শিক্ষার নব আদর্শ
শ্ৰীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় যে এদেশের চলতি শিক্ষার দর যাচাই করতে উদ্যত হয়েছেন, এ অতি সুখের কথা। কেননা, বাঙালি যদি কোনো বস্তু লাভ করবার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তো সে হচ্ছে শিক্ষা। সুতরাং আমরা দেশস ভদ্রসন্তান প্রাণপাত করে যা পাই, জহরির কাছে তার মূল্য যে কি, তা জানায় ক্ষতি নেই।
আমরা যে কত শিক্ষালোভী, তার প্রমাণ আমাদের পাঁচ বৎসর বয়েসে হাতে-খড়ি হয়। আর কমসেকম একুশ বৎসর বয়েসে হাতে-কালি মুখে-কালি আমরা সেনেট-হাউস থেকে লিখে আসি। কিন্তু এতেও আমাদের শিক্ষার সাধ মেটে না। এর পরে আমরা সারাজীবন যখন যা-কিছু পড়ি–তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক; আমাদের মনে স্বতঃই এই প্রশ্নের উদয় হয় যে, আমরা এ পড়ে কি শিক্ষা লাভ করলম। এ প্রশ্নের উত্তর মুখে-মুখে দেওয়া অসম্ভব; কেননা, সাহিত্যের যা শিক্ষা, তা হাতে-হাতে পাওয়া যায় না। সাহিত্য যা দেয়, তা আনন্দ; কিন্তু ও-বস্তু আমরা জানি নে বলে মানি নে। আমাদের শিক্ষার ভিতর আনন্দ নেই বলে আনন্দের ভিতর যে শিক্ষা থাকতে পারে, তা আমাদের বুদ্ধির অগম্য।
ফলে, পাঠকমাত্রই যখন শিক্ষার্থী, তখন লেখকমাত্রকেই দায়ে-পড়ে শিক্ষক হতে হয়। পাঠকসমাজ যখন আমাদের কাছে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত, তখন অবশ্য শিক্ষা দিতে আমাদের নারাজ হওয়া উচিত নয়; কেননা, লেকচারজিনিসটে দেওয়া সহজ, শোনাই কঠিন। তবে যে আমরা পাঠকদের সকল সময় শিক্ষা না দিয়ে সময়-সময় আনন্দ দেবার বৃথা চেষ্টা করে তাঁদের বিরাগভাজন হই, তার একটি বিশেষ কারণ আছে।
বাংলাসাহিত্যের যে শুধু পাঠক আছেন তা নয়, পাঠিকাও আছেন। দলে বোধ হয় উভয়েই সমান পরে হবেন, অথচ এ উভয়ের ভিতর বিদ্যার প্রভেদ বিস্তর। পাঠকেরা-সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাত্তীর্ণ; পাঠিকারা বালিকাবিদ্যালয়ের পরীক্ষাত্তীর্ণও নন। সুতরাং পাঠকদের জন্য লেখকদের পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেকচার দেওয়া কর্তব্য, এবং পাঠিকাদের জন্য নিম্ন-প্রাইমারির। অথচ শ্রোতাদের শিক্ষা দিতে হলে আমাদের পক্ষে সেইরূপ বক্তৃতা করা আবশ্যক যা সকলের পক্ষে সমান উপযোগী হয়। অসাধ্যসাধন করবার দুঃসাহস সকলের নেই, সম্ভবত সেই কারণে বাংলার কাব্যসাহিত্য শিক্ষাদানের ভার হাতে নেয় নি।
কিন্তু এদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের পক্ষে সমান শিক্ষাপ্রদ সাহিত্য যে রচনা করা যায় না, এ ধারণা অমূলক। উপর-উপর দেখলেই এদেশের শিক্ষিত লোক এবং অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের বিদ্যাবুদ্ধির প্রভেদ মস্ত দেখায়; কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, আমরা মনে সকলেই এক। মনোরাজ্যে যে আমাদের লিঙ্গভেদ নেই, বর্ণভেদ নেই, বয়োভেদ নেই তার প্রমাণ হাতে-কলমে দেখানো যেতে পারে। ‘ঘরেবাইরে’ লেখবার কৈফিয়ত তলব করে একটি ভদ্রমহিলা রবীন্দ্রনাথকে যে পত্র লিখেছিলেন, তা যে-কোনো এম. এ. পাশ-করা প্রোফেসর লিখতে পারতেন, এবং উক্ত গল্প পাঠ করে একটি এম. এ. পাশকরা প্রোফেসরের মনে যে সমস্যার উদয় হয়েছে, তা যে-কোনো ভদ্রমহিলার মনে উদয় হতে পারত। অতএব যে-কোনো শিকারী সাহিত্যিক একটি বাক্যবাণে এ দুটি পাখিকেই বিদ্ধ করতে পারেন। বস্তুগত্যা আমাদের মন হচ্ছে হরীতকী-জাতীয়; শিক্ষার গুণে সে মন পাকে না, শুধু শুকিয়ে যায়। সুতরাং বাংলার অশিক্ষিত স্ত্রীলোক ও শিক্ষিত পুরুষ–এ দুয়ের মনের ভিতর প্রভেদ এই যে, এর একটি কাঁচা আর অপরটি শুকনো। দেশসুদ্ধ লোক সেই শিক্ষা চান, যে শিক্ষার গুণে স্ত্রীপুরুষ সকলের মন সমান শুকিয়ে ওঠে। কেননা, হরীতকী যত বেশি শকোয়, যত বেশি তিতো হয়, তত বেশি উপকারী হয়। অপরপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সেই শিক্ষার সন্ধানে ফিরছেন, যে শিক্ষার প্রভাবে আমাদের মন-হরীতকী পেকে উঠবে, এবং যার আস্বাদ গ্রহণ করে স্বজাতি অমরত্ব লাভ করবে। এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতের মিল হবার কোনো সম্ভাবনা নেই; কেননা, উভয়ের আদশ সম্পূর্ণ বিভিন্ন।
আমাদের পক্ষে কি শিক্ষা ভালো, তা নির্ণয় করবার পূর্বে–আমরা কি হতে চাই, সেবিষয়ে মনঃস্থির করা আবশ্যক। কেননা, একটা স্পষ্ট জাতীয় আদশ না থাকলে, জাতীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে না। ধরন, যদি অশ্বত্ব-লাভ-করা গর্দভদের জাতীয় আদর্শ করে তোলা যায়, তাহলে অবশ্য সে জাতির শিক্ষকেরাও তাদের জন্য পেটনের ব্যবস্থা করবেন; অপরপক্ষে গভত্ব লাভ করা যদি অন্যদের জাতীয় আদর্শ করে তোলা যায়, তাহলে সে জাতির শিক্ষকেরাও তাদের জন্য ঐ পেটনেরই ব্যবস্থা করবেন। হয় গাধা-পিটে-ঘোড়া, নয় ঘোড়া-পিটে-গাধা করাই যে শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য–সাধারণত এইটেই হচ্ছে লোকের ধারণা। এবং আমরা এই উভয়ের মধ্যে যে কোন, জাতীয়, সেবিষয়ে দেশে-বিদেশে বিষম মতভেদ থাকলেও পেটন দেওয়াটাই যে শিক্ষা দেবার একমাত্র পদ্ধতি, সেবিষয়ে বিশেষ কোনো মতভেদ নেই। কাজেই আমাদের শিক্ষকেরা এক হাতে সংস্কৃত, আর-এক হাতে ইংরেজি ধরে আমাদের উপর দ হাতে চাবুক চালাচ্ছেন। এর ফলে কত গাধা ঘোড়া এবং কত ঘোড়া গাধা হচ্ছে–তা বলা কঠিন; কেননা, এবিষয়ের কোনো স্ট্যাটিস্টিকস অদ্যাবধি সংগ্রহ করা হয় নি।
সে যাই হোক, যে জাতীয় আদর্শের উপর জাতীয় শিক্ষা নির্ভর করে, তা যুগপৎ মনের এবং জীবনের আদর্শ হওয়া দরকার। যেদেশে জাতীয় শিক্ষা আছে, সেদেশের প্রতি ঈষৎ দৃষ্টিপাত করলেই এ সত্য সকলের কাছেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। ইউরোপে আমরা দেখতে পাই যে, জর্মানি চেয়েছিল যা নই তাই হব’, ইংলণ্ড যা আছি তাই থাকব, আর ফ্রান্স যা আছি তাও থাকব না, যা নই তাও হব না; এবং এই তিন দেশের গত পঞ্চাশ বৎসরের কাজ ও কথার ভিতর নিজ-নিজ জাতীয় আদর্শের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে।
কিন্তু আমাদের বিশেষত্ব এই যে, আমরা জীবনে এক পথে চলতে চাই–মনে আর-এক পথে।
আমাদের ব্যক্তিগত মনের আদর্শ হচ্ছে ‘যা ছিলুম তাই হওয়া’, আর আমাদের জাতিগত জীবনের আদর্শ হচ্ছে ‘যা ছিলুম না তাই হওয়া’। ফলে আমাদের সামাজিক বুদ্ধির মুখে প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে আর আমাদের রাষ্ট্রীয় বুদ্ধির মুখ নবীন ইউরোপের দিকে। এই আদর্শের উভয়সংকটে পড়ে আমরা শিক্ষার একটা সপথ ধরতে পারছি নে— স্কুলেও নয়, সাহিত্যেও নয়।
একজন ইংরেজ দার্শনিক বলেছেন যে, সমস্যাটা যে কি এবং কোথায়, সেইটে ধরাই কঠিন; তার মীমাংসা করা সহজ। একথা সত্য। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ তাই ‘ঘরেবাইরে’য় আমাদের জাতীয় সমস্যার ছবি এঁকেছেন; কেননা, ও-উপন্যাসখানি একটি রূপক-কাব্য ছাড়া আর-কিছুই নয়। নিখিলেশ হচ্ছেন প্রাচীন ভারতবর্ষ, সন্দীপ নবীন ইউরোপ, আর বিমলা বর্তমান ভারত। এই দোটানার ভিতর পড়েই বিমলা বেচারা নাস্তানাবুদ হচ্ছে, মুক্তির পথ যে কোন দিকে, তা সে খুঁজে পাচ্ছে না। এরূপ অবস্থায় এক সৎশিক্ষা ব্যতীত তার উদ্ধারের উপায়ান্তর নেই। অতএব এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে শিক্ষার একটি আদর্শ খুঁজে-পেতে বার করা দরকার।
আমি বহু গবেষণার ফলেও সে আদর্শ আজও আবিষ্কার করতে পারি নি, সুতরাং সে আদর্শ নিজেই গড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি স্বজাতিকে অনুরোধ করি যে, আমার এই গড়া আদর্শ যেন বিনা পরীক্ষায় পরিহার না করেন।
শ্ৰীমতী লীলা মিত্র নামক জনৈক ভদ্রমহিলা ‘সবুজপত্রে’ এই মত প্রকাশ করেন যে, এদেশে শিক্ষার আদর্শ ভুল, সুতরাং তার পদ্ধতিও নিরর্থক। তাঁর মতে আমরা প্রীজাতিকে সেই শিক্ষা দিতে চাই, যাতে তারা পুরুষজাতির কাজে লাগে, সুতরাং সে শিক্ষা নিল। একথা সম্ভবত সত্য। তিনি চান যে শ্রীজাতি নিজের শিক্ষার ভার নিজ-হস্তে গ্রহণ করেন। এ হলে তো আমরা বাঁচি। আমাদের মেয়েরা যদি নিজের বিবাহের ভার নিজের হাতে নেন, তাহলে দেশসুদ্ধ লোক যেমন কন্যাদায় হতে অমনি নিষ্কৃতি লাভ করে, তেমনি মা-লক্ষীরা যদি নিজ-গুণে মা-সরস্বতী হয়ে ওঠেন, তাহলে স্ত্রীশিক্ষার সমস্যা আমাদের আর মীমাংসা করতে হয় না।
সে যাই হোক, আমি বলি, পুরুষজাতিকে সেই শিক্ষা দেওয়া হোক, যাতে তারা স্ত্রীজাতির কাজে লাগে। শিক্ষার এ আদর্শ কোনো কালে কোনো দেশে ছিল না বলেই আমাদের পক্ষে তা গ্রাহ্য করা উচিত। পুরুষজাতি যদি এই আদর্শে শিক্ষিত হয়, তাহলে আর কিছু না হোক, পৃথিবীর মারামারিকাটাকাটি সব থেমে যাবে। নিখিলেশ ও সন্দীপ যদি বিমলাকে নিজের নিজের কাজে লাগাতে চেষ্টা না করে নিজেদের বিমলার কাজে লাগাতে চেষ্টা করতেন, তাহলে গোল তো সব মিটেই যেত। অতএব আমরা যাতে বিমলার কাজে লাগি, সেইরকম আমাদের শিক্ষা হওয়া কর্তব্য।
মাঘ ১৩২২