গুপ্ত ঘাতক
এক
জাহাজখানা ঘাটে নোঙর করা ছিল-ছাড়িবে সকাল সাতটায়।
ভোর পাঁচটার সময় গাড়ি জাহাজ-ঘাটে উপস্থিত হইতেই আগে নামিয়া পড়িল-কৃষ্ণা, তাহার পর সন্তর্পণে পিতার হাত ধরিয়া নামাইল।
মিঃ সত্যেন্দ্র চৌধুরি কন্যার সাহায্য লইতে চাহেন নাই,-নিজেই নামিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, কৃষ্ণা বলিল, ”পড়ে যাবেন বাবা, আমার হাত ধরে নামুন।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”কিছু দরকার নেই মা, আমি নিজেই নামছি।”
কৃষ্ণা কিন্তু সে-কথা শুনিল না, তাঁহার হাত ধরিয়া নামাইয়া লইল।
মিঃ চৌধুরি মাথার টুপিটা চোখ পর্যন্ত নামাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার মুখের নিম্নাংশই মাত্র দেখা যাইতেছিল, হঠাৎ দেখিয়া যে-কেহ তাঁহাকে চিনিতে পারিবে না। সামনের দিকে তিনি কতকটা নত হইয়া চলিতেছিলেন, তাঁহার ডানহাতখানা ছিল কৃষ্ণার কাঁধের উপর।
কাল রাত্রেই তাঁহাদের জিনিসপত্র জাহাজে আসিয়াছে, বিশ্বস্ত ভৃত্য ফুচু সে-সব লাগেজ করিয়া দিয়া গিয়াছে। আজ তাঁহাদের সঙ্গে আছে শুধু একটা বিছানা, টিফিন-ক্যারিয়ার, জলের কুঁজা ও একটা বড় সুটকেস।
ফুচু সঙ্গে আসিয়াছে, সে ইহাদের জাহাজে তুলিয়া দিয়া এখান হইতেই বিদায় লইবে, কলিকাতা পর্যন্ত তাহার যাওয়া হইবে না।
মিঃ চৌধুরি রেঙ্গুনে ছিলেন। দীর্ঘ কুড়ি বৎসর তিনি এখানে পুলিশে কাজ করিয়া আসিয়াছেন-সরকারি-খেতাব এবং প্রচুর অর্থ সবই তিনি পাইয়াছিলেন। পেনশানের এখনও বিলম্ব আছে, ইহারই মধ্যে তিনি কাজে জবাব দিয়াছেন।
সংসারে আপনার বলিতে এই একটি মাত্র কন্যা কৃষ্ণা ছাড়া আর কেহই নাই। চিরকাল তিনি বর্মা-বাসী ছিলেন না, পুলিশে কাজ লইয়া বর্মায় বদলি হইয়া যান এবং এই দীর্ঘকাল সেইখানেই কাটাইয়াছেন। কৃষ্ণা বর্মাতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, শিক্ষালাভও করিয়াছে সেইখানে, বাংলার সহিত তাহার আদৌ পরিচয় নাই।
বর্মার প্রচুর যশ-সম্পদ ছাড়িয়া, অসময়ে কাজে ইস্তফা দিয়া পিতা যে কেন হঠাৎ কলিকাতায় চলিলেন, তাহা কৃষ্ণারও অজ্ঞাত। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করিয়া সে উত্তর যাহা পাইয়াছিল, তাহাতে ঠিক খুশি হওয়া যায় না, তথাপি কৃষ্ণা তাহাতেই খুশি হইয়াছিল।
মিসেস চৌধুরি মাত্র তিনমাস মারা গিয়াছেন। তাঁহার রহস্যময় মৃত্যুই মিঃ চৌধুরির বর্মা ত্যাগের একমাত্র কারণ বলিয়া সাধারণে জানে। মিঃ চৌধুরিও এই কারণ দেখাইয়াছিলেন।
জাহাজে উঠিবার মুহূর্তে কৃষ্ণার মনে পড়িতেছিল, স্বর্গগতা জননীর কথা। মায়ের একান্ত ইচ্ছা ছিল তিনি বাংলায় ফিরিয়া যাইবেন। মিঃ চৌধুরি তিনমাস আগে কন্যা ও পত্নীকে কলিকাতায় পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, যাত্রার আয়োজনও ঠিক হইয়াছিল; কিন্তু যাত্রার পূর্বদিন রাত্রে আকস্মিকভাবে মিসেস চৌধুরির মৃত্যু হওয়াতে সমস্ত আয়োজন স্থগিত হইয়া গিয়াছিল।
ফুচু জিনিসপত্র জাহাজে উঠাইয়া দিয়া সজল নেত্রে বিদায় লইল। মিঃ চৌধুরি কেবিনে চলিয়া গেলেন। কৃষ্ণা একাই বাহিরে রেলিংয়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
কৃষ্ণা চাহিয়াছিল শহরের পানে। এই শহরের মধ্যে একটি বাড়ি ছিল তাহাদের, কি সুখে-শান্তিতে তাহাদের দিনগুলা কাটিয়া যাইত। মনে পড়ে সেই কাল-রাত্রির কথা-সে-রাত্রি প্রভাতে তাহাদের এখান হইতে চলিয়া যাইবার ব্যবস্থা হইয়াছিল।
গভীর রাত্রে একটি চিৎকার শুনিয়া তাহার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল-সামনেই দেখিয়াছিল জননীকে, বিছানার পাশে দাঁড়াইয়া খোলা জানালার পানে তাকাইয়া তিনি কেবল থর-থর করিয়া কাঁপিতেছিলেন, মুখে ছিল একটা অস্ফুট আর্তস্বর!
ও ঘর হইতে পিতা ছুটিয়া আসিলেন-চারিদিক হইতে যে যেখানে ছিল ছুটিয়া আসিল….মাকে বাঁচাইবার চেষ্টা নিষ্ফল হইল। কেবল একটা আঙুল তুলিয়া জানালা নির্দেশ করিয়া একটি মাত্র কথা তিনি বলিতে পারিয়াছিলেন, ”ওই…ওই…”
বাড়ির চারিদিকে দোতলা সমান উচ্চ প্রাচীর-গেটে সর্বদা দুইজন অস্ত্রধারী কনেস্টবল দাঁড়াইয়া থাকে, ইহারই মধ্যে মা যে জানালায় কি দেখিলেন, তাহা কিছুই জানা গেল না।
মৃতা মায়ের গলদেশে একটি মাত্র ক্ষুদ্র রক্তবিন্দু দেখা গিয়াছিল, ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছিলেন, সুঁচের আকারে কোনো-কিছু এখানে বিদ্ধ হইয়াছে এবং সেটা এমন তীক্ষ্ন-বিষাক্ত ছিল, যাহাতে দশ মিনিটের মধ্যে মিসেস চৌধুরি ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন।
ইহার পরেই মিঃ চৌধুরি অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া পড়িলেন এবং বাহিরের কাজ ছাড়িয়া নিজের গৃহে বসিয়া কাগজপত্র দেখা-শোনা করিতে লাগিলেন। তারপর হঠাৎ তিনি কাজে ইস্তফা দিয়া কলিকাতায় ফিরিবার ব্যবস্থা করিয়া ফেলিলেন এবং কৃষ্ণাকেও প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন।
এই তিনমাস কৃষ্ণা বড় ভয়ে ভয়ে কাটাইয়াছে। এখান হইতে চলিয়া যাওয়ার প্রস্তাবে সে যেন বাঁচিয়া গিয়াছে! অথচ এই স্থানটির জন্য আজ বিদায়-বেলায় তাহার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, সে একটিবার মাত্র দুই হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইল।
দুই
সন্ধ্যার সময় ডেক হইতে কেবিনে ফিরিবার পথে মিঃ চৌধুরির সহিত একটি লোকের মাথা ঠুকিয়া গেল। মনে হইল, সে লোকটা মিঃ চৌধুরির কেবিন হইতে বাহির হইল।
”কে-কে তুমি?”
চট করিয়া আলো জ্বালাইবার আগেই সে লোকটা সরিয়া পড়িল-ও-পাশের জমাটবাঁধা অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।
মিঃ চৌধুরি তাড়াতাড়ি সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিলেন-কোথাও কাহারও সাড়াশব্দ নাই।
কেবিনে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, যেখানকার জিনিস সেইখানেই যথাযথ আছে। তাড়াতাড়ি বাক্সটা খুলিয়া তিনি কাগজপত্রগুলি পরীক্ষা করিলেন…না, কিছুই অপহৃত হয় নাই।
এই সময়ে বিবর্ণমুখে কৃষ্ণা কেবিনে প্রবেশ করিল।
মিঃ চৌধুরি একবার তাহার পানে তাকাইয়া বাক্সটা বন্ধ করিতে-করিতে বলিলেন, ”জানো কৃষ্ণা, দরজা বন্ধ করে আমি মাত্র দশ মিনিটের জন্যে ‘ডেকে’ গিয়েছিলুম, ঠিক সেইটুকু সময়ের মধ্যে একজন লোক আমার কেবিনে ঢুকেছিল।”
কৃষ্ণা রুদ্ধশ্বাসে বলিল, ”আমিও সেই কথাই বলছিলুম বাবা। সকালে যখন জাহাজে উঠি, তখন জেটিতে জনকয়েক বার্মিজকে দেখেছিলুম, তাদেরই মধ্যে একজনকে জাহাজে দেখতে পেলুম। জাহাজের একজন চাকর-আমাদের জিনিসপত্র দেখাশোনার ভার যার ওপর আছে, সে আমায় বললে, একজন বার্মিজ ঘুরে ঘুরে জিনিসগুলো দেখছিল। একটু আগে ‘ডেকে’ সেই লোকটাকে দেখতে পেলুম, এমন সাপের মতো চোখ তার!”…
বলিতে বলিতে কৃষ্ণা শিহরিয়া উঠিল।
মিঃ চৌধুরি মুহূর্ত নীরব থাকিয়া বলিলেন, ”সেই লোকটাকে তুমি আমায় দেখাতে পার, কৃষ্ণা?”
কৃষ্ণা বলিল, ”কাল সকালের দিকে দেখাব বাবা!”
মিঃ চৌধুরিকে বড় বিষণ্ণ ও অন্যমনস্ক দেখাইতেছিল। কৃষ্ণা বুঝিয়াছিল, কি একটা অজ্ঞাত-আশঙ্কায় পিতা ভীত হইয়া পড়িয়াছেন। লাগেজের মধ্যে মিঃ চৌধুরি নিজের নাম দেন নাই, মিঃ এ. দাশগুপ্ত নামে তিনি জাহাজে পরিচিত হইয়াছেন। নাম ও পরিচয় গোপন করার কারণ সে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, পিতা বলিয়াছিলেন, কলিকাতায় গিয়া সব কথা তিনি কৃষ্ণাকে জানাইবেন। তিনি যে আজ সকালেই রেঙ্গুন ত্যাগ করিবেন এ সংবাদ সেখানকার কেহ জানে না, অতি গোপনে তাঁহার বিশ্বাসী ভৃত্য ফুচু জিনিসপত্র জাহাজে স্থানান্তরিত করিয়াছে, অতি গোপনে অন্ধকার থাকিতে তিনি বাড়ি ত্যাগ করিয়াছিলেন।
এই মুহূর্তে মিঃ চৌধুরি বুঝিলেন, তিনি যত গোপনেই কাজ করুন না কেন, লোকে তাহা জানিয়াছে এবং তাঁহার অনুসরণ করিয়াছে। শুধু বর্মায় নয়, জাহাজে তাঁহার দেহরক্ষী দুজন কনেস্টবল থাকিলেও তিনি নিরাপদ নহেন। তাহারা সকাল হইতে কেবিনের সামনেই ছিল, মিঃ চৌধুরি যখন ‘ডেকে’ গিয়াছিলেন, তখন তাঁহার সঙ্গে একজন গিয়াছিল, আর একজন এখানেই ছিল। বিশেষ দরকারে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য সে সেখান হইতে সরিয়া গিয়াছিল, সেই সময়টুকুর মধ্যে মিঃ চৌধুরির অনুসরণকারী কেবিনে প্রবেশ করিয়াছে। মিঃ চৌধুরির সাড়া পাইয়াই তাড়াতাড়ি সে বাহির হইয়া গিয়াছে, কিছু খুলিবার বা দেখিবার অবকাশ সে পায় নাই। পুলিশ-লাইনে কাজ করার জন্য শত্রুর সংখ্যা তাঁহার বড় কম ছিল না, তাহা তিনি জানেন। ইহাদের মধ্যেই কাহারও দ্বারা তাঁহার পত্নী হত হইয়াছেন, তাঁহার নিজের জীবন এবং একমাত্র বালিকা-কন্যা কৃষ্ণার জীবনও যে নিরাপদ নহে, তাহাও তিনি জানেন এবং সেইজন্যই তিনি বর্মা ত্যাগ করিতেছেন।
কৃষ্ণা পাছে বেশি ভয় পায়, এজন্য তাহাকে তিনি এ-পর্যন্ত কোনো কথাই বলেন নাই; আজই প্রথম তাঁহার মনে হইল তাহাকে বলা উচিত যাহাতে সে সাবধান হয়।
দরজায় কনেস্টবল দুজন সদা সতর্ক; ইহাদের মধ্যে একজন বার্মিজ; অপরটি বাঙালি মুসলমান। মিঃ চৌধুরি তাহাকেই ডাকিলেন।
আসগর আলি আসিয়া সেলাম দিয়ে দাঁড়াইল।
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বস আসগর, তোমার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে।”
আসগর দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
মিঃ চৌধুরি নিম্নস্বরে বলিলেন, ”তুমি জানো না আসগর, এই কেবিনে লোক ঢুকেছিল।”
”লোক ঢুকেছিল!”
আসগর বিস্ময় দমন করিতে পারে না-”লোক ঢুকবে কি করে সাহেব, দরজায় তাও-চি ছিল যে-সে তো সামনে পাহারায় আছে।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”তাও-চির দোষ নেই আসগর, সে এই কেবিনের ভার চাকরের হাতে দিয়ে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের জন্যে বাথরুমে গিয়েছিল-ঠিক সেই সময় অজ্ঞাত লোকটা বাইরের সুইচ অফ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। অন্য কেউ যদি তাকে দেখেও থাকে, বিশেষ সন্দেহ করতে পারেনি, হয়তো আমার চাকর বলেই ভেবেছে। তোমায় কৃষ্ণার কাছে রেখে আমি যখন বাইরে আসছিলুম, তখন এই দরজার সামনে সেই লোকটার সঙ্গে প্রায় আমার ধাক্কা লেগেছিল আর কি! আমি আলো জ্বালবার আগেই সে অন্ধকারে কোথায় যে লুকোলো-আর দেখতে পেলুম না।”
আসগর খানিকক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে কতকটা অন্যমনস্কভাবে বলিল, ”হুঁ, শয়তানেরা পিছু নিয়েছে সাহেব, কলকাতাতেও দেখছি আপনি নিরাপদে থাকতে পারবেন না।”
মিঃ চৌধুরি হতাশ সুরে বলিলেন, ”বোধহয়-না।”
কৃষ্ণা টেবলের ধারে বসিয়া অন্যমনস্কভাবে একখানা বইয়ের পাতা উল্টাইতেছিল, মুখ তুলিয়া বলিল, ”কোন শয়তানেরা পিছু নিয়েছে আসগর-যাতে বাবা কলকাতায় গিয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না?”
মিঃ চৌধুরি শান্তকণ্ঠে বলিলেন, ”এবার তোমায় সব কথাই জানাব, কৃষ্ণা। আগে ভেবেছিলুম তোমায় কিছু বলব না, কিন্তু এখন দেখছি তোমায় না বলে আজ উপায় নাই। কেবল আমার নয় মা, তোমার মাথার উপরেও সর্বদা ধারালো তলোয়ার ঝুলছে, যে কোনো সময়ে ছিঁড়ে তোমার মাথাতেও পড়তে পারে।”
আসগর চিন্তিতমুখে বলিল, ”হ্যাঁ সাহেব, আমার মতে-মাকে সব কথা জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি বাইরে যাই, আপনি মাকে সব বুঝিয়ে বলুন।”
সে সেলাম দিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
তিন
বে-অব-বেঙ্গলের বুকের উপর দিয়ে দ্রুত চলিতে চলিতে জাহাজের গতি মন্থর হইয়া আসিল। আকাশে নিবিড় কালো মেঘ সাজিয়া আসিয়াছে, মাঝে মাঝে চোখ- ঝলসানো বিদ্যুতের চমক! সঙ্গে সঙ্গে মেঘ-মাদলের গুরু-গুরু গর্জন! সাগরের বুকে প্রকৃতির প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডব নৃত্য চলিয়াছে, জাহাজের বেগ তাই কম…বন্দর ধরিবার সুযোগ খুঁজিতেছে।
কেবিনের একটা জানালা খোলা ছিল। কৃষ্ণা বলিল, ”জানালাটা বন্ধ করে দিই বাবা।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”খানিকক্ষণ খোলা থাক মা, ভারি গরম লাগছে।”
অন্যমনস্কভাবে তিনি জানালা-পথে বাহিরের পানে তাকাইয়া ছিলেন, কৃষ্ণা বলিল, ”আমাকে কি বলবেন বলেছিলেন, বাবা?”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”হ্যাঁ, কতকগুলো খুব দরকারি কথা তোমায় বলতে চাই কৃষ্ণা, যেসব কথা তোমার অবশ্য শুনে রাখা উচিত।…কলকাতায় ভবানীপুরে আমার জন্মস্থান। আমার বাবা ভবানীপুরে একখানি নূতন বাড়ি তৈরি করেছিলেন-সেইখানে আমার জন্ম হয়। তিনিও পুলিশে কাজ করতেন এবং তখনকার দিনে বেশ নাম করেছিলেন।
”ছোটবেলা হতে আমারও ঝোঁক ছিল আমি পুলিশ-লাইনে কাজ করব। কি জানি কেন-বিদেশে বাঙালি যাতে নাম পায়, সেই পরিচয় দেওয়ার ইচ্ছা ছোটবেলা হতে আমার মনে জেগেছিল। আমি তারপর বড় হয়ে পুলিশেই কাজ নিলুম এবং যাতে বাইরে যেতে পারি তার চেষ্টা করতে লাগলুম।
”মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা কখনও ব্যর্থ হয় না। চেষ্টার ফলে আমি শীঘ্রই বর্মায় চলে আসতে পারলুম। আজ বর্মা ভারত হতে বিচ্ছিন্ন হলেও, সেদিন বর্মা ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই আমার পক্ষে আসা অসম্ভব হয়নি। এতে আমায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন, পুলিশের ডেপুটি কমিশনার মিঃ আর্থার মুর। তখন তিনিও আমার সঙ্গে একত্রে কাজ করতেন।
”আমি বর্মায় যাওয়ার আগে আমার বিবাহ হয়েছিল; কুড়ি বছর আগে তোমার মাকে আমি বর্মায় নিয়ে যাই।
”পল্লীবাসিনী বাংলার মেয়ে ছিলেন তিনি, অতিরিক্ত ভীরু, অতিরিক্ত কোমল ও দুর্বল। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখে সইতে পারতেন না, নিজেই কেঁদে ফেলতেন। আমাকে উৎসাহ দেওয়া দূরে থাক তিনি শুধু আমায় নিবৃত্ত করতে চাইতেন, প্রতি পদে তাঁর এত বেশি ভয় ছিল যা শুনলে লোকে হাসবে। তুমিও দেখেছ কৃষ্ণা, যখনই তোমায় আমি নিজের ইচ্ছামতো গড়তে গেছি, তখনই তিনি তাতে বাধা দিয়েছেন।
”আমার মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই আমায় এগিয়ে দিয়েছিল উন্নতির পথে! বিদেশে বাঙালি যে কতখানি যশ, মান, খ্যাতি লাভ করতে পারে, তা তুমি নিজেই দেখেছ কৃষ্ণা! আমার ছেলে নেই, তুমি মেয়ে হলেও তোমায় গড়ে তুলেছি ছেলের মতো-আমি আশাও করি আমার যা কিছু অসমাপ্ত কাজ তুমি শেষ করবে, আমার মুখ তুমি উজ্জ্বল রাখবে। হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলুম-
”শেষ পর্যন্ত চোর-ডাকাত গুন্ডা-বদমায়েশরা আমার নামে শিউরে উঠেছে! আমি তাদের শাস্তি দিয়েছি কম নয়! এইসব কঠোর শাস্তির জন্যে তারা আমায় ভয় করত। কয়েক বছর আগেকার কথা বলি-
”শুধু রেঙ্গুন নয়, বাসিনে, ম্যান্ডালে পরপর কয়েকটা ভয়ানক ডাকাতি হয়। আমাদের বড়সাহেব ইরাবতীতে বজরায় ছিলেন, তাঁর সেই বজরা লুঠ হয়েছিল এবং বড়সাহেবকে তার পরদিন একখানা ছেঁড়া লুঙ্গি পরা ও কালিমাখা অবস্থায় পথে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
”অনুসন্ধানে জানা গেল এ সব একজন বার্মিজ-দস্যুর কাজ। তার নাম ইউ-উইন, সে নাকি বনেদি বংশের ছেলে ছিল।
”এই লোকটা এর আগে চার-পাঁচবার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। আমার দুর্ভাগ্য, আমি আগে তাকে কোনোবারই দেখিনি। তার দলের কত লোককে ধরেছি, বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দিয়েছি, দীর্ঘকালের জন্যে জেলে পাঠিয়েছি-কিন্তু ইউ-উইনকে আমি ধরতে পারিনি।
”একবার লক্ষাধিক জাল নোট ওদেরই এক আড্ডায় আমার হস্তগত হয়, জানতে পারি যে, এ সবই ইউ-উইনের কাজ। আমি যখন রাত-দুপুরে তাদের আড্ডায় হানা দিই-সর্দার ইউ-উইন তখন সেখানেই ছিল। আমার সুমুখ হতে যে-কৌশলে সে পালিয়েছিল, আমি সে কৌশল ভেদ করতে পারিনি, তার কারণ আমি তাকে চিনতুম না! বিশেষ সন্ধান করে আমি ওদের দলের তিরিশজন লোককে ধরতে সমর্থ হই, এদেরই মধ্যে ছিল, ইউ-উইনের বড় শাগরেদ-মংপো।
”বিচারে হত্যাপরাধে মংপোর ফাঁসি হয় এবং তার সঙ্গীদের দীর্ঘকালের জন্যে কারাবাসের আদেশ হয়।
”এরপর কিছুকাল ইউ-উইনের সাড়াশব্দ পাইনি, পাঁচ বছর বাদে আবার বর্মায় তার আবির্ভাব হল। লোকের মুখে শুনতে পেলুম, ইউ-উইন পাঁচ বছর ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে গিয়েছিল। তখনই আমি বুঝলুম, এইবার সে তার পরম শত্রু আমায় তার পথ হতে সরানোর চেষ্টা করবে।
”কিছুদিন পরে আমি তার একখানা পত্র পেলুম। সে জানিয়েছে-কিছুদিন আগে আমি ভামোর জঙ্গলে তাদের দলকে বিপর্যস্ত করে যে বুদ্ধ-মূর্তি পেয়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের হাতে দিয়েছি, সেই বুদ্ধ-মূর্তি অপবিত্র করার অপরাধে সে আমায় কঠিন শাস্তি দেবে। ইচ্ছা করলেই সে আমায় যে কোনো মুহূর্তে হত্যা করতে পারে, কিন্তু এত সহজে সে আমায় মুক্তি দিতে চায় না। আমি যেমন তাকে মর্মে মর্মে দগ্ধ করেছি, সেও আমায় তাই করবে। সে একমাসের মধ্যে আমার স্ত্রীকে হত্যা করবে, তারপর ছ-মাসের মধ্যে আমার কন্যাকে হত্যা করবে এই তার প্রতিজ্ঞা। পবিত্র বুদ্ধদেবের নামে সে এই শপথ করেছে, এবং এ প্রতিজ্ঞা সে পালন করবেই। সে দর্পের সঙ্গে জানিয়েছে-প্রকাশ্যেই এইসব কাজ করবে, চোরের মতো লুকিয়ে কাজ করাকে সে ঘৃণা করে। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, তার শপথ সে পালন করবেই, কিছুতেই তাকে বাধা দিতে পারবে না।
”আতঙ্কিত কিছু হয়েছিলুম! পত্রের নির্দেশানুসারে একমাস সময় ঠিক করে আমার রেঙ্গুনের বাড়ি সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলুম, তা তুমিও জান কৃষ্ণা! কিন্তু কিছুতেই পারলুম না তোমার মাকে রক্ষা করতে। সেই রাতটা গত হলে আমি তোমাদের কলকাতায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতুম-তা হল না। আমিও নিজে সে রাত্রে সশস্ত্র অবস্থায় বাড়ির চারিদিকে ঘুরে বেরিয়েছি। তোমাদের কাউকে এ পত্রের কথা বিন্দুবিসর্গ জানাইনি-পাছে তোমরা ভয় পাও! আজ ভাবছি আমি কত বড় বোকামি করেছি; তোমাদের সেদিন জানানোই আমার উচিত ছিল-তোমরা সাবধান হতে পারতে।
”সে পত্র আমি রেখেছি আমার ওই বাক্সটার মধ্যে, তুমি এরপরে দেখ। তোমার মা গেছেন, এখন তোমার জন্যেই আমার ভাবনা। ছ-মাসের মধ্যে তিনমাস অন্যান্য ব্যবস্থা করতে কেটে গেছে, এখন তোমায় আমি কলকাতায় রাখতে চাই। ভেবেছিলুম, ওরা সন্ধান পাবে না, সেজন্য আমি একমাত্র বড়সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে জানাইনি, ছদ্মনামে ছদ্মবেশে তোমায় নিয়ে চলেছি। বাড়ি থেকে নিতান্ত আবশ্যকীয় জিনিস ছাড়া কিছুই আনিনি-পাছে ওরা জানতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি আমার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে, ওরা আমার অনুসরণ করেছে,-ছ-মাস বাদে ইউ-উইন প্রতিজ্ঞা পালন করবার সুযোগ খুঁজছে।”
মিঃ চৌধুরি দুই হাতে মাথা চাপিয়া ধরিলেন :
”হ্যাঁ, আরও একটা কথা-সেই বুদ্ধ-মূর্তির কাছে এক জোড়া খড়ম ছিল, সেটা আমি কলকাতা মিউজিয়ামে দেব বলে আমার কাছেই রেখেছি। কাল হঠাৎ ফুচু সেটা দেখতে পেয়েছে,-তার কাছেই শুনলুম, সেটা নাকি বুদ্ধদেবের খড়ম। আমি সেটাও নিয়ে চলেছি কৃষ্ণা। সেটা ওই জানালার কাছে ছোট বাক্সের মধ্যে আছে। যাই হোক- পুরাকালের একটা জিনিস তো বটে, ওটা মিউজিয়ামে দিলে-”
বলিতে বলিতে কৃষ্ণার পানে তাকাইয়া,-হঠাৎ তাহার হাতে উদ্যত রিভলভার দেখিয়া সভয়ে জানালার দিকে তাকাইলেন।
খোলা জানালা-পথে একখানা কালো স্থূল হাত দেখা গেল, ছোট বাক্সটা টানিয়া লইয়া মুহূর্তে হাতখানা অদৃশ্য হইবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা গুলি করিল।
গুলি দেওয়ালে বিদ্ধ হইল-
সেই মুহূর্তে বাহিরে একটা বিকট অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল।
মিঃ চৌধুরি দুই হাতে চোখ ঢাকিলেন। কৃষ্ণা ছুটিয়া জানালার কাছে গেল।
এদিক দিয়া যে কোনো মানুষ এই জানালার কাছে আসিতে পারে, এ ধারণা মোটেই করা যায় না। নীচে অথই জল-জলের দশ-পনেরো হাত উপরে জানালা।
কৃষ্ণা তথাপি দেখিবার চেষ্টা করিল,-টর্চের আলো চারিদিকে ফেলিল, কিছুই দেখা গেল না।
চার
আউটরাম ঘাটে যখন জাহাজ আসিয়া পৌঁছাইল, তখন মিঃ চৌধুরি শান্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁহার মনে হইল, উপস্থিতকার মতো বিপদ কাটিয়া গেল,-পরের জন্য প্রস্তুত থাকা ইহার পর সম্ভব হইবে।
কাষ্ঠপাদুকা যে রাত্রে অপহৃত হয়, সেই রাত্রেই মিঃ চৌধুরির জ্বরটা বেশি করিয়া আসে। দুইদিন তিনি বিছানায় পড়িয়া কাটাইয়াছেন, এ দুইদিন কৃষ্ণা এক মুহূর্তের জন্যও তাঁহার সান্নিধ্য ত্যাগ করে নাই।
তাহার বয়স মাত্র ষোল-সতেরো বৎসর। সচরাচর বাঙালির ঘরে এই বয়সের মেয়েরা যেমন ভীরু, নম্র বা শান্ত হয়, কৃষ্ণা তেমন ছিল না-বাঙালির ঘরে এ বয়েসে ছেলেরা যেমন হয়, কৃষ্ণা তেমনও ছিল না। পিতার শিক্ষায় সে ইহার মধ্যে অনেক কিছু জানিয়া-শুনিয়া ফেলিয়াছে। স্ত্রীর বাঙালিমেয়ে-সুলভ ভীরুতা ও কমনীয়তা মিঃ চৌধুরি কোনোরকমে সহিয়া গেলেও, একমাত্র এই কন্যাকে নিজের মনের মতো করিয়া গড়িয়া তুলিবেন, এই ছিল তাঁহার একান্ত ইচ্ছা।
এই বয়সে কৃষ্ণা মাতৃভাষা ছাড়া আরও পাঁচ-সাতটি ভাষা শিখিয়াছে। কেবল শিখিয়াছে বলিলেই হইবে না, যে কোনো ভাষায় সে অনর্গল কথা বলিতে পারে, পড়িতে পারে। পিতা তাহাকে অশ্বারোহণে পারদর্শিনী করিয়াছেন, মোটর সে নিজেই চালায়, পিতার সহিত বর্মার জঙ্গলে সে বহু শিকার করিয়াছে। উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে তাহার দেহ সুগঠিত, শক্তিশালিনী; দেহে যেমন তাহার অটুট শক্তি, অন্তরে তাহার তেমনই অকুতো-সাহস।
মায়ের আকস্মিক মৃত্যু তাহাকে কতকটা দমাইয়া দিয়াছিল এ কথা সত্য। পিতার জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাও সে শুনিয়াছে। তিনি যে কত বড় বিপদে পড়িয়া অতি গোপনে তাহাকে লইয়া বাংলায় চলিয়াছেন, তাহাই মাত্র সে জানে না, পিতা তাহাকে জানান নাই।
নিজের শক্তিতে বিশ্বাসী কৃষ্ণা কেবল হাসিল-নিজের মনেই বলিল-মা মারা গিয়ে বাবা দুর্বল হয়ে পড়েছেন কিনা, তাই ছায়াকে কায়া বলে ভয় পান।
অনেক কথা উড়াইয়া দিলেও, সে রাত্রে জাহাজের জানালা-পথে যে হাতখানা দেখা গিয়েছিল এবং যে কঠোর কর্কশ হাসি সে শুনিয়াছিল, তাহা সে উড়াইয়া দিতে পারে না।
তথাপি তাহার মনে সন্দেহ জাগে-
হয়তো পিতার গল্প শুনিতে শুনিতে তাহার ঘুম আসিয়াছিল, ঘুমের ঘোরে সে বিভীষিকাময় একটা দুঃস্বপ্নই দেখিয়া থাকিবে। কিন্তু গুলি করিয়াই সে ছুটিয়া জানালার কাছে গিয়াছিল,-টর্চের আলোয় চারিদিক দেখিয়াছিল,-কিছুই দেখা যায় নাই। পরদিন সকালে আবার সে জানালা-পথে মুখ বাড়াইয়া চারিদিক দেখিয়াছিল,-জানালার নীচে মস্তবড় দুইটা কড়া ছাড়া আর কিছু দেখা যায় নাই। একটা সম্ভব হইতে পারে যে, কোনো লোক সেই কড়া ধরিয়া যদি জানালা-পথে হাত বাড়ায়। কিন্তু তাহাও যে অসম্ভব! দশ-বারো হাত নীচে বে-অব-বেঙ্গলের অথই জল, তাহার উপর ভাসিতেছে জাহাজ, কেবিনের এ-ধারে জল হইতে উঠিবার বা আসিবার কোনো পথ নাই। কড়া-ধরাই দুঃসাধ্য; জল হইতে লাফাইয়া দশ-বারো হাত উপরে কেহ কড়া ধরিতে পারে না।
পিতার তখন জ্বর আসিতেছিল। সামান্য একটু জ্বর ছিল, তাহার উপর বেশি জ্বর আসার সময় তাঁহার চিত্ত-বিভ্রম, মস্তিষ্ক-বিভ্রম, দৃষ্টি-বিভ্রম ঘটা এমন কিছু বিচিত্র নয়। ফুচু যে কাষ্ঠপাদুকার কথা বলিয়াছিল, কৃষ্ণা তাহা দেখে নাই, সে সম্বন্ধে কিছু জানেও না। কৃষ্ণা ভাবে-কাষ্ঠপাদুকার কথা পিতার মনে নাই, তাই হয়তো বর্মার বাড়িতেই পড়িয়া আছে। আর বুদ্ধদেবের পাদুকা-কৃষ্ণা হিসাব করিয়া দেখিল, বুদ্ধদেব কত বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বের কথা…সে-কাষ্ঠপাদুকা নাকি আজও থাকে!
কৃষ্ণার হাসি পায়।
এখন অসুস্থ পিতাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা চলে না, তিনি সুস্থ হইলে, শক্তি পাইলে, তাঁহাকে পরে জিজ্ঞাসা করিলেই চলিবে।
সব ব্যাপারটাই কৃষ্ণা ফুৎকারে উড়াইয়া দিল।
পিতা শত্রুর কথা বলিয়াছেন,-অমন শত্রু পুলিশের অনেকেই থাকে। রেঙ্গুনে থাকিতে হয়তো ভয়ের কারণ ছিল, কলিকাতায় আর সে সব ভয় নাই।
মিঃ চৌধুরির শ্যালক বাড়ি পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিলেন, মিঃ চৌধুরি কন্যাসহ সেই বাড়িতে গিয়া উঠিলেন। এখানে কৃষ্ণার মামা মিঃ চৌধুরির পত্রানুসারে দিন-পনেরো আগে আসিয়া সংসার পাতিয়া বসিয়াছেন। দুইজন দারোয়ান নিযুক্ত হইয়াছে, বিশেষ জানা-শোনা দাস-দাসী রাখা হইয়াছে।
নিজের দেশে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আসিয়া মিঃ চৌধুরির বুক হইতে একটা ভারী বোঝা নামিয়া গেল।
কৃষ্ণা হাসিমুখে বলিল, ”আপনার যা ভয় বাবা, যেন জাহাজেই একটা বিপদ ঘটবে। এইতো কটা দিন কেটে গেল জাহাজে, কিছুই তো হল না! নামবার সময় পর্যন্ত আমি সেই বার্মিজ লোকটার ওপর দৃষ্টি রেখেছিলুম। বেশ শান্তভাবেই সে তার জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেল। যাবার সময় বার-কয়েক আমাদের দিকে চেয়েছিল বটে, সেটা কেবল চাওয়া মাত্র।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”আর সে যে দাশগুপ্তের লাগেজগুলো জাহাজে পরীক্ষা করে বেড়িয়েছিল?”
কৃষ্ণা বলিল, ”সেটা তার কৌতূহল।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”আর সাপের মতো চাউনি?”
কৃষ্ণা বলিল, ”স্বাভাবিক মাত্র!”
গম্ভীরভাবে মাথা দুলাইয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”কেবিনের জানলার ভেতরে একখানা হাত?”
কৃষ্ণা বলিল, ”ওটা নেহাত ভুল, বাবা! আপনার তখন জ্বর আসছিল, কিছু একটা ধারণা করে ভয় পেয়েছেন, আমারও ঘুম এসেছিল-কি দেখতে কি দেখেছি! তন্দ্রা ভাঙতেই উঠে তখুনি সব দেখেছিলুম, তারপর সকালে সে-দিকটা আবার দেখলুম, কিছুই দেখতে পেলুম না। জল দিয়ে সেখানে দশ-বারো হাত ওপরে মানুষ কোনোদিন উঠতে পারে না-লাফ দিয়েও নয়। কাজেই-”
মাতুল প্রণবেশ গো-বেচারি-গোছের লোক, অনেক কিছু অসম্ভবকেও তিনি সম্ভব করিয়া লইতে পারেন। মাথা চুলকাইয়া তিনি বলিলেন, ”মানুষ না হয়ে, অন্য কিছুও তো হতে পারে।”
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”অন্য কিছু মানে?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”কোনো প্রেতাত্মা!”
কৃষ্ণা হাসিয়া উঠিল, বলিল-”কার প্রেতাত্মা, মামা?”
ভাগিনেয়ীর হাসিতে মামা ক্ষুব্ধ হইলেন, মনে মনে কিছু রুষ্টও হইলেন; বলিলেন, ”প্রেতাত্মা না হোক, দেবতা তো হতে পারেন। ধর, বুদ্ধদেবেরই আত্মা, তিনি হয়তো খড়মের মায়া ছাড়তে পারেননি, তাই সে-জোড়া নিয়ে গেলেন। বলবে, বুদ্ধদেব যে গৌরবর্ণ ছিলেন ইতিহাস তারই প্রমাণ দেয়, কিন্তু দেবতারা যে ইচ্ছামতো ঘন কালো রংও নিতে পারেন তা আমরা অনেক শুনেছি। হ্যাঁ, আগে জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো চৌধুরিমশাই, খড়মটা কি কাঠের ছিল, না-হাতির দাঁতের? সেকেলে রাজারা নাকি হাতির দাঁতের পাদুকা ব্যবহার করতেন, সে যুগের সেরা বীর আলেকজান্ডার নাকি-”
কৃষ্ণা বাধা দিল, বলিল, ”আলেকজান্ডার হাতির দাঁতের পাদুকা ব্যবহার করেছিলেন, তাইতো বলছেন, মামা?”
প্রণবেশ এবার আর রুষ্টভাব গোপন করিতে পারিলেন না, বলিলেন, ”করেননি? আমি বলছি, সেকালে দরজা-জানলা পর্যন্ত হাতির দাঁতে তৈরি হত-আলমারি, বুকশেলফ আরও কত কি! জুতো হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়। এই যে ইতিহাস প্রমাণ দিচ্ছে, এই সেদিনের কথা-লর্ড হেস্টিংসের স্ত্রী মেরিয়ানা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে ইংল্যান্ডে যান তখন এক জাহাজভর্তি হাতির দাঁতের তৈরি জিনিস নিয়ে গিয়েছিলেন। তুমি কি প্রমাণ করতে চাও, তার মধ্যে হাতির দাঁতের ‘কাষ্ঠপাদুকা’ ছিল না? আমি বলব-হ্যাঁ, মেরিয়ানা হাতির দাঁতের জুতো পরে কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন।”
মামার সঙ্গে তর্ক করিয়া কোনো লাভ নাই।
কৃষ্ণা সে প্রসঙ্গ ছাড়িয়া দিল, উদাসভাবে বলিল, ”হতে পারে, বিজাতির হাতে দেবতার পাদুকা পড়ায় দেবতা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাই অসম্ভবকে সম্ভব করেও নিয়ে গেলেন।”
মিঃ চৌধুরি নীরবে ছিলেন, বলিলেন, ”ধরলুম-অন্ততপক্ষে তর্কের খাতিরে মেনে নিলুম, সে রাত্রে জ্বরের ঝোঁকে আমি বিভীষিকা দেখেছি, তুমিও স্বপ্ন দেখেছ-কিন্তু সে খড়ম জোড়াটা যে ছোট বাক্সেতে ভরে ফুচু সেখানে রেখে গেছে-সেটা তো আর স্বপ্ন বা মিথ্যে নয়, কৃষ্ণা?”
কৃষ্ণা বলিল, ”আমার মনে হয় বাবা, ফুচু যাওয়ার সময় সেটা লুকিয়ে নিয়ে গেছে। ফুচুও বার্মিজ, সেও বৌদ্ধ-তাদের দেবতার জিনিস যে আমরা নিয়ে চলে আসব, সে কখনও তা মেনে নিতে পারে না।”
আহতভাবে মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”কিন্তু, আমিও তোমার ও-কথা মেনে নিতে পারলুম না, কৃষ্ণা! ফুচুর মতো বিশ্বাসী অনুরক্ত চাকর আর কোনো জাতের মধ্যে মিলবে না এ কথা আমি লক্ষবার বলব। তুমি জান না-তুমি জন্মাবার আগে সে আমার কাজে লেগেছে, এ পর্যন্ত একান্ত বিশ্বাসী হয়েই সে কাজ করেছে, কখনও এমন কিছু পাইনি যাতে তাকে এতটুকু সন্দেহ করতে পারা যায়। ফুচুর নামে যা-তা বললে আমি কোনোদিনই বিশ্বাস করতে পারব না।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”তাকে সঙ্গে করে আনলেন না কেন?”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”নিজের দেশ, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে কেউ একা বিদেশে যেতে চায় না…ফুচুও তাই আসেনি।”
কৃষ্ণা চুপ করিয়া রহিল।
পাঁচ
ইচ্ছা করিয়াই সেদিন মিঃ চৌধুরি কৃষ্ণাকে লইয়া ‘লেড ল’র দোকানে কতকগুলো জিনিস কিনিতে গিয়াছিলেন।
ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাঁহারা জিনিসপত্রগুলা দেখিতেছিলেন, কৃষ্ণা ঘুরিতে ঘুরিতে একটু দূরে গিয়া পড়িয়াছিল। দোকানে দর্শকের সংখ্যা বড় কম ছিল না, প্রথমটায় কৃষ্ণার তাহাদের উপর দৃষ্টি ছিল, পরে আর লক্ষ্য রহিল না।
কে একজন তাহার গায়ে একটা ধাক্কা দিয়া গেল। বিরক্ত হইয়া কৃষ্ণা তাহার পানে তাকাইয়াই স্তম্ভিত হইয়া গেল-সেই বার্মিজ লোকটা! যাহাকে সে আসিবার দিন জাহাজে দেখিয়াছিল।
হ্যাঁ, সেই বটে। কৃষ্ণার বিন্দুমাত্র ভুল হয় নাই। মূল্যবান সিল্ক-লুঙ্গি তাহার পরিধানে, মূল্যবান জামা গায়ে, পায়ে মূল্যবান জুতা, প্রভেদ শুধু ইহার চোখে চশমা আছে।
খানিক দূরে গিয়া বার্মিজ লোকটি একবার ফিরিয়া চাহিল, কৃষ্ণা শিহরিয়া উঠিল; সেই চোখের দৃষ্টিতে সে দেখিল যেন আগুন জ্বলিতেছে!
”কৃষ্ণা!…কৃষ্ণা!”
পিতার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনিয়াই কৃষ্ণা তাঁহার নিকটে ছুটিয়া গেল। মিঃ চৌধুরির মুখখানা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাঁহার চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ। কৃষ্ণা নিকটে আসিতেই তিনি তাহার হাতখানা চাপিয়া ধরিলেন। তাঁহার সে হাতখানা তখন থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”কি হয়েছে বাবা, অমন করছেন কেন?”
মিঃ চৌধুরি কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, ”বাড়ি চল কৃষ্ণা, আজ আর কিছু কিনব না, অন্যদিন একসময় আসা যাবে, আজ আমার শরীরটা তত ভালো লাগছে না।”
পিতার হাত ধরিয়া কৃষ্ণা নীচে নামিয়া আসিল-সামনেই মোটর ছিল, তাহাতে উঠিতে গিয়া দেখিল, সেই বার্মিজ লোকটি পাশের একখানা ট্যাক্সিতে উঠিতেছে।
মিঃ চৌধুরি সিটের উপর এলাইয়া পড়িলেন। তাঁহার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাইতেছিল। কৃষ্ণা রুমাল দিয়া বাতাস করিতে করিতে বলিল, ”আপনার হঠাৎ এরকম হল কেন বাবা?”
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”ইউ-উইন কলকাতায় আমাদের অনুসরণ করে এসেছে কৃষ্ণা-আমি ওর ফটো দেখেছি, আমি ওকে দেখেই চিনেছি।”
”ইউ-উইন!”
কৃষ্ণা বিস্ময় দমন করিতে পারে না।
সেই মুহূর্তে পিছনের ট্যাক্সিখানা তাঁহাদের মোটর অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। সেই ট্যাক্সির মধ্যে দেখা গেল, একটু পূর্বে দৃষ্ট সেই বার্মিজ লোকটিকে। তাহার পার্শ্বে আর একজন লোক বসিয়া আছে, সে লোকটি হিন্দুস্থানি।
মিঃ চৌধুরি প্রায় চিৎকার করিয়া উঠিলেন-”ইউ-উইন!”
কৃষ্ণা বলিল, ”একটু আগে এই লোকটিই আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে গেছে বাবা, একেই আমি জাহাজে দেখেছিলুম।”
মিঃ চৌধুরি নীরবে বসিয়া রহিলেন।
মোটর বাড়ির দরজায় থামিতে, কৃষ্ণা পিতাকে নামাইল, তাঁহার পার্শ্বে চলিতে চলিতে বলিল, ”আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন, বাবা! ধরুন-যদি ও লোকটা ইউ-উইনই হয়, তাতেই বা কি? কলকাতার মতো প্রকাশ্য আর জনবহুল জায়গায়-”
মিঃ চৌধুরী বলিলেন, ”এইরকম জায়গাতেই সে সহজে নিজের কাজ উদ্ধার করে পালাতে পারবে কৃষ্ণা। তোমার মায়ের মৃত্যুর সময় দিয়েছিল একমাস,-ঠিক সেই একমাসের শেষ দিনে তাঁর প্রাণ গেছে। তোমার সময় নির্দেশ করেছে ছ-মাস, সে ছ-মাস পূর্ণ হতে আর তিনি দিন মাত্র বাকি আছে-”
বলিতে বলিতে তিনি শিহরিয়া উঠিলেন।
কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বাবা, আপনার মেয়ে আত্মরক্ষা করতে জানে, সহজে কেউ তার অনিষ্ট করতে পারবে না।”
মিঃ চৌধুরি মলিন হাসি হাসিলেন মাত্র।
পিতা কন্যার পরিচয় জানেন, কিন্তু তথাপি মনে শান্তি পান না। দশ মিনিটের মধ্যে পত্নীর শোচনীয় মৃত্যু তাঁহার মনে জাগিয়া আছে-কৃষ্ণার জীবনকে বিশ্বাস কি?
সেইদিনই রাত্রের কথা :
প্রণবেশ থিয়েটার দেখিয়া রাতির বারোটার সময় বাড়ি ফিরিয়াছেন। দারোয়ান জাগিয়াই ছিল, তাঁহার সাড়া পাইয়া দরজা খুলিয়া দিল।
নিস্তব্ধ বাড়ি। সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সিঁড়িতে আলো জ্বালিতে গিয়া হঠাৎ প্রণবেশ বাধা পাইলেন-কাহার গায়ে তাঁহার হাত ঠেকিল।
প্রণবেশ চিৎকার করিয়া উঠিলেন-”কে?”
সেই চিৎকারে পার্শ্ববর্তী কক্ষে কৃষ্ণার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল, ত্রস্তে দেয়ালের আলো জ্বালিয়া সে দরজা খুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ”কি হয়েছে, মামা?”
প্রণবেশ আলো পাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে উঠিয়া পড়িলেন, বলিলেন, ”কে জানি অন্ধকারে ঘুরছে, তার গায়ে আমার হাত লাগল।”
কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি ফিরিয় টেবিলের উপর হইতে রিভলভার ও টর্চটা তুলিয়া লইয়া বলিল, ”দরোয়ানকে ডাকলে না কেন?”
সাহস পাইয়া প্রণবেশ চিৎকার আরম্ভ করিলেন, ”হনুমান সিং?…ভজুয়া? …বনমালী?…ইধার আও জলদি…”
সে চিৎকারে সকলেরই ঘুম ভাঙিয়া গেল-আতি-পাতি করিয়া বাড়ি খোঁজা হইল-কাহারও সাড়াশব্দ মিলিল না।
সকলেই যে যাহার ঘরে চলিয়া গেল, প্রণবেশও নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। কৃষ্ণা নিজের ঘরে শুইতে যাইবার সময় পিতার ঘরে উঁকি দিয়া দেখিল-তিনি তখনও চুপ করিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া আছেন।
কৃষ্ণার সাড়া পাইয়াই তিনি চমকাইয়া উঠিলেন, ”কে-কৃষ্ণা? এখনও শুতে যাওনি মা?”
কৃষ্ণা বলিল, ”যাচ্ছি বাবা, আপনি এখনও বসে আছেন কেন, শুয়ে পড়ুন, রাত জাগলে আবার অসুখ হবে যে!”
মিঃ চৌধুরি মলিন হাসিয়া বলিলেন, ”অসুখের ভাবনার চেয়ে অন্য ভাবনা আমায় অস্থির করে তুলেছে, মা! তার দূত এসেছিল, জানলা দিয়ে পত্র ফেলে দিয়ে গেছে, এই দেখ সেই পত্র।”
টেবিলের উপর একখানা পত্রে সামান্য কয় লাইন লেখা। কৃষ্ণা পড়িল, তাহাতে লেখা আছে :
প্রিয় চৌধুরি-
ভিন্ন নামে এলেও আমার চোখ এড়াওনি। আমি তোমার কাছে-কাছেই আছি। পুলিশে খবর দিলেও তোমার নিস্তার নেই। নিজে তুমি পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট এবং তোমার বাড়ি অহোরাত্র পুলিশ-বেষ্টিত থেকেও আমার কাজের নিদর্শন তুমি কিছুদিন আগে বর্মায় থাকতে পেয়েছ। আমি তোমার কাছে আরও জিনিস চাই, কেবল বুদ্ধদেবের খড়ম-ই তুমি আনোনি, একটা নকশা ও একটা প্রতিলিপি এনেছ। সেটা কোথায় রেখেছ, জানিনে। পত্র পাঠ সেই নকশা ও প্রতিলিপি আর কুড়ি হাজার টাকা তোমার বাড়ির শিউলিফুলের গাছতলায় রাখবে। চব্বিশ ঘণ্টার সময় দিচ্ছি, যদি এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এগুলো পাই তাহলে তোমার মেয়ের জীবন আপাতত নিরাপদ হবে-এই বুঝে কাজ করো।
পুলিশে খবর দিলেও তারা যে আমার এতটুকু অনিষ্ট করতে পারবে না, সে প্রমাণ তুমি অনেকবার পেয়েছ, কাজেই সে চেষ্টা করো না-
তোমার-ইউ-উইন
কৃষ্ণা পিতার দিকে চাহিয়া দেখিল, তিনি দুই হাতে মুখ ঢাকিয়াছেন।
ছয়
মিঃ চৌধুরি ড্রয়ার খুলিয়া কতকগুলা কাগজপত্র বাহির করিয়া দেখিতেছিলেন। এই কয়দিনেই তিনি অত্যন্ত শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছেন, চোখের নীচে তাঁহার কালি পড়িয়া গিয়াছে।
প্রণবেশ পরদা সরাইয়া একবার উঁকি দিলেন, বলিলেন, ”ভেতরে যাব?”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”এস।”
প্রণবেশ প্রবেশ করিয়া মিঃ চৌধুরির নিকটে একখানা চেয়ারে বসিলেন।
মিঃ চৌধুরি মুখ তুলিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, ”কোনো দরকার আছে এখানে?”
মাথা চুলকাইয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”দরকার? হ্যাঁ, তা একটু আছে বইকি।”
কাগজপত্রগুলা সরাইয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”বল।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”আমি আপনাকে ইউ-উইনের সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলতে চাচ্ছি।”
জিজ্ঞাসুনেত্রে মিঃ চৌধুরি প্রণবেশের পানে তাকাইয়া রহিলেন।
প্রণবেশ বলিলেন, ”আপনাকে বলা দরকার বলেই আমি বলছি। কাল সন্ধ্যায় গড়ের মাঠে যখন বেড়াতে গেছলুম, তখন হঠাৎ একটি ইউরোপিয়ানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে যায়।”
মিঃ চৌধুরি কেবলমাত্র বলিলেন, ”হুঁ-”
প্রণবেশ বলিতে লাগিলেন, ”সে নাকি অনেককাল বর্মায় ছিল, আপনাকে সে বেশ চেনে। আপনার প্রসঙ্গ নিয়ে সে অনেক গল্প করলে। দেখলুম, আমার যা জানা নেই, তার তাও জানা আছে।”
মিঃ চৌধুরি একটু হাসিলেন, বলিলেন, ”তার নামটা তুমি নিশ্চয়ই জেনে নিয়েছ?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”হ্যাঁ, তার নাম রবার্টসন-আপনি নাকি তার নাম শুনলেই চিনতে পারবেন।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”ইউরোপিয়ানের নাম করবামাত্রই আমি চিনেছি। যাক, আমার সম্বন্ধে সে অনেক কথা তাহলে তোমায় বলেছে। ইউ-উইনের সম্বন্ধে কিছু বলেনি?”
উৎসাহিত হইয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”বলেছে বইকি! ইউ-উইন এককালে নাকি তার বাপ মিঃ ব্রুসের কাছে কাজ করত; মিঃ ব্রুসের ফার্মে সে ম্যানেজার ছিল। তারপর হাজার পঞ্চাশেক টাকা আত্মসাৎ করে সে গা-ঢাকা দেয়।”
মিঃ চৌধুরি মাথা দুলাইলেন, বলিলেন, ”ওইখানেই ভুল হয়েছে প্রণবেশ; ব্রহ্মদেশের এক পুরাতন রাজবংশে ইউ-উইনের জন্ম, তার রক্তে বংশমর্যাদার গর্ব রয়েছে, অত সহজে সে কারও কাছে দাসত্ব স্বীকার করবে না। তারপরে ইউ-উইনের পিতা বার্মিজ হলেও, তার মা ছিল ইউরোপিয়ান মহিলা, আর ইউ-উইনের বেশির ভাগ সময় কাটত ইউরোপে, বর্মা অঞ্চলে সে খুব কমই থাকত। কাজেই, আমি বলতে পারি, ইউ-উইন কোনোদিনই চাকরি করেনি,-তা ছাড়া তার অর্থের অসঙ্কুলতা কোনোদিনই ছিল না বলেই আমার বিশ্বাস। যাক, তারপর তোমার রবার্টসন আর কি বললে, শুনি।”
প্রণবেশ আবার মাথা চুলকাইলেন।
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”মাথা চুলকানো তোমার একটা মুদ্রাদোষ হলেও, লোকে বলবে তুমি বোকা। কারণ, মাথা চুলকোনো বোকার চিহ্ন বলেই খ্যাত।”
প্রণবেশ লজ্জিতমুখে বলিলেন, ”রবার্টসন বলছিল, ইউ-উইন নাকি তাকে বন্দী করেছিল, একটি বছর পরে সে একদিন লুকিয়ে পালিয়েছে,-সেই থেকে সে আর বর্মায় যায়নি।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”এইবার আমার কথা শোনো-আসল কথা। সে আমার এখানকার অবস্থা, আমার এখানকার বাড়ি সম্বন্ধে তোমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছে তো?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”হ্যাঁ।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”তুমি নিশ্চয়ই কিচ্ছুই গোপন করোনি? আমার বাড়িতে ক’জন লোক, দরোয়ান-চাকর ক’জন, কি করে দিন যায় ইত্যাদি অনেক প্রশ্নই সে করেছে, আর তুমিও তোমার এক ঘণ্টার আলাপী বন্ধুকে সব কথা বলেছ। সাহেব মানুষ, তোমার মতো কালা-আদমির সঙ্গে এতটা মেলা-মেশা করেছে, কাজেই তুমি হাত বাড়িয়ে স্বর্গ পেয়েছ, কেমন?”
প্রণবেশ নীরব।
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”আমি তোমার বন্ধুর কথা শুনেই বুঝেছি, প্রণব। তুমি ভেবেছিলে, ইউ-উইনের সম্পর্কে আর কয়েকটা কথা আমায় জানিয়ে আমায় আশ্চর্য করে দেবে। আমি কিন্তু তোমার চেয়ে অনেক বেশি জানি। তোমায় আগেই বলে রাখছি, সেই ইউরোপিয়ানটিই হচ্ছে-ইউ-উইন।”
প্রণবেশ বিস্ফারিত চোখে মিঃ চৌধুরির পানে চাহিলেন,-অস্ফুটকণ্ঠে একটিমাত্র শব্দ শুনা গেল-”ইউ-উইন!!”
দৃঢ়কণ্ঠে মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”হ্যাঁ ইউ-উইন। যে কোনো রকমেই হোক, বাড়ির সমস্ত খবর তার চাই! সেইজন্যে সে নিজেই চেষ্টা করে তোমার সঙ্গে আলাপ করে অনেক কিছু খবর সংগ্রহ করেছে। তোমার কাছে কিছু জানতে না পারলেও সে যে কোনো রকমে এ সব খবর নিতই, কাজেই তোমার এতে অত সঙ্কুচিত হয়ে ওঠবার কারণ নেই, প্রণব।”
প্রণবেশ মাথা নত করিয়াছিলেন, এখন মাথা তুলিলেন, অনুতপ্ত সুরে বলিলেন, ”আমি সত্যিই বোকামি করেছি চৌধুরিমশাই, এর জন্যে আমি সত্যিই অনুতপ্ত হচ্ছি। আমি আপনার মুখে শুনেছি, ইউ-উইন বার্মিজ, কাজেই তার চেহারা সাধারণ বার্মিজদের মতো হবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল।”
বাধা দিয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে একেবারে খাঁটি ইউরোপিয়ানের মতো। তার চেহারায়, প্রকৃতিতে, শিক্ষায় আর আচারে-ব্যবহারে কেউ বুঝতে পারবে না যে, সে ইউরোপিয়ান নয়।”
প্রণবেশ খানিক চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ”আর একটা কথা বলতে চাই; আমার এক বন্ধু সমরেশের সঙ্গে দেখা হল, সে বললে, তারই বড়ভাই নাকি বিখ্যাত ডিটেকটিভ, তাঁর নাম বললেই যে কোনো লোক চিনবে, আপনিও চিনবেন। আমি ভাবছি, যদি তাঁকে এইসব তদন্তের ভার দেওয়া হয়-”
ব্যগ্রভাবে মিঃ চৌধুরী বলিলেন, ”তার নামটা কি বল দেখি?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”সমরেশের দাদার নাম-ব্যোমকেশবাবু। তিনি নাকি আপনার সঙ্গে কাজ করেছিলেন।”
”ব্যোমকেশ?…অ্যাঁ! সে এখানে আছে নাকি?”
মিঃ চৌধুরি চঞ্চল হইয়া উঠিলেন-বলিলেন, ”তবে যে তার এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলুম, সে এখানে থাকে না?”
প্রণবেশ গর্বিতভাবে বলিলেন, ”এখানেই থাকেন, পুলিশে তাঁর ভয়ানক নাম, ভয়ানক প্রতিপত্তি। যেখানে যার যে কাজ পড়ে, ব্যোমকেশবাবুই সব করে দেন। আপনি যদি বলেন চৌধুরিমশাই, আমি তাঁকে খবর দিতে পারি।”
মিঃ চৌধুরি তৎক্ষণাৎ রাজি হইলেন।
প্রফুল্লমুখে প্রণবেশ বাহির হইতেই দেখিলেন, কৃষ্ণা দাঁড়াইয়া আছে। মাতুলকে দেখিয়া একটু হাসিয়া কৃষ্ণা বলিল, ”তুমি তোমার বিশেষ বুদ্ধির পরিচয় সব-জায়গায় আর দিও না মামা-”
রাগ করিয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”তার মানে?”
কৃষ্ণা বলিল, ”এই তো শুনলুম, তুমি নাকি ইউ-উইনের কাছে বাড়ির সব বলে এসেছ। বাবা ঠিক কথা বলেছেন, সাদা মুখ দেখে তুমি ভুলে গিয়েছিলে, কেমন?”
প্রণবেশ ঝাঁজিয়া উঠিলেন, ”চুপ কর কৃষ্ণা, লুকিয়ে লুকিয়ে কারও কথা শোনা অত্যন্ত খারাপ তা জান? তোমার উচিত হয়নি, এরকমভাবে লুকিয়ে করেও কথা শোনা, সে হোক-না কেন বাবা আর মামা!”
কৃষ্ণা আগাইয়া আসিল, বলিল, ”রাগ কোরো না মামা, তোমায় ভালো কথাই বলছি, আবার ব্যোমকেশ নাম নিয়ে কোনো লোক তোমায় না ঠকায়, আমি তাই ভাবছি।”
রাগ করিয়া প্রণবেশ দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন। কৃষ্ণা তাঁহার গমনপথের দিকে চাহিয়া একটু হাসিল মাত্র।
সাত
দীর্ঘকাল এক বাড়িতে বন্ধ হইয়া থাকিতেও বিরক্তি বোধ হয়। মিঃ চৌধুরি তাই সেদিন বেড়াইতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন।
উৎসাহিত কৃষ্ণা বলিল, ”বোটানিক্যাল-গার্ডেন দেখা হয়নি বাবা, চলুন না, আজ ওইটেই দেখে আসা যাক।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”ওদিকটা বড় নিরালা, মানুষজন বড় কম-”
কৃষ্ণা বলিল, ”গাছপালা অনেক আছে, আর তুমি তো সঙ্গে থাকবে মামা, তোমার এম-এসসিতে তো বোটানিই ছিল। তোমার না হয়, বোটানিক্যাল-গার্ডেন দেখে অরুচি ধরে গেছে, আমার তো মোটে দেখাই হয়নি। তুমি সঙ্গে চল, সবগুলো দেখাবে, বুঝিয়েও দেবে।”
মিঃ চৌধুরিও কৃষ্ণার কথায় মত দিলেন, বলিলেন, ”জনতার গোলমালের চেয়ে, নিরালা জায়গাটাই আমার কাছে ভালো মনে হয় প্রণব, শিবপুরেই যাওয়া যাক চল।”
তাড়াতাড়ি চা পান শেষ করিয়া পিতা-পুত্রী এবং প্রণবেশ বাহির হইলেন। প্রণবেশ একখানা ট্যাক্সি যাওয়া-আসা ভাড়া ঠিক করিয়া আনিয়াছিলেন, কৃষ্ণা মহানন্দে সকলের আগেই তাহাতে উঠিয়া বসিল।
শান্ত বোটানিক্যাল-গার্ডেন।
জনতা নাই গোলমাল নাই-পাখির গানে মুখর; পাশ দিয়া গঙ্গা বহিয়া চলিয়াছে, তাহার বুকে কত নৌকা-কত স্টিমার! কৃষ্ণা যেন নবজীবন ফিরিয়া পাইল। তাহার চঞ্চলতা দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ চৌধুরিও অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিলেন।
খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক বেড়াইয়া তিনি একটি বেঞ্চে বসিলেন, ”তুমি কৃষ্ণাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে এস প্রণব। ওকে সব গাছপালা চিনিয়ে দিও, শেখবার ঝোঁক ওর বড় বেশি কিনা-”
প্রণবেশ ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ”আপনি এখানে একা থাকবেন, চৌধুরিমশাই?”
কথাটা কৃষ্ণার মনেও লাগিল, সে বলিল, ”সত্যি বাবা, আমাদের না যাওয়াই উচিত। ‘লেড-ল’র দোকানের কথা মনে করুন-আমাদের অনুসরণ করে সেখানে যে যেতে পেরেছে, সে কি এখানেও অনুসরণ করে আসতে পারে না?”
ইতস্তত চারিদিকে চাহিয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”এদিকে যারা চলাফেরা করছে তারা সবই স্টুডেন্ট, নিজেদের দরকারে তারা এসেছে; তাছাড়া আর কোনো লোককেই তো দেখা যাচ্ছে না। তোমাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই, অনায়াসে যেতে পার।”
তারপর ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন, ”যেখানেই যাও, এখন পাঁচটা বাজল; ঠিক ছটায় এখানে এস, আমরা সওয়া-ছটায় এখান হতে রওনা হব।”
সত্যই সন্দেহ করিবার মতো কোনো লোককেই দেখা গেল না। কৃষ্ণা যাইবার সময় পিতাকে বার বার বলিয়া গেল, ”আপনি যেন কোথাও যাবেন না, আমরা এখানে এসে যেন আপনাকে পাই।”
কৃষ্ণার উৎকণ্ঠায় পিতার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল, তিনি তাহার হাতখানা টানিয়া লইয়া সস্নেহে বলিলেন, ”ভয় নেই পাগল মেয়ে, আমি ঠিক এখানেই থাকব।”
কৃষ্ণা নিশ্চিন্ত হইয়া প্রণবেশের সঙ্গে আগাইয়া চলিল।
আই-এসসি, বি-এসসি এবং এম-এসসি এই ছয়টা বৎসর বোটানিক্যাল-গার্ডেনে আসা-যাওয়া করিয়া এবং গাছ-লতাপাতা নাড়াচাড়া করিয়া ওই সবের উপরে প্রণবেশের যে দারুণ বিতৃষ্ণা জাগিয়াছে, এই কথাটাই প্রণবেশ কমপক্ষে একশত বার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া কৃষ্ণাকে জানাইলেন।
অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়া কৃষ্ণা বলিল, ”কথাটা ভালো করে আগে বললেই হত মামা, যে, বোটানিক্যাল-গার্ডেনের চেয়ে ‘জুতে’ যাওয়া তুমি বেশি পছন্দ কর-অতএব সেইখানেই চল।”
প্রণবেশ কেবল গোঁ-গোঁ করিলেন, আর একটি কথাও বলিলেন না।
সব বাগানটা বেড়ানো হইয়া উঠিল না, সব গাছের পরিচয়ও পাওয়া গেল না; হাতের ঘড়িতে ছয়টা বাজে দেখিয়া কৃষ্ণা চঞ্চল হইয়া উঠিল; বলিল, ”চল মামা, এবার ফেরা যাক।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”ওদিকটা দেখে গেলে হত,-ওদিকে আছে গ্র্যামিনেসি জাতীয় গাছ-”
বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বলিল, ”থাক, যা দেখেছি তাই ঢের হয়েছে। গ্র্যামিনেসি আজ যাক, অন্যদিন বরং দেখা যাবে। ছটা বাজে, সন্ধে হয়ে আসছে দেখছ না? বাবা আমাদের ছটার মধ্যে ফেরবার কথা বলে দিয়েছেন।”
প্রণবেশ ফিরিলেন।
শীতের দিনে ছয়টা। ইহারই মধ্যে পাতলা-অন্ধকার ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সকাল হইতেই আকাশে ফিকে পাতলা মেঘ জমিয়াছিল। সে মেঘ এখন বেশ ঘন হইয়া সারা আকাশ ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। কাজেই, আকাশে নক্ষত্র উঠিবার সম্ভাবনা ছিল না। মিঃ চৌধুরি যেখানে বসিয়া ছিলেন সে বেঞ্চ শূন্য…!!
কৃষ্ণা ভয় পাইল, উচ্চকণ্ঠে ডাকিতে লাগিল, ”বাবা! বাবা!”
প্রণবেশও ডাকিতে লাগিলেন, ”চৌধুরিমশাই-আমরা এসেছি, এদিকে আসুন।”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
কৃষ্ণা স্তম্ভিত হইয়া গেল-প্রণবেশও তাই।
মুহূর্তমধ্যে কৃষ্ণার স্তম্ভিতভাব কাটিয়া গেল-বলিল, ”এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো ফল হবে না মামা, এস, চারিদিক দেখতে হবে, সকলকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।”
সে দ্রুতপদে ছুটিল।
পিছনে-পিছনে চলিতে-চলিতে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে প্রণবেশ বলিতেছিলেন, ”আমি তখনই বারণ করেছিলুম-এই জনমানবহীন বাগান, এখানে কেবল গাছপালা দেখতে নাকি মানুষ আসে! এখানে জিজ্ঞাসা করব কাকে আর খুঁজবই বা কোথায় বল দেখি?”
কৃষ্ণা তাঁহার কথার কোনো উত্তর দেয় নাই। সামনেই দুইজন হিন্দুস্থানিকে দেখিয়া সে দাঁড়াইল, হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করিল, ”এদিকে একজন ভদ্রলোককে তোমরা দেখেছ, তাঁর গায়ে শাল জড়ানো আছে-গলায় মফলার জড়ানো?”
এক ব্যক্তি মাথা নাড়িল, জানাইল সে দেখে নাই। হতাশভাবে কৃষ্ণা অন্যদিকে যাইতেছিল, প্রণবেশের আহ্বান শুনিয়া ফিরিল। প্রণবেশ বলিলেন, ”এই লোকটি দেখেছে কৃষ্ণা! চৌধুরিমশাই নাকি একজন লোকের সঙ্গে খুব ব্যস্তভাবে গঙ্গার দিকে গেছেন।”
”লোকের সঙ্গে…ব্যস্তভাবে?”…
কৃষ্ণার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল-”ইউ-উইন নয় তো?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”না-না, ইউ-উইন নয়, বার্মিজ বা ইউরোপিয়ানও নয়, একজন ধুতি-চাদর-পরা বাবুর সঙ্গে গেছেন বলছে!”
”ধুতি-চাদর-পরা বাবু?”
কৃষ্ণা অগ্রসর হইল-”এস মামা”…
সংবাদ-দাতাকে কিছু বকশিস দিয়া প্রণবেশ কৃষ্ণার সহিত চলিলেন।
ঘাটের পাশেই একখানা নৌকা বাঁধা-সেই নৌকার মধ্যে মিঃ চৌধুরির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর একবার মাত্র কানে আসিল, পরমুহূর্তে ক্ষুদ্র নৌকার মধ্যে একটা হুটাপুটি শব্দ পাওয়া গেল।
”বাবা!…বাবা!”
কৃষ্ণা চিৎকার করিল, সঙ্গে সঙ্গে প্রণবেশও চিৎকার করিতে লাগিলেন, ”ভয় নেই চৌধুরিমশাই, আমরা এসেছি।”
দেখিতে দেখিতে ঘাটের উপর লোক জমিয়া গেল। নৌকার মাঝি গোলমালের মধ্যে নৌকা ছাড়িবার চেষ্টা করিতেই কৃষ্ণা গর্জিয়া উঠিল,-”এই!…রোখো!”
মাঝি গ্রাহ্য না করিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিতেই প্রণবেশ অকস্মাৎ সেই দারুণ শীতে গঙ্গার জলে লাফাইয়া পড়িলেন এবং ক্ষুদ্র নৌকাকে ধরিলেন। মাঝি তাঁহাকে মারিবার জন্য দাঁড় তুলিয়াছিল মাত্র,-সেই মুহূর্তে কৃষ্ণার হাতের রিভলভার হইতে শব্দ হইল-গুড়ুম!
অব্যর্থ লক্ষ্যে গুলি মাঝির হাতে বিদ্ধ হইতেই তাহার হাতের দাঁড় পড়িয়া গেল।
নৌকা ধরিতে আরও পাঁচ-সাতজন লাফাইয়া জলে পড়িল-নৌকা টানিয়া ঘাটে আনিবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা নৌকায় উঠিয়া পড়িল।
ছইয়ের মধ্যে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়িয়া আছেন মিঃ চৌধুরি।
ক্ষিপ্রহস্তে কৃষ্ণা তাঁহার মুখের ও হাত-পায়ের বাঁধন খুলিয়া দিল, কম্পিতকণ্ঠে ডাকিল-”বাবা!”
”মা!…কৃষ্ণা!”…
মিঃ চৌধুরি কন্যার মাথাটা বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিলেন। তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হইতে কৃষ্ণা ও প্রণবেশ তাঁহাকে নৌকা হইতে নামাইয়া লইলেন।
বোটানিক্যাল-গার্ডেনে অনেক লোকই আসিয়া জুটিয়াছিল-মাঝিকে সেই মুহূর্তে পুলিশের হাতে দেওয়া হইল। সে কাঁদিয়া বলিতেছিল, ”আমি কিছু জানিনে হুজুর, আমাকে সেই বাবু পঞ্চাশ টাকা দেবে বলেছিল-গরিব মানুষ হুজুর, সেইজন্যেই রাজি হয়েছিলুম।”
পুলিশ তাহাকে ধমক দিয়া লইয়া গেল। যাইবার সময় মিঃ চৌধুরির নাম ও ঠিকানা লইয়া গেল, দাঁড়িদেরও তাহারা ছাড়িয়া দিল না, লইয়া গেল।
মোটরে উঠিয়া কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি আমাদের আসতে বলে নৌকোয় কেন গেলেন, বাবা?”
শুষ্ক হাসিয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”কর্মভোগ ছাড়া আর কি! দিব্যি বসে ছিলুম, হঠাৎ মনে হল, গঙ্গার ধারের দিকে কে যেন চিৎকার করে উঠল-কণ্ঠস্বরটা তোমার মতোই মনে হল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গঙ্গার দিকে যাচ্ছি, এমন সময় একজন হিন্দুস্থানি-ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে বললেন, ‘আপনি শীগগির আসুন, কয়েকজন লোক একটি মেয়েকে ধরে নৌকোয় তুলছে। আমি একা, তাই লোক ডাকতে এসেছি।’ শুনেই আমি ছুটলুম। নৌকোটা ঘাটেই ছিল-আগুপিছু না ভেবে-প্রণবেশ কোথায় গেল তা না চিন্তা করেই আমি নৌকোয় উঠে পড়লুম। যেই না নৌকোয় ওঠা, সেই সময়ই চার-পাঁচজন লোক আমায় চেপে ধরলে। সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার মুখ-হাত-পা বেঁধে ফেললে।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”নৌকোয় মাঝি আর দাঁড়িরা ছাড়া আর তো কেউ ছিল না দেখলুম।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”যেসময় ঘাটের লোকেরা নৌকো ধরবার জন্যে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, সেইসময় তারাও নৌকো হতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়েছে।”
কৃষ্ণা প্রণবেশের পানে ফিরিয়া বলিল, ”আর দেরি নয় মামা, তুমি কালই ব্যোমকেশবাবুকে নিয়ে এসো। এসব ইউ-উইনের দলের লোক, ওদের দলে সব দেশেরই লোক আছে দেখা যাচ্ছে। বাবাকে বন্দী বা হত্যা করাই ওদের মতলব-কাজেই বাবার এখন আর কোথাও যাওয়া চলবে না।”
মিঃ চৌধুরি কেবল হাসিবার চেষ্টা করিলেন মাত্র।
আট
ব্যোমকেশবাবু মিঃ চৌধুরির পুরাতন বন্ধু। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন-বেশ নামও করিয়াছেন।
মিঃ চৌধুরি তাঁহাকে সব কথা বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু গম্ভীরভাবে কেবল মাথা দুলাইলেন। বলিলেন, ”আজই টাকা, নকশা আর সেই প্রতিলিপি দেওয়ার কথা আছে, না?”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”হ্যাঁ কালকের পত্রে তাই লেখা আছে, এই দেখ।”
পত্রখানা তিনি ব্যোমকেশবাবুর হাতে দিলেন।
পাঠান্তে সেখানা ফিরাইয়া দিয়া ব্যোমকেশবাবু বলিলেন, ”বেশ তো, তোমার বার্মিজ-সর্দার তোমায় যেমন ভয় দেখিয়েছে, তুমিও তাকে এই শুভ অবসরে ধরতে পার! রাত্রের দিকে কয়েকজন কনেস্টেবলকে এদিক-ওদিক লুকিয়ে রাখলেই চলবে, আমি নিজেও থাকব-আজই তাকে গ্রেপ্তার করব দেখ!”
মিঃ চৌধুরি শুষ্কমুখে বলিলেন, ”তুমি তাকে চেন না ব্যোমকেশ, তাই মনে করছ সে নিজেই আসবে, আর একাই আসবে, তুমি অতি সহজেই তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। তুমি দেখ, ইউ-উইন নিজে কখনও আসবে না, তার কোনো সহচরকে হয়তো পাঠাতে পারে, কিন্তু এরকম তোড়জোড় দেখলে কাউকেই পাঠাবে না।”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”তবে তুমি কি বল, আমি তাকে ধরবার কোনও উদ্যোগ-আয়োজন করব না, তুমি তাকে তাকে প্রার্থিত সব কিছু দেবে?”
হতাশ সুরে মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”দেব কি করে বল? কুড়ি হাজার টাকা দেওয়া কি বড় মুখের কথা? তবে তুমি যে বিরাট আয়োজন করছ তা ব্যর্থ হবে একথা আমি বেশ জানি বলেই বলছি! আমি তাকে বেশ চিনি, কতবার যে সে আমাকে ঘোল খাইয়েছে তার ঠিক নেই! কেবল আমাকেই বা বলি কেন, আমাদের সাহেবকে একদিন সে যা নাকাল করেছে তা শুনলে-”
ব্যোমকেশ বিকৃতমুখে হাসিলেন, বলিলেন, ”বর্মায় বার্মিজ-দস্যুর বীরত্ব যতটা চলে, এখানে তা চলবে না তা তুমি দেখে নিও। আমি আজ রাত্রেই যে করে হোক তাকে ধরব তুমি দেখতে পাবে নিজের চোখে।”
তিনি ব্যবস্থা করিবার জন্য তখনই বাহির হইয়া গেলেন।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”নকশার কথা ইউ-উইন লিখেছে আপনি কাকাবাবুকে বললেন-কিসের নকশা, বাবা? এ নকশার কথা তো কিছু বলেননি!”
একটা নিশ্বাস ফেরিয়া মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”না, কারণ, সেটা আমার কোনো কাজে লাগবে না। একজনকে দেওয়ার জন্যে এনেছি। বর্মার ইয়াং চাংকে চেনো না, তিনি বিখ্যাত ধনকুবের,-ইউ-উইন তাঁরই সম্পর্কীয় ভাইপো হয়। বংশপরম্পরায় এঁদের মধ্যে বিবাদ চলছে, ইউ-উইনের ভয়েই ইয়াং চাং বর্মা ত্যাগ করে কলকাতাবাসী হয়ে আজ পনেরো বছর কাটাচ্ছেন। এই নকশাটা শুনেছি এঁদের পূর্বপুরুষের কোনো গুপ্ত ধনাগারের। নকশাটা ইয়াং চাংয়ের এক বিশ্বস্ত অনুচরের কাছে ছিল। এই নকশার জন্যে ইউ-উইন তাকে উৎপীড়ন বড় কম করেনি। তাকে বন্দী করে রেখেছিল, তার স্ত্রী-পুত্র সকলকে হত্যা করেছিল, তবুও নকশা সে পায়নি। আমি সন্ধান পেয়ে একটা বাড়ি হতে সেই বৃদ্ধকে উদ্ধার করি। বৃদ্ধের যে বাড়ি ইউ-উইন পুড়িয়ে দিয়েছিল, এই নকশাটা সেই বাড়ির এক জায়গায় প্রায় পাঁচ হাত মাটির তলায় একটা মাটির কলসির মধ্যে হাতির দাঁতের বাক্সে বন্ধ ছিল।”
কৃষ্ণার কৌতূহল উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিতেছিল, বলিল, ”তারপর কি হল, বাবা?”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”বৃদ্ধ আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেয়, সেই নকশা উদ্ধার করে যেমন করেই হোক তার মনিবের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমি সেই নকশা খুঁজতে গিয়ে ওই প্রতিলিপিও পাই কিন্তু ওখানা ইয়াং চাংকে দেওয়ার কথা নেই বলে আমি মনে করেছি, ওখানা এখানকার মিউজিয়ামে দেব। সেই খড়ম-জোড়াটা-হ্যাঁ, পত্র পড়ে জানতে পেরেছ কৃষ্ণা, যে, খড়ম সত্যিই জাহাজে ছিল, ওখান হতে ওরাই নিয়েছে। তোমার যে স্বপ্ন নয়, আমারও যে জ্বরের ভুল নয়, ইউ-উইনের লোক সত্যিই সেখান হতে নিয়ে গেছে। শয়তান সে-সব পারে, তার কাছে কিছু অসম্ভব নয়-বুঝলে তো?”
কৃষ্ণা বলিল, ”এখন বুঝছি বাবা-সত্যিই সেখান থেকে কেউ নিয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, সেই অথই-সমুদ্রে জাহাজ যখন ভেসে চলেছে, তখন জল হতে দশ-বারো হাত ওপরে সে উঠল কি করে।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”তুমি মনে কর কৃষ্ণা, জাহাজ যে সময় আস্তে চলছিল, আমরা বন্দরের কাছে পৌঁছেছিলুম; সেই সময় জাহাজের নীচে নৌকো রেখে সেখান হতে কৌশলে দড়ি বা সিঁড়ি বেয়ে যে কোনো মানুষের পক্ষে ওপরে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর ইউ-উইনের বা তার দলের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব। তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পাহাড়ে লাফ খায়, সমুদ্র সাঁতার দিয়ে পার হয়ে যায়। জল তো দূরের কথা, মরণকে নিয়ে ওরা ছিনিমিনি খেলে।”
মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া চাপা সুরে তিনি বলিলেন, ”সে নকশা আর প্রতিলিপি আমি আমার এই দেয়ালের মধ্যে এক গোপন কুঠরি আছে, তাতে বন্ধ করে রেখেছি। বাইরে থেকে দেখে কেউ জানতে পারবে না। এই দেয়ালের খানিকটা ফাঁপা আছে, তাতে অনেক কিছু রাখা চলে। আমার বাবা যখন এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন, তখনকার তৈরি এই কুঠরি, রামকান্ত মিস্ত্রি তৈরি করেছিল। এখন সেও বর্তমান নেই। কাজেই, এর কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।”
কৃষ্ণা বলিল, ”রামকান্তের ছেলেরা জানতে পারে।”
মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”রামকান্ত নিঃসন্তান ছিল, সেইজন্যে এর কথা বাইরের আর কেউ জানে না-খোঁজও পাবে না। তুমি এর কথা জান না কৃষ্ণা, এটা তোমায় দেখিয়ে রাখি, খোলা-দেওয়ার কৌশলটাও শিখে রাখ। মানুষের শরীরের কথা বলা যায় না; ধর, যদি হঠাৎ আজই আমার কিছু হয়-যে শত্রু শিয়রে দাঁড়িয়ে, তাকেও তো বিশ্বাস করা যায় না। দিনের বেলা দেখে রাখ, রাত্রে দেখা উচিত নয়।”
তিনি উঠিলেন।
দরজা অর্গলরুদ্ধ করিয়া পিতা ও কন্যা উভয়ে ড্রয়ারটাকে সরাইলেন। মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”দেখ, এই দেয়ালের দিকে লক্ষ করে দেখলে চুলের মতো একটি দাগ দেখা যাবে। এ-পাশে প্রায় সাত হাত দূরে এই যে পেরেকটি রয়েছে, এটা হচ্ছে এর যন্ত্র।” বলিতে বলিতে তিনি জানালার কপাটের পাশে অতি গোপনে অবস্থিত একটি পেরেক দেখাইলেন-বিশেষ জানা না থাকিলে কোনো লোকের দৃষ্টিপথে এটা পড়ে না। কৃষ্ণা সেই পেরেকটিতে চাপ দিতেই-সাত-আট হাত দূরে মিঃ চৌধুরি যে স্থানটা দেখাইয়াছিলেন সেখানে দেয়ালটা ফাঁক হইয়া গেল।
কৃষ্ণা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখিল, সেই ফাঁকের মধ্যে একটি আয়রণ-চেষ্ট আছে। মিঃ চৌধুরি বলিলেন, ”ওর চাবিটা বাঁ-দিকে আছে, গিয়ে খুলে দেখ-”
কৃষ্ণা আয়রণ-চেষ্ট খুলিল-
টাকাকড়ি, গহনাপত্র সরাইয়া তারপর সে তুলিল সেই প্রস্তর প্রতিলিপিখানি।
প্রতিলিপিতে একটি বৌদ্ধমূর্তি, তাহার নীচে কয়েক লাইন লেখা। কি ভাষায় লেখা আছে তাহা কৃষ্ণা পড়িতে পারিল না।
মিঃ চৌধুরি হস্তিদন্তের নির্মিত একটি ছোট কৌটা বাহির করিলেন, বলিলেন, ”এরই মধ্যে সেই নকশা আছে। তুমি দেখতে পার কৃষ্ণা, কিন্তু দেখেও কিছু বুঝবে না। মোটামুটি স্থানটা আমি জেনে নিয়েছি, বৃদ্ধ বলে গেছে…সেখানে নাকি লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। বর্মার কোনো রাজার সম্পত্তি। কিন্তু লোকে বলে সেসব যক দেওয়া আছে। পুরুষানুক্রমে এই সব সম্পত্তির মালিক-ইয়াং চাং। আমি নকশা ইয়াং চাংকে দিলে সে আমায় পাঁচ লক্ষ টাকা দেবে স্বীকার করেছে। এই কয়দিন এখানে এসে এমন বিব্রত হয়ে পড়েছি যে, তাকে একটা খবরও পাঠাতে পারিনি। আজ রাতটা গেলে কাল তাকে খবর দেব যাতে সে এসে তার নকশা নিয়ে যায়, আর আমাকে তার ঘোষণামতো পুরস্কার প্রদান করে।”
কৃষ্ণা নকশাটা নাড়াচাড়া করিয়া রাখিয়া দিল। পিতার নির্দেশমতো আয়রণ-চেষ্ট বন্ধ করিয়া দিয়া পেরেকটা একটু টিপিয়া দিতেই দেওয়াল যেমন পূর্বে ছিল সেইরূপ হইল।
নয়
গভীর রাত্রি-
ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে-কৃষ্ণার ঘুম ভাঙিয়া গেল।
বারান্দায় কি পড়িয়া গেছে, তাহারই ঝনঝনানিতে সে জাগিয়া উঠিয়াছে। মনে পড়িয়া গেল, আজই ইউ-উইন রাত বারোটার মধ্যে টাকা, প্রতিলিপি ও নকশা বাগানে রাখিবার কথা বলিয়াছে। ব্যোমকেশবাবু এই বৃষ্টির মধ্যে আছেন কি চলিয়া গেছেন তাই বা কে জানে!
ঠিক এমন সময় একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ চৌধুরির আহ্বান- ”প্রণবেশ? কৃষ্ণা? চৌবে? মিশির?”
”বাবা-”
কৃষ্ণা লাফ দিয়া বিছানা হইতে নামিয়া পড়িল, আলো জ্বালিয়া উপাধানের পাশ হইতে রিভলভারটা লইয়া ক্ষিপ্রহস্তে দরজা খুলিয়া ফেলিল।
সেই মুহূর্তে দরজার উপর দাঁড়াইয়া একজন লোক। হাতের রিভলভারটা কৃষ্ণার ললাটের উপর তুলিয়া ধরিয়া সগর্জনে সে বলিল, ”চুপ! এক পাও নড়ো না….”
হঠাৎ কৃষ্ণা যেন হতভম্ব হইয়া গেল! আততায়ীর হাতের রিভলভারের নলটা তাহার ললাট স্পর্শ করিয়াছে-এক-সেকেন্ডের মধ্যেই ললাট ভেদ করিয়া গুলি চালিয়া যাইবে।
পার্শ্ববর্তী পিতার কক্ষে দু-বার রিভলভারের শব্দ পাওয়া গেল-গুড়ুম-গুড়ুম….
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্যমনস্ক কৃষ্ণার হাত হইতে রিভলভারটা ছিনাইয়া লইয়া আততায়ী দস্যু কৃষ্ণার গলা চাপিয়া ধরিল।
বলবান শক্তিশালী পুরুষ, তথাপি কৃষ্ণা যতক্ষণ পারিল আত্মরক্ষার জন্য কিল-ঘুষি চালাইল। তারপর চেতনাহীন কৃষ্ণার দেহ ধরাতলে লুটাইয়া পড়িল।
সকালে যখন তাহার চেতনা ফিরিল তখন তাহার চারিদিকে অনেক লোক,- ইহাদের মধ্যে একজনকে মাত্র সে চেনে, তিনি ব্যোমকেশবাবু।
কৃষ্ণা একবার চক্ষু মেলিয়াই আবার চক্ষু মুদিল।
হাত দু-খানা অসাড়, পায়ের অবস্থাও প্রায় সেইরূপ। মনে হয়, হাত-পা ও মুখ বাঁধা ছিল, ইহারা খুলিয়া দিয়াছে।
কিন্তু কৃষ্ণার পিতা,-মিঃ চৌধুরি?
কৃষ্ণার মাথা হইতে পা পর্যন্ত বিদ্যুৎ চমকাইয়া গেল। সে ধড়ফড় করিয়া উঠিতে গেল-
ব্যোমকেশ বাধা দিলেন-”উঠো না, উঠো না! আর ঘণ্টাখানেক এইরকমই থাক,-ডাক্তার বার বার করে বারণ করেছেন, জ্ঞান হলেই যেন উঠতে না দেওয়া হয়।”
শুষ্ক হাসির রেখা মুখে ফুটাইয়া কৃষ্ণা বলিল, ”আমার কিছুই হয়নি কাকাবাবু, বেশ ভালো আছি! আমাকে উঠে বসতে দিন, আর শুয়ে থাকতে পারছিনে।”
ডাক্তার পাশেই ছিলেন, পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ”বিশেষ ভয়ের কারণ আর নেই, আপনি উঠে বসতে পারেন মিস চৌধুরি, তবে এখন আপনাকে বেড়াতে দেওয়া হবে না।”
কৃষ্ণা উঠিয়া বসিল।
হাত-পায়ের পানে তাকাইয়া বুঝিল-তাহাকে কেহ শক্ত দড়ি দিয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছিল। গলাতে দারুণ ব্যথা অনুভূত হইতেছিল, সেদিকে সে দৃকপাত করিল না, উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিল, ”আমার বাবা কেমন আছেন, কাকাবাবু? ও ঘরে গিয়েছিলেন? আপনি কখন এসেছেন, এত পুলিশ ডাকলে কে?”
ব্যোমকেশ উত্তর দিলেন, ”সব কথারই উত্তর দিচ্ছি মা-সব একে একে বলছি। কাল সারারাত জেগে ওই বাগানে বসে। চারজন কনেস্টবলও আমার সঙ্গে সমানে জেগেছে। কাল তেমনি কি বৃষ্টিও নামল। তোমাদের বাড়িতে যে এত কাণ্ড হয়ে গেল তার এতটুকু শব্দ পর্যন্ত পাইনি। আজ সকালে এ বাড়িতে এসে দেখি, সকলের ঘরে চাবি বন্ধ। দরোয়ান, চাকররা, প্রণবেশবাবু সব নিজের নিজের ঘরে চাবিবন্ধ অবস্থায় চিৎকার করছেন। তোমার ঘরে এসে দেখলুম, হাত-মুখ বাঁধা মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে আছো তুমি। থানায় খবর দিতে পুলিশ এসে পড়ল, যারা বন্ধ ছিল তাদের তালা ভেঙে বার করা হল-”
উদ্বিগ্নকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”আর আমার বাবা?”
ব্যোমকেশবাবু নিজের মাথার চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালাইতে চালাইতে বলিলেন, ”তাকে তুমি এখুনি দেখতে পাবে, কৃষ্ণা-”
কৃষ্ণা ব্যাকুল হইয়া বলিল, ”তিনি ভালো আছেন তো, কাকাবাবু? ইউ-উইন তাঁকে হত্যা করেনি তো? আমি কাল রাত্রে বাবার ঘরে দু-বার রিভলভারের আওয়াজ শুনেছি। আমি ছুটে যাচ্ছিলুম, সেই দস্যুটা আমার গলা টিপে ধরেছিল। বলুন, বলুন, আমার বাবা-তিনি কেমন আছেন?”
ব্যোমকেশ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিলেন, তারপর কৃষ্ণার পানে তাকাইয়া ধীরকণ্ঠে বলিলেন, ”আমি জানি কৃষ্ণা, যদিও তুমি বালিকা, সংসারের অনেক কিছুই তোমার অজ্ঞাত, তবুও তোমার শক্তি আছে, যাতে তুমি সকল দুঃখ-বেদনাকে জয় করতে পারবে। তোমার বাবা-”
তিনি থামিয়া গেলেন।
রুদ্ধকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিয়া উঠিল, ”আমি বুঝেছি, কাকাবাবু-বাবা আর নেই!”
দুই হাতের মধ্যে সে মুখ লুকাইল।
বালিকার জগতে একমাত্র আশ্রয়স্থল-পিতা। সেই পিতার শোচনীয় মৃত্যুতে তাহার অন্তরে যে কতখানি বেদনা লাগিল তাহা সহজেই অনুমেয়। ঘরে তখন ব্যোমকেশ ছাড়া আর কেহই ছিল না। কৃষ্ণা নিঃশব্দে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল, তারপর ব্যোমকেশের সঙ্গে কম্পিত দেহে কম্পিত পদে সে পিতার মৃতদেহ দেখিতে গেল।
পিতার ঘরের মেঝের উপর পড়িয়া আছে তাঁহার মৃতদেহ; একখানা চাদরে শবদেহ আচ্ছাদিত।
ব্যোমকেশ মৃতের আচ্ছাদন খুলিয়া দিলেন।
ছয় মাস আগে কৃষ্ণা মৃতা মায়ের যেমন বিস্ফোরিত চোখ দেখিয়াছিল, ছয় মাস পরে বাংলার রাজধানী কলিকাতায়, পিতার মুখেও সে সেই ভয়ার্ত ভাব দেখিল। সন্দেহাকুলচিত্তে সে নত হইয়া দেখিল-মায়ের কণ্ঠে যেমন একটা সূচাকৃতি ফলা বিদ্ধ হওয়ার দাগ ছিল, পিতার কণ্ঠের ঠিক সেই স্থানে তেমনই একটা সূক্ষ্ম দাগ।
কৃষ্ণা বদ্ধদৃষ্টিতে সেই ক্ষতচিহ্নের পানে তাকাইয়া রহিল।
কতটুকু সেই সূচ, কি তীব্র-বিষই তাহার মধ্যে ছিল, যাহাতে দশ মিনিটের মধ্যে অতি বলবান শক্তিশালী পুরুষও এভাবে মারা যায়!
পিতার হাতের কাছেই তাঁহার রিভলভারটা পড়িয়া আছে। হয়তো এই রিভলভারটা হইতে তিনি দুইবার গুলি ছুড়িয়াছিলেন, সে গুলি ব্যর্থ করিয়া আততায়ীর অব্যর্থ বিষাক্ত সূচই তাঁহার জীবন হরণ করিয়াছে।
কৃষ্ণা একবার ঘরের চারিদিকে চাহিল-সব এলোমেলো, বাক্স-ড্রয়ার সব খোলা, জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়ানো।
বেশ বুঝা গেল-কেহ ঘরে প্রবেশ করিয়া সব পাতি-পাতি করিয়া খুঁজিয়াছে। কি যে খুঁজিয়াছে তাহা কৃষ্ণার অজ্ঞাত নয়। সে সম্বন্ধে সে কোনো কথাই বলিল না।
দশ
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, ”তুমি এখন কি করবে কৃষ্ণা, কোনো মতলব ঠিক করেছ কি?”
কৃষ্ণা মুখ নত করিয়া কি ভাবিতেছিল, ব্যোমকেশের কথায় মুখ তুলিয়া বলিল, ”এখনও কিছু ঠিক করিনি কাকাবাবু, যা করব তা পরে জানাব। কিন্তু আপনারা বাবার হত্যাকারীকে ধরবার কিছু করলেন কি? কোনো সন্ধান পেলেন?”
ব্যোমকেশ গম্ভীর-হাসি হাসিয়া বলিলেন, ”কোনো ভাবনা নেই তোমার মা, এ তোমাদের বর্মা-পুলিশ নয়, ক্যালকাটা-পুলিশ, দু-চারদিনের মধ্যে হত্যাকারীকে ধরে তবে ছাড়বে। হত্যাকারী সামনেই আছে, যখন খুশি ধরলেই পারি, কেবল কয়েকটা প্রমাণের জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি। তুমি যদি বল, আমি এখনই তোমায় দেখাতে পারি কে হত্যা করেছে।”
মোটা সিগারেট ধরাইয়া দুই-এক টান দিয়া তিনি আবার বলিলেন, ”তুমি আর তোমার বাবা কত কল্পনাই করেছিলে-কোনো বার্মিজ ডাকাত নাকি তোমাদের অনুসরণ করে এসেছে, সে এখানে তোমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ফিরছে, তোমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে পত্র দিয়েছে। আমি কিন্তু তোমাদের বরাবরই বলে আসছি যে, বার্মিজ-টার্মিজ নয়, এ হচ্ছে খাঁটি ইন্ডিয়ানের কাজ। সে বিহারি হতে পারে, উড়িয়া হতে পারে, চাইকি বাঙালিও হতে পারে। আমার কথা সত্য কিনা দেখ, এবার মনে-প্রাণে বিশ্বাস কর।”
বিস্মিতকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”অপরাধী কে, তা জেনেও আপনারা কেবল কয়েকটা প্রমাণের অভাবে তাকে ধরেননি-তার মানে? লোকটা কে বলুন তো?”
ব্যোমকেশ বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়িলেন, বলিলেন, ”যখন ধরব তখুনি দেখতে পাবে, মা! মোট কথা, সে এই দেশেরই লোক, বার্মিজ-টার্মিজ নয়-ও-সব প্রতিলিপি- অনুলিপির কথাও নয়, কেবল ধাপ্পা দিয়ে তোমার বাবাকে লিখেছিল। আসল কথা-ভয় দেখানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, দেখ-সাত দিনের মধ্যে হত্যাকারী ধরা পড়বে।”
কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা বলা যত সহজ, কাজে তত নয়। কৃষ্ণা এতটুকুও নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না।
ব্যোমকেশবাবু হত্যাকারীকে ধরিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন, কিন্তু তিনি যে বৃথাই পরিশ্রম করিয়া যাইতেছেন, কৃষ্ণা তাহা জানে। ইউ-উইন নামে কোনো লোককে তিনি পাত্তা দিতে চান না। নির্দোষ কোনো লোকের ঘাড়ে এই বোঝাটা চাপাইয়া তিনি বাহাদুরি ও পুরস্কার লাভ করিতে চান। যে-সময় তিনি ভুল সিদ্ধান্ত লইয়া ভুল পথে ঘুরিবেন, সেই সময়ের মধ্যে আসল অপরাধী যথেষ্ট সাবধান হইতে পারিবে, এবং সেই ফাঁকে আবার কি নূতন ফ্যাসাদ বাধাইবে, কে জানে!
কৃষ্ণা হতাশ হইল না, নিজেই সে দাঁড়াইবে স্থির করিল।
পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া সে শপথ করিয়াছে, যেমন করিয়াই হোক, পিতা ও মাতার হত্যার প্রতিশোধ সে লইবেই, সে শপথ সে রক্ষা করিবেই। সে নিজে জানে, এ কাজ ইউ-উইন ছাড়া আর কাহারও নহে। সে রাত্রে ইউ-উইন নিজে আসিয়াছিল; সঙ্গে হয়তো তাহার অনুচরবৃন্দও ছিল। ব্যোমকেশবাবু সেই বৃষ্টি-ঝরা রাত্রে বাগানে বসিয়া ইউ-উইনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, জানিতে পারেন নাই সেই সময়ের মধ্যে বাড়িতে কি ঘটনা ঘটিয়া গেল। চতুর ইউ-উইন বেশ জানে-পত্র পাইয়াছি মিঃ চৌধুরি পুলিশে সংবাদ দিবেন এবং পুলিশও বাগানে পাহারা থাকিবে। সারারাত ধরিয়া অজস্রধারে বৃষ্টিপাত তাহার নিকটে ভগবানের আশীর্বাদ-সমান হইয়াছিল।
সেইদিন দুপুরে-
হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া ব্যোমকেশ সংবাদ দিলেন, আসামী গ্রেপ্তার হইয়াছে। কৃষ্ণা যদি ইচ্ছা করে, তাহাকে একবার দেখিয়া আসিতে পারে।
কৌতূহল হইয়াছিল বড় কম নয়। তাই কৃষ্ণা রাজি হইল এবং মামা প্রণবেশও সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত হইলেন।
ব্যোমকেশ নিজে তাহাদের সঙ্গে করিয়া চলিলেন ও সগর্বে বলিলেন, ”বেটা ছাতুখোর-ভেবেছিল, কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। কিন্তু এ আমার চোখ! এ চোখকে এড়িয়ে যাওয়া বড় সোজা কথা নয় কৃষ্ণা! উঃ, কি কষ্টে যে প্রমাণগুলো সংগ্রহ করেছি, তা বলবার নয়! রক্তে তার পায়ের ছাপ পড়েছিল, সেই পায়ের ছাপ ধরে অতি সহজেই ধরা গেল,-তা ছাড়া দরজায় হাতের তিনটে আঙুলেরও চিহ্ন ছিল। এই ছাপক’টা খুব কাজে লেগে গেছে।”
গর্বিতভাবে তিনি একবার গোঁফে তা দিয়া লইলেন, বলিলেন, ”এ কি আর যার-তার কাজ মা, পুলিশে কাজ করে আমার মাথার চুল পেকে গেছে। এর চেয়ে বড় বড় খুন, চুরি-ডাকাতির কিনারা আমি করেছি, অপরাধীকে ধরে এনেছি, সে সব ব্যাপারে কত যে মাথা ঘামাতে হয়েছে, তা আর কি বলব তোমাকে। কত জায়গায় মরণাপন্ন হয়ে বন্দী হয়েছি, আবার কি রকম ফিকিরে যে পালিয়েছি, তাও বলবার মতো নয়; সে সব কথা বলতে গেলে একখানা মস্ত বড় বই হয়ে যায়।”
প্রণবেশ মুগ্ধভাবে তাঁহার পানে তাকাইয়াছিলেন, বলিলেন, ”আপনার কিন্তু লেখা উচিত ব্যোমকেশবাবু। এরপরে লোকে আপনার কীর্তিকাহিনির কথা ভুলে যাবে-বই থাকলে তবে পড়ে জানতে পারবে এবং আপনার দৃষ্টান্ত নিয়ে আবার কত লোক মানুষ হয়ে যাবে।”
চিন্তিত মুখে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”কিন্তু, ওই লিখতে বসাটাই যে বড় কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে প্রণববাবু! খাতা-কলম নিয়ে বসা আমার ধাতে পোষায় না। কেউ যদি লেখে তো আমি বলতে পারি-লিখুন না আপনি।”
প্রণবেশ কথা বলিবার আগেই কৃষ্ণা বলিল, ”লেখার কথা পরে হবে কাকাবাবু, এখন যা হচ্ছে সেইটে নিয়েই আলোচনা হোক। আসামীকে থানায় রেখেছেন তো? ধরলেন আজ, না কাল, তাই বলুন।”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আজ মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে ধরা হয়েছে। পরশু থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই শুনি বাগবাজার, সেখানে গিয়ে শুনি বরানগর। আবার বরানগরে গিয়ে শুনি, টালিগঞ্জে গেছে; এমনি করে নাকে দড়ি দিয়ে পরশু থেকে ঘুরিয়ে মেরেছে। উঃ, বেটা কম শয়তান! যাক, এবার বাগাতে পেরেছি, ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হব।”
থানার যে-ঘরে আসামীকে রাখা হইয়াছিল, ব্যোমকেশবাবুর আদেশানুসারে সে-ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া হইল।
দরোয়ান হুজুরিমলকে বন্দী অবস্থায় দেখিয়া কৃষ্ণা একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। যেদিন মিঃ চৌধুরি হত হন, তার পূর্বদিন হুজুরিমলকে কাজে জবাব দেওয়া হইয়াছে। হঠাৎ এক রাত্রে মিঃ চৌধুরি বাহির হইয়া ফটকে হুজুরিমলকে দেখিতে পান নাই। শুনিয়াছিলেন, সে প্রায়ই রাত্রে-বাবুরা ঘুমাইলে বাহির হইয়া যায়, ভোরের সময় ফেরে।
মিঃ চৌধুরি বিশ্বাস করেন নাই যে, সে তাহার রুগনা মায়ের সেবা করিতে যায়,-অন্য দরকারে কোথাও যায় না। তিনি তাহাকে যথেষ্ট ভৎর্সনা করেন, অধৈর্য হইয়া সে দুই-চারিটা শক্ত কথা মনিবকে শুনাইয়া দিয়াছিল। ক্রুদ্ধ চৌধুরি তাহাকে কয়েকটা পদাঘাত করেন। সে তাঁহাকে শাসাইয়া গিয়াছে, বিনাপরাধে এই লাঞ্ছনা সে সহ্য করিবে না, শীঘ্রই ইহার প্রতিশোধ লইবে।
পুলিশের লোক এনকোয়ারির সময় হুজুরিমলের এ কাহিনি সংগ্রহ করিয়াছে এবং এই কাহিনির উপর ভিত্তি করিয়া হত্যাপরাধে তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে।
কৃষ্ণা ও প্রণবেশকে দেখিয়াই হুজুরিমল হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ”আমি সাহেবকে খুন করিনি দিদিমণি, পুলিশ আমায় মিথ্যে ধরে এনেছে, মিথ্যে হয়রান করছে। আপনি তো জানেন দিদিমণি, আমার মার অসুখের জন্যে আমি সাহেবকে লুকিয়ে আপনাকে বলে মায়ের কাছে যেতুম, সাহেব যখন আমায় ধরে মারলেন, তখন আমি ভয় দেখিয়েছিলুম বটে, তাই বলে তাঁকে খুন করব-এত সাহস আমার নেই দিদিমণি।”
কৃষ্ণা তাহাকে সান্ত্বনা দিল, ”ভয় নেই হুজুরিমল, পুলিশ অনর্থক তোমায় ধরে এনেছে, আজকালের মধ্যেই তুমি ছাড়া পাবে।”
থানার বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশবাবুকে লক্ষ করিয়া শ্লেষের সুরে কৃষ্ণা বলিল, ”রামের পাপ শ্যামের মাথায় চাপিয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো কৃতিত্বের পরিচায়ক নয়। আমি বলেছি, যে আমার মাকে হত্যা করেছে, সেই আমার বাবাকেও হত্যা করেছে। যদি আসল হত্যাকারীকে ধরতে চান, তো ইউ-উইনের খোঁজ নিন। আমার বাবার হত্যাকারীকে যে ধরে দেবে, আমি তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব, এই ঘোষণা করুন।”
ব্যোমকেশবাবুর মুখখানা কালো হইয়া গেল। তিনি নীরবে রহিলেন। এতটুকু একটি মেয়ের কথার উপর একটি কথাও বলিতে পারিলেন না।
এগারো
বিরক্ত কৃষ্ণা প্রণবেশকে লক্ষ করিয়া বলিল, ”এই খুনের তদন্ত করা এদের কাজ নয় মামা, হত্যাকারীকে ধরে দিলে বড় জোর ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারবে। এস, আমরাও খোঁজ করি…কি বল?”
প্রণবেশ প্রবল উৎসাহে বলিলেন, ”বেশ বেশ, আমি তাতে খুব রাজি আছি কৃষ্ণা। তবে তোমার ইউ-উইনকে তো আমি চিনিনে, কি করে তাকে খুঁজে বার করব, বল দেখি?”
কৃষ্ণা বলিল, ”বাবার মুখে শুনেছি, ইউ-উইন সম্ভ্রান্ত ধনী আর পুরনো রাজবংশের ছেলে,-মস্ত বড় দল আছে তার, আর সে দল চালাতে যত টাকার দরকার, তাও তার আছে। প্রতিলিপির কথা থাক, বিশেষ করে নকশাখানা নেওয়ার জন্যেই যে সে এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই, আর সে যে কলকাতাতেই আছে, তার পত্রের উপরকার পোস্ট অফিসের ছাপ দেখলেই তা বোঝা যায়।”
বিজ্ঞের মতো মাথা দুলাইয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”ঠিক কথা, ঠিক ধরেছ কৃষ্ণা! আমি বরং এক কাজ করি, ইউ-উইন তো বার্মিজ, আমি ওদের পাড়াগুলো একবার খুঁজে দেখি।-তার কোনো ফটো আছে?”
কৃষ্ণা বলিল, ”হয়তো বাবার ড্রয়ারে আছে। আমিও কোনোদিন দেখিনি, শুনেছি; বাবাও তাকে দেখেননি, কেবল ফটো দেখেছেন। খুঁজে দেখি, ফটো আছে কি না!”
মাতুল ও ভাগিনেয়ী মিলিয়া ড্রয়ার, বাক্স, আলমারি ইত্যাদি খুলিয়া ফটো খুঁজিতে লাগিল।
খুঁজিতে খুঁজিতে ড্রয়ারের মধ্যে একটা ফটোর অ্যালবাম পাওয়া গেল। মহোৎসাহে প্রণবেশ সেটাই লইয়া বসিলেন।
ছোট-বড় বহু ফটো রহিয়াছে, স্ত্রী-পুরুষ প্রত্যেকেরই নাম ফটোর নীচে লেখা আছে। ইহারই মধ্যে একখানা ফটোর নীচের নাম পড়িয়া প্রণবেশ চেঁচাইয়া উঠিলেন, ”পেয়েছি কৃষ্ণা, পেয়েছি!”
কৃষ্ণা তখন গলদঘর্ম অবস্থায় আলমারি দেখিতেছিল, মাতুলের চিৎকারে ছুটিয়া আসিল।
প্রণবেশ বলিলেন, ”এই দেখ তোদের ইউ-উইন। কিন্তু একে দেখে তো বার্মিজ বলে মনে হয় না! অতি সুন্দর চেহারা-মনে হয়, ইউরোপিয়ান যুবক।”
সত্যই সুন্দর চেহারা! ইউরোপিয়ান পোশাকে সজ্জিত থাকায় ইউরোপিয়ান বলিয়াই মনে হয়। কৃষ্ণা যে বার্মিজকে কলিকাতায় জাহাজে দেখিয়াছে, এ সে নয়।
প্রণবেশ বলিলেন, ”তোর বাবা ভুল করে কার ফটোয় কার নাম লিখে রেখে গেছেন দেখছি, এ কখনও ইউ-উইন নয়!”
কৃষ্ণা দৃঢ়কণ্ঠে বলিল, ”বাবা এমন ভুল কখনও করতে পারেন না, মামা! ইউ-উইনের সম্বন্ধে একদিন যেন তিনি বলেছিলেন, ইউ-উইনের পিতা এক ইউরোপীয় মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। এখন আমার মনে পড়ছে, আমরা জাহাজের যে কামরায় আসছিলুম, ঠিক তার পাশের কামরায় একজন সম্ভ্রান্ত ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক ছিলেন। ডিনার টেবিলে তিনি কোনোদিন আসেননি, তাঁর খানসামা তাঁর ঘরেই ডিনার দিত। ‘ডেকে’ও তিনি বেড়াতেন না, দিনরাত বই নিয়ে ঘরে থাকতেন। আজ আমার মনে পড়ছে, সেই ইউ-উইন। তখন যদি জানত যে নকশা আমাদের সঙ্গে কলকাতায় আসছে, তাহলে আমাদের জাহাজেই হত্যা করত। নিশ্চয় সে ভেবেছিল-নকশা আমাদের কাছে নেই।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”গতস্য শোচনা নাস্তি। এখন আমরা যে ডিটেকটিভের কাজ করব,-কোথায় এর খোঁজ পাব, সেটা আগে দেখতে হবে তো?”
একটু থামিয়া আবার বলিলেন, ”আচ্ছা, বার্মিজদের পাড়ার দিকে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক, যদি মেলে, কি বল?”
কৃষ্ণা বলিল, ”ক্ষেপেছ, মামা! বার্মিজদের মধ্যে ইউ-উইন কখনও থাকবে না। সে ধনী, পাশ্চাত্যে বহুকাল কাটিয়েছে। নোংরামির মধ্যে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি খোঁজ করে এস, ইউরোপিয়ান হোটেলগুলোতে। আমরা যেদিন এসেছি, সেদিনটার তারিখ দেখে নিয়ে খোঁজ নাও, কোনো হোটেলে কোনো ভদ্রলোক সেদিন এসেছেন কি না। যদি এসে থাকেন, খুব সাবধানে কোনো রকমে ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখ।”
প্রণবেশ মাথা দুলাইলেন, বলিলেন, ”সর্বনাশ! সে কথা কেউ কি আমায় বলবে? এ সব কথা বলা ওদের আইনবিরুদ্ধ যে-কাজেই কেউ বলবে না!”
কৃষ্ণা একটু ভাবিল, তাহার পর উঠিয়া গেল। মিনিট পনেরো-কুড়ি পরে সে যখন ফিরিল, তখন তাহাকে দেখিয়া প্রণবেশ বিস্মিত হইয়া গেলেন।
নিখুঁত একটি ইউরোপিয়ান-বালিকা,-এই গাউনে আর টুপিতে তাহাকে বড় সুন্দর মানাইয়াছে। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর থাকায় কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না যে, সে ইউরোপিয়ান নয়। প্রণবেশ তাহার ইংরেজি উচ্চারণ শুনিয়াছেন,-ইউরোপিয়ান গভর্নেসের কাছে দুই বৎসর হইতে মানুষ হওয়ায় কথাবার্তা ও চালচলনে তাহাকে সর্বাংশে ইউরেপিয়ান-বালিকা বলিয়াই মনে হয়।
প্রণবেশ বলিলেন, ”এরকমভাবে যাচ্ছ কোথায় কৃষ্ণা! কেউ যদি সন্দেহ করে-বিপদে পড়বে!”
কৃষ্ণা বলিল, ”কোনো বিপদে পড়ব না মামা, সন্ধে সাতটার মধ্যেই আমি ফিরে আসব। তুমি গেলে কেউই কোনো কথা বলবে না, হয়তো বিপদে পড়বে; তাই আমিই চললুম। সব জায়গাতেই জানাব-আমি একা কনভেন্টে থেকে পড়াশুনা করি; আমার দাদার বর্মা হতে আসার কথা ছিল, না আসায় খোঁজ নিতে বেরিয়েছি। ও-সব বুদ্ধি আমার বেশ আছে মামা, বাবার কাছে থেকে অনেক শিখেছি। তোমার কোনো ভয় নেই, দেখ, ঠিক সাতটায় ফিরব। তুমি এর মধ্যে এক কাজ কর-ধর্মতলায় ইয়াং চাং কোথায় থাকেন, সে খোঁজটা নিয়ে এস এবং আমি কাল তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করব, এ কথাটা তাঁকে জানিয়ে দিও।”
প্রণবেশ বলিলেন, ”চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই, ওখান থেকে আমি না হয় নেমে যাব এখন।”
কৃষ্ণা ব্যস্ত হইয়া বলিল, ”না না, আমার সঙ্গে এস না মামা, ওরা সন্দেহ করবে। তুমি বরং খানিক পরে বেরিয়ে চাকর-দরোয়ানদের ভালো করে বলে যেও-কাউকে যেন বাড়িতে ঢুকতে না দেয়।”
প্রণবেশ জানালাপথে দেখিলেন-কৃষ্ণা হন-হন করিয়া গিয়া ট্রামে উঠিল।
প্রণবেশ আপন মনে বলিলেন, ”আবার একটা ফ্যাসাদ না বাধিয়ে বসে সেই ভাবনা হচ্ছে!”
তিনি তাড়াতাড়ি জিনিসপত্রগুলো গুছাইয়া তুলিলেন এবং বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইলেন। বিশ্বস্ত দরোয়ান হনুমান সিংকে ডাকিয়া বলিলেন, ”আমি খানিকক্ষণের জন্যে বেরুচ্ছি হনুমান সিং, বাড়ি-ঘর সব রইল তোমার জিম্মায়, হুঁশিয়ার থেক।”
হনুমান সিং সেলাম দিয়ে বলিল, ”কোনো ভাবনা নেই হুজুর, আমার দেহে একফোঁটা রক্ত থাকতে কাউকে বাড়ি ঢুকতে দেব না।”
প্রণবেশ নিশ্চিন্ত হইয়া ঘরে চাবিবন্ধ করিয়া বাহির হইলেন।
সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই তিনি ফিরিবেন, যদি ইহার মধ্যে দিদিমণি আসেন, যেন বৈঠকখানায় বসেন-এই কথা তিনি বার বার করিয়া বলিয়া গেলেন, কিন্তু রাত্রি সাতটা ছাড়িয়া দশটা বাজিয়ে গেল, তখনও প্রণবেশ ফিরিলেন না। কৃষ্ণাও আসিল না।
রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় কৃষ্ণা ফিরিল-তাহার সঙ্গে ব্যোমকেশবাবু।
সন্ধ্যার পরেই সে ফিরিতেছিল, পথে ব্যোমকেশবাবু তাহাকে দেখিতে পাইয়া বউবাজারে নিজের বাড়িতে ধরিয়া লইয়া যান, সেখানে আহারাদির ব্যাপার ঘটায় কৃষ্ণার ফিরিতে বিলম্ব হইয়া গিয়াছে।
বাহিরের ফটকে একজন মাত্র দরোয়ান ছিল। কৃষ্ণাকে দেখিয়া সে সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, ”হনুমান সিং কোথায়?”
দরোয়ান উত্তর দিল, ”সে ভিতর-বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। সাহেব কোথায় বার হয়ে গেছেন, এখনও ফেরেননি। তিনি হনুমান সিংকে ভিতর-বাড়িতে থাকার হুকুম দিয়ে গেছেন।”
কৃষ্ণা উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল, ”মামা এখনও ফেরেননি? এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়! আমি তাঁকে একবার ইয়াং চাংয়ের খোঁজ নিতে বলেছিলুম কাকাবাবু, ঘণ্টা-দেড়েকই না হয় তাতে সময় লাগবে, এতক্ষণ দেরি হওয়ার তো কথা নয়! মামা বাড়ি নেই, তাই আপনার বাড়ি হতে যে ফোন করেছিলুম, কেউ ধরেনি। আপনি আসুন কাকাবাবু, আমি একবার সবগুলো দেখে-শুনে নিই।”
সে হন-হন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
সিঁড়ি বাহিয়া দ্বিতলে উঠিয়া সে স্তম্ভিত হইয়া দাড়াইল, বিকৃতকণ্ঠে ডাকিতে লাগিল-”কাকাবাবু, একবার শিগগির ওপরে আসুন।”
আর্তকণ্ঠের আহ্বান শুনিয়া ব্যোমকেশ লম্ফে লম্ফে সিঁড়ি ডিঙাইয়া উপরে পৌঁছাইলেন।
পৌঁছাইয়া সবিস্ময়ে দেখিলেন, দরোয়ান হনুমান সিং মুখখানা মাটিতে গুঁজিয়া পড়িয়া আছে, সমস্ত ঘরের দরজা খোলা।
তিনি তাড়াতাড়ি হনুমান সিংয়ের পাশে বসিয়া পড়িয়া তাহাকে পরীক্ষা করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
হতাশকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”বুঝেছি, তারা এসেছিল-হনুমান সিং বাধা দিতে গিয়েছিল, বেচারা তাতেই প্রাণ হারাল। এই দেখুন কাকাবাবু, এর গলায়ও সেই সরু ছুঁচ বেঁধার দাগ,-যে ফলায় আমার মা-বাপ হত হয়েছেন!”
ব্যোমকেশ মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইল না।
বারো
সে রাত্রে পুলিশ-তদন্তের পর কৃষ্ণা বাড়িতে না থাকিয়া ব্যোমকেশের বাড়িতে গিয়া রহিল। পরদিন সকালবেলায় ব্যোমকেশের সঙ্গে নিজের বাড়িতে আসিল।
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আমি বুঝেছি। যারা এইসব কাজ করছে, তারা সর্বদা তোমাদের বাড়ির ওপর দৃষ্টি রাখে, কে কোথায় যায় না-যায়-সর্বদা পাহারা দেয়। সন্ধের পর এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে, ডাক্তাররা মৃতদেহ পরীক্ষা করে এই কথাই বলেছেন। ডাকাতরা আগে হনুমান সিংকে হত্যা করেছে, তারপর তোমাদের চাকরদের ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করে সমস্ত ঘরের দরজার চাবি ভেঙেছে। বাইরে দরোয়ান বসে ছিল, হয় সে কিছু জানতে পারেনি, নয় বলব, শত্রুদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা আছে, তাই সে চুপচাপ বসে শুধু নিজের কর্তব্যই পালন করেছে। ঘরের অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা যা চেয়েছিল তা পায়নি, সেইজন্যে সব পাতিপাতি করেছে।”
কৃষ্ণা কি ভাবিতেছিল, বলিল, ”যা তারা খুঁজছে, তা হচ্ছে সেই নকশাখানা। কিন্তু সে নকশা তারা সারাজীবন খোঁজ করলেও পাবে না কাকাবাবু। ব্যাপার বুঝুন, সেখানা যথাস্থানে পৌঁছে দিলে আমার বাবা পাঁচ লাখ টাকা পেতেন, এখন আমি যদি সেই নকশাখানা কোনোক্রমে তাঁকে দিতে পারি, তবে সে টাকাটা পেয়ে যাব, কারণ বাবার উত্তরাধিকারিণীসূত্রে সে টাকা আমারই পাওয়ার কথা। তবু আমি সেকথা ভাবছিনে কাকাবাবু। আমি কেবল ভাবছি, মামা কোথায় গেলেন, কেন ফিরলেন না! কোনো বিপদে পড়েছেন বেশ বোঝা যাচ্ছে। আপনি একবার দেখুন কাকাবাবু, নইলে-”
বাধা দিয়া ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আমি কাল রাত্রেই প্রণবেশবাবুর জন্যে থানায় খবর দিয়েছি মা, সে কথা তোমায় বলতে হবে না। কারণ, তোমার স্বর্গগত পিতার বন্ধু হিসেবে শুধু নয়, পুলিশ হিসেবেও আমার এ অবশ্য কর্তব্য কাজ। আজ বিকেলের দিকে মনে হয় কোনো খবর পাব-তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আর-এক কথা-যদি তুমি এ বাড়িতে না থাকতে পার, তাহলে আমার বাড়িতে যেতে পার। যে পর্যন্ত তোমার মামা না আসেন, তুমি আমার ওখানেই থাকবে।”
কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি তো জানেন কাকাবাবু, যতক্ষণ না ওই নকশাখানা পৌঁছে দিতে পারি, ততক্ষণ আমার এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া হবে না। আমার মাতাপিতার হত্যাকারীকে উপযুক্ত প্রতিশোধ দিতে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করে! আপনি দয়া করে এই বাড়িতেই কয়েকজন কনেস্টবল দিন, তারা দিনরাত বাড়ি পাহারা দেবে, তাহলেই আমি থাকতে পারব।”
এতটুকু মেয়ের সাহসের কথা শুনিয়া ব্যোমকেশ চমৎকৃত হইয়া গেলেন, বলিলেন, ”তা আমাদের রাখতেই হবে। দু-জনকে রাখা হয়েছে, আরও দু-চারজন না হয় রাখা হবে। পাছে তুমি ভয় পাও, সেইজন্যেই আমি বলছি কৃষ্ণা, তুমি ছেলেমানুষ, তাতে মেয়ে; বাড়িতে পনেরো দিনের মধ্যে দুটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তুমি সাহস করে এখানে থাকতে পারবে না বলেই আমি মনে করি। তার ওপর তোমার মামা পর্যন্ত নেই। কোথায় গেলেন, কবে আসবেন, তারও কোনো ঠিক নেই। আর-এক কথা, তুমি একা বাড়ির বার হয়ো না, সর্বদা মনে রেখ, তোমার পেছনে এক-জোড়া চোখ আছে, সে ইচ্ছে করলে যে-কোনো সময়ে তোমার অনিষ্ট করতে পারে।”
তিনি উঠিলেন।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”হুজুরিমল ছাড়া পেয়েছে, কাকাবাবু?”
বিরক্তিপূর্ণকণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আর বল কেন, বেটাকে বাধ্য হয়ে পরশু ছেড়ে দিতে হয়েছে,-আমায় উপহাস করে বেটা চলে গেল!”
তিনি চলিয়া গেলেন।
দ্বারে যে দরোয়ান ছিল, সে পুলিশের হাতে বন্দী হইয়াছিল। থানা হইতে চারজন কনেস্টবল বাড়ি পাহারা দিবার জন্য প্রেরিত হইল।
সেইদিনই বৈকালের ডাকে একখানা খামে পত্র পাইয়া কৃষ্ণা আশ্চর্য হইয়া গেল। পত্র লিখিয়াছেন প্রণবেশ। লিখিয়াছেন,-বিশেষ আবশ্যকে আমি ইয়াং চাং মহাশয়ের সঙ্গে বর্মা যাইতেছি, তুমি কিছু ভাবিও না। আজই সন্ধ্যায় আমরা রওনা হইব-তুমি নকশাখানা ঠিক করিয়া রাখিবে। সন্ধ্যার আগে যে-কেহ আমার পত্র লইয়া যাইবে, তাহার হাতে নকশা দিতে অন্যথা করিও না।
-প্রণবেশ।
নকশা!…লোক! ইউ-উইনের আর-এক কীর্তি…
কৃষ্ণা তৎক্ষণাৎ একখানা পত্র লিখিয়া ব্যোমকেশকে ডাকিয়া পাঠাইল। তিনি আসিতেই পত্রখানা তাঁহার সামনে ধরিয়া বলিল, ”দেখুন, ইউ-উইনের আর-এক কীর্তি! মামাকে সে কোনোরকমে আটক করেছে, তাঁকে দিয়ে এই পত্রখানা লিখিয়েছে। এখুনি এই পত্র পেয়েছি, লোক নিশ্চয়ই সন্ধের মধ্যে আসবে। কি করবেন, বলুন।”
মহোল্লাসে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”এই তো সুরাহা হয়েছে মা, তোমার মামাকে ওরা কোথায় আটক করে রেখেছে, এইবার অতি সহজেই তা জানা যাবে।”
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”কি করে জানবেন?”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”নকশা তাকে দেব!”
কৃষ্ণা যেন আকাশ হইতে পড়িল।
ব্যোমকেশ হাসিলেন, বলিলেন, ”আসল নকশা নয়। ওরই একটা নকল করে ফেলি। যখন লোক আসবে, ইচ্ছে করলেই তাকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে বটে, কিন্তু তাতে কোনো ফলই হবে না, ওদের দল সাবধান হয়ে যাবে! সেইজন্য মনে করছি, ওরই একটা ভুল-নকশা করে সে লোকটার হাতে দেব, সে যখন নিয়ে যাবে, তার সঙ্গে সঙ্গে গোপনে গিয়ে দেখব সে কোথায় যায়, তারপর ওদের দলসুদ্ধ ধরা কিছু কষ্টকর হবে না।”
কৃষ্ণা একটু হাসিল।…ব্যোমকেশ ইউ-উইনকে চেনেন না।
ব্যোমকেশ তাহার হাসির অর্থ বুঝিলেন, গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ”চেষ্টা করে দেখা যাক না, কি হয়। আমার হাতে যখন এনকোয়ারির ভার পড়েছে, তখন আমায় চেষ্টা করতে হবে-যাতে এই রহস্যোদ্ধার হয়; তুমি সেই নকশাটা আমাকে দাও, ওখানে বসেই আমি তার একটা নকল ছাপ তুলে নিই।”
কৃষ্ণা ভিতরে চলিয়া গেল, একটু পরেই নকশা লইয়া ফিরিল, বলিল, ”আপনি কি এই নকশার অবিকল নকল করবেন?”
যে বিচিত্র নকশার জন্য তিনটি প্রাণীর প্রাণ নষ্ট হইয়াছে, সেই নকশা হাতে লইয়া ব্যোমকেশ নিষ্পলকে খানিকক্ষণ তাহার পানে তাকাইয়া রহিলেন।
মিঃ চৌধুরি বর্মায় থাকিতে ব্যোমকেশ দু-চারবার সেখানে বেড়াইতে গিয়াছেন, বাহির হইতে শুধু দেশ দেখিয়া বেড়াইয়া আসিয়াছেন মাত্র, কোথায় যে কি আছে, তাহা তাঁহার অজ্ঞাত। ইরাবতী নদী তিনি দেখিয়াছেন, এই নদী বাহিয়া পূর্বদিকে একশত মাইল গিয়া নদীর পশ্চিম তীরে একটি স্থান এই নকশায় নির্দেশ করা আছে-এ-সব স্থান ব্যোমকেশ দেখেন নাই। মিঃ চৌধুরির মুখে শুনিয়াছিলেন, ওদিকে দারুণ জঙ্গল; বোধহয়, সেই জঙ্গলের মধ্যে বর্মার বহু পুরাকালের কোনো রাজবংশের সম্পত্তি মাটির তলায় প্রোথিত আছে। এই নকশা সেখানকার সেই বনের মধ্যে নির্দেশিত স্থানের।
অনুরূপ একখানি আধময়লা কাগজ সংগ্রহ করিয়া কিছুক্ষণের মধ্যে ক্ষিপ্রহস্তে ব্যোমকেশ একখানি জাল-নকশা তৈরি করিয়া ফেলিলেন।
আসল নকশাটা কৃষ্ণার হাতে ফিরাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিলেন, ”ওখানা তুলে রেখে এস, এই নকশাটা দিয়েই আমাদের কাজ চলবে।”
কৃষ্ণা নকশা তুলিতে গেল।
তেরো
ভৃত্য বিনয় আসিয়া জানাইল-একজন লোক আসিয়াছে, কৃষ্ণার সহিত একবার দেখা করিতে চায়।
কে যে আসিয়াছে, তাহা বুঝিতে কৃষ্ণার বিলম্ব হইল না। ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি, তুমি লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে নকশাটা দিও।”
তিনি তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন। কৃষ্ণা লোকটিকে লইয়া আসিতে আদেশ দিল।
যে লোকটি আসিয়া দরজার উপর দাঁড়াইল, তাহাকে দেখিয়া কৃষ্ণা বিস্মিত হইল। …তাহাদের বাড়ির সামনে ও-পাশের ফুটপাথে বসিয়া যে লোকটি প্রতিদিন সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিনাইয়া বিনাইয়া কাঁদিয়া ভিক্ষা চায়, এ সেই লোক, ইহার একখানা পা কাঠের।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”কি চাই?”
লোকটি বিলক্ষণ তোতলা-তো-তো করিয়া কেনোরকমে জানাইল, একটা লোক তাহাকে চারিটি পয়সা ও একখানা পত্র দিয়া বলিয়াছে-এখানে আসিয়া পত্রটা দিয়া তার বদলে একটা জিনিস লইয়া গিয়া তাহাকে দিলে একটা টাকা পাইবে।
কৃষ্ণা বুঝিল, সে লোক কে। কিন্তু ইহাকে তাহার সম্বন্ধে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা, বলিল, ”কই, সে পত্র দেখি?”
খোঁড়া লোকটি কৃষ্ণার প্রসারিত হাতে পত্র দিল।
কৃষ্ণা দেখিল, তাহাতে ইংরাজি ভাষায় লেখা রহিয়াছে, নকশা-ইউ-উইন।
কৃষ্ণা টেবিলের উপর হইতে নকশাটা লইয়া তাহার হাতে দিল। সে বিস্মিতভাবে কাগজখানা উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিল, তাহার পর কাঠের পা ঠকঠক করিতে করিতে অবলীলাক্রমে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া গেল।
পিছনে পিছনে নামিলেন ব্যোমকেশ। সাদা কাপড়-জামা পরিহিত দু-জন কনেস্টবলকে ইশারায় অনুবর্তী হইতে আদেশ দিয়া তিনি লোকটির দশ-বারো হাত পিছনে-পিছনে চলিলেন।
কাঠের পা ঠকঠক করিতে করিতে লোকটি হাঁটিতে লাগিল নেহাৎ মন্দ নয়! ব্যোমকেশ জনবহুল রাজপথে ঠিক তাহার পিছনে-পিছনে চলিলেন, সাধারণ পোশাকে দুইজন কনেস্টবল পরস্পর হইতে যথেষ্ট ব্যবধান রাখিয়া তাঁহার সঙ্গে-সঙ্গে চলিল।
খোঁড়া লোকটি খানিকদূর একটা গলির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। ব্যোমকেশও নিঃশঙ্কচিত্তে তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেই গলিতে প্রবেশ করিলেন।
গলিটা খানিকদূর সমান গিয়া তিনটি পথে বিভক্ত হইয়া আঁকিয়া-বাঁকিয়া গিয়াছে। অন্ধকারে সে লোকটি কোন পথে গেল ঠিক করিতে না পারিয়া ব্যোমকেশ থমকিয়া দাঁড়াইলেন। কনেস্টবল দুইজন কোন পথে কোথায় গেল তাহাও তিনি ঠিক করিতে পারিলেন না।
অকস্মাৎ-”তবে রে রাসকেল!…এইবার তোমায় বাগে পেইছি।”-এই কথাটা কানে আসিবার সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীটা তাঁহার চোখের সামনে অন্ধকার হইয়া গেল।
মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত পাইয়া চোখে অন্ধকার দেখিবার মুহূর্তে, ব্যোমকেশের জ্ঞানশূন্য দেহখানা মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।
এদিকে অন্ধকারে অজ্ঞাতশত্রু কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল কে জানে! তাহার একটু পরেই কনেস্টবল দুইজন সেই পথে আসিয়া মূর্ছিত ব্যোমকেশকে দেখিয়া প্রমাদ গণিল। সেখানে রক্ত জমিয়া গেছে, তখনও মাথা হইতে রক্ত পড়িতেছে।
তাহারা মূর্ছিত ব্যোমকেশকে ধরাধরি করিয়া গলি হইতে সদর রাস্তায় আনিয়া একটা ট্যাক্সি ডাকিয়া তাহাতে উঠাইল এবং মেডিকেল কলেজে লইয়া গেল।
বাড়িতে কৃষ্ণার শান্তি ছিল না। ব্যোমকেশের নামে সে ফোন করিয়া জানিল-তিনি থানায় নাই, বাসাতেও নাই, কোথায় গিয়াছেন সেকথা কাহাকেও বলিয়া যান নাই।
সমস্ত রাত্রি উৎকণ্ঠায় কাটাইয়া পরদিন কৃষ্ণা আবার ফোন করিল। এবার ব্যোমকেশের সাড়া পাওয়া গেল। তিনি বলিলেন, তিনি শয্যাগত, উঠিবার সামর্থ্য নাই। গত রাত্রে কে বা কাহারা তাঁহার মাথায় লাঠি মারিয়াছে। তাঁহার মাথাটা ছাতু করিয়া দেওয়াই ছিল তাহাদের মতলব; কিন্তু অনেক পুণ্যবলে তিনি এযাত্রা বাঁচিয়া গিয়াছেন।
কৃষ্ণা হতাশ হইয়া মাথায় হাত দিয়া বসিল।
তাহার সকল আশা-ভরসা যে নিঃশেষে ফুরাইয়া গেল, এখন সে কি করিবে?
একখানা রেজেস্ট্রি-পত্র তাহার নামে আসিয়াছিল, দরোয়ান সেই পত্র আনিয়া তাহাকে দিয়া গেল।
পত্রখানা খুলিয়া কৃষ্ণা দেখিল, ইয়াং চাংয়ের পত্র। কভারের উপর ছাপ দেখিয়া বুঝিল, পত্রখানি অনেক স্থান ঘুরিয়া আসিয়াছে।
তিনি লিখিয়াছেন-
আপনার পিতার শোচনীয় মৃত্যু-সংবাদে বড় মর্মাহত হইয়াছি। বিশেষ যখন জানিতে পারিলাম, আমিই তাঁহার মৃত্যুর কারণ হইয়াছি। আমায় দিবার জন্য তিনি সেই নকশাখানি রেঙ্গুন হইতে এখানে লইয়া আসেন, কিন্তু আমায় দিবার সুযোগ তিনি পাইলেন না, অথচ সেই নকশার জন্যই তিনি নিহত হইয়াছেন।
আমি এই সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলিতে চাই। কবে এবং কখন আপনার সুযোগ হইবে আমাকে জানাইলে আমি দেখা করিবার ব্যবস্থা করিব।
আপনি আমাকে চিনেন না, সেজন্য আমার উপর সন্দেহ হওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব। যেহেতু এই নকশা উপলক্ষ করিয়া ইউ-উইন বর্মা হইতে আপনাদের অনুসরণ করিয়া এতদূর আসিয়াছে এবং ইহারই মধ্যে আপনার দ্বারবানকে হত্যা করিয়াছে।
আমাদের বংশে যে এমন মহাপাপিষ্ঠ জন্মিয়াছে, তাহার জন্য আমি লজ্জিত। তাহার পাপ-আত্মার মুক্তির জন্য আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি।
আমি একটা মতলব ঠিক করিয়াছি, তাহাতে উভয় পক্ষেরই সুবিধা হইবে। আপনার বাড়িতে আমি গেলেও আপনি আমায় সন্দেহ করিবেন, আমার বাড়িতেও আমি আপনাকে আনিতে চাহি না। আমি ডিটেকটিভ ব্যোমকেশবাবুর বাড়িতে যাইব এবং আপনিও ওখানে আসিবেন, আমাদের যাহা কিছু কথাবার্তা সেখানেই হইবে।
আমার মতে আগামীকাল বৈকালে সময় নির্দেশ করাই ভালো। যত শীঘ্র আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় উভয়েরই তাহাতে মঙ্গল। আপনার শুভ কামনা করি-
শুভার্থী
ইয়াং চাং
পত্রে ফোন নম্বর ছিল, দেখিয়া লইয়া কৃষ্ণা ফোন ধরিল-”হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এইমাত্র আপনার পত্র পেয়েছি। কাল ব্যোমকেশবাবুর বাড়ি আপনি আসবেন, আমি ওখানেই থাকব।”
ফোনে সে পুনরায় ব্যোমকেশকে ডাকিয়া ইয়াং চাংয়ের অভিপ্রায় জানাইল।
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”বার্মিজদের যদিও আমি আর বিশ্বাস করতে পারিনে মা, তবু মিঃ ইয়াং চাংকে বিশ্বাস করছি, কারণ, তিনি তোমার পিতার পরিচিত ও কলকাতায় অনেকেই এই বিখ্যাত ব্যবসায়ীকে চেনে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তাঁর কারবার চলে। বেশ, তোমরা কাল বিকেলে এখানে এস, এখানেই কথাবার্তা হবে এখন।…হ্যাঁ, তোমার মামার খবর কিছু পেয়েছি। তাকে একটা জাহাজে অজ্ঞান অবস্থায় তুলে দেওয়া হয়েছিল। তখন নাকি যে প্রকৃতিস্থ ছিল না, পাগলের মতো যা-তা বলছিল। উপস্থিত সে নিজের নাম-ধাম বলেছে, তাকে এক ভদ্রলোক বর্মার পুলিশের হাতে দিয়েছে। শুনলুম, সেখান হতে পুলিশের জিম্মায় সে শিগগিরই কলকাতায় ফিরে আসবে।”
”সর্বনাশ! মামা বর্মায়?”
কৃষ্ণার দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া উঠে-
যে ভীরু মানুষ প্রণবেশ, সে ভালো হইলেও প্রকৃতিস্থ আছে কি!
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আমি আমার ছেলেকে সঙ্গে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেব, সেই গাড়িতে তুমি এস-অন্য কোনো টাক্সিতে এস না যেন। তোমাকে যা-যা বারণ করে দিয়েছি তা পালন করো, নচেৎ বিপদে পড়বে।”
হুজুরিমলকে শেষ পর্যন্ত ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে।
যেদিন বৈকাল কৃষ্ণা ইউ-উইনের খোঁজে বাহির হইয়াছিল, সেদিন কোথাও তাহার খোঁজ পায় নাই। আর একবার চেষ্টা করিবার তাহার ইচ্ছা ছিল, ব্যোমকেশ তাহাকে বাধা দিয়াছিলেন। সামান্য বালিকার এতটা সাহস করা ভালো নয়, তাহাকে বিপদে ফেলা ইউ-উইনের পক্ষে বিশেষ কেন-মোটেই কষ্টকর হইবে না।
তাঁহার কথায় কৃষ্ণা নিরস্ত হইয়াছিল।
চৌদ্দ
ব্যোমকেশ পুত্রকে দিয়া গাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, কৃষ্ণা সেই গাড়িতে ব্যোমকেশের বাড়িতে গিয়া পৌঁছাইল।
ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিয়াছেন। মাথায় তাঁর তখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, শরীর অত্যন্ত দুর্বল।
কৃষ্ণা শিহরিয়া উঠিল! এই কয়দিনেই ব্যোমকেশ রোগা হইয়া গিয়াছেন বড় কম নয়! খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন, জোরে কথা বলিতে পারেন না। ডাক্তারের নিষেধ,-মাথায় চাড় লাগিলে আবার রক্ত ছুটিতে পারে।
আস্তে আস্তে তিনি বললেন, ”এস মা, বস।”
কৃষ্ণা বসিল, দুঃখিতকণ্ঠে বলিল, ”আপনার এমন অবস্থা হয়েছে কাকাবাবু, অথচ এ কথা আমায় জানাননি! যতবার এখনে আসার কথা বলেছি, ততবারই বারণ করে পাঠিয়েছেন, সেইজন্য জোর করে আসার ভরসাও পাইনি।”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”কেন যে বারণ করেছি তা তো বুঝবে না মা! একটু অপেক্ষা কর-আমি তোমায় সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
হাতের কাছে টেবিলের উপর কাচের গ্লাসে বেদানার রস ছিল, সেটুকু খাইয়া তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, ”ইউ-উইনের সন্ধান পেয়েছি। শুধু পাওয়া নয়, তাকে দেখেছি। তুমি যে চেয়ারে বসে আছ, আজই সকালে ওই চেয়ারে সে বসে গেছে। আমার ছেলে যে ওদিক থেকে গোপনে তার ফটো তুলে নিয়েছে তা সে জানে না।”
”এই চেয়ারে বসেছে?”
কৃষ্ণা সভয়ে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
একটু হাসিয়া ব্যোমকেশ বলিলেন, ”সেজন্য তোমার কোনো ভয় নেই মা, তুমি বস। ইউ-উইন ভূত বা প্রেত নয়, সে মানুষ-সে…”
বাধা দিয়া ঘৃণাপূর্ণকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”মানুষ সে নয় কাকাবাবু, সে পিশাচ!”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”মনে সে পিশাচ হলেও দেহে তো পিশাচ নয়! কাজেই, তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।”
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”কিজন্যে সে আপনার কাছে এসেছিল কাকাবাবু?”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”এসেছিল আমায় নিবৃত্ত করার জন্যে-যেন আমি তার অনুসন্ধান ছেড়ে দিই, সেই কথা বলতে। ব্যাপারটা আগে সব শোনো, তাহলে বুঝতে পারবে। সকালে আমার চাকর যখন ইউ-উইনের নাম লেখা কার্ডখানা এনে দিলে, আমি তাতে তার নাম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। তাকে ফিরিয়ে দেব কি ডাকব-সে কর্তব্য ঠিক করার আগেই সে দরজার পর্দা সরিয়ে নিজেই ঢুকল। তার সাহস এবং ধৃষ্টতা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলুম-সাধ করে সে সিংহের গুহাতে প্রবেশ করেছে, এতখানি শক্তি তাহলে তার আছে! যদি কার্ডে তার নাম না থাকত তাহলে আমি তাকে কোনো ইউরোপিয়ান বলে ভুল করতুম!
”সে আমায় কি বললে জান? বললে, সম্প্রতি মিস চৌধুরি খোঁজ করতে গিয়েছিলেন আমাকে, গ্র্যান্ড হোটেলে। বলবেন তাঁকে-আমারই সঙ্গে সেখানে তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। আমি ইচ্ছে করলে তখনি তাঁকে ফাঁদে ফেলতে পারতুম, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি-তাঁর ওপর রাগ হয় না, এত ছেলেমানুষ তিনি যে, তাঁকে দেখলে দয়া হয়।”
প্রায় চিৎকার করিয়া উঠিয়া কৃষ্ণা বলিল, ”দয়া হয়?…এ কথা সে বললে?…অসহ্য!”
ক্রোধে সে লাল হইয়া উঠিয়াছিল।
একটু হাসিয়া ব্যোমকেশ বলিলেন, ”বসো, বসো-তুমি এমন অস্থির হলে দেখছি শেষ পর্যন্ত আমার কোনো কথা বলা হয় না। ইউ-উইন বললে, স্ত্রীলোকের উপর সে অত্যাচার করবে না। তোমার মায়ের কথায় বললে, বিশেষ দরকার হয়েছিল তাঁকে সরিরে দেওয়ার তাই সে তাঁকে হত্যা করেছে। এবং সে কাজ করেছে কেবল তোমার পিতার জন্যে। তোমাকে সে করুণার চোখে দেখে তাই তোমার অনিষ্ট করতে চায় না। সে বলছিল-ইয়াং চাংকে নকশা দিলে সে এক পয়সাও দেবে না-পাঁচ লাখ টাকা তো অনেক পরের কথা। ইয়াং চাংয়ের ব্যবসা ভালো চলছে না, সে আর দু’দিন বাদেই লালবাতি জ্বালবে। ইউ-উইনকে আসল নকশাটা দিলে সে পাঁচ লক্ষ টাকা না হোক অন্ততপক্ষে খুশি করে দেবে।”
কৃষ্ণা সগর্জনে বলিল, ”কখনই নয়-কিছুতেই দেব না।”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”দেওয়া না-দেওয়া পরের কথা-এখনকার কথাটা শোনো। ইউ-উইন বলে-ইয়াং চাং বিধর্মী, সে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে।”
কৃষ্ণা বলিল, ”শুনেছি ইউ-উইনের মাও ইউরোপিয়ান মহিলা ছিলেন।”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাই ইউ-উইন অহঙ্কার করে আর ইয়াং চাংকে বিধর্মী বলে ঘৃণা করে। ইউ-উইন এই নকশা-সেই প্রতিলিপি সব নিজে নিতে চায়। পবিত্র বুদ্ধের জিনিস বিধর্মীর হাতে দিয়ে অপবিত্র করতে চায় না। সে আমায় এ তদন্ত ছেড়ে দিতে বলছে, তাহলে নাকি সে আমায় প্রচুর পুরস্কৃত করবে।” বলিয়া তিনি অবজ্ঞার হাসি হাসিলেন।
কৃষ্ণা কেবল মাথা কাত করিল-”হুঁ!”
ঠিক এই সময় ফোনে ক্রিং ক্রিং করিয়া শব্দ হইতে ব্যোমকেশের আদেশানুসারে কৃষ্ণা ফোন ধরিল-”কে? ও, মিঃ ইয়াং চাংয়ের সেক্রেটারি, মিঃ লি?-হ্যাঁ, কি বলছেন বলুন!…ও, হঠাৎ একটা টেলি পেয়ে মিঃ ইয়াং চাংকে বম্বে যেতে হচ্ছে-জরুরি দরকার। বেশ, যখন তাঁর সময় হবে আমাকে জানাবেন। নমস্কার…হ্যাঁ!”
ফোন রাখিয়া সে ব্যোমকেশের পানে ফিরিল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, ”ইয়াং চাং বম্বে রওনা হলেন-তাই জানালেন তো?”
কৃষ্ণা বলিল, ”হ্যাঁ, একটা জরুরি টেলি পেয়ে।”
ব্যোমকেশ হাসিলেন, বলিলেন, ”এ ইউ-উইনের কৌশল আমি ঠিক বুঝছি। আমেরিকায় ইয়াং চাংয়ের যে ব্যাঙ্ক ছিল, সেই ব্যাঙ্ক নাকি হঠাৎ লালবাতি জ্বেলেছে,-ইয়াং চাং আজই না জাহাজে উঠে বসে!”
”ব্যাঙ্ক ফেল!” কৃষ্ণা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল।
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”ইউ-উইনের দ্বারা সবই হতে পারে। একদিন এই বার্মিজ দস্যুকে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলুম, এখন দেখছি, তাকে দমন করা বড় মুখের কথা নয়। দুনিয়ার সব দেশে, সব জাতির মধ্যেই তার লোক আছে, বহুলোক নিয়ে সকল দেশে চলছে তার কারবার। এই তো কালই বলেছিলুম না, ইংলন্ডে একটা ভীষণ ডাকাতি হয়ে গেছে? শুনলুম, সেও ইউ-উইনের দলের লোকের কাজ।”
কৃষ্ণা রুদ্ধশ্বাসে বলিল, ”সাংঘাতিক লোক তো!”
ব্যোমকেশ বলিলেন, ”হ্যাঁ, এখন এই নকশার কাহিনিটা শোনো। ইয়াং চাং আর ইউ-উইনের পূর্বপুরুষ-রাজবংশের লোক ছিলেন। একসময় কোনো কারণে তাঁর প্রতি নির্বাসন দণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হয়, সেই সময় খুব গোপনে তিনি ভারতে চলে আসেন। আসার সময় তাঁর বিপুল সম্পত্তি তিনি এক জায়গায় মাটিতে পুঁতে রেখে আসেন, আর সেই গুপ্তস্থানের একটা নকশা তিনি তৈরি করে রাখেন। তাঁর বংশধর দুটি ছেলে সে নকশা খুঁজে পায়নি, কারণ, একজন কর্মচারী সে নকশা হস্তগত করেছিল। অথচ এরা সাহস করে সে জায়গা খুঁড়তে পারেনি। তারপর নিতান্ত আকস্মিকভাবে সে মারা যায় এবং নকশা তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে পড়ে। এদিকে এই পুরাতন রাজবংশও পাঁচ-ছয়-পুরুষ ধরে শুধু নকশার গল্প শুনে এসেছে, অনেক স্থান খুঁজেছে, কিন্তু কেউ পায়নি। সেই নকশা এতকাল পরে মিলেছে, কাজেই ইয়াং চাং বা ইউ-উইনের পক্ষে চঞ্চল হওয়া বিচিত্র নয়। শুনেছি, ইয়াং চাং যে পাঁচ-লাখ টাকা ঘোষণা করেছে, সেটা এমন কিছু বেশি নয়। ওদের পূর্বপুরুষের যে সব সম্পত্তি মাটির তলায় আছে তার মূল্য কোটি কোটি টাকা!”
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”আপনি এসব খবর কি করে সংগ্রহ করলেন কাকাবাবু?”
ব্যোমকেশ হাসিলেন, বলিলেন, ”আমাদের এসব খোঁজ রাখতে হয় মা, না হলে চলে না। সমরকে এখান হতে বর্মায় পাঠিয়েছি কিনা, সে সব লিখে জানিয়েছে।”
সমর ব্যোমকেশের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সেও পুলিশে কাজ করে। ইহারই মধ্যে সে পুলিশ-বিভাগে বেশ নাম করিয়া ফেলিয়াছে।
ব্যোমকেশের বাড়িতে চা পান করিয়া কৃষ্ণা বিদায় লইল।
পনেরো
কার্তিকের সকাল-
কৃষ্ণা সেদিনকার সংবাদপত্রখানা পড়িতে পড়িতে দেখিল, সম্পাদক একস্থানে পুলিশের অকৃতকার্যতাকে বিদ্রুপ করিয়াছেন। স্পষ্টই লিখিয়াছেন-সেদিন কলিকাতার মতো নগরীর বুকে একজন দরোয়ান ও পুলিশেরই একজন বড় অফিসার যে নিহত হইলেন, পুলিশ তাহাদের হত্যাকারীকে আজও ধরিতে পারিল না, ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃষ্ণা সংবাদপত্রখানা নামাইয়া রাখিল।
দরজার বাহিরে ভৃত্য দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার দিকে দৃষ্টি পড়িতে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”কি চাই?”
ভৃত্য উত্তর দিল, ”একজন সাহেব দেখা করতে চাচ্ছেন-এই কার্ড পাঠিয়েছেন।”
কার্ডে নাম লেখা-মিঃ আর্থার মুর।
কৃষ্ণা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। মিঃ আর্থার মুরের নাম সে ব্যোমকেশের মুখে শুনিয়াছে। তিনি পুলিশের ডেপুটি-কমিশনার। বিশেষ আবশ্যক ছাড়া তিনি আসেন নাই তাহা সে জানে। কেবল ব্যোমকেশের মুখে নয়, আর্থার মুর তাহার পিতারও বন্ধু ছিলেন, তাহাও সে জানে।
সে আদেশ দিল, সাহেবকে নিয়ে এস।
খোলা জানালাপথে মুখ বাড়াইয়া সে দেখিল, গেটে একখানা ব্রাউন রঙের মোটর দাঁড়াইয়া আছে, তাহা হইতে ইংরাজ ভদ্রলোক নামিলেন।
একটু পরেই সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ পাওয়া গেল, পরমুহূর্তে পর্দা সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন, মিঃ আর্থার মুর।
কৃষ্ণা অভিবাদন করিল, মিঃ মুর প্রত্যাভিবাদন করিলেন। একখানা চেয়ার দেখাইয়া কৃষ্ণা বলিল, ”বসুন।”
মিঃ আর্থার মুর বসিলেন, কৃষ্ণাও বসিল।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”আপনার আসার কারণ জানতে পারলে বিশেষ খুশি হব, মিঃ মুর!”
মিঃ আর্থার মুর বলিলেন, ”কারণটা আপনার জানাই আছে, মিস চৌধুরি! আমি নিজে সবিশেষ ঘটনা আপনার কাছ হতে জানতে চাই। আপনাদের দেশীয় সংবাদপত্রগুলি আমাদের পুলিশের বিরুদ্ধে যে বিষোদগিরণ করছে, তা আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন।”
কৃষ্ণা বলিল, ”হ্যাঁ, আজকের এই পত্রিকাটায় প্রকাশ হয়েছে দেখলুম।”
মিঃ আর্থার মুর বলিলেন, ”সেটা কিছু অন্যায় বলেনি। সত্যই পুলিশের পক্ষে দারুণ কলঙ্কের কথা যে তারা আজও তাদের কাজের পরিচয় দিতে পারলে না। আজ দেড়মাস হতে চলল, পুলিশ ভুলপথে ঘুরছে, একটা তৎপরতার পরিচয় দিলে না। থাক, আপনি বলুন মিস চৌধুরি, বর্মায় আপনার মা কিভাবে হত হয়েছিলেন, কবে আপনার পিতা এই নকশাটা আর বুদ্ধের প্রতিলিপি পেয়েছিলেন ইত্যাদি আমাকে জানান। আমি ব্যোমকেশবাবুর কথা আর বিশ্বাস করতে পারছিনে। তিনি নিজেও ভুলপথে চলেছেন, আমাকেও ভুল বোঝাচ্ছেন, এদিকে লোকের কথায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছি। আমি নিজে একবার তদন্ত করে দেখতে চাই, তাই তাদের কাউকে না জানিয়ে একাই চলে এসেছি। আশা করছি, আপনিও আজ তাদের কিছু জানাবেন না, কারণ, আমার আসার কথা শুনলে হয়তো ব্যোমকেশবাবু পূর্বের মতো তদন্ত নাও করতে পারেন।”
কৃষ্ণা বলিল, ”না, কাকাবাবু কেবল পুলিশ হিসেবেই তদন্ত করছেন না, তিনি বাবার বন্ধু হিসেবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। কাজেই, তদন্ত যে তিনি এককথায় ছাড়বেন তা আমি মনে করিনে।”
অসন্তুষ্ট হইয়া মিঃ আর্থার মুর বলিলেন, ”আপনি নেহাৎ ছেলেমানুষ, মিস চৌধুরি। আপনাকে যে কেউ যাই বলে বুঝাক, আপনি তাই বুঝে যান। আপনার পিতার সঙ্গে আমি এতদিন কাজ করেছি, তাঁকে চিনি বলেই বলছি, তিনি কখনও কোনো লোকের কথা বিশ্বাস করতেন না। অসম্ভাবিত উপায়ে এক বৃদ্ধের কাছে নকশাখানা পেয়ে তিনি আমাকেই প্রথমে দেখিয়েছিলেন, প্রতিলিপি আর কাষ্ঠপাদুকা আমিই তাঁকে মিউজিয়ামে দেওয়ার কথা বলেছিলুম। মাঝে আমি বর্মায় একটা বিশেষ কাজে গিয়ে যখন একমাস ছিলুম, আপনার পিতা প্রায় প্রতিদিনই আমার বাংলোয় আসতেন, সে কথা বোধ হয় আপনার জানা আছে?”
কৃষ্ণা বলিল, ”হ্যাঁ, তাঁর কাছে আপনার নাম শুনেছি।”
মিঃ আর্থার মুর বলিলেন, ”তাহলে বুঝতে পারছেন আমি আপনার পিতার বন্ধু ছিলুম, কাজেই, আমাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আমি একা এসেছি, ব্যোমকেশবাবু বা কোনো পুলিশ আমার সঙ্গে নেই দেখে আপনার সন্দেহ হয়েছে তা বুঝেছি। কিন্তু একটু আগেই বলেছি, এইসব অপদার্থ পুলিশের কাজের পরিচয় যা আমি পেয়েছি তাতে বিরক্ত হয়ে গেছি বলেই ওদের কোনো কথা জানাইনি, একাই এসেছি। আমি নিজে এর রহস্যোদ্ধার করব এই আমার প্রতিজ্ঞা।”
সত্যই কৃষ্ণা সন্দেহ করিয়াছিল। মিঃ আর্থার মুর যখন প্রবেশ করেন, তখন তাঁহার মুখের পানে তাকাইয়াই সে চমকাইয়া উঠিয়াছিল। এ মুখ যেন সে আর কোথায় দেখিয়াছে। কোথায় যে দেখিয়াছে তাহা সে কিছুতেই মনে করিতে পারিতেছিল না, তাই বারবার তাঁহার মুখের পানে চাহিতেছিল।
এতক্ষণে তাহার বিশ্বাস হইল, রেঙ্গুনে থাকিয়া পিতার সঙ্গে আর্থার মুরকে সে দেখিয়াছে। ভালো মনে নাই, মুখের ছাপটা কেবল মনে রহিয়াছে। কৃষ্ণা লজ্জিত হইল বড় কম নয়।
কুণ্ঠিতকণ্ঠে বলিল, ”বাস্তবিকই আমি আর কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে পারিনে, সেইজন্যে আপনাকে অবিশ্বাস করেছিলুম। আমাকে মাপ করবেন, মিঃ মুর; আমার আর অবিশ্বাস নেই, আমি সব কথাই আপনাকে বলছি ।”
বর্মা হইতে এখানে আসা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা সে খুলিয়া বলিল।
মিঃ আর্থার মুর নিবিষ্টমনে সমস্ত কথা শুনিলেন। তাহার পর মুখ তুলিলেন।
”আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মিস চৌধুরি, আপনি ইউ-উইনকে কোনোদিন দেখেছেন কি?”
কৃষ্ণা মাথা নাড়িল, ”না, তবে তার ফটো আছে, আশা করি সেই ফটো দেখে তাকে চিনতে পারব।”
একটু হাসিয়া মিঃ আর্থার মুর বলিলেন, ”ফটো দেখে যথার্থ মানুষকে চেনা যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। ধরুন, আপনার বাড়ির চাকর-দরোয়ানের মধ্যেও ইউ-উইন ছদ্মবেশে থাকতে পারে।”
”চাকর-দরোয়ানের মধ্যে!”
কৃষ্ণা বিবর্ণ হইয়া গেল, পরমুহূর্তে হাসিয়া বলিল, ”না, তা হতে পারে না, মিঃ মুর! কারণ, এরা কালো লোক। শুনেছি, ইউ-উইনকে দেখতে ইউরোপিয়ানদের মতো, গায়ের রং তো সে বদলাতে পারবে না!”
মিঃ আর্থার মুর গম্ভীরভাবে বলিলেন, ”তা বটে, তবু সাবধান থাকা সবদিক দিয়েই উচিত। ব্যোমকেশবাবুর মুখে শুনলুম, আপনার বাড়ির ওধারে যে ভিক্ষুকটা বসে থাকত সেও নাকি ইউ-উইনের গুপ্তচর; নকল নকশাখানা তাকে দিলে, সে যখন চলে যায়, তার পেছনে অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যোমকেশবাবু আহত হয়েছেন। এইখানেই তো তাঁর বোকামি প্রকাশ পেয়েছে।”
কৃষ্ণা সবিস্ময়ে বলিল, ”বোকামি!”
মিঃ আর্থার মুর উত্তেজিতকণ্ঠে বলিলেন, ”বোকামি নয়? সেই লোকটাকে তখনই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল, তাহলে তাকে দিয়েই ইউ-উইনকে ধরবার সম্ভাবনা হত।”
মিঃ আর্থার মুর বিকৃতমুখে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পর বলিলেন, ”যাই হোক, আপনি সে নকশা আর প্রতিলিপি খুব সতর্কভাবে রাখবেন, চাকর-দরোয়ানই হোক আর যেই হোক, কাউকেই বিশ্বাস করে জানাবেন না সেসব কোথায় রেখেছেন। যদি আপনার মনে তেমন সন্দেহ থাকে যে আপনার বাড়িতে এসব বেশিদিন রাখার উপযুক্ত স্থান নেই, তাহলে বরং পুলিশে জমা করে রাখতে পারেন।”
কৃষ্ণা মাথা নাড়িল, বলিল, ”না, আপনাকে বলতে বাধা নেই মিঃ মুর, আমার বাবার শোবার ঘরে দেয়ালে এমন একটা গুপ্ত কুঠরি আছে, যেখানে আমি ছাড়া আর কেউ সন্ধান পাবে না। কাজেই, সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। আমার ঠাকুরদা যখন এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন, তখন এই কুঠরিটি তৈরি করেছিলেন। কেউ এ-সন্ধান জানে না।”
মিঃ আর্থার মুর শান্তকণ্ঠে বলিলেন, ”না জানলেই ভালো। মোট কথা, সাবধানে যেন থাকে। দুর্দান্ত দস্যু ইউ-উইনের অসাধ্য তো কিছুই নেই, বাতাসের মুখে সে খবর পায়। আচ্ছা, আমি এখন উঠি। আশা করি, আমার এই গোপন তদন্তের কথা এখন ব্যোমকেশবাবুকে জানাবেন না, পরে আমিই তাঁকে জানাব।”
তিনি উঠিলেন।
কৃষ্ণা তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে নীচে পর্যন্ত নামিয়া গেল।
ষোলো
ব্যোমকেশবাবু প্রাত্যহিক সংবাদপত্রখানা কেবলমাত্র খুলিয়া বসিয়াছেন, এমন সময় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া দাঁড়াইল, রামদীন কনেস্টবল। কৃষ্ণাকে দেখাশুনা করিবার জন্য সে তাহার বাড়িতে ছিল।
”হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
তাহার মুখের পানে তাকাইয়া ব্যোমকেশ ভয় পাইলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, ”কি হয়েছে রামদীন, কি সর্বনাশ হয়েছে?”
রামদীন যাহা বলিল তাহা এই :
কৃষ্ণা কাল রাত্রে-তাহাদের সহিত যেমন প্রত্যহ কথা বলে তেমনই বলিয়া শুইতে গিয়াছিল। বারান্দায় একজন দরোয়ান যেমন থাকে তেমনই ছিল। আজ সকালে রামদীন উপরে গিয়া দেখিতে পায়, দরোয়ান হাত-মুখ-বাঁধা অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া আছে, ঘরের দরজা খোলা এবং ঘরে কৃষ্ণা নাই। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও কৃষ্ণাকে না পাইয়া সে সন্দেহবশে ঘরে গিয়া দেখিয়াছে, ঘরের একদিককার দেয়াল এতখানি ফাঁক হইয়া আছে, তাহার ভিতর একটা আয়রণ-চেষ্ট খোলা অবস্থায় পড়িয়া আছে। গুরুতর ব্যাপার দেখিয়া সে আগে থানায় ও পরে ব্যোমকেশবাবুকে সংবাদ দিতে আসিয়াছে, সেখানে কনস্টেবল মাধব সিংকে রাখিয়া আসিয়াছে।
সর্বনাশই বটে-
নিজের শারীরিক দুর্বলতা উপেক্ষা করিয়া ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বশ্বাসে কৃষ্ণার বাড়ি ছুটিলেন।
বাড়ি তখন থানার লোকে ভরিয়া গিয়াছে।
কৃষ্ণার ঘরে লুটোপুটির চিহ্ন! দেওয়ালের মধ্যে যে আয়রণ-চেষ্ট ছিল, তাহা খোলা এবং তাহার মধ্যে কিছুই নাই।
সাহেব পর্যন্ত আসিয়াছেন। ব্যোমকেশকে দেখিতে পাইয়াই তিনি বোমার মতো ফাটিয়া পড়িলেন-”তোমরা কাজে ইস্তফা দাও, চক্রবর্তী! গোয়েন্দা বিভাগের নাম তোমরা ডোবালে। এই বাড়িতে দু-দুটো খুন হল, মেয়েটি গুম হল….তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও গিয়ে যাও!”
ব্যোমকেশ মুখ অবনত করিলেন।
সেখানে এতটুকু বিলম্ব না করিয়া তিনি তখনই বাহির হইয়া পড়িলেন।
এও ইউ-উইনের কাজ-
কৃষ্ণাকে সে গুম করিয়াছে। কৃষ্ণার অনিষ্ট করার ইচ্ছা তাহার ছিল না, নিজেই সে তাহা বলিয়াছে। কোনোরকমে সে কৃষ্ণার শয়নকক্ষে গুপ্তস্থানের সন্ধান পাইয়াছে এবং তাহাই আবিষ্কার করিতে গিয়া কৃষ্ণার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া নিতান্ত বাধ্য হইয়াই তাহাকে লইয়া গিয়াছে ইহা বেশ বুঝা যায়।
জাহাজ-ঘাটে উপস্থিত হইয়া তিনি খোঁজ লইয়া জানিতে পারিলেন, আজই একখানা জাহাজ রেঙ্গুন অভিমুখে যাত্রা করিবে, ইতিমধ্যে তাহার প্যাসেঞ্জাররা টিকিট সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। সমস্ত খবর সংগ্রহ করিয়া থানায় খবর দিয়া তিনি বাড়িতে উপস্থিত হইলেন।
বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, কনিষ্ঠ ভ্রাতা সমর বর্মা হইতে ফিরিয়াছে, তাহার সহিত ফিরিয়াছেন শীর্ণাকৃতি প্রণবেশ।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, ”ব্যাপার কি, প্রণববাবু?”
প্রণবেশ বলিলেন, ”ইউ-উইনের কাণ্ড, ব্যোমকেশবাবু! ইয়াং চাংকে খুঁজতে গিয়ে একেবারে ইউ-উইনের মুখে! কি ভাবে যে আমায় বর্মায় পাঠিয়েছিল তাও জানিনে। জ্ঞান ফিরে আসতে দেখি, এক ভদ্রলোক আমায় আশ্রয় দিয়েছেন। তারপর সমরবাবুর সঙ্গে দেখা, উনিই আমায় নিয়ে এলেন। বাড়ি যেতে সাহস পাচ্ছিনে, শুনছি, কৃষ্ণাকে নাকি চুরি করে নিয়ে গেছে।”
গম্ভীরভাবে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”তাই বটে। আজ একখানা বর্মাগামী জাহাজ ছাড়বে শুনলুম। আমার মনে হয়, ইউ-উইন যে-কোনোরকমে হোক, কৃষ্ণাকে নিয়ে আজই বর্মা রওনা হবে; কারণ, যে নকশা আর বুদ্ধের প্রতিলিপির জন্যে সে এখানে ছিল তা সে পেয়েছে। ইয়াং চাং আজ বোম্বে হতে ফিরেছেন শুনে আমি এইমাত্র দেখা করেছিলুম, সব কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, কেউ তাঁকে বোম্বে হতে টেলি করেনি; পাছে নকশা তাঁর হাতে সেদিনই পড়ে তাই তাঁকে জরুরি টেলি করে সরানো হয়েছিল! আরও একটা খবর পেলুম, কাল সকালে নাকি পুলিশের ডেপুটি-কমিশনার কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে গেছলেন। আমি শুনেই মিঃ আর্থার মুরের কাছে গেছলুম, তিনি শুনে আকাশ হতে পড়লেন। আমি বুঝছি, আর্থার মুর নাম দিয়ে ইউ-উইন কৃষ্ণার কাছে গিয়েছিল। কোনো সূত্রে সেই সময় জেনেছে, নকশা কৃষ্ণার ঘরে দেয়ালের মধ্যে গুপ্তস্থানে আছে। নিশ্চিত জেনে সে রাত্রে এসে নকশা আর প্রতিলিপি নিয়ে গেছে। যাই হোক, আজ রাত্রে যে জাহাজে ছাড়বে তাতে আমরা সার্চ করতে যাব-অনুমতি এনেছি, প্রস্তুত থাকুন।”
সতেরো
সেইদিনই রাত্রে-
জাহাজখানা কেবল ছাড়িবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় সদলবলে ব্যোমকেশ জাহাজে গিয়া উঠিলেন।
পুলিশের পরওয়ানা দেখাইয়া তাঁহারা অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। জাহাজের সব লোকদের একটা স্থান রাখা হইল, কেবিনের আরোহীদের বাহির হইতে নিষেধ করা হইল।
ওদিকে জাহাজের পিছনে যে বোটখানা ভাসিতেছিল সেদিকে কাহারও লক্ষ্য ছিল না। অন্ধকারে প্রচ্ছন্নভাবে আট-দশজান লোক জাহাজ হইতে সেই বোটে গিয়া উঠিল এবং ক্ষিপ্রহস্তে বোট ছাড়িয়া দিল…মোটর-বোট সাঁ-সাঁ করিয়া ভাসিয়া চলিল।
সমর চিৎকার করিয়া উঠিল-”ইউ-উইন পালাচ্ছে-সাবধান!”
টর্চের আলো দিয়া দেখা গেল-বোট তখন বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে।
দ্রুম!!…দ্রুম!!
একসঙ্গে তিন-চারিটি বন্দুক গর্জন করিয়া উঠিল-বোটের তাহাতে এতটুকুও ক্ষতি হইল না।
হতাশভাবে ব্যোমকেশ বসিয়া পড়িলেন-”আঃ, ইউ-উইন পালাল…ধরা গেল না!”
সমর বলিল, ”ওকে ধরা প্রায় দুঃসাধ্য। বর্মা-পুলিশও ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাজেই নকশা পেলেও সে কাজে লাগাতে পারবে না।”
প্রণবেশ উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিলেন, ”বোটে কৃষ্ণাকে নিয়ে যায়নি তো?”
সমর বলিল, ”না, আমি দেখেছি ওতে আটজন লোক আছে, সবাই পুরুষ, মেয়ে কেউ নেই।”
দ্বিতলে যে কেবিনটি মিঃ রবার্টসন নামে জনৈক ইউরোপিয়ান লইয়াছিলেন তাহাতে কোনো লোককে দেখা গেল না।
ব্যোমকেশ দাঁতের উপর দাঁত রাখিয়া বলিলেন, ”এখন বোঝা যাচ্ছে, এই রবার্টসনই ইউ-উইন; আমাদের সাড়া পেয়েই সে পালিয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য তার নিজেরই বোট এই জাহাজে রেখেছিল, বিপদ দেখে সেই বোটেই পালিয়েছে।”
কেবিনের পার্শ্বে বাথরুম, এ ঘরের দরজায় তালাবন্ধ।
প্রণবেশ বলিলেন, ”নিশ্চয়ই এই ঘরে কৃষ্ণাকে রেখেছে।”
ব্যোমকেশ তালা ভাঙিতে আদেশ দিলেন। দরজা খুলিতেই প্রণবেশ চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ”এই যে কৃষ্ণা…”
হাত-পা বদ্ধ কৃষ্ণা পড়িয়া আছে, সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থা।
জাহাজের ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ”ক্লোরোফর্ম দিয়া অজ্ঞান করিয়া রাখা হইয়াছে, জীবনের আশঙ্কা নাই।”
একখানা স্ট্রেচারে কৃষ্ণাকে তুলিয়া ব্যোমকেশবাবু জাহাজ ত্যাগ করিলেন। উপযুক্ত প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত জাহাজ আটক রহিল।
পরদিনকার কথা।
কৃষ্ণার মুখে জানা গেল, ইউ-উইন মিঃ আর্থার মুরের নাম লইয়া আসিয়াছিল এবং সেও একান্ত বিশ্বাসের সঙ্গে গুপ্তস্থানের কথা বলিয়াছিল। গভীর রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া নিজেকে সে বন্দিনী অবস্থায় দেখিয়াছিল; চিৎকার করিতে পারে নাই, তাহাকে ক্লোরোফর্ম দিয়া অজ্ঞান করা হয়।
প্রণবেশ সানন্দে বলিলেন, ”যাকগে নিয়ে পরের নকশা আর প্রতিলিপি; তুমি যে বেঁচে আছ, তোমায় যে আমরা ফিরে পেয়েছি, এই আমাদের অনেক লাভ, মা।”
কৃষ্ণা ম্লান হাসিল। সেই মুহূর্তেই আবার তাহার মুখখানা রক্তরাঙা হইয়া উঠিল। তাহার মন বলিতেছিল, ভগবান যে তাকে এ-যাত্রা বাঁচিয়েছেন সে কেবল প্রতিশোধ নেবার জন্য। এখন চাই শুধু প্রতিশোধ-হত্যার প্রতিশোধ!
ব্যোমকেশ শুধু দারুণ হতাশায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। পাখি উড়িয়া গেল, হাতের ডেলা তাঁহার হাতেই রহিয়া গেল, এ বড় কম দুঃখের কথা নয়।
__