শুভঙ্করের ফাঁকি

শুভঙ্করের ফাঁকি

বাঙালির নৈমিত্তিক জীবনে নানা আলাপ-আলোচনায় শুভঙ্করের ফাঁকি— প্রবাদটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হিসেব নিকেশের মারপ্যাচে আসল বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ফায়দা হাসিল করার কৌশলকে আমরা শুভঙ্করের ফাঁকি বলে চিহ্নিত করি। কৌশল অবলম্বনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ফাঁকি দিয়ে নিজেদের জন্য শুভকর বা হিতকর কাজ কতটুকু করলো সে হিসেব করা সাধারণ মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণে ফাঁকিবাজ প্রতারক এদেশে অনেকক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ পেয়ে যায়। জনশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে অমাদের দুর্বলতা এজন্য দায়ী বলে মনে হয়।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—কে এই প্রবাদপুরুষ শুভঙ্কর? তিনি কি আসলেই প্রতারণা-কৌশলের গুরুঠাকুর নাকি অন্য কিছু? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে দেখতে হয় এবং কিছু অনুমান সম্পর্কে ভাবতে হয়।

মোটামুটিভাবে বিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত এদেশে শুভঙ্করী ধারাপাত ও হিসেব নিকেশের পদ্ধতি বেশ চালু ছিল। আজও প্রবীণ মানুষেরা ছোটবেলার গল্প শোনাতে গিয়ে একের পর এক শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ বলে যান। নবীন শ্রোতারা হতবাক্ হয়—কারণ আনা, পাই, বিঘা, কাঠা, ছটাক, কড়া, ক্রান্তি, যব, তিল, কাহন, পণ, গণ্ডা, কড়া, বুড়ি, চোক, সের, ছটাক, পোয়া, তোলা, কাঁচ্চা, রতি, ইত্যাদির হিসেব এবং মানসাঙ্ক শুভঙ্করের আর্যার মাধ্যমে সমাধানের নিয়ম-কানুন তাদের সময়ে অপ্রচলিত। তাছাড়া যেসব চিহ্ন দিয়ে এগুলো লেখা হতো তা এখন অপরিচিত হয়ে গেছে।

আমাদের সন্তানেরা ভাগ্যবান যে, স্বদেশী হিসেবের বদলে তারা শিখছে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক হিসেব পদ্ধতি। অতীত যারা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চান না তারা ভাবছেন আধুনিক পদ্ধতির পাশাপাশি পুরানো হিসেব অন্তত অতীত অনুসন্ধানের প্রয়োজনে সংরক্ষণ করলে দোষের কিছু নেই। আন্তর্জাতিকতার পাশাপাশি জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভাবাটাও প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

আর্যা সম্পর্কে সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২ খ্রি.) বলেছেন—

‘ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব হইতে জ্ঞানগর্ভ হেঁয়ালি ও সংক্ষিপ্ত ছড়াকে বলা হইত আর্যা ও তরজা। আর্যা বুঝাইত জ্ঞানগর্ভ হেঁয়ালি রচনা, আর তর্জা (আরবি শব্দ) বুঝাইত সহজবোধ্য প্রবচন। (বৃন্দাবনদাস চৈতন্যভাগবতে লিখিয়াছেন—আর্যা তরজা পড়ে লোক বৈষ্ণব দেখিয়া।) পরবর্তীকালে (অর্থাৎ অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে) আর্যা নামটি গণিতের ছড়াকেই বুঝাইত। সবচেয়ে পুরাতন যে গণিতের ছড়া পাওয়া গিয়াছে তাহাকে বলিত শুভঙ্করী আর্যা অথবা শুভঙ্করী দাঁড়া (দাঁড়া মানে বাঁধা গৎ অর্থাৎ তরজা)।’ সুকুমার উল্লেখ করেন যে, আর্যা অর্থ ছড়া। প্রাকৃত-রচনার যুগে এমন ছড়া আর্যাছন্দে লেখা হতো বলে এই নাম। আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর অলংকারশাস্ত্রবিদ দণ্ডীর দশকুমারচরিত গ্রন্থে আর্যাছন্দে লেখা শ্লোক আর্যা নামে উল্লিখিত হয়েছে।

সুবলচন্দ্র মিত্রের (১৮৭২-১৯১৩ খ্রি.) সরল বাঙ্গালা অভিধান অনুযায়ী ‘শুভঙ্কর একজন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও শুভঙ্করী নামক পাটিগণিতের রচয়িতা। বঙ্গদেশে কায়স্থবংশে তার জন্ম। গণিতবিদ্যায় তিনি নিত্য-ব্যবহার্য অঙ্কসমূহ সমাধান করার সহজ সহজ সঙ্কেত নির্ধারণ করে জনসাধারণের অশেষ উপকার করে গেছেন।

নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮ খ্রি.) সঙ্কলিত বিশ্বকোষে আমরা দেখি যে, শুভঙ্কর ছিলেন একজন বিখ্যাত মানসাঙ্কবেত্তা। অঙ্কের কঠিন নিয়ম সংক্ষিপ্তভাবে সুললিত ভাষায় হৃদয়গ্রাহী কবিতার ছন্দে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ঐ ছন্দোবদ্ধ নিয়মগুলোই আর্যা নামে পরিচিত। পয়ারে রচিত এই আর্যার মাধ্যমে শুভঙ্কর জমিজমার হিসেব, জিনিসপত্রের দরদাম এবং রাজস্ব সংক্রান্ত বন্দোবস্তের বহু তথ্য দিয়েছেন। তার আসল নাম শুভঙ্কর দাস। তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন বলে জানা যায়। নবাবি আমলে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজকীয় বিভিন্ন বিভাগে কী রূপ বন্দোবস্ত ছিল এবং কী নিয়মে নবাব সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতো তা শুভঙ্কর দাস তার লেখা ছত্রিশ কারখানা নামক পুস্তকে বিবৃত করেছেন। ছত্রিশ কারখানা পুস্তকে দুই হাজার শ্লোক ছিল বলে জানা যায়। এতে বহু ফারসি শব্দ আছে। তার অঙ্কশাস্ত্রের নাম শুভঙ্করী।

সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায় তার প্রাক্‌পলাশী বাংলা গ্রন্থে বলেছেন যে, বাংলাদেশে মুখে মুখে অঙ্ক শেখানোর রেওয়াজ শুভঙ্করের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শুভঙ্কর তার অতি পরিচিত মানসাঙ্কের ছড়াগুলোতে এ রেওয়াজকে আরো সুন্দরভাবে সুগঠিত রূপ দিয়েছেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধের আগেও বাংলাদেশে ছাত্ররা শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ করতো বলে জানা যায়। শুভঙ্কর এবং ভৃগুরাম দাস একই ব্যক্তি বলে মনে করেন অনেক পণ্ডিত। ভৃগুরাম দাসের ভণিতাযুক্ত অনেক আর্যা এদেশে পাওয়া গেছে।

ভূদেব চৌধুরী শুভঙ্করের আর্যাবলিকে সামাজিক মঙ্গলবোধের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন। শুভঙ্করকে তিনি আদি যুগের অর্থাৎ চতুর্দশ শতাব্দীর আগের মানুষ বলে মনে করেন। তার মতে, ‘এই আর্যাবলির মধ্যে প্রাকৃত শব্দপ্রাচুর্যের ঐতিহাসিক সঙ্কেতও অবশ্য লক্ষণীয়। লেখক ও তার মূল লেখা হারিয়ে গেছে, তবু আদিযুগের বাঙালির চিন্তা-সম্পদ আজও পর্যন্ত চিরন্তন বাঙালির আধিভৌতিক জীবন-সাধনার মাঙ্গলিক পথ নির্দেশ করছে, এইখানেই এই শ্রেণীর সাহিত্যের সার্থক মূল্য।’

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০ খ্রি.) বলেছেন, ‘শুভঙ্করীর আর্যা ও ডাকের বচনে অবহট্টের কিছু কিছু চিহ্ন ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শনরূপে রক্ষিত হইয়াছে।’ তিনি মনে করেন যে, এগুলো চর্যাপদের সমকালীন।

নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১ খ্রি.) প্রায় একইরূপ মত প্ৰকাশ করেছেন। মূল শুভঙ্করী আর্যাকে তিনি প্রাক্-তুর্কি আমলের রচনা বলে মনে করেন। তিনি বলেছেন, ‘ডাক ও খনার নামে যে বচনগুলি বাংলাদেশে আজও প্রচলিত তাহাও বোধ হয় প্রাক্-তুর্কি আমলের (ত্রয়োদশ শতকের পূর্বের) চলতি প্রবাদ সংগ্রহ; কালে কালে তাহাদের ভাষা বদলাইয়া গিয়াছে মাত্র। শুভঙ্করের নামে প্রচলিত গণিত-আর্যার শ্লোকগুলিতেও যে অপভ্রংশের প্রভাব বিদ্যমান তাহা অঙ্গুলি সংকেতে দেখাইবার প্রয়োজন আজ আর নেই।’

শুভঙ্করী হিসেব নিকেশ সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯ খ্রি.) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বলেছেন—

‘গণিতের অনেক সূত্র নিম্নশ্রেণীর লোকের মুখে মুখে জানা ছিল। এজন্য তাহাদের কাগজ কলম লইয়া ধ্বস্তাধ্বস্তি করিয়া অঙ্ক কষিতে হইত না। তাহারা অতি জটিল হরণ-পূরণ (ভাগ-গুণ) ও বাজার দরের সূক্ষ্মতম হিসাব মুখে মুখে করিতে পারিত।… মুখে মুখে সাধারণ লোকেরা এদেশে যেরূপ আশ্চর্যভাবে গণিতের জটিল অঙ্ক কষিতে শিখিয়াছিল তাহা এখন লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। আমরা বার্নার্ড স্মিথ মুখস্থ করিয়াছি, কিন্তু শুভঙ্কর, শিবরাম ও ভৃগুরামকে বিচারের সুবিধা না দিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছি। নিত্যকার প্রয়োজনে এখন গণিতের অনেকখানি প্রয়োজন আছে; জমিজমার হিসাব, বাজার দর, কাঁসা, তামা, পিত্তল প্রভৃতির দর ও ওজন, শস্যাদির দরের হিসাব প্রভৃতি বিষয়ে চাষারা মুখে মুখে যাহা এখনও করিতে পারে; আমাদের এম.এ. উপাধিধারী গণিতের অধ্যাপকগণ অনেক সময়ে তাহা অনেক বেশি সময়ে কষ্টেসৃষ্টে করিতে পারেন।…এই নিম্নশ্রেণীর লোকদের অতি সূক্ষ্ম হিসাব, যাহা তাহারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমাধা করে, তাহা ভুল হয় না। কিন্তু এখনকার শিক্ষিত লোক সেইরূপ করিতে গেলে দ্বিগুণ চৌগুণ সময় তো লইবেনই—তাহাতে অনেক সময়ই ভুল হইয়া থাকে।… বড়ই দুঃখের বিষয়, যে সকল সূত্র শিখিয়া এতদ্দেশের লোকেরা এত সহজে গণনাকার্য নির্বাহ করিত, সেই অসামান্য বিদ্যা—অশিক্ষিতপটুতা (শিক্ষার অভাব সত্ত্বেও দক্ষতা)—আমরা বিবেচনাহীন হইয়া হারাইতে বসিয়াছি।’

বাংলা ভাষা-সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত রেভারেন্ড জেমস্ লঙ (১৮১৪- ১৮৮৭ খ্রি.) শুভঙ্করকে The Cocker of Bengal হিসেবে চিহ্নিত করে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বলেছেন, ‘১৪০ বছর যাবৎ শুভঙ্করের আর্যার আবৃত্তিতে অনুমান ৪০,০০০ বঙ্গবিদ্যালয় মুখরিত হইয়া আসিয়াছে।’

সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২ খ্রি.) শুভঙ্কর ও ভৃগুরাম দাসকে এক ব্যক্তি হিসেবে মেনে নেননি যদিও অনেকে নাম দুটি একই ব্যক্তির বলে মনে করে থাকেন। শুভঙ্কর নামে আদৌ কোনো বিশেষ আর্যালেখক ছিলেন কিনা সে সম্পর্কেও সুকুমার সন্দেহ পোষণ করেছেন। যদি থেকেও থাকেন তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে তিনি জীবিত ছিলেন এবং অপভ্রংশে লিখেছেন বলে সুকুমারের মন্তব্য লক্ষ করি আমরা।

‘বাঙ্গালায় এবং আসামে অঙ্কের ছড়া বা আর্যা অধিকাংশই শুভঙ্করের ছাপমারা। শুভঙ্কর নামে কোনো বিশেষ আর্যা-লেখক ছিলেন কিনা বলা শক্ত। যদি থাকেন তবে তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে জীবিত ছিলেন এবং অপভ্রংশে লিখিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে একাধিক গণিতজ্ঞ ব্যক্তি—প্রধানত কায়স্থসন্তান—শুভঙ্কর উপনাম অথবা উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন। মল্লভূমিতে এক শুভঙ্কর দাসের (অথবা শুভঙ্কর সেনের) ঐতিহ্য কল্পনা করা হয়। আসামেও শুভঙ্কর দাস অজ্ঞাত নয়। সবচেয়ে পুরানো পুথি যাহাতে শুভঙ্করের ভণিতায় আর্যা পাওয়া গিয়াছে সেটির লিপিকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ (লিপিকাল ১০৫৪ মল্লাব্দ বা ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। শুভঙ্করের নামে অনেক অর্বাচীন রচনাও চলিয়া গিয়াছে। যেমন, ছত্রিশ কারখানা (বা কাগজসার) এই ক্ষুদ্র নিবন্ধটির আরম্ভ—

শ্রীকৃষ্ণচরণাম্ভোজং প্রণম্য পরয়া মুদা।
ঋজুকাগজসারোহয়ং চিত্রগুপ্ত মুখোদিতম্ ॥

পরলোকের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল ও অডিটর জেনারেল ছিলেন চিত্রগুপ্ত। সেকালের গণনাধিকৃতেরা কায়স্থ, বলিয়া উল্লিখিত হইতেন। অতএব চিত্রগুপ্ত ছিলেন যমের দপ্তরে মহাকায়স্থ। মুসলমান অধিকারের সময়ে কায়স্থ শব্দ জাতির নামে পরিণত হইয়াছে এবং হিসাবের কাজে তখনও তাহাদের একাধিপত্য। সেইজন্য গণিতের আর্যারচয়িতারা সকলেই ছড়ায় প্রায়ই পড়ুয়া কায়স্থসন্তানকে সম্বোধন করিয়াছেন।’

শুভঙ্করের নামে প্রচলিত আর্যায় আমরা অপভ্রংশ (অপভ্রষ্ট বা অবঠ) ভাষার নিদর্শন পাই, আবার আধুনিককালের নিদর্শনও লক্ষ করি। তার নামযুক্ত আর্যা আসাম অঞ্চলেও সুপরিচিত (আসাম অঞ্চলে কায়থলি আর্যা)। শুভঙ্করের নামে প্রচলিত আর্যার নমুনা-

কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্জে।
কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্জে ॥

অর্থাৎ কুড়ায় (বিঘায়) কুড়ায় কুড়া নিতে হয়। কাঠায় কুড়ায় কাঠা নিতে হয়। এই আর্যায় অপভ্রংশ ভাষা রয়েছে। আবার-

জমি বিঘা যত তঙ্কা হইবেক দর।
তঙ্কা প্রতি ষোল গণ্ডা কাঠা প্রতি ধর ॥

কিংবা

তঙ্কা প্রতি মোন (মণ) যার হইবেক দর।
তঙ্কা প্রতি অষ্টগণ্ডা সের প্রতি ধর ॥
আনা প্রতি দুই কড়া গণ্ডায় অষ্ট তিল।
শুভঙ্কর দাস কহে এই মত মিল ॥

ইত্যাদি আর্যায় আধুনিককালের ভাষার ছোঁয়া আমরা পাই।

তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, শুভঙ্কর দাস নামে একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে জীবিত ছিলেন। তিনি অন্তত বাংলা- বিহার-উড়িষ্যা-আসামে সুপরিচিত আর্যাকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছড়ার মাধ্যমে অঙ্কের কঠিন হিসেব সহজবোধ্য করা তার কৃতিত্ব। পরবর্তী সময়ে তার কাব্যভাষায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কিংবা পরবর্তিতরূপে কেউ কেউ সেগুলো উপস্থাপন করে এবং অনেকক্ষেত্রে নতুন নতুন আর্যা যোগ করে শুভঙ্করের নামেই চালু রেখেছেন। সেকালে ছাপার অক্ষর চালু না থাকায় যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে হাতে নকল করা পুথিতে নকলকারী সমকালীন বোধগম্য ভাষা প্রয়োগ করেছে। এমন ঘটনার উদাহরণ হলো— কালিদাসের হেঁয়ালি, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, খনার বচন, বীরবলের হাসির গল্প ইত্যাদি।

শুভঙ্কর নামে একজন কবি ছিলেন দ্বাদশ শতকে বা তা আগে। বর্তমান নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার জগদ্দল বৌদ্ধবিহার থেকে বিদ্যাকর কর্তৃক সঙ্কলিত সুভাষিতরত্নকোশ গ্রন্থে যেসব কবির রচনা রয়েছে তার মধ্যে একজন হলেন শুভঙ্কর। দ্বাদশ শতকে সেনযুগের সংকলন-গ্রন্থের কবি শুভঙ্কর আমাদের আর্যা-রচয়িতা শুভঙ্কর কিনা তাও সুস্পষ্টরূপে বলা যাচ্ছে না।

শুভঙ্করের হিসেবের আর্যা অপব্যবহার করে কিংবা বিকৃত করে ভুল হিসেব শুদ্ধ দেখিয়ে কোনো ধুরন্ধর যদি সরল মানুষকে প্রতারণা করে তবে সে দোষ প্রবাদপুরুষ শুভঙ্করের কাঁধে চাপানো নিশ্চয়ই সুবিবেচনার কথা নয়। বাঙালির মেধাশক্তির অপচয় ও অবক্ষয় শুভঙ্কর কিংবা শুভঙ্করীর হিসেবে হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ হরহামেশা নিয়ম-কানুন, বিধিবিধান ও হিসেবের খুঁটিনাটি বুঝি বলে প্রায়শই সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের প্রতারণা করি নানা কৌশলে। এ অবস্থা ততদিন থাকবে যতদিন সচেতনতার ধারা সৃজনে বঞ্চিত মানুষেরা নিজেরা এগিয়ে না আসবে। স্বার্থসিদ্ধির নায়কেরা শুভঙ্করকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অথচ তাকেই সাক্ষীগোপাল বানিয়ে নিত্যদিন চালিয়ে যাচ্ছে ফাঁকির মহড়া। আর সে কারণেই সৃষ্ট হয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি নামক প্রবাদের।

শুভঙ্করের ছন্দোবদ্ধ হিসেবের সহজ আর্যার শুভ-উদ্বোধন চাই আমরা। এজন্য চাই দলিত আত্মার জাগৃতি। প্রবাদ-পুরুষ শুভঙ্কর আমাদের সহজ মানুষের দেশে সম্যক বোধগম্য হলে দুর্দশার আঁধার কাটবে। চেতনার সে ধারা শুভঙ্করের আসল আর্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তার নামে ফাঁকি সৃষ্টি করে তারই নামে ব্যবহারের কৌশল ধরা পড়লেই স্বমহিমায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবেন শুভঙ্কর।

* সাপ্তাহিক অটল, রংপুর, ৩১মে ১৯৯৯

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *