ (সজ ই হতে নমস) নমস্যজ বা নমস্য সৃজন > নমস্য সৃজ > নমস্যজ। নমশূদ্রগণ বিশ্বাস করেন, তাদের কুল সম্পর্ক রয়েছে ঠিক এভাবেই–মারিচি > কাশ্যপ > নমস্ > কীর্তিবান এবং উরুবান বা অরিবান (ইন্দো-ইরানীয় ভাষায় বরুণ)।
মুনির নমস্-এর দুই পুত্র কীর্তিবান এবং উরুবান যাদের থেকেই নমদের মধ্যে প্রধানত যে দুটি শাখা ‘শোলী ও ধানী’-এর উৎপত্তি হয়। পরবর্তী প্রধান এই দুটি শাখা থেকে কালক্রমে আরও ৩টি উপশাখার উৎপত্তি হয় যথা–
১. প্রামাণিক : নমশ্রেণি বল্লাল সেনের রোষানলে পতিত হলে শ্রোত্রীয় নাপিতেরা যারা নবশায়কের অন্তর্গত, নমলের ক্ষৌরকর্ম বন্ধ করে দেয়। ফলে উক্ত কাজের জন্যে নমদের মধ্যে থেকে ‘প্রামাণিক’ (বিশ্বস্ত) শাখার উৎপত্তি হয়। প্রামাণিক যাদেরকে গ্রাম্য কথায় পরামাণিক বলা হয়, শেফালীও ধানী শাখার অন্তর্গত।
২. মৎস্যজীবী শেফালী ও ধানী শাখার মধ্যে থেকে কিছু লোক মাছধরা ও মাছের ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলে এই শাখার উদ্ভব হয় এর সাধারণত জেলে বা জালিয়া ও বাঁড়াল নামে পরিচিত।
৩. মগুয়ান পূর্বকালে আরাকান রাজ্য থেকে আগত ‘মগ’ নামক এক শ্রেণির লোক নিন্মবঙ্গে তথা পটুয়াখালি, বরিশাল, খুলনায় বসতি স্থাপন করে মৎস্যব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে ওঠে এই মগদের সঙ্গে যে সকল নম যোগ দেয়, তারা মগুয়ানম নামে পরিচিতি পায়। নমদের মূল পেশা কৃষিকাজ বা হালচাষ, তাই নমরা হালিয়া নামেও অভিহিত।
তিতোষ ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক সম্পাদিত ‘শক্তিসঙ্গম তন্ত্র’ নামক সুপ্রাচীন সংস্কৃত তন্ত্র গ্রন্থের প্রাণতোষী অধ্যায়ে ‘হর-পার্বতী সংবাদ’-এ হর ও পার্বতীর কথোপকথনের মধ্যদিয়ে নমশূদ্র জাতির উৎপত্তি ও বংশবিস্তারের যে বিবরণ পাওয়া যায় তার বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ
পার্বতী : হে দেব, ঐ যে দুজন কাকার ব্যক্তি তোমার সঙ্গে শুশানে-মশানে ঘুরে বেড়ায় ও তোমার পরিচর্যা করে, তারা কারা? ঐরূপ হীন ব্যক্তিদের তুমি এত প্রশ্রয় দাও কেন?
শিব : দেবী! তারা হীন নয়। তারা পরহিত-ব্রতে উৎসাহী দুজন গৃহত্যাগী ব্রাহ্মণ, নাম আপসার ও নৈব আমি তাদের বড় ভালোবাসি। তারা বহু কেশ ও শ্রম স্বীকার করে দুইটি ব্রাহ্মণ শিশুকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
পার্বতী : হে দেব! কোন্ ব্রাহ্মণ শিশুস্বয়কে তারা বাঁচিয়ে তুলল।
শিব : মহামুনি কশ্যপ, যিনি ব্রহ্মান্দন মারিচির পুত্র, তাঁর ঔরসে প্রধা নামক স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুনিবর নমস্। বাল্যকাল থেকেই নমস্ ছিলেন ধ্যান-যোগাদিতে মগ্ন। আপসার ও বৈ, যাদের আমি আমার নিকট আশ্রয় দিয়েছি, তারা ঐ কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনিবর নমসের যজ্ঞসঙ্গী। কালক্রমে ব্রহ্মার মানসপুত্র রুচির পরমা সুন্দরী নন্দিনী সুলোচনা সতাঁকে বিবাহ করে মুনিব নমস্ তার যজ্ঞ সঙ্গী আপসারও নৈব সহযোগে পরমসুখে মথুরায় বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সংসারের আকর্ষণ মুনিবর নমসকে বেশিদিন বেঁধে রাখতে পারে না সুলোচনা সতী যখন ছয় মাসের সন্তান সম্ভবা, তখন যজ্ঞসঙ্গী আপসার ও নৈবের উপরে স্ত্রীর দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পণ করে নমস্ মুনি তপস্যার উদ্দেশে গৃহত্যাগী হন এবং চতুর্দশ বছরের মধ্যে তার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন না।
পার্বতী : অতি চমৎকার কথা কিন্তু ঐরুপ গুপপাষ্য শিশুদের তারা কোন করে বাঁচিয়ে রাখল দেব?
শিব : সেই জন্যেই তো দেব; অপসার ও নৈ আমার নিকট এত প্রিয় তারা অতি দরিদ্র মুনিপুত্র প্রতিপালন করবার মতো সঙ্গতি তাদের ছিল না। তাই কখনো সর্পখেলা দেখিয়ে, কখনো ভিক্ষাবৃত্তি করে অর্জিত অর্থে বহু ক্লেশে তারা শিশুকে বাঁচিয়ে রাখে এতদ্ভিন্ন তাদের নানাজ্ঞানে জ্ঞান করে তোলে এ
পার্বতী : কিন্তু হে দেব! কীর্তিবান ও উরুবানকে পরিত্যাগ করে তারা তোমার নিকট আশ্রয় লইল কেন?
শিব : বিধির নিবন্ধ বৈকাইবে কে! তপস্যার তরে নমস্ মুনি সেই যে গৃহত্যাগী হন, চতুর্দশ বছরের মধ্যে আর প্রত্যাবর্তন করেন না। অতঃপর চতুর্দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে অকস্মাৎ কোন একদিন মুনিবর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে সুদর্শন সদাচারী পুত্রদ্বয়কে দেখে অত্যন্ত প্রীত হলো। পুত্রয়ের বয়স যখন কিঞ্চলধিক চতুর্দশ বছর, অথচ তখনো তাদের উপনয়ন হয়নি। নমস্ মুনি তখন পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের জন্য ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হন। কিন্তু বয়ঃসীমা চতুর্দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় কেহই উপনয়ন সংস্কারে স্বীকৃত হন না। পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হয়ে মুনিবর নমস্ মনে অত্যন্ত দুঃখ পান এবং পুত্রদের সঙ্গতি কামনায় নির্জন পর্বতকান্দারে শ্রী হরির আরাধনায় নিমগ্ন থাকতে পুনরায় গৃহত্যাগী হন। পিতৃদেবের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পুরো অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে এবং শীঘ্ন পিতৃদেবের প্রজাগমন না হওয়ায় পিতার সন্ধান অভিলাষে পুত্ররাও গৃহত্যাগী হয়। মথুরার শূন্য গৃহ তখন আপ্সার ও নৈবের নিকট দুঃসহ হয়ে ওঠে। মনের দুঃখ নিবারণের জন্যে তখন তারা আমার নিকট এসে আশ্রয় নেয় এবং এরপর থেকে তারা আমার কাছেই আছে।
পার্বতী : কীর্তিবান ও উরুবান কোথায় গেল, দেব?
শিব : পিতার সন্ধান অভিলাষে গৃহত্যাগী হয়ে বহু জনপদ পরিভ্রমণ করতে করতে পরিশেষে শিলিগুড়ি অঞ্চলে গিয়ে সীমন্ত নামক জনৈক শুত্র রাজার রাজ্যে উপনীত হয়। রাজা সীমন্ত এই সুদর্শন যুবকদ্বয়কে সমাদরে আশ্রয় দেন এবং কন্যা পরমাসুন্দরী শিপিকা ও সপত্রিকাকে তাদের সাথে বিবাহ দেন।
অত্যন্ত আনন্দের কথা। তারপর কী হলো? জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিণের স্ত্রী হয় জ্যেষ্ঠকন্যা শিপিকা এবং উবানের স্ত্রী হয় কন্যা সমতিক সীমন্ত রাজার জামাতা হয়ে, রাজ্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে এবং সুপবিত্র কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে কীর্তিন ও উন আনন্দে সেই রাজ্যে বসবাস করতে থাকে কালক্রমে তাদের ঘরে পাঁচপুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে।
তাদের সন্তানাদির নাম কী দেব?
কীর্তিবানের তিন পুত্র–অভিরাম, নন্দরাম ও লালাদ এবং দুই কন্যা-–অমলা ও বিমলা। উবানের দুই পুত্রসনঞ্জয় ও বীর লাল এবং এক কন্যা–মালবতী কালক্রমে তাদের সন্তানরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অসমঞ্জের পুত্র-কন্যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাদের বংশবিস্তার লাভ করে।
অসমঞ্জ কে, প্রভু?
অযোধ্যার সূর্যবংশের সুবিখ্যাত রাজা সগরের জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জ। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভগবদ্ভুক্ত। রাজপুত্র হওয়া রাজকার্যের প্রতি কোনোরূপ আকর্ষণ তার ছিল না। ফলে রাজা সগর তাকে রাজপুরী হতে বহিষ্কার করে দেন। পিতৃবিতাড়িত অসমঞ্জ সস্ত্রীক গৃহত্যাগী হয়ে ক্রমে সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়ে পুনরায় গৃহবাস শুরু করেন। তাদের গৃহে ক্রমে পাঁচকন্যা ও তিনপুত্র জনুগ্রহণ করে। কন্যাদের নাম : শ্যামা, মা, বামা, চিত্রা ও রাসেশ্বরী। পুত্রদের নাম বেত্র, বল্প ও বীজ। পুত্র-কন্যাদের পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করার পর কীর্তিবান, উবান ও অসমঞ্জ পরস্পরের সন্নিকটে অবস্থান করে সানন্দে নিজ নিজ সংসার ধর্ম প্রতিপালন করতে থাকে।
হে দেব! সন্তানদের সদৃগতি কামনায় নমস্ মুনি সেই যে তপস্যা করতে বাহির হন, তাঁর সে তপস্যায় সুফল কী হয়?
হ্যাঁ দেবী! শমসের আরাধনায় সুফল হয়। সন্তানদের শুভ কামনায় একাগ্রচিত্তে তিনি পূব্রহ্মের যে একনিষ্ঠ আরাধনা করেন, তাতে সন্তষ্ট হয়ে পরমদেব নারায়ণ একদিন ভক্তর নমসের সামনে আবির্ভূত হন এবং ভক্তকে বর প্রার্থনা করতে বলেন ভক্ত নমস্ তখন তাঁর নিকট একে একে তিনটির প্রার্থনা করেন।
কী কী বর তিনি প্রার্থনা করেন?
নমসের প্রথম প্রার্থনা আমার পুত্রদের বংশ যেন প্রকৃত ব্রাহ্মণসম হয়! দ্বিতীয় প্রার্থনা আমার পুত্রদের বংশ যেন আমার নামেই খ্যাত হয়। তৃতীয় প্রার্থনা আমার নাম যেন কালজয়ী হয়।
নমসের প্রার্থনা কি পূর্ণ হয় দেব?
হ্যাঁ দেবী! দেবোত্তম নারায়ণ বাঞ্ছাকল্পতরু। ব্রপোস নমসের সাধনায় প্রীত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বললেন ‘তথাস্তু। নারায়ণের প্রথম বর ‘তোমার বংশ তোমার নামেই খ্যাত হবে। তোমার সন্তানেরা শূদ্রা বিয়ে করেছে, তজ্জন্য তোমার নমস্ নামে সূত্র যুক্ত হয়ে এই বংশ নমশূদ্র’ নামে খ্যাত হবে নারায়ণের তৃতীয় বর ‘তোমার নাম কালজয়ী হবে তোমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র মহিমা ও কীর্তি গৌরবে তোমার নামের মহিমা জগতে ক্রমোজ্জ্বল হবে। এইভাবে নমসের নমস্কামনা পূর্ণ করে নারায়ণ অন্তর্হিত হলেন।
হে দেব! বরপ্রাপ্তির সংবাদ তিনি কি তার সন্তানদের অবগত করান?
হ্যাঁ দেবী! সেই কথা বলবার জন্যেই তো মুনিবর নমস্ তার পুত্রদের নিকট ছুটে যান। মুনিবর সকলকে ডেকে সস্নেহে আশীর্বাদ করে বরপ্রাপ্তির সকল কথা তাদের নিকট ব্যক্ত করেন। আরও বলেন যে, কেবল সংসার নিয়ে মত্ত থাকিও না। পাপ, দোষ, হীনতাদি বর্জন করে উচ্চ আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করিও। সংসারধর্ম প্রতিপালনের মধ্যে দিয়ে সর্বদা ব্রহ্মের উপাসনা করিও। তবেই শান্তি লাভ করবে।
তারপর কী হল, দেব?
জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিবানের আলয়ে ছিল শেফালী ফুলের প্রাচুর্য আর কনিষ্ঠপুত্র উবানের আবাসে ছিল ধান্যাদির প্রাচুর্য। তা দেখে নমস মুনি জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রকে যথাক্রমে ‘শেফালী’ ও ‘ধানী’ আখ্যা প্রদান করেন।
হে দেব, অসমঞ্জের বংশে এইরূপ কোনো খ্যাতি হয় কি?
হ্যাঁ দেবী, হয়। অসমঞ্জের পুত্র ‘পদ্মকান্তি’ ছিল যশস্বী ও খ্যাতিমান। এই পক্ষের বংশধরেরা পরে ‘পোদ্দ’ বা ‘পোদ’ খ্যাতি প্রাপ্ত হয়। অসমঞ্জের জ্যেষ্ঠপুত্র নামে খ্যাত হয়। বেত্র-ক্ষত্র ও ‘পোদ’ জাতি একই বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় জাতি, সূর্যবংশীয় রাজপুত্র অসমঞ্জের বংশধর।
হে দেব, জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নমস্ মুনি কি তার সন্তানদের নিকটেই অতিবাহিত করেন?
না। মুনিবর নমস্ ছিলেন নির্জন সাধনায় অভ্যস্ত। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়ার পরে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নির্জন পর্বত কন্দরে অবস্থিতিকার যা ঈশ্বরোপাসনায় অতিবাহিত করবার অভিলাষে মুনিবর নমস্ একদিন পুত্র-পৌত্রগণকে সঙ্গেহে আশীর্বাদ করে হরিগুণগান কীর্তন করিতে করতে পুনরায় বনে গমন করেন।
‘শক্তি সঙ্গমতন্ত্র’ গ্রহের প্রাণতোষী অধ্যায়ে ‘হের-পার্বতী সংবাদ’ সমাপ্ত।
বল্লাল সেন কর্তৃক সমাজচ্যুতকরণ
মিথ ১১০০ শতাব্দীতে সেন বংশের তৃতীয় শাসক বল্লাল সেন বঙ্গের রাজা ছিলেন। ঐ সময় রাজার পরেই ব্রাহ্মণগণ ছিলেন সামাজিক পদমর্যাদায় এবং সমাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দ্বিতীয় স্থানে। বল্লাল সেন তাঁর অনুকূলে একগুচ্ছ আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু একটি বিশাল সংখ্যার ব্রাহ্মণগণ রাজার প্রণীত নতুন আইনগুলি ভালোমনে গ্রহণ করেননি। কার্যত ব্রাহ্মণগণ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে; একদল রাজার অনুকূলে, আর অন্যদল রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তারা রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরিণতিতে দ্বিতীয় ব্রাহ্মণদল রাজার নিকট পরাজয় বরণ করে এবং শাস্তিস্বরূপ ব্রাক্ষণত্বের অধিকার হারাতে হয়। তারা আর ব্রাহ্মণ বিবেচিত না হয়ে শূদ্র হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। পরাজয়ের পর ঐ দলের ব্রাহ্মণগণকে বল্লাল সেনের রাজ্য পরিত্যাগ করতে হয় এবং দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন জলা, ডোবা বা নিমাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই লোকগুলি শূদ্র হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এরাই হিন্দু সমাজের চার বর্ণের মধ্যে সর্বনিম্ন বর্ণ। কিন্তু যেহেতু তারা মূলত ব্রাহ্মণ, সেহেতু তাঁরা নমস উপসর্গ দ্বারা উল্লিখিত। নসহত (বেন–সম্মানীয়) তাই নমশূদ্র শব্দটি নমস্য-শূদ্র-এর বিকৃত রূপ।
নমশূদ্রগণ কি দেবল ব্রাহ্মণ
দেবল ব্রাহ্মণদের পরিচয়ের আগে, দেবল কী বা কোথায় এটা জানা প্রয়োজন। অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী আধুনিক করাচী বন্দর নগরের অদূরে আরব সাগরের তীরবর্তী দেবল একটি সুপ্রাচীন পোতাশ্রয় বা সমুদ্র বন্দর। মধ্যযুগে দেবল সিন্ধু প্রদেশের একটি প্রধান সমুদ্র বন্দর ছিল। দেবল তথা সিন্ধু অঞ্চলের তৎকালীন শাসনকর্তা ছিলেন রাজা দাহির। ব্রাহ্মণ বংশীয় রাজা দাহিরের পূর্ণ নাম হলো দাহির সেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলোরের শাসনকর্তা। ৭১২ খ্রি. আরবদের দ্বারা সিন্ধু বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আলোর অঞ্চল ব্রাক্ষণ বংশীয় রাজাদের শাসনাধীনে লিপিবদ্ধ আছে।
এখন বিষয়টি হচ্ছে নমশূদ্রদের সাথে এই দেবল ব্রাহ্মণদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায় বাংলার রাজা বল্লাল সেন পদ্মিনী নাম্মি এক পরমা সুন্দরী বেশ্যাকে বিবাহ করেন। তখনকার সমাজে অসবর্ণ বিবাহ অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। তাই বিবাহ পরবর্তী কালে পদ্মিনী নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্যে এক একাদশী ব্রত পালনের আয়োজন করেন। এই ভৌমি একাদশী পালন উপলক্ষে রাজদরবারের বারোজন ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজন করেন।
সেই অনুসারে রাজা দেবল ব্রাহ্মণদেরকে নিমন্ত্রণ করেন। কাহ্নকুঞ্জ থেকে আগত দেবল ব্রাহ্মণগণ রাজা বল্লাল সেন প্রদেয় তদীয় পত্নী পদ্মিনীর একাদশী পালনে অন্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে দেবল ব্রাহ্মণগণ রাজরোষে নিপতিত হয়ে বিতাড়িত হন। এই ব্রাহ্মণগণ বাংলার ডোবা, নালা, জলাভূমি তথ। নিভৃত বনজঙ্গল ও চরাঞ্চলে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে বল্লাল সেন কর্তৃক বিতাড়িত ঐ ব্রাহ্মণগণের উত্তরসূরিরাই অধুনা নমশূদ্র বলে পরিচিত। এই হলো দেবল ব্রাহ্মণদের বাংলায় আগমনের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সুখময় সরকার তাঁর রচিত ‘নমশূদ্রই পারশব বিপ্র’ গ্রন্থে নমশূদ্রগণকে শাকদ্বীপি বা মঘা ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করেছেন। তারা দেবল ব্রাহ্মণ নামেও পরিচিত। এই শাকদ্বীপি বা মঘা ব্রাহ্মণগণ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণদের একটি অন্যতম মহান উপগোত্র। এরা প্রাক আর্ঘ্য ভারতবর্ষীয় আদি ব্রাহ্মণ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এরা ভারতবর্ষের রাজস্থান, গয়া, বিহারসহ প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে আছে। এরা ভারতীয় পুরাণের বিখ্যাত পঞ্চদেবতার অন্যতম সূর্যদেবের উপাসক। অবশ্য সূর্যের উপাসনা ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে স্থানভেদে সামান্য প্রভেদসহ প্রচলিত ছিল। ভবিষ্য পুরাণ মতে মঘী ব্রাহ্মণদের সূর্য পূজার অধিকার আছে। রাজস্থানে সূর্যবংশী নামে রাজপুতদের একটি গোত্র আজও আছে। অবশ্য একথা সকলেই জ্ঞাত যে অযোদ্ধার রাজাগণ সূর্যবংশীয় ছিলেন।
শাকদ্বীপ বা মঘাব্রাহ্মণ উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মিথ প্রচলিত আছে। এই সম্প্রদায় শুধু হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিত প্রতীম কর্মকাণ্ডেই অবদান রাখে না; বরং এরা জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মীয় পুরোহিতপ্রতিম কর্মকাণ্ডের সাথেও সম্পৃক্ত। পণ্ডিতবর্গ অভিমত প্রদান করেন যে, শাকদ্বীপি বা মঘা ব্রাহ্মণদের পূর্বপূরুষ ইরানের শাকদ্বীপি বা টিকট্রি দ্বীপ থেকে ভারতবর্ষে এসেছেন। আবার কোনো কোনো পণ্ডিতের মতানুসারে শাকদীপিগণ ভারতেরই আদি বাসিন্দা। এই দেবল বা শাকহীপি ব্রাহ্মণগণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নমসুত, ন, নমশূত্র ও কাশ্যে সন্তান বলে অভিহিত।
এই দেবল বা শাকইপি ব্রাক্ষণগণ সম দেয়ি ব্রাহ্মণ। কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনকারী বল্লাল সেনের নিগ্রহে নির্বাসিত হয়ে এবং রাজ-আদেশে পূজার্চনায় অনধিকারী ঘোষিত হলো। তাদের পৈতা ছিঁড়ে দেয়া হলো এবং বল্লালীয় চক্রান্তের জালে এই দেল ব্রাহ্মণগণ আজ নমশূদ্র নামে আখ্যায়িত হলো। যদিও ব্রাহ্মণদের ন্যায় বংশানুক্রমিক ধারায় নমগণ দশদিনে অশৌচ মুক্তি এবং এগারো দিনে আদ্যশ্রাদ্ধ এই আচার পালন করে যেতে থাকলেন গুয়াধামে পিতৃপুরুষদের উদ্ধারকল্পে শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্মে যে পিণ্ড প্রদান করা হয়, তা একমাত্র ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গয়াধাম বল্লালীয় শাসনের বহির্ভূত, তাই সেখানে দেবল ব্রাহ্মণগণ স্মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। আজও সেখানে কাশ্যপ গোত্রীয় সামদেবীয় দেবল ব্রাহ্মণ বা নমশূদ্রগণ পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করে থাকেন। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রও তাঁর গ্রন্থে নমশূদ্রদেরকে পাশব বিপ্র’ (ব্রাহ্মণ পিতা শূদ্র মাতা) বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গের নমশূদ্রগণের ধমনিতে দেবল ব্রাহ্মণদের রক্ত প্রবাহিত। এমন একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে দেবল ব্রাহ্মণের অভিশাপে সেন বংশের রাজত্ব লোপ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মহাত্মা দ্বারকানাথ মণ্ডল প্রণীত নমশূদ্র জাতিকথা নামক গ্রন্থ থেকে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করছি–
বার্ধক্য দশা হায় পুত্র লক্ষ্মণের করি রাজা বল্লাল ত্যাজিল কর, লক্ষ্মণ হইয়া রাজা সুখেতে পালেন প্রজা, প্রজাগণে করে রাজ পূজা, বিধাতার লিপি যাহা, কে পারে খণ্ডাতে তাহা? বল্লালের ছিল অভিশাপ সেন বংশ সিংহাসন, ইবনে করিবে গ্রহণ সেন বংশ পাবে অনুতাপ! সেই ব্ৰহ্মপাপ ফলে, গৌডেতে উদয় হলে সেনাপতি কুতুবন্দিনের বখতিয়ার খলজি সঙ্গে, সপ্তদশ সৈন্যরংগে বড় বড় ঘোড়ার সওয়ার। শুলি লক্ষণ যেই, খেড়কি বার দিয়া সেই এস্তে ব্যস্তে করে পলায়ন। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ শপ, এই তার অনুতাপ মশ দেল ব্রাহ্মণ ঐ বারকানাথে কয়, সমভাবে কার যায় অমূল্য সময় এই ভবে দিবা বিভাবরী মত, সুখ দুঃখ যাতায়াত করিতেছে সলা ভাবে
নমশূদ্র কি কৌম
সুদূর অতীত থেকে বর্ণ হিন্দু রাজা, জমিদার, ব্রাহ্মণ ও অভিজাতগণ নমশূদ্রদের নীচুজাত, রাক্ষস, চণ্ডাল প্রভৃতি অশোভনীয় নামে আখ্যায়িত করে আসছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নমশূদ্ররা নীচুজাত নয়, বরং অভিজাত কুলীন। কবির ভাষায় —
নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়
সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।
সমাজের কিছু মানুষ আছেন যারা অভিজাত ও অনভিজাত ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে শোষণ ও অপমান করে নিজেরা আত্মপ্রসাদ লাভ করে তারাই প্রকৃত নীচুজাত। প্রাচীন গ্রন্থ শক্তি সঙ্গমের বর্ণনা অনুসারে নমশূদ্রগণ মহামুনি কাশ্যপের বংশধর। তার দুই পুত্র ছিলেন বড়ই উদার। সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে সেই সুপ্রাচীন ভারতবর্ষে যেখানে ৭০০০ এর উধে জাত বর্ণের অস্তিত্ব ছিল, সেখানে একটি সমাজতান্ত্রিক সাম্যর সমাজ গঠনের মানসে তার দুই পুত্র ছিলেন আত্মনিবেদিত। কিন্তু বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় তাঁদের পক্ষে জাত নির্বিশেষে কল্যাণ করা সম্ভব ছিল না। তাই মহামুনি কাশ্যপের পুত্রদ্বয় মনোকষ্টে পার্শবর্তী শূদ্র রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তাঁরা শূদ্র রাজকন্যাদের বিবাহ করে শূদ্র রাজ্যে বসবাস করতে থাকেন। কাশ্যপ মুণির পুত্রদ্বয়ের ঔরসে শূদ্র রাজকন্যাদের গর্ভজাত সন্তান এবং তাদের বংশধরগণই অধুনা নমশূদ্র বলে পরিচিত। মনুসংহিতার সূত্রমতে, নমশূদ্রগণ পারশব বিপ্র। ব্রাহ্মণ নামের সাথে শূদ্র যুক্ত হয়ে নমশূদ্র নাম হয়েছে।
নমশূদ্র গণের মহিমান্বিত স্বরূপ ও উচ্চমূল্যবোধকে প্রতিহত করবার মানসে কিছু স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নমশূদ্রদের নীচুজাত আখ্যায়িত করে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। এ ধারার ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বল্লাল সেন অন্যতম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বল্লাল সেন একজন লম্পট অত্যাচারী ও অসৎ চরিত্রের রাজা ছিলেন। যতদূর জানা যায় তাঁর সহস্রাধিক রক্ষিতা ও উপপত্নী ছিলো। পদ্মিনী নামে এক বেশ্যা ছিলেন বল্লান সেনের উপপত্নীদিগের সর্দার। পদ্মিনী ভৌমি একাদশী ব্রতে রাজ্যের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করেন। কিছু ব্রাহ্মণ পদ্মিনীর নিমন্ত্রণ গ্রহণে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বল্লাল সেন নিমন্ত্রণ গ্রহণে অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণদের শূলে চড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেয়। সম্মান, ধর্ম ও প্রাণ রক্ষার্থে নদীয়ার নবদ্বীপ, পোড়াবাড়ি ও তৎসংলগ্ন এলাকার অভিজাত ব্রাহ্মণগণ পৈতা পরিত্যাগপূর্বক পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের জঙ্গলময় জলাভূমিতে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। নদীয়ায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তাঁদের থাকলেও বল্লাল সেনের ভয়ে তারা আর ফিরে না গিয়ে অত্র অঞ্চলে বসতবাড়ি গড়ে তোলে।
দীর্ঘদিনের বসতবাটি, সহায় সম্পদ, পেশা ও চেনা পরিবেশ ছেড়ে বিপদসঙ্কুল। জঙ্গলময় উপকূলীয় পরিবেশে অভিজাত ব্রাহ্মণগণের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। নতুন স্থানে আদিবাসীদের সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে এই জঙ্গলময় পরিবেশে তারা আর্থসামাজিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে। নৃতত্ত্ববিদ রিজলি হার্টন, গেটে, পণ্ডিত রামচন্দ্র ভট্টাচার্য, পণ্ডিত দিগীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, ডাঃ সতীনাথ বিদ্যারত্নসুকৃতিরঞ্জন প্রমুখ মনীষীর বিবরণমতে, শিক্ষার অভাব ও কৃষিকাজ অবলম্বন করার কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে অনগ্রসর সম্প্রদায়ে পরিণত হলেও, তাদের মতো নমশূদ্রগণ অভিজাত বর্ণসম্প্রদায়।