শিশু সাহিত্যিক
ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘বহুরূপী’ এক বছর হল বেরোচ্ছে। সম্পাদক সুপ্রকাশ সেনগুপ্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেন কাগজটাকে ভালো করতে। টাকার জোর নেই, তাই কাজটা সহজ নয়। গ্রাহক সংখ্যা দেড় হাজারের মতো; বিজ্ঞাপন যা আসে তার থেকেই টেনেটুনে চলে যায়। লাভ থাকে না মোটেই। তবে সুপ্রকাশ আদর্শবাদী, তাঁর বিশ্বাস কাগজটা দাঁড়িয়ে যাবে, এবং তার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন না তিনি।
সবচেয়ে মুশকিল হল গল্প নিয়ে। ভালো ছোটদের গল্প প্রায় আসে না বললেই চলে। এমন কি সুপ্রকাশ দু-একবার নামী লেখকদের লেখাও জোগাড় করেছেন, কিন্তু সে লেখাও দায়সারা। নাম করা জনপ্রিয় পত্রিকার লেখাও সুপ্রকাশ পড়ে দেখেছেন, তারও গল্পের মান তেমন উঁচু নয়। আসলে ভালো গল্প আর তেমন লেখাই হচ্ছে না এই হল সুপ্রকাশের ধারণা।
অথচ পাণ্ডুলিপির অভাব নেই। প্রতি মাসে ষাট-সত্তরটা করে লেখা ডাকে আসে—গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ। গল্পের উপরেই সুপ্রকাশ বেশি জোর দেন, কাজেই সেই পাণ্ডুলিপিগুলোই তিনি আগে পড়েন। দুঃখের বিষয় বেশির ভাগ লেখাই বাতিল হয়ে যায়। নতুন লেখকের অনেক লেখা আসে, এবং সে লেখা পড়েই বোঝা যায় কাঁচা। মাঝে মাঝে সে লেখা পড়বারও দরকার হয় না। পাণ্ডুলিপির চেহারা দেখেই সুপ্রকাশ তাকে বাতিল করে দেন। শুধু পাণ্ডুলিপির চেহারা কেন, সময় সময় লেখকের নাম থেকেই বোঝা যায় সে লেখা পড়ে কোনো লাভ নেই। নদের চাঁদ ভড় বলে এক ভদ্রলোক তিন-চারখানা গল্প পাঠিয়েছেন, সঙ্গে ডাকটিকিট। সুপ্রকাশ সেগুলো না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। নদের চাঁদ ভড় যার নাম সে লেখকের কাছ থেকে সুপ্রকাশ কিছু আশা করেন না। তাছাড়া পাণ্ডুলিপিও অপরিচ্ছন্ন। লেখা ফেরত পাঠাবার সময় সঙ্গে ছাপা চিঠি যায়—‘আপনার অমুক রচনা মনোনীত না হওয়ায় ফেরত পাঠানো হল। নমস্কারান্তে ইতি’—ইত্যাদি।
তেমনি বটকেষ্ট হোড়, নকুড় চন্দ্র হাতি, গজানন আইচ—এদের সকলের লেখাই সুপ্রকাশ না পড়ে ফেরত দিয়েছেন। তার মন বলেছে লেখকের নামের সঙ্গে লেখার উৎকর্ষের একটা সামঞ্জস্য থাকে। উৎকট নামের ভালো লেখক আশা করা ভুল। এখনো পর্যন্ত গল্পের দিক দিয়ে কাগজটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন দুটি লেখক—অমিয়নাথ বসু আর সঞ্জয় সরকার। দুজনেই সুপ্রকাশের আবিষ্কার, দুজনেই নিয়মিত গল্প পাঠান, এবং দুজনেই ভালো লেখেন। গল্পের বিষয় এবং ভাষা দুইই ভালো। সুপ্রকাশের গরিব কাগজ, কিন্তু তাও এ দুজন লেখককে তিনি নিয়মিত পারিশ্রমিক দেন।
লেখা যে সব সময় ডাকে আসে তা নয়। মাঝে মাঝে লেখক নিজেই লেখা সমেত এসে উপস্থিত হন। হয়ত এঁদের ধারণা যে নিজে নিয়ে এলে লেখা মনোনীত হবার সম্ভাবনা বেশি। সুপ্রকাশ তাঁদের বলেন লেখা রেখে যেতে—মতামত যথাসময়ে জানানো হবে।
একদিন দুপুরের দিকে সুপ্রকাশ তাঁর ছোট্ট অফিসে বসে পাণ্ডুলিপি দেখছেন, এমন সময় একটি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা রোগা ফরসা ভদ্রলোক একটা লেখার বাণ্ডিল নিয়ে তাঁর আপিসে এলেন। সুপ্রকাশ মুখ তুলে চাইতে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি একজন শিশু সাহিত্যিক; আমার নাম উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি কয়েকটা গল্প এনেছি আপনার পত্রিকার জন্য। আপনি অন্তত একটি যদি এখন পড়ে দেখেন।’
‘এখনই?’ সুপ্রকাশ কিঞ্চিৎ বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করলেন।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আজকাল ডাকের বড় গোলমাল হয়। তাই আমি নিজেই সঙ্গে করে লেখাগুলো নিয়ে এসেছি। তিনটে ছোট গল্প। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার পছন্দ হবে। আমি সেই প্রথম থেকে বহুরূপী দেখছি। কাগজটার উপর আমার মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি পত্রিকার গল্পগুলো তেমন যুৎসই হচ্ছে না। আমি থাকি সেই নাকতলায়। আপনি যদি অন্তত একটা গল্প এখনই পড়ে আপনার মতামত দেন তাহলে বাধিত হব। আমি এই চেয়ারটায় বসছি; আমার তাড়া নেই।’
‘সচরাচর আমি এ জিনিসটা করি না,’ বললেন সুপ্রকাশ।
‘আমি জানি, কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ। গল্প ছোট; আপনার বেশি সময় লাগবে না।’
‘বসুন।’
সুপ্রকাশ অগত্যা বাণ্ডিলটা ভদ্রলোকের হাত থেকে নিয়ে নিলেন। তিনটে গল্প, বেশ ঝরঝরে পাণ্ডুলিপি। সুপ্রকাশ একটা গল্প পড়তে শুরু করলেন।
দশ মিনিট লাগল গল্পটা পড়তে। খাসা লেখা। এত ভালো গল্প সুপ্রকাশের দপ্তরে কখনো আসেনি। সুপ্রকাশ নিজের আগ্রহেই বাকি দুটো গল্প পড়ে ফেললেন। এ দুটোও চমৎকার। ভদ্রলোকের ক্ষমতা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘ভালো গল্প’, বললেন সুপ্রকাশ। ‘আমি তিনটে গল্পই নিচ্ছি। পর পর ছাপব। ‘ভবঘুরে’ গল্পটা সব থেকে ভালো, ওটা আমি পুজো সংখ্যার জন্য নির্বাচন করলাম। আপনাকে যথাসময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাঠিয়ে দেব।’
‘অনেক ধন্যবাদ। ইয়ে, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।’
‘বলুন।’
‘আপনি কি সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়তেন?’
‘হ্যাঁ। কেন বলুন ত?’
‘আমিও একই ইস্কুলে পড়েছি। আপনার চেয়ে এক ক্লাস নিচে।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ—আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না কারণ আমি অনেক রোগা হয়ে গেছি।’
‘তা হবে। তাছাড়া প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা ত।’
‘কিন্তু আপনি খুব বেশি বদলান নি। শুধু আপনার একটা জিনিস বদলেছে।’
‘কী?’
‘আপনার নাম। আপনাকে আমি নিধুদা বলে ডাকতাম। আপনার নাম ছিল নিধিরাম ধাড়া।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে, সে নামে কি আর কাগজের সম্পাদক হওয়া যায়?’ বললেন সুপ্রকাশ। ‘তাই কাগজটা বার করার সময় নামটা বদলে নিই।’
উজ্জ্বলবাবু উঠে পড়লেন।
‘আমি তাহলে আসি। আপনাকে গল্পগুলো পড়িয়ে সত্যিই আনন্দ পেলাম, নিধুদা। আপনাকে নিধুদা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না।’
ভদ্রলোক বাণ্ডিল নিয়ে এসেছিলেন, এখন খালি হাতেই বেরিয়ে গেলেন বহুরূপীর আপিস থেকে। আসল ব্যাপারটা উনি ধরে ফেলেছেন। বহুরূপীর সম্পাদক তাঁর লেখাগুলো না পড়েই ফেরত দিয়েছিলেন। এই একই গল্প, এবং তার জন্য তাঁর নামই দায়ী। নদের চাঁদ ভড়! গোড়া থেকেই নামটা বদলে নেওয়া উচিত ছিল, আর নিজে না লিখে তাঁর ভাগনিকে দিয়েই পাণ্ডুলিপি লেখানো উচিত ছিল।
যাক্, এখন থেকে তাঁর লেখা বহুরূপীতে ছাপা হবে তাতে সন্দেহ নেই।