শেষ লেখা

শেষ লেখা

ঘরটা অস্বাভাবিক চুপচাপ। রাত এখন গভীর, কিন্তু গভীর রাতেও কিছু-কিছু শব্দ থেকে যায়। কুকুরের চিৎকার, ছুটে-যাওয়া কোনও ট্রাকের গর্জন, সিলিং-ফ্যানের শনশন, হাওয়ায় ওড়া দেওয়াল-ক্যালেন্ডারের ঘষটানি।

আমার আঙুল তখন দড়িটার গেঁট নিয়ে ব্যস্ত, আমার চোখ একটু দূরে দাঁড়ানো ত্রস্ত মেয়েটির দিকে। বুক-কেসের সামনে শক্ত কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে। লক্ষ করছে আমার প্রতিটি নড়াচড়া। ওর সুন্দর মিষ্টি মুখটা এখন ফ্যাকাসে, সেখানে প্রাণের কোনও অভিব্যক্তি নেই। ভয় নেই, করুণা নেই, এমনকী ঘৃণাও নেই।

দড়ির ফাঁসটা গলায় পরে নিলাম। তারপর কাঁপা হাতে সেটা টেনে আঁট করে বসালাম। বড্ড বেশি শক্ত হয়ে গেছে। একটু টেনে আলগা করলাম ফাঁসটা। মনের মধ্যে নানান ভাবনার ভিড়—একে অপরকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে নিতে চাইছে।

কুন্তলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভয় পেয়ো না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়ালাম। কারণ, বইয়ের থাকের ওপর আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি চাই না, সময় হওয়ার আগেই পায়ের নীচে ভরসাটুকু সরে যাক।

কুন্তলাকে আবার বললাম, কী-কী করতে হবে সব মনে আছে তো?

এসব করার কী দরকার, রাজীব?—কুন্তলার স্বর ওর মুখের মতোই ভাবলেশহীন। যেন পাথরে-পাথরে ঠোকাঠুকি হয়ে তৈরি হওয়া শব্দ। ওর জটিল মনের অন্দরে কী যে আঁকাবাঁকা চিন্তার খেলা চলে তার হদিস কখনও পেলাম না। কুন্তলা অন্য মেয়েদের মতো চিন্তা করে না। ও আলাদা।

না করে উপায় নেই, কুন্তলা—।

সবসময় তুমি একই কথা বলো—আমার বিশ্বাস হয় না। এসব শুধু আমাকে কষ্ট দেওয়ার ফন্দি।

ছেলেমানুষি কোরো না, কুন্তলা!

একটা আবছা হাসি ওর মুখের আড়ষ্টতা নরম করল। মিষ্টি হাসি? নরম হাসি? মোনালিসা?

হঠাৎই ওর হাসি মিলিয়ে গেল। চমকে বলে উঠল, দাঁড়াও!

কেন?—আমার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।

কে যেন আসছে।

বাইরে অন্ধকার বারান্দায় পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দটা একটু ইতস্তত করল, তারপর আবার চলতে শুরু করল। আমি শুধু অপলকে ওকে লক্ষ করছি। ও কি সত্যিই হেসেছে? নাকি কল্পনা?

ওরা চলে গেছে।—আমি অস্পষ্ট গলায় বললাম।

কুন্তলা যেন সে-কথা শুনতেই পেল না। নিষ্প্রাণ সুরে বলল, এসব কাণ্ড করে কি সত্যিই কোনও লাভ আছে, রাজীব?

এটা ওর অন্তরের কথা কি না টের পাওয়া ভার।

আমি কোনও উত্তর দিলাম না। আর-একটা মুহূর্ত অপেক্ষা করে দেখা যাক। এক মুহূর্ত!

একরাশ বইয়ের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস পরে একটা অতিরিক্ত মুহূর্ত কোন কাজে লাগে কে জানে!

ঢোঁক গিললাম। বেশ কষ্ট হল। দড়িটা কেমন করে যেন বেশি এঁটে বসেছে। ঘামে-ভেজা হাতের তালু ঘষে নিলাম প্যান্টের খসখসে কাপড়ে। একটু আগেই দড়িটা ঢিলে করে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি টাইট হয়ে গেছে। আমার মাথার ভেতরে একটা অংশ যুতসই শব্দ খুঁজে বেড়াল। তারপর শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তৈরি করতে লাগল কথা।

‘…তার মনটা মনটা যেন খাঁচায় বন্দি এক উদভ্রান্ত বুনো পাখি…।’

না, এটা ঠিক লাগসই হল না।

‘…তার মন যেন বুনো হাঁসের ডানায় ভর করে…।’

এটা মন্দ নয়। এটাকেই ঘষেমেজে কাল ঠিক করে নেওয়া যাবে। কাল? জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়েও একটা মানুষ আগামীকালের কথা ভাবে! সত্যি, স্বপ্ন দেখার কোনও শেষ নেই। এই কথাগুলোও মনে রাখতে হবে। বেশ ভালো। লেখার সময় যেন বাদ না পড়ে।

দড়িটা দেখছি ক্রমশ এঁটে বসছে। ঘামে ভিজে কি দড়ির আঁশগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে? না বোধহয়।

যাক, আর অপেক্ষা করে লাভ নেই—কাজটা শেষ করে ফেলাই ভালো। কারণ, একটা উপন্যাস আমাকে শেষ করতে হবে।

নাও, আমি তৈরি, কুন্তলা।—আমার কথাগুলো যেন শুকনো কাঠের খটাখট শব্দ।

এক গ্লাস জলের ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। তেষ্টা পেল। কিন্তু না, এখন জল চাইলে সময় নষ্ট হবে। কল্পনায় টের পেলাম, আমি এক গ্লাস ঠান্ডা জল ধীরে-ধীরে চুমুক দিয়ে খাচ্ছি।

‘…ঢোঁক গিলল সে। গলায় এঁটে বসা মোটা দড়িটা যেন হাজার ছুঁচ ফোটাচ্ছে। একটা শীতল অনুভূতি গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার অস্থির পাকস্থলীতে…।’

না, জল চাই না!

দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে আবার চোখ ফেরালাম। একটা দুর্জ্ঞেয় শীতল হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে অপেক্ষা করছে। যেন এভাবে অনন্তকাল ও অপেক্ষা করতে পারে।

আমার মন তখন ছুটন্ত ঘোড়া। প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি ভীষণ স্পষ্ট! কুন্তলার প্রতিটি অভিব্যক্তি, ঘরের প্রতিটি আসবাব, আমার মস্তিষ্কের কোশে-কোশে গেঁথে যাচ্ছে শিলালিপির মতো।

‘…ফ্রেমে বাঁধানো ছবির কাচে মোমবাতির শিখা থরথর করে কাঁপছে। বইয়ের তাকে ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটা যেন একটা অসুস্থ ক্ষত।’

আমার টেবিলে একরাশ কাগজপত্র ছড়িয়ে রয়েছে। যে-উপন্যাস এখন লিখছি তারই পরিশ্রমের চিহ্ন। আমার মনের অন্য অংশ তখনও খুঁজে চলেছে সুন্দর শব্দ, সুন্দরতর বাক্য…।

‘…ঘরের একমাত্র খোলা জানলার বাইরে আকাশ অন্ধকার। সেই আঁধারের বুকে এক চিলতে চাঁদ। হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে। ডাকছে এমন জগতে, যেখানে অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই, শুধু অস্তিত্ব আছে…।’

নাঃ, ঠিক হল না। উপমাগুলো বড্ড পুরোনো। এ চলবে না।

আরও বহু শব্দ উথলে উঠছে মনের ভেতরে। জায়গা করে নিতে চাইছে সবার আগে। জটিল স্তব্ধতা, চিত্রার্পিত প্রতীক্ষা, ইঙ্গিতের ভারে অন্তঃসত্ত্বা চতুর হাসি। সব মিলিয়ে কুন্তলা।

মনের জানলা নিশ্চিত হাতে বন্ধ করে দিয়েছিলাম নিশ্ছিদ্র করে, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল দরজাটা। সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এল স্মৃতির স্রোত। আমার চেতনা অচেতন হল। ওর দিকে তাকালাম। ছোট্ট দেহটা দেওয়ালে মিশিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এই নিশ্চল ভঙ্গিতেও কেমন যেন একটা গতির ইশারা ফুটে বেরোচ্ছে। প্রশান্ত সাগরের অতলে অজানা অচেনা গোপন ঢেউ ফুঁসে উঠছে…।

হ্যাঁ, বরাবরই ওর মধ্যে এই গুণটা আমি লক্ষ করেছি। যখন ওকে প্রথম দেখি, সেই মুহূর্তে বুকের ভেতরে বেজে উঠেছিল কামনার দুন্দুভি। তখনই এই চরিত্র আমি চিনতে পেরেছি। ওর বহিরাবরণ সবসময়ই নির্লিপ্ত। কখনও উচ্ছ্বাস নেই, আবার তেমন বিষণ্ণতাও নেই।। যেন সব কিছুকেই মেনে নেয়। এমনকী ওর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও এই একই ভাব আমি টের পেয়েছি। মনের গভীরে ও কী ভাবে আমি জানি না। আজ পর্যন্ত কখনও কোনওদিন ও রেগে ওঠেনি, বিরক্ত হয়নি, ঘৃণা করেনি, কোনও আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি।

যখন বাচ্চাটা মারা যায় তখনও নয়।

দুঃখ নিশ্চয়ই ও পেয়েছিল। ওর জ্বলজ্বলে চোখে আকস্মিক আঘাতের ছায়া পড়েছিল কয়েকদিনের জন্যে। কিন্তু আমার সংশয় তবু থেকে গেছে। তারপর থেকে কেমন অদ্ভুতভাবে ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

প্রথমে ভেবেছি, ও পম্পির মৃত্যুর জন্যে আমাকে দায়ী করে।

আমার শেষ উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টার নিয়ে সেদিন একেবারে মগ্ন ছিলাম। কুন্তলা কেনাকাটা করতে কোথায় যেন বেরিয়েছিল। যাওয়ার আগে বারবার করে বলে গিয়েছিল, মাঝে-মাঝে যেন উঠে আমি বাচ্চাটার খাটের দিকে নজর দিই। কিন্তু লিখতে বসে একবারও উঠতে পারিনি। যখন লিলি আর অমিতাভর দৃশ্যটা নিয়ে মেতে আছি, তখনই ঘটেছিল সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। খুব অপরাধী মনে হয়েছিল নিজেকে…। কিন্তু একজন প্রকৃত শিল্পী যখন সৃষ্টির নেশায় মগ্ন তখন পার্থিব জগতে কী ঘটল না ঘটল তার জন্যে কি তাঁকে দোষ দেওয়া চলে! আর-কেউ না বুঝলেও কুন্তলা সেটা বুঝেছিল। আর সমালোচকরা আমার উপন্যাসের সেই দৃশ্যটাকে ‘মহৎ’, ‘চিরায়ত’ ইত্যাদি বিশেষণে প্রশংসা করেছিলেন।

কয়েকদিন মনমরা হয়ে থাকার পর কুন্তলা চালচলনে স্বাভাবিক হয়েছিল। শুধু স্বাভাবিক নয়, ও যেন আমার আরও কাছাকাছি চলে এসেছিল। চটপট খুশি করতে পারত আমাকে, কোন জিনিসটা আমার কখন দরকার যেন অলৌকিক ক্ষমতায় বুঝে নিত, সৃষ্টির কাজে যখন হতাশ হয়ে পড়তাম তখন আমাকে উৎসাহ দিত সতেজ উদ্যমে। গুণীজনেরা বলেন, প্রতিটি প্রতিভাধর মানুষের পেছনে রয়েছে কোনও রমণীর প্রেরণা, ত্যাগ। আমার জীবনেও তাই। কুন্তলা। আর সাহিত্যিক হিসেবে আমার খ্যাতির পেছনে কুন্তলার কৃতিত্ব অনেকখানি! ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কখনও আমি করিনি। সীমার সঙ্গে যে নিজেকে কিছুদিনের জন্যে জড়িয়ে ফেলেছিলাম তার কারণ পম্পির আকস্মিক মৃত্যু। পরে কুন্তলাকে সীমার ব্যাপারটা খুলে বলেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম আমার হঠাৎ পদস্খলনের কারণ। কুন্তলা সে-নিয়ে কখনও কোনও অভিযোগ করেনি। শুধু বলেছে, ‘এইরকমটাই হয়ে থাকে—।’ওর সহ্যশক্তি, মানিয়ে চলার ক্ষমতা আমাকে অবাক করে দিয়েছে।

তারপর থেকে আমার লেখার কাজ দিব্যি এগিয়ে চলেছে। শুধু থমকে দাঁড়িয়েছে আজ। একটা ভালো শব্দ, একটাও ভালো লাইন মাথায় আসছে না। মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তার ভাঁড়ার সব শূন্য, নীরস মরুভূমি। কোন অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে যেন সব সাহিত্য-মনস্কতা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঝরে গেছে রুক্ষ মাটিতে। সব চিন্তা জট পাকিয়ে এক ধাঁধা তৈরি করেছে মাথার ভেতরে। পাতার পর পাতা লিখেছি আর ছিঁড়ে ফেলেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি আর লিখেছি। কুন্তলা কোনও প্রতিবাদ করেনি, বরং বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন বলেছি, এবারে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে না পড়লে আমার উপায় নেই, একমাত্র তখনই প্রতিবাদ করেছে কুন্তলা।

না, না, রাজীব, সে আমি সইতে পারব না। আমাকে জোর কোরো না!

কুন্তলা এ-কথা বলেছে, কারণ, ও জানে আমি যখন ফাঁসি দেব তখন ওর ভূমিকা কী হবে।

কিন্তু আমি জেদ ছাড়িনি। ফলে ও বইয়ের পর বই সাজিয়ে তৈরি করেছে আমার দাঁড়ানোর জায়গা, আর আমি লিখতে বসেছি আত্মহত্যার স্বীকারোক্তি: আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।

কুন্তলা দড়ি জোগাড় করেছে। রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসেছে ধারালো ছুরি। তারপর বইয়ের স্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে যখন আমি ফাঁসির গিঁট বেঁধেছি তখন ও আমাকে ধরে রেখেছে সযত্নে, যাতে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে না যাই…।

আমি ঢোঁক গিললাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

কুন্তলা আবার বলল, এসব করে সত্যিই কোনও লাভ আছে, রাজীব? এক সেকেন্ডের এদিক-ওদিক হলেই বিপদ হতে পারে।

কথাগুলো শুনে মনে হল যেন বহুবার মহলা দেওয়া কোনও নাটকের সংলাপ। এর যেন কোনও গভীরতর অর্থ রয়েছে।

ওর নির্লিপ্ততার মুখোশ ভেদ করে আবেগের ছোঁওয়া টের পেলাম। অবশেষে এই আবেগ ভাসতে-ভাসতে উঠে আসছে ওপরের স্তরে। আমার মধ্যেও শুরু হয়েছে এক অচেনা আবর্ত, এক শক্তিশালী অনুভূতি। কী লুকোতে চাইছে কুন্তলা? সেটা আমার জানার অধিকার আছে। ইচ্ছে করছে, ওর তন্বী দু-কাঁধে আমার হাতের শক্ত বাঁধন বসিয়ে প্রবল ঝাঁকুনি দিই, যাতে ওর লুকোনো চিন্তাগুলো রঙিন কাচের গুলির মতো শব্দ করে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। তখন আমি জানতে পারব কোন সর্বনাশা ধূর্ত কুটিল সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে ওর মনের ভেতরে, কেন আমার মনে জেগে উঠেছে অস্বস্তি, অচেনা সংশয়, সূক্ষ্ম সন্দেহ। এইসব অস্পষ্ট অনুভূতিগুলো আমার ভেতরে এক প্রচণ্ড ঝড় তুলেছে।

কুন্তলা আমার…? জটিল যন্ত্রণায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লেখার টেবিলের দিকে। একপাশে সাজানো রয়েছে লেখা পৃষ্ঠাগুলো। কুন্তলা…।

উঁহু, এ অসম্ভব। আমার লেখা কুন্তলা কখনও পড়তে চায় না। পাণ্ডুলিপিও নয়, বইও নয়। ও বলে, তোমার লেখার প্রতিটি বিষয় আমার এত চেনা, এত জানা যে, নতুন করে পড়ার কিছুই নেই। সুতরাং আমি কী করে তোমার লেখা সমালোচকের চোখ দিয়ে পড়ব? আমি তো জানি লেখার আইডিয়াগুলো তুমি কোথা থেকে পেয়েছ…

কথাটা সত্যি। ফলে আমার অসমাপ্ত লেখার ওই দৃশ্যটা ও পড়েছে বলে মনে হয় না। ওই জায়গাটাই হবে আমার উপন্যাসের সেরা জায়গা, আমার জীবনের সেরা লেখা। জীবন থেকে নিংড়ে নেওয়া সাহিত্য—নাঃ, এসব এখন ভেবে লাভ কী? হাতের কাজটুকু শেষ হয়ে যাক, তারপর ভাবব। কুন্তলা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে…কীসের জন্যে?

আমার মৃত্যুর জন্যে।

ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নোনতা স্বাদ পেলাম। ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এরকম ঘটনা আগেও বার-সাতেক ঘটেছে। জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আমি লেখার রসদ জোগাড় করেছি। আমাকে বাধ্য হয়ে সাহায্য করেছে কুন্তলা। বিষধর কাঁকড়াবিছের কামড়। ঘুমের ট্যাবলেট। কবজির ধমনি কেটে দেওয়া। আমার চারনম্বর উপন্যাসের সেই দৃশ্যটা—বাক্সের ভেতরে দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু। তারপর পায়ে পাথর বেঁধে জলে ডুবে মৃত্যু—যেখানে কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরা রয়েছে তীরে দাঁড়ানো এক যুবতীর হাতে। এই যুবতী ডুবন্ত নায়কের প্রেমে ও ঘৃণায় পাগল…অপূর্ব! সমালোচকরা একসুরে প্রশংসা করেছেন আমার ভয়ানক বাস্তববোধের। আমার বইয়ের প্রতিটি জীবন্ত মরণ-দৃশ্য আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কোনও খাদ নেই তাতে। মৃত্যু—এক রহস্যময়ী রূপসী রমণী!

এইরকম প্রতিটি বিপজ্জনক পরীক্ষার সময় আমি কুন্তলাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি। কখনও ভাবিনি, সেই বিপন্ন মুহূর্তে আমি ওর শক্তির কাছে পরাধীন। তা হলে এবারে এত বিচলিত হয়ে পড়ছি কেন?

কুন্তলা! কুন্তলা!—আতঙ্কে আমার স্বর রুদ্ধ বিকৃত হয়ে গেল। শরীরের আকস্মিক আক্ষেপকে সামাল দিতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়লাম। অপ্রত্যাশিতভাবে পড়ে গেল বইয়ের পাহাড়। আমার চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল, পা-জোড়া ছটফট করতে লাগল, হাত দুটো খুঁজতে লাগল যে-কোনও আশ্রয়। তারপর আপ্রাণ শক্তিতে খুলে ফেলতে চাইল গলায় এঁটে বসা ফাঁসের দড়ি।

আমার যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখের অস্পষ্ট দৃষ্টিতে ওকে দেখতে পেলাম। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ করছে, আর হাসছে—কুন্তলা হাসছে—এদিকে আমার জীবনীশক্তি ধাপে-ধাপে শেষ হচ্ছে, অথচ ধারালো ছুরিটা ওর নিথর হাতে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ধরা। এবারে ও আমাকে আর বাঁচাবে না। আর খুনের দায়ে দোষীও হবে না ও। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল ছুটন্ত আলোককণার আলপনা, তারপর একসময় সেটা ঝাপসা হয়ে নেমে এল অন্ধকার—শুধু চোখে নয়, চেতনাতেও।

ভারী চোখের পাতা ধীরে-ধীরে মেলে ধরলাম। কুন্তলা আমার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে আছে। আমার অবশ কবজি ঘষে-ঘষে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে তুলেছে। আমার যন্ত্রণাময় শরীর তৃষ্ণার্ত পশুর মতো চেটেপুটে নিচ্ছে শুদ্ধ মিষ্টি বাতাস। দড়ির ফাঁস নেই। বইগুলো আবার ফিরে গেছে যথাস্থানে—তাকের ওপরে। কতক্ষণ আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম? পাঁচ মিনিট? দশ মিনিট?

তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে—জমাট বাঁধা স্বরনালী থেকে জড়ানোভাবে লাফিয়ে-লাফিয়ে বেরিয়ে এল অভিযোগের শব্দগুলো।

হ্যাঁ, আমি তোমাকে খুন করতে চেয়েছি।—নিরুত্তাপ নির্লিপ্ত উত্তর।

আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো এখনও নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারেনি। আমি জানি, কুন্তলা সত্যি কথা বলছে। তবু যেন সেই সত্যি কথাটা আমার বোধের সীমারেখাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। কী করে ও এত শান্ত আবেগহীন?

কিন্তু কেন, কুন্তলা?

সামনের খাটো টেবিল থেকে এক গ্লাস জল নিল কুন্তলা। মাথাটা সামান্য তুলে কিছুটা ঠান্ডা জল খাইয়ে দিল আমাকে। শরীরে যেন প্রাণ এল। জ্বালাও জুড়োল কিছুটা। আমি এখনও বেঁচে আছি। সত্যি, বেঁচে থাকার স্বাদ এত সুন্দর!

রাজীব, ভেবেছিলাম একদিন-না-একদিন তুমি বুঝতে পারবে আমার কষ্ট। কী যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে রেখেছ তুমি। আমার আশা ছিল, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তোমার কাছে সে-ভালোবাসার কোনও দাম নেই। তুমি মেতে আছ নিজের লেখা নিয়ে, নিজেকে নিয়ে। এটা বুঝতে আমার বেশ সময় লেগেছে। সীমা, সীমার মতো আরও কত মেয়ে, তোমার স্বার্থপরতার শিকার হয়েছে। ওদের নিয়ে তুমি লিখেছ—লোকে তোমার লেখা জীবন্ত বলে প্রশংসা করেছে। তারপর…তারপর নিজের জীবন-মরণকে তুমি ঠেলে দিয়েছ আমার হাতে। ব্যাপারটা তোমার কাছে হয়তো খুব সহজ, কিন্তু আমার কাছে, রাজীব? যদি কাঁকড়াবিছের বিষ তাড়ানোর ওষুধ ঠিকমতো কাজ না করে? যদি ঘুমের ওষুধের ধক কাটানোর ইনজেকশান সময়মতো দিতে না পারি? কখনও কি তুমি ভেবেছ আমার মনের অবস্থাটা কী হয়? তোমার মৃত্যু-যন্ত্রণা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখি, তারপর প্রতিটি খুঁটিনাটি তোমাকে শোনাই, যাতে তুমি লিখতে পারো তোমার উপন্যাস। এ যে কী কষ্ট তুমি বুঝবে না।

ও রেগে গেছে। হালকা মনেই ভাবলাম।

‘…ওর দু-গাল ক্রোধে রক্তিম। চোখে জ্বলছে জোনাকি। ওর সপ্রাণ স্তন উত্তেজনায় উঠছে, নামছে। পোশাকের বাঁধন ছিঁড়ে বিদ্রোহ জানাবে এখুনি…।’

মন্দ নয়। একটু ঘষামাজা করে নিলে নেহাত মন্দ হবে না। জীবন্ত ছবি।

হঠাৎই একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম পেটে। পরক্ষণেই সেটা কমে গেল। গভীর শ্বাস নিয়ে বললাম, তুমি ছুরি দিয়ে দড়িটা কেটে দিয়েছিলে, তাই না, কুন্তলা? তা হলে তুমি নিশ্চয়ই এখনও ভালোবাসো আমাকে, ভালোবাসো না?

সত্যিই কি বাসি?—ওর চোখে শীতল বিদ্যুৎ। কণ্ঠস্বরেও। যদি এই মুহূর্তে ওকে স্পর্শ করি তা হলে শরীরেও পাব শীতল স্পর্শ—আমি জানি।

কুন্তলা আবার বলল, ভালোবাসা! ভালোবাসা কতরকম হয় জানো? কিংবা ঘৃণা? কিংবা দুটোই? মাথার যন্ত্রণা, মনের যন্ত্রণা, শরীরে লক্ষ-লক্ষ বিস্ফোরণ, বুকের ভেতর কান্না সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়—।

আবার সেই যন্ত্রণার ছুরিটা বিদ্ধ হল পেটে। রোমকূপ থেকে কুলকুল করে বেরিয়ে এল শীতল ঘামের ধারা। জিভটা কেমন বিস্বাদ ঠেকছে…হঠাৎ চমকে উঠলাম।

ওই জলের মধ্যে…।

হ্যাঁ, রাজীব, ওই জলের মধ্যে অ্যাকোনাইট মোশানো ছিল।

অ্যাকোনাইট!—হাত বাড়িয়ে কুন্তলার নাগাল পেতে চাইলাম, কিন্তু যন্ত্রণায় অবশ হয়ে আসা শরীর শক্তি খুঁজে পেল না। অ্যাকোনাইট বিষটা আমার খুব চেনা। শেষ দুটো বইয়ের আগের বইটায় এই বিষটা আমি ব্যবহার করেছি। মরতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। চেতনা কখনও আচ্ছন্ন হয় না। বড় যন্ত্রণাময় মৃত্যু।

ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কুন্তলা হাঁটুগেড়ে বসে আছে। সুডৌল হাত দুটি বুকের কাছে ভাঁজ করা। মুখে রাগ নেই। শুধু আমাকে লক্ষ করছে, ওর সুন্দর সুকুমার মুখে শুধু শূন্যতা।

মৃত্যু—এক রহস্যময়ী রূপসী রমণী।…আমার চোখ জ্বালা করছে। ঠোঁটের কোণে নোনা অশ্রুর স্বাদ। আতঙ্ক, যন্ত্রণা, সবকিছুর মধ্যেও বুঝতে পারছি, সাদা কাগজে আর লেখা হবে না চমৎকার শব্দগুলো: মৃত্যু—এক রহস্যময়ী রূপসী রমণী।

আমার জন্যে এই নৃশংস নিয়তি কেন বেছে নিল কুন্তলা? ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে কেন শেষ প্রশ্বাস নিতে দিল না আমাকে?

কুন্তলা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল আমার টেবিলের দিকে। লেখা পৃষ্ঠাগুলো তুলে নিল। ও কি পড়েছে লেখাটা? আমি ভেবেছিলাম পড়েনি। ভুল ভেবেছি…।

অন্যমনস্ক হাতে পাতা উলটে একটা বিশেষ পৃষ্ঠায় এসে থামল কুন্তলা। তারপর আবেগহীন শুকনো গলায় পড়তে শুরু করল। আমার দিকে একটিবারের জন্যেও তাকায়নি ও। পড়তে লাগল। জীবন নিংড়ে লেখা আমার শেষ উপন্যাসের একটা অংশ।

‘…কী সহজ, ভাবল অনিকেত। ছায়াময় ঘরে ছোট খাটটার পাশে দাঁড়িয়ে ওর শরীরে ভয়ের কাঁপুনি খেলে গেল পলকে। ও একা, ওর মুখে কথা নেই। কত তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেল। এখন আর কোনও প্রতিবাদ নেই। বাচ্চাটার ছোট্ট শরীর এখন স্পন্দনহীন। ঘুম নয়, কালঘুম। ওর সন্তান, ওর আদরের মেয়ে—শরীরে সাড়া নেই, কারণ, অনিকেত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি সংকটের মুহূর্তে। ও জানত, কোন বিপদ ওত পেতে রয়েছে মেয়েটার মাথার কাছে। অনিকেতের কৌতূহলই কি এই মৃত্যুর কারণ? জীবনের সবরকম অনুভূতিকে ও তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করতে চায়—সে-অনুভূতি যত ভয়ংকর হোক, যত নৃশংস হোক—এটা অনিকেতের একটা খেলা। এ সেই পুরনো পাপ—জানার কৌতূহল। আদম আর ইভ থেকে যার শুরু। এখন…এখন ও অন্য সবার থেকে আলাদা। এই বীভৎস অভিজ্ঞতা বুকের ভেতরে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে ওকে। এ-অভিজ্ঞতার কথা কেউ জানবে না, কেউ না। কেউ জানবে না, অনিকেত পাপী। কারণ, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা ও ইচ্ছে করলে রুখতে পারত। কিন্তু তা ও করেনি। অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল ওকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল…।’

কুন্তলা আমার অসমাপ্ত শেষ উপন্যাসের পৃষ্ঠা থেকে চোখ তুলল। ওর গলার স্বর অস্ফুট, নির্লিপ্ত—রুক্ষতা সেখানে নেই। ও বলল, ফাঁসিতে মরলে তোমার শাস্তি অনেক কম হত, রাজীব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *