সমাপ্তি
ভুলেছ কি তবে?
আগন্তুক বিরহের উদ্ভ্রান্ত গৌরবে
দিয়েছিলে যেই অঙ্গীকার,
একটি অক্ষরও তার
কালের কবল হতে পারোনি কি রাখিতে সঞ্চিয়া,
হায়, মোর অতিক্রান্ত বসন্তের প্রিয়া?
নাই মনে
বিদায়ের পথপ্রান্তে অন্তহীন অন্তিম চুম্বনে
আমার স্বতন্ত্র সত্তা চেয়েছিলে স্বায়ত্তে আনিতে
হেমন্তের জঙ্গম নিশীথে?
নিবিড় চোখের মৌনে দুঃসহ মিনতি
করেছিল দ্বিধায় মন্থর
অসমাপ্ত মুহূর্তের ঊর্ধ্বশ্বাস গতি।
ক্ষীয়মাণ তব কণ্ঠস্বর,
ব্যাপক বিচ্ছেদে হানি প্রগলভ ঘোষণা,
বলেছিল, কভু ভুলিব না।।
আজি যদি বসন্তের যবনবাহিনী
লণ্ড ভণ্ড ক’রে থাকে প্রস্তরিত সে-পুরাকাহিনী
অরক্ষিত অন্তরে তোমার;
বিশ্ববাসনার
অধীর মদির ঘ্রাণ বিকশিত লাইলাক্-বাসে,
অন্বেষি অদৃশ্য ছিদ্র, যদি ছুটে আসে
শোকস্তব্ধ সমাধিমন্দিরে;
রাত্রির গভীরে
আনে যদি চক্রী সমীরণ
নিরতীত নৈরাজ্যের রূঢ় নিমন্ত্রণ
রাজভক্ত নিবৃত্তির দ্বারে;
তোমার অক্ষম হিয়া নিরুদ্দিষ্ট প্রণয়ের ভারে
প্রথম দস্যুর পদে যদি লুটে পড়ে,
তাই হবে সিদ্ধ হোক; অপ্রাকৃত নিষ্ঠার নিগড়ে
তোমার দাক্ষিণ্য যেন বিষায়ে না উঠে,
ধর্মভ্রষ্ট অঙ্গ-সম, আত্মগত উগ্ৰ কালকূটে॥
করিলাম স্বত পরিহার
কপোলকল্পিত দাবি, বৃথা অধিকার;
আমার প্রলাপ,
পঙ্গু ঈর্ষা, ব্যর্থ অভিশাপ
ও-তনুর ভোগাতীত ঐশ্বর্যের ’পরে,
সন্তপ্ত যক্ষের মতো, জাগিবে না যুগে যুগান্তরে।
যেও সবই ভুলে;
চিত্ত হতে ফেলে দিও তুলে
প্রাণহীন প্রতিজ্ঞার অন্তর্ভৌম মূল।
অবসিত দুঃস্বপ্নের ভুল
জাগ্রত হৃদয় হতে যেন খ’সে যায়,
মিলনের সমারোহে প্রোষিতার জীর্ণ বস্ত্র প্রায় ॥
শুধু যবে গোধূলিলগনে
এ-বসন্তে পুনর্বার নব সখা-সনে
উপনীত হবে নদীতীরে:
চক্ষে অকারণ নীর, সুখশান্তি শায়িত শরীরে,
আবার দেখিবে চাহি রাত্রি দেয় জ্বালি,
দিনের স্ফুলিঙ্গ-যোগে, স্বর্গদ্বারে তারার দীপালী,
তখন পারো তো মনে কোরো ক্ষণতরে
বিগত বৎসরে,
এই পীঠে, এমনই প্রদোষে,
বিপন্ন পথিক এক, পদপ্রান্তে ব’সে,
তোমাতে জাগায়েছিল শাশ্বতীরে অকাল বোধনে।
কিন্তু যদি লজ্জা পাও সে-কথাস্মরণে,
নিঃসংকোচে তবে
নাম সুদ্ধ ভুলে যেও, মেনে নেব বিলুপ্তি নীরবে।।
২০ মে ১৯৩১