হুঁশিয়ার

হুঁশিয়ার

যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা, ভীষণ লম্বা, ভীষণ কালো একটা লোক গলাবন্ধ কালো কোট পরে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পিছনে আরও অনেক লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কোন পা জোড়া তার বুঝে নিতে আমার একটু সময় লাগল। শেষটা টের পেলাম খুব সরু, খুব নোমওয়ালা, আর খুব কালো ঠ্যাং দুটো ওর। তায় আবার একজোড়া দাঁত-বেরকরা ছেঁড়া চটি পরা, তার ফুটো দিয়ে নোংরা বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে। 

এই লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আস্তে আস্তে আমার কানের মধ্যে থেকে তার গোঁফটাকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, মনিব্যাগটা আরেকটু খামচে ধরুন, যা চোর-চামারের উপদ্রব! লোকটার কথাগুলো যেন কতদূর থেকে এল, কীরকম একটা হালকা ফিসফিস আওয়াজ। তার চোখ দুটোও যেন আর কিছুতেই গর্তের মধ্যে থাকছিল না, একেবারে বেরিয়ে এসে আমার মনিব্যাগের ভিতরের খোপের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিল।

সবাই এক জনের পিছনে এক জন দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে শেয়ালদা স্টেশনের ইন্টার ক্লাস টিকিটঘরের দিকে এগোচ্ছিলাম। খুব সাবধানে, কারণ একটু এক পাশেসরলেই ধাক্কার চোটে লাইন থেকে বেরিয়ে পড়বার ভয়। এমনি করে যখন খাঁচার ভিতরে বেশ কালোকালো মেমসাহেবের কাছে পৌঁছোলাম, তখনও টের পাচ্ছিলাম, পিছনে সেই লোকটার ফোঁসফোঁস নিশ্বাস আর আস্তে আস্তে গোঁফ নাড়া।

লোকটা দেখলাম আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। মেমসাহেবকে যখন টাকা দিলাম লোকটা ঝুঁকে ব্যাগের মধ্যে দেখতে দেখতে বলল–চেঞ্জ গুনে নেবেন, বেটিরা ভারি হঁচড়। মেম রেগে এ-গাল থেকে ও-গালে চুইংগামটা ঠুসে দিয়ে বলল– চোপরাও বাবু। তারপর লোকটা আমাকে সেইরকম যত্ন করে উপদেশ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে নিয়ে চলল। একটা কলার খোসা আর কী যেন খানিকটা খুব কসরত করে এড়িয়ে বলল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। সবাই সবারটা গিলবার ফিকিরে আছে। গেটের কাছে চেকারবাবু চিকিৎ চিকিৎকরে টিকিট হেঁটে দিলে পর আমার সঙ্গে সঙ্গে সেও প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বলল–এই যে গাড়ি–অবিশ্যি সেটা বলবার কিছু দরকার ছিল না।

আমার সঙ্গে একটা ইন্টার ক্লাস গাড়িতে ঢুকে আমার পাশে বসে বলল- জিনিসপত্র আগলে রাখুন, সুটকেসটা দূরে রাখবেন না, নিজের সিটের তলায় রাখাই ভালো। এটা জেনে রাখবেন শিয়ালদা স্টেশন চোর-বাটপাড়ের আড়ত। তারপর আমরা দুজনেই জুতো খুলে পা তুলে আরাম করে বসলে পর বলতে লাগল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। আমি নিজে যতগুলো চোর-জোচ্চর দেখেছি সবগুলোকে একটার পেছনে একটা দাঁড় করালে এখান থেকে বোলপুর স্টেশন অবধি লম্বা একটা লাইন হয়। একথা শুনে আমি অবাক হলাম।

তখন সে আরও বলতে লাগল, আর ছিচকে চুরির জন্য তারা যে অধ্যবসায়, ধৈর্য ও বুদ্ধি দেখিয়েছে, ভালো কাজে যদি লাগাত এতদিনে ভারতবর্ষ উদ্ধার হয়ে যেত।

তারপর তার কালো কোটের পকেট থেকে একটা চারকোনা পানের ডিবে বের করে বলল গিরিডির মতন সভ্য শহরে, যে জায়গা সজ্জনের বাস বলে বিখ্যাত এমন শহরে, সেবার পুজোর সময়ে সচ্চিদানন্দ জ্যাঠামশাইয়ের পাজামা সুটের ইজের গা থেকে খুলে চোরে নিয়ে চলে গেল, এর বেশি আর কী বলা যায়!

আমি নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগলাম। আর সে গোটা দুই পান মুখে পুরে, একটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বলে যেতে লাগল– গরমের জন্য বাইরে মাদুর পেতে, তায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ মাথায়, চাদর গায়, পায়ের কাছে চটি, বালিশের নীচে হাতঘড়ি, মাথার কাছে জলের গেলাশ নিয়ে, ভগবানের নাম নিয়ে রোজকার মতন শুয়ে পড়েছেন। আর সকালে উঠে দেখেন কিনা চটি নেই, গেলাশ নেই, বালিশ নেই, হাতঘড়ি নেই, এমনকী পরনের ইজেরটা পর্যন্ত কখন যেন আস্তে আস্তে খুলে নিয়েছে!

তখন সে বলল–কাউকে মশাই বিশ্বাস করা যায়? অরুণবাবু ট্রেনে করে আসছেন। সেকেন কেলাস গাড়ি, সঙ্গে উঠলেন দিব্যি খাকি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁট পরা বাঙালি সাহেব। ক্যায়সা ভাব জমে গেল দেখতে দেখতে। ইনি ওঁর বিস্কুট খেলেন, আবার উনি এঁর সিগারেট টানলেন। তারপর মুড়ি-সুড়ি দিয়ে দু-জনে ঘুম। সকালে উঠে অরুণবাবু দেখলেন বাঙালি সাহেবও নেই, তার জিনিসপত্রও নেই, আর অরুণবাবুর সুটকেশও নেই।

আমি একবার আমার সুটকেস ও পুঁটলিটা দেখে নিয়ে ঠ্যাং বদলে বসলাম। আর সে বাইরে এঁদো পুকুরে ধোপাদের কাপড় কাঁচা দেখতে দেখতে নীচু গলায় বলতে লাগল।

ছোটোবেলায় পাড়াগাঁয়ে পিসিমার কাছে থাকতাম। গ্রামের একধারে বাঁশঝাড়ের কাছে খড়ের চালের বাড়ি। যেই-না সন্ধ্যে হওয়া আর অমনি বাড়ির আর উঠোনের আনাচে-কানাচে ভয়ভীতিরা ভিড় করে আসত। বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা খসার শব্দ থেকে আরম্ভ করে আমাদের মেনি বেড়ালটারকাঁক করেইঁদুর ধরার আওয়াজটা পর্যন্ত সূর্য ডোবার পর কেমন যেন অন্যরকম লাগত। আরপিসিমা শোবার আগে প্রত্যেক ঘরের প্রত্যেকটা খিল ভালো করে দেখে নিতেন, বাক্স প্যাটরার উপর নানানভাবে ঘণ্টা বাসন সব এমন করে সাজিয়ে রাখতেন যাতে একটু সরালেই সব দুমদাম পড়ে আমাদের কেন, পাড়ার অন্য লোকদেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এইসব করতে করতে পিদ্দিমের তেলটুকু পুড়ে যেত আর আলো নিবে যেত। পিসিমাও অমনি খচমচ করে বিছানায় ঢুকতেন। মাঝে মাঝে ওঁর ঠান্ডা খড়খড়ে পা আমার পায়ে লেগে যেত, আমি শিউরে উঠতাম। শুয়েই আবার পিসিমার মনে হত–কী হবে, খাটের তলা দেখা হয়নি, যদি কোনো ধূর্ত চোর ছোরা-হাতে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে! আমাকে বলতেন–এই, তোর একটা মার্বেল খাটের তলা দিয়ে গড়িয়ে দে না, ওদিক দিয়ে বেরোলে বুঝব খাটের তলায় কেউ নেই।ভয়ে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যেত, পিসিমা যা বলতেন তাই করতাম। একবার খাটের পায়ায় মার্বেল আটকে গেল, আর সারারাত পিসিমা আর আমি জেগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। আর কখনো যদি পিসিমা আগে শুতেন আর আমাকে অন্ধকারে পরে শুতে হত, খাটের তিন হাত দূর থেকে এক লাফ মেরে খাটে উঠে পড়তাম, যাতে খাটের তলায় লুকিয়েবসা বদমায়েশটা তার ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার ঠ্যাং ধরে টেনে নিতে না পারে। একদিন হিসেব ভুল হওয়াতে পিসিমার পেটের উপরল্যান্ড করেছিলাম, আর পিসিমা আমার কানটান মলে বার বার বলতে লাগলেন যে উনি পষ্ট টের পাচ্ছেন ওঁর নাড়িভুঁড়ি সব এলিয়ে গেছে!

এতটা বলে লোকটা এক বার আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল–ছোটোবেলা থেকে এমনি আমার ট্রেনিং যে কোনো শা–র চোরও আমার কাছ থেকে কানাকড়িও পায়নি! এই দেখুন নোটের তাড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছি!

এই অবধি বলেই হঠাৎ সে এদিক-ওদিক চেয়ে সটাং শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগল। গাড়িতে আর যে দু-চারজন ছিল তারাও সবাই একসঙ্গে নেমে গেল। আর আমিও আমার যে দু-একটা কাজ ছিল সেরে নিয়ে অন্য এক বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম ও একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর হয়ে এসেছে, চোখ ঘষে উঠে দেখি আমার সঙ্গীটি কখন জানি নেমে গেছে। তার কথা মনে উঠতেই আর তার চোরের ভয় মনে করতেই বেজায় হাসি পেল। ঠিক এই সময় চোখে পড়ল বেঞ্চির তলায় আমার সুটকেস, পুটলি ও চটি কিচ্ছু নেই। আছে কেবল তার সেই দাঁত বের করা ছেঁড়া চটি জোড়া!

ভীষণ রাগ হল। ভণ্ড, জোচ্চর, বকধার্মিক কোথাকার! রাগের চোটে হঠাৎ নিজের ট্র্যাকের উপর হাত পড়ে গেল। ট্র্যাক খুলে দেখলাম, কাল রাত্রে লোকটা ঘুমিয়ে পড়বার পর তার বুকপকেট থেকে যে নোটের তাড়াটা সরিয়েছিলাম আমার সুটকেস্ ইত্যাদি চুরি যেতে পারে কিন্তু সেটি ঠিকই আছে।

বেশ একটু খুশি মনে আবার শুয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *