রাও বিল

রাও বিল

রাও কমিটির প্রস্তাবিত হিন্দু কোড বা সংহিতার প্রধান লক্ষ্য দুইটি–(১) ব্রিটিশ ভারতের হিন্দুরা এখনও যেসব বিষয়ে প্রাচীন হিন্দু আইন দ্বাবা শাসিত সেসব বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর জন্য এক আইনের প্রবর্তন; (২) প্রাচীন হিন্দু আইনের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী যে সকল সংস্কার বা পরিবর্তন প্রয়োজন, সেই সকল সংস্কার ও পরিবর্তনেব ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্য দুইটির প্রথমটি ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত হিন্দুকে এক অখণ্ড হিন্দুজাতিরূপে পরিণত করার একটি বড় উপায়। বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী হিন্দুর মধ্যে বর্তমান অবস্থায় ধর্ম ছাড়াও অন্য যোগসূত্র নিতান্ত প্রয়োজন। দেশের মধ্যে হিন্দু সংগঠনের যে কথা শোনা যায়, সেই সংগঠনের এ একটি প্রধান উপায়। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর জন্য এক আইন প্রবর্তনের উপায়–বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে এক আইনের রূপ দেওয়া।

রাও কমিটির প্রস্তাবিত সংহিতার দ্বিতীয় লক্ষ্যটি এইজন্য প্রয়োজন যে, ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজ্যশাসনের প্রতিষ্ঠার পূর্বে যে উপায়ে হিন্দু আইনের সংস্কার হত সে সব উপায় এখন অসম্ভব হওয়ায় হিন্দু আইনের স্বাভাবিক পরিণতি ও সংস্কারের ধারা বন্ধ হয়েছে। আইনসভায় হিন্দু আইনের সংস্কার না করলে বর্তমান কালোপযোগী তার সংস্কার আর সম্ভব নয়।

রাও কমিটির প্রস্তাবিত সংহিতা সম্বন্ধে যে সব আন্দোলন ও আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে দুইটি বিষয় নিয়েই সচরাচর আলোচনা দেখা যায়–(১) হিন্দু উত্তরাধিকার আইন; (২) হিন্দু বিবাহ সম্বন্ধীয় আইন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে রাও কমিটির প্রস্তাবের মৰ্ম এই রকম : নিকট সম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মোটামুটি দায়ভাগের অনুসরণ এবং দূরসম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মোটামুটি মিতাক্ষরার অনুসরণ। কারণ, নিকট সম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে দায়ভাগের বিধান মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছার অধিকতর অনুরূপ এবং দূরসম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মানুষের বিশেষ কোনও স্বাভাবিক ইচ্ছা! থাকে না। সেখানে একটি ন্যায়সম্মত সরল বিধিরই বিশেষ প্রয়োজন এবং মিতাক্ষরার বিধি এইরূপ ন্যায়বিধি ও দায়ভাগের বিধির চেয়ে অনেক সরল।

দ্বিতীয়ত, রাও কমিটির প্রস্তাবে স্ত্রীসম্পৰ্কীয়দের উত্তরাধিকারের স্বত্ব প্রচলিত আইনের তুলনায় বেশি স্বীকার করা হয়েছে। এই স্বীকারের বিরুদ্ধেই বিরুদ্ধমত সবচেয়ে প্রবল। বিশেষত, বাপের সম্পত্তিতে মেয়েকে ছেলের অর্ধেক অংশ দিবার যে প্ৰস্তাব তার বিরুদ্ধেই বিশেষ আপত্তি। আপত্তিকারীগণ বলেন যে, এতে হিন্দুর সম্পত্তি বহুভাগে বিভক্ত হয়ে হিন্দুর আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটবে। এই আপত্তি ও আশঙ্কা ভিত্তিহীন। আপত্তিকারীগণ ভুলে যান যে, সম্পত্তির যাতে ভাগ বেশি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য করেই হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন রচিত হয়নি। তা হলে পিতার এক পুত্র অথবা দুই পুত্ৰ মাত্র উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার সম্পত্তি পাবে, এইরূপ বিধান হত। সেইরূপ বিধানের অনুবর্তন প্রয়োজন, একথা কোনও আপত্তিকারী এ পর্যন্ত বলেননি। উত্তরাধিকার আইনের একটি প্রধান লক্ষ্য–যাদের উত্তরাধিকার ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়, তাদের উত্তরাধিকারী করা। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই উত্তরাধিকারের একমাত্র, এমনকী প্ৰধান উদ্দেশ্য নয়। বাপের বিষয়ে মেয়ের অংশ ও সে অংশ ছেলের অর্ধেক নির্ধারণ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। যাঁরা এই ব্যবস্থায় হিন্দুর আর্থিক অবনতির আশঙ্কা করেন, তাঁরা সম্ভব ভেবে দেখেননি যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের মধ্যে এবং বহু দেশে ছেলে ও মেয়ের একসঙ্গে উত্তরাধিকার প্রচলিত আছে এবং তাতে তাদের আর্থিক অবস্থা হীন হয়েছে, এর কিছুমাত্র প্রমাণ নেই। কেহ কেহ আপত্তি তুলেছেন, মেয়েরা যখন স্বামীর উত্তরাধিকারিণী তখন তাদের পিতার উত্তরাধিকারিণী করা উচিত নয়। একজনের উত্তরাধিকারিত্ব অপর জনের উত্তরাধিকারিত্বে বাধা হওয়া কোনও ন্যায়ই সমর্থন করে না-যেমন একথা কেহ বলে না যে, ছেলে যখন পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীতখন তাকে মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা উচিত নয়।

স্ত্রীলোকের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে রাও কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি এই যে, স্ত্রীলোকদের উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে তাদের নিৰ্বািঢ়স্বত্ব স্বীকার করা হয়েছে। প্রকৃত কথা, এক দায়ভাগশাসিত বাংলাদেশ ছাড়া মিতাক্ষরাশাসিত সমস্ত ভারতবর্ষেই এইরূপ নিৰ্বািঢ়-স্বত্বই স্বীকৃত। মিতাক্ষরাকার সুস্পষ্টভাবে সেই ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। কেবলমাত্র প্ৰিভি কাউন্সিলের নজির সমস্ত ভারতবর্ষের স্ত্রীউত্তরাধিকারীগণের সেই স্বত্ব লোপ হয়েছে। দায়ভাগ প্রচারিত স্ত্রী-উত্তরাধিকারীগণের জীবন-স্বত্বের বিধি–যা শাস্ত্ৰৰলে নয়, প্ৰিভি কাউন্সিলের নজিরবিলে এখন সমস্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত আইন, তার ফল যে কিছুমাত্র মঙ্গলকর নয়–তা প্রত্যেক আইনব্যবসায়ী অবগত আছেন। এ নিয়ে যে মামলা মোকদ্দমা উপস্থিত হয়, তা স্ত্রীউত্তরাধিকারীগণের নিরর্থক ক্লেশকর। সম্পত্তির শেষপুরুষ— অধিকারীর যে পুরুষ ওয়ারিশগণের হিতার্থে এই জীবনস্বত্ব কল্পিত, তাঁরা প্রায়শই দূর সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাদের অনুকুলে নিজের অত্যন্ত নিকট স্ত্রী-ওয়ারিশগণের সম্পত্তিভোগে বাধা জন্মানোর কিছুমাত্র অর্থ নেই। কয়েক বছর হল এক প্ৰস্তাবিত আইনে মা ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। মা যেখানে নিজের জীবনান্ত এই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তি ছেলের জন্য মা রেখে বিক্রি করবেন, ধরে নেওয়া যেতে পারে শতকরা নব্বইটি জাযগায় উপযুক্ত কারণ আছে।

এই উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে অনেক হিন্দুর মনে একটা ভুল বিশ্বাস আছে। তাঁরা মনে করেন যে, হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন হিন্দুধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই আইনের পরিবর্তনে হিন্দুর ধর্মে আঘাত লাগবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা-প্রসূত! দায়বিভাগ বিধি ধর্মশাস্ত্রের ব্যবহার অধ্যায়ের অন্তৰ্বতী। ধৰ্মশাস্ত্রের ব্যবহাব অধ্যায় যাকে ইংরেজিতে রিলিজিয়ান বলে, তার অন্তর্গত নয়। কারণ, ধর্মশাস্ত্র-বেত্তাগণ স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, ব্যবহারবিধি ও উত্তরাধিকার বৈদিক বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ওদের ভিত্তি অর্থশাস্ত্ৰ ও লোকপ্রসিদ্ধি। সুতরাং উত্তরাধিকার বিধির পরিবর্তনে হিন্দুর ধর্ম অৰ্থাৎ রিলিজিয়নে কোনও আঘাত লাগে না। লোক ব্যবহারের উপর যার প্রতিষ্ঠা, লৌকিক অবস্থার পরিবর্তনে তার পরিবর্তন না ঘটলে লোকযাত্রা ও সমাজযাত্ৰা সুষ্ঠুভাবে নির্বাহ হয় না। সেই জন্য দায়ভাগকার জীমূতবাহন বাংলাদেশে অন্যত্র প্রচলিত উত্তরাধিকারবিধির পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন।

কথাটার একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন।

হিন্দু দায়াধিকার বিধি হিন্দুধর্মের অঙ্গ; সুতরাং তার পরিবর্তনে ধর্মে আঘাত লাগে এই বিশ্বাসের মূলে আছে একটা ভুল ধারণা। সে ধারণা হচ্ছে–হিন্দুর ধর্মশাস্ত্ৰে ধৰ্ম কথাটা ইংরেজি রিলিজিয়ান শব্দের সমর্থবাচক। এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে ধর্মশাস্ত্ৰ কি তার টীকাকারদের মত থেকে নয়, কয়েকজন ইউরোপীয় লেখকের গ্রন্থ থেকে। এই সব লেখক হিন্দু সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বকে অপ্রমাণের জন্য একটি মত খাড়া করেছিলেন। হিন্দুর আইন তার ধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়ান থেকে পৃথক হয়ে পরিণতি লাভ করেনি। সকল সমগ্নজেই আদিতে ধর্ম ও আইন অবিশ্লেষিত অবস্থায় থাকে। সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়ান থেকে আইন স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। এইসব ইউরোপীয় লেখকেরা প্রচার করেছিলেন যে, হিন্দু সভ্যতা এই শেষ স্তরে পৌঁছতে পারেনি। হিন্দুর রিলিজিয়ন ও আইন চিরদিন অবিশ্লেষিত অবস্থায় থেকে গেছে। ইংরেজ লেখক হেনরি মেইন এই মতের একজন প্রধান প্রচারক। তার প্রাচীন আইন বা ‘এনসেন্ট ল’ নামক পুথি আমাদের দেশের আইন পরীক্ষার্থী ছাত্রদের পড়তে হয়। এই পুথিতে মেইন তার মত প্রচার করেছেন। হিন্দু সভ্যতার কুৎসাকারীদের এই মতকে সাহেবের লেখা বলে কোনও অনুসন্ধান না করেই আমরা মাথা পেতে নিয়েছি। এবং গর্বের সঙ্গে প্রচার করছি যে, আমরা হিন্দুরা ধমপ্ৰাণ জাতি, আমাদের যা কিছু সবই ধর্মের অঙ্গ। কিন্তু ধৰ্মশাস্ত্রকারগণ ও ধর্মশান্ত্রের ব্যাখ্যাত নিবন্ধকারগণ রিলিজিয়ন ও আইনের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা নির্দেশ করেছেন। ওর প্রথমটি হচ্ছে বৈদিক, দ্বিতীয়টি লৌকিক। একই ধর্মশাস্ত্রের গ্রন্থে এই উভয়বিধ জিনিসের আলোচনা আছে, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের প্রভেদ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করা আছে। ধর্মশাস্ত্রে ধর্ম কথাটির অর্থ ‘কর্তব্য’। কর্তব্য ও অকর্তব্যের বিধি ও নিষেধ ধৰ্ম শব্দের অর্থ।

মনুসংহিতার আরম্ভে আছে, ঋষিগণ ভগবান মনুর কাছে উপস্থিত হয়ে তার কাছে সমস্ত ধৰ্ম আনুপূর্বিক জানতে চেয়েছিলেন। সেই ধর্ম শব্দের ব্যাখ্যায় মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথি লিখেছেন: ‘ধর্ম শব্দঃ কর্তব্যতাবাচনঃ। ধর্ম শব্দঃ কর্তব্যাকর্তব্যয়োবিধি প্ৰতিষেধয়ো দৃষ্ট প্রয়োগঃ।’ এর অর্থ পূর্বেই বলেছি। এই যে কর্তব্য ও অকৰ্তব্য এটা হিন্দুর ঐহিক ও পািরত্রিক সমস্ত রকম কর্তব্য ও অকৰ্তব্যকে সূচিত করে। যে সকল করণীয় ও অকরণীয় ঐহিক নয় পারিত্রিক, সেগুলি রিলিজিয়ন অর্থে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। আর যে কৰ্তব্য ও অকৰ্তব্য ঐহিক তাঁরা ধর্ম; কিন্তু নন-রিলিজিয়স। রিলিজিয়ন অর্থে যে ধর্ম তার মূল হচ্ছে বেদ। আর যে ধর্ম নন-রিলিজিয়স তার মূল বেদ নয়, তার মূল লোকাচার ও লোকপ্ৰসিদ্ধি। বেদ হচ্ছে সেই ধর্মের প্রমাণ যা অন্য কোনও প্রমাণ দিয়ে জানা যায় না। বেদ শব্দের ব্যাখ্যায় মেধাতিথি লিখেছেন–’বিদন্তি অনন্য প্ৰমাণ বোদ্যং ধর্মলক্ষণমর্থমন্মাদিতি বেদঃ’ অৰ্থাৎ যে ধর্মের বিষয় অর্থাৎ কর্তব্যাকর্তব্যের বিষয় অন্য কোনও প্রমাণ দিয়ে জানা যায় না। তাই জানিয়ে দেয় বলেই বেদের নাম বেদ–যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে স্বৰ্গলাভ হয়। অন্য কোনও প্রমাণেই তা জানা যায় না, সুতরাং এখানে বেদই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু মানুষের মঙ্গল কি অমঙ্গলের যে সকল উপায় লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় সেটা বেদের বিষয় নয়, লৌকিক জ্ঞানের বিষয়। কারণ সেখানে বেদের কোনও প্রয়োজন নেই। মেধাতিথি লিখেছেন–’শ্রেয়ঃ সাধনং কৃষি সেবাদি ভবতি। পুরুষস্য কর্তব্য ত্বস্য চ তৎসাধনস্বভাবঅন্বয় ব্যতিরোেকাভ্যামবগম্যতে। যাদৃশেন ব্যাপারেন। কৃষ্যাদেঃ বৃহ্যাদিসিদ্ধিঃ সাপি প্রত্যক্ষাদবগম্য এব। যাগাদেন্তু সাধনত্বং যেন চ রূপেন অপূর্বোৎপত্তি ব্যবধানাদিনা তন্ন প্রত্যক্ষাদি অবগম্যম’ অর্থাৎ ‘কৃষি ও চাকুরি করে’ মানুষের শ্রেয় সাধন হয় এ জ্ঞান লৌকিক, অন্বয়-ব্যতিরেকে প্রমাণ দ্বারাই লোকে জানতে পারে। কি উপায়ে কৃষিকার্যের ফলে ধান প্রভৃতি ফসল ফলান যায় তা প্রত্যক্ষ প্রমাণেই মানুষ জানতে পারে। কিন্তু যাগযজ্ঞাদির ফলে যে এক অপূর্ব-ফলোৎপত্তি হয়ে পরকালে মানুষকে সুফল দেয় তা প্রত্যক্ষাদি কোনও লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় না। সুতরাং এখানে বেদ প্রমাণ। কৃষি ও চাকুরিতে মানুষের ফললাভ, কি চাষের উপায়–এই জ্ঞানের প্রমাণ বেদ নয়। বেদে যদি এ সম্বন্ধে কোনও কথা থাকে। তবে তা প্রসঙ্গত, মীমাংসকদের ভাষায়, অনুবাদ মাত্র। প্রকৃত বেদ অর্থাৎ বিধিনিষেধেরত অঙ্গ নয়।

যে সকল ধর্মসংহিতা সম্পূর্ণাঙ্গ তাদের তিনটি ভাগ। সেইজন্য যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির তিন অধ্যায়— আচার অধ্যায়, ব্যবহার অধ্যায় ও প্ৰায়শ্চিত্ত অধ্যায়। মনুসংহিতায় এই তিন ভাগ আছে। যদিও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিব অধ্যায় ভাগ করে তাদের বিভাগ দেখানো হয় নাই। মনুসংহিতার শেষ বা দ্বাদশ অধ্যায়ে ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ আছে। এই দুটি প্রধান সংহিতা বা ধৰ্মশাস্ত্ৰে আচার ও প্ৰায়শ্চিত্ত অধ্যায় ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশমূলক অধ্যায় বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যবহার অধ্যায় বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

বেদ প্রমাণে ও অন্য লৌকিক প্রমাণে কর্তব্যাকর্তব্যজ্ঞান সম্বন্ধে মেধাতিথি লিখেছেন যে, ‘অন্যত্র যেমন ব্যবহার স্মৃতি প্রভৃতিতে জ্ঞান ন্যায়মূল, অর্থাৎ বেদমূল নয়, তা ক্রমে প্ৰদৰ্শিত হবে।’ ‘অন্যত্ৰাপি ব্যবহার স্মৃত্যাদৌ যাত্র ন্যায়।মূলতা স্তত্র যথাবসরং দর্শায়িষ্যাম।’ এবং মনুর সপ্তম অধ্যায়ে, যেখানে রাজধর্মের বিবরণ আরম্ভ হয়েছে সেখানে মেধাতিথি লিখেছেন, ‘প্ৰমাণান্তরমূলোহি অত্র ধর্মী উচ্যন্তে। ন সর্বে বেদমূলাঃ।’ অর্থাৎ, এখানে যে ধর্ম বলা হচ্ছে, তার মূল অন্য প্রমাণ, এই ধর্মের সমস্ত বেদমূল নয়।

শাস্ত্রকারেরা এবং নিবন্ধকারগণ কেন যে ব্যবহার স্মৃতিকে বেদমূল নয় বলেছেন এবং অন্য লৌকিক প্রমাণ সাপেক্ষ বলেছেন তার কারণ ব্যবহার স্মৃতি কোনও বিষয়ের কর্তব্যাকর্তব্যের উপদেশ–তার উপর একটু চোখ বুলালেই বুঝা যায়। ব্যবহার স্মৃতির বিষয় হচ্ছে আমরা এখন যাকে বলি মামলা মোকদ্দমা। মিতাক্ষরাকার লিখেছেন–’অন্য বিরোধেন স্বাত্ম-সম্বন্ধিতয়া কখনং ব্যবহারো, যথা কশ্চিদিদং ক্ষেত্ৰাদি মদীয়ং ইতি কথয়তি। অন্যেপিতদবিরোধেন মদীয়ং ইতি’ অর্থাৎ একই বস্তুতে দুই ব্যক্তির পরস্পর বিরুদ্ধ স্বত্বেব দাবির নাম ব্যবহার–যেমন যদি একজন লোক বলে এ শস্যক্ষেত্র আমার ও অন্য লোক বলে ওই শস্যক্ষেত্র তার, তা হলে তাকে বলে ব্যবহার।

ব্যবহার স্মৃতির কাজ সাংসারিক ভোগের বস্তুতে বিভিন্ন লোকের বিরোধী দাবির বিচারের উপায় নির্ণয় করা। সুতরাং ও স্মৃতিতে আছে, রাজার বিচারসভায় কারা সভ্য

হবেন, কি প্ৰণালীতে তাঁরা বিচার করবেন, কোন প্ৰমাণ গ্রাহ্য, কোন প্ৰমাণ অগ্রাহ্য এবং যে সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে লোকের বিরোধী দাবি হতে পারে, মোটামুটি তাকে ১৮ ভাগে ভাগ করে তার আইনের ব্যবস্থা। স্মৃতিশাস্ত্রে এর নাম ‘অষ্টাদশ বিবাদ পদানি।’ এর মধ্যে আছে— ঋণ, তার সুদ ও তার পরিশোধের আইন, নানাবিধ চুক্তির আইন, ক্রয় বিক্রয়ের আইন, জমির সীমা নিয়ে বিবাদের আইন, নানারকম অপরাধের ফৌজদারি আইন ইত্যাদি। অর্থাৎ মোটামুটি প্রাচীন হিন্দু আইন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্রিটিশ আদালতে ইংরেজের প্রবর্তিত আইন দ্বার যেসব বিষয়ের বিচার হিন্দু, কি মুসলমান আজ মেনে নিচ্ছে। এতে হিন্দুর ধর্ম নষ্ট হয়েছে, অতি বড় সনাতনীও এমন কথা বলেন না।

এই সকল নিতান্ত লৌকিক বিষয়, যার ফলাফল ও মঙ্গলামঙ্গল হাতে হাতে পাওয়া যায় এবং মানুষের স্বাভাবিক লৌকিক জ্ঞানে যে বিধিব্যবস্থা করা যায়, প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা কি তাদের ভাষ্যকারেরা তা রিলিজিয়নের অঙ্গ সুতরাং অপরিবর্তনীয় একথা কখনও মনে করেননি। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনের ভার তাদের উপর ছিল। সুতরাং কাণ্ডজ্ঞানহীন গোড়ামি করার অবসর তাদের ছিল না। তার উপর তাঁরা ছিলেন তীক্ষ্ণ ধী-সম্পন্ন, সাংসারিক জ্ঞানে সম্পূর্ণ জ্ঞানবান পণ্ডিত। সেইজন্য তাঁরা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, ব্যবহার স্মৃতি লৌকিক জ্ঞান ও লৌকিক ব্যবহারের উপর স্থাপিত।

হিন্দুর দায়বিভাগ এই ব্যবহার স্মৃতির অন্তর্গত। সুতরাং এর মূল বেদ নয় এবং রিলিজিয়ন অর্থে দায়ভাগ হিন্দুধর্মের অঙ্গ নয়। স্মৃতি-শাস্ত্রকারগণের মধ্যে একটা তর্ক প্রচলিত ছিল— বস্তুর উপর স্বামিত্ব, কি স্বত্ব, শাস্ত্ৰ-প্রমাণের বিষয়, না লোক-প্রসিদ্ধির বিষয়। সকল স্মৃতিকার একবাক্যে বলেছেন যে, বস্তুর উপর স্বত্ব কি স্বামিত্ব শাস্ত্ৰ-প্রমাণের বিষয় নয়, লৌকিক স্বীকৃতির বিষয়। মিতাক্ষরাকার বলেছেন যে, তা না হলে যে সকল অহিন্দু প্রত্যন্তবাসী শাস্ত্রের প্রমাণ গ্রাহ্য করে না, তাদের মধ্যেও বস্তুর স্বামিত্ব স্বীকৃত হয় কি করে? যে সকল বিভিন্ন প্রকারে বস্তুতে লোকের স্বামিত্ব জন্মে, স্মৃতিশাস্ত্রে তার ফর্দ দেওয়া আছে। কিন্তু ভাষ্যকারেরা বলেছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রে ওই ফৰ্দ আছে বলেই ওকে শাস্ত্রের বিধি বলে মনে করতে হবে না। মিতাক্ষরাকার এর উদাহরণে যা বলেছেন, আমাদের বর্তমান আলোচনায় তা সকল সংশয় নিরসন করে। তিনি বলেছেন, ‘যদ্যপি পত্নী দুহিত।রশচ ইত্যাদি স্মরণং তত্ৰাপি স্বামী সম্বন্ধিতয়া বহুর্মুদায়বিভাগিতয়া প্ৰাপ্তেষু লোকপ্রসিদ্ধেপি স্বত্বে ব্যামোহ নিবৃতাৰ্থং স্মরণমিতি সৰ্বমনবদ্যং’ অর্থাৎ যেমন পুত্ৰহীন লোকের ধনের কারা অধিকারী হবে, সে সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য ‘পত্নী দুহিতরাশ্চা’ ইত্যাদি বচনে নির্দেশ দিয়েছেন, তবু এটা শাস্ত্রের বিধি নয়, কিন্তু ধন স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কবশত বহু লোক তার সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারে, এজন্য লোকের সন্দেহ নিবৃত্তির জন্য এই বচন বলেছেন, যদিও এ দায়াধিকার বচনের উপর নয়–লোকপ্ৰসিদ্ধির উপর নির্ভর করে, তেমনি সম্পত্তি অর্জনের নানারূপ উপায় আছে। অন্য স্মতিশাস্ত্রে সে সব উপায় বলা হয়েছে, বিধি-নিষেধের উদ্দেশ্যে নয়, লোক-প্ৰসিদ্ধ ব্যাপারের বর্ণনা হিসাবে।

এর পর যে দুটি বিখ্যাত শ্লোক যাজ্ঞবল্ক্য নির্দেশ করেছেন, কোন কোন স্বেপার্জিত সম্পত্তি উপাৰ্জনকারী নিজে রাখতে পারবেন, পরিবারের সকলের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে না। তার টীকার এক জায়গায় মিতাক্ষরাকার লিখেছেন যে, এই প্রকরণের বাচনগুলি প্রায়ই যা লোক-প্রসিদ্ধ ব্যবহার তারই অনুবাদ মাত্র অর্থাৎ শাস্ত্রের বিধি নয়।

‘অস্মিন প্রকরণে’ ‘এই প্রকরণে’ যে প্রকরণের কথা মিতাক্ষরাকার বলেছেন, সে হচ্ছেদায়বিভাগ প্রকরণ। সুতরাং মিতাক্ষরাকারের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না যে, যাজ্ঞবল্ক্যের ব্যবহার অধ্যায়ের দায়ভাগ প্রকরণের বিধিগুলি বেদমূল নয়, অর্থাৎ হিন্দু রিলিজিয়নের অঙ্গ নয়, লোক-প্ৰসিদ্ধ ও লোক-ব্যবহার সে বিধির স্রষ্টা। মিতাক্ষরার অনেক পরবর্তী গ্ৰন্থ ‘বীর মিত্ৰোদয়’ সোজাসুজি বলেছেন, ‘প্ৰায়েণ ব্যবহার-স্মৃতীনাং লোকসিদ্ধার্থনুবাদকত্বমিতি সকল নিবন্ধু ভিরভিধানাং’, অর্থাৎ ব্যবহার স্মৃতির প্রায় বচনগুলি যা লোকসিদ্ধ তারই অনুবাদক–এই কথা সকল নিবন্ধকার বলেছেন।

যাঁরা আপত্তি তুলেছেন যে, হিন্দু দায়াধিকার বিধি পরিবর্তন করলে হিন্দুধর্মে আঘাত লাগবে, ধর্মশূন্ত্রকারগণ ধর্ম বলতে কি বুঝতেন, তার কােনও খবর তাঁরা রাখেন না। রাষ্ট্র বা সমাজে কোর্সও কিছু পরিচালনের দায়িত্ব আমাদের নেই বলে সব কিছুতেই ধৰ্ম গেল। রব তোলা সম্ভব হয়েছে। সে দায়িত্ববোধ থাকলে সময়ের প্রয়োজন অনুসারে দায়বিভাগের প্রচলিত বিধির পরিবর্তনে ধৰ্মহানির কথা কখনও উঠতে পারত না।

দায়ভাগ যে ধর্মের অঙ্গ–এই ভুল বিশ্বাস বাঙালির মনে হওয়ার একটা অতিরিক্ত কারণ আছে। বাঙালি হিন্দু জীমূতবাহনের দায়ভাগদ্বারা শাসিত। জীমূতবাহন অন্যত্র প্ৰচলিত দায়বিভাগক্রমকে পরিবর্তন করেছিলেন। সেই পরিবর্তনের জন্য তিনি একটা তর্ক আশ্রয় করেছিলেন। সে তর্ক হচ্ছে এই পার্বণ–শ্রাদ্ধে পিণ্ডদান করে যে যত বেশি উপকার করে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে তার দাবি তত বেশি। পাৰ্বণ শ্রাদ্ধে পিণ্ডদান হিন্দুর আচারধর্মের অন্তর্গত। সুতরাং মনে হতে পারে যে, দায়ভাগের দায়াধিকার বিধি হিন্দুধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দায়ভাগ গ্রন্থ যিনি পাঠ করেছেন, তিনিই জানেন যে, এই তর্কটা হিন্দুধৰ্ম অর্থাৎ রিলিজিয়নের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে জীমূতবাহন আদৌ মনে করেননি। এই তর্কটা জীমূতবাহন নিয়েছিলেন উদ্যোত নামা একজন পূর্বাচার্যের কাছ থেকে। উদ্যোতের কোনও গ্রন্থ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দায়ভাগ থেকে যতদূর বোঝা যায়, কি উদ্যোত, কি জীমূতবাহন— দুজনেই এই তর্কটিকে ন্যায়ের যুক্তি বলেছেন, ধর্মের অনুশাসন বলেননি। জীমূতবাহন। এই কথা বলে তার বিচার শেষ করেছেন, ‘তদর্জিত ধনস্য চ তদুপকারতারতম্যেন তদৰ্থ্য সম্পাদনস্য ন্যায্যত্বাৎ উপকারকুত্বনৈব ধনসম্বন্ধো ন্যায়প্ৰাপ্তে মম্বাদীনামভিমতমিতি মন্যতে। অর্থাত্রাপরিতেষোবিদুষাং বাচনিক এবায়মৰ্থঃ।’ অর্থাৎ যার ধন পিণ্ড দানের তারতম্যে তার উপকারের তারতম্য হয়। সুতরাং বেশি উপকারীর ধনের উত্তরাধিকার দাবি ন্যায্য ও ন্যায়প্রাপ্ত–যাজ্ঞবল্ক্য মনু প্রভৃতির এইরূপ অভিমত— ইহাই আমি মনে করি। এতেও অর্থাৎ এইরূপ তর্কেও যদি পণ্ডিতেরা তুষ্ট না হন, তা হলে বলি যে, মনু প্ৰভৃতির বচন থেকেও আমি যে উত্তরাধিকার ক্রম স্থাপন করেছি, তা পাওয়া যায়। এর টীকায় দায়ভাগের টীকাকার শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কলংকার বলেছেন, ‘যতো ন্যায়মূলত্বে বিদুষামসন্তোেষঃ ততো বাচনিক এবাৰ্থ ইতি’ অর্থাৎ য়দি ন্যায়মূলক এই তর্কে পণ্ডিতেরা সন্তুষ্ট না হন, তবু জীমূতবাহনের মত ঋষিদের বচন থেকেও পাওয়া যায়। এটা সুস্পষ্ট যে জীমূতবাহন তার দায়ক্রম বিধিকে বেদমূল বলেননি, বলেছেন ন্যায়প্রাপ্ত অর্থাৎ ন্যায়মূল। দায়ভাগের উত্তরাধিকারবিধি জীমূতবাহন হিন্দুধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়নের উপর প্রতিষ্ঠা করেননি, করেছেন ন্যায়ের বা যুক্তির উপর।

অনেকে জানেন বাংলা ভিন্ন সমস্ত ভারতবর্ষে যেখানে মোটামুটি মিতাক্ষরা দ্বারা লোকে শাসিত, পার্বণশ্রাদ্ধে পিণ্ডের উপর দায়াধিকার নির্ভর করে না, নির্ভর করে রক্ত সম্পর্কের উপর। রক্ত সম্পর্কে যে যত নিকট মিতাক্ষরার মতে সে তত নিকট উত্তরাধিকারী। আশা করা যায়, রক্ত সম্পর্কের মধ্যে ধর্মের বীজ কেহ খুঁজে বের করবেন না।

হিন্দুর দায়বিভাগ যে হিন্দুর ধর্মের অঙ্গ, এটা হিন্দু সভ্যতাকে খাটো করার জন্য পশ্চিম দেশে কোনও কোনও লেখক প্রচার করেছিলেন। আমরা সেই প্রচারকে প্রশংসাবাক্য জ্ঞানে মাথায় করে নিয়েছি। হিন্দু শাস্ত্রকর্তাগণ প্রকৃত কি বলেছেন, তা জািনবার জন্য আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। যে অনড় অবস্থায় আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, যা তার অনুকূলে তাই হিন্দু-শাস্ত্রের বিধি-তাতে অনেকেই সন্দেহ করে না। কারণ, অনেক মানুষই—যা বিশ্বাস করলে মন খুশি হয়, তাই বিশ্বাস করে। সে বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অমূলক হতে পারে, তা তাঁরা মনে করতে চায় না। কেউ প্রমাণ করে দেখালে তার উপর বিরক্ত হয় ও গালাগালি করে।

8

রাও কমিটির প্রথম খসড়ায় বিবাহকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল-শাস্ত্রীয় বিবাহ ও লৌকিক বিবাহ। প্রচলিত হিন্দু বিবাহে যে সকল বিধি-নিষেধ আছে, শাস্ত্রীয় বিবাহে সে সমস্তই বলবৎ রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ অসবর্ণ, সগোত্র ও সমান প্ৰবাব বর-কন্যার মধ্যে বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবর্তন কেবলমাত্র এইটুকু ছিল যে, বিবাহ হবে একপত্নীক, অর্থাৎ এক পত্নী বর্তমানে পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহ করা চলবে না। প্রস্তাবিত লৌকিক বিবাহে অসবর্ণ, সগোত্র ও সমান প্রবর বর-কন্যার বিবাহ বৈধ বিবাহ করা হয়েছিল। কেবল কতকগুলি নিকট সম্পর্কে সম্পর্কিত বর-কন্যার মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য এই বিবাহও ছিল একপত্নীক। এই দুই শ্রেণির বিবাহে ব্যাবহারিক ফল একরকম হবে-এই নির্ধারণ ছিল। অর্থাৎ উভয় প্রকার বিবাহিত স্বামী স্ত্রী ও তাদের সন্তানসন্ততিরা এক হিন্দু দায়াধিকার আইনে শাসিত হবে। লৌকিক বিবাহের ফলে কেহ তার পরিবার থেকে বিচুত হবে না বা দেবোত্তর প্রভৃতির সেবাইতি থেকেও বঞ্চিত হবে না, দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা লোপ হবে না এবং লৌকিক বিবাহকারী পুত্ৰকে মৃত্যগণ্যে তার পিতার দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা হবে না। হিন্দু বিবাহের এই দুই শ্রেণি ভাগের উদ্দেশ্য ছিল সনাতন-পন্থীদের আশ্বস্ত করা। শাস্ত্রীয় বিবাহে যখন চলতি সব নিষেধ বহাল থাকল। তখন একটা অশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহ স্বীকারে ক্ষতি কি? কিন্তু এইরকম শ্রেণি ভাগের বিরুদ্ধে দুইটি আপত্তি আছে, প্রথম-এই শ্রেণি ভাগের উদ্দেশ্য কিছুতেই সিদ্ধ হবে না। কারণ সনাতনীদের তুষ্ট করে যদি এ আইন পাশ করাতে হয়, তবে এ আইন পাশ হবে না। কারণ দুই রকম বিবাহের ব্যাবহারিক ফল যেখানে এক, আশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহে পতি-পত্নীর হিন্দুর সমাজ ও ধর্মে সকল দাবি যখন সম্পূর্ণ বহাল থাকবে, তখন সনাতনপন্থী তুষ্ট বা আশ্বস্ত হবে কীসে? সনাতনপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই আইন যদি পাশ হয় তা হবে তাদের মতের জোরে যাঁরা সমগ্ৰ হিন্দু সমাজের যুগোপযোগী পরিবর্তন চায়, সমাজের বিধিবন্ধন থেকে ব্যক্তিবিশেষের মুক্তি মাত্র চায় না। এই শ্রেণি বিভাগের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি এবং যা প্রধান আপত্তি তা হচ্ছে—এই শ্রেণি ভাগ হিন্দু বিবাহবিধির সংস্কার নয়, হিন্দুকে হিন্দু বিবাহবিধি অগ্রাহ্য করে বিবাহের স্বাধীনতা দেওয়া। এইরকম ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের যথেষ্ট মূল্য আছে। কিন্তু সমস্ত সমাজের উপর তার ফল গৌণ ফল। হিন্দুর বর্তমান সমাজ এই গৌণ উপায়ে পরিবর্তনের চেষ্টার যুগ ছেড়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন, সমস্ত সমাজের হিতে হিন্দুর সামাজিক বিধি ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবর্তন, যার ফলে হিন্দু সমাজ দৃঢ় গড়ন ও নুতন বল পাবে।

এই সব আপত্তির ফলে রাও কমিটি বর্তমান যে খসড়া প্রকাশ করেছেন, তাতে শাস্ত্রীয় বিবাহ ও লৌকিক বিবাহের শ্রেণিভেদটা বহাল থাকলেও তার মধ্যে ভেদরেখা অতি অস্পষ্ট। এই শেষ খসড়ায় শাস্ত্রীয় বিবাহবিধির এক পরিবর্তিত ব্যবস্থার প্রস্তাব হয়েছে। সে বিধিতে অসবর্ণ, সগোত্র ও সমান প্রবর বর-কন্যার বিবাহে বাধা নেই; বরকন্যা সপিণ্ড ও বিশিষ্ট নিকট সম্পর্কে সম্পর্কিত না হলেই হল। প্ৰথম খসড়ার একপত্নীক বিবাহের নিয়ম এতেও বহাল আছে। এই শাস্ত্রীয় বিবাহ ও প্রস্তাবিত লৌকিক বিবাহের মধ্যে প্রকৃত তফাত কিছুই নেই। সুতরাং এই লৌকিক বিবাহের প্রস্তাবটিকে প্রস্তাবিত হিন্দু বিবাহ আইন থেকে বর্জন করলে কিছুই ক্ষতি হয় না এবং তা করা উচিত। লৌকিক বিবাহ বা সিভিল ম্যারেজ ধর্মের গণ্ডির কোনও অর্থ নেই। সুতরাং সেই রকম বিবাহকে হিন্দু বিবাহের অর্থাৎ ধর্মের গণ্ডির মধ্যে বিবাহের একটা শ্রেণি গণ্য করার কোনও অর্থ হয় না।

হিন্দু বিবাহ হিন্দুর ধর্মাচারের অঙ্গ। সুতরাং বিবাহ-বিধির পরিবর্তন এই আচারের পরিবর্তন। কাজেই এ আপত্তি উঠা কিছুই বিচিত্র নয় যে, বিবাহ-বিধির এ রকম পরিবর্তন হিন্দু ধর্মকে আঘাত করে। এ রকম আপত্তির উত্তর-হিন্দুর আচার প্রয়োজন অনুসারে যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। কারণ তা না হলে কোনও সমাজ বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এই বিবাহ-বিধিতেই গৌতম স্মৃতির সময় বিভিন্ন বর্ণের বিবাহ অবাধে প্রচলিত ছিল। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির সময় বর্ণগণের মধ্যে অনুলোম বিবাহ প্রচলিত ছিল—অর্থাৎ উচ্চবর্ণের বরের সঙ্গে নিম্নবর্ণ কন্যার বিবাহ বৈধ ছিল। সমাজ থেকে এই রকম অনুলোম বিবাহ খুব বেশি দিন লোপ হয়নি। ব্ৰাহ্মণের শূদ্ৰা পত্নী বিবাহ মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য অবৈধ বলেননি; কিন্তু নিন্দা করেছেন। এই রকম বিবাহ মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির সময়ের পরেও যে হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল, তার বহু প্রমাণ আছে। একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করি : ‘কদম্বরী’র গ্রন্থকার বাণভট্ট তার ‘ইষ্টচরিতে’ লিখেছেন যে, তিনি তাঁর পিতার ব্ৰাহ্মণ পত্নীর গর্ভজাত সন্তান এবং পিতার শূদ্ৰা পত্নীর গর্ভজাত তাঁর দুটি ভাই ছিল। অথচ বাণভট্ট গর্ব করে লিখেছেন যে, তার বংশ এই রকম বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণের বংশ যে, তাদের বাড়ির শুক পাখিরাও শুনে শুনে বেদমন্ত্র গান করত। বাণভট্ট সত্য বা ত্রেতার লোক নন। মহারাজ হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর লোক। অত্যন্ত আধুনিক গ্ৰন্থ, যেমন কালিকা পুরাণে কলিকালে কোন কোন আচার বর্জনীয়, তার ফর্দ আছে। এই ফৰ্দগুলিই প্রমাণ যে, হিন্দুর আচার যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। তার মধ্যে কতকগুলি হয়তো ইচ্ছাকৃত আর কতক সময়ের ও অবস্থার চাপে। অবস্থার চাপে যে সামাজিক আচার পরিবর্তন করতে হয়, ব্ৰাহ্মণ নির্বিশেষে বর্তমান হিন্দু সমাজে কন্যার বিবাহের বয়স তার একটি প্রমাণ। অতিবড় সনাতনীও এখন কন্যার বিবাহের বয়সে মনু যাজ্ঞবল্ক্যের বিধিনিষেধ মানতে পারেন না। সুতরাং হিন্দুর বিবাহ-বিধির সংস্কার বর্তমানে প্রয়োজন কি না, সেই কথাই বিবেচনার বিষয়; প্ৰাচীন আচার ও শাস্ত্ৰবিধি মাত্র তার নিয়ামক নয়।

প্রথম ধরা যাক, বর্তমান সমাজে অসবর্ণ বিবাহের নিষিদ্ধতা। প্রাচীন হিন্দু সমাজে যে বর্ণবিভাগ, তার সঙ্গে বর্তমান সমাজে বিবাহে জাতিভেদের গণ্ডি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বর্ণ বলতে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য, শূদ্ৰ–এই চারি বর্ণ বোঝা যায়। এখন যে জাতিভেদ বিবাহে বাধা, তা এই চারি বর্ণের ভেদ নয়; বহু জাতি ও উপজাতির ভেদ। এই ভেদ হিন্দু সমাজকে বহু ভাগে বিভক্ত ও নিতান্ত দুর্বল করেছে এবং দিন দিন বেশি দুর্বল করছে। এই জাতিভেদে বিবাহের বাধা উচ্চশ্রেণির হিন্দুরা যাকে বলে নিম্নশ্রেণির হিন্দু, সেই নিম্নশ্রেণির হিন্দুজাতির সংখ্যা লাঘব করে ক্রমশ ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ র্যার চোখ আছে, তিনিই দেখতে পাচ্ছেন। অথচ এই সকল বর্ণ ও জাতির মধ্যে বস্তুগত কোনও প্রভেদ খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব। মনুর সবচেয়ে প্রাচীন ভাষ্যকার মেধাতিথি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর লোক। তিনি তখনই প্রশ্ন তুলেছেন, ব্ৰাহ্মণ শূদ্রে যে ভেদ, এ কী রকম ভেদ? এ কি গো ও অশ্বের মতো ভেদ যে চোখে দেখলেই চেনা যায়, কোনটা গোরু আর কোনটা ঘোড়া? কিন্তু চোখে দেখে তো চেনা যায় না, কে ব্ৰাহ্মণ আর কে শূদ্র। সুতরাং তিনি মীমাংসা করেছেন-এ ভেদ কোনও বস্তুগত ভেদ নয়। প্রাচীনকাল থেকে আগত শাস্ত্রকৃত ভেদ মাত্র। আমাদের হিন্দু সমাজে জাতিভেদের ভিত্তি জাতির গণ্ডির বাইরে বিবাহে নিষিদ্ধতায়। এই নিষেধকে দূর না। করলে হিন্দু সমাজ কোনও দিনই দৃঢ়বদ্ধ এক সমাজ হয়ে গড়ে উঠবে না। এই নিষেধের সমর্থনে বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক যুক্তির নাম দিয়ে যা সব বলা হয়, সেগুলি যা আছে, তার সমর্থনে মনগড়া কল্পনা মাত্র; সত্যে তার কোনও ভিত্তি নেই। এই নিষেধকে বহাল রেখেও আমাদের জাতিগত ভেদবুদ্ধিকে এড়িয়ে হিন্দু সমাজে সংহতি আনার আর যে সব চেষ্টাযেমন অ-জল-চল জাতির হাতে মাঝে মাঝে সভা করে, জল খেয়ে তাদের কৃতাৰ্থ করা, বৎসরে একবার তাদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ভোজন করে তাদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন—সম্পূর্ণ পণ্ডশ্রম-নিজের মন ও পরের মনকে ফাঁকি দেওয়া। এই জন্য হিন্দু বিবাহ বিধির সংস্কারে প্রথম প্রয়োজন হিন্দু বিবাহে বরকন্যার অসবৰ্ণত্বের বাধা দূর করা। সুতরাং রাও কমিটির শেষ খসড়ায় শাস্ত্রীয় বিবাহে এই বাধা দূর করার যে প্রস্তাব হয়েছে, হিন্দু সমাজের মঙ্গলকামী সকল হিন্দুর তা সমর্থন করা উচিত।

প্রচলিত হিন্দু বিবাহে সগোত্র ও সমান প্রবারের বাধার মতো অর্থশূন্য বাধা আর কল্পনা করা যায় না। গোত্র কাকে বলে? থিয়োরি হচ্ছে, জমদগ্নি প্রভৃতি কয়েকজন ব্ৰাহ্মণ সকল ব্ৰাহ্মণের আদিপুরুষ। এই কয়েকজনের নামই গোত্র নাম। সুতরাং যে ব্ৰাহ্মণের বংশপরম্পরা যে গোত্র প্রসিদ্ধ, ধরতে হবে তিনি সেই নামের আদি পুরুষ ব্ৰাহ্মণের বংশধর। যদি স্বীকার করা যায় এ থিয়োরি সত্য এবং বহু শত পুরুষ পূর্বে সগোত্ৰ স্ত্রীপুরুষ ব্ৰাহ্মণের এক পূর্বপুরুষ ছিল, কোন যুক্তিতে সেটা বিবাহে বাধা হতে পারে? সপিণ্ড বরকন্যার বিবাহে নিষেধের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রকারেরা বলেছেন যে, তারাই সপিণ্ড-এক দেহ থেকে যাঁরা উদ্ভূত—’সপিণ্ডতাতু এক শরীরাবয়বান্বয়েন ভবতি’ (মিতাক্ষরা)। এই অনাদি সংসারে সকলের মধ্যেই এই রকম সপিণ্ডতা সম্ভব। কিন্তু সেটা অতি প্রসঙ্গ। কারণ তা হলে কোনও বিবাহই সম্ভব হয় না।-’তচ্চ সর্বত্র সর্বস্য যথা কথঞ্চিদ নাদেী সংসারে ভবতাতি প্ৰসঙ্গঃ’ (মিতাক্ষরা)। সুতরাং সপিণ্ড শব্দের অর্থকে নিতে হবে কাটছাট করে একটা নিয়মিত কার্যকরী গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে। ‘পঙ্কজ’ শব্দের অর্থ যেমন করা হয়

‘অতশ্চায়ম সপিণ্ড শব্দোহ বয়বশক্ত্যা সর্বত্র প্রবর্তমানেতি নির্মস্থা পঙ্কজাদি শব্দবন্নিয়ত বিষয় এব’ (মিতাক্ষবা)। এজন্য বিবাহের সপিণ্ডতা মাতার বংশে পাঁচ পুরুষ ও পিতার বংশে সাত পুরুষেই শেষ হয়। হিন্দু বিবাহে সগোত্র নিষেধের বিরুদ্ধে হিন্দু শাস্ত্রকারদের এই যুক্তির সুষ্ঠতর প্রয়োগের ক্ষেত্র আর নেই। যেখানে রক্তের সম্বন্ধ পরিজ্ঞাত, সপিণ্ড সম্বন্ধে সীমার বাহিরে হলেও তার সঙ্গে বিবাহ চলে, আর সেই সীমার মধ্যেও কন্যা ত্ৰিগোত্রান্তরিতা হলে তাকে বিবাহ করা যায়। কিন্তু যেখানে রক্ত সম্বন্ধের কোনও ইতিহাস নেই, কেবলমাত্র বংশপরম্পরাগত একটা নাম সাম্যই বিবাহের অলঙঘনীয় বাধা, এই রকম নিয়ম, যাঁরা কোনও কিছু বোঝাকেই ঘাড় ভেঙে গেলেও ঘাড় থেকে নামাতে ভরসা পায় না, তাঁরা ছাড়া আর কেউ সমর্থন করবে না। তা ছাড়া কল্পিত পূর্বপুরুষ সম্বন্ধ কেবল তো আছে ব্ৰাহ্মণের। সুতরাং শাস্ত্ৰমতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের প্রকৃত কোনও গোত্র থাকতে পারে না। পুরোহিতের গোত্র থেকেই তাদের গোত্র কল্পনা করা হয় এবং শূদ্রের বিবাহে কল্পিত সগোত্রও কোনও বাধা নয় : ‘প্রাগুক্ত মনু শাতাতব বচনে দ্বিজাতি গ্রহণং সগোত্র বর্জনে শূদ্ৰাদ্যাবৃতাৰ্থম’ (উদ্বাহতত্ত্ব)।

প্রববের ব্যাপারটা আরও একটু ঘোরাল। কাকে প্রবব বলে, তার প্রকৃত অৰ্থ বহুদিন থেকেই হিন্দু সমাজে পণ্ডিতদেরও জানা নেই। প্রতি গোত্রে অনেকগুলি করে আছে। সেগুলিও ব্যক্তিবিশেষের নাম। একটা প্ৰসিদ্ধি এই যে, প্রবর প্রবর্তক ঋষিরা গোত্র প্রবর্তক ঋষিদের পুত্র পৌত্র। সুতরাং সগোত্র ও সমান প্রবারের লোকেরা খুব দূর সম্পর্কের হলেও এক বংশের লোক এবং যাদের প্রবর এক তাদের সম্পর্কটা ওরই মধ্যে একটু নিকট। কিন্তু মুশকিল। এই যে, ভিন্ন গোত্রেও এক প্রবারের নাম আছে, যেমন উপমনু গোত্রে এক প্রবর। বশিষ্ট আবার পরাশর গোত্রেরও এক প্রবর। বশিষ্ট অর্থাৎ ভিন্ন গোত্রের লোক এক প্রবর হতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, সেজন্যই সমান প্রবারের বাধা বিবাহে সগোত্রের অতিরিক্ত আর এক বাধা। এ কি করে সম্ভব? সেইজন্য মেধাতিথি বলেছেন-স্মৃতি যখন বলেছে তখন তা স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ ওটি অলৌকিক বস্তু, লৌকিক বুদ্ধিতে কিছুতেই বুঝা যাবে না। প্রকৃত কথা এই যে, ভাষ্যকার ও নিবন্ধকারদের সময় প্রবারের যথার্থ অর্থের স্মৃতিও লোপ হয়েছিল এবং নানা পরস্পরবিরোধী কল্পনা তার স্থান পূরণ করেছিল। যদি পাঠক রঘুনন্দনের উদ্ধাহতত্ত্বে ধৃত মাধবাচার্যের প্রবারের ব্যাখ্যার সঙ্গে ‘অসপিণ্ডাতু যা মাতুঃ সগোত্ৰাচ যা পিতুঃ’ এই মনু বচনের মেধাতিথির ভাষ্য মিলিয়ে দেখেন তবে এ সত্য হৃদয়ঙ্গম হবে, কিন্তু এখনও আমরা এই বহুদিন মৃত প্রবারের বাসি মড়া ঘাড়ে করে কষ্ট পাচ্ছি এবং বিবাহের ক্ষেত্ৰকে অকারণে সংকীর্ণ করে সমাজের অমঙ্গল ডেকে আনছি।

হিন্দু বিবাহে সপিণ্ডের মধ্যে বিবাহ নিষেধের বিধি নিকট সম্পর্কিত স্ত্রী পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিবারণের নিয়ম। এই নিষেধ সকল সমাজের বিবাহ-বিধিতেই কোনও-না-কোনও রকমে আছে। হিন্দু সমাজের প্রচলিত নিয়মে পিতার বংশে সাত ও মাতার বংশে পাঁচ সিঁড়ি উপরে ও নীচে এই নিষিদ্ধ সীমার গণ্ডি—’পঞ্চমাৎ সপ্তমাদুর্ধর্ব মাতৃতঃ পিতৃতস্তথা।’ (যাজ্ঞবল্ক্য)। রাও কমিটির শেষ খসড়ায় শাস্ত্রীয় বিবাহে এই নিয়মই বহাল রাখা হয়েছে। অনেকে সম্ভব জানেন যে, এ-বিষয়ে সকল শাস্ত্রকার একমত ছিলেন না। কোনও কোনও শাস্ত্রকার এই গণ্ডিকে সংক্ষেপ করে পিতৃপক্ষ পাঁচ ও মাতৃপক্ষ তিন পর্যন্ত মাত্র গণনার বিধি দিতেন—’শ্ৰীনতীত্য মাতৃতঃ পঞ্চােতীত্য চ পিতৃতঃ’ (পৈঠনসি)। গোলাপচন্দ্ৰ শাস্ত্রী তাঁর হিন্দু আইন পুস্তকে বলেছেন যে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণদের মধ্যে পৈঠনসির পাঁচ। আর তিন মতবাদই কাৰ্যত চলে, যদিও বাঙালি স্মার্ত রঘুনন্দন সাত আর পাঁচ গণনার জোর পক্ষপাতী। শাস্ত্রী গোলাপচন্দ্রের কথা হয়তো একটু অতিরঞ্জিত, কিন্তু বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেও পৈঠনসির মত কাৰ্যত চলে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার নিজের মতে এই প্ৰস্তাবিত আইনে সপিণ্ডত্বের সীমা পাঁচ। আর তিন-এ নির্দেশ করা উচিত। এই নিয়মের পক্ষে শাস্ত্ৰও আছে এবং বর্তমান হিন্দুর সামাজিক বোধ ও রুচিরও তা বিরুদ্ধ নয়। এই নিয়মে বিবাহ্য বর ও বিবাহ্যা কন্যার ক্ষেত্র বড় হবে, যার সামাজিক প্রয়োজন আছে।

রাও বিলের প্রস্তাবিত একপত্নীক বিবাহের বিরুদ্ধ মত এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কারণ, আইনে যাই হোক, সমাজে আধুনিক হিন্দু বিবাহ মোটের উপর একপত্নীক অর্থাৎ আমাদের, প্ৰায় সকলের মনের সম্মতি এক পত্নীকে বিবাহের আদর্শের দিকেই বহু বিবাহ আইনে নিষিদ্ধ করলে অন্য দেশে ও সমাজে মাঝে মাঝে যেসব অসুবিধা ঘটে তা আমাদের মধ্যেও ঘটবে। কিন্তু তার কুফলের পরিমাণ বহু বিবাহের কুফলের তুলনায় অনেক কম। মানুষের কোনও নিয়ম সম্পূর্ণ দোষমুক্ত করা যায় না। যেটা মোটের উপর ভাল তাকেই বেছে নিতে হয়।

রাও বিলে বিবাহ ভঙ্গের যে সব বিধিনিষেধ আছে, তার একটা প্ৰধান প্রয়োজন হয়েছে। এই একপত্নীক বিবাহের আইনত প্রবর্তনে!! পরের প্রবন্ধে রাও বিলের প্রস্তাবিত বিবাহ ভঙ্গবিধির আলোচনা করা যাবে।

হিন্দু বিবাহের অনুষ্ঠানে বর বধূকে বলে ‘যদস্তি হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব। যদস্তি হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম’—আমার এই যে হৃদয় তা তোমার হোক, তোমার যে হৃদয় তা আমার হোক। অর্থাৎ বিবাহের ফলে বর বধুর হৃদয়ের যোগ হোক অতি নিবিড়। মন্ত্রের আর যে শক্তিই থাকুক, নরনারীর দুই হৃদয়কে এক করার ক্ষমতা নেই। ও মন্ত্রের উদ্দেশ্য নব বিবাহিত দম্পতির সামনে দাম্পত্য জীবন ও প্রেমের একটি আদর্শ ধরা ও প্রার্থনা করা যে দম্পতির জীবনে এ আদর্শ সফল হোক। কিন্তু এ সফলতা কদাচিৎ ঘটে। বেশির ভাগ দম্পতির জীবনে নরনারী পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণে প্রথমে আকৃষ্ট হয়। তারপর দৈনিক জীবনের সাহচর্যে, সন্তানের প্রতি স্নেহ, সংসারের নানা ঘাতপ্ৰতিঘাত একসঙ্গে সহ্য কুরে মােটের উপর সুখে দুঃখে গাৰ্হস্থ জীবন এক রকম কেটে যায়। স্বামী স্ত্রীর একাত্মতা দুর্লভ বলেই কাব্যে ও উপন্যাসে তার উজ্জ্বল চিত্রে মানুষ মুগ্ধ হয়; আর যদি বাস্তব জীবনে সে একাত্মতা কাচিৎ দেখা যায়, তবে মানুষ তাতে কাব্য পাঠের আনন্দ পায়। অর্থাৎ দুর্লভ বলে এই রকম একাত্মতাকে মানুষ অলৌকিক মনে করে। কিন্তু কখনও কখনও অদৃষ্টের নিষ্ঠুর অভিশাপে, কি স্বামী বা স্ত্রীর কৃতকর্মের ফলে সাধারণ রাগ-বিরাগের ও সুখ-দুঃখের গাৰ্হস্থ্য জীবনও স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে যাপন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয়ংকব অবস্থা থেকে স্বামী ও স্ত্রীকে মুক্তি দেবার জন্যই প্ৰায় সভ্য-সমাজে বিবাহের বন্ধন ছেদনের ব্যবস্থা করতে হয়।

বিবাহ বন্ধন অচ্ছেদ্য, কি তা ছেদন করা অত্যন্ত কঠিন, সমাজ ও আইনের এই রকম ব্যবস্থা নরনারীকে অনেক দুঃখ-কষ্ট অত্যাচার সহ্য করেও পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার অনুকুল মনোভাব সৃষ্টি করে। এই মনোভাবের অভাবে শিথিল বিবাহ-বন্ধন সভ্য-সমাজে বহু বন্ধনকেই শিথিল করে দেয়। সেই জন্য অনেক সভ্য-সমাজেই বিবাহের বন্ধন ছেদনকে যথাসম্ভব কষ্টসাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এরও একটি সীমা আছে। অবস্থা এমন হতে পারে যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবন তাদের নিজেদের পক্ষেও শুধু মহাক্লেশকর নয়, সমাজের পক্ষে অমঙ্গলকর। তেমন জায়গায় বিবাহকে ভঙ্গ হতে দেওয়াই ব্যক্তিগত ও সমাজগত প্রয়োজন। প্রাচীন হিন্দু আইনে এই কারণে অনেক স্থলে স্বামীর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার এবং স্ত্রীর স্বামীকে পরিত্যাগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কোন অবস্থায় বিবাহকে ভঙ্গ হতে দেওয়া হবে এবং কখন হবে না। এই বিধিনিষেধ প্রণয়ন সব সময়েই কঠিন। কারণ ব্যক্তির প্রয়োজন ও সমাজের প্রয়োজন এই দুই দিক বিবেচনা করে তবেই এর নিয়ম প্রণয়ন করা যায়। বিবাহবন্ধন যাতে স্বভাবতই অশিথিল থাকে, কিন্তু স্বামী কি স্ত্রীর জীবন একান্ত দুর্বহনা হয়—এই দুই দিকে সমান দৃষ্টি রাখলে তবেই বিবাহভঙ্গের বিধি গ্রহণযোগ্য হয়। রাও কমিটির প্রস্তাবগুলি এতে কতদূর সফল হয়েছে, সেটাই বিচাৰ্য বিষয়।

অন্য নানা দেশের বিবাহভঙ্গের আইন অনুসরণ করে রাও কমিটি বিবাহ ভঙ্গের বিধিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এক —কতকগুলি অবস্থায় স্বামী কিংবা স্ত্রীর আবেদনে আদালত প্রচার করতে পারবেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈধ ও আইনসঙ্গত কোনও বিবাহ আদৌ হয় নাই। দুই—অন্য কতকগুলি অবস্থায় স্বামী কি স্ত্রীর আবেদনে আদালত বৈধ বিবাহকে আদেশের তারিখ থেকে ভঙ্গ হল বলে নির্ধারণ করতে পারবেন। আন্দেী সিদ্ধ বিবাহ হয় নাই–এই প্রচারের মোটামুটি কারণগুলি এই –(১) যদি বিবাহের সময় ও আদালতে আবেদনের সময় স্বামী কি স্ত্রীর পুরুষত্ব কি স্ত্রীত্ব না থেকে থাকে; (২) যদি স্বামী-স্ত্রী এই রকম সম্পর্কিত হয় যাদের মধ্যে আইনত বিবাহ নিষিদ্ধ, (৩) যদি বিবাহের সময় স্বামী কি স্ত্রী উন্মাদ বা জড়বুদ্ধি থাকে; (৪) যদি বিবাহের সময় স্বামী কি স্ত্রীর পূর্ব বিবাহের স্ত্রী কি স্বামী জীবিত থাকে এবং সেই পূর্ব বিবাহ বলবৎ থেকে থাকে; (৫) যদি স্বামী কি স্ত্রীর বিবাহে সম্মতি, অথবা যেখানে তাদের অভিভাবকদের সম্মতি বিবাহে প্রয়োজন, সেরূপ সম্মতি বলে কি ছলে বিবাহের অপর পক্ষ নিয়ে থাকে।

সিদ্ধ বিবাহ ভঙ্গের কারণগুলি মোটামুটি এই-(১) যদি স্বামী বা স্ত্রী বিকৃতমনা হয় বা চিকিৎসার অতীত এবং বিবাহভঙ্গের আবেদনের পূর্বে যদি ক্ৰমান্বয়ে সাত বৎসর এই রকম বিকৃতমনা থেকে থাকে; (২) যদি স্বামী কি স্ত্রী অচিকিৎস্য মহাকুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হয় যে ব্যাধি আবেদনকারী কি আবেদনকারিণীর ছোয়াচ থেকে উৎপন্ন হয়নি; (৩) যদি স্বামী কি স্ত্রী বিনা কারণে স্ত্রী কি স্বামীকে সাত বৎসর পর্যন্ত ত্যাগ করে থেকে থাকে; (৪) যদি স্বামী কি স্ত্রী অন্য ধর্মাবলম্বনের ফলে আর হিন্দু না থেকে থাকে; (৫) যদি স্বামী কি স্ত্রী সাত বৎসর পর্যন্ত সংক্ৰামক যৌনব্যাধিগ্রস্ত থেকে থাকে যে ব্যাধি আবেদনকারী কি আবেদনকারিণীর ছোয়াচ থেকে উৎপন্ন নয় এবং (৬) যদি অন্য কোনও স্ত্রীলোক স্বামীর রক্ষিতা হয়ে থাকে অথবা বারবনিতার জীবনযাপন করে।

বিবাহকে অসিদ্ধ প্রচারের বিধি ও সিদ্ধ বিবাহভঙ্গের বিধি—এ দুই-ই কেবল সেই সব বিবাহ সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হবে যেসব বিবাহ হবে এই হিন্দু কোড বা সংহিতা আইন হয়ে পাশ হবার পর। তার পূর্বেকার কোনও বিবাহে এসব বিধি প্রযুক্ত হবে না।

লক্ষ করার বিষয়, প্ৰস্তাবিত আইনে স্বামী ও স্ত্রীকে বিবাহের অসিদ্ধি প্রচার ও বিবাহ ভঙ্গে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইনে হিন্দু স্বামী ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারে ও দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে, তাতে কোনও কারণ দেখাবার প্রয়োজন নাই। স্মৃতিশাস্ত্ৰে স্বামীর স্ত্রী পরিত্যাগের যেসব কারণ বলা হয়েছিল, সেগুলি আইনের ব্যবস্থা নয়; নৈতিক উপদেশমাত্র-বর্তমান আইনের এই বিধান এবং পরাশর সংহিতায় যে সব কারণে স্ত্রীকে স্বামী পরিত্যাগ করে অন্য স্বামী গ্রহণের ব্যবস্থা দেওয়া ছিল, তাও এখন আইনত বাতিল, এক বিধবার পুনর্বিবাহ ছাড়া যা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় আইন করে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তির মর্যাদার দিক থেকে স্ত্রী-পুরুষের এই সাম্য অবশ্য গ্ৰহণীয় এবং সামাজিক দিক থেকে এতে অহিতের বিশেষ কোনও সম্ভাবনা নাই। রাও বিলে যে সকল কারণে বিবাহ অসিদ্ধ কি ভঙ্গ হতে পারে, সেগুলি এমন কারণ যা সত্ত্বেও স্বামী কি স্ত্রীকে অনিচ্ছায় দাম্পত্য-জীবনযাপন করতে বাধ্য.করা কেবল মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়, সমাজের পক্ষেও অমঙ্গলকর। রাও বিলের বিধিনিষেধগুলি ব্যক্তির প্রয়োজন ও সমাজের হিত কোনওটাকে অগ্রাহ্য করে একদিকে বেশি ঝোঁক দিয়েছে বলে মনে হয় না। পূর্বকালে হিন্দু সমাজে এমন দিন ছিল, যখন এর চেয়ে অনেক লঘু কারণে বিবাহ ভঙ্গের বিধি ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে দেখি–স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পর বিদ্বেষপরায়ণতা বিবাহ ভঙ্গের একটা কারণ ছিল-‘পরস্পর দ্বেষান্মোক্ষঃ’ (কৌটিল্য)।

বিবাহকে অসিদ্ধ প্রচার করা কি বিবাহকে ভঙ্গ করা দুই-ই নির্ভর করে স্বামী কি স্ত্রীর আদালতে আবেদনের উপর। সে রকম আবেদন করা না-করা স্বামী কি স্ত্রীর ইচ্ছাধীন। খুব সম্ভব, বহুস্থলে বিবাহ ভঙ্গের কারণ উপস্থিত হলেও স্বামী বা স্ত্রী তার জন্য আবেদন করবে না। উন্মাদ স্ত্রীকে পরিত্যাগ না করে তার সেবায় স্বামী জীবন কাটিয়েছেন—এ দৃষ্টান্তের অভাব নাই এবং উন্মাদ স্বামীমাত্রকেই তার স্ত্রী পরিত্যাগ করবে, এ রকম আশঙ্কাও অমূলক। তবে সব মানুষের-কি পুরুষ, কি স্ত্রীলোক-মন সমান নয়। সকলের কাছ থেকে অসাধারণ মহত্ত্ব কি প্ৰেম আশা করা যায় না এবং তার উপর ভিত্তি করে সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন করা চলে না। ভাবী স্বামী অতি অল্পজীবী হবেন জেনেও সাবিত্রী সত্যবানকে স্বামিত্বে বরণ করেছিলেন; কিন্তু সকল স্ত্রীর সাবিত্রী হওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা আদর্শ। অল্প লোকেই সে আদর্শের নাগাল পাবে। সাধারণ মানুষের সাধারণ চরিত্রের উপর ভিত্তি করেই সামাজিক বিধিনিষেধ গড়তে হয়। মহৎ জীবনের মহত্ত্বের পথও খোলা থাকবে, সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার পথও খোলা থাকবে। রাও কমিটির প্ৰস্তাবগুলি এর অন্যথাচরণ করেনি। এক জায়গায় রাও কমিটির বিধিব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে মনে হয়। রাও কমিটির প্রস্তাবিত কোনও কোনও কারণে স্বামী বিবাহভঙ্গ করলে পরিত্যক্ত স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন-যেমন উন্মাদিনী স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ যদি ভঙ্গ হয়। তার কারণ আমাদের সমাজে ও পৃথিবীর অনেক সভ্য-সমাজেই স্ত্রী ও পুরুষের ধনতান্ত্রিক বৈষম্য।

যাঁরা ভয় করেন যে, বিবাহ অসিদ্ধি ও বিবাহভঙ্গের এই সব বিধি-বিধান হিন্দুর বিবাহবন্ধন ও সমাজকে শিথিল করবে তাঁরা হিন্দু পুরুষ ও হিন্দু নারীকে অন্যান্য সমাজের পুরুষ ও নারীর চেয়ে মনে মনে নিশ্চয়ই হেয় জ্ঞান করেন। বিবাহ ভঙ্গের বিধি থাকলেও স্বামী ও স্ত্রী সুযোগ পেলেই বিবাহ ভঙ্গের চেষ্টা করবে-এ রকম ব্যাপার অন্য সমাজে ঘটে না। হিন্দু সমাজে কোন ঘটবে, তার কারণ নেই। যাঁরা কারণ আছে মনে করেন, তাদের অবচেতন মনে সম্ভবত এই ধারণা আছে যে, হিন্দু স্ত্রী-পুরুষের বিবাহের যে বন্ধন, তা কেবল টিকে আছে, আইনে সেই বিবাহ অন্তত স্ত্রীলোকের পক্ষে অচ্ছেদ্য বলে।

প্রচলিত হিন্দু আইনের আংশিক পরিবর্তন ও আইনসভার মারফত হিন্দু কোড বা সংহিতা বিধিবদ্ধ করে সকল হিন্দুর জন্য এক আইন প্রবর্তন—এই চেষ্টার বিপক্ষে দুইটি সাধারণ আপত্তির আলোচনা এই শেষ প্ৰবন্ধে করব।

প্রথম রকমের আপত্তি হচ্ছে যে, চলতি হিন্দু আইনের কিছুমাত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন

নাই। ও আইন যা আছে, বেশ আছে। মুনি ঋষিরা আইন করে গেছেন। তাঁরা ছিলেন অভ্রান্ত ত্রিকালজ্ঞ। তাদের ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথাই উঠতে পারে না। রাও বিলের প্রথম খসড়া যখন প্রকাশ হয়, তখন ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় একজন আইনজীবী বাঙালি হিন্দু এই মত খুব জোরের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন। এখনকার দিনে আইনসভা যে সব আইন করে তার প্রথমে প্রায়ই এই বাক্য থাকে : ‘যেহেতু অমুক বিষয়ে আইন প্রবর্তন বা আইনের সংশোধন প্রয়োজন, অতএব ইত্যাদি।’ রাও বিলেও এই মামুলি কথা দিয়ে আরম্ভ করা হয়েছেঃ

‘Whereas it is expedient to amend and codify certain branches of the Hindu Law as now in force’ ইত্যাদি ‘যেহেতু প্রচলিত হিন্দু আইনের কতক অংশ সংশোধন ও সংহিতাকারে বিধিবদ্ধ করা প্রয়োজন, অতএব ইত্যাদি।’ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার লেখক বলেছিলেন যে, এখানে বিসমিল্লায় গলদ। চলতি হিন্দু আইনের কোনও অংশের কোনও রকম পরিবর্তনের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। সুতরাং রাও বিল আর অগ্রসর হওয়া সম্পূর্ণ নিম্প্রয়োজন। এই মতবাদীদের সঙ্গে যুক্তি তর্ক খুব সম্ভব নিরর্থক। মুনি ঋষিদের নামযুক্ত ধৰ্মশাস্ত্রের যে গ্ৰন্থ আমরা পাচ্ছি, যেমন মনু কি যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ কি বৃহস্পতি, তাঁরা কোন কালের লোক ছিলেন এবং তাঁদের নাম সংযুক্ত ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধ কতটুকু; সব ঋষিরাই যখন অভ্ৰাস্ত ও ত্রিকালজ্ঞ, তখন এক ঋষির সঙ্গে অন্য ঋষির মতের অমিল কেন, যাতে সংস্কৃত ভাষায় প্রবাদ হয়েছে যে, তিনি ঋষিই নন, যার একটা ভিন্ন মত নাই; ধর্ম-শাস্ত্রের যুগের পর নিবন্ধকারেরা শাস্ত্ৰ বাক্যের ব্যাখ্যাকে উপায়স্বরূপ করে কী রকম যুগে যুগে প্রয়োজন অনুসারে হিন্দু ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন এবং এখনও ইংরেজের আদালতে বিচারকেরা যাদের অনেকে হিন্দু নন, কেমন করে হিন্দু আইনের অল্পাধিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছেন—এসব বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা বোধ হয় পণ্ডশ্রম। কারণ এসব যে তাঁরা জানেন না, তা মনে হয় না। এসব জেনে শুনেও তাঁরা চোখ মুদে ও কান বন্ধ করে আচলের যোগাসনে বসেছেন। তাদের অধূষ্য মূর্তি দেখে সমাজের প্রয়োজন প্রভৃতি চপল ব্যাপারগুলি সভয়ে দূরে পলায়ন করবে। এই আপত্তির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘কভি নেহি’ আপত্তি। এই আপত্তি সম্বন্ধে বাক্যব্যয় বৃথা। এ আপত্তিকারীদের দুর থেকেই নমস্কার জানাচ্ছি।

দ্বিতীয় রকমের আপত্তির সুর অতটা চড়াগ্রামে চড়ান নয়। সে আপত্তি হচ্ছে:

এবং বর্তমানের আইনসভাগুলি তার উপযুক্ত স্থান নয়। এ আপত্তিকে বলা যায়। ‘আভি নেহি’ আপত্তি। হিন্দু মহাসভার গত বিলাসপুর অধিবেশনে রাও বিল সম্বন্ধে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, সে প্রস্তাব এই আপত্তির একটা ভাল উদাহরণ। হিন্দু মহাসভা এ প্রস্তাবে বলেছেন যে, চলতি হিন্দু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন নাই, একথা তাঁরা বলেন না। পরিবর্তনের প্রয়োজন তাঁরা স্বীকার করেন। তবে বর্তমান আইনসভাগুলি হিন্দু জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়। যখন প্রকৃত ডেমোক্ৰেটিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে আইনসভাগুলি জনসাধারণের যথার্থ প্রতিনিধি স্থানীয় হবে, তখন সে প্রতিনিধি সভা বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে হিন্দু আইনের পরিবর্তন সাধন করবেন। তার পূর্বে পরিবর্তন হতে দেওয়া উচিত নয়।

হিন্দু মহাসভা যখন বলেছেন তখন লোকে মেনে নিতে বাধ্য যে, এই প্রস্তাব হিন্দু মহাসভার সভ্যদের আন্তরিক অভিপ্ৰায় প্রকাশ করছে, ও প্ৰস্তাব অশুভস্য কালাহরণের ফিকির নয়, অথবা স্বীকার কি অস্বীকার এ দুয়ের দায় থেকে আপাতত মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় মাত্র নয়। কিন্তু মনের এ সন্দেহ দূর করা কঠিন। কারণ বলছি : মহাসভার এই অধিবেশনেই হিন্দুস্থানের ভাবী রাষ্ট্রতন্ত্র ও শাসনতন্ত্র কী রকম হওয়া উচিত তার এক খসড়ার অনুমোদন করে প্রস্তাব গ্রহণ হয়েছে। হিন্দু মহাসভা অবশ্য মনে করেন যে ওই খসড়া অনুসারে বিলাতের পার্লামেন্ট এখনই আইন পাশ করবেন অথবা ইংরেজের সম্মতি নিরপেক্ষ ভারতবর্ষের লোকেরা ওই খসড়া অনুযায়ী এখনই হিন্দুস্থানে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রবর্তিত করবে। এ সত্ত্বেও এ প্রস্তাব গ্রহণ করে হিন্দু মহাসভা তাঁর কর্তব্য কাৰ্যই করেছেন। কারণ ভারতবর্ষের ভাবী শাসনতন্ত্রের আকার কি হবে সে সম্বন্ধে দেশবাসীর মনকে প্ৰস্তুত করা সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। প্রতিষ্ঠান তার নিজের কল্পনা দেশের লোকের সামনে উপস্থিত করবার অধিকারী যাতে সেই অনুসারে দেশের লোকের মত গঠিত হয়। চলতি হিন্দু আইনের যদি পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে সে কী রকম পরিবর্তন সে সম্বন্ধে হিন্দু মহাসভার কর্তব্য ছিল দেশের লোককে উপদেশ করা এবং সেজন্য জনমত গঠন করা। হিন্দু মহাসভা বিলাসপুরের অধিবেশনে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন তাতে এ কর্তব্য করা হয় নাই। ভারতবর্ষের হিন্দুর অধিকাংশ যদি প্রচলিত হিন্দু আইনের কোনও পরিবর্তন চায়। তবে বর্তমান অবস্থাতেও সেই অনুসারে আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা, হিন্দু মহাসভার খসড়া অনুসারে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রতন্ত্র বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি।

হিন্দু মহাসভা যে বর্তমানের আইন সভাগুলিকে আন-ডিমোক্রেটিক ও নন-রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেছেন সে কথা ঠিক। কিন্তু তার উপর একটু বেশি ঝোক দিয়েছেন। প্রথমত হিন্দু মহাসভা যাকে বলেছেন আইন সভাগুলির সম্পূর্ণ ডিমোক্রেটিক গঠন, তার অর্থ যাই হোক, সে রকম গঠন পেতে যে বহু সময যাবে তাতে সন্দেহের অবসর নেই। দ্বিতীয়ত পরিবর্তিত হিন্দু আইন প্রণয়ন সোজাসুজি ডিমোক্রেসির কাজ নয়। কারণ জনসাধারণের তা সাধ্যাতীত। বিশেষ, ভারতবর্ষের হিন্দু জনসাধারণের এখনও শতকরা ৯০ জন নিরক্ষর। এ হচ্ছে তাদের কাজ যাঁরা বুদ্ধি ও বিদ্যায় অগ্ৰণী এবং সমাজতত্ত্বে যাদের দৃষ্টি আছে। এ রকম লোকই পরিবর্তিত হিন্দু আইন কী রকম হবে তার বিচার করে হিন্দু জনসাধারণের মতকে গড়ে তুলতে পারে। কেবলমাত্র ডিমোক্রেসির বিদ্যাবুদ্ধিতে যে হিন্দু সভার ভরসা নেই। ওই প্ৰস্তাবেই তাঁরা তার প্রমাণ দিয়েছেন। তা নইলে সম্পূর্ণ ডিমোক্রেটিক আইন সভার সভ্যদেরও আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ব্যবস্থা করতেন না। হিন্দু কোড এখন পাশ হোক কি অনেকদিন পরে পাশ হোক যাঁরা মনে করেন যে, প্রচলিত হিন্দু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন তাদের এখন থেকেই কী রকম পরিবর্তন প্রয়োজন তার আলোচনা করে জনমতকে শিক্ষিত করা ও পরিবর্তনের প্রতি অনুকুল করা উচিত। নইলে এ সন্দেহ কিছুতেই মন থেকে দূর করা যায় না যে তাঁরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা যে পরিবর্তনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে একথা সাহস করে বলতে চান না, কী রকম পরিবর্তন প্রয়োজন সেকথা প্রকাশ করে তাঁরা যে প্রকৃতই পরিবর্তন চান তা বলারও তাদের সাহস নেই। এতে হিন্দু জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।

রাও বিলের কতকগুলি প্রধান ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার মত সংক্ষেপে বলেছি। যদি তাতে ও বিলের আলোচনার কোনও সাহায্য হয় তবে শ্রম সার্থক হবে। হিন্দু আইন সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে যুক্তিতর্ক দিয়ে শুভবুদ্ধির বিচার। সভায় একত্র হয়ে না বা হ্যা প্রস্তাব গ্রহণের মূল্য বেশি নয়। ও রকম প্রস্তাব খুব সম্ভব মনের তম বা রজের প্রকাশ মাত্র। সত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক কম, যে সত্য মনকে আলো করে বস্তুর স্বরূপকে প্রকাশ করে।

পৌষ ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *