শকুন্তলা – ৭

সপ্তম পরিচ্ছেদ

রাজা, দানবজয়কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া, দেবলোকে কিছু দিন অবস্থিতি করিলেন। দেবকার্য্যসমাধানের পর, মর্ত্ত্যলোকে প্রত্যাগমনকালে মাতলিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেখ, দেবরাজ আমার যে গুরুতর সৎকার করেন, আমি, আপনাকে সেই সৎকারের নিতান্ত অনুপযুক্ত জ্ঞান করিয়া, মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত হই। মাতলি কহিলেন, মহারাজ! ও সঙ্কোচ উভয় পক্ষেই সমান; আপনি দেবতাদিগের যে উপকার করেন, দেবরাজকৃত সৎকারকে তদপেক্ষা গুরুতর জ্ঞান করিয়া লজ্জিত হন; দেবরাজও স্বকৃত সৎকারকে মহারাজকৃত উপকারের নিতান্ত অনুপযুক্ত বিবেচনা করিয়া সঙ্কুচিত হন।

 ইহা শুনিয়া রাজা কহিলেন, দেবরাজসারথে! এমন কথা বলবেন না, বিদায় দিবার সময় দেবরাজ যে সৎকার করিয়া থাকেন, তাহা মাদৃশ জনের মনোরথেরও অগোচর। দেখুন, সমবেত, সর্ব্বদেব সমক্ষে, অর্দ্ধাসনে উপবেশন করাইয়া, স্বহস্তে আমার গলদেশে মন্দারমালা অর্পণ করেন। মাতলি কহিলেন, মহারাজ! আপনি, সময়ে সময়ে দানবজয় করিয়া, দেবরাজের যে মহোপকার করেন, দেবরাজকৃত সৎকারকে আমি তদপেক্ষা অধিক বোধ করি না। বিবেচনা করিতে গেলে, আজি কালি মহারাজের ভুজবলেই দেবলোেক নিরুপদ্রব রহিয়াছে। রাজা কহিলেন, আমি যে অনায়াসে দেবরাজের আদেশ সম্পন্ন করিতে পারি, সে দেবরাজেরই মহিমা; নিযুক্তেরা প্রভুর প্রভাবেই মহৎ মহৎ কর্ম্ম সকল সমাধান করিয়া উঠে; যদি সূর্য্যদেব আপন রথের অগ্রভাগে না রাখিতেন, তাহা হইলে অরুণ কি অন্ধকার দূর করিতে পারিতেন? তখন মাতলি অত্যন্ত প্রীত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! বিনয় সদ্‌গুণের শোভা সম্পাদন করে, এ কথা আপনাতেই বিলক্ষণ বর্ত্তিয়াছে।

 এইরূপ কথোপকথনে আসক্ত হইয়া, কিয়ৎ দূর আগমন করিয়া, রাজা মাতলিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, দেবরাজসারথে! ঐ যে পূর্ব্বপশ্চিমে বিস্তৃত পর্ব্বত স্বর্ণনির্মিতের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে, ও পর্ব্বতের নাম কি? মাতলি কহিলেন, মহারাজ! ও হেমকূট পর্ব্বত, কিন্নর ও অপ্সরাদিগের বাসভূমি; তপস্বীদিগের তপস্যাসিদ্ধির সর্ব্বপ্রধান স্থান; ভগবান্ কশ্যপ এ পর্ব্বতে তপস্যা করেন। তখন রাজা কহিলেন, তবে আমি ভগবানকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া যাইব; এতাদৃশ মহাত্মার নাম শ্রবণ করিয়া, বিনা প্রণাম প্রদক্ষিণ, চলিয়া যাওয়া অবিধেয়। তুমি রথ স্থির কর, আমি এই স্থানেই অবতীর্ণ হইতেছি।

 মাতলি রথ স্থির করিলেন। রাজা, রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, দেবরাজসারথে! এই পর্ব্বতের কোন অংশে ভগবানের আশ্রম? মাতলি কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষির আশ্রম অতিদূরবর্ত্তী নহে; চলুন, আমি সমভিব্যাহারে যাইতেছি। কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, এক ঋষিকুমারকে সমাগত দেখিয়া, মাতলি জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবান্ কশ্যপ এক্ষণে কি করিতেছেন? ঋষিকুমার কহিলেন, এক্ষণে তিনি নিজপত্নী অদিতিকে ও অন্যান্য ঋষিপত্নীদিগকে পতিব্রতাধর্ম্ম শ্রবণ করাইতেছেন। তখন রাজা কহিলেন, তবে আমি এখন তাঁহার নিকটে যাইব না। মাতলি কহিলেন, মহারাজ! আপনি, এই অশোকবৃক্ষমূলে অবস্থিত হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি মহর্ষির নিকট আপনকার আগমনসংবাদ নিবেদন করি। এই বলিয়া মাতলি প্রস্থান করিলেন।

 রাজার দক্ষিণ বাহু স্পন্দিত হইতে লাগিল। তখন তিনি নিজ হস্তকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে হস্ত! আমি যখন নিতান্ত বিচেতন হইয়া, প্রিয়াকে পরিত্যাগ করিয়াছি, তখন আর আমার অভীষ্টলাভের প্রত্যাশা নাই; তবে তুমি কি নিমিত্ত বৃথা স্পন্দিত হইতেছ? রাজা মনে মনে এই আক্ষেপ করিতেছেন, এমন সময়ে, বৎস! এত উদ্ধত হও কেন, এই শব্দ রাজার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল; রাজা শ্রবণ করিয়া মনে মনে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন, এ অবিনয়ের স্থান নহে; এখানে যাবতীয় জীব জন্তু স্থানমাহাত্ম্যে হিংসা, দ্বেষ, মদ, মাৎসর্য্য প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়া, পরস্পর সৌহার্দ্দে কালযাপন করে, কেহ কাহারও প্রতি অত্যাচার বা অনুচিত ব্যাবহার করে না; এমন স্থানে কে ঔদ্ধত্যপ্রকাশ করিতেছে? যাহা হউক, এ বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে হইল।

 এইরূপ কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া, রাজা শব্দানুসারে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, এক অতি অল্পবয়স্ক শিশু, সিংহশিশুর কেশর আকর্ষণ করিয়া, অত্যন্ত উৎপীড়ন করিতেছে, দুই তাপসী সমীপে দণ্ডায়মান আছেন। দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া রাজা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, তপোবনের কি অনির্বচনীয় মহিমা! মানবশিশু সিংহশিশুর উপর অত্যাচার করিতেছে, সিংহশিশু অবিকৃত চিত্তে সেই অত্যাচার সহ্য করিতেছে। অনন্তর, কিঞ্চিৎ নিকটবর্ত্তী হইয়া, সেই শিশুকে নিরীক্ষণ করিয়া, স্নেহরসপরিপূর্ণ চিত্তে কহিতে লাগিলেন, আপন ঔরস পুত্রকে দেখিলে মন যেরূপ স্নেহরসে আর্দ্র হয়, এই শিশুকে দেখিয়া আমার মন সেইরূপ হইতেছে কেন? অথবা, আমি পুত্রহীন বলিয়া, এই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর শিশুকে দেখিয়া আমার মনে এরূপ স্নেহরসের আবির্ভাব হইতেছে।

 এ দিকে, সেই শিশু সিংহশাবকের উপর অত্যন্ত উৎপীড়ন আরম্ভ করাতে, তাপসীরা কহিতে লাগিলেন, বৎস! এই সকল জন্তুকে আমরা আপন সন্তানের ন্যায় স্নেহ করি; তুমি কেন অকারণে উহারে ক্লেশ দাও? আমাদের কথা শুন, ক্ষান্ত ছও, সিংহশিশুকে ছাড়িয়া দাও, ও আপন জননীর নিকটে যাউক। আর যদি তুমি উহারে ছাড়িয়া না দাও, সিংহী তোমায় জব্দ করিবেক; বালক শুনিয়া, কিঞ্চিন্মাত্রও ভীত না হইয়া, সিংহশাবকের উপর পূর্ব্বাপেক্ষায় অধিকতর উপদ্রব আরম্ভ করিল। তাপসীরা, ভয়প্রদর্শন দ্বারা তাহাকে ক্ষান্ত করা অসাধ্য বুঝিয়া, প্রলোভনার্থে কহিলেন, বৎস! তুমি সিংহশিশুকে ছাড়িয়া দাও, তোমায় একটি ভাল খেলান দিব।

 রাজা, এই কৌতুক দেখিতে দেখিতে, ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া, তাঁহাদের অতি নিকটে উপস্থিত হইলেন, কিন্তু সহসা তাঁহাদের সম্মুখে না গিয়া, এক বৃক্ষের অন্তরালে থাকিয়া, সস্নেহ নয়নে সেই শিশুকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে সেই বালক, কই কি খেলনা দিবে দাও বলিয়া, হস্তপ্রসারণ করিল। রাজা, বালকের হস্তে দৃষ্টিপাত করিয়া, চমৎকৃত হইয়া মনে, মনে কহিতে লাগিলেন, কি আশ্চর্য্য! এই বালকের হস্তে চক্রবর্ত্তি লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে। তাপসীদিগের, সঙ্গে কোনও খেলানা ছিল না, সুতরাং তাঁহারা তৎক্ষণাৎ দিতে না পরাতে, বালক কুপিত হইয়া কহিল, তোমরা খেলনা দিলে না, তবে আমি উহারে ছাড়িব না। তখন এক তাপসী অপর তাপসীকে কহিলেন, সখি! ও কথায় ভুলবার ছেলে নয়; কুটীরে মাটির ময়ূর আছে, ত্বরায়, লইয়া আইস। তাপসী মৃন্ময় ময়ূরের আনয়নার্থ কুটীরে গমন করিলেন।

 প্রথমে সেই শিশুকে দেখিয়া, রাজাৱ অস্তুঃকরণে যে স্নেহের সঞ্চার হইয়াছিল, ক্রমে ক্রমে সেই স্নেহ গাঢ়তর হইতে লাগিল। তখন তিনি মনে মনে কহিতে লাগিলেন, কেন, এই অপর চিত শিশুকে ক্রোডে করিবার নিমিত্ত, আমার মন এমন উৎসুক হইতেছে! পরের পুত্র দেখিলে মনে এত স্নেহোদয় হয়, আমি পূর্ব্বে জানিতাম না। আহা! যাহার এই পুত্র, সে ইহাকে ক্রোড়ে লইয়া যখন ইহার মুখচুম্বন, করে, হাস্য করিলে যখন ইহার মুখমধ্যে অর্দ্ধবিনির্গত কুন্দসন্নিত দন্তগুলি অবলোকন করে, যখন ইহার মৃদু মধুর আধ আধ কথাগুলি শ্রবণ করে, তখন সেই পুণ্যবান্ ব্যক্তি কি অনির্বচনীয় প্রীতি প্রাপ্ত হয়। আমি অতি হতভাগ্য! সংসারে আসিয়া এই পরম সুখে বঞ্চিত রহিলাম। পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া, তাহার মুখচুম্বন করিয়া, সর্ব্ব শরীর শীতল করিব; পুত্রের অর্দ্ধবিনির্গত দস্তগুলি অবলোকন করিয়া, নয়নযুগলের সার্থকতা সম্পাদন করিব; এবং অর্দ্ধোচ্চারিত মৃদু মধুর বচনপরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিব; এ জন্মের মত আমার সে আশালতা নির্মূল হইয়া গিয়াছে।

 ময়ুরের আনয়নে বিলম্ব দেখিয়া, কুপিত হইয়া বালক কহিল, এখনও ময়ুর দিলে না, তবে আমি ইহাকে ছাড়িব না। এই বলিয়া সিংহশিশুকে অত্যন্ত বলপূর্ব্বক আকর্ষণ করিতে লাগিল। তাপসী বিস্তর চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু তাহার হস্তগ্রহ হইতে সিংহশিশুকে ছাড়াইতে পারিলেন না। তখন তিনি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, এমন সময়ে এখানে কোনও ঋষিকুমার নাই যে ছাড়াইয়া দেয়। এই বলিয়া পার্শ্বে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিবামাত্র, রাজাকে দেখিতে পাইয়া কহিলেন, মহাশয়! আপনি অনুগ্রহ করিয়া সিংহশিশুকে এই বালকের হস্ত হইতে মুক্ত করিয়া দেন। রাজা, তৎক্ষণাৎ নিকটে আসিয়া, সেই বালককে ঋষিপুত্রবোধে সম্বোধন করিয়া, কহিলেন, অহে ঋষিকুমার! তুমি কেন তপোবনবিরুদ্ধ আচরণ করিতেছ। তখন তাপসী কহিলেন, মহাশয়! আপনি জানেন না, এ ঋষিকুমার নয়। রাজা কহিলেন, বালকের আকার প্রকার দেখিয়া বোধ হইতেছে ঋষি কুমার নয়, কিন্তু এ স্থানে ঋষিকুমার ব্যতীত অন্যবিধ বালকের সমাগমসম্ভাবনা নাই, এজন্য আমি এরূপ বোধ করিয়াছিলাম।

 এই বলিয়া, রাজা সেই বালকের হস্তগ্রহ হইতে সিংহশিশুকে মুক্ত করিয়া দিলেন, এবং স্পর্শসুখ অনুভব করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, পরের পুত্রের গাত্র স্পর্শ করিয়া আমার এরূপ সুখানুভব হইতেছে, যাহার পুত্র, সে ব্যক্তি ইহার গাত্র স্পর্শ করিয়া কি অনুপম সুখ অনুভব করে, তাহা বলা যায় না।

 বালক অত্যন্ত দুরন্ত হইয়াও রাজার নিকট অত্যন্ত শান্তস্বভাব হইল, ইহা দেখিয়া এবং উভয়ের আকারগত সৌসাদৃশ্য দর্শন করিয়া, তাপসী বিস্ময়াপন্ন হইলেন। রাজা, সেই বালককে ক্ষত্রিয়সন্তান নিশ্চয় করিয়া, তাপসীকে জিজ্ঞাসিলেন, এই বালক যদি ঋষিকুমার না হয়, কোন ক্ষত্রিয়বংশে জন্মিয়াছে, জানিতে ইচ্ছা করি। তাপসী কহিলেন, মহাশয়! এ পুরুবংশীয়। রাজা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, আমি যে বংশে। জন্মিয়াছি, ইহারও সেই বংশে জন্ম। পুরুবংশীয়দিগের এই রীতি বটে, তাঁহারা, প্রথমতঃ অশেষ সাংসারিক সুখভোগে কালযাপন করিয়া, পরিশেষে সস্ত্রীক হইয়া অরণ্যবাস আশ্রয় করেন।

 পরে রাজা তাপসীকে জিজ্ঞাসিলেন, এ দেবভূমি, মানুষের অবস্থিতির স্থান নহে; অতএব এ বালক কি সংযোগে এখানে আসিল? তাপসী কহিলেন, ইহার জননী অপ্সরাসম্বন্ধে এখানে আসিয়া এই সন্তান প্রসব করিয়াছেন। রাজা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, পুরুবংশ ও অপ্সরাসম্বন্ধ এই দুই কথা শুনিয়া, আমার হৃদয়ে পুনর্বার আশার সঞ্চার হইতেছে। যাহা হউক, ইহার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করি, তাহা হইলেই সন্দেহভঞ্জন হইবেক।

 এই বলিয়া, তিনি তাপসীকে পুনর্বার জিজ্ঞাসিলেন, আপনি জানেন, এই বালক পুরুবংশীয় কোন রাজার পুত্র? তখন তাপসী কহিলেন, মহাশয়! কে সেই ধর্ম্মপত্নীপরিত্যাগী পাপাত্মার নাম কীর্ত্তন করিবেক। রাজা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ কথা আমারেই লক্ষ্য করিতেছে। ভাল, ইহার জননীর নাম জিজ্ঞাসা করি, তাহা হইলেই এক কালে সকল সন্দেহ দূর হইবেক; অথবা পরস্ত্রীসংক্রান্ত কোনও কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়। আমি যখন মোহন্ধ হইয়া স্বহস্তে আশালতার মূলচ্ছেদ করিয়াছি, তখন সে আশালতাকে বৃথা পুনরুজ্জীবিত করিবার চেষ্টা পাইয়া, পরিশেষে কেবল সমধিক ক্ষোভ পাইতে হইবেক। অতএব ও কথায় আর কাজ নাই।

 রাজা মনে মনে এই আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে অপরা তাপসী কুটীর হইতে মৃন্ময় ময়ুর আনয়ন করিলেন এবং কহিলেন, বৎস! কেমন শকুন্তলাবণ্য দেখ। এই বাক্যে শকুন্তলাশব্দ শ্রবণ করিয়া বালক কহিল, কই আমার মা, কোথায়? তখন তাপসী কহিলেন, না বৎস! তোমার মা এখানে আসেন নাই। আমি তোমায় শকুন্তের লাবণ্য দেখিতে কাইয়াছি। ইহা বলিয়া বাজাকে কহিলেন, মহাশয়! এই বালক জন্মাবধি জননী ভিন্ন আপনার আর কাহাকেও দেখে নাই, নিয়ত জননীর নিকটেই থাকে, এই নিমিত্ত অত্যন্ত মাতৃবৎসল। শকুন্তলাবণ্যশব্দে জননীর নামাক্ষর শ্রবণ করিয়া, উহার জননীকে মনে পড়িয়াছে। উহার জননীর নাম শকুন্তলা।

 সমুদায় শ্রবণ করিয়া, রাজা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, ইহার জননীরও নাম শকুন্তলা? কি আশ্চর্য্য! উত্তরোত্তর সকল কথাই আমার বিষয়ে ঘটিতেছে! এই সকল কথা শুনিয়া আমার আশাই বা না জন্মিবে কেন? অথবা আমি মৃগতৃষ্ণিকায় ভ্রান্ত হইয়াছি, নামসাদৃশ্যশ্রবণে মনে মনে বৃথা এত আন্দোলন করিতেছি; এরূপ নামসাদশ শত শত ঘটিতে পারে।

 শকুন্তলা অনেক ক্ষণ অবধি পুত্রকে দেখেন নাই, এ নিমিত্ত অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়া, অন্বেষণ করিতে করিতে সহসা সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। রাজা, বিরহকৃশা মলিনবেশা শকুন্তলাকে সহসা সেই স্থানে উপস্থিত দেখিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইয়া। এক দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন; নয়নযুগলে জলধারা বহিতে লাগিল; বাক্শক্তিরহিত হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন, একটিও কথা কহিতে পারিলেন না। শকুন্তলাও অকস্মাৎ রাজাকে দেখিয়া, স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ করিয়া, স্থির নয়নে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন; নয়নযুগল বাষ্পবারিতে পরিপ্লুত হইয়া আসিল। বালক, শকুন্তলাকে দেখিবামাত্র, মা মা করিয়া তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইল এবং জিজ্ঞাসিল, মা! ও কে, ওকে দেখে তুই কাঁদিস্ কেন? তখন শকুন্তলা গদগদ বচনে কহিলেন, বাছা! ও কথা আমায় জিজ্ঞাসা কর কেন? আপন অদৃষ্টকে জিজ্ঞাসা কর।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাজা মনের আবেগ সংবরণ করিয়া শকুন্তলাকে কহিলেন, প্রিয়ে! আমি তোমার প্রতি যে অসদ্ব্যবহার করিয়াছি, তাহা বলিবার নয়। তৎকালে আমার মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছিল, তাহাতেই অবমাননা করিয়া তোমায় বিদায় করিয়াছিলাম। কয়েক দিবস পরেই, আমার সকল বৃত্তান্ত স্মরণ হইয়াছিল; তদবধি আমি কি অসুখে কালহরণ করিয়াছি, তাহা আমার অন্তরাত্মাই জানেন। পুনর্বার তোমার দর্শন পাইব, আমার সে আশা ছিল না। এক্ষণে তুমি, প্রত্যাখ্যানদুঃখ পরিত্যাগ করিয়া, আমার অপরাধ মার্জ্জনা কর।

 রাজা এই বলিয়া, উন্মুলিত তরুর ন্যায়, ভূতলে পতিত কইলেন। তদ্দর্শনে শকুন্তলা আস্তে ব্যস্তে রাজার হস্তে ধরিয়া কহিলেন, আর্য্যপুত্র! উঠ উঠ, তোমার দোষ কি, আমার অদৃষ্টের দোষ। এত দিনের পর দুঃখিনীকে যে স্মরণ করিয়াছ, তাহাতেই আমার সকল দুঃখ দূর হইয়াছে। এই বলিতে বলিতে শকুন্তলার চক্ষে ধারা বহিতে লাগিল। রাজা গাত্রোত্থান করিয়া বাষ্পপূর্ণ নয়নে কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ে! প্রত্যাখ্যান কালে তোমার নয়নযুগল হইতে যে জলধারা বিগলিত হইয়াছিল, তাহা উপেক্ষা করিয়াছিলাম, পরে সেই দুঃখে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এক্ষণে তোমার চক্ষের জলধারা মুছিয়া দিয়া সকল দুঃখ দূর করি। এই বলিয়া, স্বহস্তে শকুন্তলার চক্ষের জল মুছিয়া দিলেন। শকুন্তলার শোকসাগর আরও উথলিয়া উঠিল; দ্বিগুণ প্রবাহে নয়নে বারিধারা বহিতে লাগিল। অনন্তর দুঃখাবেগ সংবরণ করিয়া, শকুন্তলা রাজাকে কহিলেন, আর্য্যপুত্র! তুমি যে এই দুঃখিনীকে পুনরায় স্মরণ করিবে, সে আশা ছিল না। কি রূপে আমি তোমার স্মৃতিপথে পতিত হইলাম, ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। তখন রাজা কহিলেন, প্রিয়ে! তৎকালে। তুমি আমায় যে অঙ্গুরীয় দেখাইতে পার নাই, কয়েক দিবস পরে উহা আমার হস্তে পড়িলে, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত আমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হয়। এই সেই অঙ্গুরীয়। এই বলিয়া, স্বীয় অঙ্গুলিস্থিত সেই অঙ্গুরীয় দেখাইয়া, পুনর্বার শকুন্তলার অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিবার চেষ্টা করিলেন। তখন শকুন্তলা কহিলেন, আর্যপুত্র! আর আমার ও অঙ্গুরীয়ে কাজ নাই; ওই আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল; ও তোমার অঙ্গুলিতেই থাকুক।

 উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে মাতালি আসিয়া প্রফুল্ল বদনে কহিলেন, মহারাজ! এত দিনের পর আপনি যে ধর্মপত্নীসহিত সমাগত হইলেন, ইহাতে আমরা কি পর্যন্ত আহ্লাদিত হইয়াছি, বলিতে পারি না। ভগবান্ কশ্যপও শুনিয়া সাতিশয় প্রীত হইয়াছেন। এক্ষণে গিয়া ভগবানের সহিত সাক্ষাৎ করুন। তিনি আপনকার প্রতীক্ষা করিতেছেন। তখন রাজা শকুন্তলাকে কহিলেন, প্রিয়ে! চল অজি উভয়ে এক সমভিব্যাহারে ভগবানের চরণদর্শন করিব। শকুন্তলা কহিলেন, আর্যপুত্র! ক্ষমা কর, আমি তোমার সঙ্গে গুরু জনের নিকটে যাইতে পারিব না। তখন রাজা কহিলেন, প্রিয়ে! শুভ সময়ে এক সমভিব্যাহারে গুরু জনের নিকটে যাওয়া দূষ্য নহে। চল, বিলম্ব করিয়া কাজ নাই।

 এই বলিয়া, রাজা শকুন্তলাকে সঙ্গে লইয়া, মাতলিসমভিব্যাহারে, কশ্যপের নিকট উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, ভগবান্ অদতির সহিত একাসনে বসিয়া আছেন। তখন সস্ত্রীক সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন। কশ্যপ, বৎস! চিরজীবী হইয়া, অপ্রহিত প্রভাবে অখণ্ড ভূমওলে একাধিপত্য কর, এই বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন। অনন্তর শকুন্তলাকে কহিলেন, বৎস! তোমার স্বামী ইন্দ্রসদৃশ, পুত্র জয়ন্তসদৃশ; তোমায় অন্য আর কি আশীর্বাদ করিব; তুমি শচীসদৃশী হও। উভয়কে এই আশীর্বাদ করিয়া উপবেশন করিতে কহিলেন।

 সকলে উপবিষ্ট হইলে, রাজা কৃতাঞ্জলি হইয়া বিনপূর্ণ বচনে নিবেদন করিলেন, ভগবন্! শকুন্তলা আপনকার সগোত্র মহর্ষি কণ্বের পালিত তনয়া। মৃগয়াপ্রসঙ্গে তদীয় তপোবনে উপস্থিত হইয়া, আমি গান্ধর্ব্ববিধানে ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলাম। পরে ইনি যৎকালে রাজধানীতে নীত হন, তখন আমার এরূপ স্মৃতিভ্রংশ ঘটিয়াছিল যে ইঁহাকে চিনিতে পারিলাম না। চিনিতে না পারিয়া, প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলাম। ইহাতে আমি মহাশয়ের ও মহর্ষি কণ্বের নিকট অত্যন্ত অপরাধী হইয়াছি। কৃপা করিয়া আমার অপরাধ মার্জ্জনা করুন; আর যাহাতে ভগবান্ কণ্ব আমার উপর অক্রোধ হন, আপনাকে তাহারও উপায় করিতে হইবেক।

 কশ্যপ শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, বৎস! সে জন্য তুমি কুণ্ঠিত হইও না। এ বিষয়ে তোমার অণুমাত্র অপরাধ নাই। যে কারণে তোমার স্মৃতিভ্রংশ ঘটিয়াছিল, তুমি ও শকুন্তলা উভয়েই অবগত নই। এই নিমিত্ত আমি তোমাদিগকে সেই স্মৃতিভ্রংশের প্রকৃত হেতু কহিতেছি। শুনিলে শকুন্তলার হৃদয় হইতে প্রত্যাখ্যাননিবন্ধন সকল ক্ষোভ দুর হইবেক। এই বলিয়া, শকুন্তলাকে কহিলেন, বৎসে! রাজা তপোবন হইতে প্রতিগমন করিলে পর, এক দিন তুমি পতিচিন্তায় মগ্ন হইয়া কুটীরে উপবিষ্ট ছিলে। সেই সময়ে দুর্ব্বাসা আসিয়া অতিথি হন। তুমি এক কালে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া ছিলে, সুতরাং তাঁহার সৎকার বা সংবর্দ্ধনা করা হয় নাই। তিনি তাহাতে কুপিত হইয়া, তোমায় এই শাপ দিয়া, চলিয়া যান, তুই যার চিন্তায় মগ্ন হইয়া অতিথির অবমাননা করিলি, সে কখনও তোরে স্মরণ করিবে না। তুমি সেই শাপ শুনিতে পাও নাই। তোমার সখীরা শুনিতে পাইয়া তাঁহার চরণে ধরিয়া অনেক অনুনয় করিলেন। তখন তিনি কহিলেন, এ শাপ অন্যথা হইবার নহে। তবে যদি কোনও অভিজ্ঞান দর্শাইতে পারে, তাহা হইলে স্মরণ করিবেক। অনন্তর, রাজাকে কহিলেন, বৎস! দুর্ব্বাসার শাপপ্রভাবেই তোমার স্মৃতিভ্রংশ ঘটিয়াছিল, তাহাতেই তুমি ইঁহাকে চিনিতে পার নাই। শকুন্তলার সখীর অনুনয়বাক্যে কিঞ্চিৎ শাস্তু হইয়া, দুর্ব্বাসা অভিজ্ঞানদর্শনকে শাপমোচনের উপায় নির্দ্ধারিত করিয়া দিয়াছিলেন; সেই নিমিত্ত, অঙ্গুরীয়দর্শনমাত্র, শকুন্তলবৃত্তান্ত পুনর্বার তোমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হয়।

 দুর্ব্বাসার শাপবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া, সাতিশয় হর্ষিত হইয়া, রাজা কহিলেন, ভগবান্! এক্ষণে আমি সকলের নিকট সকল অপরাধ হইতে মুক্ত হইলাম। শকুন্তলাও শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এই নিমিত্তই আমার এই দুর্দশা ঘটিয়াছিল; নতুবা আর্য্যপুত্র, এমন সরলহৃদয় হইয়া, কেন আমায় অকারণে পরিত্যাগ করিবেন? দুর্ব্বাসার শাপই আমার সর্ব্বনাশের মূল। এই জন্যেই, তপোবন হইতে প্রস্থানকালে, সখীরাও যত্নপূর্ব্বক আর্য্যপুত্রকে অঙ্গুরীয় দেখাইতে কহিয়াছিলেন। আজি ভাগ্যে এই কথা শুনিলাম; নতুবা যাবজ্জীবন আমার অন্তঃকরণে, আর্য্যপুত্র অকারণে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন বলিয়া, ক্ষোভ থাকিত।

 পরে, কশ্যপ রাজাকে সম্বোধন করিয়া, কহিলেন, বৎস! তোমার এই পুত্র সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হইবেক, এবং সকল ভুবনের ভর্ত্তা হইয়া, উত্তর কালে ভরত নামে প্রসিদ্ধ হইবেক। তখন রাজা কহিলেন, ভগবন্। আপনি যখন এই বালকের সংস্কার করিয়াছেন, তখন ইহাতে কি না সম্ভবিতে পারে? অদিতি কহিলেন, অবিলম্বে কণ্ব ও মেনকার নিকট এই সংবাদ প্রেরণ করা আবশ্যক। তদনুসারে কশ্যপ, দুই শিষ্যকে আহ্বান করিয়া, কণ্ব ও মেনকার নিকট সংবাদপ্রদানার্থ প্রেরণ করিলেন, এবং রাজাকে কহিলেন, বৎস! বহু দিবস হইল রাজধানী হইতে আসিয়াছ, অতএব আর বিলম্ব না করিয়া, দেবরথে আরোহণপূর্ব্বক, পত্নীপুত্র সমভিব্যাহারে প্রস্থান কর। তখন রাজা, মহাশয়ের যে আজ্ঞা এই বলিয়া, প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া, সস্ত্রীক সপুত্র রথে আরোহণ করিলেন, এবং নিজ রাজধানী প্রত্যাগমনপূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।

সম্পূর্ণ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *