রামধনের বাঁশী

রামধনের বাঁশী

রামধনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগায় আরেকটু কাছে গিয়ে একটা গাছের আড়াল থেকে দেখে তার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল। দশ বছর পেরিয়ে গেলেও চিনতে কোনো অসুবিধা নেই। এই সেই খগেশবাবু। খগেশ খাস্তগির, যিনি পুরোন ইঁটপাথর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন।

খগেশবাবুর সঙ্গে ছিলেন বকুলতলার সত্যপ্রকাশবাবু। তিনি বলছিলেন; ‘কই, তেমন বদনাম ত কেউ দেয়নি এ বাড়ির। ভূতটুত এ তল্লাটে নেই। আপনি দুটো রাত এখানে অনায়াসে থাকতে পারেন। আর সঙ্গে যখন চাকর এনেছেন তখন ভাবনা কী? আপনি ত এদিকে এসেছেন আগে, দেখেছেন ত কী চমৎকার সব মন্দির। সব দেড়শ-দুশো বছরের পুরোন। আমাদের গাঁয়ে ত বড় একটা কেউ আসে না; আপনি অ্যাদ্দিন বাদে এলেন এ আমাদের পরম ভাগ্য।’

এতদিন পর মানে দশ বছর। রামধনের মেজকাকার বন্ধু হলেন খগেশ খাস্তগির। ভদ্রলোক কলকাতায় থাকেন, প্রত্নতত্ত্ব না কী জানি চর্চা করেন, তার জন্যেই বার কয়েক এই জামহাটি গাঁয়ের দেড়শ-দুশো বছরের পুরোন পোড়া ইঁটের মন্দির দেখে গেছেন কয়েকবার। সেই নিয়ে তাঁর কিছু লেখাও কাগজে বেরিয়েছে মাঝে মাঝে।

খগেশবাবুর এই কাজ নিয়ে রামধনের মনে কৌতূহল জাগলেও সেই নিয়ে কোনোদিন কিছু বলার সাহস পায়নি। বাপ্‌রে বাপ—একটা ঘটনা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। একবার খগেশবাবুর একটা পাথরের মূর্তি রামধন তুলে দেখতে গিয়ে সেটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল। এমনিতেই রগচটা লোক, তার উপর এত বড় একটা ক্ষতি। খগেশবাবু শাস্তি হিসেবে এক হাতে রামধনের চুলের মুঠি আর এক হাতে তার পাতলা কোমরটা ধরে মাথার উপর তুলে একটা আছাড় মেরেছিলেন। দশ দিন ছিল গায়ে ব্যথা।

রামধন ছিল অত্যন্ত নিরীহ মেজাজের ছেলে। খগেশবাবু যখন প্রথমবার তাদের বাড়িতে এসেছিলেন তখন রামধনের বয়স মাত্র সতের। তখন সকলে তাকে দিয়ে ফাইফরমাশ খাটিয়ে নেয় আর কথায় কথায় ধমক লাগায়। পোস্টাপিসে চিঠি ফেলে এস—তাও রামধন; বিশু জ্যাঠাকে ইস্টিশনে পৌঁছে দিয়ে এস—তাও রামধন; বাদলা হয়েছে, কেষ্টর দোকান থেকে পেঁয়াজি নিয়ে এস—তাও রামধন। ফলে রামধনকে সর্বদাই তটস্থ হয়ে থাকতে হত। পান থেকে চূণটি খস্‌লে আর রক্ষে নেই; বাড়ির বড় কর্তা থেকে শুরু করে তেরো বছরের ছোট ভাই বিষ্টুও তার দিকে চোখ রাঙিয়ে ছাড়া কথা বলে না।

খগেশবাবু অ্যাদ্দিন বাদে গাঁয়ে এসেছেন আর গাঙ্গুলীদের বাড়িতে একটা ঘর নিয়ে থাকছেন শুনে সত্যপ্রকাশবাবু সত্যিই গদ্‌গদ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আপনার কাজের দিক দিয়ে দোতলার দক্ষিণের ঘরটা সবচেয়ে সুবিধে হবে। আলোবাতাস দুইই আছে। জানালা দিয়ে গণ্ডকী পাহাড় দেখা যাবে। আপনি দিব্যি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন।’

এইরে—কেলেঙ্কারি! ওই দক্ষিণের ঘরে রামধনের বাঁশীটা রয়ে গেছে। বড় সাধের বাঁশী—রথের মেলা থেকে চার আনায় কেনা। সে কি আজকের কথা? সেই বাঁশী রামধন গাঁয়ের উত্তরের মাঠে গিয়ে একটা নেড়া বাদাম গাছের তলায় বসে বাজায়! এই ভাবে তার কত সময় কেটে গেছে। বাড়িতে থাকে সে খুব কম সময়টুকু; বেশির ভাগই একা একা মাঠে ঘাটে টোটো করে বেড়ায়। এই নিয়ে কেউ আর আপত্তিও করে না। সেই ভালো। সারা জীবন অনেকের অনেক ফরমাশ সে খেটেছে; এখন তার ছুটি।

কিন্তু বাঁশীটা কী হবে? ওই বাঁশীর জাতই যে আলাদা। এত বছর ফুঁয়ে ফুঁয়ে ওর এমন গলা খুলেছে যেমন আর কোনো নতুন বাঁশীতে খুলবে না। এখন উপায় হচ্ছে তক্কে তক্কে থাকা। খগেশবাবু একবার বাড়ি থেকে বেরোলে পর টুক্‌ করে গিয়ে বাঁশীটা নিয়ে আসা যাবে। ওর সামনে পড়া কোনোমতেই চলবে না। কে জানে, হয়ত দশ বছর আগের রাগ ভদ্রলোক এখনো পুষে রেখেছেন। চেহারায় যে দশ বছরে খগেশবাবুর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি সেটা রামধন প্রথমেই লক্ষ করেছে।

খগেশবাবু এসেছিলেন সকালে। সারা দুপুর তিনি ঘর থেকে বেরোলেন না। সূর্যি যখন প্রায় ডুবুডুবু তখন কাঁঠাল গাছের আড়াল থেকে রামধন দেখল যে খগেশবাবু আড় ভাঙতে ভাঙতে সামনের দরজা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। এবার বেরোবেন কি ভদ্রলোক? রামধন নিজেকে আরেকটু ভালো করে আড়াল করল গাছটার পিছনে।

খগেশবাবু আবার ভিতরে চলে গেলেন। তারপর একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এসে বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে পুবে রওনা দিলেন। হাঁটার মেজাজ দেখেই বোঝা যায় তিনি সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছেন।

রামধন দুমিনিট অপেক্ষা করে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। চাকরটাকেও এড়াতে হবে, না হলে আবার চোর ভেবে হল্লা শুরু করবে।

চাকরটা ছিল এক তলায় রান্না ঘরে। রামধন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সোজা দক্ষিণের ঘরের দিকে গেল!

বাইরে থেকে দরজা বন্ধ। ঘুরে গিয়ে বারান্দার দিকের জানালা দিয়ে ঢুকতে হবে। অবিশ্যি সে জানালা যদি ভোলা থাকে।

হ্যাঁ—জানালা খোলা।

রামধন ঢুকল ঘরে। চারিদিকে টেবিলের উপর নানারকম পাথরের মূর্তি ছড়ানো। তাছাড়া রয়েছে কাগজপত্র কলম পেনসিল দোয়াত ছবি।

কিন্তু বাঁশীটা নেই। অন্তত সেটা যে কুলুঙ্গীটার মধ্যে রাখা ছিল তার মধ্যে এখন রয়েছে একটা লণ্ঠন।

বাইরে মেঘের গর্জন। রামধন এখানে আসবার আগেই দেখেছিল নৈঋত কোণে কালো মেঘ জমেছে। এখন মনে হচ্ছে সে মেঘ একেবারে মাথার উপর। ঝড়ও বইতে শুরু করেছে। বারান্দার জানালা দিয়ে কয়েকটা শিরীষ গাছের পাতা এসে ঢুকল।

রামধন এসে হন্নে হয়ে বাঁশীটা খুঁজছে। খাটের নীচে, বালিশের নীচে, টেবিলের দেরাজে, ঘুলঘুলিতে।

এমন সময় হঠাৎ সিঁড়িতে একটা পায়ের শব্দ।

রামধনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে খগেশবাবু এখন ফিরে আসছেন বৃষ্টির উপক্রম দেখে।

তার সেই দশ বছর আগের কথা মনে পড়ে রামধনের বুকের রক্ত আবার হিম হয়ে গেল।

পায়ের শব্দ বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে এল।

রামধন একবার মনে করল যে বারান্দার দিকের জানালা দিয়ে পালাবে। কিন্তু কেন যেন তার শরীরে একটা অবশ ভাব এসে গেছে। তাছাড়া তার বাঁশীটা ত এখনো পাওয়া যায় নি।

একটা মচ্‌ শব্দ করে দরজার তালাটা খুলল, আর তার পরেই দরজাটা খুলে গেল। রামধন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা কপালে আছে হবে।

কিন্তু যা হবে ভেবেছিল তা ত হলই না, বরং হল তার উলটো।

দরজাটা খুলে রামধনকে সামনে দেখে খগেশবাবুর চোখ কপালে গেল, আর তিনি ভির্মি দিয়ে সটান পড়লেন মেঝের উপর। আর ঠিক সেই সময় তার কোটের পকেট থেকে রামধনের বাঁশীটা বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। রামধন সেটাকে তুলে নিয়ে খগেশবাবুর দেহ টপকে বাইরে এসে সটান সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেরিয়ে গেল।

সকলের কাছে ধমক খেয়ে এসেছে বলেই রামধন এটা বোঝেনি যে তাকে এখন দেখে খগেশবাবুর এই দশাই হবে। কারণ আজ থেকে দশ বছর আগে আজকেরই মতো একটা ঝড়ের সন্ধ্যায় মাথায় একটা কৎ-বেল প্রমাণ শিল পড়ে রামধন মাথা ফেটে অক্কা পায়।

তাঁর মেজাজ যতই ভারিক্কি হোক, চোখের সামনে রামধনের ভূতকে দেখে যে খগেশবাবু ভির্মি যাবেন তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *