স্বর্ণমৃগ ৩

০৯.

এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। ভাবছে রানা।

পুলথ্রু দিয়ে পিস্তলটা পরিষ্কার করছে ও। শুধু পাথর ফেলা ছাড়া ওয়ালী আহমেদের সঙ্গে স্বর্ণমৃগের কোনও যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দুইজন একই ব্যক্তি কি না তা এই সামান্য সূত্র ধরে হলফ করে বলা যায় না। দেখা যাক, আজ মোহাম্মদ জানের সঙ্গে গিয়ে যদি নতুন কোনও তথ্য আবিষ্কার করা যায় তখন বোঝা যাবে। গুণে গুণে আটটা গুলি ভরে নিল রানা ম্যাগাজিনে। স্লাইড টেনে চেম্বারে একটা গুলি ভরল। ম্যাগাজিনটা ঢুকিয়ে দিল যথাস্থানে। ক্লিক করে ক্যাচের সাথে আটকে গেল সেটা। সেফটি ক্যাচ অফ অবস্থায় যন্ত্রটা শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে দিল। দ্রুত কয়েকবার পিস্তল বের করা প্র্যাকটিস করল। ঠিক জায়গা মতই বারবার হাত পড়ছে দেখে নিশ্চিন্ত মনে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই এসে পড়ল মোহাম্মদ জান। একা। ম্যানেজারের সঙ্গে দুই-একটা জরুরি কথা বলেই বেরিয়ে এল রানা হোটেলের বাইরে। মোহাম্মদ জানের ওপেল রেকর্ড দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।

‘সাঈদের কাছে শুনলাম পাথর পড়ার কথা। পাথরটাও দেখলাম। এ দেখছি রীতিমত জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘এখন আমরা চলেছি কোথায়?

‘সাদারে। কয়েকটা আড্ডায় যাব আমরা। আগেই খবর দিয়েছি, লোক থাকবে আমার। আমার মালাকান্দের লোক-কারাচিতে এখন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। কিছু না কিছু খবর বেরোবেই, দেখো তুমি।

রানা চুপ করে ভাবছে অনীতা গিলবার্টের কথা।

‘ওহ-হো! আসল কথাই তো ভুলে গেছি। আবার বলল মোহাম্মদ জান।

‘তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, রানা। পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছ জিনার? দেখেছ, একদিনেই কেমন অন্য মানুষ হয়ে গেছে? জীবনে যে কাজ করেনি, দেখে এলাম সেই কাজ করছে। গুনগুন গান গাইছে আর ঘর-দোর গোছাচ্ছে। কাল যে জন্মদিন! তোমাকে কী বলব মেজর, আমার খুশি আমি চেপে রাখতে পারছি না। কিছুতেই। বাঁচালে তুমি আমাকে। মনে হচ্ছে আমার বুকের ওপর থেকে মস্ত ওজনের একটা পাথর কেউ সরিয়ে দিয়েছে। আজ সাত বছর এমন স্বস্তির নিঃশ্বাস আর ফেলিনি। মারী পাঠাবার বোধহয় আর দরকারই হবে না। রানাকে নড়েচড়ে উঠতে দেখে চট করে যোগ করল, ‘অবশ্য, তবু পাঠাতে হবে। ভাল ডাক্তার দিয়ে থরো চেকাপ করাতেই হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমার আর ভয় নেই একফোঁটাও! খোদার কাছে হাজার শোকর, কোথা থেকে তোমাকে এনে হাজির করেছেন ঠিক সময় মত।

উচ্ছ্বসিত আনন্দে বক বক করতে থাকল স্নেহান্ধ পিতা। বড় বড় রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি চলেছে এখন অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা ধরে। একটা সাইনবোর্ডে পড়ল রানা এলফিন্সটন স্ট্রিট, তারপর পড়ল ওরা ভিক্টোরিয়া রোডে।

মোড় ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়েই দাঁড়াল গাড়ি। রাস্তার ডানধারে ক্যাফে জর্জ’। বেরিয়ে এল রানা ও মোহাম্মদ জান গাড়ি থেকে। মাটির নীচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার ব্যবস্থা। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার ভিড় কমে গেছে অনেক–তবু আণ্ডারগ্রাউণ্ড ক্রসিং দিয়ে ডান ধারে এসে দাঁড়াল ওরা ক্যাফে জর্জের সামনে। বাইরে থেকে দেখতে নোংরা অথচ ভিতরটা গমগম করছে, লোকজনের কথাবার্তায়। বাইরেই একটা প্রকাণ্ড উনুনে সারি সারি শিক ঝলসানো হচ্ছে। সুগন্ধ এল নাকে। ঢুকে পড়ল ওরা কাঁচের দরজা ঠেলে। রানা লক্ষ্য করল এদিক-ওদিক থেকে কয়েকজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে সালাম করল মোহাম্মদ জানকে। সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল মোহাম্মদ জান ঢোলা পাঞ্জাবী আর বিশ গজী পাজামায় খশখশ আওয়াজ তুলে।

কোণের টেবিলে একজন গুণ্ডা কিসিমের লোক বসে ছিল। ডান চোখের নীচ থেকে উপরের ঠোঁট পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। ঝকড়া মাথার চুল। গলায়। তাবিজ। মোহাম্মদ জানের সাথে চোখের ইঙ্গিতে কিছু ভাব আদান-প্রদান হলো-রানা সেটা খেয়াল না করার ভান করে সোজা ঢুকে গেল একটা কেবিনে মোহাম্মদ জানের পিছু পিছু। তিন শিক আর তিন চায়ের অর্ডার দিল সর্দার।

মিনিট কয়েক পরেই কেবিনের পেছনে একটা দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করল সেই গুণ্ডা। পরিষ্কার ডাকাতের চেহারা। মোহাম্মদ জানের পায়ে ধরে সালাম করল সে, তারপর বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। মুখে ভয়ঙ্কর একটা নিঃশব্দ হাসি। কেবিনের পর্দাটা আগেই টেনে দিয়েছে মোহাম্মদ জান।

নিচু গলায় অনর্গল কথা বলল কিছুক্ষণ দুজনে পশতু ভাষায়। বারকয়েক মাথা ঝাঁকাল গুণ্ডাটা। রানার দিকে অবাক চোখে চাইল কয়েকবার। হঠাৎ রানার দিকে লক্ষ করতেই লজ্জিত হয়ে মোহাম্মদ জান বলল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার এই বন্ধু একবিন্দুও বুঝতে পারছেন না আমাদের আলাপ। উর্দুতেই কথা বলা উচিত ছিল আমদের।

কথার ভঙ্গিতে রানা বুঝল জেনে শুনেই পশতুতে কথা বলেছে মোহাম্মদ জান। তিন প্লেটে শিক কাবাব, সাথে তিনটে গরম নান-রুটি আর তিন পেয়ালা চা ঠক ঠক করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেল বেয়ারা। বাকি কথাবার্তা উর্দুতেই হলো।

‘তা তোমরা সোনা দাও কার কাছে?’ পোয়াটেক কাবাব মুখে ফেলে অবশিষ্ট ফাঁকটুকু দিয়ে জিজ্ঞেস করল মোহাম্মদ জান।

‘আমরা কারও কাছে দিই না, সার্দারজী। তারাই আমাদের খুঁজে বের করে। নিয়ে যায় মাল। দেড় বছর আগে আমরা যাদের কাছে যেতাম তারা আর। মার্কেটে নেই। তারাও এখন আমাদের মতন সাপ্লায়ার হয়ে গেছে। এখন, হঠাৎ কোথা থেকে এক একদিন একেকজন আসে, নগদ টাকা দিয়ে মাল নিয়ে যায়। যাবার সময় একটা সঙ্কেত বলে যায়–সেই সঙ্কেত দিলেই আমরা নতুন লোককে চিনতে পারি, নির্ভয়ে মাল দিই। আমাদের কাজ হলো শুধু মাল জমা করে রেডি রাখা। ব্যস। এর বেশি জানতে গেলেই সাফ করে দেয়। পর পর চার পাঁচজন খুন হয়ে যাবার পর আমরা আর সে চেষ্টা করি না।’

কিন্তু বছর দেড়েক ধরে যে নতুন লোকটা কারবার করছে, একটা লোকও তাকে চাক্ষুষ দেখেনি, এ কেমন কথা? তোমাদের কেউ কখনও দেখোনি ওদের লোক যায় কোথায়? পিছু নাওনি কখনও?’

বললাম তো। আপনি সর্দার। আপনার সাথে ঝুট বললে খোদার কাছে ঠেকা থাকব। চার পাঁচজন চেষ্টা করেছিল। ওদের লাশ পাওয়া গেছে।

‘ওরা চেষ্টা করতে গিয়েছিল কেন? রানা জিজ্ঞেস করল।

‘কৌতূহল।

‘তা হলে দেখা যাচ্ছে, আসল লোকটা খুবই সাবধানে নিজেকে গোপন রাখতে চায়?

‘খুব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ আহার করল তিনজন। প্লেট খতম করে তস্তরির ওপর। আধ কাপ চা ঢেলে নিয়ে ফড়ফড় করে টানছে ডাকাতটা। নীরবতা ভঙ্গ করল। মোহাম্মদ জান।

‘আল্লারাখার কাছে কোনও খবর পাওয়া যাবে? করাচিতে আছে না এখন?

‘জী, সর্দার। তবে ওর কাছ থেকেও কোনও খবর পাবেন বলে মনে হয়। এ এক সাঙ্ঘাতিক দল।’

‘তুমি পর্যন্ত এ ধরনের কথা বলছ, দিল্লির? তুমি না মালাকান্দের ছেলে? এখানে এসে বিড়ালের বাচ্চা বনে গেলে?

চুপ করে বকা হজম করে নিল দিল্লির খান।

‘তা হলে দেখছি অন্যের কাছে যাওয়া বেকার। আমাকেই নামতে হবে। ময়দানে। খবরটা আমার চাই-ই।’

‘আমরা থাকতে আপনি কেন ময়দানে নামবেন, সর্দারজি? আমরা খতম হয়ে গেলে তারপর নামবেন আপনি। তার আগে নয়। আপনি শুধু হুকুম করুন, সর্দার।

‘দিন কয়েক অপেক্ষা করলে আসবে না ওদের লোক?’

‘আসবার সময় হয়ে গেছে, সর্দার। আজও আসতে পারে, কালও। কিন্তু আমি জানি, ওদের সাথে বেঈমানী করলে আর রক্ষা নেই। কবর থেকে খুঁড়ে তুলে মারবে। আপনি হুকুম করলে মৃত্যকে পরোয়া করব না, সর্দার।’

‘আমি হুকুম করছি। তোমার যাতে কোনও বিপদ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখব আমরা।’

হাসল দিল্লির ওর ভয়ঙ্কর নিঃশব্দ হাসি।’

‘আপনার হুকুম আমার শিরোধার্য, সর্দারজি। আমি মালাকান্দের কুসন্তান। কিন্তু যত দূরেরই হোক, আপনার রক্ত আমার শরীরেও আছে।’ পা ছুঁয়ে কপালে। ঠেকাল দিল্লির। তবে আমার বিপদের দিকে লক্ষ রাখার কোনও দরকার নেই-কোনও লাভ হবে না তাতে। আপনি আমার পরিবারের ভার গ্রহণ করলে নিশ্চিন্তে জান দিতে পারব আমি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে সর্দার, সেই লোক। আপনাকেও ছাড়বে না।’

রানা ভাবল, কী আশ্চর্য ক্ষমতা এই ট্রাইবাল চিফদের। সাধারণ লোকের কাছে ঈশ্বরের নীচেই এদের স্থান। লোকটা স্থির নিশ্চিত যে কেউ ওর মৃত্যু। ঠেকাতে পারবে না-বেঈমানী করলে খুন হতেই হবে। তবু সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল!

‘আচ্ছা, এই গ্যাঙের শেষ মাথায় কী ধরনের লোক আছে বলে তোমার ধারণা?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘ভদ্রলোক। ডান ভুরুটা উপরে উঠিয়ে রানার দিকে চাইল দিল্লির খান। কানাঘুষোয় শুনেছি দারুণ এক বুদ্ধিমান লোক এসেছে এখন এই ব্যবসায়ে। পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে নাকি সারা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রিমিনালদের নিয়ে মস্ত শক্তিশালী একটা দল তৈরি করতে চায়। তাই তোক বাছাই করছে। পাঁচ হাজার থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত মায়না দেবে মাসে মাসে, যোগ্যতা অনুযায়ী। সবই শোনা কথা। টুকরো টুকরো এর-ওর কাছ থেকে শোনা। আমাদের মধ্যে প্রবল একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এই নতুন লোককে ঘিরে।

‘আচ্ছা, দিল্লির খান, দু’মিনিট ভেবে উত্তর দাও। তোমাদের মধ্যে কেউ কি ওদের আড্ডার কোনও উড়ো খবরও রাখে না? খালি একটা ঠিকানা পেলেই তোমাকে আর বিপদের মধ্যে টানব না আমরা। তোমার বালবাচ্চাকে এতিম করবার ইচ্ছে নেই আমাদের। শুধু একটা ঠিকানা।

চট করে রানার মুখের দিকে চাইল একবার দিল্লির খান। কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে চিন্তান্বিত ভাবটা দূর হয়ে গেল মুখের উপর থেকে। মনের গভীরে হাতড়ে পেয়েছে সে এক টুকরো বাঁচবার অবলম্বন। উদগ্রীব হয়ে রইল রানা।

‘সেখানে গেলে কোনও লাভ হবে কি না বলতে পারি না। হয়তো সেখানে গিয়েছিল লোকটা অন্য কাজে। কিন্তু আমি একটা দোকানে ঢুকতে দেখেছি একজনকে। চোখের ভুলও হতে পারে। তবে আমার যতদূর বিশ্বাস এই লোকটাই দশ মাস আগে আমার কাছ থেকে সোনা নিয়েছিল পাঁচ শ’ আউন্স।

কীসের দোকান?’ টেবিলের উপর দুইবাহু রেখে সামনে ঝুঁকে এল রানা।

‘মাছের!’ ফিসফিস করে বলল দিল্লির খান।

মাছের বাজার মনে করে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠল রানার মুখে। তাই আবার বলল দিলিব্ল খান, ওই মাছ না। ছোট ছোট রঙীন সব মাছ। কাঁচের বাক্সে রাখা। জ্যান্ত। যেদিন দেখলাম লোকটাকে ওই দোকানে ঢুকতে সেদিন থেকে ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটি না আমি।’

কাগজ বের করে ঠিকানাটা লিখে নিল রানা। কাছেই, ভিক্টোরিয়া রোডের উপরেই দোকানটা।

‘যদি এ ঠিকানায় কিছু পাওয়া না যায় তা হলে হয়তো তোমার সাহায্য আমাদের নিতেই হবে, দিল্লির খান,’ বলল রানা।

‘বেশক্‌। কিন্তু সাবধান! দুশমন বড় হুশিয়ার।

চোখ পাকিয়ে কথাটা বলে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল দিল্লির খান। গেলাস ঠুকে বেয়ারাকে ডাকা হলো। বিল চুকিয়ে বেয়ারাকে মোটা বখশিশ দিয়ে আবার গাড়িতে চাপল ওরা। ড্রাইভারকে ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল মোহাম্মদ জান। মাথা নেড়ে, ‘জী, সর্দার,’ বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল ড্রাইভার নির্জন হয়ে আসা রাস্তা ধরে।

অনেক দোকান সারি সারি। বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও কোনওটা সামান্য একটু খোলা-ভেতরে হিসাব-কিতাব হচ্ছে সারাদিনের বিকিকিনির। গাড়ি এসে থামল ফুটপাথের ধারে। নীল নিয়নে সুন্দর করে ইংরেজিতে লেখা: ফিশ এমপোরিয়াম। নামটা চেনা চেনা লাগল। কোথায় দেখেছে?…মনে পড়ল রানার, এই নামটা দেখেছে চট্টগ্রামের ‘বিপণী বিতানে। এদেরই ব্রাঞ্চ নাকি? নাকি এটাই ওদের ব্রাঞ্চ?

বাইরে থেকে দেখা গেল কাঁচের শো-রুমে সুন্দর করে সাজানো আছে কয়েকটা অ্যাকুয়েরিয়াম। কয়েকটা শেলফে সাজানো বিচিত্র বর্ণ ও আকারের ঝিনুক ও শঙ্খ। পেছনে কালো পর্দা টাঙানো আছে বলে দোকানের ভিতরের চেহারাটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। একদিকের শাটার টেনে নামানো হয়েছে। আরেকটাও নামানোর উদযোগ হচ্ছে। বন্ধ করছে দোকান।

ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রানা একবার ভাবল আজ ফিরে যাবে কি না। কাল এলেই বোধহয় ভাল হয়। কিন্তু খরিদ্দার দেখেই উৎসাহিত কণ্ঠে ভিতর থেকে ডাক দিল একজন। ঢুকে পড়ল ওরা দোকানের ভিতর।

চারপাশে কেবল মাছ আর মাছ। মাঝের সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে কিছুদূর গেলে অফিস ঘর। দোকানে পা দিতেই সজাগ হয়ে উঠল রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, সাবধান! সামনে বিপদ! অদ্ভুত এক ক্ষমতার বলে কী করে জানি আগে থেকেই টের পায় ও বিপদ। এবার বড়ো দেরি হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল রানা, কিন্তু মোহাম্মদ জান সোজা ঢুকে গেছে ভিতরে, তাই ও-ও চলল পিছন পিছন। বাম বাহু দিয়ে চেপে একবার অনুভব করল স্প্রিং লোডেড শোল্ডার হোলস্টারটা। দ্রুত পা ফেলল ও মোহাম্মদ জানের কাছাকাছি থাকার জন্যে।

হরেক সাইজের অ্যাকুয়েরিয়াম। ছোট, বড়, মাঝারি। তার মধ্যে সুন্দর সুন্দর, রঙীন সব মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি জারের ওপর লালচে আলোর ব্যবস্থা আছে। তাতে লাল মাছ আরও লাল দেখায়। নানান রকম গাছ, শেওলা। জাতীয় উদ্ভিদ লাগানো আছে কাঁকর ও বালিতে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদ্বুদ উঠছে সুন্দর সব স্টোন থেকে। সুন্দর সুন্দর ঝিনুক, শঙ্খ রুচিসম্মতভাবে ছড়ানো বালির উপর।

‘আসুন স্যর, আসুন। এক্ষুণি সেল ক্লোজ করতে যাচ্ছিলাম। কী মাছ। লাগবে আপনার? বার্থডে প্রেজেন্টেশান?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল রানা। ভাবল, হঠাৎ জন্মদিনের কথা মনে হলো কেন ব্যাটার? বড়লোকেরা বোধহয় বার্থ ডে-তে এসব উপহার দেয়। নইলে চলবে কী করে এসব দোকান? লোকটার মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি রাখল রানা। গোলগাল মুখটা, হাসি খুশি। যেন দুঃখ কাকে বলে জানে না। অমায়িক হাসি লেগে আছে সব সময় ঠোঁটের কোণে।

‘তা হলে, স্যর, অ্যাঞ্জেল ফিশ নিন। চমৎকার একজোড়া ব্ল্যাক অ্যাঞ্জেল আছে। মাদাগাস্কার থেকে ধরা। মাত্র পাঁচশো টাকা। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে।

এ পিছন ফিরে লোকটা হাঁটতে আরম্ভ করবে এমন সময় রানা বলে বসল, ‘আমরা চাইছি গোল্ড ফিশ। ভাল কোনও ভ্যারাইটি আছে?’ ভেতরের দিকে যেতে চাইছে না রানা।

কী যে বলেন, স্যর। নেই? কত রকম ভ্যারাইটি চান? চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। আপনার। আসুন আমার সঙ্গে।… এবার আর কোনও কথাতেই কান না দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটতে থাকল লোকটা।

কয়েক পা এগিয়েই মোহাম্মদ জানেরও বোধহয় রানার সেই অনুভূতিটা হলো। থেমে পড়েই পেছন ফিরল সে। রানার পেছনে তিনজন যণ্ডামার্কা লোক দেখতে পেল সে। ঘড় ঘড় করে নেমে গেল শাটারটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল মোহাম্মদ জানের মুখ। বুঝল, হঠাৎ বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছে। বেরোবার উপায় নেই। রানা চোখ টিপল একবার। মৃদু হাসির চেষ্টা করল মোহাম্মদ জান, কিন্তু সেটা মুখ বিকৃতির মত লাগল দেখতে। বোঝা গেল দমে গেছে সর্দার। দিল্লির খানের কথা মনে পড়ল। বেশি জানতে চাইলেই সাফ করে দেয়… কয়েকজন চেষ্টা করেছিল। ওদের লাশ পাওয়া গেছে।

একটা বড় অ্যাকুয়েরিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। পানির মধ্যে বালি আর পাথরের কুচির উপর একটা পাত্রের মধ্যে সহস্র বাহু ওপরে তুলে কিলবিল, করছে একদলা টিউবিফেক্স ওঅর্ম। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওগুলোকে গোটা কয়েক গোল্ড ফিশ। রানার সাথে মোহাম্মদ জানের চোখে চোখে কিছু ইঙ্গিত বিনিময় হয়ে গেল। মাছগুলো সম্পর্কে বক্তৃতা আরম্ভ করতে যাচ্ছিল ‘ম্যানেজার, হঠাৎ ধাই করে এক লাথি লাগাল মোহাম্মদ জান ম্যানেজারের কাকালে। ছিটকে গিয়ে পড়ল লোকটা অ্যাকুয়েরিয়ামের উপর। কনুইয়ের ধাক্কা লেগে ভেঙে গেল কাঁচ। হাতটাও কেটে গেল খানিকটা। ঝর ঝর করে পানি পড়ে ভেসে গেল মেঝে। ছোট ছোট রঙিন মাছগুলো তড়াক তড়াক করে লাফাতে থাকল মোজাইক করা। মেঝের উপর। এবার একটা প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে সটান শুয়ে পড়ল ম্যানেজার মাটিতে। মাটিতে পড়ে মাছগুলোর মতই লাফাতে থাকল লাথি থেকে বাঁচবার জন্য।

রানাও একই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে পিছনের লোকগুলোর ওপর। দড়াম করে নাকের ওপর রানার একটা অতর্কিত ঘুসি খেয়ে ছিটকে সাত হাত দূরে গিয়ে পড়ল প্রথম জন। দ্বিতীয় জনের উদ্দেশ্যে চালাল লাথি। তৃতীয় জন একটু দূরে ছিল-হঠাৎ সে পুকুরে ডাইভ দেয়ার মত সোজা ঝাঁপ দিল রানার পেট লক্ষ্য করে। মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত প্রচণ্ড জোরে এসে পড়ল রানার পেটের ওপর। ধাক্কা সামলাতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানা। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। পিস্তলটা বের করল ও তারই মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেই সময় পায়ের তলায় পড়ল একটা গোল্ড ফিশ। সড়াৎ করে পা পিছলে গেল রানার। সাথে সাথেই প্রচণ্ড একটা ঘুসি লাগল ওর বাঁ কানের উপর। পড়ে গেল রানা। হাঁটুতে লাগল খুব, এবং চোখটা আঁধার হয়ে গেল শক্ত মেঝেতে নাক ঠুকে যাওয়ায়। পিস্তলটা হাত থেকে খসে চলে গেল একটা অ্যাকুয়েরিয়াম বসানো টেবিলের নীচে। নাক থেকে রক্ত বেরিয়ে ভেজা মেঝে লাল হয়ে গেল বেশ খানিকটা জায়গা। চোখ দুটো আঁধার হয়ে গেছে। বো বো করে ঘুরছে। মাথা। তবুও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল ও।

ততক্ষণে আরও কয়েকজন লোক এসে হাজির হয়েছে। মোহাম্মদ জানকে কাবু করে ফেলে হাত দুটো বাধা গেছে পেছনে। বাঘের বাচ্চার মত গজরাচ্ছে। আর ছটফট করছে মোহাম্মদ জান বাঁধন খুলবার ব্যর্থ চেষ্টায়। রানাকেও বেঁধে ফেলা হলো।

কয়েকবার মিটমিট করে চোখের পাতা থেকে পানি সরিয়ে চারদিকে চাইল রানা। বুকের কাছে শার্টের ওপর রক্ত পড়ছে এখনও নাক থেকে টপ টপ। তিন। দিক থেকে তিনটে রিভলভার ধরা ওর দিকে। ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে একটু বাঁকা হয়ে। এক হাতে ঘষছে লাথি খাওয়া জায়গাটা।

‘আগে বাঢ়ো।

হুকুম করল একজন পিছন থেকে। এগোল ওরা পিছনের ধাক্কায়। কিছুদূর গিয়েই ছোট একটা কামরায় ঢুকল ওদের নিয়ে সব কজন। ঘরটা আট ফুট বাই আট ফুট হবে। সাতও হতে পারে। স্টোর রুম, মনে হলো। দেয়ালের গায়ে বসানো কয়েকটা বড় সাইজের কাঁচের আলমারি-ভেতরে নানান আকারের, বিচিত্র কারুকার্য খচিত সামুদ্রিক ঝিনুক আর শঙ্খ। চার কোণে চারটে অ্যাকুয়েরিয়াম-গায়ে ইংরেজিতে লেখা সাবধান! বিষাক্ত মাছ। একটা জারে বিষাক্ত স্করপিয়ন ও লায়ন ফিশ দেখে চিনতে পারল রানা। ফ্লুরেসেন্ট টিউব জ্বলছে ঘরের মধ্যে।

একটা বিষাক্ত মাছের অ্যাকুয়েরিয়ামের আড়ালে গোপন করা সুইচ টিপল একজন। নামতে আরম্ভ করল ওরা নীচে। রানা বুঝল এটা একটা লিফট। মাটির তলায় নিশ্চয়ই আরও ব্যাপার-স্যাপার আছে। স্টোর রুম দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না যে এটাই মাটির তলায় গোপন আড্ডায় যাওয়ার পথ।

নীচে এসে থামল লিফট। বেরিয়ে এল ওরা বাইরে। চারফুট চওড়া রাস্তা। ডান দিকে অল্পদূর গিয়ে আটফুটী রাস্তায় পড়ল ওরা। কিছুদূর পরপর শেড় বিহীন বালব ঝুলছে সিলিং থেকে। মাটির নিচে গোলক ধাঁধার পাতালপুরী তৈরি করেছে স্বর্ণমৃগ। গলির দু’পাশে সারি সারি ঘর। এ-গলি-ও গলি পার হয়ে বেশ, কিছুদূর যাওয়ার পর থামল ওরা একটা মোড়ের ওপর। এতক্ষণে মুখ খুলল একজন।

‘এবার দু’জন দু’দিকে। শেষ বিদায় নিয়ে নিতে পারো।

মোহাম্মদ জানের দিকে চেয়ে হাসল রানা। দাঁতে রক্ত। বলল, ভ্যাগ্যিস পুলিশে খবর দিয়ে ঢুকেছিলাম এখানে!

‘হ্যাঁ, দশ মিনিটেই হাতকড়া পড়বে ব্যাটাদের হাতে। এতক্ষণে চারদিক ঘিরে ফেলেছে নিশ্চয়ই। আচ্ছা, দেখা হবে। একটা ধাক্কা খেয়ে কথাটা শেষ করেই বয়ে এগোল মোহাম্মদ জান। চারজন গেল সঙ্গে।

এই মিথ্যে কথায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য দেখা গেল না ওদের মধ্যে।

একজন হুকুম করল, নাথু, তুমি জনাদুই লোক নিয়ে পেছনের পথ দিয়ে বেরোও। রাস্তায় দাঁড়ানো ড্রাইভারকে ধরে প্রথমে আচ্ছামত দুরমুজ করবে, তারপর নিয়ে আসবে ভেতরে। গাড়িটা একজন নিয়ে গিয়ে নুমায়েশ বা গুরুমান্দারের কাছে রেখে আসবে। কিংবা হোটেল মেট্রোপোলের সামনে পার্ক করে রেখে আসতে পারো।

‘আর তুমি এদিকে, ধাক্কা দিল পেছনের লোকটা রানাকে।

আবার কয়েকটা গলি পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপল একজন। ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজা। দরজার ফাঁক জুড়ে দাঁড়িয়ে। আছে গুংগা।

চমকে উঠল রানা। বীভৎস চেহারা। শুধু ল্যাংগোঠ ছাড়া কিছুই নেই সারা দেহে। রানাকে দেখেই ছোট ছোট চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল গুংগার। ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ বেরোল ওর মুখ দিয়ে। থাবা দিয়ে ধরল সে রানার চুল একহাতে। রানার উরুর সমান মোটা পেশিবহুল সে হাত। অন্য হাতের ইশারায় লোকগুলোকে বিদায় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে প্রায় ঝোলাতে ঝোলাতে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।

সাজানো গোছানো একটা প্রশস্ত ড্রইং-রুম। সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল একজন লোক, পায়ের শব্দে কাগজটা নামাল মুখের সামনে থেকে।

ওয়ালী আহমেদ।

‘আসুন। আসুন, মিস্টার মাসুদ রানা। বসুন ওই সোফায়।’

রানাকে বসতে হলো না। বসিয়ে দিল গুংগা চুলের মুঠি ধরে। তার আগেই। পেছন দিকে জোরে একটা লাথি চালাল রানা। হাঁটুর নীচে হাড়ের ওপর গিয়ে। লাগল স্টিলের পাত বসানো জুতোর গোড়ালি। আর কেউ হলে বাবা-গো, মা গো বলে বসে পড়ত মাটিতে। কিন্তু আশ্চর্য, একবিন্দু বিচলিত হলো না গুংগা।

‘বৃথা চেষ্টা, মিস্টার মাসুদ রানা। ওর শরীর হচ্ছে পেটা লোহা। ও-সবে ওর কিছুই হবে না,’ বলল ওয়ালী আহমেদ।

প্রতিদিন সকালে দুজন জোয়ান প্যাহেলওয়ান মুগুর পেটা করে ওর সর্বাঙ্গ মাটিতে শুইয়ে নিয়ে। সে দৃশ্য দেখলে এই সামান্য প্রয়াসে লজ্জা হত আপনার। গত বিশ বছর ধরে এই রুটিন চলে আসছে। এখন এসব সামান্য আঘাত তো। দূরে থাক, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা বা পিস্তলের গুলিও ওর শরীরে প্রবেশ করানো

কথাটা শেষ করেই মুখ দিয়ে একটুও শব্দ বের না করে কেবল ঠোঁট নাড়াল ওয়ালী আহমেদ গুংগার উদ্দেশে। রানার সারা দেহ সার্চ করে দেখল গুংগা। সিগারেট কেস, রুমাল এবং লাইটারটা বের করে রাখল নিচু টেবিলের ওপর। কোনও অস্ত্র নেই। হাঁটুর নীচে পায়ের সঙ্গে বাঁধা যে ছোরার খাপ থাকতে পারে সে কথা একবারও চিন্তা করল না সে। সন্তুষ্টচিত্তে রানার হাতের বাধন খুলে, দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পিছনে যমদূতের মত।

‘আরাম করে বসুন, মিস্টার রানা। আপনার পেছনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, অসম্ভব দ্রুতগতিতে নড়াচড়া করতে পারে সে। কাজেই কোনও রকম। কুমতলব থাকলে দয়া করে পরিত্যাগ করাই আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে। ওর হাত এড়িয়ে আমার কাছে পৌঁছতে পারবেন না আপনি কোনওদিন। তা ছাড়া আমার হাতের দিকে লক্ষ্য করলে ছোট্ট একটা যন্ত্র দেখতে পাবেন। যন্ত্রটা ছোট হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী। এটা প্রস্তুত থাকবে। বুঝতে পেরেছেন? এবার আরাম করে বসে দু’একটা খোশ-গল্প করা যাক, কী বলেন? ১ রানা চেয়ে দেখল একটা পয়েন্ট টু-ফাইভ ক্যালিবারের স্কেলিটন-গ্রিপ বেরেটা অটোমেটিক ধরা ওয়ালী আহমেদের হাতে। টেবিলের ওপর থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে নাক মুখের শুকিয়ে আসা রক্ত মুছে ফেলল রানা। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে হেলান দিয়ে বসল ফোম রাবারের নরম সোফায়।

‘আপনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না, মিস্টার মাসুদ রানা। দুই দুইবার আপনি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। বুদ্ধিমান ও সাহসী লোক আপনি। কিন্তু শেষমেশ আমার খাঁচায় তো সেই ঢুকতেই হলো। আপনাকে।

রানা ভাবছে, তা হলে ওয়ালী আহমেদই স্বর্ণমৃগ? নাকি এটা কোইনসিডেন্স? রানার করাচি আগমনের হেতুটা কী জানতে পেরেছে ওয়ালী আহমেদ? . আপনার আঘাত আমি আরও আগেই আশা করেছিলাম। এত দেরি হলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘দেরি কোথায়? যেই মাত্র জানলাম আপনার পরিচয়, তক্ষুণি হুকুম দিয়ে দিলাম। আজ ভাগ্যক্রমে দুবার বেঁচে গেছেন, আমার কিছু বিশ্বস্ত লোকও খুন করে ওভারট্রাম্প করেছেন। কিন্তু আরও অনেক ট্রিক্স ছিল হাতে। আজ রাত পোহাবার আগেই গেম এবং রাবার করে বসে থাকতাম আমি। যাক, ভালই হলো, নিজেই ঠিকানা জোগাড় করে এসে উপস্থিত হয়েছেন।’

‘এবং আরও অনেকে শিগগিরই উপস্থিত হবেন।

‘এসে লাভ নেই। যদি তাই হয়, গোপন পথে বেরিয়ে যাব আমরা। তেমন প্রয়োজন হলে এই দোকান বন্ধ করে দেব। আমার আসল কাজে কোনও অসুবিধে হবে না। যাক, যা বলছিলাম। আজ বিকেলেই স্থির করলাম আমি, আপনাকে ছাড়া চলবে না। আপনার মত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী লোককে হয়। নিয়ে নিতে হবে আমার সাথে, নয় সরিয়ে ফেলতে হবে চিরতরে। কাজেই খোঁজ নিলাম। আপনি বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যেই আপনার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলাম আমি।’ পান মুখে ফেলল সে একটা।

‘আমার অপরাধ?

‘আমার পেছনে লাগতে যাওয়াটা অপরাধই বৈকি। দুই আঙুলে খানিকটা জর্দা টিপে তুলে ছেড়ে দিল সে মুখ বিবরে।

‘আপনার জোচ্চুরি ধরে ফেলায় মৃত্যুদণ্ড? সুবিচারই বটে!

‘সেজন্যে নয়। ন্যাকামি করছেন আপনি। আপনি ভাল করেই জানেন কেন আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজ বিকেলে আমার জুয়া খেলা কৌশল আবিষ্কার করে ফেলায় আপনার ওপর যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম আমি। সেই মুহূর্তে মনে মনে আপনার বেতন ধার্য করে ফেলেছিলাম। আপনি এখন পাচ্ছেন। মাসে দু’হাজার করে-আমি অবশ্য তখন জানতাম না সে-কথা, পরে জেনেছি। আমি মনে মনে স্থির করেছিলাম আপনাকে মাসে বারো হাজার টাকা বেতন দেব, সেই সাথে হাফ পারসেন্ট কমিশন। অর্থাৎ কোম্পানির হাজার টাকা লাভ হলে পাঁচ টাকা আপনার। বছর শেষে এই কমিশনই গিয়ে দাঁড়াত দুই লাখে।’

‘বাহ, এ তো চমৎকার অফার! কোন্ বোকা এই সুযোগ ছাড়বে? টিটকারি মারল রানা।

‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, রানার টিটকারিতে কান না দিয়ে বলে চলল ওয়ালী আহমেদ, নিরাশ করেছেন আপনি আমাকে। আপনার সম্পর্কে তথ্য যা পাওয়া গেল, তাতে দেখা গেল আমার মৃত্যু গহ্বরে প্রবেশ করবার জন্যেই জন্ম হয়েছিল আপনার। আমার জন্যেই পাঠানো হয়েছে আপনাকে। আরও খবর নিয়ে জানলাম আজ পর্যন্ত কোনও রকম প্রলোভন দেখিয়েই আপনাকে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। কাজেই অন্য আর কোনও পথ থাকল না আমার।

রানা বুঝল ও খোদ স্বর্ণমুগের সামনে বসে আছে। আর কিছুক্ষণ আগেই যদি বুঝতে পারত! এক মিনিট চুপ করে থেকে নীরবতা ভঙ্গ করল ওয়ালী আহমেদ।

‘আপনি বোধহয় ভাবছেন, আর একটু আগে যদি টের পেতেন যে যার জন্যে এতদূর ধাওয়া করে এসেছেন সে হচ্ছে সুবিখ্যাত শিল্পপতি ওয়ালী আহমেদ, তা হলে…’

হাসল ওয়ালী আহমেদ।

‘এখনও যদি ছেড়ে দিই আপনাকে, সবকিছু জানার পরেও, তা হলেও আপনি আমার গায়ে একটি আঁচড়ও কাটতে পারবেন না। শত চেষ্টা করেও আমার বিরুদ্ধে একটি প্রমাণও জোগাড় করতে পারবেন না।

‘ছেড়ে দিয়েই দেখুন না!’ বলল রানা। সে সাহস তো নেই!

উত্তর দিল না ওয়ালী আহমেদ। ইশারা করতেই দেয়াল আলমারির ভিতর থেকে দুটো গ্লাস আর বোতল বের করে আনল গুংগা। ততক্ষণ একটি কথাও না। বলে রানার পেটের দিকে ধরে থাকল ওয়ালী আহমেদ পিস্তলটা। গ্লাস দুটো ভরে দিয়ে আবার রানার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল গুংগা। আবার মুখ খুলল ওয়ালী আহমেদ। গুংগার দিকে চোখ ইশারা করে বলল, এ আমার এক অদ্ভুত আবিষ্কার, মিস্টার রানা। এবং গর্বের বস্তু। দেখতে নিগ্রোর মত হলেও ও আসলে পাকিস্তানী নাগরিক। মাকরান থেকে সংগ্রহ করেছি ওকে। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীর রক্ত আছে ওর দেহে, তাই ও-রকম. চেহারা। লোকটা বোবা কালা। সেই কারণেই বোধহয় আশ্চর্য তীক্ষ্ণ ওর ঘ্রাণ এবং দৃষ্টিশক্তি। তা ছাড়াও পাথর ছোঁড়ায় অদ্ভুত রকমের দক্ষতা অর্জন করেছে ও। হোটেলের সামনে তিনমণী পাথরটা আজ সন্ধ্যায় ও-ই ফেলেছিল ছাদ থেকে। ও হচ্ছে কিং-কং গরিলার মনুষ্য সংস্করণ। এমন হিংস্র আর ভয়ঙ্কর প্রাণী জীবনে আর চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে একে কন্ট্রোল করা আমার জন্যেও শক্ত হয়ে পড়ে।’

লালচে চুলের মধ্যে কয়েকবার হাত চালিয়ে নিয়ে আবার বলল, আপনাকে এত খাতির যত্ন করে বসিয়ে এসব বাজে গল্প করে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি কেন, তার কারণ বুঝতে পারবেন কিছুক্ষণ পরেই। ততক্ষণ গল্পটা চালু রাখা যাক। আপনার ওপরওয়ালা শুনেছি খুব বুদ্ধিমান লোক, কিন্তু একাজে আপনাকে পাঠিয়ে উনি একটা মস্ত ভুল করেছেন। আপনার সম্পর্কে যা জানা গেল তাতে বুঝলাম দুঃসাহসিক কাজে পারদর্শিতা, সেই সঙ্গে অল্পবিস্তর কৌশল ছাড়া আর কিছুই পুঁজি নেই আপনার। কিন্তু আমাকে সত্যি সত্যি কাবু করতে হলে অন্য রকমের লোকের প্রয়োজন ছিল। আপনাকে শেষ করা ছাগল ধরে। জবাই করার মতই সহজ কাজ। কই, নিন।

রানা তুলে নিল গ্লাসটা। শ্যাম্পেন। দুই ঢোক খেয়ে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল একবার ওয়ালী আহমেদের সবুজ চোখের ওপর।

‘আচ্ছা, মিস্টার ওয়ালী আহমেদ, আমাকে যখন শেষ করে দেয়াই স্থির করেছেন, তখন নিশ্চয়ই আমার দু’একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে কৌতূহল মেটাতে কুণ্ঠিত হবেন না?

কী ধরনের প্রশ্ন করবেন তার ওপর নির্ভর করবে আমার উত্তর।

‘মৃত্যুর আগে আমি জানতে চাই কেন আপনি এত টাকার মালিক হয়েও আবার এই অসৎ কাজে নামলেন।’

‘অসৎ কাজ আমি প্রচুর করি। আপনি কোনটার কথা বলছেন?

‘সোনা চোরাচালান।

‘দেখুন, ওটা অসৎ কাজ নয়-অসৎ কাজের একটা উপায় মাত্র। আমি যত টাকা করেছি সবই অসৎ পথে। এতদিন যেভাবে উপার্জন করেছি তা বাইরে থেকে দেখতে ভদ্র-ব্যবসা মনে হলেও তার মধ্যে এতখানি অসততা আছে যে ধরা পড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমনকী ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এটাই আমার লাইন। চিরকাল এ-ই করেছি, ভবিষ্যতেও করব। যত টাকাই হোক না কেন, কেউ আমাকে বিপথ থেকে ফেরাতে পারবে না। আমি বরন ক্রিমিনাল। চোর পিতার ঔরসে সিফিলিস রোগাক্রান্ত বেশ্যা মায়ের গর্ভে আমার জন্ম। শারীরিক কয়েকটা দুর্বলতা থাকলেও অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছি আমি। যাই হোক, আত্মজীবনী শুনতে চাননি আপনি। বলছিলাম, বিপথই আমার পথ। সোনাতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ, তাই এদিকে একটা সাইড বিজনেস খুলেছি। কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য এটা নয়। আমি এক মহা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই। বাছাই করা সব খারাপ লোক নিয়ে গড়ব আমি আমার এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড সোসাইটি। টাকা আমার যথেষ্ট আছে, এবার আমি চাই ক্ষমতা অর্জন করতে। অপরাধ জগতে আমি সম্রাট হয়ে মরতে চাই। আমি সোনা চালান দিচ্ছি…’

কীভাবে?

‘হঠাৎ হেসে উঠল ওয়ালী আহমেদ। বেরিয়ে পড়ল এক সারি তরমুজের বিচি। শ্যাম্পেন শেষ হয়ে গেছে-পান মুখে ফেলল সে আরেকটা। সেই সাথে জর্দা।

‘আপনি দেখছি বাঁচার আশা ত্যাগ করেননি এখনও! ভাবছেন, আপনাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে আমার গোপনতম কথা বলতে দ্বিধা করব না আমি। চিরকাল যেমন হয়েছে, তেমনি দৈবক্রমে ছাড়া পেয়ে যাবেন আপনি। আর ছাড়া

পেয়েই সমূলে ধ্বংস করে ফেলবেন আমাকে। তাই না? থ্রিল সিরিজের আইডিয়াল নায়ক। আমি আপনাকে এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি, মিস্টার রানা, আমার হাত থেকে মুক্তি লাভ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু তবু আমি একটি কথাও বলব না আপনাকে। আপনার লাশের কানে কানে হয়তো বলতে পারি, কিন্তু জ্যান্ত থাকতে এই গোপন কথা জানবার অধিকার নেই আপনার।

তার মানে আপনার মনেও ভয় আছে যে চিরকাল যেমন হয়েছে, তেমনি এবারও আপনার হাত থেকে ছুটে যেতে পারি আমি?

তা ঠিক নয়। সাবধানের মার নেই।

এমন সময় টিপয়ের ওপর রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে তুলে হুঁ-হাঁ করল ওয়ালী আহমেদ কিছুক্ষণ। কথা বলল না একটিও, শুনে গেল কেবল। খুশি হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারা। বসন্তের বুটি বুটি দাগ ভরা গাল দুটো কুঁচকে গেল মুচকি হাসিতে। নামিয়ে রেখেদিল সে রিসিভার।

‘আমাকে না হয় হত্যা করবেন। মোহাম্মদ জান কী দোষটা করেছে? ওকে আটকে রেখেছেন কেন?’ রানা বলল।

‘ও-ই আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে।

‘মিথ্যে কথা। আমিই এনেছিলাম ওকে সাথে করে।’

যাই হোক, যদি বুঝি তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারবে না ও, তা হলে জানে মারব না। হাল্কা কোনও শাস্তি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেব। আপাতত কদিন বন্দি থাকতে হবে ওকে।

মেলা কথায় বিরক্ত হয়ে উঠছে রানা। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, এখন আমাকে নিয়ে কী করতে চান, মি. ওয়ালী আহমেদ?

‘আপনার দ্বারা আমার দুটো উদ্দেশ্য আমি পূরণ করব। এক এক করে বলছি। প্রথমটা হচ্ছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। আপনি বোধহয় শুনেছেন জিনাতের কাছে, আমি কামনা করেছিলাম ওর দেহ। আমাকে অবহেলা করে ও আত্মসমর্পণ করেছে আপনার কাছে। এর ফলে আমার আহত আত্মাভিমান অপমানে জর্জরিত হয়েছে। আমাকে বেকায়দায় ফেলে টাকা আদায় করে আপনারা যে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলেন, সে হাসি সূচের মত বিঁধেছে আমার মনে। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেছি আমি। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল ওয়ালী আহমেদের। চেহারা। তাই আপনার চোখের সামনে ধর্ষণ করবে জিনাতকে আমার দেহরক্ষী। গুংগা প্যাহেলওয়ান। আমি নিজে করব না, তার কারণ, টু টেল ইয়ু দ্য ট্রুথ, আমার সে ক্ষমতা নেই। আমি জন্ম থেকেই ইমপোটেন্ট। কিন্তু এই ব্যাপারে বরাবর আমার অত্যন্ত উৎসাহ আছে। পারভারটেড বলতে পারেন কিন্তু গুংগাকে আসরে নামিয়ে দিয়ে দর্শকের গ্যালারিতে বসে আমি যার-পর-নাই আনন্দ লাভ করি। আপনিও থাকবেন আমার সঙ্গে আজ।

‘আজ? চমকে উঠল রানা।

‘হ্যাঁ। আজ। জিনাতকে আনতে পাঠিয়েছি। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

‘অসম্ভব!

‘খুবই সম্ভব। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।’

‘জিনাত এখন তার বাপের বাড়িতে নিরাপদে আছে। ওকে রক্ষা করবার জন্যে যথেষ্ট সশস্ত্র লোক আছে সে বাড়িতে।

‘জানি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই আপনার-তাই আপনার এই সন্দেহ প্রকাশ করবার ধৃষ্টতা ক্ষমা করে দিচ্ছি। জিনাতকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনা অত্যন্ত সহজ কাজ। মাত্র তিনজন লোক পাঠিয়েছি। সাথে নিয়ে গেছে একখানা বড় সাইজের রেডিয়োগ্রাম। কলিং বেল টিপলে। বেরিয়ে আসবে বাইরে মোহাম্মদ জানের লোক তাকে বলা হবে আগামী কাল জিনাত সুলতানার জন্মদিন উপলক্ষে ওটা মাসুদ রানার উপহার। কেউ কিছুমাত্র সন্দেহ করবে না। কাঠের ডালা তুলে দেখানো হবে অত্যন্ত দামি রেডিয়োগ্রামের কিছুটা অংশ। সাদরে ডেকে নিয়ে যাবে জিনাত ওদেরকে ওর ঘরে। রেডিয়োগ্রামটা পছন্দসই জায়গায় ফিট করে দেবে আমার লোক। তারপর ফেরার সময় সেই কাঠের বাক্সের মধ্যে করে নিয়ে আসবে জিনাতের জ্ঞানহীন দেহটা সবার সামনে দিয়ে। এবার বুঝেছেন?’

বিস্মিত দুই চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে রানা ওয়ালী আহমেদের মুখের দিকে। কয়েকটা অশ্লীল গালাগালি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। গালি শুনে তরমুজের বিচি বের করে হাসল ওয়ালী আহমেদ, গায়ে মাখল না। পায়ে বাঁধা ছুরিটার কথা মনে হলো রানার। কিন্তু না। এখন স্থির থাকতে হবে। এখনও সময় আছে।

‘আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন থেকে জোগাড় করা আমার হাজার কয়েক প্রিয় মাছ বহুদিন মুখরোচক খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে, ওদের একটু আনন্দ দান করা। জিনাতের ধর্ষিত নগ্ন দেহ আপনার। দেহের সঙ্গে একসঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে নামিয়ে দেয়া হবে পানিতে। আমি স্টপ ওয়াচ নিয়ে থাকব কাছেই। ব্যাপারটা অনেকটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মত আর কী। এ ব্যাপারেও আমার উৎসাহের অভাব নেই। উজ্জ্বল বাতি থাকবে ট্যাঙ্কের ওপর। পরিষ্কার দেখা যাবে আপনাদের দেহ। আমার নিজের বিশ্বাস স্ত্রীলোকের। চাইতে পুরুষের মাংসই ওরা বেশি পছন্দ করে। সেই পরীক্ষাও হয়ে যাবে এই ফাঁকে। তবে আমার স্থির বিশ্বাস কোনও অবস্থাতেই তিন মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। সেটাও আজই বোঝা যাবে।

হাঙ্গর? জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আপনি একটা গর্দভ। হাজার হাজার হাঙ্গর পুষব কী করে আমি? এত খাবারই বা দেব কোত্থেকে? আর এজন্যে দক্ষিণ আমেরিকাতেই বা যাব কেন? এটা খুব ছোট মাছ। ছয় থেকে আট ইঞ্চি। শতখানেক এনেছিলাম শখ করে। এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্রিড করিয়েছি। এখন আমার স্টকে আছে পনেরো। হাজার।

পিরানহা! গলাটা শুকিয়ে এল রানার।

‘এইবার ঠিক বলেছেন। পিরানহা। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত দিয়ে পাঁচ মিনিটেই একটা আস্ত ঘোড়া খতম করে দেয় ঝুঁকের মধ্যে বাগে পেলে।

দ্রুত চিন্তা করছে রানা। অসম্ভব। নিশ্চয়ই খামোকা ভয় দেখাবার জন্যে বোম্বাস্টিক গুল মারছে ওয়ালী আহমেদ। এক ধরনের ম্যানিয়াতে ভুগছে। লোকটা। কিছুতেই এসব সত্যি হতে পারে না। এ হচ্ছে ওর বিকৃত মস্তিষ্কের বিকারগ্রস্ত প্রলাপ। কিন্তু যদি সত্যি হয়…

এবার আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনাকে এক্ষুণি রেপিং চেম্বারে নিয়ে যাবে গুংগা। অল্পক্ষণের মধ্যেই জিনাতও এসে পড়বে। আমিও কয়েকটা হাতের কাজ সেরেই আসছি।

নিঃশব্দে আবার কিছু বলল ওয়ালী আহমেদ গুংগাকে। মাথা নাড়ল গুংগা। তারপর ইঙ্গিত করল রানাকে উঠে দাঁড়াবার জন্যে। বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই। টেবিলের ওপর থেকে জিনিসগুলো তুলে আবার পকেটে চালান দিল রানা। তারপর উঠে দাঁড়াল বিনা বাক্যব্যয়ে। দেখল এখনও ওর দিকে ধরা। আছে ওয়ালী আহমেদের হাতের পিস্তলটা। শেষ চেষ্টা একবার করতেই হবে-কিন্তু এখন নয়।

পিছন থেকে গুংগার হাতের মৃদু ঠেলা খেয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল রানা। আবার সেই চারফুটী এবং আটফুটী করিডোর ধরে এগিয়ে গেল ওরা। শেডহীন বালবগুলোকে উলঙ্গ লাগল রানার কাছে। প্রতিধ্বনি উঠল ওর জুতোর শব্দের। এই গোলক ধাঁধার মত রাস্তায় উত্তর-দক্ষিণ পুব-পশ্চিম ঠিক রাখতে পারল না ও। এদিকটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। আবছা অন্ধকারে একটা ঘরে চাবি লাগাল গুংগা। আর সেই সুযোগে আলগোছে পায়ে বাধা খাপ থেকে ছুরিটা বের করে পকেটে ফেলল রানা। ঝাঁপিয়ে পড়বে কি না ভাবছিল, কিন্তু গুংগা ততক্ষণে। আবার থাবা চালিয়েছে চুলের ওপর। রানা মনে মনে ভাবল, যত খারাপই দেখাক, এ যাত্রা যদি রক্ষা পায় তা হলে ত্রু-কাট করে রাখবে মাথার চুল।

একটা সুন্দর ডাবলসাইজের খাট পাতা রয়েছে আলোকোজ্জ্বল ঘরটার এককোণে। দামি-কাভারে ঢাকা। ওদিকে পাঁচ-ছ’টা চেয়ার খাটের দিকে মুখ করা। একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল গুংগা রানাকে। হাতলের ওপর হাত রেখেই বুঝল ও আলগা ওটা। জোরে হেঁচকা টান দিলে খুলে আসার সম্ভাবনা আছে। যদিও এই সামান্য অস্ত্র দিয়ে এই পাহাড় প্রমাণ দৈত্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা ছেলেমানুষী, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? এরপর আর কোনও সুযোগ না ও আসতে পারে।

এটাই তা হলে রেপিং চেম্বার! কী পৈশাচিক বিকৃতি! এই দানব ওই খাটের ওপর জিনাত সুলতানাকে ধর্ষণ করবে, ছটফট করতে থাকবে জিনাত রানার চোখের সামনে, ওর নিরুপায় দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে গুংগা নগ্ন লালসা নিয়ে, চিন্তা করতেই রানার মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল। প্রাণ থাকতে এ দৃশ্য দেখতে পারবে না ও। তার আগে এর হাতে শেষ হয়ে যাওয়াও ভাল।

পিছন ফিরে বিছানার দিকে এগোচ্ছিল গুংগা। এক টানে মড়াৎ করে ভেঙে ফেলল রানা চেয়ারের হাতলটা। গুংগার কানে সে-শব্দ পৌঁছল না। কিন্তু রানা। উঠে দাঁড়াতেই ঘরের মধ্যে যে সামান্য একটু আলোছায়ার পরিবর্তন হলো। তাতেই বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল সে।

মাঝপথে একবার ঝিক করে উঠল তীক্ষ্ণধার ছুরিটা।

.

১০.

ভয় কাকে বলে বুঝল মাসুদ রানা আজ। শুনেছে ও, প্রাণভয়ে কেউ দৌড় দিলে হানড্রেড মিটার স্প্রিন্টের রেকর্ড হোল্ডার ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ানও তার কাছে নস্যি। গল্পের বইয়ে পড়েছে প্রাণভয়ে ভীত মানুষ অদ্ভুত সব কাজ করে বসেছে: বারো ফুট উঁচু দেয়াল টপকে চলে গেছে ওপারে, বাকিয়ে ফেলেছে মোটা লোহার শিক। আজ বুঝল সে-কথার মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে, একেবারে গাঁজাখুরি নয়।

সোজা গিয়ে বিধল ছুরিটা গুংগার বুকে।

আশ্চর্য! আধ ইঞ্চিও ঢুকল না ছুরি ওর গায়ে। সামান্য একটু বিধে বাঁটটা ঝুলতে থাকল ওর নাভির কাছে। এক মুহূর্ত সময় লাগল গুংগার বিস্ময় সামলাতে। কিন্তু তারই মধ্যে এক লাফে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে রানা। দড়াম করে লাগল চেয়ারের ভাঙা হাতলটা গুংগার নাক বরাবর। যত মুগুর পেটা শরীরই হোক না কেন, এই প্রচণ্ড আঘাতে নাকের জল আর চোখের জল এক হয়ে গেল গুংগার। হাত দিয়ে নাক ঢেকে ফেলায় মনে হলো দ্বিতীয় বাড়িটা পড়ল গিয়ে কাঠের ওপর। তৃতীয় বার আঘাতের চেষ্টা না করে খোলা দরজা। দিয়ে ছুটল রানা। দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই পেছনে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। ছুটতে ছুটতে একবার পিছন ফিরে চাইল রানা। আস্ত একটা পাহাড় ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে ওর দিকে।

নিস্তার নেই, বুঝল ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে মারল হাতলটা। একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি যেন লাগল গিয়ে গুংগার গায়ে। ঠক করে উরুতে লেগে ছিটকে চলে গেল হাতল একদিকে। গতি কমল না একটুও।

আবার ছুটল রানা। এঁকেবেঁকে এ-গলি, ও-গলি, এ-বাঁক ও-বাঁক ঘুরে ছুটল গুংগার কাছ থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে। এই গোলক ধাঁধার কি শেষ নেই? পেছনে গুংগার ক্রুদ্ধ গর্জন। ব্লাড হাউণ্ডের মত গন্ধ শুঁকে এগিয়ে আসছে সে। হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে কুঁকড়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করল রানার।

একটা বাঁক ঘুরেই দেখল, পরপর দুটো ঘরের দরজা খোলা, ভারী পর্দা ঝুলছে। চট করে দ্বিতীয় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল রানা। খালি ঘর। পর্দাটা দুলছে, হাত দিয়ে ধরে স্থির করে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকল ঘরের ভেতর।

সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল গুংগা। একটা দমকা হাওয়া পর্দা দুলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। থপথপ পায়ের শব্দ দূরে চলে গেল। রানা ভাবল, দৌড়ের ঝেকে কিছুদূর এইভাবে চলে যাবে গুংগা, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে তার বেশি দেরি হবে না। এক্ষুণি আবার ফিরে আসবে সে সামনে তাকে। দেখতে না পেয়ে।

ঘরের চারদিকে চাইল রানা। কিছুই নেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়। অনেকগুলো শামুক স্তূপ করা আছে এককোণে, আর কয়েকটা ছোট ছোট জাল। আর কিছুই নেই ঘরটায়। হঠাৎ দরজার কোণে চৌকাঠের সঙ্গে ঝোলানো একটা লোহার রডের দিকে দৃষ্টি পড়ল রানার। দরজা ভেতর থেকে। বন্ধ করবার হুড়কো, একদিক চৌকাঠের সাথে আটকানো। অসুরের শক্তি এসে গেল রানার দেহে দূরে গুংগার থপথপ পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে শুনে। দুই হ্যাঁচকা টানে খুলে এল রডটা কজা থেকে। কাছে এসে গেছে গুংগার পায়ের শব্দ। ডাণ্ডা হাতে বেরিয়েই ছুট দিল রানা উল্টো দিকে।

রানাকে দেখতে পেয়েই হুঙ্কার ছাড়ল গুংগা। তুফানের মত আসছে এবার এগিয়ে। বিশাল বুকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে দ্রুত ওঠা-নামা করছে। বাক ঘুরতেই দেখল রানা একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। বেরিয়েই রানা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই রওনা হচ্ছিল ওরা, পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়াল। মরিয়া হয়ে এগোল রানা। প্রস্তুত হবার আগেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল ও লোকদুটোর ওপর। মাথার ওপর রডের বাড়ি খেয়েই ‘ইয়াল্লা’ বলে বসে পড়ল। একজন। দ্বিতীয়জন ধরে ফেলল রডটা। প্রচণ্ড এক লাথি চালাল রানা ওর। তলপেটে। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল শরীরটা। তারপর একটা নকআউট পাঞ্চে ছিটকে পড়ল দেয়ালের ওপর।

আর পনেরো হাত দূরে এখন গুংগা। আবার ছুটল রানা। অল্পদূর গিয়েই একটা বাঁক। বাঁকটা ধরে আর না এগিয়ে বসে পড়ল ও মাটিতে। তারপর। লোহার রডটা ওপাশের দেয়ালে ঠেকিয়ে শক্ত করে ধরে বসে থাকল নৌকার। বৈঠার মত। উত্তেজনায় দাঁত বেরিয়ে গেছে রানার, ঠোঁটের দুই কোণ পিছিয়ে এসেছে কিছুটা।

তিন সেকেণ্ড পরেই তুফানের বেগে বাঁক ঘুরল গুংগা। রানাকে দেখতে পেল না। পা দিল সে রানার ফাঁদে সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায়। গুংগার পায়ের বাড়ি লেগে রানার হাত থেকে ছিটকে বহুদূরে চলে গেল রডটা। সেই সঙ্গে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল গুংগা। তুমুল গতিবেগ সামলাতে না পেরে উল্টে পাল্টে দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে থামল ওর দেহটা ঘাড় গুঁজে।

বুকের ভেতর একটা অদম্য আবেগ অনুভব করল রানা। জয়ের উল্লাসে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করল ওর। পরমুহূর্তেই শিউরে উঠল ও। প্রাণ উড়ে গেল ভয়ে। আশ্চর্য! আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে দানবটা! এই পতনের ফলে কিছুই হয়নি ওর।

এইবার? আর রক্ষা নেই। খোদা! ধরা পড়তেই হলো!

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে আরম্ভ করল রানা। পৌঁছল যে-ঘরটা থেকে লোক দুজন বেরিয়েছিল সেই ঘরের সামনে। ঘরে ঢুকেই বুঝল ওর আন্দাজটা ঠিক। চিনতে পারল ঘরটা। টিপে দিল বোতাম।

গুংগার ক্রুদ্ধ গর্জন কানে এল। দ্রুত উঠে এল লিফট ওপরে। এই পথ দিয়েই নামানো হয়েছিল ওদের। লাফিয়ে বেরিয়ে এল রানা লিফট থেকে।

দোকানটা খালি। থরে থরে সাজানো রয়েছে অ্যাকুয়েরিয়াম। নিশ্চিন্ত মনে তার মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে মাছগুলো। নিঃশব্দে। কোনও ভয় নেই, ভাবনা নেই। এত ঘটনার কোনও খবরই রাখে না ওরা।

টেবিলের তলায় রানার গারটা নেই। এখন? রানা লক্ষ্য করছে, ও লিফট থেকে বেরোতেই আবার নেমে গেছে লিফট নীচে। এখনই উঠে আসবে গুংগা। কোন দিকে যাবে ও এখন? দোকানের কোলাপসিবল গেট বাইরে থেকে নিশ্চয়ই তালা মারা। ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। ছুটল রানা শো-রুমের দিকে। অ্যাকুয়েরিয়ামের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখা গেল গুংগার ভয়ঙ্কর মুখটা। ধক ধক্ করে জ্বলছে ওর ছোট ছোট চোখদুটো। মুখটা কুঁচকে গেছে পৈশাচিক আক্রোশে। কালো পর্দা ছিঁড়ে ঢুকে পড়ল রানা শো-রুমের ভিতর।

কাঁচের ভিতর থেকে পরিষ্কার ফুটপাথ দেখতে পেল রানা। রাত কত হয়েছে? বারোটার বেশি নিশ্চয়ই নয়। এখনও হয়তো ট্যাক্সি পাওয়া যেতে পারে। ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল শো-রুমের কাঁচ রানার এক লাথিতে। লোহার ফ্রেম থেকে খানিকটা প্লাস্টার খসে পড়ল নীচে। একলাফে বেরিয়ে এল রানা। বাইরে। ভাঙা কাঁচের টুকরো লেগে কেটে গেছে কপাল, সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে, হাঁপাচ্ছে ও হাপরের মত। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসে বেরিয়ে এসে নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পেল ও। ফুটপাত ধরে ছুটল বাম। দিকে।

গাড়ি আসছে না একটা? খুশি হয়ে উঠল রানার মন। যাক এ যাত্রা বেঁচে গেল তা হলে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে ও ফোর্স নিয়ে–বারোটা বাজাবে এদের হাতেনাতে ধরে।

একটা গাড়ি আসছিল সামনে থেকে এই দিকে। কাছে এসে পড়েছে। রাস্তায় নেমে হাত দেখাল রানা।

ডাকাতের মত চেহারার একটা লোককে মাঝ রাত্তিরে এভাবে হাত তুলতে দেখে ভড়কে গেল ড্রাইভার। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে-বো করে বেরিয়ে গেল সে রানার পাশ দিয়ে বাউলি কেটে। অ্যাক্সেলারেটর পুরো টিপে ধরেছে সে। লাল রঙের একটা করোনা ডিলাক্স।

অতি দুঃখেও হাসি পেল রানার। কিন্তু পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল সে হাসি। পেছন ফিরে দেখল, শো-রুমের ভাঙা কাঁচের মধ্য দিয়ে ফুটপাতের ওপর। বেরিয়ে এসেছে গুংগা।

আঁৎকে উঠে আবার ছুটল রানা। পিছনে গুংগা। আধ মিনিট ছুটবার পর পিছন দিক থেকে জ্বলে উঠল আরেকটা গাড়ির হেড-লাইট। গুংগার ছায়াটা বিকট দেখাচ্ছে আলোতে।

এই অবস্থায় গাড়িকে থামতে বললেও যে থামবে না, ভাল করেই জানা। আছে রানার। তাই মিছে সময় নষ্ট না করে প্রাণপণে দৌড়ে চলল ও। টপ টপ ঘাম পড়ছে কালো পিচের রাস্তার ওপর। বিশ হাত পিছনে গুংগা। আর আধ মিনিটেই ধরা পড়ে যাবে রানা। কিন্তু যতক্ষণ দেহে শক্তি আছে, এগোতে হবে। আশ্চর্য! একটা পুলিশ বা নাইটগার্ড নেই কেন! এতবড় একটা শহরের উন্মুক্ত রাজপথের ওপর খুন করা হচ্ছে ওকে, কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাবে। না ও?

রানার পাশ কাটিয়ে কয়েক হাত সামনে এগিয়েই হঠাৎ ব্রেক কষল গাড়িটা। ঝটাং করে খুলে গেল এদিকের দরজা।

‘জলদি উঠে পড়ো, রানা! কুইক!’

পরিষ্কার ইংরাজিতে বলল কেউ গাড়ির ভেতর থেকে। নারী কণ্ঠ। রানা দেখল সেই লাল করোনাটা। বিস্মিত হবার সময় নেই। একলাফে উঠে পড়ল ও ড্রাইভারের পাশের সিটে। অনীতা গিলবার্ট। নিজেই ড্রাইভ করছে। আর কেউ নেই গাড়িতে।

ফার্স্ট গিয়ার দিল অনীতা। কিন্তু এক ইঞ্চিও এগোল না গাড়ি। চট করে রানা দেখে নিল হ্যাণ্ড ব্রেকটা ভোলা আছে কি না। না তো! লাফিয়ে সিট ডিঙিয়ে পেছনের সিটে চলে গেল ও। পেছনের কাঁচ দিয়ে দেখল, যা ভেবেছে তাই। পেছনে বাম্পার টেনে ধরে আছে গুংগা। দূরে রাস্তার ওপর চোখ পড়ল, চারজন লোক দৌড়ে আসছে এদিকে। ওদের লোক, সন্দেহ নেই।

‘ব্যাক গিয়ার দাও, অনীতা। পেছন থেকে টেনে ধরেছে গুংগা। খানিকটা পিছিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সামনে চালাতে হবে। পারবে না?

‘তোমার জন্যে সব পারব।’

অবাক চোখে চাইল রানা মেয়েটির দিকে। এই বিপদেও মাথা ঠাণ্ডা। রেখেছে মেয়েটা। অবলীলায় রসিকতা করছে। আশ্চর্য মেয়ে তো!

ততক্ষণে ব্যাক গিয়ার দিয়ে জোরে চালিয়ে দিয়েছে অনীতা পিছনে। খানিকটা পিছিয়েই এক ঝটকায় গুংগার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ওরা। পাঁচ সেকেণ্ডে স্পীড মিটারের কাঁটা উঠে গেল পঁচিশে, দশ সেকেণ্ডে পঁয়তাল্লিশ। মিলিয়ে গেল পিছনে গুংগার চেহারাটা দুঃস্বপ্নের মত।

হু-হু করে ছুটে চলেছে লাল করোনো ডিলাক্স নির্জন রাস্তা দিয়ে। সামনে। চলে এলো রানা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকখানি সুস্থ বোধ করছে এখন। হেলান দিয়ে বসে সামনে যতদূর সম্ভব পা ছড়িয়ে দিল।

তুমি হঠাৎ কোত্থেকে, অনীতা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আমার এক বোনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। সিনেমা স্টার। লাহোর যাচ্ছে। ওরই গাড়ি। তুমি তো প্রথমে আমাকে ভয় লাগিয়ে দিয়েছিলে একেবারে। পাশ কাটিয়ে ভেগেছিলাম ডাকাত মনে করে। চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু একটু দূরেই যখন গুংগাকে দেখলাম, তখনই বুঝলাম লোকটা তুমি ছাড়া আর কেউ না। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এলাম ছুটে।’

‘তোমার সাহস আছে বলতে হবে।’

‘সাহস দেখাবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি আমি। প্রশংসা করে লজ্জা দেবার চেষ্টা কোরো না। এখানে কী করছিলে শুনি? অবস্থা তো রীতিমত সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল দেখলাম। রেল ইঞ্জিনের মত ফেঁশ ফোঁশ করছিলে গাড়িতে উঠে। ব্যাপার কী? রণেভঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছিলে মনে হলো? না না, এক্ষুণি উত্তর দেয়ার দরকার নেই। আগে বিশ্রাম নিয়ে নাও।’

দপ দপ করছে রানার কপালের দু’পাশের শিরাগুলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকল ও। আর কান খালি পেয়ে অনর্গল বক বক করতে থাকল অনীতা গিলবার্ট।

আজই ছুটেছিলে বুঝি প্রতিশোধ নিতে? তুমি দেখছি একেবারে সিনেমার হিরোর মত শিভালরাস হয়ে উঠেছ। ভাবছি তোমার প্রেমেই পড়ে যাব কি না। একে হ্যাণ্ডসাম, তার ওপর নারীত্রাতা! রক্ষে আছে আর? কিন্তু দেখো তো, কী বিপদে ফেললাম তোমাকে গায়ে পড়ে সাহায্য চেয়ে! তোমার জন্যেই তো। আমার চাকরিটা ঘুচিয়ে না দিলে আমিই প্রতিশোধ নিতাম সুযোগ মত-তোমার। কাছে নাক-কান্না কানতে যেতাম না। এইসব বিপদ-আপদের চেয়ে বিকেল বেলা আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই কি ভাল হত না?

হেসে উঠল অনীতা খিল খিল করে। লাইট পোস্টের আলোয় ঝিক্ করে উঠল সোনা বাঁধানো একটা দাঁত। একটু চাঙ্গা হয়ে পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করল রানা। একটা সিগারেট লাগিয়ে দিল অনীতার ঠোঁটে। নিজে একটা নিয়ে আগুন ধরাল দুটোতেই।

‘এখন যাচ্ছ কোন্ দিকে, অনীতা? কাছাকাছি কোনও ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ড পাওয়া যাবে না?

তুমি যাবে কোথায়? হোটেলে?

না। আমার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। এক্ষুণি কয়েক জায়গায় ফোন করা দরকার। তারপর যেতে হবে নাজিমাবাদ। তুমি আমাকে যে কোনও ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও।

‘গাড়িটা হপ্তাখানেক আমার অধীনে থাকছে। এটাকে ট্যাক্সি হিসাবে ব্যবহার করো না এই কদিন? আর আমিও গায়ে-পড়া বেহায়া মেয়েলোক-পুরুষের সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হই।’

হাসল রানা। মেয়েটির বলিষ্ঠ মানসিকতা মুগ্ধ করতে আরম্ভ করেছে। রানাকে। অদ্ভুত সহজ, সাবলীল, স্বচ্ছন্দ অনীতার কথাবার্তা, চালচলন, দৃষ্টিভঙ্গি।

‘বেশ। সাতদিন বেঁচে থাকব কি না কে জানে। আর সাতদিনের মধ্যে আমাকে কোথায় যে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে তুমি তারও ঠিক নেই। তবু অ্যাপয়েন্ট করলাম তোমাকে। আজ আমাকে নাজিমাবাদে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও। কাল বিকেলে এসো হোটেলে। রোজকার মজুরি রোজ। আজকের মজুরি হিসেবে গত দুদিনের সব ঘটনা সংক্ষেপে বলছি তোমাকে। রাজি?’

রাজি।’

গল্প শেষ হতেই পৌঁছে গেল ওরা নাজিমাবাদ। বাড়িটা অন্ধকার। কোথাও কোনও আলো নেই দেখে মনটা দমে গেল রানার। অনীতাকে বিদায় দিয়ে। কলিং বেল টিপল ও। মিনিট দুয়েক পর চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এল সাঈদ খান।

‘চাচাজি কোথায়?’ রানাকে একা দেখে জিজ্ঞেস করল সাঈদ। গাড়িটাও দেখছি না যে?

‘জিনাত কোথায়?’ পাল্টা জিজ্ঞেস করল রানা।

‘কেন, ঘুমাচ্ছে ওর ঘরে! রানার কপালে কাটা দাগ দেখে ঘুমের রেশ কেটে গেল ওর।

‘কেউ এসেছিল রেডিয়োগ্রাম নিয়ে?

‘হ্যাঁ। আপনি পাঠিয়েছিলেন তো? সে তো প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই দিয়ে। গেছে। কিন্তু চাচাজি কোথায়?

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, সাঈদ। জিনাতের ঘরটা কোনদিকে।

সাঈদকে ঠেলে ঢুকে পড়ল রানা ঘরের মধ্যে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাঈদও এল পিছু পিছু। বলল, ‘দোতলায় উঠেই প্রথম ঘরটা। কেন, কী ব্যাপার?

তিন লাফে দোতলায় উঠে এল রানা। ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাতি জ্বালতেই চোখ পড়ল রানার চমৎকার একখানা রেডিয়োগ্রামের উপর। স্টেরিওফোনিক। দাম সাত আট হাজার টাকার কম না।

ও কেউ নেই ঘরে। ঘর খালি। বিছানার চাদরে ভাজ পড়েনি একটুও। অর্থাৎ কেউ শোয়নি আজ ওই বিছানায়। বাথরুমে খোঁজ করা নিরর্থক, যা বোঝার বুঝে নিয়েছে রানা। তবু একবার দেখে এল বাথরুমটা। সাঈদও এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। একদম বোকা বনে গেছে সে। কিছুই বুঝতে পারছে না। জিনাত গেল কোথায়? তার সঙ্গে রেডিয়োগ্রামের কী সম্পর্ক? রানাই বা এত রাতে একা এসে হাজির হলো কোত্থেকে? চাচাজি কোথায়? সব প্রশ্ন একসাথে ভিড় করে আসে ওর মনের মধ্যে।

‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন, মিস্টার রানা।

বলছি। তার আগে একটা ফোন করা দরকার। আপনি ছুটে গিয়ে গ্যারেজ থেকে জিপটা বের করুন।

সাঈদ বুঝল জরুরী ব্যাপার। ছুটে বেরিয়ে চলে গেল সে বাইরে।

একতলার বৈঠকখানায় গিয়ে বসল রানা ফোনের সামনে। একটা সিক্স ডিজিট নাম্বারে ডায়াল করল।

‘আমি মাসুদ রানা বলছি। …এক্ষুণি পঞ্চাশ জনের আমড় মিলিটারি ফোর্স, পাঠাবার ব্যবস্থা করুন এই ঠিকানায়। পেন্সিল নিয়েছেন? লিখুন ফিশ এমপোরিয়াম, ২৩৪ ভিক্টোরিয়া রোড। স্টেনগান আর টর্চ নিলেই চলবে। আমিও আসছি ওখানে। পুরো বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলতে বলবেন। আমি এসে বাকি ব্যবস্থা করব। একটি প্রাণীও যেন বেরুতে না পারে। আমার কোড নাম্বার হচ্ছে। এম আর নাইন। রাইট?

সাঈদ এসে ঢুকল ঘরে। ফোনটা নামিয়ে রেখে রানা বলল, চলুন। গাড়িতেই সব কথা বলব।’

‘এক সেকেণ্ডে কাপড় পরে আসছি আমি।

‘আমার জন্যে একটা এক্সট্রা রিভলভার আনবেন সাথে করে। আমারটা খোয়া গেছে।

‘আরও লোক নেব?

না। দরকার হবে না।’

পথে সমস্ত ঘটনা শুনে পাথরের মত স্থির হয়ে গেল সাঈদ খান। তারই চোখের সামনে দিয়ে জিনাতকে ধরে নিয়ে গেল দুবৃত্তেরা, সে কিছুই করতে পারল না! চাচাজিকে কী উত্তর দেবে সে? জিনার কাছেই বা মুখ দেখাবে কী করে? ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর।

.

১১.

ছটফট করছে রানা খাঁচায় বন্দি বাঘের মত।

নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে ওকে। একটি প্রাণীরও চিহ্ন পাওয়া যায়নি ফিশ এমপোরিয়ামে। সব পালিয়েছে। অ্যাকুয়েরিয়াম আছে, মাছও আছে। যেমন ছিল ঠিক তেমনি। শুধু মানুষগুলো সব ভোজবাজির মত, অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া যায়নি। পাহারা বসিয়ে দিয়ে রাত দুটোর সময় ফিরে এসেছে রানা হোটেলে।

এখন কিছুই করার নেই ওর, সব রকম খবরাখবর নেয়া হয়েছে ওয়ালী আহমেদের সম্পর্কে, সব রকম সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজা হচ্ছে তাকে। রাওয়ালপিণ্ডিতে বেতারে খবর চলে গেছে। ওয়ালী আহমেদের ছদ্মবেশী অনুচরকে (যে পিআইএ করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে রওনা হয়েছিল) সম্ভব হলে গ্রেপ্তার করার জন্যে।

কিন্তু বুঝতে পারছে রানা, আজই এক্ষুণি যদি ওয়ালী আহমেদের ওপর চরম আঘাত হানতে পারা না যায় তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জিনাতের। কিন্তু কোথায় আঘাত করবে? শক্রর চিহ্নই তো নেই যে মোকাবেলা করবে। হাওয়ায়। মিলিয়ে গেছে যেন সবাই ভোজবাজির মত। জিনাত আর মোহাম্মদ জানেরও কোনও খবর নেই।

ঘরের মধ্যে বহুক্ষণ পায়চারি করল রানা। এই নিরুপায় অবস্থায় নিষ্ফল আক্রোশে গজরাতে থাকল ও। সব রাগ কেন জানি গিয়ে পড়ল নিজেরই ওপর। ও-ই এদেরকে টেনে এনেছে এই বিপদের মধ্যে। কেন ও পারছে না? কেন ও পারছে না জিনাতকে রক্ষা করতে, মোহাম্মদ জানকে মুক্ত করে আনতে? ওর জন্যেই তো আজ এদের এই অবস্থা।

ঘণ্টাখানেক এভাবে পায়চারি করার পর স্থির হলো রানা অনেকখানি। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। জোর হাওয়া আসছে সাগর থেকে। সমুদ্রের শোঁ শো একটানা আওয়াজে জিনাতের কান্না।

রানা বুঝল, যা হবার হয়ে গেছে। এখন আপাতত ওর নিজের পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিশ্রাম দেয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। কাল নব উদ্যমে এগোতে হবে নতুন পথে। বিশ্রামটা প্রয়োজন। এরকম অস্থির ভাবে সারারাত পায়চারি করে বেড়ালে নিজেকে আরও দুর্বল করে ফেলা ছাড়া আর কোনও লাভ হচ্ছে না।

ঘরে এসে দুটো স্লীপিং পিল খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা বাতি নিভিয়ে। অনেকক্ষণ ছটফট করল বিছানায় শুয়ে, এপাশ-ওপাশ ফিরল কমপক্ষে পঞ্চাশবার। ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ল ও। পাতলা একটা তন্দ্রার ঘোর নামল দুচোখে।

ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল রানার। রিস্টওয়াচে দেখল পাঁচটা বাজে। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। টিপয়ের ওপর রাখা কাঁচের জার থেকে ঢেলে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেল ও। স্বপ্নের ঘোেরটা কাটেনি।

ভাবল, ওয়ালী, আহমেদের কথাগুলো অতিরিক্ত রেখাপাত করেছিল মনের ওপর, তাই বোধহয় এ দুঃস্বপ্নটা দেখল ও। স্বপ্নের ঘটনাস্থল হচ্ছে ‘রেপ চেম্বার। কিন্তু ফিশ এমপোরিয়ামের সমস্ত চেম্বারই এখন মিলিটারির দখলে। কাজেই ঘটনাটা তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল ও মন থেকে। আবার ভাবল, ওই ঘরটা ও দেখেছে বলে ওটারই স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু করাচি শহরের অন্য যে কোনও একটা ঘরে ঘটনাটা ঘটা কি একেবারেই অসম্ভব?

উঠে বসল রানা বিছানার ওপর। ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি ফলে। এতদিন কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও আজ কেন জানি রানার মনটা এই কুসংস্কারের প্রতি বিদ্রূপ করতে পারল না।

দর্শকের গ্যালারিতে বসে আছে ওয়ালী আহমেদ। তার পাশে যেখানে রানার বসবার কথা ছিল সেখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসানো হয়েছে মোহাম্মদ জানকে।

‘আব্বাজি! তুমি এদিকে চেয়ো না, আব্বাজি!’ ফুঁপিয়ে উঠল জিনাত।

এবার স্পষ্ট দেখতে পেল রানা জিনাতকে। শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দেয়া হয়েছে মাটিতে। চুলের মুঠি ধরে দড়াম করে আছড়ে ফেলল গুংগা ওকে বিছানার ওপর।

‘সাবাস! চেঁচিয়ে উঠল ওয়ালী আহমেদ।

ল্যাংগোঠ খুলে ফেলেছে গুংগা। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে বিছানায়। তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল জিনাতের মুখ থেকে। স্পষ্ট শুনতে পেল রানা সেই তীক্ষ্ণ গগনভেদী অমানুষিক চিৎকার। রক্তে ভেসে গেছে বিছানার সাদা চাদর।

এরপর সিনেমার ক্লোজ-আপের মত চারটে মুখ ভেসে উঠল রানার চোখের সামনে। কুঁচকে বিকৃত হয়ে গেছে জিনাতের মুখ, দাঁতে দাঁত চেপে দুই ঠোঁট ফাঁক করে রেখেছে সে। নীল হয়ে গেছে মুখটা বেদনায়। গুংগার মুখে পৈশাচিক কামোন্মত্ততা। ঘড়ঘড় করে শব্দ বেরোচ্ছে ওর গলা দিয়ে। মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে মোহাম্মদ জানের। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে। আর লালসা ঠিকরে বেরুচ্ছে ওয়ালী আহমেদের দুই চোখ থেকে। সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করছে সে দৃশ্যটা।

আবার একটা তীক্ষ্ণ দীর্ঘস্থায়ী চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে রানার। জেগে উঠেও কিছুক্ষণ শুনতে পেয়েছে রানা সে চিৎকার। একটু পরেই ভুল ভাঙল। দূর থেকে ভেসে আসছে জাহাজের বাঁশি।

কিন্তু জিনাতের বেদনা-কাতর মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারল না ও। উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে এসে আবার বিছানায় উঠতে যাবে, এমন সময় খুট করে দরজায় শব্দ হলো একটা।

মনের ভুল ভেবে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার খুট করে শব্দ হতেই লাফিয়ে উঠে বসল রানা। না, মনের ভুল নয়। রিভলভারটা বের করল ও বালিশের তলা থেকে। করিডোরে কয়েকটা দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। পা টিপে এসে দাঁড়াল ও দরজার পাশে। দশ সেকেণ্ড কান পেতে থেকেও আর কোনও শব্দ শুনতে পেল না ও।

নিঃশব্দে বল্টু খুলে এক ঝটকায় দরজা খুলে বাইরে চাইল ও। হাতে উদ্যত রিভলভার। করিডোরটায় কম পাওয়ারের বালব জ্বলছে। হলদে ম্লান আলো। কই, কেউ তো নেই। মানুষ দেখতে পাবে বলে উঁচুতে চেয়ে ছিল রানা, চোখ নামাতেই দেখতে পেল, জিনিসটা। দরজার সামনে রাখা আছে একটা লম্বা কাঠের বাক্স। দুই ফুট বাই এক ফুট ছয় ইঞ্চি-বাই ছয় ফুট সাইজ। ওপরে বড় বড় করে লেখা: GRUNDIG.

বুকের ভেতরটা কেপে উঠল রানার। তবে কি…

দুটো, পেরেক মেরে ডালা আটকানো। ঘরের বাতি জ্বেলে ঠেলে নিয়ে এল রানা বাক্সটা ঘরের ভেতর। ভারী। রক্তের একটা ধারা এল দরজা দিয়ে ঘরের মাঝখান. পর্যন্ত। রক্ত কেন? ডালা ধরে টান দিতেই খুলে এল সেটা। ভেতরে চেয়েই চক্ষুস্থির হয়ে গেল রানার। যা ভেবেছিল তাই। ভেতরে শোয়ানো আছে একটা মানুষের দেহ। সারা দেহে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। রক্তে ভেজা লাল। মৃতদেহ কারও? কার? জিনাত, না মোহাম্মদ জান?

খাবলা খাবলা করে সারা মুখের মাংস খাওয়া-চোখের কোটর দেখা যাচ্ছে, চোখ নেই। নাকের সামনের অংশটুকু নেই। একটু নড়ল মনে হলো না?

দেহটা তুলে নিয়ে বিছানায় শোয়াল রানা। খান মোহাম্মদ জান! বুকের ওপর কান রেখে দুর্বল হার্ট বিট শুনতে পেল রানা। কয়েক পরতা ব্যাণ্ডেজ খুলে দেখল সারা দেহই মুখের মত খুবলে খাওয়া। বাঁচানো যাবে না। জ্ঞান আছে কি না দেখার জন্যে ডাকল রানা একবার নাম ধরে।

হঠাৎ নড়ে উঠল খান মোহাম্মদ জানের মুমূর্ষ দেহটা।

‘কে? মেজর?’ দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মোহাম্মদ জান। গলার ভেতর তার আসন্ন মৃত্যুর ঘড়ঘড় শব্দ। এ শব্দ রানা চেনে। এটা মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।

‘হ্যাঁ! মাসুদ রানা, সর্দার। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল রানা।

‘তোমার জন্যেই এখনও বেঁচে আছি আমি, রানা। জ্ঞান হারাইনি।

এ অবস্থা কী করে হলো আপনার?

এই কথার উত্তর দিল না মোহাম্মদ জান। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ কথা বলার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করল। তারপর ফিশফিশ করে বলল। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিয়ো!

ঠিকানা বলতে পারবেন?

‘জিনাতকে… জিনাতকে ওরা…’

‘আমি জানি সে কথা। ঠিকানা। ঠিকানাটা বলুন!’ মুখের কাছে কান নিয়ে গেল রানা। কিন্তু কথা আটকে গেল মোহাম্মদ জানের। উত্তর দিতে পারল না। মুখ দিয়ে ভুড়ভুড়ির মত গ্যাঁজলা বেরোল খানিকটা। কেঁপে উঠল শরীরটা দুবার। তারপর স্থির হয়ে গেল। রানা বুঝল, সব শেষ।

– টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিল ও। কয়েকবার রিং-হতেই ওপাশে রিসিভার তুলল সাঈদ খান।

সাঈদ?

‘জী, হাঁ।

‘শিগগির চলে আসুন হোটেলে। আমি রানা বলছি।

‘এক্ষুণি আসতে হবে?

‘হ্যাঁ। এক্ষুনি।’

‘কোনও খবর পেলেন? নতুন কিছু?

‘দুঃসংবাদ আছে। আসুন তারপর বলব।’

আর কোনও কথা না বলে ফোন নামিয়ে রাখল সাঈদ। এবারে আবার সেই ছয় ডিজিটের বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করল রানা। মোহাম্মদ জানের খবর দিল। এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবার নির্দেশ দিল। তারপর বিছানার কাছে এসে বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।

হঠাৎ চোখে পড়ল রানার কাগজটা। বুকের কাছে ব্যাণ্ডেজের মধ্যে গোঁজা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরল ও কাগজটা। অর্থহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল ওটার দিকে কিছুক্ষণ। বুঝতে পারল না কিছুই। তীব্র উত্তেজনায় এক মুহূর্তের জন্য ব্ল্যাক আউট হলো যেন রানার দৃষ্টি। পরমুহূর্তেই ফুটে উঠল লেখাগুলো স্পষ্ট। ইংরেজিতে টাইপ করা। বাংলা করলে দাঁড়ায়:

মাসুদ রানা,

তোমার জন্যও এই একই দণ্ডাদেশ।

অপেক্ষা করো।

পুনশ্চ:

জিনাত গুংগাকে তৃপ্তি দিয়েছে।

ধক-ধক করে জ্বলল রানার চোখ কয়েক সেকেণ্ড। কঠোর হয়ে গেল মুখের চেহারা। দাতে দাঁত চেপে নিজেকে স্থির করবার চেষ্টা করল ও। তারপর খান। মোহাম্মদ জানের মৃতদেহের মাথায় রাখল ডান হাত। বলল, ‘প্রতিজ্ঞা করলাম, সর্দার প্রতিশোধ নেব!’

কথাটা বলেই রানা লক্ষ করল মোহাম্মদ জানের চুল ভেজা। পিরানহার ট্যাঙ্কে ফেলে হত্যা করা হয়েছে তাকে। কী মনে করে কয়েকটা চুল ছিঁড়ে নিল রানা লাশটার মাথা থেকে। চেটে দেখল, নোনতা। চট করে একটা কথা মনে পড়ল ওর।

ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ফর্সা হয়ে আসছে আকাশটা। সাগর থেকে আসা ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া বয়ে আনছে সমুদ্রের কল্লোলধ্বনি। দূর থেকে আবার। ভেসে এল জাহাজের বাঁশি-বুকের ভিতর কাপন ধরানো করুণ সুর। সাঈদ পৌঁছল প্রথম। ছুটে গেল বিছানার পাশে। দুই হাতে মুখ ঢেকে হু-হুঁ করে কেঁদে উঠল। একটু পরেই সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। শার্টের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে ফিরল রানার দিকে।

‘চাচার খুনের বদলা নেব আমি।’

‘আমিও।’

স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানা ওর চোখের দিকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। সাঈদ। রানাও চেপে ধরল সেই হাত। দুইজন শক্তিশালী পুরুষের মৈত্রী-স্থাপন হলো।

‘আজ সন্ধ্যায় এসো। একা।

‘আচ্ছা।’

চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের।

এরপর বাকি সব রুটিন মাফিক হয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা করে রায় দিল-মূত। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ চলে গেল মর্গে। পোস্টমর্টেম হবে। সাঈদ চলে গেল সেই সাথে। ঘর খালি হতেই আবার কাগজের টুকরোটা বের করল রানা। মোহাম্মদ জানের রক্ত লেগে আছে এক কোণে। উল্টোপিঠে আঠা লাগানো মাছের অ্যাকুয়েরিয়ামে লাগাবার লেবেল। বুক পকেটে রেখে দিল ও চিঠিটা। ফরাস এসে চাদর বদলে দিয়ে গেল বিছানার।

বাইরের ঘরে সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করল রানা। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও। ছোট্ট দু’একটা সূত্র ধরে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবার চেষ্টা করছে ও। সমস্ত মনোযোগ একত্রীভূত হওয়ায় দুই ভুরুর মাঝখানে কপাল খানিকটা ফুলে উঠেছে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা পুড়তেই থাকল-টানা হলো না একটিবারও! পুড়তে পুড়তে যখন ছোট হয়ে আঙুলে আঁচ লাগল তখন একটা টান দিয়ে ফেলে দিল রানা সেটা অ্যাশট্রেতে। সমাধান হয়ে গেছে সমস্যার।

কয়েকটা জায়গায় টেলিফোন করে কিছু নির্দেশ দিল ও। কিছু খবরও সংগ্রহ করল। সারাদিন ঘর থেকে বেরোল না।

চারটের সময় দুটো থারটি-ও-সিক্স রাইফেল এবং আরও কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস পৌঁছে দেয়া হলো রানার কামরায় পাকিস্তান কাউন্টার। ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মারফত, গোপনে। প্রতিটি রাইফেলের জন্য একটা করে পাঁচ-গুলির এক্সট্রা ম্যাগাজিন। মেশিন রেস্টে জিরোয়িং করা আছে রাইফেলগুলো এক্সপার্টের হাতে। একটা টারগেটে পাঁচটা গুলির গ্রুপিং দেখানো আছে-স্লিং-এর সঙ্গে টুইন সুতো দিয়ে বাঁধা। গ্রুপিং দেখে খুশি হলো রানা। টু হানড্রেড ইয়ার্ডসে তিনটে বুলস আই। সোয়া ইঞ্চি গ্রুপিং।

রানার নির্দেশে সাগর পারের একটা গোডাউন খুঁজে বের করেছে সাধু বাবাজি। বিভিন্ন রকমের ব্যবসা আছে এই কোম্পানির। একটা ইয়ট আছে। করাচি-চিটাগাং যাতায়াত করে মাসে একবার করে। হরেক রকম মাল নিয়ে যায় এখান থেকে চিটাগাঙে। সাথে ঝিনুক, শঙ্খ এবং নানান জাতের সৌখিন রঙীন মাছও যায়। আর যায় কলেজ এবং ইউনিভারসিটিতে রিসার্চের জন্যে নানান রকম বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ ও মাছ। ফেরার সময় আদা এবং বেতের কাজ করা কুটির শিল্পের বিভিন্ন শখের জিনিস নিয়ে ফেরে করাচিতে। এ ছাড়া এক্সপোর্টও করে এই কোম্পানি বিরাট স্কেলে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। পুলিশের কোনও খারাপ রিপোর্ট নেই। কাস্টমসেও অল ক্লিয়ার। পরিষ্কার ঝরঝরে ব্যবসা। বছর দুয়েক হলো শুরু করেছে-বেশ জমিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাজির বেগ।

রাইফেল দুটো ভালমত পরীক্ষা করে দেখল রানা বোল্ট, টেনে। সব ঠিক আছে। এখন রাতের অপেক্ষা। একাই যেত ও, কিন্তু সাঈদকে সাথে না নিলে অন্যায় করা হবে ওর প্রতি। ওরও আছে প্রতিশোধ নেবার অধিকার।

গোপনে যেতে হবে। রানা মনে মনে জানে দল নিয়ে গেলেও চলত, কিন্তু তা হলে প্রতিশোধটা নেয়া হয় না। ওদের বুঝিয়েছে মিলিটারি বা পুলিশ মুভমেন্ট টের পেলেই পালিয়ে যাবে সে নাগালের বাইরে। তা ছাড়া মাছের ব্যবসার সঙ্গে সোনা চোরাচালানের সম্পর্ক বের করা যায়নি এখনও। ছোট ছোট মাছ, বড় নয় যে পেটের মধ্যে করে সোনা চালান দেয়া যেতে পারে।

বিকেলে করাচি ব্রাঞ্চ থেকে এল দুজন। রানার বর্তমান কার্যকলাপ আবছা ঠেকছে করাচি অফিসের কাছে। অথচ রানার নিরাপত্তার দায়িত্ব ওদেরই উপর। রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান জানতে চাইল ওরা। এড়িয়ে গেল রানা। কারণ, ঠিক কোন লোকটা বোঝা না গেলেও করাচি অফিসে অন্তত একজন দুমুখো সাপ আছে। তা না হলে এত সহজে রানাকে চিনে বের করা সম্ভব হত না মোহাম্মদ জান বা ওয়ালী আহমেদের পক্ষে।

‘সবকিছু এমন রহস্যাবৃত রাখার কারণ জানতে পারি? একজন প্রশ্ন করল।

‘হেড অফিস থেকে সেটা জানতে পারবেন।’

‘এটা কি আমাদের ওপর আপনার কনফিডেন্সের অভাব বলে ধরে নেব?

‘সেটাও হেড-অফিস থেকেই জানতে পারবেন।

আমাদের চীফ আপনার কার্যকলাপে অত্যন্ত…’

‘দেখুন, উঠে দাঁড়াল রানা সোফা ছেড়ে। আপনার চীফের বিরক্তি বা ঘৃণা যা-ই থাকুক, হেড-অফিসে জানাতে বলবেন। এ কাজের ভার ডিরেক্ট হেড অফিস থেকে পেয়েছি আমি। আপনার হেডের কাছে যে ইস্ট্রাকশন এসেছে সেটা যদি তিনি ভুলে গিয়ে থাকেন তা হলে আবার তাকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। এই কেসে আমি যেটুকু সাহায্য চাইব সেটুকু সাহায্য করতে তিনি বাধ্যতার বেশি, কৈফিয়ত চাওয়া তো দূরের কথা, কোনও প্রশ্ন করবার তার অধিকার নেই। আপনারা এবার আসতে পারেন।

‘একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনার রিপোর্ট করাচি চিফের কাছে দেয়ার কথা। এখান থেকে ঢাকায় রীলে করা হবে সেটা। কিন্তু…’

‘আমার রিপোট আমি সরাসরি হেড-অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

বেরিয়ে যাচ্ছিল ওরা। রানা আবার বলল, আমারই রিসিভ করার কথা ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনার চীফকে বলবেন আজ রাতের ফ্লাইটে করাচি আসছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান কাউকে কিছু না জানিয়ে। ইচ্ছে করলে এয়ারপোর্টে গিয়ে তাঁকে রিসিভ করতে পারেন।

বেরিয়ে গেল ওরা। সেই সঙ্গে রানার মেজাজটাও বিগড়ে দিয়ে গেল। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। ঠিক করেছে ও আচ্ছামত ডাটিয়ে দিয়ে। রানার ভদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছিল ব্যাটারা। প্রয়োজন হলে লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় নিজের ক্ষমতা।

.

মিনিট পনেরো পরেই ঘরে ঢুকল অনীতা গিলবার্ট।

‘হ্যাল্লো, হিরো! এখনও বেঁচে আছ তা হলে?

‘ভয়ে ঘর থেকে বেরোইনি সারাদিন, রানা মৃদু হেসে বলল।

‘উঁহু। বিশ্বাস করলাম না। ভয়ে পিছপা হবার লোক আলাদা। তোমার চেহারায় সংকল্প দেখতে পাচ্ছি, বন্ধু। ব্যাপার কী? আরও ঘটেছে কিছু?

মাথা নাড়ল রানা। কফির অর্ডার দিয়ে মোহাম্মদ জানের পরিণতির কথা বলল অনীতাকে। সাঈদের কাছে জিনাতের পরিণতির কথা গোপন করেছিল। কিন্তু অনীতাকে পড়তে দিল চিঠিটা। ভুরু কুঁচকে গেল অনীতার।

‘এখনও চুপচাপ বসে আছ?

‘এখনও আছি। কিন্তু সন্ধ্যের পর আর থাকব না।’

‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’

‘অসম্ভব। মেয়েমানুষের কাজ এটা নয়।’

‘আমারও প্রতিশোধ নেবার আছে।’

‘সেদিক থেকে অবশ্য সাঈদের মত তোমারও দাবি আছে। কিন্তু তোমাকে সাথে নিলে কাজে বিঘ্ন হবে। অবশ্য অন্য কাজ দিতে পারি তোমাকে।’

কী কাজ?

‘ঠিক রাত এগারোটায় সাগর পারের একটা স্টোর রুমের সামনের রাস্তায় ওই করোনা ডিলাক্স নিয়ে উপস্থিত হবে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করবে না। বারোটার মধ্যে যদি আমার দেখা না পাও তা হলে একটা বিশেষ নম্বরে ফোন করে খবরটা শুধু জানিয়ে দেবে। পারবে না?

‘খুব পারব। ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দাও। ঠিক সময় মত পাবে আমাকে।’

এক টুকরো কাগজে লিখে দিল রানা ফোন নাম্বার ও ঠিকানাটা। ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল অনীতা সেটা। রানার প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল কফির কাপ শেষ করে। রাইফেল দুটো দেখে চোখ-মুখে একটা ভঙ্গি করল।

‘যুদ্ধ হবে মনে হচ্ছে!

মুচকি হাসল রানা। মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে কৌতুক আর বুদ্ধির ছটা। এমন অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলে যে না হেসে পারা যায় না। সাধারণ কথা, তবু হাসি আসে। চলে গেল ও টাটা করে।

.

সন্ধ্যের পর এল সাঈদ খান।

‘হোটেল থেকে বেরোবেন কী করে? ঢুকবার সময়ই পরিষ্কার বুঝতে পারলাম চারপাশে ছড়িয়ে আছে ওদের লোক। লাউঞ্জের মধ্যেও।’’

‘ওদের সাথে আমাদের লোকও মিশে আছে। আর বেরোবার ব্যাপারটা ভেবে রেখেছি আমি। ওদের দেখানো পথই অনুসরণ করব। কিন্তু তোমাকে যা বলেছিলাম করেছ? বিকেলে নোক পাঠিয়েছিলে ওখানে?

‘আলবত। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। দোতলার ওপর চিলেকোঠার ছাতে ফিট করা একটা লম্বা পোস্টের মাথায় ঘুরছিল রেইডার স্ক্যানার। পাঁচ শ গজ দূরের একটা অফিসের ছাত থেকে স্কোপ লাগানো রাইফেলের গুলি দিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে ওটাকে। এখন বেহুদা ঘুরছে ওটা লাঠির মাথায়। এলাকাটা তিন দিক থেকে কাঁটাতারের জাল দিয়ে ঘেরা। গেটে সর্বক্ষণ পাহারা।

আটটার সময় কামরায় বসেই খেয়ে নিল ওরা সাপার। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তারপর ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে উইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে বসল গিয়ে ব্যালকনিতে, নিচু গলায় ওর প্ল্যান বুঝিয়ে দিল রানা সাঈদকে। মাথা ঝাঁকাল সাঈদ।

আধ বোতল শেষ করে উঠে পড়ল ওরা। রাইফেল দুটো কাঁধে ঝুলিয়ে নিল দুজন। ওয়েইস্ট ব্যাণ্ডে গুঁজে নিল রিভলভার। সবশেষে কী মনে পড়ে যাওয়ায় সুটকেস থেকে একটা বিশেষভাবে তৈরি অ্যাসিড পেন নিয়ে পকেটে গুজল রানা। কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক এসিড ভরা তাতে-বোতাম টিপলেই পিচকারির মত বেরোয়। তারপর একগোছা ডিসেণ্ডিং রোপ নিয়ে কামরায় তালা লাগিয়ে। উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে ছাতে।

আধখানা চাঁদ আকাশে। সেই আলোয় খা খা করছে শূন্য ছাতটা। একটা লোহার হুকে বাঁধল রানা দড়ির এক প্রান্ত। দুই জোড়া ধাতুর তৈরি হাতলের মধ্যে দিয়ে গেছে শক্ত সরু রশিটা।

‘দুই হাতে মুঠো করে ধরবে হাতল দুটো। নিয়ম হচ্ছে, স্পিড বেশি চাইলে ওগুলো বেশি জোরে টিপে ধরবে। আর কমাতে চাইলে একটা হাত একেবারে ঢিল করে দেবে। বুঝেছ?’

মাথা ঝাঁকাল সাঈদ। এক মিনিটে নেমে এল ওরা হোটেলের পিছনের অন্ধকারে। সেইলরস ক্লাবের ওপাশ দিয়ে সোজা সাগরের দিকে চলে গেল ওরা। অপেক্ষমাণ স্পিড়-বোটে রানার নির্দেশে বৈঠা রাখা রয়েছে দুটো। সাঈদ উঠে বসতেই ঠেলে পানিতে নামাল রানা স্পিড-বোট। তারপর উঠে বসে বৈঠা দিয়ে কিছুক্ষণ লগির মত ঠেলা দিয়ে বেশি পানিতে নিয়ে এল। এবার। বিনাবাক্যব্যয়ে বৈঠা চালাল দুজন। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল স্পিড়-বোট পুব দিকে। মাথায় একরাশ ফেনা নিয়ে ঢেউ ভেঙে পড়ছে বোটের গায়ে। ছিটকে জলকণা এসে লাগছে চোখে-মুখে। দুলে দুলে উঠছে ছোট্ট বোট।

‘ডুবে যাবে না তো আবার?’ সাঈদ জিজ্ঞেস করল।

‘না, ডুববে না। কিন্তু সাঁতারটা শিখে নাও না কেন? কত সুইমিং পুল আছে। শহরে। শিখে নিলে অনেক কাজে আসবে।

‘ঠিক বলেছেন। কাল যদি সূর্যের মুখ দেখি তা হলে মেম্বার হয়ে যাব কোনও সুইমিং-ক্লাবের।

বেশ অনেকদূর সরে এসেছে ওরা তীর থেকে। হোটেল ঢাকা পড়েছে। একটা ঢিবির আড়ালে। এখন আর শব্দ পৌঁছবে না ওখানে। বৈঠা তুলে রেখে এভিনরুড ইঞ্জিনটা স্টাট দিল রানা। ফরওয়ার্ড গিয়ার দিতেই ছুটল স্পিড বোট তরতর করে পানি কেটে। বৈঠা তুলে একপাশে রেখে দিয়ে কাছে এসে বসল সাঈদ। জোর বাতাসে শীত শীত করছে। সিগারেট ধরাল দুজনে। পৌনে এক ঘণ্টার পথ।

‘তোমার চেয়ে ছোট নাকি জিনাত?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ। দু’বছরের ছোট। পনেরো বছর একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। আমরা। তারপর ও চলে গেল লাহোর।

‘যেদিন পরিষ্কার বুঝতে পারলে যে ওকে ভালবাস, তখন নিশ্চয়ই ও অনেক দূরে সরে গেছে?

চুপ করে থাকল সাঈদ। রানা যে হঠাৎ তার মনের কথাটা এভাবে বলে বসবে ভাবতেও পারেনি সে।

‘আপনাকে বলেছে ও কিছু?

না। তোমার চোরা চাহনি দেখে বুঝেছি।’

আবার চুপ হয়ে গেল সাঈদ। ওর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা।

‘এমনই হয়, সাঈদ। জীবনটাই এরকম। সবকিছুর মধ্যেই গরমিল। মানুষ একান্ত করে যে জিনিসটা চায়, কেন জানি গোলমাল হয়ে যায়, পেতে পেতেও পায় না।’

‘কিন্তু এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না, মি. রানা। সাঈদের কণ্ঠে অদ্ভুত একটা অভিমানের সুর ধ্বনিত হলো। হৃদয়ের অর্গল খুলে গেল ওর। ছোটকাল থেকেই আমি জানতাম ও আমার বউ। চার বছর বয়সে আমার আব্বাজি মারা। যান। চাচাজিই আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। চাচী আম্মা আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। আমার সব আবদার অত্যাচার সহ্য করতেন। হাসিমুখে। আট বছর বয়স থেকে শুনে আসছি আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বড় হলে বিয়ে হবে। তখন থেকেই নিজের বৌ মনে করে কত যে অধিকার ফলিয়েছি আমি ওর ওপর!’ হাসল সাঈদ। কিন্তু পনেরো বছর বয়স হতেই ও যেন আমার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল। বুদ্ধি বিবেচনায় অনেক পেকে গেল ও। দেহেও এমন বাড়ন্ত হয়ে উঠল যে ওর দিকে চাইতে লজ্জা লাগত আমার। নিজেকে ওর পাশে বড়ো অপরিণত, কাচাঁ মনে হত। চাচী আম্মা মারা গেলেন। চাচাজি মনে করলেন এখন ওকে লাহোরে কোনও বোর্ডিং স্কুলে রাখাই ভাল। নইলে চরিত্র খারাপ হয়ে যেতে পারে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানল সাঈদ। মোলায়েম, চাঁদের আলো বিছিয়ে পড়েছে সমুদ্রের উপর। কেবল জল আর জল। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। করাচি শহরের হাজার হাজার বাতি দেখা যাচ্ছে তারার মত বহুদূরে।

মাঝে মাঝে ছুটিতে যখন আসত বাড়িতে, উদগ্রীব আমি, কতবার বলতে চেয়েছি। কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে কণ্ঠরোধ করেছে আমার। এখন বুঝতে পারি, যদি সেদিন সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে দাবি করতাম, তা হলে ও আজ এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। তারপর একসময় আমি এগিয়ে এলাম। ও হেসে উড়িয়ে দিল আমাকে। অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে ও তখন। হঠাৎ বিয়ে করে বসল। এসব ঘটনা তো আপনি জানেন। তখন আমি বড় হয়ে গেছি। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে সে যখন মারীতে, আমি গিয়ে উঠলাম, বললাম। আমার মনের কথা। কদিন ও আমাকে খুব আদর যত্ন করে রাখল তারপর বলল, ‘সাঈদ ভাইয়া, আমি তোমার যোগ্য নই। তোমার মত একজন। ভালমানুষের জীবনটা আমি নষ্ট করে দিতে পারব না। কাঙালের মত বললাম, দয়া করো আমাকে, জিনা। তোমার সমস্ত দোষ-ত্রুটি, পাপ-পুণ্য নিয়ে তুমি এসো আমার জীবনে। ধন্য করো আমাকে। তোমাকে ছাড়া আর যে কিছুই ভাবতে পারি না আমি।’ দুচোখ ভরে গিয়েছিল ওর পানিতে। বলেছিল, আগে বলোনি কেন? সময় থাকতে তুমি আমাকে জোর করে ছিনিয়ে আনলে না কেন ওই বিষাক্ত জীবনের মায়াবী আকর্ষণ থেকে? এখন আর হয় না, সাঈদ ভাইয়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল রানা। কিছুটা ঢাকা বেতার কেন্দ্রের একঘেয়ে নাটকের মত শোনালেও রেডিয়োর ওপর বমি করে দিতে ইচ্ছে করল না রানার। কারণ এ নাটক রূপ লাভ করছে অতি সাধারণ হলেও একজন সত্যিকার প্রেমিকের হৃদয় মন্থন করা উপলব্ধি থেকে। শীত করছে রানার। ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা উইস্কি ঢেলে সাঈদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও খেল কয়েক ঢোক। দুই ঢোকে শেষ করল সাঈদ উইস্কিটুকু। তারপর গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার আরম্ভ করল।

‘ফিরে এলাম আমি শূন্য পাত্র নিয়ে। অনেক অনুরোধ উপরোধেও, এমন কী চাচাজির হুকুমেও বিয়ে করিনি আমি। অপেক্ষা করে ছিলাম। কিন্তু বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর আবার নষ্ট হয়ে গেল ও। তিক্ত হয়ে গেছে ও তখন জীবনের ওপর। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও কিছুতেই দেখা করল না আমার সঙ্গে। ওর পেছন পেছন লাহোর, পিণ্ডি, পেশোয়ার, করাচি ছুটে বেড়িয়েছি চাচাজির সঙ্গে পাগলের মত। তারপর আপনি এলেন ওর জীবনে। আমাকে ভুল বুঝবেন না, মি. মাসুদ রানা-আপনার প্রতি আমার কোনও বিতৃষ্ণা আছে ভাবলে ভুল হবে। আমি চাই ও সুখী হোক–ওর শান্তি হোক। আমার কপালে যা লেখা, আছে, তাই হবে। এ লিখন তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন? এত ঘটনার পরেও আমার স্নেহ-ভালবাসা এতটুকু কমল না। অদ্ভুত মেয়ে ও। কিছু দোষ নেই ওর। কারও ওপর কখনও অন্যায় করেনি জিনা। কিন্তু আমারই মত ওর ভাগ্যও বিরূপ। সুখ হলো না কিছুতেই। সবাই ঠকাল ওকে।

এই ভাবপ্রবণ যুবক জানে না জিনাতের কপালে কী ঘটেছে। স্টিয়ারিং ধরে স্থির হয়ে বসে থাকল রানা। আর বেশি দূর নেই। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা কৌশলে। নানান কথার পর মালাকান্দ স্মাগলিং সম্পর্কে কথা তুলতেই চুপ হয়ে। গেল সাঈদ। মনে মনে হাসল রানা। ব্যাটা JMTT–জাতে মাতাল তালে ঠিক। এখন ও-ই ওদের গোষ্ঠীর সর্দার। চাচাজির সমস্ত অপকীর্তি চালু রাখার মহান দায়িত্ব তুলে নিতে হবে ওকে নিজের কাঁধে। এবং বোঝা যাচ্ছে যোগ্যতার সঙ্গেই সে কাজ চালাবে ও। এই একটা মানুষের মধ্যে কী অদ্ভুত ভাবে সরল প্রেম আর ব্যবসায়িক কুটিলতা, কোমল আর কঠিনের মিশ্রণ হয়েছে ভাবতে অবাক লাগল রানার।

এবারের সিগারেটটা মাথা নিচু করে খুব সাবধানে ধরাল রানা। হাতের মধ্যে আড়াল রেখে টানল, ফেলবার, আগে খানিকটা পানি হাতে তুলে নিভিয়ে তারপর ফেলল। ছোট ছোট আধড়োবা পাহাড় দেখা যাচ্ছে দূরে।

হঠাৎ তীরের ওপর একটা সবুজ আলো জ্বলেই নিভে গেল। একটু বাঁয়ে কাটল রানা। পাঁচ মিনিট পর আরও কিছুদূর সামনে দু’বার জ্বলল আর একটা সবুজ বাতি। অনেকখানি সরে এল এবার রানা তীরের কাছে। তারপর বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন। বেশ কিছুদূর আপনাআপনি চলল বোট। তারপর আবার বৈঠা চালাতে আরম্ভ করল ওরা। তীরের ওপর তিনবার জ্বলল সবুজ বাতিআবছা মূর্তিটা চিনতে পারল রানা। দিল্লির খান।

‘বৈঠার শব্দ হচ্ছে, সাঈদ, ফিসফিস করে সাবধান করল রানা।

ধীরে ধীরে এগোল ওরা। নিঃশব্দে ইনফ্রারেড লেন্স লাগানো নাইট গ্লাসটা পরে নিল রানা চোখে। অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবার আঁধারের মধ্যে। দূরে একটা ইয়ট দেখা যাচ্ছে না? অর্ধেকটা আড়াল হয়ে আছে পাহাড়ের ওপাশে। তীরের দিকে দেখা গেল এরিয়ার মধ্যে বাঁধানো ঘাটে একটা লঞ্চ দাঁড়ানো। লোকজন দেখা গেল না। না ঘটে, না লঞ্চে।

এক শ’ গজ জায়গা খোলা আছে সমুদ্রের দিকে। ওখান দিয়েই ঢুকতে হবে। তীরে উঠে ঠেলে দিল রানা স্পিড-বোটটা বেশি পানিতে। হাওয়ার ধাক্কায় ধীরে ধীরে চলে গেল ওটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। দাঁড়িয়ে রইল পাড়ে রানা ও সাঈদ।

একটা ছোট মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদটা। ছুটে লম্বা স্টোররুমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। এই লম্বা ঘরটার ওপাশে খানিকটা জায়গা ছেড়ে রাস্তার পাশের দোতলা বিল্ডিং। ওদিকে আপাতত কোনও ঔৎসুক্য নেই রানার। প্রথমে ঢুকতে হবে এই ঘরটার মধ্যেই।

বড়-সড় একটা দরজা দেখা গেল পিছন দিকে। এই দরজা দিয়েই বোধহয় লোডিং আনলোডিং হয়। তালা মারা। কজায় তারের অস্তিত্ব দেখে বুঝল রানা বার্গলার অ্যালার্মের ব্যবস্থা আছে সেখানে। তাতে রানার কিছুই এসে যায় না। এদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে না, ও। মাছের কারবার যখন, তখন সামনে এগোলে নিশ্চয়ই কাঁচের দেয়াল থাকবে সূর্যের আলো আসবার জন্য। দরজাটা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল ওরা সামনে।

ঠিক। কিছুদূর এগিয়েই দেখা গেল লোহার ফ্রেমে কাঁচ বসানো আছে। কিন্তু বেশ অনেকখানি উঁচুতে। ভেতর থেকে ম্লান আলো আসছে। সাঈদের কাঁধে চড়ে কমার্শিয়াল ডায়মণ্ড বসানো কাঁচ কাটার স্টিক দিয়ে এক বর্গগজ আন্দাজ জায়গার কাঁচ তিন দিক থেকে কেটে ফেলল রানা। তারপর স্কচ টেপ দিয়ে অনেকগুলো স্টিচ লাগাল যাতে চতুর্থ দিকটা কাটলেই ঝন ঝন করে পড়ে না যায়। বা দিক, ডান দিক আর উপর দিকে ভাল মত স্টিচ লাগিয়ে এবার একটানে নীচের দিকটা কেটে ফেলল রানা। সামান্য ঠেলতেই প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল কাঁচ। দুই হাতে সাবধানে সেটাকে ধরে পায়ে ইশারা করতেই ধীরে ধীরে বসে পড়ল সাঈদ।

দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখল রানা কাঁচটা। সাঈদকে ওখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে রাইফেলটা মাটিতে শুইয়ে রেখে লাফিয়ে। ধরল ও লোহার ফ্রেম। তারপর পাকা জিমনাস্টের মত পা দুটো টেনে তুলে নিয়ে গেল ভেতরের দিকে।

কী যেন ঠেকল পায়ে। পা দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখল অ্যাকয়েরিয়াম একটা। হঠাৎ একটা শক খেয়ে চমকে উঠল রানা। আপনা আপনি ভাজ হয়ে গেল হাঁটু। কোনও বিষাক্ত মাছ কাটা মারল না তো? ফ্রেম থেকে বাঁ হাতটা সরিয়ে একটা পেন্সিল টর্চ বের করল রানা। মুখ ভোলা অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে পানি নড়তে দেখে সত্যিই ঘাবড়ে গেল রানা। সাবধানে এক পা রাখল টেবিলের ওপর। বেশি ভর দিতে সাহস হলো না, ভেঙে পড়তে পারে। হালকা করে টেবিলের ওপর এক পায়ের ভর দিয়ে ছেড়ে দিল ডান হাত। আরেক পা পড়ল মাটিতে। সামান্য শব্দ হলো। সেদিকে ঐক্ষেপ না করে। প্রথমেই লেবেলটা পড়ল রানা। ইংরেজিতে লেখা আছে: ‘ঈল। যাক, বাঁচা গেল। বিষাক্ত কিছু নয়। সাউথ আমেরিকান এই মাছ শুধু ইলেকট্রিক শক দেয়। হর্স কিলার বলে একে। জুত মত পেলে অনায়াসে একটা মানুষ খুন করে ফেলতে পারে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টর্চ নিভিয়ে দিল রানা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

পাশাপাশি কয়েক সারিতে অসংখ্য কাঁচের ট্যাঙ্ক চার পায়া টেবিলের ওপর রাখা। কয়েকটা ট্যাঙ্কে আলোর ব্যবস্থা আছে। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে স্নান চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। চারদিকে।

বাম পাশের সারিতে কয়েকটা লেবেল পড়ল রানাঃ প্লেটি, সোর্ডটেইল, জার্মান ফাইটার, গাপ্পি, গোরামি, ব্ল্যাক মলি, নিয়ন, সিকলিড, প্যারাডাইস, অ্যাঞ্জেল, ল্যাবিরিন্থ, গোল্ড ফিশ, সিয়ামিজ ফাইটার আরও কত কী। আর ডান দিকের সমস্ত অ্যাকুয়েরিয়ামের গায়ে সাঁটানো কাগজে লাল কালিতে ছাপা:

DANGER
Poisonous Fish

ছোট বড় নানান সাইজের ট্যাঙ্ক-মাছের আকার অনুযায়ী।

কয়েকটা লেবেলে নাম পড়ল: গিটার ফিশ, মাড ফিশ, লায়ন ফিশ, ঈল, টর্পেডো স্কেটস, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান স্করপিয়ন। এ ছাড়াও কিছু সামুদ্রিক বিষধর সাপের নামও পাওয়া গেল: হিমোফিস, হিমোডার্মা, হিমোসরাস, ইত্যাদি। রানা। লক্ষ করল এদিকের সারির প্রত্যেকটা ট্যাঙ্কে একটা করে মাছ বা সাপ। দু শ’ আড়াইশ’ ট্যাঙ্ক আছে ডানধারের এই দুই সারিতে। চারদিকে কেমন একটা বোটকা মত গন্ধ।

বহুরকম মাছের খাবার রাখা আছে মেঝেতে টিনের ট্রের মধ্যে। কিছু। পাউডার করে রাখা, কিছু জ্যান্ত। কয়েকটা চিনতে পারল রানা। ব্লাড-ওয়ার্ম, টিউবিফেক্স, মাইক্রো-ওয়ার্ম, হোয়াইটওয়ার্ম, ড্যাফনিয়া, ব্রাইন শ্রিম্প। কয়েকটা কাঁচের বোয়েমেও কয়েক পদের পাউডার ও ফ্লোটিং বল রাখা।

জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন আকারের অসংখ্য সুদৃশ্য ঝিনুক আর শঙ্খ তূপ। করা। এতেও আসে প্রচুর ফরেন কারেন্সি।

ঘরের ভিতর গরম। বদ্ধ আবহাওয়া। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে আরম্ভ করল রানার কপালে। বাইরের মুক্ত বাতাসের জন্য প্রাণটা চঞ্চল হয়ে উঠল ওর। ওদিকে সাঈদ নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে উঠেছে ভেতরে আসবার জন্য।

বিষাক্ত মাছের কথা শুনেই একটা কথা মনে এসেছিল রানার। সেটা পরীক্ষা। করে দেখতে হবে। তাই সাঈদকে বাইরে রেখে এসেছে।

হাঁটুর নীচে পায়ের সঙ্গে বাঁধা খাপ থেকে বের করল রানা অফিস থেকে পাওয়া নতুন ছুরিটা। ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা একটা লায়ন মাছের জারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। টর্চের আলো মাছটার দিকে ধরতেই নড়েচড়ে উঠল সেটা। রানার জানা আছে এ মাছ আক্রমণ করে না, আত্মরক্ষার জন্যে ব্যবহার করে বিষ। না চুলে ভয়ের কিছু নেই।

ছুরিটা পানি স্পর্শ করতেই খাড়া হয়ে গেল ওর মেরুদণ্ডের ওপরের কাঁটাগুলো প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের ছবির মত। চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে বাইরে। বিপদ টের পেয়ে গেছে সে। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পিছনে। ঘ্যাঁচ করে দুই চোখের মাঝখানে মাথার মাঝখানে গাঁথল রানা ছুরিটা। তারপর কাঁচের সাথে ঠেসে ধরেই ধীরে ধীরে উঠিয়ে আনল ওপরে। মাছটা ছটফট করছে আর লেজের বাড়ি মারছে ছুরিতে। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ওটাকে ফেলল রানা মেঝের উপর। তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে থাকল মাছটা মাটিতে পড়ে। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে ওটার ভব-যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দিল ও। তারপর আস্তিন গুটিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল অ্যাকুয়েরিয়ামের তলায় বালু আর কাদার মধ্যে।

আছে। শক্তমত কী যেন ঠেকল রানার হাতে।

বিষাক্ত মাছ আর সাপের কারবার দেখে ওর মনে যে সন্দেহ হয়েছিল, তাই ঠিক। বালি আর কাদার মধ্যে থেকে বের করে আনল রানা অন্তত এক শ’ ভরি ওজনের একটা সোনার বার।

ওপরের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাম হাতে নিল রানা সেটাকে। তারপর আবার হাত ঢুকিয়ে বাইরে না এনেই গুণে দেখল, আরও তিনটে আছে। এই ছোট ট্যাঙ্কেই যদি চারটে থাকে তা হলে বড়গুলোতে নিশ্চয়ই কমপক্ষে আটটা করে আছে। আন্দাজ করল রানা। আড়াই শ’ অ্যাকুয়েরিয়ামে কমপক্ষে দুই লক্ষ ভরি সোনা। এক শ তিরিশ টাকা হিসাবে দাম হচ্ছে কত কোটি টাকা? প্রতি ট্রিপে যদি এই পরিমাণ চালান যায় তা হলে বছরে? ওরেব্বাপ! বিরাট ব্যাপার!

চিন্তা করছে রানা খুব দ্রুত। আজকের এই অভিযানের ফলাফল অনিশ্চিত। হয়তো আজই ওর জীবনের শেষ দিন। কিন্তু এই সোনার ব্যাপারটা জানানো। দরকার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সকে। ভেবে দেখল, রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে অনীতা ফোন করবে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হবে আর্মড ফোর্স। একটা জারে মাছ না দেখতে পেলেও ওরা আসল ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সোনার বারটা এমন জায়গায় রাখা দরকার যেখানে রাখলে সোয়া বারোটার আগে এদের চোখে পড়বে না, অথচ পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর চোখে পড়বে এবং ব্যাপারটা বুঝতে পারবে ওরা।

ছুরির আগা দিয়ে সোনার বারটার ওপর M.R-9 লিখল রানা। তারপর মরা মাছটাকে ছুরিতে গেঁথে নিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার টেবিলের ওপর ট্যাঙ্কের আড়ালে রেখে দিল সোনা আর মাছ পাশাপাশি।

এবার ফিরে এল ও যেখান দিয়ে ঢুকেছিল সেইখানে। সঙ্কেত পেয়েই একটা রাইফেল চালান দিল সাঈদ ভেতরে। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল সেটা রানা। কিন্তু দ্বিতীয় রাইফেল চালান দেয়ার আগেই একসাথে জ্বলে উঠল ঘরের মধ্যে পঁচিশ-তিরিশটা এক শ’ পাওয়ারের বাল্ব। সেই সঙ্গে কানে এল ভয়ঙ্কর হিংস্র একটা গর্জন।

.

১২.

গুংগা!

চমকে উঠল রানা। একটানে বের করল রিভলভার।

পঁচিশ গজ দূরে মেইন গেটটা খুলে গেছে। সেই গেট দিয়ে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে দানবসদৃশ গুংগা। রানা বুঝতে পারল রিভলভার দিয়ে ঠেকানো যাবে না ওকে। রাইফেলটা তুলে নিতে যাবে, এমন সময় বোঁ করে দশ ইঞ্চি ইটের সমান একটা পাথর এসে লাগল দেয়ালে খাড়া করে রাখা রাইফেলের বাটের ওপর। ছিটকে চলে গেল রাইফেলটা বারো চোদ্দ হাত দূরে।

আরেকটা পাথর আসছিল ছুটে। চট করে মাথা নিচু করল রানা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল পিছনের অ্যাকুয়েরিয়াম। বিষাক্ত মাছের। লাফিয়ে সরে গেল রানা বামদিকে। আবার গর্জন শোনা গেল। অনেকখানি এগিয়ে এসেছে গুংগা ততক্ষণে। কোমরের সাথে ঝোলানো একটা পাথরভর্তি বড় থলে। তার একমাত্র অমোঘ অস্ত্র। আজ সে বাগে পেয়েছে রানাকে।

গুলি করল রানা। অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে একপাশে সরে গেল. গুংগা। দূরের একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে ঠুস করে ঢুকল রানার গুলি। মেঝের ওপর পানি পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।

দমে গেল। সম্পূর্ণ দমে গেল রানার মনটা। আশ্চর্য! মানুষ না পিশাচ? এতখানি ক্ষিপ্রতা একমাত্র পিশাচেই সম্ভব! কোন এক ইংরেজি বইয়ে পড়েছিল, আফ্রিকার জঙ্গলে অন্ধকার রাতে একটা ষাড় মেরে খেতে খেতে রাইফেলের শব্দ শুনেই লাফিয়ে সরে গিয়েছিল এক সিংহ। মনে করেছিল, হয় গাঁজা মারছে, নয় হাত কেঁপে গিয়েছিল শিকারীর। কিন্তু আজ নিজের চোখে সেই রকম ক্ষিপ্রতা দেখে ভয়ে এবং বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। আবার গুলি করল রানা। এবারও সরে গেল গুংগা। শব্দ তো শুনতে পারছে না, রানার আঙুলের নড়া দেখেই টের পাচ্ছে সে। ছুটে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আবার একটা পাথর ছুড়ল সে। রানার দিকে।

টুপ করে বসে পড়ল রানা টেবিলের তলায়। পাথর লাগল এসে অ্যাঞ্জেল ফিশের ট্যাঙ্কে। ঝুপ ঝুপ করে সব পানি পড়ল রানার মাথায়। কলারের মধ্যে দিয়ে শার্টের ভেতর ঢুকল একটা মাছ। ফড় ফড় করে লেজ ও পাখা দিয়ে অস্বস্তিকর বাড়ি মারছে সে রানার ঘাড়ে।

চোখটা মুছে নিয়ে টেবিলের তলা দিয়ে গুংগার পা লক্ষ্য করে গুলি করল। রানা। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কয়েক পা এগিয়ে এসেছে গুংগা।

এমন সময় গর্জে উঠল আরেকটা রিভলভার। রানা চেয়ে দেখল কাটা কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাঈদকে। একহাতে রিভলভার। অর্ধেকটা ঢুকে পড়েছে সে ঘরের মধ্যে।

উঠে দাঁড়িয়ে দেখল রানা গুংগার বাম বাহুতে একটা সরু রক্তের ধারা দেখা। যাচ্ছে। ট্যাঙ্কের আড়ালে আড়ালে বেশ খানিকটা সরে গেল রানা। হাতে ব্যথা। পেয়ে হুঙ্কার ছেড়ে পাথর তুলল গুংগা একটা।

এমন সময় ‘উহ্!’ করে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনেই ফিরে চাইল রানা। দেখল ঈল মাছের ট্যাঙ্কসহ হুড়মুড় করে পড়ল সাঈদ মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। হয়তো ট্যাঙ্কের মধ্যেই নেমে পড়েছিল।

এই এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতাটুকু কাজে লাগাল গুংগা। দড়াম করে একটা পাথর, এসে পড়ল রানার ডান কব্জির ওপর। ছিটকে কয়েক হাত দূরের একটা মুখ খোলা অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে গিয়ে পড়ল রিভলভার। জয়ের উল্লাসে। আরেকটা হুঙ্কার ছাড়ল গুংগা।

অসহ্য যন্ত্রণায় একটা গোঙানি বেরিয়ে এল রানার মুখ দিয়ে। কব্জিটা ভেঙেই গেছে বোধহয়। বাম হাতে চেপে ধরল ও ডান হাতের কব্জি।

নিরস্ত্র ও। ছুটে এগিয়ে আসছে পিশাচটা। সাঈদের কাছাকাছি যেতে পারলেও হত। ওর রিভলভারটা কাজে লাগানো যেত। কিন্তু সে উপায় নেই। তাড়া খাওয়া মুরগির বাচ্চার মত মাছের জারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে বেড়াতে থাকল ও। বোঁ করে কানের পাশ দিয়ে গিয়ে দেয়ালে লাগল একটা পাথর।

নিজের নিরুপায় অবস্থা ভালমত উপলব্ধি করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। কারণ গুংগা যদি ওকে ওয়ালী আহমেদের কাছে ধরে নিয়ে যাবার জন্যে এসে। থাকে তা হলে আত্মসমর্পণ করলে এক্ষুণি হত্যা করবে না। কিন্তু এখন ওকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে ঠিক মেরে ফেলবে ও। হত্যার নেশা দেখতে পেয়েছে ও গুংগার চোখে।

বেরিয়ে এল রানা মাঝের প্রশস্ত পথটায়। এগিয়ে আসছিল গুংগা তুফানের মত। দুই হাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়াল রানা।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল গুংগাও। বিস্মিত ওর চোখ-মুখ। বহুদিন পর একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে আন্তরিক খুশি হয়েছিল সে। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দিল? আক্রমণের আনন্দটা আর থাকল কোথায়? কিন্তু…সতর্ক হলো গুংগা। এই লোকটি তত সহজে কাবু হবার বান্দা নয়! নিশ্চয়ই কোনও কুমতলব আছে। সাবধানে এগোল সে সামনে। রানা মাথার ওপর হাত তুলে পিছিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে। পাঁচ হাত দূরেই গুংগা। গুংগার চোখ পড়ল পিছনে মাটিতে পড়ে থাকা সাঈদের ওপর। এতক্ষণ দেখতে পায়নি সে ওকে। রানাকে পিছিয়ে। ওদিকে যেতে দেখে একটা হুঙ্কার ছেড়ে হাতের ইশারায় থামতে বলল সে। কোঁচড় থেকে পাথর বের করল একটা।

হঠাৎ রানার মনে পড়ল বুক পকেটের বলপয়েন্ট পেনসিলটার কথা। একটানে বের করেই টিপে দিল গুংগার মুখ লক্ষ্য করে। এ অস্ত্র আর কোনওদিন প্রয়োগ করেনি ও। দেখল কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক অ্যাসিড ছুটে গিয়ে চোখে মুখে পড়তেই টগবগ করে ফুটতে লাগল গুংগার মুখের মাংস। বড় বড় ফোস্কা ও ঘায়ে বীভৎস আকার ধারণ করল মুখের চেহারা তিন সেকেণ্ডে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল গুংগা। ছিটকে পড়ে গেল পাথরটা হাত থেকে। ভয়ঙ্কর মুখটা দুইহাতে ঢাকল সে। একটা চোখ সম্পূর্ণ গলে গেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আরেকটা ভীত চোখ চেয়ে আছে রানার দিকে।

ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটল রানা রাইফেলটার দিকে। কিন্তু দুই পা এগিয়েই হঠাৎ একটা লোহার হুকে পা বেধে পড়ে গেল মাটিতে। হুকটা সরে গেল একপাশে। প্রাণভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা আবার।

কিন্তু কোথায় গুংগা? গুলি খাওয়া চিতাবাঘের মত লাফিয়ে উঠেছিল গুংগা ব্যাপার বুঝতে পেরে। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। একটা আতঙ্কিত তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। অবাক হয়ে দেখল রানা চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল গুংগা ভোজবাজির মত।

কাছে গিয়ে দেখল একটা আট ফুট বাই আট ফুট চারকোণা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে মেঝেতে। নীচে অন্ধকার। পরমুহূর্তেই চোখে পড়ল গর্তের একটা কিনারায় গুংগার আঙুল দেখা যাচ্ছে। পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কিনারাটা ধরে ফেলেছে সে। কিন্তু উঠতে পারছে না উপরে। কেউ সাহায্য না করলে পারবেও না।

এতক্ষণ পর দুই কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল রানা। কপালের ঘাম মুছে নিল রুমালে। অর্ধেক অ্যাসিড খরচ হয়েছে, বাকি অর্ধেক আছে-পেনটা পকেটে পুরল আবার। তারপর পকেট থেকে টর্চ বের করে ধরল গুংগার মুখের ওপর। স্থির নিষ্পলক বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার মুখের দিকে একটা চোখ।

কী আছে নীচে? গুংগার হাতের পাথরটা ফসকে পড়ে গিয়েছিল এক ধারে। পা দিয়ে ঠেলে এনে ফেলল রানা সেটাকে গর্তের মধ্যে। টুম’ করে শব্দ হলো। তারপরই ছলাত করে ওপরে ছিটকে এল পানি।

নিশ্চয়ই পিরানহা! এরই মধ্যে ফেলে হত্যা করা হয়েছে মোহাম্মদ জানকে। আঙুলের মাথায় খানিকটা পানি নিয়ে জিভে ঠেকাতেই সন্দেহ রইল না আর। নোনতা! সাগরের সাথে যোগ আছে এই ট্যাঙ্কের মাটির তলা দিয়ে।

গুংগার আঙুলগুলো সাদা দেখাচ্ছেনখগুলো রক্তশূন্য। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে সে মৃত্যু-গহ্বরের মুখে। আবার টর্চ ধরল রানা ওর মুখের ওপর। করুণ মিনতি ওর এক চোখে। একটা গোঙানি বেরিয়ে এল মুখ থেকে। থর থর করে কাঁপছে ওর হাতের পেশিগুলো।

রানার চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত মোহাম্মদ জানের মুখ। স্বপ্নের সেই দৃশ্যটা পরিষ্কার দেখতে পেল ও আবার। অনীতার মুখটাও ভেসে উঠল মনের পর্দায়। অনীতা, জিনাতের আর্তনাদ-গুংগার পৈশাচিক কামোন্মত্ত উল্লাস…

আগুন ধরে গেল মাথার মধ্যে।

ছোট্ট দুটো লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল ও আটটা আঙুল।

একটা প্রলম্বিত চিৎকার, হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল মাথাটা পানির তলায় চলে যেতেই। রানা মনে মনে ভাবল, এক নম্বর গেল। এবার ওয়ালী আহমেদ। ডান হাতটা টন টন করে উঠতেই চেয়ে দেখল গুংগার কব্জির মত ডবল-সাইজ দেখাচ্ছে সেটা। উত্তেজনার মাথায় ভুলেই গিয়েছিল ও ব্যথার কথা।

ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে উঠে দাঁড়িয়েছে সাঈদ। রানা গিয়ে দাঁড়াল পাশে। দূরে কয়েকটা বুটের শব্দ শোনা গেল। রাইফেলটা তুলে নিল রানা মাটি থেকে। তারপর এগিয়ে গেল ওরা খোলা গেটের দিকে।

‘গুংগা কোথায়?

কালো গর্তটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোহার বন্টুটা উল্টো দিকে ফেরাল রানা জুতো দিয়ে। খটাং করে বন্ধ হয়ে গেল গর্তমুখ। বুটের শব্দ কাছে এসে পড়েছে। দৌড় দিল রানা ও সাঈদ। দরজা দিয়ে মুখ বের করেই দেখতে পেল ওরা জনা আষ্টেক লোক পাশের দোতলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। এদিকে। প্রত্যেকের হাতেই রিভলভার। গুলি গালাচের শব্দ শুনতে পেয়েছে ওরা।

দরজার আড়াল থেকে একসাথে গর্জে উঠল রানার রাইফেল আর সাঈদের রিভলভার। দুজন আছড়ে পড়ল মাটিতে। থমকে দাঁড়াল বাকি সবাই। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভড়কে গেল। রানার রাইফেলের বোল্ট টানার অবসরে আর একটা গুলি করল সাঈদ। একজনের পায়ে গিয়ে লাগল সাঈদের দ্বিতীয় গুলি। বসে পড়ল সে-ও। বাকি পাঁচজন ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল ছত্রভঙ্গ হয়ে।

এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা নারী কণ্ঠের চিৎকারে চমকে উঠল রানা ও সাঈদ। বাঁ দিক থেকে আসছে। এই স্টোর রুমের পাশের কোনও একটা ঘর থেকে।

জিনাত!

ছুটে গেল রানা ও সাঈদ সেদিকে। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা গেল একটা স্ত্রীলোকের চেহারা। কী একটা জিনিস ঘুরাচ্ছে সে দেয়ালের গায়ে। রাইফেলের বাটের প্রচণ্ড আঘাতে কড়াসুদ্ধ ছুটে এল দরজার তালা। ঘরে ঢুকতেই হা-হা-হা হা করে হেসে উঠল স্ত্রীলোকটি। এ কে? প্রথমে চিনতেই পারেনি রানা। এই চেহারা হয়েছে জিনাতের? উদভ্রান্ত দুই চোখ টকটকে লাল, চোখের কোণে কালি। পরনে পেটিকোট ছাড়া কিছুই নেই। চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে তাতে। সমস্ত দেহে ধারাল নখের চিহ্ন। মাথার চুল উসকোখুসকো।

ওদের দেখেই হা-হা করে হেসে উঠল জিনাত আবার। মট মট করে একগোছা চুল ছিঁড়ে শুন্যে ছুঁড়ে দিল। তারপর খেলা দেয়াল-আলমারির মধ্যে বসানো একটা চাকার হাতল ধরে ঘোরাতে থাকল। মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জিনাতের।

জিনাত!’ ডাকল রানা।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? একবার চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল জিনাত। চিনতেই পারল না রানাকে।

ছুটে গিয়ে সাঈদ ধরল জিনাতের হাত।

‘জিনা! জিনা ব্যাহেন!

অবাক হয়ে সাঈদের দিকে চাইল জিনাত। চিনতে পারল ধীরে ধীরে।

‘সাঈদ ভাইয়া, উও কওন হ্যায়। রানার দিকে ভীত চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল জিনাত। তারপর চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, ‘ভৗগো, সাঈদ ভাইয়া।

জিনাতকে সাঈদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ছুটল রানা ওয়ালী আহমেদের উদ্দেশ্যে। ওই বাড়িতে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে ওকে।

ফিশস্টোরের দরজার সামনে এসে পৌচেছে রানা এমন সময় একটা সরু দড়ির ফাঁশ এসে পড়ল ওর গলায়। দুজন চেপে ধরল দুই হাত। হেঁচড়ে টেনে আবার নিয়ে এল ওকে স্টোরের ভিতর।

.

১৩.

হাত-পা ছুঁড়ে ছুটবার চেষ্টা করল রানা। সফল হলো না। রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে দড়াম করে এক বাড়ি মারল একজন রানার পশ্চাদদেশে। কয়েক পা এগিয়ে গেল রানা সে ধাক্কায়। বুঝল, বাধা দেয়ার চেষ্টা বৃথা। একজন বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে ওর ফুলে ওঠা কব্জি। বাম হাতে এতগুলো লোকের সঙ্গে পারবে না ও।

তা ছাড়া ওয়ালী আহমেদের কাছে পৌঁছবার আগেই শেষ হয়ে যেতে চায় না ও। খোদা। কিছু শক্তি অবশিষ্ট রেখো। ওয়ালী আহমেদের কণ্ঠনালীটা ছিঁড়ে ফেলতে পারলে আর কিছুই চায় না ও। তারপর ওর কপালে যা হয় হোক।

সমুদ্রের দিকে স্টোর-হাউসের একটা দরজা খুলে হাঁ করা। ওই পথেই এসেছে ওরা। ওই পথেই বের করে আনল রানাকে বাইরে। কোথায় নিয়ে। চলেছে ওকে ওরা? তা হলে কি প্রতিশোধ নেয়া হলো না? লঞ্চ ঘাটের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল ওরা রানাকে।

বাইরে খোলামেলা জোলো-হাওয়া। সমুদ্রের একটানা শোঁ শোঁ গর্জন। আর আকাশে আধখানা চাঁদ। সারা আকাশ জুড়ে টিপ টিপ করছে অসংখ্য ম্লান তারা। রানার হাতঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। রানা ভাবল, কার বারোটা বাজল? ওর, না ওয়ালী আহমেদের।

সরু দুটো তক্তা জোড়া দিয়ে লঞ্চে ওঠার গ্যাংওয়ে বানানো হয়েছে। কয়েকটা ঝটকা দিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার বৃথা চেষ্টা করল রানা। সতর্ক রয়েছে লোকগুলো। দড়াম করে পিঠের ওপর পড়ল রাইফেলের কুঁদো। সামনের টানে এবং পিছনের কয়েকটা প্রবল ধাক্কায় লঞ্চের ওপর উঠে এল ও চোখের সামনে প্রচুর শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে। কিন্তু এই ধস্তাধস্তিতে কাজ হলো। বুকের কাছে শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে গেল।

একটা কেবিনের দরজায় তিনটে টোকা দিল একজন।

‘ভেতরে এসো, গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

ওয়ালী আহমেদ! চিনতে পারল রানা গলার স্বর। লাফিয়ে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। আল্লা! এখনও সুযোগ আছে! শেষ চেষ্টা করে দেখবে ও। নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করল রানা। মাথা ঠিক রাখতে হবে এখন।

প্রশস্ত একটা কেবিন। ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে ওয়ালী আহমেদ। হাতের কাগজটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখা।

‘শেষ পর্যন্ত আসতেই হলো আপনাকে, মিস্টার মাসুদ রানা। কিন্তু দুঃখ, আমার ইচ্ছেমত এক্সপেরিমেন্টাল মৃত্যু দিতে পারলাম না আপনাকে। অবশ্য মোহাম্মদ জানের ওপর দিয়ে সে কাজটা সেরে নেয়া গেছে অনেকটা। বোঝা গেল আড়াই মিনিটের বেশি লাগবার কথা নয়। ভীতু বেড়াল-ছানার মত সারা দিন হোটেলের মধ্যে বসে থাকলেন সারা হোটেলময় একঝাড় টিকটিকি ছড়িয়ে। ভাবছিলাম ফস্কে গেলেন বুঝি। কিন্তু বিদায়ের আগে ঠিক দেখা হয়ে গেল। কপালের লিখন খণ্ডাবে কে!

রানা কোনও উত্তর দিল না। ডান হাতের কব্জির ব্যথায় মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল একটা। হাতটার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল ওয়ালী আহমেদ। একটা পান ফেলল মুখে।

আজ আর গত কালকের মত লেকচার দিয়ে আপনার বিরক্তি উৎপাদন করব না। আর তিন মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে আপনার। পাথর বেঁধে ফেলে দেয়া হবে লাশটা সাগরে। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টোর হাউসটা ঘিরে ফেলবে আর্মড ফোর্স। আমার বিরুদ্ধে কিছুই পাবে না তারা সেখানে। তবু ওরা এসে পড়বার আগেই আমি ইয়টে পৌঁছে যেতে চাই। সন্দেহজনক কিছু নেই। ওই ইয়টে। বিনা বাধায় দু’হাজার নয় শ’ মাইল, অর্থাৎ চিটাগাং পর্যন্ত চলে যাবে ইয়ট। এখান থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে একটা হেলিকপ্টার এসে তুলে নিয়ে যাবে আমাকে রাওয়ালপিণ্ডি।’

ঘড়ির দিকে চাইল ওয়ালী আহমেদ।

আর দু’মিনিট আছে। আপনার শেষ ইচ্ছা কিছু থাকলে বলতে পারেন, মিস্টার মাসুদ রানা।

‘দুই মিনিটের আগে মারবেন না আমাকে?

না।

‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনার দু’মিনিট পূর্ণ হবার আগেই আমি ঢলে পড়ব মৃত্যুর কোলে,’ বলল রানা। চোখের ইঙ্গিতে বোতাম ছেঁড়া শার্টের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওয়ালী আহমেদের। বিষ ছিল এ বোতামে। খেয়ে নিয়েছি আমি।’

বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চাইল ওয়ালী আহমেদ রানার দিকে। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে রানার দেহটা। ঢুলছে ও অল্প অল্প। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর। টেনে টেনে বলল, আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবেন?

মাথা নাড়ল ওয়ালী আহমেদ। হ্যাঁ।

তা হলে চিঠি দেব একটা। আমার…আমার বাগদত্তা স্ত্রীর কাছে। উহ! আপনার বিরুদ্ধে কিছুই…কিছুই থাকবে না সে চিঠিতে। উহ্, পানি!’

হাঁপাতে থাকল রানা। লাল হয়ে উঠল ওর চোখ-মুখ। মুচকি হাসল ওয়ালী আহমেদ। সামনের টেবিলে রাখা একটা সাদা প্যাডের দিকে ইঙ্গিত করতেই একজন তুলে ধরল সেটা রানার সামনে। পা দুটো কাঁপছে রানার থরথর করে। ডান হাতটা ছেড়ে দেয়া হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে বল পয়েন্ট পেন। বের করল রানা।

কিন্তু বোতাম টেপার আগেই টের পেয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ। চট করে। পেপার তুলে ধরায় মুখ পর্যন্ত গেল না অ্যাসিড-কাগজে বেধে গিয়ে টপ টপ। করে পড়ল কয়েক ফোঁটা ভুঁড়ির ওপর। ফড়ফড় করে পুড়তে থাকল ভুড়ির চামড়া। জ্বলুনির চোটে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার করে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ।

এক ঝটকায় বাঁ হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। বাকি অ্যাসিডটুকু শেষ করল স্যাঙাতদের ওপর। পাগলের মত নাচানাচি আরম্ভ করল লোকগুলো। অন্ধের মত ছুটাছুটি শুরু করল ঘরের মধ্যে।

ওয়ালী আহমেদ দৌড়ে গিয়ে একটা ড্রয়ার ধরে টান দিল। পরমুহূর্তে সিংহের মত লাফিয়ে পড়ল রানা ওর ওপর। পিস্তলটা আর বের করা হলো না। শিরদাঁড়ার ওপর রানার কনুয়ের এক প্রচণ্ড তো খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল ওর। দেহটা। তারপর পাঁজরের ওপর এক লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল ওয়ালী আহমেদের মেদ বহুল দেহটা মেঝেতে। কব্জির ব্যথার কথা ভুলে গেল রানা। বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিপে ধরল ওর টুটি। ঠিকরে বেরিয়ে এল ওয়ালী আহমেদের চোখ দুটো বাইরে।

এমন সময় স্যাঙাতদের একজন এসে চেপে ধরল রানার, চুলের মুঠি। ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিল রানা। পায়ে বাঁধা ছুরিটা বের করে চালিয়ে দিল ও লোকটার পেট আন্দাজ করে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। চুল ছেড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে চিত হয়ে পড়ল লোকটা। আর রিস্ক নেয়া যায় না। লাফিয়ে উঠে ড্রয়ার থেকে বেরেটা অটোমেটিক পিস্তলটা বের করল রানা। স্লাইড টানতেই ইজেক্টারের টানে ছিটকে বেরিয়ে একটা গুলি পড়ল মেঝেতে। লোডেড।

উঠে বসেছিল ওয়ালী আহমেদ। মুখের ওপর রানার বুটের এক লাথি খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার। থুক করে দুটো রক্ত মাখা ভাঙা দাঁত বের করে ফেলল মুখ থেকে। তারপর জ্ঞান হারাল। লঞ্চটা চলতে আরম্ভ করেছে তখন। ঘরের মধ্যে দুজন এবং দরজার কাছে একজন স্যাঙাত পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে। বাকি দুজন কেবিন থেকে বেরিয়ে বোধহয় সংবাদ দিয়েছে অন্যান্যদের। দ্রুত সরিয়ে নেবার। চেষ্টা করছে ওরা লঞ্চটাকে ঘাট থেকে। একবার ইয়টে পৌঁছতে পারলে আর রক্ষা নেই রানার।

ওয়ালী আহমেদের একটা পা ধরে হিড় হিড় করে টেনে কেবিন থেকে বের করে আনল রানা ডেকের ওপর। রাইফেলটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। গলার ফাসটা খুলে ওয়ালী আহমেদের গলায় পরাল। তারপর বেঁধে ফেলল ওকে রেলিং-এর সঙ্গে ছাগলের মত।

কয়েক পা এগোতেই সারেংকে দেখা গেল।

লঞ্চ ঘুরাও।

চমকে উঠেই পালাতে যাচ্ছিল সারেং-পিস্তলটা দেখে থেমে গেল। ঘুরিয়ে দিল লঞ্চ। ঘাট থেকে অল্পদূরেই গিয়েছিল, ফিরে চলল আবার সেটা ঘাটের দিকে।

চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখল রানা। আর লোকগুলো কোথায় গেল? কোনদিক থেকে আক্রমণ আসবে এবার?

নড়েচড়ে উঠল ওয়ালী আহমেদের দেহটা। জ্ঞান ফিরে পেয়েছে সে।

‘খবরদার! এক ইঞ্চি নড়েছ কি খতম করে দেব!’ বলল রানা সারেং এবং ওয়ালী আহমেদকে লক্ষ্য করে। চোখ মেলে চাইল ওয়ালী আহমেদ। চারদিকে চেয়ে সবটা পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করল সে।

আর গজ পঁচিশেক আছে। হঠাৎ ডান ধারে পায়ের শব্দ শুনে সেদিকে চাইল রানা। পিস্তল হাতে রানাকে দেখে থমকে দাঁড়াল ওরা। সেই দুজন স্যাঙাত। বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা। বিনাবাক্যব্যয়ে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ।

এমনি সময় ঘটল ঘটনাটা। রানা অন্যদিকে চাইতেই বাঁধন খুলে ফেলেছিল। ওয়ালী আহমেদ, এবারে তড়াক করে রেলিং টপকে পানিতে গিয়ে পড়ল।

সার্চ লাইট পানিতে ফেল, সারেং। জলদি।

হুকুম করল রানা। জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে না পারলে মেরে রেখে যাবে।

জ্বলে উঠল তীব্র আলো। সে আলোয় বিস্মিত হয়ে দেখল রানা খলখল করে হাসছে যেন সাগরের জল। জীবন্ত হয়ে উঠেছে লঞ্চের চারটা পাশ প্রাণচাঞ্চল্যে।

ব্যাপার কী? প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। বুঝতে পারল ওয়ালী আহমেদ ভেসে উঠতেই। ভুস করে মাথাটা ভেসে উঠল ওর পানির উপর।

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ চিৎকার করে উঠল ওয়ালী আহমেদ ভাঙা গলায়। অবাক হয়ে দেখল রানা ওর সারা মুখ কামড়ে ধরে ঝুলছে আট দশটা ছয় সাত ইঞ্চি লম্বা মাছ। আলো পড়ে চকচক করছে ওগুলোর রূপালী পেট।

পিরানহা! সাগরে বেরিয়ে এল কী করে? ওয়ালী আহমেদ আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে। দুই হাত দিয়ে সরাবার চেষ্টা করছে মাছগুলোকে সর্বাঙ্গ থেকে। কিন্তু একটা সরলে দশটা ঝাঁপিয়ে আসছে সেই জায়গায়। সর্বশরীরে ছেঁকে ধরেছে ওরা। তিন মিনিটেই শেষ করে ফেলবে।

কিন্তু এল কোত্থেকে ওরা? হঠাৎ রানার মনে পড়ল জিনাতের সেই চাকা ঘোরানোর কথা। মাটির তলা দিয়ে যখন সাগরের সাথে স্টোররুমের নীচের ট্যাঙ্কের যোগ আছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও এক জায়গায় তারের জাল দিয়ে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। জিনাতের ওই চাকা ঘোরানোর ফলে হয়তো সেই জালের বেড়া সরে গিয়ে থাকতে পারে। হয়তো ওই চাকা দিয়েই বেড়া উঠানো-নামানোর ব্যবস্থা করেছিল ওয়ালী আহমেদ। ছাড়া পেয়ে সব বেরিয়ে এসেছে বাইরে।

এবার পাগলের মত সাঁতার কাটতে আরম্ভ করল ওয়ালী আহমেদ তীরে আসার জন্যে। কন্ট্যাক্ট লেন্স থাকায় চোখ দুটো বেঁচে গেছে পিরানহার ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে। কিন্তু সারা দেহের জ্বলুনি আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ক্ষতস্থানে লাগলে কেমন জ্বালা করে, কত কষ্ট হয় হাড়ে হাড়ে টের পেল সে এতদিনে।

মৃত্যু-যন্ত্রণায় শেষবারের মত কেঁদে উঠল ওয়ালী আহমেদ। আর এগোতে পারছে না। রক্তে লাল হয়ে গেছে পানি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ডুবে গিয়েছিল-আবার যখন ভেসে উঠল, রানা দেখল নাক-কানের চিহ্নমাত্র নেই সে মুখে। কয়েক সেকেণ্ড রানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ডুবে গেল ওয়ালী আহমেদের মুমূর্ষ দেহটা। সেই সঙ্গে পিরানহার রূপলী ঝিলিক নেমে গেল সাগর গভীরে।

কপালের লিখন খণ্ডাবে কে? ঠিকই বলেছিল ওয়ালী আহমেদ।

ঘাটে ভিড়ল লঞ্চ। ইশারা করতেই সারেংসহ তিনজন নেমে গেল আগে আগে। কসম খেয়ে বলল আর লোক নেই লঞ্চে। আবার স্টোর হাউসে ঢুকল ওরা খোলা দরজা দিয়ে। যে ঘরে জিনাত ছিল সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না রানা।

এখনও আর্মড ফোর্সের পাত্তা নেই কেন? অনীতা কি তা হলে আসেনি?

দোতলা বাড়ির পাশ দিয়ে বাইরে বেরোবার গেটের দিকে এগোচ্ছে রানা। বন্দি তিনজনকে নিয়ে। হঠাৎ কানে এল: হুকুমদার (who comes there)! হল্ট! হ্যাণ্ডস আপ!’

রানাকে ‘ফ্রেণ্ড’ বলবারও সুযোগ দিল না-ব্যাপার কী? ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল। পিল পিল করে চারপাশ থেকে এরিয়ার মধ্যে ঢুকছে লোহার শিরস্ত্রাণ পরা সশস্ত্র বাহিনীর জোয়ানরা।

সামনের তিনজনের মত রানাও দাঁড়িয়ে গেল হাত তুলে। এমন সময় গেট দিয়ে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর করাচি চিফের সঙ্গে ঢুকলেন, মেজর জেনারেল রাহাত খান। তাদের পিছন পিছন ঢুকল সাধু বাবাজি সোহেল। সামনের তিনজনের ভার গ্রহণ করল মিলিটারি।

রানার বিধ্বস্ত চেহারা আর ফোলা হাতের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রাহাত খান। অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিল রানা রাহাত খানকে। ফাস্ট এইডের কথা তোলায় বলল বাইরে লোক আছে তার সঙ্গে যাবে। তারপর সোহেলকে একবার চোখ টিপে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। রাহাত খান করাচি চিফের সঙ্গে চললেন স্টোরের দিকে।

এমন সময় ছুটে এসে রানার হাত ধরল অনীতা গিলবার্ট।

‘এ কী চেহারা হয়েছে তোমার, রানা! যাক, বেঁচে আছ যে এ-ই বেশি। ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গিয়েছিল একেবারে।

‘শিগগির আমাকে কোনও হাসপাতালে নিয়ে চলো, অনীতা। ফার্স্ট এইড দরকার।’

নিশ্চয়ই।

এগোল ওরা গেটের দিকে। হঠাৎ ওপর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল অনীতা।

‘আরে! ছাতের ওপর কে! আঙুল দিয়ে দেখাল সে ছাতের দিকে।

অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে দেখল রানা বিশাল এক দৈত্যের মূর্তি! গুংগা! ভূত দেখার মত চমকে উঠল রানা গুংগাকে দেখে। চট করে রাইফেলটা নামাল কাঁধ থেকে। বুঝল সব পিরানহা সাগরে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ফেলেছিল ও তাকে গর্ত দিয়ে পিরানহার ট্যাঙ্কে।

প্রকাণ্ড একটা পাথর তুলেছে গুংগা দুই হাতে মাথার ওপর। বোধহয় এতক্ষণ ছাতে উঠে বসেছিল সে রানার অপেক্ষায়।

পর পর দুটো গুলি করল রানা আধ সেকেণ্ডের মধ্যে।

ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মত বাঁকা হয়ে গেল গুংগার দেহটার পিছন দিকে। তারপর এগজিবিশনের প্রফেশনাল ডাইভারের মত সোজা নেমে এল সে ছাত থেকে মাথা নীচের দিকে করে। মড়াত করে ভেঙে গেল বিশ বছরের দুরমুজ করা গর্দান।

এগিয়ে যাচ্ছিল সেদিকে রানা, হঠাৎ অনীতার এক হেঁচকা টানে থেমে দাঁড়াল।

গুংগার হাতের প্রকাণ্ড পাথরটা হাত থেকে খসে প্রথমে পড়েছিল কার্নিশের উপর। ওখান থেকে গড়িয়ে সোজা নেমে এল নীচে। ঠিক গুংগার মাথার ওপর এসে পড়ল তিনমণ ওজনের প্রকাণ্ড পাথর। ঠুস করে একটা শব্দ করে ফেটে গেল খুলি। মগজ আর তাজা রক্ত ছিটকে এসে লাগল রানা আর অনীতার চোখে-মুখে, কাপড়ে।

‘সেই পিশাচ, তাই না, রানা! ইটস আ জায়ান্ট!’

কানের পাশে রাহাত খানের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল রানা। দেখল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। অনীতার হাতটা ছেড়ে দিল ও চট করে।

‘জী, স্যর।

তা তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও, কুইক। কোনও হসপিটালে ফাস্ট এইড নিয়ে নাও।

সাতদিনের ছুটি দিতে হবে, স্যর।’ বলল রানা একটু ইতস্তত করে।

ভুরু কুঁচকে রানা এবং অনীতার মুখের দিকে চাইলেন একবার রাহাত খান। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অলরাইট।’

ঘৃণাভরে চাইল একবার অনীতা গুংগার মৃতদেহের পানে। তারপর এগিয়ে গেল ওরা স্টার্ট দিয়ে রাখা লাল করোনা ডিলাক্সের দিকে।

‘আজকে ড্রাইভিং-এর কী মজুরী পাওয়া যাবে?

ফার্স্ট গিয়ারে দিয়ে ক্লাচটা ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করল অনীতা গিলবার্ট।

গল্পের বাকি অংশটুকু,’ বলল রানা।

‘শুধুই মজুরী? বখশিশ মিলবে না কিছু?

‘ভাল ড্রাইভ করলে মিলতে পারে।

‘আর যদি বিপথে ড্রাইভ করি?

তা হলে আরও বেশি মিলবে।

‘অলরাইট!’ রাহাত খানের অনুকরণে বলল অনীতা গিলবার্ট, ‘বিপথেই নিয়ে যাব তোমাকে!’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *