সোনাটর বাবু

সোনাটর বাবু

আড়ে আড়ে চেয়ে চেয়ে শিবির টেপা ঠোঁটের হাসিটা যেন গজলের প্রথম বিস্তারের মতো ব্যাপারটাকে লহরার দিকে টেনে নিয়ে গেল। আর বিষ্টুপদ না-হাসি না-রাগ গোছের মুখে অপ্রতিভ তবলচির, ড়ুগিতে একটা শব্দ করে থেমে যাওয়ার মতো জিজ্ঞেস করল, মাইরি?

শুনে শিবি সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তার মিঠে গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল যেন তালফেরতা পেরিয়ে তবলায় বাজল দ্রুত রেলার বোল।

বলল, মাইরি আবার কী। মিছে বলছি বুঝিন?

মনে হল বিষ্টুপদর মুখে একটা ঘুষি মেরেছে কেউ। সে প্রায় খ্যাঁক করে উঠল, তা হলে সাত নম্বর?

শিবি অমনি ঘোমটা একটু সরিয়ে ছোট মেয়ের মতো মুখখানি বেজার করে বলল, আমার দোষ নাকি? এই নিয়ে তো আট হত, একটা চলে গেল, তাই..।

বিষ্টুপদ হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। সে অবাক হয়ে একমুহূর্ত তাকিয়ে রইল শিবির দিকে।

তার বউ শিবি। লম্বা চওড়ায় দোহারা শরীর, মাজা মাজা রং, সাধারণ দুটো চোখ। বয়স প্রায় তিরিশ। বিচার করলে রূপ তার কিছুই হয়তো নেই। কিন্তু তার এ সাদাসিধে চেহারাটার মধ্যে কোথায় যেন এমন একটা অপরূপের ছোঁয়া লেগে রয়েছে যে, পেছন ফিরলে আবার ফিরে দেখতে হয়। তার বয়স হয়েছে, বয়সের দাগটা পড়েনি। যেন পাতি হাঁসটার হাজারবার জলে ডোবানো, তবু ঝরঝরে শরীরটার মতো। মুখটা কাঁচাটে অর্থাৎ রূপের যদি কোনও কাঁচামিঠে স্বাদ থাকে, তবে তাই। ওই মুখে তা নিয়ত হাসির কারণ বোঝা দায়।

বিষ্টুপদর সাতসক্কালে এ বিস্ময় ও ক্ষুব্ধতা এখানে নয়, অন্যত্র। সে ভাবছে, এই মেয়ে ন বছর বয়সে তার ঘরে এসেছে, তেরো বছর বয়স থেকে যথানিয়মে সন্তান প্রসব করে চলেছে। শরীর একটু টসা দূরে থাক, বিষ্টুপদ যখন জ্বালা-যন্ত্রণায় রোজই বলছে, এবার শালা কেটে পড়ব, ঠিক তখনই শিবি সোহাগ করে, হেসে খাপচি কেটে বললে কিনা, মিটুর দোকান থেকে এট্টুস নঙ্কার আচার এনে দেবে? এই সামান্য কথাটাই একটা মস্ত সর্বনাশের মহা ইঙ্গিতপূর্ণ বিষ্টুপদর কাছে। এই কথাটা যতবার শুনেছে শিবির মুখ থেকে, ততবারই তার পিতৃত্বের খঞ্জনি বেজে উঠেছে আঁতুড়ঘরে। যেন মৃত্যু ঘোষণা করেছে বিষ্টুপদর। তাই সে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই জিজ্ঞেস করেছে, মাইরি? যেন তা হলে সে শুনতে পাবে, ‘না’। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের মতো শিবি হেসে উঠেছে খিলখিল করে। উপরন্তু মুখ বেজার করে বলছে, এই নিয়ে তার আট হত। বোঝো, যেন গাছের ফল।

এক মুহূর্ত সে শিবির দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল যেন শিবি তার কোন নিষ্ঠুর আততায়ী। পরমুহূর্তেই মোটা ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠল, নঙ্কার আচার না, এবার আমার মুণ্ডুটা এনে দেব। রইল শালার সমসার আর ঘর আর রোজগার।

বলেই ঘটঘট করে বেরিয়ে যেতে যেতে তার সেই স্বভাবসিদ্ধ ইংরেজি কথা কটি শোনা গেল, অল শালা ব্লাডি বোগাস।

কাদের দুড়-দাড় করে ছুটে পালাবার শব্দ শোনা গেল। আর কেউ নয়, বিষ্টুপদর ভীত সন্ত্রস্ত ছেলেমেয়ের দল পালাচ্ছে বাপের খ্যাঁকানি শুনে। আর ছটি সন্তানের মা শিবি প্রায় একটি বালিকার মতো অভিমানক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর বলিকার মতোই ঠোঁট কেঁপে চোখ ফেটে তার জল এল। কথায় বলে, মন গুণে ধন, দেয় কোন জন। শিবির ধন নেই কিন্তু পুত্র দিয়ে লক্ষ্মী লাভের সৌভাগ্য যে সংসারে এত বিড়ম্বনা, তা কে জানত!

.

বিষ্টুপদ চলেছে হনহন করে। চলা না বলে তাকে ছোটা বলাই ভাল। লম্বায় প্রায় ছ ফুটের উপর, গায়ের রং ক্ষয়-পাওয়া রোদে পোড়া ন্যাড়া গাছের মতো। তেমনি শুকনো শক্ত হাড়কাঠ সার শরীর। খোঁচা খোঁচা গোঁ-মারা চুলগুলিকে তেল-জলের সার দিয়ে যেন পেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সে চুল ভাঙে তো মচকায় না। মোটা ঠোঁট আর যাকে বলে অশ্বনাসিকা। গুলিভাটা গোল চোখ। আর খাকি, ফুলশার্টের হাতে গলার বোতামটি পর্যন্ত আটকানো। দশ হাত কাপড় হাঁটুর বেশি নামেনি। তার তলা থেকে নেমে এসেছে আগুনে সেঁকা বাঁশের মতো শিরবহুল সরু পা। পায়ে পরেছে পুরনো ফাটা টায়ার কাটা আর বে-সাইজের স্যান্ডেল।

এই হল বিষ্টুপদর চেহারা। বংশমর্যাদায় কুলিন কায়েত। কোন্ অজানা যুগে নাকি বাপ-ঠাকুরদা প্রজা শাসনও করত। আর সে এখন কাজ করে মিউনিসিপ্যালিটিতে। ডেজিগনেশন লেখা আছে, কনসারভেন্সি সুপারভাইজার, ১নং ওয়ার্ড। বিষ্টুপদ নিজে বলে, এ এস আই অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। ডোম মেথর ধাঙ্গড়ধাঙ্গড়িরা বলে, ছোট সোনাটরবাবু। মানে স্যানিটারিবাবু। পাড়ার ছোঁড়ারা আড়ালে বলে, শালা ধাওড়ার ভূত, ধাঙ্গড়-সর্দার।

সত্যি, চলেছে যেন তে-ঢিঙে লম্বা একটা একরোখা ভূতের মতো। সামনে পেছনে, ডাইনে বাঁয়ে, কোনওদিকে হেলে না। মোটা ঠোঁট কুঁচকে রয়েছে অসহ্য তিক্ততায় ও যেন কীসের প্রতিজ্ঞায়। ফুলে ফুলে উঠছে নাকের পাটা আর কোঁচকানো চোখ জোড়ার দূরে নিবন্ধ অপলক চাউনিটা হন্যে উঠেছে শিকারসন্ধানী হন্যে শ্বাপদের মতো।

ফাগুন মাস, আকাশ নির্মেঘ। হাওয়া পাগল। সকালবেলাটা যেন গোলাপী নেশার আমেজে দুলছে। রোদে তাত নেই। পাতা নেই গাছে গাছে। ধুলো উড়ছে, শুকনো পাতা উড়ছে, উড়ছে কাগজের টুকরো আর শুকনো রাবিশের ডাঁই।

মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের কম্পাউন্ডে ঢুকতে না ঢুকতেই ফ্যালা ডোম হা হা করে করে হেসে তাকে অভ্যর্থনা করল, এই যে সোনাটরবাবু, এসে পড়েছ?

বিষ্টুপদ থমকে দাঁড়াল। তার চোখ মুখ আরও বিকৃত হয়ে উঠল রাগে। খেপে উঠে ভেঙচি কেটে বলল, তা পথের মাঝে কেন, অফিস থেকে ঘুরে এলে হত না। কানা ডোম কোথাকার।

বলে সে যেন বাতাসে ধাক্কা মেরে চলে গেল অফিসে। ফ্যালা আবার হা হা করে হেসে আপন মনে বলল, যাও, অর্ডারটা লিয়ে এসো।

সত্যি, ফ্যালা একে ডোম, তায় কানা। চেহারাটা এমনিতে মন্দ ছিল না। কালো মাংসালো মাঝারি শরীর, ঘাড়ের কাছে বেয়ে-পড়া ঝাঁকড়া চুল, গলায় কালো সুতোয় বাঁদা মাদুলি। কিন্তু এক চোখো। একটা চোখ তার ভাল, এমন কী টানা সুন্দরও বলা যায়। আর একটা চোখে মণি নেই। সাদা ক্ষেত্রটা সাদানীলে মেশানো ঘষা কাচের আবরণ বলে মনে হয়। হাসলে কিংবা রাগলে তার ভাল চোখটা বুজে যায়, আর কানা চোখটা বড় হয়ে ঠেলে ড্যালা পাকিয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে গজদাঁতগুলি বেরিয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার মুখটা।

ফ্যালা বিষ্টুপদর সারাদিনের কাজের সঙ্গী হলেও সকালবেলা ওই এক চোখো ডোমের মুখ দেখতে সে রাজি নয়। কিন্তু কপাল গুণে দোষ। বোধ করি ফ্যালার মুখটা দেখার দোষেই অফিস ঢুকতে না ঢুকতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ছেঁড়া শোলার টুপিটা মাথায় চাপিয়ে তাকে এক বিদঘুটে নতুন হুকুম শুনিয়ে দিল। নতুন নয়, এর আগে অবশ্য আরও দু-চারবার তাকে এ কাজ করতে হয়েছে। তাকে কুকুর মারতে যেতে হবে। কিন্তু লাঠি দিয়ে কুকুর মারা সাম্প্রতিক আইনে নিষিদ্ধ। তা ছাড়া খাবারে বিষ দিয়ে মারলে হয়রানিও কম। ইন্সপেক্টর স্টিকনিয়া বিষের শিশিটা আর কটা টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বেরিয়ে পড়ো বাবা বিষ্টুচাঁদ। তোমাদের এক নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি দরখাস্ত এসেছে। গাদা গাদা বাড়তি কুকুরে নাকি এলাকা ছেয়ে গেছে। তার উপরে একটা নাকি পাগলা খেপী, দুজনকে কামড়েছে। টাকা দিয়ে মেঠাই মণ্ডা যা কিনবে, ভাল দেখে কিনো আর কুল্যে এক কুড়ি না হোক, ডজন খানেক সাবড়ে এসো, বুঝলে?

কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইল বিষ্টুপদ। এখন তার দাঁত চাপা মুখটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। তার চোখের সামনে ভাসছিল ফ্যালা ডোমের মুখটা। পরমুহূর্তেই সে মুখটা চাপা দিয়ে দেখা দিল শিবির টেপা হাসির সোহাগী মুখ। আসলে ওই অশুভক্ষণটি থেকেই আজকের এই অভিশপ্ত দিনটার শুরু।

ভেবেই গোঁ ধরা ভূতের মতো কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো শক্ত হাতে বিষের শিশিটা তুলে নিল। মনে মনে বলল, সেই ভাল, আজকের থেকে সকলের মুখে আমার বিষ দেওয়ার পালাই শুরু হোক।

তারপর কী মনে করে খ্যাপা শিম্পাঞ্জির মতো দাঁতগুলি বের করে খ্যাঁক করে উঠল, তা এবার আমার ওই ডেকিজনেশন না ডেকচিনেশনে সোপাইভাইজারটা কেটে ডোম করেই দেওয়া হোক।

স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিহি করে হেসে বলল, আরে ছ্যা, ডোম তো তোমার সাকরেদি করবে। তোমার পোস্টটা তা হলে বিষ্টুচাঁদ ডগ-কিলার করতে হয়।

ডগ কিলার?

হ্যাঁ ডগ মানে কুকুর, আর কিলার মানে খুনি। বলে ময়লা হাফ-প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আবার হি হি করে হেসে উঠল ইন্সপেক্টর।

নাকের পাটা ফুলিয়ে, চোখ ঘোঁচ করে বিষ্টু বলল চাপা গলায়, তার চে মানুষ-খুনি পোস্টই ভাল।

জবাব দিতে গিয়ে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের জিভে কামড় পড়ে চোখ দুটো গোল হয়ে উঠল।

বিষ্টুপদ ততক্ষণে টাকা কটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে একেবারে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। পেছনে তার ফ্যালা ডোম।

খানিকটা গিয়ে ঘাড়ের থেকে লোহাবাঁধানো লাঠিটা নামিয়ে বলল ফ্যালা, আচ্ছা সোনাটরবাবু, আগে তো শালা ডাণ্ডা হেঁকেই কাজ হত, আজকাল এ নিয়ম কেন?

আইন নেই।

কেশো গলায় খ্যাল খ্যাল করে হেসে বলল ফ্যালা, শালা আইনটা বড় মজার। মারো, তবে পিটে লয়, বিষ দিয়ে।…অল শালা বেলাডি বোকাস।

ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে চোখের কোণ দিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হেসে বিষ্টু বলল, খচাসনি ফ্যালা, টুটি চেপে এই বিষ ঢেলে দেব গলায়।

ফ্যালার কানা চোখের সাদা ড্যালাটা বেরিয়ে এসে তার চাপা হাসির মতো কাঁপতে লাগল।

প্রায় আধঘণ্টা বাদে তারা দুজনে যখন আধা শহর, আধা গ্রামাঞ্চলটার সীমানার নিরালা মাঠের ধারে, বাজ পড়া মাথা মুড়নো তাল গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল, তখন মনে হল যেন যমালয়ের দুটো গুপ্তচর নেমে এসেছে মারণ-যন্ত্র নিয়ে।

ইতিমধ্যে ফাল্গুনের রোদে একটু একটু তাত ফুটতে আরম্ভ করেছে। হাওয়াটা উদাস বৈরাগীর দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা চাপা হাহাকার তুলে দিয়ে যাচ্ছে মাঠের মাঝে। ফ্যালা ট্যাঁক থেকে একটা কলা পাতার পুরিয়া বের করে ভেতর থেকে কালো মতো একটা ছোট ড্যালা বাড়িয়ে দিল বিষ্টুর দিকে। জিনিষটা বাটা সিদ্ধি। বলল, ইচ্ছাপূরণের গুলিটা খেয়ে লাও সোনাটরবাবু। যেটাকে ধরবে আর প্রাণ নিয়ে সেটাকে ফিরতে হবে না।

বস্তুটির দিকে এমনভাবে তাকাল বিষ্টু যেন এতেও তার মেজাজ খচে যাচ্ছে। দাঁত চেপে বলল, শালা মাতাল কোথাকার। বলেই ছোঁ মেরে সিদ্ধিটুকু মুখে দিয়ে কোঁত করে গিলে ফেলল।

ফ্যালাও একটা গুলি মুখে পুরে, ভাল চোখটা বুজিয়ে কানা চোখটা দিয়ে বিষ্টুর হাতের হাঁড়িটার দিকে তাকিয়ে বোগড়া দাঁত বের করে ফেলল। সুড়ত করে মুখের নালটা গিলে নিয়ে বলল, ওই বস্তু একখান বার করো সোনাটরবাবু। লইলে ইচ্ছা শালা আধখ্যাচড়া থাকবে।

মাইরি? বলেই জ্বলন্ত চোখ দুটো ফিরিয়ে বিষ্টু সোজা হাঁটতে আরম্ভ করল। অনুপায় বুঝে পেছন ধরল ফ্যালা।

খানিকটা গিয়েই বিষ্টুর হাত চেপে ধরল ফ্যালা। দুজনেই থমকে দাঁড়াল। আঙুল বাড়িয়ে হাত কুড়ি দূরে একটা কুকুর দেখাল। একেই বলে ডোমের চোখ। তাও কানা। যেন দুটো গুপ্তঘাতক শিকার পেয়েছে।

বিষ্টু দেখল, কুকুরটাও থমকে দাঁড়িয়েছে। সাদা কালো মেশানো বেশ বড়সড় কিন্তু হাড় বের করা ক্ষীণজীবী জানোয়ারটার হলদে চোখের ভাবটা, এলোক দুটোকে দেখে খ্যাঁক করে উঠবে কি উঠবে না। বিষ্টুর নজরটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, মনে হচ্ছে দো-আঁশলা মদ্দা। এক লম্বর ওয়ার্ডের মাল তো?

ঠোঁট উলটে বলল ফ্যালা, না-ই বা হল এলাকাটা তো তোমার?

যা বলেছিস। তুই ব্যাটা ডাণ্ডা নিয়ে একটু তফাত যা। বলে সে হাঁড়ির শাল পাতার ঢাকনা খুলে বের করল একটা রসগোল্লা। ছুরি দিয়ে রসগোল্লাটা একটু ফুটো করে তার মধ্যে পুরে দিলে এক টিপ বিষ। তারপর ফুটোটা বন্ধ করে সে ফিরে তাকাল কুকুরটার দিকে। এবার তার গুলিভাটা চোখে খুনির হিংস্রতা। যেন সে কারও পেছন থেকে ছুরি মারতে উদ্যত হয়েছে।

কুকুরটা চাপা গলায় গর্জাচ্ছে। অর্থাৎ এদের মতলবটা কী। কিন্তু সেই সঙ্গেই ল্যাজ নেড়ে, জিভ দিয়ে গাল চেটে লুব্ধ চোখে দেখছে রসগোল্লাটা।

বিষ্টু জিভ দিয়ে তু তু করতেই কুকুরটা কয়েক পা পেছিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কিন্তু পালাল না। বিষ্টু এবার কয়েক পা এগিয়ে গেল। কুকুরটাও পেছুল। কিন্তু লোভ আর সন্দেহের দোটানায় পড়ে কুকুরটা ল্যাজ নেড়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করছে।

বিষ্টু হঠাৎ দাঁড়িয়ে, একটি পরিষ্কার জায়গায় রসগোল্লাটি রেখে সটান পেছন ফিরে একেবারে সেই ন্যাড়া তালগাছটার তলায় ফ্যালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

কুকুরটা কয়েক মুহূর্ত থমকে রইল। তারপর আড়চোখে তাকিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল রসগোল্লাটার কাছে।

উত্তেজনায় বিষ্টুর দাঁতগুলি চেপে বসেছে ঠোঁটের উপর। চাপা গলায় বলল, খা খা শালা? ফ্যালার সাদা চোখটা বড় হয়ে হাঁ করা মুখের কষ দিয়ে লালা গড়িয়ে এল খানিকটা আর নিসপিস করে উঠল লাঠিধরা হাতটা।

কুকুরটা আর একবার তাদের দিকে দেখেই কপ করে রসগোল্লাটা মুখে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে খানিকটা ছুটে গেল। কিন্তু লোক দুটোকে না আসতে দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে খেল। খেয়ে মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

খেয়েছে শালা, খেয়েছে। সাফল্যের উল্লাসে বিষ্টুর বেজীর মতো চোখ দুটো যেন আরও জ্বলে উঠল। বলল, চ দেখি টেস করে, মল কিনা!

ফ্যালারও গজ দাঁতগুলি বেরিয়ে পড়েছে খ্যাপা কুকুরের মতো বলল, মরবে না আবার। তবে এক্টা রসগোল্লা খেয়ে মল মাইরি!

বলে সে লালার দড়ানি জিভ দিয়ে চেটে নিল। তারপর দুজনেই মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।

কুকুরটা ইতিমধ্যেই শুয়ে পড়েছিল একটা আসশেওড়া ঝোপের তলায়, লোক দেখেই ছুটে পালাল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। খানিকটা গিয়েই টলতে লাগল আফিমখেগো আড়-মাতলার মতো।

তীরবিদ্ধ শিকারের পেছনে পেছনে ক্ষিপ্ত ব্যাধের মতো ফ্যালা আর বিষ্টু ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল পাড়ায়।

কুকুরটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে ঝিম ধরা মাতালের মতো। চোখ দুটো আধবোজা রক্তবর্ণ। ঘং ঘং করে কাশছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে বুকের পাঁজরা। ঠিক যেন একটা মুমূর্য বুড়ো। উগরে ফেলতে চাইছে পেটের বিষ।

বিষ্টু এক নজরে মুখ বিকৃত করে এ মরণলীলা দেখছিল। ফ্যালা হঠাৎ খ্যালখ্যাল করে হেসে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে গান ধরে দিল।

ও তোর ভবের খেলা সাঙ্গ হল
যম দাদাকে যেয়ে বলল,
খেয়েছি মণ্ডা মেঠাই,
সোনাটর বাবুর হাতে।

আবার হাসতে গিয়ে থেমে বলল, সোনাটরবাবু, ঠাউরের নাম লেও।

কেন?

এট্টা পানি হত্যে করলে, পাপ লাবাতে হবে না?

পাপ? বিষ্টুর প্রাণের কোথায় চাপা পড়া আগুন যেন উসকে উঠল পাপ কথাটায়। তীব্র চাপা গলায় বলল, দাঁড়া! ঘর বার সব সাবড়াই প্রাণ খুলে, তারপর দেখা যাবে তোর ঠাকুরের নাম।

বলে সে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল।…কুকুরটা সামনের দিকে বাড়ানো পায়ের মাঝখানে হাঁটুতে মাথা গোঁজার মতো এলিয়ে পড়েছে, আর ঠেলে বেরিয়ে আসা নিষ্পলক চোখ দুটো দিয়ে যেন তাকিয়ে আছে বিষ্টুর দিকে। মরে গেছে কুকুরটা।

বিষ্টু মুখটা ফিরিয়ে এগুতে এগুতে বলল, ফ্যালা বিকেলে গাড়ি করে ভাগাড়ে নিয়ে ফেলে দিস। তারপর হঠাৎ নাকটা কুঁচকে বলল, অল শালা ব্লাডি বোগাস।

তারপর চলল সারা এলাকা জুড়ে কুকুর মারার পালা। কখনও গঙ্গার ধার থেকে পুবের রেল লাইন পর্যন্ত, কখনও লাইনের উপর উত্তর দক্ষিণের এক নং ওয়ার্ডের দুই সীমানা পর্যন্ত।

কী রকম একটা নেশায় পেয়ে বসেছে বিষ্টুপদকে। ক্ষিপ্ত হিংস্র, একরোখা। যেন কোনও খুনি হত্যালীলায় মেতেছে।

ফ্যালার হাতের লাঠি ঠাণ্ডা তো ফ্যালাও ঠাণ্ডা। তার কোনও উত্তেজনা নেই। সে খালি লুব্ধ কুকুরগুলির মতোই জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে বিষ্টুর হাতের হাঁড়িটা আর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে।

কিন্তু সোনাটরবাবুর খ্যাপামি দেখে চাইতে ভরসা পাচ্ছে না। যা হয়, ওই দেখে দেখেই। আশা আছে শেষের বেলায়। বোধ হয় শেষের বেলার কথা ভেবেই কানা চোখটা নাচিয়ে নাচিয়ে হাতের লাঠিতে তাল ঠুকে গুনগুন করছে সে।

কিন্তু বিষ্টুর নজর শুধু একদিকে, কুকুর। যেমনি দেখা, অমনি রসগোল্লা, ছুরি আর বিষ। তারপর খা, খা শালা জন্মের মতো। বলে আর জিজ্ঞেস করে, ক নম্বর হল ফ্যালা?

ফ্যালা বলে, আধ ডজন লম্বর দাঁড়াল।

পেছনে পেছনে ভিড় করে পাড়ার বাচ্চা ছেলের দল। বিষ্টু খেঁকোয়, দোব রসগোল্লা? ফ্যালা তাড়া দেয় বাচ্চাগুলোকে।

কেউ বলল, অমুক কুকুরটা মেরে দিয়ো তো। রোজ শালা রাত ডিউটি থেকে ফেরবার পথে কামড়াতে আসে।

কেউ বা বলল আবার, অমুক কুকুরটা মেরো না হে বিষ্টুপদ। ওটা সারারাত খেঁকোয়, আমি তাই জেগে থাকি যা চোর ডাকাতের ভয় বাবা।

বিষ্টু ও-সব কমই শোনে। যেটাই সামনে পড়ক, গলায় দড়ি, বেল্ট বাঁধা না থাকলেই হল। কিন্তু সেই খেপী কুকুরটা কোথায় গেল? খেঁকি খেপীটা?

যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় বিষ্টু। বলে, ফ্যালা ওই যে একটা শুয়ে আছে।

ফ্যালা কানা চোখ বড় করে হেসে বলে, ওটা শোয়া নয়, মরা।

মরা? কে মারল?

কেন, তুমি সোনাটরবাবু।

তা বটে। খেয়াল নেই বিষ্টুর। প্রায় সব পাড়াতেই গাদা গাদা কুকুর দেখে তার মাথাটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে, ফ্যালা, এত কুকুর এল কোত্থেকে?

ফ্যালা বলে, কেন, ভাদ্দর মাস গেছে, পোষ মাঘ গেছে, হারামজাদীরা বিইয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি।

বিষ্টু খানিকক্ষণ চুপ করে মাথা নেড়ে বলে হুঁ! কী খেয়ে বাঁচে এগুলো?

কী আবার, পচা পাতকুড় বিষ্টা।

খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ করে বোধ হয় বিষ্টু হেসেই ফেলে। বলে, ঠিক মানুষের বাচ্চার মতো, না? বলেই বিকৃত মুখটা ফিরিয়ে আবার হনহন করে এগোয়। আবার চলতে থাকে কুকুর-নিধন অভিযান। আর ফ্যালা আবার বাড়িয়ে দেয় ইচ্ছাপূরণের গুলি। শুধু তার ইচ্ছা পূরণ হয় না।

ফাল্গুনের হাওয়া থেকে থেকে অনাগত চৈত্রের ঘূর্ণিতে মেরে উঠছে। বেলা বাড়ছে চড়চড় করে। নীল আকাশটা ধুলোয় ধুলোয় ফ্যালা ডোমের ঘষা চোখটার মতো রং ধরেছে। হঠাৎ ফ্যালা বলে, আচ্ছা সোনাটরবাবু মানুষও কি শালা বাড়তি হয়ে গেছে?

বিই বলে, নইলে এত মরে? খাবে কী! খায় তো সব পচা বিষ।

ফ্যালা ভাল চোখটা বুজিয়ে বলে, তালে মানুষের মাথার পরেও শালা সোনাটরবাবু আছে বলো! সে ব্যাটা কে?

হঠাৎ বিষ্টুর অপ্রতিভ মুখে কোনও কথা জোগায় না। তারা দুজনেই তিনটে নেশাচ্ছন্ন চোখে পরস্পরের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। দুজনেই তারা কী এক ভাবনায় যেন তলিয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য। বোধ হয়, সত্যিই ভাববার চেষ্টা করে, মানুষের বিষবাহী সেই জীবটা কে।

পর মুহূর্তেই বউ শিবির সকালবেলার মুখটা মনে হতেই সে রেগে চেঁচিয়ে ওঠে, দ্যাখ কানা ডোম, কাজের সময় বকিসনি। নিকুচি করেছে তোর মানষের সোনাটরের। শালা মরুক সব। হেজে যাক, সেই ভাল। এবার হিসেব দে, কটা মরেছে।

ফ্যালা ভাবে, কুকুর মারার মতো মানুষের সোনাটরবাবুও বোধহয় এরকমই ভাবে। বলে, তা কুল্যে আটটা হল।

মাত্তর।

.

আবার শুরু। আবার সন্ধান। বিষের শিশি যেমন তেমনই তো আছে। খরচ কোথায়? সেই খেপীটা কোথায়, যেটা কামড়ায়? ঘোর দুপুর নিঝুম। ফাঁকা পথ, লোকজন নেই। ঘরে ঘরে দরজা জানালা সব বন্ধ। এখানে ওখানে মরা কুকুর। চারদিকে মাছির উল্লাস। হয়তো আকাশে উড়ে চলেছে শকুনকে সংবাদ দিতে। আর ভ্যানভ্যান করে উড়ে চলেছে বিষ্টুর সঙ্গে হাঁড়ির গায়ে গায়ে।

আর এ বসন্ত দুপুরে, বিষ্টু ও ফ্যালাকে মনে হয়, সত্যিই বুঝি দুটো হন্যে হওয়া যমেরই অনুচর।

হঠাৎ দূর থেকে একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, হেই ফ্যালা, শিগগির আয়, এখেনে রয়েছে সেই খেপীটা। দুজনেই তারা সেদিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা আঙুল দিয়ে দেখিয়েই পালাল।

দেখা গেল, অদূরেই নর্দমাতে মুখ নিচু করে কি যেন খাচ্ছে একটা কুকুর। রোগা, লম্বা, ছাই রংএর মাদী কুকুর। সমস্ত শরীরের ভারটা নীচের দিকে ছটা পুষ্ট স্তনের ভারে ঝুলে পড়েছে। নিটোল মেটে বর্ণের চোষা স্তন।

দেখেই বিষ্টুপদর চোখের দৃষ্টি যেন জ্বলে উঠল। বলল, ফ্যালা, হারামজাদি বিইয়েছে।

ফ্যালা বলল, ওই জন্যই বোধ হয় খেঁকি হয়েছে। দেখো না, মেয়েমানুষে বিয়োলে খেঁকি হয়?

হুঁ। এটাকে মারলে একটা বিউনী কমবে। ওকে শালা আমি জোড়া রসগোল্লা খাওয়াব। বলে সে দুটো রসগোল্লা বের করে কেটে বিষ পুরে দিল।

কুকুরটা হঠাৎ নর্দমা থেকে মাথা তুলল। এদের দেখে আরও খানিকটা গলাটা টান করে ঘাড় বাঁকিয়ে বিষ্টুর হাতের বস্তুটির দিকে তাকাল। হলদে মণি আর লাল চোখে সামান্য একটু কৌতূহল ফুটল। কিন্তু একটা শাণিত খ্যাপামি ও সন্দেহে চকচক করছে চোখ দুটো।

বিষ্টু রসগোল্লা দুটো নামিয়ে ফ্যালাকে নিয়ে সরে গেল দূরে।

কুকুরটা রসগোল্লা দুটোর কাছে এসে এক মুহূর্ত মাথা নিচু করে দাঁড়াল। আবার মুখ তুলে একবার বিষ্ঠুকে দেখে, হঠাৎ পেছন ফিরে দুধের বাঁট দুলিয়ে দুলিয়ে চলে গেল।

বিষ্টু আর ফ্যালা অবাক হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে এগিয়ে এসে দেখল, কুকুর খাবার ছোঁয়নি পর্যন্ত। আশ্চর্য! আশাতীত।

রাগে বিস্ময়ে বিষ্টু জ্বলন্ত চোখে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলল, ওরে শালা, হারামজাদি যে মানুষের বাড়া দেখছি।

ফ্যালা বলল, সেয়ানা হয়ে গেছে। হবে না, ও যে মাদী। পেটের বাচ্ছা পালতে হবে যে।

দৃঢ় চাপা ক্রুদ্ধ গলায় গর্জে উঠল বিষ্টু, পালাচ্ছি বাচ্চা। যাওয়াচ্ছি ওর মাই দুলিয়ে দুলিয়ে।

থপ করে সে রসগোল্লা দুটো তুলে নিয়ে পলকে দেখে নিল, বাঁ দিকের গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল কুকুরটা। বলল, চ ফ্যালা, বিষ না হয়, তোর ডাণ্ডা দিয়েই ওকে সাবাড় করতে হবে।

ফ্যালার ওতে কিছু যায় আসে না। বলল, চলো। কিন্তু দুটো মিষ্টি লষ্ট করলে তো সোনাটরবাবু।

বিষ্টু খেঁকিয়ে উঠল, তবে কি তোকে দেব?

ফ্যালা কানা চোখের ড্যালা কাঁপিয়ে হেসে বলল, আমাকে না হয়, আমার ডোমনিটাকে তো দিতে পারতে? বলে হ্যা হ্যা করে হাসে। জানলে বাবু বউটা ওই হাঁড়ির জিলিসটা এখন খালি খেতে চায়। মানে, পোয়াতি কি না।

বিষ্টুর গায়ে যেন আগুন লাগে কথাটা শুনে। বলে, ও, তাই সক্কাল থেকে মিষ্টি দেখে তোমার এত ফুর্তি! বলি, কবিউনী হল তোর বউ।

তা তোমার এবার লিয়ে পাঁচবার।

মনে হল বিষ্টু এবার বুঝি ঘুষি কসাবে ফ্যালার ওই চোখটাতে। ভেংচে বলে, আরও চাই?

ফ্যালার হাসিটা অদৃশ্য হয়ে যায়। ভাল আর কানা দুটো চোখই মেলে ধরে চাপা গলায় বলল, তবে আর তোমাকে বলছি কী। পাইখানা-ঘাঁটা ধাওড়ার মায়ের পেটের ছেলে যে বাঁচে না। এও জানো না। চারটে তো শালা মরেই গেছে।

বিষ্টু তেমনি ভেংচে খেঁকিয়েই বলে, তবে বিষ পুরে দোবখনি, সবসুদ্ধ গায়েব হয়ে যাবে।

কিন্তু ফ্যালা ডোমের প্রাণ তাতে বাগ মানে না। ওই ভর দুপুরে বেসুরো গলায় গেয়ে ওঠে,

ভালবেসেছিলুম বলে
মালাটি দিলে গলে
সোহাগ করে কোলে দিলে
নাদাপেটা ছে—লে!

বিষ্টু আচমকা মুখ চেপে ধরে ফ্যালার। বলে, থাম্ শালা, ওই দ্যাখ।

দেখা গেল সেই মাদী কুকুরটা একটা ঝোপের আড়াল থেকে ঠিক মানুষের মতো উঁকি মেরে তাদের দেখছে।

দুজনেই একটু দাঁড়াল। ফ্যালা বলল, সরে এসো পেছু দিয়ে যাব।

বলে তারা পেছনে ফিরে একটা বাগানের ভেতর দিয়ে সন্তর্পণে এগুল। এদিকটা এলাকার শেষ, তাই জায়গাটা গাছে, জঙ্গলে, বাঁশঝাড়ে ছাওয়া গ্রাম্য নিঝুমতায় আচ্ছন্ন।

বাগানের পেছন দিয়ে, খুব ধীরে সেই ঝোপটার কাছে এসেই তারা হতাশ ভরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। নেই কুকুরটা। কোথায় গেল?

হঠাৎ খড়খড় শব্দে চমকে ফিরে দেখল, বাগানের মাঝখান দিয়ে কুকুরটা ছুটছে। তারাও দুজনে ছুটল। কিন্তু খানিকটা ছুটেই তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল কুকুরটা। নিঃশব্দ। দুজনেই কয়েক মুহূর্ত কান পেতে রইল। শুধুই হাওগার সড়সড়, পাতার মড়মড়। দুজনেই থেমে গেছে।

বিষ্টুর চোখ দুটো আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। সেই ছোঁয়াটা লেগেছে এবার ফ্যালারও। ঠেলে উঠেছে তার কানা চোখটা। বলল, হারামজাদী আমাদের চেয়েও সেয়ানা। চলো দেখি ওই বাঁশঝাড়ের দিকে।

দুজনেই পা টিপেটিপে বাঁশ বাগানের মাঝখান দিয়ে চলল। খানিকটা গিয়েই বিষ্টু ফ্যালার হাত ধরে দাঁড়াল। বলল, মনে হচ্ছে, আমাদের ডানদিকের বাঁশঝাড়টা দিয়ে কে যেন যাচ্ছে।

দুজনেই কান পাতল। না, কোনও শব্দ নেই।

কিন্তু আবার তারা পা বাড়াতেই প্রতিধ্বনির মতো ডান দিক থেকে শব্দ শোনা গেল। তারা থামলেই ওই শব্দটাও থেমে পড়ে। তারা তিন চোখে বোকার মতো পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। ভূত নাকি? তবে তারা দুজনে কী?

 বাঁশ বাগানটা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই তাদের চমকে হতাশ করে দেখা গেল কুকুরটা তাদের চোখের সামনে দিয়ে সড়সড় করে মাঠের দিকে ছুটল। তার ছোটার দোলায় যেন ছিটকে পড়ার উপক্রম করল পেটের তলার স্তনগুলি।

এবার দুজনেরই রোখ চেপে গেল। দুজনেই ছুটল মাঠের দিকে মাথা নিচু করে। দেখল, মাঠের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে কুকুরটা। ছুটে একেবারে পুবের সড়কটার উপর দিয়ে ফিরে দাঁড়াল। কিন্তু এরা দুজনেই মাথা নিচু করে রইল।

তবু কুকুরটা উত্তর দিকে ছুটে হঠাৎ রাস্তার নাবিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সূর্য ঢলে পড়েছে। দুপুর শেষ হতে চলেছে। এই নিঝুমতার সুযোগে হাওয়া যেন আরও দুর্বার হয়ে উঠছে।

হাঁপাচ্ছে বিষ্টু, আর ফ্যালা ডোম। ফ্যালা বলল, আজ ছেড়েই দেও, কাল হবে।

বিষ্টু খ্যাপার মতো উঠে দাঁড়াল-না, আজই ওকে নিকেশ করব, চ পা চালিয়ে। তারা যখন ছুটতে ছুটতে সড়কে এল, তখন দেখা গেল কুকুরটা রেল লাইন দিয়ে ছুটছে। আরও উত্তর দিকে খানিকটা ছুটে পুবের নাবিতে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিষ্টু হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, যাঃ ইউনিয়নবোর্ডের এলাকায় চলে গেল?

দুজনেই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেই মাথা ন্যাড়া তালগাছটার তলায়। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে চলল আবার মাঠ ভেঙে। বিষ্টুর চোখ ধ্বক্ ধ্বক করে জ্বলছে শিকার ফস্কানো নিষ্ফল আক্রোশে। ফ্যালার ভাল চোখটা বন্ধ থাকায় ভাবটা তার ঠিক ঠাওর করা গেল না।

ক্লান্ত পায়ে মাঠ পেরিয়ে বাগান পেরিয়ে ঠাকুরপাড়া ঘুরে মুচিপাড়ার ঝোপে ছাওয়া সরু গলি দিয়ে তারা এগিয়ে চলল।

.

মুচিপাড়ার শেষ সীমানায় বিষ্টু আবার থমকে দাঁড়াল। দেখল এর মধ্যেই ফিরে এসেছে সেই মাদী কুকুরটা। শুয়ে পড়েছে একটা মানকচু গাছের পাতার ছায়ায়। মেলে দিয়েছে ঠ্যাং, ছড়িয়ে দিয়েছে বুক, পেট। আর পুষ্ট স্তনগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কতগুলো নধর তুলতুলে ছোট ছোট বাচ্চা। চকচক শব্দে মাই খাচ্ছে, আর আরামে কুঁই কুঁই করছে।

ফ্যালা দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে ডাণ্ডাটা তুলতেই বিষ্টু চেপে ধরল তার হাতটা। ফ্যালা অবাক হয়ে লাঠিটা নামিয়ে নিল।

ক্লান্ত কুকুরটা টেরও পেল না তার দুশমনেরা এসে দাঁড়িয়েছে। দুধের ভারে তার টনটনে স্তন হালকা হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাঠাসা বুকে আরামে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাওয়া বইছে আর কোথা থেকে একটা বসন্ত পাখি উল্লাসভরে ডাকছে।

বিষ্টুপদর ক্লান্ত ঘর্মাক্ত বিকৃত মুখটার সমস্ত আঁকাবাঁকা রেখাগুলো জাদুবলে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখের ক্ষিপ্ততা কেটে গিয়ে একটা চাপা বেদনায় ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল দৃষ্টিটা। বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে এমনি একটা ছবি। এমনি, তবে সেটা গাছতলা নয়, ঘরের নিরালা কোলে একটা মানুষীর, দুপুরে অথবা মধ্য রাত্রে শুয়ে থাকার ছবি। এমনি, কিন্তু বাচ্চাগুলো মানুষের। এমনি, কিন্তু সে তার শিবি, খেপী নয়, তবু খেপী।

যেন ঘুম না ভাঙে, এমনি ফিসফিস করে বলল বিষ্টু, শুধু এই জন্যে, জানিস, হারামজাদী ছুটছিল। ছেড়ে দে এবারের মতো।

বলে সে খানিকটা গিয়ে আবার দাঁড়াল। আবার মুখটা বিকৃত করে, চোখ কুঁচকে পকেট হাতাতে হাতাতে বিড়বিড় করে বলল, অল শালা ব্লাডি বোগাস। ফ্যালা।

ফ্যালা ভাবছিল শালা পাগলা সোনাটরবাবু। বলল, বলো।

চারটে পয়সা দিবি?

ফ্যালা ট্যাঁক হাতড়ে একটা আনি দিয়ে বলল, কেন, ওই হারামজাদীকে দেবে নাকি?

বলে খ্যাল খ্যাল করে হেসে ফেলল। বিষ্টু তখন ভাবছে, এতক্ষণে বোধ হয় মিঠুর লঙ্কার আচারের দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে। আনিটা নিয়ে রসগোল্লার হাঁড়িটা হাতে দিয়ে বলল, যাঃ শালা, নিয়ে যা।

বলে উলটো দিকে ফিরে হনহন করে এগিয়ে গেল। তে-ঢিঙ্গে লম্বা, ভূতের মতো ঠ্যাং ফেলে ফেলে চলেছে যেন সেই মাথা মুড়নো তালগাছটা।

ফ্যালা একবার হাঁড়ি আর একবার সোনাটরবাবুর দিকে ভাল চোখটা মেলে দেখল। তারপর কানা চোখটা তুলে ভাল চোখটা বুজিয়ে বলল, অল শালা বেলাডি বোকাস।

বলে হাঁড়ি নিয়ে ডাণ্ডা কাঁধে ফেলে ধাওড়ার দিকে ছুটল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *