সর্বনাশের কাছাকাছি
ধর্ষণ করে খুন
স্টাফ রিপোর্টারঃ শনিবার রাতে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের চিংড়িঘাটা এলাকায় ঝরনা সামন্ত (২২) নামে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। রবিবার ভোরে তরুণীটির মৃতদেহ খালপাড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মৃতদেহে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া গেছে। পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
রবিবারের ভোরবেলাটার গায়ে কেমন যেন ছুটির মেজাজ মাখানো ছিল। সমতল পিচের রাস্তায় মসৃণ বেগে রোলার স্কেস চালিয়ে যেতে-যেতে দ্বৈপায়নের ঠিক সেরকমটাই মনে হচ্ছিল।
রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। পাখিরা গাছের ঠিকানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ঘুমজড়ানো চোখে ডানা মেলে দিয়েছে খাবারের সন্ধানে। ওদের মিষ্টি ডাকের টুকরো দ্বৈপায়নের দারুণ লাগছিল। দু-পাশের বড়-বড় গাছের পাতায় এখনও কুয়াশা জড়ানো। শৌখিন সব বাড়ির লাগোয়া বাগান থেকে গোলাপ-গাঁদার হালকা গন্ধ দ্বৈপায়ন ঘ্রাণে টের পাচ্ছিল।
সল্ট লেক এলাকাটা এমনিতেই নির্জন। তার ওপর রবিবারের এই সাতসকালে এলাকাটাকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছিল। নিস্তব্ধ পরিবেশে দ্বৈপায়নের রোলার স্কেটল্স-এর চাকার ঘর্ঘর শব্দ কানে বাজছিল। আর রিবক-এর ট্র্যাক সুট ভেদ করে ঠান্ডা যেন ঢুকে পড়ছিল বুকের ভেতরে।
একটু দূরেই কাঠগোলাপ গাছটাকে দেখতে পেল দ্বৈপায়ন। গাছে বড়-বড় সাদা ফুল ফুটে আছে। কিছু ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়।
গাছের নীচে রিকশা-স্ট্যান্ড। সেখানে মাত্র একটি সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা চাদর মুড়ি দিয়ে প্রায় কবন্ধ সেজে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করছে।
একটা লাল রঙের হুন্ডাই গাড়ি হুস করে দ্বৈপায়নকে পেরিয়ে চলে গেল। ঠিক তখনই দূর থেকে কেউ ডেকে উঠল : দিপুদা, এবার ফিরে এসো।
রোলার স্কেটস-এ চলতে-চলতেই ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল দ্বৈপায়ন। অনেকটা দূরে হলদে রঙের ট্র্যাক সুট পরে অচ্যুত দাঁড়িয়ে রয়েছে। দ্বৈপায়নকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
দ্বৈপায়ন ওকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলল। তারপর ওর চলার গতি বাড়িয়ে দিল। সুইমিং পুল স্টপেজের কাছটায় ইউ বাঁক নিয়ে ও অচ্যুতকে লক্ষ করে ফিরে চলল। অচ্যুতের ডাকনাম মিমো, তবে দ্বৈপায়ন ওকে আদর করে গুটে বলে ডাকে। বছর ন-দশের সরল সাদাসিধে ছেলে। নারায়ণ দাস বাঙ্গুর স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। দ্বৈপায়নদের ঠিক উলটোদিকের ফ্ল্যাটেই ওরা থাকে।
গুটে ডাকাবুকো স্বাস্থ্যবান ছেলে। পড়ায় যত মন তার চেয়ে ঢের বেশি মনোযোগ খেলাধুলো আর টিভি সিরিয়ালে। যেমন, যেখানে যে-অবস্থায় থাকুক না কেন শক্তিমান সিরিয়ালটা ওর দেখা চাই-ই চাই। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ওর নিত্য চেঁচামেচি লেগে আছে।
রোজ ভোরবেলায় দ্বৈপায়ন পায়ে রোলার স্কেস লাগিয়ে প্র্যাকটিস করতে বেরোয়। মাসখানেক আগে হঠাৎ একদিন গুটে বায়না ধরে বসল ওকেও রোলার স্কেট করা শিখিয়ে দিতে হবে। তারপর থেকে দ্বৈপায়ন রবিবার আর ছুটির দিনে ভোরবেলা ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। না নিয়ে গেলেই বাচ্চা ছেলেটা কান্নাকাটি করে দ্বৈপায়নকে আঁচড়ে কামড়ে একেবারে অস্থির করে তোলে।
গুটের কাছে পৌঁছে থামল দ্বৈপায়ন। রাস্তার পাশে ঘাসের ওপরে বসে পড়ল। তারপর ফিতে খুলে পা থেকে রোলার স্কেস দুটোকে আলাদা করে ফেলল। গুটেকে কাছে ডাকল, আয়, এদিকে আয়–।
গুটে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল। দ্বৈপায়ন কাছে ডাকতেই ও মায়ের শেখানো মতো রাস্তার ডান দিক আর বাঁ দিকে একবার করে তাকাল–তারপর এক ছুটে দ্বৈপায়নের কাছে চলে এল। অধীর আগ্রহ নিয়ে ওর রোলার স্কেটস-এর দিকে তাকিয়ে রইল।
ট্র্যাক সুটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা চাবি বের করল দ্বৈপায়ন। একটা রোলার স্কেটের চেসিসের দুটো নাট খুলে চেসিসের দুটো টুকরোকে মুখোমুখি ঠেলে ছোট করে গুটের পায়ের মাপে নিয়ে এল। নাট দুটো আবার টাইট করে দিল চাবি দিয়ে। চারটে চাকার নাট ঠিকমতো টাইট আছে কিনা একবার পরখ করে নিল। তারপর গুটের কেস জুতো পরা ডানপায়ে রোলার স্কেটটা ফিতে দিয়ে ভালো করে বেঁধে দিল। অন্য স্কেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
এরপর প্র্যাকটিসের পালা।
গুটের হাত ধরে দ্বৈপায়ন ওর পাশে-পাশে হেঁটে চলল। আর গুটে ডান পায়ে ভর দিয়ে চাকা গড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে লাগল।
দিপুদা, আমার শিখতে কদিন লাগবে?
দ্বৈপায়ন সামান্য চিন্তা করার ভান করে তারপর বলল, এই ধর মাসদুয়েক।
তারপর বাপিকে বলব রোলার এস্কেট কিনে দিতে।
এস্কেট নয়–স্কেটস। হাসল দ্বৈপায়ন।
ওই হল। গুটে বলল, তোমার মতো জোনেক্স কোম্পানির কিনব।
কিনিস। এখন শেখায় মন দে। বডিটা একদম স্ট্রেট রাখ–ডানদিক বাঁদিকে হেলাবি না।
শিখতে-শিখতে সময় গড়াতে লাগল। রাস্তায় লোকজন আর গাড়ির সংখ্যা বাড়তে লাগল। একসময় দ্বৈপায়ন গুটেকে দাঁড় করিয়ে ওর পা থেকে রোলার স্কেটটা খুলে নিল। তারপর চেসিসটা নিজের পায়ের মাপে ঠিক করে নিয়ে দুটো স্কেটই পায়ে লাগিয়ে নিল।
এইবার গুটের হাত ধরে স্কেট করে চলতে শুরু করল দ্বৈপায়ন। ওর সঙ্গে তাল রাখতে গুটে ছুটে চলল। ওর দিকে তাকিয়ে দ্বৈপায়ন বলল, হাঁপিয়ে গেলে বলবি, স্পিড কমিয়ে দেব।
গুটে ছুটতে-ছুটতেই ঘাড় নাড়ল।
ঠিক তখনই নীলরঙের একটা মারুতি গাড়ি দ্বৈপায়নের ডান পাশে চলে এল, ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে লাগল।
দ্বৈপায়ন দেখল, গাড়িতে মাঝবয়েসি দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন? একজন স্টিয়ারিং এ, আর অন্যজন তার পাশে।
জানলার পাশে বসা ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, ভাই, সি.ই.-১৬৫টা কোথায় পড়বে বলতে পারেন?
সি.ই.-১৬৫ দ্বৈপায়নদের বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটা পাঁচতলা ফ্ল্যাট-বাড়ি, তাতে মোট দশটা ফ্ল্যাট আছে। এঁরা কাদের গেস্ট কে জানে!
দ্বৈপায়ন হাত নেড়ে ওঁদের বুঝিয়ে দিল, কীভাবে সামনের গোলচক্কর ঘুরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পাশ দিয়ে সি.ই.-১৬৫-তে পৌঁছতে হবে।
দ্বৈপায়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে মারুতিটা স্পিড নিয়ে বেরিয়ে গেল।
গুটে এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। গাড়িটা চলে যেতেই দ্বৈপায়নকে জিগ্যেস করল, দিপুদা, ওরা কাদের ফ্ল্যাট খুঁজছে? আমাদের?
না, না। এই সকালে কাদের ফ্ল্যাটে যাবে কে জানে! গুটের কদমছাঁট মাথায় আদর করে এক চঁটি মারল দ্বৈপায়ন ও নে, চল–। দেরি হয়ে গেলে বউদি আবার বকাবকি করবে।
গুটে হেসে বলল, মোটেই না। মা তোমাকে একটুও বকবে না। মা তোমাকে ভালোবাসে।
গুটের শেষ কথাটা দ্বৈপায়নকে যেন একটা ধাক্কা দিল।
বাড়ির কাছে এসে দ্বৈপায়ন দেখল, নীল মারুতিটা ওদের সদর দরজাতেই দাঁড়িয়ে আছে। গুটে শক্তিমান সিরিয়াল নিয়ে আপনমনে বকবক করে যাচ্ছিল। গাড়িটা দেখামাত্রই ও চুপ করে গেল। তারপর দ্বৈপায়নের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, গাড়িটা কী সুন্দর দ্যাখো! আমি বাপিকে বলেছি একটা নীল রঙের মারুতি কিনতে।
দ্বৈপায়ন ছোট্ট করে হু বলে পা থেকে রোলার স্কে খুলতে লাগল।
তিনতলায় গুটেদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে ও দেখল দরজা সামান্য খোলা। ফাঁক দিয়ে বসবার ঘর দেখা যাচ্ছে। সেখানে সোফায় মারুতি গাড়ির একজন ভদ্রলোক বসে আছেন।
দ্বৈপায়ন বউদি বলে ডেকে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তখনই ড্রইং স্পেসের সম্পূর্ণ ছবিটা ওর নজরে ধরা পড়ল।
নব্বই ডিগ্রি কোণে সাজানো দুটো সোফায় মারুতি গাড়ির দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের একজনের হাতে সিগারেট। ওদের সামনে আর-একটা সোফায় গুটের বাবা শান্তনু বসে আছে। তার ঠিক পিছনে গুটের মা সীমন্তিনী দাঁড়িয়ে।
দ্বৈপায়নের ডাকে সীমন্তিনী দরজার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। তখনই দ্বৈপায়ন খেয়াল করল সীমাবউদির মুখটা কেমন ফ্যাকাসে। মুখের সৌন্দর্যে আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠা আঁচড় কেটেছে।
গুটে মাকে দেখামাত্রই বলে উঠল, আজ অনেকটা শিখে গেছি। দু-মাস পর আমি রোলার এস্কেট কিনব। তাই না, দিপুদা?
দ্বৈপায়ন সীমার দিকে তাকিয়ে কেমন আনমনা হয়ে পড়েছিল। গুটের কথায় যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে বলল, হ্যাঁ, কিনিস। এখন ভেতরে যা হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে যা
সীমাও ছেলেকে ভেতরে যেতে বলল। ওদের দিন-রাতের কাজের মেয়ে বাসন্তী একটু দূরে রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। রং ময়লা। গায়ে রঙিন ফুল-ফুল ছাপা ফ্রক।
গুটে জুতো খুলে ওর কাছে চলে গেল।
দ্বৈপায়ন চলে আসতে যাবে, সীমন্তিনী ওকে ডাকল, দিপু, তুমি একটু থেকে যাও। তারপর সোফায় বসা অপরিচিত দুই ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করে ও চাপা গলায় বলল, ওঁরা পুলিশের লোক…সল্ট লেক থানা আর লালবাজার থেকে এসেছেন।
দ্বৈপায়নের ভুরু কুঁচকে গেল। ও সীমার আকুল মুখের দিকে দেখল। তারপর রোলার স্কেট-জোড়া দরজার একপাশে নামিয়ে রেখে ঢুকে পড়ল বসবার ঘরের এলাকায়।
সীমন্তিনী দ্বৈপায়নকে দেখিয়ে অপরিচিত দুই ভদ্রলাককে লক্ষ করে ইতস্তত করে বলল, ইনি দ্বৈপায়ন বসু–আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড–সামনের ফ্ল্যাটে থাকেন।
দ্বৈপায়ন একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল।
যে-ভদ্রলোক সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি কাঠ-কাঠ গলায় বললেন, আমার নাম অমল রায় সল্ট লেক থানা, সাউথ। আর ইনি– সঙ্গীর দিকে ইশারা করে ও বিজয় মিত্র–হোমিসাইড স্কোয়াড, লালবাজার। আমরা একটা ব্যাপারে শান্তনুবাবুকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি।
দ্বৈপায়ন সাদা-পোশাকের দুই অফিসারকে বেশ খুঁটিয়ে দেখল।
অমল রায়ের গায়ের রং কালো, চোয়াড়ে চেহারা, মাথায় সামনের দিক থেকে টাক পড়তে শুরু করেছে, চোখ ছোট-ছোট। সব মিলিয়ে কেমন একটা রুক্ষ ভাব।
ওঁর সঙ্গী বিজয় মিত্রের ব্যাপারটা ঠিক উলটো। বছর পঞ্চাশের মোটাসোটা ফরসা চেহারা, গোলগাল মুখে সবসময়েই এক টুকরো হাসি লেগে আছে, চোখে চশমা, মাথায় কেঁকড়ানো চুল, যথেষ্ট ভুড়ি আছে–দেখে মনে হয় ভোজনবিলাসী।
বাসন্তী ট্রে-তে করে চা-বিস্কুট দিয়ে গেল সবার জন্য। সীমন্তিনী অতিথিদের অনুরোধ করল, নিন, চা খান।
দ্বৈপায়নও চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিল। তারপর শান্তনুর দিকে তাকাল।
শান্তনুর বয়েস সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ হবে–দ্বৈপায়নের চেয়ে বছর আট-নয়ের বড়। স্টেট ব্যাঙ্কে ভালো চাকরি করে। তা ছাড়া মানুষটাও ভালো। সিগারেট আর তাস ছাড়া অন্য কোনও নেশা নেই। এই ফ্ল্যাটে এসেছে সাত-আট মাস। দ্বৈপায়নরা এই ফ্ল্যাট-বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা। তাই এই এলাকার যে-কোনও ব্যাপারে দ্বৈপায়নই ওদের গাইড।
কিন্তু পুলিশ হঠাৎ এখানে এসেছে কী ব্যাপারে?
সিগারেট শেষ করে অমল রায় টুকরোটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তারপর শান্তনুকে প্রশ্ন করলেন, আপনারা এ-ফ্ল্যাটে এসেছেন কতদিন?
মনে-মনে হিসেব কষে নিয়ে শান্তনু বলল, প্রায় সাড়ে সাত মাস।
আপনাদের ফোন কি নতুন এসেছে?
হ্যাঁ–সবে মাসখানেক পেরিয়েছে। শান্তনু সমর্থনের আশায় সীমার দিকে তাকাল।
সীমা ছোট্ট করে ঘাড় নেড়ে বলল, এখনও প্রথম বিল আসেনি।
আপনারা ফোন নাম্বার কাউকে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। নতুন ফোন এলে সেটাই তো স্বাভাবিক।
শান্তনুর কথায় যে-খোঁচা ছিল সেটা অমল রায় গায়ে মাখলেন না। বিজয় মিত্র টেবিলে রাখা খবরের কাগজের হেডলাইনের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিলেন। মনে-মনে কিছু ভাবছিলেন কি না বোঝা গেল না।
শান্তনুর দিকে না তাকিয়েই বিজয় মিত্র বললেন, একটা চিরকুটে আপনার নাম আর ফোন নাম্বার লিখে কাউকে দিয়েছিলেন?
শান্তনু কেমন যেন দিশেহারা হয়ে ভাবতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর ইতস্তত করে বলল, হয়তো দিয়েছি–স্পেসিফিক কিছু মনে পড়ছে না।
বিজয় মিত্র স্বাভাবিক গলায় সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বললেন, রায়, চিরকুটটা ওঁকে দেখান।
অমল রায় ব্যাজার মুখ করে তার ছাইরঙা জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। নিস্পৃহ মুখে খাম খুলে একটা চিরকুট বের করে এগিয়ে দিলেন শান্তনুর দিকে।
চিরকুট হাতে নেওয়ামাত্রই সবকিছু মনে পড়ে গেল শান্তনুর। ও মুখ ফিরিয়ে তাকাল দেওয়ালে ঝোলানো বড়-বড় তারিখ ছাপা একটা ক্যালেন্ডারের দিকে। ছবিহীন ক্যালেন্ডার, বারো মাসের জন্য বারোটা পৃষ্ঠা।
দ্বৈপায়ন গলা উঁচু করে চিরকুটের লেখাটা দেখতে চেষ্টা করল। শান্তনুর হাতের লেখা খুব সুন্দর। সেই সুন্দর হরফেই লেখা রয়েছে শান্তনু সেনগুপ্ত / ৩৩৭-৪৫৩৬।
ও শান্তনুকে উদ্দেশ করে চাপা গলায় বলল, শান্তনুদা, এটা তো আপনারই হাতের লেখা। কাকে লিখে দিয়েছিলেন মনে পড়ছে না?
শান্তনু মাথা নাড়লঃ হ্যাঁ, বেশ মনে পড়ছে। চিরকুটটা ওই ক্যালেন্ডরটার পাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ওখান থেকে একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়েছিলাম।
সঙ্গে-সঙ্গে সীমন্তিনীরও সবকিছু মনে পড়ে গেল। দ্বৈপায়ন লক্ষ করল, সীমার ফরসা মুখে হালকা গোলাপি ছোপ।
নাম আর ফোন নাম্বারটা কাকে লিখে দিয়েছিলেন? অমল রায় জিগ্যেস করলেন। তারপর চিরকুটটা শান্তনুর হাত থেকে নিয়ে উঠে গেলেন ক্যালেন্ডারটার কাছে। ছেঁড়া পাতাটা খুঁজে বের করে ওটা খাঁজে খাঁজে মিলিয়ে পরখ করে দেখলেন।
শান্তনু বলল, দিন পনেরো আগে আমার এক বন্ধু এ-বাড়িতে এসেছিল। এই চিরকুটটা আমি ওকে দিয়েছিলাম।
বন্ধুর নাম কী? বিজয় মিত্র নরম গলায় জানতে চাইলেন।
পলাশ–পলাশ সান্যাল।
অমল রায় বসবার ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাচ্ছিলেন। সিগারেট ঠোঁটে নিয়েই জড়ানো স্বরে জিগ্যেস করলেন, কীরকম বন্ধু?
কীরকম বন্ধু মানে? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল শান্তনু।
আহা, রাগ করছেন কেন, মিস্টার সেনগুপ্ত! বিজয় মিত্র পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেনঃ আমরা অ্যাকচুয়ালি আপনার বন্ধু সম্পর্কে একটু ইন্টারেস্টেড। তাই জানতে চাইছি। শুধু-শুধু এক্সাইটেড হচ্ছেন কেন?
অমল রায় ফিরে এসে সোফায় বসলেন এবং একইসঙ্গে মন্তব্য করলেন, এক্সাইটেড হয়েও তো কোনও লাভ নেই। আমরা আমাদের কাজ করবই। তারপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে? হ্যাঁ, মিস্টার সেনগুপ্ত, এবার বলুন–পলাশ সান্যাল সম্পর্কে আপনি কী জানেন?
শান্তনু একটা সিগারেট ধরাল। ওর মাথার ভেতরটা কেমন করছিল। পলাশ সম্পর্কে ও কতটুকু জানে?
ভালো করে ভাবতে গিয়ে দেখল, প্রায় কিছুই না। পলাশ মেট্রোপলিটন স্কুলে ওর সঙ্গে পড়ত। ক্লাসে পলাশের সঙ্গে ওর তেমন একটা বন্ধুত্ব ছিল না। তারপর, স্কুল শেষ হতেই, ছাড়াছাড়ি। বিশ-বাইশটা বছর কোথা দিয়ে যেন গড়িয়ে গেছে। পলাশকে শান্তনু একেবারে ভুলেই গিয়েছিল।
কিন্তু হঠাৎই সেদিন–মাসদেড়েক আগে সন্ধেবেলা উলটোডাঙা-ভি.আই.পি. রোডের মোড়ে পলাশের সঙ্গে আচমকা দেখা। শান্তনু পলাশকে একটুও চিনতে পারেনি। পলাশই ওকে নাম ধরে ডেকেছিল।
তারপর ফুটপাথের কিনারায় দাঁড়িয়ে স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প, স্যারদের গল্প। শেষ পর্যন্ত অচেনা মানুষটাকে শান্তনু পলাশ বলে মেনে নিয়েছিল।
কথায় কথায় শান্তনু ওকে নিজের বিয়ের কথা, নতুন ফ্ল্যাট কেনার কথা বলেছিল। বলেছিল, একদিন সময় করে মিসেসকে নিয়ে চলে আয়।
উত্তরে হেসে পলাশ বলেছিল, একাই আসব কারণ, আমার পিকিউলিয়ার জীবনটা এখনও একলা চলো রে।
শান্তনু ভাবেনি পলাশ সত্যি-সত্যিই ওর ফ্ল্যাটে আসবে।
কিন্তু পলাশ এসেছিল। প্রায় দু-ঘন্টা ছিল। হাসি-ঠাট্টা-গল্পে সীমা আর মিমোকে একদম মাতিয়ে দিয়েছিল। ও চলে যাওয়ার পর সীমা বলেছিল, তোমার বন্ধু খুব মজার। ওঃ, কতদিন পর প্রাণ খুলে হাসতে পারলাম।
পলাশকে ওরা সবাই আবার আসার জন্য বারবার করে বলেছিল। পলাশও কথা দিয়েছিল সুযোগ পেলেই আসবে। সীমা বলেছিল ফোন করে আসতে। কারণ, আগে থেকে জানা থাকলে ও পলাশকে রাতের খাওয়া খাইয়ে তবে ছাড়বে। পলাশ হেসে বলেছিল, সাহেবরা যাকে বলে ডিনার? বলেই হো-হো করে গলা ফাটানো হাসি। তারপর ও কথা দিয়েছে, আবার আসবে।
সেদিন দু-ঘণ্টা আড্ডার পর স্কুলের পলাশ সান্যালকে যেন ধীরে-ধীরে খুঁজে পাচ্ছিল শান্তনু। স্কুলের সেই রোগা ময়লা চেহারার লাজুক ছেলেটাকে ও যেন অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল।
তারপরই এখনকার পলাশের চেহারাটা ভেসে উঠল শান্তনুর চোখের সামনে। ভারী শরীর, মাথায় টাক, চোখে চশমা, কঁচাপাকা গোঁফ। ঘন-ঘন সিগারেট খায়। কারণে-অকারণে দরাজ গলায় হেসে ওঠে। সব মিলিয়ে বেশ দিলখোলা বলে মনে হয়। তবে শান্তনু স্পষ্ট লক্ষ করেছিল, চশমার কাচের আড়ালে পলাশের চোখের মণি বেশ সতর্ক আর চঞ্চল–সবসময়েই কী যেন খুঁজছে।
পলাশের সঙ্গে এত গল্প করেছে ওরা, কিন্তু ওর সম্পর্কে কিছুই জানা হয়নি–কোথায় থাকে, কোথায় চাকরি করে, বাড়িতে আর কে-কে আছে।
সীমন্তিনী দু-একবার সেসব প্রসঙ্গ তুলেছিল বটে, কিন্তু পলাশের অন্য সব কথাবার্তায় সেগুলো চাপা পড়ে গেছে।
নাকি পলাশ ইচ্ছে করে সেসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে?
কিন্তু কেন?
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে সীমন্তিনীর দিকে একবার তাকাল শান্তনু। তারপর নীচু গলায় বলল, ও…আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত…হঠাৎ রাস্তায় দেখা…প্রায় বিশ বছর পর। একদিন মাত্র এখানে এসেছিল…তেমন একটা কিছু…ইয়ে…মানে, জানা হয়নি।
অমল রায় ও বিজয় মিত্র এরপর নোট প্যাড বের করে শান্তনু আর সীমন্তিনীকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর দরকার মতো প্যাডে নোট নিতে লাগলেন।
দ্বৈপায়ন হতবাক হয়ে গোটা ব্যাপারটার নীরব সাক্ষী হয়ে রইল।
ওঁদের জিজ্ঞাসাবাদের ধকল শেষ হলে সীমা প্রশ্ন করল, পলাশদার কি কোনও অ্যাসিডেন্ট হয়েছে?
অ্যাসিডেন্ট! বিজয় মিত্র হেসে ফেললেন : আপনি যা ভাবছেন তা নয়, ম্যাডাম। সেরকম হলে আমরা ফোন করেই কাজ সেরে নিতাম, সাতসকালে কষ্ট করে এসে আপনাদের বিরক্ত করতাম না। মিত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেনঃ ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। একইসঙ্গে বিপজ্জনক..আপনাদের পক্ষে…।
দ্বৈপায়ন উৎকণ্ঠার শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিল। ও আর থাকতে না পেরে বলল, প্লিজ, ব্যাপারটা আমাদের খুলে বলুন।
বিজয় মিত্র অমল রায়ের দিকে তাকালেন, একটু সময় নিয়ে বললেন, রায়, আপনাকে তো সব বলেছি, আপনিই ব্যাপারটা ওঁদের খোলসা করে বলুন।
অমল রায় টেবিলে বারকয়েক টোকা মেরে মাথা নাড়লেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, মিস্টার সেনগুপ্ত, আপনারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন নিশ্চয়ই, কিন্তু একটা খবর খেয়াল করেছেন কি না জানি না। গত ছমাসে কলকাতায় তিন-তিনটে রেপ অ্যান্ড মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে, দ্বিতীয়টা কসবায়, আর শেষ ঘটনাটা মাত্র চারদিন আগের মানে, গত শনিবার রাতে ইস্টার্ন বাইপাসের চিংড়িঘাটা এলাকায় হয়েছে।
তিনটে ঘটনার মধ্যে এমন কিছু কিছু মিল আমরা খুঁজে পেয়েছি যাতে মনে হয় কাজটা একই লোকের। যেমন, তিনটে ঘটনাই ঘটেছে সন্ধের পর, রাতে। অবশ্য এটা নেহাতই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, এসব অপকর্ম অন্ধকারেই হবে। তবে দ্বিতীয় মিলটা বেশ অদ্ভুত। রেপ করে মার্ডার করার পর মার্ডারার মেয়েগুলোর পোশাক-আশাক আবার বেশ সময় নিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়েছে। এছাড়া তিনজনেরই গলায় আর গালে কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর প্রত্যেককে খুন করা হয়েছে গলা টিপে।
তিনজন ভিকটিমের গড় বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ। তিনজনেরই বেশ অ্যাট্রাকটিভ চেহারা ছিল। ফোরেনসিক রিপোর্টে তিনটে কেসের মধ্যে আরও অনেক সিমিলারিটি পাওয়া গেছে। তাই আমরা এই ডিসিশানে এসে পৌঁছেছি যে, তিনটে রেপ অ্যান্ড মার্ডার একই লোকের কাজ। এ-ব্যাপারে এখনও আমরা কাউকে ট্র্যাক ডাউন করতে পারিনি বলে লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াড বেশ অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে।
অমল রায় একটু থামলেন। সিগারেটে কয়েকবার গভীর টান দিলেন। অনুসন্ধানী নজরে শান্তনু, সীমন্তিনী আর দ্বৈপায়নকে জরিপ করলেন। যেন ওদের প্রতিটি অভিব্যক্তির খুঁটিনাটি মানে বুঝে নিতে চাইলেন। তারপর সামান্য কেশে নিয়ে কথায় খেই ধরে বলতে শুরু করলেন?
চিংড়িঘাটার কেসটা আপনাদের একটু বলি। যে-মেয়েটি মারা গেছে ঝরনা সামন্ত–ও কাছাকাছি একটা ঝুপড়িতে থাকত। গায়ের রং কালো হলেও চেহারা নজর কাড়ার মতো। সন্ধের পর ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে খালধারে বোধহয় শুকনো ডালপালা জোগাড় করতে গিয়েছিল কারণ, ওর সঙ্গে একটা বস্তা ছিল। আপনারা ওদিকটায় কখনও গেছেন কিনা জানি না, তবে জায়গাটা ভীষণ নির্জনতা ছাড়া ওখানে একটা খাল আছে, খালের ধারে অনেক আগাছা আর গাছের ভিড় জঙ্গলের মতন। সেদিন খালের বাঁদিকটায় কাছাকাছি একটা বিশাল জমির আগাছা সাফ করার জন্যে কিছু লেবার সেই আগাছায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ফলে দাবানলের মতো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল সেখানে। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা সেই আগুন দেখতে ভিড় করেছিল। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ঝরনা সেখানে ছিল। তখন সময় প্রায় সাড়ে ছটা হবে। শীতের সময়…বুঝতেই পারছেন, সাড়ে ছটা মানে বেশ অন্ধকার। তার ওপর আগুন নিভতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল।
সিগারেট শেষ হয়ে আসায় অমল রায় জ্বলন্ত টুকরোটা গুঁজে দিলেন অ্যাশট্রেতে। তারপর লম্বা করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আগুন নিভে যাওয়ার পর জায়গাটা আবার নির্জন অন্ধকার হয়ে যায়। তখন ঝরনা বোধহয় খালধারের দিকে চলে যায়। ব্যস, তারপর সব শেষ।
শান্তনু, সীমন্তিনী আর দ্বৈপায়ন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অমল রায়ের কথা শুনছিল। তিনি থামতেই দ্বৈপায়ন জিগ্যেস করল, কিন্তু শান্তনুদা এর মধ্যে এল কোত্থেকে?
সামান্য হাসলেন অমল রায়, তারপর বললেন, ডেডবডির শাড়ির ভাঁজে আমরা এই চিরকুটটা পেয়েছি। এটার কথা আমরা মিডিয়াকে ফ্ল্যাশ করিনি। এই সিরিয়াল কিলার ও রেপিস্টকে ধরার এটাই একমাত্র পজিটিভ ক্লু। এই সূত্র ধরেই কেসগুলো আমরা সম্ভ করতে চাই।
বিজয় মিত্র এবার মুখ খুললেন, আমাদের বিশ্বাস আপনার স্কুলের বন্ধু পলাশ সান্যালই হল আসল কালপ্রিট। আর তাকে ধরতে হলে আপনাদের সাহায্য আমাদের কাছে ভীষণ জরুরি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিত্র, তারপর ও ব্যস, এই হল পুরো গল্প।
সীমন্তিনীর মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। অর দ্বৈপায়নের বুকের ভেতরে গুড়গুড় করে যেন ঢাক বাজতে শুরু করল। পলাশ সান্যালকে ও কখনও দ্যাখেনি। কিন্তু একজন রেপিস্ট ও মার্ডারার শান্তনুদার স্কুলের বন্ধু এটা ভাবতেই ওর কেমন লাগছিল।
সীমা বিজয় মিত্রের কাছাকাছি এগিয়ে এল, অসহায়ভাবে জিগ্যেস করল, আমরা তা হলে এখন কী করব?
শান্তনু একমনে সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছিল, ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে ছিল সামনের খোলা জানলার দিকে। বোধহয় পলাশের নতুন অবিশ্বাস্য চেহারাটার কথা ভাবতে চাইছে।
টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা নাড়াচাড়া করতে করতে বিজয় মিত্র বললেন, মিস্টার সেনগুপ্ত, আমরা আপনাদের ওপর খুব ডিপেন্ড করছি। আপনি ফোন নাম্বারটা পলাশ সান্যালকে লিখে দিয়েছেন দিন পনেরো আগে, আর সেটা আমরা পেয়েছি মাত্র চারদিন আগে মার্ডার স্পটে। চিরকুটটা দশদিনেরও বেশি সময় ধরে কেন পলাশবাবুর পকেটে ছিল বলতে পারব না। তবে এটা খুবই অস্বাভাবিক যে, পলাশবাবুর কাছ থেকে ওটা চলে গেছে আসল মার্ডারারের কাছে, আর পলাশবাবু নির্দোষ। উঁহু মাথা নাড়লেন ঘন-ঘনঃ হি ইজ আওয়ার গাই। যেহেতু আমাদের কাছে আর কোনও ব্লু নেই তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথও নেই।
সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে শান্তনু এবার নড়েচড়ে বসল : কীসের অপেক্ষা?
পলাশ সান্যাল কবে আবার আপনাদের ফোন করে, বা আপনাদের বাড়িতে আসে– তার অপেক্ষা।
আপনার কী মনে হয় ও ফোন করবে বা আসবে?
আমার মন বলছে সে আসবে… চোখ তুলে সীমন্তিনীর দিকে একপলক তাকালেন বিজয় মিত্রঃ কারণ আপনার স্ত্রী সুন্দরী। কিছু মনে করবেন না, মিস্টার সেনগুপ্ত–রেপিস্টদের সাইকোলজি যা একটু-আধটু ঘেঁটে দেখেছি তাতে বুঝেছি ওদের মধ্যে মাঝে-মাঝে লোভ মাথাচাড়া দেয় সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গ পাওয়ার লোভ। কেউ-কেউ আবার হঠাৎ-হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। পলাশ সান্যাল কী টাইপের জানি না, তবে সে যদি যোগাযোগ করে তা হলে আমি মোটেই অবাক হব না।
চিরকুটটা তো ওর কাছে আর নেই। ফোন নাম্বারটা ওর কি মনে থাকবে? আমতা আমতা করে শান্তনু প্রশ্ন করল। ওর মুখের রং কিছুতেই ফিরে আসছে না।
থাকতেও পারে। হয়তো আগেই অন্য কোথাও টুকে রেখেছে।
যদি পলাশদা আবার ফোন করে বা হঠাৎ চলে আসে তা হলে কী করব? সীমন্তিনী ভয়ের গলায় জিগ্যেস করল।
দুটো ফোন নাম্বার আপনাদের দিচ্ছি। পলাশ সান্যাল এলে তাকে যে-কোনও ছলছুতোয় আটকে রাখবেন। আর এক ফাঁকে এই দুটো নাম্বারের একটায় আমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন। আমাকে না পেলে ফোনে আপনাদের নাম বলে মেসেজটা দিয়ে দেবেন–বলবেন ইমারজেন্সি– তা হলেই ওরা আমাকে মোবাইল নাম্বারে কনট্যাক্ট করে নেবে।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে তাতে ফোন নম্বরগুলো লিখলেন বিজয় মিত্র। তারপর কার্ডটা শান্তনুর হাতে দিলেন।
কার্ডটা নিতে গিয়ে শান্তনুর হাতটা সামান্য কেঁপে গেল। পলাশকে ও একজন ভয়ঙ্কর রেপিস্ট ও নৃশংস খুনি হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করল।
বিজয় মিত্র ও অমল রায় উঠে দাঁড়ালেন।
সকলেরই মুখ থমথমে–যেন এইমাত্র কোনও শোকসভা শেষ হল।
দরজার কাছে পৌঁছে সীমন্তিনীর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন বিজয় মিত্র। স্মিত হেসে বললেন, ভয় পাবেন না, মিসেস সেনগুপ্ত–আমরা তো আছি। তবে পলাশ সান্যালকে ধরাটা খুব ভাইটাল নইলে আরও বহু মেয়ের সর্বনাশ হবে। কারণ, লোকটার কোনও বাছবিচার নেই। ওর প্রথম ভিকটিমের বয়েস ছিল মাত্র ষোলো ফুটফুটে এক কিশোরী…।
সীমন্তিনীর কানে হঠাৎই এক অলৌকিক সাইরেন বেজে উঠল। ওর মাথাটা কেমন চক্কর দিল। তারই মধ্যে আবছাভাবে বিজয় মিত্রের শেষ কথাটা শুনতে পেল ও।
আপনাদের ওপরে আমরা খুব ডিপেন্ড করছি কিন্তু।
.
আরও কুড়িদিন কেটে যাওয়ার পর, শান্তনু আর সীমন্তিনী যখন ভাবতে শুরু করেছে। পলাশ আর কখনও যোগাযোগ করবে না, ঠিক সেই সময়ে পলাশের ফোনটা এল।
রোজ সকাল নটার মধ্যে শান্তনু অফিসে বেরিয়ে যায়। তখন একঘণ্টা সময় হাতে পায় সীমন্তিনী। তারপর, দশটা বাজলেই, ও গুটেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। রান্নার ঝামেলা সকালেই প্রায় মিটে যায়। যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু সীমা সেরে নেয় এগারোটার পর।
বসবার ঘরে বসে সীমা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে কুছ কুছ হোতা হ্যায় ছবির গান শুনছিল। বাসন্তী বাথরুমে কাপড় কাচছে কলের জল পড়ার আওয়াজ, কাপড় কাঁচার শব্দ, সবই শোনা যাচ্ছে এ-ঘর থেকে।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
টেপ রেকর্ডারের গানের কলি কানে আসছিল সীমার।
তুম পাস আয়ে
ইয়ু মুসকুরায়ে
তুমনে না জানে কেয়া
সপনে দিখায়ে…
ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ও যার কথা ভাবছে নিশ্চয়ই সে এসেছে।
দরজা খুলতেই সীমা দেখল ওর অনুমান সত্যি। দ্বৈপায়ন দরজায় দাঁড়িয়ে।
ওর মাথার আঁকড়া চুল এলোমেলো। ফরসা সজীব মুখে সরল হাসি। পরনে কউল জাতীয় কাপড়ের চেক-চেক টি-শার্ট আর নীল রঙের জিন্স। পায়ে রোলার স্কেস লাগানো। ওর শরীর চাবুকের মতো টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন যে-কোনও লড়াইয়ের জন্য তৈরি।
এসো, ভেতরে এসো–। দ্বৈপায়নকে ভেতরে ডাকল সীমন্তিনী। ওর বুকের ভেতরে উলটোপালটা কীসব হচ্ছিল যেন।
দ্বৈপায়ন চাকা গড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই সীমা দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর টেপটা অফ করে দিয়ে মজা করে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার, পায়ে চাকা লাগানো কেন?
দ্বৈপায়ন টেপের গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুন করল, কুছ কুছ হোতা হ্যায়। তারপর সীমার প্রশ্নের জবাবে বলল, বহুদিন চেষ্টার পর স্কেসে একটা নতুন কায়দা রপ্ত করেছি– সেটা তোমাকে দেখাতে এলাম।
কী কায়দা?
আমি নাম দিয়েছি ল্যাটো বনবন। এই দ্যাখো।
কথা শেষ হতে-না-হতেই দ্বৈপায়ন চাকা গড়িয়ে ডাইনিং স্পেস, করিডর আর বসবার ঘরে ঘুরতে লাগল। এইভাবে পথ চলে গতি বেশ খানিকটা বাড়তেই ও সীমার কাছাকাছি এসে এক পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। দ্বৈপায়নের শরীরটা অনেকটা ব্যালে নাচিয়ের মতো বনবন করে ঘুরতে শুরু করল।
বেশ কয়েক পাক ঘোরার পর দ্বৈপায়ন কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, সীমা কোনও কিছু না ভেবেই ওকে ধরে ফেলল।
দ্বৈপায়ন পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিল, আর খুব কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছিল সীমন্তিনীর নিটোল মুখ। ওর হাত দ্বৈপায়নের বাহু আঁকড়ে ধরেছে। টানা-টানা চোখে স্পর্শকাতর আকুতি।
দ্বৈপায়ন নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বলল, থ্যাংক য়ু, বউদি। দেখছি ল্যাটো বনবন টা এখনও আমার ভালো করে রপ্ত হয়নি।
সীমার ফরসা মুখে লালচে আভা। এক অদ্ভুত চোখে ও দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছিল। আগুনের হলকা টের পাচ্ছিল কানে–যেন রাবণের চিতা জ্বলছে।
সীমা নীচু গলায় বলল, তোমার জন্যে একটু মিষ্টি আনাই।
দ্বৈপায়ন বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সীমা বাসন্তী! বাসন্তী! বলে ডেকে উঠল। তারপর দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, মিষ্টিটা হচ্ছে তোমার ওই ল্যাটো বনবন এর প্রাইজ।
কাপড় কাচা ছেড়ে বাসন্তী হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল। সীমন্তিনীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে গেল মিষ্টি নিয়ে আসতে।
মিষ্টির দোকান অনেক দূরে। দ্বৈপায়ন জানে, বাসন্তীর মিষ্টি নিয়ে ফিরতে অন্তত কুড়ি পঁচিশ মিনিট লাগবে। ওর কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল।
বাসন্তী চলে যেতেই সীমা দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর এসে দাঁড়াল দ্বৈপায়নের মুখোমুখি। সরাসরি তাকিয়ে রইল ওর চোখে।
দ্বৈপায়ন অস্বস্তি পাচ্ছিল। সীমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল বারবার।
সীমা জিগ্যেস করল, দিপু, তোমার কাছে আমার কোনও দাম নেই?
আছে। ঘাড় নেড়ে বলল দ্বৈপায়ন।
তা হলে আমাকে নাম ধরে ডাকো।
দ্বৈপায়ন মাথা নীচু করে রইল।
ডাকো। নইলে আমার দিব্যি।
ইতস্তত করে দ্বৈপায়ন নীচু গলায় বলল, সীমা।
ওরকম না। পুরো নাম। সীমা জেদের সুরে বলল।
সীমন্তিনী। আলতো করে বলল দ্বৈপায়ন।
দ্বৈপায়নের গালে আঙুল ছোঁয়াল সীমা। ওর দিকে মুখ তুলে বলল, দিপু, তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
দ্বৈপায়নের চোখ জ্বালা করছিল, বুকের ভেতরে ষাঁড়ের লড়াই চলছিল, গলাটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল। ও কোনওরকমে অস্পষ্ট স্বরে বলল, হ্যাঁ, ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি, শান্তনুদাকে ভালোবাসি, গুটেকেও ভালোবাসি।
হাত সরিয়ে নিল সীমা। অভিমানের গলায় বলল, সবাইকে ভালোবাসার কথা বলছি না। আমি শুধু আমাকে ভালোবাসার কথা বলছি।
সেটা হয় না। নরম গলায় বলল দ্বৈপায়ন, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি–তবে সেটা একটু অন্যরকম ভালোবাসা। আমার কোনও লাভার নেই। কেউ-কেউ ইন্টারেস্ট দেখালেও আমার মনে ধরেনি। কিন্তু তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ। শান্তনুদার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হলে আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত। হয়তো তোমারটাও।
সীমন্তিনী কেঁদে ফেলল, নির্লজ্জভাবে জাপটে ধরল দ্বৈপায়নকে। ওর বুকের আড়াল থেকে গোঙানির মতো দিপু! দিপু! করে ডেকে উঠছিল বারবার।
সীমার ভারে দ্বৈপায়নের রোলার স্কেসের চাকা সামান্য গড়িয়ে যাচ্ছিল। একটা পা আড়াআড়িভাবে সামান্য ঘুরিয়ে দ্বৈপায়ন সেটা রুখে দিল। তারপর একটু সময় দিয়ে সীমাকে সোজা করে দাঁড় করাল। ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, সীমা, ভালোবাসা অনেক বড় ঠিকই, তবে বিশ্বাস বোধহয় তার চেয়েও বড়।
সীমা সামনের একটা সোফায় মাথা নীচু করে বসে পড়ল, বিড়বিড় করে বলল, তুমি যে কী করেছ আমাকে! আমি কিছুতেই নরমাল হতে পারছি না। সবসময় তোমার কথা মনে পড়ে, তোমাকে চোখের সামনে দেখতে পাই। কান্না চাপার চেষ্টা করল সীমা, তারপর ভেজা চোখ তুলে দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে বলল, দিপু, তুমি এত ভালো কেন? আমার কষ্ট তুমি বুঝতে পারো না?
দ্বৈপায়ন সীমায় কাছে সরে এসে বলল, বুঝতে পারি। পারি বলেই আমার কষ্টটাও তোমাকে বোঝাতে চাই।
কলিং বেল বেজে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল সীমা। দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিল দ্বৈপায়ন।
বাসন্তী মিষ্টি নিয়ে ফিরে এসেছে।
মিষ্টির বাক্সটা বাসন্তীর হাত থেকে নিয়ে দ্বৈপায়ন বাক্স খুলল। তারপর প্রাইজ খেয়ে নিলাম বলে একটা সন্দেশ টপ করে মুখে পুরে দিল।
বাক্সটা সীমার দিকে এগিয়ে দিয়ে জড়ানো গলায় ও বলল, এই নাও, বাকি প্রাইজগুলো গুটের জন্যে।
বাসন্তী দ্বৈপায়নের কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিল। সীমা একটা সন্দেশ বাসন্তীকে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নে।
সন্দেশটা নিয়ে সীমাকে বলে বাসন্তী বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আর ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল।
সীমা উঠে গিয়ে ফোন ধরল।
হ্যালো।
পলাশ সান্যাল বলছি। ও-প্রান্ত থেকে পলাশের হাসিখুশি স্বর শোনা গেল।
চোখের পলকে সীমার মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। এতদিন ধরে ও আর শান্তনু প্রতিটি মুহূর্তে পলাশের ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছে। শান্তনু রোজ অফিসে গিয়ে সকাল-বিকেল বাড়িতে ফোন করেছে। জানতে চেয়েছে, পলাশের ফোন এসেছে কি না। ওই দুই অফিসারের কাছে পলাশের ব্যাপারে সবকিছু শোনার পর শান্তনু এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, ও কিছুদিন অফিস কামাই করে বাড়িতে বসে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সীমা সেটা হতে দেয়নি। বহু তর্ক বিতর্কের পর ও শান্তনুকে অফিস যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করাতে পেরেছিল। ও বলেছিল, দ্বৈপায়ন যখন আছে তখন শান্তনুর অফিস কামাই করার দরকার নেই।
দ্বৈপায়নের বাবার ইলেকট্রনিক্সের বিশাল ব্যাবসা। ধর্মতলায় ওদের অফিস। দ্বৈপায়ন বি.এসসি পাশ করার পর বাবার সঙ্গে খানিকটা সময় ব্যাবসা দেখাশোনা করে, আর বাকি সময়টা নিজের মতো করে কাটায়। গত পনেরো বছর ধরে ও রোলার স্কেস পাগল। আর বছরচারেক হল কাছাকাছি এক বন্ধুর বাড়ির গ্যারেজে একটা জিমনাশিয়াম খুলেছে। সেখানে ইজি-ক্রাঞ্চ, ফ্লেক্সিবার, স্লিম ডিস্ক, টামি ট্রিমার, সুপার হাইট ইত্যাদি নানান ব্যায়ামের যন্ত্র রয়েছে। দ্বৈপায়ন সারাটা দিনই প্রায় রোলার স্কেট আর জিম নিয়ে মেতে থাকে। নেহাত বাবাকে শান্ত রাখতে ও ব্যবসার পিছনে কিছুটা সময় দেয়। এ ছাড়া ওর চলাফেরার সঙ্গী হল একটা মোটরবাইক। হয় মোটরবাইক নয় রোলার স্কেস চড়ে দ্বৈপায়ন সবসময় ঘুরে বেড়ায়। শান্তনু ওকে ঠাট্টা করে বলে, তোমার তো সবসময় হয় দু-চাকা নয় আট চাকা। ভগবান ভদ্রলোকের উচিত ছিল একেবারে গোড়া থেকেই পায়ে চাকা লাগিয়ে তোমাকে পৃথিবীতে পাঠানো।
বাজপাখির তাড়া খাওয়া চড়ুইয়ের মতো উদভ্রান্ত চোখে দ্বৈপায়নের দিকে তাকাল সীমা। ওই তো উৎকণ্ঠা-ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিপু। শান্তনু এই মুহূর্তে পাশে নেই তো কী হয়েছে! দিপু তো আছে!
কিন্তু পলাশের কথা আবার শুরু হতেই সীমন্তিনীর সব ভরসা যেন উবে গেল।
কী ব্যাপার, চুপ করে গেলে যে! চিনতে পারছ না নাকি! আমি পলাশ-তোমার বোকা বোকা হাজব্যান্ড শান্তনুর ক্লাসফ্রেন্ড।
সীমা সংবিৎ ফিরে পেল। দ্বৈপায়নের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ। চিনতে পারব না কেন! উঃ, কতদিন পর আপনি ফোন করলেন। কিন্তু…কিন্তু ও তো এখন নেই… অফিসে গেছে…।
আজ কাজের দিন, অফিসে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। ভরাট গলায় হাসল পলাশ ও সেইজন্যেই তো ওর সুন্দরী বউকে একা পেয়ে ফোন করছি। কেমন আছ তুমি, সীমন্তিনী?
শান্তনুকে দেখাশোনা করে বিয়ের আগে সীমায় কোনও প্রেমিক ছিল না। তবুও ওর মনে হল, পলাশের প্রশ্নের ধরনটা যেন প্রাক্তন প্রেমিকের মতো।
ও অস্বস্তি-ভরা সুরে কোনওরকমে জবাব দিল, ভালো আছি। আপনি?
টেলিফোনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল পলাশ ও আমি ভালো নেই। আমার মাথায় একটা পিকিউলিয়ার ব্যথা হয়…সেটা কদিন ধরে খুব উৎপাত করছে।
দ্বৈপায়ন সীমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। টেলিফোনের রিসিভারের কাছে কান পেতে ও-প্রান্তের কথা শুনতে চেষ্টা করল।
সীমা তখন টেলিফোন নম্বর লেখা চিরকুটটার কথা ভাবছিল। ওটা তো পলাশ হারিয়ে ফেলেছে! তা হলে এখন ফোন করল কেমন করে? নম্বরটা কি ও মুখস্থ করে নিয়েছিল? নাকি অন্য কোথাও টুকে রেখেছিল?
এইসব ভাবতে-ভাবতেই সীমন্তিনীর মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল কথাটা।
আমাদের ফোন নাম্বারটা আপনার মনে ছিল?
কেন? একথা বলছ কেন? পলাশ অবাক হয়ে জানতে চাইল।
চিরকুটটা তো আপনি হারিয়ে ফেলেছেন–। কথাটা মুখ দিয়ে বেরোনোমাত্রই সীমায় বুকের ভেতরে আচমকা যেন বাজ পড়ল।
ও-প্রান্তে পলাশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আরও অবাক হয়ে সন্দেহের গলায় জিগ্যেস করল, ওটা হারিয়ে গেছে তুমি জানলে কেমন করে?
শীতের মধ্যেও সীমায় কপালে ঘামের বিন্দু ফুটে উঠল। ওর বুকের ভেতরে বরফের মতো ঠান্ডা জটিল জলস্রোত ঘুরপাক খেতে লাগল। ও অসহায়ভাবে দ্বৈপায়নের দিকে তাকাল। দ্বৈপায়ন
ওকে তাড়াতাড়ি জবাব দেওয়ার জন্য ইশারা করল।
সীমা কোনওরকমে বলল, ক্যালেন্ডারের পাতা ছেঁড়া ওইটুকুন এটা চিরকুট…আমি…আমি জানতাম ওটা হারিয়ে যাবে। তাই…ইয়ে..আন্দাজে বললাম। কেন, সত্যি-সত্যি হারিয়ে ফেলেছেন বুঝি?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর পলাশ জবাব দিল, হু…তুমি ঠিকই ধরেছ। ওটা হারিয়ে ফেলেছি। তবে কোথায় যে হারালাম…কে জানে!
দ্বৈপায়ন সীমার বাহুতে হাত রাখল। টের পেল সীমা ভয়ে কাঁপছে। ও সীমাকে ছুঁয়ে থেকে ভরসা দিতে চাইল। ওর কানের খুব কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওঁকে বাড়িতে আসতে বলো। মনে নেই সেদিন অমল রায় কী বলে গেলেন! কুইক…।
সীমা কোনওরকমে হেসে বলল, প্রথমদিন আলাপ করেই বুঝেছিলাম আপনি খুব ভুললামনের মানুষ। সেই যে চলে গেলেন আর কোনও পাত্তাই নেই! কবে আসছেন বলুন। আপনাকে খাওয়ানোটা তো এখনও বাকি থেকে গেল সাহেবরা যাকে বলে ডিনার।
ও-প্রান্তে হেসে উঠল পলাশ। সীমার মনে হল, ও যেন আগের চেয়ে অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
পলাশ বলল, তোমাদের ওখানে যাব তো নিশ্চয়ই…তবে আজ নয়। কোনও চিন্তা নেই তোমার–ফোন করে যাব।
সীমা হঠাৎই ছোট মেয়ের মতো বায়নার সুরে বলল, না, না, ওরকম বললে হবে না। আজকেই কথা দিতে হবে কবে আসছেন।
সীমা দিনক্ষণটা জানতে চাইছিল। সেটা জানতে পারলে পুলিশের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করতে সুবিধে হবে। উৎকণ্ঠার মধ্যেও দ্বৈপায়নের আশ্বাস ওর ভালো লাগছিল।
পলাশ হেসে বলল, তোমাকে কথা দিচ্ছি যাব, তবে কবে কখন যাব এক্ষুনি হুট করে বলতে পারছি না। মাথার ব্যথাটা বড্ড ট্রাবল দিচ্ছে। যাকগে, শান্তনুকে বোলো আমি ফোন করেছিলাম। হঠাৎই ফোন রেখে দিল পলাশ।
বিমূঢ় ভয়ার্ত চোখে দ্বৈপায়নের দিকে তাকাল সীমন্তিনী।
দ্বৈপায়ন তখন পলাশ সান্যালের চেহারাটা সামনে দেখতে পাচ্ছিল। পুলিশ অফিসারদের কাছে পলাশের চেহারার বর্ণনা দিয়েছিল শান্তনু। তখন থেকেই ওর একটা ছবি তৈরি হয়েছে দ্বৈপায়নের মনে। সেই টাকমাথা ভারী চেহারার লোকটাকে ওর ভয়ঙ্কর এক শত্রু বলে মনে হচ্ছিল।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে দ্বৈপায়নের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সীমা জিগ্যেস করল, কী করব এখন?
খুব সিম্পল। শান্তনুদাকে অফিসে ফোন করে খবরটা জানাও। তারপর লালবাজারে ফোন করে বিজয় মিত্রকে জানাও। দরকার হলে ওঁরা তোমাদের ফোন ট্যাপ করবেন। বুঝতেই পারছ, পলাশ সান্যাল ইজ আ ভেরি ডেঞ্জারাস ম্যান।
সীমা তাড়াতাড়ি ফোন নম্বরগুলো খুঁজে বের করল। দ্বৈপায়ন ওর হয়ে ডায়াল করে দিল। শান্তনু খবরটা শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সীমা ওকে ভরসা দিল। বলল, দ্বৈপায়ন আছে, ভয়ের কিছু নেই। ও এখন স্কুল থেকে মিমোকে নিয়ে আসতে যাচ্ছে।
লালবাজারে ফোন করে বিজয় মিত্রকে পাওয়া গেল। তিনি শান্তস্বরে জানালেন, দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। ওঁরা পুলিশের আর্টিস্ট দিয়ে পলাশ সান্যালের একটা ছবি আঁকিয়ে রাখছেন। সেটা শান্তনুদের দিয়ে চেক করিয়ে ফাইনাল করবেন। তারপর সেরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে টিভিতে ছবিটা প্রচার করে পলাশ সান্যালের খোঁজ করবেন। শুধুমাত্র সন্দেহ বা অনুমানের ওপরে নির্ভর করে এক্ষুনি টিভি ব্রডকাস্টে যাওয়া ঠিক হবে না।
আর টেলিফোন ট্যাপ করার ব্যাপারে বিজয় মিত্র বললেন, পলাশ সান্যাল তো রেগুলার আপনাকে ফোন করছে না। রেগুলার আপনাদের ফোন করা শুরু করলেই আমাদের জানাবেন– তখন লাইন ট্যাপিং-এর ব্যবস্থা করব। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিজয় মিত্র ও ট্যাপ করেও তেমন একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। দেখব হয়তো পাবলিক ফোন কি এস.টি.ডি. বুথ থেকে ফোন করছে। ও.কে., মিসেস সেনগুপ্ত, রাখছি।
ফোন রেখেই হাতঘড়ির দিকে তাকাল সীমা। তাকিয়েই আঁতকে উঠল। ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। ছুটির সময় ওর যেতে দেরি হলে মিমো ভীষণ ঝামেলা করে।
বাসন্তীকে বলে দ্বৈপায়নের সঙ্গেই ও ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে এল। ছোট্ট করে দ্বৈপায়নকে জিগ্যেস করল, তুমি সঙ্গে যাবে নাকি?
দ্বৈপায়ন রোলার স্কেটসটা পা থেকে খুলতে খুলতে বলল, যেতে ইচ্ছে করছে, তবে উপায় নেই। সাড়ে দশটায় ড্যাডির সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। না গেলে ড্যাডি খুব খেপে যাবে। সন্ধের পর বরং আসব।
সীমা সিঁড়ি নামতে যাচ্ছিল, পিছন থেকে দ্বৈপায়ন বলল, আর-একবার নাম ধরে ডাকব?
সীমা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও চকিতে চোখ বুলিয়ে সিঁড়ির ওপর। নীচটা দেখল। কেউ নেই। তখন ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
দ্বৈপায়ন জিগ্যেস করল, পুরো নাম?
সীমা হেসে ঘাড় কাত করল।
সীমন্তিনী–। আলতো করে ডাকল দিপু। তারপরই ওদের ফ্ল্যাটের দরজায় নক করল ঠকঠক করে।
দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে কিশোরী হয়ে হাসল সীমা। তারপর যেন হাওয়ায় ভেসে সিঁড়ি নামতে শুরু করল। দ্বৈপায়নের আলতো ডাকটা ওকে রেশমের শাড়ির মতো সর্বক্ষণ জড়িয়ে রইল। মিমোর স্কুলে পৌঁছনো পর্যন্ত সেই ডাকটা ও শুনতে পাচ্ছিল।
.
একদিন সন্ধ্যায় শান্তনুদের ফ্ল্যাটে পলাশ সান্যাল এসে হাজির হল আগাম কোনও খবর দিয়েই।
পলাশ শেষ যেদিন ফোন করেছিল তারপর সাত-সাতটা দিন সহজ-সরলভাবে কেটে গেছে। শান্তনুরা আবার ভাবতে শুরু করেছিল পলাশ আর কোনওদিনই ওদের বাড়িতে আসবে না। সীমন্তিনী এও ভাবতে শুরু করেছিল, পলাশ হয়তো সত্যি-সত্যিই অপরাধী নয়–পুলিশ মিছিমিছি ওকে সন্দেহ করছে।
ঠিক এরকমই একটা নিশ্চিন্ত অবস্থার মাঝে পলাশ এসে হাজির হল। এবং প্রমাণ করে দিল, বিজয় মিত্র বা অমল রায়ের ধারণায় কোনও ভুল ছিল না।
সীমন্তিনী সেদিন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অথচ তার আগে ও, শান্তনু আর দ্বৈপায়ন মিলে কত পরিকল্পনাই না করেছে।
পলাশ এলে কীভাবে ওরা বিজয় মিত্রকে খবর দেবে। শান্তনু যদি বাড়ি না থাকে তা হলে সীমা কী করে ওকে বোঝাবে যে, পলাশ ওদের ফ্ল্যাটে আছে। পলাশ এলে দ্বৈপায়নকেও খবরটা জানানো দরকার–ওকে কীভাবে জানানো হবে। মিমোকে একমাসের জন্য ছোটমাসির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কি না। এইরকম নানান জল্পনা কল্পনায় শান্তনুদের দিন কেটেছে। কিন্তু কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরই ওদের সব ভাবনা থিতিয়ে গেছে। পলাশ সান্যালকে মনে হয়েছে। অন্য কোনও গ্রহের মানুষ। আর অমল রায় ও বিজয় মিত্র যেন শান্তনুদের নয়, অন্য কারও ফ্ল্যাটে এসেছিলেন।
পলাশ যেদিন এল সেদিনটা ছিল শনিবার। অন্য আর-পাঁচটা দিনের মতোই দিনটা শুরু হয়েছিল।
গুটের সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। কিন্তু সোমবারে ক্লাস টেস্ট আছে বলে ওকে দ্বৈপায়নের সঙ্গে ভোরবেলা সীমা বেরোতে দেয়নি। তা ছাড়া আগের দিন বাংলা আর অঙ্ক পরীক্ষা ভালো হয়নি বলে সীমার মেজাজটাও খারাপ ছিল।
দ্বৈপায়ন জিমে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় একবার হাতঘড়ি দেখল। সওয়া দশটা বাজে। সীমাদের ফ্ল্যাট থেকে গুটের হুল্লোড়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। কী ভেবে দ্বৈপায়ন সীমাদের ফ্ল্যাটে নক করল।
একটু পরেই সীমার গলা শোনা গেল : কে?
মজা করার জন্য দ্বৈপায়ন গলার স্বর সামান্য বদলে নিয়ে বলল, আমি…পলাশ…।
সঙ্গে-সঙ্গেই ও খেয়াল করল, দরজার ওপাশে ম্যাজিক আই-এ চোখ রেখেছে সীমা। তারপরই দরজা খুলে এরকম সাঙ্ঘাতিক ঠাট্টা করার কোনও মানে হয়! এসো– বলে দ্বৈপায়নকে ঘরে ডেকেছে।
ঘুরে ঢুকেই দ্বৈপায়ন গুটেকে দেখতে পেল।
একটা টেবিলক্লথ পিঠের দিকে ঝুলিয়ে গলায় বেঁধে নিয়েছে। কোমরে একটা বেলট। বুকের কাছে ঝুলছে শক্তিমান-এর একটা পোস্টার। হাতে লম্বা একটা স্কেল।
এই অদ্ভুত সাজসজ্জাসমেত বাচ্চাটা চেয়ার থেকে টেবিলে, টেবিল থেকে সোফায়, সোফা থেকে মেঝেতে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আর একইসঙ্গে আমি শক্তিমান! আমি শক্তিমান! বলে চেঁচাচ্ছে।
মিমো, তোমাকে তখন থেকে কিন্তু বলছি এবার থামো। ওসব জঞ্জাল রেখে পড়তে বোসো।
দ্বৈপায়ন বুঝল সীমা ছেলের ওপর বেশ রেগে গেছে। ওকে ঠান্ডা করার জন্য দ্বৈপায়ন হেসে বলল, খেলছে একটু খেলুক না–।
তার মানে! ভ্রূকুটি করে দ্বৈপায়নের দিকে তাকাল সীমা : তুমি জানো, আগের দুটো টেস্টে বেঙ্গলি আর ম্যাথুস-এ ও কী করেছে!
দ্বৈপায়ন দু-হাত নেড়ে হেসে বলল, কী আর করবে! বড়জোর একটু কম নম্বর পেয়েছে, এই তো!
সে হলে তো হতই! অঙ্ক পরীক্ষায় দিয়েছিল A-র মালিক আয় বারোশো টাকা, B-র মাসিক আয় তেইশশো টাকা..এইসব দিয়ে একটা সোজা অঙ্ক দিয়েছিল। তো তোমার গুটে সে-অঙ্ক ছেড়ে দিয়েছে। জিগ্যেস করলাম, এই সোজা অঙ্কটা করলি না কেন। তাতে ও কী জবাব দিল জানো? বলল, ইংরেজি অঙ্ক আমি শিখেছি নাকি! ওই যে, ক-খ-গ-র বদলে A-B-C দিয়েছে!
দ্বৈপায়ন তো গুটের কীর্তি শুনে হেসেই অস্থির।
সীমা গুটেকে আবার ধমকে উঠল, মিমো, ওসব রেখে শিগগির পড়তে বোস কিন্তু! নইলে আমি কিন্তু…।
আঃ, বউদি কী হচ্ছে! সীমাকে থামাল দ্বৈপায়ন। তারপর গুটেকে কাছে ডাকল ও অ্যাই, এদিকে আয়–।
গুটে শক্তিমান! বলে এক তীব্র হাঁক ছেড়ে লাফ দিয়ে দ্বৈপায়নের কাছে এসে হাজির হল। ওকে দেখে মনেই হল না, মায়ের কথাগুলো ওর বিন্দুমাত্রও কানে ঢুকেছে। সীমা রেগে গিয়ে ওর কান মুলে দিল।
গুটে অসন্তুষ্ট হয়ে সীমার দিকে তাকাল, গজগজ করে বলল, সবসময় খালি আমাকে মারবে।
ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। দ্বৈপায়নের সামনে কান মুলে দেওয়ায় ব্যাপারটা ওর যথেষ্ট প্রেস্টিজে লেগেছে।
সীমা রাগি চোখে ছেলের দিকে একবার তাকাল। তারপর দ্বৈপায়নকে বলল, এবারে ওর বাংলা পরীক্ষার কীর্তি শোনো।
এ কথা বলামাত্রই গুটে সীমাকে একেবারে জাপটে ধরল। ওই অবস্থায় প্রায় লাফাতে লাফাতে বলল, না, না–দিপুদাকে কিছুতেই বলবে না। কিছুতেই না। আমি রোজ মন দিয়ে পড়ব।
কিন্তু সীমাও তখন বেশ রেগে গেছে। ও গুটেকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, শোনো, বাংলায় ও কী করেছে। কোয়েশ্চেন দিয়েছিল, তোমার যে সবচেয়ে প্রিয় তার সম্পর্কে দশ লাইন লেখো। তাতে ও কী লিখে এসেছে জানো! লিখেছে : আমার সবচেয়ে প্রিয় গরু…, তারপর গরু রচনা থেকে দশ লাইন মুখস্থ লিখে দিয়েছে–ওটা তৈরি ছিল, তাই।
দ্বৈপায়ন হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে একটা সোফায় বসে পড়ল। আর গুটে দিপুদাকে বললে কেন? দিপুদাকে বললে কেন? বলতে-বলতে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মায়ের কাছে গিয়ে ছোট্ট হাতে বারকয়েক কিল মারার চেষ্টা করল। তারপর একছুটে চলে গেল শোওয়ার ঘরের দিকে।
দ্বৈপায়ন ওকে অনেকবার ডাকল, কিন্তু ও শুনল না।
গুটের কাণ্ড শুনে দ্বৈপায়ন অনেকক্ষণ ধরে হাসল। তারপর সীমাকে বলল, বউদি, গুটেকে মারধোর কোরো না, বুঝিয়ে বলো, ঠিক বুঝবে।
আর বুঝেছে! শক্তিমানের ছবিটা ওর প্রাণ। দিন-রাত ওটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ওপর তোমার রোলার স্কেটস তো আছেই।
গুটেকে দ্বৈপায়ন খুব ভালোবাসে। প্রথম পরিচয়ের পর বাচ্চা ছেলেটা ওকে কাকু বলে ডাকত। দ্বৈপায়ন তখন ওকে বারণ করেছিল। বলেছিল দিপুদা বলে ডাকতে। কাকু ডাকটা ওর কেমন যেন কানে লাগত। দ্বৈপায়নের বউদি ডাকটাও কি সীমন্তিনীর কানে লাগে?
দ্বৈপায়ন ওদের তিনজনের কথাই ভাবছিল। মাত্র ছমাসের মধ্যেই কী অদ্ভুতভাবে ও ওদের আপনজন হয়ে উঠেছে। তেমনি ওরাও। ওদের গায়ে কোনও আঁচড় পড়লে দ্বৈপায়ন সেই জ্বালা টের পায়। ওদের সংসারে মেঘ ঘনিয়ে এলে দ্বৈপায়নের বুকের ভেতরে বৃষ্টি হয়। এ কোন অলৌকিক সম্পর্ক কে জানে!
ঠিক আছে, রোলার স্কেটস কদিন না হয় বন্ধ রাখব। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল ও ও দেখি, গুটেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পড়তে বসাই। বাচ্চাদের সবসময় এরকম মারধোর করলে হয়!
দ্বৈপায়ন ভেতরের দিকে রওনা হতেই টেলিফোন বেজে উঠল। সীমা তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোন ধরল। পলাশের ভয় এ কদিনে থিতিয়ে এলেও রিসিভার তোলার সময় সীমার হাত কেঁপে গেল।
হ্যালো।
মিসেস সেনগুপ্ত বলছেন? ও-প্রান্ত থেকে ভারী গলায় কেউ বলল।
হ্যাঁ..আপনি?
বিজয় মিত্র, লালবাজার।
সীমার বুক ঠেলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। ও আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করল, বলুন, কোনও খবর আছে?
সীমা ভাবছিল, পলাশ সান্যাল হয়তো এর মধ্যেই পুলিশে ধরা পড়ে গেছে।
ও-প্রান্তে বিজয় মিত্র হাসলেনঃ এদিকে নতুন কোনও খবর নেই। তাই আপনার কাছে খবর চাইছি।
সীমা কেমন স্তিমিত হয়ে গেলঃ নাঃ, এর মধ্যে আর ফোন করেনি।
দ্বৈপায়ন গুটেকে নিয়ে কখন যেন বসবার ঘরে চলে এসেছে। বাচ্চাটা শক্তিমানের ধড়াচূড়া সব ছেড়ে এলেও কার্ডবোর্ডে সাঁটা ছবিটা এখনও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে।
মিসেস সেনগুপ্ত, পলাশ সান্যালের স্কেচটা কাল সন্ধেবেলা আপনাদের দেখাতে নিয়ে যাব। আর্টিস্টও সঙ্গে যাবে। আপনারা থাকবেন কিন্তু।
থাকব। ছোট্ট করে বলল সীমা।
আমার দেওয়া ফোন নাম্বার দুটো মনে আছে তো?
সীমা জানাল, হ্যাঁ, আছে।
কোনওরকম ইমারজেন্সি হলেই আমাকে রিং করবেন। বিজয় মিত্র ফোন রেখে দিলেন।
সীমা রিসিভার নামিয়ে রেখে দ্বৈপায়নের দিকে তাকাল। ওর চিন্তা পলাশ সান্যালকে ঘিরে পাক খেতে শুরু করল।
দ্বৈপায়ন জিগ্যেস করল, কে ফোন করেছিল, বউদি?
সীমা অন্যমনস্কভাবে বলল, সেই পুলিশ অফিসার–বিজয় মিত্র।
কী ব্যাপার বলো তো? কী ভাবছ?
সীমা অসহায়ভাবে বলল, পলাশ সান্যাল যদি কখনও হঠাৎ করে চলে আসে তখন তুমি যদি কাছে না থাকে, তা হলে তোমাকে জানাব কেমন করে? তোমার দাদা যা ছাপোষা মানুষ! ওরকম ডেঞ্জারাস একজন মার্ডারারের সঙ্গে পেরে উঠবে না।
কে মার্ডারার, মা? গুটে কৌতূহলে জানতে চাইল।
সীমা ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, চুপ কর। সব ব্যাপারে ফোড়ন কাটা চাই!
আহা, ওকে বকছ কেন! বলে দ্বৈপায়ন গুটের মাথার ছোট-ছোট চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, এসব বড়দের ব্যাপার, তুই বুঝবি না। তারপর সীমার দিকে ফিরে ও বউদি, তোমাকে তো আগেও বলেছি, আমাকে ঘরে নয় অফিসে একটা ফোন করে দেবে। আর আমি তো মাঝেমধ্যে ফোন করে তোমাদের খবর নিই। এত ভয় পেলে কখনও চলে! তুমি বরং বিজয়বাবুর দেওয়া ফোন নাম্বার দুটো আমাকে দাও–আমি লিখে নিই।
সীমা তাড়াতাড়ি ফোন নম্বর দুটো খুঁজে বের করে একটা চিরকুটে টুকে দ্বৈপায়নকে দিল।
ওটা পকেটে রেখে দ্বৈপায়ন বলল, শান্তনুদার সঙ্গে স্কুলের আর কোনও বন্ধুর কোনও কনট্যাক্ট নেই?
সীমা বলল, সুজিত আর পার্থ নামে দুজনের সঙ্গে আছে। ওদের অনেকদিন আগেই ও জিগ্যেস করেছিল। পলাশ সান্যাল নামটাই ওরা মনে করতে পারছে না।
দ্বৈপায়ন ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুমি ভয় পেয়ো না। কেউ দরজায় নক করলে বা বেল টিপলে আগে ম্যাজিক আই দিয়ে দেখে নেবে। তবে পলাশ সান্যাল এলে তাকে যেন আবার দরজা থেকে বিদেয় করে দিয়ো না। লোকটা অ্যারেস্ট হওয়া দরকার। নয়তো আরও অনেকের সর্বনাশ করবে। তোমাকে একটিই রিকোয়েস্ট, কিছুতেই যেন নার্ভ ফেল কোরো না।
চলে যাওয়ার আগে দ্বৈপায়ন গুটের মাথায় একটা চাটি মেরে গেল। আর সীমাকে বলে গেল, তোমার ভয় কীসের, বউদি! আমি তো আছি।
এর ঠিক আট ঘণ্টা পরে, সন্ধে সাতটা নাগাদ, পলাশ সান্যাল যখন এল তখন দ্বৈপায়নের শেষ কথাগুলো সীমন্তিনীর সবচেয়ে আগে মনে পড়ল।
.
ম্যাজিক আই দিয়ে আগন্তুকের পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। শুধু শক্ত চোয়াল, গলা, আর কাঁধের খানিকটা অংশ চোখে পড়ছে। তামাটে গলায় দুটো কালো ভাঁজ, দু-চারটে কাঁচা পাকা দাড়ির খোঁচা, সাদা-নীল স্ট্রাইপ দেওয়া কলার, আর হালকা সবুজ সোয়েটার।
দরজা খুলে দেওয়ার মুহূর্তেও সীমন্তিনী ভাবতে পারেনি অতিথি পলাশ সান্যাল হতে পারে। সেই কারণেই দরজা খুলে ভিনগ্রহের মানুষটাকে দেখে ও চমকে উঠল। ওর মুখ থেকে রক্ত সরে গেল পলকে।
পলাশ অবাক হলেও হেসে বলল, কী ব্যাপার! তুমি যে ভূত দেখার মতন চমকে উঠলে!
ষষ্ঠ অথবা সপ্তম ইন্দ্রিয়ের কবলে পড়ে সীমা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছিল। ও অসহায়ভাবে দেখল, পলাশ সান্যাল হাসিমুখে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে এল, তারপর দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিল। ক্লিক করে নাইটল্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ হল।
শান্তনু বসবার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে রঙিন টিভির দিকে চোখ মেলে বসেছিল। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
পলাশকে দেখামাত্রই সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে যেতে চাইছিল। ও কোনওরকমে দুর্ঘটনাটা সামলে নিল। একইসঙ্গে সীমন্তিনীর মুখের চেহারা ওকে ভয় পাইয়ে দিল। ও সহজ গলায় পলাশকে অভ্যর্থনা জানাতে চেষ্টা করল? কী ব্যাপার! সেই যে হুট করে একদিন এলি…তারপর তো একেবারে অমাবস্যার চঁদ হয়ে গেলি। রোজই আমি বাড়ি ফিরে ওকে জিগ্যেস করি পলাশ ফোন করেছিল কি না–।
ওর কাছাকাছি একটা সোফায় পলাশকে বসতে ইশারা করল শান্তনু।
পলাশ ছোট্ট একটা শব্দ করে এগিয়ে এল সোফার কাছে। ওর চঞ্চল চোখ চারপাশটা চকিত দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছিল। সীমা আর শান্তনুকেও একপলক দেখে নিল ও।
সীমা ওর চোখে সন্দেহের দৃষ্টি খুঁজতে চাইল। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, বসুন। চা খাবেন তো?
পলাশ অবাক হয়ে সীমার দিকে তাকাল : শুধু চা! আমি তো ভাবছিলাম, সাহেবরা যাকে বলে ডিনার একেবারে তা-ই খেয়ে যাব। কথার শেষে ও হো-হো করে হেসে উঠল।
সে তো খাবেনই। হেসে বলল সীমা, ডিনার না খাইয়ে আপনাকে আজ ছাড়ছি না। পলাশকে যে-করে-হোক আটকে রাখতেই হবে।
পলাশ বসতেই শান্তনু ওকে সিগারেট অফার করল। সম্পূর্ণ নতুন চোখে ওর স্কুলের বন্ধুকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। খুঁজে পেতে চাইল একজন ধর্ষণকারী ও হত্যাকারীকে।
টেবিলে রাখা লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাল পলাশ। তারপর লাইটার রেখে সিগারেট ধরা ঠোঁটে জড়িয়ে-জড়িয়ে বলল, কেমন আছিস বল।
শান্তনুর বুকের ভেতরে এলোপাতাড়ি ঢাক বাজাচ্ছিল কেউ। বরাবর অঙ্কে ওর মাথা ভালো। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, ওর সব অঙ্ক কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। পলাশের চওড়া কাঁধ আর হাতের পেশির দিকে তাকিয়ে ও স্পষ্ট বুঝল, সমান-সমান লড়াইয়ে পলাশকে কাবু করা ওর কর্ম নয়। দ্বৈপায়ন কাছে থাকলেও বা কিছু একটা ভাবা যেত। ও ডাকাবুকো ছেলে, শক্তি সামথ্যও কম নয়। কিন্তু একা-একা…।
শান্তনু সময় পেলেই গল্প-উপন্যাস পড়ে, কেব্ল টিভি-তে সিনেমাও দ্যাখে। সেখানে অবিশ্বাস্য কত কিছু ঘটে যায়। মিমোর শক্তিমান হলেও এতক্ষণে বহু কিছু করে ফেলত। হয়তো পলাশকে শূন্যে তুলে ঘুরপাক খাইয়ে ছুঁড়ে দিত মহাকাশে। ডাই হার্ড ছবির ব্রুস উইলিস কেমন একা লড়াই করে হারিয়ে দিল এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী দলকে। ফার্স্ট ব্লাড ছবিতে সিলভেস্টার স্ট্যালোনও কি কম কিছু করেছিল। কিংবা, আরনল্ড সোয়াজেনেগার, স্টিভেন সিগাল, জাঁ ক্লদ ভ্যান ড্যাম–ওরাও তো কত লড়াই করে সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক সব ভিলেনদের সঙ্গে! সানি দেওল, সঞ্জয় দত, মিষ্টুন চক্রবর্তী…একের পর এক নাম মনে পড়ছিল। লোকে বলে বুদ্ধির জোর বেশি। কিন্তু শুধু বুদ্ধির জোরে কি কিছু করা যায়! গায়ের জোরও দরকার।
তখনই সীমার দিকে চোখ পড়ল ওর। আর মনে হল, নাঃ, মনের জোর থাকাটাও এখন বেশ জরুরি।
সীমা চোখে-চোখে কী একটা ইশারা করতে চাইল শান্তনুকে। তারপর চায়ের ব্যবস্থা করতে চলে গেল।
সীমা কি বিজয় মিত্রকে ফোন করার জন্য ইশারা করল? কথাটা ভাবতে গিয়েই শান্তনুর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোন নম্বর দুটো ও মুখস্থ করে রেখেছিল। কিন্তু এখন কিছুতেই আর মনে পড়ছে না। কেমন যেন সব গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া ফোন করতে গেলেই পলাশ নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে। ও যদি বাথরুমে যায় সেই ফাঁকে ফোনটা করে ফেলা যায়। কিন্তু হঠাৎ ও বাথরুমেই বা যাবে কেন? আচ্ছা, ওকে জিগ্যেস করলে কেমন হয়!
তুই কি বাথরুমে যাবি? এলোপাতাড়ি ভাবতে-ভাবতে এই হাস্যকর প্রশ্নটা শান্তনুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
পলাশ চোখ ছোট করে শান্তনুর দিকে তাকালঃ তার মানে! জিগ্যেস করলাম, কেমন আছিস। তার উত্তর হল, তুই কি বাথরুমে যাবি? একটু থামল পলাশ। তারপর ও কী ব্যাপার বল তো? তুই কি অন্য কিছু ভাবছিস?
বেসামাল পরিস্থিতিটা সামলে নেওয়ার জন্য শান্তনু হাতের সিগারেটে পরপর কয়েকটা টান দিল। একবার টিভির দিকে দেখল, একবার পলাশের দিকে। সীমন্তিনী চা নিয়ে এসে পড়লে বাঁচা যেত। ও কী যে করছে এতক্ষণ!
জোর করে হাসার চেষ্টা করল শান্তনু। কয়েকবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, আজকাল আমার এইরকম হয়েছে। আনমনাভাবে উলটোপালটা সব কথা বলে ফেলছি। যাকগে, তোর কী খবর বল। চাকরি-বাকরি কেমন চলছে?
চাকরি! তোকে তো কখনও বলিনি যে, আমি চাকরি করি।হেসে বলল পলাশ। তারপর বেশ সিরিয়াস ঢঙে মন্তব্য করল, আমি কারও চাকর নই। আমি স্বাধীন।
শান্তনু উত্তরে কী বলবে ভাবছিল, ঠিক তখনই সীমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। পলাশের সামনে টেবিলে কাপ-প্লেট সাজিয়ে দিতে দিতে শান্তনুকে লক্ষ করে বলল, তোমার চা করিনি। তোমাকে একটু বাজারে যেতে হবে। তারপর ফিরে এসে চা খাবে। পলাশের দিকে তাকিয়ে সীমা বলল, পলাশদা, আপনি কিছু মাইন্ড করবেন না। আপনি গেস্ট আপনার জন্যে স্পেশাল কিছু রাঁধতে না পারলে আমার মন মানবে না। দশমিনিটেই ও ঘুরে চলে আসবে–আপনি ততক্ষণ টিভি দেখুন।
শান্তনু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ও সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতেই সীমা ওকে ভেতরে ডাকল।
সীমার বুকের ভেতরে যাচ্ছেতাই ব্যাপার চলছিল। ও কোনওরকমে শান্তনুকে রান্নাঘরের কাছে ডেকে নিয়ে এল। বাজারের থলে আর টাকা ওর হাতে দিতে দিতে চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল, বাইরে বেরিয়েই দিপুকে একটা খবর দেবে। তারপর বিজয় মিত্রের দেওয়া নাম্বারে ফোন করে সব বলবে। বলবে, ভীষণ বিপদ।
শান্তনু যখন বলল, ফোন নম্বর দুটো ওর মনে নেই, তখন সীমা বলল যে, নম্বর দুটো দিপু জানে।
শান্তনু ঘোর লাগা মানুষের মতো আলগা পায়ে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে হাঁটা দিল। সীমা আর মিমোকে একটা ভয়ঙ্কর খুনির সঙ্গে রেখে যেতে ওর বুক দুরদুর করছিল।
বাসন্তী রান্নাঘরে একমনে মশলা বাটছিল। আর মিমো শোওয়ার ঘরের মেঝেতে বই খাতা ছড়িয়ে পরীক্ষার পড়া তৈরি করছিল। সীমা শান্তনুকে রওনা করে দিয়েই শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল মিমো নেই। বই-খাতা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রেখে কোন ফাঁকে উঠে পড়েছে।
সীমা তাড়াতাড়ি পা ফেলে বাথরুমের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল মিমো সেখানে নেই। তা হলে নিশ্চয়ই ও বসবার ঘরে পলাশের কাছে গেছে! সীমার বুকের ভেতরে ভেঁকির পাড় পড়ল যেন। ও মিমো! মিমো! করে ডাকতে-ডাকতে প্রায় ছুটে এল বসবার ঘরে।
বাড়িতে যে কোনও অতিথি এসেছে সেটা মিমো পড়তে-পড়তেই টের পেয়েছিল। তাই পড়ার ব্যাপারটা মোটামুটি শেষ হতেই ও চুপিসারে চলে এসেছে বসবার ঘরে।
টিভিতে তখন খবর পড়া হচ্ছিল। চা-সিগারেট খেতে-খেতে পলাশ একমনে টিভি দেখছিল। গলায় শক্তিমানের ছবি ঝোলানো বাচ্চাটাকে দেখতে পেয়েই পলাশ আদর করে ওকে কাছে ডেকেছে : কী খবর, অচ্যুতবাবু, কেমন আছ?
শান্তনু তখন পলাশকে আসছি বলে ফ্ল্যাটের ল্যাচে হাত রেখেছে। সুতরাং মিমো যখন কথা বলল তখন শান্তনু আর সীমা দুজনেই পলাশের কাছ থেকে মাত্র হাত পাঁচ-ছয় দূরে দাঁড়িয়ে। ওরা তিনজনে যেন একটা বিষমবাহু ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু তৈরি করেছে।
ওদের তিনজনকেই স্তম্ভিত করে দিয়ে মিমো পলাশকে জিগ্যেস করল, পলাশকাকু তুমি মা-মার্ডারার? সেদিন মা দিপুদাকে বলছিল…।
মিমোর কথায় জগৎ-সংসার পলকে স্থবির হয়ে গেল। কোথাও কোনও শব্দ নেই, কোনও চেতনা নেই। শুধু তিনটে রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখ পরস্পরকে বিমূঢ় চোখে দেখছে।
শান্তনুর কণ্ঠা ওঠা-নামা করছিল বারবার। যেন সাঁতার না-জানা কোনও ডুবন্ত মানুষ অসহায়ভাবে খাবি খাচ্ছে। ওর রোগা চেহারার যেটুকু বা বুদ্ধিদীপ্ত ভাব ছিল এখন সেটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। ও বড়-বড় চোখে পলাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর চোখের কোণ দিয়ে টের পাচ্ছিল সীমন্তিনীর দুর্দশা। এই মুহূর্তে কে বলবে ও সুন্দরী! কপালে ভাঁজ, চোখে-মুখে ভয়, বুক পাথর। যেন কোনও আগ্নেয়গিরির প্রলয় শুরু হওয়ার জন্য একরাশ আতঙ্ক ও উষ্কণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে।
পলাশের স্নায়ুতন্ত্রীর প্রশংসা করতেই হয়। ও সিগারেট নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে রেখে দিল। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর মিমোর মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে শান্তনুকে লক্ষ করে ঠান্ডা গলায় বলল, তোরা তা হলে সবই জেনে গেছিস!
শান্তনু শুকনো ঢোঁক গিলে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর কেমন একটা জড়ানো স্বরে জবাব দিল, হ্যাঁ…পুলিশ সব জানে…।
পলাশ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর আপনমনেই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল, আমি যে এখানে সাতটার সময়ে আসব তা তো তোরা জানতিস না! তা হলে পুলিশ এখনও খবর পায়নি যে, আমি এখানে আছি…।
সীমা অনেক চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আপনার বাঁচার আর কোনও পথ নেই, পলাশদা…। পুলিশের লোকজন সাদা-পোশাকে আমাদের ফ্ল্যাটের ওপরে নজর রাখছিল। তারা আপনাকে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই লালবাজারে খবর চলে গেছে। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল সীমা : আপনার আর কোনও আশা নেই…।
মিথ্যে কথাগুলো সত্যির মতো শোনাল তো! গলার স্বর খুব বেশি কেঁপে যায়নি তো! ভাবল সীমা।
যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ…। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল পলাশ। ওর মোটা-মোটা গাঁটওয়ালা আঙুলগুলো মিমোর মাথায়, গালে, গলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
সীমার বুকের ভেতরে উথালপাথাল চলছিল, একটা ভয়ংকর কান্না গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। পলাশ মিমোকে ছুঁয়ে আছে দেখেই ওর ভীষণ ভয় করছিল। অমল রায়, বিজয় মিত্র, ওঁদের সন্দেহের প্রতিটি কণা তা হলে সত্যি!
মিমো, আমার কাছে আয়– ছেলেকে ডাকল সীমন্তিনী। আর একইসঙ্গে পা বাড়াল ছেলের দিকে, পলাশের দিকে।
সরল, নিষ্পাপ, দুরন্ত ছেলেটা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা ভোঁতা হয়ে গেছে পলকে। ওর মুখে কোনও কথা সরছে না। শুধু অবাক হয়ে বাবার ছোটবেলার বন্ধুকে দেখছে।
মায়ের ডাকে মিমো সাড় ফিরে পেল যেন। ও কচি গলায় ডেকে উঠল, মা!
ওর ডাকে খানিকটা কান্না মিশে গেল।
পলাশের চঞ্চল চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও মনে-মনে কিছু একটা হিসেব কষছে।
সীমন্তিনী ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ও এক ঝটকায় মিমোকে ঠেলে দিল একটা সোফায় দিকে। মিমো সোফায় ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
সীমন্তিনী একটা চাপা চিৎকার করে উঠতেই পলাশ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। কখন যেন ও ডান হাতটা পকেটে ঢুকিয়েছিল। এখন সেটা বাইরে বেরিয়ে আসতেই ছোট মাপের একটা ধারালো চাকু ঝলসে উঠল ওর হাতে।
অদ্ভুত তৎপরতায় পলাশের ভারী শরীর পৌঁছে গেল মিমোর কাছে। সামান্য ঝুঁকে পড়ে এক হ্যাঁচকায় বাচ্চাটাকে টেনে তুলল। ছোট বাঁকানো ফলার ছুরিটা ওর কানের পিছনে চেপে ধরে শান্তনুকে লক্ষ করে চাপা হিংস্র গলায় বলল, দরজায় ছিটকিনি-খিল সব এঁটে দে! এক্ষুনি!
শান্তনু আতঙ্কের চাপে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। কাঁপা হাতে কোনওরকমে ও পলাশের হুকুম তামিল করল।
এখানে আমার কাছে এসে বোস। শান্তনুকে আবার আদেশ করল পলাশ।
নিশি-পাওয়া মানুষের মতো শান্তনু পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল পলাশের কাছে। একটা সোফার বসে পড়ল।
মিমো কাঁদছিল। কিন্তু শান্তনু যেন অচেনা কোনও মানুষের মতো ছেলেকে দেখছিল। ওর মনে হচ্ছিল, এগুলো ওর জীবনের ঘটনা নয়। ও ভ্যান ড্যাম অথবা ব্রুস উইলিসের কোনও অ্যাকশন ছবি দেখছে। ওসব সিনেমায় যা হয়, বাস্তবে তা হতে পারে বলে শান্তনুর মন কখনও বিশ্বাস করেনি।
মিমোকে কাঁদতে দেখে সীমন্তিনী নিজেকে আর শক্ত করে ধরে রাখতে পারেনি। ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। জল ভরা চোখেই ও দেখছিল, মিমোর বুকে শক্তিমানের ছবিটা নিছকই ছবি হয়ে ঝুলছে।
মিমোকে ছেড়ে দিন, পলাশদা! কান্না-ভাঙা কাতর গলায় পলাশের কাছে যেন ভিক্ষে চাইল সীমা। ওর মন দ্বৈপায়নকে ডাকতে লাগল আকুল হয়ে।
পলাশ দাঁত বের করে হাসল। ওর দাঁতের জোড়গুলোয় কালচে ছোপ চোখে পড়ল। হাত নেড়ে ইশারা করে সীমাকে কাছে ডাকল পলাশ, তুমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো এখানটায় চলে এসো। শান্তনুর কাছে চুপটি করে বসে পড়ো।
সীমা প্রায় ছুটে এসে বসে পড়ল শান্তনুর পাশে। এমন সময় টেলিফোন বাজতে শুরু করল।
শান্তনু নিশ্চল হয়ে বসেছিল। ওর বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল। ও পলাশের নজর এড়িয়ে সীমাকে ছোট্ট করে ঠেলা দিল। অর্থাৎ, জলদি টেলিফোনটা ধরো।
কিন্তু টেলিফোন ওঁদের কাউকেই ধরতে হল না। কারণ, মিমোকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ টেলিফোনের কাছে গেল। রিসিভার তুলে নিয়ে হ্যালো বলল।
মিস্টার সেনগুপ্ত আছেন? ও-প্রান্তে কেউ একজন জিগ্যেস করল।
পলাশ নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল, রং নাম্বার।
তারপর মন্তব্য করল, টেলিফোন যন্ত্রটাই বড় বিরক্তিকর। এবং টেলিফোনের তারটা দেওয়ালের জাংশান বক্স থেকে একটানে ছিঁড়ে দিল।
সীমন্তিনীর মনে আশার যে-সরু সুতোটা দোলাচলে দুলছিল সেটাও যেন কেউ একটানে ছিঁড়ে নিল।
বাসন্তী যে কখন ড্রইং স্পেসের সামনে করিডরে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কেউই টের পায়নি। টেলিফোনের তারটা ছিঁড়ে নেওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পলাশ ওকে দেখতে পেল। ওর দিকে ঠান্ড চোখে তাকিয়ে হিংস্রভাবে পলাশ বলল, ভেতরে গিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ কর। চেঁচামেচি করলে প্রথমে মিমোর গলা কাটব, তারপর তোর। হাত তুলে বাঁকানো ফলার ছুরিটা দেখাল পলাশ।
ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বাসন্তী প্রায় ছুটে চলে গেল ভেতরের দিকে। মিমো চোখে হাত ঘষে কাঁদছিল। পলাশ ওর কাছে গিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বলছি!
মিমো চমকে উঠে আরও জোরে কেঁদে উঠল।
পলাশ নিজের কপালের দু-পাশটা বাঁ-হাতে জোরে টিপে ধরল। মাথা ঝাঁকাল কয়েকবার। তারপর ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠল, আ-আঃ!
একইসঙ্গে বাঁ-হাতে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল মিমোর গালেঃ চুপ কর বলছি! চিৎকার করে পাগল করে দেবে দেখছি।
ওইটুকু বাচ্চার গালে কেউ যে অমনভাবে চড় কষাতে পারে এটা শান্তনু বা সীমন্তিনী কল্পনাও করতে পারেনি। ওরা দুজনেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। মিমো আরও জোরে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু এরপরই পলাশ যা করল তাতে ওইটুকু বাচ্চাও চুপ করে যেতে বাধ্য হল।
মিমোর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল পলাশ। ছুরি ধরা ডান হাতটা ওর গলার নলির কাছে নাচাতে নাচাতে চিবিয়ে চিবিয়ে হাসল, তারপর বলল, একটানে নলিটা দু-ফাঁক করে তোর কান্না থামিয়ে দেব, অ্যাঁ! পাগলের মতো হেসে উঠল পলাশ ও তখন তোর সব কান্না গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে মুখ দিয়ে আর বেরোবে না। দেখবি? কী রে, দেখবি, আঁ?
শান্তনু আর সীমন্তিনী ভয়ঙ্কর একটা খুন-পাগল মানুষকে দেখতে পেল যেন। সীমন্তিনী আর সইতে পারল না। সমস্ত বিপদ অগ্রাহ্য করে ছুটে গেল ছেলের কাছে। আর ঠিক তখনই পলাশ মিমোকে এক ধাক্কায় মায়ের দিকে ঠেলে দিল, বলল, ছেলেকে যে-করে-হোক চুপ করাও।
মিমো চুপ করে গিয়েছিল তার আগেই। ওর মুখ ভয়ে নীল। সীমা ছেলেকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল। কোণঠাসা ইঁদুর যেভাবে হন্যে হয়ে পালাবার পথ খুঁজে বেড়ায় সেইভাবে বাঁচার একটা পথ খুঁজে বেড়াতে লাগল সীমা। মিমোকে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়ল।
পলাশ তখন উঠে দাঁড়িয়ে বড়-বড় শ্বাস ফেলছে।
হঠাৎই মিমোর গলায় ঝোলানো শক্তিমানের ছবিটার দিকে নজর গেল সীমার। ছবিটা যে ওর ছেলের প্রাণ সে-কথা দ্বৈপায়ন ভালো করেই জানে। যদি…।
সীমা আর সময় নষ্ট করল না।
আবার তুমি এই ছবিটা গলায় ঝুলিয়েছ! শান্তনু আর পলাশকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে বেচারি মিমোকে ধমক দিল সীমা। শক্তিমানের ছবিটা ধরে এক টান মারল ও।
সুতো ছিঁড়ে ছবিটা চলে এল সীমার হাতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ও সেটা ছুঁড়ে দিল খোলা জানলা লক্ষ করে। গজগজ করে মন্তব্য করল, হাজারবার বারণ করা সত্ত্বেও তুমি ওইসব আজেবাজে ছবি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে! লেখাপড়া ছেড়ে যত্তসব বাজে কাজ!
সীমার আচমকা এই আচরণে পলাশ ও শান্তনু দুজনেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। পলাশ চোখ ছোট করে তাকাল সীমার দিকে। যেন সীমার আচরণের সারমর্মটুকু ও নিখুঁতভাবে মেপে নিতে চায়। কিন্তু রহস্যের কোনও উত্তর খুঁজে পেল না পলাশ। ও টের পেল না যে, সীমা তখন আকুলভাবে প্রার্থনা করছে, দ্বৈপায়ন যেন যে-কোনওভাবে রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা শক্তিমানের ছবিটা দেখতে পায়। ঠাকুর, দিপু যেন ছবিটা দেখতে পায়!
পলাশ জানলার কাছে গিয়ে দেওয়ালের আড়াল থেকে খুব সাবধানে উঁকি মারল নীচের রাস্তায়। সত্যিই কি সাদা-পোশাকের গোয়েন্দারা ওত পেতে আছে অন্ধকারে, গাছপালা ঝোপঝাড়ের আড়ালে! এই ফ্ল্যাটে কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? সীমার কথা কতটুকু সত্যি?
জানলা থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নজর চালিয়েও কাউকে দেখতে পেল না পলাশ।
তখন ও ধীরে-ধীরে পা ফেলে এগিয়ে এল সীমা আর মিমোর কাছে। অদ্ভুতভাবে হেসে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল মেঝেতে।
সীমাসুন্দরী, পুলিশকে ঠিক কতটুকু বলেছ? কী কী জানতে চেয়েছে পুলিশ? কবে এসেছিল ওরা?
সাপ যদি কথা বলতে পারত তা হলে বোধহয় এই সুরেই কথা বলত।
একটা ভয়ঙ্কর মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখছিল সীমন্তিনী। এই লোকটার হাতে ধর্ষিত হয়ে খুন হওয়ার সময় মেয়েগুলোর জঘন্য আতঙ্ক ও স্পষ্ট টের পেল। ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। মিমো উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিল মায়ের কোলে।
শান্তনু এবার সীমার জন্য ভয় পেল। স্থবির অবস্থা কাটিয়ে ও মুখ খুলল, তোকে…তোকে দেওয়া…টেলিফোন নাম্বার লেখা চিরকুটটা নিয়ে..পুলিশ আমাদের কাছে এসেছিল…।
পলাশ আনমনা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, তা হলে বাইপাসের ওই মেয়েটার কাছে কোথাও চিরকুটটা আমি হারিয়েছি…। শান্তনুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে ও জিগ্যেস করল, তারপর?
একে-একে সব বলে গেল ওরা। কখনও শান্তনু, কখনও সীমন্তিনী। ইতস্তত করে, হোঁচট খেয়ে ওরা অমল রায় আর বিজয় মিত্রের সব কথা বলে গেল। সীমা ইচ্ছে করেই দ্বৈপায়নের কথা বলেনি। সীমার কথার ধরন দেখেই শান্তনু ইশারাটা বুঝে নিয়েছিল। তাই ও-ও দ্বৈপায়নের কথা এড়িয়ে গেল।
কিন্তু তাতে পুরোপুরি পাশ কাটানো গেল না। ওদের কথা শেষ হতেই পলাশ সীমাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করল, দিপুদা কে? তোমার ছেলে বলছিল…।
আমার পিসতুতো দিদির ছেলে। বালিগঞ্জে থাকে। নির্বিকারভাবে উত্তর দিল সীমা।
পলাশ এবার আপনমনে হেসে উঠল। এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। টিভি তে কোনও একটা বিজ্ঞাপনের চড়া মিউজিক বাজছিল। বিরক্ত হয়ে সেদিকে তাকাল পলাশ। বাঁ-হাতে কপাল টিপে ধরল। তারপর ছুরিটা বাঁ-হাতে নিয়ে ডান হাতে টেবিল থেকে একটা কাপ তুলে নিল। সবাইকে চমকে দিয়ে চাপা গলায় খিস্তি করে টিভি-র পরদা টিপ করে কাপটা গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল।
বিচিত্র শব্দ করে টিভি-র পরদা চুরমার হয়ে গেল। আগুনের ফুলকি দেখা গেল। ধোঁয়া বেরোল টিভি-র ভেতর থেকে। কাপটা নিরীহ বেড়ালছানার মতো অটুট অবস্থায় টিভির খোলের ভেতরে বসে রইল।
পলাশ ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা লা পলাশ কাপের বিজ্ঞাপন। তারপর রেডিয়োর বিজ্ঞাপনের মতো সুর করে উচ্চারণ করল, টুং-টুং।
ওদের খুব কাছে এসে দাঁড়াল পলাশ। হাতে হাত ঘষে শান্তনুকে বলল, এবার আমার কথা বলি, শোন। তুই তো জানিস, স্কুলে আমি ভীষণ কম কম নম্বর পেতাম। মাস্টারগুলো এত বজ্জাত ছিল যে, কিছুতেই আমাকে নম্বর দিতে চাইত না। স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি একদিন রাতে ঢিল ছুঁড়ে নগেনবাবুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম।
শান্তনুর নগেনবাবুকে মনে পড়ল। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা। ওদের অঙ্কের স্যার ছিলেন। খুব কড়া ধাতের নীতিবাগীশ শিক্ষক ছিলেন। কোনও ছাত্রকেই অন্যায্য নম্বর দিতেন না।
পলাশ চায়ের টেবিলটাকে ঘিরে অলসভাবে পায়চারি করতে শুরু করল। আর একইসঙ্গে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো করে বলতে লাগল, আসলে ব্যাপারটা কী জানিস, কেউ কখনও আমাকে ভালো চোখে দ্যাখেনি। যেমন ধর, তোরা। ছোটবেলা থেকেই আমার কপাল পোড়া। বাবা দিনরাত্তির আমাকে হুকুম করত। আর সেসব কাজ করতে গিয়ে পান থেকে চুন খসলেই আমাকে ধরে বেধড়ক ঠ্যাঙাত। মা চেঁচাত বটে, কিন্তু বাবা মাকে একেবারেই পাত্তা দিত না। সবসময় আমাকে চাকর-বাকরের মতো ট্রিট করত। বলত, তোর দ্বারা কিস্যু হবে না। তোকে কেউ কোনওদিনই পাত্তা দেবে না…।
সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে হাসল পলাশ, গুনগুন করে আবৃত্তি করলঃ
ছন্নছাড়া ছিন্ন-ছেঁড়া গাছ পাথরের জীবন–
এই জীবনের পোশাকী নাম মরণ, শুধু মরণ।
তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে তেতো হাসি হেসে হতাশার একটা শব্দ করল : হাঃ! সেই কোন ছোটবেলা থেকে নিজের লাশটা কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেউ আমাকে আমল দেয় না…অথচ আমি আমল পেতে চাই।
জানিস, শান্তনু, কলেজেও সেই একই কেস হল। কো-এড কলেজে ভরতি হয়েছিলাম। ভেতরে-ভেতরে মেয়েদের জন্যে দারুণ একটা লোভ ছিল। আজেবাজে স্বপ্ন দেখতাম, রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে যা-তা ভাবতাম, যা খুশি করতাম। কিন্তু দিনের আলোয় সাহস করে মেয়েবন্ধুদের কিছু বলতে পারতাম না। বহুদিন ধরে মনে-মনে রিহার্সাল দেওয়ার পর রুমকি আর লোপামুদ্রাকে মনের গোপন ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলাম। ওরা অবাক হয়ে হি-হি করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, পলাশ, তুই না মাইরি একটা ভোদাই-কিতকিত! তোর বোধহয় মাথা ফাথার ঠিক নেই। হি-হি হি-হি…। চকিতে ঝুঁকে পড়ে টেবিলে জোরালো একটা চাপড় কষাল পলাশ ও ব্যস, সব গল্প শেষ। লোপামুদ্রা আর রুমকি অনেকের সঙ্গেই ইয়ে করত, অথচ শুধু আমার বেলায় বাদ!
ধীরে-ধীরে আমি নিজেকে বদলাতে শুরু করলাম। বুঝলাম, অধিকার চাইলেই পাওয়া যায় না ছিনিয়ে নিতে হয়। তাই ভেতরে-ভেতরে তৈরি হতে লাগলাম। কিন্তু একইসঙ্গে আমার একটা অসুখ দেখা দিল। মাঝে-মাঝেই মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। একটা অদ্ভুত দপদপানি। সেই সময়ে আমি কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ি, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। লাস্ট এক বছরে অসুখটা ডেঞ্জারাস চেহারা নিল। তারপর…এই মাস ছসাত আগে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা মেয়েকে শাস্তি দিলাম…আমাকে পাত্তা না দেওয়ার শাস্তি। মেয়েটা খুব ছোট ছিল… কথা বলতে-বলতে সীমন্তিনীর কাছে এগিয়ে এল পলাশ। হঠাৎই ওর গাল টিপে দিয়ে বলল, তোমার চেয়েও অনেক ছোট।
সীমা এক ঝটকায় মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
পলাশ বাঁকানো ছুরিটা সীমার চোয়ালের নীচে ঠেকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তবে মেয়েটার জিনিসপত্তর ছিল তোমার মতোই। ডান হাতে সীমার মুখটা একরকম জোর করেই নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল পলাশ ও তুমি যেন আবার ভুল করে আমাকে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। শান্তনুর দিকে তাকিয়ে ও শান্তনু, তোর ওয়াইফকে সাবধান করে দে। বেচারি এখনও আমাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।
সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় অনুনয় করল শান্তনু।
পলাশ বলে চলল, ব্রিগেডের পর কসবা, তারপর বাইপাস, তারপর…।
সীমন্তিনীর চিবুকে আলতো করে টোকা মারল পলাশঃ তারপর কি সল্টলেক?
সীমার চিবুকে অসংখ্য মাকড়সা হেঁটে বেড়াতে লাগল। ও আবার দিপুর জন্য আকুল প্রার্থনা করল।
পলাশ দু-হাত ঝাঁকিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল।
কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ও কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল টুং-টাং…।
পলাশ পলকে পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।
আর সীমন্তিনী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল।
ওর এইরকম আচমকা উঠে দাঁড়ানোয় মিমো ধাক্কা খেয়ে কেমন যেন ঘাবড়ে গেল। শব্দ করে সামান্য কেঁদে উঠে মাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরতে চাইল।
ততক্ষণে কলিংবেল আবার বেজে উঠেছে : টুং-টাং।
কে এসেছে? পুলিশ? সন্ত্রস্তভাবে জানতে চাইল পলাশ। ওর গলার স্বর কেমন যেন ফাসফেঁসে চেরা-চেরা শোনাল।
শান্তনু জিজ্ঞাসার চোখে তাকাল সীমন্তিনীর দিকে। সীমা তখন মরিয়া হয়ে ভাবছে, কে আসতে পারে এই অসময়ে? কে এই দেবদূত? পুলিশ? নাকি অন্য কেউ?
হয়তো বিজয় মিত্র অথবা অমল রায় ফোনে যোগাযোগ করতে চেয়ে পারেননি। তখন নিছকই সন্দেহের বশে চলে এসেছেন শান্তনুদের ফ্ল্যাটে। হয়তো…।
দরজা খোলার জন্য সামনে পা বাড়াল সীমা। সঙ্গে-সঙ্গে পলাশ ওকে চাপা গলায় ধমক দিল, দরজা খুলবে না!
সীমা বিরক্ত হয়ে তাকাল পলাশের দিকে। পলাশের মুখটা কোণঠাসা বাঘের মতো দেখাচ্ছে। এই শীতেও কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম ফুটেছে।
দরজা না খুললে সন্দেহ হবে। আপনার বিপদ আরও বাড়বে…। ঠান্ডা গলায় বলল সীমা। ও বেশ বুঝতে পারছিল পালটা ভয় না দেখালে পলাশের মতো পাগল খুনিকে রোখা যাবে না। দরজায় যে-ই এসে থাকুক, তাকে পলাশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। তা নইলে…।
আবার কলিং বেল বাজল।
সীমা সহজ পায়ে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগোতেই পলাশ একলাফে মিমোর কাছে চলে এল। জামার কলার ধরে এক হ্যাঁচকায় বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিল। ছুরিটা ডান হাতে নিয়ে ওর কানের পাশে চেপে ধরল। চাপা গলায় হিসহিস করে বলল, যে-ই আসুক তাকে দরজা থেকে কাটিয়ে দাও। তা নইলে বাচ্চাটার গলা…।
সর্বনাশের কাছাকাছি
থাক! বারবার একই ভয় দেখিয়ে বীরত্ব দেখাতে হবে না! ঘেন্নার সুরে পলাশকে বাধা দিল সীমন্তিনী ও আগে দেখি দরজায় কে এসেছে। আমরা স্বাভাবিক ব্যবহার করলে কেউ সন্দেহ করবে না। আপনি যদি উলটোপালটা কিছু করেন তা হলে আমরা কেউই বাঁচব না।
পলাশ ঘাড় গোঁজ করে ভারী গলায় বলল, বি কেয়ারফুল! ভুলে যেয়ো না আমার হাতে কী আছে!
সীমা দরজা খুলে দিল।
এসো আমার দেবদূত! আমার প্রিয়তম দেবতা! আমার পুরুষোত্তম! তুমি এলে সূর্যোদয় হয়। তুমি বিদায় নিলে সূর্যাস্ত। দিনে তোমায় আলোর কিরণ দিয়ে আরাধনা করি, রাতে নিবেদন করি নক্ষত্রমালা। এসো হে প্রাণপুরুষ! এসো আমার অন্তরতম দীপাবলি!
দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দ্বৈপায়ন।
কিন্তু এ কোন দ্বৈপায়ন!
পেশাদারি সেল্সম্যানের মতো ওর সাজপোশাক। হাতে বড়-বড় কয়েকটা পলিথিনের প্যাকেট। মুখে পাউডার, গলায় টাই, গা থেকে ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে।
সীমাকে দেখামাত্রই চোখ টিপল দ্বৈপায়ন। তারপর অচেনা সেজে সেল্সম্যানের মিষ্টি মোলায়েম ঢঙে বলল, মিস্টার শান্তনু সেনগুপ্ত আছেন? আমি ফ্যানট্যাসটিক কোম্পানি থেকে আসছি। আপনারা আজ একটু রাত করে আসতে বলেছিলেন। আপনারা যে-দুটো ইন্সট্রুমেন্ট চেয়েছিলেন সে-দুটো দেখানোর জন্যে নিয়ে এসেছি।
রোবটের মতো যান্ত্রিক ঢঙে গড়গড় করে কথা বলে যাচ্ছিল দ্বৈপায়ন। আর একইসঙ্গে দ্রুত নজর বুলিয়ে ঘরের পরিস্থিতি জরিপ করে নিচ্ছিল।
যা বোঝার ও স্পষ্ট বুঝতে পারল। পলাশ সান্যালকে চিনে নিতে ওর কোনও কষ্ট হল না। লোকটা গুটেকে প্রায় খামচে নিজের কাছে ধরে রেখেছে। গুটের চোখ ভেজা। ভেজা চোখে অবাক হয়ে ওর দিপুদাকে দেখছে।
সীমা ইতস্তত করে বলল, আমাদের একজন গেস্ট রয়েছেন–তাই একটু অসুবিধে আছে। পরে কখনও যদি আসেন…।
আপনি নিশ্চয়ই মিসেস সেনগুপ্ত? একগাল হেসে ঘরে ঢুকে পড়ল দ্বৈপায়ন। এমন সহজ ভঙ্গিতে কনুই দিয়ে ঠেলে দরজাটা বন্ধ করে দিল যেন এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ। তারপর ও গেস্ট থাকায় আপনাদের সুবিধেই হবে, ম্যাডাম। আপনারা ওঁর ওপিনিয়ানটাও নিতে পারবেন। আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না–মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট। এই দেখুন…।
পলিথিনের বড়-বড় প্যাকেট খুলে দুটো জিনিস বের করল দ্বৈপায়ন।
একটা জোনেক্স কোম্পানির রোলার স্কেস-এর বাক্স। আর একটা লম্বাটে আয়তাকার বাক্স যার ওপরে লাল রঙে বড়-বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা ফ্লেক্সিবার।
প্রথম বাক্স খুলে একজোড়া রোলার স্কেটস বের করে নিল ও। আর দ্বিতীয় বাক্স খুলে টেনে বের করে নিল লম্বা লাঠির মতো একটা জিনিস। লাঠির দু-প্রান্তে মোটরবাইকের হাতলের মতো ফাইবারের তৈরি দুটো হাতল। আর হাতল দুটোকে জুড়ে রেখেছে কালো রঙের মোটাসোটা একটা লম্বা স্প্রিং।
দ্বৈপায়ন যখন ওর দোকান সাজাচ্ছিল পলাশ তখন মিমোকে নিয়ে পা টিপে টিপে সরে যাচ্ছিল কাচ ভাঙা টিভি-টার কাছে। দ্বৈপায়ন যাতে টিভিটা দেখতে না পায় সেজন্য ওটাকে আড়াল করে দাঁড়াল পলাশ। মনে-মনে ভাবল, হতচ্ছাড়া সেল্সম্যানটা কতক্ষণে এ-ফ্ল্যাট থেকে বিদেয় হবে।
পলাশের চেষ্টা দেখে দ্বৈপায়ন মনে-মনে হাসল। টিভি-র করুণ অবস্থাটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই ওর নজরে পড়েছে। কিন্তু কোনওদিকে না দেখার ভান করে দ্বৈপায়ন উবু হয়ে বসে রোলার স্কেটস জোড়া নিজের পায়ের মাপে অ্যাডজাস্ট করতে শুরু করল। তারপর পা ছড়িয়ে বসে ও-দুটো দু-পায়ে শক্ত করে বেঁধে নিল। এসব কাজ করতে করতে একটানা কথা বলে যাচ্ছিল দ্বৈপায়ন।
…জোনেক্স কোম্পানির রোলার স্কেটস একেবারে চ্যাম্পিয়ান। এই মডেলটার দাম সাতশো পঞ্চাশ টাকা, তবে আমরা এখন একটা স্পেশাল ডিসকাউন্ট দিচ্ছি–দুশো টাকা। মানে, এখন নিলে সাড়ে পাঁচশো পড়বে। এটা মিস্টার সেনগুপ্তও পরতে পারবেন…। বলে শান্তনু আর পলাশের দিকে ধন্দের চোখে তাকাল ও। যেন বুঝতে চাইছে, কে মিস্টার সেনগুপ্ত।
সীমার বড়-বড় শ্বাস পড়ছিল। পলাশের শক্ত মুঠোয় ধরা ছুরিটার কথা ও ভোলেনি। দিপু তো ছুরিটার কথা জানে না! কী হবে এখন?
এইসব উথালপাথাল ভাবনার মধ্যেও দ্বৈপায়নের কথাগুলো ওর কানে ঢুকল। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ইনি হলেন শান্তনু সেনগুপ্তআমার হাজব্যান্ড। আর ইনি আমাদের গেস্ট–পলাশ সান্যাল। আর ও অচ্যুতকে দেখাল সীমা ও আমাদের ছেলে-অচ্যুত। রোলার স্কেটসটা আমরা ওর জন্যেই চেয়েছি।
দিপুদাকে আচমকা ঘরে ঢুকতে দেখে গুটের মনটা নেচে উঠেছিল। কিন্তু কেমন একটা চাপা ভয় ওকে পাথর করে রেখেছিল। বারবার হেঁচকি মতন উঠছিল। মনে হচ্ছিল, ভেতর থেকে কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে।
এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল বাচ্চাটা। দ্বৈপায়ন শুধু ওর দিকেই নজর রাখছিল। শান্তনু আর সীমন্তিনী হয়তো ওর অভিনয়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, কিন্তু গুটে? গুটে যদি হঠাৎ দিপুদা! বলে চেঁচিয়ে ওঠে তা হলেই সর্বনাশ! সেইজন্য বেশ ভয়ে ভয়ে বাচ্চাটাকে দেখছিল দ্বৈপায়ন। ও যদি হঠাৎ–।
গুটে কিছু একটা বলার জন্য সবে হাঁ করতেই দ্বৈপায়ন বিচ্ছিরিভাবে ওকে ধমকে উঠল, একদম চুপ! তারপর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ওকে চুপ করে থাকতে ইশারা করল।
গুটে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে গেল। ওর চোখে জল চলে এল আবার।
পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দ্বৈপায়ন মোলায়েম হেসে নরম গলায় বলল, রাগ কোরো না, অচ্যুত। ডিমনস্ট্রেশান দেওয়ার সময় কেউ কথা বললে আমাদের একটু অসুবিধে হয়। সবকিছু মুখস্থ-টুখস্থ করে আমরা তো তৈরি হয়ে আসি, কেউ ডিসটার্ব করলে সেগুলো কেমন গুলিয়ে যেতে চায়। দাদা, বউদি আপনারা কিছু মাইন্ড করবেন না…প্লিজ! আমার বলা হয়ে যাক, তারপর আপনারা যত খুশি প্রশ্ন করবেন।
ফ্লেক্সিবারটা হাতে নিয়ে দ্বৈপায়ন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ঘরের মেঝেতে স্কেটস করে ও এপাশ-ওপাশ সামান্য ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই শান্তনু আর পলাশকে লক্ষ করে ও যান্ত্রিকভাবে ওর যন্ত্রের গুণগান করতে শুরু করল।
..দেখুন, আমাদের কোম্পানি কখনও লো কোয়ালিটির প্রোডাক্ট বিক্রি করে না। এই যে স্কেস দেখছেন, এর চেসিসগুলো স্টিলের তৈরি, আর চাকাগুলো ইমপোর্টেড। স্কেস-এর চাকাই হল আসল। চাকা একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর রিপ্লেস করা যায় না। তখন নতুন স্কেস কিনতে হয়–একজোড়া। কারণ, সিঙ্গল স্কেট পাওয়া যায় না সবসময় পেয়ারে সাপ্লাই আসে।
কথা বলতে বলতে চাকা গড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল দ্বৈপায়ন। এইবার ও ফ্লেক্সিবারটা তুলে ধরল।
এটার নাম ফ্লেক্সিবার। এটাও আপনারা দারুণ সিলেক্ট করেছেন। এটা মুম্বইয়ের স্ম্যাশ কোম্পানির প্রোডাক্ট। আমরা মাত্র বছরখানেক এজেন্সি নিয়ে দুর্দান্ত রেসপন্স পেয়েছি। দু-পাশের এই হাতল দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বারটাকে বেঁকাতে হয়…। দ্বৈপায়ন দু-পাশের হাতল ধরে আড়াই ফুট মতন লম্বা বারটাকে বেশ সহজেই বেঁকিয়ে ধরল এইভাবে বেঁকালে বাইসেপ আর ট্রাইসেপ তৈরি হয়। বারটা ছেড়ে দিলেই স্প্রিং-এর অ্যাকশনে ওটা আবার লাঠির মতন সোজা হয়ে যায়। এর বাক্সের ভেতরে ফ্লেক্সিবারের নানারকম ব্যায়ামের চার্ট আছে। ওটা একবার দেখে নিলেই আর কোনও প্রবলেম হবে না। আর হলে আমাদের কোম্পানি তো আছেই। নিন, হাতে নিয়ে একবার টেস্ট করে দেখুন।
ফ্লেক্সিবারের গুণপনার ব্যাখ্যা করতে করতে দ্বৈপায়ন পলাশের কাছে এসে পড়েছিল। পলাশ বেশ বিরক্ত হয়ে বেহায়া সেলসম্যানটাকে দেখছিল। মিমোকে জাপটে ধরে ভাঙা টিভি টার প্রায় গায়েই দাঁড়িয়ে ছিল ও। ভাবছিল, কতক্ষণে আপদ বিদেয় হবে।
কিন্তু দ্বৈপায়ন যে হঠাৎ ওকে আক্রমণ করবে সেটা পলাশ বুঝতে পারেনি।
ফ্লেক্সিবারটা ইউ অক্ষরের মতো কোনো অবস্থায় স্কেটস করে পলাশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল দ্বৈপায়ন। আচমকা ও বারের একটা দিক ছেড়ে দিল।
স্প্রিং-এর টেনশানে ছিটকে সোজা হয়ে গেল বারটা। ওটার ভারী শক্ত হাতল দ্বৈপায়নের হিসেব মতো পলাশের ডান গালে গিয়ে আছড়ে পড়ল।
বিশ্রী শব্দ হল একটা। পলাশের গাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। সংঘর্ষের ধাক্কায় টিভি র দিকে হেলে পড়ল পলাশ। আর সঙ্গে-সঙ্গেই বাস্টার্ড বলে দ্বৈপায়ন ডান পায়ে এক তীব্র লাথি কষাল পলাশের দু-পায়ের ফাঁকে। রোলার স্কেটের ইস্পাতের চেসিস পলাশের শরীরে বোধহয় কেটে বসল। কারণ, পলাশ এইবার যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। ও লাট খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। ওর চশমা ছিটকে পড়ল দূরে।
সীমন্তিনী গলা ফাটিয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল–যে-চিৎকারটা ও এতক্ষণ ধরে প্রাণপণে করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি।
শান্তনু যেন এক অলৌকিক মন্ত্রের জোরে ঘোর কাটিয়ে উঠল। ও মিমো! মিমো! করে আর্ত স্বরে ডেকে উঠল।
পলাশ মিমোকে আঁকড়ে ধরেছিল। তাই ওর শরীরটা বেটাল হয়ে মেঝেতে পড়ে যেতে বাচ্চাটাও একইসঙ্গে কাত হয়ে পড়ল ওর গায়ে।
পলাশ সেই অবস্থাতেই বাচ্চাটার চুলের মুঠি চেপে ধরল। আর মিমো গোঙানির মতো একটা চাপা চিৎকার করে কামড় বসিয়ে দিল পলাশের পেটে।
যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে উঠল পলাশ। মিমোকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। মিমো ছাড়া পেয়েই কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছুট লাগাল মায়ের দিকে। সীমন্তিনী ওকে পাগলের মতো জাপটে ধরল। কাঁদতে কাঁদতেই ওর কপালে-গালে-মাথায় চুমু খেতে লাগল। আর বারবার বলতে লাগল, বাবুসোনা, তোর লাগেনি তো! বাবুসোনা, তোর লাগেনি তো!
দ্বৈপায়নের কাজ তখনও শেষ হয়নি। ও ফ্লেক্সিবারটাকে লাঠির মতো ব্যবহার করতে লাগল। ধোপারা যেভাবে মুগুর পিটিয়ে কাপড় কাঁচে, ও ফ্লেক্সিবার দিয়ে পলাশকে সেভাবে কাচতে লাগল।
এত হইচই চেঁচামেচিতে বাসন্তী আবার ড্রইং স্পেসে চলে এসেছিল। মিমোর হাতে রক্ত দেখে ও কেঁদে ফেলল। শান্তনু মিমোর কাছে এসে ওর হাতটা পরীক্ষা করে বুঝল, মিমোর কিছু হয়নি। পলাশের রক্ত ওর গায়ে লেগেছে।
ওরা চারজন এক জায়গায় জড়ো হয়ে দ্বৈপায়নের কীর্তি দেখছিল। ওর ইস্পাতের মতো দেহটা নমনীয় হয়ে যেভাবে খুশি বেঁকে যাচ্ছিল, আর পলাশকে আড়ং ধোলাই দিচ্ছিল। কখনও ওর হাত চলছিল, কখনওবা পা। রোলার স্কেটস-এর এইরকম অমানুষিক অপব্যবহার কেউ কোনওদিন কল্পনাও করেনি।
পলাশের সারা শরীরে রক্ত। পোশাক-আশাক নানা জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। ওর অসাড় দেহটা একতাল কাদার মতো টিভি-র কাছে পড়ে আছে। কান্না ও যন্ত্রণা মেশানো একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে আসছে ওর মুখ থেকে। শুধু তাতেই বোঝা যাচ্ছে ও এখনও খতম হয়নি।
দ্বৈপায়ন বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছিল। ওর মাথার ভেতরে আগুন জ্বলছিল। সীমা আর মিমোকে যে গায়ে আঁচড় কাটে দ্বৈপায়নের হাতে তার নিস্তার নেই।
রাস্তায় মোটর বাইক রেখে বাড়িতে ঢোকার সময় ও শক্তিমানের ছবিটা দেখতে পায়। ও অবাক হয়ে ওটা হাতে তুলে নিয়েছিল। এটা রাস্তায় ফেলে দিল কে? চোখ তুলে সীমাদের ফ্ল্যাটের জানলার দিকে তাকিয়েছিল দ্বৈপায়ন। সীমা কি মিমোর ওপর চটে গেছে? না কি অন্য কোনও বিপদ দেখা দিয়েছে সেখানে? যে-ছবিটা গুটের প্রাণ সেটা কেন অবহেলায় রাস্তায় পড়ে আছে?
শক্তিমানের ছবিটা হাতে নিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল দ্বৈপায়ন। তারপর ফোন করেছিল শান্তনুদের ফ্ল্যাটে। ফোনের ঘন্টি বেজেই চলল, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। অথচ দ্বৈপায়ন স্পষ্ট দেখেছে, ওদের ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে।
দ্বৈপায়নের সন্দেহটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল। ওর মাথার ভেতরে ব্যাগাটেলির গুলি দৌড়তে শুরু করল। কী করা উচিত এখন?
কয়েকমিনিট ধরে নানান চিন্তা করার পর দ্বৈপায়ন লালবাজারে বিজয় মিত্রের দেওয়া ফোন নম্বরে ফোন করেছে। বিজয় মিত্রের নামে ইমারজেন্সি মেসেজ দিয়ে দিয়েছে আর-একজন অফিসারের কাছে। তারপর আবার ভাবতে বসেছে। শান্তনুদের ফ্ল্যাটে গিয়ে কি ও নক করবে? নাকি আগেভাগেই শোরগোল তুলে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ফেলবে? কিন্তু তারপর যদি দ্যাখে যে, সেরকম কিছুই হয়নি!
এইরকমের বহু উলটোপালটা চিন্তার পর শেষ পর্যন্ত দ্বৈপায়ন যা ভালো বুঝেছে তাই করেছে।
সীমন্তিনী আর শান্তনুর চিৎকারে দ্বৈপায়নের ঘোর কাটল। সীমা ছুটে এসে ওর হাত চেপে ধরলঃ ঢের হয়েছে, দিপু! আর না। এবার থামো। লোকটা বোধহয় মরেই গেছে।
দ্বৈপায়ন থামল। ফ্লেক্সিবারে লাঠির মতো ভর দিয়ে ও হাপরের মতো হাঁপাতে লাগল। একটু দম নিয়ে বলল, লালবাজারে ফোন করে দিয়েছি। ওরা এখুনি হয়তো এসে পড়বে। এই লোকটাকে এখানে আটকে রেখে তোমরা আমাদের ফ্ল্যাটে চলো–
সীমার সঙ্গে-সঙ্গে মিমোও চলে এসেছিল দ্বৈপায়নের কাছে। দ্বৈপায়ন ওকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল। এক হাতে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, গুটে, তোর আর কোনও ভয় নেই…।
বাচ্চাটা দ্বৈপায়নের কোমরের কাছে মুখ গুঁজে রইল। একটু পরে আড়চোখে তাকাল নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা পলাশের দিকে। ইতস্তত করে বলল, এই…এই লোকটা মা-মার্ডারার?
দ্বৈপায়ন হেসে বলল, হ্যাঁ, মার্ডারার।
কাল সকালে আমাকে রোলার এস্কেট শেখাবে তো?
হ্যাঁ, শেখাব। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল দ্বৈপায়ন।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাসন্তী চাপা চিৎকার করে উঠল। কারণ, পলাশের নড়াচড়া ও প্রথম লক্ষ করেছে।
শান্তনুও ব্যাপারটা দেখেছিল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
পলাশ মেঝেতে দেড় পাক গড়িয়ে চোখের পলকে চলে এল মিমোর কাছে। ওর পা ধরে এক প্রচণ্ড হ্যাঁচকা মারল। দ্বৈপায়নের আলতো বাঁধন ছিঁড়ে মিমো শব্দ করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। চিতাবাঘ যেভাবে হরিণ ধরে, পলাশ সেইরকম হিংস্র ক্ষিপ্র ঢঙে মিমোকে এক টান মেরে নিয়ে এল নিজের কাছে। তারপর, মেঝেতে শোওয়া অবস্থাতেই, ও কোথা থেকে যেন বের করে নিল লুকোনো ছুরিটা। অমানুষের মতো নিষ্ঠুরভাবে ওটার বাঁকানো ফলা মিমোর গলায় চেপে ধরল। ফাঁসফেঁসে চাপা গলায় খেঁকিয়ে উঠল, সবাই দূরে সরে যা। কেউ চেঁচাবি না। তা হলে সত্যি-সত্যি এটার গলা কেটে দেব।
পলাশকে বীভৎস দেখাচ্ছিল। মুখের নানা জায়গায় রক্তের ছোপ। জামাকাপড় বিধ্বস্ত। চশমা না থাকায় চোখ দুটো কেমন অচেনা লাগছে। আর মিমো কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
নতুন করে ভয় আর আশঙ্কা নেমে এল ঘরের ভেতরে।
শান্তনু, সীমন্তিনী আর দ্বৈপায়ন পলাশের নির্দেশমতো কয়েক পা দুরে সরে গেল।
পলাশ কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল। মিমোকেও টান মেরে দাঁড় করাল। ছুরিটা ওর ডান চোয়ালের নীচে গলায় সামান্য চাপ দিয়ে বসানো। ছুরির ধারালো ডগার চাপে গলার নরম চামড়া কেটে গিয়ে রক্তের বিন্দু দেখা যাচ্ছে।
পলাশ পাগলের মতো ভয়ঙ্কর উদভ্রান্ত চোখে ওদের চারজনকে একে-একে দেখে নিল। চশমা না থাকায় মুখগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে, তবে এ ছাড়া আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
বাসন্তীকে লক্ষ করে খিঁচিয়ে উঠল পলাশ, দরজায় খিল-ছিটকিনি ভালো করে এঁটে দে। যে-কেউ হাজার ডাকলেও দরজা খুলবি না।
বাসন্তী ভয়ে ঝাঁকিয়ে উঠে ছুটে গিয়ে দরজার খিল আর ছিটকিনি ভালো করে এঁটে দিল।
দ্বৈপায়নের দিকে আঙুল তুলে শান্তনুর দিকে তাকিয়ে পলাশ জানতে চাইল, এই লোকটা কে? ঠিক-ঠিক জবাব দিবি। নইলে তোর ছেলের ছুটি করে দেব। স্কুলে ওর ক্লাসে একটা সিট খালি হয়ে যাবে।
শান্তনু হোঁচট খাওয়া গলায় বলল, ও দ্বৈপায়ন–আমাদের সামনের ফ্ল্যাটে থাকে।
মিমোর চুলের মুঠি ধরে পলাশ ওকে টেনে নিয়ে গেল একটা শো-কেসের কাছে। নিষ্ঠুরভাবে মাথাটা ঠুকে দিল শো-কেসের গায়ে। তারপর শান্তনুর দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, সত্যি করে বল, এই লোকটা কে! পলাশ তখনও হিংস্রভাবে বাচ্চাটার চুলের মুঠি ধরে রয়েছে। চোখে পাগলের মরিয়া দৃষ্টি।
সীমন্তিনী কেঁদে উঠে ভাঙা জড়ানো গলায় সব বলল পলাশকে। বারবার করে অনুরোধ করল, আপনি যা বলবেন তা-ই শুনব। বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
ছেড়ে দেব! ও হল আমার ফিক্সড ডিপোজিট। মিমোর চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরল পলাশ। তারপর দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে বলল, হিরো, ওই ফ্লেক্সিবারটা আমার দিকে ছুঁড়ে দে।
দ্বৈপায়ন চুপচাপ কথা শুনল। বারটা আলতো করে ছুঁড়ে দিল পলাশের পায়ের কাছে।
এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।
আচমকা কলিং বেলের শব্দে ওরা সবাই চমকে উঠল।
কোনও শালাকে ফ্ল্যাটে ঢোকাবি না! চাপা গর্জন করল পলাশ, সীমাসুন্দরী, তুমি শিগগির যাও দরজা না খুলে চেঁচিয়ে যা-হোক বলে উটকো পাবলিককে ফোটাও। জলদি! কুইক!
দরজার কাছে যাওয়ার আগে ছেলের দিকে একবার তাকাল সীমা। চোখ-মুখের কী অবস্থা হয়েছে ওর! ভয়ে যেন ঠান্ডা পাথর হয়ে গেছে। কান্নার একটা ভাঙা টুকরো বেরিয়ে এল সীমার গলা চিরে। ও দরজার কাছে গিয়ে ডেকে উঠল, কে?
মিসেস সেনগুপ্ত, আপনাদের ফ্ল্যাটে কোনও গোলমাল হয়েছে নাকি?
গলাটা চেনা-চেনা মনে হল সীমার। চারতলার মিস্টার সিনহা হতে পারেন।
ও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় চেঁচিয়ে বলল, না, না,–সেরকম কিছু না। আমাদের নিজেদের ব্যাপার।
ও, আচ্ছা। ঠিক আছে। যা হোক করে একটু মানিয়ে-টানিয়ে নিন।
দরজার ওপারে আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
পলাশ ছুরিটা বাঁ হাতে চালান করে দিয়ে ফ্লেক্সিবারটা ডান হাতের শক্ত মুঠোয় তুলে নিয়েছিল। ছুরিটা মিমোর বাঁ চোয়ালের নীচে চেপে ধরে ও দ্বৈপায়নকে এবার কাছে ডাকল– ঠিক যেভাবে লোকে পোষা কুকুরকে ডাকে ও আ যা, মেরে হিরো, আ যা! আঃ, তু তু তু…।
রোলার স্কেটস পরা পায়ে মেঝেতে শব্দ করে কয়েক পা এগিয়ে এল দ্বৈপায়ন। ও পলাশের চোখে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিল পাগল খুনিটা ঠিক কী করতে চায়।
এবার মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়! কুইক! কড়া গলায় হুকুম দিল পলাশ, নইলে এই ছোঁড়াটাকে খালাস করে দেব। নে, শুয়ে পড়, জলদি!
স্কেকট পরা পায়ে শুয়ে পড়তে একটু অসুবিধে হল বটে কিন্তু দ্বৈপায়ন মুখ বুজে পলাশের কথা মেনে নিল। অবশ্য না মেনে কোনও উপায়ও ছিল না।
উপুড় হয়ে শুয়ে ও ভাবতে লাগল প্রথম আঘাতটা ঠিক কীভাবে আসবে। আচ্ছা, ইন্সপেক্টর বিজয় মিত্র কি ওর দেওয়া ইমারজেন্সি মেসেজটা পেয়েছেন? ওঁরা খবর পেয়ে আসবেন তো?
শালা, শুয়োরের বাচ্চা! মুখ খিস্তি করে মেঝেতে থুতু ছেটাল পলাশ ও থুঃ! তারপরই ফ্লেক্সিবারটা প্রবল বেগে শূন্যে ঘুরিয়ে বসিয়ে দিল দ্বৈপায়নের মাথার পিছনদিকে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে ফাইবারের হাতলের একটা অংশ ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে গেল।
দ্বৈপায়ন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কিন্তু পলাশের মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। এক হাতে মিমোকে জাপটে রেখে অন্য হাতে ও দ্বৈপায়নের শুয়ে থাকা শরীরটাকে পেটাতে লাগল। আর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল।
সীমন্তিনী চিৎকার করে মারতে বারণ করে ছুটে আসতে চাইছিল, কিন্তু পলাশ দাঁত খিঁচিয়ে মিনোর গলায় আলতো করে ছুরির আঁচড় টেনে দিল। রক্তের রেখা ফুটে উঠল ওর গলায়। আর বাচ্চাটা প্রাণভয়ে মা! মা! বলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
শান্তনু আর সহ্য করতে পারছিল না। ও মনে-প্রাণে জ্ঞান হারাতে চাইছিল। শুকনো খসখসে গলায় ও পলাশকে আর্ত প্রার্থনা জানাল, মিমোকে ছেড়ে দে, ভাই। তুই যা চাস সব নিয়ে নে– ।
পলাশ দ্বৈপায়নকে পেটানো থামিয়ে শান্তনুর দিকে ঘুরে তাকাল। হেঁচকি তুলে খলখল করে হাসল ও দ্যাখ, শালা! ওই হিরো দ্বৈপায়নের দিকে আঙুল দেখাল পলাশ : আর আমি ভিলেন নিজের বুকে হাত ঠুকল এবার : দেখি, হিরোর প্রাণভোমরা বডি ছেড়ে বেরোয় কি না! ফ্লেক্সিবার বাগিয়ে ধরে আবার তৈরি হল পলাশ।
ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল আবার।
পলাশ চমকে ঘুরে তাকাল দরজায় দিকে। তারপর সীমাকে ইশারা করল। যার অর্থ হল, যে-ই এসে থাকুক তাকে যা-হোক কিছু বুঝিয়ে নিরস্ত করো।
সীমা দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, কে?
দরজার ওপাশ থেকে উত্তর এল, আমি মানে, আমরা আপনাদের হেল্প করতে এসেছি।
চেনা গলা। ইন্সপেক্টর বিজয় মিত্র।
সীমার বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠল। কী বলবে এখন ও? ঠোঁট কামড়ে বিহ্বল চোখে হতভাগা বাচ্চাটার দিকে একবার তাকাল সীমা।
পলাশ বিজয় মিত্রের কথাগুলো শুনতে পায়নি। কিন্তু সীমার চাউনিতে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবটা ও স্পষ্ট বুঝতে পারল। তাই অসভ্যের মতো খেঁকিয়ে উঠল, যে-ই হোক দরজা খুলবি না! এক হ্যাঁচকায় মিমোকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল। চঞ্চল চোখে ফ্ল্যাটের এপাশ-ওপাশ জরিপ করল।
সীমা বারকয়েক ঢোঁক গিলে কোনওরকমে বলল, আমরা ব্যস্ত আছি। দরজা খোলা যাবে না। পরে আসবেন।
মিসেস সেনগুপ্ত, কীসব আবোলতাবোল বকছেন! বিরক্ত গলায় বললেন বিজয় মিত্র, পলাশ সান্যাল কি ভেতরে আছে?
হ্যাঁ ।
আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে? এবার চাপা গলায় কথা বললেন বিজয় মিত্র।
হ্যাঁ।
ওর কাছে রিভলবার আছে?
না –না।
ছুরি?
হ-হ্যাঁ।
আপনার বাচ্চাটা কি ভেতরে আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। এবার কেঁদে ফেলল সীমন্তিনী। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার চাপে ওর বুকের ভেতরটা যেন জমাট বেঁধে ছিল। হঠাৎই সেটা গলতে শুরু করল। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল সীমা। ওর কান্না কিছুতেই আর থামতে চাইছিল না।
হিংস্র বাঘের গলায় সীমাকে ডাকল পলাশ, অ্যাই! এদিকে চলে আয়!
শান্তনু সীমার কাছে গিয়ে ওকে শান্ত করতে চাইল। বলল, কোনও ভয় নেই। এপাশে চলে এসো।
ঠিক তখনই দরজায় রুক্ষ আঘাত পড়ল। বেপরোয়াভাবে দরজায় লাথি মারছে কেউ।
পলাশ মিমোকে টেনে নিয়ে দেওয়ালের এক কোণে চলে গেল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ঘরে কেউ ঢুকলেই বাচ্চাটার গলা কেটে দেব! ওদের বারণ কর বলছি!
সীমার কান্না একফোঁটাও থামেনি।
শান্তনু কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
বাসন্তী ওদের কাছটিতে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
আর দ্বৈপায়নের অসাড় দেহটা সামান্য নড়েচড়ে উঠল।
আধমিনিটও লাগল না। দরজায় কাঠ ফেটে গেল। দুটো অজানা-অচেনা হাত সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে খিল-ছিটকিনি খুলে ফেলল। তারপরই ঘরে ঢুকে পড়ল চারজন মানুষ। দুজন সাদা-পোশাক, আর দুজন উর্দি-পরা কনস্টেবল। সাদা-পোশাকের একজনকে শান্তনু আর সীমন্তিনী চিনতে পারলঃ বিজয় মিত্র।
দরজায় বাইরে উৎসাহী জনতার ভিড় জমে গিয়েছিল। বিজয় মিত্র কনস্টেবল দুজনকে দরজায় মোতায়েন করে দিলেন। তারপর হাঁপ ছেড়ে একগাল হেসে বললেন, যাক, আর কোনও ভয় নেই। আমরা এসে পড়েছি। সীমন্তিনীর দিকে ফিরে : ম্যাডাম, আমাদের একটু চা খাওয়ান। গলাটা বড্ড শুকিয়ে গেছে।
বিজয় মিত্রের আচরণে সকলেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। এরকম একটা বিপজ্জনক মুহূর্তে ভদ্রলোক যেন পিকনিক করতে এসেছেন।
ভুড়ি সামলে হেলেদুলে হেঁটে বিজয় মিত্র একটা সোফায় গিয়ে বসলেন। তারপর এই প্রথম যেন দ্বৈপায়ন আর পলাশকে দেখতে পেলেন। পলাশকে বললেন, কী ব্যাপার? আপনারা দুজন মারপিট করছিলেন নাকি? আর বাচ্চাটাকে ওভাবে ধরে আছেন কেন? ওকে ছেড়ে দিন। সীমন্তিনীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ম্যাডাম, দাঁড়িয়ে থাকবেন না, প্লিজ। আমার তাড়া আছে– এক্ষুনি চলে যাব। চা-টা একটু জলদি হলে ভালো হয়।
দ্বৈপায়নের গলা দিয়ে উঃ-আঃ শব্দ বেরোচ্ছিল। বিজয় মিত্র সঙ্গীর দিকে ফিরে বললেন, ব্যানার্জি, একে তুলে বাথরুমে নিয়ে যান। মাথায় জল-টল দিয়ে দেখুন কী ধরনের ইনজুরি হয়েছে। সেরকম বুঝলে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
ব্যানার্জি কোনও কথা না বলে দ্বৈপায়নকে অনায়াসে চাগিয়ে দু-হাতে তুলে নিলেন। তারপর শান্তনুর দিকে চোখের ইশারা করে জানতে চাইলেন, বাথরুমটা কোনদিকে। শান্তনু দেখিয়ে দিতেই সেদিকে চলে গেলেন।
সীমন্তিনী বাসন্তীকে পাঠাল চা তৈরি করতে। কান্না থামিয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ও বিজয় মিত্রকে দেখছিল। পলাশও অবাক সতর্ক চোখে তাকিয়ে ছিল এই অদ্ভুত অফিসারের দিকে।
এবার শান্তনুর দিকে তাকালেন বিজয় মিত্রঃ মিস্টার সেনগুপ্ত, আসুন–এখানে এসে বসুন–আপনার সঙ্গে কথা আছে।
শান্তনু বাধ্য ছেলের মতো কথা শুনল। বিজয় মিত্রের কাছাকাছি একটা সোফায় বসে আমতা-আমতা করে বলল, আমি…আমাদের…।
বুঝেছি, বুঝেছি। ব্যস্ত হতে হবে না–চুপ করে বসে একটু জিরোন, চা-টা খান–তারপর কথা হবে।
মিমো। ঘরের আর-এক প্রান্ত থেকে সীমা ছেলের নাম ধরে ডেকে উঠল।
তখনই যেন বিজয় মিত্র পলাশকে আবার খেয়াল করলেনঃ আরে, কী হল! আপনাকে বললাম না বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন। ওকে ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে বসুন কথা আছে।
পলাশ হঠাৎই রাগে ফেটে পড়ে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, আমাকে আটকালে বাচ্চাটার গলা কেটে দেব! মিমোর চুলের মুঠি ধরে হিংস্রভাবে আঁকিয়ে ওর মাথাটা কাত করে ধরল পলাশ। তখনই ওর গলায় ভয়ঙ্করভাবে চেপে ধরা ছুরিটা স্পষ্ট দেখা গেল।
আমি এখান থেকে চলে যাব– হিসহিস করে বলল পলাশ, ওদের বলুন পথ ছেড়ে দিতে। কেউ যেন আমাকে না আটকায়।
বিজয় মিত্র হাসলেন, বললেন, পলাশবাবু, আপনাকে আটকাতে আমরা আসিনি। আপনার এগেইস্টে কোনও অভিযোগ কিংবা প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। আপনাকে আমরা অ্যারেস্ট করতেও চাই না। আপনি শুধু বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন। শেষ কথাটা বলার সময় বিজয় মিত্রের গলাটা কেমন ঠান্ডা শোনাল।
না! ছাড়ব না! দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করল পলাশ।
এই আপনার শেষ কথা?
হ্যাঁ।
তা হলে আপনি চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন। হেসে বললেন বিজয় মিত্র। এবং মোটা শরীরটাকে একপাশে কাত করে পকেট থেকে একটা ছোট মাপের অটোমেটিক পিস্তল বের করলেন। চোখ দিয়ে মেপে দেখলেন, তার কাছ থেকে পলাশের দূরত্ব প্রায় বারো-তেরো ফুট।
পিস্তলটা দেখেই শান্তনুর মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। সীমন্তিনী ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
পিস্তলটা নেড়েচেড়ে পলাশকে দেখালেন বিজয় মিত্র ও এটা লামা অটোমেটিক পিস্তল। সোয়া ছইঞ্চি ব্যারেল। ওজন ছশা গ্রাম মতন। আটটা গুলি করা যায়। দেখতে ছোট হলে কী হবে, ভীষণ কাজের।
সীমা, লোকটাকে ভয় দেখাতে বারণ করো! চেঁচিয়ে বলল পলাশ, নইলে আমি কিন্তু মিমোকে খতম করে দেব।
পলাশবাবু, আপনি কখনও ষাঁড়ের লড়াই দেখেছেন? হাসিমুখেই জানতে চাইলেন বিজয় মিত্র, ওই যে, স্পেনে যেটা হয়। তাতে ম্যাটাডর যখন ছুটে আসা যাঁড়টাকে তরোয়াল দিয়ে শেষ করে তখন তার মধ্যে একটা অঙ্কের হিসেব থাকে। ম্যাটাডর চার্জিং বুলের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ায়। ষাঁড়টা মাথা নীচু করে ধুলো উড়িয়ে তার দিকে ধেয়ে আসে। যখন ষাঁড়টা ম্যাটাডরের গায়ের কাছে এসে যায় তখন সামনে, ষাঁড়ের দু-শিং-এর ফাঁকে, ঝুঁকে পড়ে ম্যাটাডর একটা বিশেষ জায়গায় তরোয়ালটাকে আমূল ঢুকিয়ে দেয়। জায়গাটা হল, কুঁজের সামনে, দুধের জোড়ের ঠিক মাঝে, একটা টোল খাওয়া ছোট্ট অঞ্চল। ম্যাটাডরের সোজা সরু তরোয়ালটা এখানে বিধিয়ে দিলে সেটা মাখন কেটে বসার মতো স্ট্রেট ভেতরে ঢুকে যায়। আর লাইটের সুইচ অফ করে দেওয়ার মতো ষাঁড়টার প্রাণবাতি তক্ষুনি নিভে যায়। ওটা জাস্ট খসে পড়ে ম্যাটাডরের পায়ের কাছে, একফোঁটা ছটফট করতে পারে না। কারণ, ওটার মেইন আর্টারিটা ড্যামেজ হয়ে যায়…।
পলাশ অধৈর্য হয়ে পড়লেও বিজয় মিত্রের কথাগুলো শুনছিল। ব্যাঙ যেমন সাপের কথা শোনে।
বাসন্তী সত্যি-সত্যি চার কাপ চা নিয়ে এল ট্রে-তে করে। কাপ-প্লেটগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখার সময় বিশ্রী ঠুনঠুন শব্দ হচ্ছিল। কারণ, ওর হাত কাঁপছিল।
শান্তনু অসহায় বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছিল। মিমো যা-যা বায়না করবে এখন থেকে ও সবই কিনে দেবে। শুধু আজ কেউ ওকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে দিক।
বিজয় মিত্র হেসে একটা কাপ তুলে নিলেন বাঁ হাতে। তাতে শব্দ করে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির আঃ! শব্দ করলেন।
ব্যানার্জি ভেতর থেকে ড্রইং স্পেসে চলে এলেন। বিজয় মিত্রের কাছে এসে বললেন, ওঁর জ্ঞান ফিরে এসেছে। শোওয়ার ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলে ভালো হয়।
গুড। একটু পরে ডাক্তার ডাকার ব্যবস্থা করছি। এখন নিন, চা খান।
ব্যানার্জি ইতস্তত করে দাঁড়িয়েই রইলেন। তিনি বিজয় মিত্রের হাতের পিস্তলটার দিকে দেখছিলেন, আর দেখছিলেন পলাশের দিকে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কাপ টেবিলে রেখে বিজয় মিত্র আবার বলতে শুরু করলেন, পলাশবাবু, এখানে আপনি হলেন খ্যাপা ষাঁড়, আর আমি মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা উদ্ভট চেহারার ম্যাটাডর। তবে সোর্ডের চেয়ে বন্দুক-পিস্তল এসব আমার বেশি পছন্দ। আমি এখন যে আপনাকে ঠিক দু-ভুরুর মাঝে গুলি করব তাতে আপনার মাথার ভেতরে করপাস ক্যালোসাম, থ্যালামাস আর হাইপোথ্যালামাস সব তালগোল পাকিয়ে ভুনি খিচুড়ি হয়ে যাবে। মানে, এককথায় বলতে গেলে, আপনার বাতি নিভে যাবে। অবশ্য আপনার মাথার পেছনের দেওয়ালটা ইয়ে-টিয়ে লেগে একটু নোংরা হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি যে-কোনও হার্ড ক্রিমিনালকে প্রথমে রিকোয়েস্ট করি..তারপর বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু করে দিই। হাসলেন বিজয় মিত্র।
এবং হাসতে-হাসতেই কথা থামিয়ে পলাশকে গুলি করলেন।
বন্ধ ফ্ল্যাটে সাইকেলের টায়ার ফাটার শব্দ হল।
সীমা আর বাসন্তী চিৎকার করে উঠল।
শান্তনু ছুটে গেল মিমোর দিকে।
ঘরে বারুদের পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগল।
পলাশের মৃতহেদটা তখন দেওয়াল ঘষটে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ছে। ওর চোখে প্রাণহীন শূন্য দৃষ্টি। দেখেই বোঝা যায় বাতি নিভে গেছে।
বিজয় মিত্র পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ব্যানার্জিকে বললেন, নিন, আমার কাজ শেষ। এবার আপনার কাজ শুরু।
চায়ের কাপে আর-একবার চুমুক দিয়ে বিজয় মিত্র বাসন্তীকে লক্ষ করে বললেন, চা-টা হেভি হয়েছে, মা-মণি। তবে চিনি একটু কম হয়েছে। একটু চিনি দিতে পারো?
শান্তনু, সীমা আর মিমো তখন একে অন্যকে জাপটে ধরে যা খুশি তাই করছিল।