লাঞ্চ বক্স – ৭

সাত

ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত, বাড়ি ফেরার সময় সারাটা পথ কেবল এই কথাগুলোই মনের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো। আরো মনে হলো অপর প্রান্তে নিঃসঙ্গ অপেক্ষা করছে নাদেরা, যুগ যুগ ধরে। আর মনে হচ্ছে সেও একান্ত স্তব্ধ। ‘খাবার বাক্সটা কিন্তু আমি পাঠিয়েছিলাম’ এই শব্দগুলো মৌন ভঙ্গ না করে তাকে আরো গভীর করে দিয়েছে। আর নিসর্গ থেকে অলক্ষ্যে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে আমার কথা শেষ করবো। লেখাটা শেষ পর্যন্ত খুব রোমান্টিক হয়ে গেল। কিন্তু কী করবো বলুন। রোমান্টিকতার অপবাদ দূর করবার জন্য সত্যের অপলাপ তো আর করতে পারি না। ঘটনাটা যে ঘটেছিল। কিংবা বলতে পারেন ঘটে নি বলেই কাহিনীটি রোমান্টিক হয় গেল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কোনো কোনো ভাগ্যবানের জীবনে দীর্ঘকাল ধরে নিমেষের উপহার হিসেবে একটি পুলক ও বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে। সেই কখন মনের একটি দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ নাদেরা বাইরে থেকে শিকল ধরে নাড়া দিয়ে গেল। অবশ্য, তাদের ভাগ্যবান বলা যায় কিনা, সেও এক প্রশ্ন।

বললাম বটে বন্ধ দরজার শিকলটা নাড়া দিয়ে গেল। কিন্তু আসলে আমার মনের সেই দরজাটা কোনোদিনই খোলা ছিল না। তবু বলবো নাদেরা ‘এক মূল্যহীন ফুলের বিনাসুতোর মালা’ আমার চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার সাহায্য নিলে বলতে পারতাম ‘বাঁধনবিহীন সেই যে বাঁধন’-এর কথা। কিন্তু কে যে কোথায় কার জন্য মালা তৈরি করে রেখেছে, আর সেই মালার ফুল শুকিয়ে ঝরে গেলেও সিন্দুকে পুরনো ফুলের মরা পাপ- ড়ির মতো, কার মনের ভেতরটাকে সুবাসের স্মৃতির মতো সুরভিত করে রেখেছে তা কি আমরা সবসময় জানি?

নাদেরা এক উকিলকন্যা। সে যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন তার সঙ্গে আমার বিয়ের পয়গাম আসে। সামান্য উকিলকন্যার সঙ্গে আমার বিয়েতে আমার আত্মীয়স্বজন রাজি হলেন না। তাঁরা একজন যুবক বা মানুষ হিসেবে আমাকে যাই মনে করুন, বিয়ের পাত্র হিসেবে আমাকে অসামান্য মনে করলেন। প্রস্তাবে তাঁরা কর্ণপাত করলেন না; কিন্তু পাত্রীর পিতা একবার মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। এই উৎপাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমার আত্মীয়রা সেই মেয়েটিকে একবার দেখে নিয়ে বিপদমুক্ত হতে সম্মত হলেন। মেয়েটিকে দেখবার পর কিন্তু আমার আত্মীয়-স্বজন তাঁদের উৎপাতটাকে তাঁরা নিজেরাই আমার দিকে ঠেলে দিলেন। আমি তাঁদের উপস্থিতি থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকতে সচেষ্ট হলাম। কারণ আমাকে কাছে পেলেই আমার দু’হাত সামনে বসিয়ে এমনভাবে মেয়েটির গুণগান ও রূপকীর্তন শুরু করে দেন, যে আমার কান তো ঝালাপালা হয়ই, হাতটাও নিজের বশে থাকে না। তাঁদের পূর্বমত টলে গেছে কিন্তু আমারটা অটল থাকলো। মেয়েটিকে একবার দেখলে তো কোনোই লোকসান নেই। জোরজবরদস্তি করে তো আর কেউ আমাকে বিয়েতে বসাতে পারবে না। এরকম অনেক যুক্তি শুনলাম। কিন্তু ক্লাস টেনের মেয়েকে আমি বিয়ে করবোই না। শেষ কথা বলে দিলাম। শুধু রূপবতীকে নিয়ে আমি কী করবো? কথা বলবো কার সঙ্গে? আমি চাই, যে একই সঙ্গে রূপবতী ও বিদ্যাধরী। আমার এক ভাবি অবশ্য বলেছিলেন, ‘ভুল করলে। মেয়েটির গায়ে রূপ থরে থরে সাজানো।’

দু’বছর পর নাদেরা আই.এ. পাস করেছে। নতুন সি.এস.পি হয়েছে এমন ছেলের বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু সেই প্রথমবারের পর থেকে ‘না’ বলেছে নাদেরা। সে বিয়ে করবেই না; কিন্তু সে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যে কোনো ছেলেই যেন মনে করতে না পারে, সে এক পলক দেখবারও যোগ্য নয়। সে ঢাকা থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে, বিদেশের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ.ডি ডিগ্রিটিও অধিকার করে নিলো। এখন সে সেখানেই অধ্যাপিকা। বিয়ে না করার সঙ্কল্পে সে একেবারে অটল। এখনো তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ আসে। যা কেবলই তার সঙ্কল্পকে আরো দৃঢ় করে।

এসব খবর বের করবার জন্য আমাকে অনেক খোঁজ-খবর, তত্ত্ব-তল্লাশি নিতে হয়েছে। এই আগ্রহটা হয়েছে ট্রেনে তাকে ‘এক পলক’ দেখবার পর। এ কথাও শুনেছি, আমি তাকে আগে দেখি নি; কিন্তু সে আমাকে সেই ‘ক্লাস টেন-এর সময়েই একাধিকবার দেখেছে। সে ‘বোরখা’ পরে থাকে কেন, সে খোঁজও নিয়েছি। তার কোনো পরিষ্কার জবাব পাই নি। তার এক অতি অন্তরঙ্গ বান্ধবীকে সে নাকি বলেছে, তার মুখ স্বেচ্ছায় সে শুধু একজনকেই দেখাবে। বাইরে যেতে হয়। কাজকর্ম করতে হয়। তাই তার অনিচ্ছায় অগোচরে আরো অনেকেই দেখেছে; কিন্তু নিজের হাতে অবগুণ্ঠন খুলে সে শুধু একজনকেই তাঁর মুখ দেখাবে। সেই লোকটি কে? এই খবরটা কেউ জানে না।

এদিকে আমি বিয়ে করেছি অনেক বছর হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী যখন অনূঢ়া ছিলেন, তখন তাঁর পাণিগ্রহণের চেষ্টায় বহু পাত্র লাইন লাগিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উকিল-ব্যারিস্টারসহ সি.এস.পি ও পি.এস.পি পাত্রও ছিলেন। সুতরাং আমাকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। কী গুণে যে উত্তীর্ণ হলাম শুনলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। পাত্রীর সব আত্মীয়-স্বজন আমার ঘোর বিরোধী ছিলেন; কিন্তু স্বয়ং পাত্রী কোনো রহস্যময় কারণে ছিলেন পক্ষপাতী। আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়; কিন্তু আমরা সুখী দম্পতি। সক্কালবেলা আমার ডায়েবিটিসকে কন্ট্রোলে রাখবার জন্য যখন তিনি নিজের হাতে আমাকে করলার রস বা মেথির পানি খেতে দেন, তখন তা তেতো বা বিস্বাদ লাগে না।

কিছুদিন পর এ কথাও জানা গেল, যার ওপর অভিমান করে নাদেরা বিয়েই করলো না, সেই লোকটি আমি। পাঠকরা বলবেন, এ রকম গল্প আপনারা অনেক পড়েছেন। তা পড়েছেন। বিবাহ, বিচ্ছেদ বা মৃত্যুতে শেষ হয়েছে সে রকম গল্প-উপন্যাসও আপনারা মেলা পড়েছেন। তাই বলে কি বিবাহ হওয়া, বিচ্ছেদ ও মৃত্যু ঘটা, চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে?

নাদেরাকে এখন প্রায় মনে পড়ে। মনে পড়ে সে নিজের হাতে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর ঘোমটা তুলে ধরেছিল, আর তাঁকে আমি সেই প্রথমবার ও শেষবার কয়েক পলকের জন্য দেখেছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় চুপ করে বসে আছি। আমার স্ত্রী নয়ন হাতে একটি ট্রে নিয়ে, সামনের চেয়ারটিতে বসে, মাঝখানের টিপয়ে ট্রেটি রেখে কাগজের একটি লাঞ্চ বক্স খুলে, আমার হাতে একটি চিকেন স্যান্ডউইচ ধরিয়ে দিলেন। তারপর একটির পর আর একটি কাপে চা ঢাললেন।

তারপর যা বললেন, তা এই: ‘নাদেরার কথা আমিও শুনেছি। তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয় নি বলে তুমি মনে করেছো খুব ঠকে গেলে। কিন্তু যদি তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হতো, আর আমার সঙ্গে হতো না— তাহলেও এতো বছর পর আজ তোমার মনে হতো, খুব ঠকে গেলে।’

এই বলে তিনি একটু হাসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *