সন্ধ্যানীড়ে অন্ধকার

সন্ধ্যানীড়ে অন্ধকার

০১.

বৃদ্ধদের সমস্যা একালের নয়, চিরকালেরই। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন। মানুষ বুড়ো হলেই পরিবারের গলগ্রহ। নিজের নামে বিষয়সম্পত্তি থাকলেই বা কী? আপনজনেরা লোকদেখানো সেবা-যত্ন হয়তো করবে। কিন্তু মনে মনে তার মৃত্যুর জন্য সময় গুনবে।

এবার জানুয়ারিতেও কলকাতায় শীত তত জমে ওঠেনি। হঠাৎ শনিবার দিনভর কয়েক পশলা জোরালো বৃষ্টির পর শীত নিজমূর্তি ধরেছিল। রবিবার সকালে অবশ্য আকাশ আবার একেবারে সাফ। বৃষ্টিটা যেন প্রকৃতির একটা ম্যাজিক। সেই ম্যাজিক কলকাতাকে শিহরিত করেছিল শীতের পুলকে। সল্টলেকের ফ্ল্যাট থেকে গাড়ি চালিয়ে ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের এই তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছনোর পথে মানুষজনের গায়ে রঙবেরঙের শীতের পোশাক দেখেছিলুম। এদিন আমার গায়েও পুরু বিদেশি জ্যাকেট। কনকনে ঠাণ্ডা হিম হাওয়ার ঝাঁপটানিতে দুপাশের কাঁচ তুলে দিতে হয়েছিল। তারপর কর্নেলের ডেরায় ঢুকে গরম কফি খেতে খেতে হঠাৎ তার ওইসব কথা শুনে একটু। অবাক হয়েছিলুম।

তাই বললুম, আমার ধারণা, শীতের সঙ্গে বার্ধক্যের সম্পর্ক আপনাকে ভাবিয়ে তুলেছে!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, বুড়োরা শীতে বেজায় কাবু হয়, তা সত্য জয়ন্ত! কিন্তু আমি বলছি তাদের অন্য সমস্যার কথা। এদেশে বুড়োদের মৃত্যুর লক্ষণ দেখে–তা সঠিক হোক বা ভুল হোক, তড়িঘড়ি অন্তর্জলিযাত্রার ব্যবস্থা করা হত। প্রাচীন যুগে বুড়োদের জন্য সমাজে কী প্রথা চালু ছিল চিন্তা করো! চুল পাকলে, চামড়া শিথিল হলে আর নাতিপুতি হলেই বানপ্রস্থ। বানপ্রস্থে মৃত্যু না হলে তারপর সন্ন্যাস আশ্রম। অন্যদেশে বা অন্যান্য ধর্মেও বুড়োদের দশা ছিল একইরকম। না–বার্ধক্যের সমস্যা মোটেও আধুনিক সমস্যা নয়।

হঠাৎ আজ সকালে আপনি নিজের বার্ধক্য নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন?

 কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। তার প্রশস্ত টাকের ওপর নীল ধোঁয়া আঁকাবাঁকা হয়ে খেলা শুরু করল। সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, তোমার বোঝা উচিত ডার্লিং! নিজের বার্ধক্য সম্পর্কে আমি বরাবরই নির্বিকার।

তা ঠিক। আপনার মিলিটারি শরীর। এই বয়সে এখনও আপনি যুবক। তাছাড়া আপনার প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণ আছে। কিন্তু

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, টেবিলে পেপারওয়েট চাপানো এই চিঠিটা কালকের ডাকে এসেছে। কাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা বৃষ্টির উৎপাতে আমার ছাদের বাগান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলুম। দুর্লভ প্রজাতির কয়েকটা অর্কিড আর ক্যাকটাস আছে। শীতের বৃষ্টি তাদের পক্ষে ক্ষতিকর। যাইহোক, গত রাতে এই চিঠিটা পড়া হয়নি। আজ ভোর ছটা থেকে ছাদের বাগানে ছিলুম। তারপর নেমে এসে কফি খেতে খেতে চিঠিটা পড়লুম।

হাসতে হাসতে বললুম, তাহলে কোনও বৃদ্ধ তাঁর বার্ধক্যসমস্যা নিয়ে চিঠিটা লিখেছেন এবং আপনার শরণাপন্ন হয়েছেন, বলুন!

কর্নেল চিঠিটা তুলে নিয়ে বললেন, হাতের লেখা বড় জটিল। আতস কাঁচ দিয়ে দেখেছি, চিঠিটা তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে।

চিঠিটা দেখতে পাচ্ছিলুম। বললুম, কী ভাষায় লেখা চিঠি? হিব্রু নাকি?

কর্নেল হাসলেন। না। বাংলা। তবে তুমি উচ্চারণ করলে হিব্রু! শব্দটার উচ্চারণ কিন্তু হিব্রু নয়। হিরু। আসলে ওটা ইহুদিদের ভাষা হলেও ভাষার নামটা অন্যদের দেওয়া। হিব্রু শব্দটার প্রাচীন আক্ষরিক অর্থ ছিল : নদীর ওপারে। তাইগ্রিস নদীর ওপারে যারা বাস করত, তাদের হিব্রু বলা হত। এ সেই ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কালের কথা। বলছি বটে ব্যাবিলন, কথাটা আসলে বাব-ইলন। বাব মানে শহর। ইলন মানে ঈশ্বর। ঈশ্বরের শহর! বাব শব্দটা এখনও আরবিতে স্থান অর্থে চালু আছে।

কর্নেলের এই এক বিরক্তিকর স্বভাব। বেগতিক দেখে বললুম, আহা! চিঠিটার কথা বলুন!

কর্নেল চিঠিটা আমাকে দিলেন। ছাপানো প্যাডে লেখা চিঠি। ডানদিকে কোণে ছাপানো আছে : সন্ধ্যানীড়। তার তলায় ছাপানো আছে : কনকপুর, জেলা নদীয়া।

বারকতক চেষ্টার পর পাঠোদ্ধার করতে পারলুম।

 শ্ৰীযুক্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সমীপেষু,
মহাশয়,
আমাকে আপনার মনে পড়িতে পারে। সাক্ষাতে অবশ্য অবশ্য চিনিবেন বলিয়া আশা আছে। প্রায় দশ বছর পূর্বে ওড়িশার জঙ্গলে আপনার সহিত পরিচয় হইয়াছিল। তখন আমি কাঠের ব্যবসা করিতাম। পরে আমার জিপে আপনাকে লইয়া বহরমপুর শহরে কাঠমাণ্ডুতে গিয়াছিলাম। বর্তমানে আমি জরাগ্রস্ত অবস্থায় এই বৃদ্ধাশ্রমে আছি। সংসারে আর আমার কেহই নাই। জীবনের সর্বশেষ সঞ্চয় যাহা ছিল, তাহা হইতে মাসান্তিক আর্থিক ব্যবস্থা করিয়া এই দুঃসহ জীবন বাছিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছি। কিন্তু সম্প্রতি আবিষ্কার করিয়াছি, এখানে একজন অতিশয় অবাঞ্ছিত লোক বাস করিতেছে। মূর্তিমান শয়তান বলিলেও চলে। আমি আতঙ্কিত অবস্থায় আছি। যে-কোনও সময় বিপদ ঘটিতে পারে। আপনি যে উপায়ে পারেন, শীঘ্র আসিয়া আমাকে রক্ষা করুন। গোপনে লিখিলাম। বহু কথা বলার ছিল। তাহা পত্রে বলা যাইবে না। পরম করুণাময় ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। নমস্কারান্তে ইতি– শ্রী প্রবুদ্ধকুমার দত্ত..

দুপাতার চিঠিটা কর্নেলের হাতে ফেরত দিয়ে বললুম, ভদ্রলোককে চিনতে পেরেছেন?

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, পেরেছি। পেরেছি বলেই বার্ধক্য সম্পর্কে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন। প্রবুদ্ধবাবুর চেহারা এখনও মনে স্পষ্ট। বলিষ্ঠ শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। গোপনে হরিণ শিকার করার কথা বলেছিলেন। দুটো বাঘও মেরেছিলেন। গঞ্জাম জেলার বহরমপুর শহর তুমি দেখেছ!

হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে গতবছর ওখান থেকেই তো গোপালপুর-অন-সি গিয়েছিলুম!

প্রবুদ্ধবাবুর বাড়িটা ছিল বিশাল। তার একটি মেয়ে ছিল মনে পড়ছে। স্ত্রী অবশ্য তখন বেঁচে ছিলেন না। কাঠমাণ্ডুতে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। বনবিভাগের কাঠের কন্ট্রাক্টরি ছিল তার একচেটিয়া।

কাঠমাণ্টু মানে?

কাঠের বাজার। হিন্দি মাণ্ডি মানে বাজার। ওড়িয়া ভাষায় শব্দটা হয়েছে। মান্টু!

আচ্ছা কর্নেল, নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু।

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, নেপালি ভাষায় শব্দটা মাণ্ডু হয়েছে। কাঠমাণ্ডু মানেও কাঠের বাজার।

কথাটা বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। বললুম, আপনার কনকপুরের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া উচিত।

সন্ধ্যানীড়! কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন। নামটা বেশ লাগসই। খাসা! এই নামটা যাঁর মাথায় এসেছিল, তিনি কবিতা লেখেন কি না কে জানে!

বাঙালি মাত্রেই কবি।

কিন্তু কবির ডেরায় নাকি মূর্তিমান শয়তান ঢুকে গেছে।

কনকপুর জায়গাটা কোথায় জানেন কি?

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, মাই গুডনেস! সন্ধ্যানীড় তো আমি দেখেছি। মানে তার নাকের ডগা দিয়েই গেছি বলা যায়। নভেম্বরে। চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কালীতলার বিলে পাখি দেখতে গিয়েছিলুম। সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত পক্ষিবিশারদ হেমন্ত সেন। ওঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ওই এলাকার জমিদার। তো কালীতলার আগে একটা বাজার এলাকার পর ডানদিকে একটা ঝিলের ধারে পাঁচিলঘেরা বাড়ি দেখেছিলুম। গেটের মাথায় সন্ধ্যানীড় লেখা ছিল। পিচের সড়ক থেকে মাত্র তিরিশ-পঁয়তিরিশ মিটার দূরত্ব। আমি ভেবেছিলুম কোনও বড়লোকের বাগানবাড়ি। তাই হেমন্তবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কালীতলায় অবশ্য হেমন্তবাবুর পৈতৃক বাড়িটা এখনও আছে। ছোট্ট নদীর ধারে সুন্দর একটা সেকেলে বাড়ি। এক মিনিট! দেখি, হেমন্তবাবুকে পাই নাকি!

বলে তিনি টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন, ডোরবেল বেজে উঠল। কর্নেল বিরক্ত মুখে যথারীতি হাঁক দিলেন, যষ্ঠী!

তারপর ঘরে সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার, আমাদের প্রিয় হালদারমশাই! তার সঙ্গে এক যুবতী। পালিশ করা চেহারা। স্মার্ট হাবভাব। হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, ইনিই কর্নেল স্যার। আর উনি হইলেন গিয়া দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার ফ্যামাস জার্নালিস্ট জয়ন্ত চৌধুরী। বয়েন ম্যাডাম। কর্নেলস্যার, ইনি আমার ক্লায়েন্ট মিসেস চন্দ্রিকা মজুমদার।

চন্দ্রিকা মজুমদার কর্নেল ও আমাকে নমস্কার করে সোফায় বসল। হালদারমশাই আমার কাছাকাছি বসে একটিপ নস্যি নিয়ে রুমালে নাক মুছলেন। তারপর বললেন, ম্যাডাম! কর্নেলস্যার জানেন, আমি চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলছি। এখন, পুলিশ আমারে কোঅপারেট করে না। করলে দুইদিনেই এই মিসট্রি সলভ, করতাম।

কর্নেল বললেন, হালদারমশাই। আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করুন। আপনাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

গোয়েন্দা এবার হাসলেন। ঠিক কইছেন। এক্সাইটেড হইয়াই ম্যাডামেরে কইলাম, পুলিশ কিছু করবে না। এদিকে এমন হেভি মিট্টি, একমাত্র কর্নেলস্যারই আমারে হেল্প করতে পারবেন।

ষষ্ঠীচরণ যথারীতি দ্রুত কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল ট্রেতে। কর্নেল চন্দ্রিকা মজুমদারকে বললেন, যুবক-যুবতীদের তুমি বলাই আমার অভ্যাস। কফি খাও চন্দ্রিকা।

কর্নেলের কথায় মুহূর্তে চন্দিকার স্মার্টনেস চলে গেল। সাদাসিধে বাঙালি মেয়েদের মতোই মৃদুস্বরে বলল, আপনি আমার বাবার মতো। তুমি বললে খুশিই হব। আপনাকে দেখামাত্র আমি কিন্তু মনের জোর ফিরে পেয়েছি। তবে কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। চা-ও খাই না।

কর্নেল বললেন, তাহলে তোমার কফিটা আমিই শেষ করি। আর তোমার মুখে ঘটনাটা শুনি। বলো?

চন্দ্রিকা আস্তে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার হাজব্যান্ড অনীশ মজুমদার একটা বড় ট্রেডিং কর্পোরেশনের সেলস্ এক্সিকিউটিভ। বেলেঘাটায় আমাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। আমার শাশুড়ি ভবানীপুরে তার মেয়ে-জামাইয়ের কাছে থাকেন। আসলে উনি আমাদের বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি। খুব সেকেলে রক্ষণশীল স্বভাবের মহিলা।

হু। কিন্তু ঘটনাটা কী?

ফোর্থ ডিসেম্বর অনীশ অফিস থেকে ফিরে বলল, অফিসের কাজে সে এক সপ্তাহের জন্য বোম্বে যাচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট। সে নিজেই জিনিসপত্র কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিল। তাকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তবে আমি জিজ্ঞেস করিনি কিছু। অফিসের কাজে ওকে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়।

চন্দ্রিকা থেমে গেলে কর্নেল বললেন, তারপর?

ব্যাপারটা অনেক পরে আমার মাথায় এসেছিল। অনীশকে তার অফিস গাড়ি দিয়েছে। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা ছটায় যখন সে বেরিয়ে গেল, ব্যালকনি থেকে দেখেছিলুম, সে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল।

হালদারমশাই বললেন, এটা একটা পয়েন্ট কর্নেলস্যার!

চন্দ্রিকা আবার শ্বাস ছেড়ে বলল, ইলেভেন্থ ডিসেম্বর তার ফেরার কথা। ফিরল না। আরও দুদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পর অনীশের অফিসে ফোন করলুম। ওঁরা বললেন, অনীশবাবু তো চাকরি থেকে রিজাইন দিয়েছেন। কথাটা শোনার পর আমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল, তা বুঝতেই পারছেন।

কর্নেল বললেন, পারছি। তারপর তুমি কী করলে?

কী করব? ব্যাঙ্কে আমার নামে হাজার তিরিশ টাকা ছিল। আপাতত অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আমি রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে একটা চাকরির চেষ্টা করছিলুম। ফ্ল্যাটটা আমার নামেই কেনা। মাথা গোঁজার অসুবিধে নেই। আমি ধরেই নিলুম, অনীশ আমাকে ত্যাগ করেছে। নিশ্চয় অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে– চন্দ্রিকা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, আমি তখন নিজের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। হঠাৎ একুশে ডিসেম্বর রাত্রে একটা টেলিফোন এল। কে কথা বলছে, প্রশ্ন করেও জবাব পেলুম না। লোকটা বলল, সে অনীশের বন্ধু। অনীশ আমাকে জানাতে বলেছে, গোপনীয় কারণে তাকে গা-ঢাকা দিতে হয়েছে। সময় হলেই সে বাড়ি ফিরবে। আমি যেন তার জন্য চিন্তা না করি।

কর্নেল একটা আস্ত চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তারপর বললেন, ইন্টারেস্টিং। তারপর কী হল বলো!

এ মাসের তিন তারিখে আবার সেই লোকটা রাত্রে টেলিফোন করে একই কথা বলল। তখন আমার সন্দেহ হল, অফিসে কোনও স্ক্যান্ডাল করে গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে না তো অনীশ? তার অফিসে চলে গেলুম। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে শুধু জানতে চাইলুম, অনীশ কেন রিজাইন দিয়েছে? ভদ্রলোক একজন মারোয়াড়ি। খুব ভদ্র আর শিক্ষিত মানুষ। তিনি বললেন, অনীশ হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে তিনি অবাক হয়েছিলেন। তার ধারণা, অনীশ নিশ্চয় কোথাও ভাল সুযোগ পেয়েছে। কোথায় পেয়েছে, সেটা তার স্ত্রীরই জানার কথা। আমি চলে এলুম চুপচাপ! তারপর সোজা থানায় গেলুম। পুলিশ মুখের ওপর বলে দিল, এটা দাম্পত্য সমস্যার ব্যাপার। এতে তাদের কিছু করার নেই। একজন অফিসার পরামর্শ দিলেন, লালবাজারে মিসিং স্কোয়াডে খবর দিন। সেই রাত্রে সেই লোকটা টেলিফোনে আমাকে ধমক দিয়ে বলল, আমি চুপ করে না থাকলে অনীশের ক্ষতি হবে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, আমি নিউজপেপারে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিছিলাম। মিসেস মজুমদার আমার লগে যোগাযোগ করলেন। এনারে লইয়া লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে যাইতাম না। গিছলাম শুধু একটা কারণে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আমার চেনা এক মহিলা থাকেন। তার সাহায্যে জানছিলাম লোকটা কোন নম্বর হইতে ফোন করে। নম্বর পাইলাম। কিন্তু সেটা যার নামে, সে ওই বাড়িতে থাকে না। একটা দোতলা বাড়ি। উপরনীচে চাইরখানা ঘর। নীচের ঘরে একটা মুদির দোকান আর একটা লড়ি। উপরের একখান ঘরে যে থাকে, সে ট্যাক্সিড্রাইভার। ফ্যামিলি আছে। তারে জিগাইলাম পাশের ঘরে ফোন আছে নাকি? সে কইল, আছে। এই বাড়ির মালিকের এক আত্মীয় মাঝে মাঝে এখানে আসে। তার নাম মন্টুবাবু! আসল নাম ট্যাক্সিড্রাইভার জানে না। তবে বাড়ির মালিকের নাম সে জানে। মনমোহন বোস। বোসবাবু খুব বুড়ামানুষ। কে তারে দেখাশোনা করব? তাই কোন আশ্রমে শেল্টার লইছেন। এদিকে মন্টুবাবু বোসবাবুর নাম সাইন করিয়্যা ভাড়া লয়! বোঝেনা কাণ্ড। তাই লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ম্যাডামেরে লইয়া গিছলাম। এস আই নরেশবাবুরে তো কর্নেলস্যার চেনেন। সে জোক করল আমার নামে–আমার ক্লায়েন্টের সামনে!

গোয়েন্দাপ্রবর আবার উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তার গোঁফ তিরতির করে কঁপছিল। এক টিপ নস্যি নিয়ে গুম হয়ে বসে রইলেন।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, হালদারমশাই! সেই দোতলা বাড়িটা কোথায়?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ সোয়েটারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তার খুদে নোটবই বের করলেন। তারপর পাতা উল্টে দেখে বললেন, বউবাজার এলাকায়। ৭/১ রামকান্ত লেন।

এতক্ষণে আমি বললুম, হালদারমশাই! আপনি ছদ্মবেশে ওখানে ওত পেতে থাকলে তো মন্টুবাবুকে পেয়ে যেতেন। তাকে আপনার আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে চার্জ করলেই

হালদারমশাই হাত নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সে চেষ্টা কি করিনি? মন্টুবাবু হঠাৎ ভ্যানিশ। ম্যাডামেরে জিগান। গত এক সপ্তার মধ্যে কেউ এনারে ফোন করেনি।

চন্দ্রিকা বলল, সেইজন্যই আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলুম। মিঃ হালদারকে ইনসিস্ট করেছিলুম, আপনি তো একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। পুলিশে কি আপনার জানাশোনা এমন কোনও লোক নেই, যিনি আমার প্রতি সিমপ্যাথি দেখাবেন? পুলিশে নিশ্চয় অনেক ভালো মানুষ আছেন। আর মিঃ হালদার যদি তেমন কাকেও না পান, আমি নিজেই হায়ার অফিসারদের কাছে যাব।

হালদারমশাই বললেন, আমি ম্যাডামেরে নিষেধ করলাম। ক্যান কী, ম্যাডামের হাজব্যান্ড যদি উল্টা ফাঁসাইয়া যান!

কর্নেল বললেন, ঠিক বলেছেন। অনীশবাবু হঠাৎ চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েছেন, এটা স্পষ্ট।

চন্দ্রিকা ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরে বলল, কেন? অনীশের সঙ্গে আমার পরিচয় তিনবছর আগে একটা বিয়ের পার্টিতে। তারপর দুজনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমরা বিয়ে করেছি গতবছর মার্চে। এতদিন ধরে ঘনিষ্ঠতা। অনীশ চোর জুয়াচোর বা অসচ্চরিত্র হলে আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। কর্নেল সায়েব! আমার ধারণা, কেউ বা কারা তাকে কিডন্যাপ করেছে।

কেন তোমার এই ধারণা?

চন্দ্রিকা আস্তে বলল, অনীশ মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনে সেলস এক্সিকিউটিভ ছিল। কিন্তু সে কমপিউটার সায়েন্সে একজন এক্সপার্ট! আপনি তো জানেন, আজকাল সব ব্যবসাবাণিজ্যে কমপিউটার ব্যবহার করা হয়। এমন তো হতেই পারে মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনের কোনও গোপন তথ্য কমপিউটারে ফিড করানো ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও কোম্পানি সেইসব ডেটার কোডনাম্বার জোগাড় করেছে এবং অনীশের সাহায্যে তা ডি-কোড করানোর জন্য তাকে আটকে রেখেছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী। তোমার ধারণায় যুক্তি আছে। এবার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।

বলুন!

তোমার বাবা-মা কি বেঁচে আছেন?

না। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যান। আমি মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। বাগবাজারে আমার মামাবাড়ি।

তোমার কোনও ভাই-বোন নেই?

না।

তোমার বিয়েতে মামার কোনও আপত্তি ছিল কি?

না। আমার মামা শুভময় রায় একজন ফ্রিডম ফাইটার। উদার মনের মানুষ।

তাকে এই ঘটনার কথা জানিয়েছ?

চন্দ্রিকার মুখে যেন ছায়া পড়ল। আস্তে বলল, ছেলে-বউমার জ্বালাতনে। মামা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। আমি তাকে আমার ফ্ল্যাটে এনে রাখতে চেয়েছিলুম। অনীশও তাঁকে আনতে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি বড্ড একরোখা মানুষ। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে চলে যান। প্রায় একমাস পরে ওঁর চিঠি পেয়েছিলুম। একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। ভালোই আছেন। আমরা যেন তাকে বিব্রত না করি।

বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দেননি?

না। একটা পোস্টকার্ডে কয়েকলাইন চিঠি।

আমি কনকপুরের সন্ধ্যানীড়ের কথা বলতে যাচ্ছিলুম, কর্নেল তা টের পেয়েই আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। বুঝলুম, বলা যাবে না। তবে যোগাযোগটা ভারি আকস্মিক বটে! এদিকে ৭/১ রামকান্ত লেনের দোতলা বাড়ির বৃদ্ধ মালিক মনমোহন বোসও কোনও আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন।

তার সঙ্গে ডাকে পাওয়া প্রবুদ্ধকুমার দত্তের চিঠি জুড়ে দিলুম মনে মনে। তবে কর্নেলের সাহচর্যে বরাবর দেখে আসছি, রহস্যের সঙ্গে আকস্মিকতার যোগাযোগ যেন নিয়তিনির্দিষ্ট একটা নিয়ম। হয়তো যারা রহস্য ব্যাপারটা গড়ে তোলে, তারা হঠকারী স্বভাবের মানুষ।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে চন্দ্রিকা! ব্যাপারটা আমি দেখছি। তুমি একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো। কিছু ঘটলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ অবশ্যই করবে।

বলে তিনি তার একটা নেমকার্ড দিলেন চন্দ্রিকা মজুমদারকে। হালদারমশাই বললেন, চলেন ম্যাডাম! আমি আপনারে এসকর্ট করি।

চন্দ্রিকা আবার স্মার্ট হয়ে উঠল। বলল, দরকার হবে না মিঃ হালদার। আমি শর্টকাটে বাড়ি ফিরব।

কর্নেল বললেন, তুমি কি গাড়ি চালিয়ে এসেছ?

হ্যাঁ। অনীশ মাস তিনেক আগে আমাকে একটা মারুতি কার উপহার দিয়েছিল। আমি ছোটবেলা থেকে খেলাধুলো করতুম। ড্রাইভিং শিখতে দেরি হয়নি।

গোয়েন্দাপ্রবর চন্দ্রিকাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন। সোফায় বসে বললেন, ম্যাডামের হেভি মেন্টাল স্ট্রেন্থ কর্নেলস্যার। তবে ওনার গাড়ির কথাটাই মিস করছিলাম। আসলে ভাবছিলাম, আপনি ওনারে জিগাইবেন। কিংবা ম্যাডাম নিজেই কইয়া ফেলবেন। কিন্তু ওনার গাড়ির কথা আপনি ক্যামনে জানলেন?

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, চন্দ্রিকার আঙুলে জড়ানো চেনে চাবির গোছা ছিল। বাড়ির চাবি কেউ ওভাবে হাতে রাখে না। গাড়ির চাবি রাখে। তবে জয়ন্তের চাবি প্যান্টের পকেটে থাকে। কারণ ও তো এখানে অল্পক্ষণের জন্য কোনও কাজে আসে না।

ঠিক, কইছেন। বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটিপ নস্যি নিলেন।

একটু পরে কর্নেল বললেন, আচ্ছা হালদারমশাই, ৭/১ রামকান্ত লেনের ফোন নাম্বারে কখনও ফোন করে দেখেছেন?

হালদারমশাই বললেন, অনেকবার করছি। খালি রিং হয়। কেউ ধরে না।

এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। প্রথমে আস্তে, তারপর প্রায় চেঁচিয়ে, হ্যালো! হ্যালো! শোনা যাচ্ছে না। একটু জোরে বলুন!.. হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?… প্লিজ একটু জোরে। কোত্থেকে বলছেন?… কনকপুর? বলুন!… প্রবুদ্ধ দত্তের কী হয়েছে?… মারা গেছেন? ন্যাচারাল ডেথ?… আমি বলছি স্বাভাবিক মৃত্যু?… আমার কার্ড দিয়েছিলেন আপনাকে?… ডাক্তার কী বলছেন?… স্ট্রোক?… বুঝেছি। আপনি কে বলছেন?… একটু জোরে বলুন। লাইন ডিসটার্ব করছে।… আপনি একজন কী?… ফ্রিডম ফাইটার? বাই এনি চান্স আপনার নাম কি শুভময় রায়?… আমি জানি।… হ্যালো হ্যালো! হ্যালো!

কর্নেল রিসিভার রেখে গম্ভীরমুখে বললেন, চন্দ্রিকার মামা শুভময় রায়কে প্রবুদ্ধ দত্ত কোনও কারণে আমার নেমকার্ড দিয়েছিলেন। বোঝা গেল, তার বিপদ হলে শুভময়বাবু যেন আমাকে ট্রাঙ্ককল করে জানান।

বললুম, প্রবুদ্ধবাবু মারা গেছেন?

হ্যাঁ। ডাক্তার বলেছেন, স্ট্রোক। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন, জয়ন্ত! এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। প্রবুদ্ধবাবুর বডি পোস্টমর্টেম করাতেই হবে। কুইক!

উঠে পড়লুম। গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে তাকিয়েছিলেন। তড়াক করে উঠে বললেন, কিছু বোঝা যায় না। কর্নেলস্যার! আপনারা যান কোথায়?

কর্নেল বললেন, আপনিও সঙ্গী হতে পারেন। আপনারই কেসের একটা অংশ এটা। এক মিনিট। জয়ন্ত! তোমরা নীচে যাও। গাড়িতে ফুয়েল কম থাকলে পথে কোথাও ভরে নেব।

হালদারমশাই হন্তদন্তভাবে আমাকে অনুসরণ করলেন। দোতলার অ্যাপার্টমেন্টে লিন্ডার কুকুর রেক্সির চ্যাঁচামেচি শুনে তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, হালার কুত্তা! আমি আইলেই খালি চাঁচায়! এতদিন আইতাছি। মাইনষের গায়ের গন্ধে ট্যার পায় না?…

.

০২.

 দমদম এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটা পেট্রোলপাম্পে আমার গাড়িতে পেট্রোল ট্যাংক প্রায় ভর্তি করে পেট্রোল নিলুম। কিন্তু তার দাম মেটালেন কর্নেল। তাঁর বক্তব্য, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাতে একটা রোমহর্ষক স্টোরি দেওয়ার সময় গাড়ির জ্বালানির যে বিল করব, তা থেকে ইচ্ছে করলে কর্নেলকে এই টাকাটা মিটিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এখন সত্যিই একটা রোমহর্ষক স্টোরি মিলবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। অতএব জ্বালানি খরচের দায়িত্ব আপাতত তার।

তারপর গাড়ি যখন মধ্যমগ্রামের দিকে বাঁক নিচ্ছে, সেই সময় ব্যাকভিউ মিররে দেখলুম, পেছনে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল, এই গাড়িটা ভি আই পি রোডে পিছনে আসতে দেখেছি। বারাসত ছাড়িয়ে গিয়েও লক্ষ করলুম কালো গাড়িটা যেন পিছন ছাড়তে চায় না। আমি স্পিড কমালে ওটাও স্পিড কমাচ্ছে। এতক্ষণে একটু উদ্বেগ এসে গেল। আমার বাঁপাশে কর্নেল, পিছনের সিটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই। এবার কিছু দূরে দুধারে বিস্তীর্ণ কালো মাঠ। কালো গাড়িটা সমান দূরত্ব বজায় রেখে আসছে। তখন কর্নেলকে কথাটা না বলে পারলাম না।

কর্নেল আমার কথা গ্রাহ্য করলেন না। পিছন ফিরে গাড়িটাও দেখলেন না। বললেন, হাইওয়েতে অন্যদিকে মন দিয়ে ড্রাইভ করা বিপজ্জনক।

কর্নেলের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম পৌনে দশটায়। সাড়ে এগারোটায় একটা বাজার এলাকায় পৌঁছুনোর সময় কর্নেল বললেন, এটাই কনকপুর। আর হাফ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই সন্ধ্যানীড়।

এতক্ষণে সেই কালো গাড়িটা আমার গাড়ির পাশ কাটিয়ে জোরে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখে পড়ল গাড়িটার ড্রাইভারের মুখে পাইপ, মাথায় টুপি, চোখে সানগ্লাস। অজানা আতঙ্কে গা ছমছম করে উঠল। বললুম, কর্নেল! দুধারে কঁকা মাঠ আর জলা দেখতে পাচ্ছি। সামনে একটা বাঁক।

কর্নেল বললেন, তাতে কী হয়েছে?

কালো গাড়িতে যাকে দেখলুম, সে রীতিমতো দিশি সাহেব।

কর্নেল হাসলেন। আমার মতো?

আহা! বাঁকের আড়ালে যদি লোকটা আচমকা আমাদের ওপর হামলা করে?

কেন করবে?

কী আশ্চর্য! কলকাতা থেকে লোকটা আমাদের ফলো করে আসছিল।

কর্নেল বাইনোকুলারে ডানদিকের জলাটা দেখতে দেখতে বললেন, একসময় এই ঝিলে প্রচুর পাখি দেখেছি। এখন কয়েকটা বক মাত্র। দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

খেয়ালি প্রকৃতিবিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর। তাঁর নেম কার্ডে লেখা থাকে : কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) নীলাদ্রি সরকার। দা নেচারোলজিস্ট। এ মুহূর্তে অনুসরণকারী কোনও কালো গাড়ি সম্পর্কে তিনি নির্বিকার।

বাঁকের মুখে কালো গাড়িটা নেই দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল। এরপর সোজা রাস্তা। চোখে পড়ল, সেই কালো গাড়ি দূরে মিলিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে। এই সময় কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, এসে গেছি। ডাইনে মোরামবিছানো প্রাইভেট রোড। তারপর ওই দেখ, সন্ধ্যানীড়ের গেট।

গেট বন্ধ ছিল। হর্ন শুনে পাশের ফোকরে একটা মুখ বলল, ঠারিয়ে। তারপর একটা সংকীর্ণ অংশ খুলে উর্দিপরা সেই লোকটা, সে দরোয়ানই বটে, বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?

কর্নেল নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পিঠে আঁটা ব্যাগ, বুকের নীচে ঝুলন্ত ক্যামেরা আর বাইনোকুলার। তিনি বললেন, আমরা কলকাতা থেকে আসছি। শুভময় রায়কে খবর দাও।

সে অদৃশ্য হল। জায়গাটা আশ্রমের মতো সুদৃশ্য। গাছপালায় ঢাকা। একেবারে চুপচাপ। শুধু শীতের হাওয়ার শব্দ চারপাশে। গেটের শীর্ষে সন্ধ্যানীড় ছুঁয়ে বুগেনভিলিয়ার ঝাপি। এই শীতেও লাল ফুলের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করছে।

একটু পরে গেট খুলে গেল। লম্বা, ঈষৎ শীর্ণ, অথচ শক্ত গড়নের ধুতি পাঞ্জাবি-চাদরপরা এক ভদ্রলোক কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন, আপনিই কি কর্নেলসায়েব?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি—

 এখনও দাহ করা হয়নি।

আপনি শুভময়বাবু?

 হ্যাঁ। 

তার পাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, দাদা! আমাদের নিয়মকানুন না মেনে তো উপায় নেই। ভিজিটর বুকে এঁদের নামধাম আর প্রবুদ্ধবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক উল্লেখ করে লেখাজোখা করতে হবে।

ঠিক আছে। তুমি অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করো। কর্নেলসায়েব! আপনারা গাড়ি ভেতরে ঢোকান।

ভেতরে গিয়ে দেখলুম, দুদিকে একতলা সারিবদ্ধ বাড়ি। ফুলবাগান, শাকসবজির ক্ষেত, ছোট্ট পার্ক সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। পূর্বদিকে একটা বিশাল বটগাছের তলায় বেদির মতো শানবাঁবারো ফুট তিনেক উঁচু জায়গায় চাদরটকা মৃতদেহ। কয়েকজন বৃদ্ধ সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।

শুভময়বাবু বাঁদিকের একটা ঘকে আমাদের নিয়ে গেলেন। এটা অফিস। ভিজটস বুকে আমাদের নাম-ঠিকানার সঙ্গে প্রবুদ্ধবাবুর কাল্পনিক আত্মীয় সম্পর্ক লিখতে হল। তমালাকু বললেন, এ হল সন্ধ্যানীড়ের ম্যানেজার কেশব মুখার্জি। এই আশ্রমটার প্রতিষ্ঠাতা হলেন অনাদি ভট্টাচার্য। উনি নিজের জন্যই এই তিন একর জায়গা কিনে বাড়ি করতে চেয়েছিলেন। পরে নিজের বৃদ্ধ বয়সের নিঃসঙ্গতার কথা ভেবেই এখানে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন। নিয়মকানুনের ব্যাপারে অনাদিবাবু খুব কড়া। কারণ, যা দিনকাল পড়েছে!

কর্নেল বললেন, অনাদিবাবু কি এখন আছেন?

ম্যানেজার কেশব্বাবু বললেন, উনি এখন মন্দিরে আছেন স্যার। স্নান করে ধ্যানে বসেছেন।

শুভময় এবার আমাদের প্রবুদ্ধ দভের মৃতদেহের কাছে নিয়ে গেলেন। মুখ খোলা ছিল। চোখে শমা। কর্নেলের দেখাদেখি আমরাও গম্ভীর মুখে মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা জানালুম। যে বৃদ্ধরা ওখানে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা কে জানে কেন সরে গেলেন।

শুভময়বাবু কর্নেলকে আস্তে বললেন, আসুন। জায়গাটা দেখাই।

পূর্বদিকে ছোট্ট গেট। গেট খুললেন শুভমবাবু। খানিক শানবাঁধানো চত্বরের দুপাশে বসার জন্য শাবাঁকানো বেঞ্চ। তার নীচে সিঁড়ি নেমে গিয়ে ঝিলের জলে ডুবেছে। শুভময় কলে, এই চত্বরে ঠিক এখানে গেটের কাছে কাত হয়ে পড়েছিলেন প্রবুদ্ধবাবু। ভোরু ছটায়, তখনও শীতের কুয়াশা থাকে। তবু ওঁর খেয়াল। ছড়ি হাতে বেরিয়ে এই বেঞ্চে বসে থাকেন। সূর্য ওঠার পর ফিরে আসেন। আশ্রমের কান্টি আছে। অনেকে বশ্য স্বপাক খান। প্রবুদ্ধবাবু, আমি ক্যান্টিনেই খাই। আজ ক্যান্টিন থেকে চায়ের কাপ পৌঁছে দিয়েছিল কানু নামে ক্যান্টিন বয়। আমি তখন আমার ঘরের বারান্দায় বসেছিলুম। প্রচণ্ড শীতে হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে ছিল না। তো কানু চায়ের কাপ হাতে ফিরে এল চাঁচাতে চাচাতে। বাবু আছাড় খেয়ে পড়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি এখানে এলুম। তারপর আরো এলেন।

কর্নেল বললেন, মাথার পাশে রক্তের ছোপ দেখলুম। এখানে রক্তের ছোপ কি ধুয়ে ফেলা হয়েছে?

হ্যাঁ। তা-ই তো মনে হচ্ছে। তবে এটা স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক বলে কর্নেল চত্বরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত খুঁটিয়ে দেখলেন। এবার বলুন, কবে কখন প্রবুদ্ধবাবু আপনাকে আমার নেমকার্ড দিয়েছিলেন?

শুভময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে আস্তে বললেন, উনি আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তাই দত্তদা বলতুম। পাশাপাশি দুজনে থাকি। তো গতরাত্রে আমি একটা বই পড়ছি, তখন দত্তদা আমার ঘরে ঢুকলেন। দরজা খোলা ছিল। সাড়ে আটটা বাজে। ভাবলুম, ক্যান্টিনে খেতে যাবার জন্য ডাকতে এসেছেন। কিন্তু দত্তদা দরজা ভেজিয়ে আমাকে চুপি-চুপি বললেন, আমার খুব ভয় হচ্ছে শিগগির একটা কিছু ঘটে যাবে। যদি আমার কোনও বিপদ হয়, তুমি এই কার্ডের নাম্বারে ফোন করবে। ফোন নম্বর বদলে যেতেও পারে। তবু তোমাকে যেভাবে হোক কর্নেল সায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে। দত্তদার এসব কথা শুনে আমি তো অবাক। অনেক প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পেলুম না। তারপর আজ ভোরে এই ঘটনা ঘটে গেল।

ওঁর ডেডবডি তো ডাক্তার পরীক্ষা করেছেন?

হ্যাঁ। আশ্রমের একজন বাঁধা ডাক্তার আছেন। নাম ডাঃ অপূর্ব বাগ। কনকপুরে বাড়ি। তিনি বডি পরীক্ষা করে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। করোনারি থ্রম্বসিসে মৃত্যু।

দাহ করার জন্য তাড়া দিচ্ছিল কেউ?

শুভময় একটু ভেবে নিয়ে বললেন, নরেনবাবুনরেন মাইতি বলছিলেন, প্রবুদ্ধবাবুর আত্মীয়স্বজন হয়তো নেই। থাকলে পরে এতদিন কেউ না কেউ দেখা করতে আসত। কাজেই দাহের ব্যবস্থা করা হোক। নরেনবাবুর যুক্তি, প্রবুদ্ধবাবুর শবদেহ এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আশ্রমের লোকেরা ভয় পাবেন। সবাই তো বুড়োমানুষ। কেউ-কেউ অসুস্থ।

তারপর?

আমি বাধা দিলুম। বললুম, প্রবুদ্ধবাবু আমাকে বলেছিলেন, কলকাতায় ওঁর আত্মীয়স্বজন আছেন।

হু। ঠিক করেছেন।

শুভময় কর্নেলের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে বললেন, কোনও গণ্ডগোল আছে বলে কি আপনার মনে হচ্ছে?

থাকতে পারে। আমি ডাক্তার নই। কিন্তু করোনারি থ্রম্বসিসে মৃত্যু হয়েছে বলে আমার মনে হল না। আচমকা জোরে আছাড় খেয়ে হার্টফেল করে সম্ভবত ওঁর মৃত্যু হয়েছে। থ্রম্বসিসে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে যায়। মুখের কষায় একটু রক্তের চিহ্ন লক্ষ করা যায়। হা–ওঁর ছড়িটা কোথায় আছে?

আমি তখনই কুড়িয়ে নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিলুম।

আপনি বুদ্ধিমান!

কর্নেলসায়েব! প্রবুদ্ধবাবু আমাকে আপনার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। খুব ভয় পেয়ে গেছি

কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে নেমে জলের কাছে গিয়ে এদিকে ঘুরলেন। তারপর উঠে এসে বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের চাবি কার কাছে আছে?

আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে চাবির গোছা ওর পকেট থেকে বের করে নিয়েছিলুম। ঘরের চাবি সম্পর্কে এখনও তানাদিবাবু বা অন্য কারও মাথাব্যথা দেখছি না।

প্রবুদ্ধবাবুর পরনে গলাবন্ধ লম্বা কোট দেখলুম। কোটের সব পকেট কি খুঁজেছিলেন?

না। পাশ পকেটে উনি ঘরের চাবি রাখতেন দেখেছিলুম। তাই—

 কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, আর কেউ ওঁর পকেটে কিছু খোঁজেননি তো?

আমি সারাক্ষণ ছিলুম। কাউকে ওঁর পকেট সার্চ করতে দেখিনি। আশ্রমের কর্মীরা ওঁর ডেডবডি তুলে নিয়ে গিয়ে বটতলার বেদিতে রেখেছিল। আশ্রমে আসার পর একজনের মৃত্যু দেখেছিলাম। তিনি হাঁপানির রুগি ছিলেন। আশ্রমের নিয়ম, ডেডবডি ওই বেদিতে রাখা হবে। আবাসিকরা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন। তারপর ঝিলের ধারে শ্মশানে দাহ হবে।

 এখন কতজন আবাসিক আছেন?

নজন ছিলেন। একজন চলে গেলেন।

 প্রত্যেককে মাসে কত টাকা দিতে হয়?

এ বাজারে সস্তাই বলব। মাসে একহাজার টাকা। প্রত্যেকে ব্যাঙ্কচেকে পেমেন্ট করেন। কনকপুরে ব্যাঙ্ক আছে। সেখানে নিজের নিজের সোর্স থেকে আবাসিকরা বেশ কিছু টাকা ব্যাঙ্কড্রাফটে গচ্ছিত রাখেন। তবে অনাদিবাবু ব্যবসা কেঁদেছেন বলব না। ভদ্রলোক সাধুসন্ন্যাসী টাইপের মানুষ। এখানে সবার সঙ্গে ওঁর প্রীতির সম্পর্ক। মানুষটিকে লক্ষ করেছি। মহৎপ্রাণ পরোপকারী বললে ভুল হবে না। সুখে-দুঃখে আমাদের মাথার কাছে এসে দাঁড়ান। প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুতে ওঁকে আজ খুব বিচলিত দেখেছি। দেখুন না! স্নান করে মন্দিরে ধ্যানে বসেছেন কখন! বুঝতে পারছি, মনে খুব আঘাত পেয়েছেন।

বলে শুভময় দ্রুত গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। আমরা ওঁকে অনুসরণ করলুম। দেখলুম, মৃতদেহের পাশে কাক এসে বসেছিল বলে একটা লোককে বকাবকি করছেন। লোকটাকে আশ্রমের কর্মচারী মনে হল। সে বলল, কেউ নেই দেখেই তো আমি এখানে এলুম সার!

শুভময় ডাকলেন, ম্যানেজার! ম্যানেজার! ও কেশব!

ম্যানেজার কেশববাবু অফিসের বারান্দায় বেরিয়ে বললেন, কী হল দাদা?

এখানে কোনও লোক রাখার ব্যবস্থা করোনি?

নরেনবাবুরা তো ছিলেন!

ছিলেন। এখন নেই! মৃত্যু একদিন হবেই হবে। মৃত্যুকে ভয় করে যারা, তারা কাপুরুষ। সব্বাই যে যার ঘরে ঢুকে বসে আছে। লুকিয়ে থাকলেও কি নিস্তার আছে?

শুভময়ের তেজস্বী চেহারা আর বক্তৃতার মতো কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল, ইনি সত্যিকার স্বাধীনতাসংগ্রামীই ছিলেন। কোনও ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে এঁর কথার প্রতিবাদ করলেন না।

ম্যানেজার আরও একজন লোক পাঠিয়ে দিলেন। শুভময় তাদের বললেন, গোবিন্দ! হরেন! তোমরা লক্ষ রাখবে, যেন ডেডবডি কেউ অপবিত্র না করে। আসুন কর্নেলসায়েব। আমার ঘরে গিয়ে বসবেন।

আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ হালদারমশাই বলে উঠলেন, আমি আইতাছি। আপনারা চলেন গিয়া। তারপর তিনি হন্তদন্ত হয়ে ঘাটের দিকের গেট খুলে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন।

শুভময় অবাক হয়ে বললেন, উনি কি পূর্ববঙ্গীয়?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তবে স্বাধীনতার সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় মানুষজন এসে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কেউ-কেউ এখনও মাতৃভাষা ছাড়েননি। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এমনটি দেখবেন না। আঞ্চলিক ভাষাকে লুকিয়ে রাখা হয়।

শুভময় তাঁর ঘরের তালা খুলে বললেন, স্বাধীনতা-সংগ্রামে পূর্ববঙ্গীয়রা সর্বত্র এ নিয়েছেন। আমি অবশ্য বংশানুক্রমে কলকাতার লোক। ওই নরেন মাইতি আমার সঙ্গে এঁড়ে তক্ক করে ও মেদিনীপুরের লোক। ও বলে, আমাদের জেলায় মরা হাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিলুম। ১৯৪২ সালের অগাস্ট আন্দোলনের কথা। কিন্তু নরেনের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হয়েছে, ও ছিল ফ্রিডম-ফাইটারদের দলে ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর। বলে কি না, কাথিতে ট্রেজারি লুঠ করেছিল। বোগাস! অথচ দিব্যি আমার মত মাসে-মাসে ফ্রিডম ফাইটার পেনসন পায়।

কর্নেল বারান্দা থেকে বাইনোকুলারে হাইওয়ে দেখে নিয়ে বললেন, আপনাদের ক্যান্টিনে কি কফি পাওয়া যায়?

হ্যাঁ। আপনারা ঘরে বসুন। আমি আসছি। বলে শুভময় লম্বা পা ফেলে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলেন।

এই বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছিল হাইওয়ে হাতির পিঠের মতো উত্তর পশ্চিম কোণে উঁচু হয়ে আছে। বুঝলুম, ওখানে ব্রিজ আছে। কর্নেল পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, বাঃ! যথার্থ স্বাধীনতা-সংগ্রামীর ঘর। দেয়ালে সব বিখ্যাত নেতাদের ছবি। নেহেরু, গান্ধীজি, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ। বাঃ! নজরুলও আছেন। থাকা উচিত। শুভময়বাবুর মধ্যে বিদ্রোহী মানুষের আদল আছে। জয়ন্ত! তুমি কি জানো? আলবের কামু লিখেছেন, না কথাটি যে বলতে পারে, সে-ই বিদ্রোহী।

কামু ছাড়ুন। হালদারমশাই কী কেলোর কীর্তি বাধাতে গেলেন কে জানে!

আমি কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দাপ্রবর এসে গেলেন। চোখদুটি চিতাবাঘের মতো এবং গোঁফের ডগাও কাঁপছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে দাঁতে দাঁতে দৃঢ় পেষাই শুরু হলেই গোঁফের ডগা কাঁপতে শুরু করে। কর্নেল বললেন, আসুন হালদারমশাই।

হালদারমশাই ঘরে ঢুকে হঠাৎ বদলে গেলেন। ফিক করে হেসে বললেন, জয়ন্তবাবু য্যান কীসের কীর্তি কইছিলেন?

ঝটপট বললুম, না। আপনার সম্পর্কে কিছু বলিনি। আপনি হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলেন?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসিমুখে বললেন, এখন এক কাপ কফি বা চা দরকার ছিল।

এখনই এসে যাচ্ছে। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন। তবে তার আগেই আপনার মেজাজ অবশ্য প্রসন্ন হয়ে গেছে দেখে ভালো লাগল। নার্ভও চাঙ্গা মনে হচ্ছে।

গোয়েন্দাপ্রবর এবার চাপাস্বরে বললেন, ঘাটের ওপর খাড়াইয়া ছিলাম, তখন জিনিসটা চোখে পড়ছিল। কিন্তু আমার ক্লায়েন্টের মামাবাবুও আছেন। ওনার সামনে জিনিসটা আনতে চাইনি।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, জিনিসটা কী?

হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, এখন না। পরে কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করব। জয়ন্তবাবু! কন তো মশয়, নাইলনের দড়িতে পেরেক বান্ধ্যা কি এখানকার লোকে ছিপে মাছ ধরে? কিন্তু ছিপই বা কোথায়? দামের ওপর পেরেক বাঁধা মিহি দড়ি ভাসতাছে। কী কাণ্ড!

কর্নেল কান খাড়া করে শুনছিলেন। বললেন, এখন ওসব কথা থাক। শুভময়বাবুর চটির শব্দ মনে হচ্ছে!

শুভময়বাবুর সঙ্গে একটি কিশোর ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। সে ট্রে রেখে কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। শুভময় বললেন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কফি তৈরি করিয়ে আনলুম। এক মিনিট! আমার ঘরে বিস্কুট আছে।

কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, আচ্ছা শুভময়বাবু, বাই এনি চান্স এখানে কি মনোমোহন বসু বা বোস নামে কেউ থাকেন?

মনমোহন বোস, না মদনমোহন বোস?

তা হলে মদনমোহন বোসই হবেন।

 আপনি চেনেন নাকি।

নাঃ। তার এক আত্মীয় আছে মন্টু নামে। তার কাছে শুনেছি।

বুঝেছি। একজন বখাটে চেহারার লোক মাঝেমাঝে মদনবাবুর কাছে আসে। চেহারা পোশাকে একেবারে সিনেমার হিরো। সে এলেই মদনবাবুর ঘরে তর্কাতর্কি শুনতে পাই। পরে গোবিন্দ আমাকে চুপিচুপি বলেছিল, মদনবাবুর নাকি অনেক সম্পত্তি! তার নাতি তাসে সেই সম্পত্তি দাবি করতে। মদনবাবু কৃপণ স্বভাবের মানুষ। স্বপাক খান। অন্যের হাতে জল পর্যন্ত না। গোবিন্দ রসিকতা করে বলে, মদনবাবুকে কেউ বিষ খাইয়ে মেরে সম্পত্তি হাতাবে বলেই এখানে পালিয়ে এসেছেন। খিটখিটে মেজাজের লোক। সবসময় একা থাকতে চান। আজ দূর থেকে প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি দেখেই নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছেন। এখনও বেরুতে দেখিনি।

এই সময় বাইরে গেটের কাছে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। শুভময় বেরিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে বললেন, কর্নেলসায়েব! পুলিশের গাড়ি এসে গেছে। সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সও দেখছি। কী ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না। আপনি কি পুলিশে খবর দিয়ে এসেছিলেন?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে আস্তেসুস্থে বের হলেন। হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। কাপ হাতে বেরুলেন। আমি বেরিয়ে দেখলুম, বৃদ্ধাশ্রমের সেই শান্ত নিঝুম পরিবেশ এখন বদলে গেছে। আবাসিকরা কেউ বারান্দায় কেউ নীচে লনে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে-মুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। পুলিশ জিপ আগে ঢুকল। তার পিছনে অ্যাম্বুল্যান্স। ম্যানেজার কেশববাবু জিপের পাশে হন্তদন্ত হেঁটে আসছেন।

পুলিশের জিপ আমার গাড়ির পাশে দাঁড়াল। দুজন পুলিশ অফিসার জিপ থেকে নেমে অ্যাম্বুল্যান্স গাড়িটাকে এগিয়ে যেতে ইসারা করলেন। তারপর একজন অফিসার কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন, আপনার চেহারার ডেসক্রিপশন পেয়ে গেছি। আপনিই তো কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আমি কালীতলা থানার ওসি। আমার নাম পরেশ ব্যানার্জি। হেমন্তবাবু আমাকে খবর দিয়েছেন। শুনেই আমি—-

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, জাস্ট আ মিনিট মিঃ ব্যানার্জি। ইনি শুভময় রায়। এখানকার আবাসিক এবং প্রয়াত প্রবুদ্ধবাবুর বন্ধু। আপনি এঁর কাছে জেনে নিন, বডি কী অবস্থায় কোথায় পাওয়া গিয়েছিল।

ওসি পরেশ ব্যানার্জির সঙ্গে শুভময়বাবু ঘাটের দিকে গেলেন। একটু পরে উত্তর-পূর্ব কোণে মন্দিরের দিক থেকে পট্টবস্ত্র পরা এবং উত্তরীয় গলায় জড়ানো সন্ন্যাসীর মতো চুড়োবাঁধা চুল এবং গোঁফদাড়িওয়ালা এক বেঁটে ভদ্রলোক খালি পায়ে হন্তদন্ত এসে গেলেন। ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে তিনি চাপা গলায় কথা বলে বটতলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বুঝলুম, ইনিই সন্ধ্যানীড়ের মালিক অনাদি ভট্টাচার্য।

অ্যাম্বুল্যান্স থেকে স্ট্রেচার নামিয়ে ততক্ষণে প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি দুজন লোক স্ট্রেচারে তুলেছে। দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার অনাদিবাবুকে চেনেন মনে হল। তাঁর সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন। জিপের পিছন থেকে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অনাদিবাবু কর্নেলের কাছে এসে সবিনয়ে নমস্কার করে বললেন, আপনি প্রবুদ্ধবাবুর আত্মীয়? কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি পুলিশকে খবর দিয়েছেন কেন? ডাক্তার পরীক্ষা করে ন্যাচারাল ডেথ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। আপনি কি সন্দেহ করেছেন এখানে খুনখারাপি হয়? আমার এই পবিত্র আশ্রমে? না-না। কাজটা আপনি ঠিক করেননি। এতে সন্ধ্যানীড়ের দুর্নাম হবে।

কর্নেল বললেন, হঠাৎ এভাবে ভোরবেলা কারও ডেডবডি পাওয়া গেলে পুলিশকে জানানো উচিত অনাদিবাবু! এটা সন্দেহের বা খুনখারাপির প্রশ্ন নয়। আইনের প্রশ্ন। আপনারা কেউ কি প্রবুদ্ধবাবুকে ঘাটের কাছে হঠাৎ পড়ে যেতে দেখেছিলেন?

তা অবশ্য দেখিনি। বলে অনালিবাবু পুলিশ অফিসারের দিকে ঘুরলেন। বিশ্বাসবাবু! একটু দেখবেন। ফে আশ্রমের অকারণ সুনামহানি না হয়।

বিশ্বাসবাবু একটু হেসে বললেন, বৃদ্ধাশ্রম গড়েছেন। বৃদ্ধরা যে-কোনও সময় মারা যেতে পারেন। এখন তাদের আত্মীয়স্বজন কোনও প্রশ্ন তুলতেই পারেন। আপনি তো রাজ্যের যত বৃদ্ধকে ডেকে এনে খুন করছে না?

নিজের রসিকতায় পুলিশ অফিসারটি নিজেই হেসে উঠলেন। মনেজার কেশববাবু তাঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু বলতে থাকলেন। অনাব্বিাবু কর্নেলকে বললেন, প্রবুদ্ধবাবু আপনার কে ছিলেন?

কর্নেল বললেন, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন একসময়।

তা আপনাকে ওঁর মৃত্যুর খবর কে দিল?

শুভময়বাবু ফোন করেছিলেন। প্রবুদ্ধবাবু তাকে বলে রেখেছিলেন, তার দৈবাৎ মৃত্যু হলে যেন আমাকে খবর দেওয়া হয়।

অ। তা আপনি নাকি মিলিটারি অফিসার? কেশব বলল।

কর্নেল তার একটা নেমকার্ড দিলেন। অন্যদিবাবু বাঁহাতে কার্ডটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, বুঝলুম! তবে কি স্যার, আমার বক্তব্য হল, কোনও সন্দেহজনক ব্যাপার থাকলে আমি তা জানতে পারতুম। বুঝলেন? এতগুলো মানুষের দায়িত্ব আমার হাতে। এঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কি নেই ভাবছেন? কে কোথায় যাচ্ছেন, কী অবস্থায় আছেন, সবসময় লক্ষ্য রাখা হয়। প্রবুদ্ধবাবুর ব্যাপারটা দৈবাৎ– মানে, শীতকালে অত ভোরে উনি রোজই ঘাটের ধারে বসে থাকেন। তাই আমার লেকেরা ওঁকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আমাদের পক্ষে এটা যদি ত্রুটি বলেন, ত্রুটি। এজন্য আমি দুঃখিত। শুধু দুঃখিত নই, খুব মর্মাহত। প্রবৃদ্ধবাবু আমার অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।

বলে উত্তরীয়তে চোখ মুছতে মুছতে তিনি উত্তর দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

অ্যাম্বুল্যান্স গাড়িটা চলে গেল। ওসি এবং শুভময়বাবু ফিরে এলেন। কর্নেল বললেন, মিঃ ব্যানার্জি। একটা অনুরোধ।

বলুন কর্নেলসায়েব?

প্রবুদ্ধবাবুর পোশাক এখনই গিয়ে সার্চ করা দরকার।

হ্যাঁ। দামি কিছু থাকলে মর্গের লোকেরা তা হাতিয়ে নেয়। বলে তিনি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে তাতে গিয়ে চাপাস্বরে কাকে কিছু নির্দেশ দিলেন।

বললুম, বাঃ। এখানে পুলিশের জন্য বেশ আধুনিক ব্যবস্থা তো!

কর্নেল বললেন, বর্ডার এলাকার সব থানায় আজকাল আধুনিক সরঞ্জাম পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।

ওসি কাছে এসে বললেন, আমি এঁদের অফিসে বসে সবাইকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করব। বিশ্বাসবাবু! আপনি ম্যানেজারবাবুকে নিয়ে আসুন।

শুভময় আস্তে বললেন, পুলিশ আপনাকে পাত্তা দেবে না তা বুঝতে পেরেছি। আমি অবশ্য আপনার পরিচয় দিইনি। কিন্তু আমার মনে হল ওসি আপনার পরিচয় জানেন! যাক গে, চলুন। ঘরে গিয়ে বসি। যখন ডাক আসবে, তখন যাব! যা জানি, বলব।

তখন লক্ষ্য করিনি, কিন্তু এখন দেখলুম, শুভময় রায় তাঁর ঘরে তালা এঁটে দিয়েছিলেন। তালা খুলে ঘরে আগের মতো বসলুম। কর্নেল এবার শুভময়বাবুকে প্রবুদ্ধ দত্তের লেখা সেই চিঠিটা পড়তে দিলেন। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুভময় বিড়বিড় করে বললেন, মূর্তিমান শয়তান। কে সে? আশ্চর্য! প্রবুদ্ধবাবু আমাকে কথাটা জানাতে পারতেন।

কর্নেল বললেন, সন্ধ্যানীড়ে আপনাদের মধ্যে সবার শেষে কোন আবাসিক এসেছেন?

নরেন মাইতি। কিন্তু সে–নাঃ! অসম্ভব। নরেন ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিল বলে সন্দেহ হয়, তা ঠিক। কিন্তু সে কেন মূর্তিমান শয়তান হবে? রোগা হাড়গিলে নরেন। সবসময় বকবক করে। এ ধরনের মানুষ-না! অসম্ভব। তবে তার আগে এসেছেন মদনমোহন বোস। কিন্তু নাঃ! অসম্ভব।

এই সময় ম্যানেজার এসে বললেন, দাদা! ওসি আপনাকে ডাকছেন।

শুভময় তখনই বেরিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, হালদারমশাই তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা মিহি কালো রঙের নাইলনের দড়ি বের করে কর্নেলকে দিলেন। বললেন, এটা ঘাটের নীচে বাঁদিকে কলমিদামের ওপর দেখছিলাম।

কর্নেল দড়িটা পরীক্ষা করছিলেন। দড়ির একপ্রান্তে একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা পেরেক বাঁধা আছে। অন্যদিকে শুধু গিট পাকানো কলে দড়িটা কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, হালদারমশাই! এটাই আসলে প্রবুদ্ধবাবুকে ডেডবডিতে পরিণত করেছিল। কাজেই এটাকে মার্ডার-উইপন বলা যায়।

হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললুম, একটা দড়ি কী করে মার্ডার–

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সিঁড়ির ওপরের চত্বরে লম্বালম্বি একটা সরু ফাটল আছে। এই দড়িটা দুটো পেরেকে টানটান করে তার ওপর লম্বালম্বি রাখা হয়েছিল। এতেই পা আটকে গিয়ে প্রবুদ্ধবাবু প্রচণ্ড জোরে শানের ওপর পড়ে যান। খুনী দড়িটা ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে এসেছিল। অন্যপ্রান্তের পেরেকটা নিশ্চয় জলে পড়ে গিয়েছিল।…

.

০৩.

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার মার্ডার উইপন আবিষ্কারের গর্বে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর স্বীকার করলেন, তিনি দড়িটার এ ধরনের গুরুত্ব বোঝেননি। নিছক কৌতূহলবশতঃ এটা কুড়িয়ে এনেছিলেন।

একটু পরে যে ছেলেটি কফি এনেছিল, সে এসে কুণ্ঠিতভাবে বলল, দাদামশাই নেই? আমি কাপপ্লেট নিতে এসেছি।

কর্নেল. বললেন, নিয়ে যাও। তোমার নাম কী?

 আমার নাম কানু সার!

তুমি শুভময়বাবুকে দাদামশাই বলো?

আজ্ঞে! কানু ঢোক গিলে বলল, দাদামশাই আমাকে পড়ান। আমি ক্লাস ফাইভে পড়া ছেড়ে এখানে কাজ করতে এসেছিলুম।

তোমার বাড়ি কোথায়?

 আজ্ঞে কর্তাবাবুর যেখানে বাড়ি ছিল। কনকপুর।

কনকপুরে কর্তাবাবু মানে অনাদিবাবুর বাড়ি ছিল? এখন সেই বাড়ি নেই?

 না সার। বাড়ি বিক্রি করে এখানে এই আশ্রম করেছেন।

তুমি মদনমোহন বোসকে তো চেনো? উনি কোন ঘরে থাকেন?

কানু উল্টোদিকে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলল, আট নম্বর ঘরে। বোসবাবু খুব রাগী লোক সার! সবসময় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে থাকেন। কথাটা সে হাসিমুখে বলে, ট্রেতে কাপ-প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, আর নরেনবাবু কোন ঘরে থাকেন?

কানু এদিকের একটা ঘরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে গেল, পাঁচ নম্বরে।

সে চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, কর্নেলস্যার! শুভময়বাবুরে ওনার ভাগনি চন্দ্রিকার কথা জিগাইলে কেমন হয়?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, না হালদারমশাই! এখনই অত তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, আমি মদনমোহনবাবুর লগে আলাপ করতে চাই। আপনি কী কন?

শুনলেন তো! রাগী লোক। সবসময় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে থাকেন। আপনি পাত্তা পাবেন বলে মনে হয় না।

একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?

হালদারমশাই! তাতে অকারণ সিন ক্রিয়েট হবে। বরং শুভময়বাবু আসুন। তার সঙ্গে কথা বলে তারপর চেষ্টা করবেন। বলে কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তোমরা বসো জয়ন্ত! আমি আসছি।

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। উঁকি মেরে দেখলুম, উনি টানা বারান্দায় হেঁটে চলেছেন। একটু পরে তিনি বারান্দা থেকে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছোট্ট পার্কে ঢুকলেন।

তারপর শুভময়বাবুকে আসতে দেখলুম। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, কর্নেলসায়েব কোথায়?

বললুম, পার্কে যেতে দেখলুম।

শুভময় বিছানায় বসে বললেন, পুলিশ আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। ব্রিটিশ আমল থেকে ওদের দেখে আসছি। খালি উল্টোপাল্টা প্রশ্ন। তিনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আপনাদের খিদে পেয়েছে। ক্যান্টিনে আগে থেকে এক্সট্রা মিলের কথা না বললে অনাহারে থাকতে হবে।

বললুম, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। কর্নেল আসুন। তারপর দেখা যাবে।

শুভময় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হালদারমশাই বললেন, মিঃ রায়। আপনারে একটা কথা জিগাই,

শুভময় বললেন, বলুন।

আপনি বোসবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ করাইয়া দিতে পারেন?

শুভময় একটু অবাক হয়ে বললেন, ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে চান কেন?

হালদারমশাই এবার তাঁর আইডেন্টিটিকার্ড বের করে ওঁকে দেখিয়ে বললেন, কিছু বোঝলেন?

আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ? কর্নেলসায়েব আমাকে আপনার পরিচয় দিলেই পারতেন। যাই হোক, বোসবাবুর সঙ্গে আলাপ করে কী হবে?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, আমার এক ক্লায়েন্টের স্বার্থে ওনার সঙ্গে আমার আলাপ করা দরকার।

শুভময় হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বললেন, আপনার ক্লায়েন্ট কি বোসবাবুর সেই নাতি?

নাঃ! তবে তার ডাকনাম মন্টু, তা জানি! মন্টু একটা স্কাউন্ডেল। আমার ক্লায়েন্টেরে সে ফোনে থ্রেটন করে। কিন্তু আপনি বিজ্ঞ ব্যক্তি। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের এথিক্স আছে, তা বোঝেন। ক্লায়েন্টের নাম বলা উচিত নয়।

শুভময়বাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও ডিটেকটিভ নাকি?

একটু হেসে বললুম, না শুভময়বাবু। আমি একজন সাংবাদিক।

বলে আমিও আমার আইডেন্টিটিকার্ড ওঁকে দেখালুম। শুভময় এতক্ষণে হাসলেন। বললেন, কর্নেলসায়েব আপনাদের পরিচয় দিতে পারতেন। কেন যে দেননি এতক্ষণ, জানি না।

বললুম, দেওয়ার সুযোগ পাননি।

শুভময় হালদারমশাইকে বললেন, বোসবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারি। তবে উনি খুব রাগী খিটখিটে মেজাজের লোক। সবসময় সন্দেহপ্রবণ। তাই আপনার কেসটা কী, তার একটু আভাস পেলে ভালো হয়।

আমি হালদারমশাইকে চোখের ইসারায় বারণ করতে চাইছিলুম। কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকালেন না। একটি নস্যি নিয়ে বললেন, এইটুকখান আভাস দিই। আমার ক্লায়েন্ট একজন মহিলা। তেনার হাজব্যান্ড ভালো চাকরি করতেন। হঠাৎ রিজাইন দিয়া এক মাসেরও বেশি নিখোঁজ! আমি তদন্ত করার পর জানছি, তার লগে বোসবাবুর নাতি মন্টুর বন্ধুতা ছিল। আমার সন্দেহ, ওই মন্টুই তারে কিডন্যাপ করছে। মন্টুর হাতে একটা গ্যাং থাকতেও পারে। কিন্তু বুঝি না, আমার ক্লায়েন্টের হাজব্যান্ডেরে কিডন্যাপ করার মোটিভ কী? প্লিজ হেল্প মি মিঃ রায়!

শুভময়বাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজার বাইরে উঁকি মেরে বললেন, আপনারা বসুন। আমি বোসবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। এখন ওঁর রান্না করার সময়। আগে দেখি, কেমন মুডে আছেন।

উনি বারান্দা থেকে নেমে সোজা এগিয়ে গেলেন। তার একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকে বললেন, শুভময়বাবুকে ওদিকে যেতে দেখলুম। কোথায় গেলেন বলে গেছেন?

কর্নেল প্রশ্নটা আমাকে করেছিলেন। হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, আমি ওনাকে আমার পরিচয় না দিয়া পারলাম না কর্নেলস্যার। ক্লায়েন্টের নাম কই নাই। বোসবাবুর লগে আলাপ করার জন্য–

কর্নেল তার কথার ওপর সহাস্যে বললেন, বোসবাবু পার্কে রোদে বসে আছেন। এ বেলা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। অশৌচ পালন আর কী! তা আপনি একটু ধৈর্য ধরতে পারলেন না?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, চান্সটা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। ভুল করছি?

নাঃ। ভুল করেননি। বলে কর্নেল বসলেন। বোসবাবু মেজাজি মানুষ, তা ঠিক। কিন্তু প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুতে খুব বিচলিত। সেই সুযোগে আলাপ করে ফেললুম!

হালদারমশাই বললেন, মন্টুর ব্যকগ্রাউন্ড আমার দরকার। আপনি কিছু পাইলেন?

একটু পেয়েছি। ওর নাম অজয় ঘোষ। বোসবাবুর নাতি এবং বংশের বাতিও বটে। অজয় একটা নতুন ফিল্ম কোম্পানির মালিক। বোসবাবুর ভাষায় এলেমদার ছোকরা। একটা ছবি করতে নেমেছে। তাই দাদুর কাছে বায়না ধরেছে, রামকান্ত লেনের বাড়িটা একজন প্রমোটারকে বেচে দিতে হবে। সেলডিড তৈরি করে দাদুর সই নিতে আসে। দাদু গ্রাহ্য করেন না।

কর্নেলস্যার! আমি কিন্তু এমন কিছুই অনুমান করছিলাম। ক্যান কী– শুভময়বাবু তখন কইছিলেন এক্কেরে সিনেমার হিরো!

বললুম, তার ঠিকানা বা ফিল্ম কোম্পানির নাম জানতে পারেননি?

কর্নেল হাসলেন। আমার নেমকার্ড দিলুম বোসবাবুকে। ওঁকে বললুম, সিনেমার জন্য টাকা লগ্নিতে রিস্ক আছে। কার পাল্লায় পড়ে আপনার নাতি ফেঁসে যাবে! বোসবাবু আমাকে অনুরোধ করলেন, যেভাবে পারি, মন্টুকে যেন বুঝিয়ে বলি। আমি মিলিটারির অফিসার। আমি হুমকি দিলে সে ভয় পাবে।

হালদারমশাই বললেন, কিন্তু মন্টুর ঠিকানা?

কর্নেল বললেন, ঠিকানা পেয়ে গেছি। আপনাকে যথাসময়ে দেব।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ উত্তেজনার চোটে নস্যি নিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, আমার ক্লায়েন্টের হাজব্যান্ড তার ফাঁদে পা দিয়া বিপদে পড়ছে। এই পয়েন্টটা ক্লিয়ার নয় এখনও।

শুভময়বাবু এসে গেলেন! কর্নেলয়ে এসে গেছে দেখছি। আমি এই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোকের সঙ্গে বাসবাবুর আলাপ করিয়ে দিতে চেষ্টা করছিলুম। বোসবাবু ঘরে নেই। দেখলুম, পার্কে বসে আছেন। তারপর ম্যানেজার ওঁকে অফিসে ডেকে নিয়ে গেল দেখলুম। পুলিশের জেরার মুখে কী বলবেন কে জানে। রাগী লোক।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা শুভময়বাবু! আপনি কি পুলিশকে বলেছেন প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের চাবি আপনার কাছে আছে?

হ্যাঁ। লুকোচুরি করা আমি পছন্দ করি না। চাবি পুলিশকে দিয়েছি।

ঠিক করেছেন।

আপনাদের আহারাদির ব্যবস্থা–

চিন্তা করবেন না। এখনই আমরা বেরিয়ে পড়ব। কালীতলায় এক ভদ্রলোকের বাড়ি আমাদের আজ লাঞ্চের নেমন্তন্ন আছে। তিনি আমার বিশেষ বন্ধু। বলে কর্নেল পিঠে তার কিটব্যাগ এঁটে উঠে দাঁড়ালেন।

শুভময়বাবু তার ঘরে তালা এঁটে আমাদের অনুসরণ করলেন। আমি আমার গাড়িতে উঠলুম। হালদারমশাই শুভময়বাবুকে নমস্কার করে পিছনে উঠলেন। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! গেটের কাছে এগোও। আমি ওসি মিঃ ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করে আসছি।

শুভময়বাবু আমাদের গাড়ির সঙ্গে গেটের কাছে এলেন। হালদারমশাইকে তিনি চাপাস্বরে বললেন, আপনি দরকার হলে চলে আসবেন মিঃ হালদার। আমি আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব। ওই মন্টু ছোকরাকে আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। আমার ভয় হয়, বোসদার যা মেজাজ, কোনদিন না ওই বজ্জাত নাতির কথায় রেগে গিয়ে স্ট্রোক বাধান। এমন ঘটনা আমি দেখেছি। উত্তেজনায় বৃদ্ধদের স্ট্রোক হয়।

গোয়েন্দাপ্রবর পকেট থেকে তাকে একটা নেমকার্ড দিলেন।

কর্নেল ফিরে এসে বললেন, চলি শুভময়বাবু। আপনার সহযোগিতার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পরে আমি তো যোগাযোগ করবই, আপনি প্রয়োজনে আমাকে রিং করবেন। নমস্কার।…

হাইওয়েতে পৌঁছে হাতির পিঠের মতো উঁচু ব্রিজের কাছে গিয়েই চমকে উঠলুম। সেই কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা সামনের দিক থেকে আসছে। বললুম, কর্নেল! সেই গাড়িটা।

কালো গাড়িটা ব্রিজের ঢালুতে হঠাৎ থেমে গেল। হালদারমশাই বললেন, ফায়ার আর্মস আনছি সঙ্গে। কোন হালায়–

তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, গাড়ি থামাও জয়ন্ত। আমাদের দেরি দেখে হোস্টমশাই চলে এসেছেন।

তিনি গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমরা এগোচ্ছি। আপনি গাড়ি ব্যাক করে নিন মিঃ রায়।

পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মুখে পাইপ চোখে সানগ্লাস সেই লোকটিকে দেখে নিলুম। তারপরই আমার মনে পড়ে গেল। বললুম, ওঃ কর্নেল! আপনি মাঝেমাঝে বড় বাজে রসিকতা করেন। নিজেই বলছিলেন, হাইওয়েতে একাগ্রচিত্তে ড্রাইভ করা উচিত। আসার সময় কথাটা বললে নার্ভ ঠিক থাকত।

কর্নেল হেসে উঠলেন। হালদারমশাই পিছন থেকে বললেন, কী? কী?

বললুম, কালো গাড়িটা কর্নেলের বন্ধু ওনিথোলজিস্ট হেমন্ত রায়ের।

অ্যাঁঃ? কী কইলেন? কী কইলেন?

কর্নেল বললেন, রাগ হলে বাঙালির মুখে ইংরেজি বেরিয়ে আসে। ওর্নিথোলজিস্ট মানে পক্ষিতত্ত্ববিদ। হালদারমশাই! আমরা ওই কালো গাড়ির চালক মিঃ হেমন্ত রায়ের গেস্ট হতে চলেছি। ওঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন এই এলাকার জমিদার। কালীতলা এখন শহর হয়ে উঠেছে। সেখানে পৈতৃক বাড়িটা এখনও অক্ষত রেখেছেন মিঃ রায়। ছোট্ট নদীর ধারে ছবির মতো বাড়ি।

বললুম, এতক্ষণে বুঝলুম, তা হলে কালীতলা থানায় আপনি হেমন্তবাবুকে দিয়েই খবর পাঠিয়েছিলেন।

কর্নেল হাসলেন। ডার্লিং! তুমি বোঝো সবই। তবে দেরিতে।

ছোট্ট নদীর তীরে কালীতলার শেষপ্রান্তে নিরিবিলি জায়গায় লাল রঙের দোতলা বাড়িটা যেন ছবিতে আঁকা। দোতলার গেমে বসে কর্নেল হেমন্তবাবুকে আমার ভয় পাওয়ার কথা বললে উনি অট্টহাসি হাসলেন। চোখে এখন সানগ্লাস নেই। হেমন্তবাবু বললেন, অপরাধ নেবেন না জয়ন্তবাবু! আমি কিছু না ভেবেই আপনার গাড়ির পিছনে আসছিলুম। তবে শীতের সময় সানগ্লাস পরার কারণ আছে। সারাজীবন পাখি দেখে দেখে চোখের অসুখ বাধিয়েছি। রোদে তাই সানগ্লাস পরতে বলেছেন ডাক্তার। অবশ্য কর্নেলসায়েবের মতো আমারও বাইনোকুলার আছে। কিন্তু দেশ থেকে বিরল প্রজাতির পাখি তো প্রায় লুপ্ত। যাই হোক, বেলা হয়ে গেছে। আপনাদের স্নান করতে নিষেধই করব। এলাকার জলটা এত বেশি ঠাণ্ডা যে এক বালতি জলে দেড় বালতি গরম জল না মেশালে স্নান করা যায় না। শিগগির বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে নিন। নীচে ডাইনিং রুম।

খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড। চর্বচোষ্যলেহ্য-পেয় আমার চোখে যথারীতি ভাতঘুম এনেছিল। কর্নেল দক্ষিণের বারান্দায় রোদে বসে চুরুট টানতে টানতে হেমন্তবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। হালদারমশাইও সেখানে বসে ওঁদের আলোচনায় যোগ দিলেন। আমি বিছানায় শুয়ে কম্বল চাপা দিলুম। এখানে শীতটা বেজায় মারমুখী।..

কার ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দেখি, একটা বেঁটে মোটাসোটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। সে বিনীতভাবে বলল, সাড়ে চারটে বেজে গেছে সার! চা খান।

কম্বল থেকে বেরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলুম। ঘরে শেষবেলার লালচে রোদ পশ্চিমের জানালা দিয়ে বাঁকা হয়ে ঢুকেছে। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলুম, কর্নেলসায়েব কোথায় জানো তুমি?

সে বলল, সায়েবরা তিনটেতে বেরিয়েছেন সার!

বারান্দায় গিয়ে বসলুম। এদিকটা দক্ষিণ। কিন্তু উত্তরের হাওয়া পশ্চিম ঘুরে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নীচে নদীর ঘাটে একটা পানসি নৌকো বাঁধা আছে। মানুষজন নেই। পশ্চিমে কিছুটা দূরে হাইওয়েতে বিশাল ট্রাকের মিছিল। মনে একটু ক্ষোভ জাগল। কর্নেল আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই পারতেন।

কী আর করা যাবে? সূর্যাস্ত দেখতে থাকলুম। শীতের সূর্য শিগগির দূরের দিগন্তের নীচে নেমে গেল। তার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল এবং হালদারমশাই ফিরে এলেন। ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে কর্নেল বললেন, এতদূর ড্রাইভ করে তুমি ক্লান্ত বলে তোমাকে সঙ্গী করিনি। বাইরে ঠাণ্ডায় বসে থেকো না। ঘরে এস।

ঘরে ঢুকলে হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, থানায় গিছলাম। মর্গের প্রাইমারি রিপোর্টে লিখছে, প্রবুদ্ধবাবুর হার্টের অবস্থা ভালো ছিল না। আছাড় খাইয়াই ডেড। এদিকে আমরা আসার পর পুলিশ ওনার ঘর সার্চ করছিল। সন্দেহজনক কিছু পায় নাই।

কর্নেল বললেন, আমরা কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়ব। তৈরি হয়ে নাও, জয়ন্ত!

বললুম, আমি তৈরিই আছি।

হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার! পুলিশ গোবিন্দরে আরও জেরা করল না ক্যান, বুঝি না। সে নিশ্চয় কইয়া দিত, প্রবুদ্ধবাবু ঘাটে যাওয়ার সময় যে লোকটারে বটতলায় দেখছিল, তারে চেনে। সেই লোকটাই ঘাটের চত্বরে দড়ি বাঁধতে গেছিল।

কর্নেল বললেন, সারভ্যান্টস রুম থেকে বটতলা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মিটার দূরে। তা ছাড়া বটগাছের পিছনে অন্ধকার ছিল! ঘাট পর্যন্ত আলো পৌঁছয় না। কাজেই গোবিন্দের পক্ষে কোনও ছায়ামূর্তিকে চেনা সম্ভব ছিল না।

এই সময় হেমন্তবাবু এলেন। তাঁর সঙ্গে কফির ট্রে হাতে সেই বেঁটে লোকটা এল। ট্রে রেখে সে চলে গেল। হেমন্তবাবু বললেন, ওসি মিঃ ব্যানার্জি এইমাত্র টেলিফোন করেছিলেন। একটা পুলিশভ্যান এখনই সন্ধ্যানীড়ের দিকে রওনা হয়ে গেছে। মিঃ ব্যানার্জি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আসবেন।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর ঘর সার্চ করার সময় আমার থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এদিকে আপনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। যেতে দেরি হয়ে যাবে। এইসব ভেবেই আমি তখন চলে এসেছিলুম।

ওসি তো বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর ঘরে হ্যান্ডকাফ এঁটে দিয়ে এসেছেন। হ্যান্ডকাফ খুলে প্রবুদ্ধবাবুর ঘরে কারও ঢোকা অসম্ভব।

আচ্ছা মিঃ রায়! অনাদি ভট্টাচার্যের এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার পিছনে কি শুধুই ওঁর কর্মবোধ কাজ করছে? আপনি তো ওঁর ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন। ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে লোকে সাধুসন্ন্যাসী হতেই পারে। কিন্তু

হেমন্তবাবু একটু হেসে বললেন, লোকটা বরাবর ধড়িবাজ। ব্যবসাতে ফতুর হয়ে গিয়েছিল। শুনেছি, ব্যাঙ্কলোন নিয়ে ফিশারির কারবারে নেমেছিল। সেই লোন এখনও শোধ হয়নি। তবে আমার একটা সন্দেহ আছে।

কী সন্দেহ?

সন্ধ্যানীড়ের আবাসিকদের প্রত্যেকের কাছে গোপনে সম্ভবত এমন কোনও দলিল রেজেস্ট্রি করে নিয়েছে, যাতে তাদের মৃত্যু হলে তাদের সব সম্পত্তির মালিকানা অনাদি ভট্টাচার্যের হাতে আসবে।

এ বিষয়ে নিশ্চয় কোনও আভাস পেয়েছেন আপনি?

হেমন্তবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ম্যানেজার কেশব মুখার্জি অনাদিবাবুর ছোট শ্যালক। অনাদিবাবুর স্ত্রী বেঁচে নেই। সন্তানাদিও নেই। কেশরের জ্যাঠতুতো দাদা বসন্তবাবুর বয়স এখন প্রায় সত্তর। তিনি এই কালীতলার বাসিন্দা। তো তাঁর কাছে কথাপ্রসঙ্গে শুনেছিলুম, তার সন্ধ্যানীড়ে গিয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল। কারণ এ বয়সে তাকে দেখাশোনার লোক নেই। কিন্তু অনাদিবাবুর শর্তে রাজি হতে পারেননি। কী শর্ত, তা আমাকে খুলে বলেননি। বসন্তবাবু। শর্তটা নাকি খুব গোলমেলে। আবাসিক হতে হলে বিষয়সম্পত্তির হিসেব দিতে হবে। অনাদিবাবুর বক্তব্য ছিল, মাসে-মাসে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, তা না জেনে তিনি কারও ঝুঁকি নেবেন না। যদি আবাসিক টাকা দিতে না পারে, এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাকে তো তিনি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতে পারবেন না। বাইরের লোকেরা এসে ঝামেলা করবে। যুক্তিটা অবশ্য ঠিক।

কর্নেল হাসলেন, বিষয়সম্পত্তির হিসেব ব্যাপারটা অবশ্যই সন্দেহজনক! দেখা যাক, সন্ধ্যানীড়ে আবার গিয়ে শুভময়বাবুর কাছে এর কোনও হদিস পাই নাকি।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কান পেতে শুনছিলেন। বললেন, এ তো দেখি সাংঘাতিক ব্যবসা! কর্নেলস্যার! আমার ধারণা, অনাদিবাবুরেই গোবিন্দ বটগাছের পিছনে দেখছিল। আপনি পুলিশরে কালো দড়ির কথা।

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, ওটা যথাসময়ে পুলিশকে জানাব। আপনি ও নিয়ে ভাববেন না।

হেমন্তবাবু বললেন, হ্যাঁ। প্রবুদ্ধবাবুকে কেউ যে পরোক্ষে খুনই করেছে, তা ঠিক। কিন্তু আপনি নিজে একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। আপনি বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা জানলে পুলিশ হুলস্থুল বাধিয়ে নিজেদের যুক্তি অনুসারে ধরপাকড় করত। এতে কর্নেলসায়েব অসুবিধায় পড়তেন। কোনও নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পেতেন না। আপনিও পেতেন না। তাই না?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু দেরি করলেও পুলিশ এই ব্যাপারটা গ্রাহ্য করবে না। ভাববে, আমরা ডেলিবারেটলি কারেও ফাসাইতে চাই।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, আপনার যুক্তিটা ঠিক। তবে ওই কালো দড়িটা তাড়াহুড়ো করে কুড়িয়ে এনে আপনি একটু ভুল করেছিলেন হালদারমশাই!

ক্যান?

বরং আপনি আড়ালে ওত পেতে থাকলে কেউ দড়িটা জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে বা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে কি না দেখতে পেতেন। তারপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যেত।

হালদারমশাই চুপ করে গেলেন।

পাঁচটাতেই শীতের সন্ধ্যা কুয়াশা মেখে জাঁকিয়ে বসেছিল। সাড়ে পাঁচটায় একটা লোক এসে খবর দিল, ওসি সায়েব এসে গেছেন। আমরা নেমে গেলুম। হেমন্তবাবু বললেন, আমাকে দেখলে অনাদিবাবু খুব চটে যাবেন। আমার যাওয়ারও কোনও দরকার দেখছি না। আপনারা ফিরে এসে ডিনার খাবেন।

সন্ধ্যানীড়ে গিয়ে দেখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এক দঙ্গল সশস্ত্র পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের বারান্দায় দুজন পুলিশ অফিসার শুভময়বাবুর সঙ্গে কথা বলছেন।

কর্নেল হালদারমশাইকে চুপিচুপি বললেন, আপনি দড়িটা যেভাবে হোক, বটতলার আড়াল থেকে পাঁচিলের ওপারে ফেলে দেবেন। যেন জলে পড়ে না।

আমাদের দেখে শুভময়বাবু অবাক হয়েছিলেন। কর্নেলকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, আপনারা প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুরহস্যের সমাধান করতে পেরেছেন!

কর্নেল বললেন, না শুভময়বাবু! প্রবুদ্ধবাবুর ঘরটা আবার পুলিশ সার্চ করতে চায়। তাই আমাকে আসতে হল।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের কপাটে তালার ওপর আটকানো হ্যান্ডকাফ খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলেন। সেই সময় লক্ষ করলুম, হালদারমশাই বটতলার বেদিতে গিয়ে বসলেন। ওখানে কোনও পুলিশ নেই।

ওসি-র সঙ্গে শুধু কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। শুভময়বাবু এবং আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলুম। বাইরে প্রচণ্ড শীত। শুভময়বাবু কিছুক্ষণ পরে নিজের ঘরে ঢুকলেন। আমি তার সঙ্গে ঘরে ঢুকে বললুম, শীতে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

শুভময় বললেন, আমাদের সয়ে গেছে। আপনি আমার ঘরে বসুন। চা খাবেন কি?

আজ্ঞে না।

শুভময়ের গায়ে কালো সেকেলে আলোয়ান জড়ানো ছিল। বিছানায় মোজাপরা পাদুটো তুলে তিনি বসলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, পুলিশ আবার কেন সার্চ করতে এল জানেন?

না। হয়তো কোনও ক্লু পেয়েছে।

আমার ধারণা, কর্নেলসায়েব নিজে সার্চ করতে চেয়েছেন। বলে শুভময় কেন জানি না দেওয়ালে টাঙানো নেতাদের ছবির উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রণাম করলেন।

একটু পরে বললুম, আচ্ছা শুভময়বাবু! এই যে প্রবুদ্ধ দত্ত মারা গেলেন, এবার ওঁর ঘরের জিনিসপত্রের কী ব্যবস্থা হবে?

সবই সন্ধ্যানীড়ের মালিক অনাদি ভট্টাচার্য পাবেন। সেইমতো ডিড রেজিস্ট্রি করতে হয়েছে।

আপনাদের সবাইকে?

হ্যাঁ। শুভময়বাবু বাঁকা হাসলেন। মরে গেলে মানুষের জিনিসপত্র বা বিষয়সম্পত্তি তার কী কাজে লাগবে?

বিষয়সম্পত্তিও রেজেস্ট্রি করে দিতে হয়েছে নাকি?

না। বিষয়সম্পত্তি থাকলেও কি কেউ তা স্বীকার করে? মদনমোহন বোসের একটা বাড়ি আছে। সেটা এখন জানা যাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যানীড় শুধু সঁর ঘরের জিনিসপত্র পাবে। কেন পাবে, তার যুক্তি আছে। সেগুলোর মধ্যে বিক্রি করার মতো জিনিস থাকলে তা বিক্রি করে সন্ধ্যানীড় আবাসিকদের জন্য আরও ভালো ব্যবস্থা করতে পারবে। জয়ন্তবাবু! যারা এখানে এসেছে, তারা আত্মীয়স্বজনের মায়া বা বিষয়সম্পত্তির মায়া কাটিয়েই এসেছে।

কেউ যদি গোপনে ঘরে অনেক টাকা বা ধনরত্ন রাখেন?

শুভময় হাসলেন, অনাদিবাবু পাবেন। তবে নগদ টাকা বা ধনরত্ন নিয়ে এখানে কেউ এসেছে বলে মনে হয় না।

আপনার বাড়ি তো কলকাতায় ছিল। সেই বাড়িতে এখন কে থাকে?

প্লিজ জয়ন্তবাবু! আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।

এই সময় বারান্দায় কর্নেলকে দেখতে পেলুম। প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ করা হচ্ছিল। বেরিয়ে গিয়ে দেখি, প্রাইভেট ডিটেকটিভ দৌড়ে আসছেন। তিনি বারান্দার নীচে এসে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! কর্নেলসায়েব। আমি নেচারস কল অ্যাটেন্ড করতে ঘাটে গিছলাম। টর্চের আলোয় একটা জিনিস দেখছি। আপনারা গিয়ে দেখুন তো ওটা কী?

ব্যাপারটা টের পেলুম। কর্নেল, ওসি এবং দুজন পুলিশ অফিসার হালদারমশাইয়ের সঙ্গে ঘাটের দরজার দিকে গেলেন। নাটকীয়ভাবে কালো দড়িটা পুলিশের হাতে এতক্ষণে তুলে দেওয়া হবে।

কিছুক্ষণ পরে শুভময়বাবুর সঙ্গে ঘাটে গিয়ে দেখি, চত্বরের ফাটলের ওপর দড়িটা লম্বালম্বি টান করে ধরে আছেন দুজন পুলিশ অফিসার। কর্নেল বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! কেউ এভাবে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখেছিল।

ওসি বললেন, হ্যাঁ। কালো ফাটলের ওপর কালো দড়ি ভিকটিমের চোখে পড়েনি।…

.

০৪.

ব্যাপারটা দেখামাত্র শুভময়বাবু ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মার্ডার! ডেলিবারেট মার্ডার।

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিলেন। চুপ! শুভময়বাবু! এ নিয়ে হইচই করবেন না প্লিজ! তদন্তের অসুবিধা হবে।

শুভময়বাবু কান্না চেপে চলে গেলেন। দেখলুম, উনি নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কাছাকাছি কোনও আবাসিক ছিলেন না। প্রচণ্ড শীতে বৃদ্ধরা বাইরে বেরোতে চাননি সম্ভবত। সন্ধ্যানীড়ের ভেতর তত বেশি আলো ছিল না। কিছুটা দূরে ম্যানেজার কেশববাবু একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। অনাদিবাবুকে সন্ধ্যানীড়ে ঢোকার সময় উত্তর দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। এবার তাকে এদিকে আসতে দেখলুম।

ততক্ষণে ওসি পরেশ ব্যানার্জি কালো দড়িটা পকেটস্থ করে ফেলেছেন। তারপর কর্নেলের সঙ্গে ওঁরা সন্ধ্যানীড়ের ভেতরে ঢুকলেন। ঘাটের দরজা একজন পুলিশ অফিসার আগের মতো ভেতর থেকে আটকে দিলেন।

অনাদিবাবু এসে বললেন, ঘাটে আপনারা কী সার্চ করছিলেন।

ওসি একটু হেসে বললেন, প্রবুদ্ধবাবু খুব জোরে আছাড় খেয়ে হার্টফেল করে মারা গেছে। মর্গের এই রিপোর্ট পেয়ে জায়গাটা আবার ভালোভাবে পরীক্ষা করলুম। দেখলুম, চত্বরটা কংক্রিটের। অথচ ফাটল ধরেছে।

মেরামত করব। আসলে এই বটগাছের শেকড় এদিকের পাঁচিলও ফাটিয়ে দিয়েছে। গাছটা কাটা যাবে না। এই গাছে দেবতা আছেন। তিনি স্বপ্নে দর্শন দিয়েই তো আমাকে এখানে মানুষের সেবা করতে বলেছিলেন। আর ওই যে মন্দির দেখছেন। ওটা প্রাচীন শিবমন্দির। মন্দির সংস্কার করেছি।

কথা বলতে বলতে তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। ওসি বললেন, চলুন অনাদিবাবু! আপনার অফিসে যাই।

তা চলুন। কিন্তু প্রবুদ্ধবাবুর ঘরে যা কিছু আছে, রেজিস্টার্ড ডিড অনুসারে তা সবই আমার প্রাপ্য। ডিড দেখতে চাইলে দেখাব।

কর্নেল বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! আপনার কাজ তো শেষ। অনাদিবাবুকে প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের চাবিটা দিতে কি আপত্তি আছে?

নাহ! অপূর্ববাবু! আপনি ও ঘরের হ্যান্ডকাফ খুলে নিয়ে আসুন। আমি অফিসে গিয়ে চাবি ফেরত দিচ্ছি।

অপূর্ববাবু নামে একজন পুলিশ অফিসার প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমরা অফিসে গিয়ে ঢুকলাম। ম্যানেজার কেশবাবু বললেন, স্যারদের জন্য চা বা কফির ব্যবস্থা করি!

ওসি বললেন, থাক! আমরা বেশিক্ষণ উৎপাত করব না। আপনি ভিজিটর বুক আর আবাসিকদের রেজিস্টার বইটা দিন।

অফিসটা আধুনিক আসবাবে সাজানো। দেওয়ালে বাঁধানো অনেকগুলো গ্রুপ ফোটোগ্রাফ। সম্ভবত উদ্বোধন করেছিলেন কোনও স্থানীয় নেতা। কয়েকটি অনুষ্ঠানের ছবিও আছে।

ম্যানেজার একটা বেঁটে এবং একটা লম্বা বাঁধানো রেজিস্টার বই বের করে দিলেন র‍্যাক থেকে। ওসি বললেন, অনাদিবাবু। আপাতত এই রেজিস্টার দুটো সিজ করলুম। তদন্তের শেষে ফেরত পাবেন। আর যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়– বলে তিনি হেসে উঠলেন।

অনাদিবাবু বললেন, কী আশ্চর্য! একটা অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে আপনারা এই বৃদ্ধদের ওপর কেন জুলুম করছেন বুঝি না।

জুলুম নয় অনাদিবাবু! আইনের কাজ আইন করবে।

কিছু বুঝি না। নিছক একটা দুর্ঘটনাকে কি আপনারা মার্ডার বলে চালাবেন? আমাদের নিজস্ব ডাক্তার আছেন। তিনি একজন এম বি বি এস। তার ডেথ সার্টিফিকেটের কোনও মূল্য নেই?

ওসি তাঁর কথায় কান দিলেন না। একজন পুলিশ অফিসারকে বললেন, আপনি সিজারলিস্ট তৈরি করে ফেলুন। ম্যানেজারবাবু! আপনি সাক্ষী হিসাবে সই করে দেবেন। অনাদিবাবু! প্রবুদ্ধবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের পাসবই এবং চেকবইও আমরা সিজ করলুম।

অনাদি ভট্টাচার্য উত্তেজিতভাবে বললেন, রেজিস্টার্ড ডিড অনুসারে ওই টাকাকড়ি সন্ধ্যানীড়ের প্রাপ্য।

সে আপনি কোর্টে গিয়ে বুঝে নেবেন। বলে ওসি কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আপনি আবাসিকদের ছবির কথা বলছিলেন। এই রেজিস্টারে দেখছি, ওঁদের পাসপোর্ট সাইজ ছবি আঁটা আছে।

ম্যানেজার বললেন, আবাসিকদের প্রত্যেকের আইডেন্টিটি কার্ড আছে স্যার। এসব ছবি তারই কপি।

বাঃ। আপনাদের ব্যবস্থা একেবারে নিখুঁত।

অনাদিবাবু বললেন, কর্মচারীদেরও আইডেন্টিটি কার্ড আছে ছবিসহ। এই রেজিস্টারে তাও পেয়ে যাবেন। কেউ গুণ্ডা বা দাগি ক্রিমিন্যাল কি না আপনাদের রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন। দুজন করে বিশিষ্ট ব্যক্তির রেফারেন্স ছাড়া এখানে কাউকেও থাকতে দেওয়া হয় না। আমি দেখাচ্ছি, প্রবুদ্ধ দত্তের রেফারি কারা। একজন মিনিস্টার এবং একজন ডেপুটি সেক্রেটারি ব্যাঙ্কের অফিসার ওঁর আবেদনপত্রে সই করেছিলেন। তাঁদের নাম রেজিস্টারে আছে। কেশব! তুমি ওই ফাইলটা ওসি সায়েবকে দেখাও। ইচ্ছে করলে উনি ওটাও সিজ করতে পারেন।

ম্যানেজার একটা ফাইল দিলেন। ওসি ফাইল খুলে পাতা উল্টে বললেন, এটাও আমাদের দরকার।

অনাদিবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, যা ইচ্ছে করুন। জোর যার মুলুক তার। তবে আমারও বিগ-বিগ গার্জেন আছে। মাইন্ড দ্যাট।

কর্নেল বললেন, প্লিজ অনাদিবাবু! আপনার এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই এসব কাজ পুলিশ করছে। আপনি কি চান কোনও ফেরারি অপরাধী এখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকুক?

অনাদি ভট্টাচার্য চমকে উঠে কর্নেলদের দিকে তাকালেন, কী বলছেন আপনি?

কিছু অসম্ভব নয় অনাদিবাবু! আপনার এই সুন্দর বৃদ্ধাশ্রমের কোনও ক্ষতি হোক, এটা আমরা চাই না। এ একটা মহৎ কাজ। আপনার কাজের প্রশংসা অবশ্যই করা উচিত।

অনাদিবাবু এবার একটু শান্ত হলেন। আস্তে বললেন, সবই ঠাকুরের ইচ্ছে। আর কী বলব বলুন?

প্রায় আধঘণ্টা পরে আমরা সন্ধ্যানীড় থেকে বেরিয়ে এলুম। আসার সময় আলো-আঁধারে রহস্যময় মনে হচ্ছিল সন্ধ্যানীড়কে। হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল প্রবুদ্ধ দত্তের চিঠিতে লেখা এক মূর্তিমান শয়তান-এর কথা। গা ছমছম করে উঠেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। কে সেই মূর্তিমান শয়তান? যাঁদের দেখেছি, তারা সবাই বৃদ্ধ। কেউ কেউ স্বাস্থ্যবানও বটে! অনেকেরই গোঁফ বা দাড়ি সাদা। এক বৃদ্ধকে দুপুরে দেখেছিলুম, এই শীতে টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা জলে দিব্যি স্নান করছেন। তার চেহারা কতকটা গরিলার মতো। মূর্তিমান শয়তানের সঙ্গে তাঁকে মেলাতে গিয়ে মনে পড়ল, তিনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। একটা পায়ের পাতা একটু ওল্টানো না! এমন লোক মূর্তিমান শয়তান হতে পারে না।

মিঃ ব্যানার্জির জিপ আগে, তার পিছনে আমার গাড়ি, আমার পিছনে পুলিশ ভ্যান। রাতের দিকে হাইওয়েতে বিরাট সব ট্রাক চলাচল করছিল। কালীতলা পৌঁছুতে মিনিট পঁচিশ লাগল। কর্নেলের নির্দেশে ওসির জিপ অনুসরণ করে থানায় পৌঁছুলুম।

ওসি পরেশ ব্যানার্জির ঘরে কর্নেল, হালদারমশাই এবং আমি বসলুম। দুজন অফিসার সিজকরা খাতাপত্র দিয়ে গেলেন। একটু পরে কফি এল। মিঃ ব্যানার্জি একটু হেসে বললেন, আপনাকে বলতে ভুলেছি। বিকেলে এস পি সাহেব কৃষ্ণনগর থেকে রিং করেছিলেন। আপনার কথা বললেন। আপনাকে যেন কো-অপারেট করি। এই সঙ্গে আপনার প্রকৃত পরিচয়ও দিলেন।

কর্নেল বললেন, হেমন্তবাবুকে বলেছিলুম এস পি-কে যেন আমার কথা জানান। এস পি রূপক সিংহ আমার বিশেষ পরিচিত।

যাকগে! এই নিন ভিজিটর বুক। কী দেখতে চেয়েছিলেন, দেখে নিন।

কর্নেলের পাশে বসেছিলুম। ভিজিটরস্ বুকে তত বেশি এন্ট্রি নেই। কর্নেল পাতা উল্টে দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, এ মাসেই মদন বোসের কাছে। তিনদিন এসেছে অজয় ঘোষ। বোসবাবুর নাতি।

ওসি বললেন, বোসবাবু বলেছেন, তার একটা দোতলা বাড়ি আছে। বাড়িভর্তি ভাড়াটে। তাদের উচ্ছেদ করলে অধর্ম হবে।

আমাকেও বোসবাবু তা বলেছেন। তার নাতি অজয় সিনেমা করতে চায়। বাড়িটা তার নামে লিখে দিতে বলে অজয়। বোসবাবু লোকটি সরল বলে মনে হয়েছে। নাতির ঠিকানা আমাকে দিয়েছেন।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি হাসলেন। আমাকে বলছিলেন নাতিকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়।

হালদারমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর কাছেও লোক আসতেন দেখছি। তিনি পাতা উল্টে দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, একই লোক। ননীগোপাল চৌধুরী। ঠিকানা দেখছি কলকাতার। রিলেশন কলামে লেখা আছে মাসতুতো বা পিসতুতো বা খুড়তুতো ভাই। ইংরেজিতে কাজিন ব্রাদার লিখেছেন ননীবাবু। শেষবার এসেছেন গত সপ্তাহে সোমবার। এঁর ঠিকানাটা আমি নিচ্ছি। কর্নেল তার ছোট নোটবুক বের করে ঠিকানা টুকে নিলেন। তারপর বললেন, মিঃ ব্যানার্জি সম্ভব হলে আজ রাতেই ননীবাবুকে খবর দিয়ে প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি দাহের ব্যবস্থা করবেন।

বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলুম। কিন্তু কর্নেলের পাল্লায় পড়ে এমন কতবার হয়েছে। তবু এ তো একটা ঘর। পাহাড়-পর্বত-জঙ্গলে কর্নেলের বিরল প্রজাতির পাখি-প্রজাপতি-অর্কিড-পরগাছা অনুসন্ধানের সময় যে কষ্ট পেয়েছি, তা কহতব্য নয়।

কিছুক্ষণ পরে আবাসিকদের রেজিস্টার বই নিয়ে পড়লেন কর্নেল। প্রবুদ্ধবাবু ছাড়া এখন আটজন আবাসিক আছেন। তাদের পূর্ব-ঠিকানা টুকে নেওয়ার পর বললেন, এঁদের ছবিগুলো আমি ক্যামেরাবন্দি করতে চাই মিঃ ব্যানার্জি।

ওসি একটু হেসে বললেন, করুন। কিন্তু ছবি কি ক্যামেরায় এভাবে আসবে?

আসবে। ফ্ল্যাশবাই যথেষ্ট। তাছাড়া আমার ক্যামেরাটা বিশেষ ধরনের জাপানি ক্যামেরা।…

রাত সাড়ে নটায় থানা থেকে কর্নেল বেরুলেন। লক্ষ করলুম, ওসি-র কাছে তিনি একটা জীর্ণ এক্সারসাইজ খাতা চেয়ে নিয়ে রিসিট লিখে দিলেন। তারপর আবার ননীবাবুকে খবর পাঠানোর কথা ওসি-কে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ওই খাতাটাতে কী আছে?

কর্নেল বললেন, প্রবুদ্ধবাবু আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন বহু বছর আগে। কোনও কারণে শেষ করতে পারেননি। কিংবা পরে আর এ নিয়ে এগোতে চাননি।

হেমন্তবাবু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দোতলার সেই গেস্টরুমে ঢুকে এতক্ষণে বিরক্তিটা কেটে গেল। আবার একপ্রস্থ কফি খেয়ে চাঙ্গা হওয়া গেল।

হালদারমশাই বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি মফস্বলের হাসপাতালে কি আস্ত থাকবে? ননীবাবু আইতে আইতে হাসপাতালের লোকেরা কী করবে কে জানে?

হেমন্তবাবু বললেন, এখানে বরফকল আছে। বরফের অভাব নেই। এসব কেসে বডিতে বরফ চাপিয়ে রাখা হয়। কারণ, বলা যায় না, কেউ হঠাৎ এসে বডি দাবি করতে পারে। এমন কি ভিসেরা টেস্টের কথা তুলতে পারে। তাই পুলিশ রিস্ক নিতে চায় না।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি পুলিশ নষ্ট হতে দেবে না। কারণ ওসি-র কথায় বুঝেছি, উনি প্রবুদ্ধবাবুর আছাড় খেয়ে হার্টফেল করার। ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি।

হেমন্তবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমি জানি, পুলিশ আপনাকে তাদের হাতের কার্ড দেখাবে না এবং আপনিও আপনার হাতের কার্ড পুলিশকে দেখাবেন না।

কর্নেলও হাসলেন। এখনও কোনও কার্ড আমার হাতে নেই। তবে খুলে বলতে অসুবিধে নেই, প্রবুদ্ধ দত্ত যে মিনিস্টার এবং ডেপুটি সেক্রেটারির রেফারেন্সে সন্ধ্যানীড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, শুভময় রায়ও তাঁদেরই রেফারেন্সে ঢুকেছিলেন। তাছাড়া সময়ের ব্যবধান মাত্র দুসপ্তাহের। প্রথমে প্রবুদ্ধবাবু, তারপর শুভময়বাবু। কিন্তু না–আমি শুভময়বাবুকে সন্দেহের তালিকায় রাখিনি। দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমার ধারণা, প্রবুদ্ধবাবুর সঙ্গে শুভময়বাবুর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। পরস্পর যেন পরামর্শ করেই সন্ধ্যানীড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শুভময়বাবু কেন এ ব্যাপারটা চেপে গেলেন, এটাই আশ্চর্য।

বললুম, একজন কাঠের ব্যবসায়ী। অন্যজন স্বাধীনতা-সংগ্রামী। ওড়িশার জঙ্গলের কাঠের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আস্তে বললেন, তুমি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছ।

উৎসাহিত হয়ে বললুম, শুভময়বাবুর স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু বহু বছর পরে প্রবুদ্ধবাবু জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা করতেন। আপনি বলেছেন, এখন থেকে প্রায় দশবছর আগে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভাল করে শুনছিলেন। বললেন, কিছু বুঝলাম না জয়ন্তবাবু।

হেমন্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন। এবার আপনারা খেয়ে নিলে ভালো হয়। রাত দশটা বেজে গেছে।…

.

পরদিন সকালে উঠে দেখি, ঘন কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। তাই হেমন্তবাবু ব্রেকফাস্ট করে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর বেরুতে অনুরোধ করেছিলেন। ইতিমধ্যে কর্নেল কুয়াশার মধ্যে নদীর ধারে প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছিলেন। হালদারমশাই ততক্ষণে আমাকে প্রশ্নে জেরবার করে প্রবুদ্ধকুমার দত্তের ওড়িশার জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা এবং কর্নেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে নিয়েছিলেন।

ব্রেকফাস্ট করার পর কুয়াশা কেটে গেলে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। হেমন্তবাবু দিন দুয়েক এখানে থাকবেন। তিনি বললেন, থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্নেলকে পুলিশের তদন্ত সম্পর্কে জানাবেন।

সন্ধ্যানীড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হালদারমশাই বললেন, শুভময়বাবুর ভাগনি চন্দ্রিকার কথা ওনারে কইলে পারতাম। সুযোগ পাই নাই।

কর্নেল বললেন, একটু ধৈর্য ধরুন হালদারমশাই। এখন অজয় ঘোষ অর্থাৎ মন্টুবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা আগে দরকার। অনীশ মজুমদারের অন্তর্ধান রহস্যের সঙ্গে সন্ধ্যানীড়ের কোনও যোগাযোগ খুঁজে পাইনি। শুধু মন্টুবাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে, এটুকুই জানা গেছে।

কিছুক্ষণ পরে বললুম, গতরাতে আপনি প্রবুদ্ধবাবুর আত্মজীবনী পড়ছিলেন। তাতে কি সেই মূর্তিমান শয়তানের দেখা পেয়েছেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, হাইওয়েতে গাড়ি চলছে। একথা ভুলো না জয়ন্ত।…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। হালদারমশাই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাঁকে যষ্ঠীচরণের তৈরি প্রকৃত কফি পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

ষষ্ঠীচরণ কফি পরিবেশন করে পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করল। তারপর বলল, কাল রাত্তিরে আর আজ সকালে ফোন এসেছিল বাবুমশাই। কাল যে মেয়েটি এসেছিল, তার ফোন নম্বর লিখে নিয়েছি। চ-চন্দ্র–না কি যেন নামটা?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, নিজের লেখা নিজেই পড়তে পারছিস না হতভাগা?

হালদারমশাই ষষ্ঠীর হাত থেকে কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বললেন, আমার ক্লায়েন্ট চন্দ্রিকা মজুমদার।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার মক্কেল যখন আমাকে ফোন করেছিল তখন ফোন করার ফার্স্ট প্ৰোরেন্স আমারই।

গোয়েন্দাপ্রবর খিকখিক করে হেসে বললেন, ঠিক কইছেন।

কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন, আমি চন্দ্রিকার সঙ্গে কথা বলতে চাই।… চন্দ্রিকা? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… হ্যাঁ। বাইরে গিয়েছিলুম। এইমাত্র ফিরে… হ্যাঁ। মিঃ হালদারও আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। বলো!… ফোনে বলা যাবে না? বেশ তো! তুমি চলে এস।… হা চলে এস।

হালদারমশাই বললেন, আমারেও খুঁজছিল নাকি?

হ্যাঁ। দেখলেন তো! আমি জাদুমন্তর জানি বলেই আপনাকে এক কাপ কফি খেয়ে যেতে বললুম।

বলে কর্নেল কফি শেষ করে পোশাক বদলাতে এবং কিটব্যাগ রাখতে ভেতরে গেলেন। হালদারমশাই বললেন, ফোনে কওয়া যাইবে না কী এমন কথা? তিনি উত্তেজনার চাপে যথারীতি নস্যি নিলেন। তারপর চোয়াল আঁটো করে দাঁতে দাঁত ঘষতে শুরু করলেন। এর ফলে তার গোঁফের ডগা তিরতির করে কঁপতে থাকল।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন এবং চুরুট ধরালেন।

প্রতীক্ষা ব্যাপারটা সত্যি অসহনীয়। মনস্তাত্ত্বিক কার্ল গুস্টাভ ঘুংয়ের লেখায় পড়েছিলুম, শয়তান যখন কাকেও শাস্তি দিতে চায়, তখন তাকে আসছি বলে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে যায়।

বেলেঘাটা এলাকা থেকে ইলিয়ট রোড তত বেশি দূর নয়। কিন্তু শীতের ঝকঝকে রোদ্দুরে কলকাতার সব গাড়ি যেন পথে নেমেছে দেখে এসেছি।

প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে চন্দ্রিকা মজুমদার এল। আজ তার চেহারা কালকের বিপরীত। রাতে সম্ভবত ঘুম হয়নি। চোখের তলায় কালচে ছোপ লক্ষ করলুম। সোফায় বসে ঠোঁট কামড়ে ধরে রইল কিছুক্ষণ। কর্নেল বললেন, বলো চন্দ্রিকা।

চন্দ্রিকা জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না অনীশ এমন সাংঘাতিক কিছু করেছে।

কী করেছে অনীশ?

মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনের ইয়ার এন্ডিং ইন্টারন্যাল অডিট হয় জানুয়ারি মাসে। অডিট শেষ হতে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগে। অডিটে ধরা পড়েছে, দুবাইয়ে পাঠানো কোম্পানির দুটো কনসাইনমেন্টের মোট বারো লক্ষ টাকা সেলস ডিপার্টমেন্টের কম্পিউটারে কারচুপি করা হয়েছে। দুবাইয়ের কোম্পানি মালের দাম বোম্বের একটা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দিত। কিন্তু এই দুটো কনসাইনমেন্টের দাম ব্যাঙ্কচেকে পেমেন্টের কথা ছিল না। বোম্বেতে মহাবীর কোম্পানির ব্রাঞ্চ অফিসে নগদ মার্কিন ডলারে গোপনে পেমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অনীশ কোম্পানির হেড অফিসের বিশ্বস্ত লোক। গত মাসে সে নাকি সত্যি বোম্বে গিয়ে নগদ ডলারে পেমেন্ট নিয়েছিল। মালিকের সেইমতো নির্দেশ ছিল। অথরাইজেশন লেটারও দেওয়া হয়েছিল অনীশকে। অনীশ আগেই কম্পিউটারে ওই টাকার কারচুপি করে রেখেছিল। মালিক তাকে বিশ্বাস করেন। এরকম গোপন ক্যাশ পেমেন্ট কতবার হয়েছে কোম্পানিতে। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করা হয় এভাবে। কোম্পানির ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে এর হিসেব থাকে না। থাকে পার্সোনাল কম্পিউটারে। কাজেই মালিক কম্পিউটার চেক করে অনীশের। রেজিগনেশন লেটার অ্যাকসেপ্ট করেছিলেন।

হ্যাঁ তারপর।

চন্দ্রিকা বলল, তারপর আর কী? কোম্পানি এই গোপন পেমেন্টের কথা। তো পুলিশকে ফাস করতে পারে না। অন্য একটা মিথ্যা প্রতারণা কেস সাজিয়ে পুলিশকে জানিয়েছে। আমি কাল রবিবার এখান থেকে বাড়ি ফেরার একটু পরে অনীশের এক কলিগ জ্যোতির্ময় সেন হাজির। সে আমাকে সব ঘটনা জানাল। বলল, তৈরি থেকো। যে-কোনও সময় পুলিশ অনীশের খোঁজে আসবে। তখন তাকে অনীশের গা-ঢাকা দেওয়ার ঘটনা জানালুম। পুলিশের কাছে আমি গেছি এবং পুলিশ তখন কিছু করেনি। আমার কথা গ্রাহ্যই করেনি। জ্যোতির্ময়কে বলেছি, অনীশের খোঁজে আমি বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করেছি। এমন কি আপনার সাহায্য নিতে আসার কথাও বলেছি।

গোয়েন্দাপ্রবর বলে উঠলেন, পুলিশ আপনারে হ্যারাস করতে পারবে না।

কর্নেল বললেন, পুলিশ কি এসেছিল অনীশের খোঁজে?

গত রাতে এসেছিল। তখন নটা বাজে। ঘর তন্নতন্ন সার্চ করল। তারপর আমি সব কথা বললুম। শুনে একজন অফিসার বললেন, আপনার ব্যাপারটা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। তবে অনীশবাবু যেখানেই থাকুন, আমরা তাঁকে খুঁজে বের করব। আমি বললুম, আমিও তা-ই চাইছি।

তুমি কি উড়ো ফোনের কথা বলেছ?

 বলেছি।

হালদারমশাই বললেন, নাম্বারটা আমি আপনারে দিই নাই।

চন্দ্রিকা বলল, আপনি নাম্বার দেননি। কিন্তু ঠিকানা বলেছেন। আমি পুলিশকে ঠিকানা দিয়েছি।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বিরসমুখে বললেন, না বললেই পারতেন। আমার লগে পুলিশের ঝামেলা বাধার চান্স আছে।

কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! আপনি পুলিশকে এড়িয়ে থাকুন। আমার ধারণা, অনীশ যেহেতু কোম্পানির দুর্বল পয়েন্টগুলো জানে কোম্পানি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে সুবিধে করতে পারবে না। এদিকে পুলিশ যদি তাকে খুঁজে বের করতে পারে তা হলে চন্দ্রিকা যা ভাল বোঝে করবে।

চন্দ্রিকা ঠোঁট কামড়ে ধরে শুনছিল। সে বলল, আমি চোর-জোচ্চোরের সঙ্গে বাস করতে পারব না। আমার মামা ছোটবেলা থেকে আমাকে সৎ শিক্ষা দিয়েছেন। চন্দ্রিকার চোখে জল এসে গিয়েছিল। রুমালে চোখ মুছে সে ফের বলল, আমি ঠকেছি কর্নেলসায়েব! অনীশ আমার সঙ্গেও এতদিন ধরে প্রতারণা করে এসেছে।

কর্নেল বললেন, মনকে শক্ত করতে হবে চন্দ্রিকা। তোমার মানসিক শক্তি আছে, তা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। যাই হোক, বাই চান্স, তুমি কোনও সিনেমা প্রোডিউসার অজয় ঘোষকে চেনো?

চন্দ্রিকা একটু অবাক হয়েছে মনে হল আমার। সে একটু পরে বলল, তার নাম অজয় ঘোষ কি না মনে পড়ছে না। অনীশ একবার জয়শ্রী স্টুডিয়োতে তার এক ফিল্ম প্রোডিউসার বন্ধুর একটা ফিল্মের মহরতে নিয়ে গিয়েছিল। ভদ্রলোকের চেহারা মনে আছে। অভিনেতাদের চেহারা যেমন হয়। অনীশ বলেছিল, তিনি নিজেও অভিনয় করেন। এবার ফিল্ম প্রোডিউস করতে নেমেছেন।

কথাগুলো বলেই সে ভুরু কুঁচকে তাকাল কর্নেলের দিকে। বলল, আপনি কি ভাবছেন অনীশ কোম্পানির টাকা চুরি করে তার সেই বন্ধুর সঙ্গে ফিল্ম প্রোডিউস করতে চায়?

কর্নেল বললেন, আমি এ বিষয়ে সিওর নই। অন্তত এখন পর্যন্ত নই। অনীশের অন্তর্ধান রহস্য এখনও আমার কাছে একটুও স্পষ্ট হয়নি।

হালদারমশাই বললেন, অনীশ মজুমদার অন্য নামে বোম্বে গিয়ে ফিল্মওয়ার্ল্ডে ঢুকলে জানছে কেডা? মুখে দাড়ি দেখি নাই তার ছবিতে। দাড়ি রাখবে। ব্যস।

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। চোখ খুলে বললেন, হ্যাঁ। অনীশের একটা ছবি চাই।

চন্দ্রিকা বলল, মিঃ হালদারকে ওর ছবি দিয়েছি।

গোয়েন্দাপ্রবর অন্যমনস্কভাবে বললেন, ছবি আছে। কর্নেলস্যারেরে দিব ভাবছিলাম।

চন্দ্রিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি চলি। কর্নেলসায়েব! অনীশ সম্পর্কে আর আমার কোনও মোহ নেই। মিঃ হালদার! আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। পুলিশ ওকে খুঁজে বের করুক। আমি শুধু অনীশের কীর্তির কথা জানাতে চেয়েছিলুম।

বলেই সে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। হালদারমশাই কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। বললেন না। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আবার একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর তার ব্যাগের চেন খুলে একটা খাম বের করে কর্নেলকে দিলেন।

কর্নেল খাম খুলে একটা ছবি বের করলেন। রঙিন ছবিটা দেখে অবাক হয়ে গেলুম। অনীশ মজুমদারের চেহারায় সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব আছে। তুলনায় তার স্ত্রীকে তত সুন্দরী বলা চলে না। কর্নেল ছবিটা দেখার পর খামে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে তিনি বললেন, জয়শ্রী স্টুডিয়ো? গোপালবাবু আছেন?… গোপালবাবু! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… না, না। খুনখারাপি নয়। জাস্ট একটা তথ্য চাই। অজয় ঘোষ নামে কোনও সিনেমা প্রোডিউসারকে চেনেন?… হ্যাঁ। চিনবেন বৈকি। ওঁর কোম্পানির নাম কী?… মোহিনী ফিল্মস? বা! চমৎকার নাম। অজয়বাবু কি নতুন কোনও ফিল্ম… বুঝেছি! বাংলা ছবির যা অবস্থা… একটা কথা। অজয়বাবু কি অভিনয়ও করেন?… করতেন। ঠিক আছে। প্লিজ গোপালবাবু! ব্যাপারটা টপ সিক্রেট।.. হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি তো বরাবর আমাকে সাহায্য করেছেন।… আচ্ছা! ধন্যবাদ। ছাড়লুম।

রিসিভার রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললুম, তাহলে অনীশ মজুমদার ফিল্মের ফাঁদে–কিংবা অজয় ঘোষের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত কোনও হিরোইনের ফাঁদে পড়েছেন।

প্রাইভেড ডিটেকটিভ কে কে হালদারকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাই গিয়া!

কর্নেল বললেন, আপনি এবং আমি দুজনেই কিন্তু একটা রহস্যের দুই প্রান্তে আছি হালদারমশাই। আজ বিশ্রাম নিন। কাল সকাল নটায় অবশ্যই যেন আসবেন।

হালদারমশাই বেরিয়ে গেলেন। তার একটু পরে আমি বললুম, আমিও উঠি। আজ অফিস যেতেই হবে। একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! তোমার কাগজের জন্য বড় একটা অন্যরকম অ্যাসাইনমেন্ট সামনে এসে গেছে।…

.

০৫.

দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় এদিন অবশ্য কোন বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না। আসলে এতসব গোলমেলে ঘটনার গোলকধাঁধা থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেলের কথা অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ড্রয়িংরুমের ডিভানে ভাতঘুম দিতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু কর্নেল বললেন, আধঘণ্টা পরে আমরা বেরুব।

বেলা দেড়টায় কর্নেলের সঙ্গে বেরুতে হল। রাস্তায় পৌঁছে বললুম, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

কর্নেল বললেন, টালিগঞ্জে।

 তার মানে জয়শ্রী সিনে স্টুডিয়োর ম্যানেজার গোপাল কুণ্ডুর কাছে?

হ্যাঁ। তুমি তো জানো, অন্তত তিনটে কেসে গোপালবাবু আমাকে কত সাহায্য করেছেন। তবে এই কেসে কতটা সাহায্য পাব জানি না। তবু একটা চেষ্টা।…

জয়শ্রী স্টুডিয়োর অফিসঘরে গোপালবাবু অভ্যাসমতো দুহাতে কাপ ধরে চা পান করছিলেন। আমাদের দেখে সহাস্যে বললেন, আসতে আজ্ঞা হোক! তখন আপনার টেলিফোন পেয়েই বুঝতে পেরেছি, আবার ফিল্ম লাইনের কেউ ঝামেলা পাকিয়েছে।

তিনি ক্যান্টিন থেকে একটি লোককে আমাদের জন্য চা আনতে বললেন। তাঁর ঘরটি ছোট। আর কেউ ছিল না। কবেকার জীর্ণ সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর নড়বড়ে চেয়ার ঘরের দেওয়ালে হিরো-হিরোইনের কয়েকটা কাউতাউট আঁটা আছে। নির্মীয়মান দুটি ছবির পোস্টারও দেখতে পেলুম। একটা ছবির নাম বিধবার কান্না। অন্যটার নাম মায়ের ছেলে। আমি পোস্টার দুটি দেখছি লক্ষ করে গোপালবাবু ফিক করে হাসলেন। বললেন, আজকাল বাংলা ছবি এই লাইনে চলেছে। বেলাইনের পয়সাওয়ালা লোকজন বেনোজলের মতো ঢুকে পড়েছে। তাতে অবশ্য আমাদের স্টুডিয়োর দৈন্যদশা কিছুটা ঘুচেছে।

কর্নেল বললেন, অজয় ঘোষের কি ছবি হচ্ছে গোপালবাবু?

হচ্ছে না। হবে। তবে এবার জয়শ্রীকে একটুখানি ছুঁয়ে উনি বলিউড যাত্রা করবেন। ছিলেন অভিনেতা। হবেন প্রযোজক-পরিচালক-কাহিনীকার-চিত্রনাট্যকার সবকিছুই। গতবছর একটা বাংলা ছবি করে ফেঁসে গেছেন। এবার হিন্দি ছবি এবং বোম্বের হিরো। হিরোইন এখানকার।

কী নাম?

নীলা রায়। মন্টুবাবুর হিন্দি ছবির নামটাও শুনুন। প্যার কি দরিয়া। প্রেমে হাবুডুবু খাবে দর্শকরা। তবে আরব সাগরেই ডোবাবেন শেষপর্যন্ত।

গোপাল কুণ্ডু আমুদে মানুষ। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে অস্থির হলেন। কর্নেল বললেন, অজয়বাবু কি মন্টুবাবু নামে এখানে পরিচিত?

হ্যাঁ। বলে কণ্ঠস্বর চাপা করলেন, কেসটা কী?

তত সিরিয়াস কিছু না। স্টুডিয়োতে কি ওঁর অফিস আছে?

ছিল। এখন নেই। তবে মাঝেমাঝে আসেন। শনিবার এসেছিলেন দুপুরবেলায়। আজ আসেননি।

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে অনীশ মজুমদারের ছবিটা বের করে ওঁকে দেখালেন। একে চেনেন?

গোপালবাবু ছবিটা দেখতে দেখতে বললেন, দেখেছি সম্ভবত। ঠিক স্মরণে হচ্ছে না। কে ইনি?

এর নাম অনীশ মজুমদার। আমার ধারণা, ইনি অজয়বাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মন্টু ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো একগাদা লোক। শনিবার দেখলুম, এক শিখ ভদ্রলোক ওঁর সঙ্গে এসেছেন। মাড়োয়ারি, তামিল, মারাঠি-মন্টুবাবুর বন্ধুর শেষ নেই। আসলে মন্টু ঘোষ লোকটি মহা ধূর্ত। ফিল্মে চান্স দেবার নাম করে কতজনকে ঠকিয়েছে, তা আমি জানি। ওর এখন প্রায় কোটি টাকা দরকার। আমি জানি না, ঠকবাজি করে অত টাকা যোগাড় করতে পারবে কি না। খুলেই বলি আপনাকে। নীলা রায় ওর টোপ।

নীলা কোথায় থাকে?

নাকতলা এরিয়ায়। ঠিকানা চাইলে দিতে পারি। কিন্তু প্লিজ কর্নেল আমার কাছে ঠিকানা পেয়েছেন ভুলেও বলবেন না।

নাহ্! নীলা কি বিবাহিত?

গোপালবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, শোনা কথা। একজন গোবেচারা লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তাকে ডিভোর্স করে ফিল্ম লাইনে এসেছে। মন্টু ঘোষ ওর গার্জেন।

মন্টুবাবুর ফ্যামিলি নেই?

আছেন। থাকলে কী হবে?

এতক্ষণে চা এল! গোপালবাবু বললেন, তপন! আজ স্টুডিয়োতে মন্টু ঘোষকে দেখেছিস?

তপন নামে যে তরুণ চা এনেছিল, সে বলল, দেখিনি ম্যানেজারবাবু!

 ঠিক আছে তুই বেরো! কর্নেলসায়েব! জয়ন্তবাবু! চায়ের জন্য আমাকে দোষ দেবেন না। এটাই আমাদের ক্যান্টিনের স্পেশাল চা। সিনেমার রথীমহারথীরা এই চা খান। অবশ্য আনমনে খান।

চা খেতে খেতে গোপালবাবু কর্নেলকে একটা স্লিপে নীলা রায়ের ঠিকানা আর প্রাইভেট ফোন নাম্বার লিখে দিলেন। কর্নেল বললেন, এবার আপনাকে একটু আভাস দিই। যার ফটো দেখালুম, তার নাম অনীশ মজুমদার। মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনের সেলস এক্সিকিউটিভ ছিল। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে সে। নিখোঁজ। ওদিকে কোম্পানি এতদিনে জানতে পেরেছে, অনীশ বারো লাখ টাকা তছরুপ করেছে। সেই অনীশের সঙ্গে মন্টু ঘোষের সম্পর্ক আছে।

গোপালবাবু নড়ে বসলেন। ক্লিয়ার! অনীশবাবুর যা চেহারা দেখলুম, মন্টু ঘোষ তাকে ফিল্মে নামার টোপ গিলিয়ে টাকাটা হাতিয়েছে।

অনীশ মজুমদার এখনও নিখোঁজ। পুলিশ তাকে খুঁজছে।

আমি বলছি অনীশ মজুমদার নীলার প্রেমে পড়ে কাণ্ডটি বাধিয়েছে। তবে মন্টু ঘোষ মহা ধড়িবাজ। পুলিশের উঁচুতলায় তার যোগাযোগ আছে। কাজেই অনীশ মজুমদার নিখোঁজই থেকে যাবে। বলিউডে নতুন নামে প্যার কি দরিয়া ফিল্মে একটা সাইডরোল পাবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, দেখা যাক। তবে আপাতত মন্টু ঘোষের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। তার বাড়ির ঠিকানা জানি। কিন্তু বাড়ির ফোন নাম্বার জানি না।

আমি দিচ্ছি। বলে গোপালবাবু তাঁর নোটবুক থেকে ফোন নাম্বারটা জানিয়ে দিলেন।

কর্নেল নাম্বার টুকে নিয়ে বললেন, আপনি এখান থেকে রিং করে দেখুন না, মন্টবাবু বাড়িতে আছেন নাকি। থাকলে আমার নাম করে বলবেন, এই কর্নেল ভদ্রলোক একজন নেচারোলজিস্ট। নেচার বিষয়ে একটা ডকুমেন্টারি ছবি করতে চান। নির্ভরযোগ্য লোক খুঁজছেন ইত্যাদি।

গোপালবাবু রিসিভার তুলে তখনই ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন, মন্টুবাবু আছেন?… আমি জয়শ্রী স্টুডিয়ো থেকে বলছি।… বেরিয়েছেন? ও! তা কখন ফিরবেন? বলে যাননি?… আচ্ছা, ঠিক আছে।

রিসিভার রেখে গোপালবাবু বললেন, মন্টুবাবুর স্ত্রী মনে হল। ভদ্রমহিলার কথাবার্তা কর্কশ। আঁঝের সঙ্গে বললেন, বেরিয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মন্টুবাবুর লাইফস্টাইল যা, তাতে তার সহধর্মিনীর হিস্টেরিক হওয়া অসম্ভব নয়।

কর্নেল বললেন, আমরা উঠি গোপালবাবু। পরে দরকার হলে যোগাযোগ করব। বলে তিনি হঠাৎ ঘুরে বললেন, হ্যাঁ–আসল কথাটা বলতে ভুলেছি। মন্টুবাবুর কোনও ছবি পাওয়া যাবে?

গোপালবাবু টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সিনেমা পত্রিকা বের করে দিলেন। বললেন, এতে মন্টু ঘোষ, নীলা রায় সকলের ছবি পাবেন।…

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, এবার কি নীলা রায়ের বাড়ি যাবেন?

কর্নেল হাসলেন। নাহ্। ফিল্মের হিরোইন এই বুড়োকে পাত্তা দেবে না। অবশ্য তোমার কথা আলাদা। তাছাড়া তুমি খবরের কাগজের রিপোর্টার।

নায়িকাদের ন্যাকা ন্যাকা কথা অসহ্য লাগে।

 ঠিক আছে। তাহলে বাগবাজারে চলো।

 সর্বনাশ! পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ট্রাফিকের অবস্থা দেখছেন?

কর্নেল আস্তে বললেন, শুভময়বাবুর ছেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ছেলের নাম জানেন কি?

জানি না। তবে শুভময়বাবুর ঠিকানা পেয়েছি সন্ধ্যানীড়ের রেজিস্টারে। ঠিকানা যে ভুয়ো নয়, তার প্রমাণ চন্দ্রিকার মুখে শুনেছি, সে বাগবাজারে মামার বাড়িতে বড় হয়েছে।

বাগবাজারে পৌঁছতে সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিল। তারপর ঠিকানা খুঁজতে আরও আধঘণ্টা। একটা আঁকাবাঁকা গলির ভেতর দোতলা বাড়ি। নীচে একটা ঘরে ওষুধের দোকান। অন্য ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে তিনজন ভদ্রলোক আড্ডা দিচ্ছিলেন। কর্নেলকে দেখে তারা চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, এটা কি শুভময় রায়ের বাড়ি?

একজনের চেহারায় শুভময়বাবুর ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, হ্যাঁ। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

কর্নেল বললেন, পার্কসার্কাস থেকে। শুভময়বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। এখানে একটা কাজে এসেছিলুম। ভাবলুম ওঁকে দেখা করে যাই।

ভদ্রলোক বললেন, বাবা তো নেই! মানে এখানে থাকেন না।

তাই বুঝি? তো আপনি কি ওঁর—

মানে, উনি আমার বাবা।

অন্য দুজন ভদ্রলোক হেসে উঠলেন। একজন বললেন, হিরন্ময়! তোমার সত্যি মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। কী প্রশ্নের কীভাবে জবাব!

হিরন্ময়বাবু বললেন, আসলে আমার বাবা একজন ফ্রিডম-ফাইটার। খেয়ালি মানুষ।

কর্নেল বললেন, জানি। উনি আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন।

বলে কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। হিরন্ময়বাবু পড়ে দেখে বললেন, আপনি রিটায়ার্ড কর্নেল?

দুজন ভদ্রলোকই বললেন, বসুন! বসুন! হিরন্ময়! আমরা উঠি। তোমরা কথা বল।

ওঁরা চলে গেলে হিরন্ময়বাবু বললেন, হ্যাঁ, বসুন! বাবা তো নিজের খেয়ালে কবে চলে গেছেন। আমার পিসতুতো বোন থাকে বেলেঘাটায়। সে জানিয়েছিল, বাবা কোন বৃদ্ধাশ্রমে আছেন।

আমরা বসলুম। কর্নেল বললেন, সে কী! আপনি ওঁকে বাধা দেননি?

বাবা কি মানতেন? তাছাড়া এ পাড়ায় থাকতেন এক ভদ্রলোক। বাবার বয়সী। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। আমার ধারণা, উনিই বাবাকে তার সঙ্গী করেছিলেন।

আপনি কি প্রবুদ্ধকুমার দত্তের কথা বলছেন?

হিরন্ময়বাবু অবাক হয়ে বললেন, ওঁকে আপনি চিনতেন? আমি বলতুম দত্তজেঠু। দত্তজেঠুও ফ্রিডম-ফাইটার ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা করতেন।

জানি। ওড়িশার জঙ্গলে কাঠের কন্ট্রাকটর ছিলেন।

দত্তজেঠু জঙ্গলের গল্প শোনাতেন আমার ছেলেমেয়েকে। খুব অমায়িক মানুষ ছিলেন। আমার বাবার একেবারে উল্টো চরিত্রের লোক। বাবা চলে যাবার পর আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলুম। পরে সন্দেহ হয়েছিল, দত্তজেঠুর পরামর্শেই হয়তো সন্ন্যাসী হয়ে কোন আশ্রমে গেছেন।

প্রবুদ্ধবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ওড়িশার জঙ্গলে।

তাই বুঝি? এখানে উনি একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। মাথায় একটু গণ্ডগোল ছিল। মানে–পরে হয়েছিল। একা থাকতেন। বিয়ে করেননি। মাঝেমাঝে আমাকে চুপিচুপি বলতেন, ১৯৪২ সালের অগাস্ট আন্দোলনের সময় উনি কোথায় ট্রেজারি লুঠ করে অনেক জুয়েলস পেয়েছিলেন। সেগুলো তিনি। লুকিয়ে রেখেছেন। আমি বলতুম, দেখান না সেগুলো! দত্তজেঠু বলতেন, সেগুলি কি এখানে আছে। সারাণ্ডা জঙ্গলে পাহাড়ি গুহায় পুঁতে রেখে এসেছি। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আনতে যাব।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তারপর?

বাবাকে কথাটা বলেছিলুম। বাবা বলেছিলেন, তোমার দত্তজেঠু একজন বদ্ধ পাগল। তারপর একদিন গিয়ে দেখি, উনি উধাও। বাড়িওয়ালা বলেছিলেন, কোথায় গেছেন বলে যাননি। তার মাসতিনেক পরে বাড়িতে একটুখানি ঝগড়াঝাটি হয়েছিল। সেই রাতে বাবাও নিখোঁজ হয়ে গেলেন। ওপরে বাবার ঘরে দেশনেতাদের অনেক ছবি ছিল। সেগুলোও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা টের পাইনি।

প্রবুদ্ধবাবুর এক আত্মীয় ছিলেন। ননীগোপাল চৌধুরী। তাঁকে চেনেন?

না তো। কোথায় থাকেন ভদ্রলোক?

আগে থাকতেন ভবানীপুরে।

আমি তেমন কাকেও চিনি না বলে হিরন্ময়বাবু উঠে দাঁড়ালেন, চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।

ধন্যবাদ! একটু আগে আমরা চা খেয়েই বেরিয়েছি। উঠি তাহলে। আমার দুর্ভাগ্য, আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হল না।…

রাস্তায় যেতে যেতে বললুম, প্রবুদ্ধবাবু ফ্রিডম-ফাইটার ছিলেন!

কর্নেল বললেন, ওঁর আত্মজীবনীতে সে কথা আছে। ওঁর বয়স তখন মাত্র আঠারো বছর ছিল।

ট্রেজারি লুঠ এবং জুয়েলসের ব্যাপারটা কি আছে?

আছে। তবে সোজাসুজি লেখেননি। আভাস দিয়েছেন। হিরন্ময়বাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, কথাটা সত্যি হতেও পারে। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, চলো! বেলেঘাটা যাব। চন্দ্রিকার সঙ্গে দেখা করা দরকার।

কর্নেলের পাল্লায় পড়ে পাহাড়-জঙ্গলে কতদূর ঘুরে বেড়িয়েছি। এ তো কলকাতা! কিন্তু একইরকম দুর্গমতা। বেলেঘাটায় পূর্বাচল নামে ফ্ল্যাটবাড়িটা খুঁজে বের করতে অসুবিধা হল না। ছতলা বাড়ি। লিফট আছে। বাড়িটার তলায় কারপার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে দিল, থার্ড ফ্লোর। ফ্ল্যাট নম্বর নাইন। মেমসাব আছেন।

অটোমেটিক লিফটে উঠে থার্ড ফ্লোরে নামলুম। করিডরে একটুখানি এগিয়ে ৯ নম্বর ফ্ল্যাট। পেতলের ফলকে লেখা আছে : মিসেস সি মজুমদার। তার তলায় মিঃ এ মজুমদার। ডোরবেলের সুইচ টিপলে মিঠে পিয়ানোর বাজনা বাজল। তারপর দরজার আইহোলে একটা চোখ এবং তারপর দরজা খুলে গেল। মজবুত চেন আটকানো ছিল। সেটা খুলে চন্দ্রিকা শুধু বলল, আসুন।

আধুনিক আসবাব এবং কেতায় সাজানো বসার ঘর। মেঝেয় কার্পেট। আমরা বসলে চন্দ্রিকা বলল, একটু আগে আপনাকে রিং করেছিলুম। শুনলুম, আপনি বেরিয়েছেন। ফোনে মিঃ হালদারকেও পেলুম না।

কর্নেল বললেন, নতুন কিছু কি ঘটেছে?

চন্দ্রিকা শ্বাস ছেড়ে বলল, আজ বিকেল চারটেতে অনীশ টেলিফোন করেছিল।

ভালো। কী বলল সে?

বোম্বে থেকে ফোন করছে বলল। তারপর অদ্ভুত একটা কথা বলল। কোম্পানির এইসব গোপন ক্যাশ ট্রানজ্যাকশন বেআইনি এবং এর সঙ্গে তাকে। জড়ানোতে তার রিস্ক ছিল। তাই কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সঙ্গে তার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। ক্যাশ ট্রানজাকশনের টুপার্সেন্ট তাকে দিতে হবে। কিন্তু এতদিন সে এক পয়সাও পায়নি। দেব-দিচ্ছি করে কোম্পানি তাকে ঠকাচ্ছিল। তাই তার মোট পাওনা বারো লাখ টাকা সে নিয়েছে। কলকাতায় তার এক বন্ধুর সাহায্যে ডলার ভাঙানোর চেষ্টা করছিল এতদিন। কিন্তু তার বন্ধু–

মন্টুবাবু?

নাম বলেনি। বলল, তার সেই বন্ধু কমিশনে ডলার ভাঙিয়ে দেবার ছলে পুরো টাকা আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। টের পেয়ে অনীশ বোম্বে চলে গেছে। তার কোম্পানির ব্রাঞ্চ অফিসের এক কলিগের সঙ্গে দৈবাৎ দেখা হয়ে সে জানতে পেরেছে, তার নামে প্রতারণার মামলা করেছে কোম্পানি। কিন্তু তার হাতে এমন সব ডকুমেন্টস আছে, উল্টে কোম্পানিই ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনে বিপদে পড়বে। তাই বোম্বে ব্রাঞ্চের সেই কলিগ কলকাতা হেড অফিসে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার কেস মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। চন্দ্রিকা দম নিয়ে বলল, অনীশ জোর দিয়ে বলল, সে কোনও অন্যায় করেনি। কেস কোম্পানি যেভাবে পারে, ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করুক। তারপর সে যথাসময়ে বাড়ি ফিরবে।

কর্নেল হাসলেন, অনীশের কথা যদি সত্যি হয়, প্রতারণার মামলা পুলিশের হাতে। এটা কগনিজি অফেন্স। পুলিশ এক্ষেত্রে আইনত কেস মেটাতে পারে না। তবে চেপে রাখতে পারে। কিন্তু তা নির্ভর করছে, পুলিশের ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের মর্জির ওপর।

বললুম, টাকা খেলে পুলিশ কেসের ফাইল উধাও করে দিতে পারে। আমি এমন অনেক ঘটনা জানি।

চন্দ্রিকা আস্তে বলল, অনীশও তাই বলল। কিন্তু এখনও তার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।

বলে সে উঠে দাঁড়াল। এক মিনিট। আপনাদের জন্য কফি তৈরি করে আনি।

সে ভেতরে চলে গেলে বললুম, তাহলে আপনার থিয়োরি টিকল না।

 কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী থিয়োরি?

আপনি হালদারমশাইকে বলছিলেন, আপনারা দুজনে একই রহস্যের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।

আছি।

কীভাবে? অনীশ মজুমদারের অন্তর্ধানের সঙ্গে প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুর সম্পর্ক কোথায়?

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, এ বিষয়ে আমি এখনও সিওর নই।

কেন?

অনীশ চাকরি ছাড়ল কেন, এটা গুরুতর প্রশ্ন জয়ন্ত! চাকরি না ছেড়েই সে ইচ্ছে করলে তার কোম্পানিকে চাপ দিয়ে–এমন কি ব্ল্যাকমেল করেও তার পাওনা আদায় করতে পারত। কাজেই অনীশের হঠাৎ চাকরি ছাড়ার কোনও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা থাকা দরকার। তা যতক্ষণ না পাচ্ছি, আমি আমার থিয়োরি থেকে সরছি না।

একটু পরে চন্দ্রিকা নিজেই ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। সে মুখোমুখি বসে আমাদের হাতে কফির কাপ-প্লেট তুলে দিয়ে বলল, আমি কোনও কাজের লোক রাখি না। নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা আমি মামার কাছে পেয়েছিলুম।

কর্নেল তার কফির প্রশংসা করে বললেন, একসময় আমিও তাই করতুম। বুঝতেই পারছ, সামরিক জীবন কীভাবে কাটাতে হয়। অবশেষে বৃদ্ধবয়সে ষষ্ঠীচরণকে পেয়েছি। আসলে আমি যখন বাড়িতে থাকি না, তখন ছাদের বাগান দেখাশোনা করার জন্য একজন নির্ভরযোগ্য লোকের দরকার হয়।

হাসতে হাসতে বললুম, বলুন, আসলে কাকতাড়ুয়ার কাজ করে ষষ্ঠী।

চন্দ্রিকা বলল, আপনার ছাদের বাগানের কথা মিঃ হালদার আমাকে বলেছেন। আমার মামা জেলে থাকার সময় ফুলের বাগান করতেন। সেই গল্প শুনে আমারও বাগান করার ইচ্ছে হত। কিন্তু কলকাতায় কোথায় বাগান করব?

কর্নেল বললেন, আচ্ছা চন্দ্রিকা, তোমার মামার বাড়ি তো বাগবাজারে ছিল। ওই এলাকায় আমার একজন বন্ধু থাকতেন। আমার চেয়ে তার বয়স অন্তত ছসাত বছর বেশি ছিল। তাতে বন্ধুতায় আটকায় না। এই যে দেখছ জয়ন্তকে। জয়ন্ত যুবক হলেও আমার বন্ধু। তো আমার বাগবাজারের সেই বন্ধুর জীবন ছিল বিচিত্র। তিনিও ফ্রিডম-ফাইটার ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত পেশা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ওড়িশার জঙ্গলে কাঠের কন্ট্রাক্টর ছিলেন। সারাণ্ডা জঙ্গলে তার সঙ্গে প্রায় দশবছর আগে আমার আলাপ হয়েছিল। তখন তিনি গঞ্জাম জেলার বহরমপুর শহরে থাকতেন। তারপর বৃদ্ধবয়সে ব্যবসা ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন। বড় অদ্ভুত সব গল্প শোনাতেন প্রবুদ্ধবাবু।

চন্দ্রিকা শুনছিল। বলল, প্রবুদ্ধবাবু? একজনকে ওই নামে চিনতুম। প্রবুদ্ধকুমার দত্ত। আমরা বলতম দত্ত জ্যাঠামশাই। উনি কিন্তু ওড়িশার জঙ্গলের গল্প শোনাতেন। মামার সঙ্গে চেনাজানা ছিল। আপনি নিশ্চয় তাঁর কথাই বলছেন?

জঙ্গলের এক পাহাড়ি গুহায় অনেক ধনরত্ন অর্থাৎ গুপ্তধন আবিষ্কারের গল্প নয় তো?

চন্দ্রিকা ব্যস্তভাবে বলে উঠল, হ্যাঁ। দত্ত জ্যাঠামশাই এই গল্প প্রায়ই বলতেন। পরে তিনি হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলেন। তার মাস তিনেক পরে মামাও চলে যান। আমার কেন যেন সন্দেহ হয়েছিল, দুজনে পরামর্শ করেই সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। তারপর মামার চিঠিতে জানলুম মামা একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন।

তাহলে প্রবুদ্ধবাবুও সেখানে আছেন সম্ভবত।

 চন্দ্রিকা ঠোঁট কামড়ে ধরে থাকার পর বলল, কর্নেলসায়েব! জীবনে সেইসব দিনই ছিল আমার সুখের দিন। মল্লিকার বিয়ের পার্টিতে না যাব, না এইসব ঝামেলায় পড়ব।

অনীশের সঙ্গে তো সেখানেই তোমার পরিচয় হয়েছিল?

 চন্দ্রিকা আনমনে বলল, হুঁ।

অনীশের বাড়ি কোথায় ছিল?

রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ে। ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। আমারই মতো। দাদার ফ্যামেলিতে থাকত। মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনে ওর প্রমোশন হলে ক্যামাক স্ট্রিটে কোম্পানি ওকে ফ্ল্যাট দিয়েছিল। তারপর আমরা বিয়ে করি। কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকার সময় অনীশ এখানে এই ফ্ল্যাটটা আমার নামে কিনেছিল।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে একটু হেসে বললেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারে আমার কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই। কারণ আমি বিয়ে করার সুযোগ পাইনি। প্রথমত, দীর্ঘ সামরিক জীবন। দ্বিতীয়ত, আমি প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পাল্লায় পড়ে–তো আমার কথা থাক। তুমি তোমার নিজের জীবনের সব কথা অনীশকে জানিয়েছিলে বলে ধরে নিতে পারি। তাই না?

চন্দ্রিকা আস্তে বলল, সেটা স্বাভাবিক।

এবং অনীশও—

 জানি না।

বিয়ের পর দুজনে তোমরা মামার বাড়ি যাতায়াত করেছিলেন নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। মাসে অন্তত একবার তো গেছিই।

তোমার দত্ত জ্যাঠামশাইয়ের আশীর্বাদ নিতে যাওনি?

গিয়েছিলুম। দত্ত জ্যাঠামশাই অনীশকেও বাচ্চা ছেলে ধরে নিয়ে জঙ্গলে ভূতের গল্প শোনাতেন।

গুপ্তধনের গল্পটা? বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।

চন্দ্রিকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, মামা বলতেন, দত্ত জ্যাঠামশাইয়ের মাথায় ছিট আছে। আমার মনে হত, দত্ত জ্যাঠামশাইয়ের মধ্যে কী একটা কমপ্লেক্স, ছিল। নিজের কীর্তিকাহিনী বা বীরত্বের গল্প করতেন। দুটো বাঘ মারার গল্প বার বার শোনাতেন। কম বয়সে ব্রিটিশ সোলজারদের সঙ্গে যুদ্ধ করার গল্প বলতেন। আমরা মজা পেতুম।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, উঠি। তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলবে। অনীশ যোগাযোগ করলে আমার নাম, ঠিকানা ফোন নম্বর দেবে। বলবে, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সাহায্য চাইলে সে পাবে।..

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, এবার কোথায় যাবেন?

কর্নেল বললেন, বাড়ি। হোম! সুইট হোম!

 কর্নেল! আপনার জলি মুড দেখলে স্বস্তি পাই!

ডার্লিং! অস্বস্তি তীব্র হলে আমি তা ভুলে থাকবার জন্য আনন্দকে আহ্বান করি।

কী সর্বনাশ! অস্বস্তি হঠাৎ তীব্র হল কেন?

না। জাস্ট আ ফান!..

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেখি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই সোফায় বসে আছেন। আমাদের দেখে তিনি বললেন, বেশিক্ষণ আই নাই। ষষ্ঠী কফি খাওয়াইয়া কইল, আর একটুখান ওয়েট করুন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, নিশ্চয় কোনও সুখবর আছে হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর চাপাস্বরে বললেন, আছে। প্রবুদ্ধবাবুর সেই রিলেটিভ ননীগোপাল চৌধুরির বাড়ি গিছলাম। কালীতলা থানা ওনারে খবর দিছিল। উনি সেখানে গিছলেন। পিসতুতো দাদার বডি দাহ করছেন কইলেন। কিন্তু তার কোনও জিনিসপত্র পান নাই। সন্ধ্যানীড়ের অনাদিবাবু ওনারে রেজিস্টার্ড ডিড দেখাইয়া দিছেন।

কিন্তু আসল খবরটা কী?

ননীবাবু কইলেন, প্রবুদ্ধবাবুর কাছে কিছু দামি জিনিস ছিল। উনি ননীবাবুরে দিবেন কইছিলেন। তাই ননীবাবু প্রায় ওনার কাছে যাইয়া সাধাসাধি করতেন। বুড়া মানুষ। কখন কী ঘটে, কওন যায় না। কিন্তু প্রবুদ্ধবাবু পরে আইতে কইতেন। এখন সেগুলি বেহাত হইয়া গেল!

কী দামি জিনিস, তা বলেননি ননীবাবু!

আমার আইডেন্টিটি কার্ড ননীবাবুরে দেখাইয়া আলাপ করছিলাম। ওনারে কইলাম, দামি জিনিসগুলি কী, তা আমারে কন। উদ্ধার করব। আমারে সাধ্যমতন ফি দেবেন। অনেক কথার পর ননীবাবু কইলেন, অষ্টখান হীরা ছিল। ননীবাবুর ওয়াইফেরে প্রবুদ্ধবাবু সেগুলি দেখাইয়া কইছিলেন, আমি মরলে তোমরাই পাইবা। তারপর উনি হঠাৎ ননীবাবুর বাড়ি ছাইড়া উধাও। মাস তিনেক আগে কনকপুরের ঠিকানা দিয়া ননীবাবুরে উনি চিঠি লিখছিলেন। কর্নেলস্যার! ক্যান ইউ ইমাজিন? এইট পিসেস অব ডায়ামন্ডস্! এবারে বেঝেন, প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুর কারণ কী?

বলে গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজনাবশে একটিপ নস্যি নিলেন।…

.

০৬.

 রাত সাড়ে নটা বাজে। ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। হালদারমশাই আর কফি খেলেন না। লক্ষ্য করলুম, তিনি গুলিগুলি চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেলের প্রতিক্রিয়া জানতে চান সম্ভবত। কিন্তু কর্নেল নির্বিকারভাবে কফি পান করছিলেন।

বললুম, কর্নেল! তাহলে প্রবুদ্ধবাবুর গুপ্তধনের গল্পটা নিছক গল্প ছিল না?

গোয়েন্দাপ্রবর আমার দিকে ঘুরে বললেন, কী কইলেন? গুপ্তধন?

আমি কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, ননীবাবু কি একথা পুলিশকে জানিয়েছেন?

না। পুলিশেরে কইলে তো প্রমাণ লাগব। প্রমাণ তো নাই। মামলা যে করবেন, তার উপায়ও নাই। প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের সব জিনিস সন্ধ্যানীড়ের নামে রেজিস্ট্রি করা আছে।

ননীবাবু কী করেন?

 স্কুলটিচার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। আমি ওনারে কইছি, চেষ্টা করব।

বললুম, আপনি কী করে প্রবুদ্ধবাবুর কথা জানতে পারলেন, ননীবাবু জিজ্ঞেস :রেননি?

হালদারমশাই হাসলেন, উনি জিগান নাই। মনের অবস্থা ভালো না। আমি নিজেই কইয়া দিছি কোথায় কী ঘটছে, তার খবর রাখতে হয়। প্রাইভেট ডিটেকটিভের এটাই কাজ। পুলিশের লগে আমাগো যোগাযোগ আছে।

বললুম, কর্নেল! আমার অবাক লাগছে! প্রবুদ্ধবাবু হীরাগুলো কেন বেচে দেননি? ওঁর চিঠি পড়ে মনে হয়েছিল, আর্থিক সচ্ছলতা নেই। অথচ আপনি বলছেন, কাঠের কারবার ওঁর একচেটিয়া ছিল। ধরা যাক, সেই ব্যবসা কোনও কারণে ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু আটখানা হীরা তাঁর ছিল। যখের ধনের যখবুড়ো বলা যায়। দা ডগ ইন দা ম্যাঞ্জার! শেষে নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনলেন ভদ্রলোক। দুর্বোধ্য ব্যাপার।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় না জয়ন্ত, প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুর রহস্যের চেয়ে অনেক বেশি জটিল তার জীবনরহস্য? তুমি দা ডগ ইন দা ম্যাঞ্জার এই বিখ্যাত গল্পের উল্লেখ করলে। ঈশপের গল্প ওটা। একটা কুকুর গরুর খাবারের পাত্রে বসে আছে। ওটা তার খাদ্য নয়। তাই ঈশপ বলেছেন, নিজে খাবে না। অথচ যার খাদ্য তাকে খেতে দেবে না। কিন্তু আমাদের এই গল্পটা একজন মানুষের। মানুষ এমন করে না। কিন্তু প্রবুদ্ধবাবু করেছেন। কেন করেছেন? এই প্রশ্নটাই গুরুত্বপূর্ণ।

হালদারমশাই ঘড়ি দেখে বললেন, আপনারা গিছলেন কোথা?

এবার কর্নেল হাসলেন, জয়ন্ত গুপ্তধনের কথা বলছিল। আমরা গুপ্তধনের খোঁজে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়িয়েছি। এদিকে আপনি আমার ঘরে গুপ্তধনের আসল ঠিকানা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, একটা কথা কর্নেলস্যার?

বলুন!

আপনি আর ওসি মিঃ ব্যানার্জি প্রবুদ্ধবাবুর ঘর সার্চ করেছেন। কিন্তু—

 কিন্তু আটখানা হীরা পাইনি। একখানা পেলেও অবশ্য কথা ছিল।

সেগুলি গেল কই? ননীবাবু অকারণে মিথ্যা কইবেন ক্যান?

আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রবুদ্ধবাবুর কাছে হীরা থাকার খবর সেই লোকটা— যাকে প্রবুদ্ধবাবু তাঁর চিঠিতে মূর্তিমান শয়তান বলেছিলেন, সে জানত। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে তাকে খুন করার রিস্ক নেয়নি। কিংবা সেও বৃদ্ধ। তাই খুন করার শক্তি তার ছিল না। তাই ঘাটে দড়ি টানটান করে বেঁধে আছাড় খাইয়েছে প্রবুদ্ধবাবুকে। সে নিশ্চয় জানত, জোরে কংক্রিটের ওপর আচমকা পড়ে গেলে প্রবুদ্ধবাবু বাঁচবেন না। শেষরাতে সে ফাঁদ পেতে রেখেছিল। তারপর ধরাশায়ী প্রবুদ্ধবাবুর পকেট থেকে ঘরের চাবি নিয়ে গিয়ে সে হীরাগুলো হাতায়।

বললুম, তাহলে নিশ্চয় সে যেভাবে তোক জানত ওগুলো কোথায় আছে।

ঠিক বলেছ। হীরাগুলো হাতিয়ে দরজায় আবার তালা এঁটে সে প্রবুদ্ধবাবুর পকেটে চাবি রেখে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তারপরে কানু প্রবুদ্ধবাবুকে চা দিতে গিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে শুভময়বাবু তার বন্ধুর ঘরের চাবি পকেট থেকে

কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলেন। বললুম, কর্নেল! শুভময়বাবু কেন ওই অবস্থায় প্রবুদ্ধবাবুর ঘরের চাবি হাতালেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এই প্রশ্নটা বারবার আমাকে জ্বালিয়ে মারছে জয়ন্ত।

হালদারমশাই বললেন, শুভময়বাবু নিশ্চয় জানতেন ওনার ঘরে ডায়মন্ড আছে।

থিয়োরিটা এই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায়।

বললুম, তাছাড়া দেখুন, ওঁরা দুজনে একই পাড়া থেকে আগে-পরে সন্ধ্যানীড়ে সাশ্রয় নিয়েছিলেন। দুজনেই এক মন্ত্রী এবং ডেপুটি সেক্রেটারির রেফারেন্স নিয়েছিলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর সিধে হয়ে বসে লম্বা তর্জনী তুললেন টেলিফোনের দিকে। এখনই কালীতলা থানার ওসি মিঃ ব্যানার্জিরে ফোন করা উচিত কর্নেলস্যার। আইজ রাত্রে পুলিশ শুভময়বাবুর ঘর সার্চ করুক।

কর্নেল তাকে হতাশ করে বললেন, কিন্তু প্রবুদ্ধবাবুর চিঠিতে লেখা সেই মূর্তিমান শয়তান তো শুভময়বাবু নন। কারণ প্রবুদ্ধবাবু আমাকে লিখেছিলেন, সম্প্রতি ওখানে তাকে আবিষ্কার করেছেন। তার মানে, গত সপ্তাহে তিনি তাকে চিনতে পেরেছেন। আশ্রমে বাস করার বহু পরে যেভাবে হোক, তার পরিচয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে আমাকে চিঠি লিখেছেন।

আমিও হতাশ হয়ে বললুম, না। অঙ্কটা জটিল হয়ে গেল।

হালদারমশাই এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, অষ্টখান হীরা! এবাজারে হয়তো কোটি টাকা দাম। যে হাতাইছে, সে নিজের ঘরে বেশিদিন রাখার রিস্ক লইবে ক্যান? কর্নেলস্যার! রাত্রেই হয়তো সে উড়ান দিবে। কী কন জয়ন্তবাবু?

বললুম, উড়ান দেবে কী, হয়তো অলরেডি দিয়েছে।

কর্নেল বললেন, অনাদিবাবুকে পুলিশ কড়া হুকুম দিয়েছে, কোনও আবাসিক যেন পুলিশের বিনা অনুমতিতে বাইরে না যান। তাছাড়া আমি সন্ধ্যানীড়ের আনাচে-কানাচে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করতে বলেছি।

হীরাচোর খুনী যদি কর্মচারীদের মধ্যে কেউ হয়?

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, এই একটা ব্যাপারে আমি সিওর যে, লোকটা একজন আবাসিক।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, আপনি সিওর হইলে আর প্রশ্ন ওঠে না। আপনাগো কালকের প্রোগ্রাম কী?

কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন, এখনও কিছু ঠিক নেই।

আমারে কী করতে হবে, কন কর্নেলস্যার?

আপনাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিতে চাই।

 কন?

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটুকরো কাগজ বের করে বললেন, আপনি এই নামঠিকানা টুকে নিন। এই বাড়ির কাছাকাছি থেকে লক্ষ্য রাখবেন, এই ফিল্ম হিরোইন নীলা রায়ের বাড়িতে এমন কেউ ঢুকছে কিংবা বেরুচ্ছে কি না, যে আপনার চেনা।

হালদারমশাই বললেন, নাকতলা! কিন্তু আমার চেনা তো অসংখ্য লোক আছে কর্নেলস্যার? আপনি কার কথা কইছেন?

কর্নেল হাসলেন, সরি! আমি বলতে চাইছি আপনার ক্লায়েন্টের কেসের সঙ্গে জড়িত কোনও চেনা লোকের কথা। আপনি অনীশবাবুর ছবিটা রাখুন। আর এই সিনেমা পত্রিকাটা–এক মিনিট! বলে কর্নেল তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে রঙিন এবং ভাঁজকরা সিনেমা পত্রিকা বের করে পাতা ওল্টাতে থাকলেন।

মনে পড়ল, এই পত্রিকাটা জয়শ্রী স্টুডিয়োতে আজ বিকেলে ম্যানেজার গোপাল কুণ্ডু কর্নেলকে দিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন, এই হল সেই মন্টুবাবু। যার বাড়ির দিকে নজর রাখবেন, সেই নীলা রায়ও এতে আছে। স্পষ্ট ছবি। পাতাটা ছিঁড়ে দিচ্ছি।

গোয়েন্দাপ্রবর চলে যাওয়ার পর বললুম, অনীশবাবুর ছবি দিলেন। সে তো বোম্বেতে।

কোনওরকম চান্স ছাড়া উচিত নয় জয়ন্ত। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে তুমি মাইনাস দুপৃষ্ঠা এই পত্রিকাটা দেখ। রিলিফ পাবে। আমি আসছি। বলে তিনি ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। আমি পত্রিকার পাতা ওল্টাতে থাকলুম। সিনেমা পত্রিকা পড়তে আমার ভালো লাগে না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে কর্নেল বললেন, সন্ধ্যানীড়ের আবাসিকদের ছবিগুলো ডেভালপ করে দেখলুম, আমার নতুন ক্যামেরার দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। টাকাগুলো জলে যায়নি। রাতের জঙ্গলে জন্তুজানোয়ারের ছবি তুলতেও আমার পুরনো ক্যামেরার মতোই এটাকে কাজে লাগাব।

বললুম, আবাসিকদের ছবি তুলে কি লালবাজার হেডকোয়ার্টারে পুরনো দাগি ক্রিমিনালদের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান?

কর্নেল হাসলেন, এখনও জানি না কী করব। প্রবুদ্ধবাবুর সেই মূর্তিমান শয়তানকেই বা কীভাবে খুঁজে বের করব, তাও জানি না। ছবি প্রিন্ট করার পর সে কথা ভাবা যাবে।

আমি কিন্তু বাড়ি ফিরব। রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা, এমনকি বারোটাতেও দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কাজ সেরে সল্টলেকে ফেরার অভ্যাস আমার আছে।

এবং কোনও হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাবে? কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। তার চেয়ে ষষ্ঠীচরণের রান্না অনেক নিরাপদ জয়ন্ত! তাছাড়া প্রবুদ্ধবাবুর আত্মজীবনীর চমকপ্রদ অংশগুলো আমি পড়ে শোনালে তুমি রীতিমতো থ্রিলার পাঠের মজা পাবে।

চন্দ্রিকা বলছিল, প্রবুদ্ধবাবুর মনে কোনও অদ্ভুত কমপ্লেক্স ছিল। তাই নিজের কীর্তিকলাপ বাড়িয়ে বলতেন।

সেটা স্বাভাবিক। আত্মজীবনী অনেকের ক্ষেত্রে আত্মপ্রচার হয়ে ওঠে। তবু প্রবুদ্ধবাবুর হীরারহস্য বুঝতে ওঁর ওই আংশিক আত্মজীবনী আমার বারবার পড়া দরকার। আর, তোমাকে শোনানোর উদ্দেশ্য, তোমার প্রতিক্রিয়া জানা। হয়তো যা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, তা তোমার কাছে ধরা পড়তে পারে।…

খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে এসে কর্নেল টেবিল ল্যাম্পের আলোয় সেই জীর্ণ এক্সারসাইজ খাতাটি খুলে পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলেন। আমি সোফায় হেলান দিয়ে বসলাম।…

মোহনপুরের রাজা উপাধিপ্রাপ্ত জমিদার অম্বিকাপ্রসাদ সিংহ তৎকালে একদল গোরা সৈন্যকে আশ্রয় দিয়েছিলেন! তাহার পাইকদলও কৃষকদের উপর অত্যাচার করিত। গোরা সৈন্যেরা কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ এবং নারীধর্ষণ তাণ্ডব চালাইতেছিল। আমরা একদল তরুণ ভলান্টিয়ার বিজয়কুমার দাশের নেতৃত্বে মোহনপুরের রাজবাড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা করিলাম, কিন্তু গোরা সৈন্যদের জন্য আক্রমণের দিন স্থির করিতে বিলম্ব হইল। ইতিমধ্যে কঁথি ট্রেজারি লুণ্ঠনের পর অনেকগুলি আগ্নেয়াস্ত্র সংগৃহীত হইয়াছিল। বিজয়বাবু কিছু সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের হাতে তুলিয়া দিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা শেষ অবধি পাওয়া গেল না। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল ছিল! তবে কাঁথি ট্রেজারি লুণ্ঠনের পর মোহনপুর হইতে গোরা সৈন্যরা রওয়ানা হইয়া গেল। আমরা এইবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হইলাম। কিন্তু বিজয়বাবুর মতে, অকারণ স্বদেশবাসীকে হত্যা করা উচিত হইবে না। তাহার পরিবর্তে রাজকোষ লুণ্ঠন করিয়া সেই অর্থে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করা প্রয়োজন।…

১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সহসা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হইয়া গেল। তারিখ স্মরণ নাই। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ আমরা ছাড়িলাম না। এক রাত্রে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মোহনপুর রাজবাড়ির খাজাঞ্চিখানা আক্রমণ করিলাম। বাধা পাই নাই। সেই রাত্রে আমাদের দলে একজন কর্মকার ছিল। উহা বিজয়বাবুরই কৌশল। তিনি কর্মকারকে লুণ্ঠনের অংশ দেওয়ার ছল করিয়াছিলেন। প্রায় সারারাত্রিব্যাপী খাজাঞ্জিখানায় লুণ্ঠনকর্ম নিরাপদে ঘটিল। আয়রনচেস্ট এবং কয়েকটি সিন্দুক ভাঙিয়া প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা, ধনরত্নাদি আমাদের হস্তগত হইল। চলিয়া আসিবার সময় আমার পায়ে শক্ত কিছুতে ধাক্কা লাগিয়াছিল। তখন সকলেই বাহির হইয়া গিয়াছে। আছাড় খাইয়াছিলাম। সেই সময় একটা ক্ষুদ্র কাঠের বাক্স হাতে ঠেকিল। বুঝিলাম, উহাই আমার আছাড় খাইবার কারণ। কিছু না ভাবিয়াই ক্ষুদ্র বাক্সটি হস্তগত করিলাম।…

তখনও সমানে ঝড়বৃষ্টির উপদ্রব চলিতেছে। বাহিরে গিয়ে দলের লোকেদের দেখিতে পাইলাম না। তখন দিশাহারা হইয়া চলিতে থাকিলাম। অবশেষে একটি বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় লইলাম। ক্ষুদ্র বাক্সটি আমার জামার পকেটে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। জামার অন্য পকেটে একটি স্বদেশী পিস্তল ছিল। তাহাতে আঠারোটি গুলি ছিল।..

কর্নেল কয়েক পাতা উল্টে আবার পড়লেন : সেই ক্ষুদ্র বাক্সে বারোটি হীরকখণ্ড ছিল। তৎকালে আমাদের গ্রেফতারের জন্য হুলিয়া জারি হইয়াছে। দলের কাহারও সঙ্গে যোগাযোগ করিতে পারিলাম না। আমি উড়িষ্যার কটকে আত্মগোপন করিয়াছিলাম। কটকে আমার এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি পেশায় ব্যবহারজীবী। আমার নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে নাই। কিন্তু হীরকখণ্ডগুলি লইয়া কী করিব ভাবিয়া পাইলাম না। আমার আত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করিতে দ্বিধা ছিল। তিনি ব্রিটিশভক্ত। কিছুদিন পরে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে কলিকাতা রওয়ানা হইলাম।…

কর্নেল বললেন, এরপর আর সেই হীরার কথা নেই। কোনও কারণে প্রবুদ্ধবাবু একথা চেপে গেছেন। তারপর এইটুকু শোনো।

কলিকাতায় যে বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় লইয়াছিলাম, সে এখন পুলিশের চর হইয়াছে তাহা কল্পনাও করি নাই। একদিন শেষ রাত্রে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করিল। আমি যে কর্মের জন্য দায়ী, তাহার দরুন শাস্তি পাইলে দুঃখ ছিল না। কিন্তু আমাকে অস্ত্র আইন লঙ্ঘন এবং রাজদ্রোহের অপরাধে ছয় বৎসরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইল। এমন কি সেই বন্ধু আমার বিরুদ্ধে পুলিশের শেখানো মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছিল। অবশ্য পুলিশ আমার পিস্তলটি খুঁজিয়া বাহির করিয়াছিল। এই আগ্নেয়াস্ত্রের কথা সেই বন্ধুকে (শত্রুকে) গোপনে বলিয়া ভুল করিয়াছিলাম।…

বললাম, প্রবুদ্ধবাবুর মূর্তিমান শয়তান কি এই লোকটি?

কর্নেল বললেন, সম্ভবত। কারণ জেল থেকে ফেরার পর প্রবুদ্ধবাবুকে সে কমিউনিস্ট বলে রটিয়ে দিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্টরা স্বদেশী সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তবে প্রবুদ্ধবাবু জেল থেকে বেরিয়ে রাজনীতি আর করেননি। তিনি যা-সব লিখেছেন, তার সারমর্ম হল, যাদের একসময় ব্রিটিশরাজের সমর্থক দেখে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই তখন স্বাধীন সরকারের দলে ভোল পাল্টে ঢুকে পড়েছে। যাই হোক, এরপর প্রবুদ্ধবাবু আর সেই হীরাগুলোর কথা লেখেননি। তাঁর নাম না করা বন্ধুর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ওড়িশার কটকে চলে যান। এইখানেই তার আত্মজীবনী অসমাপ্ত থেকে গেছে।

একটু ভেবে নিয়ে বললুম, কর্নেল! প্রবুদ্ধবাবুর সেই বন্ধু কেন আবার তার পিছনে লেগেছিলেন, এর একটা উত্তর হতে পারে।

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, হয়তো প্রবুদ্ধবাবু মুখ ফসকে মোহনপুর রাজবাড়ি আক্রমণ এবং তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া হীরার কথা বলে থাকবেন। শুভময়বাবুর ছেলে হিরন্ময় এবং ভাগনি চন্দ্রিকার কথায় বোঝা যায়, তিনি গল্প বলতে ভালবাসতেন। দশবছর আগে আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর প্রবুদ্ধবাবুকে খুব গল্পবাজ মানুষ মনে হয়েছিল।

আমার ধারণা চারখানা হীরা বেচে উনি কাঠের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বাকিগুলো কেন বেচেননি এটা অবশ্য একটা রহস্য।

কর্নেল হাসলেন, সেগুলো পেলে রহস্যটা ফাঁস হত।

একটু অবাক হয়ে বললুম, হীরাগুলো পেলে রহস্য ফাঁস হত কীভাবে?

আর কথা নয়। রাত এগারোটা বাজে। শুয়ে পড়ো গে। আমি ছবির প্রিন্টগুলোর অবস্থা দেখে নিয়ে বেডরুমে ঢুকব।…

.

পরদিন সকালে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়ার তালে ছিলুম। কিন্তু কর্নেল ততক্ষণে ছাদের বাগান পরিচর্যা করে নেমে এসেছেন। আমার হাবভাব আঁচ করে তিনি সহাস্যে বললেন, তোমার ফ্ল্যাট আমি দেখেছি। ফার্নিচার আর বই চুরি করার জন্য আজকাল চোরেরা ঝুঁকি নেবে না। হ্যাঁ একটা টিভি আছে তোমার। কোনও শৌখিন চোর টিভি চুরির চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তাকে পাঁচিল টপকানোর ঝুঁকি নিতে হবে। টিভি আছড়ে পড়ে ভেঙে যাবে। গেটে কড়া সিকিউরিটি। তার চেয়ে বড় কথা, তোমার পাশের ফ্ল্যাটে রিটায়ার্ড জজসায়েবের অ্যালশেসিয়ান কুকুরটা যেমন সন্দেহপ্রবণ, তেমনই জজসায়েবের গৃহিণীও বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ। আমি তো সেই ভয়েই নীচে থেকে তোমার নাম ধরে ডাকি।

প্রফুল্ল মেজাজে থাকলে আমার বৃদ্ধ বন্ধু এই ধরনের কথাবার্তা অনর্গল চালিয়ে যান। বেগতিক দেখে বললুম, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি না।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, যাবে না কেন? তবে আমার সঙ্গে যাবে। ব্রেকফাস্ট খেয়েই দুজনে বেরিয়ে পড়ব।

ষষ্ঠীচরণ কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল। অভ্যাসমতো আমি বিছানায় বসে বেড-টি পান করছিলুম। এবার কফির পেয়ালা তুলে নিতে হল। তারপর ষষ্ঠী অন্যদিনের মতো ছাদের বাগান থেকে এদিনের খবরের কাগজগুলো দিয়ে গেল। আমি আমাদের কাগজ দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা তুলে নিলুম। কর্নেল বললেন, আজ তোমাদের মফস্বলের সংবাদদাতার পাঠানো কয়েক লাইন খবরে প্রবুদ্ধবাবুর মৃত্যুর ঘটনা ছেপেছে। হেডিংটা লাগসই।

মফস্বল খবরের পাতা খুলে আমার চোখে পড়ল, বৃদ্ধাবাসে রহস্যময় মৃত্যু।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… মিঃ মুখার্জি, তাহলে আমার সন্দেহ ঠিকই ছিল।… মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য? তার মানে, ঝিলটার মালিক ওঁরা। কী নাম?.. ভোলানাথ দুলে?… হ্য। বুঝেছি। ঘাটের পাশে জাল রেখে সন্ধ্যানীড়ে মাছ দিতে ঢুকেছিল সে। আর সেই সুযোগে জালের দড়িটা কেউ কেটে নিয়েছিল। কিন্তু ভোলা এনিয়ে হইচই করেনি?… হ্যাঁ। হাত চার-পাঁচ দড়ি কেউ কেটে নিয়েছে, এটা তখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল না।… তাই বুঝি? প্রতিদিন ভোলাই সন্ধ্যানীড়ে মাছ ধরে দিয়ে আসত। জালের দড়ি কাটা গেলে তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক।… অন্য কোনও খবর… ঠিক আছে। যাব। ধন্যবাদ।

কর্নেল রিসিভার রেখে চুরুট ধরালেন। বললুম, কালীতলার ওসি মিঃ মুখার্জি আপনাকে সম্ভবত সেই কালো নাইলনের দড়ির খবর দিলেন! কিন্তু এই দড়ি কোনও জেলের জাল থেকে কেটে নেওয়ার দরকার কী ছিল? বাজারে।

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিলেন। জয়ন্ত! তোমারও খটকা লাগা উচিত ছিল। নাইলনের দড়ি কাপড় শুকোতে বা নানা কাজে লোকে বাজার থেকে কেনে। কিন্তু অত কুচকুচে কালো দড়ি কি বাজারে কখনও দেখেছ? নানা রঙের নাইলনের দড়ি বাজারে বিক্রি হয়। কিন্তু অত কালো মিহি দড়ি? আমার সন্দেহ। হয়েছিল, এই রঙের দড়ি বিশেষ, একরকমের জালের গোড়ায় থাকে। ওসি বললেন, ওই এলাকায় ওটার নাম খেয়াজাল। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বা নৌকো থেকে পৃথিবীর সব দেশেই ওই জাল ছত্রাকারে জলের গভীরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জালের গায়ে মাদুলির মতো দেখতে এবং ওজনদার কালো লোহার টুকরো থাকে। তার ভারে জাল ডুবে যায় তলা পর্যন্ত। আজকাল জেলেরা কালো রঙের খেয়াজাল ব্যবহার করে।

বললুম, কিন্তু সেই জেলে তো বলতে পারেনি কে তার জালের দড়ি কেটেছে। কাজেই মশা মারতে কামান দাগা হল না কি?

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে বললেন, তোমাকে প্রায়ই বলি জয়ন্ত, সত্য জিনিসটা অনেকসময় ফালতু জিনিসের মধ্যে পড়ে থাকে। আর ওই কথাটাও স্মরণ করো। আমরা অনেকসময় জানি না যে, আমরা কী জানি। ভোলানাথ–এমনও হতে পারে, সে জানে না যে, সে কী জানে।..

দশটায় কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরুলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, কোথায় যেতে হবে?

বউবাজার স্ট্রিটে। ৭/১ রামকান্ত লেন খুঁজে বের করতে হবে।

বউবাজার স্ট্রিটে পৌঁছুলে কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পথনির্দেশিকা নামে বই বের করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, আর একবার দেখে নিই। হ্যাঁ, বাঁদিকে ঢোকো। তারপর জিজ্ঞেস করে নেব।

খুঁজতে খুঁজতে বাড়িটা পাওয়া গেল। কিন্তু গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই। একটু এগিয়ে বাঁকের মুখে পার্ক করলুম। কাঁচ তুলে গাড়ি লক করে কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। হালদারমশাই বলেছিলেন, নীচের একটা ঘরে মুদিখানা, অন্য ঘরে লন্ড্রি। কর্নেলকে দেখে মুদিভদ্রলোক বললেন, বলুন স্যার?

কর্নেল বললেন, এই বাড়ির মালিক কোথায় থাকেন?

সর্বনাশ। গুজব শুনছি, মালিকের নাতি বাড়ি ভেঙে প্রমোটারকে দিয়ে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানাবে। আপনারা কি

কর্নেল হাসলেন, না। আমরা বাড়ি কিনতে চাই না। এই বাড়ির ওপরতলায় নাকি একটা ঘর খালি আছে। একজনের কাছে খবর পেয়েছি। তাই মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মালিক কোথায় বৃদ্ধাশ্রমে আছে। আমাদের কাছে তার বকলমে ভাড়া নেন তার নাতি মন্টু ঘোষ।

বাড়ির মালিকের নাম অবশ্য জানি। কিন্তু তিনি–মানে, মদনমোহন বোস যে বৃদ্ধাশ্রমে আছেন, তা জানি না।

কী বললেন? মদনমোহন বোস।

হ্যাঁ।

ভুল শুনেছেন। তার নাম মনমোহন বোস। ভাড়ার রসিদ দেখতে চান দেখাতে পারি।

মনমোহন বোস বলছেন?

আপনি এ পাড়ার যাকে জিজ্ঞেস করবেন, সেই বলবে।

আপনার সঙ্গে তার তাহলে আলাপ থাকারই কথা।

মুদি ভদ্রলোক হাসলেন, বিশ বছরের বেশি এই ঘর ভাড়া নিয়েছি। আগে এখানে কী একটা সমিতির অফিসঘর ছিল। অফিস তুলে বোসদা আমাকে ভাড়া দিয়েছিলেন।

কর্নেল পকেট থেকে পাসপোর্টসাইজ একটা ফোটো বের করে বললেন, দেখুন তো। ইনিই সেই বোসবাবু কি না?

ফোটোটা দেখেই ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ। ইনিই মনমোহন বোস। বলে তিনি এবার কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। মুখে সেই ছাপ ফুটে উঠল। স্যাররা। কি পুলিশ অফিসার?

কর্নেল হাসলেন, আপনার ভয়ের কারণ নেই। এই বাড়িটা সম্পর্কে সরকার একটা তদন্ত করছেন। যাই হোক, আপনার এই দোকানঘরে কী সমিতির অফিস ছিল মনে আছে?

কী একটা কল্যাণ সমিতি যেন। ঠিক মনে পড়ছে না স্যার। তখন দোতলার দুটো ঘরে বোসদা থাকতেন। এখন মন্টুবাবু একটা ঘরে একজন। ট্যাক্সিড্রাইভারকে থাকতে দিয়েছেন। অন্য ঘরে উনি মাঝেমাঝে এসে থাকেন। ভদ্রলোক তাঁর দুজন কর্মচারীকে নির্দেশ দিয়ে রাস্তায় নামলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, বোসবাবু যেমন, তেমনই তার নাতি। বন্ধুবান্ধব নিয়ে স্মৃর্তি করতে আসে। দশটায় দোকানে তালা এঁটে আমি বাড়ি চলে যাই। ওই দেখছেন আমার বাড়ি। এখানে দোকানের পজিশন ভালো। তা যা বলছিলুম। বোসদা যতদিন ছিল, খুব জ্বালিয়েছে। বছর অন্তর ভাড়া বাড়িয়েছে। কী করব? বোসদার সঙ্গে পুলিশের খুব ভাব ছিল। পাড়ার মস্তানগুলোও তার চেলা ছিল। চলে গিয়ে বেঁচেছি স্যার।

চলে গেলেন কেন বোসবাবু?

নাতির অত্যাচারে। বয়স সত্তর-বাহাত্তর হয়েছিল। আর সে তেজ ছিল না। দাপট কমে গিয়েছিল। উল্টে মস্তানদের চাঁদার জুলুমেও অস্থির। তারপর হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে গেল। পরে গুজব শুনলুম, কোথায় যেন বৃদ্ধাশ্রমে আছে।

কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আচ্ছা চলি।

ভদ্রলোক চুপচাপ অবাক হয়ে প্রায় এক মিনিট আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর দোকানে গিয়ে ঢুকলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, তাহলে মনমোহন বোসই মদনমোহন বোস?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু সন্ধ্যানীড়ে তাকে চিনতে বেশ দেরি হয়েছিল প্রবুদ্ধবাবুর। কেন দেরি হয়েছিল, এই প্রশ্নের উত্তর আমি অনুমান করতে পেরেছি। প্রবুদ্ধবাবুর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল।

.

০৭.

 বউবাজার স্ট্রিটে পৌঁছে কর্নেল আমাকে এসপ্ল্যানেডের দিকে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ততক্ষণে অফিসটাইমে-র পিক আওয়ার শুরু হয়েছে। সারাপথ জ্যাম। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ দিয়ে ঘুরে ভিক্টোরিয়া হাউসের পাশ দিয়ে চৌরঙ্গিতে পড়তেই কর্নেল বললেন, তুমি মেট্রো সিনেমার কাছাকাছি কোথাও গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করো। আমি আসছি।

যে সময়ের এই কাহিনী, তখন কলকাতার রাস্তায় পার্কিংয়ের কড়াকড়ি ছিল না। কর্নেলকে কে সি দাশের মিষ্টান্নের দোকানের ফুটপাতে একবার দেখতে পেলুম। তারপর তিনি ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সন্দেশ-রসগোল্লার প্রতি কর্নেলের আসক্তি কম। কাজেই তিনি মিষ্টি কিনতে যাচ্ছেন, এমনটি ভাবা যায় না। নাকি কাউকে মিষ্টি ভেট দেবেন। কিছু বোঝা গেল না।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আধঘণ্টার মধ্যেই কর্নেল ফিরে এলেন। গাড়িতে বসে তিনি বললেন, সঞ্জয় খুব কাজের ছেলে। অফিসে এসে প্রথমে আমার কাজটা সেরে রেখেছে। যতটা চেয়েছিলুম, তারও বেশি।

বললুম, কথাগুলো আমার কাছে দুর্বোধ্য।

কর্নেল হাসলেন। ও! সঞ্জয়কে তুমি তো চেনো না। তবে সরকারি মহাফেজখানা নিশ্চয় চেনো।

মহাফেজখানা? সেটা কী বস্তু?

হ্যাঁ। আগের আমলে মহাফেজখানা বলা হত। এখন বলা হয় লেখ্যাগার।

তাই বলুন! পুরনো সরকারি ডকুমেন্টস যেখানে রাখা আছে। কিন্তু সেখানে কী ব্যাপার?

ব্রিটিশ আমলের পলিটিক্যাল নথিপত্র খুঁজে ১৯৪২ সালের অগাস্ট আন্দোলনের গোপন তথ্য জানার দরকার ছিল। বিশেষ করে ১৯৪২ সালে অক্টোবরে ঝড়বৃষ্টির সময় মোহনপুর রাজবাড়ির খাজাঞ্চিখানা লুঠের ঘটনায়। কাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং তার পরের ঘটনাবলি। সঞ্জয় সব ফাইল তৈরি রেখেছিল। আমার যা দরকার, তা টুকে নিয়েছি।

প্রবুদ্ধকুমার দত্তের নাম নিশ্চয় পেয়েছেন?

শুধু প্রবুদ্ধবাবুর নাম নয়, মনমোহন বোসের নামও পেয়েছি। পরে মনমোহনবাবু নিজের মাথা বাঁচাতে পুলিশের চর হয়েছিলেন। তবে প্রথম দফায় পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছিল তাদের মধ্যে প্রবুদ্ধবাবু ছিলেন না। তার নামে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফার মামলার সময় মনমোহনবাবু প্রবুদ্ধবাবুকে ধরিয়ে দিল। ব্রিটিশ সরকার মনমোহনবাবুকে পুরস্কৃত করেছিলেন।

এসব কথা মোটামুটি প্রবুদ্ধবাবুর এক্সারসাইজ খাতায় লেখা আছে! নতুন কী তথ্য পেলেন?

বলছি। কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় তোমার একাগ্রতা দরকার।

হাসতে হাসতে বললুম, না! আপনাকে অক্ষত শরীরে বাড়ি পৌঁছে দেব। ভাববেন না।

বাড়ি নয়। মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনে যাব। সোজা এগিয়ে চলো।

আপনি ওদের অফিস কি চেনেন?

দেখেছি। আর একটু এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে একটা দশতলা বাড়ির মাথায় হোর্ডিং দেখতে পাবে।

ঠিক আছে। নতুন কী তথ্য পেলেন বলুন এবার।

প্রবুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে মোহনপুর রাজবাড়ি থেকে হীরা লুঠ করার অভিযোগ ছিল না। কিন্তু সরকারি নথিতে দেখলুম, মনমোহন বোস পুলিশকে সেই হীরার কথা জানিয়েছিলেন। সেগুলো নাকি তখন প্রবুদ্ধবাবুর কাছে ছিল। তাই পুলিশ প্রবুদ্ধবাবুর ওপর প্রচণ্ড পীড়ন চালিয়ে একটা মিথ্যা অভিযোগ এনে জেলে পাঠিয়েছিল। রাজদ্রোহ এবং বোমা মেরে একজন সেপাইকে জখমের অভিযোগ। জয়ন্ত! এখানেই আমি সূত্র হারিয়ে ফেলেছি। হীরার কথা বন্ধুকে বলে থাকতে পারেন প্রবুদ্ধ দত্ত। কিন্তু পুলিশ তার হীরা খুঁজে পায়নি। তাহলে হীরাগুলো প্রবুদ্ধবাবু তখন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন?

কিন্তু নতুন তথ্যটা কী?

এসে গেছি। এখানে গাড়ি রাখো। লক করে দাও। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।..

বাড়িটার সাততলায় মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশন। লিফটের সামনে লাইন। লাইনে দাঁড়াতে হল আমাদের। তারপর প্রায় পনেরো মিনিট পরে লিফটে ঢোকার সুযোগ পেলুম।

সাততলা অর্থাৎ সিক্সথ ফ্লোরে লিফট থেকে নেমে লম্বা করিডরের শেষে রিসেপশন কাউন্টারে গেলেন কর্নেল। রিসেপশনে সুন্দরীদেরই বেছে নেওয়া হয়। তাই ফিল্মহিরোইনদের মতো রিসেপশনিস্টকে দেখে অবাক হলুম না। অবাক হলুম কর্নেলের কথা শুনে। তিনি তাঁর নেমকার্ড দিয়ে বললেন, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মিঃ ভগবানদাস কানোরিয়ার সঙ্গে সাড়ে এগারোটায় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এখন এগারোটা আঠাশ বাজে।

কথাগুলো কর্নেল ইংরাজিতেই বললেন এবং রিসেপশনিস্ট টেলিফোনের রিসিভার তুলে চাপাস্বরে কার সঙ্গে কথা বলল। তারপর রিসিভার রেখে মিষ্টি হেসে ইংরেজিতে বলল, এক মিনিট কর্নেল সরকার! এখনই লোক এসে আপনাদের নিয়ে যাবে।

একটু সরে এসে কর্নেলকে বললুম, এখানে কী ব্যাপার?

আছে। আজ সকালে তুমি যখন বিছানায়, তখন ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিলুম।

কিন্তু ব্যাপারটা কী?

অপেক্ষা করো। তুমি নিজেই জানতে পারবে।

অপেক্ষা করতে হল না। একজন উর্দিপরা বেয়ারা রিসেপশনিস্টের দিকে তাকালে ভদ্রমহিলা কর্নেলকে দেখিয়ে দিলেন। বেয়ারা সেলাম দিয়ে বলল, আইয়ে সাব!

আবার করিডর দিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে বাঁক নিতে নিতে একটা ঘরের দরজা খুলে লোকটা বলল, অন্দর যাইয়ে সাব! সে পর্দা ফাঁক করে ধরল। কর্নেল আগে এবং আমি তার পিছনে ঢুলুম।

বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে গাব্দাগোব্দা প্রকাণ্ড পুতুলের মতো এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক টাই-স্যুট পরে বসেছিলেন। হাত বাড়িয়ে কর্নেলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ইংরাজিতে বললেন, ডি সি ডি ডি ওয়ান মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ি আপনার কথা আমাকে বলেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে এসেছেন, এতে আমি খুশি হয়েছি।

কর্নেল আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিঃ কানোরিয়া আমার। সঙ্গেও হ্যান্ডশেক করে বললেন, বসুন আপনারা। তবে কর্নেল সরকার, আমার অনুরোধ, খবরের কাগজে যেন এসব কথা না লেখা হয়।

কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আমার কানে এসেছে, অনীশ মজুমদারের কেসের ব্যাপারে আপনি আর এগোতে চান না। তা কি সত্যি?

দেখুন কর্নেল সরকার। বারো লাখ টাকা আমার কোম্পানির কাছে কোনও ব্যাপার নয়। মজুমদারের বিরুদ্ধে আমরা কেস করতুম না। কিন্তু সে আমার কোম্পানির বোম্বে ব্রাঞ্চের ডাইরেক্টর আমার ছেলে অশোককে ব্ল্যাকমেল করছে। সব কোম্পানিতেই কিছু গোপন লেনদেন হয়। আইন পুরোপুরি মেনে চললে কোম্পানি মারা পড়বে। হা–এটা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু মজুমদার অশোককে ব্ল্যাকমেল করছে কেন, তা আপনি জানেন?

সিনেমা করার জন্য টাকার দরকার। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।

একজন বেয়ারা আমাদের জন্য কফি দিয়ে গেল। কথাটা শুনে মিঃ কানোরিয়া যেন অবাক হয়েছিলেন। বললেন, মজুমদার সিনেমা করবে? আমি এমন কথা তো শুনিনি।

তা হলে কী শুনেছেন?

সে বিদেশে চলে যাবে। তা-ই বলেছে অশোককে। বলে মিঃ কানোরিয়া একটু ঝুঁকে এলেন কর্নেলের দিকে। চাপাস্বরে বললেন, মজুমদার এখন বোম্বেতে নেই, এ খবর আমি পেয়েছি। সম্ভবত সে কলকাতা এসেছে। কারণ তার স্ত্রী কলকাতায় একা আছে। আপনি তাকে খুঁজে বের করুন। তারপর তাকে বলুন, অশোককে ব্ল্যাকমেল যেন সে না করে। তার কাছে কোম্পানির যে-সব কাগজপত্র আছে, তা ফেরত পেলে আমি তাকে আরও বারো লাখ টাকা দেব। ডি সি ডি ডি সায়েব আমাকে বলেছেন, আপনি অনীশ মজুমদারের কেস সম্পর্কে আগ্রহী।

হ্যাঁ। অনীশের স্ত্রী চন্দ্রিকা আমাকে ধরেছে, তার স্বামীকে যেন খুঁজে বের করি। চন্দ্রিকার ধারণা, কেউ তাকে অপহরণ করেছে। কিংবা মেরে ফেলেছে।

তাহলে মজুমদার কলকাতা আসেনি! অন্য কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আপনার সঙ্গে তার দৈবাৎ যোগাযোগ হলে তাকে বলবেন, আমি বারো লাখ টাকা দিতে রাজি। সে আমাদের কাগজপত্র ফেরত দিক। আপনি মধ্যস্থতা করুন!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, অনীশকে অপহরণ বা মেরে ফেলার আশঙ্কা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

মিঃ কানোরিয়া হাসতে হাসতে বললেন, আমরা তাকে অপহরণ করিনি বা মেরে ফেলিনি। আমার ছেলে অশোকের সঙ্গে গতকালও বোম্বেতে টেলিফোনে তার কথাবার্তা হয়েছে। কর্নেল সরকার! মজুমদারকে আপনি বোকা ভাববেন না। সে খুব ধূর্ত। আমার কোম্পানির বেশ কিছু কাজে তার বুদ্ধির পরিচয় পেয়েই তাকে সেলস্ একজিকিউটিভ পদে বসিয়েছিলুম।

কর্নেল বললেন, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।

মিঃ কানোরিয়া বললেন, বেশ! বলুন।

মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশন–আপনার এই প্রাইভেট কোম্পানি একসময় রত্নব্যবসায়ী ছিল। তখন নাম ছিল মহাবীর জুয়েলার্স। পার্ক স্ট্রিটে আপনার জুয়েলারির দোকান ছিল। তাই না?

আমি চমকে উঠেছিলুম। মিঃ কানোরিয়াও একটু চমকে উঠলেন মনে হল। বললেন, তাতে কী?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, সেই দোকান তুলে দিয়ে আপনি অন্যধরনের ব্যবসা শুরু করেন। এতে বেআইনি কিছু নেই।

আপনি কীভাবে জানলেন মহাবীর জুয়েলার্সের কথা?

সরকারি রেকর্ডস থেকে। আপনার বাবা মহাবীর দাস ছিলেন বিখ্যাত জহুরি। ১৯৪৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ পুলিশ আপনাদের দোকানে হানা দিয়েছিল। আপনি তখন যুবক। আপনার মনে পড়তে পারে, মেদিনীপুর জেলার মোহনপুর রাজবাড়ি লুঠ করেছিলেন স্বদেশী বিপ্লবীরা। রাজবাড়ির খাজাঞ্চিখানা থেকে বারোটি হীরা লুঠ হয়েছিল। গোপন সূত্রে পুলিশ খবর পেয়েছিল, সেই হীরা নাকি আপনারা কিনেছেন। কিন্তু আপনাদের দোকানে তা পাওয়া যায়নি।

মিঃ কানোরিয়া গম্ভীর মুখে বললেন, অত পুরনো ঘটনা আমার মনে নেই।

 প্লিজ মিঃ কানোরিয়া! আমি আপনার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে একথা তুলিনি। আমি জানতে চাইছি, তার পরে কেউ কি আপনার কাছে–ধরুন, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চারটে হীরা বিক্রি করেছিল? আসলে তখন ভারত স্বাধীন হয়েছে। বিপ্লবীরা জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কাজেই তাদের কেউ হীরা বিক্রি করলে আপনাদের কেনার অসুবিধা আর ছিল না।

বলছি তো! আমার মনে পড়ছে না।

পুরনো সরকারি রেকর্ডে দেখেছি, একজন বিপ্লবী হীরা বিক্রি করার জন্য আপনার বাবা মিঃ মহাবীর দাসকে গোপনে প্রস্তাব দেন। আপনার বাবা তা কিনতে চেয়েছিলেন। আপনার বাবা পুলিশের কাছে একথা স্বীকার করে বলেছিলেন, লোকটা আর হীরা বিক্রি করতে আসেনি।

মিঃ কানোরিয়া একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনি মজুমদারের সঙ্গে মিটমাট করিয়ে দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি পেলে আমি আপনাকে ওই ব্যাপারে যা মনে আছে, বলব।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। অনীশ মজুমদারকে খুঁজে বের করতে পারলে আমি মিটমাট করে দেব।

মিঃ কানোরিয়া বললেন, মহাবীর জুয়েলার্সের কোনও রেকর্ড আমি রাখিনি। তবে যেটুকু মনে পড়ছে, তা বলছি। লোকটার কাছে বারোটা হীরা ছিল। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, হীরার দাম নির্ভর করে তা কাটাইয়ের ওপর। হীরার কাটিং ঠিকমতো হলে উজ্জ্বলতা বাড়ে। দামও ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু হীরা যদি মোটেও কাটাই না হয়, তার দাম পাওয়া যায় না। না-কাটা হীরা নেহাত কৃস্ট্যালের মতো জিনিস। সেই লোকটার কাছে বারোটা হীরার মধ্যে চারটে ছিল কাটাই করা। বাকি আটটার কাটাই হয়নি। হীরা কাটাই করার কাজ সবাই জানে না। তাছাড়া চোরাই হীরা কাটাই করার ঝুঁকি সহজে কেউ নিতে চায় না। কারণ তা খনিজ হীরা। পুলিশের কানে গেলে বিপদ হতে পারে। কাটাই করা হীরার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেই।

আপনি, না আপনার বাবা সেই চারটে হীরা কিনেছিলেন?

বাবার পরামর্শে আমি কিনেছিলুম। তখনকার দরে আমরা দাম দিইনি, তা সত্য। কারণ চোরাই হীরা যে বেচছে, তাকে বাজারদরের চেয়ে কম দাম দিলেও সে নেবে। যতদূর মনে পড়ছে, হাজার তিরিশ টাকা দিয়েছিলাম।

তাহলে বাকি আটটা হীরা নিয়ে সে চলে গিয়েছিল?

হ্যাঁ। আপনাকে তো বললুম, চোরাই খনিজ হীরা কেউ কিনতে চাইবে না। কাটিং ঠিক মতো হলে তবেই হীরা হচ্ছে হীরা। বুঝলেন তো?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ধন্যবাদ মিঃ কানোরিয়া! গোপন সরকারি রেকর্ডে মহাবীর জুয়েলার্সে পুলিশের হানা দেওয়ার ঘটনা না জানলে আপনার সময় নষ্ট করতুম না।

মিঃ কানোরিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন—

চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। বলে কর্নেল বেরুলেন। আমি তাকে অনুকরণ করলুম। করিডরে যেতে যেতে বললুম, কর্নেল! এ সব জেনে কী লাভ আমি বুঝতে পারছি না।

কর্নেল তখন কিছু বললেন না। নীচে নেমে আসার পর গাড়িতে ঢুকে তিনি বললেন, চন্দ্রিকার কথার সত্যতা পুলিশের কাছে যাচাই করার চেয়ে মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনের মালিকের মুখে যাচাই করা উচিত ছিল। জানতে পারলুম, চন্দ্রিকা মিথ্যা বলেনি। দ্বিতীয়ত, আটখানা হীরা কেন প্রবুদ্ধবাবু কাছে রেখেছিলেন, তা বোঝা গেল। তার পক্ষে হীরা কোথাও কাটানো নিরাপদ ছিল না। কোনও কারিগর হীরাগুলো আত্মসাৎ করলে প্রবুদ্ধবাবু তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারতেন না। এদিকে হীরাগুলো ফেলে দিতেও পারেননি। কেউ কি তা পারে?…

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, এবার কি হোম সুইট হোম?

 কর্নেল বললেন, না। ভবানীপুরের দিকে চলো।

 সেখানে কার কাছে?

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে খুদে নোটবই বের করে বললেন, ননীগোপাল চৌধুরির বাড়ি। এই রাস্তাটা আমি চিনি।

ননীবাবুর কাছে তো হালদারমশাই গিয়েছিলেন।

 আমি যাচ্ছি অন্য কারণে।

ভবানীপুর এলাকায় কর্নেলের নির্দেশমতো শর্টকাটে অনেক আঁকাবাঁকা গলি পেরিয়ে মোটামুটি চওড়া রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, সামনে যে ব্যাঙ্কটা দেখা যাচ্ছে, তার পাশের গলির মোড়ে গাড়ি রাখবে.। নাম্বারটা মনে হচ্ছে। গোলমেলে।

গাড়ি গলিটার মুখে লক করে কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। অনেককে জিজ্ঞেস করার পর উল্টোদিকে একটা গলির মধ্যে বাড়িটা পাওয়া গেল। রোয়াকে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি ব্যস্তভাবে বললেন, আমিই ননীগোপাল চৌধুরি। আপনারা কোত্থেকে আসছেন স্যার?

কর্নেল তাকে তার নেমকার্ড দিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে।

ননীবাবু একতলায় থাকেন। বসার ঘর খুলে আমাদের অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে বললেন, বসুন স্যার! আজ সকাল থেকে আমার মন বলছিল হাবুলদার ব্যাপারে নিশ্চয় সরকার একটা কিনারা করবেন।

কর্নেল বললেন, হাবুলদা কে?

আজ্ঞে, প্রবুদ্ধকুমার দত্ত। আমার পিসতুতো দাদা। কাল প্লেন ড্রেসে একজন ডিটেকটিভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি আমাকে আশা দিয়ে গেছেন।

ননীবাবু! আপনার কাছে কয়েকটি কথা জানতে এসেছি।

বলুন স্যার! যা জানি, সব বলব। কনকপুরের বৃদ্ধাশ্রমের মালিক–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ১৯৪২ বা ১৯৪৩ সালে আপনার বয়স কত ছিল?

কত আর হবে? বারো কি তেরো বছর।

আপনার মা কি বেঁচে আছেন?

না স্যার!

বাবা?

বাবা তো আমার ছোটবেলায় মারা যান।

আপনার কি মনে পড়ে ১৯৪৩ সালে কোনও সময় আপনার হাবুলদা আপনাদের বাড়ি এসেছিলেন?

আমার আবছা মনে আছে হাবুলদাকে। তবে মায়ের কাছে শুনেছি, হাবুলদাকে যখন পুলিশ খুঁজছে, গোপনে এক রাত্রে মায়ের কাছে ওঁর জিনিসপত্র রেখে গিয়েছিলেন। জেল থেকে ছ-সাত বছর পরে সেগুলো নিতে এসেছিলেন। মা বলতেন, বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শুধু একটা তোরঙ্গ ছিল। সেটা নিয়ে যান হাবুলদা বলে ননীবাবু কণ্ঠস্বর চাপা করলেন, মা বলতেন, হাবুলদার সেই তোরঙ্গে আটখানা হীরে লুকোনো ছিল। হাবুলদা মাকে বিশ্বাস করতেন। আর মা-ও বিশ্বাসভঙ্গ করেননি।

আপনি কি বউবাজার এলাকার মনমোহন বোস নামে কাউকে চিনতেন বা এখনও চেনেন?

একটু ভেবে নিয়ে ননীবাবু বললেন, অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে। মায়ের কাছে শুনেছি। ফেরার অবস্থায় হাবুলদা কোনও এক বোসবাবুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকতেন। বোসবাবুই নাকি হাবুলদাকে ধরিয়ে দেন। জেল থেকে ফিরে হাবুলদা নিজে মাকে একথা বলেছিলেন।

আচ্ছা ননীবাবু, আপনার হাবুলদা জেল থেকে ফিরে কোথায় ছিলেন বা কী করতেন জানেন?

জানি স্যার! মানে, মায়ের কাছে শুনেছি। ওড়িশায় কাঠের ব্যবসা করতেন।

আপনার হাবুলদার একটি মেয়ে ছিল। স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে কোথায় আছে এখন, আপনি জানেন?

শুনেছিলুম, মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন কোথায়। তবে শোনা কথা। কে বলেছিল, মনে নেই। আসলে হাবুলদার সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ ছিল না। তারপর হঠাৎ মাসতিনেক আগে হাবুলদার একটা চিঠি পেয়েছিলুম কনকপুর বৃদ্ধাশ্রম থেকে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিলুম। উনি আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন। আমার অবস্থা ভালো নয়। তিন মেয়ের মধ্যে দুমেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। স্কুল থেকে রিটায়ার করেছি। তো কথায় কথায় ওঁকে সেই হীরেগুলোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলুম। উনি রেগে গিয়েছিলেন। বলতে লজ্জার কারণ নেই স্যার, আমি তবু হাবুলদার কাছে অনেকবার গেছি। হীরেগুলো বিক্রি করলে ওঁকে আশ্রয় দিতে পারতুম। মেয়েদের বিয়ে দিতেও পারতুম। কিন্তু হাবুলদা আমাকে ফিরিয়ে দিতেন। তারপর দেখুন, এখন কী অবস্থা হল। হাবুলদা মারা গেলেন। আটখানা হীরে হাতছাড়া হয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, তাহলে ওঁর মেয়ের খবর আপনি জানেন না?

ভেতরের দরজার কাছে ননীবাবুর স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার ভদ্রমহিলা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, আর চেপে রাখার কী দরকার? আমার শাশুড়ি যাকে অত সেবাযত্ন করতেন, যার যখের ধন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, সে যেমন কর্ম তেমনই ফল পেয়েছে। শেষ বয়সে কেন হাবুলবাবুর ওই দশা হয়েছিল, শাশুড়ি কি বলেননি তোমাকে?

ননীবাবু বললেন, আহা! ওসব কেলেঙ্কারির কথা কি এঁদের বলা উচিত?

ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি না পারো, আমি বলছি। মাত্র পনেরো-ষোল বছরের অমন সুন্দরী মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাইয়ের নামে সর্বস্ব লিখে দিয়েছিলেন। সেই জামাই একজন বজ্জাত মাতাল। ভুবনেশ্বরের লোক সে। সুতপা তার অত্যাচারে পালিয়ে এসেছিল। আপনাদের জানা দরকার এ কথা। সুতপারও কিছু দোষ ছিল। আমাদের বাড়িতে একমাস থাকল। আমাদের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। তার ওপর দেমাকি চালচলন মেয়ের। আমার মেয়েরা ওকে পছন্দ করত না। শেষে একদিন একটু ঝগড়াঝাটি মতো হল। তারপর মেয়েও বাবার মতো নিখোঁজ হয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, কতদিন আগে?

তা বছর দেড়েক হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা ঘুরে কাকে বললেন, তিন্নি! তোরাই তো বলছিলি সুতপা এখন নাম বদলে–

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, সিনেমার হিরোইন হয়েছে। তার নাম নীলা রায়।

আমি চমকে উঠেছিলুম। ননীবাবু নিস্পলক চোখে তাকিয়েছিলেন। তিন্নি নামে তরুণীটি মুখ বের করে বলল, ফিল্মম্যাগাজিনে সুতপাদির ছবি দেখেছি। নীলা রায়ের ছবি দেখেই সুতপাদিকে চিনতে পেরেছিলুম।

তিন্নির মা বললেন, মেয়ে এখন বাবার কথা ভুলে গেছে। খবরের কাগজে খবরটাও কি তার চোখে পড়েনি? সুতপা কোথায় থাকে জানি না। জানলে বলে আসতুম, তুমি সিনেমায় মেতে আছ, ওদিকে তোমার বাবা কী অবস্থায় মারা গেলেন। ধিক্ তোমাকে!

কর্নেল বললেন, আমরা উঠছি। নীলা রায়ের ছবি দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। কারণ তার দশবছর বয়সে তাকে আমি দেখেছিলুম। তার একটা ছবি তুলে রেখেছিলুম। যাই হোক, হীরার আশা আপনারা করবেন না। যদি তা উদ্ধার করা যায়, তার মালিক হবেন ভারত সরকার।

বলে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। তাকে অনুসরণ করে বললুম, কর্নেল! এ যে নাটকীয় ঘটনা। আপনি জেনেও নীলা রায়ের প্রকৃত পরিচয় চেপে রেখেছিলেন।

কর্নেল হাসলেন, আমার অনুমান সত্য কি না তা যাচাই হয়ে গেল। দশবছরের বালিকার চেহারা কুড়িবছর বয়সে বদলে গেছে। প্রসাধনের প্রলেপ পড়েছে। তাই সন্দেহ পুরোপুরি যায়নি। এবার সব বিভ্রম ঘুচে গেল।…

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললুম, আশ্চর্য লাগছে কর্নেল! ননীবাবু শিক্ষিত মানুষ। তিনি ফিল্ম স্টুডিয়োমহলে খোঁজ করলে প্রবুদ্ধবাবুর মেয়ের ঠিকানা পেতেন। নীলা সিনেমার নায়িকা হয়েছে বলে নিজের বাবার মৃত্যুর খবর পেলে চুপ করে বসে থাকত, এটা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ননীবাবু নিজে একা গিয়ে প্রবুদ্ধবাবুর শবদাহ করে এলেন।

যখের ধনের লোভ, এ এক সাংঘাতিক লোভ। মেয়ে গিয়ে যদি হীরাগুলো হাতিয়ে নেয়, সেই ভেবেই ননীবাবু তার হাবুলদার মেয়ের ঠিকানা জানতে ছোটাছুটি করেননি। নিজেই ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু অনাদিবাবুর কাছে ধাক্কা খেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েছেন।

কিন্তু সেই হীরার খোঁজ তো আপনি বা পুলিশ কেউই পাননি।

 কর্নেল শুধু বললেন, দেখা যাক।

এবার কোথায় যাবেন?

 হোম! সুইট হোম! দেড়টা বাজতে চলল।…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে স্নানাহারের পর ড্রয়িংরুমের ডিভানে ভাতঘুমের আশায় শুয়ে পড়েছিলুম। ষষ্ঠীচরণ একটা কম্বল দিয়েছিল। কর্নেলকে দেখেছিলুম, কী একটা গাব্দা বই খুলে ইজিচেয়ারে বসে আছেন এবং মুখে জ্বলন্ত চুরুট।

টেলিফোনের বিরক্তিকর শব্দে ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কাত হয়ে দেখলুম, কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ। বলছি।… বলুন মিঃ ব্যানার্জি!… ও মাই গড! কখন?… কেউ লক্ষ করেনি?… কিন্তু আপনাদের লোক তো ওখানে ছিল!… বুঝেছি। ঘরের ভেতরে কী হচ্ছে, বাইরে থেকে কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।… বলেন কী! ঘাটের পাশে পড়েছিল? ছড়িটা আস্ত ছিল, না ভাঙা?… হ্যাঁ। আমি এখনই বেরুচ্ছি। ডেডবডি যেমন আছে তেমনই থাক। রাখছি।

আমি ততক্ষণে কম্বল ছেড়ে উঠে বসেছি। বললুম, আবার ডেডবডি? কার? কোথায়?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সকাল দশটা নাগাদ কানু নামে সেই ছেলেটি শুভময়বাবুর ঘরে ঢুকে দেখতে পায়, তিনি খাটের নীচে পড়ে আছেন। তার গলায় নাইলনের দড়ির ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে কেউ তাকে মেরেছে। কালো দড়ি নয়। দড়িটা সবুজ রঙের। জয়ন্ত! চলো। পোশাক বদলে এখনই বেরুতে হবে। গাড়ির ফুয়েল পথে নেওয়া যাবে। কুইক।

তখনই গেস্টরুমে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটার এবং জ্যাকেট পরে নিলুম। আমার ফায়ার আর্মসও সঙ্গে নিলুম। কর্নেলও তৈরি হয়ে এলেন। পিঠে যথারীতি কিটব্যাগ আঁটা, গলা থেকে ঝুলন্ত ক্যামেরা ও বাইনোকুলার।

কর্নেল ষষ্ঠীচরণকে বললেন, হালদারমশাই এলে বা টেলিফোন করলে তাকে বলবি আমরা কনকপুর গেছি। সেখানে আবার একটা খুন হয়েছে। কনক-পুর। মনে থাকবে তো?

যষ্ঠী বলল, কনকপুর তো? খুব মনে থাকবে।

নীচে নেমে গাড়িতে উঠে সবে স্টার্ট দিয়েছি, দেখলুম প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে গেট দিয়ে ঢুকছেন। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হর্ন বাজালুম। তখনি উনি আমাদের দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কাছে এলেন। বললেন, আপনারা যান কোথা? ওদিকে এক কাণ্ড বাধছে।

কর্নেল বললেন, কনকপুরেও এক কাণ্ড বেধেছে। পিছনে উঠে বসুন।

হালদারমশাই গাড়ির ব্যাকসিটে বসে বললেন, মন্টু ঘোষেরে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। সে নীলা রায়ের বাড়িতে ছিল। নীলারে দেখলাম না। মন্টু ঘোষেরে, পুলিশ প্রিজনভ্যানে লইয়া গেল। কাছাকাছি টেলিফোন বুথ ছিল না। তাই কর্নেলসায়েবরে খবর দিতে আইলাম। তা কনকপুরে কী কাণ্ড বাধল?

কর্নেল বললেন, আরও সাংঘাতিক কাণ্ড। চলুন! যেতে যেতে বলছি।..

.

০৮.

শেষবেলায় ধূসর আলোতে সন্ধ্যানীড়কে রহস্যময় মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছিল। আজ অনেক বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বেতারভ্যান থেকে দুর্বোধ্য কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেখে ওসি পরেশ ব্যানার্জি এগিয়ে এলেন। কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন, এস পি সায়েব আসবেন। তার আগে আপনি শুভময়বাবুর ডেডবডি দেখে নিন। আপনার কথামতো ওঁর ডেডবডি অ্যাজ ইট ইজ আছে।

শুভময়বাবুর ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। ঘরের ভেতর আলো জ্বলছিল। কর্নেল ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি উঁকি দিয়ে দেখেই সরে এলুম। বিছানার পাশে মেঝেয় একটু কাত হয়ে পড়ে আছে শুভময়বাবু। গলায় সবুজ নাইলন দড়ি শক্তভাবে আটকানো। হালদারমশাই দরজার ভেতর পা বাড়িয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন, কর্নেল স্যার! দ্যাখছেন কাণ্ড? সিলিং ফ্যানে ওটা কী ঝুলতাছে?

ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, দেখেছি। খুনী সিলিং ফ্যানের গোড়ায় মোটা নাইলনের দড়ি বেঁধে রেখেছিল। শুভময়বাবুকে শ্বাসরোধ করে মেরে তার বডি ওখানে লটকাতে চেয়েছিল, যাতে শুভময়বাবু আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু সেই সুযোগ বা সময় সে পায়নি।

কর্নেল বললেন, ঠিক বলেছেন। তবে এ থেকে বোঝা যায় খুনীর গায়ের জোর আছে। শুভময়বাবুর লাশ টেনে তোলা তার পক্ষে কঠিন ছিল না। এই মোড়াটা উল্টে পড়ে আছে, তা থেকে বোঝা যায়, সে বিছানার ওপর মোড়া রেখে তার ওপর চড়ে সিলিং ফ্যানে ফাসবাঁধা দড়িটা লটকে দিয়েছিল।

হ্যাঁ। বিছানায় মোড়ার গোল দাগ আছে দেখুন।

লোকটা লম্বা এবং তার স্বাস্থ্য মজবুত।

ওসি চাপাস্বরে বললেন, আপনার কথামতো মদনমোহন বোসের দিকে আমার লোক নজর রেখেছিল। আজ বেলা আটটা নাগাদ বোসবাবু শুভময়বাবুর ঘরে ঢুকেছিলেন। দুজনে গল্প করছিলেন। বটতলার আড়াল থেকে এই ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। কানু দুজনের জন্য দ্য দিয়ে গিয়েছিল। আধঘণ্টা পরে বোসৰাবু তার ঘরে চলে যান। কানু এঁঙ্গে, কাপ নিতে এসে শুভময়বাবুকে কাগজ পড়তে দেখেছিল। তবু আমি বোসবাবুর হাইট এবং মোড়ার হাইট মেপে দেখেছি। বোসবাবুর পক্ষে সিলিং ফ্যামে দড়ি বাঁধা সম্ভব। কিন্তু বোসবাবুর শরীরের অবস্থা যা, তাতে একাজ সম্ভব, মনে হয়নি। তারপর এখানকার কর্মচারী গোবিন্দকে জেরা করে জানতে পারলুম, আজ সকাল নটা নাগাদ বোসবাবুর নাতি মন্টু ঘোষ এসেছিল। গোবিন্দ তাকে তার দাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে বটতলার দিকে আসতে দেখেছিল। কিন্তু তাকে তখন বাজারে যাওয়ার জন্য ম্যানেজার কেশববাবু ডাকছিলেন।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, মন্টুবাবুরে পুলিশ কলকাতার নাকতলা এরিয়ার একজন ফিল্মস্টারের বাড়িতে আজ তিনটার সময় অ্যারেস্ট করছে।

ওসি পরেশ ব্যানার্জি বললেন, আমরা সে-খবর পেয়ে গেছি। কর্নেল সায়েব! মন্টু ঘোষ আজ সকাল নটা পনেরোতে সন্ধ্যানীড়ে এসেছিল। আগেকার ভিজিটরস্ বুক আমাদের হাতে। তাই নতুন ভিজিটরস্ বুক করা হয়েছে। ম্যানেজার কেশববাবু ওতে আগের মতো মন্টু ঘোষের সই করিয়ে নিয়েছেন। কেশববাবুর কাছে জেনেছি, মন্টু ঘোষ তার দাদু বোসবাবুর মতোই লম্বা। তার চেয়ে বড় কথা, তার শরীরের গড়ন বলিষ্ঠ। সে মারুতি গাড়িতে চেপে প্রায়ই দাদুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। ওদিকে আমাদের কলকাতা পুলিশ ফোর্সের খবর, সে একজন ফিল্মমেকার। দাদুকে তার একটা বাড়ির আনরেজিস্টার্ড ডিডে মালিকানা নিজের নামে লিখে সই করার জন্য পীড়াপীড়ি করতেই সে আসে। বাড়িটা সে কোনও প্রোমোটারকে বেচতে চায়। কারণ সিনেমা করার জন্য তার প্রচুর টাকা দরকার।

কর্নেল বললেন, জানি। এসব কথা আপনাকে আমি আভাসে বলেছিলুম।

ওসি একটু হেসে বললেন, আমরা ব্যাপারটাতে কনফার্মড হয়েছি।

কিন্তু শুভময়বাবুকে মন্টু ঘোষের খুন করার মোটিভ কী?

ওসি পরেশ ব্যানার্জি বললেন, পরে ব্যাপারটা নিয়ে কথা হবে। এবার আমরা ডেডবডি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করি? অ্যাম্বুল্যান্স অপেক্ষা করছে।

হ্যাঁ। আমার আর দেখার কিছু নেই। তো শুভময়বাবুর ঘরে খুনী কিছু খুঁজেছিল কি না লক্ষ করেছেন?

আপনিই দেখুন। কোথাও খোঁজাখুঁজির চিহ্ন আমরা পাইনি।

কর্নেল চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন, নাহ্। কোনও জিনিস এলোমেলো অবস্থায় নেই।….

একটু পরে অ্যাম্বুল্যান্স গাড়ি শুভময়বাবুর মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। আলো জ্বলে উঠেছে। কর্নেল ওসি মিঃ ব্যানার্জিকে বললেন, সেই ছড়িটা দেখতে চাই

ওসি একজন পুলিশ অফিসারকে ডাকলেন। তিনি পুলিশের ভ্যান থেকে ছড়িটা নিয়ে এলেন। মিঃ ব্যানার্জি বললেন, ছড়িটা ঘাটের বাঁদিকে ঝোঁপের মধ্যে পড়ে ছিল।

কর্নেল বললেন, এটা আমি শুভময়বাবুর ঘরে দেখেছিলুম। তবে এ ছড়ি তারও নয়। এটা প্রবুদ্ধবাবুর।

বলেন কী!

 হ্যাঁ। ঘাটে প্রবুদ্ধবাবুর হাত থেকে এটা ছিটকে পড়েছিল। শুভময়বাবু এটা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে ছাড়া আর কাকেও একথা বলেননি। আরও একটা কথা আপনাকে এবার জানাবার দরকার মনে করছি। প্রবুদ্ধবাবুর পকেট থেকে তার ঘরের চাবি তিনি তৎক্ষণাৎ বের করে নিয়েছিলেন। এমন কি প্রবুদ্ধবাবুর ডেডবডি নিয়ে যখন হইচই চলেছে, তিনি সবার অলক্ষ্যে প্রবুদ্ধবাবুর ঘরে ঢুকেছিলেন।

কেন?

 প্রবুদ্ধবাবুর ঘর থেকে কিছু চুরি গেছে কি না দেখতে চেয়েছিলেন।

এটা অদ্ভুত কৈফিয়ত! বিশ্বাসযোগ্য নয়।

কর্নেল কোনও মন্তব্য না করে ছড়িটার গোড়ার দিকে কিছুটা অংশ পেতলে বাঁধানো মোটা হাতল ঘোরাতে শুরু করলেন। হাতলটা খুলে গেল। ছড়িটার ভেতর এক ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত। কর্নেল ছড়িটা উপুড় করে হাতের তালুতে ঠুকলেন। তারপর বললেন মিঃ ব্যানার্জি! এর মধ্যে আটখানা হীরা ছিল। তবে হীরাগুলো কাটাই করা নয়। খনিজ হীরা বলতে পারেন। কাটাই না করলে হীরাকে হীরা বলার সমস্যা আছে!

ওসি পরেশ ব্যানার্জি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আপনি জানতেন?

কর্নেল তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে ভাজকরা সেই জীর্ণ এক্সারসাইজ খাতাটা ওসি-কে দিয়ে বললেন, আপনি এটা পড়ে দেখেননি। আমি আপনাকে এটা সিজ করতে বলেছিলুম। কারণ এই খাতায় প্রবুদ্ধবাবু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এবার এটা আপনি পড়লে হীরার খবর পেয়ে যাবেন।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, চলুন! আমরা অফিসে গিয়ে বসি।

আমরা অফিস ঘরে বসার পর ম্যানেজার কেশববাবু ক্যান্টিন থেকে চা আনতে গেলেন। ততক্ষণে কর্নেল মোটা ছড়ির মুখে হাতলটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এঁটে দিয়েছেন। পরেশ ব্যানার্জি এক্সারসাইজ খাতার পাতায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। গোবিন্দ ট্রেতে চায়ের কাপ-প্লেট রেখে চলে গেল। ওসি বললেন, কেশববাবু! আপনি এখন বাইরে যান। হা–অনাদিবাবু কোথায়?

ম্যানেজার বললেন, মন্দিরে আছেন স্যার!

ঠিক আছে। দরকার হলে আপনাদের ডাকা হবে।

চা খেতে খেতে প্রবুদ্ধবাবুর আত্মজীবনীর একটা পাতার দিকে তাকিয়ে ওসি বললেন, হ্যাঁ–এখানেই হীরার কথা লেখা আছে দেখছি। মোহনপুর রাজবাড়ির হীরা! কী আশ্চর্য! ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা।

কর্নেল চুপচাপ চা খাচ্ছিলেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এই সময় চাপাস্বরে কর্নেলকে বললেন, শুভময়বাবু হীরার খবর জানলেন ক্যামনে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ওঁরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কাজেই অনুমান করা যায়, প্রবুদ্ধবাবু এখানে এক মূর্তিমান শয়তানকে আবিষ্কার করার পর ভয় পেয়েই হীরার কথা শুভময়বাবুকে বলেছিলেন। তবে শুভময়বাবুকে তিনি হীরাগুলো কোথায় রেখেছেন, তা জানাননি। জানালে শুভময় তার মৃত্যুর সময় তার চাবি হাতিয়ে তার ঘরে হীরা খুঁজতে যেতেন না।

ওসি প্রবুদ্ধবাবুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর দিকে চোখ রেখে বললেন, কর্নেলসায়েব ঠিকই বলছেন। শুভময়বাবু

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, কিন্তু শুভময়বাবু আগে প্রবুদ্ধবাবুর ছড়িটি কেন কুড়িয়ে নিয়েছিলেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। হালদারমশাইয়ের মাথায় কিছু এলে বলুন। শোনা যাক।

গোয়েন্দাপ্রবর যেন বলার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, আমার মাথায় একটা থিয়োরি আইয়া পড়ল।

বলুন!

প্রবুদ্ধবাবুর ছড়িতে অষ্টখণ্ড হীরা লুকানো আছে, তা শুভময়বাবু ট্যার পাইছিলেন। হয়তো সবসময় প্রবুদ্ধবাবুর হাতে ছড়িখান থাকত। তাই শুভময়বাবু–

তার কথার ওপর ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, ইউ আর রাইট মিঃ হালদার! আমরা তদন্ত করে জেনেছি প্রবুদ্ধবাবুর হাতে সবসময় এই ছড়িটা থাকত। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ছড়িটা পাশে রাখতেন। কানু চা দিতে গিয়ে কতবার দেখেছে।

কর্নেল বললেন, তাহলে শুভময়বাবু মৃত প্রবুদ্ধবাবুর পকেট থেকে চাবি হাতিয়ে তার ঘরে ঢুকেছিলেন কেন?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ চাপাস্বরে বললেন, ওই খাতায় প্রবুদ্ধবাবু হীরার কথা লিখেছিলেন। শুভময়বাবুকে উনি কইয়া থাকবেন, আত্মজীবনী লিখতাছি। তাছাড়া বন্ধুরে মোহনপুর রাজবাড়ি না কী কইলেন, সেখানে হীরা লুঠের ঘটনা কইছিলেন। হয়তো আত্মজীবনী বন্ধুর সামনে পড়ছিলেন। আমার থিয়োরি হইল গিয়া, অষ্টখণ্ড হীরার কথা ওই খাতাটা হাতাইয়া লইলে আর কেউ জানতে পারত না। কী কন জয়ন্তবাবু?

আমরা তিনজনে একবাক্যে বললুম, ঠিক।

তারপর ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, তাহলে আপনার মতে এই খাতাটা চুরি করার জন্য প্রবুদ্ধবাবুর ঘরে ঢুকেছিলেন শুভময়বাবু?

আমার তো তাই মনে হয়। বলে হালদারমশাই কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেলস্যার কী কন?

কর্নেল বললেন, শুভময়বাবুর ওপর সন্দেহ আমার এখানে আসার পরই হয়েছিল।

তার কুড়িয়ে নেওয়া প্রবুদ্ধবাবুর ছড়িটা পরীক্ষা করা আমার উচিত ছিল। কিন্তু প্রবুদ্ধবাবুর চিঠিতে লেখা মূর্তিমান শয়তানটাকে তার সঙ্গে কোনও যুক্তিতে মেলাতে পারিনি। তাই আমি সেই মূর্তিমান শয়তানকে আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলুম। ছড়িটার কথা ভুলে গিয়েছিলুম।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি খাতা বুজিয়ে রেখে বললেন, তাহলে হীরা হাতানোর জন্য শুভময়বাবুই ভোলা জেলের জালের গোড়া থেকেই কালো নাইলনের দড়ি কেটে নিয়েছিলেন এবং ঘাটের চত্বরে ফাটলের ওপর দিয়ে টানটান করে বেঁধে রেখেছিলেন। তিনি জানতেন সূর্যোদয় দেখার জন্য অনেক ভোরে প্রবুদ্ধবাবু ঘাটে গিয়ে বসে থাকেন। কর্নেলসায়েব! পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং যুক্তি অনুসারে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হচ্ছে। আপনি কী বলেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এ সিদ্ধান্তে যুক্তি আছে। তবে এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে একটা দৃঢ় তথ্যের ওপর।

কী তথ্য?

 প্রবুদ্ধবাবুর ছড়িটা ঘাটের পাশের ঝোপে কে ফেলে দিয়েছিল?

ওসি পরেশ ব্যানার্জি নড়ে বসলেন। মাই গুডনেস! মালী হারাধন একটা কথা বলেছে। আমরা কথাটার গুরুত্ব দিইনি। আপনার প্রশ্নের পর মনে হচ্ছে, কথাটার গুরুত্ব আছে। বলে ওসি একজন অফিসারকে ডেকে মালী হারাধনকে এখানে আনার নির্দেশ দিলেন।

একটু পরে একটা মধ্যবয়সী বেঁটে লোক কম্বল গায়ে জড়িয়ে মাথায় মাফলার বেঁধে বলির পাঁঠার মতো ঘরে ঢুকে করজোড়ে প্রণাম করল। ওসি বললেন, তোমার নাম হারাধন?

আজ্ঞে হ্যাঁ সার!

 তুমি এখানে মালীর কাজ করো?

আজ্ঞে।

 আজ কখন তুমি শুভময়বাবুকে ঘাটের দিক থেকে আসতে দেখেছিলে?

আজ্ঞে, তখন সূর্য উঠে গেছে। আমি মন্দিরের দিকে ফুলের ঝারি নিয়ে যাচ্ছিলুম। তখন বাবুকে আসতে দেখলুম।

তা তো দেখলে। তুমি বলছিলে, শুভময়বাবু আস্তে হাঁটাচলা করেন। কিন্তু উনি খুব তাড়াতাড়ি ঘাটের দিক থেকে এসে তার ঘরে ঢুকলেন!

হ্যাঁ সার! মনে হল খুব ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটছেন।

 তার হাতে কোনও ছড়ি ছিল?

না সার!

কিন্তু তুমি বলছিলে, ফুল তোলার সময় তাঁকে ঘাটের দিকে যেতে দেখেছিলে?

হ্যাঁ সার। তখনও খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছিলেন।

ওসি পরেশ ব্যানার্জি বললেন, কর্নেলসায়েব! শুভময়বাবুকে হারাধন ওভাবে যাতায়াত করতে দেখে একটু অবাক হয়েছিল। তাই না হারাধন?

আজ্ঞে হ্যাঁ সার।

এবার মনে করে বলো তো, ঘাটে যাবার সময় শুভময়বাবুর হাতে কি ছড়ি ছিল?

হারাধন বলল, ছিল সার! কাল থেকে সবসময় একটা ছড়ি হাতে এঁকে বেড়াতে দেখেছি।

এই ছড়িটা কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই ছড়িটাই বটে। তবে সার, একইরকম ছড়ি আমি দত্তবাবুর হাতেও দেখেছি।

ঠিক আছে। তুমি যাও।

হারাধন মালী বেরিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্তটা শক্ত একটা ভিত্তি পেল। শুভময়বাবু ছড়ির ভেতর থেকে হীরাগুলো বের করে নিয়েছিলেন। তারপর ছড়িটা বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। ঘাট থেকে সহজেই চোখে পড়ে, এমন জায়গায় না ফেলে ছড়িটা তিনি কাছে রাখতে পারতেন। কিন্তু কেন তা করেননি? এর সহজ জবাব হল, তিনি প্রবুদ্ধবাবুর ছড়ি চুরির দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি নিজেই ছড়ি আবিষ্কার করে হইচই বাধাতেন। বাঁট খুলে দেখাতেন, এর ভেতর রত্ন ছিল। আসলে– কর্নেল একটু হেসে বললেন, আসলে তিনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছিলেন, প্রবুদ্ধবাবুর আত্মজীবনী লেখা খাতাটা আমি খুঁজে বের করেছি। এতে হীরার কথা আছে। তাই এত সতর্কতা!

ওসি মিঃ মুখার্জি বললেন, কিন্তু হইচই বাধানোর সুযোগ শুভময়বাবু পাননি। খুনী তাকে মেরে ছড়িটা খুঁজেছে। পায়নি। তাই তাঁকে সিলিং ফ্যানে লটকানোর চেষ্টা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কর্নেল বললেন, মন্টু ঘোষকে আপনারা খুনী সাব্যস্ত করেছেন।

 হ্যাঁ। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে দেখা যাচ্ছে, মন্টু ঘোষই খুনী।

 কিন্তু সে কেমন করে জানল ছড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখা হীরার কথা?

পরেশ ব্যানার্জি মুচকি হেসে বললেন, ওর দাদু মদনমোহন বোস–

কর্নেল বললেন, ওঁর আসল নাম মনমোহন বোস। এই ভদ্রলোকের ব্যাকগ্রাউন্ড আমি পেয়ে গেছি। ইনি নাম বদলে এখানে এসে জুটেছেন। যাঁদের রেফারেন্সে এসেছেন, তারা এখন বেঁচে নেই। ফরমে তারা নামটা খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেননি। নাতির অত্যাচারই তাঁর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার মুখ্য কারণ। কিন্তু এই মনমোহন বোস ব্রিটিশ আমলে ছিলেন বিপ্লবীদের দলে পুলিশের চর। প্রবুদ্ধবাবু এঁকে বিপ্লবী বলে মনে করতেন। তাই বন্ধু বোসবাবুর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর এই বোসবাবুই প্রবুদ্ধবাবুকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সম্ভবত পুলিশের হাতে প্রবুদ্ধবাবুকে তুলে দেওয়ার কারণ প্রবুদ্ধবাবুর হীরাগুলো হাতানো। কিন্তু বুদ্ধিমান প্রবুদ্ধবাবু তা তার তোরঙ্গে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বোসবাবুর কাছে আশ্রয় নেওয়ার আগে সেই তোরঙ্গ আর বিছানা ননীগোপাল চৌধুরির মায়ের কাছে রেখে এসেছিলেন। ননীবাবু তখন বালক মাত্র। তাঁদের বাড়িতে থেকে প্রবুদ্ধবাবু বিধবা আত্মীয়াকে বিপদে ফেলতে চাননি। বোসবাবুর কাছে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ ভেবেছিলেন।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, জেরার চোটে বোসবাবু স্বীকার করেছেন, তাঁর নাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি নাকি তাঁকে বলেছিলেন, প্রবুদ্ধ দত্ত এবং শুভময় ঘোষ টেররিস্ট ছিলেন। তাঁদের কাছে কাথির ট্রেজারি লুঠ করে আনা ধনরত্ন আছে। নরেন মাইতি টেররিস্ট দলে ছিলেন। নরেন মাইতি কিন্তু একপয়সারও অংশ পাননি। আজ বোসবাবুর নাতির আসবার কথা ছিল। তাই বোসবাবু সকালে শুভময়বাবুর কাছে কথার ছলে ধনরত্নের খবর আনতে গিয়েছিলেন।

তারপর মন্টু ঘোষ এলে বোসবাবু তাকে শুভময়বাবুর ঘরে আততায়ী হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।

ওসি ভুরু কুঁচকে বললেন, বোসবাবুকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি। তিনি রাজসাক্ষী! আপনি কি বলতে চান বোসবাবু মিথ্যা বলেছেন?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীরমুখে বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! একথা সত্য যে, প্রবুদ্ধবাবু যাকে মূর্তিমান শয়তান বলে আবিষ্কার করে ভয় পেয়ে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন, তিনি অবশ্যই এই মনমোহন বোস। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু নাতির অত্যাচার থেকে বাঁচতে তিনি নাতিকে দিয়ে খুন করিয়ে তাকে ফাসাবেন, এতবড় ঝুঁকি তিনি নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ তার নাতির হাতে কলকাতার সাংঘাতিক দুবৃত্তদের একটা গ্যাং আছে। রাজসাক্ষী হয়ে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে বোসবাবু নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারবেন না, তা তার ভালোই জানা আছে।

তা হলে বোসবাবু কি মিথ্যা বলেছেন?

সম্পূর্ণ মিথ্যা। কাঠগড়ায় উঠে বোসবাবু একেবারে বিপরীত কথা বলবেন, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। নাতির হাত থেকে রেহাই পেতে এই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা বোসবাবু নিয়েছেন।

ওসি পরেশ ব্যানার্জি গম্ভীর হয়ে বললেন, তাহলে কে খুন করল শুভময়বাবুকে?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, শুভময়বাবুর ঘর লক করা আছে হ্যান্ডকাফ দিয়ে। কিন্তু পুলিশ পাহারা কি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে?

না। কারণ তার ঘরে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও আবার ভালোভাবে সার্চ করা দরকার। বিশেষ করে আপনি আসছেন বলে আপনার উপস্থিতিতে সার্চ করার প্ল্যান ছিল আমার।

বাঃ! চলুন তাহলে শুভময়বাবুর ঘরে যাই।

বারান্দায় পুলিশ প্রহরীরা টহল দিচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল। ওসি পকেট থেকে চাবি বের করে প্রথমে হ্যান্ডকাফ, তারপর তালা খুললেন। ভেতরে আলো জ্বলছিল। জানালাও বন্ধ ছিল।

আমি এবং হালদারমশাই দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলুম। কর্নেল এবং ওসি পরেশ ব্যানার্জি ভেতরে ঢুকলেন! কর্নেল খাটের কাছে গিয়ে তাঁর খুদে কিন্তু জোরালো টর্চ জ্বেলে বললেন, বাঃ! আপনার অফিসাররা চকের দাগে ডেডবডির পজিশন চিহ্নিত করে রেখেছেন।

বলে তিনি খাটের নীচে টর্চের আলো ফেলে বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! তখন এই লাল দাগগুলো আমার চোখে পড়েছিল। আমি আগে আপনার তদন্ত এবং মতামত জানতে চেয়েছিলুম বলে এদিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিনি। তাছাড়া এই দাগগুলো সহজে চোখে পড়ার কথাও নয়। কারণ খাটের এই পায়ার কাছে লাল দাগ মেঝের লাল রঙের সঙ্গে প্রায় মিশে আছে।

ওসি হাঁটু মুড়ে বসে বললেন, ও মাই গড! এগুলো কি রক্তের দাগ? হ্যাঁ। নাইলনের দড়িতে ফাঁস আটকে শুভময়বাবুকে মারার সময় খুনীর আঙুল বা হাতের তালু দড়ির টানে কেটে গিয়েছিল।

কর্নেলের কথা শোনামাত্র ওসি মিঃ মুখার্জি বললেন এক মিনিট। আসছি।

তিনি বেরিয়ে গিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে চাপাস্বরে কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে এলেন। কর্নেল চারদিকের দেওয়ালে টাঙানো প্রকাণ্ড ছবিগুলো দেখছিলেন। তিনি বললেন, সম্ভবত খুনী–

বলে কর্নেল হঠাৎ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওসি বললেন, বলুন!

কর্নেল বললেন, নেতাজির ছবিটা একটুখানি উঠে গেছে ওপরে। ফ্রেমের দাগটা লক্ষ্য করুন। দেওয়ালে নীচের ফ্রেমের পুরনো দাগ দেখতে পাচ্ছি। নীচের ফ্রেম কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে উঠে আছে। তার মানে ছবিটা সরানো হয়েছিল। তারপর আবার টাঙানো হয়েছে।

বলে তিনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার ওপর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সাবধানে প্রকাণ্ড ছবিটা নামিয়ে আনলেন। চেয়ার থেকে নেমে তিনি ছবিটা বিছানার ওপর উপুড় করলেন। অবাক হয়ে দেখলুম, পেছনে কয়েকপ্রস্থ এক ইঞ্চি চওড়া একটা ছোট্ট প্যাকেট আষ্টেপৃষ্ঠে সাঁটা আছে। প্যাকেটটা মিষ্টির প্যাকেট। কনকপুরের একটা সন্দেশের দোকানের নাম ছাপানো আছে।

ওসি বললেন, মাই গুডনেস! ওতেই কি সেই–

তা-ই মনে হচ্ছে। জয়ন্ত! হালদারমশাই! ভেতর থেকে দরজা আটকে দিন। বলে কর্নেল টেপগুলো ছবির পিছনের কাগজসমেত ছিঁড়ে প্যাকেটটা খুললেন। প্যাকেটের ভেতরে কাগজে মোড়া আটটি হীরার টুকরো সাজানো আছে দেখলুম। আলোর ছটায় কিছুটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল হীরাগুলো। পরেশ মুখার্জি চাপাস্বরে বললেন, ঠিকমতো কাটাই না হলে হীরার উজ্জ্বলতা জোরালো হয় না শুনেছি। কিন্তু শুভময়বাবু বুদ্ধিমান হয়েও অমন নির্বোধের মতো প্রাণ হারালেন!

হালদারমশাই বললেন, যকের ধনের লোভ সাংঘাতিক লোভ। কর্নেল স্যার ঠিক কইছিলেন। সেই লোভে বেচারা প্রবুদ্ধবাবুরে দড়িতে আছাড় খাওয়াইয়া মারছিলেন শুভময় রায়। এবারে সেই লোভে অন্যে তারে মারল। কর্নেল স্যার! হু ইজ দ্যাট মার্ডারার?

ওসি মিঃ ব্যানার্জি বললেন, চলুন। এতক্ষণ তাকে অ্যারেস্ট করে অফিসঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আশ্চর্য! আমরা ভাবতেই পারিনি লোকটা এমনভাবে মানুষ খুন করতে পারে। তার দুহাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখেও আমরা সন্দেহ করিনি।…

সন্ধ্যানীড়ের অফিসে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলুম, একটা ফো লোক বসে আছে। তার মাথায় মাফলার জড়ানো! পরনে খয়েরি সোয়েটার। আমরা ঢুকলে সে মুখ নিচু করল। চোখদুটো লাল। ওসি পরেশ ব্যানার্জি বললেন, চিনতে পারছেন কর্নেলসায়েব?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এই নরেন মাইতি সম্পর্কে শুভময়বাবু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেছিলেন। ওর হাত দুটো তুলে ধরুন একটু। সরকারি মহাফেজখানার নথিতে ওর ছবি মিলিয়ে দেখেছি। ওই দুটি হাতে সে অনেক মানুষকে খুন করেছিল। ওর হাত খুনীর হাত।

একজন অফিসার নরেন মাইতির হাত দুটো তুলে ধরলেন। দুহাতের আঙুল এবং তালুতে আধ ইঞ্চি চওড়া ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। হালদারমশাই বললেন, কথা কয় না ক্যান? অরে এটু গুতা দ্যান। মুখ ছাড়বে।

ওসি মিঃ ব্যানার্জি বেটনের গুঁতো মেরে বললেন, তুমি ১৯৪২ সালের অগাস্ট বিপ্লবে নাকি কঁথির ট্রেজারি লুঠ করেছিলে! সরকারি সার্টিফিকেট ঘরে লটকে রেখেছ। মুখ খোলো একটু! শুনি, কী তোমার বক্তব্য?

নরেন মাইতি গলার ভেতর বলল, বিপ্লবী প্রবুদ্ধদাকে যে হীরার লোভে খুন করেছে, তাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব? আমার বিপ্লবী রক্ত–

ওসি-র আর একবার বেটনের গুঁতো খেয়ে নরেন মাইতি চুপ করে গেল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার পুলিশি মেজাজে বললেন, বিপ্লবী রক্ত কইতাছে! হালায় হীরার লোভে মানুষ খুন করছে। আর কইতাছে। বিপ্লবী রক্ত!

নরেন মাইতি এবার জন্তুর মতো গর্জন করে বলল, ক্ষোভ থেকে গেল, ওই বিশ্বাসঘাতক–ব্রিটিশের গুপ্তচর মনা বোসকে খতম করার সুযোগ। পেলুম না।

এইসময় বাইরে জিপের শব্দ শোনা গেল। একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, এস পি সায়েব এসে গেছেন সার!

একটু পরে পুলিশ সুপার রূপক সিনহা ঘরে ঢুকে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেলসায়েব! কিছুক্ষণ আগে রেডিয়ো মেসেজে আপনার কীর্তির খবর পেয়েছি। তখন আমি সন্ধ্যানীড়ের কাছাকাছি। যাই হোক, দি অপারেশন ইজ সাকসেসফুল! মিঃ ব্যানার্জি! আপনাকেও আপনার কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করছি না। আপনি সন্ধ্যানীড়ের পিছনে লেগে না থাকলে এত শিগগির খুনী ধরা পড়ত না। কর্নেলসায়েব তাকে আবিষ্কার করার আগেই সে কেটে পড়ত।

ওসি বললেন, এই যে! এ লোকটা স্যার! নরেন মাইতি নাম। বলছে, তার বিপ্লবী রক্ত শুভময় রায়কে খতম করেছে। কারণ শুভময় রায় প্রবুদ্ধ দত্তকে আছাড় খাইয়ে মেরে ফেলেছিলেন।

ঠিক আছে। পরে সব শুনব। কর্নেলসায়েব! হেমন্তবাবু আমার সঙ্গে এসেছেন। আপনার প্রিয় বন্ধু ওর্নিথোলজিস্ট হেমন্ত রায়। চলুন, তাঁর সুরম্য বাগানবাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাবে। এবং প্রচুর কফি! বলে এস পি পা বাড়ালেন। তারপর একটু ঘুরে ফের বললেন, মিঃ ব্যানার্জি! আপনারা আপনাদের কাজ সেরে ফেলুন।

স্যার! মনমোহন বোস এবং তার নাতি মন্টু ঘোষকে ছেড়ে দিতে হবে।

 ঠিক আছে। মন্টু ঘোষকে রিলিজ করার জন্য কলকাতায় আমি মেসেজ পাঠাচ্ছি।

.

উপসংহার

পরদিন সকালে আমরা কলকাতায় ফিরছিলুম। হেমন্ত রায়ের কালো গাড়ি প্রথমদিনের মতো আমাদের পিছনে আসছিল। উল্টোডিঙির কাছে হেমন্তবাবু কর্নেলকে হাত নেড়ে ডানদিকে চলে গেলেন। আমার গাড়ি চলল ই এম বাইপাস হয়ে।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে দশটা বেজে গিয়েছিল। ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি, চন্দ্রিকা মজুমদার বসে আছে। কর্নেলকে দেখামাত্র সে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার? তুমি কখন এসেছ?

মিনিট দশেক আগে। ষষ্ঠী বলল, আপনি কোথা থেকে ফোন করে ওকে বলেছেন, দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। তাই অপেক্ষা করছিলুম।

কর্নেল হাসলেন, তুমি প্রণাম করলে। তাছাড়া তোমাকে আজ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আশা করি, অনীশের কোনও সুখবর আছে।

চন্দ্রিকা বলল, অনীশ আজ ভোরে এসেছে। সে ট্যাক্সি করে এখানে আসবে। সে বোম্বেতে তার এক বন্ধুর কাছে গতকাল জানতে পেরেছে, মহাবীর ট্রেডিং কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ভগবানদাস কানোরিয়া তার ছেলে অশোককে একটা আর্জেন্ট মেসেজ পাঠিয়েছেন। চন্দ্রিকা একটু হেসে বলল, জনৈক কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অনীশ এবং কোম্পানির বিবাদ মেটাতে মধ্যস্থতা করবেন। অনীশ আমাকে কাল বিকেলে আবার ফোন করে আপনার সম্পর্কে খবর নিতে বলল। তখন আমি ওকে আপনার কথা বললুম। ও কোম্পানির সেই সব গোপন কাগজপত্র আপনার হাতে তুলে দেবে। তারপর ওর প্ল্যান হল বিদেশযাত্রা। আমেরিকার ডালাসে একটা ভালো অফার পেয়েছে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ফ্ল্যাটটা আপাতত একজন বন্ধুকে ভাড়া দিয়ে আমরা যাব। অনীশ বলছে তার পাসপোর্ট আছে। আমারটা করিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না।

ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি ডাক দিলেন, ষষ্ঠী।

একটু পরে ষষ্ঠী একজন শিখ ভদ্রলোককে নিয়ে এল। হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, কী কাণ্ড! অনীশবাবুর মুখোন আমার মুখস্থ হইয়া গেছে। শিখ সাজছেন ক্যান?

চন্দ্রিকা আমাদের সঙ্গে শিখবেশী অনীশ মজুমদারের আলাপ করিয়ে দিল। অনীশ বলল, ঝুঁকি নিতে চাই না বলেই শিখ সেজেছি কর্নেল সরকার!

কর্নেল বললেন, বাঃ! খাঁটি শিখ দেখাচ্ছে। জয়ন্ত জানে, জীবনে আমি বারদুয়েক শিখের ছদ্মবেশ ধরেছিলুম। তো অজয় ঘোষ–মানে, মন্টুবাবু তো তোমার বন্ধু?

অনীশ বলল, হ্যাঁ। আজ সকালে তাকে টেলিফোন করেছিলুম। সে একটা অদ্ভুত ঘটনা শোনাল। পুলিশ নাকি খুনের দায়ে তাকে কাল অ্যারেস্ট করেছিল। দুপুর রাত্রে ছেড়ে দিয়েছে।

তাহলে নীলা রায়কে তো তুমি চেনো। ফিল্মস্টার!

চিনি। কেরিয়ারিস্ট টাইপ। মন্টুর কাছে শুনেছি, ওর জীবনটা নাকি খুব ট্র্যাজিক।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স আনল। আমি বললুম, কর্নেল! নীলাকে তার বাবার খবর দেওয়া উচিত। তাছাড়া শু–

কর্নেল দ্রুত আমাকে থামিয়ে একটু হেসে বললেন, শুনলে তো। নীলার জীবন খুব ট্র্যাজিক। তুমিও জানো তা কতখানি ট্র্যাজিক। আর বাবার কথা তো সে ভুলে গেছে। তার বাবা তার জীবনে আগেই মুছে গেছেন। কাজেই কেন আর বেচারিকে অকারণ বিব্রত করব? সে নিজে যে পথ বেছে নিয়েছে, সেই পথে আনন্দে হেঁটে যাক। জয়ন্ত! মানুষের জীবনের আড়ালে কী একটা অজানা শক্তি যেন আছে। তাই চেষ্টা করেও মানুষ ইচ্ছেমতো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। যাই হোক, চন্দ্রিকা! এবং অনীশ! তোমরা যাতে সুখী হও, সেই চেষ্টার ত্রুটি আমি করব না। আর মহাবীর কোম্পানির মিঃ কানোরিয়ার কাছে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই এবার অনীশ, তুমি তোমার ঝুলির বেড়াল বের করো।

হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললেন, তা কইছেন ভালো। ঝুলির বেড়ালই বটে।…