সমুদ্রর দরজা

সমুদ্রর দরজা

সারা রাত অফিসে বসে কাজ করেছি। ভোর রাতে গাড়ি এসে আমাকে নামিয়ে দিয়েছিল বাড়িতে। রাজীব যখন আমার বাড়ি এসে উপস্থিত হল তখন পরপর তিন রাত অফিসের কাজ করার পর সবার যখন ঘুম ভাঙে তখন আমি বিছানাতে শোবার উদ্যোগ নিচ্ছি ভোর পাঁচটার সময়। গাড়ি নিয়ে ভোর পাঁচটাতে আমার বাড়ি তার আসার উদ্দেশ্যটা অনুমান করতে আমার অসুবিধা হয়নি। এর আগেও বার কয়েক আমার বাড়িতে এমনই কাকভোরে উপস্থিত হয়ে সে বলেছে—’চল একটা রাত কোথাও কাটিয়ে আসি। শনি-রবি তো তোর অফিস ছুটি। এর পর বেড়িয়ে পড়েছি আমরা। কখনো দীঘা, কখনো মুর্শিদাবাদ, কখনো বা বেথুয়াডহরীর বন বাংলোতে। শনিবার রওনা হয়ে প্রকৃতির মুক্ত বাতাস সেবন করে, উপযুক্ত পানাহার সাঙ্গ করে, মন চাঙ্গা করে আমরা কলকাতা ফিরে এসেছি। আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, ওর গাড়ির হর্ন শুনে দরজা খুলতেই ও বলল, ‘নে তৈরি হয়ে নে। ঘুরে আসি, আজ যাব কাল ফিরব।’

তার কথা শুনে আমি বললাম, ‘কোথায় যাবি? একটু আগেই অফিস থেকে ফিরলাম। তিন রাত কাজ করেছি। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা।’

রাজীব বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি গেলেই বুঝতে পারবি। ঘণ্টা চার-পাঁচ সময় লাগবে যেতে। এসির মধ্যে পিছনের সিটে শুয়ে টানা ঘুম দিলেই শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে।’

শরীররটা সত্যিই আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। ঘুমে ভেঙে আসছিল চোখ। তাই অন্য দিনের মতো আমি তার প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ না করে একটু দোনামোনা করে বললাম, ‘আমাকে কি যেতেই হবে?’

আমার কথাটা শোনার সাথে সাথে রাজীবের মুখমণ্ডলে কেমন যেন একটা বিষণ্ণ ভাব ছড়িয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার খেয়াল হল, ক-দিন আগেই রাজীবের ব্রেক-আপ হয়েছে ওর প্রেমিকার সাথে। রাজীব কিছুটা মানসিক অবসাদের মধ্যে আছে। এ সময় ওর সঙ্গ দান করা আমার কর্তব্য। কাজেই আমি এরপর আর পুরানো বন্ধুর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে কিছুক্ষণের মধ্যেই চড়ে বসেছিলাম গাড়িতে। পিছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়েই ঘুম নেমে এসেছিল আমার ক্লান্ত চোখে। রাজীব পরিস্থিতি বুঝে আমার সাথে আর কোনো কথা বলেনি। ড্রাইভার সিটে বসে রওনা হয়েছিল গন্তব্যর পথে। মাঝে অবশ্য একবার কয়েক মুহূর্তর জন্য ঘুম ভেঙেছিল আমার। ঘুম জড়ানো চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলাম ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। ভরা বর্ষাকাল, এ বৃষ্টি অবাক হবার মতো ঘটনা নয়। বৃষ্টির মধ্যে ফাঁকা রাস্তায় রাজীব গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। পথের দু-পাশে ফাঁকা মাঠ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম কলকাতার বাইরে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। কয়েক মুহূর্ত বাইরের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। তিন-চার ঘণ্টার লম্বা ঘুম।

একটা নোনা বাতাসের গন্ধে ঘুম ভাঙল আমার। না, এসির বাতাস নয়। জানলার কাচ কখনো যেন নামিয়ে দিয়েছে রাজীব। নোনা, মৃদু আঁশটে গন্ধ মেশানো বাতাস ভেসে আসছে বাইরে থেকেই। একটা ছোটো বাজারের মতো জায়গার মধ্য দিয়ে চলেছে গাড়িটা। বেশ কয়েকটা মাছের আড়ত চোখে পড়ল আমার। বেশ কিছু লোকজনও চোখে পড়ল আমার। গাড়ির সিটে আমার এলিয়ে পড়া শরীরটাকে তুলে সোজা হয়ে বসতেই রাজীব হেসে বলল, ‘তুই সত্যিই যা ঘুম দিলি! তিনবার গাড়ি থেকে নেমেছি আমি। একবার চা খেতে, একবার টয়লেটে আর শেষবার হুইস্কি কিনতে। তোর কোনো হুঁশ ছিল না বলে ডাকিনি। দেখবি এবার শরীর ফ্রেশ হয়ে গেছে। আমরা পৌঁছে গেছি জায়গাটাতে।’

তার কথা শুনে প্রথমে ঘড়ি দেখলাম আমি। এগারোটা বাজে। অর্থাৎ পাঁচ ঘণ্টা আমি টানা ঘুমিয়েছি। আমি মৃদু লজ্জিতভাবে বললাম, ‘তোকে বললাম না টানা তিন রাত ঘুমাইনি। সেজন্যই এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

আর এ কথা বলেই আমি রাস্তার অন্য পাশে তাকাতেই মন নেচে উঠল আমার। রাস্তার পাশে ঘর-বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে তাদের পিছন দিকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে! আমি তা দেখতে পেয়ে উৎফুল্লভাবে বলে উঠলাম, ‘সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি! কোথায় এলাম? দীঘা-মন্দারমণি নাকি?’

গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে রাজীব জবাব দিল, ‘না, ওটা বকখালি ফ্রেজারগঞ্জ। এ জায়গাটা হল ফ্রেজারগঞ্জ।’

এদিকটায় আমি আগে কোনোদিন আসিনি। আমি জানতে চাইলাম, ‘হোটেল বুক করে এসিছিস নাকি?’

রাজীব জবাব দিল, ‘হোটেল ঠিক নয়। একটা বাড়িতে যাব। তোকে একবার বলেছিলাম না যে সমুদ্রর ধারে একটা বাড়ির খুব শখ আমার? যেখানে সমুদ্র এসে ছুঁয়ে যাবে বাড়িটাকে, যেখানে নির্জনে বসে সমুদ্রর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। অমন একটা বাড়ির সন্ধান পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেটা নিয়ে নিলাম। সেখানেই যাচ্ছি।’

রাজীবদের মোটর পার্টস বিক্রির বিরাট পারিবারিক ব্যবসা আছে। পয়সার অভাব নেই। একটা বাড়ি সে শখ করে কিনতেই পারে। তবু আমি বিস্মিতভাবে জানতে চাইলাম, ‘নিয়ে নিলি মানে?’

রাজীব সমুদ্রর দিকের রাস্তায় এগোতে এগোতে বলল, ‘এক ব্যবসায়ীর থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে টাকা পেতাম। টাকাটা দিতে তার সমস্যা হওয়াতে বাড়িটা সে অফার করল। ছবি দেখে ভালো লাগল, নিয়ে ফেললাম। এমন একটা বাড়ির শখ আমার বহু দিনের।’

রাজীব কথাটা শেষ করেই একটা ছোটো মোড়ের গায়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল। দোকানটার সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। পরনে নীল রঙের শার্ট আর ধুতি। গালে কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লোকটার বয়স মনে হয় পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে। গাড়িটা থামতেই লোকটা তার হাতে ধরা একটা কাপড়ের টুকরো দেখে নিয়ে গাড়ির নম্বর প্লেটের দিকে তাকিয়ে নম্বর মিলিয়ে গাড়ির কাছটাতে এসে দাঁড়াল। রাজীব লোকটাকে দেখে গলাটা জানলা দিয়ে একটু বাইরে বার করে তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার নাম সনাতন বিশ্বাস?’

লোকটা মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘হ্যাঁ বাবু। আমিই সনাতন, ‘নিরালা’র কেয়ারটেকার।’

তার কথা শুনে রাজীব বলল, ‘আমিই ‘নিরালা’ কিনেছি। আমার সাথেই তোমার কাল রাতে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। গাড়িতে উঠে এসো।’

এ কথা লোকটাকে বলে রাজীব ঘাড় ফিরিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাড়িটার নাম ‘নিরালা।’ বেশ কয়েকবার মালিকানা বদল হয়েছিল বাড়িটার। আগের মালিকদের মধ্যেই কেউ একজন নিশ্চয়ই নামটা রেখেছিল।’

সনাতন, নামের লোকটা গাড়িতে উঠে একটু জড়োসড়ো হয়ে রাজীবের পাশে বসল। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রাজীব লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার নামতো তুমি জানোই। আমার সঙ্গে যিনি আছেন তিনি সঞ্জীববাবু। আমার বন্ধু। নিরালা এখান থেকে কতদূর, কোনদিকে যাব?’

সনাতন সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে প্রথমে আমাকে নমস্কার জানাল। তারপর রাজীবের কথার জবাবে বলল, ‘গাড়িতে দশ মিনিট লাগবে বাবু। আমি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর আর আসতে অসুবিধা হবে না। ঘর গুছিয়ে রেখেছি। আপনারা কী খাবেন বলবেন, বাজার থেকে কিনে নিয়ে রান্না করে দেব। চিন্তা করবেন না।’

তারপর মিনিট তিনেকের মধ্যেই সমুদ্রর গায়ের রাস্তায় এসে পড়লাম আমরা। পথের একপাশ থেকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সমুদ্রতট। নীল আকাশের নীচে সমুদ্রর দিক চিহ্নহীন জলরাশি সূর্য কিরণে ঝিলিক দিচ্ছে। দূরে বাসছে দু-একটা জেলে নৌকা। তবে সমুদ্র এখন কিছুটা দূরে সরে আছে। সমুদ্রতট থেকে সমান্তরাল রাস্তাটার অন্য পাশে কিছুটা তফাতে তফাতে বেশ অনেকটা করে জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল, রিসোর্ট। সে পথ ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। সনাতন বলল, ‘ক-দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে লোকজন এখন বেশি আসছে না। হোটেলগুলো ফাঁকাই পড়ে আছে। সমুদ্র এখন কিছুটা দূরে মনে হলেও জোয়ারের সময় রাস্তার কাছে চলে আসে। আর অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে রাস্তায় জল উপচে পড়ে। আজ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা। আজও জল উঠে আসবে।’ এ পথে শেষ রিসোর্টটা অতিক্রম করে আরও মিনিট পাঁচেক এগোবার পর রাস্তার বিপরীতে সমুদ্রতটের দিকে অনুচ্চ প্রাচীর ঘেরা একটা বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো আমাদের গাড়ি। বাড়িটার কম্পাউন্ডে ঢোকার কেটের গায়ে বিবর্ণ শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা আছে— ‘নিরালা।’

সনাতন গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলে দিল। গাড়ি সোজা গিয়ে থামল পার্টিকোর কাছে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম আমরা। বাড়িটার সদর দরজাতে তালা বন্ধ। তার একপাশে একটা সাইকেল রাখা আছে। বাড়িটাকে দেখে মনে হল, বাড়িটা যেমন নতুন নয় তেমনই খুব পুরানো নয়। সম্ভবত কুড়ি-পঁচিশ বছর বয়স হবে বাড়িটার। রাজীব চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘একটা বাগান করা যেতে পারে বাড়িটার সামনেটায়।’

সনাতন বলল, ‘এক সময় বাগান ছিল বাবু। আপনি বললে বাগান করে দেব।’

পকেট থেকে চাবি বার করে সামনের বারান্দায় উঠে দরজা খুলল সনাতন। আমাদের সঙ্গে মালপত্র বলতে দুটো ব্যাগ। সনাতনের পিছন পিছন বাড়ির ভিতর আমরা পা রাখলাম ব্যাগ নিয়ে। সামনে একটা ডাইনিং-এর মতো জায়গা। তার দু-পাশে বেশ কয়েকটা ঘর। ডাইনিং-এর একপাশ দিয়ে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। টাইলস বসানো মেঝে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির ভিতর ঢুকে আমার মনে হল বাড়িটা যিনি বানিয়ে ছিলেন তিনি হোটেল বা গেস্ট হাউস হিসাবে বানাননি। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যই বানিয়েছিলেন। সনাতন বলল, ‘আপনাদের শোবার ব্যবস্থা ওপরে করেছি। নীচের ঘরগুলো আগে দেখবেন নাকি ওপরে যাবেন?’

রাজীব বলল, ‘হ্যাঁ, আগে ওপরে চলো, একটু ফ্রেশ হয়ে নেই। তা ছাড়া খিদেও পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাজার করে রান্নাও করতে হবে তোমাকে।’

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম আমরা। সামনে দুটো পাশাপাশি ঘর। তাদের দরজা খুলে দিল সনাতন। দুটো ঘরেই খাট বিছানা আছে। অ্যাটাচড বাথ। যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয় তার বিপরীতেই আরও একটা দরজা আছে। ব্যাগ নামিয়ে রাখার পর সনাতন সে দরজাগুলো খুলে দিতেই আমরা একটা বেশ বড়ো ব্যালকনি দেখতে পেলাম। তার ওপাশেই সমুদ্র। সেই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম আমরা। বেশ বড়ো জায়গাটা। বেতের চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রাখা আছে সেখানে। ব্যালকনির ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রটাকে যেন আরও কাছে মনে হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সমুদ্রটাকে যেন বেশ কাছে মনে হল এবার। রোদের তেজ এই মুহূর্তে কিছুটা ম্রিয়মাণ। খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। তার ছায়াতে সমুদ্রর রং বেশ ঘন দেখাচ্ছে। ঢেউয়ের মাথায় দূরে একটা জেলে ডিঙি দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম—’মার্ভেলাস!’

রাজীব বলল, ‘হ্যাঁ, এমন একটা বাড়ি আমি স্বপ্নে দেখতাম।’

সনাতন বলল, ‘সমুদ্র এগিয়ে আসছে! রাতে দেখবেন সমুদ্র একেবারে বাড়ির নীচে পৌঁছে গেছে।’

রাজীব তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এ বাড়িতে কবে থেকে আছো?’

সে জবাব দিল, ‘প্রথম মালিকের আমল থেকেই, কয়েক হাত বদল হয়েছে বাড়িটার। কিন্তু কোনো মালিকই আমাকে তাড়াননি। আমাকে আপনি কাজে রাখবেন তো বাবু? এ বাড়ি সামলে রাখব আমি। আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।’

সনাতনের কথা শুনে রাজীব হেসে বলল, ‘ও সব নিয়ে পরে আলোচনা হবে। আগে দেখি তোমার হাতের রান্না কেমন? এখন চটপট বাজারে যাও। চিংড়ি, পমফ্রেট আনবে। আর কাঁকড়া পেলেও আনবে। আর যা যা দরকার তাড়াতাড়ি নিয়ে এসে রান্না বসাও। আমরা সবকিছু খাই।’—কথাগুলো বলে রাজীব ওয়ালেট থেকে একটা দু-হাজার টাকার নোট বার করে সনাতনের হাতে ধরিয়ে দিল।

সনাতন যাবার আগে বলে গেল, ‘আমি সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি বাবু। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।’

লোকটা চলে যাবার পর রাজীব আমাকে বলল, ‘সঞ্জীব, সমুদ্রতে স্নান করতে যাবি নাকি? দ্যাখ, সত্যিই সমুদ্রটা এগিয়ে আসছে!’

আমার সমুদ্র দেখতে খুব ভালো লাগলেও সমুদ্র স্নান সম্পর্কে মৃদু ভীতি আছে। বছর দশেক বয়সে একবার পুরী বেড়াতে গিয়ে বাবা-মায়ের সাথে সমুদ্রতে স্নান করতে নেমে, বিরাট একটা ঢেউতে খুব নাকানি-চোবানি খেয়েছিলাম। ঢেউ প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। আজ এই তিরিশ বছর বয়সেও সমুদ্রতে স্নান করতে নামলে আমার সেই স্মৃতি মনে পড়ে যায়। খালি মনে হয় এই বুঝি কোনো বিশাল ঢেউ এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল! তাই আমি রাজীবের কথার জবাবে বললাম, ‘আমার এখন বেরোতে ভালো লাগছে না। তোর ইচ্ছে হলে তুই সমুদ্রে স্নান কর।’

রাজীব বলল, ‘হ্যাঁ, আমি যাব এখন। সনাতন যদি কাঁকড়া নিয়ে আসে তবে তাকে বলবি সন্ধ্যাবেলাতে যেন ঝাল দিয়ে কষা বানায়। হুইস্কির সাথে চাট হিসাবে দারুণ লাগে খেতে।’

ব্যালকনি ছেড়ে যে যার ঘরে ঢুকলাম আমরা। আমি পোশাক পরিবর্তন করে অ্যাটাচড বাথে ঢুকলাম। মিনিট পনেরো পর স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে আমি আবার যখন ব্যালকনিতে বেরোলাম তখন রাজীব বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে সমুদ্রে নেমে পড়েছে। আমাকে দেখে সে দূর থেকে হাত নাড়ল। আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। মহা আনন্দে স্নান করছে সে। স্বপ্না, মানে ওর প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদ ঘটার পর থেকে বেশ মুষড়ে পড়ে ছিল রাজীব। মেয়েটাকে সত্যি ভালোবাসতো ও। আজ সমুদ্রের বুকে বাচ্চা ছেলেদের মতো স্নান করতে দেখে ভালো লাগল আমার। তাকে দেখে মনে হল বিচ্ছেদ যন্ত্রণা যেন ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির নীচে সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ শুনে আমি অনুমান করলাম সনাতন ফিরে এসেছে। সে কি বাজার আনল তা দেখার জন্য আমি ব্যালকনি ছেড়ে, ঘর হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। বাজার নিয়ে ফিরেছে সনাতন। সে বলল, পমফ্রেট, গলদা, কাঁকড়া সে সবই পেয়েছে। সঙ্গে মুরগির মাংসও এনেছে। আমি কাঁকড়ার ব্যাপারটা জানিয়ে দিলাম তাকে। মনে হয় আমাদের মদ্যপানের ব্যাপারটা অনুমান করতে পারল সে। সনাতন হেসে বলল, ‘এমন কাঁকড়া রেঁধে দেব যে সঙ্গে আর কিছু লাগবে না।’

তার পিছন পিছন এরপর কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম আমি। বেশ বড়ো কিচেন। সনাতন তার কাজ শুরু করল। তবে নতুন মালিক তাকে কাজে রাখবে কিনা সে ব্যাপারে তার মনে একটা শঙ্কা কাজ করছে। তাই সে আমাকে বলল, ‘মালিককে বললেন আমাকেই যেন কাজে রাখে বাবু। বাড়িতে অনেকগুলো পেট আছে। তা ছাড়া সমুদ্রের ধারে এ বাড়িতে একলা কেউ থাকতে পারে না। দু-তিনবার আমার বদলে অন্য লোক রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন থাকার পর তারা কেউ থাকেনি। আমাকে আবার ডেকে আনতে হয়েছিল।’

সনাতনকে কাজে বহাল রাখবে কিনা সেটা একান্তই রাজীবের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সনাতনের কথায় আমি শুধু জবাব দিলাম, ‘বাবুকে বলব।’

এরপর কিচেন ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে একতলাটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম আমি। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ থাকলেও তালা দেওয়া নেই। প্রথমে ডাইনিং-এর একপাশে দুটো ঘরের দরজা খুললাম। শূন্য ঘর, কোথাও কিছু নেই। এরপর অন্যপাশে প্রথমে একটা ঘরের দরজা খুলমাম, সে ঘরেও কিছু নেই। কিন্তু তার পাশের ঘরের দরজাটা খুলতেই বেশ একটু অবাক হয়ে গেলাম আমি! যে দরজাটা আমি খুললাম তার বিপরীত দিকেই আরও একটা দরজা। আর তার পাল্লা দুটো খোলা। সেই উন্মুক্ত দরজা দিয়ে ঘরের পিছনে কিছুটা দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে! একজন নারী স্নান করতে নেমেছে সমুদ্রে। কিন্তু রাজীব কই? ঠিক ও জায়গাতেই তো ও স্নান করছিল! কিন্তু এরপরই আমার ভুল ভেঙে গেল। আমি বুঝতে পারলাম হঠাৎ ঘরে ঢুকে যা আমি দরজা বলে ভেবেছি তা আসলে ঠিক দরজার আকারেই একটা ক্যানভাসে আঁকা একটা উন্মুক্ত দরজার ছবি। এমন নিপুণভাবে ছবিটা আঁকা হয়েছে যে এক ঝলক তাকালে যে কোনো মানুষের একই ভুল হবে। ছবিটা যে দেওয়ালের গায়ে রাখা আছে তার ঠিক ওপাশেই তো সমুদ্র। ছবির জায়গাতে সত্যি একটা দরজা থাকত তবে তার মধ্যে দিয়ে অমনই সমুদ্র দেখা যেত। এটাও ছবিটার প্রতি বিভ্রমের একটা কারণ। আমি ঘরে ঢুকে এগিয়ে গেলাম ছবিটার দিকে। হ্যাঁ, ছবির ভিতর সমুদ্রতে উচ্ছল ঢেউয়ের বুকে স্নান করছে এক নারী। যদিও দূর থেকে তোলা ছবির মতো আঁকা সেই নারী মূর্তির মুখ বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ক্যানভাসটা যেন একটু বিবর্ণও হয়ে এসেছে। পুরানো ছবি। যে দরজা দিয়ে আমি ঘরে ঢুকেছি সেই দরজার পাশে দেওয়ালের গায়ে এরপর আরও বেশ কয়েকটা উলটোভাবে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা আছে দেখলাম। উন্মুক্ত দরজার ছবি আর ক্যানভাসগুলো দেখে আমার ধারণা হল আগের কোনো মালিক হয়তো বাড়িটা সাজাবার জন্য ও ছবিগুলো জোগাড় করে থাকতে পারেন।

এরপর সে ঘর থেকে বেড়িয়ে আবার দোতলায় উঠে এলাম আমি। রাজীব এর কিছুক্ষণের মধ্যে স্নান সেরে ফিরে এল। সনাতন নামের লোকটা দেখলাম বেশ করিতকর্মা, চটপটে। এক ঘণ্টার মধ্যেই রান্না সেরে ফেলল সে। আমরা খেতে বসলাম দোতলার সেই উন্মুক্ত ব্যালকনিতেই। মাথার ওপর সেখানে শেড আছে। কাজেই সেখানে বসতে কোনো অসুবিধা হল না। স্নান সেরে ফিরে আসা রাজীবের মুখ বেশ ঝলমলে লাগছে। নানা গল্প করতে করতে খেতে লাগলাম দুজনে। সনাতনের রান্নার হাত সত্যি বড়ো চমৎকার। খেতে খেতে রাজীব একসময় তাকে প্রশ্ন করল, ‘আগের মালিক তোমাকে কত টাকা দিতেন?’

সনাতন জবাব দিল, ‘তিন হাজার টাকা বাবু।’

রাজীব আবারও প্রশ্ন করল, ‘এ বাড়ির দেখাশোনা ছাড়া আর কোন কাজ করো?’

সনাতন একটু ইতস্ততভাবে বলল, ‘অনেক বড়ো সংসার আমার। তিন হাজার টাকায় কি আর চলে বাবু?’ ট্যুরিস্ট সিজনে যখন আশেপাশের হোটেল, রিসোর্টগুলোতে কাজের চাপ বাড়ে তখন তাদের লোকের দরকার হল। তখন সেখানে কাজ করি। কখনও রান্নার কাজ, কখনো বা ট্যুরিস্টদের ফরমায়েশের কাজ। সব ধরনের কাজ।’

কথাটা শুনে রাজীব বলল, ‘ধরো যদি এ বাড়িটাকে হলিডে হোম বানাই তবে ব্যবসা চলবে?’

সনাতন উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘খুব চলবে বাবু। এখানে এত হোটেল থাকলেও অনেক সময় তাতেও থাকার জায়গা মেলে না। তা ছাড়া অনেকে তখন নিরিবিলিতেই থাকতে চায়। সমুদ্রর এত গায়ে অন্য কোনো হোটেলে নেই এখানে। শুধু কয়েকটা ঘরে এসি বসিয়ে দিতে হবে, আর একটা জেনারেটার কিনতে হবে। রাত হলে মাঝে মাঝেই বাতি চলে যায়। বিশেষত ঝড়-বৃষ্টির দিন গিলোতে এই এক সমস্যা।’

রাজীব এরপর এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলল না। খাওয়া শেষ করে ওঠার পর রাজীব, সনাতনকে বলল, ‘ঠিক পাঁচটায় আমাদের চা দেবে। বিচে হাঁটতে যাব। তারপর ফিরে এসে এখানেই বসব। বড়ো দু-বোতল ঠান্ডা জল আর কাঁকড়ার ঝালটা তখন দেবে আমাদের।’

সনাতন জবাব দিল, ‘এখানে তো ফ্রিজ নেই। তবে দোকান থেকে কিনে আনব।’

তারপর যে যার ঘরে ঢুকে আমরা শুয়ে পড়লাম। ভরপেট খেয়ে ঘুম নেমে এল আমাদের চোখে। সে ঘুম ভাঙল বিকেল পাঁচটায় চা নিয়ে সনাতনের দরজাতে টোকা দেবার শব্দে।

চা-পান সাঙ্গ করে এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলা থেকে নীচে নেমে বাড়ির পিছন দিকে উপস্থিত হলাম আমরা। এদিকে কোনো প্রাচীর নেই। সামনের ঢালু জমি বেয়ে সমুদ্রতটে নেমে পড়লাম। সমুদ্র তখন অনেকটাই কাছে। সাড়ে পাঁচটা প্রায় বাজে। সূর্যদেব অবগাহন করতে শুরু করেছেন সমুদ্রর বুকে। তার মায়াবী আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রে। ছোটো ছোটো উর্মিমালা এসে ভাঙছে সমুদ্রতটে। সাদা ফেনার দাগ রেখে আবার পিছনে ফিরে যাচ্ছে তারা। অবিরাম চলছে ঢেউয়ের এই যাওয়াআসা। আর তার সাথে ঝোড়ো বাতাস। এমন মুক্ত বাতাসে অনেকদিন শ্বাস নেওয়া হয়নি। তবে আকাশের এক কোণে বেশ বড়ো এক খণ্ড কালো মেঘও দেখতে পেলাম আমি। চটি খুলে খালি পায়ে ভেজা বালুতট দিয়ে ঢেউয়ের কিনারা বরাবর নিশ্চুপভাবে হাটতে লাগলাম আমরা। মাঝে মাঝে ঠান্ডা জল এসে ধুইয়ে দিচ্ছে পায়ের পাতা, বাতাসের ঝাপটাও বেশ ঠান্ডা। বারি ভালো লাগছিল সমুদ্রর পাড় বরাবর হাঁটতে। আমরা যেদিকে এগোতে লাগলাম সেদিকে কোনো লোকজন চোখে পড়ছে না। হয়তো বা ট্যুরিস্ট সিজন নয় বলেই এত নির্জনতা। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমাদের বাড়িটা ছেড়ে অনেকটাই দূরে চলে এলাম। বাড়িটা আর চোখে পড়ছে না। সূর্য ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রর বুকে। সমুদ্রর বুক থেকে উঠে আসা বাতাসের দাপট ক্রমশ বাড়ছে। কিছুটা দূরে সমুদ্রতটে একটা ডিঙি নৌকা চোখে পড়ল আমাদের। বেশ বড়ো নৌকা। সেটা দেখে রাজীব বলল, ‘এই নৌকাটা পর্যন্ত গিয়ে তারপর ফিরব।’

হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকাটার কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। নৌকার কিছুটা তফাতে আমরা দাঁড়ালাম। জল থেকে নৌকাটা পাড়ের দিকে অনেকটা টেনে রাখা আছে লোহার নোঙর ফেলা অবস্থায়। সূর্য এবার অর্ধেক ডুবে গেছে সমুদ্রর বুকে। কেউ যেন সোনালি রং ছড়িয়ে দিয়েছে সমুদ্র বুকে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধর মতো বেশ অনেকটা সময় সে জায়গায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম সমুদ্রর দিকে। আমাদের চোখের সামনেই। রাজীব বলল, ‘চল এবার ফিরি। অন্ধকার নামলেই ব্যালকনিতে বসে সমুদ্র শোভা দেখতে দেখতে হুইস্কিতে চুমুক দেব। আজ আবার পূর্ণিমা। সমুদ্রর জল নাকি ব্যালকনির নীচ পর্যন্ত আসে। দেখা যাক কথাটা সত্যি কিনা?’

আমার হঠাৎ অনেকদিন পর সিগারেট খাবার ইচ্ছা হল। রাজীব অবশ্য সিগারেট খায়। আমি তাকে বললাম, ‘একটা সিগারেট দে আমাকে। জ্বালিয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরি।

হাত থেকে চটি নামিয়ে এবার পায়ে পড়লাম আমরা। রাজীব পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বার করে একটা সিগারেট আমাকে দিল। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস। বার কয়েক চেষ্টা করে আমরা দুজনের কেউই যখন দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে পারলাম না। তখন আমি বললাম, ‘চল ওই নৌকাটার আড়ালে গিয়ে গিয়ে কাঠি জ্বালাই।’

কিছুটা তফাতে নৌকাটার দিকে এগোলাম আমরা। কিন্তু নৌকাটার পিছনে যেতেই আমাদের দেখে চমকে উঠে মাটি থেকে লাফিয়ে উঠল এক জোড়া তরুণ—তরুণী। অবিন্যস্ত পোশাক তাদের। তা দেখে আমরা বুঝতে পারলাম এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে বিরাট নৌকাটার আড়ালে বসে তারা শুধু প্রেমালাপ নয়, শরীরের আলাপও করছিল। তাদের সে কাজে ব্যাঘাত ঘটাবার কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না। কাজেই নৌকার আড়ালে দেশলাই জ্বালিয়ে কোনো রকমে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে আমরা সে জায়গা ছেড়ে ফেরার পথ ধরলাম। সূর্যের শেষ আভা ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে সমুদ্রের বুকে। আমি খেয়াল করলাম আকাশের কোণে মেঘ যেন আবার বাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে রাজীব আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘তুই জানিস, সমুদ্রর ধারে এমন নির্জন বাড়ি কেনার ভাবনাটা প্রথমে কীভাবে আমার মাথায় আসে?’

প্রশ্নটা করে সে এরপর নিজেই জবাব দিল—’এমন একটা বাড়ির কথা স্নিগ্ধাই প্রথমে আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল। এমন একটা নিরালা বাড়ি থাকবে আমাদের সমুদ্র ধারে। অসীম সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে বসে থাকব আমরা। সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে এমন ভাবে গেঁথে গেছিল যে আমি বুঝতে পারিনি স্নিগ্ধার বলা কথাগুলো নিছকই কথার কথা ছিল—।’

রাজীব এরপর কী যেন একটা কথা বলল, যা ঝোড়ো বাতাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেল। আমি আর ব্যাপারটা নিয়ে খোঁচালাম না তাকে। বুঝতে পারলাম স্নিগ্ধাকে সে পুরোপুরি ভুলে যেতে পারছে না। হয়তো বা নৌকার আড়ালে ওই প্রেমিক যুগলকে দেখার পরই স্নিগ্ধার কথা মনে পড়ছে তার। নিশ্চুপভাবে হাঁটতে হাঁটতে আবার নিরালার কাছে পৌঁছে গেলাম। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। তার সাথে সাথে সমুদ্রর জলও এগিয়ে আসছে। ছোটো ঢাল বেয়ে বালুতট ছেড়ে ওপরে উঠে বাড়ির সামনের দিকে উপস্থিত হলাম। সদর দরজাতে সনাতন দাঁড়িয়ে আছে। রাজীব তাকে প্রশ্ন করল, ‘বাড়ির পিছন দিকে প্রাচীর নেই কেন?’

সনাতন বলল, ‘বাড়ির প্রথম মালিক বাড়িটা ঘেরার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পিছনে প্রাচীর দেবার সময় জল উঠে গিয়ে কাজ বন্ধ হয়ে গেছিল। তারপর আর ওদিকে প্রাচীর দেওয়া হয়নি। তারপর অন্য মালিকরাও আগ্রহ দেখাননি।’

কথাটা শুনে রাজীব স্বগতোক্তির স্বরে বলল, ‘ওদিকের প্রাচীরটা তবে ঘিরে নিতে হবে।’

সনাতনের সাথে এরপর আমরা বাড়ির ভিতর পা রাখতেই সে বলল, ‘বলেছিলাম না বাবু, এখানে কারেন্ট থাকে না। চলে গেছে। তবে চিন্তা নেই আপনাদের। লণ্ঠন ঠিক করে রেখেছি।’

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ইলেকট্রিক গেলে কতক্ষণ পর ফেরে?’

সনাতন জবাব দিল, ‘তার কোনো ঠিক নেই। তবে যা বাতাস আসে তাতে জানলা খোলা রাখলে আর ফ্যানের দরকার হয় না।’

রাজীব, সনাতনের কাছে জানতে চাইল, সব ব্যবস্থা করে রেখেছ তো? আমরা কিন্তু একটু পরই বসব।’

সনাতন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, বাবু। কোনো চিন্তা নেই।’

দোতলাতে উঠে এলাম আমরা।

কিছুক্ষণ পর আমি যখন ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলাম ততক্ষণে হুইস্কির বোতল নিয়ে রাজীব সেখানে উপস্থিত হয়ে গেছে সনাতন একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে এসেছে। টেবিলের ওপর সে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে গ্লাস-প্লেট। জলের বোতল একটা পাত্র কাঁকড়ার কষা আর তার সাথে স্যালাডও। সব আয়োজন সম্পূর্ণ। রাজীবের পাশেই বেতের চেয়ারে আমি বসলাম। সনাতনকে আর এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলব আমরা, প্রাইভেসিরও ব্যাপার আছে। তাই রাজীব তাকে বলল, ‘তুমি এখন যাও, দরকার হলে ডেকে নেব।’

সনাতন চলে যাবার পর রাজীব হুইস্কির বোতল খুলে দুটো গ্লাসে পেগ বানালো। দুটো গ্লাস ঠেকিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলে নিজেদের গ্লাসে চুমুক দিলাম আমরা। ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে সমুদ্রর দিক থেকে। ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দও কানে আসছে। কাঁকড়া আর স্যালাড সহযোগে মদ্যপান শুরু করে গল্প করতে লাগলাম আমরা। পুরানো দিনের গল্প। কলেজ জীবনের নানা ঘটনার কথা, তার সাথে অন্য নানা গল্প। চাঁদ উঠতে শুরু করল এক সময়। তবে তার ঔজ্জ্বল্য কেমন যেন ম্রিয়মাণ। আমি বুঝতে পারলাম আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়ছে।

আমার চেয়ে দ্রুত পান করছে রাজীব। আমি দু-পেগে শেষ করিনি, সে তিন পেগ শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল রাজীব। তারপর হঠাৎ সে বলল, ‘নৌকার আড়ালে যাদের আমরা দেখলাম তারা স্বামী-স্ত্রী নয় তাইতো?’

আমি বললাম, ‘না বলেই মনে হয়। তাহলে ওদের নৌকার আড়ালে রোমান্স করতে হত না।’

কথাটা শুনে আবারও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রাজীব। তারপর বলল, ‘কী সুন্দর ওরা জীবন উপভোগ করছে! আমি শালা মূর্খ, কিছুই করতে পারলাম না।’

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কিছুই করতে পারলিনা মানে?’ রাজীব জবাব দিল, ‘স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকবার চুমু খেয়েছি ঠিকই, কিন্তু ব্যাস ও পর্যন্তই। তার বেশি আর কিছুই করিনি, মানে ফিজিক্যাল রিলেশন। আসলে আমার মনে হয়েছিল জীবনে সে সময়তো অফুরন্ত পাব। তখন সেটা চুটিয়ে উপভোগ করব। আমি বুঝতে পারিনি স্নিগ্ধার চাহিদা আরও বেশি ছিল। আমি সব খবরই পেয়েছি। গতকাল ডাক্তার এন. আর. আই স্বামীর সাথে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়েছে তার। পাছে আমি কোনো গন্ডগোল করি সে জন্য চুপিসারে কাজ সেরেছে তার বাড়ির লোকজন। তবু খবরটা আমি পেয়েছি, আজ বা কালই হয়তো সে উড়ে যাবে তার স্বামীর সাথে ইউরোপে।’

তার কথা শুনে আমি বললাম, ‘ও নিয়ে আর ভাবিস না। যা হবার তা হয়ে গেছে। সামনে জীবন পড়ে আছে। নিশ্চয়ই আবার কেউ আসবে তোর জীবনে। এমন ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে। তা বলে জীবন থেমে থাকে না।’

রাজীব চতুর্থ পেগটা বানিয়ে এক চুমুকে সেটা শেষ করেতে লাগল। সমুদ্রর দিকে আমিও তাকালাম। জল তখন আরও অনেকটা এগিয়ে এসেছে বাড়ির পিছনে। ঢেউ ভাঙার স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে সমুদ্রর মাথার ওপর গোল চাঁদ উঠলেও সেটা মেঘের আড়ালে অস্পষ্ট।

সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে থাকার পর রাজীব আবার মুখ খুলল, ‘সে বলল, ‘তুই বিশ্বাস কর স্নিগ্ধার সাথে সম্পর্ক হবার পর তেমনভাবে কোনো মহিলার দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। ইচ্ছা করলে কি আমি কোনো মেয়ের সাথে শুতে পারতাম না? পয়সা দিলে আজকাল কোনোকিছুরই অভাব হয় না। আসলে আমি স্নিগ্ধার অগোচরেও তাকে প্রতারিত করতে চাইনি। ওই যে বললাম না আমি মূর্খ।’

স্নিগ্ধার কথা সে মন থেকে এখন কিছুতেই সড়াতে পারছে না দেখে আমি তাকে এবার মৃদু ধমকের স্বরে বললাম, ‘বলছিতো আর ওসব নিয়ে ভাবিস না। যে জীবন পড়ে আছে তাকে উপভোগ কর। এই সুন্দর রাতটা আর ওসব ভেবে নষ্ট করিস না।’

কথাটা শুনে রাজীব আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। সে বলল, ‘তুই ঠিকই বলেছিস। ওসব বিশ্বাসের কোনো দাম নেই। জীবনটা উপভোগ করাই ভালো। এত সুন্দর রাতটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।’

আমি হেসে বললাম, ‘তাইতো বলছি, জীবন উপভোগ কর।’

রাজীব এবার সনাতনের নাম ধরে বেশ কয়েকবার হাঁক দিল। ডাক শুনে নীচ থেকে এসে হাজির হল সনাতন। রাজীব কয়েক মুহূর্ত সনাতনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোমাকে যদি চাকরিতে বহাল রাখি তবে তুমি সব কাজ করে দিতে পারবে, তাই না?’

সনাতন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, বাবু।’

রাজীব এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সনাতনকে বলল, ‘এই বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ অঞ্চলের হোটেল, রিসোর্ট গুলোতে তো শুনেছি মেয়েছেলের কারবার চলে। আজ রাতের জন্য সুন্দরী মেয়ে জোগাড় করে আনতে পারবে?’

রাজীবের মুখ থেকে কথাটা শুনে সনাতন আমারই মতো বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল রাজীবের দিকে। রাজীব তাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রথমে তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘চুপ করে আছো কেন বলো? আমি জানি এখানে এসব পাওয়া যায়। আনতে পারলে বুঝব তুমি কাছের লোক। চাকরিটা পাকা হবে তোমার।’

এ কথা বলে সে আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার একজন লাগবে। তোর জন্যও লাগবে কিনা বল?’

আমি রাজীবকে জীবন উপভোগ করতে বললেও তার অর্থ বেশ্যা সংসর্গ নয়। রাজীব যে তখনই এ ভাবে জীবন উপভোগ করতে চাইবে তা আমি বুঝতে পারিনি। সনাতনের সামনে তাকে এ ব্যাপারে নিষেধ করা উচিত হবে কিনা তা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি শুধু বললাম, ‘না আমার জন্য দরকার নেই।’

আমার জবাব শুনে রাজীব সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তবে একজনই। টাকার জন্য ভেবো না। যা লাগবে দেব। যাও খুঁজে আনো।’

সনাতন এবার জবাব দিল, ‘আচ্ছা বাবু। চেষ্টা করছি আনার জন্য। সদর দরজাটা ভিতর থেকে দিয়ে দিল।’

রাজীব বলল, ‘আমরা তো এখন বাইরে যাব না, তুমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাও।’

রাজীবের কথা শুনে পা বাড়িয়েও সনাতন একবারের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে বলল, রাতে কী খাবেন বাবু? আর কিছু কিনে আনতে হবে?’

এখনও প্রচুর কাঁকড়া পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে রাজীব বলল, ‘না, রাতে আমার জন্য আর খাবারের দরকার নেই। সঞ্জীব তুই কী খাবি?’

দুপুরে ভরপেট খাবার খেয়েছি। তারপর আবার অনেকটা কাঁকড়া। তা ছাড়া মদ্যপান, রাতে ভাত খেলে অনেক সময় আমার বমি হয়ে যায়। খাবার ইচ্ছা আমারও তেমন নেই। কাজেই আমিও বললাম, ‘আমারও তেমন আর খাবার ইচ্ছা নেই রাতে। যদি প্রয়োজন হয় তখন বলব।’

সনাতন এরপর রাজীবের নির্দেশ পালন করতে চলে গেল।

সে চলে যাবার পর আমি দুজনের জন্য পেগ বানাতে বানাতে বললাম, ‘ব্যাপারটাতে রিস্ক নেওয়া হল না তো? ওই সব মেয়েরা অনেক সময় পয়সার জন্য অনেককে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা করে।’

রাজীব বলল, ‘রিস্ক হলে হবে। তবে এবার থেকে সবরকম ভাবে জীবনকে উপভোগ করব আমি।’

আমি রাজীবকে ছোটোবেলা থেকে চিনি। একবার যে কোনো ব্যাপারে জেদ ধরলে তাকে নিরস্ত করা মুশকিল। আমার মাথাটাও ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে। আমি আর রাজীবকে কিছু বললাম না। পেগ বানিয়ে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধভাবে বসে মদ্যপান করতে লাগলাম দুজন। মাঝে মাঝে মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। তবে সমুদ্র এখন বাড়ির কাছে চলে এসেছে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তার গর্জন। পূর্ণিমার জোয়ারের জল আরও এগিয়ে আসতে লাগল সময়ের সাথে সাথে।

গ্লাস শেষ হবার পর আরও এক পেগ চড়িয়ে নিলাম আমরা। নেশা বাড়ছে আমারও। সনাতন চলে যাবার পর কতটা সময় কেটে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ এক সময় রাজীব নীরবতা নষ্ট করে বলল, ‘সনাতন কখন ফিরবে কে জানে? তবে আমার এখন কী মনে হচ্ছে জানিস? যদি সত্যিই এমন কোনো নারী আসত, যে আমাকে সত্যি ভালোবাসতো, তবে তার সাথে এখানে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি আমি।’

রাজীবের কথার জবাবে আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক সেই সময় অন্ধকার আকাশের বুক চিরে প্রথম বিদ্যুৎ রেখা দেখা গেল, আর এর সাথে বাজের মৃদু কড়কড় শব্দ। কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি। আর এরপরই কিছুটা তফাত থেকে একটা নারী কণ্ঠ ভেসে এল, ‘সত্যিই যদি কেউ আপনাকে ভালোবাসে তবে তার সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেবেন?’

কথাটা শুনে আমি আর রাজীব চমকে উঠে তাকালাম সেই কণ্ঠস্বর লক্ষ করে। ব্যালকনির এক কোণে এসে দাঁড়িয়েছে একজন নারী। তার পরনে জিন্স আর টপ। সুন্দর চেহারা। দেখে মনে হয় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হবে।

অন্য কোনো মহিলা এ বাড়িতে আসার সম্ভাবনা নেই। আমরা দুজনই তাই অনুমান করলাম সনাতনই নিশ্চয়ই তাকে দোতলাতে তুলে দিয়ে গেছে। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে রাজীব তাকে প্রশ্ন করল—’আপনাকে কি সনাতন পৌঁছে দিল এখানে?’

মেয়েটা কাছে এগিয়ে এসে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আপনি ডাকলেন বলেইতো এলাম।’

রাজীব এবার লণ্ঠনটা টেবিল থেকে একটু ওপর দিকে উঁচিয়ে ধরল ভালো করে তাকে দেখার জন্য। আমিও তাকালাম মেয়েটার দিকে ভালো করে দেখার জন্য। ভরা যৌবনের হাতছানি মেয়েটার বুকে-শরীরের। ফর্সা মুখমণ্ডলে গোলাপি রঙের পুরু ঠোঁটের ওপর নাকের এক পাশে একটা ছোটো আঁচিল আছে। তা মেয়েটার সৌন্দর্য হানির পরিবর্তে যেন তাকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে।

রাজীব যুবতীকে ভালো করে দেখে লণ্ঠনটা আবার টেবিলে নামিয়ে বলল, ‘টাকাপয়সা বা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। যা চাইবে তাই পাবে।’

মেয়েটা হেসে বলল, ‘আমিতো শুধু তোমার ভালোবাসা চাই। আমি যদি তোমাকে ভালোবাসি তবে তুমি সত্যিই আমার জন্য থেকে যাবে এই নিরালাতে?’

যুবতীর কথা শুনে আমার মনে হল মেয়েটা বেশ ছলাকলা পটীয়সীও বটে। খদ্দেরদের সাথে মন রক্ষা করে কীভাবে কথা বলতে হয় তা সে জানে।

রাজীবও নিশ্চয়ই একই অনুমান করল মেয়েটার সম্পর্কে। সে হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তুমি যদি আমাকে তেমন ভালোবাসতে পারো তবে আমি নিশ্চিত তোমার সাথে এখানেই থেকে যাব।’

রাজীব এ কথা বললে তা যে নিছক কথার কথা তা অনুমেয়। একজন বেশ্যার সাথে সে নিশ্চয়ই সারাজীবন এখানে পড়ে থাকতে পারে না। কিন্তু মেয়েটা তার কথা শুনে বলল, ‘সত্যি বলছ তো? তবে ভালোবাসা দিয়েই তোমাকে আমার কাছে আটকে রাখব আমি।’

আমার মনে হল রাজীব এটুকু সময়ের মধ্যেই মেয়েটাকে দেখে, তার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। রাজীব আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তবে আর সময় নষ্ট করে কি লাভ? চলো ঘরে চলো। দেখি তুমি আমাকে কেমন ভালোবাসতে পারো?’

মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এবার হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘তোমাকে ভালোবাসা দেবার আরও সুন্দর একটা জায়গা আছে যা ঘরের থেকেও সুন্দর।’

রাজীব কথাটা শুনে মৃদু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করল, ‘সে কোন জায়গা?’

যুবতী ব্যালকনির নীচে সমুদ্রর দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই সমুদ্রর পাড়ে। কি সুন্দর রাত এখন! কেউ কোথাও নেই। আমরা একসাথে সমুদ্রে নামব। তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।’

জলকেলির ব্যাপারটা যে রোমান্টিক তাতে সন্দেহ নেই। তবুও অন্ধকার সমুদ্র দিকে তাকিয়ে রাজীব মৃদু ইতস্তত করে বলল, ‘এত রাতে আবার নীচে সমুদ্রর পাড়ে যাব? তা ছাড়া বৃষ্টিও আসছে মনে হয়।’

রাজীবের কথা শুনে মেয়েটা হেসে বলল, ‘ভয় পাচ্ছ কেন? আমিতো আছি। তা ছাড়া সমুদ্রর জল একদম কাছে চলে এসেছে দ্যাখো। ঠিক বাড়ির পিছনেই। আর বৃষ্টি এলে তো আরও বেশি মজা হবে। একসাথে ভিজব আমরা।’

মেয়েটা রাজীব ভয় পাচ্ছে বলাতে হয়তো পুরুষত্বে ঘা লাগল তার, অথবা নারী শরীরের অমোঘ আহ্বান উপেক্ষা করা এ মুহূর্তে সম্ভব হল না তার। রাজীব উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি নীচে গেলাম। তুই শুয়ে পড়িস।’

আমি তার কথায় শুধু ‘হু’ বলে শব্দ করলাম। মেয়েটা রাজীবের হাতটা এবার জড়িয়ে ধরল। ব্যালকনি ছেড়ে ঘর অতিক্রম করে নীচে নামার জন্য এগোল তারা নতুন একটা পেগ বানিয়ে রাখা ছিল। এক চুমুকে তা শেষ করলাম আমি। আর এরপরই আমার মনে হঠাৎই একটা ইচ্ছা হল—ওদের দুজনের জলকেলি দেখব আমি। পরোক্ষে আমি যৌনতা উপভোগ করব। মুহূর্তের মধ্যেই এ আকাঙ্ক্ষা আমার মনে ছড়িয়ে পড়ল। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়ে ব্যালকনি ছেড়ে অন্ধকার ঘর অতিক্রম করে আমি এসেও দাঁড়ালাম সিঁড়ির মুখটাতে। লোডশেডিং, নীচেও অন্ধকার। তবুও তারই মধ্যে আমি দেখতে পেলাম তাদের দুজনকে। ডাইনের গায়ের একটা খোলা দরজা দিয়ে মাঝে মাঝে একটা আলোক রেখা এসে পড়ছে দরজার বাইরের মেঝেতে। আমি দেখলাম আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় সেই অস্পষ্ট আলোক পথ ধরে রাজীব আর মেয়েটা সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, আমার বেশ নেশা হয়েছে। পা একটু টলছে। তবুও সে অবস্থাতেই সিঁড়ির হাতল ধরে সন্তর্পণে নীচে নেমে এলাম আমি। সনাতনের কোনো সাড়া শব্দ আমি পেলাম না। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে সেটা বন্ধই মনে হল। আমি এরপর এগোলাম যে ঘরটার ভিতর তারা প্রবেশ করল সে দিকে। পাল্লার আড়াল থেকে উঁকি দিতেই আমি বিপরীত দিকে দরজাটা দেখতে পেলাম। সেই ক্যানভাসে আঁকা দরজাটা। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে বাইরের বিদ্যুতের ঝলকের আলো ঘরে ঢুকছে কীভাবে? বাইরে একবার বেশ বড়ো বিদ্যুৎ চমকালো গর্জন তুলে। আর সেই আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় রাজীব আর সেই মেয়েটা এগিয়ে চলেছে সমুদ্রর দিকে। আমি প্রবেশ করলাম ঘরটাতে। এটাতো সেই ঘর বলেই মনে হচ্ছে যেখানে আমি দুপুরবেলা ঢুকেছিলাম। এই তো দেওয়ালের গায়ে ক্যানভাসগুলো রাখা! কিন্তু ছবির দরজা এভাবে খুলে গেল কীভাবে? দরজাটা যে খোলা তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। ওইতো প্রতিটা বিদ্যুৎ চমকের সাথে আমি বাইরেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি আলিঙ্গনাবদ্ধ নর-নারীকে। বাতাসের ঝাপটা আর ঢেউয়ের শব্দ, সমুদ্রর গর্জনও ভিতরে প্রবেশ করছে দরজা দিয়ে। তবে কি ওটা একই রকমের একটা ঘর। নেশার ঘোরে কি আমি এ ঘরকে সেই ছবির দরজার ঘর ভাবছি? নিশ্চয়ই তাই হবে। এ কথা ভেবে নিয়ে আমি এগোলাম সেই দরজার দিকে। না আমি কোথাও ধাক্কা খেলাম না। সে দরজা দিয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম।

রাজীব আর সেই নারী এখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে ঢালে নামার মুখটাতে। সমুদ্র এগিয়ে এসেছে সে পর্যন্ত। ঢাল অতিক্রম করে সমুদ্রর জল মাঝে মাঝে ছিটকে আসছে বাড়ির দিকেও। আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে দৃশ্যমান হচ্ছে তারা। কখনো বা হারিয়ে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে। গাঢ় চুম্বনরত অবস্থায় তারা পরস্পরকে নিষ্পেষণ করে চলেছে। কোনো দিকে তাদের খেয়াল নেই। বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল আমার গায়ে। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হল। তবুও ওই নরনারীর মিলন প্রত্যক্ষ করার অদম্য আগ্রহে বৃষ্টির মধ্যেই তাদের দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। প্রত্যাশা মতোই বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে আমি এক সময় দেখতে পেলাম তারা পোশাক উন্মুক্ত করতে শুরু করেছে। সেই যুবতী তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক খুলে ছুঁড়ে দিল সমুদ্রর জলে। তারপর দু-হাত ওপরে তুলে উচ্ছল আনন্দে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। আকাশ ফালা ফালা করে বিদ্যুতের ঝিলিক হল সেই সময়। আমি দেখতে পেলাম সমুদ্রর ঢেউয়ের মতোই লাফিয়ে ওঠা নারীর শঙ্খের মতো স্তন যুগল। কড় কড় শব্দে বাজ পড়ল। তারপর কয়েক মিনিট সব অন্ধকার হয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম আবারও বিদ্যুৎ চমকের জন্য। বৃষ্টি বাড়ছে। আমি অনুভব করলাম সমুদ্রর জল এসে আমার গোড়ালি ভিজিয়ে দিল। অর্থাৎ ঢাল অতিক্রম করে জল উপচে পড়তে শুরু করেছে। এর পরই আবার আকাশের বুক চিরে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমক শুরু হল। কিন্তু আমি দেখলাম যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিল সেখানে তারা নেই! সমুদ্রর জল ঢালে বেয়ে উঠে এগিয়ে এসেছে আমার সামনে। তবুও তার মধ্যেই আমি জল ভেঙে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ঢালের মুখটাতে। এবার বিদ্যুৎ চমকের সাতে সাথে আমি আবারও তাদের দেখতে পেলাম। ঢালের নীচে সমুদ্রর ঢেউয়ের মাঝে দুটো উচ্ছল নগ্ন দেহ। যেন সমুদ্রর গভীর থেকে ঢেউয়ের সাথেই উঠে এসেছে তারা। বৃষ্টি স্নাত সমুদ্রর বুকে দুই নগ্ন নর-নারী। আমি চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। জল ক্রমশ বাড়ছে। যেন জলের ভিতর ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের দেহ। এরপর বৃষ্টিও মুষলধারে পড়তে শুরু করল। বাতাসের ঝাপটা যেন আমাকে ঠেলে দিতে চাইছে মাটিতে। শেষ যখন আমি তাদের দেখতে পেলাম তখন যেন তারা সমুদ্রর বুকে দুটো বিন্দু!

সমুদ্রর গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে তারা। আর এর পরই আমি খেয়াল করলাম সমুদ্রর জল আমার হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। এবার ভয় পেয়ে গেলাম আমি। সাঁতার জানি না। বাতাস যদি আমাকে ঢালের নীচে ছিটকে ফেলে তবে অন্ধকার সমুদ্রে ভেসে যাব আমি। একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল আমার শরীরে। বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে কাছেই কোথাও কান ফাটিয়ে বাজ পড়ল। আতঙ্কিত অবস্থাতে ঢালের মাথা ছেড়ে আমি জল ভেঙে দ্রুত ফিরতে শুরু করলাম। অবশেষে আমি সেই দরজা দিয়ে বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করলাম। বাইরে আমার পিছনে তখন বর্ষণ সিক্ত সমুদ্রর প্রচণ্ড কলরব আর বাজের গর্জন। সমুদ্রর জল দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সেই ঘর অতিক্রম করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম আমি। বাড়ির ভিতরটা তখনও একই রকম অন্ধকার। আমি কোনোরকমে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাতরে হাতরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। নেশার ঘোরে পা টলছে আমার। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ঘরে ঢুকে ভিজে পোশাক পালটে কোনোরকমে বিছানাতে শুয়ে পড়লাম। খোলা জানলা দিয়ে ও পাশের বারান্দার নীচ থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রর প্রচণ্ড গর্জন। সেই শব্দ শুনতে শুনতে আমার চোখ বুজে এল। যেন অতল ঘুমের সমুদ্রতে হারিয়ে গেলাম আমি।

আমার যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোরের প্রথম আলো প্রবেশ করেছে আমার ঘরে। আড়মোড়া ভাঙতে আমার মনে পড়ে গেল বিদ্যুতের চমকে দেখা সেই শেষ দৃশ্যটার কথা। অন্ধকার সমুদ্র বুকে হারিয়ে যাচ্ছে রাজীব আর সেই মেয়েটা! কথাটা মনে পড়তেই উঠে বসে বাইরে বারান্দার দিকে তাকালাম আমি। ঝড়-বৃষ্টি আর নেই, সমুদ্র অনেকটা দূরে সরে গেছে তখন। শান্ত, নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। তার বুকে সূর্যদেব উদিত হয়েছেন। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে আমি খাট ছেড়ে নীচে নামলাম। রাজীব কখন ফিরেছে কে জানে? হয়তো সে এখনও ঘুমোচ্ছে। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রাজীবের ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম রাজীব ঘরে নেই। তবে হয়তো সে নীচে গেছে। —এ কথা ভেবে তার খোঁজে সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে এলাম আমি।

আমি নীচে নামতেই কিচেনের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সনাতন। আমাকে দেখে সে বলল, ‘আপনারা উঠে পড়েছেন? তবে চা দেই? লিকার না দুধ চা?’

আমি বললাম, ‘আমার যে কোনো কিছু হলেই চলবে। কিন্তু তোমার মালিক কই? তিনি কি আবার সকালবেলা সমুদ্রর তীরে গেছেন?’

সনাতন প্রথমে জবাব দিল, ‘তাকে তো আমি দেখিনি সদর দরকার তো বন্ধই আছে।’

তার কথা শুনে আমার মনে হল যে হয়তো ঘরের ভিতরের দরজাটা দিয়ে গত রাতের মতো বাইরে বেরিয়েছে। তাই আমিও তার সন্ধানে বাইরে বেরোবার জন্য কয়েক পা এগিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম। আর আমার পিছনে সে ঘরে প্রবেশ করল সনাতনও। কিন্তু ঘরে ঢুকে আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে ঘর থেকে বাড়ির বাইরে যাবার জন্য সত্যিকারের কোনো দরজা নেই। রয়েছে সেই ক্যানভাসে আঁকা দরজার ছবিটা! তবে হয়তো যে ঘর দিয়ে আমরা বাইরে বেরিয়েছিলাম সেটা পাশের ঘর হবে। আমি সনাতনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম—’পাশের ঘরে এমনই ছবির মতো একাটা দরজা আছে—তাই না? যা দিয়ে বাইরে যাওয়া যায়?’

সনাতন জবাব দিল—’না তো। তেমন কোনো দরজা নেই।’

তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। তবে কি কাল রাতে আমি নেশার ঘোরে অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নর মধ্যে সেই মেয়েটার সাথে রাজীবের ওই ছবির দরজা দিয়ে বাইরে যেতে দেখেছিলাম? নিশ্চয়ই তাই হবে। আমি সে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোবার আগে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এই দরজার ছবিটা খুব সুন্দর! একেবারে সত্যিকারের দরজা বলে মনে হয়!

সনাতন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ওটা নিরালা দিদিমণির আঁকা। দেওয়ালের গায়ে অন্য যেসব ছবি জড়ো করা আছে সেগুলোও তার আঁকা।’

আমি ঘরের বাইরে বেরোতে বেরোতে জানতে চাইলাম, ‘নিরালা দিদিমণি কে?’

আমার পিছন পিছন ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সনাতন জবাব দিল, ‘এ বাড়ির প্রথম মালিকের মেয়ে। এখানে এসে তিনি থাকতেন। সমুদ্রর পাড়ে বসে ছবি আঁকতেন। এই বাড়ির নাম ‘নিরালা’ বলে এখানকার সবাই তাকে নিরালা দিদিমণি বলে ডাকত। আমিও তাই বলেই তাকে ডাকতাম।’

এ কথা বলার পর সনাতন আমাকে বলল, ‘আপনার বন্ধু এ বাড়ির নতুন মালিক কি আমার ওপর রেগে গেছেন খুব? বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম।’

সনাতন যে সেই তন্বী যুবতীকে নিয়ে এসেছিল তাতো আমি জানি। তাই তার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে আমি তাকালাম তার দিকে।

সনাতন এরপর আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে বলল, ‘সুন্দরী অল্পবয়সি মেয়ে খুঁজতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। তারপর নামল ঝড়-বৃষ্টি। পথে আটকে গেলাম। রাত একটা নাগাদ বৃষ্টি থামার পর আমি মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম। দোতলায় উঠে দেখলাম ব্যালকনিতে আপনারা নেই। মালিকের ঘরের দরজা খোলা, সেখানে উনি নেই আর আপনার ঘরের দরজা বন্ধ। বুঝলাম আপনারা একই ঘরে আছেন। বিশ্বাস করুন আমি বেশ কয়েকবার আপনাদের ঘরের দরজাতে ধাক্কা দিয়ে আপনাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু আপনারা সাড়া দিলেন না, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মেয়েটা ভোর রাতে আর থাকতে চাইল না। চলে গেল। তবে ফোন নম্বর দিয়ে গেছে। বলে গেছে তাকে ফোন করলে বেলার দিকে আসবে।’ —কথাগুলো প্রত্যুত্তরের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে রইল সনাতন।

আমি তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সনাতন যে মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল সে যদি ফিরে গিয়ে থাকে তবে যে ব্যালকনিতে আমাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার সাথে রাজীব সমুদ্রে নামল সে তবে কে?

এর উত্তর হয়তো বা রাজীব দিতে পারবে। কিন্তু সে কোথায়? —এ কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরে থেকে সদর দরজা ধাক্কা দেবার শব্দ শোনা গেল। রাজীব বাইরে থেকে ফিরে এল নাকি? শব্দটা শুনে আমরা এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। সনাতন দরজাটা খুলতেই দেখতে পেলাম স্থানীয় কয়েকজন লোককে। তাদের মধ্যে একজন সনাতনকে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তোমাদের বাড়ির পিছনের ঢালের নীচে বালির ওপর একটা লাশ পড়ে আছে। দেখো তো চিনতে পারো কিনা?’

কথাটা শুনেই সনাতন আর আমি সে লোকগুলোর সাথে ছুটে সে জায়গাতে পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় মানুষদের একটা ছোটোখাটো ভিড় সেখানে। আমি সেই ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ভেজা বালির মধ্যে চিত হয়ে পড়ে আছে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া জলে ভেজা রাজীবের লাশটা! আমি শুনতে পেলাম পাশ থেকে কেউ একজন, কারও উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাজ পড়েই লোকটা মারা গেছে। মনে আছে, নিরালা দিদিমণির বাজে পোড়া লাশটাও ঠিক এখানেই ভোরবেলা মিলেছিল। তার আগের রাতেও গতরাতের মতোই ঝড়-বৃষ্টি, বাজ পড়েছিল।’

লোকটার কথা শেষ হবার পরই ভয়ংকর ঘটনার অভিঘাতে জ্ঞান হারালাম আমি।

কিছুক্ষণ পর অবশ্য আমার জ্ঞান ফিরে এল। স্থানীয় লোকেরাই ঘটনাটা জানিয়ে দিল পুলিশকে। আমিও দুঃসংবাদটা জানিয়ে দিলাম কলকাতায় রাজীবের বাড়িতে। সারাদিন ধরে রাজীবের লাশ নিয়ে আমার আর সনাতনের চলল থানা থেকে মর্গে ছোটাছুটি। থানায় আমি যে এজাহার দিলাম তাতে আমি শুধু বললাম ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রাজীব বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমুদ্রতে স্নান করতে নেমেছিল। তার সঙ্গে যে একজন নারী ছিল সে কথা বলে আমি আর মৃত বন্ধুর ওপর কলঙ্ক লেপন করতে চাইলাম না। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে সনাতনও বলল না যে তাকে মেয়ে মানুষ খুঁজে আনতে বলেছিল রাজীব। সনাতন বলল সে রাতে সে নিজের ঘরেই ঘুমাচ্ছিল। বাজ পড়েই রাজীবের মৃত্যু হয়েছে এ ব্যাপারটা তার শরীর দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কাজেই সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের চেয়ে পুলিশ বেশি কিছু করল না আমাদের। দুপুর নাগাদ কলকাতা থেকে রাজীবের বাড়ির লোকেরা উপস্থিত হল। সব কিছু খতিয়ে দেখে পুলিশ মর্গ থেকে রাজীবের দেহ তুলে দিল পরিবারের হাতে।

রাজীবের দেহ নিয়ে ফেরার জন্য রওনা হবার আগে কলকাতা থেকে আসা কয়েকজনের সাথে আমি আর সনাতন আবার গিয়ে উপস্থিত হলাম নিরালাতে। রাজীবের গাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা ছাড়া দোতলার ঘরে আমার আর রাজীবের কিছু জিনিসও পরে আছে। অন্যরা বাইরেই রইল। আমি আর সনাতন প্রবেশ করলাম বাড়ির ভিতর। দুজনে দোতলায় উঠে আমাদের জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে ভরে নীচে নেমে এলাম। বাড়ি ছেড়ে বেরোবার আগে আমার কেন জানি একবার দেখার ইচ্ছে হল সে ছবিটা, ঘরটা। দরজা খোলাই ছিল। আমি ঢুকলাম সে ঘরে। সনাতনও ঢুকল। উন্মুক্ত দরজার ছবিটা একইভাবে একই জায়গাতে আছে। আমি ওই ছবিটা দেখার জন্যই এ ঘরে ঢুকেছি। মনে হয় তা অনুমান করতে পারল সনাতন। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানেন, এই ছবিটার আড়ালে অমনই একটা দরজা ছিল। ছবির মতো অমনই সমুদ্র দেখা যেত সে দরজা দিয়ে। ওই দরজা দিয়েই এক ঝড়-জলের রাতে বাইরে বেরিয়ে নিরালা দিদিমণি আর ফেরেননি। তারপর ওই দরজাটা ইট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়। ছবিটা দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয় ইট গাঁথা দরজাটা।’

অনেকক্ষণ ধরে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। আমি সনাতনকে প্রশ্নটা করলাম—’কত বয়স ছিল তোমাদের নিরালা দিদিমণির? কেমন দেখতে ছিলেন তিনি?’

সনাতন মৃদু চুপ করে থাকার পর বিষণ্ণভাবে জবাব দিল, ‘পঁচিশ-ছাব্বিশ মতো বয়স ছিল তার। ফর্সা, সুন্দর চেহারা। ঠোঁটের ওপর নাকের একপাশে একটা আঁচিল ছিল।’

ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে আমি শেষ বারের মতো ভালো করে তাকালাম ক্যানভাসে আঁকা সমুদ্র দরজার দিকে। আর তখনই ছবিটার মধ্যে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। উন্মুক্ত দরজার ছবিতে যে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে তাতে উচ্ছল সমুদ্র তরঙ্গে শুধু একাকী এক নারী নয়, তার সাথে এক পুরুষও রয়েছে!

নিরাল সমুদ্রতে নিঃসঙ্গতা মুছে ফেলে জলকেলিতে মত্ত তারা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *