মুখবন্ধ
চাকরি’র ইন্টারভিউ
হারামজাদা মাতব্বর : জ্যাক টরেন্স মনে মনে বলল।
আলম্যান লম্বায় প্রায় ৫ ফিট ৫ ইঞ্চি, তবে সে হাঁটলে তাকে হাস্যকর রকমের খাটো আর মোটা দেখায়। তার চুলে যত্ন করে সিঁথি কাটা, এবং পরনে সুটটা আরামদায়ক হলেও তার মধ্যে একটা ভারিক্কী ভাব এনে দিয়েছে। সুটটা পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে কাস্টমারদের এটা বোঝানো যে এই সুটের মালিক এমন একজন লোক যার ওপর আস্থা রাখা যায়। একই সুট আবার কর্মচারিদের ব’লে উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমার সময় নষ্ট করবে না।
আলম্যানের কথা শুনতে শুনতে জ্যাক ভাবছিল যে দোষ আসলে আলম্যানের নয়, ডেস্কের ওপাশে যেই থাকতো জ্যাক তার ওপর বিরক্ত হত। ওর এই বিরক্তির আসল কারণ হচ্ছে ওর করুণ দশা, যার চাপে বাধ্য হয়ে ওকে এখানে আসতে হয়েছে।
ও আলম্যানের একটা প্রশ্ন খেয়াল করে নি। কাজটা করা উচিত হয় নি ওর। আলম্যান হচ্ছে সে ধরণের মানুষ যে এসব ভুল নিজের মাথায় নোট করে রাখে।
“জি?”
“আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনার বউ কি জানে আপনাদের এখানে কি ধরণের দায়িত্ব সামলাতে হবে? আপনার ছেলের কথাও তো ভাবতে হবে।” ও সামনে রাখা চিঠিটার দিকে এক ঝলক তাকালো। “ড্যানিয়েল ওর নাম, তাই না? আপনি কি শিওর আপনার বউ ঘাবড়ে যায় নি ব্যাপারটা শুনে?”
“ওয়েন্ডি আর দশটা মেয়ের মত নয়।”
“আর আপনার ছেলেও কি আর দশটা ছেলের মত নয়?”
জ্যাক বড় দেখে একটা মন গলানো হাসি দিল। “আমাদের কাছে তো অবশ্যই। অন্য পাঁচ বছর বয়সি বাচ্চাদের তুলনায় ও অনেক বুদ্ধিমান।”
আলম্যানের তরফ থেকে কোন হাসি ফেরত এল না। ও জ্যাকের চিঠিটা ফাইলের ভেতর পাঠিয়ে দিল। তারপর ফাইলটা চলে গেল একটা ড্রয়ারের ভেতর। ডেস্কের ওপর এখন একটা ব্লটার, টেলিফোন, একটা টেন্সর ল্যাম্প আর একটা ইন-আউট ব্যাস্কেট বাদে আর কিছু নেই। এমন কি ইন-আউট ব্যাস্কেটটা পর্যন্ত খালি।
আলম্যান উঠে রুমের কোণায় রাখা একটা ফাইল ক্যাবিনেটের কাছে গেল। “এদিকে আসুন, মি: টরেন্স। আপনাকে ফ্লোর প্ল্যানগুলো দেখাই।”
ও পাঁচটা বড় বড় কাগজের শীট এনে চকচকে ওয়ালনাট কাঠের ডেস্কটার ওপর রাখল। জ্যাক এসে তার কাঁধের কাছে দাঁড়াল। আলম্যানের কড়া সেন্টের গন্ধে ওর অস্বস্তি লাগছিল। পুরনো ইংলিশ লেদারের জুতো থেকে একই ধরনের গন্ধ বের হয়। এ কথাটা মনে হতে কোন কারণ ছাড়াই জ্যাকের প্রচণ্ড হাসি পেল, কিন্তু ও নিজের জিভ কামড়ে হাসিটাকে হজম করে নিল। দেয়ালের ওপাশ থেকে ওভারলুক হোটেলের রান্নাঘরে কাজ করার শব্দ ভেসে আসছিল।
“ওপরের তলা।” আলম্যান দ্রুত বলে যাচ্ছিল। “এখন চিলেকোঠাটা পুরনো জিনিসপত্র জমিয়ে রাখা বাদে আর কোন কাজে আসে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওভারলুক হোটেলের মালিকানা বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়েছে, এবং দেখে মনে হয় প্রত্যেক ম্যানেজারই তাদের সমস্ত হাবিজাবি জিনিস চিলেকোঠায় জমিয়েছে। আমি ওখানে ইঁদুরমারা বিষ আর ফাঁদ চাই। চারতলার কয়েকজন কর্মচারি বলেছে যে তারা ওপর থেকে খসখস আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। আমি এ কথা মোটেও বিশ্বাস করি না, তবে ওভারলুক হোটেলে ইঁদুর-ছুঁচো’র আবির্ভাবের ব্যাপারে আমি এক পার্সেন্টও ঝুঁকি নিতে রাজি নই।”
যদিও জ্যাকের ধারণা যে দুনিয়ার সব হোটেলেই দু’-একটা ইঁদুর পাওয়া যাবে, ও চুপ থাকাই নিরাপদ মনে করল।
“অবশ্যই আমার এটা বলে দিতে হবে না যে আপনার ছেলেকে কোন কারণেই চিলেকোঠায় উঠতে দেবেন না।”
“না।” জ্যাক আবার ওর মন গলানো হাসিটা হাসলো। এই হারামজাদা কি আসলেই মনে করে যে ও ওর ছেলেকে পুরনো আবর্জনা আর ইঁদুরের বিষে ভর্তি একটা চিলেকোঠায় খেলতে দেবে?
আলম্যান চিলেকোঠার ফ্লোরপ্ল্যানটা সরিয়ে অন্য কাগজগুলোর নিচে রাখল। “ওভারলুকে ১১০ জন অতিথি থাকার মত রুম আছে।” ও লেকচার দেবার ভঙ্গিতে বলল। “তাদের মধ্যে ৩০টা সুইট এখানে, চারতলায়। ১০টা হচ্ছে পশ্চিম উইং এ (ওখানেই প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটটা রয়েছে), ১০টা মাঝখানে, আর আরও ১০টা হচ্ছে পূর্ব উইং এ। সবগুলো থেকেই অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়।”
আমার সাথে তোমার সেলসম্যানগিরি করতে হবে না, মনে মনে বললেও জ্যাক নিজের মুখ বন্ধ রাখল। ওর চাকরিটা দরকার।
আলম্যান চারতলার প্ল্যানটাকেও নিচে চালান করে দিল আর তিনতলাকে সামনে নিয়ে এল।
“৪০টা রুম।” আলম্যান বলল। “৩০টা ডাবল আর ১০টা সিঙ্গেল। আর দোতলায় দুই ধরনেরই ২০টা করে। প্লাস প্রত্যেকতলাতেই ৩টা করে লিনেন ক্লজেট আছে। আর স্টোররুম দু’টোর মধ্যে একটা হচ্ছে দোতলার একদম পূর্বদিকে আর অন্যটা হচ্ছে তিনতলার একদম পশ্চিমদিকে। আর কিছু জানতে চান?”
জ্যাক মাথা নাড়লো। আলম্যান দোতলা আর তিনতলাকে কাগজের স্তুপের নিচে চালান করে দিল।
“এটা হচ্ছে লবি লেভেল : এর মাঝখানে হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক। তার পেছনে রয়েছে অফিসগুলো। ডেস্ককে ঘিরে লবিটা প্রায় ৮০ ফিট জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এর পশ্চিম উইং এ হচ্ছে ওভারলুক ডাইনিং রুম আর কলোরাডো লাউঞ্জ। আর পূর্ব উইং এ হচ্ছে ব্যাংকোয়েট হল এবং বলরুম। কোন প্রশ্ন?”
“শুধু বেসমেন্টের ব্যাপারে, জ্যাক বলল। “শীতের মৌসুমের কেয়ারটেকারের জন্যে ওটাই সবথেকে জরুরি লেভেল। যা কিছু ঘটার ওখানেই ঘটে।”
“ওয়াটসন আপনাকে ওখানের সবকিছু দেখিয়ে দেবে। বেসমেন্টের ফ্লোরপ্ল্যান বয়লার রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো আছে।” আলম্যান ভ্রু কুঁচকাল, যেন দেখাবার জন্য যে সে একজন ম্যানেজার, বয়লার রুম আর বেসমেন্ট নিয়ে তার মাথা ঘামাবার সময় নেই। “ওখানেও কয়েকটা ইঁদুর ধরার ফাঁদ দিয়ে দিলে খারাপ হয় না। এক মিনিট…” ও নিজের পকেট থেকে একটা প্যাড বের করে খসখস শব্দ তুলে কি যেন লিখে নিল (সবগুলো কাগজে মোটা, কাল অক্ষরে ছাপা ছিল’ : স্টুয়ার্ট আলম্যানের ডেস্ক থেকে) তারপর ছিঁড়ে কাগজটাকে ফেলল ইন-আউট ব্যাস্কেটের আউট অংশে। ওখানে আর কিছু না থাকায় কাগজের টুকরোটাকে একলা একলা দেখাচ্ছিল। তারপর আলম্যান ম্যাজিকের মত প্যাডটাকে এত দ্রুত সুটের পকেটে ফেরত পাঠিয়ে দিল যে জ্যাকের সেটা চোখেই পড়ল না। চিচিং ফাঁক, জ্যাকি।
ওরা আবার প্রথমের জায়গায় ফিরে গেল, আলম্যান ডেস্কের পেছনে আর জ্যাক ডেস্কের সামনে। বিচারক আর আসামী, অনিচ্ছুক দয়াদাতা এবং দয়াপ্রার্থি। আলম্যান নিজের পরিপাটি হাত দু’টো ডেস্কের ব্লটারের ওপর রেখে জ্যাকের দিকে সরাসরি তাকাল। একজন ছোটখাটো, মাথার চুল কমে আসা লোক, পরনে তার একখানা ব্যাংকার সুট আর ধুসর টাই। তার বুকের একপাশে লাগানো ফুলটাকে যেন ব্যালেন্স করবার জন্যে অন্যপাশে একটা ছোট ল্যাপেল পিন লাগান। পিনটায় ছোট্ট, সোনালি অক্ষরে লেখা : কমর্চারি।
“আমি আপনার সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে চাই, মি: টরেন্স। মি: অ্যালবার্ট শকলি একজন ক্ষমতাবান মানুষ এবং উনি ওভারলুক হোটেলের মালিকদের মধ্যে একজন, যা নির্মাণের পর এই প্রথমবার লাভ দেখাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও মি: শকলি ওভেরলুকের বোর্ড অফ ডাইরেকটর্সে আছেন, তিনি হোটেলের ব্যাপারে তেমন কিছু জানেন না, এবং এ কথাটা উনি নিজেও স্বীকার করবেন। কিন্তু উনি কেয়ারটেকিং এর ব্যাপারটায় নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। উনি চান যে আপনাকে হায়ার করা হোক। আমি তাই করব। তবে জেনে রাখুন যে এ ব্যাপারে আমার কিছু করার থাকলে হয়তো আমি তা হতে দিতাম না।”
জ্যাকের কোলের ওপর রাখা হাতগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল। ওর হাত ঘামতে শুরু করেছে।
মাতব্বর কোথাকার, মাতব্বর
“আপনি হয়তো আমাকে এই মুহূর্তে পছন্দ করছেন না, মি: টরেন্স-” হারামজাদা মাতব্বর-
“—কিন্তু সত্যি বলতে আমার তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। আপনি আমার ব্যাপারে কি মনে করেন না করেন তার সাথে আমার আপনাকে এই চাকরির জন্যে অনুপযুক্ত মনে করার কোন সম্পর্ক নেই। প্রতি বছর ১৫ই মে থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর ওভারলুক ১১০ জন কর্মচারি হায়ার করে, ধরে নিতে পারেন প্রত্যেক রুমের জন্যে একজন করে। তাদের মধ্যে অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না, আর তারা কেউ কেউ বলে যে আমি একটা হারামী। ওরা আমাকে চিনতে ভুল করেছে তা বলবো না। হোটেলটাকে ঠিকভাবে চালাবার জন্যে আমাকে মাঝে মাঝে হারামীপণা করতে হয়।”
আলম্যান জ্যাকের দিকে তাকাল ও কিছু বলে কিনা দেখবার জন্যে। জ্যাক ওর সবগুলো দাঁত বের করে একটা কৃতার্থ হাসি দিল।
আলম্যান বলল “ওভারলুক হোটেল বানাতে সময় লেগেছে ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত। হোটেল থেকে সবচেয়ে কাছের শহরের নাম হচ্ছে সাইডওয়াইনডার। শহরটা এখান থেকে ৪০ মাইলের মত পূর্বদিকে। শহরে যাবার রাস্তা অক্টোবরের শেষের দিক থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকে প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে। হোটেলটা রবার্ট টাউনলি ওয়াটসন নামে এক লোক বানিয়েছে, যিনি আমাদের বর্তমান মেইনটেনেন্স ম্যানের সম্পর্কে দাদা হতেন। অনেক অভিজাত পরিবার এখানে এসে থেকেছে, যাদের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে ভ্যান্ডারবিল্ট, রকাফেলার, অ্যাস্টর এবং দু’প পরিবার। চারজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওভারলুকের প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটে এসে থেকেছেন : উইলসন, হার্ডিং, রুজভেল্ট আর নিক্সন।”
“হার্ডিং বা নিক্সনের মত চোরকে নিয়ে এত গর্ব করার কিছু নেই।”
জ্যাক বিড়বিড় করে বলল।
আলম্যান ভ্রু কুঁচকালেও কিছু বলল না। সে তার বক্তৃতায় ফিরে গেল। “মি: ওয়াটসন হোটেলের দায়িত্ব আর সামলাতে পারছিলেন না, এবং তিনি ১৯১৫ সালে হোটেলটা বিক্রি করে দেন। পরে তা আরও তিনবার হাতবদল . হয় : ১৯২২ এ একবার, ১৯২৯ এ একবার এবং আরেকবার ১৯৩৬ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগ পর্যন্ত হোটেল খালি পড়ে ছিল, তারপরে তা কিনে নেন হোরেস ডারওয়েন্ট, কোটিপতি পাইলট, ব্যবসায়ী, ফিল্ম প্রডিউসার ও ডাইরেক্টর। উনি বিল্ডিংটা ঠিকঠাক করে আগের অবস্থায় নিয়ে আসেন।”
“ওনার নাম আমি শুনেছি।”
“হ্যা, উনি যা ছুঁতেন তাতেই লাভ করতেন, শুধু ওভারলুক হোটেল বাদে। যুদ্ধের পর কোন গেস্ট হোটেলে পা রাখার আগেই উনি হোটেলের পেছনে ১ মিলিয়ন ডলারের মত ঢালেন। হোটেলটাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাসাদে রুপান্তরিত করে ফেলা হয়। ডারওয়েন্টই ওই রোকে খেলার কোর্টটা বানিয়েছেন যেটার দিকে আপনি ঢুকবার সময় তাকিয়ে ছিলেন।”
“রোকে?”
“আমাদের ক্রোকে খেলার ব্রিটিশ সংস্করণ, মি: টরেন্স। ক্রোকে হচ্ছে রোকে খেলার পরিবর্তিত, বিকৃত রূপ। গুজব মতে, ডারোয়েন্ট তাঁর সোশাল সেক্রেটারির কাছ থেকে প্রথম খেলাটা শেখেন, তারপর রোকের প্রেমে পড়ে যান। আমাদের রোকে কোর্টটা আমেরিকার সবচেয়ে ভালো রোকে কোর্ট।”
“আমার কোন সন্দেহ নেই সে ব্যাপারে,” জ্যাক গম্ভীরমুখে বলল। রোকে কোর্ট, জন্তু জানোয়ারের শেপে কাটা বাগানের ঝোপ, আরো কি কি আছে ঈশ্বরই জানেন। ওর আলম্যানের সাথে কথা বলতে আর ভাল লাগছিল না, কিন্ত ও বেশ বুঝতে পারছিল যে আলম্যানের বকরবকর এখনো শেষ হয় নি। আলম্যান আরো টানবে, যতক্ষন ওর বক্তৃতা শেষ না হচ্ছে।
“তিন মিলিয়নের ক্ষতি হবার পর ডারওয়েন্ট হোটেলটা বিক্রি করে দেয় ক্যালিফর্নিয়ার একদল ব্যবসায়ীর কাছে। ওরাও ওভারলুক থেকে কোন লাভ তুলতে পারে নি। এরা কেউই আসলে হোটেল চালাবার মত লোক নয়।
১৯৭০ সালে মি: শকলি এবং তাঁর কয়েকজন সহযোগী মিলে হোটেলটা কিনে নেন এবং আমাকে নিয়োগ করে ম্যানেজার হিসাবে। আমরাও বেশ কয়েকবছর লোকসানে চলেছি, কিন্তু আমি গর্ব নিয়ে বলতে পারব যে হোটেলের নতুন মালিকরা কখনই আমার ওপর বিশ্বাস হারান নি। গত বছর আমরা লস ঠেকাতে সক্ষম হয়েছি। আর এ বছর প্রথমবারের মত ওভারলুক হোটেল লাভ করতে পেরেছে, নির্মাণের প্রায় ৭০ বছর পরে।”
এক মুহূর্তের জন্যে জ্যাকের মনে হল যে আলম্যানের তাহলে গর্ব করার অধিকার আছে, কিন্তু তারপরই আগের বিরক্তি আবার জ্যাকের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
সে বলল “আমি ওভারলুকের বৈচিত্রময় ইতিহাস আর আপনার ধারণা যে আমি আমার চাকরির জন্যে অনুপযুক্ত এ দু’টোর মধ্যে কোন সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না, মি: আলম্যান।”
“ওভারলুকের এতদিনের লসের একটা কারণ হচ্ছে প্রত্যেক শীতের সময় যে ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটা। লাভের অনেকখানি অংশ খেয়ে ফেলে এই সময়টা, মি: টরেন্স। এখানকার শীত অবিশ্বাস্য রকমের নিষ্ঠুর। এই সমস্যাকে সামাল দেবার জন্যে আমি শীতের সিজনে একজন ফুলটাইম কেয়ারটেকার হায়ার করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে বয়লার চালিয়ে হোটেলের বিভিন্ন অংশ গরম রাখবে। কোন ক্ষয়ক্ষতি রিপেয়ার করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়বে, যাতে লম্বা শীতের মাঝে সেই ক্ষতি হোটেলের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে না যেতে পারে। তাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। আমি প্রথম শীতের সিজনে একটা পরিবারকে হায়ার করেছিলাম। তাদের সাথে এখানে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। খুবই দুঃখজনক।”
আলম্যান ঠাণ্ডা চোখে জ্যাকের দিকে তাকাল।
“ভুলটা আমারই, অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই। আমি জানতাম না যে পরিবারের কর্তার মদ্যপানের নেশা ছিল।”
জ্যাকের মুখে আস্তে আস্তে একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠল-ওর আগের মন গলানো হাসির ঠিক উলটো। “এটা নিয়েই আপনার যত সমস্যা? আমি অবাক হলাম এটা দেখে যে অ্যাল আপনাকে জানায় নি। আমি তো মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”
“হ্যা, মি: শকলি বলেছেন যে আপনি আর মদ খান না। উনি আমাকে আপনার আগের চাকরির ব্যাপারেও বলেছেন…শেষ যেবার আপনার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আপনি ভারমন্টের একটা স্কুলে ইংলিশ পড়াতেন। ওখানে আপনার বদমেজাজের কারণে একটা ঘটনা ঘটে, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু আমার মনে হয় যে গ্রেডির ব্যাপারটা থেকে কিছু জিনিস শেখার আছে, এজন্যেই আপনার…আহ…পূর্ব ইতিহাস টেনে আনলাম। ১৯৭০-৭১ এর শীতের সময়, যখন ওভারলুকের পুনঃনির্মাণ শেষ তবে ব্যবসা পুরোদমে শুরু হয় নি, আমি ডেলবার্ট গ্রেডি নামে এক… হতভাগাকে হায়ার করি। আপনি এবং আপনার পরিবার যে কোয়ার্টারে থাকবেন সে ওখানেই এসে ওঠে। তার সাথে তার স্ত্রী এবং তার দুই মেয়ে ছিল। আমার ব্যাপারটা বেশ কিছু কারণে পছন্দ হচ্ছিল না, যার মধ্যে একটা কারণ ছিল শীতের প্রবলতা আর গ্রেডিরা যে পাঁচ-ছয় মাস বাইরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকবে এই ব্যাপারটা।”
“কিন্তু আসলে তো অবস্থা এরকম থাকে না, তাই না? যদি বাইরে যোগাযোগ করতে হয় তাহলে এখানে টেলিফোন আছে, তাছাড়া একটা সিটিজেন ব্র্যান্ডের রেডিও ও বোধহয় আছে। আর রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কও হেলিকপ্টার রেঞ্জের মধ্যে আছে, আর অত বড় জায়গায় দু’-একটা হেলিকপ্টার তো অবশ্যি থাকে।”
“আমি তা বলতে পারব না।”আলম্যান বলল। “হোটেলে আসলেই একটা সিবি রেডিও আছে যেটা আপনাকে মি: ওয়াটসন দেখিয়ে দেবে, ওই ফ্রিকোয়েন্সিগুলোও জানিয়ে দেবে যেগুলোতে আপনি সাহায্য চাইতে পারবেন। এখান থেকে সাইডয়াইন্ডার পর্যন্ত যে টেলিফোন লাইনগুলো গেছে সবগুলোই মাটির ওপর দিয়ে, এবং প্রতি শীতেই তুষারপাতের কারণে লাইনগুলো এক- দেড় মাসের মত নষ্ট থাকে। আমাদের ইকুইপমেন্ট শেডে একটা স্নো-মোবিলও পাবেন।”
“তার মানে আসলে আমাদের বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে না।”
মিঃ আলম্যানের চেহারায় যন্ত্রণার একটা ছাপ পড়ল। “ধরুন আপনার ছেলে অথবা বউ সিঁড়ি থেকে পড়ে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে, মি: টরেন্স। আপনার কি তখনো মনে হবে না যে আপনি বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা আছেন?”
জ্যাক ব্যাপারটা বুঝতে পারল। একটা স্নো-মোবিল ফুল স্পীডে চললেও তার সাইডওয়াইন্ডারে যেতে প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। আর ন্যাশনাল পার্ক থেকে হেলিকপ্টার আসতে কম করে হলেও তিন ঘণ্টা লাগবে, যদি আবহাওয়া ভাল থাকে তাহলে। তুষারঝড়ের সময় একটা হেলিকপ্টার মাটি থেকে উঠতেই পারবে না, আর সে সময় ফুল স্পীডে স্নো-মোবিল চালান অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর একজন আহত মানুষকে যদি নিয়ে যেতে হয় তাহলে তাকে মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে দিয়ে প্রচণ্ড বাতাস ঠেলে নিয়ে যেতে হবে।
“গ্রেডির ব্যাপারটায়,” আলম্যান বলল, “আমি তাই ভেবেছিলাম যা এখন মি: শকলি আপনার ব্যাপারে ভাবছে। একাকীত্ব একজন মানুষের জন্য খুব খারাপ, তাই পুরো পরিবার নিয়ে থাকাই ভাল। কোন বিপদ হলেও হয়তো মাথা ফাটা বা হার্ট অ্যাটাকের মত সিরিয়াস কিছু হবে না। হয়তো ফ্লু, নিউমোনিয়া, হাত-পা ভাঙ্গা, এমনকি অ্যাপেন্ডিসাইটিস পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এধরনের কিছু হলে ব্যবস্থা নেবার যথেষ্ট সময় থাকত।”
“কিন্তু শেষপর্যন্ত যা ঘটল তার কারণ ছিল সস্তা হুইস্কি, কোন অসুখ নয়। গ্রেডি প্রচুর পরিমাণে মদ নিয়ে এসেছিল আমাকে না জানিয়ে, এবং তার সাথে যোগ হয়েছিল কেবিন ফিভার নামে এক রোগ। আপনি কি এ রোগটার নাম শুনেছেন?” আলম্যান ছোট্ট করে একটা সবজান্তা হাসি দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল যাতে জ্যাক “না” বলার সাথে সাথে সে নিজের জ্ঞান জাহির করতে পারে। জ্যাক তাকে নিরাশ না করে দ্রুত মাথা নাড়ল।
“এটা হচ্ছে একধরণের ক্লস্ট্রোফোবিয়া যা কিছু মানুষ একসাথে অনেকদিন বন্দি থাকলে মাথাচাড়া দিতে পারে। এটা চরম পর্যায়ে গেলে হ্যালুসিনেশান এবং হাতাহাতি ঘটাতে পারে-রান্না পুড়ে যাওয়া বা প্লেট ধোয়ার মত ছোটখাট জিনিস নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও বিরল নয়।”
আলম্যানের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে, যা দেখে জ্যাক ভেতরে ভেতরে খুশি হল। ও সিদ্ধান্ত নিল ও আলম্যানকে আরেকটু খোঁচাবে, তবে মনে মনে ওয়েন্ডিকে কথা দিল যে ও বসকে রাগিয়ে তুলবে না।
“আমি একমত, ভুলটা বোধহয় আপনারই ছিল। গ্রেডি কি হাতাহাতি পর্যন্ত এসেছিল নাকি?”
“সে তার পুরো পরিবারকে খুন করে, মি: টরেন্স, তারপর আত্মহত্যা করে। সে নিজের ছোট মেয়েকে একটা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মারে, আর বউকে মারে একটা শটগান দিয়ে। পরে সে একই
শটগান দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে। তার পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। নিশ্চয় এত মাতাল ছিল যে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।”
আলম্যান নিজের হাত দু’পাশে ছড়িয়ে জ্যাকের দিকে দাম্ভিকভাবে তাকাল।
“ও কি শিক্ষিত ছিল? হাইস্কুল শেষ করেছে?”
“না, তা সে করে নি” আলম্যান একটু শক্তসুরে বলল। “আমি ভেবেছিলাম যে… অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ নয় এমন একজন লোককে একাকীত্ব সহজে কাবু করতে পারবে না…”
“ওখানেই আপনার ভুলটা।” জ্যাক বলল। “একজন মূর্খ মানুষের কেবিন ফিভারে ভোগার সম্ভাবনা বেশি, ঠিক যেমন তার জুয়া খেলার সময় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়বার বা ছিনতাই করবার সম্ভাবনা বেশি। সে দ্রুত বোর হয়ে যায়। তুষারপাত হবার পর হোটেল থেকে বের হবার সুযোগ না থাকলে তার টিভি দেখা আর নিজের সাথে তাস খেলা বাদে আর কিছু করার থাকে না। কিছু করার থাকে না নিজের বউয়ের সাথে চেঁচামেচি করা,বাচ্চাদের বকাবকি করা আর মদ খাওয়া বাদে। সবকিছু নিস্তব্ধ থাকে বলে রাতে তার সহজে ঘুম আসে না। তাই সে প্রতি রাতে মদ খেয়ে ঘুমাতে যায় আর সকালে ওঠে তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে। সে বদমেজাজী হয়ে যায়। হয়তো এর মধ্যে একদিন টেলিফোন বা টিভির অ্যান্টেনা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আর সারাদিন তার মদ খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না। তার মেজাজ এতে আরও খিঁচড়ে যেতে থাকে। আর শেষে…বুম, বুম, বুম।”
“আর ওখানে আপনার মত শিক্ষিত লোক থাকলে কি হত?”
“আমি আর আমার স্ত্রী দু’জনই বই পড়তে ভালবাসি। আর মি: শকলি খুব সম্ভবত আপনাকে বলেছে যে আমি একটা নাটক লিখবার চেষ্টা করছি। ড্যানির জন্যে আছে ওর ধাঁধার বই, ওর রঙ করবার খাতা আর ওর কৃস্টাল রেডিও। আমি ওকে এরমধ্যে পড়তে আর বরফের ওপর হাঁটতে শেখাতে চাই। ওয়েন্ডিও তা শিখতে চেয়েছিল আমার কাছে। হ্যা, আমার মনে হয় যে টিভি নষ্ট হয়ে গেলেও নিজেদের ব্যস্ত রাখতে আমাদের সমস্যা হবে না।” ও একটু থামল। “আর অ্যাল আপনাকে সত্যি কথাই বলেছে, আমি এখন আর মদ খাই না। একসময় খেতাম, আর আস্তে আস্তে তা অভ্যাসে বদলে গিয়েছিল। কিন্তু গত ১৪ মাসে আমি এক গ্লাস বিয়ার পর্যন্ত ছুঁই নি। আমার এখানে অ্যালকোহল নিয়ে আসার কোনরকম ইচ্ছা নেই, আর তুষারপাত শুরু হবার পর আমি চাইলেও মদ জোগাড় করতে পারব না।”
“তা আপনি ঠিকই বলেছেন।” আলম্যান বলল। “কিন্তু যত বেশি মানুষ এখানে থাকবে, ঝামেলা হবার সম্ভাবনা তত বেশি। আমি মি: শকলিকে সেটা বলেছি, আর উনি বলেছেন যে উনি সেটার দায়িত্ব নিচ্ছেন। এখন আমি আপনাকে বলছি, আর আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনিও দারিত্বটা সামলাতে প্রস্তুত আছেন-”
“জি, আমি প্রস্তুত।”
“বেশ। আমার এটা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কিন্তু আমার এখনো মনে হচ্ছে যে পিছুটান ছাড়া কোন কলেজের ছাত্র এ চাকরিটা নিলে ভাল হত। যাই হোক, আশা করি আপনি সবকিছু ঠিকভাবে সামলাতে পারবেন। এখন আমি আপনাকে মিঃ ওয়াটসনের কাছে নিয়ে যাচ্ছি যে আপনাকে বেসমেন্ট আর হোটেলের আশেপাশে ঘুরিয়ে দেখাবে। আপনার কি আর কোন প্রশ্ন আছে?”
“না, নেই।”
আলম্যান উঠে দাঁড়াল। “আশা করি আপনি রাগ করছেন না, মি: টরেন্স। আপনাকে আমি যা বলেছি তা পার্সোনালি নেবেন না। আমি শুধু তাই করতে চাই যা ওভারলুকের জন্য ভাল। এটা একটা চমৎকার হোটেল। আমি চাই এটা তেমনি থাকুক।”
“না, না। রাগ করবার প্রশ্নই ওঠে না।” জ্যাক আবার ওর হাসিটা হাসল। কিন্তু আলম্যান হ্যান্ডশেক করবার জন্যে হাত বাড়াল না দেখে ও মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। অবশ্যই ও রাগ করেছে। রাগ না করার কোন কারণ
অধ্যায় ২ – বোন্ডায়
ওয়েন্ডি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল যে ওর ছেলে বসে আছে উঠোনে, নিজের ট্রাক বা ওয়্যাগন কোনটা নিয়েই খেলছে না, এমনকি ওই কাগজের গ্লাইডারটা নিয়েও নয় যেটা নিয়ে ও সারা সপ্তাহ পড়ে ছিল। ও শুধু নিজের কনুইদু’টো দু’হাঁটুর উপর রেখে বসে বসে অপেক্ষা করছে ওদের পুরনো ভোক্সওয়্যাগনটার জন্যে। একটা পাঁচ বছর বয়সী ছেলে যে অপেক্ষা করছে বাবা কখন বাসায় ফিরবে।
ওয়েন্ডির হঠাৎ করে খুব কান্না পেল।
ডিশ টাওয়েলটা সিঙ্কের ওপর রেখে নিজের জামার বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে ও নিচতলায় এল। জ্যাকের অহংকার নিয়ে আর পারা গেল না! না, না, অ্যাল, আমার কোন অ্যাডভান্স লাগবে না! আমি বেশ ভাল আছি! এদিকে বাসার হলওয়ের দেয়ালগুলো রঙ পেন্সিল, স্প্রে-পেইন্ট আর কলমের কাটাকুটিতে ছেয়ে গিয়েছে। সিঁড়ির ধাপগুলো এত উঁচু যে একটু অসাবধানে পা ফেললেই আছাড় খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। পুরো বিল্ডিংটাতেই সময়ের নির্মম ছাপ পড়ে গেছে। স্টোভিংটনের সুন্দর বাসাটার পর এখানে ড্যানিকে নিয়ে আসা একদমই ঠিক হয় নি। ওদের ওপরের তলায় যে দম্পত্তি থাকে ওরা বিয়ে করে নি। ওয়েন্ডির তা নিয়ে সমস্যা নেই, ওর সমস্যা হচ্ছে ওদের মধ্যে যে চব্বিশঘণ্টা ঝগড়া লেগে থাকে তা নিয়ে। সারা সপ্তাহ ওদের মাঝে কথা কাটাকাটি লেগেই থাকে, কিন্তু আসল ঝগড়াগুলো হয় ছুটির দিনে, যখন বার বন্ধ থাকে। জ্যাক ঠাট্টা করে এই ঝগড়াগুলোকে নাম দিয়েছে শুক্রবারের সংগ্রাম, কিন্তু ব্যাপারটা ঠাট্টার নয়। ওপরের ছেলেটার নাম হচ্ছে টম। মেয়েটা-যার নাম ইলেইন-প্রত্যেক ঝগড়ার শেষে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর বার বার বলতে থাকেঃ “প্লিজ টম, আমি আর পারছি না। আর পারছি না।” আর ছেলেটা তখনও গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকে। একবার ওরা ড্যানিকে পর্যন্ত জাগিয়ে দিয়েছিল, আর ড্যানি মরার মত ঘুমায়। তার পরদিন টম যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল জ্যাক তাকে থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বোঝায়। টম গর্জে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু তখনি জ্যাক তাকে নিচু গলায় কিছু একটা বলে যা ওয়েন্ডি শুনতে পায় নি। কিন্তু টম সেটা শুনে চুপচাপ মাথা নীচু করে চলে যায়। এ ঘটনাটা ঘটেছে এক সপ্তাহ আগে, আর এরপর কিছুদিন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভাল ছিল। কিন্তু তারপর সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যায়। ওর বাচ্চার সামনে প্রত্যেকদিন এসব ঝগড়া-বিবাদ মোটেও ভাল নয়।
ওয়েন্ডির আবার প্রচণ্ড কান্না পেল, কিন্তু ও উঠোনে বেরিয়ে এসেছে দেখে সেটা চেপে রাখল। ও নিজের ড্রেস ঝাড়তে ঝাড়তে ড্যানির পাশে বসে জিজ্ঞেস করল : “কি অবস্থা, ডক?”
ও ওয়েন্ডির দিকে তাকিয়ে একটা দায়সারা হাসি দিল। “ভালো, আম্মু।”
গ্লাইডারটা ওর ছোট্ট দুই জুতোপড়া পায়ের মাঝখানে পড়ে ছিল। ওয়েন্ডি খেয়াল করল যে তার একটা পাখা এর মধ্যেই ছিঁড়তে শুরু করেছে।
“তুমি কি চাও মা ওটা ঠিক করে দিক, সোনা?”
ড্যানি এর মধ্যে আবার রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। “না। বাবা আসলে ঠিক করে দেবে।”
“তোমার বাবা মনে হয়না রাতের খাবারের আগে ফিরতে পারবে, ডক। ওই পাহাড়গুলো থেকে নামতে অনেক সময় লেগে যায়।”
“গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো?”
“না, আমার মনে হয় না।” কিন্তু কথাটা শুনে ওর মাথায় নতুন একটা দুশ্চিন্তা যোগ হল। ধন্যবাদ, ড্যানি।
“বাবা বলেছিল যে গাড়িটা ঝামেলা করতে পারে।” ড্যানি কিছুই হয়-নি এমন একটা ভঙ্গিতে বলল : “ফুয়েল পাম্পের নাকি বালের অবস্থা।”
“ওটা বলতে হয় না, ড্যানি।”
“ফুয়েল পাম্প?” ড্যানি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
ওয়েন্ডি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “না, বালের অবস্থা। ওটা আর বলবে না।”
“কেন?”
“ওটা একটা অশ্লীল কথা।”
“অশ্লীল মানে কি, আম্মু?”
যেমন যখন তুমি খাবার টেবিলে নাক খোঁচাও বা বাথরুমের দরজা খুলে হিসি কর, বা বালের অবস্থার মত বাজে কথা বল। বাল একটা অশ্লীল কথা, ভদ্র মানুষেরা ওটা বলে না।”
“বাবা তো বলে। যখন বাবা গাড়ির ইঞ্জিন চেক করছিল, তখন সে বলল ‘ইস্ এই ফুয়েল পাম্পটার তো বালের অবস্থা। বাবা কি ভদ্র মানুষ নয়?”
তুমি নিজেকে এসব তর্কে কিভাবে জড়াও উইনিফ্রেড? নিয়মিত প্র্যাকটিস কর?
“হ্যা, বাবা ভদ্র, কিন্তু সে তো বড়, তাই না? তাছাড়া তোমার বাবা কখনও অন্যদের সামনে এসব বাজে কথা বলে না।”
“অ্যাল আঙ্কেলের সামনেও নয়?”
“হম্ম্, তার সামনেও নয়।”
“আমি বড় হলে কি এসব কথা বলতে পারব?”
“তুমি তো মনে হচ্ছে বলবেই, আমার যদি পছন্দ না হয় তাহলেও।”
“কত বড় হলে?”
“বিশ বছর হলে চলবে?”
“বিশ বছর হতে তো অনেকদিন লাগবে।”
“তা লাগবে, কিন্তু তুমি কি চেষ্টা করবে ততদিন বাজে কথা না বলার?”
“ঠিক আছে।”
ও আবার ঘুরে রাস্তার দিকে তাকাল। ও একটু নড়ে উঠল, যেন উঠে দাঁড়াবার জন্যে, কিন্তু তারপর দেখতে পেল যে ভোক্সওয়্যাগন বিটলটা আসছে ওটা অনেক নতুন, আর উজ্জ্বল লাল রঙের। ও আবার বসে পড়ল। ওয়েন্ডি ভাবছিল ওদের কলোরাডো চলে আসাতে ড্যানির কত কষ্ট হয়েছে। ড্যানি অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই বলে না, কিন্তু ওয়েন্ডির এটা দেখতে খারাপ লাগে যে ড্যানির বেশীরভাগ সময় একলা থাকতে হয়। ভারমন্টে থাকতে জ্যাক যে স্কুলে পড়াতো সেখানকার আরও তিনজন টিচারের ড্যানির বয়সী ছেলেমেয়ে ছিল-আর ড্যানি ওখানে একটা প্রি-স্কুলেও যেত-কিন্তু এখানে ওর সাথে খেলবার মত কেউ নেই। এখানে বেশীরভাগ ফ্ল্যাটেই থাকে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা, আর গুটিকয় যেসব দম্পত্তি আছে তাদের প্রায় কারোই বাচ্চা নেই। ওয়েন্ডি হয়তো সবমিলিয়ে বারো-তের জন জুনিয়র হাইস্কুলে যাবার বয়সী ছেলেমেয়ে দেখেছে, আর কিছু বাচ্চা যারা এখনও কথা বলতে পারে না। ব্যস এটুকুই।
“আম্মু, বাবা এখন আর পড়াতে যায় না কেন?”
ওয়েন্ডি এক ঝটকায় ওর চিন্তার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে একটা উত্তর খুঁজতে লাগল। জ্যাক আর ও আগেও আলোচনা করেছে ড্যানি এধরণের প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিবে সে ব্যাপারে। সবধরণের উত্তরের কথাই ওরা ভেবে দেখেছে, প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সরাসরি সত্যি কথা বলে দেয়া পর্যন্ত। কিন্তু ড্যানি আগে কখনই জিজ্ঞেস করে নি। ও প্রশ্নটা করেছে এখন, যখন ওয়েন্ডির এমনিতেই মন খারাপ আর ওর এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তারপরও ড্যানি তাকিয়ে ছিল ওর চেহারার দিকে, হয়তো মায়ের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে নিজেই একটা উত্তর ভেবে নিচ্ছিল। ওয়েন্ডি চিন্তা করল যে একটা বাচ্চার কাছে নিশ্চয় বড়দের কাজকর্ম আর চিন্তাভাবনা অন্ধকার জঙ্গলের ভয়ংকর পশুদের মতই অচেনা আর বিপজ্জনক বলে মনে হয়। বাচ্চাদের কিছু করবার ক্ষমতা থাকে না, শুধু বড়রা যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকে যাওয়া ছাড়া। এই মন খারাপ করা চিন্তাটা মাথায় আসতেই ওয়েন্ডির আবার প্রায় কেঁদে ফেলবার মত অবস্থা হল। ও কান্না চাপতে চাপতে নিচু হয়ে গ্লাইডারটা তুলে হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখতে লাগল।
“তোমার মনে আছে ড্যানি, তোমার বাবা যে স্কুলের ডিবেট টিমের কোচ ছিলেন?”
“হ্যা। ওটা হচ্ছে তর্ক তর্ক খেলা, তাই না?”
“ঠিক।” ওয়েন্ডি সিদ্ধান্ত নিল যে ও ওর ছেলেকে সত্যি কথাই বলবে।
“সেখানে জর্জ হ্যাফিল্ড নামে এক ছেলে ছিল যাকে তোমার বাবা টিম থেকে বাদ দিয়ে দেয়। তার মানে ও অন্যদের চেয়ে খারাপ করছিল। কিন্তু জর্জ মনে করে যে তোমার বাবা ওকে ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে দেয়, তোমার বাবা ওকে পছন্দ করে না দেখে। তারপর জর্জ খুব খারাপ একটা কাজ করে। তুমি বোধহয় জানো সেটা কি।”
‘ও’ই কি আমাদের গাড়ির চাকা ফুটো করে দিয়েছিল?”
“হ্যা, ওই। ও স্কুলের পরে কাজটা করছিল আর তোমার বাবা তাকে হাতেনাতে পাকড়াও করে।” ওয়েন্ডি আবার আটকে গেল। কিন্তু এখন আর কোন উপায় নেই। হয় ওর পুরো সত্যি কথা বলতে হবে নয়তো মিথ্যা কথা বলতে হবে।
“তোমার বাবা…মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করে যার জন্যে তাকে পরে পস্তাতে হয়। ওর কখনও কখনও মাথা কাজ করে না।”
“আমি কাগজপত্র এলোমেলো করবার পর বাবা আমাকে যেভাবে মেরেছিল জর্জ হ্যাফিল্ডকে কি ওভাবেই মেরেছে?”
মাঝে মাঝে…
(ড্যানির ভাঙ্গা হাত একটা ব্যান্ডেজে ঝোলানো)
তোমার বাবা মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করে যার জন্যে তাকে পরে পস্তাতে হয়।
ওয়েন্ডি জোরে চোখ মুদল, যাতে ওর কান্না বেরিয়ে না আসে।
“অনেকটা ওভাবেই, ড্যানি। জর্জকে গাড়ির চাকা ফুটো দেখে তোমার বাবা ওকে মারতে শুরু করে, আর তখন একটা ঘুসি জর্জের মাথায় যেয়ে লাগে। তারপর স্কুলটা যারা চালায় তারা ঠিক করে যে যে জর্জ ওখানে আর পড়তে পারবে না, আর তোমার বাবাও সেখানে পড়াতে পারবে না।” ওয়েন্ডি বলার মত আর কিছু খুঁজে না পেয়ে থামল, আর ড্যানির প্রশ্নের বন্যার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করল।
“ও।” ড্যানি বলল, তারপর আবার ও চোখ ফিরিয়ে নিল রাস্তার দিকে। আপাতত আলোচনার এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু ওয়েন্ডি এত সহজে ব্যাপারটা ভুলতে পারছিল না।
ও উঠে দাঁড়াল। “আমি চা খেতে উপরে যাচ্ছি, ডক। তুমি কি দুধ আর । বিস্কিট খাবে?”
“আমি বাবার জন্যে কিছুক্ষন অপেক্ষা করি।”
“আমার মনে হয় না তোমার বাবা পাঁচটার আগে আসতে পারবে।”
“হয়তো বাবা একটু আগেই চলে আসবে।”
“হয়তো।” ওয়েন্ডি একমত হল ওর সাথে। “হতে পারে আগেই আসবে।”
ওয়েন্ডি যখন প্রায় ঘরে ঢুকে গিয়েছে তখন ড্যানি ওকে ডাকল : “আম্মু?”
“কি, ড্যানি?”
“তুমি কি শীতের সময় ওই হোটেলটায় যেয়ে থাকতে চাও?”
এখন ওয়েন্ডির চিন্তা করতে হচ্ছিল ওর কাছে এ প্রশ্নটার যে হাজার হাজার উত্তর আছে তার মধ্যে থেকে কোনটা দেবে। ওর গত পরশু এ ব্যাপারে কেমন লাগছিল সেটা বলবে, নাকি গতকাল রাতে বা আজ সকালেরটা? প্রত্যেকদিনই ওর এ ব্যাপারটা নিয়ে একেকরকম অনুভূতি হচ্ছে, তারমধ্যে কিছু ভাল, কিছু ভয়ংকর খারাপ।
ও বলল : “তোমার বাবা যদি থাকতে চায় তাহলে আমিও চাই।” ও একটু থামল। “আর তুমি কি চাও?”
“আমিও থাকতে চাই বোধহয়।” ড্যানি শেষপযন্ত বলল। “এখানে আমার সাথে খেলার মত কেউ নেই।”
“তোমার কি তোমার বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছে?”
“মাঝে মাঝে স্কট আর অ্যান্ডির কথা মনে পড়ে। ব্যস এটুকুই।”
ওয়েন্ডি ফিরে এসে ড্যানিকে একটা চুমু দিয়ে ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিল। ওর হালকা সোনালী চুল থেকে বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা এখনো যায় নি। ড্যানি এত চুপচাপ একটা ছেলে, জ্যাক আর ওয়েন্ডিকে বাবা মা হিসাবে নিয়ে ও কিভাবে টিকবে ঈশ্বরই জানেন। ওদের বিয়ের শুরুতে যা আশা ছিল সব নিঃশেষ হতে হতে অচেনা একটা শহরের বাজে একটা অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঠেকেছে। ড্যানির ভাঙ্গা হাতের ছবিটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। পৃথিবীটা যে চালায় তার কোথাও কোন একটা ভুল হয়েছে, আর সেই ভুলের জন্যে পস্তাতে হবে নিষ্পাপ একটা প্ৰাণকে।
“রাস্তায় যেয়ো না, ডক।”
ওয়েন্ডি ওর ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“ঠিক আছে, আম্মু।”
ওয়েডি ওপরে উঠে এক পট চা বসালো আর একটা প্লেটে কিছু কুকি রাখল, যাতে ও ঘুমিয়ে থাকার সময় ড্যানি ভেতরে এলে খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়। ও বড় চায়ের কাপটা সামনে নিয়ে টেবিলে বসে জানালা দিয়ে বাইরে ড্যানির দিকে তাকাল। ড্যানি এখনও উঠোনে বসে আছে, নীল রঙের জিন্স আর সবুজ রঙের ঢোলা একটা টি-শার্ট পরা যেটায় লেখা ছিল স্টভিংটন প্রেপ স্কুল। ওর গ্লাইডারটা ওর পাশে পরে ছিল। সারাদিন ওয়েন্ডির ভেতর যে চাপা কান্না জমে ছিল ওটা এখন বিস্ফারিত হল, ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল ওর চায়ের কাপের ভেতর। ও কাঁদছিল অতীতে যা হয়েছে তার দুঃখে, আর ভবিষ্যতে যা আসছে তার ভয়ে।
অধ্যায় ৩ – ওয়াটসন
আপনার বদমেজাজের কারণে, আলম্যান বলেছিল।
“এটা হচ্ছে গিয়ে ফার্নেস,” ওয়াটসন একটা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের লাইট জ্বালাতে জ্বালাতে বলল। সে সাদা শার্টপরা আর মাথাভর্তি সাদা চুলওয়ালা একজন শক্তপোক্ত মানুষ। ও ফার্নেসের পেটে বসানো একটা ছোট জানালা টান দিয়ে খুলে ফেলল, তারপর জ্যাককে ইশারা করল ভেতরে দেখতে। “এটাকে বলে পাইলট লাইট।” ভেতরে একটা ভয়ংকর শক্তিশালী সাদা-নীল রঙের আগুন জ্বলছিল। ভয়ংকর তো অবশ্যই, জ্যাক মনে মনে বলল, ওখানে হাত ঢুকালে তিন সেকেন্ডের মধ্যে কাবাব হয়ে যাবে।
আপনার বদমেজাজের কারণে।
(ড্যানি, তুমি ঠিক আছো?)
ফার্নেসটা ঘরের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। জ্যাকের দেখা সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো ফার্নেস এটা।
পাইলটটার একটা নিরাপত্তা ব্যাবস্থা আছে।” ওয়াটসন ওকে বলল।”ওটার ভেতর একটা ছোট মিটার আছে যেটা তাপমাত্রা মাপতে থাকে। যদি তাপমাত্রা বেশী নিচু হয়ে যায় তাহলে আপনারা যেখানে ঘুমাবেন সেখানে একটা অ্যালার্ম বাজবে। বয়লারটা দেয়ালের ওপাশে। আসুন আপনাকে নিয়ে যাই।” ওয়াটসন দড়াম করে জানালাটা বন্ধ করে জ্যাককে ফার্নেসের পেছনে আরেকটা দরজার কাছে নিয়ে গেল। ফার্নেসের লোহা থেকে একধরণের ভোঁতা গরম বের হচ্ছিল। জ্যাকের কেন যেন মনে হল ফার্নেসটাকে দেখে একটা বিশাল, ঘুমন্ত বেড়াল মনে হল। ওয়াটসন শিষ দিতে দিতে চাবি ঝাঁকাল।
আপনার বদমেজাজের-
(যখন জ্যাক স্টাডিরুমে ঢুকে দেখতে পায় যে ড্যানি ওখানে খালি গায়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আস্তে আস্তে প্রচণ্ড রাগের একটা গাঢ় লাল জোয়ার ওর চিন্তাভাবনাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। ওর নিজের কাছে অন্তত মনে হচ্ছিল জিনিসটা আস্তে আস্তে হচ্ছে, কিন্তু আসলে হয়তো এক মিনিটও লাগে নি। কিছু কিছু স্বপ্নে যেমন মনে হয় সবকিছু অনেক আস্তে হচ্ছে, জ্যাকের তখন তেমনই লাগছিল। দুঃস্বপ্ন দেখবার মত। দেখে মনে হচ্ছিল ওর স্টাডির প্রত্যেকটা ড্রয়ার আর আর দরজার ওপর ঝড় বয়ে গেছে। সবগুলো ড্রয়ার টান দিয়ে বের করে ফেলা হয়েছে। ওর পান্ডুলিপি, যেটাকে ও সাত বছর আগে ছাত্রাবস্থায় লেখা একটা বড়গল্প থেকে তিন অংকের একটা নাটকের রুপ দিচ্ছিল, সারা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল। যখন ওয়েন্ডি জ্যাককে ফোনটা ধরবার জন্যে ডাকে, তখন ও নাটকের দ্বিতীয় অংকের ওপর কাজ করতে করতে বিয়ার খাচ্ছিল। ড্যানি সেই বিয়ারটা সবগুলো কাগজের ওপর ফেলে দিয়েছিল। সম্ভবত কেমন ফেণা হয় তা দেখবার জন্যে। ফেণা দেখবার জন্যে, ফেণা দেখবার জন্যে, কথাগুলো বারবার জ্যাকের মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল, পিয়ানোতে একটা অসুস্থ সুর বারবার বাজার মত, আর এতে ওর রাগ আরও বেড়ে গেল। জ্যাক উদ্যেশ্যপূর্ণভাবে ওর তিন বছরের ছেলের দিকে আগাল। ড্যানি তখন মুখে সন্তুষ্টির হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, বাবার স্টাডিতে যে কাজটা করেছে তা নিয়ে খুব খুশি। ড্যানি কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল যখন জ্যাক ওর হাত ধরে মোচড় দেয় ওর হাতের টাইপরাইটার ইরেজার আর মেকানিক্যাল পেন্সিলটা ফেলে দেবার জন্যে। ড্যানি একটু কেঁদে ওঠে… না… না… সত্যি কথা স্বীকার করো, ও চিৎকার করে ওঠে। প্রচণ্ড রাগের বশে থাকার কারণে ওর সবকিছু ভাল করে মনে নেই। ওয়েন্ডি তখন আশেপাশে কোথাও ছিল, জানতে চাচ্ছিল যে কি হয়েছে। কিন্তু রাগের প্রভাবে ওয়েন্ডির গলা জ্যাক ভাল করে শুনতেই পাচ্ছিল না। ও ড্যানির হাত মুচড়ে ওকে কোলের ওপর নিয়ে আসতে চেয়েছিল, যাতে ওর নিতম্বে মারতে পারে। জ্যাকের বড় বড় আঙুলগুলো চেপে বসেছিল ড্যানির শিশুসুলভ হাতে। এরপর একটা কট্ করে ছোট্ট একটা শব্দ হয় হাতের হাড় ভাঙ্গার, একটা শব্দ যেটা জ্যাক জীবনে ভুলবে না। ওই সংক্ষিপ্ত শব্দটা তীরের মত ওর রাগ ভেদ করে মাথায় প্রবেশ করে। আর তারপরই আরেকটা জোয়ার জ্যাককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, লজ্জা, আতংক আর প্রচণ্ড অপরাধবোধের জোয়ার। শব্দটা ছিল পেন্সিলের শীস ভাঙা বা একটা ছোট গাছের ডাল ভাঙবার শব্দের মত। কিন্তু ওই শব্দটার একপাশে ছিল জ্যাকের সমস্ত অতীত আর অন্যপাশে ওর সমস্ত ভবিষ্যৎ। ড্যানির চেহারা মোমের মত সাদা হয়ে গিয়েছিল। ওর চোখগুলো এমনিতেই বড় বড়, আর এখন সেগুলো ব্যাথায় মনে হচ্ছিল ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। ওকে দেখে জ্যাকের মনে হচ্ছিল যে ও যেকোন মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। জ্যাক তারপর নিজের গলা শুনতে পায়, মাতাল, জড়ানো একজন মানুষের গলা যেটা থেকে আকুতি ঝরে পড়ছিল সবকিছু ফিরিয়ে নেবার, ও প্রশ্ন করছিল-ড্যানি, তুই ঠিক আছিস? ওর প্রশ্নের একসাথে দু’টো উত্তর এল। প্রথমে ড্যানি ওর প্রশ্নের জবাবে জোরে কেঁদে উঠল, তারপর ওয়েন্ডি সশব্দে আঁতকে উঠল ড্যানির হাতকে বিশ্রী একটা ভঙ্গিতে ঝুলতে দেখে। ওয়েন্ডি গলা থেকে প্রথমে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল, তারপর ও আবোল-তাবোল বকতে বকতে ড্যানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল : ওহ ড্যানি ওহ আমার সোনা ওহ তোমার হাতের কি হয়েছে; আর জ্যাক তখনও বোকার মত মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিল যে এরকম একটা জিনিস কিভাবে হয়ে গেল। ও দেখল যে ওয়েন্ডি ওর দিকে তাকিয়ে আছে, আর ওর চোখে জ্বলছে ঘৃণার আগুন। জ্যাকের তখনও মাথায় খেলে নি যে ওয়েল্ডির এই রাগের অর্থ কি হতে পারত। ওর চিন্তায় আসে নি যে ওয়েন্ডি ড্যানিকে নিয়ে তখনই কোন মোটেলে চলে যেতে পারত, আর সকালে জ্যাককে মুখোমুখি করাতে পারত কোন ডিভোর্সের উকিলের সাথে। ওর মাথায় শুধু একটা জিনিসই কাজ করছিল : যে ওর বউ ওকে ঘৃণা করে। জ্যাকের নিজেকে তখন প্রচণ্ড একলা মনে হচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল মারা যাবার সময় মানুষের বোধহয় এমনই লাগে। ওয়েন্ডি তারপর কান্নারত ড্যানিকে কোলে নিয়ে দৌড়ে যেয়ে ফোন ডায়াল করে। জ্যাক তখনও বেকুবের মত ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল আর ভাবছিল-)
আপনার বদমেজাজের কারনে।
জ্যাক জোরে জোরে নিজের ঠোঁট ঘসতে ঘসতে ওয়াটসনের পিছে বয়লার রুমে ঢুকল। ঘরটা ভ্যাপসা গরম, কিন্তু জ্যাক যে কারণে দরদর করে ঘামছিল তা শুধু গরমের জন্যে নয়। ও ঘামছিল ড্যানির ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায়। ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কারভাবে ওর মাথায় গেঁথে আছে। ওর মনে এক ঝটকায় সেদিনের লজ্জা আর অপরাধবোধ ফিরে আসে, আর প্রচণ্ড ইচ্ছা করে এক ঢোক মদ খেতে। জ্যাক তিক্তভাবে ভাবলো, ও কি কখনো একটা দিন মদের কথা চিন্তা না করে থাকতে পারবে না? ও তো এক সপ্তাহ বা একদিনও নয়, শুধু একটা ঘণ্টা চায় যখন ওর মদ খেতে ইচ্ছা করবে না।
“এটা হচ্ছে আমাদের বয়লার।” ওয়াটসন ঘোষণা করলো। তারপর পেছনের পকেট থেকে একটা লাল আর কাল রুমাল বের করে ফ্যাঁত করে নাক ঝাড়লো। ও রুমালটাকে পকেটে ফেরত পাঠাবার আগে এক ঝলক উঁকি মেরে দেখে নিল যে ওর নাক থেকে ইন্টারেস্টিং কিছু বের হয়েছে কিনা।
বয়লারটা হচ্ছে গায়ে দস্তার আবরণ দেয়া আর মেরামতের নিশানাওয়ালা একটা লম্বা, সিলিন্ডার আকৃতির ধাতব ট্যাংক, যেটা চারটা সিমেন্ট ব্লকের ওপর খাড়া করানো ছিল। বয়লারটার ওপর থেকে জড়াজড়ি করে অনেকগুলো পাইপ চলে গেছে মাকড়সার জালে ঢাকা বেসমেন্ট সিলিং পর্যন্ত। জ্যাকের ডানদিকে ছিল পাশের রুমের দেয়াল ভেদ করে আসা দু’টো বড় বড় হিটিং পাইপ।
“প্রেশার মাপার মিটারটা থাকে এখানে,” ওয়াটসন বয়লারের গায়ে টোকা দিল। “প্রেশার হিসাব করা হয় পি.এস.আই. বা পাউন্ড পার স্কোয়্যার ইঞ্চিতে। আমি এখন ব্যাটাকে একশ’র কাছাকাছি রেখেছি, যার জন্যে রাতে রুমগুলোতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। কয়েকজন গেস্ট অবশ্য অভিযোগ করেছে, কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তাছাড়া এ বেচারার বয়স হয়ে গিয়েছে। এতবার সারানো হয়েছে যে এটার ভেতরে এখন ঝুরঝুরে অবস্থা।” রুমালটা আবার পকেট বেরিয়ে এল। আবার ফ্যাঁত করে শব্দ, উঁকি, তারপর আবার পকেটে ফেরত।
“কি যে বালের ঠাণ্ডা লাগল,” ওয়াটসন আলাপ জমাবার সুরে বলল। “প্রতি শীতেই আমার এমন হয়। আমার তখন কাজ থাকে হয় এই হারামজাদা বয়লারের সাথে খোঁচাখুঁচি করা নয়তো রোকে কোর্টের ঘাস কাটা। আমার মা বলতেন বাইরের বাতাসই ঠাণ্ডা লাগার সবচেয়ে বড় কারণ। উনি মারা গেছেন ছয় বছর হল, ঈশ্বর ওনার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন। ওনাকে ক্যান্সারে ধরেছিল।
“আপনার উচিত প্রেশার সবসময় পঞ্চাশ কি ষাটের ঘরে রাখা। মি: আলম্যানের খায়েশ হচ্ছে পশ্চিম উইং এ একদিন হিট দেয়া, তার পরদিন পূর্ব উইং এ আর তার পরের দিন সেন্ট্রাল উইং এ। শালা পাগল না? আমি ওই হারামজাদাকে দুই চোখে দেখতে পারি না। সারাদিন বকর বকর করে, কিন্তু শালার ঘটে এক ছটাক বুদ্ধি নেই।
এখানে দেখুন। এই রিংগুলো টানলে আপনি এই ডাক্টগুলোকে খুলতে বা বন্ধ করতে পারবেন। আপনার সুবিধার জন্য আমি সবগুলো দাগিয়ে রেখেছি। নীল দাগ যেগুলোতে আছে সেগুলো পূর্ব উইং-এর রুমগুলোর সাথে কানেকশন দেয়া। লালগুলো সেন্ট্রাল, আর হলুদগুলো পশ্চিম উইং। মনে রাখবেন, পশ্চিমদিকে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে। শীতের সময় ওই উইং এর রুমগুলোতে ঢুকলে ঠাণ্ডার ঠেলায় পাছার লোম দাঁড়িয়ে যায়। যেসব দিনে পশ্চিম উইং হিট করবেন ওই দিনগুলোতে প্রেশার আশিতে নিয়ে গেলেও অসুবিধা নেই। আমি হলে অন্তত তাই করতাম।”
“আর ওপরে যে থার্মোস্ট্যাটগুলো আছে-” জ্যাক শুরু করলো।
ওয়াটসন এতো জোরে মাথা ঝাঁকালো যে ওর চুল নেচে উঠলো। “ওগুলো শুধু দেখানোর জন্য। ওগুলোর সাথে কোন কিছুর কানেকশন দেয়া নেই। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কিছু গেস্ট আসে যারা রুমগুলোকে এত গরম করে রাখতে চায় যেন ওরা ঘরের ভেতর বসে রোদ পোহাতে এসেছে। সেই হিট তো এখান থেকেই যায়। যদিও সবসময় প্রেশারের দিকে চোখ রাখতে হয়। দেখেছেন ব্যাটা কিভাবে বাড়ার তালে থাকে?”
ওয়াটসন মেইন ডায়ালে টোকা দিল, যেটা ও কথা বলতে যেটুকু সময় নিয়েছে তার মধ্যেই একশ’ পি.এস.আই. থেকে বেড়ে একশ’ দুই ছোঁবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ করে জ্যাক কোন কারণ ছাড়াই শিউরে উঠলো। ওয়াটসন বয়লারের প্রেশার হুইল ঘোরাতে জোরে ‘হিস্’ শব্দ তুলে মেইন ডায়ালের কাঁটা আবার নিরানব্বই এ নেমে এল। ওয়াটসন ভাল্ভটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দেবার পর শব্দটা নিজের অনিচ্ছাসত্বেও কমে এল।
“ব্যাটা বাড়তেই থাকে,” ওয়াটসন বললো। “আপনি যেয়ে ওই হারামজাদা মোটকা আলম্যানকে বলবেন। ও তো কিছু বললেই হিসাবের খাতা খুলে বসে, আর তিন ঘন্টা ধরে বোঝায় যে ১৯৮২ এর আগে ও নতুন কোন বয়লার কিনতে পারবে না। আমি এখনি বলে দিচ্ছি, পুরো হোটেলটা একদিন ধসে পড়ে যাবে। আমি শুধু চাই যে মোটকা যেন তখন হোটেলের ভেতরে থাকে। ঈশ্বর, আমি যদি আমার মায়ের মত ভালো হতে পারতাম। উনি সবার মাঝে ভালো দিকটা দেখার চেষ্টা করতেন। আর আমি হয়েছি একটা গোখরা সাপের মত বদমেজাজী। কি আর করার, মানুষ তো আর স্বভাব বদলাতে পারে না।
“আপনার মনে করে প্রত্যেকদিন এখানে দিনের বেলা দু’বার করে আর রাতে ঘুমাবার আগে একবার করে আসতে হবে। প্রেশার চেক করবার কথা খেয়াল রাখবেন। যদি না রাখেন তাহলে প্রেশার আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকবে যতক্ষণ না পুরো বয়লার ফেটে গিয়ে আপনার পরিবারকে চাঁদে পাঠিয়ে দেয়। তবে যদি প্রতিদিন তিনবার এসে হুইল ঘুরিয়ে যান তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে।”
“প্রেশার সবচেয়ে বেশী কত পর্যন্ত উঠতে পারে?”
“ওহ্, প্রথমদিকে টপ লিমিট ছিল ২৫০, কিন্তু এখন তার অনেক আগেই ফাটবে। এখন ডায়ালটা যদি ১৮০ এর উপরে উঠে যায় তাহলে আপনি আমাকে ধরে বেঁধেও এখানে আনতে পারবেন না।”
“কোন অটোমেটিক শাট-ডাউনের ব্যাবস্থা নেই?”
“না, নেই। এই বয়লারটা যখন বানানো হয়েছে তখন এসব জিনিসের কেউ নামও শোনে নি। কিন্তু আপনি যদি প্রতিদিন প্রেশার চেক করেন তাহলে কোন সমস্যা হবে না। আর আলম্যানের রুটিন অনুযায়ী ডাক্টগুলো খুলতে ভুলবেন না। যদি এবারের শীতকাল খুব উষ্ণ না হয় তাহলে কোন রুমের তাপমাত্রাই পঁয়তাল্লিশের ওপর যাবে না। আর আপনি নিজের রুমের তাপমাত্রা নিজের সুবিধামত ঠিক করতে পারবেন।”
“পাইপিং এর কি অবস্থা?”
“ওটার কথাই মাত্র বলতে গিয়েছিলাম। এদিকে আসুন।”
ওরা দু’জন একটা লম্বা, চারকোণা ঘরে এসে ঢুকলো যেটাকে দেখলে মনে হয় যে মাইলের পর মাইল জুড়ে ঘরটা ছড়িয়ে আছে। ওয়াটসন একটা কর্ড ধরে টানবার পর ওদের মাথার ওপর একটা ৭৫ ওয়াটের বাল্ব দুলতে দুলতে অসুস্থ, হলুদ আলো ছড়াতে লাগল। ওদের ঠিক সামনেই ছিল এলিভেটর শ্যাফটের নিচের অংশ। ওখানে পুলির সাথে লাগানো ভারী, গ্রিজ দেয়া কেবল ঝুলছে। তার সাথে ছিল একটা ভারী, তেল চিটচিটে মোটর। ঘরটার চারদিকে খবরের কাগজে ভর্তি বাক্স রাখা ছিল। আরও কিছু কার্টন রাখা ছিল, যেগুলোর গায়ে নানাধরনের সিল মারা-‘রেকর্ড,’‘ইনভয়েস, ’ ‘রিসিট,’ ইতাদি। ঘরটা থেকে প্রাচীন, স্যাঁতস্যাঁতে একধরনেরর গন্ধ বের হচ্ছে। কয়েকটা কার্টন সময়ের ভারে ছিঁড়ে নিজেদের ভেতরের হলুদ কাগজ দেখাচ্ছিল, যেগুলোর বয়স কম করে হলেও বিশ বছর হবে। জ্যাক অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। পুরো ওভারলুক হোটেলের ইতিহাস হয়তো এই কার্টনগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে।
“এই লিফ্টটাকে চালু রাখা মহা ঝামেলার ব্যাপার,” ওয়াটসন লিফটের দিকে বুড়ো আঙুল নাচিয়ে বললো। “আমি জানি যে আলম্যানকে সরকারী লিফ্ট ইন্সপেক্টরের টেবিলের তলা দিয়ে মোটা অংকের টাকা চালান দিতে হচ্ছে যাতে এই লিফ্টটা চেক না করা হয়।”
“এখানে হচ্ছে সেন্ট্রাল পাইপিং।” ওদের দু’জনের সামনে ইনসুলেশান আর স্টিলের ব্যান্ডে মোড়া পাঁচটা পাইপ দাঁড়িয়ে ছিল। পাইপগুলো লম্বা হতে হতে ছাদের কাছাকাছি অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
ওয়াটসন মাকড়সার জালে ঢাকা একটা শেলফের দিকে ইশারা করলো। ওখানে বেশ কয়েকটা ন্যাকড়ার পাশে রাখা ছিল একতোড়া কাগজ। “এখানে পাইপিং এর সব প্ল্যানট্যান রাখা আছে,” ও বললো। “মনে হয় না আপনার পাইপে লিক হওয়া নিয়ে আপনার কোন চিন্তা করতে হবে, তবে মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় পাইপগুলো জমে যায়। যদি আপনি রাতের বেলা মাঝে মাঝে পানির কলগুলো চালু রাখেন তাহলে তা হবার কথা নয়। কিন্তু হোটেলে চারশ’র বেশি কল আছে। উপরের ওই শালা মোটকা চেঁচিয়ে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলবে যদি পানির বিলটা দেখে, তাই না?”
“আপনার কথা সম্পূর্ণ সত্য।”
ওয়াটসন প্রশংসার চোখে জ্যাকের দিকে তাকালো। “আপনি আসলেই কলেজে পড়াতেন তাই না? একদম বইয়ের ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আমার এসব শুনতে ভালোই লাগে, যদি না আবার আপনি ওই মেয়েলি আঁতেলদের মত হন। অনেকগুলো আঁতেলকে আমি চিনি যারা এরকম ন্যাকা স্বভাবের। জানেন কিছুদিন আগে যে কলেজে দাঙ্গা লাগলো তার জন্যে দায়ী কারা? এসব সমকামী আঁতেলরাই। ওরা নাকি আর সমাজের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় না, সমাজকে ওদের মেনে নিতেই হবে। দুনিয়া কোথায় যাচ্ছে, চিন্তা করে দেখেন।
দেখেন, পাইপ জমলে এখানে জমার সম্ভাবনাই বেশি। এখানে কোন তাপ এসে পৌঁছায় না। এমনিতেও আপনি অন্য পাইপগুলোর কাছে যেতে পারবেন না, তাই ওগুলো নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। এখানে আসাটা আমার একদমই পছন্দ নয়। চারদিকে মাকড়সার জালে ভরা। গা ছমছম করে।”
“আলম্যান বললো যে প্রথমে যে কেয়ারটেকার ছিল সে নাকি নিজের বৌ- বাচ্চাকে মেরে ফেলবার পর আত্মহত্যা করে।”
“হ্যা, ওই গ্রেডি লোকটা। ওকে প্রথমবার দেখেই আমি বুঝেছিলাম যে ও খুব সুবিধার লোক নয়। সবসময় শয়তানের মত দাঁত বের করে হাসি দিত। তখন হোটেলটা মাত্র আবার ব্যাবসা শুরু করেছিল, আর আলম্যান তখন টাকা বাঁচানোর জন্য কোন সন্ত্রাসীকেও কাজে নিতে রাজী ছিল। ন্যাশনাল পার্কের একজন রেঞ্জার পরে ওদের খুঁজে পায়, তখন একটা ফোনও কাজ করছিল না। ওরা সবাই চারতলার পশ্চিম উইং এ পড়ে ছিল বরফে জমে যাওয়া অবস্থায়। বাচ্চা মেয়েগুলোর জন্যে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মাত্র আট আর ছয় বছর বয়স ছিল ওদের। ফুটফুটে দু’টো বাচ্চা। ওদের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আলম্যান তো শীতকালে ফ্লোরিডায় একটা রিসর্ট চালায়। ওখান থেকে ও একটা প্লেন নিয়ে ছুটে আসে এখানে। বরফের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেখে ও স্লেজে চড়ে আসে স্লেজে, বিশ্বাস করতে পারেন? এই খবরটা পেপার থেকে দূরে রাখতে ওর কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। তবে ও ভালোই সামলেছিলো, স্বীকার করতেই হবে। শুধু ডেনভার পোস্ট কাগজে ছোট্ট করে এসেছিল খবরটা, আর এস্টেস পার্কের যে একটা নামকাওয়াস্তে পেপার আছে ওটাতে ওবিচুয়ারি ছেপেছিল, কিন্তু ওইটুকুই। এই হোটেলের এমনিতেই যে বদনাম, তাতে এ খবরটা দাবানলের মত ছড়িয়ে যাবার কথা। আমি ভেবেছিলাম কোন রিপোর্টার হয়তো এই প্রেডির অজুহাতে আবার পুরনো গুজবগুলো টেনে নিয়ে আসবে।”
“কিসের গুজব?”
ওয়াটসন কাঁধ ঝাঁকালো। “সব বড় বড় হোটেলের নামেই গুজব ছড়ায়, ও বললো। “যেমন করে সব বড় হোটেলেই ভূত দেখা যায়। কেন? একটা কারণ হচ্ছে, এখানে নানারকমের মানুষের আসা যাওয়া চলতে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রুমে আচমকা পটল তোলে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক এরকম কিছু হয়ে। হোটেলের মত কুসংস্কারাচ্ছন্ন জায়গা খুব কমই আছে। হোটেলে তের তলা বা তের নম্বর রুম থাকে না, রুমে ঢুকবার দরজার পেছনে কোন আয়না থাকে না অশুভ হবার ভয়ে। মাত্র এই গত জুলাই মাসেই এক বুড়ি মহিলা মারা যায় আমাদের হোটেলে। ওটাও আলম্যানের সামলাতে হয়েছিল, আর নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ভালোভাবেই সামলেছিল। এজন্যেই ওর বেতন প্রতি মৌসুমে বাইশহাজার ডলার, আর ওকে আমি যতই অপছন্দ করে থাকি, স্বীকার করতেই হবে যে ও টাকাটা হালাল করেই খায়। মাঝে মাঝে মনে হয় যে কিছু মানুষ এখানে ঝামেলা পাকাবার জন্যেই আসে, আর আলম্যানকে রাখা হয়েছে সেসব ঝামেলা ঠিক করবার জন্যে। একবার এক মহিলা আসে, প্রায় ষাটের মত বয়স হবে আমার সমান! সেই মহিলার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক দেয়া, কানে আর গলায় ঝলমলে গয়না আর এতো ছোট স্কার্ট পড়েছে যে কুঁচকানো চামড়াওয়ালা উরু দেখা যাচ্ছে। মহিলার সাথে আবার এক ছোকড়াও ছিল। সে ছোকড়ার চুল কোমড়ছোঁয়া আর এমন টাইট প্যান্ট পড়েছে যে ভেতরের সবকিছু বোঝা যায়। ছেলের বয়স সতের’র বেশি হবে না। ওরা হয়তো এক সপ্তাহের জন্য ছিল, বা দশদিন, আর প্রত্যেকদিন একই কাহিনী। সারাদিন ওরা কলোরাডো লাউঞ্জের বারে পড়ে থাকত। বুড়ি একটার পর একটা শট নিত মদের, আর ছেলেটা একটা বোতল নিয়ে আস্তে আস্তে সারাদিন লাগিয়ে খেত। বুড়ি মাঝে মাঝে গল্প বলতো, হাসাহাসি করতো, আর প্রত্যেকবার মহিলা হাসার পর ছেলেটাও পুতুলের মত দাঁত বের করে হাসতো, যেন মহিলা ওর সুতো ধরে টান দিয়েছে। তারপরে ওরা যেত ডিনার খেতে, ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে আর মহিলা টলতে টলতে। ছেলেটা আমাদের ওয়েইট্রেসদের সাথে ফস্টিনস্টি করতো খাবার সময় কিন্তু এগুলো মহিলার চোখেই পড়ত না। বুড়ির কতক্ষণ জ্ঞান থাকবে তা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে বাজিও ধরতাম।”
ওয়াটসন কাঁধ ঝাঁকালো।
“তারপর একদিন ছেলেটা রাত দশটার দিকে নীচে নামলো। ও এসে বলে যে ওর ‘স্ত্রী’ এখন ‘একটু অসুস্থ’, মানে বুড়ি প্রতিরাতের মত আবার বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল আরকি। ছেলেটা বললো যে ও ওষুধ কিনতে যাচ্ছে। সেই যে পোর্শেটা নিয়ে ছেলেটা বের হল, তারপর থেকে ওর আর কোন পাত্তা নেই। তার পরদিন মহিলা নীচে এসে ভাব দেখালো যেন কিছুই হয় নি, কিন্তু যত সময় যেতে লাগল ওর চেহারা আস্তে আস্তে তত ফ্যাকাশে হয়ে আসতে লাগল। একসময় আলম্যান ওকে জিজ্ঞেস করল যে পুলিশকে ফোন করা উচিত হবে কিনা, ছেলেটা হয়তো রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। শুনে বুড়ি আরেকটু হলে ওর ওপর ঝাঁপিয়েই পড়েছিল আরকি। না-না-না, ও খুব ভালো গাড়ি চালায়, কোন চিন্তা নেই, ডিনারের আগেই ও চলে আসবে। সেদিন বিকাল তিনটার দিকে মহিলা কলোরাডো বারে নেমে আসে, তারপর আর ওর ডিনার খাওয়া হয় নি। সে সাড়ে দশটার দিকে নিজের রুমে ফিরে যায়, তারপর আর কেউ তাকে জীবিত অবস্থায় দেখে নি।”
“কেন, তার কি হয়েছিল?”
“কাউন্টি করোনার বলেছিল যে মহিলা আকণ্ঠ মদের পাশাপাশি ৩০টা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। পরের দিন ওর স্বামী এসে হাজির হয়, সে আবার নিউ ইয়র্কের কোন বড় উকিল। ও তো এসেই আলম্যানের ঘুম হারাম করে ছাড়লো। এই মামলা করবো সেই মামলা করবো, সবাইকে ফকির বানিয়ে ছাড়ব এসব কথা। কিন্তু আলম্যানও চালু মাল। ও কিছুকক্ষণের মধ্যে উকিলকে ঠাণ্ডা করল, সম্ভবত এটা বলে যে জিনিসটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ওর বউয়েরও বদনাম হবে। সব খবরের কাগজে আসবে যে ‘প্রখ্যাত উকিলের স্ত্রী’র ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা’ হ্যান ত্যান আরও অনেক কিছু।
“পুলিশ পরে পোর্শেটাকে লিয়ন্সের কাছে একটা খাবারের দোকানে খুঁজে পায়। আলম্যান কিছু গুটি চেলে গাড়িটাকে আবার উকিলের কাছে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করে। তারপর ওরা দু’জন মিলে কাউন্টি করোনার আর্চার হটনের ওপর চড়াও হয়। ওরা আগের রিপোর্ট বদলি নতুন করে লেখায় যে আসলে অসুখের কারণে মৃত্যু ঘটে। হার্ট অ্যাটাক। আর্চার এখন একটা দামী ক্রাইসলার গাড়ি চালায়। আমি ওকে দোষ দেই না। যেটাতে লাভ হয় মানুষের সেটাই করা উচিত। বিশেষ করে বুড়ো বয়সে।”
রুমালটা আবার দেখা দিলো। ফ্যাঁত। উঁকি। পকেটে চালান।
“শেষে কি হল? এক সপ্তাহ পরে এক বেয়াক্কেল কাজের মেয়ে, ডেলোরেস ভিকি তার নাম, ওই রুমটা গোছাতে গিয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফিরে আসে ও বলে যে ও বাথরুমে এক মহিলার লাশ দেখেছে, বাথটাবে শোয়ানো। লাশটার চেহারা নীল হয়ে ফুলে গিয়েছিল’ কাজের মেয়েটা বলে, ‘আর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছিল।’ এটা শুনবার দুই সপ্তাহের মধ্যে আলম্যান ওকে বরখাস্ত করে দেয়। আমার ধারণা আমার দাদা ১৯১০ এ হোটেলটা খোলার পর প্রায় ৫০-৮০ জন মানুষ মারা গেছে এখানে!”
ও ধৃতচোখে জ্যাকের দিকে তাকালো।
“জানেন বেশিরভাগ মরে কিভাবে? যেসব মেয়েকে ওরা সাথে নিয়ে আসে তাদের সাথে রঙ্গলীলা করতে করতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে। এধরণের রিসর্টে এসব মানুষই বেশি আসে, যারা বুড়ো বয়সে শেষ একবার যৌবনের আনন্দ উপভোগ করতে চায়। মাঝে মাঝে এসব খবর ফাঁস হয়ে যায়, সব ম্যানেজার তো আর আলম্যানের মত পাকা নয়। তাই ওভারলুকের ভালোই বদনাম আছে। বদনাম দুনিয়ার সব হোটেলেরই আছে।”
“কিন্তু কোন ভূতটুত নেই তো?”
“মি: টরেন্স, আমি এখানে সারাজীবন ধরে কাজ করছি। আপনার বাচ্চার যে বয়স দেখলাম আপনার ওই ছবিটায় আমি সে বয়স থেকে এখানে খেলি। আমি এখনও কোন ভূত দেখি নি। আপনি যদি আমার সাথে আসেন তাহলে আপনাকে এখন আমি সরঞ্জাম রাখার ঘরটা দেখাতে নিয়ে যাব।”
“ঠিক আছে।”
ওয়াটসন হাত বাড়িয়ে লাইটটা বন্ধ করবার সময় জ্যাক বলে উঠল, “এখানে অনেক কাগজ জমিয়ে রাখা দেখছি।”
“ঠিকই বলেছেন। দেখে মনে হয় গত এক হাজার বছরের পেপার এখানে ফেলে রাখা। খবরের কাগজ, হিসাবের দলিল আরও কত কি ঈশ্বরই জানেন। আমার বাবার ভালো জানা ছিল এখানের কোন কাগজ কিসের জন্য, কিন্তু এখন আর কেউ খবর রাখে না। আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে পুরো স্তুপটাকেই পুড়িয়ে ফেলব। যদি আলম্যান চেঁচামেচি না করে। করবে না, আমি যদি ওকে এটা বলে ভয় দেখাই যে এখানে ইঁদুর থাকতে পারে।”
“তাহলে ইঁদুরের সমস্যা আসলেই আছে?”
“কয়েকটা তো আছে বলেই মনে হয়। আলম্যান আপনাকে যে ইঁদুর মারার ফাঁদ আর বিষের কথা বলেছে ওগুলো আমার কাছে আছে। আপনার ছেলের কাছ থেকে জিনিসগুলো সরিয়ে রাখবেন মি: টরেন্স। আপনি নিশ্চয়ই চান না যে ওর কিছু হোক।”
“অবশ্যই নয়।” ওয়াটসনের মুখে উপদেশটা বন্ধুত্বপূর্ণই শোনাল।
ওদের সিঁড়ির কাছে গিয়ে একটু থামতে হল। ওয়াটসনের আবার নাক ঝাড়তে হবে।
“আপনি দরকারী-অদরকারী সবধরণের সরঞ্জামই ইকুইপমেন্ট শেডে পাবেন। আর ছাদের টালির ব্যাপারটাও আছে। আলম্যান কি আপনাকে বলেছে?”
“হ্যা, ও পশ্চিমের ছাদের একটা অংশতে নতুন করে টালি লাগাতে চায়।”
“ওই মোটকা শুওরটা আপনার কাছ থেকে যতটুকু পারে মাগনা কাজ আদায় করে নিতে চায়। আবার গ্রীষ্মকাল আসলে আপনাকে বলবে যে কোনকিছুই ঠিকমত করা হয় নি। একবার তো আমি ওর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম…”
ওয়াটসন আনমনে বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। জ্যাক ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে রুমটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, যদি পৃথীবির কোথাও ভূত থেকে থাকে তাহলে এখানেই থাকবে। ওর মনে আবার বিশ্রী, পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঈশ্বর, জ্যাক টরেন্স মনে মনে বললো, এখন এক গ্লাস মদ পেলে মন্দ হোত না। অথবা একশ’ গ্লাস।
অধ্যায় ৪ – ছায়াভূবন
ড্যানি ওর দুধ আর বিস্কিট খেতে গেল সোয়া চারটার দিকে। ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেই খাবার শেষ করলো, তারপর এসে ওর মাকে চুমু দিল, যে ঘুমাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। মা বললো ভেতরে বসে টিভি দেখতে দেখতে অপক্ষা করতে, তাহলে তাড়াতাড়ি সময় কাটবে-কিন্তু ড্যানি দ্রুত মাথা নেড়ে আবার উঠানে যেয়ে বসলো।
প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। যদিও ড্যানির কাছে ঘড়ি নেই, আর ও এখনও ঘড়ি ঠিকভাবে দেখতে পারে না, ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে ও ঠিকই বুঝতে পারে কি সময় হয়েছে।
ও নিজের গ্লাইডারটা হাতে নিয়ে নীচু স্বরে একটা ছড়াগান গাইতে লাগলো। ওরা স্টভিংটনে থাকতে ড্যানি যে স্কুলটায় পড়ত, জ্যাক এন্ড জিল নার্সারি স্কুল, সেখানে সবাই একসাথে এ গানটা গেত। এখানে আসার পর ওর আর স্কুলে যাওয়া হয় না কারণ বাবার নাকি এখন টাকার টানাটানি চলছে। ও জানতো যে এটা নিয়ে ওর বাবা আর মা খুব চিন্তিত। ওরা মনে করে যে এই কারণে ড্যানির একাকীত্ব আরও বাড়ছে (আর মনে করে যে ড্যানি এর জন্যে ওদের দোষ দেয়), কিন্তু সত্যি কথা বলতে ড্যানির আর জ্যাক এন্ড জিল স্কুলে যাবার বেশি ইচ্ছা নেই। ওটা বাচ্চাদের স্কুল। ও এখনও ঠিক বড় হয় নি, কিন্তু ও এখন আর বাচ্চাও নেই। বড় ছেলেরা বড়দের স্কুলে যায় আর ওখানেই লাঞ্চ খায়। আম্মু এসে খাইয়ে দেয় না। ফার্স্ট গ্রেড। আগামী বছর। এই বছরটা বাচ্চা আর বড়’র মাঝামাঝি সময়। ড্যানির তাতে কোন আসুবিধা নেই। মাঝে মাঝে ওর অ্যান্ডি আর স্কটের কথা মনে পড়ে-স্কটের কথাই বেশি- কিন্তু ড্যানির তাতেও তেমন সমস্যা নেই। সামনে যা হবে তার জন্যে একা একা অপেক্ষা করাই ওর কাছে সবচেয়ে ভালো বলে মনে হয়।
ড্যানি ওর বাবা মা’র ব্যাপারে অনেক কথাই বুঝতে পারে। ও এটাও বুঝতে পারে যে মাঝে মাঝে ওর বাবা মা এটা পছন্দ করে না, আর মাঝে মাঝে ওরা এটা বিশ্বাস করে না। কিন্তু একসময় তো ওদের বিশ্বাস করতেই হবে, আর ড্যানির অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই।
মাঝে মাঝে অবশ্য ড্যানির মনে হয় যে বাবা মা ওকে আর একটু বিশ্বাস করলে ভালো হত, যেমন আজকে। মা অ্যাপার্টমেন্টের বিছানায় শুয়ে বাবা’র চিন্তায় প্রায় কেঁদে দিচ্ছিল। মা যে জিনিসগুলো নিয়ে মন খারাপ করছিল তাদের মাঝে কয়েকটা ড্যানির বুঝবার ক্ষমতার বাইরে, যেমন পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বাবার রাগ আর অপরাধবোধ আর ভবিষ্যতে ওদের কি হবে এসব জিনিস। তবে মায়ের সবথেকে বেশি চিন্তা হচ্ছে দু’টো কথা ভেবে। একটা হচ্ছে যে বাবা হয়তো পাহাড় থেকে নামবার সময় কোন দূর্ঘটনায় পড়েছে, আর একটা হচ্ছে বাবা হয়তো আবার খারাপ কাজটা করছে। ড্যানি খুব ভালো করেই জানতো খারাপ কাজটা কি। স্কটি অ্যান্ডারসন, যে ওর চেয়ে ছয় মাসের বড়, ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে। স্কটি জানতো কারণ ওর বাবাও একসময় খারাপ কাজটা করতো। স্কটি বলেছিল যে একবার ওর বাবা ওর মার চোখে ঘুষি মেরে মাকে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর স্কটির বাবা-মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। ড্যানির জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দ হচ্ছে ওটা, ডিভোর্স। ওর মাথায় শব্দটা সবসময় ভেসে ওঠে রক্তের মত লাল অক্ষরে, আর শব্দটার চারপাশে জড়িয়ে থাকে বিষাক্ত সাপ। ডিভোর্স হলে তোমার বাবা আর মা আর একসাথে থাকবে না। তুমি কার সাথে থাকবে তা নিয়ে ওদের মধ্যে কোর্টে অনেক বড় তর্ক হবে (কোন কোর্ট? টেনিস কোর্ট, ব্যাডমিন্টন কোর্ট? স্টভিংটনে থাকতে বাবা-মা দু’টোই খেলত, তাই ড্যানি নিশ্চিত হতে পারছিল না) এরপর তোমার যে কোন একজনের সাথে যেতে হবে, বাবা নয়তো মা, আর অন্যজনের সাথে হয়তো তোমার আর কখনও দেখাই হবে না। ডিভোর্সের ব্যাপারে সবচেয়ে বিপজ্জনক জিনিসটা হচ্ছে যে ড্যানি ওর বাবা মার মনে এই শব্দটা প্রায়ই ঘুরপাক খেতে দেখেছে। কখনও কখনও ছায়ার মত আবছাভাবে, আবার কখনও কখনও মেঘলা আকাশের মত প্রকট। ও বাবার কাগজপত্র এলোমেলো করবার পর বাবা যখন ওর হাত ভেঙ্গে ফেলে তখন শব্দটার আনাগোনা সবচেয়ে বেড়ে গিয়েছিল। বাবা-মা দু’জনের মনেই তখন শব্দটা ঘোরাফেরা করছিল, বিশেষ করে আম্মুর। ড্যানি তখন কথাটা পরিষ্কার শুনতে পেত, একঘেয়ে, বেসুরো একটা গানের মত। আম্মু সারাদিন ভাবত বাবা কিভাবে ওর হাত ভেঙ্গে ফেলেছে, বা স্কুলের ছেলেটাকে কিভাবে মেরেছে। বাবা ভাবত যে সে না থাকলেই হয়তো মা আর ড্যানি ভালো থাকবে। বাবা তখন সবসময়ই খুব কষ্টের মাঝে থাকতো, আর খারাপ কাজটার কথা চিন্তা করতো। বাবা চাইতো কোন অন্ধকার জায়গায় যেয়ে টিভি দেখতে দেখতে খারাপ কাজটা করতে যতক্ষণ না বাবার মাথা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
কিন্তু আজকে বিকালে আম্মুর সে কথা ভেবে মন খারাপ করবার কোন দরকার ছিল না। ড্যানির ইচ্ছা হচ্ছে ওপরে যেয়ে আম্মুকে এ কথাটা বলতে। রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা হয় নি, বাবাও কোথাও যেয়ে খারাপ কাজটা করছে না। বাবা এখন ফিরে আসছে। ড্যানি দেখতে পাচ্ছিল যে বাবার গাড়িটা লিওন্স আর বোল্ডারের মাঝে একটা রাস্তায় ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওদের বাড়ির দিকে। বাবা খারাপ কাজটার কথা ভাবছে না। বাবা ভাবছে… ভাবছে…
ড্যানি চোখ কুঁচকে উপরদিকে তাকালো। মাঝে মাঝে ও খুব জোর দিয়ে কিছু চিন্তা করলে ওর অসুবিধা হয়। একদিন এমন হয়েছে যে ও ডিনার টেবিলে বসে বাবা-মায়ের সাথে রাতের খাবার খাচ্ছে, এমন সময় একজনের মনে ডিভোর্স কথাটা ভেসে উঠলো। ড্যানি তখন প্রচণ্ড মনোযোগ দিয়ে বের করার চেষ্টা করছিল যে কে ভাবছে কথাটা। হঠাৎ ওর কি যেন হয়। কিছুক্ষণ পর ও উঠে দেখতে পায় যে মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বাবা ব্যস্ত হয়ে কাকে যেন ফোন করছে। সেদিন ড্যানি ভয় পেয়েছিল। পরে ও বাবা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ওর আসলে কিছু হয় নি, ও কোনকিছুতে খুব মনোযোগ দিলে ওর সাথে এমন হয়। সেদিনই প্রথম ড্যানি ওদের টনির ব্যাপারে বলে, ওর অদৃশ্য খেলার সাথী I
বাবা বলেছিলেন যে ড্যানির বোধহয় হ্যা-লু-সি-নেশান হয়েছে। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেদিনের পর মা ড্যানিকে কথা দিতে বলে যে ওর আর এমনভাবে আব্বু-আম্মুকে ভয় দেখাবে না। ড্যানি তাতে রাজী হয়। সেদিন যা হয়েছিল তা ড্যানির নিজেরও ভালো লাগেনি। ও বাবার মনের কথা পড়বার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। জ্ঞান হারানোর আগে ও বাবার মনের গভীরে যেতে পেরেছিল, আর সেখানে ও ডিভোর্স এর চেয়েও রহস্যময়, ভয়ংকর একটা শব্দ দেখতে পায় : আত্মহত্যা। এরপরে ড্যানি আর কখনও বাবার মনে ওই শব্দটা দেখতে পায় নি, আর দেখতে চায়ও নি। ও শব্দটার মানে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটা বুঝেছিল যে ওটা খুব খারাপ একটা শব্দ।
তবে মাঝে মাঝে ও তীর মনোযোগ দিতে পছন্দ করে, কারণ এরকম করলে টনি আসে ওর সাথে দেখা করবার জন্যে। সবসময় নয়, বেশিরভাগ সময়ই ড্যানি শুধু কিছুক্ষণ ঝাপসা দেখে তারপর আবার সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে ওর চোখের একদম কোণায় টনি দেখা দেয়, আর ওর গলা ভেসে আসে দূর থেকে…
বোল্ডারে আসার পর এরকম দু’বার হয়েছে। ড্যানির এটা দেখে ভালো লেগেছে যে টনি ওর পিছে পিছে ভারমন্ট থেকে এখনে চলে এসেছে। তারমানে ওর সব বন্ধু ওকে ছেড়ে চলে যায়নি।
প্রথমবার যখন টনি আসে তখন তেমন কিছুই হয় নি। ড্যানি শুধু ঝাপসা দেখা শুরু করেছিল আর তারপর টনি ওর নাম ধরে ডাকে, ব্যস এই। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন ও আসে তখন ও ড্যানিকে ক্ষীণ স্বরে ডেকে নিয়ে যায় : “ড্যানি…দেখে যাও…” ড্যানির তারপর মনে হয় যে ও একটা গভীর গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তার পরমুহূর্তেই ও দেখে যে ও নিজের বাসার বেসেমেন্টে দাঁড়িয়ে আছে, আর টনি আঙুল দিয়ে একটা বাক্সের দিকে ইশারা করছে যেখানে বাবার সব জরুরি কাগজপত্র থাকে, বিশেষ করে বাবার ‘নাটক’।
“দেখতে পাচ্ছো?” টনি বলে ওর দূর থেকে ভেসে আসা, সুরেলা গলায়। “জিনিসটা সিঁড়ির নীচে রাখা… ঠিক সিঁড়ির নীচেই।” ড্যানি সামনে ঝুঁকে দেখতে চাচ্ছিল টনি কিসের কথা বলছে, কিন্তু ওর আবার পড়ে যাবার মত একটা অনুভূতি হয়। পরমুহূর্তেই ও দেখতে পায় যে ও উঠানের দোলনাটা থেকে পড়ে গেছে, যেখানে ও টনি আসার আগে বসে ছিল। ড্যানির ভালো করেই মনে আছে যে পড়ে ও বেশ ব্যাথাও পেয়েছিল।
তিন চার দিন পর বাবা রাগ করে সারা ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, আর মাকে বলছিল যে কিছুতেই সে ট্রাংকটা খুঁজে পাচ্ছে না যেটার ভেতর নাটকের পাণ্ডুলিপিটা রাখা আছে। ড্যানি তখন বাবাকে বলে : “বাবা, সিঁড়ির নীচে খুঁজলে তুমি জিনিসটা পেয়ে যাবে।”
বাবা ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে তারপর নীচে দেখতে যায়। ট্রাংকটা ওখানেই ছিল, ঠিক যেখানে টনি বলেছিল যে থাকবে। এরপর বাবা ওকে কোলের ওপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ওকে কে বেসমেন্টে আসতে দিয়েছে? উপরতলার টমি? বাবা এটা জানতে চাচ্ছিল কারণ একা একা নীচে আসা খুব বিপজ্জনক। বাবা এটাতে খুশি হয়েছে যে ড্যানি ওকে নাটকটা খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছে, কিন্তু তার জন্যে ড্যানির এত বড় ঝুঁকি নেয়া উচিত হয় নি। বাবা খুব মন খারাপ করবে যদি ড্যানি সিঁড়ি থেকে পড়ে নিজের…নিজের পা ভেঙ্গে ফেলে। বেসমেন্টের দরজাটা একবারও খোলা হয় নি, আর মাও এ কথাটার সাথে একমত হল। ড্যানি কখনও নীচে যায় না, মা বলল, কারণ জায়গাটা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে আর মাকড়সায় ভরা। আর ড্যানি কখনও মিথ্যা কথাও বলে না।
“তাহলে তুমি জানলে কিভাবে, ডক?” বাবা জিজ্ঞেস করেছিল।
“টনি আমাকে বলেছে।”
বাবা আর মা দ্রুত একজন আরেকজনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। ওরা এরকম কথা আগেও শুনেছিল, কিন্তু কখনওই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চায়নি। তার একটা কারণ হচ্ছে এটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে ওরা ভয় পায়। বিশেষ করে আম্মু। কিন্তু এখন আম্মু বাসার ভেতর ঘুমিয়ে আছে, ড্যানিকে দেখতে পাচ্ছে না। তাই ড্যানি গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল যে বাবা কি নিয়ে চিন্তা করছে।
ওর ছোট্ট হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল। ওর চোখ বন্ধ করবার দরকার ছিল না, কিন্তু প্রচণ্ড মনোযোগের কারণে ওর চোখদুটো এমনিতেই ছোট হয়ে আসলো। ও কল্পনা করার চেষ্টা করল বাবার গলা, জ্যাক ড্যানিয়েল টরেন্সের গলা, গলাটা একবার হাসছে, আবার রাগে বা দুঃখে ভারী হয়ে আসছে, আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে কারণ বাবা চিন্তা করছে একটা কথা…চিন্তা করছে…চিন্তা করছে…
(চিন্তা)
ড্যানি আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীর এলিয়ে দিল। ও এখনও পুরোপুরি সজ্ঞানে আছে। ও সামনের রাস্তা দেখতে পাচ্ছে, রাস্তায় হাত ধরাধরি করে যে ছেলে আর মেয়েটা যাচ্ছে তাদের দেখতে পাচ্ছে। ওরা একজন আরেকজনকে
(ভালোবাসে?)
ওরা দু’জনই আজকের দিনটার কথা ভাবছে, ভাবছে সারাদিন একসাথে কাটানোটা কত আনন্দময় ছিল। ওরা একটা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, যেটার ছাদ ঢাকা ছিল
(টালি দিয়ে, তাই না? সম্ভবত খুব বেশি ঝামেলা হবে না হোটেলের ছাদের টালি বদলাতে। ওয়াটসন একটা মজার লোক। ওকে ‘নাটকে’ ঢুকাতে পারলে খারাপ হয় না। আমি তো পারলে সবাইকেই ওখানে ঢুকিয়ে দেই। আচ্ছা, টালি। হোটেলে কি পেরেক পাওয়া যাবে? ধুর জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। অবশ্য পেরেক কিনে নিতে তেমন কোন অসুবিধা নেই। ছাদে বোলতার বাসা থাকতে পারে, তাই না? আমার বোলতা মারার জন্যে যে কীটনাশক বোমা পাওয়া যায় ওগুলো কিনতে হবে। নতুন টালি, পুরনো)
টালি। তাহলে বাবা এই জিনিসটা নিয়ে চিন্তা করছে। ড্যানি জানে না ওয়াটসন কে, কিন্তু বাকি কথাগুলো বুঝতে ওর তেমন অসুবিধা হল না। ও এটা ভেবে মজা পেল যে ও হয়তো একটা বোলতার চাক দেখতে পাবে।
“ড্যানিইইই…ড্যানিইইই…’
ড্যানি মাথা তুলে দেখতে পেল যে টনি রাস্তার ওপারে একটা স্টপ সাইনের কাছে দাঁড়িয়ে ওর দিকে হাত নাড়ছে। ওকে দেখে ড্যানির মন খুশিতে ভরে গেল, কিন্তু খুশির অন্তরালে কেন যেন ড্যানির একটু ভয় ভয় লাগছিল। টনিকে দেখে মনে হচ্ছে যে ওকে গভীর অন্ধকার ঘিরে আছে।
কিন্তু টনি ডাকলে ওর না যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ড্যানির শরীর আরও শিথীল হয়ে এল। ওর হাত দু’টো ওর দু’পাশে ঝুলতে লাগল, আর থুতনি ওর বুকের কাছে নেমে এল। তারপর ও অনুভব করল যেন ওর মনের একটা অংশ শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল টনির দিকে।
“ড্যানিইইই…”
টনির চারপাশের অন্ধকারে এখন সাদা আলোর ফোটা দেখা দিতে লাগলো। কাশি দেবার মত একটা শব্দ হয়ে অন্ধকারটা রাতের আকাশ আর লম্বা গাছের আকৃতি নিল। ওদের চারপাশ এখন সাদা বরফে ঢাকা।
“এত গভীর,” টনি অন্ধকারের ভেতর থেকে বলল, আর ওর গলায় এমন একটা দুঃখের ছোঁয়া জড়িয়ে ছিল যে ড্যানি ভয় পেয়ে গেল। “এত গভীর যে বের হওয়া সম্ভব নয়।”
আরেকটা আকৃতি দেখা দিল। বিশাল, চারকোণা আর ভীতিপ্রদ। একটা ঢালু ছাদ। অন্ধকারের ঝড়ে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাদা আলো। একটা টালিতে ঢাকা ছাদ। তার মধ্যে কিছু টালি অন্যগুলোর থেকে বেশি উজ্জ্বল, নতুন। ওর বাবা এই নতুন টালিগুলো লাগিয়েছে। সাইডওয়াইন্ডার শহর থেকে কেনা পেরেক দিয়ে লাগানো। এখন টালিগুলোও বরফে ঢেকে গিয়েছিল। বরফ সবকিছুকেই গ্রাস করে নিয়েছে।
একটা অশুভ সবুজ আলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠলো বিল্ডিংটার সামনে। আলোটা কয়েকবার কেঁপে উঠলো, তারপর একটা বিশাল খুলির রুপ ধারণ করলো, যার নীচে আড়াআড়ি করে দু’টো হাড় রাখা।
“বিষাক্ত,” টনি আবার অন্ধকার থেকে বলে উঠলো। “বিষাক্ত।”
ড্যানি ওর চোখের কোণা দিয়ে আরও কয়েকটা সাইন দেখতে পেল। “বিপদ!”
“হাই ভোল্টেজ।”
“দূরে থাকুন।”
“সাবধান!” ও কোনটাই পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না-ও এখনও লেখা পড়তে পারে না-কিন্তু ও অনুভব করছিল যে সবগুলো সাইনই ওকে কোন কিছুর ব্যাপারে সতর্ক করবার চেষ্টা করছে। ড্যানির ভেতর আস্তে আস্তে একটা নিস্তেজ, স্যাঁতস্যাঁতে আতংক প্রবেশ করল।
সাইনগুলো মিলিয়ে গেল। এখন ওরা দু’জন অদ্ভুত আসবাবপত্রে ভরা একটা রুমে দাঁড়িয়ে আছে। একটা অন্ধকার রুম যেটার জানালায় তুষার পড়ছে। ড্যানি অনুভব করছিল যে ওর গলা শুকিয়ে খটখট করছে, আর ওর বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। বাইরে বুম বুম করে একটা জোরালো শব্দ হচ্ছিল। দরজায় জোরে ধাক্কা দেবার মত। পায়ের আওয়াজ হল। ঘড়টার ওপাশে একটা আয়না দাঁড়া করানো ছিল, আর সেই আয়নার গভীরে সবুজ আগুন দিয়ে লেখা একটা শব্দ আস্তে আস্তে ফুটে উঠল : রেডরাম।
ঘরটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। এখন আরেকটা ঘর। ও চেনে (বা চিনবে) এই ঘরটাকে। একটা উলটানো চেয়ার। একটা ভাঙ্গা জানালা যেটা দিয়ে ঘরের ভেতর তুষার ঢুকে কার্পেটটাকে জমিয়ে দিয়েছে। জানালার পর্দা ঝুলিয়ে রাখবার রডটা ভেঙ্গে একপাশে ঝুলছে। একটা ক্যাবিনেট উলটিয়ে পড়ে আছে।
আবার বুম বুম শব্দ। একটানা, ছন্দময়, ভয়ংকর। কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ। মৃত্যু ধেয়ে আসছে ওর দিকে! একটা খসখসে গলা, উন্মত্ত গলা শুনতে পাওয়া গেল। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, ড্যানি গলাটাকে চেনে!
বেরিয়ে আয়! বেরিয়ে আয়, বজ্জাত ছেলে! তোকে আজ আমি মজা বুঝিয়ে ছাড়ব!
প্রচণ্ড জোরে কিছু ভাঙ্গার শব্দ। কাঠ চিরে দু’ফাঁক হয়ে গেল। রাগ আর তৃপ্তির চিৎকার। রেডরাম। আসছে।
ড্যানি রুমের চারপাশে দেখল। দেয়াল থেকে ছেঁড়া ছবি ঝুলছে। একপাশে একটা রেকর্ড প্লেয়ার। (? আম্মুর রেকর্ড প্লেয়ার!)
রেকর্ডগুলো মাটিতে ছড়ানো ছেটানো অবস্থায় পড়ে আছে। পাশের বাথরুম থেকে একটুকরো আলো আসছিল। বাথরুমের ভেতরের আয়নায় নিয়ন লাইটের একটা লাল শব্দ জ্বলছে আর নিভছে : রেডরাম, রেডরাম, রেডরাম…
“না,” ড্যানি ফিসফিস করে বলল। “না, টনি প্লিজ…
আর, বাথটাবের একপাশ থেকে একটা হাত ঝুলছে। একফোঁটা রক্ত (রেডরাম) হাতটার তালু থেকে গড়িয়ে এসে মাটিতে পড়ল। ড্যানি দেখতে পেল যে হাতটার নখগুলো সুন্দর করে কাটা…
না, না, না, ওহ্ না-
(প্লিজ টনি, আমার ভয় লাগছে)
রেডরাম, রেডরাম, রেডরাম
(বন্ধ কর টনি, এক্ষনি )
আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ছবিটা।
অন্ধকারে বুম বুম শব্দটা আবার হতে লাগল, জোরে, আরও জোরে, একসময় মনে হল শব্দটা চারদিক থেকেই আসছে।
এখন ও একটা কার্পেটের ওপর নীচু হয়ে বসে আছে। কার্পেটটার গায়ে অন্ধকার, বিভীষিকাময় আকৃতি খেলা করছিল। এখন ওর দিকে একটা ছায়া এগিয়ে আসছে। ছায়াটার শরীরে রক্ত আর মৃত্যুর গন্ধ। ওটার হাতে একটা বিশাল হাতুড়ি, যেটা দিয়ে ও আশেপাশের সবকিছুতে বাড়ি মারছে। বাড়ি মেরে ছায়াটা দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসিয়ে দিল, পর্দা ছিঁড়ে ফেলল আর দরজা ভেঙ্গে ফেলল :
বেরিয়ে আয় শয়তান! সাহস থাকলে বেরিয়ে আয়! আজ মজা দেখাব তোকে!
ছায়াটা ওর দিকে আরও এগিয়ে এল। ড্যানি অন্ধকারে ছোট্ট, লাল দু’টো চোখ দেখতে পেল। পিশাচটা ওকে খুঁজে পেয়েছে! ওর যাবার আর কোন জায়গা নেই। এমনকি ছাদে যাবার গুপ্তদরজাটাও বন্ধ।
অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার।
“টনি, প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ…”
তারপরই একঝটকায় ড্যানি ফেরত চলে এল ওর নিজের উঠানে। ও অনুভব করল যে ওর শার্ট ভিজে গিয়েছে ঘামে। ভয়ংকর বুম বুম শব্দটা এখনও ওর কানে বেজে উঠছিল। ড্যানির প্যান্ট থেকে পেশাবের গন্ধ ভেসে এল। প্রচণ্ড ভয়ে কোন ফাঁকে এটা হয়ে গিয়েছে ও নিজেও জানে না। ওর চোখে এখনও বাথটাবের পাশে ঝুলতে থাকা রক্তাক্ত হাতটা ভাসছিল, আর একটা শব্দ বারবার এসে হানা দিচ্ছিল ওর মনে, রেডরাম।
কিন্তু এখন চারদিকে আলো ফুটে উঠেছে। ও বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে। আশেপাশের সবকিছুই সত্যিকারের, শুধু টনি বাদে। ও এখন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ওখান থেকে টনির সুরেলা গলা ভেসে এল :
“সাবধানে থেকো, ডক…”
তারপর মুহূর্তেই টনি মিলিয়ে গেল, আর বাবার লক্কড়ঝক্কড় লাল গাড়িটা দেখা দিল। ড্যানি এক লাফে উঠে দাঁড়াল। হাত নাড়াতে নাড়াতে ও দৌড়ে এগিয়ে ডাকল : “বাবা! বাবা!”
বাবা এসে গাড়িটা ঘুরিয়ে বাসার সামনে রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করল। ড্যানি দৌড়ে বাবার কাছে যেয়ে থমকে দাঁড়াল। ওর সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গাড়িতে বাবার পাশের সীটে একটা বিশাল হাতুড়ি রাখা। হাতুড়িটার মাথায় চুল আর রক্ত লেগে রয়েছে।
পরমুহূর্তেই ওটা বদলে গিয়ে একটা বাজারের ব্যাগ হয়ে গেল।
“ড্যানি…তুই ঠিক আছিস, ডক?”
“হ্যা, আমি ঠিকই আছি। ড্যানি বাবার জীন্সের জ্যাকেটে মুখ ডুবিয়ে বাবাকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল। জ্যাকও একটু অবাক হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।
“তোর এভাবে রোদের মধ্যে বসে থাকা ঠিক হয় নি ডক। ঘামে একদম ভিজে গিয়েছিস।”
“আমি বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“আমিও অপেক্ষা করছিলাম তোকে আবার কখন দেখবো তার জন্যে। আমি বাজার থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে এসেছি। তোর শরীরে কি এগুলো বয়ে নিয়ে যাবার মত শক্তি আছে?”
“তুমি শুধু দেখো!”
“ডক টরেন্স, তুমি তো সুপারম্যান হয়ে যাচ্ছো,” কথাটা বলে জ্যাক ড্যানির চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
ততক্ষণে মাও নীচে নেমে এসেছে। বাবা এগিয়ে যেয়ে মাকে চুমু দিল। ওদের চারপাশেও ভালোবাসা খেলা করছিল, ঠিক বিকালে দেখা ছেলে আর মেয়েটার মত। ড্যানি মনে মনে খুশি হল।
সবকিছু ঠিকই আছে। বাবা বাসায় চলে এসেছে। মা এখনও বাবাকে ভালোবাসে। কোন খারাপ কিছু হয় নি। আর টনি ওকে যা দেখায় তা সবসময় সত্যি হয় না।
কিন্তু ওর মনের এক কোণায় ভয়টা তখনও লুকিয়ে ছিল। ও আয়নায় যে শব্দটা দেখেছে তার মানে কি?