শ্রীশ্রীমার আধুনিকতা

শ্রীশ্রীমার আধুনিকতা

শ্রীশ্রীমা সারদামণির লীলাকথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে হয় কোন কথাটি নিয়ে আলোচনা করবো? সেই লীলাসমুদ্র তো বহুবিচিত্র ভাবতরঙ্গে উদ্বেল নয়, নয় বহুকর্মের আবর্তে আলোড়িত। সে যেন এক ধীর স্থির প্রশান্ত মহাসাগর। তাই মনে হয় সেই মহাসাগরের কোন তট থেকে ঘট ভরবো? আর ঘট ভরে জল তুলে সমুদ্রের বিশালতার দিশা পাবো কেমন করে?

বস্তুত ঘট ভরে নিয়ে যেমন সমুদ্রের স্বরূপ বোঝা যায় না, তেমনি দুচারটি ঘটনা, দুচারটি অলৌকিক মহিমার উদঘাটন উদ্ধৃত করে মহজীবনের বিরাটত্ব উপলব্ধি করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন আলাদা দৃষ্টির, আলাদা অনুভূতির।

সে অনুভূতি আমাদের কোথায়? কোথায় সেই দৃষ্টি?

তাই প্রায়শই আমরা শ্রীশ্রীমার লীলাপ্রসঙ্গে হয় তাঁকে সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের কারণ-স্বরূপিণী মহালক্ষ্মী মহাজগদম্বা ইত্যাদি কল্পনা করে স্তবস্তুতির ভারে ভাষাকে ভারাক্রান্ত করে তুলি, না হয় তার জীবনের দৃশ্যমান এমন কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বারবার নাড়াচাড়া করে থাকি, যেগুলি তার মহিমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। এর কোনওটাই মূলভাবের দিশা এনে দিতে পারে না। ভাব নেই, তাইতো আমাদের সর্বদাই অভাব। ভাবকে স্বভাবে আনতে শিখলাম কই?

তবু মায়ের কথা আলোচনা করবার সাধ হয় বইকি। আপন অযোগ্যতা জেনেও হয়। আর হয়তো তার প্রয়োজনও আছে। প্রয়োজন আমাদের নিজেদেরই জন্য। দেবতার যে পূজা সে তো দেবতার ভোগের জন্য নয়। মানুষের নিজেরই চরিতার্থতার জন্য।

পূজা, সেবা, স্তব-স্তুতি, জপ, আরাধন, নামকীর্তন ইত্যাদির দ্বারা শুধু যে মনঃশুদ্ধি হয় তা নয়, দেহও বিশুদ্ধ হয়। মাতৃনামে তো আরোই।

তাই মায়ের কথা আলোচনা করার প্রয়োজন মাতৃজাতিমাত্রেরই আছে। অবশ্য প্রয়োজন হিসেবেই আছে।

শ্রীশ্রীমা সারদামণির প্রকটলীলা বহুকর্মের আবর্তে আলোড়িত নয় সত্য, কিন্তু সেই স্থির সমুদ্রের অন্তরালে যে প্রচ্ছন্ন কর্মপ্রবাহ ছিল, তা আজও প্রবহমান।

সমগ্র ভারতের, তথা সমগ্র বিশ্বের নারীশক্তির চেতনার মধ্যে সেই কর্মধারা আজও অব্যাহত। অত্যুক্তি করা হবে না, যদি বলি শ্রীশ্রীমার জীবনাদর্শই আজ সমগ্র ভারতের নারীশক্তিকে জাগ্রত করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে সমগ্র বিশ্বের নারীশক্তিকে। আমরা কিছু পরিমাণে অবতারবাদে বিশ্বাসী হলেও বলবো, সারদামণির মধ্যে যে শক্তি কাজ করেছে সে শক্তি দৈবীশক্তি নয়, নারীশক্তিই।

শ্রীশ্রীমার বহিমূর্তিটি ছিল প্রাচীন আদর্শের প্রতীক, কিন্তু অন্তরমূর্তিটি ছিল আশ্চর্য আধুনিক।

আধুনিক শব্দটি আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম, কারণ গতানুগতিক সংস্কারের বন্ধনমুক্ত যে মন, সেই মনকেই আমরা আধুনিক মন বলে থাকি।

সারদামণিকে আমরা দেখতে পাই শতাব্দীকাল পূর্বের বাংলার রক্ষণশীল গ্রাম্যসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। তাও আবার গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের। যেখানে উনবিংশ শতাব্দীর শহুরে আবহাওয়ার লেশমাত্র গিয়ে পৌঁছয়নি।

তার মধ্যে–সেই নিতান্ত সাধারণ নিতান্ত গণ্ডিবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে গঠিত হয়েও, শ্রীশ্রীমা যে আশ্চর্য সুন্দর একটি আধুনিক মনের অধিকারিণী হয়েছিলেন, তার তুলনা দুর্লভ।

অবশ্য বলা যেতে পারে, আমরা যদি অবতারবাদে বিশ্বাসী, তবে আর এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? যিনি ঈশ্বরের অবতার, তার পক্ষে তো সবই সম্ভব।

কিন্তু ঈশ্বর যখন মানবদেহ নিয়ে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি সাধারণ মানুষের মতই আচার আচরণ করতে ভালবাসেন। তখন তিনি মানুষের মতই সুখে দুঃখে উদ্বেলিত হন, নিন্দা প্রশংসায় বিচলিত হন, আনন্দে হাসেন, বেদনায় কাঁদেন। এই নিজেকে ঢেকে রাখা, অবতার লীলার একটি বিশেষ লক্ষণ।

এ নইলে যে, অবতীর্ণ হওয়াই ব্যর্থ। ঈশ্বরের করুণার স্পর্শ তো মানুষ নিয়তই পাচ্ছে, তবু সে পথভ্রষ্ট হয়। তাই ঈশ্বরকে নেমে আসতে হয় প্রত্যক্ষ স্পর্শের মূর্তিতে। বলতে হয় ওগো আমি তোমাদেরই একজন, বলতে হয় এই যে এসো, এইতো পথ। সত্যের পথ, নির্ভয়ের পথ, নির্ভরের পথ!

স্থূলবুদ্ধি মানুষকে হাত ধরে পথ চিনিয়ে দিতে স্থূলস্পর্শের প্রয়োজন হয় বলেই ভগবানকে যুগে যুগে অবতীর্ণ হতে হয়। অবতীর্ণ হয়ে দেখাতে হয় মানুষীলীলা।

তাই শ্রীরামচন্দ্রকেও সীতাকে হারিয়ে উন্মত্ত শোকে বিলাপ করতে হয়েছিল, আবার লোকনিন্দার ভয়ে সেই সীতাকে দেওয়াতে হয়েছিল অগ্নিশুদ্ধির পরীক্ষা, দিতে হয়েছিল তাকে বনবাস।

মানুষের ভূমিকা নিখুঁতভাবে অভিনয় করবার খাতিরেই রামচন্দ্র প্রচলিত সংস্কারের বন্ধনকে মেনে নিয়েছিলেন, নিরুপায়ের ভঙ্গিতে।

শ্রীশ্রীমাও এই নিয়মের অধীন হয়েই ভাইঝি রাধুর প্রতি অন্ধ আসক্তির খেলা দেখিয়েছেন, পাগলী ভ্রাতৃজায়ার নির্যাতনে কাতরতার ভান দেখিয়েছেন, শতাব্দীকাল পূর্বের সমাজবদ্ধ অবগুণ্ঠিতা বধূর ভূমিকা পালন করেছেন।

শুধু ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কারের আবরণ ভেদ করে বিদ্যুৎদীপ্তির মতই ঝলসে উঠেছে মুক্ত মহিমা। তথাপি একশ বছর আগের গ্রাম বাংলার সেই রক্ষণশীল সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে তিনি কী ভাবে মেনে চলেছেন, কী ভাবে চিরদিন নিজেকে আবৃত রেখেছেন অবগুণ্ঠিতা গৃহস্থবধূর আবরণের অন্তরালে, তা ভাবলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

  দক্ষিণেশ্বরে নহবৎখানায় বাসকালে এই লজ্জাসরম আশালীনতা বজায় রাখতে কত কৃচ্ছ্বসাধন, কত কষ্টস্বীকার!

এ না করলে লোকশিক্ষা হয় না।

মানুষ যখন দেবতার মধ্যে দেবত্বের বিকাশ দেখে, তখন সে বিচলিত হয় না, বলে এ তো হবেই। তুমি মহৎ, তুমি বৃহৎ কারণ তুমি যে দেবতা! এখানে মানুষের ভূমিকা শুধু স্তুতিগানের।

তুমি প্রভু আমি দাস, তুমি বৃহৎ আমি ক্ষুদ্র, আমি অধমাধম, আমি অযোগ্য–এখানে মানুষ নির্বেদ, নিশ্চেষ্ট। সেই নিশ্চেষ্টতার সুর হচ্ছে প্রভু আমার কোন গুণ নেই, তুমি নিজগুণে আমায় উদ্ধার কর।

কিন্তু মানুষ বিচলিত হয় তখন, যখন সে মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিকাশ দেখে। তখন চমকে গিয়ে বলে এ কী? এমনও হয়? তবে কি আমার মধ্যেও রয়েছে এই দিব্য সম্ভাবনা? তবে কি আমিও চেষ্টা করলে মহৎ হতে পারি, বৃহৎ হতে পারি, সুন্দর হতে পারি?

এখানে আমায় তুমি হাত ধরে তোল বলে ধুলোয় পড়ে অপেক্ষা নয়, ধূলিশয্যা ছেড়ে আপনি উঠে দাঁড়ানোর সাধনা।

মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিকাশের সাধনা।

তাই তো ঈশ্বর যখন আর্ত পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তখন দুঃখীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। নইলে যে মানুষ তাকে অবিশ্বাস করবে, দূরে রাখবে। চেষ্টা করবে না।

শ্রীশ্রীমার লীলাভূমিকাও আপাতদৃষ্টিতে দুঃখের বইকি। দীর্ঘ জীবনখানি কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে, আপন সংসার বলতে কিছু নেই, অধিকাংশকাল কেটেছে পিতৃগৃহে ভ্রাতৃজায়াদের সংসারে সেবিকারূপে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম, পরণে ছিন্নবস্তু, অন্নজোটে তো সে অন্নে লবণ জোটে না। সধবা হয়েও দাম্পত্যজীবনের আস্বাদ নেই।

সঙ্ঘজননীরূপা যে মহিমময়ী মাতৃমূর্তি আমরা দেখি, সে তত দীর্ঘজীবন পার করে এসে পরে।

.

পূর্বোক্ত যে জীবনের ভূমিকা শ্রীশ্রীমা গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রত্যেকটিই নিখুঁতভাবে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন।

গৃহস্থ নারীর চারটি রূপ, চারিটি ভূমিকা–কন্যা, ভগিনী, জায়া, জননী।

শ্রীশ্রীমার প্রতিটি রূপই অনবদ্য। কন্যারূপে তিনি অনুপমা, ভগ্নীরূপে অতুলনীয়া, জায়ারূপে অনির্বচনীয়া।

আর জননীরূপে?

 সে রূপের বিশেষণ কোথায় খুঁজে পাব? কোন অভিধানে? কোন শব্দকোষে?

তিনি সহিষ্ণুতার প্রতিমা, মমতার প্রতিমা, করুণার প্রতিমা, আর শক্তির প্রতিমা। অথচ এ শক্তিকে তিনি কোনওদিন কোনও ছলে নিজের প্রয়োজনে লাগান নি।

ঠাকুরের দেহান্তের পর রাণী রাসমণির দৌহিত্র ত্রৈলোক্য বিশ্বাসের দেওয়া মাসিক বরাদ্দ সাতটি টাকাও যখন নানা ষড়যন্ত্রে বন্ধ হয়ে গেল, তখনও তিনি নিরুপায় গ্রাম্যনারীর মতই খুদসিদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। যে অন্নের উপকরণ মাঠ ঘাট থেকে তুলে আনা শাক।

প্রয়োজনবোধ করলেন না এর চাইতে অধিকতর আয়োজনের।

কিন্তু নিজের জীবনে যিনি কোনও কিছুই অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করেন নি, তিনিই ভারতের অসংখ্য মেয়ের জন্য প্রয়োজন অনুভব করলেন এক বিরাট বস্তুর। শুধু অনুভব নয়, দাবী করে বসলেন। বললেন স্ত্রীশিক্ষা চাই।

স্ত্রীশিক্ষা হলে ভাল হয় নয়, স্ত্রীশিক্ষার দরকার একথা নয়, স্ত্রীশিক্ষা চাই!

বললেন ওরে ওরা বড় দুঃখী, ওদের মধ্যে আলো জ্বেলে দে।

অথচ তখনও বাংলার নারীসমাজে এ সংস্কার বলবৎলেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হয়।

মা বললেন ছি ওকি কথা! ওসব হলো কর্মফল। জ্ঞান চাই আলো চাই।

তখনও দেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রশ্ন নিয়ে বিরাট আন্দোলন, বিরাট দলাদলি চলছে। শহরের মহা মহা শিক্ষিত পণ্ডিত-সমাজের মধ্যেও অধিকাংশই স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী, গ্রামাঞ্চলের তো কথাই নেই। সেই পটভূমিকায় জয়রামবাটির একটি প্রৌঢ়ানারী দৃঢ় উক্তি করলেন, মেয়েরা পড়বে বইকি! লেখাপড়া না শিখলে কি ভালমন্দ বোধ জন্মায়?

বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষায় সারদামণির প্রভাব, প্রেরণা ও অবদানের কথা এখানে আলোচ্য নয়, এখানে আলোচনার বস্তু হচ্ছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর।

শ্ৰীমার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর আর একটি বড় উদাহরণ ভগিনী নিবেদিতা!

নিবেদিতা দেবীর অংশ। তবু সমাজ-পরিচয়ে তিনি বিদেশী মেয়ে। ব্রাহ্মণসমাজের গোঁড়ামীতে তখনও বিদেশী স্পর্শে স্নান করার প্রথা জোরালো ছিল। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। সকলদেশেই সর্বকালেই অন্তঃপুরের শুচিতা রক্ষার ব্যাপারে গোঁড়ামীটা প্রবল থাকে, এদেশে তো আরোই।

কিন্তু শ্রীমা অনায়াসেই নিজেকে সে আচার থেকে মুক্ত করলেন! বিদেশী মেয়ে নিবেদিতাকে কাছে টেনে নিলেন ঘরের মেয়ের মত। হাত ধরে বসালেন, ভাষার ব্যবধান ভেদ করে আলাপ করলেন, তাকে বুঝলেন, বুঝে হৃদয়ের মধ্যে ঠাই দিলেন।

কামারপুকুরে ভক্তরা গেছেন, তারা অনেকে হয়তো অব্রাহ্মণও। আহারের পর তারা নিজেদের উচ্ছিষ্টপাত্র তুলতে গেছেন, মা ব্যস্ত হয়ে বলেছেন, থাক্ থাক্‌ রেখে দাও, তোমাদের আর কষ্ট পেতে হবে না, ওসব করবার লোক আছে।

সে লোক আর কেউ নয় স্বয়ং মা সারদামণি। কারণ গ্রামের যে সব দুঃখী মেয়েরা এসব কাজকর্ম করে খেতো, তারাও অনেক সময় সকলের উচ্ছিষ্ট ছুঁতে চাইত না। মা পরে ভক্তদের অসাক্ষাতে নিজে সেই সব উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতেন।

এটা যে কতবড় জিনিস, সেটা আজকের পরিবেশে বিচার করতে গেলে ভুল হবে, বিচার করতে হবে একশো বছর আগের বাংলার গ্রাম-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। যেখানে তখনও অচলায়তনের দেওয়াল প্রস্তর কঠিন।

এই ভয়ঙ্কর অনাচার দর্শনে অন্যান্য আত্মীয়েরা যখন নিন্দাবাদ করেছে, মা হেসে বলেছেন, ওরা যে আমার ছেলে, ওদের সঙ্গে কি আমার জাতের ভেদাভেদ আছে?

অনেকে আবার অন্যপথে নিবৃত্ত করতে চেয়েছে, বলেছে ওরা শিষ্যা, তুমি গুরু। ওরা শুদ্র, তুমি ব্রাহ্মণ। তোমার এই সেবায় ওদের অকল্যাণ।

সেকথাও মা হেলায় হেসে উড়িয়েছেন। বলেছেন, মা-ছেলের সম্পর্কের কাছে কি আর কোন সম্পর্ক দাঁড়ায়?

মুসলমান প্রজা আমজাদের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করার কাহিনীটিই বা কে না জানেন?

তখনকার দিনে এতবড় সাহস বোধকরি কল্পনার অতীত, ধারণার অতীত।

মায়ের স্বচ্ছ বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গীর আরও একটি উদাহরণ আমরা পাই জনৈক গৃহস্থ ভক্তের ব্যাপারে। এ ঘটনাটিও সে যুগের আলোয় দেখতে হবে।

ওই ভক্তটির স্ত্রী বেচারা ভালমানুষ, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তার কষ্টের অবধি নেই। কষ্টের কারণ খোঁজবার দরকার নেই, পরের মেয়েকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা উৎপীড়ন আমাদের দেশে নতুন কথা নয়, এসব অকারণেই হত।

মা জানতে পেরে সেই ভক্তটিকে ডেকে বললেন, আর এরকম চললে যে বৌমা মরে যাবে, তুমি বৌমাকে নিয়ে আলাদা বাসা করো।

এ শুধু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীই নয়, তদানীন্তন কালে রীতিমত সমাজবিপ্লবই বলা চলে।

ভক্তটি বিব্রত হয়ে বললো, মা, এ আদেশ কি করে পালন করি? সামান্য আয়, মা বাপকে পাঠাতে হয়

মা সতেজে বললেন পাঠাতে হবে না। বললেন তাদের আরও ছেলে আছে, তারা কষ্টে। পড়বেন না। বৌমার তুমি ছাড়া আর কে আছে?

শ্রীমার সমসাময়িক আর কোনও বাঙালী মা কি এ মনোভাবের বা এ মনোবলের সমর্থক হতে পারতেন?

এরকম উদাহরণের শেষ নেই।

আবার ভেবে দেখলে উদাহরণটা কিছুই নয়। উদাহরণ তথ্য মাত্র, তত্ত্ব নয়। আর সেই তত্ত্বকে বুঝতে হলে চাই আলাদা অনুভূতি।

কিন্তু শ্রীশ্রীমার তত্ত্ব চিন্তা করতে গেলে, অনুভূতিও বুঝি স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু মনে হয় কে করবে এই তত্ত্বের উদ্ঘাটন?

আমাদের দৌড় ওই তথ্য পর্যন্তই। কাজেকাজেই শ্রীমার ওই সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয়বাহক আরও একটি তথ্য পরিবেশন করেই প্রবন্ধ শেষ করি। এই পরম দৃষ্টান্তটি হচ্ছে মায়ের হাতের লিচুকাঁটা বালা।

ঠাকুরের বিয়োগের পর মা সারদামণির হাতে বালা ও পরণে পাড়ওয়ালা শাড়ী রাখাও কি সেকালে কম অসমসাহসিকতা ছিল?

তবু মা দ্বিধা করলেন না।

ঠাকুর অদৃশ্য থেকে বললেন, বালা খুলছ কেন? আমি কি কোথাও গেছি? শুধু এঘর ওঘর বৈ তো নয়। লোকে বললো স্বপ্ন।

মা কিন্তু সাহসের সঙ্গে সেই বাণীকে জীবনে গ্রহণ করলেন।

 আত্মীয় মহলে কি সমালোচনা উদ্দাম হয়ে ওঠেনি? নিন্দা হয় নি?

 হয়নি এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত।

কিন্তু যিনি আঠারো বছর বয়সে ফলহারিণী কালিকা পূজার রাত্রির সেই ভয়ঙ্কর পরীক্ষা অনায়াসে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন, তাকে আর কিসে বিচলিত করতে পারবে?

সকলেই অবগত আছি, সে যুগে ইসলামধর্মের তিন তালাকের মত আমাদের পবিত্র হিন্দুসমাজেও সহজে স্ত্রীত্যাগের একটি বিধি ছিল। সে বিধি মা বলা। স্ত্রীকে মা বলে ত্যাগ করেছে মানেই পতিপত্নী সম্পর্ক একেবারে মুছে গেছে।

কিন্তু এই অভাবনীয় মাতৃপূজার পরও মা সারদামণি চির সংস্কারের বেড়াজাল কেটে ক্ষ্যাপা মহাদেবের পাশে পার্বতীর মত নিজেকে উৎসর্গ করছেন সেবায়, প্রেমে, শ্রদ্ধায়, স্নেহে।

এ এক আশ্চর্য সৌন্দর্য।

এ এক আশ্চর্য মহিমা!

ঠাকুরের সঙ্গে পতিপত্নী সম্পর্ক তাঁর নিবিড়তম ও গভীরতমই ছিল। তারও যেমন ক্ষ্যাপা ঠাকুরটির জন্য উদ্বেগের শেষ ছিল না, ছিল না ব্যাকুলতার অন্ত, ঠাকুরটিরও তার চাইতে কিছু কম ছিল না। শ্রীশ্রীমা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি। লোকে বলতো তিনি ঘোরতর সংসারী। কিন্তু সন্ন্যাস গ্রহণ না করেও দেহাতীত, লোকাতীত, সংসারাতীত। এই অনির্বচনীয় প্রেমকে তিনি নিঃশব্দে বহন করে গিয়েছেন সাধারণ সংসারের খুঁটিনাটির মধ্যে নিমজ্জিত থেকে।

ভারতের এই আদর্শকে আমরা চিরদিন পুঁথির মধ্যেই দেখে এসেছি, মা সারদামণি এলেন আদর্শের মূর্তি হয়ে।

এ আদর্শ একটি মাত্র যুগের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকার নয়, একটি মাত্র দেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকার নয়, দেশে দেশে কালে কালে যুগে যুগে এ আদর্শ অবিনশ্বর।

শ্রীমার এই ত্যাগের মধ্যে অহঙ্কার নেই, আত্ম অভিমান নেই, এ ত্যাগ স্বচ্ছন্দ সহজাত।

এ ত্যাগ মোহমুক্ত, সংস্কারমুক্ত, বন্ধনমুক্ত, এ আশ্চর্য মনের সহজ অভিব্যক্তি। এই অপূর্ব অভিব্যক্তিখানিই আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে, স্তব্ধ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *