হিটলারের শেষ দশ দিবস
ঠিক কুড়ি বৎসর আগে, ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে তিনটের অল্প পূর্বে হিটলার তার অ্যার-রেড় শেল্টার (বুঙ্কার মাটির গভীরে কন্ক্রিটের পঞ্চাশ ফুট ছাতের নিচের আশ্রয়স্থল কামানের বা প্লেন থেকে ফেলা গেলা বুঙ্কারের গর্ভ পর্যন্ত কিছুতেই পৌঁছতে পারে না) থেকে বেরিয়ে করিডোরে এলেন। সঙ্গে তার নবপরিণীতা বধূ এফা, প্রায় পনের বৎসরের বন্ধুত্বের (হিটলারের শেষ উইলে তিনি এই শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। বস্তুত নিতান্ত অন্তরঙ্গ কয়েকজন অনুচর ভিন্ন দেশের-দশের লোক জানত না যে হিটলার ও এফার মধ্যে সম্পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রীর) পর তিনি প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে এঁকে বিয়ে করেছেন। করিডরে গ্যোবে, বরমান প্রভৃতি প্রায় পনেরোজন তাঁর নিকটতম মন্ত্রী, সেক্রেটারি, সেনাপতি, স্টেনো, খাস অনুচর-চাকর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হিটলার ও এফা নীরবে একে একে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তার পর নিতান্ত যে কজনের প্রয়োজন তারা করিডরে রইলেন– বাদ-বাকিদের বিদায় দেওয়া হল। হিটলার ও এফা খাস কামরায় ঢুকলেন। অনুচররা বাইরে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে একটিমাত্র পিস্তল ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল। অনুচররা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন- তারা ভেবেছিলেন দুটো শব্দ হবে। সেটা যখন শোনা গেল না তখন তারা কামরার ভিতরে ঢুকলেন। সেখানে দেখতে পেলেন, তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছেন, কিংবা পড়ে আছেনও বলা যেতে পারে। তার খুলি, মুখ এবং যে সোফাটিতে তিনি বসেছিলেন সব রক্তাক্ত। কেউ কেউ বলেন, তিনি মুখের ভিতরে পিস্তল পুরে আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ বলেন, কপালের ভিতর দিয়ে গুলি চালিয়ে। তার কাঁধে এফার মাথা হেলে পড়েছে। এফার কাছেও মাটিতে একটি ছোট পিস্তল। কিন্তু তিনি সেটা ব্যবহার করেননি। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
তার পর কুড়িটি বৎসর কেটে গেলে পর ইয়োরোপের অনেক ভাষাতেই সেদিনের স্মরণে ও তার সপ্তাহখানেক পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার উপলক্ষে বহু প্রবন্ধ বেরিয়েছে।
আমার কাছে আসে প্রধানত জমনি, অস্ট্রিয়া ও সুইটজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত জর্মন ভাষায় লিখিত সাপ্তাহিক। এগুলোর আসতে প্রায় দুমাস সময় লাগে। অ্যার-মেল হওয়ার ফলে বুকপোষ্ট, ছাপা-মাল যে কী জঘন্য শম্বুক গতিতে আসে সেকথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
হিটলারের মৃত্যুর পর তার সাঙ্গোপাঙ্গ অন্তর্ধান করেন। কেউ কেউ ধরা পড়েন রাশানদের হাতে। তার মধ্যে হিটলারের খাস চাকর (ভ্যালে) লিঙেও ছিলেন। কেউ কেউ লুকিয়ে থাকেন মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি অধিকৃত এলাকায়। এরাও ধরা পড়েন, প্রধানত মার্কিনদের দ্বারা। আর কারও কারও কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। যেমন বরমান ইত্যাদি কয়েকজন। এঁদের কে কে পালাবার সময় হত হন বা পালাতে সক্ষম হন জানা যায়নি।
গোড়ায়, অর্থাৎ হিটলারের মৃত্যুর কয়েকদিন পর রুশ জঙ্গিলাট জুকফ প্রচার করেন যে, হিটলার এফা ব্রাউনকে বিয়ে করার পর আত্মহত্যা করেন। এদিকে মস্কোতে বসে স্তালিন বলেন, হিটলার মরেননি, তিনি ডিকটেটর ফ্রাঙ্কোর আশ্রয়ে স্পেনে আছেন (স্তালিনের মতলব ছিল এই অছিলায় ইয়োরোপের শেষ ফ্যাশি ডিটেটর ফ্রাঙ্কোকে খতম করা)। এমনকি কোনও কোনও উচ্চস্থলে একথাও বলা হল যে, ইংরেজ(!) তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ইংরেজকে তখন বাধ্য হয়ে পাকাপাকি তদন্ত করতে হয় যে হিটলার সত্যই বুঙ্কার থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি না, কিংবা তিনি মারা গিয়েছেন কি না। এ কাজের ভার দেওয়া হয় ইতিহাসের অধ্যাপক, যুদ্ধকালীন গুপ্তচর বিভাগের উচ্চ কর্মচারী ট্রেভার রোপারকে।
তিনি তাদেরই সন্ধানে বেরুলেন যারা হিটলারের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন। এদের কয়েকজন হিটলারের মৃত্যু, দাহ, অস্থি-সমাধি পুবানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেন। কিন্তু বুঙ্কার ও তৎসংলগ্ন ভূমি তখন রাশানদের অধিকারে (পূর্ব বার্লিনে); তারা সেখানে অধ্যাপককে কোনও অনুসন্ধান করতে দিল না। হিটলারের যেসব সাঙ্গোপাঙ্গ রাশানদের হাতে ধরা পড়েন তারা যেসব জবানবন্দি দেন সেগুলোও অধ্যাপককে জানানো হল না।
হিটলারের মৃত্যুর সাত মাস পরে ট্রেলার রোপার তাঁর রিপোর্ট সরকারের হাতে দেন ও সেটি প্রকাশিত হয়। এর পর আরও তথ্য উদঘাটিত হয় বটে, কিন্তু অধ্যাপক তার ময়না-তদন্তে যে বর্ণনাটি দেন তার বিশেষ কোনও রদ-বদল করার প্রয়োজন হয়নি। এসব মিলিয়ে ট্রেভার রোপার সর্বসাধারণের জন্য একখানি পুস্তিকা রচনা করে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত করেন। তার নাম লাস্ট ডেজ অব হিটলার।
এ পুস্তিকা ইয়োরোপের প্রায় সর্ব ভাষাতেই অনূদিত হয়, এবং তার যুক্তিতর্ক এমনই অকাট্য যে, জনসাধারণ হিটলারের মৃত্যু সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়। ওদিকে সরকারি রাশান মত–হিটলার মারা যাননি।–তাই লৌহ-যবনিকার অন্তরালে বইখানি নিষিদ্ধ বলে আইনজারি করা হল।
কিন্তু শেষটায় রাশানদের স্বীকার করতে হল যে, হিটলার জীবিত নেই। কাশীরাম দাস পূর্বেই বলে গেছেন :
কতক্ষণ জলের তিলক থাকে ভালে
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যেতে মারিলে।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্তালিনকে প্রায় সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সৃষ্টিকর্তার আসনে তুলে দি ফ অব বার্লিন ফিলম রাশাতে তৈরি হল। এ ছবি এদেশেও এসেছিল। এতে হিটলারের মৃত্যু যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেটা মোটামুটি ট্রেভার রোপারের বর্ণনাই। মাত্র একটি বিষয়ে তফাত। ছবিতে দেখানো হয়েছে হিটলার বিষ খেয়ে মরলেন– অথচ হিটলার যে পিস্তল ব্যবহার করেছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই পরিবর্তনের কারণ কী তাই নিয়ে অধ্যাপক তার পুস্তকের পরবর্তী সংস্করণে সবিস্তর আলোচনা করেছেন- এ স্থলে সেটা নিষ্প্রয়োজন। অধিকাংশ পণ্ডিতের বিশ্বাস to make assurance doubly sure হিটলার বিষের পিলে কামড় ও পিস্তলের গুলি ছোড়ন একইসঙ্গে।
রুশদেশে দশ বছর জেল খাটার পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের কয়েকজন পার্শ্বচর মুক্তি পান। তার ভিতর একজন হিটলারের ভ্যালে লিঙে। ইনি বেরিয়ে এসেই দীর্ঘ একটি বিবৃতি দেন। এদেশের অমৃতবাজার পত্রিকায়ও সেটি ধারাবাহিক বেরোয়। অন্যজন হিটলারের অ্যাডজুটান্ট গুশে। ইনি ও লিঙে যেসব বিবৃতি দিলেন, সেগুলোর সঙ্গে অধ্যাপকের বইয়ে গরমিল অতি কম, এবং তা-ও খুঁটিনাটি নিয়ে।
***
আমি প্রথম জমনি যাই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। হিটলার তখনও গোটা জর্মনিতে সুপরিচিত হননি। তার কর্মস্থল ও খ্যাতি প্রধানত ছিল মনিক অঞ্চলে। তার পর আমার চোখের সামনেই তিনি রাইটাগে (জর্মন পার্লিমেন্টে) তার দলের ক্ষমতা অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ালেন। ১৯৩২-এ আমি দেশে ফিরে এলুম। ৩৩-এ হিটলার জনির চ্যানসেলর প্রধানমন্ত্রী, প্রধান কর্মকর্তা হলেন। ১৯৩৪-এ আমি আবার প্রায় এক বছর জর্মনিতে ছিলুম। তখন হিটলার কীভাবে রাজ্যশাসন করেন সেটি পুরোপুরি দেখলুম। ১৯৩৮-এ আমি আবার জৰ্মনিতে চার মাস কাটালুম। চেম্বারলেন তখন হিটলারের কাছে যাবার জন্য তোড়জোড় করছেন। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল। বিশ্বযুদ্ধের পর আমি হিটলার ও তার রাজ্যশাসন (থার্ড রাইষ একেই বলা হয়, এবং হিটলার সদম্ভে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তৃতীয় রাইষ, এক হাজার বছর স্থায়ী হবে–কিন্তু তার আয়ুষ্কাল হল মাত্র বারো বছর তিন মাস!) সম্বন্ধে শত শত বই কিনি। জর্মন, মার্কিন, ফরাসি, ইংরেজ ইত্যাদির লেখা। এদের সকলেই হয় হিটলারের পক্ষে না হয় বিপক্ষে ছিলেন। আমাকে নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে। যুদ্ধের পরও আমি দু-বার জর্মনি ঘুরে আসি।
এস্থলে হিটলারের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার দম্ভ আমার নেই। উপরের কয়েক ছত্র থেকে পাঠক শুধু যেন বুঝতে পারেন আমার মিত্ররা কেন আমাকে হিটলার সম্বন্ধে প্রামাণিক পুস্তক লিখতে বলেন। আমার সেই বাসনা ছিল, কিন্তু এখন দেখছি সেটা আর হয়ে উঠবে না। তাই যেটুকু পারি সেইটুকু এইবেলা লিখে নিই।
অনেক সময় পাঠকের ধৈর্য কম থাকে বলে তিনি উপন্যাসের শেষ অধ্যায়টি পড়ে নেন। আমি শেষ অধ্যায়ই সর্বপ্রথম লিখব। পটভূমি– অর্থাৎ প্রথম বাইশ বা বত্রিশ অধ্যায় নির্মাণ করব কয়েকটি ছত্রে।
.
১৯৩৩-এ হিটলার চ্যান্সেলর হলেন। ১৯৩৪-এ জর্মনির প্রেসিডেন্ট হিডেনবুর্গ মারা গেলে তিনি সে আসনটিও দখল করে দেশের ফুরার বা একাধিপতি নেতা হন। পালিমেন্টের আর কোনও স্বাধীনতা রইল না। ১৯৩৮-এ হিটলার স্বাধীন অস্ট্রিয়া রাজ্য (তার আপন জন্মভূমি ওই দেশেই) দখল করে বৃহত্তর রাইষের অংশ করে নিলেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই তিনি চেকোশ্লোভাকিয়ার জন-ভাষাভাষী অঞ্চল গ্রাস করতে চাইলে, শান্তিভঙ্গের ভয়ে ভীত ইংলন্ডের চেম্বারলেন ও ফ্রান্সের দালাদিয়ে সে অঞ্চলটুকু তাকে লিখিত-পঠিতভাবে দান করলেন। কয়েক মাস পরে হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়ার যে অঞ্চল তিনি স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন সেইটুকুও কাউকে কিছু না বলে-কয়ে গ্রাস করলেন। তখন চেম্বারলেনের কানে জল গেল– সে-ও পূর্ণমাত্রায় নয়। ১৯৩৯-এ হিটলার পোলাডের ভেতর দিয়ে জর্মন পূর্ব প্রাণী সংযুক্ত করার মানসে পোলান্ড রাজ্যের কাছে করিডর এবং অন্যান্য এটা-সেটা দাবি করলেন। ইংলন্ড আবার মধ্যস্থ হতে চাইল, কিন্তু হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন। ইতঃপূর্বেই জর্মন তথা বিশ্ববাসীকে সচকিত শঙ্কিত করে তিনি তার জাতশত্রু স্তালিনের সঙ্গে চুক্তি করে পোলান্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। ইংলন্ড ও ফ্রান্স তখন উত্তেজিত জনমতের চাপে পড়ে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল কিন্তু পোলান্ডকে কোনও সাহায্য পাঠাতে পারার পূর্বেই পোলান্ড হেরে গেল।
তার এক বৎসর পর ১৯৪০-এর গ্রীষ্মকালে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করে অত্যল্প সময়েই তাকে পরাজিত করলেন। ফ্রান্সে আগত ইংরেজ বাহিনী প্রাণ নিয়ে কোনও গতিতে স্বদেশে ফিরে গেল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র সাজসরঞ্জাম সবকিছু ডানকার্ক বন্দরে ফেলে যেতে হল।
হিটলার ইংরেজকে বললেন, আর কেন? সন্ধি করো? ইংরেজ বলল, না, তোমাকে খতম করব।
হিটলার তখন বিরাট নৌবহর নিয়ে ইংলন্ড আক্রমণের তোড়জোড় করলেন, কিন্তু শেষটায় দেখা গেল অভিযান নিষ্কল হলেও হতে পারে। হিটলার সে চিন্তা বর্জন করলেন।
তার চিরকালের বাসনা ছিল রুশ জয় করে বিজিত অংশে জন চাষি-মজুর বসিয়ে কলোনি নির্মাণ করা।(১) ১৯৪১-এর গ্রীষ্মে তিনি রাশা আক্রমণ করলেন ও রুশ সৈন্য পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে লাগল। হিটলারবাহিনী মস্কোর দোরের গোড়ায় পৌঁছল। কিন্তু হিটলারের কপাল মন্দ। অসময়ে নেমে এল প্রচণ্ড শীত, বরফ আর বৃষ্টি। পরের বৎসর হিটলার-সৈন্য অভিযান করল ককেশাসের তেল দখল করতে। সেখানে স্তালিনগ্রাদে জর্মনরা খেল তাদের প্রথম মোক্ষম মার। ওদিকে হিটলারের মিত্র জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করার ফলে আমেরিকাও যুদ্ধে নামল। মার্কিনদের একদল গেল জাপানদের হারাতে; অন্য দল ইংরেজসহ উত্তর আফ্রিকায়। সেখানে রমেল প্রায় মিশর আক্রমণ করে সুয়েজ দখল করতে যাচ্ছিলেন। মার্কিন-ইংরেজ সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা দখল করে নামল জর্মনমিত্র মুসসোলিনির মুল্লুক ইতালিতে।
ওদিকে ১৯৪৪-এ রুশ বিপুল বিক্রমে জর্মনদের আক্রমণ করে বিজিত রাশা থেকে তাদের খেদিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেল পোলাভে তার পর জর্মন সীমান্তে। এদিকে ১৯৪৪-এর গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার জাহাজ নিয়ে মার্কিন-ইংরেজ নামল পশ্চিম ফ্রান্সের নরমাভি উপকূলে (হিটলার যে নৌ-অভিযান করতে সাহস পাননি এরা সেটাই উল্টোদিক থেকে করল)। হিটলার সমুদ্র উপকূলে প্রচুর রক্ষণ ব্যবস্থা করেছিলেন সেনাপতিদের মধ্যে রমেলও ছিলেন কিন্তু দুশমনকে ঠেকাতে পারলেন না। তারা ফ্রান্স জয় করে ১৯৪৫-এর শীতকালে জনি ঢুকে, রাইন নদ অতিক্রম করে বার্লিনের কিছু দূরে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কারণ স্তালিনের সঙ্গে মার্কিন-ইংরেজের চুক্তি ছিল, রুশরা প্রথম বার্লিন প্রবেশ করবে। রুশরা বার্লিনের পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে। এবার তারা বার্লিন আক্রমণ করবে। এটা এপ্রিলের মাঝামাঝি–১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। আর কয়েক দিন পরেই হিটলারের জন্মদিন ২০ এপ্রিল।
.
২০ এপ্রিল। আজ ফুরারের জন্মদিন। তিনি কি জানতেন, দশ দিন পর তাকে নিজের হাতে নিজের জীবন নিতে হবে না; কারণ ২৯ এপ্রিল রাত্রেও তিনি জেনারেল ভেংকের খবর নিচ্ছেন; তিনি কবে পর্যন্ত চতুর্দিকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ বার্লিন থেকে তাকে উদ্ধার করবেন। আবার ২০ এপ্রিলে ফিরে যাই।
হিটলারের আমির-ওমরাহ, সেনাপতি-জাদরেল, সাঙ্গোপাঙ্গ সেদিন সবাই জন্মদিন উপলক্ষে বুঙ্কারে উপস্থিত হয়েছেন। এদের প্রায় সকলেই মনে মনে জানতেন, ফুরারের সঙ্গে এই তাদের শেষ দেখা, কারণ রাশানরা তখন বার্লিনের প্রায় চতুর্দিকে বৃত্তাকারে ন্যূহ নির্মাণ করে ফেলেছে। যে প্রভুকে তাঁরা কেউ ১২ বছর, কেউ ২০ বছর ধরে সেবা করেছেন এবং হিটলার চ্যাসেলর হওয়ার পর ধনজন-খ্যাতি-খেতাব সবকিছুই তার অকৃপণ হস্ত থেকে পেয়েছেন তাকে তখন ত্যাগ করতে তাদের আর তর সইছে না। কারণ রাশান-বৃহ পরিপূর্ণ চক্রাকার ধারণ করার পর তারা আর বেরুতে পারবেন না। তদুপরি বার্লিনের আরও দক্ষিণে রুশ-সেনাবাহিনীর আরেক বৃহৎ অংশ রাষ্ট্রের প্রায় মাঝখানে এসেছে; মার্কিন-ইংরেজ পশ্চিম থেকে পূর্ব পানে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুই সৈন্যদল হাত মেলালে পর রাইষ দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। ২০ এপ্রিলে তারা তখনও হাত মেলায়নি-দক্ষিণ জনি পৌঁছবার জন্য তখনও একটি করিডর খোলা। বেশিরভাগই দক্ষিণ জর্মনি যেতে চান। সেখানেই নাৎসি আন্দোলনের জন্মভূমি স্যুনিক শহর; তার কাছেই হিটলারের আবাসভূমি বেহ বেটেশগাডে অঞ্চলে, আলপসের উপরে। সকলেরই বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত হিটলার ওই পর্বতসঙ্কুল গিরি-উপত্যকার গোলকধাঁধাতে এসে তারই সাহায্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য দুশমনের সঙ্গে লড়ে যাবেন–
কারণ হিটলার একাদিক্রমে বার বার তার সহচরদের বলেছেন : আপনারা নিশ্চিন্তু থাকুন, এই যে রুশ, মার্কিন, ইংরেজ মৈত্রী এটা কিছুতেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এদের আদর্শ স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন। দুই সৈন্যদল মুখোমুখি হতেই এই কোয়ালিশন (মৈত্রী) ভেঙে পড়বে। ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের বিরুদ্ধে ঠিক এইরকমই কোয়ালিশন হয়েছিল। তিনিও নিরুপায় হয়ে যখন আত্মহত্যার চিন্তা করছেন, ঠিক সেই সময় কোয়ালিশনের অন্যতম প্রধান নেত্রী রাশার মহারানি মারা গেলেন। রাশানরা বাড়ি ফিরে গেল; সঙ্গে সঙ্গে কোয়ালিশন খানখান হয়ে গেল। জনি লুপ্তগৌরব ফিরে পেল এবং উচ্চতর শিখরে আরোহণ করল।
বুঙ্কারের খাস কামরায় নৌসেনাপতি ড্যোনিস, জেনারেল কাইটেল, জেনারেল ইয়োডলের কাছ থেকে হিটলার একজন একজন করে জন্মদিনের অভিনন্দন গ্রহণ করলেন। বাদবাকিরা– গ্যোরিঙ, রিবেট্রপ, হিমলার (হিটলার এরই মারফত আইষমানকে ইহুদি-হননে নিযুক্ত করেন), গ্যোবেলু, বরমান ইত্যাদির সঙ্গে করমর্দন করলেন। তার মুখে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাস। তিনি দৃঢ়নিশ্চয়, বার্লিন মহানগরের সামনে রাশানরা পাবে তাদের চূড়ান্ত পরাজয়। ভাগ্যবিধাতাই শুধু জানেন, এইসব অপদার্থ চাটুকারদের কজন হিটলারের এই অন্ধবিশ্বাসে অংশীদার ছিলেন। কারণ এরা সবাই জানতেন, প্রায় সপ্তাহখানেক পূর্বে রাশার জারিনার (মহারানির) মতো প্রেসিডেন্ট রোজভেন্ট মারা গিয়েছেন, কিন্তু মার্কিন সৈন্যদল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেনি।
হিটলার আগের থেকেই জনিকে উত্তর দক্ষিণ দু ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিলেন। এখন আদেশ দিলেন, বার্লিনে যাদের নিতান্তই কোনও প্রয়োজন নেই তারা হয় উত্তর, নয় দক্ষিণ পানে চলে যাবেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আমির-ওমরাহ দক্ষিণ ভাগে চললেন– বিরাট বিরাট লরিতে করে দফতরের কাগজপত্র বোঝাই করে, এবং তার চেয়েও বড় কথা– আপন আপন ধন-দৌলত বোঝাই করে। পড়ে রইল বার্লিনের অসহায় লক্ষ লক্ষ নরনারী। আর রইলেন খাঁটি প্রভুভক্ত গ্যোবেলস, ক্ষমতালোভী সেক্রেটারি বরমান হিটলারের গরবে তিনি গরবিনী; দূরে চলে গেলে সে শক্তি পাবেন কোথা থেকে? বাদবাকিদের অধিকাংশের সঙ্গে হিটলারের আর দেখা হয়নি। তার দুই প্রধান সেনাপতি কাইটেল আর ইয়োডল গেলেন বার্লিনের উপকণ্ঠে, সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে; নৌসেনাপতি চলে গেলেন উত্তর-পশ্চিম সমুদ্র-পারে, তার হেডকোয়ার্টার্সে।
সবাই করজোড়ে হিটলারকে নিবেদন করলেন, আর কয়েকদিনের মধ্যেই রুশ সৈন্য বার্লিনের চতুর্দিকে ব্যহ স্থাপন করে ফেলবে। ফুরার তা হলে আর দক্ষিণে যেতে পারবেন না। যুদ্ধচালনার হুকুম-নির্দেশ তা হলে দেবে কে? হিটলার কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করতে পারছেন না। অবশ্য একথা সবাই জানতেন, একবার মনস্থির করার পর হিটলার অচল অটল হয়ে রইতেন।
তার পর হিটলার হুকুম দিলেন, বার্লিনে ও বার্লিনের চতুর্দিকে যেসব সৈন্য রয়েছে তারা যেন সবাই একত্র হয়ে একজোটে সব ট্যাংক, সব জঙ্গিবিমান নিয়ে বার্লিনের দক্ষিণভাগে রুশসৈন্যদের আক্রমণ করে। হিটলার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোনও সেনাধ্যক্ষ যদি তার সৈন্যকে সম্মুখযুদ্ধে না পাঠায় তবে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সে বাঁচবে না। জঙ্গিবিমানের সেনাপতি কলারকে বললেন, তোমার মাথার দিব্যি, কোনও সৈন্য যদি রণাঙ্গনে না যায়…। এস্থলে মাথার দিব্যি অর্থ হিটলার তার মুণ্ডুটির ভেতর দিয়ে পিস্তলের গুলি চালাবার হুকুম দেবেন।
কিন্তু হায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে হিটলারের হুকুমের কোনও সাদৃশ্য তখন আর ছিল না। মাসের পর মাস ধরে তার আমির-ওমরাহ তাঁর কাছে সত্য গোপন করে চলেছেন। যারা সত্য গোপন করেননি, তাঁদের মধ্যে যারা অশেষ ভাগ্যবান, তারা সুদ্ধ অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে বরখাস্ত হয়েছেন, অন্যরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, কারাগারে ফাঁসি যাচ্ছেন বা হিটলারের বাসসেনানীর চাবুকে চাবুকে জর্জরিত হচ্ছেন। সত্য গোপন করে হিটলারকে বলা হয়নি, ব্যাটালিয়ানের পর ব্যাটালিয়ান যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে যেখানে হিটলার ভেবেছেন পুরো ডিভিশন রয়েছে, সেখানে তার এক-দশমাংশ আছে কি না সন্দেহ, তিনজন সেপাইয়ে মিলে রয়েছে একটা বন্দুক, টোটার সংখ্যা এতই সীমাবদ্ধ যে শত্রু দশবার গুলি ছুড়লে এরা একবার; হিটলার জানতেন যে জঙ্গিবিমানের পেট্রল কমে আসছে, কিন্তু তারই অভাবে যে শত শত অ্যারোপ্লেন মাটিতেই শত্রুর বোমারু দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে তার পুরো খবর তাকে দেওয়া হয়নি।
বুঙ্কারের কনফারেন্স রুমে টেবিলের উপর বিরাট জঙ্গি ম্যাপ খুলে হিটলার তার কাল্পনিক সৈন্যবাহিনী, ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি লাল-নীল রঙিন বোতামের প্রতীক দিয়ে সাজাচ্ছেন আর কোন জায়গা থেকে কোন সৈন্যদল কোথায় কার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোন জায়গায় আক্রমণ করবে তার হুকুম দিচ্ছেন। এসব সেনাপতিদের এমনকি কোনও কোনও স্থলে কর্নেলদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার কথা– এ সমস্ত তিনি তুলে নিয়েছেন আপন স্কন্ধে। হুকুম দিচ্ছেন মাটির নিচের বুঙ্কারে বসে। যুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন ইংরেজ বোমারু, জঙ্গিবিমান জর্মানির আকাশে একচ্ছত্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং দিন নেই, রাত্রি নেই বেধড়ক বোমা ফেলে ফেলে বার্লিন শহরটাকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। হিটলার একদিনের তরে, একঘন্টারও তরে সরেজমিন অবস্থা তদন্ত করতে বেরোননি। পাছে বাস্তবতা তার অনুপ্রেরণাকে ব্যাহত করে। পক্ষান্তরে যুদ্ধের গোড়ার দিকে জর্মন বোমারু যখন লন্ডন লণ্ডভণ্ড করছিল তখন প্রায়ই দেখা যেত, বিরাট সিগার মুখে চার্চিল সেসব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর জনসাধারণকে দুঃখের দিনে উৎসাহ দিচ্ছেন– আর তারাও বলছে, আসুক না তারা, আমরাও আছি– গুড ওল্ড উইনি।(২)
বুঙ্কারে হিটলারের জীবনের শেষ কদিন সম্বন্ধে যারা লিখেছেন তারা অনেক ক্ষেত্রে সময় ও তারিখে ভুল করেছেন। কারণটি অতিশয় সরল। দিনের পর দিন এরা বিজলি বাতিতে কাজ করেছেন মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত কিছুই দেখতে পাননি। তারিখ ঠিক থাকবে কী করে? মাঝে মাঝে তারা প্রায় ভিরমি যেতেন। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস কলের সাহায্যে বুঙ্কারে ঠেলে দেওয়া হত। কিন্তু বোমাবর্ষণের ফলে বাইরের আকাশে মাঝে মাঝে এত ধুলোবালি জমে যেত যে কল সেগুলোও বুঙ্কারের ভিতর পাঠাত। বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণের জন্য কল বন্ধ করে দিতে হত। ফলে অক্সিজেনের অভাবে সবাই নিরুদ্ধনিম্বাস। বুঙ্কারের ভিতরকার অনৈসর্গিক দৃষিত বাতাবরণের দৈহিক ও মানসিক উভয়ই সর্বোত্তম বর্ণনা দিয়েছেন হার বলুট, একখানা চটি বইয়ে। ট্রেভার তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেছেন। অমূল্য চটি বইখানার অনুবাদ নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু সেটি আমার চোখে পড়েনি আমি উপকৃত হয়েছি বলে পাঠককে পড়তে বলছি। শুনেছি, বইখানা নাকি দক্ষিণ আমেরিকায় আইষমানের লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়, এবং ক্রোধোন্মত্ত আইষমান নাকি মার্জিনে লিখেছেন- ব্যাটাকে যদি একবার পেতুম!(৩)
পূর্বোল্লিখিত আক্রমণের যে আদেশ হিটলার তার জন্মদিনের পরের দিন, ২১ এপ্রিল দিলেন তার সেনাপতি নিযুক্ত হলেন স্টাইনার।
পরের দিন সকালবেলা (হিটলার শুতে যেতেন ভোরের দিকে আর উঠতেন দুপুরের দিকে। শেষের দিকে দুর্ভাবনা আর ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুন শুতে যেতেন আরও দেরিতে, উঠতেনও তাড়াতাড়ি, তিন ঘণ্টারও বেশি ঘুম হত না) থেকে হিটলার স্বয়ং এবং তার হুকুমে অন্যরা চতুর্দিকে ফোন করতে লাগলেন, স্টাইনারের আক্রমণ কতদূর এগিয়েছে। কেউই কোনও পাকা খবর দিতে পারে না। যেটুকু আসছে তা-ও পরস্পরবিরোধী; একবার স্বয়ং হিটলার বললেন তিনি অবশ্য অকুস্থল থেকে দূরে আক্রমণ চলছে; তার পরমুহূর্তেই অন্য সূত্র থেকে খবর এল আক্রমণ আদপেই আরম্ভ হয়নি। এমনকি স্টাইনার স্বয়ং যে কোথায় তা-ও কেউ সঠিক বলতে পারে না। যে জেনারেল কলারের মুণ্ডুর ভিতর গিয়ে গরম বুলেট চালিয়ে দেবার ভয় দেখানো হয়েছিল তিনি তাঁর রোজনামচায় সেই ধুন্ধুমারের বর্ণনা লিখেছেন–এবং সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিকেল তিনটে পর্যন্ত কোনও খবর নেই। তার পর নিত্যিকার প্রথামতো মন্ত্রণা-সভা বসল। উপস্থিত ছিলেন ফুরার, দুই জেনারেল কাইটেল (হিটলারের পরেই তিনি) ও তার পরে জন ইয়োডল; এবং আরও দুই সেনাপতি বুৰ্গডফ (পাঁড়মাতাল) ও ক্রেবস্– শেষের দুজন সদাসর্বদা হিটলারের পাশের বুঙ্কারে বাস করতেন ও বলতে গেলে হিটলারের লিয়েজোঁ অফিসার ছিলেন এবং হিটলারের সেক্রেটারি বরমান।(৪)
সেই ঐতিহাসিক মন্ত্রণাসভায় হিটলার-রাইষের শেষ হাঁড়ি ফাটল।
স্টাইনার-আক্রমণ আদৌ ঘটেনি। একখানি বোমারু বা জঙ্গিবিমানও আকাশে ওঠেনি। হিটলারের পুত্থানুপুঙ্খ প্ল্যান, মুণ্ডু দিয়ে বুলেট চালানোর বিভীষিকা প্রদর্শন– সব ভণ্ডুল, সব নস্যাৎ!
তার জীবনে এই প্রথমবারের মতো হিটলার পরাজয় স্বীকার করলেন।
হিটলারের মেজাজটি ছিল আগুনে গড়া। দুঃসংবাদ পেলেই তিনি চিৎকার করে উঠতেন কর্কশ কঠে, চিল্কারে চিল্কারে তার গলা কেটে যেত, পায়চারি না- ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত সবেগে ছুটোছুটি আরম্ভ করতেন, মুখ দিয়ে ফেনা ফেরুতে আরম্ভ করত, এবং চোখদুটো যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইত। প্রধান প্রধান সেনাপতিদের মুখের সামনে ঘুষি বাগিয়ে কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক পর্যন্ত বলতে কসুর করতেন না। বেদরদীরা বলে, তিনি শেষ পর্যন্ত মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে দিতে কার্পেট চিবুতে আরম্ভ করতেন তাই তারা তার নামকরণ করে কার্পেটভুক। তবে সত্যের খাতিরে বলা ভালো, হিটলারের শত্রু-মিত্র কোনও ঐতিহাসিকই এটা বিশ্বাস করেননি।
এবারে শুধু যে তাই হল নয়, এবার চিৎকার, হুঙ্কার, বেপথুর পর তিনি নির্জীবের মতো চেয়ারে বসে স্বীকার করলেন, এই শেষ। কুশের তুলনায় জর্মন জাতি হীনবল, নির্বীর্য, অপদার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার মতো লোককে তাদের ফুরাররূপে পাবার গৌরব ও সামর্থ্য তারা ধরে না। তার মনে আর কোনও দ্বিধা নেই, তিনি দক্ষিণ জর্মনি গিয়ে আপসের গিরি-উপত্যকার গুহাগরে যুদ্ধ চালাবেন না– তৃতীয় রাষ্ট্র বন্ধ্যা সপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তিনি বার্লিনেই থাকবেন। সম্মুখযুদ্ধ করার মতো শারীরিক শক্তি তার আর নেই বলে রুশরা বার্লিন প্রবেশ করলে তিনি বার্লিনের রাস্তায় বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিতে পারবেন না। তিনি তখন আত্মহত্যা করবেন।
একথা সত্য, হিটলারের শরীরে তখন আর কিছু নেই।
হিটলারের অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসেলবাখ বলেন, ১৯৩৯ পর্যন্ত হিটলারকে তাঁর বয়সের তুলনায় (তখন তিনি ৫০) অনেক কম দেখাত। ওই সময় থেকে তিনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বুড়োতে লাগলেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত ভার যা সত্যকার বয়স তাই দেখাত। ১৯৪৩-এর (স্তালিগ্রাদের পরাজয়ের পর তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্য যে একেবারে ভেঙে পড়ে তার জন্য অংশত তার হাতুড়ে ডাক্তার মরেলই দায়ী হিটলারকে যেসব গণ্যমান্য চিকিৎসক পরীক্ষা করেছেন, কিংবা সাময়িকভাবে চিকিৎসা করেছেন তারা সকলে একবাক্যে এ সত্যটি বলে গেছেন। হিটলার কার্যক্ষম থাকবার জন্যে সামান্যতম সর্দিকাশিতে পর্যন্ত তিনি ভয় পেতেন, এবং আসার লক্ষণ দেখতে পেলেই অবিচারে ইনজেকশন নিতেন– মরেলের কাছ থেকে উত্তেজনাদায়ক ওষুধ চাইতেন। মরেলও অবিচারে এমন সব ওষুধ আর ইনজেকশন দিতেন যেগুলো দিত সাময়িক উত্তেজনা কিন্তু আখেরে করত স্বাস্থ্যের অশেষ ক্ষতি। বুঙ্কারে সাময়িকভাবে থাকাকালীন অন্য এক ডাক্তার দৈবযোগে হিটলারের চাকর লিঙের ড্রয়ারে এসব ওষুধ প্রচুর পরিমাণে পান ও বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওগুলোতে মারাত্মক বিষ রয়েছে, যেগুলো অতি অল্প ডোজে কঠিন ব্যামোতে দেওয়া হয়। অথচ মরেল ওগুলো লিঙেকে দিয়ে রেখেছিলেন, হুজুর যাতে যখন খুশি, যত খুশি ওইসব ট্যাবলেট খেতে পারেন।(৫)
আর ইনজেকশনের তো কথাই নেই : লেকচার দিতে হলে পূর্বে ইনজেকশন, পরে ইনজেকশন। প্রকৃতি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ হতে সাহায্য করে; মরল বা হিটলার সে সাহায্য নিতে চাইতেন না। ফলে প্রকৃতির প্রতিশোধও শেষ বয়সে নির্মমভাবে তার প্রাপ্য নেয়।
ডাভাররা যখন হিটলারকে এ তথ্যটি বললেন, তখন তিনি রেগে টং। মরেলের ওপর না, ডাক্তারদের ওপর।
হিটলার তাদের অকথ্য অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। তার বক্তব্য, মরেলের কড়ে আঙুলের যত এলেম, এদের গুষ্টির সবকটার মগজেও তা নেই।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫ সালে বলট মিলিটারি রিপোর্ট দিতে গিয়ে তাকে জীবনের প্রথমবারের মতো কাছের থেকে দেখেন। হিটলার অনেকখানি কুঁজো হয়ে, বাঁ-পা হেঁচড়ে টেনে আনতে আনতে আমার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করতে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মর্দনের সময় নির্জীব হাত কোনও চাপ দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন তার চোখে এক অবর্ণনীয় কাঁপা-কাঁপা জ্যোতি(৬) সম্পূর্ণ অনৈসর্গিক এবং ভীতিজনক। তার বা-হাত নিস্তেজ হয়ে ঝুলে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তার মাথাও অল্প অল্প দুলছে। তার মুখ ও বিশেষ করে চোখের চতুর্দিকে দেখলে মনে হয় যেন এগুলোর সব শেষ হয়ে গেছে। সবসুদ্ধ মিলিয়ে মনে হয়, লোকটি অতিশয় বৃদ্ধ।(৭)…অন্যরা বলেছেন, নানারকমের বিষাক্ত ওষুধ খেয়ে খেয়ে তার চামড়ার রঙ বিবর্ণ পাটে হয়ে গিয়েছিল। তার বাঁ-হাত এত বেশি কাপত যে চেয়ারের হাতা বা টেবিল তিনি সে হাত দিয়ে চেপে ধরতেন; দাঁড়ানো অবস্থায় দু-হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে ডান-হাত দিয়ে বাঁ-হাত চেপে ধরে রাখতেন।… বল্টু হিটলারের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে আবার তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি আরও কুঁজো হয়ে গিয়েছেন, আরও পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে এগোন। সমস্ত চেহারাটা মৃত। সবসুদ্ধ শীর্ণ-জীর্ণ বিকৃত-মস্তিষ্ক অতি বৃদ্ধের মূর্তি। চোখেও সেই অস্বাভাবিক জ্যোতি আর নেই।
হিটলার যখন দৃঢ়কণ্ঠে বার্লিনেই মৃত্যুবরণের শপথ গ্রহণ করলেন তখন সকলেই একবাক্যে আপত্তি জানিয়ে বললেন, নিরাশ হবার মতো কিছুই নেই। দক্ষিণ জর্মনি ও উত্তর ইতালিতে, বোহেমিয়া অঞ্চলে ও অন্যত্র এখনও অনেক অক্ষত সৈন্যবাহিনী রয়েছে। হিটলার যদি দক্ষিণ জর্মনির গিরি-উপত্যকায় তাদের জড়ো করেন তবে আরও অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে।
হিটলার অচল অটল। তার হুকুমে পরের দিন বার্লিন বেতার প্রচার করল, হিটলার, গোবে ও পার্টির কর্মকর্তাগণ বার্লিন ত্যাগ করবেন না, ফুরার স্বয়ং বার্লিন রক্ষা করবেন। তার পরের কথাগুলো বোধহয় গ্যোবেসের জোড়া প্রপাগান্ডা-বাণী বার্লিন ও প্রাগ চিরকাল জর্মন শহর হয়ে রইবে। কাইটেল, ইয়োডল বরমানকে ডেকে বললেন, আমি বার্লিন ত্যাগ করব না। জেনারেলয় প্রতিবাদ করে বললেন, তা হলে দক্ষিণ জর্মনির জমায়েত সৈন্যচালনা করবে কে? হিটলার বললেন, সৈন্যচালনার কীই-বা আছে, লড়াইয়ের কীই-বা বাকি। এখন সন্ধিসুলেহ কর গে। সে কাজ গ্যোরিঙই আমার চেয়ে ঢের ভালো পারবে।
গ্যোরিঙের এই উল্লেখ পরবর্তী অনেক ঘটনার জন্য দায়ী।
২৩ এপ্রিল দুপুরবেলা দক্ষিণ জর্মনিতে গ্যোরিঙের কাছে এই কথোপকথনের খবর পৌঁছল। তিনি যে খুশি হলেন সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হল না। তবু সাবধানের মার নেই বলে হিটলারের আইন-উপদেষ্টাকে ডেকে পাঠিয়ে ১৯৪১ সালের হিটলার-দত্ত সেই পুরনো প্রত্যাদেশের দলিল বের করলেন যেটাতে হিটলার তাঁকে তাঁর ডেপুটিরূপে নিয়োগ করেছিলেন। এখন যদি রিপোর্ট সত্য হয় যে হিটলার আর কোনও হুকুম দিচ্ছেন না, এবং সন্ধিসুলেহ করার জন্য তাকেই স্মরণ করে থাকেন তবে তাকে কিছু একটা করতে হয়। পারিষদদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করার পর তিনি হিটলারকে তার পাঠালেন, আপনি যখন বার্লিনে শেষ পর্যন্ত থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। তবে কি আপনি ১৯৪১-এর প্রত্যাদেশ মোতাবেক রাজি আছেন যে আমি তাবৎ রাইষের নেতৃত্ব গ্রহণ করি? আজ রাত দশটার ভিতর কোনও উত্তর না পেলে বুঝব, আপন কর্ম-স্বাধীনতা থেকে আপনি বঞ্চিত হয়েছেন এবং তদনুযায়ী দেশের-দশের মঙ্গলের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করব। আপনি জানেন, আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বময় এই মুহূর্তে আপনার জন্য আমার হৃদয়ে কী অনুভূতি হচ্ছে! ভগবান আপনাকে ইত্যাদি ইত্যাদি (তার পর আশীর্বচন, মঙ্গল কামনা, অন্যান্য দরদী বাৎ)।
অত্যন্ত আইনসঙ্গত সহৃদয় চিঠি। কিন্তু গ্যোরিঙের জাতশত্রু জানের দুশমন সেক্রেটারি বরমান বছরের পর বছর ধরে এই মহাভ লগনের জন্য প্রহর গুনছিলেন। দিন হিটলার শুধু নেমকহারাম, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক সব দলকে দল এইসব বুলি আওড়েছেন; যখন তিনি উত্তেজনার চরমে হাঁপাচ্ছেন তখন বরমান গুঁড়িগুড়ি টেলিগ্রামখানা এগিয়ে দেবার সঙ্গে মৃদুকণ্ঠে এটাও যে আরেকটা বিশ্বাসঘাতকতা, হিটলার উট সঙ্কটে অসহায় জেনে এ শুধু গ্যোরিঙের নিছক শক্তি কেড়ে নেওয়ার নীচ-হীন ষড়যন্ত্র এবং এটা তারই নির্লজ্জ আলটিমেটাম (ভীতিপ্রদর্শনের সঙ্গে ম্যাদ)– একথাটিও বললেন।
হিটলার তখন চতুর্দিকে দেখেছেন বিশ্বাসঘাতকতা; এটা তারই আরেক নেমকহারাম নিদর্শন এই অর্থেই সেটা গ্রহণ করলেন। তীব্র কর্কশ কণ্ঠে গ্যোরিঙকে দিলেন অশ্রাব্য গালাগাল। বেবাক ভুলে গেলেন, তারই মুখে বেরিয়েছিল গ্যোরিঙ সম্বন্ধে প্রস্তাব, কিন্তু বরমান যখন গ্যোরিঙের প্রাণদণ্ডাদেশ চাইলেন তখন তিনি পার্টি এবং ফুরারের প্রতি গ্যোরিঙের পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও সেবা ভুলতে না পেরে আদেশ দিলেন, তাঁকে তাঁর সর্ব-পদ সর্বক্ষমতা থেকে পদচ্যুত করা হল, এবং আদেশ দেওয়া হল হিটলারের পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন না। এবং তাকে গ্রেফতার করে বন্দি করে রাখার হুকুম দেওয়া হল।
ইতোমধ্যে হিটলার গ্যোবেলস্ দম্পতিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তারা যেন তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে তাদের দুটি বাচ্চাসহ তার পাশের বুঙ্কারে বাসা বাঁধেন। সুবুদ্ধিমান হাতুড়ে ডাক্তার মরেল ইতঃপূর্বেই চোখের জল ফেলতে ফেলতে (কেউ কেউ বলেন চোখের জল ফেলে অনুনয় করে, অন্যেরা বলেন কুমিরের ভণ্ডা) হিটলারের কাছ থেকে বিদায় ভিক্ষা করে দূর দক্ষিণে কেটে পড়েছেন (হিটলার যেন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, যে পথে যাচ্ছি সেখানে যাবার জন্যে আপনাকে আমার আর প্রয়োজন নেই)। তাঁর কামরা ছিল বুঙ্কারে হিটলারের মুখোমুখি– গ্যোবেলস্ সে ঘরটাও পেলেন। গ্যোকে দম্পতি ও হিটলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে বসলেন। গ্যোবে বললেন তিনিও আত্মহত্যা করবেন, এবং হিটলারের আপত্তি সত্ত্বেও ফ্রাই গ্যোবেল বললেন, তিনিও সেই পথ ধরবেন এবং বাচ্চা ছটিকে বিষ খাইয়ে মারবেন।
এটা এমনি বীভত্স কাও যে কোনও ঐতিহাসিকই এ নিয়ে মন্তব্য করেননি। এর পর হিটলার তার কাগজপত্র থেকে নিজে বাছাই করে কতকগুলি পোড়াবার আদেশ দিলেন।
সমস্ত দিন ধরে দক্ষিণ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, উত্তর থেকে নৌসেনাপতি ড্যোনিস ও হিমলার এবং আরও একাধিক আমির হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, কিন্তু হিটলার অটল অচল। ২৩ তারিখে তিনি জেনারেল কাইটেলকে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন জেনারেল ভেংকের কাছে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বার্লিন উদ্ধার করবেন। ইতোমধ্যে রাশানরা বার্লিন মাঝখানে রেখে সাড়াশি বৃহ নির্মাণের জন্য বার্লিন ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে পঞ্চাশ মাইল এগিয়ে গিয়েছে। ভেংককে এদের সঙ্গে লড়াই করে করে তবে বার্লিনে পৌঁছতে হবে। হিটলার ঘড়ি ঘড়ি খোচ্ছন, ভেংকের খবর কী, তিনি কতদূর এগিয়েছেন! সমস্ত বুঙ্কারবাসীর ওই এক শেষ ভরসা। কিন্তু তার কোনও খবর নেই।
২৫ তারিখে রুশসৈন্য সমস্ত বার্লিন চক্রব্যুহ ঘিরে ফেলল। এর পর আর দশ-বিশজন লোক যে একসঙ্গে বার্লিন থেকে বেরুবে তার উপায় আর রইল না। তবে একজন দুজন গলিঘুচি দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে রাতের অন্ধকারে হয়তো বেরুতে পারে। এ অবস্থায় হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করার জন্য আর অনুরোধ করা যায় না।
কিন্তু বুঙ্কারে দিনে দু-বার কখনও-বা তিনবার হিটলার তার মন্ত্রণাসভায় নেতৃত্ব করে যেতে লাগলেন। সেখানে শুধু ওই খবরই পাওয়া যেত, রুশরা বার্লিনের কোন দিকে কতখানি ভিতরে ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় বৃদ্ধ আর বারো থেকে ষোল বছরের ছেলেরা যতখানি পারে লড়াই দিচ্ছে। যে-কোনও সেনানীর পক্ষেই কোনও শহরের অন্তর্ভাগ দখল করা সহজ নয়। রুশরা এগুচ্ছে ধীরে ধীরে, অতি সাবধানে। ইতোমধ্যে পূর্ব থেকে এসে রুশসৈন্য ও পশ্চিম থেকে এসে মার্কিন সৈন্য মধ্য-জর্মনিতে হাত মিলিয়েছে– জর্মনি এখন দু খণ্ডে বিভক্ত। উত্তর থেকে বার্লিন থেকে এখন আর আলপসের গিরি-উপত্যকায় গিয়ে যুদ্ধ প্রলম্বিত করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
দুই সেনাবাহিনীর এই হাত মেলানোর খবর হিটলার পেলেন মন্ত্রণাসভায় বসে। সংবাদদাতা বললেন, দু দলে কথা-কাটাকাটি হয়েছে। ফুরারের পাংশু মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চোখের জ্যোতি যেন হঠাৎ ফিরে এল। সোল্লাসে বললেন, আমি কি তখনই বলিনি? এইবারে রু হবে। কিন্তু হায়, পরের দিনই খবর এল, দু দল শান্তভাবে আপন আপন থানা গড়ে নির্বিরোধে খবর পরামর্শ লেন-দেন করছে।
বার্লিনের অবস্থা অবর্ণনীয়। অষ্টপ্রহর উপর থেকে বোমাবর্ষণ এবং তার সঙ্গে এসে জুটেছে শহরের উপকণ্ঠে বিরাট বিরাট কামান। বোমা ফেলছে বুঙ্কারের উপর। স্তালিনগ্রাদে যেসব জর্মন ধরা পড়েছিল তাদের অনেকে মিলে হিটলার-বিরোধী এক স্বাধীন-জর্মনি দল গড়ে। এরাই আজ রুশদের বার্লিনের রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিচ্ছে। তাই তাগেও ভুল হচ্ছে না। বুঙ্কারে ফাটল ধরেছে। শহরের কোনও জায়গায় যদি অগ্নিপ্রজ্বালক বোমায় আগুন ধরল তবে সে আগুন জলের অভাবে নেভানো যায় না বলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যতক্ষণ না পূর্বের থেকে পুড়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছয় ততক্ষণ সে ব্লকের পর ব্লক, রাস্তার পর রাস্তা পুড়িয়ে চলে। ভূগর্ভস্থ সেলারে লক্ষ লক্ষ আহত সৈনিক গোঙরাচ্ছে, শিশুরা কাঁদছে। ক্ষুধার চেয়ে তৃষ্ণা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোমা পড়ে কোনও কোনও জায়গায় জলের পাইপ ফেটে পূর্বে যে জল জমেছিল মেয়েরা সেই ঘোলাটে জল বালতিতে করে নিয়ে যাচ্ছে।
খবর এল রাস্তায় রাস্তায় লড়ে লড়ে রুশসৈন্যরা তো এগুচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে তারা ভূগর্ভস্থ রেলপথের (আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে) টানেল দিয়ে এগিয়ে আসছে। হিটলার হুকুম দিলেন স্প্রে নদীর (কানাল বা বড় খালও বলা হয়) জল বন্ধ করার গেট খুলে দিতে। সে জল রুশদের ডুবিয়ে মারবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মরবে হাজার হাজার আহত জর্মন সৈনিক– যারা মাটির নিচের স্টেশন-প্লাটফর্মে শুয়ে শুয়ে অচিকিৎসায় মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। এদের জীবন-মরণে হিটলারের ভুক্ষেপ নেই। বলট বলেছেন, সমস্ত যুদ্ধে এরকম হৃদয়হীন আদেশ তিনি শোনেননি। (এ আদেশ পালিত হয়েছিল কি না আমি জানিনে)।
এর চেয়েও নিষ্ঠুর আদেশ হিটলার বরমানকে পূর্বেই দিয়ে বসে আছেন। যে শহরের সামনে শত্রুসৈন্য দেখা দেবে তার তাবৎ কারখানা, ওয়াটার-ওয়ার্ক, বিজলি, নদীর উপর সেতু সব যেন উড়িয়ে দেওয়া হয়। সরবরাহ মন্ত্রী স্পের আপত্তি জানিয়ে বললেন, যুদ্ধের পরে জর্মনরা তবে গড়বে কী, বাঁচবে কী দিয়ে? হিটলার বললেন, এ যুদ্ধে সপ্রমাণ হয়েছে জর্মন জাত রুশের তুলনায় অপদাথ; এদের পক্ষে মৃত্যুই শ্রেয়। স্পের কিন্তু গোপনে এ আদেশ বানচাল করে দেন।
নিষ্ঠুরতম আদেশ দেন হিটলার বরমানকে জর্মন জাতকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করার। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে আবালবৃদ্ধ নরনারীকে খেদিয়ে, সঙ্গিনের ঘায়ে, গুলি চালিয়ে জড়ো করা হোক মধ্য-জর্মনির এক মধ্য অঞ্চলে। পথে বা সেখানে আহারাদির কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। সেখানে ও পথে আসতে আসতে তারা সবাই মরবে। এ আদেশ পালিত হয়নি। সেনাবাহিনীতে হুকুম দেবার মতো যথেষ্ট অফিসার ছিলেন না বলে, না অন্য কারণে কেউ স্পষ্টাস্পষ্টি উল্লেখ করেননি। তবে একাধিক ঐতিহাসিক বলেছেন, বাইবেল-বর্ণিত স্যামসন (স্যামসন ও ড্যালাইলা ছবি এদেশেও আসে) যে-রকম মৃত্যুবরণ করার সময় তার শত্রুদের মন্দির টেনে ভেঙে ফেলে তাদেরও মৃত্যু ঘটান, হিটলারও তেমনি ওপারে যাবার সময় কুল্লে জাতটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
বার্লিনবাসীরা প্যারিজিয়ানদের মতো কখনও নিজেদের মধ্যে সিভিল ওয়ার লড়েনি বলে কখনও রাস্তায় রাস্তায় পিপে, পাথর, আসবাবপত্র, ভাঙা গাড়ি, মোটর দিয়ে আঁটি বা ব্যারিকেড বানাতে শেখেনি। যেগুলো বানিয়েছিল সেগুলো এতই আনাড়ি হাতে তৈরি, কাঁচা, যে তার বর্ণনা দিয়েছেন সুইডেন রাজপরিবারের কাউন্ট ফলকে বেরনাট্টে। ইনি ব্যারিকেড বানাবার সময় বার্লিনে আসেন সুইডিশ রেডক্রসের প্রতিভূ হিসেবে, তার দেশবাসী বন্দিদের জন্য মুক্তির আবেদন করতে। (৮) ওই ব্যারিকেডগুলো নিয়ে খাস বার্লিন কনিরা (ঢাকার কুট্টিদের মতো) একে অন্যের সঙ্গে মন্তব্য বিনিময় করছিল। একজন বললে, এগুলো ভাঙতে রুশদের একঘণ্টা দুমিনিট লাগবে। কীরকম? পাকা একঘণ্টা তাদের লাগবে হাসি থামাতে। আর দু মিনিট লাগবে সেগুলো ভাঙতে।
ভিন্ন ভিন্ন বুঙ্কারে প্রায় ছ-সাতশো হিটলার-দেহরক্ষী দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, বেঞ্চিতে মাটিতে ঘুমিয়ে অথবা সংখ্যাতীত টিনে রক্ষিত হ্যাম, বেকন, সসেজ (রুটির উপর এত পুরু মাখন যে বলদ ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যাবে), মুরগি-রোস্ট আর বোতল বোতল ফ্রান্স থেকে লুট করে আনা, জর্মনির আপন উৎকৃষ্ট ওয়াইন, শ্যাম্পেন খাচ্ছে। এরা জর্মনির ঐতিহ্যগত সেনাবাহিনীর লোক নয়– তারা লড়ছে আপ্রাণ–এরা হিটলার-হিমলারের আপন হাতে তৈরি এসএস, যুদ্ধে নামবার বিশেষ আগ্রহ এদের নেই। এদের দেখে বলটু মনে মনে ভাবছেন, এরা এখানে কেন? ফুরার তথা জনির শত্রু বুস্কারের ভিতরে না বাইরে, যেখানে লড়াই হচ্ছে কিন্তু রান্নাঘরের খাস বার্লিনের কনি (কুডি) মেয়েরা স্পষ্টভাষী। হঠাৎ কয়েকজন চিৎকার করে এদের বললে, হেই, হতভাগা নিষ্কর্মার দল! তোরা যদি এখুনি বাইরে গিয়ে যুদ্ধে না নামিস তবে তোদের পরিয়ে দেব আমাদের গা থেকে মেয়েছেলেদের রান্নার সময়কার পোশাক। আর আমরা যাব লড়তে। বারো-চোদ্দ বছরের ছেলেরা প্রাণ দিচ্ছে লড়তে লড়তে, রাস্তায় আর হামদো হামদো তাগড়ারা বসে আছে এখানে!
হিটলার তাকিয়ে আছেন ভেংকের আশায়।
বুঙ্কারের এই পাগলদের দুরাশার ভিতর একটি লোকের মাথা পরিষ্কার ছিল– ইনি হিমলারের প্রতিনিধি ফেগেলাইন। কিন্তু তিনি জানতেন না, যেখানে সবাই পাগল সেখানে সুস্থ-মস্তিষ্ক হওয়া পাগলামি। ইনি মোকা বুঝে এফার (যাকে দুদিন পরে হিটলার বিয়ে করেন) বোনকে বিয়ে করে যেন হিটলার-পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন– আসলে সবাই একমত, লোকটা অপদার্থ। গোড়াতে ছিল রেস্-কোর্সের জকি। আঙুল ফুলে কলাগাছ, দম্ভতরে যাকে-তাকে অপমান করত– ওদিকে বরমান, বুর্গড, ক্রে তার এক গেলাসের ইয়ার। হিটলার-পরিবারের সম্মানিত সদস্য হয়েও পারিবারিক আত্মহত্যা করে পারিবারিক চিতানলে হিটলার-এফার সঙ্গে ভস্মীভূত হয়ে বৃহত্তর গৌরব সে কামনা করেনি। সোনা-জওহর নিয়ে পালাবার সময় সে ধরা পড়ল– এই সঙ্কটের সময়ও যে হিটলার সবদিকে নজর রাখতেন সেটা প্রমাণ হল যখন তিনিই প্রথম লক্ষ করলেন, ফেগেলাইন নেই। ধরার পর হিটলারের আদেশে তার ইউনিফর্ম, মেডেলাদি কেড়ে নিয়ে, পদচ্যুত করে তাকে বন্দি করে রাখা হল।
২৭ এপ্রিল দিনের শেষ রাত্রে রাশানরা যেন দৈবক্ষমতায় দিব্যদৃষ্টি পেয়ে অব্যর্থ লক্ষ্যে হিটলারের বুঙ্কারের আশেপাশে, উপরে বোমার পর বোমা ফেলতে লাগল। বুষ্কারবাসীরা জড়সড় হয়ে শুনতে পাচ্ছে যেন প্রত্যেকটি কামানের বিরাট গোলা তাদেরই মাথার উপর ফাটছে। কারও মনে আর সন্দেহ রইল না, এবার যে কোনও মুহূর্তে রুশেরা সরাসরি বুঙ্কার আক্রমণ করবে।
সে রাত্রে হিটলার তার অন্তরঙ্গজনকে নিয়ে মজলিসে বসলেন। স্থির হল, প্রথম রুশসৈন্য দেখা দিতেই পাইকারি হারে সবাই আত্মহত্যা করবেন। তার পর সবাই পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করলেন, কী প্রকারে মৃতদেহগুলোও শনাক্তের বাইরে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা যায়। তার পর একে একে প্রত্যেকে ছোট্ট ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে হিটলার ও জনির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন বলে শপথ নিলেন।
ব্লাফ ব্লাফ ব্লাফ! সবসুদ্ধ দুই কিংবা তিনজন প্রতিজ্ঞা পালন করেন। আর সবচেয়ে হাস্যকর হিটলারের মৃত্যুর ঘন্টা তিনেক পরেই আমিরদের পয়লা নম্বরি বরমান চার নম্বরি কেবৃকে পাঠালেন রুশদের কাছে সন্ধি-স্থাপনার্থে! সেটা বানচাল হয়ে গেলে দুজন ছাড়া সবাই চেষ্টা করলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে, বরমান একটা ট্যাঙ্কে চড়ে– এটার ব্যবস্থা তিনি শপথ নেবার পূর্বেই করেছিলেন নিশ্চয়– রুশ-ব্যহ এড়িয়ে, তখনও অপরাজিত উত্তর জৰ্মনিতে ড্যোনিৎসের (হিটলার মৃত্যুর পূর্বে এঁকেই রাষ্ট্রের প্রধান রূপে নির্বাচিত করে যান) সঙ্গে যোগ দিতে। যারা অক্ষম হয়ে মার্কিনদের হাতে বন্দি হলেন তারা তখন প্রতিদ্বন্দিতা আরম্ভ করলেন মার্কিনদের সুমুখে, কে হিটলারকে কত বেশি ঘৃণা করতেন সেইটে সাড়ম্বরে বোঝতে।
হিটলার তখনও আশা ছাড়েননি। কখনও সামনে ম্যাপ খুলে কম্পিত হস্তে রুশসৈন্য, ভেংকের সৈন্য, নবম বাহিনীর সৈন্য রঙিন বোতাম দিয়ে প্রতীক করে যুদ্ধের বৃহ নির্মাণ করছেন, আক্রমণের পথ স্থির করছেন; কখনও চিৎকার করে মিলিটারি হুকুম দিচ্ছেন– যেন তিনি নিজে রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করছেন। কখনও ঘর্মাক্ত হস্তে ম্যাপ নিয়ে দ্রুতপদে পায়চারি করছেন– ভেজা হাতের স্পর্শে ম্যাপখানা দ্রুত পচে যাচ্ছে আর যাকে পান তাকেই সেই ম্যাপ দেখান; কীভাবে, কোন পথে, সমরনীতির কোন কূটচালে শত্রুপক্ষকে নির্মম ঘায়েল করে, যেন এক অলৌকিক বিস্ময়ে ভেংক এসে সবাইকে এই সংকট থেকে মুক্ত স্বাধীন করবেন।
এদের অনেকেই ততদিনে জেনে গিয়েছেন, ভেংকের সেনাবাহিনী বলে আর কিছু নেই। যে ক-জন তখনও বেঁচে ছিল তাদের তিনি অনুমতি দিয়েছেন, পশ্চিম দিকে পালিয়ে গিয়ে মার্কিনদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে রুশদের চেয়ে মার্কিনরাই ভালো, এই তখন আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস। কিন্তু তেংকের সত্য বিবরণ হিটলারকে বলে কে বলে লাভ? কাইটেল, ইয়োডল সব জেনে-শুনে হিটলারের অতিনাদী টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রামের কোনও উত্তর দিচ্ছে না (নামেমাত্র আর্মি হেড-কোয়ার্টার্স থেকে। কী উত্তর দেবেন এরা?
লিঙে এ সময়ে হিটলারের আচরণ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে তিনি কামরার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দ্রুতগতিতে পায়চারি করছেন, কখনও-বা ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বদ্ধমুষ্টি দিয়ে দেয়ালে করাঘাত করছেন। কেন? তার কাছে ঘরের চারখানা দেয়াল কি কারাগারের চারখানা প্রাচীরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।
আর পায়চারি? এটা তার প্রাচীন দিনের অভ্যাস। ঘন্টার পর ঘন্টা কেন? দিনের পর দিন। হিটলারের একমাত্র বন্ধু ফোটোগ্রাফার হফমান লিখেছেন, হিটলারের প্রথম প্রেয়সী (সকলেরই মতে এইটেই ছিল তার প্রথম এবং শেষ গ্রেট লাভ এফার প্রতি তার প্রেম ছিল অন্য ধরনের) যখন আত্মহত্যা করে মারা যান, তখন তিনি নিচের তলা থেকে হিটলারের পদধ্বনি শুনতে পান তিন দিন তিন রাত ধরে মাঝে মাঝে ক্ষান্ত দিয়ে। এই তিন দিন তিন রাত তিনি জলস্পর্শ করেননি। প্রণয়িনীর গোর হয়ে গিয়েছে খবর পেয়ে হিটলার পায়চারি বন্ধ করে সোজা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গিয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।(৯)
আর কখনও কখনও টেবিলের উপর কনুই রেখে অনেকক্ষণ ধরে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সমুখপানে।
ভেংকের জন্য প্রতীক্ষা, তার উত্তেজনা ও জালবদ্ধ পশুর মতো ছটফটানি তার চরমে পৌঁছল ২৮ এপ্রিল। রাশানরা তখন বার্লিন নগরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে লড়াই করে করে হিটলারের বাসবনের দিকে এগিয়ে আসছে। বার্লিনের কমান্ডান্ট হিটলারকে বলে গেছেন, দু দিন, জোর তিন দিনের ভিতর রুশরা বুঙ্কারে এসে পৌঁছবে। কিন্তু ভেংক কোথায়? কী ঘটে থাকতে পারে?
নিশ্চয়ই আবার বিশ্বাসঘাতকতা! বার্লিন জয় করার মতো শক্তির শতাংশের একাংশও যে ভেংকের নেই সেকথা কে বিশ্বাস করে? ২৮শে সন্ধ্যায় বরমনি সেই সুদূর দক্ষিণ জর্মনির মনিকে তার মিত্র এডমিরাল পুটকামারকে টেলিগ্রাম করলেন, সৈন্যদের আদেশ ও অনুরোধ করে যেসব কর্তৃপক্ষ তাদের এখানে আমাদের উদ্ধার করার জন্য পাঠাতে পারতেন, তাঁরা সেটা না করে নীরব। বিশ্বাসঘাতকতা বিশ্বস্ততার স্থান অধিকার করেছে। আমরা এখানেই থাকব। ফুরার-ভবন খণ্ড-বিখণ্ড।
এক ঘণ্টা পর, বহু প্রতীক্ষার পর বাইরের জগৎ থেকে পাকা খবর এল। হিটলারকে কিছুমাত্র আভাস না দিয়ে হাইনরিশ হিমলার গ্যোরিঙের পদচ্যুতির পর এখন যিনি জর্মনির দ্বিতীয় ব্যক্তি- মিত্রশক্তির কাছে সন্ধির প্রস্তাব করেছেন, পুর্বোল্লিখিত রেসের নেতা সুইড় কাউন্ট বের্নাডট্টের মাধ্যমে। প্রস্তাবটি গোপনেই করা হয়েছিল কিন্তু কী করে কে জানে সেটা শুণ্ডিপথে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনও এক বেতার-কেন্দ্র সেটা প্রচার করেছে। হিটলারের বার্তা সরবরাহ বিভাগের কর্মচারী বেতারে সেটা শুনে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে স্বয়ং এসেছেন হিটলারকে মুখোমুখি খবরটা দিতে।
কামানের গোলা, বোমারুর বোমা তখন ডাল-ভাত। কাজেই ঘরের ভিতর বোমা ফাটলেও হিটলার অতখানি বিচলিত হতেন না। সেই বিশ্বাসী হাইনরিষ, যে কি না তার খাস সৈন্যদলের বেল্টে খোদাবার আদেশ দিয়েছিল– TREUE- বিশ্বস্ততা, প্রভুভক্তি, নেমকহালালি। সে কুকুর এখন ঠাকুরের আসনে বসতে চায়, তাঁর প্রতি নেমকহারামি করে? এই একমাত্র নাৎসি নেতা যার প্রভুতে অবিচল ভক্তি সম্বন্ধে কারও মনে কখনও সন্দেহ হয়নি। আর এ-কথা সকলেই জানতেন, যুদ্ধারম্ভের প্রথম দিনই হিটলার মার্শাল ল প্রচার করেছিলেন, তাঁর কোনও কর্মচারী– তা তিনি যত উচ্চপদেরই হোন না কেন- যদি কোনও সন্ধির আলোচনা করেন তবে তার প্রাণদণ্ড হবে– এ বাবদে কোনও করুণা দেখানো হবে না।
হিটলারের মুখ থেকে নাকি সবশেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছিল।
স্টাইনারের আক্রমণ কেন হয়ে ওঠেনি, ভেংক কেন আসছে না- এসব সমস্যা হিটলারের কাছে সরল হয়ে গেল। নিশ্চয়ই পিছনে রয়েছে হিমলারের বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য ঐতিহাসিক মাত্রেই জানেন এ সন্দেহ সত্য নয়। হিমলার শেষ মুহূর্তে সন্ধির প্রস্তাব এনে শুধু আপন প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন অন্য বহু বহু নাৎসি নেতার মতো। তারা গোপনে সুইস ও দক্ষিণ আমেরিকার জর্মন বহুল নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন একাধিক রাষ্ট্রে বিস্তর অর্থ জমা রেখেছিলেন ও জাল নামে পাসপোর্ট তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন। হিমলারকে জনসাধারণ ভালো করেই চিনত; তাঁর পক্ষে এ পন্থা সম্ভবপর ছিল না।(১০)
হিমলারের বিশ্বাসঘাতকতার পর হিটলারের সর্বশেষ কর্ম সম্বন্ধে মনস্থির করতে আর কোনও প্রতিবন্ধকতা রইল না। প্রথমেই হিমলারের বিশ্বাসী নায়েব, প্রতিতু, লিয়েজে অফিসার ফেগেলাইনকে বন্দিশালা থেকে বের করে নিয়ে এসে সওয়াল করা হল। এইসব বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে তিনি কতখানি একিবহাল ছিলেন ফেগেলাইন কী উত্তর দিয়েছিলেন তা আর জানবার উপায় নেই। প্রশ্নকর্তারা মৃত নয়, নিরুদ্দেশ। হিটলারের যুক্তি, ফেগেলাইন যদি না জানবে তবে পালাবার চেষ্টা করল কেন? বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কী? হুকুম দিলেন, বুঙ্কারের বাইরের বাগানে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে। বল্টু তার বইয়ে বলেছেন, এফা তার ভগ্নিপতিকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা করেছিলেন কি না আমরা তার কোনও খবর পেলুম না, হয়তো স্বামীর ওপর তার কোনও প্রভাবই ছিল না, কিংবা হয়তো তিনি তার স্বামীর মতোই ধর্মান্ধের মতো বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাসঘাতকের প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড– তা সে যে-ই হোক। আমাদের মনে হয় দুটোই। ওই সময় শ্রীমতী হানা রাইটশ বুঙ্কারে ছিলেন। ইনি বিশ্বের অন্যতম নামজাদা পাইলট (পরবর্তীকালে পণ্ডিতজীর সঙ্গে এর হৃদ্যতা হয় এবং তার অতিথি হয়ে কিছুদিন দিল্লিতে ছিলেন)। ইনি বলছেন, এফা নাকি ওই সময় বেদনাভরে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মোচড়াতে মোচড়াতে যাকে পেতেন তাকেই বলতেন, হায় বেচারা, বেচারা অ্যাডলফ। সবাই তাকে ত্যাগ করেছে, সবাই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দশ হাজার লোক মরুক ক্ষতি নেই, কিন্তু জর্মনি যেন অ্যাডলফকে না হারায়।
রুশরা বুঙ্কার থেকে আর মাত্র হাজার গজ দূরে।
২৮/২৯ এপ্রিলের রাত। ফেগেলাইনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হিটলার অন্যান্য কর্তব্যের দিকে মন দিলেন। যে রমণী তাঁকে ১৪/১৫ বৎসর ধরে ভালোবেসেছেন, ভালোবাসার প্রথম দিকে একবার নিরাশ হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টাতে গুরুতররূপে জখম হন, হিটলার যাকে বিশ্বাস করতেন সবচেয়ে বেশি (হিটলারও বলতেন, তিনি দুজনকে অবিচারে বিশ্বাস করেন। একা ও তার আলসেশিয়ান ব্লন্ডিকে), সঙ্কট ঘনিয়ে এলে তার নিরাপত্তার জন্য হিটলার বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও যিনি তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি, এবং যিনি দৃঢ়কণ্ঠে একাধিকজনকে একাধিকবার বলেছেন, অ্যাড আর আমার জীবনমরণ একসূত্রে গাঁথা, সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে যাকে হিটলার অল্প লোকের সামনেই বেরুতে দিতেন, কোথাও যেতে হলে ভিন্ন ভিন্ন মোটরে যেতেন, সভাস্থলে এফা দর্শকদের সঙ্গে বসে হিটলারের বক্তৃতা শুনতেন– সেই একা এত বৎসর পর তার ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার এবং আসন পেলেন। সে রাত্রে হিটলার তাঁকে বিয়ে করলেন।
কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা ডিকটেটরদের প্রিয়া, রক্ষিতা, উপপত্নী, পত্নীরা যেরকম রোমান্টিকভাবে তাদের বল্লভদের জীবন প্রভাবান্বিত করেন, পর্দার সামনে কিংবা আড়ালে বহুলোকের জীবনমরণ নিয়ে খেলা করেন চক্রান্ত, বিষপ্রয়োগ অনেক কিছু করে থাকেন, এফার সেদিকে কোনওই আকর্ষণ ছিল না। কর্মব্যস্ত হিটলার তার সঙ্গে দেখা করার সময় পেতেন কমই। বিশেষ করে যুদ্ধের পাঁচ বৎসর তিনি ভিন্ন আর্মি হেড কোয়ার্টার্সের সন্নিধানে থাকতে বাধ্য হতেন বলে প্রোষিতভর্তৃকা এফা দূর আপসের উপর হিটলারের নির্জন নিরানন্দ বের্গহ বনে একা একা দিনের পর দিন তার জন্যে প্রতীক্ষা করতেন। চাকর-বাকররা বলত এ যেন সোনার খাঁচার বদ্ধ পাখি। তার পর হঠাৎ একদিন বল্পত এসে উপস্থিত হতেন অতিশয় অন্তরঙ্গ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। বাড়ি গমগম করে উঠত। ডিনার, তার পর ফিল, তার পর সঙ্গীত, রাত দুটোয় শেষ পার্টি- হিটলার টিটোটেলার, খেতেন হালকা চা, কাপের পর কাপ, অন্য সবাই শ্যাম্পেন। হিটলার ঘুম থেকে উঠতেন দেরিতে। খেয়ে জিরিয়ে এফা, ব্লন্ডি, অনুচরদের নিয়ে নির্জন পথে বেড়াতে বেরুতেন। পথের শেষপ্রান্তে একটি বিশ্রামাগার। সেখানে চা, কেক, ক্রিম-বান্ খাওয়া হত। হিটলার প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন। সবাই ফিফিস্ করে কথা বলত, প্রভুর নিদ্রা ভঙ্গ হলে সবাই বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে তার স্থান ছিল না। হিটলারের মৃত্যুর পূর্বে ১০ লক্ষের ভিতর একজনও জানত না, হিটলারের কোনও বান্ধবী আছেন।(১১)
এই দুর্দিনে বিয়ের রেজেস্ট্রি অফিসার জোগাড় করা সহজ হয়নি। শেষটায় একজন এলেন যাকে বুঙ্কারের কেউই চেনে না। গ্যোবেলস্ এঁকে জোগাড় করে এনেছেন; লিঙের মতে ইনিই নাকি একদা গ্যোবেসের বিয়ে সম্পন্ন করেন। এমার্জেন্সি বা বিনোটিসের বিয়ে বলে বড়ম্বর আর বাহ্যাড়ম্বর বাদ দেওয়া হল। দুই পক্ষে মৌখিক সাধারণত হিটলার জর্মনিতে সার্টিফিকেট দরকার হত–শপথ দিলেন, উভয়েই অবিমিশ্র আর্যরক্ত ধরেন, ও তাদের বংশগত কোনও ব্যাধি নেই। তার পর উভয়ে রেজিস্ট্রিতে সই করলেন। কনে নাম সই করার সময় একা লিখে ব্রাউন লেখবার জন্যে বি হরফ লিখে ফেলেছিলেন; তাঁকে ঠেকানো হল, তিনি বি কেটে হিটলার ও ব্রাউন নামে জন্ম (nee) লিখলেন। গ্যোবেল ও বরমান সাক্ষী হলেন।(১২) রাত তখন একটা বেজে গিয়েছে। ২৯ এপ্রিল শুরু হয়েছে।
বিয়ের পর হিটলারের ঘরে পার্টি বসল। শ্যাম্পেন এল। বহু বৎসর পূর্বে গ্যোবে যখন বিয়ে করেন তখন হিটলার সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। গ্যোবেলুস্ দম্পতি ও হিটলার সেই অবিমিশ্র আনন্দের দিনের সঙ্গে অদ্যকার আনন্দের ওপর করাল ছায়ার তুলনা করে সে সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন। জর্মন ভাষায় একটি সংহিটে আছে, চোখের জল নিয়ে আমি নাচছি– এ যেন তাই। হিটলার আবার তাঁর আত্মহত্যার কথা তুললেন। বললেন, তাঁর জীবনাদর্শ (ভেল্টআনশাউউঙ) নাৎসিবাদ খতম হয়ে গেল; এর পুনর্জন্ম আর কখনও হবে না। তার সর্বোত্তম বন্ধুরা তার সঙ্গে প্রবঞ্চনা আর বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। মৃত্যুর ভেতর দিয়েই তিনি এসব থেকে নিষ্কৃতির আরাম পাবেন।
পার্টি চালু রেখে তিনি পাশের ঘরে তার স্টেনট-সেক্রেটারি ফ্রাউ যুঙেকে নিয়ে তার দু-খানা উইল মুখে মুখে বলে যেতে লাগলেন। প্রথম উইলখানা রাজনৈতিক, দ্বিতীয়বানা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। পাঠক হিটলার সম্বন্ধে যে-কোনও বইয়ে এ দু-খানার কপি পাবেন। আমি সংক্ষেপে সারি। সর্বপ্রথমেই তিনি আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, একথা মিথ্যে যে আমি বা জর্মনির আর কেউ এ যুদ্ধ চেয়েছিল। এটা ইহুদি এবং যারা তাদের জন্য কাজ করে তাদের কীর্তি…এখন আমার সৈন্যদল আর নেই বলে রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রান্ত হলে আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করব। আমি শক্রর হাতে ধরা দেব না–ইহুদিরা যাতে করে আমাকে নিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত জনতার জন্য একটা নয়া তামাশা সৃষ্টি না করতে পারে। তার পর তিনি গ্যোরি ও হিমলারকে নাৎসি পার্টি থেকে ও সর্ব আসন থেকে বিচ্যুত করে বললেন, এঁরা যে শক্তিলোভে শক্রর সঙ্গে গোপন-সন্ধি-প্রস্তাব করে শুধু আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাই নয়, জর্মনি ও তার নাগরিকদের মুখে অমোচনীয় কলঙ্ককালিমা মাখিয়েছেন। হিটলারের মূলমন্ত্র ছিল যুদ্ধের সাধন কিংবা জীবনপাতন–সন্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করাই বেইজ্জতির চূড়ান্ত। সর্বশেষে তিনি জর্মনদের কঠোরতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের রক্তে যেন সংমিশ্রণ না হয় তার জন্যে, এবং বিশ্বে বিষসঞ্চারণকারী আন্তর্জাতিক ইহুদিদের নির্দয়ভাবে প্রতিরোধ করার জন্য দিব্য দিলেন।…এই উইলেই তিনি এডমিরাল ড্যোনিৎসকে দেশের নেতৃত্ব দিলেন, এবং তার জন্যে মন্ত্রিসভা নির্বাচন করে গেলেন।(১৩)
তার ব্যক্তিগত হ্রস্ব উইলে তিনি একাকে বিবাহ করার পটভূমি ও কারণ দর্শালেন। তার পর বললেন, তিনি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি তিনি নাৎসি পার্টিকে দান করলেন, পার্টির অস্তিত্ব লোপ পেলে জর্মন রাষ্ট্রকে, এবং সে-ও যদি লোপ পায় তা হলে সে বিষয়ে তার আর কোনও নির্দেশ নেই। তার বিরাট চিত্রসঞ্চয় তিনি তার জন্মভূমির লিনৎস শহরের যাদুঘর নির্মাণের জন্য দিলেন। দরকার হলে তার এবং তার স্ত্রীর আত্মজন, তাঁর সহকর্মী সেক্রেটারি ইত্যাদি যেন মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মতো জীবনযাত্রা করতে পারেন, তার আর্থিক ব্যবস্থাও তিনি উইলে রাখলেন।… উইল লেখা শেষ হলে ভোর চারটায় তিনি শুতে গেলেন। হায়রে বাসরশয্যা।
গ্যোবেলসও তাঁর উইল লিখলেন। তার প্রধান বক্তব্য : ফুরার আমাকে আদেশ দিয়েছেন, নতুন মন্ত্রিসভায় অংশ নিতে, কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার (এবং ইচ্ছে করলে তিনি শেষবারের মতোও লিখতে পারতেন; কেন করলেন না, বোঝা ভার) আমি ফুরারের আদেশ সরাসরি লঙ্ঘন করছি। আমি, আমার স্ত্রী ও পুত্রকন্যাগণসহ ফুরারের পার্শ্বেই জীবন শেষ করব। এর পর আছে সর্বব্যাপী বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি ইত্যাদির কথা।
সেই দিন ২৯ এপ্রিল। দুপুরের দিকে চারজন বিশ্বস্ত লোক মারফত তিনখানা উইল তিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হল। যে করেই হোক তারা যেন কুশব্যুহ ভেদ করে, কিংবা ব্যুহে কোনও ছিদ্র থাকলে তাই দিয়ে ড্যোনিসের কাছে পৌঁছয়, নইলে ব্রিটিশ বা মার্কিন অধিকৃত অঞ্চলে।
দুপুরবেলা মন্ত্রণাসভা বসল। সেখানে প্রধান খবর, রাশানরা এগিয়ে এসেছে এবং ভেংকের কোনওই খবর নেই। তিনজন অফিসার- এদের মধ্যে ছিলেন আমাদের পূৰ্বোল্লিখিত বই– বললেন, তারা ভেংকের সন্ধানে ও তাকে বার্লিন পানে ধাওয়া করবার জন্য ফুরারের আদেশ পৌঁছে দিতে প্রস্তুত আছেন। হিটলার অনুমতি দিলেন। রাত্রের মন্ত্রণাসভার পর আরেকজন চলে যাবার অনুমতি পেলেন।
রাত্রের মন্ত্রণাসভায় বার্লিনের কমান্ডান্ট জানালেন, রাশানরা চতুর্দিক থেকেই শহরের ভিতরে এগিয়ে এসেছে। পয়লা মে তারা বুঙ্কার (এবং রাষ্ট্রভবনে পৌঁছে যাবে। বার্লিনের ভিতর যেসব জর্মন সৈন্যদল আটকা পড়েছে তারা এইবেলা যদি রুশব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে না যায়, তবে আর কখনও পারবে না। হিটলার বললেন, দু-একজনের পক্ষে কোনওগতিকে বেরোনো সম্ভব হলেও হতে পারে কিন্তু এইসব রণক্লান্ত ভাঙাচোরা হাতিয়ারে সজ্জিত তারও আবার গুলি-বারুদের অভাব সৈন্যরা দল বেঁধে, তা সে যতই ঘোট দল থোক না কেন, কখনওই বেরুতে পারবে না। ব্যস, হয়ে গেল; হিটলারের অভিমতই সর্বশেষ অভিমত। সৈন্যদের কপালে নিরর্থক মৃত্যুর লাঞ্ছন অঙ্কিত হয়ে গেল।
এই সময়ে হিটলার তার সর্বশেষ টেলিগ্রাম পাঠান জেনারেল ইয়োডকে। আশ্চর্যের বিষয়, ট্রেভার রোপারের মতো অতুলনীয় ঐতিহাসিক এই শেষ টেলিগ্রামের উল্লেখ করেননি। বলট তো তার আগেই বুঙ্কার ত্যাগ করেছেন তার কথা ওঠে না। হিটলারের কোনও প্রামাণিক জীবনীতেও আমি এর উল্লেখ পাইনি। শুধু আসমা ও অন্য কোনও নৌ-সেনাপতি এর উল্লেখ করেছেন; আমান্ তাঁর ইতিহাসে টেলিগ্রামখানার ফটোও দিয়েছেন। তাতে হিটলারের সেই আর্তকণ্ঠে প্রশ্ন, ভেংক কোথায়, নবম বাহিনীর পুরোভাগ কোন কোন স্থলে পৌঁছেছে, ইত্যাদি; আমি এই মুহূর্তেই উত্তর চাই।
সেদিনই খবর পৌঁছল, হিটলার-সখা ডিকটেটর মুসসোলিনিকে মিলানের বিদ্রোহী দল তাকে তার উপপত্নীর সঙ্গে ইতালি ছেড়ে সুইটজারল্যান্ডে পলায়নের সময় ধরে দুজনকে খতম করে শহরের মাঝখানের বাজারে পায়ে পায়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে যাতে করে উত্তেজিত প্রতিহিংসোন্মত্ত জনগণ দুজনাকে পেটাতে ও পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারে। এ সংবাদ হিটলারের মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল জানা যায়নি। তবে বহু ডিকটেটরদের শেষ পরিণতি হিটলারের কাছে কোনও নতুন খবর নয়। তাই উইল লেখার সময় ও তার পূর্বেও হিটলার আদেশ দিয়েছিলেন তার ও এফার দেহ যেন পুড়িয়ে এমনভাবে ভস্ম করে দেওয়া হয় যে ইহুদিরা পাগলা জনতাকে তামাশা দেখাবার জন্য কোনও কিছু না পায়। বুঙ্কারের একাধিক বাসিন্দা হুবহু একই ভাষায় এই মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
২৯ তারিখ অপরাহ্নে হিটলারের আদেশে তার প্যারা অ্যালসেশিয়ান কুকুর ব্লন্ডিকে গুলি করে মারা হল। সেদিনই তিনি তার দুই মহিলা সেক্রেটারিকে চরম সঙ্কটে ব্যবহারের জন্য বিষের ক্যাপসুল দিতে দিতে দুঃখ করে বললেন যে, শেষ বিদায়কালে তিনি এর চাইতে ভালো কোনও উপহার দিতে পারলেন না।
সেই রাত্রে হিটলার ভিন্ন ভিন্ন বুঙ্কারবাসীদের খবর পাঠালেন, তিনি মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চান, তারা যেন অপেক্ষা করেন। রাত আড়াইটার সময় (৩০ এপ্রিল আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। প্রায় কুড়িজন অফিসার ও মহিলা সারি বেঁধে করিডরে দাঁড়ালেন। বরমানসহ হিটলার বেরিয়ে এসে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন এবং মহিলাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। হিটলারের চোখের উপর যেন ক্ষীণ বাষ্পের হালকা পরশ লেগে আছে। এ বিষয় এবং তার মৃত্যু, শবদাহ ইত্যাদি অনেকেই সবিস্তর লিখেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হিটলারের ড্রাইভার কেম্পকার আমি হিটলারকে পুড়িয়েছিলুম এবং লিঙের কাহিনী। হিটলারের অন্যতম মহিলা সেক্রেটারি ছদ্মনামে হিটলার প্ৰিভাট অর্থাৎ হিটলারের প্রাইভেট জীবন নিয়ে বই লেখেন। সর্বশেষে হিটলারের নরদানব অ্যাডজুটান্ট গুশের বিবৃতি-রুশ কারাগারে দশ বছর কাটানোর পর জর্মনি ফিরে এসে তিনি বিবৃতি দেন। কিন্তু ট্রেভার রোপার সকলের জবানবন্দি ও বিবৃতি যাচাই করে লিখেছেন বলে তাঁকে অনুসরণ করাই প্রশস্ত। এস্থলে বলে রাখা ভালো হিটলার সপ্তাহখানেক পূর্বে তার চারজন মহিলা সেক্রেটারিকে বুঙ্কার ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার প্রস্তাব করেন। দুজন চলে যান, দুজন থাকেন। নিরামিষাশী হিটলারের জন্য রান্না করতেন ফ্রলাইন মানৃৎসিয়ালি। তিনিও থেকে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। লিঙেকেও যাওয়া না-যাওয়া তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি যাননি। ফলে রাশাতে দশ বৎসর কারাভোগ করতে হয়েছিল।
অবধারিত আশু বিপদের সামনে মানুষ সবসময় ভেঙে পড়ে না। জাপানিরা যখন সিঙ্গাপুর দখল করে তখন সবকিছু জেনেশুনেই সিঙ্গাপুর-বাসিন্দারা বিশেষ করে ইংরেজগুষ্টি নৃত্য-মদে মত্ত ছিলেন। এস্থলেও তাই হল। হিটলারের বিদায় নেওয়ার পরই সবাই বুঝে গেল, এই শেষ, আর আশা-নিরাশার কিছু নেই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বুঙ্কারে হিটলারেরটা প্রথম) তখন আরম্ভ হল জালা জালা অত্যুকৃষ্ট মদ্যপান ও গ্রামোফোনযোগে নৃত্য। হেসে নাও দু দিন বই তো নয়- এস্থলে দু দিন শব্দার্থে। ঠিক দুদিন বাদেই রুশরা বুঙ্কার দখল করে।