ভলিউম ১ – রূপালী মাকড়সা – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ১৯৮৫
০১.
আরে, আরে! হ্যানসন! চেঁচিয়ে উঠল রবিন মিলফোর্ড।
আরে লাগল…লেগে গেল তো…! প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল মুসা আমান।
বনবন স্টিয়ারিং ঘোরাল হ্যানসন, ব্রেক কষল ঘ্যাচ করে। পেছনের সিটে উল্টে পড়ল তিন গোয়েন্দা। টায়ারের কর্কশ আওয়াজ তুলে চকচকে একটা লিমোসিনের কয়েক ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল বিশাল রোলস রয়েস।
চোখের পলকে লিমোসিন থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন লোক। ড্রাইভিং সিট থেকে সবে নামছে হ্যানসন। তাকে এসে ঘিরে ফেলল। আঙুল তুলে শাসানর ভঙ্গি করছে, উত্তেজিত। কথা বলছে অদ্ভুত ভাষায়।
লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেল হ্যানসন। গাড়িতেই বসে আছে। লিমোসিনের শোফার। লাল পোশাক, কাঁধ আর হাতার কাছে সোনালি কাজ করা।
এই যে, মিস্টার, বলল হ্যানসন, এটা কি করলে? দিয়েছিলে তো মেরে!
আমি ঠিকই চালাচ্ছিলাম! উদ্ধত কণ্ঠ লোকটার। দোষ তোমার! সামনে পড়লে কেন? প্রিন্স দিমিত্রির গাড়ি দেখেছ, সরে যেতে পারনি?
ইতিমধ্যে সামলে নিয়েছে তিন গোয়েন্দা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লোকগুলোর দিকে। উত্তেজিত হয়ে প্রায় আস্ফালন শুরু করেছে হ্যানসনকে ঘিরে। ওদের মাঝে সবচেয়ে লম্বা লোকটা ইংরেজিতে বলে উঠল, বুদ্ধু কোথাকার! দিয়েছিলে তো প্রিন্সকে শেষ করে! সর্বনাশ করে দিয়েছিলে আরেকটু হলেই! তোমার শাস্তি হওয়া দরকার!
আমি ঠিকই মেনেছি, আপনাদের ড্রাইভারই ট্রাফিক আইন মানেনি, দৃঢ় গলায় বলল হ্যানসন। পুরোপুরি ওর দোষ।
কি প্রিন্স প্রিন্স করছে ওরা! রবিনের কানের কাছে বিড়বিড় করল মুসা। দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এক জানালার ওপর।
খবরের কাগজ পড় না নাকি? নিচু গলায় বলে উঠল রবিন। ইউরোপের ভ্যারানিয়া থেকে এসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সাতটা দেশের একটা। আমেরিকা দেখতে এসেছে।
খাইছে! কিশোরের মুখে শোনা বাঙালী বুলি ঝাড়ল মুসা। আরেকটু হলেই তো গেছিল!
দোষটা হ্যানসনের নয়! এই প্রথম কথা বলল কিশোর পাশা। চল নামি। সত্যিই কার দোষ, ওদেরকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার।
তাড়াহুড়া করে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। তাদের পর পরই লিমোসিনের পেছনের সিট থেকে নেমে এল আরেক কিশোর। রবিনের চেয়ে সামান্য লম্বা। কুচকুচে কালো চুল, লম্বা করে ইউরোপিয়ান ছাদে কাটা। বছর দুয়েকের বড় হবে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ।
থাম তোমরা! নিজের লোকদের ধমক লাগাল সে। সঙ্গে সঙ্গেই চুপ হয়ে গেল লোকগুলো। হাত নাড়তেই ঝটপট পেছনে সরে গেল ওরা। হ্যানসনের কাছে এগিয়ে এল ছেলেটা। ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি, চমৎকার শুদ্ধ ইংরেজি। আমার শোফারেরই দোষ।
কিন্তু, ইয়োর হাইনেস… বলতে গিয়েও বাধা পেয়ে থেমে গেল। লম্বা লোকটা। হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়েছে তাকে প্রিন্স দিমিত্রি। ফিরে চাইল তিন গোয়েন্দার দিকে।
কাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে, বলল প্রিন্স। দুঃখিত। তোমাদের ড্রাইভার খুব ভাল, তাই রক্ষে। নইলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেত!…বাহ্, গাড়িটা তো খুব সুন্দর! রোলস রয়েসটা দেখিয়ে বলল। কিশোরের দিকে তাকাল। মালিক কে? তুমি?
ঠিক মালিক নই, বলল কিশোর। তবে মাঝে মধ্যে মালিকের মতই ব্যবহার করি। রোলস রয়েস কি করে পেয়েছে ওরা, কতদিনের জন্য, সব কিছু ব্যাখ্যা করে বলার সময় এটা নয়।
কঙ্কাল দ্বীপ অভিযানের রিপোর্ট দিতে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে। ওখান থেকে ফেরার পথেই এই অঘটন।
আমি দিমিত্রি দামিয়ানি, ভ্যারানিয়া থেকে এসেছি, নিজের পরিচয় দিল রাজকুমার। এখনও প্রিন্স পদবী পাইনি। তবে আগামী মাসেই অভিষেক অনুষ্ঠান হবে। আমার লোকেরা জানে, আগে হোক পরে হোক, প্রিন্স আমিই হব, তাই ছোটবেলা থেকেই ওই নামে ডাকে। তোমরা কি পুরোদস্তুর আমেরিকান?
পুরোদস্তুর বলে কি বোঝাতে চাইছে দিমিত্রি, বুঝতে পারল না রবিন আর মুসা। চুপ করে রইল।
জবাব দিল কিশোর। ওরা দুজন আমেরিকান, দুই বন্ধুকে দেখিয়ে বলল সে। এখন আমিও তাই। বাবা এখানকার ন্যাশন্যালিটি পেয়ে গিয়েছিল। তবে, আসলে আমি বাঙালী, বাংলাদেশী।
পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসল রবিন আর মুসা। জীবনে কখনও চোখেও দেখেনি, তবু বাংলাদেশকে কতখানি ভালবাসে কিশোর পাশা, জানা আছে তাদের। তাই তার কথায় আহত হল না। আর তাছাড়া তেমন আহত হবার কোন কারণও নেই। ওরাও পুরোপুরি আমেরিকান নয়। একজনের রক্তে রয়েছে আইরিশ রক্তের মিশ্রণ, আরেকজনের দাদার বাবা ছিল খাঁটি আফ্রিকান।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। আমাদের পরিচয়।
কার্ডটা নিল দিমিত্রি।
তিন গোয়েন্দা
???
প্রধান: কিশোর পাশা
সহকারী: মুসা আমান
নথি, গবেষক: রবিন মিলফোর্ড
অপেক্ষা করে রইল তিন গোয়েন্দা কার্ড দেখে নতুন সবাই যা করে, তাই হয়ত করবে দিমিত্রি। প্রথমেই প্রশ্ন করবে, প্রশ্নবোধকগুলোর মানে কি।
ব্রোজাস! বলে উঠল দিমিত্রি। হাসল। সুন্দর করে হাসে রাজকুমার। ঝকঝকে সাদা দাঁত, মুসার মত। তবে মাড়ি বাদামী নয়, টুকটুকে লাল, ঠোঁটও তাই। ও, শব্দটার মানে বোঝনি? ভ্যারানিয়ান ভাষায় এর মানে, চমৎকার। তা, এই প্রশ্নবোধকগুলো নিশ্চয় তোমাদের প্রতীক চিহ্ন?
নতুন চোখে রাজকুমারের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। না, যা ভেবেছিল, তা নয়। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। দিমিত্রির প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল ওদের।
পকেট থেকে কার্ড বের করল দিমিত্রি। বাড়িয়ে দিল তিন। গোয়েন্দার দিকে। এটা আমার কার্ড।
কার্ডটা নিল কিশোর। দুপাশ থেকে তার গা ঘেঁষে এল রবিন আর মুসা, দেখার জন্যে। ধবধবে সাদা, চকচকে মসৃণ কার্ডটায় কালো কালিতে ছাপা: দিমিত্রি দামিয়ানি। নামের ওপরে একটা ছবি, উজ্জ্বল রঙে ছাপা। সোনালি জালের মাঝখানে বসে আছে একটা রূপালী মাকড়সা, এক পায়ে ধরে রেখেছে তলোয়ার। ছোট্ট ছবিতে এতগুলো ব্যাপার নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা খুব মুশকিল, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শিল্পী।
রূপালী মাকড়সা, বলল রাজকুমার। আমার, মানে ভ্যারানিয়ান রাজবংশেরই প্রতীক চিহ্ন এটা। নিশ্চয় অবাক হচ্ছ, একটা মাড়সা কি করে এত সম্মান পায়? সে অনেক লম্বা চওড়া কাহিনী, এখন বলার সময় নেই। একে একে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলাল দিমিত্রি। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি।
লিমোসিনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা কালো গাড়ি, প্রায় নিঃশব্দে। উত্তেজনা আর গোলমালে খেয়ালই করেনি তিন গোয়েন্দা। ওটা থেকে নামল এক তরুণ। হালকা-পাতলা, সুন্দর চেহারা। চোখে সদাসতর্কতা। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সে। এতক্ষণে দেখতে পেল তিন। গোয়েন্দা আমেরিকান যুবককে।
মাফ করবেন, ইয়োর হাইনেস, বলল যুবক। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের। এখনও অনেক কিছুই দেখা বাকি।
হোক বাকি, বলল দিমিত্রি। এদের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি ভাল লাগছে আমার। এই প্রথম আমেরিকান ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার। সুযোগ পেয়েছি।
তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরল আবার রাজকুমার। আচ্ছা, শুনেছি, ডিজনিল্যাণ্ড নাকি এক আজব জায়গা! দেখার অনেক কিছু আছে। ওখানে যাবার খুব ইচ্ছে আমার। তোমরা কি বল?
ডিজনিল্যাণ্ড সত্যিই একটা দেখার মত জায়গা, একবাক্যে স্বীকার করল তিন গোয়েন্দা। ওটা না দেখলে মস্ত ভুল করবে দিমিত্রি এটাও জানাল।
বডিগার্ডের সারাক্ষণ ঘিরে আছে, মোটেই ভাল লাগে না আমার, বলল রাজকুমার। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ডিউক রোজার, আমার গার্জেন, ভ্যারানিয়ার রিজেন্ট এখন। আমাকে চোখে চোখে রাখার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে গার্ডদের। যেন, অন্য কেউ আমার কাছে ঘেষলেই সর্দি লেগে মরে যাব! যত্তসব!…লোকের যেন আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, খালি আমাকে মারার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে! ভ্যারানিয়ার কোন শত্রু নেই, তারমানে আমারও নেই। কে আমাকে মারতে আসবে? খামোকা ঝামেলা!
ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কথা বলে ফেলল দিমিত্রি। চুপ করে গেল হঠাৎ। নীরবে দেখল তিন গোয়েন্দাকে। এক মুহূর্ত ভাবল কি যেন! তারপর বলল, তোমরা ডিজনিল্যাণ্ড যাবে আমার সঙ্গে? তোমাদের তো সব চেনা, দেখাবে আমাকে? খুব খুশি হব। বডিগার্ডের বদলে বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে দেখেও মজা পাব অনেক বেশি। চল না!
দিমিত্রির হঠাৎ এই অনুরোধে অবাক হল তিন গোয়েন্দা। দ্রুত আলোচনা করে নিল নিজেদের মাঝে। সারাটা দিন পড়ে আছে সামনে, কিছুই করার নেই তেমন। দিমিত্রির অনুরোধ রক্ষা করা যায় সহজেই। বরং ভালই লাগবে ওদের।
রোলস রয়েসে টেলিফোন রয়েছে। স্যালভেজ ইয়ার্ডে মেরিচাচীকে ফোন করল কিশোর। জানাল, ওর ফিরতে দেরি হবে। সোনালি রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে ফিরে চাইল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। দিমিত্রি।
লিমোসিনে গিয়ে উঠে বসল দিমিত্রি। বন্ধুদের ডাকল।
রাজকুমারের গাড়িতেই যেতে পারবে তিন গোয়েন্দা। হ্যানসনকে রোলস রয়েস নিয়ে চলে যেতে বলল কিশোর। তারপর গিয়ে উঠে বসল। লিমোসিনে। মুসা আর রবিনও উঠল। সামনে শোফারের পাশে বসেছে
লম্বা লোকটা।– কালো গাড়িটায় উঠল অন্যরা। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে বসতে হল। গাড়িটা আমেরিকান সরকারের। প্রিন্সের গাড়িকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে সঙ্গে দেয়া হয়েছে।
খুব রাগ করবেন ডিউক রোজার, মুখ গোমড়া করে রেখেছে লম্বা লোকটা। ঝুঁকি নিতে নিষেধ করেছেন তিনি।
কোন ঝুঁকি নিইনি, লুথার, কড়া গলায় বলল দিমিত্রি। তাছাড়া ডিউক রোজারের আদেশ মানতে আমি বাধ্য নই। আমার আদেশ মেনে। চলার সময় এসে গেছে তার। আর মাস দুয়েক পরই রাজ্য শাসন করব আমি। আমার কথাই তখন আইন, তার নয়। শোফারকে বলল, রিগো, খুব সাবধানে চালাবে। এটা তোমার ভ্যারানিয়া নয়, যে প্রিন্সের গাড়ি দেখলেই রাস্তা ছেড়ে দেবে লোকে। ট্রাফিক আইন মেনে চলবে পুরোপুরি। আর কোনরকম অঘটন চাই না আমি!
বিদেশী ভাষায় একনাগাড়ে কথা বলে গেল ডিউক লুথার। মুখচোখ কালো। মাথা ঝোঁকাল শোফার। গাড়ি ছেড়ে দিল।
মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে লিমোসিন, গতি মাঝারি। কোনরকম গোলমাল করল না আর শোফার। ঠিকঠাক মেনে চলল সব ট্রাফিক আইন। খুব সর্তক।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল ডিজনিল্যাণ্ডে পৌঁছাতে। সারাটা পথ তিন গোয়েন্দাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে এসেছে দিমিত্রি। আমেরিকা, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া সম্পর্কে জেনেছে অনেক কিছু। কখনও বাংলাদেশে আসেনি রাজকুমার। প্রায় কিছুই জানে না দেশটা সম্পর্কে। কিশোরের কাছে জানল অনেক কিছু। মুগ্ধ হয়ে গেল রাজকুমার। বলল, সুযোগ আর সময় পেলেই বাংলাদেশে ঘুরে যাবে সে। দেখবে ধানের খেত, মেঘনার চর, পদ্মার ঢেউ…শুনবে সন্ধ্যায় চৈতী শালিকের কিচির মিচির, বাঁশ বনের ছায়ায় দোয়েলের শিস, চাঁদনী রাতে শেয়ালের হুক্কাহুয়া…
গাড়ি পার্ক করল শোফার। নেমে পড়ল ছেলেরা। কালো গাড়ি থেকে প্রহরীরা নেমে পড়েছে আগেই।
ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে চলল ডিউক আর তার দলবল।
একটা জায়গায় এসে একটু পিছিয়ে পড়ল ডিউক, কিশোরের একেবারে গা ঘেঁষে এল দিমিত্রি। ফিসফিস করে বলল, ওদের ফাঁকি দিতে হবে। গায়ের ওপর থেকে খসাতে হবে!
আস্তে করে মাথা ঝোকাল কিশোর।
পুরো পার্ক চক্কর দিচ্ছে ছোট ট্রেন, বিচিত্র রঙের ইঞ্জিন, কামরা। খুদে স্টেশনে লোকের ভিড়। ওখানে এসে দাঁড়াল চার কিশোর। স্টেশনে এসে থামল একটা ট্রেন। পিলপিল করে নেমে এল যাত্রীরা। বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ওদের ভিড়ে মিশে গেল চারজনে। নতুন যাত্রী উঠল ট্রেনে। হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে লাফিয়ে একটা বগিতে উঠে বসল চার কিশোর। ডিউককে দেখতে পেল ওরা। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে ছেলেমেয়েদের মাঝে খুঁজছে দিমিত্রিকে। সরে চলে এল ট্রেন।
ট্রেনে বসেই পার্কের অনেক কিছু চোখে পড়ে। দেখল দিমিত্রি। কোটা কি; বুঝিয়ে দিল তিন গোয়েন্দা। বেশ আনন্দেই কাটল সময়টা। পুরো পার্ক একবার চক্কর দিয়ে আবার স্টেশনে এসে থামল গাড়ি। দাঁড়িয়ে আছে ডিউক লুথার। তাকে ঘিরে রয়েছে দেহরক্ষীরা। মুখচোখ কালো। নিশ্চয় প্রচুর বকাঝকা খেতে হয়েছে ডিউকের কাছে।
ট্রেন থামতেই চার কিশোরকে দেখে ফেলল ওরা। ছুটে এসে দাঁড়াল বগির সামনে।
মুখ গোমড়া করে ট্রেন থেকে নামল দিমিত্রি। ঝঝাল কণ্ঠে বলল, আমার সঙ্গে থাকনি তোমরা! ডিউটি ফাঁকি দিয়েছ। রিপোর্ট করব আমি ডিউক রোজারের কাছে।
কিন্তু…আ-আমি… তোতলাতে শুরু করল লুথার।
থাম! ধমকে উঠল দিমিত্রি। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল, চল, যাই। ইসস, আরও সময় হাতে নিয়ে আসা উচিত ছিল! কত কিছু দেখার আছে আমেরিকায়!
তিন বন্ধুকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল দিমিত্রি। পেছনের প্রহরী গাড়িতে করে আসার আদেশ দিল ডিউক লুথারকে। শোফার ইংরেজি জানে না। রকি বীচে ফেরার পথে মন খুলে কথা বলতে পারল চারজনে।
অনেক কিছু জানতে চাইল রাজকুমার। খুলে বলল সব তিন গোয়েন্দা। কি করে একসঙ্গে হয়েছে ওরা, কি করে গোয়েন্দা হওয়ার শখ জেগেছে, কি করে দেখা করেছে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের সঙ্গে, সব জানাল। সংক্ষেপে বলল ভূতুড়ে দুর্গ আর কঙ্কাল দ্বীপ অভিযানের কাহিনী।
ব্রোজাস! শুনতে শুনতে এক সময় চেঁচিয়ে উঠল দিমিত্রি। কি। আনন্দ! একেই বলে জীবন! আহা, আমেরিকান ছেলেরা কত স্বাধীন! ইসস, কেন যে রাজকুমার হয়ে জন্মালাম! আর কদিন পরেই কাঁধে চাপবে মস্ত দায়িত্ব। রাজ্য শাসন…আরিব্বাপরে! ভাবলেই হাত-পা হিম। হয়ে আসে!…স্বাধীন হব, হুহু! বাড়ি থেকেই বেরোতে দেয়া হয় না আমাকে! জীবনে কোনদিন স্কুলের মুখ দেখিনি! বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়াশোনা করিয়েছে! হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু আছে আমার, দেশে।…সত্যি বলছি, জীবনে এই প্রথম কয়েক ঘণ্টা আনন্দে কাটালাম! আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার জীবনে!
খানিকক্ষণ নীরবতা। তোমরা আমার বন্ধু হবে? অযাচিতভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি। খুব খুশি হব!
আমরাও খুব খুশি হব, বলল মুসা।
থ্যাঙ্ক ইউ! হাসল রাজকুমার। তোমরা জান না, জীবনে আজই প্রথম তর্ক করেছি ডিউক লুথারের সঙ্গে। তোমাদের সঙ্গে মিশেছি, এটা মোটেই ভাল লাগছে না তার। জানি, ফিরে গিয়ে সব লাগাবে রিজেন্টের কাছে। ব্যাপারটা মোটেই ভালভাবে নেবে না রোজার। না নিক। আর মাত্র দুয়েকটা মাস। তারপর ওদের পরোয়া কে করে!
প্রিন্সের কথা নিশ্চয় না মেনে পারবে না ডিউক রোজার, বলল রবিন।
না, পারবে না, বলল দিমিত্রি। সময় আসুক। বেশ কয়েকটা আঘাত অপেক্ষা করছে তার জন্যে! রহস্যময় শোনাল রাজকুমারের গলা।
রকি বীচে পৌঁছে গেল গাড়ি। দিমিত্রিকে বলে গেল কিশোর, কোন্ পথে যেতে হবে। দিমিত্রি তার ভাষায় বলল শোফারকে।
পাশা, স্যালভেজ ইয়ার্ডের বিশাল লোহার গেটের সামনে পৌঁছে গেল গাড়ি।
দিমিত্রিকে নামতে অনুরোধ করল কিশোর। ওদের হেডকোয়ার্টার দেখাবে।
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল দিমিত্রি। না রে, ভাই, সময় নেই। আজ রাতে এক জায়গায় ডিনারের দাওয়াত আছে। আগামীকাল সকালেই ফিরে যাব ভ্যারানিয়ায়।
রাজধানীতেই থাক নিশ্চয়? জানতে চাইল কিশোর। নাম কি?
হ্যাঁ। ডেনজো। কখনও গেলে দেখবে, কত বড় বাড়িতে থাকি! কয়েকশো বছর আগে তৈরি হয়েছিল বিশাল দুর্গের মত বাড়িটা। তিনশো কামরা। বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ছোট রাজ্য। আয় খুবই কম। বাড়ি মেরামত করারও পয়সা নেই আমাদের। অথচ রাজা!…নাহ্, আর দেরি করতে পারছি না। চলি। আবার হয়ত কখনও দেখা হবে, মাই ফ্রেণ্ডস!
বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গিয়ে লিমোসিনে উঠল দিমিত্রি। রাজকুমারের গা ঘেঁষে বসল লুথার। দেহরক্ষীরা উঠল।
ছেড়ে দিল গাড়ি। প্রতিটি জানালায় শুধু দেহরক্ষীর মুখ। লিমোসিনের পেছনে কালো এসকর্ট কার।
গাড়ি দুটো মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
একজন রাজকুমার এত ভাল হতে পারে, জানতাম না! কথা বলল, মুসা। কিশোর, কি ভাবছ? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছ…।
চোখ মিটমিট করে তাকাল কিশোর। ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিল আঙুল। ভাবছি…নাহ্, সত্যি আশ্চর্য।
কি?
সকালের ব্যাপারটা! অ্যাক্সিডেন্ট হয়েই যাচ্ছিল! হ্যানসন ঠিক সময়ে গাড়ি না থামালে…কেন, আশ্চর্য লাগেনি তোমাদের কাছে? কোনরকম খটকা লাগেনি?
আশ্চর্য! খটকা! মুসার মতই বিস্মিত হল রবিন। কপাল ভাল, অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি! এতে আশ্চর্যের কি আছে?
আসলে কি বলতে চাইছ, বলে ফেল তো! বলল মুসা।
রিগো, মানে দিমিত্রির শোফার, বলল কিশোর। পাশের রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে সামনে পড়ল। রোলস রয়েসটাকে দেখতে পায়নি, বললে মোটেই বিশ্বাস করব না। নিশ্চয় দেখেছে। ইচ্ছে করলেই গতি বাড়িয়ে আমাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। বরং ব্রেক কষেছে ঘ্যাচ করে। সময় মত হ্যানসন পাশ কাটাতে না পারলে সোজা গিয়ে লিমোসিনের গায়ে বাড়ি মারত রোলস রয়েস। দিমিত্রি যেখানে বসেছিল ঠিক সেখানে। মারাই যেত সে!
দুর্ঘটনার আগে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ, বলল মুসা। রিগোরও সেরকম কিছু হয়েছিল!
বিশ্বাস করতে পারছি না। এদিক ওদিক মাথা নাড়ল কিশোর। কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ঘাপলা রয়েছে।…যাকগে, এস যাই। চাচী হয়ত ভাবছে…
.
০২.
দিন কয়েক পর।
হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।
পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডের ভেতর আবর্জনার স্তূপের তলায় চাপা পড়ে আছে একটা ট্রেলার-মোবাইল হোম। ভাঙাচোরা। ওটাকে মেরামত করে নিয়ে নিজেদের গোপন আস্তানা বানিয়েছে তিন গোয়েন্দা। কয়েকটা গোপন পথ আছে, ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না!
কয়েক মিনিট আগে পিয়ন নিয়ে এসেছে সকালের ডাক। ইতিমধ্যেই মোটামুটি নাম ছড়িয়ে পড়েছে তিন গোয়েন্দার, অভিনেতা জন ফিলবি আর তার টেরর ক্যাসলের সৌজন্যে। অনেকেই চিঠি লেখে এখন ওদের কাছে। বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কিংবা ধনী বিধবা। কারও হয়ত বল হারিয়ে গেছে, কেউ এক বাক্স চিউইং গাম। খটুজে পাচ্ছে না, কিংবা কোন বিধবার আদরের বিড়ালটা হয়ত কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, আর ফেরেনি। খুঁজে বের করে দেবার ডাক আসে। গ্রাহ্য করে না কিশোর। এসব সাধারণ কাজ হাতে নেবার কোন ইচ্ছেই নেই তার-যদিও মুসার খুবই আগ্রহ, চিঠিগুলো সোজা ময়লা ফেলার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে গোয়েন্দাপ্রধান।
হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কুকুরটা খুঁজে দেবার অনুরোধ করে চিঠি পাঠিয়েছে এক বিধবা। এটাই পড়ছে রবিন, এই সময় বাজল টেলিফোন।
তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত টেলিফোন। ইয়ার্ডের কাজে চাচা চাচীকে সাহায্য করে ওরা অবসর সময়ে। পারিশ্রমিক হিসেবে মেরিচাচীর হাতে তৈরি আইসক্রীম-কেক আর হট-চকোলেট ছাড়াও নগদ কিছু টাকা পায় রাশেদ চাচার কাছ থেকে। ওখান থেকেই টেলিফোনের বিল দেয় ওরা। গোয়েন্দাগিরি করে স্রেফ শখে, এর জন্যে টাকাপয়সা নেয় না মক্কেলের কাছ থেকে।
ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিল কিশোর।
হ্যালো, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। তিন গোয়েন্দা। কিশোর পাশা বলছি।
গুড মর্নিং, কিশোর, স্পীকারে গমগম করে উঠল ভারি কণ্ঠস্বর। আগের মত মাইক্রোফোনের সামনে আর রিসিভার ধরতে হয় না, নতুন ব্যবস্থা করে নিয়েছে কিশোর। টেলিফোন লাইনের সঙ্গে কায়দা করে স্পীকারের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে। ওপাশ থেকে কেউ কথা বললেই বেজে উঠে স্পীকার। হেডকোয়ার্টারে বসা সবাই একসঙ্গে শুনতে পায় কথা। এ রিসিভারে চেপে বসল কিশোরের আঙুল। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসা আর রবিনের। কান খাড়া হয়ে গেছে। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার!
কিশোর, তোমাকে পেয়ে যাওয়ায় ভালই হল, আবার বললেন চিত্রপরিচালক, শিগগিরই একজন দেখা করতে যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে।
দেখা করতে আসছে? কোন কেস, স্যার?
টেলিফোনে কিছুই বলা যাবে না, জবাব দিলেন চিত্রপরিচালক। খুব গোপন ব্যাপার। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেছি আমি। অনেক কিছু জেনেছি, বুঝেছি। তোমাদের পক্ষেই সুপারিশ করেছি আমি। আশা করি, নিরাশ করবে না। হ্যাঁ, বিস্ময়কর এক প্রস্তাব আসছে তোমাদের কাছে। আগে থেকেই হুঁশিয়ার করে রাখছি। ভেবেচিন্তে কাজ কর।…রাখলাম।
লাইন কেটে গেল ওপাশে। রিসিভারের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে রইল কিশোর। ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল ক্রেডলে। স্তব্ধ নীরবতা ট্রেলারের ভেতর।
কি মনে হয়? আরেকটা কেস? অনেকক্ষণ পর কথা বলল রবিন।
কিশোর কিংবা মুসা কিছু বলার আগেই বাইরে শোনা গেল মেরিচাচীর ডাক। ট্রেলারের স্কাইলাইটের খোলা জায়গা দিয়ে বাতাস ঢোকে, ওখান দিয়েই আসছে।
কিশোর! বেরিয়ে আয় তো! একজন লোক দেখা করতে এসেছে। তোর সঙ্গে।
কয়েক মুহূর্ত পর। দুই সুড়ঙ্গের মত্ত পাইপের ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। একজনের পেছনে আরেকজন। চল্লিশ ফুট লম্বা পাইপ, হাঁটুতে খুব ব্যথা পেত আগে। তাই পুরানো কাপেট কেটে পেতে দিয়েছে ওরা ভেতরে।
লোহার পাতটা সরাল কিশোর। বেরিয়ে এল তাদের ওয়ার্কশপে। তার পেছনে বেরোল মুসা, তারপর রবিন। পাতটা আবার পাইপের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা জঞ্জালের বেড়ার অন্য পাশে।
মেরিচাচীর কাঁচঘেরা অফিসের পাশে একটা ছোট্ট গাড়ি। বনেটে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ।
দেখামাত্রই তাকে চিনল তিন গোয়েন্দা। দিমিত্রির সঙ্গে কালো এসকর্ট কারে ছিল ওই যুবক।
হাল্লো! তিন গোয়েন্দাকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়াল যুবক। হেসে এগিয়ে এল। আবার আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, নিশ্চয় ভাবনি সেদিন তো পরিচয় হয়নি, আজ হয়ে যাক। আমি বব ব্রাউন।—এই যে, আমার আইডেনটিটি।
পরিচয়পত্র দেখাল যুবক। সরকারী সিল-ছাপ্পর মারা।
আমি সরকারী লোক, কার্ডটা আবার পকেটে রাখতে রাখতে বলল যুবক। জরুরি কিছু কথা আছে। নিরাপদে বলা যাবে কোথায়?
আসুন ভাবনা চলছে কিশোরের মাথায়। সরকারী লোক; তিন গোফ্রেহ্মার কাছে এসেছে! জরুরি কথা! মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারও বার বার হুঁশিয়ার করেছেন। নাহ কিছু বুঝতে পারছে না সে।
তিন গোয়েন্দার ওয়ার্কশপে ববকে নিয়ে এল কিশোর। পুরানো দুটো চেয়ারের একটাতে বসতে দিল অতিথিকে। নিজে বসল আব্রেকটায়। মুসা আর রবিন বসল দুটো বাক্সের ওপর।
হয়ত বুঝতে পারছ, কেন এসেছি? কথা শুরু করল বব। তাকাল। তিন গোয়েন্দার দিকে।
কেউ কোন কথা বলল না।
ব্যাপারটা ভ্যারানিয়ার প্রিন্স দিমিত্রিকে নিয়ে, বলল আবার বব।
প্রিন্স দিমিত্রি! ভুরু কুঁচকে গেছে মুসার। কেমন আছে সে?
ভাল। তোমাদেরকে তার শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কিশোরের দিকে তাকাল বব। দুদিন আগে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। আগামী দুহপ্তার মধ্যেই অভিষেক অনুষ্ঠান শুরু হবে। তোমাদেরকে দাওয়াত পাঠিয়েছে সে।
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ইয়োরোপে যাব! সত্যি বলছেন তো?
সত্যিই বলছি, হাসল বব। তোমরা তার বন্ধু। আমেরিকার আর কোন ছেলেকেই সে চেনে না। দেশেও বন্ধুবান্ধব নেই খুব একটা। তাছাড়া, ভ্যারানিয়ায় কে যে তার বন্ধু, আর কে নয়, বোঝা খুবই মুশকিল। রাজকুমারের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে সবাই, তাকে তোয়াজ করে খুশি রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে আর যাই হোক, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। তাই, সত্যিকারের কয়েকজন বন্ধুকে কাছে রাখতে চায় অভিষেকের সময়।…আসল কথা কি জান, আইডিয়াটা আমিই ঢুকিয়েছি তার মাথায়।
আপনি? রবিন কথা বলল। কেন?
কারণ, আমাদের, মানে আমেরিকানদের কিছু স্বার্থ জড়িত রয়েছে, বলল বব। শান্তির দেশ ভ্যারানিয়া, অন্তত এতদিন তাই ছিল। কোন শত্রু নেই, সুইটজারল্যাণ্ডের মত। ওভাবেই থাকুক, এটাই চায় আমেরিকান সরকার। কোন শত্রুদেশ ওখানে আস্তানা গেড়ে আমাদের অসুবিধে করুক, এটা মোটেই কাম্য নয়।
কিন্তু, এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। ভ্যারানিয়ার মত ছোট দরিদ্র একটা দেশ কি এমন দিতে পারে আমেরিকাকে?
পারে, পারে। ছোট বলে ইঁদুরকে উপেক্ষা করা উচিত না সিংহের। ভ্যারানিয়া একটা স্পাই বেস, দুনিয়ার সব দেশের গুপ্তচরদের স্বর্গ। যাকগে, ওসব বলার দরকার নেই এখন। তো, তোমরা যাবে?
চোখ মিটমিট করছে তিন কিশোরই। যাবার জন্যে ওরা এক পায়ে খাড়া। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। যেমন, এতদূরে অজানা অচেনা জায়গায় যেতে মত দেবেন কিনা অভিভাবকেরা, খরচ দেবেন কিনা ইত্যাদি। বব ব্রাউনকে জানাল ওরা সে কথা।
ওসব কোন সমস্যাই না, বলল বব। রবিন আর মুসার বাবাকে ফোন করবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। তোমাদের সব দায়িত্ব আমার ওপর, সেকথা বলে দেবেন। কিশোরের চাচীর সঙ্গে আমি কথা বলব। মনে হয় না অরাজি হবেন। আর টাকা পয়সার কোন ভাবনা নেই। সব খরচ বহন করবে আমাদের সরকার। দেশের একটা সম্মান আছে, সেটা বজায় রাখতে হবে। যত খুশি খরচ কর ভ্যারানিয়ায়, পুরোদস্তুর। আমেরিকান সেজে থেক, কোন বাধা নেই।
হাসি একান-ওকান হয়ে গেল মুসার। রবিনের চোখও চকচক করছে। কিন্তু কিশোরের চেহারা দেখে বোঝা গেল না খুশি হয়েছে কি না।
কিন্তু, ভ্রূকুটি করল কিশোর, আমেরিকান সরকারের এত গরজ কেন? টাকা পয়সা খরচের ব্যাপারে কোন দেশের কোন সরকারই দরাজহস্ত নয়। আমাদের সরকারও এর বাইরে নন।
মিস্টার ক্রিস্টোফার বলেছেন, তোমরা খুব বুদ্ধিমান, হাসল বব। বুঝতে পারছি, ঠিকই বলেছেন। ঠিক আছে, বলেই ফেলছি। জুনিয়র এজেন্ট হিসেবে তোমাদেরকে ভ্যারানিয়ায় পাঠাতে চাইছেন ইউএস সরকার।
তারমানে…তারমানে প্রিন্স দিমিত্রির ওপর গুপ্তচরগিরি করতে… হতবুদ্ধি হয়ে গেছে যেন মুসা।
জোরে জোরে মাথা নাড়ল বব। মোটেই না। তবে চোখ খোলা রাখবে। সন্দেহজনক যে-কোন ঘটনা চোখে পড়ক, কিংবা কথা কানে আসুক, সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করবে। ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটছে ভ্যারানিয়ায়। শিগগিরই হয়ত বিস্ফোরণ ঘটবে। কি হচ্ছে বা হবে, কিছু জানি না আমরা। সেটা জানতে আমাদেরকে সাহায্য করবে তোমরা।
আশ্চর্য! ভুরু কুঁচকে আছে কিশোর। আমি জানতাম, গোপন খবর জানার অনেক উৎস আছে সরকারের…
মানুষ নিয়েই গঠিত হয়েছে সরকার, বাধা দিয়ে বলল বব। তাছাড়া, ভ্যারানিয়ায় কোন গোপন খবর খুবই শক্ত ব্যাপার। ছোট্ট দেশ ওটা, কিন্তু এমন কিছু মানুষের জন্ম দিয়েছে, দেশের জন্যে বিনা দ্বিধায় যারা প্রাণ দিয়ে দিতে পারে। দরিদ্র, তবু লোভী নয় ওদেশের মানুষ। বাইরের কোন সাহায্য ছাড়াই চালিয়ে নিয়েছে এতদিন। ওদের ভাঙা হয়ত সহজ, কিন্তু মচকানো প্রায় অসম্ভব। না খেয়ে থাকতে রাজি, তবু কারও কাছে হাত পাতবে না। যেচে পড়ে কেউ সাহায্য দিতে গেলেও নেবে না। দেশের স্বাধীনতাকে বড় বেশি মর্যাদা দেয় ওরা! থামল সে। তারপর বলল, তবে মক্কায়ও খারাপ লোক আছে। ভ্যারানিয়ার বর্তমান রিজেন্ট, ডিউক রোজার বুরবন তেমনি এক লোক। এটা অবশ্যই আমাদের সন্দেহ। তা না-ও হতে পারে। আমাদের সন্দেহ, দিমিত্রিকে প্রিন্স হতে দেবে না সে কিছুতেই। অভিষেক অনুষ্ঠানই হতে দেবে না। রাজ্য শাসন করছে অনেক দিন থেকে, এই লোভ সে ছাড়তে পারবে বলে মনে হয় না। যদি কোন অঘটন ঘটে ভ্যারানিয়ায়, সে-ই হবে এর হোতা।
নীরব রইল তিন কিশোর। খুশি খুশি ভাবটা চলে গেছে মুসা আর। রবিনের চেহারা থেকেও।
নিরপেক্ষ একটা দেশ, এর ঘরোয়া ব্যাপারে বাইরের কারও নাক গলানো উচিত না, আবার বলল বব। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, শিগগিরই সাংঘাতিক কিছু একটা করতে যাচ্ছে ডিউক রোজার, তখন আর ঘরোয়া থাকবে না ব্যাপারটা। বুঝতেই পারছ, আমাদের অস্বস্তির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা জানতে চাই, কি ঘটাতে যাচ্ছে রোজার। আমরা, বড়রা প্যালেসের ধারেকাছে ঘেষতে পারব না। দিমিত্রিও আমাদের কাছে মুখ খুলবে না কিছুতেই। তবে, তোমরা সহজেই ঢুকতে পারবে প্যালেসে, ওখানেই থাকতে পারবে, তোমাদের কাছে মনের কথা বলেও ফেলতে পারে প্রিন্স। গোলমালটা কি ঘটতে যাচ্ছে, আগেভাগে একমাত্র তোমাদের পক্ষেই জানা সম্ভব। তাছাড়া, ক্ষমতায় যারা রয়েছে, তোমাদেরকে সন্দেহ করবে না। অসতর্ক হয়ে কিছু একটা করে বসতে পারে তোমাদের সামনেই, যাতে অনেক কিছুই ফাস হয়ে যাবে।
এবারও কেউ কিছু বলল না শ্রোতারা।
তো, আসল কথায় আসা যাক, বলল বব। কাজটা নিচ্ছ। তোমরা?
কিশোরের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে রইল মুসা আর রবিন। সিদ্ধান্তের ভার গোয়েন্দাপ্রধানের ওপরই ছেড়ে দিল ওরা নীরবে।
গভীর চিন্তায় ডুবে আছে কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে একনাগাড়ে।
রাজনীতিতে জড়ানর কোন ইচ্ছেই আমার নেই, হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। তাছাড়া ওসব করার বয়েসও হয়নি এখনও, কিছুই বুঝি না। দেশের জন্যে ঘামানর অনেক বড় বড় মাথা রয়েছে। আমাদের কাজ ওসব নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের অভিভাবকদের খুলে বলতে হবে সব কথা। তারা যদি মত দেন, যাব। সে-ও শুধু প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্য করতেই, আর কোন কারণে নয়।
ব্যস ব্যস, ওতেই চলবে, হাত তুলল বব। বন্ধুকেই সাহায্য কর তোমরা। তবে একটা কথা। নিজে থেকে ঘুণাক্ষরেও বিপদের আভাস দেবে না দিমিত্রিকে। সে যদি বলে, বলুক। তোমরা কি কারণে গেছ, এটাও যেন কেউ না জানে। প্যালেসের সবাই জানবে, তোমরা বেড়াতে গেছ। খবরদার, অপরিচিত কারও কাছে প্রিন্স দিমিত্রি সম্পর্কে কোনরকম আলোচনা করবে না। জানিয়ে রাখছি, আট বছর আগে এক মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার বাবা। তখন থেকেই কোন কারণে ডিউকের উপর খেপে আছে ভ্যারানিয়ার জনসাধারণ। ওকে দেখতে পারে না তারা। যদি জানে, তোমরা স্পাই, বারুদে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি পড়বে। কাজেই চোখ খোলা রাখবে, কান সজাগ রাখবে, মুখ বন্ধ রাখবে।
তাহলে এবার অভিভাবকদের… বলতে গিয়ে বাধা পেল রবিন।
বলেছিই তো, সে ভার আমার, বলে উঠল বব। তাহলে উঠি। তোমরা যাবার জন্যে তৈরি হওগে। কালই ফ্লাইট।
.
০৩.
ভ্যারানিয়া! রাজধানী ডেনজো!
পাথরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। দেখছে প্রাচীন শহরটাকে। ভোরের সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে পুরানো বাড়িগুলোর টালির ছাতে, গাছের মাথায়। সরকারী ভবনগুলোর উঁচু টাওয়ারের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনার পাতে মোড়া। ঝিরঝিরে বাতাসে দুলছে গাছের ডাল, প্যালেসের দিকে মাথা নুইয়ে বার বার। অভিবাদন জানাচ্ছে যেন। প্রায় আধ মাইল দূরে ছোট একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল গির্জার সোনালি গম্বুজ।
নিচে তাকাল রবিন। রাজপ্রাসাদের পাথর মোড়ানো আঙিনায় কয়েকটা মেয়ে। হাতে ঝাড় আর বালতি। ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। প্রতিটি চৌকোনা পাথর।
পাঁচতলা পাথরের প্রাসাদের পেছনে বইছে ডেনজো নদী। চওড়া, খরস্রোতা। পুরো শহরটাকে পাক দিয়ে ঘিরে রেখেছে যেন রূপকথার বিশাল কোন রাক্ষুসে অজগর। নদীতে ছোট ছোট নৌকা, দাঁড় বেয়ে উজানভাটি করছে ধীরেসুস্থে। অপরূপ দৃশ্য। তিনতলার কোণের দিকে এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সবই চোখে পড়ছে রবিনের।
ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে কোন মিল নেই। বিশাল জানালা টপকে এসে ব্যালকনিতে নেমেছে মুসা। রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল। অনেক পুরানো শহর! দেখেই বোঝা যায়।
তেরোশো পঁয়তিরিশ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বলল রবিন। নতুন কোথাও যাবার আগে পড়াশোনা করে জায়গাটা সম্পর্কে আলামত জেনে নেয়া তার স্বভাব। বাড়ি থেকে একটা বই নিয়ে নিয়েছিল সঙ্গে, প্লেনে বসে পড়েছে। বার বার আক্রমণ করেছে হানাদাররা, ধ্বংস করে দিয়েছে প্রতিবারেই আবার নতুন করে গড়া হয়েছে শহর। তবে, সে সবই ষোলোশো পঁচাত্তরের আগে। তারপর ঘটল বিদ্রোহ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে। সেই বিদ্রোহ দমন করেন প্রিন্স পল, রাতারাতি জাতীয় লিগ বনে গেলেন তিনি। আমাদের জর্জ ওয়াশিংটনের মত। আবার গড়ি শহর। সে-ই শেষ। এখন যা কিছু দেখছ, বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে সেই তিনশো বছর আগে। নতুন শহর একটা গড়ে উঠছে অবশ্য, তবে এখান থেকে সেটা দেখা যায় না।
পুরানোটাই ভাল লাগছে আমার, বলল মুসা। আচ্ছা, দেশটা কত বড়, বলতে পার?
মাত্র পঞ্চাশ বর্গ মাইল, বলল রবিন। খুদে একটা দেশ। ওই যে দূরে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে, ওটা ভ্যারানিয়ার সীমান্ত। পা পাশটা পড়েছে এদেশের ভেতরে, ওপাশটা অন্য দেশ। ডেলজো উজান বেয়ে গেলে মাইল সাতে হবে। প্রচু আঙুরের ফলন হয়, এ ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে অনেক মদ চোলাইয়ের কারখানা। মসলিন জাতের মিহি কাপড় তৈরির কারখানা আছে বেশ কিছু। তবে, বেশির ভাগ বিদেশী টাকা আসে টুরিস্টদের কাছ থেকে। দেশটার অপরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্যে আসে তারা, ভিড় করে থাকে সাব্রা বছরই। শুধু এ কারণেই, বেশির ভাগ দোকানদার আজও পুরানো ফ্যাশন জিইয়ে রেখেছে। পুরানো ধাঁচের পোশাক পরে, আচাব্র ব্যবহার, কথাবার্তার ধরনও তিনশো বছরের পুরানো—
বাব্বাহ্! পুরোপুরি ভূগোলের ক্লাস! ব্যালকনিতে নেমে এসেছে কিশোর। পরনে স্পোর্টস শার্ট, বোতাম আঁটছে। সামনের দৃশ্য একবার দেখেই সমঝদারের মত মাথা নাড়ল। নাহ্, সুন্দর বলতেই হবে! সিনেমার সেটের জন্যে তৈরি করে রাখা হয়েছে যেনা মাস্টার সাব, বলতে পার গির্জাটার নাম কি? ওই যে পাহাড়ের চূড়ায়
সেইন্ট ডোমিনিকস, সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল রবিন। দেশের সবচেয়ে বড় গির্জা, একমাত্র সোনালি গম্বুজ। দুটো বেলটাওয়ার। বায়েরটাতে মোট আটটা ঘন্টা গির্জার কাজে আর জাতীয় ছুটির দিনগুলোতে বাজানো হয়। ডানের টাওয়ারে আছে মাত্র একটা। অনেক পুরানো, বি-শা-ল! নাম, প্রিন্স পলের ঘণ্টা। ইতিহাস আছে ওটার। ষোলোশো পঁচাত্তরে বিদ্রোহের সময় ওই ঘণ্টা বাজিয়ে ভক্তদের সাহায্য চেয়েছিলেন পল। জানিয়েছিলেন, বেঁচে আছেন তিনি। সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল ক্রুদ্ধ জনতা, ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহীদের। এরপর থেকে, রাজপরিবারের কাজেই শুধু ব্যবহার করা হয় ঘণ্টাটা।
যেমন? আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর।
যখন কোন প্রিন্সের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়, মানে মুকুট পরানো হয়, তখন একশো বার বাজানো হয় ওই ঘণ্টা, ধীরে ধীরে। যখন কোন রাজকুমার জন্ম নেয়, বাজানো হয় পঞ্চাশ বার, রাজকুমারী হলে পঁচিশ। রাজ-পরিবারে কারও বিয়ের সময় বাজে পচাত্তর বার। ঘণ্টাটার শব্দ বেশ গুরুগম্ভীর, তিন মাইল দূর থেকে শোনা যায় আওয়াজ!
মাস্টারি লাইনে গেলেই ভাল করতে, নথি, হাসল মুসা। খামোকা গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ।
চল, তৈরি হয়ে নিই, বলল কিশোর। দিমিত্রির সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। রয়্যাল চেম্বারলেন (রাজপরিবারের লোকজন আর বাড়িঘর দেখাশোনার ভার থাকে যার ওপর। আগের দিনে আমাদের দেশে জমিদারদের যেমন সরকার থাকত অনেকটা তেমনি।) খবর দিয়ে গেছে, আমাদের সঙ্গে নাস্তা করবে প্রিন্স।
তাই তো! খাবার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, বলে উঠল মুসা। পেটের ভেতর ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে গেছে।
তাড়াহুড়া করে লাভ হবে না, বলল কিশোর। এ তোমার নিজের বাড়ি নয় যে যা খুশি করতে পারবে। এটা রাজবাড়ি, এখানে কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ওগুলো মেনে চলতে হবে। খিদে লাগলেই খেতে বসে যেতে পারবে না। ওদের সময় হলে ডাকবে। মুষড়ে পড়া মুসার দিকে চেয়ে হাসল। এস, বসে না থেকে যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক করে রাখি। দেখতে হবে, সত্যিই কাজ করে কিনা ওগুলো! ভুলে যেয়ো না মত্ত দায়িত্ব নিয়ে এসেছি আমরা। কিশোরের পেছন পেছন ঘরে এসে ঢুকল ওরা আবার। মস্ত একটা স্ত্র। উঁচু ছাত। পাথরের দেয়াল কাঠের তক্তায় ঢাকা। হাত পিছলে যায়, এত মসৃণ। ছয় ফুট চওড়া বিশাল এক পালঙ্ক, একটাতেই তিনজনে ঘুমিয়েছে ওরা। ওটার মাথার দিকে দেয়ালের গায়ে একটা খোদাই কাজ, রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন।
একটা টেবিলের ওপর রয়েছে ওদের ব্যাগ। গত রাতে শুধু পাজামা আর টুথব্রাশ বের করেছিল।
অনেক রাতে রাজপ্রাসাদে পৌঁছেছে ওরা গতকাল। নিউ ইয়র্ক থেকে জেট প্লেনে প্যারিস, সেখান থেকে বিরাট এক হেলিকপ্টারে চেপে এসে নেমেছে ডেনজোর খুদে বিমানবন্দরে। বাইরে অপেক্ষা করছিল গাড়ি, ওদেরকে অভ্যর্থনা করে গাড়িতে তুলেছে রয়্যাল চেম্বারলেন। বিশেষ মীটিঙে ছিল তখন দিমিত্রি। বন্ধুদের সঙ্গে রাতে দেখা করতে পারেনি। অসংখ্য থাম আর অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে (মুসার মনে হয়েছে কয়েক মাইল পথ) এই বেডরুমে পৌঁছে দিয়ে গেছে ওদেরকে চেম্বারলেন। এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওরা, কোনমতে পোশক ছেড়ে, পাজামা পরে, দাঁত মেজেছে। তারপরই এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়।
ব্যাগ খুলে জামাকাপড় বের করল ওরা। গোছগাছ করল। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরানো একটা দেয়াল আলমারিতে তুলে রাখল ওগুলো। অন্যান্য জিনিসপত্রও সব তুলে রাখল আলমারির তাকে, তিনটে জিনিস ছাড়া।
তিনটে ক্যামেরা। দেখতে আর সব ক্যামেরার মতই, তবে ছবি ভোলা ছাড়াও আরও কিছু কাজ করে ওগুলো। বেশ বড়সড়, দামি জিনিস। চাঁদিতে বিচিত্র ফ্ল্যাশার। রেডিও হিসেবেও ব্যবহার করা যায় ক্যামেরাগুলোকে। ভেতরে বসানো আছে আধুনিক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি, শক্তিশালী একটা ওয়্যারলেস সেট। ফ্ল্যাশারটা অ্যান্টেনারও কাজ করে। ছবি তোলার ভঙ্গিতে ওই ক্যামেরা চোখের সামনে তুলে খুব নিচু গলায় কথা বললেও সেটা পৌঁছে যাবে মাইল দশেক দূরের গ্রাহকযন্ত্রে। শুধু পাঠানই না, মেসেজ ধরতেও পারে পরিষ্কার। বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকেও এর সীমানা দুই মাইল।
মাত্র দুই ব্যাণ্ডের কমুনিকেশন, নির্দিষ্ট একটা চ্যানেলে যাতায়াত করে এর শব্দ, ঠিক ওই চ্যানেলেই টিউন করা না থাকলে কোন রেডিও বা গ্রাহকযন্ত্রই ধরতে পারবে না মেসেজ। অসাধারণ একটা যন্ত্র। ওদের জানামতে এমন আর একটা মাত্র যন্ত্র আছে সারা ভ্যারানিয়ায়, সেটা আমেরিকান এমব্যাসিতে, বব ব্রাউনের কাছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে একই প্লেনে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছে বব। সেখানে একটা বিশেষ অফিসে নিয়ে গেছে তিন কিশোরকে। যন্ত্রপাতিগুলো দিয়েছে, কি করে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়েছে। বলেছে, ওদের কাছাকাছিই থাকবে সে সব সময়, তবে এমন ভান করবে, যেন চেনে না। যোগাযোগ করতে হলে, কোন কিছুর দরকার পড়লে, রেডিওতে জানাতে হবে। এছাড়াও রোজ রাতে নিয়মিত একবার যোগাযোগ করে খবরাখবর জানাতে হবে তাকে।
বিপদ আর পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে বার বার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, হয়ত সব কিছুই খুব সহজে হয়ে যাবে। কোনরকম বিপদ ঘটবে না। অভিষেক হয়ে যাবে, মাথায় মুকুট পড়বে নতুন প্রিন্স দিমিত্রি। তবে, সে আশা খুবই কম।..না না, কোন প্রশ্ন নয়। যা বলছি, শুনে যাও চুপচাপ। নিজেদের ব্যাপারে বাইরের কারোর নাক গলানো মোটেই পছন্দ করে না ভ্যারানিয়ানরা। ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে তোমরা, ছবি তুলবে। সতর্ক থাকবে সব সময়। আমেরিকান এমব্যাসিতে থাকব আমি। যখন খুশি যোগাযোগ করতে পারবে। এখানেই আমার সঙ্গে তোমাদের হয়ত শেষ দেখা। আলাদা প্লেনে প্যারিসে যাব আমি, তোমাদের সঙ্গে নয়। ওখান থেকে আলাদা প্লেনে ভ্যারানিয়া। নতুন কোন কিছু জানার দরকার পড়লে রেডিওতে জানাব, ওখানে পৌঁছে। তোমাদের সাঙ্কেতিক নাম, ফার্স্ট, সেকেণ্ড এবং রেকর্ড, ঠিক আছে? কপালের ঘাম মুছেছে বব।
মাথা ঝোকানর সময় কিশোরও ঘাম মুছেছে। এয়ারকন্ডিশন ঘরেও ঘেমে উঠেছিল ওরা। ববের ভাবসাব দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা। ফিসফিস করে রকি বীচে ফিরে যাবার কথাও কিশোরকে বলেছিল মুসা একবার। স্পাইদের বিপজ্জনক কাজকারবার ছবিতে অনেক দেখেছে। নিজেরাও স্পাইয়ের কাজ করবে একদিন, কল্পনাই করেনি তখন। ভাবছে এসব কথা এখন কিশোর।
তার ক্যামেরা তুলে নিয়ে চামড়ার খাপ খুলল মুসা। খাপের ভেতরে তলায় কায়দা করে বসানো ছোট আরেকটা খাপ। ওতে একটা খুদে টেপ-রেকর্ডার। বেশ শক্তিশালী। হাতে নিয়ে ওটা একবার দেখেই রেখে দিল আবার জায়গামত।
দিমিত্রির সঙ্গে দেখা করার আগে, নীরবতা ভাঙল মুসা, একবার বব ব্রাউনের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? যন্ত্রপাতিগুলো সত্যি কাজ করছে কিনা, শিওর হওয়া যায়।
ভাল বলেছ, সায় দিল কিশোর। ব্যালকনিতে গিয়ে ঘড়বাড়িগুলোর একটা ছবি তুলে আনি।
ক্যামেরা হাতে ব্যালকনিতে এসে নামল কিলোর। চামড়ার খাপ খুলে বের করল যন্ত্রটা। চোখের সামনে ধরে তাকাল দূরের সেইন্ট ডোমিনিকস গির্জার দিকে। টিপে দিল রেডিওর বোতাম।
ফার্স্ট বলছি, ভিউ ফাইন্ডারের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল কিশোর। ফার্স্ট রিপোর্টিং, শুনতে পাচ্ছেন?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল। মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে যেন কণ্ঠস্বরের মালিক। শুনতে পাচ্ছি, বব ব্রাউনের গলা, ঠিক চেনা যাচ্ছে। কোন কথা আছে?
যন্ত্রটা পরীক্ষা করছি। প্রিন্স দিমিত্রির সঙ্গে দেখা হয়নি এখনও। একসঙ্গে নাস্তা করব।
ভাল। সতর্ক থাকবে। আমাকে সব সময়ই পাবে। ওভার অ্যাণ্ড আউট।
চমৎকার! আপন মনেই বলল কিশোর। আবার এসে ঢুকল ঘরে। ঠিক এই সময় দরজায় টোকার শব্দ হল।
দরজা খুলে দিল মুসা। দাঁড়িয়ে আছে প্রিন্স দিমিত্রি দামিয়ানি। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে।
দুহাত বাড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে ঘরে ঢুকল, দিমিত্রি। খাঁটি ইউরোপীয় কায়দায় জড়িয়ে ধরল তিনজনকে। তোমরা এসেছ, কি যে খুশি হয়েছি!
অভ্যর্থনার পালা শেষ হল। জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি, ব্যালকনি থেকে কেমন লাগল আমার দেশ?
দারুণ! বলে উঠল মুসা।
এখনও তো কিছুই দেখনি, বলল দিমিত্রি। তবে এসে যখন পড়েছ, সবই দেখতে পাবে একে একে। চল, আগে নাস্তা সেরে নিই। এ দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল দিমিত্রি। নিয়ে এস। জানালার ধারে বসাও।
ঘরে এসে ঢুকল আটজন চাকর। টকটকে লাল পোশাকে সোনালি কাজ করা। বয়ে আনল একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর রূপার ঢাকনা দেয়া কিছু প্লেট। জানালার দিকে এগিয়ে গেল।
বন্ধুদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে গেল দিমিত্রি।
তুষার শুভ্র লিনেনের টেবিলক্লথ বিছাল চাকররা। তার ওপর রাখল রূপার ভারি বাসনগুলো। ঢাকনা তুলতেই ঘরের বাতাসে ভুরভুর করে। ছড়িয়ে পড়ল সুগন্ধ। আড়চোখে একবার টেবিলের দিকে না তাকিয়ে পারল না মুসা। ডিম আর মাংস ভাজা, টোস্ট মাখন, ভ্যারানিয়ান কেক! বড় জগে দুধ।
খাইছে! কত খাবার! ঢোক গিলল মুসা। দাদাভাইরা, আমি আর পারছি না। নাড়িভুড়ি সুদ্ধ হজম হয়ে যাচ্ছে খিদেয়!
হ্যাঁ হ্যাঁ, এস, তাড়াতাড়ি বলল দিমিত্রি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি বকর বকর করছি! এস, বসে পড়ি।…আরে, রবিন, তুমি কি দেখছ!
বেশ ছড়ানো একটা মাকড়সার জালের দিকে চেয়ে আছে রবিন। তার কাছ থেকে ফুট দুয়েক দূরে, খাটের মাথার কাছে, ঘরের এক। কোণে। দেয়ালে ঝুলছে জালটা। দেয়ালে বসানো তক্তা আর মেঝের মাঝখানের ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে একটা বড়সড় মাকড়সা। রবিন ভাবছে, দিমিত্রির অনেক চাকর-চাকরাণী আছে, অনেক কাজেই ওরা বিশেষ দক্ষ। তবে ঘর পরিষ্কারের কাজে ওরা ফাঁকি দেয়।
ওই যে, মাকড়সার জাল, বলল রবিন। দাঁড়াও, পরিষ্কার করে ফেলছি! পা বাড়াল সে।
তিন কিশোরকে অবাক করে লাফ দিল দিমিত্রি। প্রায় উড়ে এসে পড়ল রবিনের ওপর। এক ধাক্কায় ফেলে দিল মেঝেতে, জালটা ছিঁড়ে ফেলার আগেই।
স্তব্ধ হয়ে গেছে মুসা আর কিশোর। রবিনকে টেনে তুলল দিমিত্রি। বিড়বিড় করে বলছে কি যেন, ভ্যারানিয়ান ভাষায়!
আগেই তোমাকে সাবধান করা উচিত ছিল, আমারই ভুল হয়ে। গেছে, লজ্জিত কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল দিমিত্রি। তাহলে আর এটা ঘটত না! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে সময়মত রুখতে পেরেছি! নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত! এখুনি তোমাকে ফেরত পাঠাতে হত আমেরিকায়। রবিনের কাঁধে হাত রাখল সে। হঠাৎ গলার স্বর খাদে নেমে গেল। তবে, শুভলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তোমরা আমাকে সাহায্য করতে, পারবে!
ব্যথা পায়নি রবিন কোথাও। হাঁ করে চেয়ে আছে দিমিত্রির দিকে।
দরজার দিকে ঘুরল রাজকুমার। চেয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে থামল দরজার সামনে। হাতল। ধরে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লাল পোশাক পরা এক চাকর, চাকরদের সর্দার। কুচকুচে কালো চুল, কালো পাকানো গোঁফ।
রুকা, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কড়া গলায় বলল দিমিত্রি।
ইয়ে, মানে…ইয়োর হাইনেসের যদি কিছু দরকার হয়…
কিছু দরকার নেই। যাও। ঠিক আধঘণ্টা পর এসে প্লেটগুলো নিয়ে যাবে, খেঁকিয়ে উঠল দিমিত্রি।
মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল লোকটা, তারপর চলে গেল দ্রুতপায়ে।
দরজা বন্ধ করে দিল দিমিত্রি। ফিরে এল আবার তিন গোয়েন্দার কাছে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ডিউক রোজারের লোক। দরজায় কান পেতেছিল। কিছু জরুরি কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। তোমাদের সাহায্য চাই।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
অনেক কিছুই বলার আছে, আবার বলল রাজকুমার। আগে খেয়ে নিই, তারপর বলব। শুধু এটুকু জেনে রাখ, চুরি গেছে রূপালী মাকড়সা!
.
০৪.
প্রায় নীরবে খাওয়া সারল ওরা।
ঠিক আধঘণ্টা পর এল চাকরের দল। টেবিল-চেয়ার, প্লেট নিয়ে চলে গেল।
বাইরে একবার উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হয়ে এল দিমিত্রি। না, করিডরে ঘোরাফেরা করছে না আর রুকা। চলে গেছে।
ঘরে চেয়ার আছে। জানালার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বসল। চারজনে।
ভ্যারানিয়ার পুরানো ইতিহাস কিছু বলা দরকার আগে, শুরু করল দিমিত্রি। উনিশশো পঁচাত্তর সালে, প্রিন্স পলের অভিষেকের সময় বিদ্রোহ করে বসে কিছু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রিন্স। তাকে ঠাই দেয় এক মিনস্ট্রেল (মধ্যযুগীয় পেশাদার গায়ক। পয়সার বিনিময়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে লোকের মনোরঞ্জন করত।) পরিবার। প্রাণের তোয়াক্কা না করে প্রিন্সকে লুকিয়ে রাখে নিজেদের বাড়ির চিলেকোঠায়। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজল বিদ্রোহীরা। মিনস্ট্রেলের বাড়িতেও খুঁজল। পেয়ে যেত, যদি না চিলেকোঠার দরজায় জাল বুনত একটা মাকড়সা! আমাদের এখানকার চিলেকোঠা আর দরজা কেমন, বলে নিই। বাড়ির ছাতে ছোট একটা বাক্সের মত তৈরি হয় এই কোঠা, জিনিসপত্র রাখার জন্যে। নিচের দিকে একটা ডালামত থাকে, ওটাই দরজা। যাই হোক, ওই ডালার নিচে বড় করে জাল বুনেছিল মাকড়সাটা! দেখে মনে হয়েছে, অনেকদিন চিলেকোঠার ডালা খোলা হয়নি। ফলে ওখানে আর খুঁজে দেখেনি বিদ্রোহীরা।
তিনটে দিন আর রাত ওই চিলেকোঠায় বন্দি হয়ে রইলেন প্রিন্স। খাওয়া নেই, পানি নেই, কিছু নেই। জাল ছিঁড়ে যাবার ভয়ে ডালা খোলনি মিনস্ট্রেলরা, খাবার দিতে পারেনি। অবশেষে সুযোগ বুঝে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এলেন প্রিন্স। কোনমতে গিয়ে পৌঁছুলেন গির্জায়। ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকলেন ভক্তদের, জানালেন তিনি বেঁচে আছেন। দমন হয়ে গেল বিদ্রোহ।
সিংহাসনে বসে প্রথমেই স্বর্ণকারকে ডাকালেন প্রিন্স। একটা রূপার মাকড়সা বানিয়ে দিতে বললেন। সোনার চেনে আটকে লকেটের মত ঝুলিয়ে রাখবেন গলায়। ভ্যারানিয়ার রাজপরিবারের সীলমোহরে ব্যবহার হতে লাগল মাকড়সার প্রতীক। জাতীয় প্রাণী হিসেবে মর্যাদা পেল মাকড়সা। ধরে নেয়া হল, ওই বিশেষ জাতের মাকড়সা ভ্যারানিয়ার সৌভাগ্য বহন করছে। ওদের মারা নিষিদ্ধ করে দেয়া হল। শুধু তাই না, যারা একে মারবে, রাজদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হবে। তাদের। এরপর থেকেই বাড়িতে রূপালী মাকড়সার জাল ছেঁড়া বন্ধ করে দিল গৃহবধূরা। যত ময়লাই করে রাখুক, প্রাণীটাকে মারে না তারা।
আমার মা ভ্যারানিয়ায় থাকলে কবে ফাঁসি হয়ে যেত, বলে উঠল মুসা। কোন আইন করেই মাকড়সার জাল ছেঁড়া বন্ধ করানো যেত না তাকে দিয়ে। মার ধারণা, মাকড়সা একটা অতি নোংরা জীব, বিষাক্ত।
অথচ, ওরা ঠিক এর উল্টো, মুসার কথার পিঠে কথা বলল কিশোর! খুবই পরিষ্কার প্রাণী। সব সময় নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন রাখে। সব মাকড়সাই বিষাক্ত নয়। ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের কথা বলতে পার, তবে ওরা শুধু শুধু কামড়ায় না। বেশি বিবক্ত করলে তো তুমিও কামড়াতে আসবে, উইডোর আর কি দোষ? টারান্টুলার এত কুখ্যাতি, কিন্তু আসলে ওরাও তত বিপজ্জনক নয়। মানুষকে এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। ইউরোপের বেশির ভাগ মাকড়সাই কোন ক্ষতি করে না মানুষের। বরং পোকামাকড় খেয়ে উপকারই করে।
ঠিক, একমত হল দিমিত্রি। মানুষের ক্ষতি করে এমন কোন মাকড়সা নেই ভ্যারানিয়ায়। এখানে প্রিন্স পলের মাকড়সাই সবচেয়ে বড়, খুব সুন্দর। কালোর ওপর সোনালি দাগ। বাইরে থাকতেই পছন্দ করে, তবে মাঝেসাঝে এসে ঘরের ভেতর জাল পাতে। যে জালটা তুমি। ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিলে, রবিন, ওটা প্রিন্স পলের মাকড়সার। তোমাদের ঘরের ভেতর এসেছে, তারমানে শুভলক্ষণ বয়ে এনেছ তোমরা আমার জন্যে।
আমাকে বাধা দিয়ে ভালই করেছ, বলল রবিন। কিন্তু তোমার অসুবিধেটা কি?
ইতস্তত করল দিমিত্রি। তারপর মাথা নাড়ল। ভ্যারানিয়ায় কোন প্রিন্সের অভিষেকের সময় অবশ্যই ওই রূপালী মাকড়সা গলায় ঝোলাতে হবে তাকে। নইলে মুকুট পরানো হবে না। আর দুহপ্তা পরে অনুষ্ঠান, কিন্তু হবে না। আমি জানি।
কেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কারণ মাকড়সাটা চুরি গেছে, দিমিত্রির হয়ে বলল কিশোর। ওটা গলায় ঝোলাতে না পারলে অভিষেক হবে না।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল দিমিত্রি। আসলটা নিয়ে তার জায়গায় একটা নকল মাকড়সা রেখে গেছে চোর। নকল দিয়ে চলবে না। কাজেই, দুহপ্তার আগেই আসলটা খুঁজে পেতে হবে আমাকে। চুরি গেছে, এটা কাউকে জানাতে পারব না। আমাকে অলক্ষুণে ধরে নেবে দেশের লোক। এবং তাহলেই সর্বনাশ। কোনদিনই আর প্রিন্স হতে পারব না। আমি, থামল সে। এক মুহূর্ত কি ভাবল। তারপর বলল, হয়ত ভাবছ, সামান্য একটা রূপার মাকড়সা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? দেশটা আমাদের পুরানো, প্রাচীন রীতিনীতি এখনও মেনে চলি। আমরা। ছাড়তে পারব না কিছুতেই, একে একে তিনজনের দিকেই তাকাল রাজকুমার। তোমরা আমার বন্ধু। মাকড়সাটা খুঁজতে সাহায্য করবে আমাকে?
কেউ কোন জবাব দিল না।
নিচের ঠোঁটে একনাগাড়ে চিমটি কাটছে কিশোর।
দিমিত্রি, অবশেষে কথা বলল গোয়েন্দাপ্রধান। জিনিসটা কি। জ্যান্ত মাকড়সার সমান?
মাখা ঝোকাল দিমিত্রি। হ্যাঁ।
তারমানে খুবই ছোট। লুকিয়ে রাখা সহজ। নষ্টও করে ফেলে থাকতে পারে।
তা মনে হয় না, বলল দিমিত্রি। যে-ই নিয়েছে, বুঝেশুনেই নিয়েছে। ওটা তার দরকার। আমার মনে হয় লুকিয়েই রেখেছে। তবে, মস্ত বড় ঝুঁকি নিয়েছে চোর। ধরা পড়লে এর একমাত্র শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড। ডিউক রোজার হলেও মাফ নেই।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
জোরে একবার শ্বাস নিল দিমিত্রি। আমার সমস্যার কথা বললাম। কি করে সাহায্য করবে, বলতে পারব না। একটা লোক প্রস্তাব দিয়েছিল, অভিষেক অনুষ্ঠানে তোমাদেরকে দাওয়াত দিতে। প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছি আমি তোমাদের সাহায্য পাব বলেই। এখানে কেউ জানে না, তোমরা গোয়েন্দা। কাউকে জানানো হবে না। কিশোরের দিকে তাকাল রাজকুমার। তো, করবে সাহায্য?
জানি না! অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান।ছোট্ট একটা রূপার মাকড়সা, যেখানে খুশি লুকিয়ে রাখা যায়। খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তবে, চেষ্টা করতে পারি আমরা। প্রথমে দেখতে হবে, জিনিসটা কেমন, কোন জায়গা থেকে চুরি হয়েছে। নকলটা দেখে চেহারা বোঝা যাবে আসলটার?
যাবে। নকল করা হয়েছে নিখুঁতভাবে। এস, দেখাব।
ক্যামেরা তুলে নিল তিন গোয়েন্দা। দিমিত্রির পিছু পিছু বেরিয়ে এল করিডরে।
ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে চওড়া আরেকটা করিডরে নেমে এল ওরা। মেঝে, ছাত, দুপাশের দেয়াল, সব পাথরের।
তিনশো বছর আগে তৈরি হয়েছে এই প্যালেস, হাঁটতে হাঁটতে বলল দিমিত্রি। তারও আগে একটা দুর্গ ছিল এখানে। ভেঙে পড়েছিল। ওটাকেই মেরামত করে, সংস্কার করে, তার সঙ্গে আরও কিছু ঘর যোগ করে হয়েছে এই প্যালেস। ডজন ডজন খালি ঘর পড়ে আছে এখনও। বিশেষ করে, ওপরের দুটো তলায় যায়ই না কেউ। এতবড় বাড়ি ঠিকঠাক রাখতে হলে অনেক চাকর-বাকরের দরকার। ওদের পেছনে খরচ করার মত টাকা রাজপরিবারের নেই। তাছাড়া, ওই ঘরগুলো ভীষণ ঠাণ্ডা। আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে গরমের ব্যবস্থা করতে অনেক টাকা দরকার।
আগস্টের এই উত্তপ্ত সকালেও বাড়িটার ভেতরে খুব ঠাণ্ডা। শীতকালে কি ভীষণ অবস্থা হবে, অনুমান করতে অসুবিধে হল না তিন গোয়েন্দার।
দুর্গের ডানজন আর মাটির তলার ঘরগুলো আজও আগের মতই রয়েছে, আরেক সারি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল দিমিত্রি। অসংখ্য গোপন পথ, দরজা, সিঁড়ি রয়েছে ওগুলোতে যাবার। আমিই চিনি না সবগুলো। ঢুকলে সহজেই হারিয়ে যাব, বেরিয়ে আসতে পারব না আর। হাসল রাজকুমার। হরর ছবি শূটিঙের চমৎকার জায়গা। গোপন দরজা আর সুড়ঙ্গ দিয়ে ভূত আসবে-যাবে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। না না, ওরকম চমকে উঠ না, মুসার দিকে চেয়ে বলল সে। ভূত নেই প্যালেসে-ই যে, ডিউক ক্লোজার আসছে।
আরেকটা করিডরে এসে শেষ হয়েছে সিঁড়ি। লম্বা একজন লোককে তাড়াহুড়া করে আসতে দেখা গেল। সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা, মাখা সামান্য নুইক্সো অভিবাদন কবুলা দিমিত্রিকে।
গুডমর্নিং, দিমিত্রি বলো ডিউক ক্লোজার। এরাই আপনার। আমেরিকান বন্ধু? শীতল কণ্ঠস্বর। তার সঙ্গে মানিয়ে গেছে তার একহারা দীর্ঘ গড়ন, আর ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকানো নাকের নিচে ঝুলে পড়া কালো একজোড়া গোঁক।
গুড মর্নিং, ভিউক ক্লোজার, বলল দিমিত্রি। ঠিকই ধরেছেন। ওরাই আমার বন্ধু। পরিচয় করিয়ে দিল, কিশোর পাশা, মুসা আমাল, রবিন মিলফোর্ড। সবাই এসেছে ক্যালিফোর্নিফ্লা থেকে।
তিনজনের দিকে চেয়ে প্রতিবারে ইঞ্চিখানেক করে মাথা নোয়ালা রোজার। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিন্ত্রে আছে।
ভ্যারানিয়ায় স্বাগতম! বলল ডিউক ক্লোজার। একেবারে মাপজোক করা কথাবার্তা। বন্ধুদেরকে দুর্গ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন?
মিউজিয়মে নিয়ে যাচ্ছি, বলল দিমিত্রি। আমাদের দেশের ইতিহাস জানতে খুব আগ্রহী ওরা। বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, ডিউক রোজার বুরবন, ভ্যারানিক্সার বর্তমান ব্রিজেন্ট। শিকারে গিয়ে মারা পড়েছিল আমার বাবা। তারপর থেকেই প্রিন্সের প্রতিনিধি হয়ে ব্রাজ্যশাসনা করে আসছে—
প্রিন্স, বলে উঠল ক্লোজার, আমি সঙ্গে আসব মেহমানদের প্রতি একটা সৌজন্যবোধ আছে আমাদের। আপনি একা গেলে, ভাল দেখায় না।
ঠিক আছে, রাজি হল দিমিত্রি। কিন্তু ৰুবাতে অসুবিধে হল না তিন গোয়েন্দার, রোজারকে সঙ্গে নেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই রাজকুমারের। কিন্তু বেশিক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার দরকার নেই আপনার। কাজের ক্ষতি হবে। তাছাড়া একটু পরেই কাউন্সিলা মীটিঙে বসতে হবে।
হ্যাঁ, পেছনে পেছনো আসছে রোজার। অভিষেক অনুষ্ঠানে কি কি করতে হবে না হবে, সব ঠিক করতে হবে আজই। তা হলেও, কিছুটা সময় দিতে পারব এখন।
আর কিছু বলল না দিমিত্রি। বন্ধুদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। করিডরের একপাশে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তাদেরকে নিয়ে ঢুকে পড়ল বিশাল এক ঘরে।
অনেক উঁচু ছাত, দোতলার সমান। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে ছবি। কাঁচের বাক্সে বোঝাই হয়ে আছে পুরো ঘরটা। প্রাচীন সব ঐতিহাসিক জিনিস রক্ষিত রয়েছে ওগুলোতে। পতাকা, শীল্ড, মেডাল, বই এবং অন্যান্য আরও অনেক জিনিস। প্রতিটি বাক্সের গায়ে একটা করে সাদা কার্ড সাটা, তাতে ইংরেজিতে টাইপ করে লেখা রয়েছে ভেতরের জিনিসগুলোর নাম এবং সংক্ষিপ্ত বিব্রণ।
একটা বাক্সে একটা ভাঙা তলোয়ার। ওটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল তিন গোন্দো। কার্ডের লেখা পড়ে জানল, ওটা প্রিন্স পলের তলোয়ার। ১৬৭৫-এ ওটা দিয়েই যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।
এই যে, এই ঘরটাতেই রয়েছে আমাদের জাতির পুরো ইতিহাস, পেছন থেকে বলে উঠলা ডিউক রোজার। ছোট্ট দেশ, ক্ষুদ্র একটা জাতি আমরা, ইতিহাস তেমন কিছুই থাকার কথা না। নেইও। বিশাল এক দেশ থেকে এসেছেন, এসব নিশ্চয় ভাল লাগবে না। মনে হবে, অনেক বেশি প্রাচীন।
না না, মোলায়েম গলায় বলল কিশোর। মহান এক জাতি বলেই মালে হচ্ছে ভ্যারানিয়ানরা। বেশ ভাল লাগছে আমার।
আপনার দেশের অনেকের কাছেই আমাদের রীতিনীতি পছন্দ না, বলাল ব্রোজারি। মধ্যযুগীয় বর্বর বলে হাসাহাসি করে। এখন ভাল বলছেন বটে, তবে শিগগিরই বিক্ত হয়ে যাবেন।…ও হ্যাঁ, আমার এখুলি যেতে হবে। মীটিঙের দেরি হয়ে যাবে নইলে।
কারও কিছু বলার অপেক্ষা করল না ডিউক। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। শিওর, ও আমাদেরকে পছন্দ করেনি? লিচু গলায় বলল।
কারণ, তোমরা আমার বন্ধু, যোগ করল দিমিত্রি। আমার কোন বন্ধু থাকুক, চায় না সে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলি, কিংবা কথা বলি, এটাও অপছন্দ। বাদ দাও ওর কথা। এস, প্রি পলের ছবি দেখাচ্ছি।
দেয়ালে ঝোলানো লাইফ-সাইজ একটা ছবির সামনে নিয়ে এল ওদেরকে দিমিত্রি। দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা। উজ্জ্বল লাল পোর্শকে সোনালি বোতাম, হাতের তলোয়ারের মাখা মেঝের দিকে। সম্ভ্রান্ত। চেহারা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অন্য হাতটা সামনের দিকে বাড়ানো। তাতে বসে আছে একটা মাকড়সা। সত্যিই সুন্দর, কালোর ওপর সোনালি ছোপ
আমারি পূর্বপুরুষ, গর্বিত কণ্ঠে বলল দিমিত্রি। অপরাজেয় প্রিন্স পল। হাতে যেটা দেখছ, ওরকম, একটা মাকড়সা প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাঁর।
ছবিটা দেখছে তিন গোয়েন্দা। পেছনে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
ঘরে এসে ঢুকেছে দর্শকরা। বিভিন্ন ভাষায় কথা হচ্ছে, তারমাঝে ইংরেজিও আছে। বেশির ভাগই টুরিস্ট। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, হাতে গাইড বুক। দরজায় দাঁড়িয়েছে এসে দুজন প্রহরী। হাতে বল্লম। পরনে তিনশো বছর আগের ছাঁটের ইউনিফর্ম। সেই পুরানো কায়দায় ক্রস বানিয়ে ধরে রেখেছে দুটো বল্লম, কেউ ঢুকতে কিংবা বেরোতে গেলেই সালাম ঠুকে সরিয়ে নিচ্ছে। পেছনে ফিরে একবার দেখল মুসা, তারপর আবার তাকাল ছবির দিকে।
চার কিশোরের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল এক আমেরিকান দম্পতি।
বিচ্ছিরি! কানের কাছে কথা শোনা গেল মহিলার। দেখছ কি জঘন্য একটা মাকড়সা হাতে নিয়েছে!
শশশ! চাপা পুরুষ-কণ্ঠ। আস্তে বল! কেউ শুনে ফেলবে! ওটা ওদের জাতীয় জীব, সৌভাগ্য বয়ে আনে। বাজে মন্তব্য কোরো না!
আমি ওসব কেয়ার করি না, উদ্ধত কণ্ঠ মহিলার। সামনে পড়লে দেব জুতো দিয়ে মাড়িয়ে।
মুচকে হাসল মুসা আর রবিন। চোখ জ্বলে উঠল একবার দিমিত্রির। চারজনেই সরে এল ওখান থেকে।
ঘরের প্রায় প্রতিটি জিনিসই দেখল ওরা একনজর। একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন প্রহরী।
ভেতরে ঢুকব, সার্জেন্ট, গম্ভীর হয়ে বলল দিমিত্রি।
জোরে বুট ঠুকে স্যালুট করল প্রহরী। ইয়েস, স্যার! জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল এক পাশে।
চাবি বের করল দিমিত্রি। ঢুকিয়ে দিল তালায়।
ঠেলা দিতেই খুলে গেল পেতলের ফ্রেমে আটকানো ভারি কাঠের দরজা। ছোট আরেকটা ঘরে এসে দাঁড়াল চারজনে। ওপাশে আরেকটা দরজা। কম্বিনেশন লক। খুলল ওটা দিমিত্রি। আরেকটা ঘর, উল্টো পাশে আরেকটা দরজা, লোহার গ্রিলের। ওটাও খুলল সে।
ছোট, আট বাই আট ফুট একটা ঘরে এসে দাঁড়াল ওরা। ব্যাংকে মাটির তলায় টাকা রাখার একটা গুদাম যেন। ভল্ট।
একপাশে দেয়াল ঘেঁষে রাখা কাঁচের আলমারি। তাতে রাজপরিবারের গহনাপাতি, মুকুট, রাজদণ্ড, বেশ কিছু নেকলেস এবং আঙটি।
রানীর জন্যে, আঙুটি আর নেকলেসগুলো দেখিয়ে বলল দিমিত্রি। আগেই বলেছি, আমরা ধনী নই। খুব সামান্যই গহনা আছে। ওগুলোকেই ভালমত পাহারা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমরা। চল, আসল জিনিস দেখাই।
ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা একটা কাঁচের দেরাজ। ভেতরে সুন্দর একটা স্ট্যাণ্ড। তাতে রূপার চেনে ঝুলছে মাকড়সাটা। চোখে বিস্ময় তিন কিশোরের। একেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে জিনিসটাকে।
রূপার ওপর এনামেল, বলল দিমিত্রি। কালো এনামেলের ওপর সোনালি ছোপ দেয়া হয়েছে। আসলটা এরচেয়ে অনেক সুন্দর।
নকলটা দেখেই অবাক হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। আসলটা কত সুন্দর? এপাশ থেকে ওপাশ থেকে, ওপর থেকে নিচ থেকে, সব দিক। থেকেই জিনিসটাকে খুঁটিয়ে দেখল ওরা, যাতে দেখামাত্র চিনতে পারে আসলটা, অবশ্য যদি কপাল গুণে পায় ওরা!
গত হপ্তায় চুরি হয়েছে জিনিসটা, তিক্ত কণ্ঠে বলল দিমিত্রি। আমার সন্দেহ ডিউক রোজারকে। একমাত্র ওর পক্ষেই অকাজটা করা সম্ভব। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কিছু বলতে পারব না। ভ্যারানিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খুব নাজুক। সুপ্রীম কাউন্সিলের সব। মেম্বারই রোজারের লোক। ধরতে গেলে কোন ক্ষমতাই নেই এখন আমার। ওরা চায় না, আমি প্রিন্স হই। সবরকমে বাধা দেবার জন্যে। তৈরি হচ্ছে। তার প্রথম ধাপ, এই চুরি। সরিয়ে ফেলা হল রূপালী মাকড়সা, জোরে একবার শ্বাস টানল সে। আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। একটা মীটিঙ আছে আমার। বাইরে বেরোতে পারব না। তোমাদের সঙ্গে। শহর দেখতে চাইলে, তোমাদেরকে একা যেতে হবে। রাতে, ডিনারের পর দেখা হবে আবার।
ভল্ট থেকে বেরিয়ে এল ওরা। প্রতিটি দরজায় তালা লাগাল দিমিত্রি। মিউজিয়মে বেরিয়ে এল বন্ধুদের নিয়ে। করিডরে বেরিয়ে হাত মেলাল। কোন্ পথে বেরোতে হবে প্রাসাদ থেকে বলে দিল। বলে দিল, কোথায় গাড়ি অপেক্ষা করবে।
ড্রাইভারের নাম মরিডো, বলল দিমিত্রি। আমার খুব বিশ্বাসী। ওর সঙ্গে যেতে পার তোমরা নিশ্চিন্তে। একটু থেমে বলল, রাজকুমার হয়ে জন্মানো খুবই বিরক্তির ব্যাপার। জীবনের কোন স্বাদ নেই। তবু চিরদিন তাই থাকতে হবে আমাকে। যাকগে, ঘুরে এস। রাতে দেখা হবে।
ঘুরে করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল দিমিত্রি। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল দ্রুত।
মাথা চুলকাল রবিন। কিশোর, কি মনে হয়? মাকড়সাটা খুঁজে বের করতে পারব?,
ঠোঁট বাঁকাল কিশোর, কাঁধ ঝাঁকাল। জোরে একবার শ্বাস টেনে বলল, জানি না! কোন উপায় দেখছি না আমি!
০৫.
শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
দুধারের দৃশ্য বেশ লাগছে ছেলেদের কাছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়, সব কিছুই নতুন। এখানে ঠিক তার উল্টো। সব কিছুই অবিশ্বাস্য রকমের পুরানো। পাথরের তৈরি বাড়িঘর, কোথাও কোথাও হলুদ ইটের। বেশির ভাগ ছাত লাল টালির। প্রতিটি ব্লকের পর একটা করে ফোয়ারা। ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক। সেইন্ট ডোমিনিকসের সামনের আঙিনাতেই রয়েছে কয়েকশো।
পুরানো একটা ছাতখোলা বেড়ানর-গাড়ি। ড্রাইভার এক তরুণ, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। চমৎকার ইংরেজি বলে। নাম, মরিডো। গাড়িতে ওঠার পর পরই নিচু গলায় জানিয়েছে, তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারে তিন কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রিও তাকে খুবই বিশ্বাস করেন। ফিটফাট পোশাক পরনে।
ডেনজোর বাইরে পাহাড়ের কাছে চলে এল-গাড়ি। পাহাড়ী পথ ধরে উঠে গেল ওপরে। গাড়ি থেকে নেমে চূড়ায় গিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। ওখান থেকে ডেনজো নদী আর শহরের বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল আবার। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আমাদেরকে অনুসরণ করা হচ্ছে, নিচু গলায় বলল মরিডো। প্যালেস থেকে রেরোনর পর পরই পিছু নিয়েছে। পার্কে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের। ঘোরাফেরা করবেন, বিভিন্ন জিনিস দেখবেন। অনেক মজার জিনিস আছে। সাবধান, পেছনে ফিরে তাকাবেন না একবারও। ওদেরকে দেখে ফেলেছি, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেবেন না।
খুব কঠিন নির্দেশ! অনুসরণ করছে জানা সত্ত্বেও পেছনে ফিরে চাইতে পারবে না। কিন্তু কারা অনুসরণ করছে? কেন?
কি ঘটছে, জানতে পারলে ভাল হত, পথের দিকে চেয়ে আছে। মুসা। কেন আমাদেরকে অনুসরণ করছে? আমরা তো তেমন কিছুই। জানি না!
কেউ একজন হয়ত ভাবছে, জানি, বলল কিশোর।
এবং জানলে সত্যি ভাল হত, যোগ করল রবিন।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল মরিডো। বেশ বড় একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে ওরা। প্রচুর গাছপালা। লোকের ভিড়। বাজনার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
এটা আমাদের প্রধান পার্ক, গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল। মরিডো। ধীরে ধীরে হেঁটে মাঝখানে চলে যান। পেরিয়ে যাবেন ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড। দড়াবাজ আর ভাঁড়দের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন। ছবি তুলবেন। তারপর গিয়ে দাঁড়াবেন বেলুন বিক্রি করছে যে মেয়েটা, তার কাছে। ছবি তোলার প্রস্তাব দেবেন। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। আবার বলছি পেছনে তাকাবেন না। কোনরকম দুশ্চিন্তা করবেন না, অন্তত এখনও না।
এখনও না! মরিডোর কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। গাছপালার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। জোরাল হচ্ছে। বাজনার শব্দ। পেছনে ফিরে তাকাব না। কত আর সামনে তাকিয়ে থাকা যায়!
দিমিত্রিকে কি করে সাহায্য করতে পারি আমরা? নিচু গলায় বলল রবিন। অন্ধকারে হাতড়ে মরছি! শূন্য, কিছুই ঠেকছে না হাতে!
অপেক্ষা করতে হবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আমার ধারণা, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছি কি না, দেখার জন্যেই অনুসরণ করা হচ্ছে।
আরও খানিকটা হেঁটে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেক লোক। খুদে একটা ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে আটজন বাদক, হাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র। পরনে বিচিত্র উজ্জ্বল রঙের পোশাক। বাদকদলের নেতা মরিডোর। বয়েসী এক তরুণ। একটা নরম সুর বাজিয়ে থামল ওরা। প্রচুর। হাততালি আর বাহবা পেল। মাথা নুইয়ে শ্রোতাদের অভিবাদন জানিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা সুর ধরল। চড়া, দ্রুত লয়।
ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডের পাশ কাটিয়ে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সামনে পেছনে অনেক, লোক। একবার পেছনে তাকিয়ে ফেলল মুসা। কিন্তু কে অনুসরণ করছে, আদৌ করছে কিনা, বুঝতে পারল না।
শান-বাঁধানো একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালা ওরা ॥ ট্রাম্পোনি বসানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক উপভোগ্য খেলা দেখাচ্ছে দুজন দড়াবাজ। মাটিতে ডিগবাজি খাচ্ছে, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে লোক হাসাচ্ছে দুজন ভাড়। মাঝে মধ্যেই এগিয়ে এসে একটা ভাঙা পুরানো। ছোট কুড়ি বাড়িয়ে ধরছে সামনে। চেহারাটাকে হাস্যকর করে তুলে পয়সা চাইছে! কেউ মানা করছে না। হেসে দুএকটা মুদ্রা ফেলে দিচ্ছে ঝুড়িতে।
সার্কাসের জায়গার পরেই মেয়েটাকে দেখতে পেল ওরা ॥ সুন্দর দেশীয় পোশাক পরনে। হাতে সুতোয় বাধা এক গুচ্ছ বড় বড় বেলুন। সুললিত গলায় গান ধরেছে ইংরেজিতে কথাগুলো বড় সুন্দর। একটা করে বেলুন কিনে নেবার আমন্ত্রণ। কোন একটা ইচ্ছে মলে নিয়ে সেই বেলুন ছেড়ে দিতে হবে। ইচ্ছেটা আকাশের দূরতম প্রান্তে নিয়ে গিয়ে তারার দেশের কোন মনের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে বেলুন।
অনেকেই কিনছে। ছেড়ে দিচ্ছে সুতো, শাঁ করে শুন্যে উঠে পড়ছে গ্যাস ভরা বেলুন, যার যার ইচ্ছে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে নীল আকাশে। ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। তারপর টুক করে মিলিয়ে যাচ্ছে এক সময়।
ভাঁড়ের ছবি তোলো, মুসা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। দড়াবাজদের ছবি তুলছি আমি। রবিন, চারদিকে চোখ রাখী ॥ দেখ, আমাদেরকে লক্ষ্য করছে কিনা সন্দেহজনক কেউ।
ঠিক আছে, বলে ঘুরল মুসা। হাতের তালুতে মাথা রেখে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন দুই ভাড়। সেদিকে এগিয়ে গেল।
রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার খাপ খুলল কিশোর ॥ পরক্ষণেই বিরক্তিতে ছেয়ে গেল চোখ মুখ। ভাল অভিনেতা সে। দেখলে যে কেউ ধরে নেবে সত্যিই বুঝি ক্যামেরা খারাপ হয়ে গেছে তা বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল গোয়েন্দাপ্রধান।
রেডিওর বোতাম টিপে দিল কিশোর। নিচু গলায় বলল, কাস্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
স্পষ্ট, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল। ভলিউম কমিয়ে ব্রেখেছে কিশোর, কাজেই একেবারে কাছাকাছি না থাকলে কেউই শুনতে পাবে না কথা। কি অবস্থা?
ফেউ লেগেছে পেছনে, বলল কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রি সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছে। চুরি গেছে জাতীয় রূপালী মাকড়সা। নকল একটা ফেলে রেখে গেছে চোর।
তাই! অবাক মনে হল বব ব্রাউনের গলা। যা ভেবেছি, পরিস্থিতি তারচেয়ে খারাপ! সাহায্য করবে ওকে?
কি করে?
জানি না, স্বীকার করল বব। চোখ খোলা রাখ। কিছু না কিছু নজরে পড়বেই।ভেবেচিন্তে এগোতে পারবে তখন। আর কিছু
পার্কে রয়েছি। কারা অনুসরণ করছে জানি না।
জানার চেষ্টা কর। পরে জানাবে আমাকে ছেড়ে দাও। বেশিক্ষণ কথা বললে সন্দেহ করে বসতে পারে।
কেটে গেল যোগাযোগ।
ক্যামেরা ঠিক হয়ে গেছে যেন কিশোরের ॥ চোখের সামনে তুলে ধরল। ছবি তুলে গেলা একের পর এক
চারদিকে নজর ফেলল রবিন। অনেকেই চাইছে ওদের দিকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। কাউকেই সন্দেহ করতে পারল না সে। একজন ভাড় এসে দাঁড়ালা সামনে। ঝুড়ি বাড়িয়ে দিল। পকেট থেকে একটা মুদ্রা বের করে তাতে ফেলে দিল রবিন।
নতুন একটা আকর্ষণীয় খেলা শুরু করল দুই ভাড়। অন্যদিক থেকে সরে এসে তাদেরকে ঘিরে স্বরণ দর্শকরা। মেয়েটার কাছে একজনও নেই এখন।
এবার ওর ছবি তুলব, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। মুসাকে ডাকল ॥ তিনজনে এঙ্গিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটার সামনে।
ছবি তোলার প্রস্তাব দিল কিশোর। মাথা কাত করল মেয়েটা। ছবি উঠে গেল কিশোরের ক্যামেরায়।
হাসল মেটো। গুচ্ছ থেকে একটা বেলুন বের করে বাড়িয়ে ধরল। একটা বেলুন কিনুন। মনে কোন ইচ্ছে নিয়ে ছেড়ে দিন আকাশে। ঠিক পৌঁছে দেবে মেঘের দেশের কারও কাছে।
পকেট থেকে একটা আমেরিকান ডলার বের করল মুসা। দিল। মেয়েটাকে। তিনজনের হাতেই একটা করে বেলুন ধরিয়ে দিল মেয়েটা। ডলারটা ছোট থলেতে রেখে খুচরো বের করল। বেলুনের দাম রেখে বাকি মুদ্রাগুলো এক এক করে কেলাতে লাগল মুসার হাতে। যেন গুনে গুনে দিচ্ছে, এমনি ভাবভঙ্গি। নিচু গলা বলল, চর লেগেছে। একজন পুরুষ একজন মহিলা। লোক সুবিধের মনে হচ্ছে না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে হয়ত। একটা টেবিলে বসে পড়ন আইসক্রীম কিংবা অন্য কিছু খান। কথা বলার সুযোগ দিন ওদের।
পয়সা দিয়ে পিছিয়ে গেল মেটো।
দিমিত্রিকে সাহায্য করতে চাই, তিনজনের মনেই এক ইচ্ছে। সুতো ছেড়ে দিল। শাঁ করে শূন্যে উঠে পড়ল বেলুন। লাল, হলুদ, সবুজ। অনেক ওপরে তিনটি কালো বিন্দুতে পরিণত হল। মিলিয়ে গেল পরক্ষণেই।
খানিক দূরেই ঘাসে ঢাকা একটা খোলা জায়গা! তাতে টেবিল চেয়ার পাতা। মোটা কাপড়ের টেবিলক্লথ, লাল-সাদা চেক। একটা টেবিল বেছে নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল তিন কিশোর। এগিয়ে এল একজন ওয়েটার। মোটা গোঁফ। আইসক্রীম হট-চকোলেট স্যাণ্ডউইচ?
অর্ডার দিল কিশোর। চলে গেল ওয়েটার।
চারপাশে তাকাল তিন গোয়েন্দা। ঠিক পেছনেই ওদেরকে দেখতে পেল রবিন। সেই আমেরিকান দম্পতি। সকালে প্রিন্স পলের ছবি দেখার সময় যারা পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। হুমম! তাহলে এরাই!
ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল দম্পতি। একটা টেবিল পছন্দ করল। তিন গোয়েন্দার ঠিক পাশেরটা। কফির অর্ডার দিয়ে হেলান দিল চেয়ারে। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে হাসল।
তোমরা আমেরিকান, না হেসে জিজ্ঞেস করল মহিলা। স্বর কেমন খসখসে।
হ্যাঁ, ম্যাডাম্, জবাব দিল কিশোর। আপনারাও আমেরিকান
নিশ্চয়। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছি। তোমাদের মতই।
স্থির হয়ে গেল কিশোর। ওরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে, কি করে জানল দম্পতি।
মহিলা ভুল করে বসেছে, বুঝে গেল পুরুষটি ধামাচাপা দেবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ক্যালিফোর্নিয়া থেকেই তো এসেছ তোমরা, না-কি? ক্যালিফোনিয়ান ছেলেদের মতই কাপড়-চোপড় পরেছ।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। ক্যালিফোর্নিয়া থেকেই। গতরাতে এসেছি।
সকালে মিউজিয়মে দেখেছি তোমাদের, বলল মহিলা। আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে ছিল, ও প্রিন্স দিমিত্রি না?
মাথা ঝোঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। বন্ধুদের দিকে ফিরল। আইসক্রীম আসতে দেরি আছে। চল, হাত মুখ ধুয়ে আসি। ধুলোবালি লেগেছে। ওই যে, ওপাশে ওয়াশরুম লেখা রয়েছে। চল।
পাশের টেবিলের দম্পতির দিকে তাকাল কিশোর। আমরা হাতমুখ ধুতে যাচ্ছি। ক্যামেরাগুলো রইল টেবিলে। একটু দেখবেন? এই যাব আর আসব আমরা।
নিশ্চয় খোকা, হাসল লোকটা। নিশ্চিন্তে যাও। ক্যামেরা চুরি যাবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে সার্কাসের অন্য পাশে চলে এল গোয়েন্দাপ্রধান। খানিক দূরেই ওয়াশরুম!
কি ব্যাপার? পাশে হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে বলল মুসা। ক্যামেরাগুলো ফেলে এলে কেন?
শশশ। হুশিয়ার করল কিশোর। এখন কোন কথা নয়।
আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাছাকাছি কেউ নেই। অনেক কমে এসেছে হাতের বেলুনের সংখ্যা। তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিচু গলায় বলল কিশোর, দম্পতির দিকে চোখ রাখুন। ক্যামেরাগুলো ধরলেই আমাদের জানাবেন। মিনিটখানেক পরেই আসছি।
চুপচাপ রইল মেয়েটা, যেন শোনেইনি কথাগুলো।
কয়েকটা বড় বড় গাছের তলায় একটা পাথরের বাড়ি, ওয়াশরুম। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
উদ্দেশ্যটা কি তোমার? ঢুকেই জিজ্ঞেস করল মুসা।
এগিয়ে গিয়ে একটা বেসিনের ওপরের কল খুলে দিল কিশোর। নিচু গলায় বলল, ওরা দুজন কথা বলবেই। বেফাঁস কিছু বলেও ফেলতে পারে।
তাতে আমাদের কি লাভ? ফস করে বলল রবিন। কলের তলায়। হাত পেতে দিয়েছে।
টেপ-রেকর্ডারটা চালু করে দিয়ে এসেছি, বলল কিশোর। ওদের কথাবার্তা টেপ হয়ে যাবে। আর কোন কথা নয় এখন। কাছাকাছি লোক আছে। কে যে কি, বলা যায় না!
নীরবে হাতমুখ ধোয়া সারল ওরা। বেরিয়ে এল বাইরে। ধীর পায়ে এগোল। মেয়েটার পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার তাকাল কিশোর। আধ ইঞ্চি মত মাথা নাড়ল মেয়েটা।
যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি রয়েছে ক্যামেরা তিনটে। ছোঁয়নি কেউ। কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দম্পতি।
ক্যামেরার ধারেকাছেও আসেনি কেউ, হেসে বলল লোকটা। সৎলোকের দেশ। তোমাদের আইসক্রীম নিয়ে এসেছিল ওয়েটার, পরে আসতে বলে দিয়েছি। ওই যে, আসছে।
ট্রে-তে খাবার নিয়ে এসে দাঁড়াল ওয়েটার। নামিয়ে রাখল স্যাণ্ডউইচ, হট-চকোলেট আর আইসক্রীমের পাত্র।
দুপুর হয়ে এসেছে। একবারে লাঞ্চ সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল তিনজনে। আরও কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করল।
আর কয়েক মিনিট পরেই খাওয়া শেষ হয়ে গেল দম্পতির। তিন গোয়েন্দাকে গুড বাই জানিয়ে উঠে চলে গেল।
আমাদের সঙ্গে বিশেষ কিছুই বলল না, বলল মুসা। নিশ্চয় মত বদলেছে।
ওরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে থাকলেই আমি খুশি, বলল কিশোর। সবকটা টেবিল খালি। এখনও খাওয়ার জন্যে আসতে শুরু করেনি লোকে। নিজের ক্যামেরাটা টেনে নিল। নিচের দিকের একটা বোতাম টিপে রি-ওয়াইণ্ড করে নিল ক্যাসেটের ফিতে। ভলিউম কমিয়ে। রেখে প্লে বোতামটা টিপে দিল। প্রথমে ফিসফাস শব্দ, তারপরেই স্পষ্ট কথা। আমেরিকান লোকটার গলা।
উত্তেজিত হয়ে পড়ল রবিন। চাপা গলায় বলে উঠল, হয়েছে! কাজ হয়েছে…
শশশ! রবিনকে থামিয়ে দিল কিশোর। শুনি, কি বলে! খাওয়া বন্ধ কোরো না। ক্যামেরার দিকে তাকিও না।
আবার টেপ রি-ওয়াইও করে নিল কিশোর। প্রথম থেকে চালু করল। আরও কমিয়ে দিল ভলিউম। পাশের টেবিল থেকেও কেউ শুনতে পাবে না এখন।
নিজেদের মধ্যে কথা বলছে দম্পতি:
পুরুষ: খামোকাই পাঠিয়েছে আমাদেরকে, টেরা। ওই ছেলে তিনটে গেয়েন্দা হলে আমার নাম পাল্টে রাখব।
মহিলা: ভুল খুব একটা করে না টেরা। ও বলেছে, ছেলে তিনটে খুবই চালাক-চতুর। তিন গোয়েন্দা বলে নিজেদেরকে।
পুরুষ: ওই বলা পর্যন্তই। গোয়েন্দাগিরির গ-ও জানে না ওরা। বড় মাথা যে ছেলেটার, ওটা তো একটা বুদ্ধ। চেহারা দেখেই বোঝা যায়। হাবাগোবা, একটা গরু!
চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। মুখ টিপে হাসল। গ্রাহ্য করল না কিশোর। কোনরকম ভাবান্তর নেই চেহারায়। ওকে বোকা ভাবুক, এইই চেয়েছিল।
মহিলা: টেরার ধারণা, ওরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সি.আই. এ.-র হয়ে কাজ করছে ছেলে তিনটে।
পুরুষ: আরে দুত্তোর! সারাক্ষণই তো পেছনে লেগেছিলাম। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখেছ? কথা বলেছে? বড়লোকের বাচ্চা। স্রেফ টাকা ওড়াতে এসেছে এখানে।
মহিলা: কোন কথাই তো বললে না ওদের সঙ্গে। ডিউক রোজারের কথা তোলা উচিত ছিল, নয় কি?
পুরুষ: মোটেই না। ভুল করেছে টেরা। ওরা গোয়েন্দা হতেই পারে না।
মহিলা: আচ্ছা, ডিউক রোজারের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলেছে নাকি টেরা? আমার সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। তুমি তো অনেকক্ষণ ছিলে? কিছু বলেছে?
সতর্ক হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। কান খাড়া করল।
পুরুষ: বলেছে। দিমিত্রিকে সিংহাসনে বসতে দেবে না রোজার। সরিয়ে দেবে কোনভাবে। নিজে স্থায়ী রিজেন্ট হয়ে বসবে। তখন আমাদের আর ব্রায়ানের দলই হবে দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা।
মহিলা: গলা নামাও! কেউ শুনে ফেলবে!
পুরুষ: কাছেপিঠে কেউ নেই, কে শুনবে? রিলটা, কি সাংঘাতিক ব্যাপার হবে ভেবে দেখেছ! এমনি একটা কিছুরই স্বপ্ন দেখছিলাম এতদিন। ডিউক রোজার একবার ক্ষমতায় আসতে পারলেই আর আমাদের পায় কে? ছোট হোক, কিন্তু একটা দেশের মালিক হয়ে যাব, ভাবতে পার!
মহিলা: মন্টি কার্লোর মতই আরেকটা কিছু গড়ে তুলব আমরা!
পুরুষ: তার চেয়ে ভাল ব্যাংকিং সুবিধে দেব লোককে। যত খুশি কালো টাকা এনে জমাক, কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। তাদের দেশের সরকারের কাছ থেকে পুরোপুরি গোপন রাখা হবে কথাটা। বড় বড় অপরাধীরা এসে এখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে। ওদেরকে বরং ঠাই দেব আমরা। অবশ্যই অনেক টাকার বিনিময়ে। যে-কোন দেশ থেকে যা খুশি করে আসুক যে-কোন লোক, এখানে এসে পড়তে পারলে সে নিরাপদ। ধনী অপরাধীদের স্বর্গ হয়ে উঠবে ভ্যারানিয়া।
মহিলা: শুনতে তো ভালই লাগছে। কিন্তু যদি ডিউক রোজার রাজি না হয় এসব করতে?
পুরুষ: ধ্বংস করে দেব। ক্ষমতায় থাকতে হলে আমাদের কথা মানতেই হবে। রিটা, রসাল একটা আপেলে পরিণত হবে এই ভ্যারানিয়া। আমরা সবাই খুঁটে খাব।
মহিলা: চুপ! আসছে ওরা…
চুপ হয়ে গেল স্পীকার। বোতাম টিপে সেট অফ করে দিল কিশোর।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। বব ব্রাউন যা অনুমান করেছে, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা! অপরাধীদের স্বর্গ!
তাকে এখুনি জানানো দরকার! বলে উঠল রবিন।
হ্যাঁ, ধীরে ধীরে মাখা ঝোকাল কিশোর। পুরো টেপটাই শোনানো দরকার তাকে। তবে এখন নয়। তাতে অনেক সময় লাগবে। সন্দেহ করে বসতে পারে কেউ। মূল ব্যাপারটা শুধু জানানো যায় এখন।
ক্যামেরা তুলে নিল কিশোর। ফিল্ম বদলাচ্ছে যেন, এমনি ভাবসাব। টিপে দিল রেডিওর বোতাম।
ফার্স্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
পাচ্ছি, বলল বব ব্রাউন। নতুন কিছু?
টেপে কি কি শুনেছে, সংক্ষেপে জানাল কিশোর।
খুব খারাপ! বলল বব। মহিলা আর লোকটার চেহারা কেমন?
বর্ণনা দিল কিশোর।
মনে হচ্ছে, পিটার জোনস আর তার স্ত্রী। জুয়াড়ী। নেভাডায় বাস। ভয়ানক এক অপরাধী সংস্থার সদস্য। আর যে দুজন লোকের কথা বলল, নিশ্চয় আলবার্ট ট্যাঙ্গোরা, ওরফে টেরা, এবং ব্রায়ান বেরেট। সাংঘাতিক দুই খুনে। ওই সংস্থার সদস্য। যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি মারাত্মক ষড়যন্ত্র!
আমাদের এখন কি করণীয়? জানতে চাইল কিশোর।
প্রথম সুযোগেই হুঁশিয়ার করে দেবে প্রিন্স দিমিত্রিকে। সব কথা জানাবে। আগামীকাল সকালে চলে আসবে আমেরিকান এমব্যাসিতে। প্যালেসে থাকা এখন নিরাপদ নয় তোমাদের জন্যে। দিমিত্রিকে সাহায্য করতে একপায়ে খাড়া আছি আমরা, তবে আমাদের সাহায্য চাইতে হবে তাকে। গায়ে পড়ে কিছু করতে যাব না। থামল বব। তারপর বলল, অনেক বেশি খবর জোগাড় করে ফেলেছ তোমরা। এতটা আশা করিনি। তবে, এখন থেকে খুব সাবধান! সব সময় সতর্ক থাকবে! ওভার অ্যাণ্ড আউট!
.
০৬.
সারাটা বিকেল শহর আর তার আশপাশের মনোরম দৃশ্য দেখে কাটাল তিন, গোয়েন্দা। প্রাচীন কিছু দোকানপাট দেখল, একটা মিউজিয়মে দেখল পাঁচ-ছশো বছর আগের অনেক ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। একটা প্রমোদতরীতে করে ডেনজো নদীতে কাটিয়ে এল কিছুক্ষণ। চলে গিয়েছিল নদীর একেবারে উৎসের কাছাকাছি।
গাড়িতে চড়ার খানিক পরেই মরিডো জানিয়েছে, আবার চর লেগেছে পেছনে। তবে এবার আর আমেরিকান দম্পতি নয়। ভ্যারানিয়ান সিক্রেট সার্ভিস, ডিউক রোজার বুরবনের নিজের পছন্দ করা লোক।
হয়ত মেহমান বলেই নজর রাখছে, বলেছে মুসা।
যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার! মুখ কালো করে বলেছে মরিডো। আপনাদের প্রতি ওদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কেন, জানতে পারলে ভাল হত!
তিন গোয়েন্দাও ভাবছে, জানতে পারলে ভাল হত। সিক্রেট সার্ভিক্স কেন আগ্রহ দেখাবে তাদের প্রতি? এখনও তেমন কিছুই করেনি ওরা। প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্য করছে, এটা ডিউক রোজারের জানার কথা নয়। তাহলে?
রাস্তার মোড়ে মোড়ে গায়কদের ছোট ছোট দল দেখা গেল। সবার হাতে একটা না একটা বাদ্যযন্ত্র আছেই। বাজিয়ে গান গেয়ে পথচারীদের মনোরঞ্জন করছে।
মিনস্ট্রেলস, মরিডো জানাল। তিনশো বছর আগে যে পরিবারটা প্রিন্স পলকে লুকিয়ে রেখেছিল, তাদেরই বংশধর। আমিও মিনস্ট্রেলদের ছেলে। বাবা ছিল প্রধানমন্ত্রী, তাকে বের করে দিয়েছে ডিউক রোজার। আমাদেরকে, মানে মিনস্ট্রেলদেরকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন প্রিন্স দিমিত্রি। সেই প্রিন্স পলের আমল থেকেই আমাদেরকে কোনরকম ট্যাক্স দিতে হয় না। ডিউক রোজার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা দুচোখে দেখতে পারে না আমাদের। আমরা সব মিনস্ট্রেলরা মিলে একটা গোপন দল করেছি। নাম, মিনস্ট্রেল পার্টি। অনেক ভক্ত জুটেছে আমাদের। দেশের লোক দেখতে পারে না রোজারকে।
মিনস্ট্রেলদের প্রতিটি দলের সামনে গতি কমাচ্ছে মরিডো। তাকাচ্ছে আগ্রহী চোখে। দলের কেউ একজন সামান্য একটু মাথা ঝোকালেই আবার ছুটছে সামনে।
ওদেরকে চোখে চোখে রাখছি আমরা, বলল মরিডো। আপনাদের ওপরও সারাক্ষণ চোখ রয়েছে আমাদের। প্যালেসে আছে। আমাদের লোক, এমনকি রয়্যাল গার্ডেও আছে। অনেক কিছুই জেনে গেছি আমরা। কিন্তু এই একটা ব্যাপার জানতে পারছি না, আপনাদের ওপর রোজারের এত আগ্রহ কেন! সাংঘাতিক কোন প্ল্যান নিশ্চয় করেছে ব্যাটা!
দুপাশে নতুন নতুন দৃশ্য। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের জন্যে সিক্রেট সার্ভিসের কথা ভুলে গেল ছেলেরা।
আরেকটা পার্কে বিশাল এক নাগরদোলায় চেপে কিছুক্ষণ দোল খেল তিন কিশোর। তারপর রাতের খাওয়া সেরে নিল এক রেস্টুরেন্টে। ডেনজো নদীর মাছ, সুস্বাদু। রান্নাও হয়েছে খুব ভাল।
ক্লান্ত হয়ে প্যালেসে ফিরে এল ওরা। তবে মন আনন্দে ভরা। একটা খুব সফল দিন কাটিয়ে এসেছে।
ওদেরকে অভ্যর্থনা করে গাড়ি থেকে নামাল রয়্যাল চেম্বারলেন। এখন আরেকজন। ডিউটি বদলেছে। ছোট্টখাট্ট একজন তোক। টকটকে লাল আলখেল্লা পরনে।
গুড ইভনিং, ইয়ং জেন্টেলম্যান, বলল চেম্বারলেন। আজ রাতে দেখা করতে পারবেন না প্রিন্স দিমিত্রি। দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। কাল সকালে নাস্তার সময় দেখা হবে। চলুন, আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিই। নইলে পথ চিনে যেতে পারবেন না।
অসংখ্য সিঁড়ি, করিডর, হলঘর পেরিয়ে এল ওরা চেম্বারলেনের পিছু পিছু। প্রতিটি সিঁড়ির গোড়ায় করিডরের প্রান্তে প্রহরী। অবাকই হল ওরা। সকালে, কিংবা গতরাতে এত কড়াকড়ি দেখেনি। তিনতলার ঘরে পৌঁছে দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেল চেম্বারলেন। যেন জরুরি কোন কাজ ফেলে এসেছে।
ভারি ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিল কিশোর। ঘরের ভেতরে তাকাল। গোছগাছ সাফসুতরো করা হয়েছে। বিছানায় নতুন চাদর। তবে সুটকেসগুলো যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল, সেখানেই রয়েছে। মাকড়সার জালটাও রয়েছে আগের মতই। ওটার ধারেকাছেও যায়নি কেউ। সেদিকে এগোল, সে। সুতো বেয়ে নেমে গেল বড় একটা মাকড়সা, কালোর ওপর সোনালি ছোপ। তক্তা আর মেঝের মাঝখানের ফাঁকে গিয়ে ঢুকে পড়ল সুড়ৎ করে। মাথা বের করে দিল পরমুহূর্তেই।
হাসল রবিন। সকালেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। মাকড়সার জাল আর ছিঁড়তে যাবে না ভ্যারানিয়ায় থাকতে।
মনে হচ্ছে, জিনিসপত্র কেউ হাতায়নি, বলল কিশোর। বব ব্রাউনের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। নতুন কোন নির্দেশ দিতে– পারে। মুসা, দরজার তালা আটকে দাও।
তালা আটকে দিল মুসা।
খাপ থেকে ক্যামেরা খুলল কিশোর। বোতাম টিপে দিল। ফাস্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
স্পষ্ট, ভেসে এল বব ব্রাউনের গলা। নতুন কিছু
তেমন কিছু না, জানাল কিশোর। সারা বিকেলই গাড়িতে করে ঘুরেছি। শহর দেখেছি। নতুন চর লেগেছিল পেছনে। ডিউক রোজারের লোক, সিক্রেট সার্ভিস।
দিমিত্রির সঙ্গে কথা বলেছ? কণ্ঠ শুনে মনে হল ভাবনায় পড়ে গেছে। খবরটা কিভাবে নিয়েছে সে?
দেখা হয়নি। চেম্বারলেন জানিয়েছে, সকালের আগে দেখা হবে না। প্রিন্স খুব ব্যস্ত।
হুমম! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বব, তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আটকে ফেলেনি তো! ওর সঙ্গে দেখা করা খুবই জরুরি। সকালে যেভাবেই হোক, দেখা কোরো। হ্যাঁ, এক কাজ কর, ক্যামেরা থেকে টেপটা বের করে নিয়ে পকেটে রেখে দাও। আগামীকাল এমব্যাসিতে নিয়ে আসবে। এমন ভাব দেখাবে, যেন শহর দেখতে বেরোচ্ছ। গরম হয়ে উঠছে পরিস্থিতি! বুঝেছ?
বুঝেছি, বলল কিশোর। ওভার অ্যান্ড আউট।
ট্রান্সমিটারের সুইচ অফ করে দিল কিশোর। টেপ-রেকর্ডার থেকে বের করে নিল খুদে ক্যাসেটটা। বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে, এটা তোমার কাছে রাখ। কেউ যেন নিয়ে যেতে না পারে।
পারবে না, দৃঢ়কণ্ঠ মুসার। ভেতরের পকেটে রেখে দিল ক্যাসেটটা।
ড্রয়ার হাতাচ্ছে রবিন। রুমাল খুঁজছে। কোন্ ড্রয়ারটীয় রেখেছিল, ঠিক মনে করতে পারছে না। অবশেষে একটা ড্রয়ারে পাওয়া গেল ওটা। টান দিয়ে বের করে আনল রুমাল। ভাঁজের ভেতর থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল কিছু একটা, মৃদু টুং শব্দ হল। আশ্চর্য! কি ওটা! ঝুঁকে আলমারির তলায় তাকাল। চকচক করছে জিনিসটা। বের করে হাতে নিল।
একবার দেখেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, কিশোর! মুসা! দেখ দেখ!
অবাক হয়ে তাকাল দুজনেই।
মাকড়সা! ঢোক গিলল মুসা। ফেল, ফেল!
কোন ক্ষতি করে না, বলল কিশোর। প্রিন্স পলের মাকড়সা। রবিন, আস্তে নামিয়ে রাখ মেঝেতে।
চিনতে পারছ না! ভুরু কুঁচকে গেছে রবিনের। প্রিন্স পলের মাকড়সাই। রূপালী মাকড়সা!
রূপালী মাকড়সা! রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। কি বলছ।
এটা ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা, বলল রবিন। ভল্ট থেকে যেটা চুরি গিয়েছিল। আমি শিওর। এত কাছে থেকেও চিনতে পারনি?
প্রায় লাফ দিয়ে কাছে চলে এল কিশোর আর মুসা।
ছুঁয়ে দেখল কিশোর। ঠিকই বলেছ! এটা একটা মাস্টারপিস। কোথায় পেলে?
রুমালের ভাঁজে! কেউ একজন রেখে দিয়েছে। সকালে ছিল না।
ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল। নিচের ঠোঁটে। কে রাখল? কেন? বিড়বিড় করতে লাগল। আমাদেরকে চোর বলে চিহ্নিত করতে চায় না-তো। তাহলে…
কি করব আমরা এখন, কিশোর? বলে উঠল মুসা। ওটা চুরির একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! যদি ধরা পড়ি…
আমার মনে হয়… বলতে গিয়েও থেমে যেতে হল কিশোরকে। বাইরে ভারি জুতোর শব্দ। অনেকগুলো।
মুহূর্ত পরেই দরজায় চাপড়ের শব্দ হল। নবটা ঘোরানর চেষ্টা করল কেউ। ভেতর থেকে তালা দেয়া, খুলল না। শোনা গেল কুদ্ধ গলা, দরজা খোল। রিজেন্টের আদেশ!
স্তব্ধ একটা সেকেণ্ড। তারপরই লাফ দিল মুসা আর কিশোর, একই সঙ্গে। লোহার দুটো ভারি ছিটকিনি তুলে দিল দুজনে।
ঠিকমত ভাবতে পারছে না রবিন, এতই অবাক হয়েছে। হাতে ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে এখন?
.
০৭.
জোরে জোরে কিল মারার শব্দ হচ্ছে দরজায় বাইরে থেকে।
খোল! রিজেন্টের আদেশ! আমরা আইনের লোক! আবার চেঁচিয়ে উঠল ক্রুদ্ধকণ্ঠ।
দরজায় পিঠ দিয়ে চেপে দাঁড়িয়েছে কিশোর আর মুসা। নিজেদের দেহের ভার দিয়ে দরজা আটকে রাখতে চাইছে যেন।
হাতের অপূর্ব সুন্দর জিনিসটার দিকে চেয়ে আছে রবিন। মাথায় চিন্তার ঝড়। কোথাও লুকিয়ে ফেলা দরকার এটাকে। কিন্তু কোথায়?
হঠাৎ সচল হয়ে উঠল রবিন। ছুটোছুটি শুরু করল সারা ঘরময়। চোখ জায়গা খুঁজছে। কোথায় লুকিয়ে রাখবে মাকড়সাটাকে! কার্পেটের তলায়? না। বিছানার গদি? তাও না। তাহলে, তাহলে কোথায়? কোথায় রাখলে খুঁজে পাবে না অন্য কেউ?
জোরে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে দরজায়। ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সময়ই ঘটল আরেক ঘটনা। ভীষণভাবে দুলে উঠল জানালার পর্দা। লাফিয়ে এসে ঘরের ভেতরে পড়ল দুজন তরুণ! চমকে উঠল কিশোর আর মুসা! ওদিক থেকেও আক্রমণ এল।
না না, চমকাবার কিছু নেই। কাছে এগিয়ে এসেছে এক তরুণ। ফিসফিস করে বলল, আমি। মরিডো। আর, ও আমার ছোট বোন, মেরিনা।
মেরিনা…ও আপনার বোন, ফিসফিস করেই বলল কিশোর।
সেই মেয়েটা। পার্কে বেলুন বিক্রি করছিল যে। পরনে মরিডোর মতই প্যান্ট, জ্যাকেট। দেখে প্রথমে তাই তাকে ছেলে বলে ভুল করেছে ওরা।
মাথা ঝোকাল মরিডো। জলদি আসুন, পালাতে হবে। আপনাদেরকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে ওরা! ধরতে পারলে ফাঁসি দিয়ে দেবে!
আওয়াজ পাল্টে গেছে আঘাতের। দরজা ভাঙার জন্যে কুড়াল ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তিন ইঞ্চি পুরু ভারি ওক কাঠের দরজা। এত সহজে ভাঙবে না। কয়েক মিনিট সময় নেবেই।
ঘরে বসে টেলিভিশনে সিনেমা দেখছে যেন ওরা! খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে ঘটনা। তাল পাচ্ছে না তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে যেতেই হবে এঘর থেকে, এটা ঠিক, কিন্তু কি করে, বুঝতে পারছে না।
জলদি এস, মুসা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাজ করতে শুরু করেছে আবার তার মগজ। রবিন, এস। মাকড়সাটা পকেটে ঢোকাও।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। হঠাৎ সোজা হল। দ্বিধা করল এক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে ছুটে এল।
জানালার দিকে ছুটল মেরিনা। ফিরে সবাইকে একবার ইশারা করেই টপকে ব্যালকনিতে চলে গেল। ওর পিছু পিছু ব্যালকনিতে এসে নামল কিশোর, মুসা, রবিন।
ঠাণ্ডা অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল ওরা। নিচে জ্বলছে শহরের আলো।
দালানের গা থেকে বেরিয়ে আছে চওড়া কার্নিস। সেটা দেখিয়ে বলল, প্যালেসের পেছনেও আছে। এতখানিই চওড়া। হাঁটা যাবে। আসুন আমি পথ দেখাচ্ছি।
ব্যালকনির রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল কার্নিসে।
দ্বিধা করছে কিশোর। আমার ক্যামেরা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। ফেলে রেখে এসেছি!
আর আনার সময় নেই! পেছন থেকে বলল মরিডো। দুমিনিট টিকবে আর দরজা, বড় জোর তিন। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করা যাবে না।
খুব খারাপ লাগল ক্যামেরাটার জন্যে। কিন্তু আনার উপায় নেই। মুসা নেমে পড়েছে ততক্ষণে কার্নিসে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর। দেয়ালের দিকে মুখ, পা ফাঁক করে পাশে হেঁটে সরছে মেরিনা।
গায়ে গা ঠেকিয়ে মেরিনার মত করেই সরতে লাগল মুসা আর কিশোর। বেড়ালের মত নিঃশব্দে।
ভয় পাবার সময়ই নেই। ঘরের ভেতরে দরজায় আঘাতের শব্দ হচ্ছে একনাগাড়ে। প্রাসাদের এক কোণে পৌঁছে গেল ওরা। ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা দিয়ে গেল চোখেমুখে।
ক্ষণিকের জন্যে কেঁপে উঠল রবিন, দুলে উঠল দেহ। অনেক নিচে ডেনজো নদী, রাতের মতই অন্ধকার। পাক খেয়ে খেয়ে ঘূর্ণি সৃষ্টি করেছে পানি, শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঁধ খামচে ধরল মরিডোর শক্তিশালী হাত, পতন রোধ করল রবিনের। আবার ভারসাম্য ফিরে পেল সে।
জলদি! রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল মরিডো।
চমকে উঠল একজোড়া পায়রা। এ-কি জ্বালাতন! এত রাতে ঘুম নষ্ট করতে এল কে! পাখার ঝটপট শব্দ তুলে দালানের খোপ থেকে বেরিয়ে এল পাখি দুটো, অনধিকার-চর্চাকারীদের মাথার ওপর চক্কর দিয়ে দিয়ে উড়তে লাগল। হঠাৎ বসে পড়তে যাচ্ছিল রবিন, আবার তার কাঁধ খামচে ধরল মরিডো।
মোড় ঘুরে আরেকটা ব্যালকনির কাছে চলে এল ওরা। রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নামল।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে।
এবার ওপরে উঠতে হবে, ফিসফিসিয়ে বলল মেরিনা। এই যে দড়ি। গিঁট দেয়া আছে একটু পর পরই। উঠতে অসুবিধে হবে না!
এটা কেন? রেলিঙে বাঁধা আরেকটা দড়ি নেমে গেছে নিচে, সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওদের বোকা বানাতে, জবাব দিল মেরিনা। ধরে নেবে আমরা নিচে নেমে গেছি।
ওপর থেকে ঝুলছে যে দড়িটা, সেটা ধরে উঠতে শুরু করল মেরিনা। তাকে অনুসরণ করল মুসা। তারপর দড়ি ধরল কিশোর।
ওদেরকে কয়েক ফুট ওঠার সময় দিল রবিন। তারপর দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল সে-ও। উঠতে শুরু করল ধীরে ধীরে।
আবার কার্নিসে নেমেছে মরিডো। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেল কোনায়। উঁকি দিল। দেখতে চাইছে, ওদিকে কতদূর কি করল শত্রুরা।
ফিরে এল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এখনও দরজা নিয়েই আছে। তবে এসে পড়ল বলে!
কি? মরিডোর দিকে তাকাতে গেল রবিন। ঘামে ভেজা হাত, পিছলে গেল হঠাৎ। গিটও আটকাতে পারল না, সড়সড় করে নিচে নেমে চলে এল সে। ঘষা লেগে ছিলে গেল হাতের চামড়া। তার মনে হল, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মাত্র একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই এসে পড়ল নিচে দাঁড়ানো মরিডোের ওপর। পড়ল তাকে নিয়েই। জোরে কঠিন কিছুতে ঠুকে গেল মাথা। দপ করে চোখের সামনে জ্বলে উঠল কয়েক হাজার লাল-হলুদ ফুল। তারপরেই অন্ধকার!
রবিন! কানের কাছে ডাক শুনে চোখ মেলল সে।
রবিন! শুনতে পাচ্ছেন! লেগেছে কোথাও! শঙ্কিত গলা মরিডোর।
চোখ মিটমিট করল রবিন। ওপরে তারাজ্বলা আকাশ। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মরিডো। চিত হয়ে পড়ে আছে সে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা মাথায়।
রবিন, কোথাও লাগেনি তো! আবার জিজ্ঞেস করল মরিডো। উদ্বিগ্ন।
মাথা ব্যথা করছে, অবশেষে বলল রবিন। কোলা ব্যাঙের আওয়াজ বেরোল গলা থেকে। ভালই আছি। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। চারদিকে তাকাল। একটা ব্যালকনিতে বসে আছে। পাশে, প্যালেসের পাথরের কালো বিশাল দেয়াল উঠে গেছে ওপরে। অনেক নিচে ডেনজো নদীতে মিটমিট করছে নৌকার আলো।
আমি এখানে কেন! বলে উঠল রবিন। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আপনারা…তারপরই আমি এখানে!…মাথায় যন্ত্রণা।…কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
প্রিন্স পল রক্ষা করুন আমাদের, বিড়বিড় করল মরিডো। কথা বলার সময় নেই! দড়ি ধরে উঠতে পারবেন? এই যে, দড়ি। রবিনের। হাতে দড়িটা গুঁজে দিল সে। উঠতে পারবেন?
অবাক হয়ে দড়িটা ধরে আছে রবিন। এটা কোথা থেকে এল? এর আগে কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
জানি না! ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। চেষ্টা করব।
হবে না! আপনমনেই বিড়বিড় করল মরিডো। বুঝেছি, পারবেন না। টেনে তুলতে হবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। দড়ি বেঁধে টেনে তুলব।
দড়ির মাথা রবিনের দুই বগলের তলা দিয়ে এনে বুকে শক্ত করে পেঁচাল মরিডো, গিঁট দিল। চুপ করে থাকুন। আমি উঠে যাই। তারপর টেনে তুলব। দেয়ালে অনেক ফাটল আছে। ওগুলোতে পা বাধিয়ে ওপরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করবেন নিজেকে। আমাদের সাহায্য হবে। তা যদি না পারেন, চুপচাপ ঝুলে থাকবেন। ভয় নেই, ফেলে দেব না।
দড়িতে টান পড়তেই ওপরের দিকে চেয়ে বলল, আসছে! অঘটন ঘটেছে এখানে!
দড়ি ধরে রেলিঙে উঠে দাঁড়াল মরিড়ো। ঝুলে পড়ল অন্ধকারে।
নিঃশব্দে উঠে যাচ্ছে মরিডো। সেদিকে তাকিয়ে রইল রবিন। হাত চলে গেছে মাথার পেছনে, আহত জায়গা। এখনও বুঝতে পারছে না সে, কি করে এখানে এল! সঙ্গীরা কোথায় কি করছে, বুঝতে পারছে। মনে পড়ছে, ওরা ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজায় কুড়াল দিয়ে কোপানর শব্দ। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর এসে লাফিয়ে নেমেছে। দুই তরুণ…
.
বড় একটা জানালার চৌকাঠে বসল মরিডো। লাফ দিয়ে নামল ভেতরে। ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন।
পড়ে গিয়েছিল রবিন, বলল মরিডো। খুব নাড়া খেয়েছে। চোট লেগেছে মাথায়। টেনে তুলতে হবে, নিজে নিজে উঠতে পারবে না। আসুন, দড়ি ধরতে হবে।
চারজনেই চেপে ধরল দড়ি। টান দিল। ওঠার সময় সাহায্য করেছে গিটগুলো, এখন অসুবিধে সৃষ্টি করল। প্রতিটি গিঁট বেধে যাচ্ছে। চৌকাঠের কিনারে, আটকে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টান দেয়া যাচ্ছে না। গিটের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সরিয়ে আনতে হচ্ছে অনেক কষ্টে।
ওজন বেশি না রবিনের। তাছাড়া ওরা চারজন। অসুবিধা সত্ত্বেও শিগগিরই দেখা গেল তার মাথা, কাঁধ। হাত বাড়িয়ে চৌকাঠ চেপে ধরল রবিন। দুহাত ধরে তাকে তুলে আনল মুসা আর মরিডো।
এলাম! কাঁপছে রবিনের গলা। কিছু ভেব না, আমি ঠিকই আছি। মাথা ব্যথা করছে অবশ্য, ওটা এমন কিছু না। হাঁটতে পারব। কিন্তু ব্যালকনিতে কি করে এলাম, সেটাই মনে করতে পারছি না!
পারবেন, মোলায়েম গলায় বলল মেরিনা। ওসব নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই এখন। আর কোন অসুবিধে নেই তো?
না, বলল রবিন।
আরেকটা শোবার ঘরে এসে ঢুকেছে ওরা। ভাপসা গন্ধ। অনুভবেই বুঝতে পারছে, বালি গিজগিজ করছে। তারার আবছা আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে ভেতরে। কোন আসবাবপত্র দেখা গেল না।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গেল মরিডো আর মেরিনা। নিঃশব্দে দরজা খুলল মরিডো, গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল বাইরে। ফিরে এল আবার।
কেউ নেই, বলল মরিডো। লুকানর জন্যে একটা জায়গা বের করতে হবে এবার। মেরিনা, তোমার কি মনে হয়? মাটির তলার কোন একটা ঘরে নিয়ে যাব?
ননাহ, জোরে মাথা নাড়ল মেরিনা। দড়ি দেখে ভাববে, নিচে নেমে গেছেন ওঁরা। নিচের কোন, ঘরেই খোঁজা বাদ রাখবে না ব্যাটারা। দেখ!
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিল সবাই। নিচে, আঙিনায় আলো, নড়াচড়া করছে। টর্চ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রহরীরা।
ইতিমধ্যেই পাহারা শুরু হয়ে গেছে আঙিনায়, বলল মেরিনা। ওপরেই যেতে হবে আমাদের। দিনটা কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। আগামী রাতে দেখব, অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারি কিনা। কোন একটা ডানজনের ভেতর দিয়ে পানি সরার ড্রেনে নিয়ে যাব। তারপর হয়ত নিয়ে চলে যেতে পারব আমেরিকান এমব্যাসিতে।
ভাল বলেছ, সায় দিয়ে বলল মরিডো। প্যালেসের এদিকটায় লোকজন আসে না। দড়ি নিচে নেমে গেছে, এদিকে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।…সঙ্গে রুমাল আছে আপনাদের?
আছে, পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে দিল কিশোর।
নিচে আঙিনায় ফেলে দেব সুযোগমত, বলে রুমালটা পকেটে রাখল মরিভো। জানালার ফ্রেমের মাঝখানের দণ্ডে বাঁধা দড়িটা, ওটা বেয়েই উঠে এসেছে। খুলে নিয়ে হাতে পেচাল সে। আসুন, যাই। মেরি, পেছনে থাক।
একে একে করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। দুপাশে ঘর। ওপরে ছাত। অন্ধকার। মরিডোর হাত ধরেছে কিশোর। তার হাত মুসা, মুসার হাত রবিন। তার হাত মেরিনা। পাঁচজনের একটা শেকল যেন, নিঃশব্দ কিন্তু দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল।
টর্চ জ্বেলে দেখে নিল মরিডো। দেয়ালের গায়ে একটা দরজার সামনে এসে থামল। ধাক্কা দিল খুলল না। আরও জোরে ধাক্কা দিতেই মরচে পড়া কজা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল। খুলে গেল পাল্লা। চমকে উঠল সবাই।
কান খাড়া করে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইল ওরা এক মুহূর্ত। না, কোনরকম শব্দ শোনা গেল না। ভেতরে পা রাখল ওরা। একটা সিঁড়ি ঘর।
অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সামনে আরেকটা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল মরিডো।
খোলা ছাতে বেরিয়ে এল ওরা। ছাত ঘিরে রেখেছে উঁচু দেয়াল। দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝে বড় কুলুঙ্গিমত রয়েছে।
ওখান থেকে তীর ছোঁড়া হত, গরম তেল ঢেলে দেয়া হত শত্রুর ওপর, কুলুঙ্গিগুলো দেখিয়ে বলল মরিডো। আজকাল আর ওসবের দরকার হয় না। ছাতে পাহারাই থাকে না অনেক বছর ধরে।
প্রত্যেক কোনায় সেন্ট্রিরুম রয়েছে। এক কোণে পাথরের একটা খুপরিমত ঘরে নিয়ে এল ওদেরকে মরিডো। অনেক আপত্তি প্রকাশ করার পর খুলে গেল কাঠের দরজা। ভেতরে আলো ফেলল সে। চার দেয়াল ঘেঁষে চারটে লম্বা বেঞ্চ, ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে ওখানেই শুয়ে ধুমাত সেন্ট্রিরা। ধুলোয় একাকার। ছোট ছোট ফোকর রয়েছে দেয়ালে, কাঁচ নেই।
এককালে সারাক্ষণ পাহারা থাকত এখানে, বলল মরিডো। সে অনেক আগের কথা। এখানে আপাতত নিরাপদ আপনারা। আগামীকাল রাতে আবার আসব। যদি পারি।
ধপ করে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল কিশোর। কপাল ভাল, এখন গরমকাল। নইলে ঠাণ্ডায় জমেই মরতে হত।…তো, এসব কি? কি ঘটেছিল?
কোন ধরনের ফাঁদ, বলল মেরিনা। রূপালী মাকড়সা চুরির অজুহাতে আপনাদেরকে গ্রেফতার করা হত। তারপর, কোন একটা কায়দা বের করে সিংহাসনে বসতে দিত না প্রিন্স দিমিত্রিকে। এখন পর্যন্ত এইই জানি।
আমরা চুরি করিনি রূপালী মাকড়সা, বলল কিশোর।
জানি।
কিন্তু ওটা এখন আমাদের কাছেই আছে। রবিন, দেখাও ওদের।
জ্যাকেটের এক পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। তারপর ঢোকাল। অন্য পকেটে। সতর্ক হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি খুঁজল সবকটা পকেট। ঢোক গিলল। কিশোর…নেই…! নিশ্চয় পড়ে গেছে কোথাও
.
০৮.
মাকড়সাটা ছিল আপনার কাছে? হারিয়েছেন? আতঙ্কিত গলা মরিডোর।
সর্বনাশ! বলে উঠল মেরিনা। আপনাদের কাছে এল কি করে? হারালই বা কি করে?
ভল্ট থেকে রূপালী মাকড়সা চুরি যাওয়ার কাহিনী খুলে বলল কিশোর, যা যা শুনেছিল প্রিন্স দিমিত্রির কাছে। জানাল, আসলটার জায়গায় নকলটা পড়ে আছে এখন। প্রিন্সের সন্দেহ, চুরি করেছে ডিউক রোজার, দিমিত্রির প্রিন্স হওয়া ঠেকানর জন্যে।
রবিন জানাল, ড্রয়ারে রুমালের আজ থেকে কি করে পেয়েছে সে মাকড়সাটা।
ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারছি এবার, চিন্তিত শোনাল মরিডোর গলা। ডিউক রোজারই মাকড়সাটা আপনাদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর লোক পাঠিয়েছে গ্রেফতার করতে। মাকড়সাটা পাওয়া যেত আপনাদের ঘরে। প্রিন্স দিমিত্রির অসাবধানতার কারণেই ওটা চুরি। করতে পেরেছেন, ঘোষণা করে দিত ডিউক। প্রিন্সের ওপর বিশ্বাস হারাত লোকে। আপনাদেরকে ভ্যারানিয়া থেকে বের করে দিত রোজার, আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করত। রাজ্যশাসন চালিয়ে যেত! তারপর কোন এক সময়ে নিজেকে স্থায়ী রিজেন্ট ঘোষণা করে বসে পড়ত সিংহাসনে।
কিন্তু মাকড়সাটা এখন তার হাতে নেই, বলল মুসা। আর তো এগোতে পারছে না।
পারছে, বলল মরিডো। আপনাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। ধরতে পারলেই ঘোষণা করবে, মাকড়সাটা কোথাও লুকিয়ে ফেলেছেন। আপনারা। আমেরিকান এমব্যাসিতে পালিয়ে যেতে পারলেও বদনাম থেকে রেহাই পাবেন না। তাহলে বলবে, রূপালী মাকড়সা চুরি করে নিয়ে চলে গেছেন আপনারা।
কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও বুঝতে পারছি না, বলল মুসা। রূপালী মাকড়সা হারালে কিংবা চুরি গেলে, দিমিত্রির দোষটা কোথায়? আমরা না এলেও তো ওটা চুরি যেতে পারত? আগুন লেগে কিংবা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারত। তখন?
তখন সারা দেশ শোক প্রকাশ করত দীর্ঘদিন ধরে। প্রিন্স দিমিত্রির কোন দোষ থাকত না। এখন তো বলবে, আমেরিকান কয়েকটা চোর বন্ধুকে এনে ভল্টে ঢুকিয়েছে, ফলে চুরি গেছে মাকড়সা। আসলে, প্রিন্স পল আমাদের কাছে কতখানি কি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না আপনাদের। তারই প্রতীকচিহ্ন ওই রূপালী মাকড়সা। ওটার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য, স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
হয়ত বলবেন আমরা কুসংস্কারে বেশি বিশ্বাসী, আবার বলল মরিডো। কিন্তু আজ পর্যন্ত মাকড়সার অবমাননা করে টিকতে পারেনি কেউ, ধ্বংস হয়ে গেছে। বংশ বংশ ধরে প্রিন্স পলকে ভালবেসে এসেছি আমরা। তাঁর আদেশ, তাঁর নির্দেশ এখনও ভ্যারানিয়ানদের কাছে ধ্রুববাক্য। আমরা জানি, যতদিন রূপালী মাকড়সা নিরাপদে থাকবে, ভ্যারানিয়ানরা নিরাপদ। ওটার কোন ক্ষতি হলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর। ওটা রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমাদের সরাসরি না হলেও প্রিন্স দিমিত্রি এটা হারানর ব্যাপারে জড়িত, দেশের লোক তাই জানবে। মন থেকে কোনদিনই আর তাকে ভালবাসতে পারবে না। সিংহাসনে বসার অযোগ্য মনে করবে। থামল। একটু। ভাবল। তারপর বলল, তাহলে বুঝতেই পারছেন রূপালী মাকড়সা খুঁজে পেতেই হবে আমাদের। নইলে ডিউক রোজারেরই জিত।
সর্বনাশ করেছি তাহলে! বলে উঠল রবিন। গলা কাঁপছে। ঢোক মিলল। কিশোর, মুসা, আমার পকেট খুঁজে দেখ।
তন্ন তন্ন করে রবিনের সব পকেট খুঁজল মুসা আর কিশোর, টেনে উল্টে বের করে আনল পকেটের কাপড় নেই! জামার হাতার ভাঁজ, প্যান্টের নিচের ভাজ, জুতো-মোজার ভেতর, কোথাও খোঁজা বাদ রাখল না। নেই তো নেই-ই। পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ভাব, রবিন, অবশেষে বলল কিশোর। ভাল করে ভেবে দেখ, কোথায় রেখেছিলে! তোমার হাতে ছিল ওটা, তারপর কি করলে?
মনে করার চেষ্টা করল রবিন। জানি না! হতাশ কণ্ঠ। রুমালের ভাঁজ থেকে পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হাতে তুলে নিলাম। দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ হল। জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে পড়ল মরিডো। তারপর আর কিছু মনে নেই!
হুমম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অ্যামনেশিয়া, আংশিক! মাথায় আঘাত পেলে মাঝেসাঝে ঘটে এটা। বিস্মরণ ঘটে। অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে যায় কারও, কেউ হারায় কয়েক হপ্তা, কেউ কয়েক দিন। কয়েক মিনিট হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। রবিনেরটা কয়েক মিনিট। কারও কারও বেলায় ঠিক হয়ে যায় এটা, আবার ফিরে পায় ওই স্মৃতি। ওর বেলায় কি ঘটবে, জানি না। মাথায় আঘাত লাগার তিন চার মিনিট আগের সমস্ত ঘটনা মুছে গেছে তার মন থেকে।
মনে হয় ঠিকই বলেছ, বলল রবিন। হয়ত তা-ই ঘটেছে। আহত জায়গায় হাত চলে গেল। খুব আবছাভাবে মনে পড়ছে এখন, সারা ঘরে ছুটোছুটি করছিলাম। মাকড়সাটা লুকানর জায়গা খুঁজছিলাম। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম খুব। কার্পেটের তলায়, গদির তলায়, কিংবা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখার কথা মনে এসেছিল। তবে ওসব জায়গা নিরাপদ বলে মনে হয়নি…
চুপ করল রবিন।
অন্যরাও চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। এরপর কি করেছে, মনে করার সুযোগ দিল রবিনকে। কিন্তু আর কিছু মনে করতে পারল না সে।
আমাকে দেখার পর একটা কাজ করাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, বলল মরিডো। পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা। হয়ত তাই করেছেন। তবে ভালমত রাখতে পারেননি তাড়াহুড়ায়। তারপর, যখন কার্নিসে উঠলেন, কোনভাবে পড়ে গেছে মাকড়সাটা। ব্যালকনিতে যখন আছড়ে পড়েছেন, তখনও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।
কিংবা হয়ত আমার হাতেই ছিল, পকেটে ঢোকাইনি, বলল রবিন। কোন এক সময় হাত থেকে ছুটে পড়ে গেছে। কার্নিস কিংবা ব্যালকনিতে পড়ে থাকার আশা খুবই কম, তবে সম্ভবত নিচে, আঙিনায় পড়েছে।
আঙিনায় পড়ে থাকলে পাওয়া যাবে, বলল মরিডো। ব্যালকনি কিংবা কার্নিসে থাকলেও পেয়ে যাব! কিন্তু, যদি পাওয়া না যায়… চুপ করে গেল সে।
কিংবা ঘরেও ফেলে এসে থাকতে পারেন, এতক্ষণে কথা বলল মেরিনা। হয়ত খোঁজার কথা ভাবেই না গার্ডেরা। ধরেই নেবে, আপনারা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যদি আঙিনায় পাওয়া না যায়, আগামীকাল রাতে আবার সে ঘরে ফিরে যাব আমরা। খুঁজব। কার্নিস আর ব্যালকনিও বাদ দেব না।
০৯.
সারাটা রাত ওই সেন্ট্রিরুমেই কাটিয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা।
ছাতে কেউ খুঁজতে আসেনি তাদেরকে। বেশ ভালই বুদ্ধি করেছিল মরিডো। ব্যালকনি থেকে ঝোলানো দড়ি, একটা ডানজনের দরজায়। পড়ে থাকা কিশোরের রুমাল (পরে জেনেছে তিন গোয়েন্দা) অন্যদিকে চোখ সরিয়ে রেখেছে পাহারাদারদের। হাতে খোঁজার কথা ভাবেইনি কেউ।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গিয়েছিল মরিডো আর মেরিনী। তারপর লম্বা হয়ে কাঠের বেঞ্চেই শুয়ে পড়েছে তিন কিশোর। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম আর উত্তেজনার মাঝে কেটেছে, শক্ত কাঠের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপালী মাকড়সা
পরদিন সূর্য ওঠার পর ভাঙল ঘুম।
চোখ মেলল মুসা। বড় করে হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল। পাশে চেয়ে দেখল, আগেই উঠে পড়েছে কিশোর। হালকা ব্যায়াম করছে। মাংসপেশীর জড়তা দূর করার জন্যে।
উঠে বসল মুসা। জুতো গলাল পায়ে। দাঁড়াল। এখনও ঘুমিয়ে আছে রবিন।
সকালটা বেশ সুন্দর, দেয়ালের ফোকর দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল মুসা। দিনটা ভালই যাবে, তবে আমাদের জন্যে না। পেটের ভেতর ছুঁচো নাচানাচি করছে। অথচ কোন খাবার নেই, নাস্তাই নেই, লাঞ্চ আর ডিনার তো স্বপ্ন! কিশোর, খাওয়া-টাওয়া পাব কিছু?
দুত্তোর তোমার খাওয়া! ঝাঁঝালো কণ্ঠ কিশোরের। কি করে বেরোব এই মৃত্যুপুরী থেকে তাই জানি না, খাওয়া! মরিডো কি করছে না করছে, রাতেও আসতে পারবে কিনা, তাই বা কে জানে!
সত্যিই বেরোতে পারব না আমরা এখান থেকে! চুপসে গেছে মুসা। তাহলে আর জীবনেও কিছু খাওয়া হবে না! হতাশ ভঙ্গিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল সে। আচ্ছা, কিশোর, তোমার কি মনে হয়? জেগে উঠলে মনে করতে পারবে রবিন? রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছে, বলতে পারবে?
কিশোর কোন জবাব দেবার আগেই চোখ মেলল রবিন। মিটমিট করে বন্ধ করল, তারপর আবার খুলল। আমরা কোথায়? বলতে বলতেই হাত নিয়ে গেল মাথার পেছনে, আহত জায়গায়। ইহ্! ব্যথা…! হ্যাঁ, এই বার মনে পড়েছে…
কি, কি মনে পড়েছে? লাফ দিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে সরে এল মুসা। রূপালী মাকড়সা কোথায়, মনে পড়েছে?
মাথা নাড়ল রবিন। এখানে কি করে এলাম, সেটা মনে পড়েছে।
অ-অ! আবার হতাশ হয়ে পড়ল মুসা। আবার চলে গেল ফোকরের কাছে।
ভেব না, রবিন, আশ্বাস দিল কিশোর। সময় যাক। তোমার মাথার যন্ত্রণা যাক। তারপর হয়ত মনে পড়ে যাবে সব কথা…
এই, চুপ! চাপা গলায় হুঁশিয়ার করল মুসা। একটা লোক! এদিকেই আসছে!
দ্রুতপায়ে ফোকরের কাছে এসে দাঁড়াল অন্য দুজন।
ঢোলাঢালা ধূসর রঙের পোশাক পরনে। সামনের দিকে লম্বা। অ্যাপ্রন। হাতে ঝাড়, বালতি আর ন্যাকড়া। কয়েক পা এগিয়েই হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকাল একবার সেন্ট্রিরুমের দিকে। পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে এল। পায়ে পায়ে।
টোকা পড়ল দরজায়। আস্তে করে।
মুসা, দরজাটা খুলে দাওঁ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। গার্ড নয়। ও জানে, আমরা আছি এর ভেতর।
ছিটকিনি খুলে দিয়েই এক লাফে পাশে সরে গেল মুসা। তৈরি। যদি তেমনি বোঝে, লাফিয়ে পড়বে লোকটার ঘাড়ে। তিনজনে মিলে কাবু করে ফেলতে পারবে।
আস্তে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। চট করে ঢুকেই ঠেলে বন্ধ করে দিল আবার পাল্লা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল একটা ফোকরের কাছে। সিঁড়ির দিকে চেয়ে বলল, কেউ পিছু লেগেছে কিনা, দেখছি! হুঁশিয়ার থাকা ভাল।
দুটো মিনিট চুপচাপ ফোকরের কাছে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। দৃষ্টি সিঁড়ি আর ছাতের দিকে।
না, ফেউ লাগেনি পেছনে, অবশেষে বলল লোকটা। আমি ঝাড়দার। এক ফাঁকে উঠে চলে এসেছি। দেখেনি কেউ। মরিডোর মেসেজ আছে। জানতে চেয়েছে: রবিনের মনে পড়েছে কিনা।
না, জবাব দিল কিশোর। মরিডোকে বলবে, মনে পড়েনি।
বলব। অধৈর্য হতে মানা করেছে মরিডো। আঁধার নামলেই আসবে সে। এই যে নিন, খাবার। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা অয়েল-পেপারের প্যাকেট বের করে দিল লোকটা। আরেক পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করল। আর এই যে, পানি।
খাবারের প্যাকেট আর বোতল হাতে নিল মুসা।
আমি যাই, বলল লোকটা। নিচের অবস্থা খুব খারাপ। ধৈর্য হারাবেন না, সাহেবরা। প্রিন্স পল রক্ষা করবেন আপনাদের। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে চলে গেল ঝাড়দার।
দরজার ছিটকিনি তুলে দিল কিশোর।
ইতিমধ্যে খাবারের প্যাকেট অর্ধেক খুলে ফেলেছে মুসা। স্যাণ্ডউইচ, আর কিছু ফল। হাসি একান ওকান হয়ে গেল তার। আর দেরি করে লাভ কি? এস শুরু করে দিই। একটা স্যাণ্ডউইচ নিয়ে প্যাকেটটা বেঞ্চে নামিয়ে রাখল। কামড় বসাল খাবারে।
রেখে রেখে খেতে হবে, একটা স্যাণ্ডউইচ তুলে রবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। এই খাবার আর পানি দিয়েই চালাতে হবে সারাটা দিন। প্রাসাদে মরিডোর লোক না থাকলেই মরেছিলাম!
হ্যাঁ, স্যাণ্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বলল রবিন। আচ্ছা, গতরাতে প্রিন্স দিমিত্রি আর মিনস্ট্রেল পার্টি নিয়ে কি যেন আলাপ করছিলে মরিডোর সঙ্গে। মাথার ব্যথায় ভালমত কান দিতে পারিনি।
কিছু কিছু কথা তো দিনেই শুনেছ, বলল কিশোর। দিমিত্রির বাবার রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরিডোর বাবা। ডিউক রোজার রিজেন্ট হয়েই তাঁকে চেয়ার ছাড়তে বাধ্য করল। তখন থেকেই রোজারের ওপর সন্দেহ মিনস্ট্রেলদের। ওরা বুঝে ফেলল, দিমিত্রিকে সহজে প্রিন্স হতে দেবে না ডিউক। কাজে নেমে পড়ল ওরা। গোপনে। একটা দল গঠন করল। প্রিন্স পলের নাম করে শপথ নিল, নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও, রোজারের পরিকল্পনা সফল হতে দেবে না। গার্ড, অফিসার এমনকি চাকর-বাকর, ঝাড়দারদের মাঝেও লোক আছে তাদের। গতরাতে, আমাদেরকে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছিল রোজার। সেটা জেনে ফেলেছিল একজন গার্ড, মিনস্ট্রেল পার্টির লোক। সঙ্গে সঙ্গে মরিডোকে জানিয়েছে সে ব্যাপারটা। এক বিন্দু দেরি করেনি মরিডো আর মেরিনা। ছুটে চলে এসেছে। নইলে তো গিয়েছিলাম ধরা পড়ে… স্যাণ্ডউইচে কামড় বসাল কিশোর। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, ছোট বেলায় প্যালেসে প্রায়ই আসত মেরিনা আর মরিডো। কোথাও ঢোকা বারণ ছিল না ওদের। ফলে এই প্রাসাদের গলি ঘুপচি প্রায় সবই ওদের চেনা। গোপন কোন পথ দিয়ে গিয়ে কোন্ সুড়ঙ্গে, ঢোকা যায়, সেখান থেকে নেমে যাওয়া যায় বিশাল নর্দমায়, জানে ওরা। গার্ডদেরও। অনেকেই চেনে না ওই পথ। ওদের চোখ এড়িয়ে তাই সহজেই প্রাসাদে ঢুকে পড়তে পারে দুই ভাইবোন, বেরিয়ে যেতে পারে।
খুব ভাল, বলে উঠল মুসা। তবে আমরা আটকে আছি ছাতে, এটা আবার খুব খারাপ কথা। তোমার কি মনে হয়? গার্ডদের চোখ এড়িয়ে আজ রাতে আসতে পারবে ওরা? বের করে নিয়ে যেতে পারবে আমাদের?
মনে তো হয়, বলল কিশোর। তার আগেই যদি অবশ্য ধরা না পড়ে যাই। এখান থেকে বেরিয়েই সোজা আমেরিকান এমব্যাসিতে চলে যেতে হবে আমাদের। ক্যাসেটটা তুলে দিতে হবে ওদের হাতে। রোজারের বিরুদ্ধে এটা একটা সাংঘাতিক প্রমাণ।
জেমস বৎ হলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম এখন, হাতের অবশিষ্ট স্যাণ্ডউইচটুকু মুখে পুরে দিল মুসা। দুই চিবান দিয়েই গিলে ফেলল কোঁৎ করে। জেমস বণ্ডের একটা সুবিধে আছে। যে বিপদেই পড়ুক না কেন, ঠিক বেরিয়ে যায়। তারজন্যে বিপদে পড়া আর না পড়া সমান কথা। কিন্তু আমাদের? নিজেরা কিছুই করতে পারছি না। অন্যের ওপর নির্ভর করে হাঁ হয়ে বসে থাকতে হবে সারাটা দিন!
আমাদের সাধ্যমত আমরা করেছি, করব, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। এখান থেকে বেরিয়ে যাব, প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্যও করব। সহজে হাল ছাড়ছি না। তবে, মরিডো আর মেরিনা আসার আগে হাঁ করেই বসে থাকতে হবে আমাদের, এতে কোন সন্দেহ। নেই।…সেকেণ্ড, নাস্তা-লাঞ্চ সব একবারেই সেরে ফেলবে নাকি?
বাড়ানো হাতটা ঝট করে সরিয়ে নিল মুসা। করুণ চোখে তাকাল অবশিষ্ট কয়েকটা স্যাণ্ডউইচের দিকে। মনে করিয়ে দিয়েছ, ধন্যবাদ! ঠিক আছে লাঞ্চের সময়ই না হয় আবার খাব। আসলে, জানই তো, গোটা বিশেক স্যাণ্ডউইচ খাওয়ার পরেও একটা হাঁস খেয়ে ফেলতে পারি…
এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ডবল খেয়ে পুষিয়ে নিয়ো, বলল কিশোর। ভবিষ্যতে বেশি খাওয়ার জন্যেই এখন কম খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকে অনেক বড় একটা দিন পুড়ে আছে সামনে।
সত্যিই, অনেক দীর্ঘ একটা দিন। সারাটা দিন শুয়ে বসেই কাটাতে হল ওদের। কখনও উঠে গিয়ে ফোকরে চোখ রাখে, ছাতে কেউ উঠে আসছে কিনা দেখে।
অবশেষে সেইন্ট ডোমিনিকসের সোনালি গম্বুজের চূড়ার কাছে নেমে গেল সূর্যটা। দুএক মুহূর্ত ঝুলে রইল যেন অনিশ্চিতভাবে, তারপর টুপ করে ডুবে গেল পাহাড়ের ওপাশে। ভেনজো নদীর তীরে ঘন গাছগাছালির ভেতর থেকে ভেসে এল ঘরেফেরা পাখির কলরব। সেটাও থেমে গেল একসময়।
রাত নামল। ঘন হল অন্ধকার। সমস্ত প্রাসাদটা নীরব নিঝুম।
রাত বাড়ল বাড়তেই থাকল। দেখা নেই মরিডোর। অস্থির হয়ে উঠছে তিন গোয়েন্দা। তবে কি সে আসবে না? কোনরকম বিপদে পড়ে গেল?
দরজা খুলল মুসা। অন্ধকার ছাত! আকাশে মেঘ জমছে। দূরে মিটমিট করছে শহরের আলো। বাতিগুলোরও ঘুম পেয়েছে যেন।
হঠাৎ ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। পাঁই করে ঘুরল মুসা। কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা, টেরই পায়নি।
সেন্ট্রিরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে টর্চ জ্বাল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এবার বেরোতে হয়। চলুন। আমেরিকান এমব্যাসিতে যেতে হবে। পরিকল্পনা বদল করেছে ডিউক রোজার। খবর পেলাম, প্রিন্স দিমিত্রির অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করবে সে আগামী কালই। নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে রিজেন্ট ঘোষণা করবে।
ঠেকানো যাবে না? জানতে চাইল কিশোর।
সম্ভব না। জনসাধারণকে যদি আসল কথাটা জানানো যেত, ছুটে আসত ওরা। ধ্বংস করে দিত রোজারকে। কিন্তু জানানো যাচ্ছে না। টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন দখল করে বসে আছে ডিউকের লোক। মিলিটারি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ওদেরকে হটানর ক্ষমতা আমাদের নেই, রবিনের দিকে ফিরল। রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছেন, মনে পড়েছে? আঙিনায় পাওয়া যায়নি ওটা।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
মাকড়সাটা যদি পাওয়া যায়, বলে উঠল কিশোর, কি লাভ হবে? রোজারকে ঠেকানো যাবে এখন?
হয়ত, কথা বলল মেরিনা। মিনস্ট্রেলরা গোপনে একটা সভা ডাকতে পারবে। পাড়ার মাতব্বর গোছের কিছু কিছু লোককে ডেকে আনা হবে। মাকড়সাটা দেখিয়ে বলতে পারবে প্রিন্স দিমিত্রি সাহায্য চান। আমাদের হাতের রূপালী মাকড়সা দেখলে অবিশ্বাস করবে না তারা। খবরটা ছড়িয়ে পড়বে। এতে হয়ত স্রোতের মোড় ঘুরেও যেতে পারে। শুধু ডেনজো শহরের লোক খেপে উঠলেই রোজারের বারোটা বাজবে।
তাহলে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। মাকড়সাটা খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের। এবং সেটা এই প্রাসাদ ছাড়ার আগেই। ব্যালকনি, কার্নিস সব খুঁজব। শেষে ঢুকব সেই ঘরে। রূপালী মাকড়সানা নিয়ে যাব না।
বুঝতে পারছেন, কি ভয়ানক ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন? হুশিয়ার করল মরিডো।
পারছি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তবে, বিপদে না-ও পড়তে পারি। ওই ঘরে আবার ফিরে যাব আমরা, ভাববে না কেউ।…অন্তত, সে-সম্ভাবনা কম…
.
১০.
সেন্ট্রিরুম ছাড়ার আগে প্রতিটি সম্ভাবনার ব্যাপারে আলোচনা করল ওরা। এখানে ঢুকেছিল, এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে, সে ব্যাপারেও খুব সতর্ক হল। পড়ে থাকা খাবারের প্রতিটি কণা তুলে নিল, ফেলে দিল ফোকর দিয়ে ডেনজো নদীতে। প্যাকেটের কাগজটা দলে মুচড়ে বল বানিয়ে ফেলে দিল। মোট কথা, কোনরকম চিহ্নই রাখল না।
রাত আরও বাড়ার অপেক্ষায় রইল ওরা, পাহারাদারদেরকে ঝিমিয়ে পড়ার সময় দিল।
অনেক অপেক্ষা করেছি, একসময় বলে উঠল মরিডো। দুটো বাড়তি টর্চ এনেছি, এই যে, পকেট থেকে ছোট দুটো টর্চ বের করে মুসা আর কিশোরের হাতে তুলে দিল। নিতান্ত দরকার না হলে জ্বালবেন না। গতরাতের মতই আমি আগে থাকব, মেরি সবার পেছনে। ঠিক আছে?
নীরবে মাথা কাত করে সমর্থন জানাল তিন গোয়েন্দা।
এক সারিতে সেন্ট্রিরুম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। একটাও তারা নেই আকাশে, ঢেকে গেছে কালো মেঘে। ওরা বেরোতে না বেরোতেই একটা দুটো করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল, বড় বড়।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। পাঁচতলার করিডরে নেমে থামল। কালি গুলে দিয়েছে যেন কেউ। আধ হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পুরো একটা মিনিট। না, কোন শব্দ কানে আসছে না। মরে গেছে যেন বিশাল প্রাসাদটা।
ঝুঁকি নিতেই হল। টর্চ জ্বালল মরিডো, অন্ধকারে এগোতে পারবে না নইলে। একবার জেলেই নিভিয়ে দিল আবার। পথ দেখে নিয়ে পা বাঁড়াল।
অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মরিডো।
পেরিয়ে এল অসংখ্য করিডর, সিঁড়ি। ছেড়ে দিলে বলতেই পারবে না তিন গোয়েন্দা, কোন্ পথে এসেছে। পথ চিনে ফিরে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। মস্ত এক গোলক ধাঁধা যেন!
তবে মরিডো চেনে পথ। একটা ঘরে এসে ঢুকল সবাইকে নিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল দরজায়।
একটু জিরিয়ে নিই এখানে, বলল মরিডো। এ-পর্যন্ত তো ভালই এলাম। তবে সবচেয়ে সহজ পথটা পেরিয়েছি। এইবার আসতে পারে বিপদ। আমার মনে হয়, আপনাদেরকে প্যালেসে আর খুঁজছে না ওরা এখন। তাহলে সতর্কতায় ঢিল পড়তে বাধ্য। সুযোগটা নেব আমরা। প্রথমে যাব সেই ঘরে, রূপালী মাকড়সা পাই আর না পাই। তারপর চলে যাব ডানজনে। সেখান থেকে নেমে পড়ব পাতালের ড্রেনে। মাটির তলা দিয়ে চলে যাব আমেরিকান এমব্যাসির কাছে। আপনাদেরকে। নিরাপদে পৌঁছে দিয়েই অন্য কাজে হাত দেন। পোস্টার টানাব, হরতাল করব মিনস্ট্রেলদের নিয়ে। ডিউক রোজারের শয়তানী ফাস করে দেব। জনগণকে চেতিয়ে দেবার চেষ্টা চালাব। তারপর যা থাকে কপালে, হবে। চুপ করল সে। তারপর বলল, চলুন, যাই। জানালা দিয়ে বেরিয়ে গতরাতের মত ব্যালকনিতে নামি। কার্নিস ধরে চলে যাব। সেই ঘরটায়।
দুটো দড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। একটা মরিডোর হাতে পেঁচানো। আরেকটা মেরিনার কোমরে।
হাতের দড়িটা খুলে নিয়ে জানালার মাঝখানের দণ্ডের সঙ্গে শক্ত। করে বাঁধল মরিডো। তারপর দড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চাপা শিসের শব্দ এল ব্যালকনি থেকে। তারমানে পৌঁছে গেছে সে। ওদেরকে যাবার জন্যে ইঙ্গিত করেছে।
মুসা নেমে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল মেরিনা আর রবিন। ব্যালকনিতে আবছা আলো নড়াচড়া করছে। টর্চের মুখে হাত চাপা দিয়ে রূপালী মাকড়সা খুঁজছে তিনজনে।
খানিক পরেই নিভে গেল আলো। আবার শোনা গেল চাপা শিস।
রবিনকে দুড়ি ধরে ঝুলে পড়তে বলল মেরিনা।
ব্যালকনিতে নেমে এসেছে পাঁচজনে। দড়িটা ঝুলে আছে। থাকবে এভাবেই। রূপালী মাকড়সা খোঁজা শেষ করে আবার এপথেই ফিরে যেতে হবে। করিডর আর গোপন কিছু সিঁড়ি বেয়ে নামবে মাটির তলার ডানজনে।
মাকড়সাটা এখানে পড়েনি, অন্ধকারে ফিসফিস করে জানাল মরিডে। কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে, উত্তেজিত। কে জানে, নদীতেই পড়ে গেল কিনা! তবে ঘরটা অরি কার্নিস না দেখে শিওর হওয়া যাবে না।
ব্যালকনির রেলিঙ টপকে কার্নিসে নামল ওরা। দেয়ালের দিকে মুখ করে এক সারিতে এগিয়ে চলল শামুক-গতিতে। তেমনি নিঃশব্দে।
কার্নিসটা যেখানে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে মোড় নিয়েছে, সেখানে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল রবিন। নিচে অন্ধকারের দিকে তাকাল! এখানে পড়ে যায়নি তো রূপালী মাকড়সা! তাহলে গেল। আর পাওয়া যাবে না ওটা। এর বেশি ভাবতে চাইল না রবিন। পাশে সরে সরে আবার এল সঙ্গীদের সঙ্গে।
কয়েক পা করে এগিয়েই টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছে মরিডো। শেষ। পর্যন্ত পৌঁছুল এসে সেই ঘরটার ব্যালকনিতে। কিন্তু পাওয়া গেল না। রূপালী মাকড়সা। শেষ ভরসা এখন, ওই ঘর। ওখানেও যদি না পাওয়া যায়, রবিনের মতই আর ভাবতে চাইল না সে-ও।
সবাই এসে উঠল ব্যালকনিতে। সাবধানে। পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিল মরিডো। অন্ধকার। কেউ আছে বলে মনে হল না। টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হল, কেউ নেই।
একে একে ঘরে এসে ঢুকল ওরা সবাই।
এইবার খুঁজতে হবে, বলল কিশোর। কোথাও বাদ দিলে চলবে না। আনাচে-কানাচে, জিনিসপত্রের তলায়, সব জায়গায় দেখতে হবে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ কর্কশ একটা শব্দে চমকে উঠল সবাই। কি করে জানি ঘরে এসে ঢুকেছে একটা ঝিঁঝি পোকা।
ঘরে ঝিঁঝি ঢোকা সৌভাগ্যের লক্ষণ, ফিসফিস করে বলল মুসা। এটা আফ্রিকান প্রবাদ। প্রচুর সৌভাগ্য এখন দরকার আমাদের।
হয়েছে, বলল কিশোর। কথা না বলে এস এখন কাজ করি।
খুঁজতে শুরু করল ওরা। হাঁটু মুড়ে বসে, দরকার পড়লে উপুড় হয়ে শুয়ে, প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখতে লাগল। কার্পেটের তলা, গদির নিচে দেখল আগে। তারপর দেখল খাট, আলমারি আর অন্যান্য আসবাবপত্রের তলায়। শেষে দেখল আলমারির প্রতিটি ড্রয়ার, মাকড়সাটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, এমন প্রতিটি জায়গায়।
খাটের তলায় ঢুকে পড়ল রবিন। হাতে লাগল শক্ত মসৃণ কিছু। পেয়েছি! বলে চেঁচিয়ে উঠেই চুপ হয়ে গেল। প্রতিটি টর্চের আলো এসে পড়ল তার হাতের ওপর। ধাতব জিনিস। তবে রূপালী মাকড়সা নয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। ক্যামেরার ফিল্মের কৌটার ঢাকনা।
দুত্তোর! ক্রল করে এগিয়ে গেল রবিন। উপুড় হয়ে বসে আলো ধরে রেখেছে মুসা।
ক্রিক! ক্রিক! তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল।
আলো সরে গেল মুসার টর্চের। সবাই দেখল, ঘরের কোণের দিকে দ্রুত সরে যাচ্ছে কালো একটা পোকা। ঝিঁঝি। আলোয় অস্বস্তি বোধ। করছে। ছুটে অন্ধকারে পালাতে চাইছে।
কপাল খারাপ পোকাটার। তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে সরতে গিয়ে পড়ল প্রিন্স পলের মাকড়সার জালে। ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
দুলে উঠল জাল। সুতো বেয়ে খবর পৌঁছে গেল মাকড়সার কাছে। তক্তার প্রান্ত আর মেঝের মাঝখানে সেই ফাঁকটাতেই বসে আছে। মাকড়সা, গায়ে গা ঠেকিয়ে। দুটো। লাল বড় বড় চোখ চকচক করছে আলোয়।
দ্রুত জাল বেয়ে উঠে এল একটা মাকড়সা। তাই করে ওরা। সঙ্গীসাথী যতই থাকুক, শিকার ধরা পড়লে এক জালে একটা মাকড়সাই উঠে আসে। মুখ থেকে আঠালো সুতো বের করে পেঁচিয়ে ফেলে শিকারকে। তারপর ধীরেসুস্থে বসে আরাম করে চুষে খায় রস।
খুব বেশিক্ষণ ছটফট করতে পারল না বেচারা ঝিঁঝি। দ্রুত জড়িয়ে যেতে লাগল আঠালো সুতোয়। নড়ার ক্ষমতাই আর রইল না। সাদাটে কালো একটা গোল পুটুলি হয়ে ঝুলে রইল জালে।
ছুটে গিয়ে ঝিঁঝিকে মুক্তি দেবার প্রচণ্ড ইচ্ছেটা জোর করে রোধ। করল রবিন। পোকাটাকে সরিয়ে আনতে হলে জাল ছিঁড়তে হবে মাকড়সার। হয়ত বা মাকড়সাটাকে আহত করতে হতে পারে। কিন্তু সেটা অসম্ভব। ভ্যারানিয়ার সৌভাগ্যবাহী প্রাণীর গায়ে আঙুল ছোঁয়ালেই মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাবে তার।
কই, তোমার আফ্রিকান প্রবাদের কি হল? মুসার দিকে ফিরে বলল রবিন। আমাদের সৌভাগ্য আনতে গিয়ে ওই বেচারাকেই মরতে হল। ভাবছি, আমরাও না আবার রোজারের জালে জড়িয়ে মরি, ওই ঝিঁঝিটার মতই!
চুপ করে রইল মুসা।
খাটের তলায় পাওয়া গেল না, রূপালী মাকড়সা। বেরিয়ে এল রবিন। আলমারির সমস্ত ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলেছে মরিডো আর কিশোর। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দেখছে।
মনে হয়, ফিসফিস করে বলল কিশোর, নদীতেই পড়ে গেছে। মাকড়সাটা! গার্ডেরা পায়নি, আপনি শিওর তো? মরিডোকে জিজ্ঞেস করল সে।
শিওর, বলল মরিডো। ভয়ানক খেপে আছে ডিউক রোজার। মাকড়সাটা পেয়ে গেলে অন্যরকম থাকত তার মেজাজ। পেছনে এসে দাঁড়ানো রবিনের দিকে ফিরল সে। আলো ফেলল তার গায়ে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রবিন ধীরে ধীরে। সেই আগের মতই অন্ধকারে ঢেকে আছে তার স্মৃতির কয়েকটা মিনিট। কিছুতেই ঢাকনা। সরাতে পারছে না ওখান থেকে।– ঠিক আছে, আবার একবার খুঁজে দেখি সারা ঘর, বলল মরিডো। কিশোরের দিকে ফিরল। আসুন, আমরা সুটকেসগুলো দেখি। মেরি, তুমি দেখ বালিশের খোলের ভেতরে। গদিটাও তুলে দেখ আরেকবার।
জানে ওরা, বৃথা সময় নষ্ট, তবু আরেকবার খুঁজে দেখল।
পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ঘরের মাঝখানে এসে জড়ো হল সবাই।
নেই এ ঘরে, কাঁপছে মরিডোর গলা। রোজারের লোকেরা পায়নি, আমরা পেলাম না, তারমানে গেল রূপালী মাকড়সা। নদীতেই পড়েছে ওটা! পাওয়ার আশা নেই আর।
তাহলে, কি করব এখন আমরা? বলল কিশোর। স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছে মরিডোর হাতে। এছাড়া গতি নেই এপ্রাসাদে। ওর। সাহায্য ছাড়া এখানে কিছুই করতে পারবে না তিন গোয়েন্দা।
বেরিয়ে যাব, বলল মরিডো। নিরাপদ জায়গায়,.. তার মুখের কথা মুখেই রইল। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দপ করে জ্বলে উঠল। তীব্র উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো। চোখ ধাধিয়ে গেল ওদের।
খবরদার! যেখানে আছ, দাঁড়িয়ে থাক! এল কর্কশ আদেশ। অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের!
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল পাঁচজনে। হঠাৎই নড়ে উঠল মরিডো। লাফ দিল সামনে। একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, মেরিনা, ওঁদেরকে নিয়ে পালাও! ব্যাটাদের ঠেকাচ্ছি আমি!
আসুন! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা। জানালার দিকে ছুটেছে। আসুন আমার সঙ্গে!
পাঁই করে ঘুরেই জানালার দিকে দৌড় দিতে গেল রবিন আর কিশোর। শক্ত একটা থাবা পড়ল কিশোরের ঘাড়ে। তার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারল না সে।
দুপা এগোল রবিন। পরক্ষণেই পিঠের ওপর এসে পড়ল ভারি দেহ। জড়াজড়ি করতে করতে গায়ের ওপর এসে পড়েছে মরিডো আর এক প্রহরী।
ধাক্কা লেগে দড়াম করে হাত পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল রবিন। জোরে ঠুকে গেল কপাল আর মাথার একটা পাশ। মেঝেতে পুরু কার্পেট না থাকলে খুলিই ফেটে যেত হয়ত। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই নিয়ে দুবার আঘাত পেল মাথায়।
জ্ঞান হারাল রবিন।
.
১১.
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে রবিন। কানে আসছে কিশোর আর মরিডোর কথা।
ওই ঝিঁঝিটার মতই জালে আটকা পড়লাম, বলল কিশোর। বাইরে করিডরে লোক থাকবে, কল্পনাও করিনি। উত্তেজনার বশে হয়ত জোরেই কথা বলে ফেলেছিলাম। কানে গিয়েছিল ব্যাটাদের। কিংবা কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে আলোও দেখে থাকতে পারে।
আমিও কল্পনা করিনি, বিষণ্ণ কণ্ঠ মরিডোর। তাহলে ওই করিডরে আগেই একবার উঁকি দিয়ে যেতাম। যাক, মুসাকে নিয়ে মেরি অন্তত পালাতে পেরেছে।
কিন্তু ওরা দুজনে কি করতে পারবে?
জানি না। হয়ত কিছুই না। বাবা আর মিনস্ট্রেল পার্টির লোকদের জানাতে পারবে বড়জোর, আমরা ধরা পড়েছি। বাবা উদ্ধার করতে পারবে না আমাদের, তবে সময়মত লুকিয়ে পড়তে পারবে। ডিউক রোজারের হাতে পড়ে কষ্ট ভোগ করতে হবে না।
কিন্তু আমরা তিনজন পড়লাম বিপাকে! দিমিত্রিও। তিক্ত কিশোরের গলা। প্রিন্সকে সাহায্য করতে এসেছি। তা-তো করতে পারিইনি, উল্টে রোজারের পথ সাফ করে দিলাম। আমাদের কাম সারা।
কা-ম সারা!
বাংলা শব্দ। মানে, আমরা শেষ।…মনে হয়, রবিনের জ্ঞান ফিরেছে। ইসস, বেচারা নথি। দুই বার লাগল বাড়ি, দুবারই মাথায়।
চোখ মেলল রবিন। কাঠের চৌকিতে শুধু পাতলা চাদরের ওপর শুয়ে আছে চিত হয়ে। ঘরে স্লান আলো। মোমবাতিটার দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করল সে। পাথরের দেয়াল ঘেঁষে পাতা রয়েছে চৌকি। মাথার ওপরে পাথরের ছাত। লোহার ভারি দরজার ওপর দিকে ছোট গোল একটা ফুটো, বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা দেখার জন্যে।
সঙ্গীকে চোখ মেলতে দেখে কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর আর মরিডো।
উঠে বসল রবিন। এর পরে আর কখনও ভ্যারানিয়ায় এলে মাথায় হেলমেট পরে আসব, শুকনো হাসি হাসল সে।
ভালই আছেন, মনে হচ্ছে! বলল মরিডো। একটা দুশ্চিন্তা গেল।
রবিন, মনে করতে পারছ কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ভালমত ভেবে দেখ।
নিশ্চয়। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল গার্ডের। এক ব্যাটাকে আমার ওপর ছুঁড়ে ফেললেন মরিডো। ব্যস, উপুড় হয়ে পড়ে খেলাম মাথার বাড়ি। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আমি জানতে চাইছি রূপালী মাকড়সার কথা। মনে পড়ছে কিছু?
না। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন।
হুমম! অনেক সময় দ্বিতীয়বার মাথায় চোট লাগলে চলে যায় অ্যামনেশিয়া। ফিরে আসে স্মৃতি।
আসেনি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। কয়েকটা মিনিট এখনও ফাঁকা!
এটা বরং ভালই হল, বলে উঠল মরিডো। যতই চাপাচাপি করুক ডিউক রোজার, রূপালী মাকড়সার খোঁজ জানতে পারবে না।
ঠিক এই সময় চাবির গোছর শব্দ হল বাইরে। খুলে গেল ভারি দরজা। দুজন লোক। রয়্যাল গার্ডের ইউনিফর্ম পরা। বুটের গট গট শব্দ তুলে ভেতরে এসে ঢুকল ওরা। হাতে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। উজ্জ্বল আলো। দুজনেরই ডান হাতে ঝকঝকে খোলা তলোয়ার।
এস, ভারি মোটা একটা কণ্ঠস্বর। ডিউক রোজার অপেক্ষা করছেন। ওঠ। আমাদের মাঝখানে থাকবে। চালাকির চেষ্টা করলে বুঝবে মজা! তলোয়ার তুলে শাসাল সে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তিন বন্দি। আগে রইল এক প্রহরী, পেছনে অন্যজন। নিয়ে চলল বন্দিদের।
সরু অন্ধকার একটা করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। বাতাসে ভাপসা গন্ধ। পায়ের তলায় পাথরের মেঝে কেমন ভেজা ভেজা, ঘেমে উঠেছে। যেন। সামনে পেছনে দুদিকেই অন্ধকার।
ঢালু হয়ে উঠে গেছে করিডর। একটা জায়গায় এসে থেমেছে সিঁড়ির গোড়ায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ির পরেই আবার শুরু হয়েছে করিডর। দুপাশে সারি সারি লোহার দরজা। নিশ্চয় কয়েদখানা। এই করিডরের পরে আবার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। ওপরে আরেকটা করিডরের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী।
প্রহরীদের মাঝখান দিয়ে করিডরে উঠে এল ওরা। এখোল। সামনে, একপাশের একটা দরজা খোলা। উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে করিডরে। দরজার সামনে বন্দিদেরকে নিয়ে আসা হল। একবার ভেতরে চেয়েই শিউরে উঠল কিশোর আর রবিন। এই ধরনের ঘর এর আগেও দেখেছে ওরা, ভয়াল ছায়াছবিতে। শত শত বছর আগেকার, মধ্যযুগীয় পীড়ন ঘর। তবে এটা ছায়াছবি নয়, বাস্তব।
পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল ওদের। লম্বা একটা ঘর। বিচিত্র, কুৎসিত সব জিনিসপত্র। নির্যাতনের যন্ত্র। একপাশে কুৎসিত একটা ব্ল্যাক থেকে ঝুলছে এক হতভাগ্য। লোহার শেকলে বাঁধা কব্জি। পায়ের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে দিয়েছে ভারি পাথর। লম্বা হয়ে গেছে লোকটা। মাঝখান থেকে দুটুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাবে আরেকটু টান পড়লেই। পরনে একটা সুতোও নেই। হাড়ের ওপর কটুচকে জড়িয়ে আছে শুকনো চামড়া।
আরেকদিকে বিশাল একটা গোল পাথর, গম ভাঙার যাতার মত দেখতে, তবে অনেক বড়। ওটার গায়ে টান টান করে আটকে দেয়া হয়েছে আরেকটা মানুষকে। এক এক করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হয়েছে হাত-পায়ের হাড়।
আরও সব বিচিত্র যন্ত্রপাতি। বেশির ভাগেরই নাম জানা নেই কিশোর কিংবা রবিনের। পাথর, লোহা কিংবা কাঠের তৈরি। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছয় ফুট লম্বা এক লোহার মেয়েমানুষ। ওই জিনিস আগেও দেখেছে কিশোর, সিনেমায়। আয়রন মেইডেন বা লৌহমানবী নাম। আসলে মেয়েমানুষের আকৃতির একটা লম্বা বাক্স ওটা। একপাশে কজা। টান দিয়ে বাক্সের ডালা খোলার মতই খোলা যায়। ভেতরের দেয়ালে চোখ কাটা বসানো। বন্দিকে ধরে তার ভেতরে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে ডালা বন্ধ করা হয়। শরীরে ঢুকে যেতে থাকে অসংখ্য কাটা। কাটাগুলোর মাধ্যায় আবার এক ধরনের ওষুধ মাখিয়ে রাখা হয়। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে যন্ত্রণা শতগুণে বাড়িয়ে তোলে বন্দির।
টর্চার রুম! ফিসফিস করে বলল মরিডো। কাঁপছে গলা। এটা তৈরি হয়েছে সেই ব্ল্যাক প্রিন্স জনের আমলে। ভয়াবহ এক পিশাচ ছিল লোকটা। মধ্যযুগের সবচেয়ে অত্যাচারী সাত আটজন শাসকের একজন। ওর পরে এই ঘর আর কেউ ব্যবহার করেনি বলেই জানতাম। কিন্তু এখন তো দেখছি অন্যরকম! ডিউক রোজার গোপনে ঠিকই ব্যবহার করছে এটা!
পেটের ভেতরে অদ্ভুত একটা শিরশিরে অনুভূতি হল কিশোরের। একসঙ্গে ঢুকে পড়েছে যেন কয়েক ডজন প্রজাপতি, ডানা নাড়ছে! আড়চোখে দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবিনের চেহারা। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
চুপ! ধমকে উঠল এক প্রহরী। ডিউক রোজার আসছেন।
ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে দরজার দুপাশে দুজন প্রহরী। বুটের খটাশ শব্দ তুলে স্যালুট করল।
গটমট করে হেঁটে এসে ঘরে ঢুকল ডিউক রোজার। পেছনে এল। ডিউক লুথার মরিজ।
বন্দিদের সামনে এসে দাঁড়াল রোজার। কুৎসিত হাসি ফুটল ঠোঁটে। ইঁদুরের বাচ্চারা, ফাঁদে পড়লে শেষে! এইবার খেচানো হবে চোখা শিক দিয়ে। যত খুশি, গলা ফাটিয়ে চেঁচিও। কোন আপত্তি নেই। তারপর গড়গড় করে জবাব দিয়ে যাবে আমার প্রশ্নের। নইলে…
ধুলো ঝেড়ে একটা চেয়ার নিয়ে এসে পেতে দিল এক প্রহরী। বসে পড়ল তাতে রোজার। আরেকটা লম্বা বেঞ্চ এনে পেতে দেয়া হল। তাতে রোজারের মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া হল তিন বন্দিকে।
চেয়ারের হাতলে আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে টোকা দিল রোজার। তারপর, মরিডো, তুমিও আছ এর মধ্যে বেশ! টের পাবে তোমার বাবা, পুরো পরিবার। তোমার কথা বাদই দিলাম।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে মরিডো। কোন জবাব দিল না।
তারপর? আমেরিকান বিচ্ছুরা? রোজারের গলায় কেমন খুশির আমেজ। ধরা তো পড়লে। একটা অবশ্য গেল পালিয়ে। তাতে কিছু যায় আসে না। এবার কিছু প্রশ্নের জবাব দেবে আমার? না না, তোমরা কেন এসেছ, জানতে চাই না। সেটা ক্যামেরাগুলোই জানিয়ে দিয়েছে। ভ্যারানিয়ার বিরুদ্ধে গুপ্তচরগিরি করতে এসেছ। মস্ত অপরাধ। তার চেয়ে বড় অপরাধ করেছ রূপালী মাকড়সা চুরি করে। সামনে ঝুকল। হঠাৎ চেহারা থেকে চলে গেল খুশি খুশি ভাবটা। কোথায় ওটা?
আমরা চুরি করিনি, কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করল কিশোর। কোন্ হারামজাদা চুরি করে আমাদের ঘরে রেখে এসেছিল। আলমারির ড্রয়ারে।
ক্ষণিকের জন্যে ধক করে জ্বলে উঠল রোজারের চোখের তারা। তারপরই স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার। বেশ, বেশ! তাহলে স্বীকার করছ, মাকড়সাটা ছিল তোমাদের ঘরে। এটাও এক ধরনের অপরাধ। যাকগে। খুব নরম মনের মানুষ আমি। দুটো কিশোরকে মারধর করতে খুব মায়া হবে। মাকড়সাটা কোথায় আছে, বলে দাও। ছেড়ে দেব তোমাদেরকে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রধান। শেষে বলে ফেলল, আমরা জানি না। কোথায় আছে, বলতে পারব না।
জেমস বণ্ডের ছবি খুব বেশি দেখেছ, না? ভ্রুকুটি করল রোজার। মারের চোটে হেগেমুতে ফেলবে ব্যাটা, তবু মুখ খুলবে না। রবিনের। দিকে তাকাল। তোমার কি ধারণা, বাচ্চা ইবলিস? রূপালী মাকড়সা কোথায়?
জানি না, মাথা নাড়ল রবিন।
জান না! গর্জে উঠল রোজার। দেখেছ, অথচ কোথায় আছে। জান না! কোথাও লুকিয়ে রেখেছ তোমরা। ফাঁকি দিতে চাইছ এখন। জানি না বললেই হল! কোথায় রেখেছ? কাউকে দিয়েছ?…জবাব দাও!
জানি না, বলল কিশোর। সারারাত চেঁচিয়ে যেতে পারবেন, জানি না-র বেশি কিছু বলতে পারব না আমরা।
বাহ্, চমৎকার! একেবারে জেমস বণ্ডের বাচ্চা! চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। ধীরে ধীরে আঙুলের টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। হঠাৎ বলল, তবে ঘাড় থেকে ভূত ছাড়িয়ে নিতে পারব। গোয়ার্তুমি রোগ সেরে যাবে একেবারে। তোমরা তো বাচ্চা খোকা। কত বড় বড় শক্তিশালী মানুষ এসে ঢুকেছে এখানে, পাথরের মত কঠিন। শেষে পানি হয়ে গেছে গলে। কোটা দিয়ে শুরু করব? আয়রন মেইডেন?
ঢোক গিলল কিশোর। চুপ করে রইল।
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! বলে উঠল মরিডো। ভ্যারানিয়ার ইতিহাস জানা আছে আপনার, ডিউক। সিংহাসন নিয়ে এর আগেও কাড়াকাড়ি খাবলাখাবলি হয়েছে। কেউই টিকতে পারেনি। তাছাড়া, ব্ল্যাক প্রিন্সের কথাও আপনার অজানা নয়। দেশের লোক খেপে গিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়েছিল তাকে। ভুলে যাবেন না কথাটা।
বড় বড় কথা, না? দাঁত বের করে হাসল রোজার। ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। আয়রন মেইডেন ব্যবহার করব না। আগেই বলেছি, মনটা খুব নরম আমার। লোকের কষ্ট সইতে পারি না। তবে, কথা আমি আদায় করবই।
প্রহরীর দিকে চেয়ে আঙুলের ইশারা করল রোজার। জিপসি বুড়ো আলবার্তোকে নিয়ে এস।
জাদুকর আলবার্তো! উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মরিডো। ও…ওকে…
চুপ! ধমকে উঠল রোজার।
দরজায় পদশব্দ হতেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল কিশোর। রবিন আর মরিডোও তাকাল। বৃদ্ধ একজন লোক এসে ঢুকেছে ঘরে। দুদিক থেকে ধরে তাকে নিয়ে আসছে দুই প্রহরী। এককালে খুব লম্বা ছিল, বয়েসের ভারে কুজো হয়ে গেছে এখন। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে এগিয়ে আসছে। উজ্জ্বল রঙের আলখেল্লা গায়ে, কানে সোনার আঙটা। এক ছটাক মাংস আছে কিনা মুখে, সন্দেহ। চামড়া কুঁচকে বসে গেছে হাড়ের গায়ে। বড় বড় দুটো নীল চোখ, ধক ধক করে জ্বলছে যেন। সব মিলিয়ে ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠার মত চেহারা।
লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে ডিউক রোজারের সামনে দাঁড়াল বুড়ো।
এই যে, এসে গেছে জিপসি বুড়ো, রোজারের কথার ধরনে মনে হল, আলবার্তোর মালিক মনে করে সে নিজেকে। কণ্ঠস্বরে নির্লজ্জ দাম্ভিকতা। তোমার জাদুক্ষমতা কিছু দেখাও তো, আলবার্তো। এই ছেলেগুলো কথা গোপন করতে চাইছে। বের করে আন পেট থেকে।
বুড়ো জিপসির কুৎসিত মুখে কঠিন হাসি ফুটল। আদেশ মানতে অভ্যস্ত নয় জিপসি, আলবার্তো। দুপাশের দুই প্রহরীকে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। গুডনাইট, ডিউক।
স্পর্ধা বটে বুড়োর! মুখ কালো হয়ে গেল রোজারের। কোনমতে দমন করে নিল রাগ। পকেট থেকে কয়েক টুকরো স্বর্ণ বের করল।
ভুল বুঝ না, জাদুকর, মোলায়েম গলায় বলল রোজার। এই যে নাও, তোমার সম্মানী। সোনার টুকরো।
ধীরে ধীরে ঘুরল আলবার্তো। শীর্ণ, ঈগলের নখের মত বাকানো আঙুলে একটা একটা করে টুকরো তুলে নিয়ে ঢোলা আলখেল্লার পকেটে ভরল।
হ্যাঁ, আলবার্তোর সঙ্গে যারা ভদ্র ব্যবহার করে, বলল জাদুকর। তাদের সাহায্য করে সে। তো, ডিউক, কি জানা দরকার?
এই ইবলিসের বাচ্চাগুলো ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা লুকিয়ে রেখেছে, বলল রোজার। কিছুতেই বলতে চাইছে না। সহজেই জেনে নিতে পারি ওগুলো ব্যবহার করলে, নির্যাতনের যন্ত্রপাতিগুলো দেখাল। কিন্তু মনটা আমার খুবই নরম। ওসব করতে চাই না। তোমার প্রচণ্ড ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কোন যন্ত্রণা হবে না, ব্যথা পাবে না, অথচ মনের কথা সুড়সুড় করে বলে দেবে ওরা। সেগুলো শুনতে চাই আমি।
ঠিক আছে, ফোকলা হাসি হাসল আলবার্তো। ঘুরে দাঁড়াল তিন বন্দির দিকে। ঝোলা আলখেল্লার পকেট থেকে বের করল একটা পেতলের কাপ আর চামড়ার একটা ছোট থলে। থলে থেকে কয়েক চিমটি কালো পাউডার তুলে নিয়ে ফেলল কাপে। আরেক পকেট থেকে বের করল দামি একটা সিগারেট লাইটার। আগুন ধরাল পাউডারে। নীল ঘন ধোয়া বেরিয়ে এল কাপের ভেতর থেকে।
নাও, শ্বাস নাও বাছারা! গলাটা বকের মত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে জাদুকর। বিড়বিড় করছে অদ্ভুত কণ্ঠে। এক এক করে কিশোর, রবিন আর মরিডোর নাকের কাছে ধরল কাপ! জোরে শ্বাস নাও! জাদুকর আলবার্তোর আদেশ! শ্বাস নাও! বুক ভরে টেনে নাও সত্যি ভাষণের-ধোয়া!
এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে ধোয়া থেকে নাক বাঁচানর চেষ্টা করল ওরা। পারল না। নাকের ভেতর দিয়ে যেন মগজে ঢুকে গেল নীল ধোয়া। জ্বালা ধরিয়ে দিল মস্তিষ্কে, ফুসফুসে। তারপর হঠাৎ করেই আশ্চর্য এক পুলক অনুভব করল। আর জোরাজুরি করতে হল না, নিজেদের ইচ্ছেতেই টেনে নিল ধোয়া। ঢিল পড়ল স্নায়ুতে, ঘুম ঘুম লাগছে।
এবার…তাকাও আমার দিকে! ধীরে ধীরে মোলায়েম গলায় বলল আলবার্তো। আমার চোখের দিকে…
পুরোপুরি ভাবতে পারছে না ওরা, তবু চোখ সরিয়ে রাখার চেষ্টা করল বুড়োর চোখ থেকে। পারল না। প্রচণ্ড এক আকর্ষণ, এড়ানর উপায় নেই। নীল চোখের তারার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল গভীর নীল সাগরে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে। যেন পানি…কেমন এক ধরনের উষ্ণ আবেশ….
এইবার বল! আদেশ দিল আলবার্তো। রূপালী মাকড়সা কোথায় ওটা?
জানি না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মরিডো। তার দিকেই চেয়ে আছে এখন বুড়ো। নীল চোখের তারা থেকে আর সরিয়ে নিচ্ছে না চোখ। জানি না…জানি না…
অহ্! বিড়বিড় করল বুড়ো। শ্বাস নাও! আরও জোরে…আরও টেনে…!
একবার করে আবার তিন বন্দির নাকের সামনে কাপ ধরল আলবার্তো, ওদেরকে ধোয়া টেনে নিতে বাধ্য করল। রবিনের মনে হল, আর পানিতে নয়, আকাশে উঠে পড়েছে। সঁতরে চলেছে মেঘের ভেতর দিয়ে।
বাঁকানো আঙুল দিয়ে মরিডোর কপাল টিপে ধরল বুড়ো আলতো করে। ধরে রাখল কয়েক মুহূর্ত, তারপর ছেড়ে দিল। তর্জনীর মাথা ছোঁয়াল কপালের মাঝখানে। মুখ নিয়ে এল মুখের সামনে। স্থির চোখে তাকাল মরিডোর চোখের তারার দিকে।
এবার, ফিসফিস করল বুড়ো। এবার বল!…ভাব! ভাব, কোথায় রেখেছ রূপালী মাকড়সা। কোথায়!…অহ!
দীর্ঘ আরেক মুহূর্ত মরিডোর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে রাখল আলবার্তো। তারপর সরিয়ে আনল। কিশোরের ওপরও একই প্রক্রিয়া চালাল। শেষে অহ! বলে সরিয়ে আনল আঙুল কপালের ওপর থেকে।
রবিনের দিকে হাত বাড়াল বুড়ো। ওর কপালে আঙুল ছুঁইয়েই। ঝটকা দিয়ে সরিয়ে আনল, যেন জ্বলন্ত কয়লা ছুঁয়েছে। কুঁচকে গেল ভুরু। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রবিনের চোখের দিকে। স্থির চেয়ে রইল দীর্ঘ এক মুহূর্ত।
আলবার্তোর চোখের দিকে চেয়ে বার বার কেবল রূপালী মাকড়সার কথাই মনে আসতে থাকল রবিনের। দুনিয়ার আর সব ভাবনা চিন্তা সরে গেছে বহুদূরে। সে যেন উঠে বসেছে নীল মেঘের চূড়ায়। পায়ের নিচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। অদ্ভুত এক শূন্যতা মাথার ভেতরে। মনে করতে চাইছে, কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে ফেলল মনকে…
অবাক হল যেন আলবার্তো। আরেকবার তার প্রক্রিয়া চালাল রবিনের ওপর। বিড়বিড় করল নরম গলায়, ভাব! ভাব! অবশেষে শব্দ করে শ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল।
চোখ মিটমিট করতে লাগল রবিন। মনে হল, প্রচণ্ড এক ঘূর্ণিপাক। থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে।
আপনমনেই ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বুড়ো। তাকাল রোজারের দিকে।
প্রথম ছেলেটা জানে না, বলল আলবার্তো। ও দেখেনি রূপালী মাকড়সা। মাথাবড় ছেলেটা দেখেছে, তবে হাতে নেয়নি। জানে না কোথায় আছে। আর, ওই বেঁটে ছেলেটা হাতে নিয়েছিল। এবং তারপর…
তারপর? সামনে ঝুঁকে এসেছে রোজার। উত্তেজিত। তারপর কি?
ভাবছিল সে ঠিক মতই। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল মনকে। মেঘের ভেতরে হারিয়ে গেল.রূপালী মাকড়সা। এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হইনি আর কখনও! ও জানত, কোথায় আছে। রূপালী মাকড়সা, তারপর হঠাৎ করেই মুছে গেল, মন থেকে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না আর। ও না পারলে, আমারও কিছু করার নেই।
হারামির বাচ্চা! গাল দিয়ে উঠল রোজার। চিন্তিত ভঙ্গিতে টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। বুড়ো জিপসি… বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। তাড়াহুড়ো করে স্বর পাল্টাল। জাদুকর আলবার্তো, তুমি যথেষ্ট করেছ। রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছে, মনে নেই বিটার। এটা তোমার দোষ নয়। কিন্তু, অনুমানে কিছু বলতে পার না? প্রচণ্ড ক্ষমতা তোমার, জানি। অনুমান করা সম্ভব শুধু তোমার পক্ষেই। কোথায় থাকতে পারে রূপালী মাকড়সা? আগ্রহী চোখে আলবার্তোর দিকে। তাকাল সে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। ওটার আসলেই কি কোন দরকার আছে? ওটা ছাড়া আমার ইচ্ছে কি পূরণ হতে পারে না? নেহায়েত একটা দুধের বাচ্চাকে সিংহাসনে না বসালেই কি নয়? আমি বসতে পারি না?
রহস্যময় হাসি ফুটল বৃদ্ধ জাদুকরের ঠোঁটে। ডিউক, রূপালী মাকড়সার সঙ্গে সাধারণ মাকড়সার তফাৎ নেই। তোমার ইচ্ছের কথা বলছ? বিজয়ের ঘণ্টা শুনেছি আমি।…বয়েস তো অনেক হল। পরিশ্রম আর করতে পারি না। ঘুমানো দরকার। এবার তাহলে আসি। গুড নাইট!
রহস্যময় হাসিটা লেগেই রইল আলবার্তোর ঠোঁটে। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগোল দরজার দিকে।
প্রহরীদের দিকে চেয়ে হাত নাড়ল রোজার। জাদুকরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এস। তারপর ফিরল সঙ্গী ডিউক লুথারের দিকে। শুনলে তো? জাদুকর কি বলে গেল! রূপালী মাকড়সা শুধুই একটা সাধারণ রূপার টুকরো। ওটার কোন ক্ষমতা নেই। এবং ইচ্ছে করলে ওটা ছাড়াই চলতে পারি আমরা। তাছাড়া, ও বলল, বিজয়ের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছে। আর কোন দ্বিধা নেই আমার। জাদুকর আলবার্তোর ভবিষ্যদ্বাণী কখনও মিথ্যে হয় না। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। আগামীকাল সকালেই কাজে লেগে পড়। অ্যারেস্ট কর দিমিত্রিকে। অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিজেকে রিজেন্ট ঘোষণা করব আমি। আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বাতিল করে দেব, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে অন্যায়ভাবে নাক গোনর জন্যে। ঘোষণা করব, দুটো আমেরিকান স্পাই এবং চোর ধরা পড়েছে আমাদের হাতে। তৃতীয়টার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করব। ভোর হওয়ার আগেই ধরে নিয়ে এস মরিডোর পরিবারের, সব লোককে। মিনস্ট্রেলদের যাকে যেখানে পাবে, ধরে নিয়ে এসে ঢোকাও কয়েদখানায়। ওদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আন। একসঙ্গে অনেক কথা বলে দম নিল ডিউক। আগামীকাল সকালেই পুরো ভ্যারানিয়া চলে আসবে আমার হাতের মুঠোয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেব, চোর দুটোকে নিয়ে কি করা যায়। কানমলা দিয়ে ছেড়ে দেব, বের করে দেব দেশ থেকে, নাকি বিচার হবে প্রকাশ্যে? প্রহরীদের দিকে তাকাল। এগুলোকে নিয়ে ভর কয়েদখানায়।
রবিনের দিকে ঝুঁকল রোজার। ইঁদুরের বাচ্চা, ভাব…ভেবে বের কর, কোথায় রেখেছ রূপালী মাকড়সা। জনতা আমার মত নরম মনের মানুষ নয়। ওদের হাতে তুলে দিলে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেবে।…মাকড়সাটা অবশ্য দরকার নেই আমার, আলবার্তো বলেছে। তবু, ওটা গলায় পরে সিংহাসনে বসতে বেশ ভালই লাগবে। প্রিন্সের মতই মনে হবে নিজেকে।
কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রহরীরা।
ওদের দিকে চেয়ে বলল রোজার, নিয়ে যাও।
.
১২.
পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল ওদেরকে দুজন প্রহরী। আবার সেই ডানজনে, পাতালের কয়েদখানায়।
আগে একজন প্রহরী, পেছনে রবিন, কিশোর, তাদের পেছনে মরিডো। চলতে চলতে মরিডোর গা ঘেঁষে এল পেছনের প্রহরী। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, নর্দমায় বন্ধু ইঁদুর আছে। বলেই সরে গেল।
মাথা ঝোকাল মরিডো।
ডানজনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল প্রহরী। ঠেলে বন্দিদেরকে ঢুকিয়ে দিল পাথরের ছোট্ট ঘরে। দেয়ালের কাছে জ্বলছে মোমবাতি, আলতো বাতাস লেগে কেঁপে উঠল শিখা। ছায়ার নৃত্য শুরু হল দেয়ালে।
পেছনে শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল আবার লোহার দরজা। তালা আটকানর আওয়াজ হল। বাইরে দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল দুই প্রহরী। কড়া পাহারার আদেশ আছে তাদের ওপর।
দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল ওরা। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কানে আসছে অতি মৃদু চাপা একটা কুলকুল ধ্বনি। পানি বইছে কোথাও। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মরিডোর দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
প্রাসাদের নিচেই আছে ড্রেন, জানাল মরিভে। ডেনজো নদীতে গিয়ে পড়ছে পানি। বাইরে নিশ্চয় তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। থামল সে। ডেনজোর ওই ড্রেনগুলো শত শত বছরের পুরানো। পাথরের তৈরি পাতাল-খাল বলা চলে ওগুলোকে। তলাটা চ্যাপ্টা, ছাত ধনুকের মত বাঁকানো। মাটির তলায় মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে ওই ড্রেন। শুকনোর সময় হেঁটেই যাওয়া যায় ওর ভেতর দিয়ে। বর্ষায় পানিতে যদি একেবারে ভরে না যায়, নৌকা বাওয়া যায় অনায়াসে।
চুপ করে মরিডোর কথা শুনছে দুই গোয়েন্দা। চোখে মুখে আগ্রহের ছাপ।
ওদের দিকে চেয়ে হাসল মরিডো। আজকাল খুব কম লোকেই ঢোকে এর ভেতর। পথ হারিয়ে মরার ভয় আছে। তাছাড়া রয়েছে ইঁদুর। বেড়ালের সমান বড় একেকটা। কায়ামত পেলে ধরে জ্যান্ত মানুষ খেয়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। তবে আমি আর মেরি ভয় করি না ওসবকে। ভালমতই চিনি ভেতরটা। অনেকবার ঢুকেছি। ওর ভেতরে গিয়ে কোনমতে ঢুকতে পারলে ঠিক চলে যেতে পারব আমেরিকান এমব্যাসির তলায়। ম্যানহোল দিয়ে উঠে যেতে পারব বাইরে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, মাথা ঝোঁকাল আস্তে করে। বুঝলাম। কিন্তু আমরা বন্দি রয়েছি ডানজনে, দরজায় তালা। বাইরে প্রহরী। নর্দমায় পৌঁছব কি করে?
মিনিটখানেকের জন্যেও যদি সময় পাই, বলল মরিডো। পৌঁছে যেতে পারব। বাইরে যে করিডরুটা আছে, তার শেষ মাথায় রয়েছে ম্যানহোল। ওটা দিয়ে সহজেই ঢুকে পড়া যাবে ড্রেনে।
কিন্তু সেজন্যে বেরোতে হবে আগে, আবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।
ওখানে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে লোক রয়েছে। এক প্রহরী মেসেজ দিয়েছে আমাকে।
তা দিয়েছে, কথা বলল রবিন। কিন্তু ওই যে, কিশোর বলল। ডানজন থেকে বেরোব কি করে আমরা?
হুউ! ধীরে ধীরে মাথা ঝোকাল মরিডো। চুপ করে গেল।
আচ্ছা, বলল রবিন। ওই বুড়ো জাদুকরটা আসলে কে? আমাদের মনের কথা জানল কি করে? থট রীডার গোছের কিছু?
হয়ত, মাথা ঝোঁকাল মরিডো। জানি না ঠিক। ভ্যারানিয়ায় এখনও কিছু জিপসি রয়েছে। তাদের সর্দার ওই বুড়ো। একশোর বেশি বয়েস। আশ্চর্য কিছু ক্ষমতার অধিকারী। কি সে ক্ষমতা, জানে না কেউই। বুঝতে পারে না। আমার তো মনে হয়, বুড়ো ঠিক জানতে পেরেছে, কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা। কিন্তু বলেনি রোজারকে। তবে, একটা ব্যাপারে খারাপ হয়ে গেছে মনটা। ও বলেছে, বিজয়ের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছে। কখনও ভুল হয়নি ওর কথা! ফালতু কথা বলে না। তারমানে, সিংহাসন রোজারের দখলেই যাবে! ধরা পড়বে সমস্ত মিনস্ট্রেলরা, মৃত্যুদণ্ড হবে। আমার বাপকে ধরে আনবে, বন্ধুদের ধরে আনবে। ধরে আনবে মেরিকে…চুপ করে গেল সে।
মরিডোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে রবিন। হাল ছেড়ে দেব না আমরা! দৃঢ় গলায় বলল সে। এক বুড়োর কথায় নিরাশ হয়ে ভেঙে পড়ার কোন মানে হয় না। কোনদিন ভুল করেনি বলেই যে সব সময় সত্যি হবে, এটা মানতে রাজি নই আমি। কিশোর, তোমার মাথায় কোন বুদ্ধি এসেছে?
অ্যাঁ! অন্য জগতে বিচরণ করছিল যেন এতক্ষণ গোয়েন্দাপ্রধান। হ্যাঁ, একটা বুদ্ধি এসেছে। এখান থেকে হয়ত বেরিয়ে যেতে পারব। প্রহরীদের দিয়ে আগে দরজা খোলাতে হবে। তারপর কাবু করে ফেলতে হবে ওদের।
দুটো অস্ত্রধারী লোককে কাবু করব? বলে উঠল মরিডো। কি জোয়ান একেকজন, দেখেছ? হাত দিয়ে চেপে ধরলে নড়তেই পারব। না। নাহ্, পারা যাবে বলে মনে হয় না! এেিদক ওদিক মাখা দোলাল সে।
পারতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। একটা কথা মনে পড়ছে। রহস্য কাহিনীতে পড়েছিলাম। ওটা নিছকই গল্প। তবে বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে পারলে, মনে হয় কাবু করে ফেলতে পারব।
কি? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল রবিন।
আমাদের মতই বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে, বলল কিশোর। বিছানার চাদর ছিঁড়ে দড়ি পাকিয়েছিল ওরা। ফাস তৈরি করে ফেলে রেখেছিল দরজার কাছে। তারপর মেয়েটা মেঝেয় পড়ে চেঁচাতে শুরু করেছিল পেট ব্যথা পেট ব্যথা বলে।
ভুরু কুঁচকে গেছে মরিডোর। আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। ঠিক, ঠিক বলেছেন! কাজ হবে এতে! গলার স্বর খাদে নামাল। কিন্তু ফাস বানাব কি দিয়ে?
কেন, বিছানার চাদর, বলল কিশোর। ওরা যা করেছিল। আমাদের এটা পুরানো। তাতে কিছু যায় আসে না। ছিঁড়ে ভালমত পাকিয়ে নিলে যথেষ্ট শক্ত হবে। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়বে না। ওরা ছিল দুজন, তা-ও আবার একজন মেয়ে। আমরা তিনজনেই ছেলে, গায়ে জোরও আছে। আমাদের তো আরও সহজে পারা উচিত।
ঠিক, বিড়বিড় করল মরিডো। সহজেই পারা উচিত। তাছাড়া, প্রহরীদের একজন আমাদের লোক। কাজেই দরজা খোলানো তেমন কঠিন হবে না।
কাজে লেগে পড়ল ওরা। পুরানো হলেও চাদরটা বেশ শক্ত। জোরে টান দিয়ে ছিঁড়তে গেলে শব্দ হবে। তাই আস্তে আস্তে ছিঁড়তে লাগল। তাড়াহুড়ো করল না মোটেই।
চার ইঞ্চি চওড়া একটা ফালি ছেঁড়া হয়ে গেল। আরেকটা ছিঁড়তে শুরু করল ওরা।
খুব ধীরে এগোচ্ছে কাজ। দাঁত ব্যবহার করতে হচ্ছে কখনও কখনও। একের পর এক ফালি ছিঁড়তে লাগল তিনজনে। বড় চাদর। শেষই হতে চায় না যেন আর। শব্দ হয়ে যাবার ভয়ে টান দিয়ে আধ ইঞ্চির বেশি ছিঁড়তে পারছে না একবারে।
আটটা ফালি ছেঁড়া হয়ে গেলে, থামল ওরা। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। বিশ্রাম নেবে। উত্তেজিত হয়ে আছে। শুয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসল আবার। না, কাজ শেষ না করে স্বস্তি পাবে না। কোন কারণে যদি দেখে ফেলে প্রহরীরা, চাদর ছিঁড়ছে ওরা, তাহলেই গেল সুযোগ। আর বেরোতে পারবে না। কাজেই, যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবে কাজ, ততই মঙ্গল। _ আবার ছিঁড়তে শুরু করল ওরা। আঙুল ব্যথা হয়ে গেছে। নাইলনের চাদর, কাজটা মোটেই সহজ নয়।
ছেঁড়ার কাজ শেষ হল। একটার সঙ্গে আরেকটা পাকিয়ে কয়েকটা দড়ি বানিয়ে ফেলতে হবে এখন।
এটা সহজ কাজ। বেশিক্ষণ লাগল না। তৈরি হয়ে গেল নাইলনের দড়ি। শক্ত। ফাঁস তৈরি করে ফেলল কিশোর। মরিডোর পায়ে লাগিয়ে টেনে দেখল।
উত্তেজনা চাপা দিতে পারল না মরিডো। ব্রোজাস! ফিসফিস করে বলল সে। কাজ হবেই। চারটে দিয়েই তো হবে। আর কি দরকার?
হ্যাঁ, হবে, মাথা ঝোঁকাল কিশোর।
আরও কয়েকটা বানিয়ে নিই, প্রস্তাব দিল রবিন। সঙ্গে নিয়ে যাব। কাজে লাগতে পারে দড়ি।
একটার সঙ্গে আরেকটা ফালি বেঁধে জোড়া দিয়ে নিল ওরা। বেশ লম্বা শক্ত আরেকটা দড়ি তৈরি হয়ে গেল। কোমরে পেঁচিয়ে নিল ওটা মরিডো।
এইবার আসল কাজ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। নথি, চৌকিতে শুয়ে পড় চিত হয়ে। কোঁকাতে শুরু কর। মাঝে মাঝেই গুঙিয়ে উঠবে। এমন ভাব দেখাবে, যেন মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। প্রথমে আস্তে, তারপর সুর চড়াতে থাকবে। মরিডো, দরজার কাছে দুটো ফাস বিছিয়ে দিন। ব্যাটারা ঢুকলেই যেন পা পড়ে।
তৈরি হয়ে গেল ফাঁদ। এইবার টোপ ফেলার পালা। গোঙাতে শুরু করল রবিন। সেই সঙ্গে কোঁকানি। বাড়তে থাকল। চড়তে লাগল সুর। চমৎকার অভিনয়। মনে হচ্ছে, সত্যি, মাথার যন্ত্রণায় ভারি কষ্ট পাচ্ছে বেচারা।
মিনিটখানেক পরেই দরজার ফোকরের ঢাকনা সরে গেল। মুখ দেখা গেল একটা। চোখ ঘরের ভেতরে। চুপ! ধমকে উঠল প্রহরী। এত গোলমাল কিসের? ভ্যারানিয়ান ভাষা। বুঝল না দুই গোয়েন্দা।
হাতে মোমবাতি নিয়ে রবিনের মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কিশোর। চৌকির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে মরিডো। প্রহরীর কথায় ফিরে চাইল। ব্যথা পেয়েছে, ভ্যারানিয়ান ভাষায় জবাব দিল সে। গতরাতে দড়ি থেকে হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি লেগেছে মাথায়। সাংঘাতিক, জ্বর উঠেছে এখন। ডাক্তার দরকার।
সব তোমাদের শয়তানী, ইবলিসের দল!
আমি বলছি, ও অসুস্থ! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। পায়ে পায়ে এগোল দরজার দিকে। এসে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।…তাহলে…তাহলে বলব রূপালী মাকড়সা কোথায় আছে। তোদের ওপর খুশি হবে ডিউক রোজার।
দ্বিধা গেল না প্রহরীর।
ভাল করেই জান, আবার বলল মরিডো, আমেরিকান ছেলে দুটোর কোন ক্ষতি হোক, এটা চায় না ডিউক। আমি বলছি ছেলেটা অসুস্থ। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। রূপালী মাকড়সা পেয়ে যাবে। আহ, তাড়াতাড়ি কর! ওর অবস্থা খুব খারাপ!
সত্যি বলছে কিনা দেখা দরকার, ফোকরে উঁকি দিয়েছে এসে দ্বিতীয় প্রহরী। মরিডোর কানে কানে মেসেজ দিয়েছিল সে-ই। ডিউকের কুনজরে পড়তে চাই না। আমি দরজায় থাকছি, তুমি ভেতরে। গিয়ে দেখে এস। দুতিনটে বাচ্চা ছেলেকে ভয় করার কিছু নেই।
ঠিক আছে, বলল অন্য প্রহরী। যাচ্ছি। কথা সত্যি না হলে কপালে খারাপি আছে ওদের, বলে দিলাম!
তালায় চাবি ঢোকানর শব্দ হল। শব্দ তুলে, খুলে গেল দরজা। ভেতরে পা রাখল প্রহরী।
পা দিয়েই ফাঁদে আটকাল। দড়ির ফাঁসের মাঝখানে পা পড়ল প্রহরীর। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ফাঁসটা আটকে দিল মরিডো। টান সইতে না পেরে দড়াম করে চিত হয়ে পড়ে গেল লোকটা। হাতের লণ্ঠন উড়ে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
লাফ দিয়ে এগিয়ে এসেছে কিশোর। আরেকটা ফাঁস আটকে দিল প্রহরীর গলায়। জোর টান দিলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত তৃতীয়। আরেকটা ফাস তার দুহাতে আটকে দিল মরিডো।
এতই দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাগুলো, প্রথমে বিমূঢ় হয়ে গেল প্রহরী। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ জলদি জলদি এস! বিচ্ছুগুলো আটকে ফেলেছে। আমাকে!
ছুটে এল দ্বিতীয় প্রহরী। দরজার পাশেই অপেক্ষা করছে মরিডো। চোখের পলকে পায়ে আর গলায় একটা করে ফাঁস আটকে গেল দ্বিতীয় লোকটারও। হাতে আটকাল আরেকটা।
দ্বিতীয় প্রহরীর কানে কানে ফিসফিস করে বলল মরিডো। ছাড়া পাবার ভান করতে থাক! চুপ করে থেক না।
হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগল লোকটা।
শক্ত করে দুই প্রহরীকেই বেঁধে ফেলা হল। নড়ার উপায় রইল না আর ওদের।
মেঝেতে পড়ে থাকা লোক দুটোর দিকে চেয়ে হাসল মরিডো। মাকড়সার জালে আটকা পড়া পোকার অবস্থা হয়েছে যেন প্রহরীদের। শুভ লক্ষণ! আশা আর উদ্যম আবার ফিরে এল তার।
জলদি করুন! দই গোয়েন্দাকে বলল মরিডো। করিডরের অন্য মাথায় প্রহরী থাকতে পারে। চেঁচামেচি শুনলে ছুটে আসবে ওরা। লণ্ঠন তুলে নিন।
করিডরে বেরিয়ে এল মরিডো। পেছনে কিশোর আর রবিন। সামনে গাঢ় অন্ধকার। সেদিকেই ছুটল ওরা। ছোটার তালে তালে নাচছে বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলো।
করিডরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। সিঁড়ি নেমে গেছে। এক মুহূর্ত। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল মরিডো। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করল দুই গোয়েন্দা।
সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছেই একটা ম্যানহোল। লোহার ভারি ঢাকনা। কোনকালে শেষ খোলা হয়েছিল, কে জানে! মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, তার ওপর পুরু হয়ে জমেছে ধুলো।
ঢাকনার রিঙ ধরে টান দিল মরিডো। নড়াতে পারল না। আবার টান দিল গায়ের জোরে। কোন কাজ হল না। অটল রইল ঢাকনা।
আটকে গেছে! ফাঁসাসে আওয়াজ বেরোল মরিডোর গলা থেকে। মরচে! নড়াতে পারছি না!
জলদি! বলে উঠল কিশোর। জলদি দড়ি ঢোকান রিঙের ভেতর। সবাই ধরে টান দেব!
ঠিক! দ্রুত কোমরে পেঁচানো দড়ি খুলে নিতে লাগল মরিডো।
সবটা খোলার দরকার হল না। একটা প্রান্ত রিঙের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। শক্ত করে ধরল তিনজনে। টান লাগাল।
নড়ল না ঢাকনা।
ওরাও নাছোড়বান্দা। টান বাড়াল আরও, আরও…! পেছনে পায়ের শব্দ। দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর সময় নেই। হ্যাঁচকা টান লাগাল ওরা। অটল থাকতে পারল না আর ঢাকনা। নড়ে উঠল!
ঠনন আওয়াজ তুলে পাথরের মেঝেতে উল্টে পড়ল ভারি ঢাকনা। গর্তের ভেতরে কালো অন্ধকার। পানি বয়ে যাবার শব্দ আসছে।
আমি আগে যাই, টেনে রিঙের ভেতর থেকে দড়িটা খুলে আনতে আনতে বলল মরিডো। দড়ি ধরে থাকবেন। তাহলে হারানর ভয়। থাকবে না।…নাহ, এসে গেছে ব্যাটারা! ঢাকনা বন্ধ করে যাবার আর সময় নেই…
গর্তের ভেতরে পা রাখল মরিডো। দড়ির একটা প্রান্ত ধরে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
দড়ির মাঝামাঝি ধরেছে রবিন। লণ্ঠনের সরু হ্যাঁণ্ডেল ধরে রেখেছে। দাঁতে কামড়ে। গর্তের দিকে চেয়ে কেঁপে উঠল একবার। ওই অন্ধকার মোটেই ভাল লাগছে না তার। নিচ থেকে আসা পানির আওয়াজও কানে সুধা বর্ষণ করছে না। কিন্তু তবু যেতেই হবে। মুহূর্ত দ্বিধা করেই। ভেতরে পা রাখল সে।
হাঁটু অবধি পা ঢুকিয়ে দিল রবিন। কিছুই ঠেকল না। তবে কি সিঁড়ি নেই! না না আছে। লোহার মই। খাড়া। নেমে পড়ল সে। এক ধাপ…দুই ধাপ…পা পিছাল হঠাৎ করেই। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারল না ম্যানহোলের কিনারা।
রবিনের মনে হল, পতন আর কোন দিন শেষ হবে না। কিন্তু হল। প্রাচীন পাথুরে নর্দমার তলায় এসে নামল নিরাপদেই। গর্তের মুখ থেকে উচ্চতা বড় জোর সাত-আট ফুট হবে। কোনরকম আঘাত পায়নি, কারণ হাঁটু পানিতে পড়েছে। তাছাড়া, পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ধরে ফেলেছে মরিডো।
চুপ, কানে কানে বলল মরিডো। ওই যে, কিশোর। সরুন। নামার জায়গা দিন।
কিশোরও পা পিছলাল। তবে রবিনের মত নিরাপদে নামতে পারল না। সড়াৎ করে পিছলে গেল। ধপ করে পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে চিত হয়ে। মইয়ের গোড়ায় মাথা বাড়ি লাগার আগেই ধরে ফেলল তাকে মরিডো। টেনে তুলল।
বাপরে বাপ! ঠাণ্ডা!…উফফ, মেরুদণ্ডটা ভেঙেই গেছে! হাঁসফাস করে উঠল গোয়েন্দাপ্রধান।
বৃষ্টির পানি, তাড়াতাড়ি বলল মরিডো। ময়লা নেই। চলুন, কেটে পড়ি। দড়ি ছাড়বেন না কিছুতেই। পথ হারাবেন তাহলে। নদীর দিকে বয়ে যাচ্ছে পানি। ড্রেনের মুখে লোহার মোটা মোটা শিক…
মাথার ওপরে চিৎকার শুনে চুপ হয়ে গেল মরিডো। লণ্ঠন ঝুলছে, আলো।
সরে এল তিনজনে। হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক গজ এগিয়েই নিচু হয়ে এল সুড়ঙ্গের ছাত। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। মাথা সামান্য নুইয়ে রাখতে হচ্ছে। হাঁটুর নিচে পানির তীব্র স্রোত। পিচ্ছিল মেঝে। অসতর্ক হলেই আছাড় খেতে হবে।
ম্যানহোলের মুখে অনেক লোকের চেঁচামেচি। একটা মোড় ঘুরতেই আলো আর দেখা গেল না।
ধীরে ধীরে দূরে, অনেক দূরে মিলিয়ে গেল যেন চেঁচামেচি। আসলে খুব বেশি এগোয়নি ওরা। ম্যানহোল দিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে বাইরের শব্দ আসতে পারছে না ঠিকমত।
সুড়ঙ্গের একটা মিলনস্থলে এসে পৌঁছুল ওরা। আরেকটা সুড়ঙ্গের সঙ্গে আড়াআড়ি মিলিত হয়েছে প্রথমটা। যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। ওটাতে ঢুকে পড়ল ওরা।
দাঁড়ানো যাচ্ছে এখন সোজা হয়ে। ছাতে মাথা ঠেকছে না। পানি বেশি বড় সুড়ঙ্গটায়, স্রোতও বেশি। শাখা-সুড়ঙ্গগুলো থেকে এসে, এটাতে পড়ছে পানি। কলকল ছলছল আওয়াজ তুলছে পাথরের দেয়ালে বাড়ি দিয়ে। শক্ত করে দড়ি ধরে রেখেছে ওরা। বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলোতেও কাটতে চাইছে না সামনে পেছনের ঘন কালো অন্ধকার। স্রোতের বিপরীতে এগোতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চলতে চলতে দুপাশে অসংখ্য ছোটবড় ফাটল দেখতে পেল ওরা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ঝাড়া দিয়ে মাথা থেকে পানিতে ফেলে দিল কিছু একটা। তীক্ষ্ণ কাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠল ফাটলের ভেতর থেকে।
ইদুর, হেসে বলল মরিডো। পানি বইছে, তাই রক্ষে। নইলে এতক্ষণে হয়ত আক্রমণই করে বসত।
খাবি খেতে খেতে এগিয়ে এল একটা বাদামি রোমশ জীব। টকটকে লাল চোখ। কাছে এসে কিশোরের পা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ঝাড়া দিয়ে ইঁদুরটাকে আবার পানিতে ফেলে দিল সে। স্রোতের ধাক্কায় ভেসে চলে গেল ওটা।
পেছনে মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল!
ব্যাটারা আসছে! ফিসফিস করে বলল মরিডো। আসছে শুধু ডিউকের ভয়ে। সুড়ঙ্গগুলো চেনে না ওরা। তবু আসতে হচ্ছে।
গতি বাড়াল ওরা। ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে, স্রোতও বাড়ছে। আরও খানিকটা এগিয়ে ঝর্না দেখতে পেল। না না, ঝর্না না। খোলা। ম্যানহোল দিয়ে একনাগাড়ে ঝরে পড়ছে, হয়ত রাস্তার পানি।
এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। ভিজতেই হল। চুপচুপে হয়ে গেল। মাথা-গলা-শরীর। ম্যানহোলটা পেছনে ফেলে এল ওরা।
হঠাই বেরিয়ে এল একটা বড়সড় ড্রামের মত গোল কক্ষে। চারপাশের দেয়ালে ছোট বড় গর্ত। সুড়ঙ্গমুখ।চারদিক থেকে এসে প্রধানটার সঙ্গে মিশেছে শাখা-সুড়ঙ্গগুলো। পানি থই থই করছে এখানে। লোহার ঢালু মই উঠে গেছে ওপরের দিকে।
ইচ্ছে করলে এদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি, বলল মরিডোে। কিন্তু উচিত হবে না। প্রাসাদের কাছাকাছিই রয়ে গেছি এখনও। আসুন, মইটাতে উঠে বসে জিরিয়ে নিই। প্রহরীরা আসতে অনেক দেরি আছে, যদি এতটা আসার সাহস করে ওরা। পানি ঝরছে যে, ওই ম্যানহোেলটার ওপাশ থেকেই ফেরত যেতে পারে হয়ত।
দুই ফুট চওড়া একেকটা ধাপ। তিনটা ধাপে উঠে বসল তিনজনে।
হেলান দিতে গিয়েই ককিয়ে উঠল কিশোর। ছোঁয়াতে পারছে না পিঠের নিচের অংশ। উত্তেজনায় ব্যথা টের পায়নি এতক্ষণ।
কি হল, মুখ তুলে তাকাল রবিন আর মরিডো।
কিছু না। পিঠে চোট পেয়েছি। সামান্য।
শেষ পর্যন্ত তাহলে পালাতে পারলাম! জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল রবিন। এতটা যখন চলে এসেছি, আর ধরতে পারবে না।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মরিডো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, বাতি নিভিয়ে ফেলুন! জলদি!
সঙ্গে সঙ্গে বাতির সুইচ অফ করে দিল দুই গোয়েন্দা।
ড্রামের মৃত গোল দেয়ালের গায়ে বড় বড় দুটো গর্ত, প্রধান সুড়ঙ্গের দুটো মুখ। বাকিগুলো সব ছোট ছোট। ওগুলো দিয়ে ঢোকা যাবে না। বড় দুটো গর্তের একটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা খানিক আগে। ওটা দিয়েই আসছে প্রহরীরা। দ্বিতীয় মুখ, যেটা দিয়ে এগিয়ে যাবে ভেবেছিল, ওটাতে আলো দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকেও আসছে লোক!
তারমানে, ফাঁদে পড়ে গেছে তিনজনে।
১৩.
ওপরে উঠুন! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। ঢাকনা খুলে বেরিয়ে যাব!
ভেজা পিচ্ছিল সিঁড়ির ধাপে পা রেখে রবিন আর কিশোরকে ডিঙিয়ে দ্রুত উঠে চলে গেল মরিডো। তার পেছনে উঠল দুই গোয়েন্দা। পাশাপাশি দাঁড়ানর জায়গা নেই। ওরা এক ধাপ নিচে রইল।
অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। অনুমানে ওপর দিকে হাত বাড়াল মরিডো। হাঁতে লাগল লোহার ঢাকনা। ঠেলা দিল। টান দিয়ে তোলার চেয়ে ঠেলা দিয়ে তোলা সহজ, বেশি জোর করা যায়। কিন্তু তবু প্রথমবারের চেষ্টায় উঠল না ঢাকনা।
আরেক ধাপ উঠে গেল মরিডো। কাঁধের একপাশ ঠেকাল ঢাকনার তলায়। ঠেলা দিল গায়ের জোরে। নড়ে উঠল ঢাকনা। ফাঁক হয়ে গেল। চাপ কমিয়ে দিল সে। হাত দিয়ে ঠেলে আরও খানিকটা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল। সঙ্গে সঙ্গেই নামিয়ে আনল মাথা। ছেড়ে দিল ঢাকনা। বন্ধ হয়ে গেল ওটা আবার।
দুজন গার্ড! মোড়ের কাছে অপেক্ষা করছে! ফিসফিস করে জানাল মরিডো।বেরোলেই কাঁক করে এসে চেপে ধরবে!
এখানেই যদি চুপ করে বসে থাকি? বলল কিশোর। হয়ত দেখতে পাবে না আমাদের।
এছাড়া করারও কিছু নেই, হতাশ কণ্ঠ মরিডোর। বসে থাকব। চুপ করে। কপাল ভাল হলে বেঁচে যাব!
আলো বাড়ছে সুড়ঙ্গে। এগিয়ে আসছে, বোঝাই যাচ্ছে। পানিতে ঝিলমিল করছে আলো।
হঠাৎ বেরিয়ে এল একটা ছোট ডিঙি। সামনের গলুইয়ের কাছে বসে আছে একজন, মাঝে আরেকজন। নৌকার পাটাতনে রাখা লণ্ঠন। গলুইয়ে বসা লোকটার হাতে একটা লগি।
মরিডো। ডেকে উঠল মাঝে বসা মেয়ে কণ্ঠ। মরিডো, আছ ওখানে? ওপরের দিকে তাকাল সে।
মেরিনা! আনন্দে জোরে চেঁচিয়ে উঠেই আবার স্বর খাদে নামাল মরিডো। মেরি, আমরা এখানে!
থেমে গেল নৌকা। হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা টর্চ তুলে আলো ফেলল মেরিনা। চুপচুপে ভেজা ইঁদুরের মত সিঁড়ির ধাপে বসে আছে ওরা তিনজন।
প্রিন্স পলকে ধন্যবাদ! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা। আমরা তো ভেবেছিলাম, বেরোতেই পারবে না!
দেয়ালের ফাটলে লগির মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে নৌকাটাকে এক জায়গায় স্থির রাখল যুবক। তাড়াহুড়ো করে নেমে এল কিশোর, রবিন আর মরিডো। সঙ্গে সঙ্গেই লগিটা খুলে আনল যুবক। মেঝেতে লগি ঠেকিয়ে জোরে ঠেলা দিল। শাঁ করে আবার ঢুকে পড়ল নৌকাটা যে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েছিল, সেটার ভেতরে।
একজন গার্ড তোমার মেসেজ দিয়েছে আমাকে, মেরিনাকে বলল মরিডো।
কয়েক ঘণ্টা যাবৎ তোমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, জানাল মেরিনা। জানি, মেসেজ পেলে যে করেই হোক বেরিয়ে পড়বেই তোমরা। এদিকে আরও দুবার খুঁজে গেছি। এবারে না পেলে ধরেই নিতাম, মেসেজ পাওনি।…ওহ, মরিডো, তোমাদের দেখে কি-যে খুশি লাগছে।
আমাদেরও লাগছে! তিনজনের হয়েই বলল মরিডো। যুবককে দেখিয়ে বলল দুই গোয়েন্দাকে, আমার চাচাতো ভাই, রিবাতো৷, বোনের দিকে ফিরল আবার। বাইরে কি ঘটছে, মেরি?
জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল মেরিনা। সামনে হঠাৎ অন্ধকার দূর হয়ে গেছে খানিকটা জায়গায়। আলো এসে পড়েছে। কথা বলার শব্দ। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ফেলা হয়েছে ওখানটায়।
জলদি! জলদি নৌকা থামাও! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। নৌকা ম্যানহোলের প্রায় তলায় চলে এসেছে। থেম না! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। সোজা এগিয়ে যাও!
লগি দিয়ে সুড়ঙ্গের মেঝেতে জোরে গুতো মারল রিবাতো। তীরের মত ছুটল হালকা ডিঙি।
সিঁড়ি নেই এখানে। একাধিক সুড়ঙ্গের মিলনস্থল নয় এটা। এখান দিয়ে সাধারণত নামে না কেউ। ওপরে কোন কারণে পানি আটকে গেলে, গর্তের ঢাকনা খুলে দেয়া হয়। পানি সরে যায়। রোজারের লোকেরা হয়ত জানে না এটা। তাই খুলেছে। ভেবেছে, এখান দিয়েই ঢুকবে।
ম্যানহোলের নিচ দিয়ে যাবার সময় ওপরের দিকে তাকাল সবাই। উঁকি দিয়ে আছে একটা মুখ। ডিঙিটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। পা ঢুকিয়ে দিল দুহাতে ভর রেখে, ছেড়ে দিল শরীরের ভার। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল নৌকাটা। ঝপাং করে পেছনের পানিতে পড়ল লোকটা। নৌকার ওপর পড়ে ওটাকে ঠেকাতে চেয়েছিল, পারেনি।
লগি দিয়ে ওর পেটে এক গুঁতে লাগাল রিবাতো। উ-ক! করে উঠল লোকটা। চেঁচিয়ে উঠল ব্যথায়।
ওপর থেকে আরও একজন প্রহরী পড়ল পানিতে। তার পর পরই আরও একজন। পানি ভেঙে তাড়া করে এল নৌকাটাকে।
আলো নেভাও! চেঁচিয়ে আদেশ দিল মরিডো। অফ করে দাও সুইচ!
ক্ষণেই গভীর অন্ধকার গ্রাস করল ওদেরকে। ম্যানহোল দিয়ে আসা আলো দ্রুত সরে যাচ্ছে পেছনে। স্রোতের টান, তার ওপর লগির। ঠেলায় যেন উড়ে চলল খুদে ডিঙি। সামনের গলুইয়ে বসে দুপাশে হাত ছড়িয়ে দিয়েছে মরিডো। দেয়ালে বাড়ি লাগতে পারে নৌকা, হাত দিয়ে ঠেলে ঠেকাবে।
তাড়া করে আসবেই ওরা, অন্ধকারে বলল মরিডো। তবে পারবে না নৌকার সঙ্গে।
সামনে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে বসে থাকতে পারে, বলল রিবাতো। মেরি, টর্চ জ্বালা তো। সামনেটা দেখে নিই।
জ্বলে উঠল টর্চ। সামনে একটা কক্ষ। আরেকটা সুড়ঙ্গ-সঙ্গম।
পাশের আরেকটা সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ব, বলল রিবাতো। সামনে অপেক্ষা করে থাকলে ব্যাটাদের নিরাশ হতে হবে।
বেশ বড় একটা কক্ষ। তিন দিক থেকে আরও তিনটে সুড়ঙ্গ এসে মিশেছে। একটা সামনে। ওটা প্রধান সুড়ঙ্গ। দুপাশের দুটো সরু। ও দুটো দিয়ে পানি এসে পড়ছে প্রধান সুড়ঙ্গে। দুটোর সবচেয়ে সরু সুড়ঙ্গটাতে নৌকা ঢুকিয়ে দিল রিবাতো।
আবার লণ্ঠন জ্বালল মেরিনা।
স্রোত ঠেলে যেতে হচ্ছে এখন। এগোতে চাইছে না নৌকা। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে একা রিবাতো। পাটাতনের নিচে আরেকটা লগি আছে, মরিডো।
ছোট লগিটা বের করে নিল মরিডো। দুজনে মিলে বেয়ে নিয়ে। চলল নৌকাটাকে। নিচু ছাত। কোথাও কোথাও এত নিচু, মাথা নুইয়ে। ফেলতে হচ্ছে। তবে, সামনে পথ রুদ্ধ হয়ে নেই কোথাও।
রিবাতোকে চিনতে পারছেন? দুই গোয়েন্দার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল মরিডো।
এতক্ষণ উত্তেজনায় খেয়াল করেনি, ভাল করে চাইল এখন রবিন। আরে, তাই তো! চেনা চেনা লাগছে! কোথায় দেখেছে এর আগে! কোথায়,..
ব্যাণ্ড পার্টির সর্দার, বলে উঠল কিশোর। সেদিন পার্কে দেখেছিলাম।
চিনেছেন, বলল মরিডো। আমার আর মেরিনার চেয়ে ভাল চেনে সে এই সুড়ঙ্গ। ওপরে কোথায় কি আছে, তা-ও বলে দিতে পারে শুধু দেয়াল দেখেই।
সামনে আবার নিচু হয়ে আসছে ছাত। ওটা পেরোনর সময় প্রায় শুয়ে পড়তে হল সবাইকে।
পেছনে কারও আসার শব্দ নেই। শুধু দেয়ালে পানি বাড়ি লাগার ছলছলাৎ।
মুসা কোথায়? পেছনে বসে থাকা মেরিনার দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে, জানাল মেরিনা। ইচ্ছে করেই রেখে এসেছি। ছোট নৌকা। বোঝা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া, নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে রেখে এসেছি। সবাই একসঙ্গে ধরা পড়ার আশঙ্কাও রইল না।
ঠিকই করেছে মেরিনা, আর কিছু বলল না কিশোর।
কোথায় এলাম আমরা, রিবাতো? জানতে চাইল মরিডো। হারিয়ে-টারিয়ে যাচ্ছি না-তো?
কেন, এদিকটায় আসনি? জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল। রিবাতো, ঘুরপথে যাচ্ছি। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব আরেকটা কক্ষে।
এগিয়ে চলেছে নৌকা। মিনিট তিন-চার পরেই আলো দেখা গেল সামনে।
আবার আসছে কে জানি! আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে উঠল রবিন।
আসছে না, অপেক্ষা করছে, জবাব দিল মেরিনা। মুসা।
আরেকটা বড় কক্ষে এসে ঢুকল নৌকা। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বলছে। পুরানো মরচে ধরা সিঁড়ির ধাপে আরাম করে বসে আছে। গোয়েন্দা সহকারী। রবিন আর কিশোরের দিকে চেয়ে হাসল। ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁত। আহ্, বাঁচা গেল! এসে পড়েছ! আমি তো ভাবছিলাম, আর আসবেই না!
একাই বসে আছ! বলল রবিন।
না, ঠিক একা নয়, দেয়ালের ফাটলগুলোর দিকে তাকাল একবার মুসা। বেশ কয়েকটা ইঁদুর সঙ্গ দিতে এসেছে বার বার। খাতির বেশি হয়ে গেলে গায়ের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাই তাড়িয়েছি। বাপরে বাপ! ইঁদুর না-তো! যেন বেড়াল একেকটা!
দেয়ালের একপাশে বিরাট এক গর্ত। ধারগুলো অসমান। মানুষের তৈরি নয়, দেখেই অনুমান করা যায়। দেয়াল তৈরির আগে থেকেই ছিল ওটা ওখানে, তেমনি রেখে দেয়া হয়েছে।
নৌকাটাকে সিঁড়ির সঙ্গে বেঁধে ফেলা হল। কয়েক ধাপ নেমে বসল। মুসা।
নর্দমা তৈরির সময়ই ওটা দেখতে পেয়েছিল মিস্ত্রিরা, গর্তটা দেখিয়ে বলল মরিডো। বন্ধ করেনি, তেমনি রেখে দিয়েছে। ওটাও একটা সুড়ঙ্গমুখ, প্রাকৃতিক। অনেক আগেই এটা আবিষ্কার করেছি। আমরা। বলতে ভুলে গেছি, ছোটবেলায় একটা দল ছিল আমাদের। প্রায়ই নেমে পড়তাম এই সুড়ঙ্গে। একেক দিন একেকটার ভেতর ঢুকে পড়তাম। এমনি করেই চিনেছি সুড়ঙ্গগুলো। কাজটা খুবই বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু কেয়ার করতাম না। এমনকি বাবাও ঠেকাতে পারেনি আমাদের। ছেলেবেলার সেই খেলা আজ হয়ত আমাদের প্রাণই বাঁচিয়ে দিল!
দেরি করে লাভ কি? বলল মেরিনা। এদেরকে নিয়ে যাওয়া দরকার। মনে হচ্ছে, আগের প্ল্যানে চলবে না।
কি কি ঘটেছে, সেটা আগে বল আমাকে, বলল মরিডো। রিতো, তুমি এখানে এলে কি করে?
চাচাকে অ্যারেস্ট করার সময় তোমাদের বাড়িতেই ছিলাম, জানাল রিবাতো। গোপন দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছি। চাচাকে ধরার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাটা বলল: তোমার বিশ্বাসঘাতক ছেলেকেও শিগগিরই কোর্টে হাজির করা হবে। মেরিনার কথা কিছু বলল না। বুঝলাম তাকে ধরতে পারেনি রোজারের কুত্তারা। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে গেল মেরিনার সঙ্গে। পেছনের গলি দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিল। ঠেকালাম। ছুটলাম তাকে নিয়ে। এই সময় শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। তোমাদের কথা জানাল মেরিনা। মিনস্ট্রেলদের গোপন আড্ডায় চলে গেলাম। ওখানেই মুসা আমানকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল মেরিনা। তোমাদেরকে বের করে আনা দরকার। মেসেজ দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম একজনকে। আমরা তিনজন নৌকা নিয়ে ঢুকে পড়লাম সুড়ঙ্গে। ডেনজো নদী দিয়ে ঢুকেছি। অনেকদিন আগে শিক ভেঙে রেখেছিলাম। যে মুখটার…।
হ্যাঁ, বলে উঠল মেরিনা। কোন অসুবিধে হয়নি ঢুকতে। তখনও পানি বেরোতে শুরু করেনি ততটা। স্রোত খুব বেশি ছিল না। ঢুকে ডানজনের ওদিক থেকে কয়েকবার ঘুরে এসেছি, আগেই তো বলেছি। অনুমান করতে কষ্ট হয়নি, তোমাদেরকে ডানজনেই আটকে রাখবে ওরা। বেরোতে পারলে, ডানজনের বাইরের ম্যানহোল দিয়েই নামবে তোমরা। ওটা ছাড়া আর কোন পথ নেই ওখান থেকে বেরোবার, জানিই।
রেডিওটা কোথায়? মুসার দিকে চেয়ে বলল রিবাতো।
আছে, পকেট থেকে খুদে একটা রেডিও বের করল মুসা। এই যে! বন্ধ করে রেখেছি। ভাষা তো বুঝি না…
নব ঘুরিয়ে চালু করে দিল রেডিওটা মুসা।
ঝমঝম করে বাজছে যন্ত্রসঙ্গীত। বিশেষ সামরিক সুর। হঠাৎ থেমে গেল। ভেসে এল একটা ভারি গমগমে গলা। খানিকক্ষণ একটানা শব্দ বর্ষণ করে থেমে গেল। আবার বেজে উঠল বাজনা।
একটা বিন্দুও বুঝতে পারল না তিন গোয়েন্দা। ভ্যারানিয়ান ভাষা।
সকাল আটটায় সমস্ত রেড়িও আর টেলিভিশন সেট ভোলা রাখার অনুরোধ জানাচ্ছে, বলল মেরিনা। ভ্যারানিয়ার সকল নাগরিককে সেটের সামনে থাকতে বলছে। জাতির উদ্দেশে এক বিশেষ ভাষণ দেবে ডিউক রোজার।…তারমানে, সকাল আটটায় জানাবে সে: একটা– বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছে। অভিযোগ আনবে প্রিন্স দিমিত্রির বিরুদ্ধে। নিজেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে রিজেন্ট ঘোষণা করবে। লোককে বোঝাতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। আপনাদেরকে স্পাই ঘোষণা করা তেমন কঠিন হবে না তার পক্ষে। ক্যামেরাগুলো প্রমাণ হিসেবে দেখাবে দেশবাসীকে।
তারমানে, হতাশ গলায় বলল রবিন। দিমিত্রির সর্বনাশ করলাম আমরা! উপকার কিছুই করতে পারলাম না। কার মুখ দেখে যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম!
আপনাদের কোন দোষ নেই, বলল মেরিনা। আপনারা না। এলেও প্রিন্স দিমিত্রিকে সিংহাসনে বসতে দিত না রোজার। কোন না কোন উপায়ে সরিয়ে দিতই। এখন আপনাদেরকে যাতে ধরতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। পৌঁছে দিতে হবে আমেরিকান। এমব্যাসিতে। রিবাতো, কি বল?
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকাল রিবাতো।
কিন্তু আপনাদের কি হবে? মেরিনার দিকে চেয়ে বলল কিশোর। আপনার বাবা? প্রিন্স দিমিত্রি?
সেটা পরে ভাবব, দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেরিনা। অনেক দেরিতে বুঝেছি আমরা রোজারের পরিকল্পনা! আগে জানলে, প্রিন্স দিমিত্রিকে সরিয়ে ফেলতাম। তারপর দেশবাসীকে বোঝানো এমন কিছু কঠিন হত না। কিন্তু, অনেক সময় নিয়ে, চারদিক গুছিয়ে আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছে রোজার। কি করে পারব আমরা তার সঙ্গে? তাছাড়া ক্ষমতায় রয়েছে সে…
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল রিবাতো। মহা ধড়িবাজ! তবে সহজে ছাড়ব না। যতক্ষণ প্রাণ থাকবে, চেষ্টা করে যাব। একটা শয়তান দেশের স্বাধীনতা নষ্ট করবে, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। হয়ত আমরা মরে যাব! কিন্তু দিন আসবেই! কুচক্রী লোক বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি এখানে, ভ্যারানিয়ার ইতিহাস বলে। ডিউক রোজারের ধ্বংস অনিবার্য। হয়ত সময় লাগবে…….হ্যাঁ, চলুন, আপনাদেরকে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি। ধরা পড়তে দেয়া চলবে না কিছুতেই।
নৌকা নিয়ে যাওয়া যাবে না, বলল মেরিনা। সকাল হয়ে গেছে। ডেনজো নদীতে দেখে ফেলবে আমাদেরকে। ধরা পড়ে যাব।
হ্যাঁ, বলল রিবাতো। এই সুড়ঙ্গ দিয়েই বেরোতে হবে।
পানিতে নেমে পড়ল রিবাতো। তার পর পরই নামল মরিভো। একে একে নেমে পড়ল অন্যেরাও।
কোমরে পেঁচানো দড়ি খুলে নিল মরিডো। একটা লণ্ঠন হাতে ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। দড়ি ধরে তার পেছনে ঢুকে পড়ল আর সবাইকে পাশ কাটিয়ে আগে চলে গেল রিবাতো। হাতে আরেকটা লণ্ঠন। হেঁটে চলল আগে আগে।
রির্বাতোকে অনুসরণ করল দলটা নীরবে।
.
১৪.
বৃষ্টি থেমে গেছে। ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে নেমে আসা পানি দেখেই বোঝা যায়। পায়ের পাতা ভিজছে এখন শুধু, এতই কম। আস্তে আস্তে আরও কমে যাচ্ছে। লণ্ঠন টর্চ সবই আছে সঙ্গে। একটা জায়গায় এসে ঘোরপ্যাঁচও কমে গেছে। এখন প্রায় সোজা এগিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। দ্রুত হাঁটতে পারছে ওরা।
আচ্ছা, একটা কথা, একসময় বলল রিবাতো। আমেরিকান এমব্যাসির ওদিক দিয়ে যে বেরোব, যদি গার্ড থাকে?
তাই তো! এটা তো ভাবেনি কেউ! অনেকখানি চলে এসেছে ওরা। মনে হচ্ছে, না জানি কত পথ! অথচ নৌকা থেকে নামার পর বড়জোর আট কি দশটা ব্লক পেরিয়ে এসেছে। বেশ চওড়া একটা জায়গায় এসে থেমে গেল রিবাতো। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যেরাও।
প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ। কিন্তু অব্যবহৃত থাকেনি। ওপরে ম্যানহোল তৈরি হয়েছে। সিঁড়ি না বসিয়ে অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাড়া পাথরের দেয়ালে গেঁথে দেয়া হয়েছে দুই কোনা লোহার আঙটা।
একই সঙ্গে দুভাবে ব্যবহার করা যায় এটা। হাত দিয়ে ধরা যায়, পা রেখে অনেকটা মইয়ের মতই ওঠা-নামাও যায়।
এখানে দাঁড়ালে কেন? জিজ্ঞেস করল মরিডো। আরও দুটো ব্লক পেরোতে হবে।
বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, বলল রিবাতো। জায়গাটায় পাহারা থাকবেই। প্রথমে আমরা কোথায় যাব, এটা ঠিকই আঁচ করে নেবে ওরা। তারপর জায়গা মত ওত পেতে বসে থাকবে। যেই বেরোব, ক্যাক করে চেপে ধরবে গর্ত থেকে বেরোনো ইঁদুরের মত। সেইন্ট ডোমিনিকসের পেছনে রয়েছি আমরা এখন। এই একটা জায়গায় পাহারা থাকার সম্ভাবনা কম। এখান দিয়ে বেরিয়ে বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে চলে যেতে পারব এমব্যাসিতে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, সায় দিল মরিডো। ঠিক আছে। খামোকা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল, উঠি।
আঙটা বেয়ে তরতর করে উঠে গেল রিবাতো। ম্যানহোলের ঢাকনাই নেই এখানটায়। কোনকালে খুলে গিয়েছিল কে জানে, লাগানো হয়নি আর। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল একবার সে। তারপর চেঁচিয়ে বলল, একজন একজন করে উঠে আসবে। টান দিয়ে তুলে নেব আমি।
বাইরে বেরিয়ে গেল রিবাতো। গর্তের দিকে মুখ কুঁকিয়ে বসল।
প্রথমে উঠে গেল মেরিনা। ওপরে উঠে হাত বাড়িয়ে দিল। তাকে তুলে নিল রিবাতো।
অন্যেরাও উঠে এল একে একে।
আকাশ মেঘে ঢাকা। গোমড়া সকাল। বিষণ্ণ এক দিনের শুরু। পানি জমে গেছে রাস্তার দুপাশে। খানাখন্দগুলো ভরা।
সরু একটা গলি পথে এসে উঠল ওরা। বাজারের ভেতর দিয়ে গেছে পথ। দুপাশে সারি সারি দোকানপাট। বেশিরভাগই ফুল আর ফলের দোকান। ভিড় কম। মাত্র সকাল হয়েছে। ক্রেতারা আসতে শুরু করেনি এখনও। হয়ত রেডিও-টেলিভিশনের সামনে বসে আছে!
অবাক চোখে ছয়জনের দলটার দিকে তাকাল লোকে। সারা গা ভেজা, ময়লা, চুল উষ্কখুষ্ক, মুখ শুকনো। ঝড়ো কাকের অবস্থা হয়েছে! কারও দিকেই তাকাল না ওরা। নীরবে এগিয়ে চলল দ্রুত।
আগে আগে চলেছে রিবাতো। পঞ্চাশ গজমত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সামনে, মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী, রয়্যাল গার্ড।
পিছাও! চাপা গলায় আদেশ দিল রিবাতো। লুকিয়ে পড় সবাই!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। ফিরে চেয়েছে এক প্রহরী। দেখে ফেলেছে। ভেজা কাপড়-চোপড় আর চেহারা দেখেই অনুমান করে নিয়েছে, কারা ওরা। চেঁচিয়ে উঠেই ছুটে এল।
খবরদার! চেঁচিয়ে বলল প্রহরী। পালানর চেষ্টা কোরো না। রিজেন্টের আদেশে অ্যারেস্ট করা হল তোমাদেরকে!
ধরতে হবে আগে, তারপর তো অ্যারেস্ট, ফস করে বলল রিবাতো। পাঁই করে ঘুরেই দৌড় দিল। গির্জার দিকে…এছাড়া আর জায়গা নেই লুকানর…
ছুটতে শুরু করেছে দলের সবাই। লোকজন কেউ সামনে পড়লে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আশপাশে আরও প্রহরী ছিল। চেঁচামেচিতে ওরাও এসে যোগ দিয়েছে প্রথম দুজনের সঙ্গে। মোট ছজন প্রহরী তাড়া করে আসছে এখন।
ছুটতে ছুটতেই ওপরের দিকে তাকাল রবিন। সামনে বাড়িঘর। ছাতের ওপর দিয়ে চোখে পড়ছে ডোমিনিকসের সোনালি গম্বুজ। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে ও। ভাবছে, গির্জার ভেতর লুকিয়ে কি হবে? ধরা পড়তে সামান্য বিলম্ব হবে, এই যা।
পাশে চেয়ে দেখল, কিশোরও চেয়ে আছে গম্বুজের দিকে। ছুটছে, চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। জরুরি কিছু একটা ভাবছে নিশ্চয় সে। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করার সময় এখন নেই।
পেছনে, আছাড় খেল এক প্রহরী। তার গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল আরেকজন। পড়ল আরও দুজন। হৈ হট্টগোল, চেঁচামেচি। আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসে তুলছে টেনে।
অনেকখানি এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল দলটা। প্রহরীদেরকে পঞ্চাশ গজ পেছনে ফেলে এল ওরা ছয়জন। অবাকই হল রবিন। একই পথ ধরে ছুটে এসেছে ওরা। ওদের কেউ তো আছাড় খেল না! তাহলে ইচ্ছে করেই কি পড়ে গেল সামনের প্রহরীটা! মিনস্ট্রেল পার্টির লোক?
মোড় ঘুরল ছজনে। আর মাত্র একটা ব্লক। তারপরেই সেইন্ট ডোমিনিকস। বিশাল গির্জার ব্লক খানেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। প্রহরী। চেয়ে আছে এদিকেই।
প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকা যাবে না কিছুতেই।
কিন্তু সেদিকে এগোলও না রিবাতো। রাস্তা পেরিয়ে ছুটে গেল গির্জার পেছনের ছোট একটা দরজার দিকে। শাঁ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অন্যেরাও ঢুকে পড়ল তার পেছন পেছন। দরজা বন্ধ করেই। ছিটকিনি তুলে দিল।
পৌঁছে গেল প্রহরীরা। দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করল। সেই সঙ্গে ক্রুদ্ধ চেঁচামেচি।
মুহূর্তের জন্যে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আনল রবিন। বিশাল চার দেয়াল, ওপরে ছাত আছে বলে মনে হল না। তবে আকাশও দেখা যাচ্ছে না পুরোপুরি। কিছু একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের সামনে। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে লোহার সিঁড়ি। ওপর থেকে নেমে এসেছে আটটা লম্বা দড়ি। সিঁড়ির পাশে দেয়ালে গাঁথা লোহার আঙটার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে প্রান্তগুলো।
আর কিছু দেখার সময় পেল না রবিন।
ক্যাটাকম্বের দিকে যেতে হবে, কানে এল রিবাতোর কথা। লুকিয়ে থাকতে হবে ওখানেই…
ক্যাটাকম্ব কি, রবিনের জানা আছে। গির্জার ভেতরে মাটির তলায়। ভাঁড়ারের মত বড় বড় ঘর। কফিনে ভরে লাশ নিয়ে রেখে দেয়া হয় ওসব ঘরে। বড় বড় গির্জায় মাটির নিচেও থাকে একাধিক তলা। তাতে অসংখ্য ঘর, অসংখ্য করিডর, সিঁড়ি, অন্ধকার!
কি হবে ওখানে গিয়ে? বলে উঠল কিশোর। ওরা ঠিক বুঝে। যাবে, কোথায় গেছি আমরা। বাতি নিয়ে এসে সহজেই খুঁজে বের করবে।
সবাই চোখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে।
কিছু একটা ভাবছ তুমি, কিশোর! বলল মুসা। কি?
ওই দড়িগুলো, হাত তুলে দেখাল কিশোর। ওগুলো টেনে প্রিন্স পলের ঘণ্টা বাজানো যায়?
প্রিন্স পলের ঘণ্টা! অবাক হয়ে তাকাল মরিডো। কিশোরের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। না, ওগুলো সাধারণ ঘণ্টার দড়ি। প্রিন্স পলের ঘণ্টা রয়েছে অন্য টাওয়ারটাতে। ওপাশে। একটাই ঘণ্টা। বিশেষ বিশেষ সময়ে কেবল বাজানো হয়।
শুনেছি, দ্রুত বলল কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রির কাছে শুনেছি, শত শত বছর আগে আরেকবার অভ্যুত্থান হয়েছিল ভ্যারানিয়ায়। ওই ঘণ্টা বাজিয়ে দেশবাসীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন প্রিন্স পল।
হাঁ করে অন্য পাঁচজন চেয়ে আছে কিশোরের মুখের দিকে।
চোয়ালের একপাশ চুলকাল রিবাতো। হ্যাঁ। ভ্যারানিয়ায় বাচ্চা ছেলেরাও জানে একথা। কিন্তু তাতে কি?
উনি বলতে চাইছেন, প্রিন্স পলের মতই গিয়ে আমরাও বাজাব ওই ঘণ্টা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। সাহায্য চাইব প্রিন্স দিমিত্রির জন্যে! ইসস, কেউ ভাবিনি আমরা এ কথাটা! খালি খবরের কাগজ, রেডিও আর টেলিভিশনের দিকেই ছিল খেয়াল! অনেক দিন বাজেনি ওই ঘণ্টা! যদি আজ হঠাৎ করে…
..বাজতে শুরু করে, মরিডোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল মেরিনা, চমকে উঠবে লোকে! দেশবাসী ভালবাসে প্রিন্স দিমিত্রিকে। দলে দলে ছুটে যাবে তারা প্রাসাদের দিকে। জানতে চাইবে, কি হয়েছে!
কিন্তু যদি… শুরু করেই থেমে গেল রিবাতো।
আর দেরি নয়! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। দরজায় আওয়াজ শুনছ! ভেঙে ফেলবে শিগগিরই! যা করার জলদি করতে হবে!
ঠিক আছে! আর দ্বিধা করল না রিবাতো। মরিডো, তুমি এঁদেরকে নিয়ে যাও! আমি আর মেরিনা এখানে অপেক্ষা করছি। প্রহরীদের দেখিয়ে ছুটে যাব ক্যাটাকম্বের দিকে। লুকিয়ে পড়ব। ওরা আমাদের পেছনে সময় নষ্ট করবে। ঘণ্টা বাজানর সুযোগ পেয়ে যাবে। তোমরা। যাও!
আসুন! তিন গোয়েন্দাকে বলল মরিডো। এপথে!
গির্জার ভেতর দিয়েও পৌঁছে যাওয়া যায় অন্য টাওয়ারটাতে। আগে আগে ছুটছে মরিডো। পেছনে রবিন, মুসা, তার পরে কিশোর।
পেছনে পড়তে শুরু করল রবিন। হঠাৎ ব্যথা আরম্ভ হয়েছে তার। ভাঙা পায়ে। গতরাত থেকে নিয়ে অনেক বেশি দৌড়াদৌড়ি করেছে। সবে জোড়া লেগেছে পায়ের হাড়। এ-পর্যন্ত সয়েছে, এটাই বেশি।
সবার পেছনে পড়ে গেল রবিন। থামল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটল। অন্য সময় হলে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি করত মুসা। কিন্তু এখন দেখেও দেখল না।
দাঁড়িয়ে পড়েছে আগের তিনজন। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। আরেকটা বেল-টাওয়ার। প্রথম যেটায়। ঢুকেছিল, তেমনি। তবে এখানে ওপর থেকে একটা মাত্র দড়ি ঝুলে আছে।
লোহার সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল মরিডো। অন্য তিনজন অনুসরণ করল তাকে।
রিঙে বাঁধা দড়ি খুলে দিল মরিডো। ঝুলে পড়ল দড়ির প্রান্ত। দ্রুত সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠে চলল সে।
মরিডোর পেছনে উঠে যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকাল একবার কিশোর। না, পড়ে যাবে না রবিন। তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মুসা। উঠে আসছে দ্রুত।
.
১৫.
উঠেই চলেছে ওরা। সিঁড়ি যেন আর ফুরায় না।
ভীষণ ক্লান্ত ওরা। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। কষ্ট বেশি হচ্ছে রবিনের।
গতি শ্লথ হয়ে এসেছে চারজনেরই। জিরিয়ে নেবার জন্যে থামল। এই সময় নিচে শোনা গেল চেঁচামেচি।
চমকে নিচে তাকাল ওরা। কয়েকজন প্রহরী এসে দাঁড়িয়েছে। নিচে। চেয়ে আছে ওপরের দিকে। দেখে ফেলল একজন। চেঁচিয়ে উঠল। ছুটে এল সিঁড়ির দিকে।
দুদিক থেকে রবিনের দুই বাহু চেপে ধরল মরিডো আর মুসা। তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে আবার টপকাতে শুরু করল সিঁড়ি। খুব পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু থামল না ওরা। পেছনে উঠে আসতে লাগল কিশোর।
সামনে একটা বেশ বড়সড় দরজা। পাল্লা বন্ধ।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। জলদি ধাক্কা দিন দরজায়!
ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। রবিনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল মুসা আর মরিডো। কিশোর ঢুকেই বন্ধ করে দিল ভারি পাল্লাটা। বিশাল এক ছিটকিনি। তুলে দিল।
সামনে এমন আরও দুটো দরজা আছে, আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে জানাল মরিডো। আগে, দেশের ভেতরে কোন, গোলমাল দেখা দিলেই ঘণ্টাঘরে গিয়ে ঠাই নিত পাদ্রী আর গির্জার অন্যান্য লোকেরা। ভীষণ শক্ত দূরজা। ভাঙতে সময় নেবে।
দ্বিতীয় দরজাটা পেরিয়ে এল ওরা। ছিটকিনি তুলে দিল কিশোর। এই সময় কানে এল প্রথম দরজায় ধাক্কার আওয়াজ।
আরও তাড়াতাড়ি করতে হবে। বেলটা বাজানোর আগেই যদি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে প্রহরীরা, তাহলে এত কষ্ট সব বিফলে যাবে।
সময় খুব বেশি পাব না আমরা! জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর। এর মাঝেই কাজ সারতে হবে!
তৃতীয় দরজা খুলে ফেলল কিশোর। রবিনকে নিয়ে মরিডো আর মুসা ঢুকে যেতেই সে-ও ঢুকে পড়ল। তুলে দিল ছিটকিনি। হাঁপ ছাড়ল। চমকে উঠে উড়ে গেল এক ঝাঁক পায়রা।
কংক্রীটে তৈরি গোল একটা চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা। খোলা। রেলিঙে ঘেরা। চত্বরের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় গোল একটা ফোকর।
ফোকরের কাছে এগিয়ে গেল মরিডো। নিচে তাকাল। অনেক নিচে পুতুলের মত দেখাচ্ছে প্রহরীদেরকে। দড়িটা টান দিয়ে তুলে নিল সে। ঝট করে ওপরে তাকাল প্রহরীরা। কিন্তু দড়িটা চলে এসেছে তাদের নাগালের বাইরে।
প্রথম দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করছে ওরা, বলল মরিডো। শিগগিরই শাবল কুড়াল নিয়ে আসবে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘণ্টাটার দিকে তাকাল সে। কিন্তু যা ভারি! বাজাব কি করে! নড়াতেই তো পারব না!
চিন্তিত চোখে ঘণ্টার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। কি বিশাল! মোটা দুটো থামের মাথায় লোহার দণ্ডে ঝোলানো। চারদিক থেকে ঘণ্টাকে ঘিরে উঠে গেছে শক্ত কাঠের আরও কয়েকটা থাম। ওগুলোর মাথায় বসানো চোঙের মত টিনের চাল। রোদ-বৃষ্টি থেকে ঘণ্টাকে বাঁচায়। ঘণ্টার চূড়ায় মোটা একটা রিঙ। তাতে বাধা দড়ির আরেক প্রান্ত। দড়ি ধরে টানলেই দুলতে শুরু করে ঘণ্টা, ভেতরে নড়ে ওঠে দোলক। তালে তালে ঘণ্টার গায়ে বাড়ি মারে, একবার এপাশে, একবার ওপাশে। যেমন ঘণ্টা তেমনি তার দোলক। বিশাল, ভারি।
রবিনও দেখছে ঘণ্টাটাকে। ভেতরের দিকে ঘণ্টার নিচে টুপির মত ছড়ানো অংশে নানারকম সূক্ষ্ম কারুকাজ, খোদাই করা। দেখলে শ্রদ্ধা। বেড়ে যায় প্রাচীন শিল্পীর ওপর, যে করেছিল কাজগুলো।
রেলিঙের কাছে এগিয়ে গেল রবিন। নিচে তাকাল। প্রায় পুরো ডেনজো শহরটাই চোখে পড়ছে। এখান থেকে দেখলে মনে হয় একটা লিলিপুটের দেশ। খুদে মানুষ, খুদে গাড়ি। শহরের পরিবেশ শান্ত। দেখে মনে হয় না, কি সাংঘাতিক এক ষড়যন্ত্র চলছে ভেতরে ভেতরে! মনেই হয় না, প্রাণের ভয়ে ওরা এসে পালিয়েছে এখানে। নিচে প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে ঘাতকরা ওদের ধরার। পাশে তাকাল। নিচে। এখন সেইন্ট ডোমিনিকসের সোনালি গির্জা। এখান থেকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। বিশাল এক বাটি যেন উপুড় করে ফেলে রাখা হয়েছে, পিঠটা চোখা।
হায়, আল্লাহ! খামোকাই এলাম! বলে উঠল মুসা। বাজাব কি করে ওটা!
ফিরে তাকাল রবিন।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে হঠাৎ ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল কিশোর। পেয়েছি! সাধারণ নিয়মে ঘন্টাটা বাজাতে পারব না। আমরা। দড়ি ধরে টেনে কাত করে ফেলতে হবে। তারপর দোলকে দড়ি বেঁধে দোলাতে হবে ওটাকে। বাড়ি লাগবে ঘণ্টার গায়ে। এস, কাজে লেগে পড়ি।
চারজনেই দড়ি ধরে টান দিল। নড়ে উঠল ঘণ্টা, খুবই সামান্য।
জোরে! আরও জোরে! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
আরেকটু কাত হল ঘণ্টা।
হ্যাঁ, হবে। ছেড়ে দাও! বলল কিশোর।
কিশোর ছাড়া আর সবাই ছেড়ে দিল। দড়িটা নিয়ে গিয়ে। একপাশের একটা সরু থামের উল্টো পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে আনল সে। তারপর আবার সবাইকে ধরে টানার নির্দেশ দিল।
একটু একটু করে কাত হতে শুরু করল ঘণ্টা। দোলকটা সরে যেতে লাগল ঘণ্টার এক কানার দিকে। সামান্য একটু ফাঁক থাকতেই চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, এবার দড়ি পেচিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে থামের সঙ্গে!
বেঁধে ফেলা হল দড়ি। কাত হয়ে রইল ঘণ্টা।
আবার হাঁপাতে শুরু করল ওরা। ঘামে নেয়ে উঠেছে শরীর। টিনের চালে আবার নেমে এসেছে পায়রাগুলো। বাক-বাকুম বাক-বাকুম শুরু করে দিয়েছে।
নিচে, প্রথম দরজায় ধাক্কার শব্দ থেমে গেছে।
নিশ্চয় কুড়াল আনতে গেছে ব্যাটারা! বিড়বিড় করল মরিডো।
কটা বাজে, মুসা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আটটা বাজতে বিশ।
হু। তাড়াতাড়ি করতে হবে। ডিউক রোজার ভাষণ দেবার আগেই শহরবাসীকে হুঁশিয়ার করে দেব।…মরিডো, দড়িটা দিন।
দড়ি!…
কোমরে পেঁচানো…
ও, হ্যাঁ! ভুলেই গিয়েছিলাম! চাদরে তৈরি দড়িটা কোমর থেকে খুলে দিল মরিডো।
দোলকে বেঁধে দিতে হবে। ওটা ধরেই টানব।
এক মুহূর্ত স্থির চোখে কিশোরের দিকে চেয়ে রইল মরিডো। অনেকক্ষণ পর এই প্রথম হাসল। সত্যি, আপনি বুদ্ধিমান…
আহ্, তাড়াতাড়ি করুন…।
কিন্তু ওখানে উঠব কি করে?
কিশোর, বুদ্ধি বাতলে দিল মুসা। আমি আর মরিডো পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছি। তুমি আমাদের কাঁধে চড়ে উঠে যাও।
ঠিক আছে।
দোলকটার তলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা আর মরিডো। ওদের কাঁধে উঠে পড়ল কিশোর। দড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়াল। দোলকের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে দিল দড়ির এক মাথা। তারপর লাফিয়ে নেমে এল। যাক, অনেক কাজে লাগল দড়িটা!
মনে হচ্ছে ওদের, কত সময় পেরিয়ে গেছে! অথচ ঘণ্টাঘরে ঢোকার পর পেরিয়েছে মাত্র দেড় মিনিট।
আবার শব্দ শোনা গেল দরজায়।
দেরি করে লাভ নেই, বলে উঠল মুসা। এস, শুরু করে দিই।
দড়ি ধরল মুসা আর মরিডো। চারজনের মাঝে ওদের দুজনের গায়েই জোর বেশি। আস্তে করে টেনে কানার কাছ থেকে দোলকটা সরিয়ে আনল ওরা। তারপর হঠাৎ ঢিল দিল দড়িতে। প্রচণ্ড জোরে গিয়ে ঘণ্টার গায়ে আঘাত হানল ভারি দোলক।
গমগমে ভারি একটা শব্দ উঠল। কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় হল ছেলেদের! রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রবিন আর মুসা। নিচে চেয়ে দেখল, রাস্তার সবাই মুখ তুলে তাকিয়েছে এদিকে।
কানের বারোটা বেজে যাবে! বলে উঠল কিশোর। রবিন, তোমার পকেটে রুমাল আছে না?
আছে? এই নাও, বের করে দিল রবিন।
দ্রুত হাতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল কিশোর রুমালটা। দুটো টুকরো ঢুকিয়ে দিল, নিজের কানে। দুটো দিল রবিনকে। চারটে করে দিল মুসা আর মরিডোকে। ওরা কানে আঙুল দিতে পারবে না। কাজেই ভালমত বন্ধ করে নিতে হবে কানের ফুটো।
নিচে দরজার কাছ থেকে আসছে জোর আওয়াজ। কুড়াল এসে গেছে। ভেঙে ফেলবে শিগগিরই দরজা।
একনাগাড়ে ঘন্টা বাজিয়ে যেতে ইশারা করল কিশোর।
আবার বেজে উঠল ঘণ্টা। আবার, তারপর আবার। বেজেই চলল। তাল ঠিক নেই! আওয়াজটাও অনেক বেশি চড়া। বেশ দূর থেকে গিয়ে কানায় আঘাত হানছে দোলক, তাই। কান ফাটানো শব্দে ঘোষণা করে চলল যেন ঘণ্টাটা: হুশিয়ার! হুশিয়ার!
কানে আঙুল দিয়ে রেখেছে কিশোর আর রবিন। তবু রেহাই পাচ্ছে না। মাথার মগজসুদ্ধ যেন ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে প্রচণ্ড শব্দ। মুসা আর মরিডোর অবস্থা কল্পনা করতে পারল ওরা। নিচে থেকে দরজা ধাক্কানর শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। শোনা যাচ্ছে না কিছুই। সারা পৃথিবী জুড়ে আছে যেন শুধু একটাই শব্দ-প্রচণ্ড ঢ-অ-ও-ও! ঢ-অ–ঙ!
টাওয়ারের নিচে রাস্তায় জমা হতে শুরু করেছে লোক, রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখছে কিশোর আর রবিন। পিল পিল করে লোক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে অন্যান্য রাস্তায়, সবাই চেয়ে আছে গির্জার দিকে। কেউ কেউ উত্তেজিতভাবে প্রাসাদের দিকে দেখাচ্ছে হাত তুলে। মেসেজটা কি পাবে ওরা? বুঝতে পারবে, প্রিন্স দিমিত্রির বড় বিপদ?
টাওয়ারের নিচে জনতার মাঝে হঠাৎ একটা আলোড়ন উঠল। যাচ্ছে সবাই। হাঁটতে শুরু করল। রওনা হয়ে পথ ধরে, সম্ভবত প্রাসাদেই চলল ওরা।
দেখতে দেখতে জনতার ঢল নামল, যেন শহরের পথে পথে। আর তাকাচ্ছে না ওরা গির্জার দিকে। সোজা এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য, রাজপ্রাসাদ। হাসি ফুটল কিশোর আর রবিনের মুখে।
হাজারে হাজারে লোক জমে গেছে প্রাসাদের সামনে। প্রধান ফটকের সামনে ভিড়। একদল লাল কাপড় পরা পুতুল, চোখে পড়ল কিশোর আর রবিনের। নড়ছে ওগুলো। কিন্তু কয়েকটা সেকেণ্ড। জনতা-পুতুলের ধাক্কায় স্রোতের মুখে কুটোর মত ভেসে গেল যেন লাল ইউনিফর্ম পরা প্রহরীরা। আঙিনায় ঢুকে পড়তে শুরু করল জনতা।
মেসেজ পেয়ে গেছে তাহলে দেশবাসী!
হঠাৎ থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। দড়ি ছেড়ে দিয়েছে মরিডো আর মুসা, কিশোর আর রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল। ওরাও দেখতে চায়, কি ঘটছে। জনতার দিকে চেয়ে ওদের মুখেও হাসি ফুটল।
ঘড়ি দেখল মুসা। পকেট থেকে খুদে রেডিওটা বের করে নব ঘুরিয়ে দিল।
কোন শব্দ ঢুকল না কানে। ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা রেডিওর দিকে। চোখ তুলতেই দেখল, কানের ভেতর থেকে রুমালের টুকরো বের করছে কিশোর।
কানের ফুটো থেকে রুমালের টুকরো বের করে নিল সবাই। শোনা। গেল ভারি একটা কণ্ঠস্বর। ভ্যারানিয়ান ভাষা। ডিউক রোজার! নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভাষণ শুরু করে দিয়েছে?
চুপচাপ শুনল কিছুক্ষণ মরিডো, তারপর অনুবাদ করে শোনাল তিন গোয়েন্দাকে: ডিউক রোজার! বলল, সাংঘাতিক এক বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছে। অভিষেক অনুষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্থগিত। শাসনভার পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। শিগগিরই আসামীদের ধরে হাজির করবে দেশবাসীর সামনে। রূপালী মাকড়সা গায়েব। প্রিন্স দিমিত্রিকে নজরবন্দি করা হয়েছে। দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে ডিউক।
কাম সারছে! বলে উঠল মুসা। এমনভাবে বললেন, আমারই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে! আল্লাই জানে, কি হবে!
কিন্তু ডেনজোর অনেকেই শুনছে না তার ভাষণ! বলল মরিডো। ছুটে যাচ্ছে প্রাসাদের দিকে। ঘন্টা কেন বাজল, এটাই হয়ত জানতে চায়…চমকে উঠে থেমে গেল সে। এ দরজা ধাক্কানোর শব্দ। দুটো দরজা ভেঙে ফেলেছে প্রহরীরা। পৌঁছে গেছে তৃতীয় দরজার ওপাশে।
দরজা খোল! চেঁচিয়ে উঠল একটা ভারি কণ্ঠ। রিজেন্টের আদেশে অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের
দরজা ভেঙে আস! চেঁচিয়ে জবাব দিল মরিডো। আমরা খুলব না! সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, আসুন। আবার বাজাই। ওরা ঢোকার চেষ্টা করুক, আমরা বাজিয়ে যাই।
আবার কানে রুমালের টুকরো ঢোকাল ওরা।
আবার বাজতে শুরু করল ঘন্টা। মাত্র কয়েক ফুট দূরে কুড়ালি আর ক্রোবার নিয়ে দরজা আক্রমণ করেছে প্রহরীরা। সে শব্দ চাকা পড়ে গেছে প্রচণ্ড ঘণ্টাধ্বনিতে!
হঠাৎ ভেঙে পড়ল দরজা।
.
১৬.
আগেপিছে প্রহরী। সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলল ছেলেরা। ক্লান্ত।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী। গোল একটা বেষ্টনী তৈরি করে দাঁড়াল। তার মাঝে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হল ছেলেদেরকে।
গির্জা থেকে বের করে আনা হল চার বন্দিকে। রাস্তায় এখনও লোক আছে, তবে খুবই কম। কৌতূহলী চোখে তাকাল ওরা। কি হচ্ছে না হচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছুই। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কয়েকজন। প্রহরীদের ধমক শুনে পিছিয়ে গেল আবার।
চারপাশ থেকে বন্দিদেরকে ঘিরে নিয়ে সার্চ করে এগোল প্রহরীরা। দুটো ব্লক পেরিয়ে এসে থামল একটা পাথরের বাড়ির সামনে। ওটা থানা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুজন নীল পোশাক পরা পুলিশ অফিসার।
দেশের শত্রু! অফিসারদের দিকে চেয়ে বলল প্রহরীদের ক্যাপ্টেন। হাজতে ভরে রাখুন। পরে, ডিউক রোজার যা করার করবেন।
দ্বিধা করতে লাগল দুই অফিসার।
প্রিন্স পলের ঘণ্টা… বলতে গিয়েও থেমে গেল এক অফিসার।
রিজেন্টের আদেশ! খেঁকিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন। বোঝা গেল, পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে রয়্যাল গার্ডকে। অনেকটা সেনাবাহিনীর মত। সরুন! পথ ছাড়ন!
সরে দাঁড়াল দুই অফিসার। বন্দিদেরকে নিয়ে একটা হলে এসে ঢুকল প্রহরীরা। অন্য পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল করিডরে। দুটো করে দুপাশে চারটে ছোট ছোট সেল। লোহার শিকের দরজা। একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল মুসা আর মরিডোকে। আরেকটাতে কিশোর আর রবিন। বন্ধ করে দিল দরজা।
তালা আটকান, পেছনে আসা পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে আদেশ দিল ক্যাপ্টেন। ভালমত পাহারার ব্যবস্থা করুন। এখান থেকে ওরা পালালে, কপালে দুঃখ আছে আপনাদের।…আমরা যাচ্ছি। রিজেন্টকে খবর দিতে হবে।
বেরিয়ে গেল প্রহরীরা।
প্রতিটি সেলে দুটো করে বাংক। এগিয়ে গিয়ে একটাতে বসে পড়ল মরিডো। ধরা শেষতক পড়লামই! তবে, আর কিছু করারও ছিল না আমাদের। প্রাসাদে কি ঘটছে, কে জানে!
কোন জবাব দিল না মুসা। অন্য বাংকটাতে গিয়ে বসে পড়ল, চুপচাপ।
সারারাত জেগেছি, বাংকে বসে বলল কিশোর। ধকলও গেছে সাংঘাতিক! শরীরে আর সইছে না। যা হবার হোকগে পরে, আগে ঘুমিয়ে নিই… শুয়ে পড়ল সে।
রবিনও হাই তুলতে লাগল। চোখ ডলল দুহাতে। আর কিছুই করার নেই। সে-ও শুয়ে পড়ল বাংকে।
শুয়ে শুয়ে বিড়বিড় করতে লাগল কিশোর, শত শত বছর আগে একবার বাজানো হয়েছিল এভাবে, আজ আবার আমরা বাজালাম! রেডিও-টেলিভিশনের চেয়ে অনেক অনেক পুরানো মাধ্যম! আজকাল অনেক জায়গাতেই এটা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে প্রথম নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৪৫৩ সালে, তুর্কীরা কনস্টান্টিনোপল অধিকার করার পর…এই রবিন, শুনছ…
সাড়া দিল না রবিন। ঘুমিয়ে পড়েছে।
চোখ মুদল কিশোর।
.
১৭.
গাঢ় অন্ধকার। পা পিছলে নর্দমার পানিতে পড়ে গেছে রবিন। ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে তাকে তীব্র স্রোত। হাত-পা নেড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা, করছে সে। বার বার বাড়ি খাচ্ছে সুড়ঙ্গের দেয়ালে। একবার এপাশে, একবার ওপাশে। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল কিশোরের ডাক, রবিন! এই, রবিন!
উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে রবিন। পারছে না। কাঁধ চেপে ধরল একটা হাত। কানের কাছে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, রবিন! চোখ মেল! ওঠ!
চোখ মেলল রবিন। মিটমিট করে তাকাল। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কিশোরের মুখ। হাসছে।
রবিন! দেখ কে এসেছে। ওঠ, উঠে বস!
উঠে বসল রবিন। কিশোর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। নজরে পড়ল বব ব্রাউনের হাসি হাসি মুখ।
দারুণ কাজ দেখিয়েছ, রবিন! এগিয়ে এল বব। রবিনের কাঁধে। হাত রাখল। তোমরা সবাই! এতটা আশা করিনি!
চোখ মিটমিট করে ববের দিকে তাকাল রবিন। প্রিন্স দিমিত্রি? সে ভাল আছে?
খুব ভাল। এই এসে পড়ল বলে, বলল বব। ডিউক রোজার, তার প্রধানমন্ত্রী এবং দলের আর সবাইকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। রোজার আর লুথারকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে জনতা। প্রিন্স দিমিত্রি ঠিক সময়ে এসে না পড়লে, মেরেই ফেলত। মরিডোর বাবাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন তিনি…
উল্টোদিকের সেলের দরজা খোলার শব্দ হল। বেরিয়ে এল মুসা আর মরিডো। এই সেলে এসে ঢুকল। পেছনে এল দুই পুলিশ অফিসারের একজন। হাসি একান-ওকান হয়ে গেছে দুজনেরই।
ঘণ্টা বাজানর পর কি কি হয়েছে, নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের, না? চারজনের দিকেই তাকাল একবার বব।
মাথা ঝোঁকাল তিন গোয়েন্দা।
তোমাদের সঙ্গে হঠাৎ রেডিও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, বলল বব। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। আজ ভোরে আর থাকতে না পেরে অ্যামব্যাসাডর সাহেবকে নিয়ে বেরিয়েই পড়লাম। প্রাসাদের মেইন গেট বন্ধ। তালা দেয়া। গেটের ওপাশে গার্ড। ভেতরে ঢুকব, বললাম। গেট খুলল না ওরা। ডিউক রোজারের হুকুম, খোলা যাবে না, বলল। এর পরেও দরজা খোলার জন্যে চাপাচাপি করছি, এই সময় বেজে উঠল প্রিন্স পলের ঘণ্টা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার লোক। তারপর, বেজেই চলল ঘণ্টা। পিলপিল করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মানুষ। বন্যার মত ধেয়ে এল প্রাসাদের দিকে। গেট খুলে দিতে বলল গার্ডদেরকে। প্রিন্স দিমিত্রির কি হয়েছে, জানতে চাইল। ওদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারল না গার্ডেরা। ব্যস, খেপে গেল জনতা। ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলল গেট। ঢুকে পড়ল আঙিনায়। হাতে গোনা কয়েকজন গার্ডের সাধ্য হল না সে জনস্রোতকে থামান। দেখতে দেখতে ভরে গেল আঙিনা। বারান্দায় উঠে পড়ল গার্ডেরা। ঠিক এই সময়, দোতলায় রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল এক প্রহরী। চেঁচিয়ে বলল জনতাকে, প্রিন্স দিমিত্রি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে। তাকে যেন উদ্ধার করে তারা। কয়েদখানায় প্রিন্সকে আটকে রেখেছে শয়তান ডিউক রোজার। ভয়ানক এক ষড়যন্ত্র করেছে। ব্যস, আমিও পেয়ে গেলাম সুযোগ, হাসল বব। উঠে দাঁড়ালাম গাড়ির ছাতে। ভ্যারানিয়ান ভাষা জানি। শুরু করলাম শ্লোগান: প্রিন্স দিমিত্রি! জিন্দাবাদ! ডিউক রোজার! নিপাত যাক। থামল সে। তারপর বলল, এমনিতেই ডিউক রোজারকে দেখতে পারে না। জনসাধারণ। গতরাতে রেডিও-টেলিভিশনে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে, সকাল আটটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবে রোজার। প্রাসাদের গেট তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ বেজে উঠেছে প্রিন্স পলের ঘণ্টা। দোতলায় গার্ডের সাহায্যের আবেদন, আবার শ্লোগান…দুইয়ে দুইয়ে। ঠিক চার মিলিয়ে নিল জনতা। বারুদে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি পড়ল যেন। গার্ডদের আক্রমণ করে বসল ওরা। তারপর যা একখান দৃশ্য! বলে বোঝাতে পারব না! প্রাসাদে ঢুকে পড়ল জনতা। চাপের মুখে প্রিন্স দিমিত্রিকে কোথায় আটকে রেখেছে, দেখিয়ে দিতে বাধ্য হল গার্ডেরা। বের করে আনা হল তাকে। সত্যি, প্রিন্স বটে! ওইটুকু ছেলে! অথচ বেরিয়েই কি সুন্দর থামিয়ে ফেলল সব গোলমাল। রোজার আর লুথারকে অ্যারেস্ট করার আদেশ দিল। বেগতিক দেখে দল বদল করল গার্ডেরা, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এবার বিশ্বাসঘাতকতা করল ওরা দুই ডিউকের সঙ্গে। ওদেরকে ধরে আনতে ছুটল। গিয়ে দেখল ঘরের দরজা ভাঙা। দুজনকে ধরে বেদম পেটাচ্ছে জনতা। কোনমতে উদ্ধার করে আনা হয়েছে ওদেরকে। তারপর আর কি? দোতলায় দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে মিনিট দুয়েক ভাষণ দিল প্রিন্স। থেমে গেল। সব গোলমাল।
এখন দু-এক ঘা লাগানো যায় না রোজারকে? শার্টের হাতা গোটাল মুসা। মানে, হাতের ঝাল একটু মিটিয়ে নিতাম।
হেসে ফেলল সবাই।
না, হাসতে হাসতে বলল বব। সুযোগ হারিয়েছে। জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের সবকটা রুই-কাতলাকে। চুনোপুঁটিগুলো ছাড়াই আছে। ওরা আর কিছু করতে সাহস পাবে না।
ক্যালিফোর্নিয়ায় ইচ্ছে করেই অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে চেয়েছিল লিমোসিনের ড্রাইভার, বলল কিশোর। এখন এটা পরিষ্কার। ওই ব্যাটাও রোজারেরই লোক। বিশ্বাসঘাতক। প্রিন্স দিমিত্রিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ওরা আমেরিকায় থাকতেই।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল বব। ওরা… থেমে গেল সে।
সোরগোল উঠেছে বাইরে। শোনা যাচ্ছে শ্লোগান: প্রিন্স! প্রিন্স! লঙ লিভ দ্য প্রিন্স!
সেলের দরজায় এসে দাঁড়াল দিমিত্রি। ছুটে এসে ঢুকল। জড়িয়ে ধরল বন্ধুদেরকে। তোমরা সত্যি আমার বন্ধু! তোমরা না এলে… কথা শেষ করতে পারল না রাজকুমার। ধরে এসেছে গলা।
আলিঙ্গনমুক্ত হল দিমিত্রি। মরিডোর দিকে তাকাল। ঘণ্টা বাজানর বুদ্ধিটা কার?
কিশোরের, বলল মরিডো। আমরা তো খালি-রেডিও টেলিভিশন আর খবরের কাগজের কথাই ভাবছিলাম। ঘন্টার কথা মনেই আসেনি…
ধন্যবাদ…।
…ধন্যবাদটা আসলে তোমার আর রবিনের পাওয়া উচিত, প্রিন্স, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল কিশোর। ষোলোশো পঁচাত্তরের সেই বিদ্রোহের কথা তোমরাই বলেছিলে। নইলে জানতে পারতাম না। মাথায় ঢুকত না ঘণ্টা বাজিয়ে দেশবাসীর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা…
যত যা-ই বল! তোমরা না এলে গিয়েছিল ভ্যারানিয়া! হাসল দিমিত্রি। প্রিন্স পল এখন বেঁচে থাকলে তোমাদেরকে মাথায় নিয়ে নাচতেন… থেমে গেল রাজকুমার।
হঠাৎ আবার বেজে উঠেছে প্রিন্স পলের ঘন্টা। বেজেই চলল, তালে তালে।
আবার বলল দিমিত্রি, সাঁঝ পর্যন্ত ঘণ্টা বাজাতে বলে এসেছি আমি! আনন্দ প্রকাশের জন্যে, জয়ের আনন্দ, চুপ করল রাজকুমার। বিষণ্ণ হয়ে গেল হঠাৎ। তবে, রূপালী মাকড়সা সঙ্গে থাকলে পরিপূর্ণ হত আনন্দ!
দিমিত্রি, বলল কিশোর। আমাকে আরেকবার সেই ঘরে নিয়ে চল। প্রাসাদে, যে-ঘরে আমরা ঘুমিয়েছি। আরেকবার দেখি চেষ্টা করে, রূপালী মাকড়সা বের করা যায় কিনা! একটা ব্যাপারে খচখচ করছে। মনের ভেতর…
তুমি জান কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। তাহলে আগে বলনি কেন?
যা উত্তেজনা গেছে, ভাবারই সুযোগ পাইনি, বলল কিশোর। তবে, ঘুমিয়ে এখন ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। মগজের ধূসর কোষগুলো আবার কাজ করতে শুরু করেছে…চল চল, আর দেরি করে। লাভ নেই…এখুনি বেরিয়ে পড়ি…
.
রাস্তার দুপাশে লোকের ভিড়। মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। গাড়ি। হাত নাড়ছে জনতা। চেঁচাচ্ছে। সবারই মুখে এক কথা: লঙ লিভ দ্য প্রিন্স!–
ছলছল করছে দিমিত্রির চোখ। হাত নেড়ে তাদের সংবর্ধনার জবাব দিচ্ছে।
অনেক অনেকক্ষণ পর প্রাসাদের আঙিনায় এসে ঢুকল গাড়ি। ঘিরে ধরল সশস্ত্র প্রহরী। ওরা সবাই মিনস্ট্রেল পার্টির লোক। দিমিত্রি নামতেই দুদিক থেকে এগিয়ে এল দুজন দেহরক্ষী।
-একে একে কিশোর, মুসা আর রবিনও নেমে পড়ল। ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে এল মরিডো। তিন গোয়েন্দার দুপাশেও এসে দাঁড়িয়ে গেল তলোয়ারধারী দেহরক্ষী। রবিনের দিকে চেয়ে সবার অলক্ষে চোখ টিপল মুসা। ভাবখানাঃ কি ব্যাপার! আমরাও প্রিন্স হয়ে গেলাম নাকি! মুচকে হাসল রবিন।
অনেক অলিগলি করিডর আর সিঁড়ি পেরিয়ে তেতলার সেই ঘরে। এসে ঢুকল ওরা। দিমিত্রি, তিন গোয়েন্দা আর মরিডো। দেহরক্ষীরা সব দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।
এ ঘরের কোন জায়গায়ই খোঁজা বাদ দিইনি, বলল কিশোর। শুধু একটা জায়গা ছাড়া। যদি থাকে, ওই একটা জায়গাতে আছে রূপালী মাকড়সা। হয়ত আমার ভুলও হতে পারে, হয়ত পকেটেই রেখেছিল রবিন। নদীতে পড়ে গেছে…
দূর! হাত তুলল মুসা! তোমার বক্তৃতা থামাও তো, কিশোর! কোথায় আছে, বের করে ফেল!
ঠিক আছে দেখি, ঘরের কোণে এগিয়ে গেল কিশোর খাট ঘুরে। হাঁটু আর কনুইয়ে ভর দিয়ে উপুড় হল। জালটা এখনও আগের জায়গায়ই ঝুলছে। হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মাকড়সার জালের দিকে।
তক্তার প্রান্ত আর মেঝের ফাঁকে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে দুটো মাকড়সা। হাত বাড়াল কিশোর। চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল একটা মাকড়সা। আরেকটা রসেই রইল। লাল লাল চোখ।
হাত আরও সামনে বাড়াল কিশোর। আরও, আরও। নড়ল না মাকড়সা। দুআঙুলে চেপে ধরল সোনালি মাথাটা। তবু নড়ল না মাকড়সা। ধীরে ধীরে বের করে নিয়ে এল সে ওটাকে। হাতের তালুতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হেঁটে এসে দাঁড়াল প্রিন্স দিমিত্রির সামনে।
এই যে, দেখ! তালুতে বসা মাকড়সাটা দেখাল কিশোর।
ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা, বিড়বিড় করে বলল দিমিত্রি। আসলটা!
উত্তেজিত না থাকলে প্রথমবারেই বুঝে যেতাম, বলল কিশোর। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল গার্ডেরা। লাফিয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে মরিডো, অসাধারণ একটা বুদ্ধি খেলে গেল রবিনের মাথায়!
আমি রেখেছি! চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের।
হা! মাথায় আঘাত লাগায় ভুলে গিয়েছ। চমৎকার বুদ্ধি এঁটেছিলে! ঠিক বুঝেছিলে, মাত্র ওই একটা জায়গাতেই খুঁজবে না কেউ। খোঁজার সাহসই করবে না। মাকড়সার মাথা বেরিয়ে আছে, সেই সঙ্গে জাল, জ্যান্ত একটা মাকড়সা ঘোরাফেরা করছে জালের কাছে…নাহ, দারুণ দেখিয়েছ, নথি!
ব্রোজাস! রবিনের মুখে হাত রাখল দিমিত্রি। রবিন, তোমার তুলনা হয় না! বুঝতে পারছি, অলক্ষে থেকে সেদিন প্রিন্স পলই তোমাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন আমার।
মরিডো, বলল কিশোর। মনে আছে, কি বলেছিল জিপসি আলবার্তো? বলেছিল, বিজয়ের ঘণ্টা শুনছি আমি! ঠিকই বলেছে! আরও একটা কথা বলেছে সে: রূপালী মাকড়সার সঙ্গে সাধারণ মাকড়সার তফাৎ নেই! কথাটা তখন রহস্যময় ঠেকেছিল আমার কাছে। কিন্তু ঘণ্টা বাজানর পর যখন প্রিন্স দিমিত্রির বিজয় হল, বুড়ো জাদুকরের কথা মনে পড়ে গেল আমার। তার রহস্যময় কথা আর রহস্য থাকল না। অনুমান করে ফেললাম, কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা।
কিন্তু কি করে জানলা সে ভুরু কুঁচকে গেছে মুসার। জিনটিন বশ নেই তো তার
মোটেই না, বলল কিশোর। আসলে, মস্তবড় থট রীডার সে। ওই যে নীল ধোয়া, ওটা এক ধরনের কেমিক্যাল। ওটা শুকিয়েছে আমাদেরকে। তারপর সম্মোহন করেছে। তোমার অবচেতন মনে গাঁথা রয়েছে রূপালী মাকড়সার কথা, সেখান থেকে মুছে যায়নি। ঠিক ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল বুড়ো আলবার্তো তার ব্রেনওয়েভ বা ওই জাতীয় কিছু। বের করে এনেছিল মনের যত কথা। খুব ভাল ভবিষ্যৎ-বক্তাও সে। আশ্চর্য ক্ষমতা,রোজারকে অপছন্দ করে সে, তাই বলেনি কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা। দিমিত্রির দিকে চেয়ে হাসল। কাজেই, বুঝতেই পারছ, রূপালী মাকড়সাটার খোঁজ আসলে আলবার্তোই দিয়েছে…
দিয়েছে, কিন্তু আর কেউ তো সে কথার মানে বের করতে পারেনি, কিশোরের হাত থেকে রূপালী মাকড়সাটা নিল দিমিত্রি। রুমালে পেঁচিয়ে সাবধানে ব্রাখিল পকেটে। সে যাই হোক, তোমাদের ঋণ শোধ করতে পারব না আমি। আরেক পকেট থেকে তিনটে রূপালী মাকড়সা বের করল সে। তিনটাতেই রূপার চেন আটকানো। এক এক করে তিন গোয়েন্দার গলায় তিনটে মাকড়সা ঝুলিয়ে দিল সে।
হাত তালি দিয়ে উঠল মরিডো।
ভ্যারানিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত পদক, হেসে বলল দিমিত্রি। অর্ডার অভ দ্য সিলভার স্পাইডার। তোমাদেরকে ভ্যারানিয়ার লাগরিকের সম্মান দিয়েছি আমি। এর চেয়ে বেশি সম্মান দেবার ক্ষমতা আমার নেই। তোমাদের কারও কোন ইচ্ছে থাকলে বল, পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি।
না না, আর বলতে গিয়ে বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর।
আছে, কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠেছে মুসা। আমার একটা। ইচ্ছে আছে। সামান্য কিছু খাবার হবে? বেশি না, এই ডজনখানেক স্যাণ্ডউইচ, একটা মুরগি, ডিম, কিছু আঙুর আর এক জগ দুধ হলেই চলবে আপাতত।
হো হো করে হেসে উঠল সবাই।