ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা মাত্র আটটা স্টেশন। দুপুরবেলা ট্রেনে তেমন ভিড় থাকে না। তা ছাড়া মানস যেখানে যাবে সে জায়গা শিয়ালদা স্টেশনের বেশ কাছেই, পায়ে হাঁটা পথ। কাজেই গাড়ি না নিয়ে ব্যারাকপুর প্ল্যাটফর্ম থেকে কলকাতাগামী ট্রেনেই উঠে বসেছিল সে। ফাঁকা কম্পার্টমেন্ট। এই ভরদুপুরে লোক কম। প্রতিটা প্ল্যাটফর্মে মাত্র কয়েকজন করে লোক ওঠানামা করছে। তিনটে স্টেশন পরে এক দম্পতি উঠল তাদের দশ—বারো বছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা মানসের পাশেই বসল একটা ম্যাগাজিন খুলে। আর তার বাবা—মা ঠিক উল্টোদিকের আসনে। মানস তাকাল বইয়ের মলাটের দিকে। শুকতারা। ছোটবেলাতে মানসও পড়ত। গল্প পড়ার অভ্যাস ছিল মানসের। এখন কাজের চাপে সে অভ্যাস শিকেয় উঠেছে। তবে ছেলেবেলার চেনা পত্রিকাটা বাচ্চা ছেলেটার হাতে দেখে বেশ ভালো লাগল মানসের। এসব কাগজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কুলজীবনের স্মৃতি। তখন বই নিয়ে কত কাড়াকাড়ি হত বন্ধুদের মধ্যে!
ট্রেন চলছে। বইটা পড়তে পড়তে ছেলেটা হঠাৎ বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে গোল গোল চোখে তার বাবাকে জানাল— ‘বাবা, হানাবাড়িতে কঙ্কালটা দেখা দিচ্ছে!’
কথাটা শুনে মানস অনুমান করল, ছেলেটা ভূতের গল্প পড়ছে। একসময় শুকতারাতে ভূতের গল্প মানসও পড়েছে। বইটার পাতা উলটে কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা আবার উত্তেজিতভাবে তার বাবার উদ্দেশে বলল, ‘এবার মনে হচ্ছে, লোকটার ঘাড় মটকাবে কঙ্কালটা!’
দ্বিতায়বার ছেলের কথা শুনে, তাঁর ছেলের কথায় মানস বিরক্ত হতে পারে ভেবেই হয়তো ভদ্রলোক ছেলেটাকে বললেন, ‘তুমি এখন বরং ভূতের গল্পটা না পড়ে অন্য কোনো গল্প পড়ো।’
ভূতের গল্প পড়ে বাচ্চা ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে দেখেই তাকে অন্য কোনো গল্প পড়ার উপদেশ দিলেন তার বাবা। কিন্তু বাচ্চাটা তাঁর কথার মানে ধরতে না পেরে বলে উঠল, ‘এখন পড়ব না কেন? তুমি তো আজ সকালবেলাতে এ গল্পটাই পড়ছিলে। তোমার গল্পটা পড়া হয়ে গেছে আর আমাকে পরে পড়তে বলছ!’
ঠিক এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের সঙ্গে মানসের চোখাচোখি হয়ে গেল। ভদ্রলোক মৃদু অপ্রস্তুতভাবে হেসে মানসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসলে ওর গল্প পড়ার খুব নেশা। বিশেষত ভূতের গল্প।’
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা বলে উঠল, ‘শুধু আমার কেন, তোমারও তো ভূতের গল্পের নেশা। বইমেলা থেকে মোটাসোটা বড়দের ভূতের বই কেনো! তার বেলা?’
সরল ছেলেটার কথা শুনে মানস এবার প্রায় হেসে ফেলছিল। মানসের মনের ভাব পাঠ করে ভদ্রলোক যেন মৃদু লজ্জাবোধ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও পড়ি। আসলে ভূতের গল্প বা ভৌতিক ব্যাপারটার মধ্যে একটা অকর্ষণ আছে। ছেলেবেলার অভ্যাসটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’
মানস তাঁর কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, ‘আমারও ছোটবেলাতে বেশ লাগত ভূতের গল্প। এখন আর সময়াভাবে পড়া হয় না।’
ছেলে, বাবা দুজনেই চুপ হয়ে গেল এরপর, কিন্তু তাদের কথোপকথন শুনে মানসের মনে হল, যে কারণে সে আজ কলকাতাতে মিস নিশা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, ভদ্রমহিলা যদি সত্যিই সে কাজে দক্ষ হন, তবে তার পরিকল্পনা, ব্যবসাটা ভবিষ্যতে সফল হতে পারে। ছেলে হোক বা বুড়ো, ভূত বা ভৌতিক ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ আকর্ষণীয়।
পরিকল্পনাটা অবশ্য প্রথমে মানসের মাথায় দিয়েছে মানসের বন্ধু রঞ্জনই। মানস রেস্তোরাঁর ব্যবসা খুলতে যাচ্ছে শুনে সে বলেছিল, ‘এই শহর, শহরতলিতে এখন চারপাশে কত ঝাঁ—চকচকে নামী—দামি রেস্তোরাঁ। সেসব রেস্তোরাঁ—হোটেল—ফুডপ্লাজাতে না গিয়ে মানুষ তোর রেস্তোরাঁতে হঠাৎ কেন খেতে যাবে শুনি?’
তার কথা শুনে মানস বলেছিল, ‘এ প্রশ্নটা ঠিক। তবে চাকরি—বাকরি তো কিছু হল না। তাই একটা কিছু আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। হোটেল ম্যানেজমেন্টের একটা ক্র্যাশ কোর্স করেছিলাম। একমাস কলকাতাতে একটা মাঝারি মানের হোটেলে ট্রেনি হিসাবেও ছিলাম। হোটেল, রেস্তোরাঁ সম্পর্কে সামান্য কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। অন্য ব্যবসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতাই তো নেই। আর কী করব বল? তাই এ ব্যবসাটাই ট্রাই করব ভাবছি। তাতে যা হবার হবে। দেখি ব্যবসাটা চলে কি না?’
রঞ্জন বলেছিল, ‘চলতে পারে, এক যদি তুই অভিনব কোনো একটা ব্যাপার করতে পারিস তোর রেস্তোরাঁতে। আকর্ষণীয় কোনো ব্যাপার। যা লোককে ছুটিয়ে আনবে।’
‘তোর কোনো সাজেশন আছে এ ব্যাপারে?’ জানতে চেয়েছিল মানস।
রঞ্জন একটু ভেবে নিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ। একটা সাজেশন আছে। আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও ঠিকভাবে করতে পারলে ব্যাপারটা জব্বর হবে। একটা টেলিভিশন প্রোগ্রামে আমি সেটা দেখেছিলাম। বিদেশি রেস্টুরেন্ট। এ দেশে কয়েকটা চালু হলেও কনসেপ্টটা নতুন। আর নতুন ব্যাপারই লোক টানে।’
‘কী কনসেপ্ট?’ প্রশ্ন করেছিল মানস।
রঞ্জন বলেছিল, ” ‘ভৌতিক রেস্তোরাঁ’। অর্থাৎ তার অ্যাম্বিয়েন্স বা পরিবেশটা হবে গা—ছমছমে বা ভৌতিক। ইন্টিরিয়র ডেকরেশন থেকে শুরু করে ওয়েটারদের সাজপোশাক সবই হবে ভৌতিক বা সে ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ঠিকমতো যদি করতে পারিস তবে শুদু সেসব দেখার জন্যই লোক ছুটে আসবে। ছোট ছোট ছেলে—মেয়েরা থেকে শুরু করে তাদের বাবা—মায়েরা, যুবক—যুবতি থেকে বুড়োবুড়ি, ভূত ব্যাপারটার ওপর সবারই আকর্ষণ কিন্তু প্রবল। ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখতে পারিস।”
রঞ্জনের কথা শুনে ব্যাপারটা নিয়ে কয়েকদিন ভাবার পর মানসের মনে হয়েছে পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। এটা বিজ্ঞাপন আর চমকের যুগ। আর এই চমকটা যদি সত্যিই দেওয়া যায় তবে খদ্দের টানতে অসুবিধা হবে না। তবে তার নিজের তো এ সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই। তাই নেট ঘেঁটে এসব কাজে তাকে সহায়তা—পরামর্শ দিতে পারে তেমন এক কোম্পানিকে খুঁজে পেয়েছে সে। নাম—’ইউরেকা ওয়ার্ল্ড’। মালকিনের নাম—মিস নিশা চৌধুরী। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ইন্টিরিয়ার ডেকরেশন থেকে কস্টিউম ডিজাইন, বিজ্ঞাপনের প্রমোশন ইত্যাদি নানা কিছু করে থাকে সে কোম্পানি। মিস নিশা চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে মানস। তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে কলকাতা যাচ্ছে। বাবা—ছেলের ভূতের প্রতি আকর্ষণ দেখে তাই মনে মনে একটু বাড়তি উৎসাহবোধ করল মানস।
দেখতে দেখতে শিয়ালদা স্টেশন চলে এল। গাড়ি থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে মানস রওনা হল।
২
বউবাজারের মোড় থেকে মেডিকেল কলেজের রাস্তা ধরে একটু এগিয়েই রাস্তার ওপরই অফিসটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। মাথার ওপর সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘ইউরেকা ওয়ার্ল্ড’। প্রোপাইটার মিস নিশা চৌধুরী। কাচের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল মানস। ঝাঁ—চকচকে একটা ঘর। কাচের মতো স্বচ্ছ মোজাইক। মাথার ওপর কারুকাজ করা সিলিং। এসি চলছে। রিসেপশনে বসে আছে টাই পরা একজন তরুণ, আর এক তরুণী। তাদের পোশাকে, সোফাসেট সমৃদ্ধ রিসেপশন রুমে সর্বত্রই আধুনিক রুচিশীলতা কর্পোরেট ভাবনার স্পষ্ট ছাপ। মানস রিসেপশনে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারটা জানাতেই তরুণী ইন্টারকম টেলিফোনে তার আগমনবার্তা পৌঁছে দিল উপযুক্ত স্থানে। তারপর ওপাশ থেকে সংকেত পেয়ে টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রেখে মানসকে একটা দরজা দেখিয়ে বলল, ‘ওটাই ম্যাডামের চেম্বার। আপনি যান।’
দরজা ঠেলে চেম্বারে প্রবেশ করল মানস। সুদৃশ্য টেবিল—চেয়ারে সাজানো ছোট চেম্বার। কাচের টেবিলের ওপাশে বসে আছেন এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মিস নিশা চৌধুরী। তবে ভদ্রমহিলার বয়স বেশি নয়। তাকে একজন মেয়েই বলা যায়। বয়স খুব বেশি হলে ছাব্বিশ—সাতাশ হবে। মানসের মতোই, এমন কি তার থেকে কম বয়সও হতে পারে। ঝকঝকে সপ্রতিভ চেহারার এক তরুণী। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত। পরনে জিন্স, সাদা শার্ট। তার ওপর সিল্কের একটা ওয়েস্ট কোট। নমস্কার বিনিময়ের পর তার মুখোমুখি টেবিলের এপাশে একটা চেয়ারে বসল মানস। তাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে নিশা চৌধুরী প্রশ্ন করল, ‘আমি আপনাকে ঠিক কী ধরনের সাহায্য করতে পারি? আপনার পরিকল্পনাটা একটু খুলে বলুন।’
মৃদু সময় নিয়ে মানস তার পরিকল্পনাটা জানাল তাকে। তার কথা মন দিয়ে শোনার পর নিশা বলল, ‘হ্যাঁ, পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। আমি যখন প্যারিসে গেছিলাম তখন ও দেশে এমন একটা কফি পাব দেখেছিলাম। কলকাতাতে অমন দু—একটা হয়েছে বলে শুনলেও মফসসল শহরে ব্যাপারটা নতুনই। এ কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব বলেই মনে হয়। যে জায়গাতে রেস্তোরাঁটা হবে সেটা ঠিক কোথায়? একদম ব্যারাকপুর শহরের মধ্যে? কতটা জায়গা?’
মানস বলল, ‘না, ঠিক শহরের মধ্যে নয়। একটু বাইরে। বারাসত যেতে ব্যারাকপুর—নীলগঞ্জ বাসরাস্তার ওপরে আমাদের দুশো বছরের পৈতৃক বাড়ি।
তারই একতলার ঘরগুলো নিয়ে রেস্তোরাঁটা খুলব ভেবেছি। বাবা—মা মারা যাবার পর আমি একাই থাকি বাড়িটাতে।’
মানসের কথা শুনে নিশা বলল, ‘বাঃ, পুরোনো বাড়ি—এ ব্যাপারটা ভৌতিক পরিবেশ রচনাতে কাজ দিতে পারে। নীলগঞ্জ নামটা আমি যেন কোথাও শুনেছি বা পড়েছি বলে মনে হয়।’
মানস বলল, ‘আমার বাড়ি থেকে বারাসতের দিকে কিছুটা এগোলেই নীলগঞ্জ। একসময় আমাদের ওদিকে নীলের চাষ হত। তার থেকেই ওই নাম। আমার বাড়ির পিছনে একটা বিরাট ফাঁকা জমি আছে, সেই মাঠের মধ্যে নীলগাছ পচানোর জন্য এখনও একটা বিরাট চৌবাচ্চার ভাঙা অংশ দেখা যায়।’
কথাটা শুনেই নিশা বলে উঠল, ”আরে এ ব্যাপারটাও তো আপনার পরিকল্পনাতে কাজে লাগানো যেতে পারে! ‘নীলকুঠি’—এ শব্দটা শুনলেই তো মানুষের মনে ভেসে ওঠে নীলকর সাহবেদের কথা। তাদের খুন, জখম, অত্যাচারের কথা! আবার নীল বিদ্রোহের সময় সাহেব আর চাষিদের হত্যালীলার কথা। আর যেখানে এসব খুন—জখম, সেখানেই তো আত্মা—ভূত—প্রেতের বাসস্থান বলে লোকের ধারণা। ব্যাপারটাকে আমরা বিজ্ঞাপনের কাজেও ব্যবহার করতে পারব। রেস্টুরেন্টের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘নীলকুঠি। দ্য হন্টেড রেস্টুরেন্ট!’ নামের মধ্যেই বেশ একটা ভৌতিক, আকর্ষণীয় ব্যাপার থাকবে।”
‘নীলকুঠি। দ্য হন্টেড রেস্টুরেন্ট!’ বাঃ, বেশ সুন্দর নাম বলল মেয়েটা। নামটা পছন্দ হল মানসের। তা ছাড়া মেয়েটার কথাগুলো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মিশ নিশার ওপর ভরসা করা যেতে পারে বলেই ধারণা হল মানসের। সে বলল, ‘তাহলে কাজটাতে কীভাবে এগোনো যায়?’
নিশা বলল, ‘এ কাজে পরিবেশ রচনাটাই আসল। যাতে রেস্তোরাঁতে প্রবেশ করলেই খদ্দেরদের মনে একটা গা—ছমছমে ভাবের উদয় হয়। আসবাবপত্র, ওয়েটার ও কর্মচারীদের পোশাক, আলো, শব্দ, খাবার পরিবেশনের ট্রে থেকে শুরু করে মেনুকার্ডের মধ্যেও যেন একটা ভৌতিক বা ভয় ধরানোর ব্যাপার থাকে। ইন্টিরিয়ার ডেকরেশনের ব্যাপারটা আমার পরামর্শ মতো আপনি আপনার মিস্ত্রি দিয়ে করাতে পারেন, কয়েকটা ব্যাপার যা ওরা করতে পারবেনা তা বাদে। আমি স্পট ভিজিট করে সে ব্যাপারে তাদের বুঝিয়ে আসব। আর কর্মচারীদের গ্রুমিং—এর ব্যাপারটাও করে আসব। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, যা আপনি জোগাড় করতে পারবেন না, সেসবও আমি জোগাড় করব। আর বিজ্ঞাপনের, পাবলিসিটির দিকটাও আমরা দেখব।’
রান্নাবান্নার পদের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা আছে মানসের। তাই সে বলল, ‘মেনুকার্ডে ভৌতিক ভাবনা আনবেন কীভাবে?’
সামান্য ভেবে নিয়ে নিশা বলল, ”নামের মাধ্যমে আর পদের একটু রকমফের করে। ধরুন আপনি স্পেশাল কিছু খাদ্য, পানীয়, ডেসার্ট রাখলেন তালিকাতে। ধরা যাক বেদানার জুস। গাঢ় রক্তবর্ণের হয় দেখতে। আপনি মেনুকার্ডে তার নাম দিতে পারেন, ‘ব্লাড জুস’ বলে। ধরুন মানুষের আঙুলের মতো করে মাংসের টুকরো কেটে কাবাব বানিয়ে তার নাম দিলেন, ‘হিউম্যান ফিঙ্গার কাবাব’। ডেসার্ট হিসাবে মিষ্টির দোকানে অর্ডার দিয়ে স্পেশাল এমন সন্দেশ বানিয়ে আনালেন যে একজোড়া সন্দেশ প্লেটে সাজিয়ে দিলেই যেন মনে হয় কোটর থেকে খুবলে বার করা একজোড়া চোখের মণি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। মেনুকার্ডে সে মিষ্টির নাম হতে পারে ‘ডেড ম্যান আইবল’—মৃত মানুষের চোখ। ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম?”
মানস হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার বুঝলাম। খাবারের ব্যাপারটা আপনার পরামর্শ মতো আমি নিজেও সামলাতে পারব মনে হয়।’ এ কথা বলার পর মানস জানতে চাইল, ‘আপনাকে আপনাদের কাজের জন্য কী ফিজ দিতে হবে?’
নিশা একটু চুপ করে থেকে মনে মনে ভেবে নিয়ে বলল, ‘দেখুন আমার অ্যাডভাইস ফিজ কুড়ি হাজার টাকা। ভালো করে বিজ্ঞাপন আর ক্যাম্পেনিং করতে খরচ পড়বে পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। বড় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়াও হোর্ডিং, লিফলেট এসব বানাতে হবে। আর বেশ কিছু জিনিস আমাকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানাতে হবে, যা আপনি খোলা বাজারে কিনতে পারবেন না। এই যেমন, যে চিনামাটির বোল বা পাত্রে খাবার সার্ভ করা হবে সেগুলো দেখতে হবে মানুষের মাথার খুলির মতো। চামচগুলো হবে মানুষের হাড়ের মতো দেখতে হাতলওলা। ওয়েটারদের জন্য স্পেশাল কস্টিউম ইত্যাদি লাগবে। এসবের জন্য আরও হাজার পঞ্চাশ। সব মিলিয়ে একটু কম—বেশি এক লাখ কুড়ি হাজার টাকার মতো। তা আপনি কবে নাগাদ রেস্টুরেন্টটা চালু করতে চান।’
টাকাটা মোটামুটি মানসের সাধ্যের মধ্যেই বলেছে মেয়েটা। চারপাশে জিনিসের বাজারদর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মানসেরও আছে। মানস তার প্রশ্ন শুনে বলল, ‘দুর্গাপুজোতে চালু করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু পুজোর তো আর দিন পনেরো মাত্র বাকি। কাজ গুছিয়ে ওঠা যাবে না। যদি কালীপুজোতে ওপেন করা যায়? তেমনই ইচ্ছা আছে।’
নিশা বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও কাজ করতে একমাস মতো সময় লাগবে। আর কালীপুজো ব্যাপারটা একদিক থেকে এ ব্যাপারে ভালো। কালীপুজোর সঙ্গে ভূত—প্রেতের একটা সম্পর্ক আছে। পুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর রাতেও রেস্টুরেন্ট চালু করা যেতে পারে। আমাদের ভাবনার সঙ্গে দিনটা মিলে যাবে।’
আর কিছু কথা বলার পর, দু—তরফের মধ্যে কথা পাকা হয়ে গেল। রসিদের বিনিময়ে কুড়ি হাজার টাকা অ্যাডভান্সও দিল মানস। বাকি টাকা খেপে খেপে দেবে। নিশা আর তার কর্মচারীরা তো যাওয়া— আসা করবেই তার ওখানে। মানসকে কাজ শুরুর ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু পরামর্শ দিয়ে নিশা জানাল যে, মানস ঘর মেরামত, টাইলস বসানো, রং ইত্যাদি করবার পর পুজোর আগে প্রথমবার স্পট ভিজিট করবে সে। আর এ সময়ের মধ্যে সে বিভিন্ন জিনিসের অর্ডার দেওয়া, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির দিকটাও দেখবে।
নিশার সঙ্গে কথা বলে ফেরার পথ ধরল মানস।
৩
মানসের রেস্তোরাঁ বানাবার কাজ শুরু হয়ে গেল। কাজ কিছুটা এগোবার পর দুর্গাপুজোর ঠিক আগে আগে স্পট ভিজিটে এল নিশা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে গেল মানসের মিস্ত্রিদের। দুর্গাপুজো এল এবং তা কেটেও গেল। তারপর আরও জোরকদমে কাজ শুরু হল। হাতে তো আর মাত্র দু—সপ্তাহ সময়। ভূত চতুর্দশীর দিনই উদ্বোধনের দিন ঠিক করা হয়েছে এই ভৌতিক রেস্তোরাঁর। রাঁধুনি—শেফ, সিকিউরিটি পার্সন, ওয়েটার—এসব লোকও নিয়োগ করে ফেলেছে মানস। কালীপুজোর ঠিক সাতদিন আগে মালপত্র আর কর্মচারীদের গ্রুমিং—এর ব্যাপারে আসার কথা ছিল নিশার। ফাইনাল ডেকরেশনটাও করার কথা তার।
গ্রুমিং—এর জন্য নবনিযুক্ত কর্মচারীদের বেলা দশটার মধ্যে বাড়িতে হাজির হতে বলেছিল মানস। দশটা নাগাদই নিশার হাজির হবার কথা ছিল। কর্মচারীরা সঠিক সময়ই উপস্থি হল, আর নিশাও হাজির হল নির্ধারিত সময়েই তার নিজের ছোট লাল রঙের গাড়িটার পিছনে এক ম্যাটাডোর ভর্তি মালপত্র নিয়ে।
ঘরে ঢুকে নিশা কয়েকটা খবরের কাগজ মানসের দিকে বাড়িয়ে দিলে বলল, ”বাংলা—হিন্দি—ইংরাজি তিনটে ভাষাতে ‘নীলকুঠি—ভৌতিক রেস্তোরাঁ’র বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে আজকের কাগজে। লাল কালি দিয়ে মার্ক করা আছে, দেখে নিন।
কলকাতার তিনটে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে, গতকালই হোর্ডিং টাঙানো হয়েছে। আর এ শহরে টাঙাবার জন্য হোডিংও সঙ্গে এনেছি।”
কাগজগুলো খুলে বিজ্ঞাপনগুলো দেখল মানস। বেশ খুশি হল সে। নিশা অন্য কাজ শুরু করার আগে মানসকে বলল, ‘বাংলা কাগজটাতে দেখলাম এ অঞ্চলের অন্য একটা খবরও বেরিয়েছে।’
মানস কী খবর জানতে চাওয়াতে নিশা খবরটা দেখাল মানসকে। ছোট্ট একটা খবর—”প্রমাণের অভাবে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে ব্যারাকপুর—নীলগঞ্জ অঞ্চলের ত্রাস মিহির মণ্ডল ওরফে ‘কানকাটা মিহির’। একাধিক খুন —জখম—ডাকাতি—তোলাবাজির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তার মুক্তি পাবার ঘটনাতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে নাগরিক সমাজের একাংশ। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে যে উৎসবের মরশুমে তারা কড়া নজর রাখছে চারপাশে, যাতে আইন— শৃঙ্খলার কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা হলে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেবে। জনসাধারণের চিন্তার কারণ নেই।”
খবরটা দেখার পর মানস মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, লোকটা ভয়ংকর বলে শুনেছি। দূর থেকে একবার দেখেওছি। কোথায় যেন একবার দাঙ্গা করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে একটা কান কাটা যায় বলে লোকে ওকে কানকাটা মিহির বলে। একটা কালীপুজোও করে ও।’
নিশা কাজ শুরু করে দিল এরপর। তার লোকজন মালপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে আনার কাজও শুরু করল। আর নিশা কর্মচারীদের গ্রুমিং—এর কাজ শুরু করল। তাদের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক বানিয়ে আনা হয়েছে। কারো জন্য নীলকর সাহেবের পোশাক, আবার কারো জন্য ভৌতিক পোশাক। এ ছাড়া মুখোশ, পরচুলা, কৃত্রিম ভয়ংকর দাঁত, নখ, এসব তো সঙ্গে আছেই। সেসব পোশাক পরিয়ে একবার ট্রায়াল দেওয়ানো হল কর্মচারীদের। বেশ ভৌতিক লাগছে লোকগুলোকে সেসব পোশাকে। জামার বুকের কাছে এমন রং করা, যেন লাল রক্ত ঝরছে বুক থেকে! টাটকা রক্ত।
কর্মচারীদের ব্যবহারে কীভাবে ভৌতিক আচরণ ফুটিয়ে তুলতে হবে সেটাও হাতে—কলমে তাদের বুঝিয়ে দিল নিশা। সে তাদের বলল, ‘আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি প্রথম দিন সন্ধ্যায় থাকব আপনাদের সঙ্গে। কোনো সমস্যা হবে না।’ মানসও ওই দিন নিশার উপস্থিতি মনে মনে চাইছিল। সে খুশি হল ব্যাপারটা জেনে।
গ্রুমিং—এর কাজ মেটাবার পর রেস্তোরাঁর ডেকরেশনের খুঁটিনাটি কাজে মন দিল নিশা। তার পরামর্শ মতো ঘরের দেওয়ালের রং কালো করা হয়েছে। আর তাতে আঁকানো হয়েছে পূর্ণাবয়ব ভয়ংকর সব ছবি। কোথাও নীলকর সাহেব চাষিদের ওপর চাবুক চালাচ্ছে, আবার কোথাও নিজের কাটা মুন্ডু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনো মানুষ! কোনো ছবিতে অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসছে নখরযুক্ত রক্তাক্ত হাত। জানলার ভারী পর্দা টেনে দিয়ে সিলিং থেকে নেমে আসা নীল আলো জ্বালানো হল। সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে উঠতে লাগল কখনও ঝিঁঝিপোকার ডাক, চাবুকের শব্দ আর মাঝে মাঝে মানুষের আর্তনাদ বা হিংস্র চিৎকার। এসব শব্দ নিশাই রেকর্ড করে এনেছে। ভৌতিক পরিবেশে সে সাজিয়ে তুলল রেস্তোরাঁকে। মানস তার কাজে বেশ সন্তুষ্ট হল। সত্যি তার নিজেরই কেমন গা—ছমছম করছে নিজের রেস্তোরাঁ দেখে। আর বাইরের লোকদের তো নিশ্চিতভাবে করবেই। সবশেষে নিশার লোকজন একটা কাঠের কফিন বাক্স নিয়ে ঘরে ঢুকল। কাস্টমারদের বসার টেবিল—চেয়ারগুলোকে বিরাট ঘরটার দেওয়াল ঘেঁষে বৃত্তাকারে বসানো হয়েছে। তার মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানে সেটাকে নামানো হল। নিশা হেসে বলল, ‘নীলকর সাহেবের কফিন। এটা অতিথিদের চোখে ভৌতিক পরিবেশকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। তবে এটা সংগ্রহ করতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কফিনওলা আমার পরিবারের দীর্ঘদিনের পরিচিত।’—এই বলে সে তার বুকের ভিতর থেকে গলায় ঝোলানো একটা সোনার ক্রস বার করে দেখাল। মানস বুঝতে পারল মিস নিশা চৌধুরী ধর্মে খ্রিস্টান। মানস একবার কফিনের ডালাটা সরিয়ে দেখল। তার ভিতর কিছু নেই।
সাজানো—গোছানোর কাজ মিটতে মিটতে বিকেল হয়ে গেল। নিশার প্রাপ্য টাকার বেশ কিছু অংশ তাকে দিয়ে দিল মানস।
ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যার আগেই উপস্থিত হবে জানিয়ে তার লোকজন নিয়ে কলকাতাতে রওনা দিল নিশা। মানসের নিজের লোকজনও এরপর একে একে বিদায় নিল।
কার্তিকের বেলা। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। বাইরের লোক ছিল বলে সারাদিন স্নান—খাওয়ার ফুরসত মেলেনি মানসের। সবাই চলে যাবার পর মানস সদর দরজা বন্ধ করে সেসব কাজ সারতে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজার পাল্লা বন্ধ করতে না করতেই মোটর সাইকেলের বিকট ফটফট শব্দ এসে থামল বাড়ির বাইরে। কেউ এসেছে! তাই আবার দরজা খুলে বাইরে বেরোল মানস। তিনজন অচেনা যুবক নামল বাইক থেকে। তারা মানসকে দেখে এগিয়ে আসতেই তাদের মধ্যে ডোরাকাটা জামা আর বুকে খাঁড়ার লকেট ঝোলানো একজন লোককে চিনে ফেলল মানস। চিনে ফেলল তার ওই কাটা কানটার জন্যই। আরে, এ যে সেই কানকাটা মিহির গুন্ডা! যার কথা আজ খবরের কাগজে বেরিয়েছে! তার স্যাঙাতদের পোশাক আর চেহারা দেখেও তারা একই গোত্রের মনে হচ্ছে। তবে তাদের দেখে ঘাবড়ালে চলবে না বুঝতে পেরে মানস নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার? কাকে চাই?’
কানকাটা মিহিরের লম্বা চুলওলা এক সঙ্গী পানের ছোপঅলা দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘তোমার কাছেই এসেছি কালীপুজোর চাঁদা নিতে।’
কানকাটা মিহির তার কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে দরজার মাথার ওপর নতুন টাঙানো রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডটার দিকে। মানস জানতে চাইল, ‘কত দিতে হবে?’
তার প্রশ্নের জবাবে লোকটা যা বলল তা শুনে চমকে উঠল মানস। লোকটা বলল, ‘বেশি নয়, মাত্র বিশ হাজার টাকা।’
‘বিশ হাজার টাকা!’ বিস্মিতভাবে বলে উঠল মানস। আর তা শুনে কানকাটা মিহিরের অপর সহযোগী ঠান্ডাস্বরে বলে উঠল,
‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ, বিশ হাজার টাকা। এবার আমাদের কালীপুজোর পঁচিশ বছর পূর্তি। তা ছাড়া দাদাকে জেল থেকে খালাস করতেও বিস্তর খরচ হয়েছে। তাই কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে।’—এই বলে সে তাকাল তার দাদার দিকে।
এ কি চাঁদা চাইতে আসা নাকি তোলা তুলতে আসা? মানস বলল, ‘অত টাকা তো দিতে পারব না ভাই। অন্যদের দুশো—একশো করে চাঁদা দিয়েছি। তোমরা যখন বলছ যে তোমাদের অনেক খরচ, তখন না হয় তোমাদের পাঁচশোই দেব। তার বেশি চাঁদা দেবার সাধ্য আমার নেই। নতুন রেস্তোরাঁ বানাচ্ছি, তার জন্য অনেক পয়সা লাগছে।’
মানসের বক্তব্য শুনে এবার মুখ খুলল স্বয়ং মিহির গুন্ডা। কর্কশ স্বরে সে বলল, ‘এই হোটেল খুলছ বলেই তোমাকে বিশ হাজার দিতে হবে। পাঁচশো টাকা নেবার জন্য মিহির মণ্ডল কারো কাছে আসে না।’ কথাগুলো বলে থুক করে থুতু ফেলল সে।
এদের ভাবগতিক সুবিধার নয় দেখে একটা সমঝোতায় আসার জন্য মানস বলল, ‘ঠিক আছে, কষ্ট হলেও আমি আরও পাঁচশো দেব। অর্থাৎ হাজার টাকা। এর থেকে বেশি দেবার সাধ্য আর সত্যিই নেই আমার। ব্যবসা যদি সত্যিই দাঁড়ায় তবে সামনের কালীপুজোতে কিছু বেশি চাঁদা দেব কথা দিলাম।’
মিহির তার কথায় এবার ধমকে উঠে বলল, ‘কী তখন থেকে পাঁচশো—হাজার করছিস? বিশ হাজারের এক পয়সা কম নেব না। আমার নাম শুনিসনি নাকি? কানকাটা মিহির। পরপর তিনদিন যদি তোর এই রেস্টুরেন্টের সামনে বোম পড়ে তবে আর ব্যবসা করতে হবে না। কত লাশ ফেলে এলাম, দু—চারটে বোম ফেলা কোনো ব্যাপারই নয়। সেটাই চাইছিস নাকি?’
তার কথা শুনে মানস ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ না করে আবারও বলল, ‘বললাম তো, হাজার টাকা দিচ্ছি নিয়ে যাও। তার বেশি দেবার ক্ষমতা আমার নেই।’
কানকাটা মিহিরের এক স্যাঙাত বলে উঠল, ‘রাস্তার মোড়ে ঠেলাগাড়িতে যে লোকটা চাউমিন বিক্রি করে, সে—ই তো পাঁচ হাজার দিয়েছে। আর তুমি এত বড় হোটেল বানাচ্ছ! অযথা দাদার মাথা গরম কোরো না। টাকাটা দাও বা কখন দেবে বলো?’
মিহিরের স্যাঙাতের কথায় মানস বলল, ‘বললাম তো অত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।’
কানকাটা মিহির হিংস্রভাবে বলে উঠল, ‘টাকা তুই আলবাত দিবি। বিশ হাজারের এক পয়সা কম নয়। দেখি দিস কি না?’ এই বলে সে তার জামার নীচে কোমর থেকে কী যেন একটা বার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার এক সঙ্গী তাকে থামিয়ে ইশারায় রাস্তার দিকে দেখাল। বেশ কিছুটা দূরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। রুটিন টহলদারি বা অন্য কোনো কারণে হয়তো বেরিয়েছে তারা। কিন্তু গাড়িটা দেখামাত্রই সঙ্গীদের নিয়ে চটপট মোটরবাইকে চেপে বসল কানকাটা মিহির। বাইক স্টার্ট করে চলে যাবার আগের মুহূর্তে হিংস্রভাবে মানসের দিকে তাকিয়ে সে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল—’কালীপুজোর আগের রাতের মধ্যেই টাকাটা যেন পৌঁছে যায়। পুরো বিশ হাজার টাকা। নইলে ফল ভালো হবে না।’
মিহির গুন্ডার ব্যাপারটাতে প্রথম দিকে মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেছিল মানস। কিন্তু ধীরে ধীরে সে মনের জোর ফিরে পেল। সে সিদ্ধান্ত নিল সে টাকা দেবে না। কারণ, রেস্টুরেন্টটা বানাতে গিয়ে জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। টাকা নষ্ট করার ক্ষমতা তার নেই। আর দ্বিতীয়ত, কেন সে টাকা দেবে? সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে অনুমতি নিয়ে সে ব্যবসা খুলতে চলেছে। কোনো অন্যায় কাজ করছে না। নিশাকে একটা কাজে ফোন করে কথাপ্রসঙ্গে ব্যাপারটা জানাতে সেও বলল, এ ধরনের অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে অন্যায়কে সমর্থন করা। আর—একবার মানস তাকে ভয় পায় ভেবে নিলে গুন্ডা যে ভবিষ্যতে আবার এসে টাকা দাবি করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই মানস মনস্থির করে নিল, টাকা সে দেবে না। তাতে কী হয় দেখা যাবে। দরকারে সে পুলিশ—প্রশাসনকে ব্যাপারটা জানাবে। রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের দিন যত এগোতে লাগল, মানসের কাজের চাপ তত বাড়তে লাগল। এদিকে—ওদিকে ছোটাছুটি রান্না ইত্যাদির জন্য নানা জিনিস সংগ্রহ করা, এসব ব্যাপারে মানস এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে অন্য কিছু আর ভাবারই ফুরসত রইল না। মিহির গুন্ডার হুমকির ব্যাপারটাও প্রায় মুছে গেল তার মন থেকে।
৪
চলে এল ‘নীলকুঠি ভৌতিক রেস্তোরাঁ’র উদ্বোধনের দিন। সকালে ঘুম ভাঙার পরই নিশাকে ফোন করল মানস। সে জানাল, চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। সে যেমন যেমন পরামর্শ—নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, মানস আর তার কর্মচারীরা যেন তা পালন করে। বিকাল পাঁচটা নাগাদ, রেস্তোরাঁর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় সে চলে আসবে ভৌতিক সাজে। কলকাতা মাঠের এক বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলারকে ফিতে কাটার আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে মানস।
নিশাকে ফোন করার পর ঝড়ের মতো সময় কাটতে লাগল মানসের। তার কর্মচারীরাও নির্দিষ্ট সময়ে এসে পড়ল। তাদের নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল মানস। সকাল গড়িয়ে দুপুর, তারপর বিকেল হয়ে গেল একসময়।
পাঁচটার বেশ আগে থেকেই ভিড় জমতে শুরু হল রেস্তোরাঁর সামনে। বিজ্ঞাপনে যে টেলিফোন নম্বর দেওয়া ছিল, তার মাধ্যমে টেবিল বুক করেছেন কিছু মানুষ। গাড়ি করে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। এমনকি কলকাতা থেকেও এসেছেন কয়েকজন। পাঁচটার আগেই ভৌতিক পোশাকে তৈরি হয়ে গেল কর্মচারীরাও। রেস্তোরাঁর ভিতর অতিথি খদ্দেরদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল তারা।
ঠিক পাঁচটাতেই বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত হলেন। নিশা কতদূর এসেছে তা দেখার জন্য তাকে মোবাইলে ফোন করল মানস। কিন্তু ফোনে শুধু রিং হয়ে গেল। মানস খেলোয়াড় ভদ্রলোককে বাইরে বসিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে প্রতীক্ষা করতে লাগল নিশার জন্য। মানসের রেস্তোরাঁকে সাজিয়ে তুলতে তার ভূমিকাই বেশি। ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার দিকে। অন্ধকার নামতে শুরু করল। রেস্তোরাঁর বাইরে মুখোশের মতো দেখতে ঝোলানো লণ্ঠনগুলো জ্বলে উঠল। কিন্তু নিশার দেখা নেই! এদিকে বাইরে বেশ ভিড় জমে গেছে।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ উদ্বোধক ভদ্রলোক উশখুশ করতে লাগলেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ। রেস্তোরাঁ উদ্বোধন করেই তাঁকে একটা কালীপুজোর প্যান্ডেলে ফিতে কাটার জন্য যেতে হবে। তাঁর পক্ষে আর অপেক্ষা করা বেশ অসুবিধাজনক। মানস শেষ একবার ফোন করল নিশাকে। কিন্তু এবারও কানেকশন পেল না। অগত্যা সে এরপর ফুটবলার ভদ্রলোককে দিয়ে ফিতে কাটিয়ে ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় উদ্বোধন করল তার ভৌতিক রেস্তোরাঁর।
এবার একে একে খদ্দেররা প্রবেশ করতে শুরু করল রেস্তোরাঁতে। দরজার মুখে যে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িতে আছে তাকেও একটা কৃত্রিম দাঁতের সেট পরানো হয়েছে। কাচের দরজা খুলে দেবার সময় সে অতিথি খদ্দেরদের হাতে একটা করে ভৌতিক কাগজের মুখোশ তুলে দিয়ে হাসছে, আর তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে তার শ্বদন্ত। আর ভিতরে ঢুকে পরিবেশ দেখে তো সবাই চমকে উঠল। নীলাভ আলোতে আধো—অন্ধকার ঘরের দেওয়ালে নানা ভয়ংকর ছবি! সাউন্ড সিস্টেমে ভৌতিক শব্দ। ভয়ংকর সাজপোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে চার—পাঁচজন ওয়েটার। কারো মুখে রক্তরাঙা মুখোশ, বুক থেকে রক্ত ঝরছে! কারো ভয়ংকর দাঁত—নখ! নীলকর ভূতের কোমর থেকে ঝুলছে ভয়ংকর চাবুক।
এসব দেখে তো কয়েকটা বাচ্চা ভয় পেয়ে তাদের বাবা—মাকে জড়িয়ে ধরল। এমনকি একজন ভদ্রমহিলাও প্রাথমিক অবস্থায় ভয় পেয়ে ঘরের মাঝখানে কফিনটা দেখে অস্ফুট আর্তনাদ করে তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘ওর মধ্যে সত্যি কোনো মড়া নেই তো?’ অন্য বয়স্ক খদ্দেরদেরও সকলের মধ্যে বিস্ময়ের ভাব। উদ্বোধক ভদ্রলোককে যথাযথ সম্মান জানিয়ে তাঁকে বিদায় দেবার পর মানস রেস্তোরাঁর ক্যাশ কাউন্টারে বসল। শুরু হয়ে গেল রেস্তোরাঁর কাজ।
বিশেষত মেনুকার্ডে লেখা ভৌতিক পদগুলোই আকর্ষণ করতে লাগল খদ্দেরদের। সেসব চেখে দেখে তৃপ্ত হয়ে বেরোবার সময় কাউন্টারে বসা মানসকে ধন্যবাদ জানিয়ে যেতে লাগল তারা। বাইরে ছোটখাট লাইন পড়ে গেল ভিতরে ঢোকার জন্য। ওয়েটারদের আর মানসের দম ফেলার ফুরসত নেই। একদল লোক খাওয়া সেরে যেই বেরোচ্ছে, অমনি আর—একদল ঢুকে পড়ছে। কাজের প্রচণ্ড চাপে মানস ভুলে গেল নিশার কথাও। ঘড়ির কাঁটা ছুটতে লাগল—রাত সাতটা—আটটা—নটা…। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ভরে উঠতে লাগল মানসের ক্যাশ রাখার ড্রয়ারও। রাত দশটা পর্যন্ত বলতে গেলে এক বিন্দু অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পেল না মানস। দশটার পর ভিড়টা একটু ফাঁকা হল। সাড়ে দশটা নাগাদ শেষ কিছু খদ্দের ঢুকল রেস্তোরাঁতে। সিকিউরিটির লোকটা এসে জানাল যে বাইরে আর কেউ নেই। মানস তাকে জানিয়ে দিল যে আর কাউকে যেন সে আর ভিতরে ঢুকতে না দেয়। সাড়ে এগারোটার মধ্যে পরিবেশন শেষ করে জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে তার কর্মচারীরা।
শেষ যারা রেস্তোরাঁতে ঢুকেছিল তাদের মধ্যে তিনজন লোক ছাড়া অন্য সবাই সাড়ে এগারোটার মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘরের এককোণে বসে থাকা সে তিনজন লোক তখনও খেয়ে চলেছে। অনেকক্ষণ ধরেই কাগজের মুখোশ পরে মুখোশটা ঠোঁটের ওপর গুটিয়ে তুলে অর্ধেক মুখমণ্ডল ঢেকে খাচ্ছে তারা।
খাওয়া ছেড়ে তো কাউকে উঠতে বলা যায় না। মানস আর তার কর্মচারীরা অপেক্ষা করতে লাগল তাদের খাওয়া শেষ হবার জন্য। ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা ছুঁইছুঁই, তখন খাওয়া শেষ করে একজন বলে উঠল, ‘এবার ব্লাড জুস আনো।’ কথাটা শুনে ক্যাশ কাউন্টারে বসা মানস বলল, ‘মার্জনা করবেন, আমাদের রেস্তোরাঁর সার্ভিস আধঘণ্টা আগেই শেষ হয়ে গেছে। আপনারা খাচ্ছিলেন বলে আমরা অপেক্ষা করছি। আপনারা টাকা মিটিয়ে দিলেই দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক রাত হল, কর্মচারীদের এবার বাড়ি ফিরতে হবে।’
তার কথা শুনে অপর একজন বলল, ‘হ্যাঁ, এবার আমাদেরও টাকা নিয়ে উঠতে হবে। দিয়ে নয়, নিয়ে।’
মানস বলে উঠল, ‘তার মানে?’
মানসের প্রশ্নের জবাবে তারা তিনজন তাদের কাগজের মুখোশ মুখ থেকে ছিঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। কানকাটা মিহির আর তার দুই শাগরেদ! এতক্ষণ অর্ধেক মুখোশ আর আধো—অন্ধকারে তাদের ওয়েটাররা কেউ চিনতে পারেনি, তারা সবাই কাছে—পিঠের লোক হলেও। আর সিকিউরিটির লোকটা স্থানীয় নয়। সে মিহির গুন্ডা আর তার শাগরেদদের চেনে না। তাই সে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছিল তাদের। প্রাথমিক হতভম্ব ভাব কাটিয়ে নিজেকে শক্ত করে মানস বলল, ‘না, কোনো পয়সা দিতে পারব না। এমনিতেই অনেক টাকার খেলে তোমরা। এবারে বাইরে যাও।’
মিহির মণ্ডল কর্কশভাবে বলে উঠল, ‘শেষবার বলছি তুই টাকা বার করে দিবি কি না? নইলে টাকা তো নেবই, তার সঙ্গে তোর কপালেও দুঃখ আছে।’
কর্মচারীদের সামনে এভাবে অপমানিত হতে দেখে মানসও বলে উঠল, ‘না, দেব না। দেখি তুমি কী করতে পারো।’
কথাটা শুনেই মিহির গুন্ডা ইশারা করল তার এক সঙ্গীকে। সে সঙ্গে সঙ্গে সামনের টেবিলটাতে ধাক্কা মারল। প্রচণ্ড শব্দ তুলে মাটিতে পড়ে খানখান হয়ে গেল প্লেট—গ্লাসসমেত কাচের টেবিলটা! তা দেখে দুজন কর্মচারী তাদের দিকে ছুটে যেতেই মিহির মণ্ডল কোমর থেকে একটা পিস্তল বার করে সেটা উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘তোরা ভূত সেজেছিস! এক পা যদি কেউ এগোস তবে তোদের এই পিস্তলের গুলিতে ভূত বানিয়ে দেব। আমার নাম কানকাটা মিহির।’
মানসের কর্মচারীরা সেই পিস্তল দেখে ভয় পেয়ে যে যার মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিহির গুন্ডাকে তারা চেনে অথবা নাম শুনেছে। তার ওপর আবার তার হাতে এখন পিস্তল! কে বাধা দিতে যাবে তাকে?
মিহির গুন্ডা এরপর পিস্তল উঁচিয়ে ঘরের কোণা থেকে এক পা এক পা করে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগোতে লাগল মানসকে লক্ষ্য করে। আর তার দুই সঙ্গী তাণ্ডব শুরু করল! ধাক্কা দিয়ে, লাথি মেরে চেয়ার—টেবিল লন্ডভন্ড করে ভাঙতে শুরু করল তারা। মানসের চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যেতে লাগল তার আর নিশার এত কষ্টে এত যত্নে বানানো ভৌতিক রেস্তোরাঁ।
মিহির গুন্ডা পৌঁছে গেল ক্যাশ কাউন্টারে। তার মুখে ভয়ংকর মুখোশগুলোর থেকেও অনেক বেশি ভয়ংকর হিংস্র হাসি। যে পিস্তল উঁচিয়ে বলল, ‘কুড়ি হাজার নয়। তোর ক্যাশের পুরো টাকাটাই এবার নেব।’
অন্তত ষাট—সত্তর হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে মানসের। পুরো টাকাটাই ড্রয়ারে রাখা। ভয় পেয়ে ড্রয়ারটা এবার চেপে ধরল মানস। তা দেখে তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে সাপের মতো হিসহিস করে বলে উঠল মিহির গুন্ডা, ‘ড্রয়ার খোল। সব টাকা বার কর।’
ঠিক সেই মুহূর্তেই মিহির মণ্ডলের এক সঙ্গী ভাঙচুর চালাতে চালাতে সজোরে লাথি মারল ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা কফিন বাক্সের ডালার ওপর। খুলে গেল ডালা। আর এরপরই সে লোকটা বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘আরে গুরু দ্যাখো! এই বাক্সটার মধ্যে একজন শাঁখচুন্নি সেজে বসে আছে!’
কথাটা শুনে মিহির মণ্ডল ফিরে তাকাল সেদিকে। মানসও তাকাল। বিস্মিত মানস দেখল একজন মহিলা কফিন বাক্স থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে! তার মুখেও একটা ভয়ংকর মুখোশ। জামার বুকের একপাশটা রক্তে লাল। যেন রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে সেখান থেকে। ভয়ংকর সাজে সজ্জিত সেই মহিলা বাক্স থেকে নেমে দাঁড়াতেই তার অবয়ব দেখে মানস চিনে ফেলল তাকে। নিশা! সে কখন উপস্থিত হল? আর বাক্সর মধ্যে ঢুকলই বা কীভাবে?
যে লোকটা লাথি মেরে কফিনের ডালাটা সরিয়েছিল, সে নিশাকে বলল, ‘একদম চিৎকার করবি না। যা দেওয়ালের গায়ে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়া।’
কিন্তু মেয়েটা তার কথায় কর্ণপাত না করে এগোল তার দিকে। মেয়েটা তার কাছাকাছি পৌঁছোতেই শয়তান লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলতে গেল। কিন্তু মুখোশধারী মেয়েটা অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ধরে ফেলল তার হাত। তারপর তাকে অদ্ভুত কৌশলে শূন্যে তুলে সজোরে আছড়ে ফেলল দেওয়ালের গায়ে! একটা আর্তনাদ করে স্থির হয়ে গেল লোকটা। এ ঘটনা দেখে মিহির মস্তানের দ্বিতীয় স্যাঙাত ছুটে গিয়ে জাপটে ধরল মেয়েটাকে। একটা মৃদু ধস্তাধস্তি হল কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু নিশা ক্যারাটে বা কুংফু জানে নাকি! সে নিজেকে লোকটার আলিঙ্গন মুক্ত করে নিয়ে অতবড় শক্তসমর্থ লোকটাকে কোমর ধরে শূন্যে তুলে নিয়ে আছাড় মারল ঘরের মেঝেতে। মাটিতে পড়ে এবার অজ্ঞান হয়ে গেল দ্বিতীয় স্যাঙাতও।
সে দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মিহির গুন্ডা। মানস আর উপস্থিত অন্যরাও ঘটনাটা দেখে কম বিস্মিত হল না। কী অসম্ভব শক্তিধর আর সাহসী মেয়েটা!
নিশা এরপর এগোতে থাকল কাউন্টারের দিকে। সে কিছুটা এগোতেই মানস দেখল তার কণ্ঠার নীচে বুকের বাঁদিকে একটা গোল ছিদ্র। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে সেখন থেকে! যেন কেউ তাকে গুলি করেছে! কী অসাধারণ সুন্দর ভয়ংকর মেকআপ! একদম সত্যি মনে হচ্ছে! মিহির গুন্ডাও যেন কিছুটা ভয় পেয়ে গেল তার সঙ্গী দুজনের দুরবস্থা দেখে। তারা দুজনেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। নিশা কয়েক পা এগোতেই মিহির গুন্ডা মানসের বুক থেকে পিস্তলটা সরিয়ে নিয়ে নিশার দিকে তাগ করে বলল, ‘আর এক পা এগোলে গুলি চালাব।’
তার কথা শুনে মুখোশের আড়াল থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল নিশা। না থেমে সে এগোতে লাগল মিহির মণ্ডলের দিকে। সে একদম কাছাকাছি পৌঁছোতেই মিহির গুন্ডা আর কালবিলম্ব না করে পিস্তল চালিয়ে দিল। গুলির প্রচণ্ড আঘাতে কেঁপে উঠল ঘরটা। মানস দেখল মিহির গুন্ডার পিস্তলের গুলিতে আর—একটা ছিদ্র হল নিশার বুকের অন্যপাশে। ঠিক আগের ছিদ্রটার মতোই। তার থেকে রক্ত বেরোতেও শুরু করল। কিন্তু বুকে গুলি খেয়েও নিশা পড়ে গেল না। গুলির অভিঘাতে একবার ঝাঁকুনি খেল সে। তারপর একটানে খসিয়ে ফেলল তার মুখোশটা। তার চোখ দুটো কেমন যেন সবুজ। জ্বলছে সে চোখ দুটো। হয়তো বা সেটাও তার মেকআপের অঙ্গ ছিল। কিন্তু সে মুখোশটা খুলে ফেলতেই প্রচণ্ড আতঙ্ক ফুটে উঠল দুর্ধর্ষ খুনি মিহির গুন্ডার চোখে—মুখে। যেন সে আগে কোথাও দেখেছে নিশাকে! কোনো অজানা কারণে কাঁপতে শুরু করল সে। তবু তারই মধ্যে সে আর—একবার গুলি চালাতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই নিশা একহাতে চেপে ধরল তার গলা। পিস্তলটা খসে পড়ল মিহির মণ্ডলের হাত থেকে। আর এরপরই মট করে একটা শব্দ পেল মানস! নিশা মিহির গুন্ডার ঘাড়টা ছেড়ে দিতেই তার দেহটা দড়াম করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে!
ধীরে ধীরে নিশার দৃষ্টি এরপর স্বাভাবিক হয়ে এল। হতভম্ব, বিস্মিত মানসের দিকে তাকিয়ে নিশা তার পরিচিত হাসি হেসে বলল, ‘নিজের হাতে সাজানো এত সুন্দর ভৌতিক পরিবেশটা আমি কি নষ্ট হতে দিতে পারি? মেরামত করে রেস্টুরেন্টটা আবার তাড়াতাড়ি চালু করতে হবে। মিহির গুন্ডা আর তার সঙ্গীদের আর কোনোদিন এখানে পা রাখার ক্ষমতা হবে না। তা ছাড়া আমি তো এখানে রইলামই। চিন্তা নেই।’ —এই বলে কাচের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
পুরো ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর ধাতস্থ হতে কয়েক মিনিট সময় লাগল মানস আর তার সঙ্গীদের। অজ্ঞান মিহির গুন্ডা আর তার সঙ্গীরা স্থির হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মানস সংবিৎ ফিরে পেয়ে থানায়? ফোন করতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় এক পুলিশ অফিসার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলেন রেস্তোরাঁতে। মাটিতে মিহির গুন্ডাকে পড়ে থাকতে দেখে একজন পুলিশকর্মী বলে উঠল, ‘এই দেখুন স্যার, মিহির গুন্ডা! গুলির শব্দ পেয়ে আমরা তবে ঠিকই অনুমান করেছি!’
পুলিশ অফিসার মানসকে প্রশ্ন করলেন, ‘ঘটনাটা কী? ওদের এ অবস্থা হল কী ভাবে?’
মানস যথাসম্ভব সংক্ষেপে ঘটনাটা ব্যক্ত করতেই অফিসার বললেন, ‘সেই সাহসী ভদ্রমহিলা কই? গুলি খেয়েও তিনি বাইরে গেলেন কীভাবে?’
মানস বলল, ‘এখনই তো বাইরে বেরোলেন তিনি।’
কথাটা শুনে বাইরে বেরোলেন অফিসার। তাঁর পিছন পিছন মানসও বাইরে বেরিয়ে এল। সে দেখতে পেল কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে নিশার গাড়িটা! যেটা চালিয়ে সে আসা—যাওয়া করে। গাড়িটা দেখে সে বলল, ‘ওই তো স্যার নিশার গাড়ি!’
গাড়িটা দেখে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে তাতে লেখা নম্বরের সঙ্গে গাড়ির নম্বরটা মিলিয়ে অফিসার বললেন, ‘আরে এটাই তো সেই গাড়ি! মিহির মণ্ডল সন্ধ্যা নাগাদ ফাঁকা হাইওয়েতে গাড়ি থামিয়ে এক ভদ্রমহিলাকে গুলি চালিয়ে খুন করে, তাঁর দেহ ঝোপে ফেলে রেখে গাড়িটা ছিনতাই করে পালায়। এক অপরিচিত ব্যক্তি আড়াল থেকে ব্যাপারটা দেখে থানায় ফোন করে গাড়ির নম্বর সহ খবরটা জানায়। আমরা অকুস্থলে গিয়ে দেহটা উদ্ধার করে থানায় পাঠিয়েছি। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম গাড়িসমেত মিহির মণ্ডলকে। আপনি একবার থানায় চলুন। দেখুন তো চিনতে পারেন কি না সেই মহিলাকে?’
অন্য পুলিশকর্মীদের দিয়ে অচৈতন্য মিহির মস্তান আর তার সঙ্গীদের হাসপাতালে পাঠানোর পর অফিসার মানসকে নিয়ে উপস্থিত হলেন থানাতে। মৃতদেহের মুখ থেকে কাপড়টা ওঠাতেই চমকে উঠল মানস। এ যে নিশা! তার বুকের দুপাশে দুটো গুলির ছিদ্র! তাহলে কি তাকে আগেই গুলি করেছিল মিহির মস্তান? সেজন্যই নিশা মুখোশ খোলার পর তাকে দেখে চিনতে পেরে কেঁপে উঠেছিল সে?
কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতাল ফেরত পুলিশিকর্মীরা এসে জানাল, মিহির গুন্ডার শাগরেদদের একজনের হাত ভেঙেছে, আর অন্যজনের কোমর। আর মিহির গুন্ডার ঘাড় ভেঙে গেছে। সে কোনোদিন সুস্থ হবে কি না জানা নেই!
পরিশিষ্ট: পুলিশের ঝামেলা মিটিয়ে রেস্তোরাঁ মেরামত করে আবার সেটা চালু করতে দিন পনেরো সময় লাগল মানসের। সেই ভৌতিক ঘটনার পর পুরোনো কর্মচারীরা কাজ ছেড়ে দিলে নতুন লোকও নিয়োগ করতে হয়েছে মানসকে। নিশার ঘটনা প্রচারিত হলেও অনেকেরই ধারণা, খুনটা সত্যি, কিন্তু মৃত মানুষের রেস্তোরাঁয় ফিরে আসাটা ভৌতিক রেস্তোরাঁতে লোক টানার কৌশলের জন্য প্রচার করা হয়েছে। কফিনের ডালটা বন্ধ করে একইভাবে সাজিয়ে রেখেছে মানস। খদ্দেরদের আসাও আবার শুরু হয়েছে রেস্তোরাঁতে। ভৌতিক পরিবেশও একই আছে। ভূত সেজে খাবার পরিবেশ করে ওয়েটাররা। শুধু রেস্তোরাঁ বন্ধ করে কর্মচারীরা চলে যাবার পর এক—একদিন মানসের মনে হয় কেউ যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে রেস্তোরাঁর ভিতর। আগের দিনের অবিন্যস্ত, ছড়ানো জিনিসও রেস্তোরাঁর ভিতর কেউ অনেকসময় সুন্দর করে যেন সাজিয়ে রাখে, দেওয়াল থেকে মুছে ফেলে দাগ। মানসের এক—একসময় মনে হয় এই ভৌতিক রেস্তোরাঁতে শুধু সাজানো ভূত নয়, ওই কফিন বাক্সর মধ্যে হয়তো বা অন্য কেউ একজনও থাকে। যে নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিল এই ভৌতিক রেস্তোরাঁ। নিশা, যে আজও যত্ন নেয়, সাজিয়ে তোলে তার হাতে গড়া এই ভৌতিক রেস্তোরাঁকে।