ভলিউম ৭ – বোম্বেটে – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৮৯
০১.
ক্যারোলিন! চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন জিনার বাবা মিস্টার পারকার। এই, ক্যারোলিন, কোথায় তুমি?
এই যে, এখানে, বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন জিনার মা। ঘর সাফ করছি। …কি হলো, এতো চেঁচাচ্ছো কেন?
এই দেখো না, টেলিগ্রাম, বললেন মিস্টার পারকার। প্রফেসর কারসওয়েল। চিনেছো?
কয়েক বছর আগে যে এসেছিলো? খালি খাওয়ার কথা ভুলে যেতো, সেই লোকটা তো? স্বামীর কোটের হাতায় লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে দিলেন মিসেস পারকার।
ওভাবে ঝাড়ছো কেন? ভুরু কোঁচকালেন মিস্টার পারকার। আমি কি ময়লার ডিপো নাকি?…শোনো, আজ আসছে। এক হপ্তা থাকবে।
চমকে উঠলেন মিসেস পারকার। কিন্তু জিনারাও তো আসছে আজ! তুমি জানো।
অ্যাঁ, তাই তো…ভুলে গিয়েছিলাম। থাক, জিনাকে ফোন করে দাও, আগামী হপ্তায় আসতে বলো। জিনার সঙ্গে আবার কিশোর, মুসা আর রবিনও তো আসবে। না, এ-হপ্তায় ওদের আসা চলবে না। প্রফেসরের সঙ্গে আমি শান্তিতে কাজ করতে চাই। নতুন একটা আবিষ্কারের ব্যাপারে..আরে, ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
তোমাদের পাগলামির জন্যে ছেলেমেয়েদের আনন্দ আমি নষ্ট করতে পারবো। ওরা আজই আসবে। হয়তো এতোক্ষণে রওনা হয়ে গেছে…এক কাজ করো। তোমার বন্ধুকেই মানা করে দাও, যেন পরে আসে।
বেশ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন মিস্টার পারকার। গৃহিণীকে চটিয়ে দিয়ে পারিবারিক অশান্তি আর অসুবিধে সৃষ্টি করতে চান না। তবে, প্রফেসর খুব মাইণ্ড করবে। বন্ধুকে ফোন করার জন্যে চলে গেলেন তিনি।
বেডরুমে আবার ফিরে এলেন মিসেস পারকার। তাঁকে সাহায্য করার জন্যে একজন কাজের লোক রেখেছেন, তাঁরই বয়েসী এক মহিলা, নাম আইলিন।
সব চেয়ে বেশি অসুবিধে হবে থাকার, বললেন মিসেস পারকার।
ঘর থেকে সবই শুনেছে আইলিন। ঝুল পরিষ্কার করতে করতে মাথা নাড়লো।
ওই যে, আবার ডাকছে। তুমি কাজ করো, আমি শুনে আসি, আবার ঘর থেকে বেরোলেন জিনার মা।
স্টাডি থেকে ডাকছেন মিস্টার পারকার। সে-ঘরে ঢুকলেন জিনার মা। আবার কি হয়েছে?
এই দেখো না, কি কাণ্ড, রিসিভারটা ধরে রেখেছেন মিস্টার পারকার। প্রফেসর নাকি অনেক আগেই রওনা হয়ে গেছে। প্লেনে করে। ইংল্যাণ্ড থেকে আসতে আর কতো সময় লাগবে? আজই পৌঁছে যাবে..আর হ্যাঁ, সঙ্গে তার ছেলেকে নিয়ে আসছে!
তার ছেলে! সত্যি! আমি ওদের জায়গা দেবো কোথায়?
আর তো কোনো উপায় নেই। জিনাকেই ফোন করো। বুঝিয়ে বলো, আগামী হপ্তায় যেন আসে। নাও, ধরো, রিসিভার বাড়িয়ে দিলেন মিস্টার পারকার।
ডায়াল করলেন মিসেস পারকার। হ্যাল্লো। কে?..মিসেস পাশা?… কিশোর কোথায়?.রওনা হয়ে গেছে? কখন?..না না, এমনি। ওরা আসছে কিনা জানার জন্যে. হ্যাঁ। রাখি। গুড বাই। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জিনার মা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, রওনা হয়ে গেছে, সকালে। যে কোনো সময় এসে পড়বে। আমি এখন কি যে করি!…তোমাকে নিয়ে আর পারি না। খালি কথা ভল যাও। আর তোমার প্রফেসর বন্ধুও…
আমি কি করবো? রেগে গেলেন বদমেজাজী বিজ্ঞানী। আমি চিঠি দিয়েছি আসার জন্যে, আসছে। টেলিগ্রাম পেলাম আজ…
সেজন্যেই তো বলছি, খালি ভুলে যাও। তুমি তো জানো, ছেলেমেয়েগুলো আজ আসবে, তারপরেও চিঠি লিখতে গেলে কেন? আর লিখলেই যখনু, আগামী হপ্তায় আসতে বললে কি হতো? আসুক, আমি কিছু জানি না। থাকার ব্যবস্থা ভুমি। করবে। আর না পারলে নিজে গিয়ে শুয়ো কয়লা রাখার ঘরে…
ওসব আমি জানি না, কড়া গলায় বললেন মিস্টার পারকার। আইলিন আছে। দুজনে মিলে একটা কিছু ব্যবস্থা করো গিয়ে। আমার অনেক কাজ। এই কাজগুলো, টেবিলে রাখা কাগজের উঁচু একটা স্থূপ দেখালেন তিনি। সব পড়ে শেষ করতে হবে…যাও এখন। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে…
তোমার যাচ্ছে! আর আমার হয়ে গেছে। আমি বলে দিচ্ছি…জানালার দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ থেমে গেলেন মিসেস পারকার। আরি, দেখো দেখো!
দেখে মিস্টার পারকারও অবাক হলেন। বানর! ওটা এলো কোত্থেকে?
নিচতলা থেকে আইলিনের ডাক শোনা গেল। ম্যাডাম, দেখে যান…বোধহয় আপনাদের মেহমান… বানরটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন মিসেস পারকার। জানালার কাছে নাক ঘষছে ছোট্ট জীবটা, হাস্যকর শিশুসুলভ ভাবভঙ্গি। নিশ্চয়। তোমার বন্ধু! গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। বানরটাও কি ওদের নাকি? দুম দুম করে কিল পড়লো সদর দরজায়, সারা বাড়ি কেঁপে উঠলো।
তাড়াতাড়ি নিচের তলায় ছুটে এলেন দুজনে।
হ্যাঁ, প্রফেসর কারসওয়েলই এসেছেন। সঙ্গে তাঁর ছেলে। বয়েস নয়-দশের বেশি না। বানরটা এখন বসে রয়েছে ছেলেটার কাঁধে, কখন কিভাবে নেমে এসেছে কে জানে। বানর আর তার মনিবের চেহারায় খুব একটা অমিল নেই।
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছেন প্রফেসর। ড্রাইভারের দিকে চেয়ে। বাজখাই গলায় হাঁকলেন, এই, বসে আছো কেন? ব্যাগট্যাগগুলো নামাও। হাঁ। করে কি দেখছো? মিসেস পারকারের দিকে ফিরলেন। এই যে, ম্যাডাম, ভালো। আছেন? আবার এলাম আপনাকে জ্বালাতে।…তা আপনার স্বামী কোথায়? বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। এই যে, হ্যারি। অনেক ইন্টারেস্টিং নিউজ আছে।
এগিয়ে এসে হাত মেলালেন মিস্টার পারকার। আমার কাছেও আছে। চিঠি। পেয়েই চলে এসেছো, খুব খুশি হয়েছি।
এই যে আমার ছেলে… এতো জোরে ছেলের পিঠে থাবা মারলেন প্রফেসর, আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো ছেলেটা। নামটা যেন কি? খালি ভুলে যাই। থাক, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লেন কারসওয়েল। ডাক নামটাই বলি। টকার। মোটরকারের মা আর ট-এর পরে র-টা বাদ দিয়ে দিয়েছি। নিজেকে সারাক্ষণ মোটর গাড়ি ভাবে সে, আর বেশি কথা বলে, সে-জন্যেই এই নাম রেখেছি। হাহ হাহ হা!…আরে, নটি গেল কোথায়? দুষ্ট, দুষ্ট, ভীষণ দুষ্ট, তাই। টকারই ওর নাম রেখেছে টি। আরে গেল কোথায় বানরটা?
বোবা হয়ে গেছেন যেন মিসেস পারকার। একনাগাড়ে কথা বলে চলেছেন। প্রফেসর কারসওয়েল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। বানরটাকে দেখা গেল একটা স্ট্যাণ্ডের উপর হ্যাট রাখার স্ট্যাণ্ড–আগায় চড়ে বসে প্রাণপণে দোলাচ্ছে; যেন প্রতিজ্ঞা করেছে সবগুলো হ্যাট মাটিতে না ফেলে ছাড়বে না।
এ-তো সার্কাস বানিয়ে ফেলবে!..হতাশ হয়ে ভাবলেন মিসেস পারকার– আমি এখন কি যে করি! ঘরগুলোও পরিষ্কার হয়নি ঠিকমতো। দুপুরের খাবারেরই বা কি হবে? ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েগুলোও যদি এসে যায়…আর বানরটা যা শুরু করেছে! হ্যাটগুলো ফেলে এখন গিয়ে বসেছে হলের বড় আয়নাটার সামনে। নিজেকেই মুখ ভেঙচাচ্ছে।
সবার সঙ্গে কিভাবে যে লিভিংরুমে ঢুকলেন মিসেস পারকার, বলতে পারবেন, না মিস্টার পারকার ছুটে গিয়ে স্টাডি থেকে একগাদা কাগজ এনে টেবিলে বিছিয়ে বসে পড়লেন ওখানেই। আলোচনার জন্যে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চান না।
এখানে নয়! এতোক্ষণে মুখ খুললেন মিসেস পারকার, কঠিন কণ্ঠে বললেন, তোমার স্টাডিতে যাও।…আইলিন, প্রফেসর সাহেবের মালপত্রগুলো গেস্টরুমে। দিয়ে এসো। ছেলেটা এঘরেই থাকবে, সোফায় শোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাও, জলদি রেখে এসো।
বানরটার কি হবে? আড়চোখে ওটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো আইলিন। ওটারও কি বিছানা…
ও আমার সঙ্গেই থাকবে, বয়েস আর শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক জোরালো কণ্ঠ ছেলেটার। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে দিলো দৌড়। বিচিত্র শব্দ করছে।
অবাক হয়ে বললেন মিসেস পারকার, কি হলো? পেট ব্যথা?
না না, বললেন তার বাবা। ওসব কিছু না। বললাম না, মোটরগাড়ির পাগল। নিজেকে মোটরগাড়ি ভাবে। দৌড়ায় আর এঞ্জিনের শব্দ করে।
আমি একটা গাড়ি, জাগুয়ার কার। সিঁড়ির মাথা থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলো। টকার। এঞ্জিনের শব্দ শুনছেন না? হি-র-র-র-র-র!…এই নটি, জলদি আয়। গাড়িতে চড়বি না?
প্রায় চোখের পলকে সিঁড়ি পেরিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে মনিবের কাঁধে চড়ে চুল খামচে ধরলো নটি। তীক্ষ্ণ কিচমিচ করে উঠলো। ছুটলো জাগুয়ার। প্রচণ্ড গতিতে বেডরুমের ভেতর থেকে ঘুরে এলো একবার, মাঝে মাঝে বিকট শব্দে হর্ন দিচ্ছে।
সব সময় ওরকম করে? প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন মিসেস পারকার। কাজ করেন কিভাবে?
না, অসুবিধে হয় না, জানালেন প্রফেসর। বাগানে একটা সাউণ্ডপ্রফ ঘর বানিয়ে নিয়েছি। হ্যারি, তোমার স্টাডিও সাউণ্ড প্রুফ, না?
না, ভাই, জাগুয়ারের শব্দ সইতে না পেরে কানে আঙুল দিলেন মিস্টার পারকার। ছেলে একখান কারসওয়েলের! দুই মিনিটে পাগল করে দেবে সুস্থ মানুষকে! এক হপ্তা কাটবে কি করে? তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, স্টাডিতে চলো।
স্টাডিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু বৃথা। এ-বাড়ির এমন কোনো দরজা নেই, যা ওই হর্নের শব্দ ঠেকাতে পারে।
ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে কুলাতে পারছে না আইলিন। সারা বছরের জন্যে যেন চলে এসেছেন প্রফেসর, এতো মালপত্র এনেছেন। কোনো হোটেলে গিয়ে উঠলো না কেন?–সেগুলোর দিকে চেয়ে থেকে ভাবছেন মিসেস পারকার। জিনারাও এলো বলে। আর সঙ্গে রাফিয়ানকে না নিয়ে আসবে না জিনা। এতগুলো প্রাণী থাকার জায়গা কোথায় করবেন তিনি?
.
০২.
বাস থেকে নেমেই চারটে সাইকেল ভাড়া করলো জিনা। এক হপ্তা থাকবে। বাড়িতে। ততোদিন ঘোরাঘুরির জন্যে সাইকেল দরকার। ক্যারিয়ারে মালপত্র তুলে নিয়ে সাইকেলে চেপে গোবেল ভিলার উদ্দেশে চললো চারজনে। পাশে পাশে। দৌড়ে চললো রাফিয়ান।
দারুণ হবে, না! প্যাড়াল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো মুসা। দোতলার জানালা দিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে থাকা, খোলা সাগর, খোলা আকাশ! জিনা, এবারও কি তোমার দ্বীপে পিকনিক করতে যাবে?
দেখি, বললো জিনা। এখন গিয়ে বোধহয় সুবিধে হবে না, বৃষ্টির দিন তো। যখন তখন নামবে, দ্বীপে আরাম পাবো না।
বাড়িতেই বা মন্দ কি? রবিন বললো। আর ক্যারোলিন আন্টিও যা ভালো …বেশি হৈ-চৈ করবো না আমরা, আংকেলকে ডিস্টার্ব না করলেই হবে। তাহলেই আর চটবেন না।
আমার মনে হয় না বাবার হাতে এখন কোনো জরুরী কাজ আছে, বললো জিনা।
থাকতেও পারে, বললো কিশোর। চুপচাপ বসে থাকতে হলেই মরেছি। কিছু একটা কাজ না পেলে শুধু সাগর আর আকাশ দেখে কি করে কাটাবো?
কি কাজের কথা বলছে কিশোর, বুঝতে পারলো অন্য তিনজন। রহস্য কিংবা অ্যাডভেঞ্চার। কিশোর পাশার নেশা।
এগিয়ে চলেছে ওরা।
একপাশে সাগর, ঘন নীল একটা বিশাল আয়না যেন, চকচক করছে উজ্জ্বল রোদে।
সত্যি তুমি লাকি, জিনা, সেদিকে চেয়ে মুসা বললো। এতো সুন্দর জায়গায় বাড়ি…
হাসলো শুধু জিনা।
ওই যে, তোমাদের বাড়ির চিমনি, কিছুক্ষণ পর আবার বললো মুসা। ধোয়া উড়ছে! নিশ্চয় রান্নাঘরের। আমরা এতোগুলো মানুষ যাচ্ছি, দুপুরের রান্না চড়িয়েছেন ক্যারোলিন আন্টি…আহ, মনে হচ্ছে এখান থেকেই সুগন্ধ পাচ্ছি!
গতি বাড়িয়ে দিলো সে।
তার কাণ্ড দেখে হেসে উঠলো সবাই।
গোবেল ভিলার পেছনের গেটে এসে সাইকেল থেকে নামলো চারজন। গ্যারেজের পাশের ছাউনিতে নিয়ে গিয়ে রাখলো সাইকেলগুলো। তারপর চিৎকার করতে করতে দৌড় দিলো জিনা, মা, মাআ, আমরা এসে গেছি! কোথায় তুমি? মা?
পাশে ছুটছে তিন গোয়েন্দা।
হঠাৎ খপ করে জিনার হাত চেপে ধরলো রবিন। জিনা, দেখো! ওই যে, জানালায়!
আরে, বানর এলো কোত্থেকে!…এই এই, রাফি, যাবি না! খবরদার!…আয়, আয় বলছি!
কিন্তু রাফিয়ানকে থামানো গেল না। জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে রাখা ছোট্ট জীবটাকে চিনতে পারছে না কুকুরটা। ওটা কি ছোট কোনো কুকুর? নাকি অদ্ভুত কোনো বেড়াল? যা-ই হোক, তাড়াবে ওটাকে, বাড়িছাড়া করে ছাড়বে। গলা। ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে দরজার দিকে দৌড় দিলো সে। বেরিয়ে আসছিলো টকার, বিশাল কুকুরের ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। আতঙ্কিত হয়ে বানরটা লাফ দিয়ে। গিয়ে ধরলো দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির ফ্রেম, কিনার ধরে ঝুলে রইলো।
এই কুত্তা! হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালো টকার। আমার নটিকে বি না! খবরদার বলে দিচ্ছি! বলেই ঠাস করে এক চড় মারলো রাফিয়ানের নাকেমুখে।
ছুটে গিয়ে দ্বিগুণ জোরে ছেলেটার গালে চড় মারলো জিনা। চেঁচিয়ে বললো, শয়তান ছেলে কোথাকার! এত্তোবড় সাহস! আমার রাফির গায়ে হাত দিস! ওটা কি, ওই বাঁদরটা?
মনিবের দুরবস্থা দেখে আরও ঘাবড়ে গেল বানরটা। ছবি ধরে ঝুলে থেকে বিচিত্র কিচির মিচির জুড়ে দিলো। হট্টগোল শুনে দোতলা থেকে নেমে এলো আইলিন। জিনা কিংবা তিন গোয়েন্দাকে আগে দেখেনি সে, তবে বলে দিতে হলো না ওরা কারা। চিনতে পারলো। বললো, কি হয়েছে, জিনা? বানরটা কি করেছে?…আরে এই রাফি, থাম! বাড়ি মাথায় করে ফেলেছিস তো! এই ছেলে, তুমি কাঁদছো কেন? তোমার বানরকে খেয়ে ফেলছে নাকি?
কে বললো কাঁদছি? তেজের সঙ্গে জবাব দিলো টকার। দুহাতে চোখ ডলছে। নটি, নেমে আয়। আয় বলছি.. হারামজাদা কুত্তা খালি ছুঁয়ে দেখুক না তোকে…
না না, কিছু করবে না, এগিয়ে এসে অভয় দিয়ে বললো কিশোর। তুমি তোমার বানরটাকে নামাও। ছবিটা ফেলে দেবে তো।
জিভ টাকরায় লাগিয়ে চুকচুক করে ডাকলো টকার। ছবি ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধে লাফিয়ে নামলো নটি। গলা জড়িয়ে ধরে কুকুরটার দিকে চেয়ে কিচমিচ করে। উঠলো। ভয় যাচ্ছে না।
এই রাফি, ধমক দিলো মুসা। ওটা তোর সমান হলো নাকি? থাম।
ওকে ধমকাচ্ছো কেন? জিনার চোখে আগুন জ্বলছে। ঠিকই তো করছে ও। কে না কে এসে বাড়িতে ঢুকে বসে আছে!…এই ছেলে, কে তুমি?
বলবো না! রাগে গটমট করে বেরিয়ে গেল টকার।
আপনি নিশ্চয় আইলিন? আমি মুসা আমান। ছেলেটা কে?
মিস্টার পারকারের বন্ধু, প্রফেসর কারসওয়েলের ছেলে। আজই এসেছে। আগামী হপ্তায় আসার কথা ছিলো, আগেই এসে বসে আছে।
এখানে থাকবে নাকি? আঁতকে উঠলো জিনা। বাবার তো নেইই, মারও আক্কেল নেই! জানে না, আমরা আসছি? জায়গা দিলো কেন?
থামো, জিনা, হাত তুললো কিশোর। শান্ত হও। আগে শুনিই না সব কথা। হয়তো কোনো ভুল হয়েছে…
হ্যাঁ, ভুলই, বললো আইলিন। মিস্টার পারকার ভুলেই গেছেন, তোমরা আসছে। বন্ধুকে আসার জন্যে চিঠি লিখে দিয়েছেন। বন্ধুও চিঠি পেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি, এক হপ্তা আগেই চলে এসেছেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ছেলেকে, তার সঙ্গে আবার একটা বানর। জিনার মা তো ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এতোগুলো মানুষের থাকার জায়গা করবেন কোথায়? প্রফেসর নাহয় গেস্টরুমে থাকলেন, তাঁর ছেলে সোফায়। কিন্তু তোমরা
আমি ওসব বুঝি না, সব শুনে রাগ আরও বাড়লো জিনার। এখুনি গিয়ে মাকে বলছি…
পাগলামি করো না, জিনা, বিরক্ত হয়ে বললো কিশোর। ব্যবস্থা একটা হবেই। তোমার রাগ সামলাও।
হ্যাঁ, ব্যবস্থা করা হচ্ছে, বললো আইলিন। চিলেকোঠায় দুটো ম্যাট্রেস। বিছিয়ে দেবো, তোমরা তিনজন থাকতে পারবে, তিন গোয়েন্দার দিকে আঙুল নাড়লো সে। কিন্তু যা ধুলো জমেছে, সাফ করতে লাগবে একদিন…বাতাসও খুব। বেশি। ঝড় এলে আর উপায় নেই। ঠাণ্ডায়…
তাতে কিছু হবে না, হাত নেড়ে বললো কিশোর। ধুলো আমরাই সাফ করে নিতে পারবো। আর ঠাণ্ডার সময় কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকবো, আরামই লাগবে।
আন্টি কই? মেজাজ নিশ্চয়ই খারাপ?
হবে না? তিনি বলেই সামলে নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে…আর প্রফেসরেরই কেমন আক্কেল? অন্যের বাড়িতে এমনভাবে ঢুকে পড়লেন, যেন তাঁর নিজের বাড়ি। মালপত্র দিয়েই, বোঝাই করে ফেলেছেন ঘর। তার ওপর আবার একটা আজব ছেলে আর বানর! আমি যখন থালাবাসন ধুই, কেমন জুলজুল করে চেয়ে থাকে ওটা, মনে হয় এসে আমার সঙ্গে সে-ও হাত লাগাতে চায়।
রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন জিনার মা। এই যে, এসে পড়েছে, হেসে বললেন। রাফির ডাক শুনলাম। রাফি, দেখে চমকে যাবি, একটা বানর। এসেছে।
চমকে গেছে এসেই, মুখ কালো করে বললো জিনা। মা, তুমি জানো আমরা আসছি। তার পরেও কি করে ওদের জায়গা দিলে?
আহ, জিনা, কি শুরু করলে? তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। তুমি এমন করতে থাকলে আমরা চলেই যাবো।…আন্টি, আপনি কিছু ভাববেন না। দরকার হলে দ্বীপে গিয়ে থাকবো আমরা…
তুমি খুব ভালো ছেলে, কিশোর, হাসলেন মিসেস পারকার। অস্বস্তি দূর। হলো চেহারা থেকে। প্রফেসর না এলে কোনো অসুবিধে হতো না তোমাদের, জানোই তো। আর যেমন প্রফেসর কারসওয়েল, তেমনি তোমার আংকেল। দুজনেই এমন ভুলো মন। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও মনে করতে পারবে না। ভাববে, হায় হায়, পেটে মোচড় দেয় কেন!
হেসে উঠলো সবাই।
সে হঠাৎ দরজার দিকে ঘুরে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফিয়ান। আবার বানরটার গন্ধ পেয়েছে। কিচমিচ শুনে ছুটে গেল। কী, বাদরের বাচ্চা, আমাকে গাল দেয়! এতোবড় সাহস! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! এমনি ভাবসাব। কুকুরটার।
সিঁড়ির রেলিঙে বানরটা বসে আছে। রাফিকে দেখেই নাচতে শুরু করলো, মুখ ভেঙচাচ্ছে।
লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠলো রাফিয়ান। কিন্তু বানরটাকে ধরতে পারলো না। তাতে রাগ গেল আরও বেড়ে। তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল স্টাডির দরজা। গটমট করে বেরিয়ে এলেন দুই প্রফেসর। রাগে চোখমুখ লাল।
কী, হয়েছে কি! চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার পারকার। শান্তিতে কাজ করতে পারবো না নাকি?
না না, পারবে পারবে, বললেন বটে মিসেস পারকার, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, সারাদিনই ঘটতে থাকবে এ-ধরনের ঘটনা। বানরটাকে নতুন দেখেছে তো, সহ্য করতে পারছে না এখনও রাফি। ঠিক হয়ে যাবে সব। যাও, কাজ করোগে। দরজাটা বন্ধ করে দিও। আমি দেখবো, আর যেন গোলমাল করতে না পারে।
ঘাউ-ঘাউ করে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে রাফিয়ান। চোখে পড়লো প্রফেসরকে। নতুন লোক দেখে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তার ওপর। সিঁড়ি থেকে নেমে তেড়ে এলো।
এক দৌড়ে গিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পড়লেন কারসওয়েল।
হাসি থামাতে পারলো না ছেলেরা। বিশেষ করে মুসা। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল তার।
জিনা, কুত্তাটাকে থামা! গর্জে উঠলেন মিস্টার পারকার। নইলে দেবো বিদেয় করে! বলে আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন কাজের ঘরে।
উঁহ, দেবো বিদেয় করে! পেছন থেকে মুখ ভেঙচে বললো জিনা। ভাগ্যিস তার বাবা শুনতে পাননি। মা, বাবাকে হুঁশিয়ার করে দিও। রাফি চলে গেলে আমিও যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।..আরি, বানরটার কাণ্ড দেখো! আরে ঘড়ির ওপর বসেছে তো! নষ্ট না করে দেয়!..বিদেয় করবে, বললেই হলো। কেন, রাফিকে কেন, ওই বাঁদরের বাচ্চাটাকে দেখে না?
.
০৩.
কাজে হাত দিলো তিন গোয়েন্দা। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে চিলেকোঠায় তুললো দুটো পুরনো ম্যাট্রেস। ঠাণ্ডা বাতাস! কিন্তু কি করার আছে? বাইরে তাঁবুতে থাকলে ঠাণ্ডা আরও বেশি লাগবে।
গাল ফুলিয়েই রেখেছে জিনা।
ওরকম করে রাখলে শেষে আবার নামাতে পারবে না, ঠাট্টা করলো মুসা। ফুলেই থাকবে। হাসো, হাসো। তোমার মায়ের কথা একবার ভাবো? আমাদের চেয়ে তাঁর অবস্থা বহুত খারাপ। কি চিন্তায়ই না পড়েছেন!
আসলেই মিসেস পারকারের অবস্থা কাহিল। নয়জন লোকের খাবার জোগাড় করা, সহজ ব্যাপার নয়। রান্নাঘর থেকে আর বেরানোর জো নেই বেচারি আইলিনের। ছেলেমেয়েরা ঘরের কাজে সাহায্য করলো। সাইকেল নিয়ে বাজারে গেল বাজার করে আনতে।
ওই টকারটা কিছু করে না কেন? পরের দিন রাগ করে বললো জিনা।
করে না কে বললো? ওই তো করছে, হেসে বাগানের দিকে দেখালো রবিন।
বাগানময় ছুটে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। ভীষণ শব্দ করছে।
এই টকার, চুপ করবে? ডেকে বললো জিনা। তোমার বাবার কাজে। অসুবিধে হচ্ছে…,
তুমি চুপ করো! ধমক দিয়ে বললো টকার। দেখছো না আমি এখন বেন্টলি কার হয়েছি? ভারি শক্তিশালী এঞ্জিন। আর এই দেখো, ব্রেক করলে কেমন। নিঃশব্দে থেমে যায়, একটুও ঝাঁকুনি লাগে না। আর দেখো… বলেই জোরে পোঁ পোঁ করে হর্ন বাজালো দুবার। দারুণ, তাই না?
খুলে গেল স্টাডিরুমের জানালা। দেখা গেল দুই বিজ্ঞানীর ক্রুদ্ধ মুখ।
এই টকার, কি হচ্ছে? রেগেমেগে বললেন কারসওয়েল। এতো হৈ-চৈ কিসের? চুপ করে থাকতে পারো না?
বেন্টলি গাড়ি কিছুতেই নিঃশব্দে চলতে পারে না, বোঝানোর চেষ্টা করলো। টকার। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চাইলেন না বোকা মানুষ দুজন। শেষে একটা মিনি-কার হওয়ার অনুমতি চাইলো সে। এই দেখো না, বাবা, কেমন আস্তে শব্দ করে, ছুটতে ছুটতে শব্দ করে দেখালো টকার। ধরতে গেলে কোনো শব্দই নেই…।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল জানালা।
দরজা খোলা পেয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো মিনি-কার। জানালো, খুব খিদে পেয়েছে। খাবার পাওয়া যাবে কি?
গাড়িটাড়িকে খাওয়াই না আমি, জবাব দিয়ে দিলো আইলিন। এখানে পেট্রল নেই। যাও, ভাগো।
এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন তুলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিনিকার, যাত্রী খুঁজতে লাগলো। জানালার চৌকাঠে বসে আছে নটি, ডাকতেই লাফ দিয়ে গিয়ে চড়ে বসলো দুপেয়ে গাড়ির কাঁধে। গাড়ির চুল খামচে ধরে রইলো, যাতে ঝাঁকুনি লাগলে, পড়ে না যায়।
সারা বাগানে চক্কর দিতে লাগলো গাড়ি। মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ হর্ন বেজে ওঠে।
আজব ছেলে। আইলিনের দিকে চেয়ে বললেন মিসেস পারকার। ভালোই লাগছে ওকে। এই ঝামেলা না থাকলে বসে বসে দেখতাম আর কি করে? গাড়ির এমন পাগল…
তার পরদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। বাইরে বেরোতে পারে না টকার। ঘরের ভতরেই গাড়ি চালাতে শুরু করলো। প্রায় পাগল করে তুললো ঘরের সবাইকে।
দেখো, বিশ বারের মাথায় আর সইতে না পেরে ধমক দিলো আইলিন। তুমি মরিস মাইনর, স্টিন, কনসাল, নাকি রোলস, কিছু শুনতে চাই না আমি। আর রান্নাঘরে ঢুকবে না, ব্যস। রোলস রয়েসের মতো গাড়ির লজ্জা করে না, রুটি চুরি করে?
রোলসের কি দোষ? প্রতিবাদ করলো টকার। পেট্রল পায় না, কিছু খেয়ে। তো বাঁচতে হবে তাকে? চলতে তো হবে? আর খালি আমাকে বকেন কেন? নটি আপেল চুরি করছে, তাকে যে কিছু বলেন না?
আবার ঢুকেছে নাকি? আঁতকে উঠে দৌড় দিলো আইলিন। বলি, দরজাটা কে খুলেছে? কে?
রাফিয়ান, নির্দ্বিধায় বলে দিলো টকার।
এই, এই শয়তান, বেরো বেরো! ভাঁড়ারে ঢুকে চেঁচাতে লাগলো আইলিন। বানরটাকে বের করে দিয়ে বেরিয়ে এলো। রাফি খোলেনি। ও খুব ভালো, তোমার বানরটার মতো চোর না।
নটিও খুব ভালো।
ভালো, না? রাফি ওকে ধরতে পারলে দেখাবে মজা। আজ যা একখান কাজ করে এসেছে নানটি। রাফি খুব রেগে আছে।
কি করেছে, নটি?
কি করেছে? রাফির বাসন থেকে হাড় চুরি করে ফেলে দিয়েছে। ঘাউ করে তেড়ে এসেছিলো রাফি। ধরতে পারেনি, তাই বেঁচে গেছে বানরটা। আরেকটু হলেই আজ লেজ হারাতে হতো। কামড়ে ছিঁড়ে নিতে রাফি।
শঙ্কিত হলো টকার। কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, আপনারা কেউ ওকে দেখতে পারেন না। অথচ নটি কতো ভালো। দেখেন না, কেমন বেজার হয়ে বসে আছে?
এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ছোট্ট বানরটা। এক হাত মাথায় রেখে আরেক হাতে মুখ ঢেকেছে। বাদামী একটা চোখ চেয়ে রয়েছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে, বিষণ্ণ, যেন নীরবে কাঁদছে।
আরে, আবার ন্যাকামিও জানে! হেসে ফেললো আইলিন। এই নে, একটা। বিস্কুট নে। খবরদার, আর কখনও চুরি করবি না।
চোখের পলকে বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেল বানরটার। লাফ দিয়ে এসে ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিলো বিস্কুটটা। ছুটে গেল দরজার দিকে।
দরজা বন্ধ। এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলো টকার। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো রাফিয়ান। নাক উঁচু। চুলায় চড়ানো গরম স্যুপের মিষ্টি গন্ধ শুকছে।
তড়াক করে এক লাফে গিয়ে একটা চেয়ারের ওপর উঠলো নটি। ভয়ে গুঙিয়ে উঠলো। যেন বিশাল কুকুরটার কাছে মাপ চাইছে।
এক কান খাড়া করলো রাফিয়ান, নাড়লো। বানরটার ভাষা যেন বুঝতে পারছে। ফিরে তাকালো।
এক অদ্ভুত কাণ্ড করলো বানরটা। আইলিনকে সাংঘাতিক অবাক করে দিয়ে বিস্কুটটা বাড়িয়ে ধরলো রাফিয়ানের দিকে। নিচু স্বরে কিচমিচ করছে।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো কুকুরটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে মুখে নিলো বিস্কুটটা। দুই চিবান দিয়েই কোৎ করে গিলে ফেললো।
আশ্চর্য! আনমনে বিড়বিড় করলো আইলিন। কি বুদ্ধি! সকাল বেলা হাড় চুরি করেছে। অপরাধ করে ফেলেছে। বিস্কুট দিয়ে এখন মাপ চেয়ে নিচ্ছে।
লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটলো রাফিয়ান। তারপর হঠাৎ আগ বাড়িয়ে নটির খুদে, নাকটা চেটে দিলো। হয়ে গেল ভাব।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না আইলিন। জিনাকে খবরটা জানানোর জন্যে দোতলায় ছুটলো।
শুনে জিনা বিশ্বাসই করতে চাইলো না। আইলিনের চাপাচাপিতে শেষে নিচে নেমে এলো।
নটি তখন রাফিয়ানের পিঠে উঠে ঘোড়া চড়ছে। আর আনন্দে হাততালি দিয়ে চেঁচাচ্ছে টকার। আরো, আরো জোরে হাঁট, রাফি। রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে পারিস না…
না-আ! চিৎকার করে উঠলো জিনা। এই রাফি, থাম! বানরটাকে নামা পিঠ থেকে। গাধা হয়ে গেছিস নাকি?
পিঠ থেকে নেমে রাফিয়ানের পায়ের ফাঁকে গিয়ে ঢুকলো বানরটা। ভয়ে ভয়ে তাকালো জিনার দিকে।
রাফিয়ান বুঝতে পারলো, তার মনিব রেগে গেছে। জিনার দিকে চেয়ে বিচিত্র মুখভঙ্গি করলো, যেন হাসলো। তারপর আলতো করে চেটে দিলো বানরটার মাথা। যেন বলতে চাইছে, ভয় নেইরে! আমার মনিবকে বাইরে থেকেই ভয় লাগে। ভেতরটা ওর বড় ভালো।
চোখে পানি এসে গেল আইলিনের। তার মনে হলো, রাফিয়ানের মতো ভালো কুকুর আর দুনিয়ায় নেই। বললো, দেখলে, জিনা, কতো বড় হৃদয় ওর! বানরটার সঙ্গে দোস্তি করেছে বলে ওকে আর কিছু বোলো না।
বলবো, কে বললো আপনাকে? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো জিনাকে। রাফির মতো ভালো কুকুর সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এগিয়ে গিয়ে হাত। বুলিয়ে দিতে লাগলো ওটার মাথায়।
জিনার হাত চেটে দিলো রাফিয়ান। নটির দিকে তাকালো। মনের ভাব, আর ভয় নেই। এবার সবাই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, টকার। জিনার ভয়ে। কিন্তু কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে ভয় কাটলো তার, হাসলো। এতো জোরে লরির
এঞ্জিনের মতো গর্জে উঠলো, চমকে গেল সবাই। ভেঁপু বাজালো জোরে। অর্থাৎঃ. সরো, সরো, আমি এখন ছুটতে শুরু করবো।
আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি বাধা দিলো আইলিন।
চুপ, বোকা ছেলে, বললো জিনা।
হুফ! রাফিয়ান বললো।
এভাবে ভেঁপু বাজালে এখুনি এসে হাজির হবেন দুই প্রফেসর, আইলিন। বললো। এই ছেলে, শান্ত কিছু হতে পারো না? এই যেমন ধরো, সাইকেল?
কথাটা মনে ধরলো টকারের। সাইকেলের চাকার মৃদু হিসহিস আওয়াজ তুলে রান্নাঘর থেকে ছুটে হলে বেরোলো। তারপর বেল বাজালো টিংটিং করে। শব্দটা এতোই নিখুঁত আর বাস্তব মনে হলো, মিসেস পারকার ভাবলেন, কেউ বুঝি। এসেছে। কে এসেছে, দেখার জন্যে বেরিয়ে এলেন তিনি।
প্রায় একই সময়ে খুলে গেল স্টাডির দরজা। বেরিয়ে এলেন দুই বিজ্ঞানী। টকারকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন কারসওয়েল। পকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো দুটো পেন্সিল।
চেঁচাতে লাগলো টকার। গলা ফাটিয়ে। আর তার গলার যা জোর!
চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো জিনা। চিলেকোঠা থেকে তিন। গোয়েন্দা। আইলিনও বেরোলো, আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়ানো মিসেস পারকারকে।
ব্যাপার দেখে আর হাসি চাপতে পারলো না জিনা। তার রাগ যেমন বেশি, হাসিও বেশি। হাসতে শুরু করলে থামতে চায় না। হো হো করে হাসছে।
কিন্তু জিনার মতো মজা পেলেন না দুই প্রফেসর। বরং বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ভুরু।
এই মেয়ে! রাগে জ্বলছে মিস্টার পারকারের চোখ। কি হয়েছে? এতো হাসির কি হয়েছে, শুনি? ছেলেটাকে আরও আসকারা দিচ্ছো? পেয়েছে কি? জানো না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি আমরা? দুনিয়ার মানুষের কতো উপকার হবে, আমরা সফল হলে! ক্যারোলিন, বের করো ওদের। আর সহ্য করবো না। যেখানে খুশি যাক। শুনেছো? যেখানে খুশি!
গটগট করে হেঁটে গিয়ে স্টাডিতে ঢুকলেন তিনি।
টকারকে ছেড়ে কারসওয়েলও তাঁর পিছু নিলেন।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
.
০৪.
ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছেন মিসেস পারকার। কি করবেন এখন? ওই বিজ্ঞানীগুলো যে কি! সারা দুনিয়ার মানুষের শান্তির জন্যে, সুখের জন্যে, ওদের চোখে ঘুম নেই, দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, অথচ নিজের ঘরের লোকের সুখের কথা একবারও যদি ভাবে!
জিনার গোমড়া মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি। হাত ধরে টানলেন, আয়, লিভিংরুমে। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। তোর বাবা সত্যি একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত, এ-সময় তাকে ডিসটার্ব করা ঠিক হচ্ছে না।
ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে লিভিংরুমে ঢুকলেন তিনি। আইলিন সঙ্গে এলো। রাফিয়ানও এলো পিছু পিছু। নটিকে দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়েছে।
সোফায় বুসলো সবাই। রাফিয়ান গিয়ে ঢুকলো একটা টেবিলের তলায়, সামনের দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর থুতনি রাখলো।
আলোচনা শুরু হলো।
মা, জিনা বললো। এটা আমাদের বাড়ি। কেন এখান থেকে যাবো…
হয়েছে হয়েছে, হাত তুললেন মা। তুইও যেমন, তোর বাপও তেমন। কথায় কথায় রেগে যাস, আবার ঠাণ্ডা হতেও সময় লাগে না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা..যাকগে, এখন একটা উপায় বের করা দরকার।
আসলে, এখান থেকে আমাদের এখন চলে যাওয়া উচিত, বললো। কিশোর।
এক কাজ করলেই পারি, মুসা বললো। গোবেল দ্বীপে…
হা, গোবেল দ্বীপ, রবিনও সায় জানালো।
কিন্তু মিসেস পারকার মাথা নাড়লেন। না, এখন আবহাওয়া ভালো না। বৃষ্টির যা মতিগতি, চলতেই থাকবে। ঝড়ও আসতে পারে। এই সময় দ্বীপে গিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শেষে অসুখ বাধাবে।
তাহলে তোমার কি পরামর্শ? জিনার রাগ যাচ্ছে না।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ওই বানরটা কি শুরু করেছে? থামাও না ওকে।
কি দরকার? টকার বললো। আগুন খোঁচাচ্ছে, খোঁচাক। ঠাণ্ডা লাগছে হয়তো ওর।
আবার একটা ঝামেলা বাধাবে, দ্রুত গিয়ে বানরটার হাত থেকে আগুন খোঁচানোর লোহার দণ্ডটা কেড়ে নিলো আইলিন। এই নটি, ঘরে আগুন লাগাতে। চাস? যা, সর।
এই জন্যেই নাম হয়েছে বান্দর, বিমল হাসিতে ঝকঝকে শাদা দাঁত বেরিয়ে গেল মুসার।
বেশ, আবার শুরু করলো জিনা। দ্বীপে যেতে মানা করছে। এখানেও থাকতে দেবে না। যাবো কোথায়? আমি কোনো হোটেলে-টোটেলে যেতে পারবো না বাপু, আগেই বলে দিলাম।
নীরবতা। সমস্যাটা কঠিন।
আমি জানি, কোথায় যাবো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।
বেহেশতটা কোথায় শুনি? ভুরু নাচালো জিনা।
লাইট-হাউস, সবাইকে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মাথা ঝোঁকালো টকার। হ্যাঁ, আমার লাইট-হাউস। এমন করে তাকাচ্ছো কেন? লাইট হাউস চেনো না নাকি?
দেখো, টকার, শান্তকণ্ঠে রবিন বললো, এটা মজা করার সময় নয়।
মজা করছি না। বিশ্বাস না হলে বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখো।
কিন্তু টকার, মিসেস পারকার হাসলেন। তোমার বয়েসী কেউ লাইট হাউসের মালিক হতে পারে না, তাই না?
আমি হয়েছি, রেগে উঠলো টকার। শান্তিতে কাজ করার জন্যে বাবা ওটা কিনেছিলো। কিছুদিন কাজও করেছিলো। আমি গিয়েছিলাম সঙ্গে। আহ, কি সুন্দর জায়গা! বাতাস আর বাতাস, আর সারাক্ষণ ঢেউ!
সেটা তো তোমার বাবার, কিশোর বললো। তোমার না।
কেন নয়? আমি চাইলে কেন দেবে না? তার আর দরকার নেই ওটা। কারও কাছে বিক্রিও করতে পারেনি। আমিও ওটা নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেলাম। ব্যস, দিয়ে দিলো।
খাইছে! জিনার আছে দ্বীপ, টকারের লাইট-হাউস। ভাবছি, আমার একটা আগ্নেয়গিরি কিংবা মরুভূমি থাকলে ভালো হতো।
মুসার কথায় হেসে উঠলো সবাই।
জিনার রাগ শেষ। চোখ চকচক করছে। তোমার লাইট-হাউসটা কোথায়?
আমাদের বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরে, পশ্চিমে। বিশাল, জানো? পুরনো ল্যাম্পটা এখনও আছে, তবে এখন আর জ্বালানো হয় না।
কেন হয় না? প্রশ্ন করলো মুসা।
ওই লাইট-হাউস বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ভালো জায়গায় নুতন. আরেকটা বানানো হয়েছে, আধুনিক, ওটাই এখন জাহাজকে সাবধান করে দেয়। পুরনোটা বেচে দেয়া হয়েছে সে-জন্যেই। বাবার জন্যে জায়গাটা চমৎকার। কেউ ডিসটার্ব করতে পারে না। তবু রেগে গেছে বাবা, সী-গালদের ওপর। পাখিগুলো নাকি বেশি শব্দ করে। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে। বাবা বলে, সী-গালেরা। বেড়ালের মতো মিউমিউ করে, তার কাজের ক্ষতি করে…
তা তো বুঝলাম, টকারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিসেস পারকার। খুব ভালো জায়গা। কিন্তু ওটা লণ্ডনে, এখন যেতে পারবে না। আমাদের সমস্যার। সমাধান হচ্ছে না।
আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে, মা, আবদার ধরলো জিনা। বাবাকে বলেই। দেখো না।
বললেই হবে নাকি? এখানেই আবহাওয়া খারাপ, ওখানে নিশ্চয় আরও বেশি খারাপ। তাছাড়া প্রফেসর কারসওয়েল চলে এসেছেন এখানে, তিনি বাড়িতে থাকলে না হয় এক কথা ছিলো…পরে কোনো এক সময় যাস। আপাততঃ এখানেই কোথাও ব্যবস্থা করতে হবে…
একটা জায়গা আছে, বলে উঠলো আইলিন। অবশ্য যদি এখন খালি পাওয়া যায়।
সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
মিসেস লিয়ারি এলমস-এর কটেজ, আবার বললো আইলিন। ভাড়া দেয়। খাবারও ভালো।
হু, নাম শুনেছি, বললেন মিসেস পারকার। কাছেই কোথায় যেন। যাইনি। কখনও।
হা। বড় জোর দুই কিলোমিটার এখান থেকে।
যোগাযোগ করতে হবে কিভাবে?
ফোন নম্বর জানি আমি।
তাহলে একটা রিঙ করো না, প্লীজ। দেখো, খালি আছে কিনা।
টেলিফোন করলো আইলিন। টুরিস্ট সীজন নয়, খালিই আছে কটেজ। ভাড়া করে ফেলা হলো।
ফিরে এসে বসতে বসতে বললো আইলিন, ভালো জায়গা। তোমাদের খুব পছন্দ হবে। ওটার আশপাশে পুরনো অনেক ভাঙা দুর্গ আছে…
তাই নাকি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো টকার। দুর্গ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। পুরনো হলে তো আরও বেশি। সেই আনন্দেই সে একটা রেসিং-কার হয়ে গেল, ছুটতে শুরু করলো তীব্র গতিতে, সেই সঙ্গে এঞ্জিনের বিকট শব্দ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলো, চমকে জেগে উঠে টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিলো রাফিয়ান। বানরটাও তীক্ষ্ণ কিচির-মিচির শুরু করলো।
আরে থামো, থামো! তাড়াতাড়ি উঠে টকারকে থামাতে ছুটে গেলেন, মিসেস পারকার। তোমার এঞ্জিন বন্ধ করো। নইলে এখুনি আবার বেরিয়ে আসবে ওরা!
০৫.
দুই কিলোমিটার, সাইকেলে করে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। লিয়ারির কটেজটা খুব সুন্দর। শাদা রঙ বাড়িটার, জানালার পাল্লা সবুজ। গাছপালা, ফুলের বাগান, আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাগানটা ছাড়া বাকি সব গাছপালাকে বুনো মনে হয়, নিয়মিত সাফ না করায় জঙ্গল হয়ে গেছে। না, জায়গাটা ভালো, ছেলেমেয়েদের পছন্দ হলো।
তাছাড়া খুব নীরব, বললো রবিন। ভালো লাগে। পড়ালেখার জন্যে এরচে। ভালো জায়গা আর হয় না।
শুব্দ শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালো মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা, মুখে হাসি।এই যে, এসে পড়েছো তোমরা। এসো এসো, চা তৈরিই করে রেখেছি। ভাবলাম, সাইকেলে করে আসছো, নিশ্চয় খিদে লাগবে।– বাহ্, এই তো চাই! ভাবলো মুসা। না চাইতেই যদি এভাবে খাবার পাওয়া যায়…হেসে বললো সে, আসছি, এক মিনিট। সাইকেলগুলো রেখে আসি। এ হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে মালপত্র খুলে গোছাতে চললো ওরা। মাল বেশি নেই। সাইকেলের ক্যারিয়ারে করে যা যা আনতে পেরেছে। খুলে গোছাতে সময় লাগলো না। কাজ শেষ করে বাগানে বেরোলো ওরা। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
ভালোই লাগবে এখানে, জিনা বললো। জংলা জায়গা। তাছাড়া আমাদের বাড়িও কাছে। ইচ্ছে করলেই গিয়ে নৌকা বের করে নিয়ে দ্বীপে চলে যেতে পিরবো।
ঠিক বলেছো, মুসা একমত হলো। আবহাওয়া ভালো থাকলে সাগরে গিয়ে সাঁতারও কাটা যাবে।
আর মিসেস লিয়ারিকেও আমার পছন্দ হয়েছে। নরম মেজাজ। আমার বাবার মতো বদমেজাজী নয়। এখানে শান্তিতেই থাকতে পারবো আমরা।
খোলা জায়গা পেয়ে টকারেরও সুবিধে হলো। ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো সে। যাত্রী হলো নটি। মজা পেয়ে পেছন পেছন ছুটে বেড়াতে লাগলো। রাফিয়ান।
সেদিন বিকেলে ঘরে বসে আলোচনা করে ঠিক করলো ওরা, পরের কয়েকটা দিন কি কি করবে।
পরের দিন থেকে সাঁতার কাটলো ওরা, আশপাশের নির্জন এলাকায় পিকনিক করলো, বাগানে খেললো, যার যা খুশি ইচ্ছে মতো করলো। সবাই খুশি, একমাত্র কিশোর ছাড়া। তার মনের মতো কাজ পায়নি। আশা করেছিলো, যে-রকম জায়গা, একটা না একটা রহস্য পেয়ে যাবেই। চুটিয়ে মাথা খাটাতে পারবে। নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি। দিন দুই পরে আরও খারাপ হলো অবস্থা। নামলো মন-খারাপ-করে-দেয়া বৃষ্টি। ঝমঝম ঝমঝম ঝরছে তো ঝরছেই। থামার আর নাম নেই। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস যেন হাড় কাঁপিয়ে দেয়।
ঘরের মধ্যে আর কি খেলা যায়? ইনডোর গেম যা যা আছে, দাবা, কেরম, কোনোটাই ভালো লাগে না ওদের। টকারেরও না। সে গাড়ি হতে পারলে খুশি। কিন্তু জায়গা কম। ছোট বারান্দায় যতোটা ছোটাছুটি করতে পারলো করলো, তারপর বিরক্ত হয়ে সে-ও এসে বসে পড়লো ঘরে।
ঘরের কোণে আগুনের কাছে পড়ে পড়ে ঘুমায় রাফিয়ান, বানরটা মাঝে মাঝে গিয়ে তার লেজ থেকে উকুণ বেছে দেয়। কখনও সিলিং ফ্যান ধরে দোল খায়, কখনও বা চুপটি করে জানালার ধারে বসে থাকে, গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে।
কিশোরও বেশির ভাগ সময়ই জানালার ধারে বসে থাকে। বাইরের বৃষ্টি দেখে। মাঝেসাঝে ভারি গলায় কবিতা আবৃত্তি করে।
সেদিনও করছিলোঃ গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…
পাশে বসে আছে রবিন আর মুসৗ। ওরা এখন বাংলা অনেকটা বোঝে, বলতেও পারে কিছু কিছু।
কিসের নাহি ভরসা কিশোর মিয়া? ভুরু নাচিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
আর কিসের? জবাবটা দিলো রবিন। রহস্যের।…আরে, এতো মন খারাপ করছো কেন? পাবে, পাবে, নিশ্চয় পেয়ে যাবে এই দুনিয়ায় রহস্যের অভাব নেই।
যা জঙ্গল, আর পোড়ো বাড়ি আছে আশপাশে, মুসা বললো। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে গেলেও হতো। অন্তত একটা ম্যাপ-ট্যাপ…
চেষ্টা করলে হয়তো গুপ্তধনই পেতে পারো, পেছন থেকে বলে উঠলো লিয়ারি।
ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা।
মিটিমিটি হাসছে মহিলা। বললো, দাঁড়াও, চা নিয়ে আসি। তারপর বলবো।
সেইদিন লিয়ারির আরেক পরিচয় পেলো ছেলেরা। মহিলা বর্ন স্টোরি টেলার, একেবারে জাত গল্প বলিয়ে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলে, না শুনে। উপায় নেই।
একঘেয়ে ভাব অনেকটা কাটলো ছেলেমেয়েদের। খাওয়ার সময় খায়, আর বাকি সময় বসে বসে গল্প শোনে।
বাইরে বৃষ্টির থামাথামি নেই। পড়েই চলেছে। কখনও অঝোর বর্ষণ, কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। মাঝেমাঝে ধেয়ে আসে ঝড়ো হাওয়া, টালির চালের ফাঁকে ঢুকে বিচিত্র শব্দ তোলে।
জানালার ধারে বসে সোয়েটার বুনতে বুনতে গল্প করছে সেদিন লিয়ারি। হঠাৎ বাইরে চেয়ে কি দেখলো। মুখ ফিরিয়ে হেসে বললো, যাক, আর ঘরে বসে থাকতে হবে না। বেরোতে পারবে। মেঘ কাটছে। বৃষ্টি থামলে কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো হবে, সেটাও বলে দিতে পারি। রহস্যময় হাসি ফুটলো তার মুখে।
.
০৬.
আরে তাই তো! আকাশের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। খেয়ালই করিনি।…তা মিসেস এলমস, কোথায় গেলে ভালো হবে?
কয়েক দিনে কিশোরের স্বভাব অনেকখানিই জানা হয়ে গেছে লিয়ারির। বুঝে গেছে, ছেলেটা কি চায়? ওই যে সেদিন গুপ্তধনের কথা আলোচনা করছিলে, ওয়ালটার ম্যানরের কথা বললাম। ওখানেই যাও। রাস্তায় নেমে বাঁয়ে মোড় নেবে। ছোট একটা পাহাড়ের ওপর…
হা হা, দেখেছি, বলে উঠলো রবিন। আসার দিন
হ্যাঁ, ওটাই।
সেদিন কিন্তু সব কথা বলেননি, কিশোর ধরলো। খালি গুপ্তধনের গুজবের কথাই বলেছেন। ওই দুর্গ কাদের, ওয়ালটাররা কে ছিলো, কিছুই বলেননি।
তাহলে তো চা দরকার। বসো, নিয়ে আসি।
দাঁড়ান, আমিও আসছি, উঠে দাঁড়ালো রবিন। আপনাকে সাহায্য করবো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো দুজনে। লিয়ারির হাতে চায়ের সরঞ্জাম। রবিনের হাতে ইয়া বড় এক কেক।
খাবারের গন্ধে চোখ মেললো রাফিয়ান। উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।
ফ্যানের একটা পাখা ধরে ঝুলছিলো নটি, ঝুপ করে লাফ দিয়ে পড়লো ঠিক কুকুরটার পিঠে।
ওদের দিকে দুই টুকরো কেক ছুঁড়ে দিলো লিয়ারি। চায়ের কাপে ঘনঘন চুমুক দিলো কয়েকবার। তারপর কাপটা প্লেটে নামিয়ে রেখে বললো, হ্যাঁ, ওয়ালটার দের শরীরে রয়েছে জলদস্যুর রক্ত…
এই এক কথায়ই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে ফেললো লিয়ারি। ওদেরকে আগ্রহী করে বসিয়ে রেখে কাপের বাকি চা-টুকু শেষ করলো। বললো, তোমরা খাচ্ছো না কেন? খাও খাও, আমি বলিহামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার ছিলো দুর্ধর্ষ জলদস্যু। সে-ই বানিয়েছিলো ওই দুর্গ। লোকটা ছিলো ওলন্দাজ। তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা। শেষে বিশাল এক নৌবাহিনী পাঠালেন। হামফ্রেকে ধরার জন্যে। মাঝ সাগরে প্রচণ্ড লড়াই হলো। একে একে ধ্বংস করে। দেয়া হলো হামফ্রের সমস্ত জাহাজ। তার বেশির ভাগ সঙ্গীসাথীই মারা পড়লো। কিন্তু তাকে ধরতে পারলো না নেভি। একটা জাহাজ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো সে, সোজা চলে এলো আমেরিকায়। ওই একটা জাহাজেও ধনরত্ন কম। ছিলো না। ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে বিরাট এক দুর্গ বানিয়ে বাস করতে লাগলো হামফ্রে। নিরাপদেই কাটিয়ে গেল জীবনের শেষ কটা দিন। ও হ্যাঁ, এখানে এসে বিয়ে করেছিলো সে। তাদেরই বংশধর এখানকার ডেভিড ওয়ালটার, ডাক্তার। হয়েছে। ডাক্তারের বউ বিদেশী, এক আইরিশ মহিলা, নরিলি। ছেলেপুলে হয়নি। ডাক্তারের বড় এক ভাই ছিলো, মারা গেছে, এক ছেলে রেখে গেছে। নাম, ড্যানি। ওই ছেলেই একদিন এতোবড় সম্পত্তির মালিক হবে। ড্যানির বাবা ছিলো। আর্কিটেক্ট, লণ্ডনে বিরাট বাড়ি করেছে, অনেক টাকার মালিক। ড্যানি আর তার চাচা-চাচী, ওখানেই থাকে বেশি, এখানে প্রায় আসেই না। এলেও দুচারদিন থেকে আবার চলে যায়। দেশ তো আসলে ওদের ওটা-ই।
এলে কি ওই পোড়ো বাড়িতেই থাকে নাকি? জিজ্ঞেস করলো জিনা।
আরে না না, ওখানে থাকবে কি? দুৰ্গটার একটা ঘরের ছাতও অবশিষ্ট নেই, সব ভেঙে পড়েছে। কাছেই আরেকটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে ডাক্তার, চমৎকার একটা পার্কের কাছে। বাংলোটার নাম দিয়েছেঃ ওয়ালটার লজ।
ও, দেখেছি তো সেদিন বাড়িটা, মুসা বললো। দুর্গের কাছে গেলেই দেখা যায়।
হ্যাঁ। ওয়ালটার ম্যানর, ওয়ালটার লজ, পার্ক, ওয়ালটার উড, আর ওদিককার প্রায় সমস্ত জায়গাই ওদের। আমার এই কটেজটাও…
কি বললেন? ভুরু কোচকালো কিশোর। আপনার মানে লিয়ারি কটেজও ওয়ালটারদের জায়গার মাঝেই?
আগে ছিলো। এখন আলাদা। আমার স্বামীর দাদা, মানে আমার দাদা-শ্বশুর চাকরি করতো ওয়ালটারদের এস্টেটে। এই জায়গাটা তাকে দান করে দিয়েছে ডাক্তারের দাদা।
ভাঙা দুর্গ দেখার ইচ্ছে নেই আমার, জিনা বললো। ওরকম দুর্গ আমার নিজেরই একটা আছে, এক্কেবারে আস্ত এক দ্বীপ সহ। ভাঙা দেয়াল ছাড়া দেখার আর কি আছে?
পাহাড়ে চড়লেই সাগর দেখতে পাবে। তোমরা যেদিকে সাঁতার কাটতে গেছে, তার উল্টো দিকে। ওখানে সৈকত নেই, সাঁতার কাটতে পারবে না। নামতেই পারবে না। খাড়া পাহাড়, নিচে পাথরের ছড়াছড়ি, ঢেউ আছড়ে পড়ে। মাথা ঘুরে যদি নিচে পড়ো, ছাতু হয়ে যাবে। কাজেই, হুঁশিয়ার থাকবে।
সাগর অনেক দেখেছি। আর কি আছে?
ওয়ালটার উড়। বন। ভেতরে ঝর্না আছে একটা, অনেক বুনো ফুল আছে।
আর? জিনার মনে হলো, আসল কথাটা বলছে না মহিলা।
আর। হাসলো লিয়ারি। আর আছে একটা অনেক পুরনো কবরস্থান, একেবারে প্রাগৈতিহাসিক কালের। গুহামানবের অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। তার ওপরই নতুন কবর বানিয়ে নিয়েছিলো হামফ্রে ওয়ালটার। জলদস্যু ছিলো তো, মন-মানসিকতাই ছিলো অন্যরকম। নইলে বাপু, এতো জায়গা থাকতে পুরনো ওই কবরের ওপর আরেক কবর বানানো কেন?
টিউমিউল্যাস! বিড়বিড় করলো কিশোর।
টিউ..কী? বুঝতে পারলো না মুসা।
টিউমিউল্যাস। বুঝিয়ে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই ধরনের কবরস্থানকে বলে টিউমিউল্যাস।
.
বৃষ্টি থামলো বটে, কিন্তু মেঘ পুরোপুরি কাটেনি। আকাশের মুখ থমথমে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরঝর করে শুরু হতে পারে আবার।
নামলে নামুক, জিনা বললো। আর বসে থাকতে পারবো না। বসে থেকে থেকে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। একটু ঝাড়া দিয়ে না এলে আর বাঁচবো না।
রেইনকোট পরে বেরোলো ওরা।
রাফিয়ান আর নটির কৃত্রিম কোট দরকার নেই, প্রাকৃতিক আসল রোমশ কোটই আছে। কাজেই পানিকে ওদের বিশেষ ভয় নেই। ভিজলে, জোরে ঝাড়া দিলেই গা থেকে ঝরে যাবে পানি।
ছেলেমেয়েরা চললো পায়ে হেঁটে, নটি চললো রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে। গলায় গলায় ভাব এখন দুটোতে, মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যদিও লেগে যায় ঝগড়া।
দুর্গের কাছে চলে এলো ওরা। ভেঙেচুরে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো দেয়াল, ছাতের চিহ্নও নেই।
দূর, মন খারাপ করে দেয়। বিড়বিড় করলো রবিন।
পুরনো দুর্গের সেলার দেখার খুব ইচ্ছে আমার, টুকার বললো। কিন্তু নামবো কোনখান দিয়ে? পথ তো দেখছি না।
শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুরোপুরি ঢেকে দেয়ার পায়তারা কষছে যেন ঘন ঘাস আর লতার দঙ্গল।
দেখার কিছুই নেই, মুসা বললো।
হ্যাঁ, খামোকাই এলাম। আকাশের দিকে তাকালো কিশোর। জলদি চলো৷ নামলো বলে।
কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। দৌড়ে চললো ওরা। কিন্তু রেইনকোটেও মানলো না। কটেজে ফিরতে ফিরতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল সবাই।
পরের দিনও একই অবস্থা। সকাল থেকে বৃষ্টি। বিকেলের দিকে ধরে এলো। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো সূর্য।
কিশোর প্রস্তাব দিলো, চলো, বেরোনো যাক।
সবাই রাজি। বেরিয়ে এলো পেছনের বাগানে। বাগানের পরে খানিকটা জংলা জায়গা। কয়েকটা আপেল গাছ আছে, আর আছে অনেক পুরনো বিশাল এক ওক গাছ। সব ভেজা। তার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওরা। ঘরে বসে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো মনে হলো।
রাফিয়ান আর নটির আনন্দের সীমা নেই। ছুটোছুটি করে খেলছে।
ভেজা ঘাস বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না বানরটার। দুই লাফে গিয়ে উঠলো, ওকের একটা নিচু ডালে। তারপর তরতর করে উঠে গেল মগডালে।
মেঘের আড়ালে ঢুকলো আবার সূর্য।
নটি, এই নটি, নেমে আয়, ডাকলো টকার।
নামতে চাইলো না বানরটা। ওপরে থেকেই চেঁচিয়ে জবাব দিলো, ইঁক! ইঁক!
হুফ! হুফ! করে রাফিয়ানও ওকে নামার জন্যে ডাকলো।
কানেই নিলো না নটি। অনেক দিন পর ঘর থেকে ছাড়া পেয়ে গাছে চড়েছে বানর, নামতে কি আর ইচ্ছে করে? ওদিকে বৃষ্টিও প্রায় এসে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে দুবার-ঘর থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিয়ে গেছে লিয়ারি।
এই নটি, নামলি না! রেগে গিয়ে ধমক দিলো টকার।
চলো, আমরা হাঁটতে শুরু করি, জিনা বললো। আপনিই নেমে আসবে।
ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নামলো না বানরটা।
না নামলে থাক ওখানে, হাত নেড়ে বললো টকার। আমরা চলে যাচ্ছি…
তার কথা শেষ হলো না। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নামলো। ঝমঝম করে বৃষ্টি।
চমকে উঠলো বানরটা। আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। নামতে শুরু করলো। ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো টকার। লাফ দিলো নটি। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টকারের হাতে না পড়ে পড়লো গিয়ে ভেজা ঘাসে। নিচে পানি, ওপরে পানি, এই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়েই বোধহয় মাথা গোঁজার জন্যে সোজা লতানো ঝোপের দিকে দৌড় দিলো ওটা।
আরে ধরো, ধরো! চেঁচিয়ে উঠলো টকার।
বৃষ্টির মাঝে বানরটাকে ধরার জন্যে পেছনে ছুটলো সবাই। রাফিয়ান ভাবলো, এটা একটা নতুন ধরনের খেলা। দৌড়ে গেল নটির কাছে। লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসলো বানরটা। আর সওয়ারির আদেশেই যেন সোজা, গিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকলো কুকুরটা।
ধমক দিয়ে রাফিয়ানকে ডাকতে যাবে জিনা, এই সময় হাত তুলে দেখালো, রবিন। আমার মনে হয় ওখানে যাচ্ছে।
জংলা জায়গাটার ওধারে একটা পুরনো ছাউনি। কাজের জায়গা, কিন্তু কেউ কাজ করে না এখন ওখানে। অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে অনেকদিন।
দৌড়ে এসে ছাউনিতে ঢুকলো ওরা। রবিনের অনুমান ঠিকই। নটিকে নিয়ে ওখানেই এসেছে রাফিয়ান। কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে বানরটা, ঠাণ্ডায়। কিংবা ভয়ে যে কারণেই হোক, কাঁপছে। মনিবকে দেখে লাফিয়ে এসে উঠলো তার কাঁধে।
কালো আকাশটাকে চিরে দিলো যেন বিদ্যুতের শিখা। ভীষণ শব্দে বাজ পড়লো। আবার, তারপর আবার।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। ঝড়ই শুরু হলো দেখছি।
হ্যাঁ, মনে হয় একেবারে মাথার ওপর বাজ পড়ছে, বললো জিনা।
আর বাড়ছেই, কান পেতে ঝড়ের আওয়াজ শুনছে রবিন। এগিয়ে আসছে। বোধহয় সাগরের দিক থেকে…
হঠাৎ উজ্জ্বল নীল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দশদিক। ছাউনির নিচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো ছেলেরা। আলোর প্রায় পর পরই বাজ পড়লো। এতো জোরে আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে গেল ওদের, থরথর করে কেঁপে উঠলো মাটি। চেঁচালো রাফেয়ান। চি-চি করলো বানরটা।
কটেজের ওপর পড়েছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে টকারের। হায় হায়, বেচারি লিয়ারি…
চুপ! থামিয়ে দিলো তাকে কিশোর। কটেজে নয়। ওই দেখো, ওক গাছটা…দেখেছো?
ঘন বৃষ্টির মাঝ দিয়েও দেখা গেল। দেখলো সবাই। একটু আগের সুন্দর ওঁক গাছটা আর নেই, দাঁড়িয়ে আছে শুধু ওটার পোড়া কালো কাণ্ড, ধোয়া বেরোচ্ছে।
আল্লাহরে! কি সর্বনাশ! আঁতকে উঠে বললো মুসা। কয়েক মিনিট আগে…
নটি ছিলো ওটার ডালে…, বললো টকার।
আর আমরা সবাই ছিলাম ওটার তলায়! জিনা শেষ করলো কথাটা।
.
০৭.
ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল বাজের শব্দ। বিদ্যুতের ঝিলিকও কমলো। থেমে আসছে ঝড়।
শোনা গেল লিয়ারির ভয়ার্ত ডাক, কিশোর! জিনা! কোথায় তোমরা?
আমরা ভালোই আছি, চেঁচিয়ে জবাব দিলো কিশোর। আপনি বেরোবেন। না। আমি আসছি। অন্যদেরকে ছাউনিতে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল সে। এক ছুটে গিয়ে ঢুকলো কটেজে।
দশ মিনিট পর ফিরে এলো আবার। প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শুকনো সোয়েটার। নিয়ে এসেছে সবার জন্যে। আর এনেছে বড় একটা ঝুড়ি। তাতে স্যাণ্ডউইচের প্যাকেট, মস্ত এক চকোলেট কেক, বড় এক ফ্লাস্ক কোকা।
এই না হলে তুমি আমার ভাই! বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে হেসে বললো মুসা।
হয়েছে হয়েছে, এসো এখন শেষ করে ফেলা যাক। খুব খিদে পেয়েছে।
তোমারই যখন খিদে, আমার অবস্থা বোঝো!
হেসে উঠলো সবাই।
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সমস্ত খাবার। একটা কণাও অবশিষ্ট থাকলো না। এমনকি মাটিতে যা পড়লো, তা-ও না। চেটেপুটে শেষ করলো রাফিয়ান আর নটি।
বৃষ্টি থেমেছে।
রবিন বললো, চলো তো, কাছে গিয়ে দেখি গাছটার অবস্থা।
ছাউনি থেকে বেরোলো সবাই। হঠাৎ করেই দেখা দিলো সূর্য। মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে ঝড়ো বাতাস।
ইস, এতো সুন্দর গাছটা গেল? আফসোস করে বললো জিনা।
হ্যাঁ, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর। লিয়ারি বললো না সেদিন, গাছটা অনেক পুরনো। হামফ্রে ওয়ালটার যখন এসেছিলো, তখনও ছিলো।
আরও কাছে এগিয়ে গেল ওরা। গাছটার চারপাশের গোড়ার মাটি যেন খুবলে তুলে ফেলেছে কোনো দানব। গর্ত হয়ে গেছে। একটা পরিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। রয়েছে যেন এখন পোড়া কাণ্ডটা।
কাণ্ড দেখেছো, কতো বড় গর্ত? টকার বললো। বাজের এতো জোর!
খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে গর্তে নামলো নটি। কি একটা জিনিস কৌতূহল জাগিয়েছে তার। সরু সরু আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। দেখাদেখি রাফিয়ানও গিয়ে নামলো, মাটি খোঁড়ায় সাহায্য করলো বানরটাকে।
পোকা খুঁজছে, হেসে বললো টকার।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কিশোর। গম্ভীর। আরও ভালোমতো দেখার জন্যে গর্তের কিনারে গিয়ে কুঁকলো। কঠিন কিছু একটাতে কুকুরটার নখ লেগে শব্দ হয়েছে। কি ওটা? বললো, এই রাফি, খোড়। আরও খোড়।
হঠাৎ প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। বেরিয়ে পড়েছে রঙচটা, মরচে পড়া একটা ধাতব বাক্স।
কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো গুপ্তধন, রসিকতা করে হাসলো রবিন।
হু, গুপ্তধন পাওয়া এতোই সহজ! জিনা বললো।
কিশোর ততোক্ষণে নেমে পড়েছে গর্তে। মাটি সরিয়ে বাক্সটা তুলে আনার চেষ্টা করছে।
ওভাবে পারবে না, মুসা বললো। দাঁড়াও, খন্তা-টন্তা কিছু একটা নিয়ে। আসি। এক দৌড়ে গিয়ে কটেজ থেকে একটা শাবল নিয়ে এলো সে। দুজুনে মিলে খুঁড়ে তুলে আনলো বাক্সটা।
তালা আছে, কিন্তু এতো পুরনো, মরচে পড়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শাবল দিয়ে এক বাড়ি মারলো মুসা। হুক ভেঙে তালাটা খুলে,ড়ে গেল।
ডালা তুললো কিশোর।
হাঁ হয়ে গেল সবাই।
সত্যি গুপ্তধন! সোনার মোহর আর নানারকম অলংকার।
চোখ ডলো কেউ, কেউ চিমটি কাটলো নিজের হাতে। না, জেগেই তো আছে, স্বপ্ন দেখছে না। তারমানে আসলেই গুপ্তধন পেয়েছে। গুপ্তধন পাওয়া নতুন। কোনো ব্যাপার নয় ওদের জন্যে, আগেও অনেক বার পেয়েছে। তবে এভাবে নয়, অনেক খুঁজতে হয়েছে। এই
বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও আমার, বিড়বিড় করলো রবিন।
অনেক কিছুই ঘটে এই পৃথিবীতে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর, যার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।…্যাকগে, পেয়েছি এ-তো আর মিছে। কথা নয়। চলো, এগুলো কটেজে নিয়ে যাই। কার জিনিস, হয়তো লিয়ারি বলতে পারবে।
বাক্সটা নিয়ে এলো ওরা। রান্নাঘরের টেবিলে রেখে খুললো।
একবার অকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল লিয়ারি। অনেকক্ষণ পর কথা ফুটলো মুখে, গুজব তাহলে মিথ্যে নয়! সত্যিই গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে হামফ্রে ওয়ালটার।
সেদিন তো বললেনই লুকিয়েছে, কিশোর বললো।
বলেছিলামঃ লোকে বলে। বিশ্বাস করতাম না। এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি…
কিন্তু লুকালো কেন?
স্বভাব, জবাবটা দিলো রবিন। জলদস্যুরা ধনরত্ন লুকাতে অভ্যস্ত ছিলো, হয়তো সে-কারণেই নিরাপদ জায়গায় এসেও নিশ্চিত হতে পারেনি হামফ্রে। ওয়ালটার। কিছুটা লুকিয়ে রেখেছিলো ওই ওক গাছের তলায়।
কি জানি। হতেও পারে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর।
এসো না, কি কি আছে দেখি? একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলি, প্রস্তাব দিলো টকার। গুপ্তধনের গল্প শুধু বইয়েই পড়েছে এতোদিন, চোখে দেখেনি।
অন্যদেরও মনে ধরলো কথাটা। অনেকদিন পর একটা নতুন ধরনের কাজ পাওয়া গেছে।
বাক্সে রয়েছেঃ ছয়শো সোনার মোহর, পান্না খচিত এক সেট গহনা, হীরা আর নীলকান্ত মণি বসানো একটা ব্রেসলেট, বিশাল একটা রুবি পাথর, একটা টায়রা, একটা হীরার লকেট, অনেকগুলো আঙটি আর কানের দুল,–প্রায় সবগুলোতেই মূল্যবান পাথর বসানো। বড় বড় মুক্তো আছে অনেকগুলো, গোটা তিনেক সোনার ব্রেসলেট, তিনটে সোনার চেন, দুটো সোনার ঘড়ি (বন্ধ হয়ে আছে), চারটে সোনার বড় বড় মেডেল। আর আছে হাতির দাঁতে খোদাই করা দুটো প্রতিকৃতিঃ একটা পুরুষের, আরেকটা মহিলার। পুরুষেরটার নিচে নাম লেখা রয়েছে হামফ্রে ডেভিড ওয়ালটার। আর মহিলাটার নিচে টেরিলিন ওয়ালটার।
হামফ্রের স্ত্রীর নাম কি ছিলো, জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
টেরিলিন…
হু। তারমানে গুপ্তধন হামফ্রেই লুকিয়েছিলো। এই প্রতিকৃতি দুটোই তার প্রমাণ।
কি করবে এখন এগুলো? রবিন জানতে চাইলো।
জবাব না দিয়ে লিয়ারির দিকে তাকালো কিশোর। ডাক্তার ওয়ালটার এখন। কোথায়? এখানে, না লণ্ডনে?
ঠিক বলতে পারবো না, বৃষ্টির জন্যে বেরোতেই তো পারি না, বললো লিয়ারি। তবে সেদিন মুদির বৌ বলছিলো, এখানে নেই। দুচার দিনের মধ্যে আসবে। তারমানে আজ কিংবা কাল আসবে।
জানালার বাইরে তাকালো কিশোর। বৃষ্টি বোধহয় আর আসবে না। বন্ধুদের দিকে ফিরলো। একবার গেলে কেমন হয়? ওয়ালটার লজে? ডাক্তার থাকলে তাঁকে জানাবো খবরটা। এসে নিয়ে যাবেন। আইনতঃ জিনিসগুলো এখন তাঁরই পাওনা।
চলো, মুসা রাজি। হেঁটে, না সাইকেলে?
সাইকেল।
দ্রুত প্যাড়াল করে চললো ওরা। অনেক দিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকার পর। মুক্তির আনন্দ, তার ওপর গুপ্তধন পাওয়ার উত্তেজনা, টগবগ করে ফুটছে যেন শরীর রক্ত। টকারের সাইকেল নেই, সে বসেছে মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।
নটি চলেছে রাফিয়ানের পিঠে সওয়ার হয়ে।
অবশেষে দূর হয়ে গেছে মেঘ। কড়া রোদে ভেজা মাটি থেকে বাষ্প উঠছে। গাছপালা ঘন সবুজ, এক কণা বালি নেই, ধুয়েমুছে সব সাফ হয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে চললো ওরা।
.
০৮.
ভাঙা দুর্গের পাশ দিয়ে পথ চোখে পড়লো ওয়ালটার লজের শাদা, দেয়াল। প্রায় বর্গাকার চমৎকার একটা বাংলো। বেগুনী উইসট্যারিয়া আর অন্যান্য লতায়, ছেয়ে রয়েছে। সুন্দর ছিমছাম বাগানে নানারকম ফুলের ঝাড়, বেড, সবুজ ঘাসে ঢাকা লন।
গেটের কাছে এসে সাইকেল থেকে নামলো ওরা। পাল্লার লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো। বাগানে কাজ করছে একটা লোক।
গেটের পাশে লাগানো ঘন্টা বাজানোর শেকল ধরে টানলো কিশোর।
ঘন্টার শব্দে ফিরে তাকালো লোকটা। খোয়া বিছানো পথে জুতোর মচমচ শব্দ তুলে এগিয়ে এলো গেটের কাছে। মাঝবয়েসী, মাথায় পাতলা চুল, ধূসর। গোলগাল মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া বড় বেশি বেমানান। চেহারায় বিরক্তি। পরনে, কর্ডের প্যান্ট-ময়লা, মাটি লেগে রয়েছে। গায়ে নীল ওভারঅল। গভীর কণ্ঠে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?
ডাক্তার ওয়ালটার আছেন? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
জবাব দিলো না লোকটা। এক এক করে তাকালো পাঁচজনের মুখের দিকে। তারপর বললো, আজেবাজে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেন না তিনি।
কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল কিশোর।
লোকটা বললো, তোমাদের মতো কেউ যাতে ঢুকতে না পারে, সেদিকে কড়া। নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।
রাগে-লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। এমনিতেই ধৈর্য তার কম। ঝাঝালো কণ্ঠে বললো, দেখুন, বড় বড় কথা বলবেন না। আজেবাজে ছেলেমেয়ে নই আমরা। আপনাকেই বরং বাজে লোক মনে হচ্ছে আমার। যান, গিয়ে বলুন, জরুরী কথা। বলতে এসেছি তাঁর সঙ্গে।
আরও গম্ভীর হয়ে গেল কেয়ারটেকার। তারপর হঠাৎ হাসতে আরম্ভ করলো। জরুরী, না? হাহ্ হাহ্ হা! তা জরুরী ব্যাপারটা কি জানতে পারি, ম্যাডাম?
দেখুন, শীতল কণ্ঠে বললো কিশোর। ওর নাম জরজিনা পারকার। প্রফেসর হ্যারিসন পারকারের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর মেয়ে। কাজেই বুঝতে পারছেন, আজেবাজে কেউ নই আমরা। এখন দয়া করে গিয়ে যদি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেন, খুশি হবো।
দ্বিধা ফুটলো লোকটার চোখে।
যান, মুসা বললো। গিয়ে বলুন, জরুরী কথা আছে। তাঁরই লাভ।
হ্যাঁ, মুসার কথার পিঠে বলে উঠলো টকার। তাঁর জন্যে সুখবর। গুপ্তধন পাওয়া গেছে।
এই, তুমি চুপ করো তো! ধমক দিয়ে টকারকে থামিয়ে দিলো কিশোর।
গুপ্তধন? ভুরু কোঁচকালো কেয়ারটেকার। তারপর হা-হা করে হাসলো। এই গপ্লোই শোনাতে এসেছো নাকি? নিশ্চয় বলবে, মিস্টার হামফ্রে ওয়ালটারের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছো তোমরা?
কড়া গলায় জিনা বললো, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই! যা বলছি করুন। ডাক্তার ওয়ালটারকে খবর দিন, চাকরিটা না খোয়াতে চাইলে। জলদি করুন।
থাকলে তো খবর দেবো, সামান্য নরম হলো কেয়ারটেকার। বাড়ি নেই। আজ সকালেই আসার কথা ছিলো। বৃষ্টির জন্যেই হয়তো আসতে পারেননি। আকাশ ভালো থাকলে রাতে চলে আসতে পারেন, কিংবা, কাল কিংবা পরশু…ঠিক নেই। আমাকেই খুলে বলো সব। এলে তাঁকে জানিয়ে দেবো।
কর্কশ ব্যবহার অনেক কোমল হয়ে গেছে লোকটার। কিন্তু তবু কেউই তাকে পছন্দ করতে পারলো না। এমনকি রাফিয়ানও না। শিকের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে। তার জুতো শুকলো, তারপর মৃদু গররর করে উঠলো।
সরি, বললো কিশোর। ডাক্তার সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। কাল আবার আসবো আমরা।
না না, দরকার কি? এসে হয়তো পেলে না, খামোকা কষ্ট করবে। তারচে এক কাজ করো, ঠিকানা রেখে যাও। সাহেব এলেই তোমাদেরকে খবর দেবো।
আবার বোকামি করে বসলো টকার। বলে ফেললো, লিয়ারি কটেজ, চেনেন নিশ্চয়?
চিনি, চিনি, হেসে বললো লোকটা। ওদিক দিয়েই তো রোজ বাজারে যাই। ঠিক আছে, মিস্টার ওয়াল্টার এলে একটা নোট ফেলে যাবোখন তোমাদের লেটার বক্সে।
লোকটার হাসি মোটেও পছন্দ হলো না মুসার। ফেরার পথে বললো, শয়তান লোক। দেখলে, গুপ্তধনের নাম শুনেই কেমন বদলে গেল?
তা না-ও হতে পারে। মিস্টার পারকারের নাম শুনেও বদলাতে পারে, রবিন বললো। আর চেহারা দেখে মানুষ বিচার করা যায় না। মুখে কড়া, মনটা হয়তো নরম।
তুমি নিজে নরম তো, তাই সবাইকে ওরকম ভাবো, বললো জিনা। আমি মুসার সঙ্গে একমত। আস্ত শয়তান লোক। হারামী নাম্বার ওয়ান। এই কিশোর, তুমি কি বলো?
আমারও ভালো লাগেনি।
আমারও না, টকার বললো। গুপ্তধনের কথা বলে বোকামি করিনি তো?
বোকামিই করেছে। আর ঠিকানা দিয়ে করেছো গাধামি। আগ বাড়িয়ে আর কথা বলতে যাবে না কক্ষণো। তোমাকে বলেছি না, আমরা গোয়েন্দা। গোয়েন্দাগিরিতে সব সময় ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়…
কিন্তু অসুবিধে কি হবে?
গুপ্তধনের লোভে আমাদের পেছনে লাগতে পারে। ঠিকানাও বলে দিয়ে এসেছো…
তাই তো! ভুলই হয়ে গেছে…
যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। দেখা যাক কি হয়। হয়তো লোকটা বিশ্বাসই করেনি আমাদের কথা।
লিয়ারি জানালো ওদেরকে, লোকটার নাম ডেনার। ডাক্তার ওয়ালটারের বাড়িতে মালীর কাজ থেকে শুরু করে কেয়ারটেকারের কাজ, সবই সে করে। ডেনার ভালো কি মন্দ, বলতে পারলো না। কারণ, বোঝার উপায় নেই। মোটেই নাকি মিশুক না লোকটা।
পরদিন সকালে ডেনার কখন এলো লিয়ারি কটেজে কেউই জানলো না। কিন্তু নাস্তার টেবিলেই পাওয়া গেল তার নোট। একটা খামে ভরে চিঠির বাক্সে ফেলে গেছে। লিয়ারি এনে দিলো ছেলেদের।
নোটে লেখাঃ জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন ডাক্তার ওয়ালটার। তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আজ দুপুরের দিকে তোমাদের সঙ্গে দেখা করবে তার ভাইপো ড্যানি ওয়ালটার। জিনিসগুলো তার। হাতে দিয়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছেন ডাক্তার ওয়ালটার।
নিচে ডেনারের সই।
রেগে গিয়ে জিনা বললো, নিজে একটা নোট পর্যন্ত লিখতে পারলো না, এতোই জরুরী কাজে ব্যস্ত? ওই ডেনার ব্যাটা তাকে কি বলেছে, কে জানে! আসলে আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি ওরা।
ওদেরই বা দোষ কি? কিশোর বললো। আমাকে বললে আমিও বিশ্বাস করতাম না। নিজের চোখে দেখেছি, বলেই না..তবে ওরকম ভাবে হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার অনেক কাহিনী জানি আমি।
আমিও জানি, রবিন বললো। বইয়ে পড়েছি। রেফারেন্স বইতেও আছে কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ।
বিশ্বাস করেনি, মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে বললো মুসা, তো কি হয়েছে? করবে। যখন বাক্সটা নিয়ে গিয়ে তার সামনে ফেলবে তার ভাতিজা।
ড্যানি আসবে দুপুর নাগাদ। ততোক্ষণ আর কটেজের কাছ থেকে দূরে যেতে, পারছে না ছেলেমেয়েরা। রোদ উঠেছে। বাগানে আর পেছনের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেই কাটালো ওরা।
দুপুরের আগেই এলো ড্যানি। ছাউনিতে বসে গল্প করছিলো তখন ওরা। মোটর সাইকেলের আওয়াজ শুনে ছুটে গেল।
০৯.
গেটের বাইরে মোটর সাইকেল থেকে নামলো ছেলেটা। লম্বা, হালকা, কালো চুল। বয়েস আঠারো মতো হবে। বেল বাজালো।
গেট খোলার জন্যে একসাথে এগোলো পাঁচজনে।
তোমরাই গিয়েছিলে, না? বললো আগন্তুক। আমি ড্যানি ওয়ালটার। ডেনার বললো, কয়েকটা বাচ্চা দেখা করতে এসেছিলো জরুরী কথা বলতে
ছেলেটার ওপর বিতৃষ্ণা জাগলো কিশোরের। এমন ভঙ্গিতে বাচ্চা কথাটা বললো, যেন সে নিজে একজন বুড়ো মানুষ। তাছাড়া তার তীক্ষ্ণ উঁচু পর্দার কণ্ঠস্বরও পছন্দ করার মতো নয়। .,
হ্যাঁ, আমরাই গিয়েছিলাম, নিষেধ মনে থাকলো না টকারের। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেল আবার। আপনাদের পারিবারিক গুপ্তধন পেয়েছি।
চমৎকার। চাচা দেখলে খুশি হবে। চলো তো দেখি, কি পেয়েছো?
লিভিংরুমে নিয়ে আসা হলো ড্যানিকে। নিজের ঘরের খাটের নিচ থেকে বড় একটা সুটকেস বের করে আনলো কিশোর, তাকে সাহায্য করলো মুসা। টেবিলের ওপর রেখে বাক্সের ডালা তুললো।
দেখে বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠলো ড্যানি। দারুণ তো! সত্যি সত্যি পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে!
চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। লিয়ারি বলেছে, ডাক্তার ওয়ালটার নাকি খুব ভদ্রলোক। তাহলে তার ভাইপো এরকম কেন? কেমন যেন গোয়ার, দুর্বিনীত। ব্যবহারও ভালো না। জলদস্যু হামফ্রের স্বভাব পেয়েছে নাকি?
ঠিক আছে, নিয়ে যাচ্ছি, বলতে বলতে বাক্সের ডালা নামালো ড্যানি। সুটকেস বন্ধ করলো। তারপর হাতল ধরে তুলে নিলো। সুটকেসটা যে অন্যের, এ কথাটাও যেন ভুলে গেল।
এক মিনিট, ড্যানির পথরোধ করলো কিশোর। নোট লিখেছে ডেনার, সইও তার। মিস্টার ওয়ালটার লেখেননি। না লিখুন, ডেনারের কথাই নাহয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আপনি যে ড্যানি ওয়ালটার, তার প্রমাণ কি? কিভাবে বুঝবো?
হ্যাঁ, ঠিক, এগিয়ে এলো জিনা। প্রমাণ করুন, যে আপনি ড্যানি ওয়ালটার। মোটর সাইকেল এনেছেন। নিশ্চয় ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। দেখান।
ফ্যাকাশে হয়ে গেল ড্যানি। জ্বলন্ত চোখে তাকালো জিনা আর কিশোরের। দিকে। মানে! আমাকে সন্দেহ করছো? ডাক্তার ওয়ালটারের ভাতিজাকে?,
না, শিওর হতে চাইছি, দরজার দিকে এগিয়ে গেল, মুসা। প্রমাণ করার মতো কিছু সঙ্গে না থাকলে চলে যান। গিয়ে নিয়ে আসুন। আমাদেরকে বিশ্বাস। করাতে পারলে তারপর পাবেন সুটকেস।
বেশ, যাচ্ছি।
আগে সুটকেসটা রাখুন, বেশ উপভোগ করছে টকার। মোটর সাইকেলের এঞ্জিনের মতো একবার গোঁ গোঁ করে উঠে বললো, যান। পঞ্চাশ মাইল বেগে ছুটে চলে যাবেন। কতোক্ষণ আর লাগবে?
কিন্তু সুটকেস রাখলো না, ড্যানি। হঠাৎ দৌড় দিলো দরজার দিকে। পাথরের। দেয়ালের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল তিন গোয়েন্দা আর জিনা। পেছন থেকে তার জ্যাকেট খামচে ধরলো টকার।
ঝাড়া দিয়ে টকারের হাত ছাড়িয়ে ভোলা জানালার দিকে ছুটলো ড্যানি।
বাঘের মতো লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লো রাফিয়ান। কামড়ে ধরলো ড্যানির চামড়ার জ্যাকেটের ঝুল। দুই পা তুলে দিলো গায়ের ওপর।
হাত থেকে সুটকেস ছেড়ে দিলো নকল ড্যানি–কারোই আর বুঝতে বাকি নেই এখন, সে আসল ড্যানি নয়। জ্যাকেটটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। টেনে বের করে নিলো কুকুরটার দাঁতের ফাঁক থেকে।
আবার কামড় দিলো রাফিয়ান। নকল ড্যানির জিনসের প্যান্টের পেছনে। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেললো খানিকটা, কাপড় তো বটেই, সেই সঙ্গে কিছুটা চামড়াও। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো ছেলেটা। আবার দরজার দিকে দৌড় দিলো।
সুটকেস ফেলে দিয়েছে। আর আটকানোর কোনো মানে নেই। পথ ছেড়ে দিলো ছেলেরা।
পিছন দিকটা চেপে ধরে বারান্দা পেরিয়ে লাফ দিয়ে বাগানে পড়লো নকল ড্যানি। ইতিমধ্যে আরেক কাণ্ড হয়েছে। নটি ভেবেছে, সবাই কিছু না কিছু করেছে, তারও কিছু একটা করা দরকার। ড্যানি ঘর থেকে বেরোনোর আগেই গিয়ে লাফিয়ে উঠেছে তার কাঁধে, ঝাঁকড়া চুল খামচে ধরেছে। এখন হ্যাঁচকা টান মারছে।
দৌড়াবে, পাছা ডলবে, নাকি কাঁধ থেকে বানর ফেলবে? মহা মুশকিলে পড়ে, গেছে নকল ড্যানি। দুহাতে ধরে অনেক কষ্টে টেনে বানরটাকে নামিয়ে আনলো কাঁধ থেকে, ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দেখে টকার গেল রেগে। লাফ দিয়ে বাগানে নেমে ইয়া বড় এক ঢিল তুলে নিয়ে ধা করে ছুঁড়ে মারলো। ধ্যাপ করে গিয়ে লাগলো সেটা ড্যানির পিঠে। ওরে বাবারে, গেছিরে! বলে আরও জোরে দিলো দৌড়। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য তখনও শেষ হয়নি। বিশাল এক লরির মতো গর্জন তুলে তার পেছনে ছুটলো টকার।
গাড়ির আওয়াজ শুনে আরও ভড়কে গেল বেচারা ড্যানি। ভাবলো, গাড়ি নিয়ে তাকে তাড়া করেছে কেউ। পেছনে ফিরে তাকানোরও সাহস হলো না। এক লাফে গিয়ে চড়লো মোটর সাইকেলে। এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে শাঁ করে চলে গেল।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো ছেলেমেয়েরা।
মুসা তো একেবারে বাগানে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে। পেট চেপে ধরে হাসছে। হাসি কিছুটা কমলে বললো, আক্কেল থাকলে…হাহ হা…আর আসবে না…রাফি ওর পাছার চামড়া…! আবার হেসে উঠলো হো-হো করে।
হাসাহাসি চললো আরও কিছুক্ষণ।
অবশেষে হাসি থামিয়ে কিশোর বললো, স্রেফ ধাপ্পা দিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলো…
সে-তো বোঝাই গেল, বললো রবিন। নিশ্চয় ডেনারের কাজ।
তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি? আমরা যে গুপ্তধন পেয়েছি, একমাত্র সে-ই জানে…
আর লিয়ারি, মনে করিয়ে দিলো জিনা।
আরে না, প্রতিবাদ করলো মুসা। গলা কেটে ফেললেও লিয়ারি কিছু করবে। না। ভালো রান্না খেয়ে খেয়ে মহিলার ভক্ত হয়ে গেছে সে। সব শয়তানী ডেনারের।
এখন তাহলে আমরা কি করব? জিজ্ঞেস করলো রবিন। আবার যাবো ওয়ালটার লজে? দেখবো ডাক্তার ওয়ালটার এসেছেন কিনা?
তা-ই বোধহয় করতে হবে, কিশোর বললো। লিয়ারি বাজার থেকে আসুক। তাকে সব বলি। দেখি কি রিঅ্যাকশন হয়? তারপর খেয়েদেয়ে বেরোবো।
লিয়ারির অকৃত্রিম বিস্ময় দেখে বোঝা গেল, সে এই ধাপ্পাবাজিতে জড়িত নেই।
লাঞ্চের পর সাইকেল নিয়ে আবার ওয়ালটার লজে চললো ওরা।
আগের দিনের মতোই গেট বন্ধ। তবে আজ বাগানে কাউকে দেখা গেল না, ডেনারকেও না। বাংলোর দরজা-জানালাও সব বন্ধ। বেল বাজালো কিশোর। কয়েকবার। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছে, কেউ নেই বাড়িতে।
আরও কয়েক মিনিট গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দুইলো ওরা। বেল বাজালো। জবাব মিললো না।
নেই কেউ বাড়িতে, মুসা বললো।
হুঁ, রবিন একমত হলো তার সঙ্গে। ডাক্তার ওয়ালটারও ফেরেননি। কিন্তু, ডেনার গেল কোথায়?
কিশোরের দিকে তাকালো জিনা। কিশোর, এখন কি বরবো?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিলো কিশোর। আঁ? ফিরে তাকালো। এখন? শেরিফকে জানাতে হবে। তবে আগে গিয়ে গুপ্তধনগুলো নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে। চলো, জলদি চলো।
কিশোরের এই তাড়াতাড়ি করার কারণ বুঝতে পারলো না অন্যেরা। তবে কোনো প্রশ্নও করলো না। ফিরে চললো লিয়ারি কটেজে।
.
১০.
কটেজে ফিরে গুপ্তধনগুলো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। যেন আশা করেছিলৈ, ফিরে এসে আর দেখতে পাবে না, তার আগেই ডাকাতি হয়ে যাবে।
লিয়ারিও ভীষণ উদ্বিগ্ন। ছেলেদের দেখেই বলে উঠলো, ডাক্তার এসেছেন?
না, জানালো কিশোর।
তাহলে তো মুশকিল হয়ে গেল। এতো টাকার জিনিস ঘরে রাখতে আর সাহস হচ্ছে না। কিছু একটা করা দরকার।
আমিও তাই ভাবছি। শেরিফকে খবর দেয়া দরকার।
কি করে দেবে? তাহলে যেতে হবে কাউকে।
কেন, টেলিফোন?
নষ্ট। তারটার ছিঁড়েছে বোধহয় কোনো জায়গায় ঝড়ে। বাজারে গিয়েছিলাম যে, তখনই মিস্ত্রীকে খবর দিয়ে এসেছি। চলে আসবে।
হুঁ! তাহলে শেরিফের অফিসে গিয়েই খবর দিতে হবে। তবে তার আগে কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে এগুলো, গুপ্তধনের সুটকেসটা দেখালো কিশোর।
কিন্তু কোথায় লুকানো যায়? চিলেকোঠার কথা ভাবলে প্রথমে। ওখানে গিয়ে দেখা গেল, জায়গা নেই।
মুসা পরামর্শ দিলো, একটা ট্রাংকে ভরে তালা দিয়ে রাখলে কেমন হয়? কিশোর রাজি হলো না। তার ধারণা, ওখানেই প্রথম খুঁজবে চোরেরা। শেষে সেলারে লুকিয়ে রাখবে ঠিক করলো ওরা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো মাটির নিচের ঘরে।
পুরনো আমলের একটা বয়লার পড়ে আছে। বাতিল। এখন আর কাজ হয় না। ওটা দিয়ে। তার মধ্যে লুকানোর কথা বললো রবিন। দেখা গেল, বয়লারের মুখটা খুব ছোট। বাক্সটা ঢুকবে না তার মধ্যে।
ঘরের একধারে পড়ে রয়েছে একগাদা বস্তা। তুড়ি বাজিয়ে কিশোর বললো, পেয়েছি। ওখানে লুকাবো।
কোথায়? অবাক হয়ে জানতে চাইলো মুসা।
ওই যে, ওই বস্তাগুলোর তলায়। তার ওপর পুরনো একটা ময়লা চাদর ফেলে রাখবো। ব্যস, তাহলেই হবে। চোরেরা ভাবতেই পারবে না এতো দামী জিনিস ওরকম সাধারণ জায়গায় লুকানো হয়েছে।
আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো টকার, আচ্ছা, এতো ঝামেলা কেন। করতে যাচ্ছো? চোর কি আসবেই?
সেই সম্ভাবনাই বেশি! ধাক্কা দিয়ে নিতে আসার সাহসূ যখন করেছে, চুরি করা তো আরও সোজা।
খুব সাবধানে একটা একটা করে বস্তা তুলে পাশে নামিয়ে রাখলো কিশোর। কয়েকটা বস্তা সরানোর পর সুটকেসটা রাখ। বাকি বস্তাগুলোর ওপর। তারপর নামিয়ে রাখা বস্তাগুলো তুলে আবার আগের মতো সাজিয়ে দিলো সুটকেসটার ওপর। তার ওপর বিছিয়ে দিলো একটা পুরনো চাদর, এলোমেলোভাবে। যেন অনেকদিন থেকেই ওটা ওভাবে পড়ে আছে।
ঘরের আরেক ধারে পুরনো, একটা ভাঙা খাট ফেলে রাখা হয়েছে। কি ভেবে, ওই খাটটা তুলে এনে বস্তাগুলোর ওপর রাখতে বললো কিশোর।
ধরাধরি করে খাটটা তুলে এনে বস্তার দিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখলো ওরা। ঢাকা পড়ে গেল বস্তাগুলো,। খাটের নিচ দিয়ে উঁকি না দিলে আর চোখে পড়ে না।
যাক, আপাতত নিরাপদ, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো কিশোর।
তো, শেরিফকে কি আজই খবর দিতে হবে? জিনা জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করা উচিত! অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানে হয় না। কেন, তুমি যাবে নাকি?
নাহয় গেলামই।
কিন্তু সেলার থেকে বেরিয়েই বেরোনোর আশা বাদ দিলো ওরা। আবার কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। দেখে বিশ্বাসই হতে চায় না, এই কিছুক্ষণ আগেও ঝকঝকে রোদ ছিলো।
কি আর করা? ঘরে বসেই কাটাতে হলো।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি আরও বাড়লো। সাঁঝ হলো, রাত নামলো। আমার কোনো লক্ষণ নেই।
সারা রাত পালা করে পাহারা দিলো ওরা। এরকম দুর্যোগের রাতেই চোর ডাকাত আসার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল হলো। কেউ এলো না। নিরাপদেই কেটে গেল রাতটা।
পরদিন সকালে আবার রোদ উঠলো।
নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়বে ঠিক করলো ওরা। জিনা আর রবিন যাবে শেরিফকে খবর দিতে। কিশোর আর মুসা যাবে আবার ওয়ালটার লজে, ডাক্তার। এসেছেন কিনা খোঁজ নেয়ার জন্যে। আর টকার থাকবে কটেজে, লিয়ারির সঙ্গে। বাড়ি পাহারা দেবে। চোর-ডাকাত এলে ছুটে গিয়ে খবর দেবে কিশোর আর মুসাকে।
প্রথমে ঘরে থাকতে রাজি হলো না টুকার।
তাকে বোঝালো মুসা। শেষে বললো, তোমার গাড়ি চালানোর এই তো। সুযোগ। সোজা রেসিং-কার হয়ে ছুটে যাবে। তাছাড়া রাফিয়ান আর নটি থাকছে। নকল ড্যানির কি অবস্থা করেছিলো, ভুলে গেছো?
হাসি ফুটলো টকারের মুখে।
বেরিয়ে পড়লো ওরা যার যার মতো।
ওয়ালটার লজে চললো কিশোর আর মুসা। গিয়ে দেখা গেল, আগের দিনের মতোই জানালা-দরজা বন্ধ। ডেনারও নেই বাগানে। বেল বাজালো, কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। খানিকটা নিরাশ হয়েই কটেজে ফিরে এলো দুজনে।
ওখানেও কোনো রকম অঘটন ঘটেনি। দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। তবে কি তার সন্দেহ অমূলক? গুপ্তধন চুরি করার আর কোনো চেষ্টা হবে না?
কিছুক্ষণ পরেই পিকাপ নিয়ে এলেন শেরিফ। সঙ্গে রবিন আর জিনা। তাদের সাইকেলগুলো পিকাপের পেছনে তুলে নিয়ে এসেছে।
গাড়ি থেকে নামলেন শেরিফ লিউবার্তো জিংকোনাইশান। তিন গোয়েন্দার পরিচিত। (সাগর সৈকত দ্রষ্টব্য) হেসে এগিয়ে এসে হাত মেলালেন কিশোর আর মুসার সঙ্গে। বললেন, কি ব্যাপার? তোমরা যেখানেই যাও, গুপ্তধন চলে আসে নাকি তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে?
কিশোরও হাসলো। সে-রকমই তো লাগে। চলুন, দেখাবো।
বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে লিয়ারি। জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন, শেরিফ?
ভালো। আপনি?
ভালো। যান, দেখুন গিয়ে। আমি চা করে ফেলছি। না খেয়ে যাবেন না কিন্তু, বলেই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল লিয়ারি।
সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে নামলো কিশোর। নেমেই চিৎকার করে উঠলো।
কি হলো! হুড়মুড় করে নেমে এলো অন্যেরা। চমকে গেল কিশোরের মতোই। খাটটা সরানো। কাত হয়ে পড়ে আছে বস্তার প। চাদরটা ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। একধারে। সুটকেসটা নেই।
ভুরু কুঁচকে রেখেছেন শেরিফ। শিওর, ওখানেই রেখেছিলে?
নিশ্চয়ই! মুসা বললো। অনেক কষ্ট করেছি লুকিয়ে রাখতে।
স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। ভাবছে। কিন্তু ঢুকলো কিভাবে? বিড়বিড় করলো আনমনে। পাথরের দেয়াল…লিয়ারি বলেছিলো, আগে নাকি হান্টিং লজ। ছিলো এটা। সেই বাড়ি ভেঙে তার ওপর তৈরি হয়েছে লিয়ারি কটেজ। সেলারের দরজায় নিজের হাতে তালা লাগিয়েছি আমি, নিজের হাতে খুলোম। তাহলে?
ওই জানালা দিয়ে নয় তো? দেয়ালের অনেক ওপরের ছোট জানালাটা। দেখালো রবিন। ওটা দিয়েই ঘরে আলো আসে।
না। ওটা দিয়ে বড় মানুষ কেউ ঢুকতে পারবে না। বাচ্চাটাচ্চা, টকারের মতো হলে কিন্তু এতো ভারি একটা সুটকেস নিয়ে ওখানে উঠতে পারবে না টকারের মতো কেউ। বড় মানুষ হলেও মইয়ের দরকার হবে।
দা মিস্টরি অভ দা লকড় রুম! চেঁচিয়ে উঠলো টকার। একটা গোয়েন্দা, গল্পের বইয়ের নাম। পড়েছে সে। প্রায় ওটার মতোই কাণ্ড হয়েছে এখানেও। ঢোকার পথ নেই। তাহলে সুটকেস নিয়ে গায়েব হলো কিভাবে?
দরজা-জানালা সব পরীক্ষা করে দেখলেন শেরিফ। ভেঙে ঢোকার কোনো চিহ্ন নেই।
ওপরে উঠে এলো সবাই।
শুনে, আরেকটু হলেই হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিয়েছিলো লিয়ারি। ছলকে খানিকটা চা পড়ে গেল মেঝেতে।
প্রথম থেকে সব বলো তো আবার, শুনি, সোফায় বসে বললেন শেরিফ।
গোড়া থেকে আবার বলা হলো তাকে।
হুঁ, চা শেষ করে কাপটা ঠক করে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। ওই ডেনার ব্যাটাকেই গিয়ে ধরতে হবে। জানতে হবে, কাকে পাঠিয়েছিলো ড্যানির পরিচয়। দিয়ে।
.
১১.
সরাসরি সব অস্বীকার করলো ডেনার-সে কিছুই জানে না। এমনকি নোটটাও নাকি সে লেখেনি। সেটা প্রমাণও করা গেল না। কারণ, হাতের লেখা মিললো না। মহাধড়িবাজ লোক। নিশ্চয় অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে, হতে পারে নকল ড্যানিকে দিয়েই। তাকে ধরা গেল না। হয়তো লুকিয়ে আছে কোথাও, কিংবা পালিয়ে গেছে। মোট কথা, ডেনারের মুখ থেকে কিছুই বের করা গেল না। তাকে, ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন শেরিফ। দোষী প্রমাণ করতে না পারলে আটকে রাখবেন কিভাবে?
হতাশ হয়ে কটেজে ফিরে এলো ছেলেরা। কিশোর নিশ্চিত, কাজটা ডেনারই করেছে। দুপুরের খাওয়া শেষে আলোচনায় বসলো সবাই।
মিটিঙে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, তদন্ত চালিয়ে যাবে ওরা।
সেলারে চলো, বললো কিশোর। আরেকবার খুঁজে দেখি, কোনো সূত্র। পাওয়া যায় কিনা।
ওখানে গিয়ে আর কি দেখবো? মুসা বললো। তখন আমরা সবাই দেখেছি। শেরিফ দেখেছেন। থাকলে কি পাওয়া যেতো না?
দেখেছি। তবে একটা জায়গা বাকি রয়ে গেছে। মনে পড়েছে আমার।
অবাক হয়ে বললো মুসা, কোথায়?
চলো। দেখাবো।
আবার সেলারে নামলো ওরা।
ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো মুসা, কোথায়?
ওই যে, হাত তুলে দেখালো কিশোর।
ওগুলো তো বস্তা! ধাক্কা লেগে পড়েছে।
হ্যাঁ, বস্তা। তবে ধাক্কা নয়, বরং বলা ভালো, ঠেলা দিয়ে ফেলেছে।
ঠেলা তো পরে দিয়েছে। ঢুকলো কোনখান…
সেটাই তো দেখতে এলাম। বস্তাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল কিশোর। দ্রুত সরাতে শুরু করলো।
গোপন পথ-টথ আছে ভাবছো নাকি? পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রবিন।
হ্যাঁ।
রবিন আর মুসাও হাত লাগালো। দেখতে দেখতে সরিয়ে ফেললো সমস্ত বস্তা। কিন্তু কোথায় গুপ্তপথ? কোনো চিহ্নই নেই। নিরেট পাথরের দেয়াল যেন ব্যঙ্গ করে হাসছে ওদের দিকে চেয়ে।
দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো দুবার।
এবার কি বলবে? মুসা বললো।
এখনও বলবো গুপ্তপথ আছে। নইলে ঢোকার আর কোনো উপায় নেই। এসো, খুঁজে দেখি। বসে পড়ে দেয়ালে হাত রাখলো কিশোর। হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো, কোথাও বাধে কিনা, পাথরের কোনো কিনার বেরিয়ে আছে কিনা।
নেই। অন্যান্য খাঁজগুলোর মতোই বস্তার পেছনের চৌকোণা বড় পাথরটার কিনারে খাজ। অন্যগুলোর সঙ্গে কোনো তফাত নেই।
এই, এসো তো, ডাকলো কিশোর। সবাই ধাক্কা দাও।
জোরে ধাক্কা দিতেই সরে গেল পাথরটা, দরজার পাল্লার মতো বেরিয়ে পড়লো। কালো সুড়ঙ্গমুখ। টকার ধাক্কা দিচ্ছিলো এক কিনারে, আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো সুড়ঙ্গের মধ্যে, যেভাবে হঠাৎ সরেছে পাথরটা।
তাহলে আমিই ঠিক! এতোক্ষণে হাসি ফুটলো গোয়েন্দাপ্রধানের মুখে। পুরনো এলাকা এটা, বাড়িঘর বেশির ভাগই পুরনো আমলের। আর এটা তো সবচেয়ে পুরনোগুলোর একটা। তখন লোকে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে সুড়ঙ্গ-যোগাযোগ রাখতো। বিশেষ করে হামফ্রে ওয়ালটারের মতো লোকেরা। আমার বিশ্বাস, এই সুড়ঙ্গ চলে গেছে একেবারে দুর্গটার নিচে। আর গেছে। ওয়ালটার লজের নিচ দিয়ে, কিংবা পাশ দিয়ে। এটা জানে ডেনার। রাতে এই পথ। দিয়েই চুরি করতে এসেছিলো। আর এমনি কপাল, একেবারে তার পথের মুখেই জিনিসগুলো রেখে দিলাম। আমি একটা গর্দভ! আরও ভালোমতো ভাবা উচিত ছিলো।
এখানে সুড়ঙ্গ রয়েছে জানার কথা নয় তোমার, রবিন বললো। একটা কথা ঠিকই বলেছে। ডেনারই কাজটা করেছে। ওয়ালটারদের ওখানে অনেক দিন কাজ করছে সে, সব কিছু তার চেনা, জানা। সুড়ঙ্গ যে আছে, জানে।
তাহলে এখনও দাঁড়িয়ে আছি কেন আমরা? বলে উঠলো মুসা। চলো না যাই। ও-ব্যাটা যেখান দিয়ে এসে নিয়ে গেছে, ওখান দিয়ে গিয়ে আমরা আবার ফেরত নিয়ে আসি।
গেলেই তো আর হলো না, জিনা বললো। নিয়ে গিয়ে কোথায় লুকিয়েছে কি করে জানবো? তবে, এই সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে দেখতে আপত্তি নেই আমার।
বললে হয়তো যেতে দেবে না, তাই লিয়ারিকে কিছু জানালো না ওরা। ঘরে গিয়ে টর্চ নিয়ে এলো। ঢুকে পড়লো সুড়ঙ্গে।
গুপ্তদরজার কয়েক কদম পরেই সিঁড়ি পাওয়া গেল, নিচে নেমে গেছে। ওটা। দিয়ে নেমে সরু একটা গলিপথ পাওয়া গেল, দুধারে পাথরের দেয়াল, মাথার ওপরে পাথরের ছাত, মানুষের তৈরি।
এগিয়ে চলেছে ওরা। মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে নেমে গেছে পথটা। তবে এতো নিচেও পানি নেই, শুকনো।
আগে আগে চলেছে মুসা। হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার গায়ের ওপর। এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো কিশোর। কি হলো?
শ শ শ! একটা শব্দ শুনলাম!
কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। কিছুই ঘটলো না। কিন্তু মুসা যখন শুনেছে বলেছে, নিশ্চয় শুনেছে, ভুল হতে পারে না। তার শ্রবণশক্তি খুবই প্রখর।
চোখে সয়ে এলো অন্ধকার। সামনে আবছা আলো পড়লো এখন।
খোলা! বললো টকার। সুড়ঙ্গ শেষ নাকি…
চুপ? তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর।
আরও কিছুক্ষণ পঁড়িয়ে থাকার পরও কিছুই ঘটলো না দেখে আবার এগোলো ওরা। খুব সাবধানে, পা টিপে টিপে। শুরুতে যেমন নেমেছিলো, এখন আবার উঠে যাচ্ছে পথটা। শেষ মাথায় পৌঁছে গেল। সুড়ঙ্গমুখ ঘিরে ঘন হয়ে জন্মেছে লতাপাতা, ঝোপ। ওগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়লো উজ্জ্বল রোদ।
সাবধানে মাথা উঁচু করলো মুসা। আরি, ওয়ালটার লজ! ফিসফিস করে। বললো সে। ওই যে, বাংলোটা দেখতে পাচ্ছি।
পেছন থেকে কিশোরও মাথা উঁচু করে দেখলো।
এবার কি করবো? জানতে চাইলো মুসা। বেরোবো?
এক মিনিট, বললো কিশোর। দরজা-জানালা তো বন্ধ দেখা যাচ্ছে, অন্তত এদিকেরগুলো। দেখি, কেউ বেরোয় কিনা।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে বললো টকার। বেরোও।
তার কথার জবাব দিলো না কেউ।
পুরো এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কিশোর বললো, হ্যাঁ, এবার বেরোনো যায়। শব্দ করবে না। ডেনার দেখে ফেললে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। বলা যায় না, বিপদেও ফেলে দিতে পারে।
বেরিয়ে এলো সবাই।
পুরো এলাকাটাই নির্জন, লাগছে। সুড়ঙ্গমুখের কাছে ঝোপের ভেতরে বসে রইলো ওরা। সময় কাটছে খুব ধীরে। কিশোর ভাবছে, নিশ্চয় গাছপালা পরিষ্কার করার সময় কোনোভাবে এই সুড়ঙ্গমুখ আবিষ্কার করে ফেলেছে ডেনার। হয়তো ডাক্তার ওয়ালটারও এ-সম্পর্কে কিছু জানেন না।
আরও কিছুক্ষণ কাটলো।
ঝোপ থেকে বেরোনোর নির্দেশ দিলো কিশোর।
বাড়িটার দিকে এগোলো ওরা। শান্ত, যেন ঘুমিয়ে রয়েছে বাংলো।
নেই কেউ, টকার বললো।
আস্তে বলো, বললো কিশোর। শুনে ফেলবে।
যদি থাকে, বললো জিনা।
থাকতেও পারে।
বাংলোর ধার ঘুরে একপাশে চলে এলো ওরা। খানিক দূরে. একটা ছোট। কটেজ দেখা গেল।
নিশ্চয় ওখানে থাকে ডেনার, কটেজটা দেখিয়ে বললো রবিন।
চলো, গিয়ে দেখি, কিশোর বললো। আছে কিনা।
কী? মুসার প্রশ্ন। গুপ্তধনগুলো?
না, ডেনার। আমার মনে হয় না। গুপ্তধন ঘরে রাখবে। ভয় আছে না? শেরিফ যদি গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে?
যাবো? যদি দেখে ফেলে? দ্বিধা করছে মুসা।
নাথিং ভেনচার, নাথিং উইন। এরকম কাজ আর আগে কখনও করেনি টকার, খুব মজা পাচ্ছে। এর তুলনায় গাড়ি হওয়াটা অনেক পানসে মনে হচ্ছে এখন তার কাছে।
ঠিক, সায়, জানিয়ে বললো কিশোর। ঝুঁকি না নিলে জিতবো কিভাবে? আর, ফরচুন ফোভাব দা বোল্ড।
হয়েছে হয়েছে, দুহাত তুললো মুসা। ওসব তত্ত্বকথা শুনতে ভাল্লাগে না। চলো যাই।
কটেজের পেছনের ছোট বাগানে চলে এলো ওরা, বিন্দুমাত্র শব্দ করলো না। রাফিয়ানও একেবারে চুপ। টকারের কাঁধে বসা নটিও। কিভাবে যেন বুঝে গেছে, এখন জরুরী অবস্থা।
উঁকি দিয়ে দেখে এলো রবিন। ডেনার ব্যাটা আছে ঘরে! আরও একজন। আছে। কোন
দেখি তো, এগিয়ে গেল মুসা। কয়েক কদম এগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে। এগোলো। থামলো গিয়ে নিচতলার একটা জানালার নিচে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে মাথা তুললো।
অন্যেরাও একইরকম ভাবে গিয়ে থামলো তার পাশে। এক এক করে মাথা তুলতে লাগলো। ঘামছে দরদর করে, যতোটা না পরিশ্রমে, তার চেয়ে বেশি উত্তেজনায়। গরম তেমন নেই। ঝোপ থেকে যখন বেরিয়েছিলো; কড়া রোদ ছিলো। এখন নেই। যেন চোখের পলকে কোথা থেকে এসে উদয় হয়েছে কালো মেঘ, ঢেকে দিচ্ছে সূর্য।
বাইরের আলোর তুলনায় ঘরের ভেতরে অন্ধকার। আবছামতো দেখা যাচ্ছে দুজন মানুষকে। তবে ওদের চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না ছেলেদের।
একজন ডেনার। অন্যজন সেই কালো-চুল তরুণ, নকল ড্যানি। একটা টেবিলের দুধারে বসেছে দুজনে। টেবিলের ওপর দুই বোতল বিয়ার। শান্ত কণ্ঠে কথা বলছে। নিজেদের আলোচনায় এতোই মগ্ন, ওদেরকে যে দেখছে পাঁচজোড়া চোখ, খেয়ালই করলো না।
.
১২.
আসার সময়, শেরিফের একজন লোককেও দেখোনি? আশ্চর্য! বললো ডেনার। এই একটু আগে এসেছিলো ওরা, কটেজে খুঁজে দেখতে। গাধার দল। খালিহাতে ফিরে গেছে। ওদের বোকামি দেখে হাসি পেয়েছিলো আমার।
চাচা, তুমি একটা জিনিয়াস, হেসে বললো তরুণ। নিশ্চয় তাজ্জব করে দিয়েছে ওদের। ওরা কল্পনাও করতে পারবে না, কোথায় লুকিয়েছো।
না তা পারবে না। তোমাকে তো আগেই বলেছি, কিছু করতে পারবে না।
তবে, এজন্যে ছেলেগুলোকেও ধন্যবাদ দেয়া দরকার। ওরাই তো খুঁজে পেয়েছে। আর এমন জায়গায় নিয়ে লুকিয়েছে…হাহ হাহ হা! যা-ই বলো, সেলারে না রেখে ঘরে রাখলে কিন্তু বের করে আনা মুশকিল হতো। বিচ্ছ একেকটা। সঙ্গে। বাঘের মতো এক কুত্তা। বানরটাও আস্ত বাঁদর। এক মুহূর্ত চুপ করলো। খুলে দেখেছো নাকি?
দেখেছি। চমকে গিয়েছিলাম একেবারে। এতো দামী দামী সব জিনিস।
কিন্তু চাচা, ওসব জিনিস বেচবে কোথায়? যে দেখবে সে-ই সন্দেহ করবে।
তুই কি ভাবছিস সেকথা ভাবিনি? ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। হলিউডে একটা লোক আছে, চোরাই মালের ব্যবসা করে। তার নাম লিংকার। আমার পুরনো দোস্ত। ওর কাছে নিয়ে গেলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে তাড়াহুড়ো নেই। আর তাড়াহুড়ো করা উচিতও হবে না। শেরিফ কিছুদিন কড়া নজর রাখবে আমার ওপর। পরিস্থিতি এখন গরম, ঠাণ্ডা হয়ে নিক, তারপর ধীরেসুস্থে তুলে নেবো। এখন যেখানে আছে সেখানেই নিরাপদ, থাক।
সফল হবো তো, চাচা?
এখনও তোর সন্দেহ আছে নাকি, ডজ?
এরপর আর বিশেষ কোনো কথা হলো না। নীরবে বিয়ার খেয়ে চললো দুজনে। এক সময় উঠে বেরিয়ে গেল ডজ। মোটর সাইকেলের এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার। শব্দ হলো। পথের দিকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল আওয়াজ।
মাথা নিচু করে ফেললো ছেলেরা। একে অন্যের দিকে তাকালো। অল্প সময়ে অনেক কথা জেনে ফেলেছে। শেরিফ এসেছিলেন, ডেনারের কটেজ খুঁজে বিফল হয়ে ফিরে গেছেন, কিছু পাওয়া যায়নি। আর ড্যানি সেজে যে গিয়েছিলো, তার আসল নাম ডজ, ডেনারের ভাইপো। চাচা-ভাতিজা মিলে গুপ্তধনগুলো চুরি করেছে। তৃতীয় আরেক লোক, লিংকারের মাধ্যমে ওগুলো বিক্রি করবে। তবে সেটা কয়েকদিন পর। তারমানে গোয়েন্দাদের হাতে সময় আছে। খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারবে।
কিন্তু আসল কথাটাই জানা যায়নি। ডেনবার একবারও বলেনি, গুপ্তধনগুলো কোথায় লুকিয়েছে।
আর এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। ডেনার দেখে ফেললে বিপদে পড়বে। লিয়ারি কটেজে ফিরে চললো ওরা।
ওয়ালটার লজের সীমানার বাইরে চলে এলো।
ডাক্তার ওয়ালটার থাকলে সুবিধে হতো এখন, জিনা বললো। আজকালের মধ্যে চলে এলেও ইতো। তাকে বলতে পারতাম।
কি আর হতো? রবিন হাত নাড়লো। যা জেনেছি, শেরিফকে গিয়েও তো বলা যায়। কিন্তু লাভটা কি হবে?
ঠিকই বলেছো, চিন্তিত মনে হচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধানকে। বড় জোর আবার ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন ডেনারকে। ডেনার অস্বীকার করবে। তাতে আরও ক্ষতি হবে। আবারও হুঁশিয়ার হয়ে যাবে সে। গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যাবে। নাহ, খুঁজে বের করার চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে।…আমার ধারণা, ওয়ালটার লজের কাছাকাছি কোথাও লুকানো হয়েছে ওগুলো। বেশি দূরে রাখেনি ডেনার। আর এ-রকম সাধারণ চোরেরা যা করে, তা-ই করবে। মাঝে মাঝেই দেখতে যাবে, ঠিকমতো আছে কিনা জিনিসগুলো। এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো ওঁর ওপর চোখ রাখা। ও-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদেকে।
বেশ,মুসা বললো। কাল থেকে তাহলে তা-ই করা যাবে।
পরদিনও ডাক্তার ওয়ালটার ফিরলেন না। তিনি থাকলে সুবিধে হতো, ছেলেদের। তার অনুমতি নিয়ে সহজেই খুঁজতে পারতো ওয়ালটার লজ.আর আশপাশের এলাকায়। অনধিকার প্রবেশের দায় এড়াতে পারতো।
ওয়ালটার লজে ঢুকলো না ওরা। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পালা করে চোখ রাখতে লাগলো ডেনারের কটেজের ওপর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখে, রাতে বাদ।
কিন্তু লোকটার দৈনন্দিন কাজ বড় একঘেয়ে। ওয়ালটার লজের সীমানার বাইরেই যায় না, শুধু বাজার করা ছাড়া। হয় ঘরে বসে থাকে, নয়তো বাগানের লতাপাতা ঘাস সাফ করে।
দুদিন কাটলো এভাবে।
কিশোর এখন বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে, কটেজের ভেতরে বা বাইরে খুব কাছেই কোথাও গুপ্তধন লুকিয়েছে ডেনার। শেরিফের লোক জায়গামতো খুঁজতে পারেনি, তাই পায়নি।
কিশোরের সঙ্গে একমত হলো অন্যেরাও। নইলে কটেজ থেকে দূরে পারতপক্ষে যায় না কেন ডেনার? আসলে, কুকুর যেমন হাড় পাহারা দেয়, লোকটাও জিনিসগুলো পাহারা দিচ্ছে কাছে কাছে থেকে।
নাহ্, এভাবে চলতে পারে না, তৃতীয়দিন বললো কিশোর।
কিছু একটা করা দরকার। আজ ডেনার, বাজারে গেলেই ঢুকবো। আমরা আবার তার কটেজে খুঁজে দেখবো।
যদি ধরা পড়ি? মুসা প্রশ্ন তুললো।
পড়লে কি করবে? সে নিজেই এখন শেরিফের ভয়ে অস্থির। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বলবো, আমরা সব জানি। চুপ হয়ে যাবে।
বললো বটে কিশোর, কিন্তু কথাটা তার নিজেরই পছন্দ হলো না। সত্যি কি চুপ হবে? ওরকম একজন লোক, এতোগুলো দামী জিনিসের জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। হয়তো আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তার কাছে, কে জানে!
কিন্তু পরিকল্পনায় অটল রইলো কিশোর।
সুযোগ মিললো সেদিন বিকেলেই। ওয়ালটার লজের এক প্রান্তের লনের ঘাস ছাঁটতে গেল ডেনার। অনেকক্ষণ লাগবে কাজ করতে। সোজা তার কটেজের দিকে এগিয়ে গেল ছেলেমেয়েরা।
ঢুকতে অসুবিধে হলো না। নিচতলার একটা জানালা খোলা। চৌকাঠ ডিঙিয়ে টপাটপ ভেতরে ঢুকে পড়লো ওরা।
অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। কিছুই পেলো না।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো মুসা, পাবো কি? শেরিফের লোকেরা ট্রেনিং পাওয়া, চোরাই জিনিস কিভাবে খুঁজতে হয় ভালো করেই জানে। তারা যখন পায়নি, আমাদের আশা করাটাই বোকামি হয়েছে।
কিশোর, রবিন জিজ্ঞেস করলো। কিছু বলবে?
আমার এখনও বিশ্বাস, ধারেকাছেই কোথাও রয়েছে ওগুলো। কটেজের ওধারে ছোট ছোট দুটো ঘর আছে না, ওগুলোতেও খুঁজতে হবে…
থেমে গেল কিশোর। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।
নিশ্চয়ই ডেনার! কাঁপা গলায় বললো জিনা।
উঁকি দিয়ে দেখার জন্যে পা বাড়ালো টকার, তাকে আটকালো কিশোর। দ্রুত। একবার সারা ঘরে চোখ বোলালো, ওদের কোনো চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে কিনা। দেখলো। তারপর সবাইকে নিয়ে আবার নিঃশব্দে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।
ওরা বেরোতে আর সামান্য, দেরি করলেই ধরা পড়ে যেতো। ডেনারই আসছে।
ফেরার পথে ছোট একটা পশুচারণভূমিতে, একটা ওক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসলো ওরা।
নিরাশ হলে চলবে না, বললো কিশোর। কাল আবার খুঁজতে যাবো। আমি শিওর, দুর্গ আর লজের তলায় আরও সুড়ঙ্গ আছে। ওরকম কোনোটাতেই গুপ্তধন লুকিয়েছে ডেনার।
পরদিন আবার গেল ওরা। ওয়ালটার লজে পাতাবাহারের বেড়া ছাঁটতে ব্যস্ত ডেনার। সেদিন আর তার কটেজে ঢুকলো না ওরা। বাগান, আর বাগানের কাছের। ছড়ানো চত্বরে খুঁজতে লাগলো। একটা ছাউনি দেখা গেল, সামনের দিকে দেয়াল নেই। খোলা। ওটা লুকানোর জায়গা নয়। তবু তার ভেতরে খুঁজে দেখা হলো।
ছাউনি থেকে বেরিয়ে আরেকটা ছোট ছাউনিমতো দেখতে পেলো। ভেতরে পাথরে তৈরি কাপড় ধোয়ার জায়গা। জায়গাটাকে ঘিরে দেয়া হয়েছে ফুটখানেক উঁচু পাথরের দেয়াল দিয়ে।
পায়ে পায়ে সেদিকে এগোলো কিশোর। প্রত্যেকটা পাথর খুঁটিয়ে দেখলো। তারপর হাত নেড়ে ডাকলো, এই দেখে যাও।
প্রায় ছুটে এলো সবাই।
এই পাথরটা সরাতে হবে।
নিচে কিছু আছে ভাবছো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
দেখাই যাক না সরিয়ে।
সবাই হাত লাগালো। সহজেই সরিয়ে ফেললো পাথরটা। পুরনো মরচে ধরা, একটা হ্যাঁণ্ডেল দেখা গেল। ওটা ধরে টানতেই কাজ করলো পুরনো মেকানিজম, কাপড় ধোয়ার জায়গাটার ওপর থেকে সরে গেল একটা বড় পাথর। বেরিয়ে পড়লো একটা গহ্বর। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ? নাকি কুয়া? কিন্তু কুয়ার ওপর এই বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকনা লাগাতে যাবে কেন?
নিশ্চয় সুড়ঙ্গ, অন্ধকারে গর্তটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো কিশোর। চলো, নেমে দেখি।
দরকার পড়তে পারে। তাই টর্চ সঙ্গেই এনেছে ওরা।
হ্যাঁ, সুড়ঙ্গই। সিঁড়িও আছে। একে একে নেমে পড়লো সবাই। রাফিয়ান নামলো জিনার পেছনে। কিশোর রয়েছে আগে।
সিঁড়ির পাশে দেয়ালে একটা লেভার দেখা গেল। কিসের লেভার? ওপরের পাথরের ঢাকনাটা নিচ থেকে বন্ধ করার?–ভাবলো কিশোর। চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ওপরের ঢাকনা। উল্টো দিকে চাপ দিতেই খুলে গেল আবার।
ঠিক এই সময় শোনা গেল ভারি জুতোর আওয়াজ। এদিকেই আসছে।
তাড়াতাড়ি লেভার চেপে আবার ঢাকনা বন্ধ করে দিলো কিশোর। নিশ্চয় ডেনার। আমাদের দেখেছে বলে মনে হয় না। এখন এখানে এসে না ঢুকলেই বাঁচি।
ডেনারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো না ওরা। সে দেখে ফেলবে, আগেই লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করার জন্যে সুড়ঙ্গ ধরে আগে বড়িলো, দ্রুত।
দুরুদুরু করছে সবার বুক। কিশোরের পেছনে রয়েছে রবিন, তার পেছনে টকার আর তার কাঁধে নটি। মুসা রয়েছে তার পেছনে। সবার পেছন জিনা আর রাফিয়ান।
১৩.
অসমতল, এবড়ো-খেবড়ো মেঝে। মাঝে মাঝে চোখা পাথর বেরিয়ে আছে। সাবধানে এগোতে হচ্ছে, নইলে হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
সামনে মোড় নিয়েছে সুড়ঙ্গ। ওখানে এসে থামলো ওরা। কান পাতলো। ।
না, কিছু শোনা যাচ্ছে না, জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা। নীরব সুড়ঙ্গের দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিসফিসানিই হয়ে উঠলো অনেক জোরালো।
কিন্তু মুসার সঙ্গে একমত হতে পারলো না যেন রাফিয়ান। কান খাড়া করে রেখেছে। মৃদু গরগর করছে।
রাফিয়ানই ঠিক। অতি মৃদু একটা শব্দ কানে এলো ওদের।
পাথর সরাচ্ছে! বলে উঠলো টকার।
জলদি! বলেই প্রায় দৌড় দিলো কিশোর।
এখানে ডেনার তাদেরকে দেখে ফেললে কি করবে বলা যায় না। হয়তো কিছুই করবে না, কিন্তু সন্দিহান হয়ে উঠবে। তাহলেও ওদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। গুপ্তধন সরিয়ে ফেলবে ডেনার–যদি এই সুড়ঙ্গের কোথাও থেকে থাকে। হয়তো নিয়ে পালাতেও পারে আগেভাগেই।
সকলের পাশ কাটিয়ে আগে চলে এলো রাফিয়ান। মাটিতে গন্ধ শুকে এঁকে এগোলো। কোনো বিপদ থাকলে তার নাকে ধরা পড়বে।
পেছনে এগিয়ে আসছে ভারি জুতোর শব্দ। দ্রুত। এই সুড়ঙ্গ ডেনারের চেনা, কাজেই তাড়াতাড়ি চলতে তার কোনো দ্বিধা নেই। অসুবিধেও হচ্ছে না। এই হারে এগিয়ে এলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের কাছে চলে আসবে।
হঠাৎ থেমে গেল গোয়েন্দারা। ছোট গোল একটা গুহায় ঢুকেছে। মেঝেতে পাথরের ছড়াছড়ি। গুহার অন্য ধারের দেয়ালের ওপাশে আবার রয়েছে সুড়ঙ্গ। মাঝখানের পথ রুদ্ধ। লোহার পাল্লা, মোটা মোটা শিক।
পেছনে যাওয়ার উপায় নেই, সামনেও দরজা বন্ধ। ফাঁদে আটকা পড়লো ওঁরা!
গোঁ গোঁ করে উঠলো রাফিয়ান। পাগলের মতো এদিক ওদিক তাকালো টকার, জিনা আর মুসা। লুকানোর জায়গা খুঁজছে। রবিনের স্নায়ুর জোর ওদের চেয়ে বেশি। আর কিশোর একেবারে শান্ত। সহজে মাথা গরম হয় না তার। একগাদা পুরনো বস্তা অযতে ফেলে রাখা হয়েছে এককোণে, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
কুইক! বললো আচমকা। ওগুলোর তলায়ই লুকাতে হবে।
ছুটে গেল সবাই। রাফিয়ানকে শুইয়ে বস্তা দিয়ে ঢেকে দিলো জিনা। এক এক করে সবাই শুয়ে পড়লো, গায়ের ওপর টেনে দিলো বস্তা। চুপ করে অনড় পড়ে রইলো। পারলে নিঃশ্বাসও বন্ধ করে রাখতে চায়। টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। ফলে গাঢ় অন্ধকার গুহার ভেতরে।
স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ডেনারের জুতোর শব্দ। খানিক পরেই গুহায় ঢুকলো। বস্তার তলা থেকেও তার হাতের লণ্ঠনের আলো দেখতে পেলো ওরা।
এদিকে তাকাবে না তো ব্যাটা! মুসা ভাবলো। তাহলে যা থাকে কপালে, পাথর দিয়ে মারবো মাথায় বাড়ি!
তবে বাড়ি আর মারতে হলো না তাকে। হয় এদিকে তাকালোই না ডেনার, কিংবা তাকালেও বুঝলো না যে কেউ লুকিয়ে রয়েছে।
থেমে গেল পায়ের শব্দ। নিশ্চয় পাল্লার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ডেনার। আপন, মনেই কথা বললো, বুদ্ধি ছিলো হামফ্রে ব্যাটার। এমনভাবে লাগিয়েছে, বোঝার উপায় নেই। হা-হাহ!
ক্লিক করে শব্দ হলো। ছেলেরা বুঝলো, দরজা খুলছে ডেনার। কিচকিচ আওয়াজ হলো, খুব সামান্য। কজাগুলোয় তেল দিয়ে রেখেছে হয়তো ডেনার।
আস্তে করে বস্তার একটা কোণ তুলে তাকালো কিশোর। এদিকে পেছন করে রয়েছে কেয়ারটেকার। পাল্লা খুলে গেছে। লণ্ঠন হাতে সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা।
এবার কি করবো? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। উঠে দৌড় দেবো?
না, নিষেধ করলো কিশোর। কাছেই রয়েছে ডেনার। শুনে ফেলবে। কান। পেতে শুনলো এক মুহূর্ত। আমার মনে হয়, গুপ্তধনগুলো দেখতে গেছে সে। দেখে চলে যাবে। তখন আমরা গিয়ে খুঁজে বের করে ফেলবো।
কিন্তু ডেনার আর আসে না।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ওরা। পুরনো বস্তা, ধুলোময়লার নিচে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সময় যেন আর কাটতে চাইছে না। দুত্তোর! বলে উঠে পড়তে যাচ্ছিলো। মুসা, এই সময় শোনা গেল পাল্লা খোলার শব্দ।
নিজে নিজে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো ডেনার। হাহ হা, কি চমৎকার! সোনার মোহর! বড় লোক হয়ে যাবে তুমি, মিস্টার ডেনার। হোহ হহ!!
ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল তার পায়ের আওয়াজ।
আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলো কিশোর। তারপর বস্তা সরিয়ে উঠে বসলো। শুনলে তো কি বললো? সোনার মোহর। এখানেই কোথাও লুকিয়েছে।
বস্তার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। মুখে কাপড়ে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়লো। বার কয়েক লাফঝাঁপ দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিলো। রাফিয়ান। বানরটাও নাচলো তার সঙ্গে।
এই, থামাও ওকে, টকারকে বললো কিশোর। বেশি শব্দ করছে। কোত্থেকে আবার শুনে ফেলে ডেনার…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এখানেই আছি। ওটার ভেতরে, পাল্লাটা দেখালো সে। লেভার-টেভার কিছু নিশ্চয় আছে।
খুঁজতে শুরু করলো সবাই।
রবিনের আঙুলে লাগলো জিনিসটা। গোল একটা বোতামের মতো, পাল্লার পাশেই। জোরে চাপ দিতেই কিচকিচ করে খুলে গেল পাল্লাটা।
পাল্লার পরে সুড়ঙ্গ আর বেশি নেই। শেষ মাথায় খোলা। না, ঠিক খোলাও বলা চলে না। গোল মুখটা শেষ হয়েছে একটা কুয়ার দেয়ালে। বোধহয় মাঝামাঝি জায়গায়। ওপরের দিকে অনেক খানি উঠে গেছে সিলিণ্ডারের মতো গোল দেয়াল, নিচেও নেমে গেছে। কয়েক ফুট নিচে পানি।
কুয়া আর পাল্লার মাঝেই কোথাও লুকিয়েছে, মুসা বললো। এসো, খুঁজি।
নিরাশ হতে হলো। যদিও সুড়ঙ্গের কোনো গর্ত, খাজ, ফাটল বাদ দিলো না। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না গুপ্তধনের বাক্সটা।;
কোথায় রাখলো? বিড়বিড় করলো রবিন। দেখবো নাকি আরেকবার খুঁজে?
খোঁজা হলো আরেকবার। পাওয়া তো গেলই না, বরং একটা বিপদ বাধিয়ে বসলো টকার। হোঁচট খেয়ে গিয়ে পড়লো; পাল্লার ওপর। ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে গেল ওটা। এহহে, দিলাম তো সর্বনাশ করে!
গুপ্তধন খোঁজা বাদ দিয়ে এখন পাল্লা খোলা নিয়েই ব্যস্ত হলো সবাই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এপাশে কোনো বোতাম বা লেভার পাওয়া গেল না। নেইই। বোধহয়। শিক ধরে জোরে টানাটানি করে দেখলো। নড়লোও না মজবুত পাল্লা। শিরের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো মুসা–তার হাত আর সবার চেয়ে লম্বা পাল্লার পাশের বোতামটা ধরার চেষ্টা করলো। নাগাল পেলো না। শেষে শিকের ফাঁক দিয়ে নটিকে ওপাশে ঠেলে বের করে দিলো টকার। ইশারায় বোঝালো, কি করে বোতামটা টিপতে হবে।
নির্দেশ মতোই কাজ করলো বানরটা। কিন্তু তার শক্তিতে কুলালো না। টিপে নামাতে পারলো না বোতাম।
আরেকবার শিক ধরে টানা হলো, ঝাঁকি দিয়ে দেখা হলো, বৃথা চেষ্টা। বন্ধই রইলো পাল্লা।
হয়েছে, আর, শক্তি খরচ করে লাভ নেই, অবশেষে বললো কিশোর। খুলবে।
ভালো জায়গায়ই আটকা পড়লাম! বললো মুসা। কেউ জানে না আমরা। এখানে আছি। সাহায্য করতে পারবে না।
নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে কয়েকবার চিমটি কাটলো কিশোর। তারপর ঘুরে এগিয়ে চললো কুয়ার দিকে। সুড়ঙ্গের মুখে এসে থামলো। ঝুঁকে টর্চের আলো ফেললো পানিতে। কালো পানি। বোঝা গেল না, কতোখানি গভীর। যতোখানিই হোক, ওখান দিয়ে বেরোনোর পথ নিশ্চয় নেই। ওপর দিকে টর্চের মুখ ঘোরালো। দেখা গেল না কিছু। শেষ মাথায় পৌঁছলোই না ছোট টর্চের আলোকরশ্মি। নিভিয়ে দিলো টর্চ। দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দেখলো, অনেক ওপরে আবছামতো আলো দেখা যাচ্ছে।
গুড, বললো সে। কুয়ার মাথায় ঢাকনা, ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। উঠে যেতে পারলে, হয়তো ঠেলে সরিয়ে ফেলা যাবে।
কিভাবে উঠবো? গলা কাঁপছে টকারের। ভীষণ ভয় পেয়েছে। জীবনে এরকম অবস্থায় আর পড়েনি। নিজেকে দোষারোপ করছে মনে মনে।
কিভাবে যাবো? বলতে বলতেই আবার টর্চ জ্বাললো কিশোর। কুয়ার দেয়ালে আলো ফেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। ওই যে, লোহার আঙটা লাগানো, রয়েছে। ওঠানামা করার জন্যেই। একধরনের মই। বেয়ে উঠে যাবো।
যদি খসে পড়ে যায়? জিনা বললো।
পানিতে পড়বো। তাতে মরবো না। এখানে বসে থেকে তো লাভ নেই। চেষ্টা করা দরকার।
দাঁড়াও, মুসা বললো। আমি আগে দেখি। আমার ভার সইলে সবারই সইবে। একটা আঙটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো সে। কিছু হলো না। ঝুলে পড়লো। তাতেও কিছু হলো না। খুব শক্ত করে গাঁথা হয়েছে পাথরের দেয়ালে।
আঙটা ধরে ধরে বেয়ে উঠে যেতে লাগলো মুসা। নিচ থেকে আলো ধরে রাখলো অন্যেরা। ওপরে উঠে দেখলো কাঠের ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে কুয়ার মুখ। নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে ঠেলা দিতেই নড়ে উঠলো। সরিয়ে ফেলতে পারলো সহজেই।
বেরিয়ে এলো মুসা। ওয়ালটার লজের বাগানে বেরিয়েছে। একপলক দেখেই চিনলো জায়গাটা। কাছেই দেখা গেল সেই ঝোপটা, যার ভেতরে রয়েছে আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ, যেটা দিয়ে সেদিন বেরিয়েছিলো।
কুয়ার দেয়ালে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে ডাকলো, এই, উঠে এসো তোমরা।
এক এক করে উঠে এলো টকার-কাঁধে নটি, জিনা, রবিন, কিশোর। রাফিয়ান রয়ে গেছে নিচে। সে মই বাইতে পারে না। এতো ভারি, তাকে বয়ে আনাও সম্ভব হয়নি।
নিচে চেয়ে চেঁচিয়ে জিনা বললো, রাফি, তুই থাক ওখানে। আমরা দড়ি নিয়ে আসছি।
ঘাউ করে জবাব দিলো রাফিয়ান।
ডেনারকে কোথাও দেখা গেল না। লজের একটা ছাউনির ভেতরেই পাওয়া। গেল দড়ির বাণ্ডিল।
ওটার একমাথা কোমরে বেঁধে আবার নিচে নেমে গেল মুসা। রাফিয়ানের কোমরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে দিয়ে উঠে এলো। তারপর সবাই মিলে দড়ি টেনে তুলে আনলো ভারি কুকুরটাকে।
কুণ্ডলি পাকিয়ে দড়িটা আবার আগের জায়গায় আগের মতো করে রেখে দিয়ে কটেজে ফিরে চললো ওরা।
অনেক কিছু দেখেছে, অনেক কষ্ট করেছে, কিন্তু গুপ্তধন পাওয়া যায়নি। আরও খুঁজতে হবে। কাজটা পরের দিনের জন্যে স্থগিত রাখা হলো। কিশোরের। এখনও ধারণা, কুয়ার কাছাকাছিই কোথাও আছে ওগুলো। সুড়ঙ্গে নেই, এ ব্যাপারে শিওর। তাহলে কোথায়? পানিতে নয় তো!
দিনের বেলা যাওয়া আর ঠিক হবে না। ডেনারের চোখে পড়ে যেতে পারে। সন্ধ্যার পর বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। কাজেই, রাতের খাওয়া শেষ করেই সাইকেল বের করলো। লিয়ারিকে বললো, ঘুরতে যাচ্ছে। এ ওয়ালটার লজে পৌঁছে পাশের ছোট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সাইকেলগুলো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সোজা চললো কুয়ার পাড়ে। সঙ্গে করে আজ বড় টর্চ এনেছে, আর শক্ত মোটা দড়ি।
দড়ির একমাথা কোমরে পেঁচিয়ে বাঁধলো কিশোর। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায় না। বলা যায় না, পুরনো আঙটা বেশি ব্যবহারে খসে যেতে পারে। দড়ির। আরেক মাথা বাঁধলো একটা গাছের সঙ্গে। তারপর সবাইকে ওপরে থাকতে বলে নামতে শুরু করলো।
পানির কাছাকাছি এসে থামলো। পকেট থেকে একটা পাথর বের করে ছেড়ে দিলো। টুপ করে ডুবে গেল পাথরটা। পাথরের সঙ্গে সুতো বাঁধা। খুব সামান্যই ছাড়তে হলো। তারমানে পানি বেশি নেই।
গুড! আনমনে বললো কিশোর! আঙটা ধরে ধরে আবার নামতে শুরু করলো। পানির নিচে তিন আঙটা নামতেই হাতে লাগলো কি যেন। ধরে দেখলো, দড়ি। পানিতে তার কোমর পর্যন্ত ডুবেছে। ওই অবস্থায় থেকেই এক হাতে টান দিলো দড়িতে। ভারি লাগলো। টেনে তুলতে লাগলো।
দড়ির মাথা বাঁধা বাক্সটা একনজর দেখেই চিনতে পারলো। তার অনুমান। ঠিক। পানিতেই লুকিয়ে রেখেছে।
নিচে থেকেই চেঁচিয়ে বললো কিশোর, এইই, পেয়েছি! পেয়েছি!
ওপর থেকে শোনা গেল উল্লসিত চিৎকার।
উঠে আসছি, আবার বললো কিশোর।
উঠতে উঠতে মাঝপথে এসে একবার রাফিয়ানের উত্তেজিত চিৎকার শুনতে পেলো কিশোর। ছেলেদের আনন্দে যোগ দিয়েছে হয়তো কুকুরটা, ভাবলো সে। এক হাতে বাক্স নিয়ে আঙটার মই বেয়ে উঠতে পারবে না। তাই কোমরের দড়ি খুলে বাক্সের দড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখে এসেছে। ওপরে উঠে টেনে তুলবে।
কুয়ার বাইরে মাথা তুলেই স্থির হয়ে গেল কিশোর। ও, এজন্যেই হঠাৎ সবাই এতো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা, রবিন, টকার, জিনা। রাফিয়ানের কলার চেপে ধরে রেখেছে জিনা। নটি চুপ করে বসে। আছে টকারের কাঁধে। ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে ডেনার আর তার ভাইপো ডজ।
ডেনারের হাতে একটা দোনলা শটগান।
.
১৪.
উঠে এসো! কড়া গলায় আদেশ দিলো ডেনার।
মুসার পাশে এসে দাঁড়ালো কিশোর।
দড়ি ধরে টেনে দেখলো ভজ। ভারি লাগলো। চাচা, বাক্সটা মনে হচ্ছে ঠিকই আছে। ওটার সঙ্গে বেঁধে রেখে এসেছে। ভারি বজ্জাত ছেলে।
আমাদের ছাড়বে না ওরা, ভাবলো কিশোর, নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো। একবার। ছাড়লেই গিয়ে যদি শেরিফকে বলে দিই? আর তাই তো করবো!
তার দিকে ফিরলো রবিন। সে-ও একই কথা ভাবছে। আমাদেরকে এখন কি, করবে ওরা? মেরে কুয়ায় ফেলে দিলে কেউ খুঁজে পাবে না।
অনেক দেরিতে আফসোস হলো কিশোরের, বাড়াবাড়িটা সে-ই বেশি। করেছে। অন্যদের বিপদে ফেলার জন্যে সে-ই দায়ী।
চাপা গলায় গর্জাতে শুরু করলো রাফিয়ান।
চুপ, রাফি! তাড়াতাড়ি কুকুরটার মাথায় চাপড় দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো জিনা। ভয়, যদি রেগে গিয়ে গুলি করে ডেনার?
কথা মানলো রাফিয়ান।
গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এলো ছেলেরা।
ঠিকই আছে, চাচা, বাক্সটা কিছুদূর তুলে টর্চের আলো ফেলে দেখে বললো ডজ। খোলার সময় পায়নি মনে হচ্ছে। আবার বাক্সটা পানিতে নামিয়ে ওপর থেকে দড়ি কেটে দিলো সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, বিচ্ছুগুলোকে কি করা? ছেড়ে দেয়া তো যাবে না।
না। সর্বনাশ করে ফেলবে তাহলে। প্ল্যান বদলাতে হবে আমাদের। ওদের সরিয়ে দিয়ে…
সরিয়ে দিয়ে মানে? বন্দি করে রেখে?
থরথর করে কাঁপছে টকার তাকে সাহস দিয়ে মুসা বললো, আরে ভয়ের কি আছে? ব্যাটারা ছিঁচকে চোর, ডাকাত হওয়ার সাহস নেই।
এই, চুপ! ধমক দিলো ডেনার। বন্দুকটা ওদের দিকে ধরে রেখে ভাইপোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করলো।
আমি বলি কি, চলো আজই পালিয়ে যাই, পরামর্শ দিলো ডজ।
তা করা যাবে না। লিংকার এখন হলিউডে নেই। আসবে আরও দুদিন পর, খবর নিয়েছিলাম। এই বিচ্ছগুলো দেখে ফেলায়ই যতো গণ্ডগোল হলো। হলিউডে। মাল দিয়েই পালাতে হবে। নইলে ধরে ফেলবে পুলিশ। ..
দুদিন এখানে বসে থাকলেও ধরে ফেলবে। এগুলোকে ছাড়লেই সোজা চলে যাবে শেরিফের কাছে।
ছাড়ছে কে? আটকে রাখবো।
কিন্তু কোথায়? রাতে ওরা না ফিরলেই হৈ-চৈ শুরু করবে লিয়ারি। শেরিফ খুঁজতে আসবে এখানে। তোমার কটেজে রাখা যাবে না, বাংলোতেও না। তাছাড়া ডাক্তাররাও এসে পড়তে পারে যে কোনো দিন।
চুপ করে আছে ডেনার। ভাবছে।
চাচা, পেয়েছি। তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলো ডজ। সেদিন মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরছিলাম। সী-বীচ থেকে কিছু দূরে একটা ছোট দ্বীপ দেখেছি। দেখেই বোঝা যায়, লোক থাকে না-ওখানে। ভাঙাচোরা দুর্গও আছে। এদেরকে ওখানে নিয়ে গিয়ে রেখে আসতে পারি। কিছু খাবার আর কম্বল দিয়ে এলেই হবে. মরবে না। তারপর লিংকার এলে মাল নিয়ে চলে যাবো আমরা। যাওয়ার আগে ফোন করে লিয়ারিকে বলে যাবো, ওরা কোথায় আছে। আইডিয়াটা কেমন?
ভালো, একমত হলো ডেনার। ওয়ালটারদের বোটটা নিয়েই যেতে পারবো। চলো। এই, এসো তোমরা।
আদেশ পালন করা ছাড়া উপায় নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দৌড় দেয়ার কথা ভাবলো কিশোর; সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দিলো চিন্তাটা। বেপরোয়া হয়ে আছে এখন ডেনার। নির্দ্বিধায় গুলি চালাবে।
চলতে চলতে থেমে গেল ডেনার। ডিজ, ভুল করছি না তো? হুট করে কিছু করা উচিত হবে না। চলো, কটেজে চলো আগে। আরও ভেবে দেখি, কি করা যায়…
ছেলেদেরকে কটেজে নিয়ে আসা হলো। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে আলোচনায় বসলো চাচা-ভাতিজা।
প্রথমেই ধরো লিয়ারির কথা, ডেনার বললো। রাতে ছেলেদের ফিরতে না দেখলেই অস্থির হয়ে উঠবে। শিওর, শেরিফকে ফোন করবে।
ঠিকই বলেছো, মাথা ঝাঁকালো ডজ। তাহলে?
বুড়িটাকে বোঝাতে হবে, ছেলেদের কোনো বিপদ হয়নি। ইয়ে করো, দড়ি দিয়ে ওদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলো আগে।
বন্দুক ধরে রইলো ডেনার, দ্রুত কাজ সারলো ডজ। রাগে দাঁতে দাঁত চাপলো জিনা, গালও দিলো। কিন্তু ডজ শুধু হাসলো। কেয়ারই করলো না।
ইহ, ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে, বন্দুকটা নামালো ডেনার। নাও, এটা ধরো। আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছো?
লিয়ারিকে ফোন করে আসি। বলবো, আমি পারকার। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে এসেছে, থাকবে দুতিন দিন।
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। কোনো রকম ফাঁক রাখছে না ডেনার ব্যাটা!
পাগল হয়েছে? ডজ বললো। তোমার গলা চিনে ফেলবে না? বুড়িটা এতো বোকা না।
না, চিনবে না। রুমাল দিয়ে রিসিভার ঢেকে নেবো। দুএক বার খুকখুক করে কাশবো। তাহলেই বুঝবে, ঠাণ্ডা লেগেছে। গলা অন্যরকম হয়ে গেছে। আমি আসলে পারকারই, আর কেউ নই, হাহ হাহ হা!
হেহ হেহ হে! রেগে গিয়ে মুখ ভেঙুচালো জিনা। রাফিয়ান ঘেউ করে উঠতেই বললো, এই, চুপ!
ওদের দিকে ফিরেও তাকালো না চাচা-ভাতিজা।
ভালোই বুদ্ধি করেছে, চাচা, বললো ডজ। কাজ হবে
তাড়াতাড়িই ফিরে এলো ডেনার। হয়েছে, ভাইপোর দিকে চেয়ে হাসলো। চলো, বেরোও ওদের নিয়ে। নৌকায়।
খাবার-টাবার আনোনি?
না। দরকার মনে করিনি। আরেকটা কথা ভেবেছি আমি। দূর থেকে দেখে তোমার মনে হয়েছে দ্বীপটাতে লোক থাকে না। ধরে নিলাম থাকে না। কিন্তু কারও পিকনিকে যেতে বাধা কোথায়? কিংবা দিনের বেলা জেলেরা যদি খুব কাছাকাছি চলে যায়? তারমানে ওপরে রাখা যাবে না ওদের। ভাঙা দুর্গ আছে বললে না? মাটির তলায় নিশ্চয় সেলার-টেলার কিছু আছে…
কিংবা ডানজন।
তাহলে তো আরও ভালো। ভরে রাখবো ওখানে। বাইরে থাকছে না, ঠাণ্ডা লাগবে না, কাজেই কম্বলের দরকার নেই। আর খাবার-পানি ছাড়াই আটচল্লিশ ঘণ্টা বাঁচতে পারে মানুষ, বলে আবার হাহ্ হাহ্ করে হাসলো সে। হয়েছে, চলো এবার।
সাগর পারে নিয়ে আসা হলো ওদের। ওয়ালটারদের বোট হাউসে ছোট একটা মোটর লঞ্চে এনে তোলা হলো। এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে লঞ্চটা বোট হাউস থেকে বের করলো ডজ।
জিনার মুখে রহস্যময় হাসি দেখতে পেলো কিশোর, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলো।
খুব শিগগিরই অবশ্য জিনার হাসি মুছে গেল। তীর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে তখন লঞ্চ। কিনারে দাঁড়িয়ে আছে রাফিয়ান। সাবধান হওয়ার সামান্যতম সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ এক ধাক্কায় তাকে পানিতে ফেলে দিলো ডজ। চেঁচিয়ে উঠলো জিনা।
খিকখিক করে হাসলো ডজ। তারপর একটানে টকারের কাঁধ থেকে বানর টাকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো পানিতে।
এই হারামীর বাচ্চা! ভীষণ রাগে গাল দিয়ে উঠলো জিনা। এটা কি করেছিস। ভালো চাইলে জলদি তুলে আন!
না আনলে কি করবে? হাসতে হাসতে বললো ডজ। না ফেলে উপায় ছিলো। ঘাউ ঘাউ করে চেঁচাতো কুত্তাটা। জেলেরা শুনে ফেললে মুশকিলে পড়তাম। আর ওই বাঁদুরটাকে ট্রেনিং দেয়া আছে কিনা কে জানে? হয়তো তোমাদের বাঁধন খুলে দিতো। ওসব শয়তান জানোয়ার মরে যাওয়াই ভালো।
মরা তো উচিত তোর মতো হারামী জানোয়ারের, ফুঁসে উঠলো জিনা। কুকুর আর বানর তো তোর চেয়ে অনেক ভালো। দুটোকে ফেলে দেয়া হয়েছে, সে-জন্যে ভাবছে না সে, রাফিয়ান ডুবে মরবে না। খুব ভালো সাঁতার জানে। নটিও মরবে না। রাফিয়ানই তাকে বাঁচাবে। ভাবছে অন্য কারণে। পিছন পিছন আসছে কুকুরটা, মনিবকে সাহায্য করার জন্যে। এভাবে দ্রুত সাঁতরে এলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তখন বিপদ ঘটতেও পারে।
একটা দাঁড় তুলে নিয়ে রাফিয়ানকে শাসালো ডেনার। তা-ও আসছে দেখে শেষে বন্দুক তুলে নিলো।
চেঁচিয়ে বললো জিনা, এই রাফি, যা যা, চলে যা!
চাঁদের আলোয় চোখ দেখা যাচ্ছে কুকুরটার। বিষণ্ণ দৃষ্টি। থেমে গেল।
পানি এলো জিনার চোখে। অথচ সহজে কাঁদতে দেখা যায় না তাকে।
হাত বাঁধা না থাকলে এই মুহূর্তে বন্দুক কেন, কামান দেখিয়েও ঠেকানো যেতো না মুসাকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি টিপে ধরতো ডজের। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললো সে, প্রতিশোধ নেবো আমি, উজ! তোকেও যদি না চুবাই, তো আমার নাম মুসা আমান নয়!
টকার কাঁদছে।
রবিন চুপ।
কিশোরও চুপ, পাথরের মতো নিথর। বোঝাই যায়, ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কে।
কিছুক্ষণ পর দ্বীপের কিনারে এসে ভিড়লো বোট। জিনার রহস্যময় হাসির কারণ বোঝা গেল। দ্বীপটা গোবেল দ্বীপ, বন্দিদের অতি পরিচিত, টকার ছাড়া। জিনা হেসেছিলো, সে বুঝতে পেরেছিলো এই দ্বীপেই নিয়ে আসা হবে তাদ্দেরকে। আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে আর কোনো দ্বীপ নেই, যেটা মূল ভূখণ্ড থেকে দেখা যায়।
বন্দিদের নামার আদেশ দিলো ডেনার। নিয়ে আসা হলো ভাঙা দুর্গের চত্বরে। সেখানে বন্দুক ধরে বসে রইলো ডেনার। ডজ গেল মাটির নিচে ঘর-টর আছে কিনা দেখতে।
প্রায় আধ ঘন্টা পর ফিরে এলো ডজ। ঘর পেয়েছে।
দুর্গের নিচে ডানজনে নিয়ে আসা হলো বন্দিদের। যে ঘরটায় আনলো, সেখানে এর আগেই একাধিকবার এসেছে জিনা আর তিন গোয়েন্দা।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টর্চের আলো ফেলে ঘরটা দেখলো ডেনার। সন্তুষ্ট হয়ে বললো, চমৎকার জায়গা। থাকো এখানেই দুদিন। অন্ধকারে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিতে পারবে। গলা ফাটিয়ে চিল্লালেও কেউ শুনবে না, কেউ দেখতে আসবে না। তাতে শিক্ষা হবে। অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবে না জীবনে…
নাক তো তোরা গলাচ্ছিস, শয়তানের বাচ্চা! আবার গলি দিয়ে উঠলো, জিনা।
দুদিন খেতে না পেলেই এই তেজ চলে যাবে, শান্তকণ্ঠে বললো ডেনার। ডজ, চলো। আবার আসতে হবে এখানে।
নতুন কোনো আইডিয়া
হ্যাঁ। এই ছেলেগুলো যখন খুঁজে পেয়েছে, ভালোমতো খুঁজলে শেরিফও পেয়ে যেতে পারে। লিয়ারিকে ফোন করে এসেছি বটে, কিন্তু বলা যায় না কি ঘটবে। পারকার ফোন করতে পারে লিয়ারির কাছে, ছেলেমেয়েরা কেমন আছে জানার জন্যে। গোলমাল শুরু হবে তখন। বাক্সটা কুয়ায় রাখা আর ঠিক না। তার। চেয়ে এই দ্বীপ অনেক বেশি নিরাপদ, এখানেই এনে রাখবো। তারপর লিংকার এলে তুলে নিয়ে চলে যাবো।
.
১৫.
বেরিয়ে গেল দুই শয়তান।
গাধা, ব্যাটারা! হেসে উঠলো মুসা। রাফিয়ানের চিল্লানী থামিয়েছে, অথচ আমাদেরকে বললো গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে। আরে হারামজাদারা, পাঁচজনের চিৎকার তো একটা কুকুরের চেয়ে অনেক বেশি হবে। যাকগে, ভালোই হয়েছে। আর এতোই আত্মবিশ্বাস, সব আলোচনা করেছে আমাদের সামনে। বাক্সটা যে এনে রাখবে, সে-কথাও।
ওরা জানে, আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো টকার। যখন বেরোবো তখন ওরা পগার পার। ইস্, এতো শক্ত করে বেঁধেছে, হাত ঝিমঝিম করছে, আমার।
জিনার রাগ কমেনি। বসে বসে ফুঁসছে। কে বললো বেরোতে পারবো না? রাফিয়ানকে ফেলে দিয়ে মনে করেছে বেঁচে গেল। ব্যাটারা জানেই না, আরামসে সাঁতরে গিয়ে তীরে উঠবে রাফি। আর এই দ্বীপটা যে আমার, তা-ও জানে না।,
কিশোর কোনো কথা বললো না। চুপচাপ উঠে চলে গেল দেয়ালের কাছে। বেরিয়ে থাকা একটা চোখা পাথরে ঘষতে শুরু করলো হাতের দড়ি। চামড়া ছিললো, রক্ত বেরোলো, তবু থামলো না। বাঁধন-মুক্ত হতেই হবে।
দেখাদেখি অন্যেরা উঠে এসে একই ভাবে পাথরে দড়ি ঘষতে লাগলো।
কতোক্ষণ লাগলো বলতে পারবে না, তবে, অবশেষে সফল হলো ওরা। প্রায়। একই সঙ্গে কিশোর আর মুসার দড়ি ছিঁড়ে গেল। তারপর অন্যদের বাঁধন খুলে দেয়াটা কিছুই না।
ডানজন থেকে বোরোনোর পথ ভালোমতোই জানা আছে ওদের। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। বড় একটা পাথর চাপা দিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ, ওভাবেই বন্ধ করার ব্যবস্থা, জানে ওরা। কয়েকবার ওই পাথর সরিয়ে ঢুকেছে, বেরিয়েছে। নিচে থেকে সবাই মিলে ঠেলে সরাতে অসুবিধে হলো না।
বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। খোলা আকাশের নিচে।
পূর্ব দিগন্তে আলো ফুটেছে। জেগে উঠেছে দাঁড়কাকের দল। তাদের কর্কশ চিৎকারে কান ঝালাপালা। এতোক্ষণে হাসি ফুটলো জিনার মুখে। ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে। হাততালি দিয়ে বললো, আরে, দেখো দেখো, রাফি! ঠিক বুঝে গেছে কোথায় আছি আমরা।
বেশ দূরে রয়েছে এখনও রাফিয়ান। ঢেউয়ের ওঠানামার ফাঁকে ফাঁকে শুধু তার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। একা নয়। পিঠে বসে আছে নটি। দেখে, আনন্দে ধেইধেই করে নাচতে আরম্ভ করলো টকার।
সূর্য উঠলো। ভোরের কাঁচা রোদে ঝিলমিল করে উঠলো সাগর, পানি তো নয়, যেন তরল সোনা।
তীরে পৌঁছলো রাফিয়ান।
হুল্লোড় করে ছুটে গেল ছেলেমেয়েরা।
ঝাড়া দিয়ে গা থেকে পানি ঝাড়ছে রাফিয়ান আর নটি। কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরলো জিনা। টকার কোলে তুলে নিলো বানরটাকে।
রাফি, আদর করতে করতে বললো জিনা। কিছু ভাবিস না। তোকে কষ্ট দিয়েছে তো, ভেবেছে পার পেয়ে যাবে। ব্যাটারা আসবে আবার। যতো খুশি। কামড়াস তখন, কিছু বলবো না।
টকার বললো নটিকে, হ্যাঁ, চুল ছিঁড়ে দিস। কামড়ে কান কেটে ফেলিস। আমিও মানা করবো না।
ওদের কথাবার্তা শুনে হাসতে শুরু করলো মুসা। তার হাসি সংক্রামিত হলো সবার মাঝে। হো হো করে হাসলো সবাই। কাছেই বসে কৌতূহলী চোখে দেখছিলো একটা কাক। সম্মিলিত হাসির শব্দে চমকে উড়ে গেল কা-কা করে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তুমুল কা কা। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতে লাগলো কাকেরা।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, কিশোর বললো। বাক্সটা খুঁজে বের করতে হবে। চলো, দেখি।
বেশি খুঁজতে হলো না। চত্বরের একধারের মাটিতে দাগ দেখতে পেলো রবিন। সদ্য খোঁড়া হয়েছে। রাফি আর নটিকে লাগিয়ে দিতেই খুঁড়ে বের করে ফেললো বাক্সটা। আধ হাত মাটির তলায় লুকিয়েই নিশ্চিন্তে ফিরে গেছে ডেনার আর তার ভাইপো। গর্তের কিনারে একটা কাঠিও পুঁতে রেখে গেছে, চিহ্ন, যাতে পরে এসে চিনতে পারে।
চলো, নিচে ভাঁড়ারে লুকিয়ে ফেলি, বললো কিশোর।
ডানজনের পাশেই ছোট একটা ঘরকে ভাড়ার বানিয়ে নিয়েছে জিনা। কিছু টিনের খাবার, চিনি, লবণ আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব সময় জমা রাখে। ওখানে। যাতে দ্বীপে এলে দরকারের সময় কাজে লাগে। ওখানেই এনে গুপ্তধনগুলো লুকিয়ে রাখলো ওরা।
তুরুপের তাস এখন ছেলেদের হাতে। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। গুপ্তধনগুলো আবার উদ্ধার করেছে। আর রয়েছেও ধরতে গেলে একেবারে নিজেদের বাড়িতে। ইচ্ছে করলেই যে কোনো সময় তীরে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু আপাতত যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
কিশোর, ব্যাটাদের শায়েস্তা করা দরকার, জিনা বললো। কিভাবে করা যায়?
সেটা পরেও আলোচনা করতে পারবো, বলে উঠলো মুসা। পেটের মধ্যে ছুঁচো নাচছে। আগে ওটাকে দাঁড়িয়ে নিই।
ভাঁড়ারের আলমারি থেকে দুধ, চকোলেট, কোকা বের করা হলো। রুটি নেই, তবে বিস্কুট আছে অনেক। স্টোভ বের করলো রবিন। বললো, মুসা, টকার, দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে এসো।
নাস্তা ভালোই হলো। বিস্কুট আর চকোলেটের সঙ্গে গরম গরম কোকা মেশানো দুধ। খেয়েদেয়ে শান্ত হয়ে এরপর আলোচনায় বসলো ওরা।
দ্বীপে থাকাটা কিছু না, বললো রবিন। দুই তিন দিন সহজেই কাটিয়ে দিতে পারবো। তবে, কেরি আন্টিকে একটা খবর দেয়া দরকার, যে আমরা ভালোই আছি।
সেটাও কোনো সমস্যা নয়, জিনা বললো। সিঁতরে চলে যেতে পারবো।
আরে কি বলো? বুকে চাপড় দিয়ে বললো গোয়েন্দাসহকারী। এই মুসা আমান থাকতে তুমি কষ্ট করবে কেন? আমিই যাবো।
আর খবর না দিলেই বা কি? মুচকি হাসলো কিশোর। ব্যাটাদের আগে শিক্ষা দিয়ে নিই। তারপর একবারেই সকলে মিলে যাবো দ্বীপে।
মানে? চকচক করছে টকারের চোখ। ভয়-ডর সব চলে গেছে। বরং মজা পাচ্ছে এখন।
মানে হলো, ডেনার, ডজ আর তাদের দোস্ত লিংকার এখানে এলে দেখবে, তাদের জন্যে ফাঁদ পাতা রয়েছে। এরকম কিছু ঘটতে পারে, আশাঁই করবে না। ওরা, তাই সোজা এসে আমাদের ফাঁদে পা দেবে। এখন আমাদের ভাবতে হবে, ফাঁদটা কী হবে।
হেসে উঠলো মুসা। উরুতে চাপড় দিয়ে বললো, দারুণ আইডিয়া। খুব ভালো হবে। ব্যাটাদের চেহারাটা তখন যা দেখতে লাগবে না!
হ্যাঁ, একেবারে চমকে যাবে, বললো রবিন। কল্পনাও করবে না, আমরা ছাড়া পেয়ে গেছি। খেয়েদেয়ে রীতিমতো আরামেই আছি…
আর রাফি আর নুটিও বেঁচে আছে, যোগ করলো টকার।
সেই সঙ্গে গুপ্তধন গায়েব, আনন্দে দাঁত বের করে হাসলো জিনা।
এখন একটা ছক করে ফেলা দরকার, কিশোর বললো। কড়া নজর রাখবো আমরা, পালা করে। ওরা যেন আগে আমাদেরকে দেখে না ফেলে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
কিভাবে কি করবে, ঠিক করা হলো। আরও কিছু কাজ করলো, তাতেই যেন। উড়ে চলে গেল সকালটা। লাঞ্চের আয়োজন করলো রবিন আর জিনা। টিনজাত সেদ্ধ সীম আর ভাজা মাংস আছে। ওগুলো বের করে গরম করলো। টিনের সংরক্ষিত কিছু ফলও বের করলো। এক প্যাকেট লেমোনেড ক্রিস্টাল আছে। ওগুলো থেকে কিছু নিয়ে ঝর্নার পানিতে মেশাতেই তৈরি হয়ে গেল লেমোনেড। পেটে হাত বোলাতে বোলাতে মুসা বললো, জিনা, কসম খোদার, এরপর ঝগড়া লেগে, যদি তুমি আমার মাথার চুল সব ছিঁড়ে ফেলো, কোনোদিন কিছু বলবো না।
তোমার চুল থাকলে তো ছিড়বো? সব তো কোঁকড়া তার, খুলি কামড়ে রয়েছে।
তাহলে অন্য কিছু করো। এই যেমন, চিমটি কাটা, কিল মারা। চাইলে হাত কামড়েও দিতে পারো
আমি কি রাফি নাকি, যে কামড়াবো?
রাফি না হও, ওর ঘনিষ্ঠ দোস্ত তো… দোস্ত তো তুমিও…
বাকযুদ্ধে কিছুতেই জিনাকে ঘায়েল করতে পারলো না মুসা। হাসলো সবাই। টকার বেশি হাসছে। এ-রকম রোমাঞ্চের স্বাদ জীবনে এই প্রথম পাচ্ছে। এ-রকম। অ্যাডভেঞ্চারও কপালে জোটেনি কখনও। খুব ভালো লাগছে তার। গাড়ি হওয়ার কথা ভুলেই গেছে। ওটা এখন তার কাছে মনে হচ্ছে ফালতু।
খাওয়ার পর একটা, উঁচু জায়গা বেছে নিয়ে পাহারায় বসলো ওরা। ওখান থেকে সাগরের অনেকখানি দেখা যায়। কেউ এলে ওদের চোখ এড়িয়ে আসতে। পারবে না।
সাঁঝ হলো। নামলো অন্ধকার রাত। বেশ কিছু কম্বলও রাখা আছে, পলিথিন দিয়ে মুড়ে রেখেছে জিনা। খুলে নিয়ে আসা হলো ওগুলো। আকাশে মেঘ নেই, কিন্তু বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। দুর্গের যে একটিমাত্র ঘর আছে, যেটার ওপরে ছাত, তাতে ঢুকে শুয়ে পড়লো. সবাই, একজন বাদে। সে পাহারায় রইলো উঁচু জায়গাটায়। কয়েক ঘন্টা পাহারা দিয়ে এসে আরেকজনকে তুলে দেবে ঘুম থেকে।
প্রথম পাহারায় রয়েছে জিনা। পাশে রাফিয়ান। যেখানে বসেছে, তার খানিক দূর দিয়ে সরু পথ নেমে গেছে দ্বীপের ছোট সৈকতে।
জিনার পরে পাহারা দিলো মুসা। তারপর কিশোর। সব শেষে রবিন। কিন্তু চোরেরা এলো না।
পরের দিনও সারাটা দিন সাগরের দিকে চোখ রাখলো ওরা।
সেদিন সন্ধ্যার পর প্রথম পাহারায় বসলো টকার। বয়েস কম, এধরনের কাজে অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রথমে রাজি হতে চায়নি কিশোর। কিন্তু মুখ কালো করে যখন টকার বললো-ছোট বলে আমাকে অবহেলা করছে–আর রাজি না। হয়ে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বললো, বেশ থাকো। তবে চোখ খোলা রাখবে। খবরদার, ঘুমোবে না।
ঘুমালো না টকার। তার সঙ্গে রয়েছে নটি আর রাফিয়ান। বিপদের গন্ধ পেলে সাবধান করে দেবে তাকে।
আটটা বাজলো, নটা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো টকার, এই, জলদি এসো! একটা মোটর বোট!
ছুটে এলো সবাই। দেখল।
হু, ওরাই, বললো কিশোর। গুড!
এসো দোস্তরা, এসো, হাত নেড়ে ডাকলো মুসা। এসে দেখো, ধান-দুর্বা সাজিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্যে।
.
১৬.
হ্যাঁ, ডেনার আর ডজই। সঙ্গে আরেকজন লোক, মোটা, বেঁটে, নিশ্চয় লিংকার। পাহাড়ের চূড়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। চাঁদ উঠছে, ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার, ফলে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না ওদের।
ভালো জায়গাতেই লুকিয়েছো দেখা যাচ্ছে, কর্কশ কণ্ঠে বললো লিংকার, ওর। গলাটা খসখসে। চট করে বের করে ফেলো। নিয়ে কেটে পড়ি।
আমি যাচ্ছি, ডজের হাতে টর্চ। চাচা, ছেলেমেয়েগুলোকে কি করবো? দুদিন অন্ধকারে থেকে, না খেয়ে, আমার মনে হয় কাবু হয়ে গেছে।
ওদেরকে? গুরত্বই দিলো না ডেনার। থাকুক। আমরা নিরাপদে বেরিয়ে যাই আগে। তারপর একটা ফোন করে দেবো মেয়েটার বাপের কাছে। আরও কিছুক্ষণ থাকুক, শিক্ষা হোক কিছুটা। অনেক উৎপাত করেছে।
উৎপাত তো কিছুই করিনি, উৎপাত দেখবে এখন, মনে মনে বললো মুসা। এই শুরু হলো। ছোট একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো। নিখুঁত নিশানা। ডেনারের মাথায় গিয়ে পড়লো পাথরটা।
উফ! করে উঠে চাঁদিতে হাত রাখলো ডেনার। কি পড়লো?
ও কিছু না, ছোট পাথর, বললো তার ভাতিজা। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছে। খামোকা চিল্লাচ্ছো।
কয়েক পা এগিয়েই দড়াম করে আছাড় খেলো সে। পাথরে বাড়ি লেগে চুরমার হয়ে গেল টর্চের কাঁচ।
কি হলো? চেঁচিয়ে বললো তার চাচা।
কিসে যেন পা পড়লো। পিছলে গেল।
দেখে চলতে পারো না? কিসে পিছলালো?
কি জানি!
কিসে পিছলেছে বলে দিতে ইচ্ছে হলো মুসার। কুকর্মটা সে-ই করেছে। পাথুরে পথের ওপর রান্নার তেল ঢেলে পিছলা করে দিয়েছে। তাতে পা পড়লেই দড়াম।
উঠে এগোলো আবার ডজ। পেছনে এলো তার চাচা। ওই জায়গাটাতে আসতেই ভাতিজার চেয়ে জোরে আছাড় খেলো। তাকে তুলতে এসে ডেনারের গায়ের ওপরই পড়লো লিংকার।
জোরে জোরে হাসলো ডজ। অন্যকে বলার বেলায় তো খুব তোমরা দেখে। চলতে পারো না?
গালাগাল করতে করতে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। খাড়াই বেয়ে উঠে আসতে লাগলো আবার।
তেলের ওপর পা পড়ে আরেক জায়গায় আবার আছাড় খেলো ডজ। তার চাচাও। কিছু দূর এগিয়ে আবার।
হাসতে হাসতে দুর্গের ঘরে ফিরে এলো ছেলেরা।
চত্বরে পৌঁছলো তিন চোর।
ওই যে, ওখানে, সদ্য খোঁড়া গর্তের ধারে কাঠিটা দেখিয়ে বললো ডেনার। ডজ, খোড়ো।
খালি হাতেই ওপরের আলগা মাটি খুঁড়ে সরিয়ে ফেললো ডজ। এই যে, বলতে বলতে টেনে তুললো একটা প্রাস্টিকের ব্যাগ। ভেতর থেকে বের করলো ভারি বাক্সটা.। লিংকারের দিকে বাড়িয়ে দিলো, এই যে, নিন।
বাক্সটা মাটিতে রেখে বসে পড়লো লিংকার। ডালা তুলে চেঁচিয়ে উঠলো। সোনার মোহর আর অলঙ্কার কোথায়? এ তো মস্ত এক সী-গালের কঙ্কাল, আর পাথর! রাগে গর্জে উঠলো, এই তোমাদের গুপ্তধন!
টর্চের আলোয় বাক্সের জিনিসগুলোর দিকে বোবা হয়ে চেয়ে আছে ডেনার। ডজও হাঁ হয়ে গেছে।
ঠিক এই সময় লাফ দিয়ে ডেনারের কাঁধে নামলো ছোট একটা জীব। দোল খেয়ে বাহুতে নেমে ছোঁ মেরে টর্চটা কেড়ে নিয়েই দিলো দৌড়।
কী ওটা? চিৎকার করে বললো ডেনার। বানর না? এখানে বানর এলো কোত্থেকে…আরে ডজ, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ধর না!
বানরটার পেছনে দৌড় দিলো ডজ।
কিছুদূর এগিয়ে থেমে ফিরে তাকালো নটি। যেন ডজের কাছে আসার অপেক্ষা করছে। তারপর ঘুরে আবার ছুটলো। উজকে টেনে নিয়ে চললো ভাঙা দুর্গের ধ্বংসস্তূপের দিকে। ঢুকে পড়লো একটা দরজা দিয়ে।
সোজা তার পেছনে ছুটে এলো ডজ। দরজায় পেতে রাখা ফাঁদ দেখতে পেলো না। আড়াআড়ি ভাবে একটা শক্ত দড়ি বেঁধে রাখা হয়েছে। তাতে পা বেধে উড়ে গিয়ে ধুডুস করে পড়লো। কাদায় পড়া মাছের মতো কঠিন মেঝেতে পিছলে গেল দেহটা। বিশাল এক পাথরে বাড়ি লাগলো মাথা। প্রচণ্ড আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো সে।
নিঃশব্দে তাকে তুলে নিয়ে একটা অন্ধকার কোণে সরে গেল ছেলেরা। দ্রুত হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখলো একটা দেয়ালের আড়ালে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ডেনার আর লিংকার। অবাক হয়ে ভাবছে, ডজ এখনও আসছে না কেন? হঠাৎ ডজের বিকৃত জোরালো চিৎকার কানে এলো, চাচা, চাচা, মেরে ফেললো। বাঁচাও, চাচা!
পাকা অভিনেতা কিশোরের কণ্ঠস্বর ধরতেই পারলো না ডেনার, ভাবলো, ডজই বুঝি চিৎকার করছে। লিংকারকে বললো, তুমি দাঁড়াও এখানে। আমি দেখি কি হয়েছে?
দৌড়ে এলো ডেনার। ভাতিজার মতোই দড়িতে পা বেধে খেলো আছাড়। ভারি শরীর ময়দার বস্তার মতো পড়লো। একটা পা বেকায়দা ভাবে মুচড়ে গিয়ে। পড়লো পেটের তলায়। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, গেছিরে, মরে গেছি! হায় হায় রে, আমার পা শেষ। এক্কেবারে ভেঙে গেছে!
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নীরব হাসিতে ফেটে পড়লো ছেলেমেয়েরা।
দুটো বেকার, ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। টকার, দাও নটিকে লেলিয়ে।
বানরটাকে নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দিলো টকার।
হুফ! করে উঠলো রাফিয়ান। সে-ও কিছু করার অনুমতি চাইছে জিনার কাছে।
যা। যা ইচ্ছে কর গিয়ে, খুশিমনে অনুমতি দিয়ে দিলো জিনা।
জিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটলো রাফিয়ান।
ডেনারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিলো লিংকার। দরজার কাছে পৌঁছার। আগেই দেখলো, বিরাট এক জীব মস্ত একটা ছায়ার মতো ছুটে আসছে তার ওপর আঁপিয়ে পড়ার জন্যে।
আর কি দাঁড়ায় চোরাই মালের ব্যবসায়ী? ভারি শরীর নিয়ে এমনভাবে ঘুরলো, যেন পালকের মতো হালকা। দিগগজ দৌড়-বিদদের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে ছুটলো প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। সামনে একটা গাছ দেখে চোখের পলকে তাতে চড়ে বসলো।
নিচে থেকে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো রাফিয়ান, লাফঝাঁপ দিতে লাগলো। লিংকারকে ধরতে না পারায় ভীষণ খেপে গেছে।
গাছে উঠে যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো লিংকার, এলো আরেক বিপদ। ঝুপ করে তার কাঁধের ওপর লাফিয়ে পড়লো একটা বানর। চুল, খামচে ধরে কামড় বসালো কানে।
ওরে বাবারে, খেয়ে ফেললো রে! বলে চেঁচিয়ে বানরটাকে সরাতে গিয়ে ডাল থেকে ছুটে গেল হাত। ওপর থেকে পড়লো আবার নিচে, একেবারে রাফিয়ানের মুখের কাছে। আচ্ছামতো কয়েকটা কামড় খেয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে আবার উঠলো গিয়ে গাছে।
হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো ছেলেমেয়েরা। বানরটাকে ডেকে নামালো। টকার। গলার বেল্ট ধরে জোর করে টেনে রাফিয়ানকে সরালো জিনা।
বোটে চলো সবাই, আদেশ দিলো কিশোর। কুইক!
ঢালু পথ বেয়ে দৌড় দিলো সবাই। টকারের কাঁধে নটি। মুসার কাঁধে গুপ্তধনের ব্যাগ। কোথায় তেল ফেলেছে, জানা আছে ওদের। ওগুলো এড়িয়ে গেল, আছাড় খেতে হলো না। এক এক করে লাফিয়ে উঠলো, বোটে। গাছের দিকে ফিরে জোরে আরেকবার ঘেউ ঘেউ করে রাফিয়ানও উঠে পড়লো।
এঞ্জিন স্টার্ট দিলো মুসা। জিনা ধরলো হুইল। তিন মিনিট পর খোলা সাগরে বেরিয়ে এলো ওয়ালটারদের মোটর বোট। ছুটলো মূল ভূখণ্ডের দিকে।
দূর থেকেই গোবেল ভিলায় আলো দেখা গেল, স্টাডিরুমে।
দুই প্রফেসর নিশ্চয় মাথার ঘাম বের করে ফেলছেন, হেসে বললো মুসা। আমাদের এই অবস্থায় দেখলে কি যে…
জিনা, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। আগে শেরিফের ওখানে যাও।
বোটের মুখ ঘুরিয়ে দিলো জিনা।
ছেলেমেয়েদের দেখে অবাক হলেন শেরিফ আর তার ডেপুটি। সব কথা। শুনলেন। গুপ্তধনগুলো রেখে দিলেন নিরাপদ জায়গায়।
মনে হলো ডাক্তার ওয়ালটার এসেছেন, বললেন শেরিফ। একটু আগে ওপথেই আসছিলাম। বাড়িতে আলো দেখলাম।
শেরিফের অফিসে বসেই লিয়ারিকে টেলিফোন করলো কিশোর। মিসেস পারকারকে ফোন করে সংক্ষেপে সব কথা জানালো। শেরিফ ফোন করলে ডাক্তার ওয়ালটারকে। তারপর নিজেদের লঞ্চ আর লোকজন নিয়ে দ্বীপে চললেন চোরগুলোকে ধরে আনার জন্যে। ছেলেমেয়েরাও চললো সঙ্গে।
তিন চোরকে নিয়ে ফিরে এসে ওরা দেখলো, শেরিফের অফিসে বসে আছেন ডাক্তার ওয়ালটার আর তার মিসেস। ছেলেদের মুখে গুপ্তধনের গল্প শুনে তো অবাক।
ডজকে হাজতে ভরা হলো। মাথার একপাশ গোল আলুর মতো ফুলে আছে। ডেনার পায়ের ব্যথায় ককাচ্ছে। লিংকারের সারা গায়ে কামড় আর আঁচড়ের ক্ষত; রক্তাক্ত। দুজনকে কড়া পাহারায় পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন শেরিফ।
আর এই সময় এসে অফিসের সামনে থামলো আরেকটা গাড়ি। নামলেন মিসেস পারকার আর দুই বিজ্ঞানী।
অফিসে ঢুকেই জিনার দিকে চেয়ে ভুরু কুঁচকে বলে উঠলেন মিস্টার পারকার,, তোমাদের জ্বালায় শান্তিতে কাজ করার জো নেই। কেন জড়ালে এসবে?
আহ, তুমি থামো তো, মৃদু ধমক দিলেম মিসেস পারকার। ঠিকই তো করেছে। চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখেও পালিয়ে আসবে নাকি?
কিন্তু মারাও যেতে পারতো, বললেন প্রফেসর কারসওয়েল।
যায়নি যখন আর বলে লাভ কি? টকারকে কাছে টানলেন মিসেস পারকার। কেমন ছিলি? খুব কষ্ট হয়েছিলো?
আরে না, কি যে বলো, আন্টি, মাথা নেড়ে বললো টকার। দারুণ মজা পেয়েছি। বাবা, তোমাকে আর জ্বালাবো না। গাড়ি হতে আর ভালো লাগে না এখন আমার। গোয়েন্দা হবো।
গোয়েন্দা হয়ে করবিটা কি শুনি? বললেন কারসওয়েল। হলে বিজ্ঞানী হবি।…এই হ্যারি, চলো চলো, পরীক্ষাটা শেষ করে ফেলি। এরা ভালোই আছে।
চলো।
অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন দুই বিজ্ঞানী।
লিয়ারিও এসে হাজির হলো। জানালো, ছেলেদের–বিশেষ করে মুসার জন্যে তৈরি হয়ে পড়ে আছে বিশাল এক ফুট কেক।
পরদিন লাঞ্চে দাওয়াত করলেন সবাইকে মিসেস ওয়ালটার। লিয়ারি, পারকার দম্পতি, প্রফেসর কারসওয়েল, শেরিফ, আর ছেলেমেয়েদেরকে তো অবশ্যই।
দাওয়াতে গেল সবাই। চমৎকার খাওয়া-দাওয়া হলো। ছেলেময়েদের সবাইকে একটা করে সোনার মোহর উপহার দিলেন ওয়ালটার, স্যুভনির হিসেবে রেখে দেয়ার জন্যে। বাকি গুপ্তধনগুলো রাখবেন না, জানালেন। ডাকাতি করে। এনেছিলো তাঁর পূর্বপুরুষ। ওসব লুটের মাল রাখতে চান না তিনি। দান করে দেবেন কোনো রিসার্চ সেন্টারে। মানুষের উপকারে লাগবে ওই গুপ্তধন বিক্রির টাকা।