ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বাহিরে আসিয়া, মুখে চক্ষে জল দিয়া অশ্রচিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া, রাধরাণী ভাবিতে লাগিল। ভাবিল, ইনিই ত রুক্মিণীকুমার। আমিও সেই রাধারাণী। দুইজনে দুইজনের জন্য মন তুলিয়া রাখিয়াছি। এখন উপায়? আমি যে রাধারাণী, তা উহাকে বিশ্বাস করাইতে পারি–তার পর? উনি কি জাতি, তা কে জানে। জাতিটা এখনই জানিতে পারা যায়। কিন্তু উনি যদি আমার জাতি না হন! তবে ধর্মবন্ধন ঘটিবে না, চিরন্তনের যে বন্ধন, তাহা ঘটিবে না, প্রাণের বন্ধন ঘটিবে না। তবে আর উঁহার সঙ্গে কথায় কাজ কি? না হয় এ জন্মটা রুক্মিণীকুমার নাম জপ করিয়া কাটাইব। এতদিন সেই জপ করিয়া কাটাইয়াছি, জোয়ারের প্রথম বেগটা কাটিয়া গিয়াছে–বাকি কাল কাটিবে না কি?”
এই ভাবিতে ভাবিতে রাধারাণীর আবার নাকের পাটা ফাঁপিয়া উঠিল, ঠোঁট দুখানা ফুলিয়া উঠিল–আবার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। আবার সে জল দিয়া মুখ চোখ ধুইয়া টৌয়ালিয়া দিয়া মুছিয়া ঠিক হইয়া আসিল। রাধারাণী আবার ভাবিতে লাগিল,–“আচ্ছা! যদি আমার জাতিই হন, তা হলেই বা ভরসা কি? উনি ত দেখিতেছি–বয়:প্রাপ্ত–কুমার, এমন সম্ভাবনা কি? তা হলেনই বা বিবাহিত? না! না! তা হইবে না। নাম জপ করিয়া মরি, সে অনেক ভাল–সতীন সহিতে পারিব না।
“তবে এখন কর্তব্য কি? জাতির কথাটা জিজ্ঞাসা করিয়াই কি হইবে? তবে রাধারাণীর পরিচয়টা দিই। আর উনি কে, তাহা জানিয়া লই; কেন না, রুক্মিণীকুমার ত ওঁর নাম নয়–তা ত শুনিলাম। যে নাম জপ করিয়া মরিতে হইবে, তা শুনিয়া লই। তার পর বিদায় দিয়া কাঁদিতে বসি। আ পোড়ারমুখী বসন্ত! না বুঝিয়া, না জানিয়া এ সামগ্রী কেন পাঠাইলি? জানিস না কি, এ জীবনসমুদ্র অমন করিয়া মন্থন করিতে গেলে, কাহারও কপালে অমৃত, কাহারও কপালে গরল উঠে!
“আচ্ছা! পরিচয়টা ত দিই |” এই ভাবিয়া রাধারাণী, যাহা প্রাণের অধিক যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা বাহির করিয়া আনিল। সে সেই নোটখানি; বলিয়াছি, রাধারাণী তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল। রাধারাণী তাহা আঁচলে বাঁধিল। বাঁধিতে বাঁধিতে ভাবিতে লাগিল–
“আচ্ছা, যদি মনের বাসনা পূরিবার মতনই হয়? তবে শেষ কথাটা কে বলিবে?” এই ভাবিয়া রাধারাণী আপনাআপনি হাসিয়া কুটপাট হইল। “আ, ছি–ছি–ছি! তা ত পারিব না। বসন্তকে যদি আনাইতাম! ভাল, উঁহাকে এখন দুদিন বসাইয়া রাখিয়া বসন্তকে আনাইতে পারিব না? উনি না হয় সে দুই দিন আমার লাইব্রেরি হইতে বহি পড়ুন না! পড়া শুনা করেন না কি? ওঁরই জন্য ত লাইব্রেরি করিয়া রাখিয়াছি। তা যদি দুই দিন থাকিতে রাজি না হন? উঁহার যদি কাজ থাকে? তবে কি হবে? ওঁতে আমাতেই সে কথাটা কি হবে? ক্ষতি কি, ইংরেজের মেয়ের কি হয়? আমাদের দেশে তাতে নিন্দা আছে, তা আমি দেশের লোকের নিন্দার ভয়ে কোন্ কাজটাই করি? এই যে ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিয়ে করলেম না, এতে কে না কি বলে? আমি ত বুড়া বয়স পর্যন্ত কুমারী;-তা এ কাজটা না হয় ইংরেজের মেয়ের মত হইল |”
তার পর রাধারাণী বিষণ্ণ মনে ভাবিল, তা যেন হলো; তাতেও বড় গোল! মোমবাতিতে গড়া মেয়েদের মাঝখানে প্রথাটা এই যে, পুরুষ মানুষেই কথাটা পাড়িবে। ইনি যদি কথাটা না পাড়েন? না পাড়েন, তবে–তবে হে ভগবান! বলিয়া দাও, কি করিব! লজ্জাও তুমি গড়িয়াছ–যে আগুনে আমি পুড়িতেছি, তাহাও তুমি গড়িয়াছ! এ আগুনে সে লজ্জা কি পুড়িবে না? তুমি এই সহায়হীনা, অনাথাকে দয়া করিয়া, পবিত্রতার আবরণে আমাকে আবৃত করিয়া লজ্জার আবরণ কাড়িয়া লও। তোমার কৃপায় যেন আমি এক দণ্ডের জন্য মুখরা হই!”