শামসুন নাহার-কে
কৃষ্ণনগর
১১-৮-২৬
সকাল
স্নেহের নাহার,
কাল রাত্তিরে ফিরেছি কলকাতা হতে। চট্টগ্রাম হতে এসেই কলকাতা গেছলাম। এসেই পড়লাম তোমার দ্বিতীয় চিঠি – অবশ্য তোমার ভাবিকে লেখা। আমি যেদিন তোমার প্রথম চিঠি পাই, সেদিনই – তখনই কলকাতা যেতে হয়। মনে করেছিলাম কলকাতা গিয়ে উত্তর দেব। কিন্তু কলকাতার কোলাহলের মধ্যে এমনিই বিস্মৃতি হয়েছিলাম নিজেকে যে কিছুতেই উত্তর দেওয়ার অবসর করে নিতে পারিনি। তাছাড়া ভাই, তুমি অত কথা জানতে চেয়েছ, শুনতে চেয়েছ, যে কলকাতার হট্টগোলের মধ্যে সে বলা যেন কিছুতেই আসত না। আমার বাণী হট্টগোলকে এখন রীতিমতো ভয় করে, মূক হয়ে যায় ভীরু বাণী আমার – ওই কোলাহলের অনবকাশের মাঝে। চিঠি দিতে দেরি হল বলে তুমি রাগ কোরো না ভাই লক্ষ্মীটি। এবার হতে ঠিক সময়ে চিঠি দেব, দেখে নিয়ো। কেমন? বাহারটাও না জানি কত রাগ করেছে, কী ভাবছে। আর তোমার তো কথাই নেই, ছেলেমানুষ তুমি, পড়তে না পেয়ে তুমি এখনও কাঁদ! বাহার যেন একটু চাপা, আর তুমি খুব অভিমানী, না? কী যে করছ তোমরা দুটি ভাই-বোনে যে এসে অবধি মনে হচ্ছে যেন কোথায় কোন্ নিকটতম আত্মীয়কে আমি ছেড়ে এসেছি। মনে সদাসর্বদা একটা বেদনার উদ্ বেগ লেগেই রয়েছে। অদ্ভুত রহস্যভরা এই মানুষের মন! রক্তের সম্বন্ধকে অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যার, সে-ই কখন পথের সম্বন্ধকে সকল হৃদয় দিয়ে অসংকোচে স্বীকার করে নেয়। ঘরের সম্বন্ধটা রক্তমাংসের, দেহের, কিন্তু পথের সম্বন্ধটা হৃদয়ের অন্তরতম-জনার। তাই ঘরের যারা, তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, মেনে চলি, কিন্তু বাইরের আমার-জনকে ভালোবাসি, তাকে না-মানার দুঃখ দিই। ঘরের টান কর্তব্যের, বাইরের টান প্রীতির-মাধুর্যের। সকল মানুসের মনে সকল কালের < এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরের আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই সে অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই! আকাশ আলো কানন ফুল, এমনই সব না-চেনা জনেরা হয়ে ওঠে তার অন্তরতম। বিশেষ করে গানের পাখি যারা, তারা চিরকেলে নিরুদ্দেশ দেশের পথিক। কোকিল বাসা বাঁধে না, ‘বউ কথা কও’-এর বাসার উদ্দেশ্য আজও মিলল না, ‘উহু উহু চোখ গেল’পাখির নীড়ের সন্ধান কেউ পেল না! ওদের আসা যাওয়া একটা রহস্যের মতো। ওরা স্বর্গের পাখি, ওদের যেন পা নেই, ধুলার পৃথিবীতে যেন ওরা বসবে না, ওরা যেন ভেসে আসা গান। তাই ওরা অজানা ব্যথার আনন্দে পাগল হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দেশে বিদেশে, বসন্ত-আসা বনে, ফুল-ফোটা কাননে, গন্ধ-উদাস চমনে। ওরা যেন স্বর্গের প্রতিধ্বনি, টুকরো-আনন্দের উল্কাপিণ্ড! সমাজ এদের নিন্দা করেছে, নীতিবাগীশ বায়স তার কুৎসিত দেহ— ততোধিক কুৎসিত কণ্ঠ নিয়ে এর ঘোর প্রতিবাদ করেছে, এদের শিশুদের ঠুকরে ‘নিকালো হিয়াসে’বলে তাড়িয়েছে, তবু আনন্দ দিয়েছে এই ঘর-না-মানা পতিতের দলই। নীড়-বাঁধা সামাজিক পাখিগুলি দিতে পারল না আনন্দ, আনতে পারল না স্বর্গের আভাস, সুরলোকের গান…।
এত কথা বললাম কেন, জান? তোমাদের যে পেয়েছি এই আনন্দটাই আমায় এই কথা কওয়াচ্ছে, গান গাওয়াচ্ছে। বাইরের পাওয়া নয়, অন্তরের পাওয়া। গানের পাখি গান গায় খাবার পেয়ে নয়; ফুল পেয়ে, আলো পেয়ে সে গান গেয়ে ওঠে। মুকুল আশা কুসুম-ফোটা বসন্তই পাখিকে গান-গাওয়ায়, ফল-পাকা জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় নয়। তখনও পাখি হয়তো গায়, কিন্তু ফুল যে ফুটতে দেখেছিল, গন্ধ সে তার পেয়েছিল-গায় সে সেই আনন্দে, ফলপাকার লোলুপতায় নয়। ফুল ফুটলে পায় গান, কিন্তু ফল পাকলে পায় খিদে; আমি পরিচয় করার অনন্ত ঔৎসুক্য নিয়ে বেড়াচ্ছি মানুষের মাঝে, কিন্তু ফুল ফোটা মন মেলে না ভাই, মেলে শুধু ফল-পাকার ক্ষুধাতুর মন। তোমাদের মধ্যে সেই ফুল-ফোটানো বসন্ত, গান-জাগানো আলো দেখেছি বলেই আমার এত আনন্দ, এত প্রকাশের ব্যাকুলতা। তোমাদের সাথে পরিচয় আমার কোনো প্রকার স্বার্থের নয়, কোনো দাবির নয়। ঢিল মেরে ফল পাড়ার অভ্যেস আমার ছেলেবেলায় ছিল, যখন ছিলাম ডাকাত, এখন আর নেই। ফুল যদি কোথাও ফোটে, আলো যদি কোথাও হাসে সেখানে আমায় গান গাওয়ায় পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। ওর মাঝে শিশিরের করুণা যেটুকু, সেটুকু আমার আর কারুর নয়। যাক, কাজের কথাগুলো বলে নিই আগে।
আমায় এখনও ধরেনি, তার প্রমাণ এই চিঠি। তবে আমি ধরা দেওয়ার দিকে হয়তো এগোচ্ছি। ধরা পড়া আর ধরা দেওয়া এক নয়, তা হয়তো বোঝ। ধরা দিতে চাচ্ছি, নিজেই এগিয়ে চলেছি শত্রু-শিবিরের দিকে, এর রহস্য হয়তো বলতে পারি। এখন বলব না। এত বিপুল যে সমুদ্র, তারও জোয়ারভাঁটা আসে অহোরাত্রি। এই জোয়ার-ভাঁটা সমুদ্রেই খেলে, আর তার কাছাকাছি নদীতে; বাঁধ-বাঁধা ডোবায়, পুকুরে জোয়ার-ভাঁটা খেলে না। মানুষের মন সমুদ্রের চেয়েও বিপুলতর। খেলবে না তাতে জোয়ার ভাঁটা! যদি না খেলে, তবে তা মানুষের মন নয়। ওই শান-বাঁধানো ঘাটভরা পুকুরগুলোতে কাপড় কাচা চলে, ইচ্ছে হলে কলসি বেঁধে ডুবে মরাও চলে, চলে না ওতে জাহাজ, দোলে না ওতে তরঙ্গ দোলা, খেলে না ওতে জোয়ার-ভাঁটা… আমি একবার অন্তরের পানে ফিরে চলতে চাই, যেখানে গোপন সৃষ্টিকুজ্ঞ, যেখানে আমার অনন্ত দিনের বধূ আমার জন্যে বসে বসে মালা গাঁথছে। যেমন করে সিন্ধু চলে ভাটিয়ালি টানে, তেমনি করে ফিরে যেতে চাই গান-শ্রান্ত ওড়া-ক্লান্ত আমি। আবার অকাজের কথা এসে পড়ল। পুষ্প-পাগল বনে কাজের কথা আসে না, গানের ব্যথাই আসে, আমায় দোষ দিয়ো না।
‘অগ্নিবীণা’বেঁধে দিতে দেরি করছে দফতরি, বাঁধা হলেই অন্যান্য বই ও ‘অগ্নিবীণা’২ পাঠিয়ে দেব একসাথে। ডি.এম. লাইব্রেরিকে বলে রেখেছি। আর দিন দশেকের মধ্যেই হয়তো বই পাবে। আমার পাহাড়ে ও ঝরনাতলে তোলা ফটো একখানা করে পাঠিয়ে দিয়ো। গ্রুপের ফটোর একখানা (যাতে হেমন্তবাবু ও ছেলেরা আছে), আমি বাহার ও অন্য কে একটি ছেলেকে নিয়ে তোলা যে ফটো তার একখানা এবং আমি ও বাহার দাঁড়িয়ে তোলা ফটোর একখানা – পাঠিয়ে দিয়ে আমায়। ফটোর সব দাম আমার বই বিক্রির টাকা হতে কেটে নিয়ো।
এখন আবার কোন্ দিকে উড়ব, ঠিক নেই কিছু। যদি না ধরে, কোথাও হয়তো যাব, গেলে জানাব। এখন তোমার চিঠিটার উত্তর দিই। তোমার চিঠির উত্তর তোমার ভাবিই দিয়েছে শুনলাম! আরও শুনলাম, সে নাকি আমার নামে কতগুলো কীসব লিখছে তোমার কাছে। তোমার ভাবির কথা বিশ্বাস কোরো না। মেয়েরা চিরকাল তাদের স্বামীদের নির্বোধ মনে করে এসেছে। তাদের ভুল, তাদের দুর্বলতা ধরতে পারা এবং সকলকে জানানোই যেন মেয়েদের সাধনা। তুমি কিন্তু নাহার, রেগো না যেন। তুমি এখনও ওদের দলে ভিড়নি। মেয়েরা বড্ড অল্পবয়সে বেশি প্রভুত্ব করতে ভালোবাসে। তাই দেখি, বিয়ে হওয়ার এক বছর পরে ষোলো-সতেরো বছর বয়সেই মেয়েরা হয়ে ওঠে গিন্নি। তারা যেন কাজে অকাজে, কারণে অকারণে স্বামী বেচারিকে বকতে পারলে বেঁচে যায়। তাই সদাসর্বদা পুরুষের পেছনে তারা লেগে থাকে গোয়েন্দা পুলিশের মতো। এই দেখ না ভাই, ছটাক খানেক কালি ঢেলে ফেলেছি চিঠি লিখতে লিখতে একটা বই-এর উপর, এরজন্য তোমার ভাবির কী তম্বি, কী বকুনি। তোমার ভাবি বলে নয়, সব মেয়েই অমনই। স্ত্রীদের কাছে স্বামীরা হয়ে থাকেন একেবারে বেচারাম লাহিড়ি!
একটা কথা আগেই বলে রাখি, তোমার কাছে চিঠি লিখতে কোনো সংকোচের আড়াল রাখিনি। তুমি বালিকা এবং বোন বলে তার দরকার মনে করিনি। যদি দরকার মনে করো, আমায় মনে করিয়ে দিয়ো। আমি এমন মনে করে চিঠি লিখিনি যে, কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে চিঠি লিখছে। কবি লিখছে চিঠি তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিতা কাউকে, এই মনে করেই চিঠিটা নিয়ো। চিঠি লেখার কোথাও ত্রুটি দেখলে দেখিয়ে দিয়ো।
আমার ‘উচিত আদর’করতে পারনি লিখেছ, আর তার কারণ দিয়েছ, পুরুষ নেই কেউ বাড়িতে এবং অসচ্ছলতা। কথাগুলোয় সৌজন্য প্রকাশ করে খুব বেশি, কিন্তু ওগুলো তোমাদের অন্তরের কথা নয়। কারণ, তোমরাই সবচেয়ে বেশি করে জান যে তোমরা যা আদর-যত্ন করেছ আমার, তার বেশি করতে কেউ পারে না! তোমরা তো আমার কোথাও ফাঁক রাখনি আমার শূন্যতা নিয়ে অনুযোগ করবার। তোমারা আমার মাঝে অভাবের অবকাশ তো দাওনি তোমাদের অভাবের কথা ভাববার; এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সহজেই সহজ হতে পারি – সকলের কাছে, ওটা আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, কিন্তু তোমাদের কাছে যতটা সহজ হয়েছি – অতটা সহজ বুঝি আর কোথাও হইনি। সত্যি নাহার, আমায় তোমরা আদর-যত্ন করতে পারনি বলে যদি সত্যিই কোনো সংকোচের কাঁটা থাকে তোমাদের মনে, তবে তা অসংকোচে তুলে ফেলবে মন থেকে। অতটা হিসেব-নিকেশ করবার অবকাশ আমার মনে নেই, আমি থাকি আপনার মন নিয়ে আপনি বিভোর।
মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে বলতেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি খেই হারিয়ে ফেলি কথার। আমরা গোপনতম কে যেন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে আদেশ করে। আর আর্থিক অসচ্ছলতার কথা লিখেছে। অর্থ দিয়ে মাড়োয়ারিকে, জমিদার মহাজনকে বা ভিখিরিকে হয়তো খুশি করা যায়, কবিকে খুশি করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’৩ কবিতাটি পড়েছ? ওতে এই কথাই আছে।– কবি রাজ-দরবারে গিয়ে রাজাকে মুগ্ধ করে রাজপ্রদত্ত মণি-মাণিক্যের বদলে চাইলে রাজার গলার মালাখানি। কবি লক্ষ্মীর প্যাঁচার আরাধনা কোনো কালে করেনি, সরস্বতীর শতদলেরই আরাধনা করেছে– তাঁর পদ্মগন্ধে বিভোর হয়ে শুধু গুন গুন করে গান করেছে আর গান করেছে। লক্ষ্মীর ঝাঁপির কড়ি দিয়ে। কবিকে অভিবন্দনা করলে কবি তাতে অখুশি হয়ে ওঠে। কবিকে খুশি করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত। সে সওগাত তোমরা দিয়েছ আমায় অজ্ঞলি পূরে। কবি চায় না দান, কবি চায় অজ্ঞলি, কবি চায় প্রীতি, কবি চায় পূজা। কবিত্ব আর দেবত্ব এইখানে এক। কবিতা আর দেবতা-সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় সুন্দর যা তাই দিয়ে। রুপার দাম আছে বলে রুপা অত হীন; হাটে বাজারে মুদির কাছে, বেনের কাছে ওজন হতে হতে ওর প্রাণান্ত ঘটল; রূপার দাম নেই বলেই রূপ এত দুর্মূল্য, রূপ এত সুন্দর, এত পূজার! রুপা কিনতে হয় রুপেয়া দিয়ে, রূপ কিনতে হয় হৃদয় দিয়ে। রূপের হাটের বেচা-কেনা অদ্ভুত। যে যত অমনই – যে যত বিনাদামে কিনে নিতে পারে, সে তত বড়ো রূপ-রসিক সেখানে। কবিকে সম্মান দিতে পারনি বলে মনে যদি করেই থাক, তবে তা মুছে ফেল। কোকিল পাপিয়াকে বাড়িতে ডেকে ঘটা করে খাওয়াতে পারনি বলে তারা তো অনুযোগ করেনি কোনোদিন। সে-কথা ভাবেওনি কোনোদিন তারা। তারা তাই বলে তোমার বাতায়নের পাশে গান গাওয়া বন্ধ করেনি। তাছাড়া কবিকে হয়তো সম্মান করা যায় না – কাব্যকে সম্মান করা যায়। তুমি হয়তো বলবে, গাছের যত্ন না নিলে ফুল দেয় না কিন্তু সে যত্নেরও ত্রুটি হচ্ছে না। অনাত্মীয়কে লোকে সংবর্ধনা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে; বন্ধুকে গ্রহণ করে হাসি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে।
উপদেশ আমি তোমায় দিইনি। যদি দিয়ে থাকি, ভুলে যেয়ো। উপদেশ দেওয়ার চাণক্য আমি নই। দিয়েছি তোমার অনাগত বিপুল সম্ভবনাকে অঞ্জলি – তোমার মাঝের অপ্রকাশ সুন্দরকে প্রকাশ-আলোতে আসার আহ্বান জানিয়েছি শঙ্খধ্বনি করে। উপদেশের ঢিল ছুঁড়ে তোমার মনের বনের পাখিকে উড়িয়ে দেওয়ার নির্মমতা আমার নেই, এ তুমি ধ্রুব জেনো। আমি ফুল-ঝরা দিয়ে হাসাই, শাখার মার দিয়ে কাঁদাই নে।
তোমায় লিখতে বলেছি, আজও বলছি লিখতে। বললেই যে লেখা আসে, তা নয়। কারুর বলা যদি আনন্দ দেয়, তবে সেই আনন্দের বেগে সৃষ্টি হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে। তোমরা আমায় বলেছ লিখতে। সে-বলা আমায় আনন্দ দিয়েছে, তাই সৃষ্টির বেদনা জেগেছে অন্তরে। তোমাদের আলোর পরশে, শিশিরের ছোঁয়ায় আমার মনের কুঁড়ি বিকচ হয়ে উঠেছে। তাই চট্টগ্রামে লিখেছি। নইলে তোমরা বললেই লেখা আসত না। তোমার মনের সুন্দর যিনি, তিনি যদি খুশি হয়ে ওঠেন, তাহলে সেই খুশিই তোমায় লিখতে বসাবে। আমার বলা তোমার সেই মনের সুন্দরকে অজ্ঞলি দেওয়া। বলেছি, অজ্ঞলি দিয়েছি। তিনি খুশি হয়ে উঠেছেন কিনা তুমি জান। তুমি আজও অনেকখানি বালিকা। তারুণ্যের যে উচ্ছ্বাস, যে আনন্দ, যে ব্যথা সৃষ্টি জাগায়, সেই উচ্ছ্বাস, সেই আনন্দ, সেই ব্যথা তোমার জীবনে আসার এখনও অনেক দেরি। তাই সৃষ্টি তোমার আজও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল না। তার জন্যে অপেক্ষা করবার ধৈর্য অর্জন করো। তরুর শাখায় আঘাত করলে সে ফুল দেবে না, যখন দেবে সে আপনি দেবে। আমাদের দেশের মেয়েরা বড়ো হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্রয়োজনের দাবিতে। ঘরের প্রয়োজন তাদের বন্দিনি করে রেখেছে। এত বিপুল বাহির যাদের চায়, তাদের ঘিরে রেখেছে বারো হাত লম্বা আট হাত চওড়া দেয়াল। বাহিরের আঘাত এ দেয়ালে বারে বারে প্রতিহত হয়ে ফিরল। এর বুঝি ভাঙন নেই অন্তর হতে মার না খেলে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি। তারা ভেতর হতে দ্বার চেপে ধরে বলছে আমরা বন্দিনি। দ্বার খোলার দুঃসাহসিকা আজ কোথায়? তাকেই চাইছেন, যুগদেবতা। দ্বার ভাঙার পুরুষতার নারীদের প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের দ্বার ভিতর হতে বন্ধ, বাহির হতে নয়। তোমারও যে কী হবে বলতে পারিনে। তার কারণ তোমায় চিনলেই তো চলবে না, তোমায় চালাবার দাবি নিয়ে জন্মেছেন যাঁরা তাঁদের আজও চিনিনি। আমার কেমন যেন মনে হল অভিভাবক নয়। ভুল যদি না করে থাকি, তাহলেই মঙ্গল। অভিভাবক যিনিই হন তোমার, তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর আলোর ছোঁয়া পাননি বলেই মনে হল। তোমায় যে আজ কাঁদতে হয় বসে বসে কলেজে পড়তে যাওয়ার জন্য, এও হয়তো সেই কারণেই। মিসেস আর. এস. হোসেনের মতো অভিভাবিকা পাওয়া অতি বড়ো ভাগ্যের কথা। তাঁকেও যখন তাঁরা স্বীকার করে নিতে পারলেন না, তখন তোমার কী হবে পড়ার, তা আমি ভাবতে পারিনে! তোমার আর বাহারের উপর আমার দাবি আছে – স্নেহ করার দাবি, ভালোবাসার দাবি, কিন্তু তোমার অভিভাবকদের উপর তো আমার দাবি নেই। তবুও উপর-পড়া হয়ে অনেক বলেছি এবং তা হয়তো তোমার আম্মা ও নানি সাহেবাও শুনেছেন। বিরক্তও হয়েছেন হয়তো।
আলোর মতো, শিশিরের মতো আমি তোমার অন্তরের দলগুলি খুলিয়ে দিতে পারি হয়তো। দ্বারের অর্গল খুলি কী করে? – তুমি আমার সামনে আসতে পারলে বলে আমার কোনোরূপ কিছু মনে হয়নি। তার কারণ, আমি তোমাকে দেখেছি এবং দেখতে চাই লেখার মধ্য দিয়ে। সেই হল সত্যিকার দেখা। মানুষ দেখার কৌতূহল আমার নেই, স্রষ্টা দেখার সাধনা আমার। সুন্দরকে দেখার তপস্যা আমার। তোমার প্রকাশ দেখতে চাই আমি, তোমায় দেখতে চাইনে। সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে যে দেখেছে, সেই বড়ো দেখা দেখেছে। এই দেখা আর্টিস্টের দেখা, ধেয়ানীর দেখা, তপস্বীর দেখা। আমার সাধনা অরূপের সাধনা। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীরপারের যে রাজকুমারী বন্দিনি, সেই রূপকথার অরূপাকে মায়া-নিদ্রা হতে জাগাবার দুঃসাহসী রাজকুমার আমি। আমি সোনার কাঠির সন্ধান জানি – যে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় বন্দিনী উঠবে জেগে, রুপার কাঠির মায়ানিদ্রা যাবে টুটে, আসবে তার আনন্দের মুক্তি। যে চোখের জল বুকের তলায় আটকে আছে, তাকে মুক্তি দেওয়ার ব্যথা-হানা আমি। মানস সরোবরের বদ্ধ জলধারাকে শুভ শঙ্খধ্বনি করে নিয়ে চলেছি কবি আমি ভগীরথের মতো। আমার পনেরো আনা রয়েছে স্বপ্নে বিভোর, সৃষ্টির ব্যথায় ডগমগ, আর এক আনা করছে পলিটিক্স, দিচ্ছে বক্তৃতা, গড়ছে সংঘ। নদীর জল চলছে সমুদ্রের সাথে মিলতে, দুধারে গ্রাম সৃষ্টি করতে নয়। যেটুকু জল তার ব্যয় হচ্ছে দুধারের গ্রামবাসীদের জন্য, তা তার এক আনা। বাকি পনেরো আনা গিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। আমার পনেরো আনা চলেছে আর চলেছে সৃষ্টি-দিন হতে আমার সুন্দরের উদ্দেশে। আমার যত বলা আমার সেই বিপুলতরকে নিয়ে, আমার সেই প্রিয়তম, সেই সুন্দরতম কে নিয়ে। তোমাকেও বলি, তোমার তপস্যা যেন তোমার সুন্দরকে নিয়েই থাকে মগ্ন। তোমার চলা, তোমার বলা, যেন হয় তোমার সুন্দরের উদ্দেশে, তাহলে তোমায় প্রয়োজনের বাঁধ দিয়ে কেউ বাঁধতে পারবে না। তোমার অন্তরতমকে ধ্যান করো তোমার বলা দিয়ে। বাধা যেন তোমার ভিতর দিক থেকে জমা না হয়ে ওঠে। এক কাজ করতে পার, নাহার? তোমার সকল কথা আমায় খুলে বলতে পার? কী তোমার ব্রত, কী তোমার সাধনা – এই কথা। আমার কাছে সংকোচ কোরো না। আমি তাহলে তোমার গতির উদ্দেশ পাব, আর সেই রকম করে তোমায় গড়ে উঠবার ইশারা দিতে পারব। আমি অনেক পথ চলেছি, পথের ইঙ্গিত হয়তো দিতে পারব। তাই বলে আমি পথ চালাব, এ ভয় কোরো না।
বড়ো বড়ো কবির কাব্য পড়া এই জন্য দরকার যে তাতে কল্পনার জট খুলে যায়, চিন্তার বদ্ধ ধারা মুক্তি পায়। মনের মাঝে প্রকাশ করতে না পারার যে উদ্য়বেগ, তা সহজ হয়ে ওঠে। মাঠির মাঝে যে পত্র-পুষ্পের সম্ভাবনা, তা বর্ষণের অপেক্ষা রাখে। নইলে তার সৃষ্টির বেদনা মনের মাঝেই গুমরে মরে।
আমার কাছে দামি কথা শুনতে চেয়েছ। দামি কথার জুয়েলার আমি নই। আমি ফুলের বেসাতি করি। কবি বাণীর কমল-বনের বনমালি। সে মালা গাঁথে, সে মণি-মাণিক্য বিক্রি করে না। কবি কথাকে দামি করতে পারে না, সুন্দর করতে পারে। ‘বউ কথা কও’যে কথা কয়, কোকিল যে কথা কয় তার এক কানাকড়ি দাম নেই। ওরা দামি কথা বলতে জানে না। ওদের কথা শুধু গান। তাই বুদ্ধিমান লোক তোতা পাখি পোষে, ময়না পাখি পোষে, ওরা ওদের রোজ ‘রাধা কেষ্ট’বুলি শোনায়। আমরা যা বলি, তার মানেও নেই, দামও নেই। তোমায় বুদ্ধিমান লোকের দলে জানিনে বলে এত বকে যাচ্ছি। শুনতে যদি বালো না লাগে জানিয়ো, সাবধান হব।
আমার জীবনের ছোটো-খাট কথা জানতে চেয়েছ। বড়ো মুশকিল কথা ভাই। আমার জীবনের যে বেদনা, যে রং তা আমার লেখায় পাবে। অবশ্য লেখার ঘটনাগুলো আমার জীবনের নয়, লেখার রহস্য টুকু আমার, ওর বেদনাটুকু আমার। ওইখানেই তো আমার সত্যিকার জীবনী লেখা রয়ে গেল। জীবনের ঘটনা দিয়ে কৌতুক অনুভব করতে পার। কিন্তু তা দিয়ে আমাকে চিনতে পারবে না। সূর্যের কিরণ আসলে সাতটা রং–রামধনুতে যে রং প্রতিফলিত হয়। কিন্তু সূর্য যখন ঘোরে, তখন তাকে দেখি আমরা শুভ্র জ্যোতির্ময় রূপে। সূর্যের চলাটা প্রতারণা করে আমাদের চোখকে – তার বুকের রং দেখতে দেয় না সে। কিন্তু ইন্দ্রধনু যখন দেখি, ওতেই দেখতে পাই ওর গোপন প্রাণের রং। ইন্দ্রদনু যেন সূর্যের লেখা কাব্য। মানুষের জীবনই মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করে। রাধা ভালোবেসেছিল কৃষ্ণকে নয়, কৃষ্ণের বাঁশিকে। তোমরাও ঠিক ভালোবাস আমাকে নয় – আমার সুরকে, আমার কাব্যকে। সে তো তোমাদের সামনেই রয়েছে। আবার আমায় নিয়ে কেন টানাটানি, ভাই? সূর্যের কিরণ আলো দেয়, কিন্তু সূর্য নিজে হচ্ছে দগ্ধ দিবানিশি। ওর কাছে যেতে যে চায় সেও হয় দগ্ধীভূত। আলো সওয়া যায়, শিখা সওয়া যায় না। আমি জ্বলছি শিখার মতো, আপনার আনন্দে আপনি জ্বলছি, কাছে এলে তা দেয় দাহ, দূর হতে দেয় আলো। তোমাদের কাছে ছিলাম আমি, সেই-আমি আর চিঠির-আমি কি এক? তোমরা কবিকে জানতে চাও, না নজরুল ইসলামকে জানতে চাও, তা আগে জানিয়ো; তাহলে আমি এর পরের চিঠিতে একটু একটু করে জানাব তার কথা। চাঁদ জোছনা দেয়, কথা কয় না। বহু চকোর-চকোরীর সাধ্য-সাধনাতেও না। ফুল মধু দেয়, গন্ধ দেয়, কথা কয় না – বহু ভ্রমরার সাধ্য-সাধনাতেও না। বাঁশি কাঁদে, যখন গুণীর মুখে তার মুখে চুমোচুমি হয় ; বাকি সময়টুকু সে এক কোণে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকে। একই ঝাড়ের বাঁশ ভাগ্যদোষে বা গুণে কেউ হয়ে ওঠে লাঠি, কেউ বা বাঁশি। বীণা কত কাঁদে, কথা কয় গুণীর কোলে শুয়ে, বাকি সময়টুকু তার খোলের মধ্যে আপনাকে হারিয়ে সে নিষ্পন্দিত হয়ে থাকে। গানের পাখি, তাকে গানের কথাই জিঞ্জাসা কর, নীড়ের কথা জিঞ্জাসা কোরো না। নিজেই বলতে পারবে না যে, কোথায় ছিল তার নীড়। জন্ম নিয়ে গান শিখে উড়ে যাওয়ার পর নীড়টার মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর তার কাছে নেই। নীড়ের পাখি তখন বনের পাখি হয়ে ওঠে। গুরুদেব বলেছেন, ফসল কেটে নেওয়ার পর মাঠটার মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর নেই। তবু সেই অপ্রয়োজনের যদি প্রয়োজন অনুভব করে তোমাদের কৌতুক তবে জানিয়ো।
চিঠি লিখছি আর গাচ্ছি একটা নতুন লেখা গানের দুটো চরণ:
হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া।
কোন অমরার বিরহিনীরে চাহনি ফিরে,
কার বিষাদের শিশির নীরে এলে নাহিয়া।
কবির আসা ওই শেফালির পথ বেয়ে আসা। কার বিষাদের শিশির-জলে নেয়ে আসে তা সে জানে না। তার নিজের কাছেই সে একটা বিপুল রহস্য।
আমার লেখা কবিতাগুলো চেয়েছ। হাসি পাচ্ছে খুব কিন্তু। কী ছেলেমানুষ তোমরা দুটি ভাই বোন। যে-খন্তা দিয়ে মাটি খোঁড়ে মালি, সেটারও যে দরকার পড়ে ফুলবিলাসীর, এ আমার জানা ছিল না। যে পাতার কোলে ফুল ফোটে, সে-পাতা কেউ চায় না, এই আমি জানতাম। মালা গাঁথা হওয়ার পর ফুল-রাখা পদ্ম-পাতাটার কোনো দরকার থাকে, এও একটা খুব মজার কথা, না? যাক, চেয়েছ –দেব। তবে এ পল্লব শুকিয়ে উঠবে দুদিন পরে, থাকবে যা তা ফুলের গন্ধ। তাছাড়া অত কবিতাই বা লিখব কোত্থেকে যে খাতা ভরতি করে দেব। বসন্ত তো সবসময় আসে না। শাখার রিক্ততাকে যে ধিক্কার দেয়, সে অসহিষ্ণু; ফুল ফোটার জন্যে অপেক্ষা করতে জানে যে, সে-ই ফুল পায়। যে অসহিষ্ণু চলে যায়, সে তো পায় না ফুল,তার ডাল চিরশূন্য রয়ে যায়। তোমাদের ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা দেশ, তোমাদের সিন্ধু পর্বত গিরিদরী-বন আমায় গান গাইয়েছিল। তোমাদের শোনার আকাঙ্ক্ষা আমায় গান গাইয়েছিল। রূপের দেশ ছাড়িয়ে এসেছি এখন রুপেয়ার দেশে, এখানে কি গান জাগে? বীণাপাণির রূপের কমল এখানকার বাস্তবতার কঠোর ছোঁয়ায় রুপার কমল হয়ে উঠেছে। কমলবনের বীণাপাণি ঢুকেছেন এখানের মাড়োয়ারি মহলে। ছাড়া যেদিন পাবেন, আসবেন তিনি আমার হৃদকমলে। সেদিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায নেই আমার।
আমার কবিতার উৎস-মুখের সন্ধান চেয়ে। তার সন্ধান যতটুকু জানি নিজে, দেখিয়ে দেব।
আর কিছু লিখবার অবসর নেই আজ। মানস-কমলের গন্ধ পাচ্ছি যেন, কেমন যেন নেশা ধরছে; বোধ হয় বীণাপাণি তার চরণ রেখেছেন এসে আমার অন্তর শতদলে। এখন চললাম ভাই। চিঠি দিয়ো শিগগির। আমার আশিস নাও। ইতি-
তোমার
‘নুরুদা’
পুঃ—
তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে এসেছি, সে সব ভুলে যেয়ো। তোমার আম্মা ও নানি সাহেবার পাক কদমানে হাজার হাজার আদাব জানাবে আমার। শামসুদ্দিন৫ ও অন্যান্য ছেলেদেরে স্নেহাশিস জানাবে। তুমি কী বই পড়লে এর মধ্যে বা পড়ছ, কী কী লিখলে, সব জানাবে। তোমার লেখাগুলো আমায় আজই পাঠিয়ে দেবে। চিঠি দিতে দেরি কোরো না। ‘কালি কলম’পেয়েছ বোধ হয়। তোমায় পাঠানো হয়েছে। তোমার লেখা চায় তারা।
‘নুরুদা’