রাক্ষুসি

রাক্ষুসি

(বীরভূমের বাগদিদের ভাষায়)

[ ক ]

আজ এই পুরো দুটো বছর ধরে, ভাবছি, শুধু ভাবছি, – আর সবচেয়ে আশ্চয্যি হচ্ছি, লোকে আমাকে দেখলেই এমন করে ছুটে পালায় কেন! পুরুষেরা, যাঁরা সব পর্দার-আড়ালে গিয়ে মেয়ে-মহলে খুব জাঁদরেলি রকমের শোরগোল আর হল্লা করেন, আর যাঁদের সেই বিদঘুটে চেঁচানির চোটে ছেলেমেয়েরা ভয়ে ‘নফ্‌সি নফ্‌সি’ করে, সেই মদ্দরাই আবার আমায় দেখলে হুঁকো হাতে দাওয়া হতে আস্তে আস্তে সরে পড়েন, তখন নাকি তাঁদের অন্দর-মহলে যাওয়ার ভয়ানক ‘হাজত’ । মেয়েরা আমাকে দেখলেই কাঁখ হতে দুম করে কলসি ফেলে সে কী লম্বা ছুট দেয়! ছেলেমেয়েরা তো নাকমুখ সিঁটকে ভয়ে একেবারে আঁতকে উঠে। হাজার গজ দূর থেকে বলে, ‘ওরে বাপরে, ওই এল পাগলি রাক্ষুসি মাগি, পালা – পালা! খেলে, খেলে!’ – কেনে! আমি কোন্ উনোনমুখো সুঁটকোর পাকা ধানে মই দিয়েছি? কোন্ খালভরা ড্যাকরার মুখে আগুন দিয়েছি? কোন্ চোখখাগী আবাগির বেটির বুকে বসে তপ্ত খোলা ভেঙেছি? কার গতর আমকাঠ না কুল-কাঠের আখায় চড়িয়েছি? কোন্ ছেলেমেয়ের কাঁচা মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছি? বল তো বুন, তাদের কি ‘সরোকার’ আছে আমায় যা তা বলবার? কে তারা আমার? – মেরেছি? – বেশ করেছি, নিজের ‘সোয়ামিকে’ মেরেছি! … শুধু মেরেছি? দা দিয়ে কেটেছি! তাতে ওদের এত বুক চড় চড় করবে কেন? ওদের কারুর বুক থেকে তো সোয়ামিকে কেড়ে লি নাই, আর হত্যেও করি নাই, তাতে ওদের কথা বলবার আর সাওখুড়ি করবার কী আছে? ওরা কি আমার সাতপুরুষের কুটুম না গিয়াঁত? যদি এই রকমই করতে থাকে, তবে আমি সত্যিকারের রাক্ষুসিই হয়ে দাঁড়াব বলে রাখছি তখন। এক এক দায়ের কোপে ওদের সোয়ামির মাথাগুলো ধড় থেকে আলাদা করে দিব, মেয়েগুলোর বুক ফেঁড়ে কলজেগুলো ধরে পিষে পিষে দিব, তবে না সে আমার নাম সত্যসত্যিই রাক্ষুসি হয়ে দাঁড়াবে!

আমায় পাগল করলে কে? এই মানুষগুলোই তো – আমি তো ফের তেমনি করেই – যেন কিছু হয় নাই – ঘর পেতেছিলুম। রাত্তির দিন আমার কানের গোড়ায় আনাচে-কানাচে, পথে-ঘাটে, কাজেকর্মে, মজলিসে-জৌলুসে আমার নামে রাক্ষুসি রাক্ষুসি বলে কুৎসা, ঘেন্না, মুখ ব্যাঁকানি, চোখ রাঙানি, – এই সব মিলেই তো আমার মাথার মগজ বিগড়ে দিল? যে ব্যথাটাকে আমি আমার মনের মাঝেই চেপে রেখেচিলুম সেটাকে আবার জাগিয়ে তুলে চোখের সামনে সোজা করে ধরলে তো এরাই! আচ্ছা তুই-ই বল তো বুন, এ পাগল হওয়ার দোষটা কার? একটা ভালো মানুষকে খোঁচা মেরে মেরে ক্ষেপিয়ে তুললে সে দোষটা কি সেই ভালোমানুষের, না যে ভালোমানুষেরা তাকে খেপিয়ে তোলে, তাদের? –

আমার সোয়ামি ছিল সিদেসাধা মানুষ, সে তো সোজা ছাড়া বাঁকা কিছু জানত না। সে চাষ করত, কিরষাণি করত, আমি সারাটি দিন মাছ ধরে চাল কেঁড়ে, ধান ভেনে আনতুম। তা না হলে চলবে কী করে দিদি? তখন আমাদের তিনটি পুষ্যি, – বড়ো ছেলে সোমত্থ হয়ে উঠেছে, বে-থা না দিলে ‘উপর-নজর’ হবে, মেয়েটাও ঢ্যাং-ঢেঙিয়ে বেড়ে উঠেছিল, আর আমার ‘কোলাপুঁছা’ ছোটো মেয়েটিও তখন হাঁক্কো হাঁক্কো করে দু-একটি কথা ফুটছিল। ছা-পোষা মানুষ হলেও দিদি আমাদের সংসারে তো অভাব ছিল না কোনো কিছুর, তোমাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে। এই বিন্দিই তখন নাই নাই করে দিনের শেষে তিনটি সের চাল-তরকারির জন্যে মাছ রে, শামুক রে, গুগলি রে পিত্থিমির জিনিস জোগাড় করে আনত। তাছাড়া বড়ো ছেলেটাও তোমাদের শীচরণের আশীর্বাদে করে কর্মে দু-পয়সা ঘরে আনছিল। মেয়েটাও পাড়ার বউ-ঝিদের সঙ্গে যা দু-চারটে শাগ-মাছ আনত, তাতেও নেহাৎ কম পয়সা হত না। লুন-তেলের খরচটা ও দিয়েই বেশ দিব্যি চলে যেত। এ সবের উপর সোয়ামি বছরের শেষে চাষবাস আর কিরষাণি করে যা ধান-চাল আনত তাতে সারা বছর খুব ‘সচল বচল’ করে খেয়েও ফুরাত না। সংসারে তখন কি ছিরিই ছিল! লক্ষ্মী যেন মুখ তুলে চেয়েছিলেন। এত সব কার জন্যে – ওই ছেলে-মেয়েগুলির জন্যেই তো? সারাদিন রেতে একটি সেরের বেশি চাল রাঁধতাম না। বলি আহা, শেষে আমার ছেলেরা কষ্ট পাবে! সোয়ামি আর ছেলেগুলোকে দিতুম ভাত, আর নিজে খেতুম মাড় – শুধু ভাতের ফেন! মেয়ে মানুষের আবার সুখ কী, ছেলেমেয়ে যদি ঠান্ডা রইল তাতেই আমাদের জান ঠান্ডা! নাইবা হলুম জমিদার। আমরা তো কারুর কাছে ভিক্ষে করতুম না, চুরি-দারিও করতুম না। নিজের মেহনতের পয়সা নেড়ে-চেড়ে খেতাম। নিজে খেতুম, আর পালে রে পার্বণে রে যেমন অবস্থা দু-দশটা অতিথ-ফকিরকেও খাওয়াতুম। আহা, ওতেই তো আমার বুক ভরে ছিল দিদি! লোকে বলত আমি নাকি বড্ডো ‘কিরপণ’; কারণ আমি একটি পয়সা বাজে খরচ করতুম না। তা বললে আর কী করব, তাতে আমার বয়ে যেত। তারা তো জানতো না, আমার মাথায় কী বোঝা চাপানো রয়েছে। দু দুটো মেয়ে আর একটি ছেলের বিয়ে দিতে হবে, বাড়িতে বউ আসবে, জামাই আসবে, আমার এই মাটির ঘরই আনন্দে ইন্দিরপুরি হয়ে উঠবে, দুটো সাদ-আরমান আছে – তাতে কত খরচ বল দিকিনি বুন? দায়ে ঠেকলে কেউ একটা পয়সা কর্জ দিয়ে চালাবে? বাপরে বাপ এই বিন্দির অজানা নেই গো, গলায় সাপ বেঁধে পড়লেও কোনো বেটি একটি ক্ষুদ্রকণা দিয়ে শুধোয় না। তার আবার গুমোর! আমার কাছে ও-সব শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজে না বাপু! তবে বুঝতুম, অনেক কড়ুই রাঁড়ির বুক চচ্চড় করত হিংসেয় আমাদের এই এতটুকু সুখ দেখে।

এমনি করেই খুব সুখে দিন যাচ্ছিল আমাদের! আমি মনে করতুম, আর যটা দিন বাঁচি এমনি করে সোয়ামির সেবা করে, ছেলে-মেয়ে চরিয়ে, নাতিপুতি দেখে আমার হাতের নোওয়া অক্ষয় রেখে মরি ; কিন্তু তা আমার পোড়া বিধাতার সইল না। আমার সাধের ঘরকন্না শ্মশানপুরী হয়ে গেল! আর এত আশা-ভরসা সব-তাতে চুলোর ছাই-পাঁশ পড়ল! শুনে যা দিদি, শুনে যা সব, আর যদি দোষ দেখিস তো তোর ওই মুড়ো খ্যাংরা দিয়ে আমার বিষ ঝেড়ে দিয়ে যাস, সাত উনুনের বাসি ছাই আমার পোড়া মুখে দিয়ে দিস! হায় বুন, আমার ‘দুখখুর’ কথা শুনলে পাথর গলে মোম হয়ে যায়, কিন্তু গাঁয়ের এই বে-দিল মানুষগুলো আমায় এতটুকু পেরবোধ তো দেয়ই না, তার উপর রাত্তির-দিন নানান কথা বলে জানটাকে খেপিয়ে তুলেছে! মনে করি আমার সব পেটের কথা কারুর কাছে তন্ন তন্ন করে বলি আর খুব আর খুব একচোট কেঁদে নিয়ে মনটাকে হালকা করি। তা যারই কাছ ঘেঁসতে চাই, সেই মনে করে এই আমায় খেলে রে। আমি যেন ডাইনি কুহকীরও অধম! এই ‘হেনস্থা’ আর ভয় করার দরুনে আমার সমস্ত মগজটা চমচম করে ধরে যায়। কাজেই আমার পাগলামি তখন আরও বেড়ে যায়। সাধে কি আমার মুখ দিয়ে এত গালিগালাজ শাপমন্যি বেরোয়, বুন! তুই সব কথা শুন আর নাথি মেরে আমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে যা!

 

[ খ ]

তু তো বরাবরই জানতিস দিদি, আমাদের পাঁচুর বাপ ছিল বরাবরকার সিদেসাদা মানুষ, সে হের-ফের বা কথার প্যাঁচ বুঝত না। নাকটা সোজাসুজি না দেখিয়ে হাতটা পিঠের দিক দিয়ে বাঁকিয়ে এনে দেখানোটা তার মগজে আদৌ ঢুকত না। কত আঁটকুড়ো নদী-ভরাই যে ওকে দিয়ে বিনি পয়সার বেগার খাটিয়ে নেত, হাত হতে পয়সা ভুলিয়ে নেত, তার আর সংখ্যা নাই! ওই নিয়ে বেচারাকে আমি কতদিন গালমন্দ দিয়েছি, কত বুদ্ধি দিতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। কথায় বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে’ – ওর আর একটা বদ-অভ্যেস ছিল, ও বড্ড মদ খেত। কতদিন বলেছি, ‘তুমি মদ খাও ক্ষতি নাই, দেখো তোমায় মদে যেন না খায়!’ কিন্তু সে তা শুনত না; একটু ফাঁক পেলেই যা রোজগার করত তা সব শুঁড়ির পায়ে ঢেলে আসত। যাক, ওরকম দু-চারটে বদ অভ্যাস পুরুষ মানুষের থাকেই থাকে – ওতে তেমন আসত যেত না, কিন্তু অমন শিবের মতো সোয়ামি আমার শেষে এমন কাজ করে ফেললে, যা বুন তুই কেন – আমারও এখন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মতো অমন সোজা লোক পেয়ে কে কী খাইয়ে দিয়ে তাকে যে অমন করে দিয়েছিল, তা আমি নিজেই বুঝতে পারি নাই।

জানিস ওপাড়ার রঘো বাগদির দু-তিনটে ‘স্যাঙ্গা-করা’ কড়ুই রাঁড়ি’ মেয়েটা কিরকম পাড়া মাথায় করে তুলেছিল। ছুঁড়ি কখনও সোয়ামির ঘর তো করেই নাই, মাঝ থেকে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের কাঁচা বুকে ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর তার বাপ মাকেই বা কী বলব, – ছি, আমারই মনে হত যে, বিষ খেয়ে মরি! মাগো মা, বাগদি জাতটার উপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে! –

‘তু তো জানিস মাখন-দি, ঝুটমুট আমদের গাঁয়ের লোকের আর আমাদের বাগদিগুলোর বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের হাতে অনেক টাকা আছে। আবার সে কত পুতখাগীর বেটিরা লোকের ঘরে ঘরে রটিয়ে এসেছিল, আমরা নাকি যক্ষির টাকা পেয়েছি। বল তো বুন এতে হাসি পায় না?

‘হেঁ,– আমাদের ওই টাকার লোভেই ওই ‘রাঁড় হয়ে ষাঁড় হওয়া’ ছুড়িটা ওই শিবের মতোন সোজা ভোলানাথ সোয়ামিকে আমার পেয়ে বসল। আর সত্যি বলতে কি মিনসের চেহারাও তো আর নেহাত মন্দ ছিল না! ধুতি-চাদর পরিয়ে দিলে মনে হত একটি খাসা ‘ভদ্দরনুক’।

‘ওরে যেদিন আমি পেত্থম এই কথাটি শুনলুম, তখন আমার মনটা যে কেমন হয়ে গেল, তা বুন তোকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। মাথায় বাজ পড়লেও বোধ হয় লোকে এত বেথা পায় না। আমি সেদিন তাকে রাতে খুব ঝাঁটাপেটা করলুম! অ বুন! – যে অমন মাটির মানুষ, সাত চড়ে যার রা বেরোত না, সেও কিনা সেদিন আমার এই ঝুঁটি ধরে একটা চেলাকাঠে করে উঃ সে কী মার মারলে! কাঠটার চেয়েও বেশি ফেটে ফেটে আমার পিঠ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তখনকার এত যে বাইরের বেথা, তাতো আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেননা আমার বুকটা তখন আরও বেশি ফেটে গিয়েছিল! আমি যে সেদিন স্পষ্ট বুঝলুম, আমার নিজের সোয়ামি আজ পর হল! আমি দেখতে পেলুম, আমার কপাল পুড়েছে। তখন ঠিক যেন কেউ তপ্ত লোহা দিয়ে আমার বুকের ভিতরটায় ছ্যাঁকা দিচ্ছিল – আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলুম!

সেই সঙ্গে আমার যত রাগ হল সেই হারামজাদি বেটির উপর। মনে হতে লাগল, এখন যদি তাকে পাই, তো নখে করে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু কোনোদিনও তার নাগাল পাই নাই। সে আমাকে দেখলেই সরে পড়ত।

 

[ গ ]

ক্রমেই আমার সোয়ামি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করলে। সে আর প্রায়ই ঘরে আসত না! মুনিব-ঘরে খাটত, খেত, আর ওদের ঘরটাতেই গিয়ে শুয়ে থাকত! আমি, আমার ছেলে, পাড়ার সব ভালো লোক মিলে কত বুঝালুম তাকে। কিন্তু হায়, তাকে আর ফিরাতে পারলুম না, ছুঁড়ি যে ওকে যাদু করেছিল! একেবারে ভেড়া বানিয়ে দিয়েছিল! তখন বুঝলুম এতদিনে মিনসের ভীমরতি ধরেছে; ওকে ‘ঊনপঞ্চাশে’ পেয়েছে; তা নইলে কি এমন চোখের মাথা খেয়ে বসে লোকে! একদিন পায়ে ধরে জানালুম, সে কত বড়ো ভুল করতে যাচ্ছে। সে আমার মুখে লাথি মেরে চলে গেল। আমার সারা দেহ দিয়ে আগুনের মতো গরম কী একটা ঠিকরে বেরুতে লাগল। বুঝলুম সে এত বেশি এগিয়ে গিয়েছে নরকের দিকে যে, তাকে ফেরানো যায় না।

তার উপর রাস্তায়-ঘাটে ওই বিশ্রী কথাটা নিয়ে আমায় গঞ্জনা – খোঁচা। আমি খেপার মতো হয়ে পেতিজ্ঞা করলুম, শোধ নেব, শোধ নেব। তবে আমার নাম বিন্দি!

আর একদিন মাঠ হতে এসে শুনলুম মিনসে নাকি আমার বাক্‌স ভেঙে জোর করে যা দু-চার পয়সা জমিয়েছিলুম সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, একটা কানাকড়িও থুয়ে যায় নাই। আরও শুনলুম, তার দু-দিন পরেই নাকি ওই ছুঁড়ির সঙ্গে তার ‘স্যাঙ্গা’ হবে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সে নাকি ওই সমস্ত নগদ টাকা নিয়ে গিয়ে তার হবু-শ্বশুরের ‘শীপাদপদ্দে’ ঢেলেছে। – হায়রে আমার রক্তের চেয়েও পিয়ারা টাকা! তার এই দশা হল শেষে? মানুষ এত নিচু দিকে যেতে পারে? তখন ভাববার ফুরসত ছিল না; ওই দু-দিনের মধ্যেই যা করবার একটা করে নিতে হবে, তার পর আর সময় পাওয়া যাবে না। ভাবতে লাগলুম, কী করা যায়? একটা দেবতার মতো লোক সিধা নরকে নেমে যাচ্ছে এক-এক পা করে, আর বেশি দূর নাই, অথচ ফিরাবার কোনো উপায় নাই। তখন তাকে হত্যা করলে কি পাপ হয়? তা ছাড়া আমি তার ‘ইস্ত্রি’, আমারও তো একট কর্তব্য আছে, আমার সোয়ামি যদি বেপথে যায়, তো আমি না ফিরালে অন্য কে এসে ফিরাবে? আর সে এই রকম বেপথে গেলে ভগবানের কাছে ধর্মত আমিই তো দায়ী। ধর, আমি যদি তাকে এই সময়ে একেবারে শেষ করে ফেলি তাহলে তার তো আর কোনো পাপ থাকবে না। যত পাপ হবে আমার। তা হোক, সোয়ামির পাপ তার ‘ইস্ত্রি’ নেবে না তো কি নেবে এসে শেওড়াগাছের ভূত?

আমি মনকে শক্ত করে ফেললুম! হাঁ, হত্যেই করব যা থাকে কপালে! – ভগবান, তুমি সাক্ষী রইলে, আমি আমার দেবতাকে নরকে যাবার আগে তাঁর জানটা তোমার পায়ে জবা ফুলের মতো ‘উচ্ছুগু’ করব, তুমি তাঁর সব পাপ খণ্ডন করে আমাকে শুধু ‘দুখ্‌কু আর কষ্ট দাও! আমার তাই আনন্দ!

সেদিন সাঁঝে একটু ঝিমঝিম বিষ্টির পর মেঘটা বেশ পরিস্কার হয়ে এসেছে! এমন সময় দেখতে পেলুম, আমার সোয়ামি একা ওই আবাগিদের বাড়ির পেছনের তেঁতুলগাছটার তলায় বসে খুব মন দিয়ে একটা খাটের খুরোয় র‍্যাদা বুলোচ্ছে! – কি করতে হবে ঝাঁ করে ভেবে নিলুম! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম কেউ কোথাও নাই। আমি পাগলির মতো ছুটে এসে দা-টা বের করে নিলুম, সাঁঝের সূর্যটার লাল আলো দা-টার উপর পড়ে চকমক করে উঠল! ওই ঝাপসা রোদে আবার বিষ্টি নেমে এল – ঝিম ঝিম ঝিম! বাড়ির পাশে তখন একপাল ন্যাংটা ছেলে জলে ভিজতে ভিজতে গাইছিল।

রোদে রোদে বিষ্টি হয়,
খ্যাঁকশিয়ালির বিয়ে হয়।

আমি আঁচলে দা-টা লুকিয়ে দৌড়ে বাঘিনীর মতো গিয়ে, ওঃ সে কী জোরে তার বুকে চেপে বসলুম! সে হাজার জোর করেও আমায় উলটিয়ে ফেলতে পারলে না! তার ঘাড়ে মস্ত একটা কোপ বসিয়ে দিতেই আমার হাতটা অবশ হয়ে এল। তখন সে দৌড়ে পাশের পাট খেতটায় গিয়ে চিৎকার করে পড়ল। আমি তখন রক্তমুখো হয়ে উঠেছি। আমি আবার গিয়ে দুটো কোপ বসাতেই তার ঘাড়ে হতেই মাথাটা আলাদা হয়ে গেল! তারপর খালি লাল আর লাল! আমার চারিদিকে শুধু রক্ত নেচে বেড়াতে লাগল! তারপর কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।

যেদিন আমার বেশ জ্ঞান হল সেদিন দেখলুম আমি একটা নতুন জায়গায় রয়েছি, আর তখন চারিদিকে সে কতই রংবেরং-এর লোক! আর সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছিলুম এই দেখে যে, আমিও তাদের মাঝে খুব জোরে জাঁতা পিষছি! এতদিনের পর সূর্যের আলো – ওঃ সে কত সুন্দর সাদা হয়ে দেখাল! এর আগে চোখের পাতায় শুধু একটা লাল রং ধুধু করত। জিজ্ঞাসা করে জানলুম, ওটা শিউড়ির জেলখানা। আমার সাত বছরের জেল হয়েছ! এই-মাত্তর তিনমাস গিয়েছে। আমি নাকি মাজিস্টর সাহেবের কাছে সব কথা নিজ মুখে স্বীকার করেছিলুম। তবে আমার শাস্তি অত হত না – দারোগাবাবু গাঁয়ে গিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করায় আমি নাকি তাকে খ্যাংরাপেটা করে বলেছিলুম, সে যেন জোরজুলুম না করে গাঁয়ে, সে-ই নাকি সাহেবকে বলে এত শাস্তি দিইয়ে দিয়েছে।

মাগো মা! সে কী খাটুনি জেলে। তবু দিদি, যতদিন মনে ছিল না, কিছু, ততদিন যে বেশ ভালো ছিলুম। জ্ঞান হয়ে সে কী জ্বালা! তখন কাজের অকাজের মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই ফিং-দিয়ে-ওঠা-হলকা রক্ত! ওঃ কত সে রক্তের তেজ! বাপরে বাপ! সে মনে পড়লে আমি এখনও বেহুঁশ হয়ে পড়ি! মাথাটা যখন কাটা গেল, তখন ওই আলাদা ধড়টা, কাতলা মাছকে ডেঙায় তুললে যেমন করে, ঠিক তেমনি করে কাতরে কাতরে উঠছিল! এত রক্তও থাকে গো একটা এতটুকু মানুষের দেহে! আমি একটুকুও আঁধারে থাকতে পারতুম না ভয়ে! কেননা তখন স্পষ্ট এসে দেখা দিত সেই মাথাছাড়া দেহটা আর দেহছাড়া মাথাটা! – ওঃ –

তারপর দিদি, কোন্ জজ নাকি সাত-সমুদ্দর তেরো নদী পার হয়ে এসে দিল্লির বাদশাহি তকতে বসলেন, আর সব কয়েদিরা খালাস পেলে! আমিও তাদের সাথে ছাড়া পেলুম।

দেখলি দিদি, ভগবান আছেন! তিনি তো জানেন, আমি ন্যায় ছাড়া অন্যায় কিছু করি নাই। নিজের সোয়ামি-দেবতাকে নরকে যাবার আগেই ও-পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। পুরুষেরা ওতে যাই বলুক, আমি আর ভগবান এই দুই জনাতেই জানতুম, এ একটা মস্ত সোজাসুজি সত্যিকার বিচার! আর পুরুষেরা ওরকম চেঁচাবেই, – কারণ তারা দেখে আসছে যে, সেই মান্ধাতার আমল থেকে শুধু মেয়েরাই কাটা পড়েছে তাদের দোষের জন্যে। মেয়েরা পেথম পেথম এই পুরুষদের মতোই চেঁচিয়ে উঠেছিল কী না এই অবিচারে, তা আমি জানি না। তবে ক্রমে তাদের ধাতে যে এ খুবই সয়ে গিয়েছে এ নিশ্চয়। আমি যদি ওইরকম একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসতুম আর যদি আমার সোয়ামি ওই জন্যে আমাকে কেটে ফেলত, তাহলে পুরুষেরা একটি কথাও বলত না। তাদের সঙ্গে মেয়েরাও বলত, ‘হাঁ, ওরকম খারাপ মেয়েমানুষের ওই রকমেই মরা উচিত। কারণ তারাও বরাবর দেখে আসছে, পুরুষদের সাত খুন মাফ।

তা ছাড়া, আমি মানুষের দেওয়ার চেয়ে অনেক বড়ো শাস্তি পেয়েছিলুম নিজের মনের মাঝে। আমার জ্বালাটা যে সদা-সর্বদা কী রকম মোচড়ে মোচড়ে উঠত, তা কে বুঝত বল দেখি, বুন? নিজের হাতে কাটলেও সে তো ছিল আমার নিজেরই সোয়ামি। কোন্ জজ নাকি তার নিজের ছেলের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন, তাহলেও – অত শক্ত হলেও – তাঁর বুকে কি একটুকুও লাগে নাই ওই হুকুমটা দিবার সময়? – আহা, যখন তার বুকে বসে একটা পেরকাণ্ড রাক্ষুসির মতোই তার গলায় দাটা চেপে ধরলুম, তখন আঃ, কি মিনতি-ভরা গোঙানিই তার গলা থেকে বেরোচ্ছিল। চোখে কী সে একটা ভীত চাউনি আমার ক্ষমা চাইছিল। – আঃ! আঃ!

জেলে রাত্তিরদিন কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকে কোনো কিছু ভাববার সময় পেতুম না। মনটাকে ভাববারই সময় দিতুম না। কাজের উপর কাজ চাপিয়ে তাকে এত বেশি জড়িয়ে রাখতুম যে, শেষে যে ঘুম এসে আমাকে অবশ করে দিয়ে যেত, তা বুঝতেই পারতুম না। এখন, যেদিন ছাড়া পেলুম, সেদিন আমার সমস্ত বুকটা কীসের কান্নায় হা হা করে চেঁচিয়ে উঠল। এতদিন যে বেশ ছিলুম এই জেলের মাঝে! এতদিন আমার মনটা যে খুব শান্ত ছিল। এখন এই ছাড়া পেয়ে আমি যাই কোথা? ওঃ ছাড়া পাওয়ার সে কী বিষের মতোন জ্বালা!

ঘরেই এলুম! – দেখলুম আমার ছেলে বে করেছে। বেশ টুকটুকে বেণিপরা বউটি। আমি ফিরে এসেছি শুনে গাঁয়ের লোকে ‘হাঁ হাঁ’ করে ছুটে এল; বললে ‘গাঁয়ে এবার মড়কচণ্ডি হবে। বাপরে, সাক্ষাৎ তাড়কা রাক্ষসী এবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে, এবার আর রক্ষা নাই – নিঘঘাত যমালয়! – পেথম পেথম আমি তাদের কথায় কান দিতুম না। মনে করলুম ‘কান করেছি ঢোল, কত বলবি বল।’ শেষে কিন্তু আর কান না দিয়েও যে আর পারলুম না। তাদের বলার মাঝে যে একটুও থামা ছিল না! যেন কিছুই হয় নাই এই ভেবে আমি আমার বউ-বেটা নিয়ে ঘর-সংসার নতুন করে পাতলুম, লোকে তা লন্ডভন্ড করে দিলে। মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলুম, কেউ বিয়ে করলে না, বললে, ‘রাক্ষসীর মেয়ে রাক্ষসী হবে’ এ ডাহা সত্যি কথা! এতদিন যে বেথাটা আমি দুহাত দিয়ে চাপা দিতে চাইছিলুম, সেইটাই দেশের লোক উসকে উসকে বের করে চোখের সামনে ধরতে লাগল! সোনার চাঁদ ছেলে আমার একটি কথাও শুনলে না – আমার যে কেমন করে কী হল তা ভুলেও কোনো কথার মাঝে জিজ্ঞেস করলে না, খুশি হয়েই আমাকে সংসারের সব ভার ছেড়ে দিলে; কেননা সে বুঝেছিল যা গিয়েছে তার খেসারতের জন্যে আর একজনকে হারাব কেন! আর এই কড়ুইরাঁড়ি আঁটকুড়িরা যারা আমার সাত পুরুষের গিয়াতকুটুম নয়, তারা কিনা রাত্তিরদিন খেয়ে না খেয়ে লেগে গেল আমার পেছনে। দেবতাদের শাপের মতো এসে আমাদের সব সুখশান্তি নষ্ট করে দিলে! – আমার ছেলেকে তার একঘরে পতিত করলে, তাতেও সাধ মিটল না। নানান পেকারে – নানান ছুতায় এই দুটো বছর ধরে কী না কষ্টই দিয়েছে এই গাঁয়ের লোকে! দিদি, পথের কুকুরকেও এত ঘেন্না হেনস্থা করে না! এতে যে ভালো মানুষেরই মাথা বিগড়ে যায়, আমার মতো শতেক-খুয়ারি ডাইনি রাক্ষুসির তো কথাই নাই। তাও দিদি খুবই সয়ে থাকি, নিতান্ত বিরক্ত না করে তুললে ওদের গালমন্দ দিই না। বত্রিশ নাড়ি পাক দিলে তবে কখনও লোকের মুখ দিয়ে ‘শাপমন্যি’ বেরোয়!

এখন তো তুই সব শুনলি দিদি, এখন বল, দোষ কার? আর তুই ওই হাতের মালসাটা আমার মাথায় ভেঙে আমার মাথাটা চৌচির করে দে – সব পাপের শাস্তি হোক! – ওঃ ভগবান!।

2 Comments
Collapse Comments

কমেন্টে কি আর লিখিব, কাজী নজরুল ইসলামের যাদুর হাতের লিখনি আমাকে সহ পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে । এত সুন্দর উপস্থাপনা, আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার ও ট্রাজিক ঘটনা ‘রাক্ষুসী’ গল্পকে সাহিত্যের অনন্য মর্যাদা দিয়েছে ।

আব্দুল্লাহ আল সিফাত October 19, 2024 at 12:08 am

কাজী নজরুল ইসলাম একজন অসাধারণ লেখক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *