০১. টানা দুটো অনার্স পিরিয়ড

জলছবি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক
বিমল করের স্মৃতির উদ্দেশে

.

॥ এক ॥

টানা দুটো অনার্স পিরিয়ড শেষ করে সোজা অফিসরুমে এসেছিল সোমনাথ। আজ আর ক্লাস নেই। মাইনেটা তুলবে, তারপর চারটে বাজলে কেটে পড়বে গুটিগুটি। কাল রাত্তিরে রুপাই ফোনে দাদুন দাদুন করছিল খুব, সেই থেকে টানছে নাতিটা, পারলে আজ একবার যাবে বরানগর।

কলেজে শুরু হয়েছে অ্যাডমিশনের মরশুম। ক্যাশকাউন্টারের সামনেটা ভিড়ে ভিড়। ভরতি হতে আসা ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের ক্যালরব্যালরে অফিস যেন এখন মেছোহাটা। একপাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে থানা গেড়েছে ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা। চাঁদার বিল কাটছে ফটাফট, টাকা পুরছে টিনের বাকসে।

কোনওক্রমে স্যালারির চেকটা নিয়ে সোমনাথ বেরিয়ে আসছিল, হঠাৎই চিৎকার চেঁচামিচি শুনে থমকাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ইউনিয়নের মাতব্বরদের সঙ্গে জোর কাজিয়া বেধেছে এক সদ্য-ভরতি-হওয়া তরুণীর। গলার শির ফুলিয়ে তর্ক জুড়েছে মেয়েটি,—কেন দেব চাঁদা? জোরজুলুম নাকি?

—সবাই দিচ্ছে, তুমিই বা দেবে না কেন?

—আমার ইচ্ছে। আমি কোনও ইউনিয়নে থাকতে চাই না।

—ওসব ইচ্ছে ফিচ্ছে বাইরে দেখিয়ে। অ্যাডমিশন নিয়েছ, এখানে টাকা ফেলে যাও।

—কী করবে না দিলে?

—এখান থেকে বেরোতে পারবে না।

—ভয় দেখাচ্ছ?

—যা খুশি ভাবতে পারো। ছাত্রস্বার্থ-বিরোধী কাজ আমরা বরদাস্ত করব না।

আশপাশের কলরোল থেমে গেছে। নবাগত ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকরা থতমত মুখে দেখছে কোন্দল, রা কাড়ছে না কেউই।

সোমনাথ মেয়েটিকে দেখছিল। কোথায় যেন মিল আছে মিতুলের সঙ্গে। মুখশ্রীতে? বাচনভঙ্গিতে?

হঠাৎই মেয়েটার চোখ পড়েছে সোমনাথের দিকে। হাতের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার দেখেই পলকে বুঝে নিল সোমনাথ এখানে জড়ো হয়ে থাকা অভিভাবকদের একজন নয়, সে এই কলেজের অধ্যাপক। প্রায় দৌড়ে এল সোমনাথের কাছে। উত্তেজিত স্বরে বলল,—এ কী অন্যায় কথা স্যার? আমি যদি কোনও পার্টির ইউনিয়ন না করি তা হলেও আমায় চাঁদা দিতে হবে? আপনি ওদের একটু বারণ করে দিন না প্লিজ।

সোমনাথ প্রমাদ গুনল। সে কোনও ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়ার মানুষই নয়। চিরকালই ঝামেলা গণ্ডগোল থেকে সে শতহস্ত দূরে। কোথাও সামান্যতম অশান্তির সম্ভাবনা দেখলেই তার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে, হাঁটুর জোর কমে যায়, অবশ হয়ে আসে স্নায়ু। সবাইকে তুইয়ে বুইয়ে চলাটাই তার স্বভাব। সে কী বা ঘরে, কী বা বাইরে। এমন একটা মানুষকে সালিশি মানার কোনও অর্থ হয়?

চোরা চোখে ইউনিয়নের ছেলেমেয়েগুলোকে একবার দেখে নিল সোমনাথ। পরিচিত মুখ। জনা চারেক বর্তমান সংসদের, বাকিরা প্রাক্তনী। ছাত্র ফ্রন্টের স্থানীয় নেতা হওয়ার সুবাদে পাশ করে যাওয়া ছেলেরাও এসে জাঁকিয়ে বসে এই ভরতির সময়টায়। দু’হাত্তা টাকা তোলে প্রাদেশিক ইউনিয়নের জন্য। আগের প্রিন্সিপালের আমলে তাও একটা রাখঢাক ছিল, যতীন দাশগুপ্ত নরমে গরমে বশে রাখতেন এইসব ছেলেমেয়েদের, সেভাবে ট্যাঁফো করার সুযোগ দেননি কোনওদিন। তখনও টাকা তোলা চলত, তবে লুকিয়ে চুরিয়ে। কলেজগেটের বাইরে। পুলকেশ কুন্ডু আসার পরে আমূল বদলে গেছে ছবিটা। পুলকেশের নীরব প্রশ্রয়ে ছাত্র ইউনিয়নই এখন কলেজের সর্বেসর্বা।

এমন একটা পরিস্থিতিতে গলা বাড়িয়ে দিয়ে সোমনাথ মরবে নাকি?

মুখে স্মিত হাসি টেনে সোমনাথ মেয়েটিকে বলল,—আহা, মিছিমিছি বিবাদ করে কী লাভ? দিয়েই দাও। এক কলেজে পড়বে, সবাই বন্ধুবান্ধবদের মতো থাকবে…

মেয়েটার মুখ চুন হয়ে গেল। অসহায় স্বরে বলল, —দিতে পারব না স্যার। নেই। পাঁচ-দশ টাকা হলে নয় কথা ছিল, কিন্তু দুশো…!

এতক্ষণে সোমনাথের নজরে পড়ল মেয়েটার পোশাকআশাক মোটেই মহার্ঘ নয়। সস্তা ছিটের সালোয়ার কামিজ পরেছে মেয়েটা, চোখেমুখে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। কাঁধঝোলা কাপড়ের ব্যাগটারও রীতিমতো হতশ্রী দশা।

কেমন যেন মায়া হল সোমনাথের। মুহূর্তের জন্য একটা স্মৃতিও যেন দুলে গেল বুকে। ইন্টারমিডিয়েটে ভরতি হতে গেছে সোমনাথ, অ্যাডমিশন ফি-র সঙ্গে তিন মাসের মাইনেও জমা করতে হবে, অত টাকা সোমনাথের কাছে নেই….। কী করে? কী করে? ঠিক তখনই ঠোঁটের কোণে পাইপ চেপে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ইংরিজির হরনাথ স্যার। সোমনাথ তখন তাঁকে চিনতও না, তবু সটান গিয়ে ধরেছিল। হরনাথ স্যার তাকে নিয়ে গেলেন অধ্যক্ষের চেম্বারে, অবস্থা খুলে বলায় মকুব হল টিউশ্যন ফি।

সেই ঘটনা আর এই ঘটনা কি এক? কিংবা সেই সময় আর এই সময়? তবু খানিকটা মায়ার বশে, খানিকটা বা স্মৃতিতাড়িত হয়ে, দুম করে একটা স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসল সোমনাথ। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,—অ্যাই, ও যা পারবে তাই নিয়ে নাও। জোরাজুরি কোরো না।

সঙ্গে সঙ্গে লম্বা মতন মেয়েটি, সম্ভবত বর্তমান এ-জি-এস, চোয়াল শক্ত করে বলে উঠেছে,—কেউ কাউকে জোর করছে না স্যার। আপনাকেও ইন্টারফিয়ার করতে হবে না। স্টুডেন্টদের ব্যাপার স্টুডেন্টদেরই বুঝে নিতে দিন।

সোমনাথ বলতে পারত, কী করছ না করছ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বলতে পারত, তোমাদের এই চাঁদা আদায় করাটাই তো বেআইনি। সারা বছরের খরচখরচা চালানোর জন্য কলেজ ফান্ড থেকে তো মোটা টাকা পাও তোমরা।

কিছুই বলতে পারল না সোমনাথ। উলটে নিবে গেল যেন। ঢোক গিলে বলল,—না মানে…ও বলছিল, তাই…। তোমাদের অ্যামাউন্টটা তো সত্যিই একটু বেশি।

—বেশি কি কম সে আমরাই বুঝে নেব স্যার। বিলবই নিয়ে বসে থাকা প্রাক্তন ছাত্রটির কড়া স্বর উড়ে এল,—কনসিডার করার হলেও আমরাই করব। কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে কারুর চ্যালেঞ্জ করাটা বরদাস্ত করব না। সে যেই হোক না কেন।

কাকে শাসায়? মেয়েটিকেই? নাকি সোমনাথকেও? চাঁদার পরিমাণের কথা তোলাটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল? ছাত্রছাত্রীরা একটু বেশিই স্পর্শকাতর হয়, যদি এই ইস্যু নিয়েই তুলকালাম বাধিয়ে বসে?

সোমনাথের গা ছমছম করে উঠল। তাকে ঘিরে হট্টগোল বাধবে কলেজে? সর্বনাশ!

তড়িঘড়ি আপসের সুরে সোমনাথ বলল,—না না, কনসিডার তো তোমরাই করবে। দ্যাখো, যা ভাল বোঝে করো।

এ-জি-এস মেয়েটি বলল,—ঠিক আছে স্যার, আপনি যান।

অফিসরুমের বাইরে এসে সোমনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে মনে কষে ধমকালও নিজেকে। বেমক্কা আগুনে হাত লাগানোর দরকারটা কী ছিল, অ্যাঁ? ছ্যাঁকা খেয়ে শিক্ষা হল তো!

পায়ে পায়ে স্টাফরুমে এল সোমনাথ। ঘরখানা বেশ বড়সড়। মাঝখানটা দখল করে আছে এক অতিকায় আয়তাকার টেবিল, তাকে ঘিরে খান তিরিশেক চেয়ার। খুদে খোপঅলা লোহার আলমারি। অধ্যাপকদের নিজস্ব জিনিসপত্র রাখার ভল্ট। দেওয়ালের টঙে বিদ্যাসাগর রামমোহন রবীন্দ্রনাথ জগদীশ বোস প্রমুখ মনীষী বিরাজমান। প্রত্যেকেই মলিন, ঢেকে গেছেন ধুলোয়। বড় বড় তারিখওলা একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে এক দেওয়ালে, পাশে গোটা তিনেক নোটিসবোর্ড। ঠিক তার মাথায় প্রকাণ্ড ঘড়ি।

রেজিস্টারখানা স্বস্থানে রেখে সোমনাথ চেয়ার টেনে বসল। একবার আলগা চোখ বুলিয়ে নিল চারদিকে। অনেকেই আছে এখনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পাঁচদিন পাঁচ ঘণ্টা’ আইন বছরখানেক হল চালু হয়েছে কলেজে, চারটের আগে তাই পুরো ফাঁকা হয় না স্টাফরুম। ক্লাস থাকল তো ভাল, নইলে বই নিয়ে বসে থাকো, কিংবা গল্প-আড্ডায় মাতো, কিংবা তরিজুত করে টিফিন খাও। আজও মোটামুটি দৃশ্যটা একই রকম।

ক্ষণপূর্বের কষ্‌টে অভিজ্ঞতাটা সরিয়ে রেখে ঢাউস ফোলিও ব্যাগখানা খুলল সোমনাথ। দুটো মোটা বইয়ের ফাঁকে অতি সাবধানে রাখল মাইনের চেকখানা। রেখেও আর একবার তুলে দেখে নিল টাকার অঙ্কটাকে। উনিশ হাজার ন’শো তিরাশি। ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল সোমনাথের। আঠাশ হাজার টাকার ওপর মাইনের কী হাল! চার হাজার ট্যাক্সে খায়, চার হাজার যায় পি-এফে। তাও ভাগ্যিস তুতুলের বিয়ের সময়ে তোলা পি-এফ লোনটা নন-রিফান্ডেবল। অবশ্য রিফান্ডেবল নিলেও লোন বোধহয় বছরখানেক আগে শোধ হয়ে যেত। ছোট্ট ডায়েরি বার করে এ মাসের হিসেবে ডুবে গেল সোমনাথ। এইচ-ডি-এফ-সি-কে দিতে হবে চার হাজার একশো ছাব্বিশ। কো-অপারেটিভকে চোদ্দশো। তুতুলের বিয়ের সময়ে মরিয়া হয়ে শেষ মুহূর্তে অমিয় সামন্তর থেকে ছত্রিশ পারসেন্ট সুদে এক লাখ নিয়েছিল, সুদে আসলে মিলিয়ে তার মাসিক পাওনা চার হাজার। একটা এল-আই-সি প্রিমিয়াম এ মাসেই পড়েছে, অর্থাৎ আরও একুশশো সাতষট্টি। যোগ বিয়োগের শেষে হাতে পড়ে রইল আট। কী করে চলবে সারা মাস? আবার খামচা মারবে সেভিংস থেকে? আছে তো মাত্র তেইশ মতো, সেখান থেকেই নয় সাবসিডি ভরবে এবারও। একটাই বাঁচোয়া, এই এল-আই-সি টার এটাই শেষ প্রিমিয়াম। সামনের বছর ম্যাচিয়োরিটির টাকা এসে গেলে এক লপ্তে শেষ হয়ে যাবে অমিয় সামন্তর দেনা। কো-অপারেটিভের লোনও অক্টোবরে খতম। পুজোর পর থেকে তবু যা হোক খানিকটা বাড়তি অক্সিজেন আসবে ফুসফুসে। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চে শেষ প্রিমিয়াম দুটো চুকিয়ে দিতে পারলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ওই দুটো টাকার জোগাড় অবশ্য হয়ে আছে। ডিসেম্বরে এন-এস-সি থেকে মিলবে কিছু, মাছের তেলেই মাছ ভেজে ফেলবে চাকরির অন্তিম লগ্নে।

আচমকা পিঠে ভারী হাতের চাপড়। সোমনাথ ফিরে তাকাল। নির্মল। হাসছে মৃদু মৃদু।

—কী এত লেখালেখি চলছে? বুড়ো বয়সে ঘোড়ারোগে, আই মিন পদ্য রোগে ধরল নাকি?

—না রে ভাই, হিসেব কষছি।

—জীবনের ডেবিট ক্রেডিট? কী পেলে, আর কী পেলে না? বলতে বলতে পাশের চেয়ারে বসেছে নির্মল,—একটা ব্যাপারে শিয়োর থাকতে পারো। পেনশানটি তুমি পাচ্ছ না।

—কেন?

—সার্ভিসবুকে তোমার হাজার গন্ডা ভুল। তোমার কনফার্মেশান সংক্রান্ত জি-বি রেজোলিউশানে মেমো নাম্বার নেই, ডেট নেই। ছুটির হিসেবে অন্তত চার জায়গায় ডিসক্রিপেন্সি।….পঁচানব্বইতে তুমি একটা আর্নড লিভ নিয়েছিলে না?

—হ্যাঁ। একবার নয়, দু’বার। প্রথমটা তিরিশ দিন, দ্বিতীয়টা তিন সপ্তাহ। প্রথমবার মা’র সেরিব্রাল হল,দ্বিতীয়বার মা চলে গেলেন।

—কারেক্ট। জি বি রেকর্ড তো তাই বলছে। কিন্তু সার্ভিসবুকে দ্বিতীয়টার এন্ট্রি নেই। ব্যস, গোটা ছুটির ক্যালকুলেশানটাই গুবলেট।

—কী হবে?

—কিছু একটা করতে হবে। ফ্রেশ হিসেব, তারপর যতীন দাশগুপ্তর বাড়িতে ধরনা দিয়ে ইনিশিয়াল মারিয়ে আনা। দশাসই চেহারার নির্মল গাল চওড়া করে হাসল, —আরে শোনো শোনো, নির্মল রায় যখন সার্ভিসবুকগুলো কমপ্লিট করার দায়িত্ব নিয়েছে, কোনও ভুলই আর চুপচাপ শুয়ে থাকবে না।

সোমনাথ খানিকটা স্বস্তি বোধ করল। নির্মল কর্মী পুরুষ, নিজে যখন যেচে স্টাফদের হাত থেকে কাজটা নিয়েছে, নিখুঁতভাবে শেষ না করে সত্যিই ছাড়বে না। তা ছাড়া সোমনাথেরটা তো নির্মল করবেই। তাদের সম্পর্কটাও তো আলাদা। অনেক বেশি গভীর। একই দিনে দু’জনে এই কলেজে ঢুকেছিল যে।

তবু সোমনাথ বলে ফেলল, —আর কনফার্মেশানের ব্যাপারটা কী হবে?

—হবে রে ভাই, হবে। হয়ে যাবে। ঘাবড়াচ্ছ কেন? আমি সিরিয়ালি রেডি করছি। রিটায়ারমেন্টের ডেট ধরে। প্রথমে দেবব্রতবাবু, তারপর সীতাংশু ঘোষ, তার পরেই তুমি। ….তোমার তো নেক্সট ইয়ারের নভেম্বর, এখনও ঢের দেরি।

—তাও তো মাত্র ষোলো মাস। দেখতে দেখতে এসে যাবে। সোমনাথকে ঈষৎ উদাস দেখাল, —মনে পড়ে, এই সেদিন জয়েন করলাম? তুমি শিবতোষবাবুর ঘরে বসেছিলে, মিলিটারি গোঁফে পাক দিতে দিতে শিবতোষবাবু তোমায় বলছিলেন, এত কচি ছেলে, কোএড কলেজের ক্লাস সামলাতে পারবে তো?…!

—শিববাবু নার্ভাস হয়েছিলেন অন্য কারণে। তখন আমিও আইবুড়ো কার্তিক তো!

—ভাবো, তারপর কোথা দিয়ে তিরিশটা বছর চলে গেল!

—ডোন্ট বি নস্টালজিক সোমনাথ। ওটা বুড়োমির লক্ষণ। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল নির্মল। ইতিউতি চাইল একটু। হালকা প্রশ্ন ছুড়ল,—ও মালবিকা ম্যাডাম, ধরাব?

দর্শনের মালবিকা টিফিনবক্স খুলে শীতল চাউমিন খাচ্ছিল। শীতলতর চোখে বলল, —একদম না। ধরালেই পুলিশে খবর দেব। অ্যাটেমপ্ট্ টু মার্ডার চার্জে ধরে নিয়ে যাবে। লাঙ্স ফুটো করার পরোক্ষ যড়যন্ত্রের দায়ে।

—কী পুলিশ আসবে? ছেলে পুলিশ? না মেয়ে পুলিশ? হ্যা হ্যা হাসছে নির্মল, —মেয়ে পুলিশ হলে সঙ্গে সঙ্গে সারেন্ডার। আর একটা মেয়ে পুলিশের গারদ থেকে তো মুক্তি মিলবে।

—দাঁড়ান, বউদিকে বলছি।

—ভুলটা কী বলেছি ম্যাডাম? স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আর মেয়েদারোগায় ফারাক কতটুকু? স্কুলে তিনি ছড়ি ঘোরান, আর বাড়িতে রুল।

ঘর জুড়ে হাহা হাসি, হোহে হাসি। বাচ্চা বাচ্চা পার্টটাইমার ছেলেমেয়েও আছে দু’-তিনজন, তারাও হাসছে মিটিমিটি। নির্মলের উপস্থিতিতে গোমড়া থাকা কঠিন।

নির্মল ফস্ করে ধরিয়েই ফেলেছে সিগারেট। ঝোলাব্যাগ কাঁধে নিয়ে সোমনাথকে বলল, —কী, উঠবে তো?

সোমনাথ ঘড়ি দেখল, —চারটে তো বাজেনি!

—ওফ্, সেই নিয়মের জালে বন্দি হয়ে গেছ? গভর্নমেন্টও পারে বটে। বেশিক্ষণ আটকে রাখলেই যেন কলেজে পড়াশুনো উপচে পড়বে। ওভাবে কি ফাঁকিবাজি রোখা যায়? গোয়ালঘরে শেকল তুলে দিলে গরু কি বেশি দুধ দেয়? যার যেটুকু দেওয়ার সেটুকুই দেবে। আর যে বাছুরকে খাওয়ানোর জন্য মরিয়া, সে ঠিক বাছুরকে খাইয়ে আসবে।

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সহসা আনমনা হয়ে গেল স্বপন, দেওয়াল দেখছে পল্লব, উঠে বাথরুমে চলে গেল অংশুমান।

সোমনাথের একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন সে ব্রহ্মচারী বটে, খানিকটা ভয়ে, খানিকটা বা লোকলজ্জায়। তবে বহুকাল তো স্বপনদেরই সমগোত্রীয় ছিল সে। টিউশ্যনি নিয়ে খোঁচা উপভোগ করা তাকেও বোধহয় মানায় না।

ঝটপট কথা ঘুরিয়ে বলল, —পাঁচ ঘণ্টা থাকা অবশ্য আমার হয়ে গেছে। পৌনে এগারোটায় ঢুকেছিলাম আজ।

—তা হলে আর বসে কেন? এরপর বেরোলে চারটে চোদ্দো পাবে?

ফোলিও ব্যাগের চেন টানার আগে সোমনাথ ফের একবার দেখে নিল চেক স্বস্থানে আছে কিনা। উঠে নির্মলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। এগোচ্ছে করিডোর ধরে।

সিঁড়ির মুখে এসে দীপেনের সঙ্গে দেখা। হন্তদন্ত হয়ে স্টাফরুমে যাচ্ছিল দীপেন, দাঁড়িয়ে পড়েছে, —আপনারা চলে যাচ্ছেন?

নির্মল লঘু স্বরে বলল,—কলেজ তো আমাদের জন্য খাটবিছানার ব্যবস্থা রাখেনি ভাই। …তা তুমি এই শেষবেলায় কোথ্থেকে? সারাদিন তো তোমার টিকিটি দেখিনি?

—একটু চপলানন্দ মহাবিদ্যালয়ে গেছিলাম।

—হঠাৎ? নির্মল চোখ টিপল, —সমিতির কাজে?

—ওই আর কী। ওখানে সমিতির জেলা কমিটির উদ্যোগে একটা সেমিনার হবে, তারই একটু গ্রাউন্ডওয়ার্ক টোয়ার্ক করা…

—একটা কথা বলব দীপেন? তোমার মাইনে কে দেয়, অ্যাঁ? সমিতি?

—মানে?

—ছেলেমেয়েরা স্টাফরুমে এসে তোমায় খুঁজছিল। তুমি বরং এবার থেকে তোমার একটা ভাল ছবি দিয়ে যেয়ো, স্টাফরুমে টাঙিয়ে রাখব। ছেলেমেয়েরা এলে দেখিয়ে দেব ছবিটা।

হেসে হেসেই বলছে নির্মল, সুরটাও তরল, তবু দীপেন যথেষ্ট আহত হয়েছে। গোমড়া মুখে বলল, —আমাদের অ্যাটেন্ডেন্স দেখার জন্য প্রিন্সিপাল আছেন নির্মলদা।

—হুম। তিনিও তো জানেন কোথায় চোখ বুজে থাকতে হয়। তুমি হচ্ছ বড় নাও-এর মাঝি, তোমাকে কি পুলকেশ কুন্ডু চটাতে পারে? তবে আমরা তো দীন অভাজন, আমাদের জানতে ইচ্ছে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ দিন পাঁচ ঘণ্টা আইন নেতাদের ক্ষেত্রে খাটে কিনা।

দীপেন আরও গোমড়া। আড়চোখে সোমনাথকে দেখে নিয়ে বলল, —আমি আজ সি-এল নিয়ে নেব।

—নিয়ো কিন্তু। নির্মল হা হা হাসছে, —ভুল করে সই মেরে বোসো না।

দীপেনের মুখ আমসি। গত এপ্রিলে একদিন কলেজে না এসে সই মেরেছিল দীপেন, নির্মলের নজর এড়ায়নি, অনেককেই দেখিয়েছিল ডেকে। লজ্জা পেয়ে দীপেন সইটা কেটে দিয়েছিল। মুখফোঁড় নির্মল সেটাও শোনাতে ছাড়ল না। পারেও বটে।

সোমনাথ টানল নির্মলকে, —অ্যাই, চলো তো। এবার কিন্তু সত্যিই ট্রেনটা মিস করব।

নির্মল ঘড়ি দেখে বলল, —হ্যাঁ, তাই তো। …চলি দীপেন।

দীপেন বুঝি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পা রেখেছে করিডোরে।

একটু গিয়েও নির্মল ঘুরে দাঁড়িয়েছে, —দীপেন? অ্যাই দীপেন? চপলানন্দতে সেমিনারের টপিকটা তো বললে না? কোন কুমিরছানাটা দেখাচ্ছ? সাম্রাজ্যবাদ? না সাম্প্রদায়িকতা?

দীপেন এগিয়ে এল। গুমগুমে গলায় বলল, —আমাদের কি আর কোনও বিষয় নেই?

—আছে?

—অবশ্যই। এবার আলোচনা হবে বিশ্বায়নের পটভূমিতে শিক্ষকদের কী ভূমিকা হওয়া উচিত, তাই নিয়ে।

—বাহ্ আর একটা কুমিরছানা আমদানি করেছ তো! এবার বুঝি এটাকেই কিছুদিন খেলাবে? …তা নতুন নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে যে বকলমে ক্যাপিটেশান ফি চালু হয়ে গেল, তাই নিয়ে বক্তব্য থাকবে তো শিক্ষকদের? তোমাদের বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে?

—সে আমি কী করে জানব? বক্তারা যা বলবে।

—এমন বক্তা আছে তাহলে যাদের বক্তব্য তোমরা আগে থেকে জানো না?

—আপনি বড্ড বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে কথা বলেন নির্মলদা। ধরেই নিচ্ছেন কেন সবাই আমাদের লাইনেই কথা বলবে? সমিতি মোটেই পার্টিজান নয়, আমরা সব্বাইকে নিয়ে চলি।

—তা তো বটেই। সব লাইনের শিখণ্ডীই তো আমাদের সমিতিতে খাড়া করা আছে। বাম, ডান, অতি বাম, অতি ডান, মধ্যপন্থী, মৃদুপন্থী… গুদামে সব্বাই মজুত। শুধু ঠুলিপরা ঘোড়ার লাগামটা তোমাদের হাতে। তোমরা খাচ্ছ ক্ষীর, বাকিরা তোমাদের আঙুল চেটেই খুশি। কিছু মনে কোরো না, তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। অন্যরা তোমাদের জায়গায় এলে তোমাদের মতোই গুলি ফোলাবে। রাদার দে উইল বি মোর ফেরোশাস। সেই আতঙ্কেই না তোমাদের আমরা মাথায় করে রেখেছি!

আবার নির্মল চড়ছে। নির্মলকে ফের টানল সোমনাথ, — তুমি যাবে? না আমি এগোব?

নির্মলের সংবিৎ ফিরেছে, —হ্যাঁ, চলো চলো।

কলেজ গেটের বাইরে এসে চটপট রিকশা নিল সোমনাথ। নির্মলকে বিশ্বাস নেই, আবার এক্ষুনি ক্যারা নড়ে উঠবে, ওমনি ছুটবে দীপেনকে খেপাতে। পারেও বটে!

রিকশা চলছে। মফস্সল টাউনের বুক চিরে। একসময়ে জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা ছিল। গত ছ’-সাত বছরে দোকানপাট গজিয়েছে অজস্র। লোকজনও বেড়েছে। পথচারীদের সামলে সুমলে এগোচ্ছে বুড়ো রিকশাওয়ালা। সামনে টানা ঝিল পড়ল। স্নিগ্ধ সবুজ জল, চোখ জুড়িয়ে যায়।

সোমনাথ ঘাড় তুলে আকাশটাকে দেখল একঝলক। শেষ আষাঢ়ের ঘন আকাশ। কাল রাত্তিরেও বৃষ্টি হয়েছিল জোর, আজ দিনভর জিরিয়ে নিয়ে ফের বুঝি মাঠে নামার জন্য কোমর বাঁধছে মেঘবাহিনী। সোমনাথের আবছাভাবে মনে হল বরানগরে তুতুলদের পাড়ায় বড্ড জল জমে, সোমনাথ গিয়ে আটকে যাবে না তো?

কানের পরদায় নির্মলের নিচু গলা, —দীপেনটা আজ জোর বেঁচে গেল। ওকে আর একটু ঝাড়ার ইচ্ছে ছিল।

সোমনাথ হাসল, —তুমি দীপেন বেচারাকে এত হ্যাটা করো কেন বলো তো?

—ওদের দ্বিচারিতাটা আমার সহ্য হয় না। মুখে বড় বড় আদর্শের বুলি কপচাবে, কিন্তু কাজের বেলায় ফাঁকিবাজদের শিরোমণি। এবং ধান্দাবাজ। সব সময়ে লাইন করে চলেছে কী ভাবে কিছু একটু বাগানো যায়। তুমি তো জানো না ও ব্যাটা কলকাতায় ইতিহাসের একটা অ্যাডভান্স স্টাডি সেন্টারের মাথায় বসার জন্য ইদানীং তুড়ে লাইনবাজি চালাচ্ছে। দেখে নিয়ো, উইদিন টু ইয়ারস দীপেন উইল লিভ আওয়ার কলেজ। অথচ তুমি শুনে অবাক হবে, এই দীপেন কিন্তু কলেজ লাইফে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনীতির ছেলে ছিল।

—কী করা যাবে বলো, এটাই এখন যুগের ধারা।

—আমরা অ্যালাও করেছি বলেই ধারাটা এমন হয়েছে। সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো আমরা শুধু সয়ে যাচ্ছি।

—তুমি আর সইছ কোথায়? অবিরাম চেঁচাচ্ছ তো।

—চেঁচানিটুকুই সার। কে শোনে? এখন একার চেঁচানো হাওয়ায় উড়ে যায়। চিৎকার করার জন্যও এখন একটা দল লাগে।

— তা দল একটা গড়ে ফ্যালো। অল বেঙ্গল চিৎকার সমিতি।

—আওয়াজ মারছ? ভাল মতোই জানো ওই ধরনের দলে আমার বিশ্বাস নেই। এখন দল মানে তো অন্ধত্ব। একটা ডগ্‌মা খাড়া করে গ্রুপবাজি। নির্মল ফের একটা সিগারেট ধরাল। হাওয়া বাঁচিয়ে। কায়দা করে। পোড়া দেশলাই কাঠিটা টোকা মেরে ফেলে দিয়ে বলল, —তবে একটা সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। আমি আর কোনও দলেফলে নেই। সমিতিকেও আর চাঁদা দেব না। দীপেন চাইতে এলে ওর ধুধ্ধুড়ি নেড়ে দেব।

—দিয়ো।

—তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত নও?

—আমাকে আবার জড়াচ্ছ কেন? তোমার এখনও সাড়ে তিন বছর চাকরি আছে, আমার সামনে রিটায়ারমেন্ট…

—তাই ঝুটঝামেলা এড়াতে চাও? শনিঠাকুরের প্রণামীর বাকসে সিকিটা আধুলিটা ফেলে দেবে… শনিঠাকুর তুষ্ট হলেন তো ভাল, নইলে অন্তত যেন কুপিত না হন তিনি।

সোমনাথ মনে মনে বলল, সে তুমি যাই ভাবো, তুমি আর আমি তো এক নই নির্মল। হাতের পাঁচটা আঙুলই সমান হয় না, সব মানুষ এক মাপের হবে কী করে? তোমার মতো বুক ফুলিয়ে চলার কথা ভাবলেই যে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। তা ছাড়া তোমার বউ চাকরি করে, ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে, মাথার ওপর কোনও দায়দায়িত্ব নেই, দেনা নেই, তোমার সঙ্গে আমার তুলনা চলে? চারদিকে এমন মিডিয়ার হল্লাগুল্লা উঠল, আমি টিউশ্যনিগুলো পর্যন্ত ছেড়ে দিলাম, এখন তো আমায় প্রতিটি পা সতর্কভাবে ফেলতে হবে, নয় কি?

স্টেশন এসে গেছে। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে চটপট দু’ভাঁড় চা নিল নির্মল। শেষ চুমুক দেওয়ার আগেই ট্রেন হাজির। চারটে চোদ্দো চারটে চৌত্রিশে ঢুকছে। এখনও ট্রেনে ভিড় হয়নি তেমন, বসার জায়গা না মিললেও শান্তিতে একটু দাঁড়ানো গেল। মাত্র চার-পাঁচটা তো স্টেশন, এটুকু পথ দাঁড়িয়ে থাকতে কী বা কষ্ট!

নির্মল নামল দমদম ক্যান্টনমেন্টে। আপাত দৃষ্টিতে নির্মলকে খানিক বেহিসেবি মনে হয় বটে, আদতে সে রীতিমতো গোছানো মানুষ। চাকরি পাওয়ার সাত-আট বছরের মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে দিব্যি একটা প্লট কিনে ফেলেছিল, চমৎকার একটা বাড়িও বানিয়ে ফেলেছে। তুলনায় অনেক সতর্ক অনেক হিসেবি সোমনাথ তো যাকে বলে একজন দ-এ পড়া মানুষ। সাতচল্লিশ বছর বয়সে সাতশো তিরানব্বই স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে আজ নাভিশ্বাস উঠছে সোমনাথের। এখনও আটটা কিস্তি বাকি, টানতে হবে সেই সামনের এপ্রিল পর্যন্ত। চাকরিজীবনের ক’টা দিনই বা সে অঋণী হয়ে কাটাতে পারবে?

এইসব টুকরোটাকরা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে ট্রেন ঢুকছে দমদমে। ফোলিওব্যাগ সাপটে ধরে নেমে পড়ল সোমনাথ। প্ল্যাটফর্মের বাইরে আসতে না আসতেই বৃষ্টি। মোটা মোটা দানা ঝরছে টুপটাপ। হাওয়াও উঠল একটা। শিরশিরে। শীতল।

দু’-চার মিনিটের মধ্যেই তেজ বাড়ল বর্ষণের। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ছে। উদ্দাম ছুটন্ত জলকণায় পথঘাট ধোঁয়া ধোঁয়া।

সোমনাথ প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঠায় একটা দোকানের শেডে দাঁড়িয়ে রইল। বরানগর যাওয়ার আর প্রশ্নই নেই, বৃষ্টি একটু ধরতেই রিকশা নিয়ে সোজা বাড়ি। হুড তুলে দিয়েছে রিকশার, প্লাস্টিকের পরদা নামানো, তবু সোমনাথ ভিজেমিজে একসা।

সোমনাথের ফ্ল্যাটখানা তিনতলায়। দরজা খুলেছে মৃদুলা। সোমনাথকে ঝলক দেখে ধমকের সুরে বলল —ছাতা নিয়ে যেতে কী হয়?

সোমনাথ জুতো ছাড়তে ছাড়তে বলল, —এই বৃষ্টি ছাতায় আটকায় না।

—তবু লোকে বর্ষাকালে একটা রাখে সঙ্গে। তুতুলের দেওয়া ফোল্ডিং ছাতাটা তো ব্যাগেই রেখে দিতে পারো।

ওরেব্বাস, ওটা যা দামি! হারিয়ে গেলে তুমি আস্ত রাখবে? মনে এলেও কথাটা অবশ্য মুখে আনল না সোমনাথ। মৃদুলার কাঠ কাঠ বাক্য বলে দিচ্ছে আজ গিন্নির মেজাজ ভাল নেই।

মৃদুলা চা বানিয়ে ফেলেছে। বাথরুম ঘুরে সোমনাথ ডাইনিং টেবিলে এল। সঙ্গে সঙ্গে কর্ণকুহর বিদীর্ণ করে মাইকে গান বেজে উঠেছে। চটুল হিন্দি সংগীত।

সোমনাথ বিরক্ত মুখে বলল, —এ আবার কী আরম্ভ হল?

—কী-একটা পুজো। মনসা না শীতলা। পেছনের বস্তিতে। চিড়েভাজার বাটি এগিয়ে দিল মৃদুলা, —সকাল থেকেই তো চলছে। বৃষ্টিতে একটু দমেছিল, আবার…। দশ টাকা চাঁদা নিয়ে গেছে, মনে নেই?

—তার জন্য আমাদের দিকে মাইক ফিট করে দেবে?

—তোমার মনোরঞ্জন করছে।

—ওফ্, যন্ত্রণা!

—গিয়ে বলে এসো না কমাতে। যদি তোমার কথা শোনে।

ব্যঙ্গ করছে মৃদুলা। জানে সোমনাথ কিছুই পারবে না।

চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদুলা ফের বলল, —মিতুল গিয়েছিল। মোড়ের ছেলেদের বলতে। তারা স্ট্রেট বলে দিল, গরিব ছেলেগুলো একটা দিন ফুর্তিফাৰ্তা করছে…। সব সমান। সব সমান। তারাও তো এসে পার্টির নাম করে মাসে মাসে বিল ধরিয়ে যাচ্ছে!

সোমনাথ চুপ মেরে গেল। চিঁড়েভাজা খুঁটতে খুঁটতে ঘোরাল প্রসঙ্গটাকে, —মিতুল কোথায়?

—পড়াতে গেছে।

—এই বৃষ্টিতে বেরোল?

—আগেই বেরিয়েছে। মেঘ দেখে বারণ করেছিলাম, শুনলই না। তারও তো আজ ফুর্তির প্রাণ…

—ফুর্তি কীসের?

—তার আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে। স্কুল সার্ভিস কমিশানের।

—তাই নাকি? স্পনসর লেটার এসে গেল? আগে বলবে তো! মিইয়ে যাওয়া সোমনাথ সহসা উজ্জীবিত, —কোথায় দিল পোস্টিং?

—মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়।

—ক্‌ক্‌কী?

—মা-টি-কু-ম-ড়া।

—সেটা আবার কোথায়?

—কী করে বলব? হবে কোনও গণ্ডগ্রাম। মৃদুলা ঝনঝনিয়ে উঠল। —কবে থেকে তোমায় বলছি, মেয়েটার ইন্টারভিউ হয়ে গেল, এবার একটু ধরাকরা করো…।

—কাকে ধরব? কোথায় চেনাজানা আছে আমার? সোমনাথের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, —জায়গাটার লোকেশান দেওয়া নেই?

—আছে। থানা বামুনঘাটা। পোস্ট মুন্সিডাঙা।

—বামুনঘাটা? সে তো বিস্তর দূর। নাগেরবাজার থেকে বাসে কম করে দু’ঘণ্টা।

—ট্রেন রুট নেই?

—জানি না ঠিক। দেখতে হবে। সোমনাথকে ভারী উদ্বিগ্ন দেখাল, —মিতুলের কী রিঅ্যাকশান?

—বললাম তো। সে নাচছে। অচেনা অজানা জায়গা দেখে কোথায় ঘাবড়ে যায় মানুষ…! কালই তো বোধহয় ডি-আই অফিস ছুটবে।

মাইকের ঝংকার আছড়ে পড়ছে কানে। ঝিমঝিম করছে মাথা। সোমনাথ চুল খামচে ধরল। আবার একটা টেনশান? কোনও মানে হয়?

.

॥ দুই ॥

দুপুরের ভাতঘুমটি সেরে বেরোনোর জন্য সাজগোজ করছিল তুতুল। তখনই ফোনটা বেজে উঠল। এই অসময়ে কার বংশীধ্বনি? প্রতীক নাকি?

মহার্ঘ ক্রেপ সিল্কের আঁচল সামলাতে সামলাতে তুতুল বিছানা থেকে তুলল কর্ডলেসখানা, —হ্যালো?

—আমি কি মিসেস অনন্যা চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা বলতে পারি?

—আমিই মিসেস চ্যাটার্জি। বলুন?

—গুড আফটারনুন ম্যাডাম। আমার নাম সুদেব সামন্ত। আপনার সঙ্গে লাস্ট মানডে আমার ব্যাঙ্কে দেখা হয়েছিল। আপনি বলেছিলেন পরে ফোন করতে। রিগার্ডিং ক্রেডিট কার্ড।

মনে পড়েছে। সেই কালো মতন স্মার্ট ছেলেটা। মুখে টকাটক ইংরিজির খই ফোটাচ্ছিল। কিন্তু সেদিনই তো তুতুল হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে ক্রেডিট কার্ডে আগ্রহী নয়! তবু ছেলেটা হাল ছাড়েনি, লেগে আছে পিছনে! বেচারা। ক’টাকা কমিশনের জন্য কী মরিয়া!

তুতুল নির্লিপ্ত স্বরে বলল, —সরি। আয়াম নট ইন্টারেস্টেড।

—আমাদের কিন্তু একটা ভাল স্কিম চলছিল ম্যাডাম। কার্ড করলে ফার্স্ট ইয়ারের জন্য নো অ্যানুয়াল চার্জ। প্লাস আপনি পাচ্ছেন হানড্রেড রিওয়ার্ড পয়েন্টস্। প্লাস ইউজুয়াল ফেসিলিটিজ। ভেবে দেখুন, আজকের দিনে পথেঘাটে টাকা ক্যারি করা কত আনসেফ। অথচ কার্ড সঙ্গে থাকলে ইউ ক্যান হ্যাভ এনিথিং ইউ লাইক।

—আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন। বললাম তো, করাব না।

—আমাদের ইনস্ট্যান্ট লোন ফেসিলিটিজও আছে ম্যাডাম। ছেলেটা শুনছে না, উগরে যাচ্ছে নিজের বক্তব্য, —ওভার ফোন রিকোয়েস্ট করলেই উইদিন টোয়েন্টিফোর আওয়ারস্ আপনার হাতে ড্রাফট পৌঁছে যাবে।

—বলছি তো লাগবে না। সরি।

রুক্ষ্মভাবে কথাটা ছুড়েই ফোন কেটে দিল তুতুল। হুঁহ, লোভ দেখায়। তুতুলের বাবা ক্যাশই ভাল। ব্যাগে গোছা গোছা নোট নিয়ে না বেরোতে পারলে মার্কেটিংয়ে সুখ কোথায়! ফের ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফিরল তুতুল। ন্যাচারাল শাইন বিদেশি ওষ্ঠরঞ্জনী বোলাচ্ছে পাতলা ঠোঁটে। মোম মসৃণ নিটোল মুখখানা দেখতে দেখতে ভ্রূভঙ্গি করল আপন মনে। ক্রেডিট কার্ডে কিনলেই তো চুকে গেল না, পেমেন্ট তো করতে হবে চেকেই। বেশি চেক চালাচালি পছন্দ করে না প্রতীক। কী সব অ্যাসেট স্টেটমেন্টের ঝামেলা ফামেলা আছে বেচারার। টাকা যখন আছেই, কেন ফালতু ঝঞ্ঝাটে যাবে?

তুতুলের রূপটান প্রায় শেষ। এবার ফিনিশিং টাচ। প্লাক করা ভুরুর ওপর আঙুল বোলাল আলতো করে, কম্প্যাক্টের পাফ আলগা থুপল গালে কপালে, ডিওডোরেন্ট ছড়াল বাহুসন্ধিতে, স্তনের খাঁজে, ঘাড়ে গলায়। ব্যস, সে এখন অপরূপা।

ঝুঁকে শাড়ির কুঁচি ঠিকঠাক করছিল, হুড়মুড়িয়ে ঘরে রুপাই। পরিপূর্ণ উদোম, গায়ে খাবলা খাবলা বেবিপাউডার। পিছন থেকে মাকে বেড় দিয়ে ধরে হাসছে খিলখিল।

চম্পাও এসেছে পিছন পিছন,—দ্যাখো না বউদি, কিছুতেই ডায়াপার পরছে না।

তুতুল আহ্লাদি গলায় বলল,—অমন করে না সোনা, লক্ষ্মীটি। আমরা বেই বেই যাব।

—না। পুচকে রুপাই জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল,— আমাল দলম লাগে। বলেই হাত ছুড়ে ছুড়ে চম্পাকে তাড়াচ্ছে,—যাহ্, যাহ্…

—আচ্ছা বাবা আচ্ছা। তুতুল হেসে ফেলল,—জামাপ্যান্টটা দে, আমি পরিয়ে দিচ্ছি।

—ডায়াপার পরাবে না? বৃষ্টিবাদলার দিন, শুশু করে ভাসাবে যে!

—ব্যাগে গোটা পাঁচেক প্যান্ট নিয়ে নে। বোতলে দুধ ভরেছিস? জল?

—সব রেডি।

—এবার তুই রেডি হ চটপট।

চম্পা বেরিয়ে যেতেই ছেলেকে পেড়ে ফেলল তুতুল। রুপাই একটু মুক্তপুরুষ ধরনের, গায়ে সুতোটি পর্যন্ত রাখা পছন্দ করে না, রীতিমতো কসরত করে প্যান্ট পরাল তাকে, যুদ্ধ করে জামা। বারবার পিছলে পিছলে যাচ্ছে ছেলে, তাকে সভ্যভব্য করতে গিয়ে তুতুলের যত্নের সাজ লন্ডভন্ড হওয়ার জোগাড়। উফ, প্রতীকের মতো শান্ত বাপের ছেলে কী করে যে এমন দুরন্ত হল! শাশুড়ি তো বলেন ছোটবেলাতেও প্রতীক নাকি খুব নিরীহ গোছের ছিল, কোথাও বসিয়ে দেওয়া হল তো বসেই আছে, বসেই আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শাশুড়ির অবশ্য একটু রং চড়ানোর অভ্যেস আছে, বিশেষত ছোটছেলের বেলায়। বেশি বয়সের সন্তান তো, তাই বুঝি মাত্ৰাজ্ঞান থাকে না। তবে প্রতীক যে মোটামুটি ধীরস্থির ছিল তা অবশ্য এখনও আন্দাজ করা যায়। কথা বলে কম, তেমন একটা উচ্ছ্বাস নেই, ছটফটানি নেই, হাহা হাসে না…। তবে কথার ওজন আছে। এখনও তুতুলের মনে গেঁথে আছে প্রথম আলাপের দিনটা, যেদিন দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে তাকে দেখতে গিয়েছিল প্রতীক। আগেই তুতুল শুনেছে ছেলে লেখাপড়ায় খুব ব্রিলিয়ান্ট, এম-এ-তে ফার্স্ট ক্লাস, মাত্র বত্রিশ বছর বয়সেই একটা প্রোমোশন পেয়ে মোটামুটি ভারী গোছের গেজেটেড অফিসার, কিন্তু তখনও তুতুল অজস্র দ্বিধাদ্বন্দ্বে। একান্ত কথোপকথনের সামান্য সুযোগ মিলেছিল সেদিন। প্রতীক তখনই শান্ত স্বরে বলেছিল, আমি কিন্তু বিশাল মাপের মানুষ কিছু নই। নিতান্তই অ্যাভারেজ। গুণে। দোষে। শুধু এটুকুই কথা দিতে পারি, আমাকে বিয়ে করলে তুমি ঠকবে না। কী যেন এক জাদু ছিল কথাটায়, পলকে ঘুচে গেল তুতুলের দোলাচল।

সেই মানুষের ছেলে রুপাই জতো গলিয়ে ধাঁ। সারা বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে। তুতুলও উঠে পড়ল। ভ্যানিটিব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে শাশুড়ির দরজায় এসেছে। সুসজ্জিত দু’কামরার ফ্ল্যাটে এই ঘরখানা মাপে অপেক্ষাকৃত ছোট, তবে নেহাত খুপরি নয়। সিংগলবেড খাট আলমারি আলনা ফেলার পরেও যথেষ্ট ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এক কোণে স্ট্যান্ডে শোভা পাচ্ছে কালার টিভি। চোদ্দো ইঞ্চির। গত বছর কিনে দিয়েছে প্রতীক। মায়ের নিজস্ব পছন্দসই প্রোগ্রাম দেখার জন্য।

ওই টিভিতেই শেফালি মগ্ন এখন। বাংলা ফিল্ম দেখছে। উত্তম সাবিত্রী। দরজায় পুত্রবধূকে দেখে প্রশ্ন করল,—বেরোচ্ছ নাকি?

—হ্যাঁ। বাপের বাড়ি যাচ্ছি। বৃষ্টি এলে জানলাটানলাগুলো বন্ধ করে দেবেন।

—চম্পাকেও নিয়ে যাচ্ছ?

—তো রুপাইকে কে সামলাবে?

—ও। শেফালির মুখ সামান্য ভার দেখাল,—বিকেলে রুণুর বাড়ি যাব ভাবছিলাম…

তুতুল মনে মনে বিরক্ত হল। যত তোলা তোলা করে রাখা হয়, তত বায়নাক্কা বাড়ে। সপ্তাহে দু’দিন-তিন দিন তো মেয়ের বাড়ি ছুটছে, তবু যেন আশ মেটে না। কী এত টান সেখানকার? ঘোঁট? তুতুলকে নিয়ে? তাই হবে। মনের সুখে ছেলের বউয়ের নিন্দে না করলে কি পেটের ভাত হজম হয়! প্লাস, চলবে রিপোর্টিং। আজ তুতুল এই কিনল, কাল তুতুল ওই কিনল…।! ননদই ছোটভায়ের বিয়ের মূল হোতা ছিল বটে, কিন্তু এখন প্রতীক-তুতুলের সুখসমৃদ্ধি দেখে তারও বেশ চোখ টাটায়। তুতুল হাবেভাবে টের পায়। নাহ্, ও বাড়িতে শাশুড়ির যাওয়াটা এবার বন্ধ করতে হবে।

তুতুল গলা ভারী করে বলল,—অন্য দিন যাবেনখন। সুষমা এলে রাত্তিরের রান্না ঠিকঠাক করিয়ে রাখবেন। রুটি আপনাদের দু’জনের মতো হবে। আপনি, আর আপনার ছেলে। আর হ্যাঁ, উলটোপালটা লোককে দরজা খুলবেন না।

শুভ্রবসনা শেফালি ঈষৎ কম্পিত গলায় বলল,—খুলি না তো।

—কেন মিথ্যে বলছেন মা? কালই তো আপনি উটকো সেল্সম্যানের কাছ থেকে দু’দুটো ফিনাইল কিনেছেন।

—তখন তো চম্পা বাড়িতে ছিল। ফিনাইলের সঙ্গে একটা বালতি দিল বলে…

—ওই বালতিতে হবেটা কী? থুতুও ফেলা যাবে না। সংসারের জিনিস কেনার আপনার দরকারটাই বা কী? কোনটা আসে না বাড়িতে? শুধু শুধু অপচয়।

থমকে গেল শেফালি। মুখ বুজে আছে।

রুপাইয়ের হাত ধরে চম্পা সমভিব্যাহারে বেরিয়ে পড়ল তুতুল। শাশুড়িকে খানিক ঝাড়তে পেরে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। মহিলাকে মাঝে মাঝেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার কে এই সংসারের আসল কর্ত্রী। ছোটছেলে কাছে এনে রেখেছে, যথেষ্ট খাতিরযত্ন করা হয়, বুড়ো বয়সে দুধটা ঘিটা ফলটা মাখনটা কোনও কিছুরই কমতি নেই, তা বলে তো মাথায় বসতে দেওয়া যায় না!

তুতুলদের হাউজিং কমপ্লেক্সটা আয়তনে বিশাল। চারদিকে খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা রেখে মাথা তুলেছে এগারোটা পাঁচতলা বাড়ি। নীচের জমিতে কিছু গাছপালাও লাগিয়েছে প্রোমোটার, বানিয়েছে মনোরম সবুজ লন। সঙ্গে একটা মিনি চিলড্রেনস পার্কও। সন্ধে হলেই জ্বলে ওঠে সারি সারি হ্যালোজেন বাতি, আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে গোটা কমপ্লেক্স।

ভেতরের পরিবেশ যতই দেখনবাহার হোক, এই অঞ্চলটা মোটেই পছন্দ নয় তুতুলের। শহরের এদিকটা যা ঘিঞ্জি। বাড়ির গায়ে বাড়ি, সরু সরু রাস্তা, মলিন দোকানপাট, বড্ড বেশি ধুলোময়লা, যানবাহনের উৎকট কোলাহল…কেমন বাজার বাজার লাগে। তার ওপর কাছেই ননদের বাড়ি, সেটাও একধরনের উৎপাত। বিয়ে দিয়েছে বলে মাঝেমাঝেই এসে গার্জেনি ফলিয়ে যায় দিদি। উফ্, কেন যে প্রতীক জামাইবাবুর কথা শুনে এইখানেই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল! আর কি জায়গা ছিল না কলকাতা শহরে? প্রথম সুযোগেই তুতুলকে এ তল্লাট ছেড়ে সরে পড়তে হবে।

গেটের বাইরে এসে তুতুল দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্যাক্সি চাই। আজকাল এই এক অভ্যেস হয়েছে, বাস মিনিবাসে আর উঠতেই পারে না। ঠেলাঠেলি আর ভিড়ের কথা ভাবলেই বুক ধড়ফড় করতে থাকে। প্রতীকই করিয়েছে অভ্যেসটা। রুপাই পেটে আসার পর থেকে তার কড়া নির্দেশ, হয় ট্যাক্সি চড়ো, নয় ভাড়ার গাড়ি, নো বারোয়ারি যানবাহন।

হাত তুলে একটা ট্যাক্সি থামাল তুতুল। গন্তব্যস্থল দমদম শুনেই হলদে-কালো ধাঁ। পরেরটাও তথৈবচ, তার পরেরটাও। তুতুলের মেজাজ তেতো মেরে গেল। পয়সা ফেলে ট্যাক্সিতে চড়ব, তাও কী রকম রোয়াব দেখায় দ্যাখো! এইসব অভদ্র ট্যাক্সিঅলাগুলোকে ঘাড় ধরে গারদে পুরে দেওয়া উচিত। কী করে যে সওয়ারি প্রত্যাখ্যান করার মতো বেআইনি কাজ করেও এরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়!

একপাশে ঝোলাকাঁধে চোদ্দো বছরের চম্পা, অন্য হাতে রুপাই, দু’জনকে নিয়ে তুতুল ছোটাছুটি করল খানিক। সপ্তম প্রচেষ্টায় ভাগ্য খুলেছে। অবশেষে দর্শন মিলল দয়ালু ট্যাক্সিঅলার। রুপাই-চম্পাকে নিয়ে পিছনের সিটে গুছিয়ে বসল তুতুল। ব্যাগ থেকে মিহি সুগন্ধি টিস্যুপেপার বার করে ঘাম মুছছে নিজের, মুছিয়ে দিল ছেলের মুখও। বড্ড ভ্যাপসা গরম আজ। সকাল থেকে বৃষ্টি নেই বলেই বোধহয় বাতাস বড় বেশি আর্দ্র। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘে ভারী হয়ে আছে বিকেল। কে জানে সন্ধেবেলা কালকের মতো ঢালবে কিনা।

ঢিকিয়ে টিকিয়ে চলেছে ট্যাক্সি। জ্যামে ঠোক্কর খেতে খেতে। সিঁথির মোড়ে এসে ড্রাইভারকে একটু দাঁড়াতে বলল তুতুল। নেমে বড় দোকান থেকে রাবড়ি কিনে নিল এক কেজি। একদম খালি হাতে বাপের বাড়ি যেতে আজকাল কেমন বাধো বাধো ঠেকে। মনে হয় নিজের সুখটুকু বুঝি পুরোপুরি দেখানো হচ্ছে না।

আবার ট্যাক্সি নড়ে উঠতেই ভ্যানিটিব্যাগে বাজনার সুর। চটপট চেন খুলে সেলফোনখানা বার করল তুতুল। জন্মদিনের উপহার। গত মাসেই দিয়েছে প্রতীক। পারলার, মার্কেট যেখানেই থাকুক না কেন তুতুল, অন্তত রুপাইয়ের খোঁজখবরটা তো রাখতে পারবে।

চোখ কুঁচকে নম্বরটা দেখে নিয়েই তুতুল কানে চেপেছে খুদে টেলিফোন,—তুমি?

ও প্রান্তে প্রতীকের ঠান্ডা স্বর—বাড়িতে করেছিলাম। মা বলল তোমরা বেরিয়ে পড়েছ…

—হুঁ। এখন ট্যাক্সিতে। তুতুল গলা নামিয়ে ঠাট্টা জুড়ল,— হঠাৎ ফোন কেন? প্রেমালাপ করার শখ জাগল নাকি?

প্রতীক যেন শুনতেই পেল না। একই রকম স্বরে বলল,— এক ভদ্রলোক এসেছেন অফিসে। আমার চেম্বারেই রয়েছেন। পার্ক স্ট্রিটের এক নামকরা অকশন শপের মালিক। ওঁর দোকানে নাকি ভাল ভাল ঝাড়লণ্ঠন এসেছে। পাথুরিয়াঘাটার সিংহবাড়ির।… তুমি তো ড্রয়িংহলের জন্য একটা ঝাড়লণ্ঠনের কথা বলছিলে সেদিন। গিয়ে দেখবে?

—ধ্যাৎ। বনেদি বাড়ির পেল্লাই মাল আমাদের ফ্ল্যাটে ধরবে কেন?

—ডিফারেন্ট সাইজ আছে। সরেজমিন করেই এসো না, যদি কোনওটা পছন্দ হয়ে যায়…

—কী রকম দাম? অনেক, তাই না?

—ওটা তো তোমার ভাবার কথা নয়।… কবে যাবে? কাল? পরশু? মিস্টার দত্ত তা হলে সেদিন প্রেজেন্ট থাকবেন।

—তুমি বলো কবে যাব?

—কালই চলো। কাল অমাবস্যা, ওখান থেকে একবার কালীঘাটেও ঘুরে আসব। একসঙ্গে তো অনেকদিন মন্দির যাওয়া হয়নি।

—বেশ। তাই চলো।

—ও কে। ছাড়ছি।

প্রতীক টেলিফোন ছাড়ার পরে মনে মনে খানিক হাসল তুতুল। মুখে প্রেমের কথা বলে না বটে, তবে তুতুল কোন ক্ষণে কী একটা চেয়েছে ঠিক মগজে ভরে রেখে দেয় প্রতীক। তারপর থেকেই বুঝি তক্কে তক্কে ছিল কখন একটা মুরগি ফাঁদে পড়ে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার প্রতীক চ্যাটার্জি সাহেবের কাছ থেকে কি হাত পেতে দাম নিতে পারবে নিলাম ঘরের দত্ত! আর ওই যে একসঙ্গে মন্দিরে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করল, ওটাও তো ভালবাসা। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার কালীঘাট, ঠনঠনে, দক্ষিণেশ্বর ছোটে প্রতীক, তবে বউ সঙ্গে থাকলে পুণ্যটা বুঝি তার আরও বেশি হয়। পুণ্য? না তৃপ্তি? প্রতীক বলে, সংসার আমাদের দু’জনেরই, একসঙ্গে দু’জনে মা’র সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালে প্রার্থনার জোর আরও বাড়ে। মুখে যাই বলুক, আসলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই তুতুলকে ভীষণভাবে পাশে চায় প্রতীক। তুতুল জানে।

পুলকিত মুখে রুপাইয়ের গাল টিপল তুতুল, —কার ফোন ছিল বলো তো রুপাইবাবু?

রুপাইয়ের মধ্যে তেমন ঔৎসুক্য দেখা গেল না। তার চোখ ছোট হয়ে এসেছে, ঘাড় কাত হচ্ছে ক্রমশ।

চম্পা বলল, —ওর দম শেষ বউদি। এক্ষুনি ঘুমোবে।

—না রুপাই, না। ঘুমোয় না। আমরা এক্ষুনি দমদম পৌঁছে যাব। এই তো ছানাপট্টি এসে গেছে, এবার লাইনটা পেরোব, মাথার ওপর দিয়ে ট্রেনগাড়ি যাবে…। দমদমে দাদুন আছে, দিদুন আছে, মাসিমণি আছে…

জাগতিক কোনও আকর্ষণেই প্রলুব্ধ হল না রুপাই। ঢক করে ঝুলে গেছে ঘাড়। ট্যাক্সি যখন মতিঝিলের স্বপ্ননিবাসে পৌঁছোল, সে তখন পুরোপুরি স্বপ্নরাজ্যে।

মিতুল ব্যালকনিতে ছিল, ট্যাক্সি দেখেই লাফাতে লাফাতে নেমে এসেছে। রুপাইকে কাঁধে ফেলে ওপরে এনে শুইয়ে দিল। তুতুল উঠেই হাঁপাচ্ছে। রাবড়ির হাঁড়ি মা’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধপাস বসে পড়ল সোফায়। ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, —উফ্, তোমাদের ফ্যানটা আর একটু জোর হয় না?

সোমনাথ কলেজ থেকে ফিরেছে এইমাত্র। সবে শার্ট ছেড়েছে। হেসে বলল, —ফুলস্পিডেই তো আছে রে। দু’মিনিট বোস, আরাম লাগবে।

মিতুল হাসছে হিহি। বলল, —এত মুটোলে গরম লাগবে না?

—অ্যাই, ঠুকিস না তো। মৃদুলা ছদ্ম ধমক দিল ছোট মেয়েকে, —বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে মেয়েদের শরীর একটু ভারী হয়। এতেই বেশ দেখায় মেয়েদের।

—ওটা মোটেই পোস্ট ন্যাটাল ফ্যাট নয় মা। খেয়ে ঘুমিয়ে জমানো চর্বি।

—বেশ করি খাই ঘুমোই। তাতে তোর কী রে শাকচুন্নি? তোর মতো প্যাংলা থাকব নাকি চিরকাল, অ্যাঁ?

পলকে সোমনাথের গৃহ সরগরম। রুপাইয়ের দুধের বোতল ফ্রিজে পুরে দিয়ে চম্পা চলে গেছে মিতুলের ঘরে, খাটে শোয়ানো রুপাইকে পাহারা দিচ্ছে। সোমনাথ বারবার ঘুরে আসছে সেখান থেকে, উৎসুক মুখে দেখছে নাতি চোখ খুলল কিনা।

কথার মাঝেই বড়মেয়ের জন্য নুন চিনি লেবুর শরবত বানিয়ে আনল মৃদুলা। বলল, —তুই অত রাবড়ি আনতে গেলি কেন রে তুতুল? কে খাবে?

—তোমরাই খাবে। মিতুলকে বেশি করে দেবে।

মিতুল মুখ বেঁকাল, —আমার আজকাল রাবড়ি ভাল্লাগে না।

—সে কী রে? তোর নাম করেই আনলাম… তুই লাউকুমড়োর দিদিমণি হয়েছিল, সেই অনারে…

—লাউকুমড়ো নয় দিদি, মাটিকুমড়া। একটা জায়গার নামের সঙ্গে সেই জায়গার মানুষের সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে থাকে। ভুলভাল নাম বললে মানুষগুলোকে অপমান করা হয়।

—বাবা দেখেছ, মিতুলের এখনই মাটিকুমড়ার ওপর কী টান!

সোমনাথ মৃদু হাসল, —টান বলে টান! কাল থেকে কত বোঝাচ্ছি অত দূরে চাকরি করতে যাওয়ার দরকার কী… শুনছেই না।

—কিছুই এমন সাঙ্ঘাতিক দূর নয় বাবা। মিতুল প্রতিবাদ জুড়ল, —আজ ডি-আই অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছি। বামুনঘাটায় নেমে বাস চেঞ্জ করতে হবে। বাসে আর চার-পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা।

—সেটা কম দূর হল? নির্ঘাত আড়াই-তিনঘণ্টা লেগে যাবে।

—লাগবে। সাতটার মধ্যে বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়ব। আবার চারটেয় বাস ধরে ব্যাক।

—অত সোজা! মৃদুলা গরগর করে উঠল, —সব যেন তোমার ঘড়ি মেপে চলে। দু’দিনে বিছানায় পড়ে যাবে।

—শরীরে না কুলোলে ওখানেই নয় থেকে যাব মা। আস্তানা ঠিক একটা জুটিয়ে নেব। শনিবার বাড়ি চলে আসব, সোমবার ভোরে ফুড়ুৎ।

—ওসব মতলব ছাড়ো। অচেনা জায়গায় তোমার একা থাকা চলবে না।

—আহা, জায়গাটা তখন তো আর অচেনা থাকছে না মা। মিতুল চোখ টিপল, —যাতায়াত করলেই সব চেনা হয়ে যাবে।

—তক্কো কোরো না মিতুল। সাফ কথা শুনে রাখো, চাকরি করো আর যাই করো, এবার তোমার বিয়ে দেবই। তারপর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করো কী করবে, কোথায় থাকবে…

—উফ্ মা, কতবার বলেছি, ওই চিন্তাটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যালো। বিয়ে করে কোনও মোক্ষলাভ হয় না।

তুতুল ফুট কাটল, —তুই কী করে বুঝলি রে মোক্ষলাভ হয় না?

—তোকে দেখে। ছিলি ছেচল্লিশ কেজির ফুরফুরে যুবতী, হয়েছিস বাষট্টি কেজির কেঁদো গিন্নি।

—মোটেই আমি বাষট্টি নই। ছাপ্পান্ন।

—ওই হল।

তুতুল হেসে ফেলল, —তার মানে তুই শুধু মোটা হওয়ার ভয়ে বিয়ে করবি না?

—তা কেন। বিয়ে করে মোক্ষলাভ হয় না বলেছি, বিয়ে করব না তো বলিনি। করতেও পারি, না-ও করতে পারি। আপাতত আমার টপ প্রায়োরিটি চাকরি। আগে সেট্ল করা। বলেই মিতুল সোমনাথের দিকে তাকিয়েছে, —বাবা, তুমি মোটামুটি পাকা চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলে?

—অ্যাই, বড় বড় লেকচার ঝাড়িস না তো। মৃদুলা ঝামটে উঠল, —বিয়ে আমরা করিনি? লেখাপড়া তো আমরাও শিখেছিলাম। আগে চাকরি, পরে বিয়ে এমন ধনুর্ভাঙা পণ করে আমরা তো ঘাড় টেড়া করিনি। বাবা-মা যা বলেছে, সমাজ যা নিয়ম করেছে, সেই মতোই আমরা চলেছি। বাধ্য মেয়ের মতো। দরকার হলে চাকরি করতাম। প্রয়োজন হয়নি, করিনি। চাকরি করিনি বলে কি আমাদের জীবন বিফলে গেছে? সংসারধর্ম করাও তো একটা কাজ, না কী? …এই যে তোর দিদি, তোর মতো অসভ্যতা করেনি, বাবা-মা যা বলেছে শুনেছে… বিয়ে করে সে খারাপ আছে? সেও তো তোর মতো জেদ ধরতে পারত। পারত না?

—সকলের মেন্টাল স্ট্রাকচার তো এক হয় না মা। দিদি দিদির মতন। আমি আমার মতন। দিদি প্রতীকদার ওপর বডি ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ভাল। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লাইফ শুরু করতে চাই, সেটাই বা কী এমন দোষের? লেখাপড়া শেখার পরও আমি অন্যের পয়সায় খাব পরব, এ আমি ভাবতেই পারি না মা।

কথাটায় সোজাসুজি খোঁচা আছে। তুতুলের মুখ কালো হয়ে গেল। মিতুলও কি তাকে হিংসে করে? দিদির মতো সুন্দরী নয় বলে মিতুলের মনে চোরা কমপ্লেক্স আছে, তাই বুঝি জ্বলছে মনে মনে। পেটি একটা চাকরি জুটিয়ে কী বড় বড় বুকনি, ফুঃ।

বড়মেয়ের মুখভাব সোমনাথের বুঝি চোখে পড়েছে। হাসি, আনন্দের এই আসরে ছন্দপতনটা মোটেই ভাল লাগল না তার। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ভ্যাজরভ্যাজর থামা তো। এই তুতুল, ছেলেটাকে তোল, একটু পাকা পাকা কথা শুনি।

—ওফ্, তুমি একেবারে নাতি নাতি করে পাগল হয়ে গেলে। মৃদুলাও কথা ঘোরাল, —বেচারাকে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও তো। কাঁচা ঘুম ভাঙালে খুব খেপে যাবে। বলতে বলতে তুতুলের দিকে ফিরেছে, —হ্যাঁ রে, প্রতীক আসবে তো? তোদের নিতে?

—না মা। ওর কাজ আছে।

—সে কী, এতবার করে বলে দিলাম সবাই রাতে খেয়ে যাবি…! প্রতীক ভালবাসে বলে আমি রসমালাই বানালাম…

তুতুল চুপ করে রইল। কথায় কথায় শ্বশুরবাড়ি আসা পছন্দ করে না প্রতীক। বলে, জামাইয়ের মর্যাদা নাকি তাতে খাটো হয়। একথা কি মাকে বলা যায়? মা আহত হবে না?

মৃদুলা ঈষৎ ভার মুখে বলল, —তোরা খেয়ে যাবি তো? নাকি তোদেরও কাজ আছে?

তুতুল হেসে ফেলল, —চটে যাচ্ছ কেন? আমি গান্ডেপিন্ডে গিলে যাব।

—রুপাই এখন ঘুম থেকে উঠে কী খাবে? দুধ?

—আগে দুধই খাবে। তারপর ম্যাগি ট্যাগি গোছের কিছু করে দিতে পারো। চাউমিনটা তাও আজকাল ভালবেসে খাচ্ছে, অন্য কিছু তো মুখে তোলে না।

—আর রাতে?

—অত ভেবো না মা। দুধে রুটি ভিজিয়ে দিয়ো, চম্পা খাইয়ে দেবে।

খানিকটা যেন স্বস্তি পেল মৃদুলা। উঠে গেছে রান্নাঘরে। চা বানাতে। রান্নাঘর থেকেই প্রশ্ন ছুড়ল, —তোর শাশুড়ির শরীর এখন কেমন রে?

—কেমন মানে? দিব্যি আছেন। সারাদিন বসে টিভি সিরিয়াল দেখছেন। আর উইকে তিনদিন নিয়ম করে মেয়ের বাড়ি।

—পরশু বিকেলে ফোন করেছিলাম…তুই বোধহয় তখন রুপাইকে নিয়ে নীচে গেছিলি। …বলছিলেন গা’টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে…

তুতুলের মনে পড়ল পরশু রাতে খাননি শাশুড়ি। বলছিলেন, পেটটা দম মেরে আছে, আজ রাতটা উপোস দিই…! আশ্চর্য, গা ম্যাজম্যাজ করার কথা একবারও বলেননি তো? কী যে স্বভাব! অসুখবিসুখ বাধিয়ে ছোটছেলেকে অপ্রস্তুতে ফেলার চেষ্টা! লোককে দেখাবেন, ছেলে-ছেলের বউ আমার খোঁজখবর রাখে না!

ঝটপট মাথা নেড়ে তুতুল বলল,—সেদিনই ঠিক হয়ে গেছেন। প্রতীক তো এসেই ওষুধ দিয়েছিল।

—কবে যেন উনি বড়ছেলের কাছে যাবেন বলছিলেন?

এ গল্পও করা হয়ে গেছে? তুতুল সোফায় বাবু হয়ে বসল,—সে তো ঢের দেরি। পুজোয়। তোমায় সেদিন বললাম না এবার পুজোয় আমরা রাজস্থান যাচ্ছি…তখনই মাসখানেক বহরমপুরে থেকে আসবেন।

সোমনাথ ফস করে জিজ্ঞেস করল, —তোর শাশুড়ি যাচ্ছেন না তোদের সঙ্গে?

—প্রতীকের তো খুব ইচ্ছে মা যাক। এবারও দ্রুত উত্তর দিয়ে দিল তুতুল, —মা’র তো কখনও কোথাও যাওয়া হয়নি, বহরমপুরের ওই প্রাচীন বাড়িটাতেই পড়ে থেকেছেন চিরকালটা..তা উনি রাজি হলে তো। তোমরা তো জানোই প্রতীক কী মাতৃভক্ত, ঘুম থেকে উঠে ঠাকুর প্রণাম করার আগে মাকে প্রণাম করে। ….কিন্তু ওঁর মন পড়ে আছে সেই বড়ছেলের কাছে।

সোমনাথ বলল,—তা তো হবেই। যার যেখানে শিকড়। এতকাল উনি বহরমপুরে রইলেন, হঠাৎ তাঁকে উপড়ে এনে এখানে পুরে ফেললে চলবে কেন!

—পুরে ফেলা কেন বলছ বাবা? প্রতীক তো তাঁকে মাথায় করে রেখেছে। আসলে উনি বহরমপুরে গিয়ে বড়ছেলের বউয়ের মুখঝামটা খেতে বেশি ভালবাসেন।

কথাটা বলেই তুতুল ঠোঁটের কোণ দিয়ে হাসল একটু। এ ধরনের অনৃত ভাষণে সে আজকাল ভারী মজা পায়। এ যেন এক ধরনের খেলা। ভাবমূর্তি গড়ার। ভাবমূর্তি ভাঙার।

মৃদুলা চা এনেছে, কাপে চুমুক দিয়ে বলল,—যাক গে, আমাদের কর্তব্য আমরা করছি। তারপরও যদি ছোটছেলের সংসারকে তিনি ভালবাসতে না পারেন, এত আদরযত্ন পাওয়ার পরেও…।

মিতুল উঠে গিয়েছিল কখন। ঘর থেকে ডাকছে,—দিদি শোন।

তুতুল গলা ওঠাল, —কী রে?

—আয় না। দেখে যা কী সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ কিনেছি।

চা শেষ করে তুতুল ঘরে এল। সালোয়ার কামিজটা দেখে খুব খুশি হল না। বেবি পিংকের ওপর ছাইরং সুতোর কাজ, এ রংটাই তার একদম পছন্দ নয়। তা ছাড়া মিতুলের গায়ের রং বেশ চাপা, তাকে এটা মানাবেও না। মুখে অবশ্য প্রশংসাই করল। জিজ্ঞেস করল,—কত নিল?

—সাড়ে চারশো।

—কটন?

—সিন্থেটিক মিক্সড। খুব গরম হবে না, বর্ষায় পরা যাবে। কামিজ ভাঁজ করছে মিতুল। রুপাইয়ের ঘুম ভাঙবে এবার, নড়াচড়া করছে। ঝুঁকে তাকে থাবড়ে দিতে দিতে বলল,—তোকে একটা খবর দেওয়া হয়নি রে দিদি।

মিতুলের গলা হঠাৎ কেমন অন্য রকম।তুতুলের চোখ সরু হল,—কী রে?

—অতনুদার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল।

তুতুল ঝাঁকুনি খেল একটা। দু’-চার সেকেন্ড নীরব থেকে অস্ফুটে প্রশ্ন করল,—কবে? কোথায়?

—দিন পাঁচ-সাত আগে। নন্দনে মেঘে ঢাকা তারা দেখতে গেছিলাম, তখনই হঠাৎ…

নিজেকে সামলে নিয়েছে তুতুল। প্রতীক চ্যাটার্জির স্ত্রীর অকারণ চিত্তচাঞ্চল্য শোভা পায় না। উদাসীন মুখে জিজ্ঞেস করল,— ওখানে কী করছিল?

—গ্রুপের শো ছিল। শিশির মঞ্চে।

—অ৷ এখনও দিনরাত নাটকই করে বেড়ায়?

—কী একটা চাকরিও করছে বলল। সেল্সলাইনে।

—অর্থাৎ ফেরিওলা?

—ওভাবে বলছিস কেন? জব ইজ জব। তুতুলের চোখে চোখ রাখল মিতুল, —তুই কিন্তু কাজটা ভাল করিসনি রে দিদি।

—ভুলও কিছু করিনি। ওরকম ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে সংসার পাতা যায় না।

—কিন্তু চার বছর প্রেম প্রেম খেলা খেলা যায়! আঙুলে নাচানো যায়! মিতুল তীক্ষ হাসল, —এবং অবলীলায় তাকে ডিচ মারা যায়, তাই না?

—অ্যাই, জ্ঞান মারিস না তো। তুতুল ঝপ করে রেগে গেল,—আমি যা ভাল বুঝেছি, করেছি।

—তা ঠিক। তোর ভাল তো তুইই বুঝবি। মিতুলকে কেমন বিষণ্ণ দেখাল, —তবে অতনুদাকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল রে। তোর কথা বারবার জিজ্ঞেস করছিল। তুই কেমন আছিস, কী করছিস…। অতনুদার মধ্যে সেই লাইভলি ভাবটাই আর নেই। বড় মায়া হচ্ছিল রে।

—হুঁহ্‌। ভেতরের আলোড়নটাকে থামাতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে গেল তুতুলের। —বিদ্রুপের সুরে বলল,—অত যদি মায়া লাগে, তুই নিজেই ঝুলে পড় না।

দিদির দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল মিতুল। তুতুল গ্রাহ্য করল না, রাজহংসীর চালে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

রাতে বাড়ি ফেরার পথে কে জানে কেন বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল তুতুল। পাশে চম্পার সঙ্গে খুনসুটি করছে রুপাই, দেখেও দেখছে না। অতনু কি তাকে এখনও ভালবাসে? ভাবে তার কথা?

বাদামি-রং অতনুর প্রাণবন্ত মুখখানা আবছাভাবে মনে পড়ল তুতুলের। মিলিয়েও গেল।

.

॥ তিন ॥

ঝাঁকড়া এক শিশুগাছের নীচে পাশাপাশি তিনটে চালা। প্রথমটা চায়ের দোকান, দ্বিতীয়টা সাইকেল সারাইয়ের, তৃতীয়টির ঝাঁপ বন্ধ। পিচ রাস্তার উলটোপারে একটা ছাদবিহীন অর্ধসমাপ্ত ইটের কাঠামো, দেখে মনে হয় বহুকাল ধরেই পরিত্যক্ত। কালচে মেরে যাওয়া ইটের গাঁথুনি ঢেকে আছে সিনেমা আর রাজনৈতিক দলের পোস্টারে।

মিতুল বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। অস্বস্তি ভরা চোখে। কী নিঝুম জায়গা রে বাবা! পাশের দোকানদুটো ছাড়া আর তো তেমন লোকজনও চোখে পড়ছে না! কনডাক্টর এটাই মাটিকুমড়া বলে নামিয়ে দিয়ে গেল, কিন্তু মাটিকুমড়া গ্রামটা কোথায়? রাস্তার দুধারে টানা চাষজমি, দু’দিকেই সবুজ খেত চিরে ভেতরে ঢুকে গেছে খোয়াবাঁধানো রাস্তা, দু’পাশেই চোখে পড়ে গ্রামের আভাস, কোন পথে এখন যাবে মিতুল? এহ্, বোকামি হয়ে গেছে, নামার আগে কনডাক্টরকে ভাল মতন পুছতাছ করে নিলে হত।

কব্‌জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল মিতুল। সওয়া এগারোটা। সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে, বামুনঘাটা এসে এ রুটের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হল পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট। এই লাইনের বাস পাঁচ কিলোমিটার এল আধ ঘণ্টায়। আজ প্রথম দিন, আজই হয়তো পড়াতে হবে না। কিন্তু কাল থেকে বাসের টাইম মাথায় রাখতে হবে, সেই মতো রওনা হতে হবে বাড়ি থেকে। দশ মিনিট আগে বামুনঘাটা পৌঁছেলে আগের বাসটা পাওয়া যেত।

যাক গে, আজকের দিনটা আগে পার হোক তো। সামান্য ইতস্তত করে মিতুল চায়ের দোকানটায় এল। খুপরি চালায় গোটা দুয়েক বেঞ্চি, একটায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে এক ধুতিশার্ট আধবুড়ো, অন্যটায় বাবু হয়ে বসে মাঝবয়সি লুঙ্গি খালি গা, কচাকচ আলু কুটছে। দোকানের মুখেই নিবন্ত উনুনে বসানো আছে ছ্যাতলা পড়া কেটলি, রাখা আছে এক বালতি জল। মাটির কাউন্টারে চায়ের গ্লাস, সস্তা দামের কেক বিস্কুটের বয়াম। দু’-চারটে ডুমো ডুমো মাছি উড়ছে।

মিতুল গলা ঝাড়ল,—শুনছেন?

দুটো ঘাড়ই ঘুরেছে একসঙ্গে। দু’জোড়া চোখেই কৌতূহল।

আধবুড়ো কাগজ মুড়ল, —আপনি বুঝি এই বাসে এলেন?

—হ্যাঁ। মাটিকুমড়া গ্রামটা কোথায়?

—মাটিকুমড়া যাবেন? কাদের বাড়ি?

—মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়ে যাব।

—মাটিকুমড়ায় তো কোনও মেয়েদের স্কুল নাই!

—না, না, নতুন খুলছে। নিউ সেট আপ। মিতুল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —আমি সেখানে জয়েন করতে এসেছি।

—অ।

আধবুড়ো মাঝবয়সির দিকে তাকাল। কী যেন চোখে চোখে কথা হল দু’জনের। মাঝবয়সি বিচিত্র এক হাসি হেসে বলল, —পরশুও একটা মেয়েছেলে এসেছিল। বলছিল চাকরি পেয়েছে। বলেই মিতুলকে আঙুল তুলে দেখাল, —ওই তো, ওপারের রাস্তা ধরে চলে যান। আধ মাইলটাক হাঁটতে হবে।

হাঁটায় মিতুল পিছ-পা নয়। কিন্তু এখন কেমন যেন লাগল। ক’দিন পর আজ বেশ রোদ উঠেছে, গরমে চিটপিট করছে গা, এই বেলায় এখন অতটা রাস্তা…

মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, —রিকশা পাওয়া যায় না?

পাশের সাইকেল সারাইয়ের ছেলেটাও উঠে এসেছিল দোকান ছেড়ে। সম্ভবত অচেনা মহিলা দেখেই। হাঁ করে শুনছিল কথাবার্তা। টুপ করে বলে উঠল, —ভ্যানরিকশা আছে। তবে এখন পাওয়া যাবে কি? সব তো আজ চলে গেছে মুন্সিডাঙার হাটে। বিকেলের আগে কেউ ফিরবে না।

—ও।

একটু দাঁড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে। ওদিক থেকে যদি কোনও ভ্যান এসে পড়ে… দাঁড়াবে মিতুল? না হাঁটাই লাগাবে? দাঁড়ালেও বা কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে কে জানে!

মিতুল হাঁটাই শুরু করল। গ্রামের স্কুলে আসবে বলে শাড়ি পরেছে আজ। মা’র শাড়ি। ঘামে ভিজে সায়া চিপকে চিপকে যাচ্ছে পায়ে, চলতে অসুবিধে হচ্ছে বেশ। রাস্তাটাও মোটেই সমতল নয়, যথেষ্ট এবড়োখেবড়ো, যত্রতত্র উঠে আছে খোয়া। নির্ঘাত রোলার চালায়নি, দুরমুশ করেছে, বৃষ্টিতে খসে গেছে ছালচামড়া। এমন একটা পথে হাঁটা কি সহজ কাজ? চলতে চলতে বার কয়েক তো টুকটাক হোঁচটই খেল মিতুল। ইস, কতক্ষণে পৌঁছোবে কে জানে! একটু আগেও তেমন একটা টেনশান ছিল না মিতুলের, হঠাৎই কেমন নার্ভাস নার্ভাস লাগছে এখন। জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে কি? নাকি জায়গাটা এক্কেবারে অজানা, তাই…? বাবা বারবার সঙ্গে আসতে চাইছিল। প্রথম দিন বাবাকে নিয়ে এলেই বোধহয় ভাল হত। গোঁ ধরে এমন গণ্ডগ্রামে চাকরি করতে আসাটাও কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল? কিন্তু অত পড়ে টড়ে পরীক্ষা দিল, কোয়ালিফাই করল, তার পরেও হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হত? চান্স ছেড়ে দিলে ফের চান্স মিলবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? হয়তো এ বছরের পুরো প্যানেলটাই দুম করে কোনও একদিন বাতিল হয়ে যাবে! এ বছরটা ছেড়ে দিয়ে সামনের বছর আবার পরীক্ষায় বসা যায়। অবশ্যই যায়। হয়তো মিতুল বসবেও। হয়তো অন্য কোনও কম্পিটিটিভ পরীক্ষাতেও মিতুল লড়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই সব পরীক্ষার ফল কী হবে তা তো আর মিতুল আগাম দেখতে পাচ্ছে না! তা হলে এই চাকরিটা সে প্রত্যাখ্যান করে কোন যুক্তিতে? ঠিক জায়গায় ধরাধরি করতে পারলে হয়তো বেটার পোস্টিং পাওয়া যেত। যেমন পারমিতা পেয়ে গেল। পারমিতার কাকা রাইটার্সের কোন মন্ত্রীর যেন পি-এ, তিনি দিব্যি ম্যানেজ ট্যানেজ করে ভাইঝিকে ফিট করে ফেললেন লেক টাউন স্কুলে। অথচ পারমিতা মোটেই মিতুলের চেয়ে বেটার ছাত্রী নয়, এম এ-তে মিতুলের চুয়ান্ন পারসেন্ট, পারমিতার একান্ন। গ্র্যাজুয়েশান, হায়ার সেকেন্ডারি, মাধ্যমিক, প্রতিটি ধাপেই মিতুলের চেয়ে কম মার্কস ছিল পারমিতার। কী আর করা, মিতুলের তো ওরকম কোনও কাকা-মামা নেই! শ্রাবণীর বাবাও তো কোন এক এমপি-কে ধরে বাগুইআটিতে শ্রাবণীর ব্যবস্থা করে ফেললেন। মিতুল মরে গেলেও বাবাকে ওসব বলতে পারবে না। বাবা পারবেই বা কী করে? মুখচোরা মানুষ, কোথাও সাতেপাঁচে থাকে না, রাজনীতির ছায়াও এড়িয়ে এড়িয়ে চলে, এমন লোককে কে’ই বা আমল দেবে?

চিন্তার ঝাঁপি খুলে পথ ভাঙতে ভাঙতে মিতুল থমকাল হঠাৎ। সামনে এক বিশাল গর্ত। জমে আছে কাদাজল। শাড়ি পরে পারবে টপকাতে? উঁহু, পারতেই হবে। চওড়া সবুজকালো পাড় সাদা শাড়ির কুঁচিখানা তুলে ধরে চোখ বুজে একখানা লাফ দিল মিতুল। ভাবনা ভুলে হাসল মনে মনে। নিজেকে বলল, এভাবেই ছোট-বড় খানাখন্দগুলো পার হতে হবে রে মিতুল, অসুবিধেগুলোকে মানিয়ে নিতে হবে আস্তে আস্তে। দূর হোক আর যাই হোক, চাকরি তো বটে। কত লোক আরও দূরে দূরে কাজ করতে যায়। মাইনেকড়িও তো মিতুল মন্দ পাবে না। জুনিয়র হাইস্কুল, মানে এখন এইট পর্যন্ত আছে, পরে বোধহয় মাধ্যমিক হবে। তবে সে তো পাবে অনার্সের স্কেল। ডি-আই অফিস থেকে সেদিন হিসেব করে দেখিয়ে দিল সব মিলিয়ে হবে এখন নয় থেকে সাড়ে নয়। এই বাজারে ন’হাজার টাকার চাকরি কি টুসকি বাজালেই পাওয়া যায়?

এতক্ষণে সামনে একটা সাইকেল। কেরিয়ারে বড় ঝুড়ি বাঁধা। হাটে যাচ্ছে বোধহয়। আরোহী প্যান্টশার্ট পরা এক যুবক।

মিতুল ইতস্তত করে থামাল ছেলেটাকে, —ভাই, মাটিকুমড়া কদ্দূর?

—এই তো সামনেই। যুবকটি সাইকেল থেকে নেমেছে, —ডাইনে একটা পুকুর পাবেন, তার পরেই…

—আর মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়?

—বালিকা বিদ্যালয়? মাটিকুমড়ায়? ছেলেটাও যেন আকাশ থেকে পড়ল। —বলতে পারব না তো।

মিতুল রীতিমতো বিস্মিত। এ অঞ্চলে লেখাপড়ার হাল তো বেশ খারাপ! নতুন একটা মেয়েদের স্কুল তৈরি হয়েছে, স্থানীয় মানুষ খোঁজখবরই রাখে না?

কথা বাড়াল না মিতুল। ব্যাগ থেকে স্পনসর লেটারখানা বার করল। তলায় সেক্রেটারির নাম দেওয়া আছে, তার কাছেও পাঠানো হয়েছে চিঠির কপি। নামটায় চোখ বুলিয়ে মিতুল বলল, —বিশ্বম্ভর দাস মাটিকুমড়ায় থাকেন তো?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, তাঁর বাড়ি কাছেই। ঢুকেই শিবমন্দির পাবেন, তারপর দেখবেন একটা মুদিখানা, সেটা পেরোলেই…

মিতুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আগে তবে সেক্রেটারির বাড়িই যাওয়া যাক। আশা করা যায় তিনি নিশ্চয়ই স্কুলের খবর রাখেন!

মাটিকুমড়া গ্রামটার আলাদা করে তেমন বিশেষত্ব নেই কিছু। আর পাঁচটা গ্রামের মতোই এলোমেলো মেঠো পথ, খড়ে-ছাওয়া মাটির ঘরবাড়ি, দাওয়া উঠোন পুকুর, পুকুরঘাট, সবুজের সমারোহ, ধুলোবালি, গোরু ছাগল হাঁস মুরগি সবই চোখে পড়ে। বিদ্যুৎ আছে গ্রামে। টেলিভিশানের অ্যান্টেনাও দেখা যায়।

ছোটখাটো পুরনো শিবমন্দিরের কাছে এসে বিশ্বম্ভর দাসের বাসস্থান খুঁজে পেতে সময় লাগল না মিতুলের। আশপাশের মানুষরাই আগ্রহী হয়ে দেখিয়ে দিল।

মাটির পাঁচিল ঘেরা বড়সড় বাড়ি। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রশস্ত উঠোন। দেখেই বোঝা যায় সেক্রেটারিমশাই রীতিমতো অবস্থাপন্ন মানুষ। মাটির দোতলা বাড়ির মাথায় টিনের চাল। দোতলার বারান্দা নকশাদার গ্রিলে ঘেরা। উঠোনের এক ধারে বড় বড় দু’খানা ধানের মরাই। একপাশে কুয়োতলা, লাগোয়া টিউবওয়েলও আছে। গাছও আছে কয়েকটা। লেবুগাছে লেবু ঝুলছে, গন্ধরাজ গাছ ছেয়ে আছে শুভ্র ফুলে। আলাদাভাবে বানানো একতলা বাড়ির মতো রান্নাঘরটা থেকে ছ্যাঁকছোক আওয়াজ ভেসে আসছে, সঙ্গে মশলার ঘ্রাণ। তুলসীমঞ্চের কাছে এক্কাদোক্কা খেলছে দুটি মেয়ে, ছানাপোনা নিয়ে মুরগি চরছে উঠোনে। তারই মাঝে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে এক ঢাকা দেওয়া মোটরসাইকেল।

মিতুলের আগমন সংবাদ পেয়ে বিশ্বম্ভর নামল দোতলা থেকে। বছর পঞ্চাশ বয়স, থলথলে দেহ, ফোলা ফোলা গাল, গায়ের রং মিশকালো। তেল চুপচপে চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়েছে লোকটা, পরনে লুঙ্গি হাফপাঞ্জাবি।

সামনে এসে নমস্কারের মতো ক’রে একটু হাত ওঠাল, —জয়েন করতে এসেছেন?

মিতুল সসম্ভ্রমে বলল, —হ্যাঁ। আমি সুকন্যা। সুকন্যা মুখার্জি।

—উম্। ধ্বনিটুকু বার করে প্রায় মিনিট দুয়েক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল বিশ্বম্ভর। তারপর খুদে খুদে চোখদুটো পিটপিট করে বলল, —আসেন। ভেতরে আসেন।

দোতলা বাড়ির একতলার একটা ঘরে বিশ্বম্ভর নিয়ে এল মিতুলকে। ছোট ঘর। মাটির দেওয়াল গাঢ় সবুজ। খান চারেক হাতলঅলা কাঠের চেয়ার আছে ঘরে, একটা উঁচু গোলটেবিল। কুলুঙ্গিতে হ্যারিকেন, সম্ভবত লোডশেডিংয়ের জন্য। দেওয়ালে ক্যালেন্ডার। তিনখানা। লেনিন। সিংহবাহিনী দুর্গা। মাঝখানে হাস্যমুখ শিশু। এক দেওয়ালে ঝুলছে বাঁধানো ফটো। মিলিটারি পোশাকে সুভাষচন্দ্র বসু।

মিতুলকে বসতে বলে বিশ্বম্ভর পাখা চালিয়ে দিল। জ্বেলে দিয়েছে টিউবলাইটটাও। সামনে আসন গ্রহণ করেছে রাজসিক ভঙ্গিতে। বসে আছে তো বসেই আছে, কোনও কথাই বলে না। যেন তার সামনে মিতুল নয়, কোনও জড়বস্তু বিদ্যমান, এমনই অভিব্যক্তিহীন তার মুখাবয়ব।

কিছু লোক আছে যারা কথা শুরুর আগে নির্বাক গাম্ভীর্য দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে নেয়। অনেকটা প্রতীকদার মতো। লোকটা কি সেরকমই…? নাকি মিতুল সরাসরি বাড়িতে এসেছে বলে ক্ষুব্ধ হয়েছে সেক্রেটারিমশাই?

আমতা আমতা করে মিতুল বলল, —আমি স্কুলেই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তার আগে আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

লোকটা যেন শুনেও শুনল না। অদ্ভুত মোলায়েম স্বরে বলল, —আপনার চিঠিটা কিন্তু এখনও দেখান নাই দিদিমণি।

ও, এই জন্য পোজ মেরে বসে আছে? চটপট ব্যাগ থেকে উইন্ডো খামটা বার করে বাড়িয়ে দিল মিতুল।

কোনও তাড়াহুড়ো নেই, কণামাত্র ব্যস্ততা নেই, ধীরেসুস্থে খাম থেকে চিঠি বার করল বিশ্বম্ভর। হাফপাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমা বার করে চোখে লাগাল। অনেকটা সময় নিয়ে পড়ল নিয়োগপত্র। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যেন কোনও গুপ্তচরের সংকেতলিপির কোড ডিসাইফার করছে। তারপর চিঠি টেবিলে রেখে আবার বসে আছে চুপচাপ।

এবার রীতিমতো মানসিক চাপ অনুভব করছিল মিতুল। গলা খাকারি দিয়ে বলল, —আমি কি জয়েনিং লেটারটা আপনাকেই দেব?

বিশ্বম্ভর শম্বুক গতিতে ঘাড় নাড়ল—তাই তো দেওয়ার কথা।

—আমি দু’কপি এনেছি। সোমনাথের শেখানো বুলি আউড়ে দিল মিতুল,—একটা কপি কাইন্ডলি রিসিভ করে দিন।

—দেব’খন। স্ট্যাম্প মারতে হবে। দুটো কপিই বিশ্বম্ভর পুরে ফেলল পকেটে। খুদে খুদে চোখ থেকে চশমা সামান্য নামিয়ে বলল,—আপনাকে কিন্তু স্কুলের তরফ থেকে এখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়া হয় নাই দিদিমণি।

—মানে?

—মানে সার্ভিস কমিশন তো শুধু আপনাকে পাঠিয়েছে। এবার তো আপনাকে নিয়োগ করবে স্কুল। মানে আমি।

—ও।

—দুশ্চিন্তার কিছু নাই। বলেই মন্থর হাতে গোলটেবিলের তলা থেকে একখানা ফোলিওব্যাগ টেনে তুলেছে বিশ্বম্ভর। ভেতরের তাড়া কাগজ বার করে স্তূপ করল টেবিলে। অলস ভঙ্গিতে কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,—আমি প্রোফর্মা টাইপ করেই রেখেছি। নাম ঠিকানা শুধু বসিয়ে দেব, ব্যস।

নিয়োগপত্র খোঁজা, এবং স্বাক্ষর, এতেই প্রায় মিনিট দশেক গেল। শুধু মিতুলের নামটুকু লিখতেই সময় লাগল তিনমিনিট। মুখার্জি বানান জে আই হবে, না জে ই ই, তাই মেলাতে লোকটা স্পনসর লেটারে চোখ চালাল বার চারেক। স্ট্যাম্প বার করে ধরে ধরে ছাপ মারল। মিতুলের জয়েনিং লেটারেও দেখে শুনে সিলমোহর লাগাল একটা।

চিঠিদুটো হস্তগত করে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে মিতুল। হাসি হাসি মুখে বলল, —এবার কি আমি স্কুলে যেতে পারি?

আবার পাক্কা তিন মিনিট মিতুলকে অবলোকন। আবার চোখ পিটপিট,—আপনার মার্কশিট অ্যাডমিট কার্ডের অ্যাটেস্টেড জেরক্স কিন্তু এখনও দ্যান নাই দিদিমণি। অরিজিনালও দেখান নাই।

—ও হ্যাঁ, তাই তো।

—দ্যান।

সেক্রেটারি মহাশয়ের কর্মপ্রক্রিয়া দেখতে দেখতে মিতুল এবার প্রায় ধৈর্যের শেষ সীমায়। তেষ্টা পাচ্ছে। চাইবে জল? দেবে কি?

আশ্চর্য, লোকটা যেন মনের কথা পড়ে ফেলেছে! মিতুলের স্কুল সার্টিফিকেট নিরীক্ষণ করতে করতে হঠাৎ বাজখাঁই গলায় হেঁকে উঠল, —বাসন্তী, এ ঘরে এখনও জল দাও নাই কেন? দিদিমণি কত দূর থেকে তেতেপুড়ে এসেছেন…

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক গোলগাল মহিলার প্রবেশ। বছর তিরিশ বয়স, কমলারং তাঁতের শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরা, মাথায় আলগা ঘোমটা। মুখখানা বেশ ঢলোঢলো, কপালে সিঁদুরের ছোট্ট টিপ। চায়ের প্লেটে করে খানিকটা সন্দেশও এনেছে বউটি, সঙ্গে চামচ। বিশ্বম্ভরের আদেশের অপেক্ষায় দরজার আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল নাকি?

মোটা বড় কাচের গ্লাস এক ঢোকে শেষ করল মিতুল। বেশ ঠান্ডা জল, স্বাদটাও ভাল। খেয়ে যেন প্রাণ জুড়োল। বিনয়ী মুখে বলল, মিষ্টি লাগবে না।

—খান খান। এতক্ষণে এই প্রথম বিশ্বম্ভরের কালো মুখে সাদা হাসি দেখা দিয়েছে—এ মিষ্টি আমার ঘরে বানানো। মাখা সন্দেশ। ঘরের গোরু, ঘরের ছানা… এত খাঁটি কাঁচাগোল্লা আপনি দোকানে পাবেন না। আপনাদের বড় দিদিমণি তো খেয়ে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে গেছিলেন।

মিতুল আর বিশেষ আপত্তি করল না। খিদে তো পেয়েছেই, মিষ্টিই সই। চামচে একটুখানি সন্দেশ তুলে মুখে পুরল। উৎসাহভরে জিজ্ঞেস করল,—বড়দিদিমণি বুঝি অনেক দিন জয়েন করে গেছেন?

—দিন কুড়ি। আরও দু’জন জয়েন করেছেন। আপনার মতোই। অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার। অপর্ণা ধর, আর মুনমুন সর্দার। অপর্ণা ধর আসবেন চন্দ্ৰপল্লি থেকে, মুনমুন সর্দার থাকেন বামুনঘাটার কাছে। শিমুলপুরে।

আসবেন আসবেন কেন করে রে লোকটা? এখনও ঠিকঠাক ক্লাস শুরু হয়নি? সংশয়ান্বিত মুখে মিতুন ফের প্রশ্ন করল—স্কুলে আপাতত কত ছাত্রী হয়েছে?

—আপনারা এসে গেছেন, এবার সব ভরতি হয়ে যাবে। নতুন নতুন সব কিছুতেই খানিক টাইম লাগে তো। বলেই বিশ্বম্ভর আবার মৌনী নিয়েছে। চোখের ইশারায় চলে যেতে নির্দেশ দিল বউটিকে। তারপর হঠাৎই মুখখানা বেজায় ভারিক্কি করে বলল, —আমি ঘোরপ্যাঁচ ভালবাসি না দিদিমণি। স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই। স্কুল কিন্তু এখন নাই।

সন্দেশ গলায় আটকে মিতুল প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড়,—মানে?

—নাই মানে নাই। স্কুল এখনও ওঠে নাই।

—সে কী! আমাকে যে জয়েন করতে পাঠানো হল…?

—আগে স্কুল? না আগে মাস্টার? যেন কোনও জটিল দার্শনিক প্রশ্ন হেনেছে, এমনই বিশ্বম্ভরের মুখভঙ্গি! যেন মিতুলের কাছ থেকে শুনতে চায় আগে মুরগি, না আগে ডিম! আগে বীজ, না আগে গাছ!

থতমত মিতুলকে বিশ্বম্ভরই জবাবটা শুনিয়ে দিল, —ভাবেন দেখি, স্কুলবাড়ি তৈরি করে বসে রইলাম, মাস্টার এল না! তখন কী হবে? তো এখন আর চিন্তা নাই। আপনাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট যখন করিয়ে আনতে পেরেছি, এবার স্কুলটাও বানিয়ে ফেলব।

মিতুলের বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। এ আবার হয় নাকি? স্কুল যদি নাই থাকে, স্কুল সার্ভিস কমিশন চাকরি দেয় কী করে? ডি আই অফিস বলেছিল বটে নতুন সেটআপ্। কিন্তু তার মানে কি স্কুলের অস্তিত্বই না থাকা?

বিশ্বম্ভর সামান্য গলা নামিয়েছে। শীতল স্বরে বলল,—অনর্থক উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নাই দিদিমণি। আপনার চাকরি পাওয়া নিয়ে কথা, চাকরি আপনি পেয়ে গেছেন। এবার যত বাধাই আসুক, স্কুলবাড়ি আমি তুলবই। আমার ঠাকুরমার বড় সাধ ছিল এই মাটিকুমড়ায় মেয়েদের জন্য একটি স্কুল হোক। আমার ঠাকুরদাদা সেই পুণ্য কাজে আড়াই বিঘা জমি দান করে গেছিলেন। এখন আমার একমাত্র ব্রত ওই জমিতে মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। প্রয়োজনে আমি যে-কোনও ধরনের লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কোনও অশুভ শক্তি আমায় দমিয়ে রাখতে পারবে না।

মিতুলের মগজে ঢুকছিল না কথাগুলো। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কীসের বাধা? অশুভ শক্তিটাই বা কী? দমিয়ে রাখার প্রশ্নই বা আসছে কেন? বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলে কেন বিশ্বম্ভর?

বিশ্বম্ভরের স্বর আরও নামল,—আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব দিদিমণি?

—কী?

—আপনি তো দমদমে থাকেন, এত দূরে পোস্টিং নিলেন কেন?

—আমি তো নিইনি। স্কুল সার্ভিস কমিশন আমায় পাঠিয়েছে।

—অ।

—হঠাৎ এ-প্রশ্ন করলেন কেন?

—এমনিই। জেনে নিলাম। বাকি দিদিমণিরা তো সবাই কোনও না কোনও কানেকশনে এসেছেন। এই যেমন ধরেন, বড়দিদিমণি। তিনি আমাদের পাশের কন্সটিটুয়েন্সির এম-এল-এ’র ওয়াইফ। অপর্ণা ধরের কাকা মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলার। আর মুনমুন সর্দারের বাবা কৃষক রাজনীতির নেতা, তাকে এ-তল্লাটের অনেকেই চেনে। অথচ আপনি বলছেন আপনার গায়ে কোনও গন্ধ নাই?

—বিশ্বাস করুন, আমি কোনও পার্টি ফার্টি করি না।

—অ। বিশ্বম্ভরের তবু যেন পুরোপুরি প্রত্যয় হল না। চশমার ফাঁক দিয়ে মিতুলকে দেখতে দেখতে বলল,—যাক গে, বলবেন না যখন, থাক। তবে আমার স্কুলে জয়েন যখন করেছেন, কিছু নিয়মকানুন আপনাকে মানতে হবে। সেক্রেটারি হিসেবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয় আছে। আপনি দেখতে পেলেও আছে, না দেখতে পেলেও আছে। সুতরাং আপনি নিয়মিত আসবেন, আমার এই অফিসঘরে এসে বসবেন। ইতিমধ্যে স্কুলও তৈরি হয়ে যাবে, ছাত্রীও পেয়ে যাবেন।

অসাড় মস্তিষ্ক নিয়ে মিতুল বেরিয়ে এল। মাটিকুমড়া গ্রামে এখন দ্বিপ্রাহরিক আমেজ। পুকুরে স্নানে নেমেছে মেয়েবউরা, কাপড় কাচছে, বাসন মাজছে। ধুলোকাদা মেখে রোদ্দুরে ছোটাছুটি করছে একদল খালি-গা বাচ্চা। জনাচারেক যুবক ছায়ায় মাদুর পেতে তাস পেটাচ্ছে। পাশে ট্রানজিস্টর। বাজছে এফ-এম চ্যানেল।

চারদিকের প্রতিটি চোখ ঘুরে ঘুরে দেখছিল মিতুলকে। কোনও দিকে না তাকিয়ে মিতুল হাঁটছিল ধীর পায়ে। চুঁই চুঁই করছে পেট, জ্বালা জ্বালা করছে মাথা। কিন্তু খিদে তেষ্টার অনুভূতিও যেন দম মেরে গেছে এক অচেনা বিস্ময়ে।

শিবমন্দির পেরিয়ে গ্রামের বাইরে এসেছে, তখনই পিছন থেকে ডাক,—এই যে দিদি, শুনছেন? দাঁড়াবেন একটু?

মিতুল চমকে ফিরে তাকাল। তাকেই ডাকল কি? হ্যাঁ, তাকেই তো! পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে বছর পঁয়ত্রিশের লোকটা তার কাছেই আসছে!

সামনে পৌঁছে বলল,—চলে যাচ্ছেন?

মিতুলের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল।

—বিশ্বম্ভর দাসের কাছে এসেছিলেন তো?

—হ্যাঁ। কেন?

—স্কুলে জয়েন করলেন?

মিতুল উত্তর দিল না।

—কিছু মনে করবেন না দিদি, কাজটা কিন্তু আপনার ভুল হয়ে গেল।

মিতুলের ভুরুর ভাঁজ বাড়ল।

—বিশ্বম্ভর দাসের কাছে আপনার জয়েন করার কোনও অর্থই হয় না।

—কেন বলুন তো?

—কারণ বিশ্বম্ভর দাস স্কুলের সেক্রেটারি নন।

মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আছে বলেই বোধহয় তেমন ভয়ংকর চমকাল না মিতুল। এক দিনে, মাত্র ঘণ্টা খানেকের ব্যবধানে মানুষ ক’বার চমকাতে পারে? তবে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল।

লোকটা আবার বলল,—বিশ্বম্ভর দাস এখন আর স্কুলের সেক্রেটারি নেই। অনেকদিন আগেই তাকে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। স্কুলের বর্তমান সেক্রেটারি সনৎদা। সনৎ ঘোষ। …সনৎদাই আমাকে আপনার কাছে পাঠাল। আপনাকে কিন্তু আলটিমেটলি সনৎদার কাছেই জয়েন করতে হবে।

—তাই নাকি? ভেতরর ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে মিতুল হঠাৎই খানিকটা সপ্রতিভ,—তা আপনাদের মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়টি কোথায় জানতে পারি?

—স্কুলবাড়ি তৈরি হয়নি এখনও। তবে হয়ে যাবে। জমি রেডি আছে।

—যদি ভুল না শুনে থাকি, সে জমি তো বিশ্বম্ভরবাবুদের? মানে বিশ্বম্ভরবাবুর ঠাকুরদার?

—ছিল একসময়ে। তবে তিনি সেই জমি স্কুলকমিটিকে দান করে গেছিলেন। ওই জমিতে বিশ্বম্ভরবাবুর আর কোনও অধিকারই নেই। ম্যানেজিং কমিটির কাছে কাগজপত্র সব আছে।

—বুঝলাম। তবে স্কুল সার্ভিস কমিশান কিন্তু বিশ্বম্ভরবাবুর কাছেই রিপোর্ট করতে বলেছে। জানেন কি সেটা?

—ও তো বিশ্বম্ভর দাসের কারসাজি। ডি-আই অফিসে গিয়ে কী সব কলকাঠি নেড়েছে…। সনৎদার কাছে চলুন না ভাল করে শুনবেন।

মিতুল মুহূর্তের জন্য দ্বিধায়। যাবে, কি যাবে না? একটা উটকো লোক কোত্থেকে এসে কী বলল তার পিছন পিছন ছোটাটা কি শোভন হবে? লোকটাকে আপাত দৃষ্টিতে ভদ্র বলে মনে হয়, কিন্তু পেটে কী মতলব আছে বোঝা ভার, বিপদ আপদ ঘটতে পারে। আবার একটা কৌতূহলও টানছে যে! মাটিকুমড়া জায়গাটা তো ভারী রহস্যময়! একটা অস্তিত্ববিহীন স্কুল… সেই স্কুলে দু’দুজন সেক্রেটারি পদের দাবিদার…! গিয়ে একবার ব্যাপারটা দেখলে হয়!

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলল মিতুল। উঁহু, আজ নয়। আগে ডি-আই অফিস, তারপর অন্য কিছু।

.

॥ চার ॥

পরদা সরিয়ে মৃদুলা ডাকল,—কী হল, খেতে আসবে না?

—হুঁ।

—হুঁ নয়, এসো। অনেকক্ষণ খাবার দেওয়া হয়েছে।… তোমার ছোট কন্যের তো কাল আবার সকাল সকাল বেরোনো আছে।

—এক সেকেন্ড, এই খাতাটা শেষ করে নিই।

পলকের জন্য ঘাড় তুলেই আবার পরীক্ষার খাতায় মাথা নামাল সোমনাথ। অনার্স। থার্ড পেপার। এহ্, কী হাবিজাবি লিখেছে ছেলেটা! রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কিছু জানে না। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যাপারটাই বোঝেনি। পুরো গোল্লা দিয়ে দেবে উত্তরটায়? থাক, দু’নম্বর দিয়ে দিক। শূন্য দেখলেই স্ক্রটিনিয়ারের চোখে পড়বে, হয়তো বা প্রশ্ন তুলবে টানা দু’পাতা লেখার পরেও একটি নাম্বারও না দেওয়া কি উচিত হয়েছে সোমনাথের? আজকাল কথায় কথায় কোর্ট কেস হচ্ছে, কোত্থেকে কী ফ্যাসাদে পড়ে যায়…!

পাতা উলটে উলটে সোমনাথ নম্বরগুলো যোগ করল। বত্রিশ। মন্দের ভাল। বাকি তিনটে পেপার মিলিয়ে নিশ্চয়ই কোয়ালিফাই করে যাবে। দেখা খাতার স্তূপের নীচে উত্তরপত্রটা চালান করল সোমনাথ। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে গুনে নিল এখনও ক’টা খাতা দেখা বাকি। ঊনত্রিশ। সর্বনাশ, কালকের মধ্যে জমা দেবে কীভাবে? কিন্তু না দিয়েও তো উপায় নেই, আজকে আবার ফোন করেছিল হেড এগ্জামিনার। এতগুলো পার্টওয়ানের খাতা কেন যে তার ওপর চাপাল? মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না বলে তাকেই বোঝা বইতে হবে? নাহ্, রাতটা আজ জাগতেই হবে। পারবে কি? শরীরে আজকাল আর দেয় না, অজান্তেই জড়িয়ে আসে চোখ। তেমন হলে সক্কালবেলাই নয় বসে যাবে খাতা নিয়ে। এবং কলেজ ডুব। যাবে নয় একটা সি-এল, কী আর করা। ইস, কেন যে মাঝে ক’টা দিন গা-ছাড়া দিয়ে বসে রইল!

অবশ্য গা-ছাড়া বলাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক হল না। সোমনাথ পরীক্ষার খাতা এমনি এমনি ফেলে রাখে না, তাড়াতাড়ি কাজ চুকিয়ে ফেলতে পারলেই তো শান্তি। কিন্তু এবার মিতুলকে নিয়ে যা টেনশান যাচ্ছে। প্রথম দিন মাটিকুমড়া ঘুরে এসে মিতুল যা শোনাল তাতে তো সোমনাথের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। এ কাদের মাঝে গিয়ে পড়ল মেয়ে? মৃদুলা হাউমাউ করে আরও বাড়িয়ে দিল উদ্বেগটা। মেয়েকে বোঝাও, মেয়েকে সামলাও, নয়তো নিজে গিয়ে দ্যাখো ঘটনাটা কী! তা মেয়ে সোমনাথকে যেতে দিলে তো! তার এক গোঁ, আমার সমস্যা আমায় বুঝে নিতে দাও, প্লিজ! বলছি তো, তেমন ঝামেলা হলে আমি একাই ফেস করতে পারব! কিন্তু মেয়ে বলল, আর ওমনি বাপ-মায়ের দুশ্চিন্তা চলে গেল, তাই কখনও হয়? পরদিন মৃদুলা প্রায় জোর করে ঠেলে পাঠাল সোমনাথকে। প্রথমে স্কুল সার্ভিস কমিশনের অফিস। সেখানে বাপ-মেয়েকে তো প্রায় হাঁকিয়েই দিল। আমরা কিছু জানি না মোওয়াই, ডি-আই অফিস থেকে রিকুইজিশান করেছিল, আমরা সেই মতো ক্যান্ডিডেট অ্যালট করে ছেড়ে দিয়েছি, স্কুল আছে কি নেই তা দেখা আমাদের কাজ নয়! শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ ছোট্ ছোট্, সোজা ডি-আই অফিস। ডি-আই সাহেব ছিলেন না, কোথায় যেন ইন্সপেকশানে গেছিলেন, হেডক্লার্কের সঙ্গে মোলাকাত করেই সাঙ্গ করতে হল অভিযান।

বড়বাবুর কথাবার্তা ধুরন্ধর রাজনীতিককেও হার মানায়। প্রতিটি প্রশ্নেরই কাটা কাটা উত্তর, কিন্তু সঠিক জবাবটি মেলা মুশকিল।

—মাটিকুমড়া স্কুলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে আমার মেয়ে। সেই মতো সে জয়েনও করেছে। কিন্তু সেখানে তো আদৌ কোনও স্কুল নেই?

—এমন তো হওয়া উচিত নয়। হলে অবশ্যই দেখা হবে।

—স্কুলের সেক্রেটারি বিশ্বম্ভর দাসকে জয়েনিং লেটার দিয়েছিল আমার মেয়ে। তারপরই লোকাল একজনের কাছে সে জানতে পেরেছে বিশ্বম্ভর দাস নাকি আর স্কুলের সেক্রেটারিই নন!

—হতে পারে। বছর দুয়েক আগে স্কুল সার্ভিস কমিশানে রিকুইজিশান পাঠানো হয়েছিল, তখন হয়তো ওই বিশ্বম্ভর দাসই সেক্রেটারি ছিলেন।

—কিন্তু এখন তো জনৈক সনৎ ঘোষ দাবি করছেন তিনিই স্কুলের সেক্রেটারি?

—তাও সম্ভব। হয়তো ইতিমধ্যে নতুন কমিটি ফর্ম হয়েছে

—তা নতুন কমিটি ফর্ম হলে তারা নিশ্চয়ই আপনাদের জানায়?

—জানানোটাই তো নিয়ম।

—তা হলে নিশ্চয়ই আপনাদের রেকর্ডে আছে কে এখন নতুন সেক্রেটারি?

—কাগজপত্র ভাল করে দেখতে হবে।

—যদি দেখা যায় সনৎ ঘোষই স্কুলের সেক্রেটারি, তা হলে আমার মেয়ের জয়েনিং লেটারটার কী হবে?

—এক কথায় বলা যাবে না। খতিয়ে দেখতে হবে তখন।

শুনে মিতুল আর চুপ থাকতে পারেনি। পাশ থেকে বলে উঠেছিল,—কিন্তু স্কুলই যে নেই, তার কী হবে? নিউ সেটআপই হোক, আর যাই হোক, একটা ঘরদোর তো থাকবে!

—হুম। অন্তত একটা ঘর তো থাকাই উচিত। ঘর দেখে এসে ইন্সপেকশান রিপোর্ট দিলে তবে টিচার পোস্টে লোক চাওয়া হয়।

—বিশ্বাস করুন, ওখানে কিছু নেই। বিশ্বম্ভরবাবুই বললেন…

—শুনেছি। আপনাদের হেডমিস্ট্রেসও জানিয়ে গেছেন।

—এসেছিলেন তিনি?

—হুম্। কালও তো একবার ঘুরে গেলেন। আরও দুই দিদিমণিকে সঙ্গে নিয়ে।

বোঝো অবস্থা! পাক্কা পনেরো মিনিট বাতচিত চালানোর পর প্রকাশ হল বড়বাবুটি মাটিকুমড়া এপিসোড সম্পর্কে ভাল মতোই ওয়াকিবহাল!

মিতুল জেরার ঢঙে প্রশ্ন ছুড়েছিল,—আমি তো জয়েন করার আগে এই অফিসে এসেছিলাম, তখন নিশ্চয়ই আপনারা জানতেন স্কুলটি আদৌ নেই? এবং স্কুলের সেক্রেটারি পদ নিয়ে কনট্রোভার্সি আছে?

বড়বাবু চুপ। সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রীরা যেভাবে ‘নো কমেন্টস’ বলেন, অবিকল সেই ভঙ্গি।

সোমনাথ আহত মুখে বলেছিল, —আপনারা সেইদিনই মেয়েটাকে তো বলে দিতে পারতেন। অত দূর গিয়ে তা হলে ওভাবে হ্যারাসড হতে হত না।

—উনি তো জিজ্ঞেস করেননি।

—এখন জিজ্ঞেস করছি। এখন বলুন আমার কী করণীয়?

—যাবেন স্কুলে।

—স্কুলটা কোথায়?

আবার মুখে কুলুপ। ‘নো কমেন্টস’-এর সাইনবোর্ড।

—আমি রিপোর্ট করবই বা কোথায়? কার কাছে?

—সেটা আপনি আপনার নিজস্ব বুদ্ধি বিবেচনা মতন স্থির করুন। আমার পরামর্শ যদি শোনেন তা হলে বলব রোজ অন্তত হাজিরাটা দিয়ে আসুন। নইলে কিন্তু সার্ভিসের প্রথমেই একটা স্পট পড়ে যাবে। যদি আদৌ ওখানে স্কুলটা না হয়, যদি গভর্নমেন্ট কনসিডার করে আপনাদের আর কোথাও শিফ্ট করে, তখন তো দেখা হবে আপনারা আদৌ চাকরিতে উইলিং কিনা। রেগুলার অ্যাটেন্ডেন্সটাও তো তখন কাউন্ট করা হবে।

কার কাছে অ্যাটেন্ডেন্স দেবে মিতুল? কে রাখবে রেকর্ড? গিয়ে বসবেই বা কোথায়? সোমনাথের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। কিন্তু মিতুলকে দমিয়ে রাখে কে! সে প্রতিদিন নিয়ম করে সকালবেলা বেরিয়ে যাচ্ছে। হেডমিস্ট্রেস রেখা সেনগুপ্ত আর বাকি দুটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়ে গেছে মোটামুটি। মাটিকুমড়ায় গিয়ে সবাই মিলে নাকি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ, গল্পগুজব করে, তারপর চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ি। অ্যাটেন্ডেন্সের ব্যাপারে মাথা খাটিয়ে একটা বন্দোবস্তও হয়েছে। হেডমিস্ট্রেসের বুদ্ধিতেই। গাঁটের কড়ি খরচা করে অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার কিনে সই মারছে সকলে, খাতা থাকছে রেখা সেনগুপ্তর জিম্মায়। সেক্রেটারি নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক, ওই হাজিরাখাতা তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না! স্কুলে তো হেডমিস্ট্রেসের কাছেই সই করতে হয় শিক্ষিকাদের।

তবু মিতুল যতক্ষণ না ফেরে, কাঁটা হয়ে থাকে মৃদুলা। কলেজে গিয়েও সোমনাথের বুক ধড়ফড় করে, ঘন ঘন ফোন করে বাড়িতে। কবে কী অশান্তি বেধে যায়, কোন গণ্ডগোলে পড়ে যায় মিতুল, এই চিন্তা কুরে কুরে খায় অহর্নিশি। মাথার ঠিক না থাকলে কি কাজকর্মে মন বসে?

বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে সোমনাথ টেবিলে এসে দেখল মা-মেয়ে খেতে বসে গেছে। সাদামাটা মেন্যু। আলু-পটলের ডালনা, মাখা মাখা ডিমের কারি, আর রুটি।

চেয়ার টেনে বসল সোমনাথ। ক্যাসারোল খুলে রুটি নিতে নিতে বলল, —আজ স্যালাড করোনি?

মৃদুলা চোখ ঘোরাল, —বাজার গেছিলে আজ? শসা এনেছ?

—কলেজ বেরোনোর সময়ে বলতে পারতে, শসা নিয়ে আসতাম।

—আমাদের ওখানকার শসা খাবে? দারুণ শসা। যেমনি সাইজ, তেমনি টেস্ট। একেবারে ফ্রেশ ফ্রম খেত। কাল নিয়ে আসব, দেখো।

—না। তোমাদের মাটিকুমড়ার শসা আমার দরকার নেই।

—মাটিকুমড়ার ওপর রাগ করছ কেন মা? মিতুল মুচকি হাসল, —মানুষগুলো হয়তো একটু তেড়াবেঁকা, তাতে জায়গাটার কী দোষ?

—মানুষ দিয়েই জায়গা চেনা যায়!

মৃদুলার কথার উত্তরে কিছু বলবে মিতুল, তার উত্তরে মৃদুলা, ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে খাবার টেবিল, এই আশঙ্কাতেই বুঝি সোমনাথ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —হ্যাঁ রে, তোদের সনৎ ঘোষ আর এসেছিল? তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?

—একদিনই এসেছিল। ওই একদিনই মুখ দেখিয়ে গেছে। তোমাকে তো বলেছি। বড়দি মানে রেখাদিকে ডাকল, রেখাদি কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন…

—আর সেই বিশ্বম্ভর? সে কিছু বলছে না?

—তার বোধহয় একটু গোঁসা হয়েছে। তার অফিসঘরে গিয়ে বসছি না তো। লোক পাঠিয়ে দেখে নেয় আমরা এসেছি কিনা, তবে আর ডাকে না।

—তা তার বাড়ি গিয়ে বসলেই পারিস। তাও তো একটা ঘর।

—রেখাদি বারণ করেন। বলেন, একটু সরে সরে থাকাই ভাল। লোকাল পলিটিক্‌সে জড়িয়ে পড়া কোনও কাজের কথা নয়।

—সে কী রে? তার বরই তো পলিটিক্‌সের লোক!

—ওটাই তো আমারও খুব আশ্চর্য লাগে বাবা। রেখাদি বরের প্রসঙ্গ তোলেনই না। কতবার ভেবেছি জিজ্ঞেস করব, সাহস হয় না। বড্ড গম্ভীর। তবে হাবেভাবে মনে হয় উনি খানিকটা আদর্শবাদী ধরনের। নইলে একটা স্কুলে কুড়ি বছর চাকরি করছিলেন, সেটা ছেড়ে দুম করে এমন একটা উদ্ভট স্কুলে জয়েন করলেন, এ কিন্তু মুখের কথা নয়।

—চাকরি ছেড়ে এসেছেন? তুই শিয়ের? লিয়েনে নেই তো?

—লিয়েন? সেটা কী?

—পারমানেন্ট চাকরি হলে সেটা না ছেড়েও একটা সার্টেন টাইম অব্দি সিমিলার টাইপ অফ জবে চলে যাওয়া যায়। যেমন গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট, সেমি গভর্নমেন্ট টু সেমি গভর্নমেন্ট…স্কুল টু স্কুল অর কলেজ…

—এমন নিয়ম আছে বুঝি? হয়তো তাহলে রেখাদিও সেরকম কিছু…

—খবর নিয়ে দ্যাখ, তাই। হেডমিস্ট্রেসের স্কেল খুব ভাল তো, বোধহয় সেই আশাতেই উনি অকূল পাথারে ঝাঁপ দিয়েছেন। খাবার টেবিলের পরিবেশ খানিকটা লঘু করে দিল সোমনাথ। তরল স্বরে বলল, —আর তোর সেই দুই কলিগ? তারা রোজ আসছে তো?

—হুঁউউ।

—তারা কী বলে?

—বাড়িফাড়ির গল্প করে, স্কুল নিয়ে বিশেষ একটা আলোচনায় যায় না। মনে হয় ওরা একটু ভয়ে ভয়ে থাকে।

—কেন? তাদের তো খুঁটির জোর আছে।

—হয়তো সেই জন্যই ভয়। ভাবছে হয়তো খুঁটির জোরটাই বুমেরাং হয়ে গেল। ধরাকরা করে কাছাকাছি পোস্টিং পেয়েছিল, এবার স্কুল না হলে যদি চাকরিটাই চলে যায়! কী বলে ফেলবে, কে কোথায় কী লাগাবে, তার ঠিক আছে?

—আর তুমি কী করো? মৃদুলা এক ঢোক জল খেয়ে বলল, —ডোন্ট কেয়ার হয়ে লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ো তো?

—কেউ কথা না বললে সময়টা কাটবে কী করে মা? সারাক্ষণ মাঠের ছাগল চরা দেখে?

—কিচ্ছু করবে না। অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে, এবার থামো। কালও তো দুর্গাপুর থেকে ফোন এসেছিল। তোমার কাকা-কাকি দু’জনেই পইপই করে বলল, মিতুলকে মানা করো, মনে হচ্ছে ও কোনও পলিটিকাল ফিউডের মধ্যে পড়ে গেছে। ওসব স্কুল কস্মিনকালেও হবে না, মাঝখান থেকে কোনও একটা পলিটিকাল পার্টির গ্রাজে পড়ে যাবে মিতুল, কোত্থেকে কী বিশ্রী বিপদ ঘটে যাবে!

মিতুল গ্রাহ্যই করল না। ডিমের কুসুমে নুন মাখাতে মাখাতে বলল, —তুমি রেগে গেলে আমায় ‘তুমি তুমি’ কেন করো মা?

—ফাজলামি কোরো না। যে শুনছে সে-ই এক কথা বলছে। তোমার মামা মাসি পিসি প্রত্যেকের এক মত। মিতুলের এসব গোঁয়ারতুমি ছাড়া উচিত। মৃদুলা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, —তুতুল ঠিকই বলে। ছোট বলে তুমি বেশি আশকারা পেয়েছ তো, তাই মাথায় উঠে গেছ।

—আর তোমার জামাই কী বলে মা? ঠাকুরের যখন ইচ্ছে নয় তখন সুকন্যার এই চাকরি না করাই শ্রেয়… বলে না?

প্রতীককে নকল করার ঢঙে সোমনাথ হেসে ফেলছিল প্রায়, মৃদুলার গুমগুমে মুখের দিকে তাকিয়ে গিলে নিল হাসিটা। প্রতীকের প্রগাঢ় ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে মাঝেসাঝেই রঙ্গরসিকতা করে মিতুল। সেদিনই তো বলছিল, বাথরুমে ঢোকার আগেও নাকি ঠাকুর প্রণাম করে প্রতীকদা! প্রার্থনা করে, হে মাকালী, আজকের মতো কোষ্ঠটা সাফ করে দাও! এই ধরনের ব্যঙ্গবিদ্রূপ মৃদুলার একেবারেই না-পসন্দ্। কৃতী জামাইয়ের ওপর শাশুড়ির দুর্বলতা তো থাকতেই পারে।

সোমনাথ সামান্য ধমকের সুরে বলল, —মানুষের বিশ্বাস নিয়ে সবসময়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিস না মিতুল। করতে নেই। ভক্তি করে প্রতীক যদি তৃপ্তি পায়, শক্তি পায়… থাকুক না ওর মতো।

—তো আমিই বা কেন আমার মতো থাকতে পারব না? কেনই বা আমাকে নিয়ে তোমরা সবাই মিলে ঘোঁট পাকাচ্ছ? মিতুল সহসা সিরিয়াস, গলায় বিষণ্ণতার আভাস, —তুমিই বলো বাবা, আমি কি কিছু অন্যায় করেছি? পড়াশুনো করে পরীক্ষা দিলাম, একটা চাকরি পেয়েছি, আশা নিয়ে জয়েন করতে গেলাম… এর কোনওটা নিশ্চয়ই অন্যায় কাজ নয়? কপাল খারাপ, চাকরিটা দূরে হয়েছে। কপাল আরও খারাপ, চাকরিস্থলে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তো আমার দোষ নয়। তা ছাড়া আমার চাকরি করা নিয়েও তোমাদের তো সেভাবে আপত্তি নেই। তা হলে তোমরা আমাকে আটকাতে চাইছ কেন? তোমাদের ইচ্ছেটাই বা কেন আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছ?

—তা নয় রে মিতুল। সোমনাথ নরম স্বরে বলল, —আমরা ভয় পাচ্ছি। তুই মা হলে তুইও বুঝবি।

—কীসের ভয় বাবা? কার ভয়? আমি তো কারুর সঙ্গে শত্রুতা করতে যাইনি। আমাকে একটা চাকরি দেওয়া হয়েছে, অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু স্টিক টু দ্যাট জব। কাল্পনিক একটা ভয়ের অজুহাত খাড়া করে কেন আমি পিছিয়ে আসব? ক্রটি যখন আমার নয়, কেন আমি শেষ পর্যন্ত দেখব না?

মিতুলের চোখ জ্বলছে। ভেতর থেকে কেঁপে উঠল সোমনাথ। এ মেয়ে যেন তার একেবারেই অচেনা। কবে তার ছোট্ট মিতুল এত বড় হয়ে গেল?

গোমড়া মুখে খাওয়া সেরে উঠে গেছে মৃদুলা। সিঙ্কে বাসন নামাচ্ছে। সোমনাথও উঠে পায়ে পায়ে বেসিনে গেল। আঁচিয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছছে, ড্রয়িংস্পেসে টেলিফোনের ঝংকার।

মিতুলই দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলেছিল, বলল, —তোমার ফোন। স্বপনকাকু।

এত রাতে স্বপন? সোমনাথ তাড়াতাড়ি এসে টেলিফোন ধরল।

—সরি সোমনাথদা, আপনাকে রাত্তিরে ডিসটার্ব করছি।

—আরে না না, বলুন।

—খাওয়াদাওয়া কমপ্লিট?

—এই তো, জাস্ট…

—কাল রুটিন সাব কমিটির মিটিংয়ে আসছেন তো? কাল কিন্তু আমি কয়েকটা ভাইটাল প্রশ্ন তুলব। আমাদের পল সায়েন্সের সঙ্গে এ বছরও ইকনমিক্স কম্বিনেশান রয়ে গেল, এতে কিন্তু আমাদের ক্লাস অ্যাডজাস্টমেন্টে খুব সমস্যা হবে। চারদিন অনার্সের ক্লাস ফেলা হচ্ছে সাড়ে তিনটের পর, এ কী? এমন জোরালোভাবে বলতে হবে যেন সামনের বছর অন্তত সিচুয়েশানটা পালটায়। আপনি কিন্তু আমায় ডিটো দেবেন।

সোমনাথ মাথা চুলকোল, —কিন্তু আমি যে কাল… কাল আমায় ছেড়ে দেওয়া যায় না?

—সে কী? কাল আপনি আসবেন না?…ভাবলাম কাল র‍্যালি আছে, বারোটায় বেরিয়ে দুটোর মধ্যে ফিরে আসব… সেই হিসেব করে মিটিংয়ের ডেট টাইম ফিক্স করলাম, আপনি নোটিসে সই করলেন…!

—সই করেছিলাম, না?

—ওহ্, সোমনাথদা, আপনাকে অ্যালজাইমার ধরল নাকি? ও প্রান্তে স্বপনের গলায় ঠাট্টার সুর। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুরটা পালটেও গেছে, —আপনি কি কাল র‍্যালিতেও আসছেন না?

র‍্যালির কথাটা মাথাতেই ছিল না সোমনাথের। অপ্রস্তুত স্বরে বলল, —না মানে… এখনও পার্টওয়ান অনার্সের একগাদা খাতা দেখা বাকি, কাল লাস্ট ডেট…!

—প্রিন্সিপাল কিন্তু খুব এক্‌সেপশান নেবেন। এমনিতেও আজ দেখলাম উনি আপনার ওপর বেশ অফেন্ডেড হয়ে আছেন।

—কেন?

—আপনি নাকি ইউনিয়ানের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন? এ-জি-এস মেয়েটি, ওই যে কী যেন নাম… তাকে নাকি আপনি কবে শাসিয়েছেন? বলেছেন, তোমরা এরকম বেআইনিভাবে চাঁদা তুলতে পারো না…?

—না তো। বলিনি তো। সোমনাথ মরিয়া হয়ে প্রতিবাদ জুড়ল, —একটা মেয়ে ভরতির সময়ে আমায় খুব ধরেছিল, আমি জাস্ট ওদের রিকোয়েস্ট করেছিলাম যেন একটু কন্‌সিডার করে। তা সেও তো হপ্তা দুয়েক আগের কথা। সেই পে-ডের দিন।

—আমি কিছু জানি না। প্রিন্সিপালের মুখে যা শুনলাম, তাই বলছি। উনি গজগজ করছিলেন সিনিয়ার টিচাররা যদি ইউনিয়ানের সঙ্গে মানিয়ে গুনিয়ে না চলতে পারেন, তা হলে আমি কলেজে ডিসিপ্লিন রাখব কী করে? …যাই হোক, মনে রাখবেন কালকের র‍্যালিটা কিন্তু স্টুডেন্ট ইউনিয়ানেরই। যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে আমরা নেহাতই নৈবেদ্যর ওপর বাতাসা। আপনি না গেলে দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যেতে পারে কিন্তু।

ফোনটা রেখে রগ টিপে সোফায় বসে পড়ল সোমনাথ। কী গেরো রে বাবা! সেদিন তো সোমনাথ মানে মানে সরেই গেছিল, তারপরও মেয়েটা গিয়ে নালিশ করল? আর প্রিন্সিপালও মনে মনে পুষে রেখে দিয়েছে ব্যাপারটা? কতবার তো দেখা হয়েছে এর মধ্যে, একবারও তো মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না? সোমনাথকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যেত? কেন করল না? নির্মলের সঙ্গে একটা অন্য ধরনের বন্ধুত্ব আছে সোমনাথের, পুলকেশ কুণ্ডু জানে। নির্মলের সঙ্গে মোটেই বনে না পুলকেশের, মাঝে মাঝেই নির্মল তাকে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দেয়। সেই সূত্রে এদিকেও দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল নাকি? পুলকেশ কুন্ডু কি ধরেই নিল সোমনাথও নির্মলের দলে? অথচ কী আয়রনি, নির্মলের সত্যিই কোনও দল নেই।

নির্মলকে একটা ফোন লাগাবে? নির্মল নিশাচর প্রাণী, সাড়ে দশটা তো ওর সন্ধে। হয়তো তাসটাস খেলে সবে ক্লাব থেকে ফিরছে। কম্পিউটার খুলেও বসতে পারে। ইদানীং ইন্টারনেট চষার নেশা হয়েছে নির্মলের। সদ্য চাকরি পেয়ে বাঙ্গালোর চলে যাওয়া ছেলের সঙ্গেও চ্যাটে বসে প্রায়ই। তেমন হলে তো লাইনই পাওয়া যাবে না।

তবু ডায়াল করে দেখবে একবার? কী লাভ, নির্মল কী কী বলবে তা তো সোমনাথ মোটামুটি জানে। তুমি পুলকেশ কুন্ডুর ভয়ে থরথর কাঁপছ? ছোঃ। ও ব্যাটা তো চামচার চামচা। দাদাদের পায়ের কাছে লেজ নেড়ে নেড়ে, আর কুইন্টাল কুইন্টাল তেল ঢেলে প্রিন্সিপালের পোস্টটা বাগিয়েছে। স্টুডেন্ট ইউনিয়ানকে তোয়াজ না করলে দাদারা ওর কান মুলে দেবে না? ছাত্রদের ডাকা যুদ্ধবিরোধী মিছিলে ওকে তো একটা লিডিং পার্ট নিতেই হবে। তা বলে আমরাও ওর ল্যাংবোট হতে যাব কোন পুলকে? তা ছাড়া ওরকম একটা হাস্যকর র‍্যালিতে যাবই বা কেন? মফস্সলের রাস্তায় ট্যাবলো নিয়ে ঘুরলেই বন্ধ হয়ে যাবে আমেরিকার দাদাগিরি? ওরে, বঙ্গসন্তানরা চেঁচাচ্ছে রে বলে চম্পট লাগাবে মার্কিন সেনা? জর্জ বুশের হাঁটু কাঁপবে? নিজের ঘরে দাদাগিরি চললে টুঁ শব্দটি নেই, হাজার মাইল দূরে কোন মস্তান কাকে মাস্ল দেখাচ্ছে তাই নিয়ে যত লম্ফঝম্ফ! তাও যদি তোমার নিজের বিবেক চায়, তো যাও তুমি যুদ্ধবিরোধী মিছিলে। কিন্তু কারুর চোখ রাঙানোর ভয়ে? নৈব নৈব চ।

হায় রে, নির্মলের মতো সোমনাথও যদি সরব হতে পারত! তাকে কাল কলেজে যেতেই হবে, মিছিলে হাঁটতেই হবে, মিটিংয়েও বসতে হবে, আবার খাতাও জমা দিতে হবে হেড এগ্জামিনারের কাছে। রাত জাগা ছাড়া তার আজ উপায় নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শোওয়ার ঘরে এল সোমনাথ। বসল চেয়ার-টেবিল টেনে, ডুবছে খাতার ডাঁইয়ে। বিরস মুখে। পঞ্চম উত্তরপত্রটা দেখতে দেখতে থমকাল একটু। ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপরেখা বর্ণনা করতে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি নিজস্ব মন্তব্য জুড়েছে পরীক্ষার্থীটি। …আগেকার দিনের নেতারা ধুতিখদ্দর ছাড়া পরত না, এখন তাদের দু’পকেটে মোবাইল। কথায়বার্তায়, আচারআচরণে দক্ষিণপন্থী নেতাদের সঙ্গে বামপন্থীদের এখন পৃথক করা কঠিন। দু’পক্ষই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে, গুন্ডা-মস্তান পোষে, যে যার মতো নিজের আখের গোছায়, জনগণ এখন তাদের খেলার পুতুল…। কোনও পাঠ্যবইতে এ ভাষায় লেখা নেই কথাগুলো, উত্তরের এই অংশটা কি ভুল বলে লাল কালির আঁচড় টানবে সোমনাথ? কোনটা সত্যি? বই? না বাস্তব অবস্থা?

মৃদুলা জলের জগ নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। টেরচা চোখে সোমনাথকে দেখে নিয়ে বলল, —তোমার আজ ঘুমটুম নেই?

—নাহ্। তুমি শুয়ে পড়ো।

—ম্যাট জ্বালিয়ে নাওনি কেন? মশা কামড়াচ্ছে না?

—তিনতলায় আর তেমন মশা কোথায়?

—বোকো না। সন্ধেবেলা জানলা বন্ধ না করে দিলে এতক্ষণে ছিঁড়ে খেয়ে নিত। এবার বর্ষায় আরও যেন বেড়ে গেছে। টেবিলের কাছে এসে মশক বিতাড়ন যন্ত্রের সুইচ অন করে দিল মৃদুলা। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, —একটা কথা শুনবে আমার?

—কী?

—মিতুল যতই না না করুক, একদিন মাটিকুমড়া ঘুরে এসো না। সরেজমিন করে দ্যাখো ওখানের কী হালচাল। ইয়াং মেয়ে… জেদ করে যাচ্ছে… কতটা রিস্ক আছে না আছে একবার তো বুঝে নেওয়া উচিত।

—ছাড়ো না ওর ওপর। মিতুল এখন যথেষ্ট ম্যাচিয়োর। ডি-আই অফিসে গিয়ে কী রকম টকটক কথা বলছিল! ও ঠিক ম্যানেজ করে চলতে পারবে।

মৃদুলা কণামাত্র স্বস্তি পেল না। অপ্রসন্ন মুখে বলল, — তোমার প্রশ্রয়েই মেয়ে এত বেড়েছে।

—আমার প্রশ্রয়ে?

—না তো কী? মেয়ে যা বায়না করছে, তাই মেনে নিচ্ছ। …কী ভাল একটা সম্বন্ধ আনল দাদা… ছেলে সেরামিক ইঞ্জিনিয়ার, এম-বি-এ, গুরগাঁওতে কত বড় চাকরি করে, মোটা স্যালারি…। মেয়ে না বলল বলে তুমি নেগোসিয়েশানেই এগোলে না!

—ওখানে হত না। ওরা ফরসা মেয়ে চায়…।

—হত না তো হত না। তুমি হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কেন?

সোমনাথ চোখ থেকে চশমা নামাল। ডটপেনটাও রাখল খাতার ওপর। ঈষৎ ঘুরে বসে বলল, —শোনো, বি প্র্যাকটিকাল। মিতুল যে এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছে না এ তো মন্দের ভাল।

—মানে?

—টাকা। টাকার কথাটা ভাবো। আমার লোনটোনগুলো চুকতে এখনও এক বছর। তুমি কি চাও রিটায়ারমেন্টের মুখে এসে আবার নতুন ধারকর্জে জড়িয়ে পড়ি? ভুলে যেয়ো না, তুতুলের সময়ে আমার হাতে তাও ক’টা বছর ছিল। সঞ্চয়ও ছিল কিছু। টিউশ্যনি করেও খানিকটা সামাল দিয়েছি। এখন তো ফুটো সামলাতে ন্যাংটো দশা।

—আবার ধরছ না কেন টিউশ্যনি? নির্মলবাবু তো বলছিলেন তোমাদের অনেকে নাকি আবার লুকিয়ে চুরিয়ে শুরু করেছে!

—সে তাদের বুকের পাটা আছে। আমি পারব না।

—তুমি কিসুই পারবে না। ভিতুর ডিম একটা! সারাজীবন গর্তে ঢুকেই কাটালে।

মৃদুলা সরে গেল। মশারি টাঙাচ্ছে। সোমনাথ সঙ্গে সঙ্গে খাতায় মন ফেরাতে পারল না। মৃদুলার শেষ কথাটুকু যেন বাজছে বুকে। সত্যি, আতঙ্কের সুড়ঙ্গেই কেটে গেল সারাটা জীবন। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা মারা গেল, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রায় নিঃসম্বল মা’র আশ্রয় জুটল জেঠার সংসারে। তখন থেকেই কি রোপিত হয়েছিল ভয়ের বীজ? মাথার ওপর ছাদ না থাকার ভয়? দু’বেলা দু’মুঠো ভাত না জোটার ভয়? পড়াশুনো চালিয়ে যেতে না পারার ভয়? জেঠিমা শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত কতটা করে খাচ্ছে তারা পিঠোপিঠি তিন ভাইবোন। মনে আছে একবার জেঠিমার ছোট বোন এসেছিল বেড়াতে। তখন সোমনাথ কলেজে পড়ে। সোমনাথের পাতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ওমা, এ যে বেড়াল টপকানো ভাত খায়! সোমনাথ অধোবদন, সেদিন থেকেই খাওয়া অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। এখনও নিজের সংসারে দ্বিতীয়বার ভাত চাইতে কেমন বাধো বাধো লাগে। জেঠার বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরখানা জুটেছিল তাদের কপালে, গাদাগাদি করে সেখানে থাকত চারজন। সারাদিন ঝিয়ের মতো খাটত মা, মন জুগিয়ে চলত জেঠিমার, তবু মাকে কত মুখঝামটা সহ্য করতে হয়েছে। জেঠিমার তপ্ত গলা কানে এলে ঘরের ভেতর ঠকঠক কাঁপত সোমনাথ। হাড়ের সেই কাঁপুনি আজও থামল না? সব সময়ে মনে হয়, এই যে ছোট্ট বৃত্ত, এই যে সামান্য একটু নিশ্চিন্ততা সে অর্জন করেছে, এই বুঝি সেটা উবে গেল। আশ্চর্য, দীপু আর খুকুও তো একসঙ্গেই মানুষ হয়েছে, তাদের মধ্যে তো এই হীনম্মন্যতা নেই? তারা তো দিব্যি বুক ফুলিয়ে বেঁচে আছে!

আরও বেশি অবাক লাগে মিতুলকে দেখে। তার ছত্রছায়ায় বড় হয়েও ভয়ডরের কোনও বালাই নেই? কোত্থেকে এত জোর পায় মিতুল? ঠাকুমার ধাত? শত কষ্টের মধ্যেও মাকে কখনও ভেঙে পড়তে দেখেনি সোমনাথ। কানের কাছে পাখি পড়ার মতো আওড়াত মা, ঘাবড়াস না, সমু, দিন বদলাবে, দিন বদলাবে।

দিন তো অনেকটাই বদলেছে, সোমনাথ নিজের বদল ঘটাতে পারল কই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *