সে এসেছিল – আলজারনন ব্ল্যাকউড
রাত এগারোটা। লন্ডন শহরের এডিনবার্গ অঞ্চলের রাস্তাঘাট নির্জন, নিস্তব্ধ। পথে লোকজনের যাতায়াত খুবই কম। রাস্তার ধারের এক হোস্টেলের চারতলায় থাকে ম্যারিয়ট। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। এই হোস্টেলে তার মতো কিছু ছাত্র এবং সাধারণ কেরানি চাকরিজীবী থাকে।
ম্যারিয়ট মন দিয়ে পড়া মুখস্থ করছে। দরজায় খিল লাগানো। সে বেশ কয়েকবার পরীক্ষায় ফেল করায় তার বাবা-মা হুমকি দিয়েছেন-এটাই তার শেষ সুযোগ। আর তারা টাকা পয়সা খরচ করতে পারবেন না। ম্যারিয়ট সেকথা মনে রেখেই এবার জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছে-এবার তাকে পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে কারণ তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সে এরকম নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে যাচ্ছে। তার পরিচিতরা ব্যাপারটা জানত তাই তার পড়ার কোনো ব্যাঘাত ঘটাত না।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। এত রাতে বেল বাজার শব্দে ম্যারিয়ট অবাক হলো। এত রাতে কে এল?
বাড়িওয়ালি রোজ ঠিক রাত দশটার সময় খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে যায়। এরপর দরজায় বেল বাজলে সে না শোনার ভান করে। ম্যারিয়ট ভাবল আগন্তুকের আসার উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে তাকে বিদায় করে দেবে। তাই সে দরজা খোলার জন্য টেবিল ছেড়ে উঠল।
পাথর বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ম্যারিয়ট আবার বেল বাজানোর শব্দ শুনতে পেল। রাগ ও বিরক্তির সঙ্গে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে এল। দরজা খুলে বলল, সব্বাই জানে আমি পরীক্ষার পড়া তৈরি করছি আর এই অসময়ে এসে কেন বিরক্ত করা হচ্ছে?
বই হাতে ম্যারিয়ট দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আপন মনে বকে যাচ্ছিল। কিন্তু আগন্তুক কই! জুতোর খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে এত কাছে এবং এত জোরে যে মনে হচ্ছে পা দুটো যেন আগে আগে আসছে। আগন্তুক যেই-ই হোক না কেন অসময়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য তাকে কড়া কথা শোনাতে ম্যারিয়ট রেডি হয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ সে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু আগন্তুকের দেখা নেই। পায়ের শব্দটা খুব কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে, তবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
এবার ভয়ে তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। একবার ভাবল চিৎকার করে অদৃশ্য আগন্তুকটিকে ডাকবে তারপর ভাবল না; দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে আবার ওপরে গিয়ে পড়ায় মন দেবে। এই সব সাতপাঁচ ভাবছিল ম্যারিয়ট। হঠাৎ সেই জুতোর শব্দটা একেবারে কাছে শোনা গেল এবং আগন্তুককে দেখা গেল।
আগন্তুক বয়সে তরুণ, বেঁটে, খাটো, মোটা। মুখটা চুনের এত সাদা, উজ্জ্বল চোখ দুটোর তলায় কালি পড়েছে। একমুখ দাড়ি, চুল আলুথালু আর পোশাকের। পরিপাট্য দেখে তাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হলো ম্যারিয়টের। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার তার মাথায় কোনো টুপি নেই এমনকি গায়ে ওভারকোট বা হাতে ছাতাও নেই। অথচ সন্ধ্যে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
লোকটিকে দেখে ম্যারিয়টের মনে নানারকম প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল-কে আপনি? আর কেনই-বা এত রাতে এখানে এসেছেন? রাস্তার গ্যাসের আলো তার মুখের ওপর পড়ল। চমকে উঠল ম্যারিয়ট। চিনতে পারল আগন্তুককে। ফিল্ড! ফিল্ড, তুমি বেঁচে আছ? ভয়ে ম্যারিয়টের দমবন্ধ হবার জোগাড় হলো।
ম্যারিয়ট এই ফিল্ডের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। সে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই-ই হয়েছে। তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পরে একবারই মাত্র দেখা হয়েছিল। ম্যারিয়টের বাড়ির কাছেই ফিল্ড থাকত তাই তার বোনদের মারফত সব খবরই ম্যারিয়ট পেত। ফিল্ড অসংযত জীবনযাপন করত, মদ, আফিং, চরসের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। সে একেবারে উচ্ছন্নে চলে যায়।
ম্যারিয়টের রাগ-বিরক্তি মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। সে তাকে ভেতরে আসতে বলল। বলল, মনে হচ্ছে কিছু ঘেট পাকিয়েছ। এসো ভেতরে, সব শুনছি। আমাকে সব খুলে বলো–হয়তো আমি কোনো সাহায্য…আর কি বলবে ম্যারিয়ট ভেবে পেল না, শুধু সে তো তো করতে লাগল। তারপর নিজেকে সংযত করে, সদর দরজাটা বন্ধ করে বন্ধুকে নিয়ে হলের দিকে এগোল। ফিল্ড খুব পরিশ্রান্ত এবং ক্লান্ত। তার টলায়মান পা দুটো দেখলেই বোঝা যায়। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন সে কিছু খায়নি।
ম্যারিয়ট এবার হাসিমুখে সমবেদনার স্বরে বলল–আমার সঙ্গে এসো, তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। এইমাত্র আমি খেতে যাচ্ছিলাম, তুমি ঠিক সময়েই এসেছ।
ফিল্ডের দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে এতই দুর্বলভাবে হাঁটছিল যে ম্যারিয়ট তার হাতটা ধরে নিয়ে চলল। এই প্রথম সে লক্ষ করল ফিল্ডের জামা কাপড় তার গায়ে মোটেই ফিট করেনি। খুব ঢিলেঢালা লাগছে। তার বিরাট চেহারাটা কঙ্কালসার।
ফিল্ডকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসালো ম্যারিয়ট। আশ্চর্য হচ্ছিল ভেবে কোথা থেকে ফিল্ড এল আর কী করেই-বা সে তার ঠিকানা জানল।
ম্যারিয়ট বলল, ফিল্ড, তুমি সোফায় বিশ্রাম করো কিছুক্ষণ, তুমি খুব ক্লান্ত। পরে তোমার কাছে সব শুনব। তখন দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু ঠিক করা যাবে।
ফিল্ড সোফায় বসে কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ম্যারিয়ট আলমারি থেকে বাদামি রঙের পাউরুটি, কেক এবং একটা বড় পাত্রে কমলালেবুর আচার বের করল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফিল্ডের চোখ দুটো ভীষণ চকচক করছে। ম্যারিয়ট ভাবল এটা নিশ্চয়ই কোনো ওষুধের প্রভাব। ওর অবস্থা খুবই শোচনীয়। কথা বলবার শক্তিও বোধহয় তার নেই।
ম্যারিয়ট কোকো তৈরি করার জন্য স্পিরিট ল্যাম্প জ্বালাল। পানি যখন ফুটছে তখন খাবার টেবিলটা সোফার কাছে টেনে নিয়ে এল যাতে ফিল্ডের চেয়ারে উঠে গিয়ে বসতে কষ্ট না হয়। এসো, এখন খাওয়া যাক। বলল ম্যারিয়ট। তারপর পাইপ টানতে টানতে গল্প করব। এবার পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি। যদিও খুব ব্যস্ত এখন আমি, তবুও তোমার এত বন্ধুকে কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে।
ম্যারিয়ট আবার ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল তার অতিথি বন্ধুটি তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ম্যারিয়টের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শিহরন বয়ে গেল। ফিল্ডের মুখ মরার মতো ফ্যাকাসে। ব্যথা ও মানসিক কষ্টের একটা ছাপ তার মুখে ফুটে উঠেছে।
এইরে! ম্যারিয়ট লাফিয়ে উঠল। একেবারে ভুলেই গেছিলাম। বলে আলমারি থেকে মদের বোতল আর গেলাস বার করল। গেলাসে মদ ঢেলে ফিল্ডকে দিল। ফিল্ড পানি না মিশিয়ে সেটা এক ঢোকে শেষ করল। ম্যারিয়ট লক্ষ করল ফিল্ডের কোটটা ধুলোয় ভর্তি, কাঁধে মাকড়সার জাল। কোটটা শুকনো খটখটে। বৃষ্টি ঝরা রাতে ফিল্ড এসেছে-টুপি, ছাতা, ওভারকোট কিছুই নেই-অথচ শুকনো, এমনকি ধুলোভর্তি! ব্যাপারটার অর্থ কিছুতেই মেলাতে পারছিল না ম্যারিয়ট। তবে কি ফিল্ড এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়েছিল?
তবু ম্যারিয়ট কিছুই জিজ্ঞেস করল না। ঠিক করেছে, ফিল্ডের খাওয়া ও ঘুম হওয়া পর্যন্ত তাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবে না। খাবার এবং ঘুম-দুটোই এখন তার খুবই প্রয়োজন। একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফিল্ডকে কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না।
তারা দুজনে খেতে লাগল। ম্যারিয়ট একাই কথা বলে যাচ্ছে। তার নিজের সম্বন্ধে, তার পরীক্ষার ব্যাপারে, বুড়ি বাড়িওয়ালির কথা-একনাগাড়ে বলেই চলেছে। ম্যারিয়টের খাবার কোনো ইচ্ছা নেই, হাতে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। যদিও ফিল্ড গোগ্রাসে গিলছে। একজন ক্ষুধার্তের এভাবে ঠান্ডা, বাসি খাবার খাওয়ার আগ্রহ দেখে ম্যারিয়ট ভাবছিল, ফিল্ডের গলায় আবার খাবার আটকে না যায়!
কিন্তু ফিল্ড যেমন ক্ষুধার্ত ছিল তেমনি তার ঘুম পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তার মাথা সামনের দিকে ঝুলে পড়ছে, মুখের খাবার চিবোনো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ম্যারিয়ট বারবার তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে রাখছিল। আর ফিল্ড পশুর এত গরগর করে খাবার মুখে পুরে সরু গলনালি দিয়ে গিলে ফেলছে।
শেষ কেকটি ফিল্ড গলাধকরণ করার পর বোকার মতো ম্যারিয়ট বলল-তোমাকে দেবার মতো আমার আর কিছুই নেই।
ফিল্ড কিছুই বলল না। তার নিজের জায়গায় প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার দশা। ক্লান্ত ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সে একবার চোখ তুলে দেখল।
এখন তোমার একটু ঘুমের দরকার, নইলে শরীর খারাপ করবে। আমাকে সারা রাত জেগে পড়াশোনা করতে হবে। আমার বিছানায় তুমি আরাম করে শোও। কাল একটু বেলাতে ব্রেকফাস্ট করব কেমন, আর-আর দেখি কি করা যায়। ঘরের গুমোট পরিবেশ হালকা করার জন্য ম্যারিয়ট বলল।
ফিল্ড যেন মৃত্যুর নীরবতা পালন করে চলেছে। তার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে ম্যারিয়ট তাকে নিজের ছোট শোবার ঘরে নিয়ে গেল। ফিল্ড জমিদারের ছেলে। তাদের বিশাল অট্টালিকা। তার কাছে এই ছোট সামান্য ঘরটা নেহাতই পুতুলঘরের মতোই।
ক্লান্ত ফিল্ড কোনো ধন্যবাদের ধার না ধেরে কিংবা ভদ্রতার ভান না করে বন্ধুর হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে ঘরে ঢুকল। ম্যারিয়ট তাকে তার গায়ের পোশাকসুদ্ধ বিছানায় শুইয়ে দিল।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ম্যারিয়ট তার আপাদমস্তক দেখল। পরমুহূর্তেই তার চিন্তা হলো, এই অনাহুত অতিথিকে নিয়ে কাল সে কি করবে? কিন্তু বেশিক্ষণ এ ভাবনা তাকে উতলা করতে পারল না, কারণ পরীক্ষার টেনশনটা তাকে বড় খোঁচাচ্ছে।
দরজায় খিল লাগিয়ে সে আবার পড়তে বসল বই নিয়ে। মেটিরিয়া মেডিকার যেখান থেকে নোট করতে করতে কলিংবেল শুনে উঠে গিয়েছিল, সেখানে আবার মনোনিবেশ করল। কিন্তু সে বেশ খানিকক্ষণ মনোসংযোগ করতে পারল না। তার চিন্তা কেবলই সেই মূর্তিটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে-সাদা ফ্যাকাসে মড়ার মতো মুখ, অদ্ভুত জ্বলন্ত চোখ, ক্ষুধার্ত ও মলিন বেশ, পোশাক ও জুতো পরে ফিল্ডের বিছানায় শুয়ে থাকা।
হঠাৎ ম্যারিয়টের একটা শপথের কথা মনে পড়ে গেল। ইস্ একেবারে ভুলে গিয়েছিল!
ম্যারিয়ট আধখোলা দরজা দিয়ে ছোট শোবার ঘরটা থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। শ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষের গভীর নিদ্রা তাকেও বিছানার দিকে আকর্ষণ করছিল।
ম্যারিয়ট ভাবছে, একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক, খুব ঘুম পাচ্ছে।
তখন বাইরে সোঁ সোঁ শব্দে ঠান্ডা বাতাস বইছে; সার্সিতে এবং রাস্তায়। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ম্যারিয়ট পুনরায় পড়ায় মনোসংযোগ করার চেষ্টা করল; কিন্তু বই পড়তে পড়তে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল পাশের ঘরের লোকটির ভারি ও গভীর নিশ্বাস!
প্রথমে, হয় ঘরের অন্ধকারে সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। নয়তো, আলোয় এতক্ষণ বসে থাকার কারণে তার চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল। কিছুই সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না-আসবাবগুলো কালো ঢেলার মতো, দেয়ালে ড্রয়ারের আলমারিটা একটা কালো বস্তু, ঘরের মাঝখানে সাদা বাথটাবটা যেন একটা সাদা প্রলেপ।
তারপর ধীরে ধীরে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল তার ওপর একটা ঘুমন্ত দেহের রেখা ক্রমে ক্রমে আকার নিল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে অদ্ভুতভাবে সে বাড়তে লাগল। পরিষ্কার দেখা গেল বিছানার সাদা চাদরের ওপর একটা লম্বা কালো মূর্তি।
মনে মনে হাসল ম্যারিয়ট। ফিল্ড একটুও নড়েনি। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখে ম্যারিয়ট আবার বইয়ের কাছে ফিরে এল।
একটানা বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। বাইরে গাড়ির কোনো শব্দ নেই, তবে দুধের গাড়ি চলার সময় এখনো হয়নি। ম্যারিয়ট পড়তে লাগল। ঘুম আসছিল বলে মাঝে মাঝে ঘুম তাড়াবার জন্য কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তারই মধ্যে ফিল্ডের গভীর নিশ্বাস তার কানে আসছে।
বাইরে তখনো ঝড় থামেনি। সঙ্গে অবিরাম বৃষ্টি। ঘরের মধ্যে নিঃসীম নিস্তব্ধতা। টেবিল ল্যাম্পের আলো টেবিলে ছড়িয়ে আছে বাকি ঘরের সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছোট শোবার ঘরটা-যেখানে ফিল্ড শুয়ে আছে সে যেখানে বসে আছে ঠিক তার উল্টোদিকে, তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাবার মতো কিছুই নেই, তবে মাঝে মাঝে ঝড়ের ঝাঁপটা জানালার ওপর পড়ছে আর হাতে সামান্য একটু ব্যথা অনুভব করছে।
এই ব্যথাটা যে কী করে হলো তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বেশ টনটন করছে। ম্যারিয়ট মনে করার চেষ্টা করছে, কেমন করে, কখন এবং কোথায় তার হাতে ধাক্কা লেগেছিল কিন্তু কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
নিচে রাস্তায় গাড়ির শব্দে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। ঘড়ির দিকে তাকালো। ভোর চারটা। ম্যারিয়ট চেয়ারে হেলান দিয়ে বিরাট হাঁ করে হাই তুলল। তারপর উঠে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিল। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে ঘন কুয়াশায়– দৃষ্টি চলে না। ব্রেকফাস্টের আগে সোফায় শুয়ে বাকি চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল ম্যারিয়ট। কিন্তু তখনো সেই শোবার ঘরটা থেকে গভীর নিশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর একবার নিঃশব্দে আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ভোরের মৃদু আলোয় বিছানাটা পরিষ্কার দেখতে পেল। বিছানায় কেউ নেই। একবার চোখটা কচলে নিল ভালো করে। অবাক বিস্ময়ে তার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। বিছানা শূন্য, ঘরেও কেউ নেই।
ফিল্ডের প্রথম আবির্ভাবে যে ভয় ম্যারিয়টের মনে জেগে উঠেছিল সেই ভয় হঠাৎ যেন সে আবার অনুভব করতে লাগল। এবার যেন আরও বেশি। সেইসঙ্গে সে সচেতন হয়ে উঠল তার বাঁ হাতটা দপদপ, টনটন করছে, আরও বেশি সে যন্ত্রণা বোধ করছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ম্যারিয়ট। চিন্তা করার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে। আপাদমস্তক ঠকঠক করে কাঁপছে।
অনেক চেষ্টায় সে মনে বল এনে সাহসের সঙ্গে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। দেখল, বিছানার ওপরে যেখানে ফিল্ড শুয়ে ঘুমিয়েছিল সেখানে দেহের চাপ পড়ে একটা ছাপ তৈরি হয়েছে। বালিশে মাথা রাখার দাগ, নিচের দিকে বিছানার যেখানে বুটজুতো পরা পা রেখেছিল সেখানটা গর্ত হয়ে গেছে। আর সে বিছানার এত কাছে ছিল যে, পরিষ্কার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।
ম্যারিয়ট হঠাৎ চিৎকার করে তার বন্ধুর নাম ধরে ডাকতে লাগল-ফিল্ড! তুমি কোথায়? তুমি কি বাথরুমে গেছ? কোথায় তুমি?
কোনো সাড়া নেই। বিছানা থেকে তখনো নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ম্যারিয়টের নিজের গলার আওয়াজ নিজের কানেই অদ্ভুত ঠেকছে। আর সে ডাকল না। হাঁটু গেড়ে বসে বিছানার ওপরে নিচে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল। শেষে তোশক তুলে ফেলল, একটার পর একটা চাদর তুলে দেখতে লাগল। যদিও ফিল্ডকে দেখা যাচ্ছিল না তবু সে তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে। দেয়ালের কাছ থেকে খাটটা টেনে নিয়ে এল তবু শব্দটা সেখান থেকে অবিরাম আসতে লাগল।
ক্লান্তিকর এ অবস্থায় ম্যারিয়ট মাথাটা ঠিক রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বারবারই সে টালমাটাল হয়ে যাচ্ছিল। সামলাতে পারছিল না নিজেকে। সে তন্নতন্ন করে সমস্ত ঘর, বাথরুম খুঁজে দেখল। কোথাও কারও চিহ্ন নেই। ঘরের ওপর দিকে ছোট জানালাটা বন্ধ। তবে ওটা বেড়াল যাবার মতোও চওড়া নয়। বসার ঘরের দরজাটা ভেতর দিক থেকে বন্ধ। সেপথ দিয়ে ফিল্ড বেরিয়ে যেতে পারে না। অদ্ভুত সব চিন্তা ম্যারিয়টের মনকে অস্থির করে তুলল। ভেতরটা তার তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। আবার সে বিছানা উল্টেপাল্টে ভালো করে দেখল। দুটো ঘর, বাথরুম আবার খুঁজে এল। না, কোথাও কিছু নেই। সে দরদর করে ঘামছিল। ঘরের কোণে বিছানায় যেখানে ফিল্ড শুয়েছিল সেখান থেকে তখনো নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল।
তখন সে অন্যভাবে চেষ্টা করল। খাটটা যেখানে ছিল, সেখানে টেনে এনে সেই বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। শোবার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে সে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিশ্বাসটা একেবারে তার মুখের ওপর পড়ছে
ম্যারিয়ট দ্রুত পড়ার ঘরে ফিরে গিয়ে সবকটা জানালা খুলে দিল। ঘরে আলো হাওয়া খেলতে লাগল। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা ধীরে সুস্থে চিন্তা করার চেষ্টা করল। সে জানত, যারা খুব বেশি পড়াশোনা করে এবং কম ঘুমোয়, তাদের মনে নানা অলীক, অবাস্তব চিন্তা জেগে উঠে যন্ত্রণা দেয়। আবার মনকে সে শান্ত করে রাতের ঘটনাগুলো পরপর বিশ্লেষণ করেও কোনো কূলকিনারা পেল না।
এসব খতিয়ে দেখে আর বিশ্লেষণ করতে করতে একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হঠাৎ তার মনে উদয় হলো। ফিল্ড কিন্তু একবারও মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বার করেনি! তার ভাবনা চিন্তাকে ঠাট্টা করার জন্য তখনো ভেতরের ঘর থেকে দীর্ঘ গভীর ও স্বাভাবিক নিশ্বাসের শব্দ আসছে! একটা অবিশ্বাস্য অযৌক্তিক ব্যাপার!
ভুতুড়ে চিন্তার জালে জড়িয়ে পাগলের মতো মাথায় টুপি ও গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে পড়ল। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস, গাছগাছালির বুনো গন্ধ, আর স্যাঁতসেতে ভিজে মাটির ওপর ঘুরে বেড়িয়ে যখন সে বুঝতে পারল, মন থেকে ভয় দূর হয়েছে, খিদেও পেয়েছে বেশ, তখন সে বাড়ি ফিরে এল।
ঘরে ঢুকতেই দেখল একজন লোক জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে ম্যারিয়ট প্রথমটায় চমকে উঠলেও পরে তাকে চিনতে পারল। এ তার বন্ধু গ্রিন-তার সঙ্গে পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে।
সে বলল, সারা রাত খুব পড়েছ, ম্যারিয়ট। ভাবলাম, তোমার সঙ্গে নোটগুলো মিলিয়ে নিই, আর ব্রেকফাস্টটাও করি। তাই তোমার কাছে চলে এলাম। তুমি এত সকালে কোথায় গেছিলে? বাইরে?
ম্যারিয়ট বলল, মাথাটা ধরেছিল, তাই একটু বেড়িয়ে এলাম।
ও! গ্রিনের কণ্ঠে বিস্ময়। একজন পরিচারিকা ঘরে ঢুকে গরম গরম পরিজ টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল। গ্রিন বলল, ম্যারিয়ট, তোমার মদে আসক্তি আছে। জানতাম না তো!
নীরস সুরে ম্যারিয়ট বলল সে নিজেও তা জানে না।
মনে হচ্ছে বিছানায় কেউ আরামে ঘুমিয়ে আছে, তাই না? মাথা নেড়ে ছোট শোবার ঘরটা দেখিয়ে কৌতূহলী হয়ে ম্যারিয়টের দিকে তাকিয়ে রইল।
দুজনে কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে সাগ্রহে ম্যারিয়ট বলল, তাহলে তুমিও শুনেছ? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
নিশ্চয়ই আমি শুনেছি। দরজা খোলা রয়েছে। আমি যে ঘরে ঢুকে পড়েছি তুমি কিছু মনে করোনি তো?
না, না। আমি কিছু মনে করিনি। ম্যারিয়ট নিচু স্বরে বলল, এখন আর আমার ভয় করছে না। আমি ব্যাপারটা বলি। ভেবেছিলাম আমার মাথায় কোনো গোলমাল হয়েছে। তুমি জানো, এই পরীক্ষার ওপর আমার অনেক কিছু নির্ভর করছে। অথচ আমি পড়ায় মন বসাতে পারছি না। সাধারণত কোনো শব্দ, দৃশ্য অথবা অলৌকিক চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকলে এমনটা হতে পারে কিন্তু আমি… বাজে যত্তসব!
তার কথার মাঝে হঠাৎ গ্রিন বলল, তুমি কিসের কথা বলছ?
শান্তস্বরে ম্যারিয়ট বলল, আমার কথা শোনো, গ্রিন। আমি যা বলতে চাই, পরপর বলে যাব-তুমি কোনো বাধা দেবে না। রাতে যা যা ঘটেছিল সবিস্তারে বলল ম্যারিয়ট। হাতের ব্যথার কথাটাও বাদ দিল না। বলা শেষ হলে টেবিল থেকে উঠে সে ঘরের ওপাশে গেল। বলল, এখন তুমি স্পষ্ট নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছ তো? তাই না?
গ্রিন ঘাড় নেড়ে বলল, হুঁ! বেশ, এবার এসো আমার সঙ্গে, আমরা দুজনে ভালো করে ঘরটা খুঁজে দেখব। গ্রিন কিন্তু চেয়ার থেকে নড়ল না! শুধু। নিষ্ক্রিয়ভাবে বলল, আমি আগেই ওখানে খুঁজে এসেছি। আমি শব্দ শুনে ভেবেছিলাম যে তুমি। দরজা হাট করে খোলা ছিল, তাই ভেতরে ঢুকেছিলাম।
ম্যারিয়ট কোনো মন্তব্য না করে দরজাটা ঠেলে একেবারে খুলে দিল। দরজাটা খুলতেই নিশ্বাসের শব্দটা আরও জোরে এবং পরিষ্কারভাবে হতে লাগল। কেউ নিশ্চয়ই ওখানে আছে। চাপা স্বরে গ্রিন বলল।
কেউ ওখানে আছে, কিন্তু কোথায়? ম্যারিয়ট বিস্মিত হয়ে বলল। আবার তার সঙ্গে ঘরে ঢোকবার জন্য জেদ ধরল। গ্রিন রাজি হলো না। বলল সে একবার ঘরে ঢুকে ভালো করে খুঁজে দেখেছে, কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পায়নি। অতএব, সে আর ভেতরে যাবে না।
ওরা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসার ঘরে ফিরে এল। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। ম্যারিয়ট বলল, সঠিক এবং যুক্তিসংগত একমাত্র যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হলো আমার হাতের ব্যথাটা। হাতটায় প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। কখন যে। চোট লেগেছিল কিছুই মনে করতে পারছি না।
গ্রিন বলল, দেখি তো তোমার হাত। ম্যারিয়ট কোটটা খুলে জামার হাতাটা গুটিয়ে ফেলল।
হায় ঈশ্বর! এ যে দেখছি রক্ত! সে চিৎকার করে উঠল। দেখো, দেখো, এটা কী?
হাতের কবজির কাছাকাছি একটা সরু লাল দাগ! তার ওপরে টাটকা রক্তের ফোঁটা। গ্রিন কাছে এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ সেটা খুঁটিয়ে দেখল। তারপর চেয়ারে বসে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বন্ধুর মুখ দেখতে লাগল। মন্তব্য করল অজান্তেই তুমি নখের আঁচড় কেটেছ।
কোনো চিহ্ন নেই তো! নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণে আমার হাতে এমন ব্যথা হচ্ছে।
ম্যারিয়ট নিশ্চল বসে একদৃষ্টে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন সব রহস্যের সমাধান হাতের চামড়ার ওপর লেখা আছে।
কি ব্যাপার? একটা আঁচড়ে অদ্ভুত কিছু আমি দেখছি না- নিরুত্তাপ স্বরে গ্রিন বলল। আর ওটা হয়তো তোমার আস্তিনের বোতামের দাগ। গতরাতে উত্তেজনাবশত
ম্যারিয়টের ঠোঁট দুটো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে কথা বলার চেষ্টা করল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। অবশেষে সে তার বন্ধুর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
মৃদু কম্পিত অনুচ্চ স্বরে সে বলল, দেখো, ঐ লাল দাগটা দেখছ? হাতের নিচের দিকে, যাকে তুমি আঁচড় বলছ?
এবার গ্রিন স্বীকার করল, কিছু যেন দেখেছে। ম্যারিয়ট রুমাল দিয়ে সেটা মুছে ফেলে আবার তাকে ভালো করে লক্ষ করতে বলল।
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটা একটা পুরোনো ঘায়ের দাগ।
এটা একটা পুরোনো ঘা! ফিসফিস করে ম্যারিয়ট বলল। ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে থরথর করে। এখন সবকিছু মনে পড়ছে।
সবকিছু কী? চেয়ারে বসে অস্থির হয়ে গ্রিন জিজ্ঞেস করল।
চুপ! আস্তে! আমি তোমাকে বলব। এ ক্ষত ফিল্ডেরই কীর্তি!
বিস্মিত হয়ে তারা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কারোর মুখে কোনো কথা নেই।
ঐ ক্ষত ফিল্ডেরই সৃষ্টি। অবশেষে ম্যারিয়ট একটু উঁচু গলায় পুনরাবৃত্তি করল।
ফিল্ড! তুমি বলছ-কাল রাতে?
না, কাল রাতে নয়–অনেক বছর আগে একটা ছুরি দিয়ে স্কুলে আমরা হাত কেটে একে অন্যের ক্ষতে রক্ত দিয়ে বদল করেছিলাম। সে এক ফোঁটা আমার হাতে ফেলেছিল, আমিও এক ফোঁটা তার–।
হায় ঈশ্বর, কিসের জন্য?
এটা একটা নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধন। আমরা পবিত্র অঙ্গীকার করেছিলাম, একটা চুক্তি। আমার এখন সব স্পষ্ট মনে পড়ছে। আমরা ভূতের গল্পের বই পড়তাম এবং শপথ করেছিলাম যে আগে মারা যাবে সে অন্যকে দেখা দেবে। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আজ থেকে সাত বছর আগে, এক ভীষণ গরমের। দুপুরবেলায় খেলার মাঠে কাজটা আমরা করি এবং একজন শিক্ষকের হাতে ধরা খাই। তিনি ছুরিটি কেড়ে নেন–
তাহলে তুমি বলতে চাইছ–গ্রিন তোতলাচ্ছে।
ম্যারিয়ট কোনো উত্তর দিল না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে সোফার ওপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। দুহাতে ঢাকল মুখ।
গ্রিন নিজেও একটু হতবাক। সে একা একা সমস্ত ব্যাপারটা আবার চিন্তা করতে লাগল। একটা ধারণা তার মাথায় এল, সে ম্যারিয়টের কাছে গিয়ে তাকে সোফা থেকে তুলল। আমি বলি কি ম্যারিয়ট, এতে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এটা অলীক কিছু হলে আমরা জানি কি করতে হবে। আর তা যদি না হয়, তবে আমরা বিষয়টিকে নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে পারি, তাই না?
ফ্যাকাসে মুখে গ্রিনের দিকে তাকিয়ে ম্যারিয়ট বলল, হয়তো তাই। কিন্তু আরেকটা কথা ভেবে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। ঐ বেচারা আত্মা
ঐ লোকটা তার প্রতিজ্ঞা রেখেছে-ব্যস, ব্যাপারটা মিটে গেল তাই না? ম্যারিয়ট মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
গ্রিন বলল, আচ্ছা, একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, তুমি কি নিশ্চিত যে সত্যিই সে খাওয়াদাওয়া করেছিল?
ম্যারিয়ট কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকে দেখে জানাল এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। সে শান্তভাবে কথা বলছিল। বলল, আমাদের খাওয়া শেষ হলে আমি নিজের হাতে সেগুলো সরিয়ে রেখেছি। ঐ আলমারির তৃতীয় তাকে পাত্রগুলো রাখা আছে। চেয়ারে বসেই ম্যারিয়ট দেখাল। গ্রিন উঠে গিয়ে পাত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখে মন্তব্য করল, যা ভেবেছি! এটা নিছকই মনের কল্পনা। খাবারগুলো কেউ ছোঁয়নি। এদিকে এসো, নিজের চোখে দেখে যাও।
তারা দুজনে তাকটা পরীক্ষা করে দেখল। বাদামি রঙের পাউরুটি পড়ে আছে, থালায় বাসি কেক, পাত্রে কমলালেবুর আচার যেমন রাখা হয়েছিল, তেমনি পড়ে রয়েছে, কেউ স্পর্শও করেনি। এমনকি ম্যারিয়টের গেলাসভর্তি মদও আগের মতোই রয়েছে।
গ্রিন বলল, তুমি কাউকে খাওয়াওনি, ফিল্ড কোনো খাবারও খায়নি, কিছু পানও করেনি। সে এখানে মোটেই ছিল না।
কিন্তু নিশ্বাস? চাপাগলায় ম্যারিয়ট জানতে চাইল।
গ্রিন উত্তর দিল না। সে ছোট শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ম্যারিয়টের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করল। সে দরজা খুলে কান পেতে কী যেন শুনল। কথা বলার দরকার হলো না। গভীর নিশ্বাসের শব্দ অবিরাম ভেসে আসছে। ম্যারিয়ট যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সামনের পড়বার ঘরে-সেখানেও শুনতে পাচ্ছিল শব্দটা।
গ্রিন দরজা বন্ধ করে ফিরে এল। সে এই বলে ব্যাপারটার উপসংহার টানল, একটা কাজই করার আছে। বাড়িতে চিঠি লিখে ফিল্ড সম্বন্ধে তুমি জেনে নাও। আর এ কদিন আমার ঘরে থেকে তোমার পড়াশোনা চালিয়ে যাও। আমার আলাদা বিছানা আছে, তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
বেশ রাজি আমি। এবার আমাকে পাশ করতেই হবে।
এ ঘটনার এক সপ্তাহ পরে ম্যারিয়ট তার বোনের কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেয়েছিল। চিঠির কিছু অংশ সে গ্রিনকে পড়ে শুনিয়েছিল, তার বোন লিখেছিল
…তুমি ফিল্ডের ব্যাপারে জানতে চেয়েছ। কিছুদিন আগে কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সে কোথাও না গিয়ে বাড়ির বেসমেন্টে আশ্রয় নেয়। ধীরে ধীরে অনশন করে প্রাণত্যাগ করে। …ওর বাড়ির লোকেরা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের বাড়ির পরিচারিকার কাছে একথা শুনেছি, সে আবার তাদের দারোয়ানের মুখে শুনেছে। ১৪ তারিখে ফিল্ডের মৃতদেহ দেখতে পায় তারা। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলেছে বারো ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু ঘটেছে।… ভয়ংকর দেখাচ্ছিল ফিল্ডকে…।
গ্রিন ঢোক গিলে বলল, তাহলে সে ১৩ তারিখেই মারা গেছে?
ম্যারিয়ট বলল, হুঁ।
ঠিক ওই রাতে সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল! ম্যারিয়ট আবার মাথা ঝাঁকাল।