শাখা-প্রশাখা
[একটি চিত্রনাট্যের অংশ]
পাত্র-পাত্রীর background
আনন্দমোহন মজুমদার—বয়স ৭০। পদ্মভূষণ। আনন্দনগরের প্রতিষ্ঠাতা। ছোটনাগপুরের কোন এক অভ্রের খনিতে আনন্দেমোহনের চাকরি জীবনের শুরু। তারপর অধ্যবসায়, কর্মদক্ষতা, দূরদৃষ্টি ও কিছুটা ভাগ্যের গুণে সে খনির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল। তার বিবিধ গুণাবলীর মধ্যে সততাও একটি, সেটা উল্লেখ করা দরকার। গত বিশ বছরে স্কুল কলেজ হাসপাতাল পার্ক এটা-ওটা-সেটা-মঙ্গল সমিতি ও বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যবসাকেন্দ্র নিয়ে আনন্দনগর গড়ে উঠেছে। স্থানীয় লোকে আনন্দমোহনকে দেবতার সম্মান দিয়েছে। আনন্দমোহনও তাদের আপনার জন বলেই মনে করেছে। এমনিতে সে প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। পঁচিশ বছর আগে তার পত্নীবিয়োগ হয়। এগার বিঘা জমির উপর প্রাসাদোপম বাড়িতে এখন সে নিজে ছাড়া থাকেন—
অন্নদাচরণ—৯১ বছরের অথর্ব বৃদ্ধ, আনন্দমোহনের বাবা। ইনি কেন যে এখনো বেঁচে আছেন তা একমাত্র বিধাতাই জানেন। আর আছে—
প্রবোধ—বয়স ৪৮, আনন্দমোহনের বড় ছেলে! অকৃতদার। মেধাবী ছাত্র ছিল। বি এস-সি পাশ করে বিলেত গিয়ে মিনার্যালজি প’ড়ে বাপের কাজে এসে যোগ দেয়। এক বছরের মধ্যে মেনিনজাইটিসে মস্তিষ্কের সামান্য বিকার ঘটে। ফলে কাজের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। এখনো দেখলে শুনলে মনে হয় ছিটগ্রস্ত, তবে মাঝে মাঝে lucid moments আসে। বর্তমানে তার ঝোঁক পরলোকতত্ত্বের দিকে। Spiritualism, Extra-sensory perception ইত্যাদি নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা সম্পর্কে তার প্রচুর কৌতূহল। বিলাতে থাকতে উচ্চাঙ্গ ইউরোপীয় সংগীতে আকৃষ্ট হয়েছিল। একটা গ্রামোফোন ও কিছু রেকর্ড এখনো আছে, মাঝে মাঝে শোনে।
প্রবোধের পর আনন্দমোহনের আরো তিনটি ছেলে আছে। মেয়ে নেই। তিন ছেলেই কলকাতায় থাকে। প্রবোধের দুর্ঘটনার পর আনন্দমোহন তাদের সকলকেই জীবিকা নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে, এবং তারা কেউই বাপের ব্যবসায় যোগ দেয়নি।
এর মধ্যে মেজো ছেলে—
প্রতুল—Fenwick Brothers এ উচ্চপদস্থ কর্মচারী। বয়স ৪৪। তার জীবনটা নির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাড়ি থেকে আপিস, আপিস থেকে বাড়ি। ক্লাব, ককটেল ইত্যাদিতে যাওয়া ক্রমশ কমিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে স্ত্রীর প্ররোচনায় এক আধটা দিশি-বিলিতি ছবি দেখতে হয়। তবে প্রতুল প্রধানত family man। তার স্ত্রী—
রমা—পতিগতপ্রাণা আমুদে হাল্কা প্রকৃতির মহিলা। বয়স ৩৭। ছেলেমানুষীটা যেন বয়সের পক্ষে একটু বেশি। হয়ত বুদ্ধিও একটু কম। কিন্তু রমার মনে কোন সংকীর্ণতা নেই। আর গৃহিণী হিসাবেও সে ভালোই। রমার তিন সন্তান। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে গত বছর। ছোট মেয়ে—
তনিমা (টিনা)—বয়স ১৪। গোখেলে পড়ে। ভালো ছাত্রী। নাচগান ভালোবাসে। টুইস্ট জানা আছে। বাপ-মায়ের আদুরে মেয়ে, তবে spoilt নয়। কোথায় যেন একটা গাম্ভীর্য আছে যেটা বাপ-মা কারুর মধ্যেই নেই।
রমার ছেলে—
অরূপ (ডিঙ্গো)—৭ বছর বয়স। ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলে পড়ে। চতুর চটপটে। American Comics-এর ভক্ত। Superman তার আরাধ্য দেবতা। খেলনা যা আছে সবই প্রায় সামরিক সরঞ্জামের বালখিল্য সংস্করণ। তবে Airgunটা দিয়ে পাখি মারা চলে। আনন্দমোহনের সেজো ছেলে—
প্রতাপ—বয়স ৩৮। নানা সময়ে নানান ব্যবসায় টাকা ঢেলেছে; খুইয়েছে। এখন মোটরের ব্যবসা ধরেছে। তাছাড়া শেয়ার বাজার আছে, রেস আছে, পানদোষ স্ত্রীদোষ দুইই আছে। জামা কাপড় চুলের টেরি ইত্যাদি সম্পর্কে ভারী সচেতন। প্রয়োজনে দিনে দুবার দাড়ি কামায়। বেশভূষায় আধুনিক রুচির ছাপ আছে, কারণ সেটা মার্কিনি ফ্যাশন-পত্রিকা থেকে আয়ত্ত। অন্য কোন ব্যাপারে রুচির বালাই নেই।
প্রতাপের স্ত্রী—
অঞ্জনা—বয়স ৩৩। প্রতাপের সঙ্গে মনের বিশেষ মিল না-থাকা সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে বিয়ের আগেই তার সঙ্গে একটা শারীরিক সম্পর্ক হয়। ফলে অঞ্জনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। তার দুমাস পরে প্রতাপ একরকম বাধ্য হয়েই অঞ্জনাকে বিয়ে করে, কারণ অঞ্জনা abortion-এ মত দেয়নি। বিয়ের ভিৎ তাই প্রথম থেকেই দুর্বল। মৃত সন্তান প্রসব করার পর থেকে আজ অবধি—অর্থাৎ এই সাত বছরে—পরস্পরের ব্যবধান ক্রমেই বেড়েছে। আর সন্তান হয়নি। প্রতাপের গতিবিধি কার্যকলাপ অঞ্জনার জানতে বাকি নেই। প্রতাপ বন্ধনমুক্ত হলে হয়ত নিশ্চিন্তই হবে—কিন্তু অঞ্জনা তাকে একটি উপায়ে বেঁধে রেখেছে। প্রতাপের বিপদের সময় অঞ্জনা তার ধনী বাপের কাছ থেকে টাকা এনে প্রতাপকে দিয়েছে। বাপ একমাত্র মেয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেনি, প্রতাপও সে টাকা না নিয়ে পারেনি, কারণ নিজের বাপের কাছে হাত পেতে নিজের অপদার্থতা প্রমাণ করার সাহস তার নেই। স্বামীকে বেঁধে রেখে অঞ্জনা তার আত্মাভিমান বজায় রেখেছে। সহজে সে প্রতাপকে হাতছাড়া করবে না, রেহাই পেতে দেবে না। অবিশ্যি অঞ্জনার নিজের জীবনে যদি অন্য কোন পুরুষের আবির্ভাব হয়, তাহলে কী হবে বলা যায় না।
আনন্দমোহনের ছোট ছেলে—
প্রদ্যুম্ন—কলেজে থাকতে অল্পবিস্তর বামপন্থী রাজনীতি করেছে, বিলিতি আপিসে চাকরি নেবার পর সেদিকটা চাপা দিতে হয়েছে। চাকরির উন্নতিকল্পে অনেক কিছুই করতে হয়েছে তাকে—প্রথমে দাঁতে দাঁত চেপে, পরে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিকভাবে। এতে ফলও হয়েছে—কারণ, প্রথমত, প্রদ্যুম্ন সুপুরুষ, তাকে স্যুট পরলে প্রায় সাহেবের মত দেখায়। দ্বিতীয়ত, ককটেল পার্টিতেও সে চালিয়ে নেয় ভালোই—কারণ মদ্যপানে তার আসক্তি না থাকলেও, আপত্তি নেই। কিন্তু সাফল্য পেয়েও সে কোনদিন শান্তি পায়নি, কারণ বিবেক বলে একটা বস্তুর খানিকটা অংশ এখনো তার অন্তরে টিঁকে আছে—যে কারণে সে রাজনীতির সংস্রব সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেনি—যদিও বারে বারেই তার মন বলেছে দু নৌকায় পা দিয়ে বেশি দিন চলা যায় না। সম্প্রতি ভিয়েতনামের ব্যাপারে তাকে কিছুটা সক্রিয়ভাবেই যোগ দিতে হয়েছিল। তার ফল ভালো হয়নি। ঘটনাটা কানে যাবার পর Boss তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে নরম-গরম কথা শুনিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন।
গভীর উদ্বেগ ও উষ্মা নিয়ে প্রদ্যুম্ন বাড়ি ফিরেছে। পরদিন Boss-এর সঙ্গে দেখা করে মার্জনা চেয়েছে, বলেছে ভবিষ্যতে আর এমন ভুল করবে না।
চিত্রনাট্য
মুখবন্ধ।
কাহিনীর শুরু ২২ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৬। আজ আনন্দমোহনের সপ্ততিতম জন্মোৎসব। তিনি অতিরিক্ত আড়ম্বর চাননি—দেশে এত সমস্যা—তার মধ্যে নিজেকে ঘিরে উৎসবে তিনি আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্মচারীরা এবং আনন্দনগরের বাসিন্দারা তাঁর আপত্তিতে কর্ণপাত করেনি।
আনন্দপার্কের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের সামনে তাঁর সম্বর্ধনার আয়োজন হয়েছে। মনোরম পরিবেশ। দূরে পিছনে তাল খেজুর গাছের সারি, ছোট-বড় টিলা, ধানের ক্ষেত, টালির ছাতওয়ালা কিছু ছোট ছোট বাড়ি। অশ্বত্থের সামনেই মঞ্চ, মঞ্চের সামনে মাঠ জুড়ে জনতা। আনন্দনগরের কেউই আসতে বাকি নেই।
মঞ্চে মাল্যভূষিত সম্মানিত অতিথি ও অন্যান্য বক্তারা চেয়ারে বসে আছেন। সামনের টেবিলের উপর মাইক, গেলাসে জল, ফুলদানিতে ফুল, ও কিছু বাঁধান ও পাকানো মানপত্র। সভাপতি ভাষণ দিচ্ছেন। আনন্দমোহন চাদরের খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন। সভাপতির শেষ কয়েকটা কথা আমরা শুনি—
সভাপতি ⋯সুতরাং তাঁর প্রতি আমাদের যে ঋণ, সে-ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা যেটা পারি, সেটা হল তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা এবং সেই কর্তব্যটুকু পালন করার জন্যই আজ এই শুভ দিনে, এই পবিত্র দিনে, তাঁর সপ্ততিতম জন্মদিনে—আমরা, অর্থাৎ, তাঁর নামে এই যে উপনগর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার বাসিন্দারা—এই সামান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এই যে এমন একজন কৃতী পুরুষ, এমন একজন আদর্শপুরুষ—তাঁকে যে আমরা আমাদের মাথার উপর পেয়েছি, এবং সেই সঙ্গে আমাদের এত কাছেও পেয়েছি—আমাদের friend, pholosopher and guide হিসাবে পেয়েছি, তার জন্য আমরা ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই। আজ এই শুভ দিনে আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, আনন্দমোহনের দীর্ঘ—রোগমুক্ত এবং আরো কৃতিত্বে সমুজ্জ্বল—দীর্ঘজীবন। জয়হিন্দ্।
করধ্বনির শব্দে এ-গাছ সে-গাছ থেকে পাখি উড়ে যায়। মাইকে ঘোষণা করা হয় এবার আনন্দমোহন ভাষণ দেবেন।
আনন্দমোহন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেমন যেন একটা অন্যমনস্ক ভাব। সে যেন একটু কষ্ট করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পরমুহূর্তেই তার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়। তার ডান হাতটা বুকের উপর চলে যায়। বাঁ হাতটা দিয়ে টেবিলের উপর ভর করতে গিয়ে জলের গেলাস উলটে পড়ে মানপত্র ভিজে যায়। চারিদিকে ব্যস্ততা, কী হল কী হল রব। ম্যানেজার সুরেশবাবু দ্রুত এগিয়ে আসেন আনন্দমোহনৈর দিকে। সভাপতি বীরেশ সমাদ্দার তাকে দুহাত দিয়ে জাপটে ধরে সামলাতে চেষ্টা করেন।
আনন্দমোহন কী যেন বলার চেষ্টা করে। আমরা তার মুখের দিকে এগিয়ে যাই। সমস্ত পর্দা জুড়ে তার ঠোঁট-দুটো কথা বলার চেষ্টা করে।
আনন্দ ওদের⋯খবর⋯
আনন্দমোহনের মাথা frame-এর নীচে চলে যায়। মাথার জায়গায় অশ্বত্থগাছের ডালপালা প্রতীয়মান হয়। ক্যামেরা ডালপালার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
পরিচয়লিপি শুরু হয়।
পরিচয়লিপি শেষ হলে পর মূল কাহিনী শুরু হয়।
প্রথম দৃশ্য
সকাল। আন্দমোহনের বাড়ির গেট। গেটের গায়ে সাদা মার্বেলের ফলকে লেখা ‘আনন্দধাম’।
একটা সাদা ব্যুইক গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে এসে গেটের সামনে থেমে দুবার হর্ন দেয়। দারোয়ান কাছেই ছিল, দৌড়ে এসে গেট খুলে সেলাম ঠোকে। গাড়ি নুড়িফেলা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পোর্টিকোয় থামে।
গাড়ি থেকে প্রতাপ, প্রতুল, রমা, অঞ্জনা, টিনা ও ডিঙ্গো নামে। প্রতাপ নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। সকলকেই বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। গাড়ির গায়ে ধুলো এবং কাদার ছিটে দেখে বোঝা যায় বেশ অনেকখানি রাস্তা এসেছে। বেয়ারা ও আরেকটি চাকর বেরিয়ে এসে স্যুটকেস-বেডিং নামাতে থাকে। আনন্দমোহনের ম্যানেজার সুরেশবাবু বেরিয়ে এসে সকলকে অভ্যর্থনা করেন।
প্রতুল উনি⋯?
সুরেশ এখনো⋯আসুন না—একতলাতেই আছেন।
সকলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।
যে ঘরটায় আনন্দমোহনকে রাখা হয়েছ, সেটা আসলে গেস্টরুম।
খাটে বেহুঁশ অবস্থায় আনন্দমাহন শোয়া। তার পাশে চেয়ারে ডাঃ নাগ বসে আনন্দমোহনের নাড়ী পরীক্ষা করছেন। খাটের অন্যপাশে একটি পরিচারিকা দাঁড়িয়ে আছে।
সকলে ঘরের ভিতর আসে। ডাঃ নাগ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। ডিঙ্গো বাদে সকলেরই মুখে উদ্বেগের ভাব।
ডাঃ নাগ প্রতুলের দিকে এগিয়ে আসেন। দুজনে হেঁটে জানালার দিকে যায়। নীচু গলায় কথা হয়।
প্রতুল Coronary?
নাগ উঁহু। এটা বলে Hypertensive Encephalopathy, pressure টা হঠাৎ খুব high হয়ে গেলে⋯বাঁ দিকটা একটা paralysisএর tendency রয়েছে। তবে ওটা চলে যেতে পারে।
প্রতুল কিন্তু⋯?
নাগ এখন খুব carefully ইয়ে করতে হবে আর কি। একটা দিন না গেলে⋯
প্রতুল এমনি কি রকম⋯?
নাগ আর further কিছু না হলে he might…survive. তবে বয়েসটা ত⋯
প্রতুল হ্যাঁ হ্যাঁ⋯
প্রতাপও প্রতুলের পিছন পিছন গিয়েছিল—ডাক্তারের কথা শুনেছে। সে আরেকবার বাপের দিকে দেখে ঘর ছেড়ে পাশের বৈঠকখানায় চলে যায়।
বৈঠকখানা। আসবাবপত্রে সজ্জিত প্রকাণ্ড ঘর। দেয়ালে একটি মহিলার বাঁধানো ফটো রয়েছে—নিঃসন্দেহে আনন্দমোহনের স্ত্রী। এছাড়া চার ছেলের ছবি রূপোর আলাদা আলাদা ফ্রেমে বাঁধিয়া দাঁড় করানো রয়েছে একটা সাইড-বোর্ডের উপর। ওই একই সাইডবোর্ডের এক পাশে গতকাল পাওয়া আনন্দমোহনের মানপত্রগুলো রাখা রয়েছে।
প্রবোধ পিছনে হাত জড়ো করে অন্যমনস্ক ভাবে পায়চারি করছিল, প্রতাপ আসাতে পায়চারি থামায়।
প্রতাপ একটা সিগারেট ধরায়।
প্রবোধ গাড়িতে এলি?
প্রতাপ হুঁ।
হাতের দেশলাইটা নিয়ে প্রতাপ টেবিলের উপর রাখা অ্যাশ-ট্রের দিকে এগিয়ে যায়।
প্রবোধ সবাই এক গাড়িতে?
প্রতাপ ছোট্কা বোধহয় ট্রেনে আসছে। দাদার ড্রাইভার ছুটিতে⋯ও আবার নিজে চালায় না, তাই ফোন করেছিল। পাঁচটায় বেরিয়েছি।
প্রতাপ হেঁটে জানালার দিকে যায়। বাইরে বাগানের একটা অংশ দেখা যায়, তার পিছনে মাইল খানেক দূরে একটা পাহাড়। প্রতাপ পাহাড়ের দিকে চেয়ে সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
প্রবোধ আবার অন্যমনস্ক হয়ে পায়চারি শুরু করে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর—
প্রতাপ এবার বৃষ্টি কেমন?
প্রবোধ উঁ?
প্রতাপ বৃষ্টি?
প্রবোধ Average…average…
ডিঙ্গোর প্রবেশ।
ডিঙ্গো (বেশ জোরে ফিস্ফিস্ করে) জেঠু! জেঠু!
প্রবোধ ডিঙ্গোকে দেখে।
প্রবোধ ডিঙ্গো বাবু—কেমন আছ?
ডিঙ্গো ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে প্রবোধের দিকে এগিয়ে আসে।
ডিঙ্গো (ফিস্ফিস্) মা বলেছে জোরে কথা বলতে বারণ করেছে। খালি ফিস্ ফিস্।
প্রবোধ ফিস্ ফিস্?
ডিঙ্গো ফিস্⋯(হঠাৎ গলা চড়িয়ে) আমি গ্র্যান্ট্যাং রোডে স্টিয়ারিং
ঘুরিয়েছি।
প্রবোধ বটে?
ডিঙ্গো হ্যাঁ! কাকুকে জিগ্যেস করো।
ডিঙ্গো প্রতাপের দিকে এগিয়ে যায়।
ডিঙ্গো হ্যাঁ কাকু—ঘুরোই নি?
প্রতাপ হেসে ডিঙ্গোর মাথাটা ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায়।
ডিঙ্গো তারপর একটা লরি আসছে দেখে কাকু—
ডিঙ্গো হঠাৎ থেমে যায়। তার চোখ জানালার বাইরে পাহাড়ের দিকে গেছে।
ডিঙ্গো ওটা মুঙ্গারি পাহাড়?
প্রবোধ মুরাঙ্গি।
ডিঙ্গো সুপারম্যান্ ওই পাহাড়টাকে একহাতে তুলে নিয়ে সাঁই-ই-ই-ই করে উড়ে চলে যেতে পারে।
প্রবোধ আর আরেকটা ম্যান যে পারে সে কে বল ত?
ডিঙ্গো কে?
প্রবোধ ডিঙ্গোর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস্ ফিস্ করে বলে—
প্রবোধ হনুম্যান!
ডিঙ্গো খিল্খিল্ করে হেসে ওঠে।
ডিঙ্গো ধ্যাৎ!
প্রবোধ ঠোঁটে আঙুল দেয়।
প্রতুল রমা অঞ্জনা ও টিনা আনন্দমোহনের ঘর থেকে বৈঠকখানায় আসে। রমা অঞ্জনা ও টিনা প্রবোধকে প্রণাম করে।
প্রবোধ তোমরা সব⋯(ভালো ত)?
রমা আপনি কেমন? রোগা হয়েছেন ত!
প্রবোধ স্মিতহাস্য করে। সে টিনার মাথায় হাত বোলায়।
অঞ্জনা ডিঙ্গো, ওপরে যাবে আমার সঙ্গে?
রমা যাও বাবা, কাকীর সঙ্গে যাও।
ডিঙ্গো আমরা মুং—মুরাঙ্গি পাহাড়ে যাব না?
রমা হ্যাঁ যাবো—নিশ্চয়ই যাবো।
ডিঙ্গো কবে? আজকে?
ডিঙ্গোর দেরি দেখে অঞ্জনা একাই দোতলার দিকে রওনা দেয়। এবার টিনাই ডিঙ্গোর হাত ধরে তাকে সিঁড়ির দিকে রওনা করায়।
টিনা তুই আর আমি যাবো—কেমন?
ডিঙ্গো আজ বিকেলেই ত?⋯
প্রতুলও একটা সিগারেট ধরিয়ে সাইডবোর্ডটার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা মানপত্র তুলে নেয়।
রমা কোথা থেকে যে কী হয়! আমরা ত এই weekend-এ আসব – আসবই করছিলাম। গতকাল কিছুতেই ছুটি পেলেন না। এত খারাপ লাগছিল। আমি আবার কাল বাজারে গিয়ে ওঁর জন্য ধুতি চাদর পাঞ্জাবীর কাপড় – টাপড় সব⋯(রমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
প্রতুল মানপত্রগুলো রেখে দেয়।
প্রবোধ প্রদ্যুম্ন⋯ট্রেনে
প্রতুল হ্যাঁ—সে তো বোধহয় এগারোটা নাগাৎ⋯unless they have…
প্রবোধ স্টেশনে গাড়ি⋯?
প্রতুল সুরেশবাবুকে বলে দিয়েছি।
প্রবোধ ও।
রমা সোফায় বসেছিল—এবার উঠে পড়ে।
রমা যাই দেখি⋯আশা করি ভালোয় ভালোয়⋯
রমা দোতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায়।
প্রতুল তুমি ছিলে কাছে?
প্রবোধ উঁ?
প্রতুল যখন attackটা…তুমি তখন কাছে ছিলে?
প্রবোধ কিছুক্ষণ নিরুত্তর। প্রতুল দাদার মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে থাকে।
প্রবোধ আমি⋯জানতাম⋯
প্রতুল জানতে? কি কোন complain করেছিলেন—ব্যথা-ট্যথা?
প্রবোধ মাথা নেড়ে না বলে। প্রতুল puzzled।
প্রবোধ কতকগুলো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। Not physical. Psychic.
প্রতুল এবার বুঝতে পারে যে প্রবোধ তার চেনা পথ ধরেছে, যে পথে তার আদৌ গতিবিধি নেই। সে কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করে তারপর দোতলার দিকে রওনা দেয়।
প্রতুল তুমি ত নীচেই আছ। কোন দরকার-টরকার হলে⋯
প্রবোধ কিছু বলে না। প্রতুল চলে যায়।
প্রবোধ ধীরে ধীরে গেস্টরুমের দিকে যায়।
আনন্দমোহন এখনো বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে আছে। ডাঃ নাগ চলে গেছেন। পরিচারিকা হাতে উপন্যাস খুলে বসেছিল—দরজার দিকে দেখে বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। প্রবোধ ঘরে আসে।
প্রবোধ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তার বাপের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
প্রবোধ মহাপুরুষ!
CUT TO
দোতলা। অন্নদাচরণের ঘর।
অন্নদা খাটে বসে আছে—তার পরনে কেবল একটি ঢলঢলে পায়জামা। বহুদিনের পুরোনো চাকর প্রয়াগ তোয়ালে দিয়ে তার পিঠ মুছিয়ে দিচ্ছে। অন্নদার কানের লতি ও নাকের ডগায় জলের বিন্দু দেখে বোঝা যায় তাকে সবে মাত্র হয় স্নান না হয় স্পঞ্জিং দেওয়া হয়েছে। অন্নদার হাঁ করা মুখ ও চোখের উদাস দৃষ্টি দেখলে অসহায় শিশুর কথা মনে হয়। পাঁজরে আর বগলে তোয়ালের ঘষাতে অন্নদার হঠাৎ সুড়সুড়ি লেগে যায়। সে খিক্ খিক্ করে হেসে উঠে।
রমা এসে দরজার মুখটায় দাঁড়িয়েছে।
প্রয়াগ হাঁ!—কে আই গেলো দেখো!
অন্নদার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাসি থামিয়ে এখন তার পায়জামার দড়ির দিকে মনোনিবেশ করে। দড়ির মুখটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। রমা এগিয়ে গিয়ে অন্নদাকে প্রণাম করে। বৃদ্ধ ঘাড় তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে রমার দিকে চায়।
অন্নদা বা-ইশ্।
প্রয়াগ হাঁ হাঁ—বাইশ বাইশ।
রমা কী বলছেন?
প্রয়াগ ভাত খাবেন—ভাত। (অন্নদাকে) ভাত হোনেমে আউর আধাঘণ্টা। আধা ঘণ্টা পোরে খাইবেন—কেমোন?
অন্নদা বা-ইশ্।
প্রতুল আসে। এগিয়ে গিয়ে অন্নদাকে প্রণাম করে।
প্রতুল কেমন আছেন?
অন্নদা বা-আ-আ⋯
প্রয়াগ হাঁ, ভালো—খুব ভালো।
অন্নদা —ইস্। বাইস্।
প্রয়াগ এবার তোয়ালে রেখে একটা মট্কার পাঞ্জাবী হাতে নেয়।
প্রয়াগ হাথ উঠাইয়েন।
রমা এগিয়ে যায় সাহায্য করতে।
প্রয়াগ আপনি ছোড়েন না—উনি আপনেই উঠাবেন। (অন্নদাকে) বুঢ়া বাবু জামা পেহিনবেন না?
অন্নদা এবার তার কম্পমান শীর্ণ হাত দুটো মাথার উপর তুলতে আরম্ভ করে।
প্রয়াগ (encourging) হাঁ! বাহ্বা, বাহ্বা, বাহ্বা!
দরজার দিক থেকে একটা খিলখিল হাসির শব্দ আসে। ডিঙ্গো কখন জানি এসে দাঁড়িয়েছে। তার স্নান হয়ে গেছে—হাতে বন্দুক। বৃদ্ধকে নিয়ে এত কাণ্ড দেখে তার ভারী আমোদ লেগেছে।
অন্নদার হাত তোলা হয়ে গেছে। প্রয়াগ ক্ষিপ্রহস্তে পাঞ্জাবীর হাত দুটো গলিয়ে দিয়ে গলাটা গলিয়ে দেয়।
ডিঙ্গো নিজে কেন পারো না?
এবার অন্নদা ঘাড় ফিরিয়ে ডিঙ্গোকে দেখে। তার চোখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, মুখ দন্তবিহীন হাসিতে তিনগুণ বেশি ফাঁক হয়ে যায়। এই বীভৎস হাসিই বোধহয় ডিঙ্গোর মনে ত্রাসের সঞ্চার করে। সে এক দৌড়ে দরজার মুখ থেকে পালিয়ে যায়।
প্রতুল (প্রয়াগকে) বাবার কথা জানেন?
প্রয়াগ জানিয়েই বা কী, আর না জানিয়েই বা কী?
অন্নদা প্রতুলের দিকে দেখে—সেই ভাবলেশহীন দৃষ্টি।
রমার চোখে জল এসে গেছে। সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
অন্নদা বা-ইশ।
CUT TO
প্রতাপের ঘর।
প্রতাপের সবে দাড়ি কামানো শেষ হয়েছে। কানের পাশে এখনো সাবান। সে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে একটা face towel দিয়ে মুখ মোছে। মুছতে মুছতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে।
প্রতাপের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় বাড়ির পাঁচিলের বাইরে কিছু দূরে মেঠো রাস্তা দিয়ে তিনটি উদ্ভিন্নযৌবনা সাঁওতাল মেয়ে দেহ হিল্লোলিত করে গুজব করতে করতে হেঁটে চলেছে।
অঞ্জনা স্নানের ঘর থকে স্নান করে বেরিয়ে আসে।
অঞ্জনা Razorটা ওতবে ফেলে রেখো না please। এখানে বেয়ারা নেই তোমার।
প্রতাপ এখনো বাইরের দিকে চেয়ে আছে—স্ত্রীর কথা যেন তার কানে ঢোকেইনি। অঞ্জনা ড্রেসিং টেবিলের দিকে যায়।
অঞ্জনা কী দেখছ কি অত?
প্রতাপের সম্বিত ফিরে আসে।
প্রতাপ উঁ? না।⋯
প্রতাপ জানালা থেকে সরে আসে। খাটের ওপর তার ব্যাগ খোলা রয়েছে, সেইটের দিকে যায়।
অঞ্জনা তোমার সব কিছু বার করে আমি স্নানের ঘরে রেখে এসেছি।
প্রতাপ ও।
প্রতাপ আয়নার দিকে ফেরে। হাতের তোয়ালে দিয়ে কানের পাশের সাবানটা মোছে, ধীরে ধীরে, দৃষ্টি যায় অঞ্জনার দিকে।
অঞ্জনা চুল আঁচড়াচ্ছে।
অঞ্জনা জলটা hard না soft না কী জানি না⋯সাবান যেতেই চায় না।
প্রতাপ Soft…
প্রতাপ অঞ্জনার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে পিছন থেকে আলিঙ্গন করে, তার ভিজে মাথায় বার বার চুম্বন করে।
প্রতাপ Soft…Soft…Soft…
কয়েক সেকেণ্ডের জন্য অঞ্জনাও যেন কেমন হয়ে যায়। সে চোখ দুটো বন্ধ করে বসে থাকে, প্রতাপকে বাধা দেয় না, মুখেও কিছু বলে না। প্রতাপের আলিঙ্গন দৃঢ়তর হয়। সে অঞ্জনাকে বসা অবস্থা থেকে টেনে তুলতে চেষ্টা করে। বাইরে বাগান থেকে ডিঙ্গোর গলা আসে।
ডিঙ্গো দিদি! দিদি!
অঞ্জনা হঠাৎ নিজেকে সামলে নেয়।
অঞ্জনা কী হচ্ছে⋯ছাড়! ছাড়!⋯
অঞ্জনা প্রায় গায়ের জোরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
প্রতাপ তাহলে promise করো—আজ—
অঞ্জনা চুপ! তুমি অতি..জঘন্য!
CUT TO
প্রতুলের ঘর। প্রতুল স্নান করতে যাবে। রমা বাক্স থেকে তার জামা কাপড় তোয়ালে সাবান ইত্যাদি বার করে দেয়।
রমা নাও। আমি একবার চট্ করে বাবুর্চিখানায় ঢুঁ মেরে আসি।
রমা রওনা দেবে, এমন সময় প্রতুল ডাকে—
প্রতুল শোন—
রমা দরজার মুখে থামে।
রমা কী?
প্রতুল বেশি rich কিছু না করে যেন—আমার আবার⋯
রমা পাগল!⋯ডাল ভাত⋯
রমা চলে যায়। প্রতুল স্নানের ঘরে ঢোকে।
টিনার স্নান হয়ে গেছে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ক্রীম লাগাচ্ছে।
বাইরে থেকে ডিঙ্গোর গলা শোনা যায়।
ডিঙ্গো দিদি! দিদি!
টিনা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
বাইরে নীচে বাগানে ডিঙ্গোকে দেখা যায়—হাতে এয়ার গান। ডিঙ্গো জানালায় টিনাকে দেখে। টিনা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ডিঙ্গোকে চ্যাঁচাতে বারণ করে। ডিঙ্গো আর কথা না বলে হাত দিয়ে কী জানি একটা বোঝাতে চেষ্টা করে—দেখে মনে হয় একটা গিরগিটি বা কাঠবেড়ালি জাতীয় কিছুর বর্ণনা দিচ্ছে।
টিনা হাত তুলে বুঝিয়ে দেয় সে এক্ষুনি আসছে।
টিনা এবার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে আসে। তারপর সে আনন্দমোহনের ঘরের দিকে যায়।
আনন্দমোহনের ঘর।
প্রবোধ চুপটি করে খাটের পাশে চেয়ারে বসে আছে।
টিনা এগিয়ে গিয়ে তার জ্যাঠার পাশে দাঁড়ায়।
আনন্দমোহনের চেহারায় কোন পরিবর্তন নেই। বুকের ওঠা পড়া দেখে নিশ্বাসটা যেন কেমন দমকে দমকে পড়ছে বলে মনে হয়।
টিনা একদৃষ্টে সেই ওঠা পড়া লক্ষ করে। তার নিজের ডান হাতটা প্রায় অজান্তেই নিজের বুকের কাছে উঠে আসে।
প্রবোধ কোন কষ্ট নেই।
টিনা তার জ্যাঠার দিকে দেখে।
প্রবোধ কোন কষ্ট নেই।
টিনা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বাইরে থেকে একটা গাড়ির শব্দ শোনা যায়।
টিনা যখন পোর্টিকোর কাছে পৌঁছেছে, তখনই আনন্দমোহনের Vauxhall গাড়ি এসে থামে।
গাড়ি থেকে ব্যাগ হাতে প্রদ্যুম্ন নামে। সামনেই টিনা।
প্রদ্যুম্ন কখন এলি?
টিনা সাড়ে নটা।
প্রদ্যুম্ন এদিকে ওদিকে চায়।
প্রদ্যুম্ন কোথায়?
টিনা গেস্টরুমে।
প্রদ্যুম্ন সোজা আনন্দমোহনের ঘরের দিকে চলে যায়।
আনন্দমোহনের ঘর।
প্রদ্যুম্ন আসে। প্রবোধ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
প্রদ্যুম্ন কিছুক্ষণ আনন্দমোহনের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর প্রদ্যুম্ন ও প্রবোধ বৈঠকখানার দিকে চলে যায়।
বৈঠকখানা। দুজনে আসে।
প্রদ্যুম্ন কী বলছে ডাক্তার?
প্রবোধ নতুন করে কিছু না হলে⋯এ যাত্রা⋯
প্রদ্যুম্ন আমি message পেয়েছি সেই সাড়ে সাতটায়। বাড়ি ছিলাম না। ফিরে এসে এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে স্টেশনে গিয়ে⋯তাও একটা booking clerk-এর সঙ্গে চেনা ছিল তাই⋯ওঃ!⋯এমনিতে পরশুই আসতাম, কিন্তু এমন একটা গোলমাল বেধে গেল।
প্রবোধ এসেই বা কী করতিস। Prevent ত করতে পারতিস না।
প্রদ্যুম্ন সেটা ঠিক—তবে আমরা কেউই ত আসতে পারিনি। হয়ত মনের মধ্যে সেটা work করছিল।
প্রবোধ তোরা ভালো আছিস, সুখে আছিস, established হয়েছিস্—এতেই উনি খুশি ছিলেন। অনেকবার বলেছেন। এক আমিই—কাছে থেকেও⋯
প্রদ্যুম্ন এবার প্রথম ভালো করে তার বড়দার দিকে দেখে।
প্রদ্যুম্ন তোমারও অসুখ নাকি দাদা?
প্রবোধ উঁহু।
প্রদ্যুম্ন এত রোগা লাগছে কেন?
প্রবোধ রোগা নয়—সূক্ষ্ম। I can live almost on nothing.
প্রদ্যুম্ন হাসে। সে প্রবোধের কথা seriously নিতে চায় না, যদিও জানে প্রবোধ নিজে serious।
প্রদ্যুম্ন Lucky! সরকার তোমায় পেলে লুফে নেবে। তোমার secret প্রচার করতে আপত্তি নেই ত?
প্রবোধ Plain living and high thinking.
প্রদ্যুম্ন বৈঠকখানার আসবাবগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার প্রবোধের দিকে দেখে।
প্রবোধ আমি জানি তুই কী ভাবছিস। আয়—
বৈঠকখানার একপ্রান্তে দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রবোধের ঘর।
প্রবোধ প্রদ্যুম্ন ঘরে প্রবেশ করে।
একটি চাদর ঢাকা তক্তপোষের উপর একটা পাতলা বালিস। দেয়ালে আলনা থেকে দু-একটা কাপড় ঝুলছে। একটা র্যাকে ২০/২৫ খানা বই। একটা তেপায়া টেবিল। এক কোণে একটা পুরোন আমলের বাক্স-গ্রামোফোনের মাথায় ২/৩ বাক্স রেকর্ড।
প্রবোধ ভারী আরামে আছি।
প্রদ্যুম্ন গান শোন এখনো?
প্রবোধ মাঝে মাঝে। জবড়জং ভালো লাগে না আর। Gregorian chant শুনেচিস্?
প্রদ্যুম্ন আমি এখন কর্ণাটকী আর রেডিও সিলোনের মাঝখানে স্যাণ্ডউইচ হয়ে আছি।
প্রবোধ শোনাব তোকে।
দুজনে আবার বৈঠকখানায় বেরিয়ে আসে।
প্রদ্যুম্ন সেজদা মেজদা দুজনেই এসেছে ত?
প্রবোধ হ্যাঁ। তোদের সব ওপরে ব্যবস্থা।
প্রদ্যুম্ন যাই⋯দেখি⋯
প্রদ্যুম্ন দোতলার দিকে রওনা দেয়।
দ্বিতীয় দৃশ্য
দুপুর। খাবার ঘর। বারো জনের উপযোগী খাবার টেবিলে মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রতুল, প্রতাপ, টিনা, ডিঙ্গো বসেছে। অঞ্জনা যেন একটু ইতস্তত করছে—বসে পড়া উচিত কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। রমা পরিবেশনের দিকটা একটু এগিয়ে দিচ্ছে—যদিও বেয়ারা রয়েছে। টিনা ও ডিঙ্গো আগেই বসেছিল, তাদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
প্রতুল সবাই একসঙ্গে বসে গেলে হোত না? পরিবেশনের লোক ত আছেই⋯
রমা অঞ্জনা বসে পড়-না⋯
প্রতাপ সব ত সামনেই আছে—নিয়ে নিলেই হল।
প্রদ্যুম্ন আসে।
রমা বট্ঠাকুরপো এলেন না?
প্রদ্যুম্ন দাদা একটু বাবার ওখানে আছেন। আমাদের হলে উনি আসবেন।
প্রতুল (উদ্বিগ্ন) কেন, কিছু⋯?
প্রদ্যুম্ন না। এমনি। নার্স আছে, তবু⋯
রমা ঠিক আছে। আমি পরে বসব।
অঞ্জনা এর মধ্যে বসে ভাতে হাত দিয়ে ফেলেছে।
অঞ্জনা ইস্—দ্যাখ ত আমি আবার⋯
রমা আহা, তাতে কী হয়েছে⋯
ডিঙ্গো ইস্, দ্যাখ ত⋯ইস্ দ্যাখ ত⋯
প্রতুল উঁ!
ডিঙ্গো চুপ করে যায়।
সকলে খেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ খাওয়ার শব্দ আর কাঁটা চামচের টুংটাং ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
প্রতুল ও প্রতাপই কেবল কাঁটা চামচে খাচ্ছে। আর সকলেই হাতে।
প্রতাপ কাল রাত্রে⋯সাড়ে নটায়⋯এক রিপোর্টার ফোন করছে। ট্রাঙ্ক কলটা পেয়েছি—তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। আমায় condolence জানাচ্ছে! Fool!
ডিঙ্গো April fool!
রমা উঁ—বাপী!
প্রতুল Condolence!
প্রতাপ তারপর বলে কি—কিছু বলুন—ওঁর life-এর details!হুঁ!
প্রতুল Wonderful!
রমা ইস্!
প্রদ্যুম্ন ভাতের সঙ্গে ডাল মেখে মুখে গ্রাস পুরে ভ্রূকুঞ্চিত করে। অঞ্জনা তার দিকে নুনের পাত্রটা এগিয়ে দেয়। প্রদ্যুম্ন হেসে পাত্র নিজের কাছে এগিয়ে নিয়ে খানিকটা নুন ভাতে ঢালে।
প্রদ্যুম্ন Thank you.
প্রতুল (প্রতাপকে) তুই কী বললি?
প্রতাপ কিস্যু না। Just banged the phone down.
প্রতুল হুঃ!
প্রতাপ মনে মনে বললুম—তোমাদের অসাধ্য কিছুই নেই। রাতকে দিন করতে পার।
ডিঙ্গো টিনার দিকে ফিরে ফিস্ ফিস্ করে বলে—
ডিঙ্গো সুপারম্যান!
এই গম্ভীর মুহূর্তেও টিনা হাসি চেপে রাখতে পারে না। ফলে তাকে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যেতে হয়।
রমা ডিঙ্গো,—ওঠো আর প্লেট চাটে না। যাও ওঠো।
ডিঙ্গো অগত্যা উঠে পড়ে।
প্রতাপ Actually—এই খবরের কাগজের reporting-এর ব্যাপারটা একটা⋯একটা⋯
প্রতুল Disgusting!
রমা (প্রদ্যুম্নকে) সেদিন তোমার নাম দেখলাম যে কাগজে—কোথায় কী বক্তৃতা না কী দিলে।
প্রতাপ বটে? তুই আবার speech ঝাড়চিস নাকি?
প্রদ্যুম্ন পাগল!
প্রতাপ কী—Company luncheon?
প্রদ্যুম্ন ওই আর কি! Vote of thanks!
অঞ্জনা আড়চোখে দেখছে প্রদ্যুম্নর দিকে। প্রদ্যুম্ন-অঞ্জনা চোখাচুখি হয়।
অঞ্জনা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়, ভাবটা যেন সে আসল ব্যাপারটা জানে।
CUT TO
আনন্দমোহনের ঘর।
প্রবোধ অন্যমনস্কভাবে জানালার দিকে চেয়ে ছিল। খাটের দিক থেকে একটা শব্দ পেয়ে সে আনন্দমোহনের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।
ধীরে ধীরে আনন্দমোহনের চোখের পাতা ফাঁক হয়—মণিটা দেখা যায়। গলা দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বার হয়। পরিচারিকাও উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রবোধ বাবার উপর ঝুঁকে পড়ে, হাত দিয়ে তার হাতটা ধরে।
CUT TO
খাবার ঘর।
প্রতুল (প্রদ্যুম্নকে) তোদের Dunbar এখনো আছে না চলে গেছে?
প্রদ্যুম্ন তুমি কোথায় আছ।
প্রতুল কবে গেলো?
প্রদ্যুম্ন বহুকাল।
প্রতুল এখন কে?
প্রদ্যুম্ন Hyams.
প্রতুল কেমন?
প্রদ্যুম্ন চামড়া সাদাই। না—ঠিক সাদা না। এটা লাল, আগেরটা ছিল ফ্যাকাশে, হল্দেটে। ওটাকে jaundice মনে হত। এটা measles.
প্রতুল ও প্রতাপ মৃদু হাস্য ক’রে প্রদ্যুম্নের কথার ঝাঁঝটাকে কিছুটা মোলায়েম করার চেষ্টা করে।
প্রতুল তুমি সুনজরে আছ ত—তাহলেই হল।
প্রদ্যুম্ন সেটাও রঙের জোরে। মজুমদার বংশে এককালে ইরাণের রক্ত মিশেছিল, তার সুফল ভোগ করছি আমরা।
প্রতাপ কেন বাবা—ভুলু বিশ্বাস—রংটি ত খোলতাই—সেও ত এক সাহেবেরই right hand হয়ে বসে আছে।
প্রদ্যুম্ন সেটা জিভের জোরে। অঢেল হুইস্কি ঢেলে এমন চেক্নাই হয়েছে যে ইংরিজিটা একেবারে পিছলে বেরোয়। আমাদের মত হোঁচট খায় না। ভালো ইংরিজিতে চামড়ার রংটা—
প্রবোধ খাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সকলে তার দিকে দেখে—
প্রবোধ তোদের এখনো⋯
রমা আপনি বসবেন?
প্রবোধ বাবা চোখ খুলেছেন⋯তোরা যদি⋯
তিন ভাই তৎক্ষণাৎ খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে। প্রতাপ ও প্রতুল সোজা সিঁড়ির দিকে চলে যায়। প্রদ্যুম্ন দৌড়ে বেসিনে যায় হাত ধুতে।
CUT TO
আনন্দমোহনের ঘর।
প্রতুল এগিয়ে আসে, পিছনে প্রতাপ। প্রদ্যুম্নও এসে পৌঁছে যায়। তিনজনে খাটের পাশে বাপের উপর ঝুঁকে পড়ে।
প্রতুল বাবা, আমরা সবাই এসেছি⋯রমা, অঞ্জনা, খোকা, টিনা⋯আনন্দমোহনের আধখোলা চোখে হাসির আভাস দেখা দেয়। তারপর মণিগুলো যেন ছল ছল করে ওঠে। তার ডান হাত অল্প প্রসারিত হয়, তেলোটা কম্পিতভাবে চিৎ হয়।
প্রতুল বাপের হাতের উপর হাত রাখে, প্রদ্যুম্নও। প্রতাপ তার হাত এগিয়ে দেয়।
এবার আনন্দমোহনের ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হয়।
প্রবোধ এগোয়নি—সে পিছনে জানালার দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রমা ও অঞ্জনাও ঘরে এসে ঢুকেছে।
প্রতুল, প্রতাপ ও প্রদুম্ন ব্যগ্রভাবে আনন্দমোহনের দিকে চেয়ে আছে। কী বলতে চায় আনন্দমোহন?
অবশেষে বাক্য উচ্চারিত হয়।
আনন্দ অ্যা⋯অ্যাতো⋯আ⋯আনন্⋯
আর বলতে পারে না। তার ঠোঁটের কোণে হাসিটি লেগে থাকে।
বাইরে বাগানে ডিঙ্গোর বন্দুক গর্জিয়ে ওঠে—পটাং!
FADE OUT
***