সো-ফার

সো-ফার

সো : ঝঙ (Significant Other)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ

১. গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি (বাবা-মা, বন্ধু ইত্যাদি)

২. স্বামী কিংবা স্ত্রী, প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা

ফার : দূরত্ব

১. বিশাল দূরত্ব

এতদিনে আমি কিছুটা বড় হয়েছি। ইলিমেন্টারি স্কুল পার করে ফেলেছি, শিগগিরি জুনিয়র হাইতে উঠবো। তাই এখন অনেক দিন আগে ঘটা কিছু অদ্ভুত ঘটনার ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। সে সময় আমি স্রেফ একটা বাচ্চা ছিলাম, যে কিনা কিন্ডারগার্টেনে পড়ত। আমি প্রায়ই নার্ভাস থাকতাম আর সহজেই যে কোন কিছুতে আপসেট হয়ে যেতাম। সবাই আমার চেয়ে লম্বা ছিল, তাদের সাথে কথা বলতে আমাকে উপরে তাকাতে হত। যখনই বড়দের কেউ তাদের কোমরের উপর হাত রেখে রাগী রাগী চেহারা করে তাকাত, তখন আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতাম যে নিশ্চয়ই কোন ভুল করে ফেলেছি। তাই আমি যদি আমার বক্তব্য বড় কাউকে বুঝিয়ে বলতে যেতাম, জানতাম যে ঠিক মত বোঝানো যাবে না।

অনেক দিন আগে আমার ধারণা ছিল যে কিছু একটা আমার বিছানার নিচে বসবাস করে, যেখানে কোন আলো পৌঁছায় না। আমার ধারণা ছিল স্পর্শ না করে শুধু কঠিনভাবে চিন্তা করেই আমি একটা পেন্সিল গড়িয়ে ফেলতে পারব। শেষ পর্যন্ত এর সব কিছুই মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিল, কিন্তু ওগুলোকে অসম্ভব কিছু মনে হয় নি, আপনি যদি বুঝে থাকেন আমি কি বলতে চাইছি। আমি সবসময়ই বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে এসেছি, কিন্তু তারপরেও আমার ধারণা এই জগতে কিছু বিষয় আছে যা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না।

***

কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় আমার সাথে যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা বলা যাক। আমার মনে হয়েছিল আমার নিজের স্মৃতি নিশ্চয়ই অনেকখানি মলিন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে আমি প্রতিটা খুঁটিনাটি একটার পর একটা মনে করতে পেরেছিলাম, আর অন্যদের থেকেও এই সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলাম। এসবকিছু একসাথে করে আমি এখন এটা বেশ ভালভাবে মনে করতে পারি।

আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে থাকতাম। শুধু আমরা তিনজন। একটা বিশাল বিল্ডিঙের দোতলার একটা অ্যাপার্টমেন্টে আমরা ভাড়া থাকতাম। ছোট একটা পাহাড়ের উপর ছিল বিল্ডিংটা। আমাদের জানালা থেকে আমরা নিচের শহর থেকে আসা আলো দেখতে পেতাম। ট্রেনের রেল লাইন আমাদের এলাকার এক মাথা থেকে পাশের এলাকার দিকে চলে গিয়েছিল, আশেপাশের বাড়িগুলোকে একসাথে সেলাইয়ের মত জোড়া দিয়ে। এই ছিল আমাদের বাসা থেকে দৃশ্য আর আমার এসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেও ভাল লাগত।

আমাদের একটা লিভিং রুম, একটা কিচেন ছিল। সাথে সম্ভবত আরো দুটো রুম। আমার মনে পড়ে যে মূল দরজার কাছে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত একটা খাম্বা ছিল। ওখানে আমি আমার আঁকা বাবার ছবিগুলো লাগিয়ে রাখতাম। আমার স্কুলের ক্যাপ আর ব্যাকপ্যাকও ওখানে ঝুলিয়ে রাখতাম।

আমি আমার বাবা-মাকে ভালবাসতাম। শুধুমাত্র যে কার্ড গেমটা আমি খেলতে পারতাম তখন, সেটা ছিল “ওল্ড মারমেইড।” সবসময় আমরা সেটা খেলতে পছন্দ করতাম। আমরা বাসার মধ্যে লুকোচুরিও খেলতাম। কিচেনের টেবিলে বসে ডিনার খেতাম, তারপর লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বসে গল্প করতাম।

সোফাটা ছিল ধূসর রঙের। আমার মনে হয় আমাদের সমস্ত আসবাবপত্রের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল এই সোফাটাই। আমরা ওখানে বসে টিভি দেখতাম, নাহলে বই পড়তাম, কিংবা ছোট খাট ঘুম দিতাম। সত্যি বলতে কি আমাদের এই নরম কিন্তু দৃঢ় সোফাটাই ছিল আমাদের সুখি পরিবারের রহস্য। সোফাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেমনটা ছিল কফি টেবিল আর টিভিটাও।

টিভি দেখার সময় আমি সবসময় আমার বাবা-মায়ের মাঝখানে বসতাম।

মায়ের জায়গা ছিল আমার বামে, যেখান থেকে কিচেন কাছে ছিল। ফলে তার জন্য সহজ হত স্লিপার পরে কিচেনে গিয়ে বাবা আর আমার জন্য ড্রিঙ্ক নিয়ে আসতে। আমি জুস খেতাম আর বাবা বিয়ার।

বাবা আমার ডানে বসতেন। টিভি দেখার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ওটা। তাছাড়া এসিরও সবচেয়ে কাছে ছিল। আমার বাবা, যিনি সবসময় বলতেন যে তার বিচ্ছিরি রকমের গরম লাগে, ওখানে বসে ঠাণ্ডা হতেন। আমি সোফার মাঝখানে পা ঝুলিয়ে বসে তাদেরকে বলতাম স্কুলে কি কি হয়েছে। বাবা-মা আমার দুপাশে বসে হাসিমুখে আমার গল্প শুনতেন।

***

প্রথমে আমি ধরতে পারিনি কি হচ্ছিল। যতক্ষণে বুঝতে পেরেছিলাম ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

বাবা আর আমি সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। বাবা সামনের দিকে হেলে দু হাতে থুতনি রেখে বসে ছিলেন। মুখটা অন্ধকার। আমরা অলৌকিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে একটা শো দেখছিলাম-একটা ভৌতিক গল্প আমি জানতাম ভয়ের হবে, কিন্তু তারপরেও দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছিলাম না। গল্পটা ছিল এক লোকের ট্রাফিক এক্সিডেন্টে মরে গিয়ে ভুত হয়ে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু গল্পে একটা প্যাঁচ ছিল। ভুতটা বুঝতে পারছিল না যে মৃত, এবং কিছুই হয়নি এমনভাবে বাসায় ফিরে যায়।

মা দরজা খুলে লিভিং রুমে এলেন। বাবার মত তাকেও হাসিখুশি দেখাচ্ছিল না।

“তুমি একা একা টিভি দেখছ কেন?” মা আমাকে বললেন। একম সাধারণভাবে বলা, আমি প্রায় খেয়ালই করিনি। কিন্তু এখন পেছনে ফিরে তাকালে আমি নিশ্চিত, তিনি এ শব্দ দুটো বলেছিলেন, “একা একা।”

আমার কথাটা শুনে অস্বস্তি হল, বাবার দিকে তাকালাম। আমি ভেবেছিলাম তাকে উপেক্ষা করার জন্য তিনি ক্ষেপে যাবেন। কিন্তু তাকে দেখে মনে হল না মা যে রুমে ঢুকেছে তা তিনি খেয়াল করেছেন।

“কি করছ তুমি?” মা বললেন। “ডান দিকে তাকিয়ে কাকে দেখছ? ওখানে তো কেউ নেই।”

মায়ের মুখভঙ্গি খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, আর সেজন্য আমার আরো নার্ভাস লাগছিল।

এর কিছুক্ষণ পর বাবা চুপচাপ সোফা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার বা মায়ের দিকে তাকালেন না। আমি খুবই বিভ্রান্ত বোধ করছিলাম। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে, আমি জানি না সেটা কি। আমি নিশ্চিত আমাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলব। মা এক মুঠো কার্ড বের করে এনে হেসে হেসে বললেন, “চল ওল্ড মেইড খেলি!” আমি ছটফট করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু মায়ের হাসিটা বন্ধুত্বপূর্ণ আর ভরসাদায়ক ছিল, যে কারনে একটু পর আমি শান্ত হলাম।

মা আর আমি কিছুক্ষণ খেলার পর বাবা লিভিং রুমে এসে ঢুকলেন।

“একা একা কি করছ? সলিটেয়ার খেলছ নাকি?” তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

তারপর হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। “চল আজকে বাইরে খেতে যাই,” বাবা বললেন।

আমি সোফা থেকে নেমে দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। পেছনে ফিরে দেখি মা কার্ড হাতে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি আমাকে বলছিল, “কোথায় যাচ্ছ?”

আমি ভেবেছিলাম মাও আমাদের সাথে বাইরে যাবে, কিন্তু যাননি। আমি লিভিং রুম থেকে বের হতেই বাবা আলো নিভিয়ে দরজা লক করে দিলেন। মা আমাদের সাথে আসেননি।

আমি আর বাবা একটা ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টে গেলাম। আর ওখানে পুরোটা সময় মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার।

“এখন থেকে জীবনটা কঠিন হতে যাচ্ছে…” বাবা নিজ মনে বলেছিলেন।

***

পরদিনের ডিনারটাও অস্বাভাবিক ছিল। মা শুধু আমার আর তার জন্য ডিনার বানিয়ে ছিলেন। কিচেনের টেবিলের উপর শুধু আমার আর তার জন্য প্লেট আর চলটিক সাজানো।

তারপর বাবা বাসায় ফিরলেন, এমন ভাব করলেন, মায়ের বানানো খাবার তার চোখেই পড়েনি। ব্যাগ থেকে কিছু বক্স করা খাবার বের করে লিভিং রুমের নিচু টেবিলটায় রাখলেন। ওগুলো কনভেনিয়েন্স স্টোর থেকে কেনা। একটা তার জন্য একটা আমার জন্য।

কিচেনে বসে আমি মায়ের কাছে জানতে চাইলাম, “বাবার ডিনার কোথায়?”

“হুম?” চোখে প্রশ্ন নিয়ে মা আমার দিকে তাকালেন। তাকে নিশুপ দেখাল, অনেকটা এরকম যে আমার বলা উচিত নয় এমন কিছু আমি বলে ফেলেছি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আবার প্রশ্ন করতে চাইলাম না।

তারপর লিভিং রুম থেকে শুনতে পেলাম, “অ্যাঁই তুমি ওখানে কি করছ? এই খাবারগুলোর কোনটা তুমি খেতে চাও?” বাবা বলছিলেন। বাবা যখন মায়ের সাথে কথা বলতেন তখন তার গলার সুর একরকম হত, যখন আমার সাথে কথা বলতেন তখন আরেক রকম হত। তাই আমি বুঝতে পারছিলাম যে তিনি কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছিলেন।

আমি কিচেন থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে গেলাম। বাবা ওখানে বসে গলার টাই ঢিলে করছিলেন।

“মায়ের জন্য নেই?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। বাবা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালেন। তার হাতের নড়াচড়া হঠাৎ থমকে গিয়েছিল। আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। প্রশ্নটা করা আমার উচিত হয়নি।

আমার মনে হল দুজনকেই সমান পরিমান মনোযোগ দেয়া উচিত। তাই কয়েকবার কিচেন আর লিভিং রুমের মধ্যে যাওয়া আসা করলাম। মায়ের রান্না করা খাবার একটু খেয়ে লিভিং রুমে গিয়ে টেকআউট মিলের থেকে একটু খেলাম। এভাবে কয়েকবার যাওয়া আসা করলাম।

শেষে গিয়ে দুটো খাবারই আমি অর্ধেক অর্ধেক করে শেষ করতে পারলাম। কিন্তু সেজন্য দুজনের কেউই আমার উপর রাগ দেখালেন না। ডিনার শেষ হলে আমি সোফায় গিয়ে আমার নির্ধারিত স্থানে বসলাম। মা

আমার বামে বসলেন, বাবা ডানে। আমরা চুপচাপ টিভি দেখছিলাম। খবরে কয়েকদিন আগে ঘটা ট্রেন এক্সিডেন্টের উপর একটা প্রতিবেদন দেখাচ্ছিল।

অন্যদিন এই সময়টা আমাদের হাসিখুশি কাটে। ঐদিন আমার বাবা-মা দুজনেই পুরোপুরি চুপ হয়ে ছিল। খারাপ কিছু একটা ঘটেছিল যার কারনে আমাদের তিনজনের মধ্যে গভীর কোন দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। আমি যখন এটা নিয়ে ভাবছিলাম তখন আমার মা আমার দিকে তাকালেন। তার অভিব্যক্তি ছিল সিরিয়াস রকমের।

“শোন, তোমার বাবা মারা গিয়েছে। এখন থেকে আমাদের জীবনটা হবে শুধু তোমাকে আর আমাকে নিয়ে। ব্যাপারটা কঠিন হবে কিন্তু আমরা কোন না কোনভাবে সামলে নেব।”

বিষয়টা বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু মায়ের কণ্ঠস্বর এতটাই সিরিয়াস ছিল যে আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম আর মা বলেছিলেন, “চিন্তা কোর না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারপর ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে একটু হাসলেন।

এরপর আমার বাবা আমার দিকে তাকালেন। একদম আমার চোখে চোখ রেখে তাকালেন যেন মায়ের কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে।

“আমাদেরকে শক্ত হতে হবে। তোমার মা বেঁচে থাকলে সেটাই চাইত নিশ্চয়ই।”

তখন আমার উপলদ্ধি হল যে তারা কেউ একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে না। বাবা দেখতে পাচ্ছে না মাকে। মা দেখতে পাচ্ছে না। বাবাকে। দুজনেই ভাবছে সে ছাড়া আর কেউ আমার পাশে বসে নেই।

দুজনের কথা থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে ওদের মধ্যে কেউ একজন নিশ্চয়ই মারা গিয়েছেন। বাবা ভাবছিল মা মারা গিয়েছে আর আমাকে মাকে ছাড়া চলতে শিখতে হবে। অন্যদিকে মা ভাবছিল বাবা মারা গিয়েছে।

দুজনের কেউই একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছিলেন না বা একে অপরের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। শুধুমাত্র আমিই তাদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

সে সময় আমার জানা শব্দ ভান্ডার সীমিত ছিল, তাই আমি আমার কথাগুলো পরিস্কারভাবে আমার বাবা-মায়ের কাছে বলতে পারিনি। আমি তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম যে, আমি অন্যজনকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা আমার কথা আমলে নেননি।

“বাবা তো ঐ অন্য রুমটায় বসে আছে, মায়ের এপ্রন টেনে বলেছিলাম। তিনি তখন কিচেনে থালাবাসন ধুচ্ছিলেন। বাবা লিভিং রুমের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

“ও আচ্ছা, হুম… প্রথম দিকে মা শুধু হালকাভাবে তার মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু আমি যখন বার বার একই কথা বলতে লাগলাম তখন। আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালেন।

“আমি জানি বিষয়টা তোমার জন্য কঠিন,” তিনি বললেন। তাকে চিন্তিত শোনাল। আর আমার মনে হল নিশ্চয়ই আমার মাথার ভেতর কোন সমস্যা হয়েছে, আর এই বিষয়টা হল সেরকম কোন বিষয় যা নিয়ে আমার কথা বলা উচিত না।

তারপরও আমি অনেকবার পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম।

এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজন সোফায় বসে ছিলাম। অবশ্যই আমরা তিনজন” দিয়ে আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝাতে চাইছি। আমার বাবা-মা ভাবছিলেন তারা একা আমার সাথে সোফায় বসে ছিল।

“মা নীল রঙের সোয়েটার পরে আছে,” ডান দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললাম। তারা দুজনেই আমার দিকে তাকালেন।

“কি বললে?” বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাবোধ করছেন। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছিলেন আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।

“আসলেই! আসলেই মা নীল রঙের সোয়েটার পরে আছে।” অন্যদিকে মাও অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

“আমি তোমাদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছি। বাবা, মা, আমরা সবাই এই রুমের মধ্যে আছি।”

আর তারা দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে বাঁকা চোখে তাকালেন আমার দিকে।

এরকম অনেকবার হয়েছে। প্রথম প্রথম তারা ভান করতেন যে তারা আমার কথাগুলো শুনছেন।

একবার এমন হল, আমি স্ন্যাক্সের একটা প্যাকেট খুলতে পারছিলাম, মা কাঁচি খুঁজতে গেলেন।

“তোমার বাবা কাঁচি কোথায় রেখেছে?” ড্রয়ারের জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করলেন। “আমি খুঁজে পাব এরকম কোথাও রেখে গেলে ভাল করত।”

বাবা পা ভাঁজ করে সোফার উপরে বসেছিলেন। তাকে দেখে মনে হল যে মা রুমের মধ্যে আছেন তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কাঁচি কোথায় রেখেছে।

“আমি নিশ্চিত যে কাঁচি কিচেন কেবিনেটের ড্রয়ারে রেখেছিলাম,” তিনি আমাকে বললেন। আমি একই কথা মাকে আবার বললাম, যদিও তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

“বাবা বলছে কিচেন কেবিনেটের ড্রয়ারে আছে। বাবা মাত্রই আমাকে বলল।”

অতপর সেখানেই সেটা পাওয়া গেল। এরকম অনেকবার হল। শেষে বাবা-মা দুজনই আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন।

“আমি বাবাকে দেখতে পাচ্ছি, তার কথাও শুনতে পাচ্ছি।” মাকে তারপরেও বিভ্রান্ত দেখাত, কিন্তু আমার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতেন।

“মা এখানেই আছে। তুমি আর আমি একা নই। তুমি যদি মাকে কিছু বলতে চাও তাহলে আমাকে বল, আমি তাকে বলে দিচ্ছি।” আমি যখন বাবাকে এই কথাটা বললাম তিনি খুশি হয়ে হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।”

তখন থেকে আমি তাদের মধ্যে কথা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা মজার ছিল।

আগের মতই আমরা তিনজন একসাথে সোফায় বসে টিভি প্রোগ্রামগুলো দেখতাম।

“আমার ট্রাভেল শো ভাল লাগে,” মা হয়ত বললেন, আমি সাথে সাথে তার কথাটা বাবাকে জানালাম।

“মা চ্যানেল বদলাতে চায়। ট্রাভেল শো দেখতে চায়।”

“তাকে বল তাকে এই পলিশ শোই দেখতে হবে,” বাবা বললেন, স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই।

“বাবা চ্যানেল বদলাতে চায় না।” কথাটা শুনে মা উঠে কিচেনে চলে গেলেন।

আমি হেসে গড়িয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা মজার কারন আমাদের জীবন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। একমাত্র পার্থক্য যেটা ছিল সেটা হল বাবা-মা যদি একে অপরের সাথে কথা বলতে চাইতেন তাহলে আমাকে। মাঝখানে রেখে কথা বলতে হত। আবারও আমার মনে হতে লাগল যে আমরা তিন সদস্যের পরিবার। আর এতে আমি সখি ছিলাম।

***

সেই সময় আমার বাবা-মা যে যেই জগতে বাস করতেন সেটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করতাম। তারা আমাকে যা বলেছিলেন তা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে টিভিতে শোনা ট্রেন এক্সিডেন্টে নিশ্চয়ই তাদের কেউ একজন মারা গিয়েছিলেন। আসলে ব্যাপারটা এখানে একটু জটিল ছিল কারন তারা দুজনেই ভাবতেন অন্যজন ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।

মনে হচ্ছিল তাদের কারো একজনের কোন আত্মীয়র বাসায় কিছু একটা দিয়ে আসার কথা ছিল। তো তারা ঠিক করলেন রক-পেপার-সিজার খেলবেন এবং যে হারবে সে ট্রেনে করে ঐ আত্মীয়র বাসায় যাবে।

এই অংশের পর তাদের গল্প যার যার দিক থেকে বদলে যায়। মায়ের জগতে, বাবা খেলায় হেরে গিয়ে ট্রেনে চড়েন। আর বাবার জগতে, বাবা নয় বরং মা গিয়েছিলেন আত্মীয়র বাড়িতে।

তারপর ট্রেন দুর্ঘটনাটা ঘটে। আমার বাবা-মায়ের প্রত্যেকেই ভাবেন তারা আমার সাথে একা রয়ে গিয়েছেন।

মা আর বাবার জগতের মধ্যে সংযুক্তিটা ছিল কিছু সেমিট্রান্সপারেন্ট ছবি একত্র করার মত যেখানে দুটোতেই আমি রয়েছি। আমি এই দুই জগতটাকেই একই সাথে একই সময়ে দেখতে পাচ্ছিলাম। এর জন্য আমার গর্ববোধও হত। আমার মনে হত আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, বাবা মায়ের মধ্যে কোন রকমের কোন লিয়াজোঁ অফিসারের মত দায়িত্ব পালন করছি।

যেমন ধরা যাক, বাবা দরজা খুলে রুমে ঢুকলেন। মায়ের কাছে, যিনি বাবাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, মনে হতে পারত যে দরজাটা নিজে নিজে খুলে আবার নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আসলে তিনি দরজা খোলা-বন্ধ হওয়া খেয়ালই করতেন না। আমি যদি সেটার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম তাহলে বলতেন, “ও হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি এইমাত্র খেয়াল করলাম।” তখন তিনি বুঝতে পারতেন।

আবার ধরা যাক মা হয়ত কিচেনে থালাবাসন ধছেন। বাবা তাকে কিংবা তিনি কি করছেন তার কোনটাই দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের দুজনের জন্যই যা যা তাদের নিজেদের জগতে ঘটা সম্ভব নয় তা তাদের থেকে অদৃশ্য থাকত।

খাওয়ার সময়, বরাবরের মত তারা আলাদা আলাদাভাবে খেতেন। মা রান্না করতেন, বাবা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসতেন, আর তারা সেগুলো খেতেন।

“বাবা তুমি কি এই ভাত তরকারি দেখতে পাচ্ছ না?” আমি তার সামনে একটা প্লেট রেখে জানতে চাইতাম। কিন্তু মনে হত তিনি সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। তার চেহারায় বিভ্রান্তি ফুটে উঠত।

মাঝে মাঝে বাবা হয়ত ঘরের কোন এক কোনার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথা বলতেন যেন মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ মা হয়ত তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেটা বাবা বুঝতে পারছিলেন না। মাও তার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। আমি তাদের দুজনকেই বলতাম যে ব্যাপারটা আমার কাছে কতখানি অদ্ভুত লাগত।

যখন আমার মনে হত তাদের একজন আসলেই মৃত, তখন অনেক খারাপ লাগত। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার বাবা-মায়ের দুই জগতের মাঝখানে আমি রয়েছি।

প্রথম প্রথম আমার ভয় লাগত, যখন তারা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতে পারতেন না। একটা সময়ে গিয়ে আমার আর সমস্যা হয়নি। আমি সোফায় তাদের মাঝখানে বসে নিরাপদ আর নিশ্চিন্তবোধ করতাম।

কিন্তু যদিও তখন একটা বাচ্চা ছিলাম, তারপরেও বুঝতে পারছিলাম এভাবে আজীবন চলতে পারে না। একসময় না একসময় আমাকে যে কোন একটা জগত বেছে নিতে হত। মনের গভীরে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারছিলাম।

শুরুতে যেরকম ছিল, সেরকম আবার শুরু হল। এক পর্যায়ে বাবা-মা যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধ বলতে কিন্ডারগার্টেনের খেলার মাঠে যেরকম দেখা যায় সেরকম কিছু না।

এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজন সোফায় বসে ছিলাম। টিভি দেখছিলাম। আর আমি অটোমেটিকভাবে একজনের কথা আরেকজনের কাছে পুনরাবৃত্তি করছিলাম। এরকম অনেকদিন ধরে হচ্ছে বলে আমি বেশিরভাগ সময়ই কোণ চিন্তা না করে সেগুলো পুনরাবৃত্তি করতাম।

টিভিতে আমার প্রিয় কার্টুনগুলোর একটা হচ্ছিল, আমার সমস্ত মনোযোগ সেটার উপর ছিল। সোফার উপর শুয়ে গালে হাত দিয়ে ছিলাম। এরকম পুরো সোফা জুড়ে থাকাটা মায়ের পছন্দ হল না, আমাকে বললেন এটা খারাপ, কিন্তু আমি তারপরেও ওভাবেই ছিলাম।

হঠাৎ বাবা তার খবরের কাগজটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। ঐ সময় প্রথম আমি উপলদ্ধি করলাম যে আমার বাবা-মা দুজনেই খারাপ মুডে আছেন। তারা একজন আরেকজনকে আঘাত দিয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু আমি সেগুলো বলার সময় মনোযোগ দেইনি।

মা উঠে বেডরুমের দিকে চলে গেল।

“মা তার রুমে চলে গিয়েছে,” আমি বললাম।

“তো কি হয়েছে?” বাবা খেঁকিয়ে উঠল।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কার্টুন শো এর কথা ভুলে গেলাম। আমি চাচ্ছিলাম তাদের মিল হয়ে যাক। তারা দুজন আমার দুপাশে না থাকলে আমি সুখি হতে পারছিলাম না।

“অ্যাঁই,” একটু পর বাবা আমাকে বললেন। “যাও গিয়ে তোমার মাকে বল।”

“কি বলব?”

“গিয়ে বল যে সে মরে যাওয়াতে আমি খুশি হয়েছি।”

বাবার মুখটা দেখে ভয় লাগছিল। আমি করতে চাইছিলাম না কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যে কথাটা মাকে না বললে তিনি হয়ত আমার উপর ক্ষেপে যেতে পারেন। তাই আমি উঠে মায়ের কাছে দৌড়ে গেলাম।

“বাবা বলেছে, তুমি মারা যাওয়ায় সে খুশি। আমাকে বললেন তোমাকে বলতে,” আমি কান্না চেপে বললাম। মা কিছু বললেন না। কাঁদতে শুরু করলেন। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল। আমি এর আগে কখনো কোন বয়স্ক মানুষকে কাঁদতে দেখিনি, অনেক ভয় পেয়েছিলাম। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি করব।

“তাহলে, তুমি তোমার বাবাকে গিয়ে বলতে পার…” তিনি বাবাকে কিছু খারাপ কথা বলার জন্য বললেন। কথাগুলোর কিছু অংশ আমি বুঝতে পারিনি, তাই তিনি আমাকে প্র্যাকটিস করালেন। আমি তখন ছোট ছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে বলার জন্য এগুলো খুবই বাজে কথা।

“আমি পারব না! থামো!” আমি তাকে বলেছিলাম, কিন্তু কোন কাজ হল না।

“তুমি তাকে অবশ্যই বলবে! বুঝতে পেরেছ?”

তাই একজন দায়িত্ববান ডাকপিয়নের মত আমি বেডরুম থেকে লিভিং রুমে, আবার লিভিং রুম থেকে বেড রুমে যাওয়া আসা করতে লাগলাম আর তাদের জোর করে শেখানো খারাপ কথাগুলো আদান প্রদান করতে লাগলাম।

প্রতিটা নতুন মন্তব্যর সাথে আমার বাবা-মা আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাদের চাহনি দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম এই কথার যুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের জন্য আমার প্রতি তারা ঘৃণাবোধ করছিলেন। তারা একজন আরেকজনের দিকে চেঁচাচ্ছিলেন না, তারা চেঁচাচ্ছিলেন আমার প্রতি। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন অভিশপ্ত কেউ।

প্রথমদিকে তাদের সাথে কথা বলতে আমার অনেক শক্তি খরচ হচ্ছিল। কিন্তু ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি আস্তে আস্তে সব অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। আমি তাদের কণ্ঠও আর শুনতে পাচ্ছিলাম না।

আমার মুখটা ছিল একটা টেপ রেকর্ডারের মত। রেকর্ড করে রিপ্লে করতাম, আবার রেকর্ড করে আবার রিপ্লে করতাম। কান্না থামাতে পারছিলাম না। আমি আমার বাবা-মা দুজনকেই ভালবাসতাম। আর এসব কথা বলতে হচ্ছিল বলে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিল আমার।

***

ঘন্টাখানেক পর লড়াই থামল।

আমি চাইছিলাম আমরা সবাই গিয়ে আবার লিভিং রুমের সোফায় একসাথে বসি। কিন্তু ভয়ে প্রস্তাবটা তুলতে পারলাম না। আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলাম, আমার বুক ধুকপুক করছিল। বাবা লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমে গিয়েছিলেন মুখ ধুতে। এতে তিনি কিছুটা শান্ত হয়েছিলেন, যদিও তখনও তাকে খানিকটা আপসেট দেখাচ্ছিল।

তিনি যখন ছিলেন না, মা তখন লিভিং রুমে এসেছিলেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে তারা আবার যুদ্ধ শুরু করবেন। মা এসে আমার পাশে বসলেন। তাকে খানিকটা উন্মত্ত দেখাচ্ছিল। সোফার কুশনের উপর তার ভারের জন্য আমি খানিকটা তার দিকে কাত হয়ে গিয়েছিলাম।

“আমি দুঃখিত,” তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। আমি তখন দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আশা করছিলাম যে কোন মুহূর্তে বাবা ফিরে আসবেন আর আমি সাথে সাথে মাকে তার আসার কথা জানাবো। কিন্তু তিনি এলেন না।

মা উঠে কিচেনে চলে গেলেন। তিনি চলে যেতেই, আমি আমার পাশে ম্যাগাজিন উল্টানোর শব্দ শুনতে পেলাম।

বাবা কোন এক সময় ফিরে এসে সোফায় তার নির্দিষ্ট স্থানে বসেছিলেন। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তাকে ঢুকতে দেখতে পাইনি। তিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন। সিগারেটের ধোঁয়া আমার ভাল লাগে না। অসুস্থ বোধ হয়। কিন্তু ঐ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত আমি সিগারেটের কোন গন্ধ একদম টের পাইনি।

বাবার মুখটা কঠোর হয়ে ছিল।

“এতক্ষন ধরে তোমাকে বলছি, অথচ আমার দিকে তাকাচ্ছ না,” তিনি বললেন। মায়ের মত তিনিও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত তার হাতটা আসলেই ছিল। কারন স্পর্শটা উষ্ণ ছিল। আমার অদ্ভুত লাগছিল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম আগে কেন তাকে খেয়াল করিনি।

অপেক্ষা করছিলাম মায়ের ফিরে আসার জন্য। অপেক্ষা করতেই থাকলাম করতেই থাকলাম কিন্তু তিনি এলেন না। বাবা আর আমি সোফায় বসে টিভিতে একটা বিচিত্রানুষ্ঠান দেখতে থাকলাম।

“তোমার মাকে একটু জিজ্ঞেস করবে কালকের শিডিউল কি?” বাবা জানতে চাইলেন। তিনি তার প্রশ্নটা এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে আপসেট করার মত কিছু না বলে ফেলেন। আমি উঠে কিচেনে গেলাম।

দরজা খুলে মাকে খুঁজলাম। কিন্তু কেউ সেখানে ছিল না। শুধু কল থেকে পানি পড়ছিল। অ্যাপার্টমেন্টের ডিজাইনটাই এমন ছিল যে, কিচেনে বা অন্য কোথাও হলে লিভিং রুমের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। খুবই অদ্ভুত যে তিনি সেখানে ছিলেন না।

আমি যখন এর মানে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন লিভিং রুমে ফিরে দেখি মা সোফায় বসে আছেন। তিনি কিভাবে সেখানে এলেন আমার কোন কোন ধারণা নেই। এক মুহূর্ত আগে যেখানে কেউ ছিল না, সেখানে বসে তিনি এমনভাবে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন যেন অনেকক্ষণ ধরে ওখানে বসে আছেন।

বাবাকে কোথাও দেখা গেল না। কোন অ্যাস্ট্রে না, কোন আধ খাওয়া সিগারেট না, বাতাসে কোন ধোঁয়া না।

আমি হাঁ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, প্রশ্ন করার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম।

“কোন সমস্যা?” তিনি মাথা কাত করে আমাকে প্রশ্ন করলেন।

আমি বুঝতে পারলাম মা এতক্ষন এখানেই বসে ছিলে। আর শুধু মা নয়, তারা দুজনেই এখানে ছিলেন, আমার দু পাশে। কিন্তু আমি তাদের দুজনকে এক সাথে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

আমি দৌড়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে সাথে সাথেই আবার ঢুকলাম। এবার মাকে কোথাও দেখা গেল না, সোফার কোন অংশ দেবে পর্যন্ত নেই। কিন্তু বাবাকে তার জায়গায় বসা অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন আমি সব বুঝতে পারলাম।

সোফায় বসে নিজের চোখগুলো কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখলাম। ডানপাশ থেকে আধখাওয়া সিগারেট উধাও হয়ে গেল, বাম পাশে কফি কাপ হাজির হল।

এখন আমি তাদের দুজনকে একইসাথে কথা বলতে শুনতে পারছি না।’ আমার বাবার জগত আর মায়ের জগত একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। যখন এক জগতে আছি, অন্য জগত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি আর দু জগতের মাঝামাঝি কোথাও নেই। স্রেফ জগত দুটোর মধ্যে যাওয়া আসা করছিলাম-আর তারা ক্রমশ নিজেদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।

আমি এতটা কষ্ট পেয়েছিলাম যে বাকি রাত তাদের কারোর সাথেই আর কথা বলতে পারিনি। আর কখনো আমরা তিনজন এক সাথে সোফায় সময় কাটাতে পারব না। এই নতুন তথ্যটা হজম করতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। মা আমার নিস্তব্ধতায় দুশ্চিন্তাবোধ করছিলেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। আর আমাকে তাদের যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে।

যতদূর মনে পরে, পরদিন ছিল শনিবার। আকাশ গুমোট হয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে। মা কোথাও এক জায়গায় ছিল, বাবা আমার পাশে বসে খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মা নেই, পুরো অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজলাম তাকে। কিন্তু আমি জানতাম যে বাবার সাথে এক রুমে থাকলে মাকে দেখতে পাব না। হয়ত তিনি আমার পাশেই বসে আছেন।– আমি সবগুলো রুম খুঁজে নিজেকে বোঝালাম যে তিনি নেই। হাল ছেড়ে দিয়ে সোফায় বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। অনেকটা সময় আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করে নীরবতা ভাঙব। টিভিতে আমার প্রিয় সুপারহিরোর প্রোগ্রাম চলছিল, কিন্তু আমি এতটা অস্থির হয়ে ছিলাম যে দেখা হচ্ছিল না। বাবা ডান হাত দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন।

“আমরা আর মাকে একসাথে দেখতে পাব না…” একসময় ইতস্তত করে বললাম আমি। বাবা আস্তে করে মাথাটা আমার দিকে ঘোরালেন, তার কাঁধগুলো সতর্ক হয়ে উঠেছিল।

“কি বললে তুমি?”

“আমি এখন একবারে শুধু তোমাদের একজনকে দেখতে পাচ্ছি, তুমি আর মা…”

তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল আমি ভুল কিছু করে ফেলেছি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম তিনি আমার উপর রেগে উঠবেন, আমার দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা হচ্ছিল। পেটের মধ্যে সবকিছু গিট পাকিয়ে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম কথাটা আমার গোপন রাখা উচিত ছিল। বাবার তীব্র চাহনির সামনে আমি হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম।

“আমি যখন তোমার সাথে থাকি তখন মাকে আর দেখতে পাই না।”

আমি বার বার একই কথা বলতে থাকলাম। একসময় মনে হল তিনি আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছেন। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালেন যেন কিছু জানতে চান।

“সত্যি…এটা সত্যি।” আমি ভয়ে কাঁদছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা আসলে মাকে ভালবাসেন, আমি একমাত্র সুতো ছিলাম যে তাদের দুই জগতটাকে বেঁধে রেখেছিল। আমি যদি একটা ভাল ছেলে হতাম তাহলে তারা আজীবন একসাথে থাকতে পারতেন-এরকমই আমি ভেবেছিলাম।

বাবা রেগে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। আমি খালি কাঁদছিলাম, আর তাতে তার রাগ আরো বাড়ছিল। তিনি হাত তুলে আমার গালে চড় লাগালেন। আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম। বার বার বলতে লাগলাম আমি কতটা দুঃখিত। আমি জানি আমি একটা খারাপ ছেলে। আমি শুধু চাইছিলাম মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর আমি ভেতরে হারিয়ে যাই। সব দোষ আমারই ছিল। আর আমার বাবা আমাকে ঘৃণা করতেন।

আমি উঠে দৌড়ে রুন্ম থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাবা আমার নাম ধরে ডাকলেন, কিন্তু পেছন পেছন এলেন না। আমি মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। জুতো না পরেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এলাকার পার্কের দিকে ছুটলাম। আমি আমার বাবা আর লিভিং রুমের সোফাটাকে এতটাই ভালবাসতাম যে ওগুলোর সামনে আর থাকতে পারছিলাম না। বাবার থাপ্পড় প্রমাণ করে দিয়েছে যে তার আমাকে আর দরকার নেই। দৌড়ানোর সময় আমার পায়ের তলা কেটে গিয়েছিল কিন্তু আমি কিচ্ছু টের পেলাম না।

পার্কে কেউ ছিল না। অন্য বাচ্চারা সম্ভবত বৃষ্টি হতে পারে এই ভয়ে বাসায়ই ছিল। এমনিতে পার্কটা হাসাহাসি হৈচৈতে ভরপুর থাকে। সেদিন স্লাইড আর দোলনাগুলো একদম খালি ছিল। আমার খেলাধুলা করার কোন ইচ্ছা ছিল না, খালি পার্কে আমি আমার একাকীত্ব আরো বেশি করে অনুধাবন করতে পারছিলাম।

স্যান্ডবক্সে বসে আমি আমার পা বালির ভেতর যতটা সম্ভব ঢুকিয়ে দিলাম। আমি শুধু বাবার কথা ভাবছিলাম। আমার মত একটা ছেলেকে তিনি কি করে ভালবাসবেন? গতরাতের লড়াইটা পুরোপুরি আমার দোষ ছিল। আমি যদি একটা ভাল ছেলে হতাম, যেরকম ছেলেরা জামাকাপড়ের উপর না ফেলে পুরো খাবার খেতে পারে, যে ছেলেরা খেলা শেষে সব খেলনা গুছিয়ে রাখতে পারে, তাহলে তারা কখনো লড়াই করতেন না।

বালিটা কালো রঙের আর উষ্ণ ছিল। আমার হাতেপায়ে লেগে গিয়েছিল। পেছন থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা শপিং ব্যাগ তার হাত থেকে ঝুলছিল।

“তুমি কি বাবার সাথে এখানে এসেছ?”

একটু হেসে তিনি পার্কে এদিক ওদিক তাকালেন। আমি মাথা নাড়লাম। মা এসে আমার পাশে বসলেন। তার চেহারায় চিন্তিত ভাব।

“তোমার জুতো জোড়া কোথায় ফেলেছ? আর তোমার গাল লাল হয়ে আছে কেন?”

আমি হাত দিয়ে আমার আহত গাল চাকলাম। আমি চাইছিলাম না যে তিনি জেনে যাক বাবা আমার উপর রেগে গিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম তিনিও আমাকে বকবেন। কিন্তু মা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তার ব্যাগ নামিয়ে রেখে দুহাত দিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।

“কি হয়েছে?” জানতে চাইলেন। তার শরীরে পরিচিত গন্ধ আমাকে শান্ত করে তুলল। আমি কিছুটা ভাল বোধ করতে লাগলাম।

“বাবা আমার উপর রেগে গিয়েছেন।”

মা জিজ্ঞেস করলেন কি ঘটেছে। তিনি চুপচাপ সব শুনলেন আর আস্তে করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি ফুঁপিয়ে চলছিলাম। ঐ নীরব পার্কের মধ্যে, যেখানে আর কেউ ছিল না, মা একটা বিস্ময়কর কিছু ঘটালেন। তিনি আমাকে, তার কাঁদুনে ছেলেকে নিরাপত্তাবোধ আর ভালবাসার অনুভূতি দিলেন।

“মা। তোমার কি মনে আছে অনেক আগে তুমি আমাকে কি বলেছিলে?”

“কি বলেছিলাম যেন?”

“তুমি বলেছিলে এখন থেকে শুধু আমরা দুজন থাকব। তুমি বলেছিলে ব্যাপারটা কঠিন হবে কিন্তু আমরা কোনভাবে সামলে নেব।”

“হ্যাঁ আমার মনে পড়েছে,” তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন। এক পর্যায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। মা আমার কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিলেন।

“আমি তোমার জগতে থাকতে চাই,” আমি বললাম। আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কোলে করে আমাকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। পুরোটা পথ আমি কাঁদলাম।

এরপর আর কখনো বাবাকে দেখিনি।

***

এখন একজন জুনিয়র হাইয়ের ছাত্র হওয়ার পরও, আমার সে সময়ের ঘটনা পরিস্কার মনে পড়ে। আমি অনেকজনকে আমার এই অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। অন্যদের মতামত জানতে চেয়েছি।

আমার মনে আছে সেই দিনটির কথা-যেদিন বাবাকে শেষ বারের মত দেখেছিলাম। আকাশ একদম নীল ছিল আর কোন মেঘ ছিল না। মাটিতে প্রত্যেকটা গাছের প্রত্যেকটা পাতার আলাদা আলাদা ছায়া পড়ছিল। মা আর আমি হাত ধরে এলাকার মধ্যে হাঁটছিলাম। বাইরে বেশ গরম ছিল আর আমি অনেক খুশি ছিলাম। আমি আকাশের দিকে চেয়ে আমার চোখ বন্ধ করেছিলাম। চোখের পাতার পেছনটা সূর্যের আলোর কারনে লাল দেখাচ্ছিল। মা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে অনেক অনেক খেলনা আর ছবির বই ছিল। আমার বয়সি অনেক বাচ্চাকাচ্চাও ছিল। কিছুক্ষণ খেলার পর একজন আমার হাত ধরে একটা রুমে নিয়ে গেল। রুমের ভেতর একটা টেবিলে একটা লোক বসে ছিল। আমাকে বলা হল তার সামনের একটা চেয়ারে বসতে।

লোকটা আমাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি তাকে জানালাম যে, বাবা ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। লোকটা মনে হল আমার কথা বুঝতে পারেনি। সে দু হাত ভাঁজ করে একটু হেসে আমাকে আরেকটা প্রশ্ন করল। “তোমার পেছনে যেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কে?”

আমি পেছনে তাকালাম, কিন্তু কেউ সেখানে ছিল না। মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি লোকটাকে বললাম কেউ তো নেই।

“ও মনে হচ্ছে ওর বাবাকে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে,” মা বলল। তিনি কাঁদছিলেন। “ও আমার কণ্ঠ শুনতে পায়, কিন্তু মনে হচ্ছে না ওর বাবার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে। যখন ওর বাবা ওর হাত ধরে বা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন মনে হয় না ও কিছু অনুভব করে। সে যদি ওকে কোলে নেয় তাহলে ও পুতুলের মত নিস্তেজ হয়ে যায়।”

“বুঝলাম, লোকটা বলল। তারপর আমার মায়ের সাথে কথা বলে চলল। “তারমানে সহজ কথায় বললে, আপনি আর আপনার স্বামীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, তারপর আপনারা দুজনেই অভিনয় করেছিলেন যে অন্য জন মৃত। একইভাবে আপনারা আপনাদের সন্তানের সাথে কথা বলেছিলেন আর তাকে আপনাদের গল্পের সাথে খেলিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এরপর এই অবস্থা হয়েছে।”

এখন বড় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারছি আমার মা আর ডাক্তার অভদ্রলোকের মধ্যে কি কথা হয়েছিল। আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি কিভাবে কি হয়েছিল। মা আমাকে বলেছিলেন বাবা ওখানে আছেন তাই আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কি করছি বুঝতে না পেরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় বাবা।

“কেন তুমি তাকে অনুভব করতে পারছ না?” মা বললেন। “তুমি এই মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করছ তো!” হতাশায় ভেঙে পড়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন। এক মুহূর্ত পর তিনি আমার কাঁধের উপর দিয়ে তাকালেন এবং কথা বলতে থাকলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি কার সাথে কথা বলছিলেন।

আমার অবস্থা এরকম হওয়ার পর থেকে এখন আমার বাবা-মায়ের মধ্যে আর কোন সমস্যা নেই। আমি এখনো আমার বাবাকে দেখতে পাই না, কিন্তু মা যখন কাঁদেন তখন অনুভব করতে পারি যে তিনি মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, আমরা একটা সুখি পরিবার। সবাই বলে যে আমি পাকাপাকি রকমের ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছি কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখি না। আমি উপলদ্ধি করেছি যে, এটাই আমি সবসময় চেয়ে এসেছি-আমার বাবা আর মাকে সবসময় একসাথে রাখতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *