হোস্টেলে হত্যা
মেরিন ড্রাইভের কাছেই একটা আরামপ্রদ হোটেলের সাত তলার স্যুটের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের লীলাখেলা দেখার ফুরসতে কত বিশ-তিরিশ ভাবছিল গার্গী। শীত পড়ব-পড়ব এমন ঋতুতে আরব সাগর যতটা শান্ত থাকবে ভাবা গিয়েছিল তেমনটি নয়। বরং ঢেউগুলো মস্ত ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল বালুকাবেলায়। হয়তো এটা ভাঁটার সময়। তাই বিদায় নিতে না-চাওয়া জলের এমন দৌরাত্ম্যপনা। তবে এমন অশান্ত না হলে যেন সমুদ্রকে মানায় না।
জানলা দিয়ে কী যেন দেখে গার্গী লাফিয়ে উঠল উচ্ছ্বাসে, দেখে যাও, কী সুন্দর জাহাজ একটা, মনে হচ্ছে একটা বিশাল ঈগল উড়ে এসে বসল সমুদ্রের উপর।
সায়ন যথারীতি ব্যস্ত তার কাজে। মুম্বাইতে অবশ্য বেড়াতে আসেনি সায়ন, ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে এসেছে। কাজটা উপলক্ষ্য, উদ্দেশ্য গার্গীকে সঙ্গে নিয়ে দু-তিনদিন নির্ভেজাল বেড়ানো। সেই ছোট্ট কাজটির গভীরে ডুব দিয়েছে ভোরে উঠেই, এখন গার্গীর ডাকাডাকিতে তার সাড় ভাঙে, ঘাড় তুলে বলল, এখনও জাহাজ দেখার বয়স আছে?
-বাহ, জাহাজটা কী সুন্দর! জানলায় এসে দেখলে তবেই বুঝবে বয়স আছে কি না! যে-কোনও সুন্দর জিনিস যে-কোনও বয়সে দেখা যায়।
গার্গীর তৃতীয়বারের ডাকে আর সাড়া না দিয়ে পারল না সায়ন, তার হাতের গুচ্চের কাগজ সেন্টার টেবিলে উপুড় করে রেখে এসে দাঁড়াল জানলায় চোখ রেখে, জাহাজটা কিছুক্ষণ অপলক দেখে বলল, নাহ্, আমার বউটা বেশ রোমান্টিক তাতে সন্দেহ নেই।
গার্গী হাসি-হাসি মুখে বলল, কাল তুমি তো কমলা নেহরু পার্কে যেতেই চাইছিলে! অথচ গিয়ে বুঝতে পারলে মেরিন ড্রাইভ এমনিতেই সুন্দর, কিন্তু মালাবার হিলসের উপর কমলা নেহরু পার্ক যেমন সুন্দর, সেখান থেকে মেরিন ড্রাইভ আরও কী চমৎকার দেখায়!
সত্যিই মুম্বাইয়ের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ এই মেরিন ড্রাইভ। আরব সাগরের কিনার এখানে একেবারে তৃতীয়ার চাঁদের মতো আশ্চর্যভাবে বাঁকানো। কিনারে রাতের বেলা সার সার আলো থাকায় মেরিন ড্রাইভকে দেখায় যেন লতিয়ে পড়ে আছে একটা দীর্ঘ সোনার বিছেহার। মালাবার হিলসে উঠে দেখলে সেই সৌন্দর্য আরও বহগুণ। মুম্বাইবাসী তাই, মেরিন ড্রাইভকে আদর করে নাম দিয়েছে কুইনস নেকলেস।
সেই কুইনস নেকলেস দেখে সায়নের মতো কেজো মানুষও কাল বলেছিল, চমৎকার!
রথদর্শন ও কলাবিক্রয়ের এমন রৌপ্যসুযোগ পেয়ে সায়ন বেশ খুশমেজাজে আছে সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে নামা ইস্তক। গার্গীর রোমান্টিকতার সঙ্গে চেষ্টা করছে তাল মেলানোর। গার্গী তাতে বেশ উল্লসিত বোধ করছে, কারণে-অকারণে হাসছেও বারবার।
সায়নের সঙ্গে হঠাৎ মুম্বাই উড়ে আসাটা গার্গীর কাছে একেবারেই অভাবনীয়। কলকাতার ব্যস্তসমস্ত জীবনে অবসর বলতে কী বোঝায় তা গার্গীরা ভুলতেই বসেছে। রোজ সকালে উঠে সেই একই রুটিন। সকালে উঠে বাড়ির কাজ সেরে অফিসে যাওয়া, সারাদিন অসংখ্য ফাইলে সই, মিটিঙের পর মিটিং, তারপর সন্ধেয় ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে সোফায় বা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কাগজ বা ভালো বইপত্র পেলে তাতে চোখ পাতা। কখনও ফিরতে রাত সাড়ে ন’টা-দশটা। ততক্ষণে লুনা ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের অপেক্ষায় থেকে থেকে। কাজের মেয়ে গীতার জিম্মায় কেটে গেল তার তিন বছরের জীবন। বাবা-মাকে কাছে পাওয়া তার কাছে তাজমহল দেখার মতো। ঘুমন্ত লুনাকে আদর করার সময়ও নেই তাদের। তখন ক্রমাগত হাই তুলতে তুলতে কোনও ক্রমে খাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।
ঠিক এরকম ব্যস্তসমস্ততার মধ্যে মুম্বাই থেকে এই আমন্ত্রণপত্রটি এসে পৌঁছোতে সায়ন একদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে ঝিঙে-পোস্ত দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলল, চলো, সামনের সপ্তাহে মুম্বাই যাই।
গার্গীর গলায় ভাত আটকে যাচ্ছিল আর একটু হলে। ভূতের মুখে রামনাম উপমাটা ব্যবহার করতে গিয়েও বেধে গেল। সায়ন সম্পর্কে এহেন অভিধা না দিয়ে বলল, এভারেস্ট কি তিরিশ ডিগ্রি হেলে গেল আজ?
না, এভারেস্ট হেলে না গেলেও সায়ন ঠিক করেছে এই আমন্ত্রণটি সে রাখবেই। তার সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিছুটা এগিয়ে পিছিয়ে গার্গীকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে মুম্বাইতে। কিন্তু ছোট্ট লুনাকে সঙ্গে আনেনি। সোনালিচাঁপার খুবই ন্যাওটা হয়েছে লুনা। সে-ই বলল, এরকম হারিকেন টুরে ওকে নিয়ে গেলে খুব ধকল যাবে ওর উপর দিয়ে। এখনও ভ্রমণের আনন্দ বুঝতে শেখেনি ও। তা ছাড়া তোমাদের কোথায় কখন থাকতে হয়, ছুটতে হয় তার ঠিক কি! আমি আর গীতাদি দুজন মিলে সামলে রাখব ওকে। তোমরা ঘুরে এসো, দিদি।
সোনালিচাঁপার প্রাজ্ঞতাকে তারিফ করে দুজনে দীর্ঘ আলোচনান্তে সেরকমই সাব্যস্ত করেছে অতএব। কিন্তু তবু মনের খুঁতখুতানি যায় না। প্লেনে ওঠা ইস্তক লুনার অনুপস্থিতি একটা আলপিন ফোঁটাচ্ছে মনের কোথাও। কিন্তু দিন চারেকের ব্যাপার। তার মধ্যে প্রচুর ঘোরাঘুরি। লুনার কষ্টই হত মা-বাবাকে কাছে পেতে গিয়ে।
মেটোমুটি তিন-চার ঘণ্টা পরপর একবার করে ফোন করে খবর নিচ্ছে লুনার। লুনার সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছে বার দুই। লুনা মোটেই বুঝতে পারছে না তার মা-বাব ঠিক কত দূরে আছে। প্রতিদিন তো এভাবেই দুজনে অফিসে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাতে। শুধু রবিবারেই যা একটু সময় দিতে পারে ওকে। লুনা সেরকম হিসেব করেই ফোনে জিজ্ঞাসা করছে, এখনও অফিস শেষ হয়নি? আর একটু পরেই চলে আসবে তো?
সোনালিঠাপাও বলছে, তোমাদের কোনও চিন্তা নেই, দিদি। ও দিব্যি খেলছে ওর একশো খেলনা নিয়ে। আমি তো সারাক্ষণ ওর সঙ্গেই খেলছি।
গার্গীর চিন্তা তাতে কিছুটা কম। সোনালিচাঁপা ভারি চমৎকার মেয়ে। ওর জীবনের শুরুতে একটা বড় ধরনের আঘাত পাওয়াতে নিজেকে স্থিতধী করে তুলছে ক্রমশ। গার্গীর সঙ্গে গামস্টিকের মতো ঘোরে। অবসর কাটায় লুনাকে নিয়ে।
মুম্বাই পৌঁছে কোম্পানির নির্দিষ্ট হোটেলে উঠে গার্গী কিছুটা নিশ্চিন্ত। মেরিন ড্রাইভের কাছে এই হোটেলটা যেমন চমৎকার দেখতে, তেমনই বিলাসবহুল। দামও আকাশছোঁয়া। সুবিধে এই যে, সব খরচ আমন্ত্রণকতাদের। খুবই আরামদায়ক অ্যাটে দিন চারেকের বসবাস। সায়নকে একটা পেপার পড়তে হবে মাঝের দিনটায়। ঘণ্টা তিনেকের উপস্থিতি। ব্যস। বাকি সময়টা শহরের দ্রষ্টব্য দর্শন।
গার্গী প্রথম দিনেই মুম্বাইয়ের অনেকটা পথ একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে ঘুরে নিয়েছে, যাওয়া-আসার পথে দেখেছে মুম্বাইয়ের কিছু দ্রষ্টব্য। গিয়েছিল আন্ধেরি আর জুহু বিচেও যেখানে ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রির যাবতীয় গ্ল্যামাররা বসবাস করেন বিশাল এক-একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। রাতে মালাবার হিলস থেকে নেমে চৌপট্টিতে গিয়ে চানা-বাটোরা খেয়েছে তারিয়ে তারিয়ে। দ্বিতীয়দিনটা সায়নকে পেপার পড়তে হবে বলে তাদের ভ্রমণসূচি ফাঁকা। সন্ধেয় কী করবে এখনও ভাবেনি। আগামীকাল যাবে এলিফ্যান্টা কেভস দেখতে।
আপাতত সায়ন খুব মনোযোগ দিয়ে তার পেপারটায় চোখ বুলোচ্ছে, এখানে ওখানে কাটাকুটি করছে, ভুরুতে ভাঁজ ফেলে তন্ময় হয়ে আছে নিজের বক্তব্য যথাযথ হল কি
ভেবে। একটু আগেই সে তার দ্বিতীয়বারের কফি খাওয়া শেষ করেছে, পেপারে মনোনিবেশ করার ফুরসতে তাকাচ্ছে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে, এবারে শেভ করে প্রস্তুত হবে তার সেমিনারের জায়গায় যাওয়ার। শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে সারা রাত ধরে জড়ো হওয়া আলসেমি। তার মধ্যেই গার্গীকে বলল, তুমি কি সেমিনার শুনতে যাবে?
গার্গীর যাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। বলল, কাল সারাদিন জার্নি করে কিছুতেই শরীরে জুত পাচ্ছি না।
-তা হলে ছেড়ে দাও। আমার পেপার তো তোমার তিনবার পড়া। বাকিদের পেপার শুনে সময় নষ্ট না-ই বা করলে।
গার্গী জানে তার উপর সায়ন কখনও জোর করে না। বলল না ‘চলো চলো’। বরং তার অনিচ্ছে দেখে বলল, তা হলে ডাইনিং-এ ফোন করে ব্রেকফাস্টের কথা বলে দাও। সাড়ে ন’টায় গাড়ি আসবে বলেছে।
গার্গী তখন ইন্টারকমের বোম টিপে ধরছে ডাইনিং হলের ম্যানেজারকে, অড়ার দিচ্ছে সায়নের ব্রেকফাস্ট, বলল, মিনিট দশেকের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?’ কেন
সায়ন শেভ করা থেকে শুরু করে স্নান সারতে সময় নেয় মাত্র দশ মিনিট। তার পরেই বসে পড়বে ব্রেকফাস্ট নিয়ে।
হোটেলটা দারুণ কর্মতৎপর, তার অর্ডার দেওয়ার পর তাদের রুমে ব্রেকফাস্ট আসতে ঠিক দশ মিনিটই লাগল। সাদা ঝকঝকে প্লেটে ভবল ডিমের ঘন হলুদ ওমলেট। তাতে উঁকি মারছে টম্যাটোর লাল সৌন্দর্য। সায়ন পছন্দ করে এমনটাই রং। বলে, খাবার প্লেটে রঙের একটা বড় ভূমিকা থাকে। ভাতের রং হবে দুধসাদা, কারির রং হবে লালচে, সবজির রং হবে ঘন হলুদ-সবুজ, এমন নানা বায়নাক্কা তার।
পেপারটা বার কয়েক ঝালিয়ে সায়ন তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে, এহে, দেরি হয়ে গেল যে! বলতে না বলতে ব্রেকফাস্ট!
সায়ন ততক্ষণে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে, এবার শুরু হবে তার দিনের রেলগাড়ি। সায়নের পাজামা পাঞ্জাবি পরা শরীরটার দিকে একপলক চাউনি ছুঁড়ে গার্গী লাল-হলুদ ওমলেট সবে ঢেলেছে প্লেটটায় সেসময়ই চমৎকার জলতরঙ্গের সুরে (মোবাইলটা বাজল। অন্যদিনকার চেয়ে একটু বেশি জোরেই। মোবাইলটা সায়নের।
সায়ন ততক্ষণে সাবানের ফেনায় ভরপুর করে ফেলেছে দুই গাল, ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলল, কী জানি এখন আবার কে ফোন করল?
–নিশ্চয় উদ্যোক্তাদের কেউ কথা বলবেন তোমার সঙ্গে।
সাবান মাখা গালেই মোৰাইল চেপে ধরে সায়ন, হ্যালো–
পরক্ষণে কী যেন শুনে মোবাইলটা কান থেকে তুলে এগিয়ে দেয় গার্গীর দিকে, কলকাতা থেকে বলছে।
গার্গী চমকে উঠে বলল, সোনালিচাঁপা ফোন করেছে নাকি?
–না, না। ফ্যাক্টরির কেউ মনে হচ্ছে।
হাঁপ ছেড়ে গার্গী বলল, নিশ্চয়ই তোমার ফোন। নইলে এত সকালে আমাকে কে আর ফোন করবে। ফ্যাক্টরির কেউ স্মরণ করছে কোম্পানির চেয়ারম্যানকে।
গার্গী তখন মরিচের গুঁড়ো ছড়াচ্ছে ওমলেটের উপর।
কোম্পানির চেয়ারম্যান সায়ন চৌধুরি গালে রেজার চালাতে চালাতে বলে, উঁহু, ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার পল্লব দস্তিদার। বললেন ব্যক্তিগত ব্যাপার। খুব সিরিয়াস। তুমি শুনে নাও তো চট করে। বলল সন্ধের পর রিং ব্যাক করব।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে গার্গী দেখল তাতে সাবানের ফেনা। শাড়ির আঁচল দিয়ে ফেনা মুছে হাসল এক ঝলক, বলল, চেয়ারম্যানকে চাইছে, তুমি অমনি আমাকে ধরিয়ে দিলে মোবাইল! পাহোও বটে–
ম্যানেজিং ডিরেক্টর গার্গী চৌধুরি বুঝল এই তাড়াহুড়োর মুহূর্তে সায়ন টেলিফোন ধরতে চাইছে না। তবে সাবানরঞ্জিত সায়নের পক্ষে সত্যিই ফোন ধরা অসুবিধের সে কথা বুঝেই গার্গী প্লেটটায় ঢাকা দিয়ে কানে লাগাল মোবাইল, হ্যালো–
-ম্যাম, পল্লব দস্তিদার বলছি। খুব বিপদে পড়েই আপনাদের বিরক্ত করছি এখন—
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন ফ্যাক্টরির মাঝবয়সি সুপারভাইজারটি।
এক-একদিন সকালটা আসে একদম অদ্ভুত ভাবে, কোনও আগাম নোটিশ না দিয়ে আচমকা হানা দেয় গার্গীর ভাবনার সুতোগুলো ঘেঁটেঘুঁটে দিয়ে। সেরকমই একটা দিন শুরু হল আজ যখন গার্গী প্রবল ব্যস্ত সায়নকে প্রস্তুত করে সেমিনারে পাঠানোয়।
রিসিভার কানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ শোনার পরেই তার মুখের চেহারা বিবর্ণ, কোনও মে বলল, সে কী! এত ভালো ছেলে, তার কী করে এরকম–
বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর রিসিভার রাখল যথাস্থানে, অতঃপর তাকাল সায়নের দিকে, সায়ন তখন দু-গালে ব্লেডের আঁকিবুকি কাটছে তুলির মতো করে, তার ফর্সা গালে ফুটে উঠছে চমৎকার সবুজ আভা, গার্গীর কথায় এমন কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল যার কারণে তার তুলি থেমে যায় কিছু মুহূর্তের জন্যে, জিজ্ঞাসা করে, কোনও দুর্ঘটনা?
–সাংঘাতিক। খুবই স্যাড নিউজ।
–তাই নাকি? কী হয়েছে?
–তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে প্রোডাকশন উইঙের দেবদত্তবাবুকে, তার ছেলে দিব্যসারথি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছিল বলে আমরা খুব কনগ্রাচুলেশন জানিয়েছিলাম। দেবদত্তবাবুর স্ত্রী তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে। ছেলেটাকে অনেক টাকা খরচ করে পাঠিয়েছিলেন পুণে। সেই ছেলেটা পুণে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে মারা গেছে কাল রাতে।
–বলো কী! সায়নের হাতের ব্লেড কেঁপে গেল, আর একটু হলেই কেটে যাচ্ছিল চিবুকের কাছটা। বলল, সে তো খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে! উচ্চ-মাধ্যমিকে অনেকগুলো লেটার পেয়েছিল। কী হয়েছিল তার? কোনও অসুখ-বিসুখ?
গার্গী মুখ শুকনো করে, না। আনন্যাচারাল ডেথ। হোস্টেল থেকে জানানো হয়েছে আত্মহত্যা।
সায়নের ব্রেড থেমে যায়, আত্মহত্যা? হঠাৎ কী এমন হল!
–পল্লববাবু জানালেন তার হাতের শিরা নাকি ব্লেড দিয়ে কাটা।
–মাই গড! সায়ন চোখ বুজল মৃত্যুর কারণ জেনে। মুখে বলল, ভেরি স্যাড।
–দেবদত্তবাবু সব শুনে পুলিশকে বলেছেন আমার ছেলে এভাবে আত্মহত্যা করতেই পারে না। ওকে খুন করা হয়েছে।
–খুন! সায়ন তার গাল থেকে ব্লেড নামিয়ে নিল। বহুক্ষণ তার মুখে কথাই সরল না। স্তম্ভিত মুখে গার্গীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সংবিৎ কাটিয়ে বলল, তাহলে তো খুবই সিরিয়াস ব্যাপার। কী করবে এখন?
–পল্লববাবু পুণে মেডিকেল কলেজটার ঠিকানা দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘দেবদত্তবাবু এই একটু আগে খবরটা পেয়েই পাগলের মতো কান্নাকাটি করছেন। আমরা প্লেনের খবর নিতে গিয়ে শুনলাম পুণে যাওয়ার একটাই ফ্লাইট সকাল ছ’টায়। সারাদিনে আর কোনও ফ্লাইট নেই। মুম্বাই যাওয়ার সকালের সব ফ্লাইটও ছেড়ে গেছে ছ’টা সাড়ে ছ’টার মধ্যে। নেক্সট ফ্লাইট বলতে বেলা একটা পঞ্চাশ। মুম্বাই থেকে পুণে বাই রোড় যেতে গেলেও রাত ন’টা সাড়ে ন’টার আগে কোনও সুযোগ নেই পুণে পৌঁছোনোর। কাল রাতে আপনাদের খুঁজেছিলেন ফোনে। আপনারা মুম্বাই আছেন জেনে বললেন ঘটনাটা আপনাদের জানাতে। যদি কোনওরকম সাহায্য করতে পারেন আপনারা। কী কষ্টকর বলো!
–আমার তো মনে হয় এখনই পুণে যাওয়া দরকার। কিন্তু আমি অন্তত বিকেল চারটের আগে ফ্রি হতে পারব না।
গার্গীর যা স্বভাব তাতে ছটফট করে ওঠে। সায়ন এসেছে তার কাজে। গার্গীর কাছে এটা প্লেজার ট্রিপ। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই অবশ্য সেমিনারের পালা চুকলে তারা দুজনেই ফ্রি। ভেবে রেখেছে কাল সারাদিন এলিফ্যান্টা দ্বীপে যাওয়া ছাড়াও গোটা মুম্বইয়ের আরও কিছু এলাকা ঘুরে বেড়াবে ইচ্ছেমতো। তাদের এই ভাবনাসূচির মধ্যে হঠাৎ এহেন অঘটন।
এই সামান্য সময়ে বাইরে বেড়াতে এসে এরকম একটি জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়তে হবে তা সে একেবারেই ভাবেনি। পল্লববাবু যেভাবে তাঁর এক কলিগ-বন্ধুর দুঃখে কেঁদে ফেললেন, তাতে গার্গী খুবই বিচলিত বোধ করছিল। এখান থেকে পুণে খুব কাছে তা নয়। ম্যানেজারের কাছে ফোন করে জেনে নিল একশো তেষট্টি কিলোমিটার। গাড়িতে গেলে ঘণ্টা চার-পাঁচ লাগবে। পুণে শহরে সে কখনও যায়নি। অতএব চেনেও না শহরটা। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে বিভুয়ের একটি শহরে একা যাওয়াটা খুবই অসুবিধের।
বিষয়টা সায়ন বুঝে ফেলল তক্ষুনি, বলল, দেবদত্তবাবুর বিপদের দিনে আমাদের তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমি এখানকার সেমিনারের অগানাইজারদের বলছি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে যাতে তুমি এখনই রওনা দিতে পারো পুণেয়। কিন্তু শহরটা তোমার কাছে অচেনা। একজন বিশ্বস্ত লোক যদি ওরা তোমাকে দেন যিনি পুণে শহরটা চেনেন তাহলে তুমি দ্রুত পৌঁছে যেতে পারো সেখানে। তাই না?
গার্গী ঠিক এরকমটাই ভাবছিল পল্লববাবুর ফোন পাওয়ার পর থেকে। সায়ন প্রায় থট-রিডিঙের মত জেনে ফেলেছে তার অভিপ্রায়। সেমিনারে পেপার পড়ার ভাবনার মধ্যেও সে যে গার্গীর জন্য এত কথা ভেবেছে এটাই গার্গীর কাছে বিস্ময়ের। সায়ন তা হলে তার কোম্পানির বাইরের জগৎটাতেও ঘুরছে।
–নাথিং লাইক দ্যাট, গার্গী তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে ব্রেকফাস্ট খেয়েই রওনা দেবে পুণের উদ্দেশে যাওয়ার পথে কোথাও খেয়ে নেবে দুপুরের খাবার। মুম্বাই থেকে তার পুণে যাওয়ার মধ্যে দেবদত্তবাবু কলকাতা থেকে এসে পৌঁছোতে পারবেন না কিছুতেই। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে খুবই বিপর্যস্ত। গার্গী চাইছে তিনি পৌঁছোনোর আগে সেখানে পৌঁছোতে। তাকে দেখলে এই ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখোমুখি লড়াই করার সাহস পাবেন কিছুটা।
–তুমি গিয়ে তোমার কাজ শুরু করে। তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমিও গিয়ে পোঁছোব। সায়ন প্রস্তুত হতে হতে বলল।
গার্গী মাথা নেড়ে বলল, তোমার কি যাওয়ার দরকার হবে। সারাদিনে তোমার উপর দিয়ে যা ধকল যাবে, তারপর–
পরক্ষণেই গার্গী বলল, ঠিক আছে, আমি ওখানে পৌঁছে আগে পরিস্থিতি বুঝি। যদি মনে হয় তোমার প্রয়োজন আছে, তাহলে মোবাইলে তোমাকে জানিয়ে দেব। আর তেমন দরকার না হলে তোমার যেতে হবে না। আই উইল টেক কেয়ার অফ। আমি যাচ্ছি ওদের হোস্টেলে। ওখানে গেলে হয়তো কিছুটা পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা। আগে বুঝি সুইসাইড, না মার্ডার। হয়তো সুইসাইড। আজকাল অল্পবয়সিরা কত সামান্য কারণে কত অসামান্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে। পরীক্ষা একটু খারাপ হল, অমনি সুইসাইডের ভাবনা মাথায় ঘুরতে শুরু করল। যেন এইটেই জীবনের শেষ পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটা খারাপ হল মানে জীবনে আর কিছু হবে না। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরলেই হয়তো তার জীবন বদলে যেতে পারে। হয়তো পরের পরীক্ষায় একটা অসাধারণ রেজাল্ট করে ফেলল। তখন মনে হবে জীবন অনেক বড়। জীবনের একটা বছর নষ্ট হওয়া তেমন কিছু নয়।
–একজ্যাক্টলি, সায়নকে একইসঙ্গে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত দেখায়। কব্জিতে চোখ রাখে। তার সময় এখন দৌড়োচ্ছে একশো মিটরের স্পিন্টারদের মতো।
গার্গীও সচেতন হয়। এখন মোটেই বক্তৃতা দেওয়ার সময় নয়। সেমিনারের কথাও ভাবতে হচ্ছে সায়নকে। এদিকে একজন ব্রিলিয়ান্ট তরুণের মৃত্যু সংবাদ, অন্যদিকে তার প্রফেশনাল জীবনের ঝামেলা।
সায়নের ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ। কাঁটা-চামচ ক্রশ করে রেখে উঠে পড়েছে সোফা থেকে। দেরাজ খুলে পোশাক বার করে পরে ফেলল দ্রুত। রঙিন টাইটা বাঁধা শেষ করে দ্রুত কার সঙ্গে কথা বলল মোবাইলে। মোবাইল অফ করে গার্গীকে বলল, আধঘণ্টার মধ্যে গাড়ি ও পথপ্রদর্শক কাম-নিরাপত্তারক্ষী এসে যাবে তোমার কাছে।
-ওকে, গার্গী উৎকণ্ঠা মিশিয়ে হাসল। তার মনে তখন উথল দিয়ে উঠছে হাজার ঝড়। লক্ষ প্রশ্ন।
সায়ন বেরিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই গার্গীর কাছে এসে পৌঁছোল একটি চমৎকার আধুনিক কেতার গাড়ি। চকোলেট রঙের গাড়িটায় ঝাঁকুনি প্রায় নেই বললেই চলে। মেরিন ড্রাইভের নীল সমুদ্রের মায়া ত্যাগ করে তাদের গাড়ি ছুটে চলল পুণের পথে।
২
মুম্বাই থেকে পুণের দূরত্ব যাই হোক না কেন রাস্তাটি ভারি সুন্দর। প্রায় তেল-চকচকে পিচঢালা পথ। দুপাশে চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ, কিন্তু গার্গী সেই দৃশ্যাবলিতে মুগ্ধ হতে পারছিল না। হঠাই সকালের একটি মোবাইল কল এক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে দিয়েছে মুম্বাই আসার ছন্দ। এখন তার মাথায় দেবদত্তবাবুর শোকে ভাঙাচোরা মুখখানা ভাসছিল শুধু।
দামি গাড়িটা প্রায় উড়ে যাচ্ছিল মসৃণ পথ বেয়ে। গাড়ির সামনে প্রায় স্ট্যাচুর মতো বসে আছেন বছর তিরিশের এক যুবক। রং ফর্সা, চোখা নাক, মুখে চাপ দাড়ি। এতখানি পথ চুপচাপ বসে থেকে টুকটাক কথা চালিয়ে যাওয়াই সময় কাটানোর ও যন্ত্রণা কমানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। যুবকটি উদ্দেশে অতএব কথা ভাসিয়ে দেয় গার্গী, ইংরেজিতে বলল, পুণেয় আপনার নিয়মিত যাতায়াত আছে বুঝি?
–ইয়েস, ম্যাডাম।
দীনেশ নারলিকার নামের এই মারাঠি যুবক ইংরেজি ও হিন্দিতে ভারি স্বচ্ছন্দ। তিনি তার আত্মজীবনীর ছোট্ট একটি খসড়া গার্গীর কাছে মিনিট চারের মধ্যে বিবৃত করে বললেন, বাংলা নেহি আতে। লেকিন সমঝতে হুঁ।
গার্গী কিছুটা ধাক্কা খেল কেন না দীনেশ নারলিকার বলছেন তিনি পেশায় একজন গাইড। মুম্বাই পুণে, নাসিক–যেখানেই টুরিস্টরা যেতে চাইবে, সব শহরগুলোই তার পাই-টু-পাই চেনা।
গার্গী বুঝে ফেলল সায়নের আমন্ত্রকরা ঘটনার দ্রুততায় কোনও দিশে না পেয়ে একজন পেশাদার গাইডকেই জুড়ে দিয়েছেন গার্গীর টুরের সঙ্গে। তবু তার ভারি পছন্দ হল যুবকটিকে। চমৎকার কথা বলেন দীনেশ। গার্গী যখন জানাল সে পুণে চলেছে বেড়াতে নয়, একটি তরুণের মৃত্যুর রহস্য উদ্ধার করতে, তখন চাপদাড়িতে হাত বুলিয়ে হেসে দীনেশ বললেন, ইটস ভেরি স্ট্রেঞ্জ যে, আজকের টুরে আপনিই গাইড, আমি টুরিস্ট!
এরকম আশ্চর্যাশ্চর্যির পালা শেষ হলে কিছুক্ষণ দুজনে দু-মেরুতে দাঁড়িয়ে। দুজনেই মৌন। গাড়ির সামনে বসায় কথা বলতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু যুবকটি কিছুতেই তার পাশে এসে বসতে চাইলেন না। হয়তো গার্গীর অফিসিয়াল র্যাঙ্কের কথা ভেবেই।
অগত্যা সে ভাবনা নিবৃত্ত করে গার্গী জানতে চাইল পুণের কথা। শহরটার মানুষজনের কিছু হদিশ যদি উদ্ধার করতে পারে দক্ষ গাইডটির কাছ থেকে। পুণে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। একটি অচেনা শহরে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশে চট করে দু’একদিনের মধ্যেই সে যে কিছু করতে পারবে এ ভরসা তার হচ্ছে না। দীনেশ কী বুঝলেন কে জানে, অমনি গড়গড় করে বলতে শুরু করেন, ছত্রপতি শিবাজির হাতে গড়া এই শহরকে এককালে বলা হত কুইন অফ ডেকান। পরে নাম হয় পুণে। কেউ বলেন প্রাচীনকালের পুণ্যপুর থেকে, কেউ বলেন পুণ্যেশ্বর মন্দির থেকে পুণে শহরের নামকরণ।
এভাবেই একটু একটু করে শহরটার কথা বলছিলেন দীনেশ নারলিকার। জানাচ্ছিলেন পুণের ঐতিহ্যের কথা। গার্গী অবশ্য এ সব তথ্য শুনতে চাইছিল না। কিন্তু দীনেশ পেশাদার গাইড। তার মুখে তো শহরের মানুষদের জটিলতার কথা শোনা যাবে না। শোনা যাবে পুণের টুরিস্ট স্পটগুলির তালিকা।
ততক্ষণে দীনেশ বলতে শুরু করেছেন সম্প্রতি কোনও একটি হিন্দি সিনেমায় বিখ্যাত হয়ে ওঠা দুটি যমজ শহরের কথা। পুণে যাওয়ার পথে দুটি ছোট শহর লোনাভিলা ও খাণ্ডালা। দুটোরই প্রাকৃতিক দৃশ্য ভারি সুন্দর। একের পর এক পাহাড় এখানে ছবি হয়ে পাহারা দিচ্ছে এলাকাটিকে। সেই ছবির দেশ পার হতে খুব বেশি সময় লাগল না তাদের। কয়েক ঘণ্টার পথ কখন যে ফুরিয়ে গেল দুই মারাঠির কল্যাণে–একজন মারাঠি ড্রাইভার বুম্বা ও অপরজন মারাঠি পথপ্রদর্শক দীনেশ–তা বুঝতেই পারল না গার্গী।
দীর্ঘ বোডজার্নির পর পুণের কাছাকাছি পৌঁছোতে দীনেশ সতর্ক করে দেয় গার্গীকে, ম্যাডাম, শহরে ঢোকার মুখে একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে, এখানে লাঞ্চ সেরে নিন, না হলে একবার পুণে পৌঁছে গেলে আপনি আর খাওয়ার সময় পাবেন না।
গার্গী দীনেশের উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না। এই জন্যেই পেশাদার গাইডের প্রয়োজন। মুম্বাই-পুণে রোডের বাঁদিকে চলে গেছে নাসিক যাওয়ার পথ। আরও একটু এগিয়ে গাধি আড্ডার কাছে একটা ঝকঝকে রেস্তোরাঁ পেতেই ড্রাইভার বুম্বাকে বলা হল গাড়ি পার্ক করতে। গার্গী সত্যিই খাওয়ার কথা ভুলে ভাবছিল দেবদত্তবাবুর কথা। তিনি পৌঁছে নিজের সন্তানের মৃতদেহ দেখলে কী অবস্থা হবে তা ভাবতে গিয়ে গার্গীর নিজেরই মাথাটা খারাপ হওয়ার জোগাড়!
রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে পুণে শহর সম্পর্কে আবারও খবর নিচ্ছিল গার্গী। দীনেশ বললেন, দেখার তো অনেক কিছু আছে, মাডাম। কিন্তু আপনার তো সময় হবে না, নইলে নিয়ে যেতাম এখানকার সয়স বাগে–একেবারে মাইশোরের বৃন্দাবন গার্ডেনের ধাঁচে তৈরি উদ্যান। তারপর নিয়ে যেতাম স্নেক পার্কে। তারপর বাল গার্ডেনে যাকে এখন বলা হয় গান্ধী উদ্যান। তারপর শিবাজি রোডে শিবাজির একটা চমৎকার মূর্তি শিবাজি পুতলায় যা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখার মতো। আরও আছে আগা খাঁ প্রাসাদ, এম ফুলে মিউজিয়াম, আরও কত কী! ঘণ্টা চার-পাঁচ সময় দিলেই দেখিয়ে দিতে পারি শহরটা।
আরও কিছুক্ষণ পরে দীনেশ আপশোস প্রকাশ করে বলল, ম্যাডাম, একটা বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আপনাদের, নইলে বলতাম দুটো রাত মহাবালেশ্বর কাটিয়ে যান।
মহাবালেশ্বর একটি ছোট্ট হিলস্টেশন। গার্গী আগেই নাম শুনেছিল পাহাড়ি শহরটার। এখন শুনল, মহাবালেশ্বর মহারাষ্ট্রের দার্জিলিং। পাহাড়ের উপর এই শহরে কয়েকটা রাত কাটালে একেবারে স্বর্গসুখ।
দীনেশ আরও কিছু বর্ণনা দিতে চাইছিল মহাবালেশ্বরের। কিন্তু গার্গীর এখন সেসব কথা শোনার মতো অবস্থায় নেই। ড্রাইভার বুকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলল, আপনি এই মেডিকেল কলেজে নিয়ে চলুন প্রথমে।
আর দশ-বারো মিনিট পরে মেডিকেল কলেজের বিশাল বিল্ডিংটার সামনে গিয়ে পার্ক করল তাদের গাড়ি। পোঁছেই একে ওকে জিজ্ঞাসা করল কলেজ হোস্টেলটা ঠিক কোনদিকে। তবে বেশিক্ষণ জিজ্ঞাসা করতে হল না। শহরের কোথাও একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলে সেদিকে পিলপিল করে চলতে থাকে মানুষের স্রোত।
গার্গী অতএব কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হল দিব্যসারথিদের কলেজের হোস্টেলের সামনে। নতুন গড়ে ওঠা মেডিকেল কলেজটা বেশ অভিজাত গড়নের। সামনে সবুজ ঘাসে ওতপ্রোত বিশাল মাঠ। মাঠ পার হয়ে কলেজ বিল্ডিং। তার পিছনের দিকে হোস্টেল। কলেজের গোটা কম্পাউন্ডটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গার্গী এখানে একেবারেই নতুন। কিন্তু দীনেশ নারলিকার থাকায় তার পক্ষে শহরের কোনও কিছু খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। হোস্টেল খুঁজে দোতলায় উঠে দেখল বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষের ভিড়। হোস্টেলের ছেলেমেয়েরাই বেশি। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় হোস্টেলটিতে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এসে ভরতি হয়েছে এখানে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদেরই মুখ উদ্বিগ্ন। কিছু মুখে আবার কোনও বিকার নেই। একজায়গায় কয়েকটি ছেলে দিব্যি খোশমেজাজে গল্প করে চলেছে নিজেদের মধ্যে। হাসিঠাট্টায় মুখর জায়গাটা। যেন এক সহপাঠির মৃত্যু তাদের মনে কোনও রেখাপাতই করেনি।
ভিড়ের মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখছিল গার্গী। কয়েকজন মাঝবয়সি মানুষও এসেছেন, তাঁরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দা। খবর নিয়ে জানা গেল তাঁদের কেউ শিবাজিনগরের, কেউ সিংহগড়ের, কেউ মানচরের। তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে খবরটা পেয়ে ভিড় করেছেন উদ্বিগ্ন মুখে। সবাইয়ের চোখে-মুখেই বিবর্ণ চাউনি।
হোস্টেলের ঘরটার ভিতরে ও বাইরে ভিড় করে আছে কয়েকজন পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবল। সবারই বেশ তাগড়াই-তাগড়াই মোচ। শরীরের ধাত মোটা। গায়ের রং কালোর দিকেই। তাদের মধ্যে একজন মোটামতো অফিসারকে কী যেন ঘসঘস করে লিখতে দেখে গার্গী অনুমান করল হয়তো তিনিই তদন্তকারী অফিসার। কিন্তু একটু পরেই তার ভুল ভাঙে, কেন না অফিসারটি বারবার মোবাইলে কার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে জানাচ্ছেন, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার কাছেই আছেন, স্যার, এখনই আসবেন।
গার্গী ঘুরছে ফিরছে আর মনে পড়ছে দেবদত্তবাবুর মুখটা। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন দেবদত্তবাবুর ছেলের বয়স ছিল আট কি নয়। তারপর কী কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে তিনি একা হাতে পুপুকে বড় করে তুলেছিলেন তা বলতেন প্রায়ই। সেকথা দেবদত্তবাবুর কাছে আগেই শুনেছে গার্গী। তারপর থেকে তিনি ভাবতেন তাঁর একমাত্র ছেলেকে ডাক্তার করবেন।
হ্যাঁ, এরকমই একটা স্বপ্ন ছিল দেবদত্তবাবুর। ছেলে ডাক্তার হলে কী করবেন কী করবেন তা বলতেন সবাইকে। বলতেন, আমার ছেলে ডাক্তার হলে একটা দাঁতব্য চিক্কিৎসালয় করব। সেখানে গরিবদের কোনও টাকা লাগবে না। সারা দিনরাত খোলা থাকবে সেই চিক্কিৎসালয়। রাতে টেলিফোন এলেও যাতে ডাক্তার ছুটে যেতে পারে রোগী দেখতে সেই ব্যবস্থাও রাখবেন সেখানে।
এহেন স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে পিতার অবস্থা কীরকম হয় তা দেবদত্তবাবুকে না দেখলে বোঝা যাবে না। তার কথা ভাবতে ভাবতে দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে গার্গী হোস্টেলের ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেল ঘরের সামনে দাঁড়ানো রক্ষী হিসেবে দাঁড়ানো ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে। রোগা, কিন্তু মস্ত গোঁফ আছে এমন অফিসারটি হাত নাড়িয়ে হিন্দিতে বললেন, অন্দর মাৎ যাইয়ে।
গার্গী জানত এরকম বাধা আসতেই পারে। গুঁফো অফিসারটিকে ইংরেজিতে বলল, ইনি দিব্যসারথির বাবা তা নিশ্চয়ই জেনেছেন। দেবদত্তবাবু আমার অফিসের কলিগ। উনি আমাকে কয়েকটি কথা বলেছেন যা বুঝতে আমাকে একবার যেতেই হবে ভিতরে। তা ছাড়া–
গুঁফো পুলিশ অফিসারটি মুখে অনেকগুলো ভাঁজ এঁকে বললেন, কিন্তু এখন ইনভেস্টিগেশন চলছে। আই, ও, বলেছেন এখন যেন কেউ ভিতরে না যায়।
গার্গীর কপালে অনেক ভাঁজ। আই, ও, মানে ইনভেস্টিগেশন অফিসার। তিনি এরকম নির্দেশ দিতেই পারেন। কিন্তু গার্গীকে তো একবার ভিতরে যেতে হবে। সে তার পরিচয় দিয়ে বলল, দেখুন, আমার নাম গার্গী চৌধুরি। সেরকম প্রয়োজনে আমি কখনও প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করি। ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশ হেডকোয়াটোরের হোমিসাইড ব্রাঞ্চের অনেক অফিসারই আমাকে চেনেন। তবে আমার আর একটি পরিচয় আছে। আমি কলকাতার বিখ্যাত কোম্পানি প্যারাডাইস প্রোডাক্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। দেবদত্তবাবু আমাদের কলকাতা অফিসে কাজ করেন। কীভাবে দিব্যসারথি মারা গেল তা দেখা দরকার মনে করছি। সুতরাং আমাকে ভিতরে যেতে দিন। আমার মনে হয় আমি আপনাদের কাজে সাহায্য করতে পারব।
অতঃপর তারা কেন মুম্বাইতে এসেছে সে কথাও জানিয়ে বলল, আপনাদের কাজে কোনও অসুবিধেই ঘটাব না এটুকু কথা দিতে পারি। তা ছাড়া দিব্যসারথির বাবা বলছেন, তাঁর ছেলের মৃত্যু বেশ মিস্টেরিয়াস। তাঁকে সাহায্য করাও আমার কর্তব্য।
বলে জানাল সে তদন্তের কাজে সাহায্য করবে বলেই মুম্বাই থেকে এতদুর ছুটে এসেছে।
পুলিশ অফিসারটি গার্গীর দিকে এতক্ষণ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল, প্রাইভেট ডিটেকটিভ শুনে মুখটা বেঁকে গিয়েছিল আরও। কিন্তু পদের পরিচয় শুনে সোজা করল ভুরু। গার্গী জানে পুলিশের লোক পদকে সম্মান করে অনেক বেশি। আর একবার তার আপাদমস্তক পুলিশি কায়দায় পরখ করে ঘাড় নেড়ে জানাল, ঠিক আছে। একজন যান। আই. ও. এলে বেরিয়ে আসবেন। নইলে স্যার খুব বকাবকি করেন।
স্যার মানে নিশ্চয় তদন্তকারী অফিসার। তাঁর নাম এন কে ভোঁসলে। তাঁর সম্পর্কে দু-চার কথা জেনে নিল গার্গী। পুণে শহরের কেন্দ্রস্থল শিবাজি স্টেডিয়ামের কাছে তাঁর ফ্ল্যাট। তিনি অবশ্য থাকেন থানা-কোয়াটারে। খুবই দক্ষ অফিসার হিসেবে তাঁর খ্যাতি। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন, এখানে তিনি কখন আসবেন সে তথ্য কেউ জানে না।
গার্গী থমকে যায়, একজন?
দীনেশ মাথা ঝাঁকায়, ঠিক আছে, ম্যাডাম, আপনি যান। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। গার্গী বিষয়টা বুঝে ফেলল পলকে, তাহলে আপনি বাইরে থাকুন। আমি ভিতরে গিয়ে দেখে এখনই ফিরে আসছি।
হোস্টেলের ঘরের পর্দা সরিয়ে গার্গী মাথা গলিয়ে দিল এক ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে। একটু আগেই যেরকম সহজে কথাটা বলে এল, ঘরের ভিতরে যেতেই কিন্তু চমকে উঠল ভীষণ।
ঘরে তখন কোনও পুলিশ অফিসার বা কনস্টেবল কেউই নেই। যা কিছু পাহারা সবই বাইরে। খাটের দিকে তাকিয়ে গার্গী কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকে।
বছর কুড়ির এক তরুণের মৃতদেহ দেখার মতো শাস্তি আর হয় না। গার্গী এক মুহূর্ত চোখ ফেলেই তুলে নিল অন্যদিকে
হোস্টেলের ঘরগুলো বেশ বড় আকারের এক-একটি ঘরে দুজন করে বোডার থাকে। দুজনের তুলনায় ঘরগুলো বেশ প্রশস্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনো করতে খরচ যেমন বেশি, থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশুনো সবই বেশ উচ্চমানের। প্রতি ঘরে দুখানা করে খাট আড়াআড়ি করে পাতা। তার সঙ্গে একসেট করে চেয়ার-টেবিল। টেবিলে ছড়ানো ছিটোনো বইখাতা। টেবিলের উপরে ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা করে টেবিল লাইট। টেবিলের পাশে একটা করে ছোট আলমারি। তার দরজা ভেজানেনা। আলমারির পাশে একটা ছোট আলনা। তাতে আরও একসেট জামা-প্যান্ট ঝুলছে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে গেঞ্জি আর পাজামা। তা ছাড়াও আলগা হয়ে ঝুলছে একটা নীল-কালোয় মেশা টি-শার্ট। এই টি-শার্টটা হয়তো কাল সকালে বা অন্য সময় পরেছিল পুপু।
অন্য দিকের খাটটি ফাঁকা। তার বিছানার চাদর ভারি অগোছালো। যে রাতে শুয়েছিল সে ঘুম থেকে উঠেই যে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে ঘর ছেড়ে, তারপর গোছানো আর সময় পায়নি তা বিছানার অবিন্যস্ত ছবি দেখে প্রতীয়মান। তার টেবিলের বইও ছড়িয়ে আছে এলোমেলো। তার আলনায় আলগা হয়ে ঝুলছে একটা সবুজ রঙের টি-শার্ট।
রুমমেটের বিছানা-টেবিল ইত্যাদিতে নজর ছুঁয়ে গার্গীর আবার চোখ রাখল পাশের খাটে। ঘরের বাঁ-দিকের খাট টায় চিত হয়ে শুয়ে আছে পুপু। খুবই শান্ত চেহারার, ভালো ছেলে টাইপের তরুণ। মাঝারি উচ্চতার শরীর। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখদুটো বোজা। গায়ে নীলরঙের একটা টি শার্ট। পরনে কালোরঙের ফুলপ্যান্ট।
এভাবেই সে প্রতিদিন বিছানায় শুতে যায় কি না তা গার্গী জানে না। তবু টি-শার্ট আর ফুল প্যান্ট পরে বিছানায় রাতে শুতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত ঠেকে তার চোখে। তার হাতের নীচের বিছানার অনেকটা রক্তে ভেজা। বিছানার কিনার বেয়ে মেঝেয় নেমে এসেছে রক্তের ধারা। বিছানায় বহু রক্ত শুষে যাওয়ার পরেও সারা মেঝে জুড়ে কালো রক্ত। মেঝেয় এখনও জমে সেই চাপ চাপ রক্ত।
গার্গী সেই মৃতদেহের কাছে গিয়ে নীচু হয়ে দেখল পুপুর দুই হাতের কবজির শিরাই বেশ নিখুঁত করে কাটা। সেই ক্ষত থেকে অনর্গল রক্ত বেরিয়ে ভেসে গেছে বালিশ, বিছানা, ঘর। এক সময় রক্তশূন্য হয়ে মারা গিয়েছে পুপু।
পুপু যেখানে প্রাণহীন শুয়ে আছে, ঠিক তার পাশেই একটা চিরকুট পড়ে ছিল, তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
৩
গার্গীর এই কয়েক বছরের গোয়েন্দগিরির জীবনে মাঝেমধ্যেই উদিত হয় এরকম মন পুড়ে যাওয়া দৃশ্য। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে চাপতে চাইল তার যন্ত্রণা। খুব চিরাচরিত আত্মহত্যার ছবি। কিন্তু পুপুর বাবা দেবদত্তবাবু যেমন বলেছিলেন সেই কথার সঙ্গে মেলাতে বসে গার্গী কোনও ক্ল আবিষ্কার করার চেষ্টা করল যা থেকে বোঝা যায় পুপু সত্যিই আত্মহত্যা করেছে নাকি খুন করা হয়েছে তাকে।
পুপুর মৃতদেহ দেখে যে তথ্যগুলো তার মগজে ধাক্কা দিল তা এরকম:
পুপু শুয়ে আছে খুব নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে। যন্ত্রণায় ছটফট করলে যেরকম চেহারা বা শোয়ার ভঙ্গি হওয়া উচিত তা লক্ষ্য করা গেল না।
আশ্চর্য এই যে, দুই হাতের শিরা কাটা হয়েছে, এক হাতের নয়। প্রথম হাতের শিরা কাটার পর দ্বিতীয় হাতের শিরা না কাটলেও চলত। কিন্তু পুপু নিজে বা অন্য কেউ, যে-ই হাতের শিরা কেটে থাকুক, সে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছে যাতে মৃত্যু অনিবার্য হয়।
টি-শার্ট আর ফুল প্যান্ট পরে ঘুমোনোর অন্য অর্থ সে বাইরে থেকে ফিরেই তার হাতের শিরা কাটতে বসে। তারপর রোজই যেরকম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায় সেরকমই ঘুমোতে গিয়েছে। অর্থাৎ বেশ ঠান্ডা মাথায় কাটা হয়েছে শিরাদুটো।
হঠাৎ তার নজরে পড়ল পুপুর বাঁবাহুতে একটা ইঞ্জেকশনের দাগ। চমকে উঠে ভালো করে দেখল দাগটা। কীসের ইঞ্জেকশন এটা? কোনও ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।
ডেডবডিটা তন্নতন্ন করে আরও পরীক্ষা করে গার্গী আবার চোখ রাখল অন্য বিছানাটার দিকে। পুপুর রুমমেট নিশ্চয় রাতে পাশের খাটেই ঘুমিয়েছিল, নইলে তার বিছানাটা অমন ধামসানো চেহারার হবে কেন? না কি ধামসানোর অন্য কোনও অর্থ বহন করছে।
কিন্তু কে ঘুমিয়েছিল পাশের বিছানায়? কে তার রুমমেট?
সেই মুহূর্তে সারা ঘরে চোখ পেতে আর তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে সে বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে। দীনেশ দাঁড়িয়ে ছিল তার অপেক্ষায়। এক বাঙালি ভদ্রলোক খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তার কাছে। দীনেশ পরিচয় করিয়ে দিল, ম্যাডাম, ইনি বিশ্বরঞ্জনবাবু। পুণের বাসিন্দা। তিনি অনেকক্ষণ থেকে ঠায় অপেক্ষা করছেন কী হয় জানতে।
ভদ্রলোক মাঝবয়সি। চাকরি নিয়ে পুণে এসেছিলেন প্রথম যৌবনে। এখন পুণেই তাঁর ঘরবাড়ি। গার্গীকে দেখে বলল, শুনলাম আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ছেলেটা বাঙালি, এখানে তার কোনও আত্মীয় থাকে না বলে আমাদের বাড়ি মাঝেমধ্যে আসত। আমার ছেলে রজতাভর সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছিল। আমি এসেছি পুলিশ কী করে তাই দেখতে। দেখেছেন একটা চিরকুট লেখা রয়েছে ওর ডেডবডির পাশে। আমি সিওর ওটা ওর হাতের লেখা নয়। তাই আমারও মনে হয়েছে এটা মার্ডার।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে। গার্গী বিষয়টা বিশ্লেষণ করছে নিজের মনে, কাটাছেঁড়া করছে তখন থেকে, বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন, বিশ্বরঞ্জনবাবু, ওর হাতে একটা ইঞ্জেকশনের দাগ। একেবারে টাটকা দাগ।
বিশ্বরঞ্জনবাবু বললেন, আমি আগেই দেখেছি। পুলিশ কিছুতেই আমাকে ডেডবডির কাছে ঘেঁসতে দিচ্ছিল না। প্রায় জোর করেই ঢুকেছিলাম ঘরটায়। ওদের স্যারকে ব্যাপারটা বলতে হবে। হঠাৎ কেন ইঞ্জেকশন নিতে যাবে ও?
–খুব স্ট্রেঞ্জ!
বিশ্বরঞ্জনবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, দেখলেন তো ম্যাডাম? কীরকম ঠান্ডা মাথায় মার্ডার করা হয়েছে ওকে।
–আপনি ঠিক বলছেন ও কোনও ইঞ্জেকশন নিত না?
–আমি তো কোনওদিন শুনিনি।
গার্গী তখনও ভেবে চলেছে দিব্যসারথির মৃত্যু বিষয়ে। যে-কোনও মৃত্যুই ভয়াবহ। একটি তরুণের মৃত্যু আরও অধিকতর কষ্টের। কিন্তু কী এমন কারণ ঘটল যার ফলে ঘটে গেল এই ভয়াবহ ঘটনা?
বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথার উত্তর আসার আগেই সেখানে ঘটে গেল একটা বিশ্রি কাণ্ড। বিশ্বরঞ্জনবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সেসময় সেখানে এসে পৌঁছোলেন একজন সুবেশ ভদ্রলোক। একেবারে সুটেড-বুটেড চেহারা। বেশ হন্তদন্ত পায়ে উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। পাগীকে দিব্যসারথির ঘর থেকে বেরোতে দেখে ভুরু কুঁচকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কী! আপনি কে? ও ঘরে কী করছিলেন?
গার্গী খুব ভালো হিন্দি বলতে পারে তা নয়। আসলে বলা অভ্যেস নেই তার। তাদের কোম্পানি ‘প্যারাডাইস প্রোডাক্টস’-এ মাঝেমধ্যে হিন্দিভাষী ক্লায়েন্ট এলে তাকে সামলাতে হয় প্রোডাকশনের মাহাত্ম্য বোঝাতে। কিছুটা ইংরেজি, কিছুটা হিন্দি বলে ম্যানেজ করে নেয়। ইদানীং কিছুটা সহজ হয়ে গেছে সে কাজ। বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট সামলায় সায়নই।
গার্গী লক্ষ্য করেছে আজকালকার বাচ্চারাও দিব্যি হিন্দি বলে ও বোঝে। তাদের অফিসের অনেক মহিলাও হিন্দি বুঝতে পারে, এমনকী কথার মধ্যে এমন দু-চারটে হিন্দি শব্দ ঢুকিয়ে দেয় যা গার্গীর কাছে চমকপ্রদ মনে হয়। তারা বলে টিভিতে সিরিয়াল দেখেই নাকি তাদের হিন্দি জ্ঞান ক্রমবর্ধমান।
সুবেশ ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর খুব আক্রমণাত্মক মনে হয় গার্গীর। লোকটিকে নিরিখ করে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কে?
–অদ্ভুত! আমি কে মানে! লোকটি বেশ খেঁকিয়ে বলে ওঠে, আমি এই হোস্টেলের সুপার, আর আপনি কিনা আমার চাকরির জায়গায় এসে জিজ্ঞাসা করছেন আমি কে! অদ্ভুত তোর
গার্গীর মনে পড়ে যায় এখানেই এসে শুনে নিয়েছে হোস্টেলের সুপার লোকটি বাঙালি। তাঁর নাম প্রাংশু দত্ত। বাঙালি হলে তার তদন্তের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু লোকটির হিন্দি সংলাপ এতটাই নিখুঁত যে গার্গীর সন্দেহ হয় যা শুনেছে তা হয়তো সত্যি নয়।
গার্গী সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে ইংরেজিতেই বলল, আই অ্যাম সরি, সুপারসাহেব। আসলে কী হয়েছে, দিব্যসারথির বাবা-দেবদত্তবাবু, আমার অফিস কলিগ। বুঝতেই পারছেন–
বলে গার্গী তার আসার কারণ বুঝিয়ে বলতেই হোস্টেল সুপার মোটেই খুশি হলেন না, গম্ভীর গলায় হিন্দির পরিবর্তে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, দেবদত্তবাবুকে আমি চিনি। এর আগে ভরতি হওয়ার সময় তিনি ছেলের সঙ্গে দু তিনবার এসেছিলেন।
–চেনেন! গার্গী এতক্ষণে সুপারের গলায় বাংলা শুনে মনে বল পেল, তাহলে আপনিই তো আমাদের ভরসা। কী যে সর্বনাশ ঘটে গেল দেবদত্তবাবুর জীবনে তা নিশ্চয় আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন।
–কেন পারব না। আমারও যে কী ট্রাবল হল তাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। আগে যদি জানতাম দিব্য এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে তা হলে ওকে হোস্টেলে থাকতে দিতাম না।
গার্গী স্তম্ভিত হয়ে গেল হোস্টেল সুপারের কথায়। একজন পিতা তার সন্তান হারিয়েছে, সেই যন্ত্রণার সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের হয়রানির তুলনা করছেন, এর চেয়ে অবিবেচকের কাজ আর কী হতে পারে! অদ্ভুত লোক তো!
হোস্টেল সুপার প্রাংশু দত্ত তখনও গজগজ করে চলেছেন, এখন এই আনন্যাচারাল ডেথ। কে এই ঝক্কি সামলাবে বলুন! পুলিশ তো হোস্টেল সুপারকেই যত নষ্টের গোড়া বলে ঠাউরেছে। যেন কেউ সুইসাইড করলে তার দায়ও সুপারের!
গার্গীর বুঝতে অসুবিধে নেই যে, এ ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে এখন অনেক হ্যাঁপা সামলাতে হবে হোস্টেল সুপারকে, মুখোমুখি হতে হবে অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের, আর সেই কারণেই প্রাংশু দত্ত এতটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন দিব্যসারথির মৃত্যুতে। ইতিমধ্যে পুলিশ শুরু করে দিয়েছে নিয়মমাফিক তদন্ত, তার পরিণামে হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেডের উপর একটা দায়িত্ব তো বতাবেই। তিনিই তো হোস্টেলের ছাত্রছাত্রীদের স্থানীয় অভিভাবক। তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তো তাঁরই।
গার্গী লক্ষ্য করছিল হোস্টেল সুপারের অস্থিরতা। বলছিলেন, জানেন, পুলিশ যখন হোস্টেলে ঢুকেছে, তখন এই হোস্টেলের সুনাম গেল! এখন দেখছি হোস্টেলের সুপার হওয়া এক পাপ। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা এক-একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে, আর তার যাবতীয় ঝক্কি সামলাতে হবে এই সুপারকেই। তার মধ্যে যদি উটকো লোক এসে ভিড় করে তাহলে কার না রাগ হয় বলুন।
গার্গী বিস্মিত হচ্ছিল লোকটির বেলাগাম কথায়। গার্গী এর আগে বহু জায়গায় গেছে তার তদন্তের কাজে। কিন্তু কখনও তাকে এমন মুখের উপর উটকো শব্দটি শুনতে হয়নি। এরকম একজন বদমেজাজি লোকের হাতে এতগুলি ছেলেমেয়ের দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দেখে গার্গী বিস্মিত হচ্ছিল!
ইচ্ছে করছিল তাঁকে কিছু উচিত জবাব দেয়। তাতে অবশ্য একটা সিন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা। বরং এই মুহূর্তে কলহটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
বিশ্বরঞ্জনবাবুও স্তম্ভিত হোস্টেল সুপারের ব্যবহারে। বলল, কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম। আমরা জানি সুপার লোকটি খুব ইল-বিহেভড।
হোস্টেল সুপার সম্পর্কে কিছু খবর বললেন বিশ্বরঞ্জনবাবু, বললেন, ম্যাডাম, প্রাংশু দত্তর নিবাস ছিল মুম্বাইয়ের অনেকটা বাইরে, বিরার নামের একটা ছোট্ট শহরে। তাঁর বাবা দাদারে একটা চাকরি নিয়ে এসেছিলেন পঞ্চাশের দশকে। প্রথমে থাকতেন মুম্বাইয়ের শহরাঞ্চলে বাড়ি ভাড়া করে। পরে একটা ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হন বিরারে। সেই থেকে তাঁরা মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। প্রাংশু দত্ত পরবর্তীকালে পুণের এই মেডিকেল কলেজে সুপারের চাকরি পেয়ে এখানেই থাকেন আজ কয়েক বছর।
তাঁর বয়স গার্গীর আন্দাজে পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। তার মানে, গার্গী হিসেব করে দেখল প্রাংশু দত্ত মহারাষ্ট্রেই বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ। ফলে তাঁর শরীর থেকে বাঙালিয়ানা লুপ্ত হওয়ার পথে। যদিও বাংলাটা এখনও ভোলেননি, কিন্তু আর দু-এক প্রজন্ম পরে বাংলা তাদের কাছে চিনেভাষার মতো দুবোধ্য ঠেকবে।
যাই হোক, এহেন হোস্টেল সুপার একটি বাঙালি ছাত্রের অকাল মৃত্যুর জন্য ব্যথিত তো ননই, বরং বিরক্ত হচ্ছেন প্রবলভাবে।
একটু পরেই পুলিশ অফিসারদের মধ্যে বেশ ব্যস্ততা লক্ষ্য করছিল গার্গী। শুনল পুপুর প্রাণহীন দেহ তারা নিয়মমতো পাঠিয়ে দেবে মর্গে কাটাছেঁড়া করতে। দৃশ্যটা একলহমা ভাবতেই গার্গীর বুকটা কীরকম শূন্য হয়ে গেল। একটা ছেলেকে এত বড় করে তুলতে একা কোনও বাবাকে কতখানি ধকল সইতে হয় তা দেবদত্তবাবুই জানেন।
পুপুর ডেডবড়ি মর্গে পাঠাবে শুনতে গার্গীও অস্থির হয়ে বলল, পুপুর বাবা না-আসা পর্যন্ত পুপুর ডেডবডি যেন কোনও ক্রমেই পোস্ট মর্টেম না করা হয়। আমি একটু দেখা করব আই ও মানে ইনভেস্টিগেটিং পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। দীনেশ, আপনি ব্যবস্থা করতে পারেন?
দীনেশ নারলিকারকে সে কথা বলতেই তিনি তৎপরতা দেখালেন এতক্ষণে। পুলিশের কনস্টেবলটিকে কী যেন বললেন নিজেদের ভাষায়, তারপর গার্গীর কাছ থেকে তার অফিসিয়াল ডেজিগনেশন লেখা একটি ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন ঘরের ভিতর যেখানে ইনস্পেক্টার ভোঁসলে মিটিং করছেন অন্য পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে। একটু পরেই ফিরে এল বাইরে, বলল, চলুন ম্যাডাম, ইনস্পেক্টার ভোঁসলে বললেন, কলকাতা থেকে এসেছেন যখন, উই শু্যড গিভ হার ডিউ রেসপেক্ট।
বিশ্বরঞ্জনবাবুকে নিয়ে গার্গী যে-ঘরটিতে ঢুকল সেখানে অবশ্য ইনস্পেক্টার ভোঁসলে ছিলেন না। ছিলেন কাঠের পার্টিশন দেওয়া পাশের ঘটিতে। তারা ভিতরে ঢুকতেই পাশের ঘর থেকে এলেন ইনস্পেক্টার ভোঁসলে, বললেন, বৈঠিয়ে, বৈঠিয়ে, মিসেস চৌধুরি। বলুন, কী জানতে চান? কীভাবে আপনাদের সাহায্যে আসতে পারি।
গার্গী এই অচেনা পরিবেশে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল এতক্ষণ। এখন ইনস্পেক্টার ভোঁসলের কথায় সহজ হয়ে ওঠে, হেসে বলল, এখানে এসে ইস্তক শুনছি আপনি খুব কড়া অফিসার। তাই বেশ ভয়ে ভয়ে পেশ করছিলাম আমার আবেদন।
পুলিশ অফিসারটি হিন্দিতে বললেন, আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন।
গার্গী স্বস্তিতে ফিরে বলল, আমার রিকোয়েস্ট—
বিষয়টি বলতেই পুলিশ অফিসার সায় দিয়ে বললেন, অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে ওর বাবার জন্য। কিন্তু তিনি থাকেন কলকাতায়। কখন তিনি এসে পৌঁছোবেন বলে আপনি খবর পেয়েছেন?
গার্গী মনে মনে হিসেব করে বলল, যতদূর জানি উনি বেলা একটা পঞ্চাশে একটা ফ্লাইট আছে সেইটে ধরে বেরোবার কথা। আমি বরং মোবাইলে আর একবার কনফার্ম করে নিই কোন ফ্লাইটে আসছেন।
গার্গীর ঘড়িতে তখন বিকেল। কোথা থেকে এতগুলো ঘণ্টা তার জীবনে নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়ে গেল তার মনেই নেই। মোবাইলের বোতাম টিপতেই ওপ্রান্তে পল্লব দস্তিদারের কণ্ঠস্বর, পুপুর খবরাখবর নিয়ে বললেন, ম্যাডাম, একটা পঞ্চাশের ফ্লাইটের টিকিট কোনওক্রমে জোগাড় করে ওঁকে তুলে দিয়েছি প্লেনে। পুণে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে মনে হয়।
–দ্যাটস রাইট।
গার্গী আর কথা না বাড়িয়ে পরক্ষণে ধূরল সায়নকে, দেবদত্তবাবু বোধহয় এতক্ষণে পুণের দিকে রওনা দিয়েছেন। আমাকে আজ রাতে থেকে যেতে হচ্ছে এখানে। বিশ্বরঞ্জনবাবু নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এখানেই সেটল্ড। তিনি থাকার সুবন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন আমাদের। তুমি পারলে চলে এসো একটা গাড়ি নিয়ে। ঘটনাটা খুবই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। ইট উইল টেক টাইম।
মোবাইল বন্ধ করে গার্গী তাকায় পুলিশ অফিসারের দিকে, মি. ভোঁসলে, পুপুর ডেডবড়ি আপাতত কোথাও রাখা হোক বরফ দিয়ে। সেটা মর্গেও হতে পারে। পুপুর বাবা পৌঁছোনোর পর পোস্ট মর্টেম করার ব্যবস্থা করবেন।
–ওকে, ম্যাডাম। অঅমরা নিশ্চয়ই পুপুর বাবার জন্য অপেক্ষা করব। ইনস্পেক্টার ভোঁসলে সেরকমই নির্দেশ দিলেন তাঁর অফিসারদের।
গার্গী তাঁকে থ্যাঙ্কস জানিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। তার ভিতরে এখন উসকে উঠছে এক লক্ষ প্রশ্ন। কোনও তদন্তে নেমে এরকমই প্রশ্নাবলিতে বিদ্ধ হয় গার্গী। প্রথম দর্শনেই নানা অসঙ্গতি চোখ ধরা পড়ে তার। মগজে ছটফট করতে থাকে ছোট ছোট দৃশ্যগুলি। সেগুলোই নিজের মনে চালাচালি করছিল চারদিকে তার চাউনি আছড়ে ফেলার ফুরসতে।
বিশ্বরঞ্জনবাবু বললেন, মিসেস চৌধুরি, আপনি বরং আমার ওখানে চলুন। আমরা একটা আউটহাউস আছে সেখানেই থাকবেন রাতে। ইতিমধ্যে মিস্টার চৌধুরি নিশ্চয় এসে পৌঁছোবেন। আর গাড়ির ড্রাইভার ও দীনেশ নারলিকারের থাকার বন্দোবস্তও করে ফেলছি এখনই।
৪
বাইরে প্রস্তুত ছিল পুণে থেকে আনা গাড়িটা। সেই গাড়িতে করে বিশ্বরঞ্জনবাবুর ডেরায় আসতে কিছু স্বস্তি। গার্গী এরকম একটি পরিবারের সাহায্যই চাইছিল যেখানে গেলে কিছু জরুরি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এখনই। ততক্ষণে ডানা মেলে সন্ধে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে পুণে শহরেরর বুকে। সন্ধের পর সব শহরই কিছু মায়াজাল বিস্তার করে নতুন আগন্তুকদের চোখে। পুণে তার এই প্রথম আসা। প্রথমবারেই তাকে কিনা মুখোমুখি হতে হল ঘোর অবাঞ্ছিত এক সমস্যার।
প্রাসাদোপম বাড়িটিতে পা দিতেই গার্গী অনুভব করল বিশ্বরঞ্জনবাবু বেশ অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। চাকরি ছাড়াও তাঁর কিছু ব্যবসা আছে যার দৌলতে এত বড় একটা বাড়ি তৈরি করতে পেরেছেন। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা মিলে দেখে ব্যবসাটা। বিকেলে পুপুর মৃতদেহ দেখে তার মনে কিছু প্রশ্ন অমনিই উসোচ্ছিল, আরও কিছু জানার জন্য শুরু করল তার জিজ্ঞাসাবাদ।
কিছু জলখাবার ও চায়ের সদ্ব্যাবহারের পর বিশ্বরঞ্জনবাবুর সঙ্গে একান্ত হতেই গার্গী জানতে চায়, এবার বলুন তো, বিশ্বরঞ্জনবাবু, আপনার কেন মনে হল এটা আত্মহত্যা নয়, খুন? আপনি তো পুপুর হাতের লেখা চেনেন বললেন। তার মানে এই চিরকুটটা আপনার মতে পুপুর লেখা নয়, তাই তো?
বিশ্বরঞ্জনবাবু ঘাড় নাড়লেন, পুপু মাঝেমধ্যে আমার ছেলে রজতাভকে দু-চারবার চিরকুট পাঠিয়েছে এটা-ওটা লিখে। প্রায় সময়ে চিরকুটটা আমার হাতে পড়ত। আমি আবার রজতকে ডেকে দিয়েছি চিরকুটটা। দু-এক সময় টাকা চাইত রজতের কাছে। হয়তো কলকাতা থেকে ওর টাকা পৌঁছোয়নি–তাই। ওর বাবা টাকা পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে রজতকে মিটিয়ে দিত ধার। তাই ওর হাতের লেখা আমি চিনি। এই চিরকুটটা এখানে কে রেখে গেল সেইটেই তো আমি বুঝে উঠতে পারছিনে। এই চিরকুটটা কোনও আনাড়ি লোকের লেখা। পুপুর হাতের লেখা মোটেই এরকম নয়। ওর লেখা খুব আলংকারিক। অক্ষরও লেখে স্পষ্ট করে। তা ছাড়া
–তা ছাড়া?
–তা ছাড়া আরও একটা ঘটনা আমাকে অবাক করেছে তা হল ওর রুমমেটের ব্যবহার।
–রুমমেট। গার্গীর মনে এই প্রশ্নটাই উথল দিচ্ছিল এতক্ষণ।
দেখুন, ম্যাডাম, একটা ছেলে হাতের শিরা কেটে সারারাত ধরে রক্ত চুঁইয়ে মারা গেল, আর তার পাশের খাটে তার রুমমেট ভোস ভোঁস করে বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমোল! সে জানতেই পারল না তারই পাশের খাটে এরকম বীভৎস একটা কাণ্ড ঘটে গেল। গল্পটা কেউ বিশ্বাস করবে?
গার্গী এখনও সকালের ঘটনা সবটা জানে না। এবার একটু একটু করে বিষয়ের গভীরে ঢুকতে চেষ্টা করে। আত্মহত্যা আর খুনের মধ্যে অনেক তফাত। খুন হলে অনেকগুলো পয়েন্ট সাদা চোখে ধরা পড়ে যা আত্মহত্যার কেসে দেখা যায় না। খুন হলেই কিছু না কিছু ক্লু রেখে যাবে খুনি।
জানতে চাইল কোথায় সেই রুমমেট? কী নাম তার?
–তার নাম চিরঞ্জয়। চিরঞ্জয় দত্তরায়। তাকে পুলিশ জেরা করেছে আজ। গার্গী ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর অনেক আগেই পুলিশ অফিসারটি অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তা জেনেছে গার্গী। তাকে আবার নতুন করে জিজ্ঞাসা করতে হবে কাউকে কাউকে।
তাদের কথাবাতার মধ্যেই প্রথমে দেবদত্তবাবু, তারপর এসে পৌঁছোল সায়ন। বিশ্বরঞ্জনবাবুর বাড়ি ততক্ষণে খুবই উত্তেজনার মধ্যে। দেবদত্তবাবু তাদের দেখেই ভেঙে পড়লেন কান্নায়। এ সব মুহূর্তে ভারি অসহায় বোধ করে গার্গী। কী করে এক পুত্রহারাকে সান্ত্বনা দেওয়া যায় তা ভেবে পায় না। কিন্তু তাঁকে তো শক্ত হতেই হবে। সেই রাতে তাঁকে নিয়ে মর্গে নিয়ে যাওয়া মৃতপুত্রের মুখ দেখানো কী যে কঠিন কাজ তা গার্গী বুঝল। দেবদত্তবাবু ততক্ষণে খুঁটিয়ে দেখছেন পুপুর শরীরের এখানে ওখানে কাটার দাগগুলি। ইঞ্জেকশনের দাগটাও দেখলেন। তারপর ফুঁপিয়ে আবার কেঁদে উঠে বললেন, ওরা আমার ছেলেটাকে খুন করেছে, ম্যাডাম।
৫
গার্গী পরদিন সকাল থেকেই শুরু করল বিভিন্ন বিষয়ে খবরাখবর নেওয়া। পুপু কবে ভরতি হয়েছে, বাবার কাছে কখন কী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাঠাত কি না ইত্যাদি নানা প্রশ্ন রাখল দেবদত্তবাবুর কাছে। কাল রাতে প্রায় কারও ঘুম হয়নি। গার্গী তার শরীরের বৈকল্যের প্রতি দৃক্ষেপ না করে পোঁছে গেল পুপুদের কলেজে। এতক্ষণে তার অফিসের পরিচয় খুলে ফেলে শুরু করল তদন্তের কাজ। কাকে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তার একটা তালিকা তৈরি করল মনে মনে। একে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কানে পৌঁছোবে এমন সব তথ্য যা তার সামনে উন্মোচিত করবে ঘটনার আশ্চর্য সব ছবি। জানতে পারবে এই অঘটনের মূলে ঠিক কী আছে তার নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিবরণ। তার তালিকায় প্রথম নাম পুপুর রুমমেট।
এ ধরনের কলেজের হোস্টেলে প্রতি ছাত্রই চেষ্টা করে যাতে নিজের নিজের রাজ্যের ছাত্রকে রুমমেট হিসেবে পায়। পুপুর রুমমেট হিসেবে যে ছাত্রটি তার ঘরে থাকে সেই চিরঞ্জয় দত্তরায় কলকাতার দমদমের বাসিন্দা। পুপুর নাকি কোনওদিনই ছেলেটিকে পছন্দ ছিল না। খুব ডিস্টাবিং। কিন্তু ওদের সুপারিটেন্ডড যেহেতু বাঙালি, তিনি নাকি পুপুকে বলেছিলেন, একজন বাঙালি রুমমেট পেয়েও তোমার অশান্তি! অবাঙালি রুমমেট পেলে কী করতে! রুমমেট নিয়ে অত পছন্দ-অপছন্দ থাকলে আর রাজ্যের বাইরে পড়াশুনো করা যায় না।
সেই বাঙালি রুমমেট চিরঞ্জয় দত্তরায়কে আবার জেরা করা হচ্ছে শুনে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল গার্গী। বলল, তাই নাকি? সেই জেরাটা তো আমারও শোনা দরকার। তা হলে আমাকে আর আলাদা করে জেরা করতে হবে না। চলুন তো কোন ঘরে জেরা করছে সেখান যাই।
–কিন্তু পুলিশ সেই ঘরে কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।
–না দেওয়ার কী আছে? আমি তো তাদের কথোপকথন শুনব শুধু। চলুন, দেখি
পুলিশ একটু দূরেই, হোস্টেলের অন্য একটা ঘরে জেরা করছে শুনে গার্গী পা চালিয়ে পোঁছোল সেখানে।
যে-ঘরে জেরা করা হচ্ছে সেই ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বহু ছাত্র-ছাত্রী। অবাঙালি ছাত্র ছাত্রীই বেশি। তাদের ভিড় সামলাচ্ছে দুজন কনস্টেবল। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রায় সবারই চেহারা বেশ বলশালী গোছের। অনেকেরই কথায় হিন্দির সঙ্গে মারাঠি টান। তাদের কথা বুঝতে গেলে তার গাইড দীনেশ নারলিকারের সাহায্য লাগবে। দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে গার্গী তার ইচ্ছের কথা বলতেই কনস্টেবলরা তদ্দণ্ডে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হবে না, হবে না। ইনস্পেক্টার ভোঁসলে খুব কড়া লোক। কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিলে আমাদের উপর বেঁকে উঠবেন।
ও, ইনস্পেক্টার ভোঁসলে এখানে অন্তরিন হয়েছেন রুমমেটকে জেরা করতে! তা হলে তাঁর সঙ্গেই তো গার্গী সরাসরি কথা বলতে পারে।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলের চেহারাটি বেশ সমীহ করার মতো। ছ’ফুটের উপর লম্বা, তেমন মেদবহুল নয় বলে খুবই সুপুরুষ গড়ন। স্পষ্ট হিন্দিতে, বেশ চাঁচাছোলা গলায় বললেন, বুঝলেন, কড়া না হয়ে উপায় নেই। এরকম কড়া না হলে হুড়হুড় করে লোক ঢুকে যাবে ঘরে। তদন্ত করাই যাবে না। দেখছেন বাইরে কি ভিড়!
–ঠিকই বলেছেন। গার্গী এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেলে তার অভীষ্টে পৌঁছোতে চাইল, বলল, ইনস্পেক্টার ভোঁসলে, আপনি তো কাল রাতেই আলাপিত হয়েছেন দিব্যসারথির বাবা দেবদত্তবাবুর সঙ্গে। বুঝতেই পারছেন তার মনের অবস্থা। একমাত্র ছেলেকে এত দূরে মেডিকেল পড়তে পাঠিয়েছিলেন অনেক আশা নিয়ে। তারপর এই অঘটন। দেবদত্তবাবু কিন্তু মনে করছেন তাঁর ছেলে সুইসাইড করেননি। তাকে মার্ডার করা হয়েছে।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে মুখ থমথমে করে বললেন, সুইসাইড, না মাভার, সেটা বলার মতো সময় কিন্তু এখনও হয়নি, ম্যাডাম।
–তা জানি, ইনস্পেক্টার ভোঁসলে। কিন্তু আমাদের বক্তব্যটা জানিয়ে রাখলাম আপনার ইনভেস্টিগেশনের সুবিধে হবে মনে করেই। এই সুযোগে আপনাকে জানিয়ে রাখি আমি কলকাতায় মাঝেমধ্যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করে থাকি।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে কিছুটা সময় থমকালেন গার্গীর এই নতুন পরিচয় পেয়ে, বললেন, ইটস এ প্লেজার টু মিট ইউ, মিসেস চৌধুরি।
গার্গী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আমি মুম্বাইতে এসেছিলাম অন্য একটা কাজে। তারপর হঠাৎই ফোন পেয়ে কাল ছুটে এসেছি পুণেয় বিষয়টা ভালো করে জানব বলে। আপনি যদি এই কাজে আমাকে অনুমতি দেন তো আমার মনে হয় আপনার কাজে আমি কিছুটা সহায়তা করতে পারি।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে বিষয়টা গভীর করে ভাবলেন, তারপর বললেন, আমার কোনও অসুবিধে নেই।
গার্গী খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি বরং আপনার ইন্টারোগেশন চালিয়ে যান। আমি মনে মনে নোট করে নিচ্ছি উত্তরগুলো।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে গার্গীকে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে যেখানে চিরঞ্জয় নামের তরুণটিকে জেরা করছিলেন এতক্ষণ। চিরঞ্জয়ের মুখের দিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল গার্গী। বছর একুশ-বাইশের তরুণটি কাঠ হয়ে বসে আছে ইনস্পেক্টার ভোঁসলের সামনের চেয়ারে। ইনস্পেক্টার যেখানে শেষ করেছিলেন, এতক্ষণে আবার তাঁর প্রশ্নে থিতু হলেন চিরঞ্জয়ের মুখের দিকে চোখ ফেলে। হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে এবার বলো তো, চিরঞ্জয়, তোমার কানে পরশু রাতে কোনও শব্দই যায়নি?
চিরঞ্জয়ের মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছে। দুটি উজ্জ্বল চোখ। নাক সামান্য ভোঁতা। চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। ছেলেটি যে মেধাবী তা তার চাউনি দেখেই স্পষ্ট। তাকে এত জেরা করছে বলে ভয়ে তার অভিব্যক্তি কাঁচুমাচু। এক পলক গার্গীর মুখের দিকে নজর ছুঁয়ে চোখ পাতল ইনস্পেক্টার ভোঁসলের লম্বাচওড়া শরীরটার উপর। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, একদম না। তিন সত্যি বলছি।
–একেবারে তিন সত্যি! তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল আগরওয়াল! সে-পাশের ঘর থেকে তোমাকে ডাকতে এসে দেখল এই দৃশ্য! আর তুমি সারা রাতের মধ্যে কিছুই জানলে না?
–না, স্যার। সত্যি বলছি। এর মধ্যে একটুকরো মিথ্যেও নেই।
–তুমি ঘুম থেকে উঠে দিব্যসারথিকে ওই অবস্থায় দেখে তোমার কোনও কথাই স্মরণে এল না? রাতে কখন তুমি ঘুমোতে এলে, তখন দিব্যসারথি ঘুমিয়ে পড়েছে কি না, না কি তখনও দিব্যসারথি ফেরেনি, কিছুই বলতে পারছ না?
–না, স্যার। যখন রাতে ফিরেছিলাম, তখন চোখে এত ঘুম ছিল যে, গায়ের সবুজ রঙের টি-শার্টটা খুলে আলনায় ছুঁড়ে দিয়েই সোজা বিছানায়।
গার্গী একটু একটু করে তখন শুনছে পুপুর লাশ আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার ঘরের হারা। রুমমেট চিরঞ্জয়েরও লেখাপড়ার কেরিয়ার খুব ভালো। ইনস্পেক্টার ভোঁসলে জ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু কারণ বলতে পারো কেন দিব্যসারথি সুইসাইড করল?
–আমি কিছুই বলতে পারব না।
–তুমি তো ওর সঙ্গে একই ঘরে থাকো। তোমার পক্ষেই বলা সম্ভব ওর জীবনে এমন কিছু ছিল কি না যার ফলে ওর এরকম একটি পরিণতি হল?
–আমি বলতে পারব না। আসলে সত্যি কথা কি জানেন আমার সঙ্গে ওর বোঝাপড়া খুব ভালো ছিল না।
-তাই নাকি? স্ট্রেঞ্জ! কেন ভালো ছিল না তা বলতে কোনও বাধা আছে, চিরঞ্জয়? চিরঞ্জয় চুপ করে থাকে, ভয়ে ভয়ে তাকায় ইনস্পেক্টার ভোঁসলের বিশাল শরীরটার দিকে।
–কী হল, চুপ করে কেন, বাবা? চুপ করে থাকলে আমাদের আরও বেশি করে সন্দেহ হবে যে!
চিরঞ্জয়ের চোখেমুখে আশঙ্কা ঘনায়, কী সন্দেহ হবে?
–এই আর কী, তুমিই দিব্যসারথিকে কোনওভাবে মোটিভেট করেছে।
–না, স্যার। ওকে সুইসাইড করতে বলার মতো মোটিভেট করার মতো মানসিকতা আমার নেই। তবে দিব্যসারথির সঙ্গে আমার টিউনে মিলত না।
–টিউনে মিলত না! বাহ, বেশ বলেছ। তোমার টিউন কীরকম তা শুনতে পারি? চিরঞ্জয় আবারও চুপ করে থাকে। কী উত্তর দেবে বোধহয় তাই ভাবছিল অন্যমনস্ক হয়ে।
কী হল, উত্তর দিচ্ছ না যে! পুলিশ ইন্টারোগেট করলে তার উত্তর দিতে হয় চটপট করে। দেরি হলেই সন্দেহ।
–স্যার, একই ঘরে থাকতাম বটে, কিন্তু কথাবার্তা হত খুবই কম।
–তা তোমরা দুজনে একই ঘরে থাকো, টিউনে মেলে না, তা ঘর চেঞ্জ করার কথা ভাবোনি?
–স্যার, চাইলেই তো চেঞ্জ করা যায় না। হোস্টেল সুপার বলেন, বেশি টিউনে মেলার দরকার নেই। তাহলে পড়ার ক্ষতি হবে। সারাক্ষণ গল্প করতেই ব্যস্ত থাকবে দুজনে। তার চেয়ে দুই বে-টিউনের ছেলে একই ঘরে বাস করবে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে গল্প করে সময় নষ্ট করবে না, সেইটেই আইডিয়াল। তাহলে পড়াটা ভালো
–অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়তে বুঝি দুজনে?
–দুজনের পড়ার সময় দুরকম। ও পড়ে ভোরে উঠে। অনেক বেলা পর্যন্ত পড়ে। সন্ধেয় ঘরে থাকে না। কোথায় যায় আমি তার খবর রাখি না। ফেরে অনেক রাতে।
–আর তুমি?
–আমি উঠি বেলায়। সকালে দু-ঘণ্টা পড়ি। সন্ধের পর আমি সাধারণত লাইব্রেরিতে যাই। সাড়ে ন’টা-দশটা পর্যন্ত পড়ি। তারপর ক্যান্টিনে খেতে যাই। খেয়ে ঘরে ফিরে আসি।
–হুঁ, ইনস্পেক্টার ভোঁসলেকে চিন্তিত দেখা গেল, বললেন, তোমরা দুজন কি একই সময়ে ঘুমোতে যেতে বোজ?
–ক্যান্টিনে খেয়ে আমার ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা সাড়ে দশটা, তারপর কিছু ম্যাগাজিনটিন ওলটাই। রাত এগারোটা হয় শুতে। দিব্যসারথি কখনও আগে ফেরে কখনও পরে ফেরে। ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
–তার মানে কখনও রাত এগারোটারও পরে ফেরে?
–তা হয় মাঝে মাঝে।
–রাত বারোটাও হয়?
–হতে পারে। আমি জানি না। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে কাদা।
–পরশু রাতের কথা বলতে পারছ না? আচ্ছা, ঘরের দরজা কে দেয়? না কি খোলা থাকে রাতে?
–যে শেষে ফেরে ঘরের দরজা দেয় সে-ই। আমি পরে ফিরলে আমিই দরজা বন্ধ করি।
–কাল রাতে তুমি দাওনি?
–মনে পড়ছে না।
–একেবারেই মনে পড়ছে না?
চিরঞ্জয় ঘাড় ঝাঁকাল, কি জানি মনে পড়ছে না কী করেছিলাম।
ইনস্পেক্টার ভেঁসলে এতক্ষণে কষে একটা ধমক লাগালেন চিরঞ্জয়কে, ঠিক করে বলো। না হলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে।
গার্গী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখছিল চিরঞ্জয়ের অভিব্যক্তির পরিবর্তন। ইনস্পেক্টার ভোঁসলের ধমকে কাজ হল মনে হচ্ছে। বলল, আমি ঠিক জানি না পরশু রাতে ঠিক কী ঘটেছিল। কারণ বললাম যে, পরশু রাতে চোখে এত ঘুম ছিল যে কিছুই মনে করতে পারছি না এখন। তবে মনে হয় পরশু যখন ঘুমোতে গিয়েছিলাম তখনও দিব্যসারথি ঘরে ফেরেনি।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে আবার কষে এক ধমক দিয়ে বললেন, এই কথাটা বলতে এতখানি সময় লাগল? এর পর থার্ড ডিগ্রি দিলে আরও কথা বার করে নেব। দেখবে মনে পড়ে কি না! ঠিক করে বলল রাতে কোনও শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল কি না!
–স্যার, শুয়ে পড়ার পর রাতে ঘরে বাঘ ঢুকলেও আমার ঘুম ভাঙবে না।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে তাকে আর একবার নিরিখ করে জিজ্ঞাসা করলেন, হোস্টেলে ফিরতে দিব্যসারথির রোজ দেরি হয় কেন এত?
–তা জানি না, স্যার।
–জানো না? কিন্তু এটা তো জানো অত রাতে হোস্টেলের ক্যান্টিনে খাবার পাওয়া যায় কি না?
চিরঞ্জয় হঠাৎ বলল, ও তো রাতে হোস্টেলের ক্যান্টিনে খায় না।
–তবে কোথায় খায়? চিরঞ্জয় চুপ করে থাকে। তারপর ইনস্পেক্টার ভোঁসলের আর এক ধমক খেতে বলল, আমি ঠিক জানি না, স্যার।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে আরও বহুক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়ে বললেন, ইমপসিবল। নিশ্চয় রাতে নেশাটেশা করে, কিংবা পাতাটাতা খেয়ে ফিরেছিল। ঠিক আছে, এই নরেশ, পবন আগরওয়াল নামের ছেলেটিকে ডাক তো। ওই নাকি প্রথম দিব্যসারথিদের ঘরে উঁকি মেরে আবিষ্কার করেছিল দিব্যসারথির ডেডবডি।
চিরঞ্জয় ছাড়া পেতে তার চোখেমুখে আলোর ফুলকি।
একটু পরেই চুল উসকোখুসকো, বড় বড় চোখের একটি তরুণ এসে ঢুকল সেই ঘরে। তাকে বসতে বলে ইনস্পেক্টার ভোঁসলে গলার স্বর বদলে বেশ কড়া করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিই তো সেই কালপ্রিট।
পবন আগরওয়াল ঠিক প্রস্তুত ছিল না এরকম একটি কড়া ট্যাকলের মুখোমুখি হওয়ার, ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তার মানে?
–কোথায় বাড়ি তোমার?
–স্যার, মুম্বাই। ওয়াসিতে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন বাবা।
–তোমার বাবা বেশ ঘ্যামা লোক, তাই না?
পবন বুঝে উঠতে পারে না প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ হবে, না কি না?
পরক্ষণে ইনস্পেক্টার ভোঁসলে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিই তো কাল সকালে ঘরে ঢুকে দেখেছিলে দিব্যসারথি শুয়ে আছে চিত হয়ে, আর তার দুই হাতের শিরা কাটা, তাই না?
পবন আগরওয়াল ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁ।
–তুমি ঘরের ভিতর ঢোকার সময় দেখেছিলে দরজা খোলা?
–হ্যাঁ।
–ঠিক করে বলল, দরজা খোলা ছিল, না ভেজানো?
-–খোলাই ছিল।
–তা তুমি হঠাৎ ওদের ঘরে ঢুকতে গেলে কেন?
–চিরঞ্জয়ের কাছে আমার একটা বই ছিল। হঠাৎ ওটার দরকার হয়েছিল বলেই ডাকতে গিয়ে দেখি চিরঞ্জয় তখনও ঘুমোচ্ছে, আর দিব্যসারথি–
বলে হঠাৎ থমকে গেল বোধহয় দৃশ্যটির নৃশংসতার কথা মনে পড়তে।
–তাহলে তুমিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলে ওদের দরজা খোলা?
–না। আমাদের পাশের ঘরের মহেশ প্যাটেল ভোরে উঠে দেখেছিল দিব্যসারথিদের দরজা খোলা।
–মহেশ প্যাটেল কে?
–স্যার, আমাদের পাশের ঘরে থাকে। লোনাভিলায় ওর বাবার একটা বড় কারখানা আছে চিক্কির।
–চিক্কি? গার্গী অচেনা শব্দটি খোলসা করতে চায়।
–চিক্কি জানেন না, ম্যাডাম? গুড় চিনি বাদাম মিশিয়ে এক ধরনের টফি। ইনস্পেক্টার ভোঁসলে পরক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠেন, মহেশ প্যাটেল কী বলল?
–মহেশ প্যাটেলের কথায় তখন তার কিছু সন্দেহ হয়নি, ভেবেছে হয় চিরঞ্জয়, অথবা দিব্যসারথি-ওদের দুজনের কেউ ভোরে উঠে পড়েছে পড়বে বলে।
–তারপর তোমার নজরে পড়ল দিব্যসারথিকে?
–বরং বলা ভালো দিব্যসারথিকে দেখার আগেই চোখে পড়ে তাদের ঘরের মেঝেয় রক্তের ধারা। দিব্যসারথির বিছানায় নজর পড়তেই চমকে উঠে চেঁচিয়ে চিরঞ্জয়কে ডাকি।
–চিরঞ্জয় তখন ঘুমোচ্ছিল?
–হ্যাঁ। সাংঘাতিক ঘুমোচ্ছিল। বহু চেঁচামেচি করে তুলতে হল। উঠেই ওই দৃশ্য দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল।
–তারপর?
–তারপরই হোস্টেল জুড়ে তুমুল কোলাহল।
গার্গীর মনে যে কৌতূহল প্রথমেই উসকে ওঠে তা প্রকাশ করে ফেলল, জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু তুমি কি বলতে পারে ওরা দরজা খোলা রেখেই ঘুমোয়?
–দরজা তো ভেজানোই থাকে। ভিতর থেকে লক করে কি না তা বলতে পারব। । চিরঞ্জয় বলেছিল যে শেষে ফেরে সে-ই দরজা বন্ধ করে। পরশু কাল রাতে বিছানায় শোওয়ার আগে ও দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল। তবে দিব্যসারথি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ। করেছিল কি না তা নিশ্চিত করে বলতে ও পারছে না। তবে–
–কী তবে?
–ওদের দুজনের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হত। দরজা বন্ধ করা নিয়েও হত। দিব্যসারথি সাধারণত দেরি করে ফেরে, আর রাতে দরজা বন্ধ না করেই শুয়ে পড়ত বরাবর।
গার্গী বহুক্ষণ দুই ছাত্রের উত্তর শুনে তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঠেকছে কিনা। সে ভাবছিল ঘটনার আগাপাশতলা। পবন আগরওয়ালকে অতঃপর আর জেরা না করাই সিদ্ধান্ত নিলেন ইনস্পেক্টার ভোঁসলে। তাকে, –ঠিক আছে, এসো বলতেই সে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যাচ্ছিল বাইরে। তাকে, ‘এক মিনিট’ বলে বাইরের বারান্দায় দাঁড় করাল গার্গী। গার্গীকে দেখে বেশ অবাক হল পবন আগরওয়াল। ‘আপনি?’ বলে বিস্ময়বোধক চাউনি দিতেই গার্গী তার পরিচয় দিয়ে বলল, তুমি কিন্তু কিছু চেপে যাচ্ছ, পবন।
–কী চেপে যাচ্ছি?
–আমাদের কিন্তু মনে হচ্ছে দিব্যসারথি সুইসাইড করেনি। ওকে খুন করা হয়েছে।
খুন শুনে পবন আগরওয়াল খুব একটা আশ্চর্য হয়েছে বলে মনে হল না। বরং বলল, তা আমি কী করব?
–কিছু করতে হবে না। শুধু তুমি কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবে।
–কী প্রশ্ন?
–তুমি জানো চিরঞ্জয়ের সঙ্গে কোনও বিষয়ে দিব্যসারথির কলহ চলছিল। তোমাকে বলতেই হবে কী সেই কারণ যার ফলে একই রুমে থাকা সত্ত্বেও চিরঞ্জয়ের সঙ্গে দিব্যসারথির কথা ছিল না।
পবন আগরওয়াল থমকে গেল গার্গীর জেরায়। একটু পরে বলল, সে অন্য ব্যাপার–
–যে ব্যাপারই হোক তা জানতে হবে আমাদের। তুমি না বলে যে পরিত্রাণ পাবে তা নয়। আজকাল এই বয়সের ছেলেদের মধ্যে খুব সামান্য কারণে বিবোধ বাধে তা অসামান্য হয়ে দেখা দেয় পরবর্তী সময়ে। বললো, কী সেই কারণ?
পবন আগরওয়াল ইতস্তত করে বলল, সে ওই মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে।
–কে মাধুরী দীক্ষিত? সিনেমা আর্টিস্ট?
–না, আসলে ওর নাম মাধুরী প্যাটেল।
-কে মাধুরী প্যাটেল? তোমাদের কোনও ক্লাসমেট?
–হ্যাঁ। কোনওক্রমে ঘাড় নাড়ে পবন।
–কী হয়েছিল?
পবন আবারও ইতস্তত করতে থাকে, তারপর বলে, হোস্টেলের মাঠে গোল হয়ে বসে গল্প করার সময় দিব্যসারথি একদিন মাধুরীর কোলে শুয়ে পড়েছিল। তাই নিয়ে চিরঞ্জয় গ্রেট করেছিল দিব্যসারথিকে। বলেছিল, তুই বাঙালির নাম ডোবাচ্ছিস।
গার্গী এতক্ষণে সর্বনাশের গন্ধ পেয়েছে পবন আগরওয়ালের কথায়। জিজ্ঞাসা করে, তারপর?
–তার আর পর নেই। প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর কথা বন্ধ।
–সেই কারণ থেকে এরকম একটা সাংঘাতিক পরিণতি ঘটতে পারে?
–কী পারে আর কী পারে না তা জানা আমার সাধ্য নয়, ম্যাডাম। এর পর কী ঘটেছে তা আমি বলতে পারব না। বলতে পারে পুলিশের ইনভেস্টিগেশন।
–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। কিন্তু পুলিশ তো গাছ থেকে কালপ্রিট পেড়ে আনবে না। তোমরা অনেকেই অনেক কিছু জানো। সবাই যদি তদন্তে সাহায্য করো তাহলে হয়তো পুলিশ কিছু বার করলেও করতে পারে।
পবন চুপ করে থাকে।
–অল রাইট। আর কোনও ক্ল দিতে পারো দিব্যসারথির বিষয়ে।
হঠাৎ ক্লু শব্দটা শুনে পবন আগরওয়াল ভারি মজা পায়, বলল, আপনি কি ডিটেকটিভ?
গার্গী চোখের পলক নেড়ে সায় দেয়, ধরো তাই। বলো আর কিছু জানো কি না এ বিষয়ে।
–স্যার, এ ব্যাপারটা মাধুরী হয়তো বলতে পারে। মাধুরীর সঙ্গে ইদানীং ওর খুব ভাব হয়েছিল। চিরঞ্জয় এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কি না তা মাধুরীই বলতে পারবে। তবে কথাটা যে আমি বলেছি তা যেন চিরঞ্জয় বা মাধুরী কেউ যেন জানতে না পারে। তাহলে আমার হালুয়া টাইট করে দেবে ওরা।
গার্গী বেশ ভাবনায় পড়ে। এতক্ষণে ঘটনাটা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। এই অল্পবয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশার আর একটা দিক।
পবন আগরওয়ালকে ওকে বলার পর গার্গী চলে এল চিরঞ্জয়ের খোঁজে।
তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে ভাবল কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ পড়েছে দেবদত্তবাবুর উপর। সে ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর আগেই কলকাতা থেকে উড়ে এসেছেন দেবদত্তবাবু। গার্গীকে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মাঝবয়সি ভদ্রলোক।
গার্গীর বুকের ভিতরটা ফাঁকা ঠেকল সহসা। দেবদত্তবাবুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছেন চোখদুটো। চুল উসকোখুসকো। চোখে শূন্য চাউনি। তাকে দেখেই আবার কেঁদে ফেললেন হু-হু করে, ম্যাডাম, আমার নিঃস্ব করে চলে গেল পুপু।
একমাত্র পুত্রসন্তান, তার উপর মেধাবী, তাকে হারিয়ে জীবনটা প্রায় ব্যর্থ দেবদত্তবাবুর। দিব্যসারথির ডাকনাম যে পুপু তা গার্গী জানে। প্রায় তাদের চোখের সামনেই বড় হয়ে উঠল পুপু। পুপু পড়াশুনায় ভালো বলে সাধারণ মানের একজন কর্মচারী দেবদত্তবাবুর গর্বের অন্ত ছিল না। বলতেন, কী বলব, মশাই, একবার যা পড়ে হুবহু মনে রাখতে পারে। বলতে পারেন ফটোগ্রাফিক মেমারি।
শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তি থাকলেই যে লেখাপড়ায় ভালো হবে তার কোনও মানে নেই। দিব্যসারথির বুদ্ধিও ছিল তীক্ষ্ণ। সে কথাও দেবদত্তবাবু বলতেন, পুপু কিছু একটা হবেই, ম্যাডাম।
দেবদত্তবাবুর কণ্ঠে অহংকারের সামান্য ঝাঁজ। তার মানে তাঁর অহংকারে মাটিতে পা ঠেকত না তা নয়। তাঁর সহকর্মীদের বলতেন পুপুকে ডাক্তার করে ভোলার ইচ্ছে তার ছোটবেলা থেকে। দেবদত্তবাবুর স্ত্রী খুব সাধারণ রোগে মারা গিয়েছিলেন। মাত্র দুদিনের জুরে। হয়তো সময়মতো ডাক্তার দেখাতে পারলে পরিণতি অন্যরকম হত, কিন্তু গভীর রাতে ঘটনাটা ঘটেছিল বলে ডাক্তার ডাকার আগেই চোখের সামনে ছটফট করে মারা গিয়েছিলেন তিনি। বলা যায় কোনও চিক্কিৎসাই করা যায়নি।
৬
একটা কলেজের হোস্টেলে নানা ধরনের ছেলেমেয়েরা থাকে। প্রত্যেকের চিন্তাভাবনার ওয়েভলেংথ আলাদা। বড় হয়ে ওঠার ধরনও ভিন্ন। শুধু তাদের মধ্যে একটাই মিল, প্রত্যেকেই ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী। কিন্তু তারা যখনই এক সঙ্গে পাশাপাশি ঘরে থাকতে আসে, একই সংসারের শরিক হয় সেখানে নানাধরনের গোলোযোগ ঘটতেই পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে গোলোযোগের সূত্রটা কী। সে আবারও তন্নতন্ন করে মনে করার চেষ্টা করল পুপুর নিস্পন্দ শরীরটা।হঠাই তার চোখে পড়ল একটু আগেই দেখা পুপুদের হোস্টেলের সুপারকে। তিনি কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন জটলা করা ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ রেখে। গার্গী দেবদত্তবাবুকে গলা নামিয়ে বলল, আপনি বলছিলেন না ইঞ্জেকশনের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করবেন সুপারকে। জিজ্ঞাসা করুন তত দিব্যসারথি কোনও ইঞ্জেকশন নিত তা উনি জানেন কি না!
দেবদত্তবাবু এগিয়ে গিয়ে তাকে বিষয়টা বলতেই তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, দেখুন, আজকালকার ছেলেদের গতিবিধি বোঝাই মুশকিল। হোস্টেলের বাইরে গিয়ে কে কখন কার সঙ্গে মিশছে তা আমাদের জানা থাকে না। হতে পারে কোনও নেশার পাল্লায় পড়েছিল ইদানীং।
উত্তর শুনে দেবদত্তবাবু চুপ করে গেলেন। দিব্যসারথি অনেকদিন বাড়িছাড়া, তার সম্পর্কে সবটুকু যে জানেন না তা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া উপায় কী।
–আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন দেবদত্তবাবু? বাড়ি গিয়ে কিছু বলত-টলত? আপনার সঙ্গে কিছু না বললেও চেনাজানা অন্য কারও সঙ্গেও বলতে পারে।
দেবদত্তবাবুর তখন ভালো করে কথা বলার ক্ষমতাই নেই, তবু গলা নামিয়ে বললেন ইদানীং পুপু হঠাৎ বলতে শুরু করেছিল, বাবা, আমার হোস্টেলে থাকতে ভালো লাগে না। এখানে অনেক প্রাইভেট বাড়ি আছে। তুমি আমাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দাও।
গার্গী আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী, তারপর?
–কিন্তু আমার মনে হয়েছি হোস্টেলে থাকাই নিরাপদ। তাই ওকে নিবৃত্ত করেছিলাম এটা-ওটা বলে। তখন যদি জানতাম এরকম হবে–
বলতে বলতে দেবদত্তবাবুর গলা বুজে আসে।
–এরকম আগে কখনও বলেছিল?
–হোস্টেলে ঢোকার পর প্রথম প্রথম কিছুদিন এরকম বলেছিল, বাবা, এখানে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। তখন সবাই বলেছিল, ‘থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে যাবে।’ অভ্যাস হয়েও গিয়েছিল, আজ প্রায় দুবছর আছে, অনেকদিন আর কিছু বলত না। ইদানীং আবার কী যে হয়েছিল!
গার্গী জিজ্ঞাসা করল, কতদিন ধরে এরকম বলছে আবার?
–তা তিন-চার মাস হবে। অন্য ছেলেমেয়েরা নাকি ওর পিছনে ওকে নিয়ে কথা বলে। ওকে দেখে হাসে। কেউ কেউ ওকে দেখলে এড়িয়ে যায়।
গার্গী বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে, কেন তা ও বলত?
–ঠিক পরিষ্কার করে কখনও বলত না।
–আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, দেবদত্তবাবু এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগে যে বিষয়টা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তা হল ওর জীবনে এমন কিছু গোপনীয় ঘটেছিল কি না যার ফলে এরকম একটা দুর্ঘটনা হতে পারে।
দেবদত্তবাবু হয়তো বিষয়টা বুঝেছেন, তবু আরও একটু ভালো করে বোঝার জন্যে গার্গীর দিকে তাকিয়ে থাকেন জিজ্ঞাসু চোখে।
গার্গী আরও পরিষ্কার করে বলে, মানে পুপু কারও সঙ্গে মেলামেশা করছিল কি না! এমন কারও সঙ্গে–যে সম্পর্কটা ঠিক সহজ নয়। আপনার কি কিছু জানা আছে, না হলে আমি ওর সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলব।
দেবদত্তবাবু চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। হয়তো ভাবতে থাকেন কিছু, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না, তেমন কিছু জানা নেই আমার।
গার্গী অতএব ঘটনার প্রেক্ষিত সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে নিয়ে এবার তাকাল পুপুর ঘরের আশেপাশে ভিড় করে থাকা বাকি মানুষজনের দিকে। দিব্যসারথির সহপাঠীদের ভিড়ই বেশি। কিছু হাসপাতালের স্টাফ ও তাদের বাড়ির লোকজন। তাদের মধ্যে একজন বছর চল্লিশের মহিলাকে চোখে পড়ল গার্গীর। বেশ সুন্দরীই দেখতে। তাঁর চোখদুটো কেমন ফোলা-ফোলা। কাঁদছিলেন নাকি মহিলা। গার্গী জিজ্ঞাসা করে জানল উনি সুপার গৃহিণী।
পুলিশ অফিসাররা ততক্ষণে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব গুটিয়ে আনছেন দ্রুত। একজন পুলিশ অফিসার ততক্ষণে এগিয়ে এসে দেবদত্তবাবুকে বলছেন, আপনার কিছু বলার থাকলে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে আপনাকে। নইলে আমরা সুইসাইডের কেস দিয়ে দেব।
গার্গী তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে, মাঝবয়সি সাব-ইন্সপেক্টার, মোটা করে গোঁফ রাখায় তার কালো মোটা চেহারা আরও রঙিন করে তুলেছে। ইনস্পেক্টার ভোঁসলেরই কোনও সহকমী। দেবদত্তবাবুর পাশেই দাঁড়ানো গার্গী হঠাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মনে হচ্ছে এটা সুইসাইড?
–হ্যাঁ। আপাতদৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিকত্ব যখন পাইনি, তখন—
–ওর হাতে একটা ইঞ্জেকশনের দাগ দেখেছেন?
–দেখেছি। পোস্ট মর্টেম হলে যদি কিছু জানা যায় তখন ভাবা যাবে সে বিষয়।
–আপনি ক্লাসমেটদের সবাইকে ইন্টারোগেট করেছেন?
–ভালো বললেন আপনি। হোস্টেলে এখন প্রায় দুশোর উপর ছেলেমেয়ে সবাইকে ইন্টারোগেট করা যায় নাকি। যাকে ইন্টারোগেট করার প্রয়োজন আই. ও. এতক্ষণ করলেন তা তো আপনি দেখলেন?
গার্গী সামান্য অপ্রতিভ, তা বলিনি আমি। যাদের ইন্টারোগেট করা দরকার তাদের নিশ্চয়ই জেরা করেছেন।
–দরকার হলে আরও করবেন।
–হ্যাঁ। তা হয়তো করবেন। কিন্তু এটা কি কোনওভাবে জানা গেছে পরশু রাতে হোস্টেলের এই ঘরে বোর্ডাররা ছাড়া বাইরের আর কেউ এসেছিল কি না?
–না। শুধু হোস্টেলের সুপার যেমন প্রতিদিন ভিজিট করতে আসেন তেমনই এসেছিলেন একবার।
–তাই নাকি। গার্গী ভাবল সুপারকে পরে জিজ্ঞাসা করবে তিনি কিছু অস্বাভাবিক দেখেছিলেন কিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে নিবৃত্ত করল নিজেকে। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করল, কেন সুইসাইড করেছে তার কোনও কারণ কি অনুমান করতে পেরেছে কেউ।
–হ্যাঁ, ওরা তো বলল, হি ওয়াজ অ্যা মেন্টাল পেসেন্ট।
–মেন্টাল পেসেন্ট! গার্গী যত না অবাক হল, তার চেয়েও বেশি দেবদত্তবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, ইমপসিব! আমার ছেলে মেন্টাল পেশেন্ট।
গার্গী লক্ষ করছিল দেবদত্তবাবুর প্রতিক্রিয়া, বলল, কেন ওরা এরকম বলল তা দেখছি আমি।
দেবদত্তবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, দেখলেন তো। আমার ছেলে মেন্টাল পেশেন্ট কি না তা আমার চেয়ে ওরা বেশি জানে! নিশ্চয়ই কোনও মিস্ত্রি আছে এর পিছনে
গার্গী দেবদত্তবাবুকে সামাল দিতে গুঁফো পুলিশ অফিসারটিকে জিজ্ঞাসা করে, কে আপনাকে বলেছে ও মেন্টাল পেশেন্ট ছিল?
–কে আবার। সবাই। দেখুন না ওদের জিজ্ঞাসা করে। এই সব মেন্টাল পেশেন্টরা শেষপর্যন্ত সুইসাইড করে।
পুলিশ অফিসার তার অভিজ্ঞতার সারসত্যটি গার্গীদের কানে ঢেলে দিয়ে তাদের কর্তব্য কর্ম করতে শুরু করে দিলেন অতঃপর। দেবত্তবাবুকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাদের কাগজে সই সাবুদ করবে বলে।
গার্গী ততক্ষণে রহস্যের গভীরে ঢুকতে শুরু করেছে দ্রুত। চিরঞ্জয়ের কথার মধ্যে কিছু ফাঁকফোকর ছিল যা ধন্দে ফেলেছিল গার্গীকে। তাই ভিড়ের মধ্যে প্রথমেই খুঁজে বার করেছে চিরঞ্জয়কে। বছর একুশ-বাইশের তরুণটি চেহারায় সাধাসিধে। এর মধ্যে কখন যেন সে তার পরনের পোশাক বদলে এসেছে। পরনে সাদা পাজামার উপর রঙিন পাঞ্জাবি। একটু আগেই মনে হচ্ছিল চোখে ঘুম ভরা। এখন জেরার চোটে ঘুমের পরি তার রঙিন ডানা মেলে হাওয়া।
এখন তার বড় বড় চোখ খুঁটিয়ে দেখছে পুলিশের রকমসকম। দু-চোখে উদাসীন চাউনি। পুলিশের জেরায় কিছুটা বিব্রতও। গার্গী তাকে হাত নেড়ে ডাকল, শোনো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার। আমার কিছু কথার উত্তর দাও তো।
–আবার প্রশ্ন! বহু প্রশ্নের উত্তর এতক্ষণ তত দিলাম। চিরঞ্জয় বিহ্বল চোখে জিঞ্জাসা করে, আপনি আবার কে? মেয়ে পুলিশ নাকি?
গার্গী চোখ নাচিয়ে বলল, ধরে নাও সে রকমই। কিন্তু তোমার রুমমেট সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তুমিই জানবে। তোমাকেই তো সবাই জিজ্ঞাসা করবে এটা-ওটা। বিশেষ করে পরশু রাতে তোমার পাশে শুয়েই সুইসাইড করেছে দিব্যসারথি। তার বাবা কী রকম ভেঙে পড়েছে দেখছ তো। তুমি বলো তো, পরশু দিনের বেলা যখন শেষবারের মতো ওকে দেখেছ, তখন ওর ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখেছিলে কি না!
–দিনের বেলা! চিরঞ্জয় মাথা ঝাঁকায়, পরশু তো ওর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি!
-দেখা হয়নি বলছ?
–না তো! সকালে উঠেই আমি বেরিয়ে গিয়েছিলাম পুণে বাসস্ট্যান্ডের কাছে। আমার এক পিসিমা ওখানে থাকেন। ফিরেছি বেলা সাড়ে বারোটায়। তার আগেই দিব্যসারথি বেরিয়ে গেছে ক্লাস করতে। আমি যখন ক্লাস করতে গেছি, ও তার একটু পরেই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল কোথাও। রাতে আমি ক্যান্টিনে খেয়ে যখন ঘরে ফিরেছি আমার মনে নেই ও তার আগেই ফিরেছে কি না! মনে হয় ফেরেনি।
–ঠিক আছে এবার বলো তো, ইদানীং ও কেন কথা বলত না প্রায় কারও সঙ্গে?
–কী করে বলব!
–ওয়াজ হি এ মেন্টাল পেশেন্ট?
পুলিশের জেরার পরে চিরঞ্জয় তার প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠেছে এতক্ষণে, বলল, আমি ঠিক বলতে পারব না। ও আজকাল খুব চুপচাপ থাকত। আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বলত না।
–কেন, তা কিছু অনুমান করতে পারো?
–না।
–গত কয়েকদিনে এমন কোনও ঘটনা কি ঘটেছিল যে কারণে দিব্যসারথি এমন একটা সাংঘাতিক ডিশিসন নিল? অন্তত তোমার চোখে কিছু পড়েছিল কি না!
–না।
–কোনও অস্বাভাবিকতা নয়?
গার্গীর মনে হচ্ছিল কিছু একটা চেপে যেতে চাইছে চিরঞ্জয়।
–বললাম তোর দেখিনি।
–পরশু একবারের জন্যও দেখা হয়নি?
–বললাম তো। কাল সকালে ওর ঘুম ভাঙার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম পিসিমার বাড়ি। ওর সঙ্গে কোনও একটা ক্লাসঘরে দেখা হয়েছিল দূর থেকে। না দেখা হওয়ারই মতন। তারপর ও ক্লাস করে কোথায় গিয়েছিল, কার সঙ্গে কাটিয়েছিল সন্ধেটা, কখন ফিরেছিল তার কিছুই জানা নেই আমার।
–তাহলে একটা কথা বলো। তুমি রুমমেট বলেই তোমার পক্ষে জানা সম্ভব হতে পারে বলেই জিজ্ঞাসা করছি। মানে তেমন কারও সঙ্গে ওর কোনও রিলেশন হয়েছিল কিছুদিনের মধ্যে?
চিরঞ্জয় বিষয়টা এড়াতে চাইল চকিতে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার তেমন কিছু জানা নেই।
–একেবারেই কি জানা নেই! রুমমেটের চোখে কিছু না কিছু ধরা পড়েই।
–বললাম তো ও খুব ইন্ট্রোভার্ট ধরনের ছিল
গার্গী তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাল, দেখো চিরঞ্জয়, পরশু রাতে তুমিই তার পাশের খাটে ঘুমিয়েছ। তুমি তাকে যতটা চেনো, এই হোস্টেলের আর কেউ চিনবে না। পুলিশ এই আনন্যাচারাল ডেথ নিয়ে একটা মামলা দায়ের করবে এর পর। তখন কোর্টে দাঁড়িয়ে তোমাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
কোর্টের নাম শুনে চিরঞ্জয়কে কিছুটা বিচলিত দেখা গেল, পট করে বলল, দিব্যসারথিকে চেনা ভারি শক্ত।
গার্গী এবার তার চোখ তীক্ষ্ণ করে, কেন এ কথা বললে?
–ও তো কারও সঙ্গেই মন খুলে কথা বলত না।
–কিন্তু বিকেলে এমন কোথায় যায় যার ফলে ওর ঘরে ফিরতে এত দেরি হয় রোজ?
চিরঞ্জয় ঘাড় ঝাঁকায়, জানি না।
–কার সঙ্গে সন্ধেটা কাটিয়ে আসে তা অনুমান করতে পারো?
–না। কী করে জানব কোথায় যায় সন্ধের পর!
গার্গী তার প্রশ্ন তীক্ষ্ণ করতে থাকে ক্রমশ, একই ঘরে থাকে, অথচ বলছে কিছুই জানে না এটাই ভারি আশ্চর্য লাগছে। নিশ্চয় চেপে যাচ্ছে চিরঞ্জয়।
–তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছিল এরকম প্রায়ই অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। তখন হোস্টেলের ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায়। কোথায় যেত সন্ধের পর!
–হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা নানা কাজে বাইরে যায়। কেউ তো কাউকে বলে যায় না। ও কোথায় যায় তা তো আমাকে বলে না!
–এ ছাড়া অন্য কোনও অস্বাভাবিকতা! গার্গী নির্দিষ্ট করে জানতে চাইল। চিরঞ্জয় চুপ করে থাকে।
–দ্যাখো, চিরঞ্জয়, আমাদের দৃঢ় ধারণা দিব্যসারথির মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তোমার সঙ্গে দিব্যসারথির এতদিন যে সম্পর্কই থাকুক, এখন আর সে বেঁচে নেই। এখন তোমার সবকিছু খুলে বলা উচিত। তুমিও কি চাও না তার মৃত্যুর রহস্য ভেদ হোক। যদি তুমি সব চেপে যেতে চাও, তাহলে রুমমেট হিসেবে প্রথমেই তোমার উপর আমাদের সন্দেহ
চিরঞ্জয় অনেকক্ষণ ইতস্তত করে, বোধহয় গার্গীর প্রশ্নাবলির চাপেই হঠাৎ বলে ফেলে, একটা কথা, কিছুদিন ধরে সবাই বলাবলি করছিল, ও নাকি মেয়েদের গায়ে-পড়া ধরনের হয়ে যাচ্ছিল। আজকাল মেয়েরা ওকে দেখলেই খুব সন্ত্রস্ত হত।
গার্গী অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি! মেয়েরা মানে তোমার ক্লাসমেটরা।
–আমরা সেটুকুই জানি।
গার্গী তৎক্ষণাৎ তার প্রশ্নবাণ তীক্ষ্ণ করতে থাকে, তাহলে এবার বলো তো, বিশেষ কারও গায়ে পড়ত কিনা তা জানো?
চিরঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, মাধুরী নামে একটি মেয়ে আছে, আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আর চিরঞ্জয় আবারও ইতস্তত করে, মাঝে মাঝে সন্ধের পর সুপারের বাড়ি যেত। আমাকে বলত সুপার বউদি ওকে মায়ের মতো ভালোবাসেন।
–তাই নাকি! গার্গী অনুভব করে দিব্যসারথির একটা গোপন ব্যথা ছিল তার মায়ের জন্য।
–ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ, চিরঞ্জয়। তোমার এই ক্লটাই অনেক কাজে লাগবে। এই কথাগুলো যদি প্রথমেই বলতে তাহলে তোমাকে এতক্ষণ বিরক্ত করতে হত না।
৭
এহেন একটা ছোট্ট কু পেতেই গার্গী তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাসা করতে চলে গেল মেয়েদের জটলায়। একটা জটলা নয়, মেয়েরা অনেকগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ফিসফিস করছে নিজেদের ভিতর। তারই মধ্যে কোন জটলায় মাধুরী আছে কায়দা করে সেই জটলাটা খুঁজে বার করে গার্গী চলে এল সেই দলটার সঙ্গে কথা বলতে।
গার্গীর পক্ষে মেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদ করা অনেক সুবিধের। গিয়ে একথা সে-কথা বলার পর চিনে ফেলে মাধুরী নামের মেয়েটিকে। নীল জিনসের উপর সাদা টপ। একটু বেশি স্বাস্থ্য ভালো ধরনের চেহারা। চোখের চশমায় অর্ধেক কাঁচ। বেশ উজ্জ্বল ধরনের চোখজোড়া। মেয়েটি মারাঠি। ওদের বাড়ি পুণে থেকে পানাজির পথে। মুম্বাইয়ের একটি ভালো স্কুলে পড়ত। চমৎকার ইংরেজি বলে। গার্গী তাকে চিহ্নিত করে তার সামনে দাঁড়ানো ঘন নীল শালোয়ার কামিজ পরা অন্য একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, দিব্যসারথিকে তো তোমরা সবাই চিনতে। নিশ্চয় তার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তোমরা সবাই অবাক। তাই না?
মেয়েরা সবই অবাঙালি। মারাঠি ধাঁচের মুখের সংখ্যাই বেশি। কিছু গুজরাটি, কিছু রাজস্থানি ধাঁচের। তারা নিজেদের মধ্যে চোখোচোখি করে বুঝতে চেষ্টা করে গার্গীর পরিচয় কী?
জোড়া জোড়া চোখে বিস্ময় উথলে উঠতে গার্গী তাদের মনের কথাও বুঝতে পারে পলকে, বলল, আমি দিব্যসারথির বাবার অফিস কলিগ। দিব্যসারথিকে আমি খুব ছোটবেলা থেকে চিনি। আমি চাইছি ওর মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে।
মেয়েরা তাকাতাকি করে, রহস্যভেদ!
-হ্যাঁ, আমাদের মনে হচ্ছে দিব্যসারথির মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। হঠাৎ একটি হবু ডাক্তার কেন এভাবে মারা গেল তা খুঁজে বার করাই আমার অভীষ্ট। এ বিষয়ে তোমাদের সহযোগিতা চাই।
মেয়েরা সমস্বরে বলল, নিশ্চয় সাহায্য করব।
–থ্যাঙ্ক ইউ, গার্গী তাদের সম্মতি পেতেই বলল তাহলে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করছি। তোমরা ঠিকঠিক জবাব দাও। তোমরা কি জানো ইদানীং দিব্যসারথির ব্যবহারে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছিল কি না?
–অস্বাভাবিকতা! গার্গীকে হোস্টেলের কেউই চেনে না। তবু তার পরিচয় পেয়ে মেয়েরা আমতা আমতা করে বলল, না। ঠিকই তো ছিল।
–আর ইউ শিওর ঠিকই ছিল। কিন্তু কেউ কেউ বলছে ঠিক ছিল না।
গার্গীর প্রশ্নে মেয়েরা চোখোচোখি করতে থাকে নিজেদের মধ্যে।
–লুক, ফ্রেন্ডস, গার্গী তাদের বোঝাতে থাকে, যেমন তোমরা বলতে পারবে কারও সঙ্গে কোনও রিলেশন গড়ার চেষ্টা করছিল কিনা! এই বয়সে অনেক সময় হয় যেমন–
রিটা কাপুর নামের একটি সুন্দরী মেয়ে এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমাদের জানা নেই।
–শিওর? কেউ জানো না?
সব ক’জন মেয়েই চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ একটা অদ্ভুত নীরবতা। মৃত্যুটা অস্বাভাবিক বলেই সবাই এড়াতে চাইছে প্রসঙ্গটা।
–কী অদ্ভুত! গার্গী প্রথম থেকেই দেখছে দিব্যসারথির ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে চাইছে না। তাকে আরও নির্দিষ্ট প্রশ্নে এগোতে হবে। অথবা এও হতে পারে এত ভিড়ের মধ্যে কেউ খুলতে চাইছে না প্যান্ডোরার বাক্সটা। সে ক্ষেত্রে আলাদা করে প্রশ্ন করতে হতে পারে। তবু অনেক প্রসঙ্গ ভিড়ের মধ্যেই ভালো জবাব আসে।
–ঠিক আছে, গার্গী এবার সরাসরি তার প্রশ্নে চলে এল, বলল, দেখো, আমি এখানে এসে শুনলাম দিব্যসারথি ইদানীং মেয়েদের গায়ে পড়া ধরনের হয়ে গিয়েছিল। মানে তেমন কোনও ঘটনা কি ঘটেছিল যাতে এরকম ধারণা হয়েছে ক্লাসমেটদের মধ্যে।
মাধুরী প্যাটেল নামের মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আপনাকে কে বলল?
গার্গী ম্লান হাসে, কেউ বলেছে নিশ্চয়ই। না বলে আমি এত অল্পক্ষণের মধ্যে জেনে ফেললাম কী ভাবে?
কয়েকটি বিস্মিত মুখ একে অপরের চাউনি বিনিময় করে নেয় মুহূর্তে। চট করে মিথ্যেটা মুখে এল না বোধহয়। গার্গী তাদের উসকে দিতে বলল, দেখো, মাধুরী, এরকম একটা ঘটনা ঘটতেই পারে এই বয়সে। তাতে লুকোনোর কিছু নেই। যে ছেলেটি আত্মহত্যা করার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার সম্পর্কে অনেক কথাই বেরোবে একটু একটু করে। পৃথিবীতে কোনও কথাই বেশিদিন গোপন থাকে না। কোনও না কোনও ভাবে জানা যায় না-বলা কথাগুলো। তার চেয়ে যদি তোমরা মুখ খোলো তাহলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধে হয় আমাদের
মাধুরী ইতস্তত করে বলল, নট সাচ ইমপট্যান্ট। একদিন বেড়াতে বেড়াতে আমরা ক’জন শিবাজিনগরে একটা পার্কে আমরা সবাই চানাবাটারা খেতে খেতে গোল হয়ে বসে গল্প করছি, হঠাৎ দিব্যসারথি আমার কোলে শুয়ে পড়ে বলল, তুই বেশ আমার মা। আমাকে একটু আদর করবি?
ভুরুতে ভাঁজ ফেলে গার্গী, আশ্চর্য হল, আবার হল না। বলল, তা তোমার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
নীল জিনসের উপর সাদা টপ পরা মেয়েটি–মাধুরী প্যাটেল থমকে গিয়ে বলল, নো রি-অ্যাকশন। দিব্য ওয়াজ আওয়ার ফ্রেন্ড। অনেকদিন ধরে ওকে চিনি। আস্তে আস্তে ওকে উঠিয়ে দিয়ে বললাম, তোর বাবাকে জিজ্ঞাসা করিস, কেন তিনি ছোটবেলায় তোর জন্য আর একটা মা এনে দেননি। তাহলে সেই মায়ের কোলে যতক্ষণ খুশি শুয়ে থাকতে পারতিস, আদর খেতে পারতিস।
–ওয়ান্ডারফুল! গার্গী মাধুরীর উপস্থিতবুদ্ধি দেখে খুবই বিস্মিত হল। মেয়েটি মেধাবী তা তার বুদ্ধিমত্তাই বলে দেয়। বিষয়টা অনুধাবন করে বলল, এনি মোর ইনসিডেন্স?
–নট সো সিগনিফিকেন্ট। সায়রা বানু নামের একটি ইউ পি-র মেয়ে বলল। মাধুরী ভুরু নাচিয়ে বলল, এই সায়রা, তুই কেন চেপে থাকতে চাইছিস! তোর ঘটনাটা বল না?
সায়রা বানুর পরনে নীল শিফনের শাড়ি। খুবই স্মার্ট মেয়ে।
-হ্যাঁ, তুমিই বলো, গার্গী সায়রার কাঁধে হাত রাখে।
সায়রা বানু অবশ্য বলতে চাইছিল না, তবু বন্ধুদের চাপাচাপিতে বলল, ওই আর কি, ওরকমই অভ্যেস ছিল ওর। আমাদের কারও না কারও গা ঘেঁষে বসার চেষ্টা করত।
–শুধু গা ঘেঁষে বসা! অন্য কোনও ইঙ্গিত?
–তার বেশি কিছু নয়। আসলে আমরা খেয়াল করতাম মেয়েদের শরীর ছুঁয়ে বসার চেষ্টা করত। হয়তো কেউ বসে আছে, তার কাঁধে মাথা রাখার চেষ্টা করত।
সায়রা বানুর কথার পৃষ্ঠে কথা বলল আর একটি তরুণী, তার নাম লায়লা। সবুজ শালোয়ার-কামিজের উপর লম্বা করে বিছোনো ওড়না। বলল, হ্যাঁ। আমার কোলেও একদিন শুয়ে পড়েছিল। তবে এগুলো কিছু নয়। আই ডিডনট মাইন্ড।
পিঙ্কি পান্ডে নামের একটি অতি-আধুনিকা, ঝলমলে স্কার্ট-ব্লাউজ পরা মেয়ে বেশ চোস্ত ইংরেজিতে বলল, ম্যাম, দিজ আর নট মাচ ইমপর্ট্যান্ট। আজকাল অনেক ছেলেই ইয়ার্কি করতে এমন করে। চুল টেনে ধরে, গালে টোকা দেয়। বাট দিজ আর পার্টস অফ দি লাইফ। তবে দিব্যসারথির ভঙ্গিটা একটু অন্যরকম। সেদিন যা করেছিল।
গার্গী চোখ তীক্ষ্ণ করে, কীরকম?
–ও কিছু না! পিঙ্কি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। মেয়েরা সবাই এ ওর দিকে তাকায়। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় কোনও রহস্যময় কারণে।
রায়তা নামের একটি ছোটখাটো চেহারার মেয়ে মুখ গম্ভীর করে বলল, নাথিং অফিসিয়াল। তার সঙ্গে দিব্যসারথির সুইসাইড করার কোনও সম্পর্ক নেই।
–তবু বলল, যদি কিছু কু পাওয়া যায়। গার্গী তাকে চাপ দিতে থাকে, তোমরা তো বেশ লিবারাল। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়লে এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সমাজটা বদলাচ্ছে কি না।
মেয়েরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়, ইয়েস, ম্যাম?
তাকে গোল হয়ে ঘিরে থাকা মেয়েদের দিকে চোখ রেখে গার্গী ব্যাখ্যা করে, আমাদের সময়ে অনেক কনজারভেটিভ ছিল সবাই। তুইলোকারি চলত। ব্যস, ওই পর্যন্ত। কোথাও একটা দেওয়াল তুলে রাখতে হত মেলামিশির মধ্যে। আর আমাদের বাবাদের আমলে তো মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের কথা বলাটাই ছিল ভারি দুঃসাহসের।
পিঙ্কি হেসে উঠে বলল, তেমন কিছু নয়। আসলে একদিন দিব্যসারথি আর আমি গল্প করছিলাম কলেজের বারান্দার সোফায় বসে। দিব্যসারথি হঠাৎ সোফার উপর শুয়ে আমার একটা হাত টেনে নিল তার চুলের মধ্যে। বলল, একটু বিলি কেটে দে না চুলে। মায়েরা যেমন বিলি কেটে দেয় ছেলেদের চুলে। আমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এরকম ওপেন জায়গা। কেউ দেখলে কী বলবে! কিন্তু ও কিছুতেই ছাড়বে না। হাতটা ধরে রেখেছে জোর করে। তারপর আমি অনেকক্ষণ ওর চুলে বিলি কেটে দিতে তবে ওর শান্তি।
গার্গী শুনে চমৎকৃত, বলল, অদ্ভুত কিন্তু।
–হ্যাঁ। অদ্ভুত বলেই বলছিলাম মনে হত ও একটা মেন্টাল পেশেন্ট।
–তোমাদের কি কারও মনে হয় সেই কারণেই কি ও সুইসাইড করল?
পিঙ্কি, লায়লা, মাধুরী সবাই এ ওর দিকে চোখ পাতে, একটু পরে বলল, বলা মুশকিল, ম্যাম।
গার্গী হঠাৎ এতগুলি মেয়ের জটলার দিকে গভীর চোখে তাকায়, হঠাৎই তাদের আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ওয়েল, তোমাদের কি কারও মনে হচ্ছে এটা সুইসাইড কেস নয়, মার্ডার!
–মার্ডার! মেয়েরা বেশ চমকে গেল। আবার এ ওর মুখের দিকে তাকাতাকি করে। মাধুরী বলল, কিন্তু সবাই জানে ও সুইসাইড করেছে।
–কিন্তু হঠৎ একটি তরুণ কোনও কারণ ছাড়াই কেন সুইসাইড করবে!
একটু জোর দিয়েই, তর্জনী নেড়ে গার্গী প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল ওদের মুখের উপর।
একঝাঁক তরুণী চুপ করে গেল সহসা। গার্গীর চেঁচিয়ে কথা বলাটা অবাক করল তাদের। গার্গী গলায় আবেগ মিশিয়ে বলল, ওয়েল, এখনও সময় আছে, তোমরা ওর সম্পর্কে যদি কিছু জানো তাহলে নির্ভয়ে বলো। তোমরা নিশ্চয় জানো দিব্যসারথি ওর বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। কেন এরকম নিষ্ঠুর একটা ঘটনা ঘটল তা জানা দরকার। ওর বডি মর্গে পাঠানো হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই জানা যাবে ওর মৃত্যুর কারণ। ওর বাবার বিশ্বাস ও সুইসাইড করেনি। মার্ডার করা হয়েছে।
–আপনি কী করে জানলেন ওকে মার্ডার করা হয়েছে। জটলায় উপস্থিত তরুণীরা একযোগে চেঁচিয়ে ওঠে, সবাই জানে ও ডিপ্রেশনে ভুগছিল বহু দিন ধরে। বলত, আমার কিছু ভালো লাগে না। বাবাকে বলে আমি হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে যাব।
–রাইট ইউ আর। কিন্তু হোস্টেলে ভর্তি হওয়ার এতদিন পরে কেন বলত তা ভেবে দেখতে হবে তো! পুণেয় তো দু-বছর হয়ে গেল ওর।
–বাট হি ওয়াজ এ মেন্টাল পেশেন্ট!
–বাহ, গার্গী হঠাৎ বলল, কেন ওকে বারবার মেন্টাল পেশেন্ট বলছ? ওর মধ্যে এমন কিছু কি দেখেছিলে যাতে মনে হতে পারে ওর মধ্যে মানসিক বিকৃতি দেখা গিয়েছিল?
–নো, ম্যাম, বাট–
–এই তো একটু আগেই তো তোমরা ওকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিলে। বললে তোমাদের সঙ্গে যা কিছু করেছে সবই পার্ট অফ দি লাইফ।
তরুণীরা চুপ করে থাকে। কী বলবে বুঝে পায় না।
–দেন হোয়াই আর উ টেলিং লাইক দ্যাট?
লায়লা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ম্যাম, তাহলে আসল কথাটা বলি। মেন্টাল পেশেন্ট টার্মটা আমরা বলিনি। ডা. দত্ত, মানে হোস্টেলের সুপারই মাঝেমধ্যে বলতেন আমাদের কাছে। মে বি ইট ওয়াজ দিব্য’স ফন্ট। হয়তো ওঁর বাড়ি গিয়ে দিব্য কিছু করত
–তাই নাকি? কী করত ওঁর বাড়িতে গিয়ে তা কি তোমরা জানো কেউ?
–নো, ম্যাম, মাধুরী মাথা ঝাঁকায়, আমরা কিছুই জানি না।
–কেউ জানো?
কেউ কথা বলে না। একে অপরের দিকে তাকায় শুধু।
-–আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে দিব্য যে ধরনের ব্যবহার করত, তা তো একটু আনইউজুয়াল, তাতে কি মনে হত দিব্যসারথি ওয়াজ এ মেন্টাল পেশেন্ট?
একটু ইতস্তত করে সবাই মাথা নাড়ে, না। তা মনে হয়নি।
–ও, তাহলে কি সুপার একাই বলতেন?
চুপ করে থাকে তরুণীর ঝাঁক।
–বাহ, একজন সুপারিটেন্ডেন্ট, তিনি একজন ডাক্তার, তিনি একটি তরুণ সম্পর্কে এরকম সিরিয়াস একটা কথা বলছেন, কোনও কারণ ছাড়াই, এটা তোমরাই বা মেনে নিয়েছিলে কেন? তোমরাও তো ডাক্তারি পড়ছ। তোমরা ম্যাচিওরড এনাফ।
–কী জানি, ওঁর বাড়িতে গিয়ে কী করতেন তা উনিই ভালো জানবেন।
–ডা. দত্ত কি মেডিসিনের ডাক্তার?
–নো, ম্যাম। ডা. দত্ত ইজ এ সার্জেন। সামহাউ হি হ্যাঁজ বিন গিভন দি চার্জ অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।
–হুঁ, গার্গী বিড়বিড় করে বলতে থাকে, যেন নিজের মনে ভাবছে কোনও জটিল তত্ত্ব, হুঁ, তোমরা তাহলে জানো না কেন দিব্যসারথিকে মেন্টাল পেশেন্ট বলছিলেন হোস্টেল সুপার! পরক্ষণে গার্গী তার স্বরে রূঢ়তা আনল, এটা কিন্তু তোমাদের পক্ষে খুব ডিসগ্রেস। একটি তরুণকে পাগল বললে তার মনের উপর খুব চাপ তৈরি হয় তা জানো নিশ্চয়। তোমরাও তো এক-একজন হবু ডাক্তার। তোমরা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি দেখবে না!
–আসলে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে কীরকম নাকি একটা সম্পর্ক ছিল শুনেছি। হয়তো সেই কারণেই বলতেন–
ঝাঁকের মধ্যে কেউ কথাটা বলতে গার্গী লাফিয়ে উঠল, কে বললে কথাটা?
সঙ্গে সঙ্গে মাধুরী বলে ওঠে, তুই কী করে জানলি, লায়লা?
সবাই লায়লার দিকে তাকায়। গার্গী মেয়েটিকে আলাদা করে বাছল, বলল, কাম অন, বলো দেখি কীরকম সম্পর্ক!
গার্গী যেন কীসের একটা গন্ধ পেয়ে লাফিয়ে পড়তে চাইল তক্ষুনি।
–তা জানি না। মিসেস সুপারই ভালো বলতে পারবেন।
লায়লা নামের মেয়েটি আবার বলল, কথায় বলে না রতনে রতন চেনে। সেরকমই বলতে পারা যায় পাগলে পাগল চেনে।
গার্গী চমকে উঠে বলল, তার মানে?
মেয়েরা চুপ মেরে যায় আবার। গার্গী একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল। হবু ডাক্তারনিরা সারাক্ষণই তার সামনে একটা মস্ত কিন্তু ঝুলিয়ে রাখছে। কিছুতেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করছে না। অতএব গাগহি স্পষ্ট করতে চাইল বিষয়টা, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, হোস্টেল সুপারও তোমাদের মতে পাগল, তাই তো!
সবাইয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসির একটা চোরাস্রোত বয়ে গেল পলকে।
–কিন্তু কেন এ কথা বললে?
গার্গী বেশ জোর দিয়ে কথাটা বলল।
–আসলে কী জানেন উনি নাকি খুব সন্দেহবাতিক।
গার্গী আবারও চমকে ওঠে, তাই নাকি? সন্দেহবাতিক। কিন্তু কেন?
তার প্রশ্নের উত্তর কেউ দিচ্ছে না দেখে গার্গী বাছল মাধরকে, মাধুরী, তুমিই বলল তো এ কথা বলার মানে কি? তোমরা তো নিশ্চয় জেনেশুনে এরকম একটা মন্তব্য করেছ?
মাধুরী তার অন্য বন্ধুদের দিকে ভৎর্সনার চোখে তাকায়, যেন তাদের আলগা মন্তব্যের দায় তাকেই কেন নিতে হবে! বলল, আমি তো সব জানি না। এখানে সবাই যা বলে তাই শুনে এসেছে হোস্টেলে ভরতি হওয়ার পর। লায়লা আরও ভালো জানে।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো, গার্গী লায়লাকে উৎসাহ দিতে থাকে, বলো তো কী শুনেছিলে?
–দেখুন, ম্যাম, শুনেছি ডা. দত্তের একসময় খুব নাম ছিল দক্ষ সার্জেন হিসেবে। কিন্তু এমনই কাজপাগল ছিলেন যে, দিনে রাতে কাজের ব্যস্ততায় স্ত্রীকে একেবারেই সময় দিতে পারতেন না।
–ইজ ইট! গার্গী সন্ধান পাচ্ছে এক অন্য পৃথিবীর। একটু আগেই দেখেছে বছর চল্লিশেক বয়স সেই সুপারগৃহিণীকে অঝোরে কাঁদতে। কেন কাঁদছিলেন তা স্পষ্ট হচ্ছে এবার।
লায়লা বলে চলে, অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে তার সুন্দরী স্ত্রী নাকি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন অন্য একজনের প্রতি। তাই নিয়ে তুমুল গোলোযোগ সংসারে।
–অদ্ভুত তো!
লায়লার কণ্ঠে সামান্য সংশয়, হয়তো ভাবছে এত সব কথা বলা ঠিক হচ্ছে কি না! কিন্তু এ সব তথ্য একবার বলা শুরু করলে আর থামা যায় না, তখনও সে বলে চলেছে, বাধ্য হয়ে সেখান থেকে ডাক্তার দত্ত বদলি নিয়ে চলে এসেছেন নতুন হাসপাতালে। নিজে থেকেই অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বের চাকরি–হোস্টেল সুপারের কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
–অ্যান্ড দেন?
–তারপর কি তা তো আপনি নিজে চোখেই দেখছেন।
বেশ কিছুক্ষণ জেরা করেও এর বেশি মুখ খুলতে চাইল না ওরা কেউ। গার্গীর মনে তখন এক গভীর খটকা। হোস্টেল সুপারের বাড়িতে কেন যেত দিব্যসারথি তা কী করে জানা যাবে! বেশ জোরাজোরি করেও দিব্যসারথির ক্লাসমেটদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি জানা গেল না। কিন্তু তাকে তো আরও কিছু খবর সংগ্রহ করতে হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে গার্গী চলে এল তার পরবর্তী কার্যক্রমে।
৮
ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে, পুলিশের প্রাথমিক কাজ শেষ হলে দিব্যসারথির বড়ি চলে গেল তার গন্তব্যে। দেবদত্তবাবুর মুখের দিকে চোখ রাখা যাচ্ছিল না। তাঁর একমাত্র অবলম্বনও পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে শূন্য হয়ে গেল তাঁর মন। কান্নায় ভেঙে পড়তে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইল গার্গী। তবু বুঝল এই শোকের কোনও সান্ত্বনা নেই। কিছুক্ষণ তাঁকে কাঁদতে দিয়ে হালকা হতে দেওয়াই প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
মনটা ভারী হয়ে গেল গার্গীর। কিছু মানুষের জীবনে এমন শোক নেমে আসে যা সহ্য করাই কঠিন। কিছুক্ষণ দেবদত্তবাবুর কথা ভেবে সে নিবিষ্ট হল একটু আগেই শোনা হোস্টেল সুপারের কথায়। হোস্টেল সুপার বলছিলেন ছেলেমেয়েগুলো এক একটা কাণ্ড বাধাবে আর তার ঝক্কি নিতে হবে সুপারকে। কথাটা সত্যি, কেন না হোস্টেল সুপারই তো এতগুলি তরুণ-তরুণীর লোকাল গাজেন। ছেলেমেয়েদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁর উপরই।
কিছুক্ষণের মধ্যে হোস্টেল চত্বর খালি হতে শুরু করে। পুলিশও তাদের তল্পি বেঁধে রওনা হবে এর পর। পুলিশ চলে গেলে আজকের মতো উত্তেজনা প্রায় শেষ। গার্গী তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল হোস্টেল সুপারকে। এর ওর কাছে খবর নিয়ে জানল ডা. প্রাংশু দত্ত মানুষটি নিঃসন্তান, মধ্যবয়স্ক ডাক্তার প্রশাসক হিসেবে একটু পাগলাটে ধরনের তা হোস্টেলের বোর্ডারদের দেওয়া তথ্য থেকে জেনেছে। সেই ডাঃ দত্ত তখন তার কোয়ারের দিকে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে গার্গী শরণাপন্ন হল পুলিশ অফিসারের। ইনস্পেক্টার ভোঁসলে তখন তাঁর বাহিনীকে হুকুম দিচ্ছেন সবাইকে নিয়ে পুণে থানায় ফিরে যেতে। গার্গী সামান্য নাভাস বোধ করল থানার বাহিনীকে ফিরে যাচ্ছে দেখে। তাঁকে ডেকে বলল, মি, ভোঁসলে, নতুন কোনও তথ্য পেলেন যা থেকে এই দুর্ঘটনার কারণ কিছু অনুমান করা যায়?
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আগে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে পাই, তারপর ইনভেস্টিগেশনের বাকি পর্বে এগোব।
–ও, গার্গীর মনঃপূত হল না কথাটা, তার আগে আপনি কি হোস্টেল সুপারকে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে তেমন গুরুত্ব দিলেন না গার্গীর কথায়, বললেন, করেছি। ওঁকে খুব ডিস্টার্বড় দেখলাম। একজন ছাত্রের আত্মহত্যা নিয়ে এখন তো ওঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। খবরের কাগজ, টিভির লোকেরা নাকি ফোনাফোনি করছেন এর মধ্যে।
–হ্যাঁ, তা তো হবেই। ওঁকে অনেক জবাবদিহি করতে হবে এখন। কিন্তু একটা খবর কি আপনারা পেয়েছেন দিব্যসারথি ওঁর কোয়ার্টারে প্রায় রোজই সন্ধেয় থাকত!
–সে তো প্রথমেই শুনেছি। ডা, দত্ত বললেন ওঁর স্ত্রীর কাছে আসত দিব্যসারথি।
–দিব্যসারথি কালও সন্ধেয় ওঁর বাড়িতে গিয়েছিল তা জানেন আপনারা?
–তাও তো শুনলাম। তারপর রাতে হোস্টেলে ফিরেই সুইসাইড করে।
–ইনস্পেক্টার ভোঁসলে, আপনাদের কি স্থির বিশ্বাস দিব্যসারথি সুইসাইড করেছে?
–ইয়েস, এখনও পর্যন্ত তাই মনে করছি। তবে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যদি অন্য কথা বলে তখন নতুন করে ভাবব বিষয়টা।
প্লিজ, মি. ভোঁসলে, এ বিষয়ে হোস্টেল সুপারের কোনও বক্তব্য যদি আর একবার নেন!
–গট ইট ডান অলরেডি, মিসেস চৌধুরি, উনি তেমন কিছু লক্ষ্য করেননি। ওঁর স্ত্রীও কিছু বলতে পারলেন না। শুধু কাঁদছেন হাউহাউ করে। আপনি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলেছেন?
গার্গী এতক্ষণে বলল, না। ডা. দত্ত তো আমাকে একেবারেই পছন্দ করছেন না। আমি ওঁকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনারা কেউ যদি আমার পাশে থাকেন। না হলে আমার ধারণা উনি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইবেন।
ইনস্পেক্টার ভোসলেও সন্তুষ্ট হলেন না গার্গীর কথায়, বললেন, আমরা প্রত্যেককে যথেষ্ট জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সবই রেকর্ড করা আছে আমার খাতায়।
–তবু আমার কয়েকটি জিজ্ঞাস্য আছে। মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে।
মি. ভোসলের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গার্গী চলে এল হোস্টেল সুপার ডাঃ প্রাংশু দত্তের কাছে। ডাঃ দত্তকে পাওয়া গেল হোস্টেলে দিব্যসারথিদের ঘরে। তিনি কী যেন তন্নতন্ন করে খুঁজছেন ঘরের মধ্যে।
তাঁকে দেখেই গার্গী জিজ্ঞাসা করে, কী খুঁজছেন, ডাক্তার দত্ত? খুবই উত্তেজিত আছেন ডা. প্রাংশু দত্ত। গার্গীকে দেখে কপালে ভাঁজ, বললেন আপনি কে? আবার কী কারণে এসেছেন এখানে?
–ডা. দত্ত, এই যে দেবদত্তবাবু, মানে দিব্যসারথির বাবা আমার কলিগ। ভদ্রলোক খুবই ভেঙে পড়েছেন তার একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে তাই কেন তার এই আত্মহত্যা তা জানার চেষ্টা করছি আমরা। ডাঃ দত্ত, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল। শুনলাম পরশু রাতেও আপনি অন্যান্য দিনের মতো হোস্টেলে এসেছিলেন ভিজিট করতে।
হোস্টেল সুপার খুব সন্তুষ্ট হলেন না গার্গীর অনাবশ্যক কৌতূহলে, রুখে উঠে বললেন হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
কাল রাতে আপনি যখন এসেছিলেন তখন দিব্যসারথি কি ফিরেছিল তার রুমে? ডাঃ দত্ত, মাথা কঁকালেন, ফিরেছিল বইকি। না হলে আমার নজরে ঠিক পড়ত।
গার্গী পরক্ষণে আরও একটু ঝাঁকুনি দিতে বলল, দেখুন ডাঃ দত্ত, কাল সন্ধের পর দিব্যসারথি আপনার কোয়ারে গিয়েছিল এ কথা হোস্টেলের অনেকেই জানে।
উত্তেজনায় ফুটছিলেন ডাঃ দত্ত, গার্গীর জেরায় হঠাৎ ফেটে পড়লেন রাগে, তার মুখ চোখে আগুনের ফুলকি, কে বলেছে আপনাকে? কই নাম বলুন তো?
গার্গী সুর নরম করল, যায়নি বুঝি! কিন্তু অনেকেই দেখেছে পরশু রাতে আপনিই দিব্যসারথিকে নিয়ে হোস্টেলে ফিরেছেন। তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আপনিই।
ডাঃ দত্ত একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, কে বলেছে, চিরঞ্জয়? চিরঞ্জয় তো তখন ঘুমোচ্ছিল।
–না। অন্য অনেক বোর্ডার দেখেছে।
–কে বলেছে? তার নাম বলুন?
গার্গী মাথা ঠান্ডা রাখে, নাম না-ই বা বললাম। ঘটনাটা সত্যি কি না বলুন?
-তাতে কাজ হল? ডাঃ দত্ত এবার প্রবলভাবে বেঁকে উঠে বললেন, যদি তাই হয়েই থাকে, তাতে কার কী?
–বাট, ডা. দত্ত, কারও কিছু না এলেও দেবদত্তবাবুর আসে যায়। আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন দিব্যসারথি আপনার কোয়ার্টারে প্রায়ই যেত সন্ধের পর।
–হু টোল্ড ইউ? হু ইজ দ্যাট ফেলো?
–হু এভার ইট মে বি, গার্গী আস্তে আস্তে বলতে থাকে, যেই বলে থাকুক, আমার কানে এসেছে। কিন্তু ও যখন আসত, আপনি তখন কোয়াটারে থাকতেন না। তাই ব্যাপারটা আপনার পছন্দের ছিল না, তাই না?
ডাঃ দত্ত বলে ফেললেন, একজ্যাক্টলি, পছন্দ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
হ্যাঁ, এবার আপনারা সবাই শুনুন, গার্গী খুবই সাহসের সঙ্গে বলে ফেলল, আপনার অনুপস্থিতিতে দিব্যসারথি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করুক তা আপনি চাননি। আপনি আসলে খুব সন্দেহবাতিক। আপনি বারণ করা সত্ত্বেও দিব্যসারথি এ বাড়িতে আসা বন্ধ করছিল না। তারই ফলে দিব্যসারথিকে প্রাণ দিতে হল কাল রাতে।
–হোয়াট? ডাঃ দত্ত লাফিয়ে উঠে বললেন, কী বলতে চাইছেন আপনি?
–দেখুন, ডা. দত্ত, খুব স্পষ্ট করে বলতে চাইছি আপনি পরশু রাতে দিব্যসারথিকে নিয়ে হোস্টেলে আসেন। আসার আগেই তার শরীরে কোনওভাবে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন। তার প্রভাবে সে হোস্টেলে ফেরা মাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর আপনি খুবই নিপুণ হাতে তার হাতের শিরা কেটে দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরে যান। যেভাবে ওর দুই হাতের শিরা কাটা হয়েছে তা কোনও দক্ষ সার্জেনের পক্ষেই সম্ভব। ওর নিজের পক্ষে তো নয়ই, ওর কোনও সহপাঠীর পক্ষেও সম্ভব নয়।
–ইমপসিবল। আপনি কোত্থেকে কিছু গাঁজাখুরি গল্প চালাতে চাইছেন আমার নামে। ডাঃ দত্ত গর্জে ওঠেন।
গার্গী গম্ভীর হয়ে বলল, গল্পটা তৈরি করতে পুণেয় এসে বেশ কয়েকজনকে ইন্টারোগেট করতে হল, ডাঃ দত্ত। আপনার স্ত্রী খুবই রূপসী। সেই কারণে দিব্যসারথির সঙ্গে তার সম্পর্কটা আপনার সহ্য হয়নি। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না দিব্যসারথি খুব অল্প বয়সে মাকে হারায়। মায়ের স্নেহের উপর তার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। তার সহপাঠিনীদের সঙ্গেও সে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করত যাতে তার সহপাঠিনীদেরও ভুল বোঝার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ওর সহপাঠিনীরা ওকে বুঝত বলেই মেনে নিত ওর এই শিশুসুলভ ব্যবহার। সেই একই কারণে আপনার স্ত্রীরও প্রশ্রয় পেয়ে সেখানেই মায়ের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করত দিব্যসারথি। আপনি ভুল সন্দেহ করে এরকম একটা গর্হিত কাজ করলেন, ডাঃ দত্ত। আমি নিশ্চিত দিব্যসারথির পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে লেখা থাকবে তার হাতের শিরা কাটার আগে তার শরীরে কোনও সিডেটিভ প্রয়োগ করা হয়েছিল। যে তরুণ হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করবে, তার পক্ষে সিডেটিভ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ঝুঁকিটা বাস্তোবোচিত নয়। তাই না, ডাঃ দত্ত?
উত্তর দিলেন না ডা, প্রাংশু দত্ত, তার নীরবতাই বুঝিয়ে দেয় উপস্থিত সবাইকে, গার্গী যা-যা বলছে তা মেনে নিচ্ছেন অভিজ্ঞ ডাক্তার।
গার্গীর চোখেমুখে সাফল্যের আলো, অতঃপর ইনস্পেক্টার ভোঁসলের দিকে তাকিয়ে বলল, ইনস্পেক্টর ভোঁসলে, আপনি নিশ্চয় বিষয়টা অদ্যোপান্ত বুঝেছেন। অতএব গোটা বিষয়টা আবার নতুনভাবে ভাবতে হবে আপনাকে। দিব্যসারথি হত্যাকাণ্ডের মূল অপরাধ ইনি, ডা. প্রাংশু দত্ত, এই মুহূর্তে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। উনি একটু আগেই এ-ঘরে ঢুকেছিলেন দিব্যসারথির লেখা সুইসাইডাল নোটটির খোঁজে। কিন্তু পাচ্ছেন না বলে মাথার চুল ছিঁড়ছেন এখন।
–রাইট, ইনস্পেক্টার ভোঁসলেও সচকিত হয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন, আমিও অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছি কাগজটা। কোথায় যে গেল!
গার্গী এতক্ষণে থমথমে মুখে বলল, কোথাও যায়নি। আমিই সরিয়ে রেখেছিলাম পাছে ডা. দত্ত ওটা সরিয়ে ফেলেন। এই নিন কাগজটা–
ভাঁজ করা চিরকুটটা ইনস্পেক্টার ভোঁসলের হাতে দিয়ে গার্গী তার উপসংহার টানে, বলল, এই চিরকুটের হস্তলিপি ডাঃ দত্তর। উনিই লিখে রেখেছিলেন দিব্যসারথির হয়ে যে, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। প্রমাণ লুকোতে এই কাগজটা সরিয়ে ফেলতে চাইছিলেন এখন। তাই এতক্ষণ হাঁকপাক করছিলেন এ-ঘরে ঢুকে।
ইনস্পেক্টার ভোঁসলে খুবই বিস্মিত গার্গী যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপিত করল সামান্য সময়ের মধ্যে। তাঁর কপালের ভাজ দেখে বোঝা যাচ্ছিল তিনি তখনও ধন্দে।
সায়ন সকাল থেকে গার্গীর তদন্তের কাজ দেখছিল দূর থেকে। হঠাৎ পটভূমিতে সায়নের আবিভাব। সবকিছু দেখে শুনে সেও হতবাক, গার্গীকে উদ্দেশ করে বলল, এর মধ্যেই তোমার কাজ শেষ।
গার্গী হতাশ কণ্ঠে বলল, যে কাজে এসেছিলাম তা শেষ। অপরাধী শনাক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু পুপুকে তত আর ফেরানো যাবে না।