অধ্যায় ২৩
কথা বলার সময় খুব যে আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে আকিও মায়েহারাকে, তা নয়। তবে অভিনয় করছে, এমনটাও মনে হচ্ছে না। চেহারার অভিব্যক্তি বলছে কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে তার, গলার স্বর খসখসে। পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকা ইয়াইকো খানিক পরপর নাক টানছে। হাতে ধরে থাকা রুমাল ভিজে গেছে অনেকটাই।
লাশটা কিভাবে বাড়ি থেকে পার্কে নিয়ে গেল, আকিওর সেই বর্ণনাও বিশ্বাসযোগ্য। বিশেষ করে মেয়েটার পিঠ থেকে ঘাস ঝেরে ফেলার বিষয়টা। মিডিয়ার কেউ এখনো এই ব্যাপারে কিছু জানে না।
আতঙ্ক চেপে বসেছে তার চিত্তে, কথা বলার সময় কেন এতটা নার্ভাস, তা-ও বোঝা যাচ্ছে। যে করেই হোক লাশটা বাড়ি থেকে বের করতে চেয়েছিল সে, কিন্তু তাড়াহুড়োয় গোলমাল করে বসেছে। বাড়ির উঠানে কয়েক ঘন্টা পড়ে ছিল ইউনার লাশ, তখনই ঘাসগুলো লেগে গেছে কাপড়ে।
“আপনারা বেশ কয়েকবার এসেছেন আমাদের বাড়িতে। কিন্তু শেষবার যখন আমাদের অ্যালিবাই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন বুঝতে পারি যে আর লুকানো সম্ভব নয়। এরপর আমার স্ত্রী’র সাথে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেই সবকিছু খুলে বলার। সরি, আপনাদের ওভাবে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। মেয়েটার মা-বাবার কাছে মাফ চাইতে পারলে কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হত।”
আবেগে রুদ্ধ হয়ে এলো মায়েহারার কন্ঠস্বর। কাগার দিকে এক নজর চাইল মাতসুমিয়া।
“আমার সহকর্মীদের সাথে কথা বলবো এই ব্যাপারে।”
কাগা কিছু বললো না। কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে তাকে।
“আর কিছু জানতে চাও?” জিজ্ঞেস করলো মাতসুমিয়া।
আকিও’র দিকে তাকালো কাগা।
“আমরা কি আপনার মা’র সাথে আরেকবার দেখা করতে পারি?”
“নিশ্চয়ই, কিন্তু যেমনটা দেখলেন, তার সাথে কথা বলাটা একটু…”
আকিও কথা শেষ করার আগেই উঠে দাঁড়াল কাগা। আগের করিডোরটা পেরিয়ে মাসায়ের ঘরের সামনে চলে এলো। দরজা খুলে দিল আকিও। ভেতরে মাসায়ে এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। দৃষ্টি সামনের বাগানের দিকে হলেও সে কি দেখছে তা বলা মুশকিল।
সামনে এগিয়ে তার পাশে বসলো কাগা। আগের মতনই কোন বিকার নেই মাসায়ের।
“কি করছেন আপনি?” বাচ্চাদের সাথে বড়রা যেভাবে কথা বলে, ঠিক সেই সুরে বললো সে।
কোন জবাব দিল না মাসায়ে। দেখে মনে হচ্ছে কাগার উপস্থিতি এখনো আঁচ করতে পারেনি সে।
“সময় নষ্ট করছেন আপনি, স্যার। মা বুঝতে পারছে না যে আপনি ওর সাথে কথা বলছেন,” আকিও বলে।
তার দিকে ঘুরে হাত উঁচিয়ে চুপ থাকার ইশারা করলো কাগা। এরপর মাসায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু।
“একটা ছোট্ট মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল আপনার?“
এবারে মাথাটা ঈষৎ ঘোরায় মাসায়ে, কিন্তু কাগার দিকে সরাসরি তাকালো না। “বৃষ্টি,” বলে সে।
“তাই নাকি?” জবাবে বলে কাগা।
“বৃষ্টি হচ্ছে। আজকে আমাদের পাহাড়ে যাওয়া হবে বলে মনে হয় না।” বাইরে তাকাল মাতসুমিয়া। বৃষ্টির ছিটেফোটাও নেই। হালকা বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে অবশ্য।
“আজকে বাইরে যাওয়া যাবে না, বাসার ভেতরেই খেলতে হবে। মেকআপ দিতে হবে মুখে।”
“বলেছিলাম না,” আকিও বলে। “কোন লাভ নেই। আবোল-তাবোল বকছে। মনে মনে ছোটবেলায় ফিরে গেছে মা।”
নড়লো না কাগা। এখনও একই ভঙ্গিতে মাসায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
খানিকবাদে সামনের দিকে ঝুঁকে মাসায়ের পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা জিনিস তুলে নিল কাগা। দেখতে অনেকটা কাপড়ের বলের মত বলে মনে হলো মাতসুমিয়ার।
“একটা গ্লাভস,” কাগা বলে। “এটা কি তখন যে মাটি থেকে তুলে নিলেন তিনি, সেটা?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“কখন? কিসের কথা বলছো?” মাতসুমিয়া জিজ্ঞেস করে।
“গতকাল এখানে এসে ওনাকে বাগান থেকে একটা জিনিস হাতে তুলে নিতে দেখি আমি। এই গ্লাভসটা,” ব্যাখা করে বলে ওর সহকর্মী।
“কোন কিছু ভালো লাগলে সেটা লম্বা সময় নিজের কাছে রেখে দেয় মা। গ্লাভসটা নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ আগেই খুলেছে। এখন আর খেলতে ভালো লাগছে না। একদম বাচ্চাদের মতন। কখন কি ভাবছে সেটা জানা মুশকিল,” সতর্ক স্বরে বললো মায়েহারা।
গ্লাভসটা আরো কিছুক্ষণ দেখে সেটা ভাঁজ করে মাসায়ের পাশে রেখে দিল কাগা। এরপর আরো একবার গোটা ঘরে নজর বুলালো।
“আপনার মা কি ঘর থেকে বের হয়?”
“না। শুধু বাথরুমে যাওয়ার জন্যে দিনে দুই তিনবার। “ “ঘটনার দিনের পর কি বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন তিনি?”
মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল মায়েহারা।
“না, একবারও না। মাথা বিগড়ে যাওয়ার পর থেকে একবারও বের হয়নি কোথাও।”
“আচ্ছা। আপনাদের রুমটা কোথায়?”
“উপরতলায়।”
“আপনার মা কি ওখানে যান মাঝে মাঝে?”
“না। মায়ের হাঁটুতে বেশ কয়েক বছর ধরেই সমস্যা। সিঁড়ি বাইতে পারে না।”
কাগা কেন এই প্রশ্নগুলো করছে তা বোঝার চেষ্টা করছে মাতসুমিয়া। ওর মতে এতক্ষণে থানায় খবর দিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু মায়েহারাদের সামনে কাগাকে সরাসরি প্রশ্নটা করা সম্ভব না।
কাগা উঠে দাঁড়িয়ে গোটা ঘরে একবার চক্কর দিল, যেন কিছু একটা খুঁজছে।
“আপনার কি কিছু দরকার?” মায়েহারা জিজ্ঞেস করে। তার যেন আর সহ্য হচ্ছে না।
মাতসুমিয়া নিজেও কিছু বুঝছে না।
“মেয়েটা যে পুতুলটা ভেঙ্গে ফেলেছে, সেটা কি ফেলে দিয়েছেন?”
“না, ওখানে রেখে দিয়েছি,” বলে কাবার্ড থেকে একটা বাক্স বের করে আনে মায়েহারা।
ভেতরে উঁকি দেয় মাতসুমিয়া। চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায় ওর। সহকর্মীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বাক্সটা। “এটা তো দেখতে…” কথা শেষ করে না ও।
ছোট্ট ইউনা যে ধরণের পুতুল সংগ্রহ করতো, ভেতরে রাখা পুতুলটাও সেরকম দেখতে।
“এটা কোত্থেকে এলো?”
“গত বছর কেনা হয়েছিল খুব সম্ভবত,” কাগার প্রশ্নের জবাবে বলে মায়েহারা।
“আপনি কিনেছিলেন?”
“যেমনটা দেখলেন, আমার মা এখন ছোট্ট মেয়েদের মত আচরণ করে সবসময়। পুতুল খুব পছন্দ তার। তাই এটা দোকান থেকে কিনে এনেছিলাম মা’র জন্যে। তখনই জানতে পারি যে পুতুলটা একটা জনপ্রিয় অ্যানিমে চরিত্রের। তবে মা’র তখন খুব একটা পছন্দ হয়নি পুতুলটা, কাবার্ডে ঢুকিয়ে রাখে। পরে নিশ্চয়ই বের করে এনেছিল এক সময়, তখনই ঘটনাটা ঘটে।”
ইউনার পুতুলগুলোর কথা মনে পড়ে গেল মাতসুমিয়ার। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ওগুলোর জন্যে কতটা পাগল ছিল সে। তাই এখানে একটা পুতুল দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ার বিষয়টা অবিশ্বাস্য নয়।
“আপনার বোনকে এই ব্যাপারে কিছু বলেননি?
“না, আসলে কিভাবে বলবো তা ভেবে পাইনি। তবে এক সময় না এক সময় অবশ্যই বলতাম,” কাগার প্রশ্নের জবাবে বলে মায়েহারা।
“শুক্রবারের পরে তো বাড়িতে আসেনি আপনার বোন। তাহলে আপনার মায়ের খেয়াল রাখল কে?”
“আমি আর আমার স্ত্রী। খুব জটিল তো কিছু না। বাথরুমে একাই যেতে পারে মা।”
“আর খাবার?“
“এখানে দিয়ে যাই আমরা।”
“একাই খান উনি?”
“হ্যাঁ। বেশিরভাগ সময় স্যান্ডউইচই খায় মা।”
“স্যান্ডউইচ?” অবাক হলো মাতসুমিয়া।
“আমার বোনকে যখন বলি তার আসতে হবে না, তখন একটা ব্যাগে অনেকগুলো স্যান্ডউইচ দিয়ে যায়। ইদানিং এটাই মা’র বেশি পছন্দ।”
ঘরের ময়লার ঝুড়িটার দিকে একটা খালি স্যান্ডউইচের প্যাকেট আর দুধের কার্টন চোখে পড়লো মাতসুমিয়ার।
ভ্রু কুঁচকে আরো কিছুক্ষণ পেছন থেকে মাসায়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভাইয়ের দিকে ফিরল কাগা।
“চলো বাগানে গিয়ে একবার দেখি।”
“বাগানে?”
“মি. মায়েহারা তো বললেন ওখানেই কার্ডবোর্ডের বাক্সের মেয়েটার মৃতদেহ ঢুকিয়েছিলেন। তাই দেখতে চাইছি।”
কাগার উদ্দেশ্য না বুঝলেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় মাতসুমিয়া। ওখানে গিয়ে কি হবে?
“আপনি এখানেই থাকুন,” মায়েহারাকে বললো কাগা। এরপর মাতসুমিয়াকে নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো সে। বাগানে এসে নিচু হয়ে বসে ঘাস স্পর্শ করলো একবার।
“বাগানের কিছু পরীক্ষা করে দেখতে চাইছ?
““না, বাইরে আসার ছুতো খুঁজছিলাম। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে,” জবাবে বলে কাগা।
“কি বিষয়ে কথা?”
“কোবায়াশিদের সাথে যোগাযোগ করার আগে একটু অপেক্ষা করা উচিৎ বলে মনে হয় আমার।“
“কি?”
“ওনাদের বলা গল্পটা শুনে কি মনে হলো তোমার?“
“অবাক হয়েছি, ভীষণ অবাক হয়েছি। ওই বয়স্ক মহিলা যে এরকম একটা কাজ করতে পারেন, তা কল্পনাতেও আসেনি।”
নিচে ঝুঁকে কিছুটা ঘাস ছিড়ে নিল কাগা। চোখের সামনে নিয়ে দেখতে লাগল।
“বিশ্বাস হয়েছে তাদের কথা?”
“কেন, তোমার ধারণা মিথ্যে বলছে?”
উঠে দাঁড়াল কাগা। সামনের গেটের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার মনে হচ্ছে না তারা সত্যি বলছে।”
“পুরোপুরি কিন্তু উড়িয়ে দেয়া সম্ভব না কথাগুলো।”
“তা তো বটেই। পুরো একদিন পেয়েছে কাহিনীটা বানানোর।”
“এত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত হচ্ছ কি করে? আর তোমার ধারণাটা যদি ঠিকও হয়, তবুও আমাদের উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে জানানো। তারা কিছু লুকালে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসবে।”
মাতসুমিয়ার কথা শেষ হবার আগে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে দেয় কাগা। সম্মতি নেই তার এই ব্যাপারে।
“তুমি মেট্রোপলিটন পুলিশের লোক। যদি তোমার মনে হয় কথা বলাটা আসলেও জরুরি, তাহলে বলো। আমি থামাবো না। সেই ক্ষেত্রে লেফটেন্যান্ট কোবায়াশি বা ক্যাপ্টেন ইশিগাকির সাথে আমার কথা বলিয়ে দাও। একটা সাহায্য চাই তাদের কাছে।”
“কি সাহায্য?”
“সরি, সেই বিষয়ে তোমাকে এখনই কিছু বলতে পারছি না।”
মাতসুমিয়ার মনে হচ্ছে ওর সাথে একজন নোভিসের মত আচরণ করছে কাগা। বিষয়টায় বিরক্ত হলো ও।
যেন ওর মনের কথা ধরতে পেরেই কাগা বললো, “পরে ওদের সাথে কথা বললেই জানতে পারবে সব।”
বিস্মিত হলেও এবারে আর মানা করলো না মাতসুমিয়া। বিভ্রান্তচিত্তে পকেট থেকে ফোনটা বের করে আনল। দু’বার রিং হতেই ফোন ধরলো কোবায়াশি। আকিও মায়েহারা যা যা বলেছে, সব খুলে বললো ও। সেই সাথে কাগার মতামত জানিয়ে বললো সে কথা বলতে চায়।
ফোনটা ভাইয়ের হাতে দিলে সেটা নিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলো সে। খানিকবাদে ফিরে এসে ওর হাতে ফোনটা তুলে দিল।
“তোমার সাথে কথা বলবে।”
আবার ওটা কানে চাপাল মাতসুমিয়া।
“ঘটনা বুঝতে পেরেছি আমি।”
“আমরা এখন কি করবো তাহলে?
“তোমাদের সময় দিচ্ছি আমি। কাগার একটা পরিকল্পনা আছে। ও যা বলছে, শোনো।”
“মায়েহারাদের এখনই থানায় নিয়ে এলে ভালো হতো না?”
“বললাম তো এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ক্যাপ্টেনকে আমি সব বুঝিয়ে বলবো।”
“ঠিক আছে,” ফোন কেটে দিতে উদ্যত হলো মাতসুমিয়া।
“শোন মাতসুমিয়া,” এসময় ওপাশ থেকে বলে কোবায়াশি। “কাগা কি করছে, সেটা খুব ভালো করে খেয়াল করো। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে তোমার।”
মাতসুমিয়া পুরো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পারলেও চুপ করে রইলো।
“গুড লাক,” বলে ফোন কেটে দিল ওর বস।
“এসবের মানে কি?” কাগাকে জিজ্ঞেস করে মাতসুমিয়া।
“খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে। একটা কথা শুনে রাখ আপাতত। একজন গোয়েন্দা কখনোই হুট করে সত্যটা জানতে পারে না। কখন এবং কিভাবে, এই প্রশ্ন দু’টোর উত্তর পাওয়াটা জরুরী।
“কপালে আবারো ভাঁজ পড়লো মাতসুমিয়ার। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়ে কাগা বললো, “এই বাড়িটায় একটা সত্য লুকিয়ে আছে। জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সেই সত্যটা আপনাআপনি বেরিয়ে আসবে, তা নয়। এই বাড়ির বাসিন্দারাই আমাদের সেই সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে। ধৈর্য্য ধরো।”